মাটির ব্যাংক
ঘরের ভেতরে মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে বাহার। গত চারদিন যাবৎ তার বাসায় কোনো খাবার নেই। লকডাউন এর জন্যে নেই কোনো কাজ-কর্ম। বাহারের নিজের জন্যতো কোনো চিন্তা নেই। যত চিন্তা তার ছোট্ট ফুটফুটে তিনমাসের বাচ্চাটার জন্য। ডাক্তার বলেছেন, মায়ের শালদুধ বাচ্চাটা খেতে পারবে না। তাই বাহির থেকে কেনা স্পেশাল গুঁড়োদুধকে লিকুইড বানিয়ে খাওয়াতে হয়। নিজেদের খাবারের সাথে সাথে বাচ্চাটার গুঁড়োদুধও সবটা শেষ। হাতে কোনো টাকা নেই। এই মুহুর্তে কোটি টাকা না, স্রেফ দুধের দাম অর্থাৎ, আটশো পঁচাত্তর টাকা তার কাছে নেই বলে নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে নিষ্কর্মা পিতা মনে হচ্ছে। বাহারের স্ত্রী বানু উঠে দাড়ালো। ভাঙ্গা খাটের নীচ থেকে একটা মাটির ব্যাংক বের করলো সে। ব্যাংকটা বাহারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বানু বলল,
“এই নেন রিনার বাবা। ব্যাংকটা ভাঙ্গেন। আমরা খাই- না খাই সেইটা পরে, আগে রিনার জন্যে দুধ নিয়া আসেন। মাইয়াটা আমার একদমই ক্ষিধা সহ্য করতে পারে না।”চোখ তুলে বানুর দিকে তাকালো বাহার। দুজনের চোখই অকারণে ভিজে আসছে। সত্যিই কি অকারণে? বানুর প্রতি ভালোবাসাটা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বাহারের। অভাব অনটনের সংসারে এরকম চমৎকার সঙ্গীনীর কোনো তুলনা হয় না।
দশম শ্রেণী পড়ুয়া আবিদ। সহজ-সরল একটা ছেলে। মা-বাবার আদর্শকে লালন করবার চেষ্টা করে সে। আবিদের মা মারা গেলেন তিনবছর হলো। ব্রেইন ক্যান্সার ছিলো তার। আজ আবিদের মায়ের মৃত্যু দিবস।
প্রতিবছর এই দিনটা আবিদ বিশেষভাবে উৎযাপন করে। প্রতিবছরই আবিদ একটা মাটির ব্যাংকে টাকা জমায় এবং মায়ের মৃত্যুদিবসে সেই টাকা দিয়ে মায়ের মাগফেরাতের জন্যে এলাকার একটা বা দুটো পরিবারকে সাহায্য করে। ফজরের নামাজ পড়েই চলে গেল মায়ের কবর জেয়ারতে। গতকাল রাতে কেনা বস্তাভর্তি বাজারগুলো ভোরে চুপিচুপি রেখে এসেছে বাহার ভাইয়ের ঘরের দরজায়। আবিদ জানে বাহার ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। লকডাউনে তার কোন কাজকর্মও নেই। তাই, বস্তাভর্তি খাবার দেখে বাহার ভাই নিশ্চই দোয়া করবে এবং সেই দোয়া যেন খোদা তার মায়ের কবরে পৌঁছে দেন।
সূর্য উঠতেই জানালা কড়া, তাজা রোদ ঢুকে পুরো ঘর আলোকিত করে দিল। ঘুম থেকে উঠে মুখে হায় তুলে চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলতেই দেখে, ঘরের সামনে একটা বিরাট বস্তা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বউকে ডেকে জিজ্ঞাস করলে বউও অবাক। সেকেন্ডে মনে কত প্রশ্ন খেলে গেল। কে রাখল এই বস্তা? কী আছে এতে? কেনই বা রেখে গেল? বাইরে খানিকটা গলা টেনেও আশেপাশে কাউকে দেখা গেল না। কৌতুহল নিয়ে বস্তাটা ভেতরে ঢুকিয়ে খুলতেই চোখ আরো বড় বড় হয়ে গেল। চোখ মুখে আনন্দের ফোয়ারা বইতে
লাগল। বস্তাভর্তি নানারকম খাদ্যসামগ্রী। কাল রাতে যার বাচ্চার জন্য দুধ কেনার পয়সা নাই, আজ তার ঘরে বস্তা ভর্তি খাবার। আনন্দে আত্মহারা বাহার সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় পড়ে গেলো। এবছর পাড়ার মাহফিলে শোনা মৌলভী এহসানুজ্জামান এর ওয়াজটা মনে পড়ে গেলো। তিনি বলেছিলেন, মহান আল্লাহ কোরআনের আয়াতে বর্ণনা করেছেন, “তারা কি তোমার পালনকর্তার অনুগ্রহ বণ্টন করে? আমিই তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করি পার্থিব জীবনে এবং তাদের একজনের মর্যাদা অন্যজনের ওপর উন্নীত করেছি, যাতে তারা একে অন্যকে সেবকরূপে গ্রহণ করতে পারে (সুরা জুখরুফ, আয়াত- ৩২)।” সাথে সাথে দুহাত তুলে বাহার মোনাজাত করলো সেই মানুষটার জন্যে যিনি এই খাবারগুলো একটা অসহায় পরিবারকে দান করলেন।
বাসায় যেতে যেতে আবিদ আল্লাহ তা’লার চমৎকার একটা ম্যাসেজের কথা ভাবছে। “যারা আল্লাহর পথে নিজের ধনসম্পদ ব্যয় করে এবং যা ব্যয় করে, তার কথা বলে বেড়ায় না এবং (ঐ দানের বদলে কাউকে) কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার আছে এবং তাদের জন্য কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না (সূরা বাকারা, আয়াত-২৬২)।”
আব্দুল্লাহ ইবনে আলী
শিক্ষার্থী, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ