জ্বীন_প্রতিবেশী
#পর্ব_০১
লেখা: সুমাইয়া জান্নাতি
অনিলারা নতুন বাসায় উঠেছে আজ এক সপ্তাহ হলো।এই বাসাটা শহর ছেড়ে অনেকটা ভেতরের দিকে।খুব বেশি লোকজনের আনাগোনা নেই এদিকটায়। অনিলার মায়ের অফিস টা বাসা থেকে বিশ মিনিটের পথ।তাই এদিকে বাসাটা নেয়া।
এখানে অনিলাদের পরিবার বলতে শুধু অনিলা আর ওর মা লাবনি ইসলাম।ওর বাবা দেশের বাহিরে থাকেন। দু বছর পরপর দেশে এসে ঘুরে যান।
এইস.এসসি এক্সামের পর এখন অবসরই অবসর অনিলার হাতে।রেসাল্ট আসতেও অনেক দেরি।অনিলার একা একা বাসায় ভালোলাগেনা।আগের বাসার কাছাকাছিই ছিলো ওর সব বান্ধবীদের বাসা।এখন দূর হওয়াতে ওদেরও এদিকে আসা হয়না।অার অনিলারো বের হওয়া হয়না। সারা দিন গল্পের বই পড়েই সময় কাটে ওর।
দুদিন ধরে অবশ্য নিচে নেমে কেয়ার টেকার চাচার সাথে বেশ ভালোই গল্প হচ্ছে অনিলার।গল্প শুধু সেই বলে,আর কেয়ারটেকার চাচা শুধু মুখ গম্ভীর করে নিচের দিকে তাকিয়ে শুনে যায়। কোন কথাই বের হয়না তার মুখ থেকে।অনিলার মাঝে মাঝে খুব বাচাল মনে হয় নিজেকে।কিন্তু তাতে তার কিছু অাসে যায়না।মনের কথা মুখে অানতে পারলেই তার শান্তি।কথা বলতে বড্ড ভালো বাসে সে।
অনিলাদের এই বিল্ডিং টা তিন তলা।নিচের ফ্লোর টা পুরাটা খালি।দোতালায় ওরা,আর তিনতালার ফ্লাট টা মাত্র কমপ্লিট হলো। অনিলা সেদিন কেয়ারটেকার চাচাকে জিজ্ঞেস করলো তিন তলায় ভাড়াটিয়া কবে আসবে?কেয়ার টেকার চাচা ওর প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। অনিলাও এতো দিন পর কেয়ারটেকার চাচার চোখের দিকে ভালো ভাবে তাকালো। সব সময় তো মাথা নিচু করেই থাকেন তিনি। আজ তার চোখ দেখে খুব অবাক হলো অনিলা।।গাড় সবুজ রং এর দুটি শীতল চোখ। কেমন যেনো অসাভাবিক একটা ভাব আছে চোখ দুটোয়।সবুজ রং এর চোখতো অনেকেরই হয়।অনিলা দেখেছেও।কিন্তু এই চোখ দেখে খুব ভয় পেয়ে যায় সে।কেয়ারটেকাট চাচার চোখ কি আগেও এমন ছিলো, অনিলা খেয়াল করেনি,নাকি হঠাৎ করে এমন হয়ে গেলো?অনিলা মনে করতে পারছেনা।সে দ্রুত সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যায়।পেছনে সে শুনে কেয়ারটেকার বলছে,”উনারা খুব তাড়াতাড়িই উঠবেন নতুন বাসায়।”এই উনারা কে বা কারা এটা শুনার ইচ্ছা আর নেই অনিলার।বাসায় ঢুকে দরজা লক করে দেয় সে।
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে লাবনি ইসলাম দেখেন অনিলা চুপচাপ বসে আছে সোফায়।অন্য সময় অফিস থেকে ফিরলে অনিলার গল্প শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে যান তিনি।কোন গল্পের ক্যারেক্টার কেমন,গল্প এভাবে কেনো শেষ হলো ইত্যাদি ইত্যাদি..। কিন্তু আজকে তার মেয়ে এতো চুপচাপ কেনো।
– কিরে মা,শরীর খারাপ নাকি?আজকে কোন গল্পের বই পড়িসনি,?
– না মা,অাজকে পড়িনি।ভালো লাগছেনা।
-কিছু খেয়েছিস?রাতেতো তোর ফেভারিট ভুনা খিচুরি রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেসি,দেখেছিস?
-না মা..ফ্রিজ খুলে দেখিনি। এখন দাও একটু গরম করে। হ্মিধে পেয়েছে।
লাবনি ইসলাম খাবার গরম করতে রান্না ঘরের দিকে গেলেন।
অনিলা বুঝতে পারছেনা মা কে কেয়ারটেকার চাচার কথা বলবে কিনা! মা তো মনে হয় হেসেই উরিয়ে দিবে।থাক, বলার দরকার নেই।
অনিলা তার মাকে কিছু আর বলেনা কেয়ারটেকার এর চোখের কথা।কিন্তু মনে খুতখুত থেকেই যায় অনিলার।
রাত নয়টার দিকে অনিলা আর ওর মা বসে
টিভি দেখছিলো।রিমোট সবসময় অনিলার কাছে থাকলেও আজকে একবারও রিমোট এ হাত দেয়নি সে।লাবনি ইসলাম আড় চোখে মেয়েকে দেখে বুঝার চেস্টা করছেন হঠাৎ তার এই পরিবর্তন এর কারন কি..।কলিংবেল বেজে উঠলো। অনিলা দরজার লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলো কেয়ারটেকার চাচা।অনিলা বুঝতে পারছেনা সে দরজা খুলবে কিনা।সকালের সেই চোখের কথা এখনো তার মাথাতে ঘুরছে।
-কিরে কে এসেছে?দরজা খুলে দেখ।
অনিলা দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকলো
-আজকে যে কি হয়েছে তোর।সরে দাড়া।আমি দেখছি কে এসেছে। লাবনি ইসলাম দরজা খুলে বলেন, ওহ,কেয়ারটেকার ভাই,আপনি।
“জি,আপা।আপনি অফিসে যাওয়ার আগে বলেছিলেন না মশার কয়েল কিনে রাখতে,এই যে সেটা।আর এই নেন বাকি টাকা”। বিশ টাকার একটা চকচকে নোট দিলো সে। অনিলা মায়ের পেছনেই দাড়িয়ে ছিলো।সে মনে মনে আরেকবার কেয়ারটেকার এর চোখ ভালোভাবে দেখার কথা ভাবলো।মায়ের পাশ থেকে উঁকি দিয়ে তাকালো সে। নাহ।খুব স্বাভাবিক চোখ কেয়ারটেকারের।একজন,, পঞ্চান্ন বয়সের লোকের চেহারা, চোখ এমন সাধারন ই হয়।এর মাঝে কোন অস্বাভাবিকতা একদম নেই।অনিলা নিজের রুমের দিকে চলে যায়।সকালে যে সে কেয়ারটেকার এর চোখ অসাভাবিকতা দেখেছিল সে এই ব্যপারে একদম নিশ্চিত। অনিলা সিধান্ত নেয় সে আর কেয়ারটেকার এর সাথে গল্প কথা বলতে যাবেনা।
পুরোটা সপ্তাহ অনিলা বাসা থেকে আর বের হয়নি।টিভি দেখে, বই পরে কাটিয়ে দিয়েছে।কেয়ারটেকার এর চোখের ব্যপারটা মাথা থেকে পুরোপুরি যায়নি যদিও। আজকে ভাবছে একটু ছাদে যেয়ে হেটে আসবে।মায়ের অফিস থেকে ফিরতে দেরি আছে আরও। অনিলা তিন তলার ফ্লাট এর সিড়ি বেয়ে ছাদের দরজার দিকে উঠতে যায়।হঠাৎ ওর মনে হলো এই তিন তলার ফ্লাটের দরজা টা খোলা,চাপিয়ে রাখা।নতুন ভাড়াটিয়া আসলো নাকি,যেয়ে দেখবো নাকি,নিকেই প্রশ্ন করে অনিলা।ছাদে না যেয়ে ওই ফ্লাটের দরজার সামনে দাঁড়ায় সে।
– কেউ কি আছেন?তিনবার ডাকে অনিলা।কোন সাড়া শব্দ নেই।অনিলা আস্তে করে দরজা সরিয়ে ভেতরে পা রাখে।ভিতরে ঢুকে দেখে সে বিশাল বিশাল সব আসবাবপত্র। কারুকার্য খচিত সোফা,খাট,কারপেট,এমনকি বিশাল এক ঝারবাতিও আছে।আজকালকার দিনেতো এমন ফার্নিচার খুব কম মানুষ ই ব্যবহার করে। অনিলা ভাবতে থাকে,তবে এসব যার পছন্দ তার রুচি আছে বলতে হবে।সব কিছুই চোখ ধাঁধানো সুন্দর।
– আসসালামু আলাইকুম। অনিলা পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠের সালাম শুনতে পায়। মনে মনে লজ্জায় পরে যায় সে।কি ভাববে,কার ঘরে আমি না বলেই ঢুকে গেলাম।অনিলা পেছনে ফিরে তাকায়,পেছনে ফিরে সে মনে কয়েকশো ভোল্টের শক্ খায়।যেই মেয়েটি তাকে সালাম দিয়েছে সে প্রায় সাত ফিট লম্বা।আর মারাত্মক রকমের সুন্দরী। মেয়েটা চেহারা থেকে যেন আলো ঠুকরে বের হচ্ছে।তার চুল ছাড়া, প্রায় পায়ের পাতা ছুয়ে যাচ্ছে। মিষ্টি সুবাশে ভরে গেছে ঘর।অনিলার মাথা উচু করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
-অামি সালাম দিয়েছি আপনাকে।মেয়েটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে অনিলাকে।
– ও হা..ওয়ালাইকুমাসসালাম।বোকার মত হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকে অনিলা।সে এখনো বুঝতে পারছেনা,মানুষ কিভাবে এতো সুন্দর হয়।সে চোখে ভুল দেখছে নাতো?
– আপ্নিও কিন্তু খুব সুন্দর। মেয়েটি অনিলা কে বলে।অনিলা চমকে যায়।মেয়েটা কিভাবে বুঝলো যে অনিলা কি ভাবছে মনে মনে?
-দাঁড়িয়ে কেনো? প্লিজ বসুন।অনিলাকে বসতে বলে নিজেও একটা সোফায় বসে মেয়েটা।
-অাপনারা দোতলায় থাকেন,তাইনা।
– “জি,অামার নাম অনিলা।ছাদে যাচ্ছিলাম,দরজা খোলা দেখে ভাবলাম নতুন এসেছেন পরিচিত হয়ে নেই।” ঢোক গিলে এক নিঃশ্বাসে বলল অনিলা। এখনো সাভাবিক হতে পারছেনা মেয়েটা কে দেখেসে। অনিলা নিজেরো খুব সুন্দরী বলে নাম ডাক আছে বন্ধু মহলে।কিন্তু এই মেয়েটিকে স্বাভাবিক সুন্দরী বলে মোটেও মনে হচ্ছেনা।অনিলার হিংসে হচ্ছে নাতো মেয়েটিকে দেখে!
– আমি আফসানা।আমরা এক সপ্তাহ হলো এসেছি।আমি ছাদেই ছিলাম।মেয়েটি এখনো হাসি দিয়েই আছে।কে কে আছে আপনার বাসায়?
– আমি আর আমার মা।মা জব করেন।বাসাতে একাই থাকি। তাই একটু ছাদে যাচ্ছিলাম।
– ওহ তাই,আপনি একটু বসুন, আমি ভেতর থেকে আসছি। মেয়েটি উঠে ভেতরে যায়।
অনিলা খেয়াল করে মেয়েটি একটা ধব ধবে সাদা গাউন টাইপ জামা পরেছে।পা পর্যন্ত ঢাকা।সাদা ওরনা দিয়ে মাথায় কাপড় দেয়া।যদিও চুল ঢাকা পরেনি।মেয়েটির বয়স কেমন হতে পারে?নিজেকে জিজ্ঞেস করে অনিলা।সে মানুষের বয়স অান্দাজ করাতে খুব পটু। কিন্তু এখন কিছুতেই ঠাহর করতে পারছেনা অনিলা এই মেয়েটার বয়স। তার মনে হচ্ছে সতেরও হতে পারে,অাবার সাতাশো হতে পারে।এমন কি সাইত্রিশও হতে পারে।অনিলার কেমন
যেনো অস্থির লাগা শুরু হয়।অনিলা তাকিয়ে দেখে আফসানা মেয়েটা একটা বড় পিতলের বাটিতে করে খাবার নিয়ে আসছে।
– কি দরকার ছিলো এতো কিছুর।অনিলা ভদ্রতা করে বললো।কিন্তু বলেই বুঝতে পারলো তার খুব হ্মুধা লেগেছে।দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি।
– আপনি হ্মুধার্ত। কিছু খেয়েনিন।ভালো লাগবে।হাসি দিয়ে বললো মেয়েটা। অনিলা দেখলো বাটিতে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন।এমন মিষ্টি অাগে কখনো খায়নি,দেখেওনি সে। গোলাপী রংএর একটা মিষ্টি মুখে দেয় অনিলা।মুখে দিয়েই বুজলো অনিলা, এমন স্বাদের মিষ্টি সে কোনো দিনও খায়নি।সে টুপ করে আরো কয়েক্টা মিষ্টি মুখে পুরে দিলো।
– আরো কয়েক টা নিয়ে আসি?আপনার খুব ভালো লেগেছে মনে হচ্ছে। মেয়েটা অনিলা কে বলল।
অনিলা মিষ্টি চাবানো বাদ দিয়ে মুখ বন্ধ করে হাতে ইশারারা করে বুঝালো অার লাগবেনা।
মেয়েটি এক দৃষ্টিতে অনিলার দিকে তাকিয়ে থাকে।অনিলা অস্বস্থি তে পরে যায়।বাসায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়।
– আরো কিছুক্ষণ বসুন না।আফসানা মেয়েটা অনিলা কে বলল।
– আরেকদিন আসবো।মা অফিস থেকে চলে আসবে। আপনি একদিন আসুন না আমাদের ফ্লাট এ।আমিতো একাই থাকি।
– আমার যাওয়া হবেনা। আপনিই আসবেন।মেয়েটি কেমন করে যেনো বলল কথাটা।অন্য কেও হলে বোধ হয় এতোক্ষণ অনিলার অহমে লাগতো।কিন্তু এই মেয়ের কথা শুনে তার মনে হলো অনিলারই যেনো এখানে প্রতিদিন আসতে হবে।
– ঠিক আছে আমিই আসবো। জোর করে মুখে হাসি এনে অনিলা বেরিয়ে যায় । মাথাটা খুব ঘুরছে তার। বাসায় যেয়ে শুয়ে পরে।
(চলবে)
জ্বীন_প্রতিবেশী
#পর্ব_২_ও_৩
অনিলার মনে হচ্ছে সে খুব সুন্দর একটা জায়গায় চলে এসেছে।চারপাশে খুব মিষ্টি ঘ্রাণ।আর দূর থেকে কেমন যেন একটা অপার্থিব সুর ভেসে আসছে। অনিলার খুব ভালো লাগছে।সে দেখতে পেলো দূর থেকে দুজন মানুষ হেটে তার কাছে আসছে।অনিলা তাদের মুখ দেখতে পারছেনা।তারা খুব কাছে চলে এসেছে। মানুষ দুটো খুব লম্বা।তারা অনিলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকছে।যেন তাকে তাদের সাথে যেতে আহবান জানাচ্ছে তারা।অনিলা হাত বাড়ায় তাদের দিকে।কিন্তু ঠিক তখনি সে পেছন থেকে তার মায়ের ডাক শুনে।ওই মানুষ গুলোর হাত অনিলা আর ধরতে পারেনা।
— “অনিলা,অনিলা। এই অবেলায় ঘুমাচ্ছিস কেনো।ওঠ।সেই কখন থেকে ডাকছি।” অনিলার মা লাবনি ইসলাম অফিস থেকে ফিরেছেন।তার কাছে বাসার ডুপ্লিকেট চাবি থাকে সবসময়।অনিলা চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকায়। �- কখন এলে অফিস থেকে মা?অনিলা শোয়া থেকে উঠে বসে। �- এই তো দশ মিনিট হলো এসেছি।কি স্বপ্ন দেখছিলি?হাসি হাসি মুখ করে ঘুমাচ্ছিলি।�-” কি দেখছিলাম মনে আসছেনা।ফ্রেস হয়ে নিচ্ছি।একটু চা দিয়োতো মা।�অনিলা উঠে ওয়াশরুমের দিকে যায়।বেসিনের কল ছেড়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে সে।মা কে মিথ্যা বলেছে সে।তার স্পষ্ট মনে আছে সে কি স্বপ্ন দেখছিলো।এখনো তার কানে ঐ সুর টা বাজছে।মুখে পানির ঝাপ্টা দেয় সে।মানুষ দুটোর মুখ দেখতে পারলে ভালো হতো।
কড়া দুধচায়ের সাথে ড্রাই কেক ভিজিয়ে খাওয়া অনিলার খুব প্রিয়। একবসায় সে গুনে গুনে দশ পিছ ড্রাই কেক খেয়ে ফেলে।মগ ভর্তি চা তখন ড্রাই কেকের গুরো দিয়ে গিজ গিজ করে।�-“ভাবছি অফিস থেকে কয় দিন ছুটি নিবো।” গ্রিন টি তে চুমুক দিতে দিতে বলল লাবনি ইসলাম।দুধ চা খেতে পারেন না তিনি।গ্যাসটিকের কারনে ডাক্তার বারন করেছেন।যদি ও তিনি আগে থেকে রং চাই খেতেন। আদা কুচি আর এলাচ দিয়ে।�- কেন মা? হঠাৎ ছুটি নিবে কেন? ড্রাই কেক নরম হয়ে অর্ধেক ডুবে গেছে চায়ের ভেতর। সেটার জন্য মনে মনে আফসোস করতে করতে মায়ের দিকে তাকালো অনিলা।�- “এই যে,তুই সারাদিন একা থাকিস,কথা বলারো কেও নাই এখানে।কয়দিন ছুটি নিয়ে মা মেয়ে কথাও ঘুরে আসবো।কি বলিস?”�অনিলা মাকে বলতে যায় যে,তিন তলায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। আজকে গিয়েছিলো সে।বলার জন্য যেই মুখ খুললো সে,তখনি ড্রাই কেকের টুকরা গলায় আটকে যায়। কাশতে কাশতে চোখ দিয়ে পানি চলে অাসে অনিলার।মা কে আর বলা হয়না সুন্দরী প্রতিবেশীর কথা।আজকের মতো সাড়ে সাত পিছ ড্রাই কেক খেয়েই উঠে যায় সে।
অনিলা একটা গল্পের বই নিয়ে বারান্দায় যেয়ে বসে।বই টার কভার টা সুন্দর। একটা মেয়ের ছবি দেয়া।মেয়েটা পেছনে ঘুরে আছে, সাদা একটা জামা পরা।তার চুল কোমর ছাড়িয়ে পা ছুই ছুই করছে।মেয়েটার হাতে ফুলের ঝুরি।অনিলার বইয়ের মেয়েটিকে দেখে মনে হলো মেয়েটি কে যেন সে বাস্তবে দেখেছে।তার মনে পরলো বইয়ের মেয়েটা দেখতে তার নতুন প্রতিবেশীনির মতো।অনিলা মনে মনে হাসে।আফসানা মেয়েটা খুব সুন্দর করে কথা বলে।তার সাথে ভালোই বন্ধুত্ব জমবে অনিলার।�–কিরে মা,কিছু খাবিনা?লাবনি ইসলাম বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়ায়।�–না মা,ইচ্ছে করছেনা খেতে।তুমি খেয়ে নাও।বাবার সাথে কথা হয়েছে?অনিলা হাতের বই বন্ধ করতে করতে বলে।�–না,এখনো কথা হয়নি।ভাবলাম একেবারে ঘুমানোর টাইমে দিবো কল। লাবনি ইসলাম মেয়ের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলেন।খুব সুন্দর বাতাস হচ্ছে বাহিরে।প্রতিদিন এই সময়টা মেয়ের সাথে একান্তে কাটাতে ভালবাসেন তিনি।�– কি বই এটা,কাহিনী কি নিয়ে?মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন লাবনি।�– “একটা মেয়েকে নিয়ে।যাকে জন্মের পর চুরি করে আরেক মহিলাকে দিয়ে দেয়া হয়।ভালো লাগছে গল্পটা।তুমি পড়বে মা”?অনিলা মায়ের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়।অনিলার গল্পের প্লট টা শুনে লাবনি ইস্লামের মুখ সাদা হয়ে যায়।তিনি সেকেন্ডের মধ্যে বইটা কেড়ে নেন অনিলার হাত থেকে।�– কি সব বই পড়িস তুই?কোন কাহিনী হলো এটা?লাবনি শক্ত করে বই টা ধরে রাখে।আমাকে দে,আমি পড়তে পড়তে ঘুমাবো। �অনিলা অবাক হয়ে যায়।�–“মা,আমার পড়া শেষ হয়নিতো এখনো।শেষ হলে তুমি নিয়ো।�– “না,তোর পড়া লাগবেনা এই বই।তুই এখন ঘুমাতে যা। “লাবনি ইসলাম বই টা নিয়ে রুমে চলে গেলেন।অনিলার মন টা খারাপ হয়ে যায়।মাঝে মাঝে মা অদ্ভুত আচরণ করে অনিলার সাথে।�যেমন লাবনি ইসলাম যেন কখনোই চান না যে অনিলা অন্য মানুষের সাথে বেশি মিশুক।খুব বেশি সাজগোজ করুক,চুল ছেড়ে বাহিরে যাক আরো অনেক কিছু।অনিলার মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয় মায়ের এসব ব্যপারে। আবার নিজেই ভাবে যে,সেএখন বড় হচ্ছে, তাই হয়তো সাধারন সব মায়ের মতই তার মাও তাকে চোখে চোখে রাখছে।অনিলা এসব ভেবে নিজেকে শান্তনা দেয়।কিন্তু সে এটাও বুঝে মায়ের এমন ব্যাপার গুলি অনিলার শৈশবেও ছিলো।অনিলার সব ব্যাপারেই লাবনি ইসলাম ওভার প্রটেক্টিভ ছিলেন এবং আছেন।কিন্তু তারপরেও মাকে খুব ভালোবাসে সে।
অনিলা আরো কিছুক্ষন বারান্দায় বসে থাকে।চেয়ারে হেলান দিয়ে বারান্দার সিলিংএর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে।আফসানাদের বাসার ঝার বাতিটার কথা মনে পরে অনিলার।কিযে সুন্দর দেখতে সেটা।অাফসানাদের ফার্নিচার গুলিও কি দারুন!�হঠাৎ অনিলার মনে হল এতো ভারী ভারী জিনিসপত্র তিন তলায় উঠালো কখন অাফসানারা।কোনো শব্দই তো পায়নি সে!আফসানারাতো তাদের ঠিক উপরের ফ্লাটেই উঠেছে।�অনিলার মনে আছে,তাদের আগের বাসার উপরের ফ্লাটে নতুন কেও উঠলে তাদের ফার্নিচার টানাটানির শব্দে খুব বিরক্ত হতো সে।আর এখানে সে টের ই পেলোনা কিছু।ভালোই হয়েছে।জিনিসপ্ত্রের টানাটানির শব্দে মাথা ধরে যায় তার।এটার জন্য আফসানা কে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে।মনে মনে ভাবে অনিলা।ঘুমাতে চলে যায় সে নিজের ঘরে।
— “অনিলা,উঠে পর।আমি অফিসে যাচ্ছি।খাবার রেডি করে রেখেছি ডাইনিংএ।খেয়ে নিবি কিন্তু।রাতেও খাসনি।মায়ের ডাকে ঘুম ভেংগে যায় অনিলার।ভালোই রোদ উঠেছে আজকে।ঘর আলোয় ভরে গেছে।�– ঠিক আছে খেয়ে নিবো। তুমি নাস্তা করেছো মা?
অনিলা চুল পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকাতে আটকাতে মায়ের দিকে তাকায়।লাবনি আজকে নীল রঙের সুতির শাড়ি পরেছেন।তার শ্যামলা রঙের সাথে শাড়িটা মানিয়েছে বেশ।অনিলা মাকে বলতে যায় যে আজ তাকে খুব মিস্টি লাগছে,তখনি সে খেয়াল করে মায়ের অফিসের ব্যাগে কাল রাতের বই টা।মা অফিসে নিয়ে যাচ্ছে সেটা। অনিলার মনটা খারাপ হয়ে যায়।ভেবেছিলো অাজ সারাদিনে বইটা পড়ে শেষ করবে। সেটা অার হলোনা।লাবনি ইসলাম বেরিয়ে যায়।মায়ের প্রশংসা করা হয়না অার অনিলার।
দুপুর বারোটা বাজছে ঠিক।অনিলা টিভি অন করে অন্য দিকে ফিরে বসে আছে।কিছুই করার নেই।�সে ভাবলো একটু ছাদে গিয়ে হেটে আসা যাক।অনিলা দরজা লক করে বাহিরের জুতা পায়ে দিতে লাগলো ছাদে যাওয়ার জন্য। পেছন ফিরে দেখে কেয়ারটেকার চাচা সিড়ি দিয়ে নামছে।অনিলা একবার ভাবে যে সালাম দিবে।কিন্তু অনিলাকে অবাক করে দিয়ে কেয়ারটেকারই অনিলাকে সালাম দেয়।অনিলার দু সপ্তাহ আগের কথা মনে পরে যায়।সে কোনমতে সালামের উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায় কেয়ারটেয়াকার চাচার।তার সাথে চোখাচোখি হওয়ার ইচ্ছা আপাতত নেই অনিলার।�তিন তলা পার হয়ে ছাদের সিড়িতে পা দেয়ার সময় অনিলা দেখে আজকেও আফসানাদের দরজা খোলা,চাপিয়ে দেয়া।অনিলা ভাবে হয়তো কেও বের হয়েছে,অাটকায়নি পরে কেউ।সে আফসানাদের দরজার দিকে আর না দেখে ছাদের সিড়িতে পা দেয়।কিন্তু অনিলা আর পা বাড়াতে পারেনা।তার মন যেন চাচ্ছে সে আফসানাদের বাসায় যাক।নিজের উপর রাগ হয় অনিলা।সে যাবেনা আজকে।কারো বাসায় কি প্রতিদিন যাওয়া যায়?তাও এই ভর দুপুরে?অনিলা নিজের সাথে যুদ্ধ করে।কিন্তু সে কোন ভাবেই ছাদের দিকে যেতে পারেনা।তার মনে কি যেন তাকে টানছে তিন তলার ফ্লাটের দিকে!�অনিলা আফসানাদের দরজায় নক করতেই দেখে আফসানা দাড়িয়ে আছে।যেন অনিলার অপেক্ষাতেই ছিলো সে!�– আসসালামু আলাইকুম।আফসানা হাসিমুখে সালাম দেয় অনিলাকে।কেমন আছেন?�–ওয়ালাইকুম আস্সালাম।আলহামদুলিল্লাহ ভালো অাছি।সালামের জবাব দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে অনিলা।যদিও আফসানা তাকে ভেতরে যেতে বলেনি,ব্যাপারটা খেয়াল করতে লজ্জায় পরে যায় সে।�–আমি জানতাম আপনি আসবেন।তাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।আফসানা অনিলাকে বলল। অনিলা সোফায় বসতে বসতে খেয়াল করলো আফসানাদের বাসায় খুব কম আলো।বুঝার উপায় নেই যে এখন দুপুর আর বাহিরে এতো রোদ।ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছেনা অনিলা।সে তাদের জানালার পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে।�– “আজকে বাহিরে খুব রোদ।আমাদের এতো অালো ভালোলাগেনা।তাই ভাইয়া অনেক দূর থেকে এই কাপড় গুলি আনিয়েছেন, যেনো ঘরে আলো না আসে।” অাফসানার কথা শুনে অনিলা অবাক হয়ে বলে�– “আপনাদের বুঝি আলো ভালো লাগেনা?আমারতো ঝলমলে রোদ খুবই পছন্দ।”অনিলা কথাটা বলে আফসানার দিকে সরাসরি তাকায়। �আফসানার হাসিমুখ টা যেনো হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলো। অনিলা ব্যাপারটা খেয়াল করে।�– “সব সময় অবশ্য আবার এতো রোদ আমারও ভালো লাগেনা।ইদানিং যা গরম পরে।” অনিলা কথা ঘুরানোর চেস্টা করে।অাপনার বাসায় কে কে অাছেন?কাওকে দেখছিনা যে?�–“এখানে আমি,আমার বড় ভাই আর আমার দূর সম্পক্রের এক চাচা থাকেন।” আবার হাসি ফিরে আসে আফসানার মুখে।অনিলা স্বস্থি পায়।
অনিলার নাকে খুব সুন্দর একটা ঘ্রান অাসছে।মনে হচ্ছে আগেও যেন ঘ্রান টা সে পেয়েছিলো।কিন্তু কোথায়,সে মনে করার চেস্টা করে।�অনিলা দেখে টেবিলের উপরে গতকালের মিস্টি গুলো সেই পিতলের বাটিতে রাখা।অনিলা সেদিকে তাকিয়ে বলল “আপনার বাবা, মা?,উনারা এখানে থাকেন না?�”নাহ।আব্বু,আম্মি অনেক দূরে থাকেন।” কথাটা বলার সময় কন্ঠ সর কিছুটা নামিয়ে নেয় অাফসানা।�মিস্টি গুলি খুব খেতে ইচ্ছে করছে অনিলার।ব্যাপারটা এমন না যে অনিলার মিস্টি খেতে খুব ভাললাগে।কিন্তু এই মিস্টি গুলির ব্যাপারই আলাদা।সে মনে মনে ভাবে আফসানাকে জিজ্ঞেস করবে কোথাথেকে কিনেছে মিস্টি গুলি।অনিলা মনের অজান্তেই পিতলের বাটি থেকে একটা মিস্টি তুলে নেয়।মিস্টি টা হাত থেকে মুখ পর্যন্ত আনার সাথে সাথে�অনিলা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।কি হচ্ছে এসব তার সাথে!!সে কখনো তার মায়ের জিনিসো না বলে ধরেনা। আর আজকে সে কি করছে এসব!!�– প্লিজ খান না।আপনার জন্যই এনে রেখেছি মিস্টি গুলি।অাফসানা অনিলাকে মিস্টি খেতে অনুরোধ করে।অনিলা মিস্টিটা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মুখে দেয়।কি স্বাদ এই জিনিসে।কথায় পেলো এই খাবার ওরা!!�– আপনার এই মিস্টি খুব ভালো লাগছে,না?আফসানা মুচকি হাসি ধরেই রেখেছে ঠোটের কোনে।�– হুম,খুবই মজা খেতে।কোথা থেকে আনিয়েছেন এগুলি?অনিলা জিগ্যেস করে।�–“এগুলি অনেক দূর থেকে এসেছে।আপনি চিনবেন না”আফসানা কেমন রহস্য করে বলল কথাটা।�– “না না,চিনবো আমি।বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে ভালো আইডিয়া আছে আমার।” অনিলা মজা করে বল্ল কথাটা।অনিলা ভেবেছিলো তার কথা শুনে হাসবে আফসানা।কিন্তু আফসানা হাসলোনা।সে তার কন্ঠসর আরো নামিয়ে বলল “এটা এখানকার মানচিত্রের বাহিরের অনেক দূর দেশ থেকে এসেছে।” সেই জায়গাটা অনেক দূরে। �– ওহ।তাই নাকি।যেখান থেকেই আসুক,খেতে কিন্তু দারুন।আপনিও নিন না একটা আমার সাথে।”
অনিলা একটা মিস্টি এগিয়ে দেই আফসানার দিকে মিস্টিটা হাতে নেয়ার সময় অনিলার হাতের সাথে আফসানার হাতের ছোয়া লাগে।অনিলা চমকে যায়!এতো ঠান্ডা হাত আর এতো নরম!আফসানা ঝাটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়।অনিলা উঠে দাঁড়ায়।�–আজকে আসি তাহলে। অনিলা ভাবে যে আফসানা কে তাদের বাসায় যেতে বলবে।কিন্তু তার আগেই আফসানা আল্লাহ হাফেয বলে তাড়াতাড়ি ভেতরের ঘরে চলে যায়।অনিলা কে ঠিক মত বিদায়ও যানায়নি সে।অনিলাও সাথে সাথে বাসায় চলে যায়।
লাবনি ইসলাম দুদিন ধরে বাসায় আছেন।পর পর দুদিন সরকারি ছুটি পেয়েছেন তিনি।ভেবেছিলেন এই দুদিন মেয়েকে নিয়ে তার খালাতো বোনের বাসায় বেরিয়ে আসবেন।কিন্তু দুদিন ধরে অনিলার জ্বর শরীরে।হঠাৎ জ্বর কেনো আসলো বুঝতে পারছেন না তিনি।এখনতো সিজন ও বদলাচ্ছেনা।তিনি মেয়ের মাথায় জ্লপট্টি দিচ্ছেন বার বার।�–কিরে মা,একটু ভালো লাগছে এখন?লাবনি ইসলাম মেয়েকে আদর মাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন।�– হ্যা মা।আগের থেকে একটু বেটার লাগছে। �– এখন তাহলে একটু কস্ট করে চল ডক্টর এর কাছে যাই।হঠাৎ জর কেন অাসলো!�–মা,তুমি এতো টেনশন করো নাতো প্লিজ।সামান্য জ্বর।নাপা খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।তুমি বরং আমার জন্য ঝাল ঝাল কিছু বানিয়ে দাও মা।ঝাল কিছু খেতে ইচ্ছা করছে।”�লাবনি ইসলাম রান্না ঘরের দিকে গেলেন। অনিলাও ভাবছে হঠাৎ করে জ্বর অাসলো কেনো!�সেদিন আফসানাদের বাসা থেকে আসার পর ই তার জ্বর চলে আসে।অনিলার মনে আছে, আফসানার হাতের কথা। এতো ঠান্ডা ছিলো কেনো ওর হাত!আর এতো নরম!মানুষের শরীর কি এতো নরম হয়!�কিছুহ্মন পর লাবনি ইসলাম মেয়ের জন্য ঝাল ঝাল করে মাংস আর সব্জি দিয়ে নুডুলস করে নিয়ে আসেন।অনিলা বালিশে হেলান দিয়ে নুডুলস খেতে থাকে।
রাতে ঘুমের মাঝে অনিলা সেই আগের সপ্নটা দেখে। সেই মন ভোলানো সুর,খুব মিস্টি একটা ঘ্রান।আর দূরে দাড়ানো দুজন লম্বা মানুষ। তাদের মুখ দেখতে পাচ্ছেনা অনিলা।কিন্তু সে বুঝতে পারছে এদের একজন পুরুষ, আরেকজন নারী!তারা হাত বাড়িয়ে ডাকছে অনিলাকে। �অনিলার ঘুম ভেংগে যায়।নাকে মিস্টি গন্ধ টা লেগে আছে।অনিলার মনে হচ্ছে ঘ্রান টা সে আগেও পেয়েছে।কিন্তু কথায়? হঠাৎ অনিলার মনে পরে যায়।সেতো এই ঘ্রান আফসানাদের বাসায় পেয়েছিলো!অনিলার শরীর ঘামতে থাকে।তার জ্বর ছেড়ে দিয়েছে।পাশ ফিরে দেখে লাবনি ইসলাম পাশেই ঘুমুচ্ছেন।মেয়েরজ্বর দেখে আজকে মেয়ের সাথেই ঘুমিয়েছেন তিনি।
সকালে অনিলা ঘুম থেকে উঠে দেখে তার মা পাশে বসে আছে।অনিলা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়।�– শরীর এখন কেমন মা,?দেখলাম গায়ে জ্বর নেই।�– আলহামদুলিল্লাহ। এখন একদম ফ্রেস লাগছে মা।মনেই হচ্ছেনা দুদিন বিছানায় পরে ছিলাম জ্বর নিয়ে।তুমি অফিসে যাবে কখন মা?�–ভেবেছিলাম যাবনা আজকে।মেয়েকে জ্বরের মধ্যে রেখে কি মায়ের কাজে মন বসবে বল?�অনিলা মাকে জড়িয়ে ধরে। “আমার জ্বর সেরে গেছে মা।তুমি নিশ্চিন্তে অফিস কর এখন।নাহলে তোমার বদরাগী বস্ আবার রাগ দেখাবেন তোমার সাথে।তুমি আমাকে নিয়ে একদম ভেবোনা মা”।�লাবনি ইসলাম মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বল্লেন,” ঠিকাছে মা,আমি যাচ্ছি তাহলে।নাস্তা,দুপুরের খাবার সব রেডি করে রেখেছি। খেয়েনিস কিন্তু।” লাবনি ইসলাম অফিসে চলে যায়।�অনিলা বেড থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নেয়।চুল গুলি এলোমেলো হয়ে একাকার হয়ে অাছে।হেয়ার ব্রাশ টা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে অনিলা।ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ রূপবতী সে।যেমন তার গায়ের রং,তেমন চেহারা।হাইট ও তার অনেক ভালো।বাম গালের মাঝ বরাবর কালো তিলটি যেনো সোনায় সোহাগা।নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ অনিলা।ক্লাসে বান্ধুবীদের মধ্য মনি ছিলো সে।অনিলার বান্ধুবীরা তাকে পরী বলে ডাকতো।কিন্তু অনিলার মা খুব রেগে যেতেন,যদি অনিলার কোন ফ্রেন্ড তার সামনে অনিলাকে পরী বলে ডাকতো।মা কেন রেগে যেতো অনিলার সেটা আজো অজানা!!
•
#পর্ব_৩
অনিলা নাস্তা খেয়ে দেখে তার টেবিলের উপর কিছু বই রাখা।সে বুঝতে পারে দুদিন আগে মা অফিস থেকে আসার সময় কিনে এনেছেন।জ্বরের কারনে অনিলা বইগুলি দেখেনি।মনে মনে মা কে ধন্যবাদ দেয় সে।
একটা বইয়ের বদলে পাচঁ টা বই। খারাপ কি!অনিলা খুশি খুশি মনে বই গুলি নিয়ে বসে।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে।লাবনি ইসলাম এখনো বাসায় ফেরেন নি।অনিলা বই বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়।আকাশ টা খুব সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে কেউ যেন রং ছিটিয়ে দিয়েছে পুরো আকাশ জুড়ে।অনিলার ছাদে যেতে মন চাচ্ছে।অনিলা ভাবে,মা আসার আগে একবার ছাদে ঘুরে আসলে মন্দ হয়না।অনিলা চুলে হাল্কা করে চিরুনী বুলিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।
অনিলাদের ছাদটা খুব সুন্দর।অনেক ধরনের ফুলের গাছ আছে।দুটো দোলনাও আছে পাশাপাশি। বাড়িওয়ালার রুচি আছে ভালো ।কিন্তু বাড়ির মালিক এখানে থাকেনা না কেনো অনিলার বুঝে আসেনা।নিজের এতো সুন্দর বাড়ি রেখে কেউ যে কিভাবে অন্য জায়গায় থাকে!অনিলা এসব ভাবতে ভাবতে ছাদের দুটো দোলনার কাছে যেয়ে দাড়ায়।ছাদে আসার সময় ভেবেছিল আফসানা কে নিয়ে আসবে। কিন্তু ওদের দরজা আজকে বন্ধ ছিল। তাই অনিলা একাই ছাদে আসে। অনিলা দোলনার চেইন ধরে বসতে নেয়।হঠাৎ তার নাকে সেই সুঘ্রানটা আসে,যেটা সে আফসানাদের ঘরে পেয়েছিল আবার তার সপ্নের মাঝে ও পেয়েছে সে দুদিন!
যদিও অতটা গুরুত্ব দেয়নি অনিলা।কিন্তু এখন এই ঘ্রান কোথা থেকে আসছে। অনিলা ছাদের বাম সাইডে দেখে,কেউ নেই সেখানে,ডান দিকে দেখে অনিলা সেখানেও কাওকে দেখতে পায়না সে।অনিলা আর কিছু না ভেবে দোলনায় বসে পরে।দোলনায় দোল খেতে খেতে চোখ বন্ধ করে সুঘ্রান টা টেনে নেয় অনিলা।আর গুন গুনিয়ে গান গাইতে থাকে।কিছুক্ষন পরে একটা সুর কানে আসে অনিলার।অনিলা দোলনায় দোলা বন্ধ করেদিয়ে কান খাড়া করে শুনে।তার বুক কেঁপে উঠে! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনিলা বুঝে যায় এই সুর তার সপ্নে শোনা সেই সুর! খুব কাছে থেকেই আসছে সেটা। অনিলা তার পেছনের দিকটায় ফুল গাছ গুলির দিকে তাকায়।অনিলা যা দেখে সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা সে।অনিলার মুখ হা হয়ে যায়!!!
খুবই লম্বা,চওড়া কাধ,বাবড়ি চুলের একজন সাদা পাঞ্জাবি,পায়জামা পরা মানুষ উল্টো দিকে ঘুরে দাড়ানো।মুখ দেখা যাচ্ছেনা তার।সুরটা তার কাছ থেকেই আসছে।
অনিলা একবার ভাবে সে দৌড়ে পালাবে ছাদ থেকে।কোন পুরুষেরর সামনে কখনোই পড়তে চায়না সে।হতে পারে এটা ছোটবেলা থেকে গার্লস্ স্কুল, কলেজে পড়ার কারনে হয়েছে।অনিলার দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় দোলনার চেইনের শব্দ হয়।অনিলা থমকে দাঁড়ায়।আর সামনের পুরুষ টি শব্দ পেয়ে পেছনের দিকে ফিরে তাকায়!
অনিলার মনে হয় তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে।সে একশো পার্সেন্ট শিওর এতো সুন্দর চেহারা সাধারন কোন মানুষের হতে পারেনা! বড় বড় মায়াবী চোখ,সুরু নাক,হাল্কা চাপ দাড়ি,বাবড়ি চুল,চরম নুরানি চেহারা!অনিলার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দেয় ছেলেটা।তার হাতে একটা বাঁশি!
অনিলা মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়।কিন্তু পরে যাওয়ার ঠিক আগে ছেলেটা খুব দ্রুত এসে তাকে ধরে ফেলে।অনিলা তার কাধে খুব ঠান্ডা আর নরম হাতের ছোয়া পায়।অনিলা নিজেকে সামলে নেয়।ছেলেটা অনিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
অনিলা তার চোখ নামিয়ে নিচের দিকে চেয়ে থাকে।কিন্তু সে তার চোখ দুটো কে বেশিহ্মন নামিয়ে রাখতে পারলো না।
অনিলা তার সামনে দাড়ানো অসাভাবিক সুদর্শন যুবকের দিকে মাথা তুলে হা করে তাকিয়ে থাকেলো।এতে যদি তার ঘাড় ব্যাথা হয়ে ছিড়েও যায় কোন আফসোস থাকবেনা।ছেলেটার শরীর থেকে আসা মিষ্টি সুবাশ টা আরো তীব্র ভাবে অনিলার মন কে শিহরিতো করে তুলে।
মাগরিবের আজানের ধ্বনি শুনে অনিলার হুশ ফিরলো। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। কতহ্মন এভাবে তাকিয়ে ছিলো অনিলা বলতে পারবেনা।ছেলেটি মিটি মিটি হাসছে অনিলাকে এভাবে দেখে।অনিলা ভিষন লজ্জা পায় এবার।আর বেশিহ্মন দাঁড়িয়ে থাকলে সারা জনমের মতো এখানেই মুর্তির মতো স্থির হয়ে যেতে হবে তাকে!
অনিলা ছাদের দরজার দিকে যেতে নেয়।
— এই যে শুনুন”ছেলেটা অনিলাকে পেছন থেকে ডাক দেয়।অসাধারণ ভরাট পুরুষালি কন্ঠ তার।এমন কন্ঠের অধিকারী কাউকে উপেক্ষা করার দুঃসাহস কোন মানুষের আদৌ আছে কিনা অনিলার জানা নেই!সে ফিরে তাকায়।কিন্তু প্রানপনে চেস্টা চালিয়ে যায় তার চোখের দিকে না তাকানোর।
–জি,বলুন।অনিলার হাত ঘামতে থাকে।সে ওড়নার ঝুলে থাকা অংশ দিয়ে হাত মুছতে থাকে।
–“আমি আহমাদ। আপনাদের নতুন প্রতিবেশী। তিন তলায় উঠেছি কিছুদিন আগে।”
ছেলেটা অনিলার দিকে এক দৃস্টিতে তাকিয়ে বলে।
অনিলা মনে মনে উচ্চারন করে “অাহমাদ”!কি চমৎকার নাম!
— আফসানা আপনার…অনিলার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই আহমাদ বলে,
–” জি, আফসানা আমার ছোট বোন।ও অামাকে বলেছেলো অাপনার কথা।”
অাহমাদের কথা শুনে অনিলা মনে মনে ভাবে,ছেলেটা কিভাবে বুজলো যে উনার বোন যার কথা বলেছে,অামিই সে?”অন্য কেউতো হতে পারতো। মা বলেছিলো একবার, বাড়িওয়ালার বোনের ফ্যামিলি এদিকে কাছাকাছি কোথায় যেনো থাকে।তার মেয়েরা নাকি প্রায় অাসে।ছাদে উঠে ছবি টবি তোলে।অবশ্য তাদের সাথে দেখা হয়নি অনিলার।ওদের কেউ যদি হতো!!অনিলা ভাবতে থাকে।
— “আমি আসলে আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনিই যে অনিলা”। আহমাদের এই কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায় অনিলা।এই দুই ভাইবোনের কি কোন স্পেসাল টেকনিক জানা আছে নাকি মানুষের মনের ভাবনা বুঝে ফেলার?আজবতো!!
— “আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম” আহমাদ মুচকি হাসি দেয়। অনিলা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবার আহমাদের চোখে চোখ রাখে।
এক বারের জন্যও দুজনের কারোরি চোখের পলক পরেনা।হঠাৎ অাহমাদের হাত থেকে তার বাঁশি টা পরে যায়।অাহমাদ বাঁশিটা উঠাতে যায়,আর তখনি অনিলা এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে যায়।সে যদি তখন একবারো পেছনে ফিরে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো,আহমাদের জ্বল জ্বল করা সবুজ দুটি চোখ অনিলার দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অাছে!!
অনিলা বাসায় যেয়ে দেখে লাবনি ইসলাম অফিস থেকে চলে এসেছেন।অনিলা কে দেখে তিনি বল্লেন,”কিরে,কোথায় ছিলি এতোহ্মন?আমি সেই কখন এসেছি”।
–ওহহো,সরি মা।একা একা বোর লাগছিলো তাই ভাবলাম একটু ছাদে যেয়ে বাতাস খেয়ে আসি।”
অনিলার ছাদে যাওয়ার কথা শুনে হঠাৎ রেগে গেলেন লাবনি ইসলাম।তিনি ধমক দিয়ে বল্লেন,
“তুই আমাকে না জানিয়ে ছাদে গেলি কেনো? অনিলা মায়ের এমন আচরণে ভয় পেয়ে যায়।সে
মিন মিন করে মা কে বললো ” কি করে তোমাকে জানাবো মা?কখনো একটা ফোনও তো কিনে দাওনি।সারাদিন বাসায় একা একা থাকি।কতোহ্মন আর শুধু বই পড়ে কাটিয়ে দেয়া যায়?এতো দূরে বাসা নিয়েছো,কেউ আসতেও পারেনা।” কথা গুলি বলতে যেয়ে অনিলার কান্না চলে আসে।সে তার নিজের রুমে চলে যায়।
লাবনি ইসলাম নিজের রুমে না যেয়ে ড্রইং রুমেই একটা সোফায় বসে পড়েন।তিনি নিজেও বুঝেন অনিলাকে তিনি অনেকটা বন্দীদের মত করেই রেখেছেন।এমনকি একটা সাধারন মোবাইল ও কখনো কিনে দেননি। কোথাও গেলে অনিলাকে তিনি এক মূহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেননি।সে কার সাথে মিশবে,কত জনের সাথে বন্ধুত্ব করবে সবই তিনি ঠিক করে দিয়েছেন।
কিন্তু কি করবেন লাবনি ইসলাম।
এসব নিয়মের মধ্যে অনিলাকে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা তার।অনিলা যে তার নিজের সন্তান নয়।সে তো একজনের আমানত!
অনিলা নিজের বেডের উপর একটা কুশন নিয়ে বসে আছে।টপ টপ করে চোখ থেকে পানি পড়ছে তার।মা কেনো তাকে বকলো?সে তার বাম হাত দিয়ে ডান চোখের পানি মুছে।পানি মুছতে যেয়ে অনিলা তার বাম বাহুতে একটু ব্যাথা পায়।সে তার জামার হাতা কিছুটা সরিয়ে রুপা দিয়ে বাধানো তাবিজটা একটু নাড়িয়ে নেয়।তাবিজ টা টাইট হয়ে এসেছে। এটাকে বদলিয়ে আরেকটা লাগানোর সময় হয়েছে!
প্রতি বছর অনিলার মা লাবনি ইসলাম একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে নিজ হাতে তাবিজটা বদলিয়ে দেন।অনিলা অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে মা কে,এটা কিসের জন্য? মা কখনোই কিছু বলেনি তাকে।এই তাবিজ টা যেনো কেউ কখনো না দেখতে পায় এজন্য খুব ছোট থেকেই অনিলা কে বড় হাতার জামা পরাতেন লাবনি ইসলাম।
অনিলার রুমের দরজার সামনে যেয়ে দাড়ালো লাবনি।মা কে দেখে অভিমানে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অনিলা।একটা চেয়ার টেনে বসেন লাবনি।মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়
— “ছাদে কি একাই গিয়েছিলি নাকি?হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন তিনি।অনিলার মনে হলো তার মা যেনো ভুলেই গেসেন যে একটু আগে তিনি অনিলা কে বকেছেন!অনিলার খুব অভিমান হয় মায়ের সাথে।কিন্তু সাথে সাথেই তার আহমাদের কথা মনে পরে তার।ছাদে সে একা ছিলো না।আহমাদ নামের একজন অতি সুদর্শন যুবক ছিলো তার সাথে।আহমাদের চেহারা চোখে ভাসতেই অনিলার মন এক অজানা আনন্দে ভরে উঠে!
কিন্তু মাকে আহমাদের কথা বলা যাবেনা, অনিলা মনে মনে ভাবে।এমনকি তারা যে অনিলাদের নতুন প্রতিবেশী একথাও মা কে বলবেনা সে।কারন অনিলার মা একদম পছন্দ করেন না যে সে কারো সাথে মিশুক!
— কিরে,কিছু বলছিস না কেনো? লাবনি ইসলাম অনিলার তাকিয়ে আছেন।
— কার সাথে আর যাবো? এখানে কি কেও আছে নাকি?অনিলা গাল ফুলিয়ে উত্তর দেয়।
আমার হ্মিধে পেয়েছে।নুডুল্স বানাবো। অনিলা বসা থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়। যখন মায়ের সাথে অভিমান হয় অনিলার,তখন সে নিজে নিজে নুডুল্স বানিয়ে খায়।এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস।অনিলার মায়ের সাথে তার অভিমানের একমাত্র বহিঃপ্রকাশ এটা!!
#চলবে
লেখা: সুমাইয়া জান্নাতি
জ্বীন_প্রতিবেশী
#পর্ব_০৪_ও_৫
রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। আহমাদ আর আফসানা ছাদের ট্যাংকির উপর বসে আছে। আফসানা তার ভাইকে কিছু বলতে চাচ্ছে। আহমাদ তার হাতের বাঁশিটা বাজাতে নেয়। ” ভাইজান, একটা বলবো?”
— কি কথা বল?
আফসানা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল “আপনার কি ঠিক হয়েছে এতো জলদি “উনার” সাথে দেখা করা? আব্বুজানের কাছে এই খবর পৌছালে কি হবে ভেবে দেখেছেন আপনি? ব্যাপার টা নিয়ে খুব সমস্যায় পরে যেতে আব্বু, আম্মি কে আমাদের সমাজে।”
— “সমস্যার কিছু নেই। এখানে আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ আমাদের অস্তিত্ব টের পাবেনা। না কোনো ইনসান, না কোনো জ্বীন!!
ভাইয়ের কথায় পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেনা আফসানা। অনেক আগে তাদের বংশে এমন কাহিনী আরেকবার ঘটেছিলো। সেবার অনেক কস্টে তাদের আব্বু আর দাদাজান মিলে সব কিছু ঠিক করেছিলেন। আবার যদি সময়ের আগে তার ভাই এমন ভুল করে ফেলে তাহলে এবার তারা আর ফিরে যেতে পারবেনা তাদের সমাজে।
–” দেখ বোন,আমি “ওর” জন্য তিন’শ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। এটা আব্বুজান,আম্মি খুব ভালো ভাবেই যানেন।তাদের অনুমতি নিয়েইতো এখানে এসেছি। আমি অনেক চেস্টা করেছি ওকে দেখা না দেয়ার। কিন্তু আর কতো দিন অদৃশ্য হয়ে ওকে দেখে যাবো?”
অনিলার চেহারা টা আহমাদের চোখে ভেসে উঠে। আজ সন্ধায় হলুদ পোষাকে কি সুন্দর লাগছিলো ওকে!!
আফসানা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাইয়ের মিটি মিটি হাসির কারন বুঝতে চেস্টা করে। ওদের জ্বীনজাতির মাঝে মানুষের মনের ভাবনা পড়ে ফেলার ক্ষমতা তো আছে, কিন্তু নিজেদের কারো মনের ভাবনা বুঝে ফেলার শক্তি তাদের নেই।
আফসানা দেখে ছাদের উপর একটা কালো কুকুর হাটছে। আফসানা হাসি দিয়ে কুকুরটাকে বলে “চাচাজান, ওখানে কি করছেন? এদিকে আসুন। কুকুরটা আফসানার ডাক শুনে একলাফে ট্যাংকিতে উঠে আহমাদের পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। সে মানুষ রুপে আসে।আফসানা তাকে মানুষ রূপে দেখে হাসি দিয়ে বলে “চাচাজান, আপনাকে এই বাড়ির কেয়ারটেকার এর রুপে ভালোই মানিয়েছে। তাইনা ভাইজান?”
বোনের কথা শুনে আহমাদ হাসি দিয়ে তাদের দূর সম্পর্কের চাচা রাশিদ বেগ এর দিকে তাকায়।
দু’শ বছর ধরে তিনি আহমাদ দের পরিবারের সাথেই আছেন। আহমাদের বাবা সালমান বেগ উনাকে তার সন্তানদের সাথে এখানে পাঠিয়েছেন।
— “কি করছেন দুই ভাই বোন এখানে বসে? রাশিদ বেগ একটা রেশম কাপরের থলে খুলে আহমাদ আর আফসানার সামনে রাখতে রাখতে বলল। থলের মধ্যে কিছু হাড় আর মিষ্টি রাখা।
আহমাদ তার চাচাকে বলল, “চাচা ভালোই হয়েছে এগুলি এনেছেন। কয়েক দিন থেকে কেবল মানুষ জ্বাতির হাতে বানানো খাবার খাচ্ছি।” আহমাদ হাড্ডি গুলো তার হাত দিয়ে ছুয়ে দেয়, আর সাথে সাথেই সেগুলি বিভিন্ন রকম মশলাদার রান্না করা মাংসে রূপ নেয়। আহমাদ মনে মনে মহান আল্লাহ জ্বিন জাতির খাবারের ব্যাপার টা কত সহজ করে দিয়েছেন। সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।
ফজরের অাজান শুনে লাবনি ইসলামের ঘুম ভেংগে যায়। আজ শুক্রবার, তাই অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। লাবনি ফজর নামাজ পরে অনিলার রুমে যায়। সে মেয়ের মাথা কাছে যেয়ে দাড়ায়। কি নিস্পাপ একটা মুখ মেয়েটার!
এই মেয়েকে তিনি আঠারো বছর যাবৎ বুকে পিঠে করে বড় করেছেন। কখনো অফুরন্ত ভালোবাসা, স্নেহ দিয়েছেন, কখনো শাসন করে আবার কাছে টেনে নিয়েছেন। কিন্তু বেশিদিন সেটা আর করা হবেনা তার।খুব দ্রুত সময় ফুরিয়ে আসছে এই মমতার বাধঁন ছিন্ন হওয়ার!
লাবনি ইসলামের চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পরে। তিনি অনিলার রুমের দরজা টেনে দিয়ে নিজের রুমে চলে যান। বিছানার উপর বালিশটাকে উচু করে আধশোয়া হয়ে বসেন।
চোখবুজে ধীরে ধীরে গভীর থেকে নিঃস্বাস নেন তিনি।
লাবনি ইসলাম আর আশরাফ হোসেনের বিয়ে হয় পঁচিশ বছর আগে। দুজনেই খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। লাবনিদের আদি নিবাস এক পাহাড়ি অঞ্চলে। তার দাদার পূর্বপুরুষরা সেখানে বহু আগে থেকে নিজেদের বাড়ি, জমি, ব্যবসা শুরু করেছিলেন। লাবনি ইসলামের বাবা ওই পাহারী অঞ্চলের খুব গন্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ওই অঞ্চলে তার নিজের গড়ে তোলা মসজিদের ইমাম ছিলেন তিনি। সেই মসজিদে অনেক মানুষ দূর দূরান্ত থেকে এসে নামাজ আদায় করতে আসতেন।
সেই সব মানুষের মাঝে একজন ছিলেন যার সাথে খুব ভালো মিত্রতা ছিলো লাবনি ইসলামের বাবা আজহার ইসলামের। সেই ব্যাক্তিটি কে দেখলে স্বাভাবিক মানুষ মনে হলেও আসলে তিনি কোন মানুষ ছিলেন না। তিনি আসলে ছিলেন জ্বিন জাতিদের একজন।
তার মানুষ না হওয়ার ব্যপারটা আজহার ইসলামের কাছে কখনোই গোপন করেননি তিনি। এই মসজিদে নামাজ আদায় করার পর সারা রাত জেগে কোরান তেলাওয়াত করতেন তিনি। কখনো কখনো সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তেন। একদিন রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে উঠার সময় লাবনি ইসলামের বাবার কানে একজনের খুব সুন্দর করে তেলাওয়াতের সুর ভেসে আসে।
আজহার ইসলাম চমকে উঠেন। কারন মসজিদে সেদিন তিনি একাই ছিলেন। মসজিদের মূল দরজাও নিজ হাতে আটকিয়ে এসেছিলেন তিনি। কারো ঢুকে পড়ার কথাও না। তিনি আস্তে আস্তে এগিয়ে যেয়ে দেখলেন বিশাল লম্বা, সাদা টুপি, সাদা জুব্বা পড়া, মুখে সাদা দাড়ি ওয়ালা একজন মানুষ বসে কুরআন পড়ছে। আজহার ইসলামের আর বুঝতে বাকি থাকলোনা যে তিনি কাকে দেখছেন।তিনি সেখানেই এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অজ্ঞান হয়ে এভাবে কতক্ষণ ছিলেন তিনি বলতে পারবেন না।
তিনি যখন চোখ খুলেন তখন দেখতে পান একটা বিশাল বড় পালংকের এক পাশে শুয়ে আছেন তিনি। আর তার ঠিক সামনেই ওই লোক দাঁড়িয়ে আছেন যাকে তিনি দেখেছিলেন বেহুশ হওয়ার আগে। আজহার ইসলামের গলা শুকিয়ে যায়। তিনি ভাবেন আর হয়তো কখনো তার পরিবারে কাছে ফিরে যাওয়া হবেনা।
— “আসসালামু আলাকুম ইমাম সাহেব।”
লোকটা আজহার ইসলামকে হাসি মুখে সালাম দেয়। কিন্তু আজহার ইসলাম এতো টাই ভয় পাচ্ছিলেন যে তার মনে হচ্ছে তিনি আবার বেহুঁশ হয়ে যাবেন। তাকে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে তিনি বুঝতে পারছেন না। ঘরের চার পাশে চোখ বুলান তিনি। ঘরে আলো খুব কম। বিশাল বিশাল তিনটি জানালা আছে। সেগুলিতে খুব ভারি কোন কাপড়ের পর্দা ঝুলানো। চারপাশে খুব মিষ্টি একটা ঘ্রাণ।
— “শরীর কেমন এখন আপনার ইমাম সাহেব?”
লোক টি আবার জিজ্ঞাসা করে।
আজহার ইসলাম এখনও কোনো উত্তর দেন না। তিনি ছোটবেলায় তার দাদীর কাছে শুনেছেন যে জ্বীন দের নজর একবার নাকি যার উপর পড়ে হয়তোবা তাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলে অথবা তাকে ওদের কাছে নিয়ে যায়, আর কখনো পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়না।
–“আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবোনা৷ ভয় পাবেন না দয়া করে৷ আপনাকে আপনার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসবো। ”
এবার আজহার ইসলাম একটু সাহস ফিরে পান৷ তিনি খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করেন
— “কে আপনি? আমাকে আপনি কোথায় নিয়ে এসেছেন?”
তার আওয়াজ যেন তার নিজের কাছেই পৌছায় না৷
লোকটি আজহার ইসলামের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলেন,
— “আমি আপনার ই মত আল্লাহর একজন সৃষ্টি। আমার নাম সোলায়মান বেগ৷ এই অঞ্চলের জ্বীন সমাজের প্রধান আমি। আপনি এখন আমার প্রাসাদে আছেন।”
লোকটার কথা শুনে আজহার ইসলাম এর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে৷ তিনি জিজ্ঞেস করেন,
–” আমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ কী?”
–“আপনি আমাকে হটাৎ দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, সঠিক সময়ে আপনার জ্ঞান না ফিরলে বড় বিপদ হতে পারতো৷ মসজিদে আর কেউ ছিলোনা বলে আমি আপনাকে এখানে এনেছি৷ আপনার শরীর একটু ভালো হলেই আপনাকে আবার পৌছে দিয়ে আসবো৷ আপনি এখন বিশ্রাম করুন।”
এ কথা বলে লোক টি ঘর থেকে বের হয়ে যায়৷৷
#পর্ব_০৫
আজহার ইসলাম মনে মনে দোয়া দুরুদ পরা শুরু করলেন। ভালোয় ভালোয় এখন ফিরে যেতে পারলেই বাঁচেন তিনি। চোখ বন্ধ করে স্ত্রী অার আট বছরের মেয়ে লাবনি ইসলামের কথা ভাবতে থাকেন।
হঠাৎ একটা শব্দ তার কানে আসে । তিনি চোখ খুলে দেখেন পালংকের পাশে দুটো মাঝারি আকারের সাপ ফণা তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আজহার ইসলাম ‘ইয়া আল্লাহ” বলে জোরে এক চিৎকার দেন। তার চিৎকার শুনে সোলায়মান বেগ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘরে ঢুকেন।
–“কি হয়েছে ইমাম সাহেব?
জিজ্ঞেস করতে করতেই সাপ দুটো তার চোখে পরে। তিনি সাপ দুটোকে অন্য ভাষায় ধমক দিয়ে কি যেন বললেন। ভাষাটা অনেকটা আরবী ভাষার মতো মনে হলো আজহার ইসলামের কাছে। সাপ দুটি সাথে সাথে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
–” আপনি ভয় পাবেন না। এরা আমার ছেলে মেয়ে।আপনাকে দেখতে এসেছে। কোন ক্ষতি করবে না ওরা।”
–“ওহ আচ্ছা!”
অাজহার ইসলামের খুব পানির পিপাসা লাগে। তিনি বলতে যান পানির কথা, তখনি সোলায়মান বেগের হাতে একটা পিতলের পাত্রে পানি দেখতে পান। তিনি তার দিকে পাত্রটি এগিয়ে দেন। আজহার ইসলাম কাঁপা কাঁপা হাতে পাত্রটি ধরে এক ঢোক পানি গিলেন। পানিটার স্বাদ তার কাছে অন্যরকম মনে হয়। তিনি তৃপ্তি সহকারে পুরোটা পান করে ফেলেন।
–“ইমাম সাহেব,আপনি ক্ষুধার্ত। দয়া করে এই ফল আর খাবার গুলি খেয়ে নিন।”
সোলায়মান বেগের হাতে পিতলের পাত্র ভর্তি হরেক রকমের ফল আর মিষ্টান্ন। আজহার সাহেব ভাবলেন একটু আগে তো লোকটার হাতে এসব ছিলো না। এখন আসলো কোথাথেকে! তখন তার মনে পরলো, তার দাদী বলেছিলেন জ্বীন জাতি চোখের পলকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বিচরণ করতে পারে। আল কুরআন এবং হাদিস শরিফেও লিখা আছে এ কথা।
আজহার ইসলাম খাবার গুলি খেতে সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু তিনি কখনোই ক্ষুধা নিয়ে থাকতে পারেন না। তিনি আপেলের মত দেখতে একটা ফল হাতে নেন।কিছুক্ষণ ফল টা কে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আস্তে একটা কামড় বসালেন। খুবই মিস্টি একটা ফল। দেখতে আপেলের মত হলেও এর স্বাদ মিষ্টি অামের মতো। আজহার ইসলাম দুটো ফল খুব আগ্রহ করে খেলেন।
–“আপনাকে পৌছে দেয়ার সময় হয়ে গেছে ইমাম সাহেব। দয়া করে অাপনি চোখ বন্ধ করে নিন।”
সোলায়মান বেগের কথা শুনে আজহার ইসলাম চোখ বন্ধ করলেন। তার মনে হচ্ছে রাজ্যের ঘুম তার দুচোখের পাতায় নেমে এসেছে। তিনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
চারদিকে ফজরের আজান হচ্ছে। আজহার ইসলামের ঘুম ভেংগে গেলো। তিনি হকচকিয়ে উঠে বসলেন।মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেব ছুটিতে বাড়ি গেছেন। এ কদিন আজান দেয়ার দায়িত্ব আজহার ইসলামকে দিয়ে গেছেন।
আজহার ইসলাম মনে করার চেষ্টা করলেন, কিছুক্ষণ অাগে যেখানে গেলেন, যাদের দেখলেন এসব কি স্বপ্ন ছিলো নাকি বাস্তব! তার সব কিছু খুব স্পষ্ট ভাবে মনে হতে লাগলো।
তিনি আজান দেয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। অজু খানার দিকে যাওয়ার সময় হটাৎ তিনি খেয়াল করলেন তার বালিশের পাশে ফলের মত কিছু রাখা। যেটা দেখতে অনেকটা আপেলের মতো! আজহার ইসলাম আর কিছু চিন্তা না করে আজান দিতে চলে গেলেন। পাছে আবার নামাজের ওয়াক্ত চলে যায়!!
নামাজ আদায় করে আজহার ইসলাম সেই ফলটা নিয়ে বাড়ি গেলেন। তার বাড়ি মসজিদ থেকে কয়েক গজ দূরে। তিনি ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন তার স্ত্রী নামাজ পরে তাসবিহ পরছেন। তিনি ঘরে ঢুকে খুব সাবধানে দরজা লাগিয়ে দিলেন। তাদের বিছানাতেই তাদের একমাত্র মেয়ে লাবনি ইসলাম ঘুমাচ্ছে। তিনি মসজিদে থাকলে তার স্ত্রী মেয়েকে নিজেদের বিছানাতে নিয়েই ঘুমান।
ঘরে প্রবেশ করতে তার স্ত্রী তাকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের উত্তর নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
–” লাবনির মা, তোমাকে একটা কথা বলবো। কথাটা খুব গোপনীয়।”
তিনি কথাটা বলে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ের দিকে তাকালেন।
–” আপনি বলতে পারেন যা বলতে চান। মেয়ে ঘুমাচ্ছে।কিছু শুনতে পাবেনা। আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।”
লাবনি ইসলামের মা তার স্বামী কে বললেন।
–” লাবনির মা, আমি যা বলতে যাচ্ছি এই কথা কোনদিন কাউকে বলবেনা, যতদিন বেঁচে থাকবে। আজকে আমি জ্বীন জাতির সাক্ষাত পেয়েছি ।”
কথাটা বলে দম নিলেন তিনি। স্বামীর মুখে একথা শুনে লাবনি ইসলামের মায়ের মুখ হা হয়ে গেলো। তিনি মুখ ঢেকে রাখলেন হাত দিয়ে। বড় বড় চোখ করে স্বামীকে বললেন
–“তারপর, তারপর কি হলো?”
আজহার ইসলাম পুরো ঘটনা খুলে বললেন। পকেট থেকে ফলটা বের করে স্ত্রী কে দেখালেন। লাবনির মা অনেক ভয়ে ভয়ে হাতে নিলেন সেটা।
–“খুব মিষ্টি ফল। একটু খেয়ে দেখ।”
–” না না লাবনির অাব্বু। অামি খেতে পারবো না এই ফল।”
তিনি আবার ফল টা স্বামীর হাতে দিয়ে দিলেন।
— ” একটু খেয়ে ই দেখোনা। খুব ই স্বাদ। অল্প একটু খাও”।
স্বামীর অনুরোধে একটা কামড় দিলেন। সত্যি, অতুলনীয় স্বাদ এই ফলটার। লাবনির মা আরেক কামড় বসান।
দুজন ফল টা খেয়ে, কথা বার্তা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
বাবা, মা ঘর থেকে বের হওয়ার পর চোখ খুলে লাবনি ইসলাম। আজকে তার ঘুম খুব ভোরেই ভেংগে গেছে।বাবা মা ঘরে থাকায় এতোক্ষণ ঘুমের ভান করে শুয়েছিলো সে। বাবা তার মাকে যা বলেছে সব স্পষ্ট শুনেছে সে।
##
–“মা, উঠো। অনেক বেলা হয়ে গেছে। তোমার জন্য নাস্তা রেডি করেছি। এক সাথে খাবো।”
অনিলা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। ছুটির দিনে সে নিজ হাতে মায়ের জন্য নাস্তা তৈরী করে। মা কে বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়।
লাবনি ইসলাম চোখ মেলে ঘড়ি দেখেন। সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। বাজার করতে যেতে হবে তাকে। তিনি উঠে ফ্রেস হয়ে নেন।
–“ঘুম কেমন হলো মা?”
অনিলা মায়ের কাপে চা ঢেলে দেয়।
–“ভালোই হয়েছে মা। তুই কি খুব জলদি উঠেছিস নাকি আজকে? এতো কিছু বানিয়ে ফেললি!”
লাবনি ইসলাম হাসি দিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন।গতকাল রাতের অভিমানের ছিটেফোঁটাও নেই মেয়ের মুখে। মেয়েটা এমনি। তার সাথে অভিমান করে থাকতেই পারেনা।
–“হুম মা। খুব তাড়াতাড়ি উঠে গেছি।”
রোদ পড়ছিলো রুমে অনেক। কেন জানিনা, রোদ ভালো লাগছেনা অাজ।
অনিলার একথা শুনে লাবনি ইসলাম চায়ে চুমুক দেয়া থামিয়ে দিলেন!
আর ঠিক দের মাস পর আরবী ” সফর” মাসের সাত তারিখ অনিলার আঠারো বছর পূর্ন হবে। সেদিন থেকে অনিলার মাঝে মানুষদের যতো গুনাগুণ, আচরণ, স্বভাব আছে সেগুলি ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।
লাবনি ইসলামের মনে হচ্ছে আজকে থেকেই হয়তো সেটা কিছুটা শুরু হয়েগেছে। কারণ সকালের রোদ গায়ে মাখানো অনিলার প্রিয় কাজের মধ্যে একটি।
লাবনি ইসলাম ভাবনায় পড়ে যান। কিভাবে যে সব কিছু জানাবেন অনিলাকে তিনি!
–“কি ভাবছো মা? খাচ্ছনা যে!”
অনিলা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা কি যেন ভাবছে অনেক্ষন থেকে!
–“মা,আমার হাতের তাবিজ টা টাইট হয়ে আসছে।বদলে দিওতো। ব্যাথা পাই হাত নাড়ালে।”
লাবনি ইসলাম একথা শুনে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বললেন,
“আর বদলাতে হবেনা ওটা। দেড়টা মাস কষ্ট করে পরে থাক মা। তারপর আর কখনো তোকে তাবিজ পরতে হবেনা মা।”
–“তাই! খুব ভালো হবে তাহলে মা।”
অনিলা খুব উচ্ছাস নিয়ে বলে।
–“আমার বুঝ হওয়ার পর থেকেইতো হাতে তাবিজ বাধা দেখছি। একদম ভালো লাগেনা পরতে।”
অনিলা তাবিজটাকে হাত দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলে।
লাবনি ইসলাম আর কিছু বলেননা মুখে। মনে মনে ভাবেন, ” তোকে প্রথম যখন আমার কোলে “তারা” তুলে দেয়, তখন থেকেই এই তাবিজ তোর হাতে বাধা দেখেছি। “তারা” বলেছিলো, যেদিন তোর আঠারো বছর পূর্ণ হবে সেদিন থেকে এই তাবিজ আর পড়া লাগবেনা। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত বারো মাসে বারো টা তাবিজ তোকে বদলিয়ে বদলিয়ে পড়াতে হবে। “তারা” দুইশো চৌদ্দটা তাবিজ আমার হাতে দেয়। প্রতি মাসের প্রথম চাঁদরাতে তোকে তাবিজ গুলি হাতে লাগিয়ে দিয়েছি আমি।”
লাবনি ইসলাম নাস্তা শেষ করে উঠে যান। এখন আর বাজারে যেতে মন চাচ্ছেনা তার। অফিসের পিয়ন কে কল দিয়ে করে বাজার করে দিয়ে যেতে বলবেন।
তিনি আজকে সারাদিন অনিলার সাথে কাটাতে চান।
অনিলার রুমে যেয়ে দেখেন অনিলা চুল আচড়াচ্ছে।
–“আয় মা, তোর চুলে তেল লাগিয়ে দেই। লাবনি ইসলাম তেলের বোতল হাতে নিয়ে অনিলার পাশে দাঁড়ালেন।
— “বাহ মা। আজকে দেখি তুমি অনেক ভালো হয়ে গেছো। তুমিতো হাতে তেল লাগাতেই চাওনা।”
মেয়ের কথা শুনে লাবনি ইসলাম হেসে উঠেন। মেয়েকে কাছে টেনে চুলে তেল দেয়া শুরু করেন।
সকাল থেকেই অনিলার ইচ্ছা করছিলো একটু আফসানাদের ফ্লাটে যেতে। আফসানার ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে তার। “আহমাদ” অস্ফুট ভাবে উচ্চারন করে সে।
অনিলা ভেবেছিলো মা বাজারে গেলে এক ফাঁকে আফসানাদের বাসায় যাবে। কিন্তু মায়ের মতি গতি দেখে মনে হচ্ছেনা যে মা বের হবে বাজার করতে।
–”মা,বাজার করতে যাবে না। প্রতি শুক্রবার সকালেতো বাজার করো তুমি।”
অনিলা ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
লাবনি ইসলাম মেয়ের মাথা আবার সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে চুল আচড়াতে আচড়াতে বলেন,
— “আজকে আমি কোথাও যাবনা। অাজ সারাদিন তোর সাথে গল্প করবো।”
–“থ্যাংকস মা। অনিলা হাসি দিয়ে মাকে ধন্যবাদ জানায়।
লাবনি ইসলাম সারাদিন অনিলার সাথে কাটাবেন শুনে অনিলা খুব খুশি হয়। মাকে তো তেমন পাওয়াই হয়না তার। কিন্তু মা বাসায় থাকলে আহমাদ কে কোনভাবেই দেখা যাবেনা ভেবে মন খারাপ হয়।
কিন্তু আহমাদের জন্য এতো মন টানছে কেনো তার? সে নিজেকেই প্রশ্ন করে। অনিলা বুঝতে পারে, এই প্রথম তার মনে কোন পুরুষের ভাবনা আসছে! এমনটা আগে কখনো কল্পনাও করেনি সে।
(চলবে।)
লেখা: সুমাইয়া জান্নাতি
জ্বীন_প্রতিবেশী
#পর্ব_৬_ও_৭
লাবনি ইসলাম অনিলার মাথায় এতো তেল দিয়ে দিয়েছেন যে, তার বার বার মনে হচ্ছে ঘাড় আর কানের পাশ দিয়ে তেল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সে একটা টিস্যু দিয়ে মুছতে থাকে।
–“এতো তেল দিয়েছো না মা! দেখো এখন টপটপ করে কিভাবে পরছে!!
অনিলা মিছে মিছে মায়ের সাথে ঢং করে। লাবনি ইসলাম হাসি দিয়ে কি যেন বলতে যান আর ঠিক তখনি তার মোবাইল টা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠে “অনিলার বাবা”।
তিনি ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে যান।
অনিলা ভাবে সেও বাবার সাথে কথা বলবে।কিছুদিন যাবৎ বাবার সাথে কথা হয়নি তার। মায়ের কাছ থেকেই বাবার খবর নিয়েছে এই কয়েকটা দিন।
অনিলা তার বাবাকে খুব কমই কাছে পেয়েছে।তার যখন চার মাস বয়স তখনি আশরাফ হোসেন বিদেশ পাড়ি জমান। তার পর প্রথমবার যখন আসেন তখন অনিলার বয়স
সাত ছুঁই ছুঁই করছে। বাবার সাথে ফোনেই যতো অাল্হাদ করতো সে।
তার মনে আছে, বাবা যখন প্রথম বিদেশ থেকে আসেন, সেদিন সে বাবার সাথে অভিমান করে কথা বলেনি। কারণ এতো বছর পর তার বাবা তাকে দেখতে এসেছে!এতোদিন অাসেনি।
অনিলার সব সময় মনে হয়েছে, তার বাবার কাছ থেকে সে ঠিক যতটা ভালোবাসা পাওয়ার কথা তার একমাত্র সন্তান হিসেবে, সে ততো টা কখনোই পায়নি। এটা নিয়ে তার মনে তীব্র কষ্ট লুকিয়ে থাকলেও অনিলা সেটা কখনোই প্রকাশ করেনি।
কিন্তু একটা ব্যাপার সে সব সময় খেয়াল করেছে, তার বাবা তাকে যেমনি ভালোবাসুক না কেনো, অনিলার মায়ের প্রতি তার বাবার ভালোবাসা সীমাহীন। হাজার হাজার মাইলের দুরত্বও কখনো তাদের স্বামী, স্ত্রীর ভালবাসার মাঝে পঁচিশ বছরেও কোন দাগ ফেলতে পারেনি।
অনিলা এতেই খুশি!
লাবনি ইসলাম তার প্রিয় রকিং চেয়ারে বসে হাসবেন্ডের কল রিসিভ করেন। সালাম দিয়ে কথা শুরু করেন তিনি।
–“কি দিয়ে নাস্তা করেছো লাবু?”
আশরাফ হোসেন লাবনি কে আদর করে লাবু বলে ডাকেন। কিন্তু লাবনির এই ডাক শুনলেই রাগ লাগে। কেমন লেবু লেবু শোনা যায়! অসহ্য!
–“অনেক কিছু দিয়ে। আজকে তোমার মেয়ে নাস্তা বানিয়েছে। যা টেস্টি ছিলোনা খাবারটা!
–“লাবনি, তোমাকে না কতোবার বলেছি ওকে আমার মেয়ে বলবে না। এই মেয়ে আমার সন্তান নয়। কোথেকে এনেছো, কে দিয়েছে তোমাকে কখনোই বলনি অামাকে তুমি। যত বার জানতে চেয়েছি তোমার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছো। এই মেয়ের কারনে আমরা দুজন স্বামি স্ত্রী হয়েও একসাথে সংসার করতে পারছিনা। না তুমি আমার কাছে আসতে পারছো, না আমি দেশে এসে থাকতে পারছি! দু বছর পর পর এসে পনেরো বিশ দিন
থাকাকে সংসার করা বলেনা লাবনি!”
লাবনি ইসলাম একটা কথাও বলেন না। তার চোখে পানি ছল ছল করে। গলা ভারী হয়ে আসছে তার। আশরাফ হোসেন আর কিছু না বলে লাইন কেটে দেন।
লাবনি ইসলাম চেয়ার দোলাতে দোলাতে সিলিং এর দিকে চেয়ে থাকেন। তিনি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারেন, অনিলার দায়িত্ব নিতে গিয়ে তিনি স্বামী কে ঠকিয়েছেন।
কিন্তু লাবনি এটা এক বাক্যে স্বীকার করেন আশরাফ হোসেনের জায়গায় অন্য কেউ হলে কখনোই অনিলা কে এভাবে মেনে নিতনা।লাবনির সাথেও হয়তো কোন সম্পর্ক থাকতোনা।কে মানতো, এক রাতের মধ্যে চল্লিশ দিনের পরিচয় না জানা একটা বাচ্চাকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দিতে? তাও শুধু মাত্র তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে! হয়তো কেউ দিতো, লাবনির জানা নেই।
অনিলা জানে, মা যখন ছুটির দিনে বাবার ফোন রিসিভ করে, তখন কমসে কম এক ঘন্টাতো লাগেই তাদের আলাপ শেষ হতে!
সে ভাবে এর ফাকে একবার একটু আফসানাদের বাসায় যেয়ে আসা যাক। মা টের পাবেনা। সে মায়ের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা লক করা।
নিজেকে এক নজর আয়নায় দেখে নেয় অনিলা। নাহ,যতই তেলে চপচপ করুক তার চুল, এতে করে তার চেহারা একটুও মলিন হয়নি। সে একটা ওড়না মাথায় দিয়ে বের হয়।
আফসানা দের বাসার দড়জা লাগানো। অনিলা কয়েক বার নক করে। কারো টু শব্দটিও নেই। অনিলার মন টা খুব খারাপ হয়ে যায়।
খুব রাগ লাগে তার আহামদের উপর। কেনো তারা দরজা খুলছেনা। নাকি বাসায় কেউ নেই ?
অনিলা নিচে নামতে যায়, ঠিক তখনি আফসানাদের ফ্লাটের দরজা খোলার শব্দ আসে। অনিলা দাড়িয়ে যায়। আহমাদ দরজা খুলে। অনিলার সাথে চোখাচোখি হয় তার। সালাম দিয়ে মুচকি হাসি দেয় সে।
অনিলার হার্টবিট খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। তার মনে হয়, না আসলেই ভালো হতো!!
অনিলা খুব ধীরে সালামের উত্তর নেয়। তার কেনো জানি খুব লজ্জা লাগছে!!
— “আপনি বোধহয় আফসানার কাছে এসেছেন।আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। আপনি ভেতরে এসে বসুন।”
আহমাদ দরজার সামনে থেকে সরে দাড়িয়ে অনিলাকে ভেতরে ঢোকার পথ করে দিলো। অনিলার মনে হলো, এই বুঝি আহমাদের গায়ের সাথে ধাক্কা খেলো সে! আহমাদ অনিলাকে বসতে বলে ভেতরে চলে যায়।
আফসানা আর তাদের চাচা রাশিদ বেগ থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহমাদ তাদের কাছে যেয়ে দাড়ালো।
–“ভাইজান,আপনি এটা একদমই ঠিক করছেন না। আপনি আজও “উনার” সাথে দেখা দিয়েছেন। আফসানা অনেকটা রাগী কন্ঠে ভাইকে বলে।
–“এমন করা তোমার একদমই ঠিক হচ্ছেনা আহমাদ বেটা।”
আফসানার সাথে সুর মেলালো চাচা রাশিদ বেগ।
–“কোন সমস্যা হবেনা চাচাজান।অাপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন।দাদজান বা অাব্বুজান কিছুই জানবেনা।”
–“ভাইজান, আর কয়েকটা দিনইতো বাকি ছিলো।আপনি একটু ধৈর্য ধরতে পারলেন না!জানেনইতো, আমাদের সমাজে এসব কিছু গোপন রাখা খুবই কষ্টকর। একবার যদি একথা কেউ জেনে যায় যে, তাদের জ্বীন সমাজের প্রধানের একমাত্র ছেলে নিয়ম ভংগ করেছে, যে কিনা পরবর্তীতে জ্বীন সমাজের প্রধাণ হওয়ার দাবিদার। তাহলে অাব্বু জানের প্রাধান্য তো যাবেই সাথে আপনিও আর সমাজ প্রধাণ হতে পারবেন না।
আপনি কি ভুলে গেছেন, সাবরিন ফুফুজানের কারনে দাদাজান কতটা অপমানিতো হয়েছিলো আমাদের সমাজে। দাদা জানের প্রাধান্য ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো ফুফুজানের ভুলের কারনে।কতটা অপমানিত করা হয়েছে আমাদের।”
বোনের কথা শুনে আহমাদের প্রায় আঠারো বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। বেশিদিন হয়নি সেই কাহিনীর।
আহমাদের দাদা সোলায়মান বেগের একজনই সন্তান হয়। সে হচ্ছে অাহমাদ বেগের বাবা সালমান বেগ। তার দাদা সোলায়মান বেগ তখন জ্বীন সমাজের মধ্যে খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাদের অঞ্চলের প্রধাণ।
একদিন ইয়ামেন রাজ্য থেকে সেখানকার জ্বীন প্রধাণ আহমাদের দাদা সোলায়মান বেগকে দাওয়াত পাঠান। তিনি সপরিবারে সেই দাওয়াতে হাজির হন। ইয়েমেনের জ্বীন প্রধাণ খুব আপ্যায়ন করলেন মেহমানদের। দাওয়াত গ্রহন শেষে ফিরে আসার সময় অনেক উপহার দেন।
কিন্তু সেই উপহার গুলির মাঝে “খাস” একটা উপহার থাকে। সেটা হচ্ছে একটা ফুটফুটে জ্বীনের কন্যা শিশু!!
সোলায়মান বেগের খুব মায়া লাগে বাচ্চাটাকে দেখে। কারণ তার কোন মেয়ে নেই।তার স্ত্রীও খুব আনন্দিত হয় জ্বীন কন্যা শিশু টিকে পেয়ে। ইয়েমেনে জ্বীন প্রধান জানায় বাচ্চাটা এতিম। তারা চাইলে তাকে নিজেদের সন্তানের মতো লালন পালন করতে পারে।
সোলায়মান বেগ তাদের সাথে বাচ্চা টিকে নিয়ে আসেন। তিনি আর তার স্ত্রী মিলে কন্যা শিশুটার নাম রাখেন” সাবরিন”। অাহমাদের বাবা সালমান বেগ খুব খুশি হয় নতুন বোনকে পেয়ে।
সোলায়মান বেগের পরিবার নতুন সদস্য পেয়ে খুশি হলেও, খুশি হয়না তাদের জ্বীন সমাজ।
তারা অন্য দেশ থেকে আসা এতিম শিশুটাকে সমাজে মেনে নিতে চায়না। তারা তখন সোলায়মান বেগের বিরোধীতা করে। তাদের কে অনেক বুঝানোর পর তারা শান্ত হয়। কিন্তু শর্ত দেয়, এই মেয়েকে সোলায়মান বেগের বংশ পরিচয়ে পরিচিত করানো যাবেনা এবং সে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে জ্বীন সমাজের কোনো নিয়ম ভংগ করে তাহলে তাকে তো শাস্তি পেতেই হবে সাথে সোলায়মান বেগও তার জ্বীন সমাজের প্রধাণ থাকার ক্ষমতা হারাবেন।
অাহমাদের দাদা সোলায়মান বেগ তাদের শর্ত গুলি মেনে নেন। সাবরিন কে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করে তোলেন।
সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো তাদের পরিবারে। আহমাদের আর আসাফসানার জন্ম হয়। তাদের কাছে তাদের সাবরিন ফুফুজান খুব প্রিয় ছিলো।সাবরিনের ও সারা সময় কাটতো ভাতিজা, ভাতিজি কে নিয়ে।
হঠাৎ একদিন আহমাদ বুজতে পারে তাদের ফুফু আর আগের মতো নেই। তাদেরকে বেশি সময় দেননা। প্রাসাদের বাহিরেই বেশি সময় কাটান।
একদিন সাবরিন আর ঘরেই ফিরেনা।সোলায়মান বেগ অনেক খোজেন মেয়েকে। কিন্তু সাবরিন কে পাওয়া যায়না।
এর প্রায় বছর খানেক পরে আহমাদ দের কাছে খবর আসে তার ফুফু এক মানুষ জাতিকে বিয়ে করে তাদের সমাজে থাকছেন!
এ খবর খুব দ্রুত পুরো জ্বীন সমাজে ছড়িয়ে যায়। প্রভাবশালী জ্বীনরা তখন সাথে সাথে সোলায়মান বেগের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন এবং তাদের খুব অপমান করেন। তারা সাবরিন আর তার মানব স্বামী শোয়েব কে খুজে বের করে আটক করেন। তখন সাবরিনের কোলে তার চল্লিশ দিনের কন্যা শিশু!
মানব জাতিকে বিয়ে করার অপরাধে সাবরিন আর তার স্বামী কে সারা জীবনের জন্য কারাদন্ড দেয় জ্বীন সমাজ।
কিন্তু তাদের নব জাতক শিশু কন্যাটিকে তারা মেরে ফেলতে চায়। সোলায়মান বেগ তখন তাদের কাছে অনেক মিনতি করেন তারা যেনো বাচ্চা টাকে না মেরে ফেলে।
কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি হয়না। অনেক অনুরোধের পর তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ জ্বীন এগিয়ে আসে। তিনি সবাইকে বুঝিয়ে বলেন এই কন্যা সন্তান তার আঠারো বছর বয়সে পা দিলেই সে জ্বীন জাতির মত সব ক্ষমতা,অাচার,স্বভাব এর অধিকারী হবে। তাই তাদের নিজেদেরই একজন কে হত্যা করে ফেলা কোনভাবেই উচিৎ হবেনা তাদের। কিন্তু এই মেয়ে তখনি তাদের সমাজে ফিরে আসতে পারবে যখন তাকে জ্বীন জাতির মধ্যে কোনো ক্ষমতাবান, শক্তিশালী পুরুষ বিবাহ করবে। তার আগ পর্যন্ত তাকে মানব সমাজেই থাকতে হবে।
বৃদ্ধ জ্বীনের কথার সাথে অন্য সব জ্বীনরা সায় দিলো।সোলায়মান বেগ জ্বীন সমাজের এই রায় শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন। মনে মনে অাল্লাহকে শুকরিয়া জানান।
কিন্তু সাথে সাথেই তিনি ভাবেন, মানব সমাজের কার কাছে তিনি তার নাতনি কে দিবেন? কে তার দায়িত্ব নিবে আঠারোটা বছর পর্যন্ত? তিনি ভাবনায় পরে যান।
কিন্তু পরক্ষনেই মনে পরে তার মানব মিত্রের কথা। যার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এর পরেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো সোলায়মান বেগের। তার চোখে ভেসে উঠলো বন্ধু আজহার ইসলামের ছবি। সোলায়মান বেগের সব চিন্তা নিমিষেই দূর হয়ে গেলো!!
#পর্ব_৭
আফসানা তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তার ভাই কি যেনো ভাবছে! সে এতোক্ষণ যা বুঝিয়েছে ভাইকে সেগুলি নিশ্চয়ই তার কানে যায়নি।
–“ভাইজান, আপনি কি ভাবছেন? আমাদের কথা কি কানে যাচ্ছে আপনার?” আফসানার বিরক্তি এখন চরমে। আসলে সে খুব ভয় পেয়ে গেছে। সে কোনো ভাবেই চায় না এবার আহমাদের ভুলের কারণে তাদের দাদাজান আর আব্বুজান কোন ঝামেলায় পরুক।
–“ঠিক আছে বোন, আমি আর “ওর” সাথে আর দেখা দিবো না। ওর সামনে অদৃশ্য হয়েই থাকবো। আর ও যখন ঘুমাবে তখন ওর স্বপ্নে দেখা দিবো। এবার আপনারা নিশ্চিত হতে পারেন।”
আহমাদ মন খারাপ করে বোন অার চাচাকে বলে।
আহমাদের কথা শুনে আফসানা স্বস্তুি পেলেও তাদের চাচা রাশিদ বেগ সূক্ষ্ণ ভাবে একটা রহস্যের হাসি হাসেন। কিন্তু এই হাসি আহমাদ আর তার বোনের নজরে পরেনা!!
আফসানা ড্রইং রুমে অনিলার সাথে দেখা করতে আসে। আহমাদ ও তার সাথে সাথেই আসে। কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছেনা। সে অদৃশ্য হয়ে অনিলার একদম কাছাকাছি যেয়ে বসে। আফসানার হাসি পেয়ে যায় ভাইয়ের কান্ড দেখে।
–“কেমন আছেন? এ কদিন আসেননি যে?আমিতো আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।”
আফসানা হাস্যজ্জল মুখে অনিলার দিকে তাকিয়ে বলে। অনিলা কে আকাশি সালোয়ার কামিজে খুব মানিয়েছে। আফসানার মনে হয় তাদের সমাজের যে কোনো জ্বীন কন্যার চেয়ে অনিলা দেখতে বেশি সুন্দরী।
–“আসলে বাসায় একটু কাজ ছিলো এ কদিন।তাই আসা হয়নি।”
অনিলা নিজের কথা শুনে নিজেই হতাশ হয়।সে তো এসেইছিলো, কিন্তু অাফসানাদের দরজা অাটকানো দেখে ছাদে গিয়েছিলো। কিন্তু কোন কারনে এটা সে আফসানাকে বলল না!
অনিলা বার বার ভেতরের রুমের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। আহমাদ বের হচ্ছেনা কেনো!
তাকে একটু মন ভরে দেখতেইতো মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে এখানে আসা!
আহমাদ আর আফসানা অনিলার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মিটি মিটি হাসে।
–“আপনি কি বাসায় একা? অনিলা আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেনা। যদিও সে জানে আহমাদ বাসাতেই আছে!
–“না, আমার ভাই বাসায় আছে। ওইতো আপনাকে দরজা খুলে দিলো “।
–” ও হ্যা। আসলে আমি খেয়াল করিনি কে ছিলো ওটা।”
অনিলা ঠোঁট উল্টিয়ে এমন ভাব করলো যেন সে আহমাদ কে পাত্তাই দিলো না।
অনিলার বাহিরে এমন ভাব দেখে আহমাদ খুব মজা পেলো। সে অনিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকলো। অনিলা আফসানার সাথে কথা বলছে আর নিজের তেল চপ চপ করা চুলের বেনিকে নাড়াচ্ছে হাত দিয়ে।
আহমাদ অনিলার তেলে চপ চপ করা চুলের প্রেমে পরে গেলো!
অনিলা আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না আফসানা দের বাসায়।আহমাদের কোন খবর নেই। দরজা খুলে দিয়ে সেই যে ভেতরে গেলো আর আসলোনা। অনিলা কষ্ট পেলো মনে।
তার মনে হলো সে অযথাই আহমাদ কে নিয়ে ভাবছে! সে আফসানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসে।
তার জন্য অনিলার মনের অবস্থা দেখে আহমাদের খুব খারাপ লাগে। সে অনিলাকে কোনো ভাবেই কষ্ট দিতে চায়না। কিন্তু এখন কি করবে সে। অনিলার সাথে যদি বাকিটা জীবন কাটাতে চায় তাহলে একয়টা দিন তাকে অদৃশ্য হয়েই থাকতে হবে অনিলার পাশে পাশে।
কিন্তু সে অবশ্যই প্রতিদিন অনিলার সপ্নে আসবে! নিজের কাছে নিজে ওয়াদা করে আহমাদ।
অনিলা বাসায় এসে দেখে লাবনি ইসলাম এখনও রুম থেকে বের হয়নি। হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। মা যদি দেখতো সে বাসায় নেই কি কান্ডটাই না করতেন।
অনিলা তার মায়ের রুমে দরজা নক করে।
–“ভেতরে আয় মা।”
লাবনি ইসলাম মেয়েকে ভেতরে আসতে বলেন। তিনি মেয়েকে অনেকবার বলেছেন, তার রুমে নক করে আসার প্রয়োজন নেই। মা, মেয়ে দুজনইতো শুধু থাকেন বাসায়। কিন্তু অনিলা কখনোই অনুমতি ছাড়া রুমে ঢুকবেনা। বড়ই লক্ষী মেয়েটা।
অনিলা রুমে ঢুকে দেখে মা রকিং চেয়ারে দুলছেন। হাতে ফোন।
–“বাবার সাথে কথা হয়েছে মা? কেমন আছে বাবা? অনিলা তার মা কে জিজ্ঞেস করে।
–“তোর বাবা ভালো আছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলো বার বার। তোর সাথে কয়দিন থেকে কথা হচ্ছেনা দেখে মন খারাপ। তুই ফোন দিয়ে কথা বলিস তোর বাবার সাথে।”
লাবনি ইসলাম অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা গুলি বল্লেন মেয়েকে। কারন অনিলার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না।
অনিলা মা কে হাসি দিয়ে বলে
–“তাই মা! বাবা আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে? ঠিক আছে মা, আমি বাবার সাথে কথা বলবো।”
বলেই সে মায়ের রুমের দরজা চাপিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে যায়।
অনিলা খুব ভালো করেই জানে তার বাবা তার কথা কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। এসব কিছুই মা বানিয়ে বলেছেন। তবে এসব যে মা আজকে থেকে বলছেন তা নয়।
অনেক আগে থেকেই লাবনি ইসলাম অনিলা আর আশরাফ হোসেনের মধ্যে বাবা মেয়ের স্নেহের সম্পর্কটা কে সুন্দর করার চেষ্টা করে অাসছেন। অনিলা যখন ছোট ছিলো তখন ব্যাপার গুলি সহজ ছিলো তার জন্য। কিন্তু অনিলা যতই বড় হচ্ছে ততোই তার জন্য সব কিছু কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
অনিলা কাঁদছে। খুব করে কাঁদছে। তার আজ কিছুই ভাল্লাগছেনা। সে জানতে চায় তার বাবা তাকে কেনো কখনো তার নিজের সন্তানের মতো করে ভালোবাসেনি। সে অার মায়ের সামনে মিথ্যা অভিনয় করতে চায়না। সে তার মাকে বুঝাতে চায় যে সে ভালোভাবেই বুঝে তার বাবা তার কোনো খবর নেয়না। অনিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
আহমাদ অনিলার একদম মুখোমুখি বসে আছে।
অনিলাকে কাঁদতে দেখে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।কিভাবে অনিলার মনটা ভালো করা যায় আহমেদ ভাবতে থাকে। সে অনিলার চোখের পানি আংগুল দিয়ে ছুয়ে দেয়।
সাথে সাথে অনিলার দু চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় সে।
অনিলা দেখে তার বিছানায় একজন পুরুষ বসে আছে। তার মুখ অন্য দিকে ঘোরানে।
অনিলা ভাবছে তার ঘরে কে ঢুকলো? অনিলার ঘর খুব সুন্দর একটা সুবাশে ভরে গেছে।
পুরুষ টিকে দেখে অনিলার ভয় পাওয়ার কথা।কিন্তু অনিলার একদম ভয় লাগছেনা।
–“কে আপনি?আমার ঘরে কিভাবে ঢুকলেন?”
অনিলা তাকে জিগ্যেস করে।কিন্তু সে কোনো কথা বলেনা।
–”কি ব্যাপার কোনো উত্তর দিচ্ছেন না কেনো?অনিলা আবারো পুরুষ টিকে প্রশ্ন করে।
এবার পুরুষ টি ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে অনিলার দিকে তাকায়। তাকে দেখে অনিলা ভীষন চমকে যায়! এ সে সেই, যাকে দেখার জন্য, যার সাথে একটু কথা বলার জন্য অনিলা সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলো। পুরুষটিকে দেখে অনিলার ঠোট দিয়ে অস্ফুটে সুরে এক নাম বের হয়, আর সেটা হলো “আহমাদ”।
–” আপনি? আপনি এখানে কিভাবে এলেন? মা দেখেনি আপনাকে?”
অনিলা আহমাদ কে জিজ্ঞেস করে। আহমাদ হাসে অনিলার কথা শুনে। মুখে কিছুই বলেনা সে।
অনিলা রাগ দেখায়,
–“হাসছেন কেনো। আমি কি কৌতুক বলছি আপনাকে?” অনিলা চোখ গরম করে বলে।
–” কৌতুক কি?” আহমেদ অনিলাকে জিজ্ঞেস করে।
–“ওমা! কৌতুক কি অাপনি জানেন না। কোন দেশ থেকে এসেছেন শুনি?”
অনিলা কপট রাগ দেখায়।
আহমাদ আরো হাসতে থাকে অনিলার রাগ দেখে।
অনিলার খুব ভালো লাগছে আহমাদকে দেখে।তার মনে হচ্ছে সে তার অতি আপন জনকে বহু দিন পর তার সামনে দেখছে।
কিন্তু অনিলা কিছুতেই চাচ্ছেনা যে আহমাদ বুঝে ফেলুক সে কতটা খুশি আহমাদকে দেখে।
অনিলা তাকিয়ে দেখে আহমাদের হাতে সেই বাঁশিটা। অনিলা বাশিঁটা দেখিয়ে আহমাদ কে বাজাতে বলে।আহমাদ মাথা নাড়ায়।সে বাজাবেনা।
অনিলা গাল ফুলিয়ে অভিমান করে। আর তখন আহমাদ মুচকি হাসি দিয়ে বাঁশিটি তুলে বাজানোর জন্য।
কি অদ্ভুত সুন্দর এই বাঁশির সুর। অনিলা বিমোহিত হয়ে যায় বাঁশির সুরে। তার দু চোখ বন্ধ হয়ে অাসতে চায়। অনিলা দেখে বাঁশি বাজাতে বাজাতে আহমাদ অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।অনিলার চায়না আহমাদ এখন তাকে রেখে চলে যাক। অনিলা হাত তুলে আহমাদকে না যেতে ইশারা করতে চায়। কিন্তু সে পারেনা। গভীর ঘুম এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনিলা কে।
(চলবে)
লেখা: সুমাইয়া জান্নাতি
জ্বীন_প্রতিবেশী
#পর্ব_১০_ও_১১
সালামান বেগ ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগ পাশাপাশি বসে আছেন। তাদের এতো বড় প্রাসাদ প্রায় খালি পরে আছে।আজ অনেক দিন হচ্ছে তাদের ছেলে, মেয়ে এখানে নেই। সালমান বেগের বোনের মেয়েকে তাদের জ্বীন সমাজে ফিরিয়ে নিয়ে অাসতে আহমাদ আর আফসানাকে পাঠিয়েছেন তার পিতা সোলায়মান বেগ। তার পালিত কন্যা সাবরিন ও তার মানব স্বামীকে যাবৎ জীবন কারাদণ্ড থেকে রেহাই দেয়ার জন্য তাদের কন্যা কে খুবই দরকার।
সোলায়মান বেগ তার পালিত কন্যা সাবরিনের সাথে খুব অভিমান করেছিলেন মানব স্বামী গ্রহণ করার কারনে।কিন্তু পরবর্তীতে যখন দেখলেন, সাবরিন এক কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে, যার দেহে মানব রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তখন তার মন গলে যায়। তিনি তার চল্লিশ দিনের নাতনির মায়ায় পরে যান।
তিনি চেয়েছিলেন সবাই এবার এক সাথেই থাকবেন তাদের প্রাসাদে।কিন্তু জ্বীন সমাজের কিছু অংশের বিরোধীতার মুখে পরে তিনি তার প্রাধান্য হারিয়ে নাতনি কে মানব সমাজের কাছে লালন পালন করতে দিয়ে দেন আর মেয়ে এবং তার মানব জামাতা কে আজীবনের জন্য কারাবন্দী হতে হয়।
সোলায়মান বেগ তার নাতনির নাম রাখেন! ‘বিলকিস’। কারন বহু বছর অাগে ‘সাবা’নামক এক জাতি ছিলো। তাদের রানীর নাম ছিলো বিলকিস। তার পিতা অথবা মাতার মধ্যে একজন জ্বীন এবং আরেক জন মানুষ ছিলেন!
কিন্তু সোলায়মান বেগ যখন তার নাতনি বিলকিস কে মানব জাতির কাছে লালিত পালিত হতে দেন তখন তিনি তার নামের ব্যপারে তাদের কিছু জানান নি।তাই মানব সমাজে যেয়ে তার নাম রাখা হয় ‘অনিলা।’
সোলায়মান বেগ ভালো করে জানেন,যখন একজন মানুষ আর জ্বীনের সন্তান হয় তাদের বৈধ বিবাহের মাধ্যমে ,তখন সেই সন্তান কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠে।
সালমান বেগ তার বাবা সোলায়মান বেগের ঘরে আসেন। তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতটা চিন্তিত তিনি। পিতার পাশাপাশি যেয়ে বসলেন।
–”আব্বুজান,আজ কয়েক দিন থেকে আমার কাছে কিছুই যেন ভালো ঠেকছেনা।আহমাদের মায়ের কাছেও অনুরূপ। ” সামলান বেগ মাথা নিচু করে বললেন পিতাকে।
–“কেনো? কি হয়েছে বেটা? কি নিয়ে এতো পেরেশানি তে আছো?সব কিছুতো ঠিকঠাকই চলছে!”
–“না অাব্বু জান,ঠিক নেই। অামার কয়েকদিন থেকেই মনে হচ্ছে অাপনার অাদরের নাতি,নাতনি কোনো সমস্যায় পড়েছে। অাবার হতেও পারে এটা আমার মনের ভুল।”
সালমান বেগের কন্ঠে যথেষ্ঠ চিন্তার ছাপ।
–” বেটা ওদের নিয়ে কেনো দুঃচিন্তা করছো।রাশিদকে তো পাঠিয়েছি ওদের সাথে।কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়!”
সালমান বেগ তার পিতার কথা শুনে অারো বেশি অস্থির হয়ে ওঠেন।
কেনো যে তার বাবা রাশিদ বেগ কে এতো ভরসা করেন তিনি ভেবে পাননা।
রাশিদ বেগের অতীততের কর্ম কান্ডের কারনে তাকে কখনোই মন থেকে ক্ষমা করতে পারেন নি তিনি।কিন্তু পিতার সিদ্ধান্ত কে শ্রদ্ধা দেখাতেই তার সাথে সালমান বেগ তার কলিজার টুকরা সন্তানদের এতো দূর পাঠিয়েছেন।
–“বেটা,আমার নাতি নাতনির চিন্তা যদি তোমাকে এতই পেরেশানিতে ফেলে দেয়, তাহলে আমি বলবো আজই একজন “জ্বীন খাবরি” কে পাঠিয়ে দাও তাদের খবর জেনে আসার জন্য।
তাছাড়া ভুলে গেলে হবেনা,নতুন চাঁদ আসমানে দেখা দিতে অতি অল্প সময় বাকী অাছে।”
সালমান বেগ জানেন,তার পিতা নতুন চাঁদের কথা বলে কি বুঝাতে চাইছেন। তার পালক বোনের মেয়ে বিলকিসের মানব শরীরে নতুন চাঁদ ওঠার সাথে সাথে জ্বীন দের সমস্ত শক্তির উপসর্গ দেখা দিবে স্পষ্ট ভাবে ।সে সময় আহমাদ বা আফসানার সেখানে থাকা জরুরি।
সালমান বেগ তার পিতার সাথে আর কিছু না বলে একজন জ্বীন খাবরির সাথে কথা বলতে চলে যান।যতক্ষন পর্যন্ত তার সন্তান দের ভালো থাকার খবর না পাচ্ছেন,তার মনে শান্তি অাসবেনা!
অনিলার শরীর খারাপের লক্ষন গুলি বেড়েই চলছে। তার মনে হচ্ছে তার শরীরের চামড়া পুড়ে পুড়ে গলে পড়ছে। সে নিশ্চিত মারা যাবে।
মেয়ের কষ্ট দেখে লাবনি ইসলাম মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছেন।
যেই মেয়েকে তিনি এতো বছর ধরে লালন পালন করলেন তার এমন কষ্টের সময় তিনি কিছুই করতে পারছেন না।
অনিলাকে কোলে তুলে দেয়ার সময় লাবনি ইসলামের বাবা একটা তাবিজের পুটলির সাথে কিছু লিখা সহ একটা কাগজও দিয়েছিলেন।
লাবনি সেখানে পড়েছেন, অনিলা যখন সাধারন মানুষ থেকে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন জ্বীনজাতি দের একজন হওয়া শুরু করবেন তখন তার মৃত্যুসম কষ্ট হবে। এসয় তাকে কোনো প্রকার ঔষধ সেবন করানো যাবেনা।একটা বদ্ধ ঘরে আটকিয়ে রাখতে হবে তাকে। কিন্তু এসময় যদি জ্বীনজাতি হতে কেউ অনিলার পাশে থাকে তাহলে তার উপস্হিতির কারনে অনিলার এই ভয়ানক যন্ত্রণা কিছুটা কম হবে।
কিন্তু লাবনি ইসলাম জানেনা,অনিলার এই সময় কেউ তার পাশে থাকবে কিনা।
লাবনি ইসলাম তার বাবার প্রিয় মিত্রের কথা ভাবেন।সে কি আসবেন তার নাতনির এমন কষ্টের সময়ে।নাকি কাউকে পাঠাবেন?কিন্তু লাবনি ইসলাম কিভাবে বুঝবেন যে তারা এসেছে?তিনি ভাবতে থাকেন। পাশের ঘর থেকে অনিলার গোংগানির শব্দ পাচ্ছেন তিনি।
নিঃশব্দে চোখের পানি মুছলেন লাবনি ইসলাম।
সারাটা আকাশ ভয়ংকর কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে।বাতাসো খুব জোরে বইছে।যে কোনো সময় ভীষন ঝড় শুরু হতে পারে।
আফসানা বারান্দায় দাড়িয়ে আছে।তাকে খুব ভীতো দেখাচ্ছে। তার ভাই আহমাদের কোনো খবর নেই। সে এই খবর তাদের প্রাসাদেও পৌছাতে পারছেনা কোনো ভাবে। অাফসানা মোটামোটি নিশ্চিত যে তার ভাই কোনো বিপদে পরেছে। কিন্তু এখন এই পরিস্হিতি থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় জানা নেই তার।তার ইচ্ছা করছে সব কিছু বাদ দিয়ে ভাই কে খুঁজে নিয়ে আসতে।
খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকালো আকাশে।আফসানা ভয় পেয়ে ভেতরে চলে এলো। জ্বীন জাতির জন্য ঝড়, বাজ এবং বিদুৎ চমকানো খুবই বিপদজনক।
অাফসানার হঠাৎ মনে হলো তার ঘরে কেউ ঢুকেছে।সে ভয়ানক হুংকার ছেড়ে বলল,
“কে এসেছো এখানে,?যদি নিজের জান প্রিয় হয়ে থাকে,এই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ কর।” আফসানার চোখের রং পরবর্তন হয়ে সবুজ হয়ে গেলো।তার চোখ থেকে যেন ঠিকরে ঠিকরে সবুজাভ আগুন বের হচ্ছে।
— “আমাকে জ্বীন প্রধান এখানে পাঠিয়েছেন।আমার নাম আসাদ। দয়া করে আপনি শান্ত হন।” একটি শীতল কিন্তু গম্ভীর কন্ঠ আফসানাকে বলল।
–“সামনে হাজির হয়ে কথা বলো।”অাফনার কন্ঠ এখনো শান্ত হয়নি।তার চোখ রাগে জ্বলছে।
একটি লম্বা পুরুষের অবয়ব ধীরে ধীরে আফসানার সামনে প্রকাশ পায়। সে মাথা নিচু করে আফসানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
–“আব্বু জান তোমাকে পাঠিয়েছেন?”
–“জ্বী।তিনি বেশ কয়েকদিন যাবৎ আপনাদের নিয়ে দুঃচিন্তায় অাছেন।আপনারা এখানে ভালো আছেন কিনা আমাকে দেখতে পাঠিয়েছেন।”
আফসানার মনটা নরম হয়ে আসে।সে মনে মনে আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া জানায়।
তাদের পিতার মনে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে তার সন্তানেরা পেরেশানিতে আছেন।
“আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি।” অাফসানা উত্তর দেয়।সে মনে মনে ভাবে,আহমাদ ভাই তাহলে প্রাসাদে পৌছায়নি।কারন পৌছালেতো তাদের অাব্বুজান এই খাবরি কে এখানে পাঠাতেন না। আফসানার ধারনাই তাহলে ঠিক।তার ভাই বিপদে পড়েছে।সে খাবরি আসাদ কে বলে,
–“কিন্তু আহমাদ ভাই বেশ কয়েক দিন আগে প্রাসাদে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন।কিন্তু ফিরে আসেন নি।”একথা বলে আফসানা বিমূর্ষ হয়ে পরে। “ভাইজান আমাদের চাচাজান রাশিদ বেগ এর গায়েব হওয়ার খবর পৌছে দিতে রওনা হয়েছিলেন।এখন বুঝতে পারছি তিনি পৌছাননি প্রাসাদে।”
–” দয়া করে আপনি পেরেশান হবেন না। আমি একটি খবর পেয়েছি।কিন্তু এটা হুজুর প্রধান কে জানানো হয়নি।আমি যখন প্রাসাদ থেকে এখানে আসার উদ্দেশ্যে বের হই তখনি আমাকে একজন পাহাড়াদার এই খবর দিয়েছেন।আমি খবরের সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে হুজুর প্রধান কে পেরেশানিতে ফেলতে চাইনি।”
–“কি খবর পেয়েছো?কোনো ভনিতা না করে জলদি বলো”অাফসানা অাবার ভয়ানক হুংকার দিয়ে বলল।
তার হুংকার শুনে খাবরি আসাদ ভয়ে কুকড়ে যায়।সে মাথা নিচু করে বলে,
–“কয়েক দিন আগে প্রাসাদের একজন জ্বীন পাহারাদার এর শিশু পুত্র প্রাসাদের বাহিরে খেলা করার সময় ছোট হুজুর অাহমাদবেগ কে প্রাসাদের দিকে আসতে দেখে।কিন্তু প্রাসাদে প্রবেশ করার আগেই উনাকে ভয়ংকর রকমের কালো ধোয়ার মত কিছু ঘিরে ফেলে। ওই শিশুটি এটা দেখার সাথে সাথে তার পিতাকে ডেকে আনতে যায়।কিন্তু সে এসে দেখে সেখানে কিছু নেই।”
এইটুকু বলে খাবরি আসাদ থেমে যায়।
আফসানা তাদের বিশাল আরাম কেদারায় বসে পরে।সে বুঝতে পারছে তার ভাইয়ের সাথে কি হয়েছে। তাদের প্রাসাদের মধ্যে শুধু তিন জনের কালো ধোঁয়ার মত রূপ ধরার ইখতিয়ার আছে।সেই তিনজন হচ্ছেন তাদের দাদা সোলায়মান বেগ,তাদের পিতা সালমান বেগ,এবং তাদের দুঃসম্পর্কের চাচা রাশিদ বেগ এর।
রাগে আফসানার চোখ ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে।রাশিদ বেগ এর উপর প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছে তার।দাদা জান কত ভরসা করে তাকে পাঠিয়েছিলেন তাদের সাথে।আর এই রক্ষক ই ভক্ষকের রূপ নিলো!দাদাজানের ভুল হয়েছে তাকে অাবার বিশ্বাস করে।
কিন্তু অাহমাদ ভাই কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে? আফসানা ভাবতে থাকে!সে বুঝে উঠতে পারছেনা এই খবর প্রাসাদে তার পিতা কে জানাবে কিনা।নাকি নিজেই ভাইকে উদ্ধারের জন্য বেড়িয়ে পড়বে।
–“আপনি চাইলে আমি প্রাসাদে এই খবর টি পৌছে দিয়ে আসতে পারি। হুজুর প্রধান খোঁজ লাগাবেন যে কার এতো বড় দুঃসাহস হয়েছে যে ছোট হুজুর কে কয়েদ করার!!”
–“নাহ।এখনি আব্বুজান কে বলার দরকার নেই।কিন্তু কে ভাইজান কে নিয়ে গেছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। “আফসানা খাবরি আসাদের দিকে জ্বল জ্বল ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে।
–“দয়া করে আপনি আমাকে তার নাম বলুন।আমি এখনি তার সমস্ত শক্তি ধ্বংস করে দিয়ে তাকে হত্যা করে আসবো।শুধু দয়া করে তার নামটি বলে আমাকে হত্যা করার অনুমতি দিন।”
আসাদের কন্ঠে অানুগত্যের দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে। সে পারলে এক মূহুর্তের মধ্যে তাদের সমাজ প্রধানের পূত্র কে মুক্ত করে আনে শত্রুর কয়েদ থেকে!!
#পর্ব_১১
চারদিকে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আহমাদকে কাঁচের ঘরটা তে এখনো বন্দী করে রেখেছে রাশিদ বেগ। কিন্তু এখন সে আশেপাশে নেই। ঝড় বৃষ্টি কে যমের মত ভয় পায় সে।
অাহমাদ বুঝতে পারছে এখন রাশিদ বেগ তার কাছাকাছি নেই। কারণ সে যতোক্ষণ এখানে ছিলো, ততোক্ষণ আহমাদ এর দৃষ্টি শক্তি কে সে তার বদশক্তির মাধ্যমে দুর্বল করে রেখেছিলো।যেনো সে এই কাঁচের দেয়ালের বাহিরে কিছু না দেখতে পারে। কিন্তু এখন সে দূরে থাকাতে আহমাদ বাহিরের সব কিছু স্পষ্ট ভাবেই দেখতে পাচ্ছে।
আহমাদ বুঝতে পারছে, তাকে কোনো এক গহীন জংগলে আটকে রাখা হয়েছে। তার চারপাশে অনেক বড় বড় গাছ দেখা যাচ্ছে। সূর্যের অালো খুব কম পৌছাতে পারে এইদিকে।
এখনি পালানোর মোক্ষম সময়! আহমাদ মনে মনে ভাবতে থাকে। যদিও এই ঝড় বৃষ্টি তার জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
আহমাদ তার সমস্ত শক্তি দিয়ে কাঁচের দেয়াল ভেদ করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তার চেষ্টা বার বার বিফল হতে থাকে। আহমাদ আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।
অনিলার কথা মনে পরে যায় আহমাদের। অনিলা না জানি এখন কেমন আছে!
আহমাদ বুঝতে পারছেনা যে চাঁদ উঠে গেছে কি না। এমন কি এটাও বুঝতে পারছেনা এখানে কয়দিন ধরে আছে।
সে ভাবে, যদি এমন হয় চাঁদ উঠে গেছে আর আফসানাও কোনো কারণে অনিলার সাথে না থাকতে পারে তাহলে অনিলার জন্য এটা মারাত্মক কষ্টকর তো হবেই, আবার সে যখন বুঝে ফেলবে যে মানব সমাজে সে আর থাকতে পারবেনা তখন হয়তো অন্য কোনো জ্বীনদের অঞ্চলে চলে যেতে পারে। আবার রাশিদ বেগ তাকে কয়েদ ও করে ফেলতে পারে!
অাহমাদ অার কিছুই ভাবতে পারেনা! সে কাঁচের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে৷
#
আফসানা আর খাবরি আসাদ তাদের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এদিক টায় ঝড় থেমে গেছে। কিন্তু আকাশ এখনও পরিস্কার হয়নি।
অাফসানা চিন্তা করছে, চাঁদ আসমানে দেখা দিতে আর মাত্র দুইদিন বাকি। আহমাদ ভাই কে রাশিদ বেগের কয়েদ থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসতে হবে এই দু দিনের মধ্যেই। কিন্তু রাশিদ বেগ আহমাদ কে কোথায় কয়েদ করেছে আগে সেটা জানতে হবে। আফসানা ভাইকে উদ্ধার করার কৌশল আটছে মনে মনে।
— “আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমি কিছু বলতে চাই। ”
খাবরি আসাদ আফসানার ঠিক পেছনে দাড়িয়ে আছে।
–“বলে ফেলো যা বলতে চাও।”
–“অামাদের আগে জানতে হবে রাশিদ বেগ ছোট হুজুর কে কোথায় কয়েদ করেছেন।সেটা জানা হয়ে গেলে তাকে উদ্ধারের জন্য আমরা অতি দ্রুত বের হতে পারবো।”
–” নিজেকে এতো হুশিয়ার ভেবোনা। তোমার কি মনে হয় এই কথা অামি ভেবে দেখিনি?” আফসানা খাবরি আসাদের কথা পুরোপুরি না শুনেই তাকে ধমক দেয়।
–” জ্বি, আমি বুঝতে পারছি আপনি অবশ্যই এ ব্যাপারে ভেবেছেন। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি যে রাশিদ বেগের অাস্তানা কোথায় এটা জানার জন্য কোনো জ্বীন কে পাঠাবো কিনা? অামি এ ব্যাপারে আপনার অনুমতি চাচ্ছিলাম।”
খাবরি আসাদ আফসানা কে বুঝিয়ে বলে।
আফসানা মনে মনে ভাবে এটা খাবরি ঠিক ই বলেছে। এভাবে চিন্তা করে করে শুধু সময় নষ্টই হচ্ছে। তার চেয়ে ভালো কিছু সাধারণ জ্বীন সেবক দের সে পাঠিয়ে দিক ভাইজান কোথায় বন্দী হয়ে আছে, সেটা খুজে বের করতে। হাতে একদমই সময় নেই।
–“ঠিক আছে। তুমি কিছু জ্বীন সেবক দের পাঠিয়ে দাও। কিন্তু তাদের সতর্ক করে দিবে, যেনো এসব ব্যাপার কোনো ভাবেই প্রাসাদে না পৌছায়। আর যতো দ্রুত সম্ভব তারা যেনো ভাইজানের খবর আমাকে এনে দেয়।!”
–“আপনি একদম পেরেশান হবেন না। আমি কিছু শক্তিধর জ্বীন সেবক দের পাঠাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, ওরা ভোরের সূর্য উঠার আগেই ছোট হুজুরের খবর জানাবে।”
একথা বলে আসাদ উড়ে চলে যায়।
আফসানা ছাদে দাঁড়িয়ে অনিলার কথা ভাবে। অনিলার শরীরের হাল এখন নিশ্চয়ই বেশি ভালো না। সে উড়ে এসে অনিলার রুমের বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায়। আফসানা দেখে অনিলা ভীষন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বিছানার এপাশ ওপাশ করছে আর আল্লাহ কে ডাকছে।
আফসানার ভীষণ মায়া হয় অনিলাকে দেখে। সে চিন্তা করে অনিলার পাশে যেয়ে কিছুক্ষণ বসবে।কারন তার ভাইজান যদি পরে কখনো জিজ্ঞেস করে তার অনুপুস্থিতি তে সে অনিলার পাশে ছিলো কিনা, তখন অাফসানা কি জবাব দেবে?
আফসানা অনিলাদের বারান্দার কাঠের দরজা ভেদ করে তার পাশে যেয়ে বসলো। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আর সাথে সাথেই অনিলার গোঙানির শব্দ থেমে যায়।
অনিলার মনে হচ্ছে তার পাশে কেউ বসে আছে। তার কাছ থেকে খুব সুঘ্রাণ ভেসে অাসছে অনিলার নাকে। তার শরীরের তীব্র যন্ত্রণাও অনেক টা কম লাগছে। সে চোখ খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু হঠাৎ যন্ত্রনা কমে আসাতে তার দু’চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে। অনিলা সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরে।
আফসানা এখনো অনিলার পাশেই বসে আছে।সে অনিলার দিকে তাকিয়ে ভাবে, তার প্রিয় ফুফুজান সাবরিনের সাথে তার মেয়ে বিলকিসের চেহারার হুবহু মিল আছে। বরং সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, বিলকিস আরো বেশি রূপবতী হয়ে উঠছে তার মায়ের থেকে।
কিন্তু সে যে শুধু রূপবতীই হবেনা! সে হবে তাদের জ্বীন সমাজের মধ্যে অন্যতম ক্ষমতাধর জ্বীন কন্যা। কেননা তার মধ্যে জ্বীন এবং ইনসান এই দুই জাতির সমস্ত সত্তার গুণাগুণ রয়েছে।
কিন্তু বিলকিস তখনি পুরোপুরি ভাবে এইসব ক্ষমতার অধিকারী হবে যখন সে তাদের জ্বিন অঞ্চলের কোনো ক্ষমতাধর জ্বীন পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
আফসানার মাথায় হঠাৎ চিন্তা আসে, তার ভাইজান যে বিলকিস কে চল্লিশ দিনের শিশু অবস্থায় দেখে এতোটা বছর তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে, একথা তাদের দাদাজান, আব্বুজান বা আম্মি কেউই জানেন না। শুধু মাত্র আফসানা আর ওই রাশিদ বেগ ই জানে! একথা আফসানার মাথায় আসতেই সে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে যায়।
দাদাজান ব্যাপার টাকে কিভাবে নিবেন?এতোদিন এটা তার দেমাগে কেনো আসেনি?
আফসানা আবারো ভীষণ পেরেশানিতে পরে যায়।
#
খাবরি আসাদ তিনজন শক্তিশালী জ্বীন কে আদেশ করে আহমাদ বেগ কে খুজে বের করে আনার জন্য। এই তিন জন জ্বীনের তিনটি বিশেষ ক্ষমতা অাছে। এদের একজন তার বিকট আওয়াজের প্রতিধ্বনির মাধ্যমে সামনে থাকা যেকোনো অদৃশ্য বস্তুর অস্তিত্ব টের পায়।
তাদের অপর জন মাটি, সমুদ্র এবং বাতাসে লুকিয়ে থাকা যে কোনো বস্তুকে খুজে এনে দিতে পারে। আর আরেক জন যে কোনো কঠিন, তরল, বায়বীয় বস্তুর সাথে মিশে তার গুণাগুণ নষ্ট করে দিতে পারে।
খাবরি আসাদ ভেবে দেখলো এই তিনজন জ্বীন এর নজর থেকে আহমাদ বেগ কে কোথাও লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ভোরের অালো ফোটার অাগেই তারা অাহমাদ বেগের খবর এনে দিতে পারবে। আসাদ তাদের কে জ্বীন অঞ্চল থেকে উত্তর পূর্ব দিকে যাওয়ার হুকুম দেয়। কারণ ওদিক টায় জ্বীন এবং ইনসান উভয়েরই আনাগোনা খুব কম হয়। ওদিকেই কোনো ভাবে লুকিয়ে রাখা হতে পারে আহমাদকে।
#
আহমাদ অনেক্ষণ থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে কাঁচের দেয়াল ভেদ করার। এখনো রাশিদ বেগ কাছাকাছি আসেনি। বিদ্যূৎ চমকানো দেখে হয়তো কোনো গর্তের ভিতর লুকিয়ে আছে।আহমেদ চিন্তা করে, ঠিক এখনি যদি সে এখান থেকে বের হতে পারতো!
হঠাৎ আহমেদ দূর থেকে কেমন বিকট চিৎকার এর আওয়াজ শুনতে পায়। সে আওয়াজের উৎসের দিকে ভালো ভাবে তাকায়। সে দেখতে পায় তিনটি আগুনের হুল্কা আহমাদের কাচের ঘর দিকে ছুটে আসছে। সেই আগুন কাচের দেয়ালের সাথে খুব জোরে ধাক্কা খায়। আহমাদ চমকে গিয়ে পিছিয়ে যায়। সে তার চার পাশে তাকিয়ে দেখে কাঁচের দেয়াল আর নেই।
তার সামনে তিনজন জ্বীন দাঁড়িয়ে আছে। তারা আহমাদ কে সালাম দিয়ে জানায় তাকে উদ্ধার করার জন্য তার বোন আফসানার আদেশে খাবরি আসাদ এখানে পাঠিয়েছে।
আহমাদ আল্লাহর কাছে হাজার কোটি শুকরিয়া জানায়। সে আর একমুহুর্ত সময় নষ্ট না করে অনিলার কাছে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়।
যদি রাশিদ বেগ কোনো ভাবে টের পায় আহমাদ তার কবজা থেকে ছুটে গেছে তাহলে খুব ঝামেলা হয়ে যাবে। আহমাদ মনে মনে আফসোস করে রাশিদ বেগ কে এখান থেকে পাকড়াও না করতে পারার কারনণ। কিন্তু আহমাদ তাকে কোনো ভাবেই ছেড়ে দিবেনা!
খাবরি আসাদ কে খুব ভোরে ওই তিনজন জ্বীন এসে আহমাদ কে খুজে পাওয়ার সুখবর জানায়।
খাবরি আসাদ এই সুখবর আফসানাকে জানাতে যায়। সে যেয়ে দেখে আফসানা তার ঘরে চিন্তিতে মুখে বসে আছে।
(চলবে)
লেখাঃ সুমাইয়া জান্নাতি
জ্বীন_প্রতিবেশী
#পর্বঃ১২_ও_১৩_শেষ_পর্ব
খাবরি অাসাদ অাফসানার পাশে এসে দাঁড়ায়।আফসানা মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলো। আসাদের উপস্হিতি টের পেয়ে সে মুখ তুলে তাকায়।
–“ভাইজানের কোনো খবর পেয়েছো?”
–“জ্বি, অাপনার জন্য সুখবর অাছে। ছোট হুজুর কে খুঁজে পেয়েছি। উনি এখন মুক্ত। ইনশাআল্লাহ, আগামিকাল ভোরের মধ্যে ই তিনি এখানে পৌছে যাবেন।”
খাবরি আসাদের কথা শুনে আফসানার মুখ খুশিতে জ্বলে উঠে! কিন্তু সে ভাবে খাবরি আসাদ এই খবর পেলো কি ভাবে?
–“তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে যে ভাইজান রাশিদ বেগের কয়েদ থেকে মুক্তি পেয়েছে। যাদের কে পাঠিয়েছিলে তারা কি করে এতো জলদি খুজে পেলো?”
অাফসানা এখনো নিশ্চিত হতে পারছেনা।
–“আপনার অনুমতি পেয়ে আমি যাদের পাঠিয়েছিলাম তারা তিনজন খুব শক্তিশালী এবং দ্রুতগামী জ্বীনসেবক। বাতাসের সাথে মিশে তারা চলাচল করতে পারে। তাদের একজন আমাকে এই খবর দিয়ে গেছে।”
–“ওহ। আলহামদুলিল্লাহ। ভাইজান তাহলে আসছেন। কিন্তু রাশিদ বেগ কে কি পাকড়াও করতে পেরেছো?”
অাফসানা উৎক্ন্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করে আসাদ কে।
–“জ্বি না। সে আশেপাশে ছিলোনা। কিন্তু আমি দুজন জ্বীন সেবক কে সেখানে পাহাড়ায় থাকতে বলেছি। যেন রাশিদ বেগের উপস্হিতি টের পেলেই তারা তাকে ধরে প্রাসাদে নিয়ে যায়।”
খাবরি আসাদের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে আফসানা। আসাদ কে মনে মনে ধন্যবাদ জানায়।
#
আগামী কাল রাতের মধ্যেই চাঁদ উঠে যাবে। লাবনি ইসলাম এই কয়দিন অফিসে যাচ্ছেন না। সারাদিন শুধু কাঁদছেন। কারণ তার মেয়ে খুব কষ্টে আছে এখন। আর চাঁদ উঠার পর পরই অনিলা চিরদিনের মতো তাকে ছেড়ে চলে যাবে।
লাবনি ইসলাম মেয়ের কাছে যেয়ে বসেন। অনিলা এখন ঘুমাচ্ছে। এ কয়দিনে খুব সুন্দরী হয়ে গেছে সে। তিনি মেয়ের পায়ের দিকে তাকান। অনিলার দুই পা লম্বা হতে হতে বিছানার শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌছে গেছে।
লাবনি ইসলামের মনে আছে তিনি যখন অনিলার জন্য এই নতুন খাট বানিয়ে আনেন, তখন অনিলা রাগ করেছিলো, কারণ খাট টার দৈর্ঘ্য অনেক বেশি ছিলো বলে। তার মেয়ের নাকি এতো বিশাল বিছানায় শুতে ভালো লাগেনা।
লাবনি ইসলাম সেই দিনের কথা ভেবে হাসি দিয়ে চোখের পানি মুছেন। তিনি অনিলার হাত ধরেন। ভয়ানক শীতল হয়ে আছে দুই হাত। আর তুলার মতো নরম। লাবনি ইসলামের জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে মারাত্মক ভয় পেতো। কিন্ত তিনি পাননি। সেই কাগজ টায় লেখা আছে, অনিলার শরিরে এই সময় কি কি পরিবর্তন ঘটবে, লাবনি ইসলাম পড়েছেন সব।
অনিলা ধীরে ধীরে চোখ মেলে। ভীষণ যন্ত্রণায় তার চোখ দুটি ভারী হয়ে আছে। সে তার মায়ের দিকে তাকায়। মা হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মায়ের চোখ ফুলে আছে। মা কি কেঁদেছে নাকি? অনিলা নিজেকে জিজ্ঞেস করে।
লাবনি ইসলাম মেয়ের দু চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। গায়ে শিহরণ জাগানো সবুজ দুটি চোখ অনিলার। এতো দ্রুত তার চোখের রং পালটে যাবে লাবনি ইসলাম ভাবতে পারেন নি। তিনি মেয়ের চোখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন!
— “কি দেখছো মা? আমাকে খুব দূর্বল দেখাচ্ছে না?”
–” নাহ। তোকে খুব সুন্দর লাগছে।”
লাবনি ইসলাম মেয়েকে হেসে জবাব দেন।
–“আচ্ছা মা, এ কয়দিন সূর্য ডোবার সাথে সাথে আমার এমন লাগে কেনো? আজকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে চলো আমাকে।”
অনিলার কথা শুনে লাবনি ইসলামের বুক হাহাকার করে উঠে। তিনি মনে মনে ভাবেন, তার যেই কারণে এতো যন্ত্রণা হচ্ছে, এটা কমানোর জন্য কোনো ডাক্তার বা ঔষধ নেই।
–“তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
আজ আর কোনো লুকোচুরি নয়। অাজ এখনই লাবনি ইসলাম সব খুলে বলবেন অনিলা কে। সে কে, কী তার অস্তিত্ব, সব।
–” মা, আগে কিছু খেতে দাও। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। পরে তোমার সব কথা শুনবো। ”
মেয়ের কথা শুনে লাবনি ইসলামের খুব মায়া লাগে। আর একদিন আছে মেয়েটা তার কাছে।
আজ তাকে তিনি নিজ হাতে তুলে খাওয়াবেন যা খেতে চায় সে।
–“কি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে তোর মা? ঝাল কিছু বানিয়ে আনবো?”
ঝাল খাবারের কথা শুনে অনিলা কেমন লাফ দিয়ে উঠে।
–“না না মা, ঝাল কিছু দিও না। খুব মিষ্টি কিছু দাও। সেমাই বা জর্দা টাইপের।”
লাবনি ইসলাম জানতেন, জ্বীন রা মিষ্টি জাতীয় খাবার খুব পছন্দ করে। আজ সেটা নিজের চোখেই দেখলেন৷ তিনি অনিলার জন্য জর্দা বানাতে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। অনিলার খাওয়া শেষ হলেই তিনি আর দেরি করবেন না তাকে সব জানাতে।
অনিলা ভাবতে থাকে, আসলে তার আফসানাদের বাসায় খাওয়া সেই মিষ্টি গুলি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু মা কে তো এটা বলা যাবে না। কারণ মা ওদের কথা কিছুই জানেনা।
অনিলা আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে। সারা শরীরে এখনও খুব ব্যাথা তার। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায় সে।
ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় অনিলা তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে আয়নায় দেখে খুব জোরে চিৎকার দেয় । লাবনি ইসলাম চিৎকার শুনে দৌড়ে অাসেন।
–” কি হয়েছেরে।চিৎকার দিলি কেনো।”
অনিলার উচ্চতার কারনে লাবনি ইসলাম কে ঘাড় উচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে তার সাথে। লম্বায় ছয় ফুট ছাড়িয়ে গেছে অনিলা। তার পড়নের পোষাক গুলি খুবই ছোট হয়ে গেছে!
–“মা, আমার কি হয়েছে? আমি দেখতে এমন হয়ে গেছি কেনো?”
অনিলার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে এখনি কেঁদে দিবে।
–“আরেহ কিছু হয়নি। তুই ফ্রেস হয়ে আয়। আমি খাবার নিয়ে আসছি”।
লাবনি ইসলাম ইচ্ছা করেই মেয়ের সামনে থেকে সরে আসলেন। আজ আর কিছু লুকাবেন না তিনি। কোনো বাহানাও দেখাবেন না অনিলা কে। অনিলা নিজেই নিজের অস্বাভাবিকতা গুলোকে বুঝার চেষ্টা করুক। তাহলে লাবনি ইসলামের জন্যও অনেক সহজ হয়ে যাবে অনিলাকে সব কিছু বুঝানো।
অনিলা ভালো করে আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে। যদিও আয়নাটাতে নিজেকে দেখতে তার কিছুটা ঝুকে নিতে হচ্ছে। নিজের গালে হাত দেয় সে। কেমন নরম আর ঠান্ডা হয়ে আছে তার মুখ। অনিলা এবার নিজের চোখাচোখি হয় আয়নায়। সে দেখে তার চোখ কেমন সবুজ হয়ে আছে। সে তার হাত দিয়ে দুই চোখ স্পর্শ করে।অনিলা এবার খুবই চমকে যায়। তার চোখ দুটো খুব শীতল হয়ে আছে।কিন্তু অনিলার মনে হচ্ছে তার চোখের মতো আর কার যেনো চোখ সে দেখেছিলো একবার। কিন্তু সে মনে ক রতে পারেনা। অনিলা নিজের ডান হাত কে বা হাত দিয়ে ছুয়ে দেয়। সাথে সাথেই তার মনে পরে যায়, ঠিক এমনি স্পর্শ সে আফসানার কাছে পেয়েছিলো একদিন!! অনিলা খুব ভাবনায় পরে যায়।
লাবনি ইসলাম চুলায় জর্দা বসিয়ে নিজের ঘরে যান। আলমারি খুলে তার পুরোনো ডায়েরি টা বের করেন। আর সাথে সেই রেশমি কাপরের পুটলিটা। এটা তিনি কিছুক্ষন পর অনিলার হাতে দিবেন। এই ডায়েরিতে সবকিছু লিখে রেখেছেন তিনি। লাবনি ইসলাম তার ফোনটা হাতে নিয়ে “অনিলার বাবা” কে ডায়াল করেন।
#
অাহমেদের অার তর সইছেনা অনিলার কাছে জলদি পৌছানোর জন্য । সে জেনে গেছে নতুন মাসের চাঁদ এখনো উঠেনি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় সে। জলদি পৌছাতে পারলে ভালো হতো। আহমাদ মনে মনে ভাবে।
তার আরও প্রায় একশো বছর পার না হওয়া অবধি সে খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করার বিশেষ ক্ষমতা লাভ করতে পারবেনা।
অাহমাদ তার বোন অাফসানার কাছে শুনেছিলো তাদের অঞ্চলে জ্বীনদের হাতে বানানে মিষ্টি গুলো অনিলার খুব ভালো লেগেছে। অাহমাদ তাদের অঞ্চলের কাছাকাছি এসে তার রূপ পরিবর্তন করে অনিলার জন্য কিছু মিষ্টি কিনে নেয়।
#
লাবনি ইসলাম এক বাটি মিষ্টি জর্দা নিয়ে অনিলার রুমে আসেন। অনিলা এখনো আয়নাতে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। লাবনি ইসলাম হাতের বাটিটা টেবিলের উপর রাখেন।
–“আর কত নিজেকে দেখবি মা? আয়,জর্দা করেছি তোর জন্য, খেয়ে নে।”
লাবনি ইসলাম হাসি দিয়ে মেয়েকে কাছে ডাকেন।
–” যাই বলো মা, আমার কিন্তু নিজের এই পরিবর্তন খুব ভালো লাগছে।”
অনিলা আয়নায় তাকিয়ে নিজে নিজেই হাসতে থাকে।জর্দার বাটিটা টেবিল থেকে নিয়ে লাবনি ইসলামের হাতে দেয় সে।
–“আজকে তোমার হাতে খেতে ইচ্ছা করছে মা। খাইয়ে দাও প্লিজ। লাবনি ইসলাম হাসি মুখে মেয়ে মুখে খাবার তুলে দেন। তার খুব কান্না পাচ্ছে।কিন্তু তিনি নিজেকে শক্ত রাখছেন। অনিলার সামনে কিছুতেই কাঁদবেন না তিনি, যত কষ্টই হোক না কেন!
অনিলাকে খাওয়ানো প্রায় শেষ। এখনি সময় তার হাতে ডায়েরি টা দেয়ার। লাবনি ইসলাম তার ঘরে যান ডায়েরি টা নিয়ে আসতে।
#
আফসানা একটা চুড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে। চুড়িটার উপর অনেক সূক্ষ্ণ কারুকার্য করা। প্রতিটা কারুকার্যের মাঝে মাঝে খুব মূল্যবান পাথর বসানো। চোখ ধাঁধানো আলো বের হচ্ছে গয়নাটা থেকে।
সোলায়মান বেগ যখন আহমাদ আর আফসানাকে এখানে পাঠান তখন এই একজোড়া চুড়ি তাদের সাথে পাঠান তার নাতনি বিলকিসের জন্য। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেনন, বিলকিস যখন তাদের প্রাসাদে পৌছাবে তখন যেনো এই চুরিজোড়া তার হাতে পরা থাকে।
অাফসানা খুব ভয়ে ভয়ে চুড়িটার দিকে তাকিয়ে অাছে।কারন তার হাতে শুধু একটা চুড়ি। আরেকটা সে খুজে পাচ্ছেনা। কিন্তু আফসানা বুঝে ফেলেছে এই চুড়ির আরেকটা জোড়া কথায় আছে। রাশিদ বেগের নাম মাথায় আসতেই আফসানার মেজাজ বিগড়ে গেলো। যে ভাবেই হোক, প্রাসাদে পৌছানোর আগে তাকে খুঁজে বের করতেই হবে!
#
অনিলা মায়ের হাত থেকে ডায়েরি টা নিয়ে তার মাঝ বরারবর খুলে। লাবনি ইসলাম মেয়ের পাশে দাড়িয়ে আছেন। তার বুক ধক্ ধক্ করছে। তিনি বুঝতে পারছেন না, অনিলা সব কিছু জানার পর কী করবে!!
#পর্ব_১৩_ও_শেষ_পর্ব
অনিলা ডায়েরির একেক টা পেজ উল্টায় আর হাত দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছতে থাকে। সে যে একজন জ্বীনের বংশধর এই ব্যাপার টা না যত বেশি অবাক করেছে তাকে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে সে এটা জেনে যে তার এই মা, বাবা তাকে জন্ম দেননি।
অনিলার হাত কাঁপছে। সে আর পড়তে পারছেনা। অনিলা ডায়েরি টা হাতে নিয়ে তার মায়ের রুমে যায়। লাবনি ইসলাম মেয়েকে ডায়েরিটা পড়তে দিয়ে নিজের রুমে চলে গিয়েছিলেন। অনিলা মায়ের কাছে যেয়ে দেখে তিনি তার রকিং চেয়ারে বসে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছেন। তার গাল বেয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অনিলা মায়ের সামনে হাঁটু গেরে বসে মায়ের কোলে মাথা রাখে। লাবনি ইসলাম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। দু জনের মুখেই কোনো কথা নেই। চারপাশে শুধুই নীরবতা!
অনেক্ষন পর অনিলা মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকায়। এখনও মায়ের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। অনিলা মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
–” মা,আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবনা। আমি তোমার সাথেই থাকবো। অনিলা মায়া ভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
–“বোকা মেয়েটা অামার, তোকে যদি অামার সাথে এখন রাখা যেতো, তাহলে কি আমি কোথাও যেতে দিতাম তোকে , বল মা? কিন্তু তোকে যে যেতে হবে, তোর জাতির কাছে।
যেই সমাজে তোর জন্ম। এটাই তোর জন্য সবচেেয়ে উত্তম হবে মা।”
লাবনি ইসলাম কান্নামাখা কন্ঠে বললেন।
–” কিন্তু মা, আমি কোথায় যাবো? আমিতো কিছুই জানিনা এসবের? আমি কোথা থেকে এসেছি, আমার বাবা মা কে? কোথায় আমার ঠিকানা?”
অনিলার কথা শুনে লাবনি ইসলামের মনে পড়ে যায় তার বাবা মারা যাওয়ার সময়ের কথা। লাবনি ইসলামের বাবা যখন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন তিনি তার বাবাকে অনিলার বাবা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি শুধু এত টুকুই বলেছেন, অনিলার যখন যাওয়ার সময় হবে মানুষের সমাজ থেকে, তখন যেনো লাবনি ইসলাম তাকে যেতে দেয়। অনিলা সব ব্যাপার আগে থেকেই নাকি ব্যবস্থা করা আছে।
লাবনি ইসলামের বাবা এতো টুকু বলেই আর কিছু বলতে পারেন নি। তিনি তার পর পরই ইন্তেকাল করেন।
অনিলা মায়ের সাথে কথা সময় খেয়াল করলো তার শরীর আবার খারাপ হয়ে আসছে। লাবনি ইসলাম ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তিনি মেয়েকে ধরে আস্তে আস্তে তার রুমের দিকে নিয়ে গেলেন। অনিলা রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পরলো।
#
অাহমাদ বাসায় পৌছে গেছে। ভাই কে এতোদিন পর দেখে আফসানা আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়েছে। আহমাদ বোনের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে বলল, –“বোন, তুই জ্বীন সেবক দের আমাকে খুজতে পাঠিয়ে খুব ভালো করেছিস। আর ভালো হয়েছে প্রাসাদে কিছু জানাস নি। আমিতো ভেবেছিলাম আর কোনোদিন হয়তো কারো সাথে দেখা হবেনা।”
–” ভাইজান, আমিও খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আপনি ফিরে আসছেন না দেখে।ভাগ্যিস, অাব্বু জান খাবরি আসাদ কে পঠিয়েছিলেন।না হলেতো আমি বুঝতেই পারছিলাম না যে কি করবো!”
অাফসানা বাতাসে ভাসতে ভাসতে আহমাদ কে বলে। কিন্তুু ভাইজান, রাশিদ বেগ কি আপনাকে কিছু বলেছে? কেনো কয়েদ করেছিলো অাপনকে?
–“কেনো আবার? সেই আগের কাহিনী তার।আমি না থাকলে আমাদের পরিবার থেকে পরবর্তী সমাজ প্রধাণ তো ওই হবে। কিন্তু এবার সে সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো। বলেছিলো, নতুন চাঁদ উঠার সাথে সাথে আমাকে আগুনে জ্বালিয়ে মারবে!”
ভাইয়ের কথা শুনে আফসানার কলিজা কেঁপে উঠে।
–“ভাইজান, আপনি এখন আর চিন্তা করবেন না। খাবরি আসাদ দুজন জ্বীন সেবকদের হুকুম দিয়েছে ওই বদমাশ কে পাকড়াও করে প্রাসাদে নিয়ে যেতে।
কিন্তু ভাইজান, একটা সমস্যা হয়ে গেছে।দাদা জান যে দুটো চুরি দেয়েছিলেন বিলকিস কে দেয়ার জন্য, সেখান থেকে একটা গায়েব!
আফসানার কথা শুনে আহমাদ অবাক হয়ে গেলো। ওই চুরি জোড়া লাগবেই। না হলে বিলকিস প্রাসাদে প্রবেশ করতে পারবেনা। খুব ঝামেলা হয়ে যাবে।
–“কি বলিস?কোথায় যাবে খুজে দেখিসনি?”
–” খোজা লাগবেনা ভাইজান।কারন চুড়িটা চুরি করে নিয়ে গেছে রাশিদ বেগ।”
এবার আহমাদের ভীষন রাগ উঠে যায়। তার চোখ সবুজ হয়ে জ্বলতে থাকে। এসে ভাবতে থাকে, এবার আর ছাড় দিবেনা রাশিদ বেগ কে। না কোনো ক্ষমা, না তো যাবজ্জীবন দন্ড। এবার রাশিদ বেগ কে মরতেই হবে!
লাবনি ইসলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।আকাশ আজ একদম পরিস্কার। মেঘের ছিটে ফোটাও নেই। কে বলবে দুদিন আগেও ঝড় হয়েছিলো। তিনি দেখছেন কখন চাঁদ উঠবে।চাঁদ উঠলেই অনিলা কে নতুন পোষাক পড়িয়ে দিবেন। আগের গুলিতো এখন আর পড়তে পারবেনা। তিনি মনে মনে ভাবলেন, আচ্ছা, জ্বীনরা কি জামা কাপড় পরে? নিজের প্রশ্নে নিজেই হাসেন লাবনি ইসলাম।
#
আহমাদ আর আফসানা ছাদেে ট্যাংকির উপর বসে আছে। আর কিছুক্ষণ পর ই চাঁদ উঠবে।আহমাদ এর মাঝে একবার অনিলা কে দেখে এসেছিলো। কিন্তু অনিলার যন্ত্রনা মাখা মুখ দেখে আহমাদ খুব কষ্ট পাচ্ছিলো। তাই আফসানা ভাইকে ছাদে নিয়ে আসে।
–“ভাই, তোমার এতো দিনের প্রতীক্ষা তাহলে শেষ হতে যাচ্ছে!”
আফসানা দুষ্ট হাসি দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়।
–” এখনো অনেক কাজ বাকি আছেরে! বিলকিস আমাদের সাথে কিভাবে মানিয়ে নিবে,দাদাজান কে কিভাবে জানাবো আমার পছন্দের কথা?”
আহমাদের মুখে চিন্তার ছাপ।
–“হ্যা ভাইজান। আপনি যখন এখানে ছিলেন না তখন আমিও ভেবেছিলাম এই ব্যাপারে।
–” বিলকিস কে প্রাসাদে নেয়ার পর আরো এক টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অাছে।”
অাহমাদ মুচকি হেসে বোনের দিকে তাকায়।
অাফসানাও হাসি দিয়ে মাথা নাড়ে। এই মাথা নাড়ানোর অর্থ হচ্ছে সে জানে গুরুত্বপূর্ণ কাজ টা কি!
#
লাবনি ইসলাম মেয়েকে খুব সুন্দর একটি সাদা পোষাক পড়িয়ে দিলেন। তাকে দেখতে রাণীর মত লাগছে।
অনিলার কোনো হুশ নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব গভীরঘুমে তলিয়ে অাছে। কিন্তু কিছুক্ষন পর পর যন্ত্রণায় কাতরে উঠছে সে।
লাবনি ইসলাম এখনো কান্না করেই যাচ্ছেন। তিনি অনিলার রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন।হঠাৎ তার মনে হলো তার পুরো বাসা খুব মিষ্টি একটা সুবাসে ভরে গেছে। লাবনি ইসলাম চোখ মুছে একটা হাসি দিলেন। তিনি বুঝতে পারছেন অনিলার যাওয়ার সময় একদম ঘনিয়ে এসেছে। তিনি হাসি মুখে মেয়েকে বিদায় জানাতে চান।
আহমাদ আর আফসানা অনিলার দু পাশে বসে আছে। অনিলাকে সাদা পোষাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আহমাদের ইচ্ছা করছে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অনিলার দিকে এর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু ছোট বোন পাশে থাকাতে লজ্জায় সে তাকাতে পারছেনা
#
অনিলার যন্ত্রণা বেড়েই চলছে। খুব ছটফট করছে সে। একটু পর পর চোখ মেলছে । যন্ত্রণাতে তার দুই চোখ থেকে সবুজ রঙ এর আগুনের হলকা বের হচ্ছে!
আহমাদ আর আফসানা অনিলার দুই হাত শক্ত করে ধরে আছে। চাঁদ ডুবে যাওয়ার সাথে সাথেই অনিলার সব কষ্ট, যন্ত্রণা দূর হয়ে যাবে।
আহমাদের খুব খারাপ লাগছে অনিলার এই অবস্থা দেখে। কিন্তু পরক্ষণেই এই ভেবে ভালো লাগছে তার যে, আর কিছুক্ষণ পরই অনিলা তাদেরই একজন হয়ে যাবে।
আহমাদ এক হাতের তার বাঁশিটা বের করে বাজাতে থাকে। কারণ সে জানে এই বাঁশির সুর অনিলার খুবই পছন্দের।
অনিলা দেখতে পাচ্ছে দুজন মানুষ অনেক দূর থেকে হেটে আসছে তার দিকে। কিন্তু তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছেনা। তাদের একজনের হাতে সুন্দর একটা বাঁশি। সে খুব মোহনীয় সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে। তারা দুজন অনিলার আরো কাছাকাছি চলে আসে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকছে তারা অনিলা কে। অনিলা তাদের মুখ দেখার চেষ্টা করছে। তারা অনিলার হাত ধরে ফেলে।আর সাথে সাথেই তাদের চেহারা স্পষ্ট হয় অনিলার কাছে।এতো আহমাদ আর আফসানা!!
অনিলার চোখ খুলে যায়। তার মাথা খুব হালকা হালকা লাগছে। পুরো ঘর অন্ধকার।
অনিলার মনে হচ্ছে তার দুপাশে দুজন বসে আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো তার একদম ভয় লাগছেনা!! ধীরে ধীরে অনিলার সামনে সব স্পষ্ট হয়ে আসে। যদিও কোনো অালো নেই। অনিলা তাকিয়ে দেখে তার বাম পাশে আহমাদ বসা। সে তার হাত ধরে আছে। অনিলা লজ্জা পেয়ে যায়। সে তাড়াতাড়ি তার হাত ছাড়িয়ে নেয় আহমাদের হাত থেকে। ডান দিকে তাকিয়ে দেখে আফসানা বসা। তারা দুজনই তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
অনিলার আর বুঝতে কষ্ট হলোনা তারা কে
এবং তারা দুই জন এখানে কেনো এসেছে। সে উঠে বসে। এখন শরীর একদম ঝরঝরে। কোন যন্ত্রণা নেই।
–“সু-স্বাগতম অাপনাকে অামাদের জ্বীন সমাজে।”
অাফসানা হাসি দিয়ে অনিলাকে বলে।
–“ধন্যবাদ।”
অনিলা ছোট করে জবাব দেয়।
আহমাদ এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।অনিলার খুব লজ্জা লাগছে। সে মনে মনে চাচ্ছে আহমাদ যেন এখান থেকে চলে যায়।
ভাগ্যিস, জ্বীন দের মনের কথা অন্য জ্বীনরা বুঝতে পারেনা!
–“আপনার নানাজান আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনাকে এখন আমাদের সাথে যেতে হবে।”
অবশেষে আহমাদ মুখ খুলল।
–
-“কোথায় যেতে হবে অামাকে?”
অনিলা জিজ্ঞেস করে।
–“অনেক দূরে। যেখানে এই মিষ্টি গুলি পাওয়া যায়।”
অাফসানা হাসি দিয়ে আহমাদের নিয়ে আসা মিষ্টি গুলি অনিলার সামনে এনে রাখে।
অনিলার মিষ্টি গুলো দেখে অবাক হয়ে যায়।তার তো এই মিষ্টি গুলি খেতে খুবই ইচ্ছা করছিলো। সে অাল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানিয়ে একটা মিষ্টু মুখে দেয়।
–“ভাইজান আপনার জন্য মিষ্টি গুলি এনেছেন। তাকে একটা ধন্যবাদতো দিন।”
আফসানার দুষ্টমি দেখে লজ্জায় অনিলার দুই গাল লাল হয়ে যায়। আহমাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
–“আমি যাওয়ার আগে আমার মায়ের সাথে দেখা করতে চাই।”
অনিলা আফসানার দিকে তাকিয়ে বলে।
–“ঠিক আছে।আপনি তার সাথে দেখা করে আসুন। আমরা অপেক্ষা করছি।”
আফসানা অনিলাকে মায়ের সাথে দেখা করে আসতে বলে।
অনিলা বিছানা থেকে তার রুম নেমে লাবনি ইসলামের ঘরের দিকে যায়। তার নিজের শরীরটা খুব হালকা লাগছে। অনিলার মনে হচ্ছে সে বাতাসে ভেসে ভেসে হাটছে!!
লাবনি ইসলাম এখনো বাড়ান্দায় বসে আছেন। অনিলা মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
–“মা,আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ওরা আমাকে নিতে এসেছে।”
অনিলা অঝোরে কান্না করছে। কিন্তু লাবনি ইসলাম নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছেন। মেয়েকে বিদায় দিতে হবে।
–“যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস মা।”
লাবনি ইসলাম জোর করে গলায় কান্না অাটকে রাখার চেষ্টা করন।
–“মা,তুমি একা থাকবে কি করে? তোমার কষ্ট হবেনা?”
অনিলার কথা শুনে লাবনি ইসলাম হেসে বলেন,
–“কালকে তোর বাবা আসছেন দেশে।এখন থেকে আমরা একসাথেই থাকবো।”
লাবনি ইসলামের কথা শুনে অনিলা শান্তি পায়। সে বুঝতে পেরেছে আশরাফ হোসেন এতোদিন কেনো দেশের বাইরে ছিলেন।
–” বাবার সাথে দেখা করা হলনা আর।” অনিলা আক্ষেপের সুরে বলে। লাবনি ইসলাম মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। তার মনে হলো যেনো তিনি খুব নরম কিছুকে ধরেছেন, যার দেহে কোনো হাড় নেই!
— “আমি আসি মা। নিজের খেয়াল রেখো। কখনো সুযোগ পেলে তোমাদের এসে দেখে যাবো।” অনিলে বের হতে নেয়।
— “একটু দাড়া মা।”
লাবনি ইসলাম পেছন থেকে ডাকেন। তিনি অনিলার সামনে যেয়ে তার বাহুতে বাধা তাবিজের সুতলি টা খুলে দেন। অনিলা একটা হাসি দিয়ে চোখের পানি মুছে বেরিয়ে যায়।
আহমাদ, অনিলা আর আফসানা বাতাসে ভাসছে। অনিলা হঠাৎ হঠাৎ পড়ে যেতে নেয়। এসবে অভ্যস্ত হতে আরো সময় লাগবে তার।
আফসানা বক বক করেই চলছে। এখন থেকে অনিলা কে কি করতে হবে, কিভাবে চলতে হবে, কি কি খেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু
আহমাদ বেশ চুপচাপ। সে শুধু কিছুক্ষণ পর পর অনিলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিচ্ছে।
— “ভাইজান,আমরা কিন্তু উনাকে আর অনিলা নামে ডাকতে পারবো না। দাদাজানের দেওয়া নামেই ডাকতে হবে।”
আফসানা হাসতে হাসতে আহমাদ কে বলে। আহমাদ বোনের কথায় সায় দেয়।
–” নানাজান কি নাম রেখেছিলেন অামার?”
–“বিলকিস।”
অাহমাদ খুব খুব নিচু স্বরে বলে।
–” আপনি কি জানেন, বিলকিস কার নাম ছিলো?”
আফসানা অনিলাকে জিজ্ঞেস করে। অনিলা মাথা নাড়ে, সে জানেনা।
অনিলার পেছন থেকে আহমাদ ইশারা করে আফসানাকে। যেনো সে এখন চুপ থাকে। অনিলাও আর কিছু বলেনা। সে কিছু কিছুক্ষণ পর পর আড় চোখে অাহমাদ কে দেখে। অার দু’জনের চোখা চোখি হলেই অনিলা খুব লজ্জায় পরে যায়!
আহমাদরা প্রাসাদের কাছাকাছি চলে এসেছে।কিন্তু এখন ওরা প্রবেশ করতে পারবেনা সেখানে। কারণ অনিলা মানে বিলকিসের চুড়িটা নেই সাথে। খাবরি আসাদ এর এখানে থাকার কথা।
আফসানা কিছুক্ষণ পর দেখলো অনেক দূর থেকে বাতাসের সাথে মিশে কয়েকজন জ্বীন সেবক অাসছে। তাদের সাথে আসাদ কেও দেখা যাচ্ছে।
–“ভাইজান দেখেন। খাবরি আসাদ আসছে।তার সাথে আরো ক’জন আছে।”
আহমাদ তাকিয়ে দেখে যে দুজন জ্বীন সেবক তাকে মুক্ত করেছিলো তারা রাশিদবেগ কে ধরে নিয়ে আসছে। তার ঠোঁট অাগুন দিয়ে সেলাই করা। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে সে।
অনিলা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের একজন কে তার অনেক পরিচিত লাগছে।
–” আরেহ কেয়ারটেকার চাচা! আপনি এখানে।”
অনিলার মুখ হা হয়ে আছে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই লোকটাও যে জ্বীন। রাশিদ বেগ অনিলার দিকে জ্বল জ্বল সবুজ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আর তখনই অনিলার মনে পড়ে যায়, সে একদিন এই জ্বীনলোক টার চোখ দেখে এতো ঘাবড়ে গিয়েছিলো।
–“এ কোনো কেয়ারটেকার নয়। এ রাশিদবেগ। যাকে আমরা আপন চাচাজানের মত সম্মান করতাম। আর সে আমাদের কত ক্ষতি করতে চেয়েছিলো। ভাইজান কে প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছিল এই বদজ্বীন।” অাফসানার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে।
–“থাক বোন। এখানে আর সময় নষ্ট না করি। অাব্বুজান একে কঠিন শাস্তি দিবেন।”
–“ঠিক বলেছেন ভাই।”
আফসানা খাবরি আসাদের দিকে তাকায়। সে হাতে সেই চুড়িটা ধরে আছে। আফসানা আর কথা না বাড়িয়ে চুড়িটা নিয়ে অনিলার হাতে পড়িয়ে দেয়। অনিলা চুড়ি দুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এতো সুন্দর গয়না সে অাগে কখনো দেখেনি!
#
অনিলার সামনে বিশাল বড় একটা প্রাসাদ। খুবই সুন্দর দেখতে। প্রতিটা দেয়াল থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। প্রাসাদের সামনে খুব সুন্দর একটা ফুলের বাগান। সেখানে নানা রকম ফুল ফুটে আছে। এসব ফুলের নাম অনিলার জানা নেই।প্রাসাদের বাহিরে কিছু ফুটফুটে বাচ্চারা খেলছে। কিন্তু অনিলা কে দেখে সবাই খেলা থামিয়ে তাকিয়ে আছে। অনিলার কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছে।
–” আপনি ভয় পাবেন না। এখন থেকে এটাই আপনার ঠিকানা।”
আহমাদ অভয় দেয়। অনিলা আহমাদের দিকে তাকিয়ে ভাবে, ছেলেটা এতো সুন্দর করে কিভাবে কথা বলে!
অাফসানা প্রাসাদের ভেতরে গেছে আহমাদ আর অনিলাকে বাহিরে রেখে। খাবরি আসাদ একটা কাঁচের ঘরে রাশিদ বেগকে বন্দী করে রেখেছে। সোলায়মান বেগ এবং তার ছেলে সালমান বেগ এর বিচার করবেন।
অনিলা প্রাসাদের মুখ্য দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে মানুষ আকৃতির অনেক মহিলা আর পুরুষ দাড়ানো। তাদের মধ্যে থেকে দুজন অনিলার দিকে এগিয়ে আসছে। আহমাদ এখনো অনিলার পাশেই আছে।
–“সু-স্বাগতম তোমাকে। তুমি কেমন অাছো বিলকিস?”
তাদের মধ্যে একজন ভীষণ সুন্দরী মহিলা অনিলাকে জড়িয়ে ধরলো। তার কাছ থেকে সুন্দর ঘ্রাণ আসছে অনিলার নাকে। অনিলা কিছু না বলে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
–“উনি আমাদের দাদিজান। সালাম দিন উনাকে।”
আহমাদ মুচকি হেসে অনিলাকে ফিসফিসিয়ে বলে। সালাম বিনিময় করে মহিলা দু’জন তাকে প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে যান। অনিলা বুঝতে পারলো এদের একজন নিশ্চয়ই আহমাদ আর আফসানার আম্মিজান।
প্রাসাদের ভেতরটা অনিলা মুগ্ধ দেখতে থাকে। বিশাল বড় একটা ঝর্ণা এখানে। কিন্তু ঝর্ণা থেকে কোনো পানি পড়ছেনা। বিভিন্ন রকমের মনি মুক্তা ঝরে পড়ছে সেখান থেকে।
পুরো প্রাসাদ জুড়ে সুন্দর সুন্দর আসবাব।ভারী ভারী পর্দা। দামী কার্পেট। একেক টা জিনিস থেকে একেকটা জিনিস সুন্দর। অনিলা বুঝতে পারেনা সে কী রেখে কী দেখবে!!
আফসানা অনিলাকে আরেকটি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে বিশাল পালংকের উপর একজন নুরানী চেহারার বৃদ্ধ আধশোয়া হয়ে আছেন।
–“উনি আমাদের দাদা জান। আপনি উনার আদরের নাতনি। উনার কাছে যান। উনি অধীর আগ্রহে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
আফসানা অনিলাকে সোলায়মান বেগের কাছে এগিয়ে দেয়। আহমাদ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে তার দাদাজানের সামনে যেতে লজ্জা পাচ্ছে।
–“কাছে এসো আমার আদরের নাতনি।”
নানা সোলায়মান বেগের কন্ঠ শুনে অবাক হয়ে যায় অনিলা। বৃদ্ধ বয়সেও এতো ভরাট কন্ঠ!!
অনিলা তার পাশে যেয়ে বসে। সোলায়মান বেগ অনেক কথা বলেন। কিছুক্ষণ পর সালমান বেগও আসেন তার পিতার কাছে।
#
সোলায়মান বেগের কক্ষে এখন প্রায় সবাই আছেন। তিনি একে একে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অনিলার সাথে। কিন্তু অনিলার মনে তার নিজের পিতা মাতার চিন্তা ঘুরছে। তারা এখন কোথায় আছে? অনিলার সাথে কি তাদের দেখা হবেনা?
আফসানা অনেক গুলি খাবার নিয়ে অনিলার সামনে আসে। এখানে মহিলাদের মধ্যে সবাই আছে। কিন্তু অনিলার এখন খেতে ইচ্ছা করছেনা। সে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।
হঠাৎ একজন মহিলার কথা কানে আসে তার। সে বলছে, সোলায়মান বেগ নাকি কিছুদিন আগেই পুরো সমাজে ঘোষণা দিয়েছেন অনিলাকে বিয়ে করবে এমন শক্তিশালী জ্বীন পুরুষের জন্য। কিন্তু কেও নাকি রাজি হচ্ছেনা।কারন সে অর্ধমানব! তাদের সবার মতো তার মাতা বাবা দুজনই জ্বীন নয়।
অনিলার কাছে এবার সব কিছু পানির মতো পরিস্কার হয়ে।
কিন্তু কথাটি কানে আসার পর অনিলার খারাপ লাগে। কারণ সে এখন তার জীবনসঙীর জায়গায় আহমাদকে ছাড়া কাউকে দেখতে চায়না। কিন্তু আহমাদ কি এমন কিছু ভেবেছে অনিলাকে নিয়ে? অনিলা তার আশেপাশে আহমাদ কে খুঁজে। কিন্তু সে এখানে নেই। অনিলার প্রচুর অভিমান হয় অাহমাদের উপর!
আহমাদ তার দাদা সোলায়মান বেগের পাশে বসে আছে। সালমানবেগ ও আছেন। রাশিদ বেগের সমস্ত বদ কীর্তি বাবা আর দাদার কাছে খুলে বলেছে আহমাদ। সোলায়মান বেগ খুব মনে কষ্ট পেলেন এসব শুনে। তিনি ভেবেছিলেন রাশিদ বেগ শুধরে গেছে। কিন্তু এখন তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তিনি সোলায়মান বেগ কে বললেন রাশিদ বেগ কে যেনো সে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। সমাজ প্রাধাণের পুত্র কে হত্যার চেষ্টা করা গুরুতর অপরাধ। এর কোনো ক্ষমা নেই।
সালমান বেগ তার পিতাকে জানালেন, চাঁদ পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে রাশিদ বেগের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ কার্যকর করতে হবে। কিন্তু আরো দুটি বিশেষ কাজ এই দিনেই করতে হবে। কারণ অমাবস্যা শুরু হয়ে গেলে জ্বীন সমাজের বিশেষ কার্যক্রম গুলি করা যায়না, একেবারে নিষেধ।
সালমানবেগের কথা শুনে তার পিতা চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই পূর্নিমাতে তার একমাত্র নাতি আহমাদ বেগ পরবর্তী সমাজ প্রধাণের দায়িত্ব নিবে। কিন্তু জ্বীন সমাজের নিয়ম অনুযায়ী সমাজ প্রধাণ কে বিবাহিত হতে হয়।
অার তার নাতনীর জন্য এখনও কোনো ক্ষমতাশালী জ্বীন পুরুষ বিয়ের জন্য এগিয়ে আসেনি। সোলায়মান বেগ কি করবেন ভেবে পাননা!
অনিলা কে একটা আলাদা কক্ষ দেয়া হয়েছে।খুবই সুন্দর তার এই নতুন ঘর। কি নেই এখানে!
অনিলা তার ঘরে এসে আরাম করছে। তার চোখ ঘুমে লেগে আসছে। কিছু একটার শব্দে অনিলার চোখ খুলে যায়। সে তাকিয়ে দেখে আহমাদ তার পালংকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আহমাদ একটি কালো পাঞ্জাবি পড়া। মাথায় কালো রঙের পাগড়ি বাধা। চোখে হালকা সুরমা লাগানো তার। আহমাদকে দেখে অনিলার মনে হচ্ছে সে যুগ যুগ ধরে যেনো এই পুরুষটি কে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলো।
আহমাদ হালকা কাশি দিলো। অনিলা নিজের বোকার মত চেয়ে থাকার কারণে লজ্জা পেয়ে গেলো। সে তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। এবার তার উচ্চতা অনেকটা আহমাদের মত ই!
আহমাদ মুখ খুলে কিছু বলার জন্য৷
-” আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।” আহমাদ একথা বলে অনিলার কক্ষের দরজার দিকে তাকায়। আর সেটা সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায়।
–“আমি আপনাকে তখন থেকে আমার জীবন সঙিনী করতে চাই যখন থেকে আপনার বয়স চল্লিশ দিন। আমি আপনাকে ছাড়া কোনোদিন কোনো জ্বীন বা ইনসান মেয়েকে কল্পনাও করিনি। আমি জানিনা আপনি আমার ব্যপারে কি ভাবছেন।”
এত টুকু বলে আহমাদ থেমে গেলো।
তার মনে হলো কেউ যেনো কক্ষের বাহির থেকে তাদের কথা শুনেছে। অনিলা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাস হচ্ছেনা, যাকে সে এতোটা চায়, সেই ব্যাক্তি বহু অাগে থেকেই তার প্রেমে পড়ে আছে!
অনিলার মনটা খুশিতে ভরে যায়। সে আহমাদের দিকে তাকায়। আহমাদ বড় বড় চোখ করে অনিলার দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু অনিলা কিছু বলছেনা।
–” কিছু বলছেন না যে?”
আহমাদের কন্ঠে এবার ভয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সে ভয় পাচ্ছে অনিলা যদি না করে দেয়!
–“আমার ভাবতে হবে এ বিষয়ে। অামি এতো দ্রুত কোনে সিদ্ধান্ত নেই না কখনো।”
অনিলা গম্ভির ভাব নিয়ে আহমাদ কে উত্তর দেয়। আহমাদের মুখ কালো হয়ে যায়।
–” ঠিক আছে।আপনি সময় নিন।”
আহমাদ মুখ ভার করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
অনিলা মনে মনে ভীষন হাসছে। সে নিজেইতো অাহমাদের জীবনসঙী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু মেয়েদের কি এতো জলদি হ্যা বললে চলে!!
আহমাদ জেনে গেছে, তার দাদা সোলায়মান বেগ অনিলার জন্য জ্বীনপাত্র খুঁজছেন। এবং তাকেও বিয়ে করাবেন খুব দ্রুত। সব মিলিয়ে আহমাদের মন খুব খারাপ হয়ে অাছে। অনিলা যদি তাকে বিয়ের জন্য রাজি না হয়, সে অার কোনো দিন বিয়ে করবেনা।
আফসানা তার ভাইয়ের কক্ষে অাসে। ভাইয়ের মন খারাপের ব্যপারে জিজ্ঞেস করে। আহমাদ বোন কে সব বলে। অনিলার কথা শুনতেই আফসানা হাসিতে ভেংগে পড়ে। সে ভাই কে বুঝায় যে অনিলাও তাকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু কোনো মেয়েই এসব ব্যাপারে এত দ্রুত হ্যা বলবেনা। সে ভাইকে শান্তনা দেয়। আফসানা ভাই কে জিজ্ঞেস করে,
–“আচ্ছা ভাইজান, যদি এমন হয় জ্বীন সমাজ যদি বলে,আপনি বিলকিস কে বিবাহ করলে সমাজ প্রধাণ হিসেবে দায়িত্ব পাবেন না। তখন কি করবেন। হুম?
–“অবশ্যই আমি বিলকিস কেই বিবাহ করবো। কারন শরীয়তের দিক থেকে তাকে বিয়ে করতে কোনো রকম বাধা নেই।”
অাহমাদ সাথে সাথে উত্তর দিলো।
–” তাছাড়া আমার সমাজ প্রধান হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। অামি শুধু বিলকিসকে তার পিতা মাতার সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য সমাজ প্রধান হতে চাই। ইন শা অাল্লাহ, আমি প্রধাণ হলেই তাদের কয়েদ থেকে মুক্ত করে দিবো। অনিলাকে আর আর মাতা পিতার স্নেহ হতে বঞ্চিত হতে হবেনা।”
ভাইয়ের কথা শুনে আফসানার চোখে পানি এসে যায়। যেভাবেই হোক, সে তার ভাইয়ের সাথেই অনিলার বিবাহ করিয়ে দিবে।
#
আজ ভরা পূর্নিমা। অাহমাদ অার অনিলা সমুদ্রের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। তারা দু’জনে দুজনের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। আজ দুপুরেই তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।
সোলায়মান বেগ প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু পরে আফসানা তাকে খুব করে বুঝিয়েছে, বিলকিসের জন্য আহমাদ বেগের চেয়ে ভালো এবং শক্তিশালী জ্বীন পুরুষ অার কোথাও পাওয়া যাবেনা। সোলায়মান বেগ এবং নার্গীস বেগও আর কোনো দ্বিমত পোষণ করেন নি।অার আহমাদের দাদীজান তো খুব খুশি এই বিয়েতে।
রাশিদ বেগের মৃত্যু দন্ড আরো কয়েকদিন অাগেই কার্যকর হয়ে গেছে। তাকে তার বেইমানির সঠিক শাস্তি দিয়েছেন সালমানবেগ এবং তার পিতা সোলায়মান বেগ।
রাশিদ বেগের মৃত্যুর পর অাহমাদ সমাজ প্রধাণের দায়িত্ব গ্রহন করে। দায়িত্ব পাওয়ার পর সবার আগে সে তার ফুফু সাবরিন আর তার মানব স্বামী শোয়েবকে কয়েদ থেকে মুক্ত করে। সাবরিন তার কন্যাকে পেয়ে সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়। সোলায়মান বেগ তার মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে তার কাছেই রেখে দেন৷
অনিলা খিল খিল করে হাসছে। সে আহমাদের হাত ছেড়ে দিয়ে উড়ে উড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। আহমাদ তাকে আবার শক্ত করে ধরে ফেলছে। আহমাদ তাকে দুষ্টমি বলছে,
–“আপনার এতো বড় দুঃসাহস! আপনি জ্বীন প্রধানের কয়েদ হতে পালিয়ে যাচ্ছেন!”
আহমাদের এই কথা শুনে অনিলার হাসি আরো বেড়ে গেছে। সে খিল খিল করে হেসেই যাচ্ছে। আহমাদ মনে মনে চাচ্ছে তার এই প্রাক্তন প্রতিবেশী যেনো সারা জীবন এভাবেই খিল খিল করে হাসতে থাকে।
সমাপ্ত
এতদিন ধরে ধৈর্য ধরে সাথে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
লেখা: সুমাইয়া জান্নাতি