#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১+২
-“পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছি কী ক্লাস এইটের মেয়ে বিয়ে করার জন্য?”
-“তা আমি কি করে বলবো! তোর মন তুই ভালো জানিস।”
-“আম্মা প্লিজ কথা ঘুরাবে না।”
ছেলের কথায় চোখমুখ কুঁচকে বিছানায় বসলেন মোরশেদা বেগম। চিন্তিত মুখে বললেন,
-“এখন এইমুহূর্তে এসব কথা কেনো উঠছে? তোর আব্বা যা ঠিক করেছে অবশ্যই তা ঠিকভুল বিবেচনা করেই করছে।”
-“এটাই তোমাদের ঠিক? আমি, যে কিনা দেশের বাইরে থেকে পড়ে এসেছি সে শুধুমাত্র তোমাদের উপর সম্মান রেখে তোমাদের পছন্দমতো গ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তাই বলে ক্লাস এইটের একটা বাচ্চা মেয়ে? আম্মা, তোমার বিবেকে বাধছে না?”
-“না, বাধছে না। বড়টার জন্য তো বেশ পড়ুয়া ভালো ঘরের মেয়েই আনা হয়েছিল। আজ কই সে? তোর ভাইয়ের কপালে পাঁচ লাথি বসিয়ে অন্য ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে তার তো বুক কাঁপেনি। তোর ভাইয়ের কথা না হয় নাই ভাবলো.. নিজের নাড়ি ছেড়া ধনকেও ফেলে যেতে বেহায়া মেয়ে দু’বার ভাবেনি। আসলে এসব মেয়েদের বুক-পিঠ নেই। সব পারে এরা.. সব।”
-“ভাবিকে এর মাঝে কেনো টানছো? তাছাড়া দুনিয়ার সব মেয়েই তো আর ভাবির মতো হবে না।”
-“তর্ক করিস না, মেসবাহ। রেডি হয়ে নিচে আয়। অর্পা হলুদ নিয়ে অপেক্ষা করছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে, এখন আর কিছুই করার নেই তার। তার মা কোনোভাবেই তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে টু শব্দ করবে না। শুধু মা নয়, এবাড়িতে কারোই সেই সাহস নেই। তবে কিছু একটা করা উচিৎ। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থেকে অজপাড়াগাঁর বাচ্চা এক মেয়েকে বিয়ে করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া মেয়েদের অবস্থাও তো একবার দেখা উচিৎ। পড়াশোনার খাতিরে দেশ বিদেশে তার বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই। বিয়ের খবর পেলেই সকলে ঘাড়ে চেঁপে বসবে তার শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াতের জন্য। তখন কোন মুখে ওই ছোট্ট দু’ঘরের ছাপড়ায় নিয়ে যাবে তাদের? কপালের ঘাম মুছে আরও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। চিন্তিত মনে আবারও ফিরে এল বিছানায়। মোরশেদা বেগম এ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন বেশ খানিক্ষন হলো। তবে তার সেই সুগন্ধি পানের ঘ্রাণ এখনো রয়েই গেছে। পানের এই ঘ্রাণ পেলেই মাকে খুব করে মনে পড়ে তার। পেশার খাতিরে তার নানান শ্রেণির লোকের সাথে উঠাবসা হয়। তবে তার মায়ের মত পানের ঘ্রাণ এখনো কোথাও পায়নি সে। এ যেন উপরওয়ালা শুধু তার মায়ের জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছেন! মৃদু হেসে মেসবাহ বিছানায় শরীর মেলে দিতেই ফোন বেজে উঠলো তার। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই তার সামনে ভেসে উঠলো তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নাম। ছোট বেলা থেকেই যার কাজ নিজের সকল দোষ তার উপরে চাপিয়ে দেয়া। -“বিয়ে তাইলে করেই ফেললি!”
-“করার তো ইচ্ছে নেই। তবে ভাবসাব তো বলছে বিয়ে আমার হয়েই যাচ্ছে।”
-“শালা প্যাচাইস না। ঝেড়ে কাশ।”
ঘরের বাইরের দিকে নজর দিল মেসবাহ। তারপর হালকা কেশে বললো,
-“এসেছি কাল রাত দু’টোর পর। ভাবলাম অনেকদিন পর জব্বব একটা ঘুম দিব। কিন্তু ভোর না হতেই আব্বার চেচামেচিতে ঘুম গেল আমার আকাশে। উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে বসতেই আব্বা জানালেন, আমার মেয়েকে একবার দেখে আসতে হবে এবং তা এখনি। আমি দ্বিমত জানিয়ে বললাম, কোনো দরকার নেই। আপনি তো দেখেছেনই। তাতেই হবে। তবে কে শোনে কার কথা! যাকগে.. অবশেষে গেলাম মেয়ে দেখতে।”
-“আচ্ছা.. তারপর?”
-“তারপর তো তারপরই। আমি হতবাক! এনি আইডিয়া আমার হবু বউ কীসে পড়ে? ক্লাস এইটেরে… ক্লাস এইটে।”
খানিকক্ষণ থেমে ওপাশ থেকে লিমন বললো,
-“আর ইউ কিডিং মি?”
-“উহু.. আই অ্যাম সিরিয়াস।”
-“তাইলে তো ভালোই.. কচি মেয়ে পাচ্ছিস। একদম কচি। সেইরাম খেলা হবে।”
-“এত কচি মেয়ে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোর শখ হলে না হয় তুইই রাখ সেইরাম খেলার জন্য।”
মেসবাহর কথা শেষ হতেই গলা ছেড়ে হাসতে শুরু করলো লিমন। যেনো এর চেয়ে হাস্যকর কথা তার জীবনে শোনেনি সে।
-“এই তুই বন্ধু? চিন্তায় চিন্তায় আমি কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। আর তুই নির্দ্বিধায় হেসেই যাচ্ছিস!”
-“কী করবো বল? তোর যে বাপ! তার উপরে কারো সাধ্য আছে কিছু বলার? বাপ তো না যেনো আগুনের গোলা। কেউ কিছু বলতে গেলে তার আগুনের গোলার মাঝে থেকে এক মুঠো আগুন ছুঁড়ে দুনিয়া ছেড়ে তাকে পরকালের রাস্তা ধরিয়ে দেবে।”
বলে আবারও সমানতালে হাসতে শুরু করলো লিমন। তার হাসির জবাবে তাকে কড়া কিছু কথা শোনানোর ইচ্ছে থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়ে কল কেটে চোখজোড়া বুজলো মেসবাহ। আপাতত তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে হবে। পাঁচ ভাই বোনের মাঝে বড় ভাই মাজহারুল এবং বড় বোন অর্পাসহ তার নিজের তাদের বাবার মুখের উপরে কিছু বলার সাহস নেই। বাদ থাকলো মুবিন এবং অনা.. মুবিনের কথা বাবা উপেক্ষা করলেও অনার কথা ফেলার মত মন এখনো হয়ে উঠেনি তার। তাহলে কী একবার অনাকে দিয়েই চেষ্টা করিয়ে দেখবে? ভাবামাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। এগুলো লম্বা বারান্দা ধরে। দোতালার দক্ষিণের একদম কোণার ঘরেটি অনার। বেশ বড়সড় সেই ঘরটিতে বইপত্রের উপস্থিতি না মিললেও সাঁজগোঁজের জিনিসের অভাব নেই।
-“অপেক্ষা হলো শুদ্ধতম ভালোবাসার একটি চিহ্ন। সবাই ভালোবাসি বলতে পারে। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করে সেই ভালোবাসা প্রমাণ করতে পারে না…”
চৈতালির কথায় পাশ ফিরে তার হাতে হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাসের বইটি দেখে কপাল কুঁচকে গেল অনার। হাতের কাজল রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে সে বললো,
-“তুই কবে এসব গল্প উপন্যাস পড়া বন্ধ করবি বল তো? এসব তোকে শুধু মধুর স্বপ্ন দেখাবে কিন্তু তোর বাস্তব জীবন এসবের মতো সুন্দর করে তুলতে পারবে না। তখন আফসোস বিহীন বিকল্প কিছু থাকবে না তোর জীবনে।”
বই থেকে চোখ না উঠিয়েই চৈতালি বললো,
-“আফসোস করতে কিন্তু আমার ভালোই লাগে। এই যেমন ধর, আমি তোর মতো সুন্দরী হতে পারলাম না এই আফসোস আমার আজীবনই রয়ে যাবে।”
-“মজা করছিস?”
-“মোটেও না।”
ঠোঁট বাকিয়ে অনা বললো,
-“সৌন্দর্যের উদাহরণ দিতে গেলে সকলেই সেখানে তোকে টানে। এখন বল.. এনিয়ে কী বলার আছে তোর?”
বই বন্ধ করে অনার দিকে তাকালো চৈতালি। মিটিমিটি হেসে সে বললো,
-“অনেক কিছু বলার আছে আমার। শুনতে চাস? তাহলে কাছে আয়। আমার কপাল ছুঁয়ে দেখা।”
বলেই দৌড়ে ঘরের বাইরের দিকে এগুলো চৈতালি। ইশ! মেয়েটি কী দারুণ রূপবতী! কোমর সমান কোঁকড়াচুল নিয়ে যখন দৌড়ানো শুরু করলো তখন এক পলক দেখে মনে হচ্ছিল রূপকথার রাজ্য ছেড়ে কোনো পরী যেনো নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়ে জন্মালে নির্ঘাত এই মেয়ের প্রেমে পড়ে এতদিনে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেত। ভেবে মুচকি হেসে অনাও দৌড়ে এগুলো চৈতালির পিছুপিছু। আজ তাকে চৈতালির কপাল ছুঁতেই হবে। মেয়েটি এভাবে একেকদিন একেক খেলা দিয়ে তাকে হারিয়ে দিতে পারবে না। কখনোই না..
-“এই অনা? এভাবে কোথায় যাচ্ছিস? দৌড়াচ্ছিস কেন? কথা আছে তোর সাথে। দাঁড়া না!”
মেসবাহর ডাকে থেমে গেল চৈতালি। পেছন ফিরে অনাকে দেখামাত্রই সে ঠোঁট টিপে হেসে তার সামনে দাঁড়ানো মেসবাহর উদ্দেশ্যে বললো,
-“বরকে বর বর লাগছে না। কিছু একটা কম কম লাগছে। কী হতে পারে? মুখের হাসি নয় তো?”
-“কচু.. আমার ভাইকে সবসময়ই বর বর লাগে। তার বিয়ে থাকুক বা না থাকুক।”
খিলখিল করে হেসে উঠলো দুই বান্ধবী। তাদের দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“শুধুশুধু হাসবি না। কথা আছে তোর সাথে। ঘরে আয়।”
অনা বললো,
-“বয়েই গেছে আমার! তোমার কথা থাকলে তুমি আসবে আমার ঘরে। আমি কেনো যাবো?”
-“আচ্ছা। তোর যেতে হবে না। চল, তোর ঘরেই চল।”
মেসবাহর কথা শেষ হতেই চৈতালির কপাল ছুঁয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে এগুলো অনা। কেনো যেনো প্রচুর আনন্দ হচ্ছে তার। কেন? চৈতালির খেলায় সে জিততে পেরেছে বলে?
-“তোর ওই মেয়েকে পছন্দ হয়েছে?”
-“কোন মেয়ে?”
-“আমার সঙ্গে যার বিয়ে। কী যেন নাম…”
-“উল্লাসী..”
বোনের কথার পিঠে কিছু বললো না মেসবাহ। অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে তার মন। উল্লাসী আবার কেমন নাম? এমন নামও বুঝি মানুষের হয়?
-“আমার তো খারাপ লাগেনি। তবে অনেক ছোট। আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।”
-“এটাই তো সমস্যা। তুই জাস্ট ভাব তাহলে আমাদের মাঝে বয়সের পার্থক্য ঠিক কত হতে পারে! তবে এসব কথা আব্বাকে কে বোঝাবে? সে তো কিছু শুনতেই নারাজ।”
চিন্তিত গলায় অনা বললো,
-“এসব আমাকে কেনো বলছো? নিশ্চিত আমাকে আব্বার কাছে পাঠানোর পায়তারা করছো তুমি!”
-“তুই তো আমার একমাত্র ছোট আদরের বোন। তুই না বুঝলে এসব আর কে বুঝবে বল?”
-“অসম্ভব। আমি এসব নিয়ে আব্বার সাথে কথা বলতে পারবো না।”
বোনের হাত চেপে ধরলো মেসবাহ। অসহায় গলায় বললো,
-“প্লিজ.. তুই আমার শেষ ভরসা।”
ভাইয়ের হাতের মাঝ থেকে হাত ছাড়িয়ে দরজার দিকে এগুতে এগুতে অনা বললো,
-“এতবড় একটি বিষয় নিয়ে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমি পারবোও না কিছু বলতে। তোমার বিয়েতে অমত থাকলে তুমি আব্বাকে সব খুলে বলো। আব্বা এতটাও পাষাণ না যে তোমার সমস্যা বোঝার চেষ্টা করবে না।”
অনা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই হতাশ মনে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। উল্লাসী নামের মেয়েটির চেহারা বারবার ভেসে উঠছে তার সামনে। বাচ্চাসুলভ আচরণ তার মাঝে আছে কিনা তা জানা নেই। তবে মেয়েটির দুধে আলতা গায়ের রঙের মাঝে চিকন স্বাস্থ্যের লম্বা চওড়া গড়নের চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা ভাব রয়েছে। বড় বড় দুটি চোখ, তড়তড়া নাক, চিকন ঠোঁট যেনো তার বয়সের অপরিপক্কতা বোঝাতে উঠে পড়ে লেগেছে। তবে জোর করে মেয়েটি চলনে এক অস্বাভাবিক মন্থরতা এনেছে তার অপরিপক্কতা ঢাকার চেষ্টায়। যদিওবা তা আদৌ কোনো কাজে দিয়েছে বলে মনে হয়না। লম্বা কিছু দম ছেড়ে দরজা টেনে নিজের ঘরে ঢুকে টিশার্ট খুলে একটি স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে নিল মেসবাহ। তারপর খুব ধীরেসুস্থে এগুলো নিচতলার দিকে।
একটি পাটি বিছিয়ে তার সামনে হলুদ সহ নানান ফলমূল সাজিয়ে অপেক্ষা করছে অর্পা। তার পাশের চেয়ারে তিনবছরের মেয়ে মৌমিকে কোলে নিয়ে বসে বোনের কার্যক্রম দেখছে মাজহারুল। সাতমাসের বাচ্চাকে রেখে জ্যোতি যেদিন চলে গিয়েছিল মাজহারুলকে ফেলে সেদিন বুকটা ফেঁটে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল তার। শ্বাস নেয়া ভুলে গিয়েছিল, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তার। জ্যোতি কীভাবে পারলো এতবড় একটি পাপ করতে? বিশ্বাস হচ্ছিল না তার। মেনে নিতে পারছিল না। দীর্ঘদিন যাবৎ বাস্তবতা ছেড়ে দূরে পালিয়ে বেরিয়েছে। তবে সবশেষে ছোট্ট মৌমির মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিতে হয়েছে তাকে। কঠিন কিছু বাস্তবতা মেনে তাকে এগুতে হয়েছে পৃথিবীর বুকে। সব কিছুকে ভাষায় প্রকাশ করা গেলেও কষ্টকে তেমন একটা প্রকাশ করতে পারা যায় না। কারণ, কিছু কষ্ট থাকে যা কখনোই কাউকে বলা যায় না। নিজের মাঝেই চেপে রাখতে হয় দিনের পর দিন। আপন মানুষের দেয়া কষ্টও হয়তো এর মাঝেই একটি।
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_২
-“আমার জিনিস কইরে?”
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বোনের দিকে একনজর তাকিয়ে মুবিন বললো,
-“প্রতিবারই তোর জন্য কিছু না কিছু আনতেই হবে?”
-“তা আনতে হবে না? দুটো নয় তিনটে নয় তোমাদের একমাত্র আদরের ছোট বোন আমি।”
-“আহারে! তাতে যেন উনি সব উদ্ধার করে ফেলেছে!”
-“এমন করলে কিন্তু হবে না। ভালোই ভালোই কী এনেছো দেখিয়ে দাও।”
ক্লান্ত শরীর বিছানায় মেলে ঠোঁট ভর্তি হাসির ফোয়াড়া ছেড়ে বোনের দিকে তাকালো মুবিন। ভার্সিটি থেকে সকাল সকাল রওনা হলেও গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ে গেছে। ভাইয়ের বিয়ের খবর হঠাৎ করে পাবার ফলে টিকেট কাটার মতো সময় না পাওয়াতে অর্ধেক পথ দাঁড়িয়েই আসতে হয়েছে তাকে। যার ফলে কোমরটা ব্যথায় চিনচিন করছে। তবুও এসবের মাঝে ছোট্ট বোনটির একেকটি কর্মকাণ্ড যেন শান্তির অপর নাম। হাজারো ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরার পর বোনের প্রতিটি মুখের ধ্বনি নতুন উদ্যমে চলার শক্তি বয়ে আনে। এরই নাম বুঝি ভাইবোনের ভালোবাসা!
-“তুমি কী সত্যিই আমার জন্য কিছু আনো নি?”
বোনের অসহায় মাখা মুখের দিকে চেয়ে এপর্যায়ে মুবিন বললো,
-“ব্যাগ খুলে দেখ…”
ভাইয়ের অনুমতি পাওয়া মাত্র ব্যাগ খুলে একেএকে সব বের করতে শুরু করলো অনা। কিছু চকলেটসহ একটি বই হাতে নিয়ে সে এগিয়ে এল মুবিনের দিকে। মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,
-“আমার সাজগোজের জিনিস কই? তাছাড়া বই এনেছো কেনো? আমি কী এসব পড়ি?”
-“পড়িস না?”
-“উহু.. তবে থাক! চৈতালি বই পড়তে ভালোবাসে। ওকেই না হয় বইটি দিয়ে দিব।”
-“চৈতালি টা কে?”
-“আরে.. চৈতালি আমার বান্ধবী। তুমি কেনো যে ওর নাম মনে রাখতে পারো না!”
-“অহ.. হ্যাঁ। মনে পড়েছে।”
-“বেশ হয়েছে। এবার চলো। নিচে হলুদ নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। মেজভাইকে এক চিমটি হলুদ লাগিয়ে দিয়ে এসো তো!”
শরীর সায় না দিলেও বোনের কথামতো বিছানা ছেড়ে উঠে একটি টিশার্ট পড়ে নিল মুবিন। তারপর আয়নায় একবার নিজের চেহারা দেখে চোখে চশমা চাপিয়ে এগুলো বোনের পিছুপিছু। আজকাল পড়াশোনার চাপ খুব বেড়ে গেছে। রাত জেগে পড়লেই মাথার যন্ত্রনায় ছটফট করতে হয় সারাদিন। এমবিএটা কোনোমতে শেষ করলেই এসবের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ভেবে নিজেকে বুঝ দিয়ে আসলেও আজকাল বুঝেও শরীর টিকছে না। পড়াশোনার সকল অধ্যায় কবে চুকবে কে জানে!
-“মুবিন ভাই না? কেমন আছেন?”
একপলক পাশ ফিরেই চোখ সরিয়ে নিল মুবিন। অস্পষ্ট গলায় জবাব দিল,
-“ভালো..”
-“ভালো থাকলেই ভালো। তা দিনকাল ভালো যাচ্ছে তো? শুনলাম আপনার নাকি ভার্সিটির কোন মেয়েকে মনে ধরেছে!”
চৈতালির কথা শেষ হতেই মুবিনের ফর্সা টসটসে মুখ নিমেষেই কুচকে লাল হয়ে এল। কঠিন কিছু কথা চৈতালির উদ্দেশ্যে শোনাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সে। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ভাইয়ের মুখে হলুদের ছোঁয়া লাগিয়ে তার পাশে বসলো মুবিন। উদাস মনে আশেপাশের পরিবেশের দিকে দৃষ্টি দিতেই মাথা বেয়ে শরীরে পানির উপস্থিতি টের পেয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো অনা এবং চৈতালি। কী হলো এটা? তাকে ছাড়া আর কেউ কী নজরে আসেনি তাদের?
রঙ এবং পানি খেলার মাঝ থেকে উঠে মৌমিকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল মাজহারুল। গম্ভীর প্রকৃতির এই মানুষটিকে হাসিঠাট্টার দুনিয়া একদমই টানে না। বরং দুই মেরু এক হওয়ামাত্র তা বিকর্ষণে লেগে যায়। মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে আলমারি খুলে লেহেঙ্গা বের করলো সে। তারপর তা মেয়ের কাছে রেখে পা বাড়ালো তার পিতা আলাউদ্দীন শেখের ঘরের দিকে। হঠাৎ করেই বিষয়টি মাথায় এসেছে তার। মনভুলো স্বভাবের কারণে হয়তো খানিকবাদে তা মাথা থেকে বেরিয়েও যাবে। তার আগেই না হয় একবার এবিষয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনা করে আসা যাক…
-“আব্বা, আসবো?”
আছরের নামাজ সেরে তসবিহ জপছিলেন আলাউদ্দীন শেখ। অবশ্য বছর দুই আগে হজ্ব করে আসার পর থেকে তার নামের পূর্বে একটি হাজী শব্দ যোগ হয়ে পুরো নাম হয়েছে হাজী আলাউদ্দীন শেখ। গ্রামে প্রভাবশালী হবার কারণে তাকে সম্মান থেকেই হোক বা ভীতি, সকলে তাকে হাজীসাব নামেই ডেকে আসছেন। নামাজ কালাম অথবা দান দক্ষিনায় তার কমতি না থাকলেও মুখের ভাষায় কিছুতেই নিজেকে আয়ত্তে আনতে পারছেন না তিনি। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও মাথা ঠান্ডা রাখায় ব্যর্থ হওয়াই বেশকিছু সময় মুখের ভাষা নোংরা করে ফেলছেন। অবশ্য তাতে খুব বেশি একটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না তাকে। তার সকল চিন্তা আপাতত এসে আটকে আছে মেজ ছেলের বিয়েতে। বড় ছেলের বিয়ের দুবছরের মাথায় ছেলের বউ তাকে ফেলে চলে যাবার পর থেকেই পাড়ায় একপ্রকার ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিল তাদের নিয়ে। তবে তার হজ্ব সেরে আসার পর তা কমলেও সেই একই চিন্তা খেয়ে যাচ্ছে তাকে। আবারও একই অঘটন ঘটবে না তো!
-“আব্বা, আপনি যা করছেন তা কী আরেকটিবার ভাবা যায় না? মেয়েটির বয়স খুবই কম হয়ে যায়।”
বড় ছেলের কথায় জায়নামাজ ছেড়ে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ ছুড়ে আলাউদ্দীন শেখ বললেন,
-“তোমার পত্নীর বয়স কী কম আছিলো?”
-“জ্যোতির কথা থাক আব্বা।”
-“কেন? তা থাকবো কেন? তুমি কী চাইতোছো তোমার ভাইও তোমার মত পত্নীহারা হোক। লোকজন ছিঃ ছিঃ করুক তোমার ভাইরে নিয়া?”
-“না…”
-“তাইলে এইখান থাইকা যাও। নিজে যেইখানে নিজের পত্নীরে ধইরা রাখবার পারো নাই সেইখানে তোমার মুখে এইসব কথা মানায় না।”
বুকচিরে বেড়িয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো মাজহারুল। ধীর গলায় সে বললো,
-“এটা বাল্যবিবাহ হচ্ছে। আপনার নামে কেসও হয়ে যেতে পারে।”
-“হেহে.. শালার পুত পুলিশগো ভয় দেখাও আমায়? এসব পকেটে নিয়া আমি ঘুরি। যাও এখন। তোমার ব্যর্থ মুখখানা নিয়া এবার তুমি বিদায় হও।”
শান্ত পায়ে বাবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল মাজহারুল। এই স্বল্প সময়ের মাঝেই মৌমি লেহেঙ্গার নিচের পার্টটি টানাটানি করে পড়ে ফেলেছে। যদিওবা তা ঠিক জায়গা মতো নেই। তবুও দেখতে মন্দ লাগছে না। মেয়েটির চেহারা অবিকল হয়েছে জ্যোতির মত। জ্যোতির মত ছোট ছোট দুটি চোখ, তরতরা নাক, খাড়া দুটি কান। তার এবং জ্যোতির বিবাহিত জীবন অল্পদিনের হলেও মাঝেমধ্যে প্রায়ই তাকে খরগোশের বাচ্চা বলে ডেকে উঠতো মাজহারুল। ডাক শুনে নাক ফুলিয়ে আহ্লাদে গদগদ করলেও আড়ালে কী হাসতো জ্যোতি?
গরমের ভেতর শেরওয়ানি গায়ে চাপিয়ে বসে থাকা যেখানে দায় হয়ে পড়েছে সেখানে চারপাশে কিছু উটকো ঝামেলা নিয়ে খানিকক্ষণ বসে মেজাজ সপ্তমে উঠে গেছে মেসবাহর। সাধেই কী গ্রামের মেয়েদের পছন্দ নয় তার? কী আছে তার মাঝে? সে কী চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী? তাকে ঘিরে কেনো এত হৈচৈ? আর কেনই বা সকলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে তাকে ঘিরে রয়েছে? হাতের মুঠ চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পাটি ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগুলো মেসবাহ। চাঁদের আলোয় উঠোনে তার বাবা আলাউদ্দীন শেখকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে কারো হাত ধরে তাকে কোনো ব্যপারে আস্বস্ত করছেন তিনি। ভুল না হলে লোকটিই মেয়ের বাবা। কী কথা হচ্ছে তাদের মাঝে? নিশ্চয়ই তার মেয়েকে আজীবন খুশি রাখার প্রতিজ্ঞা করছেন তার বাবা। তবে তা কী আদৌ সম্ভব তার পক্ষে? তাছাড়া খুশি কী এক পাক্ষিক জিনিস? যা শুধু দিয়েই গেলাম কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পেলাম না?
-“বাপজান কিছু বলবা?”
আলাউদ্দীন শেখ মেসবাহর কাঁধে হাত রেখে প্রশ্নটি করতেই আস্থা খুঁজে পেল সে। বাবার দিকে চেয়ে ঢোক চেপে বললো,
-“আব্বা, মেয়ের বয়স খুবই কম। আপনার প্রতি সম্মান রেখে আমি আপনার পছন্দসই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তবে এই বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে আমার মন কোনোভাবেই টানছে না।”
ছেলের কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এল আলাউদ্দীন শেখের। রূঢ় গলায় তিনি বললেন,
-“চুপচাপ পিড়িতে যাইয়া বইসা পড়ো। বড়ডা মানসম্মান যা ডুবাই দিছিলো তা কামাইতে আমার বহুদিন লাগছে। তুমিও তার পথে হাইটো না।”
-“বড়ভাই তো ইচ্ছা করে কিছু করেনি। তার ভাগ্যে যা লেখা ছিল তা হয়েছে। তাছাড়া বিয়েতো সে আপনাদের পছন্দমতোই করেছিল। আর আব্বা, আপনি আমাকে এত টাকা খরচ করে বাইরে থেকে লেখা পড়া শিখিয়েছিলেন কী আজ এতবড় একটি অন্যায় করার জন্য?”
-“বেশি নাইচো না বাপজান। ভদ্র পোলার মতো যাইয়া পিড়িতে বসো। নয়তো আমার জুতা তোমার পিঠে। আল্লাহর কসম মাটিতে একখান পড়বো না।”
বাবার এমন কথায় খানিকটা চমকালেও নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। এরপর আর কিছুই করার বা বলার উপায় না পেয়ে নিরুপায় হয়ে আবারও ঘরে ফিরে এল সে। আশেপাশের সকলের দিকে একপলক তাকিয়ে পাটির উপর জবুথবু হয়ে বসতেই কাজীর প্রবেশ ঘটলো সেই ঘরে। নিরব দৃষ্টিতে কাজীর মুখের কথা শুনে একসময় শান্ত গলায় সে বলে উঠলো,
-“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩+৪
মাথার উপর ফুল স্পিডে ভনভনিয়ে ফ্যান চললেও কুল কুল করে ঘামছে উল্লাসী। তাকে ঘিরে চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। নতুন বউ দেখতে আসা পাড়ার মহিলাদের ভিড়ে গরমের তোপে একদম হাসফাস অবস্থা তার। অপরদিকে শাড়ি এবং গহনার ভাড়.. সবমিলিয়ে নিজেকে পুরো পাগল পাগল লাগছে। সব ছেড়ে ছুড়ে এক দৌড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে নিজের বাড়িতে। তবে সেখানেও বারণ রয়েছে। ছোটমা খুব ভালো করে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এবাড়িতে আসার পর কী কী করণীয় তার। এমন কোনো কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন যে কাজে এবাড়ির লোক অসন্তোষ হয়। তবে আপাতত কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার। চোখজোড়া জ্বলছে ফেলা আসা ছোট্ট বোনটির জন্য। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করছে। ছোট মা নিশ্চয়ই সুহাকে নানান জিনিস বলে কয়ে যত্নসহকারে খাওয়াবে না। তাহলে কী আজ পুরো রাত না খেয়েই কাটাবে সুহা?
-“বৌমা, এটা খাও।”
খুব কাছ থেকে এক মেয়েলী কণ্ঠস্বর কানে আসায় চোখজোড়া তুলে সামনে তাকাতেই বেশ বয়সী এক মহিলাকে দেখতে পেল উল্লাসী। তার দিকে ড্যাবডেবে চোখে তাকাতেই তিনি আবারও বলে উঠলেন,
-“কী ব্যাপার? নাও। জামাইয়ের খাওয়া দুধ একটু হলেও খাইতে হয়।”
অর্ধপূর্ণ দুধের গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়ে তা এক চুমুক খেয়ে আবারও ফিরিয়ে দিল উল্লাসী। তারপর আঁড়চোখে পাশের মানুষটির দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটায় টিপটিপ করে উঠলো। বেশ উঁচু স্বাস্থ্যবান পুরুষই বলা চলে লোকটিকে। শ্যাম বর্ণের শরীরের রঙের সাথে মুখ ভর্তি খোঁচাখোঁচা কালো দাঁড়িতে তাকে দেখতে কোনো অংশে দানবের চেয়ে কম লাগছে না। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ লোকটির পাশে বসে থাকলেও চোখ উঁচিয়ে তাকে দেখার সাহস হয়ে উঠেছিল না। কোথাও একটি জড়তা কাজ করছিল।
-“ভাবি.. ও ভাবি। আমার ভাবি.. প্রাণের ভাবি। এটা খাও তো।”
চিন্তা রাজ্যের বেড়াজাল ছিঁড়ে বাস্তবে প্রবেশ করতেই মুখের সামনে একটি চামচ দেখতে পেয়ে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো উল্লাসী। এবাড়িতে আসার পর থেকেই এটাসেটা তাকে খাইয়েই যাচ্ছে সকলে। ছোটোমোটো এক পেটে এত খাবার আটবে কিনা তা একবারও ভেবে দেখছে না এরা। খানিকটা বিরক্ত হয়ে চামুচের খাবার মুখে পুড়তেই পুরো মুখ তেতো হয়ে উঠলো উল্লাসীর। চোখমুখ কুঁচকে চামচ আঁকড়ে ধরে তাকে খাইয়ে দেয়া মেয়েটির দিকে তাকাতেই হোহো করে হেসে উঠলো সে। তার দিকে বুড়ো আঙুল মেলে ধরে বললো,
-“লবণের গল্প পড়োনি? লবণের সেই ঐতিহাসিক গল্পের স্মৃতিচারণ করতেই তোমাকে সামান্য লবণ খাইয়ে দিলাম আরকি!”
পাশ থেকে তার সমবয়সী আরও একজন মেয়ে এসে বললো,
-“তুমিও না! এত বোকা মানুষ হয়? চিনি এবং লবণের মাঝেই পার্থক্য করতে পারো না?”
তাদের করা উপহাস উপেক্ষা করে উল্লাসী খুব কষ্টে মুখ ভর্তি লবণ গিলে ফেলতেই দরজা ঠেলে একগ্লাস পানি হাতে ঘরে প্রবেশ করলো অর্পা। অনা এবং চৈতালির করা কার্যকলাপে তাদের সামান্য ঝেড়ে সে এগিয়ে এল ভাই এবং ভাই বউয়ের দিকে। পানির গ্লাস ভাইয়ের বউয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“ইশ কী একটা অবস্থা! মেয়ে দুটো আচ্ছা পাজি হচ্ছে দিনকেদিন! আর মেসবাহ তুইও! দেখছিসই যে ওরা এসব করছে তখন ওদের নিষেধ করবি না?”
এপর্যায়ে মুখ খুললো মেসবাহ। গম্ভীর গলায় বললো,
-“আমি কী করে জানবো ওরা চিনি না লবণ খাওয়াচ্ছে!”
-“তাও তো কথা! এই উল্লাসী? কতটুকো খাইয়েছে রে? খারাপ লাগছে কী?”
অর্পার করা প্রশ্নে মাথা ঝাকালো উল্লাসী। যার অর্থ ঠিক বোধগম্য হলো না অর্পার। তবুও গলা হালকা প্রসস্থ করে ঘরে থাকা সকলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলতেই একেএকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ভিড় জমানো সকলে। তারপর ভাইয়ের হাত ধরে তাকে উঠিয়ে বাইরে টেনে এনে বললো,
-“তুই আপাতত বাইরে থাক। ঘরে আমার কিছু কাজ আছে। কাজ হয়ে গেলেই তোকে ডাকবো।”
-“ঠিকাছে।”
লম্বা বারান্দা ধরে সামনে এগুলো মেসবাহ। বুকের ভেতরটায় প্রচুর ছটফট করছে তার। মনে চলা কথাগুলো দ্রুত গতিতে বারবার কানে এসে ঠেকছে। এমনটা তার সঙ্গে শেষ কবে হয়েছিল মনে করার চেষ্টা করলো মেসবাহ। দেশ ছেড়ে প্রথম যেদিন পা রেখেছিল বিদেশের মাটিতে সেদিন ঠিক এমন অদ্ভুত অনুভূতিই হচ্ছিল তার সঙ্গে। নিজের দেশ ফেলে অচেনা অজানা এক দেশে পাড়ি জমানোয় অদ্ভুত এই অনুভূতি হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। তবে আজ? আজ ঠিক কেনো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে?
বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। খানিকক্ষণ আগের গরমের সেই ভ্যাপসা ভাবটি এখন আর নেই। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পুরো ঘর শীতল করে তুলেছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা না হলেও বাতাসের তীব্রতার কারণে খানিকক্ষণ পরপর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে উল্লাসীর। সাথে মেঘের গর্জনে ভয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সুহা কী করছে এখন? মেঘের ডাকে ভয় পাচ্ছে না তো? ভয় পেলেও কী ছোট মা তাকে নিজের বুকে চেপে ধরছে? যেমনটা সে পরম মমতায় বুকে আঁকড়ে ধরতো সুহাকে? হ্যাঁ.. ছোট মা কথা দিয়েছে তাকে। বিয়েটা করলে খোকনের মত সুহাকেও ভালোবাসবেন তিনি। তাহলে আজ নিশ্চয়ই সুহা এবং খোকন দুজনকে একসাথে বুকে আঁকড়ে নিয়ে বসে রয়েছেন ছোট মা।
-“তোমার নাম যেনো কী?”
পুরুষালী কন্ঠ কানে আসতেই সম্মুখে চাইলো উল্লাসী। কাঁপা গলায় জবাব দিল,
-“উল্লাসী।”
-“কে রেখেছে এই নাম?”
-“মা।”
-“তোমার মাকে তাহলে দেখতে হচ্ছে। অদ্ভুত এক নাম রেখেছেন উনি। উল্লাসী.. গ্রামের এক মহিলার মাথায় এমন নাম এল কী করে তা সত্যিই ভাবাচ্ছে আমায়।”
-“আমার মা গ্রামের ছিলেন না। উনার বাবার বাড়ি ঢাকায়। বাবাকে বিয়ে করার পর উনি গ্রামে এসেছেন।”
মেসবাহ একটি চেয়ার টেনে উল্লাসীর মুখোমুখি বসে বললো,
-“ইন্ট্রেস্টিং। লাভ কেস নাকি?”
-“হু..”
-“গ্রেট। কয় ভাইবোন তোমরা?”
প্রশ্নটি প্রচুর কষ্ট দেয় উল্লাসীকে। তবুও জবাব দিতে হয়। যেখানে সকল প্রশ্নের উত্তর আছে সেখানে তার এই প্রশ্নের উত্তর থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এ প্রশ্নটির উত্তর না থাকলেই হয়তোবা ভালো হতো।
-“তিন ভাই বোন।”
-“অহ.. চোখের কাজল লেপ্টে পুরো মুখ ছড়িয়ে গেছে তোমার। মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো তুমি। ওপাশটায় ওয়াশরুম।”
মেসবাহ হাতের ইশারা করতেই বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে এগুলো উল্লাসী। লোকটি দেখতে দানব দানব হলেও কথা বলার ভঙ্গি অত্যন্ত মনোরম। ম্লান হেসে আয়নায় নিজের চেহারা দেখেই আঁতকে উঠলো উল্লাসী। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় কেঁদেছিল সে। বাবা এবং সুহাকে বুকে চেপে ধরে প্রচুর কেঁদেছিল। তবে তাতে কাজলের এত ভয়ংকর অবস্থা হবে তা মোটেও ধারণায় ছিল না তার। বালতিতে জমানো পানি থেকে একচোল পানি উঠিয়ে খুব দ্রুত চোখেমুখে দিল উল্লাসী। আশপাশে খুঁজে সাবানের সন্ধান না পেয়ে হতাশ হয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে কাজল মোছার কাজে লেগে পড়লো সে।
-“নীচে শুতে সমস্যা হবে না তো তোমার?”
গামছায় চোখমুখ মুছে মেঝেতে বিছানো চাদরের দিকে তাকিয়ে উল্লাসী ধীর গলায় বললো,
-“না..”
-“গুড। শুয়ে পড়ো এখানে।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে শরীর মেলে দিল মেসবাহ। সারাদিনের চিন্তা এবং ক্লান্তির চোটে ঘুমে চোখজোড়া আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার। তাই বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো সে। অপরদিকে খানিকক্ষণ গামছা হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকার পর অন্ধকার ঘরে হাতরিয়ে হাতরিয়ে সামনে এগুলো উল্লাসী। ছোটমার কথামতো স্বামীর একটি কথাও অগ্রাহ্য করা যাবে না। তাতে উপরওয়ালা নারাজ হবে। শুধুশুধু উপরওয়ালাকে নারাজ করে কী লাভ? দীর্ঘশ্বাস ফেলে একদন্ড ভেবে পরণের শাড়ি খুলে তার ভেতর সকল গহনাদি খুলে তা মাথার কাছে রাখলো উল্লাসী। তারপর নিশ্চিন্তমনে নিদ্রার আয়োজন করলো। ভয় লাগছে তার। অচেনা এক বাড়িতে এই প্রথম একা রয়েছে সে। না সাথে আছে সুহা আর না বাবা…
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৪
বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাবার কারণে বাড়ি না ফেরার সিদ্ধান্ত নিল চৈতালি। একদম কাল সকালেই না হয় বাড়ি ফেরা যাবে। তবে বাবাকে খবর খানা পৌঁছে দিতে হবে। অনার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চৈতালি এগুলো আলাউদ্দীন শেখের ঘরের দিকে। ওঘরে একটি টেলিফোন রয়েছে। যা দিয়েই বাড়ির বাইরে থাকা সকল সদস্যের খবরাখবর নেয়া হয়। তাদের বাড়িতেও অবশ্য একটি টেলিফোন রয়েছে। তবে তা বেশ পুরোনো আমলের। দাদার কালের। গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে ধীর পায়ে লম্বা বারান্দা ধরে এগুচ্ছিল চৈতালি। আচমকা পেছন থেকে হালকা টান অনুভব করলো সে। কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্ধকার আচ্ছন্ন এক ঘরে নিজের উপস্থিতি টের পেয়ে আঁতকে উঠলো বুকের ভেতরটা। তবে পরমুহূর্তেই ঘাড়ে পড়া একেকটি চিরচেনা নিঃশ্বাসে আত্মায় পানি ফিরে এল তার। ঠোঁটে ফুটলো একরাশ মিষ্টি হাসি।
-“খুব প্রেম পাচ্ছে বুঝি?”
জবাবে চৈতালির কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে মুবিন বললো,
-“ভালোবাসি..”
পরম আবেশে চৈতালি চোখজোড়া বুজে সজোরে কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে পেছন ফিরে জড়িয়ে ধরলো মুবিনকে। দুমাস আগে রোযার ঈদের ভেতর শেষ দেখা হয়েছিল তার মুবিনের সঙ্গে। তারপর মাঝেমধ্যে টেলিফোনে কথা হলেও তার স্থায়িত্বকাল খুব বেশি দীর্ঘ ছিল না। তবে ভালোবাসায় দূরত্ব থাকা উচিৎ। দূরত্ব কখনোই ভালোবাসা কমাতে পারেনা, সম্পর্ক নষ্ট করতে পারেনা। এতে শুধুই ভালোবাসা বাড়ে। যে ভালোবাসার নেই কোনো সীমাপরিসীমা।
-“কাঁদছো?”
মুবিনকে ছেড়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চৈতালি বললো,
-“তোমার জন্য কাঁদতে আমার বয়েই গেছে!”
-“না কাঁদলেই ভালো। এখন কাঁদতে দেখলে মার একটাও মাটিতে পড়তো না। তা বই পেয়েছো?”
-“পেয়েছি। নিজে না দিয়ে অনাকে দিয়ে দেয়ানোর কী দরকার ছিল? আবার ওকে এও নাকি বলেছো চৈতালি কে?”
হেসে উঠলো মুবিন। দু’হাতে চৈতালির কোমর চেপে তাকে শরীরের সাথে লেপ্টে নিয়ে বললো,
-“আর নিজে যে আমাকে পানিতে চুবানি খাওয়ালে.. তা কিছুই না?”
-“ইশ! নিজে কেনো আমার উপর চোখ রাঙ্গালেন?”
-“আর নিজে যে বললে আমার নাকি ভার্সিটিতে কাকে মনে ধরেছে!”
-“তো ধরেনি? কাওকে মনে না ধরলে আমাকে ছাড়া দিনের পর দিন কীভাবে কাটাও তুমি? কষ্ট হয় না একটুও বুঝি?”
-“হয় তো.. প্রচুর কষ্ট হয়৷ তাই তো একবার কাছে পেলেই সবটা একেবারে উশুল করতে লেগে পড়ি।”
বলেই চৈতালির গালে এলোপাথাড়ি চুমু দিতে শুরু করতেই নিজেকে মুবিনের বাহুডোর থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো চৈতালি। দু’হাতে মুবিনের ঠোঁট চেপে ধরে লাজুক এক হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে সে বললো,
-“কেউ দেখে ফেলবে তো! দেখি ছাড়ো। আজ রাতে এখানে থাকবো তা বাবাকে জানাতে হবে। বেশি রাত হয়ে গেলে আবার তোমার আব্বা শুয়ে পড়বেন।”
হাতের বাঁধন শিথিল করে মুবিন বললো,
-“তাহলে চাচাকে খবরটা দিয়ে দ্রুত ছাদে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করবো।”
-“মোটেও না। ঘুম ভেঙে অনা আমাকে কাছে না পেলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।”
-“আরে! ও উঠবেই না। সারাদিন প্রচুর দৌড়ঝাঁপ করেছে। শুলেই দেখবে ঘুমে তলিয়ে গেছে।”
-“জ্বি না। আপনার চালাকি আমি খুব বুঝি! জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে যান ঘুমিয়ে পড়ুন।”
নিজেকে মুবিনের হাত থেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে অন্ধকারে মিশে গেল চৈতালি। মুবিন গ্রামে এলেই বুকের ভেতরটা সবসময় ছটফট করতে থাকে তার। এই বুঝি মুবিন আসবে আর তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ভালোবাসার অথৈ সাগরে! এত সুখ কেনো ভালোবাসায়?
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগুতেই মেঝেতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা উল্লাসী নজরে এল মেসবাহর। মেয়েটির গায়ে ব্লাউজ এবং পেটিকোট ছাড়া তৃতীয় কোনো বস্ত্র নেই। বিয়ের শাড়ি পরে রয়েছে মাথার কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিক থেকে নজর সরিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অনার উদ্দেশ্যে সে বললো,
-“নিচে আসছি। তুই যা।”
তারপর এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। চোখমুখে কোনোরকম পানির ঝাপটা মেরে আবারও ফিরে এল ঘরে। উল্লাসীর পাশে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো তাকে।
মোটা পুরুষালী গলায় নিজের নাম উচ্চারিত হচ্ছে শুনেও চোখ মেললো না উল্লাসী। গতকালের সারাদিনের ধকলের পর মেঝেতে শরীর মেলে দেয়ার পরপরই শরীরের ব্যথায় পুরো শরীর চিনচিন করছিল তার। ব্যথাজর্জর শরীর নিয়ে কখন ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল সেটিও অজানা। তবে আপাতত ঘুমের ভাব কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। আরও কয়েকদন্ড শুয়ে শুয়ে সুহার সঙ্গে কাটানো মধুর কিছু সময়ের স্মৃতিচারণ করতে মন উঠে পড়ে লেগেছে।
-“এই উল্লাসী? উঠো। উঠে দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। আমি নিচে যাচ্ছি।”
মেসবাহর অনুপস্থিতিতে খানিকক্ষণ সেভাবেই কাটানোর পর চোখজোড়া মেলে চারপাশটায় নজর দিল উল্লাসী। এবং প্রায় সাথেসাথেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তার। তার স্বামী তাকে ডাকছিল, অথচ সে তার কথার অবাধ্য হয়ে নিঃশ্চিন্তায় সেভাবেই পড়ে রয়েছিল? তার এ কাজের ফলে উনি কী অসন্তোষ হবেন? আর অসন্তোষ হলেই বা কী করবেন? বকবেন নাকি মারবেন? আঁতকে উঠা মন নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো উল্লাসী। মেঝেতে বিছানো চাদর এবং বালিশ উঠিয়ে শাড়ি গায়ে জড়াতেই ঘরে আগমন ঘটলো মোরশেদা বেগমের। একনজরে ছেলের বউকে আদ্যোপান্ত দেখে তিনি বললেন,
-“মেসবাহ তোমার সঙ্গে কোনো বাজে ব্যবহার করেছে কী?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল উল্লাসী। ঢোক চেপে ধীর গলায় বললো,
-“উহু…”
অস্থির মনে শান্তি ফিরে পেলেন মোরশেদা বেগম। এগিয়ে এসে উল্লাসীর চুলে হাত রেখে জানতে চাইলেন,
-“গোছল দাও নি?”
-“উহু…”
-“কেনো? তেমন কিছু কী হয় নি?”
মোরশেদা বেগমের ছোঁড়া প্রশ্ন ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না উল্লাসী। মেঝের দিকে তাকিয়ে সে হাতের নখ কচলাতে শুরু করতেই ওপাশ থেকে মোরশেদা বেগম আবারও বললেন,
-“পাক পবিত্রতা আল্লাহর নেয়ামতের অংশ। এসব করার পর সবসময় গোছল করে নাপাক শরীর পবিত্র করে নিবা। বুঝছো?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী সম্মতি জানাতেই তার শাড়ির দিকে নজর দিলেন মোরশেদা বেগম। ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,
-“শাড়ি পড়তে জানো না?”
-“উহু…”
-“সমস্যা নেই। তুমি গোছলের জন্য ঢোকো। আমি অর্পাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ.. কলা পাতা রঙের শাড়িটা পড়বে। মেসবাহর পছন্দের রঙ ওইটা।”
মিষ্টি এক সকাল। চারিপাশ থেকে বেয়ে আসা হিমেল হাওয়া, নরম দু’টুকরো রোদ, আশপাশের সজীব করা প্রকৃতি, সবুজে ঘেড়া গাছগাছালীর ডালে বসে নির্বিকারভাবে ডেকে যাওয়া পাখির সুমধুর কন্ঠ… সব মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। মুগ্ধতায় মন ভরে উঠার মত পরিবেশ হলেও তা স্পর্শ করতে পারলো না মেসবাহকে। মনের গহীনে ভেসে বেড়ানো মেয়েটির সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই মিল নেই উল্লাসীর। নিজের সহধর্মিণীর বেশে কোনোভাবেই সে বসাতে পারছেনা তাকে। অস্থির লাগছে। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক কষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদের রেলিঙে হাত রাখতেই পেছন থেকে বড় বোন অর্পার গলার স্বর শুনতে পেল মেসবাহ। চাপা গলায় সে কাওকে আদেশ দিয়ে যাচ্ছে, ‘সাঁজ যেনো কোনোভাবেই নষ্ট না হয় এবং মেসবাহ যা বলবে সবটাই চুপচাপ শুনে তা মেনে নেবে। ঠিকাছে?’ বোনের কথা শুনে আর বুঝে উঠতে বাকি রইলো না ঠিক কাকে আদেশ দিয়ে তার কাছে পাঠানো হচ্ছে। লম্বা কিছু দম ছেড়ে আকাশপানে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর পেছন ফিরলো মেসবাহ। তার সম্মুখে দাঁড়ানো উল্লাসীর আপাদমস্তক দেখে গম্ভীরমুখে বললো,
-“কে সাজিয়ে দিয়েছে?”
জবাবে ক্ষীণ গলায় উল্লাসী বললো,
-“অর্পা আপা।”
-“আর সাজবে না ওর কাছ থেকে।”
-“জ্বি, আচ্ছা।”
-“তোমাকে মোটেও ভালো দেখাচ্ছে না এই সাজে। তাছাড়া তোমার বয়সও নয় এখন সেজেগুজে স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবার।”
-“আচ্ছা..”
-“যাও.. গিয়ে শাড়ি বদলিয়ে অন্যকিছু পড়ে নাও। শাড়ি পড়ার সময় এখনো হয়নি তোমার। তাছাড়া ক্যারি করারও একটি ব্যাপার আছে। বুঝি না আমি! যে যা বলবে তাই তুমি করবে? একজন শাড়ি পড়তে বলবে আরেকজন সঙ সাজিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেবে.. তাই তুমি মেনে নেবে? একবার আয়নায় তাকিয়ে দেখে নেবে না নিজেকে? এই হচ্ছে বাচ্চা মেয়েদের সমস্যা। নিজস্বতা বলতে এদের কিছুই থাকে না।”
ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না উল্লাসীর। সে নিজেকে দেখেছে আয়নায়। দেখতে তো বাজে দেখাচ্ছিল না তাকে। তারপরও কেনো ভালো লাগলো না উনার? ছোটমা বারবার বলে দিয়েছেন স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে। কিন্তু ঠিক কী করলে, কীভাবে সাজলে স্বামীর মন জোগাতে সফল হবে সে?
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৫+৬
সকালের খাবারের পাঠ চুকেছে বেশ খানিকক্ষণ। তবে এবাড়ির সকল সদস্যর সাথে একসাথে খেতে বসে সংকোচে কাজ করছিল উল্লাসীর। যার ফলে ইচ্ছে থাকা সত্বেও তেমন কিছু পেটে পুড়তে পারেনি সে। এখন হালকা ক্ষুধাভাব পেলেও কাউকে কিছু বলা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে একরকম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। এমতবস্থায় শাড়ির আঁচলে টান অনুভব করতেই পিছন ফিরলো উল্লাসী। ছোট্ট বছর চারেকের মত এক বাচ্চা ঠোঁট ভর্তি হাসি নিয়ে তার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে আসার আগে অবশ্য ছোটমা এবাড়ির আদ্যোপান্ত জানিয়েছে তাকে। ছোট থেকে শুরু করে এবাড়ির প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে দিয়েছে নানান তথ্য। যা ভুল না হলে এমেয়ের নাম মৌমি। জন্মের পর মা ছেড়ে চলে গেলে বাবার ছায়ায় যে বেড়ে উঠছে ধীরেধীরে। আশ্চর্যজনক হলেও তার নিয়তির সঙ্গে মেয়েটির নিয়তি অনেকটাই মিলে যায়। তবে অমিল শুধু রয়ে যায় একটি জায়গায়। মেয়েটির বাবা মায়ের ছায়া না খুঁজে নিজেই তার মা হয়ে উঠেছে। যা আজকালকার দিনে দূর্লভ এক ব্যাপার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে মৌমিকে কোলে উঠালো উল্লাসী। তারপর ধীরপায়ে এগুলো বিছানার দিকে।
-“তুমিই কী আমার আম্মু?”
মৌমির ছোঁড়া প্রশ্নে একদন্ড ভেবে উল্লাসী জবাব দিল,
-“উহু..”
-“বাবা যে বললো তুমিই আমার আম্মু!”
-“বাবা যেহেতু বলেছে তাহলে হয়তো আমিই তোমার আম্মু।”
-“তাহলে প্রথমে কেনো উহু বললে?”
এপ্রশ্নের ঠিক কি জবাব দেবে তা ভেবে পেল না উল্লাসী! মৌমির চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
-“জানো? তোমার মত আমার ছোট্ট একটি বোন আছে?”
-“কী নাম ওর? আর কোথায় ও?”
-“আমাদের বাড়িতে।”
-“অহ বুঝেছি! তাহলে তুমি ওর জন্যই এতদিন আমার কাছে আসোনি.. না?”
বিবর্ণ ঠোঁটে হাসি ফুটলো উল্লাসীর। মৌমির কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-“জানি না। তবে তোমার বাবা বললে ঠিকাছে।”
-“কেনো? বাবা বললে ঠিক থাকবে কেনো?”
-“কারণ, বড়রা কখনোই মিথ্যে বলেনা। তাছাড়া ছোটমাও বলে দিয়েছে এবাড়ির সকলের কথা মেনে চলতে।”
-“ছোটমা কে?”
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করলো মেসবাহ। তার উপস্থিতিতে চুপসে গেল উল্লাসী। শান্ত বেশে মৌমির হাত চেপে চুপচাপ বসে রইলো সে।
-“মেজ বাবা? ও মেজ বাবা…”
হাতের ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে মৌমির দিকে এগিয়ে এল মেসবাহ। একটি চেয়ার টেনে বসে আদুরে গলায় বললো,
-“কী লাগবে আমার আম্মার?”
-“কিচ্ছুটিই না। জানো? আম্মু এতদিন আম্মুর বোনের জন্য আমার কাছে আসেনি? আমার তো ওর জন্য রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওকে একটি মেরে দাঁত ফেলে দেই।”
মৌমির কথা বোধগম্য হলো না মেসবাহর। কপাল কুঁচকে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উল্লাসীর দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল উল্লাসীর। মৌমি তাকে আম্মু বলায় কী রাগ করেছেন উনি? কিন্তু সে নিজে তো কিছু বলেনি। মৌমির বাবাই তো ওকে শিখিয়ে দিয়েছেন!
-“ও বাবা! শিশি পেয়েছে।”
মৌমির কথায় তাড়াহুড়ো করে মেসবাহ চেয়ার ছেড়ে উঠে তার দিকে হাত বাড়াতেই পিছিয়ে গেল মৌমি। আহ্লাদী গলায় বললো,
-“আম্মুর কাছে শিশি করবো।”
একপলক মেসবাহর দিকে তাকিয়েই মৌমিকে কোলে চাপিয়ে দ্রুতপায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগুলো উল্লাসী। উনি ক্ষেপেছেন। প্রচুর ক্ষেপেছেন। হয়তো সকালের মতো খানিকক্ষণ বকাবকিও করবেন! উল্লাসী সচকিত মনে মৌমিকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসতেই তার কোল ছেড়ে নেমে একদৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মৌমি। তার যাত্রাপথের দিকে খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেসবাহ। এরপর গম্ভীর গলায় বললো,
-“আম্মু তোমায় ডাকছে মৌমি?”
ঢোক চেপে হালকা মাথা নেড়ে উল্লাসী সম্মতি জানাতেই মেসবাহ আবারও বললো,
-“কে শিখিয়েছে?”
-“ওর বাবা…”
ভাইয়ের কথা আসতেই খানিকটা নরম হয়ে এল মেসবাহ। দু’কদম এগিয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে চোখজোড়া বুজে কিছুক্ষণ কাটানোর পর ধীর গলায় সে বললো,
-“শাড়ি এখনো বদলাওনি কেনো? যা তুমি ঠিকঠাক রাখতে পারবে না সেগুলো পড়বেও না। যে কাজে নিজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে সেগুলোই করার চেষ্টা করবে।”
-“জ্বি আচ্ছা।”
-“যাও.. শাড়ি বদলে অন্যকিছু পড়ে নাও।”
-“কিন্তু শাড়ি ছাড়া তো অন্য কিছু নেই আমার।”
চোখ মেলে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“তোমার বাড়িতে কী পড়েছো তুমি?”
-“সালোয়ার কামিজ।”
-“তাহলে ওগুলোই পড়ো।”
-“কিন্তু ছোটমা তো বলেছে মেয়েদের বিয়ের পর শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পড়তে হয় না।”
বিরক্ত হলো মেসবাহ। আবারও চোখ বুজে ছোট্ট কিছু নিঃশ্বাস ফেলে সে বললো,
-“ইললজিক্যাল কথাবার্তা যতসব! চোখে আলো লাগছে। দরজা চাপিয়ে দিয়ে তুমি এখন যাও। আমি ঘুমোবো কিছুক্ষণ।”
মেসবাহর আদেশ পেয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো উল্লাসী। দরজা টেনে লম্বা বারান্দা ধরে সামান্য এগিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়লো সে। ভর দুপুরের চড়া রোদ গায়ে এসে লাগছে তার। তীব্র এই রোদের প্রখরতায় গায়ে জ্বালা ধরলেও নড়লো না উল্লাসী। রাশভারী চোখে তাকিয়ে রইলো উঠানের দিকে। সেখানে ছোট একটি বিড়ালের পেছনে পেছনে দৌড়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছে মৌমি। তীব্র রোদে তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে উঠলেও চোখেমুখে তার অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম.. বিছানায় শরীর মেলে জোর গলায় কয়েকবার অনাকে ডেকে উঠলো মুবিন। হঠাৎ করেই মাথাটা ধরেছে। একজন মাথা বানিয়ে দিলে হয়তো আরাম পাওয়া যেত!
-“ডাকছিলে?”
অনার উপস্থিতিতে স্বস্তি ফিরে পেল মুবিন। চোখজোড়া বুজে বোনের উদ্দেশ্যে বললো,
-“একটু মাথাটা টিপে দে। মাথার ব্যথার অসহ্য লাগছে।”
-“মাথা টিপে দিলে তাহলে কী পাবো আমি? বিনামূল্যে আমি কোনো কাজ করিনা।”
-“রাতে ঠান্ডা খাওয়াবো.. যা।”
চোখমুখ কুঁচকে অনা বললো,
-“শুধু ঠান্ডা?”
-“আর কী চাস? দু’দন্ড কাজের কত পারিশ্রমিক চাস তুই?”
-“পারিশ্রমিক বলছো কেন? এগুলো হচ্ছে বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা।”
মুবিনের পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখলো অনা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“এর পরের বার আসতে আমার জন্য সাজুগুজুর জিনিস আনবে মনে করে। এসব বই-পুস্তক আর আনবে না। ওসব কী আমি পড়ি?”
পরম শান্তিতে চোখজোড়া বুজে হালকা হেসে মুবিন বললো,
-“ওসব সাজুগুজুর জিনিস আমায় দ্বারা কেনা হবে না।”
-“এহ! ঠিকই কিনবে একসময়। আজ বোন বলে এসব বলছো। কাল যখন বউ চাইবে তখন কী বলবে?”
-“তোর মতো সাজুনী হবে নাকি আমার বউ!”
-“তো চৈতালির মতো বই পড়ুয়া হবে?”
অনার কথার পিঠে কিছু বললো না মুবিন। নীরবে খানিকক্ষণ কাটানোর পর নরম গলায় বললো,
-“তোর বান্ধবী চলে গেছে?”
-“হ্যাঁ.. একটু আগেই গেছে। জানো, আমার মাঝেমাঝেই মনে হয় ও আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে!”
-“হঠাৎ এমন মনে হবার কী কারণ?”
-“ছোট বেলা থেকেই তো ওকে দেখে আসছি। তাছাড়া ও নিজেও ওদের বাড়ির চেয়ে আমাদের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। আমি ওকে খুব ভালো করে চিনি, ভাই। ও কিছু তো একটা নিশ্চিত লুকাচ্ছে আমার কাছ থেকে!”
আবারও নিশ্চুপ হয়ে গেল মুবিন। মাথার ব্যথা অনেকটাই কমে এসেছে। শুধু মাঝেমাঝে কপালের ডান পাশটায় হালকা ঝিনঝিন করে উঠছে।
রাতে সকলে একসাথে খেতে বসে আলাউদ্দীন শেখ কোরবানির গরুর কথা উঠালেন। সকলের সাথে আলোচনা করে মাজহারুলের উপর গরু কেনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি মেসবাহকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“বাপজান ঈদের পর কয়দিন আছাও?”
-“একদিন আছি।”
-“অহ.. তা বৌমারে নিতেছো তো?”
একদন্ড ভেবে মেসবাহ বললো,
-“জ্বি না, আব্বা।”
-“কেন?”
ঠিক কি উত্তর দেবে না ভেবে পেল না মেসবাহ। শিক্ষিত এক লোক বাল্যবিবাহর মত নিকৃষ্ট এক কাজ করেছে! তার সোসাইটির লোকেরা একাজ কখনোই ভালো চোখে দেখবে না। সকলের চোখে তাকে নিয়ে যে সম্মান ছিল তা হারিয়ে ফেলবে সে। তাকে নিয়ে নানান সমালোচনা হবে, হাসাহাসি করবে সকলে। এমনকি তার পেশাগত দিকেও এর প্রভাব পড়বে। তাছাড়া তার স্ট্যাটাস, পজিশন.. কোনোএকটার সাথেও যায় না উল্লাসী। আর না উল্লাসী সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। আজ বাচ্চা একটি মেয়ের জায়গায় প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো গ্রাম্য মেয়ে হলেও তার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা রাখতো মেসবাহ। নিজেই তাকে তৈরি করে নিত নিজের চাহিদা মতো। কিন্তু উল্লাসী.. বাচ্চা একটি মেয়ে। তার কাছে কী প্রত্যাশা রাখবে সে? প্রত্যাশার মানেই হয়তো জানা নেই তার।
-“তুমি থাকবা ওইখানে আর বউ থাকবো এইখানে। তাইলে আর প্রেম পিরিত কেমনে হইবো তোমাগো মাঝে? দেখা যাইবো কিছুদিন পর খবর আসবো হাজীসাবের মেজ বউ কোন পোলার লগে ভাগছে। খুব সুন্দর কথা হইবো.. না?”
ভাতের প্লেট থেকে হাত উঠিয়ে মেসবাহ তাকালো তার বাবার দিকে। ক্ষীণ গলায় বললো,
-“আব্বা, এবিষয়ে আমাকে জোর করবেন না। আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করে আমি বিয়েটা করেছি। কিন্তু তাই বলে…”
-“তুমি যা বললা আরেকবার বলো! তোমার সাহস হয় কেমনে এই কথা মুখ দিয়া বাইর করার?”
আলাউদ্দিন শেখের মেজাজের সাথেসাথে তার গলার স্বর বাড়তে দেখে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো মাজহারুল। মুখে কথা আসলেও কিছুই বললো না সে। নির্বাক শ্রোতা বেশে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো মেসবাহর দিকে।
-“তোমারে আবারও আমি জিগাইতেছি। তুমি বৌমারে নিবা কী নিবা না?”
-“আব্বা, প্লিজ।”
-“এই শেষবার ভালো করে জিগাইতেছি। তারপর যা হইবো তার জন্য শুধু দায়ী হইবা তুমি। কথা খানা মাথায় রাইখা উত্তর দিও। তুমি তোমার লগে বৌমারে নিবা?”
-“জ্বি.. নিব।”
লম্বা একটি দম ছেড়ে চোখজোড়া বুজে মেসবাহ কথাটি বলেই উঠে পড়লো টেবিল ছেড়ে। কিছুসময় তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নজর সরিয়ে উল্লাসীর দিকে দিল মোরশেদা বেগম। ইশারায় তাকে মেসবাহর পিছুপিছু যেতে আদেশ করলেও তা বোঝায় ব্যর্থ হলো উল্লাসী। তবে পরমুহূর্তেই পাশ থেকে অর্পা ধীর গলায় মেসবাহর পিছুপিছু তাকে যাবার কথা বলতেই খাবার ফেলে উঠে পড়লো সে। দ্রুত পায়ে ছুটলো সেদিকে।
-“কী সমস্যা? তুমি কেনো এখানে এসেছো? তোমাকে আসতে বলেছি আমি? তাহলে কেনো এসেছো? নিশ্চয়ই তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তুমিও কুকুরের মতো ওদের কথা শুনে নাচতে নাচতে এখানে চলে এসেছো! নিজস্বতা বলতে কিছু নেই তোমার? অবশ্য তোমার কীভাবে থাকবে যেখানে আমার নিজেরই নেই! এবাড়িতে কারো সেই অধিকার নেই। দিস হাউজ ইজ রুইননিং মাই লাইফ।”
রাগে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে মেসবাহর। খুবই ঠান্ডা মাথার একজন মানুষ তিনি। সকলের সঙ্গে ঠান্ডা মেজাজেই কথা বলে অভ্যস্ত। তাছাড়া মাঝেমাঝে কারো উপর রেগে গেলেও তা শুধু গম্ভীরমুখে কথা বলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে আজ নিজের ভেতরের এই ক্রোধকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না মেসবাহ। হাতের পাশের ফুলদানিটি ছুঁড়ে ফেলে আবারও চেচিয়ে উঠলো সে। ক্ষিপ্র গলায় বললো,
-“বের হও। এখনি বের হও। তোমার চেহারাও দেখতে চাই না আমি। বের হও বলছি!”
আতংকে কাঁপা বুক নিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল উল্লাসী। প্রচুর কান্না পাচ্ছে তার। কেনো শুধুশুধু বকেন উনি? সে নিজে তো কিছু বলেনি। যা বলেছেন উনার বাবা বলেছেন। উনাকে বকেছেন। এখানে ঠিক তার দোষ কোথায়? চোখভর্তি জল নিয়ে দেয়ালে শরীর ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো উল্লাসী। আজ অনেকদিন পর মাকে খুব করে মনে পড়ছে। মায়ের কোলে মাথা গুঁজে অঝোর ধারায় কাঁদতে ইচ্ছে করছে। একটিবার কী আসবে তার মা মেয়ের আবদার পূরণ করতে?
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৬
বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে পদার্পণের দিন দশেকের মতো হয়ে এসেছে উল্লাসীর। এর মাঝে না বাবার বাড়ি থেকে কেউ দেখতে এসেছে তাকে আর না সে নিজে গিয়েছে সেখানে। ছোট্ট বোনটির জন্য মন সবসময় আকুপাকু করলেও কাউকে কিচ্ছুটি বলার সাহস করে উঠতে পারেনি সে। তবে আজ তো ঈদ। মিলনের দিন। সকল কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে উঠার দিন। ঈদের মত একটি দিনেও কী তাহলে সে দেখা পাবে না সুহার? সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই বাড়িতে কাটানো ঈদের সকালগুলো খুব করে মনে পড়ছে। সকল বাঁধা অতিক্রম করে একটিবার দৌড়ে নিজের সেই কুটিরে যেতে মন টানছে৷ সে না হয় এবাড়ির মানুষজনকে সাহস করে কিছু বলে না উঠার ফলে যেতে পারছে না বাড়িতে। কিন্তু বাবা? সে কেনো এখানে আসেনা একটিবার তাকে দেখতে? তার বুঝি মনে পড়ে না তার এই মেয়েকে! একটিবার বুকে আঁগলে নিতে ইচ্ছে করেনা? তাছাড়া খুব বেশি ভুল না হলে কালই তাকে স্বামীর সঙ্গে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। তাহলে কী শহরে যাবার আগে সুহা, বাবা.. এদের সঙ্গে দেখা হবে না তার? উত্তরে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল উল্লাসীর। খিচুড়ির চুলোর আঁচ কমিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে সে পা বাড়ালো উঠোনের দিকে। উঠোনের দক্ষিণ দিকে গরুর মাংস নিয়ে বসেছেন মোরশেদা বেগম সহ কিছু মহিলা। মোরশেদা বেগম তদারকি করে যাচ্ছেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন মহিলাগণ। কেউবা মাংস কেটে কেটে ছোট টুকরো করে যাচ্ছেন কেউবা ভূরি পরিষ্কারে লেগে আছেন। সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর শাশুড়ির দিকে এগুলো উল্লাসী৷ পাশে বসে ক্ষীণ গলায় বললো,
-“খিচুড়ি হয়ে গেছে।”
-“মাংস রান্নার জন্য তাইলে পেঁয়াজ মরিচ কেঁটে নাও। এই রহিমা, এক পাতিল মাংস ধুয়ে রান্নাঘরে দিয়া আসো তো।”
মোরশেদা বেগমের আদেশ পেয়ে বয়স্ক এক মহিলা কলাপাতার উপর থেকে কিছু মাংস বড়সড় এক পাতিলে উঠিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির ভেতরের দিকে। তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটি দম ফেললো উল্লাসী। তারপর আমতাআমতা করে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললো,
-“আমি কী আজ বাবার বাড়িতে যেতে পারি?”
চোয়াল শক্ত হয়ে এল মোরশেদা বেগমের। ছেলের বউয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললেন,
-“এই কথা আমারে বলছো ঠিকাছে। তোমার শ্বশুরের কানে যেন এই কথা না যায়!”
ঢোক গিলে মাটির দিকে তাকিয়ে উল্লাসী মোরশেদা বেগমের কথায় সম্মতি জানাতেই তিনি আবারও বলে উঠলেন,
-“স্বামীর ঘরই মেয়েদের সব। একবার বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি আসার পর ভুলেও মুখের ফাঁক দিয়ে বাবার বাড়ির নাম নেয়া বারণ। আর এ নিষেধ আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তার কুরআনে করেছেন। বুঝেছো?”
-“হু..”
-“সর্ব সময় মাথায় রাখবা তুমি হাজী বাড়ির বউ। তোমার যেন ধ্যানজ্ঞান চিন্তাভাবনা এখন সবটাই এই হাজী বাড়িকে ঘিরেই হয়৷”
-“জ্বি, আচ্ছা..”
-“আর সবসময় এটা মাথায় রাখবা স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একথা তার কুরআনে বলেছেন। স্বামী যা আদেশ দেবে চোখবুঁজে তা পালন করবা। কোনোরকম টুশব্দ তার বিপরীতে করবা না। এতে স্বামী তো নারাজ হবেই সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা নিজেও নারাজ হবে। বুঝলা কিছু?”
-“হু..”
-“তাইলে এখন যাও। মাংস তাড়াতাড়ি তুলে দাও। তোমার শ্বশুর নামায পড়ে আসলো হয়তো!”
মোরশেদা বেগমের আদেশ অনুযায়ী বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়াতেই তার ডাকে আবারও ফিরে এল উল্লাসী। নিরব দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে বললো,
-“বলুন..”
-“শহরে যাচ্ছো.. ভালো কথা। তবে বাইরে বেরুলে ঢেকে ঢুকে চলবা। খোলামেলা যা হবা সব স্বামীর সামনে। পরপুরুষদের সামনে শরীর দেখিয়ে চলা মেয়েরাই বেশ্যা। তাছাড়া…”
মোরশেদা বেগমের কথার মাঝে তাকে থামিয়ে দিল চৈতালি। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে সে বললো,
-“এসব কে বলেছে তোমাকে, চাচী? কুরআনে এসবের উল্লেখ আছে?”
-“তোর চাচাজান বলছে। কেন? তোর কী উনার কথায় সন্দেহ আছে?”
-“সন্দেহ না তবে চাচাজানের জানায় তাহলে ভুল আছে। এমন কিছুই কুরআনে লেখা নেই যাতে একজন মেয়ের তার পিতামাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে। বরং কুরআনে লেখা আছে রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাছাড়া তুমি যে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত, কথাটি বললে এটা ভুল। সঠিক হচ্ছে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। তবে একটি মেয়ের জান্নাতে প্রবেশের জন্য যে চারটি জিনিস জরুরী তার মাঝে একটি হলো স্বামীর সন্তুষ্টি। স্বামীকে সম্মান করা প্রতিটি নারীর কর্তব্য।”
-“ওই একই তো হলো। ঘুরেফিরে বেহেশত যাওয়া তো স্বামীর উপরই নির্ভরশীল।”
-“২৫ শতাংশ.. বাদবাকি ৭৫ তো নয়।”
-“ধুর.. যা তো তুই। তুই কী তোর চাচাজানের চেয়ে বেশি জানোস? উনি হজ্ব করে আসছেন।”
-“হজ্ব করে আসলেই সবাই হাজী হয় না গো, চাচী।”
বলেই জিহবা কামড়ে মোরশেদা বেগমের দিকে তাকালো চৈতালি। প্রচুর ক্ষেপেছেন উনি। তবে আশেপাশে থাকা মহিলাদের জন্য তা মুখে প্রকাশ করতে না পারলেও তার বড়বড় দুটো চোখ দিয়ে ঠিকই গিলে ফেলছেন তাকে। সেদিক থেকে দ্রুত নজর সরিয়ে উল্লাসীর দিকে দিল চৈতালি। মেয়েটি অবুঝ বেশে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। এত অবুঝ মেয়েও বুঝি পৃথিবীর বুকে আছে! মেয়েটির বয়স খুব বেশি না হলেও কমও তো নয়। সংসার জগৎ নিয়ে এসব সাধারণ কথা বোঝার মত বয়স তার হয়েছে। সে নিজেও এবয়সী থাকতেই প্রেম শুরু করেছিল মুবিনের সঙ্গে। সেসময়ে খুব বুঝতো সে এসব। তবে তার মতোই কেনো হতে হবে উল্লাসীকে? সকলের বিকাস শক্তি তো এক নয়। তাছাড়া এসব নিয়ে চিন্তাভাবনার মত তার হাতে বহু সময় ছিল। সেসময় টুকু তো উল্লাসীর নাও থাকতে পারে! সে হয়তো ঘোরপ্যাঁচযুক্ত এই জগত নিয়ে কখনো ভাবেই নি! তাছাড়া মেয়েটি তো সৎমার কাছে থেকে মানুষ। প্রতিবন্ধী এক বোনও রয়েছে। বাস্তব হোক বা কল্পনা.. এসব নিয়ে ভাবার তার সময় কোথায়? হঠাৎ চৈতালির মনে পড়লো শিশুর পরিচর্যা নামের বইটির কথা। যার মলাটে স্পষ্ট ভাষায় লেখা রয়েছে, প্রতিটি শিশুর মানসিক বিকাসে তার বাবামায়ের ভালোবাসা এবং সান্নিধ্যের বিকল্প নেই। বইটি গতবছর মুবিন দিয়েছিল তাকে। এবং বইয়ের প্রথম পাতায় লিখে দিয়েছিল, বাবুর মাকে আদর্শ মা হবার পথ খুঁজে দিল বাবুর বাবা। যা দেখে দুদিন যাবৎ লজ্জায় মুবিনের সামনে যেতে পারেনি সে। এত বেশি অসভ্য কেনো মুবিন?
হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল মুবিন। দশটা বেজে কুড়ি মিনিট। সারাদিনের খাটাখাটির পর এর মাঝে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব ধীরে সদর দরজা খুলে চৈতালির বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। সাড়ে দশটার সময় বাড়ির পেছনের বাগানে তাকে উপস্থিত থাকতে বলেছে চৈতালি। নানান ঝামেলার কারণে সারাদিনে চোখাচোখি হলেও ভালোভাবে একটিবারও দেখা হয়নি দুজনের। কথা তো দূরস্থান!
উড়ুউড়ু মনে বাগানে পায়চারী করছিলো মুবিন। হঠাৎ পাশ থেকে চৈতালির মধুর গলার স্বর কানে এল তার। অদ্ভুত এক মায়া আছে এই মেয়ের গলায়। একবার শুনলে তার ঘোর কানে লেগে থাকে বহুদিন…
-“নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…
নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…
জ্বালায়ে চান্দের বাতি
আমি জেগে রব সারা-রাতি গো।
কব কথা শিশিরের সনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…”
চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠা চৈতালির মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক কদম এগুলো মুবিন। তার কোমর চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে বললো,
-“অসাধারণ… বিয়ের পর প্রতি রাতে আমি, তুমি, আমাদের ভালোবাসাবাসি এবং তোমার এই গান… ভাবলেই মন চায় তোমাকে আজই নিজের করে নেই!”
-“তো নাও না! কারো বারন আছে?”
-“অধৈর্য হয়ও না বালিকা। সবুরে মেওয়া ফলে।”
-“কচু ফলে.. দেখি, চশমাখানা খোলো তো।”
-“কেনো?”
নিজেই মুবিনের চশমা খুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে চৈতালি বললো,
-“এবার চোখজোড়া বন্ধ করো।”
সময় নিল না মুবিন। পরম সুখে চোখজোড়া বুজতেই পা উঁচিয়ে তার চোখে উপর নিজের ঠোঁটজোড়া ঠেকালো চৈতালি। নিজের ভালোবাসার রঙ ছড়িয়ে দিল মুবিনের চোখজোড়ায়।
ট্রেন ছেড়েছে অনেক্ক্ষণ। ফার্স্ট ক্লাসের একটা কামড়া বুক করেছে মেসবাহ। সেখানে অস্থির মনে পায়চারী করে যাচ্ছে সে। বাবার কথামতো উল্লাসীকে সাথে নিয়ে এলেও অস্থির মন কোনোভাবেই শান্ত হচ্ছে না তার। কয়েক দন্ড চুপচাপ বেডে বসে পাশে বসা উল্লাসীর উদ্দেশ্যে মেসবাহ বললো,
-“ঢাকায় পৌছুতে আরও পাঁচ ঘন্টা লাগবে। খারাপ লাগছেনা তো তোমার?”
-“না..”
-“এই প্রথম ট্রেনে চড়লে?”
-“উহু.. ছোটমার বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার ট্রেনে।”
ছোটমা কে? প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না মেসবাহ। অযথা কথাবার্তা না চালিয়ে আসল কথা বলা উচিৎ ভেবে ধীর গলায় বললো,
-“আমি একজন ডক্টর। সোসাইটিতে আমার সম্মান রয়েছে। আলাদা জায়গা রয়েছে। আর আমি চাইনা তা নষ্ট হোক।”
থামলো মেসবাহ। লম্বা একটি দম ছেড়ে গলা খানিকটা গম্ভীর করে আবারও বললো,
-“আমাদের বিয়ের ব্যপারটা আমরা দুজনেই গোপন রাখবো। যদি ওখানের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তুমি তার জবাব দেবে না। মোটকথা তুমি ফ্ল্যাট ছেড়ে কখনো বেরুবেই না। আশেপাশের সকলকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে।”
-“আচ্ছা..”
-“আর আমি তোমাকে আমার দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে সকলকে পরিচয় করিয়ে দিব। আমার খাওয়াদাওয়ার সমস্যা হয় বলে আম্মা গ্রাম থেকে তোমাকে পাঠিয়েছে রান্নাবান্না করার জন্য। তোমার এতে কোনো সমস্যা আছে?”
-“উহু…”
-“থ্যাংকস…”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। যদিওবা তার জানা নেই ঠিক ক’দিন এভাবে সকলের কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে রাখতে পারবে সে। তবুও আগবাড়িয়ে নিজের এই জঘন্য অপরাধের কথা কাওকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে। এতে শুধু তার সম্মানহানি নয় সাথে চরিত্র নিয়েও নানান বাজে কথা শুনতে হবে তার। যা একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে মোটেও কাম্য নয়। অপরদিকে শাশুড়ির কথামতো স্বামীর কথার বিপরীতে টু শব্দ করলো না উল্লাসী। উদাস মনে সে তাকিয়ে রইলো ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার ফেলে আসা গ্রামটির জন্য। সুহার জন্য, বাবার জন্য। আর কী কখনোই সে দেখা পাবে না তাদের?
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৭+৮
-“তুমি শাড়ি বদলে কামিজ পরে নাও। আমি এতক্ষণ তোমার বাসায় পরার জন্য আরও কিছু কামিজ দেখছি।”
উল্লাসীকে ট্রায়াল রুম দেখিয়ে আরও কিছু সালোয়ার কামিজ তার জন্য নিল মেসবাহ। তারপর ধীরেসুস্থে এগুলো ট্রায়াল রুমের দিকে। স্টেশন থেকে সরাসরি শপিংমলে এসেছে তারা। উল্লাসী যে সাজসজ্জায় ছিল তা নিয়ে বাসায় ঢুকলেই সকলের মনে সন্দেহ ঢুকে যেত। তাই কোনো উপায় না পেয়ে সরাসরি শপিংমলে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে।
-“শুনছেন? আমার হয়েছে।”
উল্লাসীর ডাকে পেছন ফিরে তাকে একনজর দেখলো মেসবাহ। তারপর শান্ত গলায় বললো,
-“কানের দুল খোলো.. সাথে গলার হারটাও।”
কোনো প্রশ্ন না করে কাঁপা হাতে উল্লাসী স্বর্ণের হার এবং দুল খুলে বাড়িয়ে ধরলো মেসবাহর দিকে। মেসবাহ সেগুলো নিয়ে একটি শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে বললো,
-“হাতের বালা দুটো খোলো।”
বাঁধ সাধলো উল্লাসী। বিয়ের আগে এই বালা তার হাতে পরিয়ে দেবার সময় ছোটমা বলে দিয়েছে, বিয়ের পর হাত কখনোই খালি রাখবি না। এতে স্বামীর অকল্যাণ হয়। আর একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে স্বামীর অকল্যাণ চাওয়া কোনো স্ত্রীর কাম্য নয়। একদন্ড ভেবে দু’কদম পিছিয়ে উল্লাসী বললো,
-“আপনার অকল্যাণ হবে।”
বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“লেইম কথা রেখে বালাজোড়া খুলে ফেলো।”
-“ছোটমা বারন করেছে। আপনার অকল্যাণ হবে।”
-“আমার কল্যাণ অকল্যাণ নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি আপাতত আমার কথা মতো কাজ করো।”
-“উহু..”
মেজাজ চওড়া হয়ে এল মেসবাহর। কড়া গলায় সে বললো,
-“সিনক্রিয়েট করো না। যা বলছি দ্রুত করো।”
ঢোক গিলে আরও কয়েক কদম পেছালো উল্লাসী। এই লোককে কোনোভাবেই বুঝতে পারে না সে। মাঝেমাঝে এত মনোরম ভাষায় কথা বলে আবার মাঝেমাঝে প্রচুর রাগ দেখায়। একজন মানুষের দুই রূপ কীভাবে হয়?
কথা বাড়ালো না মেসবাহ। দ্রুত পায়ে উল্লাসীর দিকে এগিয়ে এসে সজোরে চেপে ধরলো তার হাত। সময় নিয়ে বালাজোড়া খুলে তা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে চারিপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিল। লোকজনের আনাগোনা এদিকে খুব একটা না থাকলেও দু’একজনের উপস্থিতি রয়েছে। যারা সকলেই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে তাদের দিকে। সেদিক থেকে নজর সরিয়ে সকলের দৃষ্টি উপেক্ষা করেই উল্লাসীর হাত ধরলো মেসবাহ। তারপর তাকে টেনে দ্রুত বের হয়ে এল শপিংমল ছেড়ে। শহরে পা ফেলতে না ফেলতেই যে মেয়েকে নিয়ে একদফা ঝামেলায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে, সেই মেয়েকে নিয়েই পুরো জীবন কাটাবে কী করে সে? জবাবে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। খুব দ্রুত একটি রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসে উল্লাসীর দিকে দৃষ্টি দিতেই তার নজরে এলো মেয়েটির কান্নামাখা মুখ। নিরবে কাঁদছে সে। অঝোরে ধারায় যা টপাটপ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে…
বাড়ির আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজেও মুবিনের দেখা না পেয়ে অনার ঘরে এল চৈতালি। হাতে থাকা একটি বাটি টেবিলে রেখে এগিয়ে এল অনার কাছে। চোখমুখ কুঁচকে বললো,
-“তুই পড়ছিস?”
চমকে উঠে বই বন্ধ করে উঠে বসলো অনা। আতংকে তার চোখমুখ নীল হয়ে উঠেছে। থমথমে গলায় সে বললো,
-“কী সমস্যা তোর? ঘরে নক করে ঢুকবি না?”
-“নক করে কেন ঢুকবো? তাছাড়া আমাকে দেখেই বা তুই এত ভয় পেলি কেন!”
কথার মোড় ঘোরাতে অনা বললো,
-“কোথায় ভয় পেলাম? ঠিকই তো আছি আমি। কী এনেছিস তুই ওই বাটির ভেতরে? দেখি…”
-“নারিকেলের নাড়ু…”
-“তুই জানিস না আমি নারিকেল খাই না? আচ্ছা.. এনেছিস যখন থাক। ছোটভাইয়ের খুব পছন্দ নারিকেলের নাড়ু।”
-“একদমই না.. তুই ওনাকে মোটেও দিবি না। যে ছেলে আমার নামই মনে রাখতে পারে না তাকে আর যাই হোক নিজ হাতে নারিকেলের নাড়ু বানিয়ে খাওয়াবো না আমি।”
উঠে দাঁড়ালো অনা। টেবিলের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“বললেই হলো! তুই এটা আমায় দিয়েছিস। এখন আমি যাকে খুশি তাকে দেব।”
-“তুই কিন্তু বড্ড পাকামি করছিস! তা কী দেখছিলি ওই বইয়ের ভেতর? পড়ছিলি না সেটা তো নিশ্চিত।”
বলেই চৈতালি হাত বাড়ালো বইয়ের দিকে। হঠাৎ চৈতালির এমন কাজে দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে এল অনা। বইটি একপাশে চেপে ধরে চেচিয়ে বললো,
-“অন্যের ব্যক্তিগত জিনিসে এভাবে হাত দিতে নেই। চৈতালি.. ছাড় বলছি।”
বইয়ের অপরপাশ ধরে নিজের দিকে টেনে চৈতালি বললো,
-“তোর আবার ব্যক্তিগত জিনিসও আছে? দেখি ছাড়। কি আছে এতে দেখতে দে আমায়।”
-“ভালো হবে না একদম চৈতালি।”
-“সব কিছুতেই ভালো কেনো হতে হবে?”
-“ছাড় বলছি..”
-“তুই ছাড়।”
-“উফফ.. ছাড় না!”
এক ধাক্কায় চৈতালিকে বিছানায় ফেলে বই নিয়ে দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। বুকের ভেতরটা এখনো অনবরত কেঁপে যাচ্ছে তার। চৈতালির হাত থেকে আজ নিস্তার নেই। যতক্ষণ এবাড়িতে থাকবে ততক্ষণ প্রশ্ন করতে করতে একদম জ্বালিয়ে মারবে তাকে।
রাতের খাবার কিনে ফুটপাত ধরে এগুচ্ছিল মেসবাহ। হঠাৎ ফোনে লিমনের কল আসায় তাকে সবটা খুলে বললো সে। সব শুনে লিমন ফোনের ওপাশ থেকে বললো,
-“শেষমেশ বউকে বোন? বড় অন্যায়!”
-“এসব রাখ…”
-“রাখলাম। তবে আমার মনে হচ্ছে কাজটা তুই ঠিক করিসনি।”
-“তাহলে কী করতাম আমি? তুইই বল।”
-“যেটা সত্যি সেটাই বলতি।”
-“আর আমার মানসম্মান?”
-“কিছুদিন পর যখন সবাই সবটা জানতে পারবে, তখন তোর এই মানসম্মান কোথায় যাবে সে নিয়ে ভেবেছিস? তাছাড়া তুই একা বাসায় দুঃসম্পর্কের এক বোনকে এনে তুলেছিস। এ নিয়ে সমালোচনা হবে না মনে করেছিস?”
-“হ্যাঁ, এনিয়ে সমালোচনা হবে না। উল্লাসী বাচ্চা একটা মেয়ে। আমাকে এবং ওকে এক করে এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মত বয়স এখনো হয়নি ওর। তাছাড়া ওর ক্লাস, ওর চালচলন, কথাবার্তা দেখেও মানুষ তেমন কিছু ভেবে সেসব রটানোর সুযোগ পাবে না।”
-“সকলে তো তোর মতো করে নাও ভাবতে পারে!”
লিমনের কথা একদন্ড ভেবে চিন্তিত মুখে মেসবাহ বললো,
-“পজিটিভ ভাব। নেগেটিভ কেনো ভাবছিস?”
-“কারণ আমাদের সোসাইটি নেগেটিভের উপরই চলে। দুটো দিন শুধু যেতে দে, দেখবি তোর পাশের ফ্ল্যাটের ভুড়িওয়ালা ভাবিই ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দিয়েছে!”
-“বাজে কথা রাখ.. আচ্ছা, আমি এখন রাখছি। কাল তাহলে দেখা হচ্ছে।”
কল কেঁটে সদর দরজার লক খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকলো মেসবাহ। হাতে থাকা খাবারের প্যাকেট টেবিলে রেখে ডাকতে শুরু করলো উল্লাসীকে।
মেসবাহর গলার আওয়াজ শোনামাত্র ভয়ে কোঁকড়ানো শরীর নিমেষেই শীতল হয়ে উঠোলো উল্লাসীর। মেঝে থেকে উঠে দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মেসবাহর সম্মুখে।
-“খাবার খেয়ে নাও। বসো।”
মেসবাহর কথায় চেয়ার টেনে হালকা সরাতেই মেসবাহ থামালো উল্লাসীকে। নরম গলায় বললো,
-“শব্দ করে চেয়ার টানতে হয় না। নিচের ফ্লোরেও মানুষ থাকে। শব্দের কারণে তাদের সমস্যা হয়। ওয়েট, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তোমায়।”
মেসবাহ চেয়ার টেনে দেখিয়ে দিতেই উল্লাসী বসলো তাতে। শান্ত দৃষ্টিতে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এই বাসাটা কয় তলার?”
-“বারো। আর আমাদের ফ্লোর আটে।”
-“অহ..”
-“হুম… আর শোনো, তুমি কখনোই ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে বেরুবে না। তাছাড়া শুধুশুধু বেরুবেই বা কেনো? তোমার কী বাইরে কোনো কাজ আছে?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী নেতিবাচক জবাব দিতেই মেসবাহ আবারও বললো,
-“আর আমি সকালে বেরিয়ে যাবার পর কেউ কলিংবেল বাজালেও দরজা খুলবে না। পাশের ফ্ল্যাটের এক ভাবি আছে। হয়তো আমি যাবার পর বা বিকেলে গল্পগুজব করতে আসতে পারে। তবে হাজার কলিংবেল বাজালেও তুমি দরজা খুলবে না। তারপর যা বলার আমি বলে ম্যানেজ করবো। ঠিকাছে?”
-“জ্বি..”
-“গুড.. নাও। খাওয়া শুরু করো।”
খাবারের কারবার চুকিয়ে উল্লাসীকে ঘর দেখিয়ে দিয়ে ড্রইং রুমে এল মেসবাহ। টেলিভিশন ছেড়ে সোফায় শরীর মেলে দিল সে। অপরদিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর টেলিভিশনের শব্দ কানে আসতেই উঠে বসলো উল্লাসী। কয়েক দন্ড ভেবে বিছানা ছেড়ে নেমে সে ধীর পায়ে এগুলো টেলিভিশনের ঘরের দিকে। তাদের বাড়িতে টেলিভিশন না থাকলেও পাশের বাড়িতে একটি টেলিভিশন রয়েছে। ছোটমার অগোচরে প্রায়ই সুহাকে নিয়ে সেই টেলিভিশন দেখতে যেতো সে। তবে সে টেলিভিশন এত বড় নয়। এত চিকনও নয়। তার শ্বশুর বাড়িতেও যে টেলিভিশন রয়েছে সেটিও দেখতে বেশ মোটাতাজা।
-“কী ব্যপার? ঘুমোও নি?”
পাশ থেকে মেসবাহর কথায় তার দিকে তাকালো উল্লাসী। হালকা মাথা নেড়ে সে বললো,
-“উহু.. ঘুম আসছে না।”
-“নতুন জায়গা তো। একটু সময় লাগবে। বসো, বসে টিভি দেখো।”
উল্লাসীকে মেঝের মাঝবরাবর বসতে দেখে উঠে বসলো মেসবাহ। শান্ত গলায় বললো,
-“উঠে সোফায় বসো।”
মেসবাহর আদেশে সোফায় বসলো উল্লাসী। অপলক দৃষ্টিতে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। আজ তার পাশে সুহা থাকলে সে প্রচুর খুশি হতো। কিছু বলতে না পারলেও টেলিভিশন দেখার সময় তার মুখের উজ্জ্বলতাই বলে দেয় ঠিক কতটা আনন্দিত হয় সে তা দেখে।
-“ব্যথা পেয়েছিলে চুড়ি খোলবার সময়?”
টেলিভিশনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেসবাহর দিকে দিল উল্লাসী। বললো,
-“না..”
-“তাহলে কাঁদলে কেনো?”
-“জানি না..”
-“ঠিকাছে। এই নাও রিমোট। নিজের ইচ্ছেমতো চ্যানেল বদলিয়ে নাও। আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।”
খুশি মনে রিমোট হাতে নিল উল্লাসী। তবে পরমুহূর্তেই নিজেকে একা আবিষ্কার করে আঁতকে উঠলো তার মন। দ্রুত সে এগুলো ঘরের দিকে। তবে সে ঘরে মেসবাহর উপস্তিতি না পেয়ে ভীত গলায় সে ডেকে উঠলো মেসবাহকে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মাত্রই ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেসবাহ। আচমকা পাশের রুম থেকে মেয়েলি গলায় কান্নার আওয়াজ ভেসে এল তার কানে। উল্লাসী কাঁদছে? কিন্তু কেনো? সে তো খুশিমনে বসে টেলিভিশন দেখছিল! ভ্রু কুঁচকে পাশের ঘরের দিকে এগুলো মেসবাহ।
-“কী হয়েছে উল্লাসী? কাঁদছো কেনো?”
চোখ উঁচিয়ে মেসবাহকে দেখামাত্র দৌড়ে তার দিকে এগুলো উল্লাসী। দু’হাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে শুরু করলো সে।
নির্বিকারভাবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মুখ খুললো মেসবাহ। নিজের বাহুডোর থেকে উল্লাসীকে ছাড়িয়ে সে বললো,
-“আমি কোথাও যাইনি। পাশের রুমেই ছিলাম।”
-“মিথ্যা কেনো বলছেন?”
-“মিথ্যা কেনো বলবো! আমি ওঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।”
-“আপনি ওঘরে ঘুমোবেন?”
-“হ্যাঁ..”
-“তাহলে আমিও ওঘরে ঘুমোবো। একা আমি এঘরে থাকবো না।”
-“ভয়ের কিছু নেই উল্লাসী। ঘর থাকতে তুমি শুধুশুধু নিচে শোবে কেনো? তুমি এঘরেই থাকবে।”
-“তাহলে আপনিও এঘরেই থাকবেন।”
উল্লাসীর শরীরের থরথরিয়ে কাঁপুনিই বলে দিচ্ছে ঠিক কতটা ভয় পেয়েছে সে। তবে তাই বলে তার অদ্ভুত চাওয়া তো মেনে নেয়া যায় না! একদন্ড ভেবে গলা খানিকটা গম্ভীর করে মেসবাহ বললো,
-“আমি আমার ঘরেই থাকবো। এবং তুমি এঘরে থাকবে। এনিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না।”
মেঝেতে বসে পড়লো উল্লাসী। কাঁপা হাতে মেসবাহর দু’পা আঁকড়ে ধরে সে বললো,
-“আমি একা কখনোই থাকিনি। নতুন এই বাসায় একা এঘরে থাকলে আজ রাতেই আমি মরে যাবো। ওঘরে থাকিনা একটু! আমি নীরবে নিচে শুয়ে থাকবো। সুহার কসম…”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৮
ঘড়ির কাটায় রাত ১টা। চারিদিকে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। মেঘে আচ্ছন্ন আকাশে চাঁদের কণাটা আবছা হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়েই আরেকটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। বাড়িতে যাবার কারণে বেশ কিছুদিন যাবৎ সিগারেটের স্বাদ নিতে পারেনি সে। বাবার সামনে সিগারেট হাতে দাঁড়ানোর সাহস তার নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেট টেনে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে নির্ঘুম রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। পায়চারী করতে শুরু করলো ব্যালকনিজুড়ে।
আজ কঠিন একটি সত্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে হাপিয়ে উঠেছে। আটাশ বছরের এই জীবনকে অনর্থক ঝামেলা লাগছে। অস্থির লাগছে বাচ্চা একটি মেয়ের পাশাপাশি চলে… চিন্তার জগতে বিচরণ করতে করতেই চোখজোড়া লেগে এসেছিল মেসবাহর। তবে পাশ থেকে আসা মেয়েলী স্বরের কাকুতিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। ঝটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরে ঢুকতেই ড্রিমলাইটের ঝাপসা আলোয় তার নজরে এল উল্লাসীর নিষ্পাপ মুখ। গুটিসুটি মেরে মেঝেতে শুয়ে ছটফটিয়ে যাচ্ছে সে। মেয়েটির অসহায়ত্বর কাছে হেরে আজ তাকে নিজের ঘরে থাকার অনুমতি দিয়েছে মেসবাহ। যদিওবা ঘর ফাঁকা পরে থাকতে মেয়েটিকে নিচে শোয়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। তবে ব্যাকুল স্বরে উল্লাসীর আকুতি মিনতি বুকের ভেতরটায় কাঁটার মতো বিঁধছিল তার। তাই কোনো উপায় না পেয়ে নিজের ঘরে নিচে বিছানা করে শোবার যোগাড়যন্ত্র করে দিয়েছে সে। কিন্তু হঠাৎ উল্লাসী এভাবে ছটফট করছে কেন? ধীর গলায় উল্লাসীকে কয়েকবার ডাকলো মেসবাহ। তবে অপরপাশ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তার কপালে হাত রাখলো সে। যা ভেবেছিল সেটিই। মেয়েটির গা গরম হয়ে উঠেছে। তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে হয়তো খুব বেশিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল উল্লাসী। যার ফলে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর বাধিয়ে ফেলেছে সে।
জ্বর মেপে দেখে ঔষধ সহ এক গ্লাস পানি এনে সাইড টেবিলে রাখলো মেসবাহ। তারপর এসে আবারও উল্লাসীর পাশে বসে তাকে কয়েকবার জোর গলায় ডাকতেই বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে উঠে বসলো উল্লাসী। কিছুসময়ের জ্বরেই ফর্সা মুখ তার লাল টকটকে হবার উপক্রম হয়েছে। চোখ দুটিও রক্তের কুন্ডলী পাঁকিয়ে রক্তলাল বর্ণ ধারণ করেছে। ভয়ংকর সেই চোখের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল মেসবাহ। নরম গলায় বললো,
-“শীত করছে?”
-“করছে..”
-“বিছানায় উঠে শোও।”
-“তাহলে আপনি কোথায় শোবেন?”
সে কথার জবাব না দিয়ে হাত ধরে উল্লাসীকে উঠালো মেসবাহ। তারপর তার দিকে ঔষধ এবং পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“খেয়ে নাও…”
-“আপনি এঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না তো?”
-“না..”
-“সত্যিই?”
-“হ্যাঁ..”
-“কসম কাটুন।”
-“কাটলাম..”
-“এভাবে না। ভালো করে কাটুন।”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মেসবাহ ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“তুমি শুয়ে পড়ো উল্লাসী।”
-“আচ্ছা.. তবে আপনি কিন্তু এঘরে আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবেন না।”
-“ঠিকাছে, যাবো না।”
কাথা গায়ে চাপিয়ে উল্লাসী শুয়ে পড়তেই চেয়ার টেনে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো মেসবাহ। তারপর চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড বইটি খুলে তাতে মনোযোগ দিল।
শরীরের উষ্ণতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে চারিপাশে চোখ বুলালো উল্লাসী। তবে ঘরে কোথাও মেসবাহর দেখা না পেয়ে ধীর পায়ে সে এগুলো পাশের ঘরের দিকে। ঘুমন্ত মেসবাহকে এক পলক দেখে আবারও সে ফিরে এল ঘরে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খানিক্ষন শহুরে সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করলো। বেশ ফুরফুরে লাগছে এখন তার শরীরটা। কিছুক্ষণ আগের ম্যাজমেজে ভাবটাও কেটে গেছে। লম্বা কিছু দম ছেড়ে ঘরে ফিরে গতকাল বিকেলের কেনা কিছু সালোয়ার কামিজের মাঝে একটি উঠিয়ে সে এগুলো গোসলের জন্য।
পাউরুটিতে জেলী মাখিয়ে দুটো প্লেটে রাখলো মেসবাহ। তারপর উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এখন কী একটু ভালো লাগছে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো উল্লাসী। সেদিকে তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“এত সকালে গোসল করেছো কেনো?”
-“বিয়ের পর সকালে গোসল করতে হয় বলে।”
উল্লাসীর এমন উত্তরে ধাক্কা খেলেও নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। চোখেমুখে একরাশ অস্বস্তি ফুটিয়ে বললো,
-“আর করবে না। এসবের কোনো দরকার নেই।”
-“কিন্তু আপনার আম্মা যে বলে দিয়েছেন! প্রতি সকালে গোসল করে নাপাক শরীরকে পাক পবিত্র করতে।”
-“আম্মা বলে দিয়েছেন তো গ্রামে গেলে এসব করবা। এখানে যতদিন আছো প্রতি সকালে গোছলের কোনো দরকার নেই।”
আবারও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে পাউরুটিতে হাত দিল উল্লাসী। অধীর আগ্রহে মেসবাহকে দেখে তাকে অনুসরণ করে পাউরুটিতে কামড় বসালো সে।
-“আপনি কাল আমাকে একা ঘরে রেখে পাশের ঘরে এসে ঘুমিয়েছিলেন.. তাই না?”
প্লেট থেকে নজর সরিয়ে উল্লাসীর দিকে দিল মেসবাহ। ঠান্ডা গলায় বললো,
-“উহু.. সারা রাতই ওঘরে ছিলাম। ভোরের দিকে এসে এঘরে শুয়েছি।”
-“অহ..”
-“সব ভয় তো তোমার রাতে। দিনে তো কোনো ভয় নেই। নাকি আছে?”
-“জানি না..”
-“জানতে হবে। আর তোমাকে তা জানাতেই আমি এখন কিছুক্ষণের জন্য বের হবো।”
বুকটা ছ্যাত করে উঠলো উল্লাসীর। ঢোক গিলে সে বললো,
-“কোথায় যাবেন?”
-“এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বেশিক্ষণ না এই ধরো এক’দু ঘন্টার মাঝেই ফিরবো। কোনো ভয় নেই। নিজের ইচ্ছেমতো তুমি এটুকু সময় কাটাও।”
চোখমুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। ব্যথিত গলায় সে বললো,
-“আচ্ছা…”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেসিনের দিকে এগুতে এগুতে মেসবাহ বললো,
-“দুপুরের রান্নাটা কী তুমিই করবে? নাকি আমি আসার পথে খাবার নিয়ে আসবো?”
-“আমিই করবো..”
-“ঠিকাছে। তবে আমি আসার পর তুমি রান্না শুরু করবে। নয়তো আবার হাত পা পুড়িয়ে বসবে!”
লিমনে সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হলো মেসবাহর। উল্লাসীর জন্য বেশ চিন্তা হচ্ছে তার। মেয়েটি আবার ভয়টয় পেল না তো? সকল ভাবনা একপাশে রেখে কয়েকবার কলিংবেল টিপলো মেসবাহ। তবে ওপাশ থেকে উল্লাসীর সাড়া না পেয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। হাতে থাকা ফলভর্তি পলিথিন ব্যাগ ডাইনিং টেবিলে রেখে উল্লাসীর নাম নিতে নিতে সে এগুলো ঘরের দিকে।
মেসবাহর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়ে ছিল উল্লাসী। তবে বেশি একটা সময় টিকতে পারলো না সে ঘুমের সেই রাজ্যে। বেশ ঠান্ডা কিছুর উপস্থিতি কপালে অনুভব করতেই ঘুমভাবটা কেঁটে গেল তার। আতংকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল উল্লাসী। তবে পরমুহূর্তেই মেসবাহকে দেখামাত্র আত্মায় পানি ফিরে এল তার। বুকে থুতু দিয়ে সে বললো,
-“না, জ্বর নেই।”
-“ভয় পেয়েছো?”
-“হুম…”
চিন্তিত মনে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে মেসবাহ বললো,
-“আমি হসপিটালে যাওয়া শুরু করলে তুমি কিভাবে সময় কাটাবে তা ভাবাচ্ছে আমাকে। এজন্যই তোমায় আনতে চাইনি। আব্বা যে কোনো প্রতিটা জিনিসে জোরাজুরি করে!”
কি বলবে ভেবে পেল না উল্লাসী। নীরবে খানিক সময় সেভাবেই কাটানোর পর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“তুমি কিচেনে যাও। আমি জামাকাপড় ছেড়ে আসছি।”
চুলো জ্বালিয়ে উল্লাসীকে একেএকে সব দেখিয়ে দিল মেসবাহ। তারপর বাড়ি থেকে আনা গরুর মাংস ফ্রিজ থেকে বের করে তা পানিতে ভিজিয়ে বললো,
-“বরফ ছাড়লে ভালোভাবে ধুয়ে তারপর রাঁধবে।”
-“আপনি রান্না জানেন?”
-“তেমন জানি না.. তবে চলে। ভাত, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা এসব আর কি!”
-“আর মাছ মাংস?”
-“তেমন একটা খাই না। কখনো খেতে ইচ্ছে হলে বাইরে থেকে আনিয়ে নেই।”
বলেই রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এসে চেয়ারে বসলো মেসবাহ। মেয়েটিকে একা রেখে পুরোটা দিন হাসপাতালে কি করে কাটাবে সে, যেখানে ঘন্টা তিনেকের জন্য তাকে ফেলে বাইরে গেলেই মেয়েটি ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে! অবশ্য গ্রামের বাচ্চা একটি মেয়ের পক্ষে অচেনা এক জায়গায় এসে একা একটি ফ্ল্যাটে সময় কাটানো বেশ কঠিনও। তাহলে এখন কী উপায়? মেয়েটির জন্য কী এখন চাকরি বাদ দিয়ে ঘরে বসতে হবে তার! হঠাৎ দরজায় বেজে উঠা কলিংবেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো মেসবাহর। উদাস মনে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই তার সামনে ভেসে উঠলো লিমনের ভাষ্যমতে ভুড়িওয়ালা ভাবির ছবি।
-“ভালো আছো?”
-“জ্বি, আছি। আপনি ভালো আছেন?”
-“আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি। শুনলাম তুমি নাকি গ্রাম থেকে কাজের মেয়ে এনেছো।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এল মেসবাহর। গম্ভীরমুখে সে বললো,
-“বোন.. দুঃসম্পর্কের বোন। কাজের মেয়ে নয়।”
-“অহ.. তাই বলো! তা কোথায় তোমার সেই বোন? ডাকো তো ওকে। একটু দেখা সাক্ষাৎ করে যাই। ভাই, তোমরা তো পুরুষেরা যে যার যার কাজে বেরিয়ে যাও! আর বাড়িতে বসে পঁচে পঁচে মরতে হয় আমাদের। কথা বলার মত পাশে একজন থাকলে বেশ লাগে!”
বলেই হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন মুন্নি সরকার। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে তার পিছু নিল মেসবাহ। ডাইনিং প্লেসে যেতেই তাকে থামিয়ে বললো,
-“ভাবি আপনি এখানে বসুন। আমি ওকে ডেকে আনছি। আপনি কেনো শুধুশুধু এত গরমের ভেতর আগুনের কাছে যাবেন! আপনি বসুন…”
তারপর দ্রুত পায়ে মেসবাহ এগুলো রান্নাঘরের দিকে। এই মহিলাকে একদম পছন্দ নয় তার। অবশ্য শুধু এই মহিলা নয়, আগবাড়িয়ে খাতির জমাতে আসা সকল ব্যক্তিই চক্ষুশূল তার।
-“যা বলেছি বুঝেছো তো?”
-“হুম..”
-“তাহলে বলো উনার সামনে আমাকে কী ডাকবে?”
-“ভাই..”
-“গ্রেট। আর হ্যাঁ, বেশি কথা বলবে না। রান্নার বাহানা দেখিয়ে দ্রুত চলে আসবে।”
-“আচ্ছা।”
-“চল এবার।”
সব শিখিয়ে পড়িয়ে উল্লাসীকে নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে চেয়ারে বসলো মেসবাহ। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ওই উল্লাসী।”
-“উল্লাসী? সুন্দর নাম তো। কীসে পড়ো তুমি?”
মুন্নি সরকারের প্রশ্নে হাত কচলাতে কচলাতে উল্লাসী জবাব দিল,
-“ক্লাস এইট।”
-“বেশ ছোট। অবশ্য ছোট মেয়েকে এনেই ভালো করেছো মেসবাহ। আরও ছোট মেয়ে হলে ভালো হত। আজকালকার মানুষের যা মনোভাব! তারা ভাইয়ের সঙ্গেও বোনকে জড়াতে দুবার ভাবে না!”
গলা শুকিয়ে এল মেসবাহ। কোনোমতে ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে মুন্নি সরকারের কথায় সম্মতি জানালো সে। অপরদিকে মুন্নি সরকার উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বলেই যাচ্ছে,
-“আমি কিন্তু ফ্রি হলেই গল্প করতে চলে আসবো তোমার সাথে। তুমি তো বেশ ছোট। আমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে তুমি। রান্নাবান্না বলো বা টুকিটাকি জিনিস। তোমার সমস্যা নেই তো?”
উল্লাসীর জবাবের জন্য একদন্ড অপেক্ষা করে মুন্নি সরকার আবারও বললো,
-“তুমি দেখছি খুবই কম কথা বলো! বসো না! দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
-“আমি ঠিকাছি।”
-“আরে বসো তো। বাড়ি কোথায় তোমার?”
পাশ থেকে মেসবাহ জবাব দিল,
-“আমাদের গ্রামেই।”
-“কেমন বোন হয় ও তোমার?”
-“আমার চাচাতো ভাইয়ের মামাতো বোনের ফুপাতো ভাইয়ের খালাতো বোনের নানার দুঃসম্পর্কের বেয়াইয়ের ছেলের মেয়ে উল্লাসী।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
-“বেশ দূরের সম্পর্ক তো!”
-“জ্বি। বেশ দূরের..”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৯+১০
রাতে খাবার শেষে সব কিছু গোছগাছ করে উল্লাসী ড্রইংরুমে এলো। পাশেই সোফায় শরীর মেলে দিয়ে শুয়ে রয়েছে মেজবাহ। নজর তার টেলিভিশনের দিকে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে সেদিক থেকে নজর সরিয়ে সোফায় বসলো উল্লাসী। উৎফুল্ল চোখে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে তা দেখায় মনোযোগ দিল।
-“পানি গরম দিয়ে এসেছো?”
পাশ থেকে মেসবাহর প্রশ্নে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল উল্লাসী। তারপর মেজবাহর দিকে ফিরে বললো,
-“আপনার লাগবে এখন?”
-“না, যখন লাগবে আমি নিয়ে নেব।”
-“আচ্ছা..”
-“ছোট হিসেবে বেশ ভালো রাঁধো তুমি।”
-“আপনার ভালো লেগেছে?”
-“হ্যাঁ.. ভালো লেগেছে।”
মেজবাহর কথায় খুশির এক দোলা বয়ে গেল উল্লাসীর মনজুড়ে। সোফায় দু’পা উঠিয়ে আরাম করে বসে সে মেসবাহর দিকে সকল মনোযোগ জুড়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললো,
-“আপনি জানেন, আমার বাবার ছোটমার চেয়ে আমার হাতের রান্না খেতে বেশি ভালোলাগে?”
-“জানা ছিল না.. তবে এখন জানলাম। রান্নাবাড়া করতে কী খুব ভালো লাগে তোমার?”
-“খুউউব ভালো লাগে…”
-“বেশ তো.. তা আর কী কী করতে ভালোলাগে তোমার?”
-“ঘুরতে, টেলিভিশন দেখতে, সুহার সঙ্গে সময় কাটাতে, বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, বৃষ্টিতে ভিজতে, আর…”
আঙুলে কড় ধরে ধরে একেএকে নিজের ভালোলাগা গুলো মেসবাহর কাছে খুলে বললো উল্লাসী। তারপর আগ্রহী গলায় জানতে চাইলো,
-“আর আপনার?”
-“আমার তো কিছুই ভালোলাগে না। তবে বয়স বলো বা পরিস্থিতি, এসব মেনে সব কিছুকেই ভালো লাগাতে হয়।”
-“তার মানে আপনার ভাল্লেগেনা অসুখ হয়েছে। ডাক্তারদেরও তাহলে অসুখবিসুখ হয়!”
ঠোঁটে হাসি ফুটলো মেসবাহর। শোয়া থেকে উঠে বসে সে বললো,
-“তোমার কী ধারণা ছিল হয় না?”
-“হু… মানে উহু।”
-“ঠিকাছে। ডাক্তারদের নিয়ে আপাতত তোমার আর গবেষণা করতে হবে না। দ্রুত ঘরে চলো। অনেক রাত হয়েছে।”
টেলিভিশন বন্ধ করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। তার পিছুপিছু ঘরে ঢুকে নিচে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো উল্লাসী। তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল মেসবাহ। স্বাভাবিক গলায় সে বললো,
-“বেডেই শুয়ে পড়ো।”
-“তাহলে আপনি কোথায় শোবেন?”
সে প্রশ্নের জবাব আজও উপেক্ষা করলো মেসবাহ। বেড সাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো সে।
-“আপনি আমাকে পছন্দ করেন না, তাই না?”
উল্লাসীর কথায় বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি অনুভব করলো মেসবাহ। তবে পরমুহূর্তেই নিজের সকল মনোযোগ ঘোরাতে গতকালের পড়া ডেভিড কপারফিল্ড বইটি বের করে অবশিষ্ট অংশতে চোখ ডোবালো সে।
-“ছোটমা খোকনকে আমাদের সঙ্গে প্রায়ই ঘুমোতে বলে। কিন্তু খোকন কখনোই আমাদের সঙ্গে ঘুমোয় না। কারণ ওর সুহাকে পছন্দ নয়। সুহার কাছে শুলে নাকি ওর গা ঘিনঘিন করে।”
বলেই থামলো উল্লাসী। আঁড়চোখে মেজবাহর দিকে ফিরে সে আবারও বললো,
-“তেমন আমাকেও আপনার পছন্দ নয় বলে আপনি আমার সঙ্গে ঘুমুতে চান না। আপনার গা ঘিনঘিন করে.. তাই না?”
-“অদ্ভুত সব কথা বলবে না। ঘুমোতে এসেছো ঘুমোও। ঘুমোনোর সময় এত কথা কিসের?”
মেসবাহর ধমকে দমিয়ে গেল উল্লাসী। ঝটপট বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমের পায়তারা শুরু করলো সে। লোকটি বড়ই অদ্ভুত। তাকে বোঝা বড় দায়!
বই বন্ধ করে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিল মেসবাহ। রাত দু’টোর উপরে বেজে গেছে। এমনটাই হয়.. বই পড়তে ধরলেই সময়-জ্ঞান একদম ভুলতে বসে সে! হাই তুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকলো সে। তবে অপর পাশ থেকে উল্লাসীর কোনো জবাব না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘরের আলো নিভিয়ে পাশের ঘরে চলে এল মেসবাহ। একটি সিগারেট ধরিয়ে বেতের চেয়ারে শরীর মেলে দিল। উল্লাসীকে কী আসলেই পছন্দ নয় তার? হয়তো.. কিন্তু কেনো পছন্দ করে না সে উল্লাসীকে? গ্রামের মেয়ে বলে, অবুঝ বলে নাকি ছোট বলে? জবাবে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। ভুল ভাবছে সে উল্লাসীকে নিয়ে। পছন্দ না করলেও মেয়েটিকে অপছন্দ করে না সে। মেয়েটির নিষ্পাপ চেহারা, ডাগর ডাগর দু’চোখের চাহনিতে মায়া হয় তার। ইচ্ছে হয় সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে আবারও তার আগের দুনিয়ায় ফিরিয়ে দিতে। তবে পরিবারের কথা ভেবে তা শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। অস্থির মনে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে আবারও উল্লাসীর চিন্তায় ডুব দিল সে। উল্লাসীর দেখানো যুক্তিগুলো ভুল ছিল। না সে তাকে অপছন্দ করে না তার সঙ্গে ঘুমোতে গা ঘিনঘিন করবে। তবে সব কিছুর উর্ধ্বে সে একজন পুরুষ। কিছু চাওয়া-পাওয়া রয়েছে তার। আছে শারীরিক চাহিদা। সেসব ভেবে নিজের পুরুষত্ব দেখাতে শিকার বানাতে চায় না সে বাচ্চা মেয়েটিকে। বাল্যবিবাহর মতো পাপ করার পর আবারও একই পাপের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় না সে। এ পাপ যে সকল পাপের চেয়ে জঘন্য!
সকাল সকাল মেসবাহকে বেরিয়ে যেতে দেখে খুশি হলো মুন্নি সরকার। খুব দ্রুত হাতের কাজ সেরে ফ্ল্যাট লক করে সে বেরিয়ে পড়লো পাশের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। আজ বেশ জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে মেয়েটির সাথে। ভেবে খুশিতে টগবগিয়ে কলিংবেলে দু’বার চাপ দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল উল্লাসী। বিস্মিত গলায় বললো,
-“আপনি!”
-“কেনো? তুমি কাকে আশা করছিলে?”
-“উনাকে.. মানে ভাইকে।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। ভেতরে প্রবেশ করে ড্রইং রুমের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“তুমি যেন মেসবাহর কেমন বোন হও?”
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে শুরু করলো উল্লাসীর। উনি বারবার বলেছিলেন হাজারো কলিংবেল বাজালেও দরজা না খুলতে। অথচ তার কথার অমান্য করে বসলো সে!
-“কী হলো? দরজার কাছে দাঁড়িয়ে করছোটা কী? দরজা লাগিয়ে দিয়ে এদিকে এসো।”
মুন্নি সরকারের কথামতো দরজা বন্ধ করে ড্রইংরুমে এলো উল্লাসী। পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে তার। ভুল করে তার মুখের ফাঁক দিয়ে উলোটপালোট কিছু বের হয়ে গেলে আবার ক্ষতি হবে না তো উনার?
-“আরে! বসো তো। বসো।”
জোর করে উল্লাসীকে নিজের পাশে বসালো মুন্নি সরকার। তারপর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“তুমি যেনো কেমন বোন হও মেসবাহর?”
-“ওই যে! কাল উনি.. না মানে ভাই যা বললো।”
-“ও যে কি দিয়ে কি বললো তা বুঝিই নি আমি! তুমি বুঝেছিলে?”
মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিল উল্লাসী। ভালোলাগছে না তার। একদম ইচ্ছে করছে না এই মহিলার পাশে বসে গল্প করতে।
-“আচ্ছা, তুমি আমাকে শুধু এইটা বলো, মেজবাহর বাবা তোমার কী হয়?”
ঢোক গিললো উল্লাসী। ধীর গলায় বললো,
-“জানিনা..”
-“এই মেয়ে বলে কী! তাইলে আবার এই বুড়া ধামড়া ছেলের সাথে তোমার বাবামা তোমাকে থাকতে পাঠিয়েছে কেন?”
-“জানিনা..”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে বললো,
-“কোন রুমে থাকো তুমি?”
-“জানিনা..”
-“কি আশ্চর্য! এভাবে কথা বলছো কেনো?”
-“জানিনা..”
-“কী জানো তুমি?”
-“জানিনা..”
বিরক্তে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“যাচ্ছি আমি.. দরজাটা লাগিয়ে দাও।”
হনহনে পায়ে মুন্নি সরকার ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো উল্লাসী। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে ধীর গলায় বললো,
-“জানিনা জানিনা জানিনা…”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১০
বাড়ি ছেড়ে হলে ফেরার সময় হয়ে এসেছে মুবিনের। আবারও তার সেই একঘেয়ে জীবন শুরু। পড়া পড়া আর পড়া, যেখানে নেই একদন্ডের জন্য স্বস্তি। না জানি কবে মুক্তি মেলবে এর হাত থেকে! এদিকে চৈতালি মেয়েটাও এক দৃঢ় ভালোবাসার জালে জড়িয়ে ফেলেছে তাকে। খুব বেশি কষ্ট হয় আজকাল তাকে ছাড়া থাকতে। মন চায় সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে এসে চৈতালির আশেপাশে পরে থাকতে। তাকে নিজের করে নিতে। তবে নানান বাঁধার কারণে তা আর হয়ে উঠে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ গোছানোয় মন দিল মুবিন। বিকেল পাঁচটায় তার ট্রেন। এখন বাজে বেলা বারোটা। বেশি একটা সময় নেই মাঝে…
-“আমি সাহায্য করবো?”
চৈতালির প্রশ্নে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো মুবিন। মৃদু হেসে বললো,
-“এসো…”
মুবিনের একটি শার্ট হাতে তুলে নিল চৈতালি। তা ভাজ করতে করতে অভিমানী গলায় বললো,
-“আজ না গেলে হয় না?”
-“অনেক দিন তো হলো এসেছি..”
গলা খানিকটা ধরে এল চৈতালির। ভারী স্বরে সে বললো,
-“কষ্ট হয় আমার..”
-“তোমার এইচএসসির তো আর বেশিদিন নেই। ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে কোচিংয়ের জন্য রাজশাহী চলে আসবে৷ চাচার সঙ্গেও এই বিষয়ে আমি কথা বলে রেখেছি।”
-“কোচিং তো মাত্র কয়েকমাসের.. তারপর?”
-“তারপর তোমাকে কোনো না কোনোভাবে আমার কাছেই রেখে দেবো। তোমার এনিয়ে টেনশন করতে হবে না।”
চোখ ভর্তি জল নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো চৈতালি। এই একটি দিন কেন আসে তার জীবনে?
-“কাঁদে না চৈতালি। দেখি উঠে দাঁড়াও।”
একরকম জোর করেই চৈতালিকে টেনে উঠালো মুবিন। তারপর নিজের বুকে চেপে বললো,
-“যাবার দিন কান্নাকাটি না করলে হয় না?”
সে কথার জবাব না দিয়ে ভেজা গলায় চৈতালি বললো,
-“আমাদের বিয়ে? তা কী শুধু আমাদের ভাবনাতেই রয়ে যাবে?”
বুকচিরে বেড়িয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো মুবিন। পঁচিশ বছরের এই জীবনে তার বাবাকে চিনতে আর বাকি নেই তার। চৈতালিকে সহজভাবে মেনে নেবেন না তিনি। নানান অযুহাত দেখাবে, নানান কথা শোনাবে। তবে সেও কম যায় না! বাবা না মানলেও কি করে চৈতালিকে নিজের করে পেতে হয় তাও জানা রয়েছে তার। ম্লান হেসে চৈতালির চুলে ঠোঁট ডোবালো মুবিন। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“উহু.. সেটাও হবে। শুধু একটু বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”
মুবিনের ঘরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো অনা। বিস্ময়ে চোখজোড়া প্রশস্ত হয়ে এল তার। এসব কী দেখছে সে? চৈতালি আর ভাই একে অপরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে? ঠিক কী ঘটছে এখানে? তাছাড়া এমন এক পরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিৎ তার? ভেবে পেল না অনা। কয়েকদন্ড চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর একরাশ অস্বস্তি নিয়ে নিঃশব্দে সে বেরিয়ে পড়লো সে ঘর ছেড়ে।
দুপুরে ভাত ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেসবাহ। কাল থেকে আবারও ব্যস্ত জীবন শুরু হয়ে যাবে তার। যাতে দুপুরে ঘুম তো দূরের কথা চোখ বোজার সময়টুকুও নেই! তবে সবকিছুর মাঝে উল্লাসীকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে তার। মেয়েটি সবটা সামলে সারাদিন একা বাসায় থাকতে পারবে তো?
-“ঘুমিয়েছেন?”
চোখ মেলে মেঝেতে গুটিসুটি মেরে বসা উল্লাসীকে একনজর দেখে আবারও চোখ বুজলো মেসবাহ। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“কিছু বলবে?”
-“হ্যাঁ.. কিছু না অনেক কিছু।”
-“শুরু করো।”
-“আজ আপনি বাইরে যাবার পর ওই মহিলা এসেছিল?”
-“কোন মহিলা?”
-“ওই যে কাল এসেছিল যে!”
চোখ মেলে উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“তুমি দরজা খুলেছিলে?”
দু’হাতে কান চেপে ধরলো উল্লাসী। নরম গলায় বললো,
-“ভুল করে ফেলেছিলাম! উনি আমাকে নানান উল্টাপাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলো। তবে সেসবের উত্তর তো আপনি আমায় শিখিয়ে দেন নি।”
-“শিখিয়ে দেইনি বলে সত্যিটাই বলে দিয়েছো?”
-“উহু.. কিচ্ছু বলিনি। উনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই বলেছি জানিনা জানিনা জানিনা।”
উল্লাসীর কথা বোধগম্য হলো না মেসবাহর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে চাইতেই ধীরেসুস্থে তাকে সবকিছু গুছিয়ে বললো উল্লাসী। সব শুনে ঠোঁটে ফুটলো মেসবাহর একরাশ হাসি। উচ্চস্বরে খানিক্ষন হেসে সে বলিলো,
-“গুড জব। এবার কান থেকে হাত নামাও।”
-“মাফ করে দিয়েছেন আমায়?”
-“হ্যাঁ, তবে মুন্নি ভাবি যে মানুষ! দেখবে কালই আবার এসে হাজির হবে! তবে আজকের করা ভুল কাল রিপিট করা যাবে না। হাজার কলিংবেল বাজলেও তুমি কী করবে?”
-“দরজা খুলবো না।”
-“মনে থাকবে তো?”
-“থাকবে..”
স্বস্থির শ্বাস ছেড়ে আবারও চোখ বুজলো মেসবাহ। মেয়েটির মাঝে বেশ চঞ্চলতা রয়েছে। তবে তা প্রকাশে কিছু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সে। ভয়, সংকোচ, জড়তা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে চেপে ধরে রাখছে। তাহলে কী কেউ ভুলভাল কথা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে? যার দরুন প্রভাবিত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েও পারছে না সে? হতেই পারে। উল্লাসীকে সে একয়দিনে যতটুকু চিনেছে তাতে নিজস্বতা বলতে কিছু নেই তার ভেতর। এমতবস্থায় কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখা অসম্ভব কিছু নয়।
-“আপনি আজও আমায় একা ফেলে পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছিলেন.. তাই না?”
-“না, আজও ফজরের সময় উঠে তারপর ওঘরে গিয়েছি।”
-“সুহার কসম?”
আবারও চোখ মেললো মেসবাহ। হাই তুলে বললো,
-“সুহাটা যেনো কে?”
-“আমার বোন…”
-“বয়স কত ওর?”
-“পাঁচ বছর..”
-“তারপরই তোমার ভাই। তাই না?”
চোখমুখ শক্ত হয়ে এল উল্লাসীর। হালকা মাথা নেড়ে সে উঠে পড়লো মেঝে থেকে। সুহার জন্মের সময়ই মারা যায় মা। পিচ্চি সেই সুহাকে দেখাশোনার জন্যই বাবা বিয়ে করে আনেন ছোটমাকে। তার ঠিক এক পছর পরই জন্ম হয় খোকোনের। সেই সাথে সুহার সকল আদরযত্ন স্থানান্তর হয় খোকনে। মাঝেমাঝে মন হয়, ভালোবাসাও বুঝি স্থানান্তর হবার জিনিস? তবে পরমুহূর্তেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মায়ের জায়গায় তো ছোটমা এসেছে বেশ ক’বছর হলো! স্বয়ং মানুষই যেখানে স্থানান্তর হয় সেখানে ভালোবাসা আর কি জিনিস!
রাতে দ্রুত খাওয়াদাওয়ার কাজ সেরে উল্লাসীকে ঘুমের জন্য তাড়া দিতে শুরু করলো মেসবাহ। আগামীকাল যেহেতু সকাল সকাল উঠেই নিজের কর্মক্ষেত্রে ছুটতে হবে সেহেতু বেলা করে ঘুমোনোর কোনো সুযোগ নেই। আবার উল্লাসী না ঘুমোনোর আগে ওঘরে গিয়ে নিজের শরীর মেলে দেবারও কোনো উপায় নেই। তাই সব ভেবে রাত দশটার মাঝেই উল্লাসীকে ঘুমোনোর আদেশ দিয়ে শেক্সপিয়ারের দ্য টেমপেস্ট বই খুলে বসলো মেসবাহ। ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে কিছু পাতা পড়ে উঠে পড়লো সে। ঘুমের দরুন গভীর নিঃশ্বাস ফেলছে উল্লাসী। একেকটি নিঃশ্বাস তার ঠোঁট ছুঁয়ে পুরো ঘরে মিশে যাচ্ছে। যা হয়তো একসময় তার নিঃশ্বাসের সঙ্গেও মিলিত হচ্ছে! অদ্ভুত এই ভাবনাকে আর এগুতে দিল না মেসবাহ। দ্রুত গতিতে পা বাড়ালো পাশের ঘরের দিকে।
গভীর ঘুমের তলিয়ে গিয়েছিল মেসবাহ। হঠাৎ শরীরের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখমুখ কুঁচকে উঠে বসতে বসতে বললো,
-“কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো?”
-“আমাকে একা ওঘরে ফেলে আপনি এঘরে এসে কেনো ঘুমিয়েছেন?”
-“তাতেই কাঁদতে হবে?”
-“জানি না। আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল! আপনি কেনো এসে এঘরে ঘুমিয়েছিলেন?”
কিছু বুঝলো না মেসবাহ। হাই তুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিতেই সে দেখলো ঘড়িতে বাজছে রাত একটা। অর্থাৎ উল্লাসীকে ফেলে এঘরে আসার দু’ঘন্টাও হয়নি। অথচ এর মাঝেই উঠে পড়েছে সে! মেজাজ চরম খারাপ হয়ে এল তার। তবুও নিজেকে সে যথাসাধ্য সামলে নিয়ে বললো,
-“অবুঝের মতো করোনা উল্লাসী। ওঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল আবার আমার সকাল সকাল উঠতে হবে।”
কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিল উল্লাসী। উনি কেনো বোঝে না একা ঘরে শুয়ে ঠিক কতটা ভয় পায় সে! নানানরকম বাজে স্বপ্নও দেখে। তখন পাশে একজনকে না পেলে আতংকে দিশেহারা হয়ে পড়ে তার অবুঝ মন। এসব কেনো বোঝেন না উনি?
-“কান্না থামাও, উল্লাসী। এত রাতে এভাবে কাঁদলে আশেপাশের মানুষেরা কি ভাববে! কান্না থামাও বলছি।”
মেসবাহর ধমকে কান্নার বেগ খানিকটা কমালো উল্লাসী। মেসবাহর দু’হাত ধরে সে আকুল গলায় বললো,
-“আমি একা ওঘরে থাকবো না।”
-“তোমার থাকতে হবে। এখন কী আমার ঘুম বাদ দিয়ে তোমাকে পাহারা দিতে জেগে বসে থাকবো আমি? এসবের চাকরি নিয়েছি আমি? আমার নিজের জীবন নেই? কাজকর্ম নেই? সব ফেলে কী এখন তোমায় নিয়ে পরে থাকতে হবে আমার?”
ফোঁপাতে ফোপাঁতে উল্লাসী জবাব দিল,
-“আমি যাবো না।”
-“তুমি যাবে। এবং এক্ষুনি যাবে।”
বলেই উল্লাসীর হাত ধরে বিছানা ছেড়ে নামলো মেসবাহ। তারপর দ্রুত পায়ে তাকে টানতে টানতে নিয়ে এলো পাশের ঘরে। এক ধাক্কায় বিছানার মাঝ বরাবর উল্লাসীকে ফেলে ক্রোধে বিস্ফোরিত গলায় বললো,
-“একটা শব্দ যেনো না শুনি। চুপচাপ ঘুমোও। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
এরপর আর অপেক্ষা না করে উল্লাসীকে একা ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। রাগ হচ্ছে তার। রাগের চোটে পুরো শরীর, কপালের রগ কেঁপে কেঁপে উঠছে।
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১১+১২
খানিক্ষণ ঘরের ভেতরে পায়চারী করে বিছানায় শরীর মেলে দিল মেসবাহ। তবে এপাশ ওপাশ করেও ঘুমের দেখা পেল না। রাগ তার কিছুটা কমে এলেও মনের ভেতরটা অস্থিরতায় ছটফট করছে। সে কি ঠিক করলো কাজটি? ভয় পায় মেয়েটি একা ঘরে ঘুমোতে। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে উঠা একটি মেয়ের পক্ষে এমনটাই কি স্বাভাবিক নয়? তাছাড়া মেয়েটির বয়সও তার একবার বিবেচনায় আনা উচিৎ ছিল। অস্থির মনে বিছানা ছেড়ে উঠে ডাইনিংয়ে এসে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে ফেললো মেসবাহ। তারপর লম্বা একটি দম ছেড়ে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লো তাতে। কী এমন হবে মেয়েটির পাশে ঘুমোলে? নিজেকে সংযত রাখতে পারবে না সে? তাহলে তার এবং কোনো পশুর মাঝে পার্থক্য থাকলো কি? বাচ্চা একটি মেয়ের পাশে শুয়েই যে ব্যক্তি নিজেকে সংযত রাখতে ব্যর্থ হবে, বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে নানান আজেবাজে চিন্তাভাবনা করবে, সে আর যাই হোক কোনো মানুষ নয়। পশু সে.. নীচু স্তরের এক নিকৃষ্ট পশু। ভাবামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। নীরব পায়ে এগুলো উল্লাসীকে একা ফেলে রেখে আসা ঘরের দিকে।
বিছানায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো উল্লাসীর। তবে সেদিকে চোখ তুলে তাকাবার মতো সাহস হলো না তার। যদি অদ্ভুত সেই চেহারার মানুষগুলো হয়? তখন কী করবে সে? এক দৌড়ে এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সকল পথই যে বন্ধ!
-“উল্লাসী… এই উল্লাসী?”
হঠাৎ মেসবাহর ডাক কানে আসতেই মাথা উঠালো উল্লাসী। অবিশ্বাস্য চোখে একবার মেসবাহর দিকে তাকিয়েই ঝাপিয়ে পড়লো তার বুকে। অপরদিকে খানিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর এক হাত উঠিয়ে উল্লাসী মাথায় রাখলো মেসবাহ। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় বললো,
-“খুব ভয় পেয়েছিলে?”
মেসবাহর বুকে মুখ ডুবিয়ে উল্লাসী নাক টেনে জবাব দিল,
-“হু…”
-“এত ভয় কিসের বোকা মেয়ে? দেখো চারপাশের দরজা জানালা সব কিছুই তো বন্ধ। এর ভেতর কেউ কি আসতে পারবে এই ফ্ল্যাটে?”
-“উহু…”
-“তাহলে এত কিসের ভয় তোমার?”
-“জানিনা…”
-“আজ কি তোমায় জানিনা রোগ হয়েছে? সব প্রশ্নেরই এক উত্তর করে যাচ্ছো! জানিনা জানিনা আর জানিনা।”
শরীরের কাঁপুনির সঙ্গে কান্নার বেগ খানিকটা কমে এল উল্লাসীর। ভেজা গলায় সে বললো,
-“আপনার যদি ভাল্লাগেনা রোগ হতে পারে তাহলে আমার জানিনা রোগ হলে দোষ কী?”
-“আমি তো ডক্টর। নিজের রোগ হলে নিজে চিকিৎসা করে তা সারিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু তুমি? তোমার এই রোগ কে সারাবে শুনি?”
-“কেনো? আপনি সারাবেন। আপনি আমার স্বামী না?”
জবাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে উল্লাসী। কান্নার দরুন আর শরীর কেঁপে কেঁপেও উঠছে না তার। হয়তো কিছুক্ষণের মাঝে একদম ঠিকঠাকও হয়ে যাবে সে।
-“চলো.. শুয়ে পড়ি।”
মেসবাহর বুক থেকে মাথা উঠালো উল্লাসী। অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
-“আমার তো আজ জ্বর নেই। আমি নিচে শুই? আর আপনি এঘরেই বিছানায় ঘুমোন?”
-“উহু.. আমি তুমি, আমরা দুজনেই আজ একসাথে ঘুমোবো। এবং তা বিছানায়। নাও দেখি তোমার বালিশ একপাশে রাখো।”
খানিক্ষনের জন্য বিস্মিত হলেও উল্লাসী ঠোঁটে ফুটলো মিষ্টি হাসি। সত্যিই এই মানুষটিকে বোঝা বড় দায়!
বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ একনাগাড়ে বেঁজে যাচ্ছে কলিংবেল। তবে দরজার কাছে একবার গিয়ে তা খোলার সাহস করে উঠতে পারছে না উল্লাসী। গতকাল দুপুরে বারবার তাকে দরজা খুলতে নিষেধ করে দিয়েছে মেসবাহ। তবে এভাবে একজন অপরপাশ থেকে ডেকে যাচ্ছে অথচ সে তার ডাকের সাড়া দিচ্ছে না। কাজটি অসভ্যের মতো হয়ে গেলো না? তাছাড়া একা বাসায় থাকতে তার নিজেরও ভালো লাগছে না। ভয় লাগছে, দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। কী এমন হবে দরজা খুলে ওপাশে আসা মানুষটির সঙ্গে দুটি কথা বললে? উল্টাপাল্টা প্রশ্ন না করলে না হয় আবারও জানিনা বলে কাটিয়ে দেয়া যাবে! তাতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও তো কারো সঙ্গ পাওয়া যাবে! আড়ষ্ট পায়ে দরজার দিকে এগুলো উল্লাসী। সময় না নিয়ে দ্রুত দরজা খুলতেই দেখতে পেলো গতকালের সেই মহিলাকে।
-“কী করছিলে? কতক্ষণ যাবৎ বেল বাজিয়ে যাচ্ছি! দেখো ঘেমে টেমে একাকার অবস্থা!”
বলেই মুন্নি সরকার এগুলো ড্রইংরুমের দিকে। ফ্যান ছেড়ে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে বললো,
-“দেখি এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়াও তো..”
দরজা বন্ধ করে মুন্নি সরকারের কথামতো বরফ শীতল পানি এনে তার দিকে বাড়িয়ে দিল উল্লাসী। নরম গলায় জানতে চাইলো,
-“আপনি ভালো আছেন?”
পুরো পানি শেষ করে আরাম করে আবারও সোফায় বসে সে বললো,
-“আছি কোনোরকম! তুমি ভালো আছো?”
-“হ্যাঁ…”
-“সকালে খেয়েছো?”
-“হ্যাঁ..”
-“কী খেলে?”
-“রুটি আর আলু ভাজি।”
-“সব তুমি করেছো? দেখি একটা রুটি আর আলুভাজি নিয়ে এসো তো। খেয়ে দেখি কেমন হয়েছে!”
-“রুটি তো নেই। তবে আলুভাজি আছে। ওটা আনবো?”
-“যাও.. আনো।”
উৎসাহের সাথে উল্লাসী রান্নাঘরের দিকে এগুতেই নিজের মনকে আবারও বোঝালো মুন্নি সরকার। আজ এমন তেমন কোনো প্রশ্ন নয়! আজ সহজ ভাবে কথা বলতে হবে উল্লাসীর সাথে। যাতে কাল হঠাৎ করেই তার পরিবর্তনের কারণটি ধরতে পারে সে। তাছাড়া মেয়েটির মাথায় পাগলামো আছে কিনা, চরিত্র ঠিকঠাক কিনা তাও তো দেখতে হবে!
-“বাহ! বেশ ভালো হয়েছে তো।”
মুন্নি সরকারের কথায় হাসি ফুটলো উল্লাসীর ঠোঁটে। পানির গ্লাস তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“রুটি খেতে চাইলে কাল আপনার জন্য বানিয়ে রাখবো।”
-“ঠিকাছে। রেখো। তা আর কী কী রাধতে পারো তুমি?”
-“গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ, শাক ভাজি, পটল ভাজি…”
উল্লাসীকে কথার মাঝে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকার। খুশি মনে বললো,
-“সব পারো?”
-“মোটামুটি..”
-“তা কাল তোমার কী হয়েছিল? আমি তো বাবা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”
-“দরজা খুলে আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে দেখে।”
যাক! মেয়েটি তাহলে পাগল নয়। গ্রামের মেয়ে, শহরের রীতিনীতি আর কতটুকুই বা জানে! তাছাড়া একা বাসায় অচেনা কেউ এলে ছোটো এক মেয়ের পক্ষে ভয় পাওয়ারই কথা। ভয়েই হয়তো উলোটপালোট কিছু বলে ফেলেছে! একে এত আমলে নেবার দরকার নেই! ভেবে সামান্য হাসলো মুন্নি সরকার। বললো,
-“আমাকে দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি। দরজা খুললেই যে ফ্ল্যাটটি দেখো না? ওটিই আমাদের। তোমার ভাই সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তো, তাই কথা বলার মানুষ পাইনা। একা একা প্রচুর বোর হই।”
-“অহ..”
-“তাই তোমার সাথে গল্প করতে আসা। জানো, তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে আমার? বেশ সুন্দর তুমি। যেনো আল্লাহ নিজ হাতে গড়েছে তোমায়। আর আমাকে দেখো? বিয়ে হয়েছে চার বছর। বাচ্চাকাচ্চাও এখনো হয় নি। অথচ এখনি শরীরের ফুলে কলাগাছ!”
বলেই হেসে উঠলো মুন্নি সরকার। যেনো নিজের এই স্বাস্থ্য নিয়ে দারুণ খুশি সে!
বেশ সময় নিয়ে নানান গল্পগুজব করে প্রায় অনেক বিষয়েই তথ্য বের করলো মুন্নি সরকার। তবে মেসবাহর ঠিক কেমন বোন হয় উল্লাসী তা জানতে একরকম ব্যর্থ হলো সে। উদ্বিগ্ন মনে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেই সে কল দিয়ে বসলো তার স্বামীকে হাসান সরকারকে। আপাতত তার মনের কথাগুলো তাকে জানাতে হবেই হবে।
-“বলো..”
-“কী করছিলে তুমি?”
-“তেমন কিছু না। কিছু বলবে?”
-“হ্যাঁ.. আমার শীতল ভাইয়ের জন্য উল্লাসীকে খুব পছন্দ হয়েছে।”
-“উল্লাসী কে?”
-“ওই যে! মেসবাহর বোন। কাল রাতে যে তোমায় বললাম! আজই ভুলে গেছো?”
-“অহ হ্যাঁ! কিন্তু মেয়েটা তো ছোট। প্রাপ্ত বয়স্ক নয়।”
চোখমুখ কুঁচকে মুন্নি সরকার বললো,
-“ছোট আর কই? পিরিয়ড হলেই একটা মেয়ে বিয়ের যোগ্য হয়ে পড়ে। সে হিসেবে উল্লাসীও হয়েছে।”
-“তবুও। আমার মতামত চাও তো আমি বলবো, অন্য মেয়ে দেখতে। তাছাড়া তোমার ভাইও তো বেকার।”
-“হ্যাঁ, তা তো বলবেই! নিজের ভাই না তো। তাই তোমার ওর উপরে কোনো মায়া দয়াও নেই। নিজের ভাই হলে ঠিকই গ্রামের সাধাসিধা মেয়েকেই ঘরে আনতে। যাতে তাকে দিয়ে সংসারের সব কাজ করিয়ে আবার মায়ের দেখাশোনায়ও লাগিয়ে দিতে পারো।”
-“তো তোমার উদ্দেশ্যও কী সেটা নয়?”
হালকা কেশে গলা ঠিক করলো মুন্নি সরকার। দাপুটে গলায় বললো,
-“মোটেও নয়.. মেয়েটিকে প্রথম দেখাতেই আমার পছন্দ হয়েছিল। যাকগে আমার ভাইকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আমার ভাইয়েরটা আমিই বুঝবো। রাখছি।”
কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুন্নি সরকার। মাঝেমাঝে হাসানের উপর তার খুব বেশি রাগ হয়। বেশ অরসিক একজন মানুষ তিনি। কোনো বিষয়ে রসিকতা তো নেইই সাথে মুখ ভর্তি উজানী কথায় ভর্তি। এই লোক কবে মানুষ হবে কে জানে! অবশ্য এই বয়সে আর তাকে মানুষ করাও সম্ভব নয়। বয়সটা তার উল্লাসীর কাছাকাছি হলে তাও একটা সুযোগ থাকতো মানুষ করার। আসলে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা কিছুটা কাদার মতো। সামান্য শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো গড়িয়ে নেয়া যায় তাদের। উল্লাসীকেও ঠিক সেভাবেই গড়িয়ে নেবে সে। তাছাড়া মেয়েটি যথেষ্ট শান্তশিষ্ট। কাজকর্মেও যথেষ্ট পাঁকা। এর চেয়ে গুণী মেয়ে সারা দুনিয়ায় খুঁজলেও তার ভাইয়ের জন্য পাবে না সে। ওদিকে শীতল ভাইয়ের বাউন্ডুলের মত ঘোরাফেরা, বাজী ধরে টাকা উড়ানো দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এমতবস্থায় একটি বিয়ে করলে ঘরে লাল টুকটুকে সুন্দর একটি বউ আসলে হয়তো ঘরে মন বসবে তার। আর সেইসাথে হাসানকে বলে না হয় ছোটোখাটো কোনো চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। অপরদিকে মারও বয়স হয়েছে। সব কাজকর্ম নিজের হাতে সামলানো তার একার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। উল্লাসী গিয়ে সংসারের হাল ধরলে না হয় মা এসব থেকে ছুটি নেবে। সেই সাথে ছেলের বউয়ের হাতের সেবাশুশ্রূষা তো রয়েছেই। তবে সব থেকে বড় যে কারণে উল্লাসীকে নিজের ভাইয়ের জন্য নির্বাচন করেছে সে, তা হলো বাপের বাড়িতে তার অধিপত্য ধরে রাখা। নইলে আজকালকার যুগের যা বৌ, তাতে ননদের মুখোমুখি হতেও নারাজ তারা। বাড়িতে অধিপত্য চালানো তো দূরের কথা! এক্ষেত্রে উল্লাসীকে এই ব্যাপারে নিরাপদ মনে হয়েছে তার। মেয়েটিকে এই তিনদিনে যতটুকু চিনেছে সে, তাতে নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই তার মাঝে। একটু বুঝিয়ে শুঝিয়ে তাকে যেভাবে চালানো যাবে বিনাপ্রশ্নে সে সেদিকেই ধাবিত হবে।
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১২
-“কথা বলবি না আমার সাথে? সত্যিই কথা বলবি না?”
অপরপাশ থেকে অনার কোনো জবাব না পেয়ে উদ্বিগ্ন হলো চৈতালি। অনা তার উপর রাগ করেছে তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে ঠিক কী কারণে? গতকাল মুবিন যাবার পর মন ভালো না থাকায় আজ সারাদিন এবাড়িতে আসাও হয় নি তার। এরমাঝে কী এমন হলো যে একদম কথাবার্তায় বন্ধ করে দিল অনা? বোধগম্য হলো না চৈতালির। নিজের দু’হাতে দু’কান ধরলো সে। তারপর আবারও অসহায় গলায় বললো,
-“আমি কী করেছি এটা তো আমায় বল! না বললে বুঝবো কী করে? এই অনা? এদিকে একটু তাকা। দেখ তোর রাগ ভাঙ্গাতে তোর চিতৈই পিঠা কান পর্যন্ত ধরেছে।”
একনজর চৈতালিকে দেখে আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিল অনা। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“আমি কারোর উপর কোনো রাগ করিনি।”
-“তাহলে কথা বলছিস না কেন?”
-“কথা বলতে ইচ্ছে না করলেও কথা বলতে হবে কেন?”
-“তো কথা বলতে ইচ্ছে করবে না কেন?”
-“নাই করতে পারে। তুই যা তো এখন।”
-“কেনো যাবো? আমি আজ আরও আসলাম তোর সাথে রাতে থাকবো বলে!”
-“যা তো তুই। বিরক্ত করিস না।!”
হঠাৎ অনার চিৎকারে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো চৈতালি। মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল তার। এরকম কেনো করছে অনা ভেবে পেল না সে। অনা খানিকটা জেদি স্বভাবের। তবে কখনোই সে নিজের জেদ বন্ধুত্বের মাঝে আনেনি। মনোমালিন্য হওয়া তো দূরের কথা। তাহলে আজ হঠাৎ করেই কী এমন হলো যে তার সঙ্গে এতটা দুর্ব্যবহার করছে অনা! খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো চৈতালি। তবে মাঝপথে এসেই থেমে আরও একবার ধরা গলায় বললো,
-“সত্যিই চলে যাবো?”
-“হ্যাঁ, যা…”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বলে চোখ জোড়া বন্ধ করলো অনা। চৈতালি তার ছোটবেলার বন্ধু। সবচেয়ে কাছের মানুষ। অথচ তার জীবনের এতবড় একটি সত্য কী করে লুকিয়ে রাখলো সে? তাও তার ভাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে! কী দুর্দান্ত অভিনয় তাদের! যেনো একে অপরকে চেনে জানেই না! নাম মনে রাখা তো দূরের কথা। কিভাবে পারলো তারা এসব করতে? এভাবে কয় বছর যাবৎ তারা এ অভিনয় অভিনয় খেলছে কে জানে! কী এমন হতো তাকে সবটা জানালে? সে কী চৈতালির শুভাকাঙ্ক্ষী নয়? তারপরও কেনো চৈতালি জানালো না তাকে? লম্বা করে দম ছেড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আলমারি খুলে ছবির একটি অ্যালবাম বের করলো অনা। তারপর তার এবং চৈতালির সকল ছবি বেছে আলাদা করে একটি মোম জ্বালিয়ে পোড়াতে শুরু করলো ছবিগুলোর একপাশ থেকে চৈতালিকে।
ল্যাবএইডে সন্ধ্যার পর বসার কথা থাকলেও উল্লাসীর কথা ভেবে চেম্বারে বসলো না মেসবাহ। বিকেল থাকতেই বাড়ি ফিরে সময় নিয়ে গোসল সেরে টেলিভিশনের সামনে বসলো সে। তারপর উল্লাসীকে ঢেকে চা চাইলো এক কাপ। স্বামীর আদেশ পাওয়ামাত্র উল্লাসী পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। চুলোয় গরম পানি বসিয়ে ঝটপট চা বানিয়ে কাপে ঢেলে তা নিয়ে এগুলো ড্রইংরুমের দিকে।
-“তুমি খাবে না?”
-“উহু.. আমি খাই না।”
কথা বাড়ালো না মেসবাহ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারও টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি দিল সে। অপরদিকে মেসবাহর দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর উল্লাসী উৎসাহী গলায় বললো,
-“আজও উনি এসেছিলেন।”
-“কে?”
-“ওই যে উনি। মুন্নি ভাবি।”
চোখমুখ কুঁচকে গেল মেসবাহর। টেলিভিশনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকালো সে। কড়া গলায় বললো,
-“তুমিও আজও দরজা খুলেছিলে?”
-“হ্যাঁ.. উনি বেল বাজিয়েই যাবে আর বাজিয়েই যাবে! আর আমি ভেতরে থেকেও সাড়া দিব না?”
-“না, তুমি দেবে না। তোমাকে নিষেধ করিনি আমি?”
মেসবাহর মেজাজ খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে মুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। মেঝের দিকে চেয়ে সে ধীর গলায় বললো,
-“আমার একা বাসায় ভয় করলে একটু সময় উনার সাথে কথা বললে কী এমন হবে?”
-“একা বাসায় তোমার ভয় করবে কেন? একা তো একা। ভয় দেখানোর মতো কেউ আছে কি?”
জবাব দিল না উল্লাসী। এক বেলা তরল তো এক বেলা কঠিন। এই লোককে বোঝা সত্যিই বড় দায়!
-“তাছাড়া দিনের বেলায় আবার কিসের ভয়? পৃথিবীর সব ভুতপ্রেত কি নিজেদের সব কাজকর্ম ফেলে সারাদিন তোমায় ভয় দেখানোর চাকরি নিয়ে রেখেছে?”
-“হ্যাঁ, আপনার চাকরি যেমন ডাক্তারগীরি করা তেমন ওদের চাকরিও ভুতগীরি করা।”
হঠাৎ উল্লাসীর এমন কথায় থেমে গেল মেসবাহ। একদন্ড নীরব থেকে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“ভুতগীরিটা কী?”
-“কেনো জানেন না? ভুতগীরি হলো ভয়দেখানো। ভুতের একমাত্র কাজ। আমাদের ভয় দেখাতে সফল হলেই তো ওদের সরদার খুশি হয়ে ওদের টাকা দেয়।”
উল্লাসীর ভুতগীরির সঙ্গা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মেসবাহ। এই মেয়ে পারেও বটে!
-“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন না?”
ঠোঁট চেপে হাসি থামানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হাসতে হাসতেই মেসবাহ জবাব দিল,
-“করি তো।”
-“তাহলে শুধুশুধু হাসছেন কেনো?”
-“কোথায় হাসছি? হাসছি না তো!”
-“এই তো.. এই যে হাসছেন!”
হাসির বেগ আরও কয়েক ডিগ্রী বাড়িয়ে দিল মেসবাহ। মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দর এক সঙ্গা দিয়েছে ভুতগীরির!
-“এই মেসবাহ.. এই দাঁড়াও।”
সিগারেট কিনতে নিচে এসেছিল মেসবাহ। হঠাৎ পেছন থেকে মহিলা কন্ঠের কারো ডাক শুনে থেমে গেল সে। ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভেসে উঠলো তার সামনে লিমনের ভাষ্যমতের ভুড়িওয়ালা ভাবির ছবি। খানিকটা অস্বস্তি হলো তার। এই মহিলা কেনো ডাকছে তাকে? উল্লাসী আবার উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলেনি তো!
-“কেমন আছো?”
-“জ্বি, ভালো। আপনি ভালো?”
-“আছি কোনোরকম! জানোই তো.. একদম সময় দেয় না তোমার ভাই আমায়।”
কী বলবে ভেবে পেল না মেসবাহ। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
-“আপনি এখানে কেনো? কোনো কাজে এসেছেন?”
-“হ্যাঁ.. মাসের বাজার নিতে এসেছিলাম। শফিক আছে না? ওর দোকান থেকেই নেই। তা তুমি কোত্থেকে নাও?”
-“ওখান থেকেই।”
-“ভালো করো। ছেলেটা বেশ ভালো।”
-“হুম..”
মেসবাহর দিকে কিছুটা এগিয়ে এল মুন্নি সরকার। গলা খানিকটা নামিয়ে বললো,
-“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। এখানে দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে। আসলে সব কথাই তো আর উল্লাসীর সামনে বলা যায় না!”
জোর করে ঠোঁটে হাসি ফোঁটালো মেসবাহ। হালকা মাথা নেড়ে বললো,
-“জ্বি..”
-“আমার ভাইকে তুমি তো দেখেছো। কেমন লেগেছে উনাকে তোমার?”
ঠিক মনে করতে পারলো না মেসবাহ। তবুও এক গাল হেসে সে বললো,
-“খুবই ভালো।”
-“আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তো সব হয়েই গেলো। উল্লাসীর সঙ্গে…”
কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ মাঝপথে হাসান সরকার এসে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকারকে। তার কাঁধে হাত রেখে হাসান সরকার বললো,
-“তুমি যে চুলোয় তরকারি দিয়ে বেরিয়েছিলে তা তো পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। কী একটা অবস্থা! তাড়াতাড়ি চলো..”
-“আমি তরকারি কখন চড়ালাম? তুমি ভুল ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওনি তো? আমি ফেইসবুকে একটি ভিডিও দেখেছিলাম। ফোন টিপতে টিপতে কোনো হুশ না পেয়ে অন্যের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল এক লোক!”
-“না না.. তুমি এসো তো। মেসবাহ তুমি যাও। পরে দেখা হবে।”
একরকম জোরপূর্বক মুন্নি সরকারকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরলো হাসান সরকার। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“এক গ্লাস পানি দাও।”
-“বিষ দিব বিষ? বিষ খাবা?”
-“আপাতত পানি…”
-“তোমার পানির মাইরে বাপ। তুমি মিথ্যে বলে আমাকে নিয়ে আসলে কেনো?”
-“তো কী করতাম? দেখা নেই শোনা নেই! দুইদিনের দেখায় একটি মেয়েকে কিভাবে নিজের ভাইয়ের জন্য ঠিক করো তা আমার মাথায় আসে না!”
ফুঁসে উঠলো মুন্নি সরকার,
-“যথেষ্ট দেখাশোনা হয়েছে। এই মুন্নি সরকারের চোখ একবার দেখেই সব বুঝে ফেলে। তুমি আসলে আমার ভাইয়ের সুন্দরী একটা বউ হোক তা চাওনা! কারণ কী বলো তো? আবার নিজেই উল্লাসীকে বিয়ে করার পায়তারা করছো না তো!”
কপাল চাপড়ে সোফায় শরীর মেলে দিল হাসান সরকার। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
-“চাইলেই বা ক্ষতি কী? অন্তত পাগলের হাত থেকে তো বাঁচা যাবে!”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৩+১৪
রাতের আকাশে তারারা দল বেধে ছোটাছুটি করছে। যেনো নিকষ কালো আঁধার আকাশে তাদের মেলা বসেছে। বাড়ি থাকতে এমন তারাভরা রাতের আকাশ সুহাকে নিয়ে প্রায়ই উপভোগ করা হতো। তবে আজ পাশে নেই সুহা। একাকী বসে তারার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা কামড়ে ধরছে কেউ৷ কী করছে সুহা? ছোটমা খোকনের মতোই আদর করে কি সুহাকে? হয়তো না। তবে যে কথা দিয়েছিল ছোটমা!
-“কী করছো একা বসে বসে?”
মেসবাহর গলার স্বরে ঘোর কাটলো উল্লাসীর৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেসবাহকে বসার জায়গা করে দিতেই বাধা দিল সে। নরম গলায় বললো,
-“তুমি বসো.. আমি আরেকটা চেয়ার আনছি ভেতর থেকে।”
তবুও বসলো না উল্লাসী। ঠাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মেসবাহর জন্য। লোকটি মাঝেমাঝে খুব বকে তাকে, আবার মাঝেমাঝে খুবই ভালোবাসে। যেমনটা তার মা বেঁচে থাকতে তার মাকে ভালোবাসতো তার বাবা…
ব্যালকনিতে চেয়ার এনে তাতে বসলো মেসবাহ। তারপর উল্লাসীর দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
-“বসে পড়ো.. এত সম্মান দেখাতে হবে না।”
দু’কদম এগিয়ে চেয়ারে বসলো উল্লাসী। তারপর উদাস গলায় বললো,
-“বাবা মাকে যতটা ভালোবাসতো আপনিও কি আমায় ততোটাই ভালোবাসেন?”
বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো মেসবাহর। বাতাসে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাঙ্গা গলায় সে বললো,
-“ভালোবাসার মানে বোঝো?”
-“উহু.. তবে এটুকু জানি বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসতে হয়।”
-“কে বলেছে এসব?”
-“ছোটমা বলেছে। আপনাদের বাড়িতে আসার পর অর্পা আপাও বলেছে।”
-“আর কী বলেছে?”
-“ছোটমা না অর্পা আপা?”
-“বড় আপা..”
-“উনি তো অনেক কথাই বলেছেন। এই যেমন আপনার সামনে সবসময় সেজেগুজে থাকতে বলেছে, আপনার সামনে শাড়ি আঁচল ঠিকঠাক ভাবে নিতে নিষেধ করেছেন। এমন ভাবে নিতে বলেছেন যাতে কোমর এবং বুক দুই-ই দেখা যায়।”
হালকা কেশে উঠলো মেসবাহ। প্রসঙ্গ পালটাতে বললো,
-“তুমি আজ মুন্নি ভাবিকে উলোটপালোট কিছু বলো নি তো? ভাবি আজ আমায় কিছু একটা বলতে চাইছিল।”
-“উহু.. তেমন কোনো কথাই আমি বলিনি। তাছাড়া উনি কালকের মতো তেমন কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। করলে আবারও জানিনা জানিনা বলে কাটিয়ে দিতাম।”
মৃদু হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। বললো,
-“চলো, শুয়ে পড়ি। রাত অনেক হয়েছে।”
-“আরেকটু থাকি?”
-“না.. চলো চলো।”
একরকম জোর করেই উল্লাসীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এল মেসবাহ। তারপর উল্লাসীকে বিছানা গোছাতে বলে সে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। বড় আপা বাচ্চা এক মেয়েকে এসব অশ্লীলতা কিভাবে শেখায় তা মোটেও মাথায় আসছে না তার।
-“আম্মা, চৈতালি কী আজ এসেছিল?”
-“না, আসে নাই। শোন, তোর আব্বা তোরে বলতে বলছে…”
মোরশেদা বেগমের কথা উপেক্ষা করে দ্রুত তার ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। পা বাড়ালো চৈতালির বাড়ির উদ্দেশ্যে। কাল রাতে ভেবেছে সে। চৈতালির সঙ্গে তার করা ব্যবহার নিয়ে অনেক ভেবেছে। ছবি পুড়িয়ে একজনকে নিজের পাশ থেকে সরিয়ে ফেললেই নিজের জীবন থেকে তার উপস্থিতি মুছে ফেলা যায় না। তাছাড়া কেনোই বা চৈতালিকে নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলবে সে? মুবিন ভাই এবং তার সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু জানায়নি বলে? তাহলে নিজের একাজের বাচ্চামো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নাম খুঁজে পাচ্ছে না সে। হয়তো এখানে চৈতালির কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে যেমনটা তাকেও জুড়ে দিয়েছে এমাদ। যার কারণে মন সারাক্ষণ আনচান করলেও কিচ্ছুটি মুখ ফুটে বলতে পারছেনা সে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ চৈতালিকে। হয়তো তার ক্ষেত্রেও মুবিন ভাই নিষেধ করেছে, বোনের সামনে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বলে! তবে সে অপেক্ষা করবে। নিজে থেকে চৈতালি যেদিন মুখ ফুটে সবকিছু জানাবে তাকে সেদিনই নিজের বন্ধুত্বের এই রাজত্বে চৈতালিকে জয়ী করে তার হাতে তুলে দেবে একটি উপহার। এবং যেটিই হবে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পায়ের গতি বাড়ালো অনা। কাঠফাটা রোদের মাঝে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে ঘামে পুরো শরীর ভিজে উঠেছে তার। সূর্যর প্রখর তাপে খানিকক্ষণ পরপর শরীর জ্বলে জ্বলে উঠছে।
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ। আকাশে প্রচুর মেঘও ধরেছে। মুশলধারে বৃষ্টি হবে হয়তো। চিন্তা হচ্ছে উল্লাসীর জন্য। কিন্তু উপায়ও নেই। সন্ধ্যার আগে না হোক তার খানিক পরেই বাড়ি তাকে ফিরতেই হবে। টানা তিনজন রোগীকে সময় নিয়ে দেখলো মেসবাহ। স্নায়বিক সমস্যা বাংলাদেশে খুব প্রচলিত সমস্যাগুলোর মধ্যে না হলেও এতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এবং সপ্তাহের পাঁচদিনেই রোগী দিয়ে ভর্তি থাকে সিরিয়ালের খাতা। লম্বা কিছু দম ছেড়ে রায়হানকে ডাকলো মেসবাহ। ক্লান্ত গলায় বললো,
-“বাইরে আরও কতজন আছে?”
-“আছে স্যার বেশ কিছু।”
-“আমার শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। আজ আর পেশেন্ট দেখবো না। উনাদের নিষেধ করে দাও।”
-“স্যার, বেশি খারাপ লাগতেছে কী?”
-“না, তুমি গিয়ে একটা রিকশা ডাকো। আমি আসছি।”
রায়হান বেরিয়ে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। হাত ঘড়িতে সময় দেখে উঠে পড়লো চেয়ার ছেড়ে। ডাক্তারী পেশায় নতুন এলেও চারিদিকে যেভাবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে তাতে সামনে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তার। তবে এভাবে উল্লাসীর জন্য কাজে গাফলতি দিলে সেই সুনাম দুর্নামে পরিবর্তন হতেও সময় লাগবে না। কিন্তু এপরিস্থিতিতে ঠিক কী করনীয় তার? দিনটুকো সমস্যা না হলেও সন্ধ্যার পর থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত উল্লাসীকে কারো কাছে রেখে আসতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত। তবে কার কাছেই বা রেখে আসবে? তাছাড়া প্রতিদিন এভাবে অন্যের বাড়িতে রাখা তারাই বা কিভাবে নেবে! উদ্বিগ্ন মনে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গেইটের দিকে এগুতেই তার নজরে এল দল বেধে কয়েকটি মেয়ে পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে ঢুকছে কিছুদূরের আদর্শ নামের এক কোচিং সেন্টারে। সাথেই সাথেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেসবাহর। লেখাপড়ার ব্যপারে না উল্লাসী কিছু বলেছে তাকে আর না সে নিজে উল্লাসীর কাছে কিছু জানতে চেয়েছে। নানান কিছুর ভীড়ে লেখাপড়ার ব্যপারটি মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল তার। তবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। পা বাড়ালো লিফটের দিকে। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত্রি নয়টা.. যতটুকু সময় সে রোগী দেখবে ততটুকু সময় না হোক কোচিং সেন্টারেই সময় কাটাক উল্লাসী। বাদবাকি রইলো স্কুল। তা নয় ধীরেসুস্থে খোঁজ খবর নেয়া যাবে। বছরের মাঝামাঝিতে এসে কোনো স্কুলে উল্লাসীকে ভর্তি করানো যাবে কিনা তা অবশ্য জানা নেই তার।
-“এই মেসবাহ.. আরে এই মেসবাহ।”
কলিংবেল চাপার আগেই পাশ থেকে মুন্নি সরকারের গলার আওয়াজ থামিয়ে দিল মেসবাহকে। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে পাশ ফিরে সে জবাব দিল,
-“জ্বি ভাবি, বলুন।”
-“টায়ার্ড মনে হচ্ছে!”
-“জ্বি, তা তো একটু আকটু।”
-“সমস্যা নেই। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলেই ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তা কাল যা বলছিলাম!”
বিরক্তর সীমা ছাড়িয়ে গেলেও ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো মেসবাহ। চোখমুখে হাসির রেখা ফোটাতে ব্যর্থ হয়ে সে অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“বলুন..”
-“তুমি তো উল্লাসীর ভাই। দুঃসম্পর্ক হও বা কাছের.. ভাই তো ভাই-ই। তো যা বলছিলাম, উল্লাসীর বাবামা যেহেতু তোমার ভরসায় ওকে এখানে পাঠিয়েছে সেহেতু ওর বর্তমান গার্ডিয়ান তুমিই। তাই আরকি তোমার কাছেই বলা! উল্লাসীর সঙ্গে শীতল ভাইয়ের বিয়ের কথা ভাবছিলাম। তোমার কী মত এতে?”
মুন্নি সরকারের কথা ঠিক বোধগম্য হলো না মেসবাহর। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কী বললেন?”
-“আরে আমার ভাই আছে না শীতল? ওর সাথে উল্লাসীকে নিতে চাই আমরা। মেয়েটি দারুণ মিষ্টি। প্রথম দেখাতেই আমার মনে ধরে গিয়েছিল।”
চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো মেসবাহর। হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো মুন্নি সরকারের মুখ বরাবর।
-“আমার ভাই মাশাল্লাহ ব্যবসাপাতি ভালোই করে। তোমার ভাই চাকরি নিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আমার ভাই কোনোভাবে তা কানেই নেয় না। আসলে ও আমাদের এলাকায় সফল এক ব্যবসায়ী তো। তাই ব্যবসা ছাড়তে চায় না। আমি বলি চাকরি, ব্যবসা দুইটাই তুমি করো। তুমি তো আবার মাল্টিট্যালেন্টেড.. ঠিক বলেছি না?”
ওপাশ থেকে মেসবাহর জবাব না পেয়ে কপাল কুঁচকে গেল মুন্নি সরকারের। গলা উঁচিয়ে সে ডেকে উঠলো মেসবাহকে।
-“কী হলো? বললে না তোমার মত কী এতে?”
বিস্ময় যেনো কাটছেই না মেসবাহর। মহিলার মাথায় এমন কিছু খেলবে তা মনের ভুলেও কখনো মাথায় আসেনি তার। মহিলা তো মহিলা নয়.. আস্ত গরুর গবর। উভয়ের কাজই মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা। নিজেকে কোনোরকম সামলে নিল মেসবাহ। জোর গলায় বললো,
-“অসম্ভব!”
-“অসম্ভব কেনো?”
একদন্ড ভেবে মেসবাহ বললো,
-“অসম্ভব কারণ, উল্লাসী ছোট। ওর বিয়ের মতো বয়স হয়নি।”
-“খুব হয়েছে। যে মেয়ের পিরিয়ড শুরু হয়েছে, সে মেয়ের বিয়ের বয়সও….”
কথা শেষ করার আগেই জিহবা কামড়ে নিজেকে সামলে নিল মুন্নি সরকার। কথার মোড় ঘোরাতে দ্রুত বলে উঠলো,
-“ভাই হিসেবে তুমি চাওনা তোমার বোনের ভালো জায়গায় বিয়ে হোক?”
চোখমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে মেসবাহ জবাব দিল,
-“উল্লাসী ছোট৷ আপনি দয়া করে আর এসব কথা তুলবেন না।”
-“কেনো? সমস্যা কোথায়? আজ বিয়ে দাও বা দশ বছর পর, আমার ভাইয়ের চেয়ে যোগ্য ছেলে কখনোই পাবে না।”
-“আশ্চর্য! আপনি এক কথা বারবার কেনো বলছেন?”
-“তুমি শুধুশুধু ক্ষেপছো কেনো? যাকগে! তুমি দুঃসম্পর্কের ভাই, দূরেই থাকো। দেখি ওর বাবা মা কারো ফোন নাম্বার দাও। বা যোগাযোগ করার কোনো ওয়ে বলো। উনারা নিশ্চয় অমত করবে না! মেয়েকে অন্যের বাসায় ঝিগিরি না করিয়ে বিয়ে দেয়াটাই কি বেটার অপশন না?”
-“বললাম তো বিয়ে দিব না। আপনি প্লিজ যানতো।”
ক্ষুব্ধ গলায় কথাগুলো একদমে বলেই পকেট থেকে চাবি বের করে সদর দরজা খুললো মেসবাহ। তারপর দ্রুত পদে ভেতরে ঢুকেই মুন্নি সরকারের মুখের উপর বন্ধ করে দিল দরজা।
-“আপনি আজ এত দেরিতে এসেছেন কেনো? আমি যে একা ভয় পাই তা আপনি জানেন না?”
-“একা কোথায় থাকো তুমি? আমি যাবার পরপরই যে ওই ভুটকি মহিলাকে বাসায় ডেকে আনো, তা আমি বুঝি না মনে করেছো?”
-“ভুটকি মহিলা কে?”
-“এখন তো চিনবাই না! অথচ সারাদিন তার সাথে ঘুরঘুর করো। ইচ্ছে করেই নিজেকে তার সামনে এভাবে প্রেজেন্ট করো যাতে উনি…”
দাঁতে দাঁত চেপে হাত থেকে ব্রিফকেস বিছানায় ছুড়ে ফেললো মেসবাহ। তারপর ক্রুদ্ধ গলায় আবারও বললো,
-“বাচ্চা একটি মেয়ে.. যে না আমার হাটুর সমান বয়স! তার আবার একটা বিয়ে করে হয় না। আরো বিয়ে করার শখ জাগছে মনে.. না?”
হতবাক চোখে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে রইলো উল্লাসী। ভুটকি মহিলা, হাটুর সমান বয়স, বিয়ে.. এর কোনোটির অর্থই বুঝে উঠতে পারছে না সে। তবে এটুকু বুঝতে পারছে বকাবকি শোনার সময় ঘনিয়ে এসেছে তার।
-“ছ্যাঁচড়া মহিলা, ভুড়িওয়ালা মহিলা, চামার মহিলা, জল্লাদ মহিলা, রাক্ষস মহিলা… আমার বউয়ের বিয়ে ঠিক করে! কেন রে? আমার বউকে আমি খাওয়াতে পড়াতে পারবো না যে অন্য ব্যাটার সাথে তার বিয়ে দেব আমি? বলো, পারবো না?”
ঢোক গিলে উল্লাসী জবাব দিল,
-“হু.. পারবেন?”
-“তাহলে জ্বলে কেনো ওই ভুটকির? আবার যদি দেখছি তুমি ওই মহিলার সাথে মেলামেশা করছো, তাহলে তোমাকে পুরো একরাত এই বাসায় একা রেখে আমি হসপিটালে গিয়ে থাকবো। তারপর সেই রাতে তুমি বুঝবা ভুতগীরি কী আর কত প্রকার!”
বলেই হন্যে পায়ে পাশের ঘরের দিকে এগুলো মেসবাহ। না মুন্নি সরকার না উল্লাসী, কারোর উপর রাগ হচ্ছে না তার। রাগ হচ্ছে নিজের উপর। সে মানুক আর নাই মানুক, উল্লাসী তার স্ত্রী। এবং তীক্ত হলেও এটি সত্য। তাহলে কেনো বেশি বুঝে উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তার?
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৪
খানিকক্ষন থম ধরে মেসবাহর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর মুন্নি সরকার পা বাড়ালো নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। বিয়ে তো সে দেবেই দেবে। এতে যা হবে দেখা যাবে। তাছাড়া মেসবাহই বা কে বিয়ের প্রস্তাবে মানা করে দেয়ার? দরকার পড়লে গ্রামে গিয়ে উল্লাসীর বাবামার সাথে কথা বলবে সে। তবুও এই মেয়েকে হাতছাড়া করবে না। গভীর কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোন হাতে নিয়ে মায়ের নাম্বারে ডায়াল করলো মুন্নি সরকার। অস্থির মনে অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশ থেকে মায়ের একটি সাড়ার।
-“আম্মা তুমিই কাল সকাল সকাল রওনা হবা। কাল দুপুরের মাঝে তোমাকে আমার বাসায় আমি দেখতে চাই। তুমি এখনি ভাইয়ারে বলো টিকেট করে রাখতে। নয়তো ঘুম নষ্ট করে ভোরে উঠে তোমাকে বাসে তুলে দেবে না ও।”
একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে ওপাশ থেকে শায়লা বেগম বললেন,
-“সে কী বাড়িতে আছে! পামু কই তারে আমি! রাত একটার আগে বাড়িতে আসে সেই মহারাজা?”
-“ফোন দাও। ফোন দিয়ে বলো।”
-“কেন? এত পারাপারি কিসের? কাল কেন তোর ওইখানে যাওয়া লাগবো?”
-“আরে আম্মা! তোমারে যে মেয়ের কথা বলছিলাম, ওই মেয়েকে দেখার জন্য কাল আসবা তুমি।”
-“কেন? কালকের পর কী ওই মাইয়া উইড়া যাইবো?”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। ছটফটিয়ে বললো,
-“উফফ! তুমি বুঝবা না! তোমারে কাল আসতে বলছি তুমি আসবা। ব্যস!”
-“আচ্ছা.. দেখি।”
-“দেখাদেখি না। তোমার আসতেই হবে। আমার পছন্দ করা মেয়েকে একবার দেখলেই তুমি ফিদা হয়ে যাবা। বলবা, এরেই আমার ছেলের বউ হিসেবে চাই।”
মেয়ে যে দুই ডিগ্রি বাড়িয়ে কথা বলে তা অজানা নয়। তাই তাতে একটা পাত্তা দিলেন না শায়লা বেগম। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,
-“সবই বুঝলাম! কিন্তু একা একখান মাইয়া একই বাড়িতে আরেক পোলার লগে থাকে। জিনিসখান কেবা না?”
-“আরে আম্মা! ওরা তো ভাইবোন। তুমি ওভাবে ভাবছো কেনো? তাছাড়া আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পছন্দ টছন্দ আছে নাকি বা গ্রামের কারো সাথে কিছু ছিল নাকি। কিন্তু মেয়ে তো মেয়েই! মাশাল্লাহ.. এসব বোঝেই না ও। প্রেম পিরিত তো দূরের কথা।”
-“ঠিকাছে.. ভালো হইলেই ভালো। তুই তাইলে রাখ। আমি শীতলরে ফোন দেই। দেখি টিকিটের কথা কই।”
-“আচ্ছা, রাখছি তাহলে। তুমি কিন্তু ভোরের বাসের টিকেট কাটাবা।”
ফোন রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুন্নি সরকার। যাক! একটা কাজ তো এগিয়ে রাখা হলো। বাদবাকি গুলো না হয় ধীরেসুস্থে হবে!
সিগারেট হাতে অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে চিন্তার জগতে বিচরণ করছিল মেসবাহ। বেশ খানিকক্ষন হলো খাওয়াদাওয়ার পাঠ চুকেছে তাদের। তবে উল্লাসীর সঙ্গে আজ রাগারাগি করার পর মেয়েটি একদম চুপসে গেছে। খেতে বসেও চুপচাপ খেয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত মেয়েটির উপর রাগ ঝাড়া যেনো তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অভ্যাসটি পরিবর্তন করতে হবে। মেয়েটি ছোট। না বুঝে করে ফেলে একটি কাজ। অবশ্য এই পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখাও যায় না। কিন্তু কেনো রাখা যাবে না? সে তো স্ত্রী মানে না উল্লাসীকে। বাবার কথায় সে বিয়ে করেছে এবং একরকম বাধ্য হয়েই তাকে নিয়ে এসেছে নিজের সাথে। এবং দায়িত্ব হিসেবেই সে দেখে আসছে উল্লাসীকে। এছাড়া বেশি কিছু নয়। তাহলে উল্লাসীর বিয়ে আসুক বা অন্য কিছু তাতে তার এত মাথা গরম হবে কেনো? পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনার উপর মেজাজ খারাপ হলো মেসবাহর। আশ্চর্য চিন্তা ভাবনা তার! ছোট হোক বা বড়.. উল্লাসী তার বিয়ে করা বউ। বাবার কথায় হোক বা বাধ্য হয়ে, তিন কবুল পড়ে তো সে বিয়ে করেছে উল্লাসীকে। আর সেই উল্লাসীর জন্য যদি কেউ বিয়ের প্রস্তাব আনে তা অবশ্যই একজন স্বামী হিসেবে চুপচাপ মেনে নেয়া যায় না। কেনোই বা মেনে নেবে সে? উল্লাসী তার দায়িত্ব হলেও সর্বপ্রথম সে তার স্ত্রী।
-“আসবো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। জ্বলন্ত সিগারেট এশট্রেতে রেখে উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বললো,
-“চেয়ার নিয়ে এসো..”
চেয়ার টেনে ব্যালকনিতে এনে মেসবাহর পাশে বসলো উল্লাসী। উদাস মনে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকাতেই পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“ব্যালকনির জন্য ডাবল সিটের চেয়ার বা দোলনা কিনলে কেমন হয়?”
-“জানি না..”
-“কেনো জানো না?”
-“জানি না…”
-“মন খারাপ?”
এপর্যায়ে মেসবাহর দিকে ফিরলো উল্লাসী। ধীর গলায় বললো,
-“আমি কখনোই আর মুন্নি ভাবির সঙ্গে কথা বলবো না। উনি এলে কখনোই দরজা খুলবো না।”
-“না, তুমি বলবে।”
-“না, আমি বলবো না। কখনোই বলবো না।”
-“না, উল্লাসী। তুমি বলবে।”
মেসবাহর এমন কথায় অবাক চোখে তার দিকে তাকালো উল্লাসী। বললো,
-“কেনো?”
-“কারণ, ওই মহিলা আজকের পর থেকে তোমার এবং আমার লাইফ হেল করে ছাড়বে। অনেক্ক্ষণ যাবৎ কলিংবেল বাজানোর পর যদি তুমি দরজা না খোলো, উনি পুরো বাসা মাথায় তুলে ফেলবে। সবাইকে ডেকে এনে দরজা ভেঙে হলেও দেখবে ভেতরে ঠিক কী চলছে! তাছাড়া নানান কথা ছড়ানো তো রয়েছেই। এ কারণেই তুমি দরজা খুলবে। তবে উনাকে দেখামাত্রই বলবে তুমি এখন ব্যস্ত আছো বা এখন তুমি গোসলে যাবে। এমন নানান এক্সকিউজ দেখাবে। অর্থাৎ দরজা খুললেও ভেতরে ঢুকতে দেবে না। এড়িয়ে চলবে। কী? বোঝাতে পারলাম তো?”
পুরোটা না বুঝলেও মাথা নেড়ে মেসবাহর কথায় সম্মতি জানালো উল্লাসী। অপরদিকে উল্লাসীর সম্মতি পেয়ে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেসবাহর। মৃদু হেসে সে বললো,
-“পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয় তোমার?”
-“হয়.. মাঝেমাঝে। জানেন আমি যখন পড়তে বসতাম তখন সুহা আমার পাশে বসে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো।”
-“তাই?”
-“হ্যাঁ..”
উল্লাসী থেমে যেতেই হাতের ইশারায় কিছু একটা দেখিয়ে মেসবাহ বললো,
-“ওই যে দূরে খানিকটা আলো জ্বালানো একটি বিল্ডিং দেখতে পাচ্ছো, ওটার দোতলায় একটি কোচিং সেন্টার আছে। তোমায় ভাবছি ওখানটায় ভর্তি করে দেব। পড়বে ওখানটায়?”
সময় নিয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো উল্লাসী। তারপর ধীর স্বরে বললো,
-“আপনি বললে পড়বো।”
-“আমি তো বলছিই। ওখানে ক্লাস করতে থাকলে তারপর না হয় কোনো স্কুলে ঢুকিয়ে দিলাম। আর কোনো স্কুলে যদি নাও ঢোকাতে পারি তাহলে তুমি না হয় বোর্ড এক্সাম গ্রাম থেকেই দিলে। সমস্যা হবে কি?”
-“উহু..”
-“গ্রেট.. তাহলে কাল গিয়েই কথা বলে আসবো।”
আঁড়চোখে কিছুক্ষণ উল্লাসীকে দেখার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। এতটা নীরব কেনো উল্লাসী? পড়াশোনার ব্যপারে কী তাহলে আগ্রহ নেই তার? নতুবা অবশ্যই উচ্ছ্বসিত হতো সে। খানিকক্ষণ বেলকনিজুড়ে পায়চারী করে আবারও চেয়ারে এসে বসতেই পাশ থেকে হতাশ গলায় উল্লাসী বললো,
-“প্রতিদিন কোচিং করতে হবে?”
-“হ্যাঁ..”
-“তারমানে প্রতিদিন আমাকে নিচে নামতে হবে?”
-“তা তো নামতেই হবে..”
মেসবাহর জবাবে চোখমুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। মেঝের দিকে তাকিয়ে সে থেমে থেমে বললো,
-“তাহলে আমি সিঁড়ি দিয়েই নামবো। ওসব দিয়ে নামবো না।”
-“কী? লিফট?”
-“হ্যাঁ.. দরজা বন্ধ হবার সাথেসাথেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর যখনই চলতে শুরু করে তখন আমার মাথা ঘুরায়। আমি সিঁড়ি দিয়েই নামবো।”
উল্লাসীর নীরবতার কারণ বুঝতে পারলো মেসবাহ। সামান্য হেসে সে বললো,
-“আমি পাশে আছি না? ভয়ের কী আছে? যখন তোমার খারাপ লাগবে তখন না হয় আমার হাত আঁকড়ে ধরবে।”
সকালে উল্লাসীকে ফেলে হাসপাতালে আসার পর থেকেই অস্থির লাগছে মেসবাহর। মুন্নি ভাবি যেমন মানুষ তাতে উল্লাসীর একার পক্ষে সবটা সামলে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নানান প্রশ্নের মুখে ফেলে পাগল করে দেবে মেয়েটাকে। তাছাড়া অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা তো রয়েছেই। তাই হাসপাতালে চাপ কম থাকায় দুপুরে বাসায় খেতে যাবার সিন্ধান্ত নিল মেসবাহ। অবশ্য এর পেছনে আরেকটি কারণও রয়েছে। কোচিং সেন্টারে উল্লাসীর ব্যপারে কথা বলা। কোনো সমস্যা না থাকলে না হয় আজই ভর্তি করিয়ে দেয়া যাবে উল্লাসীকে। তারপর তাকে ক্লাসে বসিয়ে সে নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারবে তার কাজে। এতে যেমন মুন্নি ভাবির হাত থেকে বাঁচা যাবে তেমন সে নিজেও শান্তিতে দু’দন্ড কাটাতে পারবে। স্বস্তি নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কাঁচা বাজার সেরে বাসার উদ্দেশ্যে রিকশা নিল মেসবাহ। বেলা বাজে দুপুর একটা। সূর্যের প্রখর তাপ এসে লম্বভাবে পড়ছে তার শরীরে। হুডটা উঠিয়ে দিলে ভালো হত। অবশ্য রাস্তাও বেশি একটা নেই। ততক্ষণ না হয় একটু গরম সহ্য করলো…
লিফট ছেড়ে বেরিয়ে ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা দেখতে পেয়ে যা বোঝার বুঝে নিল মেসবাহ। ঠিক একারণেই সকাল থেকে অস্থিরতার উপরে রয়েছে সে। এই মহিলার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া খুব সহজ হবে মনে হচ্ছে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকে এক নজর তাকিয়ে মেসবাহ দ্রুত পদে এগুলো নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। তবে ফ্ল্যাটে ঢোকামাত্রই তার বিস্ময়ের সকল সীমা অতিক্রম করলো। মুন্নি সরকারের পাশেই বসে রয়েছে বয়স্ক এক মহিলা। যাকে প্রায়ই তার কাছে এসে থাকতে দেখেছে মেসবাহ। এবং ভুল না করলে উনিই মুন্নি সরকারের মা। মাথায় রক্ত উঠে গেল মেসবাহর। ঠিক কী করবে ভেবে না পেয়ে হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো সে।
-“কী চলে এখানে? আপনাকে আমি কাল নিষেধ করে দিয়েছি না?”
মেসবাহর গলার স্বর শোনামাত্রই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো মুন্নি সরকারের। চুপেচাপে কাজ সারতে চাইলেও মাঝ থেকে এই বান্দা কই থেকে উদয় হলো তা একদমই মাথায় আসছে না তার।
-“তারপরও আপনার এখানে কী কাজ? হোয়াই আর ইউ কামিং হেয়ার?”
উঠে দাঁড়ালো মুন্নি সরকার। পাশ ফিরে মেসবাহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
-“চিৎকার করছো কেনো? বসো.. বসে কথা বলি।”
-“কিসের বসবো? কেনো বসবো? আপনাকে আমি কাল নিষেধ করে দেই নি?”
-“শুনেই নিষেধ করে দিলে হবে নাকি? ঘরে বোন থাকলে এমন বিয়ের প্রস্তাব আসবেই। তাই বলে এমন হাইপার হওয়া যাবে?”
অস্থির মনে মেসবাহ বলো,
-“আশ্চর্য! আপনি তো প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের। প্লিজ আপনি বের হন।”
-“তুমি বসো, ভাই। বসে কথা বলি। তাছাড়া ভাই হিসেবে তোমার কাজ তোমার বোনের ভালো খারাপ বিবেচনা করা। তাছাড়া কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি? বাছবিচারের ব্যপার আছে না?”
নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায় দু’হাতের মুঠ চেপে লম্বা একটি দম ছাড়লো মেসবাহ। তারপর শান্ত গলায় বললো,
-“ওকে বিয়ে দেবো না। কাল আপনাকে সুন্দরভাবে নিষেধ করেছিলাম। তারপরও আজ আপনি আপনার মাকে কেনো নিয়ে এসেছেন?”
-“আমিও তোমায় বারবার বলছি, মেয়ে হয়ে জন্মেছে উল্লাসী। বিয়েতো একসময় ওকে দিতেই হবে। তাহলে আজ দিলে কী দোষ?”
-“আপনি প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করুন।”
-“তুমি বোঝো মেসবাহ। ভাই হয়ে বোনের ভালো চাওনা। এ কেমন ভাই তুমি? তাও যদি আমার ভাই কানা, বোবা বা খোড়া হতো! আমার ভাইয়ের মত ছেলে তুমি সারা জীবন খুঁজলেও উল্লাসীর জন্য পাবে না।”
আরও কিছু বলতে চাইছিল মুন্নি সরকার। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে উল্লাসীকে বেরিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল সে।
-“আপনি কখন এলেন?”
উল্লাসীর প্রশ্নে পিছন ফিরে তার দিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। চড়া গলায় বললো,
-“তোমাকে কাল রাতে কী বলেছিলাম? একে বাসায় ঢোকাতে নিষেধ করিনি? কিন্তু তুমি আজ একে বাসায় তো ঢুকিয়েইছোই সাথে আদর আপ্যায়নের জন্যও নিশ্চিত খাবার বানাচ্ছিলে।”
মেঝেতে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো উল্লাসী। তারপর ধীর গলায় বললো,
-“উনার মা এসেছিলেন। তাই আরকি….”
-“চুপ.. একদম চুপ।”
উল্লাসীর এক হাত চেপে তাকে টেনে ড্রইং রুমে নিয়ে এল মেসবাহ। তারপর মুন্নি সরকারকে উদ্দেশ্য করে স্থির গলায় বললো,
-“আপনিই ওকে জিজ্ঞেস করুন ও বিয়ে করবে নাকি। এই উল্লাসী, তুমি বিয়ে করবা?”
এসবের আগামাথা কোনোটাই মাথায় ঢুকলো না উল্লাসীর। তবে স্বামীর কথায় সম্মতি দেয়া শ্রেয় ভেবে ঢোক চেপে হালকা মাথা নাড়লো সে।
-“কী? হলো তো? এবার দয়া করে এসব বন্ধ করুন।”
ভ্রু কুঁচকে মুন্নি সরকার বললো,
-“ও ছোট। ও এসবের কিছু বুঝবে না। ওর খারাপ ভালো দেখার দায়িত্ব ভাই হিসেবে তোমার।”
-“আমিও দিব না।”
-“দেব না বললেই হলো! ভাই হইছো কি এই কাজে?”
-“বারবার কী ভাই ভাই লাগাই রাখছেন? উল্লাসী আমার বোন না। ও আমার দুঃসম্পর্কের বউ।”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“দুঃসম্পর্কের বউ মানে?”
-“ওইতো.. দুঃসম্পর্কের না শুধু বউ!”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৫+১৬
কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে মেসবাহ। রাগের মাথায় সত্যিটা এভাবে বলে দিল সে? একবারো ভাবলো না পরবর্তীতে এটি কতবড় আকার ধারণ করবে? সাথে ফলস্বরূপ বাঁশ বাগান তো রয়েছেই। কপালের ঘাম মুছে সোফায় বসে পড়লো সে। করুণ দৃষ্টিতে তাকালো মুন্নি সরকারের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যে তাকিয়ে রয়েছে তারই দিকে।
-“উল্লাসী তোমার বউ?”
মুন্নি সরকারের কথার পিঠে কোনো জবাব দিল না মেসবাহ। ভাবতে লাগলো ভয়ংকর এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার একটি উপায়…
-“কথা বলছো না কেনো? উল্লাসী তোমার বউ?”
-“জ্বি..”
-“তাহলে এতদিন বউকে বোন বলেছো কেনো?”
ঢোক গিলে পরিস্থিতি সামলাতে আবারও উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। গলা খাকড়ি দিয়ে সামান্য এগিয়ে এল মুন্নি সরকারের দিকে। তারপর স্থির গলায় বললো,
-“বোন বলিনি। দুঃসম্পর্কের বোন বলেছি। দুঃসম্পর্কের বোনও তো মাঝেমাঝে বউ হয়। তাই না?”
-“হলে হয়। তবে তুমি মিথ্যে বলেছো। সকলের কাছে নিজের বউকে বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছো।”
-“আলাদা করে আমি কারো সাথেই উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেইনি আপনি ছাড়া। আপনার জোরাজুরির সাথে না পেরে উঠে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আর বাদবাকি ছড়ানোর কাজটা আপনি করেছেন। তাহলে এখানে মিথ্যে কে বলেছে.. বলুন?”
ফুসে উঠলো মুন্নি সরকার,
-“একদম কনফিউজড করো না আমাকে। একদম না। এই আম্মা ওঠো তো। এসবের শেষ আজ আমিই দেখেই ছাড়বো।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে শায়লা বেগম বললেন,
-“তুই চুপ করতো। তোরে বারবার আমি কইছি, আগে ভালো করে খোঁজ খবর নে। কিন্তু তুই শুনলে তো! প্রত্যেক বিষয়েই এত নাচানাচি করলে চলে?”
-“না চললে নাই। মেসবাহর মনের ভেতর কি আমি বসে রইছিলাম যে ওর মিথ্যে কথা আমি ধরতে পারবো?”
পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“আমি তো মিথ্যে বলিনি।”
-“আবারও বলছো মিথ্যা বলোনি?”
-“হ্যাঁ.. উল্লাসী আমার দুঃসম্পর্কের বোনও হয়।”
-“তো? বিয়ের পর বউকে তুমি বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিবা?”
আবারও কপালের ঘাম মুছলো মেসবাহ। এ কেমন অবস্থায় পড়লো সে! কী দরকার ছিল উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করে দেয়ার? সত্যিটা বললে আর যাই হোক আজকের মতো পরিস্থিতিতে তো পড়তে হতো না!
-“বিয়েই তো আমাদের হয়নি। না মানে গ্রামে হয়েছে। এখানে তো হয়নি। তাই গ্রামে উল্লাসী আমার বউ। আর এখানে দুঃসম্পর্কের বোন।”
-“মানে? তুমি আবারও আমাকে কনফিউজড করছো!”
-“মোটেও না, ভাবি। এই যেমন ধরেন আপনি হাসান ভাইয়ের ওয়াইফ। কিন্তু আপনারা বিয়ের আগে একে অপরকে চিনতেন না। তাই বিয়ের পর আগের সেই পরিচয় নিজেদের মাঝে বাঁচিয়েও রাখতে পারলেন না। কিন্তু এদিকে আমি আর উল্লাসী তো দুঃসম্পর্কের ভাইবোন। তাই না? তাই আমরা সেই সম্পর্কের ছিটেফোঁটা নতুন জীবনে হালকার উপর ঝাপসা হলেও রাখার চেষ্টায় আছি। বলুন, ঠিক করছি না?”
বিষয়টি বোধগম্য হলো না মুন্নি সরকারের। চিন্তিত মুখে সে বললো,
-“হ্যাঁ.. তবে বউকে বোন?”
-“বোন না বোন না। দুঃসম্পর্কের বোন।”
-“ওই হলো! উহু.. কোথাও ঘাপলা আছে। অবশ্যই আছে। সত্যিটা বলো মেসবাহ। আসল কাহিনী কী?”
মুন্নি সরকারকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চুপ করানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিপাকে পড়লো মেসবাহ। আকাশ পাতাল ভেবেও এর জবাব না পেয়ে সে ধীর গলায় বললো,
-“এক সেকেন্ড! একটু ওয়াশরুমে যাবো আর আসবো। আপনি যাবেন না। বসুন। আমি আসছি।”
কোনোরকম দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে লিমনের নাম্বারে ডায়াল করলো মেসবাহ। দুইবারের মতো রিং বাজতেই ওপাশ থেকে লিমন ফোন ধরতেই তাকে সংক্ষেপে সবটা খুলে বললো সে। তারপর অস্থির গলায় বললো,
-“কী করবো এখন?”
-“আমি আগেই বলছিলাম তোরে! কী দরকার ছিল এসব বলার?”
-“এখন ওসব ভেবে হবে টা কী? এই মহিলাকে কিভাবে চুপ রাখবো সেটা বল। নয়তো এই মহিলা আমার মানসম্মান আর কিছু রাখবে না। পুরো সোসাইটিতে ব্যাপারটি নানানভাবে ছড়িয়ে দেবে।”
-“সময় দে একটু..”
-“সেই সময়টাই তো নেই।”
একদন্ড ভেবে লিমন ফোনের ওপাশ থেকে শীতল কন্ঠে বললো,
-“সময় যেহেতু নেই সেহেতু কমন কাহিনীই শুনিয়ে দে। সময় থাকলে না হয় আনকমন কিছে ভেবে দিতাম!”
-“কমন কাহিনীটাই কী?”
-“তুই উল্লাসী একে অপরকে পছন্দ করিস। কিন্তু উল্লাসীর বাবা ছোট মেয়ে বিয়ে দেবে না। প্লাস ওর বাবা গ্রামের সনামধন্য একজন ব্যক্তি। অনেক পাওয়ার আছে। তাই কোনো উপায় না পেয়ে তুই উল্লাসীরে নিয়ে ভাগছিস।”
লিমনের কথা শুনে বিস্ময়ের শেখরে পৌঁছে গেল মেসবাহ।
-“অসম্ভব!”
-“সম্ভব।”
-“মোটেও আমি এই কাজ করবো না। এতে আমার মানসম্মান যা আছে তার কাণিকোণাও আর থাকবে না।”
-“আরে শালা! প্রেম পিরিত খারাপ জিনিস না। বউকে বোন বানানোর তোমার এই অপকর্মের কথা ঢাকতে আপাতত একটা টপিক দরকার। আর আমার মনে হয়না এরচেয়ে বেটার অপশন পাবি।”
-“আমি পারবো না।”
-“না পারলে যা! পুরো সোসাইটির কাছ থেকে লুচ্চা উপাধি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যা।”
মেসবাহর স্থানত্যাগের পর থেকেই উল্লাসীর উপর প্রশ্নের হাঁড়ি খুলে বসেছে মুন্নি সরকার৷ একেরপর এক প্রশ্ন করে মেয়েটির কাছ থেকে কিছু জানতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। মেয়েটি জানিনা বিহীন মুখ থেকে কোনো আওয়াজই বের করছে না। ধৈর্যচ্যুত হয়ে আবারও সোফায় বসে পড়লো মুন্নি সরকার। অশান্ত গলায় বললো,
-“মেসবাহ তোমার স্বামী হয়?”
-“জানিনা..”
-“তো জানোটা কী?”
-“জানিনা..”
আগমন ঘটলো মেসবাহর। ঠান্ডা মাথায় উল্লাসীর পাশে দাঁড়িয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করলো সে লিমনের বানানো মিথ্যা গল্প। সবশুনে মুন্নি সরকার ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কিন্তু তুমি তো প্রতিষ্ঠিত একজন ছেলে। তোমার সাথে বিয়ে দিতে কী সমস্যা?”
-“উল্লাসীর তো বিয়ের বয়স হয়নি ভাবি।”
-“গ্রামেও এমন চিন্তাধারার মানুষ আছে?”
-“থাকবে না কেনো? অবশ্যই আছে। তাছাড়া ওর মা তো ঢাকাতেই মানুষ। উনার চিন্তাধারা অন্য পর্যায়ের।”
-“অহ.. কিন্তু আমার মাথায় এটা আসছে না, তুমি মেসবাহ কী করে এত ছোট এক মেয়ের প্রেম পড়লে!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসবাহ জবাব দিল,
-“আপনার যেমন এক দেখাতেই ওকে মনে ধরেছিল তেমন আমারও ধরেছিল। সুন্দর মেয়ে। অবুঝ মন.. ভাবি।”
সন্তুষ্ট হলো না মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উল্লাসীর দিকে ছুঁড়ে বললো,
-“তাই বলে বউকে বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে?”
-“আরে ভাবি! বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে সোসাইটির সবাই জেনে যেত না? এটা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় হতো, নানান আলোচনা হতো। আর যা ওর বাবার কাছে পৌঁছুতেই বেশি সময় লাগতো না। বোঝেনিই তো! পাওয়ারের ব্যাপার। এজন্যই চুপচাপে ছিলাম। তবে একটি মেয়ে যেহেতু নিয়ে এসেছি সেহেতু পরিচয় তো দিতেই হবে। তাই আরকি দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া।”
-“তা ঠিকাছে। কিন্তু ওর বাবা কি তোমার ঠিকানা জানে না? বা কোন হসপিটালে বসো তা জানে না? তার ক্লু ধরেই তো মেয়েকে নিতে এতদিন এখানে এসে পড়বার কথা!”
টনক নড়লো মেসবাহর। যুক্তিযুক্ত একটি প্রশ্ন। এবং প্রশ্নটির কাছে লিমনের দুই পয়সার গল্পটি হার মানতে বাধ্য। মহিলার মাথায় গোবর নয় বরং খাটি সোনা রয়েছে। অদ্ভুত ভুলভাল একটি কাহিনী তার হাতে ধরিয়ে দিলেও সে তার লেজ টেনে ধরেই সত্যতা যাচাই করে নিচ্ছে। আরও একটি দীর্ঘশ্বাস বুকচিরে বেরিয়ে এল মেসবাহর। পরিস্থিতি সামলাতে সে বললো,
-“এখানে আপন বলতে আমার কেউ নেই ভাবি। শুধুমাত্র আপনাকে এবং হাসান ভাইকে আমি কাছের মানুষ মনে করি। আপন মনে করি। আপনার সাথে কাল রাতে এবং কিছুক্ষণ আগে যে ব্যবহার করেছি এর জন্য আমায় ক্ষমা করুন। আসলে মাথা ঠিক ছিল না। ভাবি আপনিই বলেন! কেউ যদি আপনাকেই এসে অন্য মেয়ের সঙ্গে হাসান ভাইয়ের বিয়ে প্রস্তাব দেয়.. তা আপনি চুপচাপ মেনে নিতে পারবেন?”
-“অসম্ভব! তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তবেই আমি মানবো। তুমি ভুল কিছু করোনি। একদম ঠিক করেছো।”
-“বোঝার জন্য ধন্যবাদ ভাবি। আমাকে আপনি না বুঝলে আর কে বুঝবে বলুন!”
-“সেটাই তো। তা তোমরা পালিয়ে আসার পর বিয়ে করেছো তো?”
-“হ্যাঁ.. করেছিলাম। এই উল্লাসী, আমরা বিয়ে করেছিলাম না?”
উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। মেয়েটি চোখেমুখে একরাশ আতংক নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পাশে। মায়া হচ্ছে তার মেয়েটির জন্য। স্বল্প বয়সের এই জীবনে কত মিথ্যার না সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে! তবে আপাতত মিথ্যা ছাড়া সত্য বললে নারীবাদী লোকেরা তাকে পিটিয়ে ছাড়বে। অসৎ চরিত্রের লোক, নারী নির্যাতনকারী এমনকি নারী পাচারকারীর খাতায় নাম ফেলতেও এদের দু’দন্ড লাগবে না। তবে সে আবারও একই ভুল করছে। সম্মান বাঁচানোর ধান্দায় আরও একটি নতুন মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। পূর্বের মিথ্যা নিয়েই যেখানে জান রফাদফা হয়ে যাচ্ছে সেখানে নতুন এই মিথ্যা নিয়ে কতদূর এগুতে পারবে সে! প্রচুর ভাবাচ্ছে তাকে।
সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলো না মেসবাহ। উল্লাসীর কোচিং-এ আজ তাকে নিয়ে কথা বলতে যাবার জন্য হাসপাতাল ছেড়ে আসলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে বাসা ছেড়ে না বেরুনোই শ্রেয় মনে হলো তার। দুপুরে নানান কথা বলে কোনোমতে বুঝিয়ে শুঝিয়ে মুন্নি সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেলেও অস্থিরতা তার একবিন্দুও কমছে না। বরং সময় বাড়ার সাথেসাথে তা ক্রমে বাড়ছে। মহিলা নিশ্চিত এতক্ষণে পুরো সোসাইটিতে কথা ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে কথা কিভাবে ছড়িয়েছে ভালো না মন্দ.. তা কেবল সেই জানে! তবে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।
-“আপনার চা..”
চিন্তার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল মেসবাহ। তারপর তাতে একবার চুমুক দিয়ে বললো,
-“আমাকে কি খুব খারাপ একজন মানুষ মনে হয় তোমার?”
-“উহু…”
-“সত্যি করে বলো।”
একমুহূর্ত ভেবে উল্লাসী বললো,
-“আপনাকে আমি বুঝি না। মাঝেমাঝে চেষ্টা করি, তবে আমার এই ছোট মাথায় আপনাকে ঢোকাতে পারি না।”
মৃদু হেসে আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিল মেসবাহ। মাঝেমাঝে মেয়েটি সহজ সরল, মাঝেমাঝে মেয়েটি চঞ্চল, আবার মাঝেমাঝে একেবারেই নীরব। তবে যেমনই হোক, মন্দ নয়। যার সঙ্গে বেশ সুখে-শান্তিতেই দিনের পর দিন পাড় করা যায়। তবে মেয়েটি যে ছোট! হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো মেসবাহর। ভ্রু কুঁচকে সে পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকাতেই উঠে পড়লো উল্লাসী। ধীর পায়ে এগুলো সদর দরজার দিকে। এবং দরজা খোলামাত্র হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো মুন্নি সরকার সহ কিছু মহিলা। মুখে তাদের অজস্র হাসি।
-“এই তোমার শাড়ি আছে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় শাড়ি টাড়ি এনেছিলে কী?”
মুন্নি সরকারের প্রশ্নের জবাবে মুখ ঘুরিয়ে মেসবাহর দিকে তাকালো উল্লাসী। শাড়ি তো তার আছেই৷ তবে বলে দিলে যদি উনি রেগে যান!
-“ওর দিকে তাকাচ্ছো কেন? আর মেসবাহ তুমিও যাও। পাঞ্জাবি পড়ে তৈরি হয়ে নাও।”
পুরো ব্যাপার বুঝে উঠতে পারলো না মেসবাহ। এভাবে মুন্নি সরকার তার দলবল নিয়ে বাসায় ঢোকার সাথেসাথেই তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। তবে পরবর্তীতে সকলের মুখে হাসি দেখে অস্থিরতা কিছুটা হলেও কমেছিল। কিন্তু এসব কী? হঠাৎ পাঞ্জাবি কেনো পড়বে সে?
-“নাকি তোমার বউয়ের মতো তোমারও পাঞ্জাবি নেই!”
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো উপস্থিত সকলেই। তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“আছে। কিন্তু হঠাৎ পাঞ্জাবি কেনো?”
-“তো কী পড়ে বিয়ে করতে চাও তুমি? টিশার্ট পড়ে?”
কপাল কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। প্রশ্নসূচক চোখে মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কিসের বিয়ে?”
-“তোমার আর উল্লাসীর।”
-“আমাদের বিয়ে তো হয়েই গেছে।”
-“বেশ ভালো কথা। তাহলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে তো কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। তাছাড়া আমাকে যেহেতু কাছের মানুষ ভাবো.. সেহেতু আমার কথাটা রাখো। আমাদের সকলের সামনে আবারও বিয়েটা করে ফেলো। আমি সবাইকেই তোমার সমস্যার কথা বলেছি। আমরা আছি তোমাদের পাশে। উল্লাসীকে কেউ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। আর না উল্লাসীর বাবার ভয়ে তোমার নিজের বউকে দুঃসম্পর্কের বোন বলতে হবে!”
আবারও উপস্থিত সকলেই খিলখিল করে হেসে উঠতেই তাদেরকে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকার। মেসবাহকে তাড়া দিতে বললো,
-“হাসানকে পাঠিয়েছি কাজী ডাকতে। এলো বুঝি ও! যাও তাড়াতাড়ি তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমরা এদিকে উল্লাসীকে তৈরি করে দেই। বাচ্চা মেয়ে! সবটা সামলে নিতে পারবে না।”
নড়লো না মেসবাহ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। নতুন বলা মিথ্যেটি আবারও কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে?
পুরো ফ্ল্যাটজুড়ে লোকজনের সমাগমে গমগম করছে। কিছুক্ষণ হলোই পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে এসে বরবেশে নীরবে বসে সকলের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে যাচ্ছে মেসবাহ। বিয়ে করা বউকে আরো একটিবার বিয়ে করাই যায়। এ আর তেমন কী কঠিন কাজ! তবে একটি বিষয় প্রচুর ভাবাচ্ছে তাকে। যে মেয়েকে কিছুদিন আগেই একরকম বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছে সে, ভাগ্যের পরিহাসে আজ তাকে আরও একটিবার বিয়ে করতে হচ্ছে। তবে সেদিনের মাঝে এবং আজকের মাঝে প্রচুর তফাৎ। সেদিন মনে বাবাকে নিয়ে একরাশ ভয় কাজ করলেও আজ তা কাজ করছে না। আজ শুধুই কাজ করছে একরাশ ভালোলাগা। উপভোগ করছে সে সময়টিকে। যদিও খানিকক্ষণ আগে এর ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। হ্যাঁ, সে মুখোমুখি হতে চায়। দেখতে চায়, এবারের বলা মিথ্যেটি কোথায় নিয়ে যায় তাকে।
-“১৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি রহমান নিয়াজির জ্যেষ্ঠ কন্যা আঞ্জুমান আরা উল্লাসী, আলাউদ্দিন শেখের মধ্যম পুত্র মেসবাহ শেখের সাথে বিবাহে রাজি থাকলে বলুন ‘কবুল’।”
আঁড়চোখে পাশে বসা উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি পড়েছে সে। মাথায় গুঁজে দিয়েছে ঘোমটা। যার দরুন উল্লাসীর মুখটা নজরে আসছে না তার। কী চলছে মেয়েটি মনে? নিশ্চয় ভয় পাচ্ছে সে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে সকলের চোখের অগোচরে উল্লাসীর হাত আঁকড়ে ধরলো মেসবাহ। তারপর তাতে হালকা চেপে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“বলো, উল্লাসী। আমি তো আছিই।”
ভরসার হাতের সন্ধান পেয়ে মনের ভেতরে চলা আতংক কমে গেল উল্লাসীর। জোরে চেপে ধরলো সে মেসবাহর হাত। তারপর ধীর গলায় বললো,
-“কবুল..”
মেয়ের মুখে তিনবার কবুল শুনে এবারে কাজী এলেন মেসবাহর দিকে। সময় নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,
-“১৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি আলাউদ্দিন শেখের মধ্যম পুত্র মেসবাহ শেখ, রহমান নিয়াজির জ্যেষ্ঠ কন্যা আঞ্জুমান আরা উল্লাসীর সাথে বিবাহে রাজি থাকলে বলুন ‘কবুল’।
সময় নিল না মেসবাহ। সাথেসাথেই জোর গলায় বললো,
-“কবুল স্কয়ার। কিন্তু কাজী সাহেব মাইনাসে মাইনাসে যেমন ‘প্লাস’ হয়ে যায় তেমন এক মেয়েকে দুইবার বিয়ে করলে কবুলে কবুলে কি তা ‘না কবুল’ হয়? বা বিয়ে ভেঙে যাবার কোনো চান্স থাকে?”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৬
পুরো ঘরজুড়ে বিরাজ করছে শুভ্রতা। ফুলের সৌরভে চারিপাশটা ম ম করছে। চারিদিক থেকে অদ্ভুত এক শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগছে। পুলকিত মনে বিছানায় এসে বসলো মেসবাহ। তাকালো খানিকটা দূরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা উল্লাসীর দিকে। মেয়েটির মুখে উজ্জ্বল এক আভা ফুটে উঠেছে। এইরূপে দারুণ দেখাচ্ছে তাকে। তাদের প্রথম বিয়ের দিনেও কি উল্লাসীর মুখে একই আভা ফুটে উঠেছিলো? হয়তোবা। তবে সেদিন তা নজরে আসেনি। অপার্থিব এক পরিবর্তন ঘটেছে তার নিজের মাঝে। আজ খুব করে ইচ্ছে করছে বয়সের ব্যবধান ভুলে উল্লাসীর প্রতি প্রত্যাশা রাখতে। ধীরস্থির ভাবে তাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে। তবে একদিন না একদিন তো বড় হবে উল্লাসী। সব কিছু বুঝতে শিখবে। সেসময় যদি বেঁকে বসে সে? নিজের জীবনে আর তার প্রয়োজন বোধ না করে! তখন? তখন কী অন্যায় করা হবে না মেয়েটির সাথে? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। নিজের চিন্তাভাবনা সংযত করে ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা টেনে সে বললো,
-“গরম লাগছে না?”
মুখ তুলে মেসবাহকে দেখামাত্র উল্লাসী এগিয়ে এল তার দিকে। মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিয়ে বললো,
-“উহু.. রাতে আপনি খেয়েছেন?”
-“খেয়েছি.. তুমি?”
-“আমিও খেয়েছি। একটা সত্যি কথা বলুন তো। মুন্নি ভাবির রান্না আপনার ভালো লাগে নাকি আমার হাতের রান্না?”
-“তোমার।”
-“আমি জানতাম! আমি জানতাম আপনি এটাই বলবেন।”
-“তাহলে প্রশ্ন করলে কেনো? যেহেতু জানাই ছিল!”
-“মুন্নি ভাবি জিজ্ঞেস করতে বলেছিলো বলে। ভাবি যে আজ ইলিশ মাছ ভাজি করেছিলো ওটায় কিন্তু ভাবি লবণ দেয়নি। আপনি খেয়ে বুঝেছিলেন?”
-“বুঝেছিলাম…”
-“আমিও বুঝেছিলাম। কিন্তু কিছু বলিনি।”
-“গুড.. ভালো কাজ করেছো।”
বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের আলো নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে আবারও বিছানায় এল মেসবাহ। পা উঠিয়ে আরাম করে বসে বললো,
-“তুমি গ্রামের মেয়ে হয়েও যথেষ্ট শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো। ব্যপারটি প্রথম আমায় বেশ ভাবিয়েছে। অনাও এভাবে কথা বলেনা যেভাবে তুমি বলো। দারুণ লাগে শুনতে।”
হাসলো উল্লাসী। উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
-“আমার মা শিখিয়েছে।”
-“তোমার মার পড়াশোনা কতদূর?”
-“জানি না। তবে অনেক পড়েছে। পড়তে পড়তে বাবার সাথে বিয়ে হয়ে যাবার পর আর পড়েনি।”
-“তোমার বাবামায়ের কাহিনী টা কী বলোতো! কিভাবে কী হলো উনাদের মাঝে? ঢাকা থেকে সব ছেড়েছুড়ে সরাসরি গ্রামে!”
-“আমিও খুব বেশি জানি না। তবে মার মুখে যেটুকু শুনেছি তাতে মার বাবারা ছিল অনেক বড়লোক। মা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বাবাকে নতুন ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেয় নানা। মাকে নিয়ে যাওয়া আসাই ছিল তার প্রধান কাজ। দীর্ঘদিন এভাবে চলার পর মা বুঝতে পারে উনি বাবাকে পছন্দ করে। তার ধীর স্বভাব, তার মুখের হাসি, তার নীরবতা.. সবটাই নাকি মাকে খুব করে টানতো। আমার বাবাকে দেখেছেন তো আপনি। সুন্দর মনে হয়নি আপনার?”
মাথা নেড়ে উল্লাসীর কথায় সম্মতি জানাতেই আবারও সাদাকালোর দুনিয়ায় নিজের বাবামাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ শুরু করলো উল্লাসী। বেশ লাগে তার এই গল্পটি সকলের কাছে শুনাতে। তবে আজকাল আর এগল্প কেউ শুনতে চায়না। শুনলেও বা নাক শিটকোয়। তবে আজপর্যন্ত তাদের এই অদ্ভুত কাজকর্মের কোনো ব্যখ্যা খুঁজে পায়নি সে।
-“মা একদিন হুট করেই বাবাকে বলে সে বাবাকে বিয়ে করতে চায়। সবশুনে বাবার নাকি একঘন্টার মতো কোনো মুখের জবান ছিল না। হাস্যকর না ব্যাপারটি?”
-“হ্যাঁ.. তারপর?”
-“তারপর আর কী? বাবা রাজি ছিল না ওদিকে মাও ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না। ঠিকই নিজের মায়াজালে বাবাকে আটকে ফেলে মা। এসব কিন্তু আমি না, মা বলেছে।”
বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। তারপর বললো,
-“বুঝেছি.. তারপর?”
-“তারপর যখন মায়ের বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে, তখন বাবাকে হুট করেই বিয়ে করে ফেলে মা। নানাকে জানায় তবে সে মেনে নেয় না। বের করে দেয় বাড়ি ছেড়ে। ঘুড়েফিরে গ্রামে মাকে নিয়ে ফিরে আসে বাবা। তারপর আসি আমি.. মা আমাকে কী বলতো জানেন?”
-“কী?”
-“আমি নাকি তাদের ভালোবাসার ফসল বুনতেই পৃথিবীতে এসেছি। আমিও তখন মাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম, কোথায় মা? ফসল তো বুনছে বাবা। আমি তো ফসল বুনছি না। মা আমার তখন হেসে কুটিকুটি হতো।”
গলা হঠাৎ ধরে এল উল্লাসীর। চোখভর্তি জল নিয়ে বিছানার চাদরে দৃষ্টি স্থির করে আবারও বললো,
-“মা যেদিন মারা যায় সেদিনও মা আমার চুল বেঁধে দিয়েছিলো। কপালে চুমু দিয়ে বলেছিল, বলতো আমাদের ভালোবাসার ফসল বুনতে তোর ভাই আসছে না বোন? আমি বলেছিলাম, বোন। ওকে আমি খুব আদর করবো মা। সারাদিন নিজের কোলে রাখবো। মা বলেছিল, আর পড়াশোনা? আমি বলেছিলাম, গোল্লায় যাক!”
স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলো না মেসবাহ। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো উল্লাসীর দিকে। ওদিকে উল্লাসী বলার উপরেই রয়েছে,
-“আশেপাশের সবাই বলছিলো, মারে শেষ দেখা দেইখা দে। আর কখনোই আসবো না তোর মা। আমিও খুব করে শেষ দেখা দেখে নিয়েছিলাম সেদিন। মার ঘুমন্ত মুখে হাজার হাজার চুমো দিয়েছিলাম। চিৎকার করে কেঁদে বলেছিলাম, মা আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না.. যেতে পারে না।”
উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলো উল্লাসী। পাঁচ বছর আগের সেই দৃশ্য আজও স্পষ্ট দেখতে পায় সে। সাথেসাথেই বুকের ভেতরটায় অসহ্য যন্ত্রণা হয় তার। মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, মুখে চুমো দিতে ইচ্ছে করে। তবে কোথায় পাবে সে তার মায়ের দেখা!
-“আমি মায়ের আদর পেয়েছি, কিন্তু আমার বোন তা পায়নি। কথা বলতে, ভালোভাবে চলতে না পারলেও ও যে মায়ের আঁচল খুঁজে বেরায় তা আমি খুব বুঝি। ওর কষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। আপনি তো ডাক্তার.. সব কিছুর ঔষধই আপনার কাছে আছে। আমার বোনটাকে ভালো করে দেবেন আপনি? ওর কষ্ট কমিয়ে দেবেন?”
বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো মেসবাহর। এপরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিৎ ভেবে পেল না সে। তবে মেয়েটির কান্নার বেগ ধীরেধীরে বাড়ছে। কিছু একটা করা উচিৎ তার…
-“ছোটমা কথা দিয়েছে আমায়।আপনাকে বিয়ে করলে ছোটমাও খোকনের মতোই আদর করবে সুহাকে। সুহাও মায়ের আদর পাবে। আমি তো বিয়ে করেছি আপনাকে। কিন্তু ছোটমা কী তার কথা রেখেছে? যে মেয়েটি আমায় ছাড়া একদন্ড থাকতে পারতো না, সেই মেয়েটি আজ আমায় ছাড়া কী করে থাকে বলতে পারবেন? আমি ছাড়া ওর দুনিয়ায় আর কেউ নেই। প্রতিবন্ধী বলে কেউ ওকে ভালোবাসে না, কেউ আদর করে কাছে টেনে নেয় না। কী দোষ ওর? বলুন না..”
এগিয়ে এসে উল্লাসীকে নিজের বুকে আঁকড়ে নিল মেসবাহ। মেয়েরটির বলা একেকটি কথা তার বুকে এসে বিঁধছে তীরের মতো। মেয়েটির মা নেই ভাবতেই বুকের ভেতরটায় শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। মায়া হচ্ছে মেয়েটির জন্য। নাম না জানা এক কষ্ট বারবার এসে গলা চেপে ধরছে।
-“ওর কেউ নেই। ওকে কেউ আদর করে না। বাবাও না.. বাবাও ওকে আদর করে না। আমার কত কষ্ট হয় জানেন?”
-“জানি..”
-“জানেন না। আপনি জানেন না। কেউ জানে না।”
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেসবাহ বললো,
-“ঠিকাছে। কেউ জানে না। একটু শান্ত হও তুমি।”
মেসবাহর মমতাময়ী স্পর্শে ধীরেধীরে শান্ত হয়ে এল উল্লাসী। তবে খানিকটা ফোঁপানি রয়েই গেল। মেয়েটির নীরবতা যতটা ভালোলাগে, ততটাই কষ্ট হয় মেয়েটির কান্নামাখা মুখ দেখলে। বুকের ভেতরটায় উথালপাথাল শুরু হয়, অস্থির লাগে। উল্লাসী কি বোঝে তার এই অস্থিরতার কারণ? নিজের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে দু’হাতের আঁজলে মেসবাহ তুলে ধরলো উল্লাসীর মুখ। মৃদু আলোয় মেয়েটির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছে। কী আছে তার ওই দুই চোখে? প্রশ্নের জবাব না পেলেও নিজের ঠোঁটজোড়া নিয়ে সে ঠেকালো উল্লাসীর কপালে। চোখজোড়া বুজে সময় নিয়ে তাতে এঁকে দিল স্নেহের স্পর্শ।
-“সেদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবা মাকে যতটা ভালোবাসতো আপনিও কি আমায় ততোটাই ভালোবাসেন? কিন্তু আজ বলছি, আপনি কখনোই আমাকে সেভাবে ভালোবাসবেন না, যে ভালোবাসা আমি হারিয়ে গেলেই ফুরিয়ে যাবে। আপনি আমাকে সেভাবেই ভালোবাসবেন, যে ভালোবাসায় আমি মার মতো হারিয়ে গেলেও ছোটমার মতো কেউ কখনোই আসবে না।”
বুকচিরে আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। ঠোঁটজোড়া উল্লাসীর কপাল থেকে উঠিয়ে বালিশে মাথা গুঁজলো সে। ভাগ্য তাকে একোন স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? যার একূল অকূল দুকূলই ঘন আঁধারময়।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত উল্লাসীকে আগাগোড়া লক্ষ্য করলো মুন্নি সরকার। তারপর ভ্রু নাচিয়ে বললো,
-“গোসল দাও নি?”
-“উহু.. বাড়িতে আম্মা সকালে গোসল দিতে বললেও উনি তো আমাকে সকালে গোসল করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।”
-“কে? মেসবাহ?”
-“হ্যাঁ…”
উদ্বিগ্ন মনে প্রশ্নের হাঁড়ি খুলে বসলো মুন্নি সরকার। মেসবাহ কেনো উল্লাসীকে সকালে গোসল করতে নিষেধ করবে? এটুকো বোঝার বয়স তো মেসবাহর হয়েছে৷ তাহলে কী তেমন কিছুই হয়নি দুজনের মাঝে? পরমুহূর্তেই নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই করে নিল মুন্নি সরকার। কেনো হবে না ওসব? তাহলে প্রেম করে বিয়ে করেছে কী কাজে? অবশ্যই রান্নাবান্না করে শুধু খাওয়ানোর কাজে তো নয়। তবুও নিজের মনে চলা প্রশ্নোত্তরের পাঠ চুকাতেই উল্লাসীকে নিজের কাছে এনে বসালো মুন্নি সরকার। একদন্ড ভেবে ক্ষীণ গলায় বললো,
-“তোমায় মেসবাহ আদর করে?”
মাথা নেড়ে তাতে সম্মতি জানিয়ে উল্লাসী বললো,
-“করে তো।”
-“কোথায় কোথায় করে?”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“আদর আবার জায়গায় জায়গায় করা যায় নাকি!”
-“যায় তো.. জানো না?”
-“উহু..”
মনের ভেতরে চলা সন্দেহ আরও জোরজার হলো মুন্নি সরকারের। উল্লাসীর দিকে চেয়ে আগ্রহী গলায় বললো,
-“মুখে, গলায়, ঠোঁটে আলাদা আলাদাভাবে পুরো শরীরেই তো স্বামীরা আদর করে। কেনো? তোমায় মেসবাহ এভাবে আদর করে না?”
চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে উল্লাসী জবাব দিল,
-“না তো।”
পুরো ব্যপার বোধগম্য না হলেও এর কারণ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলো মুন্নি সরকারের মন। কেন করবে না মেসবাহ এসব? সে যতটুকু মেসবাহকে চেনে জানে তাতে অত্যন্ত ভদ্র সুলভ একজন ব্যক্তি সে। কথাবার্তা খুব একটা না বললেও অত্যন্ত আন্তরিক। এবং ডাক্তার হবার সুবাদে প্রচুর স্বাস্থ্য সচেতন। তাহলে কী ঠিক একারণটাই তাদের ভালোবাসার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে? মেসবাহ উল্লাসীকে এতটাই বাচ্চা ভাবে যে পারলে তাকে এখনি ধরে ফিডার খাওয়াবে! সেখানে বাচ্চা একটি মেয়ের সাথে মেসবাহর মতো ছেলে এসব করতে অবশ্যই দশবার ভাববে। কারণ খুঁজে পেয়ে বেস উচ্ছ্বসিত হলো মুন্নি সরকার। উল্লাসীর দিকে আবারও ফিরে সে ফিসফিস করে বললো,
-“আমার কথা মন দিয়ে শুনো। আমি যা বলবো তাই করবে। কী? করবে তো?”
শুক্রবার হওয়ায় বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠলো মেসবাহ। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে এসে বসে জোর গলায় কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকতেই রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। টেবিলে গোছানো সব খাবারের দিকে ইশারা করে বললো,
-“সব মুন্নি ভাবি দিয়ে গেছে।”
-“আশ্চর্য! সে আবার কেনো দিয়েছে এসব? তুমি নিষেধ করোনি?”
-“উহু..”
-“এটা কী ঠিক করেছো?”
-“কী যে!”
আর কথা বাড়ালো না মেসবাহ। থালায় খিচুড়ি উঠিয়ে মাংসের ঝোল নিয়ে মুখে পুড়তে শুরু করলো একের পর এক।
খাবার শেষে মেসবাহ ড্রয়িংরুমে এসে বসতেই তার পিছুপিছু এল উল্লাসী। পাশে বসে নরম গলায় বললো,
-“আপনি আমায় আদর করেন না কেনো?”
প্রশ্ন শুনে বড়সড় একটি ধাক্কা খেলো মেসবাহ৷ চোখজোড়া প্রশস্ত করে বললো,
-“মানে?”
-“মানে আপনি আমায় কেনো আদর করেন না? স্বামী তো তার স্ত্রীকে অনেক জায়গায় আদর করে। আপনি কেনো আমায় করেন না?”
ওপাশ থেকে মেসবাহর কোনো জবাব না পেয়ে উল্লাসী আবারও বললো,
-“মুখে, ঠোঁটে, গলায় আলাদা আলাদাভাবে পুরো শরীরেরই তো স্বামীরা আদর করে। তাহলে আপনি কেনো করেন না? একটু সবজায়গায় আদর করলে কী এমন হয়?”
ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। আশেপাশে নজর বুলিয়ে ধীর গলায় বললো,
-“কাল রাতে তো করলাম। ঐযে কপালে…”
-“ওটা তো চুমু ছিলো।”
-“আরে পাগলি! চুমু আদর একই।”
একমুহূর্ত ভেবে মুন্নি সরকারের বলা কথাগুলো স্মরণ করলো উল্লাসী। তারপর আহ্লাদী গলায় বললো,
-“তাহলে এখনি ঠোঁটে একটু আদর করে দিন..”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। দ্রুত পায়ে সদর দরজার দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“সর্বনাশ! আমি ফোন করেছিলো, না মানে লিমন ফোন করেছিলো। দেখা করে আসি। লিমন লাগাও। না মানে.. ইশশ! দরজা লাগাও।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৭+১৮
শুভ্র বিকেলের সঙ্গে মেঘেদের প্রণয়.. আজ কয়েকদিন যাবৎ প্রচুর দেখা যাচ্ছে। বিকেল শুরু হতে না হতেই মেঘেরা এসে ভীড় জমায় দূর ঐদেশে। যার কারণে রোজ ঠিকমতো প্রাইভেট পড়তেও যাওয়া হচ্ছে না। তবে আজ চৈতালি এসে উপস্থিত হওয়ায় শান্তির বিছানা ছেড়ে উঠতেই হলো অনাকে। ঝটপট জামা বদলে চুলে চিরুনি বোলাতে বোলাতে বললো,
-“আজ না গেলে হয় না?”
-“উহু.. হয় না। দ্রুত কর তো।”
ব্যাগে ম্যানেজমেন্টের একটি খাতা ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। পড়তে তার ভালোলাগে না.. তবে সবাই বলে পড়। প্রেম করতে ভালোলাগে.. অথচ কেউ বলেনা প্রেম কর। অদ্ভুত না? না পড়ে প্রেম-ভালোবাসায় মগ্ন থাকলে বুঝি জীবনে সুখী হওয়া যায় না?
-“তোর কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানে কিরে?”
হঠাৎ অনার প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে গেল চৈতালির। তীক্ষ্ণ গলায় সে বললো,
-“তুই কি প্রেমে পড়েছিস?”
-“ধুর! বল না!”
-“কী বলবো?”
-“তোর কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানে কী?”
থেমে পড়লো চৈতালি। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ভালোবাসা কিছুটা এক পাক্ষিক। এক পক্ষ থেকে কাওকে নিঃস্বার্থ ভাবে চাওয়া, তার ভালোলাগাকে নিজের ভালোলাগা বানিয়ে নেয়ার নামই ভালোবাসা। আর প্রেম দু’পক্ষের সেই ভালোবাসার সমন্বয়।”
-“দারুণ এক লজিক দিয়েছিস তো। তা এসব কোত্থেকে জানলি? কাওকে কখনো ভালোবেসেছিস?”
-“তাহলে কী তোকে জানাতাম না?”
চৈতালির কথার পিঠে কথা বাড়ালো না অনা। আবারও হাটতে শুরু করলো রাস্তা ধরে। সামনেই বড় বাজার। বড় বাজারেই ছোট একটি ঘর নিয়ে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের পড়ান সবুজ স্যার। স্যারের বয়স খুব একটা বেশি নয় এবং এখনো অবিবাহিত। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, স্যার পছন্দ করে চৈতালিকে। সকলের অগোচরে প্রায়ই চৈতালির দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি দেয়। যেনো তার শরীরের প্রতিটি অংগসমূহ সর্বক্ষণ লজ্জায় ভরপুরই থাকে। ঠোঁট চেপে নিজের হাসিকে নিয়ন্ত্রণে আনলো অনা। তারপর চৈতালির কাঁধে হাত রেখে গলি ধরে এগুতেই নজরে এলো এমাদ। সাথেসাথেই তার মনজুড়ে খেলে গেল খুশির জোয়ার।
-“তুই যা.. আমি আসছি।”
-“কেনো? তুই কই যাবি?”
-“আরে তুই যা না! আমি আসছি তো..”
বেশ জোর করেই চৈতালিকে সামনে এগুতে বলে পেছন ফিরলো অনা। কয়েক কদম এগিয়ে এসে এমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মুখের সিগারেট নিজের হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“সিগারেট খাচ্ছিলে কেনো?”
মৃদু হাসলো এমাদ। দেয়ালের সাথে নিজের শরীর ঠেসে দাঁড়িয়ে বললো,
-“তোমার দেখা না পেয়ে বোর হচ্ছিলাম। তাই আরকি…”
মুখ ভেংচি কেটে অনা বললো,
-“তোতার তেখা তা তেয়ে তোর তত্তিলাম… না? আজ যদি না আসতাম, তখন কী হতো? তখন কী সিগারেটের ফ্যাক্টরি খুলে বসতে?”
-“আরে না.. কী যে বলো!”
-“কিছুই বলি না। চুলে চিরুনি লাগাওনি না? এলোমেলো চুলেই বেরিয়ে পড়েছো?”
-“হুম..”
-“দাঁড়াও।”
আশেপাশে তাকিয়ে লোকজনের উপস্থিতি দেখে এমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে চুল গুলো ঠিকঠাক করলো অনা। তারপর তার গাল টেনে বললো,
-“ওরে আমার প্যাঁচাটা! এখন দেখো কত সুন্দর লাগছে দেখতে! তা তুমি এখানে কতক্ষণ হলো এসেছো?”
-“এই দশ মিনিট..”
-“এই দশ মিনিটে এই রাস্তা দিয়ে কয়টি মেয়ে গেছে?”
-“আমি কী করে বলবো!”
-“তুমি সেভাবেই বলবে যেভাবে তাদের ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখেছো!”
-“আমি তো ওসব দেখিনি।”
-“মিথ্যে..”
-“সত্যিই।”
-“তিন সত্যিই?”
-“চার সত্যি। এবার বিশ্বাস হলো তো?”
-“কচু হয়েছে। আমি যাচ্ছি।”
-“সিগারেটটা তো দিয়ে যাও!”
-“এই সিগারেট এখন আমি খাবো।”
বলেই দৌড়ে সামনে এগুলো অনা। তার যাত্রা পথের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো এমাদ। তারপর উঁচু স্বরে বললো,
-“এই অনা। অনা… কাল কিন্তু কলেজের সামনে থাকবো। জলদি এসো…”
লিমনের সাথে ফোনে কথা বলে মাথায় চিরুনি লাগিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে তা লক করলো মেসবাহ। তারপর জোর গলায় কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকতেই বেরিয়ে এল সে মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাট ছেড়ে। নীল শাড়িজমিনের মাঝে সাদা রঙের সুতোর কাজের একটি শাড়ি পড়েছে সে। সোজা পিঠসমান চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে রেখেছে। সাথে কানের একপাশটায় সাদা ফুল গুঁজে দিয়েছে। ঠোঁট ভর্তি করে লাগিয়েছে টকটকে লাল লিপস্টিক, চোখে এঁকেছে গাঁঢ় কাজলের রেখা। অপূর্ব সুন্দর লাগছে। ঈদের দিনটিতেও কি ঠিক এতটাই অপূর্ব দেখাচ্ছিলো উল্লাসীকে? হয়তোবা। তবে কেনো সেদিন তা নজরে আসেনি তার?
-“নাও.. তোমার বউকে সাজিয়ে দিলাম।”
মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য সূচক একটি হাসি দিল মেসবাহ। তারপর এগুলো লিফটের দিকে। এই মহিলা উল্লাসীকে বড্ড পাকামো শেখাচ্ছে। সকালে উল্লাসীর হঠাৎ ওমন আচারণে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো সে। তবে শুক্রবারের নামাযের কথা ভেবে খানিক পরে আবারও ফিরে আসায় উল্লাসীর সেই অদ্ভুত আবদার আবারও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন ভর সেই একই কথা বলে বলে জ্বালিয়ে মেরেছে তাকে। এই মেয়ে যে বড় অবুঝ তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। তবে অবুঝেরও তো একসময় বুঝ হয়, তা এর কবে হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসবাহ লিফটের বোতাম চেপে সরে দাঁড়াতেই তার গা ঘেষে দাঁড়ালো উল্লাসী। চোখজোড়া বুজে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ভেতরে টেনে নিয়ে বললো,
-“মাথা ঘুরছে আমার।”
উল্লাসীর হাত আঁকড়ে জোরে একটি চাপ দিল মেসবাহ। তারপর নরম স্বরে বললো,
-“আমি তো আছি.. চোখ খোলো।”
-“মাথা ঘোরে..”
-“চোখ বন্ধ করে রাখলে তো মাথা ঘুরবেই। আমার দিকে তাকাও। আমার সাথে কথা বলো। দেখবে কিছুই ফিল হবে না.. এই মেয়ে, চোখ খোলো।”
সময় নিয়ে উল্লাসীকে পর্যবেক্ষণ করলো লিমন। এরপর মেনুকার্ড হাতে নিয়ে বললো,
-“কী খাবি বল?”
-“নরমাল কিছু অর্ডার কর। যাতে উল্লাসীর জন্য খেতে সুবিধা হয়।”
বলেই পাশ ফিরে উল্লাসীর দিকে নজর দিল মেসবাহ। ক্ষীণ গলায় বললো,
-“খারাপ লাগছে?”
-“উহু..”
-“তাহলে কথা বলছো না যে!”
মেসবাহর হাতের আঙুলের মাঝে নিজের আঙুল ডুবিয়ে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো উল্লাসী। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“অস্থির লাগছে…”
-“কেনো? আমি তো আছি..”
-“কী গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিস দুজনে?”
লিমনের প্রশ্নে মৃদু হেসে মেসবাহ বললো,
-“কিছু না.. অর্ডার করেছিস? দ্রুত ফিরতে হবে।”
-“করলাম তো। তা ছুটির দিনে বউকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েও তোর তাড়াহুড়ো? বড্ড বেরসিক মানুষ তুই! উল্লাসী, আমার এই বেরসিক বন্ধু তোমাকে খুব জ্বালায়… না?”
-“চুপ করতো। এসব কী বলছিস?”
-“আরে ব্যাটা তুই চুপ কর। আমাকে আর উল্লাসীর সঙ্গে কথা বলতে দে। তো যা বলছিলাম, মেসবাহ তোমাকে খুব জ্বালায়?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী অসম্মতি জানাতেই ফের প্রশ্ন করলো লিমন।
-“তাহলে কি তুমি জ্বালাও?”
-“না.. আমি কেনো উনাকে জ্বালাবো?”
-“তাই তো! তুমি তো আর ছোট বাচ্চা নও। তবে আমার বন্ধু কিন্তু তোমাকে বাচ্চাই ভাবে। পারলে তোমাকে কোলে করে পুরো দুনিয়া ঘুরলে বাঁচে!”
খিলখিল করে হেসে উঠলো উল্লাসী। লোকটি তো বেশ মজার!
-“তুমি হাসছো? আর আমি কাঁদি.. ভাবি আমার একটা বাচ্চা বউ হলে কী হতো!”
-“আপনার বউ আছে?”
-“থাকবে না? আছে আছে.. বউ আমার বাচ্চা নয়। বুড়ো বউ।”
পাশ থেকে কপাল কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“এই.. তুই কী শুরু করলি! থাম তো এবার!”
-“তুই চুপ করতো.. এই উল্লাসী, আমাকে ভালো করে দেখো তো! কী.. দেখেছো?”
একমুহূর্ত লিমনকে দেখে উল্লাসী বললো,
-“হ্যাঁ..”
-“আমাকে দেখে কী মনে হলো তোমার?”
-“কিছুই তো মনে হয়নি।”
-“সুন্দর অসুন্দর কিছুই না?”
-“হয়েছে। সুন্দর মনে হয়েছে।”
-“গ্রেট। এবার মেসবাহর দিকে তাকাও। তারপর বলো, আমাদের দুজনের মাঝে কে বেশি ফর্সা?”
সময় নিল না উল্লাসী। সাথেসাথেই বললো,
-“আপনি।”
-“তার মানে মেসবাহর চেয়ে আমিই সুন্দর৷ এই তো?”
আবারও পাশ থেকে কপাল কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“এসব কী শুরু করলি তুই?”
-“চুপ কর তো তুই। আচ্ছা উল্লাসী.. তোমার পাশে মেসবাহ না থেকে আমি থাকলে কেমন হতো? সেই হতো না?”
উল্লাসীর জবাব দেবার আগেই উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। শক্ত গলায় লিমনকে বললো,
-“এদিকে আয়। কথা আছে।”
-“কী কথা? এখানেই বল! সুন্দরী ভাবিকে ফেলে তো উঠতে মন টানে না!”
-“ব্যাটা তুই উঠবি?”
মেসবাহ ক্ষেপেছে বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ালো লিমন। দু’হাতজোড়া প্যান্টের পকেটে গুঁজে ধীরেসুস্থে এগুলো মেসবাহর পিছুপিছু।
-“তুই কী করছিস এসব?”
আকাশ থেকে পড়ার ভান করে লিমন বললো,
-“কী?”
-“বুঝিস না কী? আমার বউ, আমি তার পাশে.. অথচ তুই কিনা নিঃসংকোচে ফ্লার্ট করে যাচ্ছিস!”
মেসবাহর কথার তাল না দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে ক্ষীণ গলায় গেয়ে উঠলো লিমন,
-“তোমার কেনো জ্বলেরে বন্ধু তোমার কেনো জ্বলে? তোমার বাচ্চা বউ কারো হলে, তোমার কেনো জ্বলে?”
-“তুই কিছু বললি?”
-“উহু.. গান গাইছি। গান”
-“বাজে বকিস না তো! আমার কোথাও জ্বলে না। আমার জ্বলবে কেনো শুধুশুধু?”
ফোন আবারও পকেটে পুড়ে মেসবাহর কাঁধে হাত রাখলো লিমন। পাশ ফিরে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বউ তোর কোনো দিক থেকেই বাচ্চা নেই। এমন সুন্দর একটা বউ পাশে রেখে তুই ঘুমাস কেমনে? বলিকি.. এসব জ্বলাজ্বলি বন্ধ করে এবার তোর বাচ্চা বিড়ালটা মেরেই ফেল।”
বলেই মেসবাহর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো লিমন। যাক! কাজে দিয়েছে। ব্যাটা প্রচুর ক্ষেপেছে। এতই ক্ষেপেছে যে খানিকক্ষণ এভাবে থাকলে ফুলে ফেঁপে বেলুন হয়ে আকাশে উড়াল দেবে। একগাল হেসে মেসবাহর কাঁধে চাপড় দিল লিমন। তারপর কোমল গলায় বললো,
-“জোক্স আ পার্ট। চলো বন্ধু, সুন্দরী ভাবি আমার অপেক্ষা করছে। ভাবির কাছেই যাই।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৮
সময়ের সাথে মানুষের অভ্যাস বদলে যায়, ভালোলাগাগুলো পাল্টে যায়। ছাত্র অবস্থায় একসময় রাতের এই ঢাকায় রিকশা নিয়ে এলোমেলো ভাবে ঘোরা হতো। তবে আজকাল নানান দায়বদ্ধতায় বাঁধা পড়ায় তা আর হয়ে উঠে না। কেনো যেনো আগের মতো ইচ্ছেও করে না। কিন্তু আজ করছে। সারাটা রাত রিকশায় করে উল্লাসীর পাশে বসে পুরো ঢাকায় ঘুরতে ইচ্ছে করছে। উল্লাসীর কোমরে হাত চাপিয়ে তাকে নিজের দিকে টানতে ইচ্ছে করছে৷ ইচ্ছে করছে মৃদু বাতাসের ছোঁয়াকে উপেক্ষা করে উল্লাসীর চুলের মাঝে নাক ডোবাতে। দেবে কি সে তাকে এসবের অনুমতি? বাতাসে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতের সিগারেট ফেলে দিল মেসবাহ। তারপর পাশে তাকিয়ে বললো,
-“রাতের ঢাকা অপরূপ সুন্দর না?”
-“হ্যাঁ.. বেশ লাগছে আমার।”
-“আগামী শুক্রবার আবার বেরুবো।”
চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো উল্লাসীর। ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-“সত্যিই?”
-“হ্যাঁ.. তবে সেদিন লিমন থাকবে না।”
-“শুধু আপনি আর আমি?”
-“হ্যাঁ।”
-“ঠিকাছে।”
ফুটপাতের রাস্তার দিকে নজর দিল মেসবাহ। লিমন আজ যথেষ্ট জ্বালিয়েছে তাকে। এটাসেটা নানান কথাবার্তার মাঝে ফুটিয়ে তুলেছে, উল্লাসী সুন্দর। এবং উল্লাসীর মতো সুন্দরী এক মেয়ের পাশে তার মতো সুদর্শন এক পুরুষকেই মানায়। বিষয়টি হয়তো হাসি ঠাট্টার হলেও একদম ভালোলাগেনি মেসবাহর। লিমনের স্ত্রীর সঙ্গে তো বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তার। তবে কখনোই এমন বিশ্রী রসিকতা তো করেনি সে। আর না কখনো করবে…
-“লিমনকে কেমন লাগে তোমার?”
হঠাৎ মেসবাহর এমন প্রশ্নে তার দিকে তাকালো উল্লাসী। সহজ গলায় বললো,
-“ভালোই তো লাগে। মানুষটা অনেক মজার।”
-“আর আমাকে?”
-“আপনিও ভালো.. তবে উনার মতো মজার নন।”
-“অহ। আচ্ছা.. লিমন কি সত্যিই আমার চেয়ে সুন্দর?”
-“হ্যাঁ.. উনি তো অনেক বেশি ফর্সা।”
মন অসম্ভব রকমের খারাপ হয়ে এল মেসবাহর। তবে এর ঠিক যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেল না সে। লিমন সুন্দর। এবং তার চেয়ে কয়েকগুনে বেশিই সুন্দর। উল্লাসী তো ভুল কিছু বলেনি! তাহলে শুধুশুধু খারাপ লাগছে কেনো তার? উল্লাসীর মুখে লিমনের প্রশংসা শুনে? লম্বা একটি দম ছেড়ে আরেকটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। চলন্ত রিকসায় বসে সিগারেট ফোঁকার মতো মজা এজীবনে আর কিছুতে আছে বলে আগে মনে হতো না। তবে আজ ভিন্ন কিছুর সুখ অনুধাবন করতে পারছে সে। এসুখ সকল সুখের উর্ধ্বে।
-“কিছু খাবে?”
-“উহু..”
সিগারেট শেষ করলো না মেসবাহ। আবারও তা রাস্তায় ফেলে শীতল গলায় বললো,
-“কেনো? ফুচকা, চটপটি বা আইসক্রিম.. কিছু একটা খাও।”
-“ঠিকাছে, খাবো। জানেন, অনা আপা যে কলেজে পড়ে তার সামনে রোজই ফুচকাওয়ালা ফুচকা, চটপটি নিয়ে আসে? তবে ছোটমা ওসব খাবার জন্য টাকা দিত না। আমি প্রায়ই দেখেছি ওসব, কিন্তু কখনো খাওয়া হয়নি।”
বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো মেসবাহর। ছোটমার কথা এর আগে অনেকবারই বলেছে উল্লাসী। তবে প্রায়ই তা উপেক্ষা করে গেছে সে। জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করা হয়ে উঠেনি। একজন সন্তান কতটা নিঃস্ব তার মাকে ছাড়া তা আজ খুব করে অনুভব করতে পারছে। বুকচিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট হালকা প্রশস্ত করলো মেসবাহ। তারপর বললো,
-“চলো.. আজ আমি খাওয়াই তোমাকে। মামা, রিকশা এক সাইড করে থামাও তো।”
চুলের ফুল খুলে বাসায় পড়ার জামা হাতে ওয়াশরুমে ঢুকলো উল্লাসী। অসম্ভব মজার ছিল আজকের বিকেল। প্রথমে অস্বস্তি হলেও পরবর্তীতে তা কাটিয়ে উঠে সময়কে বেশ উপভোগ করেছে। উচ্ছ্বাসে ভরপুর মনে মাথার চুলগুলো হাত খোপা করলো উল্লাসী। তারপর শাড়ি খুলতেই নজরে এল শাড়ির মাঝবরাবর লেগে থাকা দাগ। দ্রুত জামা বদলে কল ছেড়ে শাড়ি এবং পেটিকোট ধুয়ে ফেললো সে। ভাগ্যিস উনার নজরে পড়েনি এসব। নয়তো কেলেংকারী হয়ে যেত!
ব্যালকনিতে কাপড় মেলে ঘরে এল উল্লাসী। গ্রাম থেকে আনা কাপড়ের ব্যাগ খুঁজতে সে পা বাড়ালো পাশের ঘরের দিকে। ব্যাগপত্র এখনো যেভাবে আনা হয়েছিলো সেভাবেই রয়েছে ওঘরে। যখন যা দরকার পড়ে তা ব্যাগ থেকেই বের করা হয়। অবশ্য এতে নানান ঝামেলা পোহাতে হয় তাকে। কোনো কাপড় ঠিকঠাক ভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। যার দরুন পুরো ব্যাগের কাপড়চোপড় বের করতে হয়। এবং আবারও তা পুনরায় গুছিয়ে রাখতে হয়। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে ধীরেসুস্থে মেঝেতে বসলো উল্লাসী। তল পেটে হালকা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। যা কিছুক্ষণের মাঝে আরও বাড়বে। অসহনীয় এই ব্যথা নিয়ে আবারও তিন রাত জেগে কাটাতে হবে। ভাবতেই উল্লাসীর চোখমুখ ছোট হয়ে এল। কেনো এসব হয় মেয়েদের? এসব না হলে কী এমন ক্ষতি হতো তা হাজার ভেবেও মাথায় আসে না তার। কপাল কুঁচকে পুরো ব্যাগ হুলস্থুল করে খুঁজেও মাসিকে ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দেখা পেল না উল্লাসী। তাহলে কী সেসব নিয়েই আসেনি সে? মনে পড়ছে না। তবে বিয়ের আগের রাতে ছোটমার কথায় ব্যাগ গুছিয়েছিল সে। তাতে মোটামুটি তার সকল ব্যবহার্য জিনিসই উঠিয়েছিল। তাহলে এসব কিভাবে বাদ পড়ে গেলো?
রাত দশটার খবর শেষ করে সোফা ছেড়ে উঠলো মেসবাহ। এগুলো শোবার ঘরের দিকে। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর উল্লাসী একবারও আজ টেলিভিশন দেখতে ড্রইংরুমে আসেনি। বিষয়টি খানিকটা গোলমেলে লাগলেও টক শো দেখায় এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিল সে যে উল্লাসীর ব্যাপারটি মাথা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু করছে কী একা ঘরে মেয়েটি? এতক্ষণ যাবৎ একবারও যে দেখা মিললো না তার!
-“কী ব্যাপার? আজ তোমার ভূতেরা ভূতগিরী দেখাতে আসেনি নাকি? একাই ঘরে বসে রয়েছো যে!”
মেসবাহর প্রশ্নের জবাব দিল না উল্লাসী। বিছানায় গুটিসুটি মেরে দু’হাতে পেট চেপে চুপচাপ বসে রইলো। ওদিকে উল্লাসীর উত্তরের অপেক্ষা করে মেসবাহ এগুলো রান্নাঘরের দিকে। রাত অনেক হয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পালা এবার চুকাতে হবে। আসার সময় রাতের জন্য হালকা খাবার কিনে এনেছিল তারা। সেসব ফ্রিজ থেকে বের করে ডাইনিংয়ে রেখে জোর গলায় কয়েকবার উল্লাসীকে ডেকে উঠলো মেসবাহ। তবে ঘর থেকে উল্লাসীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কুঁচকানো কপাল নিয়ে মেসবাহ এগুলো তার খোঁজে।
-“কী ব্যাপার? আসছো না যে! খাবে না?”
এবারো জবাব দিল না উল্লাসী। আতংকিত মনে চুপচাপ বসে রইলো নিজের জায়গায়। বিছানা ছেড়ে উঠলেই সবটা দেখে ফেলবেন উনি। মাসিকে ব্যবহার্য জিনিসপত্রাদি না থাকার কারণে পুরো পায়জামা জামা লেপ্টে গেছে। বিছানার চাদরের অবস্থাও নাজেহাল। যেখানে এসব ব্যাপারে পুরুষদের সামনে টু শব্দ করাও পাপ সেখানে বিছানার চাদরের এঅবস্থা দেখলে কী হবে! ভেবেই ভয় লাগছে। এদিকে তল পেটের ব্যথায় অসহ্য লাগছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে ভেতরটা। তবে কিচ্ছুটি করার নেই। ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকতে যখন প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার পর পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছিল সে তখন বারবার ছোট মা বলেছিল, এই অসুখের ব্যাপারে তোর বাবারে বলবি না। এইটা একটা লজ্জার কথা। কোনো পুরুষ মানুষ এসব জানলে তোর পেটের ব্যথা আরও বাড়বো। মেয়েগো আল্লাহ এসব ব্যথা মুখ বুজে চুপচাপ সহ্য করার আদেশ দিছে.. বুঝছিস? তারপর থেকে মাসের পর মাস চুপচাপ মুখ বুজে অসহনীয় এই ব্যথা সহ্য করলেও ছোটমার নির্দেশ মেনে চলেছে সে। কখনোই কিচ্ছুটি জানায়নি বাবাকে। সেখানে উনাকে কিভাবে জানাবে?
-“কী হয়েছে উল্লাসী? শরীর খারাপ লাগছে?”
উল্লাসীর পাশে বসে তার কপালে হাত রাখলো মেসবাহ। তবে গাড়ে জ্বরের উপস্থিতি না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“জ্বর তো নেই।”
-“আপনি খেয়ে নিন। আমি খাবো না।”
-“কেনো? খাবেনা কেনো? এতবড় একটি রাত না খেয়ে কাটাতে পারবে?”
-“পারবো।”
-“পারবে না.. দেখি ওঠো।”
উল্লাসীর হাতের দিকে দৃষ্টি দিতেই মেসবাহর নজরে এল দু’হাতে পেট চেপে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে সে। চোখমুখে তার কোথাও একটি ভীতি ফুটে উঠেছে।
-“পেটে ব্যথা করছে?”
মেসবাহর প্রশ্ন শোনামাত্র মাথা নেড়ে উল্লাসী বললো,
-“উহু…”
-“তাহলে দু’হাতে পেট চেপে বসে রয়েছো কেনো?”
হাত সরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসতেই তল পেটের ব্যথা মাথা নাড়া দিয়ে উঠলো। ঠোঁট চেপে চোখজোড়া বুজে উল্লাসী ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“আপনি যান। আমি খাবো না।”
-“আশ্চর্য! তোমার কিছু হয়েছে। কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো।”
-“কিছু হয় নি। আপনি যান।”
-“আমি একা নই.. তুমিও যাবে।”
জোর করে উল্লাসীকে বিছানা থেকে উঠানো মাত্র চোখজোড়া প্রশস্ত হয়ে এল মেসবাহর। চাদরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকালো সে। চোখভর্তি জল নিয়ে চুপচাপ তার টিশার্ট খামচে দাঁড়িয়ে রয়েছে উল্লাসী। ভয় পাচ্ছে মেয়েটি। প্রচুর ভয় পাচ্ছে…
-“পিরিয়ড হয়েছে?”
মেসবাহর প্রশ্নের জবাবে মাথা নাড়ালো উল্লাসী। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে আসছে। কী করবে এখন সে?
-“না বলছো কেনো? তাছাড়া এত ভয়েরই বা কী আছে? প্যাড এনেছো?”
প্যাডের কথা শুনলেও কখনোই তা ব্যবহার করা হয়ে উঠেনি উল্লাসীর। প্রথমবার ছোটমা তার পুরোনো শাড়ি কেটে দিয়েছিল। প্রায় এক বছর তা দিয়েই চালানোর পর দ্বিতীয়বার সুহার পুরোনো জামা কেটে তাই ব্যবহার করে এসেছে সে। তবে উনি প্যাডের কথা কিভাবে জানলেন? পুরুষদের তো এসব জানার কথা নয়!
-“আচ্ছা.. তুমি চুপচাপ বসো। আমি আসছি। আর শোনো ভয়ের কিছু নেই। আমি আসছি।”
উল্লাসীকে বসিয়ে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে মানিব্যাগ নিয়ে দ্রুত বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো মেসবাহ। আপাতত উল্লাসীর কাছে এসব প্রশ্ন করা অহেতুক। গ্রামে জন্ম, সৎমার ঘর.. এক্ষেত্রে বিলাসবহুল জীবন তো তার পাবার কথা নয়। বাদবাকি রইলো চিন্তাভাবনা.. তাতে ওর ছোটমা কী বলে দিয়েছেন তা না হয় উল্লাসীর মুখ থেকেই শোনা যাবে..
একটি শপিং ব্যাগ উল্লাসীর হাতে দিয়ে তাকে পরিষ্কার হয়ে আসতে বললো মেসবাহ। তারপর এগুলো পাশের ঘরের দিকে। মেয়েটির জামাকাপড়ের জন্য আলমারিতে কিছু তাক খালি করে দিতে হবে। আসার পর জামা কাপড় ব্যাগ থেকে কিছুই নামায়নি সে। হয়তোবা সাহস করে উঠতে পারেনি অথবা এসব মাথাতেই আসেনি তার। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে একটি কামিজ নিয়ে আবারও শোবার ঘরে ফিরলো মেসবাহ। এবং তা উল্লাসীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“দ্রুত যাও।”
দাঁড়াতে একরাশ অস্বস্তি এসে চেপে ধরলেও ধীরেসুস্থে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো উল্লাসী। পেট আঁকড়ে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। অপরদিকে উল্লাসী উঠার পর বিছানার চাদর তুলে তা এককোনায় রেখে নতুন চাদর বের করে তা বিছানায় বিছালো মেসবাহ। তারপর এগুলো রান্নাঘরের দিকে। বেশ ক’বছর আগে পায়ের কিছু অসুবিধার কারণে হট ওয়াটার বোতল কিনেছিল সে। যা দিয়ে প্রায়ই সেঁক নিয়ে যেমন পায়ের সমস্যা লাঘব করতো তেমন শীত কালেও হাত পা গরম করার কাজে ব্যবহার করতো। তবে বোতলটি কোথায় রাখা হয়েছে তা ঠিক মনে পড়ছে না। চুলোয় গরম পানির হাঁড়ি উঠিয়ে দিয়ে আবারও ঘরে ফিরে এল মেসবাহ। পুরো ঘরজুড়ে চিরুনী অভিযান শুরু করলো বোতলের আশায়।
-“দাও.. টাউয়েল আমার হাতে দাও। আমি মেলে দিচ্ছি।”
মেসবাহর কথায় তার হাতে টাউয়েল দিয়ে বিছানায় এসে বসলো উল্লাসী। গোসলের পর একটু আরাম অনুভব হলেও তল পেটের ব্যথায় অস্থির লাগছে। সটানভাবে পেট আঁকড়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো উল্লাসী। কিছুই ভালোলাগছে না তার। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে।
-“উল্লাসী? তোমার পেট ব্যথা কী খুব বেশি?”
-“হু..”
-“সহনীয় না অসহনীয়?”
-“জানিনা। কিচ্ছু জানি না।”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে পাশের ঘরে গিয়ে ঔষধের কার্টুন খুলে এলজিনের একটি পাতা বের করলো মেসবাহ। তারপর এক গ্লাস পানি হাতে উল্লাসীর পাশে বসে বললো,
-“এটা খাও।”
-“কিচ্ছু লাগবে না আমার। আপনি এখান থেকে যান।”
ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো উল্লাসী। সেদিকে তাকিয়েই হাতের গ্লাস নামিয়ে রাখলো মেসবাহ। নরম গলায় বললো,
-“এটা খেয়ে নাও। আর আমি পানি গরম দিয়েছি। বোতলে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছি। তল পেটে সেঁক নিলেই ব্যথা অনেকটা কমে আসবে।”
-“আপনি কী করে জানলেন? আপনি জানার পরই আমার পেটের ব্যথা এত বেশি হয়েছে!”
-“কে বলেছে এসব তোমায়? নিশ্চিত ছোটমা!”
-“হ্যাঁ..”
-“তো এটা বলে দেয়নি স্বামীর কাছে এসব বিষয় নিয়ে হেজিটেট অর্থাৎ সংকোচ বোধ করার কিছু নেই।”
-“কেনো? থাকবে না কেনো? স্বামী কি পুরুষ নয়?”
উল্লাসী ফোঁপাতে ফোপাঁতে একথা বলতেই হেসে উঠলো মেসবাহ। জোর করে তাকে উঠিয়ে ঔষধ মুখে পুড়ে দিয়ে বললো,
-“আমাদের সমাজে পিরিয়ড হওয়াকে একটি মেয়ের দুর্বলতা হিসেবে ভাবা হয়। যদিও তেমনটি নয়। এই পিরিয়ড নামক শব্দটি আছে বলেই আজ আমি এই পৃথিবীর বুকে এসেছি, তুমি এই পৃথিবীর বুকে এসেছো। তাহলে কেনো একে নিজের দুর্বলতা ভাববে? বরং একে নিজের সবলতা মনে করে মাথা উঁচিয়ে চলাই কী প্রতিটি নারীর উচিৎ নয়? কেনো আমরা সবাই পিরিয়ডকে দুর্বলতা ভাবি? কেনো মেয়েরা দোকানে প্যাড কিনতে গিয়ে লজ্জা পায়? যেনো পিরিয়ড এমন একটি ব্যাপার যেটি কাওকেই বলা যাবে না। বিশেষ করে পুরুষদের তো না-ই। অথচ যে শারীরিক প্রক্রিয়াকে মানুষ নোংরা ভাবে, অসুস্থতা ভাবে.. সেটি না ঘটলে এই পৃথিবীতে বংশ বিস্তারের প্রকিয়াই বন্ধ হয়ে যেত।”
অবাক চোখে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো উল্লাসী। সত্যিই কী এটি তার অসুস্থতা নয়? তবে যে ছোটমা বলেছিল এটি মেয়েদের অসুখ!
-“পুরুষেরা জানলেই যে পেটের ব্যথা বাড়বে এটি আসলে কুসংস্কার। তাছাড়া শুধু পিরিয়ডের ক্ষেত্রে নয়, আমি তোমার স্বামী। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র সমস্যা হলেও তুমি সেগুলো আমাকে বলবে। তবেই না আমাদের মাঝের বন্ধন দৃঢ় হবে।”
মাথা নেড়ে উল্লাসী মেসবাহর কথায় সম্মতি জানাতেই উঠে পড়লো সে। বোতলটি পাওয়া গেছে। তবে তাতে ধুলোবালির স্তর পড়েছে। ধুয়ে মুছে ঠিকঠাক করে তবেই পানি উঠাতে হবে তাতে।
বোতল ধোয়ার কাজে লেগে পড়লো মেসবাহ৷ সময় নিয়ে ধুয়ে তাতে পানি উঠিয়ে ফিরে এল শোবার ঘরে। উল্লাসীর হাতে বোতলটি দিয়ে বললো,
-“খাবার আনি?”
-“খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“না করলেও সামান্য খেয়ে নাও।”
-“উহু…”
-“কিসের উহু? না খেলা আমি কিন্তু বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাবো। তখন থেকো রাতে একাএকা।”
কপাল কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। অভিমানী সুরে বললো,
-“যান না.. যান! আমিও মুন্নি ভাবিকে ডেকে আনবো।”
(চলবে।)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৯+২০
পুরো রাত পেটের ব্যথায় ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে উল্লাসী। তাই আর সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে ডাকলো না মেসবাহ। নাস্তা করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মেয়েটিকে এভাবে একা ফেলে যেতে কোনোভাবেই মন টানছে না তার। বুকের ভেতরটায় অস্থির লাগছে। তবুও তাকে যেতেই হবে। বাইরে থেকে দরজা লক করে মেসবাহ এগুলো মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকে। আপাতত উনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়ন্তর নেই। তাছাড়া মহিলা এমনিতে খারাপও নয়। তবে তার অতিরিক্ত বকবকের কারণে একদমই সহ্য হয়না তাকে মেসবাহর।
-“কী খবর? এত সকাল সকাল আমাকে কী মনে করে মনে পড়লো?”
সৌজন্য সূচক মৃদু হেসে ফ্ল্যাটের চাবি মুন্নি সরকারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মেসবাহ বললো,
-“এটা রাখুন। খানিকক্ষণ পর পর গিয়ে উল্লাসীকে একটু দেখে আসবেন।”
-“কেনো? উল্লাসীর কিছু হয়েছে?”
-“ওই আরকি.. একটু অসুস্থ।”
-“বলো কী! কী হলো আবার ওর? গিয়ে দেখে আসি!”
মুন্নি সরকার ফ্ল্যাটের দিকে এগুতেই তাকে থামিয়ে দিল মেসবাহ। বললো,
-“এখন ও ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমোক। আপনি একটুপর গিয়ে ওকে একটু খাইয়ে দিয়ে আসবেন। আমি টেবিলে ব্রেড রেডি করেই রেখে এসেছি। আর আমিও একটু ফ্রি হলে চলে আসবো। আপনি প্লিজ ওকে একটু দেখবেন।”
-“আরে! এভাবে আবার বলতে হবে নাকি! অবশ্যই আমি দেখবো। তুমি যাও।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লিফটের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার উল্লাসীকে ফেলে যেতে। যেনো পুরো জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলছে সে উল্লাসীকে। না চাইতেও অজ্ঞাত এক মায়াজালে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে উল্লাসীর সঙ্গে। তাকে নিয়ে ভাবছে। তার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে। এসব কি মায়া? নাকি অন্যকিছু?
কলেজের গেটে এমাদের দেখা না পেয়ে মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল অনার। কাঁধের ব্যাগ চৈতালির কাছে দিয়ে তাকে ভেতরে পাঠিয়ে সে পায়চারী শুরু করলো রাস্তা ধরে। দু’মাস হলো এমাদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। এই কলেজেরই ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলামের বড় ছেলে এমাদ। পড়াশোনায় খুব একটি মনোযোগী না হলেও বাবার ইচ্ছেতে ঢাকার একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত রয়েছে সে। তবে মাসের ৭ দিন ঢাকায় কাটালেও বাদবাকি দিনগুলো গ্রামে শুয়ে-বসে কাটায় এমাদ। এভাবেও বুঝি পড়াশোনা হয়? ভেবে পায় না অনা। অবশ্য তার নিজেরই যেখানে পড়াশোনায় মন বসে না সেখানে এমাদের কী করে বসবে? দু’জনে কি দু’পথের যাত্রী? মোটেও নয়। দুজনেই তারা একই পথে গমনকারী…
-“সরি.. সরি। দেরি হয়ে গেল!”
এমাদের ক্লান্তিমাখা মুখ দেখে মৃদু হাসলো অনা। আদুরে গলায় বললো,
-“ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় এভাবে দৌড়ে আসতে হবে? আজ না এলে কী এমন হতো?”
-“তুমি যে অপেক্ষা করতে!”
-“ইশ! আমার প্যাঁচাটা কত ভাবে! চলো.. একটু হেটে আসি।”
-“তোমার কলেজ?”
-“কলেজের তো তোমার মতো দৌড়ানোর সাধ্যি নেই। থাকবে সে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে।”
হাসলো এমাদ। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অনার হাতের আঙুলের মাঝে ডুবিয়ে দিল নিজের আঙুল।
-“জানো, কাল রাতে কি স্বপ্ন দেখেছি? দেখেছি তুমি আমার ঘরে এসে আমার কাছে গামছা চাইছো। আমিও তোমায় গামছা এগিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি তখন এইবেশে নয়.. শাড়ি পড়া অবস্থায় ছিলাম। স্বপ্নটা সুন্দর না?”
অনার প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে এমাদ বললো,
-“হ্যাঁ.. সুন্দর।”
-“বিয়ের পর কি আমি শাড়ি পড়বো?”
-“তুমি চাইলে পড়বে।”
-“তোমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই?”
-“উহু.. তোমার খুশিতেই আমি খুশি।”
এমাদের হাত জোরে চেপে ধরলো অনা। সাথেসাথেই এক অদ্ভুত অনুভূতি ছেয়ে গেল তার মনজুড়ে। দু’চোখ বুজে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে সে বললো,
-“আমাদের ব্যাপারে আমরা কবে সবাইকে জানাবো?”
-“আরও কিছুদিন যেতে দাও। জানিয়ে দিব।”
-“ঠিকাছে। তবে চৈতালিকে তো জানানোই যায়। প্লিজ.. ওকে জানাই? ওর কাছে আমি কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারিনা। দম বন্ধ বন্ধ লাগে।”
পথ চলা থামিয়ে অনার মুখোমুখি দাঁড়ালো এমাদ। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো,
-“গোপন প্রেমের গভীরতা বেশি… তাছাড়া কিছুদিন যেতে দাও। সময় হলে আমরা দু’জনেই একইসাথে সবাইকে জানাবো।”
ব্যাকুল স্বরে অনা বললো,
-“সময়টি কবে আসবে?”
-“খুব দ্রুত.. চলো। তোমার কলেজের দিকে এগোই।”
ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে সেই চিরপরিচিত রাস্তা ধরে আবারও এগুলো অনা। এমাদকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। যতটুকু ভালোবাসলে তার খুশির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতেও সে দু’বার ভাববে না।
হাসপাতালের কাজের চাপ বেশি থাকায় আর বাসায় যাওয়া হয়ে উঠলো না মেসবাহর। তবে ঘন্টাখানেক পর পর মুন্নি সরকারের নাম্বারে কল করে উল্লাসীর খবরাখবর রাখছে সে। এই মেয়েকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার। একয়দিন যাবৎ তাকে বাড়িতে একা ফেলে রেখে আসার চিন্তা, আজ থেকে আবারও নতুন চিন্তার সূচনা ঘটলো। অস্থিরতা কাটাতেই দুপুরের রাউন্ড দেয়া শেষ হতেই মুন্নি সরকারের নাম্বার ডায়াল করলো মেসবাহ। অশান্ত মনে অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশ থেকে একটি সাড়ার।
-“মেসবাহ.. তুমি এত কেনো টেনশন করছো বলো তো? এসব তো প্রতিটি মেয়েরই হয়। স্বাভাবিক একটি ব্যাপার এটি।”
এব্যাপারে মুন্নি সরকারের সাথে কথা বলতে অস্বস্তি হলো মেসবাহর। কোনোরকমে কথা কাটিয়ে সে বললো,
-“জ্বি.. তা উল্লাসী দুপুরে খেয়েছে?”
-“না.. ওকে খাওয়াতেই এসেছি। কথা বলবে ওর সাথে? নাও বলো।”
অপরপাশ থেকে উল্লাসীর গলার স্বর কানে আসতেই অস্থির মনে স্বস্তি ফিরলো মেসবাহর। শান্ত স্বরে সে বললো,
-“গোসল হয়েছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“ব্যথার কী অবস্থা?”
-“একটু কম..”
-“ধীরেসুস্থে আরও কমবে। মুন্নি ভাবিকে বলো যাবার আগে যেনো পানি গরম করে বোতলে উঠিয়ে দিয়ে যায়। পন্ডিতি করে তুমি একা করো না। গরম পানি হাতে পায়ে লাগতে পারে।”
-“আচ্ছা..”
-“মুন্নি ভাবি কি ভাত নিয়ে এসেছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“ঠিকাছে। কোনো বাহানা না দেখিয়ে খেয়ে নাও। আমি দেখি বিকেলের দিকে একবার বাসায় আসবো।”
-“আচ্ছা..”
-“কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলো। নিয়ে আসবো।”
-“না, কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“আচ্ছা.. রাখছি।”
ইচ্ছে না থাকা সত্বেও কল কেটে চেম্বারে এল মেসবাহ। অস্থিরতা খানিকটা কমে এলেও উল্লাসীকে একটিবার দেখার জন্য মন উতলা হয়ে উঠেছে। এ কেমন বিপদে পড়লো সে! উল্লাসী ছাড়া কী কিছুই মাথায় আসেনা তার?
ভর সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে রয়েছে উল্লাসী। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। যাক! ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। ঘুমোনোর সময়টুকুতো একটু শান্তিতে আছে। নয়তো কষ্টে আচ্ছন্ন মুখ নিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতো উল্লাসী। দিন শেষে বাড়ি ফিরে যা দেখা মোটেও সুখকর হত না। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হাতের আইসক্রিমের বাটি ফ্রিজে রেখে এসে শার্ট খুললো মেসবাহ। কিছুক্ষণ বসে ঠান্ডা হয়ে পা বাড়ালো গোসলের উদ্দেশ্যে।
থালাবাটির ঝনঝন শব্দে ঘুম ভাঙলো উল্লাসীর। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো সে। এখন সকাল নাকি রাত? কখন ঘুমিয়েছিল সে? আর কখনই বা উঠলো? বোধগম্য হলো না। সময় নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সে ধীরপায়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
-“আপনি কখন এসেছেন?”
পিছন ফিরে উল্লাসীকে দেখামাত্র হাসি ফুটলো মেসবাহর ঠোঁটে। হাতের আলু রেখে সে এগিয়ে এল উল্লাসীর কাছে। মিষ্টি স্বরে বললো,
-“অনেক্ক্ষণ.. শরীরের কী অবস্থা?”
-“ভালো। কী করছিলেন আপনি?”
-“ভাত টা উঠিয়ে দিলাম। আলুভর্তা আর ডিম ভাজি.. চলবে তো রাতে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উল্লাসী পা বাড়ালো ড্রইংরুমের দিকে। ঘুম থেকে উঠার পর কিছুই ভালোলাগছে না তার। কোমর টেসে টেসে আসছে। শরীরে একদম শক্তি পাচ্ছে না। দু’পা প্রচন্ড চাবাচ্ছে..
-“এই উল্লাসী, আপেল খাবে? কেটে দেব?”
ডাইনিং থেকে গলা উঁচিয়ে মেসবাহ ডেকে উঠতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। ক্ষীণ গলায় জবাব দিল,
-“উহু..”
-“আইসক্রিম?”
-“উহু..”
-“হালকা কিছু খেয়ে নাও। ততক্ষণে ভাত হোক।”
-“আচ্ছা হোক। একেবারে ভাতই খাবো।”
আর কথা বাড়ালো না মেসবাহ। এগুলো রান্নাঘরের দিকে। উল্লাসী আসার পর রান্নাঘর কী তার একরকম ভুলতেই বসেছিল সে। মেয়েটি অবুঝ হলেও যে পাক্কা রাধুনি তা মানতেই হবে! অবশ্য হবেই বা না কেনো? নিশ্চয় তার বাড়ির সকলের রান্না নিজে হাতে সামলাতে হয়েছে তাকে। সৎ মা যে কখনোই আপন মা হতে পারে না তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ উল্লাসীর ছোট মা। কী করে পারলেন উনি মিথ্যে লোভ দেখিয়ে ছোট একটি মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসাতে? জবাবে মেসবাহর বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ভাতের হাঁড়িতে আলু ছেড়ে ডিমের জন্য পিয়াজ, মরিচ কাটতে শুরু করলো সে।
চোখ বুজে শুয়ে থাকার পরও ঘুমের দেখা না পেয়ে উঠে বসলো উল্লাসী। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় ঘরের পুরোটা নজরে এলেও কোথাও মেসবাহর দেখা না পেয়ে জোর গলায় ডেকে উঠলো তাকে। খাবারের পাঠ চুকেছে অনেক্ক্ষণ। এখনো কেনো ঘরে আসেননি উনি?
-“কী হয়েছে? কিছু লাগবে?”
সিগারেট হাতে ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো মেসবাহ। জবাবে উল্লাসী বললো,
-“উহু.. আপনি কখন ঘুমোবেন?”
-“এইতো.. এখনই।”
-“তো আসুন না! একা একা ঘুম পাচ্ছে না।”
জ্বলন্ত সিগারেট এশট্রেতে ফেলে বিছানায় এল মেসবাহ। বালিসে মাথা গুঁজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই ওপাশ থেকে উল্লাসী বললো,
-“আপনার কি সিগারেট খুব বেশিই পছন্দ?”
-“বলতে পারো!”
-“কেনো পছন্দ? বিশেষ কী আছে এতে?”
মাথার নিচে এক হাত রেখে ফ্যানের দিকে চেয়ে মেসবাহ জবাব দিল,
-“এতে শান্তি আছে.. “
-“তাহলে আপনার ভেতরে যখন অশান্তি কাজ করে তখনই আপনি সিগারেট খান?”
-“উহু.. তেমন কিছু নয়।”
-“তাহলে কেমন কিছু?”
-“তুমি ঘুমোও উল্লাসী।”
হতাশ মনে চোখজোড়া বুজলো উল্লাসী। তবে হঠাৎ করে মুন্নি সরকারের বলা কথাগুলো মাথায় আসায় আবারও চোখ মেললো সে। অনুরোধের গলায় বললো,
-“একটু আদর করে দিন না!”
-“আবারও শুরু করলে?”
-“কী হয় একটু আদর করলে? হাসান ভাইও তো মুন্নি ভাবিকে আদর করে। তাহলে আপনি আমায় করেন না কেনো?”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মেসবাহ বললো,
-“তুমি পিচ্চি বলে। বড় হও.. অনেক আদর দিব।”
-“আমি যেহেতু পিচ্চি তাহলে আমায় পিচ্চি আদরই দিন। বড় হবার পর না হয় বড় আদর দেবেন!”
-“ঘুমোও উল্লাসী..”
-“দিন না! দিন একটু। একটুই তো। দিন না!”
-“ঘুমোও..”
-“দেবেন না আপনি? আমি কিন্তু উঠে মুন্নি ভাবির কাছে চলে যাবো।”
উল্লাসীর ছটফটের সাথে পেরে না উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিকে এগুলো মেসবাহ। চোখজোড়া বুজে পরম যত্নে কপালের মাঝবরাবর আলতো করে বসিয়ে দিল তার ঠোঁটের ছোঁয়া।
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_২০
সকাল থেকেই প্রচুর ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটাচ্ছে উল্লাসী। অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছে সে দিন পাঁচেক হলো। ঠিক অসুস্থতাও নয়, উনি বলেছেন মাসিক কোনো অসুস্থতা নয়৷ তবে যেটাই হোক সেটি ভেজাল ছাড়া দ্বিতীয় কিছু মনে হয় না তার। তল পেটে ব্যথা, হাটতে অসুবিধা, কোমর টেসে আসা.. এত কিছুর মুখোমুখি হবার পরও এই প্রথমবার নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। উৎফুল্ল মনে ব্যাগের সব কাপড়চোপড় বের করে একেএকে আলমারিতে গুছিয়ে রাখলো উল্লাসী। তারপর পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। দুপুরের রান্নাটা দ্রুত সেরে মুন্নি ভাবির কাছে যেতে হবে। দুজনে মিলে আজ সিনেমা দেখার কথা রয়েছে। তবে তা মোটেও জানানো যাবে না উনাকে। মুন্নি ভাবির বারণ আছে। সব কথাই নাকি স্বামীকে জানাতে নেই। তাতে স্ত্রীর গুরুত্ব তাদের কাছে কমে যায়। ভাতের চাল ধুয়ে তা চুলোয় দিল উল্লাসী। তারপর ফ্রিজ থেকে মাছের পোটলা বের করে বেসিনের দিকে এগুতেই কানে এল কলিংবেলের শব্দ। নিশ্চিত মুন্নি ভাবি ডাকতে এসেছেন তাকে। তবে রান্নাই তো হয়নি এখনো! সব ফেলে এখন কী করে যাবে সে সিনেমা দেখতে? নিরাশ মনে মাছের পোটলা ভিজিয়ে রেখে দরজার দিকে এগুলো উল্লাসী। তবে দরজা খোলার মাত্র নিমেষেই মুখের ভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে এল তার। মুন্নি ভাবি নয়.. মৌমিরা এসেছে!
প্রতি রাতের উল্লাসীর ভিন্ন ভিন্ন আবদারগুলোকে বেশ উপভোগ করে মেসবাহ। তার বলা কথা এবং কার্যক্রমগুলো বেশ আনন্দ দেয় তাকে। মাঝেমাঝে আবদারগুলো নিয়ে কোথাও একটি ভয় কাজ করলেও তা উপেক্ষা করে উল্লাসী বোঝানোর চেষ্টা করে সে। যা কিছুসময় পেরে না উঠে পিচ্চি আদর দিতেই হয় তাকে। তাছাড়া সে নিজে যেখানে শক্ত আছে সেখানে উল্লাসীর ছোট ছোট আবদার পূরণ করাই যায়! তবে সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা অন্যখানে। উল্লাসীকে একা বাসায় ফেলে হাসপাতালে এসেও কাজে মন দিতে পারে না মেসবাহ। উদ্ধত মন সারাক্ষণ আনচান করে মেয়েটির জন্য। কখন রাত হবে সেই প্রহর গুনে। মেয়েটি মায়াজালে যে বেশ শক্তপোক্ত করে আঁটকে পড়েছে সে তা বুঝেও মনকে হাজারটা কারণ দেখিয়ে বুঝ দেয় মেসবাহ। কেনো যেনো বিবেক কোনোভাবেই সায় দেয় না এ কথায়…
নিউরো সাইন্স হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ল্যাবএইডের উদ্দেশ্যে রিক্সায় উঠে মুন্নি সরকারের নাম্বারে ডায়াল করলো মেসবাহ। উল্লাসীর জন্য একটি ফোন নিতে হবে। বারবার তার খবর নিতে মুন্নি সরকারের কাছে কল করায় বড্ড সংকোচ বোধ হয়। তাছাড়া উনার নানান প্রশ্ন তো রয়েছেই! সবমিলিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে মুন্নি সরকারের আওয়াজ শোনামাত্র অজস্র অস্বস্তি এসে চেপে ধরে তাকে।
-“হ্যালো, মেসবাহ?”
-“জ্বি, ভাবি। একটু উল্লাসীকে ডেকে দেবেন?”
-“তাকে আর কোথায় পাই আমি? তোমার ভাই বোনেরা এসেছে না? তাদের নিয়েই পড়ে আছে সে। তুমি একটু লাইনে থাকো। আমি দিচ্ছি…”
হতবাক হলো মেসবাহ। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“ভাইবোন এসেছে? আমার? কারা এসেছে?”
-“তোমার বড় ভাই আর ছোট বোন।”
-“বলেন কী! আচ্ছা.. আমি আসছি।”
-“তা এসো.. তবে তোমাদের পরিবার থেকে যে উল্লাসীকে এত সহজভাবে মেনে নিয়েছে তা দেখেই আমার ভালোলাগছে।”
-“হ্যাঁ.. ওইতো। আচ্ছা, রাখছি।”
দ্রুত ফোন কেটে রিক্সা ঘোরাতে বললো মেসবাহ। আপাতত বাসায় যাওয়া তার বেশ জরুরী হয়ে পড়েছে। বড় ভাই এবং অনা যে আসবে তা তো একবারও জানায়নি তাকে! তাহলে এভাবে হুট করে আসার মানেটা কী? অস্থিরতায় চিপের কোণা দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়তেই তা মুছলো মেসবাহ। তাদের প্রেমের বিয়ের কথাটি যে মিথ্যে তা হয়তো এখনো জানতে পারেনি মুন্নি সরকার। নয়তো ফোনে এত শান্ত ভাবে কখনোই কথা বলতো না সে। তাছাড়া বড় ভাই গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। মুন্নি সরকারের সাথে গল্প জুড়ে দেবার মতো মানুষ তিনি নন। বাদ রইলো অনা, সে গল্প পাগল এক মেয়ে। একবার গল্পের আসর খুলে বসলে তার সকল লুকোনো কথা মুন্নি সরকারের সামনে আসতে দু’সেকেন্ডও লাগবে না সেখানে তার বাসায় পৌঁছানো তো দূরের কথা! আবারও ঘামে সিক্ত কপাল মুছলো মেসবাহ। রিক্সা চালকের উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় বললো,
-“ভাই.. একটু তাড়াতাড়ি চালান না!”
-“এর থাইকা বেশি পারমু না! পাও দিয়া রিক্সা চালাই আমি.. এ তো আমার উইড়াজাহাজ না!”
-“ঠিকাছে.. ঠিকাছে। যেভাবে খুশি চালান।”
সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে গোসল সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল মেসবাহ। তারপর ধীরেসুস্থে এগুলো পাশের ঘরের দিকে। অনা মৌমির সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত, মাজহারুল চোখবুঁজে শুয়ে রয়েছে। এরমাঝে অনাকে ডেকে তাদের বিয়ের কথা উঠানো ঠিক হবে কিনা ভেবে পেল না মেসবাহ। ঘরজুড়ে কয়েকবার পায়চারী করে সে এগুলো রান্নাঘরের দিকে। এই রাতে আর এদিকটায় আসবে না মুন্নি সরকার। তাই আপাতত ভয় নেই। রাতের খাবার পর না হয় ধীরেসুস্থে পুরো ব্যপারটা বুঝিয়ে বলা যাবে অনাকে।
-“কী করছো?”
রান্নাঘরে ঢুকে উল্লাসীকে প্রশ্ন করামাত্র পিছন ফিরলো সে। মুখ ছোট করে হতাশ গলায় বললো,
-“আমি এতবড় মাছ কখনোই কাটিনি।”
-“মাছ কোথায় পেলে?”
-“আপনার আম্মা পাঠিয়েছে।”
চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় মেসবাহ বললো,
-“আম্মাও না! কেটে পাঠালেই তো পারতো! দেখি কী মাছ?”
উল্লাসী সরতেই প্রায় তিন কেজি ওজনের রুই মাছ দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“বাড়িতে এতগুলো কাজের মানুষ থাকতে তোমার ভরসায় এই মাছ মা কী করে পাঠায়! আর কী কী পাঠিয়েছে?”
-“মাংস আর কিছু শাকসবজি। ওগুলো অনা আপা ফ্রিজে তুলে রেখেছে।”
-“অহ.. দেখি সরো। আমি চেষ্টা করে দেখি!”
-“আপনি পারবেন?”
-“দেখি চেষ্টা করে.. তুমি শুধু আমাকে ডিরেকশন দেবে কোথায় কিভাবে কাটবো।”
মেসবাহর কথামতো সরে বসে মেসবাহকে জায়গা করে দিল উল্লাসী। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেসবাহর মাছ কাটা দৃশ্যের দিকে।
-“আরে না.. ওইখানে না। এইযে.. এই মাথার কাছে কাটুন। হ্যাঁ.. আরেকটু নিচে। এইতো.. এবার ঠিকাছে।”
উল্লাসীর কথামতো মেসবাহ মাছের মাথা কাটতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ডিম আছে মাছে!”
-“তাই তো দেখছি…”
-“আস্তেধীরে বের করুন।”
-“তা করছি.. একটা কাজ করো তো।”
-“কী কাজ?”
-“গলার এপাশটা চুলকে দাও। উফ! অসহ্য লাগছে..”
মেসবাহর গলায় হাত রেখে উল্লাসী বললো,
-“এখানে?”
-“হু..”
-“দিচ্ছি.. আপনি এত ঘামেন কেনো? এটুকুতেই ঘেমে টেমে একাকার হয়ে পড়েছেন! দাঁড়ান.. মুছে দেই।”
উল্লাসী এক হাতে পরণের ওড়না তুলে মেসবাহর কপালের ঘাম মুছে দিতেই তার ঠোঁটে ফুটলো মিষ্টি হাসির ঝলক। সুখী সে.. প্রচুর সুখী। এর চেয়ে বেশি সুখী হওয়া আর কোনোভাবেই সম্ভব নয় তার পক্ষে।
ডাইনিং থেকে মেসবাহ এবং উল্লাসীকে দেখে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাজহারুলের। ধীর পায়ে আবারও সে ফিরে এল ঘরে। তার এবং জ্যোতির বিবাহিত জীবনটাও হয়তো এমন হতে পারতো। তবে হয়নি। আর না কখনোই হবে। বাড়ির বড় বউ হবার কারণে যখন সংসারের সকল কাজ নিজে হাতে একা সামলেছে জ্যোতি তখন সে একমুহূর্তের জন্যও এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করেনি তাকে। না তার ছোটছোট চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু সময় ইচ্ছে করলেও বাবার কারণে করা হয়ে উঠেনি, কিছু সময় নিজের ইচ্ছে করেনি। শুধু জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেই একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাতে যেমন সম্মান দরকার ঠিক ততটাই দরকার একে অপরকে বোঝা। তার মনে অপরপক্ষকে নিয়ে চলা ক্ষোভকে খুঁজে বের করা। যা খুঁজে পেলেও একজন আত্মমর্যাদাহীন মানুষ হিসেবে তা মুছে দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল না…
গাড়ি থেকে নেমে রাশেদ রহমানকে বিদায় জানিয়ে একটি রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকলো জ্যোতি। সানগ্লাস খুলে অনুসন্ধানী চোখে চারপাশে নজর বুলাতেই দেখতে পেল মাজহারুলকে। বয়স তিনকের মতো একটি মেয়েকে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে সে। এই মেয়েই কি মৌমি? তার মেয়ে?
-“কেমন আছো?”
দূর থেকে জ্যোতিকে দেখেই নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল মাজহারুল। তবে ধীরেধীরে জ্যোতির কাছে আসামাত্র বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো তার। বড্ড বদলে গেছে জ্যোতি। এই জ্যোতির সাথে কোনো অংশেই মিল নেই আগের সেই অভিমানী জ্যোতির…
-“বললে না কেমন আছো?”
-“আছি একরকম.. তুমি বসো।”
-“হ্যাঁ.. বসছি।”
মাজহারুলের মুখোমুখি বসলো জ্যোতি। হাতে থাকা ব্যাগ এবং ফোন একপাশে নামিয়ে রেখে বললো,
-“কিছু অর্ডার করেছো?”
-“হ্যাঁ.. মৌমির জন্য আইসক্রিম।”
-“তোমার জন্য কিছু করোনি?”
-“না.. আমি বাইরের খাবার খাই না।”
-“তুমি একদমই বদলাও নি.. ঠিক সেই আগের মতোই রয়ে গেছো!”
গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মৌমির দিকে তাকালো মাজহারুল। হুট করে ঢাকায় আসার একমাত্র কারণ তার এই মেয়েটি। পরশু রাতে তার মৃত্যুর স্বপ্নটি দেখার পর কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছিলো না সে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিলো। দম বন্ধ বন্ধ লাগছিলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো মৃত্যুর আগে একবার হলেও মৌমিকে দেখিয়ে আনা উচিৎ তার মাকে। মা কী তা বোঝে না সে.. তবে সকলের মা আছে তার নেই তা খুব করে বুঝতে পারে। বাস্তবতা বড়ই নির্মম! তবু্ও সেই নির্মমতা দেখেই কাটিয়ে দিতে হয় বছরের পর বছর।
-“আম্মা.. ওদিকে তাকাও। তোমার আম্মু.. আম্মুকে দেখো।”
মাজহারুলের হাতের ইশারায় মৌমি তার দিকে চাইতেই বুকের ভেতরটায় হু হু করে উঠলো জ্যোতির। ঠোঁটজোড়া চেপে পাশ থেকে সানগ্লাস তুলে আবারও চোখে পড়ে নিল সে।
-“এটা আম্মু হলে ওটা কে?”
মৌমির প্রশ্নে কপাল কুঁচকে মাজহারুল বললো,
-“কোনটা?”
-“মেজবাবার বউ.. তুমি তো বলেছিলে ওই আমার আম্মু।”
-“ওটাও আম্মু। তবে এটা আসল আম্মু।”
পাশ থেকে হালকা কেশে গলা ঠিক করলো জ্যোতি। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললো,
-“মেসবাহ বিয়ে করেছে?”
ভারী গলায় মাজহারুল বললো,
-“হ্যাঁ.. তুমি কী মৌমিকে একবার কোলে নেবে?”
-“অবশ্যই..”
মাজহারুল মৌমিকে কোলে দেয়ামাত্র তাকে বুকে চেপে ধরলো জ্যোতি। ঠোঁট চেপে খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকার পর আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। অতীতের পিছুটানকে বুকে চেপে আর পারছে না সে নিজেকে শক্ত রাখতে।
-“তুমি কাঁদছো কেনো আসল আম্মু?”
মৌমির কথায় কোনো জবাব দিল না জ্যোতি। দু’হাতের আঁজলে তার মুখ তুলে চুমুতে ভরিয়ে দিল তাকে। মৌমি নিজেও জ্যোতির বুকে গিয়ে তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো তাকে। ঠোঁটে তার ভুবনভুলানো হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“আসল আম্মু.. তুমিও কী ওই আম্মুর মত অন্য কারো ছিলে এতদিন? কেনো ছিলে? আমার কথা কি একবারও মনে পড়তো না তোমার?”
মৌমির একথারও জবাব দিল না জ্যোতি।চোখের সানগ্লাস খুলে সে অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করলো,
-“আমাকে মাফ করে দিস মা। আমাকে মাফ করে দিস। আমি জানি তোর ভেতর বুঝ এলে তুই আমাকে ঘৃণা করবি.. কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোর মুখের দিকে তাকিয়েও আমি ওসব সহ্য করতে পারিনি।”
জ্যোতির কথা বোধগম্য হলো না মৌমির। তবে তার ছোট্ট দুই হাত দিয়ে সে মুছে দিল মায়ের চোখের পানি। তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
-“কাঁদে না আসল আম্মু। ও বাবা.. আসল আম্মুকে একটা আইসক্রিম কিনে দাও না! আসল আম্মু কাঁদছে..”
ক্রন্দনরত অবস্থায় আরও দৃঢ়ভাবে মৌমিকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরলো জ্যোতি। ঠিক একারণেই ওবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর দ্বিতীয়বার আর মৌমিকেও দেখতে যাবার সাহস করে উঠতে পারেনি সে। সে জানতো, সবকিছুর মায়া ছেড়ে ওবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসলেও নিজের পেটের সন্তানের মায়া কাটানো সম্ভব নয়…
-“মা, আমি তোকেও আমার সাথে আনতে চেয়েছিলামরে। কিন্তু তোর দাদু আনতে দেয়নি। আমাকে মাফ করে দিস মা। বড় হবার পর আমাকে ঘৃণা করিস না।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১১+১২
খানিক্ষণ ঘরের ভেতরে পায়চারী করে বিছানায় শরীর মেলে দিল মেসবাহ। তবে এপাশ ওপাশ করেও ঘুমের দেখা পেল না। রাগ তার কিছুটা কমে এলেও মনের ভেতরটা অস্থিরতায় ছটফট করছে। সে কি ঠিক করলো কাজটি? ভয় পায় মেয়েটি একা ঘরে ঘুমোতে। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে উঠা একটি মেয়ের পক্ষে এমনটাই কি স্বাভাবিক নয়? তাছাড়া মেয়েটির বয়সও তার একবার বিবেচনায় আনা উচিৎ ছিল। অস্থির মনে বিছানা ছেড়ে উঠে ডাইনিংয়ে এসে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে ফেললো মেসবাহ। তারপর লম্বা একটি দম ছেড়ে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লো তাতে। কী এমন হবে মেয়েটির পাশে ঘুমোলে? নিজেকে সংযত রাখতে পারবে না সে? তাহলে তার এবং কোনো পশুর মাঝে পার্থক্য থাকলো কি? বাচ্চা একটি মেয়ের পাশে শুয়েই যে ব্যক্তি নিজেকে সংযত রাখতে ব্যর্থ হবে, বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে নানান আজেবাজে চিন্তাভাবনা করবে, সে আর যাই হোক কোনো মানুষ নয়। পশু সে.. নীচু স্তরের এক নিকৃষ্ট পশু। ভাবামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। নীরব পায়ে এগুলো উল্লাসীকে একা ফেলে রেখে আসা ঘরের দিকে।
বিছানায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো উল্লাসীর। তবে সেদিকে চোখ তুলে তাকাবার মতো সাহস হলো না তার। যদি অদ্ভুত সেই চেহারার মানুষগুলো হয়? তখন কী করবে সে? এক দৌড়ে এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সকল পথই যে বন্ধ!
-“উল্লাসী… এই উল্লাসী?”
হঠাৎ মেসবাহর ডাক কানে আসতেই মাথা উঠালো উল্লাসী। অবিশ্বাস্য চোখে একবার মেসবাহর দিকে তাকিয়েই ঝাপিয়ে পড়লো তার বুকে। অপরদিকে খানিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর এক হাত উঠিয়ে উল্লাসী মাথায় রাখলো মেসবাহ। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় বললো,
-“খুব ভয় পেয়েছিলে?”
মেসবাহর বুকে মুখ ডুবিয়ে উল্লাসী নাক টেনে জবাব দিল,
-“হু…”
-“এত ভয় কিসের বোকা মেয়ে? দেখো চারপাশের দরজা জানালা সব কিছুই তো বন্ধ। এর ভেতর কেউ কি আসতে পারবে এই ফ্ল্যাটে?”
-“উহু…”
-“তাহলে এত কিসের ভয় তোমার?”
-“জানিনা…”
-“আজ কি তোমায় জানিনা রোগ হয়েছে? সব প্রশ্নেরই এক উত্তর করে যাচ্ছো! জানিনা জানিনা আর জানিনা।”
শরীরের কাঁপুনির সঙ্গে কান্নার বেগ খানিকটা কমে এল উল্লাসীর। ভেজা গলায় সে বললো,
-“আপনার যদি ভাল্লাগেনা রোগ হতে পারে তাহলে আমার জানিনা রোগ হলে দোষ কী?”
-“আমি তো ডক্টর। নিজের রোগ হলে নিজে চিকিৎসা করে তা সারিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু তুমি? তোমার এই রোগ কে সারাবে শুনি?”
-“কেনো? আপনি সারাবেন। আপনি আমার স্বামী না?”
জবাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে উল্লাসী। কান্নার দরুন আর শরীর কেঁপে কেঁপেও উঠছে না তার। হয়তো কিছুক্ষণের মাঝে একদম ঠিকঠাকও হয়ে যাবে সে।
-“চলো.. শুয়ে পড়ি।”
মেসবাহর বুক থেকে মাথা উঠালো উল্লাসী। অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
-“আমার তো আজ জ্বর নেই। আমি নিচে শুই? আর আপনি এঘরেই বিছানায় ঘুমোন?”
-“উহু.. আমি তুমি, আমরা দুজনেই আজ একসাথে ঘুমোবো। এবং তা বিছানায়। নাও দেখি তোমার বালিশ একপাশে রাখো।”
খানিক্ষনের জন্য বিস্মিত হলেও উল্লাসী ঠোঁটে ফুটলো মিষ্টি হাসি। সত্যিই এই মানুষটিকে বোঝা বড় দায়!
বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ একনাগাড়ে বেঁজে যাচ্ছে কলিংবেল। তবে দরজার কাছে একবার গিয়ে তা খোলার সাহস করে উঠতে পারছে না উল্লাসী। গতকাল দুপুরে বারবার তাকে দরজা খুলতে নিষেধ করে দিয়েছে মেসবাহ। তবে এভাবে একজন অপরপাশ থেকে ডেকে যাচ্ছে অথচ সে তার ডাকের সাড়া দিচ্ছে না। কাজটি অসভ্যের মতো হয়ে গেলো না? তাছাড়া একা বাসায় থাকতে তার নিজেরও ভালো লাগছে না। ভয় লাগছে, দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। কী এমন হবে দরজা খুলে ওপাশে আসা মানুষটির সঙ্গে দুটি কথা বললে? উল্টাপাল্টা প্রশ্ন না করলে না হয় আবারও জানিনা বলে কাটিয়ে দেয়া যাবে! তাতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও তো কারো সঙ্গ পাওয়া যাবে! আড়ষ্ট পায়ে দরজার দিকে এগুলো উল্লাসী। সময় না নিয়ে দ্রুত দরজা খুলতেই দেখতে পেলো গতকালের সেই মহিলাকে।
-“কী করছিলে? কতক্ষণ যাবৎ বেল বাজিয়ে যাচ্ছি! দেখো ঘেমে টেমে একাকার অবস্থা!”
বলেই মুন্নি সরকার এগুলো ড্রইংরুমের দিকে। ফ্যান ছেড়ে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে বললো,
-“দেখি এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়াও তো..”
দরজা বন্ধ করে মুন্নি সরকারের কথামতো বরফ শীতল পানি এনে তার দিকে বাড়িয়ে দিল উল্লাসী। নরম গলায় জানতে চাইলো,
-“আপনি ভালো আছেন?”
পুরো পানি শেষ করে আরাম করে আবারও সোফায় বসে সে বললো,
-“আছি কোনোরকম! তুমি ভালো আছো?”
-“হ্যাঁ…”
-“সকালে খেয়েছো?”
-“হ্যাঁ..”
-“কী খেলে?”
-“রুটি আর আলু ভাজি।”
-“সব তুমি করেছো? দেখি একটা রুটি আর আলুভাজি নিয়ে এসো তো। খেয়ে দেখি কেমন হয়েছে!”
-“রুটি তো নেই। তবে আলুভাজি আছে। ওটা আনবো?”
-“যাও.. আনো।”
উৎসাহের সাথে উল্লাসী রান্নাঘরের দিকে এগুতেই নিজের মনকে আবারও বোঝালো মুন্নি সরকার। আজ এমন তেমন কোনো প্রশ্ন নয়! আজ সহজ ভাবে কথা বলতে হবে উল্লাসীর সাথে। যাতে কাল হঠাৎ করেই তার পরিবর্তনের কারণটি ধরতে পারে সে। তাছাড়া মেয়েটির মাথায় পাগলামো আছে কিনা, চরিত্র ঠিকঠাক কিনা তাও তো দেখতে হবে!
-“বাহ! বেশ ভালো হয়েছে তো।”
মুন্নি সরকারের কথায় হাসি ফুটলো উল্লাসীর ঠোঁটে। পানির গ্লাস তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“রুটি খেতে চাইলে কাল আপনার জন্য বানিয়ে রাখবো।”
-“ঠিকাছে। রেখো। তা আর কী কী রাধতে পারো তুমি?”
-“গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ, শাক ভাজি, পটল ভাজি…”
উল্লাসীকে কথার মাঝে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকার। খুশি মনে বললো,
-“সব পারো?”
-“মোটামুটি..”
-“তা কাল তোমার কী হয়েছিল? আমি তো বাবা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”
-“দরজা খুলে আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে দেখে।”
যাক! মেয়েটি তাহলে পাগল নয়। গ্রামের মেয়ে, শহরের রীতিনীতি আর কতটুকুই বা জানে! তাছাড়া একা বাসায় অচেনা কেউ এলে ছোটো এক মেয়ের পক্ষে ভয় পাওয়ারই কথা। ভয়েই হয়তো উলোটপালোট কিছু বলে ফেলেছে! একে এত আমলে নেবার দরকার নেই! ভেবে সামান্য হাসলো মুন্নি সরকার। বললো,
-“আমাকে দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি। দরজা খুললেই যে ফ্ল্যাটটি দেখো না? ওটিই আমাদের। তোমার ভাই সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তো, তাই কথা বলার মানুষ পাইনা। একা একা প্রচুর বোর হই।”
-“অহ..”
-“তাই তোমার সাথে গল্প করতে আসা। জানো, তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে আমার? বেশ সুন্দর তুমি। যেনো আল্লাহ নিজ হাতে গড়েছে তোমায়। আর আমাকে দেখো? বিয়ে হয়েছে চার বছর। বাচ্চাকাচ্চাও এখনো হয় নি। অথচ এখনি শরীরের ফুলে কলাগাছ!”
বলেই হেসে উঠলো মুন্নি সরকার। যেনো নিজের এই স্বাস্থ্য নিয়ে দারুণ খুশি সে!
বেশ সময় নিয়ে নানান গল্পগুজব করে প্রায় অনেক বিষয়েই তথ্য বের করলো মুন্নি সরকার। তবে মেসবাহর ঠিক কেমন বোন হয় উল্লাসী তা জানতে একরকম ব্যর্থ হলো সে। উদ্বিগ্ন মনে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেই সে কল দিয়ে বসলো তার স্বামীকে হাসান সরকারকে। আপাতত তার মনের কথাগুলো তাকে জানাতে হবেই হবে।
-“বলো..”
-“কী করছিলে তুমি?”
-“তেমন কিছু না। কিছু বলবে?”
-“হ্যাঁ.. আমার শীতল ভাইয়ের জন্য উল্লাসীকে খুব পছন্দ হয়েছে।”
-“উল্লাসী কে?”
-“ওই যে! মেসবাহর বোন। কাল রাতে যে তোমায় বললাম! আজই ভুলে গেছো?”
-“অহ হ্যাঁ! কিন্তু মেয়েটা তো ছোট। প্রাপ্ত বয়স্ক নয়।”
চোখমুখ কুঁচকে মুন্নি সরকার বললো,
-“ছোট আর কই? পিরিয়ড হলেই একটা মেয়ে বিয়ের যোগ্য হয়ে পড়ে। সে হিসেবে উল্লাসীও হয়েছে।”
-“তবুও। আমার মতামত চাও তো আমি বলবো, অন্য মেয়ে দেখতে। তাছাড়া তোমার ভাইও তো বেকার।”
-“হ্যাঁ, তা তো বলবেই! নিজের ভাই না তো। তাই তোমার ওর উপরে কোনো মায়া দয়াও নেই। নিজের ভাই হলে ঠিকই গ্রামের সাধাসিধা মেয়েকেই ঘরে আনতে। যাতে তাকে দিয়ে সংসারের সব কাজ করিয়ে আবার মায়ের দেখাশোনায়ও লাগিয়ে দিতে পারো।”
-“তো তোমার উদ্দেশ্যও কী সেটা নয়?”
হালকা কেশে গলা ঠিক করলো মুন্নি সরকার। দাপুটে গলায় বললো,
-“মোটেও নয়.. মেয়েটিকে প্রথম দেখাতেই আমার পছন্দ হয়েছিল। যাকগে আমার ভাইকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আমার ভাইয়েরটা আমিই বুঝবো। রাখছি।”
কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুন্নি সরকার। মাঝেমাঝে হাসানের উপর তার খুব বেশি রাগ হয়। বেশ অরসিক একজন মানুষ তিনি। কোনো বিষয়ে রসিকতা তো নেইই সাথে মুখ ভর্তি উজানী কথায় ভর্তি। এই লোক কবে মানুষ হবে কে জানে! অবশ্য এই বয়সে আর তাকে মানুষ করাও সম্ভব নয়। বয়সটা তার উল্লাসীর কাছাকাছি হলে তাও একটা সুযোগ থাকতো মানুষ করার। আসলে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা কিছুটা কাদার মতো। সামান্য শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো গড়িয়ে নেয়া যায় তাদের। উল্লাসীকেও ঠিক সেভাবেই গড়িয়ে নেবে সে। তাছাড়া মেয়েটি যথেষ্ট শান্তশিষ্ট। কাজকর্মেও যথেষ্ট পাঁকা। এর চেয়ে গুণী মেয়ে সারা দুনিয়ায় খুঁজলেও তার ভাইয়ের জন্য পাবে না সে। ওদিকে শীতল ভাইয়ের বাউন্ডুলের মত ঘোরাফেরা, বাজী ধরে টাকা উড়ানো দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এমতবস্থায় একটি বিয়ে করলে ঘরে লাল টুকটুকে সুন্দর একটি বউ আসলে হয়তো ঘরে মন বসবে তার। আর সেইসাথে হাসানকে বলে না হয় ছোটোখাটো কোনো চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। অপরদিকে মারও বয়স হয়েছে। সব কাজকর্ম নিজের হাতে সামলানো তার একার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। উল্লাসী গিয়ে সংসারের হাল ধরলে না হয় মা এসব থেকে ছুটি নেবে। সেই সাথে ছেলের বউয়ের হাতের সেবাশুশ্রূষা তো রয়েছেই। তবে সব থেকে বড় যে কারণে উল্লাসীকে নিজের ভাইয়ের জন্য নির্বাচন করেছে সে, তা হলো বাপের বাড়িতে তার অধিপত্য ধরে রাখা। নইলে আজকালকার যুগের যা বৌ, তাতে ননদের মুখোমুখি হতেও নারাজ তারা। বাড়িতে অধিপত্য চালানো তো দূরের কথা! এক্ষেত্রে উল্লাসীকে এই ব্যাপারে নিরাপদ মনে হয়েছে তার। মেয়েটিকে এই তিনদিনে যতটুকু চিনেছে সে, তাতে নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই তার মাঝে। একটু বুঝিয়ে শুঝিয়ে তাকে যেভাবে চালানো যাবে বিনাপ্রশ্নে সে সেদিকেই ধাবিত হবে।
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১২
-“কথা বলবি না আমার সাথে? সত্যিই কথা বলবি না?”
অপরপাশ থেকে অনার কোনো জবাব না পেয়ে উদ্বিগ্ন হলো চৈতালি। অনা তার উপর রাগ করেছে তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে ঠিক কী কারণে? গতকাল মুবিন যাবার পর মন ভালো না থাকায় আজ সারাদিন এবাড়িতে আসাও হয় নি তার। এরমাঝে কী এমন হলো যে একদম কথাবার্তায় বন্ধ করে দিল অনা? বোধগম্য হলো না চৈতালির। নিজের দু’হাতে দু’কান ধরলো সে। তারপর আবারও অসহায় গলায় বললো,
-“আমি কী করেছি এটা তো আমায় বল! না বললে বুঝবো কী করে? এই অনা? এদিকে একটু তাকা। দেখ তোর রাগ ভাঙ্গাতে তোর চিতৈই পিঠা কান পর্যন্ত ধরেছে।”
একনজর চৈতালিকে দেখে আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিল অনা। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“আমি কারোর উপর কোনো রাগ করিনি।”
-“তাহলে কথা বলছিস না কেন?”
-“কথা বলতে ইচ্ছে না করলেও কথা বলতে হবে কেন?”
-“তো কথা বলতে ইচ্ছে করবে না কেন?”
-“নাই করতে পারে। তুই যা তো এখন।”
-“কেনো যাবো? আমি আজ আরও আসলাম তোর সাথে রাতে থাকবো বলে!”
-“যা তো তুই। বিরক্ত করিস না।!”
হঠাৎ অনার চিৎকারে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো চৈতালি। মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল তার। এরকম কেনো করছে অনা ভেবে পেল না সে। অনা খানিকটা জেদি স্বভাবের। তবে কখনোই সে নিজের জেদ বন্ধুত্বের মাঝে আনেনি। মনোমালিন্য হওয়া তো দূরের কথা। তাহলে আজ হঠাৎ করেই কী এমন হলো যে তার সঙ্গে এতটা দুর্ব্যবহার করছে অনা! খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো চৈতালি। তবে মাঝপথে এসেই থেমে আরও একবার ধরা গলায় বললো,
-“সত্যিই চলে যাবো?”
-“হ্যাঁ, যা…”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বলে চোখ জোড়া বন্ধ করলো অনা। চৈতালি তার ছোটবেলার বন্ধু। সবচেয়ে কাছের মানুষ। অথচ তার জীবনের এতবড় একটি সত্য কী করে লুকিয়ে রাখলো সে? তাও তার ভাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে! কী দুর্দান্ত অভিনয় তাদের! যেনো একে অপরকে চেনে জানেই না! নাম মনে রাখা তো দূরের কথা। কিভাবে পারলো তারা এসব করতে? এভাবে কয় বছর যাবৎ তারা এ অভিনয় অভিনয় খেলছে কে জানে! কী এমন হতো তাকে সবটা জানালে? সে কী চৈতালির শুভাকাঙ্ক্ষী নয়? তারপরও কেনো চৈতালি জানালো না তাকে? লম্বা করে দম ছেড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আলমারি খুলে ছবির একটি অ্যালবাম বের করলো অনা। তারপর তার এবং চৈতালির সকল ছবি বেছে আলাদা করে একটি মোম জ্বালিয়ে পোড়াতে শুরু করলো ছবিগুলোর একপাশ থেকে চৈতালিকে।
ল্যাবএইডে সন্ধ্যার পর বসার কথা থাকলেও উল্লাসীর কথা ভেবে চেম্বারে বসলো না মেসবাহ। বিকেল থাকতেই বাড়ি ফিরে সময় নিয়ে গোসল সেরে টেলিভিশনের সামনে বসলো সে। তারপর উল্লাসীকে ঢেকে চা চাইলো এক কাপ। স্বামীর আদেশ পাওয়ামাত্র উল্লাসী পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। চুলোয় গরম পানি বসিয়ে ঝটপট চা বানিয়ে কাপে ঢেলে তা নিয়ে এগুলো ড্রইংরুমের দিকে।
-“তুমি খাবে না?”
-“উহু.. আমি খাই না।”
কথা বাড়ালো না মেসবাহ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারও টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি দিল সে। অপরদিকে মেসবাহর দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর উল্লাসী উৎসাহী গলায় বললো,
-“আজও উনি এসেছিলেন।”
-“কে?”
-“ওই যে উনি। মুন্নি ভাবি।”
চোখমুখ কুঁচকে গেল মেসবাহর। টেলিভিশনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকালো সে। কড়া গলায় বললো,
-“তুমিও আজও দরজা খুলেছিলে?”
-“হ্যাঁ.. উনি বেল বাজিয়েই যাবে আর বাজিয়েই যাবে! আর আমি ভেতরে থেকেও সাড়া দিব না?”
-“না, তুমি দেবে না। তোমাকে নিষেধ করিনি আমি?”
মেসবাহর মেজাজ খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে মুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। মেঝের দিকে চেয়ে সে ধীর গলায় বললো,
-“আমার একা বাসায় ভয় করলে একটু সময় উনার সাথে কথা বললে কী এমন হবে?”
-“একা বাসায় তোমার ভয় করবে কেন? একা তো একা। ভয় দেখানোর মতো কেউ আছে কি?”
জবাব দিল না উল্লাসী। এক বেলা তরল তো এক বেলা কঠিন। এই লোককে বোঝা সত্যিই বড় দায়!
-“তাছাড়া দিনের বেলায় আবার কিসের ভয়? পৃথিবীর সব ভুতপ্রেত কি নিজেদের সব কাজকর্ম ফেলে সারাদিন তোমায় ভয় দেখানোর চাকরি নিয়ে রেখেছে?”
-“হ্যাঁ, আপনার চাকরি যেমন ডাক্তারগীরি করা তেমন ওদের চাকরিও ভুতগীরি করা।”
হঠাৎ উল্লাসীর এমন কথায় থেমে গেল মেসবাহ। একদন্ড নীরব থেকে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“ভুতগীরিটা কী?”
-“কেনো জানেন না? ভুতগীরি হলো ভয়দেখানো। ভুতের একমাত্র কাজ। আমাদের ভয় দেখাতে সফল হলেই তো ওদের সরদার খুশি হয়ে ওদের টাকা দেয়।”
উল্লাসীর ভুতগীরির সঙ্গা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মেসবাহ। এই মেয়ে পারেও বটে!
-“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন না?”
ঠোঁট চেপে হাসি থামানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হাসতে হাসতেই মেসবাহ জবাব দিল,
-“করি তো।”
-“তাহলে শুধুশুধু হাসছেন কেনো?”
-“কোথায় হাসছি? হাসছি না তো!”
-“এই তো.. এই যে হাসছেন!”
হাসির বেগ আরও কয়েক ডিগ্রী বাড়িয়ে দিল মেসবাহ। মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দর এক সঙ্গা দিয়েছে ভুতগীরির!
-“এই মেসবাহ.. এই দাঁড়াও।”
সিগারেট কিনতে নিচে এসেছিল মেসবাহ। হঠাৎ পেছন থেকে মহিলা কন্ঠের কারো ডাক শুনে থেমে গেল সে। ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভেসে উঠলো তার সামনে লিমনের ভাষ্যমতের ভুড়িওয়ালা ভাবির ছবি। খানিকটা অস্বস্তি হলো তার। এই মহিলা কেনো ডাকছে তাকে? উল্লাসী আবার উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলেনি তো!
-“কেমন আছো?”
-“জ্বি, ভালো। আপনি ভালো?”
-“আছি কোনোরকম! জানোই তো.. একদম সময় দেয় না তোমার ভাই আমায়।”
কী বলবে ভেবে পেল না মেসবাহ। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
-“আপনি এখানে কেনো? কোনো কাজে এসেছেন?”
-“হ্যাঁ.. মাসের বাজার নিতে এসেছিলাম। শফিক আছে না? ওর দোকান থেকেই নেই। তা তুমি কোত্থেকে নাও?”
-“ওখান থেকেই।”
-“ভালো করো। ছেলেটা বেশ ভালো।”
-“হুম..”
মেসবাহর দিকে কিছুটা এগিয়ে এল মুন্নি সরকার। গলা খানিকটা নামিয়ে বললো,
-“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। এখানে দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে। আসলে সব কথাই তো আর উল্লাসীর সামনে বলা যায় না!”
জোর করে ঠোঁটে হাসি ফোঁটালো মেসবাহ। হালকা মাথা নেড়ে বললো,
-“জ্বি..”
-“আমার ভাইকে তুমি তো দেখেছো। কেমন লেগেছে উনাকে তোমার?”
ঠিক মনে করতে পারলো না মেসবাহ। তবুও এক গাল হেসে সে বললো,
-“খুবই ভালো।”
-“আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তো সব হয়েই গেলো। উল্লাসীর সঙ্গে…”
কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ মাঝপথে হাসান সরকার এসে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকারকে। তার কাঁধে হাত রেখে হাসান সরকার বললো,
-“তুমি যে চুলোয় তরকারি দিয়ে বেরিয়েছিলে তা তো পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। কী একটা অবস্থা! তাড়াতাড়ি চলো..”
-“আমি তরকারি কখন চড়ালাম? তুমি ভুল ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওনি তো? আমি ফেইসবুকে একটি ভিডিও দেখেছিলাম। ফোন টিপতে টিপতে কোনো হুশ না পেয়ে অন্যের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল এক লোক!”
-“না না.. তুমি এসো তো। মেসবাহ তুমি যাও। পরে দেখা হবে।”
একরকম জোরপূর্বক মুন্নি সরকারকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরলো হাসান সরকার। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“এক গ্লাস পানি দাও।”
-“বিষ দিব বিষ? বিষ খাবা?”
-“আপাতত পানি…”
-“তোমার পানির মাইরে বাপ। তুমি মিথ্যে বলে আমাকে নিয়ে আসলে কেনো?”
-“তো কী করতাম? দেখা নেই শোনা নেই! দুইদিনের দেখায় একটি মেয়েকে কিভাবে নিজের ভাইয়ের জন্য ঠিক করো তা আমার মাথায় আসে না!”
ফুঁসে উঠলো মুন্নি সরকার,
-“যথেষ্ট দেখাশোনা হয়েছে। এই মুন্নি সরকারের চোখ একবার দেখেই সব বুঝে ফেলে। তুমি আসলে আমার ভাইয়ের সুন্দরী একটা বউ হোক তা চাওনা! কারণ কী বলো তো? আবার নিজেই উল্লাসীকে বিয়ে করার পায়তারা করছো না তো!”
কপাল চাপড়ে সোফায় শরীর মেলে দিল হাসান সরকার। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
-“চাইলেই বা ক্ষতি কী? অন্তত পাগলের হাত থেকে তো বাঁচা যাবে!”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৩+১৪
রাতের আকাশে তারারা দল বেধে ছোটাছুটি করছে। যেনো নিকষ কালো আঁধার আকাশে তাদের মেলা বসেছে। বাড়ি থাকতে এমন তারাভরা রাতের আকাশ সুহাকে নিয়ে প্রায়ই উপভোগ করা হতো। তবে আজ পাশে নেই সুহা। একাকী বসে তারার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা কামড়ে ধরছে কেউ৷ কী করছে সুহা? ছোটমা খোকনের মতোই আদর করে কি সুহাকে? হয়তো না। তবে যে কথা দিয়েছিল ছোটমা!
-“কী করছো একা বসে বসে?”
মেসবাহর গলার স্বরে ঘোর কাটলো উল্লাসীর৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেসবাহকে বসার জায়গা করে দিতেই বাধা দিল সে। নরম গলায় বললো,
-“তুমি বসো.. আমি আরেকটা চেয়ার আনছি ভেতর থেকে।”
তবুও বসলো না উল্লাসী। ঠাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মেসবাহর জন্য। লোকটি মাঝেমাঝে খুব বকে তাকে, আবার মাঝেমাঝে খুবই ভালোবাসে। যেমনটা তার মা বেঁচে থাকতে তার মাকে ভালোবাসতো তার বাবা…
ব্যালকনিতে চেয়ার এনে তাতে বসলো মেসবাহ। তারপর উল্লাসীর দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
-“বসে পড়ো.. এত সম্মান দেখাতে হবে না।”
দু’কদম এগিয়ে চেয়ারে বসলো উল্লাসী। তারপর উদাস গলায় বললো,
-“বাবা মাকে যতটা ভালোবাসতো আপনিও কি আমায় ততোটাই ভালোবাসেন?”
বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো মেসবাহর। বাতাসে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাঙ্গা গলায় সে বললো,
-“ভালোবাসার মানে বোঝো?”
-“উহু.. তবে এটুকু জানি বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসতে হয়।”
-“কে বলেছে এসব?”
-“ছোটমা বলেছে। আপনাদের বাড়িতে আসার পর অর্পা আপাও বলেছে।”
-“আর কী বলেছে?”
-“ছোটমা না অর্পা আপা?”
-“বড় আপা..”
-“উনি তো অনেক কথাই বলেছেন। এই যেমন আপনার সামনে সবসময় সেজেগুজে থাকতে বলেছে, আপনার সামনে শাড়ি আঁচল ঠিকঠাক ভাবে নিতে নিষেধ করেছেন। এমন ভাবে নিতে বলেছেন যাতে কোমর এবং বুক দুই-ই দেখা যায়।”
হালকা কেশে উঠলো মেসবাহ। প্রসঙ্গ পালটাতে বললো,
-“তুমি আজ মুন্নি ভাবিকে উলোটপালোট কিছু বলো নি তো? ভাবি আজ আমায় কিছু একটা বলতে চাইছিল।”
-“উহু.. তেমন কোনো কথাই আমি বলিনি। তাছাড়া উনি কালকের মতো তেমন কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। করলে আবারও জানিনা জানিনা বলে কাটিয়ে দিতাম।”
মৃদু হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। বললো,
-“চলো, শুয়ে পড়ি। রাত অনেক হয়েছে।”
-“আরেকটু থাকি?”
-“না.. চলো চলো।”
একরকম জোর করেই উল্লাসীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এল মেসবাহ। তারপর উল্লাসীকে বিছানা গোছাতে বলে সে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। বড় আপা বাচ্চা এক মেয়েকে এসব অশ্লীলতা কিভাবে শেখায় তা মোটেও মাথায় আসছে না তার।
-“আম্মা, চৈতালি কী আজ এসেছিল?”
-“না, আসে নাই। শোন, তোর আব্বা তোরে বলতে বলছে…”
মোরশেদা বেগমের কথা উপেক্ষা করে দ্রুত তার ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। পা বাড়ালো চৈতালির বাড়ির উদ্দেশ্যে। কাল রাতে ভেবেছে সে। চৈতালির সঙ্গে তার করা ব্যবহার নিয়ে অনেক ভেবেছে। ছবি পুড়িয়ে একজনকে নিজের পাশ থেকে সরিয়ে ফেললেই নিজের জীবন থেকে তার উপস্থিতি মুছে ফেলা যায় না। তাছাড়া কেনোই বা চৈতালিকে নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলবে সে? মুবিন ভাই এবং তার সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু জানায়নি বলে? তাহলে নিজের একাজের বাচ্চামো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নাম খুঁজে পাচ্ছে না সে। হয়তো এখানে চৈতালির কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে যেমনটা তাকেও জুড়ে দিয়েছে এমাদ। যার কারণে মন সারাক্ষণ আনচান করলেও কিচ্ছুটি মুখ ফুটে বলতে পারছেনা সে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ চৈতালিকে। হয়তো তার ক্ষেত্রেও মুবিন ভাই নিষেধ করেছে, বোনের সামনে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বলে! তবে সে অপেক্ষা করবে। নিজে থেকে চৈতালি যেদিন মুখ ফুটে সবকিছু জানাবে তাকে সেদিনই নিজের বন্ধুত্বের এই রাজত্বে চৈতালিকে জয়ী করে তার হাতে তুলে দেবে একটি উপহার। এবং যেটিই হবে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পায়ের গতি বাড়ালো অনা। কাঠফাটা রোদের মাঝে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে ঘামে পুরো শরীর ভিজে উঠেছে তার। সূর্যর প্রখর তাপে খানিকক্ষণ পরপর শরীর জ্বলে জ্বলে উঠছে।
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ। আকাশে প্রচুর মেঘও ধরেছে। মুশলধারে বৃষ্টি হবে হয়তো। চিন্তা হচ্ছে উল্লাসীর জন্য। কিন্তু উপায়ও নেই। সন্ধ্যার আগে না হোক তার খানিক পরেই বাড়ি তাকে ফিরতেই হবে। টানা তিনজন রোগীকে সময় নিয়ে দেখলো মেসবাহ। স্নায়বিক সমস্যা বাংলাদেশে খুব প্রচলিত সমস্যাগুলোর মধ্যে না হলেও এতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এবং সপ্তাহের পাঁচদিনেই রোগী দিয়ে ভর্তি থাকে সিরিয়ালের খাতা। লম্বা কিছু দম ছেড়ে রায়হানকে ডাকলো মেসবাহ। ক্লান্ত গলায় বললো,
-“বাইরে আরও কতজন আছে?”
-“আছে স্যার বেশ কিছু।”
-“আমার শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। আজ আর পেশেন্ট দেখবো না। উনাদের নিষেধ করে দাও।”
-“স্যার, বেশি খারাপ লাগতেছে কী?”
-“না, তুমি গিয়ে একটা রিকশা ডাকো। আমি আসছি।”
রায়হান বেরিয়ে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। হাত ঘড়িতে সময় দেখে উঠে পড়লো চেয়ার ছেড়ে। ডাক্তারী পেশায় নতুন এলেও চারিদিকে যেভাবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে তাতে সামনে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তার। তবে এভাবে উল্লাসীর জন্য কাজে গাফলতি দিলে সেই সুনাম দুর্নামে পরিবর্তন হতেও সময় লাগবে না। কিন্তু এপরিস্থিতিতে ঠিক কী করনীয় তার? দিনটুকো সমস্যা না হলেও সন্ধ্যার পর থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত উল্লাসীকে কারো কাছে রেখে আসতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত। তবে কার কাছেই বা রেখে আসবে? তাছাড়া প্রতিদিন এভাবে অন্যের বাড়িতে রাখা তারাই বা কিভাবে নেবে! উদ্বিগ্ন মনে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গেইটের দিকে এগুতেই তার নজরে এল দল বেধে কয়েকটি মেয়ে পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে ঢুকছে কিছুদূরের আদর্শ নামের এক কোচিং সেন্টারে। সাথেই সাথেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেসবাহর। লেখাপড়ার ব্যপারে না উল্লাসী কিছু বলেছে তাকে আর না সে নিজে উল্লাসীর কাছে কিছু জানতে চেয়েছে। নানান কিছুর ভীড়ে লেখাপড়ার ব্যপারটি মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল তার। তবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। পা বাড়ালো লিফটের দিকে। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত্রি নয়টা.. যতটুকু সময় সে রোগী দেখবে ততটুকু সময় না হোক কোচিং সেন্টারেই সময় কাটাক উল্লাসী। বাদবাকি রইলো স্কুল। তা নয় ধীরেসুস্থে খোঁজ খবর নেয়া যাবে। বছরের মাঝামাঝিতে এসে কোনো স্কুলে উল্লাসীকে ভর্তি করানো যাবে কিনা তা অবশ্য জানা নেই তার।
-“এই মেসবাহ.. আরে এই মেসবাহ।”
কলিংবেল চাপার আগেই পাশ থেকে মুন্নি সরকারের গলার আওয়াজ থামিয়ে দিল মেসবাহকে। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে পাশ ফিরে সে জবাব দিল,
-“জ্বি ভাবি, বলুন।”
-“টায়ার্ড মনে হচ্ছে!”
-“জ্বি, তা তো একটু আকটু।”
-“সমস্যা নেই। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলেই ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তা কাল যা বলছিলাম!”
বিরক্তর সীমা ছাড়িয়ে গেলেও ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো মেসবাহ। চোখমুখে হাসির রেখা ফোটাতে ব্যর্থ হয়ে সে অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“বলুন..”
-“তুমি তো উল্লাসীর ভাই। দুঃসম্পর্ক হও বা কাছের.. ভাই তো ভাই-ই। তো যা বলছিলাম, উল্লাসীর বাবামা যেহেতু তোমার ভরসায় ওকে এখানে পাঠিয়েছে সেহেতু ওর বর্তমান গার্ডিয়ান তুমিই। তাই আরকি তোমার কাছেই বলা! উল্লাসীর সঙ্গে শীতল ভাইয়ের বিয়ের কথা ভাবছিলাম। তোমার কী মত এতে?”
মুন্নি সরকারের কথা ঠিক বোধগম্য হলো না মেসবাহর। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কী বললেন?”
-“আরে আমার ভাই আছে না শীতল? ওর সাথে উল্লাসীকে নিতে চাই আমরা। মেয়েটি দারুণ মিষ্টি। প্রথম দেখাতেই আমার মনে ধরে গিয়েছিল।”
চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো মেসবাহর। হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো মুন্নি সরকারের মুখ বরাবর।
-“আমার ভাই মাশাল্লাহ ব্যবসাপাতি ভালোই করে। তোমার ভাই চাকরি নিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আমার ভাই কোনোভাবে তা কানেই নেয় না। আসলে ও আমাদের এলাকায় সফল এক ব্যবসায়ী তো। তাই ব্যবসা ছাড়তে চায় না। আমি বলি চাকরি, ব্যবসা দুইটাই তুমি করো। তুমি তো আবার মাল্টিট্যালেন্টেড.. ঠিক বলেছি না?”
ওপাশ থেকে মেসবাহর জবাব না পেয়ে কপাল কুঁচকে গেল মুন্নি সরকারের। গলা উঁচিয়ে সে ডেকে উঠলো মেসবাহকে।
-“কী হলো? বললে না তোমার মত কী এতে?”
বিস্ময় যেনো কাটছেই না মেসবাহর। মহিলার মাথায় এমন কিছু খেলবে তা মনের ভুলেও কখনো মাথায় আসেনি তার। মহিলা তো মহিলা নয়.. আস্ত গরুর গবর। উভয়ের কাজই মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা। নিজেকে কোনোরকম সামলে নিল মেসবাহ। জোর গলায় বললো,
-“অসম্ভব!”
-“অসম্ভব কেনো?”
একদন্ড ভেবে মেসবাহ বললো,
-“অসম্ভব কারণ, উল্লাসী ছোট। ওর বিয়ের মতো বয়স হয়নি।”
-“খুব হয়েছে। যে মেয়ের পিরিয়ড শুরু হয়েছে, সে মেয়ের বিয়ের বয়সও….”
কথা শেষ করার আগেই জিহবা কামড়ে নিজেকে সামলে নিল মুন্নি সরকার। কথার মোড় ঘোরাতে দ্রুত বলে উঠলো,
-“ভাই হিসেবে তুমি চাওনা তোমার বোনের ভালো জায়গায় বিয়ে হোক?”
চোখমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে মেসবাহ জবাব দিল,
-“উল্লাসী ছোট৷ আপনি দয়া করে আর এসব কথা তুলবেন না।”
-“কেনো? সমস্যা কোথায়? আজ বিয়ে দাও বা দশ বছর পর, আমার ভাইয়ের চেয়ে যোগ্য ছেলে কখনোই পাবে না।”
-“আশ্চর্য! আপনি এক কথা বারবার কেনো বলছেন?”
-“তুমি শুধুশুধু ক্ষেপছো কেনো? যাকগে! তুমি দুঃসম্পর্কের ভাই, দূরেই থাকো। দেখি ওর বাবা মা কারো ফোন নাম্বার দাও। বা যোগাযোগ করার কোনো ওয়ে বলো। উনারা নিশ্চয় অমত করবে না! মেয়েকে অন্যের বাসায় ঝিগিরি না করিয়ে বিয়ে দেয়াটাই কি বেটার অপশন না?”
-“বললাম তো বিয়ে দিব না। আপনি প্লিজ যানতো।”
ক্ষুব্ধ গলায় কথাগুলো একদমে বলেই পকেট থেকে চাবি বের করে সদর দরজা খুললো মেসবাহ। তারপর দ্রুত পদে ভেতরে ঢুকেই মুন্নি সরকারের মুখের উপর বন্ধ করে দিল দরজা।
-“আপনি আজ এত দেরিতে এসেছেন কেনো? আমি যে একা ভয় পাই তা আপনি জানেন না?”
-“একা কোথায় থাকো তুমি? আমি যাবার পরপরই যে ওই ভুটকি মহিলাকে বাসায় ডেকে আনো, তা আমি বুঝি না মনে করেছো?”
-“ভুটকি মহিলা কে?”
-“এখন তো চিনবাই না! অথচ সারাদিন তার সাথে ঘুরঘুর করো। ইচ্ছে করেই নিজেকে তার সামনে এভাবে প্রেজেন্ট করো যাতে উনি…”
দাঁতে দাঁত চেপে হাত থেকে ব্রিফকেস বিছানায় ছুড়ে ফেললো মেসবাহ। তারপর ক্রুদ্ধ গলায় আবারও বললো,
-“বাচ্চা একটি মেয়ে.. যে না আমার হাটুর সমান বয়স! তার আবার একটা বিয়ে করে হয় না। আরো বিয়ে করার শখ জাগছে মনে.. না?”
হতবাক চোখে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে রইলো উল্লাসী। ভুটকি মহিলা, হাটুর সমান বয়স, বিয়ে.. এর কোনোটির অর্থই বুঝে উঠতে পারছে না সে। তবে এটুকু বুঝতে পারছে বকাবকি শোনার সময় ঘনিয়ে এসেছে তার।
-“ছ্যাঁচড়া মহিলা, ভুড়িওয়ালা মহিলা, চামার মহিলা, জল্লাদ মহিলা, রাক্ষস মহিলা… আমার বউয়ের বিয়ে ঠিক করে! কেন রে? আমার বউকে আমি খাওয়াতে পড়াতে পারবো না যে অন্য ব্যাটার সাথে তার বিয়ে দেব আমি? বলো, পারবো না?”
ঢোক গিলে উল্লাসী জবাব দিল,
-“হু.. পারবেন?”
-“তাহলে জ্বলে কেনো ওই ভুটকির? আবার যদি দেখছি তুমি ওই মহিলার সাথে মেলামেশা করছো, তাহলে তোমাকে পুরো একরাত এই বাসায় একা রেখে আমি হসপিটালে গিয়ে থাকবো। তারপর সেই রাতে তুমি বুঝবা ভুতগীরি কী আর কত প্রকার!”
বলেই হন্যে পায়ে পাশের ঘরের দিকে এগুলো মেসবাহ। না মুন্নি সরকার না উল্লাসী, কারোর উপর রাগ হচ্ছে না তার। রাগ হচ্ছে নিজের উপর। সে মানুক আর নাই মানুক, উল্লাসী তার স্ত্রী। এবং তীক্ত হলেও এটি সত্য। তাহলে কেনো বেশি বুঝে উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তার?
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৪
খানিকক্ষন থম ধরে মেসবাহর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর মুন্নি সরকার পা বাড়ালো নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। বিয়ে তো সে দেবেই দেবে। এতে যা হবে দেখা যাবে। তাছাড়া মেসবাহই বা কে বিয়ের প্রস্তাবে মানা করে দেয়ার? দরকার পড়লে গ্রামে গিয়ে উল্লাসীর বাবামার সাথে কথা বলবে সে। তবুও এই মেয়েকে হাতছাড়া করবে না। গভীর কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোন হাতে নিয়ে মায়ের নাম্বারে ডায়াল করলো মুন্নি সরকার। অস্থির মনে অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশ থেকে মায়ের একটি সাড়ার।
-“আম্মা তুমিই কাল সকাল সকাল রওনা হবা। কাল দুপুরের মাঝে তোমাকে আমার বাসায় আমি দেখতে চাই। তুমি এখনি ভাইয়ারে বলো টিকেট করে রাখতে। নয়তো ঘুম নষ্ট করে ভোরে উঠে তোমাকে বাসে তুলে দেবে না ও।”
একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে ওপাশ থেকে শায়লা বেগম বললেন,
-“সে কী বাড়িতে আছে! পামু কই তারে আমি! রাত একটার আগে বাড়িতে আসে সেই মহারাজা?”
-“ফোন দাও। ফোন দিয়ে বলো।”
-“কেন? এত পারাপারি কিসের? কাল কেন তোর ওইখানে যাওয়া লাগবো?”
-“আরে আম্মা! তোমারে যে মেয়ের কথা বলছিলাম, ওই মেয়েকে দেখার জন্য কাল আসবা তুমি।”
-“কেন? কালকের পর কী ওই মাইয়া উইড়া যাইবো?”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। ছটফটিয়ে বললো,
-“উফফ! তুমি বুঝবা না! তোমারে কাল আসতে বলছি তুমি আসবা। ব্যস!”
-“আচ্ছা.. দেখি।”
-“দেখাদেখি না। তোমার আসতেই হবে। আমার পছন্দ করা মেয়েকে একবার দেখলেই তুমি ফিদা হয়ে যাবা। বলবা, এরেই আমার ছেলের বউ হিসেবে চাই।”
মেয়ে যে দুই ডিগ্রি বাড়িয়ে কথা বলে তা অজানা নয়। তাই তাতে একটা পাত্তা দিলেন না শায়লা বেগম। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,
-“সবই বুঝলাম! কিন্তু একা একখান মাইয়া একই বাড়িতে আরেক পোলার লগে থাকে। জিনিসখান কেবা না?”
-“আরে আম্মা! ওরা তো ভাইবোন। তুমি ওভাবে ভাবছো কেনো? তাছাড়া আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পছন্দ টছন্দ আছে নাকি বা গ্রামের কারো সাথে কিছু ছিল নাকি। কিন্তু মেয়ে তো মেয়েই! মাশাল্লাহ.. এসব বোঝেই না ও। প্রেম পিরিত তো দূরের কথা।”
-“ঠিকাছে.. ভালো হইলেই ভালো। তুই তাইলে রাখ। আমি শীতলরে ফোন দেই। দেখি টিকিটের কথা কই।”
-“আচ্ছা, রাখছি তাহলে। তুমি কিন্তু ভোরের বাসের টিকেট কাটাবা।”
ফোন রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুন্নি সরকার। যাক! একটা কাজ তো এগিয়ে রাখা হলো। বাদবাকি গুলো না হয় ধীরেসুস্থে হবে!
সিগারেট হাতে অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে চিন্তার জগতে বিচরণ করছিল মেসবাহ। বেশ খানিকক্ষন হলো খাওয়াদাওয়ার পাঠ চুকেছে তাদের। তবে উল্লাসীর সঙ্গে আজ রাগারাগি করার পর মেয়েটি একদম চুপসে গেছে। খেতে বসেও চুপচাপ খেয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত মেয়েটির উপর রাগ ঝাড়া যেনো তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অভ্যাসটি পরিবর্তন করতে হবে। মেয়েটি ছোট। না বুঝে করে ফেলে একটি কাজ। অবশ্য এই পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখাও যায় না। কিন্তু কেনো রাখা যাবে না? সে তো স্ত্রী মানে না উল্লাসীকে। বাবার কথায় সে বিয়ে করেছে এবং একরকম বাধ্য হয়েই তাকে নিয়ে এসেছে নিজের সাথে। এবং দায়িত্ব হিসেবেই সে দেখে আসছে উল্লাসীকে। এছাড়া বেশি কিছু নয়। তাহলে উল্লাসীর বিয়ে আসুক বা অন্য কিছু তাতে তার এত মাথা গরম হবে কেনো? পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনার উপর মেজাজ খারাপ হলো মেসবাহর। আশ্চর্য চিন্তা ভাবনা তার! ছোট হোক বা বড়.. উল্লাসী তার বিয়ে করা বউ। বাবার কথায় হোক বা বাধ্য হয়ে, তিন কবুল পড়ে তো সে বিয়ে করেছে উল্লাসীকে। আর সেই উল্লাসীর জন্য যদি কেউ বিয়ের প্রস্তাব আনে তা অবশ্যই একজন স্বামী হিসেবে চুপচাপ মেনে নেয়া যায় না। কেনোই বা মেনে নেবে সে? উল্লাসী তার দায়িত্ব হলেও সর্বপ্রথম সে তার স্ত্রী।
-“আসবো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। জ্বলন্ত সিগারেট এশট্রেতে রেখে উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বললো,
-“চেয়ার নিয়ে এসো..”
চেয়ার টেনে ব্যালকনিতে এনে মেসবাহর পাশে বসলো উল্লাসী। উদাস মনে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকাতেই পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“ব্যালকনির জন্য ডাবল সিটের চেয়ার বা দোলনা কিনলে কেমন হয়?”
-“জানি না..”
-“কেনো জানো না?”
-“জানি না…”
-“মন খারাপ?”
এপর্যায়ে মেসবাহর দিকে ফিরলো উল্লাসী। ধীর গলায় বললো,
-“আমি কখনোই আর মুন্নি ভাবির সঙ্গে কথা বলবো না। উনি এলে কখনোই দরজা খুলবো না।”
-“না, তুমি বলবে।”
-“না, আমি বলবো না। কখনোই বলবো না।”
-“না, উল্লাসী। তুমি বলবে।”
মেসবাহর এমন কথায় অবাক চোখে তার দিকে তাকালো উল্লাসী। বললো,
-“কেনো?”
-“কারণ, ওই মহিলা আজকের পর থেকে তোমার এবং আমার লাইফ হেল করে ছাড়বে। অনেক্ক্ষণ যাবৎ কলিংবেল বাজানোর পর যদি তুমি দরজা না খোলো, উনি পুরো বাসা মাথায় তুলে ফেলবে। সবাইকে ডেকে এনে দরজা ভেঙে হলেও দেখবে ভেতরে ঠিক কী চলছে! তাছাড়া নানান কথা ছড়ানো তো রয়েছেই। এ কারণেই তুমি দরজা খুলবে। তবে উনাকে দেখামাত্রই বলবে তুমি এখন ব্যস্ত আছো বা এখন তুমি গোসলে যাবে। এমন নানান এক্সকিউজ দেখাবে। অর্থাৎ দরজা খুললেও ভেতরে ঢুকতে দেবে না। এড়িয়ে চলবে। কী? বোঝাতে পারলাম তো?”
পুরোটা না বুঝলেও মাথা নেড়ে মেসবাহর কথায় সম্মতি জানালো উল্লাসী। অপরদিকে উল্লাসীর সম্মতি পেয়ে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেসবাহর। মৃদু হেসে সে বললো,
-“পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয় তোমার?”
-“হয়.. মাঝেমাঝে। জানেন আমি যখন পড়তে বসতাম তখন সুহা আমার পাশে বসে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো।”
-“তাই?”
-“হ্যাঁ..”
উল্লাসী থেমে যেতেই হাতের ইশারায় কিছু একটা দেখিয়ে মেসবাহ বললো,
-“ওই যে দূরে খানিকটা আলো জ্বালানো একটি বিল্ডিং দেখতে পাচ্ছো, ওটার দোতলায় একটি কোচিং সেন্টার আছে। তোমায় ভাবছি ওখানটায় ভর্তি করে দেব। পড়বে ওখানটায়?”
সময় নিয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো উল্লাসী। তারপর ধীর স্বরে বললো,
-“আপনি বললে পড়বো।”
-“আমি তো বলছিই। ওখানে ক্লাস করতে থাকলে তারপর না হয় কোনো স্কুলে ঢুকিয়ে দিলাম। আর কোনো স্কুলে যদি নাও ঢোকাতে পারি তাহলে তুমি না হয় বোর্ড এক্সাম গ্রাম থেকেই দিলে। সমস্যা হবে কি?”
-“উহু..”
-“গ্রেট.. তাহলে কাল গিয়েই কথা বলে আসবো।”
আঁড়চোখে কিছুক্ষণ উল্লাসীকে দেখার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। এতটা নীরব কেনো উল্লাসী? পড়াশোনার ব্যপারে কী তাহলে আগ্রহ নেই তার? নতুবা অবশ্যই উচ্ছ্বসিত হতো সে। খানিকক্ষণ বেলকনিজুড়ে পায়চারী করে আবারও চেয়ারে এসে বসতেই পাশ থেকে হতাশ গলায় উল্লাসী বললো,
-“প্রতিদিন কোচিং করতে হবে?”
-“হ্যাঁ..”
-“তারমানে প্রতিদিন আমাকে নিচে নামতে হবে?”
-“তা তো নামতেই হবে..”
মেসবাহর জবাবে চোখমুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। মেঝের দিকে তাকিয়ে সে থেমে থেমে বললো,
-“তাহলে আমি সিঁড়ি দিয়েই নামবো। ওসব দিয়ে নামবো না।”
-“কী? লিফট?”
-“হ্যাঁ.. দরজা বন্ধ হবার সাথেসাথেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর যখনই চলতে শুরু করে তখন আমার মাথা ঘুরায়। আমি সিঁড়ি দিয়েই নামবো।”
উল্লাসীর নীরবতার কারণ বুঝতে পারলো মেসবাহ। সামান্য হেসে সে বললো,
-“আমি পাশে আছি না? ভয়ের কী আছে? যখন তোমার খারাপ লাগবে তখন না হয় আমার হাত আঁকড়ে ধরবে।”
সকালে উল্লাসীকে ফেলে হাসপাতালে আসার পর থেকেই অস্থির লাগছে মেসবাহর। মুন্নি ভাবি যেমন মানুষ তাতে উল্লাসীর একার পক্ষে সবটা সামলে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নানান প্রশ্নের মুখে ফেলে পাগল করে দেবে মেয়েটাকে। তাছাড়া অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা তো রয়েছেই। তাই হাসপাতালে চাপ কম থাকায় দুপুরে বাসায় খেতে যাবার সিন্ধান্ত নিল মেসবাহ। অবশ্য এর পেছনে আরেকটি কারণও রয়েছে। কোচিং সেন্টারে উল্লাসীর ব্যপারে কথা বলা। কোনো সমস্যা না থাকলে না হয় আজই ভর্তি করিয়ে দেয়া যাবে উল্লাসীকে। তারপর তাকে ক্লাসে বসিয়ে সে নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারবে তার কাজে। এতে যেমন মুন্নি ভাবির হাত থেকে বাঁচা যাবে তেমন সে নিজেও শান্তিতে দু’দন্ড কাটাতে পারবে। স্বস্তি নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কাঁচা বাজার সেরে বাসার উদ্দেশ্যে রিকশা নিল মেসবাহ। বেলা বাজে দুপুর একটা। সূর্যের প্রখর তাপ এসে লম্বভাবে পড়ছে তার শরীরে। হুডটা উঠিয়ে দিলে ভালো হত। অবশ্য রাস্তাও বেশি একটা নেই। ততক্ষণ না হয় একটু গরম সহ্য করলো…
লিফট ছেড়ে বেরিয়ে ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা দেখতে পেয়ে যা বোঝার বুঝে নিল মেসবাহ। ঠিক একারণেই সকাল থেকে অস্থিরতার উপরে রয়েছে সে। এই মহিলার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া খুব সহজ হবে মনে হচ্ছে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকে এক নজর তাকিয়ে মেসবাহ দ্রুত পদে এগুলো নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। তবে ফ্ল্যাটে ঢোকামাত্রই তার বিস্ময়ের সকল সীমা অতিক্রম করলো। মুন্নি সরকারের পাশেই বসে রয়েছে বয়স্ক এক মহিলা। যাকে প্রায়ই তার কাছে এসে থাকতে দেখেছে মেসবাহ। এবং ভুল না করলে উনিই মুন্নি সরকারের মা। মাথায় রক্ত উঠে গেল মেসবাহর। ঠিক কী করবে ভেবে না পেয়ে হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো সে।
-“কী চলে এখানে? আপনাকে আমি কাল নিষেধ করে দিয়েছি না?”
মেসবাহর গলার স্বর শোনামাত্রই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো মুন্নি সরকারের। চুপেচাপে কাজ সারতে চাইলেও মাঝ থেকে এই বান্দা কই থেকে উদয় হলো তা একদমই মাথায় আসছে না তার।
-“তারপরও আপনার এখানে কী কাজ? হোয়াই আর ইউ কামিং হেয়ার?”
উঠে দাঁড়ালো মুন্নি সরকার। পাশ ফিরে মেসবাহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
-“চিৎকার করছো কেনো? বসো.. বসে কথা বলি।”
-“কিসের বসবো? কেনো বসবো? আপনাকে আমি কাল নিষেধ করে দেই নি?”
-“শুনেই নিষেধ করে দিলে হবে নাকি? ঘরে বোন থাকলে এমন বিয়ের প্রস্তাব আসবেই। তাই বলে এমন হাইপার হওয়া যাবে?”
অস্থির মনে মেসবাহ বলো,
-“আশ্চর্য! আপনি তো প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের। প্লিজ আপনি বের হন।”
-“তুমি বসো, ভাই। বসে কথা বলি। তাছাড়া ভাই হিসেবে তোমার কাজ তোমার বোনের ভালো খারাপ বিবেচনা করা। তাছাড়া কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি? বাছবিচারের ব্যপার আছে না?”
নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায় দু’হাতের মুঠ চেপে লম্বা একটি দম ছাড়লো মেসবাহ। তারপর শান্ত গলায় বললো,
-“ওকে বিয়ে দেবো না। কাল আপনাকে সুন্দরভাবে নিষেধ করেছিলাম। তারপরও আজ আপনি আপনার মাকে কেনো নিয়ে এসেছেন?”
-“আমিও তোমায় বারবার বলছি, মেয়ে হয়ে জন্মেছে উল্লাসী। বিয়েতো একসময় ওকে দিতেই হবে। তাহলে আজ দিলে কী দোষ?”
-“আপনি প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করুন।”
-“তুমি বোঝো মেসবাহ। ভাই হয়ে বোনের ভালো চাওনা। এ কেমন ভাই তুমি? তাও যদি আমার ভাই কানা, বোবা বা খোড়া হতো! আমার ভাইয়ের মত ছেলে তুমি সারা জীবন খুঁজলেও উল্লাসীর জন্য পাবে না।”
আরও কিছু বলতে চাইছিল মুন্নি সরকার। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে উল্লাসীকে বেরিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল সে।
-“আপনি কখন এলেন?”
উল্লাসীর প্রশ্নে পিছন ফিরে তার দিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। চড়া গলায় বললো,
-“তোমাকে কাল রাতে কী বলেছিলাম? একে বাসায় ঢোকাতে নিষেধ করিনি? কিন্তু তুমি আজ একে বাসায় তো ঢুকিয়েইছোই সাথে আদর আপ্যায়নের জন্যও নিশ্চিত খাবার বানাচ্ছিলে।”
মেঝেতে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো উল্লাসী। তারপর ধীর গলায় বললো,
-“উনার মা এসেছিলেন। তাই আরকি….”
-“চুপ.. একদম চুপ।”
উল্লাসীর এক হাত চেপে তাকে টেনে ড্রইং রুমে নিয়ে এল মেসবাহ। তারপর মুন্নি সরকারকে উদ্দেশ্য করে স্থির গলায় বললো,
-“আপনিই ওকে জিজ্ঞেস করুন ও বিয়ে করবে নাকি। এই উল্লাসী, তুমি বিয়ে করবা?”
এসবের আগামাথা কোনোটাই মাথায় ঢুকলো না উল্লাসীর। তবে স্বামীর কথায় সম্মতি দেয়া শ্রেয় ভেবে ঢোক চেপে হালকা মাথা নাড়লো সে।
-“কী? হলো তো? এবার দয়া করে এসব বন্ধ করুন।”
ভ্রু কুঁচকে মুন্নি সরকার বললো,
-“ও ছোট। ও এসবের কিছু বুঝবে না। ওর খারাপ ভালো দেখার দায়িত্ব ভাই হিসেবে তোমার।”
-“আমিও দিব না।”
-“দেব না বললেই হলো! ভাই হইছো কি এই কাজে?”
-“বারবার কী ভাই ভাই লাগাই রাখছেন? উল্লাসী আমার বোন না। ও আমার দুঃসম্পর্কের বউ।”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“দুঃসম্পর্কের বউ মানে?”
-“ওইতো.. দুঃসম্পর্কের না শুধু বউ!”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৫+১৬
কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে মেসবাহ। রাগের মাথায় সত্যিটা এভাবে বলে দিল সে? একবারো ভাবলো না পরবর্তীতে এটি কতবড় আকার ধারণ করবে? সাথে ফলস্বরূপ বাঁশ বাগান তো রয়েছেই। কপালের ঘাম মুছে সোফায় বসে পড়লো সে। করুণ দৃষ্টিতে তাকালো মুন্নি সরকারের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যে তাকিয়ে রয়েছে তারই দিকে।
-“উল্লাসী তোমার বউ?”
মুন্নি সরকারের কথার পিঠে কোনো জবাব দিল না মেসবাহ। ভাবতে লাগলো ভয়ংকর এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার একটি উপায়…
-“কথা বলছো না কেনো? উল্লাসী তোমার বউ?”
-“জ্বি..”
-“তাহলে এতদিন বউকে বোন বলেছো কেনো?”
ঢোক গিলে পরিস্থিতি সামলাতে আবারও উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। গলা খাকড়ি দিয়ে সামান্য এগিয়ে এল মুন্নি সরকারের দিকে। তারপর স্থির গলায় বললো,
-“বোন বলিনি। দুঃসম্পর্কের বোন বলেছি। দুঃসম্পর্কের বোনও তো মাঝেমাঝে বউ হয়। তাই না?”
-“হলে হয়। তবে তুমি মিথ্যে বলেছো। সকলের কাছে নিজের বউকে বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছো।”
-“আলাদা করে আমি কারো সাথেই উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেইনি আপনি ছাড়া। আপনার জোরাজুরির সাথে না পেরে উঠে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আর বাদবাকি ছড়ানোর কাজটা আপনি করেছেন। তাহলে এখানে মিথ্যে কে বলেছে.. বলুন?”
ফুসে উঠলো মুন্নি সরকার,
-“একদম কনফিউজড করো না আমাকে। একদম না। এই আম্মা ওঠো তো। এসবের শেষ আজ আমিই দেখেই ছাড়বো।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে শায়লা বেগম বললেন,
-“তুই চুপ করতো। তোরে বারবার আমি কইছি, আগে ভালো করে খোঁজ খবর নে। কিন্তু তুই শুনলে তো! প্রত্যেক বিষয়েই এত নাচানাচি করলে চলে?”
-“না চললে নাই। মেসবাহর মনের ভেতর কি আমি বসে রইছিলাম যে ওর মিথ্যে কথা আমি ধরতে পারবো?”
পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“আমি তো মিথ্যে বলিনি।”
-“আবারও বলছো মিথ্যা বলোনি?”
-“হ্যাঁ.. উল্লাসী আমার দুঃসম্পর্কের বোনও হয়।”
-“তো? বিয়ের পর বউকে তুমি বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিবা?”
আবারও কপালের ঘাম মুছলো মেসবাহ। এ কেমন অবস্থায় পড়লো সে! কী দরকার ছিল উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করে দেয়ার? সত্যিটা বললে আর যাই হোক আজকের মতো পরিস্থিতিতে তো পড়তে হতো না!
-“বিয়েই তো আমাদের হয়নি। না মানে গ্রামে হয়েছে। এখানে তো হয়নি। তাই গ্রামে উল্লাসী আমার বউ। আর এখানে দুঃসম্পর্কের বোন।”
-“মানে? তুমি আবারও আমাকে কনফিউজড করছো!”
-“মোটেও না, ভাবি। এই যেমন ধরেন আপনি হাসান ভাইয়ের ওয়াইফ। কিন্তু আপনারা বিয়ের আগে একে অপরকে চিনতেন না। তাই বিয়ের পর আগের সেই পরিচয় নিজেদের মাঝে বাঁচিয়েও রাখতে পারলেন না। কিন্তু এদিকে আমি আর উল্লাসী তো দুঃসম্পর্কের ভাইবোন। তাই না? তাই আমরা সেই সম্পর্কের ছিটেফোঁটা নতুন জীবনে হালকার উপর ঝাপসা হলেও রাখার চেষ্টায় আছি। বলুন, ঠিক করছি না?”
বিষয়টি বোধগম্য হলো না মুন্নি সরকারের। চিন্তিত মুখে সে বললো,
-“হ্যাঁ.. তবে বউকে বোন?”
-“বোন না বোন না। দুঃসম্পর্কের বোন।”
-“ওই হলো! উহু.. কোথাও ঘাপলা আছে। অবশ্যই আছে। সত্যিটা বলো মেসবাহ। আসল কাহিনী কী?”
মুন্নি সরকারকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চুপ করানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিপাকে পড়লো মেসবাহ। আকাশ পাতাল ভেবেও এর জবাব না পেয়ে সে ধীর গলায় বললো,
-“এক সেকেন্ড! একটু ওয়াশরুমে যাবো আর আসবো। আপনি যাবেন না। বসুন। আমি আসছি।”
কোনোরকম দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে লিমনের নাম্বারে ডায়াল করলো মেসবাহ। দুইবারের মতো রিং বাজতেই ওপাশ থেকে লিমন ফোন ধরতেই তাকে সংক্ষেপে সবটা খুলে বললো সে। তারপর অস্থির গলায় বললো,
-“কী করবো এখন?”
-“আমি আগেই বলছিলাম তোরে! কী দরকার ছিল এসব বলার?”
-“এখন ওসব ভেবে হবে টা কী? এই মহিলাকে কিভাবে চুপ রাখবো সেটা বল। নয়তো এই মহিলা আমার মানসম্মান আর কিছু রাখবে না। পুরো সোসাইটিতে ব্যাপারটি নানানভাবে ছড়িয়ে দেবে।”
-“সময় দে একটু..”
-“সেই সময়টাই তো নেই।”
একদন্ড ভেবে লিমন ফোনের ওপাশ থেকে শীতল কন্ঠে বললো,
-“সময় যেহেতু নেই সেহেতু কমন কাহিনীই শুনিয়ে দে। সময় থাকলে না হয় আনকমন কিছে ভেবে দিতাম!”
-“কমন কাহিনীটাই কী?”
-“তুই উল্লাসী একে অপরকে পছন্দ করিস। কিন্তু উল্লাসীর বাবা ছোট মেয়ে বিয়ে দেবে না। প্লাস ওর বাবা গ্রামের সনামধন্য একজন ব্যক্তি। অনেক পাওয়ার আছে। তাই কোনো উপায় না পেয়ে তুই উল্লাসীরে নিয়ে ভাগছিস।”
লিমনের কথা শুনে বিস্ময়ের শেখরে পৌঁছে গেল মেসবাহ।
-“অসম্ভব!”
-“সম্ভব।”
-“মোটেও আমি এই কাজ করবো না। এতে আমার মানসম্মান যা আছে তার কাণিকোণাও আর থাকবে না।”
-“আরে শালা! প্রেম পিরিত খারাপ জিনিস না। বউকে বোন বানানোর তোমার এই অপকর্মের কথা ঢাকতে আপাতত একটা টপিক দরকার। আর আমার মনে হয়না এরচেয়ে বেটার অপশন পাবি।”
-“আমি পারবো না।”
-“না পারলে যা! পুরো সোসাইটির কাছ থেকে লুচ্চা উপাধি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যা।”
মেসবাহর স্থানত্যাগের পর থেকেই উল্লাসীর উপর প্রশ্নের হাঁড়ি খুলে বসেছে মুন্নি সরকার৷ একেরপর এক প্রশ্ন করে মেয়েটির কাছ থেকে কিছু জানতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। মেয়েটি জানিনা বিহীন মুখ থেকে কোনো আওয়াজই বের করছে না। ধৈর্যচ্যুত হয়ে আবারও সোফায় বসে পড়লো মুন্নি সরকার। অশান্ত গলায় বললো,
-“মেসবাহ তোমার স্বামী হয়?”
-“জানিনা..”
-“তো জানোটা কী?”
-“জানিনা..”
আগমন ঘটলো মেসবাহর। ঠান্ডা মাথায় উল্লাসীর পাশে দাঁড়িয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করলো সে লিমনের বানানো মিথ্যা গল্প। সবশুনে মুন্নি সরকার ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কিন্তু তুমি তো প্রতিষ্ঠিত একজন ছেলে। তোমার সাথে বিয়ে দিতে কী সমস্যা?”
-“উল্লাসীর তো বিয়ের বয়স হয়নি ভাবি।”
-“গ্রামেও এমন চিন্তাধারার মানুষ আছে?”
-“থাকবে না কেনো? অবশ্যই আছে। তাছাড়া ওর মা তো ঢাকাতেই মানুষ। উনার চিন্তাধারা অন্য পর্যায়ের।”
-“অহ.. কিন্তু আমার মাথায় এটা আসছে না, তুমি মেসবাহ কী করে এত ছোট এক মেয়ের প্রেম পড়লে!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসবাহ জবাব দিল,
-“আপনার যেমন এক দেখাতেই ওকে মনে ধরেছিল তেমন আমারও ধরেছিল। সুন্দর মেয়ে। অবুঝ মন.. ভাবি।”
সন্তুষ্ট হলো না মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উল্লাসীর দিকে ছুঁড়ে বললো,
-“তাই বলে বউকে বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে?”
-“আরে ভাবি! বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে সোসাইটির সবাই জেনে যেত না? এটা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় হতো, নানান আলোচনা হতো। আর যা ওর বাবার কাছে পৌঁছুতেই বেশি সময় লাগতো না। বোঝেনিই তো! পাওয়ারের ব্যাপার। এজন্যই চুপচাপে ছিলাম। তবে একটি মেয়ে যেহেতু নিয়ে এসেছি সেহেতু পরিচয় তো দিতেই হবে। তাই আরকি দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া।”
-“তা ঠিকাছে। কিন্তু ওর বাবা কি তোমার ঠিকানা জানে না? বা কোন হসপিটালে বসো তা জানে না? তার ক্লু ধরেই তো মেয়েকে নিতে এতদিন এখানে এসে পড়বার কথা!”
টনক নড়লো মেসবাহর। যুক্তিযুক্ত একটি প্রশ্ন। এবং প্রশ্নটির কাছে লিমনের দুই পয়সার গল্পটি হার মানতে বাধ্য। মহিলার মাথায় গোবর নয় বরং খাটি সোনা রয়েছে। অদ্ভুত ভুলভাল একটি কাহিনী তার হাতে ধরিয়ে দিলেও সে তার লেজ টেনে ধরেই সত্যতা যাচাই করে নিচ্ছে। আরও একটি দীর্ঘশ্বাস বুকচিরে বেরিয়ে এল মেসবাহর। পরিস্থিতি সামলাতে সে বললো,
-“এখানে আপন বলতে আমার কেউ নেই ভাবি। শুধুমাত্র আপনাকে এবং হাসান ভাইকে আমি কাছের মানুষ মনে করি। আপন মনে করি। আপনার সাথে কাল রাতে এবং কিছুক্ষণ আগে যে ব্যবহার করেছি এর জন্য আমায় ক্ষমা করুন। আসলে মাথা ঠিক ছিল না। ভাবি আপনিই বলেন! কেউ যদি আপনাকেই এসে অন্য মেয়ের সঙ্গে হাসান ভাইয়ের বিয়ে প্রস্তাব দেয়.. তা আপনি চুপচাপ মেনে নিতে পারবেন?”
-“অসম্ভব! তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তবেই আমি মানবো। তুমি ভুল কিছু করোনি। একদম ঠিক করেছো।”
-“বোঝার জন্য ধন্যবাদ ভাবি। আমাকে আপনি না বুঝলে আর কে বুঝবে বলুন!”
-“সেটাই তো। তা তোমরা পালিয়ে আসার পর বিয়ে করেছো তো?”
-“হ্যাঁ.. করেছিলাম। এই উল্লাসী, আমরা বিয়ে করেছিলাম না?”
উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। মেয়েটি চোখেমুখে একরাশ আতংক নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পাশে। মায়া হচ্ছে তার মেয়েটির জন্য। স্বল্প বয়সের এই জীবনে কত মিথ্যার না সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে! তবে আপাতত মিথ্যা ছাড়া সত্য বললে নারীবাদী লোকেরা তাকে পিটিয়ে ছাড়বে। অসৎ চরিত্রের লোক, নারী নির্যাতনকারী এমনকি নারী পাচারকারীর খাতায় নাম ফেলতেও এদের দু’দন্ড লাগবে না। তবে সে আবারও একই ভুল করছে। সম্মান বাঁচানোর ধান্দায় আরও একটি নতুন মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। পূর্বের মিথ্যা নিয়েই যেখানে জান রফাদফা হয়ে যাচ্ছে সেখানে নতুন এই মিথ্যা নিয়ে কতদূর এগুতে পারবে সে! প্রচুর ভাবাচ্ছে তাকে।
সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলো না মেসবাহ। উল্লাসীর কোচিং-এ আজ তাকে নিয়ে কথা বলতে যাবার জন্য হাসপাতাল ছেড়ে আসলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে বাসা ছেড়ে না বেরুনোই শ্রেয় মনে হলো তার। দুপুরে নানান কথা বলে কোনোমতে বুঝিয়ে শুঝিয়ে মুন্নি সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেলেও অস্থিরতা তার একবিন্দুও কমছে না। বরং সময় বাড়ার সাথেসাথে তা ক্রমে বাড়ছে। মহিলা নিশ্চিত এতক্ষণে পুরো সোসাইটিতে কথা ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে কথা কিভাবে ছড়িয়েছে ভালো না মন্দ.. তা কেবল সেই জানে! তবে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।
-“আপনার চা..”
চিন্তার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল মেসবাহ। তারপর তাতে একবার চুমুক দিয়ে বললো,
-“আমাকে কি খুব খারাপ একজন মানুষ মনে হয় তোমার?”
-“উহু…”
-“সত্যি করে বলো।”
একমুহূর্ত ভেবে উল্লাসী বললো,
-“আপনাকে আমি বুঝি না। মাঝেমাঝে চেষ্টা করি, তবে আমার এই ছোট মাথায় আপনাকে ঢোকাতে পারি না।”
মৃদু হেসে আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিল মেসবাহ। মাঝেমাঝে মেয়েটি সহজ সরল, মাঝেমাঝে মেয়েটি চঞ্চল, আবার মাঝেমাঝে একেবারেই নীরব। তবে যেমনই হোক, মন্দ নয়। যার সঙ্গে বেশ সুখে-শান্তিতেই দিনের পর দিন পাড় করা যায়। তবে মেয়েটি যে ছোট! হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো মেসবাহর। ভ্রু কুঁচকে সে পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকাতেই উঠে পড়লো উল্লাসী। ধীর পায়ে এগুলো সদর দরজার দিকে। এবং দরজা খোলামাত্র হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো মুন্নি সরকার সহ কিছু মহিলা। মুখে তাদের অজস্র হাসি।
-“এই তোমার শাড়ি আছে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় শাড়ি টাড়ি এনেছিলে কী?”
মুন্নি সরকারের প্রশ্নের জবাবে মুখ ঘুরিয়ে মেসবাহর দিকে তাকালো উল্লাসী। শাড়ি তো তার আছেই৷ তবে বলে দিলে যদি উনি রেগে যান!
-“ওর দিকে তাকাচ্ছো কেন? আর মেসবাহ তুমিও যাও। পাঞ্জাবি পড়ে তৈরি হয়ে নাও।”
পুরো ব্যাপার বুঝে উঠতে পারলো না মেসবাহ। এভাবে মুন্নি সরকার তার দলবল নিয়ে বাসায় ঢোকার সাথেসাথেই তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। তবে পরবর্তীতে সকলের মুখে হাসি দেখে অস্থিরতা কিছুটা হলেও কমেছিল। কিন্তু এসব কী? হঠাৎ পাঞ্জাবি কেনো পড়বে সে?
-“নাকি তোমার বউয়ের মতো তোমারও পাঞ্জাবি নেই!”
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো উপস্থিত সকলেই। তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“আছে। কিন্তু হঠাৎ পাঞ্জাবি কেনো?”
-“তো কী পড়ে বিয়ে করতে চাও তুমি? টিশার্ট পড়ে?”
কপাল কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। প্রশ্নসূচক চোখে মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কিসের বিয়ে?”
-“তোমার আর উল্লাসীর।”
-“আমাদের বিয়ে তো হয়েই গেছে।”
-“বেশ ভালো কথা। তাহলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে তো কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। তাছাড়া আমাকে যেহেতু কাছের মানুষ ভাবো.. সেহেতু আমার কথাটা রাখো। আমাদের সকলের সামনে আবারও বিয়েটা করে ফেলো। আমি সবাইকেই তোমার সমস্যার কথা বলেছি। আমরা আছি তোমাদের পাশে। উল্লাসীকে কেউ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। আর না উল্লাসীর বাবার ভয়ে তোমার নিজের বউকে দুঃসম্পর্কের বোন বলতে হবে!”
আবারও উপস্থিত সকলেই খিলখিল করে হেসে উঠতেই তাদেরকে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকার। মেসবাহকে তাড়া দিতে বললো,
-“হাসানকে পাঠিয়েছি কাজী ডাকতে। এলো বুঝি ও! যাও তাড়াতাড়ি তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমরা এদিকে উল্লাসীকে তৈরি করে দেই। বাচ্চা মেয়ে! সবটা সামলে নিতে পারবে না।”
নড়লো না মেসবাহ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। নতুন বলা মিথ্যেটি আবারও কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে?
পুরো ফ্ল্যাটজুড়ে লোকজনের সমাগমে গমগম করছে। কিছুক্ষণ হলোই পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে এসে বরবেশে নীরবে বসে সকলের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে যাচ্ছে মেসবাহ। বিয়ে করা বউকে আরো একটিবার বিয়ে করাই যায়। এ আর তেমন কী কঠিন কাজ! তবে একটি বিষয় প্রচুর ভাবাচ্ছে তাকে। যে মেয়েকে কিছুদিন আগেই একরকম বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছে সে, ভাগ্যের পরিহাসে আজ তাকে আরও একটিবার বিয়ে করতে হচ্ছে। তবে সেদিনের মাঝে এবং আজকের মাঝে প্রচুর তফাৎ। সেদিন মনে বাবাকে নিয়ে একরাশ ভয় কাজ করলেও আজ তা কাজ করছে না। আজ শুধুই কাজ করছে একরাশ ভালোলাগা। উপভোগ করছে সে সময়টিকে। যদিও খানিকক্ষণ আগে এর ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। হ্যাঁ, সে মুখোমুখি হতে চায়। দেখতে চায়, এবারের বলা মিথ্যেটি কোথায় নিয়ে যায় তাকে।
-“১৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি রহমান নিয়াজির জ্যেষ্ঠ কন্যা আঞ্জুমান আরা উল্লাসী, আলাউদ্দিন শেখের মধ্যম পুত্র মেসবাহ শেখের সাথে বিবাহে রাজি থাকলে বলুন ‘কবুল’।”
আঁড়চোখে পাশে বসা উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি পড়েছে সে। মাথায় গুঁজে দিয়েছে ঘোমটা। যার দরুন উল্লাসীর মুখটা নজরে আসছে না তার। কী চলছে মেয়েটি মনে? নিশ্চয় ভয় পাচ্ছে সে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে সকলের চোখের অগোচরে উল্লাসীর হাত আঁকড়ে ধরলো মেসবাহ। তারপর তাতে হালকা চেপে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“বলো, উল্লাসী। আমি তো আছিই।”
ভরসার হাতের সন্ধান পেয়ে মনের ভেতরে চলা আতংক কমে গেল উল্লাসীর। জোরে চেপে ধরলো সে মেসবাহর হাত। তারপর ধীর গলায় বললো,
-“কবুল..”
মেয়ের মুখে তিনবার কবুল শুনে এবারে কাজী এলেন মেসবাহর দিকে। সময় নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,
-“১৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি আলাউদ্দিন শেখের মধ্যম পুত্র মেসবাহ শেখ, রহমান নিয়াজির জ্যেষ্ঠ কন্যা আঞ্জুমান আরা উল্লাসীর সাথে বিবাহে রাজি থাকলে বলুন ‘কবুল’।
সময় নিল না মেসবাহ। সাথেসাথেই জোর গলায় বললো,
-“কবুল স্কয়ার। কিন্তু কাজী সাহেব মাইনাসে মাইনাসে যেমন ‘প্লাস’ হয়ে যায় তেমন এক মেয়েকে দুইবার বিয়ে করলে কবুলে কবুলে কি তা ‘না কবুল’ হয়? বা বিয়ে ভেঙে যাবার কোনো চান্স থাকে?”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৬
পুরো ঘরজুড়ে বিরাজ করছে শুভ্রতা। ফুলের সৌরভে চারিপাশটা ম ম করছে। চারিদিক থেকে অদ্ভুত এক শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগছে। পুলকিত মনে বিছানায় এসে বসলো মেসবাহ। তাকালো খানিকটা দূরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা উল্লাসীর দিকে। মেয়েটির মুখে উজ্জ্বল এক আভা ফুটে উঠেছে। এইরূপে দারুণ দেখাচ্ছে তাকে। তাদের প্রথম বিয়ের দিনেও কি উল্লাসীর মুখে একই আভা ফুটে উঠেছিলো? হয়তোবা। তবে সেদিন তা নজরে আসেনি। অপার্থিব এক পরিবর্তন ঘটেছে তার নিজের মাঝে। আজ খুব করে ইচ্ছে করছে বয়সের ব্যবধান ভুলে উল্লাসীর প্রতি প্রত্যাশা রাখতে। ধীরস্থির ভাবে তাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে। তবে একদিন না একদিন তো বড় হবে উল্লাসী। সব কিছু বুঝতে শিখবে। সেসময় যদি বেঁকে বসে সে? নিজের জীবনে আর তার প্রয়োজন বোধ না করে! তখন? তখন কী অন্যায় করা হবে না মেয়েটির সাথে? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। নিজের চিন্তাভাবনা সংযত করে ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা টেনে সে বললো,
-“গরম লাগছে না?”
মুখ তুলে মেসবাহকে দেখামাত্র উল্লাসী এগিয়ে এল তার দিকে। মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিয়ে বললো,
-“উহু.. রাতে আপনি খেয়েছেন?”
-“খেয়েছি.. তুমি?”
-“আমিও খেয়েছি। একটা সত্যি কথা বলুন তো। মুন্নি ভাবির রান্না আপনার ভালো লাগে নাকি আমার হাতের রান্না?”
-“তোমার।”
-“আমি জানতাম! আমি জানতাম আপনি এটাই বলবেন।”
-“তাহলে প্রশ্ন করলে কেনো? যেহেতু জানাই ছিল!”
-“মুন্নি ভাবি জিজ্ঞেস করতে বলেছিলো বলে। ভাবি যে আজ ইলিশ মাছ ভাজি করেছিলো ওটায় কিন্তু ভাবি লবণ দেয়নি। আপনি খেয়ে বুঝেছিলেন?”
-“বুঝেছিলাম…”
-“আমিও বুঝেছিলাম। কিন্তু কিছু বলিনি।”
-“গুড.. ভালো কাজ করেছো।”
বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের আলো নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে আবারও বিছানায় এল মেসবাহ। পা উঠিয়ে আরাম করে বসে বললো,
-“তুমি গ্রামের মেয়ে হয়েও যথেষ্ট শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো। ব্যপারটি প্রথম আমায় বেশ ভাবিয়েছে। অনাও এভাবে কথা বলেনা যেভাবে তুমি বলো। দারুণ লাগে শুনতে।”
হাসলো উল্লাসী। উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
-“আমার মা শিখিয়েছে।”
-“তোমার মার পড়াশোনা কতদূর?”
-“জানি না। তবে অনেক পড়েছে। পড়তে পড়তে বাবার সাথে বিয়ে হয়ে যাবার পর আর পড়েনি।”
-“তোমার বাবামায়ের কাহিনী টা কী বলোতো! কিভাবে কী হলো উনাদের মাঝে? ঢাকা থেকে সব ছেড়েছুড়ে সরাসরি গ্রামে!”
-“আমিও খুব বেশি জানি না। তবে মার মুখে যেটুকু শুনেছি তাতে মার বাবারা ছিল অনেক বড়লোক। মা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বাবাকে নতুন ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেয় নানা। মাকে নিয়ে যাওয়া আসাই ছিল তার প্রধান কাজ। দীর্ঘদিন এভাবে চলার পর মা বুঝতে পারে উনি বাবাকে পছন্দ করে। তার ধীর স্বভাব, তার মুখের হাসি, তার নীরবতা.. সবটাই নাকি মাকে খুব করে টানতো। আমার বাবাকে দেখেছেন তো আপনি। সুন্দর মনে হয়নি আপনার?”
মাথা নেড়ে উল্লাসীর কথায় সম্মতি জানাতেই আবারও সাদাকালোর দুনিয়ায় নিজের বাবামাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ শুরু করলো উল্লাসী। বেশ লাগে তার এই গল্পটি সকলের কাছে শুনাতে। তবে আজকাল আর এগল্প কেউ শুনতে চায়না। শুনলেও বা নাক শিটকোয়। তবে আজপর্যন্ত তাদের এই অদ্ভুত কাজকর্মের কোনো ব্যখ্যা খুঁজে পায়নি সে।
-“মা একদিন হুট করেই বাবাকে বলে সে বাবাকে বিয়ে করতে চায়। সবশুনে বাবার নাকি একঘন্টার মতো কোনো মুখের জবান ছিল না। হাস্যকর না ব্যাপারটি?”
-“হ্যাঁ.. তারপর?”
-“তারপর আর কী? বাবা রাজি ছিল না ওদিকে মাও ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না। ঠিকই নিজের মায়াজালে বাবাকে আটকে ফেলে মা। এসব কিন্তু আমি না, মা বলেছে।”
বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। তারপর বললো,
-“বুঝেছি.. তারপর?”
-“তারপর যখন মায়ের বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে, তখন বাবাকে হুট করেই বিয়ে করে ফেলে মা। নানাকে জানায় তবে সে মেনে নেয় না। বের করে দেয় বাড়ি ছেড়ে। ঘুড়েফিরে গ্রামে মাকে নিয়ে ফিরে আসে বাবা। তারপর আসি আমি.. মা আমাকে কী বলতো জানেন?”
-“কী?”
-“আমি নাকি তাদের ভালোবাসার ফসল বুনতেই পৃথিবীতে এসেছি। আমিও তখন মাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম, কোথায় মা? ফসল তো বুনছে বাবা। আমি তো ফসল বুনছি না। মা আমার তখন হেসে কুটিকুটি হতো।”
গলা হঠাৎ ধরে এল উল্লাসীর। চোখভর্তি জল নিয়ে বিছানার চাদরে দৃষ্টি স্থির করে আবারও বললো,
-“মা যেদিন মারা যায় সেদিনও মা আমার চুল বেঁধে দিয়েছিলো। কপালে চুমু দিয়ে বলেছিল, বলতো আমাদের ভালোবাসার ফসল বুনতে তোর ভাই আসছে না বোন? আমি বলেছিলাম, বোন। ওকে আমি খুব আদর করবো মা। সারাদিন নিজের কোলে রাখবো। মা বলেছিল, আর পড়াশোনা? আমি বলেছিলাম, গোল্লায় যাক!”
স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলো না মেসবাহ। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো উল্লাসীর দিকে। ওদিকে উল্লাসী বলার উপরেই রয়েছে,
-“আশেপাশের সবাই বলছিলো, মারে শেষ দেখা দেইখা দে। আর কখনোই আসবো না তোর মা। আমিও খুব করে শেষ দেখা দেখে নিয়েছিলাম সেদিন। মার ঘুমন্ত মুখে হাজার হাজার চুমো দিয়েছিলাম। চিৎকার করে কেঁদে বলেছিলাম, মা আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না.. যেতে পারে না।”
উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলো উল্লাসী। পাঁচ বছর আগের সেই দৃশ্য আজও স্পষ্ট দেখতে পায় সে। সাথেসাথেই বুকের ভেতরটায় অসহ্য যন্ত্রণা হয় তার। মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, মুখে চুমো দিতে ইচ্ছে করে। তবে কোথায় পাবে সে তার মায়ের দেখা!
-“আমি মায়ের আদর পেয়েছি, কিন্তু আমার বোন তা পায়নি। কথা বলতে, ভালোভাবে চলতে না পারলেও ও যে মায়ের আঁচল খুঁজে বেরায় তা আমি খুব বুঝি। ওর কষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। আপনি তো ডাক্তার.. সব কিছুর ঔষধই আপনার কাছে আছে। আমার বোনটাকে ভালো করে দেবেন আপনি? ওর কষ্ট কমিয়ে দেবেন?”
বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো মেসবাহর। এপরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিৎ ভেবে পেল না সে। তবে মেয়েটির কান্নার বেগ ধীরেধীরে বাড়ছে। কিছু একটা করা উচিৎ তার…
-“ছোটমা কথা দিয়েছে আমায়।আপনাকে বিয়ে করলে ছোটমাও খোকনের মতোই আদর করবে সুহাকে। সুহাও মায়ের আদর পাবে। আমি তো বিয়ে করেছি আপনাকে। কিন্তু ছোটমা কী তার কথা রেখেছে? যে মেয়েটি আমায় ছাড়া একদন্ড থাকতে পারতো না, সেই মেয়েটি আজ আমায় ছাড়া কী করে থাকে বলতে পারবেন? আমি ছাড়া ওর দুনিয়ায় আর কেউ নেই। প্রতিবন্ধী বলে কেউ ওকে ভালোবাসে না, কেউ আদর করে কাছে টেনে নেয় না। কী দোষ ওর? বলুন না..”
এগিয়ে এসে উল্লাসীকে নিজের বুকে আঁকড়ে নিল মেসবাহ। মেয়েরটির বলা একেকটি কথা তার বুকে এসে বিঁধছে তীরের মতো। মেয়েটির মা নেই ভাবতেই বুকের ভেতরটায় শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। মায়া হচ্ছে মেয়েটির জন্য। নাম না জানা এক কষ্ট বারবার এসে গলা চেপে ধরছে।
-“ওর কেউ নেই। ওকে কেউ আদর করে না। বাবাও না.. বাবাও ওকে আদর করে না। আমার কত কষ্ট হয় জানেন?”
-“জানি..”
-“জানেন না। আপনি জানেন না। কেউ জানে না।”
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেসবাহ বললো,
-“ঠিকাছে। কেউ জানে না। একটু শান্ত হও তুমি।”
মেসবাহর মমতাময়ী স্পর্শে ধীরেধীরে শান্ত হয়ে এল উল্লাসী। তবে খানিকটা ফোঁপানি রয়েই গেল। মেয়েটির নীরবতা যতটা ভালোলাগে, ততটাই কষ্ট হয় মেয়েটির কান্নামাখা মুখ দেখলে। বুকের ভেতরটায় উথালপাথাল শুরু হয়, অস্থির লাগে। উল্লাসী কি বোঝে তার এই অস্থিরতার কারণ? নিজের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে দু’হাতের আঁজলে মেসবাহ তুলে ধরলো উল্লাসীর মুখ। মৃদু আলোয় মেয়েটির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছে। কী আছে তার ওই দুই চোখে? প্রশ্নের জবাব না পেলেও নিজের ঠোঁটজোড়া নিয়ে সে ঠেকালো উল্লাসীর কপালে। চোখজোড়া বুজে সময় নিয়ে তাতে এঁকে দিল স্নেহের স্পর্শ।
-“সেদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবা মাকে যতটা ভালোবাসতো আপনিও কি আমায় ততোটাই ভালোবাসেন? কিন্তু আজ বলছি, আপনি কখনোই আমাকে সেভাবে ভালোবাসবেন না, যে ভালোবাসা আমি হারিয়ে গেলেই ফুরিয়ে যাবে। আপনি আমাকে সেভাবেই ভালোবাসবেন, যে ভালোবাসায় আমি মার মতো হারিয়ে গেলেও ছোটমার মতো কেউ কখনোই আসবে না।”
বুকচিরে আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। ঠোঁটজোড়া উল্লাসীর কপাল থেকে উঠিয়ে বালিশে মাথা গুঁজলো সে। ভাগ্য তাকে একোন স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? যার একূল অকূল দুকূলই ঘন আঁধারময়।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত উল্লাসীকে আগাগোড়া লক্ষ্য করলো মুন্নি সরকার। তারপর ভ্রু নাচিয়ে বললো,
-“গোসল দাও নি?”
-“উহু.. বাড়িতে আম্মা সকালে গোসল দিতে বললেও উনি তো আমাকে সকালে গোসল করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।”
-“কে? মেসবাহ?”
-“হ্যাঁ…”
উদ্বিগ্ন মনে প্রশ্নের হাঁড়ি খুলে বসলো মুন্নি সরকার। মেসবাহ কেনো উল্লাসীকে সকালে গোসল করতে নিষেধ করবে? এটুকো বোঝার বয়স তো মেসবাহর হয়েছে৷ তাহলে কী তেমন কিছুই হয়নি দুজনের মাঝে? পরমুহূর্তেই নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই করে নিল মুন্নি সরকার। কেনো হবে না ওসব? তাহলে প্রেম করে বিয়ে করেছে কী কাজে? অবশ্যই রান্নাবান্না করে শুধু খাওয়ানোর কাজে তো নয়। তবুও নিজের মনে চলা প্রশ্নোত্তরের পাঠ চুকাতেই উল্লাসীকে নিজের কাছে এনে বসালো মুন্নি সরকার। একদন্ড ভেবে ক্ষীণ গলায় বললো,
-“তোমায় মেসবাহ আদর করে?”
মাথা নেড়ে তাতে সম্মতি জানিয়ে উল্লাসী বললো,
-“করে তো।”
-“কোথায় কোথায় করে?”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“আদর আবার জায়গায় জায়গায় করা যায় নাকি!”
-“যায় তো.. জানো না?”
-“উহু..”
মনের ভেতরে চলা সন্দেহ আরও জোরজার হলো মুন্নি সরকারের। উল্লাসীর দিকে চেয়ে আগ্রহী গলায় বললো,
-“মুখে, গলায়, ঠোঁটে আলাদা আলাদাভাবে পুরো শরীরেই তো স্বামীরা আদর করে। কেনো? তোমায় মেসবাহ এভাবে আদর করে না?”
চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে উল্লাসী জবাব দিল,
-“না তো।”
পুরো ব্যপার বোধগম্য না হলেও এর কারণ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলো মুন্নি সরকারের মন। কেন করবে না মেসবাহ এসব? সে যতটুকু মেসবাহকে চেনে জানে তাতে অত্যন্ত ভদ্র সুলভ একজন ব্যক্তি সে। কথাবার্তা খুব একটা না বললেও অত্যন্ত আন্তরিক। এবং ডাক্তার হবার সুবাদে প্রচুর স্বাস্থ্য সচেতন। তাহলে কী ঠিক একারণটাই তাদের ভালোবাসার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে? মেসবাহ উল্লাসীকে এতটাই বাচ্চা ভাবে যে পারলে তাকে এখনি ধরে ফিডার খাওয়াবে! সেখানে বাচ্চা একটি মেয়ের সাথে মেসবাহর মতো ছেলে এসব করতে অবশ্যই দশবার ভাববে। কারণ খুঁজে পেয়ে বেস উচ্ছ্বসিত হলো মুন্নি সরকার। উল্লাসীর দিকে আবারও ফিরে সে ফিসফিস করে বললো,
-“আমার কথা মন দিয়ে শুনো। আমি যা বলবো তাই করবে। কী? করবে তো?”
শুক্রবার হওয়ায় বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠলো মেসবাহ। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে এসে বসে জোর গলায় কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকতেই রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। টেবিলে গোছানো সব খাবারের দিকে ইশারা করে বললো,
-“সব মুন্নি ভাবি দিয়ে গেছে।”
-“আশ্চর্য! সে আবার কেনো দিয়েছে এসব? তুমি নিষেধ করোনি?”
-“উহু..”
-“এটা কী ঠিক করেছো?”
-“কী যে!”
আর কথা বাড়ালো না মেসবাহ। থালায় খিচুড়ি উঠিয়ে মাংসের ঝোল নিয়ে মুখে পুড়তে শুরু করলো একের পর এক।
খাবার শেষে মেসবাহ ড্রয়িংরুমে এসে বসতেই তার পিছুপিছু এল উল্লাসী। পাশে বসে নরম গলায় বললো,
-“আপনি আমায় আদর করেন না কেনো?”
প্রশ্ন শুনে বড়সড় একটি ধাক্কা খেলো মেসবাহ৷ চোখজোড়া প্রশস্ত করে বললো,
-“মানে?”
-“মানে আপনি আমায় কেনো আদর করেন না? স্বামী তো তার স্ত্রীকে অনেক জায়গায় আদর করে। আপনি কেনো আমায় করেন না?”
ওপাশ থেকে মেসবাহর কোনো জবাব না পেয়ে উল্লাসী আবারও বললো,
-“মুখে, ঠোঁটে, গলায় আলাদা আলাদাভাবে পুরো শরীরেরই তো স্বামীরা আদর করে। তাহলে আপনি কেনো করেন না? একটু সবজায়গায় আদর করলে কী এমন হয়?”
ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। আশেপাশে নজর বুলিয়ে ধীর গলায় বললো,
-“কাল রাতে তো করলাম। ঐযে কপালে…”
-“ওটা তো চুমু ছিলো।”
-“আরে পাগলি! চুমু আদর একই।”
একমুহূর্ত ভেবে মুন্নি সরকারের বলা কথাগুলো স্মরণ করলো উল্লাসী। তারপর আহ্লাদী গলায় বললো,
-“তাহলে এখনি ঠোঁটে একটু আদর করে দিন..”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। দ্রুত পায়ে সদর দরজার দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“সর্বনাশ! আমি ফোন করেছিলো, না মানে লিমন ফোন করেছিলো। দেখা করে আসি। লিমন লাগাও। না মানে.. ইশশ! দরজা লাগাও।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৭+১৮
শুভ্র বিকেলের সঙ্গে মেঘেদের প্রণয়.. আজ কয়েকদিন যাবৎ প্রচুর দেখা যাচ্ছে। বিকেল শুরু হতে না হতেই মেঘেরা এসে ভীড় জমায় দূর ঐদেশে। যার কারণে রোজ ঠিকমতো প্রাইভেট পড়তেও যাওয়া হচ্ছে না। তবে আজ চৈতালি এসে উপস্থিত হওয়ায় শান্তির বিছানা ছেড়ে উঠতেই হলো অনাকে। ঝটপট জামা বদলে চুলে চিরুনি বোলাতে বোলাতে বললো,
-“আজ না গেলে হয় না?”
-“উহু.. হয় না। দ্রুত কর তো।”
ব্যাগে ম্যানেজমেন্টের একটি খাতা ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। পড়তে তার ভালোলাগে না.. তবে সবাই বলে পড়। প্রেম করতে ভালোলাগে.. অথচ কেউ বলেনা প্রেম কর। অদ্ভুত না? না পড়ে প্রেম-ভালোবাসায় মগ্ন থাকলে বুঝি জীবনে সুখী হওয়া যায় না?
-“তোর কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানে কিরে?”
হঠাৎ অনার প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে গেল চৈতালির। তীক্ষ্ণ গলায় সে বললো,
-“তুই কি প্রেমে পড়েছিস?”
-“ধুর! বল না!”
-“কী বলবো?”
-“তোর কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানে কী?”
থেমে পড়লো চৈতালি। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ভালোবাসা কিছুটা এক পাক্ষিক। এক পক্ষ থেকে কাওকে নিঃস্বার্থ ভাবে চাওয়া, তার ভালোলাগাকে নিজের ভালোলাগা বানিয়ে নেয়ার নামই ভালোবাসা। আর প্রেম দু’পক্ষের সেই ভালোবাসার সমন্বয়।”
-“দারুণ এক লজিক দিয়েছিস তো। তা এসব কোত্থেকে জানলি? কাওকে কখনো ভালোবেসেছিস?”
-“তাহলে কী তোকে জানাতাম না?”
চৈতালির কথার পিঠে কথা বাড়ালো না অনা। আবারও হাটতে শুরু করলো রাস্তা ধরে। সামনেই বড় বাজার। বড় বাজারেই ছোট একটি ঘর নিয়ে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের পড়ান সবুজ স্যার। স্যারের বয়স খুব একটা বেশি নয় এবং এখনো অবিবাহিত। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, স্যার পছন্দ করে চৈতালিকে। সকলের অগোচরে প্রায়ই চৈতালির দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি দেয়। যেনো তার শরীরের প্রতিটি অংগসমূহ সর্বক্ষণ লজ্জায় ভরপুরই থাকে। ঠোঁট চেপে নিজের হাসিকে নিয়ন্ত্রণে আনলো অনা। তারপর চৈতালির কাঁধে হাত রেখে গলি ধরে এগুতেই নজরে এলো এমাদ। সাথেসাথেই তার মনজুড়ে খেলে গেল খুশির জোয়ার।
-“তুই যা.. আমি আসছি।”
-“কেনো? তুই কই যাবি?”
-“আরে তুই যা না! আমি আসছি তো..”
বেশ জোর করেই চৈতালিকে সামনে এগুতে বলে পেছন ফিরলো অনা। কয়েক কদম এগিয়ে এসে এমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মুখের সিগারেট নিজের হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“সিগারেট খাচ্ছিলে কেনো?”
মৃদু হাসলো এমাদ। দেয়ালের সাথে নিজের শরীর ঠেসে দাঁড়িয়ে বললো,
-“তোমার দেখা না পেয়ে বোর হচ্ছিলাম। তাই আরকি…”
মুখ ভেংচি কেটে অনা বললো,
-“তোতার তেখা তা তেয়ে তোর তত্তিলাম… না? আজ যদি না আসতাম, তখন কী হতো? তখন কী সিগারেটের ফ্যাক্টরি খুলে বসতে?”
-“আরে না.. কী যে বলো!”
-“কিছুই বলি না। চুলে চিরুনি লাগাওনি না? এলোমেলো চুলেই বেরিয়ে পড়েছো?”
-“হুম..”
-“দাঁড়াও।”
আশেপাশে তাকিয়ে লোকজনের উপস্থিতি দেখে এমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে চুল গুলো ঠিকঠাক করলো অনা। তারপর তার গাল টেনে বললো,
-“ওরে আমার প্যাঁচাটা! এখন দেখো কত সুন্দর লাগছে দেখতে! তা তুমি এখানে কতক্ষণ হলো এসেছো?”
-“এই দশ মিনিট..”
-“এই দশ মিনিটে এই রাস্তা দিয়ে কয়টি মেয়ে গেছে?”
-“আমি কী করে বলবো!”
-“তুমি সেভাবেই বলবে যেভাবে তাদের ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখেছো!”
-“আমি তো ওসব দেখিনি।”
-“মিথ্যে..”
-“সত্যিই।”
-“তিন সত্যিই?”
-“চার সত্যি। এবার বিশ্বাস হলো তো?”
-“কচু হয়েছে। আমি যাচ্ছি।”
-“সিগারেটটা তো দিয়ে যাও!”
-“এই সিগারেট এখন আমি খাবো।”
বলেই দৌড়ে সামনে এগুলো অনা। তার যাত্রা পথের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো এমাদ। তারপর উঁচু স্বরে বললো,
-“এই অনা। অনা… কাল কিন্তু কলেজের সামনে থাকবো। জলদি এসো…”
লিমনের সাথে ফোনে কথা বলে মাথায় চিরুনি লাগিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে তা লক করলো মেসবাহ। তারপর জোর গলায় কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকতেই বেরিয়ে এল সে মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাট ছেড়ে। নীল শাড়িজমিনের মাঝে সাদা রঙের সুতোর কাজের একটি শাড়ি পড়েছে সে। সোজা পিঠসমান চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে রেখেছে। সাথে কানের একপাশটায় সাদা ফুল গুঁজে দিয়েছে। ঠোঁট ভর্তি করে লাগিয়েছে টকটকে লাল লিপস্টিক, চোখে এঁকেছে গাঁঢ় কাজলের রেখা। অপূর্ব সুন্দর লাগছে। ঈদের দিনটিতেও কি ঠিক এতটাই অপূর্ব দেখাচ্ছিলো উল্লাসীকে? হয়তোবা। তবে কেনো সেদিন তা নজরে আসেনি তার?
-“নাও.. তোমার বউকে সাজিয়ে দিলাম।”
মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য সূচক একটি হাসি দিল মেসবাহ। তারপর এগুলো লিফটের দিকে। এই মহিলা উল্লাসীকে বড্ড পাকামো শেখাচ্ছে। সকালে উল্লাসীর হঠাৎ ওমন আচারণে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো সে। তবে শুক্রবারের নামাযের কথা ভেবে খানিক পরে আবারও ফিরে আসায় উল্লাসীর সেই অদ্ভুত আবদার আবারও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন ভর সেই একই কথা বলে বলে জ্বালিয়ে মেরেছে তাকে। এই মেয়ে যে বড় অবুঝ তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। তবে অবুঝেরও তো একসময় বুঝ হয়, তা এর কবে হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসবাহ লিফটের বোতাম চেপে সরে দাঁড়াতেই তার গা ঘেষে দাঁড়ালো উল্লাসী। চোখজোড়া বুজে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ভেতরে টেনে নিয়ে বললো,
-“মাথা ঘুরছে আমার।”
উল্লাসীর হাত আঁকড়ে জোরে একটি চাপ দিল মেসবাহ। তারপর নরম স্বরে বললো,
-“আমি তো আছি.. চোখ খোলো।”
-“মাথা ঘোরে..”
-“চোখ বন্ধ করে রাখলে তো মাথা ঘুরবেই। আমার দিকে তাকাও। আমার সাথে কথা বলো। দেখবে কিছুই ফিল হবে না.. এই মেয়ে, চোখ খোলো।”
সময় নিয়ে উল্লাসীকে পর্যবেক্ষণ করলো লিমন। এরপর মেনুকার্ড হাতে নিয়ে বললো,
-“কী খাবি বল?”
-“নরমাল কিছু অর্ডার কর। যাতে উল্লাসীর জন্য খেতে সুবিধা হয়।”
বলেই পাশ ফিরে উল্লাসীর দিকে নজর দিল মেসবাহ। ক্ষীণ গলায় বললো,
-“খারাপ লাগছে?”
-“উহু..”
-“তাহলে কথা বলছো না যে!”
মেসবাহর হাতের আঙুলের মাঝে নিজের আঙুল ডুবিয়ে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো উল্লাসী। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“অস্থির লাগছে…”
-“কেনো? আমি তো আছি..”
-“কী গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিস দুজনে?”
লিমনের প্রশ্নে মৃদু হেসে মেসবাহ বললো,
-“কিছু না.. অর্ডার করেছিস? দ্রুত ফিরতে হবে।”
-“করলাম তো। তা ছুটির দিনে বউকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েও তোর তাড়াহুড়ো? বড্ড বেরসিক মানুষ তুই! উল্লাসী, আমার এই বেরসিক বন্ধু তোমাকে খুব জ্বালায়… না?”
-“চুপ করতো। এসব কী বলছিস?”
-“আরে ব্যাটা তুই চুপ কর। আমাকে আর উল্লাসীর সঙ্গে কথা বলতে দে। তো যা বলছিলাম, মেসবাহ তোমাকে খুব জ্বালায়?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী অসম্মতি জানাতেই ফের প্রশ্ন করলো লিমন।
-“তাহলে কি তুমি জ্বালাও?”
-“না.. আমি কেনো উনাকে জ্বালাবো?”
-“তাই তো! তুমি তো আর ছোট বাচ্চা নও। তবে আমার বন্ধু কিন্তু তোমাকে বাচ্চাই ভাবে। পারলে তোমাকে কোলে করে পুরো দুনিয়া ঘুরলে বাঁচে!”
খিলখিল করে হেসে উঠলো উল্লাসী। লোকটি তো বেশ মজার!
-“তুমি হাসছো? আর আমি কাঁদি.. ভাবি আমার একটা বাচ্চা বউ হলে কী হতো!”
-“আপনার বউ আছে?”
-“থাকবে না? আছে আছে.. বউ আমার বাচ্চা নয়। বুড়ো বউ।”
পাশ থেকে কপাল কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“এই.. তুই কী শুরু করলি! থাম তো এবার!”
-“তুই চুপ করতো.. এই উল্লাসী, আমাকে ভালো করে দেখো তো! কী.. দেখেছো?”
একমুহূর্ত লিমনকে দেখে উল্লাসী বললো,
-“হ্যাঁ..”
-“আমাকে দেখে কী মনে হলো তোমার?”
-“কিছুই তো মনে হয়নি।”
-“সুন্দর অসুন্দর কিছুই না?”
-“হয়েছে। সুন্দর মনে হয়েছে।”
-“গ্রেট। এবার মেসবাহর দিকে তাকাও। তারপর বলো, আমাদের দুজনের মাঝে কে বেশি ফর্সা?”
সময় নিল না উল্লাসী। সাথেসাথেই বললো,
-“আপনি।”
-“তার মানে মেসবাহর চেয়ে আমিই সুন্দর৷ এই তো?”
আবারও পাশ থেকে কপাল কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“এসব কী শুরু করলি তুই?”
-“চুপ কর তো তুই। আচ্ছা উল্লাসী.. তোমার পাশে মেসবাহ না থেকে আমি থাকলে কেমন হতো? সেই হতো না?”
উল্লাসীর জবাব দেবার আগেই উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। শক্ত গলায় লিমনকে বললো,
-“এদিকে আয়। কথা আছে।”
-“কী কথা? এখানেই বল! সুন্দরী ভাবিকে ফেলে তো উঠতে মন টানে না!”
-“ব্যাটা তুই উঠবি?”
মেসবাহ ক্ষেপেছে বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ালো লিমন। দু’হাতজোড়া প্যান্টের পকেটে গুঁজে ধীরেসুস্থে এগুলো মেসবাহর পিছুপিছু।
-“তুই কী করছিস এসব?”
আকাশ থেকে পড়ার ভান করে লিমন বললো,
-“কী?”
-“বুঝিস না কী? আমার বউ, আমি তার পাশে.. অথচ তুই কিনা নিঃসংকোচে ফ্লার্ট করে যাচ্ছিস!”
মেসবাহর কথার তাল না দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে ক্ষীণ গলায় গেয়ে উঠলো লিমন,
-“তোমার কেনো জ্বলেরে বন্ধু তোমার কেনো জ্বলে? তোমার বাচ্চা বউ কারো হলে, তোমার কেনো জ্বলে?”
-“তুই কিছু বললি?”
-“উহু.. গান গাইছি। গান”
-“বাজে বকিস না তো! আমার কোথাও জ্বলে না। আমার জ্বলবে কেনো শুধুশুধু?”
ফোন আবারও পকেটে পুড়ে মেসবাহর কাঁধে হাত রাখলো লিমন। পাশ ফিরে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বউ তোর কোনো দিক থেকেই বাচ্চা নেই। এমন সুন্দর একটা বউ পাশে রেখে তুই ঘুমাস কেমনে? বলিকি.. এসব জ্বলাজ্বলি বন্ধ করে এবার তোর বাচ্চা বিড়ালটা মেরেই ফেল।”
বলেই মেসবাহর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো লিমন। যাক! কাজে দিয়েছে। ব্যাটা প্রচুর ক্ষেপেছে। এতই ক্ষেপেছে যে খানিকক্ষণ এভাবে থাকলে ফুলে ফেঁপে বেলুন হয়ে আকাশে উড়াল দেবে। একগাল হেসে মেসবাহর কাঁধে চাপড় দিল লিমন। তারপর কোমল গলায় বললো,
-“জোক্স আ পার্ট। চলো বন্ধু, সুন্দরী ভাবি আমার অপেক্ষা করছে। ভাবির কাছেই যাই।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৮
সময়ের সাথে মানুষের অভ্যাস বদলে যায়, ভালোলাগাগুলো পাল্টে যায়। ছাত্র অবস্থায় একসময় রাতের এই ঢাকায় রিকশা নিয়ে এলোমেলো ভাবে ঘোরা হতো। তবে আজকাল নানান দায়বদ্ধতায় বাঁধা পড়ায় তা আর হয়ে উঠে না। কেনো যেনো আগের মতো ইচ্ছেও করে না। কিন্তু আজ করছে। সারাটা রাত রিকশায় করে উল্লাসীর পাশে বসে পুরো ঢাকায় ঘুরতে ইচ্ছে করছে। উল্লাসীর কোমরে হাত চাপিয়ে তাকে নিজের দিকে টানতে ইচ্ছে করছে৷ ইচ্ছে করছে মৃদু বাতাসের ছোঁয়াকে উপেক্ষা করে উল্লাসীর চুলের মাঝে নাক ডোবাতে। দেবে কি সে তাকে এসবের অনুমতি? বাতাসে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতের সিগারেট ফেলে দিল মেসবাহ। তারপর পাশে তাকিয়ে বললো,
-“রাতের ঢাকা অপরূপ সুন্দর না?”
-“হ্যাঁ.. বেশ লাগছে আমার।”
-“আগামী শুক্রবার আবার বেরুবো।”
চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো উল্লাসীর। ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-“সত্যিই?”
-“হ্যাঁ.. তবে সেদিন লিমন থাকবে না।”
-“শুধু আপনি আর আমি?”
-“হ্যাঁ।”
-“ঠিকাছে।”
ফুটপাতের রাস্তার দিকে নজর দিল মেসবাহ। লিমন আজ যথেষ্ট জ্বালিয়েছে তাকে। এটাসেটা নানান কথাবার্তার মাঝে ফুটিয়ে তুলেছে, উল্লাসী সুন্দর। এবং উল্লাসীর মতো সুন্দরী এক মেয়ের পাশে তার মতো সুদর্শন এক পুরুষকেই মানায়। বিষয়টি হয়তো হাসি ঠাট্টার হলেও একদম ভালোলাগেনি মেসবাহর। লিমনের স্ত্রীর সঙ্গে তো বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তার। তবে কখনোই এমন বিশ্রী রসিকতা তো করেনি সে। আর না কখনো করবে…
-“লিমনকে কেমন লাগে তোমার?”
হঠাৎ মেসবাহর এমন প্রশ্নে তার দিকে তাকালো উল্লাসী। সহজ গলায় বললো,
-“ভালোই তো লাগে। মানুষটা অনেক মজার।”
-“আর আমাকে?”
-“আপনিও ভালো.. তবে উনার মতো মজার নন।”
-“অহ। আচ্ছা.. লিমন কি সত্যিই আমার চেয়ে সুন্দর?”
-“হ্যাঁ.. উনি তো অনেক বেশি ফর্সা।”
মন অসম্ভব রকমের খারাপ হয়ে এল মেসবাহর। তবে এর ঠিক যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেল না সে। লিমন সুন্দর। এবং তার চেয়ে কয়েকগুনে বেশিই সুন্দর। উল্লাসী তো ভুল কিছু বলেনি! তাহলে শুধুশুধু খারাপ লাগছে কেনো তার? উল্লাসীর মুখে লিমনের প্রশংসা শুনে? লম্বা একটি দম ছেড়ে আরেকটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। চলন্ত রিকসায় বসে সিগারেট ফোঁকার মতো মজা এজীবনে আর কিছুতে আছে বলে আগে মনে হতো না। তবে আজ ভিন্ন কিছুর সুখ অনুধাবন করতে পারছে সে। এসুখ সকল সুখের উর্ধ্বে।
-“কিছু খাবে?”
-“উহু..”
সিগারেট শেষ করলো না মেসবাহ। আবারও তা রাস্তায় ফেলে শীতল গলায় বললো,
-“কেনো? ফুচকা, চটপটি বা আইসক্রিম.. কিছু একটা খাও।”
-“ঠিকাছে, খাবো। জানেন, অনা আপা যে কলেজে পড়ে তার সামনে রোজই ফুচকাওয়ালা ফুচকা, চটপটি নিয়ে আসে? তবে ছোটমা ওসব খাবার জন্য টাকা দিত না। আমি প্রায়ই দেখেছি ওসব, কিন্তু কখনো খাওয়া হয়নি।”
বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো মেসবাহর। ছোটমার কথা এর আগে অনেকবারই বলেছে উল্লাসী। তবে প্রায়ই তা উপেক্ষা করে গেছে সে। জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করা হয়ে উঠেনি। একজন সন্তান কতটা নিঃস্ব তার মাকে ছাড়া তা আজ খুব করে অনুভব করতে পারছে। বুকচিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট হালকা প্রশস্ত করলো মেসবাহ। তারপর বললো,
-“চলো.. আজ আমি খাওয়াই তোমাকে। মামা, রিকশা এক সাইড করে থামাও তো।”
চুলের ফুল খুলে বাসায় পড়ার জামা হাতে ওয়াশরুমে ঢুকলো উল্লাসী। অসম্ভব মজার ছিল আজকের বিকেল। প্রথমে অস্বস্তি হলেও পরবর্তীতে তা কাটিয়ে উঠে সময়কে বেশ উপভোগ করেছে। উচ্ছ্বাসে ভরপুর মনে মাথার চুলগুলো হাত খোপা করলো উল্লাসী। তারপর শাড়ি খুলতেই নজরে এল শাড়ির মাঝবরাবর লেগে থাকা দাগ। দ্রুত জামা বদলে কল ছেড়ে শাড়ি এবং পেটিকোট ধুয়ে ফেললো সে। ভাগ্যিস উনার নজরে পড়েনি এসব। নয়তো কেলেংকারী হয়ে যেত!
ব্যালকনিতে কাপড় মেলে ঘরে এল উল্লাসী। গ্রাম থেকে আনা কাপড়ের ব্যাগ খুঁজতে সে পা বাড়ালো পাশের ঘরের দিকে। ব্যাগপত্র এখনো যেভাবে আনা হয়েছিলো সেভাবেই রয়েছে ওঘরে। যখন যা দরকার পড়ে তা ব্যাগ থেকেই বের করা হয়। অবশ্য এতে নানান ঝামেলা পোহাতে হয় তাকে। কোনো কাপড় ঠিকঠাক ভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। যার দরুন পুরো ব্যাগের কাপড়চোপড় বের করতে হয়। এবং আবারও তা পুনরায় গুছিয়ে রাখতে হয়। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে ধীরেসুস্থে মেঝেতে বসলো উল্লাসী। তল পেটে হালকা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। যা কিছুক্ষণের মাঝে আরও বাড়বে। অসহনীয় এই ব্যথা নিয়ে আবারও তিন রাত জেগে কাটাতে হবে। ভাবতেই উল্লাসীর চোখমুখ ছোট হয়ে এল। কেনো এসব হয় মেয়েদের? এসব না হলে কী এমন ক্ষতি হতো তা হাজার ভেবেও মাথায় আসে না তার। কপাল কুঁচকে পুরো ব্যাগ হুলস্থুল করে খুঁজেও মাসিকে ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দেখা পেল না উল্লাসী। তাহলে কী সেসব নিয়েই আসেনি সে? মনে পড়ছে না। তবে বিয়ের আগের রাতে ছোটমার কথায় ব্যাগ গুছিয়েছিল সে। তাতে মোটামুটি তার সকল ব্যবহার্য জিনিসই উঠিয়েছিল। তাহলে এসব কিভাবে বাদ পড়ে গেলো?
রাত দশটার খবর শেষ করে সোফা ছেড়ে উঠলো মেসবাহ। এগুলো শোবার ঘরের দিকে। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর উল্লাসী একবারও আজ টেলিভিশন দেখতে ড্রইংরুমে আসেনি। বিষয়টি খানিকটা গোলমেলে লাগলেও টক শো দেখায় এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিল সে যে উল্লাসীর ব্যাপারটি মাথা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু করছে কী একা ঘরে মেয়েটি? এতক্ষণ যাবৎ একবারও যে দেখা মিললো না তার!
-“কী ব্যাপার? আজ তোমার ভূতেরা ভূতগিরী দেখাতে আসেনি নাকি? একাই ঘরে বসে রয়েছো যে!”
মেসবাহর প্রশ্নের জবাব দিল না উল্লাসী। বিছানায় গুটিসুটি মেরে দু’হাতে পেট চেপে চুপচাপ বসে রইলো। ওদিকে উল্লাসীর উত্তরের অপেক্ষা করে মেসবাহ এগুলো রান্নাঘরের দিকে। রাত অনেক হয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পালা এবার চুকাতে হবে। আসার সময় রাতের জন্য হালকা খাবার কিনে এনেছিল তারা। সেসব ফ্রিজ থেকে বের করে ডাইনিংয়ে রেখে জোর গলায় কয়েকবার উল্লাসীকে ডেকে উঠলো মেসবাহ। তবে ঘর থেকে উল্লাসীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কুঁচকানো কপাল নিয়ে মেসবাহ এগুলো তার খোঁজে।
-“কী ব্যাপার? আসছো না যে! খাবে না?”
এবারো জবাব দিল না উল্লাসী। আতংকিত মনে চুপচাপ বসে রইলো নিজের জায়গায়। বিছানা ছেড়ে উঠলেই সবটা দেখে ফেলবেন উনি। মাসিকে ব্যবহার্য জিনিসপত্রাদি না থাকার কারণে পুরো পায়জামা জামা লেপ্টে গেছে। বিছানার চাদরের অবস্থাও নাজেহাল। যেখানে এসব ব্যাপারে পুরুষদের সামনে টু শব্দ করাও পাপ সেখানে বিছানার চাদরের এঅবস্থা দেখলে কী হবে! ভেবেই ভয় লাগছে। এদিকে তল পেটের ব্যথায় অসহ্য লাগছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে ভেতরটা। তবে কিচ্ছুটি করার নেই। ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকতে যখন প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার পর পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছিল সে তখন বারবার ছোট মা বলেছিল, এই অসুখের ব্যাপারে তোর বাবারে বলবি না। এইটা একটা লজ্জার কথা। কোনো পুরুষ মানুষ এসব জানলে তোর পেটের ব্যথা আরও বাড়বো। মেয়েগো আল্লাহ এসব ব্যথা মুখ বুজে চুপচাপ সহ্য করার আদেশ দিছে.. বুঝছিস? তারপর থেকে মাসের পর মাস চুপচাপ মুখ বুজে অসহনীয় এই ব্যথা সহ্য করলেও ছোটমার নির্দেশ মেনে চলেছে সে। কখনোই কিচ্ছুটি জানায়নি বাবাকে। সেখানে উনাকে কিভাবে জানাবে?
-“কী হয়েছে উল্লাসী? শরীর খারাপ লাগছে?”
উল্লাসীর পাশে বসে তার কপালে হাত রাখলো মেসবাহ। তবে গাড়ে জ্বরের উপস্থিতি না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“জ্বর তো নেই।”
-“আপনি খেয়ে নিন। আমি খাবো না।”
-“কেনো? খাবেনা কেনো? এতবড় একটি রাত না খেয়ে কাটাতে পারবে?”
-“পারবো।”
-“পারবে না.. দেখি ওঠো।”
উল্লাসীর হাতের দিকে দৃষ্টি দিতেই মেসবাহর নজরে এল দু’হাতে পেট চেপে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে সে। চোখমুখে তার কোথাও একটি ভীতি ফুটে উঠেছে।
-“পেটে ব্যথা করছে?”
মেসবাহর প্রশ্ন শোনামাত্র মাথা নেড়ে উল্লাসী বললো,
-“উহু…”
-“তাহলে দু’হাতে পেট চেপে বসে রয়েছো কেনো?”
হাত সরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসতেই তল পেটের ব্যথা মাথা নাড়া দিয়ে উঠলো। ঠোঁট চেপে চোখজোড়া বুজে উল্লাসী ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“আপনি যান। আমি খাবো না।”
-“আশ্চর্য! তোমার কিছু হয়েছে। কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো।”
-“কিছু হয় নি। আপনি যান।”
-“আমি একা নই.. তুমিও যাবে।”
জোর করে উল্লাসীকে বিছানা থেকে উঠানো মাত্র চোখজোড়া প্রশস্ত হয়ে এল মেসবাহর। চাদরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকালো সে। চোখভর্তি জল নিয়ে চুপচাপ তার টিশার্ট খামচে দাঁড়িয়ে রয়েছে উল্লাসী। ভয় পাচ্ছে মেয়েটি। প্রচুর ভয় পাচ্ছে…
-“পিরিয়ড হয়েছে?”
মেসবাহর প্রশ্নের জবাবে মাথা নাড়ালো উল্লাসী। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে আসছে। কী করবে এখন সে?
-“না বলছো কেনো? তাছাড়া এত ভয়েরই বা কী আছে? প্যাড এনেছো?”
প্যাডের কথা শুনলেও কখনোই তা ব্যবহার করা হয়ে উঠেনি উল্লাসীর। প্রথমবার ছোটমা তার পুরোনো শাড়ি কেটে দিয়েছিল। প্রায় এক বছর তা দিয়েই চালানোর পর দ্বিতীয়বার সুহার পুরোনো জামা কেটে তাই ব্যবহার করে এসেছে সে। তবে উনি প্যাডের কথা কিভাবে জানলেন? পুরুষদের তো এসব জানার কথা নয়!
-“আচ্ছা.. তুমি চুপচাপ বসো। আমি আসছি। আর শোনো ভয়ের কিছু নেই। আমি আসছি।”
উল্লাসীকে বসিয়ে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে মানিব্যাগ নিয়ে দ্রুত বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো মেসবাহ। আপাতত উল্লাসীর কাছে এসব প্রশ্ন করা অহেতুক। গ্রামে জন্ম, সৎমার ঘর.. এক্ষেত্রে বিলাসবহুল জীবন তো তার পাবার কথা নয়। বাদবাকি রইলো চিন্তাভাবনা.. তাতে ওর ছোটমা কী বলে দিয়েছেন তা না হয় উল্লাসীর মুখ থেকেই শোনা যাবে..
একটি শপিং ব্যাগ উল্লাসীর হাতে দিয়ে তাকে পরিষ্কার হয়ে আসতে বললো মেসবাহ। তারপর এগুলো পাশের ঘরের দিকে। মেয়েটির জামাকাপড়ের জন্য আলমারিতে কিছু তাক খালি করে দিতে হবে। আসার পর জামা কাপড় ব্যাগ থেকে কিছুই নামায়নি সে। হয়তোবা সাহস করে উঠতে পারেনি অথবা এসব মাথাতেই আসেনি তার। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে একটি কামিজ নিয়ে আবারও শোবার ঘরে ফিরলো মেসবাহ। এবং তা উল্লাসীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“দ্রুত যাও।”
দাঁড়াতে একরাশ অস্বস্তি এসে চেপে ধরলেও ধীরেসুস্থে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো উল্লাসী। পেট আঁকড়ে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। অপরদিকে উল্লাসী উঠার পর বিছানার চাদর তুলে তা এককোনায় রেখে নতুন চাদর বের করে তা বিছানায় বিছালো মেসবাহ। তারপর এগুলো রান্নাঘরের দিকে। বেশ ক’বছর আগে পায়ের কিছু অসুবিধার কারণে হট ওয়াটার বোতল কিনেছিল সে। যা দিয়ে প্রায়ই সেঁক নিয়ে যেমন পায়ের সমস্যা লাঘব করতো তেমন শীত কালেও হাত পা গরম করার কাজে ব্যবহার করতো। তবে বোতলটি কোথায় রাখা হয়েছে তা ঠিক মনে পড়ছে না। চুলোয় গরম পানির হাঁড়ি উঠিয়ে দিয়ে আবারও ঘরে ফিরে এল মেসবাহ। পুরো ঘরজুড়ে চিরুনী অভিযান শুরু করলো বোতলের আশায়।
-“দাও.. টাউয়েল আমার হাতে দাও। আমি মেলে দিচ্ছি।”
মেসবাহর কথায় তার হাতে টাউয়েল দিয়ে বিছানায় এসে বসলো উল্লাসী। গোসলের পর একটু আরাম অনুভব হলেও তল পেটের ব্যথায় অস্থির লাগছে। সটানভাবে পেট আঁকড়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো উল্লাসী। কিছুই ভালোলাগছে না তার। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে।
-“উল্লাসী? তোমার পেট ব্যথা কী খুব বেশি?”
-“হু..”
-“সহনীয় না অসহনীয়?”
-“জানিনা। কিচ্ছু জানি না।”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে পাশের ঘরে গিয়ে ঔষধের কার্টুন খুলে এলজিনের একটি পাতা বের করলো মেসবাহ। তারপর এক গ্লাস পানি হাতে উল্লাসীর পাশে বসে বললো,
-“এটা খাও।”
-“কিচ্ছু লাগবে না আমার। আপনি এখান থেকে যান।”
ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো উল্লাসী। সেদিকে তাকিয়েই হাতের গ্লাস নামিয়ে রাখলো মেসবাহ। নরম গলায় বললো,
-“এটা খেয়ে নাও। আর আমি পানি গরম দিয়েছি। বোতলে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছি। তল পেটে সেঁক নিলেই ব্যথা অনেকটা কমে আসবে।”
-“আপনি কী করে জানলেন? আপনি জানার পরই আমার পেটের ব্যথা এত বেশি হয়েছে!”
-“কে বলেছে এসব তোমায়? নিশ্চিত ছোটমা!”
-“হ্যাঁ..”
-“তো এটা বলে দেয়নি স্বামীর কাছে এসব বিষয় নিয়ে হেজিটেট অর্থাৎ সংকোচ বোধ করার কিছু নেই।”
-“কেনো? থাকবে না কেনো? স্বামী কি পুরুষ নয়?”
উল্লাসী ফোঁপাতে ফোপাঁতে একথা বলতেই হেসে উঠলো মেসবাহ। জোর করে তাকে উঠিয়ে ঔষধ মুখে পুড়ে দিয়ে বললো,
-“আমাদের সমাজে পিরিয়ড হওয়াকে একটি মেয়ের দুর্বলতা হিসেবে ভাবা হয়। যদিও তেমনটি নয়। এই পিরিয়ড নামক শব্দটি আছে বলেই আজ আমি এই পৃথিবীর বুকে এসেছি, তুমি এই পৃথিবীর বুকে এসেছো। তাহলে কেনো একে নিজের দুর্বলতা ভাববে? বরং একে নিজের সবলতা মনে করে মাথা উঁচিয়ে চলাই কী প্রতিটি নারীর উচিৎ নয়? কেনো আমরা সবাই পিরিয়ডকে দুর্বলতা ভাবি? কেনো মেয়েরা দোকানে প্যাড কিনতে গিয়ে লজ্জা পায়? যেনো পিরিয়ড এমন একটি ব্যাপার যেটি কাওকেই বলা যাবে না। বিশেষ করে পুরুষদের তো না-ই। অথচ যে শারীরিক প্রক্রিয়াকে মানুষ নোংরা ভাবে, অসুস্থতা ভাবে.. সেটি না ঘটলে এই পৃথিবীতে বংশ বিস্তারের প্রকিয়াই বন্ধ হয়ে যেত।”
অবাক চোখে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো উল্লাসী। সত্যিই কী এটি তার অসুস্থতা নয়? তবে যে ছোটমা বলেছিল এটি মেয়েদের অসুখ!
-“পুরুষেরা জানলেই যে পেটের ব্যথা বাড়বে এটি আসলে কুসংস্কার। তাছাড়া শুধু পিরিয়ডের ক্ষেত্রে নয়, আমি তোমার স্বামী। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র সমস্যা হলেও তুমি সেগুলো আমাকে বলবে। তবেই না আমাদের মাঝের বন্ধন দৃঢ় হবে।”
মাথা নেড়ে উল্লাসী মেসবাহর কথায় সম্মতি জানাতেই উঠে পড়লো সে। বোতলটি পাওয়া গেছে। তবে তাতে ধুলোবালির স্তর পড়েছে। ধুয়ে মুছে ঠিকঠাক করে তবেই পানি উঠাতে হবে তাতে।
বোতল ধোয়ার কাজে লেগে পড়লো মেসবাহ৷ সময় নিয়ে ধুয়ে তাতে পানি উঠিয়ে ফিরে এল শোবার ঘরে। উল্লাসীর হাতে বোতলটি দিয়ে বললো,
-“খাবার আনি?”
-“খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“না করলেও সামান্য খেয়ে নাও।”
-“উহু…”
-“কিসের উহু? না খেলা আমি কিন্তু বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাবো। তখন থেকো রাতে একাএকা।”
কপাল কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। অভিমানী সুরে বললো,
-“যান না.. যান! আমিও মুন্নি ভাবিকে ডেকে আনবো।”
(চলবে।)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৯+২০
পুরো রাত পেটের ব্যথায় ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে উল্লাসী। তাই আর সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে ডাকলো না মেসবাহ। নাস্তা করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মেয়েটিকে এভাবে একা ফেলে যেতে কোনোভাবেই মন টানছে না তার। বুকের ভেতরটায় অস্থির লাগছে। তবুও তাকে যেতেই হবে। বাইরে থেকে দরজা লক করে মেসবাহ এগুলো মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকে। আপাতত উনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়ন্তর নেই। তাছাড়া মহিলা এমনিতে খারাপও নয়। তবে তার অতিরিক্ত বকবকের কারণে একদমই সহ্য হয়না তাকে মেসবাহর।
-“কী খবর? এত সকাল সকাল আমাকে কী মনে করে মনে পড়লো?”
সৌজন্য সূচক মৃদু হেসে ফ্ল্যাটের চাবি মুন্নি সরকারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মেসবাহ বললো,
-“এটা রাখুন। খানিকক্ষণ পর পর গিয়ে উল্লাসীকে একটু দেখে আসবেন।”
-“কেনো? উল্লাসীর কিছু হয়েছে?”
-“ওই আরকি.. একটু অসুস্থ।”
-“বলো কী! কী হলো আবার ওর? গিয়ে দেখে আসি!”
মুন্নি সরকার ফ্ল্যাটের দিকে এগুতেই তাকে থামিয়ে দিল মেসবাহ। বললো,
-“এখন ও ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমোক। আপনি একটুপর গিয়ে ওকে একটু খাইয়ে দিয়ে আসবেন। আমি টেবিলে ব্রেড রেডি করেই রেখে এসেছি। আর আমিও একটু ফ্রি হলে চলে আসবো। আপনি প্লিজ ওকে একটু দেখবেন।”
-“আরে! এভাবে আবার বলতে হবে নাকি! অবশ্যই আমি দেখবো। তুমি যাও।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লিফটের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার উল্লাসীকে ফেলে যেতে। যেনো পুরো জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলছে সে উল্লাসীকে। না চাইতেও অজ্ঞাত এক মায়াজালে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে উল্লাসীর সঙ্গে। তাকে নিয়ে ভাবছে। তার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে। এসব কি মায়া? নাকি অন্যকিছু?
কলেজের গেটে এমাদের দেখা না পেয়ে মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল অনার। কাঁধের ব্যাগ চৈতালির কাছে দিয়ে তাকে ভেতরে পাঠিয়ে সে পায়চারী শুরু করলো রাস্তা ধরে। দু’মাস হলো এমাদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। এই কলেজেরই ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলামের বড় ছেলে এমাদ। পড়াশোনায় খুব একটি মনোযোগী না হলেও বাবার ইচ্ছেতে ঢাকার একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত রয়েছে সে। তবে মাসের ৭ দিন ঢাকায় কাটালেও বাদবাকি দিনগুলো গ্রামে শুয়ে-বসে কাটায় এমাদ। এভাবেও বুঝি পড়াশোনা হয়? ভেবে পায় না অনা। অবশ্য তার নিজেরই যেখানে পড়াশোনায় মন বসে না সেখানে এমাদের কী করে বসবে? দু’জনে কি দু’পথের যাত্রী? মোটেও নয়। দুজনেই তারা একই পথে গমনকারী…
-“সরি.. সরি। দেরি হয়ে গেল!”
এমাদের ক্লান্তিমাখা মুখ দেখে মৃদু হাসলো অনা। আদুরে গলায় বললো,
-“ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় এভাবে দৌড়ে আসতে হবে? আজ না এলে কী এমন হতো?”
-“তুমি যে অপেক্ষা করতে!”
-“ইশ! আমার প্যাঁচাটা কত ভাবে! চলো.. একটু হেটে আসি।”
-“তোমার কলেজ?”
-“কলেজের তো তোমার মতো দৌড়ানোর সাধ্যি নেই। থাকবে সে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে।”
হাসলো এমাদ। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অনার হাতের আঙুলের মাঝে ডুবিয়ে দিল নিজের আঙুল।
-“জানো, কাল রাতে কি স্বপ্ন দেখেছি? দেখেছি তুমি আমার ঘরে এসে আমার কাছে গামছা চাইছো। আমিও তোমায় গামছা এগিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি তখন এইবেশে নয়.. শাড়ি পড়া অবস্থায় ছিলাম। স্বপ্নটা সুন্দর না?”
অনার প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে এমাদ বললো,
-“হ্যাঁ.. সুন্দর।”
-“বিয়ের পর কি আমি শাড়ি পড়বো?”
-“তুমি চাইলে পড়বে।”
-“তোমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই?”
-“উহু.. তোমার খুশিতেই আমি খুশি।”
এমাদের হাত জোরে চেপে ধরলো অনা। সাথেসাথেই এক অদ্ভুত অনুভূতি ছেয়ে গেল তার মনজুড়ে। দু’চোখ বুজে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে সে বললো,
-“আমাদের ব্যাপারে আমরা কবে সবাইকে জানাবো?”
-“আরও কিছুদিন যেতে দাও। জানিয়ে দিব।”
-“ঠিকাছে। তবে চৈতালিকে তো জানানোই যায়। প্লিজ.. ওকে জানাই? ওর কাছে আমি কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারিনা। দম বন্ধ বন্ধ লাগে।”
পথ চলা থামিয়ে অনার মুখোমুখি দাঁড়ালো এমাদ। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো,
-“গোপন প্রেমের গভীরতা বেশি… তাছাড়া কিছুদিন যেতে দাও। সময় হলে আমরা দু’জনেই একইসাথে সবাইকে জানাবো।”
ব্যাকুল স্বরে অনা বললো,
-“সময়টি কবে আসবে?”
-“খুব দ্রুত.. চলো। তোমার কলেজের দিকে এগোই।”
ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে সেই চিরপরিচিত রাস্তা ধরে আবারও এগুলো অনা। এমাদকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। যতটুকু ভালোবাসলে তার খুশির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতেও সে দু’বার ভাববে না।
হাসপাতালের কাজের চাপ বেশি থাকায় আর বাসায় যাওয়া হয়ে উঠলো না মেসবাহর। তবে ঘন্টাখানেক পর পর মুন্নি সরকারের নাম্বারে কল করে উল্লাসীর খবরাখবর রাখছে সে। এই মেয়েকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার। একয়দিন যাবৎ তাকে বাড়িতে একা ফেলে রেখে আসার চিন্তা, আজ থেকে আবারও নতুন চিন্তার সূচনা ঘটলো। অস্থিরতা কাটাতেই দুপুরের রাউন্ড দেয়া শেষ হতেই মুন্নি সরকারের নাম্বার ডায়াল করলো মেসবাহ। অশান্ত মনে অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশ থেকে একটি সাড়ার।
-“মেসবাহ.. তুমি এত কেনো টেনশন করছো বলো তো? এসব তো প্রতিটি মেয়েরই হয়। স্বাভাবিক একটি ব্যাপার এটি।”
এব্যাপারে মুন্নি সরকারের সাথে কথা বলতে অস্বস্তি হলো মেসবাহর। কোনোরকমে কথা কাটিয়ে সে বললো,
-“জ্বি.. তা উল্লাসী দুপুরে খেয়েছে?”
-“না.. ওকে খাওয়াতেই এসেছি। কথা বলবে ওর সাথে? নাও বলো।”
অপরপাশ থেকে উল্লাসীর গলার স্বর কানে আসতেই অস্থির মনে স্বস্তি ফিরলো মেসবাহর। শান্ত স্বরে সে বললো,
-“গোসল হয়েছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“ব্যথার কী অবস্থা?”
-“একটু কম..”
-“ধীরেসুস্থে আরও কমবে। মুন্নি ভাবিকে বলো যাবার আগে যেনো পানি গরম করে বোতলে উঠিয়ে দিয়ে যায়। পন্ডিতি করে তুমি একা করো না। গরম পানি হাতে পায়ে লাগতে পারে।”
-“আচ্ছা..”
-“মুন্নি ভাবি কি ভাত নিয়ে এসেছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“ঠিকাছে। কোনো বাহানা না দেখিয়ে খেয়ে নাও। আমি দেখি বিকেলের দিকে একবার বাসায় আসবো।”
-“আচ্ছা..”
-“কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলো। নিয়ে আসবো।”
-“না, কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“আচ্ছা.. রাখছি।”
ইচ্ছে না থাকা সত্বেও কল কেটে চেম্বারে এল মেসবাহ। অস্থিরতা খানিকটা কমে এলেও উল্লাসীকে একটিবার দেখার জন্য মন উতলা হয়ে উঠেছে। এ কেমন বিপদে পড়লো সে! উল্লাসী ছাড়া কী কিছুই মাথায় আসেনা তার?
ভর সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে রয়েছে উল্লাসী। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। যাক! ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। ঘুমোনোর সময়টুকুতো একটু শান্তিতে আছে। নয়তো কষ্টে আচ্ছন্ন মুখ নিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতো উল্লাসী। দিন শেষে বাড়ি ফিরে যা দেখা মোটেও সুখকর হত না। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হাতের আইসক্রিমের বাটি ফ্রিজে রেখে এসে শার্ট খুললো মেসবাহ। কিছুক্ষণ বসে ঠান্ডা হয়ে পা বাড়ালো গোসলের উদ্দেশ্যে।
থালাবাটির ঝনঝন শব্দে ঘুম ভাঙলো উল্লাসীর। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো সে। এখন সকাল নাকি রাত? কখন ঘুমিয়েছিল সে? আর কখনই বা উঠলো? বোধগম্য হলো না। সময় নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সে ধীরপায়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
-“আপনি কখন এসেছেন?”
পিছন ফিরে উল্লাসীকে দেখামাত্র হাসি ফুটলো মেসবাহর ঠোঁটে। হাতের আলু রেখে সে এগিয়ে এল উল্লাসীর কাছে। মিষ্টি স্বরে বললো,
-“অনেক্ক্ষণ.. শরীরের কী অবস্থা?”
-“ভালো। কী করছিলেন আপনি?”
-“ভাত টা উঠিয়ে দিলাম। আলুভর্তা আর ডিম ভাজি.. চলবে তো রাতে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উল্লাসী পা বাড়ালো ড্রইংরুমের দিকে। ঘুম থেকে উঠার পর কিছুই ভালোলাগছে না তার। কোমর টেসে টেসে আসছে। শরীরে একদম শক্তি পাচ্ছে না। দু’পা প্রচন্ড চাবাচ্ছে..
-“এই উল্লাসী, আপেল খাবে? কেটে দেব?”
ডাইনিং থেকে গলা উঁচিয়ে মেসবাহ ডেকে উঠতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। ক্ষীণ গলায় জবাব দিল,
-“উহু..”
-“আইসক্রিম?”
-“উহু..”
-“হালকা কিছু খেয়ে নাও। ততক্ষণে ভাত হোক।”
-“আচ্ছা হোক। একেবারে ভাতই খাবো।”
আর কথা বাড়ালো না মেসবাহ। এগুলো রান্নাঘরের দিকে। উল্লাসী আসার পর রান্নাঘর কী তার একরকম ভুলতেই বসেছিল সে। মেয়েটি অবুঝ হলেও যে পাক্কা রাধুনি তা মানতেই হবে! অবশ্য হবেই বা না কেনো? নিশ্চয় তার বাড়ির সকলের রান্না নিজে হাতে সামলাতে হয়েছে তাকে। সৎ মা যে কখনোই আপন মা হতে পারে না তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ উল্লাসীর ছোট মা। কী করে পারলেন উনি মিথ্যে লোভ দেখিয়ে ছোট একটি মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসাতে? জবাবে মেসবাহর বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ভাতের হাঁড়িতে আলু ছেড়ে ডিমের জন্য পিয়াজ, মরিচ কাটতে শুরু করলো সে।
চোখ বুজে শুয়ে থাকার পরও ঘুমের দেখা না পেয়ে উঠে বসলো উল্লাসী। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় ঘরের পুরোটা নজরে এলেও কোথাও মেসবাহর দেখা না পেয়ে জোর গলায় ডেকে উঠলো তাকে। খাবারের পাঠ চুকেছে অনেক্ক্ষণ। এখনো কেনো ঘরে আসেননি উনি?
-“কী হয়েছে? কিছু লাগবে?”
সিগারেট হাতে ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো মেসবাহ। জবাবে উল্লাসী বললো,
-“উহু.. আপনি কখন ঘুমোবেন?”
-“এইতো.. এখনই।”
-“তো আসুন না! একা একা ঘুম পাচ্ছে না।”
জ্বলন্ত সিগারেট এশট্রেতে ফেলে বিছানায় এল মেসবাহ। বালিসে মাথা গুঁজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই ওপাশ থেকে উল্লাসী বললো,
-“আপনার কি সিগারেট খুব বেশিই পছন্দ?”
-“বলতে পারো!”
-“কেনো পছন্দ? বিশেষ কী আছে এতে?”
মাথার নিচে এক হাত রেখে ফ্যানের দিকে চেয়ে মেসবাহ জবাব দিল,
-“এতে শান্তি আছে.. “
-“তাহলে আপনার ভেতরে যখন অশান্তি কাজ করে তখনই আপনি সিগারেট খান?”
-“উহু.. তেমন কিছু নয়।”
-“তাহলে কেমন কিছু?”
-“তুমি ঘুমোও উল্লাসী।”
হতাশ মনে চোখজোড়া বুজলো উল্লাসী। তবে হঠাৎ করে মুন্নি সরকারের বলা কথাগুলো মাথায় আসায় আবারও চোখ মেললো সে। অনুরোধের গলায় বললো,
-“একটু আদর করে দিন না!”
-“আবারও শুরু করলে?”
-“কী হয় একটু আদর করলে? হাসান ভাইও তো মুন্নি ভাবিকে আদর করে। তাহলে আপনি আমায় করেন না কেনো?”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মেসবাহ বললো,
-“তুমি পিচ্চি বলে। বড় হও.. অনেক আদর দিব।”
-“আমি যেহেতু পিচ্চি তাহলে আমায় পিচ্চি আদরই দিন। বড় হবার পর না হয় বড় আদর দেবেন!”
-“ঘুমোও উল্লাসী..”
-“দিন না! দিন একটু। একটুই তো। দিন না!”
-“ঘুমোও..”
-“দেবেন না আপনি? আমি কিন্তু উঠে মুন্নি ভাবির কাছে চলে যাবো।”
উল্লাসীর ছটফটের সাথে পেরে না উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিকে এগুলো মেসবাহ। চোখজোড়া বুজে পরম যত্নে কপালের মাঝবরাবর আলতো করে বসিয়ে দিল তার ঠোঁটের ছোঁয়া।
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_২০
সকাল থেকেই প্রচুর ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটাচ্ছে উল্লাসী। অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছে সে দিন পাঁচেক হলো। ঠিক অসুস্থতাও নয়, উনি বলেছেন মাসিক কোনো অসুস্থতা নয়৷ তবে যেটাই হোক সেটি ভেজাল ছাড়া দ্বিতীয় কিছু মনে হয় না তার। তল পেটে ব্যথা, হাটতে অসুবিধা, কোমর টেসে আসা.. এত কিছুর মুখোমুখি হবার পরও এই প্রথমবার নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। উৎফুল্ল মনে ব্যাগের সব কাপড়চোপড় বের করে একেএকে আলমারিতে গুছিয়ে রাখলো উল্লাসী। তারপর পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। দুপুরের রান্নাটা দ্রুত সেরে মুন্নি ভাবির কাছে যেতে হবে। দুজনে মিলে আজ সিনেমা দেখার কথা রয়েছে। তবে তা মোটেও জানানো যাবে না উনাকে। মুন্নি ভাবির বারণ আছে। সব কথাই নাকি স্বামীকে জানাতে নেই। তাতে স্ত্রীর গুরুত্ব তাদের কাছে কমে যায়। ভাতের চাল ধুয়ে তা চুলোয় দিল উল্লাসী। তারপর ফ্রিজ থেকে মাছের পোটলা বের করে বেসিনের দিকে এগুতেই কানে এল কলিংবেলের শব্দ। নিশ্চিত মুন্নি ভাবি ডাকতে এসেছেন তাকে। তবে রান্নাই তো হয়নি এখনো! সব ফেলে এখন কী করে যাবে সে সিনেমা দেখতে? নিরাশ মনে মাছের পোটলা ভিজিয়ে রেখে দরজার দিকে এগুলো উল্লাসী। তবে দরজা খোলার মাত্র নিমেষেই মুখের ভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে এল তার। মুন্নি ভাবি নয়.. মৌমিরা এসেছে!
প্রতি রাতের উল্লাসীর ভিন্ন ভিন্ন আবদারগুলোকে বেশ উপভোগ করে মেসবাহ। তার বলা কথা এবং কার্যক্রমগুলো বেশ আনন্দ দেয় তাকে। মাঝেমাঝে আবদারগুলো নিয়ে কোথাও একটি ভয় কাজ করলেও তা উপেক্ষা করে উল্লাসী বোঝানোর চেষ্টা করে সে। যা কিছুসময় পেরে না উঠে পিচ্চি আদর দিতেই হয় তাকে। তাছাড়া সে নিজে যেখানে শক্ত আছে সেখানে উল্লাসীর ছোট ছোট আবদার পূরণ করাই যায়! তবে সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা অন্যখানে। উল্লাসীকে একা বাসায় ফেলে হাসপাতালে এসেও কাজে মন দিতে পারে না মেসবাহ। উদ্ধত মন সারাক্ষণ আনচান করে মেয়েটির জন্য। কখন রাত হবে সেই প্রহর গুনে। মেয়েটি মায়াজালে যে বেশ শক্তপোক্ত করে আঁটকে পড়েছে সে তা বুঝেও মনকে হাজারটা কারণ দেখিয়ে বুঝ দেয় মেসবাহ। কেনো যেনো বিবেক কোনোভাবেই সায় দেয় না এ কথায়…
নিউরো সাইন্স হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ল্যাবএইডের উদ্দেশ্যে রিক্সায় উঠে মুন্নি সরকারের নাম্বারে ডায়াল করলো মেসবাহ। উল্লাসীর জন্য একটি ফোন নিতে হবে। বারবার তার খবর নিতে মুন্নি সরকারের কাছে কল করায় বড্ড সংকোচ বোধ হয়। তাছাড়া উনার নানান প্রশ্ন তো রয়েছেই! সবমিলিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে মুন্নি সরকারের আওয়াজ শোনামাত্র অজস্র অস্বস্তি এসে চেপে ধরে তাকে।
-“হ্যালো, মেসবাহ?”
-“জ্বি, ভাবি। একটু উল্লাসীকে ডেকে দেবেন?”
-“তাকে আর কোথায় পাই আমি? তোমার ভাই বোনেরা এসেছে না? তাদের নিয়েই পড়ে আছে সে। তুমি একটু লাইনে থাকো। আমি দিচ্ছি…”
হতবাক হলো মেসবাহ। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“ভাইবোন এসেছে? আমার? কারা এসেছে?”
-“তোমার বড় ভাই আর ছোট বোন।”
-“বলেন কী! আচ্ছা.. আমি আসছি।”
-“তা এসো.. তবে তোমাদের পরিবার থেকে যে উল্লাসীকে এত সহজভাবে মেনে নিয়েছে তা দেখেই আমার ভালোলাগছে।”
-“হ্যাঁ.. ওইতো। আচ্ছা, রাখছি।”
দ্রুত ফোন কেটে রিক্সা ঘোরাতে বললো মেসবাহ। আপাতত বাসায় যাওয়া তার বেশ জরুরী হয়ে পড়েছে। বড় ভাই এবং অনা যে আসবে তা তো একবারও জানায়নি তাকে! তাহলে এভাবে হুট করে আসার মানেটা কী? অস্থিরতায় চিপের কোণা দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়তেই তা মুছলো মেসবাহ। তাদের প্রেমের বিয়ের কথাটি যে মিথ্যে তা হয়তো এখনো জানতে পারেনি মুন্নি সরকার। নয়তো ফোনে এত শান্ত ভাবে কখনোই কথা বলতো না সে। তাছাড়া বড় ভাই গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। মুন্নি সরকারের সাথে গল্প জুড়ে দেবার মতো মানুষ তিনি নন। বাদ রইলো অনা, সে গল্প পাগল এক মেয়ে। একবার গল্পের আসর খুলে বসলে তার সকল লুকোনো কথা মুন্নি সরকারের সামনে আসতে দু’সেকেন্ডও লাগবে না সেখানে তার বাসায় পৌঁছানো তো দূরের কথা! আবারও ঘামে সিক্ত কপাল মুছলো মেসবাহ। রিক্সা চালকের উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় বললো,
-“ভাই.. একটু তাড়াতাড়ি চালান না!”
-“এর থাইকা বেশি পারমু না! পাও দিয়া রিক্সা চালাই আমি.. এ তো আমার উইড়াজাহাজ না!”
-“ঠিকাছে.. ঠিকাছে। যেভাবে খুশি চালান।”
সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে গোসল সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল মেসবাহ। তারপর ধীরেসুস্থে এগুলো পাশের ঘরের দিকে। অনা মৌমির সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত, মাজহারুল চোখবুঁজে শুয়ে রয়েছে। এরমাঝে অনাকে ডেকে তাদের বিয়ের কথা উঠানো ঠিক হবে কিনা ভেবে পেল না মেসবাহ। ঘরজুড়ে কয়েকবার পায়চারী করে সে এগুলো রান্নাঘরের দিকে। এই রাতে আর এদিকটায় আসবে না মুন্নি সরকার। তাই আপাতত ভয় নেই। রাতের খাবার পর না হয় ধীরেসুস্থে পুরো ব্যপারটা বুঝিয়ে বলা যাবে অনাকে।
-“কী করছো?”
রান্নাঘরে ঢুকে উল্লাসীকে প্রশ্ন করামাত্র পিছন ফিরলো সে। মুখ ছোট করে হতাশ গলায় বললো,
-“আমি এতবড় মাছ কখনোই কাটিনি।”
-“মাছ কোথায় পেলে?”
-“আপনার আম্মা পাঠিয়েছে।”
চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় মেসবাহ বললো,
-“আম্মাও না! কেটে পাঠালেই তো পারতো! দেখি কী মাছ?”
উল্লাসী সরতেই প্রায় তিন কেজি ওজনের রুই মাছ দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“বাড়িতে এতগুলো কাজের মানুষ থাকতে তোমার ভরসায় এই মাছ মা কী করে পাঠায়! আর কী কী পাঠিয়েছে?”
-“মাংস আর কিছু শাকসবজি। ওগুলো অনা আপা ফ্রিজে তুলে রেখেছে।”
-“অহ.. দেখি সরো। আমি চেষ্টা করে দেখি!”
-“আপনি পারবেন?”
-“দেখি চেষ্টা করে.. তুমি শুধু আমাকে ডিরেকশন দেবে কোথায় কিভাবে কাটবো।”
মেসবাহর কথামতো সরে বসে মেসবাহকে জায়গা করে দিল উল্লাসী। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেসবাহর মাছ কাটা দৃশ্যের দিকে।
-“আরে না.. ওইখানে না। এইযে.. এই মাথার কাছে কাটুন। হ্যাঁ.. আরেকটু নিচে। এইতো.. এবার ঠিকাছে।”
উল্লাসীর কথামতো মেসবাহ মাছের মাথা কাটতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ডিম আছে মাছে!”
-“তাই তো দেখছি…”
-“আস্তেধীরে বের করুন।”
-“তা করছি.. একটা কাজ করো তো।”
-“কী কাজ?”
-“গলার এপাশটা চুলকে দাও। উফ! অসহ্য লাগছে..”
মেসবাহর গলায় হাত রেখে উল্লাসী বললো,
-“এখানে?”
-“হু..”
-“দিচ্ছি.. আপনি এত ঘামেন কেনো? এটুকুতেই ঘেমে টেমে একাকার হয়ে পড়েছেন! দাঁড়ান.. মুছে দেই।”
উল্লাসী এক হাতে পরণের ওড়না তুলে মেসবাহর কপালের ঘাম মুছে দিতেই তার ঠোঁটে ফুটলো মিষ্টি হাসির ঝলক। সুখী সে.. প্রচুর সুখী। এর চেয়ে বেশি সুখী হওয়া আর কোনোভাবেই সম্ভব নয় তার পক্ষে।
ডাইনিং থেকে মেসবাহ এবং উল্লাসীকে দেখে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাজহারুলের। ধীর পায়ে আবারও সে ফিরে এল ঘরে। তার এবং জ্যোতির বিবাহিত জীবনটাও হয়তো এমন হতে পারতো। তবে হয়নি। আর না কখনোই হবে। বাড়ির বড় বউ হবার কারণে যখন সংসারের সকল কাজ নিজে হাতে একা সামলেছে জ্যোতি তখন সে একমুহূর্তের জন্যও এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করেনি তাকে। না তার ছোটছোট চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু সময় ইচ্ছে করলেও বাবার কারণে করা হয়ে উঠেনি, কিছু সময় নিজের ইচ্ছে করেনি। শুধু জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেই একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাতে যেমন সম্মান দরকার ঠিক ততটাই দরকার একে অপরকে বোঝা। তার মনে অপরপক্ষকে নিয়ে চলা ক্ষোভকে খুঁজে বের করা। যা খুঁজে পেলেও একজন আত্মমর্যাদাহীন মানুষ হিসেবে তা মুছে দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল না…
গাড়ি থেকে নেমে রাশেদ রহমানকে বিদায় জানিয়ে একটি রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকলো জ্যোতি। সানগ্লাস খুলে অনুসন্ধানী চোখে চারপাশে নজর বুলাতেই দেখতে পেল মাজহারুলকে। বয়স তিনকের মতো একটি মেয়েকে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে সে। এই মেয়েই কি মৌমি? তার মেয়ে?
-“কেমন আছো?”
দূর থেকে জ্যোতিকে দেখেই নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল মাজহারুল। তবে ধীরেধীরে জ্যোতির কাছে আসামাত্র বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো তার। বড্ড বদলে গেছে জ্যোতি। এই জ্যোতির সাথে কোনো অংশেই মিল নেই আগের সেই অভিমানী জ্যোতির…
-“বললে না কেমন আছো?”
-“আছি একরকম.. তুমি বসো।”
-“হ্যাঁ.. বসছি।”
মাজহারুলের মুখোমুখি বসলো জ্যোতি। হাতে থাকা ব্যাগ এবং ফোন একপাশে নামিয়ে রেখে বললো,
-“কিছু অর্ডার করেছো?”
-“হ্যাঁ.. মৌমির জন্য আইসক্রিম।”
-“তোমার জন্য কিছু করোনি?”
-“না.. আমি বাইরের খাবার খাই না।”
-“তুমি একদমই বদলাও নি.. ঠিক সেই আগের মতোই রয়ে গেছো!”
গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মৌমির দিকে তাকালো মাজহারুল। হুট করে ঢাকায় আসার একমাত্র কারণ তার এই মেয়েটি। পরশু রাতে তার মৃত্যুর স্বপ্নটি দেখার পর কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছিলো না সে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিলো। দম বন্ধ বন্ধ লাগছিলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো মৃত্যুর আগে একবার হলেও মৌমিকে দেখিয়ে আনা উচিৎ তার মাকে। মা কী তা বোঝে না সে.. তবে সকলের মা আছে তার নেই তা খুব করে বুঝতে পারে। বাস্তবতা বড়ই নির্মম! তবু্ও সেই নির্মমতা দেখেই কাটিয়ে দিতে হয় বছরের পর বছর।
-“আম্মা.. ওদিকে তাকাও। তোমার আম্মু.. আম্মুকে দেখো।”
মাজহারুলের হাতের ইশারায় মৌমি তার দিকে চাইতেই বুকের ভেতরটায় হু হু করে উঠলো জ্যোতির। ঠোঁটজোড়া চেপে পাশ থেকে সানগ্লাস তুলে আবারও চোখে পড়ে নিল সে।
-“এটা আম্মু হলে ওটা কে?”
মৌমির প্রশ্নে কপাল কুঁচকে মাজহারুল বললো,
-“কোনটা?”
-“মেজবাবার বউ.. তুমি তো বলেছিলে ওই আমার আম্মু।”
-“ওটাও আম্মু। তবে এটা আসল আম্মু।”
পাশ থেকে হালকা কেশে গলা ঠিক করলো জ্যোতি। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললো,
-“মেসবাহ বিয়ে করেছে?”
ভারী গলায় মাজহারুল বললো,
-“হ্যাঁ.. তুমি কী মৌমিকে একবার কোলে নেবে?”
-“অবশ্যই..”
মাজহারুল মৌমিকে কোলে দেয়ামাত্র তাকে বুকে চেপে ধরলো জ্যোতি। ঠোঁট চেপে খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকার পর আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। অতীতের পিছুটানকে বুকে চেপে আর পারছে না সে নিজেকে শক্ত রাখতে।
-“তুমি কাঁদছো কেনো আসল আম্মু?”
মৌমির কথায় কোনো জবাব দিল না জ্যোতি। দু’হাতের আঁজলে তার মুখ তুলে চুমুতে ভরিয়ে দিল তাকে। মৌমি নিজেও জ্যোতির বুকে গিয়ে তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো তাকে। ঠোঁটে তার ভুবনভুলানো হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“আসল আম্মু.. তুমিও কী ওই আম্মুর মত অন্য কারো ছিলে এতদিন? কেনো ছিলে? আমার কথা কি একবারও মনে পড়তো না তোমার?”
মৌমির একথারও জবাব দিল না জ্যোতি।চোখের সানগ্লাস খুলে সে অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করলো,
-“আমাকে মাফ করে দিস মা। আমাকে মাফ করে দিস। আমি জানি তোর ভেতর বুঝ এলে তুই আমাকে ঘৃণা করবি.. কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোর মুখের দিকে তাকিয়েও আমি ওসব সহ্য করতে পারিনি।”
জ্যোতির কথা বোধগম্য হলো না মৌমির। তবে তার ছোট্ট দুই হাত দিয়ে সে মুছে দিল মায়ের চোখের পানি। তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
-“কাঁদে না আসল আম্মু। ও বাবা.. আসল আম্মুকে একটা আইসক্রিম কিনে দাও না! আসল আম্মু কাঁদছে..”
ক্রন্দনরত অবস্থায় আরও দৃঢ়ভাবে মৌমিকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরলো জ্যোতি। ঠিক একারণেই ওবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর দ্বিতীয়বার আর মৌমিকেও দেখতে যাবার সাহস করে উঠতে পারেনি সে। সে জানতো, সবকিছুর মায়া ছেড়ে ওবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসলেও নিজের পেটের সন্তানের মায়া কাটানো সম্ভব নয়…
-“মা, আমি তোকেও আমার সাথে আনতে চেয়েছিলামরে। কিন্তু তোর দাদু আনতে দেয়নি। আমাকে মাফ করে দিস মা। বড় হবার পর আমাকে ঘৃণা করিস না।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩১
সকালের তীক্ষ্ণ রোদের সঙ্গে জানালার পর্দার লুকোচুরি খেলা শেষে নীরবে ঘরে রোদ প্রবেশ করতেই ঘুম ভেঙে গেলো উল্লাসীর। আড়মোড়া ভেঙে ঘুমে আচ্ছন্ন চোখজোড়া মেলতেই মেসবাহর ঘুমন্ত মুখ সামনে এল তার। দু’হাতের মাঝে আষ্ঠেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে বেশ আয়েশেই নিদ্রায় নিদ্রিত রয়েছেন তিনি। কী নিষ্পাপ লাগছে তাকে দেখতে! কে বলবে কাল পুরো রাত এই নিষ্পাপ লোকটিই কিভাবে জ্বালিয়ে মেরেছে তাকে! ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়েও তার কার্যকলাপের মুখে পরে বারবার অজানা এক সুখের রাজ্যে ভেসে গেছে। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে থাকার পর তার মাথার দিকে হাত বাড়ালো উল্লাসী। চুলে হাত ডুবিয়ে বিলি কাটতে শুরু করতেই নড়েচড়ে উঠলো মেসবাহ। মাথার অবস্থান পরিবর্তন করে তা গুঁজে দিল উল্লাসীর বুকে। সুপ্ত গলায় বললো,
-“কখন উঠলে?”
-“এইতো মাত্র..”
-“ঘুম হয়েছে?”
-“জানি না।”
ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটলো মেসবাহর। মুখ উঠিয়ে উল্লাসীর দিকে চেয়ে বললো,
-“তা কী জানেন আপনি?”
-“জানি না। এভাবে তাকাবেন না।”
-“কেনো? লজ্জা পান?”
-“মোটেও না। দেখি ছাড়ুন।”
-“ছাড়াছাড়ির কারবার কি না টানলেই নয়?”
-“না.. ছাড়ুন।”
-“ছাড়বো তো অবশ্যই। গোসলের পাঠ তো চুকাতে হবে।”
ভ্রু কুঁচকে উল্লাসী বললো,
-“কিসের গোসল? আপনি তো বলেছিলেন এখানে থাকা অব্দি আমার সকালে গোছলের দরকার নেই।”
-“এখন থেকে দরকার।”
-“কেনো? এখন দরকার কেনো?”
-“এতসব বোঝাতে পারবো না। প্রতি সকালে দুজন একসাথে গোসল সারবো.. ব্যস! কথা শেষ।”
-“ছিঃ! এত বাজে কথা কেন বলেন আপনি? মোটেও না.. আমি একদম আপনার সাথে গোসল করবো না।”
-“করবে না?”
-“না.. ছাড়ুন। ছাড়ুন না!”
উল্লাসীর ছটফটানি কমাতে তার গলায় মুখ ডোবালো মেসবাহ। সময় নিয়ে একেরপর এক চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে ঠোঁটের দিকে এগুতেই তার নজর গেল উল্লাসীর পিছনের দিকে। গুটিসুটি মেরে উল্লাসীর পাশে শুয়ে চোখজোড়া প্রসস্থ করে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সুহা। কিন্তু সুহা এঘরে এলো কখন? ভোরে? তাহলে কী চোখ মেলে উল্লাসীর দেখা না পেয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে কী এঘরে চলে এসেছে সে? অজস্র অস্বস্তি নিয়ে উল্লাসীকে ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। এমন বিশ্রী এক পরিস্থিতিতে এর আগেও মৌমির সামনে পড়েছিল তারা। তবে তখন আদরের ডোজ কম থাকলেও আজ তা সীমানা ছাড়িয়েছে।
-“কী হলো?”
উল্লাসীর প্রশ্নের জবাবে ঢোক গিলে মেসবাহ বললো,
-“সুহা..”
-“কী সুহা? সুহার কিছু হয়েছে?”
-“না.. পেছনে তাকাও।”
মেসবাহর কথায় পেছনে ঘুরতেই সুহাকে দেখে চোখমুখ সংকুচিত হয়ে এল উল্লাসীর। বোনের কপালে হাত বুলিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“তুই কখন এলি? ভয় পেয়েছিলি? আমি আপনাকে বারবার বলেছি, সুহা একা আছে। ওর কাছে যাই। আপনি যেতেই দিলেন না! ইশ.. কলিজার টুকরোটা আমার! ভয় পেয়েছিলি রে?”
লম্বা একটি দম ছেড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো মেসবাহ। পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে। সুহা যে তাদের মাঝের আদর ভালোবাসার বেশ কিছু অংশ দেখে ফেলেছে সেদিকে সামান্য ভ্রুক্ষেপ নেই উল্লাসীর। তার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান আপাতত তার ভুতগীরিতে সীমাবদ্ধ। বোনকে একা পেয়ে যে ভুতেরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়নি এইবা কম কী!
হাসপাতালের চারপাশটা মানুষের ভিড়ে গমগম করছে। সচরাচর সকালের দিকে মানুষের আনাগোনা বেশি হলেও দুপুরের দিকে তা ধীরেধীরে কমতে থাকে। অথচ আজ দিনটি সেই শৃঙ্খলা মাফিক চলছে না। কেনো যেনো দিন বাড়ার সাথে সাথে মানুষের আনাগোনাও আরো ধীরেধীরে বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। চারপাশের মানুষের সোরগোলের আওয়াজে তার মাথাটা ধরে উঠেছে। পুরো মাথা ফাকা ফাকা লাগছে। কিছুসময় চুপচাপ বসে থাকার পর হাসপাতাল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটি কয়েকবার টেনে তাকালো আকাশের দিকে। কখন এই আকাশজুড়ে আঁধার নেমে আসবে? আর কখন সে আবারও কাছে পাবে তার উল্লাসীকে? প্রচুর অস্থির লাগছে তার। মধুময় একটি রাত কাটানোর পর আর একদন্ডও উল্লাসীকে ছাড়া থাকা তার পক্ষে বড্ড দায় হয়ে পেড়েছে!
-“রাত আটটার উপরে বাজে! অথচ তুই এখনো খেতে আসিস না কেন অনা?”
মোরশেদা বেগমের গলার স্বর শুনে কাপড়ভর্তি ব্যাগ খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিল অনা। তারপর দরজা খুলে বললো,
-“আসতেছি আম্মা।”
-“তাড়াতাড়ি আয়।”
লম্বা বারান্দা ধরে মোরশেদা বেগম নিচে নেমে যেতেই আলাউদ্দিন শেখের ঘরের দিকে এগুলো অনা। বাড়ির সকল সদস্যই খাবারের জন্য এখন নিচে রয়েছে। যা করতে হবে এইসময়ের মাঝেই দ্রুত করতে হবে। চোখজোড়া বুজে বুকে ফু দিয়ে ধীর পায়ে আলাউদ্দীন শেখের ঘরে ঢুকলো অনা। আলো জ্বেলে টেলিফোনের কাছে গিয়ে চৈতালির বাড়ির নাম্বারে কল দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল চৈতালির গলার স্বর..
-“হ্যালো..?”
-“তুই আজ একটিবারও এলি না কেন আমাদের বাড়িতে?”
-“অহ.. তুই! ওইতো কাল সারারাত তোর কাছে ছিলাম। ভোরে বাড়ি আসার পর থেকে মার ঝাড়ি শুনে কুল পাচ্ছি না আর তুই আছিস ওসব ধান্দায়!”
-“অহ। শুন চিতৈ পিঠা.. আমি তোকে খুব ভালোবাসি।”
-“ঢং করিস না তো! কি বলতে কল করেছিলি সেটা বল।”
-“মুবিন ভাই কাল আসছে। আমি রাখছি এখন।”
ওপাশ থেকে চৈতালির কোনো কথা না শুনেই টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখলো অনা। আজ সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে কাল নিঃসন্দেহে তার ভাইয়েরা হাজির হবে বাড়িতে। সেই সুযোগেই আবারও দেখা হবে মুবিন এবং চৈতালির। আচ্ছা.. চৈতালি কি মুবিনের দেখা পেয়ে খুশি হবে নাকি তাকে হারিয়ে হবে ব্যথিত? চিন্তার ধারা বেশিদূর না গড়িয়ে বিছানার তোশক তুলে আলমারির চাবি বের করলো অনা। ভয়ে তার আত্মা থরথর করে কাঁপছে। তবে এমাদের কথামতো তাকে সাথে টাকাকড়ি নিতেই হবে। ভুল কিছু তো চায়নি সে। ছাত্রমানুষ এমাদ। তার তোপের মুখে পরে পালাতে বাধ্য হলেও টাকা পয়সা কোথায় পাবে সে?
ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে বিশ মিনিট। অথচ এখনো ঘুমের দেখা নেই সুহার চোখে। উল্লাসীকে জড়িয়ে ধরে তার চুল নিয়ে খেলা যেনো তার মুখ্য কাজ হয়ে পড়েছে। একয়দিনে তো এত রাত অব্দি জেগে পাড় করে নি সুহা। তাহলে আজ কী এমন হলো? অবুঝ মেয়েটি যদি বুঝতো উল্লাসীকে এই মুহূর্তে কাছে পেতে ঠিক কতটা অস্থির হয়ে উঠেছে তার মন! ছটফটে মনে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। খাবার পর থেকে এরমাঝে একাধিকবার দুই ঘরজুড়ে পায়চারী করার উপরেই রয়েছে সে।
-“ঘুমিয়েছে?”
-“না.. এতবার বার আসছেন কেনো?”
উল্লাসীর জবাব শুনে বিরক্ত হলো মেসবাহ। আবারও ফিরে এল নিজের ঘরে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে একটি বই খুলে কয়েক পাতা উল্টেপাল্টে দেখলো। তবে তাতে মনোযোগ দিতে না পেরে শেষমেশ উঠে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে উল্লাসীতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। উল্লাসীকে ঘিরে সকল অনুভূতি একত্রিত হয়ে তার মনে অদ্ভুত এক চাহিদার জানান দিচ্ছে। যা ক্রমেই মাথার ভেতরে এত করে চেপে ধরছে যে কোনোভাবেই তাকে সেখান থেকে নামাতে পারছে না… ডাইনিংয়ে এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিল মেসবাহ। একটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি রয়েছে। এখনো কী ঘুমায়নি সুহা? ভাবামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে সেদিকে এগুলো মেসবাহ। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বললো,
-“ঘুমিয়েছে?”
তন্দ্রাভাব এসে গিয়েছিল উল্লাসীর। হঠাৎ মেসবাহর গলার স্বরে তা কেটে গেল। ভ্রুজোড়া কুঁচকে সে বললো,
-“ধীরে কথা বলুন।”
-“ঠিকাছে। সুহা ঘুমিয়েছে?
সুহার দিকে চেয়ে তার প্রসস্থ চোখ এবং ঠোঁট ভর্তি হাসি দেখে আবারও মেসবাহর দিকে তাকালো উল্লাসী। মাথা নেড়ে বললো,
-“উহু.. আমি তো বলেছি সময় হলে আসবো।”
-“সময়টাই কখন হবে তোমার? রাত ফুরিয়ে সকাল হলে?”
-“আবারও জোরে কথা বলছেন!”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। ধীর গলায় বললো,
-“তুমি সুহাকে ঘুম পারাও। এবং দ্রুত।”
-“ওতো চুক্তি নিয়ে আমি কাজ করতে পারবো না।”
-“করতে হবে না। তুমি নিজে না ঘুমিয়ে ওকে ঘুম পারাও। আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবো না।”
-“অপেক্ষা করতে বলেছে কে? আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল রাতেও মেয়েটি ভয় পেয়েছে। আজ রাতে পাবেনা তার কী গ্যারান্টি!”
-“চুপ.. একদম চুপ। ওকে ঘুম পারাও। দশমিনিটের মধ্যে ওকে ঘুম পারিয়ে তুমি ওঘরে আসবে নয়তো আমিই কিন্তু এঘরে চলে আসবো।”
-“তো আসুন না! এতবড় বিছানা পড়ে আছে! মেয়েটিকে একা ফেলে আমার ওঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“সব কাজ সবার সামনে করতে হয় না উল্লাসী।”
-“করলে কী হয়?”
দু’হাতের মুঠ চেপে ধরলো মেসবাহ। লম্বা একটি দম ছেড়ে কড়া গলায় বললো,
-“আমার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। তুমি দ্রুত ওকে ঘুম পারাও।”
-“অদ্ভুত তো! আপনি আমার উপর রাগ দেখাচ্ছেন কেনো? লাগবে না আপনার আদর। ঘুমান গিয়ে যান।”
-“মারবো একটা চড়। শুধু মুখেমুখে কথা! শালার আমার জীবনটা দিনেদিনে করোলার মতো তেতো হয়ে যাচ্ছে। একদিন বিরিয়ানি খেয়ে দশদিন কাটাতে হয় তার স্বাদ স্মরণ করে করে!”
ভোর হতে একটু বাকি। রাতের শেষ প্রহর চলছে। চারিদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। নিশাচর পাখিগুলোরও দেখা নেই। তারাও হয়তোবা আপন সঙ্গীনির সাথে মজা লুটতে ব্যস্ত আছে। আপন মনে হেসে উঠলো এমাদ। তাকালো তারাভরা আকাশের দিকে। বিশাল আকাশে রাতের তারাগুলো মিটিমিটি জ্বলছে। আশেপাশে চাঁদ নেই। অবশ্য চাঁদ দেখার তেমন পিপাসাও তার নেই। গভীর কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে জ্বলন্ত সিগারেটে একটি টান দিয়ে ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে অনার আনা ব্যাগ খুলে গয়নাগাটি দেখলো এমাদ। তারপর টাকায় হাত বুলিয়ে তার গন্ধ নিতেই পাশ থেকে পল্টু বললো,
-“এসব পরে। আগে কাম কাজ সাইরা ল।”
-“তোরা কর.. আমার মুড নাই।”
-“একবারেই খতম? আমরা সক্কলে মিলা তিন-চার বার সাইরা ফেলছি। ভাই, খাঁসা মাল আনছিস ভাই.. খাঁসা মাল। জিন্দিগীতে এমন মাল আর পামু কিনা আল্লাহ মালুম!”
-“পাইছিস তো এখন কামড়ে ছিঁড়ে খা। আমাকে আমার কাজ করতে দে।”
-“তুই তাইলে আরেকবার মালটার স্বাদ লইবি না? পস্তাবি ভাই পস্তাবি।”
-“না, যা তো হারামজাদা। শালার এই এমাদ এক মালরে একবার খায়। ফুট বালের ছালা।”
-“সত্যিই হান্দাবি না? তাইলে যাই কবিররে কই। ওই ব্যাটা এমনিতেই মাল খাইয়া টাল হইয়া আছে।”
-“যারে ইচ্ছা বল। তাড়াতাড়ি কর। ভোর হবার আগেই অনারে সরিয়ে ফেলতে হবে কিন্তু।”
ঘন জংগলের মাঝে অনার নগ্ন নিথর দেহটি পড়ে রয়েছে। যা একনাগাড়ে কামড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে একেরপর এক মানুষরূপী কিছু জানোয়ারের দল। রাতে যথাসময়েই বেরিয়েছিল অনা। বুকভর্তি স্বপ্ন এবং এমাদের প্রতি অজস্র ভালোবাসা নিয়ে সে ছেড়ে এসেছিল বাড়িঘর, আত্মীয় স্বজন। অথচ সেই এমাদই তাকে ঠকালো! কী করে পারলো সে? চোখের কোণা বেয়ে নীরবে দু’ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়লো অনার। শরীর তার জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক কষ্ট হচ্ছে। কেমন যেনো ধীরেধীরে অনুভূতি শূন্য হয়ে পাথর হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা।
-“কী দরকার ছিল শুধুশুধু পালানোর? তোকে আমি এতবার না করার পরও কেনো শুনলি না তুই? খুব শখ পালানোর.. খুব শখ না?”
এমাদের গলার স্বর কানে আসতেই চোখজোড়া মেললো অনা। আবছা আলোয় এমাদের ভয়ংকর হিংস্র চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো বলহীন চোখে।
-“আমি ধরি খাই ছেড়ে দেই। এসব বিয়ে করা আমার ধাচে নেই। আর যেখানে তোর মতো স্টুপিড গাইয়া মেয়ে সেখানে তো প্রশ্নই উঠে না। যদিও এসবের কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। কিন্তু তোর জোরাজুরিতে পেরে না উঠেই শেষমেশ এই প্লানটা করলাম। টাকা গয়না সাথে একটা খাঁসা মাল। ছাড়ে কেউ? বল না.. ছাড়ে?”
অনার দুর্বলচিত্ত দেখে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটলো এমাদের। মুখ বাড়িয়ে অনার ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে সামান্য মাংস তুলে আনতেই কাতরিয়ে উঠলো অনা। মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজের রক্তমাখা ঠোঁট কামড়ে হাতের জ্বলন্ত সিগারেট অনার যোনিপথের কাছে আনলো এমাদ। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“আমি ছেলে ভালো.. তবে তোর মতো খেয়ে দেয়া মালদের কাছে আমি শয়তান। আমি নাকি ইবলিশও ফেইল। কীরে? আমি কি সত্যিই ইবলিশ ফেইল?”
সিগারেটের আগুনের স্পর্শ পেতেই চিৎকার করতে গিয়েও মুখে ঢুকানো কাপড়ের ফলে চিৎকার করতে পারলো না অনা। দূর্বল শরীরের অবশিষ্ট শক্তির জোরে এমাদের বুকে কষিয়ে লাথি দিতেই খানিকটা ফাকে লুটিয়ে পড়লো এমাদের শরীর।
-“শালীর ঘরের শালী! তুই আমারে লাথি দিস? বেশ্যা শালী, আমারে?”
পকেট থেকে ছুরি বের করে অনার দিকে তেড়ে এল এমাদ। রাগে তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে পড়েছে। মুহুর্তের মাঝেই এমাদ হাতের ছুরি দিয়ে মেরে দিল অনার গলায় একটান। প্রায় সাথেসাথেই ফিনকি দিয়ে রক্তের স্রোত ছিটে এসে লাগলো তার চোখমুখে। রক্তমাখা ক্রোধে ভরপুর চোখে সে তাকালো অনার উলঙ্গ শরীরের দিকে। যা ছটফট করতে করতে ধীরেধীরে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়লো শুকনো পাতার মাঝে।
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩২
‘আব্বা,
আমি যাচ্ছি… জানি ভুল কিছু করছি না আমি। সত্যি বলতে আপনাদের ঠিক করা সম্পর্ক আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এখন হয়তো ভাববেন নিশ্চিত আমার কারো সাথে সম্পর্ক রয়েছে। হ্যাঁ, আপনার ধারণাই ঠিক। আমি একজনকে পছন্দ করি। পছন্দ বললে ভুল হবে। আমি ভালোবাসি.. খুব ভালোবাসি। আর যেটি হজ্ব করে আসা নামের হাজী হিসেবে আপনি কখনোই মেনে নিতেন না। হাজীসাবের মেয়ে প্রেম করছে! তওবা তওবা! এমন হাজারো কথায় বিচলিত হয়ে আপনি বড়ভাই এবং মেজভাইয়ের মতো নিজের সিদ্ধান্তই আমার উপর চাপিয়ে দিতেন। এবং আমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিতেন। তাই আমি একরকম বাধ্য হয়েই পালানোর সিদ্ধান্তে আসলাম। জানি, আপনি আর কখনোই আমার মুখ দেখতে চাইবেন না। তবে আব্বা, আমি বিশ্বাস করি আমার ভালোবাসার মানুষটি আমায় সুখে রাখবে। আমি ভালো থাকবো আব্বা.. খুব ভালো থাকবো।
আপনার একমাত্র মেয়ে
অনা
বিদ্রঃ কিছু টাকা এবং আমার জন্য আপনার জমিয়ে রাখা গয়নাগুলো আমি আমার সাথেই নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে মাফ করে দেবেন আব্বা।’
অনার চিঠি হাতে খানিকক্ষণ থম ধরে বসে রইলেন আলাউদ্দিন শেখ। তারপর লোক দিয়ে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনালো চৈতালিকে। চেয়ারে হাতলে দুটো গুতো মেরে গম্ভীর গলায় বললেন,
-“অনা কার সাথে পালাইছে?”
-“মানে? অনা পালিয়েছে মানে?”
-“তামশা না কইরা ভালোয় ভালোয় সবটা খুইলা কও।”
-“চাচা আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না।”
আলাউদ্দিন শেখ অনার ফেলে যাওয়া চিঠি চৈতালির দিকে বাড়িয়ে ধরতেই তা হাতে নিল চৈতালি। সময় নিয়ে পুরোটা পড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। স্তব্ধতা তার কোনোভাবেই কাটছে না। অনা আর প্রেম! কিভাবে সম্ভব? তাকে তো এব্যাপারে কিছুই জানায়নি সে!
-“আমার মাইয়া কোনহানে আছে? কার সাথে পালাইছে সবটাই খুইটা খুইটা কও। নয়তো ওর পরিণতি ভয়ংকর হবো কইয়া দিলাম!”
আলাউদ্দিন শেখের কথায় দু’কদম পিছিয়ে পড়লো চৈতালি। চোখেমুখে এসে জড়ো হলো একরাশ আতংক। ঢোক চেপে ভাঙা গলায় কোনোমতে বললো,
-“বিশ্বাস করেন চাচা, আমি কিচ্ছু জানি না। অনা এব্যাপারে আমারে কিচ্ছু জানায়নি।”
-“এইডা বিশ্বাস করবার কও? এইডা? পরশু রাতেও তুমি ওর লগে ছিলা। কেন ছিলা জানি না মনে করছো? তুমি ওরে প্ল্যান কইরাই ভাগাইছো। কোন কুত্তার বাচ্চার লগে ভাগাইছো সেইডা কও।”
-“চাচা সত্যিই আমি কিছু জানি না। আমি জানলে কি ওকে থামাতাম না? বিশ্বাস করেন ও আমাকে কিছুই বলেনি।”
উদ্বিগ্ন হলেন আলাউদ্দিন শেখ। চৈতালিকে আর কিছুই না বলে উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। আপাতত তাকে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। নতুবা এসব পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেলে বড্ড বিপদে পড়তে হবে তাদের। দোতালায় উঠে এসে আলাউদ্দিন শেখ নিজের ঘরে খানিকক্ষণ পায়চারী করার পর কল করলেন মেসবাহর নাম্বারে। তার এই বিপদে আপাতত তিন ছেলেকেই তার পাশে দরকার। যাদের মুখের দিকে তাকিয়েই দূর্বল শরীরে বল খুঁজে পান তিনি।
পড়ন্ত বিকেলের তীব্র রোদে পুরো শরীর ঘেমে শার্ট ভিজে উঠেছে মেসবাহর। অসহ্য লাগছে এই সময়টি। আচ্ছা.. পড়ন্ত বিকেলের রোদও কি এতটাই তীব্র হয় নাকি কঠিন এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে হাঁপিয়ে উঠছে? পারছে না লড়তে সে এই নির্মম সত্যির সঙ্গে? কপালের ঘাম মুছে মর্গ লেখা ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ালো মেসবাহ। তার পাশেই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের নখ কামড়ে যাচ্ছে মুবিন। গ্রামে এসে পৌঁছনোয় তাদের অনেক সময় হয়ে এসেছে। সকালে বাবার ফোন পেয়ে অনার পালানোর খবর শুনে আর একদন্ডও দেরি করেনি মেসবাহ। উল্লাসী এবং সুহাকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়েছিল গ্রামের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ পথ যাত্রার পর বাড়ি এসে পৌঁছে বেশ আলোচনার পর থানায় একটি মিসিং কমপ্লেইন করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিল সকলে মিলে। তার প্রায় কিছুক্ষণ পরেই সে মুবিনকে সাথে নিয়ে চলে এসেছিল থানায়। তবে থানায় আসার পর পাশের গ্রামের গ্যাং-রেপের কবলে পড়া এক মেয়ের গলা কাটা লাশ উদ্ধারের কথা শুনে গলা শুকিয়ে এসেছিল দু’ভাইয়ের। কিন্তু শেষমেষ পুলিশের কথামতো তাদের অনিচ্ছা থাকা সত্বেও আসতে হয়েছে গ্রামের সরকারি হাসপাতালে।
-“অনা তো পালিয়েছে। অনা এখানে থাকতে পারে না।”
মুবিনের কথা শুনে তার দিকে তাকালো মেসবাহ। ঘাড় নেড়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“হ্যাঁ..”
-“তাহলে আমরা এখানে কেনো আসলাম? আমার একদম ভালো লাগছে না৷ মেজভাই চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই।”
-“যাবো.. ওরা যেহেতু বলছে একটাবার দেখেই যাই।”
-“অনা পালিয়েছে.. এই মেয়ে অনা কখনোই হতে পারে না।”
কথা বাড়ালো না মেসবাহ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মর্গের সামনে। মুবিনের কথাটিই যেনো ঠিক হয় তা সেও মনে প্রাণে চাইছে। তবে পুলিশের আশংকা মতে এই মেয়েটিই যে অনা!
-“আসুন..”
ফর্সা ছিমছাম বর্ণের রোগা পাতলা একটি ছেলের ইশারা পেয়ে তার পিছু পিছু মর্গের ভেতরে ঢুকতেই বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো মেসবাহর। বড়সড় এই ঘরটি বেশ শীতল। দু’পাশের দেয়ালে বেশ কিছু ফ্রিজারে ঠাসা। মাঝে কিছু স্ট্রেচার। যাতে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে প্রাণহীন কিছু দেহ রাখা। আশপাশ থেকে নজর সরিয়ে চোখজোড়া বুজে লম্বা একটি শ্বাস ছেড়ে পেছনে ফিরলো মেসবাহ। চোখের পলক ফেলে মুবিনকে আস্বস্ত করে এগুলো কয়েক কদম।
-“তাড়াতাড়ি দেখবেন। আমার ডিউটি শেষ। তবুও আপনাদের জন্য আমার এখনো হাসপাতালে থাকা লাগতেছে। একটু আগে আসতে পারেন নাই? গোয়ার গোড়ায় গু না আসলে আপনাদের হাগা বাড়ায় না?”
খানিকক্ষণ আগে রোগা পাতলা ছেলেটিকে দেখে মেসবাহর মনে মায়া কাজ করলেও তার মুখে এমন কথা শুনে মেজাজ খারাপ হলো তার। কড়া কিছু কথা শোনানোর জন্য মুখ খোলার ইচ্ছে থাকলেও স্ট্রেচারে রাখা নিষ্প্রাণ দেহটির মুখ থেকে কাপড় সরাতেই সেদিকে নজর গেলো মেসবাহর। সাথেসাথেই তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। রক্তমাখা ছিন্নবিচ্ছিন্ন মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল মেসবাহ। খানিকদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মুবিনের দিকে চেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।
পুরো হাজী বাড়িজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাড়ির ছোট মেয়ে অনা খুন হয়েছে। একদল মানুষ তাকে ধর্ষণ করে গলা কেটে ফেলে রেখে গিয়েছিল ঘন জংগলের মাঝে। যা সকালে এক গ্রামবাসীর চোখে পড়ায় তা পুলিশের নির্দিশে মর্গে রাখার পর মেসবাহ এবং মুবিন মিলে নিয়ে এসেছে বাড়িতে। মৃতদেহটি এনে রাখা হয়েছে উঠোনের মাঝবরাবর। অল্প সময় হলো লাশ আনায় লোকজনের উপস্থিতিও খুব কম। লাশের পাশেই একদল মাদ্রাসার ছাত্ররা জড়ো হয়েছে দোয়াদরুদ পড়ার কাজে। সেখানে বসেই তারা জোর গলায় কোরআন পাঠ করে যাচ্ছে। তারই বিপরীত পাশে বসে চিৎকার করে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছেন মোরশেদা বেগম। তার করুণ আর্তনাদ দেখে আশেপাশের মানুষের হৃদয়ও কেঁদে উঠছে। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানির স্রোত।
-“কাল রাতেই খাইতে বসে মেয়ে আমায় কয় আম্মা আমারে একটু খাওয়াইয়া দাও রে। আমি কই ঢেঙ্গী মেয়ে কী কয় রে! আমি আমার মেয়েরে শেষ খাওয়া খাওয়াইয়া দিলাম নারে।”
মোরশেদা বেগমের আহাজারি শুনে পাশ থেকে বয়স্কমতো এক মহিলা শান্তনা দিতেই আরও ব্যাকুল স্বরে কেঁদে উঠলেন তিনি। হাতপা মেলে মাটি থাপড়িয়ে থাপড়িয়ে বলতে লাগলো,
-“খাইতে বসে মৌমিরে কোলে নিয়ে কয় ফুপু তুই আমাকে ভালোবাসিস? মৌমি ওর গালে চুমা দিয়ে কয় আম্মুর থেকেও অনেক ভালোবাসি তোমায় ফুপুরে। ওর বাপের কাছে কয় আব্বা তুমি আমার আর মৌমির মধ্যে কারে বেশি ভালোবাসো? ওর বাপ হাইসা কয় মৌমিরে বেশি ভালোবাসিরে। মেয়ে আমার রাগ কইরা আমারে আইসা কয় আম্মা আব্বারে বলো অনাও তার আব্বার থেকে আম্মারে বেশি ভালোবাসেরে। আমার পরির মতো মেয়ে আর কখনোই ওর বাপের সাথে রাগ করবো নারে। কোন কুত্তার দলেরা আমার মেয়েরে খাঁমচে ছিঁড়ে খাইছেরে। আমার মেয়ে কতই মনে হয় চিৎকার করছেরে। কতই মনে হয় কষ্ট পাইছেরে।”
-“শান্ত হ বোন। শান্ত হ।”
-“কেমনে শান্ত হমুরে? আমার তাজা ধরফরা এক মাইয়ারে কেমনেই মনে হয় ওরা মারছে রে! গলা কাটার পর আমার মেয়ে মনে হয় কেমন ছটফট করছেরে! এত কষ্ট আমার মেয়ের কপালেই কেন লিখা রাখছিল আল্লাহ মালিকরে?”
-“আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। একটু ধৈর্য ধর বোন।”
-“আমি কেমনে ধৈর্য ধরমু? আমারে কী আল্লাহ চোখে দেখছিলো না? আমারে রাইখা আমার মেয়েরে কেন নিলরে? আমার মেয়ে মনে হয় কেমনে ছটফটাইছে রে! ওই কুত্তা গুলা কতই কষ্ট দিছে আমার মেয়েরে রে। মেয়ে আমার আর কখনোই আমার বুকে আসবেনারে। সাজার জিনিস কিনবার জন্য আমার কাছে টাকা চাইবেনারে। আমার গালে চুমা দিয়ে কইবো না আম্মা ভাইয়েরা আসলে এবার বেশি করে টাকা আমার জন্য চাইবারে। আমি কেমনে বাচমুরে? বুড়া বয়সের কত সাধনার পর এই মেয়েটারে পাইছিলামরে। কিন্তু আল্লাহ তারেই আমার কোল থেকে আগে কাইরা নিলরে! আমার বুক খালি কইরা তারে নিয়া গেলরে। ওই হারামিরা আমার মেয়েরে কত্ত কষ্ট দিয়ে মারছে রে..”
খবর পাওয়ামাত্র বাড়ি থেকে ছুটে এসে মোরশেদা বেগমের করুণ আর্তনাদ ধ্বনি শুনে তার দিকে পা বাড়ালো চৈতালি। তবে কয়েক কদম এগুতেই পাশ থেকে বাঁধা অনুভব করলো সে।
-“এদিকে এসো..”
আচমকা মুবিনের টানে হকচকিয়ে গেল চৈতালি। ব্যথাতুর মুখে সে মোরশেদা বেগমের দিকে চেয়ে বললো,
-“আগে চাচির কাছে যাই।”
-“না, তুমি ওদিকে যাবে না।”
-“কেনো?”
চৈতালির প্রশ্ন উপেক্ষা করে তাকে এক টানে বাড়ির এক কোণায় এনে দাঁড় করালো মুবিন। চোখেমুখে স্পষ্ট ক্রোধ ফুটিয়ে বললো,
-“তুমি এত হিংসে করতে অনাকে? এত? ছিঃ! চৈতালি। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কী করে পারলে তুমি এগুলো করতে?”
চোখজোড়া প্রসস্থ হয়ে এল চৈতালির। বিস্মিত গলায় সে বললো,
-“কী যাতা বলছো এসব!”
-“যাতা বলছি? যাতা? তুমি পরশু রাতে অনার সাথে ছিলে না? এমনকি কাল রাতেও তোমার ওর সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে। হালিমা চাচি নিজে শুনেছেন অনাকে তোমার সাথে কথা বলতে।”
-“হ্যাঁ, অনা আমায় কল করেছিল। কিন্তু ও তো আমায় এসব কথা বলেনি। বিশ্বাস করো মুবিন।”
-“তাহলে কেনো কল করেছিল?”
-“তুমি আজ আসবে সেকথা জানতে।”
-“হাসালে! বোকা পেয়েছো আমায়? আমি আজ আসবো তা কাল কী করে জানবে অনা?”
-“আমি জানি না। সত্যিই আমি জানি না।”
-“তুমি জানো চৈতালি। আর তুমি ইচ্ছে করেই ওকে এমন একটি কাজ করাতে বাধ্য করিয়েছো!”
-“পাগল হয়েছো তুমি? আমি কেনো এসব করবো?”
-“কারণ তুমি অনার অবস্থানকে হিংসে করতে। পরিবারের ভালোবাসা, ভাইদের আদর সবকিছুকে তুমি হিংসে করতে। আমি অনাকে না তোমাকে কাকে বেশি ভালোবাসি তাও কিন্তু তুমি একদিন প্রশ্নও করেছিলে।”
-“প্রশ্ন আমি মজার ছলে করেছিলাম। তুমি বিশ্বাস করো আমি কিছু জানি না। ও আমায় কিছু জানালে কখনোই আমি ওকে পালানোর মতো জঘন্য একটি কাজ করতে দিতাম না।”
লম্বা একটি দম ছাড়লো মুবিন। ঠোঁটজোড়া চেপে কান্না থামানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বললো,
-“তুমি দায়ী চৈতালি।”
কেঁদে উঠলো চৈতালিও। ক্রন্দনরত গলায় বললো,
-“আমি দায়ী নই। তুমি কেনো এমনটা বলছো? অনা আমার ছোটবেলার বান্ধবী। তোমার চেয়ে বেশিরভাগ সময় ও আমার সাথে কাটিয়েছে। ও আমার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ। ওর ক্ষতি আমি কখনোই চাইতে পারি না।”
-“কাছের মানুষ, বান্ধবী.. অথচ অনা তোমায় কিচ্ছুটি জানায়নি? এসব গাঁজাখুড়ি কথা বিশ্বাস করতে বলো আমায়?”
-“হ্যাঁ বলি। আমার আর তোমার মাঝের সম্পর্কের ব্যপারেও কিন্তু আমি অনাকে কিছুই জানাইনি। তাহলে অনা না জানালে সেটা অস্বাভাবিক কেনো হবে?”
-“কারণ এটা ওটা ভিন্ন ব্যাপার। না তোমার ভাই আছে আর না অনা তার সাথে প্রেম করেছে!”
হাটুজোড়া ভাজ করে বসে পড়লো চৈতালি। মুবিনের দু’পা আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো সে।
-“আল্লাহর কসম.. অনা আমায় জানায়নি। আমার যে কী পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তা আমি কাওকে বলে বোঝাতে পারবো না, মুবিন। প্লিজ সবার মতো তুমি অন্তত আমায় ভুল বুঝো না!”
-“তুমি এখান থেকে যাও। তোমার ছায়া আমার বোনের আশেপাশে থাকলেও ওর আত্মার কষ্ট হবে। তুমি যাও এখান থেকে…”
চৈতালির হাতের মাঝ থেকে পা ছাড়িয়ে উঠানের দিকে এগুলো মুবিন। কষ্টে তার বুকের ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কেনো করলো চৈতালি এমনটা? কেনো তার বোন তাকে ফেলে চলে গেল পরপারে? আর কখনোই বোনের দেখা পাবে না সে। আর কখনোই তাকে মাথা বানিয়ে দেবে না। কখনোই বলবে না বিনামূল্যে আমি কোনো কাজ করিনা ভাই!
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩৩
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। সূর্য অস্তের সাথেসাথে অনাও ধীরেধীরে অস্ত হয়ে গেছে সকলের জীবন থেকে। পৃথিবীর সকল দুঃখকষ্টকে তুচ্ছ করে সে হারিয়ে গেছে দূর ওই বিশাল আকাশে। যেখান থেকে চাইলেও আর কখনোই ফিরতে পারবে না তাদের মাঝে। কেনো করলো অনা এমনটা? এই ছিল তার ভালোবাসা? কেনো একটিবার তাকে জানালো না তার মনের কথাগুলো? অঝোর ধারায় চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়াতেই বালিশে মুখ ডুবালো চৈতালি। কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভেতরটা বারবার মুচড়ে উঠছে। বারবার কানে ভেসে আসছে অনার বলা একেকটি কথা।
-“খাইতে আয় চৈতালি।”
শেফালী বেগমের ডাক শুনে উঠে বসলো চৈতালি। চোখজোড়া মুছে ভাঙা গলায় বললো,
-“অনার মাটি হয়ে গেছে?”
-“হইছে। তোর আব্বা জানাজা করে মাত্রই আইলো।”
-“অহ..”
কষ্টগুলো দলা পেকে গলায় এসে আঁটকে গেল চৈতালির। ঠোঁট চেপে আবারও বিছানায় শরীর মেলে দিল সে। বুকের ভেতরটা তার হাহাকারে ভরে উঠেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনার হাসিমাখা মুখের প্রতিচ্ছবি। কী করে অন্ধকার ওই মাটির ঘরে একলা রাত কাটাবে অনা? আর ফিরবে না সে.. কখনোই ফিরবে না। তাকে চিতৈ পিঠা বলে ঢাকবে না। তার সঙ্গে অভিমান করবে না। তার হাতে ব্যাগ চাপিয়ে দিয়ে বলবে না তুই যা, আমি আসছি। কেনো অনা তাকে কিছু না জানিয়েই পালিয়ে গেল? কার সাথেই বা গেল? কে ওকে এইভাবে কষ্ট দিয়ে মারলো? ওরা কি অমানুষ? ওদের ভেতরে কি সামান্য মায়া নেই? যেই মেয়েকে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেও চিৎকার করে উঠতো সেই মেয়ে কী করে সহ্য করেছে এত অত্যাচার? খুব কষ্ট হয়েছে তোর? বলনা অনা.. খুব কষ্ট দিয়েছে ওরা তোকে? কেঁদেছিস? চিৎকার করেছিস? তবুও ছাড়েনি ওরা তোকে? তুই কেনো মানুষ চিনলি না? ভুল মানুষের হাত ধরে কেনো তুই ঘরছাড়া হলি? আমি মানতে পারছিনা। আমার বুকের ভেতরটায় প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। ফিরে আয়না অনা.. একটিবার ফিরে আয়।
-“এখন কেঁদে কেটে কী হইবো? যখন মেয়েটা চলে গেলো তখন না করতে পারোস নাই?”
অশ্রুসজল চোখে মায়ের দিকে তাকালো চৈতালি। ক্রন্দনরত গলায় বললো,
-“আমি জানলে বারণ করতাম না? মা আমি সত্যিই জানি না। অনা কিচ্ছু জানায়নি আমাকে।”
-“দুই বান্ধবীর গলায় গলায় ভাব। অথচ এই প্রেম পিরিতির কথা ও তোরে বলে নাই এইডা কেউ বিশ্বাস করবো.. বল?”
-“অন্যরা না করলো। কিন্তু আমার কাছের আপন মানুষগুলিই যদি আমায় বিশ্বাস না করে তখন মরে যেতে ইচ্ছে হয় মা।”
মেয়ের পাশে এসে বসলেন শেফালী বেগম। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
-“তুই আর অনা সারারাত দিন এক সাথে থাকছোস। এতে সবার মনে তোরে নিয়ে প্রশ্ন জাগা ভুল কিছু না। আমি তোর মা। তোর আপনজন। তোর কথায় আমার আস্থা থাকলেও ওদের থাকবে না।”
মুবিনের কেনো নেই? মুখে আসা কথা গিলে ফেললো চৈতালি। মুবিন যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তাতে এখন ওকে বুঝিয়েও লাভ হবে না। আর কেউ না জানলেও মুবিন খুব ভালো করেই জানে অনার ঠিক কতটা কাছের মানুষ সে। সেখানে প্রেম বিষয়ক কথা অনা তাকে জানাবে না! সত্যিই এটা মানা যায়না…
-“কত কী বলতেছে পাড়ার মানুষ মেয়েটাকে। চরিত্র খারাপ, যা হইছে ভালো হইছে। বাবামায়ের মুখে যেমন চুনকালি মাইখা ভাইগা যাইতেছিল তেমন প্রেমিক তারে ভইরা দিছে। চরিত্রহীন মেয়ের কপালে চরিত্রহীন ছেলেই জোটে। হ্যান ত্যান নানান কথা। কানে নেয়ার মতো না।”
মায়ের কথার পিঠে দীর্ঘশ্বাস ফেললো চৈতালি। উঠে বসে ধীর গলায় বললো,
-“অনা ওমন মেয়ে না মা। তুমি তো জানো। ও মা তুমিও কি ওদের কথা বিশ্বাস করো?”
-“না.. এসব কথা তোরে বলার একটাই উদ্দেশ্য। পাড়ার মানুষেরা যেমন ওরে নিয়ে বাজে কথা ছড়াইতেছে তেমন তোরে নিয়েও ছড়াইতেছে। তুই নাকি সব জানতি। দুই বান্ধবি একসাথে মিলেই কলেজে যাবার নাম করে নষ্টিফষ্টি করে বেড়াতি। আবার কিছু মানুষ তো বলতেছে তুই-ই অনারে মতলব কইরা মারছোস। এমনকি এইডা অনার মাবাপও বলতেছে।”
কান্নার বেগ ক্রমশ বেড়ে গেলো চৈতালির। মায়ের দু’হাত চেপে ধরে ব্যাকুল সুরে সে বললো,
-“আমি অনারে মারিনি মা। অনা আমাকে কিছুই জানায়নি। ওরা কেনো সবাই এসব বলছে? কেনো ওরা একটিবারও আমাকে অনাকে দেখতে দিল না? ও আমার কী ছিল তা কি কেউ বোঝে না?”
-“তুই আর যাবি না ওদের বাড়িতে চৈতালি। শোন, শান্ত হ। আমার কথা মন দিয়ে শোন।”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্তনা দিলেন শেফালী বেগম। অনার মৃতদেহ থাকতেই চৈতালিকে যাতা কথা শুনিতে ওই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে হাজীসাব। অনাকে শেষ দেখাও দেখতে দেয়নি মেয়েটাকে। এতটা পাষাণ কী করে হতে পারে মানুষজন? যেখানে তাদের কাছে ছোটবেলা থেকেই মানুষ হয়েছে চৈতালি! বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল শেফালী বেগমের। গলার স্বর খানিকটা নরম করে তিনি বললেন,
-“সবুজ আছে না? তোদের সবুজ স্যার? উনি একমাস আগে বিয়ের প্রস্তাব দিয়া পাঠাইছিল। কিন্তু তোর আব্বা তখন সময় নিছিলো। ইন্টারটা দেয়ার পর আগাইতে চাইছিলো। কিন্তু আজ অনারে মাটি দিয়া আসার পর উনি সবুজরে কল দিয়া কাল ওর বাড়ির বড় দুই একজনরে নিয়া আসতে বলছে। চুপেচাপেই আংটি পড়াইয়া রাইখা যাবে। মা, তুই তো দেখতেছিস আশেপাশের অবস্থা। মানুষ যা নয় তাই বলতেছে। অনা মরে গিয়ে বাইচা গেছে। কিন্তু তুই তো বাইচা আছোস। তোর তো একখান জীবন আছে। এসব কথা শুনলে পরের বাড়িতে কেউ তোরে নিব? নিব না। তাছাড়া সবুজ ছেলে খারাপ না। আচার ব্যবহার নাকি খুব ভালো। টাকা পয়সাও আছে।”
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো চৈতালির। বিস্ময় নিয়ে মায়ের দিকে চাইতেই সে আবারও বলে উঠলেন,
-“যুগ জামানা তো দেখলামই। অনার সাথে ঘইটা যাওয়া ঘটনা সবার মনেই আঘাত করছেরে। এই ঘটনার পর তোর আব্বাও তোরে আর বিশ্বাস করতে পারতেছে না। উনার মনে একটাই ভয়, তুই আবার এমন কিছু ঘটাবি না তো! তার মেয়েকেও অনার মতো হারাতে হবে না তো তার!”
-“তাই বলে বিয়ে? এটা কোনো কথা?”
-“কেন? তোর এতে মত নাই?”
-“না.. কখনোই না। আমি উনাকে মরে গেলেও বিয়ে করবো না। পাগল হয়েছো তোমরা?”
মেয়ের গলার স্বর ক্রমেই উঁচু হচ্ছে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন শেফালী বেগম। দরজার দিকে এগুতে এগুতে বললেন,
-“আমি ওসব জানি না। তোর মত না থাকলে তোর আব্বারে তুই বল। তাও ভাইগা যাইস না। অনারে তো দেখলি। ওর থেকেও যদি শিক্ষা না নিতে পারোস তাইলে এইডা আমার লালন পালনের দোষ। খাইতে আয়…”
শেফালী বেগম বেরিয়ে যেতেই উঁচু স্বরে কেঁদে উঠলো চৈতালি। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? আব্বা.. সে কী ওর কথা শুনবে? তাছাড়া কী বলেই বা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে সে? মুবিনের কথা বলে? যে মুবিন তার চেহারাও দেখতে চায় না! বিছানার চাদর খামচে নিজের কাছে নিয়ে এল চৈতালি। বালিশ ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। দুই হাটুর মাঝে মাথা গুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। অনা.. তুই কেনো করলি এমনটা আমার সাথে? কেনো তুই এভাবে সকলের চোখে আমাকে দোষী বানিয়ে চলে গেলি? এখন কী করবো আমি, অনা? একটা উপায় অন্তত বলে দে আমায়…
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩৪
নিঝুম রাত। কোলাহলে মুখরিত করে রাখা প্রাণ হারিয়ে পুরো হাজীবাড়ি জুড়ে নেমে এসেছে নীরবতা। আশেপাশে নেই কোনো পাখির কুজন, নেই কোনো মানুষের কোলাহল। শুধুই কানে ভেসে আসছে টিপটিপ করে পড়তে থাকা বৃষ্টির শব্দ। অনাকে মাটি দিয়ে আসার পর থেকেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। মানুষের সঙ্গে কি তাহলে আকাশ-পাতালও কাঁদছে? তারাও কি মেনে নিতে পারছে না তার এই মর্মান্তিক মৃত্যুকে? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল উল্লাসীর। আপনজন হারানোর কষ্ট তার অজানা নয়। ছোটকালে মাকে হারানোর পর এই কষ্ট দিনের পর দিন মাসের পর মাস উপলব্ধি করে এসেছে সে। এ কষ্ট যে সকল কষ্টের উর্ধ্বে। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে রান্নাঘর ঢুকলো উল্লাসী। মৃত বাড়ি হওয়ায় আজ তাদের বাড়িতে উনুন ধরানো হয়নি। আশেপাশের দু’এক বাড়ি থেকে ভাত ডাল দিয়ে গেছে। যা যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেভাবেই পড়ে রয়েছে। কে খাবে এসব? কারো খাবার মতো পরিস্থিতি রয়েছে? খাবার সব ঢেকেঢুকে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো উল্লাসী। লম্বা বারান্দা ধরে খানিকটা সামনে এগিয়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো বৃষ্টির দরুন আঁধারে চিকচিক করা উঠোনের দেকে। বৃষ্টির তেজ ক্রমেই বাড়ছে। সারারাত এভাবে বৃষ্টি চলতে থাকলে অনার কবরের কোনো ক্ষতি হবে না তো! তার বাবার বাড়ির পাশের বাড়ির রহমত নামের এক চাচার মৃত্যু দিনেও এভাবে মুশলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। যার কারণে তার কবর ঢসে পড়েছিলো। অনার ক্ষেত্রেও কি তেমন হবার আশংকা রয়েছে? মনে চলা প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেলেও উঠোনে কারো অস্তিত্ব লক্ষ্য করলো উল্লাসী। চোখজোড়া প্রসস্থ করে সেদিকে ভালোভাবে তাকাতেই দেখতে পেল চৈতালিকে। আকাশ-পাতাল ফেটে পড়া বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সে এগিয়ে আসছে তারই দিকে।
-“আপনি এখানে? এতরাতে?”
-“আমার একটা উপকার করবে উল্লাসী?”
-“আগে আপনি উপরে উঠে আসুন। পুরো শরীর ভিজে গেছে একদম!”
ভেজা শরীরে জবুথবু হয়ে চৈতালি বারান্দায় উঠতেই তার দিকে এগিয়ে গেল উল্লাসী। অনেক্ক্ষণ যাবৎ বৃষ্টিতে ভেজার ফলে ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। কিন্তু এত রাতে বৃষ্টিতে ভিজে কেনো সে এসেছে এবাড়িতে?
-“মুবিনকে একটু ডেকে দেবে? প্লিজ উল্লাসী। না করোনা! আমি অনেক্ক্ষণ হলো অপেক্ষা করছিলাম।”
-“মুবিন ভাইকে? কিন্তু উনাকে কেনো? কিছু হয়েছে?”
-“না.. তুমি কাওকে কিছু না জানিয়ে প্লিজ ওকে ডেকে দাও। আমি রান্নাঘরের ওই কোণাটায় অপেক্ষা করছি।”
চৈতালির ব্যাকুল স্বর শুনে মায়া হলো উল্লাসীর। পেছন ফিরে দু’কদম এগিয়ে থেমে গেল সে। পাশ ফিরে ক্ষীণ গলায় বললো,
-“আপনি অনা আপাকে পালাতে নিষেধ করেন নি কেনো?”
-“আমি কিছুই জানতাম না উল্লাসী। অনা আমাকে জানায়নি..”
কথা বাড়ালো না উল্লাসী। দোতলায় উঠে মুবিনের খোঁজে তার ঘরে ঢুকলেও তার দেখা না পেয়ে সে এগুলো দক্ষিণের একদম কোণার ঘরটির দিকে। ঘরটি অনার। বড়সড় সেই ঘরের মালিকের স্থান আজ সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে। জগতের কত অদ্ভুত নিয়ম না? দুনিয়ায় জীবনে ঘর যত বড়ই হোক না কেনো কবরের পরিমাপ নির্দিষ্ট..
তিন ভাই নীরবে বসে রয়েছে অনার বিছানায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নীরবতা ঘিরে ধরেছে তাদের। অজস্র স্মৃতিরা এসে বুকের ভেতরটায় তুফান তুলে দিয়েছে। এ তুফানের গভীরতা যত তীব্রই হোক না কেনো এর কোনো ধ্বনি নেই। নিঃশব্দে যে তুফান উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে মনের অন্তস্তল।
-“মুবিন ভাই? একটু আসবেন?”
উল্লাসীর গলার আওয়াজে অতীতের স্মৃতিচারণ থেকে বেরিয়ে এল মুবিন। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দু’ভাইয়ের মাঝ থেকে উঠে পড়লো সে। অদ্ভুত এক কষ্ট হচ্ছে তার বুকের ভেতরে। গতকাল রাতেও এসময় এঘরে অনার বিচরণ ছিল। অথচ তা শূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। ঘরে মানুষের উপস্থিতি থাকলেও তা সেই শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। যেনো ঘরের প্রতিটি জিনিস নিজেদের শূন্যতা জানান দিতে হাহাকার করে ডেকে যাচ্ছে অনার নাম ধরে। ফিরে আয় অনা.. ফিরে আয়।
উল্লাসীর পিছুপিছু রান্নাঘরের দিকে আসতেই বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো মুবিনের। সে প্রচুর ভেবেছে চৈতালিকে নিয়ে। চৈতালি আর যাই হোক মিথ্যা বলার মতো মেয়ে নয়। তাছাড়া আর কেউ না জানলেও সে তো জানে অনাকে ঠিক কতটুকু ভালোবাসতো চৈতালি। তবে সবকিছুর পরে কোথাও একটি কিন্তু থেকে যায়। সকলের মনে থেকে যায় প্রশ্নের ঝুড়ি। নিজের মনের সেই প্রশ্নের উত্তর গুলো নিজে খুঁজে নিলেও সে পারবে অন্যের মনের প্রশ্নগুলোর উত্তর জোগাড় করতে। অনা সেই পথ রেখেই যায়নি…
-“সবার মতো তুমিও আমায় অবিশ্বাস করলে?”
চৈতালির প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুবিন। পাশ ফিরে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটার দিকে চেয়ে বললো,
-“এত বৃষ্টির মাঝে কেনো এখানে এসেছো তুমি?”
-“কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে।”
-“আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
-“কিন্তু আমি জানতে চাই। না জানা অব্দি আমি একপাও এখান থেকে নড়বো না।”
-“পাগলামি করো না!”
-“তোমাদের আচরণে কী আমার পাগলামি করাই উচিৎ না? অনা আমাকে কিচ্ছুটি বললো না। তুমি আমার কাছ থেকে কিচ্ছুটি শুনলে না। আমার সাথেই কেনো?”
ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো চৈতালি। ঠান্ডায় তার পুরো শরীর ধীরেধীরে অবশ হয়ে আসছে। নিজেকে সামলাতে দুইহাতের মুঠ
চেপে ধরলো সে। ক্রন্দনরত গলায় বললো,
-“অনাকে হারিয়েছি… তোমাকে হারাতে পারবো না। আব্বা সবুজ স্যারের সাথে বিয়ের কথা বলছে। কাল উনারা আংটি পড়াতে আসবে। আব্বাও আমাকে তোমার মতো অবিশ্বাস করে মুবিন। আর দশটা মানুষের মতো সেও ভাবে আমি আর অনা খারাপ মেয়ে। আমিও অনার মতো খারাপ কিছু ঘটাবো। আর এজন্যই উনি খুব দ্রুত আমায় বিয়ে দিয়ে দিতে চান। কেউ কেনো বুঝতে চাইছে না মুবিন? কেনো কেউ সত্যটা জানার চেষ্টা করছে না? সবাই কেনো অনাকে খারাপ বলছে? অনা খারাপ মেয়ে নয়। আমরা কখনো কোনো খারাপ কাজ করিনি।”
দম ছাড়লো চৈতালি। কয়েক কদম এগিয়ে এসে মুবিনের হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
-“তুমি কিছু বলছো না কেনো মুবিন? বিশ্বাস করো অনা আমায় কিছু জানায়নি। তুমি কিছু করো.. প্লিজ তুমি কিছু করো।”
চৈতালির চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে তীক্ষ্ণ গলায় মুবিন বললো,
-“কী করতে বলছো তুমি আমায়? বিয়ে?”
-“না..”
-“তাহলে?”
মুবিনের ছোড়া প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না চৈতালি। আসলে কী চাইছে সে? বিয়ে না মুবিনের সঙ্গ? দুটো সমীকরণই কি এক হয় গেল না?
-“আজ আমার বোন মারা গেছে। কাল আমি বিয়ে করবো? তাও সেই মেয়েকে যাকে আমার পরিবারের সকলে অনার মৃত্যুর জন দায়ী ভাবছে। এটা আদৌ সম্ভব?”
বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো চৈতালির। আহত গলায় সে বললো,
-“তাহলে আমি কী করবো মুবিন?”
-“জানি না। তোমার আর তোমার পরিবারের মনে এতই যদি আনন্দ লেগে থাকে তাহলে অপেক্ষা না করে বিয়ে করে ফেলো। হু কেয়ার্স?”
হন্য পায়ে দোতলায় উঠে গেল মুবিন। তার যাত্রাপথের দিকে খানিকক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর উঠোন ভর্তি জলে নেমে পড়লো চৈতালি। আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। সেই সাথে শান্ত গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে হেটে চলছে চৈতালি। বুকের বামপাশটায় তার প্রচুর ব্যথা হচ্ছে। ঠান্ডায় হাত পা জমে আসছে। তবুও থামলো না সে। দ্রুতপদে এগুলো নিজের বাড়ির দিকে। অপেক্ষা নাকি শুদ্ধতম ভালোবাসার একটি চিহ্ন! সেও তো অপেক্ষা করেছিল মুবিনের। কিন্তু মুবিন কী তার অপেক্ষার মান রাখতে পেরেছে? পরিস্থিতি অনুকূলে থাকুক বা প্রতিকূলে, একটি ভালোবাসা তখনই পূর্ণতা পায় যখন তার ভালোবাসার মানুষটি ঝড়ঝাপটা আসলেও তার হাত ধরে রাখে। কিন্তু মুবিন তা করলো না। সকল ভালোবাসার সঙ্গাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ছেড়ে দিল তার হাত।
সুহা ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক্ক্ষণ। বেচারি গতকাল রাতে দুটোর পর ঘুমিয়েছিল। দিনে জার্নি, দৌড়ঝাঁপ সব মিলিয়ে বেশ মিইয়ে পড়েছিল। তাই সকাল সকালই মৌমি এবং সুহাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল উল্লাসী। সকল কাজ শেষে ক্লান্তি মেটাতে সুহার পাশে এসে শুয়ে পড়লো উল্লাসীও। বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এর মাঝে কেনো এবাড়িতে এল চৈতালি? আর কেনইবা মুবিনকে ডাকলো? যেখানে বিকেলে যাচ্ছেতাই বাজে কথা শুনিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন তার শশুর? বিষয়খানা বোধগম্য হলো না উল্লাসীর। উদ্বিগ্ন মনে চোখজোড়া বুজে সুহাকে জড়িয়ে ধরতেই দরজাই খিল দেবার শব্দ পেল সে। উনি এলেন নাকি? চোখ মেলতেই মেসবাহর ব্যথিত মুখ দেখে বুকের ভেতটায় ধুকপুক করে উঠলো উল্লাসীর। উঠে বসার জন্য তোড়জোড় করতেই ওপাশ থেকে মেসবাহ বলে উঠলো,
-“তুমি উঠছো কেনো? শুয়ে থাকো।”
সুহাকে মাঝখান থেকে একপাশে সরিয়ে মাঝে এসে শুয়ে পড়লো মেসবাহ। চোখজোড়া বুজে লম্বা একটি দম ছেড়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“অনা কালও এসময় হয়তো জীবত ছিল।”
-“হুম..”
-“এত কষ্ট হচ্ছে.. বুকের ভেতরটায় যেন কেউ পাথর বেধে রেখেছে।”
-“আপনি কাঁদছেন না কেনো? আপনার মার মতো আপনিও কাঁদুন। দেখবেন হালকা লাগবে।”
উল্লাসীর কথার পিঠে কিছু বললো না মেসবাহ। কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভনভনিয়ে ঘোড়া ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“অনা কি তোমাকে কারো কথা বলেছিল? ঢাকায় তো বেশ কদিন ছিল। এরমাঝে তোমাকে কিছু বলেনি ও?”
একদন্ড ভেবে উল্লাসী জবাব দিল,
-“না।”
-“চৈতালিটাকেও নাকি কিছু বলেনি। কিসের জের ধরে পুলিশ সামনে এগুবে? তেমন কোনো ক্লুও নেই।”
-“আপনি চৈতালির কথা বিশ্বাস করেন?”
-“অবশ্যই করি। আমার মতে সকলেরই কিছু আলাদা ভুবন থাকে। কাছের মানুষ হলেই যে তাকে তার সেই আলাদা ভুবন সম্পর্কে অবগত করতে হবে তেমন তো নয়। হয়তো অনা চৈতালিকে পরে জানাতে চেয়েছিল। আবার এও হতে পারে অনাকে জোর খাটিয়েই চুপ রাখা হয়েছিল।”
মেসবাহর কথা না বুঝলেও মাথা নেড়ে তাতে সম্মতি দিল উল্লাসী। চৈতালি এবং মুবিনের ব্যাপারটা কী বলবে মেসবাহকে? বলা উচিৎ… তবে পরক্ষণেই নিজের মত পালটে ফেললো উল্লাসী। চৈতালি নিজে যেখানে অনুনয় করেছে বিষয়টি কাওকে না জানাতে, সেখানে কাওকে তা জানানো মোটেও উচিৎ হবে না।
-“অনার সাথে খুব বেশি সময় কাটানো হয়নি আমার। তবে অনেক দিন পরপর যখনই এসেছি তার বায়নার সীমা থাকেনি। এইটা আনোনি কেনো ওইটা আনোনি কেনো বলে বলে মাথা খেয়েছে। বকেছি.. আম্মাকে বলেছি এ কেমন লোভী মেয়ে জন্ম দিয়েছো তুমি! অথচ আজ যখন অনা নেই, এসব চাইবার মতো কেউ নেই তখন এত কষ্ট কেনো হচ্ছে উল্লাসী? আপনজন হারানোর কষ্ট কী এতটাই তীব্র হয়?”
চোখজোড়া জলে ছলছল করে উঠতেই উল্লাসীর বুকে মুখ লুকালো মেসবাহ। হাতজোড়া দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তার কোমর। অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে তার বুকের ভেতর। উপরওয়ালা কেনো প্রিয়জনকে কেড়ে নেয় তাদের আপনজনদের জীবন থেকে?
লাল টকটকে কাতান শাড়ি, পেটা সোনার হার, মাঝারি আকারের একজোড়া সোনার চুড়ি সামনে নিয়ে নীরবে বসে রয়েছে চৈতালি। তাকে আংটি পড়াতে আসা দু’জন বয়স্ক লোকের পরামর্শেই আজ কালেমা পড়িয়ে রাখা হবে। পরবর্তীতে বউ উঠিয়ে নেয়ার সময় কাবিন করে নেবে। এতে যেমন বেশি ঝৈ-ঝামেলা হবে না তেমন স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও নিরাপদ থাকবে। নয়তো আজকালকার যুগের ছেলেপেলেদের যেমন বাজে স্বভাব তাতে দেখা যাবে কাবিন কালেমার আগেই পেট বাধিয়ে বসেছে। তখন সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়বে। নানান মুখ নানান কথা বলবে! দরকার কী তাদের সেই সুযোগ দেবার? এর চেয়ে কালেমা পড়ানো থাক। তারপর পেট বাধাক আর ডজনখানেক বাচ্চা পয়দা করুক মানসম্মান তো যাবেনা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে বেশ যত্নসহকারে শাড়ি পড়ে সাজগোজ করলো চৈতালি। সময় নিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে টিপ পড়ে কোমর সমান চুলগুলো খুলে দিল সে। কেউ কথা রাখেনি। অনা বলেছিল, তার বিয়েতে ছোট থেকে বড় সব কাজ একহাতে করবে সে। হাতে মেহেদী পড়িয়ে দেবে, নিজ হাতে তাকে সাজিয়ে দেবে। মুবিন বলেছিল, তার লাল টুকটুকে বউকে বিয়ের সাজে প্রথমে দেখবে সেই। বারণ করেছিল তার আসা অব্দি কপালের টিপখানা না পড়ার। বউ সাজে তাকে দেখেই টিপখানা কপালে পড়িয়ে চুমু দিয়ে নিজের বুকে আঁকড়ে নেবে সে। কিন্তু কই আজ তারা? তার হাতে তো মেহেদী নেই। বিয়ের সাজও একাই সাজলো সে। না তার আশেপাশে কোথাও মুবিনের অস্তিত্ব আছে আর না তার কপাল খালি। তারা তো তাদের দেয়া কথা রাখেনি। কেনো মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিল অনা? কেনো মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল মুবিন? দুজনেই তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দুজনেই প্রতারক…
জলভরা চোখে নিজেকে আরেকবার আয়নায় দেখে নিল চৈতালি। তারপর খুবই সন্তপর্ণে বেরিয়ে এল বাড়ি ছেড়ে। এত সহজে ছাড়বে না সে মুবিনকে। মুবিন তাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে, ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আজ মুবিন অনার মৃত্যুর দোহাই দিয়ে পিছে হটতে পারেনা। পাঁচ বছর নিজের মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসার শেষ পরিণতি কখনোই কষ্টের হতে পারেনা। সে হতে দেবেই না…
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩৫
সুখের সময় দ্রুত ফুরিয়ে গেলেও দুঃখের সময় এগোই ধীরেধীরে। অনার মৃত্যুর একদিন পেড়িয়ে গেলেও মনে হচ্ছে কত যুগযুগান্তর পেড়িয়ে গেছে অনাকে হারানোর। হারানো জিনিসটি সর্বসময় দুঃখকর কেন হতে হবে? কিছু হারিয়ে কি জীবনে সুঃখের সন্ধান পাওয়া যায় না? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মুবিনের। চোখে তার অজস্র ঘুম। কাল সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। অজস্র হিংস্র পাখি ঠুকড়ে ঠুকড়ে খেয়েছে তার বুকের ভেতরটা। বারবার চোখজোড়া ভিজে উঠেছে। পুরুষদের কাঁদতে নেই, তবে আঁধারে কাঁদার বারণও নেই। পাশ ফিরে শুয়ে লম্বা একটি দম ছেড়ে চোখজোড়া বুজলো মুবিন। ভর এই দুপুরে ঘুমের দেখা পাওয়া অসম্ভব। তবে আজকাল অসম্ভব জিনিসগুলোই খুব ভাবে আঁকড়ে ধরছে তাকে।
-“আমি চলে এসেছি…”
আচমকা কানে চৈতালির স্বর ভেসে আসলেও তা আমলে নিল না মুবিন। কোলবালিশ চেপে গভীর ঘুমের তোড়জোড় করতেই আবারও তার কানে এল চৈতালির আওয়াজ।
-“আমি যাবো না। তুমি আমাকে না চাইলেও আমি যাবো না।”
শোনামাত্র হুড়োহুড়িয়ে উঠে বসলো মুবিন। চৈতালির দিকে তাকিয়ে রইলো ড্যাবডেবে চোখে। লাল টকটকে একটি শাড়ি পড়েছে সে। কোমরসমান চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে দিয়েছে পিঠময়। ঠোঁট ভর্তি করে লাগিয়েছে টকটকে লাল লিপস্টিক, চোখে এঁকেছে গাঁঢ় কাজলের রেখা। তবে তার চাওয়া মতো কপালটা রেখেছে খালি। যেমনটি সে দেখতে চেয়েছিল বধু বেশে তার চৈতালিকে। বুকের ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠতেই নিজেকে সামলে নিল মুবিন। দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে বারান্দায় নজর দিল। তবে আশপাশটায় কোথাও কাওকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির সঙ্গে দরজা বন্ধ করে সে এগিয়ে এল চৈতালির দিকে।
-“তুমি এভাবে হুটহাট আসবে না চৈতালি।”
-“আর কখনোই আসবো না। আজই শেষ। এখন থেকে এইঘরই হবে আমার আবাসস্থল।”
কপাল কুঁচকে ফেললো মুবিন। ধীর গলায় বললো,
-“পাগলামো করো না!”
-“আমি পাগলামো করছি না!”
-“বাড়ি ফিরে যাও চৈতালি।”
-“ফিরে যাবো বলে তো আসিনি।”
-“কিন্তু তোমার যেতে হবে।”
-“আমি যাবো না।”
-“তুমি যাবে।”
-“না.. আমি কখনোই যাবো না।”
-“প্লিজ চৈতালি! পাগলামো না করে বোঝার চেষ্টা করো। আমি পারবো না তোমাকে নিজের সঙ্গে জড়াতে।”
-“তাহলে কথা দিয়েছিলে কেনো আমায়? স্বপ্ন দেখিয়েছিলে কেনো আমায়? ছোট্ট সেই চৈতালি কখন তোমার দৃষ্টিতে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছিল তা সে নিজেও বোঝেনি। কিন্তু তুমি তাকে বুঝিয়েছিলে। কেনো বুঝিয়েছিলে? আজ এই কথা বলার জন্য? মানুষের মন নিয়ে খেলার জন্য?”
সেকথার জবাব না দিয়ে শক্ত গলায় মুবিন বললো,
-“কেঁদো না.. কাঁদার মতো কিছু হয়নি।”
-“অহ.. তাই তো। কাঁদবো কেন? আজ আমার বিয়ে। খুশির দিন। কাঁদবো কেনো আমি?”
কলিজায় টান অনুভব করলো মুবিন। তার চৈতালি আজ থেকে অন্য কারো সম্পদ হয়ে যাবে। এমনটা হবার তো কথা ছিল না। তবে হচ্ছে। কারণ জগৎ-সংসার চলে তার নিজস্ব গতিতে..
-“তোমাকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি, কিভাবে ভালোবাসি জানিনা। তবে এটুকু জানি তোমাকে ছাড়া আমি একপাও চলতে পারবো না। আজ যদি আমাকে এবাড়িতে থেকে বেরিয়েই যেতে হয়, তাহলে শুধু চৈতালির দেহটাই বেরুবে। তার মনটা নয়।”
-“তুমি ফিরে যাও।”
-“আমি যাবোনা, মুবিন। একটাবার বিশ্বাস করো। আমাকে অনা কিচ্ছুটি জানায়নি। কেনো তোমরা বিশ্বাস করছো না?”
-“কারণ এখানে বিশ্বাস করার মতো কোনো অপশন নেই।”
-“বাদবাকিদের না থাকলো। কিন্তু তোমার? পুরো গ্রাম শুদ্ধ মানুষ যেখানে আমাকে নিয়ে যা নয় তাই কথা ছড়াচ্ছে সেখানে সবুজ স্যার সেই সব কথা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়ে তার বাড়ির সদস্যকে নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চলে এসেছে। আর সেখানে তুমি? অনার মৃত্যু, পারিবারিক পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে আমাকে বারবার দূরে ঠেলে দিচ্ছো। কেনো মুবিন? তাহলে কি আমি ধরে নেব তোমার চেয়ে বেশি আমায় সবুজ স্যার ভালোবাসে?”
-“হয়তো..”
-“আমি মানি না। কেউ আমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসতেই পারেনা।”
-“তার চেয়ে বেশি তো পারেতেই পারে।”
-“না.. পরিস্থিতি জটিল। তবে তুমি আমার পাশে থাকলে আমি সবটা সামলে নিতে পারবো মুবিন।”
চৈতালির কান্নার বেগ ক্রমশ বাড়ছে। সাথে গলছে মুবিনের মনের ভেতরটা। নিজেকে সামলে নেয়া দরকার। কিন্তু কিভাবে? উদ্বিগ্ন গলায় মুবিন বললো,
-“অনেক হয়েছে। কেউ দেখে ফেলার আগে তুমি বাড়ি ফিরে যাও।”
-“আমি যাবো না।”
-“তুমি যাবে.. তুমি এখন তোমার বাড়িতে ফিরে গিয়ে সবুজকে বিয়ে না করলে আমার মরা মুখ দেখবে।”
বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো চৈতালির। চোখভর্তি জল নিয়ে অবাক চোখে মুবিনের দিকে তাকাতেই সে বললো,
-“তুমি যাও চৈতালি।”
-“তুমি এতবড় কথা বলতে পারলে? এই কথা বলতে একবারও তোমার বুক কাঁপলো না?”
-“না কাঁপেনি।”
-“তুমি এটা বলতে পারো না। না না না।”
মুবিনের বুকে আছড়াতে আছড়াতে চৈতালি মেঝেতে বসে পড়তেই তার পাশে বসলো মুবিন। গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-“সব ভালোবাসাই পূর্ণতা পেতে হবে এমন নয়। মানুষের জীবনেই জড়িয়ে রয়েছে অপূর্ণতা। জানো, যেসব ভালোবাসা অপূর্ণ রয়ে যায় সেই ভালোবাসার গভীরতা মেপেও শেষ করা যায় না?”
-“মিথ্যে কথা।”
-“ভালোবাসার জগতে অনেক স্বপ্ন দেখা হয়, অসংখ্য কথপোকথনে ফোটানো হয় হাজারো আশা আকাঙ্খা। কিন্তু জীবন! প্রিয় মানুষটাকে ভালো রাখতে, ভালোবেসে অপূর্ণতাকেই না হয় আমি মেনে নেই।”
নাক টেনে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে চৈতালি বললো,
-“মনটা তো তোমার সৃষ্টি নয়, তাহলে ধ্বংস করার অধিকার কে দিল তোমায়?”
-“ধ্বংস নয় চৈতালি। গড়া.. নতুনভাবে জীবন গড়ে নাও।”
-“আমি সেই জীবন চাইনা যে জীবনে তুমি নেই।”
-“আমি আছি। তোমার মনে আছি। তোমার কপালে আছি। কই টিপটা? কোথায় রেখেছে?”
চৈতালি হাত পাততেই তার হাত থেকে টিপ উঠিয়ে কপালে পড়িয়ে দিল মুবিন। ম্লান হেসে বললো,
-“অপূর্ব লাগছে।”
-“আমাকে যেতে দিও না। আমাকে তোমার কাছে রেখে দাও। কষ্ট হচ্ছে আমার। মরে যাবো আমি।”
লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলে চৈতালিকে আঁকড়ে ধরে কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিল মুবিন। চোখজোড়া বুজে আস্বস্ত করে বললো,
-“সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি সুখে হবে।”
-“আমার সুখ দুঃখ সব তুমি মুবিন।”
কান্নার দরুন কেঁপে কেঁপে উঠছে চৈতালির শরীর। তাকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো মুবিন। চুলের মাঝে হাত দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
-“এসবও স্থানান্তর হবে।”
-“হবে না। কখনোই হবে না।”
-“আর হলে?”
জবাব দিল না চৈতালি। খানিকক্ষণ নীরবে মুবিনের বাহুডোরে বন্দী থাকার পর মুখ উঠালো সে। তার চোখের জলে মুবিনের টিশার্ট ভিজে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে তার উপর হাত বোলালো চৈতালি। ব্যাকুল সুরে বললো,
-“একটাবার চেষ্টা করে দেখতে!”
-“না আমি মানতে পারবো আর না আমার পরিবার। পরিস্থিতি আমাদের প্রতিকূলে। আমরা হয়তো একজন অপরের জন্য তৈরিই হইনি। নয়তো আমাদের কেনো এমন এক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে?”
-“তাহলে ভালোবাসার বন্ধনে কেনো জড়ালো আমাদের?
-“পরীক্ষা। দুনিয়ার জীবনে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেই না তুমি সফল!”
-“তাহলে আমি সফল হতে চাই না।”
-“কিন্তু আমি চাই। কিছু সম্পর্কে তিক্ততা প্রবেশ করার আগেই সেই সম্পর্কের ইতি টানা উচিৎ। যেখানে আমাদের সম্পর্কে যথারীতি সময়ের স্রোতে তা আরও বাড়বে। তুমি কেনো একটিবার বারণ করলে কেন অনাকে! তুমি চেষ্টা করলে আজ হয়তো অনা আমাদের মাঝে থাকতো। এসব ভেবে আমার মনে তোমাকে নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। তবে রাগ নয়। কাল অনার মৃত্যুর পর এই ক্ষোভের পরিমাণ এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে আমি একটিবারও তোমার অবস্থান বোঝার চেষ্টা করিনি। পরবর্তীতে এমন আরও হবে না তার গ্যারান্টি কী? আর আমি চাইনা আমার মাঝের এই ক্ষোভ ক্রমেই রাগে পরিবর্তন হয়ে তোমাকে নিয়ে আমার মনে খারাপ ধারণা জন্ম নিক। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম.. আর এই ভালোবাসা নিয়েই আমি আমাদের সম্পর্কের ইতি টানতে চাই। সবুজ নামের লোকটি ভালো। পরিবার ভালো। তুমি ওখানে ভালো থাকবে। অপরদিকে আমি.. কখনোই ভালো রাখতে পারবো না তোমায়। আব্বা আম্মা কেউ তোমাকে মেনে নেবে না। কথা শুনতে হবে কষ্ট পেতে হবে। আজীবনের দুঃখ কষ্টের চেয়ে দুইদিনের ক্ষনস্থায়ী কষ্টই না হয় আমি তোমায় দিলাম।”
-“তোমাকে না পেলে আমি কখনোই ভালো থাকবো না।”
-“থাকবে। সময় তোমাকে ভালো রাখবে।”
-“তুমি তাহলে আমাকে তোমার কাছে রাখবে না?”
সময় নিল না মুবিন। স্বাভাবিক গলায় বললো,
-“না..”
-“আমি উনাকে মেনে নিতে পারবো না।”
-“তুমি পারবে.. আমার জন্য হলেও তোমাকে সুখী হতেই হবে।”
-“আর তুমি?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুবিন। কী করবে সেই এই পরিস্থিতিতে? পরিবার কখনোই মানবে না চৈতালিকে। আর না সে বোনের শোক কাটিয়ে উঠে চৈতালিকে বিয়ের করার কথা ভাবতে পারবে। তার দ্বারা এতটা নির্দয় হওয়া সম্ভব নয়। মৃত্যু শোক বড় শোক। এর কাছে দুনিয়ায় প্রেম ভালোবাসা তুচ্ছ জিনিস। তবে কেনো যেনো দুটোকেই একই সুতোর বাঁধন মনে হচ্ছে মুবিনের। একমুহূর্ত একদিকে তীব্র টান অনুভব করলেও পরমুহূর্তেই অপরদিক থেকে তাকে টানতে থাকে সমানতালে।
-“আমিও সুখী।”
আবারও মুবিনের বুকে মুখ গুঁজে দিল চৈতালি। তীব্র আর্তনাদ ধ্বনি মুখে ফুটিয়ে বললো,
-“এত ভালোবাসলাম কেনো তোমায় মুবিন? জীবনটা আমার ছারখার হয়ে গেল।”
রোদ্র ভরা দুপুর। চারিপাশে রোদের প্রখরতায় তাকানোই দায় হয়ে পড়েছে। এরই মাঝে সুহার বায়নার জন্য বাইরে বেরুতে হলো মেসবাহকে। মেয়ে আইসক্রিম খাবে। এই গরমের ভেতর আইসক্রিম মন্দ নয়। তবে দোকানপাট খোলা থাকলে তো! কিছুপথ হেটে আবারও বাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিল মেসবাহ। সূর্যের প্রখর তাপ গায়ে এসে লাগতেই পুরো শরীর জ্বলে উঠছে। ভর দুপুরে ছাতা ছাড়া বেরুনো একদম উচিৎ হয়নি তার। বাড়ির সামনে আসতেই চৈতালিকে দৌড়ে তাদের বাড়ির থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে চোখমুখ কুঁচকে গেল মেসবাহর। মেয়েটির পরণে লাল শাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘসময় হলো কেঁদেকেটে ফুলিয়ে ফেলেছে চোখমুখ। কাছাকাছি আসতেই চৈতালিকে ডেকে উঠলো মেসবাহ। তবে চৈতালি তা উপেক্ষা করে দ্রুত ছুটে চললো রাস্তা ধরে। চিন্তিত মনে চৈতালির যাত্রা পথের দিকে তাকাতেই ফোন বেজে উঠলো মেসবাহর।
-“হ্যালো..”
-“হ্যাঁ.. কী অবস্থা তোমাদের?”
-“আছি..”
-“তোমার আব্বা আম্মা?”
-“আছে একরকম।”
-“তোমরা ছেলেমেয়েরা ভেঙে পড়োনা। তোমরা ভেঙে পড়লে তাদের কারা দেখবে বলো?”
-“জ্বি..”
মুন্নি সরকারের শান্তনা সূচক বাণী শুনে বিরক্ত হলো মেসবাহ। কেনো যেনো কাল থেকে শান্তনার বাণী একদমই নিতে পারছে না সে।
-“কালই তোমায় একবার কল করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হলো এই অবস্থায় তোমার সাথে কথা বলা ঠিক হবে না। তাই আজ কল করলাম।”
-“অহ..”
-“তা অনার হত্যাকারীর ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছো?”
বুকের ভেতর হুঁ হুঁ করে উঠলো মেসবাহর। কষ্টগুলো দলা পেকে জড়ো হলো গলায়। নিজেকে সামলে কোনোমতে ধরা গলায় মেসবাহ জবাব দিল,
-“না।”
-“আমার একটা তথ্য জানা আছে। অনা যখন ঢাকায় এসেছিল প্রায় সময়ই তো আমার সাথে বসে আড্ডা দিত। তখনই ও বলেছিল। জানিনা কতখানি হেল্প হবে তোমাদের তবে আমার মনে হলো বিষয়টি তোমাদের জানানো উচিৎ।”
কপাল কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“কোন বিষয়?”
-“অনার প্রেমিকের ব্যাপারে। ও তোমাদের পাড়াতেই থাকে। নাম ইমাদ.. না না। ইমাদ নয় এমাদ।”
-“আপনি সিউর?”
-“হ্যাঁ.. ওই ছেলে তো এখানেও এসেছিল। অনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো আর ওই ছেলে নিচে। এত মাখোমাখো প্রেম দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল! তখন যদি একবার তোমাদের জানিয়ে দিতাম তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না!”
-“থ্যাংকইউ ভাবি। থ্যাংকইউ সো মাচ। আমি আপনাকে একটু পর কল করছি।”
ফোন কেটেই মেসবাহ দ্রুত পায়ে ছুটলো বাড়ির ভেতরে। পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে তার। কিছু একটা করতে হবে তার। খুব দ্রুত করতে হবে।
-“চাচা, আমি আজ থেকে যাই?”
-“বড্ড বেলেহাজ পোলা তুই!”
বড় চাচা হাসানুর মিয়ার কথা শুনে মুখ নিচু করে ফেললো সবুজ। চোখেমুখে একরাশ অস্বস্তি ফুটিয়ে ক্ষীণ গলায় বললো,
-“জ্বি না। মানে ঠিকাছে।”
-“কিয়ের ঠিকাছে? থাকতে চাইলে থাকপি। তোর শ্বশুর বাড়ি তোর বউ এর মধ্যে আমি কেডায়?”
-“না না। ঠিকাছে।”
-“ঠিক নাই। বিয়া করছু বউরে ছাড়া থাকপি ক্যা? তোর এই বেলেহাজ পানা আমার ফাইন লাগছেরে! যাই তোর শ্বশুরের লগে কথা কইয়া আসি।”
হাসানুর মিয়া পা বাড়াতেই চৈতালির ঘরে প্রবেশ করলো সবুজ। বিছানার মাঝখানটায় ঘোমটা টেনে চুপচাপ বসে আছে চৈতালি। যাকে কিছুক্ষণ আগেই তিন কবুলের মাধ্যমে সারাজীবনের জন্য নিজের নামে করে নিয়েছে সে। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক তৃপ্তি অনুভব করতেই চৈতালির পাশে এসে বসলো সবুজ। আশেপাশে চেয়ে ইতঃস্তত করে বললো,
-“আজ আমি এখানে থাকলে তোমার কোনো সমস্যা হবে?”
-“না।”
-“অহ.. ঠিকাছে।”
এপর্যায়ে চৈতালির দিকে তাকালো সবুজ। বিয়ের পর মেয়েদের ভেতর কি খুব বেশি পরিবর্তন হয়? আগে যে মেয়েকে একদন্ড থামিয়ে রাখা যেত না আজ সে নীরবতা পালন করে বসে রয়েছে। বিষয়টি কি সন্দেহজনক? নাকি সে নিজেই বেশি ভাবছে চৈতালির নীরবতা নিয়ে? হয়তো লজ্জা পাচ্ছে সে। সংকোচে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। ভাবনার গতিপথ থামিয়ে মুখ খুললো সবুজ। বললো,
-“খেয়েছো দুপুরে?”
-“হুম।”
-“অহ.. সুন্দর লাগছে তোমায়।”
-“ওই চৈতালি.. চৈতালি? খবর শোন। অনার ধর্ষণকারীরে পাওয়া গেছে। ওই যে এমাদ আছে না? তোগো কলেজের মাস্টার সাহেবের পোলা? ওর সাথেই অনার প্রেম ছিল৷ ওই ছ্যাড়াই ওরে ভাগাই নিয়া গেছিল। পুলিশ ওর বাড়ি থেইক্যা মাত্র ওরে ধইরা নিয়া গেল।”
শেফালি বেগমের মুখ থেকে এমন কথা শুনে পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো চৈতালি। এক দৌড়ে দৌড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে হাজীবাড়ি। অনার ঘরে ঢুকে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবে সে যাবেনা। ওই বাড়ির সাথে যে সকল বন্ধন বিসর্জন দিয়ে এসেছে সে…
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩৬
রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া.. হালকা ঠান্ডাভাব পড়তে শুরু করেছে। চারিপাশ থেকে সূর্যের তাপ গায়ে এসে লাগাতে শরীরে ম্যাজমেজে ভাব চলে আসছে। বাস থেকে নেমে হাই উঠিয়ে মুবিন হাটতে শুরু করলো গ্রামের চিরপরিচিত চেনা পথ ধরে। অনার মৃত্যুর তিনমাস পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে গ্রামে একবারও পা দেয়নি সে। দিতে ইচ্ছে হয়নি। মন টানেনি নি। কিছু পথ হেটে একটি ভ্যান দেখতে পেয়ে তার কাছে এগিয়ে এল মুবিন। গম্ভীরমুখে বললো,
-“হাজীবাড়ি যাবে?”
-“জ্বি ভাই যাবো। আপনি কেমন আছেন? মেলাদিন পর দেখলাম আপনারে।”
-“ভালো।”
ভ্যানে উঠে বসতেই পুরো মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো মুবিনের। বেশ ক’মাস হলো সারারাতে একদন্ডের জন্যও দ’চোখের পাতা এক করতে পারেনা সে। একফোঁটা ঘুমও ভর করতে পারেনা তার এই ছোট্ট দু’চোখের পাতায়। বিপরীতে সেখানে এসে ভর করে নিজের প্রতি একরাশ হতাশা, প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ-কষ্ট।
-“ভাই দুইডা মিনিট বসেন। আমি এক প্যাকেট বিড়ি নিয়া আসি।”
-“যাও।”
ভ্যানওয়ালা দৌড়ে গলির ভেতর ঢুকে যেতেই চোখজোড়া বুজে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ফেললো মুবিন। বাড়িতে আজও আসতো না সে। তবে বাবামায়ের কান্নাকাটির সাথে পেরে না উঠে আসতে একরকম বাধ্য হলো। কেনো যে তারা আবেগকে উপেক্ষা করতে পারেনা! নিয়ন্ত্রণ জিনিসটি সে পারলে তারা কেনো পারেনা? সে কি কোনো মানুষ নয়? কোনো যন্ত্র? তার মাঝে কি কোনো অনুভূতি নেই? কোনো বোধ শক্তি নেই? সবই আছে। তারপরও সে যেখানে নিজের আবেগকে বশিভূত করে নীরবতা পালন করে রয়েছে সেখানে তারা কেনো পারেনা?
-“আরে মুবিন না?”
পুরুষালী মোটা কন্ঠ কানে আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো মুবিন। প্রায় সাথেসাথেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তার। কিছু শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে সবুজের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে চৈতালি।
-“কেমন আছো?”
চৈতালির দিক থেকে নজর সরিয়ে সবুজের দিকে তাকিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলো মুবিন। বললো,
-“ভালো.. আপনি ভালো?”
-“আলহামদুলিল্লাহ। তা বাড়ি যাচ্ছো?”
-“জ্বি..”
-“অনেকদিন পর এলে! বড় ভাই হিসেবে একটা কথা বলি কেমন? অনার মৃত্যুর পর তোমার বাবামা অনেক মিইয়ে পড়েছে। ছেলে হিসেবে তোমাদের উচিৎ তাদের পাশে থেকে তাদের সাপোর্ট দেয়া। তাদের বোঝা, তাদেরকে সময় দেয়া। কষ্ট দিও না তাদের। এমন একদিন আসবে যখন তোমার হাতে অফুরন্ত সময় থাকবে কিন্তু তোমার বাবামা থাকবেন না।”
সবুজের কথার পিঠে কোনো জবাব দিল না মুবিন। ইতস্ততবিক্ষিপ্ত চোখে আশেপাশে তাকাতেই ওপাশ থেকে আবারও সবুজ বললো,
-“অনেক জটিল কথা বলে ফেললাম কী?”
-“না ঠিকাছে।”
-“বাড়ি এসো একদিন। এখন তো চৈতালিকেও বাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছি। গিয়ে না হয় বোনের বান্ধবীর সংসার দেখে এসো।”
কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠলো মুবিনের। কোনোমতে ক্ষীণ স্বরে সে বললো,
-“জ্বি.. যাবো।”
হাসলো সবুজ। পকেট থেকে মোটরসাইকেলের চাবি বের করতে করতে চৈতালির উদ্দেশ্যে বললো,
-“তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি বাইকটা এদিকে নিয়ে আসছি।”
দ্রুত পায়ে সবুজ রাস্তা পেড়োতেই মুবিনের অস্থির চোখের দিকে তাকালো চৈতালি। ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“কেমন আছো?”
-“ভালো। তুমি?”
-“আমিও ভালো। দেখছো না হাতে কত শপিং ব্যাগ? পুরোটা ভর্তি আমার বায়না।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুবিন বললো,
-“বলেছিলাম না সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন?”
-“হ্যাঁ.. তবে জানো তোমাকে নিয়ে একটা আফসোস এখনো আছে আমার?”
-“আফসোস?”
-“হ্যাঁ, আফসোস। শুনবে?”
-“বলো..”
-“তুমি কেনো আমার জীবনে এসেছিলে? কেনো আমাকে স্পর্শ করেছিলে? নয়তো আমার জীবনের প্রথম পুরুষ আমার জীবনের প্রথম স্পর্শ সবটা আমার স্বামীই থাকতো। আফসোস হয়.. প্রচুর আফসোস হয়।”
-“শুনে খুশি হলাম। ভালো থেকো তোমরা।”
কথার গতিপথ না বাড়িয়ে ভ্যান ছেড়ে নেমে ব্যাগ হাতে উঠিয়ে মুবিন হাটতে শুরু করলো রাস্তা ধরে। জটিল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে চৈতালি। তবুও তার প্রতিটি কঠিন কথায় কেমন যেনো হাহাকার ছিল। তাকে না পাবার বেদনা ছিল। চোখে ছিল কষ্ট। যে কষ্ট সে দিয়েছিল তাকে অনার মৃত্যুর পর। অনার হত্যাকারীর বিচারকার্য চলছে। একসময় হয়তো রায় তাদের পক্ষেও আসবে। তবে চৈতালিকে নিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তাকে, তা নিয়ে মাঝেমাঝেই অনুতাপ হয় তার। অস্থির লাগে। খুব ইচ্ছে হয় সকল বাধানিষেধ ভুলে চৈতালিকে নিজের করে নিতে। তার কাছে মাফ চাইতে। তবে বিবেকের কাছে পেরে উঠেনা। যা যেভাবে চলছে চলুক না! যেখানে ভালোবেসে চৈতালির উপর বিশ্বাস টুকুই রাখতে পারেনি সে, সেখানে আর যাইহোক একদমই যোগ্যই নয় সে চৈতালির। বুকচিরে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল মুবিনের। হাটার বেগ খানিকটা কমিয়ে সে খানিকটা দূরের কবরস্থানের দিকে। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে অনা। তার সেই ছোট্ট বোন। বাড়ি ফিরে যার সঙ্গে খুঁনসুটিতে না জড়ালে চলতোই না তার…
কড়াইয়ে তেল ঢেলে পেঁয়াজ মরিচ তাতে ছেড়ে দিল উল্লাসী। চুলোর আঁচ কমিয়ে মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
-“ঘুম বেড়ে গেছে নাকি উনার আমাকেই ভালোলাগছে না বুঝি না!”
-“কাররে?”
-“আরে উনার..”
কপাল কুঁচকে মুন্নি সরকার বললো,
-“মেসবাহর?”
-“হু..”
-“কেনো? কিছু হয়েছে? খুলে বল তো?”
-“তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারছি না ভাবি। তবে উনার কথাবার্তা কমে গেছে। মনখুলে কিছু বলেনা। হাসি ঠাট্টা তো ভুলেই গেছে।”
-“আর রাতে? ওটা হয় ঠিকমতো?”
-“আমি নিজে থেকে গেলে হয়। মাঝেমধ্যে তো সুহাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সেদিন একটিবার ডাকেওনা। যেনো উনার নিজের কোনো চাওয়া নেই। জানো? কত খারাপ লাগে আমার?”
চিন্তিত মুখে উল্লাসীর কথা শুনলো মুন্নি সরকার। অনার মৃত্যুর পর তার সঙ্গে উল্লাসীর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। স্বাভাবিক বলতে এতটাই স্বাভাবিক যে সে নিজে তুই এবং উল্লাসী তুমিতে নেমে এসেছে। তাদের মাঝে বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে। কেনো যেনো মেয়েটিকে প্রচুর ভালোলাগে তার। তার সঙ্গে সময় কাটাতে, সংসারের সুখ দুঃখের গল্প শোনাতে ভালোলাগে।
-“আসলে তুই ছোটো। তবে এতটাও ছোট নস যে ওর পরিস্থিতি বুঝতে পারবি না। আবার মেসবাহরও এত উদাস হওয়া ঠিক না। বোনের মৃত্যুর শোক নিয়ে আর কদিন এভাবে চলবে? জন্ম মৃত্যু তো জীবনেরই অংশ।”
-“তুমি কী বলতে চাইছো এর মাঝেও আমার বয়সের দোষ? এমনিতেই উনি সারাদিন বলে তুমি ছোট.. বুঝবে না। আবার আজ তুমিও বলছো!”
-“ইশ! চুপ কর তো। এত ন্যাকা কান্না পাস কই? শোন, মেসবাহকে শোক কাটিয়ে উঠতে তোকে সাহায্য করতে হবে। একজন স্ত্রী হিসেবে তোর উচিৎ ওকে স্বাভাবিক করা।”
মাছের গামলা এগিয়ে এনে তাতে হাত দিল উল্লাসী। একে একে কড়াই ভর্তি পেঁয়াজ মরিচের মাঝে মাছের পিচ ছেড়ে দিতে দিতে বললো,
-“কিভাবে?”
-“মানসিকভাবে সাপোর্ট দিয়ে।”
-“সেটা কী? আর কিভাবে…”
কথা শেষ করার আগেই পুরো শরীর গুলিয়ে উঠলো উল্লাসীর। মুখ ভর্তি বমি নিয়ে এক দৌড়ে বেসিনের দিকে ছুটলো সে। আজকাল মাছ মাংসের গন্ধ একদম সে সহ্য করতে পারছেনা। মাছের গন্ধ নাকে আসলেই প্রায় সময়ই গা গুলিয়ে উঠছে।
একটু সুস্থ বোধ করতেই চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেললো উল্লাসী। মুন্নি সরকারের সহায়তায় ডাইনিংয়ে বসে দূর্বল গলায় বললো,
-“চুলোটা বন্ধ করে দিয়ে এসো।”
-“করেছি। তুই বয়। পানি দিচ্ছি।”
-“না। কিছুই দিও না। পেটের ভেতর কেমন যেন লাগছে। যেন কিছু ঘাটছে!”
-“ঘাটছে বলতে?”
-“জানি না। কিছুদিন হলোই এমন হচ্ছে। মাছ মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারছি না। উনাকে বললাম সেদিন। উনি বললো হয়তো গ্যাস হয়েছে। মেডিসিন নিতে। এই লোকটাকে আমার কিছুদিন হলো মেরে ফেলতে মন চায়। লোভ দেখিয়ে এখন নিজেই দূরে দূরে থাকে। বদমাশের উপর কোনো সুন্দর গালি আছে? থাকলে সেটাই উনি।”
কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো মুন্নি সরকার। চোখে মুখে একরাশ শঙ্কা ফুটিয়ে বললো,
-“তোর লাস্ট কবে পিরিয়ড হয়েছিল রে?”
-“জানি না। এখন মনে করতেও ইচ্ছে করছে না।”
-“এক্সাক্ট ডেট বলতে হবে না। কমাস আগে হয়েছিল এটা বল।”
একদন্ড ভেবে উল্লাসী বললো,
-“এবাড়িতে আসার পর।”
-“চারমাস আগে?”
-“হ্যাঁ.. কেনো?”
উল্লাসীর প্রশ্নের জবাব দিল না মুন্নি সরকার। উল্লাসী না হয় অবুঝ। এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই তার। কিন্তু মেসবাহ? সে এতটা অসচেতন কিভাবে হলো? এতমাস হলো মেয়েটির মাসিক হচ্ছে না অথচ সে একবার খোঁজ নিয়েও দেখেনি? অবশ্য অনার মৃত্যুর পর মেসবাহ যেভাবে ভেঙে পড়েছে তাতে এর দোষ তার উপর পুরোপুরি চাপানোও যায়না। তবে সে তো একজন ডাক্তার। তাছাড়া একজন সচেতন মানুষ হিসেবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক এক মেয়েকে কীভাবে গর্ভবতী করলো সে? নাকি সবটাই অনাকাঙ্ক্ষিত? উদ্বিগ্ন বোধ করলো মুন্নি সরকার। উল্লাসীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এসে মেসবাহর নাম্বারে ডায়াল করলো। কয়েকবার রিং বাজার পর অপর পাশ থেকে মেসবাহ কল রিসিভ করতেই সে অস্থিরতা নিয়ে বললো,
-“হ্যালো মেসবাহ.. তুমি কখন বাসায় আসবে?”
-“ফিরতে রাত হবে।”
-“আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরলে হয় না?”
-“কেনো বলুন তো?”
-“দরকার আছে। আচ্ছা শুনো, আসার সময় প্রেগন্যান্সি স্টিক নিয়ে এসো।”
-“কী নিয়ে আসবো?”
-“প্রেগন্যান্সি স্টিক.. প্রেগন্যান্সি স্টিক।”
অবাক হলো মেসবাহ। প্রেগন্যান্সি স্টিক দিয়ে কী করবেন উনি? উনি কি কনসিভ করেছেন? তবে উনি যদি কনসিভ করেও থাকে তাহলে তাকে কেনো প্রেগন্যান্সি স্টিক আনতে বলবেন? লজ্জাজনক কথাবার্তা না?
-“শুনতে পাচ্ছো?”
মুন্নি সরকারের আওয়াজে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। বিব্রত গলায় বললো,
-“জ্বি পাচ্ছি।”
-“মনে করে এনো তাহলে।”
-“ঠিকাছে।”
-“রাখছি তাহলে।”
-“অবশ্যই।”
কল কেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। এই মহিলা কি দিনেদিনে পাগল হচ্ছেন? তাকে কোন দুঃখে এসব আনতে বলছেন উনি? নাকি মেসবাহ ডাক্তার বলে মুন্নি সরকার ভেবেছে এসব প্রেগন্যান্সি স্টিক ফ্রিতেই হাসপাতাল থেকে ম্যানেজ করতে পারবে সে? নিজের মনে চলা যুক্তিহীন প্রশ্নের জন্য নিজেকেই পাগল মনে হলো মেসবাহর। প্রেগন্যান্সি স্টিকের দাম কি খুব বেশি নাকি উনারাই গরীব? যাচ্ছেতাই এসব কী ভাবছে সে!
হাজার ভেবেও মাথায় কিছু আসেনি মেসবাহর। ল্যাবএইড থেকে বেরিয়ে ইচ্ছে না থাকা সত্বেও দূরের এক ডিসপেনসারি থেকে একটি প্রেগন্যান্সি স্টিক কিনে রওনা হয়েছে বাসার উদ্দেশ্যে। তবে চিন্তিত বোধ করছে সে। মুন্নি সরকারকে গিয়ে এটি সে কীভাবে দেবে? নিজে দিতে যাওয়া কেমন হয়ে যায় না? উল্লাসীর কাছে দিয়ে পাঠালে কেমন হয়? না.. থাক। কোনো দরকার নেই। কাজের চেয়ে প্রশ্ন করবে বেশি সে। এটি কী, কী হয় এটি দিয়ে এমন নানান প্রশ্ন করে একদম বিরক্ত করে ফেলবে। আজকাল তার বকবকানির পরিমাণ প্রচুর বেড়েছে। সাথে বেড়েছে তার প্রতি চাওয়া-পাওয়া। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। হাসান সরকার যদি বাসায় থাকেন? তাহলে এটি কি বলে দেবে সে? তাছাড়া উনিই বা কী ভাববেন? নাকি উনারও সবটাই জানা? জানা থাকলে উনি নিজে না এনে তাকে দিয়ে আনাচ্ছে কেনো? উদ্বেগপূর্ণ চোখেমুখে কলিংবেলে চাপ দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল মুন্নি সরকার। গম্ভীর গলায় বললো,
-“তুমি? আমি আরও ভাবছি তোমার ভাই। আজ ও শুধু বাড়ি আসুক। বারবার বলেছি শীতলের জন্য মেয়ে দেখতে যাবো। জলদি এসো জলদি এসো অথচ ওই হাঁদারামের খবরই নেই!”
-“অহ.. হাসান ভাই নেই?”
-“না। কিছু বলবে?”
-“হ্যাঁ। মানে এই তো। নিন।”
-“কী এটা?”
-“ইয়ে মানে আপনি যে আনতে বললেন! প্রেগন্যান্সি স্টিক।”
-“তো এটা আমায় কেনো দিচ্ছো?”
আমতাআমতা করে মেসবাহ জবাব দিল,
-“তাহলে কাকে দিব? আপনি কনসিভ.. না মানে আচ্ছা যাকে দেবার আপনিই দেবেন। ধরুন।”
-“আরে ব্যাটা! নিয়ে যাও তো সাথে। এমনিতেই তোমার ভাই আমাকে ঘোরালো! আসুক আজ!”
-“আমি নিয়ে যাবো?”
-“হ্যাঁ.. টেস্ট করে কী খবর আসে জানিয়ো।”
বিস্ময় নিয়ে মেসবাহ আবারও বললো,
-“টেস্ট?”
-“তো কী প্রেগন্যান্সি স্টিক পুঁজো দেবার জন্য এনেছো? মেয়েটা ছোট। একটু দেখে শুনে চলবে না! ওই দেখো আবার ফোন বাজে। যাও তুমি পরে কথা বলবো!”
মুন্নি সরকার ফ্ল্যাটের সদর দরজা লাগিয়ে দিতেই স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো মেসবাহ। কোনোভাবে উল্লাসীর কথা বলছেন কী মুন্নি ভাবি? তাছাড়া আর কারই বা বলবে! সে তো আর কোনো মেয়ে নয়! আর না সে কনসিভ করতে পারবে! কিন্তু উল্লাসী কিভাবে!
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩৭
আলাউদ্দিন শেখের পায়ে পানি ধরেছে। পা ফুলে টসটসে হয়ে রয়েছে দু’দিন যাবৎ। ঘটনা মেসবাহকে ফোনে জানানোর পর ঔষধের নাম বলে দিলে তা খেয়ে সামান্য কমলেও আজ সকালে আবারও বেড়েছে। তাই শেষমেশ আজ মুবিন আসার পর তাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল সে। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধপত্র নিয়ে এসেছে। দুনিয়ায় এই জীবনে মনে হচ্ছে হায়াৎ দিনেদিনে কমে আসছে তার। দ্রুত মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। তবে অনেক কাজই যে এখনো অসম্পূর্ণ রয়েছে! ছোট মেয়ের হত্যাকারীর শাস্তির খবর না শুনে মরে গেলেও শান্তি পাবে না সে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেললেও বড় ছেলেটা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে। তারও একটি গতি করে দিতে হবে। ওদিকে মেজোটা মোটামুটি থাকলেও ছোট ছেলেটার পড়াশোনাও এখনো শেষ হয়নি। তার একমাত্র নাতিন, যার দুনিয়ায় মা থেকেও নেই। এসব রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। জীবনে ছেলেমেয়েদের উপর কম অধিপত্য খাটায়নি সে। মেয়েকে তো তার এই অধিপত্যের জোরেই জীবন দিতে হলো। আজও তার চিঠি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে নীরবে চোখের জল ফেলে সে। বুকের ভেতরটা ব্যথা করে। খুব কষ্ট হয়। বারবার তার ভেতরের দাম্ভিকতা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সে খারাপ মানুষ। তার উদ্দেশ্য খারাপ। আল্লাহর ঘরে গিয়ে হজ্ব পর্যন্ত করে এসেছে সে গ্রামে নিজের নাম ও প্রতিপত্তি পাবার উদ্দেশ্যে। তার মতো নিকৃষ্ট মানুষ এদুনিয়ায় থাকা মানায়ও না! আজ তার ছেলেমেয়েরা ভদ্র সভ্য বলে নীরব থেকেও তার আদেশ মাথা পেতে মেনে নেয়। নয়তো তারা একেকজন যে অবস্থায় অবস্থান করছে তাতে এই বুড়ো বাপের আদেশ পরোয়া কেনো করবে? তবে তারা এই বুড়োর কথা পরোয়া করে। বড় ছেলের বউ মনমতো না হওয়ায় যখন বুদ্ধি করে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করলো তখন মুখ বুজে নীরবে তার আদেশ মেনে নিয়েছিল মাজহারুল। মেজো ছেলে মেসবাহ দেশের বাইরে থেকে ড্রিগ্রী নিয়ে আসা ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও তার কথায় গরীব ঘরের বাচ্চা এক মেয়েকে বিয়ে করলো! অনা তো ভুল কিছু বলেনি। সে লোকের কথায় বিচলিত হয়েই তার দুই ছেলের উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে তাদের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আলাউদ্দিন শেখের। বালিশে হেলান দিয়ে চোখজোড়া বুজলো সে। নিজেকে সে সর্বজ্ঞানী সবজান্তা ভাবে। ভাবে তার সিন্ধান্তই এই পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। তার চিন্তাধারাই সঠিক চিন্তাধারা। তবে অনার মৃত্যুর পর পদে পদে বুঝেছে সে। প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে জীবন তাকে দু’চোখে হাত দিয়ে স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে নিজেকে নিয়ে তার ধারণা গুলো ভুল। এই যেমন অনার বান্ধবী চৈতালিকে খুনি বলে তাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালিগালাজ করেছিল সে। পুরো গ্রামবাসীর সামনে তাকে হেয় করেছিল। অথচ কিছুদিন পর যখন অনার হত্যাকারীকে রিমান্ডে নেবার পর পুরো ঘটনা আদ্যোপান্ত খুলে বলেছিল সে তখন তার ধারণা কতটা ভুল তা প্রমাণিত হয়েছিল। সেদিন নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো চৈতালির পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে। এই তিনটি মাসে জীবন তাকে বারবার দেখিয়ে দিয়েছে তার অবস্থান। সে যে মানুষের মতো দেখতেই জঘন্য এক কীট তা জানতে আর বাকি নেই। তবে সবকিছুর পরে সে অনুতপ্ত। তার ভেতরের সত্তা আজ উপলব্ধি করতে পারে তার ভুলগুলো, তার করা অন্যায় গুলো। বাঁচতে হবে তাকে.. দীর্ঘদিন বাঁচতে হবে। নয়তো তার করা অন্যায়গুলো কী করে শোধরাবে সে?
-“দাদু? এই যে তোমার মলম। বাবা নিয়ে এসেছে।”
মৌমির গলার স্বর কানে আসতেই চোখ মেললেন আলাউদ্দিন শেখ। মেয়েটি এই তিনমাসে বড্ড রোগা হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া নেই, যত্ন নেই। একা আর কতদিক সামলাবে মোরশেদা? তাছাড়া বিচ্ছু এই মেয়ে তার কথা আমলেও নেয়না। অনা থাকতে মৌমির খাবার গোসল সবদিকই সে সামলিয়েছে। আজ যখন অনাই নেই তখন তার অভাব আর পূরণ করবেই বা কে! ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে আলাউদ্দিন শেখ বললেন,
-“তোর আব্বা আইছে?”
-“হ্যাঁ তো।”
-“তুই এতক্ষণ কোনহানে ছিলি?”
-“দাদীর সাথে। দাদীর ঘরে।”
-“খাইছিস?”
-“না।”
ইশারায় মৌমিকে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন শেখ। নীচু গলায় বললেন,
-“তোর কি তোর আম্মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে?”
-“করে তো।”
-“থাকতে ইচ্ছে করে আম্মার কাছে?”
-“করেই তো।”
-“অহ.. যা তোর আব্বাকে ডাইকা আন।”
-“কেন?”
-“তোর আম্মার ব্যবস্থা করমু। যা..”
মৌমির একদৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার দু’দন্ড যেতে না যেতেই হালকা কেশে দরজায় টোকা দিল মাজহারুল। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“আব্বা ডাকছিলেন?”
-“হ্যাঁ.. আয়।”
কয়েক কদম এগিয়ে আলাউদ্দিন শেখের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে মাজহারুল বললো,
-“জ্বি, বলেন..”
-“তোর কাছে বড় বৌমার নাম্বার আছে?”
ঘাবড়ে গেল মাজহারুল। ঢাকায় গিয়ে জ্যোতির সাথে তার দেখা করার খবর কী কোনোভাবে জেনে গেছেন আব্বা? ঢোক গিলে একরাশ আতংক নিয়ে মাজহারুল জবাব দিল,
-“না…”
-“মিথ্যা কইস না। তোর ফোনে বড় বৌমার নাম্বার আছে। ক.. আছে না?”
-“আছে।”
-“দেখি ফোন লাগাইয়া আমার কাছে দে।”
বুকের ভেতরে উথালপাতাল শুরু হতেই আমতাআমতা করতে লাগলো মাজহারুল। অস্থিরতায় সত্যিটা বলে দিলেও ভয় হচ্ছে তার।
-“কী দরকার আব্বা?”
-“তুই কল লাগাইয়া দে।”
-“কিন্তু আব্বা হঠাৎ? যে গেছে যাক না! তাছাড়া…”
মাজহারুলকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন শেখ। থমথমে গলায় তিনি বললেন,
-“তোর কাছে মিথ্যা বলছিলাম আমরা। বৌমা কোনো ছেলের হাত ধইরাই পালায় নাই। আমরাই তাকে এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করছিলাম!”
প্রেগন্যান্সি স্টিক হাতে নিয়ে থম ধরে খানিকক্ষণ বসে রইলো মেসবাহ। উল্লাসী অন্তঃসত্ত্বা। তবে তা কিভাবে সম্ভব? সে উল্লাসীর সাথে যতবার মিলিত হয়েছে প্রতিবারই প্রোটেকশন ব্যবহার করেছে। বাদবাকি রইলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা.. যা প্রথম দু’বার ঘটেছিল। কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাদের। তবে প্রথমবারে মিলিত হবার সময় তো উল্লাসীর প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল। যাতে কনসিভ হবার চান্স না থাকার মতোই। তাছাড়া সেসময় পরিস্থিতি এতটাই বিগড়ে গিয়েছিল যে ব্যবস্থা নেবার মতো কিছু মাথাতেই আসেনি। পরবর্তীতে দ্বিতীয়বারের মিলনও ছিল পরিকল্পনা বিহীন। তবে সেসময় তো সেইফ পিরিয়ড চলছিল উল্লাসীর। এবং তা ভেবেই বার্থকন্ট্রোল পিল খাওয়ানোর প্রয়োজন মনে করেনি সে। তাছাড়া পিল সেবন করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সেখানে উল্লাসী বাচ্চা একটা মেয়ে। পিলের সাইড ইফেক্ট একদমই সহ্য করতে পারবে না সে। তারপর থেকে পরবর্তীতে তো পরিকল্পনা মোতাবেক প্রোটেকশন ব্যবহার করেই মিলিত হয়েছে তারা। তাহলে এইঘটনা ঘটলো কী করে? অস্থিরতা নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। পরণের শার্ট খুলে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। খুশি হবার মতো একটি খবর জেনেও খুশি হতে পারছেনা সে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। মনের ভেতরে ভয় কাজ করছে। ডাক্তার হিসেবে আর কয়টি সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হত না তার? অথচ সে করেনি। মুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে এল মেসবাহ। টাউয়েল হাতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ মুছতে শুরু করতেই পেছন থেকে উল্লাসী বললো,
-“কী হয়েছে আমার? যা বললেন সবই তো করলাম! কিন্তু কী হয়েছে তাই তো বললেন না!”
পেছন ফিরে উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। গম্ভীরমুখে বললো,
-“কিছুই হয়নি।”
-“তাহলে ওটায় কী দেখলেন?”
-“কিছুনা।”
-“কিছুনা বললে তো হবে না। কিছু তো অবশ্যই হয়েছে আমার। কী হয়েছে বলুন না! বড় কোনো অসুখ হয়েছে?”
-“আরে না..”
-“তাহলে?”
উল্লাসীর কথা এড়িয়ে যেতেই বেলকনির দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। ভালোলাগছে না তার। এ কেমন অপরাধ করে বসলো সে! চৌদ্দ বছর বয়সী এক বাচ্চার শরীরে আরেকটি প্রাণের বীজ বপন করে দিল!
-“আপনি বলছেন না কেনো? কী দেখলেন ওটায় আপনি? আমার কী হয়েছে?”
-“অদ্ভুত তো! যাও পড়তে বসো। আজ কোচিংয়ে গিয়েছিলে?”
-“হ্যাঁ.. ওটায় কী দেখলেন আপনি?”
-“কিছু না বাবা!”
-“উহু.. বুঝেছি আমি। আমার কিছু হয়েছে। বড় কোনো অসুখ করেছে।”
নানান আজেবাজে কথা বকতে শুরু করতেই উল্লাসীকে সবটা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিল মেসবাহ। লম্বা একটি দম ছেড়ে সে উল্লাসীকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এল ঘরের ভেটরটায়। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নীচু গলায় বললো,
-“তুমি আর এখন একা নও। তোমার ভেতরে তোমার সাথেসাথেই বেড়ে উঠছে এক প্রাণ। তুমি প্রেগন্যান্ট উল্লাসী। তুমি মা হতে চলেছো..”
থেমে গেল মেসবাহ। চোখেমুখে একরাশ অস্বস্তি ফুটিয়ে আবারও বললো,
-“আসলে সবটাই অনাকাঙ্ক্ষিত। না তুমি না আমি আর না তোমার শরীর কোনোটাই এখন এসব সামাল দেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। তবে কথায় আছে না কপালের লেখন না যায় খন্ডন? এঅবস্থায় আমরা না চাইলেও আমাদের কিছু করার নেই। মেনে নিতে হবে। তুমি ছোট একটি মেয়ে। তোমার জন্য প্রেগ্ন্যাসির সময়টা অনেক বেশি কষ্ট হবে, রিস্ক থাকবে। তবে.. আই অ্যাম সরি উল্লাসী!”
-“আমি মা হবো? মানে আমার বাবু হবে? পিচ্চি সুহার মতো আবারও কেউ আসবে?”
-“হুম…”
খুশিতে আত্মহারা হয়ে ফেটে পড়লো উল্লাসী। পা উঁচিয়ে মেসবাহর গালে একটি চুমু দিয়ে তার কাঁধে হাত ঠেকিয়ে বললো,
-“আপনি বাবা.. আমি মা। সুহা ওর খালামুনি। মৌমি বড় বোন। বড় ভাই বড় বাবা, মুবিন ভাই ছোট বাবা…”
উৎসাহী বেশে উল্লাসীর কথাগুলো শুনে মনের ভেতরটায় তৃপ্তি অনুভব করলো মেসবাহ। এতক্ষণ যাবৎ মনে চলা অস্থিরতা অনেকটাই কমে এল। তৃপ্ত গলায় সে বললো,
-“তুমি খুশি?”
-“হ্যাঁ.. খুব। আমার না নাচতে ইচ্ছে করছে!”
-“এই না। মোটেও না। এইসময় ধীরেসুস্থে চলাফেরা করবে। এমনিতেই তুমি ছোট।”
-“ঠিকাছে.. করবো। সব করবো…”
শান্ত গলায় মেসবাহ বললো,
-“গুড। এবার যাও.. পড়তে বসো। কয়টা দিন পরই এক্সাম। সে খেয়াল আছে?”
-“খুব আছে.. একটু নানাজানকে কল দিয়ে দিন না! উনাকে বলি.. সুহাকে বলি। ইশ! আমার এত খুশি লাগছে কেন?”
-“এখন না। আমি দেখেশুনে তাকে বুঝিয়ে বলবো।”
-“না। আপনি কেনো বলবেন? আমি বলবো..”
-“ব্যাপারটি উনি ভালোভাবে নাও নিতে পারে। প্লিজ উল্লাসী। আমার কথা শুনো.. আমি বুঝিয়ে বলবো।”
-“কচু..”
ঠোঁট বাঁকিয়ে ব্যাগ খুলে বই নিয়ে বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসলো উল্লাসী। ইচ্ছে করছে না তার পড়তে। কিন্তু উনি সেসব শুনলে তো! বমির অভিনয় করলে কেমন হয়? ভাবামাত্র আঁড়চোখে মেসবাহর দিকে তাকালো উল্লাসী। কিছু একটা ভাবছেন উনি। কী ভাবছে? নানাজানকে কিভাবে জানাবে সে কথা? ভাবতে থাকুক। এর মাঝে না হয় নিজের কাজ সেরে নেয়া যাক! বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো উল্লাসী। দরজা আটকে খানিকক্ষণ ওয়াক ওয়াক শব্দ করতেই ওপাশ থেকে টোকা পড়লো দরজায়।
-“কী হয়েছে উল্লাসী? শরীর খারাপ লাগছে? দেখি দরজা খোলো।”
-“কচু খুলবো! আপনি কী বোঝেন না বইয়ের গন্ধ নাকে আসলেই আমার বমি পায়?”
-“তুমি আগে দরজা খোলো…”
-“খুলবো না.. খুললেই আবারও গন্ধ পাবো। আবারও বমি হবে।”
-“ওয়েট.. ওয়েট। আমি বই গুছিয়ে টেবিলে রেখে আসছি।”
দরজা খুলে উল্লাসী বেরিয়ে আসতেই তার হাত ধরে বিছানায় বসালো মেসবাহ। চিন্তা হচ্ছে তার। বইয়ের গন্ধেও গা গুলিয়ে উঠে উল্লাসীর? শরীরের অবস্থা কি তাহলে খুব বেশি খারাপ তার? শঙ্কিত মনে ফোন উঠিয়ে ইভানার নাম্বারে ডায়াল করলো মেসবাহ। জরূরী ভিত্তিতে মেয়েটিকে নিয়ে ইভানার সঙ্গে দ্রুত একবার কথা বলা দরকার।
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩৮
গতকাল রাতে আলাউদ্দিন শেখ কল করেছিলেন। অনুনয় করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন তার কৃতকর্মের জন্য। ফিরে যেতে অনুরোধ করেছেন নিজের সংসারে। লোকটি কি সত্যিই পরিবর্তন হয়েছেন? নয়তো শেষ বয়সে এসে অভিনয়ই বা করবেন কেনো? বিষয়টি কোনোভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না জ্যোতির। এই লোককে যতটুকু চেনে সে তাতে উনি ভাঙবে তবে মচকাবে না। ছোট কিছু নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল জ্যোতি। অফিসে এলেও কাজে মন দিতে পারছেনা সে। মেয়ের জন্য মনটা আনচান করছে। আসলে একটা সময় জীবন এতোটাই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে যে তখন মানুষ আত্মহত্যা করে মুক্তি পেতে চায় স্বার্থপর এই পৃথিবী ছেড়ে। তবে সে তা করেনি। নিজের জীবনের মূল্য বুঝে সে সরে এসেছে দূর্বিষহ জীবন ছেড়ে। নিজেকে নিজের চেষ্টায় স্বাধীন করে তুলেছে। তবে অতীতের পিছুটান কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। আসলে নাড়ী ছেঁড়া ধন ফেলে আসলে কোনো মায়ের পক্ষেই অতীতের পিছুটান পুরোপুরি ফেলে আসা সম্ভব নয়। নিজেকে শক্ত প্রমাণ করতে যদিও সে সবসময় বলে আসছে তার কোনো পিছুটান নেই। নেই কোনো আফসোস.. বুকচিরে আরও কিছু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল জ্যোতির। মেয়ের জন্য হলেও আলাউদ্দিন শেখের কথায় মন সায় দিতে চাইলেও বিবেক চাইছে না। ওই বাড়িতে আবারও ফিরে গিয়ে নিজের জীবনটা দূর্বিষহ করতে চায়না সে। তবে আলাউদ্দিন শেখ তো পরিবর্তন হয়েছেন। তার চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটেছে। তাছাড়া মানুষ মাত্রই তো ভূল হয়। সেখানে আলাউদ্দিন শেখের দ্বারাও না হয় ভুল হয়েছে! মেয়ের মৃত্যুর পর হয়তো নিজের কৃতকর্মের জন্য সত্যিই অনুতপ্ত সে!
-“আসবো?”
জ্যোতির মন এবং বিবেকের যুক্তিতর্ক থেমে গেল রুমে রাশেদের উপস্থিতিতে। চোখ মেলে সোজা হয়ে উঠে বসে সে বললো,
-“এসেই তো পড়েছো..”
হাসলো রাশেদ। জ্যোতির মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললো,
-“তোমার সাথে লাঞ্চ সারতেই চলে এলাম। ফ্রি ছিলাম..”
-“ফোন দিয়ে আসতে পারতে। আমিতো ফ্রি নাও থাকতে পারতাম!”
-“হয়তো.. তবে তুমি তো ফ্রি আছো।”
অজস্র ক্লান্তি মুখে ফুটিয়ে জ্যোতি বললো,
-“ফ্রি থাকলেও বাইরে খেতে যাবার ইচ্ছে নেই। আমি টায়ার্ড। আমার একটু সময় প্রয়োজন।”
-“তুমি কি জানো, তুমি মাঝেমধ্যে এমন কিছু কথা বলো যা আমায় হার্ট করে?”
-“জানি.. তবে তুমি সব জেনেশুনেই আমার সাথে রিলেশনশিপে এসেছো। এমনকি বিয়ের মতো একটি জটিল সম্পর্কে জড়াতে আমাকে প্রস্তাবও দিয়েছো!”
-“এবং তুমি তা মেনেও নিয়েছো.. তারপরও বিয়ের ডেইটটা ফাইনাল করতে কেনো দিচ্ছো না?”
লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেললো জ্যোতি। নীচু স্বরে বললো,
-“কারণ আমি এখনো কনফিউজড। মাজহারকে ছেড়ে চলে আসার পর ফ্যামিলির সাপোর্ট পাইনি আমি। উঠতে বসতে কথা শুনিয়েছে তারা। আমাকে ফিরে যেতে বলেছে। তবে আমি যাইনি। কেনো যেনো যেতে ইচ্ছে করেনি। তারপর যখন ফ্যামিলির কাছ থেকে এমন কথা শুনলাম, আমি যদি মাজহারের কাছে ফিরে না যাই তাহলে যেনো আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। আমার জন্য নাকি তাদের সমাজে চলতে ফিরতে কষ্ট হয়, লজ্জায় পড়তে হয়। তখন ছেড়ে এলাম বাবার বাড়ি। তুমি জানো আমি প্রথম প্রথম ঢাকায় আসার পর গার্মেন্টসেও পর্যন্ত কাজ করেছি? জানো না.. কারণ আমি আমার কষ্টগুলো নিজের মাঝে জমিয়ে রাখতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।”
মন দিয়ে জ্যোতির কথাগুলো শুনলো রাশেদ। মাথা নেড়ে তাতে সম্মতি জানিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
-“তো তুমি এখন কী চাইছো?”
-“যদি বলি আমার অতীতে ফিরে যেতে?”
-“যেতে পারো.. আমার কোনো বাধা নেই।”
-“তুমি বাধা দিলেও আমার সিদ্ধান্তে কোনো হেরফের হতো না.. বাই দ্য ওয়ে, তুমি কবে বিয়ে করতে চাও আমায়?”
-“যদি বলি আজ? করবে?”
-“আগে চলো খেয়েদেয়ে মাথাটা ঝালাই করে নিয়ে আসি। ফাঁকা মাথায় কোনো।সিদ্ধান্ত আমি নিতে চাই না।”
ম্লান হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে কোটের একটি বোতাম লাগালো রাশেদ। জ্যোতির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“চলো..”
ইভানাকে নিয়ে শাহানাজ তালুকদারের চেম্বারে বসে রয়েছে মেসবাহ। মন মেজাজ অসম্ভব খারাপ তার। চেকআপের জন্য উল্লাসীকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ায় খানিকটা ভয়ও লাগছে।
-“এত টেনশন করছিস কেন বলতো?”
পাশ থেকে ইভানার কথা শুনে বিরক্ত হলো মেসবাহ। কপাল কুঁচকে বললো,
-“টেনশন করাটা কী স্বাভাবিক না?”
-“স্বাভাবিক.. তবে এতটা হাইপার হওয়া স্বাভাবিক না। তাছাড়া তুই এত হাইপার হলে উল্লাসী কী করবে?”
-“উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। তবে ওর সামনে আমি যথেষ্ট কুল থাকি। প্লাস আমি ওকে এটাও বুঝিয়েছি এটা হওয়ারই ছিল।”
-“অবশ্যই হওয়ারই ছিল। তোর মতো স্টুপিডের কাছ থেকে তো হওয়ারই ছিল। কই? লিমনের বিয়ের তো একবছর হয়ে এল! ওর বউকে কী ও প্রথম রাতেই প্রেগু বানিয়ে দিয়েছে?”
-“অশ্লীল কথাবার্তা বলিস না।”
-“ওরে আমার শালীন রে!”
গম্ভীরমুখে মেসবাহকে বসে থাকতে দেখে হাসিতামাশা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল ইভানা। ফিরে যাবার সময় তার হয়ে এসেছে। খুব বেশি হলেও পাঁচদিনের মতো এদেশে রয়েছে সে। এর মাঝে শুধুশুধু মেসবাহকে রাগিয়ে কী লাভ? এমনিতেই তার যাবার খবর শুনে প্রচুর রেগে রয়েছে মেসবাহ। কিন্তু সে এখানে থেকে করবেই বা কী? তার বুঝি কষ্ট হয় না? মেসবাহ এবং উল্লাসীকে একসাথে দেখলে কলিজা ছিঁড়ে যায় তার। তারপরও তো নিজের কষ্ট টা সামলে তাদের বিপদেআপদে সর্বসময় পাশে থাকার চেষ্টা করে। অথচ মেসবাহ সেসব বোঝেই না! অবশ্য দরকার কী বোঝার? সে নিজেও তো বোঝাতে চায় না..
-“তুই পাশে থাকলে আমি সাহস পেতাম। ভেবেছিলাম তোর আন্ডারেই ওকে রাখবো। অথচ তুই…”
-“আমি কি তোর পাশে নেই? সবসময় আছি। তাছাড়া শাহানাজ আপা তো ভালো একজন ডক্টর। আর তা তোর বা আমার কারোই অজানা নয়!”
-“তবুও…”
ম্লান হেসে মেসবাহর কাঁধে হাত রেখে তাকে আস্বস্ত করে ইভানা বললো,
-“কী তবুও? দেখলিনা আপা কী বললেন? ভালো আছে উল্লাসী। ঠিকঠাক আছে। টেনশন করিস না। শুধু উল্লাসীর দেখাশোনা টা ঠিকঠাক ভাবে কর।”
বাড়িতে জানাতে হবে, উল্লাসীর নানাজানকে জানাতে হবে। ব্যাপারটি কে কিভাবে নেবে কে জানে! তবে বুঝিয়ে সবটা খুলে বলতে হবে তাদের। কিন্তু কিভাবে বুঝিয়ে বলবে? সেভ পিরিয়ড বা পিল না খাওয়ানোর কারণ এসব তো আর বলা যাবেনা তাদের। তাহলে ঠিক কি বলবে? কী বলে বুঝ দেবে? মাথায় আসছে না মেসবাহর। ডাক্তার দেখিয়ে রিপোর্ট দেখিয়ে উল্লাসীকে বাসায় নিয়েছে ঘন্টাখানেক হয়েছে। যদিও ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নেই, তবুও তার চিন্তা কমছে না। অস্থির লাগছে। উল্লাসীর প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চিন্তার জগতে বিচরণ ছেড়ে বেরিয়ে এল মেসবাহ। ওয়াশরুমের দরজায় নক করে উল্লাসীকে দ্রুত গোসল সারবার তাড়া দিয়ে সে এগুলো সদর দরজার দিকে।
-“কী ব্যাপার? কখন এলে? আর ডাক্তার কী বললো?”
দরজা খুলে মুন্নি সরকারকে দেখে বিব্রত বোধ করলো মেসবাহ। ড্রইংরুমের দিকে এগুতে এগুতে সে নীচু গলায় বললো,
-“সব ঠিকঠাক আছে। খাওয়াদাওয়া, চলাফেরার দিকে নজর দিতে বললো। মা হবার জন্য উল্লাসীর ওজন খুবই কম।”
মেসবাহর পিছুপিছু সোফায় এসে বসলো মুন্নি সরকার। আশেপাশে নজর দিয়ে বললো,
-“অহ.. তা এই বয়সী বউকে প্রেগন্যান্ট বানানোর জন্য কিছু বললো না ডাক্তার?”
-“না.. এটা সম্পূর্ণই আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হলেও নিজেকে সংযত রাখলো মেসবাহ। সে নিজেও যেখানে বুঝতে পারছে তার দ্বারা ভুল হয়েছে সেখানে বাইরের মানুষ তা বললে দোষের কী?
-“সরি সরি। মজা করছিলাম। যাইহোক কংগ্রাচুলেশনস।”
মেজবাহর কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বললো,
-“কী ব্যাপার? তুমি কী খুশি নও?”
-“এটা কী আদৌ খুশি হবার মতো নিউজ?”
-“হবে না কেনো? তোমাদের মাঝে নতুন অতিথি আসছে। অবশ্যই এটি খুশি হবার মতোই একটি নিউজ।”
-“আমার তা মনে হয়না।”
-“কেনো?”
-“উল্লাসীর বয়স কম। আপনি আমি সবাই জানি এই বয়স কোনো মেয়ের পক্ষেই মা হবার জন্য সঠিক সময় নয়। প্রচুর রিস্ক আছে। তাছাড়া ও অবুঝ। যার ভেতরের বাচ্চামিগুলোই এখনো যায়নি। সে কিভাবে আরেক বাচ্চাকে সামলাবে? সব ভেবে আমার প্রচুর অস্বস্তি হচ্ছে। মেনে নিতে পারছিনা।”
সোফায় আরাম করে বসলো মুন্নি সরকার। মাথা নেড়ে মেসবাহর কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো,
-“সব ঠিক আছে। তবে তোমার মেনে নেবার ব্যাপারটি মোটেও ভালো লাগলোনা আমার। একটা কথা বলোতো.. আমাদের নানী-দাদীদের কি বাচ্চা হয়নি? এমনকি তোমার মাকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো উনার কত বছর বয়সে প্রথম সন্তান হয়েছে!”
-“তখন আর এখনকার যুগ! প্রচুর পার্থক্য আছে।”
-“এক্সাক্টলি। এটাই তো আমি বলছি। তখন ডক্টর, হসপিটাল এসব তেমন ছিল না। ভালো চিকিৎসা ছিল না। অথচ এখন সব আছে। কোনো সমস্যা হলে তুমি আছো পাশে। প্রযুক্তির কথা আর নাই বললাম!”
-“তারপরও রিস্ক তো থেকে যায়।”
-“তা প্রতিটি প্রেগন্যান্ট মেয়েরই থাকে। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও তুমি তো খুশির এই নিউজটি পেয়েছো। আর যে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আছে শুধুমাত্র এই নিউজটি শোনার জন্য কিন্তু পাচ্ছে না একবার গিয়ে তার ফিলিংস গুলো শুনে এসো। আর কেউ নয়, একবার হাসানের সাথেই কথা বলে দেখো! বুঝতে পারবে বাচ্চার জন্য ঠিক কতটা পাগল সে!”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“সব বুঝলাম। তবে আমি উল্লাসীর উপরে কাওকে প্রায়োরিটি দিতে পারবো না। আর যে আমার দুনিয়ায় আসেইনি তাকে তো আরও নয়। আমি জাস্ট উল্লাসীর কষ্ট দেখতে পারবোনা।”
-“বিশ্বাস রাখো.. কিচ্ছু হবে না।”
-“বিশ্বাসটাই রাখতে পারছি না। সত্যি বলতে অনার মতো আমি আর কাওকে হারাতে চাইনা। আপনজনকে হারানোর কষ্ট যে কতটা তীব্র হয় তা আজও আমি পদেপদে অনুভব করতে পারি।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩৯
আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আগে মেসবাহর কাছে ছুটির দিন মানেই ছিল লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠে গোসল সেরে জুমার নামাযে যাওয়া। এদিনটায় নেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সময়মতো হাসপাতালে যাবার কোনো তাড়া। নেই ছকে বাঁধা কাজের হিসেব, নেই রোগীদের করুন আর্তনাদ ধ্বনি। তবে আজ থেকে মনে হচ্ছে বাধা ধরা কাজের নিয়মে পরিবর্তন আনতে হবে। উল্লাসী অন্তঃসত্ত্বা তারউপর বয়স কম। এর মাঝে তাকে একা হাতে পুরো বাড়ির কাজ সামলাতে দেয়া যাবে না। ছুটি থাকুক বা হাসপাতালে ডিউটি প্রতিদিন সকালে উঠে উল্লাসীকে রান্না সহ সকল ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কাজেও সাহায্য করতে হবে। দরকার পড়লে গ্রাম থেকে কাওকে আনতে হবে সারাদিন উল্লাসীকে দেখেশুনে রাখার কাজে। আজ অনা বেঁচে থাকলে না হয় আম্মাকে কিছুদিন এনে এখানে রাখা যেত! হঠাৎ অনার কথা স্মরণ হতেই বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। অনার মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারেনি সে। কেনো যেনো মনে হয় বেঁচে আছে অনা। তার আশেপাশেই আছে। ব্যাগ হাতে বাড়িতে ঢোকার পর সে ছুটে আসবে তার পাওনাকড়ি বুঝে নেবার জন্য। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠতেই ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
-“তোমাকে বারবার বললাম মাংস টাংস রাধতে হবে না। অল্প কিছুর মাঝেই করে ফেলো.. কথা কেনো শোনো না তুমি?”
মেসবাহ কড়া স্বরে কথাগুলো বলতেই তার দিকে ফিরলো উল্লাসী। চোখেমুখে কুঁচকে আহ্লাদী গলায় বললো,
-“আমার মাংস খেতে ইচ্ছে করলে আমি কী করবো?”
-“তোমার মাংস খেতে ইচ্ছে করছে?”
-“হ্যাঁ.. খুব।”
-“ঠিকাছে। আমি ধুয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছি। তুমি ওদিকেই থাকো.. নয়তো আবার বমি হবে!”
-“উফ.. বাঁচালেন! আমি আরও ভাবছিলাম আরও একদফা বমির জন্য তৈরি হ উল্লাসী!”
হালকা হেসে মাংসর গামলায় হাত দিল মেসবাহ। একেকটি টুকরো পরিষ্কার করতে করতে উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বললো,
-“বাড়িতে কল করবো ভাবছি.. তবে এখন করলে আব্বাকে পাবো কিনা সন্দেহ!”
পেয়াজ কুঁচিকুঁচি করে মরিচে হাত দিল উল্লাসী। আগ্রহী গলায় বললো,
-“কেনো? পাবেন না কেনো?”
-“আমাদের ওখানে জুমার নামাজ অনেক আগেই পড়ায় না? আব্বা হয়তো নামাজেই গেছে।”
-“অহ.. হ্যাঁ! কিন্তু আব্বার তো পায়ে পানি ধরেছে। উনি কী মসজিদে যেতে পারবেন?”
-“ওহহো! এটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম! তুমি চুলোয় পেয়াজ মরিচ দাও। আমি কথা বলে আসি।”
-“আপনি যান.. আপনাকে আর লাগবে না।”
মাংসের গামলা উল্লাসীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মেসবাহ বললো,
-“বেশি পন্ডিতগীরি করো না! আমি এসে ঢেলে দিব।”
-“ওটুকু আমি পারবো।”
-“পারবে না। দেখি দাও মাংসের ডিশটা। আমি সাথেই নিয়ে যাই।”
-“আরে! ঠিকাছে, আমি নাড়বো না মাংস। রেখে যান ওটা।”
উল্লাসীর কথায় পাত্তা না দিয়ে মাংসভর্তি গামলা নিয়ে ঘরে ফিরে এল মেসবাহ। চার্জ থেকে ফোন খুলে ডায়াল করলো বাড়ির টেলিফোন নাম্বারে।
-“আসসালামু আলাইকুম আব্বা.. আপনার শরীর ভালো?”
-“আল্লাহ রাখছে। তোরা ভালা?”
-“জ্বি.. আপনার পায়ের পানির কী অবস্থা?”
-“মুবিন পরশু হাসপাতালে নিয়া গেছিলো। ঔষধ দিছে। খাইয়া আলহামদুলিল্লাহ এল্লা কমকম।”
-“সময়মতো খান। ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠবেন।”
-“হহ.. কিছু কবি?”
অস্বস্তি অনুভব করছে মেসবাহ। তবে বলতে তো তাকে হবেই। কিন্তু কিভাবে বলবে? তাছাড়া এত ছোট এক মেয়ের অন্তঃসত্ত্বার খবর শুনে তার কাছে কৈফিয়ত চাইলেই বা কী কৈফিয়ত দেবে সে? লম্বা একটি দম ছেড়ে নিজেকে শান্ত করলো মেসবাহ। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“হ্যাঁ.. আব্বা আপনি দাদা হচ্ছেন।”
-“কস কী? মেজো বৌমা পোয়াতি? শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। ও মোরশেদা শুইনা যাও…”
আলাউদ্দিন শেখের উৎসাহ দেখে কপাল কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। সঙ্কুচিত গলায় বললো,
-“রাখছি তাহলে আব্বা!”
-“রাখ রাখ। সব খুশি আমার পরিবারে একবারেই আইলো। সকাল সকাল বড় বৌমা আইসা হাজির। দুপুরে আবার মেজো বৌমার খবর! আল্লাহ তুমি বড়ই ক্ষমাশীল! তোমার ক্ষমা বড়ই সুন্দর।”
-“বড় বৌমা বলতে? বড়ভাবি এসেছে?”
-“হহ.. আমার কী বড় বৌমা হাজারডা?”
-“না.. কিন্তু উনি কেন?”
-“ফিরা আইছেরে বৌমা। সবই আল্লাহর নেয়ামত। রাইখা দে বাজান।”
ফোন নামিয়ে রেখে পুরো ব্যপার বুঝে উঠার জন্য কিছু সময় নিল মেসবাহ। বড়ভাবি কি সত্যিই একেবারে ফিরে এসেছে? বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
দুপুরে খাবার শেষে মৌমিকে কোলে নিয়ে আলাউদ্দিন শেখের ঘরে প্রবেশ করলো জ্যোতি। সে যে আলাউদ্দিন শেখকে দেখে এবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সেই লোকের সাথে কোনোদিক দিয়েই মিল নেই এই আলাউদ্দিন শেখের। চিন্তায় চিন্তায় বয়সের তুলনায় তাকে খুব বেশি বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। শরীরের চামড়া কুঁচকে যায়গায় যায়গায় কালচে হয়ে পড়েছে। দাড়িগোঁফ পেঁকে সাদা হয়ে গেছে। চোখের নিচে পড়েছে কালচে আবরণ। তার বর্তমান এই অবস্থা দেখে যে কারো কঠিন হৃদয় গলতেও বাধ্য। বুকভর্তি তৃপ্তি নিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়েই একটি চেয়ারে বসলো জ্যোতি। চির পরিচিত এই বাড়িতে আসার পর থেকেই অন্যরকম ভালোলাগছে তার। কেনো যেনো রাশেদকে ফেলে এবাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্তই মনে হচ্ছে জীবনের উত্তম একটি সিদ্ধান্ত। ঠোঁটে মুখে অজস্র স্বস্তি ফুটিয়ে আলাউদ্দিন শেখের মায়ায় মোড়ানো চেহারার দিকে তাকালো জ্যোতি। নীচু গলায় বললো,
-“ডেকেছিলেন?”
-“অহ.. হ্যাঁ। আইছো? মাজহারুল আইছে?”
-“না.. ওর খাওয়া হয়নি। হলেই এসে পড়বে।”
-“আচ্ছা.. ও আইসুক। তারপরই বলি। তা আমার দাদুভাই খুশি তো? ও মৌমি তুই খুশি?”
দাদুর কথা শুনে মায়ের বুক থেকে মাথা উঠালো মৌমি। হাসিমুখে মায়ের গালে হাত বুলিয়ে বললো,
-“অনেকগুলো খুশি। কিন্তু আম্মুতো আবারও চলে যাবে। মেজো বাবার বাসায় গিয়েও যখন আম্মুকে পেয়েছিলাম তখনও আম্মু চলে গিয়েছিল।”
মেয়ের কপালে চুমু দিল জ্যোতি। চোখ নেড়ে তাকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
-“আর যাবো নারে মা।”
-“আমি জানি। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখবো তুমি নেই। তবে আমিও কম চালাক না। তোমাকে এখন যেভাবে জড়িয়ে রেখেছি সবসময় এভাবেই জড়িয়ে ধরে থাকবো। কোনোদিনই যেতে দিব না তোমায়।”
-“যাইবো না তোর মা। চাইলেও আমি যাইবার দিমু না। ও বড় বৌমা তুমি মেজবাহর বাড়িত গেছিলা নাকি?”
আলাউদ্দিন শেখের কথায় মাথা নাড়ালো জ্যোতি। ঠিক কী জবাব দেবে ভেবে পেল না সে। মৌমির সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য মাজহারুল এবং সে এক হোটেলে ছিল। এবং সেই রাতে দুজনের ইচ্ছেতেই এমন কিছু ঘটে গিয়েছিল যা চাইলেও একয়দিনে ভুলতে পারেনি সে। নতুন করে আবারও মাজহারুলকে নিয়ে ভাবার ওই রাতটিও একটি কারণ। নতুবা এবাড়িতে নতুন করে ফিরে আসা মোটেও সহজ ছিল না তার পক্ষে।
-“তাইলে মৌমি কোনকার কথা কয়?”
-“ওকে আমি গল্প শুনিয়েছিলাম। ওসব বলছে।”
দরজার কাছ থেকে জবাব দিতে দিতে আলাউদ্দিন শেখের পায়ের কাছে এসো বসলো মাজহারুল। আলতো হাতে পায়ের অবস্থা দেখে বললো,
-“কমে গেছে অনেকটা। তা আব্বা কিছু বলতে চাইছিলেন বোধহয়!”
-“হহ.. প্রথমেই আমি তোগো দুইজনের কাছে ক্ষমা চাই। কীরে? ক্ষমা করবি না?”
-“এভাবে বলবেন না আব্বা।”
মাজহারুলের কথা শুনে জ্যোতির দিকে তাকালো আলাউদ্দিন শেখ। ব্যাকুল স্বরে বললেন,
-“বড় বৌমা তুমি কিছু কও।”
-“আমার এখানে কিছু বলার নেই। ভুল কমবেশি আমারও ছিল। মনজুগিয়ে চলা বলতে একটি কথা আছে। যেটি আমি কখনোই করার চেষ্টা করিনি। তাছাড়া আমি অতীত ভুলেই এখানে এসেছি।”
-“সেইডাই আমার জন্য বড় ক্ষমা। আর কোনো ছেলেমেয়ের জীবনে কাটা হয়ে দাঁড়াইতে চাই না বৌমা। অনেক খারাপ কাজ করছি। মেয়েকে হারাইয়া শাস্তিও পাইছি। জানো না বৌমা মধ্যরাতে বুকের ভেতরটা কাঁইপা ওঠে। ফাঁকাফাঁকা লাগে মেয়েডার জন্য। ইশ কী কষ্ট দিয়াই না আমার মেয়েটারে মারছে রে!”
আলাউদ্দিন শেখের আর্তনাদ ধ্বনি শুনে চোখজোড়া ছলছলে হয়ে এল জ্যোতির। অনার মৃত্যুর খবর জানা ছিল না তার। জানলেও হয়তো শেষ দেখা দেখতে আসতো না সে। কী দরকার বীভৎস এক মুখকে স্মৃতির পাতায় স্থান দেয়ার? তার মনে যে অনার ছবি আজও রয়েছে তার হাস্যজ্বল মুখটিই না হয় আজীবন থাকুক স্মৃতির পাতায়।
-“আমি মেয়েডারে হারাইয়া বুঝছি কলিজার টুকরা ছাড়া দিনের পর দিন কাটাইতে কেমন লাগে। এত কষ্ট হয় বৌমা! আর সেই কষ্ট আমি তোমারে দিছি। তুমি কেমনে সহ্য করছো বৌমা? তুমি আমারে ক্ষমা করতে পারলেও এই কাজের জন্য আমি নিজেরে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারুম না।”
-“থাক না সেসব কথা!”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন আলাউদ্দিন শেখ। মৃদু স্বরে বললেন,
-“হহ.. থাক। যেডার জন্য ডাকছিলাম.. তুমি তো ঢাকায় চাকরি করো। মাজহারুল এইখানে হাই স্কুলে মাস্টারি করে। তাইলে তোমরা কেমনে দুইজন একসাথে থাকবা? বলি কি মাজহারুল তুই ঢাকার কোনো চাকরি খোঁজ। মেসবাহরে ক। ও ঠিকই ব্যবস্থা কইরা দিবে।”
আলাউদ্দিন শেখের এমন কথা শুনে অবাক হলো মাজহারুল। তার বাবা এসব কী বলছেন? তার কী ধারণা তাদের করা ভুলের জন্য তাদের ফেলে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে নতুন সংসার সাজাবে সে? অসম্ভব! সন্তান ভুল করলে যেখানে তা মাফ করে তাদের সঠিক পথের দিকে ধাবিত করে পিতামাতা, সেখানে পিতামাতা ভুল করলে সন্তান কেনো পারবেনা তাদের সঠিক পথে আনতে? তাছাড়া ছেড়ে চলে যাওয়া কোনো সমস্যার সমাধান নয়। জ্যোতিও তো সকল দায়দায়িত্ব ফেলে চলে গিয়েছিল নিজের নতুন এক পৃথিবী সাজাতে। তবে পেরেছে কী? দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পাশ থেকে জ্যোতি বললো,
-“আর আপনারা?”
আলাউদ্দিন শেখ জবাব দিলেন,
-“আর কতকাল বাপ-মা বাপ-মা কইরা যাইবো মাজহারুল? এখন তো ওর নিজের দিকে তাকাইতে হইবো! তোমরা ভালো থাকো বৌমা। তোমরা ভালো থাকলেই আমরা ভালো।”
-“আমি রিজাইন দিয়েই এসেছি। আমি এখানেই থাকবো। আপনাদের সবার সাথে।”
-“কিন্তু বৌমা তোমার কাজ?”
-“হবে.. এখানে থেকেও হবে। অন্যকিছু করবো। তাছাড়া মাজহার তো সাথে আছেই। কী? তুমি নেই?”
জ্যোতির কথায় সুখের এক ছায়া ছেঁয়ে গেল মাজহারুলের পুরো মনজুরে। বুকভর্তি তৃপ্তি নিয়ে সে বললো,
-“আছি…”
সিকান্দার মির্জার সাথে কথা শেষে ফোন রেখে পড়ার টেবিলে বসলো মেসবাহ। পুরো ব্যপারটা নিয়ে যতটা আতংক কাজ করছিল তার মনের ভেতরটায়, সবাইকে সবটা জানানোর পর তার চেয়ে দ্বিগুন বেশি বিস্মিত সে। কত সহজেই না বিষয়খানা মেনে নিয়েছে সকলে! যেখানে সকলের মনে উল্লাসীকে নিয়ে ভয় হবার কথা সেখানে তাদের মনে ভর করেছে একরাশ আনন্দ। কেনো আমাদের সমাজটা এমন? কেনো এই সমাজের মানুষের চিন্তাধারা যে এখনো পৃথিবীর আলোয় দেখেনি তাকে নিয়েই সীমাবদ্ধ?
-“নানাজান কী বললো?”
উল্লাসীর প্রশ্ন শুনে পিছন ফিরে বিছানার দিকে তাকালো মেসবাহ। গম্ভীরমুখে বললো,
-“বললো ভালো খবর। তিনি অনেক খুশি হয়েছেন।”
-“আর?”
-“তোমাকে তার ওখানে রাখার কথাও বললো। ওখানে নাকি দেখাশোনার মানুষ আছে..”
-“বললেই হলো? আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”
-“হুম.. আমিও দিব না।”
উদ্বিগ্ন গলায় কিছু একটা বলেই আবারও চিন্তায় ডুব দিল মেসবাহ। তীক্ষ্ণ চোখে তাকে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে গলা উঁচিয়ে তাকে ডেকে উঠলো উল্লাসী। ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
-“আপনি দিনদিন যেন কেমন বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছেন! কেমন গম্ভীর.. যেনো আপনার মতো রাগী মানুষ এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই।”
-“বাবা হবো তো সামনে.. তাই প্রাকটিস করছি কঠোর বাবা হবার।”
-“কচু করছেন! বাবা হবেন না হয় দুইদিন আগে জানলেন। তাহলে এর আগেও কেনো ওরকম করেছেন? যেনো রাগীভুত একটা!”
-“তখনও আমি জানতাম। তাছাড়া আমি কী তোমার মতো? সারাদিন টৈটৈ করবো? তুমিও আমার মতো নিজেকে বদলাও। মাতৃ সূলভ আচরণ নিজের মাঝে আনো। নয়তো বাচ্চা হবার সাথেসাথেই তোমার মতো বিচ্ছুপানা শিখে যাবে।”
-“এহ! সবসময় এই এক কথা! বাচ্চা মানুষ.. আরেকটি বাচ্চার ঝামেলা নিতে পারবে না হ্যানত্যান.. দু’দিন ধরে এই কথা বলে আসছেন। তো শুনে রাখেন ডাক্তার সাহেব, এই বাচ্চাই কিন্তু সুহাকে বড় করেছে। ছোট্ট সেই সুহার প্রস্রাব পায়খানা থেকে শুরু করে সবটাই এই বাচ্চাই করেছে। আর এখন যখন আমার নিজের বাবু হবে তখন নাকি আমি বাচ্চা পালতে পারবো না! সবাই কী আপনার মতো বোকা হালুম? শুধু লম্বাতেই বেড়েছেন বুদ্ধিতে নয়।”
-“আপনি পাকনা বুড়ি.. এবার ঠিকাছে?”
-“খুব হয়েছে। একটা কথা জানেন? আপনি যখন রাগী চেহারা নিয়ে থাকেন, আমাকে বকেন, আমি আদর চাইলে কপাল কুঁচকে বলেন উফফ উল্লাসী! পড়ছি, বিরক্ত করো না। তখন আপনাকে দেখতে গরুগরু লাগে?”
কপাল কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। কড়া গলায় বললো,
-“যথেষ্ট হয়েছে। এত রাত জাগতে নেই। ঘুমোও।”
-“এই যে এই চেহারা! আপনাকে এখন ঠিক গরু গরুই লাগছে।”
হেসে ফেললো মেসবাহ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখে ঘরের আলো নিভিয়ে এল বিছানায়। একহাতে উল্লাসীকে বুকে আঁকড়ে ধরে তার চুলের মাঝে ঠোঁট ডুবিয়ে মৃদু স্বরে ডুবিয়ে বললো,
-“ঘুমোও.. রাত অনেক হয়েছে।”
সেকথার তাল না দিয়ে মেসবাহর বুকে মুখ গুঁজলো উল্লাসী। বিড়ালছানার মতো নাক ঘষতে ঘষতে আহ্লাদী গলায় বললো,
-“বাবু এখন আমার পেটে কী করে? আমার এই ছোট্ট পেটে ওর থাকতে কষ্ট হয় না? দম বন্ধ হয়ে আসেনা?”
-“না.. ওর জন্য এটাই সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। তুমি যখন শ্বাস নাও বাবুও তোমার মাধ্যমে শ্বাস নেয়। তুমি যখন খাও, বাবুও খায়। তুমি যখন হাসো, বাবুও হাসে।”
-“তাহলে তো আমায় সবসময় হাসতে হবে। আমার বাবুও খুশি থাকবে।”
-“হ্যাঁ.. মা খুশি তো সন্তানও খুশি।”
মেসবাহর কথার পিঠে কিছু বললোনা উল্লাসী। চোখবুঁজে চুপচাপ খানিকক্ষণ থাকার পর মনটা ভারী হয়ে উঠলো তার। মুখ তুলে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে সে নীচু স্বরে বললো,
-“কাল রাতে আমি মা’কে স্বপ্ন দেখেছি। ছোট্ট সুহাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল মা। আমাকে কিছু একটা বলছিল.. তবে আমি অনেক দূরে থাকায় ঠিকভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম না… সুহাকে জন্ম দিতে গিয়ে মা যেমন মারা গেছে বাবুকে জন্ম দিতে গিয়ে যদি আমিও মারা যাই, তখন কি বাবার মতো আপনিও ছোটমার মতো কাওকে বিয়ে করে আনবেন?”
বুকের ভেতরটা হুঁহুঁ করে উঠলো মেসবাহর। যে ভয়টাই সে পাচ্ছিলো, আজ তা উল্লাসীর মুখ থেকে শুনে কলিচা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। ধরা গলায় সে কোনমতে বললো,
-“ঘুমোও উল্লাসী..”
-“ঘুমোবো… আমি আপনাকে আগেও বলেছিলাম আপনি কখনোই আমাকে সেভাবে ভালোবাসবেন না, যে ভালোবাসা আমি হারিয়ে গেলেই ফুরিয়ে যাবে। আপনি আমাকে সেভাবেই ভালোবাসবেন, যে ভালোবাসায় আমি মার মতো হারিয়ে গেলেও ছোটমার মতো কেউ কখনোই আসবে না। আজও আপনাকে বলছি আপনি আমার জায়গায় কাওকে এনে সুহার মতো আমার বাবুটাকে কষ্ট দেবেন না। সুহার পাশে আমি ছিলাম কিন্তু আমার বাবুটার কেউ থাকবে না।”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)
সূর্যোদয়ের সাথেসাথে নতুন দিনের সূচনা হয়। শুরু হয় জনজীবন প্রকিয়া। নতুন শিশু জন্ম নেয় আবার অনেকেই বিদায় নেয় মমতাময়ী পৃথিবীর বুক ছেড়ে। জন্ম মৃত্যু যে জীবনেরই অংশ! জন্ম যার হয়েছে মরতে তো তাকে হবেই। তাই বলে কী থেমে থাকে জীবন? থাকে না। ধরাবাঁধা নিয়ম ভেঙে জীবন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে। যে গতিতে চলে এসেছে মেসবাহ জীবন। দেখতে দেখতে চোখের পলকেই আরও ছয়টি মাস হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে অকস্মাৎ যেভাবে সে হারিয়েছিল তার বোনকে। তবে অন্য আরও দশটি দিনের চেয়ে তার আজকের দিনের সূচনা হয়েছে ভিন্নভাবে। সকাল সকাল উঠে ব্যথায় ছটফট করা উল্লাসীকে দেখে অস্থির হয়েছে, প্রিয়জন হারানোর ভয়ে ডেকেছে উপরওয়ালাকে।
আজও নতুন একটি শিশু জন্মাবে। রহস্যময় এই পৃথিবীতে নিজের পদার্পণের জন্য যে উতলা হয়ে উঠেছে। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে নতুন জগতে নিজের রঙ ছড়ানোর জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তবে মা যে তার এই আগমনী বার্তা সহ্য করতে পারছেনা। ব্যথায় অস্থির হয়ে কাকুতি মিনতি করছে ব্যথা কমিয়ে দেবার। বুঝতে পারছেনা সে তার শিশুর রুপটি। কেনো শুধুশুধু মা’কে কষ্ট দিচ্ছে সে? ব্যথায় কোঁকড়ানো মুখ নিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আর্তনাদ ধ্বনি করে উঠলো উল্লাসী। মুন্নি সরকারের হাত চেপে ধরে বললো,
-“ভাবি আমার কি সময় হয়ে এসেছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“আমার খারাপ লাগছে ভাবি। কষ্ট হচ্ছে। আমি কি মরে যাচ্ছি ভাবি?”
-“বাজে বকিস কেন? মরা কি খুব সহজ? শুধু তুই একাই এই দুনিয়ায় বাচ্চা জন্ম দিচ্ছিস? আর কেউ দিচ্ছে না?”
জবাব দিল না উল্লাসী। পেট আঁকড়ে ধরে আবারও চিৎকার করে উঠলো সে। এত কষ্ট কেনো মা হওয়ায়? কেনো..!
কেবিনে ঢুকলো মেসবাহ। চোখমুখ তার আতংকে নীল হয়ে রয়েছে। নতুন শিশু আসছে পৃথিবীতে। তবে তার আগমনে বুকের ভেতরটায় ভয় হচ্ছে। অজানা এক শঙ্কা গ্রাস করে ফেলছে নতুন প্রাণের আগমনী খুশি। তবে তার আগমনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করা প্রয়োজন। যেনো কখনোই উল্লাসী ধরতে না পারে বাবা হিসেবে তার ব্যর্থতাগুলো..
-“আপনি বারবার কোথায় যান আমাকে ফেলে?”
উল্লাসীর কাঁপা গলার স্বর কানে আসতেই তার পাশে বসলো মেসবাহ। হাতের মুঠোয় তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
-“আর যাবো না। এই তো বসলাম।”
-“আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।”
-“এখনি ঠিক হয়ে যাবে।”
-“যদি ঠিক না হয়? আমি যদি মারা যাই?”
কোমল স্বরে মেসবাহ জবাব দিল,
-“কিচ্ছু হবেনা।”
-“হবে.. আমার মনে হচ্ছে আমিও মায়ের মতো মারা যাবো। আপনি আমার বাবুটাকে দেখবেন তো?”
-“কিচ্ছু হবেনা ওসব। তুমি ভালো কিছু ভাবো। আমাদের বাবুর নাম ঠিক করেছিলে না? কী নাম যেনো ঠিক করেছিলে?”
-“ছেলে বাবু হলে উচ্ছ্বাস আর মেয়ে বাবু হলে মৈত্রী। আপনি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছেন আপনি সুহার মতো আমার বাবুকে কষ্ট পেতে দেবেন না। আমার বাবুটাকে সবসময় আদর করবেন। আপনার কাজে বিরক্ত করলেও বকবেন না। একা রুমে কখনোই রাখবেন না।”
ধরা গলায় মেসবাহ বললো,
-“চুপ.. একদম চুপ।”
থামলো না উল্লাসী। ব্যাকুল সুরে সে বলতে লাগলো তার মনের ভেতরের জমানো কথাগুলো।
-“আপনি যদি আমার যায়গায় কাওকে আনতেই চান তাহলে আমার বাবুটাকে নানাজানের কাছে দিয়ে আসবেন। আমি জানি উনি সুহার মতো আমার বাবুটাকেও ভালোবাসবে।”
-“আর একবার এসমস্ত কথা বলবা তো আমি উঠে চলে যাবো।”
-“না আপনি যাবেন না। আপনি আমার পেটে হাত রাখুন। দেখুন আমার বাবুটা কীভাবে নড়ছে। শুনুন.. ওকে কিন্তু বকবেন না কখনোই। কখনোই বলবেন না তুই কেনো এত কষ্ট দিয়ে তোর মাকে মেরে ফেললি!”
অটির সামনে বসে অপেক্ষা করছে লিমন। অজানা এক ভয় তাকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ডাক্তার হবার সুবাদে তার অজানা নয় অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটি মেয়ের মা হবার সময় ঠিক কতটুকু ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। তবুও সবটা জেনেশুনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে মেনে নিয়েই মেসবাহ সবটা সামাল দিয়েছে। উল্লাসীর ছোটবড় সকল আবদার মিটিয়েছে। ধৈর্য ধরে নিজের সবটা দিয়ে সেবা করেছে অর্ধাঙ্গিনীর অন্তঃসত্ত্বার সময়টিতে৷ মেসবাহর এই ভালোবাসা, কষ্ট যেনো বিফলে না যায়! নয়তো জীবনের অর্থকেই হারিয়ে বসবে সে। চোখবুঁজে উপরওয়ালার নিকট প্রার্থনার মাঝপথে ইভানার আসা ফোনকল ব্যাঘাত ঘটালো তাতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করে লিমন বললো,
-“হ্যাঁ.. বল।”
-“কী অবস্থা ওখানের? উল্লাসীর কী অবস্থা?”
-“ওটিতে নিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ হলো।”
-“আর মেসবাহ?”
-“ওর সাথেই আছে। ও তো আরেক নাছোড়বান্দা। উল্লাসীকে কোনোমতেই একা ছাড়বে না সে।”
-“যাক.. ভালোই হয়েছে৷ এতে উল্লাসীও সাহস পাবে।”
-“মোটেও না.. আরও তার বিপরীত হচ্ছে। মেসবাহকে কাছে পেয়ে উল্লাসীর চিৎকার চেচামেচি আরও বেড়েছে। এদিকে ব্যথাও উঠেছে অনেক্ক্ষণ যাবৎ। কিন্তু বাচ্চা আসছে না। উয়ার্ড সিচুয়েশন!”
আৎকে উঠে ইভানা বললো,
-“তারপর? কী ব্যবস্থা নিল?”
-“ডক্টর আরও কিছুক্ষণ ওয়েট করতে চাইলো। কিন্তু মেসবাহই লাস্টে ডিসিশন দিল সিজারের। উল্লাসীর কষ্ট দেখার ক্ষমতা নেইরে মেসবাহর। একবিন্দুও নেই..”
-“ভালোবাসলে কী এভাবেই বাসা উচিৎ না? তাছাড়া কম সময় হলো উল্লাসী সহ্য করছে পেইন। বাচ্চা মানুষ আর কতই বা নেবে!”
-“হুম..”
-“আমি কোনো কাজেই মন দিতে পারছি না। তুই একটু পরপর আমায় আপডেট দিস। রাখছি..”
ইভানা কল কেটে দিতেই আরও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো লিমন। কিছু নীরবতা যদি অন্যের জীবনে আনন্দের সন্ধান এনে দেয় তাহলে ক্ষতি কী? থাকুক না কিছু নীরব ভালোবাসা মনের মনিকোঠায়। ফোন পকেটে রেখে অটির দিকে তাকাতেই মেসবাহকে বেরিয়ে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো লিমন। উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকে এগোতেই মেসবাহ বললো,
-“পারছি নারে উল্লাসীকে ওই অবস্থায় দেখতে! কী কষ্ট! পারছি না আমি একদম।”
-“তুই এদিকে আয়.. এদিকে এসে বয়।”
লিমন হাত ধরে মেসবাহকে পাশে এনে বসাতেই লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। নিজেকে অসহায় লাগছিল। বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছিল অনার মৃত মুখের ছবি। উল্লাসীর অন্তঃসত্ত্বার খবর যখন তারা পেয়েছিল তখন উল্লাসীর সাড়ে তিনমাসের মত চলছিল। সেসময় তার শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটলেও মানসিক পরিবর্তনটা চোখে পড়ছিল না। তবে ধীরেধীরে দিন বাড়তে লাগলো। শুরু হলো উল্লাসীর মুড সুইং। এই ভালো এই খারাপ। খাবার দাবার ঠিকঠাক মতো খেত না। অল্পস্বল্প যাই খেত গন্ধ গন্ধ বলে বমি করে ভাসিয়ে দিত। জেদ করতো, মাঝরাতে উঠে এটাসেটা খাবার আবদার করতো। তবে এনিয়ে কখনোই কিছু বলেনি সে উল্লাসীকে। বিরক্ত হলেও শান্ত থেকে বিষয়গুলো সামলিয়েছে। তবে রাতে যখন উল্লাসীকে বুকে আঁকড়ে ধরে ঘুমের চেষ্টা করেছে, তখন তার দেখা পায়নি। অজস্র ক্লান্তি, ভয় একসঙ্গে এসে চেপে ধরেছে তাকে। মানসিক ভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে। ঘটনা বেশি একটা আগের নয়। উল্লাসীর যখন সাতমাস চলছিল। শারীরিক, মানসিক সবদিক থেকেই প্রচুর পরিবর্তন ঘটেছে উল্লাসীর মাঝে। রোগা স্বাস্থ্যের মেয়েটির পেট ফুলে ফেঁপে উঠছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক ভাবে না করায় তার রোগা পাতলা শরীর আরও রোগা হয়েছে। ঠিকঠাক ঘুম না হবার কারণে চোখের নিচে কালি জমেছে। সেরাতেও ঘুম পায় না পায় না করেও রাত দু’টোর দিকে নানান ঝামেলা করে উল্লাসীকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিল মেসবাহ। ডুব দিয়েছিল গভীর স্বপ্নের রাজ্যে। ঘন অন্ধকারময় অথচ চারপাশ থেকে আসছে আলোর ঝিলিক। বেশ বড়সড় একটি গাছের তলায় দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে অনা। চোখেমুখে তার একরাশ অভিমান৷ কেনো সবাই তাকে হারিয়ে নীরব হয়ে পড়েছে? সে তো নিজের জগতে ভালো আছে। তাহলে তারা কেনো নেই? ও মেজোভাই, তোমরা নীরবতা ভেঙে ফেলো না! সদ্যজাত শিশুর মতো হয়ে ওঠো না সরব… আচমকা ঘুম ভেঙে গেল মেসবাহর উল্লাসীর ডাকে। চোখজোড়া প্রসস্থ করে সে উতলা মনে বললো,
-“অনা.. অনাকে দেখলাম।”
-“পাগল হয়েছেন? অনা আপাকে কিভাবে দেখবেন?”
উল্লাসীর কথায় ঘোর কাটলো মেসবাহর। উঠে বসে ঘনঘন কিছু নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“উঠলে কখন তুমি?”
-“জানি না.. আমার ক্ষিধে পাচ্ছে।”
-“রাতে ঠিকমতো না খেলে এমনই হবে। তুমি বসো.. আমি ভাত নিয়ে আসি।”
-“না না.. ভাত খাবোনা। এত রাতে কেউ ভাত খায়?”
-“তাহলে কী খাবে? সেদিন রাতের মতো এখন আবার বলো না আইসক্রিম খাবো.. ঠান্ডার কারণে তোমার ওসব মানা।”
ঠোঁট বেঁকে উল্লাসী বললো,
-“আইসক্রিম বলবোও না। আমার কেক খেতে ইচ্ছে করছে।”
-“কেক? ঘরে কী আছে? থাকার কথা তো। দাঁড়াও খুঁজে দেখি।”
মেসবাহ উঠতে নিতেই তার হাত টেনে ধরলো উল্লাসী। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“খুঁজতে হবে না। কেক নেই। সন্ধ্যায়ই আমি খেয়ে শেষ করে ফেলেছি।”
-“তো সেটা তখনই বলবে না? এখন এত রাতে আমি তাহলে কেক কোথায় পাবো? তিনটার উপরে বাজে।”
-“সেটা তো আমি জানিনা। আমি খাবো মানে খাবোই।”
-“তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। ফজরের আযানটা দিলে না হয় আমি কেকের ব্যবস্থা করছি।”
-“অসম্ভব! ততোক্ষণ আমি কী করে থাকবো। ক্ষুধা পেয়েছে বললাম না?”
-“অন্য কিছু খাও। বিস্কিট দেই? বা চকোলেট?”
-“না.. ওসবের গন্ধে আমার বমি পায়। আমার কেকই লাগবে।”
কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ গলায় মেসবাহ বললো,
-“জেদ করো না উল্লাসী। এখন আমি কেক কোথায় পাবো?”
-“হ্যাঁ.. তা তো পাবেনই না! জানি তো। সব জানি। মুন্নি ভাবি আমাকে সব বলেছে। বউ প্রেগন্যান্ট হলে নাকি আর জামাইদের তাকে আর ভালোলাগেনা। মধু আছে না মধু? বউয়ের কাছে না পেয়ে তারা সেই মধু বাইরে খুঁজতে যায়।”
-“এই মুন্নি ভাবিই তোমায় পাকাচ্ছে। ছোট বাচ্চার মুখে এসব কী কথা হু? দেখি ছাড়ো এবার।”
-“কেনো? কই যাবেন?”
-“ইউটিউব ঘেটে চেষ্টা করে দেখি। বউয়ের জন্য কেক মেক করতে পারি কিনা!”
আচমকা লিমনের ডাকে অতীতের বেড়াজাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এল মেসবাহ। একরাশ হতাশা নিয়ে লিমনের দিকে চাইতেই পাশ থেকে শুনতে পেল আলাউদ্দিন শেখের আওয়াজ। শঙ্কিত গলায় সে বলছেন,
-“মেজো বৌমা কোনহানে? ঠিক আছে তো হে?”
বাস্তবতা বড়ই নির্মম। তবে অসুন্দর নয়। অনা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছে। রেখে গেছে আপনজনদের হাহাকার.. গভীর নীরবতা। তবে জীবন সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দূর্বিষহ অতীত চলে যায় কিছু সুখকর ভবিষ্যৎ দেবার আশায়। একঘেয়ে জীবনের অবসান ঘটাতেই পৃথিবীতে চলে নানান সুখদুঃখের খেলা। এখেলায় কেউবা সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়, কেউবা নতুন করে আসে আশীর্বাদ হয়ে। আলাউদ্দিন শেখের পরিবারেও এসেছে নতুন প্রাণ। তার আগমন সকলের চোখে পানি এনে দিয়েছে। ছোট্ট এই প্রাণটার ভেতর যেনো স্বয়ং অনার বসবাস! চোখভর্তি জল নিয়ে নাতনিকে কোলে তুলে নিলেন আলাউদ্দিন শেখ। হাতপা অনবরত কাঁপছে তার। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভরে উঠেছে। যেমনটা আজ থেকে বিশবছর আগে সদ্য জন্মানো অনাকে কোলে নিয়ে অনুভব হয়েছিল তার মনের ভেতরটায়। উপরওয়ালার কত সুন্দর লীলাখেলা!
-“ও দাদু.. তুমি একা কেনো আমার বোনকে কোলে নিয়ে আছো? আমাকেও দাও!”
মৌমির কথা শুনে কেঁদে ফেললো আলাউদ্দিন শেখ। বুকে আঁকড়ে ধরলো দুই নাতনিকে। চারিপাশর সকলের কোলাহল বলে দিচ্ছে তারা ঠিক কতটা খুশি। অনার মৃত্যুর পর যে ঘোর নীরবতা নেমে এসেছিল তাদের জীবনে কালের স্রোতে সদ্যজাত এই প্রাণ তা সরবে পরিবর্তন করে দিয়েছে। সত্যিই জীবন সুন্দর.. বড়ই সুন্দর!
রাত অনেক হয়েছে। হাসপাতালে মৈত্রীকে গ্রাম থেকে দেখতে আসা সকলে মেসবাহর বাসায় চলে গিয়েছে। উল্লাসীর পাশে জ্যোতির থাকবার ইচ্ছে থাকলেও মৌমির যন্ত্রণায় তা পেরে না উঠে সেও গেছে সকলের সাথে। শুধু হাসপাতালে রয়ে গেছে মুন্নি সরকার এবং মেসবাহ। রাতের আলোবাতাস খেতে মুন্নি সরকার কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই মেসবাহ এসে বসেছে উল্লাসীর কাছে। এনেস্থিসিয়ার ঘোর ধীরেধীরে কাটছে উল্লাসীর। বাবুকে বারবার দেখতে চাইছে। তার কথামতো বাবুকে মুখের সামনে ধরলেই তার পুরো মুখে চুমু খাচ্ছে। মাঝেমাঝে কোমড়ের ব্যথার নড়েচড়ে উঠার চেষ্টা করছে। তার ব্যথাভর্তি কোমল মুখে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল মেসবাহ। নীচু গলায় বললো,
-“খুব কষ্ট হচ্ছে?”
-“উহু..”
-“বাবুকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে?”
-“হু..”
-“কালই নিতে পারবে ইনশাআল্লাহ।”
-“বাবুকে দেখবো।”
-“একটু আগেই তো দেখলে!”
-“আবারও দেখবো..”
উল্লাসীর কথায় মৈত্রীকে কোলে তুললো মেসবাহ। অন্যরকম এক ভালোলাগা অনুভব হচ্ছে তার বুকের ভেতরটায়। সদ্যোজাত এই প্রাণের দিকে চাইতেই বুকের ভেতরটায় তৃপ্তি অনুভব করছে। নতুন উদ্যমে আবারও জীবনকে উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। দীর্ঘদিনের শোক, মানসিক যন্ত্রণা অবশেষে বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে! আনন্দ লাগছে তার.. উৎফুল্লতায় ছেয়ে যাচ্ছে মনের ভেতরটা। স্বস্তির কিছু নিঃশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিকে মৈত্রীকে বাড়িয়ে ধরলো মেসবাহ। প্রফুল্লচিত্তে খানিকক্ষণ মা-মেয়ের ভালোবাসার গভীরতা দেখার পর ঠোঁটজোড়া দুজনের মাথায় ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-“কলিজা বের হয়ে গিয়েছিল আমার। বলেছিলাম বাচ্চা হবার সাথেসাথেই তোমার মতো বিচ্ছুপনা শিখে যাবে.. কিন্তু মেয়ে তো আমার আরও এক ডিগ্রি উপরে! আসার আগেই তার বিচ্ছুপনা দেখিয়ে আমার জান পুরো বের করে দিয়েছিল…”
-“একটু জান বেরুলে কিছুই হয়না..”
হেসে উঠলো মেসবাহ। উল্লাসীর দিকে খানিকটা ঝুকে একহাতে তার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতেই পাশ থেকে এল মুন্নি সরকারের আওয়াজ।
-“ভুল সময় এসে পড়লাম মনে হচ্ছে…”
-“আরে না না.. আসুন।”
-“উহু.. দাও। তোমার দুঃসম্পর্কের বাচ্চাটাকে আমায় দিয়ে দাও। আমি আরেকবার চক্কর কেটে আসি.. ততক্ষণে না হয় তোমার দুঃসম্পর্কের বউকে নিয়ে তুমি আরেকটু ভালোবাসাবাসি সেরে ফেলো।”
খলখল করে হেসে উঠে মুন্নি সরকার মৈত্রীকে কোলে চাপিয়ে বেরিয়ে যেতেই ঠোঁট চেপে হাসলো মেসবাহ। এই সেই উল্লাসী.. যাকে একসময় মেনে নিতে কষ্ট হলেও আজ একদন্ডের জন্য উল্লাসীহীন নিজেকে ভাবতে পারেনা সে। এই বুঝি ভালোবাসা? কারণ যাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসা যায় তাকে একমুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করা যায়না। সেও পারবেনা উল্লাসীকে চোখের আড়াল করতে। পারবেনা উল্লাসীকে ছাড়া দু’পা হাটতে। শিশির ভেজা সকালে, রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে, ঘন আঁধারময় রাতেও উল্লাসীর হাতে হাত রেখে পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে চলবে সে বাকিটা পথ।
(সমাপ্ত)