জান্নাহ

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৩৬
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    শান্ত নদী বয়ে চলছে অবিরাম।তার পাড় ঘেঁষেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নারকেল আর সুপারি গাছ।তা মাঝে ছোট ছোট বুনো গাছ জড়িয়ে আছে দুই,তিন ফুটের বড়ই গাছে।তাল গাছের ছড়ানো পাতা দেখলে মনে হয় যেন জীবন্ত হাত পাখা ঝুলছে।সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেক বাকি।আজকের বিকেলটা চমৎকার।ভ্যাবসা গরমের পরিবর্তে একটা স্নিগ্ধ পবন মুড়ে রেখেছে তপ্ত পরিবেশকে।নদীর পানিতে ঢেউ খেলছে।সেই ঢেউয়ের তালে পানি সর্পিলকারের আঁছড়ে পড়ছে পাড়ে।তাতে মৃদু ছন্দ তুলছে।

    সেই স্নিগ্ধ,শীতল,ফুরফুরে বাতাসে রাফাতের ঝাঁকড়া চুলগুলো উড়ছে।আবেগশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর পানে।নদীর মধ্যখানে একটা পালতোলা নৌকা।দুটো ছেলেমেয়ে পাশাপাশি বসে আছে।মৃদুহাস্য অধরে ভ্রু নাচায় রাফাত।তার পাশেই গম্ভীর চাহনিতে রাফাতকে পর্যবেক্ষণ করছে ইশাক।সন্তর্পনে রাফাতকে জিঙ্গেস করলো–

    “কী ভাবছিস তুই?

    রাফাত কিঞ্চিৎ অধরের কোণ বাঁকায়।ব্রাউন রঙের পোলোশার্টের কলারটা টানদিয়ে নামিয়ে নরম ঘাসের উপর হাতের ভর দিয়ে পেছনে হেলান দেয় রাফাত।নদীর পাড়ের সাথেই পাকা রাস্তা।দশ ফিটের প্রশ্বস্ত রাস্তার এই পাড়ে নদী আর ওই পাড়ে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত।রাস্তার দুই ধারের গাছের শীতলতায় প্রায়ই ডুবন্ত বিকেলে মানুষ নদীর পাড়ে এসে বসে সময় কাটায়।স্মিতহাস্য অধরে রাফাত প্রানবন্ত গলায় বললো—

    “জান্নাহ্ ফিরেছে।”

    চোখের পাল্লা প্রশ্বস্ত করে অতি উৎসুক গলায় ইশাক বললো—

    “তুই কী করে জানলি?

    রাফাত বিরস হাসে।ইশাকের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সহজ গলায় বললো–

    “নিধি বলেছে।”

    ইশাক যেনো এটাই ধারণা করেছিলো।হেয়ালি গলায় বললো–

    “ও।”

    ইশাক নদীর দিকে তাকালো।সরস হাসলো সে।সোজা বললো–

    “তাহলে এখন কী করবি?

    রাফাত গাঢ় গলায় বললো–

    “পরীক্ষা চলছে জান্নাহ্ এর।”

    “তো?

    রাফাত সাবলীলভাবে বললো–

    “ওকে আমি কোনো টেনশন দিতে চাই না।ভালো করে পরীক্ষা দিক।তারপর কথা হবে ওর সাথে আমার।আমার প্রশ্নের উত্তর আমার চাই।”

    থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে ইশাক—

    “কী করবি তুই?

    রহস্য হাসলো রাফাত।গম্ভীর গলায় বললো—

    “সারহানের সাথে দেখা করবো আমি।”

    ইশাক লাফিয়ে উঠে বললো—

    “পাগল হয়েছিস!

    একটা দমকা বাতাস মুখে লাগতেই রাফাতের ঝাঁকড়া চুলগুলো নড়ে উঠলো।চমৎকার হাসলো সে।খানিকক্ষন চুপ থেকে সরব গলায় বললো—

    “জান্নাহ্ ওর পরিচয় লুকিয়ে রেখেছে।কেন বলতো?সারহানের মতো দশটা ছেলেকে কেনার ক্ষমতা আছে জান্নাহ্ এর।তবুও একটা অসহায় মেয়ের মতো কেন পড়ে আছে ওই বাড়িতে?জান্নাহ্ সারহানকে ভালোবাসে।কিন্তু সারহান কাউকে বিয়ে করতে চায়নি।কেন?
    এমন তো নয় সারহানের বিয়ের বয়স হয়নি।জান্নাহ্কে দেখেই কেন বিয়েতে রাজী হলো?জান্নাহ্ তখন মাত্র ফিফটিন ছিলো।জান্নাহ্ কেন তার পরিচয় লুকিয়ে সারহানকে বিয়ে করলো?

    উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে ইশাক।ঝট করেই বললো–

    “হয়তো জান্নাহ্ এর পরিচয় জানলে ওরা জান্নাহ্কে সারহানের সাথে বিয়ে দিতো না।”

    রাফাত নিরুত্তাপ গলায় বললো–

    “তেমন নয়।সারহানের মা পাঁচলক্ষ টাকা যৌতুক নিয়েছে।আমার রেড চেরি কোনো দিক দিয়ে কম না যে তাকে টাকা দিয়ে বিয়ে করতে হবে।সারহান কী সত্যিই জানে না এই বিষয়ে?

    ইশাক খেঁপে গিয়ে নিজের হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো আউলাঝাউলা করে ব্যগ্র গলায় বললো–

    “মাফ চাই।এতো প্যাঁচাল পারিস না।ক্লিয়ার কইরা ক।”

    রাফাত দুর্বোধ্য হাসলো।ভারি গলায় বললো–

    “আঙ্কেল,আন্টির মৃত্যুর পর পুরো হসপিটাল বন্ধ করে দেওয়া হয়।যেই হসপিটাল আঙ্কেলের স্বপ্ন ছিলো।আমি আর জান্নাহ্ দুই জনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ডক্টর হয়ে সেখানেই জয়েন করবো আমরা।
    জান্নাহ্ এর বিয়ে হয়েছে একবছর।কিন্তু ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে প্রায় আঠারো মাস।কোথায় ছিলো এই ছয় মাস?ওর মামার কাছে!যদি তাই হয় তাহলে এতোদূর কী করে বিয়ে হলো জান্নাহ্ এর।প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা পথ পাড়ি দিতে হয়।”

    ইশাক জিঙ্গাসু গলায় বললো–

    “কোথায় থাকে জান্নাহ্ এর মামারা?

    “দোহার।”

    “তুই গিয়েছিলি?

    “নাহ।কিছুদিন আগেই জানলাম।”

    ইশাক তাড়া দিয়ে বললো–

    “তাহলে চল আমরাও যাই।”

    শান্ত চোখে তাকালো ইশাকের দিকে রাফাত।আপত্তির সুরে বললো–

    “নাহ।আমার প্রশ্নের জবাব আমি ওর কাছ থেকেই নিবো।

    মৃদু কম্পনরত গলায় ইশাক বললো—

    “তুই আসলে কী জানতে চাইছিস বলতো?

    উন্মনা হয়ে আকাশের দিকে তাকায় রাফাত।সন্ধ্যা নেমেছে আরো আগেই।লালচে আভা বক্রকার হয়ে বিছিয়ে আছে পুরো আকাশ।তার মাঝেই একটা কালো রঙের পাখি উড়ে যাচ্ছে।ওপাড়ের দৃশ্য এখন আর চোখে স্পষ্ট নয়।অন্ধকার ঘনিয়ে দিনের আলো সরিয়ে রাতের মায়া জড়াচ্ছে প্রকৃতিকে।বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে।আচমকাই তাল গাছের পাতা জোরালো শব্দ করতে থাকে।বাতাসে ঝংকারের সৃষ্টি হয়।তীব্র বাতাসে গাছের মস্তিষ্ক যেনো লড়াই শুরু করে।নদীর পানিতে উত্তাল ঢেউ শুরু হয়।শান্ত রাস্তা হতে ধূলো এসে মাখিয়ে দেয় রাফাত আর ইশাককে।চোখ ডলতে থাকে দুই বন্ধু।বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ বলছে ঝড় হবে।ভয়ংকর ঝড়।ইশাকের উত্তর প্রকৃতি দিয়েছে।কিন্তু তা কী ইশাকের বোধগম্য আদৌও হয়েছে?
    ,
    ,
    ,
    বিছানায় নম্র হয়ে বসে আছে জান্নাহ্।অনবরত সারহানের কলে বিরক্ত সে।আজ বারোদিন।কথা বলে নি জান্নাহ্ সারহানের সাথে।যতবার কল করেছে মোবাইলটাকে সামনে রেখে শুধু চেয়ে থাকে।পুড়ছে তার মন সেই সাথে ক্ষয় হচ্ছে অনুভূতি।কিন্তু ভালোবাসা যে দুর্লভ সোনার মতো।পুড়তে পুড়তেই খাঁটি হয়।

    মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে জান্নাহ্ এর।পরীক্ষা আসার পর রাত জাগতে হয়।দুই হাতে কপালের দুই পাশ চেপে বসে আসে।কিন্তু তার কাতর,স্থির দৃষ্টি মোবাইলে।এই নিয়ে আজকে সারাদিনে ষাটবার কল করেছে সারহান।কিন্তু জান্নাহ্ বজ্রকঠোর।চকিতে তার ধ্যান ভাঙে তিতির চিকন আহ্লাদী কন্ঠে।

    “পরীমা,পরীমা!

    পা দুটো ছড়িয়ে সহজ হয়ে বসে জান্নাহ্।ঝপাৎ করে তার কোলে এসে পড়ে তিতি।মিষ্টি গলায় চোখের পাতা চড়িয়ে বললো—

    “আমাকে খাইয়ে দাও।”

    জান্নাহ্ গম্ভীর মুখে বললো–

    ‘তুমি এখনো খাওনি তিতি?

    তিতি ডান হাতের লাল চুড়িগুলোতে বা’হাতের আঙুল ঢুকিয়ে সজোরে টান দিতে দিতে স্বশব্দে বললো-

    “না।খাইয়ে দাও।”

    বিব্রত হয় জান্নাহ্।রাত এগারোটা বেজে গেছে মেয়েটা এখনো খায়নি।দুই হাত দিয়ে তিতিকে কোল থেকে সরিয়ে বিছানায় বসায়।তিতির উলুথুলু চুলের মাঝে হাত দিয়ে সিঁথি করে দেয়।ঝকঝকে হাসে তিতি।জান্নাহ্ মায়াভরা গলায় বললো—

    “তুমি বসো,আমি খাবার নিয়ে আসি।”

    জান্নাহ্ তার দুই কোমল পা বাড়াতেই পেটে মোচড় দিয়ে উঠে।দু’একদিন ধরে এমনটাই হচ্ছে।চঞ্চল পা দুটো দ্রুত চালিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।বিছানায় বসা তিতি তা দেখেই ঠোঁট উল্টে কান্না শুরু করে।প্রায় মিনিট পাঁচেক ওয়াশরুমে অতিবাহিত করে রুমে আসে জান্নাহ্।পুরো মুখ জুড়ে ফোঁটা ফোঁটা পানির বিন্দু।ঠান্ডা পানির ঝাঁপটা দেওয়াতে ভালো লাগছে এখন।জান্নাহ্ অবাক হয় সামনেই ভ্রু বাকিয়ে দাঁড়ানো শুভ্রাকে দেখে।শুভ্রা শশব্যস্ত হয়ে সন্দিগ্ধ গলায় বললো–

    “কী হয়েছে তোর?

    জান্নাহ্ নিরুদ্বেগ গলায় বললো–

    “তেমন কিছু নাতো।কেন?

    শুভ্রা সরল গলায় বললো—

    “তিতি বললো তুই নাকি বমি করছিস।”

    জান্নাহ্ দ্বিধান্বিত গলায় বললো–

    “আসলে কয়েকদিন ধরে রাতে পড়ছি তো,ঘুম কম হচ্ছে।তাই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।”

    আশ্বস্ত হতে পারলো না শুভ্রা।সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো–

    “সত্যিই কিছু হয়নি তো!

    জান্নাহ্ খেয়াল করে ছোট্ট তিতি তার মায়ের কাপড় খামছে ধরে জলভরা চোখে ঠোঁট উল্টো করে দাঁড়িয়ে আছে।জান্নাহ্ নিচু হয়ে তিতিকে কাছে টেনে নেয়।মখমলে গলায় বললো—

    “কী হয়েছে তিতি সোনা!দেখো পরীমার কিচ্ছু হয়নি।একদম ঠিক আছি।”

    তিতি পিঠ ভেঙে ঝুঁকে জান্নাহ্ এর গলা জড়িয়ে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে থাকে।জান্নাহ্ ওর পিঠের দিকটায় হাত দিয়ে ঘষতে থাকে।মোবাইলে আবার রিং বাজতে থাকে।শুভ্রা মেয়েকে টেনে নিয়ে জান্নাহ্কে উদ্দেশ্য করে বললো–

    “সারহান কল করেছে বোধহয়!রিসিভ কর।”

    জান্নাহ্ ফিকে গলায় বললো–

    “তিতির খাওয়া…।”

    শুভ্রা আশ্বস্ত গলায় বললো–

    “তোকে ভাবতে হবে না।আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

    কল রিসিভ করার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলো শুভ্রা।তাই বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করে জান্নাহ্।তিতিকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয় শুভ্রা।
    জান্নাহ্ ছোট্ট দম ফেলে মোলায়েম গলায় বললো–

    “হ্যালো।”

    ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না।শুধু ক্ষীন নিঃশ্বাসের ছন্দপতন হচ্ছে।জান্নাহ্ আবারও নম্র গলায় বললো—

    “হ্যালো।”

    তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে থমথমে গলায় সারহান বললো–

    “এতোটা পাষাণ কী করে হলেন রজনীগন্ধা!আমি তো আপনার গায়ে পাষাণ প্রেয়সীর তকমা কখনো লাগাইনি।”

    জান্নাহ্ এর বিপরীতে কিছু বললো না।ধুম ধরে বসে রইলো।ফ্যানের নিচে বসলেও তার চোখে মুখে কেমন উষ্ণতা অনুভব করতে লাগলো।আদৌ কী তা পরিবেশের উষ্ণতা না তা হৃদয়ের দহনের তা সে বোঝে না।সারহানের বিষন্ন কন্ঠে কান্না পেলো জান্নাহ্ এর।ঘোলা চোখে উদ্দেশ্যহীনভাবে পুরো ঘরে নজর বিলাতে থাকে।ঠোঁট কামড়ে কান্না রোধ করে জান্নাহ্।
    জান্নাহ্ থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে সারহান ওপাশ থেকে বিরস হেসে বিতৃষ্ণা গলায় বললো–

    “আমাকে পুড়িয়ে কতটুকু শান্তি পাবেন রজনীগন্ধা?যে দহনে আমায় পুড়াবেন তার আঁচ যে আপনাকেও সহ্য করতে হবে।”

    জান্নাহ্ ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে লাগলো।চেনা পরিবেশটা হঠাৎ অচেনা মনে হলো।বুকের হাহাকার বাড়তে লাগলো তার।স্মিত ধারায় গড়িয়ে পড়া জলধারা ক্রমশ বাড়তে লাগলো।সারহান তার নয়নযুগল নিমীলিত করে।বদ্ধ চোখে ভেসে উঠে জান্নাহ্ এর দুই চোখ।সে হাস্যোজ্জ্বল দুই চোখ।আবেগভরা গলায় আর্তনাদ মিশিয়ে সারহান বললো–

    “কী করে পারলেন এমনটা করতে!এই বারোটা দিন একবার আপনার মনে হলো না আমি আপনাকে ছাড়া অচল!

    জান্নাহ্ কিছু বললো না।কান্না গিলে নিয়ে আবেগশূন্য দৃষ্টিতে এলোমেলো তাকালো।সারহান দৃঢ়হয়ে বললো—

    “আমি নিজেকে বদলাতে চেয়েছি অনেকবার।কিন্তু দ্বিতীয় সুযোগ আমি পাইনি।আমি নিজে যায়নি আপনার কাছে।আপনি নিজে এসে করা নেড়েছেন আমার বন্ধ দ্বারে।গত দুইমাসে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশিয়েছেন নিজেকে।আমার পঁচা নর্দমায় পদ্মফুল হয়ে ফুটেছেন।এখন কেন মেনে নিতে পারছেন না আমাকে?নাকি আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে আপনার জীবনে?

    সারহান থামলো।জান্নাহ্ এর মুখ নিঃসৃত ধ্বনি বলছে সে কাঁদছে।সারহান কঠিন গলায় বলে উঠে—

    “তবে যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আপনি ভুল করছেন।আমার জীবনে আপনার প্রয়োজন কখনো ফুরাবে না।কোনো কিছুর বিনিময়ে আপনাকে আমি ছাড়ছি না।যে সুযোগ আপনাকে আমি দিয়েছি তা আপনি কাজে লাগান নি।নাউ মাই টার্ন।নিজেকে আপনার যোগ্য করার চেষ্টা আমি করছি।শুধু একটা সুযোগ চাই আমি।ভালো থাকবেন।”

    কল কাটতেই ডুকরে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।উত্তাল নদীর মতো উথলে উঠছে তার নয়নাসার।তার মেদহীন পেটের উপর আলতো হাত রেখে ক্রন্দনরত গলায় স্বগতোক্তি করে উঠে—

    “আমি দিলাম আপনাকে সুযোগ সারহান।আপনি আমার প্রাণ হয়ে ফিরে আসুন।প্লিজ ফিরে আসুন।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৩৭
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    জাবিন বাড়ন্ত বয়স থেকেই পড়ালেখায় উদাসীন।কেন যেনো তার পড়ালেখায় মন বসে না।সারহানের প্রতি বিদ্বেষ সেই জ্বলন্ত আগুনে খাঁটি ঘিয়ের মতো।সারহান যেমন নিজের মন মতো চলাফেরা করে জাবিনও তেমনটা চায়।কিন্তু পারে না সারহান আর তার মা শুভ্রার জন্য।দুইজনই জাবিনের পড়ালেখায় মাত্রাতিরিক্ত তৎপর।এক চিমটি ছাড় নেই যেনো।তাই তো টেনশন এড়াতে মানবিক শাখা নিয়ে পড়ছে।জাবিনের মুখস্ত বিদ্যা দারুন লেবেলের।

    একটা চেয়ারের উপর বসে আরেকটা চেয়ারে পা উঠিয়ে টেবিলে খাতায় কিছু একটা লিখে চলছে।আজকাল পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী জাবিন।জান্নাহ্ এর সাথে ভাবটাও বেড়েছে।ঝাঁকড়া চুলগুলো বৈদ্যুতিক ফ্যানের বাতাসে উড়ে চলছে।পড়ার টেবিলটায় বই খাতায় ঠাসা।বিছানার পাশেই টেবিল।উত্তরে দেয়ালের সাথে ছোট্ট আলমিরা।তার পাশেই ক্রিকেট ব্যাট,ক্যারামের বোর্ড রাখা।আর কোনো ভারি আসবাবপত্র নেই বললেই চলে।ভেজানো দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে সুরেলী কন্ঠে জান্নাহ্ অনুমতি চাইলো।

    “ভেতরে আসতে পারি?

    শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় জাবিন।চেয়ার থেকে পা টা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে।একগাল প্রানবন্ত হেসে বললো–

    “ইয়েস মিসেস জেইদি।”

    কোমল হাসে জান্নাহ্।দরজাটা তার যতটুক প্রয়োজন ততটুকু ফাঁক করে ভেতরে আসে।জাবিনের সামনে গিয়ে উচ্ছল হেসে বললো–

    “পড়ছো?

    জাবিন নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।পায়ের কাছে থাকা চেয়ার আরেকটু আলগা করে জান্নাহ্কে বসার জন্য ইশারা করে।জান্নাহ্ মিষ্টি হেসে বসে।জাবিন খাতাটা বন্ধ করে পেনস্ট্যান্ডে পেনটা রেখে জান্নাহ্ এর দিকে আস্ত নজর দিয়ে বললো–

    “কিছু বলবে?

    জান্নাহ্ মৃদুহাস্য অধরে বললো–

    “হুম।”

    “কী?

    জান্নাহ্ অনেকটা মন মরা হয়ে বললো—

    “সারহানের উপর রাগ কমেছে?

    জাবিন তাচ্ছিল্য হাসলো।সরব গলায় বললো–

    “মামার উপর আমার রাগ নেই।তুমি ভালো আছো তো?

    জান্নাহ্ এর চোখ চকচক করে উঠে।প্রসন্ন হাসে সে।জাবিন আজ সারহানকে মামা বলেছে।মিচকি হেসে ফিচেল গলায় জান্নাহ্ বললো—

    “এইবার আমাকে মামি বলো।”

    বিরস হাসে জাবিন।ম্লাণ গলায় বললো—

    “যদি তুমি খুশি হও তাতে তাহলে ডাকবো।তাহলে কিন্তু আর আমরা ফ্রেন্ড থাকবো না।আমাদের সম্পর্ক বদলাবে।মামি,ভাগ্নে হবে।তুমি রাজী তো?

    টিমেটিমে চোখে তাকায় জান্নাহ্।ক্ষুন্ন খলায় বললো—

    “এ কেমন কথা!

    জাবিন ফিচেল হেসে বললো–

    “এটাই কথা।”

    জান্নাহ গুমোট গলায় বললো–

    “তাহলে দরকার নেই।”

    ফকফক করে হেসে উঠে জাবিন।ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো–

    “ইশ!এসেছেন আমার মামি হতে!

    জান্নাহ্ চোখ ছোট ছোট করে নাক কুচকে সরব গলায় বললো–

    “দুষ্ট ছেলে কোথাকার!

    চকিতে জান্নাহ্ এর পায়ের উপর দু হাতের কনুই ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিতি।উচ্ছলিত গলায় আবেগ নিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো—

    “পরীমা,বাবু আনবে?

    জান্নাহ ভ্রু কুঞ্চি করে বিমূঢ় গলায় বললো–

    “কীসের বাবু তিতি সোনা!

    তিতি গদগদ গলায় হাত নাড়িয়ে বললো–

    “ছোট্ট বাবু।”

    জান্নাহ্ চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে পা ঠেসে বসে।তিতির দুই ফুলকো গাল অঞ্জলিতে নিয়ে বললো–

    “আমার তিতি সোনার বাবু লাগবে?

    তিতি ঝুমঝুমিয়ে হেসে উঠে।খিলখিলিয়ে বললো–

    “হা,হা।”

    জান্নাহ্ তিতির নরম গালে ঠুসে চুমু খেয়ে বললো–

    “আচ্ছা।মামাকে বলবো আমার তিতি সোনার জন্য একটা বাবু নিয়ে আসতে।ওকে?

    “আচ্ছা।”

    ঝলমলে গলায় জাবিন বলে উঠে–

    “জান্নাহ্!

    জান্নাহ্ হেয়ালি চোখে তাকিয়ে বললো–

    “কী?

    “তুমি যাবে?

    জান্নাহ্ অতি উৎসাহের সাথে বললো-

    “কোথায়?

    “ওই যে অতিনদের বাড়ি।অতিনের ভাবির ছেলে হয়েছে।চলো না যাই।”

    জান্নাহ্ ভাবনাতীত বিস্ময় নিয়ে বললো–

    “এখন!আম্মা জানলে খবর আছে।এই সন্ধ্যায় বের হলে তিনটারই ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে।”

    জাবিন আর তিতি ঘর কাঁপিয়ে হাসে।ছোট দম ফেলে আবেগী গলায় জাবিন বললো–

    “তিতি যখন ছোট ছিলো কী মিষ্টি ছিলো!একদম তুলোর বল।কী নরম নরম ছিলো ওর হাত,পা।আর চোখ গুলো একদম চাইনিজদের মতো ছিলো।গাল দুটোতে এতো মাংস ছিলো চোখই খুলতে পারতো না।”

    ঝরঝরে হাসে জাবিন।হাসতে হাসতে হঠাৎ ই তার হাসি মিলিয়ে যায়।দুঃখী দুঃখি গলায় বললো–

    “ইশ!এখন যদি তিতি ছোট থাকতো কতো ভালো হতো!

    জান্নাহ্ দেখতে পায় জাবিনের চোখে মুখে এক অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা লুকোচুরি খেলছে।সলজ্জ হাসে জান্নাহ্।হয়তো এই ছোট্ট আকাঙ্ক্ষা অতি সত্তর পূরণ হতে চলেছে।
    ,
    ,
    ,
    শুভ্র বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে জসিম।তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো।সমস্ত শরীর নিথর,নিস্তব্ধ,অসাড়।জসিমের শরীরে এমন ধরনের পয়জন ইনজেক্ট করা হয়েছে যাতে তার পুরো শরীর প্রাণহীন হয়ে যায়।একমাত্র তার হার্টবিট চলছে।ডক্টর আরো একটা জরুরী ইনফরমেশন দিয়েছে।আর সেইটা এই কেসে আপাতত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

    জসিমের সামনেই একটা প্রজেক্টর লাগানো।তার স্থির দুই দৃষ্টি নিশ্চলভাবে আবদ্ধ সেই প্রজেক্টরে।কৃত্রিম অক্সিজেনই এখন তার বাঁচার একমাত্র উপায়।জসিমের পাশেই হসপিটালে সিনিয়র নিউরোলজিস্ট দাঁড়ানো।তার পাশেই তার জুনিয়র যে বর্তমানে জসিমকে কেয়ার করছে।জসিমের মুখে তাক করা ক্যামেরা যাতে তার মুখের প্রতিটি অভিব্যক্তি স্পষ্ট বোঝা যাবে।যার কানেকশন দেওয়া ইহতিশামের ল্যাপটপে।ক্যাবিনের একপাশে একটা চেয়ারে গম্ভীর হয়ে বসে আছে ইহতিশাম।তার ভয়ংকর সরু চোখ দুটো আবদ্ধ সামনের ল্যাপটপের স্ক্রিনে।দুই হাতের আঙুলগুলো একে অপরের মাঝে গুঁজে তার উপর চিবুক দিয়ে দেখে যাচ্ছে জসিমের দুই চোখ।

    বেশ কিছু সময় যাওয়ার পরও কোনো ফল না পেয়ে বিতৃষ্ণা ইহতিশাম।প্রজেক্টরে একের পর এক হিস্ট্রিশিটারদের ছবি দেখানো হচ্ছে।এসির ভোঁতা ঝিমঝিম শব্দের সাথে তার বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কের নিউরণগুলো যেনো লড়াই শুরু করেছে।চকিতে ইহতিশামে চোখ আটকে যায়।হাতের ইশারায় তার অ্যাসিস্টেন্টকে প্রজক্টর পজ করতে বলে।ইহতিশাম ল্যাপটপের আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে দেখে জসিমের সমাহিত চোখের পল্লবে মৃদু কম্পন দেখা দিচ্ছে।তার চোখের মনি কিঞ্চিৎ নড়ছে।স্কেচ করা ছবিটি প্রজেক্টরে প্লে হতেই জসিম যেনো সপ্রতিভ হয়।ওই অসাড় দেহে প্রাণ সঞ্চিবনী বোধহয় এখনই দৌঁড়ে এসে বলতো,”এই,এই সে ব্যক্তি।”

    জসিমের অবস্থা খারাপ হতে থাকে।তার শ্বাসের গড়পড়তা বাড়তে থাকে।ইহতিশাম প্রজেক্টর অফ করার অর্ডার দেয়।ছবিটা নিয়েই ক্যাবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে সে।
    এই ছবিটা সেই হুডি পড়া লোকটার।ক্যাফেটেরিয়ার অনেক সার্ভিস বয়ই তাকে দেখেছে।তাদের সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় এই স্কেচ তৈরি করা হয় যার ফুল প্রুভ চেক করে জসিম।ইহতিশাম নিমগ্নচিত্তে স্কেচ দেখতে থাকে।আচমকা তার টিমের একজন দৌঁড়ে এসে তাকে একটা ফাইল দেয়।গত একমাস ধরে একটা খুনের তদন্ত করছে পুলিশ।কিন্তু কিছুই করতে পারছে না।ইহতিশাম তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফাইলটা খুলে দেখে।

    নামঃশ্রীজা ব্যানার্জী।
    বয়সঃ২৫

    বাকিটা আর পড়লো না ইহতিশাম।তোতাপাখির মতো তার টিমের জুনিয়র ফারুক বলতে লাগলো–

    “মেয়েটা একটা মাল্টিন্যাশনার কোম্পানিতে জব করতো।একটা এনজিওর সাথেও যুক্ত ছিলো।সেখানেই থাকতো।যেদিন খুন হয় সেদিনও এনজিওর কাজে গাজীপুর যাচ্ছিলো।পথে কিছু একটা হয়।যে বা যারা খুন করেছে পুরো মুখটা ঝলসে দিয়েছে।তাই তো পরিচয় পেতে এতো সময় লাগলো।কিন্তু মৃত্যু হয়েছে সার্জিক্যল নাইফে কাটা শ্বাসনালির এক্সেস ব্লিডিংএ।”

    ইহতিশাম চোখের কোন ক্ষীন করে অবাক বিস্ময়ে বললো–

    “হোয়াট?আর ইউ সিরিয়াস?

    ফারুক নিরুত্তাপ গলায় বললো–

    “ইয়েস স্যার।”

    “এনজিওর ওনার কে?

    ফারুক নির্দ্বিধায় বললো–

    “ফাইলে তার নাম আছে স্যার।”

    ইহতিশাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরেকবার চোখ বুলায় ফাইলের ফার্স্ট পেজে।চকচক করে তার ইগল চোখ দুটি। থম মেরে কিছু একটা ভাবতে লাগলো সে।হাতে থাকা স্কেচটা নাক বরাবর ধরে সুক্ষ্ম চাহনিতে দেখছে।রাশভারী গলায় বললো—

    “সবগুলো মার্ডারে একটা কমন জিনিস!বলতে পারো সেইটা কী?

    ফারুক কৌতূহলী গলায় বললো—

    “কী স্যার?

    ইহতিশাম নির্বিঘ্ন গলায় বললো–

    “সার্জিক্যাল নাইফ।মার্ডারার সার্জিক্যাল নাইফের ব্যবহার অতি সন্তর্পনে করে যাতে প্রতীয়মান হয় সে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ।”

    উৎসুক চাহনিতে আবদ্ধ করে ফারুক ইহতিশামকে।কিন্তু ইহতিশামের বিচলিত অক্ষিদ্বয় সেই স্কেচে নিবদ্ধ।কেনো যেনো তার মনে হলো স্কেচের মানুষটিকে সে চেনে।কারো সাথে তার চেহারার অনেকটা মিল।ইহতিশামের চোখে ভাসে তার প্রিয়তমার সেই স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি।হাসলে অনেকের যেখানে টোল পড়ে তার প্রিয়তমার সেই জায়গায় টোলের পরিবর্তে এক মারাত্মক সুন্দর তিল।
    আরো একটা বিষয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ইহতিশামের।সবগুলো খুনের সাথেই একটাই নাম জড়িয়ে।সে মানুষটা তার খুব কাছের।কিন্তু খুন!

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৩৮
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    নিরাক,থমথম পরিবেশ।নিকষ কালো আকাশ জুড়ে বিশাল থালার মতো চাঁদ।তার সাথেই জ্বলছে টিমটিম তারা।দেখে মনে হচ্ছে সুপারি গাছের ফুল।যেনো অগোছালো হয়ে ঝরে পড়ে আছে।হাত বাড়ালেই কুড়িয়ে নিয়ে পকেট ভর্তি করা যাবে।ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে দূরের দালানগুলো।দালানের জানালার পর্দাসহ থাই গ্লাস ভেদ করে লালচে আলোর ছড়াছড়ি।

    তপ্ত বালুতে এক পা ভাঁজ করে মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে শুয়ে আছে সারহান।তার বিষন্ন দৃষ্টি ওই স্পর্শসীমার বাইরের আকাশে।
    আজ সারাদিন সারহান এখানেই ছিলো।যেই হোটেলটায় সারহান এন্ট্রি নিয়েছে তার পাশেই একটা ছোট্ট খেলার মাঠ।যেহেতু এলাকাটা ঘনবসতি তাই বাচ্চাদের খেলার তেমন একটা জায়গা।এই ছোট্ট জায়গাটাই তাদের আত্নার খোরাক যোগায়।

    সারাদিনের দিবাকরের নিংড়ানো গনগনে,উষ্ণ লাভা বালু তার বুকের মধ্যে ধারণ করেছে।এখন রাতের স্নিগ্ধ,নিরাক পরিবেশে তা উগড়ে দিচ্ছে।সেই জ্বলন্ত বালু যেনো স্ফুলিঙ্গ মতো বিঁধছে সারহানের পিঠে।তবুও অনুভূতিশূন্য হয়ে সে সমাহিত হয়ে আছে সেই ধূ ধূ বালুর বুকে।সারাদিন বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড় দেখার পর হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষন থেকে আবার আসে।মাঠটা বেশি বড় নয়।তার একপাশে সংকীর্ণ রাস্তা।দুই পাশে নড়বড়ে,পলেস্তার উঠানো মানুষে গিজগিজ করা অনাবাসিক হোটেল,টেবিল বেঞ্চের সমন্বয়ে ছোট্ট খাবার দোকান।আর আরেক পাশে একটা একটা বিশাল নদী।এখনো নদী থেকে ট্রলারের ইঞ্জিনের আওয়াজ ভেসে আসছে।

    সেই খোলা মাঠের একপাশে অশ্বথ গাছ।সারহান মাঠের ঠিক মাঝখানে শুয়ে আছে।তার চোখের সামনে ভাসছে তার অতীত।এমনটা না হলেও পারতো।কী দরকার ছিলো এতো ভালোবাসার !ভালোবাসা মানুষের জীবনে সুখ বয়ে আনে।তবে তার জীবনে কেন যন্ত্রণা বয়ে আনলো!সারহান আরো গভীরভাবে ওই চাঁদকে দেখে।মানুষ বলে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে।কিন্তু তবুও সে রাতের রাণী।তার ওই মনোহারিণী রূপে ভুলে যায় তার কলঙ্ক।
    তপ্ত নিশ্বাস ফেলে সারহান।তার জীবনও কলঙ্কে ভরা।যেখানে শুধু অন্ধকার।এমনটা কী সত্যিই হওয়ার ছিলো।সারহানের তার দাদার কথা মনে পড়ে।বুড়ো প্রচন্ডরকম ভালোবাসতো তাকে।তার মনে পড়ে স্কুলে যাওয়ার দিনগুলোতে সকালের সেই স্নিগ্ধ পরিবেশে চিরচেনা সেই রাস্তা ধরে বৃদ্ধ দাদার হাতের আঙুল ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা।দাদার কাছে বায়না করা।মেলায় যাওয়ার বায়না,আইসক্রীম খাওয়ার বায়না,ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার বায়না,পাশের বাড়ির ছোট মালিহার সাথে খেলতে যাওয়ার বায়না।
    বাবার ঘাড়ে চড়ে সিড়ি বেয়ে উঠা,বাইরে যাওয়ার জন্য তার কোলে উঠে বসে থাকা।আড়তে যাওয়ার জন্য জেদ ধরা।
    মা কখনো সারহানকে বকে নি।পাশের বাড়ির মালিহা খেলবে না বলে যখন চলে যাচ্ছিলো রাগের বশে সারহান পেছন থেকে তাকে ধাক্কা মারে।মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে মালিহার সামনের একটা দাঁত ভেঙে যায়।বাড়িতে বিচার নিয়ে আসে মালিহার মা।অন্তরা খেঁকিয়ে উঠে নিজের ছেলের দোষ আড়াল করে।মায়ের হাতের এক লোকমা খাবার মুখে নেওয়ার পর দ্বিতীয় লোকমা সারহানের মুখে ঠুসে দিতে সারা ঘর দৌঁড়ে বেড়াতে হয় অন্তরাকে।সামান্য কাঁশি হলে সারারাত বুকের সাথে জড়িয়ে বসে থাকতেন অন্তরা।

    একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারহান।এতো আবেগ,এতো ভালোবাসা,এতো স্নেহ কী করে লোক দেখানো হয়!বারো বছর!বারো বছর আগের সেই ঘটনা সব পাল্টে দিলো।বদলে দিলো সারহানকে।নিজের অস্তিত্বকে খুঁজতে গিয়ে নিজেকে ক্ষয়ে ফেললো সে।
    সারহানের ভাবনার ব্যবচ্ছেদ হয় তার মোবাইলের রিং এ।শোয়া অবস্থায় হালকা নড়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সারহান।তার রজনীগন্ধার মনে পড়লো তার কথা।রিসিভ করে চুপ করে রইলো সারহান।তার মাথার নিচে বা’হাত।চোখ দুটো ওই চাঁদেশ্বরীতে আবদ্ধ।ওপাশের কোমল গলায় স্মিত হাসে সারহান।

    “আসসালামু আলাইকুম।”

    প্রত্যুক্তি করে সারহান।

    “ওয়ালাইকুমুস সালাম।কেমন আছেন রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ স্থির গলায় বললো–

    “ভালো।আপনি কেমন আছেন?

    সারহান দায়সারা ভাবে বললো—

    “হয়তো ভালো।”

    জান্নাহ উদ্বিগ্ন গলায় শান্তভাবে বললো—

    “এমন কেন বলছেন!কী হয়েছে?

    সারহান বিরস হেসে অচঞ্চল গলায় বললো–

    “কিছু না।”

    জান্নাহ্ ছোট্ট দম ফেলে প্রশ্ন ছুঁড়ে–

    “আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

    সারহান অস্ফুট গলায় বললো—

    “হুম।”

    “কবে ফিরবেন?

    সারহান অধর কোণে হাসে।ম্লাণ গলায় বললো-

    “কেন!ডিবোর্স দিবেন নাকি আমাকে?

    উবলে উঠে জান্নাহ্।বিপন্ন গলায় বললো–

    “সারহান!
    এইসব কী বলছেন?

    মৃদু ছন্দে হেসে উঠে সারহান।অবিচলিত গলায় বললো—

    “খেয়েছেন?

    “হুম।”

    “তাহলে জেগে আছেন কেন?অনেক রাত হয়েছে ঘুমান।”

    “আপনি খেয়েছেন?

    সারহান চুপ করে রইলো।আজ দু’দিন ধরে সে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেনা।গত দেড় মাসে যে আশায় সে বুক বেঁধে ছিলো তা শেষ।পায়নি সে ওই মানুষটাকে।আর কখনো পাবে বলেও মনে হয় না।তার জীবনটা সে এই মানুষটাক খুঁজতে খুঁজতেই বিনাশ করে ফেলেছে।সেদিন যদি ওই নিষ্ঠুর সত্য তার সামনে না আসতো তাহলে সে কোনো দিন ওই বাড়ির বাইরে আসতে না।না,ইহতিশামের সাথে তার দেখা হতো।না ওই নোংরা স্ক্যান্ডাল হতো।না তার জীবনটা এমনভাবে বিষিয়ে উঠতো।

    জান্নাহ্ অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠে—

    “সারহান!আপনি কথা বলছেন না কেন?আপনি ঠিক আছেন তো?

    সারহানের চোখ ভিজে আসে।উঠে বসে সে।নদীর বুকে ট্রলার যাচ্ছে।নৌকাও আছে।তাতে ফিকে আলো দেখা যাচ্ছে।লন্ঠনও জ্বলছে।সারহান নির্নিমেখ তাকিয়ে আছে সেই দিকে।তার বুকটা ক্রমশ ভার হয়ে আসছে।এই মেয়েটাকে কী জবাব দিবে সে?তার নর্দমার জীবনে কেনো এলো এই মেয়ে?
    প্রথমবার জান্নাহ্কে দেখেও বেমালুম তাকে ভুলে যায় সারহান।কিন্তু ছয় মাস পর নতুনরূপে তার সামনে এসে ধরা দেয় তার রজনীগন্ধা।সেদিন নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়েছে সারহানের ।এক পবিত্র ফুলকে সে দুমড়ে মুছড়ে দিয়েছে তার অপবিত্র হাতে।বিয়ের পরও জান্নাহ্কে সাথে রাখেনি সারহান তার এই নোংরা স্বভাবের জন্য।জড়াতে চায়নি ভালোবাসা নামক মায়ায়।কিন্তু যে দুই মাস জান্নাহ্ তার কাছে ছিলো সেই দুই মাস সারহানের কেনো যেনো নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হলো।শুরু থেকে সবটা সাজাতে ইচ্ছে হলো।কিন্তু তা অসম্ভব ভেবে নিজের চোখের ঘুম উবে গেলো সারহানের।
    তার জীবনে যত নারী এসেছে তারা কখনো সারহানকে ভালোবাসেনি।ভালোবেসেছে তার বিছানাকে।হারিয়েছে নিজেদের সেই নোংরা সুখে।সারহানের জীবন চলছিলোও এমনভাবে।তার জীবনে এমন কারো প্রয়োজন ছিলো না।বিয়ে নামক বন্ধনে সে কখনো নিজেকে বাঁধতে চায় নি।এই বাঁধন পীড়াদায়ক।
    কিন্তু পারেনি সারহান।ওই নিষ্পাপ ফুটন্ত রজনীগন্ধা যখন নিজে এসে তার দিকে ভালোবাসার হাত বাড়ালো তখন আর নিজের ইচ্ছাকে অবদমন করতে পারেনি সারহান।জড়িয়ে নিলো তাকে নিজের সাথে।

    কোনো নেশাগ্রস্ত মানুষ একদিনে নেশা ছাড়তে পারে না।সারহানের দীর্ঘদিনের সেই ঘৃনিত অতীত মুছতেও তার সময় প্রয়োজন।একদিনে যদি নেশা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে তাহলে আর শহরে শহরে নেশামুক্তির কেন্দ্র গড়ে উঠতো না।চাইলেই নেশা ছেড়ে দিতে পারলে নেশাগ্রস্ত মানুষ তার নেশার প্রয়োজনীয়তা অনুভবে মানুষ খুন করতো না।

    সারহানের কানে ভেসে আছে অ্যাম্বুলেন্সের আর্তনাদের শব্দ।বিগলিত হাসে সারহান।এই সরু রাস্তায়ও প্রয়োজনে বৃহৎ গাড়ি ঢুকতে হয়!
    আহত গলায় জান্নাহ্ এর কথার প্রত্যুক্তি করে সারহান—

    “কিছু না।আমি ঠিক আছি।”

    ঝরা হাসে জান্নাহ্।অনুরক্তির সুরে বললো—

    “সারহান!

    সারহান সন্তর্পনে বললো–

    “বলুন,আমি শুনছি।”

    ফিক করে হেসে ফেললো জান্নাহ্।যেনো নিজের কথায় সে অত্যধিক মজা পাবে।আহ্লাদী গলায় বললো–

    “তিতি বলেছে ওর জন্য বাবু নিয়ে আসতে।”

    ঠোঁট চিপে ওপাশ থেকে সলজ্জ হাসে জান্নাহ্।সারহানের অধর কোণে তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ঝুলে।নিরেট গলায় বললো–

    “তাহলে শুভ্রা আপুকে বলুন নিয়ে আসতে কিনে কোনো বাচ্চাকে।”

    জান্নাহ্ ভ্রু নাঁচিয়ে হতবুদ্ধির গলায় বললো–

    “এইসব কী বলছেন!কিনে আনবে কেন?

    করুন হাসে সারহান।গম্ভীর গলায় বললো—

    “এই বয়সে তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে পারবে না।আর এইসব কেনা কাটার অভ্যাস তাদের ফ্যামিলিতে আছে।”

    জান্নাহ্ ধুম ধরে বসে সারহানের কথা বোঝার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।গা ঝাড়া দিয়ে বললো–

    “আপনি সবসময় আজেবাজে কথা বলেন।”

    ঝরা হাসে সারহান।নরম গলায় বললো–

    “আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

    “ভালো।”

    “আমি আপনার জীবনে না থাকলে সবকিছুই ভালো হবে।”

    জান্নাহ্ কী বলবে বুঝতে পারে না।আজকাল সারহান বেখেয়ালি কথাবার্তা বলে।জান্নাহ্ চায় সারহান দ্রুত ফিরে আসুক।তাকে যে একটা খুশির সংবাদ দেওয়া বাকি।কিন্তু জান্নাহ্ এর মন ভয়ে আড়ষ্ট হয়। যদি হিতে বিপরীত হয়।সারহান কোমল গলায় বললো–

    “রজনীগন্ধা,ঘুমান।অনেক রাত হয়েছে।রাখি।ভালো থাকবেন।”

    কল কেটে ঝরঝরে বালির উপর মোবাইলাটা রাখে সারহান।ঘাড়টা পেছনে হেলিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।সারহানের মনে হলো একটা শুকতারা খসে পড়ছে।সারহান উদ্ব্যস্ত হয়ে তার হাত বাড়িয়ে দেয় সামনে।জ্বলন্ত ঝিকিমিকি তারাটা যেনো তার হাতে এসেই পড়লো।সারহানের চোখ হীরে ঝলসানো চোখের মতো চকচক করে উঠে।তার অধরে ফুটে উঠে পরম প্রাপ্তির হাসি।সারহান আলতো করে হাতভর্তি সেই তারাকে তার বুকের সাথে চেপে ধরে যেখানটায় তার রজনীগন্ধা থাকে।যেনো তার হৃদপিন্ডের ভেতর গলে গেলো সেই জ্বলন্ত তারা।সারহান প্রানবন্ত হাসে।হাতটা একটু সরিয়ে বুকের মাঝ বরাবর ঘষতে থাকে।পাঁজরের হাড়গুলো আজকাল বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার উপর।স্বামীর পাঁজরের হাড়ে নাকি স্ত্রীকে তৈরি করা হয়।তার এতো এতো নারী!ক্লান্ত পাঁজর যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চায় সারহানের সাথে।সারহান পরাস্থ সৈনিকের মতো হাত জোড় করে অনুযোগের সুরে বলে,”তার জীবনে শ্রেষ্ঠ নারী একজনই।তার রজনীগন্ধা।”ফিচেল হাসে সারহান।আদৌ কী সে নারী!সে তো এখনো কিশোরী।এই কিশোরী রজনীগন্ধাকে সে টেনে এনেছে পচা গন্ধযুক্ত আস্তাবলে।

    সারহান সম্মুখে তাকায়।তার পায়ের কাছে ঝরঝরে বালিতে তর্জনী চালায়।লিখে জেড,এ,এন,এন,এ,এইচ।জান্নাহ্।ভালো লাগলো না সারহানের।মুছে ফেললো তা এলোমেলো করে।হাতের তালু দিয়ে সেই এলোমেলো বালু আবারও চেপে চেপে সমান্তরাল করে সারহান।তাতে লিখে র,জ,নী,গ,ন্ধা।রজনীগন্ধা।শুধু তার রজনীগন্ধা।

    জীবন কোনো নাটক বা সিনেমা নয়।এখানে কেউ মি.পারফেক্ট হয় না।খাদবিহীন সোনাতে কখনো টেকসই গয়না হয় না।আর সে তো মানুষ!

    সারহান খুশিতে মুখভর্তি হাসে।তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।সে তার অতীত ভুলতে চায়।একটা ঝলমলে দাগহীন বর্তমান চায়।তার রজনীগন্ধার সাথে বাঁচতে চায়।জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ সে কখনো পায়নি।অন্ধকার গহীনে আপনজন খুঁজে বেড়িয়েছে সে।কিন্তু চাঁদের আলোয় যে আপনাজন দাঁড়িয়ে আছে তাকে কেন দেখতে পায়নি সে!
    সারহান আবারো আকাশের দিকে তাকায়।বিদ্রুপপূর্ণ হাসে ওই চন্দ্রকে দেখে।আশাভরা বুক নিয়ে অনুনয় করে বললো—-

    “একটা সুযোগ দিবেন আমাকে রজনীগন্ধা?

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৩৯
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    হসপিটালের করিডোরে উৎসুক জনতার ভীড়।একটু আগেই একটা লাশ বের করা হয়েছে ওটি থেকে।তার সার্জারি চলছিলো।কিন্তু ডক্টররা কিছু করার আগেই পেশেন্ট এর অবস্থা এতোটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে তাদের পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব হয়নি।কিন্তু পেশেন্টের পরিবার তা মানতে চায় না।তাদের ধারণা ডক্টররা ইচ্ছে করে এইসব করেছে।কারণ যখন গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়েটাকে হসপিটালে আনা হয় তখন নাকি হসপিটাল কর্তৃপক্ষ পুলিশ কেস বলে গড়িমসি করতে থাকে আর এতেই মেয়েটির মৃত্যু ঘটে।কিছু কিছু জনতারা এতোটাই উত্তেজিত যে হসপিটালের করিডোরের ওয়েটিং চেয়ার,নার্সদের হাতা থাকা সার্জারি ট্রে সব ভেঙেচুরে একাকার করে ফেলছে।কিছুতেই যখন থামানো যাচ্ছে না তখন বাধ্য হয়ে পুলিশকে কল করা হয়।পুলিশ আসতেই ধীরে ধীরে সিচুয়েশন কন্ট্রোলে আসে।

    আর এ সবকিছুই নির্ভয়চিত্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো মেহনাজ।এইসব তার কাছে নতুন নয়।দিল্লীর একটা নামি হসপিটালের সিনিয়র নার্স সে।তার আন্ডারে প্রায় অর্ধ শতাধিক জুনিয়র রয়েছে।সে একজন ট্রেইনারও।শীতল নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাবিনে ঢুকে মেহনাজ।
    হুসনা বেডে শুইয়ে আছে।একটা চেয়ার টেনে তার কাছে বসে মেহনাজ।হুসনার হাতটা ধরে পরম আদুরে গলায় প্রশ্ন করে—

    “চিন্তুা হচ্ছে?

    হুসনা চোখের পাল্লা ফেললো দুইবার।মেহনাজ মিষ্টি হেসে আশ্বস্ত গলায় বললো—

    “ডোন্ট ওয়ারি মা।সব ঠিক হয়ে যাবে।অপারেশনের পর তুমি আবার হাঁটতে পারবে।ডক্টর যে টেস্ট গুলো করিয়েছে তার সবগুলোর রেজাল্ট পজিটিভ।”

    হুসনা মলিন হাসলো।তার চোখে উজ্জ্বলতা।ত্রস্ত পায়ে ক্যাবিনে ঢুকলো শরীফ।মৃদু গলায় বললো—

    “ডক্টর বললো সব ঠিক আছে।আমরা ইচ্ছে করলেই তোর মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি।”

    ম্লান হাসলো মেহনাজ।চোখে থাকা মাইনাস পাওয়ারের চশমাটা ঠিক করে নির্মল গলায় বললো–

    “ওয়েল।আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।তুমি মাকে নিয়ে যাও।”

    শরীফ ভ্রু কুঞ্চি করে জিঙ্গাসু গলায় বললেন–

    “তুই যাবি না বাড়িতে?

    মেহনাজ খসখসে গলায় বললো–

    “নাহ।আমার ছুটি শেষ হয়ে এসেছে।আমাকে দিল্লী ফিরে যেতে হবে।”

    “তাই বলে..।”

    শরীফকে কথা শেষ করতে দিলো না মেহনাজ।কাঠখোট্টা গলায় বললো—

    “আমাকে তোমার কী প্রয়োজন বাবা?তোমার জান্নাহ্ আছে তো।”

    মেহনাজ দাঁড়ালো না।চাপা কান্না উগরে আসার আগেই ক্যাবিন থেকে বেরিয় এলো।শরীফও মেয়ের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো।মেহনাজের কাঁধে হাত রাখতেই তেঁতে উঠে সে।রুক্ষ গলায় বললো—

    “প্লিজ,বাবা।এমন কিছু বলবে না যা আমি রাখতে পারবো না।”

    শরীফ অনুনয় করে বললো—

    “একবার অন্তত চল।জান্নাহ্ তোর সাথে দেখা করতে চায়।মেয়েটা কতো আগ্রহ নিয়ে বসে আছে।”

    তাচ্ছিল্য হাসে মেহনাজ।বাবার দিকে পূর্ণ নজর ক্ষেপন করে বললো—

    “হাসালে বাবা।একটা কথা বলবে বাবা,আমার একটা ভুলে আমার গায়ে হাত তুলেছিলে তুমি।আর জান্নাহ্!এতো বড় একটা নাটক করলো তুমি ওকে বাঁধা দেওয়ার বদলে উল্টো ওর নাটকে পার্টিসিপেট করলে!

    শরীফ তেজী গলায় বললো–

    “মেহনাজ!

    মেহনাজ নাক ফুলিয়ে দমদমে গলায় বললো—

    “জান্নাহ্কে তো অস্কার দেওয়া উচিত।কোটিপতির মেয়ে হয়েও একটা অনাথ,দরিদ্র মেয়ের অভিনয় করে যাচ্ছে।সমাজে চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে বাবা মায়ের মৃত্যুর পর মামা,মামির চক্ষুশূল ভাগ্নিকে টাকার বিনিময়ে ঘর থেকে বিদায় করতে পারলে শান্তি।এমনটাই সাজিয়েছিলে না পুরো নাটকটা?

    গর্জে উঠে শরীফ।তার এহেন আচরণে হসপিটালের নার্স চোখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো।এমন চাহনিতে বিব্রত হয় শরীফ।নিজেকে শান্ত করে শান্ত সুরে কঠোর গলায় বললেন—

    “জান্নাহ্ সারহানকে ভালোবাসে।আর ওরা সত্যি জানলে কী সারহানের সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে দিতো!শুধু শুধু জল ঘোলা হতো।তাই এমনটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।”

    উপহাসমিশ্রিত হাসে মেহনাজ।নিষ্কম্প গলায় জিঙ্গাসুসূচক হয়ে বললো—

    “ভালোবাসায় নাটক করার কী প্রয়োজন!ওই ছেলেকে ভালোবাসার কোনো স্পেশাল কারন?রাফাত!রাফাতের দোষ কোথায়?

    শরীফ প্রতিবাদের সুরে বললো–

    “তোকে এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।ওকে ওর মতো থাকতে দে।মেয়েটা এমনিতেও অনেক কিছু সহ্য করেছে।”

    অধর কোণে বিপন্ন হাসে মেহনাজ।গম্ভীর গলায় বললো—

    “এতো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে জান্নাহ্ ঠিকই তার ভালোবাসা পেলো।আর আমি!বিশ্বাস করে বারবার ধোঁকা খেয়েছি।আমার সাথেই এমন কেন হলো বলোতো!

    মেহনাজের চোখে উবরে আসে শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণ।ঝাপসা চোখে করিডোর থেকে সে দেখতে পায় স্ট্রেচারে করে একটা রোগীকে হসপিটালে ভেতরের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে।নিজের ভাগ্যের উপর বেদনাগ্রস্ত হাসি আসে মেহনাজের।প্রথমবার কাউকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে যখন হৃদয়টা ভেঙে গুড়িয়ে দিলো সেই ভাঙা মন নিয়ে দ্বিতীয়বার যখন কাউকে উজার করে ভালোবাসলো সেও তাকে ধোঁকা দিলো।সেই ধোঁকাটাও এতোই গভীরভাবে তাকে বিক্ষিপ্ত করলো এই মনে সে আর কোনোদিন কাউকে জায়গা দিতে পারবে।যে ক্ষতের অস্তিত্ব সে তার শরীরে বহন করে তা কোনো দিন মুছার নয়।
    ,
    ,
    ,
    অন্তরার খুশি যেনো আজ সাত অসমান ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।যখন থেকে জানতে পেরেছে জান্নাহ্ কনসিভ করেছে কী থেকে কী করবে ভেবে পায় না সে।পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছে গত একদিনে।জান্নাহ্কে না পারে মাথায় তুলে রাখতে।
    জমিরের বুকটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠে।সে দাদুভাই হতে চলেছে।পুরো ঘরের খুশির আমেজ তিতি বুঝতে না পারলেও ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে সে।জাবিনের মুখে হাসি।আফটার অল তার ভাই বা বোন আসতে চলেছে।যদিও ব্যপারটার একটু অকওয়ার্ড।তবুও জাবিন বেশ খোশমেজাজে আছে।জান্নাহ্ এর জন্য একগাদা আচার কিনে এনেছে।জান্নাহ্ জিঙ্গেস করতেই বললো,সে নাকি মুভিতে এমনটা দেখেছে।প্রেগন্যান্সিতে টক খেতে ভালো লাগে।তাই।তার এই বাচ্চাসুলভ আচরণে হেসে কুটুকুটি হয় জান্নাহ্।তার অবশ্য একটু লজ্জাও করছে।কী একটা সাংঘাতিক ব্যাপার!ষোড়শী জান্নাহ্ মা হতে চলেছে।ইশ!আর কয়েকদিন পর তারও একটা পিচ্চি বাবু হবে!ভাবতেই গা নেচে উঠে জান্নাহ্ এর।তার আর তার প্রাণের অংশ আসতে চলেছে।এখন আর তার শাশুড়ি তাকে কথা শুনাতে পারবে না।বাড়ির সবার মনে খুশির মোলায়েম,স্নিগ্ধ ভালোবাসার হাওয়া বইলেও কেউ একজন একদমই খুশি হয়নি এই খবরে।তার এতো বছরের সব পরিকল্পনা এক নিমিশেই ধূলিসাৎ করে দিবে জান্নাহ্ আর সারহানের অনাগত সন্তান।তা সে কিছুতেই হতে দিবে না।

    জান্নাহ্ এর প্রাণবন্ত হাসিতে যেনো স্বর্গ নেমেছে আজ এই বিরাণ বাড়িতে।কিন্তু জান্নাহ্ জানে না তার এই খুশি ভয়ংকর ঝড় তুলবে তার প্রাণের জীবনে।সেই ঝড়ে চিরতরে শেকড় হতে উপরে যাওয়া গাছের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তার প্রাণের অস্তিত্ব।

    হাসির ফোয়ারা বইছে জান্নাহ্ এর।গত এক ঘন্টা যাবৎ কথা বলছে সারহানের সাথে।সারহান আজ বেশ খুশি।কিন্তু কেন তা সে জানে না।কথার মাঝেই তিতি ওর আহ্লাদী গলায় ডেকে উঠে—

    “পরীমা,পরীমা।”

    সারহানের সাথে কথা শেষ করে মোবাইল রাখে জান্নাহ্।তিতিকে কোলে তুলে নিয়ে খুশি খুশি গলায় জিঙ্গেস করে—

    “কী হয়েছে তিতি?

    তিতি ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো—

    “আঙ্কেল এসেছে।”

    “কোন আঙ্কেল?

    “তায়িখ।”

    খিলখিলিয়ে উঠে জান্নাহ্।তিতির গালে শক্ত চুমু খেয়ে বললো—

    “শায়িখ।বলো।শা,,য়িখ।”

    “শাআআয়িখ।”

    “আমার পাখিটা।চলো।”

    শায়িখ ঘরে ঢুকে ফ্যানের নিচে বসেই কলারটা ছড়িয়ে দেয়।ঘামে ভিজে জামাটা ঝাপ্টে আছে তাকে।এক থালা মিষ্টি এনে রাখে তার সামনে শুভ্রা।অনেক বিস্ময় নিয়ে হতবাক হয়ে শায়িখ বললো—

    “মিষ্টি কেন হঠাৎ!কোনো খুশির সংবাদ?

    শুভ্রা ভ্রু ক্রুটি করে সন্দিহান গলায় বললো—

    “সারহান তোমাকে কিছু বলে নি?

    শায়িখ তার পুরু ঠোঁট জোড়া কুঁচকে রইলো।ভ্রু নাচিয়ে সাবলীল কন্ঠে বললো–

    “বলেছে।কিন্তু মিষ্টি খাওয়ার মতো কিছু ঘটেছে বলে তো মনে হয় না।”

    “আরে সারহা….।”

    কথা শেষ করতে দিলো না জান্নাহ্।মাঝ পথেই শুভ্রাকে থামিয়ে দেয় তার মখমলে কন্ঠে।

    “আপু।”

    শুভ্রা পেছন ফিরে তাকায়।শায়িখকে সালাম জানায় জান্নাহ্। প্রত্যুত্তরে শায়িখও উষ্ণ হাসে।তার দিকে একটা চেক বই এগিয়ে দেয়।সারহান বলেছে শায়িখকে দেওয়ার জন্য।বিগলিত হাসে শায়িখ।টপাটপ দুটো মিষ্টি মুখে পুরে নিয়ে ভজভজ করে বললো–

    “খুশির সংবাদটা কী ভাবিজান?

    মিষ্টি হাসে জান্নাহ্।লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো–

    “ওটা আপনার স্যারের কাছ থেকে জেনে নিবেন।”

    শায়িখ উঠে দাঁড়ায়।মৃদুহাস্য অধরে বললো–

    “ঠিক আছে।স্যারের কাছ থেকেই না হয় শুনবো।অনেক দিন স্যারের মুখে গুড নিউজ শুনি না।শুধু আউলাঝাউলা খবরাখবর।”

    শায়িখের এহেন কথায় ফিক করে হেসে ফেললো জান্নাহ্।মুহূর্তে শায়িখ গোমড়া মুখে বললো–

    “স্যার না আসা পর্যন্ত অনেক ঝামেলা হচ্ছে।শ্রীজা ম্যামের খুনি এখনো ধরা পড়েনি।রোজ রোজ পুলিশ আসায় আতঙ্কিত সবাই।”

    গোলগোল চোখে তার দিকে অভিনিবেশ করে জান্নাহ্।শুভ্রা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–

    “এই এইসব কী কথা বলছো ওর সামনে!এই সময় এই ধরনের কথা শুনতে নেই।জানো না জান্নাহ্…।”

    “আপু।”

    আবারো তাকে থামিয়ে দেয় জান্নাহ্।শায়িখকে ইশারা করে চলে যেতে।শায়িখ যেতেই উৎসুক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে শুভ্রা–

    “এই কী হয়েছে বলতো তোর!বারবার আমাকে থামাচ্ছিস কেন?

    জান্নাহ্ খসখসে ঠোঁট দুটো জীভ দিয়ে ভিজিয়ে অনুযোগের সুরে বললো—

    “সারহানকে বলিনি আমি।”

    শুভ্রা বাজ পড়ার মতো আঁতকে উঠে বললো–

    “কি!সারহান জানে না!কী বলছিস এইসব?

    জান্নাহ্ নম্র গলায় বললো–

    “সারহান জানে না।সে ফিরলে তারপর বলবো।”

    শুভ্রা জান্নাহ্ এর হাত ধরে ঝাঁকি মেরে ত্রস্ত কন্ঠে শুধালো–

    “এই তুই কী বলছিস বলতো!তুই কনসিভ করেছিস সেইটা সারহান জানে না?

    জান্নাহ্ ভোলা ভোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোলায়েম গলায় বললো–

    “উঁহু।”

    বজ্রকঠোর গলায় খেমটি মেরে উঠে শুভ্রা–

    “কী করেছিস বলতো?

    জান্নাহ্ কিছুক্ষন চুপ থেকে নির্বিকার গলায় বললো–

    “আম্মা যা বলেছে তাই করেছি।আমি পিল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”

    শুভ্রা চোখের পাল্লা ছড়িয়ে অবিশ্বাস্য গলায় বললো–

    “এমন কেন করলি তুই!সারহানকে না জানিয়ে এইসব করার কী দরকার ছিলো তোর!এখন আমি কিছু জানি না।তুই,তোর আম্মা আর সারহান বুঝবি।আমাকে কিছু বলতে পারবি না।”

    জান্নাহ্ ভীত গলায় বলে উঠে-

    “এমন করে বলো না প্লিজ।আম্মা বললো উনি সবকিছু সামলে নেবে।সারহানকে বোঝাবে।”

    শুভ্রা গা ঝাড়া দিয়ে বললো–

    “তাইলে বোঝা।আমাকে কেন বলছিস!

    টলটল করে উঠে জান্নাহ্ এর দুই চোখ।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪০
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    নৈঃশব্দের মাঝেও ভয়াবহ আলোড়ন।হাত দুটো বুকে ভাঁজ করে অপরাধির মতো দাঁড়িয়ে আছে ইহতিশাম।তার সামনেই চোয়াল শক্ত করে কপালে দীর্ঘ গম্ভীরতার রেখা টেনে স্থির,শান্ত কিন্তু ভয়ংকর আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে আছে সরফরাজ মাহমুদ।অত্যন্ত শান্ত হলেও তার কন্ঠ বেখাপ্পা শুনালো।

    “ইহতিশাম,হোয়াটস রং উইথ ইউ?

    ইহতিশাম মাথাটা হালকা উঁচু করে অনুযোগের সুরে সংক্ষিপ্ত শব্দে বললো–

    “সরি স্যার।”

    “হোয়াট?

    ইহতিশাম অবনত মাথা উঁচু করে তাকালো।এসির হাওয়ায় শীতল রুমেও ইহতিশামের গলা শুকিয়ে আসছে।ভ্যালভ্যাল দৃষ্টিতে সরফরাজের টেবিলে থাকা পানির গ্লাসের দিকে তাকাতেই সরফরাজ দাঁত কিড়মিড় করে বললেন–

    “ড্রিংক ইট।”

    ইহতিশাম আনুগত্যের সুরে বললো–

    “থ্যাংক ইউ।”

    ইহতিশাম চেয়ার টেনে বসলো।দীর্ঘ পনেরো মিনিট সে এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো।পানিটা নিয়েই ঢকঢক করে পান করলো।একটু ধাতস্থ হয়ে সরফরাজের দিকে তাকাতেই কম্পিত হলো তার শরীর।সরফরাজ আহত বাঘের মতো তার দিকে চেয়ে আছে।ইহতিশাম ফিকে গলায় বললো–

    “আরেকটু সময়ের প্রয়োজন আমার।”

    সরফরাজ উত্তেজিত গলায় বললেন–

    “সময়!আর কতো সময়!গত পাঁচ মাস ধরে তো সময় দিয়েই যাচ্ছি।”

    ইহতিশাম নির্বিকার গলায় বললো–

    “সরি স্যার।আমার কারণে যা হচ্ছে তার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।আপনি তো শুনেছেন মিস শ্রীজা ব্যানার্জীর কেসটার কথা।”

    সরফরাজ পাত্তাহীন ভাবে বললেন-

    “তো?

    ইহতিশাম দৃঢ় গলায় বললো–

    “আই থিংক এই কেসটাও বাকি কেসগুলোর সাথে জড়িত।একই মার্ডার উইপেন ইউস করা হয়েছে।শুধু ডাম্প করার পদ্ধতি ডিফারেন্ট।”

    সরফরাজ কৌতূহলী গলায় বললেন–

    “কী বলতে চাচ্ছো তুমি?

    ইহতিশাম নির্বিঘ্ন গলায় বললো–

    “সবগুলো খুনই একজন করেছে।আর সে একা নয়।আই মিন খুনি একের অধিক।”

    “আর ইউ সিরিয়াস?

    ” ইয়েস স্যার।”

    সরফরাজ মৌনতা অবলম্বন করলেন।তার চোখের সামনে তার মেয়ে সামিরার চেহারা ভেসে উঠলো।খুন হওয়ার আগেরদিন অনেক উৎফুল্ল ছিলো সামিরা।বাবাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো।কিন্তু সরফরাজ তখন জরুরি কাজে আউট অফ টাউন থাকায় সামিরা সিদ্ধান্ত নেয় সরাসরি বাবাকে খুশির খবর দিবে।কিন্তু তার আগেই..।আর ভাবতে পারলেন না সরফরাজ।মেয়ের সেই লাশের কথা মনে পড়লে আজো তার বুক কেঁপে উঠে।ইহতিশামের দিকে গাঢ় দৃষ্টি দিয়ে বজ্রকঠোর হয়ে বললেন–

    “অনলি ফিফটিন ডেইস।আই ওয়ান্ট রেজাল্ট।”

    ইহতিশাম প্রসন্ন হেসে আশ্বস্ত গলায় বললো–

    “শিওর স্যার।”

    চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তীক্ষ্ম গলায় শাঁসিয়ে উঠে ইহতিশামকে সরফরাজ।

    “পনেরো দিনের বেশি একদিনও নয়।তুমি না পারলে আমি ক্রাইম ব্রাঞ্চকে এই কেস হ্যান্ড ওভার করবো।যা আমি আগেই করতে চেয়েছিলাম।শুধুমাত্র সারহান তোমার নাম রিকোমেন্ড করেছিলো বলে আমি কেসটা তোমাকে দিয়েছি।”

    ভ্রু নাচায় ইহতিশাম।তার দুই চোখের কোণে একটা সমান্তরাল রেখা ফুটে উঠে।কিন্ত সে উদ্বিগ্ন নয়।সে আশ্বস্ত।সারহান তার নাম রিকোমেন্ড করেছে।কোনো বড় কারণ তো আছে।সরফরাজের রুম থেকে বের হতেই একটা উষ্ণ হাওয়া ধাক্কা মারে ইহতিশামকে।বিরক্তিতে তেতো হয় মুখটা।এই গ্রীষ্মকালকে একটা জবরদস্ত গালি দিতে ইচ্ছে হলো তার।কিন্তু মুহূর্তেই খেলে যায় তার মস্তিষ্কে একটা খেল।সারহান!কী চায় সে?
    ইহতিশাম ডেম শিওর এই খুনের সাথে কোথাও না কোথাও জড়িয়ে আছে সারহান।কিন্তু ইহতিশাম দ্বিতীয়বার ভুল করতে চায় না।সে আগে সারহানের সাথে কথা বলতে চায়।নিজের একটা ভুলে সারহানকে অন্ধকার গলিতে ছুঁড়ে ফেলেছে সে।আর সে ভুল করতে চায় না।এইবার সে বন্ধুত্ব নেভাবে।তাই পুরো বিষয়টা নিয়ে সারহানের সাথে কথা বলতে চায়।কিন্তু সারহানকেও পাওয়াও দুষ্কর।কল তো রিসিভ করেই না।উল্টো কোথায় আছে তাও জানা নেই ইহতিশামের।শায়িখটাও হয়েছে পাক্কা চামচা।সারহানের অনুমতি ছাড়া যেনো নিঃশ্বাসও নিতে চায় না।
    ,
    ,
    ,
    ক্লাস শেষে সিঁড়ি বেয়ে নামছে তিল আর জান্নাহ্।কৃঞ্চচূড়ার গাছটা কেমন কাঠ হয়ে আছে।জান্নাহ্ এর মন খারাপ হয়।কৃষ্ণচূড়া জান্নাহ্ এর বেশ ভালো লাগে।বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে যখন থোকায় থোকায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে থাকে পুরো গাছ তখন যেন আগুন ফুলের গাছ মনে হয়।
    কিন্তু আজ আর তা নেই। বিবর্ন সেই গাছ।গাছের পাতারাও শাখা-প্রশাখার সাথে আড়ি কেটেছে।সেদিকে তাকাতে তাকাতেই হোচট খায় জান্নাহ্।পড়তে গেলেই তাকে সামলায় তিল।তীক্ষ্ম সুরে কপট রাগ দেখিয়ে বললো—

    “আরে দেখে হাঁট।এখনই তো পড়ে যেতি।”

    ভড়কে গিয়ে নিজেকে সামলায় জান্নাহ্।বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।এখন তো সে একা নয়।তাকে সাবধানে থাকতে হবে।তিলকে জানানো হয়নি।মেয়েটা বিদ্যুতের মতো চঞ্চল।ছোট খাটো বিষয়েই আকাশ কাঁপিয়ে ফেলে।এই কথা শুনলে না জানি কী করে বসে!

    স্কুলের ভবন পার হয়ে গেইট অব্দি পৌঁছে যায় দুই বান্ধবী।চকিতে তিলের চোখ গিয়ে ঠেকে রাফাতের ওই হিমশৈল অবয়বে।গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে।চোখ দুটো একদম শান্তু,স্থির,নিষ্কম্প।যেনো কোনো কথা নেই সেই চোখে।তিলের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে ভুবন ভোলানো হাসি।উৎফুল্ল হয়ে একটা গুতো মারে জান্নাহ্ এর কনুইতে।ইশারায় রাফাতকে দেখায়।রাফাতের পাশেই বট বৃক্ষের ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ইশাক।তার চোখে মুখে উৎকন্ঠা।ঘাবড়ে যায় জান্নাহ্।তার পা দুটো স্থির হয়ে আসছে।প্রাণহীন মনে হচ্ছে নিজেকে।ফাঁকা ঢোক গিলতে থাকে জান্নাহ্।রাফাত ভ্রু কুঞ্চি করে ভাবুক নয়নে পর্যবেক্ষন করে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে।লুকাতে চায় জান্নাহ্।কিন্তু রাফাত নাছোড়বান্দা।তার প্রশ্নের উত্তর আজ তার চাই।রাফাত পদযুগল বাড়াতেই ইশাক ধুম করে তার কাঁধে চাপড় মেরে বসে।কড়া গলায় বললো–

    “ঝামেলা করিস না।পাশে ওর ফ্রেন্ড।”

    রাফাত স্থির হয়।নিজেকে সংযত করে।জান্নাহ্ এখনো ভয়াতুর চোখে তাকিয়ে আছে।চোখের পল্লব যেনো আপনা আপনি তার কম্পন বাড়িয়ে চলছে।গলা ধরে আসে জান্নাহ্ এর।হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে আসে।তিল নিজের বাড়ির দিকে চলে গেছে অনেকক্ষন।কিন্তু চিন্তায় সেইদিকে মনোযোগ নেই জান্নাহ্ এর।চঞ্চল পা দুটো চলছেই বিরতিহীন।হতবুদ্ধির মতো থমকে যায় জান্নাহ্।তার সামনে অশ্বথ গাছের মতো উদ্ভব হয় রাফাতের।চমকে গিয়ে দু’কদম লাফিয়ে পিছু হটে জান্নাহ্।ঝাড়া মেরে উঠে বললো–

    “এইসবের মানে কী রাফাত!

    রাফাত মিচকি হাসলো।কৌতুকের ছলে বললো—

    “ওয়েলকাম রেড চেরি।
    তলে তলে পাখি তুমি খেয়েছো যে ধান
    এইবার পাখি তোমায় বাঁধিবে পরাণ।

    জান্নাহ্ নাকের পাল্লা ফুলিয়ে চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে ধৈর্য্য হারা হয়ে বললো—

    “এইসব কী বলছো তুমি?

    মৃদুহাস্য অধরে শুধালো রাফাত—

    “কেমন আছো জান্নাহ্?

    জান্নাহ্ বিতৃষ্ণা গলায় দৃঢ় হয়ে বললো–

    “যেতে দাও আমাকে।”

    ঝরঝরে হাসে রাফাত।মুগ্ধ নয়নে দেখে তার রেড চেরি ওই ভাসন্ত দুই চোখে।দীর্ঘ অক্ষিপল্লব ভিজে যেনো আরো কৃষ্ণকালো বর্ণ ধারণ করেছে।রাফাত প্রশ্বস্ত গলায় বলে উঠে—

    “আমার প্রশ্নের জবাব?

    জান্নাহ্ এর গলা বসে আসে।শুকনো গলায় কথা আটকে যায়।দূর্বল গলায় বললো—

    “প্লিজ রাফাত,চলে যাও তুমি এখান থেকে।প্লিজ।”

    ফুঁসলে উঠে রাফাত বললো–

    “তাহলে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।”

    জান্নাহ্ আর্দ্র গলায় বললো–

    “আমি তোমাকে কিছু বলতে পারবো না।যদি সত্যিই তুমি তোমার রেড চেরির ভালো চাও তাহলে চলে যাও এখান থেকে।আর কখনো এসো না।”

    রাফাত রুক্ষ কন্ঠে ঘোষণা করলো—

    “যতক্ষন না আমার প্রশ্নের জবাব আমি পাচ্ছি আমি কোথাও যাচ্ছি না।কীসের এতো নাটক!কেন এই মিথ্যের মায়াজাল!কী সেই কারণ?বলো আমাকে জান্নাহ্।”

    ফুঁসে উঠে জান্নাহ্।মেঘের মতো গর্জন করে বললো—

    “কোনো জবাব আমি তোমাকে দেবো না।যেতে দাও আমাকে।”

    রাফাতকে পাশ কাটিয়ে যেতেই জান্নাহ্ এর হাত চেপে ধরে রাফাত।তৎক্ষণাৎ গা গুলিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর।মুখভর্তি বমি আসতেই মুখ চেপে ধরে নিজের।আটকাতে পারলো না।গরগর করে ফুটপাতের দেয়াল ধরে বমি করে দেয়।রাফাত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তার দৃষ্টি যেনো আজ তাকেই ধোঁকা দিচ্ছে।একটু ধাতস্থ হয়েই তীব্র গতীতে শ্বাস ফেলতে থাকে জান্নাহ্।তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।দ্রুত পা চালায় সে।
    রাফাতের পেছনে এসে দাঁড়ায় ইশাক।উৎসুক কন্ঠে বললো–

    “কীরে কী হয়েছে?

    রাফাত ভয়ংকর শীতল গলায় বললো–

    “জান্নাহ্ মা হতে চলেছে।আমার রেড চেরির শরীরে অন্য কারো সত্তা।তুই ভাবতে পারছিস!

    ইশাকের উদ্ভাসিত,স্থির নয়ন জান্নাহ্ এর এলোমেলো পায়ের দিকে।জান্নাহ্ চলছে।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪১
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    বিছানার উপর এক পা হাঁটু ভেঙে অন্য পা ঝুলিয়ে মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে শুয়ে আছে সারহান।তার সাবলীল দৃষ্টি ওই ফ্যানের দিকে।কেমন করে ঘুরছে!ভনভন,ভনভন।আচ্ছা,ফ্যানের কী তিনটা পাখা!ঘুরলে বোঝা যায় না কেন?ছোটকালে যখন মাথার উপর এমন ফ্যান ঘুরতো মনে হতো এই যা এখনই মাথার উপর ঠুস করে পড়লো বুঝি।কিন্তু না,পড়লো না কখনো।আচ্ছা ফ্যানটা মাথায় পড়লে কী আমি মারা যেতাম!আমার মাথাটা থেঁতলে যেতো!যদি থেঁতলে যাওয়ার পরও বেঁচে যেতাম।ছিঃ!কী বিচ্ছিরি হতো ব্যাপারটা।

    এমনটা ভাবতে ভাবতেই সারহানের চোখ বুজে আসে।আজ সন্ধ্যায় সে বাংলাদেশ ব্যাক করেছে।বাড়ি আসার কোনো প্ল্যান ছিলো না।কিন্তু অন্তরার মুখে জান্নাহ্ এর কথা শুনে বিনা সময় ব্যয়ে বাড়ির পথ ধরে সারহান।

    সারহানের পায়ের কাছেই এক সমুদ্র দ্বিধা নিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে জান্নাহ্।তার চোখের পাঁপড়িগুলো ভেজা।সারহান আসার পর থেকে একটা কথাও বলেনি।বিছানায় শুয়ে আছে নিস্তব্ধ হয়ে।নৈঃশব্দ কাটিয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বলে উঠে সারহান—

    “এতোবড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন আমাকে না জানিয়েই?

    জান্নাহ্ মৃদু আওয়াজে কেঁদে উঠে।ফুঁপিয়ে যাচ্ছে সে।সারহান আবারো নির্বিকার গলায় শুধায়–

    “কাজটা কী ভালো করলেন আপনি?

    জান্নাহ্ ভেজা গলায় বললো–

    “প্লিজ সারহান,আমার কথা শুনুন।”

    সারহান উঠে বসে।ভাঁজ করা হাঁটু নিচে নামিয়ে দু পা ঝুলিয়ে দিয়ে দুলাতে থাকে।পা দুলাতেও একটা আর্টের প্রয়োজন হয়।সারহান যখন ক্লাস সেভেনে পড়তো তখন এক স্যারকে প্রশ্ন করলে স্যার বলে এতো দুঃচিন্তা দূর হয়।
    তখন না বুঝলেও এখন সারহানের মনে হয় কথাটা সবার ক্ষেত্রে না হলেও তার পক্ষে ঠিক।ঘাড়টা দু’পাশে হেলিয়ে আবার সোজা করে।নরম গলায় বললো–

    “বলুন,কী বলবেন।”

    জান্নাহ্ সারহানের দিকে সিক্ত চোখে তাকায়।জান্নাহ্ এর দুই চোখ লালিমা ধারণ করেছে।নাকের ডগাও লালচে।ফর্সা মুখটাও কেমন ফিকে।সারহান থমথমে ভাব ধরে তাকিয়ে রইলো।সরু ভ্রু দুটো কপালের মাঝ থেকে উঁচিয়ে ইশারা করলো।জান্নাহ্ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো–

    “প্লিজ সারহান।আই এম সরি।”

    অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেললো সারহান।চোখে হেসে বললো—

    “কীসের জন্য সরি?আপনি এইসব মায়ের কথায় করেছেন।আমার কথার কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে?

    কাতর গলায় অনুনয় করে বললো জান্নাহ্—

    “প্লিজ,সারহান।এইভাবে বলবেন না।আম্মা বলেছে তাই..।”

    “আপনার এমন কেন মনে হলো!বাচ্চার জন্য আমি আবার বিয়ে করবো!

    ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।মেকি কৌতুকপ্রদ হয়ে সারহান বললো–

    “আরে কাঁদছেন কেন আপনি!আপনার তো খুশি হওয়া উচিত।পড়ালেখার কোনো দরকার নেই আপনার।ইচ্ছে হয়েছে পনেরো বছর বয়সেই বিয়ে করে ফেললেন।ইচ্ছে হলো ষোলো বছর বয়সেই মা হয়ে যাবেন।ক্যায়া জিন্দেগি হ্যায়!

    ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সারহানকে দেখে জান্নাহ্।যেনো তার কোনো আগ্রহ নেই এই বিষয়ে।খুশি হওয়ার বদলে যেনো ঘোর অমাবস্যা নেমে এলো জান্নাহ্ এর খুশির দুয়ারে।সারহান উঠে দাঁড়ায়।দুই হাত উঁচু করে আড়মোড়া ভাঙার মতো আচরণ করে খেয়ালিপনায় বললো–

    “ভালোই করেছেন।আমার চেয়ে আপনার শাশুড়ি আপনার কাছে বেশি আপন।তাই আমাকে না জানিয়ে এতোবড় একটা স্টেপ নিয়ে নিলেন।ওয়েল বি হ্যাপি।”

    সারহানের এই একেক টা শব্দ যেনো বিষের ফলা হয়ে বিঁধতে থাকে জান্নাহ্ এর কোমল মনে।তার সকল খুশি যেনো বিষাদে রূপ নেয়।সারহান দুই হাত পকেটে পুরে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায়।তেতো কন্ঠে ফিচেল হেসে বললো–

    “ভাবুন তো একবার,যদি আপনার মেয়ে হয়।যেই শাশুড়ি আপনাকে মাথায় নিয়ে নাচ্ছে সেই এই বাড়ি থেকে বিদায় করে দিবে আপনাকে।তখন কী হবে বলুন তো?

    জান্নাহ্ ভীত সুরে বলে উঠে–

    “সারহান!এইসব কী বলছেন?

    ফুরফুরে হাসে সারহান।জান্নাহ্কে টেনে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে।স্নিগ্ধ কন্ঠে মিষ্টি করে বললো–

    “এতো বড় পাগলামি কেন করলেন?আপনার বয়স মাত্র ষোলো।তার উপর সামনে আপনার বোর্ড এক্সাম।এতো বড় রিস্ক কেন নিলেন?

    জান্নাহ্ দুই হাতে খামচি মেরে ধরে সারহানকে।মোলায়েম গলায় বললো–

    “পরীক্ষা সামনের বছর দিবো। এই বছর মা হবো।”

    সারহান দুই হাতের বাঁধনে শক্ত করে আড়ষ্ট করে জান্নাহ্কে।নরম কন্ঠে শুধালো–

    “এতো ভালোবাসা কোথায় রাখবো আমি?

    জান্নাহ্ দুষ্টমির ছলে বললো—

    “জানি না।”

    জান্নাহ্কে ছেড়ে নিচে বসে সারহান।তার নরম পেটে টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে বললো—

    “এখানে আছে আমার ছোট্ট পরী।দেখে রাখতে পারবেন তো?

    জান্নাহ্ মিষ্টি হেসে বলল–

    “হুম।”

    ডিভানে বসে সারহান।মাথাটা ঠেকিয়ে দেয় ডিভানের উঁচু বোর্ডের দিকে।তার পাশেই জান্নাহ্ সারহানের দিকে নরম দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।
    মখমলে গলায় বললো—

    “এইবার থেকে আমরা বাড়িতেই থাকবো।আপনি এখানেই চলে আসুন।”

    অধর কোণে বাঁকা হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর দিকে মুখ করে তার গালে হাত রেখে সরব গলায় বললো—

    “নাহ।আমার স্ত্রী আর সন্তানকে চালানোর মতো যোগ্যতা আমার আছে।তাদের জন্য কারো দারস্থ আমাকে হতে হবে না।”

    “কিন্তু..।”

    জান্নাহ্কে কথা বলতে না দিয়ে রসালো গলায় সারহান বললো–

    “আপনাকে অনেকদিন চুমু খাই না।”

    হতবুদ্ধি জান্নাহ্ কিছু বুঝে উঠার আগেই তার অধরপল্লব আঁকড়ে ধরে সারহান।

    “মামা।”

    তিতির বাচ্চা কন্ঠে সারহানকে এক ধাক্কা মারে জান্নাহ্।লজ্জায় কুপোকাত সে।নিজের ঠোঁটে স্লাইড করে ফিচেল হাসে সারহান।তিতিকে কোলে টেনে নেয়।
    নম্র গলায় বললো–

    “এখনো ঘুমায় নি কেন আমার প্রিন্সেস?

    তিতি আমুদে গলায় বললো–

    “বাবু কোথায়?

    আলতো হাসে জান্নাহ্।তিতির গাল টিপে বললো–

    “বাবু তো আল্লাহর কাছে।”

    মুখটা চুপসে যায় তিতির।চোখ দুটি টিমটিম করে ঠোঁট গুঁজ করে বললো—

    “আনো।”

    সারহান তিতির গাল টেনে সরস গলায় বললো–

    “আনবো তো।আগে আমার তিতিপাখি বড় হোক।বাবুকে কোলে নিতে হবে তো।”

    “আমি পারি।”

    “তাই নাকি।ওকে নিয়ে আসবো।”
    ,
    ,
    ,
    ঘরে ঢুকেই চড়ুই পাখির মতো মাথা নাড়াতে থাকে লুবনা।আজ সকালেই সারহানের ছোট চাচার বউ আর তার মেয়ে এসেছে।সারহানের ছোট চাচার তিন মেয়ে।বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে।তারা তাদের স্বামীর সাথে একজন দেশের বাইরে থাকে আরেকজন গৃহস্থ পরিবারের বউ।সারহান বর্তমানে তাদের বংশের একমাত্র ছেলে।

    লুবনা এদিক ওদিক তাকায়।ঘরে কেউ নেই।এইবার এইস.এস.সি দিয়েছে সে।তার ছড়ানো চুলগুলো পুরো পিঠ দখল করে আছে।ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ পেয়েই বুঝতে পারে সারহান ওয়াশরুমে।ছোট ছোট পায়ে বেড সাইড টেবিলের দিকে এগিয়ে আসে লুবনা।সেখানে একটা ফটো ফ্রেম।যেখানে সারহান আর জান্নাহ্ এর একটা বাঁধানো ছবি।ঠোঁট দুটো গুঁজ করে চোখ দুটো ক্ষীন করে লুবনা।নাক কুঁচকে তীব্র আক্রোশ প্রকাশ করে সারহানের ওই হাস্যোজ্জ্বল মুখটার দিকে।মুখে চিবানো চুইংগামটা হাতে নিয়ে তা ছবিটায় থাকা সারহানের মিষ্টি মুখটার উপর সেঁটে দেয়।এক পৈচাশিক আনন্দ পায় লুবনা।ফিক করে হেসে চোখে টিপ্পনী কাটে।আচম্বিত হয় নিজের হাতে বলিষ্ঠ কোনো কিছুর চাপে।দুরুদুরু করতে থাকে লুবনার বুক।গলা শুকিয়ে কাঠ।তার হাত শক্ত করে ধরে আছে সারহান।

    পাতলা টিশার্টের সাথে ফোর কোয়ার্টার প্যান্ট পরা।চোখ দুটো বড় বড় করে ধমকে জিঙ্গেস করে সারহান—

    “কী করছিলি তুই?

    বুকটা কেঁপে উঠে লুবনার।ছোটবেলা থেকেই সারহান আর লুবনার সাপে নেঁউলে সম্পর্ক।ছবিটা উল্টো করে টেবিলের উপর রাখে।হালকা চেপে দাঁড়ায় যেনো তা সারহানের নজরে না আসে।সারহান আবারও ধমকে উঠে–

    “কথা বলছিস না কেন লবণ!কী করছিলি এইখানে?

    লুবনা ভীত গলায় কথা আটকে আটকে বললো—

    “কককইই কিইইইইছুছুছু নাআআআ তো।”

    সারহান সরু ভ্রু জোড়া কুঞ্চি করে সন্দিহান চোখে তাকায়।অধর কোণ চিপে ধরে সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো—

    “কিছুই করিস নি?

    লুবনা দ্বিধা ও ভয় নিয়ে মিনমিনে গলায় বললো—

    “ননননাআআ।”

    সারহান লুবনাকে হালকা টান দিয়ে সরিয়ে দেখে তার আর জান্নাহ্ এর ছবিটা উপুর করা।ডান হাতে লুবনার হাত চেপে ধরাতে তাকে ডিঙিয়ে বা’হাত দিয়ে ছবিটা সিধা করে দেখে লুবনার অকাজ।দমদমে গলায় বলে উঠে সারহান—

    “লবণের বাচ্চা কী করেছিস এইটা!

    লুবনার যেনো শক্তি সঞ্চার হলো।খেমটি মেরে উঠে দম্ভ করে বললো—

    “বেশ করেছি।তোমার মতো টারজানকে জান্নাহ্ এর মতো মিষ্টি মেয়ের সাথে একদম মানায় না।তাই ব্ল্যাঙ্ক করে দিলাম।না থাকবে বাঁশ,না বাঝবে বাঁশুরী।”

    কথা শেষ করে পাত্তাহীনভাবে নিজের ঠোঁট বাঁকায় লুবনা।সারহানের চোখ দিয়ে যেনো তপ্ত আভা নির্গত হয়।হাতের চাপ বাড়াতেই আর্তনাদ করে উঠে লুবনা।

    “ও মা আমার হাত!

    সারহান ফিচেল হেসে দৃঢ় গলায় বললো–

    “দেখ এইবার তোর কী অবস্থা করি।”

    লুবনার বুঝতে দেরি হয় না।তার সাথে ভয়াবহ কিছু হতে চলেছে।সারহানের মস্তিষ্ক চলছে মিচকিগিরি।চুইংগামটা নিয়ে সোজা লুবনার চুলে লাগাবে।সারহানের সাথে কখনো পারে না লুবনা।তবুও দুইজন যেনো এক বনে বাস করা দুই বাঘ।একজন আরেক জনকে সহ্য করতে পারে না।সারহানকে পছন্দ হলেও তার কার্যকলাপে অতিষ্ঠ লুবনা।ছোটবেলা থেকেই লুবনাকে লবণ বানিয়ে ফেলা সারহান বাইরে এতো মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখলেও কখনো ঘরের মেয়েদের দিকে তার দৃষ্টি ছিলো না।যা ছিলো অপরিমেয় মায়া আর ভালোবাসা।জান্নাহ্ অন্তঃসত্ত্বা সেই খুশিতেই সারহানের চাচাকে আসতে বলা হয়।কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি আসেন নি।

    কাঁদো কাঁদো হয়ে লুবনা বললো–

    “সারহান ভাইয়া ছাড়ো।লাগছে আমার।”

    সারহান ঝট করে ঠোঁট দুটো গোল করে কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বললো–

    “ও,,লাগছে লবণের।”

    “তুমি আমাকে লবণ বলো কেনননননন?

    সারহান বিনয়ী দৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখে লুবনাকে।চিবুকের সাথে হাতের আঙুল ঠেকিয়ে তর্জনী দিয়ে গালের মাঝের কয়েকটা টৌকা মেরে কিছু ভাবার মতো অঙ্গভঙ্গি করে ফিচেল গলায় বললো—

    “তোকে দেখে তো আমার মিষ্টির কথা একদম মনে পড়ে না,পাজি লবণাক্ত।”

    সারহান তার গাল থেকে হাত সরিয়ে চুইংগাম নিয়ে যেই লুবনার মাথায় হাত দিবে তখনি সেন্টার টেবিলে থাকা পানির জগ হাতড়ে নিয়ে তা ঝপ করে পুরো ঢেলে দেয় সারহানের মাথায়।চমকে লাফিয়ে উঠে সারহান।হাতের বাঁধন শিথিল হতেই ভোদৌঁড় লাগায় লুবনা।সারহান চেচিয়ে বললো–

    “লবণাক্ত,একবার হাতের কাছে পেয়ে নেই তোকে।”

    রান্নাঘরে ব্যস্ত জান্নাহ্।তার সাথে আছে নিধি।আড়চোখে বারবার জান্নাহ্কে দেখছে সে।জান্নাহ্ বুঝতে পেরেও কোনো উচ্চবাচ্য করলো না।বাসায় মেহমান।অন্তরা মানা করার পরও শুধুমাত্র একটা আইটেম বানানোর অনুমতি পেয়েছে জান্নাহ্।গরুর মাংসের কালা ভূনা।জান্নাহ্ এর বাবা তাকে রান্না করে খাওয়াতো।এইটা খুব ভালো রান্না করতে পারে সে।চুপ্পি ভেঙে নিধি স্বশব্দে বললো–

    “একটা কথা বলবো তোমাকে?

    জান্নাহ্ অস্ফুট আওয়াজে বললো–

    “হু।”

    সাবলীল গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে নিধি–

    “রাফাতকে তুমি আগে থেকেই চিনো?

    চোখ বাকিয়ে তাকায় জান্নাহ্।তার চাহনি অদ্ভুত শান্ত।আলতো হেসে বললো–

    “তোমার এমন মনে হলো কেন?

    ভ্রু নাচিয়ে দ্বিধান্বিত গলায় বললো নিধি—

    “মনে হলো।রাফাত যেভাবে…।”

    তড়িৎ বেগে বলে উঠে জান্নাহ্—

    “হ্যাঁ।চিনি রাফাতকে।সে আমাদের স্কুলের খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলো।আপাতত নেই।এর বেশি কিছু না।”

    আশ্বস্ত হতে পারলো না নিধি।ম্লাণ গলায় বললো–

    “রাফাত ঢাকা চলে গেছে।জানো তুমি?

    একটা বড় শ্বাস ফেললো জান্নাহ্।ত্রস্ত হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে লুবনা।ব্যথায় মুখ ফুলিয়ে বললো—

    “দেখো তোমার ওই শয়তান টারজানটা আমার হাতের কী অবস্থা করেছে!

    জান্নাহ্ স্টোভটা নিভিয়ে লুবনার কাছে গিয়ে দেখে সারহান যেখানে ধরেছিলো জায়গাটা নীল হয়ে আছে।ব্যস্ত গলায় জান্নাহ্ বললো–

    “এইসব কী করে হলো লুবনা আপু?

    লুবনা তীর্যক গলায় রাগ নিয়ে বললো–

    “ওই শয়তান সারহান করেছে।বিয়ে করলে কেন তুমি ওকে!শয়তানটা সারা জীবন আবিয়াত্তাই থাকতো।আবার বাবাও বানাচ্ছো!

    ছোট্ট শ্বাস ফেলে জান্নাহ্।বিয়ের সময় এসেছিলো লুবনা।তখন থেকেই জান্নাহ্ এর প্রতি অনেক টান।নিজের বোনদের বিয়ের হয়ে যাওয়ায় এখানে এলেই সারাদিন প্রভু ভক্ত বিড়ালের মতো ঘুরতে থাকে জান্নাহ্ এর আশেপাশে।হয়তো সারহানকে অপছন্দ করে বলেই জান্নাহ্কে এতো পছন্দ লুবনার।

    ঘরে এসে দেখে বিছানার উপর ভেজা টিশার্টটা ছুঁড়ে ফেলে রেখেছে সারহান।সারহানের এই অভ্যাস বদলানোর নয়।জামা কাপড় এখানে সেখানে ছুঁড়ে ফেলা।বিছানার উপর থেকে টিশার্টটা হাতে তুলে নিতে থমথমে গলায় প্রশ্ন করে জান্নাহ্–

    “লুবনা আপুর সাথে এমন করলেন কেন?

    সারহান কালো রঙের পাতলা টিশার্ট গায়ে গলিয়ে নিয়ে কড়া গলায় বললো–

    “হাতের কাছে একবার পাই লবণটাকে।ওকে যদি না গলিয়েছি আজ!

    চোখ তুলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় জান্নাহ্।এ নতুন কিছু নয়।
    ঘরে এসেই জান্নাহ্কে খুঁজতে থাকে লুবনা।জান্নাহ্ সারহানের ভেজা টিশার্ট টা বারান্দায় মেলে দিয়ে সবেই ঘরের দিকে পা রেখেছে।
    লুবনাকে দেখে কোনো উল্লেখ্য যোগ্য প্রতিক্রিয়া করলো না সারহান।মোবাইলে দিব্যি ফ্রি ফায়ার খেলছে।লুবনার অগোচরেই একবার তাকে দেখে নেয় সে।ডিভানে পা ছড়িয়ে কুশনের মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।

    লুবনা তার পাতলা ঠোঁট দুটোকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ভেঙচি কাটে সারহানকে।দম দম করে পা ফেলে জান্নাহ্ এর কাছে গিয়ে আনম্র গলায় বললো–

    “জান্নাহ্,চাচী তোমাকে ডাকছে।”

    জান্নাহ স্মিতহাস্য অধরে বললো–

    “তুমি যাও আমি আসছি।”

    “আচ্ছা।”

    ঘুরে দাঁড়িয়ে আবারো সারহানের দিকে নজর দেয় লুবনা।এইবারও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না সারহান।সে মশগুল তার কাজে।ছোট্ট শ্বাস ফেলে সামনে এগোতে থাকে।চকিতে ধুম করে সামনের দিকে হেলে পড়ে লুবনা।সারহান ডিভানের সামনে থাকা সেন্টার টেবিলটাকে হালকা ধাক্কা মারে পা দিয়ে।আর তাতেই আঘাতপ্রাপ্ত হয় লুবনা।আর্তনাদ করে উঠে লুবনা।

    “ও মাগো আমার পা!

    ভাবলেশহীনভাবে শুয়ে আছে সারহান।কৌতুকমাখা গলায় বলে উঠে–

    “রজনীগন্ধা,জালে লবণাক্ত ইলিশ ধরা পড়েছে।”

    জান্নাহ্ ব্যস্ত হয়ে এসে অসহিষ্ণু গলায় বললো-

    “তুমি ঠিক আছো তো?

    ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলে লুবনা।জান্নাহ্ তাকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়।কান্নার তোড় বাড়তে থাকে লুবনার।কেঁদে কেঁদে বললো—

    “শয়তান টারজান।”

    সারহান মিচকি হেসে ফিচেল গলায় বললো–

    “এখন তো শুধু আঙুল ভেঙেছে আরেকটা কথা বললে তোর পা ভেঙে ফেলবো লবণাক্ত ইলিশ।জান্নাহ্ কীরে!ভাবি বল।”

    লুবনা ঘোর আপত্তি করে বললো—

    “বলবো না।”

    “লবণ কী ডেকচি!জিহ্বা কেটে ফেলবো তোর আমি আরেকবার নাম ধরে ডাকলে।”

    লুবনা জোর গলায় অসহায় হয়ে বললো—

    “দেখলে,দেখলে কী বললো তোমার ওই শয়তান বর।কেন বিয়ে করলে ওকে?তুমি বিয়ে না করলে সারাজীবন আয়বুড়ো থাকতো।শিক্ষা হতো ওই টারজানের।”

    মুচকি হাসে জান্নাহ্।সারহান মাথাটা হালকা কাত করে মজার ছলে বললো—

    “আমাকে তো কেউ বিয়ে করেছে।তোকে যে বিয়ে করবে তার জীবনটা নোনতা সমুদ্র বানিয়ে ফেলবি লবণ কী বাচ্চি।বের হ আমার ঘর থেকে।”

    “শয়তান টারজান।উহু!কী অবস্থা করেছে আমার পায়ের!

    জান্নাহ্ মৃদু গলায় পরম যত্নে বললো–

    “তুমি বসো,আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি।”

    “দাও দাও।বর পা কেটে দিয়েছে এইবার বউ চিকিৎসা করে দাও।”

    সারহান স্বাভাবিক গলায় বললো—

    “তাহলে আর কী ফ্রি চিকিৎসা পাবি।আয় তোর পা ভেঙে দেই।”

    লুবনা মেকি কান্না করে বলে উঠে—

    “দেখলে শয়তানটা কী বলছে!

    জান্নাহ্ স্বাভাবিক গলায় বললো–

    “শান্ত হও।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪২
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    জান্নাহ্ এর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে সারহান।তার অধরে বাঁকা হাসি আর চোখে একরাশ প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।সোজা হয়ে বসে অত্যন্ত সাবলীল কিন্তু দৃঢ়চিত্তে প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান—

    “আপনাকে দেখে কেরানির মেয়ে মনে হয় না।মনে হয় কোনো ডক্টরের মেয়ে।সবকিছুই যেনো ছোটবেলা থেকেই আপনাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে?

    জান্নাহ্ এর মধ্য কোনো ভাবাবেশ হলো না।বারান্দায় থাকা কিছু শুকনো কাপড় এনে তা ভাঁজ করতে করতে সরল গলায় নির্বিঘ্নে বললো—

    “প্রাথমিক চিকিৎসা সবার জানা উচিত।তা ডক্টরের মেয়ে হোক আর কেরানির।”

    সারহান প্রশ্রয়ের সুরে বললো–

    “ওয়েল সেইড।আর আপনার ফোবিয়া?

    ভাঁজ করা কাপড়গুলো আলমিরাতে গুঁছিয়ে রেখে স্বশব্দে বললো জান্নাহ্—

    “প্রেগন্যান্সিতে ব্লিডিং এর ব্যাপার আছে।তাই আগে থেকেই ট্রিটমেন্ট নিচ্ছি।আপনি ইচ্ছে করলে শুভ্রা আপুকে জিঙ্গেস করতে পারেন।”

    সারহানের হাতে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেয় জান্নাহ্।সন্দিগ্ধ দুই চোখ দিয়ে ভ্যাবলার মতো প্রেসক্রিপশন আদ্যোপান্ত দেখছে সারহান।মিচকি হেসে স্বগতোক্তি করে বললো—

    “অস্কার তো আপনাকে দেওয়াই উচিত রজনীগন্ধা।ফুল প্রুভ প্ল্যাণ করেই নেমেছেন।আপনার বাবা না জানি আপনাকে কী খাইয়েছে!

    পায়ের আঙুলের ব্যাথায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে লুবনা।তা দেখে হেসে কুটিকুটি জাবিন।হেসে হেসে বললো–

    “কী হলো লবণ আন্টি!মামা বুঝি তোমার আঙুল ভেঙে দিলো!

    লুবনা গর্জে উঠে বললো—

    “এক থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো।লবণ কিরে?

    হা হা করে হেসে উঠে জাবিন।ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে হাত চেপে হাসে তিতি।পাশেই থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়ানো নিধি।জাবিন একগাল হেসে ফিচেল গলায় বললো–

    “মামার সাথে লাগতে গেলে কেন!জানো না,তাকে ইটের টুকরো মারলে পুরো আস্ত ইট ছুঁড়ে মারবে তোমাকে।”

    “জাবিন!

    শুভ্রার ধমকানোতে ভ্রু ক্রুটি করে জাবিন।উষ্ণ গলায় শুভ্রা আবার বললো—

    “এইসব কী ধরনের কথাবার্তা বড়দের সাথে?

    জাবিন ভেঙচি কেটে হেয়ালি গলায় বললো—

    “আমি কী করলাম!লবণ আন্টিইতো মামার সাথে লাগতে গেছে।”

    শুভ্রা দাঁত কিড়মিড় করে বললো—

    “আবার!

    প্রাণখোলা হাসে জাবিন।হাঁটু ভেঙে বসে তিতিকে বললো—

    “চল তিতি,পরীমা আর মামা আমাদের জন্য বাবু আনছে সেই খুশিতে আজ তোকে কুলফি খাওয়াবো।”

    তিতি দাঁতের সাথে দাঁত পিষে ধরে অদ্ভুতভাবে হাসে।স্বশব্দে বললো–

    “আচ্ছা।”

    নিজের ঘরে অন্তরা তার জা এর সাথে খোশখল্পে মশগুল।জরুরি দরকার ছাড়া তেমন একটা মিল নেই তাদের।দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি প্রার্থনা করে জান্নাহ্।

    “ভেতরে আসবো আম্মা?

    অন্তরা পান খাওয়া দুই ঠোঁট ছড়িয়ে বললো—

    “আসো বউ।”

    কোনোরকম ছন্দ পতন ছাড়াই অন্তরার পাশে গিয়ে বসে জান্নাহ্।লুবনার মা লতা অবাক গলায় বললেল—

    “বাহ!পোয়াতি হইয়া তো বউমা আরো সুন্দরী হইছে।কী কও আফা?

    অন্তরা মুখে একটা পাট ঠুসে নিয়ে ভজভজ করে বললেন—

    “কেন!আমার বউমা এমনেই সুন্দরী।”

    অন্তরার সাথে তাল মিলিয়ে লতা হেসে হেসে বললেন—

    “কথা তো ঠিক আছে।কিন্তু বিয়ার সময় তো এই চিকন আছিলো।এহন তো গায়ে গতরেও বড় হইছে।আর কী ফর্সা হইছে দেখছো!চুলগুলানও মাশাআল্লাহ্!

    অন্তরা দাম্ভিকতার সাথে হাসলেন।যেনো তিনি এভারেস্ট জয় করলেন।উচ্ছ্বাসিত গলায় বললেন–

    “তা তুই ঠিক ই কইছোস।বউমা আগের তোন মেলা সুন্দরী হইছে।”

    ছোট্ট দম ফেলে জান্নাহ্।এছাড়া কী আর কথা নেই!জান্নাহ্ সংকীর্ণ গলায় বললো–

    “আম্মা,ডাকছেন আমাকে?

    অন্তরা মাথা নেড়ে বললেন—

    “হয় ডাকছি তোমারে।তোমার কাকিমা তোমারে কিছু কইতে চায়।”

    জান্নাহ্ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে লতাকে বললো–

    “কিছু বলবেন কাকিমা?

    সরস হাসলেন লতা।ফিকে গলায় বললেন—

    “তুমি কিছু মনে কইরো না বউ।তোমার চাচা আইতে পারে নাই তার জরুরি কাম আছিলো।তয় তোমার লাইগা কিছু পাডাইছে সে।”

    লতা জান্নাহ্ এর দিকে এক জোড়া বালা এগিয়ে দেয়।বেশ পুরু আর ভারি মনে হলো জান্নাহ্ এর কাছে।জান্নাহ্ একটু না অনেক বেশিই চমকালো।সারহান আর জান্নাহ্ এর বিয়ের সময়ও তার কাকা শশুড় আসেনি।তবে গয়না তিনি ঠিকই পাঠিয়েছেন।আর আজও তাই হলো।লতা জান্নাহ্ এর দুই হাতে বালা পড়িয়ে বললেন —

    “দেহতো পছন্দ হয় কিনা?

    জান্নাহ্ মিষ্টি হেসে আলতো গলায় বললো–

    “পছন্দ হবে না কেন?জিনিস ত বড় কথা নয় কাকিমা।এর মধ্যে যে আপনাদের ভালোবাসা আর দোআ আছে তা আমার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।এইসব গয়না তো টাকা দিয়ে কত পাওয়া যায়।কিন্তু ভালোবাসা কী টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায়!

    লতা দারুণভাবে হাসলেন।উচ্চ গলায় গদগদ হয়ে বললেন–

    “”একখান সোনার টুকরা নিয়া আইছো গো আফা।”

    অন্তরা গর্বিত হাসলেন।জান্নাহ্কে এই বাড়ির বউ করে তিনি ভুল করেন নি।এইবার তার ছেলে তার কাছে ফিরে আসলেই হয়।
    ,
    ,
    ,
    পাশাপাশি একে অপরের গা ঘেঁষে বসে আছে জান্নাহ্ আর সারহান।মোবাইলে স্ক্রল করে একের পর এক বেবি স্যুট দেখে যাচ্ছে।ছেলে মেয়ে তফাৎ নেই।গভীর মনোযোগ সেই দিকে জান্নাহ্ এর।সারহান পাশেই বসে আছে।জান্নাহ্ এর শরীরের মিষ্টি সৌরভে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঝাঁঝিয়ে উঠে তার।জান্নাহ্ এর কাঁধের দিকটায় নাক ঘষতে থাকে।পরম আবেশে জান্নাহ্ বললো—

    “এই ড্রেসটা দেখুন।”

    সারহান মত্ত অন্য কাজে।বিরক্তিকর গলায় জান্নাহ্ বলে উঠে–

    “দেখুন না!

    সারহান কিছু না শোনার মতো চমকে বললো–

    “হু।কিছু বললেন?

    “হুম।এইটা দেখুন।”

    “দেখার দরকার নেই।আপনার যা যা পছন্দ হয় সিলেক্ট করুন।”

    সারহানের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া না করে জান্নাহ্ ব্যস্ত হলো দেখায়।হঠাৎ করে অত্যধিক উৎফুল্লতা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।হকচকিয়ে যায় জান্নাহ্।মুখ ভর্তি প্রাণখোলা হেসে সারহান বললো—

    “ভাবুন তো বাবু আসলে কী হবে!ওকে প্রথম আমি কোলে নিবো।উঁহু।আপনি।আরে ধুর! একজন নিলেই হলো।ইশ!কবে যে আসবে!

    ঝট করে উঠে সারহানকে জড়িয়ে ধরে জান্নাহ্।অধর ছড়িয়ে খোলা শ্বাস নেয় সারহান।দুই হাতে জান্নাহ্কে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে আবেগী গলায় প্রশ্ন করে—

    “কবে আসবে আমাদের পরী?

    জান্নাহ্ গভীর আশ্লেষে সারহানের বক্ষস্থলে নাক ঘষে দ্বিরূক্তি করে বললো—

    “যদি ছেলে হয়?

    সারহান হাতের বেড় শক্ত করে ফিচেল গলায় বললো—

    “তাহলে নেক্সট টাইম ট্রাই করবো।”

    “ধুর!

    একে অপরের সাথে মিশে বেশ কিছু সময় স্থির হয়ে থাকে সারহান জান্নাহ্।জান্নাহ্ আলগোছে তার অধরের স্পর্শ আঁকতে থাকে সারহানের বুকে।বাঁকা হেসে সারহানের বুকের মধ্যে ছোট্ট কামড় বসিয়ে দেয় জান্নাহ্।সারহান আরো চেপে ধরে জান্নাহ্কে।ফিসফিসিয়ে বললো—

    “বড্ড সাহস বেড়েছে আপনার!আপনা টাইম ভি আয়েগা।সুদসহ আসল উঠিয়ে নিবো।”

    ঘরে ঢুকেই নিজের দুই চোখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে লুবনা।ব্যস্ত হয়ে বললো—

    “আমি কিছু দেখিনি,আমি কিছু দেখিনি।”

    সলজ্জ চোখ নিয়ে সারহানের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায় জান্নাহ্।সারহান চোয়াল শক্ত করে তীর্যক গলায় বললো—

    “ম্যানারলেস লবণ,কারো ঘরে ঢুকতে হলে পারমিশন নিতে হয়।জানিস না?

    লুবনা শাহাদাত আর অনামিকা আঙুলের ফাঁক গলিয়ে তাদের দুইজনকে দেখে। চোখের উপর থেকে নিজের দুই হাত সরিয়ে নিজের রেফারেন্সে বললো—

    “আমি কী জানি দুইজন যে দরজা খোলা রেখেই জড়াজড়ি শুরু করেছো!

    সারহান তিক্ত গলায় বলে উঠে—

    “লবণ কী বাচ্চি!
    রজনীগন্ধা এই লবণাক্ত পঁচা ইলিশ যতদিন এখানে থাকবে ততদিন দরজা লক করে রাখবেন।ছিঃ!গন্ধে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।”

    লুবনা ফুঁসলে উঠে বললো—

    “জান্নাহ্,তুমি এই সারহান হনুমানের কথা একদম শুনবে না।জংলী টারজান।”

    সারহান তেড়ে গিয়ে লুবনার চুল খাবলা মেরে ধরে।কড়া গলায় বললো—-

    “ভাবি বল।”

    লুবনা চিৎকার দিয়ে উঠে অস্বীকার করে।সারহান আরো জোরে টেনে ধরে চুল।লুবনা আর্তনাদ করে বললো—-

    “আহ!ছাড়ো সারহান ভাইয়া।চুল ছিঁড়ে গেলো আমার।”

    জান্নাহ্ হতভম্ব হয়ে যায় সারহানের এমন কান্ডে।লোকটা কীসব আচরণ করে!লুবনার চোখে পানি জমে গেছে।কেঁদে দেয় লুবনা।জান্নাহ্ ঝাড়া মেরে সারহানের হাত সরিয়ে দেয়।কপট রাগি গলায় বললো–

    “ছাঁড়ুন।কী করছেন!

    সারহানের কোনো মায়া হলো না।ডিভানে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসলো।বার কয়েক লুবনার দিকে তাকাতেই দেখে ফুঁপাচ্ছে লুবনা।সারহান কৌতুকপ্রদ হয়ে বললো—

    “রজনীগন্ধা,তিতির জন্য আনা চকলেটটা লবণের মুখে দিয়ে দিন।এমনভাবে কাঁদছে যেনো ওর চকলেট কেউ নিয়ে নিয়েছে।ঢং!

    জান্নাহ্ কোনো কথার তোয়াক্কা না করে সারহানের কাছে এসে তার ঝাঁকড়া চুলগুলো এক মুঠ নিয়েই একটা টান দেয়।ভড়কে যায় সারহান।নাকের ডগায় বিরক্তি নিয়ে বললো–

    “এইটা কী হলো!

    জান্নাহ্ ফিচেল হেসে ছোট্ট করে বললো–

    “টিট ফর ট্যাট।”

    “দিজ ইজ নট রাইট রজনীগন্ধা।”

    “কেন!রাইট নয় কেন?এখন দেখুন কেমন লাগে।”

    “আমার বিড়াল আমারেই বলে ম্যাও।”

    জান্নাহ্ চোখ ছোট ছোট করে নাক কুঁচকে বললো–

    “আই এম নট বিড়াল।”

    সারহান স্বশব্দে ঘোষনা করে—-

    “বিল্লি।”

    তাদের দুইজনের কথা কাটাকাটিতে কান্না থামে লুবনার।জান্নাহ্ আড়চোখে সারহানকে ইশারা করে বোঝানোর চেষ্টা করে লুবনার জন্যই এইসব করা।জান্নাহ্ মিষ্টি হেসে লুবনার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় জিঙ্গেস করে—

    “তুমি কী কিছু বলতে এসেছিলে?

    লুবনা দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নাক টানতে টানতে ধরা গলায় বললো—

    “চাচা তোমাকে খেতে ডাকছে।”

    থামে লুবনা।সারহানের দিকে রোষভরা চোখে তাকিয়ে হিনহিনে গলায় বললো—

    “এই হনুমানটাকে নিয়ে আসবে না।এটাকে ঘরে আটকে আসবে।”

    “তবে রে লবণাক্ত!

    সারহান ডিভান থেকে উঠার আগেই হাওয়াই মিলিয়ে যায় লুবনা।খিলখিল করে হেসে উঠে জান্নাহ্।তার হাসিতে মুচকি হাসে সারহান।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪৩
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    খাওয়ার টেবিলে একে অপরের দিকে চাপা রাগ নিয়ে আড়চোখে দেখছে।বাড়ির সবাই খাওয়ায় অভিনিবেশ করেছে।সারহান যতবার লুবনার দিকে তাকিয়েছে ততবারই লুবনা মুখ ভেঙচি দিয়েছে নাহলে অদ্ভুত কোনো মুখভঙ্গি করেছে।সেইসব বেশ মজা নিয়ে উপভোগ করছে জাবিন আর সারহানের পাশে দাঁড়ানো জান্নাহ্।ফচকে হাসিতে ব্যস্ত জাবিন।জান্নাহ্ ইশারা করে হাসতে বাড়ন করে জাবিনকে।আচমকাই লুবনা উবলে উঠে বললো—

    “বড় চাচা,তুমি এই টারজানটাকে জঙ্গল থেকে আনলে কেন?

    লুবনার অকস্মাৎ এহেন কথায় সবাই হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠার আগেই সারহান দীপ্ত কন্ঠে বলে উঠে—

    “কাকীমা, যত তাড়াতাড়ি পারো এই লবণকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করো।নাহলে কিন্তু এ পঁচা ইলিশের জন্য বর খুঁজে পাবে না।”

    লুবনা কৃত্রিমতা কাটিয়ে স্বশব্দে বললো–

    “হে,এসেছে।আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।তোমার ভাগ্য ভালো যে জান্নাহ্ এর মতো এতো কিউট একটা মেয়ে তোমাকে বিয়ে করেছে।ওর জায়গায় আমি হলে তোমাকে ওই বেল তলার নাক বোঁচা আর দাঁত উঁচু শিয়াল কন্যার সাথে বিয়ে দিতাম।”

    সারহান ঠোঁট গুঁজ করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মিয়ম্রান কন্ঠে বললো–

    “আমার তো হয়েছে বিয়ে।তুই তো সারাজীবন কুমারিই থাকবি।মনে নেই,রুবিনার বিয়ের সময় ওর দেবর তোকে অন্ধকার ঘরে দেখে কী ভয়টা পেয়েছিলো!বেচারা টানা তিনদিন জ্বরে বিছানায় পড়েছিলো।আগে নিজের চেহারা ঠিক কর পঁচা ইলিশ।ছিঃ!

    লুবনা থমথমে ভাব নিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকলো।তার বড় বোনের বিয়ের দিন লুবনা অদ্ভুতভাবে নিজের হাতে সাজে।রুবিনার দশ বছরের চাচাতো দেবর কারেন্ট চলে যাওয়ার পর যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো তখন হঠাৎ কারেন্ট আসায় আর লুবনা সামনে পড়ায় বিষম খায়।তা দেখেই ছেলেটা এতো জোরে চিৎকার দেয় ওই এক চিৎকারে পিচ্চি বেহুশ।
    সারহানের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা শুকনো হৃদয়ে যেনো প্রাণের বন্যা বয়ে যায় অন্তরার।আজ অনেকদিন পর সারহানকে এতোটা প্রাণবন্ত দেখছে সে।সারহানের এই হাসিটাই যেনো এতোদিনে আঁধারে আলো খোঁজার মতো করে খুঁজে চলছিলো অন্তরা।পাশে দাঁড়ানো জান্নাহ্ এর চমৎকার হাসি মুখটা দেখে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নেয় নৈঃশব্দে অন্তরা।যদি মা হওয়ার বার্তাতেই সারহানের এতো পরিবর্তন হয় না জানি যখন এই বাচ্চা স্বশরীরে এই দুনিয়াতে তার কান্না জুড়ানো দেহ নিয়ে আবর্তিত হবে তখন কতোটা বদলে যাবে সারহান!অন্তরা এটাই চেয়েছিলেন।তার বুকের মানিক তার কাছে ফিরে আসুক।উপর ওয়ালার সাথে সাথে তিনি জান্নাহ্ এর শুকরিয়া আদায় করেন।

    সারহানের কাঁধে হালকা চাপ দেয় জান্নাহ্।যেনো কথা আগে না বাড়ায়।সে আশায় গুঁড়ে বালি দিলো লুবনা।কাটকাট গলায় উচ্চ শব্দে বললো–

    “আগে নিজের চেহারা ঠিক করো।আরে তোমার বাচ্চাই তো তোমাকে চিনবে না।হু।নিজের চেহারা দেখেছো!তোমাকে দেখলেই তো মনে হয় তুমি এই বাড়ির ছেলে না।বড় চাচা আর চাচি কারো সাথেই তোমার চেহারার মিল নেই।মিলবে কী করে!কুড়িয়ে পাওয়া ছেলের সাথে মিলে নাকি!

    মুহূর্তেই সারহানের হাসি মুখটা তীব্র রোষে ভরে গেলো।চোয়াল শক্ত হয়ে মসৃণ কপালটায় সমান্তরাল ভাঁজ ফুটে উঠে।দাঁতের সাথে দাঁত নিষ্পেষণ করে ফোঁস করে এক দম ছাড়ে।নিজের ভয়ংকর জাগ্রত ইচ্ছাকে চোখের পাতা বন্ধ করে অবদমন করার চেষ্টা করে সে।সারহানের ঘাড়ের রগ ফুলে উঠে।তার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে সবাই।খাওয়ার প্লেটে রাখা হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ধীম ধীম শ্বাস ফেলছে সারহান।জান্নাহ্ কিছু বুঝতে না পেরে অসহায় দৃষ্টিতে সবার চোখের দিকে তাকিয়ে সারহানের দিকে তাকায়।শুভ্রা ভীত চোখে তাকিয়ে আছে।ফট করে উঠে যায় সারহান।সামনে থাকা বাটি ভরা মসুরের ডাল,সবজি,মাংস সব এক এক করে লুবনার গায়ের উপর ঢেলে দেয়।আঁতকে উঠে সবাই।ভীতসন্ত্রস্ত লুবনা জোর গলায় চিৎকার করে উঠে।লতা ভড়কে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে।সারহানের রাগ সম্পর্কে অবগত সে।কেউ কোনো কথা বললো না।খাবার টেবিলে চারধারের মানব – মানবীরা অত্যন্ত ভীত,শান্ত আর পরাস্থের মতো চেয়ে রইলো।কারো মুখে কোনো শব্দ বের হলো না।যেনো নিস্তব্ধ কোনো ফাঁকা মজলিস।
    ,
    ,
    ,
    এক সমুদ্র রাগ আর বিরক্তি নিয়ে ব্যস্ত হাতে বিছানা ঝাড়ছে জান্নাহ্।আজকাল বেঢপ আচরণ করে সারহান।কী দরকার ছিলো মেয়েটার সাথে এমন করার!লুবনার শরীরে আধাঘন্টা বরফ ঢলতে হয়েছে।সে কিছুতেই এই বাড়িতে থাকবে না এই মধ্য রাতেই সে চলে যাবে বলে জেদ ধরেছে।তখন সারহান গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই চুপসে যায় লুবনা।একটু আগেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে।জমির আর অন্তরা কিছু বলতে গিয়েও যা বললো তা নিতান্ত পান্তা ভাত।নিজের ভাবনার মাঝেই কোমরের দিকটায় কারো হাতের স্পর্শ আর কাঁধে উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে।জান্নাহ্ এর ঘন,কালো রেশমচুলে নাক গলিয় দেয় সারহান।তার গন্ধ নিতে থাকে।বার কয়েক ঠোঁট ছোঁয়ায় ভারি চুলে।জান্নাহ্ সেভাবেই গম্ভীর গলায় বললো—

    “লুবনা আপুর সাথে এমন করলেন কেন আপনি?

    সারহান কোনো শব্দ করলো না।আলতো হাতে জান্নাহ্ এর ঘাড়ের পাশ থেকে চুল সরিয়ে তার জামার গলাটা হালকা নামিয়ে উষ্ণ চুম্বন করে।জান্নাহ্ বিরক্ত ঝুলায় নাকের ডগায়।সারহান থেকে নিজেকে সরাতে চাইলেই সারহান তাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়।দুই হাত জান্নাহ্ এর কোমরের দিক রেখে নিজের এক হাতের কব্জি অন্য হাত দিয়ে ধরে বৃত্তাকার বলয়ে আবদ্ধ করে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ মেকি রাগ দেখিয়ে বললো—

    “এমন করলেন কেন?

    সারহান জান্নাহ্ এর গালে গাল ছুঁইয়ে বললো–

    “লবণাক্ত বেশি বাড় বেড়েছে।”

    জান্নাহ্ ফোঁস করে দম ফেলে বললো—

    “তাই বলে এমন করবেন!মেয়টার পুরো শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে।”

    সারহান ফচকে হেসে মৃদু গলায় বললো–

    “আই ডোন্ট কেয়ার।জ্বলে পুড়ে লবণ গলে যাক।”

    “এটা আপনি ঠিক করেন নি সারহান।”

    সারহানকে ছাড়িয়ে যেতে চাইলে জান্নাহ্কে আঁকড়ে ধরে সারহান।মোহনীয় গলায় তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো—

    “যাবেন?

    জান্নাহ্ নির্বিকার গলায় সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো—

    “কোথায়?

    “পদ্মদিঘী।”

    জান্নাহ্ এক সমুদ্র আতঙ্ক আর উচ্ছ্বাসের মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে বললো–

    “সত্যি!এতো রাতে?

    সারহান নরম গলায় বললো–

    “হুম।”

    “কিন্তু আম্মা?

    সারহান জান্নাহ্ এর গলায় চুমু খেয়ে সরব গলায় বললো—

    “আমার বউ আমি নিবো তাতে কার কী!

    জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় হতাশ হয়ে বললো–

    “কিন্তু সারহান আম্মা জানলে রাগ করবে।এতো রাতে বাইরে যাওয়া!

    “আমার উপর ভরসা নেই?

    চোখে হাসে জান্নাহ্।ভরসা!আজীবন সাথে থাকার পণ নিয়ে যার সাথে জীবন বেঁধেছে তার উপর ভরসা থাকবে না!
    ,
    ,
    ,
    রাত তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই।কালো আকাশে রুপালি চাঁদ জোৎস্না ছড়িয়েছে।বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুরণন।নিঃশব্দে সারহানের গাড়ি এসে থামে দিঘীর বিশাল গেইটের সামনে।দুইজন নামতেই জান্নাহ্ খেয়াল করে গেইটে বড় একটা তালা ঝুলছে।

    গেইটের সাথেই বড় বড় রেইনট্রি,মেহগনি,কাঠালি আরো অনেক বিশাল বিশাল গাছ।এখান থেকেই দিঘীর কালো জল দেখা যাচ্ছে।চাঁদ আজ তার রূপের পসরা সাজিয়েছে দিঘীর ওই নিকষ কালো জলে।গেইটের সামনে আসতেই থমকে যায় দুইজন।মিচকে হাসে সারহান।চাপা গলায় বললো—

    “কেরানির মেয়ে,দেয়াল টপকাতে পারেন তো?

    সরু কপালটা এক চোটে ভাঁজ করে জান্নাহ্।ভ্রু নাচিয়ে বললো–

    “মানে কী?

    সারহান মৃদুহাস্য অধরে মিষ্টি করে বললো—

    “ভেতরে যেতে হবে না!

    “তো?

    “গেইট টপকাতে হবে।”

    থমথমে রূপ ধারণ করে জান্নাহ্ এর মুখটা।সারহান ফিচেল হেসে ব্যগ্র হয়ে গেইট বেয়ে এপাশে চলে আসে।চোখ দিয়ে টিপ্পনী কেটে বললো–

    “আসুন।”

    জান্নাহ্ অশ্বথ গাছের মতো স্থির হয়ে রইলো।সারহান গা দুলিয়ে হেসে উঠে।প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে জান্নাহ্ এর সামনে ধরে।জান্নাহ্ টিমটিমে চাহনিতে চাবির অর্থোদ্বার করার চেষ্টা করে।কিন্তু পারলো না।সারহান গেইটের দিকে ঝুঁকে মিনমিনে গলায় বললো—

    “বিকেলে যখন এসেছিলাম হরিনাথ চাবিওয়ালাকে নিয়ে এসে ছিলাম।চাবিটা বানিয়ে নিলাম।”

    জান্নাহ্ ঝাঝালো কন্ঠে বললো—

    “তাহলে এমন করলেন কেন?

    ” এইটা দেখানোর জন্য,ডোন্ট পাঙ্গা উইথ সারহান জেইদি।আন্ডারস্ট্যান্ড মিসেস জেইদি?

    “আপনি একটা পাগল।”

    “হ্যাঁ,আমার পরীর পাগলাবাবা।এখন আসুন তো।আচ্ছা দাঁড়ান।আমি খুলে দিচ্ছি।”

    সারহান চাবি দিয়ে গেইট খুলে তা অতি সন্তর্পনে ফাঁক করে জান্নাহ্কে ভেতরে নিয়ে আসে।ভেতরে এসে খুশিতে উড়তে ইচ্ছে হয় জান্নাহ্ এর।এর আগেও পদ্মদিঘীতে আসতে চেয়েছিলো জান্নাহ্।কিন্তু আন্ডার আঠারো কাউকে দিঘীতে যাওয়ার অনুমতি নেই।স্কুল ছাত্রছাত্রীদের আরো নয়।কিন্তু কেয়ারটেকার দাদুতো জানে না আঠারোর আগেই জান্নাহ মা হতে চলেছে।এইসব মনে করেই ফিক করে হেসে ফেলে জান্নাহ্

    গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলছে সারহানের পাশে জান্নাহ্।সারহানের এক হাত নিজের সাথে চেপে ধরে আছে।জান্নাহ্ আজ ভীষণ খুশি।তার প্রাণ সত্যিই ফিরে এসেছে।যখন থেকে সারহান ফিরে এসেছে এক অন্য সারহানকে আবিষ্কার করেছে জান্নাহ্।এতোটা উচ্ছল,এতোটা প্রাণবন্ত সারহানকে সে কখনো দেখেনি।যখনই বাড়িতে আসতো সারাক্ষন ঘরে ঘাপটি মেরে থাকতো।কারো সাথে কথা বলাতো দুর তাকাতই না।

    অন্ধকারে বিড়ালপায়ে হাঁটছে দুইজন।শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি যেনো নিস্তব্ধ পরিবেশে ঝঙ্কার তুলছে।ঝিঝিপোকার ডাক যেনো ষোলোকলা পূর্ণ করলো।সাথে কাঠপোকার আওয়াজ।একটু পরপর দমকা হাওয়ায় নড়ে উঠে গাছগাছালি।ঝনঝনিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর শরীর।সারহানের হাতটা আরো চেপে ধরতেই ফিকে গলায় হিসহিসিয়ে সারহান বললো—

    “চিন্তা করবেন না।আমি থাকতে যমদূতও আপনার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না।”

    চাঁদের আলোয় আরো লাবণ্যময় লাগছে সারহানের স্মিতহাস্য মুখটা।তার পুরু ঠোঁট জোড়ায় এক অচেনা সুখ।চোখে তার তৃপ্তি।নিজের মাথাটা এলিয়ে দেয় জান্নাহ্ সারহানের গায়ের সাথে।হাঁটতে হাঁটতে দিঘীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়।প্রায় পনেরোটা সিড়ি অতিক্রম করে দিঘীর জলে পা ছোঁয়াতে হবে জান্নাহ্ এর।চাঁদের আলোয় যেনো কোনো রূপকথার রাজ্য মনে হচ্ছে পদ্মদিঘীকে।চারপাশের প্রকান্ড গাছের সারি।দিঘীর দুই ধারে পাঁচ ফুটের ব্যবধানে সিমেন্টের বেড় দেওয়া বলয়ে খাম্বাকৃতির নিয়নের বাতি লাগানো।যে পাশে জান্নাহ্ রা দাঁড়িয়ে আছে তার বিপরীত পাশে উঁচু ডিবি যাকে ছোটখাট পাহাড় বলে আখ্যায়িত করে গ্রামবাসী।দিঘীতে ফুটে আছে পদ্ম।চাঁদের আলোয় দিঘীর মাঝের সেই লাল পদ্মে চোখ আটকে যায় জান্নাহ্ এর।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪৪
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    চাঁদের নরম আলোয় বসে আছে জান্নাহ্।তার অদূর দৃষ্টি দিঘীর লাল পদ্মে।দিঘীর জল থেকে দুটো সিঁড়ি উপরে বসে পা দুটো ডুবিয়ে রেখেছে দিঘীর কালো,অস্বচ্ছ,শীতল জলে। হালকা করে পা দুলাচ্ছে জান্নাহ্ তাতে দিঘীর জলে অদ্ভুত মোহনীয় শব্দ হচ্ছে যা এই নিথর পরিবেশে হাঁক তুলছে।

    সিঁড়ির বসার জায়গাতে বসে আছে সারহান।অনিমেষ চেয়ে আছে তার সামনে বসা ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের সেই জীবন্ত পুতুলের দিকে।সারহান সাথে করে দুটো ছোট টর্চ লাইট নিয়ে এসেছে।তা অন করে সিঁড়ির উপরের শুরুর দিকটায় রেখেছে।দিঘীর দুই পাশের নিয়নের বাতি আর চাঁদের আভায় সুনসান অন্ধকার পরিবেশকে জীবন্ত মনে হচ্ছে।

    সারহান নরম পায়ে এসে জান্নাহ্ এর পাশে বসে।জান্নাহ্ আলতো হাসে।সারহান তার ডানহাত দিয়ে জান্নাহ্ এর অগোচরেই তার দীঘল কালো চুলের হাত খোঁপাটা খুলে দেয়।কোমড় পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় সেই চুল।চাঁদের আলোয় এক মায়াবী মূর্তি মনে হচ্ছে জান্নাহ্কে।তার খোলা চুলের ছোট ছোট কেশ এসে উড়ে পড়ছে তার চোখে,মুখে।তার পাতলা ওষ্ঠাধরের ওই একরোখা হাসি চুম্বকের মতো টানছে সারহানকে।ঘন পল্লবের নিচে ডাসা ডাসা দুই আঁখি যেনো প্রাণের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে সারহানকে।জান্নাহ্ এর ওই তীক্ষ্ম নাকের ডগায় যেনো তারা বসে আছে।চাঁদের লুকোচুরি আলোয় হীরে বসানো সেই নাকফুল যেনো তার অবস্থানের অস্তিত্ব বলছে।
    জান্নাহ্ এর ঠোঁটের সেই হৃদয়গলানো হাসিতেই যেনো সারহানের মনে পড়ে সেই দিনের কথা যেদিন জান্নাহ্কে সে প্রথম দেখেছিলো।এক কিশোরী লাবন্যকন্যা।

    আশেপাশে কোথাও ব্যাঙ ডাকছে।সেই সাথে নাম না জানা এক পাখি।ঝিঝিপোকার টিপটিপ আলো।দিঘীর জলে এই লাবন্যকন্যার পদযুগল।এক মুহূর্তেই সারহানের মনে হলো সে যেনো পদ্মাসনে বসা কোনো শশীকে দেখছে।
    যে হাসছে তার স্বমহিমায়।তার রূপের আগুন ঝলসে দিচ্ছে সারহানের দুই চোখ।থামিয়ে দিচ্ছে তার হৃদকম্পন।এ যেনো মরেও সুখ।এ সুখ অপার্থিব,এই পাওয়া দুর্লভ।এ যেনো সেই বিষাক্ত সাপের মনি যাকে পেয়ে মনে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য ধনের মালিক সে।সারহান ভাগ্যবান।পেয়েছে সে তা।তার সামনেই বসে আছে সেই ভাগ্যকন্যা।সেই পরশ পাথর।যার ছোঁয়ায় সে পবিত্র হবে।যার পরশে সে তার ভাগ্য বদলাবে।বদলাবে তার জন্ম ইতিহাস।বদলাবে তার অন্ধকার অতীত।

    জান্নাহ্ এর পা দিঘীর জলে সমাহিত।তার পায়ের রুপোলি নুপুর তার ফর্সা টলটলে পায়ে উদ্বাসিত হয়ে আছে।বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সারহান তার সামনে বসা অপ্সরার দিকে।এ দেখার যেনো শেষ নেই,নেই কোনো তৃপ্তি।এতো আজন্মকালের জন্য।জান্নাহ্ মৃদু গলায় নৈঃশব্দে প্রশ্ন ছুঁড়ে—

    “কী দেখছেন?

    সারহান অধর কোণ প্রসারিত করে মুগ্ধ গলায় বললো–

    “আমার ভালোবাসার দেবীকে।যার চরণে নিজেকে সমার্পিত করতে চাই।দেবেন কী সেই সুযোগ?

    জান্নাহ্ মুহূর্তেই মুখটা গম্ভীর করে।কপট দম্ভের সাথে বললো—

    “দিলাম মহামান্য।”

    ঝুমঝুম করে হেসে উঠে জান্নাহ্।সেই হাসির তরঙ্গ সোজা গিয়ে বিঁধে সারহানের বুকে।

    ” বিষে ভরা বাণ,বাঁচাইবে পরাণ
    অমৃতের সুধা যে করিবে দান।”

    সারহান চোখে হাসে।কেনো যেনো তার কাঁদতে ইচ্ছে হলো।খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলো।কিন্তু কষ্টে নয়।সুখে।সেই সুখ যা আজ তার দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে।সেই সুখ যা তার পরাণ বাঁধিয়েছে।সারহানের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছে,

    “ভোরের শিশির হোক,কিংবা তপ্ত লাভা
    তোমার পরাণেই হোক আমার জীবন বাঁধা।”

    জান্নাহ্ এর পাশ ঘেঁষে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল গুঁজে দেয় সে।তাতে আলতো চুমু খায়।জান্নাহ্ এর কোমল মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে তার ললাটে অধর ছোঁয়ায়।চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণকে সাক্ষী রেখে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় জান্নাহ্ এর দুই মুদিত চোখের পাতায়।জান্নাহ্ নিমীলিত অক্ষিযুগলের দ্বার খুলে তার প্রাণকে দেখে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের মোনাজাতে সে এভাবেই তার প্রাণকে ফিরে পেতে চেয়েছে।তার প্রাণ শুধু তার হয়ে ফিরে আসুক।যেমনটা সে সারাজীবন স্বপ্নে দেখেছে।জান্নাহ্ এর নরম গালে গাল ছোঁয়ায় সারহান।ইচ্ছে করছে এই পুতুলকে নিজের মাঝে সমাহিত করতে।মিষ্টি করে আদর করতে।জরিয়ে নিতে ভালোবাসার চাদরে।জান্নাহ্ এর চোখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে সারহান।জান্নাহ্ মৃদু কম্পনে বললো—

    “সারহান,মামা বাড়ি যাবেন?আপু এসেছে।বিয়ের পর তো আপুর সাথে আপনার দেখা হয়নি।”

    সারহান নির্লিপ্ত গলায় বললো–

    “যাবো।আপনি যেখানে বলবেন সেখানে যাবো।মরতে বললে মরেও যাবো।”

    আঁতকে উঠে জান্নাহ্ বললো–

    “সারহান!

    সারহান বিগলিত হাসে।আশ্বস্ত গলায় বললো–

    “চিন্তা করবেন না।এতো সহজে আমি মরছি না।যতদিন আপনার শ্বাস ততদিন আমার নিঃশ্বাস।”

    সারহান জোরালো কন্ঠে ঘোষনা করে বললো—

    “আমায় নিয়ে যত অভিযোগ
    মিথ্যের আড়ালে সত্যেরা অপারগ
    ভূমধ্যসাগরীয় অতল স্রোত
    তোমার শ্বাসেই হোক আমার নিঃশ্বাস রোধ।”

    কেঁপে উঠে দিঘী।নেচে উঠে দিঘীর জল।আলোড়ন সৃষ্টি হয় রহস্যপুরীর মায়াজালে।এক প্রেমে পাগল যুবা আজ আর অর্ধাঙ্গীনির প্রতি তার প্রেম নিবেদন করছে।এক প্রেমিক পুরুষ আজ তার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে।ওই আকাশকে সাক্ষী রেখে,ওই চাঁদের আলোকে সাক্ষী রেখে বলতে ইচ্ছে করছে,”ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।”

    সারহানের কথায় উচ্ছ্বাসিত হয় জান্নাহ্।তার বুকের মাঝে ছোট্ট পিঞ্জিরায় আবদ্ধ ভালোবাসার পাখিটি আজ ডানা মেলতে চায়।তরতর করে বয়ে যাচ্ছে খুশির হাওয়া।সারহান এক সিঁড়ি নেমে জলের কাছাকাছি সিড়িতে বসে।মোলায়েম গলায় বললো—

    “পা উঠান রজনীগন্ধা।”

    আচম্বিত হয় জান্নাহ্।সন্দিহান চোখে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত গলায় বললো–

    “কেন?

    “উঠান দেখাচ্ছি।”

    “আপনার শরীরে ভিজে যাবে সারহান।”

    “আমার পুরো জীবনটাইতো ভালোবাসার সমুদ্রে ভাসিয়ে নিলেন।শরীর দিয়ে কী হবে!

    জান্নাহ্ তার ভেজা কোমল পা দুটো সারহানের ছড়ানো উরুর উপরে রাখে।সংকোচ হচ্ছে জান্নাহ্ এর।বিব্রত সে।সারহান স্মিত হেসে বুক পকেট থেকে দুটো আংটি বের করে জান্নাহ্ এর পায়ের আঙুলে পড়িয়ে দেয়।জান্নাহ্ ব্যগ্রতা নিয়ে পা দুটো গুঁটিয়ে আংটি গুলো দেখে অবিশ্বাস্য হাসে।উচ্ছলিত কন্ঠে বললো–

    “কোথা থেকে আনলেন?

    সারহান স্বাভাবিক কন্ঠে প্রত্যুত্তর করে—

    “ইন্ডিয়া থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছি।পছন্দ হয়েছে আপনার?

    “খুব।ধন্যবাদ।”

    সারহান নাক বরাবর কপাল কুঁচকে বললো—

    “ধন্যবাদ কেন?

    জান্নাহ্ হেসে হেসে বললো—

    “এই যে গিফ্টের জন্য।”

    সারহান ভ্রু বাকিয়ে নিরুত্তাপ কন্ঠে বলে–

    “আমি তো আপনাকে ধন্যবাদ দেইনি।”

    “কেন?

    “এই যে আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিসটা গিফ্ট করার জন্য।”

    জান্নাহ ফিচেল হেসে মজা নিয়ে বললো—

    “তাহলে এখন দিন।”

    সারহান উঠে দাঁড়ায়।শক্ত কন্ঠে শুধায়–

    “বলুন আপনার কী চাই?

    জান্নাহ্ উঠে দাঁড়ায়।তার কাপড়ের আঁচলটা ডান কাঁধ থেকে পড়ে যায়।খোলা চুলে এক শশীকন্যা স্বশব্দে বলে উঠে—

    “আমার ওই লাল পদ্ম চাই।”

    সারহান চোখ টিপে হাসে।বিগলিত গলায় বললো–

    “আপনি চাইলে ওই চাঁদকেও আজ ধরণীতে নিয়ে আসতাম।”

    কথা শেষ করেই এক ঝাঁপ দেয় পদ্মদিঘীতে সারহান।ভড়কে যায় জান্নাহ্।সে ভাবতে পারেনি সারহান এমন কাজ করবে।প্রায় মিনিট পনেরো পর দিঘী থেকে উঠে আসে সারহান।তার হাতে লাল পদ্ম।ভেজা শরীর বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে।সারহান সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো এক হাতে পেছনে ফিরিয়ে দেয়।তার আর্দ্র ভ্রুযুগল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল জল।জান্নাহ্ এর সামনে দুই হাতে লাল পদ্ম নিয়ে বলে–

    “নিন আপনার লাল পদ্ম।”

    তেতে উঠে জান্নাহ্ বললো—

    “আপনি কী পাগল!এই রাতে কেউ দিঘীতে নামে?

    সারহানের তার আর্দ্র আঙুল দিয়ে জান্নাহ্ এর ফোলা নাকে আলতো ছুঁইয়ে বললো—

    “আপনার না রেড চেরি পছন্দ।পরী আসলে আপনাকে রেড চেরির দেশে নিয়ে যাবো।”

    জান্নাহ্ লাফিয়ে উঠে বলে—

    “সত্যি?

    “প্রমিজ।”

    জান্নাহ্ খুশিতে গদগদ হয়ে সারহানের কাছে এগিয়ে গেলে সারহান চমকে বললো—

    “আরে কী করছেন!আমি এখন ভেজা মানব।”

    “ভেজা হোক আর শুকনো,আমারই তো।”

    জান্নাহ্ ঝাঁপিয়ে পড়ে সারহানের বুকে।বুক ভরে শ্বাস নেয় সারহান।নিজেকে একদম গুঁজ মেরে নেয় জান্নাহ্ সারহানের বুকে।আর তখনই এক অবাক কান্ড করে বসে সারহান।ঝট করে জান্নাহ্কে কোলে তুলে নেয়।তার ভেজা চুলের পানি টুপটুপ করে জান্নাহ্ এর বুকের ওপর পড়ছে।সারহান তার ভেজা ঠোঁট চেপে ধরে জান্নাহ্ এর কিশলয়ের মতো ঠোঁটে।জান্নাহ্ দুই হাত সারহানের গলায় জড়িয়ে রাখে।দীর্ঘ সময় নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারহান জান্নাহ্ এর অধরপল্লবের অধরসুধায়।সারহান ধীরে ধীরে সিঁড়িতে তার পা বাড়াতে থাকে।মৃদু হেসে বললো—

    “নেক্সট টাইম এমন কিছু করলে আগে থেকে আমাকে জানাবেন।”

    “কেন?

    সারহান ফিচেল হেসে বললো—

    “তাহলে আরেকটু বেশি করে আদর করতাম আরকি!

    জান্নাহ সারহানের বুকে দুর্বল ঘুষি মেরে লজ্জামিশ্রিত গলায় বললো—

    “অসভ্য লোক!

    ” আমি তো কোনো কালেই সভ্য ছিলাম না রজনীগন্ধা।মিছে মায়ায় পড়লেন আমার।”

    ঠোঁট বাকায় জান্নাহ্।ঝরা হাসে সারহান।
    আজ পদ্ম দিঘী দেখলো এক প্রেমিকযুগলের প্রেমে বন্দির খেল।
    ,
    ,
    ,
    সারহানদের বাড়ির সদর দরজায় স্টিলের বিশাল গেইট। ডুপ্লেস বাড়ির ঢুকতেই প্রকান্ড কাঠের কারুকার্যখচিত দরজা।তার সামনেই করিডোরের মতো প্রায় চার ফুটের জায়গা।বাড়ির সবাই নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে।সদর দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাইভেট কার।সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেছে লুবনা।সকলের সাথে কথা বললেও লুবনা কথা বলেনি সারহানের সাথে।ধীরপায়ে সিঁড়ির পাঁচটা ধাপ নেমে সদর দরজার বাইরে আসে সারহান।মুখ ফুলিয়ে বসে আছে লুবনা।গাড়ির জানালার উপর হাতটা রেখে ঝুঁকে দাঁড়ায় সারহান।তার মুখটা একদম লুবনার কাছাকাছি।স্মিতহাস্য অধরে বললো–

    “কীরে,কথা বলবি না?

    বার কয়েক নাক টানে লুবনা।সারহানের দিকে ক্ষীপ্ত চোখে তাকায়।চোয়াল শক্ত করে নাক ফুলাতে থাকে।সারহানের হাসি হাসি মুখটা দেখে ক্ষনকালেই রাগ পড়ে যায় লুবনাথ।
    অভিমানি গলায় বললো—

    “নাহ।এমন করলে কেন তুমি?

    সারহান গম্ভীর মুখে বললো—

    “সরি।”

    “সরি বললেই সব মাফ।দেখো কী অবস্থা করেছো আমার !পুরো শরীর লাল হয়ে আছে।”

    সারহান লুবনার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়।আসলেই!লুবনার সমস্ত শরীর লাল হয়ে আছে।সারহান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে।আরেকটু ঝুঁকে লুবনার কানের কাছে মুখ নিয়ে মখমলে গলায় বললো —

    “এখন বুঝতে পারছিস কেন আমি তোকে বিয়ে করি নি!আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা তোর নেই।ভালো থাকিস।”

    লুবনা কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে সারহানের দিকে।এ তার চোখের কাতরতা নয়।হৃদয়ের কাতরতা।পেয়েও হারানোর ব্যর্থতা।ছাই চাপা আগুনে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা।এই যন্ত্রণা অব্যক্ত,অবর্ণনীয়,অপরিমেয়,অসহনীয়।সারহান লুবনাকে একটা বক্স দেয়।আলতো কন্ঠে বললো—

    “তোর সরি গিফ্ট।ভালো লাগলে রাখিস।যদি তোর টারজানকে মনে পড়ে দেখিস।”

    লুবনার চোখে বাঁধ ভাঙে অশ্রু।বুকের ব্যথাটা তরতর করে গলায় উঠে এসেছে।কষ্টে কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে গলায়।তাই সে কিছু বলতে পারলো না।চেয়ে রইলো তার আকাঙ্ক্ষীত সেই না পাওয়া দুর্লভ বস্তটির দিকে।

    সারহান জোরালো গলায় বলে উঠে—

    “ড্রাইভার মামা, সাবধানে ড্রাইভ করবেন।আমার লবণাক্ত ইলিশ পড়ে না যায় যেনো।”

    গাড়ি চলতে শুরু করে।জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে সম্মোহিনী দৃষ্টিতে অনিমেখ চেয়ে থাকে সারহানের দিকে লুবনা।যতক্ষন পযর্ন্ত সারহানের ওই উজ্জ্বল মুখটা লুবনা দেখতে পেয়েছে ততক্ষন চেয়ে রইলো।তা দৃষ্টির আড়াল হতেই মাথাটা ভেতরে এনে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের কান্না রোধ করে লুবনা।

    বক্সটা খুলতেই চোখের জল আর বাঁধ মানলো না।স্মিত ধারায় তা গড়াতে লাগলো।বক্সের উপরে বিভিন্ন রঙের ফিতে আর কৃত্রিম ফুল দিয়ে সাজানো।তার ভেতরে এক মুঠ লাল রেশমি চুড়ি,এক পাতা টিপ,একটা পায়েল আর ছোট্ট একটা পারফিউম।গোলাপ আর গাঁদাফুল ছড়ানো তাতে।একটা চিরকুটও পায় লুবনা।
    টলটলে পানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে লুবনার।না,দেখবে না।জড়াবে না নিজেকে এ মায়ায়।যা তার হওয়ার কথা ছিলো তা আজ অন্যের।কেন এমন হলো!মন মানে না লুবনার।নিজের মধ্যকার বিদ্বেষী মানুষটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুটটা খুলে লুবনা।তাতে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা–

    “যদি কখনো পড়ে মনে
    ভেবে নিস দেখা হবে ওই জনমে
    যদি দেখিস মনের দুয়ার খুলে
    আমি ছিলাম তোর হৃদয়ের কোণে।”

    চিরকুটটা মুচড়ে হাতের মুষ্টিতে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে লুবনা।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে।গত কয়েকদিন অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে সে।আজ আর পারলো না।পাশে থাকা নিজের মাকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো লুবনা।ড্রাইভার ফ্রন্ট গ্লাসে লুবনাকে একবার দেখে।ভারী নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি।

    ছোটবেলা থেকেই সারহানকে পছন্দ করে লুবনা।হয়তো সারহানও করতো।কিন্তু যেদিন থেকে বাড়ির বাইরে সে পা বাড়িয়েছে লুবনা নামের মেয়েটিকে সে ভুলতে চেয়েছে।
    সারহানের কাকা চেয়েছিলেন লুবনার সাথে সারহানের বিয়ে দিতে।এই পরিবারে তিনি বাইরের কোনো মেয়েকে প্রবেশ করাতে চান নি।কিন্তু প্রথমে তা হবে বলে মনে হলেও পরে সারহানের এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ তিনি দেখেন নি।জান্নাহ্কে বিয়ে করায় সারহানের কাকার চাপা ক্ষোভ রয়েছে।তাই তিনি বিয়েতে তো আসেন নি উপরন্তু আজ পর্যন্ত তিনি এই বাড়ির মুখো হন নি।লতাও আসতেন না।কিন্তু সারহানকে দেখার লোভ লুবনা সামলাতে পারে না।তার জন্যই বাধ্য হয়ে আসে লতা।কিন্তু সারহান তার আর লুবনার মাঝে দেয়াল তুলে দেয়।সে চায় লুবনা তাকে ঘৃণা করুক।কিন্তু সারহানের অযাচিত কাজে লুবনা ধীরে ধীরে আরো ঝুঁকে পড়ে তার দিকে।সারহান আসলেই ছুটে আসে লুবনা তার মায়ের সাথে।কিন্তু সেই খুশি বেশি স্থায়ী হয়না।কারণ সারহান আসেই হুট করে,আবার চলেও যায়।কিন্তু এইবার জান্নাহ্ মা হবে সেই খুশিতে সারহান নিশ্চয়ই এখানেই থাকবে তাই অন্তরার মুখে সারহান আসার কথা শুনে আর দেরি করে নি।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪৫
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    লাল গোলাপের ছাপ ওয়ালা সফেদ রঙের বিছানায় ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসে একটা নয় মাসের বাচ্চা মেয়ে।তার মাথাভর্তি ঘন কালো দুই ইঞ্চি লম্বা চুলগুলো এলোথেলো।চোখের পাঁপড়িগুলো ভ্রমরকালো।ছোট ছোট চোখে ঘুমো ঘুমো ভাব।নিমিঝিমি চোখে সে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে তার সামনে বসা অতি আপনজনের মুখটি।নাকে,মুখে অস্বস্তির ভাব পেয়ে দুই হাতে বেপরোয়াভাবে ঘষতে থাকে।তাতে করে বাচ্চাটির মোমের মতো কোমল নাকটা লাল হয়ে যায়।ফুলকো গালদুটো টসটসে।চিকন লাল ঠোঁট দুটি কিঞ্চিৎ ছড়িয়ে ক্লান্ত হাসে বাচ্চাটি।তার হাসিতে মৃদু ছন্দ হয়।ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তাকায় সেই গলুমলু পুতুলের দিকে সারহান।চোখে হাসে সে।একটা ছোট গেঞ্জি আর নরম কাপড়ের তৈরি হাফ প্যান্ট পরা বাচ্চাটি।দুই হাত দিয়ে দুই পায়ের তালু চাপকে ধরে চমৎকার হাসে সে।সারহান আয়েশি ভঙিতে কাউচে হেলান দিয়ে বাচ্চাটির কর্মকান্ড দেখে।মুহূর্তেই নেচে উঠে দুই হাতে তালি বাজায় বাচ্চাটি।সারহান ঝরা হাসে।বাচ্চাটি সারহানের হাসিতে উচ্ছ্বাসিত হয়।তার ঘুম জড়ানো চোখ দুটি উদ্ভাসিত হয় আনন্দে।

    সারহান দেখছে তাকে।এক মায়াবীনি কন্যাকে।যে তারই অংশ,তার রক্ত বইছে ওই অবুঝ,জীবন্ত মাংসপিন্ডে।বুক ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস নেয় সারহান।এক সমুদ্র সুপ্ত শিহরণ অগোছালোভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে তাকে।

    বাচ্চা মেয়েটি তার বাবাকে দেখে।আপ্লুত হয় সে।অবাক হয় সে।কারণ তার বাবা তাকেই মনোযোগ দিয়ে দেখছে।বাচ্চাটি ভাবলো তাকে যেতে হবে।তার বাবার কোলে আঁছড়ে পড়তে হবে।কোলে উঠে মুখ গুঁজে দিতে তার ওই বুক।তার ছোট ছোট চার,পাঁচেক দাঁত বসাতে হবে তার বাবার ওই গালে।তার চোখে মুখে নিজের ধারালো,নরম নখের আঁচড় বসাতে হবে।তাই তাকে ছুটে যেতে হবে ওই বাবা নামক যত্নশীল,প্রেমময়,স্নেহশীল মানবটির কাছে।বাচ্চাটি তাই করলো।শিয়রের বালিশটিকে বালুর বস্তার মতো টেনে নিচে ফেলে দেয়।ভারি কষ্ট হচ্ছে তার।সারহান বিমুগ্ধ চিত্তে নিজের মেয়ের কর্মকান্ড দেখে।বাচ্চাটি আরো একটা বালিশ টেনে ফেলে নিচে।সারহান স্মিত হাসে।মায়ের মতো বুদ্ধিমতী।এইবার অবাক কান্ড করে বাচ্চাটি।বিছানার চাদর খামছে ধরে অতি সন্তর্পনে একটা পা নামিয়ে দেয় ফ্লোরে পড়া সেই বালিশের তাম্বুলের উপর।বাবার দিকে অতি দম্ভের সাথে তাকায়।সারহান অধর কোণে হাসে।বাচ্চাটি তার বাবাকে দেখতে দেখতে অসাবধানতায় আরেক পা বালিশের উপর রাখে।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা বালিশের উপর না পড়ে তা চলে যায় বালিশের পাশ কাটিয়ে ফ্লোরে।ব্যালেন্সহীন হতেই নিজের হাতের কন্ট্রোল হারিয়ে ধপাস হয়ে পড়ে যায় টাইলসের ফ্লোরের উপর।নরম,কচি মাথায় শক্ত ফ্লোরের স্পর্শ লাগতেই গলগলিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।উদ্ভ্রান্তের মতো শ্বাস আটকে দৌঁড়ে আসে সারহান।বাচ্চাটির রক্তমাখা মাথাটা হাতের তালুতে নিয়েই গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলে উঠে—-

    “সারজান!

    হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে সারহান।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।কপাল জুড়ে মুক্তোর দানার মতো ঘাম জমেছে।কানের দুই পাশের চিপ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ।হাপড়ের মতো উঠানামা করছে সারহানের বুক।তার নাকের ডগায় ঘামের পাহাড়।ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে তার।অধর ছড়িয়ে মুক্ত শ্বাস নেয় সারহান।

    বিছানা ভাঁজ করছিলো জান্নাহ্।সারহানকে চিৎকার করতে দেখে দৌঁড়ে এসে তার সামনে বসে।সারহান দিকভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।যেনো কিছু খুঁজছে সে।জান্নাহ্ শুধায়–

    “কী হয়েছে সারহান?

    সারহান কোনো কথা বললো না।অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো।ডিভানে শুয়ে শুয়ে মোবাইল নিয়ে কিছু করছিলো।তন্দ্রাচ্ছন্ন হতেই সেই ভয়ংকর স্বপ্ন এসে হানা দেয়।সারহান ধুপ করে ডিভানের নিচে বসে পড়ে।জান্নাহ্ এর কোমর জড়িয়ে ধরে তার পেটে মুখ গুঁজে দেয়।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো—

    “আমার পরীর খেয়াল রাখবেন রজনীগন্ধা।আমি সারাজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।”

    জান্নাহ্ চকিত হয়।গত কয়েকদিনে এমন অনেকবার হয়েছে।ঘুমের মধ্যেই আঁতকে উঠে সারহান।বাকি রাত জেগে বসে থাকে।জান্নাহ্কে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে।জান্নাহ্ যতবার জিঙ্গেস করেছে ততবার বলে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে।সে দেখেছে কেউ তার প্রিয় জিনিস তার থেকে কেড়ে নিচ্ছে।

    ক্ষীণ শ্বাস পড়ছে সারহানের।জান্নাহ্ এর উদরের সাথে লেপ্ট আছে সে।জান্নাহ্ আলগোছে সারহানের মাথাটা তোলে।কী শান্ত আর নিষ্পাপ মুখ।জান্নাহ্ সারহানের গালে হাত রেখে তার চোখের নিচে জমা ঘাম টুকু মুছে দেয়।ললাটে অধর ছোঁয়ায় জান্নাহ্। নিজের দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে নেয় সারহানের মুখটা।কোমল গলায় বললো—

    “কী হয়েছে সারহান?এমন করছেন কেন?

    সারহান বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলে।থমথমে গলায় বললো–

    “আমার অতীত আমার বর্তমান ছিনিয়ে নিতে চায় রজনীগন্ধা।আমার পরী!

    আর কিছু বললো না সারহান।তার চোখে জল জমে আসে।জান্নাহ্ কিছু বুঝতে পারে না।সারহানকে ভেতর থেকে কিছু খুবলে খাচ্ছে।কিন্তু তা সে কাউকে বলতে পারছে না।নিজে সহ্যও করতে পারছে না।জান্নাহ্ নরম চোখে তাকিয়ে সারহানকে দেখে।এ কয়েকদিনে প্রকুপিত,উন্মত্ত,উগ্র মানুষটা একদম শান্ত,নিশ্চল আর অসহায় হয়ে পড়েছে।জান্নাহ্ নিষ্কম্প গলায় বললো—

    “আজ শুক্রবার সারহান।সবসবয় নিজেকে বিশ্বাস করেছেন আজ না হয় আল্লাহ্ পাককে করুন।আপনার সমস্ত কষ্ট,গ্লানি,অভিযোগ ওই ওপর ওয়ালাকে বলুন।দেখবেন তিনি ঠিক বুঝবেন।আপনাকে সঠিক নির্দেশনা দিবেন।”

    সারহান তার কপোল থেকে জান্নাহ্ এর হাত নামিয়ে তার অঞ্জলিতে চুমু খায়।নিরুত্তেজ গলায় বললো—

    “তিনি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করবেন?আমি আমার অতীত ভুলতে চাই রজনীগন্ধা।আমার বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে চাই।”

    “আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল।তিনি তার সকল বান্দাদের ভালোবাসেন।তার প্রিয় বান্দারা যখন ভুল করে তখন তিনি আশায় থাকেন কখন তার বান্দারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে ক্ষমা চাইবেন।তিনি তাদের পরীক্ষা করেন।সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তিনি পুরষ্কারও দেন।যে মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পারে তার চেয়ে বড় অনুশোচনা আর নেই।তাই তো আমাদের সব সময় আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হয়।অতীতে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা বর্তমান ধ্বংস করে।উঠুন।আযান দিয়েছে।গোসল করে মসজিদে যান।আল্লাহর দরবার থেকে তিনি আপনাকে খালি হাতে ফেরাবে না।তার সামনে আপনার সব প্রশ্ন রাখবেন।তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে তার উত্তর দিবে।”

    সারহান ধীরপায়ে উঠে দাঁড়ায়।মৃত্যুকে ভয় না পেলেও আল্লাহভীতি তার খুব কম ছিলো।নিজেকে বিশ্বাস করতো বেশি।কিন্তু আজ!

    সারহান ওয়াশরুমে যেতেই ডিভানের কুশন ঠিক করতে গেলে জান্নাহ্ টের পায় কুশনের ডানপাশ ভেজা।হয়তো ঘুমের মধ্যে সারহান কাঁদছিলো।মানুষটা এভাবে কেন ভেঙে পড়ছে!

    একটা সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী পরে সারহান।মাথায় সাদা রঙের টুপি।আয়নায় নিজেকে দেখে অপ্রস্তুত হয় সে।আড়াল করার চেষ্টা করে।এমনটা করতে ওই ছোট্ট প্রাণটা তাকে বাধ্য করলো।ঘরে ঢুকেই সারহানকে দেখে থমকে যায় জান্নাহ্।স্মিতহাস্য অধরে তাকে ইশারা করে বোঝায় ভালো লাগছে দেখতে।ফর্সা সারহানের গায়ে সাদা পাঞ্জাবীতে তাকে যেন ভিনগ্রহের কোনো প্রাণি মনে হচ্ছে।জান্নাহ্কে অবাক করে দিয়ে ঝাঁপটে ধরে সারহান তাকে।হতবুদ্ধিতা কাটিয়ে ধাতস্থ হতেই জান্নাহ্ টের পায় বেগতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সারহানের হৃদকম্পন।তা যেনো কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে।মোলায়েম গলায় জান্নাহ্ বললো–

    “সারহান,দেরি হচ্ছে।বাবা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”

    সারহান শান্ত হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায়।জান্নাহ্ সারহানের ডান হাতের উল্টো পাশে চুমু খেয়ে নিজের দুই চোখের পাতায় পরম আবেশে ছোঁয়ায়।হৃষ্ট হয় সারহানের মন।অকৃত্রিম শীতলতা তিরতির করে আবদ্ধ করছে সারহানকে।রুম থেকে বের হতেই দেখে জমির আর অন্তরা আগ্রহদীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে।অন্তরার চোখে চঞ্চলতা।খুশির হাওয়া বইছে তার হৃদয়ের দ্বারকোণে।আজ কতো বছর পর সারহানকে এই রুপে দেখছে সে।সারহানের চোখের সামনে তার মমতাময়ী।কিছু একটা ভেবে পা বাড়িয়েও পিছু হটলো সারহান।তার শান্ত,নরম চোখ দুটো মুহূর্তেই ঘৃণার সমুদ্রে উতলে উঠলো।দাঁড়ালো না আর সে।লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে চলে এলো।
    অন্তরা কাঁদলো।কিন্তু সে প্রসন্ন।তার ছেলেটা তার চোখের সামনেই থাকুক।এই ঢের।

    তিনতলা মসজিদের সামনে এসে থমকে যায় সারহান।মসজিদের পাশেই বাচ্চাদের সকালবেলা আরবি পড়ানোর জন্য দোচালা ঘর তৈরি করা হয়েছে যার পাশ দেয়ালগুলো ইটের তৈরী।এখনো পলেস্তার করা হয়নি।তার পাশেই একটা বিশাল কাঁঠাল গাছ।উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কাঁঠাল ঝুলে আছে।মসজিদের বা’দিকেই কবরস্থান।এখানেই কবর দেওয়া হয়েছে সারহানের দাদুকে।কবরটা বাঁধানো।কিন্তু অনেক দিন সংস্করণ না হওয়ায় ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।বাঁশের বেড়া দেওয়া সেই কবরের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে সারহান।তার মনে পড়ে ছোটবেলার কথা।একপাশে বাবা আর আরেকপাশে দাদুকে রেখে তাদের দুইজনের দুই আঙুল ধরে একরাশ উদ্দীপনা নিয়ে জুম্মার নামাজ পড়তে আসা সারহান।মুখে তার যুদ্ধ জয়ে যাওয়ার হাসি।ধীরে ধীরে ঘোলা হতে থাকে সারহানের অক্ষিযুগল।এই মানুষটাকে এতোটা ভালোবাসার পরও খুব ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়।

    নামাজ শেষে দাদুর কবর জিয়ারত করে জমিরের আগেই বের হয়ে কোথায় যেনো চলে যায় সারহান।জমির মসজিদের আশপাশ বেশ কিছক্ষন খুঁজেও যখন পেলো না সারহানকে তখন হতাশ শ্বাস ফেলে বাড়ির পথ ধরে।

    কুঞ্জপুকুরের এসে বসে থাকে সারহান।শান বাঁধানো ঘাট।তার নিমগ্নদৃষ্টি পুকুরের শ্যাওলা পড়া জলে।কয়েকটা মাছ খাবারের খোঁজে উপরিভাগে এসেছে।সারহান বিমুগ্ধচিত্তে তা দেখছে।একটা মিষ্টি হাওয়া এসে লাগে সারহানের গায়ে।তার চোখ নড়ে উঠে।পুকুরের ওই প্রান্তে বাঁশঝাড়।তার শুকনো পাতা পড়ে আছে পুকুরের জলে।তার একটু দুরেই আরেকটা ঘাট তৈরি করা।এর পাশেই রেইনট্রি।মোটা বটগাছ,একটা কদম গাছ।মাঝের কিছু জায়গা ফাঁকা।এখানে হিন্দুদের একটা সমাধি আছে।রোজ ধূপ জ্বালানো হয়।একটা উঁচু বলয়ে তুলসি গাছ লাগানো।রোজ সন্ধ্যায় হিন্দু বাড়ির খুড়োপিসি পিদিম জ্বালিয়ে দেয় তুলসি তলায়।

    সারহানের বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক নড়ে উঠে।তার বুকের ভেতরটা ক্রমশ এক ভয়ংকর ভয়ের আবেশে ভারি হচ্ছে।তার হৃদপিন্ডটা যেনো কেউ খাবলে ধরেছে।যেনো এখনি তা টেনে হিঁচড়ে বের করে নিবে।এমন কেনো হচ্ছে সারহান জানে না।ওই ছোট্ট প্রাণ যা এখনো এই দুনিয়াতেই আসে নি তার জন্য এই মনটা কেন উতলা হয়!কেন এতো ভয় হয় তাকে হারানোর!এরই নাম বুঝি পিতৃত্ব!
    সারহান বোঝে না।জীবনের মায়া না করা সারহানের আজ খুব বাঁচতে ইচ্ছে হয়।ওই ছোট্ট প্রাণটাকে এই হাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।তার নরম কপোলে চুমু আঁকতে ইচ্ছে হয়।
    কিন্তু সারহান ভাবে,তার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার এতো চিন্তা সেখানে তার মায়ের কোল থেকে যখন তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে তখন তার কেমন লেগেছে!তার কী আদৌ বাঁচতে ইচ্ছে হয়েছে!এ কেমন মায়াজাল!
    যার অস্তিত্ব এখনো পৃথিবী দেখেনি তাকে পাওয়ার জন্য সারহানে সত্তা আকুলিবিকুলি করছে সেখানে তার মায়ের বুক খালি করে তাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

    তৎক্ষণাৎ সারহানের শান্ত,কোমল মন গর্জে উঠে।তার ভেতরকার মানুষটা হুংকার দিয়ে বললো–

    “নাহ,করবে না সে ক্ষমা।ওই মানুষটাকে সে কখনো ক্ষমা করবে না।”

    কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে অন্তরার সে মায়াভরা মুখ।এতো স্নেহ,এতো ভালোবাসা।সব কী মিথ্যে !মা কী কখনো মিথ্যে হয়!

    কিন্তু সেই বিদ্বেষী আবার সারহানকে শ্বাসায়—

    “নাহ।তোকে নরম হলে চলবে না।এই কষ্ট তার প্রাপ্য।সন্তান হারানো এক মায়ের আকুতি।তাকে ক্ষমা করা যাবে না।”

    সারহান চমকে উঠে।তার কাঁধে আলতো হাত রাখে জমির।সারহানদের বাড়ি যাওয়ার পথেই কুঞ্জপুকুর।ছোটবেলাই কতো ঝাঁপাঝাঁপি করেছে এই পুকুরে।আজ শুধু তা স্মৃতিকথা।
    জমির নির্বিঘ্নে বসলেন।কোমল হাসলেন তিনি।সারহান ঘুরে বসলো।বাবার দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো।জমির সারহানের কাঁধে পুরো হাতটা দিলেন।নিজের বুকের একপাশে সারহানের মাথাটা ছোঁয়ালেন।আজ এতোদিন পর ছেলের স্পর্শে বাবার হৃদয় গভীর উচ্ছ্বাসে সরব হলো।সারহান শান্ত হয়ে রইলো।জমির তাকে ছেড়ে বসলেন।আবেগী গলায় বললেন—

    “বাবা হতে চলেছিস।নিশ্চয়ই ভয় হচ্ছে?

    সারহান তার বাবার দিকে তাকালো।কী সুন্দর ওই দুই চোখ।কতো মমতা খেলে যাচ্ছে সেখানে।সারহানের সেই মমতা দেখতে ইচ্ছে হলো।সে তাকিয়ে রইলো।জমির স্মিতহাস্য অধরে আবার প্রশ্ন করলেন—

    “কথা বলছিস না যে?

    সারহান সরব হলো।বললো—

    “হুম।হচ্ছে।কোথাও কিছু হচ্ছে বাবা।বুঝতে পারছি না।বাবা হওয়ার অনুভূতি বুঝি এমনই হয়!

    জমির চমৎকার হাসলেন।স্বাভাবিক গলায় বললেন—

    “হয়।সব পুরুষের মধ্যেই একটা বাবা থাকে।কিন্তু তা অদৃশ্য।তার পরিস্ফুটতা ঘটে ওই ছোট্ট একটি ডাকে।বাবা!

    সারহান সরস হাসলো।বাবা!চমৎকার শব্দ।অদ্ভুত একটা অনুভূতি আছে এতে।ছেলে হয়ে জন্মানো সারহান একদিন কিশোরে রূপ নেয়।তারপর যুবকে।একজন স্বামী।আজ তার পূর্ণতা আসতে চলেছে।সেও বাবা হবে।তার ভেতরকার সুপ্ত একটা মানব যার আছে স্নেহ,আদর আর ভালোবাসা তা সবার সামনে আসতে চলেছে।বটবৃক্ষের মতো কাউকে ছায়া দিবে সে।তার ছোট্ট আঙুল ধরে কেউ বলবে বাবা।কী অদ্ভুত শব্দ!

    সারহান সুপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।আবার ঘুরে বসে সে।পুকুরের ওই পাড়ে তাকায়।একটা পাখি দেখা যাচ্ছে ওই সমাধিতে।সারহান আলতো গলায় প্রশ্ন করে–

    “বাবা,একটা প্রশ্ন করি?

    জমির সোজা গলায় বললেন—

    “কর।”

    নির্বিঘ্নে প্রশ্ন করে সারহান—

    “তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?আমাকে না আপুকে?

    দুর্বোধ্য হাসলো জমির।অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় উদাস ভঙিতে পাল্টা প্রশ্ন করে—

    “আমি যদি তোকে বলি তোর দুই চোখের মধ্যে কোন চোখটা আমায় দিবি তাহলে তুই কোনটা দিবি?

    ফট করে ঘুরে বসে সারহান।অবিশ্বাস্য গলায় বলে উঠে–

    “মানে?

    জমির শীতল গলায় বললো—

    “সন্তান বাবা মায়ের সেই দুই চোখ,যার একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন কাঁদতে বাধ্য।তুই যদি আমাদের প্রাণ হোস তাহলে শুভ্রা আমাদের দেহ।প্রাণ ছাড়া যেমন দেহ মূল্যহীন তেমন দেহ ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন।”

    নীরস হাসলো সারহান।হালকা কন্ঠে শুধায়—

    “তাহলে দাদু এমন কেন করলো?

    জমির আকাশের দিকে তাকালেন।নির্মেঘ আকাশে যেনো তিনি তার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখলেন।প্রসন্ন হাসলেন তিনি।গম্ভীর গলায় বললেন—

    “বাবা সেকেলে মানুষ।বংশ রক্ষায় ছেলে সন্তানের গুরুত্ব বুঝতেন।তাই।”

    “তাই বলে..।”

    জমির হুট করেই বললেন—

    “তুই নিশ্চয়ই তোর বোনকে ফেলে দিবি না!

    সারহান চুপ করে রইলো।জমির আলতো করে সারহানের হাত ধরলেন।বললেন—

    “চল, আজ তোকে মহানবী( সাঃ) এর সেই মা পাখিটি আর তার ছানার গল্প শোনাবো।তারপর একসাথে খাবো।অনেকদিন একসাথে খাওয়া হয় না।কী জানি তোর ছেলে এলে আর সে সুযোগ নাও পেতে পারি!

    সারহান মৃদু লজ্জায় হাসলো।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪৬
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ইশাককে দেখে খলবলিয়ে উঠে রাফাত।যখন থেকে ওই গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে এই ঘরে নিজেকে বদ্ধ করে নিয়েছে।গর্জে উঠে রাফাত বললো—

    “কেন এসেছিস এখানে?বের হ,বের হ আমার ঘর থেকে।”

    হতচকিত গলায় ইশাক বললো–

    “এমন করছিস কেন?কী হয়েছে তোর?

    দাপিয়ে উঠে রাফাত।ইশাককে এক ধাক্কা মেরে বললো—

    “চলে যা এখান থেকে,চলে যা।আমার কাউকে চাই না।কাউকে না।”

    ইশাক রাফাতকে শান্ত করা চেষ্টা করছে।কিন্তু রাফাতের রাগ তরতর করে যেনো তার সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনের চেষ্টায় অব্যাহত।খাবলে ধরে ইশাকের টিশার্ট রাফাত।গরগরে গলায় ক্ষীপ্ত হয়ে বললো—

    “বলছি না চলে যা।আর কখনো আসবি না।কেউ আসবি না আমার কাছে।কাউকে চাই না আমার।সবাই ধোঁকাবাজ।সবাই।”

    রাফাতের চিৎকার চেঁচামেচিতে দৌঁড়ে আসে তার বাবা মা।কোনো মতে ক্ষুব্ধ রাফাত থেকে ইশাককে ছাড়িয়ে রুমের বাইরে নিয়ে আসে।দরজা লক করেই দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে নিচে বসে পড়ে রাফাত।দুই হাতে নিজের চুল খাবলা মেরে ধরে।চিৎকার করে উঠে রাফাত।সেই চিৎকারে কেঁপে উঠে রাফাতের মা,বাবা আর ইশাক।
    পুরো ঘরে সমস্ত জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ওয়াইনের বোতলের টুকরোগুলো ফ্লোরে গড়িয়ে আছে।সিলিং আর দেয়াল জুড়ে শ’খানেক ড্রিম ক্যাচার।বিছানায় পড়ে আছে জান্নাহ্ এর জন্য আনা সেই রেড গাউন।শুকনো চেরি ফুলের ধ্বংসাবশেষ।খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভরে আছে রাফাতের নির্জীব চেহারা।চোখের নিচটায় দেবে আছে।কালো রঙে ছেয়ে আছে তা।ফ্লোরে আছে কালচে রক্তের ছোপ।রাফাতের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় শুকনো রক্ত কালসে হয়ে আছে।সমস্ত ঘরজুড়ে ভোটকা গন্ধ।এক মৃত্যুপুরীতে বসবাস রাফাতের।এক হতজীব প্রাণি সে।

    রাফাতের বাড়ি থেকে বিষন্ন মন নিয়ে বের হয় ইশাক।ঝাপসা চোখে পকেটে দু হাত পুরে অগোছালোভাবে হাঁটছে।আকস্মিক সামনে আসা তীব্র বেগের গাড়ির হুডের উপর আঁছড়ে পড়ে ইশাক।ধাতস্থ হয়ে সামনে তাকাতেই গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে উগ্রমুর্তি ধারণকারী সুদর্শন পুরুষটি তড়িৎ বেগে এসে ইশাকের গালে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেয়।হতভম্ব ইশাক কিছু বুঝে উঠার আগেই তার কান চেপে ধরে ব্যক্তিটি।অরুনলোচন চোখে তাকিয়ে তপ্ত গলায় বললো—

    “তাহলে এই তোর ডাক্তারী?

    ইশাক কিছু বলবে তার আগেই ব্যক্তিটি তার কান চেপে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসায়।
    ,
    ,
    ,
    বিভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে ইশাক।সামনের ব্যক্তিটির প্রকুপিত মুখ দেখে ভয়ে তটস্থ সে।সামনের ব্যক্তিটি দারাজ গলায় বললো–

    “কবে এসেছিস তুই?

    ইশাক ভাঙা ভাঙা গলায় প্রত্যুক্তি করে—

    “সাত মাস।”

    উবলে উঠে ইহতিশাম,বললো—

    “সাত মাস! আর তুই এই পর্যন্ত আমার সাথে দেখা করিস নি!

    ইশাক ভীত গলায় নরম হয়ে বললো—

    “ভাই।আই এম রিয়েলী সরি।আসলে..।”

    ইহতিশাম নাকের পাটা ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে।দমদমে গলায় বলে উঠে—

    “চাচা,এতো কষ্ট করে তোকে ডক্টরী পড়তে পাঠিয়েছে আর তুই চলে এলি!চাচার কষ্টের কোনো দাম নেই তোর কাছে?

    ইশাক অনুযোগের সুরে বললো—

    “ভাই,আই এম সরি।আসলে যা হয়েছে তার জন্য আমি..।”

    ইশাক চুপ হয়ে যায়।ক্ষুব্ধ গলায় শাসিয়ে উঠে ইহতিশাম–

    “বল।চুপ করে আছিস কেন?

    ইশাক ধীর গলায় রাফাতের পুরো কথা শোনায়।ইশাক ইহতিশামের চাচাতো ভাই।ইশাক দেশে ফিরেও গ্রামে যায়নি।এতোদিন রাফাতের সাথেই ছিলো।কিন্তু গ্রাম থেকে ফিরে এসে একটা ম্যাসে থাকা শুরু করে।সম্পূর্ন ঘটনা শুনে উদ্দীপিত হয় ইহতিশাম।কৌতূহলী গলায় বললো—-

    “মেয়েটার নাম কী?

    সহজ গলায় উত্তর করে ইশাক—

    “জান্নাহ্।”

    ঝিমুনি দিয়ে উঠে ইহতিশামের শরীর।চোখের পাতা কাঁপতে শুরু করে।নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে সে।চাপা গলায় প্রশ্ন করে—

    “ওর হ্যাজব্যান্ডের নাম সারহান?সারহান জেইদি?

    ইশাক উৎসুক গলায় বললো–

    “তুমি কী করে জানলে?

    ইহতিশাম শীতল নিঃশ্বাস ফেললো।নাকের তলায় হাত রেখে কিছু একটা ভাবছে।পৃথিবী আসলেই গোল।এক গোলকধাঁধা।সেই ধাঁধার উত্তর পেতে আমরা সবাই একে অপরের অপর নির্ভরশীল।ইশাক সম্মোহিনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।গভীরভাবে ইহতিশামের চিন্তিত মুখের অর্থোদ্বার করার চেষ্টা করলো।সে দেখলো ইহতিশামের দুই ভ্রু এর সন্ধিস্থলের সেই তারকা চিহ্ন মৃদু ছন্দে নড়ছে।কপালের উপরে মসৃনতা ভেঙে মোটা মোটা ভাঁজ পড়েছে।মৌনতা ভেঙে চটপটে গলায় আবদার করে বসে ইহতিশাম–

    “তুই আমার সাথে রাফাতের দেখা করিয়ে দিতে পারবি?

    ইশাক দ্বিধান্বিত গলায় প্রত্যুত্তর করে বললো—

    “ভাই,রাফাত এখন উন্মাদ।কাউকে সহ্য করতে পারে না।হি ইজ লাইক আ ব্লাডি হান্টার।”

    ইহতিশাম জীভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তা আবার চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বললো—

    “আই উইল ম্যানেজ।তুই আমার সাথে ওর দেখা করিয়ে দে।”

    ইশাক আশ্বস্ত গলায় বললো–

    “আচ্ছা ভাই।”

    তপ্ত গলায় বললো ইহতিশাম—

    “আজ এখানেই থাকবি।বস,মাকে খাবার দিতে বলছি।রাফাতের সাথে আমার মিট করিয়েই বাড়ি যাবি।চাচা আমাকে পাগল করে ফেলছে।”

    ইশাক আনম্র চোখে তাকায়।
    ,
    ,
    ,
    বিছানায় আসন পেতে বসে আছে জান্নাহ্।চারপাশে সুনসান নিরবতা।জান্নাহ্ এর কোমর জড়িয়ে তার কোলে মাথা দিয়ে বসে আছে সারহান।শান্ত,শীতল,নিষ্কম্প।প্রায় এক ঘন্টা ঠাঁই এভাবেই বসে আছে সারহান।জান্নাহ্ আলতো হাতে সারহানের ঘন চুল নাড়িয়ে যাচ্ছে।তার দুই চোখের পল্লব সিক্ত।নাক টেনে নিয়ে বললো—

    “সারহান,এমন কেন করছেন?আমি ঠিক আছি।”

    সারহান এক চুলও নড়লো না।কোনো প্রতিক্রিয়াও করলো না।উল্টো আরও জোরে চেপে ধরলো জান্নাহ্কে।মুখটা সোজা করে জান্নাহ্ এর পেটের দিকে গুঁজে দেয়।ক্ষনকাল পরপর বিক্ষিপ্ত শ্বাস টানে সারহান।তার শুষ্ক অধর ছোঁয়ায় জান্নাহ্ এর উন্মুক্ত উদরে।কেঁপে উঠে জান্নাহ্।সারহানের ভেজা গালের স্পর্শ পায় জান্নাহ্।আলগোছে সারহানের মাথাটা উঠিয়ে নির্বিকার চোখে তাকায় সে।সারহানের দুই গালে লেপ্টে আছে নোনতা জল।যা জবজবে।জান্নাহ্ দুই হাতের তালু দিয়ে ভালো করে মুছে দেয় সারহানের গাল।নরম গলায় বললো—

    “আমি ঠিক আছি সারহান।দেখুন,একদম ঠিক আছি।”

    চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে আবারও আঁকড়ে ধরে জান্নাহ্কে।কেঁপে কেঁপে উঠে সারহান।তার ভয় তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো।একটু আগেই তিতির সাথে ছোটাছুটি করতে গিয়ে সিঁড়িতে পিছলে যায় জান্নাহ্।দুই সিঁড়ি নিচে গড়িয়ে পড়তেই সিঁড়ির ধারালো কোণা লেগে ছুঁলে যায় জান্নাহ্ এর হাঁটু।ভাগ্যিস সারহান ধরে ফেলেছিলো তার হাত।তাই পেটে কোনো চাপ লাগেনি।চিৎকার চেঁচামেচিতে ছাদ থেকে ত্রস্ত পায়ে দৌঁড়ে আসে নিধি।একটু আগেই একগাদা কাপড় নিয়ে ছাদে উঠেছে সে।সিঁড়ির উপরে পানি হয়তো তার অজান্তেই পড়েছে।
    অন্তরা পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে।নিধির চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে অভব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।বেচারি নিধি শুধু চোখের জল নাকের জল এক করেছে।

    আর সেই থেকে সারহান ঘরের দরজা বন্ধ করে জান্নাহ্কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।কাউকে একটা কথাও বলেনি।এমনকি নিধিকেও না।বাড়ির সবাই তাজ্জব বনে যায় সারহানের এই আকস্মিক পরিবর্তনে।এইসব কী শুধুই সারহানের প্রায়শ্চিত্ত নাকি ওই ছোট্ট প্রাণটার প্রতি আর হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা !

    দুপুরের সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে।জৈষ্ঠ্যের কাঠফাটা রোদ যেনো আগুনের লেলিহান শিখা।নিরাক পরিবেশ।একটা পাতাও নড়ছে না।সূর্যের দম্ভ করা অগ্নিলাভা থেকে শেষ রক্ষে হলো না।থমথমে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠাঁল গাছটা যেনো রোদকে শাসিয়ে বলছে সময় একদিন আমারও আসবে।মুহূর্তেই কিঞ্চিৎ নড়ে উঠে কাঠাঁল গাছের পাতা।কাকের কর্কশ ধ্বনির সাথে তাল মিলিয়ে যেনো পাতারা হাসছে।

    মৃদু গলায় সারহান বললো—

    “এতো কষ্ট না দিয়ে একবারেই মেরে ফেলুন আমাকে।মরে যাই আমি।”

    জান্নাহ্ এর বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়।সারহানকে না জানিয়ে যখন সে কনসিভ করে জান্নাহ্ বুঝতে পারেনি সারহান এতো সহজে সবটা মেনে নিবে।কিন্তু যখন থেকে বাবা হওয়ার আনন্দকে সে উপলব্ধি করেছে সে যেনো অন্য এক সারহান।ঘি ঢালা আগুনে তেঁতে উঠা সারহান যেনো তাপে গলে যাওয়া প্যারাফিন।বাচ্চা নিয়ে এতোটা কনসার্ন হবে তা জান্নাহ্ কখনো ভাবতে পারে নি।সারহানের কখনো এইসবে আগ্রহ ছিলো না।উপরন্ত সে চাই নি জান্নাহ্ মা হোক।কিন্তু এমন কী হয়েছে এখন সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ই তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে!

    নিষ্প্রভ সুরে বললো জান্নাহ্—

    “সারহান,নিজেকে সামলান।আমি সাবধানে থাকবো।বিশ্বাস করুন।আর কখনো এমন হবে না।”

    সারহান তপ্ত হয়ে উঠে।কড়া গলায় বললো—

    “কী করে বিশ্বাস করি আপনাকে!আজই তো আমার সবকিছু শেষ করে দিচ্ছিলেন।”

    “সরি।”

    সারহান রাগের সাথে অভিমান মিশিয়ে বললো—

    “আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আমি নিজেকে বদলাতে চাই।কেন দিচ্ছেন না সেই সুযোগ আমাকে?

    অপ্রত্যাশিত এক ঘটনার সম্মুখীন হয় জান্নাহ্।সারহানের দুই শান্ত চোখ মুহূর্তেই আগ্নেয়গিরির মতো উগরে উঠে।হিংস্র হায়েনার মতো জান্নাহ্ এর উপর ক্ষেপে উঠে তার দুই গাল নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরে দাঁতখামটি মেরে বললো—

    “যদি আমার সন্তানের কিছু হয় জান নিয়ে নিবো আপনার।আমার পরীর গায়ে যদি কেউ একটা ফুলের টোঁকা দেয় তার পুরো জীবন ভ্রংশ করে দিবো আমি।”

    ব্যথায় কুঁকড়ে যায় জান্নাহ্।তার দুই চোখ টলটল করে উঠে।সারহান শিথিল করে তার হাত।জান্নাহ্ এর ভীতসন্ত্রস্ত দুই চোখ আটকে আছে সারহানের ওই ক্ষীপ্ত চাহনিতে।একটু ধাতস্থ হয়ে জান্নাহ্ এর পেটের উপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে গনহারে চুমুর আন্দোলন চালাতে থাকে।অস্বাভাবিক কিন্তু শান্ত ভঙ্গিতে সারহান বললো—

    “ডোন্ট ওয়ারি পরী।পাপা আপনার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না।আপনি একটুও ভয় পাবেন না।পাপা ইজ অলওয়েজ উইথ ইউ।”

    সারহান চোখ তুলে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।পেছন দিকে ঝুঁকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।তার শ্বাস যেনো তার মায়া ছেড়ে দিচ্ছে।সারহান গম্ভীর থাকলেও আজ পর্যন্ত তার সাথে কোনোদিন এমন আচরণ করে নি।ফাঁকা ঢোক গিলে জান্নাহ্।ঠোঁট দুটো চেপে ভেতরে নিয়ে তা ভিজিয়ে নেয়।গাঢ় দৃষ্টিতে সারহানকে দেখে।কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছে সে।জান্নাহ্ এর নরম মেদহীন উদরে হাত বুলাতে থাকে।যেনো কোনো শিশুকে আদরে ঘুম পাড়াচ্ছে ।অস্পষ্ট ছড়া কাটে সারহান।অধরে বোকা বোকা হাসি।চোখে আদুরে ভাব।তার অঙ্গভঙ্গি কেমন দিশেহারা,পাগল,চেতনাহীন মানুষের মতো।জান্নাহ্ এর শ্বাস ভারি হতে থাকে।এ কোন মহাবিপদ সংকেত!না চাইতে আঁতকে উঠে জান্নাহ্।ভয়ে তার কলিজা ফুড়ে যাচ্ছে।সারহানের আচরণ স্বাভাবিক নয়।এইটুকুতেই সারহান আজ যে আচরণ তার সাথে করেছে যদি সত্যিই কিছু হয়ে যায়!
    তাহলে প্রলয় শুরু করে দিবে সারহান।সেই প্রলয়ে সব ভ্রষ্ট হয়ে যাবে।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪৭
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    সকালটা তপ্ত রোদে ছাওয়া।ভ্যাবসা গরমে নাভিশ্বাস উঠার যোগাড়।ঘূর্ণায়মান ফ্যানের নিচেও যেনো মনে হচ্ছে আগুনের দলা সিলিং খসে খসে পড়ছে।সেই হাওয়াতেও জ্বলছে শরীর।

    ড্রয়িং রুমে বসে পান চিবুচ্ছে অন্তরা।তার পাশেই বসে আছে সারোজা বেগম।জান্নাহ্কে ডেকে আনে নিধি।তাকে দেখেই একগাল হাসলেন সারোজা বেগম।পান খাওয়া দাঁতগুলো কেলিয়ে বললেেন—

    “অ্যারে বউ তুই দেহি আগেরতুন আরো বেশি সুন্দর হইছোস!

    জান্নাহ্ মৃদু হাসে।নিঃশব্দে সারোজা বেগমের পাশে গিয়ে বসে।তার দিকে উন্মুখ হয়ে আছে শুভ্রা,অন্তরা,নিধি।সারোজা দাঁত কেলিয়ে হেসেই জান্নাহ্ এর শাড়ির আঁচল ভেদ করে তার পেটে হালকা চাপ দেয়।চমকে উঠে জান্নাহ্।চোখ বড় বড় করে তাকাতেই মৃদু হেসে অন্তরা বললেন—

    “ভয় পাইয়ো না বউ।খালা দেখতাছে তোমার পোলা অইবো না মাইয়া।”

    জান্নাহ্ কিঞ্চিৎ ভ্রু ক্রুটি করে তার বিরক্তি বুঝানোর চেষ্টা করে।সারোজা বেগম দাম্ভিক হেসে বললেন—

    “চিন্তা করিস না অন্তরা,পোলাই অইবো।”

    অন্তরা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো যেনো।তার চোখ,মুখ ঝলমলে সোনালী রোদের মতো চিকচিক করে উঠে।
    প্রাণখোলা হেসে বললেন–

    “সত্যি কইতাছো খালা!

    সারোজা ক্রোধান্বিত গলায় বললেন—

    “তোর কী মনে অইতাছে আমি মিছা কথা কই!সারোজা বেগম যা কয় তাই ই অয়।তোর সারহাইন্নার পোলাই অইবো।মনে নাই শুভার সময় কী কইছিলাম!পোলা অইবো কইছিলাম আর তোর নাতি অইছিলো।”

    প্রশান্তিময় হাসলেন অন্তরা।সারোজা বেগম সেকেলে মানুষ।তার চক্ষু তীরের ফলার মতো।যেনো খুঁচিয়ে ভেতরের খবর বাইরে নিয়ে আসেন।তাই তিনি দেখেই বলতে পারেন ছেলে হবে না মেয়ে।দাত্রী হিসেবেও তার অনেক পরিচিতি।জাবিন আর তিতির সময় তিনিই ছিলেন।হয়তো কোনো মেডিক্যাল ইস্যু না থাকলে জান্নাহ্ এর নর্মাল ডেলিভারিতে তিনিই থাকবেন।কিন্তু সারোজা বেগমের বয়স হয়েছে।

    জান্নাহ্ অধর কোণে হাসলো।মনে মনে আরেক পসলা হাসলো।এভাবে কী বলা যায় নাকি ছেলে হবে না মেয়ে হবে!তার উপর সারহান চায় তার মেয়ে হোক।সারহানের ধারণা তার একটা ছোট্ট পরী হবে।কিন্তু সে যদি জানে তার পরী নয় রাজকুমার হবে তখন!

    জান্নাহ্ কথা বাড়ালো না।বয়স্ক মানুষ যা বুঝেছেন তাই বলেছেন।যা হবে দেখা যাবে।আপাতত তার বাবার পাগলামি ভয়ংকর।মৃদু গলায় জান্নাহ্ বললো—

    “দাদু,আপনার জন্য চা নিয়ে আসি?

    সারোজা বেগম আপত্তি করে বললেন–

    “নাহ।গরমে মইরা যাইতাছি।এই গরমে চা খাইতাম না।”

    “তাহলে বেলের শরবত নিয়ে আসি?

    “যাও,এতো যখন কইতাছো নিয়া আসো।একটু চিনি বাড়াইয়া দিও।”

    “আচ্ছা।”

    জান্নাহ্ উঠে দাঁড়াতেই দেখে ঝড়ের বেগে দরজা দিয়ে ঢুকেছে সারহান।কোনোদিকে তার খেয়াল নেই।সোজা গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে।অন্তরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরস গলায় বললেন–

    “তোমারে আর শরবত বানান লাগবো না বউ।সারহান আইছে তুমি ঘরে যাও।”

    “জ্বী আম্মা।”

    অন্তরা নিধিকে শরবত বানিয়ে আনতে বললেন।সারোজা বেগম মুখে বড়সড় পান গুঁজে নিলেন।পান চিবুতে চিবুতে বললেন—

    “বউডা দিনদিন কী সুন্দর হইতাছে!পোয়াতি মাইয়ারা এমনেই সুন্দর অয়।তার উপর তোমার বউর তো পোলা অইবো।পোলা অইলে মায়েগো রূপ খেইলা উঠে।দেহোনাই শুভার সময় অইছিলি!আমাগো শুভা কী সুন্দর অইছিলো!

    অন্তরা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

    ঘরে ঢুকে আরেক দফারফা।সারহান তার ঘামার্ত জামা কাপড় বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে রেখেছে।শশব্যস্ত হয়ে কাপড় পরিবর্তনে ব্যস্ত সে।ধূসর রঙের শার্টটা পরেই আলমিরা খুলে কিছু নগদ টাকা আর চেক বইটা নিয়ে নেয়।জান্নাহ্ মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

    “কী হলো?কোথায় যাচ্ছেন?

    সারহান সরল গলায় বললো—

    “ঢাকা।”

    চমকে গিয়ে জান্নাহ্ বললো—

    “কেন?

    নিজের সবকিছু গোছগাছ করে নিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় সারহান বললো–

    “এই শ্রীজাটাও মরার সময় পেলো না!

    জান্নাহ্ এর সন্দিগ্ধ চোখের চাহনিতে সারহান আবার বললো–

    “এনজিও পেছনের দিকে ঘরগুলো অনেক পুরোনো।গত ঝড়ে সেগুলোতে ফাটল দেখা দেয়।বিভিন্ন ঝামেলার কারণে ঠিকও করতে পারিনি।তৌহিদ আর তানিয়াকে কতবার বললাম কাউকে যেনো সেদিকে যেতে না দেয়।গাধার বাচ্চাগুলা কী করে কে যানে!আর এই শ্রুতিটাও কারো কথা শোনে না।কী করতে গিয়েছিলো কে জানে!দেয়াল ধ্বসে শ্রুতির পায়ের উপর পড়েছে।”

    আঁতকে উঠে জান্নাহ্।উদ্বেলিত গলায় বললো—

    “কী বলছেন এইসব?

    “হুম।শায়িখ ওকে হসপিটালে নিয়েছে।আমাকে এখনই যেতে হবে।”

    জান্নাহ্ এর কাছে এসে দাঁড়ায় সারহান।তার ললাটে অধর ঠেকিয়ে বললো—

    “আমি দু’দিন পর এসে আপনাকে নিয়ে যাবো।সাবধানে থাকবেন।আর আমার পরীর খেয়াল রাখবেন।”

    জান্নাহ্ সারহানের দুই হাত ধরে চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে।

    “আসি।”

    ব্যস্ত পদযুগলে লম্বা লম্বা পা ফেলে বের হয় সারহান।জান্নাহ্ এর পাংশুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস।
    ,
    ,
    ,
    হসপিটালের করিডোরে বিষন্ন মনে দাঁড়িয়ে আছে সারহান।হসপিটালে এসে শ্বাস নেওয়ারও সময় পায়নি।শ্রুতির চিৎকারে যেনো মুছড়ে যায় তার ভেতরটা।মেয়েটা কী কখনো একটু সুখ পাবে না!

    করিডোর থেকে সারহানের চোখ যায় রিসিপশনে।একটা তেরো কী চৌদ্দ বছরের মেয়ে একজন বয়স্ক মানুষের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।গাঢ় দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখে সারহান।মেয়েটি রিসিপশনে ওয়েটিং চেয়ারে বসে।পাশে অতি সাবধানে বয়স্ক মানুষটিকে নিয়ে বসায়।

    সারহানের মানসপটে ভেসে উঠে সেই সন্ধ্যেবেলা।এমনই একদিন হসপিটালে প্রথম দেখেছে সে তার রজনীগন্ধাকে।দুই ঘন পল্লবে আবৃত চোখ,একপাশে সিঁথি করে চুল ফেলে রেখেছে দু’পাশে।সেই চুল গিয়েছে ঠেকেছে তার রজনীগন্ধার কোমরে।সিঁথির দুই পাশে তিনটি করে মৌ ক্লিপ লাগানো।ব্রাউন কালারের চুড়িদারের সাথে হলুদ,কালোর মিশেলে হাঁটু অব্দি লম্বা ফ্রক।পায়ে লাইট পিংক কালারের স্ক্যাকার্স।
    জান্নাহ্ তার বাবার হাত ধরে যাচ্ছে আর বারবার ফিরে দেখছে সারহানকে।সারহানের পুরো শরীর তখন রক্ত মাখানো।বেখেয়ালিভাবেই সারহান তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।কিন্তু জান্নাহ্ এর ওই হৃদয়হরণ করা চোখ আর কলিজা কাঁপিয়ে দেওয়া তার পাতলা ঠোঁটের হাসিতেই যেনো ক্ষনে ক্ষনে মরতে ইচ্ছে হয় সারহানের।কিন্তু পরক্ষনেই সারহানের মনে হলো সে তো অনেক আগেই মরে গেছে।এখন যা আছে তা শুধুই দেহ নেই তার আত্না।

    বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় সারহান।আজ সে জীবন্ত।ওই ছোট্ট মেয়ে তার প্রাণ সঞ্চারিনী।তার নির্জীব দেহে প্রাণের জন্ম দিয়েছে।তাকে প্রাণদেবতা বানিয়েছে।

    সারহানের ভাবনার ব্যবচ্ছেদ ঘটে তার মোবাইলের রিংটনে।হাতে নিতেই দেখে এই মূহুর্তে যাকে তার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে সেই ব্যক্তির কল।সারহান পরম আবেশে হাসলো।রিসিভ করেই অতি আবেগের সাথে বললো—

    “কেমন আছেন রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ্ অভিমানি গলায় বললো–

    “দুরে গেলে আর আমাকে মনে পড়ে না?

    স্মিতহাস্য অধরে প্রত্যুক্তি করে সারহান–

    “মনে তো তাকে করবো যে দুরে।যে এই বুকে তাকে কী করে ভুলে যাই!

    লজ্জামিশ্রিত হাসে জান্নাহ্।ফিকে গলায় বললো–

    “শ্রুতি কেমন আছে?

    সারহান সাবলীল গলায় বললো—–

    “ভালো নেই।গোড়ালির উপরের দিকে হাড়টা ভেঙে নিচের দিকে চলে গেছে।অপারেশন ইমিডিয়েট করতে হবে।আমি এখন আসতে পারবো না রজনীগন্ধা।সময় লাগবে।”

    জান্নাহ্ মিষ্টি গলায় ভরসা দিয়ে বললো—

    “চিন্তা করবেন না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আগে শ্রুতি ঠিক হোক তারপর আসুন।আমি নিজের খেয়াল রাখবো।”

    সারহান কন্ঠে গভীরতা টেনে বললো—

    “শুধু নিজের নয়।আমার পরীরও খেয়াল রাখবেন।তার কিছু হলে কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়বো না।”

    জান্নাহ্ ঝুমঝুমিয়ে হাসে।সারহান ভ্রু নাচিয়ে বললো–

    “হাসছেন কেন?

    আরেক পসলা হাসে জান্নাহ্।ঠোঁট চিপে হাসি রোধ করে ক্ষীন গলায় বললো–

    “আজ সারোজা দাদু এসেছিলেন।তিনি বললেন আমাদের ছেলে বাবু হবে।”

    হঠাৎ করেই সারহানে কিছু হলো।কড়া গলায় বললো—

    “মা নিয়ে এসেছে তাই না?

    “হুম।”

    তাচ্ছিল্য হাসলো সারহান।তার ঘৃণা যেনো বিদ্যুতের মতো ঝাঁকিয়ে তুললো তাকে।থমথমে গলায় বললো—

    “কিছু খেয়েছেন আপনি?

    “হুম।আপনি নিশ্চয়ই কিছুই খান নি?

    “সারহান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো—

    “আপাতত খেতে ইচ্ছে করছে না।কাল সকালেই শ্রুতির অটি।দোআ করবেন।মেয়েটা যেনো ঠিক হয়ে যায়।”

    “আল্লাহ্ এর ভরসা রাখুন সারহান।তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”

    সারহান কথা কাটতে বললো–

    “আচ্ছা রাখছি।রেস্ট নিন।রাতে খেয়ে ঘুমাবেন।”

    “আচ্ছা।”

    মোবাইলটা পকেটে রেখে রেলিং এ হাত দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ায় সারহান।নিমীলিত চোখের পর্দায় সে দেখতে পায় শ্রুতিকে।যে মানুষটাকে সে খুঁজে চলছে সেও শ্রুতির মতো।এই জন্যই কী এতোটা অনুভব করে সে শ্রুতিকে!

    জান্নাহ্ এর পাশে শুয়ে আছে তিতি।বিকেলে এসে সে যে শুয়েছে আর উঠেনি।আধশোয়া হয়ে কথা বলছিলো জান্নাহ্।কথা শেষে নিজের পেটের উপর আলতো হাত রাখে জান্নাহ্।স্বগতোক্তি করে বললো—

    “দেখলি পুঁচকো,তোর বাবার আমার জন্য কোনো চিন্তা নেই।সব চিন্তা তোর জন্য।তুই এলেই তোর বাবা একদম বদলে যাবে।আমি আমার প্রাণকে ফিরে পাবো পুঁচকো।তুই ভালো থাকিস।তোর কিছু হলে যে আমি আমার সব হারিয়ে ফেলবো।”

    ছোট্ট দম ফেলে জান্নাহ্।ডেলিভারি নিয়ে তার ততটা ভয় নেই।অনেক কাছ থেকে সে এইসব দেখেছে।ছোটবেলা থেকেই হসপিটালে আসা যাওয়া তার।প্রেগন্যান্সির জটিল বিষয়গুলো সে তার বাবার কাছ থেকেই জেনেছে।শুনেছে সেইসব মায়েদের আর্তনাদ যারা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুসম যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছে।কিঞ্চিৎ ভয় হয় জান্নাহ্ এর।কিন্তু এই বাড়ির মানুষগুলোর খুশি আর তার প্রাণের জন্য সে এইটুকু সহ্য করেই নিবে।মা হবে সে।এইটুক যদি সহ্য করতে না পারে তাহলে মা হওয়ার সার্থকতা কী!

    কিন্তু জান্নাহ্ এর ভয় হয় সারহানকে নিয়ে।সারহানের ব্যবহার কেমন ভয়ংকর,শান্ত।সন্তান নিয়ে সে একটু বেশিই পজেসিভ।দুনিয়াজুড়ে তামাম কথা ভাবতে ভাবতে চোখে বুজে আসে জান্নাহ্ এর।ঘুমে ঢুলে পড়ে সে।

    রাত প্রায় দশ।হঠাৎ জান্নাহ্ নড়ে উঠে।বুঝতে পারে না সে।একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে বসে।তলপেটে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে।কিছু বুঝে উঠার আগেই তরতরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।জান্নাহ্ এর মনে হলো কেউ যেনো তার পেটে ছুরিকাঘাত করছে।জান্নাহ্ চমকিত হয় তার শরীরের নিম্নাংশ দেখে।সে অনুভব করে একটা উষ্ণ স্মিত ধারা নেমে যাচ্ছে।ঠোঁট কামড়ে ধরে জান্নাহ্।পায়ের দিকটা রক্তে মাখামাখি।বিছানার চাদর খামছে চিৎকার দিয়ে উঠে জান্নাহ্।পাশে গভীর ঘুমে তলিয়ে থাক ছোট্ট তিতি ধড়ফড় করে উঠে চোখ কচলাতে থাকে।জান্নাহ্কে এই অবস্থায় দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।জান্নাহ্ ক্রন্দনরত গলায় বললো—

    “তিইইইতি।আহ্!

    তিতি ঝাপটে ধরে জান্নাহ্ এর গলা।কেঁদে কেঁদে বললো—

    “পরীমা।”

    তিতি জান্নাহ্ এর পায়ের দিকটা দেখে আরো চিৎকার দিয়ে উঠে।ছোট্ট বাচ্চার তীক্ষ্ম গলায় স্বর তার উপর জান্নাহ্ এর গলার আওয়াজে দরজায় করাঘাত শুরু হয়।কিন্তু জান্নাহ্ এর পক্ষে দরজা খোলা সম্ভব না।নিজের এই অবস্থা আর তিতির কান্নায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে জান্নাহ্।উচ্চ গলায় বলে উঠে—

    “আম্মা,শুভ্রা আপু!

    কিন্তু ভেতরে আসার আর কোনো পথ নেই।ছোট্ট তিতি কী করবে ভেবে পায় না।তার পরীমার চোখের পানি সে দেখতে পারছে না।জান্নাহ্ ধীরে ধীরে নুইয়ে পড়ছে।ওদিকে সমানতালে দরজা ধাক্কাচ্ছে জমির,সেরাজ।
    এক অদ্ভুত কাজ করলো তিতি।বিছানা থেকে নেমে ডিভানের সামনে থাকা সেন্টার টেবিল ধাক্কা দিতে লাগলো।কিন্তু তা একবিন্দুও নড়াতে পারলো না তিতির ওই কচি হাত।সমানতালে কাঁদছে তিতি।রক্তে মাখা জান্নাহ্কে দেখে আরো ভয়ে কুঁকড়ে যায় তিতি।একটা টুল টেনে আনে।সারহানের রুমের দরজার দুটো ছিটকিনি।জান্নাহ্ মাঝের টাই লক করে।একমাত্র সারহান আসলেই উপরের ছিটকিনিটাও লক করা হয়।ছোট্ট তিতি নাগাল পেলো না।তখন অবিশ্বাস্য কাজ করলো সে।বারান্দায় থাকা তুলসি গাছটা মরে গেছে।তার টবটা এমনিতেই পড়ে আছে।ছোট্ট তিতি সেটাই নিয়ে আসে।সে একটা মুভিতে দেখেছিলো এমন।টবটাকে উপুর করে রাখে তিতি।টুলের উপর উঠে সাবধানে পা উঠায় টবের উপর।অনেক কষ্টে ছিটকিনি খোলে তিতি।হুরহুড়িয়ে ঘরে ঢুকে সবাই।জান্নাহ্কে দেখে মরা কান্না জুড়ে দেয় অন্তরা।শুভ্রা গিয়ে জান্নাহ্ এর মাথাটা নিজের কোলে নেয়।শ্রান্ত জান্নাহ্ হাত পা ছেড়ে দেয়।অজ্ঞান হওয়ার আগে শুধু এতটুকুই বললো—

    “শুভ্রা আপু,আমার বাচ্চা…।”

    অন্তরা সেরাজকে অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিতে বলে।অন্তরা মাথা চাপড়াতে থাকে।রক্তের শ্লথ ধারা বলে দিচ্ছে আর কোনো আশা নেই।জমির যেনো পুরো জমে গেলেন।জাবিন ভেতরে আসলো না।বরফখন্ডের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো।জান্নাহ্ এর অচেতন শরীর পড়ে রইলো শুভ্রার কোলে।জাবিন এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে আসে।জান্নাহ্ এর ফর্সা মুখটা নীল হয়ে আছে।জাবিনের পা খাবলে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো তিতি—

    “ভাইয়া,পরীমা!

    জাবিনের দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।বিছানার রক্ত দেখে গা গুলিয়ে উঠলো তার।যেনো নিঃশ্বাস আটকে আসলো।
    অন্তরা বিলাপ করতে থাকে।সেরাজ একের পর এক কল করেই যাচ্ছে।জান্নাহ্ নিশ্চেতন।সে অবচেতন মনে তার প্রাণকেই দেখছে নিশ্চয়ই।কী জবাব দিবে সে তার প্রাণকে?
    সে যে তাকে দেওয়া কথা রাখতে পারে নি।ক্ষমা করবে তার প্রাণ তাকে?
    সে ফিরে আসবে তো মৃত্যুর দুয়ার থেকে?নাকি নিজ সন্তানের সাথে সেও চলে যাবে তার প্রাণ থেকে দুরে,বহুদুরে।আর কখনো তাদের দেখা হবে না।হবে না কথা।হয়ে যাবে সব স্মৃতিকথা।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪৮
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    হসপিটালের সফেদ বিছানায় শুয়ে আছে জান্নাহ্।তার মাতৃত্বের বিসর্জন হয়েছে।যে ছোট্ট প্রাণটা এক সমুদ্র খুশি নিয়ে এসেছে সেই খুশিকে এক মুহূর্তে পা দিয়ে পিষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।জানালার পর্দা উড়িয়ে ফিনফিনে বাতাস বইছে।শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।তার দেহ তো পড়ে আছে কিন্তু তা প্রাণহীন।

    এক মুহূর্তে মনে হয়েছে সে নিজেও হয়তো আর মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসবে না।কিন্তু সে এসেছে,সব হারিয়ে এসেছে।এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো।বুক কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।ঠোঁট কামড়ে বিছানার সফেদ চাদর হাতের মুষ্টি বদ্ধ করে।তার পাপের সাজা আজ তার সন্তানকে পেতে হলো।
    ঘোলা চোখে কেবিনে কারো অস্তিত্ব টের পায় জান্নাহ্।নরম পায়ে কেবিনে ডুকেছে সারহান।রাতে জান্নাহ্কে হসপিটালে নিয়ে আসার পর ভোরের দিকে সারহানকে জানানো হয় পুরো ঘটনা।আর এই ভয়ংকর কাজটা করে সারহানকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করা সেই ব্যক্তি জাবিন।সারারাত কেঁদেছে জাবিন।তার উনিশ বছরের জীবনে এমন বীভৎস ঘটনার সম্মুখীন সে কখনো হয়নি।যেই মানুষটাকে এতোটা ঘৃণা করতো আজ তার জন্য গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছিলো তার।

    সারহানকে দেখেই পাশ ফিরে জান্নাহ্।কী করে দেখবে এই মানুষটার মুখ।কাল রাতেও একরাশ বুক ভরা আশা নিয়ে ছিলো।আর আজ!

    সারহান নিঃশব্দে জান্নাহ্ এর পাশে এসে দাঁড়ায়।ফিনাইলের কটকটে গন্ধ নাকে এসে ঠেকে তার।হাঁটু মুড়ে বসে সে।জান্নাহ্ এর ছড়ানো চুলে নিজের মাথা ঠেকিয়ে ভেজা গলায় বলে উঠে—-

    “এমন কেন করলেন রজনীগন্ধা?এতো বড় শাস্তি কেন দিলেন আমায়?এর চেয়ে আমার প্রাণটাই কেড়ে নিতেন।”

    জান্নাহ্ ঠোঁট কামড়ে চুপ করে আছে।তার শ্বাস আটকে আসছে সারহানের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দে।বুকের ভেতর পুঞ্জীভূত ব্যথাটা যেনো ফুটন্ত গরম পানির মতো টগবগ করে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।বিবশ হয়ে আসছে তার শরীর।ক্রমশ নিজেকে একটা লাশ হিসেবে আবিষ্কার করছে জান্নাহ্।

    সারহান আলতো করে জান্নাহ্ এর চুল থেকে মাথা উঠায়।থমথমে গলায় বললো–

    “আপনার আল্লাহ্ কেন করলো এমন আমার সাথে?জবাব দিন রজনীগন্ধা।আমার পাপ কী আমার প্রায়শ্চিত্তের চেয়েও বড়!
    উত্তর দিন রজনীগন্ধা।”

    কান্নার তোড়ে ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠে জান্নাহ্ এর নির্জীব শরীর।সারহান ঘুরে বিছানায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে।হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁটের উপর অগোছালো একটা ঘষা মেরে স্বাভাবিক গলায় বললো—

    “ভালোই হয়েছে।আমার মতো পুরুষের বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই।আমার জন্মই পাপ।আমার সন্তান সেই পাপের সমুদ্রে আসতে চায়নি।আপনি তাকে টেনে আনতে চেয়েছেন।ভালোই হয়েছে।”

    জান্নাহ্ সমানতালে কেঁদেই যাচ্ছে।বিড়বিড় করে আবোলতাবোল বলেই যাচ্ছে সারহান।তা নিরব দর্শকের মতো হজম করছে জান্নাহ্।পাপ তো সেও কম করেনি।আজ তার পুঁচকোকে তার জান দিয়ে সে পাপের ভার হালকা করতে হলো।

    ধীমপায়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।কোনো রকম শব্দ ছাড়াই কেবিন থেকে বেড়িয়ে হাঁটা ধরে।দেয়ালে এক পা ঠেসে হেলান দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেরাজ।সারহান কিছুই দেখলো না।সে উন্মনা হয়ে হাঁটছে।ওয়েটিং চেয়ারে বসে আছে জমির।তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক হতপ্রায় জীব।যার মনে ছিলো উচ্ছলতা,বুকে ছিলো বাবা হওয়ার খুশি,চোখ ভরা ছিলো আশা।আজ সব শেষ।জমির নিরবে কাঁদলেন।সারহান তার সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।অচঞ্চল পায়ে অগোছালোভাবে এগিয়ে চলছে সে।সারহান জানে না তার আশে পাশে কী হচ্ছে।তার বুকটা কেমন খালি খালি মনে হচ্ছে।এই যে এখানে,এখানে একটা যন্ত্র থাকে।যাতে প্রাণের শ্বাস থাকে।সারহানের মনে হচ্ছে তা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে।এই যে এইখানে পাঁজরগুলো,খুব যন্ত্রণা হচ্ছে এখানে।এই যে চোখ দুটো যা দিয়ে সে তার পরীকে দেখতে চেয়েছিলো,তা জ্বলে যাচ্ছে।ধীম ধীম পায়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সারহান।জমির তার অশ্রুভরা চোখে তার সারহানকে দেখছে।সেই সারহান,যে তিনটা আইসক্রীম চাইলে তিনটাই তাকে দিতে হতো।নাহলে বাকিগুলো রাস্তায় ফেলে বালিতে মেখে ফ্রিজে রেখে আসতো।সেই সারহান,যার পায়ে একটা পিঁপড়া কামড় দিলে সেই দিন আর কারো কোল থেকে সে মাটিতে পা রাখতো না।আজ সে শান্ত,সমাহিত।জমির অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।তার নেকড়ে বাঘ যেনো হুংকার দিতে ভুলে গেছে।

    সিঁড়ি দিয়ে ব্যাগভর্তি ঔষধ নিয়ে উঠছিলো জাবিন।স্টিলের রেলিং ধরে নিষ্প্রাণ প্রাণির মতো এক পা এক পা করে অসাঢ় পা দুটো ফেলে আবেগশূন্য চাহনিতে নেমে যাচ্ছে সারহান।তাকে দেখেই থমকে দাঁড়ায় জাবিন।দুই প্রান্তের দুই মানুষের মাঝ দিয়ে ব্যস্ত মানুষগুলো উঠছে আর নামছে।জাবিনকে পেছন ফেলে সিঁড়ির নিচের দিকটায় চলে যায় সারহান।ঔষধের ব্যাগটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে আচমকাই জাবিনের মনে হলো ওই ঘৃণিত মানুষকে একবার মামা বলে ডাকতে।একবার তার বুকে পড়ে কেঁদে বলতে আমরা আছি তো।
    কিন্তু বলা হলো না।জাবিনের ভেতরকার মানুষটি সায় দিলো না।একটা দ্বিধান্বিত মন তাকে কষে চড় মেরে বললো,” ভুল করলি জাবিন।একদিন এই জন্যই তোকে পস্তাতে হবে।”

    সারহান হেঁটে চলছে।উদ্দেশ্যহীন পথ চলা তার।তার পাপ তাকে ঘিরে ধরেছে।এর থেকে মুক্তি নেই।হাঁটতে হাঁটতে আজান শুনতে পায় সারহান।সামনেই সদরের মসজিদ।বেখিয়ালিভাবেই মসজিদে ঢুকে সারহান।খাদেম হুজুর নামাজিদের জন্য জায়গা ঠিক করছেন।সারহান অজু করে ভেতরে যেতেই দেখে পুরো ফ্লোর খালি।সে গিয়ে সামনের দিকের তৃতীয় সারির দেয়ালের পাশের দিকে বসলো।একটা পিলার আছে সেখানে।সারহান তার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়ালের দিকে মাথা হেলিয়ে দিলো।যথা সময়ে নামাজ শুরু হলে সবার সাথে নামাজ আদায় করে সারহান।একে একে মসজিদ ফাঁকা হতে থাকে।ইমাম সাহেব দেখলেন কেউ একজন বসে আছে এখনো।তিনি কাছে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে শুনছেন সারহানের কান্না।কান্না থামাতে নিজে বা’হাতের তালু কামড়ে ধরে রেখেছে সারহান।সে যতই চাইছে নিজেকে শান্ত করতে ততই যেনো তার ভেতরকার সন্তান হারানো বাবা কঠোর দীর্ঘশ্বাসে বেরিয়ে আসতে চাইছে।এই বুকটা চিরে দেখাতে ইচ্ছে করছে কতটা ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছিলো এই বুকে।কান্নার তোড় থামাতে নিজের দাঁতের উপরেই জোর লাগায় সারহান।নিজেকে গুটিয়ে একটা বলয় তৈরি করে যেনো তাতেই আবদ্ধ হতে চায় সে।আরেক হাত দিয়ে দুই হাঁটু জড়ো করে ধরে রেখেছে সারহান।তার গলা বেয়ে ঝড়ছে নোনতা জলের ধারা।

    তীক্ষ্ম দাঁতের আঘাতে সারহানের হাত কেটে রক্ত ঝড়তে লাগলো।ইমাম সাহেব আর চুপ থাকলেন না।শশব্যস্ত হয়ে বসে পড়লেন সারহানের পাশে।তার মুখ থেকে হাত টা সরাতেই গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে আসে।ইমাম সাহেব তার পকেটে থাকা মসৃন,নরম সাদা ছোট্ট তোয়ালে টা সারহানের হাতে পেচিয়ে দিলেন।উদ্ভ্রান্তের মতো ইমাম সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো সারহান।গলার স্বর সূচাঁলো করে কাঁদতে লাগলো।ইমাম সাহেব বেশ অবাক হলেন।চমকে গিয়ে বললেন—

    “আল্লাহর ঘরে এসে কেউ ফেরত যায় না বাবা।শুধু চাইতে হয়।”

    সারহান ধরা গলায় ব্যস্ত হয়ে বললো—

    “চেয়েছি,চেয়েছি আমি তার কাছে।পাইনি আমি।ফিরিয়ে দিয়েছে সে আমায়।কেন ফিরিয়ে দিলো?আমাকে কী ক্ষমা করা যেতো না?তার দরবারে নাকি সবাই ক্ষমা পায়।তাহলে আমাকে কেন খালি হাতে ফেরালো?

    ইমাম সাহেব সারহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—

    “ধৈর্য্য ধরো বাবা।তিনি কাউকে নিরাশ করেন না।এই পৃথিবীতে তিনি তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন যারা তার উপর ভরসা রাখে।সবুরে মেওয়া ফলে।আল্লাহ্ পাক তোমার থেকে যা কেড়ে নিয়েছেন তার দ্বিগুণ ফেরত দিবেন।শুধু প্রয়োজন তাকে বিশ্বাস করা,তার প্রতি একাগ্রতা থাকা।”

    ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ইমাম সাহেবের সুশ্রী মুখের দিকে চেয়ে রইলো সারহান।
    ,
    ,
    ,
    আজ সাতদিন।সময়ের সাথে ভরতে থাকে ক্ষত।কিন্তু তার রেশ রয়ে যায় বহুদিন।সেদিনের পর থেকে জান্নাহ্ এর সাথে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় সারহানের।শুধু জান্নাহ্ নয়,বাড়ির কোনো মানুষের সাথে কথা বলে না সারহান।বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকে।তার দাদুর কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে।সারহানের মনে হয় তার জীবনের এই বিপর্যয়ের শুরু এই মানুষটার জন্যই হয়েছে।ক্ষমা করবে না সে তাকে।বাড়ির প্রতিটি মানুষের মাঝেই অদ্ভুত নীরবতা।সবাই অতি স্বাভাবিক আচরণ যাকে সহজ ভাষায় অস্বাভাবিক বলে।

    বাইরের দুনিয়া দেখা হয় না জান্নাহ্ এর।তার সমস্ত খুশি এক নিমিষেই মিলিয়ে গেছে।শরীর সুস্থ হলেও তার মন কখন সুস্থ হবে তা সে জানে না।বিছানার উপর ঘাপটি মেরে জানালা ঘেঁষে বসে আছে।নীলাভ ঝকঝকে আকাশ।আছে শুধু দলা পাকানো শুভ্র মেঘের ছড়াছড়ি।সাদা আর নীলের এক অকল্পনীয় মিশ্রণ।জান্নাহ্ ঠাঁই নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে আছে।

    বিড়ালপায়ে রুমে ঢুকে সারহান।কোনো ধরনের কৃত্রিম উত্তেজনা ছাড়াই ট্রলি ব্যাগটা টেনে নিয়ে আলমিরা থেকে সাবধানে জান্নাহ্ এর কাপড় নিয়ে তা গুঁছাতে থাকে।আকস্মিক ঘটনায় সরব হয় জান্নাহ্।তবুও শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে —

    “কী করছেন সারহান?

    থমকে যায় সারহান।তার রজনীগন্ধার কন্ঠস্বরে যেনো প্রাণ ফিরে পেলো সে।কাপড় ভাঁজ করতে করতে নরম গলায় বললো—-

    “আমরা ফিরে যাচ্ছি।”

    ব্যস্ত ভঙিতে বিছানা ছাড়ে জান্নাহ্।কৌতূহলী গলায় বললো—

    “কোথায় যাবো?

    “ঢাকা।”

    জান্নাহ্ গলার স্বর শক্ত করে বললো—

    “আমি কোথাও যাচ্ছি না সারহান।”

    সারহানের চাপা ক্ষোভটা সেকেন্ডেই ফুঁসলে উঠলো।দারাজ গলায় বললো—

    “কী বলতে চান আপনি?

    চোখের পলকেই কেঁপে উঠে জান্নাহ্।স্থির গলায় বললো–

    “এই বাড়িতেই থাকবো আমরা।”

    ছুঁড়ে ফেলে দেয় ব্যাগ।মসৃণ কপালটা ভাঁজ করে চোয়াল শক্ত করে বললো—

    “কেন যাবেন না আপনি?

    জান্নাহ্ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে—

    “দেখতেই তো পাচ্ছেন সবার অবস্থা।তবুও কেন পাগলামি করছেন?

    এইবার যেনো সারহানের রাগ পাহাড়ের মতো ধ্বসে পড়লো।তেড়ে এসে জান্নাহ্ এর দুই বাজু চেপে ধরতেই শক্ত হয়ে যায় জান্নাহ্।চোখের পল্লব প্রশস্ত করে ভয়াতুর চাহনিতে সারহানের ওই ক্ষোভিত নয়নযুগল দেখে।প্রানআত্না কেঁপে উঠে তার।সারহান যেনো ওই চোখ দিয়েই তাকে শেষ করে দিবে।বজ্রকঠোর কন্ঠে শাসিয়ে উঠলো সারহান—

    “পাগল তো আপনি আমাকে বানিয়েছেন।কেন কথা রাখেন নি আপনি?কেন আমাকে এতো আশা দিলেন! আমি তো আপনাকে বলিনি এইসব করতে।তাহলে এখন কেন সব কেড়ে নিলেন আমার কাছ থেকে?

    জান্নাহ্ বরফখন্ডের মতো জমে যায়।সারহান আবারো অগ্নিনালা মতো জ্বলে উঠে বললো—

    “যেতে আপনাকে হবেই।এই বাড়িতে আমি আপনাকে রাখবো না।যেই বাড়ির মানুষগুলো আমার সব ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে সেই বাড়িতে আমি আপনাকে রাখবো না।”

    এক পশলা পানি ঝড়িয়ে ফিকে গলায় জান্নাহ্ বললো-

    “কিন্তু সারহান..।”

    হতচকিত জান্নাহ্ তার কথা শেষ করার আগেই দেয়ালের সাথে লেপ্টে থাকা টেবিলের উপর থেকে ল্যাম্পশেডটা নিয়ে কর্ণার শোকেসে ছুঁড়ে মারে সারহান।ঝনঝন করে তা ভেঙে পড়ে।সেরাজ,শুভ্রা,অন্তরা বাদ বাকি সবাই দৌঁড়ে আসে।জান্নাহ্কে ভীতসন্ত্রস্ত দেখে যেই অন্তরা তার কাছে এগোতে লাগলো ঠিক তখন ই সারহান খলবলিয়ে উঠে —

    “একদম আগাবেন না।ছোঁবেন না আমার রজনীগন্ধাকে।এই বাড়ির মানুষগুলো আমার সব কেড়ে নিয়েছে।”

    অন্তরা ক্রন্দনরত গলায় শুধায়–

    “কী হইছে বাপ?এমন করতাছোস ক্যান?মায়ের কথা শোন।সব ঠিক হইয়া যাইবো।বউ আবার মা হইবো।তোর সব আশা পূরণ হইবো।”

    সারহান তাচ্ছল্য চোখে তাকিয়ে দাঁত মুখ খিঁচে চড়ানো গলায় বললো—-

    “চুপ করুন আপনি।এইসব কিছুর জন্য আপনি দায়ী।কে বলেছিলো আমাকে ভালোবাসতে?কে বলেছিলো ওই নোংরা আস্তাকুড় থেকে টেনে আনতে আমাকে।যেখানে শুরু হয়েছিলো সেখানেই আমার জীবন শেষ হয়ে যেতো।মরে যেতাম আমি।তাহলে এই জঘন্য জীবন পেতে হতো না আমাকে।”

    হতবিহ্বল দৃষ্টি সকলের।সারহানের কথা জের কেউ বুঝলো না।তিতির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে জাবিন।তার চোখে প্রশ্নের আকুলিবিকুলি।বিমূঢ় গলায় অন্তরা বললো–

    “এইসব কী কইতাছোস?

    সারহান ধমকে উঠে বললো—

    “ঠিক ই বলছি।আপনারা সবাই খুনি।আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছেন।এখানে থাকলে আমার রজনীগন্ধাকেও মেরে ফেলবেন।”

    বিপন্ন গলায় অন্তরা বললো–

    “পাগল হইছোস!কী কইতাছোস!আমরা কেন মারতে যামু তোর বউরে?

    শুভ্রা যেনো একটা সুযোগ খুঁজছিলো।জোর গলায় মরিয়া হয়ে বললো—

    “এমন নাটক করছিস কেন তুই?মিসক্যারেজ হওয়া আহামরি বিরল কিছু না।আর এতো তাড়া কীসের ছিলো বাচ্চা নেওয়ার!সবে তো ষোলো বছর।এই বয়সে বাচ্চা নিলে তো এমন হবেই।
    যা হওয়ার হয়েছে।সময় চলে যায়নি এখনো।জান্নাহ্ তো ভালো আছে।বেঁচে আছে।মা হওয়ার অনেক সময় আছে।”

    গনগনে আগুনে ঘি ঢালার মতো ফুঁসলে উঠে সারহান।দারাজ গলায় চিৎকার করে বলে উঠে—-

    “মিসক্যারেজ স্বাভাবিক হলেও আমার সন্তানকে তার মায়ের গর্ভেই মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই।তোমারও নেই।”

    ছয় জোড়া উৎসুক,কৌতূহলী আর প্রশ্নবিদ্ধ চোখ চেয়ে রইলো সারহানের দিকে।জান্নাহ্ যেনো গলে যাওয়া বরফের মতো অসহায় চাহনি দিয়ে তার প্রাণের আক্রোশ দেখছে।শুভ্রা হতভম্ব হয়ে যায়।তার চোখের পাতা কাঁপতে শুরু করে।পুরো পরিবেশ নিমিষেই থমথমে রূপ ধারণ করে।সারহান তাচ্ছিল্যের সাথে আক্রোশ মিশিয়ে বললো—

    “আমার শাস্তি আমার সন্তানকে কেন দিলে আপু?ওর তো কোনো দোষ ছিলো না।কেন করলে তুমি এমন?কেন?

    শেষটুকু যেনো সবার হৃদয় কাঁপিয়ে দিলো।সবার আস্ত নজরে শুভ্রা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে মনে হয়।সারহান তীব্র ক্রোধে ক্রোধান্বিত হয়ে ক্ষেপে এসে শুভ্রার হাত ধরে নিজের রুম থেকে বের করে নিয়ে এসে শুভ্রার ঘরের মধ্যে নিয়ে ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়।বাড়িসুদ্ধ মানুষ ভয়ে তটস্থ হয়ে দরজায় করাঘাত করতে থাকে।জমির হঠাৎই তার বুকে চাপ অনুভব করে।ঝিমঝিম করে উঠে তার মস্তিষ্ক।হাত,পা বিবশ হয়ে আসছে।ধপ করে কাউচে বসে পড়ে সে।বুকের ভেতরের থিতিয়ে থাকা ব্যথাটা ক্রমশ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

    জমিরের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।তার মেয়ে!
    ভাবতেই শরীরের মাংস যেনো কোনো সাড়াশীতে বিদ্ধ হচ্ছে।জমির ভাবতেই পারছে না শুভ্রা এইসব করেছে।শুভ্রা তার ভাইকে কখনো আপন ভাবতে পারে নি।সেই ছোট্ট সারহানকে তার মনে জায়গা দিতে পারে নি।সারাক্ষন বোনের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকা সারহান ভাবতে পারেনি তার সবচেয়ে বড় শত্রু তার প্রিয় বোন।
    জমিরের নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে।সে দেখতেই পেলো না।চোখের সামনে ঘটা স্বাভাবিক ঘটনার পেছনেও এতো জঘন্য ষড়যন্ত্র।তার সারহানকে এইভাবে তিলে তিলে শেষ করে দিলো।আর এই জন্যই সারহান তার বাবাকে চেপে ধরেছে নিজের জন্ম ইতিহাস জানতে।

    জমিরের যেনো শ্বাস আটকে আসছে।সে কাউচে হেলান দিয়ে ভাবতে থাকলো।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৪৯
    লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

    প্রায় মিনিট পনেরো পর শুভ্রার রুম থেকে বেরিয়ে আসে সারহান।বাইরে তালা লাগিয়ে তার চাবি নিয়ে নেয় বুক পকেটে।কঠিন শান্ত সে।রুম থেকে বেরিয়েই স্বাভাবিক হয়ে ডাইনিং চেয়ার সরিয়ে আরাম করে বসে সারহান।সবাই উদ্ভাসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।জান্নাহ্ সারহানের সামনে গিয়ে অস্বস্তিকর গলায় বললো–

    “এইসব কী শুরু করেছেন আপনি?

    সারহান দুর্বোধ্য হাসলো।হালকা গলায় শুধায়—

    “আপনি আমার সাথে যাবেন রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ্ প্রতিবাদের সুরে বললো—

    “নাহ।কোথাও যাবো না আমি।আপনি চাবি দিন।কী করেছেন আপনি শুভ্রা আপুর সাথে?

    সারহান জান্নাহ্ এর প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে থমথমে গলায় বললো–

    “আপনি আমার সাথে যাবেন কিনা বলুন?

    সেরাজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।সারহানের এমন রুক্ষ ব্যবহারে সে বরাবরই বিরক্ত।ফুঁসে উঠে বললো—

    “এইসব কী ধরনের ব্যবহার সারহান?বোনের সাথে কেউ এমন করে?

    সারহান ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে চরম আক্রোশ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।তার গায়ে যেনো অসুর ভর করলো।পুরো খাবারের টেবিলটাকে উল্টে ফেলে সংক্ষুব্ধ গলায় ঘোষনা করলো—

    “নাহ।শুভ্রা আমার বোন নয়।কোনো সম্পর্ক নেই এই বাড়ির সাথে আমার।আমি আমার রজনীগন্ধার সাথে কথা বলছি।আর একটা কথাও কেউ বলবে না।”

    সারহান তার রাগ প্রশমিত করে চেয়ারটাতে আবার বসে।ফোঁস ফোঁস করছে সে।সরব দৃষ্টি রেখে মখমলে গলায় বললো–

    “পটাসিয়াম সায়ানাইড চিনেন তো রজনীগন্ধা!আপনার হাতে মাত্র পাঁচ মিনিট আর শুভ্রা আপুর কাছে দশ থেকে পনেরো মিনিট।এখন বলুন আপনি আমার সাথে যাবেন কিনা?

    আঁতকে উঠে জান্নাহ্।এইসব কী বলছে সারহান!পটাসিয়াম সায়ানাইড ইনজেক্ট করা হলে ভিক্টিমের হাতে বেশি সময় থাকে না।অধৈর্য গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

    “কেন পাগলামি করছেন সারহান?

    সারহান অধর কোণে হেসে বিগলিত গলায় বললো—

    “আপনি চলুন আমার সাথে রজনীগন্ধা।আপনি যেমনটা বলবেন আমি তেমনটা করবো।সময় বেশি নেই রজনীগন্ধা।যাবেন?

    সারহানের কথা শুনে রক্তশূন্য হয়ে যায় সবার মুখ।ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই।জান্নাহ্ অবস্থা বেগতিক ভেবে বললো–

    “যাবো,যাবো আমি।”

    ঝরা হাসে সারহান।মিষ্টি গলায় বললো–

    “যান তৈরি হয়ে আসুন।”

    বিনা সময় ব্যয়ে নিজের রুমে পা বাড়ায় জান্নাহ্।সারহান উঠে দাঁড়ায়।বুক পকেট থেকে চাবিটা নিয়ে ছুঁড়ে মারে সেরাজের দিকে সাথে একটা সিরিঞ্জ।মৃদু গলায় বললো–

    “এর মধ্যে সোডিয়াম থায়োসালফেট আছে।শুভ্রা আপুকে পুশ করে দিবেন।এতে সে আরো কিছুটা সময় পাবে।আমি অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিয়ে দিয়েছি।আসলো বলে।নিয়ে যান।খুনি নই আমি।তাকে বলবেন এর শাস্তি সে পাবে।আমার সন্তান দোষী ছিলো না।”

    সারহান লম্বা শ্বাস টেনে নেয়।জাবিনের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো–

    “পারলে তোর মামাকে ক্ষমা করে দিস জাবিন।”

    জাবিন ভোলা চাহনিতে চেয়ে রইলো।সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

    অন্তরা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন—

    “এইসব কী কইতাছোস বাপ!শুভ্রা তোর বইন।অয় কেন তোর মানিকরে মারবো?

    সারহানের কিছু একটা হলো।ভুমিকম্প উঠলো যেনো তার পায়ের নিচের স্তম্ভে।দুই হাঁটু ভেঙে নিচে বসে অন্তরার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো—

    “কেন এতো ভালোবাসলে তুমি আমাকে?কেন এতো আগলে রাখলে?তোমার ভালোবাসা আমায় যে মৃত্যু দিলো মা।”

    অন্তরা যেনো তার শ্বাস ফিরে পেলেন।মা!তার ছেলে তাকে মা বলে ডেকেছে।লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলতে থাকে অন্তরা।আর্দ্র গলায় বললেন–

    “তোরে ভালোবাসমু নাতো কারে ভালোবাসমু!তুই তো আমার কলিজার ধন।”

    “সত্যিই যদি তোমার গর্ভে আমার জন্ম হতো তাহলে এ পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান হতাম আমি।”

    অন্তরা যেনো বিষ খেয়ে নিলো।তার সারা শরীরে বিষাক্ত হয়ে গেলো যেনো।সেই বিষ যেনো তাকে খুড়তে লাগলো।সন্দিগ্ধ গলায় বললেন–

    “কী কস তুই!তুই আমার পোলা।এই কলিজায় রাইখা পালছি আমি তোরে।আমার পোলা তুই।আমি তোর মা।”

    সারহান উঠে দাঁড়ায়।গাঢ় গলায় বললো—

    “সত্য বদলায় না মা।আমাকে ক্ষমা করো।না বুঝে বারোটা বছর তোমাকে আমি কষ্ট দিয়েছি।বুজতেই পারি নি সন্তানের দেওয়া কষ্ট মা কে কতটা কাঁদায়।”

    অন্তরা হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলো।এর মধ্যে জান্নাহ্ এসে দাঁড়ায়।সারহান শক্ত করে জান্নাহ্ এর হাত ধরে পা বাড়ায়।অন্তরা ঝাপটে ধরে সারহান কে।সারহানের বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার মায়ের কান্নায়।তবুও নিজেকে বজ্রকঠোর রেখে বললো—

    “ভুলে যাও আমাকে মা।আমি আর কখনো এই বাড়িতে ফিরবো না।এই বাড়ি আমার নয়।বাবা মাকে সামলাও।”

    জমির বরফ হয়ে গেলেন।তার দুনিয়ায় যেনো আজ উল্টে গেলো।তিতি দৌঁড়ে এসে খাবলে ধরে জান্নাহ্কে।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো–

    “পরীমা তুমি যেওনা।মামা,তুমি পরীমাকে নিও না।”

    অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে জান্নাহ্ এর কাছ থেকে তিতিকে ছাড়িয়ে নিলো সারহান।তিতির চোখে মুখে চুমু খেয়ে বললো—

    “তোমার পরীমা আর কখনো আসবে না তিতিসোনা।এই যে সবাই আছে।সবার সাথে থেকো।ভাইয়া আছে।ভাইয়ার সাথে রোজ খেলো।জাবিন সামলা তিতিকে।”

    দাঁড়ালো না সারহান।হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো জান্নাহ্ কে নিয়ে।অন্তরা বিলাপ করতে লাগলো।জমির তাকে জড়িয়ে ধরলেন।সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–

    “সারহান সব জেনে গেছে অন্তরা।ও আর ফিরে আসবে না।”

    অন্তরা খেটখেটিয়ে উঠলেন—

    “ক্যান আইবো না!জন্ম না দিয়ে কী মা হওয়া যায় না।আমি ওরে জন্ম দেইনাই তো কী অইছে।এই বুকে আগলাইয়া রাখছি ওরে আমি।আপনি ওরে থামান।থামান ওরে।ওরে ছাড়া আমি বাঁচুম না।”

    সারহান সদর দরজায় পৌঁছায়।অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা যাচ্ছে।সারহান গাড়ির দরজা খুলে আবার পেছন ফিরে তাকায়।পুরো বাড়িটাকে দেখে যেখানে তার শৈশব কেটেছে।আর কখনো ফেরা হবে না এই বাড়িতে।দেখা হবে না এই মানুষগুলোর সাথে।
    গাড়ি চলতে শুরু করলো।এক হাতে স্টেয়ারিং অন্য হাতে নিজের চোখ মুছে চলছে সারহান।তার ভেতরকার মানুষটি আজ সত্যিই মরে গেছে।

    জান্নাহ্ চেয়ে আছে অবিরাম।

    ছোটবেলা থেকে প্রাণচঞ্চল,দুরন্ত আর ডানপিটে ছেলে সারহান।ক্লাসেও সবসময় ভালো রেজাল্টের অধিকারি।দুষ্টমির সাথে সাথে ভালো ব্যবহারেরও সুনাম তার।ষোলো সতেরো বছরে দাদুর দেওয়া ভালোবাসার উপহার ছিলো তার সাইকেল।সারা এলাকা চষে বেড়াতো তার প্যাডেল মেরে।একদিন দুর্ঘটনাবশত সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে তার শিক ঢুকে যায় সারহানের পায়ে।খবর পৌঁছাতে পৌঁছাতে সারহানের অবস্থা হাতের বাইরে।ছোট্ট একটা অপারেশন করাতে গিয়ে তাকে ব্লাড দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

    প্রায় পনেরো দিন পর যখন সারহান সুস্থ তখন কথায় কথায় সারহান বললো তার বাবা তাকে রক্ত দিয়েছে।কিন্তু শুভ্রা ফট করে বলে ফেলে কী করে দিবে তার রক্ত তো কখনো ম্যাচ করবে না সারহানের সাথে।মুখ ফসকে বলা সেই কথার রেশ ধরে সারহান বোনের আগে পিছে ঘুরতে থাকে।জাবিন তখন তিন কী চার বছরের।
    সারহান ছোটবেলা থেকেই প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারি।কোনো দ্বিধা তার মনের ঘরে ঘর বাঁধলে তা সে যে করেই হোক পরিষ্কার করবেই।তটস্থ সারহান বুদ্ধি করে যেই হসপিটালে তার অপারেশন করায় সেই ডক্টরের কাছে চলে যায়।তিনদিন তার আগে পিছে ঘুরে ডি এন এ টেস্ট করিয়ে জানতে পারে অন্তরা বা জমির কেউ তার বাবা মা নয়।চাপা কষ্টে যেনো ঘিরে ধরে সারহানকে।ভেতরে ভেতরে নিষ্পেষিত হতে থাকে সারহান।মরিয়া হয়ে উঠে সে।তার সেই জলন্ত আগুনে ঘি ঢালে শুভ্রা।সারহানকে বলে তার মা এই বাড়িতে কাজ করতো।অন্তরা যখন সন্তান ধারণ করতে পারছে না আর এই দিকে সারহানের দাদু তার বংশ রক্ষার জন্য পুত্র সন্তানের দিকে পথ চেয়ে আছেন।সারহানের বাবা তার মাকে ছেড়ে চলে যান।আর এই বাড়িতে কাজ করার সময় সে জানতে পারে যে সে মা হতে চলেছে।টাকার বিনিময়ে সারহানকে কিনে নিতে ব্যর্থ অন্তরা সারহানকে কেড়ে নেয় এবং তার মাকে ব্রোথেলে বিক্রি করে দেয় যাতে করে সে আর কোনো দিন ফিরে আসতে না পারে।

    এমনটা বলা হয় সারহানকে।আর দ্বিধান্বিত সারহান তাই বিশ্বাস করে এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর শহরে লেখাপড়ার নাম করে বেরিয়ে আসে সেই বাড়িতে।শুরু হয় তার অতীত খোঁজার লড়াই।

    কিন্তু সত্য ছিলো অন্য।সারহানের দাদুর দুই ছেলে।জমির আর জয়নাল।দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্ধ ছিলো না।শুভ্রার জন্মের পর অন্তরা ইউটেরাসে ইনফেকশনের জন্য আর গর্ভধারণ করতে পারেনি।কিন্তু এই কথা কাউকে জানানো হয়নি।এর মধ্যে জয়নালের দুই মেয়ের জন্ম হয়।সারহানের দাদু বংশ রক্ষায় পুত্রশোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।এর মধ্যে অন্তরার বোন সান্তনা তাদের গ্রামের কমল নামে এক ছেলেকে ভালোবাসতো।ষোলো কী সতেরো বয়স ছিলো সান্ত্বনার।আবেগের বশে সবচেয়ে বড় ভুল করে।সংসারের টানাপোড়েনে কমল পাড়ি জমায় দুর দেশে।তার কিছুদিন পর সান্ত্বনা জানতে পারে সে মা হতে চলেছে।কিন্তু কমল বা তার পরিবার কেউ তা মানতে রাজি ছিলো না।এই অবস্থায় কম বয়সি হওয়ায় এবোর্শনেও ঝুঁকি দেখা দেয়।অন্তরা সেই সুযোগ কাজে লাগায়।জমিরকে তার কাজে প্রায়ই রূপগঞ্জ আসতে হতো।অন্তরা সেই সুবাদে জমিরের সাথে তাদের যৌথ পরিবার ভেঙে এখানে চলে আসে।সারহানের দাদু আপত্তি করলেন না।কারণ একজন ছেলের আশা যখন কেউ পুরণ করতে পারেনি তাই তিনি কারো উপর কোনো আশা রাখলেন না।
    রূপগঞ্জ এসে নিজের বোনকে নিজ বাড়িতেই রাখেন।জানতে পারেন সান্ত্বনার ছেলে হবে।এক ঢিলে দুই পাখির মারার ফন্দি আটলেন অন্তরা।নিজের স্বার্থসিদ্ধি আর বোনের কলঙ্ক ঘুচাতে সারহানকে আপন করে নিলেন।সারহানের জন্মের সময় মারা যায় সান্ত্বনা।বোনের মৃত্যু শোকে কাতর অন্তরা সারহানকে বুকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখলেন।সারহানের জন্মের পরই জানানো হলো তার দাদুকে।এই নিয়ে জয়নাল আর লতা আপত্তি করলেন।অন্তরা জানান তিনি আগে থেকে কিছু বলেন নি কারণ যদি আবারো মেয়ে হয়।সারহানের দাদু যেনো পুর্নিমার চাঁদ হাতে পেলেন।নিজের বনেদি বাড়ি ছেড়ে রুপগঞ্জ এসে থাকতে লাগলেন।অঢেল আর অফুরন্ত ভালোবাসায় বড় হতে লাগলো সারহান।সারহানের দাদু তার সম্পত্তির আশি ভাগ সারহানের নামে করলেন।এই নিয়ে দ্বিমত করেন নি জয়নাল।কারণ ততদিনে লুবনার জন্ম হয়েছে এবং সে ভেবেছে লুবনার সাথেই সারহানের বিয়ে দিবে।

    শুভ্রা সব নিরবে সহ্য করলেও ভেতরে ছিলো ছাই চাপা আগুন।যা একদিন দাবানল হয়ে সব জ্বালিয়ে দিলো।নিধির সাথেও বিয়ের ব্যপারে মত ছিলো না শুভ্রার।শুভ্রা কখনো চায়নি সারহান বিয়ে করুক।কারণ পরবর্তীতে এই সম্পত্তির মালিকানা পাবে সারহানের সন্তান।আর যদি সারহানের কোনো সন্তান না থাকে তাহলে জাবিন।নিজের সন্তানদের জন্যই এই ঘৃণিত ষড়যন্ত্রের ছক কষে শুভ্রা।কিন্তু মাঝে জান্নাহ্ এসে সব নড়বড়ে করে দেয়।সারহান কেন বিয়েতে রাজি হলো শুভ্রার তা অজানা।সারহানের মনে তার বাবার প্রতি ঘৃণা ছিলো যে তার মাকে ছেড়ে চলে যায়।
    কিন্তু ভাগ্য হয়তো অন্য কিছুই চেয়েছে।শুভ্রা চায়নি সারহান আর জান্নাহ্ এর মাঝে সব ঠিক হোক।কিন্তু অন্তরা তাকে কিছু না জানিয়েই এই কান্ড করে বসে।তাই আর কোনো উপায় না পেয়ে খাবারের সাথেই মেডিসিন মিশিয়ে জান্নাহ্ এর গর্ভেই তার সন্তানের আত্নাহুতি দেয়।

    ভেবেছিলো কম বয়সের কথা বলে সব মাটি চাপা দিবে।কিন্তু সারহানকে ডক্টরই বলে যে ফিটার্স আগেই নষ্ট হয়ে গেছে আর সেই কারণেই ব্লিডিং বেশি হয়।সারহান আর কিছু না ভেবে তার বাবার কাছ থেকে সবটা জানতে চায়।বেকায়দায় পড়ে বাধ্য হয়েই জমির সবটা বলে।তাই সারহানের আর বুঝতে বাকি রইলো না যেই মানুষটাকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছে সেই ই তার বুকে খঞ্জর ঢুকিয়েছে।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫০
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    রোদের তপ্ততায় ইহতিশামের নাভিশ্বাস।তবুও দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তমার এক ঝলক পাওয়ার জন্য।মেহনাজদের বাড়ির পাশেই যে বিশাল বটগাছ তার ছায়াতেই দাঁড়িয়ে আছে ইহতিশাম।ঘন্টা ধরে আজ তিনদিন এমনভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে ইহতিশাম।মেহনাজদের বাড়ির সামনেই সূর্যের প্রখর তাপমাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে শরীর গলিয়েও মন গলাতে পারেনি মেহনাজের।বাড়ির পাশের বাগান থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে রোজ নিয়ম করে ইহতিশামকে দেখে মেহনাজ।আর তাকে দেখেই তাপে ছড়িয়ে পড়া ইলেকট্রনের মতো বিক্ষিপ্ত হতে থাকে মেহনাজ রাগ।

    দুপুর রোদে জ্বলে পুড়ে মাত্রই বটগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ইহতিশাম।আজ আর সে ফিরবে না।যতক্ষন না পর্যন্ত সে তার কথা ব্যক্ত করতে পারবে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।
    মেহনাজদের বাড়ির দরজাটা কাঠের তৈরি।টিনের উপর আড়াআড়ি করে কাঠ লাগিয়ে তার দুটো পাল্লা করে মাঝে ছিটকিনি দেওয়া যেমনটা সাধারণ ঘরবাড়ির হয়ে থাকে।মেহনাজের তপ্ত দেহ যেনো আরো জ্বলে উঠলো ইহতিশামকে এখনো না যেতে দেখে।চঞ্চল পা তড়িৎ বেগে বাড়িয়ে বটগাছ তলায় এসে স্থির হয়।ক্ষোভিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

    “কেন বারবার এখানে আসছো তুমি?তোমাকে না বাড়ন করেছি।”

    ইহতিশাম বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো।কোমল গলায় বললো–

    “কথাতো বললে নাজ।এতোটা দহন ক্রিয়ায় জ্বালিয়েও না আমায়।অনেক তো পুড়ালে,এইবার না হয় একটু প্রেমের বর্ষণই করাও।”

    তেতে উঠে মেহনাজ।স্বশব্দে বলে উঠে—-

    “প্লিজ,আর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।যা ছিলো তা শেষ অনেক আগেই।আর কিছু হওয়ার বাকি নেই।”

    ইহতিশাম করুণ গলায় বললো—

    “একবার আমাকে বলার সুযোগ তো দাও।”

    ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের মতো ইহতিশামের বুকে পড়ে মেহনাজ। তার শার্ট খামচে ধরে বুক কাঁপিয়ে কেঁদে বললো—

    “কেন এমন করলে?কেন ধোঁকা দিলে আমায়?

    ইহতিশাম আলতো হাতে জড়িয়ে নেয় মেহনাজকে।তার বুকটা যেনো অদ্ভুত শীতলতায় অাচ্ছন্ন হলো।মখমলে গলায় প্রত্যুক্তি করে বললো—

    “আমি তোমাকে ধোঁকা দেয়নি নাজ।আমি আজও ঠিক ততটাই তোমায় ভালোবাসি যতটা প্রথম দেখায় বেসেছি।যা হয়েছিলো তা আমাদের ভাগ্যের দোষ।”

    মেহনাজ ইহতিশামের বুক থেকে মাথা উঠায়।কান্না মিশিয়ে অভিমানি গলায় বললো—

    “এখন ভাগ্যের দোষ কেন দিচ্ছো?সেদিন এমন কেন করলে?

    ইহতিশাম বিগলিত গলায় দৃঢ় হয়ে বললো—

    “যা দেখেছো ভুল দেখেছো ।”

    মেহনাজ ভ্রু ক্রুটি করে।কান্নার ফলে তার চশমাটা ঘোলা হয়ে যায়।ইহতিশাম ধীর হাতে তা খুলে নিয়ে একটা টিস্যু দিয়ে মুছে আবার মেহনাজের চোখে লাগিয়ে দেয়।মেহনাজ তার কান্নার দলা গিলে নেয়।সম্পর্কের শুরু থেকেই ইহতিশাম যত্নশীল ছিলো তার প্রতি।কিন্তু হঠাৎ সবকিছু ছন্নছাড়া হয়ে গেলো।

    বটগাছে নিচে বসে আছে দুইজন।গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্যের তীর্যক রশ্মি ভেদ করে চলে আসছে।গাছের ডালের ছায়া পড়েছে মাটিতে।মেহনাজ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে।মৃদু গলায় বিড়বিড় করে বলছে ইহতিশাম—

    “আসলে ওর সাথে অনেক বছরের টানাপোড়েন।একটা ঘটনার জের ধরে ও আমার উপর ক্ষেপে আছে।তাই সেদিন ওই ছবিগুলো ইডিট করে তোমার কাছে পাঠিয়েছে।আমরা সবাই একটা পার্টিতে ছিলাম।ড্রিংস করেছিলাম।কিন্তু লিমিট ক্রস করিনি।মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত নেশাগ্রস্থ ছিলো।ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম।এর বেশি কিছুই না।তুমি সেদিন আমার পুরো কথা না শুনেই আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে।কতো খুঁজেছি তোমায় আমি।পাইনি।”

    মেহনাজ স্থবির হয়ে রইলো।এই ছোট্ট ঘটনায় সে যে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে।ইহতিশাম ঘাড় বাকিয়ে সরব দৃষ্টিতে তাকালো।স্মিত গলায় বললো—

    “ক্ষমা করবে না আমাকে?

    মেহনাজ দু’ফোটা চোখের পানি ফেললো।থমথমে গলায় বললো—

    “আমার সেই অধিকার নেই ইহতিশাম।আমি তোমার যোগ্য নই।”

    ভ্রু কুঁচকে ফেললো ইহতিশাম।গভীর সুরে বললো—

    “এমন বলছো কেন?

    হঠাৎ করেই ঝমঝম করে কেঁদে ফেলে মেহনাজ।বটতলায় যেনো ঝড় বইতে শুরু হলো।ব্যগ্র হয়ে বুকের সাথে মেহনাজকে চেপে ধরে ইহতিশাম।উদ্বেলিত গলায় বললো—

    “শান্ত হও।কী হয়েছে খুলে বলো আমাকে।”

    মেহনাজ তীক্ষ্ম সুরে ইহতিশামের হাতা খামছে ধরে বিলাপ করতে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে আসে তার।ইহতিশাম হাত বুলাতে থাকে মেহনাজের মাথায়।

    কাকের কর্কশ আওয়াজ ছন্দ তুলে নিরাক পরিবেশে।বেশ কিছুক্ষন কান্নার পর একটু ধাতস্থ হয়ে মেহনাজ ধরা গলায় বললো—

    “তোমাকে ভুল বুঝে আমি চট্রগাম চলে গিয়েছিলাম।সেখানে একটা নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে কোর্স করছিলাম।সেখানে আমার সাথে পরিচয় সীমানের সাথে।ও একজন ফটোগ্রাফার ছিলো।অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই কেনো যেনো ওকে ভালোবেসে ফেললাম আমি।রোজ হোস্টেলের বাইরে ঘন্টা ধরে আমার অপেক্ষা করতো।আমি ক্লাস শেষ করে আসতাম।আমার ছোট ছোট সব আবদার আমার বলার আগেই পূরণ করতো।কী থেকে কী হয়ে গেলো আমি জানি না।তোমার দেওয়া ধোঁকার পর আমি পুরো ভেঙে পড়েছিলাম।সবটা যেনোও সীমান আমাকে মেনে নিয়েছে।নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।উড়তে শিখিয়েছে।কিন্তু পরক্ষনেই আমার সেই সবকিছু এক নিমিষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে সীমান।নিজের স্বার্থসিদ্ধর পর হাওয়া হয়ে যায়।কোথায় থাকে,কোথায় কাজ করে কিচ্ছু জানি না আমি।ওকে খোঁজার কোনো উপায়ই ছিলো না আমার কাছে।”

    ঝর্ণার বেগে কাঁদতে থাকে মেহনাজ।ভালোবেসে সতিত্ব হারিয়ে সে এখন ভাঙা আয়নার মতো।তাতে মুখচ্ছবি তো দেখা যায় কিন্তু তাতে অকল্যাণ বয়ে আনে।
    ইহতিশামের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।মস্তিষ্কের রগগুলো টনটন করে যেনো ছিঁড়ে যাবে।হাতের রগগুলো ফুলে ফেঁপে উঠে।ফোঁস ফোঁস করতে থাকে ইহতিশাম।ভাবতেই ঘৃণা লাগছে।তার প্রিয়তমার শরীরে অন্য কারো স্পর্শ।ছিঃ!

    বেশ কিছুক্ষন মৌনতায় কাটে দুইজনের।মেহনাজ নিজের অপরাধে অপরাধি।ইহতিশাম নিজের ভুলে সাজাপ্রাপ্ত।কিন্তু সে সত্যিই এই মেয়েটিকে ভালোবাসে।সত্যিই ভালোবাসে।হুট করে অবাক কান্ড করে ইহতিশাম।বুকের পিঞ্জিরায় ঝাপটে ধরে মেহনাজকে।আশ্বস্ত করে সকল ভুল,দুঃস্বপ্ন ভুলে তারা নতুন করে শুরু করবে।মেহনাজ রাজী নয়।সে এই মানুষটাকে ঠকাতে চায় না।কিন্তু নাছোড়বান্দা ইহতিশাম।শরীরকে নয় হৃদয়কে ভালোবেসেছে সে।আর এই হৃদয়ের পরিশুদ্ধতা হৃদয় দিয়ে করবে।

    মেহনাজের বাবা ইটালি গিয়েছে তার মাকে নিয়ে।দুই দিন আগেই তার অপারেশন হয়েছে।কৃত্রিম হাড় বসিয়েছে হুসনার পায়ে।হয়তো সে হাঁটতে পারবে।ইহতিশাম দেয়ালের সাথে চেপে জানালা দিয়ে নির্নিমেখ তাকিয়ে আছে।হাতে তার ধোঁয়া উড়ানো কফি।মেহনাজ শান্ত হয়ে বিছানায় বসে আছে।কফিতে চুমুক দিয়েই ইহতিশাম সন্দিহান গলায় বললো–

    “সীমানের কোনো ছবি আছে তোমার কাছে?

    মেহনাজ অস্ফুট স্বরে বললো—-

    “নাহ।”

    “ও ফটোগ্রাফার ছিলো?

    “হুম।”

    ইহতিশাম চট করে কিছু একটা ভাবলো।পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা ছবি দেখালো মেহনাজকে।তড়ক করে উঠে মেহনাজের হৃদপিন্ড।এ তো সীমান!

    থতমত খেয়ে বললো—

    “তুতুতুমি এই ছবি কোথায় পেলে?ওকে চেনো তুমি?

    এই এক লাইনেই যেনো গা ছাড়া দিয়ে উঠলো ইহতিশাম।বিছানায় বসে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো মেহনাজের দিকে।ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনাজ।অতি শীতল গলায় ইহতিশাম বললো—-

    “ও সীমান নয়।ও সারহান।আর ও কোনো ফটোগ্রাফার নো।একজন জার্নালিস্ট।”

    ধপ করে নিচে বসে পড়ে মেহনাজ।ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে কম্পনরত গলায় বললো—

    “সাআআরহান!সারহান জেইদি?জান্নাহ্ এর স্বামী?আমি আজ পর্যন্ত ওর স্বামীকে দেখিনি।শুধু শুনেছি।ওরর বিয়ের পর আর আসিনি বাড়ি।”

    ইহতিশামের কানে বাঝতে থাকে সেই কথা।সারহান বলেছিলো সে বদলা নিবে,”না গিলতে পারবে না উগরাতে”।তাই ই করলো সারহান।বদলা নিলো।

    দুই মানব-মানবীর ধূ ধূ নিঃশ্বাসের আওয়াজ বাতাসে আলোড়ন তুলতে লাগলো।ইহতিশাম নিজের মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে।চোখ দুটো লালা হয়ে রক্তিম রঙ ধারণ করেছে।নাক ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে।এইভাবেও কেউ বদলা নেয়?
    ,
    ,
    ,
    ছোট্ট মুখটা ম্লান করে ডিভানে বসে আছে জান্নাহ্।তার সামনেই তার প্রাণ অধীর আগ্রহে বসে আছে কখন কথা বলবে তার রজনীগন্ধা।জান্নাহ্ ভাবতেই পারছে না শুভ্রা এমন কাজ করতে পারে!

    গোধূলিয ম্লান আলো তার পাট চুকিয়েছে অনেক আগেই।নিশুথি রাত ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে ঘড়ির কাটার সাথে।সময় চলে তার আপন গতিতে।কিন্তু সেই সময় বড্ড বেইমান।কাউকে দেয় আকাশসম খুশি আর কাউকে দেয় সমুদ্রের অগণিত জলরাশি সমান কষ্ট।কেউ তা দলিয়ে পা দিয়ে পিষে ফেলে সামনে এগুতে পারে কেউবা নিজেই নিষ্পেষিত হয় সেই মায়াজালে।

    বিয়ের পর থেকে শুভ্রা জান্নাহ্কে নিজের ছোট বোনের মতো আগলে রেখেছে।সারহানের সব ব্যাপারে অবগত করেছে।কিসে সারহান খুশি হয়,কিসে সে রাগ করে।কিন্তু এতো কেয়ারিং এর মাঝে এতটা ঘৃণা চেপে রেখেছে মনে যার জন্য আজ তার অনাগত সন্তানকে মাতৃগর্ভেই প্রান দিতে হলো!

    সারহান নির্বিকার গলায় বললো—

    “কথা বলবেন না রজনীগন্ধা!শাস্তি দিচ্ছেন আমায়?

    জান্নাহ ছোট্ট ঢোক গিলে আলতো গলায় বললো–

    “বাড়ি যাবেন না সারহান?

    তাচ্ছল্য হাসলো সারহান।উপহাস করে বললো—

    “কার বাড়ি যাবো?ওই বাড়ি আমার নয় রজনীগন্ধা।আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে তারা।এতো ভালোবাসা আমি চাইনি রজনীগন্ধা।”

    জান্নাহ্ এর চোখ ভরে আসে।উপচে পড়ে সাগরের নোনতা জল।ধরা গলায় বললো—

    “আপনি এমন কেন করলেন?যদি শুভ্রা আপুর কিছু হয়ে যেতো!

    তাচ্ছিল্য সুরে বলে সারহান—

    “আমি এতোটাও নিষ্করুণ নই।এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো সত্যিই ওই মানুষটার জানটা আমি ছিনিয়ে নেই।যে আমার ছোট্ট সোনাকে বাঁচতে দেয়নি।কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি ওই দুইজন বৃদ্ধ মানুষের জন্য যারা হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়েছে আমায়।এক গলিত পঁচা নর্দমার সারহানকে বুকে তুলে নিয়েছে।ওই ছোট্ট দুটি আকুল সত্ত্বার জন্য যারা আমাকে মামা বলে ডেকেছে।আমি তো আপনাকে ছাড়া আমার একটা নিঃশ্বাসও কল্পনা করতে পারি না।তাহলে সেরাজ কী করে তার অর্ধাঙ্গীনিকে ছাড়া বাকি জীবন কাটাবে!তাই ক্ষমা করেছি তাকে আমি।আল্লাহ্ নাকি সবাইকে তার পাপের শাস্তি দেয়।আমি তার উপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত করলাম।”

    বারকয়েক নাক টানে জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর সামনে আসন পেতে মেঝেতে বসে থাকা সারহান ধীরগতিতে হাঁটু মেঝেতে ঠেকিয়ে উঁচু হয়।জান্নাহ্ এর নাকের ডগায় অধর স্পর্শ করায়।নাকের নিচে উপরের ঠোঁটের মাঝ বরাবর যে দ্বিখন্ডিত ভাঁজ আছে তাতে ছোট্ট চুমু খায় সারহান।জান্নাহ্ এর নরম তুলতুলে দুই গালে শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ আঁকে ।আঁজলায় নিয়ে নেয় জান্নাহ্ এর মুখটা।অতি সন্তর্পনে মৃদু কামড় বসায় জান্নাহ্ এর নিচের অধরপল্লবে।ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললো—

    “আপনাকে অনেক আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে রজনীগন্ধা।রেস্ট নিন।”

    সারহান উঠে যেতে চাইলে তার হাত ধরে কাতর গলায় বললো জান্নাহ্—

    “সারহান!

    সারহান চোখে হেসে গাঢ় গলায় বললো–

    “আপনাকে যে পুরো সুস্থ হতে হবে রজনীগন্ধা।এই প্রমত্তা নদীর উপচে পড়া ঢেউ তো আপনাকেই সামলাতে হবে।তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫১
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    কোলাহল মুক্ত রেস্তোরাঁয় বসে আছে ইহতিশাম আর সারহান।স্বচ্ছ কাঁচ গলিয়ে দিনের শেষ সূর্যের লালিমা রশ্মির একটা তীক্ষ্ম ফলা এসে হানা দিয়েছে তাদের টেবিলে।একটু পরেই ম্রিয়মান দিনের আলো গোধূলির মায়ায় জড়াবে।রেস্তোরাঁর পাশে থাকা কদম গাছটা নিরাক।তার নিচেই বেড়ির মধ্যে বসে আছে এক জোড়া কাপল।
    রেস্তোরাঁর দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে গোলাপ,বেলি আর চাঁপা ফুলের গাছ।বেলীর ফুলের তীব্র গন্ধে যেনো সরব হয়ে আছে সেই জায়গাটা।বসে থাকা সেই কাপলের মেয়েটি উন্মুখ দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করছে আর মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে নিয়ে নিচ্ছে বেলি ফুলের সেই ঘ্রাণ।

    স্থির চাহনি চাপা আক্রোশ একে অপরের প্রতি।বিন্দু বিন্দু করে জমে থাকা রাগ যেনো অথৈ সাগরে রূপ নিয়েছে ইহতিশামের।ইহতিশামের ঘাড়ের রগ টানটান হয়ে আছে।সামনের ব্যক্তিটাকে এতো দিন হৃদয়ে স্থান দিলেও আজ ইচ্ছে করছে সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পদধূলিত করতে।নিজের ভেতরকার রাগকে নিজের মধ্যেই দমিয়ে নিলো ইহতিশাম।কোনোরকম চিন্তা ছাড়াই নির্ভয়চিত্তে বসে আছে সারহান।একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সামনের ফাইল থেকে একটা স্কেচ এগিয়ে দেয় ইহতিশাম।চোখের পাতা ঝাঁকিয়ে তা দেখার জন্য বলে সারহানকে।সারহান বেখেয়ালিভাবেই নাক কুঁচকে স্কেচটা হাতে নেয় ।দপদপ করে উঠে তার শিরা উপশিরা।চোখের পাল্লা দুটো প্রশস্ত করে শ্বাসের গতি বাড়িয়ে দেখতে থাকে।ইহতিশাম গভীর দৃষ্টিতে সারহানের প্রতিক্রিয়া দেখে।মুহূর্তেই বিগলিত হাসে সারহান।স্কেচটা হাতে নিয়ে খামখেয়ালি করে বললো—

    “তো?

    ইহতিশাম চেয়ার থেকে পিঠ আলগা করে ভারি গলায় শুধায়—

    “তুই জানিস উনি কে?

    মুখটা ফুলিয়ে জীভ নাড়ে সারহান।কোনো ধরনের ভাবাবেশ হলো না তার।শান্ত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার তাকায় ইহতিশামের দিকে।সরস গলায় বললো—

    “আমি কী করতে পারি তোর জন্য?

    খলবলিয়ে উঠে ইহতিশাম।রাগে ফেটে যাচ্ছে তার মস্তিষ্ক।গনগনে গলায় বললো—

    “বুঝতে পারছিস না কী করবি!জান্নাহ্ এর মামা উনি।”

    ফোঁস করে দম ফেললো সারহান।নির্ভীক গলায় বললো—

    “তো?

    রেস্তোরাঁর অনেকেই চেয়ে আছে তাদের দিকে।সারহানকে শান্ত মনে হলেও ঝড় বয়ে এনেছে ইহতিশাম।তার দারাজ গলার আওয়াজে কেঁপে উঠে বদ্ধ রেস্তোরাঁ।

    ইহতিশাম জমাট গলায় বললো–

    “ওই খুনগুলোর সাথে জান্নাহ্ এর মামা জড়িয়ে আছে।”

    সারহান বিক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে বললো —-

    “জানি।”

    ইহতিশাম অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলে সংক্ষুব্ধ গলায় বললো—-

    “তাহলে নিশ্চয়ই এইটাও জানিস ওই খুনগুলো জান্নাহ্ ই করেছে।”

    সেকেন্ডে ধরা কাঁপিয়ে ক্ষেপে উঠে সারহান।রেস্তোরাঁয় রাখা প্লাস্টিকের টেবিলটা সারহানের হাতের জোরালো ধাক্কায় কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা জানে না।কলকল শুরু হয় রেস্তোরাঁয়।ভীতসন্ত্রস্ত বাকি কাস্টমাররা হকচকিয়ে উঠে।সারহান ইহতিশামের কলার ঝাপটে ধরে প্রশ্বস্ত গলায় বললো—

    “এইসবের মধ্যে আমার রজনীগন্ধাকে টানবি না।আমি সব জানি।আর জানি বলেই তোকে এই কেস দিয়েছি।”

    ইহতিশামের বুক হাপড়ের উঠানামা করছে।মেঘের মতো গর্জন করে বললো—

    “কী বলতে চাস তুই?

    সারহান তার মোবাইল বের করে কিছু একটা করে।ইহতিশামের মেসেজ টোন বেজে উঠে।সারহান নির্বিঘ্ন গলায় বললো—

    “একটা এম.এম এস. সেন্ট করেছি দেখ।তারপর বল কী করবি।”

    ইহতিশাম তড়িৎ বেগে নিজের মোবাইল হাতে নেই।এম.এম.এস.দেখে যেনো তার পায়ে তলার মাটিই সরে গেলে।কোনো উপায়ন্তরের ধার সে ধারলো না। সারহানের চোয়ালে এক সজোরে ঘুসি লাগায়।বেকায়দায় সারহান দাঁড়িয়ে থাকলো না।সেও এক পাল্টা ঘুসি মেরে বসে ইহতিশামের নাক বরাবর।দস্তদস্তি শুরু হয় দুই বন্ধুর মধ্যে।রেস্তোরাঁর সার্ভিস বয়রা ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে যায়।ম্যানেজার কল করে পুলিশকে।ততক্ষনে একে অপরের রক্তে গোসল করে নিয়েছে দুইজন।ইহতিশামে সাদা শার্ট রক্তে মেখে গেছে।সারহানের কপাল আর ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।তার পোলোশার্টের বুকের মাঝে চাপড় বসায় ইহতিশাম।এক ঝটকায় নিজের মুখের সামনে টেনে ধরে বললো—

    “তোর পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে সারহান।এইবার তোর প্রায়শ্চিত্তের পালা।হারানোর যন্ত্রণা কী এইবার বুঝবি তুই।”

    সারহান উন্মত্ত হাসে নিজের ঠোঁটের রক্ত হাত দিয়ে স্লাইড করে নিয়ে আবার মুখ পুরে দেয়।সাবলীল গলায় বললো–

    “আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।তুই নিজেকে নিয়ে ভাব।জান্নাহ্ আর তার মামা কেউই এই কেসে ইনভল্ব থাকবে না।তুই ওদেরকে এই কেস থেকে মুক্ত করবি।নাহলে মেহনাজের এই ভিডিও শুধু তুই কেন আম জনতা দেখবে।”

    ইহতিশাম নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে পাঞ্চ করে সারহানের কানের একটু নিচে।ধপাস করে পেছনের চেয়ারের উপর গিয়ে পড়ে সারহান।উন্মাদের মতো হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায় সারহান।দুই রক্ত মাখা হাত দিয়ে নিজের জামা ঝাড়তে থাকে।শান্ত কিন্তু ভারি গলায় বললো–

    “কষ্ট হচ্ছে তোর?আমারও হয়েছে।তোর কারণে রোজ এক ঘন্টার রাস্তা পায়ে হেঁটে আমাকে কোচিং করতে যেতে হতো।কলেজের টিচাররা আমাকে পড়াতে চাইতো না।আর যদি কোনো টিচার রাজীও হতো তাহলে কলেজের কোনো না কোনো স্টুডেন্ট আসতোই সেই কোচিংএ।ওই যে আমার দুর্ভাগ্য !তোর মতো বন্ধু পেয়েছি।সারাটা জীবন যাদের মা,বাবা জেনে এসেছি তারাও আমায় ধোঁকা দিলো।যেই বোনকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি সেই আমার জীবনটা নষ্ট গলির বানিয়ে দিলো।আর তুই!
    তোর আর আমার হিসেব শেষ।তুই এই কেস থেকে মামা আর জান্নাহ্কে ক্লিয়ার করবি।আর আমি মেহনাজকে।”

    ইহতিশাম বজ্র কন্ঠে বললো–

    “আরে গাধা,তুই যাকে বাঁচানোর কথা বলছিস মেহনাজ তারই মেয়ে।জান্নাহ্ এর আপন মামাতো বোন মেহনাজ।”

    সারহানের বিস্ময় যেনো আকাশ ছুঁলো।গা গুলিয়ে উঠলো তার।যেনো এখনই সব বেরিয়ে আসবে ভেতর থেকে।কাঁপতে থাকে সারহান।মিহি গলায় বললো—

    “কী বলছিস তুই?
    এটা হতে পারে না।”

    চেয়ারের উপর ধপাস করে বসে পড়ে ইহতিশাম।চিৎকার করে পুরো দুনিয়া উল্টে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।নিজের চুলগুলো টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো—

    “আমি ঠিকই বলছি।মেহনাজ জান্নাহ্ এর ই বোন।কী করে পারলি এইসব করতে তুই!কী করবি এখন তুই!জান্নাহ্ যদি জানতে পারে!

    কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তেড়ে এসে ইহতিশামের কলার ধরে তাকে ঝাঁকাতে থাকে সারহান।তীব্র রোষ নিয়ে বললো—

    “কে বলবে তাকে!তুই?ভুলে যাসনা ওই ভিডিও এখনো আমার কাছে।জান্নাহ্ ছাড়া কারো কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।যদি তুই জান্নাহ্কে এইসব বলিস তাহলে আমি..।”

    দুই হাতে সারহানের বুকে ধাক্কা মারে ইহতিশাম।প্রদৃপ্ত গলায় বললো—

    “কতোদিন লুকিয়ে রাখবি তুই? একদিন না একদিন তো জান্নাহ্ জানবেই যে ওর বোনের জীবনটা যে নষ্ট করেছে সে আর কেউ নয় তারই প্রাণপ্রিয় স্বামী।তখন কী হবে ওই মেয়েটার?

    সারহান ভয় আর আবেগ নিয়ে বললো–

    “কিচ্ছু হবে না।আমি তার কিছু হতে দিবো না।সব হারিয়ে আমি জান্নাহ্কে পেয়েছি।ওই একজনই আছে যাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।যে আমাকে ভালোবাসে।ছাড়বো না আমি তাকে।পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েও না।আমার রজনীগন্ধা আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না।কোথাও না।”

    শেষের কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে সারহানের।তার সমস্ত পৃথিবী যেনো শূন্য হয়ে গেলো এক নিমিষে।সে তার রজনীগন্ধাকে ছাড়া বাঁচবে না।সত্যিই বাঁচবে না।
    ,
    ,
    ,
    দরজা খুলতেই ভ্যালভ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহনাজ।ইহতিশামের সাদা শার্ট রঙিন হয়ে আছে।তটস্থ হয়ে বললো–

    “এই অবস্থা কী করে হলো তোমার?

    ইহতিশাম কোনো জবাব দিলো।ব্যস্ত পা দুটো চালিয়ে বেডরুমে গিয়ে বিছানায় বসলো।মেহনাজ দরজা লক করে উদ্বেলিত গলায় বললো—

    “বসলে যে!চলো হসপিটালে যাই।”

    ইহতিশাম খাপছাড়া সুরে বললো—

    “এইটুকুর জন্য হসপিটালে যেতে হলে তোমাকে বিয়ে করেছি কেন?

    মেহনাজ কোনো প্রত্যুক্তি করলো না।ওদের বিয়ে হয়েছে আজ দুই দিন।কোনোরকম আড়ম্বর ছাড়াই বিয়েটা করে ইহতিশাম।রাগে ইহতিশামের জ্বলন্ত চোখ দিয়ে যেনো অগ্নিনালা বিচ্ছুুরিত হচ্ছে।হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে মেহনাজ।নরম হাতে ইহতিশামের শার্টটা খুলে প্রশ্ন করে—

    “কার সাথে মারামারি করলে?

    ইহতিশাম নিরুত্তেজ গলায় বললো—

    “সারহানের সাথে।আহ!আস্ত ইয়ার।মেরে ফেলবে নাকি?

    মেহনাজ অনুযোগের সুরে বললো—-

    “সরি,সরি।”

    ইইতিশামের কাঁধের দিকটায় কাচ গেথে আছে।সেইটা বের করতেই ব্যথামিশ্রিত আওয়াজ করে সে।মেহনাজ পরম যত্নে তা ড্রেসিং করতে থাকে।ভাগ্যিস ইহতিশামের বাবা,মা বাসায় নেই।থাকলে হৈ হুল্লোড় করে ফেলতো।মেহনাজ স্বাভাবিক গলায় শুধায় —

    “মারামারি করলে কেন?

    ইহতিশাম ক্ষোভ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললো—

    “ওই শালা একটা গাধা।এতো জেদ!জেদের বসে কখন কী করে কিচ্ছু বুঝতে পারে না।আস্তে ইয়ার।”

    ড্রেসিং করতে গিয়ে জ্বালা হয় ইহতিশামের।মুখবিকৃত করে সে।মনোযোগ সহকারে নিজের কাজ করছে মেহনাজ।মিহি গলায় প্রশ্ন করে ইহতিশাম—-

    “তোমার বাবাকে বিয়ের কথা বলেছো?

    মেহনাজ নমনীয় গলায় প্রত্যুত্তর করে—

    “বলেছি।”

    “কী বললো?

    “খুশি হয়েছেন।বললো,জান্নাহ্ নাকি তোমার কথা বাবাকে বলেছিলো!

    ইহতিশাম তাল মিলিয়ে বললো—

    “চার বছর আগে যখন জান্নাহ্ এর ছবি তুমি আমাকে দেখিয়েছিলো তখন তো ও অনেক ছোট।সারহানের বাসায় দেখে কেন যেনো মনে হলো ওকে আমি কোথাও দেখেছি।তাই কায়দা করেই কার্ডটা দিয়েছিলাম।”

    মেহনাজ মিচকি হেসে রসালো গলায় বললো—

    “যদি অন্য কেউ হতো তাকে বিয়ে করে নিতে?

    ইহতিশাম স্বাভাবিক চোখে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো—

    “একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করি কী করে!

    ভালো করে রক্ত মুছে তা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয় মেহনাজ।অধৈর্য হয়ে উঠে ইহতিশাম।কাভার্ড থেকে একটা অফ হোয়াইট রঙের শার্ট বের করে তা গলিয়ে নেয় গায়ে।ফাইলগুলো হাতে নিয়ে ক্ষীন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

    “সারহান কে ক্ষমা করতে পারবে তো?

    ভ্রু কুঞ্চি করে মেহনাজ।একটা পিচাশকে কী করে ক্ষমা করা যায়!

    ইহতিশাম শান্ত পায়ে মেহনাজের কাছে এসে দাঁড়ায়।তার কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বলে—

    “সারহান ভুল করেছে।ওর আজকের এই জীবনের জন্য কোথাও না কোথাও আমিই দায়ী।ও জীবনে অনেক কিছু সয়েছে মেহনাজ।একদম একলা ও।জান্নাহ্কে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে চায় ও।তোমার সাথে যা করেছে সেই জন্য আমি ওকে ক্ষমা করবোনা।কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে,বন্ধু হিসেবে আমার দায়িত্ব ওকে এই জীবন থেকে বের করে আনা।তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা সেই প্রথম দিনের মতো যার একবিন্দুও কমে নি।আশা করবো তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো।”

    শশব্যস্ত হয় পা বাড়ায় ইহতিশাম।উদ্বিগ্ন কন্ঠে মেহনাজ বললো—

    “কোথায় যাচ্ছো?

    “স্যারের কাছে।সারহান আমার কাছে একটা জিনিস চেয়েছে।আজ এতো বছরে আমি আমার ভুলের মাশুল দিতে যাচ্ছি।তা যেনো দিতে পারি।খেয়ে নিও তুমি।ফিরতে লেট হবে আমার।বাই।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫২
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    নিকষকালো আকাশে চোখ মেলে আছে কুসুম রঙের চাঁদ।ফুরেফুরে বাতাস বইছে।জমাট কালো আঁধার ঘনিয়ে আরো আঁধারে পরিণত হচ্ছে।রাস্তায় দুই একটা কুকুর লেজ নাড়িয়ে দৌঁড়াচ্ছে।জনমানবশূন্য রাস্তায় ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে সোডিয়ামের বাতি।

    ফ্ল্যাটের লক খুলে ভেতরে ঢুকে সারহান।তার কপালের আর ঠোঁটের রক্ত শুকিয়ে কালসে হয়ে আছে।হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের স্মিত ধারা কেমন লেপ্টে আছে।গলায়,চিবুকে লেগে আছে শুষ্ক লহু।

    দরজা লক করেই কাউচে ধপ করে বসে সারহান।পুরো শরীরটা ছেড়ে দেয় সারহান।বিষন্ন দুই চোখ নিমীলিত করে মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে দেয়।জীবন চলার পথে ভুল করতে করতে আজ ভীষণ ক্লান্ত সারহান।আপন মানুষের ধোঁকায় জর্জরিত তার দেহপিঞ্জর।বধির হয়ে আসছে তার কান।সে কিছু শুনতে চায়,চায় না দেখতে এই বিদঘুটে পৃথিবী।চকিতে সারহান একটা বাচ্চার খলখলানি শুনতে পায়।আচম্বিত হয় সে।অমিলীত চোখ জোড়া দিকভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ঘুরিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে শব্দটা খুঁজে।তড়াক করে উঠে সারহানের মস্তিষ্ক।তার সামনে কিছুদূরে একটা বাচ্চা বসে আছে।ঝাঁকড়া চুলে ঢেকে আছে বাচ্চাটির কপাল।একপাশের চুল একটু বড় হওয়ায় চোখের একপাশ ঢেকে আছে।গাঢ় লাল দুটো ঠোঁট ছড়িয়ে সে খিলখিল করে হাসছে।তার হাসিতেই যেনো দমকা হাওয়া বয়ে গেলো সারহানের শরীরে।ধীম ধীম করে উঠে দাঁড়ায় সারহান।বিড়ালপায়ে দ্বিধা নিয়ে সামনে এগুতে থাকে।সারহানের ভেতরকার সত্তা কী যেনো বলছে।বাচ্চাটি এক হাতের উপর অপর হাত দিয়ে চাপড় মেরে চোখ বন্ধ করে হাসছে।সারহান মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে সেই ছোট্ট প্রাণটির দিকে।মুহুর্তেই খলখল করে উঠে বাচ্চাটি।কেঁপে উঠে সারহান।হাঁটু গেড়ে বাচ্চাটির সামনেই বসে।বাচ্চাটি হাসি থামায়।চোখ দুটো স্বাভাবিক রেখে হালকা ভ্রু কুঁচকায়।যেনো সে অবাক করা কিছু দেখেছে।

    সারহান দুই হাঁটু মেঝেতে ঠেকিয়ে তার উপর হাত ঠেসে রেখেছে।তার মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকানো।বিমুগ্ধচিত্তে দেখে যাচ্ছে বাচ্চাটিকে।সারহানকে হতভম্ব করে দিয়ে বাচ্চাটি হঠাৎ করে ঝুমঝুম করে হেসে উঠে।হকচকিয়ে যায় সারহান।দ্বিধান্বিত হয়ে সত্য মিথ্যের প্রভেদ করতে ধীরেসুস্থে নিজের হাতটা বাচ্চাটির খুব কাছে নিয়েও আবার পিছিয়ে নেয়।অত্যন্ত শান্ত,নরম আর আবেগী গলায় বললো—

    “সারজান!

    বাচ্চাটি উচ্ছলিত হাসে।দাঁতের সাথে দাঁত চেপে নিজেকে এপাড় থেকে ওপাড় ঘুরাতে থাকে যাতে করে তার পেটের উপরিঅংশ নড়ছে।মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করে বাচ্চাটি,”ব্বা,ব্বা।”

    খুশিতে ভরে যায় যেনো সারহানের হৃদপিন্ড।তার থমকে যাওয়া শ্বাস বেগতিক হারে ছুঁটতে থাকে।ঘোড়দৌঁড় শুরু হয়েছে তার মস্তিষ্কে।হৃদয়ের সুপ্ত অনুভূতিগুলো গুটগুট করে বেরিয়ে আসতে চাইলো।তরতর করে এই অদ্ভুত শিহরণ আবিষ্ট করে ফেললো সারহানকে।বাচ্চাটি আবারো বললো,”ব্বা,ব্বা।”

    চোখে হাসে বাচ্চাটি।এই হাসিতেই যেনো পৃথিবীর সমস্ত সুখ খুঁজে পেলো সারহান।আদুরে গলায় বললো—

    “সারজান,পরী আমার।”

    বাচ্চাটি আবার হাসলো।এইবার বাচ্চাটি তার চোখের উপর চুলগুলো রেগে গিয়ে দুই হাত দিয়ে সরালো।বাবাকে ভালো করে দেখলো সে।ডেকে উঠে,”ব্বা,ব্বা।”

    সারহান মুখ ফুলিয়ে হাসে।তার গা ভর্তি খুশি ঝনঝন করছে।কোনো কিছু না ভেবেই বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে থমকে যায় সারহান।নিজের হাতকে দেখে।ঘন কালো রক্ত।সারহানের নাক বেয়ে ঘাম পড়লো তার হাতে।সংকীর্ণ দৃষ্টিতে তা দেখে সারহান।দুধে আলতা গায়ের রঙের বাচ্চাটির ঠোঁট ঠিক তার রজনীগন্ধার মতো।আর চোখগুলোও তার মতো করেই হাসে।চুলগুলো সারহানের মতো।বেপরোয়া।আর ওই যে নাকটা,চিকন বাঁশির মতো।মায়ের নাক পেয়েছে।তাহলে কী এই তার সারজান! রজনীগন্ধা আর তার ভালোবাসার প্রতীক।

    বাচ্চাটি সারহানের দিকে কিঞ্চিৎ গম্ভীর চাহনি দেয়।সারহানের হাতে,মুখে লেগে থাকা রক্তে সে কিছু একটা আঁচ করতে পারে।রক্তিম ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে নিমিঝিমি করে তাকায়।আবার টানটান করে ঠোঁট।তা ছড়িয়ে মিষ্টি করে বললো,”ব্বা,ব্বা।”

    সারহান আন্দোলিত হয় তার ছোট্ট সারজানের আধো বুলিতে।ভরাট চোখে চেয়ে রয় সে।ঘরের কোথাও জান্নাহ্ এর অস্তিত্ব নেই।একে অপরকে দেখছে সারজান আর সারহান।সারহান গাল ভর্তি খুশি নিয়ে আসন পেতে বসে।তার ছোট্ট সারজান তাকে বারবার ছুঁতে চায়।সারহান নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয় এইবার।একবার ছুঁয়ে দেখবে সে তার সারজানকে।কিন্তু সারহানের ভেতরকার অপরাধি সত্তার টনক নড়ে উঠে।
    নাহ,সে ছোঁবে না সে সারজানকে।এই পবিত্র প্রাণটাকে সে অপবিত্র করবে না।সারহান করুন গলায় অনুযোগের সুরে বললো—

    “সারজান,পাপাকে ক্ষমা করবে না?

    মিটিমিটি করে তাকায় সারজান।চোখে হাসে সে।সারজান হাসতেই তার দু’চোখ বন্ধ হয়ে চোখের দুই কোণে তারকার মতো হয়।সারহান আপ্লুত গলায় বললো—

    “ভালোই করেছো সারজান।তোমার পাপা ভালো না।একদম পঁচা।তাই বুঝি চলে গেছো তাকে ছেড়ে?পাপা একটুও ভালো না।”

    সারজান গম্ভীর হয়ে যায়।সে তার বাবাকে দেখে।তার বাবার চোখে অথৈ জল খেলছে।সারজান বিক্ষিপ্ত চোখে তাকায়।নিচের ঠোঁট টা উল্টে ভ্যা ভ্যা করে চোখ কুঁচকে কাঁদতে থাকে।সারহান অধৈর্য হয়ে পড়ে।উদ্বেলিত গলায় বললো–

    “কাঁদে না পরী।দেখো পাপাকে।কাঁদে না আমার সোনা।পাপা লাভস ইউ।ইউ আর মাই এঞ্জেল।”

    সারহানের শ্বাস রোধ হয়ে আসে।এতো কাছে পেয়েও সে তার মেয়েকে ছুঁয়ে দেখতে পারছে না।এর চেয়ে বিষাক্ত যন্ত্রণা আর কিছু হতে পারে না।ডুকরে কেঁদে উঠে সারহান।আচমকা সারহানের ভেতরকার সুপ্ত মানব বেরিয়ে আসে। রুষ্ট গলায় বললো–

    “কীরে কাঁদছিস?

    সারহান ঝাপসা চোখে পেছন ফিরে তাকায়।কাউচের দক্ষিন পাশে থাকা ক্যাবিনেটের সাথে হেলে দাঁড়িয়ে আছে সেই মানব।তার চোখে মুখে একরাশ তাচ্ছিল্য।পৈচাশিক হেসে আবার বললো—

    “কষ্ট হচ্ছে তোর?এই তো সবে শুরু সারহান জেইদি।”

    সারহান বিক্ষিপ্ত গলায় বলে–

    “কিসের শুরু?

    “তোর দহনের।জ্বলে,পুড়ে নিঃশেষ হবি তুই।”

    সারহান কাঁপা গলায় বললো—

    “নিঃশেষ তো হয়ে গেছি আমি।সব হারিয়েছি আমি।আমার সন্তানকেও হারিয়েছি আমি।”

    সুপ্ত মানব খিক খিক করে হেসে বললো—

    “এখনো অনেক বাকি।তোর রজনীগন্ধা।”

    সারহান চিৎকার করে উঠে—

    “নাহ।আমার রজনীগন্ধা আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না।”

    সুপ্ত মানব বাঁকা হাসলো।দুই হাত পকেটে পুরে শিষ বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে বললো—

    “কী করে আটকাবি তাকে?জান্নাহ্ যখন জানবে তুই ওর বোনের সাথে নোংরামি করেছিস তখন কী তোকে ও ক্ষমা করবে?

    সারহান অনুযোগের সুরে ক্ষীন গলায় বললো—

    “আমি ভুল করেছি।না জেনে ভুল করেছি আমি।অতীতে করা ভুলের কারণে আমি আমার রজনীগন্ধাকে হারাতে পারবো না।”

    সুপ্ত মানুষ ফোঁস করে দম ফেলে বললেন—

    “হায়রে,ভাবিয়া করিয়ো কাজ করিয়া ভাবিয়ো না।গুনীজন বলে।আর মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে অপদার্থ চিজ।ভালো কথা কানে নেয় না।তিন বছর আগে যদি নিজের রাগকে দমন করতি তাহলে আজ এতো বড় বাঁশটা খেতি নি।এখন কী হবে রে সারহান পাগলা!

    সারহান বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকে।রুদ্ধ কন্ঠে বললো—

    “আমি কিচ্ছু জানি না।আমার রজনীগন্ধা আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না।কোথাও যেতে দিবো না আমি তাকে।কোথাও না।আমার নিঃশ্বাস থাকতে সে আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না।ভুল করেছি আমি।তার শাস্তিও পেয়েছি।সব হারিয়েছি আমি।কিছু নেই আমার।ওই রজনীগন্ধাই আমার সব।আমার আত্না,আমার প্রান,আমার হৃদমোহিণী।”

    সারহানের কানে বেজে উঠে সারজানের খলখলানি।সামনে তাকায় সে।সারজান অস্ফুট শব্দ করে,”উুঁ,উুঁ।
    আমোদিত হয় সারহান।সেই সুপ্ত মানুষ উসহাস করে বলে উঠে—

    “সন্তান হারিয়েছিস,এইবার অস্তিত্ব হারাবি।তুই সারাজীবন একাই রয়ে যাবি রে সারহান।একা।
    কথায় আছে না,
    “এসেছি একা,যেতে হবে একা
    কেন এতো মিছে মায়া?
    মায়ার পৃথিবী বেঁধেছে মায়ায়
    ছিন্ন হবে তার ছায়া।”

    সারহান স্বশব্দে বলে উঠে—

    “নাহ,নাআআআ।এ হতে পারে না।আমার রজনীগন্ধা শুধুই আমার।আমার প্রাণদেবী।আমার হৃদস্পন্দন।আমার অন্ধকার জীবনের চন্দ্রকিরণ।”

    সারহানের ভেতরকার সেই বিদ্বেষী মানব বেখেয়ালিভাবে পুরো ঘরে হাঁটতে থাকে আর বাঁকা হেসে আনমনে শিষ বাজাতে থাকে।সেই আওয়াজ গরম লোহার মতো বিঁধে যাচ্ছে সারহানের কানে।সারহান উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাতেই হালকা হতে থাকে তার অবয়ব।সারহান ব্যস্ত হয়ে সারজানের দিকে তাকায়।অধর ছড়িয়ে মুক্ত শ্বাস টেনে নিয়ে হাত বাড়াতেই সারজানের ছোট্ট শরীর হাওয়ায় একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে থাকে।চিৎকার করে ডেকে উঠে সারহান—

    “সারজান,পরী আমার।”
    ,
    ,
    ,
    দরজা খুলেই আকাশ গুড়ুম রাফাতের মা রিতার।তার সামনেই বরফমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্। অবাক বিস্ময় বলে উঠে–

    “জান্নাহ্!

    জান্নাহ্ ধীর গলায় বললো—

    “কেমন আছো আন্টি?ভেতরে আসতে দেবে না?

    রিতা যেনো হাতে চাঁদ পেলো।সাদরে গ্রহণ করে নেয় জান্নাহ্কে।কিন্তু চাঁদের চোখে যে জল!
    জান্নাহ্ এর কোমল,শুষ্ক,জীর্ণ চেহারা দেখে কষ্ট পেলেন রিতা।গরগর করে বললেন—

    “এই কী অবস্থা তোর?কোথায় ছিলি এতোদিন?

    জান্নাহ্ ঝাঁপটে ধরে রিতাকে।ঝমঝম করে বর্ষাতে থাকে তার চোখের নীর।জান্নাহ্ এর পিঠের উপর হাত বুলাতে থাকে রিতা।মখমলে গলায় বললেন—

    “কী হয়েছে তোর?কোথায় ছিলি তুই?তোর রিফাত আঙ্কেল কতো খুঁজেছে তোকে।রাফাতও ফিরে এসেছে।”

    জান্নাহ্ কান্নার তোড়ে কিছু বলতে পারলো না।রাফাতের বাবা রিফাত নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।আচমকা জান্নাহ্কে দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন তিনি।মেয়েটা অনেক বদলে গেছে।মায়াবী মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে।শরীরটাও কেমন ভেঙে পড়েছে।চোয়াল দেবে হাড় দেখা যাচ্ছে।বিভ্রান্ত গলায় বললো—

    “জান্নাহ্!

    জান্নাহ বরফ ঠান্ডা গলায় বললো–

    “আঙ্কেল!

    “কোথায় ছিলি তুই?হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলি?

    জান্নাহ্ ধরা গলায় বললো–

    “রাফাত কোথায়?আমি ওর সাথে দেখা করবো।”

    জান্নাহ্ কিছু না বলেই রাফাতের ঘরের দিকে দৌঁড় লাগায়।এই বাড়ির সব চেনা জান্নাহ্ এর।শৈশবের অনেকটা সময় সে এখানে কাটিয়েছে।

    রাফাতের দরজার সামনে গিয়ে থমকে যায় জান্নাহ্।সেই পরিচিত ঘর,সেই পরিচিত দেয়াল।সেই অতিপরিচিত মানুষ।কিন্তু তা আজ নতুন।নতুন করে চেনা হবে,জানা হবে।আলতো হাতে করাঘাত করে জান্নাহ্।বারকয়েক করাঘাত হলেও কেউ কথা বললো না।রিতা আর রিফাত উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে।কখন খুলবে এই বদ্ধ দ্বার।

    কিছুসময় পর একটা কর্কশ কন্ঠ শুনতে পায় জান্নাহ্।

    “বলেছি না কেউ আসবে না আমার কাছে।চলে যাও,চলে যাও তোমরা।”

    জান্নাহ্ কান্না গিলে রাফাতের মা,বাবার দিকে তাকায়।তারা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে।স্বাভাবিক গলায় মিহি সুর তুলে জান্নাহ্–

    “রাফাত,আমি জান্নাহ্।ওপেন দ্যা ডোর প্লিজ।তোমার রেড চেরি এসেছে দেখো।”

    ফট করেই দরজা খুলে যায় সেকেন্ডেই।ভরাট দৃষ্টিতে দমবন্ধ করে তাকিয়ে আছে রাফাত।জান্নাহ্ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।একটা বিদঘুটে গন্ধ এসে তার নাকে লাগে।এ কাকে দেখছে সে!
    মনে হচ্ছে প্রাচীন যুগের কোনো আদিমানব! একটা হতপ্রায় জীব।রাফাতের পুরো মুখের মধ্যে শুধু তার মায়াভরা চোখ দুটোই বুঝা যাচ্ছে।বাকিসব এলোথেলো বাড়ন্ত চুল আর দাঁড়ি গোফে ঢেকে আছে। জীর্ণশীর্ণ দেহে একটা ডুলডুলে টিশার্ট পরে আছে রাফাত।মুখের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতের দাগ।হাতের কোথাও কোথাও এখনো তাজা রক্ত লেগে আছে।জান্নাহ্ স্থির দৃষ্টিতে তার বেস্ট ফ্রেন্ডকে দেখে।যাকে দেখলে তার ক্লাসমেটরা হা করে গিলে নিতো।রাফাতের সাথে কথা বলার জন্য তার সাথে বন্ধুত্ব করতো।

    আর সেই বেস্ট ফ্রেন্ডকে দেখে জান্নাহ্ যেনো চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেলো।

    জীবন বড় কঠিন।ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তার রূপ।জীবন কাটানো হয়তো সোজা কিন্তু তাকে বোঝা মুশকিল।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫৩
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    হসপিটালের করিডোরে চিৎকার চেঁচামেচিতে হুলস্থুল পরিবেশ।একটা অ্যাকসিডেন্ট পেশেন্ট আনা হয়েছে।কিন্তু কর্তব্যরত ডক্টটরা পেশেন্টকে এডমিট করতে অস্বীকৃতি জানান।আর তাতেই ক্ষেপে গিয়ে পেশেন্টকে নিয়ে আসা যুবকটি বর্তমান শিফটের মেডিসিন ডক্টর অতনুর গলা চেপে ধরেছে।রাগে অগ্নিশর্মা ছেলেটির এমন নির্ভীক কাজে হসপিটালের বাকিরা ভড়কে যায়।তারা বোবা দর্শকের মতো চেয়ে আছে।
    ডক্টর অতনু রুদ্ধ গলায় ভাঙা ভাঙা শব্দে আওড়ালেন—

    “দেখুন মি.আআপনি কিইন্তু বাড়াবাড়ি করছেন!

    ছেলেটি চোয়াল শক্ত করে খেমটি মেরে বললো—

    “আমি যা বলেছি তাই করুন।যদি মেয়েটার কিছু হয় তাহলে পুরো হসপিটাল আমি সিজ করে দিবো।”

    ডক্টর অতনু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন—

    ” এটা পুলিশ কেস।পুলিশ না আসা পর্যন্ত আমরা পেশেন্টকে এডমিট করতে পারবো না।”

    ছেলেটি ডক্টর অতনুর কাঁধের দুই পাশে চাপড় মেরে ধরে থমথমে গলায় বললো—

    “হিট এন্ড রান কেস।আই নো।পুলিশ আসলে তাদের সাথে আমি বুঝবো।কিন্তু ততক্ষন অপেক্ষা করলে মেয়েটি মরে যাবে।ওর ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করুন।”

    তৎক্ষণাৎ হার্ট স্পেশালিস্ট ডক্টর রিফাত ত্রস্ত পায়ে এসে চকিত গলায় বললেন—

    “হোয়াট ইজ দিস?হচ্ছেটা কী এখানে?

    ছেলেটি তার হাতের বাঁধন শিথিল করে ডক্টর রিফাতের দিকে তাকায়।শান্ত গলায় জানায় সবটা।ডক্টর রিফাত আশ্বস্ত করলেন ছেলেটিকে।ডক্টর অতনুকে বললেন মেয়েটার ট্রিটমেন্ট শুরু করতে।তিনি তাই করলেন।ছেলেটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।ডক্টর রিফাতের কাছে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সরস গলায় বললো—

    “আই এম রিয়েলী সরি।আসলে মেয়েটার অবস্থা ভালো নেই।যত দেরী হবে তার মৃত্যু ঝুঁকি বাড়বে।তাই বাধ্য হয়েই…।”

    ডক্টর রিফাত চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলেন।একজন নার্স একটা ফর্ম নিয়ে এলেন।ছেলেটি তা পূরণ করে।নার্স যখন কৌতূহলী হয়ে ছেলেটিকে জিঙ্গেস করে মেয়েটির আপনার কী হয়,ছেলেটি স্মিত হাসলো।বললো,”রক্তের সম্পর্কের ঊর্ধ্বেও সম্পর্ক হয়।মনুষ্যত্বের সম্পর্কে।”

    জান্নাহ্ এর কাছে কথাটা বেশ লাগলো।যেনো তার বাবা বললো কথাটা।একটু দূরে দাঁড়িয়েই পুরো ঘটনা অবলোকন করলো জান্নাহ্।শীতল নিঃশ্বাস ফেলে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো।ছেলেটি কিছুক্ষন কথা বললো ডক্টর রিফাতের সাথে।এরপর কাউন্টারে গিয়ে কার্ডের মাধ্যমে পুরো বিল পরিশোধ করে।রিসিপশনের সামনে থাকা ওয়েটিং চেয়ারে বসে থাকার সময় খেয়াল করে দুইজন বৃদ্ধ আর তার সাথে একটা ছেলে হন্য হয়ে হসপিটালের ভেতরে ঢুকছে।তাদের ব্যস্ততা আর উদ্বেগ দেখে বুঝলো যে মেয়েটিকে সে হসপিটালে নিয়ে এসেছে এরা তারই পরিবার।ছেলেটির মধ্যে কোনো ভাবাবেশ হলো না।পুলিশ আসার অপেক্ষায় সে বসে রইলো।ছেলেটির আপাদমস্তক রক্তের জমাট দাগ।মেয়েটিকে হসপিটালে আনতে গিয়েই এই অবস্থা।আচমকা মুখ বিকৃত করে ছেলেটি।গলাটা শুকিয়ে আসে তার।কেঁশে উঠতেই কেউ তার সামনে পানির বোতল ধরে।ছেলেটি বিনা দ্বিধায় তা নিয়েই চুমুক লাগায়।কে দিলো তাতে ভ্রুক্ষেপ করলো না।পানি পান করেই আবার বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে মোবাইলে চোখ রেখেই বললো–

    “থ্যাংকস।”

    সামনের ব্যক্তি মিষ্টি করে বললো—

    “ইটস মাই প্লেজার।”

    একটা মেয়েলী মিষ্টি কন্ঠ শুনে ভ্রু কুঁচকে আসে ছেলেটির।সামনে তাকাতেই দেখে চৌদ্দ কী পনেরো বছরের একটা কিশোরী মেয়ে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।ছেলেটি এক পলক দেখে আবার বললো–

    “থ্যাংকস।”

    কিশোরী মেয়েটি মিষ্টি করে হাসলো।ছেলেটি তার মোবাইলে আবার অভিনিবেশ করে।জান্নাহ্ বামদিকের করিডোরের অভিমুখে দাঁড়িয়ে নির্নিমেখ তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে।কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে সচকিত হয় জান্নাহ্।জাফিন মোলায়েম গলায় প্রশ্ন ছুঁড়—

    “কী ব্যাপার ডল?তোমাকে তো আমি চেম্বারে থাকতে বলেছি।এখানে কেন?

    জান্নাহ্ তার বাবার ক্লান্ত মুখটা দেখে বললো—

    “তুমি কী খুব টায়ার্ড বাবা?

    “হোয়াই ডল?

    জান্নাহ্ স্মিত হাসলো।তার বাবাকে চোখের ইশারায় ছেলেটিকে দেখায়।জাফিন ঘুরে তাকায়।সাতাশ,আটাশ বছরের একটা যুবক বসে আছে আনমনে।তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তের ছড়াছড়ি হলেও সে আঘাত প্রাপ্ত নয় তা জাফিন বুঝতে পারে।জাফিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন—-

    “আমি কী করতে পারি?

    জান্নাহ্ আদুরে গলায় বললো—

    “তুমি কী তার সাথে একবার কথা বলবে?

    জাফিনের পুরু ভ্রু জোড়া মুহূর্তেই কুঁচকে এলো।গম্ভীর হলো মুখ।জান্নাহ্ একটু আগের ঘটনা খুলে বললো।আমোদিত হলেন জাফিন।আজকালও এমন মানুষ হয়!

    ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় জাফিন।সংক্ষিপ্ত সুরে বললেন—

    “হ্যালো ইয়াং ম্যান!

    ছেলেটি সরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।গাঢ় চাহনিতে জাফিনকে দেখে ছোট্ট করে বললো—

    “আপনি?

    জাফিন চমৎকার হাসলেন।হ্যান্ডশেকের জন্য হাতটা বাড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন–

    “আই এম জাফিন।জাফিন চৌধুরী।একজন নিউরো সার্জন।অবশ্য আরেকটা পরিচয় আমার আছে।এই হসপিটালটা আমারই।”

    ছেলেটির অতি আনন্দে হাতটা বাড়িয়ে ঝলমলে হেসে বললো—

    “আমি সারহান।সারহান জেইদি।একজন ক্রাইম স্পেশাল জার্নালিস্ট।”

    “ওও,ইটস সাউন্ড গুড।”

    “থ্যাংকস।”

    নামটা শুনতেই দুইবার আওড়ালো জান্নাহ্।মানুষটার মতো নামটাও তার পছন্দ হলো।সে উচ্ছল দৃষ্টিতে সেই অপরিচিত মানুষটিকে দেখতে লাগলো।জাফিন খুশ মেজাজে গল্প করতে লাগলেন।আর জান্নাহ্ সেই মানুষটাকে দেখতে লাগলো।তার কোমল কিশোরী মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হলো।তার নাম সে দিতে পারছে না।এমনটা আগে কখনো হয়নি।সারহান যতবার তার ঠোঁট নাড়াচ্ছে জান্নাহ্ গুনে গুনে দেখছে তা।তার চোখের পলক গুনছে সে।কথার ফাঁকে সারহান কতবার স্মিত হাসলো তাও সে ঠাওর করলো।কতবার লজ্জায় সারহান তার মাথানত করে হাসলো তাও।জান্নাহ্ এর কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগলো না।এমন করে কেউ কাউকে দেখে!ছিঃ! কী বিশ্রি ব্যাপার!

    জান্নাহ্ তার চোখ সরাতে চাইলো।সাথে তার অবচেতন মস্তিষ্কের ওলট পালট চিন্তা।কিন্তু পারলো না।সে আবারো দেখলো ওই মানুষটাকে।তার পিচ কালারের ওষ্ঠাধর অনুরণিত হচ্ছে।ওই গম্ভীর কিন্তু মায়াবী দুই চোখ যেনো জান্নাহ্কে দেখেই হাসছে।
    জান্নাহ্ এর মনে হলো সে কোনো নদীর মাঝে চরে দাঁড়িয়ে আছে।এখান থেকে ফেরার জন্য একটাই উপায় তাহলো ছোট্ট ডিঙি নৌকা।কিন্তু মাঝির সাথে বেজায় ঝগড়া জান্নাহ্ এর।এখন সে বাড়ি ফিরবে কী করে?
    তাই বাধ্য হয়েই মাঝির সাথে ভাব করতে হলো তার।জান্নাহ্ এর এমনটাই মনে হলো।এই মানুষটাকে তার সেই দুষ্ট মাঝি মনে হলো।যে তাকে পাড়ে
    ভিড়াবে।জান্নাহ্ তার দুষ্ট মাঝির একটা নাম দিলো।প্রাণ।

    জান্নাহ্ এর সম্বিৎ ফিরে তার বাবার মৃদু কন্ঠে।

    “ডল,এখন কী আমরা যেতে পারি?

    চমকে উঠে জান্নাহ্।সে তার প্রাণকে দেখায় ব্যস্ত ছিলো।আনম্র গলায় বললো–

    “হ্যাঁ,বাবা।”

    সারহান তার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত।তার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় জাফিন আর জান্নাহ্।সেদিকে তাকালো না সারহান।সারহানের কাছে থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে পেছন ফিরে তাকায় জান্নাহ্।বা’হাতে সে তার বাবার হাত ধরে রেখেছে।জরুরি একটা কল আসতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।মোবাইল কানে চেপে ধরেই বেখেয়ালিভাবে তাকায় হসপিটালের এক্সিটে।যেখান থেকে চেয়ে আছে জান্নাহ্।সারহান গভীর দৃষ্টিতে দেখে সে কিশোরীকে এইবার।ঘন পল্লবের নিচে দুই হাসি হাসি চোখ।কিশলয়ের মতো পাতলা অধরপল্লব।কোমর পর্যন্ত ছড়ানো চুল।একটা হাঁটু অব্দি লম্বা ফ্রক।সাথে চুরিধার।পায়ে লাইট পিংক কালারের স্ক্যাকার্স।সারহানের কিছু একটা হলো।সে কিশোরী মেয়েটির চোখের দিকে অনিমেখ চেয়ে রইলো যেনো ওই চোখ থেকে নিঃসৃত অমৃতের বাণ তার হৃদপিন্ডে বিঁধে গেলো।

    আলতো চোখের পলকে জান্নাহ্কে দেখে সারহান।চোখ সরায় সে।মনোযোগ দেয় মোবাইলের ওপাশের ব্যক্তিটির প্রতি।জানলো না সারহান।তার এই গম্ভীর চোখের চাহনি এক কিশোরী মনে ঝড় তুলে দিলো।প্রাণ নামের সেই ঝড়।যা সম্পর্কে সেই কিশোরীও অবগত নয়।
    ,
    ,
    ,
    ল্যাপটপের হোল স্ক্রীন জুড়ে রাফাতের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা।টুকটুক করে একে অপরের সাথে কথা বলছে দুইজন।

    “জান্নাহ্,কী করছো তুমি?

    জান্নাহ্ একগাল হেসে বললো—

    “ইটস সিক্রেট।”

    রাফাত কপাল ভাঁজ করে বললো—

    “পেইন্টিং করছো?

    স্মিতহাস্য অধরে ভ্রু নাচিয়ে জান্নাহ্ বললো—

    “কী করে বুঝলে?

    “রেড চেরি,তোমার অস্থিমজ্জাকে আমি চিনি।”

    জান্নাহ্ ঝুমঝুম করে হাসে।সেন্টার টেবিলের উপর ল্যাপটপ রেখে মেঝেতে বসে কথা বলছে রাফাতের সাথে অনলাইনে।হাতে থাকা পেইন্টিং টা উঁচু করে ধরে।লাইট পিংক আর রেডের সমন্বয়ে চেরি গাছ আঁকা।পাশেই এইটি মেয়ে বসে চেরি খাচ্ছে।রাফাত গা দুলিয়ে হেসে উঠে।জান্নাহ্ ঠোঁট উল্টে রাগি রাগি গলায় বললো—

    “হাসলে কেন?

    রাফাত সরব গলায় বললো–

    “চেরি গার্ল।একবার আমাকে আসতে দাও তোমাকে চেরির সাগরে ডোবাবো।”

    “ইশ!তোমায় বেঁধে রাখবো।”

    হা হা করে হেসে উঠে রাফাত।জান্নাহ্ উৎসুক গলায় বললো—

    “খেয়েছো?

    “ইয়েস রেড চেরি।একজন ভবিতব্য ডক্টর অবশ্যই তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হবে।অলরেডি টুয়েলভ এ.ম।”

    জান্নাহ্ চোখে হাসে। রাফাত কপালে তর্জনী দিয়ে চুলকে পাল্টা প্রশ্ন করে—

    “আজ তোমাকে খুশি খুশি লাগছে?

    জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে বললো—

    “ইটস সিক্রেট।বলা যাবে না।”

    “তোমার আমার মাঝে সিক্রেট আসলো কোথ থেকে?

    “রাফাত,আই এম আ বিগ গার্ল নাউ।ওকে বাই।নয়টা বেজে গেছে।বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

    “ওকে,লাভ।বাই এন্ড টেক কেয়ার।”

    “টা টা।”
    ,
    ,
    ,
    খাওয়ার টেবিলে চুপ চাপ বসে আছে জান্নাহ্।জাফিন মেয়ের মতিগতি খানিকটা আঁচ করে বললেন—

    “তুমি কী কিছু ভাবছো ডল?

    জান্নাহ্ অস্ফুট সুরে বললো–

    “হুম।”

    “আমি কী তা জানতে পারি?

    জান্নাহ্ চটপটে গলায় বললো—

    “ছেলেটা ভালো না বাবা?

    জাফিন চমকে হাসলেন।তার মেয়ে আজ প্রথম কোন ছেলের প্রশংসা করেছে।এই বয়সের মেয়েদের মধ্যে ফ্যান্টাসি কাজ করে।মুভির হিরোদের নিয়েও তারা সংসার সাজিয়ে বসে।লাইফ পার্টনারকে কল্পনা করে কোরিয়ান কোনো হিরোর মতো।কিন্ত জান্নাহ্ তা নয়।সে সবার থেকে আলাদা।বাবার মতো বাস্তব প্রিয় মানুষ।নিজের বাবাকে সে নিজের আদর্শ মানে এবং জীবনসঙ্গী হিসেবে সে তার বাবার মতো কাউকে চায়।
    জাফিন সরস গলায় বললেন—

    “ডল,তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো ইউ আর অনলি ফোরটিন।”

    জান্নাহ্ সহজ গলায় বললো–

    “আই নো বাবা।আই এম নট আ কিড।”

    মেয়ের কথায় হা হা করে হাসির বর্ষণ করলো জাফিন।জান্নাহ্ গুমোট গলায় বললো—

    “মাম্মা এখনো ফিরেনি বাবা?

    জাফিন মৃদু স্বরে বললেন–

    “নাহ।”

    “আজও মাম্মা ক্লাবে গিয়েছে?

    “হয়তো।”

    “বাবা,তুমি মাম্মাকে কেন কিছু বলছো না?

    “কী বলবো?

    জান্নাহ্ রাগাম্বিত গলায় বললো–

    “মাম্মা তোমাকে ভালোবাসে না বাবা।”

    জাফিন শীতল নিঃশ্বাস ফেললেন।যুক্তি দাঁড় করিয়ে বললেন—-

    “এমনটা নয় ডল।ভালোবাসলেই যে তা মুখের স্বীকার করতে হবে তা নয়।ভালোবাসা সুপ্ত অনুভূতি।তোমার মাম্মা আমাকে তার অবচেতন মনে ভালোবাসে তাই সে তার সজ্ঞানে তা প্রকাশ করতে চায় না।সে নিজেকে কঠোরভাবে।কিন্তু আসলে সে তা নয়।আমার প্রতি তার যে রাগ তা তোমার জন্মের সাথে সাথে ঢলে গিয়েছে।কিন্তু তার সাথে হওয়া অন্যায়টা সে আজও মেনে নিতে পারেনি।দ্বিতীয়বার কাউকে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভালোবাসা যায় তা মানতে সে নারাজ।তোমার মামা তার বোনের ভালোর জন্যই আমার সাথে তার বিয়ে দিয়ে ছিলো।হয়তো মৃণালের সাথে আমার বয়সের ডিফারেন্টটাকে ও অনেক বড় করে দেখেছে।তার কারণ সেম এইজ রিলেশন।কিন্তু আমাকে সে নেগলেট করেনি কখনো।”

    “কারণ তুমি তাকে তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছো।”

    “হতে পারে।আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।তার ফলে আমি তোমায় পেয়েছি।”

    “আই ডোন্ট থিংক সো।”

    “ওকে,সময় হলে বুঝবে।এখন খাও।সাড়ে ন’টা বেজে গেছে।এইটা ঠিক নয়।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫৪
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    রাতের আঁধার ঘুচে ঝলমলে সূর্যে অবগাহন করছে নিরাক পরিবেশ।থমথমে পরিবেশে হলদে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে তরতর করে তার আচ্ছাদন।শান্ত কিন্তু তেজী সূর্য তার মিষ্টি আলোয় মুড়িয়ে রেখেছে আজকের সকাল।জান্নাহ্ বসে আছে ছাদে।হালকা বাতাসে ছাদে রাখা ফুলের গাছগুলো দুলে যাচ্ছে হঠাৎ করে।গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণ এসে তার নাকে ঠেকে।শীতল নিঃশ্বাস ফেলে জান্নাহ্।

    আজকাল নিজেকে কেমন খাপছাড়া মনে হয় তার।অকারণে সাজতে ইচ্ছে হয়।চোখে কাজল আঁকতে ইচ্ছে।চুলে আস্ত খোঁপা করে বউ সাজতে ইচ্ছে হয়।দু’চোখ ভরে তার প্রাণকে দেখতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু তা তো সম্ভব নয়।জান্নাহ্ কোমল হাসে।এর একটি সমাধান সে বের করেছে।একটা পেইন্টিং সে বানিয়েছে তার প্রাণের যার সাথে সে কথা বলে রাতভর।ঘুমও হয় না তার।কীসব অদ্ভূতুড়ে স্বপ্ন আসে তার।
    ভাবা যায়!ছিঃ!সলজ্জ চোখ দুটি দিয়ে নীলাভ ঝকঝকে আকাশ দেখে জান্নাহ্।তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে।তার মাম্মা কেন তার বাবাকে ভালোবাসে না!

    ঘড়ির কাটা এগারোর ঘর ছুঁয়েছে।মৃণালিনী উঠে বসলেন।মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার।এখনো হ্যাংআউট হয়নি।রাতের দ্বিপ্রহরে ফিরেছে সে।চোখের সামনে জান্নাহ্কে দেখে একটু অবাকই হলেন।জান্নাহ্ শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে।ক্ষোভ নিয়ে জান্নাহ্ বললো—

    “তুমি কালও ক্লাবে গিয়েছো মাম্মা!ড্রিংসও করেছো?

    মৃণালিনী ক্লান্ত চোখে হাসলেন।মৃদু গলায় বললেন–

    “সেটাতো তুমি জানো ডল।প্রশ্ন কেন করছো?

    জান্নাহ্ অসহায় গলায় বললো—

    “কেন এমন করো মাম্মা?বাবা তোমাকে এতো ভালোবাসে!

    “বাট আই ডোন্ট লাভ হিম।”

    অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বললেন মৃণালিনী।জান্নাহ্ বিদ্রোহী গলায় বললো–

    “তাহলে বিয়ে কেন করলে বাবাকে?

    হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন মৃণালিনী।আক্ষেপ করে বললেন—

    “ওইটা বিয়ে নয়।ওইটা একটা কমিটমেন্ট ডল।তোমার বাবার একজন সুন্দরী স্ত্রী দরকার ছিলো আর আমার লাক্সারী লাইফ।”

    জান্নাহ্ আপত্তির সুরে বললো–

    “বাবা সম্পর্কে তুমি এভাবে বলতে পারো না মাম্মা।”

    মৃণালিনী তার কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো চুল মাথার মধ্যখানে নিয়ে খোঁপা করলেন।সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া ক’গাছি চুল ঠোঁট উঁচু করে ফুঁ দিয়ে সরাতে চাইলেন।ক্লান্ত দেহখানি হালকা নাড়ালেন।স্লিভলেস টপসের গলাটা ছড়ানো হওয়ার ভেতরে জামার স্ট্রিপটা বাইরে বেরিয়ে আছে।বিছানায় দু’হাত দিয়ে হেলান দিয়ে বললেন—

    “তুমি দেখতে আমার মতো হলেও স্বভাবটা তোমার বাবার পেয়েছো।এটা ঠিক নয় ডল।তোমাকে আমার মতো ওপেন মাইন্ডেড হওয়া উচিত।”

    জান্নাহ্ নাক ফুলিয়ে ব্যগ্র গলায় বললো—

    “যদি ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে রাত বিরাতে ক্লাবে গিয়ে বিয়ার খাওয়া,নেশা করা,বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া ওপেন মাইন্ডেড হয়।তাহলে তার কোনো প্রয়োজন নেই আমার।আমি আমার বাবার মতো হওয়ায় গর্ববোধ করি।”

    মৃণালিনী উদাস গলায় বললেন–

    “ওকে,ইটস ইউর চয়েজ।”

    অগোছালো টপস টা টান দিয়ে উদর ঢাকলেন মৃণালিনী।জান্নাহ্ নম্র চাহনিতে সন্দিহান গলায় বললো—

    “ভালো যখন ভাসোই না তাহলে বাবাকে ছেড়ে যাচ্ছো না কেন?

    মৃণালিনী স্মিত হাসলেন।বিগলিত গলায় বললেন–

    “ইউ নো হোয়াই?এর কারণটা তুমি।বিয়ের এতো বছর পরও যখন আমি কনসিভ করছিলাম না জাফিন আমার সব স্বাধীনতা কেড়ে নিলো।এক রকম বন্ধি করে ফেললো আমায়।ওর একটাই কথা,তোমাকে ওর চাই।গড নৌজ ওয়েল এট লাস্ট তুমি এলে আমাদের জীবনে।আমি আমার সব কিছু ফিরে পেলাম।কিন্তু তোমার মায়ায় পড়ে গেলাম বলে আর জাফিনকে ছাড়তে পারলাম না।অবশ্য আমার তাতে কোনো অসুবিধা নেই।জাফিন আমাকে সব স্বাধীনতা দিয়েছে যেভাবে আমি বাঁচতে চেয়েছি।”

    জান্নাহ্ অনেকটা কষ্ট নিয়ে ধরা গলায় বললো—

    “বাবা তোমায় এতো ভালোবাসে তবুও কেন তুমি তাকে মেনে নিতে পারো না?

    মৃণালিনী নির্ভয়ে বললেন–

    “কী করে মেনে নেই!তোমার বাবা আমার থেকে বারো বছরের বড়।আমি নিশ্চয়ই এর চেয়ে ভালো কিছু ডিজার্ব করি।”

    “ভালোবাসা থাকলে বয়স কোনো ফ্যাক্ট নয় মাম্মা।”

    “ডল,ভুল বললে।তোমার মতো বয়সে মনে হবে একটু গুরু গম্ভীর,ব্যস্ত,বাস্তবিক আর পোলাইট টাইপ মানুষ পার্ফেক্ট।কিন্তু আসলে তা নয়।বয়স বাড়ার সাথে সাথে তোমার আর তার বয়সের সাথে সাথে মতেরও অমিল হবে,পছন্দের অমিল হবে,ফিজিক্যাল নিড চেঞ্জ হবে,মুড চেঞ্জ হবে।তখন সবকিছু দূর্বিষহ মনে হবে।আমি নিশ্চয়ই তোমার বিয়ে সাত,আট এমনকি পাঁচ বছরের বড় ছেলের সাথে দিবো না।আমি তোমাকে আমার মতো সাফার হতে দেখতে চাই না।”

    জান্নাহ্ সংক্ষোভ নিয়ে বললো—

    “তাহলে তুমি যেতো পারো।”

    মৃণালিনী চমৎকার হাসলেন।অত্যন্ত বিনয়ী গলায় বললেন—

    “তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না তোমার বাবা তার ফিজিক্যাল নীড বাইরে থেকে পূরণ করুক!আমি তো বলেছি আমি এখানে তোমার জন্য আছি।জাফিনের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই,না আছে কোনো অনুভূতি।”

    জান্নাহ্ থম মেরে রইলো।এইসবই তার জানা।তবুও আজ আবার তা শুনলো সে।মৃণালিনী শ্রান্ত গলায় বললেন—

    “আজ এতো সকালে আমার ঘরে!তোমার কী কিছু চাই ডল?

    জান্নাহ্ রাগ গিলে নিয়ে নির্বিঘ্নে বললো—

    “হুম।আমার একটা শাড়ি চাই।তুমি কী আমাকে তা দিতে পারবে?

    মৃণালিনী মনে করার চেষ্টা করলেন আদৌ তার কাছে শাড়ি আছে কিনা!মনে পড়তেই বললেন—

    “হুম,দিতে পারি।ক্লোজেট এর থার্ড ড্রয়ারে আছে।ওটা তোমার বাবা আমাকে বিয়েতে দিয়েছিলো।তুমি জানো শাড়ি আমি পড়িনা।সেদিন শুধু একঘন্টার জন্য পরেছিলাম।”

    জান্নাহ্ ক্লোজেট খুলে যথাস্থানে শাড়িটা পায় ঠিক যেখানে তার মা বলেছিলো।মানুষ বুঝি অপছন্দের জিনিসগুলো এতো খেয়াল করে রাখে!

    “বাহ!শাড়িটাতো বেশ সুন্দর!

    মৃণালিনী বিছানা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে বললেন—

    “কালারটা আমার একদম পছন্দ নয়।তুমি রেখে দাও।”

    জান্নাহ্ দ্বিধা নিয়ে বললো—

    “তোমার বিয়ের শাড়ি তুমি অন্য কাউকে দিয়ে দিবে?

    “অন্য কাউকে দিচ্ছি নাতো।তোমাকে দিচ্ছি।তুমি তো অন্য কেউ নও।”

    জান্নাহ্ পরম আশ্লেষে শাড়িটাতে হাত বুলাতে থাকে।অফ হোয়াইট শাড়ির খয়েরি পাড়।গোল্ডেন আর হোয়াইট স্টনের সাথে কারচুপির কাজ।জান্নাহ্ এর বেশ ভালো লাগলো।মৃণালিনী তাচ্ছিল্য গলায় বললেন–

    “তোমার পছন্দ তোমার বাবার মতো।আই থিংক শাড়িটার তোমার পছন্দ হবে।”

    জান্নাহ্ মুখে হাসি রেখে বেখেয়ালেই বললো–

    “হুম।”

    “জান্নাহ্!

    “হ্যাঁ,মাম্মা?

    “আলীকে বলো আমার জন্য অ্যাপেল জুস আর ফ্রুট স্যালাড করতে।আজ আর অন্য কিছু খাবো না।অনেকদিন হলো এক্সারসাইজ করা হয় না।মুটিয়ে যাচ্ছি।”

    জান্নাহ্ মৃদু হাসলো।থার্টি সিক্স কোমরে তার মা নাকি মুটিয়ে যাচ্ছে!

    মৃণালিনী একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফট করে বললেন–

    “উফ!মাথাটা শেষ আমার।গায়ে এখনো বিয়ারের গন্ধ।আমি শাওয়ারে গেলাম।তোমার যা ইচ্ছে নিয়ে নাও।”

    ফোঁস করে দম ফেললো জান্নাহ্।তার মা একবারো জিঙ্গেস করলো না শাড়িটা দিয়ে সে কী করবে!আজ জান্নাহ্ তার প্রাণের জন্য প্রথম বারের মতো শাড়ি পরবে।মেয়েদের প্রথম শাড়ি নাকি তার মায়েরই হয়।জান্নাহ্ এর বেলাও তাই ঘটলো।কিন্তু সে বিষন্ন।তার মা একবারো কেন জিঙ্গেস করলো না।মন খারাপ হয় তার।ভীষণ মন খারাপ।
    ,
    ,
    ,
    শাড়িরটা নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে নিজেকে দেখছে জান্নাহ্।ভীষণ লজ্জা লাগলো তার।এ কেমন পাগলামি!
    সারহানের পেইন্টিংটা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার ঠিক উপরের দিকটায় লাগানো।টেবিলের দুই পাশে দুটো পাল্লা।নিচের দিকটায় একটা ড্রয়ার।সেখানে বসার জন্য একটা ছোট্ট টুলও আছে।

    জান্নাহ্ হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো—

    “শাড়িটা সুন্দর না প্রাণ!এইটা আমার মাম্মার।আজ আমি এটাই পড়বো।শুনেছি ছেলেরা নাকি শাড়ি পড়া মেয়েদের পছন্দ করে।আপনিও কী করেন?

    জান্নাহ্ এর মুখ ভার হয়।তার প্রাণের যদি তাকে পছন্দ না হয়।কই সেদিন তো একবারো ফিরে দেখলো না তাকে।জল ভরে আসে জান্নাহ্ এর চোখে।রাফাত বলে সে নাকি রেড চেরি।বাবা বলে সে নাকি ডল।আর তার মামা তাকে পরীজান বলে কারণ সে পরীর মতো সুন্দর দেখতে।তাহলে তার প্রাণ কেন তাকে ফিরে দেখলো না।
    জান্নাহ্ আয়নার কাছে এসে দাঁড়ায়।গভীরভাবে সারহানের পেইন্টিং টা দেখে।অনুজ্জল গলায় বললো—

    “আমাকে কী আপনার পছন্দ নয় প্রাণ?

    জান্নাহ্ এর কিশোরী মন হঠাৎ ঝড়ের বেগে ঝনঝনিয়ে উঠে।তার কাঁদতে ইচ্ছে হয়।ঠোঁট কামড়ে ধরে জান্নাহ্।আচমকা ফিক করে হেসে ফেলে।চকচক চোখে তাকিয়ে ঝলমলে গলায় বললো—

    “শাড়িতে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে আমায়?

    জান্নাহ্ ঝুমঝুম করে হাসে।তার কিশোরী মন হঠাৎ করে রঙধনুর সাত রঙে মুড়িয়ে যায়।জান্নাহ্ ভ্রু নাচিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো–

    “এভাবে কেন তাকান?আপনি এভাবে তাকালে আমি শাড়ি পরবো কী করে!বিয়ের আগে এইভাবে আমাকে দেখার অধিকার আপনার নেই।”

    খিলখিলিয়ে হাসে জান্নাহ্।সারহানের পেইন্টিংএর উপর একটা ওড়না ঝুলিয়ে দেয়। শাড়ি পরা শেষ করে আয়নায় নিজেকে দেখে জান্নাহ্।লজ্জায় টইটুম্বর চোখ দুটো চেপে ধরে নিজের হাত দিয়ে।হাতের ফাঁকে নিজেকে দেখেই অবাক হয় জান্নাহ্।তাকে একদম বউ বউ লাগছে।তার প্রাণের মিষ্টি বউ।নিজের ভাবনায় একগাল হাসে জান্নাহ্।কী লজ্জা!কী লজ্জা!
    কাল সারারাত জেগে সে ইউটিউবে শাড়ি পরা দেখেছে।আজ পরেও নিলো।তার প্রাণের জন্য।

    দরজায় করাঘাত পড়তেই চকিত হয় জান্নাহ্।দরজা খুলতেই অবিশ্বাস্য চোখে জাফিন দেখে তার ছোট্ট ডলকে।সে হতবাক।মুগ্ধ গলায় বললেন—

    “হোয়াট আ সারপ্রাইজ ডল?

    জান্নাহ্ ফিক করে হেসে বললো—

    “আমাকে কেমন লাগছে বাবা।”

    “জাস্ট লাইক ইউর মাম্মা।”

    কথা শেষ করে জাফিন গম্ভীর অভিব্যক্তিতে মেয়েকে দেখে আবার বললেন–

    “তুমি তোমার মায়ের মতো ততটা সুন্দরী নও।”

    জান্নাহ্ নাক ফুলিয়ে বাবার হাত ধরে আহ্লাদী গলায় বললো—

    “বাবা!

    গা দুলিয়ে হাসলেন জাফিন।আহ্লাদ করে বললেন—-

    “হঠাৎ শাড়ি পরলে ডল!অ্যানি স্পেশাল রিজন?

    জান্নাহ্ এর ঘরে তার বেডের পাশেই ডিভান।আয়েশ করে বসলেন জাফিন।জান্নাহ্ বাবার সামনে দাঁড়িয় খুশি খুশি গলায় বললেন—

    “ইচ্ছে হলো তাই।”

    “তুমি কিছু লুকোচ্ছো ডল।”

    জান্নাহ্ ট্রিপিক্যাল বাঙালী কিশোরীদের মতো নিজের নখ খুটে বললো—

    “সারহানের খোঁজ পেয়েছো বাবা?

    জাফিন মেয়ের এই আমূল পরিবর্তনে বিস্মিত হলেন,কিন্তু চিন্তিত নয়।তিনি মোলায়েম গলায় বললেন—

    “রাফাতের সাথে এই বিষয়ে কথা হয়েছে তোমার?

    জান্নাহ্ ম্লান গলায় বললো–

    “নাহ।”

    “তোমার তাকে জানানো উচিত।রাফাত তোমার প্রতি সিরিয়াস ডল।”

    “উফ!বাবা।রাফাত ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।হি ইজ মাই ওয়েল উইশার।বাট আই ডোন্ট লাভ হিম।”

    ঝট করেই প্রশ্ন করে বসলেন জাফিন—

    “ডু ইউ লাভ উইথ সারহান?

    জান্নাহ্ সাবলীল কন্ঠে বললো–

    “আই লাইক হিম।”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাফিন।মেয়েকে আদুরে গলায় বললেন—

    “তুমি মাত্র চৌদ্দ জান্নাহ্।সারহান অলরেডি টুয়েন্টি সেভেন আপ।আই থিংক তোমার দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত।আমি অবশ্যই তোমাকে আন্ডার এইটিন বিয়ে দিবো না।”

    জান্নাহ্ তার বাবার পায়ের কাছে বসলো।হাত দুটো বাবার পায়ের উপর রেখে স্বাভাবিক গলায় বললো—

    “জানি বাবা।সারহানও নিশ্চয়ই এখন বিয়ে করবে না।আর আমি তো তোমায় শুধু কথা বলতে বলেছি,খোঁজ নিতে বলেছি।”

    জাফিন মেয়ের কপালে আদুরে চুমু খেয়ে বললেন—

    “তাকে পছন্দ করার যথাযোগ্য কোন কারণ।”

    প্রসন্ন গলায় জান্নাহ্ বললো—

    “সে তোমার মতো বাবা।একজন অপরিচিত মানুষের জন্য যদি সে এতোটা করতে পারে তাহলে ভাবো সে নিজের মানুষের জন্য কতোটা করতে পারে!আমি তার সেই নিজের মানুষটা হতে চাই।”

    জান্নাহ্ সবসময় তার বাবার মতো কাউকে চেয়েছে।যেদিক থেকে সারহানের সব গুন তার বাবার মতো।তাই নিজেকে রুখতে গিয়ে পারে না জান্নাহ্।জাফিন চিন্তিত হলেন।জান্নাহ্ তার বাবার সাথে সবচেয়ে বেশি এটাচ।নারী আচরণের সুক্ষ্ম বিষয়গুলোও তার ডক্টর বাবা তাকে শিখিয়েছেন।তাই তো জীবনের প্রথম অনুভূতি অকপটে প্রকাশ করতে একটুও দ্বিধা হলো না তার।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫৫
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত মৃণালিনী।ঘড়িতে সন্ধ্যা সাত।হলুদ রঙের টপস এর সাথে ব্রাশ জিন্স।টপসের এক হাতা হেলানো নিচের দিকে যেখানে তার ভেতরকার জামার স্ট্রিপ বেরিয়ে আছে।কাঁধ পর্যন্ত থাকা চুলগুলোকে এক সাইডে সিঁথি করে ফেলে রেখেছে।ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি লিপস্টিক।কানের মধ্যে ঝুলছে আজকালকার ফ্যাশনেবল রিং।দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের মাকে পর্যবেক্ষণ করছে জান্নাহ্।মৃণালিনী মেয়েকে দেখে উচ্ছ্বাসিত হাসলেন।মেয়ের কাছে গিয়ে হাত দুটো ধরে বললেন—

    “মাম্মাকে কেমন লাগছে ডল?

    জান্নাহ্ গম্ভীর মুখে বললো—

    “ভালো।কোথায় যাচ্ছো তুমি?

    মৃণালিনী হাসি হাসি মুখে বললেন—

    “আজ আমার এক বন্ধুর জন্মদিন।ওটা সেলিব্রেট করতে যাচ্ছি।এবং তুমিও যাচ্ছো আমার সাথে।”

    জান্নাহ্ চট করেই বললো–

    “নো মাম্মা।আমি তোমার সাথে যাবো না।তুমি জানো এইসব আমার পছন্দ না।”

    মৃণালিনী আদর মাখা গলায় বললেন—

    “আমার বন্ধু তোমাকে দেখতে চেয়েছে ডল।আমি তাকে কথা দিয়েছি।তোমার নিশ্চয়ই যাওয়া উচিত।”

    জান্নাহ্ আপত্তি করে বললো—

    “নাহ।আমি যাবো না।”

    মৃণালিনী আনম্র গলায় বললেন—

    “ডু ইউ লাভ মি?

    জান্নাহ্ এর কেনো যেনো কান্না পেলো।মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো—

    “আই লাভ ইউ মাম্মা।আই লাভ ইউ সো মাচ।”

    “আই লাভ ইউ টু ডল।যাও তৈরি হয়ে এসো।”

    অগত্যা জান্নাহ্কে যেতে হবে।
    সারহানের পেইন্টিং এর সামনে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।একটা স্লিভলেস গাউন পরেছে জান্নাহ্।তার উপর গোল্ডেন কালারের কটি।চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক।বাম হাত ভর্তি চুড়ি।চুড়ি জান্নাহ্ এর ভীষণ প্রিয়।সারহানের দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে।মৃণালিনীর পায়ের শব্দে আড়াল করে সারহানকে।
    ,
    ,
    ,
    ধীম ধীম আওয়াজে গান চলছে।ক্লাবের সবাই ব্যস্ত।ক্ষীণ আলো জ্বলছে।তাতে অবশ্য মুখ দেখা যায়।জান্নাহ্ এর গা ঘিনঘিন করে।কেমন উটকো গন্ধ!
    তার দিকেই আস্ত নজরে তাকিয়ে আছে পাশে বসা রৌশান।জান্নাহ্ সেদিকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না করে নিজের কোল্ড ড্রিংসের স্ট্রতে সিপ লাগায়।রৌশান মুগ্ধ গলায় বললেন–

    “মানতে হয়।তোমার মেয়ে কিন্তু তোমার মতো সুন্দরী।”

    মৃণালিনী দাম্ভিকতার সাথে বললেন—

    “ভুল বললে।আমার ডল আমার চেয়েও সুন্দরী।শী ইজ লাইক আ এঞ্জেল।”

    মৃণালিনী নিজের মেয়ের হাতে চুমু খেলেন।রৌশান ফিচেল হেসে বললো—

    “তা অবশ্য তুমি ভুল বলোনি।”

    জান্নাহ্ আড়চোখে রৌশানের দিকে তাকায়।লোকটাকে পছন্দ হচ্ছে না জান্নাহ্ এর।সেই কখন থেকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকে উপর থেকে নিচে দেখছে।মৃণালিনী তার এক বন্ধুকে দেখে বললেন—

    “ডল,তুমি বসো আমি আসছি।”

    “ওকে মাম্মা।”

    মৃণালিনী উঠে যেতেই রৌশানের চোখে দ্যুতি খেলে গেলো।অদ্ভুত দৃষ্টিতে জান্নাহ্ এর গলার দিকটায় তাকিয়ে রইলো।জান্নাহ্ তার খোলা চুলগুলো ঘাড়ের দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়।শক্ত গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

    “আপনিই মাম্মার সেই কলেজ টাইমের বয়ফ্রেন্ড?

    রৌশান স্মিত হেসে সম্মতি দিলো।জান্নাহ্ কড়া গলায় শাসিয়ে উঠে—

    “কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না আমার মাম্মার পিছু?আপনি তো বিয়ে করেছেন।তবুও কেন আমার মাম্মাকে নিজের প্রতি অ্যাট্রাক্ট করছেন?

    রৌশান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এই টুকু বাচ্চা মেয়ে কী সুন্দর কথা বলে!জান্নাহ্ এর ঠোঁটের নড়াচড়া দেখছে রৌশান।সাবলীল গলায় রৌশান বললো–

    “তুমি হয়তো জানো না ডল,আমার ডিবোর্স হয়ে গেছে।”

    জান্নাহ্ ক্রোধান্বিত গলায় বলে উঠে—

    “একদম আমাকে ডল ডাকবেন না।এই নামে শুধু আমার মাম্মা আর বাবা ডাকবে।”

    রৌশান চতুর হেসে জান্নাহ্ এর হাত স্পর্শ করে বললো—

    “ওকে,ওকে।জাস্ট ইজি জান্নাহ্।তোমার মা ঠিকই বলেছে।তুমি তার চেয়েও সুন্দরী।জাস্ট আ ফায়ার বিউটি।এই বয়সে এতো সুন্দর তুমি ভাবতো আঠারো ক্রস করলে তুমি তো দুনিয়া কাঁপাবে।তুমি ইচ্ছে করলেই মডেলিং করতে পারো।আমি হেল্প করবো তোমায়।”

    জান্নাহ্ ঝাঁড়া মেরে উঠে দাঁড়ায়।গর্জে উঠে বললো—

    “ডোন্ট টাচ মি।ইউ রাবিশ!

    রৌশান ক্ষীপ্র গলায় বললেন—

    “জান্নাহ্!

    “চুপ করুন।”

    মেয়ের গলার উঁচু আওয়াজে মৃণালিনী দপদপিয়ে আসেন।মায়ের বুকে মাথা গুঁজে দেয় জান্নাহ্।কেঁদে কেঁদে বললো—

    “দেখনা মাম্মা,হি টাচ মি ইন ব্যাড ওয়ে।”

    মৃণালিনী খলবলিয়ে বললেন—

    “হোয়াট?

    রৌশান নিজের ডিফেন্সে বললেন—

    “মৃণালিনী তোমার মেয়ে মিথ্যে বলছে।আমি তো…।”

    তার আগেই এক চড় বসিয়ে দেয় মৃণালিনী রৌশানের গালে।ক্লাবের সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে।ক্ষীপ্ত কন্ঠে ঝাঁজিয়ে উঠে মৃণালিনী—-

    “তোমার সাহস কী করে হলো আমার মেয়েকে ছোঁয়ার!ইউ ফ** ফেলো।”

    রৌশান উত্তেজিত হয়ে বললেন—

    ” ইউ স্লাট,ভাবিস কী নিজেকে তুই!

    মৃণালিনী সজোরে আরেক চড় বসিয়ে দেয় রৌশানের গালে।দু দুটো চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে যায় রৌশান।মৃণালিনী অ্যাডিক্টেড হলেও নিজের সম্ভ্রমে কখনো আঘাত হানতে দেয়নি।সেখানে নিজের ফুলের মতো মেয়ের জন্য এক চুলও ছাড় নয়।রৌশান তেড়ে গিয়ে মৃণালিনীকে পাল্টা আঘাত করতে চাইলে কেউ তার হাত ধরে ফেলে।রসালো গলায় বলে উঠে—

    “আরে মামা।রিল্যাক্স।নারীর গায়ে হাত দেওয়া কাপুরুষের কাজ।”

    রৌশাণ গমগমে গলায় বললেন—

    “হোয়াট রাবিশ!তুই কে?

    “তোর বাপ।”

    রৌশানের হাতটা পেছনে মুড়ে ধরে ছেলেটি।মৃণালিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো—

    “আপনি যেতে পারেন ম্যাম।একে আমি দেখছি।”

    মৃণালিনী কৃতজ্ঞতার সুরে বললো—

    “থ্যাংকস আ লট।”

    জান্নাহ্ নিজের মায়ের বুকে মুখ গুঁজে নাক টেনে যাচ্ছে।কিন্তু ছেলেটার কন্ঠস্বর তার পরিচিত মনে হলো।হালকা মাথা বাঁকিয়ে দেখলো সে।ছেলেটার পেছন দিকটা দেখে সে বুঝতে পার এ তারই প্রাণ।সারহান আরো কয়েকধাপ কথা বললো।গলার আওয়াজ আর এক সাইড থেকে দেখে জান্নাহ্ নিশ্চিত হলো এটা সারহানই।নিজেকে লুকায় জান্নাহ্।সে চায় না তার প্রাণ তাকে এইভাবে দেখুক।সারহান থমথমে গলায় মৃণালিনীকে ডেকে বলে–

    “আমি পেছন থেকে আপনার মেয়ের কথাগুলো শুনেছি।সে ভুল কিছু বলেনি।আপনার মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো এইসব জায়গার জন্য উপযুক্ত নয়।নেক্সট টাইম তাকে এখানে আনার আগে দু’বার ভাববেন।আর পারলে নিজেও এভয়েট করবেন এইসব জায়গা।এগুলো সবার জন্য নয়।রঙিন পালক লাগালেই তো আর কাক ময়ূর হয়ে যায় না।তাই ময়ূর রূপী কাক চিনতে আমাদের ভুল হয়।যান।”

    মৃণালিনী অপ্রস্তুত হলেন সারহানের কথায়।কিন্তু তার গভীরতাও বুঝতে পারলেন।

    সারহান কপট হেসে ফিচেল গলায় বললো—

    “শালা পার্ভাট, আজ তিনদিন ধরে তোকে টার্গেট করে রেখেছি।আর তুই আছিস নতুন পাখি ধরার ধান্দায়।”

    ভ্যাবাচাকা খেয়ে রৌশান বললেন—

    “কে তুই?কী চাস?

    সারহান জোরালো গলায় ডেকে উঠে—

    “শায়িখ,শায়িখ।”

    শায়িখ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দম স্থির করে বললো—

    “জ্বী স্যার।”

    সারহান খটমটিয়ে বললো—

    “কোথায় ছিলে তুমি?

    শায়িখ মিনমিনে গলায় প্রত্যুক্তি করে—

    “ওয়াশরুমে স্যার।”

    সারহান নাক ফুলিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

    ” আমি বুঝিনা জরুরি কাজের সময় তোমার সবসময় ওয়াশরুমে কেন যেতে হয়।”

    শায়িখ অনুযোগের সুরে বললো–

    “সরি স্যার।”

    “ওই ছেলে দুটো কোথায়?

    “এখনই নিয়ে আসছি স্যার।”

    একটু পরই দুটো উঠতি বয়সের ছেলেকে নিয়ে ফিরে শায়িখ।ছেলে দুটো ভয় তটস্থ হয়ে থরথর করে কাঁপছে।সারহান তেজি গলায় বললো—

    “এই দুটোকে চিনিস?

    রৌশান দম্ভ করে বললো —

    “নাহ।”

    সারহান রৌশানের ব্লেজারে কলার টেনে এক ঘা বসায় তার গালে।তপ্ত গলায় বললো–

    “আরেকবার মিথ্যে বললে এখানেই পুঁতে দিবো।”

    রৌশান ক্ষীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে।সারহান স্বশব্দে বললো—

    “মেয়েদেরকে মডেলিং এর কথা বলে বাইরে পাচার করিস আর যুবক ছেলেদের ড্রাগসের নেশা ধরিয়ে ওদের দিয়েই ড্রাগস সাপ্লাই করাস।”

    রৌশান প্রতিবাদ করে বললেন—

    ” এইসব মিথ্যে।”

    “প্রীতির অ্যাকসিডেন্ট এদের দিয়ে করিয়েছিলি তাই না!

    ভীত চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলতে থাকে রৌশান।সারহান ছেলেদুটোর দিকে কড়া চোখে তাকাতেই ছেলে দুটো হন্তদন্ত হয়ে বললো—

    “জ্বী স্যার।রৌশান স্যার ই বলেছিলো প্রীতির অ্যাকসিডেন্ট করাতে।প্রীতির কাছে একটা ভিডিও আছে।”

    “ইয়া।ওটা এখন আমার কাছে।আর প্রীতিও বেঁচে আছে।
    শায়িখ,পুলিশ আসতে আর কতক্ষন?

    হকচকিয়ে যায় রৌশান।শায়িখ মৃদু গলায় বললো—

    “পুলিশ কমিশনার কে কল করেছি।”

    সারহান বিরক্তি নিয়ে বললো—

    “ওই নাদাপেটাকে কল করেছো কেন?বউ ছেড়ে আসতেই তো সকাল হয়ে যাবে।”

    শায়িখ ঠোঁট চিপে হেসে বললো—

    “কমিশনার তার মেয়ের হবু জামাইকে পাঠাচ্ছে।”

    সারহান রসালো গলায় বললো—

    “ওর জামাই তো কচ্ছপ।”

    শায়িখ বিজ্ঞ আচরণ করে বললো—

    “স্যার,ছোটোবেলার গল্পটা মনে আছে না।স্লো এন্ড স্টেডি উইন দ্যা রেস।”

    সারহান শায়িখের কাঁধে চাপড় মেরে বললো–

    “সাবাস!

    জান্নাহ্ রা যেই টেবিলটায় ছিলো সেটার উপরে উঠে বসে সারহান।ছেলেদুটো কে বললো রৌশানকে পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত ধরে রাখতে।তাহলে ওদেরকে সে ছেড়ে দিবে।ছেলে দুটো তাই করলো।চেপে ধরে রাখলো রৌশানকে।রৌশান টাকা অফার করে সারহানকে।সারহান মশকারি করে বললো—

    “টাকার বালিশে ঘুমালে স্লিপিং পিল লাগে আমার।আগে ওটা পেয়ে নেই তারপর।”

    মুচকি হাসে শায়িখ।তার স্যার বিয়ের কথা বলছে।দমদমে গলায় ক্লাবের ম্যানেজারকে ডাকে সারহান।

    “ম্যানেজার!

    ম্যানেজার কাঁচুমাচু হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।তীর্যক গলায় বললো—

    “আজকের পর যদি আন্ডার এইটিন কোনো ছেলে বা মেয়েকে ক্লাবে ঢুকতে দিয়েছিস তো তো তু গ্যায়া।”

    “সরি স্যার,আর ভুল হবে না।”

    “শায়িখ আমার জন্য ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংস নিয়ে এসো।এদের সামলাতে গিয়ে আমার গলা শেষ।”

    ভৃত্যের মতো শায়িখ বললো—

    “জ্বী স্যার।এখনই আনছি।”

    “দুই মিনিটে পুরো ক্লাব খালি চাই আমি।”

    এতোক্ষন দর্শকের মতো মজা লুটে নেওয়া মাতালরা আস্তে আস্তে ক্লাব থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো।সারহান দুই হাতে টেবিলের উপর ভর দেয়।সে অনুভব করে তার হাতে কিছু একটা লেগেছে।সারহান হাত উঠিয়ে তালুতে দেখে একটা লেন্স লেগে আছে।বিক্ষিপ্ত হাসে সারহান।স্বগতোক্তি করে বললো–

    “মনে হয় ওই বাচ্চা মেয়েটার লেন্স!এতো কম বয়সে কেউ লেন্স ইউজ করে!স্ট্রেঞ্জ!

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫৬
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    বাবার পায়ে মুখ গুঁজে সমানতালে কেঁদে চলছে জান্নাহ্।জাফিন মেয়েকে আনম্র গলায় বললেন—

    “ডল,প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।”

    ঝাড়ি মেরে উঠে জান্নাহ্–

    “কাঁদবো, একশবার কাঁদবো আমি।”

    জাফিন বিগলিত হাসলেন।বাবার পায়ের উপর থেকে মাথা উঠিয়ে জান্নাহ্ আবার ক্রন্দনরত গলায় বললো—

    “কেন নিয়ে গেলো আমায়?ওই নোংরা লোকটা আমাকে ওভাবে ছুঁয়েছে।শুধুমাত্র মাম্মার জন্য।”

    জাফিন মেয়ের দুই চোখ মুছে বিনয়ী গলায় বললেন–

    “আই এম সরি।আমার তোমাকে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি।”

    জান্নাহ ঠোঁট ভেঙে বললো—

    “আজ শুধু মাম্মার জন্যই ওই নোংরা লোক আমাকে স্পর্শ করলো।আই হেট মাম্মা।”

    “এভাবে বলেনা ডল।”

    “কেন?

    জাফিন হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—

    “মাম্মা তোমাকে প্রটেক্ট করেছে ।সে জানতো না তার বন্ধু এমন।”

    ভাঙা ভাঙা গলায় জান্নাহ্ বললো—

    “মাম্মা তোমাকে ভালোবাসে না।ওই নোংরা লোকটাকে কী করে পছন্দ করে?

    ফিক করে হাসলেন জাফিন।জান্নাহ্ ভ্রু নাচিয়ে বললো—-

    “হাসছো কেন তুমি?

    জাফিন শীতল গলায় বললেন—

    “তোমার মাম্মা যতটা তোমায় ভালোবাসেন তার চেয়ে একটু কম আমাকে ভালোবাসেন।”

    জান্নাহ্ এপাশ ওপাশ করে ঠোঁট।ভ্রু দুটো কুঞ্চি করে চোখের কোণ ক্ষীণ করে বললো–

    “আজ যদি সারহান আমাকে দেখে ফেলতো!তাহলে কী ভাবতো বলোতো।ভাবতো আমি খারাপ মেয়ে।”

    জাফিন আওয়াজ করে হেসে উঠলেন।সরস গলায় বললেন–

    “তাহলে আমার ডলের এই জন্য রাগ হচ্ছে!

    ঝট করে উঠে দাঁড়ায় জান্নাহ্।সংকীর্ণ গলায় বললো—

    “আরেকটু হলেই সারহান আমাকে দেখে ফেলতো।এই সবকিছুর জন্য মাম্মা দায়ী।জোর করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো।”

    জাফিন চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে তাকালেন।জিঙ্গাসু গলায় বললেন—

    “ডল,তোমার চোখের আরেকটা লেন্স কোথায়?

    জান্নাহ্ গালের উপর থেকে নোনতা জল মুছে ফিকে গলায় বললো—

    “কোথায় যেনো পড়ে গেছে।”

    জাফিন মনমরা হয়ে বললেন–

    “তোমাকে কতোবার বললাম,লেন্স ইউজ করতে না।তবুও।”

    জান্নাহ্ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।চোখ থেকে বাকি লেন্সটা খুলে সন্তর্পনে রাখে।নম্র গলায় বললো—

    “তুমি জানো আই লাভ ঐশ্বরিয়া রায় বচ্চন।তাকে নীলনয়না বলা হয়।তার চোখ আমার পছন্দ।আই উইশ আমার চোখও তার মতো হতো!

    “তাই বলে তুমি সবসময় লেন্স ইউজ করতে পারো না!

    “আমি তো বাইরে গেলে ইউজ করি।”

    জান্নাহ্ নিজের বাবার কাছে গেলো।তার হাত ধরে গদগদ হয়ে বললো–

    “আচ্ছা বাবা,আমাকে কোন চোখের মনিতে ভালো লাগে?
    নীল না কালো।”

    জাফিন দম্ভ করে বললেন—

    “উপরওয়ালা আমার মেয়েকে কোনোদিক দিয়ে কম দেয়নি।তার আর্টিফিসিয়াল কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই।”

    থমথমে হাসে জান্নাহ্।সে ঠিক করে তার প্রাণের সামনে সে এইভাবেই যাবে।সে কী তাকে চিনতে পারবে?কারণ সারহান যখন জান্নাহ্কে একপলক দেখেছিলো তখন জান্নাহ্ এর চোখের মনি নীল ছিলো।

    জান্নাহ্ সারহানের সামনে গিয়ে তাকায়।গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে করে অনুযোগের সুরে জান্নাহ্ বললো–

    “প্লিজ প্রাণ, আমি খারাপ মেয়ে নই।আমি আর কখনো সেখানে যাবো না।”

    জাফিন প্রগাঢ় দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে।তার শান্ত হৃদয়ে হঠাৎ এলোমেলো ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।জাফিনের সমান্তরাল কপাল ধীরে ধীরে কুঞ্চি হতে লাগলো।চোখের দৃষ্টি হতে লাগলো প্রশ্বস্ত।মেয়ের হাবভাব নিয়ে সে ততটা চিন্তিত না থাকলেও এখন তাকে তা ভাবাচ্ছে।জান্নাহ্কে যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার মতো শিক্ষা জাফিন দিয়েছে।কিন্তু তাতে এখন সংকোচ হচ্ছে।ধীরে ধীরে সারহানের প্রতি জান্নাহ্ এর দুর্বলতা বেড়ে চলছে।ছোটবেলা থেকেই নিজের বাবাকে আইডল মানে জান্নাহ্।তাই সারহানের প্রতি তার অ্যাটার্ক্ট হওয়া স্বাভাবিক।কিন্তু জাফিন ভাবছে অন্যকিছু।দুই দুইবার দেখা হওয়া আর সারহানের প্রতি জান্নাহ্ এর ঝুঁকে যাওয়া এটা কী নিছক কো ইন্সিডেন্ট নাকি ভবিতব্য!তার শান্ত,স্থির মেয়ের এমন চঞ্চলতা সত্যিই আশ্চর্যজনক।
    সে যাই হোক।নিজের মেয়েকে জাফিন যাকে তাকে দিতে পারে না।পারে না নিজের মেয়ের মনে জন্ম নেওয়া প্রথম অনুভূতিকে দমিয়ে ফেলতে।জাফিন একবার ভুল করেছে।দ্বিতীয়বার তা করতে পারে না।সে তার মেয়েকে তার মতো সাফার হতে দিতে পারে না।তাই সে মন স্থির করলো।সারহান সম্পর্কে সে খোঁজ নেবে।তার মেয়ে হীরে।হীরে কে নিশ্চয়ই জহুরির হাতে তুলে দিবে সে।
    ,
    ,
    ,
    ল্যাপটপের সাটার অফ করে মাত্রই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জান্নাহ্।একটা কোমল গলা শুনতে পায় জান্নাহ।

    “পরীজান!

    জান্নাহ্ চকিতে দরজার দিকে তাকায়।প্রাণখোলা হাসিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে শরীফ।স্মিতহাস্য অধরে জান্নাহ্ বললো—

    “এসো মামা।”

    শরীফ এসে ভাগ্নীর পাশে বসলেন।মোলায়েম গলায় বললেন–

    “আপনি কী ব্যস্ত?

    জান্নাহ্ সাবলীল ভাষায় প্রত্যুত্তর করে—

    “নাহ মামা।রাফাতের সাথে কথা বলছিলাম।সারাদিন অ্যাসাইমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই ওর সাথে কথা বলতে পারি নি।তোমাকেও সময় দিতে পারি নি।সরি।”

    শরীফ একগাল হেসে বললেন—

    “ইটস ওকে পরীজান।”

    জান্নাহ্ তার অ্যাসাইমেন্টের পেপারগুলো ভাঁজ করে সমান্তরালের রাখে।নম্র গলায় প্রশ্ন করে—

    “মামি কেমন আছে মামা?

    “ভালো।”

    জান্নাহ্ এর মুখটা হঠাৎই চুপসে যায়।নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে ম্লান গলায় বললো—

    “মামির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।”

    শরীফ ভাগ্নীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—

    “এতে আপনার কোনো দোষ নেই পরীজান।যা হওয়ার তা হয়েছে।”

    জান্নাহ্ বিষন্ন গলায় বললো—

    “আপুকে বলেছো?

    শরীফ সরস গলায় বললেন—

    “নাহ।তুমি তো জানো মেহনাজ ভালো নেই।তার উপর এইসব জানলে সে আরো ডিপ্রেসড হয়ে যাবে।”

    জান্নাহ্ এর মনটা ভেঙে আসে।ছোটবেলা থেকেই তার মামি তাকে নিজের মেয়ের থেকে বেশি ভালোবাসে।এর জন্য জান্নাহ্ এর ব্যবহার অন্যতম।জাফিন নিজের মেয়েকে সেভাবেই গড়েছেন।চৌদ্দ বছরের জান্নাহ্ একজন পূর্ণ বয়সী নারীর মতো আচরণ করে।যেকোন পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার দারুন ধৈর্য্য তার।মেহনাজ ছোটবেলা থেকেই একরোখা।ভীষণ অবাধ্য।যা একদম জান্নাহ্ এর বিপরীত।

    শরীফ ক্ষীণ গলায় বললেন—

    “আপনার বাবার সাথে এই বিষয়েই কথা বলতে এসেছি।তিনি বললেন আমাকে আসতে।আমি আপনার মামির সব রিপোর্ট নিয়ে এসেছি।”

    জান্নাহ্ উচ্ছলিত হয়ে বললো–

    “তাই!

    “হুম।”

    প্রসন্ন হলো জান্নাহ্। গালভর্তি হেসে বললো—

    “আমি বিয়ে করছি মামা?

    শরীফের মসৃণ কপালে হালকা ভাঁজ দেখা দিলো।পুরু ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁকড়ে বললেন—-

    “মানে?

    জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে হাসে।মুগ্ধ গলায় বললো—

    “আই এম ইন লাভ।দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি।”

    চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে জান্নাহ্ এর দিকে নির্নিমেশ চেয়ে রইলেন শরীফ।জান্নাহ্ সারহানের পেইন্টিংটা শরিফের হাতে দিয়ে বললো—

    “হি ইজ দ্যা ওয়ান।”

    শরীফ চমৎকার হাসলেন।গাঢ় গলায় বললেন—

    “কে সে?

    “সারহান।সারহান জেইদি।একজন ক্রাইম স্পেশাল জার্নালিস্ট।আর একজন পরোপকারী।জাস্ট লাইক মাই বাবা।”

    “রিয়েলী?

    “ইয়েস মামা।”

    “শরীফ অধর কোণে হেসে বললেন—

    “ছেলে দেখতে তো রাজকুমার।বাবাকে বলা হয়েছে?

    জান্নাহ্ মিটমিট করে হেসে বললো—

    “শুধু বলেনি দেখিয়েওছি।এন্ড হি লাইম হিম।”

    শরীফ যেনো সাত রাজার ধন পেলেন।গৌরবাণ্বিত হয়ে বললেন—

    “এই নাহলে আমার পরীজান!রাফাতকে জানিয়েছো?

    জান্নাহ্ ডিনাই করে বললো—

    “নাহ।বাবা বলেছে আমার হাতে আরো চার বছর সময় আর রাফাত ফিরে আসতেও সময় আছে।তাই আমি ওকে ফিরে আসলেই বলবো।কজ হি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।”

    ঝলমলে হাসে জান্নাহ্।শরীফ তার পরীজানকে দেখে।কত দ্রুত মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে!
    জান্নাহ্ নরম গলায় প্রশ্ন করে—

    “তুমি খেয়েছো মামা?

    “নাতো।”

    “উফ!তাহলে চলো।বাবা রাগ করবে।সাড়ে ন’টা বেজে গেছে।আজও লেট লতিফ হলাম।চলো,চলো।”
    ,
    ,
    ,
    কোকেন নিয়ে দেয়ালের সাথে মাথা হেলিয়ে বসে আছে মৃণালিনী।চোখ দুটো নিমিঝিমি।হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে তা ফুঁকে যাচ্ছে।মহাজাগতিক এক সুখ অনুভব করছে সে।আজ সাতদিন তার বাইরে যাওয়া বন্ধ।জাফিন সংক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মৃণালিনীর দিকে।তার মধ্যে কোন ভাবাবেশ নেই।দিব্যি সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলিতে চোখের সুখবিলাস করছে সে।জাফিন রুষ্ট গলায় শুধায়—

    “তুমি কী এইসব ছাড়বে না?

    মৃণালিনী দেয়ালে ঠেকানো মাথাটা সোজা করলেন।ধোঁয়াতে স্পষ্ট নয় তার চোখের দৃষ্টি।লালিমায় ছেয়ে আছে তা।চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে তাকিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।ঘাড়টাও স্থির রাখতে পারছেন।নেশার্ত গলায় বললেন—

    “ইউ নো দ্যাট,ফর দিস আই হেট ইউ।তোমার এই লোক দেখানো কেয়ারিং ইরেটেটিং লাগে আমার কাছে।”

    জাফিন রেগে উঠে দাঁড়ান।কড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠেন—

    “এটাই আমার দুর্বলতা।তোমাকে আমি আজও ভালোবাসি।এই তোমার কারণে আমার মেয়েটা বোধ হওয়ার পর প্রথম বার কেঁদেছে।আজ পর্যন্ত তার গায়ে একটা ফুলের টোকা পড়তে দেই নি।কিন্তু তোমার কারণে ওই রৌশান আমার মেয়েকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেছে।ভাগ্য ভালো সেদিন ওই ছেলেটা সেখানে ছিলো।নিউজ পেপারে দেখেছি আমি হি ইজ আ ব্ল্যাডি ক্রিমিনাল।আজকের যুব সমাজকে ধ্বংস করতে ওর মতো কতিপয় বাস্টার্ড ই দায়ী।”

    মৃণালিনী থমকালেন।বা’হাতের উল্টো পাশ দিয়ে বেপরোয়া নাক ঘষে গ্যারগ্যারে গলায় বললেন—

    “আমি রৌশান কে বলেছি যা বলার।আই নো,ইটস মাই ফল্ট।আমি বুঝতে পারি নি ও ডলের সাথে এমন কিছু করবে।আমার জানা ছিলো না রৌশান আ ফা** গায়।”

    গর্জে উঠলেন জাফিন।

    “কী বুঝতে পারো নি তুমি!আজ চব্বিশ বছরেরও তোমার বোধদয় হয়নি!আজ তুমি এইটিনের নও।আমার ওই চৌদ্দ বছরের মেয়েও তোমার থেকে বুঝদার।সে নিজের ভালোত বোঝে।”

    মৃণালিনী জাফিনের কথা তোয়াক্কা না করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন—

    “তোমার মেয়ে!হাউ ফানি জাফিন! ওকে জন্ম আমি দিয়েছি।”

    বজ্র গলায় ঘোষণা করে জাফিন—

    “জন্ম তুমি দিলেও ওকে মানুষ করেছি আমি।আগলে রেখেছি আমি।নিজের হাতে তিন বেলা খাইয়েছি আমি।জ্বর হলে সারারাত জেগে থেকেছি আমি।স্কুলে নিয়ে গিয়েছি আমি।আমার মেয়ের শিশু থেকে কিশোরীতে রূপান্তর হয়েছে আমার হাত ধরে।মা হয়ে তুমি কী করেছো?রাতদিন ক্লাব,পার্টি,ড্রাগস,ড্রিংস আর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছো।জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না মৃণাল।”

    মৃণালিনী সারা রুম কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠেন।বললেন—

    “হ্যাঁ,হ্যাঁ,হ্যাঁ।চাইনি আমি ওকে জন্ম দিতে।সাজা দিতে চেয়েছি তোমাকে।আমাকে বন্দি করার সাজা।আমার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার সাজা।আই জাস্ট হেট ইউ।”

    জাফিন নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলেন না।ক্রোশে ফেটে পড়লেন তিন।কড়া হাতে এক চড় বসিয়ে দিলেন মৃণালিনীর গালে।মৃণালিনী যেনো হিংস্র বাঘিনী হয়ে উঠলেন।জাফিনের বুকের দিকটা খামচে ধরে ঘি ঢালা আগুনে তেতে উঠে স্বর বিকৃত করে বললেন—

    “ইউ….।কোন সাহসে তুমি আমার গায়ে হাত দিলে!শুধু এক বিছানায় রাত কাটালেই স্বামী হওয়া যায় না।ভালোবাসলে তার যত্ন করতে হয়।কী করেছো তুমি আমার জন্য।নিজের হসপিটাল,পেশেন্ট,ইমপ্লয়ী নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।আমি কোথায় ছিলাম!কোথায় ছিলাম আমি!

    মৃণালিনী রাগের বশে হিতাহিত ঞ্জানশূন্য হয়ে ধাক্কা মেরে বসলেন জাফিনকে।

    বাবার চিৎকার কানে আসতেই সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর পাশেই তার মায়ের ঘর।মাঝে করিডোর।তার পাশে জাফিনের।কোনো কিছু না ভেবেই উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে জান্নাহ্।থমকে যায় তার পা।বন্ধ হয়ে আসে যেনো তার হৃদকম্পন।পা দুটো অসাঢ় যেনো।জান্নাহ্ এর উদ্ভাসিত দুই চোখ দিয়ে বর্ষণ শুরু হলো।থরথর করে কাঁপতে লাগলো জান্নাহ্।সেই কম্পিত শরীরে ধীম ধীম করে এগিয়ে আসছে সে তার বাবার নিষ্প্রাণ শরীরটার কাছে।ধপ করে নিচে বসে পড়ে জান্নাহ্।কম্পিত হাতটা দ্বিধা আর সাহসের সমন্বয়ে একটু একটু করে জাফিনের বুকের উপর রেখে হালকা ধাক্কা মেরে আদুরে গলায় বললো—-

    “বাবা,ও বাবা।কী হয়েছে তোমার!বাবা,বাবা!
    কথা বলো বাবা।”

    মৃণালিনীর অতর্কিত ধাক্কা সামলাতে পারেনি জাফিন।ভারি সেন্টার টেবিলের কোনায় উল্টো হয়ে পড়ে যাতে করে তার মাথার পেছনে নরম জায়গায়টা টেবিলের কোনা এক ইঞ্চি গেঁথে যায়।গলগলিয়ে উষ্ণ লহুতে ভেসে যায় মেঝে।জাফিন সময় পায়নি তার মেয়েকে শেষ বারের মতো দেখতে।তার প্রশ্বস্ত দুই চোখ যেনো তৃষ্ণার্ত রয়ে গেলো।

    পাশেই মৃণালিনী সমানতালে কেঁপে যাচ্ছে।মাথার চুল খামছে ধরে বোঝার চেষ্টা করছে কী করেছে সে।গলায় কথা আটকে গেছে তার।কথা বলতে গিয়ে অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে।জান্নাহ্ বুক ক্ষনে ক্ষনে থরথরিয়ে যাচ্ছে।ততক্ষনে শরীফ এসে দাঁড়িয়েছে।

    জান্নাহ্ নরম কিন্তু ভয়ংকর স্থির গলায় বললো—

    “কেন মারলে তুমি বাবাকে মাম্মা?কেন মারলে?

    মৃণালিনীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল জলের প্রস্রবণ।থমকে থমকে বললেন—

    “আআআমি ইইইইচ্ছে করে করিনি ডল।বিইইইশ্বাস করো।আমি কককরিনি।”

    জান্নাহ্ নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে ধরা গলায় বললো—

    “বাবাকে মেরে ফেললে তুমি!কেন মারলে মাম্মা?

    মৃণালিনী বড় বড় ঢোক গিলে নিজের সাফাই গাইতে লাগলেন।জান্নাহ্ ঝমঝমিয়ে কেঁদে উঠে।তার কান্নায় যেনো আজ বাতাসও কাঁদতে চায়।সমানতালে কেঁদে বললো—

    “আই হেট ইউ মাম্মা।আই হেট ইউ।ইউ আর আ মার্ডারার।আই নেভার ফরগিভ ইউ।”

    মৃণালিনী মেয়ের হাত ধরে বললেন—-

    “আমার কথা শুনো ডল,আমি ইচ্ছে করে করিনি।জানি না আমার কী হয়ে গেলো।ধাক্কা লেগে…।”

    মৃণালিনী দমকে দমকে কাঁদতে লাগলেন।জান্নাহ্ গা ঝাঁড়া দিয়ে বললো–

    “একদম ছোঁবে না তুমি আমাকে।আই হেট ইউ।আমি এখনই পুলিশ কে কলে করবো।তুমি আমার বাবাকে মেরে ফেলেছো।আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না।কখনো না।”

    মৃণালিনী জোড়াজুড়ি করতে লাগলেন।ভ্যালভ্যাল চাহনিতে সবকিছু হজম করতে কষ্ট হচ্ছে শরীফে।নিজের প্রিয় ভগ্নিপতির এমন নির্দয় মৃত্যু তিনি একদম আশা করেন নি।
    চাপা কষ্টে ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে শরীফের।নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন।আচমকা ঘটে গেলো আরেক ভয়াল কান্ড।জান্নাহ্কে থামাতে গেলে বেপরোয়া ধাক্কায় উল্টে পড়ে মৃণালিনী।পাশে থাকা ছোট টেবিলটার উপর ছিল একটা শ্বেত পাথরের মূর্তি যা একজন তীরন্দাজের।অতর্কিতে মৃণালিনী সেই মূর্তির উপর গিয়ে পড়ে।আর তাতেই সেই তীরের ফলা ঢুকে যায় মৃণালিনীর গলায়।

    জান্নাহ্ এর পুরো দুনিয়ার উল্টে গেলো এক ঝটকায়।চিৎকার করে দম আটকে।

    “মাম্মা!

    শরীফ এসে বোনকে জড়িয়ে ধরলেন।বেশি সময় নিলেন না মৃণালিনী।চোখের ইশারায় মেয়েকে দেখালেন ভাইকে।জান্নাহ্ এর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলেন।মুহূর্তেই নিভে গেলো তার প্রাণ প্রদীপ।জান্নাহ্ তটস্থ পায়ে উপড়ে পড়লো নিজের মায়র উপর।

    “মাম্মা,কথা বলো।মাম্ম,মাম্মা।”

    মৃণালিনী চেয়ে রইলেন তার নিথর দুই চোখ দিয়ে।রক্তে ভেসে গেলো মেঝে।জান্নাহ্ উন্মাদের মতো বিলাপ করতে থাকে।তারা সারা শরীরে রক্ত জড়িয়ে যায়।থরথর করে কাঁপতে থাকে জান্নাহ্।নিজের দুই হাতে বাবা মায়ের রক্ত জান্নাহ্ দিকভ্রষ্টের মতো তাকাতে থাকে।
    প্রলাপ বকতে থাকে—

    “মামা,আমি আমার মাম্মাকে মেরে ফেলেছি।তুমি পুলিশকে কল করো।আমি খুনি মামা।আমি খুনি।”

    হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।শরীফ নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন জান্নাহ্।তার মাথা কাজ করছে না।কী করবেন তিনি।জান্নাহ্ শরীফের বুকে আঁছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঢলে পড়ে তার মামার কোলে।

    শেষ হয়ে যায় জান্নাহ্ এর সুখের ঘর।তার বেস্ট বাবার আর দেখা হলো না তার মেয়ের সংসার।তার বেপরোয়া কিন্তু বুকের গহীনে চেপে রাখা ভালোবাসা পূর্ণ মায়ের জানা হলো না তার ছোট্ট ডল কাউকে ভালোবেসে প্রমাণ করবে ভালোবাসা থাকলে সব সম্ভব।জান্নাহ্ তার প্রাণকে বলতে পারলো না সে তাকে তার বেস্ট বাবার জায়গায় বসিয়েছে।তাই তো সে তাকে এতো ভালোবাসে।জান্নাহ্ এর ছোট্ট শরীরটা নিয়ে সেই লাল রঙের গাঢ় নোনতা লহুর সমুদ্রে বসে রইলো শরীফ।এখন শুধু ভোরের অপেক্ষা।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫৭
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    বিছানার সাথে মাথাটা হেলান দিয়ে গা ছাড়া দিয়ে টানটান হয়ে আছে জান্নাহ্।বিছানার সাইড টেবিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে আগ্রহী চোখ জোড়া আবদ্ধ করে রেখেছে রাফাত জান্নাহ্ এর ওই কোমল মুখের দিকে।নিরুঙ্কুশ চেয়ে আছে সে।জান্নাহ্ নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে।

    রাফাতের মস্তিষ্ক জুড়ে আলোড়ন তুলে দিলো।তার ছোট্ট রেড চেরি এতোটা সহ্য করেছে ভাবতেই তার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে।ভেতরের মানুষটা কাঁদছে হু হু করে।নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে আছে রাফাত।ধীর হাতে গালের পানিটা মুছে জান্নাহ্ বললো—

    “বিশ্বাস করো রাফাত,আমি মাম্মাকে মারতে চাইনি।আমি…।”

    শব্দ করে কেঁদে ফেলে জান্নাহ্।রাফাত জান্নাহ্ এর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললো—

    “এরপর কী হয়েছে?

    জান্নাহ্ কান্নার তোড় গিলে একটু ধাতস্থ হয়ে বললো—

    “মামা পুলিশকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে অ্যাকসিডেন্ট কেস সাজিয়ে দেয়।সবার জানাজানি হলে আমাকে নিয়ে যায় তার সাথে।আর বাবার অবর্তমানে হসপিটালটাওটা বন্ধ করে দেয়।”

    রাফাত ব্যগ্র হয়ে কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—-

    “সারহান!সারহান কী করে এলো এই সবকিছুর মাঝে?

    জান্নাহ্ শান্ত হয়।তার চোখে মুখে ভরসার চিহ্ন ফুটে উঠে।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো—

    “বাবা খোঁজ নিয়েছিলো।সারহান ওদের ডিপার্টমেন্টের বেস্ট ছিলো।মামাকেও বলেছিলো তার সম্পর্কে।মামাকে বলেওছিলো তার বাড়ির খোঁজ নিতে।কিন্তু তার আগেই…।”

    রাফাতের চোখ জোড়া আরো প্রশ্বস্ত হলো।তটস্থ হয়ে বললো—

    “এরপর?

    “আমিই মামাকে বলেছিলাম আমার বিয়ে দিয়ে দিতে।মামা রাজী হয়নি।আমিই তাকে জোর করি।সারহানকে আমি বাবার জায়গায় বসিয়ে আমার শেষ আশ্রয় মেনেছি।মামা অনেক কষ্ট তার বাড়ির ঠিকানা বের করে।বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।ঘটক কে এও বলে বিয়েতে যৌতুকও দিবে যেহেতু মেয়ের কেউ নেই।তারা গ্রামের মানুষ টাকার লোভ সামলাতে পারবে না।সারহান নাকি প্রথমে রাজি হয়নি।কিন্তু তার বাবা,মা জোর করে শুধু আমাকে দেখানোর জন্য পাঠায়।সারহান প্রথম দেখায় আমাকে পছন্দ করে।আর বিয়েতে রাজি হয়।”

    রাফাত অসহিষ্ণু গলায় বললো—

    “সারহান তোমাকে চিন্তে পারে নি।”

    জান্নাহ্ সহজ গলায় প্রত্যুক্তি করে—

    “নাহ।কী করে চিনবে?সে তো আমাকে একবারই দেখেছে।তখন তো আমি সাড়ে চৌদ্দ বছরের ছিলাম।চোখে লেন্স ছিলো।আমি আমার চুল কেটে ছোট করে ফেলেছিলাম।নর্মাল ড্রেস ছেড়ে পড়ছিলাম শাড়ি।ছয় মাসে নিজেকে বদলাতে একটু কার্পণ্য করি নি আমি।”

    লম্বা শ্বাস নিলো জান্নাহ্।রাফাত ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।মাখনের মতো শরীরে কখনো ভুলেও হাত লাগায়নি রাফাত।সেই ছোট্ট রেড চেরি এতো কচি বয়সে বিয়ে করে নিলো।রাফাতের ভেতরকার মানুষটি হঠাৎ বিক্ষিপ্ত হাসলো।তাচ্ছিল্য সুরে তাকে বললো,”একবার কেন বলিসনি তুই ভালোবাসিস তোর রেড চেরিকে?রাফাতের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাস।যা তার এই জন্মের প্রাপ্তি।কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে রাফাতের।গুমোট বাঁধা কষ্ট গুলো একে একে আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার সমস্ত দেহপিঞ্জরে।তার শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছে।অসহনীয় যন্ত্রণা।ক্রমশ নিজেকে ভারী অনুভূত হলো রাফাতের।

    জান্নাহ্ দুটো ঢোক গিললো।তার গলা শুকিয়ে এসেছে।ছোট্ট টেবিল থেকে পানি নিয়ে তা পান করে।পরিষ্কার গলায় বললো—

    “সবকিছুই তো ঠিক ছিলো।সারহান সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছে।বাবার মতো করে আগলে রেখেছে।আমাকে খাইয়ে দিতো।আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো।ক্লাস,টিউশন কোনো কিছুতে বাঁধা দেয়নি।সারহানের বাবা আমাকে নিজের মেয়ের মতো করে ভালোবাসেন,আম্মাও আমাকে কম আদর করেন নি।শুভ্রা আপু নিজের বোনের মতোই ভালোবাসতো।জাবিন তো ছিলো তোমার অনুরূপ।আমার বন্ধু।তিতি আমাকে পরীমা বলে ডাকতো।যতটা হারিয়েছে তার চেয়ে বেশি পেয়েছি।ভালোই তো ছিল সব।কিন্তু!কিন্তু আমার কপালে যে সুখ সয় না।”

    বুক কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।উন্মাদের মতো নিজের চুল খামচে ধরে বললো–

    “সব শেষ হয়ে গেলো আমার।সব।”

    রাফাত অধর ছড়িয়ে শ্বাস নেয়।জান্নাহ্ এর মাথাটা আলগোছে বুকের সাথে চেপে ধরে বিনয়ী গলায় বললো—

    “শান্ত হও।কী হয়েছে খুলে বলো আমায়।”

    জান্নাহ্ পাগলের মতো রাফাতে হাত খাবলে ধরে।জান্নাহ্ এর সমস্ত মুখ ভেজা জবজবে।গলার দিকটাও ভিজে আছে চোখের জলে।চোখ দুটো ফুলে আছে।ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ফর্সা মুখটা।

    “জানো রাফাত,সারহানকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।আমার সারহানও আমাকে খুব ভালোবাসে।সে যা বলেছে আমি তাই করেছে।যেভাবে চেয়েছে সেভাবে তার চাহিদা পূরণ।বিনিময়ে তার বুকে জায়গা দিয়েছে আমাকে।কিন্তু তবুও এমন কেন হলো।আমার ভালোবাসা মিথ্যে কেন হলো!ওরা সবাই আমার সারহানকে কেন আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়!

    অশান্ত হয়ে উঠে জান্নাহ্।তার পুরো শরীরে কম্পন শুরু হয়েছে।রাফাত শক্ত হাতে জান্নাহ্কে চেপে ধরে।জান্নাহ্কে থামানো যাচ্ছে না।তার বুকের ভেতর থেকে কেউ যেনো তার হৃদপিন্ডে বের করে নিয়ে আসছে।সেই যন্ত্রণায় যেনো সে পুরো ধরা কাঁপিয়ে ফেলছে।জান্নাহ্ একটু কান্না কমতেই বলে—

    “দুই মাস পর যখন আমি মামার কাছে আসি তখন মামা বলে সে নাকি সারহানকে কোন মেয়ের সাথে দেখেছে।আমি বিশ্বাস করিনি।আমার সারহান আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না।মামা আরো খোঁজ নেয় এবং তা সত্য হয়।
    কিন্তু তবুও আমি বিশ্বাস করি নি।কী করে করি!এতো প্রেম,এতো ভালোবাসা!সব মিথ্যেতো ছিলো না।”

    জান্নাহ্ ফুঁফাতে থাকে।রাফাত প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।এ কোন রেড চেরিকে সে দেখছে।এইটুকু বয়সেই কাউকে কেউ এতো ভালোবাসতে পারে!জান্নাহ্ কাতর গলায় বলে–

    “তোমার মনে আছে রজত আঙ্কেলের কথা?আমাদের ড্রাইভার।”

    রাফাত ছোট্ট করে বললো—

    “হুম।”

    “শায়িখ ভাইয়ার বাবা সে।আঙ্কেল সবসময় বলতো তার ছেলে বড় চাকরি করে।শায়িখ ভাইয়া সারহানের অ্যাসিস্টেন্ট ছিলো।আঙ্কেল আমাকে অনেকবার তার ছেলের ছবি দেখিয়েছিলো।শায়িখ ভাইয়ার মাকে ছেড়ে আঙ্কেল দ্বিতীয় বিয়ে করে।সেখানে তার কোনো সন্তান ছিলো না।তাই তিনি তাদের কাছে ফেরত যেতে চান।কিন্তু শায়িখ ভাইয়া নাকচ করেন।একটা অ্যাকসিডেন্টে শায়িখ ভাইয়ার বোন মারা যায়।তার মা হসপিটালাইজড হয়।সে প্রায়ই আসতো সারহানের সাথে।একদিন আমি তাকে সাহস নিয়ে সব খুলে বলি।নিজের বোনের জায়গায় বসায় সে আমাকে।আর সব খুলেও বলে।
    সামিরাকে আমি মারতে চাইনি।মামাকে দিয়ে ওকে আমার আর সারহানের বিয়ের কথা বলায়।কিন্তু সামিরা সারহানকে ছাড়ার বদলে আমাকেই ডিবোর্স দিতে বলে।তার ধারণা আমি তো গ্রামের মেয়ে আর সে মডার্ণ।কিন্তু সারহান আমাকে ডিবোর্স দিতে চায়নি।সে আমাকে কিছু জানায়ওনি এই ব্যাপারে।সামিরা মামার কথা বলেনি।কারণ মামা তার পরিচয় দেয়নি।কারো মাধ্যমে আমার আর সারহানে ছবি সামিরাকে পাঠায়।সামিরা ব্ল্যাকমেল করতে থাকে সারহানকে।সামিরার বাবার অধীনেই কাজ করতো সারহান।সেদিন ওই বাংলোতে সারহানের যাওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু কোনো কারণে যেতে পারেনি তা আমাকে শায়িখ ভাইয়াই জানায়।আমি মামাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।ঠিক আমার আসল রূপে।কী করবো বলো,আমি আমার সারহানকে হারাতে পারবো না।সামিরা আমার কথা তো শুনলোই না উল্টো আমাকে মারার জন্য উঠেপড়ে লাগে।মামা বাধ্য হয়ে তাকে আঘাত করে।আর আমিও তখন।”

    ঝরঝর করে অশ্রু বিসর্জন দেয় জান্নাহ্।রাফাতের হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠে।কী বলে তার রেড চেরি!খুন!যেই হাতে মানুষ বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলো সেই হাতে খুন!

    জান্নাহ্ মিইয়ে গলায় বললো—

    “কী করতাম আমি!আমার সারহানের পুরো ক্যারিয়ার শেষ করে দিতো।কেন ছাড়তে চাইছিলো না সে?কেন?আমি বাধ্য হয়েই।আমার কিছুই করার ছিলো না রাফাত।নিজেকে,মামাকে আর সারহানকে বাঁচাতে আমাকে এই ঘৃন্য কাজ করতে হলো।”

    থামলো জান্নাহ্।সমস্ত রুমে থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগলো।এসির ভোঁতা আওয়াজে ঝিমিয়ে উঠে মস্তিষ্ক।গভীর নিঃশ্বাসের আলোড়ন ঘর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।একে অপরের দিকে স্থির চাহনিতে আবদ্ধ দুইজন।

    “তিথি গ্রাম থেকে এসেছিলো।একটা পাবলিক ভার্সিটিতে জার্নালিজমে পড়তো।সারহান ছাড়াও আরো অনেক ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো।ছেলেদের সাথে প্রতারণ করে তাদের থেকে টাকা হাতাতো।ওই স্লাটের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”

    জ্বলে উঠে জান্নাহ্ এর চোখ।হিংস্র হয়ে উঠে তার মুখভঙ্গি।জান্নাহ্ সরব গলায় আবার বললো—

    “মেঘনোলিয়া বিবাহিত সারহান জানতো না।যখন যেনেছে তখন সরে আসতে চাইছিলো।জ্যাকব স্যার ম্যামকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলো।কিন্তু সে সারহানকে ছাড়বে না।শায়িখ ভাইয়া মেঘনোলিয়া ম্যামের কথা জানতো না।কারণ সারহান গ্রামে আসলেই তার সাথে দেখা করতো।আমাকে জাবিন বলেছিলো মেঘনোলিয়ার কথা।আমি শায়িখ ভাইয়াকে জানিয়েছি।মামাকেও সেদিন আসতে বলেছি।তাকে মারতে আমার বেশি বেগ পেতে হয়নি।সে নিজেই আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো।”

    একটা শীতল নিঃশ্বাস ফেলে জান্নাহ্।রাফাতের শ্বাস আটকে আসছে।কী বলছে এইসব!এই ও কী সম্ভব !এক ষোড়শী মেয়ে এতোটা নিঁখুত খুনী!শুধুই ভালোবাসার জন্য?
    জান্নাহ্ গুমোট গলায় বললো–

    “শ্রীজা সারহানের বন্ধু ছিলো।সে সব জানতো।আমি এনজিওতে যেদিন যাই সেদিন জানতে পারি।সে আমার জায়গা নিতে চায় আমার সারহানের জীবনে।কেন তাকেই পেতে হবে তাদের!তাই আমি তাকেও ছাড়িনি।সারহান শুধু আমার,শুধু আমার।আমার সারহানের ভাগ আমি কাউকে দিবো না কাউকে না।”

    ফোঁস ফোঁস করতে থাকে জান্নাহ্।তার স্বরনালী ফেঁপে উঠেছে।চোখে মুখে অদৃশ্য আক্রোশ।দুই চোখের অগ্নিনালায় যেনো ঝলসে দিবে সব।
    চুপ করে থাকে জান্নাহ্।যেনো তার দেহে প্রাণ নেই।রাফাত অনিমেষ চেয়ে আছে জান্নাহ্ এর দিকে।তার ছোট রেড চেরি এতোটা ভয়ংকর !ভাবতেই অন্তরাত্না কেঁপে উঠে তার।

    আচমকাই বিলাপ করে উঠে জান্নাহ্।খসখসে গলায় বললো—

    “সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী।আমি যেখানে যাই সেখানে সবকিছু শেষ হয়ে যায়।আমার জন্যই বাবা মাম্মার সাথে ঝগড়া করেছে।আমার জন্যই বাবা মারা গিয়েছে।আমিই মাম্মাকে মেরে ফেলেছি।আমার জন্যই আমার সারহান আজ এতোটা কষ্ট পেয়েছে।না আসতাম আমি তার জীবনে।সে থাকতো তার মতো।বেঁচে থাকতো।আজ আমি তাকে জীবন্ত মেরে ফেলেছি।আমার জন্যই সে তার পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে।আমি,আমিই দোষী।আমার মা হওয়ার কারণেই তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।এতো পাপ করেছি আমি।ভালোই হয়েছে এই জন্যই আল্লাহ্ আমার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে।আমার সারহান একটা সুযোগ চেয়েছিলো আমার কাছে।আমি পারি নি তাকে বাবা হওয়ার খুশি দিতে।আমার পাপ আমার সব শেষ করে দিলো।অন্ধকারে ঠেলে দিলো আমার সারহানকে আবার।আমি সত্যিই পাপী।সত্যিই পাপী।আমার মরে যাওয়া উচিত,মরে যাওয়া উচিত।তুমি মেরে ফেলো আমাকে রাফাত।তুমি মেরে ফেলো।আমি তোমাকেও কষ্ট দিয়েছে।সবাইকে শুধু কষ্টই দেই আমি।”

    জান্নাহ্ এর বুক ফাঁটা ক্রন্দনে বদ্ধ ঘরের বাতাস যেনো ভারি হয়ে এলো।নিজেকে অসাঢ় মনে হচ্ছে রাফাতের কাছে।কী বলবে সে!কাকে বলবে সে!
    জান্নাহ্কে এইবার আর থামালো না রাফাত।দীর্ঘ দিনের জমে থাকা কষ্ট আজ যেনো বিগলিত হলো।

    জান্নাহ্ কাতর চোখে তাকিয়ে অসহায় গলায় শুধায়—

    “তুমি আমাকে ক্ষমা করবে রাফাত?

    রাফাত তার শ্বাস ফিরে ফেলো।একটু নড়েচড়ে মখমলে গলায় প্রত্যুত্তর করে—

    “তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই ছিলো অভিমান।ভালোবাসায় তো একটু অভিমান জায়েজ।”

    জান্নাহ্ নাক টানতে থাকে।নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে তার।সে তার পাপের সাজা পেয়েছে।হারিয়েছে তার সন্তানকে।রাফাত গাঢ় গলায় বলে উঠে—

    “ইহতিশাম ইশাকের কাজিন।সে এই কেসের ডিকেটটিভ ইনভেস্টিগেটর।আমার সাথে দেখা করেছে সে।আমি তাকে তোমার সব কথা বলেছি।যদি ইহতিশাম জানতে পারে এই খুনগুলোর সাথে তুমি জড়িত।তাহলে?

    জান্নাহ্ বিক্ষিপ্ত হাসলো।হেয়ালি গলায় বললো–

    “আর কী হবে!আমার ফাঁসি হবে।আমার মরে যাওয়াই উচিত।আমি মরে গেলে আমার সারহান বেঁচে যাবে।তাকে আমি অন্য কারো সাথে দেখতে পারবো না।এর চেয়ে ঢের ভালো আমি মরে যাই।আমি জীবিত থাকতে তো আমি তার ভাগ কাউকে দিতে পারবো না।”

    রাফাত খটমটিয়ে উঠে নাকের পাটা ফুলিয়ে বললো—

    “এমন কিছুই হবে না।আমি তোমার কিছুই হতে দিবো না।”

    “কী করে বাঁচাবে আমাকে তুমি? আমি তো খুনী।আমার শাস্তি হওয়া উচিত।”

    “যে শাস্তি পেয়েছো এর চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই।আর এতে তোমার একার দোষ নেই।আমি আছি।তোমার কিছু হবে না।”

    “আমার সারহানকে ফিরিয়ে দিতে পারবে আমায়?সারহানকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।তাকে ছাড়া আমি একটা নিঃশ্বাসও নিতে পারবো না।”

    রাফাত তার শুকনো ঠোঁট জোড়া জীভ দিয়ে ভিজিয়ে ভরসার সুরে বললো—

    “তোমার সারহান তোমারই থাকবে।আমি ব্যবস্থা করবো সব।এখন থেকে আমিও তোমার সাথে আছি।”

    ম্লান হাসে জান্নাহ্।চোখের জলের দাগ লেগে আছে তার মুখে।সমস্ত ঘরে চোখ বুলিয়ে বললো—

    “ঘরের এই অবস্থা করেছো কেন? আর এমন জংলীর মতো হয়ে আছো কেন?”

    ঝরঝরে হাসে রাফাত।খেয়ালিপনায় বললো—

    “তুমি এসে ঠিক করবে বলে।ভালো না হয় নাই বাসলে বন্ধু তো হতে পারো।”

    জান্নাহ্ সংকীর্ণ হাসে।নরম গলায় বললো—

    “যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।আযমর এইসব জংলী অবতার ছেড়ে মানুষ হও।”

    মুখভর্তি হাসে রাফাত।তার ঠোঁটে টান পড়ে।আজ এতোদিন পড়ে হাসায় অস্বস্তি হয় অধরে।চট করে রাফাত বললো—

    “সারহানকে বলে এসেছো?

    “নাহ।”

    “তাহলে?

    জান্নাহ্ উঠে দাঁড়ায়।বিছানার চাদরে হাত লাগিয়ে বলে—

    “প্রয়োজন হলে সে নিজেই আমাকে খুঁজে নিবে।তুমি যাও।আমার খিদে পেয়েছে।”

    রাফাত ফুরফুরে গলায় বললো—

    “ওকে ওকে যাচ্ছি।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫৮
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    স্থির নয়ন জোড়া আবদ্ধ করে সারহানের নির্লিপ্ত মুখের দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে সরফরাজ।এমন একটা কাজ করবে তার ডিপার্টমেন্টের বেস্ট রিপোর্টার সে ভাবতে পারেনি।সরফরাজের গভীর,শীতল দৃষ্টিতেও ভাবান্তরহীন সারহান।
    সরফরাজের নিষ্কম্প মস্তিষ্ক তড়াক করে উঠে সারহানের এমন আবদারে।আগামী এক বছরের জন্য লিভ অ্যাপলিকেশন জমা দিয়েছে সারহান।সরফরাজ থমথমে গলায় বলে উঠেন—

    “এইসবের মানে কী সারহান!এক বছরের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান লিভ অ্যাপলিকেশন মঞ্জুর করে?

    উদ্বেগহীন ঝরঝরে হাসে সারহান।আরেকটা পেপার টেবিলে রেখে মৃদু গলায় বললো—

    “এইটা আমার রেজিগনেশন লেটার।দুটোর যেকোনো একটা এক্সেপ্ট করে বাকিটা পাঠিয়ে দিবেন।আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

    কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই উঠে দাঁড়ায় সারহান।তার সাথে হতবাক দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়ায় সরফরাজ।কৌতূহলী গলায় বললেন—

    ” এইসবের মানে কী সারহান?

    সারহান চট করে হাসি ফুটায় তার পুরু অধরে।নির্বিঘ্ন গলায় বললো—

    “বেঁচে থাকলে আবার ফিরে আসবো স্যার।আপনার কাছে আমি ঋনী।আমার সবচেয়ে দুর্দিনে আপনি যদি আমার পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে আজকের সারহান তৈরি হতো না।নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ করে দিয়েছেন আপনি।থ্যাংকস আ লট।আপনার সুস্থতা কামনা করছি।ভালো থাকবেন।আসি।”

    সরফরাজ ব্যগ্রতায় বারকয়েক ডেকে উঠলেন।কিন্তু সারহানের কর্ণকুহর হলো না তা।নিজের গাড়িতে গিয়ে বসলো সারহান।তার চোখে ভেসে উঠে তার রজনীগন্ধার সেই মায়াবী চোখ।স্বগতোক্তি করে বললো—

    “আই এম রিয়েলী সরি রজনীগন্ধা।আই এম রিয়লী সরি।”
    ,
    ,
    ,
    হু হা করে হেসে ঘর কাঁপাচ্ছে রাফাত।তার হাসিতে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে জান্নাহ্ এর।তার ঘরে ঢোকার গুটি টা খেয়ে দিলো!ফ্যাকাশে চোখে চেয়ে আছে জান্নাহ্।মিটিমিটি হাসছে রাফাত।

    লুডুর ঘরে এখনো জান্নাহ্ এর তিনগুটি অবশিষ্ট।যেখানে রাফাতের একটাই।রাফাতের দৃষ্টি জান্নাহ্ এর চিন্তিত মুখে।আর জান্নাহ্ এর তার গুটিতে।রাফাতের ওই রাক্ষুসে গুটির ভয়াল গ্রাস থেকে নিজের গুটি বাঁচাতে তটস্থ সে।

    রিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।এ কয়েকদিনে যেনো তার ঘরে প্রাণ ফিরে এসেছে।রাফাত হাসছে,খাচ্ছে,কথা বলছে।সেই প্রাণচঞ্চল,প্রাণউচ্ছল রাফাতের প্রাণ সঞ্জিবনী নিয়ে ফিরেছে জান্নাহ্।কাঁদো গলায় বলে উঠে জান্নাহ্–

    “খেলবো না আমি।তুমি আমার সব গুটি খেয়ে দিলে।বেহুদা রাফাত।”

    হা হা করে হেসে উঠে রাফাত।সরব গলায় বললো—

    “জান্নাহ্!তুমি এখন পর্যন্ত কখনো আমার সাথে জিততে
    পারো নি।আজও হারবে।”

    জান্নাহ্ নাক ফুলিয়ে চোখ,মুখ বিকৃত করে পুরো লুডুর বোর্ড এলোমেলো করে ফেলে।রাফাত ফচকে হেসে বললো—

    “হারু পার্টি।”

    “বেহুদা রাফাত।মেরেই ফেলবো আজ তোমাকে।”

    জান্নাহ্ বসা থেকে উঠতেই ডোর বেল বাজে।চকিতে সবাই সেইদিকে দৃষ্টি ক্ষেপন করে।ড্রয়িং রুমেই বসা ছিলো রাফাত আর জান্নাহ্।রিতা কিচেন থেকে দ্রুত পা চালিয়ে আসেন।জান্নাহ্কে বসতে বলে দরজা খুলে দাঁড়ায় রাফাত।রাফাতের বিস্ময় আকাশ ছুঁলো।অধরে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারহান।হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে জিঙ্গেস করলো—

    “কেমন আছো রাফাত?

    বিস্ময় কাটাতে খানিকটা সময় নিলো রাফাত।হতচকিত চোখ জোড়া স্থির হয়ে রইলো।হাসি হাসি মুখটার হৃদয়খোলা হাসি যেনো কোথায় মিলিয়ে গেলো!
    অপ্রভ গলায় প্রত্যুত্তর করে রাফাত—

    “ভালো।তুমি?

    সারহান চোখে হেসে নরম গলায় বললো—

    “ভেতরে আসতে বলবে না?

    হতভম্ব রাফাত কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।মিইয়ে গলায় বললো–

    “এএএসো।”

    স্মিত হাসে সারহান।ঘরে প্রবেশ করেই তার নয়নযুগল আটকে যায় জান্নাহ্ এর দিকে।থমথমে মুখ তার।জান্নাহ্ এর কাছে গিয়ে হৃদয় গলানো হাসি দিয়ে বললো—

    “কেমন আছেন রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ্ বেশ কিছু সময় অনিমেখ চেয়ে রইলো তার প্রাণের দিকে।চোখ দিয়ে জল ছাপিয়ে আসে জান্নাহ্ এর।সারহান অদ্ভুত কান্ড করে বসে।দুই হাতে ঝাঁপটে ধরে জান্নাহ্কে।রিতা নিজের ছেলের দিকে তাকায়।রাফাত তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়।ছেলের চাপা আর্তনাদ শুনতে বেগ পেতে হলো না রিতার।বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নেয় সারহান।জান্নাহ্কে ছেড়ে দাঁড়ায় সারহান।মিষ্টি সুরে বললো—

    “চলুন রজনীগন্ধা।আমি আপনাকে নিতে এসেছি।”

    আলতো করে জান্নাহ্ এর হাত ধরে সারহান।রিতা কে কৃতজ্ঞতা জানায়।রাফাতকে বললো–

    “থ্যাংকস।আমার রজনীগন্ধার খেয়াল রাখার জন্য।”

    রাফাতের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে।খুশিতে আত্নহারা দুই চোখ মুহূর্তেই উত্তাল সমুদ্রে রূপ নেয়।কিন্তু ঢেউ উপচে আসার আগেই নিজেকে সতন্ত্র করে রাফাত।সে তার রেড চেরিকে খুশি দেখতে চায়।রাফাতের দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।চোখে হেসে অধর ছড়ায় রাফাত।হাত উঠিয় ইশারা করে।চোখের ভাষা বুঝে নেয় জান্নাহ্।রাফাত বলছে,আমি ভালো আছি রেড চেরি।তুমি ভালো থাকলেই তোমার বেহুদা রাফাত ভালো থাকবে।খুব ভালো থাকবে।”

    গাড়ি চলছে তার নিজ গতিতে।জান্নাহ্ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।গাড়িতে উঠে আর একটা কথাও বলে নি সারহান।ধরা গলায় ডেকে উঠে জান্নাহ্—

    “সারহান!

    গাড়ির স্প্রীড বাড়ায় সারহান।কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না সে।হালকা হালকা কেঁপে উঠে প্রস্ফুরিত গলায় আবার ডেকে উঠে জান্নাহ্—

    “সারহান!

    চট করে রেডিও অন করে সারহান।গাড়ির গতিও বৃদ্ধি পায়।সারহান যেনো তার সুপ্ত রাগে পিষে ফেলবে গাড়িকে।রেডিওতে তখন গান হচ্ছে।

    “পৃথিবীর যত সুখ,যত ভালোবাসা
    সবই যে তোমায় দেবো একটাই আশা,
    তুমি ভুলে যেওনা আমাকে…
    আমি ভালোবাসি তোমাকে….।

    সারহানের এহেন ব্যবহারে আর কোনো কথা বললো না জান্নাহ্।খোলা জানালায় মুখ দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো।জান্নাহ্ এর শঙ্কিত মনে একটা প্রশ্ন উদয় হয়।সারহানের গাড়ি শহর ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে।কোথায় যাচ্ছে সারহান?
    ,
    ,
    ,
    শহর থেকে দূরে একটা কৃত্তিম নদীর থেকে মাইল খানেক দূরে একটা বাংলো বাড়ি।প্রায় কয়েক একর জমির উপর বাংলোটি।চারপাশে সবুজের সমারোহ।বড় বড় দেবকাঞ্চন,রাধাচূড়া,রেইনট্রির আরো বিভিন্ন পাহাড়ি আর ফলের গাছ লাগানো বাংলোর একপাশে।বিশাল বাংলোটির বাইরের সদর দরজাটিও বিশাল।যেনো বাড়িটির জন্যই সে উপযুক্ত।আশপাশ একদম অনিকেত প্রান্তর।বাংলো থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা টাওয়ার।আশেপাশে ফসলি জমি।

    সারহানের গাড়ি এসে থামে বাংলোটির সামনে।শান্ত পা দিয়ে বাইরে নেমে আসে জান্নাহ্।তার চোখে মুখে উছলে উঠছে হাজারো প্রশ্ন।সারহান কোনো কথা বললো না।জান্নাহ্ও কোনো কথা বললো না।সারহানকে অনুসরণ করতে লাগলো।বিশাল সদর দরজায় ডাসা এক তালা লাগানো।সেইটা খুলেই ভেতরে প্রবেশ করে সারহান সাথে বিনাবাক্যে জান্নাহ্।বাংলোর দরজা খুলে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে জান্নাহ্।বাংলোর বাইরেটা মিহি হলুদ আর ভেতরটা সাদা আর মিহি গোলাপী রঙের।আধুনিক ইন্টিরিয়র ডিজাইন।বাংলোতে ঢুকতেই প্রশ্বস্ত লিভিং রুম।এর একপাশের দেয়ালে জান্নাহ্ এর ছবিতে দেয়াল ভরা।আরেক পাশে দেশী-বিদেশী বড় বড় চিত্রকরদের চিত্রকর্ম।দরজার দুই পাশেই দুটো মানব আকৃতির সমান এন্টিং ফুলদানি।কৃত্তিম ফুল তাতে।দরজার বাম দিকটার কোণার দিকে কিছু জায়গা জুড়ে ফলস গ্রাস কার্পেট বিছানো।তাতেই দাঁড় করানো সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য আনয়িত কৃত্তিম বাঁশঝাড়।যা দেখলে প্রথম দেখায় মনে হবে একদম বাস্তবিক।তার পাশেই দৈত্যাকৃতির একুরিয়াম।ডান দিকে দেয়াল ঘেঁষেই কাউচ।কাউচের সাথে লাগোয়া একটা শ্বেত পাথরের অর্ধ বিবসনা আবেদনময়ী নারীর মূর্তি।জান্নাহ্ আলতো পায়ে মূর্তিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ধীর হাতে তাকে ছুঁয়ে দেখে।ধবধবে সাদা মূর্তিটির বুকের খানিকটা অংশ দৃশ্যমান।তাতেও যে তার কামনা উপচে পড়ছে।

    ধীর গলায় প্রশ্ন করে জান্নাহ্—

    “এইটা কোথায় থেকে এনেছেন সারহান?

    সারহান ততক্ষনে জান্নাহ্ এর পেছনে এসে দাঁড়ায়।তার কোমর জড়িয়ে বুকের সাথে পিঠে ঠেকিয়ে কাঁধে চিবুক রেখে ফিসফিসিয়ে বললো—

    “আমেরিকা।আপনার পছন্দ হয়েছে?

    জান্নাহ্ অস্ফুট স্বরে বললো–

    “হুম।”

    সারহান জান্নাহ্ এর গলার দিকটায় অধর ছোঁয়ায়।তার শুকনো ঠোঁটের স্পর্শে সরব হয়ে উঠে জান্নাহ্ এর থিতিয়ে থাকা অনুভূতি।সচল হয়ে উঠে জমাট বাধা রক্তকণিকা।জান্নাহ্ ঘুরে দাঁড়ায়।ক্ষীণ গলায় বললো—

    “এইটা কার বাড়ি সারহান?

    সারহান হালকা ঝুঁকে জান্নাহ্ এর ললাটে অধর ছোঁয়ায়।মোলায়েম গলায় বললো—

    “আমাদের।সারহান আর তার রজনীগন্ধার।”

    জান্নাহ্ কিঞ্চিৎ উৎসুক গলায় বললো—

    “মানে?

    সারহান সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে।জান্নাহ্কে ঘুরিয়ে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বললো—

    “এনজিও প্রতিষ্ঠাতার প্রিয় বাংলো এইটা।এইটা উনি আমার নামে করে গেছেন।আমার ফ্ল্যাটটা আমি বিক্রি করে দিয়েছি।আজ থেকে আমরা এখানে থাকবো।চলুন,ভেতরে দেখবেন।”

    জান্নাহ্ কে ভেতরে নিয়ে যায় সারহান।লিভিং রুম থেকে সামনের দিকে প্রশ্বস্ত করিডোর।তার একপাশে সংকীর্ণ করিডোর হয়ে গেলে সেখানে একসাথে তিনটি বেডরুম।শেষের রুমটার সাথে একটা খোলা বারান্দা।যা থেকে পেছনের দিক সম্পূর্ণটা অবলোকন করা যায়।উত্তর দিকের করিডোর দিয়ে গেলে একটা মাষ্টার বেডরুম।দু’দিকে বড় জানালা।যেপাশে বারান্দা তার বিপরীত পাশে বাইরের দিকে বারান্দা।সেখানে ক্যাচিগেট লাগানো।কিন্তু রুমের সাথে মোটা কাঠের দরজা।ইচ্ছে করলেই এই রুম থেকে সরাসরি বাংলোর বাইরের দিকে যাওয়া যায়।বাংলোর পেছন দিকে সমান্তরালে দুটো ঘর।সেই ঘরগুলো একটাই জয়েন্ট খোলা বারান্দা।বর্ষার দিনে এখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকে ছুঁয়ে তার সৌন্দর্য আস্বাদন করা যায়।এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় ধোঁয়া উঠা এক মগ কফি আর দুরের নদীর সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেনো হৃদয়গ্রাহী।

    জান্নাহ্ সেই মাষ্টার বেডরুমে এসে বাইরের বারান্দার সেই জানালার পাশে দাঁড়ায়। সফেদ পর্দাটা একটানে সরাতেই ঝলমলে দিনের আলো ধেই ধেই করে চোখে বিঁধে গেলো জান্নাহ্ এর।এতোটা স্বচ্ছ থাই হওয়াতে তা খোলার প্রয়োজন বোধ করলো না জান্নাহ্।নিশ্চল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলো।হালকা হাওয়ায় দুলছে আমগাছের পাতা।আমগুলো স্থির।পাশে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছে রক্ত বর্ণীয় ফুল।জান্নাহ্ তার পেছনে ভারি বাতাস অনুভব করে।পেছন ফিরতেই সারহান তার অধর ছুঁইয়ে ধরে জান্নাহ্ এর অধরে।ভড়কে যায় জান্নাহ্।একগাল হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সারহান।মোহনীয় গলায় বললো—

    “ভয় পেয়েছেন রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ্ নিঃশব্দে চোখের পলক ফেলে বললো—

    “আপনি কী আমার উপর রেগে আছেন?

    “কেন?

    ” আমি আপনাকে না বলে চলে গিয়েছিলাম।”

    সারহান অধর কোণে হাসে।চঞ্চল গলায় বললো—

    “নো,মাই ডিয়ার রজনীগন্ধা।”

    জান্নাহ্ ছোট্ট ঢোক গিলে থমথমে গলায় জিঙ্গেস করে–

    “আপনি কী আমাকে সন্দেহ করেন?

    সারহান নাক টানে।জান্নাহ্ এর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললো—

    “আই ট্রাস্ট ইউ।আমি জানি,আমার রজনীগন্ধা তার জীবনে আমার জায়গা কাউকে দিবে না।”

    জান্নাহ্ আলগোছে দুর্বল হাতে সারহানকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।অতি আদরে মাথাটা রাখে সারহানের বুকে।চোখ ভরে আসে তার।তার জীবনটা এমন না হলেও পারতো।এই মানুষটার ভালোবাসার একমাত্র অধিকারীনি সে হলেও পারতো।তার ভালোবাসার ছোঁয়া শুধু তার জন্য হলেও পারতো।
    কিন্তু কেন হলো না!সে তো সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে এই মানুষটাকে।খামতি তো রাখেনি।তাহলে?

    সারহানের পিঠের দিকটা জ্বলে উঠে।নিজের অজান্তেই ক্রন্দনরত জান্নাহ্ সারহানকে খামচি মেরে ধরেছে।সারহানের বুকের দিকটায় আর্দ্রতা অনুভব করে সে।সারহানের বুক ফুড়ে বেরিয়ে আসে এক সমুদ্র গ্লানিভরা দীর্ঘশ্বাস।নিজের হাতের বাঁধন জোরালো করে সারহান।তার বক্ষপিঞ্জিরায় আবদ্ধ হয় জান্নাহ্ নামের ছোট্ট পাখি।

    আদুরে গলায় সারহান বললো—

    “রজনীগন্ধা!চেঞ্জ করে নিন।আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি।”

    জান্নাহ্ সারহানের বুক থেকে মাথা তোলে।চোখে হাসে সারহান।ওয়াল আলমিরা খুলতেই চক্ষু ছানাবড়া জান্নাহ্ এর।তার জন্য শাড়ির বদলে স্কার্ট,টপস,সালোয়ার কামিজ,স্লিভলেস ড্রেস রাখা।চকিত গলায় শুধায় জান্নাহ্—

    “এইসব কী সারহান?

    সারহান আলমিরার সাথে হেলান দিয়ে সাবলীল গলায় বললো—

    “এইটা আপনার শশুড় বাড়ি নয়।আপনার বাড়ি।আপনার যা ইচ্ছে তাই পড়বেন।জলদি ফ্রেশ হয়ে আসুন।আমি অপেক্ষা করছি।”

    জান্নাহ্ অবাক দৃষ্টিতে সব দেখে।এইসব কাপড় পরা ছেড়েছে আজ অনেকদিন।জান্নাহ্ এর তার বাবার কথা মনে পড়লো।কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ে জান্নাহ্।এখন আর সে তার বাবার ডল নয় এখন সে একজন খুনি।ঘোলা চোখে জান্নাহ্ এর চোখ যায় আলমিরার নিচের দিকটায়।একজোড়া গোলাপী স্ক্যাকার্স।অচঞ্চল হাতে তা নেয় জান্নাহ্।হাত বুলাতে থাকে।তার মাম্মা তার জন্মদিনে গিফ্ট করেছিলো এমন একজোড়া স্ক্যাকার্স।ভীষণ পছন্দ ছিলো তা জান্নাহ্ এর।বুক ভেঙে কান্না আসে জান্নাহ্ এর।মাম্মা,বাবা বলে কাঁদতে থাকে।কে শুনবে তার কান্না?
    কেউ নেই তার।কেউ না।

    টেবিলে দু হাতের উপর চিবুক লাগিয়ে জান্নাহ্ এর দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে সারহান।কাটা চামচের মাথায় হালকা একটু অমলেট নিয়ে মুখে দেয় জান্নাহ্।গাঢ় গলায় জিঙ্গেস করে—

    “এভাবে কী দেখছেন?

    সারহান মুচকি হেসে বলে—

    “এই ড্রেসে আপনাকে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।”

    জান্নাহ্ তাচ্ছিল্য সুরে বললো—

    “বিয়ের সময় মনে ছিলো না?

    “তখন তো এইভাবে দেখিনি।”

    “কীভাবে দেখেছেন?

    সারহান আলতো হেসে বললো–

    “কামুক দৃষ্টিতে।”

    “আর এখন?

    “ভালোবাসার দৃষ্টিতে।”

    জান্নাহ্ গম্ভীর গলায় বললো–

    “ভালোবাসেন আমাকে?

    “উঁহু।আমার রজনীগন্ধাকে ভালোবাসি।”

    জান্নাহ্ মুখ ভার করে বললো–

    “আমি আপনার রজনীগন্ধা নই।”

    “জানি।আপনি তো ফুলনদেবী।”

    জান্নাহ্ উৎসুক গলায় বললো–

    “সেইটা কী?

    “জানি নাতো।”

    “কী জানেন?

    “আপনাকে ভালোবাসতে।”

    বিনাশব্দে উঠে দাঁড়ায় জান্নাহ্।তার চোখে মুখে থমথমে ভাব।বিরস অঙ্গভঙ্গি।গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে জান্নাহ্—

    “কাজে যাবেন না?

    সারহান বিক্ষিপ্ত হেসে বললো—

    “জবটা আমি ছেড়ে দিয়েছি রজনীগন্ধা।”

    জান্নাহ্ উদ্বিগ্ন গলায় বললো—

    “কেন?

    জান্নাহ্কে বুকে টেনে নেয় সারহান।কোমল গলায় বললো—

    “গত এক বছরে আপনার কাছ থেকে যা কেড়ে নিয়েছি তা ফিরিয়ে দিবো আপনাকে।আগামী এক বছর আমি আপনার সাথে আপনার ছায়া হয়ে থাকবো।এতোদিন যে দেহকে ভালোবেসেছি আমি আজ থেকে তার হৃদয়কে ভালোবাসবো।”

    জান্নাহ্ কিছু বললো না।মুখ গুঁজে রইলো সারহানের বুকে।সারহান জান্নাহ্ এর মাথায় চুমু খায়।নির্বিকার গলায় বললো–

    “আপনাকে আজ এক জায়গায় নিয়ে যাবো।”

    সারহানের বুক থেকে হালকা মাথা উঠিয়ে জান্নাহ্ বললো–

    “কোথায়?

    “প্রেমের সমাধিতে।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৫৯
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    পশ্চিমাংশের দিকে ধাবিত হচ্ছে সূর্য।ঝলমলে নীল আকাশ একটু একটু করে ধূসর রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছে।গনগনে সূর্য তার তেজস্বী ভাব গুটিয়ে নিয়ে ম্রিয়মান রোদে রাঙাতে ব্যস্ত কিশোরী বিকেলকে।

    একটা অনাথ আশ্রমের সামনেই নরম সবুজ ঘাসের উপর কিলকিল করছে কয়েক ডজন ছোট্ট বাচ্চা।
    তাদের দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে জান্নাহ্।মুখ ভর্তি তিক্ত অনুভূতি নিয়ে বললো—

    “আমরা এখানে কেন আসছি সারহান?

    সারহান স্মিতহাস্য অধরে বললো–

    “কিছু দেখাবো আপনাকে।”

    সারহান দুরে দাঁড়ানো মারশিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বললো–

    “ওই যে দেখতে পাচ্ছেন,তার নাম মারশিয়াদ আরজান।তাকে তার স্ত্রী জান বলে ডাকে।কিন্তু তার মুখের যে আদল সেইটা তার স্ত্রীর রাহান ভাইয়ার।”

    গোল গোল চোখ করে তাকায় জান্নাহ্।সন্দিহান গলায় জিঙ্গেস করে—

    “আমি বুঝিনি।”

    সারহান মারশিয়াদ,প্রহর,আজরাহানের ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী শোনায়।বিস্ময়ে ক্রমাগত জান্নাহ্ এর চোখ জোড়া পূর্ণ প্রকাশিত হয়।সে আবেগপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে মারশিয়াদের দিকে।তার অবাক লাগে,যে মানুষটাকে সে সামনে দেখছে সে আসলে সে নয় যাকে সে দেখছে।এভাবেও কেউ ভালোবাসতে পারে!নিজেকে বিসর্জন দিয়ে!
    আর রাহান ভাইয়া!সে কী করে পারলো নিজের ভালোবাসাকে সজ্ঞানে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে!জান্নাহ্ তো তা পারবে না।সে তার প্রাণের ভাগ কাউকে দিতে পারবে না।
    জান্নাহ্ এর কানের কাছে আচমকাই ফিসফিসিয়ে উঠে সারহান।বললো-“আমি কিন্তু এতোটা সুহৃদ নই।আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলেও আমার রজনীগন্ধাকে আমি অন্য কারো হাতে তুলে দিবো না।”

    জান্নাহ্ এর পায়ের কাছে এসে থামে ছয় সাত বছরের একটি ছেলে।ছোট ছোট চোখে মুগ্ধ হয়ে দেখে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ হাঁটু ভেঙে নিচে বসে।বাচ্চাটির গালে হাত দিয়ে আদুরে গলায় বললো–

    “কী নাম তোমার?

    বাচ্চাটি ফিক করে হেসে আমুদে গলায় বললো–

    “আজরাহান।”

    জান্নাহ্ বিস্ফোরিত চোখে তাকায়।সারহান এক হাটু ঘাসের উপর ঠেকায়।আরেক পায়ের হাঁটু ভেঙে বসে।আজরাহানের গাল টেনে বলে–

    “কেম আছো আজরাহান?

    খুশি খুশি গলায় উত্তর করে আজরাহান।

    “ভালো।তুমি কেমন আছো আঙ্কেল?

    “ভালো।”

    জান্নাহ্ উদ্বেগপূর্ণ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

    “ও আপনাকে চিনে?

    সারহান গালভর্তি হেসে বললো—

    “হুম।যতবার এখানে এসেছি আজরাহান মারশিয়াদের সাথেই ছিলো।”

    আজরাহান ঝলমলে হাসে।জান্নাহ্ এর হাত ধরে টানতে টানতে বললো—

    “এসো আন্টি,এসো।”

    প্রহর মাঠের মধ্যে বসে প্রহরিনীকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।প্রহরিনী না খেয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে দৌঁড়ে দৌঁড়ে খেলছে।বিকেল বেলায় বাচ্চাদের হালকা খাবার খেতে দেওয়া হয়েছে।জান্নাহ্ ও বসে আছে তাদের সাথে।তার পাশেই সারহান।বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন খেলনা আর খাবার নিয়ে এসেছে।মারশিয়াদ আশ্রমের কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলছে।অসহায় গলায় ডেকে উঠে প্রহর—

    “জান!

    মারশিয়াদ কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলা শেষ করে প্রহরের কাছে এসে দাঁড়ায়।সংকীর্ণ গলায় বললো–

    “কিছু বলবেন?

    “দেখুন না প্রহরিনী খাচ্ছে না।”

    মারশিয়াদ এলোথেলো হয়ে দৌঁড়ানো প্রহরিনীকে খপ করে ধরে বললো—

    “দুষ্ট পরী,মাম্মাইকে জ্বালাচ্ছেন কেন?

    “বাব্বাই!

    মারশিয়াদ প্রহরিনীর গালে টুপটুপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে ওকে নিয়ে আসন পেতে প্রহরের সামনে বসে।হাসি হাসি গলায় বললো—

    “আমি ধরে রেখেছি আপনি খাওয়ান।”

    প্রহর ভ্রু কুঞ্চি করে বললো—-

    “ধুর!

    জান্নাহ শ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে।আনমনেই এক হাত দিয়ে সারহানের পায়ের দিকটায় খাবলা মেরে ধরে।সারহান ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো–

    “ভয় পাচ্ছেন রজনীগন্ধা?ভয় পাবেন না।আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।”

    থমথমে চোখে তাকায় জান্নাহ্।তার সত্যিই ভয় হয়।মারশিয়াদের আশ্রমের গুটিকতক বাচ্চা আনার ব্যবস্থা করেছে সারহান।তার এনজিওতে আপাতত ওভারলোড।আর সংস্কারের কাজ চলছে।মারশিয়াদের সাথে এমন একটা কেসেই সারহানের পরিচয়।জান্নাহ্ প্রহরের কাছে গিয়ে প্রহরিনীকে আদর করে বললো—

    “কেমন আছেন আপনি?

    প্রহর নিষ্প্রভ গলায় বললো—

    “ভালো।”

    জান্নাহ্ চোখে হাসে।এমন কখনো হয়!একজনকে ভালোবেসে অন্যজনের সাথে সংসার করা।
    মারশিয়াদের সাথে কথা বলা শেষ করে সারহান।জীবন্ত প্রেমের সমাধি দেখে জান্নাহ্। এক জনের মৃত্যুতে তিন জনই মরে বেঁচে আছে।
    ,
    ,
    ,
    রেস্টুরেন্টে বসে খাবারে চামচ দিয়ে বসে আছে জান্নাহ্।উসখুস করছে তার মন।সারহান চিন্তিত গলায় বললো—-

    “কী হলো রজনীগন্ধা!খাচ্ছেন না কেন?
    ফিরতে হবে আমাদের।”

    জান্নাহ্ চোখ-মুখ বিকৃত করে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—-

    “আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

    সরল নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।গম্ভীর গলায় বললো–

    “খেয়ে নিন রজনীগন্ধা।সারাদিন কিছুই খান নি।বাসায় কিন্তু রান্না করা নেই।”

    চকিতে নিজের পিঠে বলয় আকৃতির কিছু একটা স্পর্শ পায় জান্নাহ্।পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে দুই -তিন বছরের একটা বাচ্চা ছেলে।ভয়ে জড়সড় হয়ে এসে তার বলটা হাতে নেয়।জান্নাহ্ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।বেশ মিষ্টি বাচ্চাটা।জান্নাহ্ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই বাচ্চাটি অনুযোগের সুরে বললো–

    “সলি,আননি।”

    না চাইতেও হাসতে বাধ্য হয় জান্নাহ্।বাচ্চাটির টসটসে গাল ধরে বললো–

    “কী নাম তোমার?

    “আমাদ।”

    জান্নাহ্ আহ্লাদী হয়ে আমাদ এর কপালে চুমু খায়।কিন্তু তার বিপরীতে অস্বস্তিকর অঙ্গভঙ্গি করে আমাদ।বললো—

    “নো,পাপ্পি।”

    জান্নাহ্ ঘাবড়ে যায়।অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন করে —

    “কী হয়েছে?

    আমাদ তার কপালে হাত ঘষতে থাকে।পেছন থেকে চিকন কন্ঠ স্বর ভেসে আসে।

    “ওর বাবাই ছাড়া কেউ ওকে কপালে চুমু খায় সেটা আমাদ পছন্দ করে না।”

    জান্নাহ্ ধীরগতিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।নরম চোখে তাকায়।দেখে শ্যামবর্ণের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখে মুখে উজ্জ্বলতা।স্নিগ্ধ একটা হাসি অধরে।চোখের তারায় যেনো ঝলমলে আকাশের তারা খসে পড়ছে।জান্নাহ্ বিনয়ী গলায় বললো—

    “সরি।”

    আম্বের নিরুদ্বেগ গলায় বললো—

    “ইটস ওকে।বাবাইয়ের পাগলা তো তাই।আমি ওর মা।আম্বের।এই যে দেখছেন ওর হাতের বলটা।ঘুমাতে গেলেও বিছানায় পাশে রেখে ঘুমায়।কারণ এটা তার বাবাই দিয়েছে।”

    জান্নাহ্ ফিকে হাসে।ততক্ষনে মাহাদ এসে দাঁড়ায় আম্বের এর পাশে।ঝরঝরে হেসে আমাদকে কোলে তুলে নেয়।মসৃণ গলায় বললো–

    “হ্যালো!

    মাহাদ হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালেও জান্নাহ্ এর ভাবান্তর হলো।আম্বের অপ্রস্তুত হয়।মাহাদের পেটের মধ্যে কনুই দিয়ে ঘুষি মেরে মেকি হাসি দিয়ে মাহাদকে চাপা সুরে বললো—

    “মেয়ে মানুষ দেখলেই হ্যান্ডশেক করতে ইচ্ছে করে!

    মাহাদ মুখটা আম্বেরের কানের কাছে নিয়ে বললো—

    “হ্যান্ডশেক ই করতে চেয়েছি চেস্টশেক নয়।”

    আম্বের ত্রস্ত হয়ে বললো—

    “চুপ করুন।ঠোঁট কাটা পুরুষ।”

    “হায়!আজকাল আপনার মুখে পুরুষ শব্দটা না শুনলে আমি ভুলেই যাই আমি পুরুষ হয়ে জন্মেছি।”

    আম্বের জ্বলন্ত চোখে তাকাতেই নিভে যায় মাহাদ।ফিচেল হেসে বললো–

    “নাহ।মানে আমাদ আমারই ছেলে তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই।”

    আম্বের মৃদু গলায় জান্নাহ্কে বললো—

    “আপনি কিছু মনে করবেন না।মাহাদ এমনিতেই ফান করে।”

    মাহাদ ব্যগ্র গলায় বললো—-

    “সরি মিস।”

    মাহাদের কথার পিঠেই বলে উঠে জান্নাহ্—

    “মিসেস।মিসেস জান্নাহ্।”

    জান্নাহ্ এর পাশে এসে দাঁড়ায় সারহান।উষ্ণ ভাব বিনিময়ে বললো–

    “শী ইউ মাই ওয়াইফ।আই এম সারহান।সারহান জেইদি।”

    মাহাদ প্রত্যুত্তরের বললো–

    “মাহাদ আবইয়াজ।”

    “জানি।একসময় কার মেয়েদের ক্রাশ।”

    মাহাদ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো—

    “এখন দেয়ালের ব্রাশ।”

    চোখে হাসে সারহান।মাহাদ আম্বেরকে তাড়া দিয়ে বললো—

    “চলুন মিস সুগন্ধি।দেরি হচ্ছে আমাদের”

    “হুম।আসি মিসেস জান্নাহ্।বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।”

    জান্নাহ্ নিজেকে হেলিয়ে দেয় সারহানের বুকের একপাশে।চিবুক উঁচু করে অসহায় চোখে তাকায় সারহানের দিকে।
    মাহাদ আর আম্বের তাদের যাওয়ার পথ ধরে।মৃদু হেসে ফিচেল গলায় বললো মাহাদ—

    “বাহ!দেশ কোথায় এগিয়েছে দেখেছেন।এমন কচি বউ থাকলে জীবনটাই স্বর্গ।”

    আম্বের দমদমে গলায় বললো—

    “ও আচ্ছা!বুড়ো বয়সে টসটসে,কচকচে বউ পেতে ইচ্ছে হচ্ছে!

    “বুড়ো হতে যাবো কেন?

    “নাহ,তা কেন।আপনি তো বুড়ো খোকা।এই যে নাক টিপলে তরতর করে দুধ পড়ে।”

    “দুধ পড়বে কেন?
    অন্যকিছুও পড়তে পারে।”

    “ইউ,অসভ্য পুরুষ!চুপ করুন।”

    জান্নাহ্ নির্নিমেখ চেয়ে আছে।কাতর গলায় বললো—-

    “সবার খুশির ঝুড়িই পরিপূর্ণ।শুধু আমাদের ঝুড়িটাই পূর্ণ হলো না কেন সারহান।”

    “ধৈর্য্য ধরুন রজনীগন্ধা।সব হবে।”
    ,
    ,
    ,
    এক সপ্তাহ অতিবাহিত হতে সময় লাগলো না।জান্নাহ্ নিজেকে একটু একটু করে স্ট্যাবল করার চেষ্টা করছে।নিজের অবচেতন মনে করা ভুল আজকাল তাকে বড্ড পোড়ায়।নিজের সন্তানকে হারিয়ে জান্নাহ্ উপলব্ধি করেছে যা সে করেছে তা ভুল।
    কিন্তু কী করতো সে।অথৈ সাগরে ভেসে থাকার জন্য যে ভেলাটুকু তার সহায় তাকে সে কী করে ডুবতে দেয়!

    সারহানের ব্যবহারে আচম্বিত জান্নাহ্।সারাদিন ঘরে বসে সব কাজ নিজের হাতে করে।এমনকি জান্নাহ্ গোসল করলে তার চুল পর্যন্ত মুছে দিতে দ্বিধা করে না।সারহান কেয়ারিং ছিলো।কিন্তু এখন!

    ধুম ধরে বসে আছে জান্নাহ্।সারহানের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।সারহানের কোনো ধ্যান নেই সেইদিকে।ক্রুদ্ধ গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

    “কেন নিয়ে গেছেন আমাকে ডক্টরের কাছে?

    সারহান বিছানার এই কোনায় বসে ছিলো।সেখান থেকে উঠে অত্যন্ত সাবলীল গলায় বললো—

    “আপনার রেগুলার চেকাপের জন্য।”

    আলমিরা খুলে একটা সাদা টিশার্ট গলিয়ে নেয় সারহান।জান্নাহ্ উঠে দাঁড়ায়।শক্ত গলায় বললো—

    “মিথ্যে বলছেন আপনি।”

    সারহান স্বাভাবিক গলায় বললো—

    “আমি চুরি করিনি যে মিথ্যে বলবো!

    “আমি বাইরে থেকে সব শুনেছি।”

    মৃদু হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর সামনে এসে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায়।নরম গলায় বললো—-

    “শুনেছেন যখন প্রশ্ন কেন করছেন?

    “কেন এমন করছেন সারহান?

    সারহান হেয়ালি গলায় বললো—

    “কেন করছি জানেন না!

    “আমি পারবো না।”

    “পারতে হবে রজনীগন্ধা।আমার পরীকে আমার চাই।আপনি এখন সুস্থ।আপনি চাইলেই কনসিভ করতে পারবেন।পুরো খেয়াল রাখবো আপনার।”

    জান্নাহ্ ছোট্ট করে বললো—

    “আমি পারবো না।”

    হিংস্র হায়েনার মতো ক্ষেপে উঠে জান্নাহ্ এর গলা চেপে ধরে সারহান।হাতের চাপ বাড়াতেই শ্বাস আটকে আসে জান্নাহ্ এর।চোখ হয়ে উঠে টলটল।স্থির,নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে আছে সারহান।জান্নাহ্ এর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে হাতের বেড় শিথিল করে।কেঁশে উঠে জান্নাহ্।গলা শুকিয়ে ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে।সারহান শান্ত হয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে জান্নাহ্ এর হাতে দেয়।তড়িৎ বেগে তা পান করে জান্নাহ্।মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলে সে।
    সারহান নির্ভীক ও অতি স্বাভাবিক গলায় বললো—

    “নিজের হাতে নিজের প্রাণটা তো আমি নিতে পারবো।কিন্তু আপনাকে কেন আঘাত করতে পারি না বলুন তো!

    জান্নাহ্ কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে সারহানকে দেখে।তার দুই চোখ সারহানের ওই অরুনলোচন চোখে আবদ্ধ।সারহান আবারো ক্ষুন্ন গলায় বললো—

    “কেন শুনছেন না আপনি আমার কথা?আমার পরীকে আমার চাই।”

    জান্নাহ্ প্রস্ফুরনিত কন্ঠে বললো—

    “কেন পাগলামি করছেন সারহান?

    সারহান বিক্ষিপ্ত হাসে।বিগলিত গলায় বললো—

    “আমি তো পাগলই।এই পাগলকে কেন ভালোবাসলেন আপনি?
    মানুষ তার সমস্ত জীবনে ভালোবাসা কুড়োয়।আর আমাকে দেখুন।উপচে পড়া ভালোবাসা আমার পুরো জীবনটা একটা ধ্বংসাবশেষ তৈরি করে দিলো।এই ধ্বংসাবশেষ ভালোবাসার ফুল আপনিই ফুটাতে পারবেন।ফিরিয়ে দিন আমার পরীকে।আমি কথা দিচ্ছি আমি ওর বেস্ট বাবা হয়ে দেখাবো।যেমনটা আপনি আপনার বাবাকে ভাবতেন।আমি সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো।শুধু আমার পরীকে আমায় ফিরিয়ে দিন রজনীগন্ধা।আমাকে বাঁচতে দিন রজনীগন্ধা।প্লিজ বাঁচতে দিন।”

    জান্নাহ্ তার অশ্রুসিক্ত চোখে তার প্রাণকে দেখে।এই সারহানকে চিন্তে তার কষ্ট হয়।ডিভানে গিয়ে বসে সারহান।দুই হাতে কপাল চাপকে ধরে রাখে।পায়ের আঙুলগুলো উঠানামা করে মেঝের উপর ছন্দের সৃষ্টি করে।ঠোঁট কামড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।আচমকা উঠে দাঁড়ায়।জান্নাহ্ স্থির হয়ে চেয়ে আছে।
    জান্নাহ্ এর সামনে গিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

    “কেন করলেন এইসব!কী দরকার ছিলো এইসব করার!কেন খুন করলেন আপনি?

    শেষের লাইনটা যেনো জান্নাহ্কে একদম নাড়িয়ে দিলো।বদ্ধ শ্বাসে কেঁপে উঠে জান্নাহ্।বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে সে।সারহান অধর ছড়িয়ে শ্বাস নেয়।তীব্র হতাশ হয়ে বললো—

    “কেন করলেন আপনি এইসব রজনীগন্ধা?ভয় লাগেনি আপনার?ভাবেন নি এর পরিণতি কী হবে!এই ছোট্ট দুই হাতে এতো নৃশংস কাজ কী করে করলেন?

    ড্রেসিং টেবিলে সজোরে ধাক্কা মারায় তা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে।সারহানের হাতেও লেগে যায়।এক নাগাড়ে কেঁদে কেটে বুক ভাসায় জান্নাহ্।
    সারহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো—

    “দোষ তো একার ওদের ছিলো না।দোষী আমিও।তাহলে ওরা একা কেন শাস্তি পাবে!আরে আমি নর্দমা।নিজেকে কেন জড়ালেন আমার সাথে।কেন খোঁজ নিলেন না আমার।যখন জানতে পেরেছেন আমি আপনার যোগ্য নই কেন চলে গেলেন না?

    জান্নাহ্ মৃদু গলায় গোঙানি দিয়ে বললো—

    “কোথায় যাবো আমি।আপনি ছাড়া তো আমার কেউ নেই।”

    সারহান আর্দ্র গলায় বললো—-

    “কেন আমাকেই বেছে নিলেন আপনি।মানুষের উপরের অংশ আর ভেতরের অংশে অনেক তফাৎ রজনীগন্ধা।আপনার কেন মনে হলো আমি আপনার বাবার মতো!আমি তা নই।আমি তো জারজ রজনীগন্ধা।”

    জান্নাহ্ ঝাঁপিয়ে পড়ে সারহানের বুকে।ভাঙা গলায় বললো–

    “নাহ।এইসব বলবেন না।আমি আপনাকে ভালোবাসি সারহান।ক্ষমা করে দিন আমায়।আমি ভুল করেছি।কী করবো বলুন।মা,বাবাকে হারিয়ে আমি যে আপনাকেই সব মেনেছি।আপনার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না।কাউকে না।”

    সারহান গুমোট গলায় বললো—

    “কাউকে এতোটাও ভালোবাসতে নেই যে ভালোবাসা তাকে দূর্বল করে দিবে।ভালোবাসতে হয় পানির মতো।উষ্ণতায় গলবে তো শীতলতায় কঠিন হবে।”

    “আমি ইচ্ছে করে করি নি সারহান।ওরা…।”

    “তাই বলে এইসব করবেন!আপনার যদি কিছু হয়ে যায়?

    “আপনি আমাকে বাঁচাবেন না সারহান?

    সারহান নিজের দুই ঠোঁট চেপে ধরে জান্নাহ্কে আবদ্ধ করে তার বক্ষস্থলে।গাঢ় গলায় বললো—

    “কিছু হতে দিবো না আমি আপনার।কাউকে পৌঁছাতে দিবো না আপনার কাছে।

    “মামা কিছু করে নি সারহান।তাকে বাঁচান।”

    “কারো কিছুই হবে না।বসুন আপনি।”

    সারহান জান্নাহ্কে বিছানায় বসায়।ভারি গলায় বললো—

    “আপনার কেন মনে হলো আমি আপনাকে চিনতে পারি নি!ষোলো সতেরো বছরের সারহান যখন তার মায়ের জন্য দেশ চষে ফেলতে পারে তাহলে আপনাকে কী করে ভুলে যায়!

    শীতল নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।মেঝেতে আসন পেতে বসে।জান্নাহ্ এর চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।থমথমে গলায় সারহান বললো—

    “আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি রজনীগন্ধা।ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছি আমি।ক্রিমিনাল না হয়েও হয়েছি জেলখাটা আসামী।সেখান থেকে বেরিয়ে সারহান হয়ে গেলে পাথর সারহান।ডুবে গেলাম ক্রাইমের দুনিয়ায়।কী করিনি আমি!নিজেকে শেষ করেছি তিলে তিলে।ভাবিনি কখনো নিজেকে নিয়ে।কারো মায়ায়ও পড়িনি।
    সামিরার মৃত্যুতে চমকাই নি আমি।স্যার আর আমি অনেক কাজ করেছি।ভেবেছি হয়তো তার কোনো শত্রু এইসব করেছে।তিথিকে তো আমি নিজেই জেলের ভাত খাওয়াতাম।মেঘনোলিয়ার মৃত্যুর দিনের ওই ভিডিওর মানুষটিকে চিনতে ভুল হয়নি রজনীগন্ধা।সেদিন ক্যাফেটেরিয়াতে আপনার মামাকে দেখে শিওর হলাম আমি।শ্রীজার মরার আগে ওই চিঠি!
    শায়িখ ছাড়া কেউ তো জানতো না আমি কোথায় আছি।”

    বিগলিত হাসে সারহান।একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বললো—

    “তিথির মৃত্যুর পরই আমার সন্দেহ শুরু হয়।তাইতো ইহতিশামকে কেসটা হ্যান্ডওভার করতে বলেছি স্যারকে।”

    জান্নাহ্ ধরা গলায় বললো—

    “তিশাম ভাইয়া জানে আমি খুন করেছি?

    “হুম।”

    “আমার ফাঁসি হবে তাই না সারহান?

    ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।সারহান নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্ এর ক্রন্দনরত মুখের দিকে।
    দম্ভ করে বললো–

    “আপনি ভাবলেন কী করে আপনার কোনো ক্ষতি হতে দিবো আমি!আপনার কাছে কাউকে পৌঁছাতে দিবো না আমি।”

    সারহানেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে জান্নাহ্।তার দেহ ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছে।জান্নাহ্ গলিয়ে পড়ছে সারহানের দেহের সাথে।জান্নাহ্ ছড়ানো চুলগুলো আলতো হাত একপাশ করে সারহান।ফিকে গলায় বললো—

    “আপনার বাবা মায়ের ছবি আমি পত্রিকায় দেখেছি।চিন্তে কষ্ট হয়নি আমার।কী করে হলো এইসব?

    জান্নাহ্ নির্দ্বিধায় সবটা বলে।আর হু হু করে কেঁদে উঠে।

    “কাঁদবেন না রজনীগন্ধা।এতে আপনার কোনো দোষ নেই।অতীত ভুলে যান।আমি যা বলেছি তা নিয়ে ভাবুন।আমরা নতুন করে শুরু করবো।”

    জান্নাহ্ সারহানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ভ্যালভ্যাল চোখে তাকায়।ফ্যাকাশে সুরে বললো—

    “আপনি কী করে জানলেন আমি রাফাতের বাসায়?

    “মামার কাছ থেকে।”

    সারহান আলগোছে জান্নাহ্কে কোলে তুলে নেয়।বিছানায় শুইয়ে ললাটে আলতো চুমু খায়।

    “ঘুমান রজনীগন্ধা।ভুলে যান বিষাক্ত অতীত।আমি থাকতে আপনার কোনো ভয় নেই।জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি আপনার সাথেই থাকবো।”

    “চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬০
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    গ্রীষ্মের দুপুরের তপ্ত রোদের লীলা খেলা আকাশ জুড়ে।নীলাভ আকাশের বুকের কোথাও কোথাও জটলা বেঁধে আছে গুমোট উজ্জ্বল মেঘ।নদীর পাড়ে শিয়র উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটার নিচে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে দুটো পাখি।নদীর বুকে চলছে পালতোলা নৌকা।দু একটা মাছ ধরার নৌকাও দেখা যাচ্ছে।নদীর তীর ঘেঁষে এ পাড়ে দাড়িয়ে আছে অশ্বথ গাছ।তিরতির করে মৃদু শীতল হাওয়া বইছে।তপ্ত রোদের রাসলীলা এখানে কম প্রতীয়মান হচ্ছে।নদীর পাড়ের বায়ুর শীতলতায় ক্রমশ উষ্ণ শরীর প্রশান্তিতে আচ্ছাদিত হতে থাকে।

    নদীর পানিতে চক্ষু স্থির করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো সাদা বক।তাদের হিংস্র,নিষ্কম্প চাহনি পানির অগভীরে থাকা আকাঙ্ক্ষীত সেই ভীত প্রাণটিতে।নাম না জানা আরো একাধিক গাছে ভরে আছে নদীর ডিম্বাকৃতির বলয়।

    তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অাছে সারহান।নিরুদ্বেগ,নিরবচ্ছিন্ন,অনিমেখ চাহনি ওই বহমান নদীতে।সূর্যের তাপের প্রখরতা কমতেই নদীর পাড়ের বায়ুতে ঠান্ডা ঠান্ডা পরশ আসে।প্রভাকরের ওই দগদগে আভাকে চিরে পবনের মায়ায় জড়ায় সারহানকে।তার গায়ের পাতলা টিশার্ট ফুরফুরে বাতাসে উড়তে থাকে।ঝাঁকড়া চুলগুলো উলুথলু হয়ে সরে আসছে বাতাসের বিপরীত দিকে।
    পাশেই শান্ত হয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে তার পুরো মনোযোগ দুরের নদীতে না দিয়ে সারহানের দিকে দিয়ে রেখেছে ইহতিশাম।চোখে স্থিরতার সাথে একরাশ কাতরতা।প্রশ্নের মায়াজালে থমথমে মুখ।বাতাস বাড়তে থাকে।নদীর তীরের বাতাসে আলোড়ন সৃষ্টি হয় গাছগাছালিতে।বাতাসে মুখনিঃসৃত শব্দের আওয়াজ ক্ষীন হয়ে আসে।মৌনতা ভেঙে কথার ছন্দ তোলে ইহতিশাম।

    “কেন ডেকেছিস?

    মৃদু হাসলো সারহান।খেয়ালিপনায় বললো—

    “ধন্যবাদ জানাতে তো একদম ই নয়।”

    আলতো হাসে ইহতিশাম।তার দোস্ত বদলাবার নয়।সারহান ধীর পায়ে ইহতিশামের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।হুরহুরে বাতাসে দুই বন্ধুর চোখের ইশারায় একে অপরকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে অবলোকন করে।একপাশে নদীর অথৈ ঢেউ অন্যপাশে প্রশ্বস্ত রাস্তা।শূন্যে ছেড়ে রাখা হাত দুটো পকেটে গুঁজে দৃঢ় গলায় সারহান বললো—

    “আজকের পর তোর আর আমার সব সম্পর্ক শেষ।তুই আমার জন্য যা করেছিস তার জন্য আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ নই।কারণ,হয়তো তুই আমার জীবনে না এলে এইসবের সৃষ্টিই হতো না।”

    ফোঁস করে দম ছাড়লো ইহতিশাম।থমথমে গলায় বললো—

    “সম্পর্ক শেষ বললে তো আর সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না।বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষের সাথে সাথে আমাদের নতুন সম্পর্ক শুরু হয়েছে তা তুই অস্বীকার করতে পারবি না।”

    সারহান ক্ষীন চোখে তাকাতেই মুখভর্তি হাসে ইহতিশাম।চটপটে গলায় বললো—

    “এখন তো আমরা ভায়রা ভাই।”

    তাচ্ছিল্য হাসে সারহান।বিরস মুখে বললো—

    “এই সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।ইনফেক্ট কোনো সম্পর্কেরই কোনো মূল্য নেই।একটা কথা কী জানিস!আগে আমার আফসোস হতো যে এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য আমি এখন খুশি যে আমার কেউ নেই।আমার কেউ নেই বলেই হয়তো ওই ওপর ওয়ালা ওই সুবাসিত ফুলকে আমার ভাগ্যের খাতায় লিখেছেন।তাই আমি আজ তৃপ্ত।তার ওপর আমার কোনো অভিমান নেই।নেই না পাওয়ার কোনো অভিযোগ।”

    ইহতিশাম নিরবতা অবলম্বন করে অনিমেষ চেয়ে রইলো সারহানের দীপ্ত মুখে।চকচকে চোখ দুটো এক পশলা প্রফুল্লতা যেনো ছুঁকছুঁক করে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।ইহতিশামের মনের দুয়ারে সত্যিই প্রতীত হয় সে ভুল করেছে।তার দুই কান উৎকর্ণ হয়ে আছে শোনার জন্য।সারহান নির্বিকার গলায় বললো—-

    “আমি সত্যিই আমার রজনীগন্ধাকে ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।বুঝতে দেরি করে ফেলেছি।কিন্তু এই সুযোগ আমি কাজে লাগাতে চাই।আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমি করতে চাই।যে মেয়ে আমার জন্য এতো কিছু করতে পারে তার জন্য আমি নিজেকে বদলাতে চাই।”

    ইহতিশাম সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়।তার দৃষ্টি গভীর থেকে গভীর হতে লাগলো।সারহান উন্মনা স্বরে বললো—

    “আমার আর কাউকে চাই না।আমি আমার রজনীগন্ধাকে নিয়ে বাঁচতে চাই।আশা করি সেই সুযোগ তুই আমাকে দিবি।”

    ইহতিশাম আলগোছে মাথা ঝাঁকায়।একটা কর্কশ আওয়াজ শুনতেই দুই জোড়া চোখ উন্মুখ হয় আকাশ পানে।প্রশ্বস্ত চাহনিতে দেখে একটা বাজপাখি উড়ে যাচ্ছে।সারহান নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে।অনুজ্জ্বল স্বরে বললো—

    “মেহনাজকে বলিস পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিতে।আমি জানি তা কষ্টকর।তবুও।”

    ইহতিশাম সম্মতিসূচক অঙ্গভঙ্গি করে বললো—

    “ওকে।তুই যেমনটা চাইবি তেমনটাই হবে।জান্নাহ্ আসলেই তোকে ভালোবাসে।ওইটুকু মেয়ে কতবড় স্টেপ নিয়েছে তোর জন্য।আই এম সারপ্রাইজ!ভালো থাকিস।”

    সারহান তাচ্ছল্য চোখে তাকিয়ে বিক্ষিপ্ত হাসলো।বললো—

    “থ্যাংকস।”

    বিগলিত হাসলো ইহতিশাম।একটা দমকা হাওয়া এসে লাগে ইহতিশামের কানের পাশে।ফুরফুরে স্নিগ্ধ বাতাসে নদীর পানে তাকায় দুই বন্ধু।দীর্ঘদিনের জমাট বাঁধা সুপ্ত রাগ তরলে পরিণত হতে লাগলো।
    ,
    ,
    ,
    বদ্ধচাহনিতে আবদ্ধ করে রেখেছে জান্নাহ্কে সারহান।জান্নাহ্ এর চোখে মুখে অলস ভাব।মিহি গলায় বললো—

    “কী ভাবলেন?

    জান্নাহ স্বাভাবিক গলায় প্রত্যুক্তি করে—

    “কী সম্পর্কে?

    “আমি আপনাকে যা বলেছি।”

    “আমাকে সময় দিন সারহান।”

    সারহান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো—

    “সেই সময়টাই তো নেই আমার কাছে রজনীগন্ধা।”

    জান্নাহ্ চোখের পাতা প্রসারিত করে উৎসুক চোখে তাকাতেই ঝরা হাসে সারহান।সরব গলায় বললো—

    “এই যে আপনার বাবা মাকেই দেখুন।তারা আপনার সংসার দেখে যেতে পারে নি।ঠিক তেমনভাবে আমর পরী আসতেও এতোটা দেরি না হয়ে যায় যখন আমার হাতে আর সময় থাকবে না।।”

    বুক কেঁপে উঠে জান্নাহ্ এর।এইসব কী বলছে তার প্রাণ!
    জান্নাহ্ এর চোখ টলটল করে উঠে।চোখের বারি বাঁধ ভাঙতে চায়।সারহান জান্নাহ্কে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে।নির্ভীক গলায় বললো—

    “আমার এমন কেন মনে হয় একদিন আপনিই আমার প্রাণটা কেড়ে নিবেন।আমার পরীকে আমার আর দেখা হবে না!

    জান্নাহ্ আঁতকে উঠে।দুর্বল হাতে এলোপাথাড়ি কয়েকটা কিল ঘুষি মারে সারহানের বুকে।আর্দ্র গলায় বললো—

    “কী বলছেন এইসব!কেন বলছেন!কিছু হবে না আপনার,কিছু না।”

    ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।সারহান ছোট্ট শ্বাস ফেলে সংক্ষিপ্ত সুরে বললো—-

    “তাহলে কেন শুনছেন না আপনি আমার কথা?

    জান্নাহ্ ধরা গলায় বললো—

    “শুনবো,সব শুনবো।আপনি যা বলবেন তাই শুনবো আমি।”

    সারহান গম্ভীর মুখে বললো—

    “আজকের পর আপনার বন্ধুকে বলবেন সে যেনো আপনার কাছ থেকে দূরে থাকে।”

    জান্নাহ্ সারহানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে নরম গলায় বললো—

    “কেন?

    অধর কোণে হাসে সারহান।বিমুগ্ধ গলায় বললো—

    “আপনার বেস্ট ফ্রেন্ডকে বলবেন,আমার রজনীগন্ধা শুধু আমারই।তার সর্বত্র শুধু আমার অধিকার।তার সুবাসের একমাত্র অধিরাজ আমি।”
    ,
    ,
    ,
    নিরাক পরিবেশে দম্ভ করে দাঁড়িয়ে আছে কাঁঠাল গাছটা।ঝরে পড়া পাতার ফাঁকে এখনো ঝুলে আছে ছয় সাতেক হৃষ্টপুষ্ট কাঁঠাল।পাক ধরেছে আম গাছের রসালো আমে।হালকা হাওয়া বইতেই নড়ে উঠে কাঁঠাল গাছটা।কিন্তু দিব্যি মন খারাপ করে মুখ বাঁকিয়ে রেখেছে আমগাছ।সূর্য উদয়ের বিপরীত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠাঁল গাছে ম্রিয়মান আলো পড়ছে।কিন্তু তেঁতে আছে আমগাছ।তীর্যক রশ্মি যেনো আজ চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে তার ভেতরটা।

    বাংলোর বাগানটায় নানা রকম গাছের সমাবেশ।দুটো মোটা আমগাছের ফাঁকেই একটা স্টিলনেইস দোলনা রাখা।সেখানে নিরব বসে মোবাইলে অভিনিবেশ করে রেখেছে সারহান।বেডরুম থেকে তা স্পষ্ট দেখছে জান্নাহ্।কিশোরী বিকেল সবেই যৌবনে পা রেখেছে।দিনের শেষ সূর্যের কিরণ গোধূলির পা ছুঁইছে।

    শব্দহীনভাবে সারহানের পাশে এসে বসে জান্নাহ্।সেদিকে মনোযোগ না দিয়েই শক্ত মাটিতে পা ঠেকিয়ে দোলনাকে পেছন দিকে হালকা নিয়ে আবার শূন্যে ছাড়তেই দুলে উঠে দোলনা।ঘটনার আকস্মিকতায় জান্নাহ্ হেলে পড়তে গেলেই তার হাত ধরে ফেলে সারহান।নির্বিঘ্ন গলায় বললো—

    “বি কেয়ারফুল রজনীগন্ধা।নিজেকে সামলাতে শিখুন।”

    জান্নাহ্ ঠোঁট কামড়ে জ্বলন্ত চোখে তাকায়।থমথমে গলায় বললো—

    “আপনি আমার মোবাইল দিচ্ছেন না কেন?

    সারহান চোখ তুলে তাকায়।মৃদুহাস্য অধরে বললো–

    “আগে আপনি আমার ইচ্ছে পূরণ করবেন ।তারপর।”

    জান্নাহ্ নাক ফুলায়।কপট রাগি গলায় প্রশ্ন করে—

    “আম্মার সাথে কথা বলেছেন?

    সারহান অস্ফুট সুরে বললো—

    “হুম।”

    “কেমন আছে আম্মা?

    সারহান সহজ গলায় বললো–

    “ভালো।”

    জান্নাহ্ কিছুক্ষন থেমে সরস গলায় বললো—

    “মোবাইল দিন।”

    সারহান পূর্ণ দৃষ্টি ক্ষেপন করে জান্নাহ্ এর দিকে।মেকি হাসে জান্নাহ্।উষ্ণ গলায় বললো—

    “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?দিন মোবাইল।আমি আম্মার সাথে কথা বলবো।”

    সারহান নির্লিপ্ত।বিনাবাক্য ব্যয়ে মোবাইলটা জান্নাহ্ এর হাতে দেয়।মোবাইলটা পেয়ে প্রফুল্লচিত্তে উঠে দাঁড়ায় জান্নাহ্।সারহান হাত টেনে ধরতেই গম্ভীর চোখে তাকায়।মোলায়েম গলায় সারহান বললো—

    “এখানে বসুন।”

    অগত্যা বসলো জান্নাহ্।কল করতেই ক্ষণকাল বাদ কল রিসিভ করে অন্তরা।রিসিভ করতেই হু হু করে উঠে অন্তরার মাতৃ মন।জান্নাহ্ নির্মল গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

    “কেমন আছেন আম্মা?

    অন্তরা কেঁদে কেঁদে বললেন—-

    “আমি আর কেমন থাকমু কও।তুমি কেমন আছো বউ?

    “আমি ভালো আছি আম্মা।বাবা কেমন আছেন?

    “সে ভালাই আছে।”

    গলা জমে আসে জান্নাহ্ এর।সামনে তার দিকেই চোখ তাক করে বসে আছে সারহান।নিজের কান্নাকে প্রদমিত করে জান্নাহ্।কিন্তু চোখে ছলছল অথৈ সাগর উপচে পড়বে বলে।অন্তরা ক্রন্দনরত গলায় শুধালেন—

    “আমার পোলাডা কেমন আছে?

    জান্নাহ্ অত্রস্ত গলায় প্রত্যুত্তর করে—

    “সে ভালো আছে আম্মা।”

    অন্তরার বুক ভেঙে কান্না আসে।সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না।ঝরঝরিয়ে বইতে থাকে তার জলপুকুর।কম্পিত গলায় বলতে থাকেন—

    “আমার পোলাডার দিকে খেয়াল রাইখো বউ।সে আর কারো রে ভালো না বাসলেও তোমারে সে প্রথ্থম থাইকাই ভালোবাসে।ভরসা করে।তারে দেইখা রাইখো।আমার পোলাডা কত কষ্ট বুকে চাইপা রাখছিলো!ওর তো কোনো দোষ নাই মা।ওরে তুমি ঘেন্না কইরোও না।ও তো এখন তোমারেই বিশ্বাস করে।”

    গলা বসে আসে অন্তরার।অন্তরার বুক ফাটা কান্নায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না জান্নাহ্।ঝমঝমিয়ে কেঁদে বুক ভাসায়।বিলাপ করে অন্তরা বললো—

    “এতোকাল রাগ থাকলেও মাসে একবার অন্তত ওর মুখটা দেইখা কইলজা জুড়াইতাম আমি।কিন্তু এহন আর তা অইবো না।আমার সারহান আর কোনোদিন এই বাড়িতে আইবো না।শুভ্রা যে এমন একটা কাম করবো আমি কোনোদিনও স্বপ্নেও ভাবি নাই।বইন হইয়া ভাইয়ের লগে কেমনে করলো এমন!আমার পোলাডার জীবনডা শেষ কইরা দিলো।আর কোনোদিন আমার পোলা মা কইয়া আমারে ডাকবো না।আর কোনোদিন সে আমার হাতের খাওন খাইতে চাইবো না।সব শেষ কইরা দিছে শুভ্রা।আমার পোলাডারে এতিম বানাইয়া দিছে।”

    হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে অন্তরা।জান্নাহ্ ব্যগ্র গলায় বললো—-

    “আম্মা,প্লিজ আর কাঁদবেন না।দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।সে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে যাবে।”

    ফট করেই মোবাইল নিয়ে নেয় সারহান।কল কেটে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

    “মিথ্যে আশ্বাস কেন দিচ্ছেন?

    “সারহান!

    ” ও বাড়িতে আমি আর কখনো ফিরে যাবো না।”

    জান্নাহ্ উঠে দাঁড়ায়।তার চোখের পল্লব বেয়ে পড়ছে শীতল জলের প্রস্রবণ।প্রস্ফুরণ হয় কন্ঠে।সে কন্ঠ কাঁপিয়ে বললো—-

    “এইসব কী বলছেন?কেন যাবেন না আপনি?আম্মা কাঁদছে শুনতে পাচ্ছেন না?

    সারহান ভাবলেশহীন স্বরে বললো—

    “আমার কিছুই করার নেই।ওই বাড়ির সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে এসেছি আমি।”

    জান্নাহ্ ক্ষুন্ন গলায় বললো—

    “সম্পর্ক কোনো শুকনো কাঠ নয় যে হালকা আঘাতেই ভেঙে যাবে।সম্পর্ক হলো আকাশের মতো।মেঘের শেষে নির্মেঘ হবেই।প্রয়োজন শুধু অপেক্ষা আর সময়ের।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬১
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    বাংলোর বাগানে বসে আছে জান্নাহ্ আর সারহান।ম্রিয়মান সূর্যের আলোই আকাশ ধীরে ধীরে ধূসরের রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছে।গাছপালায় আচ্ছাদিত বাগানের ভূমি নরম ঘাসে পরিপূর্ণ।বাতাসে ভেসে আসছে পাকা কাঁঠালের মিষ্টি ঘ্রাণ।এলোমেলো নাতিশীতোষ্ণ বাতাস।হালকা বাতাসেই দোদুল্যমান গাছের পত্রপল্লব।

    জান্নাহ্ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সারহানের দিকে।আচমকাই মৃদু শীতল হাওয়া বইতে লাগলো।আমগাছটায় হঠাৎ করেই কাঠুরে পাখি ডেকে উঠলো।বিকেলের ম্রিয়মান রশ্মি পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে গলিয়ে পড়ছে।
    সেই শীতল বাতাসেই নড়ে উঠে জাম গাছটার সদ্য কচি পাতা।নরম সবুজ ঘাসের উপর ঝড়ে পড়া শুকনো পাতা লেগে আছে সারহানের এলোথেলো চুলে।জান্নাহ্ আলতো হাতে তা সরিয়ে দেয়।শুষ্ক গলায় বললো—

    “সারহান,একটা কথা বলবো?

    সারহান নির্বিকার গলায় উত্তর করে—

    “বলুন।”

    “আপনি আমাকে রজনীগন্ধা কেন ডাকেন?

    দুর্বোধ্য হাসে সারহান।মুগ্ধ গলায় বললো–

    “কারণ আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে সুবাসিত ফুল।আমার দুর্গন্ধ যুক্ত কলুষিত জীবন আপনার সুবাসে সুবাসিত করেছেন।”

    জান্নাহ্ ধীম গলায় বললো—

    “মানুষ কখনো ফুল হয়?

    সারহান ঝলমলে হাসে।ফিচেল গলায় বললো—

    “হয়তো।যেমন আপনি।আপনার ঘ্রাণ রজনীগন্ধার মতো।যেদিন আমি আপনাকে প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম বিশ্বাস করুন,আপনার শরীরের সেই ঘ্রাণে আমারতো পুরো অবস্থাই খারাপ হয়ে গেছিলো।ভাগ্যিস আপনার মামা দুই দিনের মধ্যে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।নাহলে আমার অবস্থা….।”

    সারহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই জান্নাহ্ অধৈর্য হয়ে সারহানের গলা চেপে ধরতেই ঘাসের উপর ঢলে পড়ে সারহান।তার উপর উপুর হয়ে তার গলা ধরে রেখেছে জান্নাহ্।অসহিষ্ণু গলায় বললো—

    “অসভ্য লোক!

    ফুরফুরে হাসে সারহান।সংক্ষিপ্ত সুরে বললো—

    “আরে,আরে রজনীগন্ধা!কী করছেন?মরে যাবো তো!

    “মেরে ফেলবো আপনাকে।”

    সারহান গলা থেকে জান্নাহ্ এর হাত সরাতেই জান্নাহ্ পুরোদস্তুর ঝুঁকে পড়ে সারহানের উপর।জান্নাহ্ এর অধর গিয়ে ঠেকে সারহানের গলায়।নরম গলায় সারহান বললো—

    “আমাকে মারতে পারবেন আপনি?

    জান্নাহ্ মেকি হিংস্রতা দেখিয়ে বললো–

    “পারবো,পারবো।”

    “তাই না!

    জান্নাহ্কে কিছু বোঝার সময় না দিয়ে তাকে নিচে শুইয়ে তার উপর নিজেকে ছেড়ে দেয়ে সারহান।নেশার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সারহান।নিরাক পরিবেশে পবনের আন্দোলন শুরু হয়।তাদের ওপরে থাকা কদম গাছটায় কদমের মুকুল দেখা যাচ্ছে।সারহানের নেশাভরা চাহনি ফাঁকি দিয়ে জান্নাহ্ সেদিকেই তাকায়।মোহিত সারহান একের পর এক চুমু খেতে থাকে জান্নাহ্ এর ললাট,চোখ,কপোল আর গলাতে।জান্নাহ্ এর শ্বাস ভারি হতে থাকে।হালকা বাতাসে উড়ছে সারহানের এলোথেলো চুল।জান্নাহ্ ভ্যালভ্যাল দৃষ্টিতে সারহানের কর্মকান্ড দেখে।তার পুরুষালী স্পর্শের অদ্ভুত মাদকতায় ক্রমশ আচ্ছন্ন হতে থাকে জান্নাহ্।সলজ্জ চোখ দুটো আদুরে মায়ায় বুজে নেয়।জান্নাহ্ চকিত হয়ে তার অধরে ভেজা স্পর্শে।সারহানের অধরের গভীরতায় ধীরে ধীরে বিবশ হয়ে আসছে জান্নাহ্।তার চোখে মুখে সারহানের উষ্ণ নিঃশ্বাসের ছন্দপতন হতে লাগলো।

    আচমকা সারহানের বুকে ধাক্কা মারে জান্নাহ্।সারহান হেলে পড়ে ঘাসের উপর।স্মিতহাস্য অধরে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।জান্নাহ্ ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো–

    “সরুন এখান থেকে।দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার।”

    সারহান ফচকে হাসে।আকাশে মেঘের ঘনঘটা শুরু হয়।কালো মেঘ জমাট বাঁধতে শুরু করে।বাতাসের তোড় বাড়তে থাকে সাথে শীতল পরশ।আশেপাশের শুকনো পাতা এসে পড়ে তাদের গায়ে।জান্নাহ্ ব্যস্ততা নিয়ে বললো—

    “ঘরে চলুন বৃষ্টি আসবে।”

    সারহান মৃদু গলায় বললো—

    “আপনি যান আমি আসছি।”

    জান্নাহ্ চোখ রাঙিয়ে বললো—

    “একদম ভিজবেন না আপনি।”

    সারহান চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।চঞ্চল পায়ে ক্যাচিগেট খুলে ঘরে ঢুকে জান্নাহ।এখান থেকে সরাসরি তাদের বেডরুমে যাওয়া যায়।
    আকাশ ধীরে ধীরে কালো হতে থাকে।সারহান ঘাসের উপর গা এলিয়ে দেয়।মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে ওই মেঘভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে।তার জীবনটা এমন না হলেও পারতো!ওই রৌদ্রজ্জ্বল নির্মেঘ আকাশের মতো হলেও পারতো!ঝলমলে স্বচ্ছ আকাশের চাঁদ হয়ে তার রজধীগন্ধা থাকলেও পারতো!তবে কেন তার জীবনটা আঁধার ঘেরা আকাশ হয়ে গেলো?

    ,
    ,
    ,
    তটস্থ হয়ে পায়চারী করছে রাফাত।কল করতে করতে ক্লান্ত সে।কোনোভাবেই জান্নাহ্ এর সাথে কন্টাক্ট করা যাচ্ছে না।রাগে দপদপ করছে তার মস্তিষ্কের শিরা।রাফাতের মা রিতা ছেলের এই অগোছালো ভাবগাম্বীর্যে বিরক্ত।রিতা তপ্ত গলায় বললেন—

    “রাফাত,এইবার তোমার নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত।”

    উন্মনা রাফাত শুনেও শুনলো না যেনো।সে ব্যস্ত তার কাজে।রিতা দৃঢ় গলায় ক্ষেপে বললেন—

    “রাফাত!
    কিছু বলছি তোমাকে আমি।”

    রাফাতের কর্ণগোচর হতেই প্রত্যুত্তর করে সে—

    “আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার।আমি ঠিক আছি।”

    রিতা খলবলিয়ে বললেন—

    “ঠিক নেই তুমি।ধূ ধূ মরুভূমির বুকে মরিচিকার পেছনে ছুটছিলে তুমি।কিন্তু আমি আশ্চর্য !যখন বুঝতেই পারছো এইটা কোনো তপ্ত মরুর বুকে শীতল জলের ফোয়ারা নয় বরং চোরাবালি।তাহলে কেনো ছুটে চলছো তুমি!হোয়াই রাফাত?

    রাফাতের চোখে মুখে আগুন জ্বলে উঠে।কন্ঠের গাঢ়তা বাড়িয়ে নিমিষেই আগুনের ফুলকির মতো বিক্ষিপ্ত হয়ে বললো—

    “বিকজ আই লাভ হার।ছাড়তে পারবো ওকে আমি ওই থার্ড ক্লাস বাস্টার্ডের সাথে।ও জান্নাহ্ এর যোগ্য নয়।শেষ করে দিবে ও আমার জান্নাহ্কে।আই সয়ের,আমার জান্নাহ্ এর যদি কিছু হয় ছাড়বো না ওকে আমি।”

    ফোঁস ফোঁস করতে থাকে রাফাত।বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঝলকে উঠতে লাগলো রাফাতের শান্ত দেহ।শান্ত,সুধীর রাফাত মুহূর্তেই যেনো তার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো।রিতা আকাশসম বিস্ময় নিয়ে অতলান্তিক মায়ায় চেয়ে রইলেন।এ কোন রাফাতকে আবিষ্কার করলেন তিনি!

    দমদমে পা ফেলে বেরিয়ে যেতেই রিতা প্রশ্ন করে—

    “কোথায় যাচ্ছো তুমি?

    রাফাত ভারি গলায় দৃঢ় হয় বললো—

    “ইহতিশামের কাছে।ও নিশ্চয়ই জানবে জান্নাহ্ কোথায় আছে।”

    ,
    ,
    ,
    নিশুতি রাতের মায়ায় মোহাচ্ছন্ন পরিবেশ।নিকষ কালো আকাশে উঁকি দিচ্ছে এক ফালি চাঁদ।ঝিমঝিম করে ঝরছে শ্রাবণের ধারা।উষ্ণ আবহাওয়া হাওয়ায় মিলিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে শীতল হাওয়া।চারদিকে ঝুমঝুম বৃষ্টির ছন্দে মুখরিত কালো আঁধার।

    আধভেজা হয়ে ঘরে ঢোকে সারহান।মাথার চুল আর শরীরের আধ অংশ ভিজে আছে।কোনো রকমে নিজেকে সামলে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেডরুমে চলে যায়।জানালার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।ভেজা লেপ্টানো শার্টের বোতাম আনলক করতে করতে চোখ পড়ে জান্নাহ্ এর দিকে।বদ্ধদৃষ্টিতে জান্নাহ্ তাকিয়ে আছে জানালার ফাঁক গলিয়ে।রিনিঝিনি বৃষ্টিতে এতোটা আচ্ছন্ন জান্নাহ্ টের পায়নি সারহানের উপস্থিতি।দু’চোখের অক্ষিপুট মেলে সরব দৃষ্টি জান্নাহ্ এর যেনো এক বিন্দু বৃষ্টিও তার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে ভূমি না ছুঁইয়ে ফেলে।বাংলোর পেছনের দিকের রুমদুটোর বারান্দায় টিনের চাল বিছানো। যাতে করে সেখানে দাঁড়িয়ে গ্রামের মতো টিনের চালের উপর পড়ন্ত সেই বৃষ্টির মাদকছন্দ স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়।এখান থেকে তা শোনা যায় না।এখান থেকে দেখা যায় বাংলো পেছন দিকের গাছপালা।শিরশির করে জানালা দিয়ে পবনের আন্দোলন শুরু হয়েছে।জান্নাহ্ এর চোখে মুখে অদ্ভুত মোহ।ডান হাতের তর্জনী দিয়ের গ্রীল ঘঁষে তার শীতল জল এনে অধর অবগাহন করায়।একটা দমকা হাওয়া আসতেই ঘাড় ঘুরায় জান্নাহ্।চকিতে দেখে তাকে নিবিড়ভাবে দেখছে সারহান।জান্নাহ্ প্রসন্ন হাসে।চোখে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে এগিয়ে আসে সারহানের দিকে।খুশি খুশি গলায় বললো—-

    “কোথায় ছিলেন?

    সারহান চোখে হেসে নরম গলায় বললো—

    “কাজ ছিলো।”

    জান্নাহ্ গভীর চাহনিতে আবদ্ধ করে সারহানকে।খুসখুসে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে–

    “ভিজলেন কেন আপনি?

    সারহান অধর কোনে আলতো হেসে মোলায়েম গলায় বললো—

    “ইচ্ছে করে ভিজিনি রজনীগন্ধা।”

    জান্নাহ্ মেকি রাগ দেখিয়ে বললো—

    “আজকাল অনিচ্ছায়ও ভিজতে হয় আপনার!

    সারহান দীপ্ত হাসে।জিঙ্গাসু গলায় বললো—

    “খেয়েছেন?

    জান্নাহ্ ক্ষীন গলায় বললো—

    “হুম।”

    তাহলে জেগে আছেন কেন?শুয়ে পড়ুন।”

    হাতে থাকা ধূসর রঙের ফাইলটা টেবলের উপর রাখে সারহান।ভারি তোয়ালেটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললো—

    “আমার লেট হবে।আপনি শুয়ে পড়ুন।”

    জান্নাহ্ হালকা হাতে কৌতূহল নিয়ে ফাইলটা খুলে দেখে ব্যগ্র গলায় বলে উঠে—

    “আপনি তো জব ছেড়ে দিয়েছেন।তাহলে এইগুলো কী?

    সারহান ওয়াশরুম থেকে গলা ছড়িয়ে বললো—-

    “জব ছেড়েছি। কাজ তো ভুলে যাই নি।”

    ফোঁস করে দম ছাড়লো জান্নাহ্।লোকটা মাঝে মাঝে আজব কথা বলে।ফাইলটাতে কিছুক্ষন চোখ বুলায় জান্নাহ্।আন্ডারওয়ার্ল্ডের কতিপয় ড্রাগস ড্রিলারদের ইনফরমেশন আছে তাতে।

    রাত জেগে তার একটা সুবিন্যস্ত অ্যাসাইমেন্ট তৈরি করলো সারহান।বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষন।এখনো তার রেশ রয়ে গেছে।বাতাসের শীতলতা জানান দিচ্ছে নতুন বর্ষণের পরশ।বেডরুমে আসতেই দেখে নীল রঙের ডিম লাইট জ্বলছে সগৌরবে।জান্নাহ্ গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।হালকা ঠান্ডা হওয়ায় গায়ে পাতল চাদর টেনে নিয়েছে।নিঃশব্দে বিছানার কাছ ঘেঁষে হাঁটু ভাঁজ করে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর ভারি নিঃশ্বাসের শব্দে আলতো হাসে সারহান।তার শুকনো অধর ছোঁয়ায় জান্নাহ্ এর কপালে।ক্রমান্বয়ে চোখ,গাল,চিবুকে।অত্যল্প নড়ে উঠে জান্নাহ্।সারহানের চোখে ঘোর লাগে।মৃদু কম্পনে জাগ্রত হয় তার পৌরষীয় কামনা।জান্নাহ্ এর পদ্মকোমল ওষ্ঠাধরে গভীর চুমু খায়।সারহানের উষ্ণ শ্বাস আর আর্দ্র স্পর্শে চোখের পল্লব মেলে তাকায় জান্নাহ্।ঘুম জড়ানো চোখে বলল—

    “কাজ শেষ আপনার?

    সারহান ছোট্ট করে বললো–

    “আপাতত।”

    অধরের কোন প্রসারিত করে জান্নাহ্।তার উপর ঝুঁকে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে সারহান বললো—

    “ম্যায় আই?

    প্রশ্রয়ের হাসি হাসে জান্নাহ্।সারহান হৃদয়গ্রাহী হেসে তার অধর ডোবায় জান্নাহ্ এর গলায়।

    বাইরে আবারো ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছ।খসে যাওয়া তারা যেনো মিলিয়ে গিয়েছে নিকষকৃষ্ণ আকাশে।আমগাছের সরু পাতা বেয়ে টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ছে পানি।চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর সাথে বৃষ্টির হিমেল পরশে প্রকৃতি যেনো মন মাতানো নৃত্য করছে।মেলে ধরেছে নিজেকে।

    জান্নাহ্কে নিজের বক্ষপিঞ্জিরায় আবদ্ধ করে সারহান।প্রগাঢ় মায়ায় তার বুকে আদুরে বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে নিজেকে সপে দেয় জান্নাহ্।একে অপরের ভালোবাসায় বর্ষণস্নাত রাতে অবগাহনে ব্যস্ত হয় প্রেমেমগ্ন দুই নর-নারী।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬২
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    সকালের এক পশলা হলদে নরম রোদ এসে ঝলমলিয়ে দেয় রান্নাঘরের কাঁচের ক্যাবিনেট।সারা রাতের বৃষ্টিতে প্রকৃতি যেনো তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।বাংলোর পেছনের দিকটার নরম মাটি যেনো আরো নরম হয়ে ধরণীকে জানান দিচ্ছে তার কোমলতা।রান্নাঘরের পাশ ঘেঁষে হুংকার দিয়ে উঠা কদম গাছটার পাতায় রোদের আলোয় পড়ায় তা ঝিকমিক করছে।

    চুলার উবলানো চায়ের জন্য দেওয়া পানিতে চাপাতা দিয়ে হালকা নেড়ে চুলার আঁচ কমিয়ে দেয় জান্নাহ্।রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আসা সতেজ স্নিগ্ধ বাতাসে কেঁপে উঠে সে।সদ্যস্নান করে বেরিয়েছে জান্নাহ্।তার কোমর পর্যন্ত ছড়ানো রেশম চুল দিয়ে পানি পড়ছে।রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট পায়ে বেডরুমে আসে জান্নাহ্।সারহান অঘোরে ঘুমোচ্ছে।ঘড়ির কাটায় তখন সকাল আট টা।উপুর হয়ে শুয়ে থাকা সারহান তার মুখ গুঁজে রেখেছে বালিশের মধ্যে।জান্নাহ্ স্থবির হয়ে দাঁড়াতেই লজ্জা ভর করে তার দু’চোখের পাতায়।সারহানের ফর্সা পিঠের বিভিন্ন জায়গায় নখের আঁচড় স্পষ্টত।অপ্রস্তুত হয় জান্নাহ্।ছিঃ!কী বিদঘুটে ব্যাপার!
    জান্নাহ লজ্জামিশ্রিত বিব্রত হাসে।আলতো পায়ে সারহানের পাশে এসে বসে।তার পিঠের সেই আঁচড়ে সন্তর্পনে হাত ছোঁয়ায়।
    চুলের ভেতর আঙুল নেড়ে সারহানের মাথায় অস্পষ্ট চুমু খায়।জান্নাহ্ এর হাতের শীতল স্পর্শে জাগ্রত হয় সারহান।জান্নাহ্ এর দিকে ফিরেই মোহবিষ্ট হাসে।জান্নাহ্ এর চোখ দুটো আটকে যায় সারহানের গলা আর বুকে।আস্ত দাঁতের কামড়ের দাগ জ্বলজ্বল করছে।সারহান স্মিত হেসে বিমুগ্ধ গলায় বললো—

    “এতো সকালে উঠলেন যে?

    জান্নাহ্ খেয়ালিপনায় তার হাত ছুঁইয়ে দেয় সারহানের বুকে।অনুযোগের সুর তুলে বললো—

    “সরি।”

    সারহান ফিচেল হেসে চাপা গলায় দুষ্টুমি নিয়ে বললো–

    “আজকাল আপনি এতো ওয়াইল্ড হয়ে যান কেন!

    জান্নাহ্ মুহুর্তেই ঠোঁট চিপে রাগ দেখিয়ে বললো—

    “আর আপনি!

    সারহান টুপ করে জান্নাহ্ এর নিচের ঠোঁটে ছোট কামড় বসিয়ে বললো—-

    “আমি তো জন্ম থেকেই ওয়াইল্ড।যান,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

    জান্নাহ্ দ্রুততার সাথে বললো—

    “জলদি আসুন।নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

    “ওকে,ওকে ডিয়ার বিউটি কুইন।আসছি।”
    ,
    ,
    ,
    চায়ের কাপে চুমুক দিতেই জান্নাহ্ বলে উঠে—-

    “আজ কোথায় নিয়ে যাবেন?

    সারহান আলগোছে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে চিবুক তুলে সহজ গলায় বললো—

    “কোথায় যাবেন?

    জান্নাহ্ ঝট করেই চিন্তাহীনভাবে বললো—

    “মেঘনা নদী।”

    ফস্ করেই হেসে ফেলে সারহান।কিঞ্চিৎ জিঙ্গাসু গলায় বললো—-

    “বাড়ির কাছে নদী থাকতে আপনি এতোদূর নদী দেখতে যাবেন!

    জান্নাহ্ বিজ্ঞের মতো বললো—

    “এইটা কৃত্রিম খাল।নট নদী।”

    “বুঝলাম।কিন্তু আপনার পছন্দ এতো আজব কেন?

    জান্নাহ্ সংক্ষিপ্ত সুরে বললো—

    “জানি না।”

    সারহান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।হেয়ালি গলায় বললো—-

    “আপনার পছন্দ এতো আজব বলেই আপনি আমাকে চুজ করলেন।নাহলে এতো ভালো ভালো অপশন ছেড়ে আদৌ কী আমার কাছে আসতেন!

    জান্নাহ্ উসখুস গলায় বললো—-

    “এইসব কেন বলছেন?

    সারহান অধর কোণে হেসে নির্বিঘ্নচিত্তে বললো—

    “আপনার মা থাকলে এমনটা হতো না।সে অবশ্যই আপনাকে ওয়েল বিহেবড,হাই সোসাইটির কারো সাথেই আপনার বিয়ে দিতো।আমারে কপালে তখন আপনি থাকতেন না।আপনার মা নিশ্চয়ই আপনার চেয়ে বারো তেরো বছরের বড় কোনো ছেলের সাথে আপনার বিয়ে দিতো না।বাট আফসোস!শাশুড়ির অকাল প্রয়াণ আমার ভাগ্য খুলে দিলো।”

    জান্নাহ্ কটমটে গলায় বললো—

    “কী সমস্যা আপনার!আফসোস হচ্ছে আমাকে বিয়ে করে?

    সারহান লম্বা শ্বাস ফেলে বললো—

    “আপনার অবশ্যই হচ্ছে।রাফাত হাত ছাড়া হয়ে গেলো।”

    দারাজ গলায় বলে উঠে জান্নাহ—-

    “সারহান!

    সারহান স্বাভাবিক গলায় বললো—

    “আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড কে আমার সহ্য হয় না।”

    “রাফাত এমন কিছুই করেনি।”

    সারহান গম্ভীর গলায় বললো—-

    “আপনার কী মনে হয় ও এমন কিছু করবে তার অপেক্ষায় আমি বসে থাকবো!

    জান্নাহ্ শক্ত গলায় বললো—

    “আপনি একটু বেশিই ভাবছেন।”

    “ওকে,যাচ্ছি আমি।”

    জান্নাহ্ তড়িৎ বেগে বললো—

    “কোথায় যাচ্ছেন আপনি?আমাকে সাথে নিবেন না?

    “নাহ।কাজ আছে আমার।পরে নিয়ে যাবো।”

    সারহান আর কথা বাড়ালো না।ব্যস্ত পা দুটো সামনে বাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।দরজায় লাগিয়ে গেলো লক।ছোট্ট শ্বাস ফেললো জান্নাহ্।সারহান যতক্ষন বাইরে থাকে তাকে এই ঘরেই বন্দি হয়ে থাকতে হয়।বাড়ির বাইরে সেন্সর লাগানো।যাতে করে দরজার সামনের যে কারো উপস্থিতি সবার আগে সারহান তার ডিভাইসের মাধ্যমে টের পায়।

    জান্নাহ্ তার বেডরুমের বহিরাংশের বারান্দার ক্যাচিগেট খুলে বাগানে আসে।নরম ঘাসের উপর পা ফেলে একটু একটু করে এগিয়ে আসে বাংলোর কার্নিশ ঘেঁষে সদর দরজার দিকে।এইখান থেকে সরাসরিভাবে যাওয়া যায় বাংলোর সদর দরজায়।কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়।সারহান বাংলোর বাইরের সাথে লাগিয়ে সদর দরজার দেয়ালের সাথে নতুন দেয়াল তুলে দিয়েছে।যাতে করে বাংলোর বাইরে যাওয়ার একটাই পথ।আর তা হলো বাংলোর ভেতর দিয়ে জান্নাহ্দের বেডরুম হয়ে।

    উঁচু দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ ভরা হতাশা নিয়ে স্থির হয়ে থাকে জান্নাহ্।তার এমন কেন মনে হয় তার জীবনটাও তার বাবা মায়ের মতো হবে!জান্নাহ্ এর মনে পড়ে তার মায়ের কথা।জান্নাহ্ এর মা যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন তার বাবাও তার মাকে ঘরবন্দি করে রেখেছিলো।মৃণালিনী ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিলো,ছিলো বেসামাল,বেপরোয়া।তাই নিজ সন্তানের নিরাপত্তার জন্য জাফিন বাধ্য হয়েছে এমনটা করতে।কিন্তু জান্নাহ্ তা নয়।সে তার নিজের চাইতে তার প্রাণকে বেশি ভালোবাসে।ঠিক তেমনভাবে তার সন্তানকেও।সে চায় তার আর তার প্রাণের ভালোবাসার অংশ তাদের কোল জুড়ে আসুক।সে বাঁচতে চায় হাজার বছর তার প্রাণের সাথে এই পৃথিবীতে।কিন্তু জান্নাহ্ এর ভয় হয়।তার মনে হয় তার জীবনটাও তার বাবা মায়ের মতো হবে।এমনটাই তো হয়ে চলছে।তার আর তার প্রাণের সম্পর্কটাও দিনদিন অতীত নাড়িয়ে দিচ্ছে।জান্নাহ্ এর অক্ষিযুগল থৈ থৈ করে উঠে।সে চায় না এমনটা হোক।সে ভুল করেও ভাবতে চায় না তার প্রাণকে আঘাত করার কথা।

    ভেজা কর্দমাক্ত ঘাসের উপর নগ্ন পা আওড়াচ্ছে জান্নাহ্। বাতাসে এখনো শীতলতার ভর।তরতর করে তা বইছে।জান্নাহ্ এর ভেজা চুল উড়ে এসে অগোছালো হয়ে পড়ে তার মুখের উপর।ব্যস্ত হাতে তা সরাতেই জান্নাহ্ দেখতে পায় তার বাবা,মা দাঁড়িয়ে আছে।মুহুর্তেই হীম হয়ে আসে জান্নাহ্ এর শরীর।তার ভেজা পা আচমকায় উষ্ণতায় তলিয়ে যায়।জান্নাহ্ ভরা দৃষ্টিতে তার মা,বাবাকে দেখে।তারা অনিমেষ চেয়ে আছে জান্নাহ্ এর দিকে।তাদের অধরে নির্লিপ্ত হাসি।।জান্নাহ্ এর ভয় হয়
    ।তার শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে।জান্নাহ্ ধীরে ধীরে তার চোখের প্রগাঢ়তা বাড়ায়।সে ভুল দেখছে নাতো!

    জান্নাহ্ এর ঘনঘন শ্বাস পড়তে থাকে।জান্নাহ্ এর মনে পড়ে সেই ভয়ংকর রাত।তার রক্তাক্ত মা,বাবা।রক্তে লেপ্টে থাকা নিজের শরীর।কেঁপে উঠে জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর মনে হলো তার মা পৈচাশিক সুখে হাসছেন।তিনি যা চাননি তাই ই ঘটেছে।জান্নাহ্ তার মাকে ঘৃণা করতো শুধু তার বাবার সাথে তার মায়ের সুসম্পর্ক ছিলো না বলে।কিন্তু মৃণালিনী ভালোবাসতেন তার মেয়েকে।জান্নাহ্ এর বুক ভেঙে কান্না আসে।তার এই অবস্থা হয়তো তার মায়ের অভিশাপ।স্বশব্দে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।তার হাত,পা বিবশ হয়ে আসে।চোখ দিয়ে ছলকে উঠে শান্ত,শীতল জলের প্রস্রবণ।ধপ করে নিচে বসে পড়ে জান্নাহ্।এই পৃথিবীতে কেউ নেই তার।কেউ না।তার ভুল শুধরানোর কেউ ছিলো না।যদি থাকতো তাহলে সে এই ভুল কখনো করতো না।কখনো না।সমানতালে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।ভেজা মাটিতে তার শরীরের নিচের অংশ মেখে যায়।তার চুলের আগা দোল খেলতে থাকে কাঁদাজলে।ঘোলা চোখে অস্পষ্ট দেখতে পায় জান্নাহ্ তার বেস্ট বাবাকে। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তার কাছে।হাঁটু গেড়ে বসে জাফিন।জান্নাহ্ এর চোখেরনীরে ভেজা মুখটা মুছে দিয়ে কোমল গলায় বললেন—

    “ইউ আর মাই ব্রেভ গার্ল,মাই ডল।ডোন্ট লুজ হোপ।আই এম অলওয়েজ উইথ ইউ মাই ডল।ডোন্ট ক্রাই।”

    জান্নাহ্ কেঁদে কেঁদে বললো—-

    “আই এম সরি,আই এম সরি বাবা।আই ওয়াজ রং।হি ওয়াজ নট লাইক ইউ।বাট আই লাভ হিম।আই লাভ হিম ভেরি মাচ।”

    জাফিন মেয়ের কপালে উষ্ণ চুম্বন করলেন।নির্মল গলায় বললেন—

    “ভুল থেকেই তো মানুষ শেখে ডল।আমি চাইবো তুমি আর কখনো এই ভুল করবে না।”

    জান্নাহ্ ফুঁপিয়ে উঠে বললো—

    “মাম্মা,আমাকে ক্ষমা করবে বাবা?আমি যে ভুল করে ফেলেছি।তুমি আমাকে কেন ছেড়ে গেলে বাবা?তুমি থাকলে আমি এতোবড় ভুল কখনো করতাম না।এতোটা অন্ধ হতাম না সারহানের ভালোবাসায়।তুমি থাকলে আমি মানুষ চিনতে ভুল করতাম না।”

    জান্নাহ্ উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদতে থাকে।জাফিন সন্তর্পনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—

    “ভাগ্য তো নির্ধারিত ডল।তাতে আমাদের কারো হাত নেই।আল্লাহ্ এর লিখিত সংবিধান তো কেউ বদলাতে পারে না।তুমিও না,আমিও না।”

    “এখন আমি কী করবো বাবা?

    “ধৈর্য্য ধরো।ধৈর্যের ফল সুমিষ্ট হয়।”

    “আর আমার পাপ?আমি যে পাপ করেছি।তার কী হবে বাবা!আমার সন্তান যে আমার পাপের সাজা পেলো।”

    জাফিন আলতো হাতে মেয়ের মাথাটা বুকের সাথে স্পর্শ করালেন পরম মমতায়।জড়িয়ে নিলেন অতলান্তিক মায়ায়।চকিতে জান্নাহ্ অনুভব করলো সেই মমতার হাত ধীরে ধীরে লীন হয়ে যাচ্ছে।জান্নাহ্ অধৈর্য হয়ে মাথা তুলে।জাফিন ক্রমশ প্রলীন হচ্ছে শীতল,শান্ত,স্বচ্ছ বাতাসে।জান্নাহ্ শশব্যস্ত হয়ে তার বাবাকে আটকানোর প্রচেষ্টা চালায়।কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।জাফিন মিলিয়ে যায় বাতাসে।অস্পষ্ট,অদৃশ্য,অস্পর্শনীয় সত্তায় পরিণত হয়।দিকভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাতে থাকে জান্নাহ্।ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুসম ভয় আড়ষ্ট করতে থাকে তাকে।জান্নাহ্ এর শরীর ক্রমাগত তার ভার হারাতে থাকে।চোখের পাল্লা দুটো বন্ধ হতে থাকে ক্ষীন গতিতে।নিশ্চেতন হওয়ার আগ পর্যন্ত জান্নাহ্ দেখতে পায় তার মা দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছে তার দিকে।ঢুলে পড়ে জান্নাহ্ সেই বৃষ্টি ভেজা নরম ভূমি গর্ভে।
    ,
    ,
    ,
    রৌদ্র ঝলমলে দিন।তেজী সূর্য ক্রমশ তার পূর্বের রূপে ফিরে যাচ্ছে।ভেজা রাস্তার স্যাঁতসেঁতে আবরণ শুকিয়ে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে প্রভাকরের তপ্ত লাভা।

    এসির নিচে বসেও স্বস্তি মিলছে না রাফাতের।তার মন,মস্তিষ্ক দুটোই ঘোড়দৌঁড়ের মতো ছুটছে।ক্লান্ত,শ্রান্ত।তার সমান্তলার কপালে চিন্তার ভাঁজ।মুখ জুড়ে এলোমেলো অঙ্গভঙ্গি।চোখে অগ্নিলাভা।ব্যতিব্যস্ত হাতের নাড়াচাড়া।ইহতিশাম পূর্ণ দৃষ্টি ক্ষেপণ করলো।হালকা গলায় উৎসুক হয়ে বললো—

    “এনি থিংক রং?

    অধর ছড়িয়ে শ্বাস নিলো রাফাত।কপালের ঘামটা মুছে সোজা চেয়ে রইলো ইহতিশামের দিকে।মস্তিষ্কের জাগ্রত চিন্তাগুলো ক্রমশ তরতর করে সারা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।নিদারুন যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠলো রাফাত।এই যন্ত্রণার শেষ হওয়া প্রয়োজন।মুখ খুললো রাফাত।স্বশব্দে বললো—

    “জান্নাহ্ এর খোঁজ জানো?

    ইহতিশাম অবাক হলো না।কিন্তু গাঢ় গলায় বললো—

    “তুমি ঠিক আছো তো রাফাত?

    রাফাত ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে বললো—

    “হুম।আমি ঠিক আছি।”

    রাফাতের অস্থিরতা চোখ এড়ালো না ইহতিশামের।পানিভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে নম্র গলায় বললো–

    “পানিটা নাও।”

    গলায় প্রস্ফুরণ হচ্ছে রাফাতের।পানিটা পান করে একটু ধাতস্থ হয়ে বুক ভরে লম্বা শ্বাস নেয় রাফাত।কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললো—-

    “আমি কাল রাতেও এসেছিলাম তোমার কাছে।কিন্তু তুমি ক্যাবিনে ছিলে না।তোমার অ্যাসিস্টেন্ট বললো বাসায় চলে গেছো।”

    ইহতিশাম মৃদু হাসলো।সরস গলায় বললো—-

    “তুমি ঠিক নেই রাফাত।শান্ত হও।”

    রাফাত বিচলিত গলায় বললো—

    “তুমি প্লিজ আমাকে জান্নাহ্ এর ঠিকানাটা বলো।গত একমাস ধরে ওর সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারছি না।ওর নাম্বারও বন্ধ।আমি সারহানের ফ্ল্যাটেও গিয়েছি।কোথাও নেই ওরা।তুমি প্লিজ বলবে কোথায় আছে জান্নাহ্।ও ঠিক আছে তো?

    ইহতিশাম দুর্বোধ্য হাসলো।রাফাতের দিকে ঝুঁকে আস্ত নজরে তাকে পর্যবেক্ষণ করে সরব গলায় বললো—–

    “জান্নাহ্ ভালো আছে।কারণ সারহান ভালো আছে।”

    ফুঁসলে উঠে রাফাতের সুপ্ত রাগ।উচ্চকিত গলায় বললো—

    ” তুমি কেন বুঝতে পারছো না!জান্নাহ্ সারহানের সাথে সেফ নয়।মেয়েটা এইটুকু বয়সেই কতবড় ভুল করে ফেলেছে।না জানি সামনে আরো কত বড় ভুল করে বসে!সারহান যোগ্য নয় আমার জান্নাহ্ এর।”

    লম্বা দম নেয় কথা শেষ করে রাফাত।আশ্চর্যচকিত ইহতিশাম।মুহূর্তেই এতোটা এগ্রেসিভ হয়ে গেলো রাফাত।আমার দুম করে নিভেও গেলো।ইহতিশাম ছোট্ট দম ফেলে অনুরক্তির সুরে বললো—

    “সারহান জান্নাহ্কে ভালোবাসে রাফাত।ডোন্ট ওয়ারি।ও ভালো থাকবে।”

    পৈচাশিক হাসে রাফাত।চোখে তাচ্ছল্য নিয়ে উপহাস করে বললো—

    “ভালোবাসে!যে পুরুষ নিজের স্ত্রী থাকতেও পরকীয়ায় লিপ্ত থাকে সে কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারে না।”

    ইহতিশাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো।নমনীয় গলায় বললো—

    “তুমি ভুল ভাবছো রাফাত।সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিত যদি মন থেকে সে অনুতপ্ত হয়।আর সারহানের আলবৎ পাওয়া উচিত।ওর এই জীবনের জন্য ও একা দায়ী নয়।”

    “বাট ইহতিশাম…।”

    “আমাকে বলতে দাও।আমি মানছি সারহান ভুল করেছে।ভুলের শাস্তিও সে পেয়েছে।এখন সে নতুন করে জান্নাহ্কে নিয়ে বাঁচতে চায়।আমি ওকে সেই সুযোগ দিয়েছি।জান্নাহ্ নিজে সেই সুযোগ দিয়েছে সারহানকে।”

    রাফাত উদ্বেলিত গলায় বললো—

    “কারণ জান্নাহ্ এখনো অবুঝ।ও বুঝতেই পারছে না কী হচ্ছে ওর সাথে।ছোটবেলা থেকে চিনি ওকে আমি।কাউকে কিছু বলে না।নিরবে সব সহ্য করে নেয়।ওর ভেতরের চাপা কষ্ট বোঝার কেউ নেই।সারহানও নয়।”

    তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ইহতিশাম।তার পুরু ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে।নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে চোয়াল শক্ত করে।উষ্ণ গলায় বললো—

    “আমি মানছি তোমার কথা।কিন্তু সারহান সত্যিই জান্নাহ্কে ভালোবাসে।”

    খলবলিয়ে উঠে রাফাত।বললো—

    “তাহলে গায়েব কেন হয়ে গেলো ও?কোথায় সে?আমি একবার জান্নাহ্ এর সাথে কথা বলতে চাই।আমার জান্নাহ্কে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে সারহান।আই ডোন্ট বিলিভ হিম।একটা বাস্ট…।”

    ইহতিশাম অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠে—

    “মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ।তোমার রাগের কারণে তুমি এ ধরনের ধারণা পোষণ করতে পারো না সারহান সম্পর্কে।”

    “ওকে।তাহলে বললো কোথায় আছে সে?

    ইহতিশাম স্বাভাবিক গলায় বললো–

    “আমি জানি না।শায়িখের সাথে কথা বলেও লাভ হয়নি।ও বলেছে ও জানে না।আর আমার মনে হয় ও জানলেও বলবে না।”

    রাফাত চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে উদ্বিগ্ন গলায় বললো—

    “তাহলে কোথায় পাবো আমি জান্নাহ্কে?

    “অপেক্ষা।”

    রাফাতের চোখের চাহনি গাঢ় হতে লাগলো।তার কেন মনে হলো ইহতিশাম কিছু লুকোচ্ছে।কী লুকোচ্ছে?

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬৩
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    চারপাশে মৃদুমন্দ হিমেল বাতাসে আজকের বিকেলটা অন্য বিকেল থেকে আলাদা।জৈষ্ঠ্য মাসের প্রভাকরের প্রখর রশ্মি জানান দেয় এইতো মধু মাস।

    বাগানের দোলনায় বসে আছে সারহান।নিরুঙ্কুশ ভেবে চলা অতীত হাতড়ে খুঁজে চলছে বর্তমানের ছোঁয়া।মোবাইলের রিং অনবরত বেজে যাচ্ছে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভ করলো সারহান।মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করলো—

    “কেমন আছো শায়িখ?

    এপাশ থেকে শীতল শ্বাস ফেললো শায়িখ।নির্মল গলায় প্রত্যুক্তি করে বললো—

    “ভালো আছি স্যার।আপনি কেমন আছেন?

    সারহান হেয়ালি গলায় হতাশ শ্বাস ফেলে বললো—

    “ভালো।কী মনে করে কল করলে?

    শায়িখ চুপ করে রইলো।আচমকা বলে উঠে—

    “ভাবীজান কেমন আছেন?

    স্বশব্দে হেসে উঠে সারহান।অনেকটা অবিশ্বাস নিয়ে বললো—

    “ধোঁকা দেওয়ার জন্য তুমিই বাকি ছিলে।”

    মুহূর্তেই ধক করে উঠে শায়িখের হৃদয়টা।নিভে গেলো তার গলার ক্ষীন স্বর।আমতা আমতা করে আধ ভাঙা গলায় বললো—

    “আমিইইইই….।”

    মলিন হাসলো সারহান।বাঁধাহীন সুরে বললো—

    “জান্নাহ্কে তুমি থামাতে পারতে ইচ্ছে করলে।”

    তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো শায়িখ।তার বুকটা ভার হয়ে এলো অপরাধবোধে।অনুযোগের সুরে বললো—

    “আমি আসলে স্যার….।”

    “জান্নাহ্ তোমাকে ভাই বলে ডেকেছে।অন্তত সেই কারণেই তাকে থামাতে পারতে।আমার অন্যায়ের শাস্তি সে কেন পাবে!

    ত্রস্ত গলায় বলে উঠে শায়িখ—

    “বিশ্বাস করুন স্যার,জান্নাহ্ তেমন মেয়েই নয়।কী থেকে কী হয়ে গেলো।আমি…।”

    সারহান একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো—

    “তোমার মা কেমন আছে?

    শায়িখ ক্ষণকাল চুপ থেকে শঙ্কামুক্ত হয়ে বললো—

    “মা ভালো আছে স্যার।জান্নাহ্ কেমন আছে?

    অধর কোণে হাসলো সারহান।তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক তার সাথে থেকেই এতবড় একটা খেলা খেললো তার কিছুই সে বুঝতে পারলো না।সাবলীল গলায় বললো—

    “জান্নাহ্ ভালো আছে।”

    স্বস্তির শ্বাস নিলো শায়িখ।মৃদু হাসলো সারহান।শায়িখ ব্যগ্র হয়ে আবার প্রশ্ন করে—-

    “আপনি কেন নিজেকে আড়াল করেছেন স্যার?

    সারহান শঙ্কিত গলায় বললো—

    “আমার অতীত যে আমায় ছাড়ছে না শায়িখ।”

    “কিন্তু স্যার,জান্নাহ্ তো সব জানে।আপনাকে কিছু লুকাতে হবে না।”

    নিজের জীবনের উপর বিদ্রুপাত্মক হাসলো সারহান।থমথমে গলায় বললো—

    “এখনো সব জানা হয়নি শায়িখ।জানি না আমার সেই অতীত আদৌ আমার রজনীগন্ধা মেনে নিবে কিনা!

    শায়িখ অবগত নয় সেই মেহনাজ সম্পর্কে।হয়তো শায়িখ জানলে অনেক আগেই জান্নাহ্ এর সামনে চলে আসতো এই সত্য।চট করেই অদ্ভুত কথা বলে ফেললো শায়িখ—-

    “এই জন্য আপনি জান্নাহ্কে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছেন?

    নিজের কথায় নিজের জীভ কাটে শায়িখ।বৃহৎ ঢোক গিলে মিনমিনে গলায় আবার বললো—

    “আসলে স্যাআআর,…..।”

    অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললো সারহান—

    “ঠিক বলেছো তুমি।তাকে আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাতে পারবো না।”

    দুই পাশে নিরবতার বাতাস বইতে লাগলো।মৌনতা কাটিয়ে শায়িখ বললো—

    “ইহতিশাম স্যার পাগর হয়ে খুঁজছে আপনাকে।আমাকেও বার কয়েক আপনার কথা জিঙ্গেস করেছিলো।আমি বলেছি আপনার সাথে আমার কন্টাক্ট নেই।”

    স্মিত হাসলো সারহান।খসখসে গলায় বললো—

    “তোমার কী মনে হয় ইহতিশাম আদৌ তোমার কথা বিশ্বাস করেছে?

    খলখল করে হেসে উঠে শায়িখ।রসালো গলায় বললো—

    “আমি আপনার একমাত্র অনুজ্ঞাবহ সহচর স্যার।এতো বোকা নই আমি।রাফাত গত দুই মাস ধরে আমাকে চুষে খাচ্ছে শুধু আপনার ঠিকানা জানার জন্য।”

    “তো এখন কী করবে তুমি?

    “এই মাত্র সিমটা অন করলাম।কথা শেষ করে এই যে হাতির ঝিল দাঁড়িয়ে আছি।সিমটা ডেসট্রয় করে এখানেই ফেলে দিবো।”

    ম্লান হাসে সারহান।মখমলে গলায় বললো—

    “রাফাত ছেলেটা কিন্তু খারাপ না।”

    “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ স্যার।সেদিন আমার কলার চেপে ধরলো।ইচ্ছে করছিলি ওর নাকটা ফাটিয়ে ওকে ওর বাবার পেশেন্ট বানাই।ছেড়ে দিলাম শুধু জান্নাহ্ এর জন্য।”

    সরস গলায় বললো সারহান—

    “রাফাতের চিন্তা কারণবিহীন নয়।আমার মতো একজনের সাথে সে তার ভালোবাসার মানুষকে কল্পনা করতে পারছে না।আর তা হওয়ারই কথা।আমি ভালো লোক নই শায়িখ।”

    শায়িখ মুখ বিকৃত করে তীর্যক গলায় বললো—

    “কিন্তু জান্নাহ্ তো আপনাকে ভালোবাসে।রাফাত এমন কোন দুধে ধোওয়া পুরুষ নয় যে জান্নাহ্কে তার ভালোবাসতে হবে।দীর্ঘ বারো বছরেরও যখন আম খেয়ে আঁটি গুনতে পারলো না ওই ছেলের কোনো অধিকার নেই জান্নাহ্ এর পেছনে আঠার মতো লেগে থাকার।”

    সারহান নির্লিপ্ত হাসে।শায়িখ আগ্রহী হয়ে বললো—

    “একটা কথা বলবো স্যার?

    “হুম।”

    “আমার মনে হয় আপনার জান্নাহ্কে সব বলে দেওয়া উচিত।ও যেহেতু সব মেনে নিয়েছে ও নিশ্চয়ই আপনাকে বুঝবে।আর আমার বিশ্বাস আমার স্যার জেনে বুঝে কখনো কোনো ভুল করবে না।”

    সারহান দীপ্ত গলায় বলে উঠে—-

    “মানুষ মাত্রই ভুল শায়িখ।এখনো সময় হয়নি তার সবটা জানার।জানোতো ক্ষুধার্ত পুরুষ বাঘ নিজের সন্তান কে ভক্ষন করতেও দ্বিধা করে না।।রাখছি আমি।বাই।”
    ,
    ,
    ,
    মুখভর্তি বমি করতেই শ্বাসে টান পড়ে জান্নাহ্ এর।অধর চেপে ধরে বার কয়েক বদ্ধ শ্বাস টেনে চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে তাকায়।আজকাল কিছু মুখে দিলেই এমনটা হয়।তা নিয়ে বিচলিত নয় জান্নাহ্।একটু ধাতস্থ হয়ে গ্লুকোজ গোলা পানি পান করে মুক্ত শ্বাস নেয় জান্নাহ্।পাশে রাখা ফালুদা ভর্তি আইসক্রীম এর বাটির ট্রে টা হাতে নেয় জান্নাহ্।গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে বাগানে।সারহানের দিকে ট্রে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো–

    “নিন।খেয়ে ঠান্ডা হোন।”

    সারহান শান্ত গলায় বললো—-

    “আপনাকে তো রান্নাঘরে যেতে নিষেধ করেছি।”

    জান্নাহ্ স্মিত হেসে ঝলমলে গলায় বললো—

    “তাহলে ফ্রিজটা বেডরুমে এনে দিন।”

    গম্ভীর মুখে চোখে হাসে সারহান।ছোট্ট করে বললো—

    “বসুন।”

    সারহানের পাশে বসেই তার কাঁধে মাথা রাখে জান্নাহ্।বাটি থেকে আইসক্রীম মুখে দিয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকায় সামনে সারহান।জান্নাহ্ কাতর গলায় প্রশ্ন করে—

    “শুভ্রা আপু কেমন আছে সারহান?

    সারহান ঝটকা মেরে বলে উঠে—

    “জানি না।”

    সারহানের কাঁধ থেকে মাথা উঠায় জান্নাহ্।ক্ষীণ গলায় বললো—

    “তিতি খুব কাঁদছিলো।আপু নাকি খুব অসুস্থ।কারো সাথে কথা বলে না।শুধু তাকিয়ে থাকে।এমনটা কেন করলেন সারহান?

    সারহান চুপ করে রইলো।গুমোট যন্ত্রণা বিক্ষিপ্ত হতে লাগলো।জল ছেপে আসে চোখের কোণে।রুষ্ট গলায় ঘোষণা করে—

    “পাপের শাস্তি সবার প্রাপ্য।তার একটা মিথ্যে আমার পুরো জীবনটা অথৈ সাগরে তলিয়ে দিয়েছে।সেদিন যদি ওই বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে না আসতাম তাহলে ইহতিশামের সাথে কখনো দেখা হতো না আমার।না এমন হতো আমার জীবনটা।”

    সারহানের কথার পিঠেই বেখেয়ালিভাবেই বলে উঠে জান্নাহ্—-

    “তাহলে আপনার সাথেও আমার কখনো দেখা হতো না সারহান।”

    সারহান ঘাড় বাকিয়ে তাচ্ছিল্য চোখে তাকিয়ে নিষ্প্রভ গলায় বললো–

    “তাহলে আপনার জীবনটাও এমনভাবে নষ্ট হতো না রজনীগন্ধা।আপনি মানেন বা না মানেন এইটা সত্য যে আমি আপনার যোগ্য নই।”

    জান্নাহ্ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো।বিষয় বদলাতে সারহান বলে উঠে—-

    “আপনাকে এমন লাগছে কেন?ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না?দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছেন।খাওয়ার কষ্ট দিচ্ছি আপনাকে আমি?

    জান্নাহ্ ঝট করেই বললো—-

    “আমি কী আপনাকে বলেছি!

    অধর কোণে সংকীর্ণ হাসে সারহান।আচমকা মাথা চক্কর দিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর।মুখে আইসক্রীম দিয়ে তাকাতেই হেলে পড়তে গেলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জান্নাহ্কে বুকের সাথে চেপে ধরে সারহান।উদ্বেলিত গলায় ডেকে উঠে—

    “রজনীগন্ধা,রজনীগন্ধা!
    ,
    ,
    ,
    ফট করে উঠেই সারহানকে ধাক্কা মারে জান্নাহ্।মেকি রাগ দেখিয়ে বললো—

    “সরুন,অসভ্য লোক!

    সারহান মৃদু ছন্দে হাসে।ফিচেল গলায় বললো—

    “কী সমস্যা আপনার!এখনো হাত লাগাতেই ছ্যাত করে উঠেন!এতো সুড়সুড়ি কোথায় পান!

    “আপনার মাথায়।”

    সারহান জান্নাহ্ এর কপালে কপাল ঠেকিয়ে অভিমানি গলায় বললো—-

    “আগে বলেন নি কেন আমাকে?

    জান্নাহ্ প্রতিক্রিয়াহীন সুরে বললো—

    “আমি কেন বলবো!আপনি বুঝে নিতে পারেন না।”

    প্রাণখোলা হাসে সারহান।কৃতজ্ঞতার সুরে বললো—

    “থ্যাংকস।”

    “ভ্যা।”

    ভেঙচি কাটে জান্নাহ্।খলখলিয়ে হেসে উঠে সে।সারহান জান্নাহ্ এর গালের উঁচু জায়গায় কামড় বসায়।অতর্কিত এই ভালোবাসার অত্যাচারে জান্নাহ্ নাক ফুলিয়ে বললো—

    “অসভ্য লোক।”

    সারহান ফিচেল হেসে চাপা গলায় বললো—

    “অসভ্য বলেই তো এখন বাবা হবো।নাহলে তো সালমান খান হতাম।”

    ঝুমঝুমিয়ে হেসে উঠে জান্নাহ্।তার হাসিতে সারহানের রুক্ষ বুকে প্রশান্তির হাওয়া বইতে লাগলো।দুই হাতে জান্নাহ্কে আলিঙ্গন করে বললো—

    “আমার জানপাখি।”

    সারহান জান্নাহ্ এর গলায়,গালে অধর ছোঁয়াতে থাকে।সারহানের হাত ধরে আনম্র গলায় জান্নাহ্ বললো–

    “আপনি খুশি সারহান?

    সারহান এক সমুদ্র হৃদয় ভেজা ভালোবাসা নিয়ে বললো—-

    “আমার প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন আর আমি খুশি হবো না!

    সোনালী রোদের মতো চকচক করে উঠে জান্নাহ্ এর দুই চোখ।তার মনে খুশির হাওয়া পালতোলা নৌকার মতো ফড়ফড় করে বইতে লাগলো।সারহানের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে একটু উঁচু হয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় তার কপালে।বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সারহান।দুষ্টুমির ছলে বললো—

    “পড়লেখা তো সব চাঁন্দের দেশে পাঠালেন।”

    জান্নাহ্ চটপটে গলায় বললো—

    “তা হবে কেন!বাবু আসলে আবার ভর্তি করিয়ে দিবেন।আমি পড়বো।আর বাবুকে আপনি সামলাবেন।বাবুর ন্যাপি চেঞ্জ করবেন,বাবুকে খাওয়াবেন,ওকে গোসল করাবেন।পারবেন না?

    সারহান কিছুক্ষন চুপ থেকে রসালো গলায় বললো—

    “পারবো না কেন!না পারলে শিখে নিবো।আর দরকার হলে একটা সুন্দরী আয়া রেখে দিবো।মেয়েরও সুবিধা,বাবারও সুবিধা।”

    জান্নাহ্ চোখ মুখ খিঁচে সারহানের কলার চেপে ধরে।খরখরে গরায় বললো—-

    “এরপর যদি কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন তাহলে আপনার চোখ তুলে ফেলবো আমি।”

    সারহান শ্বাসবন্ধ করে মৃদু হাসে।জান্নাহ্ এর কোমরের দুই পাশে সুড়সুড়ি দিতেই অকস্মাৎ বিছানায় গড়িয়ে পড়ে জান্নাহ্।সারহান তার উপর ঝুঁকে জান্নাহ্ এর অধরে ভয়ংকর,দম বন্ধকর চুমু খায়।মোহবিষ্ট গলায় বললো—

    “মাই লাভ বার্ড।”

    “তোর পরাণে বাঁধিয়াছি ডোর
    তোর হৃদয়ে জীবনের ঘোর
    তোর শ্বাসেই আমার বাস
    তোর ভালোবাসায় আমার সর্বনাশ।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬৪
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    স্নিগ্ধ সকালের এক ঝাঁক উল্লাসিত রোদ এসে ঘুম কেড়ে নেয় জান্নাহ্ এর।জানালার পর্দা কাঁপিয়ে ফিনফিনে বাতাস ঢুকে চোখের পাল্লা নাচিয়ে দিচ্ছে।অগোছালো ঘুম ভেঙে যেতেই জান্নাহ্ আবিষ্কার করে সে জড়িয়ে আছে সারহানের বক্ষস্পন্দের সাথে।যেখান থেকে স্পষ্টত তার উষ্ণ প্রাণশ্বাস আর বুকের ছোট্ট প্রাণপাখির পাখা ঝাঁপটানোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।নিমিঝিমি অক্ষিপুট মেলে তাকায় জান্নাহ্।সারহানের স্নিগ্ধ,নিষ্পাপ আদুরে মুখচ্ছবি দেখে আলতো হাসে।নিজেকে একটু ঘুরিয়ে সারহানের মুখ পানে সমান্তরাল করে।নিজের নরম আদর মাখা হাতের ছোঁয়া দেয় সারহানের ঘুমন্ত মুখে।প্রগাঢ় ভালোবাসায় ডান হাতের তর্জনীর মৃদু স্পর্শ আঁকে সারহানের পুরু পিচ রঙা অধরে।আড়মোড়া ভেঙে নিজের হাতের বলয় আরো জোড়ালো করতেই জান্নাহ্ এর সম্পূর্ণ ভর গিয়ে পড়ে সারহানের বুকে।জান্নাহ্ মৃদু কম্পনে বললো—

    “সারহান!
    সাবধান!

    মুদিত চোখেই স্মিত হাসে সারহান।মাথাটা হালকা নিচে নামিয়ে জান্নাহ্ এর গলায় মুখ গুঁজে দেয়।সারহানের বুকের কাছে আনমনে বলয় আঁকতে থাকে জান্নাহ্।

    একটা পাখি এসে বসেছে জানালার গ্রীলে।ছোট্ট চড়ুই পাখি।রোজ আসে।জান্নাহ্ মন ভরে দেখে তাকে।একা আসে না সে।সঙ্গী নিয়ে আসে।অনেক কথা বলে তারা।জান্নাহ্ আড়ি পেতে শোনে।এক ছোট্ট ভালোবাসার ঘরের কথা।দুই জন প্রেমেমত্ত কপোত-কপোতীর কথা।শোনে তাদের সুন্দর আগামীর কথা।
    জান্নাহ্ ভাবে,আচ্ছা পাখির কথা কেউ বোঝে?
    জান্নাহ্ এর মনে হয় সে বোঝে।সে স্পষ্ট শুনতে পায় তারা কী বলছে।সেদিন যখন জান্নাহ্ একা বাগানে বসে ছিলো তখনও এরা দুইজন সেখানে এসেছিলো।কথা বলছিলো।পাশে জান্নাহ্ তার বাবাকেও দেখতে পায়।সেও শুনছিলো।বর পাখিটি তাদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর কথা বলছিলো।বউ পাখিটি রেগে গিয়ে বললো,সে এখন বেবি প্ল্যানিং এ একদম প্রস্তুত নয়।ঝগড়া বেঁধে যায় তাদের মধ্যে।জান্নাহ্ কৌতূহলী দৃষ্টিতে ঝুমঝুমিয়ে হাসে।তার বাবা এসে তার পাশেই বসে।মুগ্ধ হাসে সে।জাফিন আলগোছে মেয়ের মাথায় হাত বোলায়।বুক ভরে দোয়া করে তাকে।জান্নাহ্ নরম চোখে তার বাবাকে দেখে।নিগূঢ় মমতা,পরম স্নেহ আর বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে চেয়ে থাকে জাফিন।তারপর ধীরে ধীরে প্রলীন হতে থাকে বাতাসে সে।জান্নাহ্ ফের একা হয়ে যায়।নিজের পেটের উপর হাত রাখতেই চোখে পড়ে তার মাকে।মৃণালিনী বিস্মিত নয়নে ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে আছে।জান্নাহ্ দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ায়।মাকে ছোঁয়ার জন্য একটু একটু করে পা বাঁড়ায় জান্নাহ্।মৃণালিনী ইশারায় অতলস্পর্শী মায়ায় ডাকতে থাকে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ খেয়ালই করেনি কখন তার সামনে একটা বড় ইটের টুকরো এসে পড়েছে।আর এক পা বাড়ালেই ইটের সাথে লেগে সোজা গিয়ে পড়তো জান্নাহ্ সেই ইটের ভাঙা টুকরোর উপর।যাতে করে ওই ভাঙা টুকরোটা গেঁথে যেতো জান্নাহ্ এর উদরে।কিন্তু তার আগেই চড়ুই পাখি দুটো ফুড়ুৎ করে জান্নাহ্ এর চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যায়।আকস্মিক ঘটনায় থমকে যায় জান্নাহ্।বেঁচে যায় তার অনাগত সন্তান,প্রাণের শ্বাস নেয় জান্নাহ্।দিকভ্রান্তের মতো তাকাতে থাকে জান্নাহ্।তার মায়ের চোখে ভরা জল।কাতর চোখে তাকিয়ে আছে মৃণালিনী মেয়ের দিকে।জান্নাহ্ ভেজা গলায় ডেকে উঠে—

    “মাম্মা,মাম্মা।”

    চকিতে থেমে যায় বাতাস।থমথমে পরিবেশ।কিচকিচ করে ডেকে উঠে সেই চড়ুই দুটো।জান্নাহ্কে ডেকে বলছে—

    “মিথ্যের মায়ায়,সত্যের জয়
    চোখে দেখা সত্য,কভু মিছে হয়
    এপারে লেনদেন,ওপারে হিসেব
    তাই যত চাই,বেড়ে যায় দায়,
    হিসেব মিলেতে প্রাপ্তির খাতায়
    তবুও গড়মিল চোখে পড়ে রয়।
    যত কষে অঙ্ক,জীবনের হিসেব
    হয়ে যায় শূন্য,অন্তিম শয্যায়।”

    চোখ সরায় জান্নাহ্।একা থাকলেই সে অনুভব করে তার বাবা মাকে।তার মা কখনো কথা বলে না।তার বাবা তার সাথে কথা বলে।তাকে আশ্বাস দেয়।যেমনটা সারহান দেয়।

    গম্ভীর শ্বাস ফেলে সারহানের দিকে তাকায় জান্নাহ্।বেচারা কাল ঘুমাতে পারে নি।বার কয়েক বমি করায় জান্নাহ,তাকে বুকে জড়িয়েই বসে থাকে সারহান।শেষ প্রহরেই ঘুমিয়েছে সারহান।জান্নাহ্ অনিমেষ চেয়ে থাকে তার প্রাণের দিকে।কোমল স্পর্শ করে তার ঠোঁটে।আদুরে গলায় বললো—

    “সারহান!

    ঘুম জড়ানো গলায় আওয়াজ করে সারহান—

    “হুম।”

    “আমি রাফাতের সাথে কথা বলবো।”

    সময় ব্যয় না করেই সারহান বললো—

    “মোবাইল ওখানেই আছে।কথা বলুন।”

    জান্নাহ্কে ছেড়ে পাশ ফিরে শোয় সারহান।পেটের উপর হাত রেখে অত্যন্ত সাবধানে বিছানা থেকে পা নামায় জান্নাহ্।বেড সাইড টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে ধীরে ধীরে ছোট ছোট পা ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।রাফাতের নাম্বারে ডায়াল করে এক পশলা উচ্ছ্বাস নিয়ে।
    ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই মুক্ত শ্বাস ফেলে খুশি খুশি গলায় বলে উঠে জান্নাহ্–

    “কেমন আছো রাফাত?

    রাফাত যেনো দুনিয়া কাঁপিয়ে ফেললো।ভয়ংকর অনুভূতি নিয়ে আঁতকে উঠে বললো—

    “জান্নাহ্!তুমি!কোথায় আছো তুমি?কেমন আছো তুমি?এতোদিন কোথায় ছিলে?তোমার নাম্বার বন্ধ কেন?

    ঝুমঝুমিয়ে হাসে জান্নাহ্।হেসে হেসে বললো—

    “শ্বাস নেও রাফাত।এত্তো প্রশ্ন!আমি কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবো!

    উচ্চকিত কন্ঠে রাফাত বললো–

    “কোথায় তুমি?

    জান্নাহ্ ফিক করে হেসে বললো—

    “আমি আকাশে,আমি সাগরে,আমি মাটিতে আর আমি তোমার রেড ওয়াইনে।”

    খিলখিল করে আবার হাসে জান্নাহ্।ওপাশ থেকে স্বস্তির শ্বাস ফেলে আশ্বস্ত হাসে রাফাত।তার রেড চেরি ঠিক আছে।জান্নাহ্ অনুসন্ধানী গলায় বললো—

    “এই,তুমি এখনো রেড ওয়াইন পান করো নাকি?

    মৃদুহাস্য অধরে উত্তর করে রাফাত।দৃঢ় হয়ে বললো–

    “আই হেট রেড।”

    আওয়াজ করে হেসে উঠে জান্নাহ্।মিইয়ে গলায় বললো—

    “ইউ হেট মি?

    রাফাত দ্বিধাহীন হয়ে সহজে বলে ফেললো—

    “আই লাভ ইউ।
    বলা হয়নি কখনো।ভেবেছিলাম বুঝবে তুমি।কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।বড্ড দেরি করে ফেললাম আমি।”

    জান্নাহ ধুম ধরে থাকে বর্ষণের আগ মুহূর্তের মেঘলা আকাশের মতো।যেনো এখনই ভারী বর্ষণ হবে।হলোও তাই।তবে তা মেঘের আড়ালে।মৃদু গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

    “তোমাকে যে আরো একজনকে ভালোবাসতে হবে রাফাত।আই এম প্রেগন্যান্ট।ফাইভ মানথ রানিং।”

    ধপ করে জ্বলে উঠে রাফাত।রুষ্ট কন্ঠে বললো—

    “এইসব কী বলছো তুমি?পাগল হয়ে গিয়েছো?

    জান্নাহ্ ক্ষীণ সুরে বললো—

    “আমি সত্য বলছি রাফাত।আমি মা হতে চলেছি।”

    দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে খটমটিয়ে বললো রাফাত—

    “এইসব কেন করছো তুমি?মাত্র সিক্সটিন তুমি।এখনই এইসব!

    জান্নাহ্ প্রসন্ন গলায় বললো—

    “সারহান চায় আমাদের সম্পর্ক আরো স্ট্রং হোক।আজ প্রথমবার সে আমার কাছে নিজ থেকে কিছু চেয়েছে।আমি সারহানকে ভালোবাসি রাফাত।”

    রাফাত ঝামটা মেরে বললো–

    “ভালোবাসলেই ওর সব কথা শুনতে হবে!নিজের কথা ভাববে না তুমি?

    “কে বললো ভাবি নি!আমি ভালো আছি রাফাত।সারহান আমার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখে।ঘরের সমস্ত কাজ নিজের হাতে করে।বাবার মতো আমাকে খাইয়েও দেয়।তোমার মতো প্রায়ই আমাকে ঘুরতে নিয়ে যায়।মাম্মার মতো কঠোর যত্নে রাখে আমায়।তোমাদের সবার কম্বিনেশন আমার সারহান।সে বলেছে,সে তার পরীর বেস্ট বাবা হবে।তাহলে কেন আমি তাকে সেই সুযোগ দিবো না?

    রাফাত দাম্ভিক শ্বাস ফেলে দাঁতখামটি মেরে বললো—

    “পাগল হয়ে গেছো তুমি।কার সাথে কার কম্পেয়ার করছো ?

    জান্নাহ্ সরস হেসে বললো—

    “ঠিক।আমার সারহান সবার থেকে আলাদা।ভালো থেকো রাফাত।আমি ভালো আছি।ডোন্ট ওয়ারি ফর মি।”

    লাইন ডিসকানেক্ট হতেই তা সজোরে নিক্ষেপ করে রাফাত জানালার থাই এ।পুরু থাই গ্লাসে কিঞ্চিৎ ফাটল দেখা দিলেও মোবাইল ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে।চুল টেনে ধরে নিচে বসে পড়ে রাফাত।গনগনে সূর্যের মতো টগবগ করছে তার মস্তিষ্ক।

    ঘুরে দাঁড়াতেই জান্নাহ্ এর নাক ঠেকে সারহানের বক্ষস্থলে।দুর্বোধ্য হাসে সারহান।কোমল গলায় বললো—

    “আপনার ব্রেকফাস্ট রেডি।যান ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন।”

    জান্নাহ ভ্রু কুঁচকে শুষ্ক গলায় বললো—

    “আপনাকে কে বলেছে এইসব করতে?

    “তাহলে কে করবে মাই লাভ বার্ড!

    অকস্মাৎ জান্নাহ্ এর অধরযুগল নিজ ওষ্ঠাধরে লুফে নেয় সারহান।জান্নাহ্ ঝাড়া মেড়ে অসহিষ্ণু গলায় বললো—

    “ছিঃ!খবিশ।আপনি আসলেই একটা অসভ্য লোক!

    ফিচেল হাসে সারহান।জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে চোখের পাতায় নমনীয়তা আনে।সারহান বিমুগ্ধ গলায় প্রশ্ন করে—

    “কথা বলেছেন?

    জান্নাহ্ নির্জীব চোখে তাকিয়ে হালকা হাতে আঁকড়ে ধরে সারহানকে।তার বুকে সন্তর্পনে মাথা রাখে।সারহান দুই হাতের বেঁড়ে বাঁধে জান্নাহ্কে।সারহানের হৃদপিন্ডের স্পন্দন ঝংকার তোলে জান্নাহ্ এর সারা অঙ্গে।জান্নাহ্ এর ছড়ানো চুলে আঙুল হাতড়ে নরম গলায় সারহান বললো—-

    “আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড রেগে আছে তাই না?

    জান্নাহ্ অস্পষ্ট আওয়াজে বললো—

    “হুম।”

    সরস গলায় বললো—-

    “তাকে বলবেন চিন্তা না করতে।আমি আপনার খেয়াল রাখবো।”

    আকাশে গুমোট মেঘ ডেকে উঠে।চকিতে জান্নাহ্ সপ্রতিভ হয়ে বাইরের দিকে তাকায়।বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবের উন্মেষ হলো।জান্নাহ্ চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে বললো—

    “আজ বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে?
    ,
    ,
    ,
    ঝুম বৃষ্টিতে রাতের আকাশ নেচে উঠেছে উল্লাসে।বেলি ফুলের সৌরভে ভরে আছে বারান্দা।ঝুলন্ত টবে জানালার সাথে ঝুলছে মানি প্ল্যন্ট।বারান্দায় সারি বিছানো বেলি,গাঁদা আর গোলাপের গাছ।তার সাথেই পাথর কুচি।বেলি ফুলের গাঢ় সুবাসের সাথে বাতাসে দোল খেলছে গোলাপের মিষ্টি সুপ্ত ঘ্রাণ।হাত বাড়িয়ে বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মেহনাজ।বৃষ্টির তাল তার মনেও স্বপ্নচূড়ার ডাক দিয়েছে।গাঢ় নিঃশ্বাসের ছন্দ আসে মেহনাজের কানে।পাশ ফিরতেই চমকে উঠে বিদ্যুৎ সেই সাথে মেহনাজের শুষ্ক অধর।কম্পিত হয় মেহনাজ।তার দেহপিঞ্জরে উঠে ঝড়।বেসামাল ঝড়।বিদ্যুৎ চমকানোর সেই তীক্ষ্ম,সংক্ষিপ্ত আলোতে মেহনাজ দেখতে পায় তার স্বামী নামের প্রিয় মানুষটিকে।আলতো হাসে হৃষ্ট গলায় বললো ইহতিশাম—-

    “কী দেখছো এমন করে?

    মেহনাজ ঘোর লাগা চোখে বললো—

    “তোমাকে।এতো দেরি করলে কেন?

    ইহতিশাম কোমল হাসে।মেহনাজের চোখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে মোহনীয় গলায় প্রত্যুত্তর করে—

    “স্যারের কাছে গিয়েছিলাম।স্যার জান্নাহ্ এর কেসটা আমারই এক জুনিয়রকে দিয়েছে।”

    ত্রস্ত হয়ে মেহনাজ বললো—

    “এখন কী হবে?

    মেহনাজের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ইহতিশাম নরম সুরে বললো—

    “কী আর হবে!আমি তো অলরেডী কেস ক্লোজ করে দিয়েছি।প্রুভ সব ভ্যানিশ করেছি।বাকিটা আই ডোন্ট নো।”

    মেহনাজ ব্যস্ত হয়ে বললো—

    “তোমার জুনিয়র তো তোমার মতোই হবে।জান্নাহ্ এর কিছু হবে নাতো?এই সারহানটা জান্নাহ্ এর জীবনটা হেল করে দিলো।”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইহতিশাম।বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ,শীতল পবনে মিশে গেলো তার তপ্ত নিঃশ্বাস।মিইয়ে গলায় ইহতিশাম বললো—-

    “ক্যারিয়ারে আজ প্রথমবার কেস হেরেছি আমি।স্যারের সাথে ঝগড়াও হয়েছে।আমার যতটুকু করার আমি করেছি।বাকিটা জান্নাহ্ এর ভাগ্য।ভাগ্য পরম সত্য।”

    একটা দমকা হাওয়ায় মেহনাজের ঘন অরন্যের মতো চুল ছড়িয়ে পড়ে ইহতিশামে মুখে।এক পশলা বৃষ্টির শীতলতা কাঁপিয়ে দেয় দুজনকে।দুর্বল হাতে মেহনাজের কোমর জড়িয়ে তাকে চেপে ধরে নিজের সাথে ইহতিশাম।ইহতিশামের গলায় মুখ গুঁজে দেয় মেহনাজ।মিনমিনে গলায় বললো—

    “বাবা,মা সত্যিটা জানলে আমাকে মেনে নিবে তো?

    ইহতিশাম আশ্বস্ত গলায় বললো—

    “আমি সব জেনেশুনে তোমাকে বিয়ে করেছি।বাবা,মাকে আমি বোঝাবো।”

    মেহনাজ শঙ্কিত গলায় বললো–

    “যদি বাবা,মা মেনে না নেন?

    ইহতিশাম সরব গলায় বললো—

    “পৃথিবীতে এমন অনেক পরিবার আছে।এইটা নতুন কিছু নয়।

    মেহনাজ বিষন্ন গলায় বললো—

    “আমি তোমাকে সেই সুখ কখনো দিতে পারবো না ইহতিশাম।”

    ইহতিশাম আশ্বাস দিয়ে বললো–

    “একটা সম্পর্ক শক্ত থাকার জন্য প্রয়োজন বিশ্বাস,ভরসা,ভালোবাসা আর একে অন্যকে বোঝার ক্ষমতা।তোমার নিশ্চয়ই আমার উপর সেই আস্থা আছে।”

    মেহনাজ অস্পষ্ট গলায় বললো—

    “হুম।”

    আচমকা মেহনাজের ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন করতে গেলে তার চশমা লেগে যায় ইহতিশামে নাকে।বিরক্তি নিয়ে ইহতিশাম বললো—

    “তোমার গ্লাসের সাথে আমার কোন জনমের শত্রুতা বলো তো!সবসময় রোমান্সের বারোটা বাজায় আমার।”

    মেহনাজ মুচকি হাসে।হাতেল তালুতে ইহতিশামের চিবুক আবদ্ধ করে তার দুই গালে,কপালে চুমুর বর্ষণ ঘটায়।ইহতিশাম বন্দি পিঞ্জিরার পাখির মতো ব্যস্ত হয়ে মেহনাজকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।মেহনাজ নিজেকে ছাড়াতে চাইলে ধমকে উঠে ইহতিশাম।

    “একদম নড়াচড়া করবে না।এই রোমান্টিক ওয়েদার মিস করা যাবে না।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬৫
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ছন্দ।বাংলোর পেছন দিকের দুটো ঘরের বারান্দায় টিনের চাল।ঝমঝমিয়ে পড়ছে বৃষ্টি।শীতল,চঞ্চল বাতাস শনশন করে বইছে।ঝড়ো বৃষ্টির সাথে তীব্র বাতাসের আন্দোলন।

    জান্নাহ্ হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁইছে।তার পাশেই তার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারহান।অন্ধকার রাতের আকাশ ফুঁড়ে চলছে বৃষ্টির মাতম।এক পশলা বৃষ্টি এসে ঝপ করেই ছুঁয়ে যায় জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ মুগ্ধ হাসে।ঝুমঝুমিয়ে উচ্ছাসের সাথে বললো—

    “আমার বৃষ্টি ভালো লাগতো না।ছোটবেলা বৃষ্টি হলেই বাবা আর মাম্মা আমাকে স্কুলে যেতে দিতো না।বড্ড মন খারাপ হতো আমার।”

    সারসান ফিক করে হেসে ফেলে।জান্নাহ্ কপাল কুঁচকে ভ্রু নাচিয়ে বললো—

    “হাসছেন কেন?

    সারহান বেশ কিছুক্ষন আনমনে হাসে।পাতলা টিশার্টের সাথে পরেছে ছাই রঙা ট্রাউজার।বৃষ্টির ছটা লেগে পিঠের দিকটা ভিজে আছে।পকেটে দু’হাত পুরে মোলায়েম গলায় বললো—

    “আমার তো সেই লাগতো।স্কুলে যাওয়ার তাড়া ছিলো না।সামান্য বৃষ্টি হলেই মা আর আমাকে স্কুলে পাঠাতো না।সারাদিন চলতো ইনডোর গেম।মা রান্নাও করতেন অনেক।”

    অনর্গল বলতে থাকে সারহান।ছোটবেলাকার স্মৃতিমন্থনে ব্যস্ত সারহানের চোখ,মুখ নিশি রাতের মায়া কাটিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠে।আচমকা থেমে যায় সারহান।উজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তেই চুপসে যায়।জান্নাহ্ গাঢ় গলায় আবেগী হয়ে বললো—

    “মায়ের কথা মনে পড়ছে সারহান?

    তীব্র আক্রোশ নিয়ে সহজ গলায় বলে উঠে সারহান—-

    “নাহ।”

    জান্নাহ্ মৃদু হাসে।কোনোরূপ উচ্চ ভাবাবেশ ছাড়া পড়ন্ত বৃষ্টির দিকে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি দিয়ে বললো—

    “আপনি মিথ্যে বলছেন সারহান।”

    উন্মনা চোখে তাকায় সারহান।গম্ভীর গলায় বললো—

    “কফি খাবেন?

    জান্নাহ্ কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে অধর।হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।সারহান দু কদম বাড়িয়ে কঠিন গলায় দৃঢ় চাহনিতে বললো—-

    “বৃষ্টিতে ভিজবেন না।ঠান্ডা লাগবে আপনার।”

    ঝরা হাসে জান্নাহ্।বারান্দায় বৃষ্টির পানি জমে আছে।তাতে একটু একটু করে নগ্ন পা ছোঁয়ায় জান্নাহ্।শিউরে উঠে তার রোম।আকাশে চমকে উঠে বিদ্যুৎ।নিকশকৃষ্ণ আকাশ মুহূর্তেই আলোকসভায় পরিণত হয়।ধোঁয়া উড়ানো কফির মগ নিয়ে হাজির হয় সারহান।জান্নাহ্ এর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের মগ নিয়ে তাতে চুমুক লাগায়।বৃষ্টি ভেজা শীতল পরশে কফির উষ্ণতা যেনো সোনায় সোহাগা হয়ে উঠলো।বৃষ্টির ছন্দের ফাঁক গলিয়ে বলে উঠে জান্নাহ্—-

    “আপনি আমার বাবার মতো হবেন সারহান?

    সারহান দুর্বোধ্য হাসে।বারান্দার হাফ দেয়ালের সাথে ঠেকানো পিঠ আলগা করে জান্নাহ্কে কাছে টেনে নেয়।নিজের কফির মগ পাশের ছোট্ট টেবিলটার উপর রাখে।জান্নাহ্কে পেছন দিক দিকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া আঁকে।শুষ্ক,মোলায়েম চুলে মুখ গুঁজে ফিকে আওয়াজে বললো–

    “উঁহু।জগতে কেউ কারো মতো হতে পারে না রজনীগন্ধা।সবারই নিজস্ব স্বকীয়তা আছে,আছে ব্যক্তিত্ব।কারো সাথে কারো একটা দিক মিললেই সে পুরোপুরি কখনো ওই মানুষটার মতো হতে পারে না।আমি কখনো আপনার বাবার মতো নই।না সে কখনো আমার মতো।কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি।হয়তো তার থেকে বেশি নাহয় তার থেকে কম।কিন্তু তার সমান নয়।”

    সারহানের দেহের উষ্ণতায় জান্নাহ্ এর শীতল দেহ তপ্ত হতে থাকে।সারহান আদুরে মায়ায় জড়িয়ে নেয় জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর শরীরে কম্পন হয়।হাতে থাকা কফির মগটা আলগোছে নামিয়ে নেয় সারহান।জান্নাহ্ এর ঠোঁটে দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু খেয়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো—

    “আমার পরীবউ।”
    ,
    ,
    ,

    রেগুলার চেকাপের জন্য হসপিটালে এসেছে জান্নাহ্।গাইনোকলোজিস্ট মুনিরার কেবিন থেকে বেরিয়েই জান্নাহ্কে দাঁড় করায় সারহান।ছোট্ট শরীরে ভারি পেট নিয়ে চলতে কষ্ট হয় জান্নাহ্ এর।কিন্তু তার পাশে ছায়ার মতো থাকে তার প্রাণপুরুষ।হাতের ফাইলটা শক্ত করে ধরে জান্নাহ্কে বললো সারহান–

    “আপনি এখানে দাঁড়ান,আমি আসছি।”

    “হুম।”

    জান্নাহ্কে দাঁড় করিয়ে করিডোর ধরে হসপিটালের উত্তর দিকে হেঁটে যায় সারহান।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই পা দুটো ভার হয়ে আসে।করিডোরে তেমন মানুষ নেই।কতিপয় ডক্টর,নার্স আর ওয়ার্ড বয়দের পদচারণা।জান্নাহ্ ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে।
    অগোছালো পা বাঁড়াতেই সাদা ড্রেস পরিহিত নার্সের সাথে ধাক্কা লাগে।ব্যস্ত হাতে জান্নাহ্কে সামলায় নার্স।তটস্থ গলায় বললো—

    “বি কেয়ারফুল ম্যাম।”

    জান্নাহ্ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রস্ফুরনিত কন্ঠে বললো—

    “সসরি।থ্যাংক ইউ।”

    “ইটস ওকে ম্যাম।”

    কৃতজ্ঞতা জানায় জান্নাহ্ নার্সকে।জান্নাহ্ নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে।একটু ধাতস্থ হয়ে সামনে এগুতেই আবারো জোরালো ধাক্কা লাগতেই পেছন দিকে হেলে পড়ে জান্নাহ্।ভয়ে আঁতকে উঠা জান্নাহ্ চোখের পাতা বন্ধ করে সামনের মানুষটির বুকের দিকে খাঁমচে ধরে নিজেকে বাঁচানোর খাতিরে।জান্নাহ্ এর ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে এসে ঠেকে সেই পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণ।ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে ভয়ে জড়সড় জান্নাহ্।নিমিঝিমি চোখ মেলে তাকাতেই চোখের পাতা ক্রমশ প্রশ্বস্ত হতে থাকে জান্নাহ্ এর।সামনের সুদর্শন ব্যক্তির চোখ ভরা উচ্ছ্বাস,ঠোঁটে হঠাৎ প্রিয় জিনিস ফিরে পাওয়ার আঁতকে উঠা খুশি।অবাক বিস্মিত গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

    “অর্নিশ!তুমি?

    ছেলেটি মুখভর্তি উচ্ছলিত হাসে।কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া ছড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে দেখে জান্নাহ্কে।গাঢ় গলায় একবুক খুশি নিয়ে বললো—

    “জান্নাহ্!
    কোথায় ছিলে এতোদিন তুমি?

    জান্নাহ্ এর শ্বাসের গড়পড়তা বাড়তে থাকে সাথে সংশয়।তাকে সোজা করে দাঁড় করায় অর্নিশ।মোহবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্ এর দিকে সে।এক পাশে ছড়ানো ওড়নাটা মেলে ধরে নিজের উদর ঢাকে জান্নাহ্।অর্নিশ উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো—

    “কেমন আছো তুমি?

    জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় বললো—

    “ভালো।তুমি?

    প্রাণখোলা হাসে অর্নিশ।প্রসন্ন গলায় প্রত্যুত্তর করে—

    “ভালো।
    কোথায় ছিলে তুমি?আমি তোমায় কত খুঁজেছি!অস্ট্রেলিয়া থাকতেই মম এর কাছে তোমার প্যারেন্টসের ডেথের খবর শুনলাম।বড় চাচ্চুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো।তাকে দেখতে গিয়েছিলাম আমি।ফিরে এসে তোমাকে আর খুঁজেই পেলাম না।”

    জান্নাহ্ গাঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো।তার হাত পায়ে মৃদু কম্পন শুরু হয়েছে।কম্পনরত গলায় বললো—

    “আমি..।”

    “রজনীগন্ধা,এখানে কী করছেন?

    সারহানের গলার আওয়াজে পরপর কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে জান্নাহ্।তার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকায় অর্নিশ।উৎসুক গলায় মিইয়ে সুর তুলে—

    “আপনি কে?

    সারহান উষ্ণ হাসে।ঝরা গলায় বললো—

    “সারহান।জান্নাহ্ এর হ্যাজবেন্ড।”

    কৌতূহলী চোখ জোড়া ক্ষণকালেই প্রশ্বস্ত হয়।বিব্রত হয় জান্নাহ্।অপ্রস্তুত চাহনিতে বললো—

    “সারহান,ও অর্নিশ।মাম্মার ফ্রেন্ডের ছেলে।”

    “ও।আসসালামু আলাইকুম।”

    অর্নিশের অবস্থা আকাশ গুড়ুম।জান্নাহ্ এর হ্যাজবেন্ড!হাউ পসিবল!অর্নিশ যেনো থমকে গেলো নিমিশেই।না শোনার মতো করে সালামের উত্তর করে।ব্যগ্রতা দেখিয়ে সারহান বললো—

    “রজনীগন্ধা,আমাদের দেরি হচ্ছে।চলুন।”

    “হুম।
    আসি অর্নিশ।”

    অর্নিশ ভ্যালভ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো।যতক্ষন পর্যন্ত তার দৃষ্টি সীমানায় ছিলো জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর অবয়ব দৃষ্টির আড়াল হতেই চঞ্চল পা দুটো দপদপ করে ফেলে মুনিরার কেবিনে ডুকে অর্নিশ।অধৈর্য গলায় বললো—

    “একটু আগে যে মেয়েটা এখান থেকে বেরিয়েছে ও কেন এসেছিলো?

    মুনিরা আচম্বিত গলায় প্রশ্ন করেন—

    “তুমি কেন জানতে চাচ্ছো?

    “আন্টি ও জান্নাহ্।মনে পড়ছে তোমার !মম বলেছিলো ওর কথা তোমাকে। সংযুক্তার মৃত্যুর পর আমাকে ডিপ্রেশন থেকে বাঁচাতে মম জান্নাহ্দের বাসায় আমাকে পাঠিয়েছিলো।”

    মুনিরা কিছু মনে করার চেষ্টা করে বললেন—

    “আই সী।মনে পড়েছে।মেয়েটা বিবাহিত অর্নিশ।শী ইজ প্রেগন্যান্ট।ফাইভ মানথ রানিং।”

    আঁতকে উঠে বললো অর্নিশ—

    “হোয়াট?আর ইউ সিরিয়াস?শী ইজ অনলি সিক্সটিন!

    “আই নো অর্নিশ।আর সে সেকেন্ড টাইম কনসিভ করেছে।প্রথমবার মিসক্যারেজ হয়েছিলো।”

    অর্নিশ মুক্ত শ্বাস নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।কিছুক্ষণ ধুম ধরে বসে থেকে বললো—

    “ওর নাম্বার আছে তোমার কাছে?

    “নাহ।ওর হ্যাজবেন্ডের আছে।বাট আমি তোমাকে দিতে পারবো না।এইটা রুলসের বাইরে অর্নিশ।”

    অর্নিশ অসহায় গলায় বললো—

    “প্লিজ আন্টি!

    “ওকে মাই বয়।ওয়েট।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬৬
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    নদীর ধার ঘেঁষে জেগে আছে বুনো ঘাস।তাতে সগৌরবে মাথা উচু করে আছে নানা রঙের ঘাসফুল।কারো রঙ লাল তো কারো সাদা।নদীর পাড়ের ফিনফিনে বাতাসে বুনোফুলের মিষ্টি গন্ধ এসে ঠেকছে নাকে।তার সাথেই দুলছে দূর্বা ঘাস।তাতেও আলাদা মোহনীয়তা।ফুলবিহীন সরু,লম্বা পাতার দূর্বা ঘাস কাটা ঘায়ের রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।তা ছিলো আমাদের আদিকালের চিকিৎসার প্রাথমিক পদ্ধতির পরিচিত অংশ।

    সারহানের কাঁধে মাথা হেলান দিয়ে পা দুটো হালকা সোজা করে বসে আছে জান্নাহ্।ফুরফুরে বাতাসে জান্নাহ্ এর বেনুনী করা চুলের সামনের দিকের ছোট ছোট কেশ উড়ছে।বাতাসের বেগ বাড়তেই তাতে ফরফর করে আওয়াজ হয়।তীব্র,মৃদু শীতল বাতাসের ছোঁয়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে লাগতেই সারহানের হাত চেপে ধরে জান্নাহ্।সারহান গভীর দৃষ্টিতে তাকায়।তার ঝাঁকড়া চুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়তেই চোখ ঢেকে যায়।জান্নাহ্ ফিক করে হেসে ফেলে।সারহানের নাকের ডগা ধরে টান মারে জান্নাহ্।স্মিত হাসে সারহান।নির্বিঘ্ন গলায় বললো—

    “আপনার ভালো লাগা এতো আজব কেন?

    জান্নাহ্ ভ্রু ক্রুটি করে বললো—

    “আজব মানে?

    সারহান সরস গলায় বললো—

    “এই যে নদী!

    জান্নাহ্ স্মিত হাসে।নরম গলায় বললো—

    “সব ভালো লাগার কারণ থাকে না।কিছু ভালো লাগা চোখের প্রশান্তি,কিছু ভালো লাগা হৃদয়ের অনুরক্তি।নদী আমার চোখের প্রশান্তি আর..।”

    এইটুকু বলেই জান্নাহ্ থামে।গাঢ় চোখে তাকিয়ে আগ্রহী গলায় সারহান বললো—

    “আর হৃদয়ের অনুরক্তি?

    জান্নাহ্ বদ্ধ ঠোঁটে হেসে বললো—

    “আমার পরীর বাবা।”

    সারহান বিমোহিত চোখে তাকিয়ে রয়।গ্রীষ্মকালে র খরতাপে নদীর পানি নেমে গেছে পাড় থেকে অনেকটা নিচে।তবুও মাঝিমাল্লারা বসে নেই।জীবনধারনের অন্যতম উপায় মাছ বিক্রি যাদের হাতিয়ার তারা কী বসে থাকতে পারে?

    নদীর বুকে তাকিয়ে জান্নাহ্ জিঙ্গাসু গলায় বলে উঠে—

    “আপনি আমাকে আটকে কেন রেখেছেন সারহান?

    সারহান ভাবলেশহীন প্রত্যুক্তি করলো—

    “আপনার এমন কেন মনে হলো?

    “তাহলে আপনি বলেন নি কেন তিশাম ভাইয়া আপুকে বিয়ে করেছে।আমি মামার কাছ থেকে জানলাম।”

    সারহান নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া করলো—

    “আপনি যেতে চাইবেন তাই।”

    “কেন?গেলে কী সমস্যা?

    সারহান নির্লিপ্ত গলায় বললো—

    “কোনো সমস্যা নেই।পরী আসুক।আপনি যেখানে যেতে চাইবেন সেখানে নিয়ে যাবো।”

    জান্নাহ্ অভিমানি গলায় জোর দিয়ে বললো—

    “তাই বলে আমাকে আটকে রাখবেন!

    সারহান ফিচেল হেসে নিজের মুখটা জান্নাহ্ এর মুখের কাছে নিয়ে আসে।চাপা সুরে দম্ভ নিয়ে বললো—

    “জানেন তো,এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”

    জান্নাহ্ এর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।খুশি খুশি গলায় জানার আগ্রহ নিয়ে বললো—

    “আপনি আমাকে ভালোবাসেন সারহান?

    নদীর পাড়ে স্নিগ্ধ বাতাসে গা জুড়িয়ে আসে।ছোট্ট একটা দম ফেলে ঘাস বিছানো মাটিতে গা এলিয়ে দেয় সারহান।মাথার নিচে ডান হাত দিয়ে মুক্ত আকাশে তাকায়।নীলাভ ঝলমলে আকাশে উড়ছে শুভ্র মেঘ।সেদিকে আস্ত নজর রেখে সারহান বললো–

    “আপনার কী মনে হয়?

    জান্নাহ্ একটু সময় নিলো।ঘুরে বসে সারহানের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।নীলাভ শুভ্র আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটা বাজপাখি।জান্নাহ্ সারহানের বা’হাত আলগোছে তার স্ফীত উদরের উপর রাখে। গম্ভীর গলায় বললো—

    “তাহলে বললেন না কেন?

    “সব কথা ব্যক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না।কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।”

    “যদি সামনের ব্যক্তি না বুঝে?

    “তাহলে বুঝতে হবে সে আপনাকে কখনো ভালোবাসে নি।ভালোবাসা একটা সুপ্ত অনুভূতি।তা মুখ নিঃসৃত শব্দে প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ে না।যদি কেউ কাউকে ভালোবাসে তাহলে সামনের ব্যক্তি অবশ্যই তা অনুভব করবে।যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বুঝতে হবে সামনের ব্যক্তির হৃদয়ে সেই অনুভূতি হয়নি যা আপনার হয়েছে।কারো প্রতি ঘৃণা থাকলে তা প্রকাশের প্রয়োজন হয়,কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশের প্রয়োজন হয় না।তা আপনাআপনি প্রকাশ্য।”

    মুচকি হাসে জান্নাহ্।মৃদু গলায় বললো—

    “একবার আমি আর বাবা রাফাতের নানু বাড়ি গিয়েছিলাম।তখন শীতকাল ছিলো।নদীর মাছ যাওয়ার একটু উষ্ণতা পেতে পানির উপরিভাগে চলে আসে।আমি দেখতে দেখতে কখন যে নৌকার পাটাতনের সাথে জুতোর হিল বেঁধে গেছে খেয়ালই করি নি।পড়তে পড়তে বাচলাম।রাফাত না থাকলে তো ওই মাছগুলো আমাকে খেয়েই নিতো।”

    আওয়াজ করে হেসে উঠে সারহান।মাথাটা হালকা বাকিয়ে জান্নাহ্ রাগ দেখিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো—

    “হাসছেন কেন?

    সারহান বেশ কিছুক্ষন হাসে।হাসি থামিয়ে ঠোঁট চিপে বললো–

    “মাছ আপনাকে খেয়ে নিতো!হাউ ফানি!

    খেমটি মেরে বললো জান্নাহ্—

    “হা তো?

    “মাছের হজম ক্রিয়ায় সমস্যা হতো আপনাকে খেয়ে ফেললে!

    সারহান আবারো বাতাস কাঁপিয়ে হাসে।উঠে বসে জান্নাহ্।ঝামটা মেরে বললো–

    “হাসি বন্ধ করুন।”

    হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে সারহান।অনেক চেষ্টায় হাসি বন্ধ করে বললো—

    “মাছ আপনাকে খেয়ে নিতো!এতো সাহস!আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড থাকতে আপনাকে খেয়ে নিতো!হাউ পসিবল রজনীগন্ধা!

    জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় অভিমানি মনোভাব নিয়ে বললো—

    “এই জন্য হাসছেন!
    রাফাত ছিলো বলে?

    সারহান বেখেয়ালি গলায় বললো–

    “তেমন কিছু নয় রজনীগন্ধা।”

    জান্নাহ্ অসহায় গলায় বললো—

    “আপনি আমাকে বিয়ে করে সুখী নন সারহান?

    সারহান হৃদয় ভেজা হাসি হেসে বললো—

    “সুখ সাগরে ডুবে যাচ্ছি আমি।উদ্ধার করুন আমায়।”

    সলজ্জ হাসে জান্নাহ্।সারহানের হাতের দিকে তাকাতেই চোখের পল্লব নাচিয়ে বললো—

    “আপনার হাতের আংটি কোথায়?

    সারহান সহজ গলায় বললো—

    “ফেলে দিয়েছি।”

    আঁতকে উঠে জান্নাহ্ বললো—

    “সারহান!ওইটা আমাদের এংগেজমেন্টের আংটি।”

    সারহান হেয়ালি গলায় বললো—

    “তো!আপনার মামা সোনার বদলে তামা দিয়েছে বোধহয়!

    “মামা মোটেও এমন কাজ করেনি।”

    সারহান কঠিন গলায় বললো—

    “আমি বলিনি সে করেছে।বলেছি বোধহয়।”

    জান্নাহ্ দুঃখী দুঃখী চোখে তাকাতেই শার্টের কলার ছড়িয়ে গলার চেইনটা বের করে আনে সারহান।তার হাতের আংটি গলায় ঝুলছে।জান্নাহ্ মিহি গলায় বললো–

    “এইটা কেমন কথা!হাতের আংটি গলায় কেন?এমন কেউ করে?

    “আমি তো কেউ নই রজনীগন্ধা।আমি সারহান।”

    জান্নাহ্ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকে।সারহান জান্নাহ্ এর অধরের দিকে অনিমেষ চেয়ে একটু এগিয়ে আসতেই জান্নাহ্ পেছনের দিকে সরে ভ্রু নাচায়।ঠোঁট গুঁজ করে বললো—-

    “অসভ্য লোক!
    যেখানে সেখানে এইসব কী?

    “ইটস কল্ড রোমান্স।”

    “আপনার মাথা!খোলা আকাশের নিচে কীসের রোমান্স!

    জান্নাহ্ এর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো—-

    “চোখের মায়ায়,ঠোঁটের ছোঁয়ায়
    বেঁধেছি বুকের ক্রন্দন,
    মরুর বুকে,তরুর ছায়ায়
    জেগেছে প্রাণের স্পন্দন।”

    জান্নাহ্ পরম আদরে সারহানের বুকে মাথা রাখে।নদীর পানির উপরে একটা সাদা বক উড়ে যাচ্ছে।সারহান তার অধর ঠেকায় জান্নাহ্ এর শিয়রে।হালকা হাতের বেড়ে বাঁধে তাকে।

    সারহানের মোবাইলে ভাইব্রেট হতে থাকে।তা বের করে দেখতেই দেখে একটা আননো নাম্বার।সকালে হসপিটাল থেকে ফেরার পর থেকে একটা নাম্বার থেকে অনবরত ইনকামিং কল হচ্ছে।সারহান চিন্তিত।তার এই নাম্বার কতিপয় বিশেষ মানুষ ছাড়া কাউকে দেয় নি সে।
    কল ডিসকানেক্ট করে ব্লক করে সারহান।

    কল কাটতেই ক্ষুব্ধ হয় অর্নিশ।একান্ন বার কল করেছে সে।এখন ব্লক।অর্নিশের কপাল জুড়ে অদ্ভুত কিছু ঘটে যাওয়ার শঙ্কার ভাঁজ পড়ে।অর্নিশ চোয়াল শক্ত করে ফিরে তাকায়।তার মা শোয়েতা বেডে শুয়ে আছে।মিনমিনে গলায় বললো—

    “কী হলো!

    অর্নিশ তটস্থ হয়ে বললো–

    “ওর হ্যাজবেন্ড কিছুতেই কল রিসিভ করছে না।”

    ফোঁস করে দম ফেললো শোয়েতা।নমনীয় গলায় বললো—

    “মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।কতদিন দেখি না।”

    অর্নিশ কিছু বললো না।একজন নার্স কেবিনে ঢুকলো।হাতে ট্রে ভর্তি মেডিসিন।আধশোয়া করে উঠে বসায় শোয়েতাকে।ঔষধ খাইয়ে নার্স চলে যায়।শোয়েতা কপাল কুঁকড়ে বললেন–

    “ওর হ্যাজবেন্ড কেমন?

    অর্নিশ কন্ঠে গাঢ়তা টেনে বললো–

    “জান্নাহ্ এর বিয়ে মৃণাল আন্টি দেয় নি মম।আন্টি থাকলে কখনই ওই ছেলের সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে দিতো না।”

    শোয়েতা তীব্র হতাশা নিয়ে বললেন—

    “হয়তো।তোকে রিফিউসজড তো এইজন্যই করেছিলো।তবে জান্নাহ্ এর ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।ও না থাকলে তোকে তো আমি হারিয়েই ফেলতাম।”

    মায়ের কথায় তাল মিলিয়ে অর্নিশ বললো–

    “হুম।কৃতার্থ ওর প্রতি আমি।কিন্তু ওর বিয়ে!
    আমি মানতে পারছি না মম।জান্নাহ্ কী করে করতে পারে আমার সাথে এমনটা!

    শোয়েতা ছেলের উচাটন বুঝতে পারলেন।তবে ভাগ্যের কাছে সব সম্ভব।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬৭
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    ভেজা চুলগুলো মুছে বিছানায় বসে ইহতিশাম।চোখে,মুখে অরন্যের ন্যায় ক্লান্তি।বুক ফুলিয়ে একটা শ্বাস ফেলে স্থির হয়ে বসে।একটু আগেই সরফরাজের সাথে কথা কাটাকাটি করে এসেছে জান্নাহ্ এর কেস নিয়ে।ইহতিশামের জুনিয়রের সন্দেহ ইহতিশাম ইচ্ছে করেই কেস ধামাচাপা দিতে চাইছে।সরফরাজ ব্যাকুল হয়ে আছে নিজের মেয়ের খুনিকে স্বচক্ষে দেখার জন্য।দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে মেহনাজ।ইহতিশামের কপালে চিন্তার রেখা দেখে জিঙ্গাসু গলায় বললো–

    “কী নিতে এতো চিন্তিত তুমি?

    চোখ তুলে নির্জীব চাহনিতে তাকায় ইহতিশাম।খসখসে গলায় বললো–

    “কিছু না।”

    ইহতিশাম চায় না এই ব্যাপারে আর ঝামেলা হোক।সারহানকে কথা দিয়েছে সে।মেহনাজ ইহতিশামের পাশে বসে স্বাভাবিক গলায় বললো—

    “একটা কথা বলবো?

    “হুম।”

    “ইয়াস বোধহয় স্মোক করে!

    ঝট করেই বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকায় ইহতিশাম।তীর্যক গলায় বললো—

    “কী বলছো এইসব?

    মেহনাজ মিহি গলায় বললো—

    “আসলে তোমাকে কয়েকদিন ধরে বলবো ভাবছিলাম।সেদিন ওর ঘর গিয়ে দেখলাম সিগারেটের উটকো গন্ধ।আর আজ যখন ও কলেজে গেলো তখন ঘর গুঁছাতে গিয়ে দেখি বালিশের তলায় সিগারেটের প্যাকেট।”

    ফোঁস করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ইহতিশাম।কটমটিয়ে উঠে দাঁড়ায়।ভারী গলায় বললো—

    “এখন কোথায় ও?

    “ঘরেই আছে।গেম খেলছে।”

    ইহতিশাম রাগ নিয়ে দু’কদম বাড়াতেই মেহনাজ নরম গলায় বললো—

    “বেশি ঝামেলা করো না।মা,বাবা নেই এখন বাসায়।আর ও এখনো ছোট।বন্ধুদের সাথে মিশে হয়তো কৌতূহল বশত নেশায় পড়েছে।বুঝিয়ে বলো।”

    দরজায় করাঘাত পড়ে তখনি।মেহনাজ কথা শেষ না করেই সেদিকে তাকায়।ইয়াস তার ছোট্ট মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে আছে।ইহতিশাম তাকাতেই সপ্রতিভ হয়ে বললো—

    “কেউ এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে।”

    ইহতিশাম রাগাম্বিত গলায় বললো—

    “তুই যা।আমি আসছি।”

    বসার ঘরে নিমগ্নচিত্তে বসে আছে রাফাত।তাকে দেখেই পুরু ভ্রু জোড়া কুঞ্চি করে ইহতিশাম।চোখে জমা হয় উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।রাফাতের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বিস্ময় নিয়ে বললো—

    “তুমি !এখানে?

    রাফাত ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকায়।নিষ্প্রাণ গলায় বললো—

    “গতকাল সকালে জান্নাহ্ কল করেছিলো আমাকে।”

    ইহতিশাম সানন্দে আগ্রহপূর্ণ হয়ে শুনতে চাইলো।

    “তাই নাকি!কেমন আছে জান্নাহ্?

    রাফাত নিষ্প্রভ চোখে মেহনাজের দিকে তাকায়।ভারাক্রান্ত গলায় বললো—

    ” জান্নাহ্ প্রেগন্যান্ট।ফাইভ মানথ রানিং।”

    ইহতিশাম প্রসন্ন হেসে উচ্ছলিত গলায় বললো—

    “রিয়েলী!ইটস আ গুড নিউজ।”

    তৎক্ষণাৎ মেহনাজের তীক্ষ্ম স্বর ভেসে আছে।

    “ও,তাহলে সারহান জেইদি তার আসর রঙ দেখিয়েছে!

    ভরাট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় রাফাত।কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

    “কী বললে?

    মেহনাজ তাচ্ছিল্য হাসে।ক্ষুব্ধ গলায় বললো—

    “এই জন্য জান্নাহ্কে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে!যেনো ওর জঘন্য সত্য জান্নাহ্ এর সামনে না আসে।”

    রাফাত তিক্ত শ্বাস ফেলে হতাশ গলায় বললো—

    “জান্নাহ্ সব জানে মেহনাজ।তবুও ও…।”

    খলবলিয়ে বলে উঠে মেহনাজ—

    “কী জানে জান্নাহ্?ওর স্বামীর জঘন্য সত্য।যে শুধু নারী দেহেই সুখ খুঁজে বেরিয়েছে।মেয়েদের ধোঁকা দিয়ে তাদের সাথে…।”

    মেহনাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই জ্বলে উঠে ইহতিশাম।অধৈর্য গলায় বললো—

    “কিপ কোয়াইট মেহনাজ।স্টপ দিস ননসেন্স।”

    খটমটিয়ে উঠে মেহনাজ।জোর গলায় বলে উঠে—

    “কেন চুপ করবো আমি।আমার পুরো জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে ওই সারহান।আর ও নিজেকে সুখী করায় ব্যস্ত!এতো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলে এখন ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে জান্নাহ্কে!সারহান কখনো জান্নাহ্কে ডিজার্ব করে না।”

    ইহতিশাম প্রদৃপ্ত গলায় বললো—

    “কে কাকে ডিজার্ব করে তা নিয়ে তোমাকে না ভাবলেও চলবে।”

    কলের পুতুলের মতো সব গ্রোগ্রাসে গিলছে রাফাত।তার মস্তিষ্কের নিউরণে ছুটতে লাগলো একটি কথা,সারহান মেহনাজের জীবন নষ্ট করেছে!তার মানে সারহান মেহনাজের সাথে এমন কিছু করেছে।রাফাতের ভেতরকার প্রেমিকপুরুষ এক মুহূর্তে ছলকে উঠলো।সে কিছুতেই তার রেড চেরিকে এমন একটা নিচু মানুষের সংস্পর্শে থাকতে দিবে না।

    রাফাতকে লক্ষ্য করে মেহনাজ তিরিক্ষি গলায় বললো–

    “ভালো তো তুমি জান্নাহ্কে বাসতে।ফুফু,ফুপা তো তোমার সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে দিতে চেয়েছিলো।তাহলে ওই সারহান এলো কী করে এইসবে মধ্যে?আর তুমি এতো মেরুদণ্ডহীন কেন?কেউ এসে জান্নাহ্কে বিয়ে করে ফেললো আর তুমি হাত গুঁটিয়ে বসে রইলে?

    অসহায় চোখে তাকিয়ে রয় রাফাত।তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।এতোদিনকার চাপা রাখ মুহূর্তেই যেনো আগ্নেয়গিরির মতো ফুটতে শুরু করলো।
    দমদমিয়ে বের হয়ে যায় রাফাত।
    ইহতিশাম ক্ষেপা গলায় বলে উঠে—-

    “কী শুরু করলে তুমি?রাফাতের সামনে এইসব বলার কী দরকার ছিলো?

    ঝামটা মেরে বলে উঠে মেহনাজ—

    “ছিলো।দরকার ছিলো।সারহানকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না।আমাকে কষ্ট দিয়ে ও কী করে সুখী হতে পারে?

    ইহতিশামের তপ্ত রাগ নিমিষেই বিগলিত হয়।অসহায় চোখে তাকিয়ে নিরাস গলায় বললো—

    “তার মানে আমি তোমাকে সুখী করতে পারি নি?তুমি খুশি নও আমার সাথে?

    ব্যস্ত হয়ে উঠে মেহনাজ।নিজের স্বীকারোক্তিতে বললো—

    “ইহতিশাম,আমি তা মিন করি নি।”

    “তুমি কি মিন করেছো তা আমার বোঝা হয়ে গেছে।আফসোস হচ্ছে আমার মেহনাজ।তোমাকে ভালোবাসা হয়তো আমার জীবনের দ্বিতীয় ভুল।যার খেসারত এইবার জান্নাহ্কে দিতে হবে।আমাকে তুমি আবার অপরাধি করলে সারহানের কাছে।যদি তাই হয় আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না মেহনাজ।কখনো না।”

    বার কয়েক করুণ গলায় ডেকে উঠে মেহনাজ।শুনেও শুনলো না ইহতিশাম।রাতের মায়ায় নেমে গেলো নিজের ভুলের মাশুল গুনতে।আদৌ কী তা পারবে তা ইহতিশাম?

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬৮
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    নিশুতি রাতের মায়ার আচ্ছন্ন চারপাশ।আকাশে জুড়ে আছে অর্ধচন্দ্র।ম্রিয়মান আলো ক্রমশ প্রস্ফুটিত হচ্ছে।গাঢ় হচ্ছে চন্দ্রের আলোর বর্ষণ।বারান্দার পাশের জবা ফুলের গাছে ফুটে রয়েছে রক্তিম জবা।

    বিছানায় আধশোয়া বসে পা বিছিয়ে রেখেছে জান্নাহ্।তলপেটে ভারী অনুভূত হওয়ায় পিঠটা ঠেসে রেখেছে বালিশের সাথে।তার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে সারহান।খানিক সময় পর অনাগ্রহ নিয়ে বললো—

    “আমি আর খাবো না।”

    সারহান গাঢ় গলায় বললো—

    “আরেকটু খেয়ে নিন।দুপুরে কিছুই খান নি।”

    জান্নাহ্ অরুচি নিয়ে মুখ বিকৃত করে বললো—

    ” আর ইচ্ছে করছে না সারহান।ভালো লাগছে না।”

    ফোঁস করে শ্বাস ফেললো সারহান।প্রশ্রয়ের সুরে বললো—

    “ওকে।”

    সারহানের মোবাইল বেজে উঠতেই চকিত হয় সে।আবারো আননোন নাম্বার।সারহান চিন্তিত ভাবনায় রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে ব্যগ্র হয়ে কেউ বললো—

    “হ্যালো,হ্যালো!
    সারহান জেইদি বলছেন?

    সারহান ভ্রু কুঞ্চি করে।কয়েকটা শ্বাস ফেলে নির্বিকার গলায় বললো—

    “আসসালামু আলাইকুম। ইয়েস,সারহান বলছি।আপনি কে?

    অর্নিশ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেললো।ব্যগ্র হয়ে বললো–

    “আমি অর্নিশ।চিনতে পারছেন?

    সারহান পূর্ণ নজরে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।তার উৎসুক দৃষ্টি আবদ্ধ সারহানের কুঞ্চিত কপালে।চোখের পল্লব ধীরে ধীরে উঠানামা করছে।সারহান নাক ফুলিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো—

    “না চেনার কারণ নেই।কেন কল করেছেন?

    মৃদু হাসে অর্নিশ।মোলায়েম গলায় বললো—

    “রাগ করলেন নাকি!জান্নাহ্ আছে?

    সারহান অধর কোণে হাসলো।তপ্ত গলায় বললো—

    “না থাকার কথা?

    অর্নিশ গালভর্তি হাসে।সহজ সুরে বললো–

    “আপনার রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।”

    সারহান চোয়াল শক্ত করে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

    “ওয়েট।”

    কান থেকে মোবাইল সরিয়ে জান্নাহ্ এর দিকে এগিয়ে দেয় সারহান।জান্নাহ্ কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে–

    “কে?

    সারহান তাচ্ছল্য চোখে তাকিয়ে বললো—

    “হয়তো আপনার পরিচিত।”

    উঠে চলে যায় সারহান।জান্নাহ্ কাঁপা হাতে সাবধানে কানে স্পর্শ করায় মোবাইল।দ্বিধান্বিত গলায় বললো—

    “হ্যাআআলো!

    মুক্ত শ্বাস ফেললো অর্নিশ।নরম সুরে বললো—

    “কেমন আছো জান্নাহ্?

    জান্নাহ্ আকাশ ছোঁয়া বিস্ময় নিয়ে বললো—

    “অর্নিশ!

    “কন্ঠ চিনতে কষ্ট হয়নি তোমার।”

    “কেমন আছো?

    “ভালো।”

    “কল কেন করেছো?

    “জিঙ্গেস করলে না নাম্বার কোথায় পেলাম?

    জান্নাহ্ ভাবলেশহীন গলায় বললো—

    “বোকা নই আমি।”

    ফিচেল হাসে অর্নিশ।থমথমে গলায় বললো–

    “রাইট।যাকে বলে মাত্রাতিরিক্ত চালাক।”

    জান্নাহ্ গুমোট গলায় বললো—

    “কী চাও তুমি?

    শীতল শ্বাস ফেললো অর্নিশ।উপহাসমিশ্রিত গলায় বললো—

    “বিয়ে করে ফেললে!
    আমার চেয়েও যার এজ বেশি তাকেই?তাহলে আমাকে কেন রিফিউজড করলে?আমার খামতি কী ছিলো জান্নাহ্?

    জান্নাহ্ উষ্ণ গলায় বললো–

    “সংযুক্তাকে ভুলে গেলে?

    অর্নিশ সাবলীল গলায় বললো–

    “ওকে ভোলার জন্য ভালোবাসি নি।কিন্তু তোমাকে নতুন করে জায়গা দিয়েছি।”

    জান্নাহ্ কঠিন গলায় বললো—-

    “আমি কী তোমাকে তেমন কিছু বলেছি?

    “চার বছর কী অনেক সময়?
    হয়তো।তবুও তো বুঝতে তুমি।”

    জান্নাহ্ দৃঢ় গলায় বললো—-

    “মাম্মা যা বলেছে তা ঠিক ছিলো অর্নিশ।”

    “তাহলে সারহান!সে কেন এলো?রাফাত থাকার কথা।কোথায় সে?

    “রাফাত আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।আমি কখনো রাফাত কে ভালোবাসি নি।”

    নীরস হাসলো অর্নিশ।জিঙ্গাসু গলায় শুধায়—

    “বিয়েটা আন্টি থাকলে হতো না।তাই না জান্নাহ্?

    জান্নাহ্ থম মেরে রইলো।নিথর,নিস্তব্ধ,নির্বিকার।অর্নিশ বলে উঠে—

    “ওকে।তুমি আমার জন্য যা করেছো আমি ঋণী তোমার কাছে।হয়তো আমাদের ভাগ্য আলাদা ছিলো।একটা রিকোয়েস্ট করতে পারি।”

    “হুম।”

    “মম তোমাকে দেখতে চেয়েছে।তার হার্ট সার্জারী করা হয়েছে।সময় করে এসো।ভালো থেকো।”

    জান্নাহ্ ভেজা গলায় বললো—

    “হুম।আসবো।তুমিও ভালো থেকো।থেমে থেকো না।জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না অর্নিশ।অল দ্যা বেস্ট।”

    দরজায় দাঁড়ানো সারহান।তার অনিমেষ চাহনি দৃষ্টি কাড়লো জান্নাহ্ এর।ধীরপায়ে ড্রেসিং টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।ক্ষীণ গলায় বললো–

    ” সৈয়দ অর্নিশ।সাতাশ বছরের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।যার সাম্প্রতিক তৈরি করা সফটওয়্যার বর্তমান বাজার মূল্য থেকে দ্বিগুণ দামে কিনে নিচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার একটি আইটি কোম্পানি।”

    জান্নাহ্ নরম দৃষ্টিতে তাকায়।তার চোখে নির্লিপ্ততা।সারহান বাঁকা হেসে তার হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।পেছন দিকে হেলান দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালির উপর ডান পা উঠিয়ে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায়।নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সারহান।মুচকি হাসে সেভাবেই।কৃত্তিম আলোয় সারহানের মুখের দিকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জান্নাহ্।সারহান অদ্ভুত সুরে বললো—-

    “আফসোস!
    একজন ডক্টর আর একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে ছেড়ে আমার মতো একজনকে কেন বেছে নিলেন রজনীগন্ধা?আজ সত্যিই আপনার জন্য আফসোস হচ্ছে আমার।”

    জান্নাহ্ দুম ধরে রইলো।ক্ষীণ শ্বাস ফেলছে সে।সারহান আবারও বললো—

    “একদিকে রাফাত,একদিকে অর্নিশ।আরও কেউ আছে রজনীগন্ধা?তবে রাফাত ছেলেটা কিন্তু একদম পার্ফেক্ট ছিলো আপনার জন্য।ছেলেটাকে কষ্ট দিলেন।”

    রাগে চোখে জল ছেপে এলো জান্নাহ্ এর।থিতিয়ে থাকা রাগ তরতর কে উঠে এলো মস্তিষ্কের কোণে কোণে।গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় জান্নাহ্।তার নিঃশ্বাসের ভয়াল আওয়াজ নৈঃশব্দ বাতাসে আলোড়ন তুলে।তীক্ষ্ম গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

    “কী সমস্যা আপনার?কেন বারবার একই কথা বলেন? আপনার আফসোস হচ্ছে আমাকে বিয়ে করে?নাকি এখন আর বাইরে মেয়েদের নিয়ে রাত কাটাতে পারছেন না তাই কষ্ট হচ্ছে!কীসের এতো সন্দেহ আপনার?কী করি নি আমি আপনার জন্য।পনেরো বছর।মাত্র পনেরো বছর ছিলো আমার।তবুও আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন আপনি!নাহ।নিজের খায়েশ ঠিকই মিটিয়ে নিয়েছেন।আমার কষ্ট একবারো চোখে পড়েছিলো আপনার?পড়েনি।সব সয়ে নিয়েছি আমি।কেন জানেন?শুধু আপনাকে ভালোবাসি বলে।সব,সব মেনে নিয়েছি আমি।
    একজন স্ত্রী হয়ে আপনার সব চাহিদা পূরণ করেছি আমি।তবুও কীসের অভাবে এইসব করলেন আপনি? ইচ্ছেই যখন ছিলো না তখন বিয়ে কেন করেছিলেন আমাকে?শুধু আমার এই কচি শরীরের জন্য?

    ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।একনাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে উঠে সে।সারহান দম বন্ধ করে শুনে যাচ্ছে।আজ এতোদিনে তার রজনীগন্ধার ভেতরকার ছাই চাপা আগুনের স্ফুলিঙ্গ তার চোখ জ্বালিয়ে দিচ্ছে।একটু সময় নিয়ে আবারো জান্নাহ্ বলে উঠে—

    “আমার কষ্ট দেখেছেন আপনি?দেখেন নি।যদি দেখতেন তাহলে বুঝতেন।আপনার সব সত্য জেনেও চুপ করে ছিলাম আমি।তবুও একবিন্দু ঘৃণা কেন জন্মায় নি আমার আপনার প্রতি!শুধু আপনাকে ভালোবাসি বলে।নিজের স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে দেখেও তার ছোঁয়া কতটা কষ্টদায়ক তা আপনি কখনো উপলব্ধি করতে পারবেন না সারহান।সূঁচের ফলার মতো বিঁধেছে তা আমার শরীরে।তবুও চুপ করেছিলাম আমি।শুধু আপনাকে ভালোবাসি বলে।
    রাফাতের সাথে এক ঘরেও রাত কাটিয়েছি আমি।তবুও কখনো আমার শরীরে কারো ছোঁয়া লাগতে দেই নি ।কিন্তু আপনি!কী করেছেন আপনি!ভালো তো শুধু আমি আপনাকে বেসেছে।আপনি ভালোবেসেছেন শুধু আমার শরীরকে।”

    ঝরঝর করে নিজের চোখের অশ্রু বিসর্জন দেয় জান্নাহ্।ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার বললো—

    “অর্নিশ সংযুক্তাকে ভালোবাসতো।সংযুক্তার অ্যাকসিডেন্টে ডেথ হয়ে যায়।অর্নিশ ডিপ্রেশনে চলে যায়।রাফাত জাপান চলে যাওয়ায় সারাদিন বাসায় আমাকে একা থাকতে হত।বাবা আমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতো।মাম্মা প্রায়ই আমাকে শোয়তা আন্টির বাসায় নিয়ে যেতো।সেখানেই কথা হয় অর্নিশের সাথে আমার।বাবা সবসময় বলতো,একজন সাধারণ রোগীকেও বাঁচানো সম্ভব নয় যদি না তার মধ্যে বাঁচার আগ্রহ থাকে।সেক্ষেত্রে একজন কোমার রোগীকে বাঁচানো সম্ভব যদি তার মধ্যে বেঁচে থাকার স্পৃহা থাকে।আমি শুধু অর্নিশকে সেই স্পৃহা দিয়েছি।শোয়েতা আন্টি মাম্মাকে বলেছিলেন আমাদের বিয়ের কথা।কিন্তু মাম্মা তা সাথে সাথেই না করে দেয়।
    আমি কখনো ভাবি নি অর্নিশকে নিয়ে।কখনো না।তবুও কেন শুনতে হয় আমাকে বারবার একই কথা!কই এতোকিছুর পরও আমি তো আপনাকে কিছু বলি নি।আপনার কেন মনে হয় এইসব!
    তবে একটা কথা মনে রাখুন সারহান।আমার সহ্যের সীমা শেষ।আর পারবো না আমি।এরপর যদি এমন কিছু হয় তাহলে আমি আমার সাথে সাথে আমার সন্তানকেও শেষ করে দিবো।কোন দরকার নেই ওর এই অশুদ্ধ পৃথিবীতে আসার।
    তখন আপনার যা ইচ্ছে করবেন,যার সাথে ইচ্ছে রাত কাটাবেন।আই ডোন্ট কেয়ার।”

    নিজেকে সামলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় জান্নাহ্।প্রস্তরখণ্ডের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারহান।তার বুকের পিঞ্জিরায় ঝড় উঠেছে।
    তার রজনীগন্ধা তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।মেহনাজ নামের সেই ভুল এক ঝটকায় তার জীবন বদলে দেবে যেকোনো সময়।

    বসার ঘরে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে জান্নাহ্।তার অতীত কেন বারবার তার সামনে এসে দাঁড়ায়।বিড়ালপায়ে তার পাশে এসে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর মাথাটা বুকের সাথে আলগোছে চেপে ধরে।আনম্র গলায় বললো—

    “থামুন রজনীগন্ধা।ক্ষমা করুন আমায়।”

    বিনা সময় ব্যয়ে ধরা গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—-

    “কেন এমন করেন আপনি?কেন বলেন এইসব!আপনি তো বলেছেন অতীত ভুলে যেতে।তবুও কেন বারবার মনে করিয়ে দেন।”

    সারহান কিছু বললো না।অতলস্পর্শী ভালোবাসায় জান্নাহ্কে নিজের সাথে চেপে ধরলো।অনুরক্তির গলায় জান্নাহ্ বললো—

    “যদি আমি এমন করতাম তাহলে মেনে নিতেন আপনি আমাকে?পারতেন সব ভুলে যেতে?

    সারহান বিক্ষিপ্ত হাসলো।জান্নাহ্ এর বুকে মাথা নুইয়ে মখমলে গলায় বললো—

    “আমি তো আপনার সৌরভের ভাগও কাউকে দিতে পারবো না।সেখানে আপনার ভাগ কী করে দিবো?আমার রজনীগন্ধা শুধু আমারই।তার অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত সে আমার।”

    দু’হাত দিয়ে সারহানকে ঝাঁপটে ধরে জান্নাহ্।তার চোখ বেয়ে নেমে যাচ্ছে শীতল,নোনতা জলের প্রস্রবণ।জান্নাহ্ এর পিঠে হালকা হাত রেখে মিহি গলায় সারহান বললো—

    “আপনি আমাকে যতটা ভালোবেসেছেন হয়তো ততটা ভালো আমি আমাকে বাসতে পারি নি।কিন্তু যেভাবে আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন সেভাবে আমি আপনাকে ভালোবাসি নি।আমি তার বিপরীত রজনীগন্ধা।তাই দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন আমাকে করবেন না।আপনার অন্তিম শ্বাসও আমার জন্য।আপনার অন্তিম স্পন্দনও আমার জন্য।সেখানে আর কেউ নেই রজনীগন্ধা।কেউ না।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৬৯
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    সকালে হলুদ রঙের মিষ্টি রোদ এসে ছুঁয়ে যায় জান্নাহ্ এর অক্ষিপল্লব।নিভুনিভু চোখে তাকাতেই এক ঝাঁক আলো এসে হানা দেয় জান্নাহ এর অক্ষিকোটরে।ঝট করে চোখ বন্ধ করে জান্নাহ্।জানালার কাছ থেকে সরে আসে সারহান।মিষ্টি হেসে জান্নাহ্ এর পাশে বসে সারহান।তার আঙুল জান্নাহ্ এর গলায় বেপরোয়া ছোঁয়াতেই তেড়ে উঠে জান্নাহ্।বিমোহিত কন্ঠে সারহান বললো—

    “রাগ কমে নি রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ্ অস্পষ্ট কন্ঠে বললো—

    “উঁহু।”

    “তাহলে শাস্তি দিন।”

    “কথা বলবেন না আমার সাথে।”

    “তাহলে আমার প্রাণটা কেড়ে নিন।”

    “সরুন এখান থেকে।”

    ফিচেল হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর কামিজের নিচে হাত দিয়ে তার নগ্ন কোমরে আঙুল ছোঁয়াতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে জান্নাহ্।অসহায় গলায় বললো–

    “সারহান!এমন করছেন কেন?

    ঝলমলে হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো—

    “সরি,সরি,সরি,সরি,সরি,সরি,সরি…..।”

    সারহান যতবার সরি বলছে ততবার ই জোর করেই জান্নাহ্ এর ঠোঁট,গলা,গালে চুমু আঁকতে থাকে।জান্নাহ্ বিরক্ত হয়।অতিষ্ঠ হয়ে বললো—-

    “সরুন এখান থেকে।”

    “তাহলে বলুন ক্ষমা করেছেন?

    “হুম।”

    টুপ করেই জান্নাহ্ এর বুকের উপরের সেই ক্ষত যায়গায় চুমু খেয়ে বসে সারহান।অনুযোগের সুরে বললো–

    “সরি।”

    জান্নাহ্ ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো—

    “তখন মনে ছিলো না?

    সারহান মর্মাহত গলায় বললো—

    “উঁহু।ভালোবাসি নি তো।এখন ভালোবাসি।আকাশের চেয়েও বিশাল,সাগরের চেয়েও গভীর,বরফের চেয়েও শীতল,আগ্নেয়গিরির চেয়ে উতপ্ত।ঠিক তেমন করে ভালোবাসি।ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।”

    মৃদু হাসে জান্নাহ।তার বুকে জমাট বাঁধা অভিমাণ সারহানের ভালোবাসার স্বীকারোক্তির উষ্ণতায় গলতে থাকে।
    মৃদু গলায় জিঙ্গেস করে সারহান—-

    “কী খাবেন?

    জান্নাহ্ ঝট করেই বললো–

    “আলুর পরোটা।”

    সারহান হতভম্ব হয়ে বললো—

    “কী!পাগল হয়েছেন?খালি পেটে তেল!

    জান্নাহ্ অধরপল্লব এধার ওধার ঘুরিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো—

    “খাবো,খাবো,খাবো।”

    উজ্জ্বল হাসে সারহান।নিরস্ত্র সৈনিকের মতো আত্নসমর্পনিত হয় বললো—

    “ওকে।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

    ,
    ,
    ,
    বিছানায় বসে কোলের উপর একটা বালিশ নিয়ে রেখেছে জান্নাহ্।তার উপর প্লেটের মধ্যে রাখা চার,পাঁচটা গরম গরম আলুর পরোটা।জান্নাহ্ আরামসে খেয়ে যাচ্ছে।তার দিকেই ডিভানে বসে অনিমেখ চেয়ে আছে সারহান।জান্নাহ্ সারহানের দিকে তাকিয়ে কপালের মাঝ বরাবর কুঞ্চি করে।চোখের কোণ ক্ষীণ করে বললো—

    “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?ওদিক তাকান।আমার আর পরীর পেট ব্যাথা করবে।”

    স্মিত হাসে সারহান।ব্যস্ত গলায় শুধায়—

    “দুপুরে কী খাবেন?

    জান্নাহ্ একগাল হেসে উচ্ছ্বাস নিয়ে বললো—

    “পিজ্জা।”

    সারহানের পুরু ভ্রু জোড়া তড়িৎ বেগে কুকড়ে আসে।আচম্বিত হয়ে বললো—

    “কী!

    “সাথে আইসক্রীম আর ফ্রেন্স ফ্রাইও।ও কোল্ড ড্রিংসও।”

    সারহান নাক ফুলিয়ে বললো—

    “পাগল হয়েছেন!এইসব কী খাওয়ার কথা বলছেন!আর এতোকিছু!আগামী এক সপ্তাহ কী খাওয়া বন্ধ করে দিবেন নাকি?

    জান্নাহ্ মেকি চোখ রাঙিয়ে বললো–

    “আমি কী একা খাচ্ছি?বাবুও তো খাচ্ছে।”

    তখনই বাইরে দরজার সেন্সর বেজে উঠে।সারহান ব্যগ্র হয়ে তার মোবাইল বের করে।জান্নাহ্ উৎসুক হয়ে বললো—

    “কে?

    তীর্যক হাসে সারহান।ফিচেল গলায় বললো—

    “আমার পরীর মামা এসেছে।আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড।দশটা না,পাঁচটা না একটা মাত্র শ্যালক আমার।আপনি বসুন আমি দেখা করে আসছি।”

    দরজা খুলেই বিগলিত হাসে সারহান।স্মিত গলায় বললো–

    “ভেতরে এসো রাফাত।”

    রাফাতের চোখে মুখে জ্বলন্ত কয়লার আভা।কিন্তু তা টের পেলো না সারহান।রাফাতকে বসতে বলে নিজেও বসে।কিন্তু রাফাত বসলো না।সারহান পুনরায় বললো–

    “প্লিজ সিট রাফাত।”

    দমদমে গলায় বলে উঠে রাফাত—

    “জান্নাহ্ কোথায়?

    “ঘরেই আছে।”

    “ডাকো ওকে।”

    রাফাতের গলার অদ্ভুত স্বরে উঠে দাঁড়ায় সারহান।কৌতূহলী গলায় বললো—

    “হোয়াটস রঙ রাফাত?

    রাফাত দাঁত কিড়মিড় করে বললো—

    “জান্নাহ্কে ডাকো অামি ওকে নিতে এসেছি।”

    ফট করেই হেসে ফেলে সারহান।তাচ্ছিল্যের সাথে বললো—

    “আর ইউ ক্র্যাজি?

    রাফাতের সমস্ত রাগ উবলে উঠলো।বজ্রের মতো কন্ঠ কাঁপিয়ে বললো—

    “তোমার মতো কোনো পুরুষের সাথে জান্নাহ্কে আমি এক মুহূর্তও থাকতে দিবো নাহ।”

    সারহানের অক্ষিপল্লব কেঁপে উঠে।ভীত গলায় বললো—

    “কী বলতে চাও তুমি?

    “কী বলতে চাই তুমি জানো না।একটা নোংরা কীট তুমি।জঘন্য বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষ।যে নিজের স্ত্রী বোনকেও ছাড়ে না।”

    সারহানের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো যেনো।চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে তাকাতেই তার শরীরে কম্পন শুরু হয়।তবুও স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে বললো—

    “গেট আউট।জাস্ট লিভ।”

    পৈচাশিক হাসে রাফাত।দৃঢ় গলায় বললো—

    “জান্নাহ্কে না নিয়ে আমি যাচ্ছি না।”

    “তুমি ভাবলে কী করে তাকে আমি যেতে দিবো?

    “তুমি না চাইলেও ওকে নিয়ে যাবো।জান্নাহ্ আর তার সন্তানের সংস্পর্শে আসতে দিবো না তোমাকে আমি।”

    “ভুলে যেওনা ওই সন্তান আমার।”

    রাফাত দাঁতখামটি মেরে বললো—

    “কিসের সন্তান?তোমার মতো পুরুষ বাবা হওয়ার যোগ্যই না।অবশ্য তোমার থেকে এর বেশি আশা করা যায় না।কারণ ইউ আর আ ব্ল্যাডি বাস্টা*।”

    তৎক্ষণাৎ রাফাতের গালে একটা কষে চড় পড়ে।হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে রাফাত।অশ্রুভরা নয়ন যুগলে ঘি জ্বালানো আগুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।রুষ্ট গলায় বললো–

    “তোমার সাহস কী করে হলো আমার সারহানকে এইসব বলার?বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।”

    রাফাতের তপ্ত রাগ যেনো ক্রমশ প্রলীন হতে লাগলো জান্নাহ্ এর মায়াবী মুখটা দেখে।মিইয়ে গলায় বললো–

    “জান্নাহ্ তুমি জানো না সারহান…।”

    রাফাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার বুকে ধাক্কা মারে জান্নাহ্।ধরা গলায় রাগ নিয়ে বললো—

    “কিছু শুনতে চাই না আমি।চলে যাও এখান থেকে। মরে গেছে তোমার রেড চেরি।আর কখনো আসবে না তুমি এখানে।গেট আউট।আই সে গেট আউট।”

    রাফাত ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তার বদ্ধদৃষ্টিতে ছলকে উঠে নোনতা জল।তা গড়িয়ে পড়তে লাগলো চোখের পল্লব বেয়ে।জান্নাহ্ দাঁত,মুখ খিঁচে তার ভারী শরীরটা সামলে নিয়ে রাফাতকে বের করে বাড়ি থেকে।লক করে দেয় দরজা।ততক্ষনে হুশ ফিরে রাফাতের।জান্নাহ্কে অনেক ডাকলেও তা তার কর্ণকুহর হলো না।দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।হাপাচ্ছে সে।সারহান দু’কদম সামনে আসতেই দাপিয়ে উঠে জান্নাহ্।

    “ওখানেই দাঁড়ান।একদম আমার কাছে আসবেন না।”

    সারহান বিচলিত গলায় বললো—

    “রজনীগন্ধা,একবার আমার কথা শুনুন।”

    “বলেছিনা এক পাও আগাবেন না।আপনার ওই নোংরা হাতে আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না।মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।”

    ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।সারহানের বুকের ভেতরটা ক্রমশ খালি হতে লাগলো।সব যেনো তপ্ত মরুভূমি।সারহান উদ্বেলিত গলায় বললো—

    “প্লিজ রজনীগন্ধা।আমার কথাটা একবার শুনুন।”

    “নাহ।কিছু শুনতে চাই না আমি।কেন করলেন আপনি এইসব?এতোটা নিচে কী করে নামলেন আপনি?

    “আমি ভুল করেছি রজনীগন্ধা।প্লিজ ফরগিভ মি।”

    খসখসে গলায় বললো—

    “নো।নেভার।বারবার কেন আপনি ভুল করেন?আর কতো ভুল করেছেন আপনি!আপনার ভুলের সাজা কেন আমার সন্তানকেই পেতে হয়!ভালোই হয়েছে ও মরে গেছে।যার বাবা মায়ের জীবন এতোটা ঘৃণিত তার এই দুনিয়ায় আসার কোনো দরকার নেই।”

    সারহান শশব্যস্ত হয়ে জান্নাহ্ এর কাছে এগিয়ে আসলে তেতে উঠে বললো সে—

    “আপনার ওই নোংরা হাতে আমাকে ছোঁবেন না।ঘৃণা হচ্ছে আমার।আপনার মতো একটা নোংরা লোকের সন্তান আমার গর্ভে।এরচেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভালো।”

    স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সারহান।একবিন্দুও নড়লো না।তার দুই চোখের পাতা নিশ্চল,শান্ত।মিহি গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

    “এভাবে কেন ছোট করলেন আপনি আমাকে?কী করে যাবো আমি আপুর সামনে?কেন করলেন সারহান?

    সারহান ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো।তার প্রাণপাখি যেনো স্পন্দন করতেই ভুলে গেলো।গুমোট মেঘ জমতে লাগলো তার চোখের তারায়।জান্নাহ ভেজা গলায় বললো—

    “আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।ভালো হয়েছে ও মরে গিয়েছে।একেও মেরে ফেলবো আমি।নিজেও মরে যাবো আমি।থাকুন আপনি।যা ইচ্ছে করুন।”

    কাঁদতে কাঁদতে বেডরুমে গিয়ে ঢোকে জান্নাহ্।দরজার ধড়াম আওয়াজে হুশ ফিরে সারহানের।বদ্ধ দরজার কাছে গিয়ে চাপড় মারতে থাকে সারহান।ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলো না।অসহিষ্ণু গলায় বললো সারহান—

    “প্লিজ রজনীগন্ধা,আমার পাপের সাজা আমার সন্তানকে দিবেন।আপনি তো আমাকে সুযোগ দিয়েছিলেন।তাহলে কেন সেই সুযোগ কেড়ে নিচ্ছেন?আপনাদের কিছু হলে আমি মরে যাবো রজনীগন্ধা।প্লিজ দরজাটা খুলুন।”

    অনেকক্ষন যাবত কোনো শব্দ হলো না।সারহান চুপচাপ বসে রইলো দরজার কাছে।আচমকাই কিছু পড়ার আওয়াজে সপ্রতিভ হয় সারহান।ভয়ে উদ্বেলিত সারহান দারাজ গলায় ডেকে উঠে—

    “রজনীগন্ধা,রজনীগন্ধা!প্লিজ আমাকে এতোবড় শাস্তি দিবেন না।প্লিজজজজ।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৭০
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    রাগে অগ্নিশর্মা সারহানের চোখ দিয়ে ধোঁয়া বইছে।তার উলুথুলু চুলে ঢেকে গেছে চোখ।কানের পাশ দিয়ে নিরবধি গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের স্মিত ধারা।সারহানের দুই হাত কঠোর হয়ে আছে ইহতিশামের শার্টের কলারে।ক্রুব্ধ কন্ঠে বললো—

    “কেন এসেছিস আমার জীবনে?তোর জন্য আমার পুরো জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে।”

    ইহতিশাম ছোট্ট দম ফেলে সংক্ষিপ্ত সুরে বললো—

    “শান্ত হ।আমার কথা শোন।”

    সারহান ক্ষেপা গলায় অধরপল্লব ছড়িয়ে বললো—

    “কী শুনবো আমি তোর কথা?কেন শুনবো?সব তো ঠিক ছিলো।কেন আমার জীবনটা আবার নরক বানিয়ে দিলি?বল কেন?

    ইহতিশাম শীতল নিঃশ্বাস ফেললো।মাথার উপর অনবরত ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাসও যেনো থমথমে পরিবেশের উত্তপ্ততা ঢলাতে পারলো না।সারহান মিইয়ে কন্ঠে বললো—

    “কেন করলি ইহতিশাম।আমি তো তোর কাছে ক্ষমা চেয়েছি।কেন বুঝতে পারছিস না তুই।আমার কেউ নেই ইহতিশাম।তোর তো সব আছে।আর আমি একা।আমার রজনীগন্ধা আর আমার সন্তানই আমার সব।কেন কেড়ে নিতে চাইছিস তুই।”

    ইহতিশাম শান্ত গলায় বললো—

    “আমি সব ঠিক করে দিবো।আমি জান্নাহ্কে বোঝাবো।তুই একটু শান্ত হ।”

    সারহান পরাস্থ হয়ে ইহতিশামকে ছেড়ে দাঁড়ায়।অসহায় মুখ করে বললো–

    “কী করে ঠিক করবি তুই।গত দুইদিন ধরে কথা বলছে না আমার রজনীগন্ধা আমার সাথে।কিছু খায়ও না।আমাকে সহ্যই করতে পারছে না।এমনটা না করলেও পারতি তুই।”

    ইহতিশাম নির্বিকার গলায় বললো—

    “প্লিজ,আমার কথা শোন।”

    দাপিয়ে উঠলো শান্ত,স্থির মেহনাজ।ক্ষুব্ধ গলায় বললো–

    “তোমার সাথে এমনই হওয়া উচিত।এখন কেন কষ্ট হচ্ছে তোমার?

    জ্বলে উঠে সারহানের নিভে যাওয়া আগুন।দগদগে গলায় বললো—

    “কী বলতে চাস তুই?

    মেহনাজ খসখসে গলায় বলল—

    “ভদ্রভাবে কথা বলো।”

    সারহান বাঁকা হেসে তীর্যক গলায় বললো—

    “তোর সাথে কিসের ভদ্রতা আমার।এইসব কিছুর জন্য তুই দায়ী।”

    ইহতিশাম নিজের স্ত্রীর অসম্মান সহ্য করলো না।গমগমে গলায় বললো—

    “সারহান,শী ইজ মাই ওয়াইফ।”

    সারহান বিক্ষিপ্ত হেসে কন্ঠ শক্ত করলো।বললো—

    “এই জন্যই ওর গায়ে এখন পর্যন্ত হাত তুলিনি আমি।নাহলে ও যা করেছে তার জন্য ওকে খুন করতেও আমি দ্বিতীয়বার ভাবতাম না।”

    ইহতিশাম শব্দহীন নিঃশ্বাস ফেললো।মেহনাজ খরখরে গলায় বাতাস কাঁপিয়ে বললো–

    “ভাবো কী তুমি নিজেকে?লজ্জা করে না তোমার?এতো কিছুর পরও এতবড় মুখে কথা বলছো!কাউকে ধোঁকা দিলে কেমন লাগে এইবার দেখো।”

    সারহান মুক্ত হেসে উঠলো।দারাজ গলায় বললো—

    “লজ্জা!তোর লজ্জা করেনি আমার সাথে বিছানায় আসতে?তাহলে আমার কেন করবে?তোকে ফোর্স করেছি আমি?নিজ ইচ্ছায় এসেছিস।তোর তো খুশি হওয়া উচিত।এতো কিছুর পরও ইহতিশাম তোকে মেনে নিয়েছে।সব দিয়েছে তোকে।তাহলে আমার সুখ কেন তোর সহ্য হলো না?

    মেহনাজ উদ্ভাসিত নয়ন যুগলে আঁকড়ে ধরলো সারহানের মুখচ্ছবি।নির্বিকার,নিশ্চল দৃষ্টি।সারহান দাঁতে দাঁত চেপে নাকের ডগা ফুলিয়ে তীব্র আক্রোশে বললো—

    “তোদের মতো মেয়েদের সাথে এরচেয়ে ভালো কী হবে!জান্নাহ্ আর তোদের মধ্যে পার্থক্য কী জানিস?তোরা শুধু আমার উপরিটাকে দেখে মোহাচ্ছন্ন হয়েছিস।কিন্তু আমার রজনীগন্ধা আমার ভেতরের সত্তাকে ভালোবেসে।নিজেকে জড়িয়েছে আমার সাথে।বিয়ে করেছে আমাকে।পনেরো বছরের মেয়েও বুঝে বিয়ের আগে অনৈতিক সম্পর্ক ঠিক নয়।আর তোরা?শুধু নিজেদের চাহিদা মিটিয়েছিস।এখন দোষ শুধু আমার?

    মেহনাজ ঝাঁমটা মেরে বললো—

    “জাস্ট শাট আপ।”

    “ইউ শাট আপ।তুই কী ভেবেছিস তোকে আমি ছেড়ে দিবো?যদি আমার স্ত্রী,সন্তানের কিছু হয় তাহলে তুই,তোর ইহতিশাম আর ওই রাফাত কাউকে ছাড়বো না আমি।ওদের ছাড়া তো আমি এমনিতেই শেষ হয়ে যাবো।তার আগে তোদেরকেও শেষ করে যাবো।মনে রাখিস।”

    গটগট করে বেরিয়ে যায় সারহান।ইহতিশাম ফুলে ফেঁপে আছে।স্তব্ধ হয়ে আছে সে।মস্তিষ্কের দুই পাশের রগ দপদপ করছে।হাতের শিরাগুলো শিরশির করছে।রাগে থরথর করছে ইহতিশামের শরীর।বদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে মেঝেতে।তার নিস্পলক চোখ দিয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা স্বচ্ছ,শীতল জল।
    মেহনাজ ধীরপায়ে এসে ইহতিশামের হাত স্পর্শ করতে ঝাটকা মেরে সরে দাঁড়ায় ইহতিশাম।রুদ্ধ গলায় বললো–

    “এইবার খুশি তুমি?

    মেহনাজ ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থামলো।কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করে নিষ্প্রভ গলায় বললো–

    “তুমিও আমাকে দোষ দিচ্ছো?

    বিদ্রুপপূর্ণ হাসে ইহতিশাম।ক্ষেপা খলায় বললো–

    “কেন,সারহানের একার দোষ হবে কেন?ও দোষী হলে তুমিও দোষী।জোর তো করেনি সারহান তোমাকে।আমাদের তিন বছরের সম্পর্কে আমি তো তোমার কখনো এতো কাছে আসিনি।মাত্র ছয় মাসে সারহান কী করে এলো?
    এখন সব সারহানের দোষ?

    মেহনাজ চোখের পাতা কাঁপিয়ে বললো—

    “এইসব কী বলছো তুমি।তুমি জানো না তখন আমি…।”

    “জানতে চাইও না আমি।যতই আমি সব ঠিক করতে চেয়েছি ততই সব বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে।তুমি আর রাফাত মিলে কী করলে বলো তো?সারহানকে ঘৃণা করলেও জান্নাহ্কে তো ভালবাসতে তোমারা।ওই বাচ্চা মেয়েটার কথা একবারও ভাবলে না।জান্নাহ্ প্রেগন্যান্ট মেহনাজ।একজন নার্স হয়ে এইটুকু উপলব্ধি করার ক্ষমতা তো তুমি অর্জন করেছো।”

    মেহনাজ থম মেরে রইলো।তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।ইহতিশাম বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

    “সারহানকে চেনো না তুমি।রাগের মাথায় কী করে বসে ও নিজেও জানে না।”

    মেহনাজ নিভুনিভু চোখে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।ইহতিশাম নাক টেনে আক্ষেপের সুরে বললো—

    “আমার নিজেকে কার্টুন মনে হচ্ছে।কেন জানো?
    মনে হচ্ছে তোমাকে বিয়ে করে আমি শুধু তোমাকে ক্ষণকালের বিনোদন দিয়েছি।তোমাকে সত্যিকারের ভালো আমি বাসতে পারি নি,করতে পারি নি তোমাকে সুখী।যদি তাই হতো তাহলে আমাকে বুঝতে তুমি।কিন্তু তুমি!
    মনে রেখো মেহনাজ ক্রোধ,হিংসা আর মিথ্যে মানুষের সবচেয়ে বড় দুশমন।এর ফল কখনো ভালো হয় না,কখনো না।”

    ইহতিশামের রোশভরা কথার ছুরি ছিন্নভিন্ন করল মেহনাজে মন,মস্তিষ্ক।তার চোখ বেয়ে গড়াতে লাগলো স্বচ্ছ শীতল জলের নহর।

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৭১
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    সারাদিন এধার ওধার ঘুড়ে নিশুতিতে বাড়ি ফিরলো সারহান।বাসায় থাকলে তাকে দেখে উদ্ভট ব্যবহার করে জান্নাহ্।সারহানকে সহ্য করার ক্ষমতা দিনদিন বিলুপ্ত হচ্ছে জান্নাহ্ এর।বাড়িতে ঢুকেই সোজা চলে আসে নিজের রুমে।অন্ধকারে আচ্ছন্ন পুরো ঘরে থাই গ্লাসের কাঁচ গলিয়ে কুসুমরঙা চাঁদের আলো জোসনা ছড়াচ্ছে।সেই জোসনা ছড়ানো আলোয় জান্নাহ্কে দেখতে পায় সারহান।হাঁটু ভাঁজ করে বিছানার হেডবোর্ডের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে।উন্মনা,শান্ত,নিশ্চল।সারহান লাইট অন করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়।ঘামার্ত শার্ট খুলে তা বারান্দায় ছড়িয়ে দেয়।ব্যস্ত পা দুটো চালিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে।প্রায় মিনিট পনেরো পর হাত,মুখ ধুয়ে বের হয় সারহান।জান্নাহ্ এখনো সেভাবে বসে আছে।
    আলমিরা থেকে একটা পাতলা টিশার্ট নিয়ে গায়ে জড়ায় সারহান।রুম থেকে বেরিয়েই সোজা চলে যায় রান্নাঘরে।ওভেনে খাবার গরম করে ফিরে আসে রুমে।জান্নাহ্ এর সামনে বসে।কোনো কথা ছাড়াই জান্নাহ্ এর মুখে খাবার তুলে দিতে গেলেই তা ছুঁড়ে ফেলে দেয় জান্নাহ্।ফিকে চোখে তাকায় সারহান।কোনো কথা বললো না।অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে পুনরায় একই কাজ করলো।জান্নাহ্ও তার কাজের পুনরাবৃত্তি করলো।সারহান নরম চোখে তাকায়।তৃতীয়বারের মতো খাবার নিয়ে বসে জান্নাহ্ এর সামনে।স্থির গলায় বললো–

    “খেয়ে নিন রজনীগন্ধা।”

    জান্নাহ্ কঠোর হয়ে বললো—

    “খাবো না আমি।”

    সারহান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো–

    “অন্তত আমাদের পরীর জন্য খেয়ে নিন।”

    জান্নাহ্ রুষ্ট কন্ঠে বললো—

    “কীসের পরী?কার পরী?কোনো অধিকার নেই এই বাচ্চার উপর আপনার।”

    সারহান নিষ্কম্প গলায় বললো—

    “আমার ভুলের সাজা কেন নিজেকে দিচ্ছেন?

    তাচ্ছল্য চোখে তাকায় জান্নাহ্।বিদ্রুপ করে বললো—

    “ভুল! আপনার কেন ভুল হবে?ভুল তো আমি করেছি।ভালোবেসেছি আপনাকে।জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি আমি।”

    সারহান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো।স্বশব্দে বললো—

    “একটা সুযোগ দিন আমাকে।প্লিজ রজনীগন্ধা।”

    জ্বলন্ত চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল,স্বচ্ছ স্মিত ধারা।ফুঁসলে উঠে জান্নাহ বললো—

    “চলে যান আপনি এখান থেকে।আপনাকে সহ্য হচ্ছে না আমার।মুক্তি দিন আমাকে।মুক্তি দিন।আপনার যা ইচ্ছে করুন।”

    ঝমঝমিয়ে স্ফীত ধারায় বুক ভাসায় জান্নাহ্।ব্যগ্র হয়ে তা মুছতে গেলে সারহান ঝামটা মেরে উঠে জান্নাহ্–

    “একদম ছোঁবেন না আপনি আমাকে।ঘৃণা লাগে আপনার ছোঁয়ায় আমার।আমার সবচেয়ে বড় পাপ কী জানেন?আপনার মতো একজন নিকৃষ্ট মানুষের সন্তান আমার গর্ভে।যে সবসময় মনে করিয়ে দেয় আমাকে আপনার ওই নোংরা ছোঁয়া।যদি মা হয়ে সন্তানের জীবন নেওয়ায় কোনো পাপ না হতো আমি সত্যিই ওকে মেরে ফেলতাম।এই বিকৃত,নষ্ট পৃথিবীতে আসার ওর কোনো দরকার নেই।যেখানে ও জানবে ওর মা একজন খুনী আর বাবা একজন জঘন্য নারী লোভী পুরুষ।”

    রাগে হতবিহ্বল সারহান অবিশ্বাস্য কান্ড করে বসে।তার বলিষ্ঠ হাত উঁচু হয়েও আবার পরক্ষনেই স্মিমিত হয়।হিসহিসিয়ে বললো—

    “এখন কেন ঘৃণা হচ্ছে আপনার?চলে যেতেন সেদিন,যেদিন জানতে পেরেছেন।আমি তো আটকাই নি আপনাকে।আসতে বলিও নি আমার জীবনে।কেন এসেছেন তাহলে?

    “সেটাই আমি ভুল করেছি।আপনাকে ভালোবেসে ভুলে নয় পাপ করেছি আমি।আর এই পাপের সাজা আমার অনাগত সন্তানকে দিতে হয়েছে।”

    সারহান ফুঁসে উঠে জান্নাহ্ এর গাল চেপে ধরে।ক্ষীপ্ত গলায় বললো—

    “কেন জড়ালেন আমায় এই মায়ায়?আমি তো বলি নি।ভালোও বাসি নি আপনাকে।বাধ্য কেন করলেন আমাকে?আমার জীবন তো চলেই যাচ্ছিলো।কারো দরকার ছিলো না আমার।তাহলে কেন এলেন আপনি আমার জীবনে?স্বপ্ন কেন দেখালেন আপনি?আমি বলেছি আপনাকে?আমি জোর করেছি?

    জান্নাহ্ ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলো।সারহান বাঁকা হেসে বিক্ষিপ্ত গলায় বললো–

    “এখন কেন সহ্য হচ্ছে না!যখন ওদের খুন করলেন তখন আপনার হাত কাঁপলো না?আজ নিজের বোন বলে সাত খুন মাফ?মেহনাজকে আমি জোর করেছি?নাহ।যদি আমি দোষী হই তাহলে সেও দোষী।শুধু আপনার বোন বলেই এখন আমাকে ঘৃনা হচ্ছে আপনার?আমার জীবনে যারাই এসেছে সবাই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসেছে।আপনিও তার ব্যতিক্রম নন।বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর কাউকে প্রয়োজন ছিলো আপনার।আমাকেই বেছে নিলেন।কেন নিলেন?
    যদি আপনি আমার জীবনে না আসতেন আমার জীবনটা এমন হতো না।না নিজের রক্তকে হারাতাম আমি।আরে ভালোবাসার উপর তো কোনো বিশ্বাসই ছিলো না আমার।আমার জন্মদাতা আমার মাকে ধোঁকা দিয়েছে।নিজের বোনের অপবাদ ঢাকতে আমার আরেক মা আমাকে কাছে টেনে নেন।সম্পত্তির লোভে আমার বোন আমাকে এক মিথ্যের মায়াজালে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।কেড়ে নেয় আমার সন্তানকে।যেই সন্তানের কারণে প্রথমবার আমার মনে হয়েছে এই পৃথিবীতে আমার কেউ আছে।আমিও একজন মানুষ।আমারও নিজের পরিচয় আছে।কিন্তু সব শেষ হয়ে গেছে।সারহান একা,একাই রয়ে গেলো।ইহতিশাম আমার জীবনের আরেক ঝড়।ও যদি সেদিন সত্য বলতো তাহলে আমাকে জেলে রাত কাটাতে হতো না।আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে আমার সন্তানকে হারাতে হতো না।আমার জীবনটা এমন অকুলপাথারে ভাসতো না।হ্যাঁ,রাগের মাথায় ভুল করেছি আমি।সবতো ঠিক হয়েছে।মেহনাজকে মেনে নিয়েছে ইহতিশাম।তাহলে এখন কেন এমন করছেন আপনি?

    জান্নাহ্ ভেজা অক্ষিপল্লব মেলে চেয়ে রইলো।তার চোখ ভরা অশ্রু কিন্ত নির্বাক ঠোঁট।অধর ছড়িয়ে বিতৃষ্ণা শ্বাস ফেললো সারহান।শাসিয়ে উঠে বললো—

    “আপনার যা ইচ্ছে করুন।কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়ছি না।আর আমার সন্তানের যদি কিছু হয় তাহলে আমি কী করবো আমি নিজেও জানি না।যা হয়ে যাক জীবনের অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।যদি বাঁচতে হয় আমার সাথেই বাঁচবেন আর যদি মরতে হয় তাহলে আমার সাথেই মরবেন।”

    অসহিষ্ণু পা দুটো দপদপ করে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সারহান।অঝোরে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।ভেজা গলায় বলতে থাকে—

    “তাহলে মেরে ফেলুন,মেরে ফেলুন আমাকে।এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মরে যাওয়া ভালো।কী বলবো আমি আপুকে?কোন মুখে দাঁড়াবো আমি তার সামনে?কেন করলেন সারহান এমন?কেন?কেন?

    বাতাস ভারী হতে থাকে জান্নাহ্ নিরন্তর কান্নায়।তার চোখ,কপোল,গলা সব ভিজে যায় তার অশ্রুবারিতে।ঝাপসা চোখ দুটো প্রস্ফুটিত করতেই জান্নাহ্ তার বাবাকে দেখতে পায়।জাফিন ম্লান চোখে তাকিয়ে আছে।তাকে দেখেই কান্নার বেগ বাড়াতে থাকে জান্নাহ্।জাফিন নরম পায়ে জান্নাহ্ এর পায়ের কাছে এসে বসে।জান্নাহ্ অবিরত চোখের জল ফেলে বললো—

    “এতদিন পরে কেন এলে বাবা?আমি কাঁদলে তোমার ভালো লাগে বাবা?তাই তুমি আমাকে দেখতে আসো?

    জাফিন আলতো চুমু খেলেন মেয়ের হাতে।চোখে ছোঁয়ালেন তার হাত।জান্নাহ্ অভিমানি সুরে বললো—

    “এতদিন কেন এলে না বাবা?কেন চলে গেলে তুমি আমাকে ছেড়ে?কেন নিয়ে গেলে না আমাকে তুমি?কেন রেখে গেলে আমাকে?

    জাফিন ছলছল চোখে চেয়ে রইলো।মেঘাচ্ছন্ন মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।জান্নাহ্ স্বশব্দে বললো–

    “সারহান এমন কেন হলো বাবা?তুমি থাকলে আমি এমন ভুল করতাম না।তুমি আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও বাবা।আমার আর সহ্য হচ্ছে না।সহ্য হচ্ছে না।”

    জাফিন উঠে বসলেন বিছানায়।নিজের মেয়ের মাথাটা বুকের সাথে আলগোছে চেপে ধরলেন।বললেন—

    “ধৈর্য্য ধরো ডল।আল্লাহ্ তোমার পরীক্ষা নিচ্ছেন।আমার ডল তো হেরে যাওয়ার মেয়ে নয়।”

    জান্নাহ্ প্রতিবাদ করে বললো—

    “আমি তোমার ডল নই বাবা।আমি খুনি।আমি রাফাতের রেড চেরি নই।আমি স্বার্থবাদী।আমি মামার পরীজান নই।আমি রাক্ষুসী।নিজের সন্তানকে মেরে ফেলেছি আমি।আমি কেউ নই,কেউ নই।”

    জান্নাহ্ ছোটাছোটি করলে জাফিন শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে রাখেন জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ সমানতালে কেঁদে যাচ্ছে।তার ঝাপসা চোখ ঠাওর করে মৃণালিনীকে।মৃণালিনী আবেগশূন্য দৃষ্টিতে জান্নাহ্ এর দিকে তাকিয়ে আছে।তার দৃষ্টিতে হৃদয় কেঁপে উঠে জান্নাহ্ এর।হিম হয়ে আসে তার শরীর।মৃণালিনী অদ্ভুত,অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

    জান্নাহ্ চিবুক উঠিয়ে হালকা গলায় বললো—

    “মাম্মা আমাকে ক্ষমা করে নি তাই না বাবা?আমি মাম্মার কথা শুনি নি।মাম্মা থাকলে তার ডলের জীবন কখনো এমন হতো না।সারহান কখনো আসতো না আমাদের মাঝে।আমি পাপ করেছি বাবা।তাই মাম্মা আমার বাবুকে কেড়ে নিয়েছে।বাবা,ও বাবা!মাম্মা কী এবারও আমাকে শাস্তি দিতে আমার বাবুকে কেড়ে নিবে।ও বাবা,বলো না?
    তাহলে যে আমার সারহান মরে যাবে।তার পরীকে ছাড়া যে সে মরে যাবে।তুমি মাম্মাকে বলো না আমায় ক্ষমা করে দিতে।ও বাবা,বলো না।বাবা,বাবা।ও বাবা।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৭২
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    সময় বহতা নদী।সে চলে তার আপন মহিমায়।সময়ের সাথে চলতে হয় মৃত্তিকার গড়া মহান আল্লাহ্ পাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে।

    মান,অভিমানের পালা বদলের সাথে কেটে যায় আরো চার মাস।ষোড়শী জান্নাহ্ সপ্তদর্শীতে রূপ নেয়।তার শরীর জুড়ে ফুটে উঠে মাতৃত্বের লক্ষণরেখা।জান্নাহ্ এর সামনেই নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে শরীফ।চোখে,মুখে থমথমে ভাব।নির্ভয়চিত্তে অপলক চেয়ে আছে তার দুই পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে।কাতর গলায় শুধায় জান্নাহ্—

    “তুমি সারহানকে ক্ষমা করেছো তো মামা?

    শরীফ নির্বাক রইলেন।শুধু গ্রহণ করলেন জান্নাহ্ এর মুখ নিঃসৃত শব্দ।জান্নাহ্ ব্যাকুলতায় বললো–

    “ক্ষমা করবে না তুমি সারহানকে?না বুঝে সে ভুল করে ফেলেছে।ক্ষমা করে দাও তাকে মামা।”

    নরম চোখে জান্নাহ্কে দেখলেন শরীফ।বাঁধাহীন সুরে বললেন—

    “আমি সবসময় আমার দুই মেয়েকে সুখী দেখতে চেয়েছি।তার জন্য যা করার আমি করেছি।হোক তা ন্যায় বা অন্যায়।কিন্তু আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ।পাপের শাস্তি সবার প্রাপ্য।এক মেয়ের ঘর বাঁচাতে আমি অন্য মেয়েকে ডুবিয়ে ফেললাম।”

    স্বশব্দে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।বিচলিত গলায় বলে উঠে শরীফ—

    “কাঁদবেন না পরীজান।সারহানকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।কারণ সে অনুতপ্ত।নিজের মুখে সে তার অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে আমার কাছে।
    বিবেকের স্বীকারোক্তি,দেহের পাপের কাছে হার মানে।”

    নৈঃশব্দে নয়ন বারির বর্ষা নামিয়েছে জান্নাহ্।ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে তার শরীর।বাগানের দোলনায় বসে আছে সারহান।নিশ্চল তার দৃষ্টি।নির্বাক তার কন্ঠ।উন্মনা তার মস্তিষ্ক।তার অতীত খুবলে খুবলে খাচ্ছে তার বর্তমান।তার ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন।আদৌ কী সারহান তার অতীতের পাপ থেকে মুক্তি পাবে?

    ভেতর থেকে শরীফের দারাজ কন্ঠস্বর পেয়ে ছুটে যায় সারহান।বিছানায় কাতরে যাচ্ছে জান্নাহ্।ডেলিভারি পেইনে মিইয়ে গেছে বিছানার সাথে।উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে ভীতসন্ত্রস্ত সারহান বললো–

    “কী হয়েছে?

    ব্যতিব্যস্ত হয়ে শরীফ বললো—

    “পরীজানকে এখনই হাসপাতাল নিতে হবে।”
    ,
    ,
    ,
    হসপিটালের শুভ্র বিছানায় বসে আছে জান্নাহ্।স্থির,নিষ্কম্প,কঠোর।আবেগশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সফেদ রঙের সেই বিছানায়।তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্মিত শীতল,স্বচ্ছ অঝোর ধারা।বিড়ালপায়ে কেবিনে ঢুকে সারহান।তার শক্ত,কঠোর,নির্বিঘ্ন চিত্ত।ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে জান্নাহ্ এর সামনে এসে বসে।প্রতিক্রিয়াহীন জান্নাহ্।সে এখনো পাথরমূর্তি মতো স্থির।

    তাচ্ছল্য হাসলো সারহান।করুণ সুর তুলে বললো—

    “বদলা নিলেন রজনীগন্ধা?এতোটা ঘৃণা আপনার আমার প্রতি।এই ঘৃণার আগুনে এতোটা না পুড়ালেও পারতেন।কেন প্রাণ দিয়ে সে প্রাণটা কেড়ে নিচ্ছেন আপনি?

    নিরুত্তর জান্নাহ্।কোনো ধরনের ভাবান্তর হলো না তার।নিরুত্তেজ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান—

    “আমার মেয়ে কোথায় রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ্ ভাবলেশহীন গলায় প্রত্যুত্তর করে–

    “জানি না আমি।”

    নিরুত্তেজ গলায় সারহান বললো–

    “আমার পরীকে ফিরিয়ে দিন আমায়।”

    জান্নাহ্ অনুচ্চ গলায় বললো–

    “আমি জানি না ও কোথায়।”

    ক্ষেপে উঠে জান্নাহ্ এর গাল চেপে ধরে সারহান।দাঁতের সাথে দাঁত নিষ্পেষণ করে বললো—

    “আমার মেয়েকে আমার চাই।বলুন কোথায় আমার পরী?

    জান্নাহ্ অর্ধ ঢোক গিলে চোখের বদ্ধ পানি ছেড়ে দেয়।ভেজা গলায় বললো—

    “আমার লাগছে সারহান।”

    তড়িৎ গতিতে জান্নাহ্কে হালকা হাতে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।বিছানার পাশে থাকা চলন্ত ট্রে তে থাকা ঔষধাদি সব ফেলে দেয়।বজ্র গলায় বলে উঠে—

    “এতোই যখন ঘৃণা তাহলে তাহলে মেরে ফেলতেন আমাকে।মৃত্যু যন্ত্রণা কেন দিচ্ছেন?

    জান্নাহ্ ঠায় বসে রইলো।নেই কোন আবেগ,নেই কোনো অনুভূতি।একটা শীতল,সমাহিত বরফখন্ড।বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে উঠে সারহান—

    “আপনার কী মনে হয় আমি ওকে খুঁজে বের করতে পারবো না?
    আমার মেয়েকে আমি খুঁজে বের করবোই। আপনি ঠিক করেন নি রজনীগন্ধা,আপনি এইটা ঠিক করেন নি।”

    সারহান চলে যেতেই দরজায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা জাবিনকে দেখে জান্নাহ্।অবাক গলায় বললো—

    “জাবিন!

    মৃদু হাসে জাবিন।পায়ের কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা তিতি দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জান্নাহ্ এর বুকের উপর।আহ্লাদী গলায় ডেকে উঠে—

    “পরীমা।”

    জান্নাহ্ বুকের সাথে চেপে ধরে তিতিকে।নিজের শূন্য বুকটা যেনো থইথই করে ভরে উঠলো জান্নাহ্ এর।ছলছল অশ্রু ঝরে পড়লো।বইয়ে দিলো খুশির বন্যা।তিতির চোখে,মুখে অজস্র চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললো জান্নাহ্—

    “কেমন আছো তিতি সোনা?

    কোমল গলায় ছোট্ট করে বললো তিতি—

    “ভালো।”

    নিজের কোলে পুরোদস্তুর তিতিকে গুঁজে নেয় জান্নাহ্।সামনে বসা জাবিন নিস্পলক চেয়ে আছে।যেনো অন্য জান্নাহ্কে দেখছে সে।কেবিনের বাইরে ঘটা সারহানের উন্মাদের মতো আচরণে ভীতসন্ত্রস্ত জাবিন।হাসি হাসি মুখে জান্নাহ্ বললো—

    “কেমন আছো জাবিন?এতোদিন পর মনে পড়লো আমার কথা?

    জাবিন নিরুপায়ের সুরে বললো—

    “মামা তো আসতে দিচ্ছিলো না।ঠিকানা বলে নি কখনো।গত তিনদিন ধরে তিতি সমানতালে কেঁদে যাচ্ছে।ওর জন্যই…।”

    জাবিনের কথা কেটে বললো জান্নাহ্–

    “বাড়ির সবাই কেমন আছো?

    জাবিন নিশ্চল গলায় বললো–

    “ভালো।”

    “শুভ্রা আপু কেমন আছে?

    তিতি মাথা ঘুরিয়ে বললো—

    “মামুনি কথা বলে না।আদর করে না।”

    মুহূর্তেই ঠোঁট ভেঙে কান্না শুরু করে তিতি।ব্যস্ত হয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করে জান্নাহ্।জাবিন আহত গলায় বললো—

    “আমি ভাবতে পারি নি মা মামার সাথে এমন করবে!মায়ের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।”

    “শুভ্রা আপুর কী হয়েছে?

    জাবিন নম্র গলায় বললো—

    “ডক্টর বলেছে সায়ানাইডের ইফেক্ট মায়ের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।তাই সে কাউকে চিনতে পারছে না।”

    “সারহানকে ক্ষমা করে দিও।সে রাগের মাথায়..।”

    “মামার জায়গায় আমি হলেও এমনটা করতাম।”

    এক মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে যায় জান্নাহ্ এর মুখমণ্ডল।অপলক চোখ দুটোতে ভর করে জলরাশি।জাবিন সংকীর্ণ গলায় বললো–

    “মামাকে কষ্ট কেন দিচ্ছো জান্নাহ্।”

    জান্নাহ্ চোখের চাহনি শক্ত করে।কড়া গলায় বললো—

    “তার কষ্টের পথ সে নিজেই সৃষ্টি করেছে।”

    তিতি তার ছোট্ট কোমল হাত দিয়ে জান্নাহ্ এর গাল স্পর্শ করে তার দিকে ফেরায়।মখমলে গলায় বললো—

    “পরীমা,বাবু কোথায়?

    জাবিনের দিকে তাকায় জান্নাহ্।জাবিন নির্ভীক গলায় বললো—

    “আমি বলেছি বাবুর কথা।”

    তিতি আবারও তাড়া দিয়ে বলে উঠে—

    “পরীমা,বাবু কোথায়।আমি কোলে নিবো।”

    জান্নাহ্ আলতো করে তার ঠোঁট ছোঁয়ায় তিতির কপালে।মৃদু গলায় বললো–

    “বাবু তার বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গেছে।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৭৩
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    একটা পুরো ডিম অমলেট করে খাইয়ে দিচ্ছে তিতিকে জান্নাহ্।তার সামনেই প্রসন্ন দৃষ্টিতে বসে আছে জাবিন।তিতির মুখে লেপ্টে থাকা আধাসিদ্ধ কুসুমের হলুদাংশ টিস্যু দিয়ে মুছে দিতেই ফিক করে হেসে ফেলে তিতি।জান্নাহ্ চট করেই তিতির কপালে চুমু খায়।গ্লাসে রাখা পানি অতি সন্তর্পনে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে ঢকঢক করে গিলে তিতি।পানি পান করে অধর পল্লব দুটো বৃহৎ ফাঁক করে ভেতর থেকে শ্বাস বের করে।জাবিন আর জান্নাহ্ তিতির এই অদ্ভুত কান্ডে শব্দ করে হাসে।

    আজ চারদিন তিতি আর জাবিন সারহানের বাসায়।কিন্তু সারহান!
    সে নিরন্তর ঘুরে ফিরছে তার পরীর খোঁজে।সারাটা দিন খুঁজে ফেরে রাতে।কখনো আবার ফেরে না।কলিং বেল বাজতেই সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।হয়তো সারহান ফিরেছে।চঞ্চল পা দুটো চালিয়ে অনেকটা আশা নিয়ে দরজা খুলে সারহান।সারহান ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকতেই নির্মল গলায় জান্নাহ্ বললো–

    “সারহান,হাত-মুখ ধুয়ে আসুন।আমি খাবার দিচ্ছি।”

    সারহান তার পা দুটো থমকে দেয়।ধমকে উঠে বললো–

    “আপনি ভাবলেন কী করে আমি খাবো?লজ্জা করছে না আপনার?আর কী চান আপনি আমার কাছ থেকে?

    জান্নাহ্ আহত নয়নে তাকিয়ে ভেজা গলায় বললো—

    “সারহান!

    “প্লিজ,রজনীগন্ধা।অনেক করেছেন আমার জন্য।আর নয়।এইবার অন্তত আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন।আপনার যা করার আপনি করেছেন।আমাকে শাস্তি দিলেন।আমার ভালোবাসা হেরে গেলো আপনার ঘৃণার কাছে।আমি ব্যর্থ।পারি নি আপনাকে ভালোবাসতে আমি যতটা আপনি চেয়েছেন।”

    অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো জান্নাহ্।সারহান লম্বা লম্বা পা ফেলে বেডরুমে চলে যায়।সারহানের আক্রোশভরা স্বরে ভীত হয়ে উঠে তিতি।আঁতকে উঠে জাবিনের কোমর জড়িয়ে ধরে তার পায়ের কাছে মুখ গুঁজে দেয়।বেশ কিছুক্ষণ পর বের হয়ে আসে সারহান।কারো সাথে কোনো বাক্যলাপ হলো না তার।অসহিষ্ণু মনোভাব,উন্মাদ আচরণ,বেসামাল চলাফেরা।

    ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে জান্নাহ্।জাবিন নিরুত্তাপ গলায় বললো–

    “কেন করছো এইসব জান্নাহ্?কেন মামাকে কষ্ট দিচ্ছো?

    জান্নাহ্ মিনমিনে গলায় বললো—-

    “আমার কিছু করার নেই জাবিন।”

    জাবিন দ্রুত তার পা দুটো বাড়ায়।নিজের রুমে গিয়ে কাপড়-চোপড় গুছাতে হাত থামিয়ে ধরে জান্নাহ্–

    “কোথায় যাচ্ছো জাবিন?

    ছোট্ট দম ফেললো জাবিন।অত্রস্ত গলায় বললো—

    “বাড়ির কেউ ভালো নেই।বিষিয়ে উঠছিলো সব।তাই এখানে এসেছি।ভেবেছি এখানে এসে কয়েকদিন তোমার আর মামার সাথে ভালো থাকবো।কিন্তু তুমি যা করলে তা ঠিক করোনি জান্নাহ্।আমি জানি না তুমি কেন এইসব করেছো।শুধু একটা রিকোয়েস্ট করবো।মামাকে আর কষ্ট দিও না। আমি বয়সে তোমার বড় হলেও সম্পর্কে তোমার ছোট।তবুও আজ বলছি।মামি,যদি পারো মামাকে ক্ষমা করে দিও।”

    হনহন করে তিতির হাত ধরে বেরিয়ে যায় জাবিন।জান্নাহ্ গলা ফাটিয়ে বললো—

    “জাবিন,জাবিন।প্লিজ দাঁড়াও।যেয়ো না।”

    জান্নাহ্ এর কোনো কথাই কর্ণকুহর হলো না জাবিনের।এক মুহূর্তের জন্য পেছন ফিরলো না সে।নিরস্ত্রের মতো মূর্তি হয়ে রইলো জান্নাহ্।গুটি গুটি পায়ে নিজের ঘরে আসে জান্নাহ্।ধীর হাতে মোবাইল হাতে নিয়ে বাগানের দিকে পা বাড়ায় জান্নাহ্।একটা নাম্বারে ডায়াল করে জান্নাহ্।ওপাশের ব্যক্তি রিসিভ করতেই জান্নাহ্ অতটস্থ গলায় বললো—

    “কেমন আছো আপু?

    মেহনাজ একরাশ খুশি নিয়ে বললো–

    “ভালো।তুই কেমন আছিস?

    জান্নাহ্ মৃদু হেসে ক্ষীণ গলায় বললো–

    “আমার সারহানকে তুমি ক্ষমা করেছো তো আপু?

    মেহনাজ উল্লাসিত গলায় বললো—

    “করেছি।তুই আমাকে যা দিয়েছিস তার জন্য আমি সারাজীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ।”

    নিজের অজান্তেই চোখের জল ছাড়ে জান্নাহ্।কান্নার তোড়ে শরীর কেঁপে উঠে তার।সজোরে কামড়ে ধরে ঠোঁট।জমে যাওয়া গলায় স্বাভাবিকতা এনে বললো–

    “পুঁচকো কে একটু দেখতে দিবে আপু?

    মেহনাজ আদুরে গলায় বললো—

    “দেখবি?
    দাঁড়া দেখাচ্ছি।পুঁচকো ঘুমোচ্ছে।”

    কল কেটে ভিডিও কল করে মেহনাজ।একটা ছোট্ট লালচে গোলাপী হাওয়াই মিঠাই যেনো শুয়ে আছে।তার ভরাট কপালে একটা কালো চন্দ্রের মতো গোলাকার টিপ।জান্নাহ্ আলতো হাত বুলাতে থাকে মোবাইলের স্ক্রীনে।বুক কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।তার প্রাণ যেনো তাকে ছেড়ে যাচ্ছে।বুকের ভেতর অথৈ সাগরের প্রমত্তা ঢেউ।জান্নাহ্ এর মনে হলো তার হৃদপিন্ডটা কেউ টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে।

    বাচ্চাটি নড়ে উঠে।কোমল দুই হাত লাল দুই অধর পল্লবের মধ্য ঢুকিয়ে দেয়।ছোট ছোট চোখ দুটি অর্ধ নিমীলিত।জান্নাহ্ তার দৃষ্টি গাঢ় করে।অতলান্তিক মায়ায় আচ্ছন্ন দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে পড়ছে শীতল শ্রাবণ ধারা।
    এমন কেন হলো?

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৭৬
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে মেহনাজ।তার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে ঝড়ের বেগে।গোলাপী হাওয়াই মিঠাইটিকে মেহনাজ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না।গত পনেরো দিনে যে অতলান্তিক মায়া,প্রগাঢ় ভালোবাসা,তীক্ষ্ম সূঁচালো অনুভূতি আর ঐন্দ্রজালিক মায়াডোরে বাচ্চাটি মেহনাজকে বেঁধেছে তা সে ছাড়তে পারছে না।জান্নাহ্ এর কথামতো বাচ্চাটির একটি নামও রেখেছিলো মেহনাজ।জান্নাতুল সারহান।কিন্তু ডাকা হয়নি কখনো।মেহনাজের চোখের পানি টুপ টুপ করে পড়ছে বাচ্চাটির গাঢ় লাল ঠোঁটের উপর।তার অশ্রু ধারা শীতল আর নোনতা স্বাদে অ্যাঁ শব্দ করে বাচ্চাটি জেগে উঠে তার ঘুম থেকে।মেহনাজ আরো জোরে জড়িয়ে নেয় বাচ্চাটিকে।বাচ্চাটির চোখে,মুখে চুমু খেয়ে শক্ত গলায় স্বগতোক্তি করে বললো—

    “কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি তোকে ছাড়বো না পুঁচকো।আমি তোকে জন্ম না দিলেও আমিই তোর মা।আমার অনাস্বাদিত উরোজের প্রথম আস্বাদন করেছিস তুই।তোর স্পর্শে আমি মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করেছি।কী করে ছাড়বো তোকে আমি!

    “ছাড়তে না চাইলেও ছাড়তে হবে তোমায় মেহনাজ।”

    ইহতিশামের কঠিন গলার আওয়াজে হতচকিত মেহনাজ ভঁড়কে যায়।ভীত গলায় বললো—

    “তুতততমি!

    “কেন?ভয় পেলে?আশা করো নি তাই না?

    মেহনাজ আঁতকে উঠা গলায় বললো–

    “তুমি এখানে কী করে এলে?

    ইহতিশাম চোয়াল শক্ত করে দাঁত কিড়মিড় করে বললো—

    “আমি কী করে এলাম তা তুমি না জানলেও চলবে।তুমি এতোটা নিচে কী করে নামলে মেহনাজ?

    মেহনাজ ফাঁকা ঢোক গিলে।মিনমিনে গলায় বললো–

    “আমার কথা শোনো ইহতিশাম।”

    “কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে আমি তোমার মতো মেয়েকে ভালোবেসেছি।কী করে পারলে তুমি নিজের বোনের কাছ থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিতে?

    মেহনাজ ক্ষীণ গলায় বললো—

    “প্লিজ ইহতিশাম আমার কথা শোনো।আমি তো কখনো মা হতে পারবো না।”

    ইহতিশাম দারাজ গলায় বললো–

    “সবকিছু জেনেই আমি তোমাকে বিয়ে করেছি মেহনাজ।হাজারো বাচ্চা শহরের অলিতে গলিতে মানুষ হচ্ছে।এতিম খানায় হাজরো বাচ্চা।তাদের কাউকে দত্তক নিয়ে নিতাম আমি।তোমার খামতিকে কখনো তোমার চোখে আঙুল তুলে দেখাই নি আমি।তাহলে এতো বড় স্টেপ কেন নিলে তুমি?

    শরীর ঝাঁকনি দিয়ে কাঁদতে থাকে মেহনাজ।তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না ইহতিশাম।জোর হাতে বাচ্চাটিকে কেড়ে নেয়।আর্তনাদ করে উঠে মেহনাজ।নিরেট গলায় বললো–

    “ওকে নিওনা প্লিজ।ওরা তো চাইলেই আবার বাচ্চা নিতে পারবে।তুমি সারহানকে বুঝিয়ে বলো।”

    ঝাঁড়া মেরে ইহতিশাম বললো—

    “কী বুঝাবো ওকে আমি।যে মানুষটা অনেক আগেই মরে গেছে।
    সত্যি করে বলোতো আদৌ তুমি ওকে ভালোবাসো বলে কেড়ে নিয়েছো!

    মেহনাজ চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে পলক ঝাঁপাতেই নির্ঝরের ধারা বইতে লাগলো।ইহতিশাম তীর্যক হেসে বললো—

    “তুমি আসলে ওদের শাস্তি দিতে চেয়েছো।এক ঢিলে দুই পাখি।জান্নাহ্কে তুমি সহ্য করতে পারতে না।তার উপর যোগ হয়েছে সারহান।জান্নাহ্ তো বাচ্চা একটা মেয়ে।যে বয়সে ওর দরকার ছিলো একজন ভালো গাইড, একজন শুভাকাঙ্ক্ষী,একজন নিজস্ব আপন মানুষ সে বয়সে শুধু ভুল করেছে একের পর এক।তোমার বাবা,শায়িখ কেউ জান্নাহ্কে সঠিক পথ দেখাতে পারে নি।যে মানুষটাকে বিশ্বাস করেছে,ভালোবেসেছে,সবটা দিয়ে তাকে চেয়েছে যখন তাকে হারানোর ভয় ওকে আচ্ছাদিত করলো তখন ওর দরকার ছিলো মেন্টাল সাপোর্ট,ওকে দেওয়া উচিত ছিলো সত্য মেনে নেওয়ার সাহস,বাস্তব বোঝার ক্ষমতা।কিন্তু তার কিছুই জান্নাহ্ পায় নি।তাই নিজের ভুলকে সঠিক মনে হয়েছে ওর।তবে এতো ভুলের মাঝেও সঠিক ছিলো ওর ভালোবাসা।সব ছাপিয়ে ভালোবেসেছে সারহানকে।ভালোবাসার সাগরে ডুবে মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ডুবেছে সে।কিন্তু তুমি তাকে পাড়ে ভেড়ানোর নাম করে ওর বাঁচার অবলম্বন ভেলাটাই কেড়ে নিয়েছো।ছুঁড়ে ফেলেছো ওই অগাধ জলরাশির বুকে।
    সারহানকে ক্ষমা করার বদলে ওদের মেরে ফেলার জাল ফেঁদেছো তুমি।এতোটা জঘন্য তুমি আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে মেহনাজ।”

    মেহনাজ নিরন্তর তপ্ত শ্বাস ফেলতে থাকে।ভয়ে,রাগে,উৎকন্ঠায় তার চোখ,মুখ ফুলে উঠে।ইহতিশামের দিকে নজর রেখেই বিছানার পাশের টেবিলের উপর থাকা কাঁচের শোপিস টা ভেঙে বললো—

    “পুঁচকো কে নিয়ে গেলে কিন্তু আমি নিজেকে শেষ করে ফেলবো ইহতিশাম।”

    চমকে গলায় বললো ইহতিশাম —-

    “মেহনাজ,পাগলামি করবে না।”

    “বাবুকে ফিরিয়ে দাও আমায়।প্লিজ ইহতিশাম।”

    “আমি সারহানকে কথা দিয়েছি।”

    “ওকে ফিরিয়ে দাও আমায়।”

    ইহতিশামের কোলে কেঁদে উঠে বাচ্চাটি।সেদিকে চোখ পড়তেই আকাশকুসুম কান্ড করে বসে মেহনাজ।
    ,
    ,
    ,
    বারে একনাগাড়ে মদ গিলে টেবিলের উপর মাথা নুইয়ে রেখেছে সারহান।লাল,নীল বাতির ঝলকানিতেও অন্ধকার সারহানের প্রাণসত্তা।নেশায় মত্ত সকল মানব-মানবী নিজেদের ভুলে মদের প্রেমে মশগুল।সারহানের সামনেই ছলছল চোখে বসে আছে শায়িখ।জমাট গলায় বললো—

    “চলুন স্যার,বাসায় চলুন।অনেক রাত হয়েছে।”

    সারহান আলগোছে মাথা তুলে তাকায়।জমাট রক্ত যেনো তার চোখে বেঁধে আছে।কপালের সুক্ষ্ম ভাঁজগুলো ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে।নাকের পাটা ফেঁপে বেরিয়ে যাচ্ছে তপ্ত নিঃশ্বাস।নেশার্ত মস্তিষ্ক।বেসামাল চিত্ত।ঘোরের কন্ঠে বললো সারহান—

    “কোথায় যাবো?বাসায়!কার বাসায়?কীসের জন্য যাবো?কে আছে আমার?

    শায়িখ অচক্রী গলায় প্রত্যুক্তি করে—

    “এভাবে বলছেন কেন স্যার?আপনার বাসা।আপনার ঘর।”

    নেশাগ্রস্থ সারহান প্রতিবাদ করে বললো—

    “নাহ।কিছুই নেই আমার।সারহান একা।সে সারাজীবন একাই থাকবে।”

    শায়িখ মৃদু গলায় বললো—

    “এভাবে বলবেন না স্যার।জান্নাহ্ ভুল করে ফেলেছে।আপনি তো জানেন ও অবুঝ।”

    সারহান নেশার্ত হাসে।তার চোখ দুটো টিমটিম করে জ্বলছে।গ্লাসের ওয়াইন টুকু টুক করে গিলে বললো—

    “অবুঝ!সত্যিই অবুঝ সে।আমার পরীকে কেড়ে নিলো আমার কাছ থেকে।আমাকে শাস্তি দিলো সে।এতোটা ঘৃণা তার আমার প্রতি।”

    শায়িখ মুক্ত গলায় বললো—

    “জান্নাহ্ এর কোনো দোষ নেই স্যার।মেহনাজই ওকে ভুলভাল বুঝিয়ে এমনটা করেছে।”

    সারহান নির্বিঘ্ন গলায় বললো–

    “আমার ভালোবাসা হেরে গেলো শায়িখ।চিরতরে হেরে গেলো।আমার ভালোবাসা আমার জীবনের মতোই কাঁচের ঘর।মৃদু পবনেই ঝনঝন করে ভেঙে গেলো।তা আর কোনোদিনও জোড়া লাগবে না শায়িখ।”

    অটল গলায় ব্যস্ত হয়ে বললো শায়িখ—

    “স্যার সব ঠিক হয়ে যাবে।আপনি বাসায় চলুন।আপনার যেমন কষ্ট হচ্ছে জান্নাহ্ এর কষ্ট হচ্ছে।ওর এখন আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।প্লিজ স্যার।”

    সারহান কিছু বলতে যাবে তখনই—

    “কোনো দরকার নেই জান্নাহ্ এর জীবনে ওর।”

    উৎকন্ঠিত চোখে তাকায় শায়িখ।রাফাতকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে যায় শায়িখের।চোখের সাদা অংশ ফুলিয়ে বললো—

    “এখানে কেন এসেছো তুমি?

    রাফাত বাঁকা হেসে বললো—

    “দেখতে এলাম দেবদাস কী করছে।”

    সারহান স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।রাফাত তেরছা সুরে বললো–

    “এখন তো শুধু মেয়েকে হারিয়েছিস।জান্নাহ্কেও হারাবি তুই।”

    সহ্য হলো না সারহানের।উন্মাদের মতো খাবলা মেরে ধরল রাফাতকে।তীক্ষ্ম গলায় বললো—

    “কী বলতে চাস তুই?

    দগদগে গলায় প্রত্যুত্তর করে রাফাত—

    “কেন যেতে দিচ্ছিস না ওকে?আর কতো কষ্ট দিবি জান্নাহ্কে?কী না করেছে মেয়েটা তোর জন্য!

    চোয়াল খিঁচে আসে সারহানের।অনমনীয় গলায় বললো—

    “তাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।আমার স্ত্রীকে আমি সামলে নিবো।”

    রাফাত অধরের কোনে তিরিক্ষি হাসে।কড়া গলায় বললো—

    “সামলাতে হবে না তোকে।নিয়ে যাবো জান্নাহ্কে আমি তোর এই বন্দি দশা থেকে।”

    রাগে হতবিহ্বল সারহান সজোড়ে ঘুষি মারে রাফাতের মুখে।ঘুষি গিয়ে লাগে রাফাতের ঠোঁটে।ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তেই তা আঙুলে স্লাইড করে নেয় রাফাত।পৈচাশিক হেসে বললো–

    “দেখলি না মেহনাজ তোর মেয়েকে কী করে নিয়ে গেলো।জান্নাহ্কেও নিয়ে যাবো আমি।এখান থেকে দূরে,অনেক দূরে।তোর ছায়ায়ও পড়তে দিবো ওর উপর আমি।”

    চিৎকার করে উঠে সারহান।উপস্থিত অনেকেই থমকে যায়।ডিজে বয় তার গান বন্ধ করে চকিত চোখে তাকিয়ে থাকে।দাম্ভিক গলায় বলে উঠে সারহান—

    “আমার রজনীগন্ধা শুধু আমারই।তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সে আমার।তাকে বাঁচতেও হবে আমার সাথে।মরতেও হবে আমার সাথে।আমার প্রাণদেবীকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।”

    শব্দ করে শয়তানি হাসি হেসে উঠে রাফাত।কর্কশ গলায় বললো—

    “তাহলে আটকা ওকে।আমিও দেখি কী করে তুই জান্নাহ্কে আটকাতে পারিস!
    ,
    ,
    ,
    অনেকটা আনন্দ নিয়ে সারহানের পছন্দের খাবারগুলো তৈরি করেছে জান্নাহ্।এক সমুদ্র খুশি তার মনের আনাচে কানাচে উপচে পড়ছে।ইহতিশাম তাকে কথা দিয়েছে সে তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে আনবে।জান্নাহ্ তার প্রানকে,প্রানসত্ত্বা ফিরিয়ে দিবে।একটা গাঢ় লাল রঙের জামদানি পড়েছে জান্নাহ্।চোখে গাঢ় কাজল।তার লম্বা চুলে বেনুনির ভাঁজে ভাঁজে ক্লিপের সাহায্যে রজনীগন্ধার গুঁজেছে সে।

    বাড়ির দরজার চাবি সারহানের কাছে আছে।তাই তাকে নক করার প্রয়োজন পড়ে না।টেবিলে খাবার গুঁছাতে ব্যস্ত জান্নাহ্।আজ তার পরী তার কাছে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।
    পেছনে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে চকিতে তাকায় জান্নাহ্।সারহান গম্ভীর চাহনিতে দাঁড়িয়ে আছে।প্রাণখোলা হাসে জান্নাহ্।উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো—

    “সারহান!

    সারহান কিছু বললো না।ত্রস্ত পায়ে গিয়ে ঝাঁপটে ধরলো জান্নাহ্কে।তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে,রক্তে বয়ে গেলো শিহরণ।সারহান তার হাতের বাঁধন শক্ত করতেই আদুরে বিড়ালের মতো তার বুকে গুঁজে যায় জান্নাহ্।দুই হাতে প্রাণকে জড়িয়ে ধরে সে।আর কখনো সে তার প্রাণকে নিজের থেকে আলাদা হতে দিবে না।বেশ সময় ধরে জান্নাহ্কে জড়িয়ে ধরে নিরব হয়ে থাকে সারহান।মাথাটা তার কাঁধ থেকে সরিয়ে এনে গাঢ় দৃষ্টিতে দেখে জান্নাহ্কে।তার অধরে গভীর চুমু খায়।তারপর কপালে,গালে,গলায়।আচ্ছন্ন জান্নাহ্ ভরাট চোখে তাকিয়ে বললো—

    “কী হয়েছে সারহান?

    সারহান আবারও জান্নাহ্ এর অধর আঁকড়ে ধরে।শুষে নিতে থাকে তার অধরপল্লবের অধরামৃত।তার শার্ট খামচে ধরে জান্নাহ্।চমকিত গলাত প্রশ্ন করে জান্নাহ্—

    “আপনার কী হয়েছে সারহান?এমন করছেন কেন?

    সারহান মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকে বললো—

    “আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন রজনীগন্ধা?

    বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে জান্নাহ্ বললো—

    “এমন কেন বলছেন সারহান!কোথায় যাবো আমি?

    “আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড আপনাকে কেড়ে নিবে আমার কাছ থেকে।আমি আপনাকে ছাড়া কী করে বাঁচবো রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ্ উপর্যুপরি দশেক চুমু খায় সারহানের চোখে মুখে।আশ্বাসিত গলায় বললো–

    “কোথাও যাবো না আমি।কোথাও না।আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

    অবিশ্বাসের সুরে বললো সারহান—

    ” আপনি মিথ্যে বলছেন রজনীগন্ধা।আপনিও আমার পরীর মতো আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন।আমাকে শাস্তি দিবেন তাই না রজনীগন্ধা!

    জান্নাহ্ এর বাঁধ ভাঙে সারহানের মর্মান্তিক কথায়।তার চোখের টলটলে জল,বুকের আর্তনাদ,হৃৎপিন্ডের ভয়াল স্পন্দনে ভীতসন্ত্রস্ত জান্নাহ্।আচমকা অদ্ভুত কান্ড করে সারহান।চোয়াল শক্ত করে,দাঁতে দাঁত চেপে জান্নাহ্ এর গলা চেপে ধরে।আক্রোশ ভরা কন্ঠে বললো—

    “আমি বেঁচে থাকতে আমার রজনীগন্ধা অন্য কারো হতে পারে না।”

    দম বন্ধ হয়ে আসে জান্নাহ্ এর।তার প্রাণপাখি যেনো তার চোখ দিয়ে উড়াল দিচ্ছে।শ্বাস নিতে না পারাই নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারে সারহানকে।স্থির সারহান গিয়ে পড়ে ডাইনিং আর ড্রয়িং এর মাঝের বিভেদ দেয়ালে।লম্বা দম নেয় সারহান।কেঁশে উঠে জান্নাহ।ব্যগ্র হাতে জগ থেকে পানি ঢেলে সেকন্ডেই গিলে নেয়।সারহান দেয়ালের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে।ধীরে ধীরে তা ঘেঁষেই নিচে বসে পড়ে।জান্নাহ্ এর উদ্ভাসিত চোখ দুটো যেনো বের হয়ে আসছে কোটর থেকে।যেখানটায় সারহানের মাথায় ধাক্কা লেগে ছিলো তা দিয়ে লহুর রেখা এঁকে যায়।তটস্থ হয়ে সারহানের কাছে আসে জান্নাহ্।গুমোট গলায় বললো—

    “সারহান!সারহান!
    আমি ইচ্ছে করে করি নি।সারহান।”

    সারহান মৃদু হাসে।তর্জনী দিয়ে লেপ্টে দেয় জান্নাহ্ এর ঠোঁটের লিপস্টিক।ক্ষীণ সুরে বললো—

    “আমি ভালোবাসি আপনাকে রজনীগন্ধা।খুব ভালোবাসি।”

    বিলাপ করে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।বললো–

    “আপনার কিছু হবে না সারহান।কিছু না।”

    স্মিতহাস্য অধরে সারহান বললো—

    “তা কী করে হয় রজনীগন্ধা!আমি না মরলে তো আপনি মুক্তি পাবেন না।”

    মুক্ত গলায় চিৎকার করে উঠে জান্নাহ্–

    “সারহান!এইসব কী বলছেন?

    সারহান তার মাথার পেছন থেকে হাত আনতেই দেখে তা রক্তে রাঙানো।সেই রক্ত আদরের সাথে মেখে দেয় জান্নাহ্ এর পাতলা ঠোঁটে।মৃদু গলায় বললো সারহান—

    “আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে রজনীগন্ধা।আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচার চেয়ে আমি মরতে রাজি।”

    অধর ছড়িয়ে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কাঁদে জান্নাহ্।ফিরফিরে গলায় বললো—

    “এমন বলবেন না সারহান।আপনার কিছু হবে না।আমি এখনই আপনাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।”

    তাচ্ছিল্য হাসে সারহান।নিরুদ্বেগ গলায় বললো—

    “আপনি তা পারবেন না রজনীগন্ধা।দরজা আমি লক করে দিয়েছি।পার্সওয়ার্ড ছাড়া তা খুলবে না।আর আপনি আপনার কোমল হাত দিয়ে দরজা ভাঙতেও পারবেন না।”

    ঝামটা মেরে উঠে জান্নাহ্।চোখের পানি দুই হাত দিয়ে টেনে মুছে ফেলে বললো—

    “কী পাগলামো করছেন আপনি?কোথায় আপনার মোবাইল?আমি তিশাম ভাইয়াকে কল করবো।”

    “মোবাইল তো আমি আনি নি রজনীগন্ধা।ফেলে দিয়েছি।আজকের পর তা আর কাজে আসবে না আমার।”

    রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে জান্নাহ্।সারহানের বুকে কয়েকটা চাপড় মেরে বললো—

    “কী শুরু করেছেন আপনি!কোথায় যাবেন আপনি আমাকে ছেড়ে?আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিবো না।সব হারিয়ে আপনাকে পেয়েছি আমি।আমি থাকতে পারবো না আপনাকে ছাড়া সারহান।পারবো না আমি।”

    ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।বেডরুমও লক।জান্নাহ্ এর আর কিছু করার নেই সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে সারহান।যেনো নিজের প্রাণ সে নিজেই উৎসর্গ করছে।বাচ্চাদের মতো গলা ফাটিয়ে কাঁদছে জান্নাহ্।তার কান্না শোনার জন্য তার প্রাণই আছে তার সাথে।সারহান নিরুত্তাপ গলায় বললো—

    “আমি আমার নামের সব সম্পত্তি জাবিনের নামে করে দিয়েছে।ওর একুশ বছর হতেই এর মালিকানাসত্ত ওর হাতে চলে যাবে।বাড়িটা আমি তিতির নামে করে দিয়েছি।অনেক সহ্য করেছে ওরা আমার জন্য।মা,বাবাকে বলেছি আমাকে ভুলে যেতে।ভাববে সারহানে নামে তাদের কেউ ছিলই না।আপুর কাছে ক্ষমা চেয়েছি আমি।
    কিন্তু আপনার ঋণ কী করে শোধ করবো আমি?বলতে পারেন রজনীগন্ধা?

    “আমার শুধু আপনাকে চাই।আর কিছু চাই না আমার।কিছু না।”

    জান্নাহ্ ঝাঁপিয়ে পড়ে সারহানের বুকে।সারহান জোড়ালো হাতে জান্নাহ্কে চেপে ধরে নিজের প্রশ্বস্ত বুকে।পাঁজর ভাঙা ক্রন্দনে বললো—

    “কী করে বাঁচবো আপনাকে ছাড়া আমি রজনীগন্ধা?বলতে পারেন,আপনাকে ছাড়া আমি শ্বাস নিবো কী করে?ওরা যে আপনাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে!

    জান্নাহ্ সমাহিত হয়ে যায় সারহানের বুকে।কোনো কথা বললো না সে।সারহানের বুকের সেই ছোট্ট যন্ত্রটা ক্রমশ বেগবান হচ্ছে।

    রাত গভীর হচ্ছে।আকাশ জুড়ে তারার মেলা।চন্দ্র তার আলো ছড়াচ্ছে।বাতাসে বইছে নীরবতা।ধীরে ধীরে সারহানের শ্বাস ভারী হতে লাগলো।জান্নাহ্ এর চোখের পানিতে ভিজে যায় সারহানের বক্ষ:স্থল।

    “তুমি আমার এমনই একজন যারে
    একজনমে ভালোবেসে ভরবে না এমন,
    এক জনমের ভালোবাসা,এক জনমের কাছে আসা
    একটি চোখের পলক পড়তেই লাগে যতক্ষন।”

    চলবে,,,

    #জান্নাহ্
    #পর্বঃ৭৭
    লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

    সারহানের বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে জান্নাহ্।নিরাক পরিবেশে একে অন্যের শ্বাসের আওয়াজ শুনতে পারছে।জান্নাহ্কে দুই হাতে আরো শক্ত করে আবদ্ধ করে নিজের সাথে সারহান।থমথমে গলায় বললো—

    “আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমার শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে করতে হবে রজনীগন্ধা।”

    ফুঁপাতে থাকে জান্নাহ্।তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।ঠাঁয় লেপ্টে রইলো সারহানের বুকের সাথে।সারহান ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বললো—

    “আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না রজনীগন্ধা।”

    সারহানের ক্ষীণ স্বর জান্নাহ্ এর হৃদকম্পন থমকে দেয়।সে আরো জোরে খামছে ধরে সারহানের শার্ট।তার বুকে মুখ ঘষতে থাকে।মৃদু ছন্দে বললো সারহান—

    “জানেন,ছোটবেলা মা বলতো দৌঁড়াস না সারহান পড়ে যাবি,পড়ে যাবি।সারহান থামতোই না।কারণ তাকে সামলে নেওয়ার জন্য তার মা ছিলো,বাবা ছিলো,দাদু ছিলো।
    আজ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমি অনেক ক্লান্ত রজনীগন্ধা।এই ভুলে ভরা জীবনে অনেক দৌঁড়েছি আমি।অতীতকে ভুলতে,ভবিষ্যৎ কে ছিনিয়ে আনতে।কিন্তু বর্তমানকে নিয়ে ভাবিই নি।বর্তমানই তো একসময় অতীত হয়।”

    জান্নাহ্ শুনলো কিছু বললো না।সারহান বারকয়েক নাক টেনে অনায়ত গলায় বললো—

    “সারহান কখনো ভাবে নি সে কাউকে এতোটা ভালোবাসবে।এতোটা উন্মাদ হবে কারো জন্য।সে শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছে।নিজেকে ভালোবেসেছে।
    ঘর,পরিবার,সংসার কিছু ছিলো না তার।আপনি এলেন তার অন্ধকার জীবনের চন্দ্রপ্রভা হয়ে।তার কলুষিত জীবনে ফুলের সুবাস হয়ে।তার রজনীগন্ধা হয়ে।কী করে বাঁচবে সে আপনাকে ছাড়া!
    ভুল আমি করেছি।তার শাস্তিও আমি পেয়েছি।তবে আপনাকে কেন হারাতে হবে আমার বলুনতো?

    সারহান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো—-

    “আজ আমার ভুলে ভরা জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস নিবো আমি।এতে যদি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়।”

    জান্নাহ্ ফিকে আওয়াজ তুলে তার নিরেট গলায়।বললো—

    “আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না সারহান।আপনার রজনীগন্ধা আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।যাবেন না আপনি।”

    মৃদু হাসে সারহান।তেজহীন গলায় বললো—

    “তা তো হয় না রজনীগন্ধা।সারহান কে যে যেতেই হবে।এই পৃথিবী তার জন্য নয়।এই পৃথিবীর মায়া সে কাটিয়ে ফেলেছে।এখন শুধু অন্তিম শ্বাস নেওয়ার অপেক্ষা।”

    জান্নাহ্ এর কলিজা ভাঙা ক্রন্দনে অনুরণন হয় সারহানের শরীরে।দুই হাতের বাঁধন শক্ত করতে থাকে সারহান।থামানো যায় না জান্নাহ্কে।তার প্রাণ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।কিছুতেই না।

    সারহান চুপ করে রইলো। তার প্রানসঞ্চিবনী ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে।নৈঃশব্দে দীর্ঘ শ্বাস ফেলতে থাকে সারহান।কাতর গলায় বললো—

    “আমার পরীকে আর দেখা হলো না আমার রজনীগন্ধা।এতোটা নিষ্ঠুর কী করে হলেন আপনি?একটুও মায়া হলো না আমার উপর?

    জান্নাহ্ এর চোখ বেয়ে নামছে স্বচ্ছ,শীতল জলের নহর।সে চুপ করে সারহানের বুকের ভেতর গুঁজে রইলো।সে এখানে থাকতে চায়।এখানেই।
    সারহান অসহায় মুখ করে বললো—

    “আপনি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন তো রজনীগন্ধা?

    জান্নাহ্ দুই হাতে খাঁমচে ধরলো সারহানের শার্ট।নিজেকে সন্তর্পনে আরো গুঁজে দিলো সারহানের সাথে।যেনো মৃত্যুও তাদের আলাদা করতে পারবে না।অস্ফুট আওয়াজে বললো—

    “উঁহু।”

    চোখের জল ছেড়ে প্রসন্ন হাসে সারহান।দুর্বল গলায় বললো—

    “আপনাকে আমি কাউকে দিতে পারবো না রজনীগন্ধা।কাউকে না।”

    সারহানের গলায় ডান হাত জড়িয়ে নিজের মুখটা সারহানের গলার কাছে নিয়ে আসে জান্নাহ্।তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে কম্পিত হতে থাকে সারহানের পুরুষালী ব্যক্তিত্ব।সারহান ডান হাতে চেপে ধরে জান্নাহ্কে নিজের সাথে।জান্নাহ্ সেভাবেই পড়ে রইলো।নিজের শ্বাস আটকে নেয় সারহান।এই মুহুর্তে সে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর কাজ করবে।বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে সারহান।তা সাবধানতার সাথে ইনজেক্ট করে জান্নাহ্ এর গলায়।হেঁচকি তুলে কয়েকটা অর্ধ শ্বাস নেয় জান্নাহ্।তারপর!
    তারপর!
    জান্নাহ্ এর শ্বাস প্রলীন হতে থাকে তার প্রাণের বুকে।জান্নাহ্ তার শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার আগেও সারহানকে প্রবল আবেগ,ভালোবাসায় আর মায়ায় জড়িয়ে ধরে।নিজেকে বাঁচানোর কোনো তাগিদ নেই তার।চিবুকটা হালকা সারহানের বুক থেকে সরিয়ে উঁচু করে সারহানের মোহনীয় মুখটার দিকে তাকায় জান্নাহ্।অস্পষ্ট কন্ঠে বললো—

    “সারহান,আমাদের মেয়ে….।”

    জান্নাহ্ এর সময় হলো না আর কিছু বলার।তার প্রাণের বুকেই তার অন্তিম নিঃশ্বাস নিঃসৃত হলো।যেমনটা সে চেয়েছে।
    বাতাস ভারী হয়ে আসে সারহানের গুমোট কান্নায়।বুকের ভেতরের কষ্টগুলো বিক্ষিন্ত হতে থাকে সারা দেহে।সারহান তার সমস্ত শক্তি দিয়ে জান্নাহ্কে আঁকড়ে নেয় তার বুকে।বদ্ধ গলায় বললো—-

    “আমাকে ক্ষমা করে দিন রজনীগন্ধা।আমি যে আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।কাউকে দিতেও পারবো না।আপনি যে শুধু আমার।আমার রজনীগন্ধা।”

    সারহানের চোখ বেয়ে নামে নোনতা জলের প্রস্রবণ।তার বুক কেঁপে কেঁপে উঠে ক্ষণকাল পরপর।নিজের সকল ভালোবাসা,আবেগ,অনুভূতির অন্তিম বিসর্জন দেয় সারহান।তার হৃদয়ভরা ভালোবাসার সমর্পণ করেছে সে।তার কান্নায় যেনো দেয়ালের প্রতিটি ইট তীব্র কষ্টের নিঃশ্বাস নিচ্ছে।জমাট গলায় বলে উঠে আকুতি নিয়ে সারহান—-

    “আমার যে কিছু করার ছিলো না।আপনাকে আমি হারাতে পারবো না।এপারে আপনাকে ভালো আমি বাসতে পারি নি আপনার মতো করে।কিন্তু ওপারে,ওপারে শুধু আপনাকেই ভালোবাসবো আমি।শুধু আপনাকে।আপনার প্রাণ শুধু তার রজনীগন্ধাকেই ভালোবাসবে।ওপারে কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”

    সারহান সিরিঞ্জের বাকি সায়ানাইড টুকু নিজের হৃৎপিন্ডে পুশ করে নেয়।অতলান্তিক মায়ায়,গভীর শ্বাসের পতন ঘটে।সারহান অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলতে থাকে।লম্বা শ্বাস।স্বগতোক্তি করে বললো—-

    “ওপারে আবার দেখা হবে রজনীগন্ধা।আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”

    সারহান তার রজনীগন্ধার সুবাসেই অন্তিম শ্বাস নেয়।যতক্ষন তার হৃদপিন্ড স্পন্দিত ছিলো ততক্ষন সে জান্নাহ্কে জড়িয়েই বসে থাকলো।চোখ বোজার আগে সে শুনতে পায় দরজায় কারো চাপড়ের আওয়াজ।বিলীন হয়ে যায় সারহানের শ্বাস।

    দরজায় ক্রমাগত করাঘাতেও খুললো না তা।তাই বাধ্য হয়ে তা ভাঙতে হলো।ইহতিশামের অধৈর্য পা দুটো থমকে যায় মুহূর্তেই।নিথর,নিস্তব্ধ,নিরব।উদ্ভাসিত দুই চোখে টলটলে জল ইহতিশামের।তার পেছনেই রাফাত,মেহনাজ,শায়িখ।
    রাফাত থমকে গিয়েই একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিলো।গা গুলিয়ে উঠলো মেহনাজের।শায়িখ যেনো তার নিজের লাশ দেখলো।

    রাফাত অস্ফুট আওয়াজে ডেকে উঠে–

    “জান্নাহ্!

    পা বাড়াতেই হিংস্র বাঘের মতো গর্জে উঠে ইহতিশাম।

    “একদম আগাবে না তোমরা।”

    মেহনাজ বাতাসে ঝড় তোলে তার কান্নার আওয়াজে।ইহতিশাম ঝড়ো গলায় বললো—

    “এখন কাঁদছো কেন তুমি?এটাই তো তুমি চেয়েছিলে।শেষ হয়ে গেলো এক স্বপ্ন,এক স্বপ্নচোরা প্রেমিক,এক ভালোবাসার কাঙালিনী।ধ্বংস করে দিলে তোমরা সব।”

    রাফাতের দিকে তাকিয়ে খলবলিয়ে বললো—

    “বেরিয়ে যাও এখান থেকে তোমরা,বেরিয়ে যাও।আজ যদি এই ছোট্ট প্রাণটা আমার হাতে না থাকতো তাহলে তোমাদের দুজন কে আমি..।এখন
    ই আমার সামনে থেকে যাও।দুর হও এখান থেকে।”

    রাফাত অসহায় মুখ করে কাতর গলায় বললো–

    “প্লিজ ইহতিশাম,একবার আমাকে দেখতে দাও ওকে।এ আমি কী করলাম!আমার জান্নাহ্।”

    “ইউ রাস্কেল!ও তোমার জান্নাহ্ নয়।ও শুধুই সারহানের রজনীগন্ধা।তোমরা দুই জন মিলে খুন করেছো ওদের।শায়িখ,ওদের বের করে দাও এখান থেকে।ওদের ছায়াও যেনো না পড়ে সারহান আর জান্নাহ্ এর উপর।”

    ইহতিশামকে অনেক মিনতি করেও ওদের দুই নিথর দেহের কাছে পৌঁছাতে পারলো না রাফাত আর মেহনাজ।শায়িখ শক্ত হাতে ওদের বের করে দেয়।দরজায় বাইরেই বসে থাকে রাফাত মেহনাজ।গুমড়ে কেঁদে উঠে রাফাত।মেহনাজ তীক্ষ্ম স্বরে চেঁচাতে থাকে।ভেতরে এসে হাত,পা ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়ে শায়িখ।দ্বিতীয় বারের মতো সে তার মাথার উপর থাকা বটবৃক্ষের ছায়াকে হারালো।বোনকে হারালো।নৈঃশব্দে চলে শায়িখের ক্রন্দন।

    নরম পায়ে সারহান আর জান্নাহ্ এর সামনে আসে ইহতিশাম।হাঁটু ভেঙে তাদের সামনে বসে।কোলের বাচ্চাটিকে মেঝেতে রাখে।আবেগপূর্ণ গলায় বলে উঠে ইহতিশাম—

    “এমন কেন করলি দোস্ত!আমি তো তোকে কথা দিয়েছে।শেষ বারের মতো আমাকে বিশ্বাস করতি।আমি তোর পরীকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি সারহান।কিউটি,প্লিজ উঠো।আমি আমার কথা রেখেছি।নিয়ে এসেছি তোমার মেয়েকে।উঠো প্লিজ।”

    কেউ উঠলো না।পড়ে রইলো দুটি প্রাণহীন দেহ।বাচ্চাটি স্বশব্দে কেঁদে উঠে।তার কান্না শুনতে পায় নির্বাক বাতাস,গুমোট কান্না,সিমেন্ট বালুর দেয়াল।শুনলো না তার জন্মদাতা বাবা।শুনলো না তার জন্মদাত্রী।যারা একবুক আশা নিয়ে বুক বেঁধে ছিলো তার জন্য।ইহতিশাম আবার বলে উঠে—-

    “উঠনা সারহান,উঠনা দোস্ত।আমি তোর পরীকে নিয়ে এসেছি।দেখ,তোর পরী তোকে ডাকছে।কিউটি উঠো।তোমার মেয়ে তোমাকে ডাকছে।এতোটা নিঠুর হয়ো না।ওকে কোলে তুলে নাও প্লিজ।নিয়ে যাও তোমাদের পরীকে এখান দেখে।দুরে চলে যাও।”

    দুই হাতে নিজের চোখ চেপে ধরে আর্তনাদ করে বলে উঠে ইহতিশাম—

    “এই তুই কী করলি সারহান!কেন আমাকে অপরাধী বানালি?কেন ভরসা করলি না নিজের ভালোবাসার উপর?কেন শেষ বারের মতো বিশ্বাস করলি না আমাকে?

    মাথা নুইয়ে আসে ইহতিশামের।বাচ্চাটি সমানতালে কেঁদেই যাচ্ছে।ইহতিশামের চোখ পড়ে সারহানের হাতের দিকে।একটা সাদা রঙের কাগজের টুকরো।ইহতিশাম দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে তা হাতে নেয়।ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তা খুলে মেলে ধরে।জল ছেপে আসে ইহতিশামের নয়নযুগলে।গুটি গুটি হাতে তাতে লেখা—-

    “আমায় ক্ষমা করে দিস ইহতিশাম।ভাগ্যের কাছে আমি অসহায়।আমার পরীর মতো আমার রজনীগন্ধাকেও ওরা কেড়ে নিবে।তাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো নারে।আমার শাস্তি আমি পেয়ে গেছি।জীবদ্দশায় আমি আমার মেয়েকে চোখে দেখতে পারি নি।মৃত্যু আমার জন্য যন্ত্রণা নয়।তার চেয়ে বড় শাস্তি পেয়েছি আমি।

    আমার মেয়েটাকে দেখিস দোস্ত।ওকে আমি তোকে দিয়ে গেলাম।আমার পরীরে দেখে রাখিস।ওর তো কোনো দোষ নেই।ওকে কখনো ওর বাবা মায়ের অতীত জানতে দিস না।আমি চাই না আমার পরী আমাকে ঘৃণা করুক।তুই আমাকে আবার ঋণী করলি।

    আমি আমার রজনীগন্ধাকে খুব ভালোবাসিরে।খুব।তাকে ছাড়া তো আমি একটা নিঃশ্বাসও নিতে পারবো না।তাহলে ওপারে থাকবো কী করে আমি!তাই আমি তাকে আমার সাথে করে নিয়ে গেলাম।

    ভালো থাকিস দোস্ত।আমার মেয়টাকে তুই তোর আদর্শে মানুষ করিস।তোর মতো করে।ক্ষমা করে দিস আমায়।ক্ষমা করে দিস।আমি আমার রজনীগন্ধার প্রাণ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছি।জানিস তো-

    “এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার”

    টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল ইহতিশামের চোখ থেকে।নাকের উপরে থাকা ভারী ফ্রেমের চশমাটা মুছে আবার চোখে পড়ে।দরজায় অনবরত করাঘাত পড়ছে।

    আজ আঠারো বছর ধরে ইহতিশাম এই এক টুকরো কাগজ প্রতি বছর এই দিনে পড়ে।কাঁদে,ভাবে।তারপর তা অতি যত্নের সাথে ড্রয়ারে রেখে দেয়।দরজা খুলতেই একগাল হেসে মেয়েটি তার বাবার বুকের সাথে মিশে যায়।হাস্যোজ্জ্বল গলায় অভিমান নিয়ে বললো—

    “কী করছিলে তুমি দরজা বন্ধ করে বাবা?তুমি এখনো আমাকে বললে না।প্রতি বছর তুমি এই দিনে ঘরের দরজা বন্ধ করে কী করো?

    ইহতিশাম শীতল নিঃশ্বাস ফেলে বললো—

    “কিছু না আমার রজনীগন্ধা।এতো সেজেগুঁজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে আপনার?

    মেয়েটি চমৎকার হেসে বললো—

    “উফ বাবা!ভুলে গেলে!আজ কলেজে বিদায় সংবর্ধণা অনুষ্ঠান।কয়েকদিন পরেই তো আমাদের পরীক্ষা।”

    ইহতিশাম অনুযোগের সুরে বললো—

    “সরি,সরি রজনীগন্ধা।ভুল হয়ে গেছে বাবার।ক্ষমা করে দিন।”

    “দিলাম ইহতিশাম।আর যেনো না হয়।”

    বিজ্ঞের মতো নিজের বাবাকে এই কথা বলেই ঝরঝর করে হেসে ফেলে মেয়েটি।ইহতিশাম মৃদু হাসে।সরস গলায় বললো—

    “আপনি কী এখনই বের হবেন রজনীগন্ধা?

    “হ্যাঁ,বাবা।”

    “সাবধানে যাবেন।”

    অনেকটা সংকোচ নিয়ে মেয়েটি বললো—-

    “তোমাকে একটা কথা বলবো বাবা?

    “বলুন।”

    “আমি যদি কোনো ভুল কর ফেলি তুমি কী আমায় ক্ষমা করবে?

    ইহতিশাম সন্দিহান চোখে তাকায়।দ্বিধান্বিত গলায় বললো—-

    “ঠিক বুঝলাম না।”

    মেয়েটি বিনয়ী সুরে বললো—

    “কাউকে ভালোবাসা কী অপরাধ বাবা?

    “নাহ।তবে ভালোবেসে এমন কিছু করা অপরাধ যা আপনি পরবর্তীতে শোধরাতে পারবেন না।”

    “তাহলে যে বড় বাবা বলতো,”এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”

    ইহতিশাম সহজ গলায় বললো—

    “আপনার বড় বাবা তাই বলেছেন যা তিনি করেছেন।”

    মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো—

    “ওকে আমি যাচ্ছি।”

    “হুম।”

    বাবার ঘর থেকে বের হয়ে করিডোর দিয়ে সামনে আসতেই দাঁড়িয়ে যায় মেয়েটি।সে তার ডানপাশে তাকায়।দুটো ছবি বাঁধানো সেখান।সারহান আর জান্নাহ্ এর হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি।মেয়েটি হাসে। প্রাণখোলা হাসি।হাসি হাসি মুখে বললো–

    “বড় বাবা,তুমিও কী আমার সাথে রাগ করবে?

    সামনের ফটোফ্রেমে বন্ধি সুদর্শন পুরুষটি মনে হলো হাসলো।তার হাসিতে হৃদয় গলে পানি হয়ে গেলো মেয়েটির।কোমল গলায় আবার বললো–

    “বড়মা,তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো।তোমার কথা বাবা শুনবে।আমি কী করবো বলো!ইন্তেজার আমার কথা শুনছেই না।ও কিছুতেই আমাকে ভালোবাসতে চায় না।তাই আমিও প্রতিজ্ঞা করেছি ওকে বিয়ে করেই ছাড়বো।কারণ,এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”
    ,
    ,
    ,
    লাল রঙের একটা গাউন পড়েছে মেয়েটি।তার চোখ জুড়ে কাজল।মাথায় আকর্ষনীয় খোঁপা।তাতে গুঁজে দেওয়া রজনীগন্ধার সদ্য ফোঁটা কলি।

    বাড়ি থেকে বের হয়ে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটি।প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা কবর দেখতে পায় সে।কিন্তু অদ্ভুতভাবেই সে থমকে যায়।কারণ যখন থেকে মেয়েটির বোধদয় হয়েছে তখন থেকে সে রোজ যাওয়া আসার পথে দু’জন বৃদ্ধ,বৃদ্ধাকে এখানে বসে থাকতে দেখে।কবরস্থানের পাহাড়াদারকে জিঙ্গেস করে জানতে পারে এখানে তাদের ছেলে আর ছেলের বউকে সমাহিত করা হয়েছে।তারা রোজ রজনীগন্ধা ফুলের ডাল এনে কবরের বুকে রাখে।আর কবরের পাশের বেঞ্চিতে একে অন্যের কাঁধে হেলান দিয়ে বসে কাঁদে।মেয়েটি দূর থেকেই সবসময় দেখে।কিন্তু আজ সে কবরস্থানের ভেতরে এসেছে।পুরাতন কবর দুটোর পাশে আরো দুটো নতুন কবর।জানতে পারে বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা মারা গেছে গত দুইদিন।

    চোখ জ্বলে উঠে মেয়েটির।কারণ মেয়েটি নিজেও জানে না এরা তারই আপনজন।পুরোনো কবর দুটোতে এখন আর রজনীগন্ধা নেই।মেয়েটি তার খোঁপা থেকে ফুলগুলো খুলে একটা একটা করে সেই কবরের উপর রাখে।
    মেয়েটি জানে তার বড় বাবা আর বড় মা তাকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের প্রাণ দিয়েছে।একে অন্যকে ছাড়া বাঁচবেনা বলে একসাথেই প্রাণ ত্যাগ করেছে।কিন্তু তাদের কবর কখনো দেখা হয়নি তার।

    সারহান আর জান্নাহ্ রোজ তাদের মেয়েকে দেখে এখান থেকেই।ইহতিশাম কবরের পাশেই একটা বাড়ি বানিয়েছে।সারহানের শেষ অংশকে সে মানুষ করেছে তার মতো করেই।
    মেহনাজকে ফিরিয়ে নেয় নি ইহতিশাম।একবার সে তাকে অনুরোধ করেছিলো।কিন্তু নাকোচ করে ইহতিশাম।মেহনাজ কোথায় আছে কেউ জানে না।শুভ্রার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়।সে কাউকে চিন্তে পারে না।তার শেষ ঠিকানা হয় মানসিক হসপিটাল।সারহানের মৃত্যুর খবরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় জাবিন।তার মামার এই পরিণতির জন্য সে নিজেকেই দায়ী করে।তিতি আজও মাঝে মাঝে তার মাকে দেখতে আসে।কিন্তু শুভ্রা!
    সেরাজ আবার বিয়ে করেছে।
    ,
    ,
    ,
    হাত বাঁধা ইন্তজারের।তার সামনে চোখ পিটপিট করছে মেয়েটি।চোখে হাসলো সে।ইন্তেজার রুষ্ট গলায় বললো—

    “এইসবের মানে কী!ছাঁড়ো আমাকে।”

    মেয়েটি সলজ্জ গলায় বললো—

    “এমন করো না বাবু।”

    ইন্তেজার নাক ফুলিয়ে বললো—

    “ছাড়ো আমাকে।”

    মেয়েটির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার বন্ধু-বান্ধব।মেয়েটি হৈ-হৈ করে বললো—

    “কাজী সাহেবকে খবর দিয়েছিস?এতো দেরি করছে কেন?

    তার বন্ধু বান্ধব স্বমস্বরে বলে উঠে—-

    “আরে,আরে চিন্তা করিস না।সোহেল নিয়ে আসছে বলে।”

    তৎক্ষণাৎ সোহেল নিয়ে আসে একজনকে।সাদা রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত ব্যক্তির দীঘল দাঁড়ি গোফ।তার হাতে একটা ঝকঝকে খাতা।কাজী সাহেব ভীত চোখে তাকালেন ইন্তেজারের দিকে।ইন্তেজারের আকুতি ভরা চোখ দেখে ভড়কে যান কাজী সাহেব।হতভম্ব গলায় বললেন—

    “এএএএসব কী।একে বেঁধে রেখেছো কেন?

    মেয়েটি ঝলমলে গলায় বললো—

    “বিয়ে করবো তাই।”

    প্রস্ফুরিত গলায় বললো কাজী সাহেব—-

    “তোতোতত বেঁধে রেখেছো কেন?

    মেয়েটি চটপটে গলায় বললো—

    “রাজী হচ্ছে না তাই।বিয়েটা পড়ান কাজী সাহেব।আমার বাবুর কষ্ট হচ্ছ।কতোক্ষন থেকে বেঁধে রেখেছি।”

    কাজী সাহেব টিমটিমে চোখে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন।ইন্তেজার কিছুতেই বিয়ে করবে না।সব ফর্মালিটিস শেষে যখন কবুল বলতে বললো ইন্তেজার কিছুতেই বলছে না।তখন মেয়েটি একটা ধারালো,পাতলা চাকু ইন্তেজারের গলায় ধরতে ভয়ে আঁতকে উঠে ইন্তেজার।আমতা আমতা গলায় বললো—

    “কী কী করছো তুমি!

    “কবুল বলবে নাকি…।”

    “কককবুল,কবুল,কবুল।”

    “দে তালি।”

    মেয়েটি উচ্ছলিত হয়ে বন্ধুদের সাথে আনন্দে কোলাকুলি করে।তখনই একজন অতীব সুদর্শন পুরুষ তটস্থ হয়ে ঢোকে সেখানে।নতুন দালান করা হচ্ছে।বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতার কারণে কাজ বন্ধ।পুরুষটি ঢুকেই গনগনে গলায় বললো–

    “কী হচ্ছে এখানে?

    ইন্তেজার ভরসার দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে শশব্যস্ত হয়ে দৌঁড়ে গেলো বলিষ্ঠ পুরুষটির পাশে।উদ্বিগ্ন গলায় বললো—

    “দেখো না মামা এই মেয়েটা…।”

    ইন্তেজারকে থামিয়ে মেয়েটি রসালো গলায় বললো—

    “মেয়ে বলছো কেন!বউ বলো।এখন তো আমি তোমার বউ।”

    পুরুষটি ধমকে উঠে বললো—

    “বউ!কীসের বউ।”

    মেয়েটি চকচকে চোখে তাকিয়ে চট জলদি বললো–

    “ও আপনি বুঝি ইন্তেজারের সেই কুমার মামা।প্রিয়তমার মৃত্যুতে চিরকুমার থাকার পণ করেছেন!

    পুরুষটি দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো।মেয়েটি স্মিতহাস্য অধরে তাকাতেই ইন্তেজার খরখরে গলায় বললো—

    “এইসব কিছুর জন্য তুমি দায়ী মামা।না সেদিন তুমি আমাকে রজনীগন্ধা ফুল আনতে পাঠাতে না এই অসহ্য মেয়েটার সাথে আমার দেখা হতো।আমার পুরো জীবনটা হেল করে দিলো।”

    পুরুষটি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ক্ষীপ্ত গলায় বললো—

    “এইসবের মানে কী?কে তুমি?কী নাম তোমার?

    মেয়েটি চোখে হাসলো।উচ্ছ্বসিত গলায় বললো—

    “জান্নাহ্।জান্নাতুল সারহান জান্নাহ্।”

    রাফাত বদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।জান্নাহ্ হাসতেই তার অধরের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকাতেই মনে হলো যেনো তার রেড চেরি হাসছে।জান্নাহ্ এখনো হাসছে।তার হাসির প্রগাঢ়তা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে।রাফাতের দম বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।অতীত ফিরে আসছে যেনো ক্রমশ সময়ের পরিক্রমায়।রাফাত বিভ্রান্ত,চকিত,ভীত।

    আবার না ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়!কারণ জান্নাহ্ সে।এক মায়াবী প্রতিমা,এক রহস্যে ঘেরা মানবী,এক প্রেমে পাগল কাঙালিনী।চোখের সামনে থেকেও এক অদেখা পৃথিবীর আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত নারী।তার নাম জান্নাহ্।

    ____________________সমাপ্ত______________________

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।