সবুজ মানুষ
আমি যার কথা লিখতে যাচ্ছি তার সঙ্গে সবুজ মানুষের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, তা আমার সঠিক জানা নেই।
সে নিজে পৃথিবীরই মানুষ, এবং আমারই একজন বিশিষ্ট বন্ধু–স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক–প্রফেসর নারায়ণ ভাণ্ডারকার।
ভাণ্ডারকারের সঙ্গে আমার পরিচয় দশ বছরের–এবং এই দশ বছরে আমি বুঝেছি যে, তার মতো শান্ত অথচ সজীব, অমায়িক অথচ বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ খুব কমই আছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন জীবিত, ভাণ্ডারকার তখন শান্তিনিকেতনে ছাত্র ছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন তাকে প্রভাবিত করেছিল। বিশেষত, বিশ্বমৈত্রীর যে বাণী রবীন্দ্রনাথ প্রচার করেছিলেন, সেবাণী ভাণ্ডারকার তার জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করেছিল। সে বলত, যতদিন না জাতিবিদ্বেষের বিষ মানুষের মন থেকে দুর হচ্ছে ততদিন শান্তি আসবে না। আমার অধ্যাপক জীবনে সবটুকু আমি আমার ছাত্রদের মনে বিশ্বমৈত্রীর বীজ বপন করে কাটিয়ে দিতে চাই।
সুইডেনে উপসালা শহরে সম্প্রতি যে দার্শনিক সম্মেলন হয়ে গেল, ভাণ্ডারকার তাতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। কাল বিকেলে উপসালা থেকে ফিরে এসে সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
এখানে আমার নিজের পরিচয়টা একটু দিয়ে রাখি।
আমি যে জগৎটাকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জানি এবং ভালবাসি, সেটাকে সবুজ বলা বোধহয় খুব ভুল হবে না। আমার জগৎ হল গাছপালার জগৎ। অর্থাৎ আমি একজন বটানিস্ট। আমার দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটে গ্রিনহাউসের ভিতর। দুষ্প্রাপ্য ক্যাকটাস ও অর্কিডের যে সংগ্রহ আমার গ্রিনহাউসে আছে, ভারতবর্ষে তেমন আর কারুর কাছে আছে কিনা সন্দেহ।
ভাণ্ডারকার যখন এল, তখন আমি আমার গ্রিনহাউসেই আমার প্রিয় লোহার চেয়ারটিতে বসে টবে রাখা একটি এপিফাইলাম ক্যাকটাসের বিচিত্র গোলাপি ফুলের শোভা উপভোগ করছিলাম।
বিকেলের রোদ কাঁচের ছাউনি ভেদ করে এসে গাছের পাতার উপর পড়েছে, আর তার ফলে সমস্ত গ্রিনহাউসের ভিতরটা স্নিগ্ধ সবুজ আভায় ছেয়ে গেছে। ভাণ্ডারকারকে দেখলাম সেই আলোতে। তাকে স্বাগত জানিয়ে বললাম, তোমাকে সবুজ রঙটা ভারী ভাল মানিয়েছে।
সে যেন একটু চমকে উঠেই বলল, সবুজ রঙ? কোথায় সবুজ?
আমি হেসে বললাম, তোমার সর্বাঙ্গে। তবে ওটা ক্ষণস্থায়ী। সুর্যের আলো যতক্ষণ আছে ততক্ষণ। কিন্তু ওটা তোমাকে মানায় ভাল। তোমার মনটা যে কত তাজা সে তো আমি জানি! রবীন্দ্রনাথ বোধহয় তোমাকে লক্ষ্যকরেই তাঁর সবুজের অভিযান লিখেছিলেন।
ভাণ্ডারকারকে দেখে মনে হচ্ছিল, বিদেশ সফরের ফলে তার যেন কতগুলি সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়েছে। তার চাহনিটা যেন আগের চেয়ে বেশি তীক্ষ্ণ, অঙ্গচালনা আগের চেয়ে বেশি চঞ্চল।
ভাণ্ডারকার অন্য চেয়ারটায় বসে পড়ল। বললাম, তোমার খবর বলো। বাইরে কেমন কাটল?
ভাণ্ডারকার কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে গলার স্বর নামিয়ে নিয়ে বলল, অবনীশ, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীর সন্ধান পেয়েছি উপসালাতে।
আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, কার কথা বলছ বলল তো।
সে বলল, নাম বললে চিনবে না। তার নাম বিশেষ কেউ জানে না–ও দেশেও না। তবে অদূর ভবিষ্যতে জানবে। কিন্তু নামের আগে যেটার সঙ্গে পরিচয় হওয়া দরকার, সেটা হল তার চিন্তাধারা। আমার নিজের চিন্তাধারা সে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছে।
আমি এবার একটু হালকাভাবেই বললাম, সে কী হে! তোমার চিন্তাধারা পালটানোর প্রয়োজন আছে বলে তো আমার মনে হয়নি কখনও।
ভাণ্ডারকার আমার ঠাট্টায় কর্ণপাত করল না। একটা হাতের উপর আর একটা হাত মুঠো করে রেখে। আমার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে, তার অস্বাভাবিক রকম পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে সে বলল, অবনীশ–মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, সৌহার্দ্যে আর আমি বিশ্বাস করি না। দুর্বলের সঙ্গে সবলের, ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের, মূর্থের সঙ্গে মনীষীর সৌহার্দ্য হবে কী করে? আমরা মানবিকতা বলে একটা জিনিসে বিশ্বাস করি, যেটার আসলে কোনও ভিত্তিই নেই। ইকুয়েটর-এর মানুষের সঙ্গে মেরুর দেশের মানুষের মিল, হবে। কোত্থেকে! মঙ্গোলয়েড আর এরিয়ান-এ যা মিল, বা নর্ডিক ও পলিনেশিয়ান-এ যা মিল, বাঘে আর গোরুতেও ঠিক ততখানি মিল। হেরেডিটি, এনভাইরনমেন্ট ও অদৃষ্ট–এই তিনে মিলে মানুষে মানুষে যে প্রভেদের সৃষ্টি করে–সেখানে মৈত্রীর বুলি কোন কাজটা করতে পারে? কালো মানুষ নির্যাতিত হবে কেন? তাদের চেহারা দেখোনি, ফিজিওগনোমি লক্ষ করোনি? মানুষের চেয়ে বানরের সঙ্গেই যে তাদের মিলটা বেশি, সেটা লক্ষ করোনি?
ভাণ্ডারকার উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে এমন দৃষ্টি এর আগে কখনও দেখিনি।
আমার কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য সংযত করে বললাম, ভাণ্ডারকার, তুমি নেশা করেছ কিনা জানি না। কিন্তু তোমার কথার তীব্র প্রতিবাদ না করে আমি পারছি না। এতগুলো ছাত্রের ভবিষ্যৎ হাতে নিয়েও যার এমন। মতিভ্রম হতে পারে, তাকে আমি বন্ধু বলে মানতে রাজি নই। আমার এখনও একটা ক্ষীণ আশা আছে যে, এটা তোমার একটা রসিকতা; যদিও তাই বা হবে কেন জানি না, কারণ আজ তো পয়লা এপ্রিল নয়।
ভাণ্ডারকার এক পা পিছিয়ে গিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, অবনীশ, তোমাদের মতো লোকের সারা জীবনটাই হল পয়লা এপ্রিল, কারণ তোমরা বোকা বনেই আছ। আমিও তোমাদের দলেই ছিলাম এতদিন, কিন্তু এখন আর নেই। আমার চোখ খুলে গেছে। আমার ছাত্ররা যাতে আমার পথে চলতে পারে, এখন থেকে সেটাই হবে আমার লক্ষ্য। আমি ওদের বুঝিয়ে দেব যে, আজকের দিনেও যে কথাটা সত্যি সেটা হল সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা–সারভাইভ্যাল অফ দি ফিটেস্ট। যারা সবল, তারা যদি তাদের শক্তি প্রয়োগ করে দুর্বলদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে, তবেই জগতের মঙ্গল।
যে শক্তির কথা আমি বলছি সেটা অল্পদিনের মধ্যেই পৃথিবীর লোকে অনুভব করবে–তুমিও করবে। বিশ্ব-মৈত্রীর ধোঁয়াটে অবাস্তব বুলিতে যারা বিশ্বাস করে, তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে, অবনীশ। কিন্তু আমরা
আছি, আমরা থাকব। আর আমাদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, এবং বাড়বে। আমরাই হব পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি। আমি চললুম। গুড বাই।
কথা শেষ করে উলটোদিকে ঘুরে দৃপ্ত পদক্ষেপে গ্রিনহাউসের দরজার দিকে এগিয়ে যাবার সময়, একটা সাধারণ ফণীমনসার গায়ে ভাণ্ডারকারের বাঁ হাতটা ঘষে গেল।
একটা অস্ফুট আজাদ করে ভাণ্ডারকার তার কোটের পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে হাতের ওপর চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করলাম রুমালে রক্তের ছোপ লেগেছে। ভাণ্ডারকারও দেখল সে রক্ত, তারপর তার বিস্ফারিত দৃষ্টি আমার দিকে মুহূর্তের জন্য নিক্ষেপ করে সে ঝড়ের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সে রক্তের কথা আমি কোনওদিনও ভুলব না, কারণ তার রঙ ছিল সবুজ।
ভাণ্ডারকার চলে যাবার পর আমি যে কতক্ষণ গ্রিনহাউসে বসে ছিলাম জানি না। কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। আজ সকালে আমার প্রিয় সবুজ ঘরে গিয়ে যে দৃশ্য দেখেছি, তারপর আমার আর বেঁচে থাকার কোনও সার্থকতা আছে বলে মনে হয় না।
গিয়ে দেখি, আমার গাছপালার একটিও আর বেঁচে নেই। শুধু তাই নয়, প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সবুজ রঙটিও যেন কে শুষে নিয়েছে। যা রয়েছে, সেটা পাংশুটে–ভস্মের রঙ।…
আকাশবাণীর সাহিত্যবাসর অনুষ্ঠানে প্রচারিত।
১৬.২.৬৬, রাত্রি ৮টা।