#নীহারিকার_জন্য (পর্ব ১)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
আকাশ আধোঘুমে টের পায় নীহারিকা অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছে। ক্রিম, বডি স্প্রের একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পায় আকাশ। ইচ্ছে করছে ঘুম থেকে ওঠে নীহারিকাকে একবার জড়িয়ে ধরতে। থাক, সকাল বেলাতেই নীহারিকার মেজাজ থাকে সপ্তমে।
একটু পরেই নীহারিকার গলা পায়, “অ্যাই, আমি নক্ষত্রকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ফেরার সময় ও স্কুল বাসেই ফিরবে। টেবিলে নাস্তা দেওয়া আছে, তুমি খেয়ে নিও।”
আকাশ ঘুম জড়ানো কন্ঠে ছোট্ট করে বলে, “আচ্ছা”।
এবার নীহারিকা নক্ষত্রকে তাড়া দেয়, ” নক্ষত্র, এখনো তোমার নাস্তা শেষ হয়নি? পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি নামব, তাড়াতাড়ি করো বাবা।”
নক্ষত্রের অসহিষ্ণু গলা পাওয়া যায়, “মা, আমি এখন ক্লাশ এইটে পড়ি। আমি একাই স্কুলে যেতে পারি, তুমি যাও না তোমার মতো করে।”
সাথে সাথে নীহারিকা রাগী গলায় বলে, “খুব বড় হয়ে গেছ, তাই না? কথা না বলে রেডি হও এখুনি।”
নক্ষত্র ওদের একমাত্র ছেলে, এবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়া ওর একদমই অপছন্দ, ও নাকি এখন বড় হয়ে গেছে। স্কুল বাসে যেতেই ওর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।
একটু পর আকাশ কানের কাছে ফিসফিস শব্দ পায়, “বাবা, আমি জানি তুমি ঘুমের ভান করছ। স্কুল থেকে এসেই তোমার সাথে খেলব কিন্তু।”
আকাশ মিটিমিটি হেসে সম্মতির মাথা নাড়ে। ছেলের সাথে দারুণ ভাব আকশের। স্কুলের যত গল্প আছে তা বাবার সাথে করা চাই। সাধারণত এই বয়সে ছেলেগুলো দূরে সরে যেতে চায়, কিন্তু নক্ষত্রের ক্ষেত্রে উল্টোটাই হয়েছে।
আকাশ শুয়ে শুয়েই টের পায় দরজা বন্ধ হবার, ওরা বের হলো। পুরো বাসাটা এখন একদম নিস্তব্ধ। আরো কিছুক্ষণ সময় নেয় আকাশ, তারপর গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে পড়ে। আজ একটা গোপন মিশন আছে, কোনোভাবেই নীহারিকাকে জানানো যাবে না। মনে একটা ভীষণ উত্তেজনা কাজ করছে আজ।
আকাশ দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়, তারপর রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। এরপর সাবধানে সিঁড়ির রেলিঙ ধরে নিচে নেমে আসতেই এই বিল্ডিংয়ের গার্ড জামাল এক লাফে কাছে চলে আসে। আকাশের হাতটা ধরে ফেলে বলে, “স্যার, আপনি আন্ধা মানুষ একাই আজ বাসা থেকে নামছেন!?? ম্যাডাম জানলে খুব রাগ করব।”
একটা ধাক্কা খায় আকাশ, ‘অন্ধ’ শব্দটার সাথে ও এখনও মানিয়ে নিতে পারেনি। বছর খানেক আগের ঘটনা, আকাশ তখন ব্যস্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, ক্যারিয়ারের তুঙ্গে। এই ফ্ল্যাটটা তখনই কেনা। একদিন ঢাকার বাইরে একটা সাইট ভিজিট করে ফিরছিল, খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। আকাশ নিজেই ড্রাইভ করছিল। হঠাৎ করেই দূর্ঘটনাটা ঘটে, সামনের কাঁচের টুকরোগুলো মুহূর্তে চোখ দুটো ক্ষতবিক্ষত করে দেয়, মাথায় জোর আঘাত পায়, শরীরের কতগুলো হাড় ভাঙে। কয়েক মাস পরে ভাঙা হাড় জোড়া লাগে, কিন্তু চোখ দুটো স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। সাথে সাথে ওর চেনা পৃথিবীটা মুহূর্তে পাল্টে যায়, তুঙ্গে থাকা ক্যারিয়ার থেমে যায়। সেদিন থেকেই ও গৃহবন্দী। এতদিন ওর উপরে সবাই নির্ভর করত আর এখন ও নিজেই সবার উপর নির্ভরশীল। মানতেই পারে না ব্যাপারটা।
পুরনো ঘটনা মনে হতেই আকাশের মনটা খারাপ হয়ে যায়, এখনো মেনে নিতে কষ্ট হয় ও অন্ধ।
আকাশ অনুরোধের ভঙ্গিতে বলে, “জামাল, তুই কিছু বলিস না কাউকে। তুই আমাকে একটু কষ্ট করে সামনের রেস্টুরেন্টে বসিয়ে দিয়ে আসতে পারবি? ওদের নেহারি আর নান রুটিটা অসাধারণ আর শেষে গরুর দুধের চা।”
জামাল হেসে বলে, “স্যার, আমি নাহয় আপানারে দিয়া আসলাম। কিন্তু আমারে কইলেই তো বাসায় খাবারগুলো দিয়া আসতাম।”
আকাশ পাত্তা না দেবার ভঙ্গিতে বলে, “আরে, বাসায় বসে কী আর রেস্টুরেন্টের মজা পাওয়া যায়? চল, তুই আমারে বসিয়ে দিয়ে আয়। নাস্তা শেষে আমি তোকে ফোন দেব।”
সেদিন বহুদিন পর আকাশ আরাম করে নাস্তা করে। রেস্টুরেন্টের ছেলেটা ওকে চেনে, খুব খাতির করে বসিয়ে গরম নেহারি আর নান দেয়। নাস্তা শেষে আয়েশ করে এক কাপ চা খায় আকাশ। আশেপাশের মানুষের নানা কথা কানে আসছে, খুব ভালো লাগে, মনে হয় আগের জীবনে ফিরে গেছে ও। এই যখন ভাবছে ঠিক তখন জামাল আসে রেস্টুরেন্টে, কাছে এসে বলে, “স্যার, এতক্ষণ ধইরা কী খান? আমি তো চিন্তায় পইড়া গেছিলাম। চলেন বাসায় দিয়া আসি।”
আকাশের মুখটা বেজার হয়ে যায়, হায় রে, নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই। এই অল্প পথটুকু যেতেও অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কী ভীষণ পরনির্ভরশীল ও!
জামাল ওকে বাসায় পৌঁছে চলে যেতে নিলে আকাশ ডেকে বলে, “জামাল, টেবিলে আমার সকালের নাস্তা রাখা আছে। তুই এটা খেয়ে নি, নাহলে তোর ম্যাডাম সব বুঝে যাবে।”
জামাল না না করেও নাস্তাটা খেয়ে ফেলে। স্যারের জন্য ওর আসলেই খারাপ লাগে। লোকটা আগে কত ফূর্তিবাজ ছিল, প্রায়ই ওরে টিপস দিত।
জামাল চলে যেতেই আকাশ রেডিওটা ছাড়ে। একটা এফএম ব্যান্ডে একটা ছেলে চটুল ভঙ্গিতে নানান মাথামুণ্ডুহীন কথা বলে যাচ্ছে, শুনতে খারাপ লাগে না আকাশের। বাসায় ও যতক্ষণ থাকে এফএম রেডিও চলতে থাকে, মনে হয় ওর নিঃসঙ্গ জীবনে বন্ধুর মতো। দুপুরের দিকে নীহারিকা অবশ্য ফোন করে খবর নেয় ও খেলো কি না, নক্ষত্র ফিরেছে কি না।
নক্ষত্র ফিরে দুপুর দুই টায়। এসেই ফ্রিজে রাখা খাবারগুলো গরম করে দেয়। তারপর বাপ বেটায় বসে একসাথে খায়। এই এক বছরে এখন এটাই রুটিন। যে বাবাকে আগে পেতই না এখন সেই বাবার সাথেই ওর সময় সবচেয়ে বেশি কাটে।
খাবার খেয়েই নক্ষত্র বলে, “আসো বাবা, এক দান সাপ লুডু হয়ে যাক।”
ইদানীং নক্ষত্র আকাশের সাথে মোবাইলে এই খেলাটা খেলে। এই খেলাটায় গুটি একটা থাকে, একা একাই খেলাটা এগোতে থাকে। নক্ষত্র মনে হয় ভেবে ভেবে আবিষ্কার করেছে ওর অন্ধ বাবার জন্য এই খেলাটা উপযুক্ত। বাবার মন ভালো রাখতেই বুঝি বেচারা ভালো না লাগলেও এই খেলাটা ওর সাথে খেলে।
নীহারিকা ফিরতে ফিরতে সেদিন রাত দশটা বেজে যায়। ইদানীং নীহারিকার প্রায়ই ফিরতে দেরি হয়। আগে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসত। আহারে, বেচারা কী করবে, সংসারের সব ঝামেলা ওর কাঁধে। অফিস শেষে বাজারটাও করে ফিরতে হয়। আজ অবশ্য বাজারে যায়নি ও। অফিসের কী একটা ডিনার প্রোগ্রাম ছিল, সেখান থেকেই ওদের বাপ ছেলের জন্য রাতের খাবার নিয়ে এসেছে।
খাওয়া দাওয়া শেষে নীহারিকা নক্ষত্রের পড়াশোনার খবর নেয়। ক্লাশের খাতাগুলো খুলে খুলে দেখে হঠাৎ নীহারিকার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, চিৎকার করে বলে, “তুমি তো অংক কিছুই পারো না। এমন করে পড়লে পাশ করবে কী করে?”
আকাশ কিছু বলতে যেতেই নীহারিকা বলে, “আচ্ছা, তোমাকে না বলেছিলাম তোমার পরিচিত কাউকে বলতে, একটা ম্যাথ টিচারের জন্য। এই সামান্য কাজটুকুও আমাকে করতে হবে?”
আকাশ একটু লজ্জিত হয়, আসলে ও দু’একজনকে বলেছে। কিন্তু কেউ হয়ত গুরুত্ব দেয়নি। আকাশ এবার সংকুচিত গলায় বলে, “আমি কাল আবার আমার বন্ধুদের ফোন করে খোঁজ নেব ওর টিচারের ব্যাপারে।”
নীহারিকা একটু বিরক্ত গলায় বলে, “থাক, আমি আহিরকে বলব, ও ঠিক ভালো একটা টিচার খুঁজে আনবে।”
ইদানীং কিছু হলেই এই নামটা শোনা যায়। আহির ওদের অফিসের কলিগ। ছেলেটা ভালো, অনেক কাজে ওর সাহায্য পাওয়া যায়। এই তো সেদিন আকাশের একটা ওষুধ কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন নীহারিকা আহিরকে ফোন করতেই পরদিনই আহির নিজে বাসায় এসে ওষুধটা দিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা আসলেই খুব ভালো।
রাতে যখন নীহারিকা ঘুমোতে আসে তখন রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আলোটা নিভিয়ে দিতেই আকাশ একটা হাত বাড়িয়ে নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তোমার ভীষণ চাপ যাচ্ছে, আমি একটুও কিছু করতে পারছি না।”
নীহারিকার খুব ক্লান্ত লাগছিল, আলতো করে বলে, “অসুবিধে নেই।”
আকাশ আরো ঘন হয়, নীহারিকাকে বুকে টেনে নিয়ে চুমু খায়, গলায় মুখ রাখে। একটা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ পায়, ভিবিএলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক। এক সময় এই ব্র্যান্ডটা আকাশের ভীষণ পছন্দের ছিল। কিন্তু নীহারিকা তো এটা দেবার কথাই না, এটা ছেলেদের ব্র্যান্ড। আর এত দামী পারফিউম তো কিনে পয়সা খরচ করার মতো অবস্থা নেই ওদের। তাহলে!?
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে আকাশের। আস্তে করে নীহারিকাকে ছেড়ে দেয়। নীহারিকাও যেন স্বস্তিবোধ করে, ক্লান্ত গলায় বলে, “খুব ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমোয়, কাল আবার সকালে উঠতে হবে।”
সেদিন রাতে আকাশের আর ঘুম আসে না। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টির সেই ঝমঝম শব্দ যেন ওর বুকে হচ্ছে।
পরদিন সকালে নীহারিকা গোসল করে যখন রেডি হচ্ছিল তখন খেয়াল করে আজ আকাশ এই সকালেই ঘুম থেকে ওঠে পড়েছে। একটু অবাকই হয়, ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “কী ব্যাপার, আজ এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে?”
আকাশ ম্লান একটা হাসি হাসে, বলে, “কেন যেন ঘুমটা ভেঙে গেল।”
নীহারিকা সাজগোজ শেষ করে ওর প্রিয় বডি স্প্রেটা দেয়, আকাশ নাক টেনে ঘ্রাণটা নেয়। হ্যাঁ, এই ঘ্রাণটায় ওর মাথা ধরে না, মাথা ঝিমঝিমও করে না। আকাশ আলতো গলায় বলে, “নীহারিকা, তুমি কী ভিবিএলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক পারফিউম ব্যবহার করো?”
নীহারিকা একটু থমকায়, তারপর চোখ সরু করে বলে, “এ কথা কেন বলছ?”
আকাশ থতমত খেয়ে বলে, “না, মনে হলো ভিবিএলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক এর ঘ্রাণটা পেলাম।”
নীহারিকা এবার আস্বস্ত হয়, বলে, “তোমার চোখের সাথে নাকের ঘ্রাণও কী চলে যাচ্ছে? আরে আমি তো একটা সস্তা ব্র্যান্ডের বডি স্প্রে দিলাম। অত দামী পারফিউম আমি কোথায় পাবো?”
আকাশ একটু আহত হয়ে মাথা নাড়ে, কিছু বলে না।
সেদিন ওরা চলে যেতেই আকাশ রেডিওটা ছাড়ে, সকালেই একটা সুন্দর গান হচ্ছে,
“মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে,
কেউ না জানি এসে কারুকে না পেয়ে
গেছে কি ঘুরে।”
আকাশ আবার নাকটা টেনে নিঃশ্বাস নেয়, নীহারিকার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা এখনো ভেসে আসছে। হঠাৎ করেই ও আবার কাল রাতের ভিবিএলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক এর ঘ্রাণটা পায়। মুহূর্তেই আবার মাথাটা ধরে যায় আকাশের। এ কেমন নতুন অসুখ হলো ওর, বিষন্ন মুখে আকাশ ভাবতে বসে।
#নীহারিকার_জন্য (পর্ব ২)
নীহারিকা অফিসে এসেই টেবিলে মাথাটা রেখে একটু ঘুমায়। প্রতিদিন এত সকালে ঘুম থেকে ওঠে সবার জন্য নাস্তা, দুপুরের খাবার রেডি করতে ওর খুব পরিশ্রম যায়। সকালে আরেকটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। আকাশের ওই দূর্ঘটনার পর নীহারিকার জীবনটা যেন আরো কঠিন হয়ে ওঠেছে।
একট মৃদু টুনটুন শব্দে নীহারিকার ঘুম ভাঙে, চেয়ে দেখে আহির দাঁড়িয়ে হাসছে, হাতে একটা চায়ের কাপ। চামচ দিয়ে আবার টুনটুন শব্দটা করে বলে, “ম্যাডাম, এই নিন গরম গরম চা, খেয়েই তাজা হয়ে যাবেন।”
নীহারিকা হাসে, হাত বাড়িয়ে চা টা নেয়, আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে বলে, “থ্যাঙ্কিউ আহির। এখন এক কাপ চায়েরই দরকার ছিল। তোমারটা কই?”
আহির ওর সামনে বসে পড়ে, হাতের তালুতে মুখটা রেখে বলে, “তুমি খাও, আমি দেখি।”
নীহারিকা একটু বিব্রত হয়, এই ছেলেটা এমন এমন কথা বলে যে মাঝে মাঝেই নীহারিকা বেশ ধন্দে পড়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আচ্ছা আহির, নক্ষত্রের জন্য একটা ভালো ম্যাথ টিচার লাগবে। তুমি একটু ব্যবস্থা করে দেবে?”
আহির এবার সোজা হয়ে বসে, মুখে এখন দুষ্টুমি নেই, বলে, “উম, আমাকে ক’টা দিন সময় দাও। আমি ঠিক খুঁজে বের করে নিয়ে আসব।”
আহিরের এই জিনিসটা খুব ভালো লাগে নীহারিকার, ওর ছোট ছোট ব্যাপারগুলোও খুব গুরুত্বের সাথে নেয়। আবার দুষ্টুমির বেলায় সবার আগে, সারাদিন ওর পেছনে লেগেই থাকে। আহিরের জন্যই এই অফিসটা ভালো লাগে।
সেদিন অফিস থেকে বের হতে নীহারিকার দেরি হয়ে যায়। মেজাজ খারাপ লাগছে, অফিসের গাড়ি নেই, আবার টুকটাক কিছু কেনাকাটাও আছে। বাইরে বেরিয়ে এসে তাকাতেই দেখে আহির হাত নাড়ছে ওর গাড়ির ভেতর থেকে। নীহারিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তার মানে ছেলেটা ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল?
কাছে যেতেই আহির কৃত্রিম গম্ভীরমুখে বলে, “ম্যাডাম, নিশ্চয়ই উত্তরায় যাবেন। ভাড়া কিন্তু একশটা মুচকি হাসি, একটাও কম না।”
নীহারিকা হেসে ফেলে, বলে, “তা বুঝলাম। কিন্তু তুমি এখনো কার জন্য অপেক্ষা করছ, নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড?”
আহির ফিচেল হাসি হেসে বলে, “একদম ঠিক বলেছেন, আর কথা না বাড়িয়ে উঠে বসুন। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমাদের ওদিকেই আমার একটা কাজ আছে।”
নীহারিকা একটু ভাবে, এই সময় কোনোকিছু পাওয়া খুব কঠিন। আহিরের সাথে যেতে পারলে ওর সময়টা বাঁচবে যেহেতু ও উত্তরাই যাচ্ছে। যদিও ওর কথা বিশ্বাস হচ্ছে না যে ওর কোনো কাজ আছে উত্তরা। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নীহারিকা গাড়িতে উঠে পড়ে।
আহির গাড়ি স্টার্ট করেই বলে, “কই, আমার মুচকি হাসি কই?”
নীহারিকাও একটু দুষ্টুমি করে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, “এই যে দিলাম। কিন্তু আমার ম্যাথ টিচারের কথা যেন মনে থাকে।”
আহির একটা হাত তুলে বলে, “তথাস্তু।”
ওর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলে নীহারিকা। আহির পাশে থাকলে সময়টা ভালো কাটে, ও ভুলেই যায় ওর জীবনের কষ্টগুলো। কিন্তু এই ছেলেটা আসলে কী চায় ওর কাছে?
এর ঠিক কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় আহির নক্ষত্রের ম্যাথ টিচারকে নিয়ে আসে। নীহারিকা তো মহাখুশি, আকাশও খুব খুশি হয়। নক্ষত্রের ম্যাথ টিচারের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হতেই নীহারিকা নক্ষত্রকে ডেকে বলে, “নক্ষত্র, তোমার টিচারকে রুমে নিয়ে যাও, আমি আসছি।”
নক্ষত্রকে খুব একটা খুশি মনে হয় না, মুখ গোমড়া করে টিচারকে নিয়ে ওর পড়ার ঘরে নিয়ে যায়।
নীহারিকা এবার আহিরের দিকে ফিরে হেসে বলে, “অনেক ধন্যবাদ আহির, বিশাল একটা উপকার করলে তুমি। একটু বসো, আকাশের সাথে গল্প করো। আমি নাস্তাটা নিয়ে আসি।”
নীহারিকা চলে যেতেই আকাশ টুকটুক করে ওদের অফিসের গল্প শোনে। আহিরের সব গল্পই শেষ হয় নীহারিকাকে দিয়ে। ওর গলার স্বরের উঠানামা টের পায় আকাশ।
একটু পরই নীহারিকা নাস্তা নিয়ে আসে, প্রথমে নক্ষত্রের রুমে নাস্তা দিয়ে আসে। তারপর ওদের নাস্তাটা দেয়। আহির নীহারিকার বানানো লুচি আর আলুর দম মুখে দিয়েই বলে, “আহ, কতদিন পর এমন স্বাদের খাবার খেলাম। নীহারিকা তোমার হাতে যাদু আছে।”
নীহারিকাও দুষ্টুমি করে বলে, “যাদু আমার হাতে না, যাদু আছে তোমার মুখে। তাই এই পচা লুচিও ভালো লাগছে।”
আহিরও জোরে হেসে ওঠে। একটু পর পরই ওরা দু’জন নানা দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে। আকাশ খেতে খেতে বুঝতে পারে ওদের দু’জনের সম্পর্কটা খুব দুষ্টুমির।
গল্প শেষে আহির উঠে দাঁড়ায় যাবার জন্য, আকাশও উঠে দাঁড়িয়ে আন্দাজে হাত বাড়ায়। আহির কাছে এসে আকাশের হাতটা ধরে। আকাশ আহিরের হাতটা চেপে ধরে আরো কাছে এসে ওর কাঁধে হাত চাপড়ে বলে, “আহির, অনেক ধন্যবাদ। তুমি প্রায়ই আমাদের অনেক কাজে সাহায্য করো। এসো মাঝে মাঝে।”
বলতে বলতে হঠাৎ একটা পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণ পায়, সেই ব্যুলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক, মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। আকাশ আস্তে আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিতেই আহির বলে, “আরে আকাশ ভাই, কী যে বলেন। এটা তো আমার দায়িত্ব।”
নীহারিকা আহিরকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। তারপর এসে সোজা রান্নাঘরে চলে যায় রাতের রান্না করতে। আজ মনটা নিশ্চিন্ত লাগছে, নক্ষত্রের ম্যাথ টিচার শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল।
এদিকে আকাশ হাতড়ে হাতড়ে ব্যালকনিতে চলে এসে চুপ করে বসে থাকে। কোথায় যেন কামিনী ফুল ফুটেছে, মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে। আচ্ছা, নীহারিকা কী আহিরের সাথে…. নাহ, ভাবনাটা ভাবতেই চাই না। এমন যখন ভাবছে ঠিক তখন পিঠে আলতো একটা স্পর্শ পায়, আকাশ চমকে উঠতেই নীহারিকা নরম গলায় বলে, “কী হয়েছে, আমার আকাশের আজ মন খারাপ কেন? আমি আজ ভীষণ খুশি, নক্ষত্র এবার থেকে অংকে আর খারাপ করবে না। কিন্তু তুমি এখানে চুপ করে বসে আছো কেনো?”
নীহারিকার হাতের স্পর্শে আকাশের মনের সন্দেহগুলো শরতের মেঘের মতো ভেসে উড়ে যায়। ভীষণ ভালো লাগায় মনটা ভরে ওঠে। প্রিয় মানুষের এমন একটু ছোঁয়া যেন ম্যাজিকের মতো কাজ করে।
এর কিছুদিন পর একদিন নীহারিকা অফিস থেকে ফিরে এসে মুখ গোমড়া করে বলে, “আমার অফিস থেকে আগামী শুক্রবার তিনদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হবে। চিটাগং এ আমাদের একটা সেমিনার আছে, কিন্তু আমি যাব কী করে?”
আকাশ উৎসাহের সাথে বলে, “কেন, যেতে অসুবিধে কোথায়? আমি আর নক্ষত্র ঠিক সামলে নেব। আর শুক্র, শনি তো ওর স্কুল বন্ধ। শুধু রবিবার ঝামেলা। একদিন না হয় নাই গেল।”
নীহারিকা চিন্তিত গলায় বলে, “কিন্তু, তোমাদের খাওয়া দাওয়া? আমি না হয় বেশি করে চিকেন, বিফ ভুনা করে দিয়ে যেতে পারব। কিন্তু ভাতটা?”
আকাশ ওকে আশ্বস্ত করে, বলে, “আরে, আমি আর নক্ষত্র ঠিক রাইস কুকারে ভাত রান্না করে নেব। তুমি অযথা চিন্তা করো না। আর জামাল তো আছেই, ওকে বললে ও টুকটাক করে দেবে।”
এবার নক্ষত্র হাততালি দিয়ে বলে, “মা, আমি আর বাবা মিলে পিকনিক করব, পারব আমরা। তুমি যাও।”
নীহারিকা চোখ পাকিয়ে বলে, “জ্বী, আপনার তো খুব মজা। শোন, আর যাই করো, পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া যাবে না। আমি ফোনে খবর নেব সবসময়।”
দেখতে দেখতে নীহারিকার যাবার দিন চলে আসে। নীহারিকা পই পই করে সব বুঝিয়ে দিয়ে যায়, কোথায় কোনটা আছে। আকাশ ওকে আশ্বস্ত করে যে সব ঠিক থাকবে, ও নিশ্চিন্তে ঘুরে আসুক।
নীহারিকা চলে যেতেই আকাশ চটুল গলায় বলে, “নক্ষত্র, আজ রাতে কিন্তু আমার সাথে ভাত রান্না করতে হবে। আর কী কী খেতে চাস, শুধু আমাকে বলবি, ঠিক বানিয়ে দেব।”
সেদিন রাতে নক্ষত্র মহাউৎসাহে বাবাকে ভাত রান্না করতে সাহায্য করে। বাবার কথামতো চাল মেপে একটা ছোট বোলে রাখে। এবার আকাশ পানি দিয়ে চালটা ধুয়ে ফেলে। তারপর চালটা রাইস কুকারে ঢেলে পানি দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর যখন ভাতটা হয়ে যায় তখন নক্ষত্র বলে, “বাবা, ভাত রান্না তো খুব সহজ। কাল থেকে আমিই রান্না করব।”
নক্ষত্রের কথা শেষ হতে না হতেই নীহারিকার ফোন আসে। ভাত রান্না হয়ে গেছে শুনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর খুটিয়ে খুটিয়ে সারাদিন ওরা কী করল সব জেনে নেয়। নক্ষত্রের পড়াশোনার খবর নেয়, আজ কী কী পড়ল। ফোনটা রাখার একটু আগে হঠাৎ একটা গলা শুনতে পায় আকাশ, “এই নীহারিকা ডিনার করবে না, আসো”, গলাটা আহিরের, চিনতে পারে আকাশ।
নীহারিকা এবার তাড়াহুড়ো করে বলে, ” আকাশ আমি রাখছি, সবাই ডিনারের জন্য ডাকছে। তোমাকে রাতে আবার ফোন দেব।”
আকাশের মনটা কোথায় যেন একটা গোত্তা খায়, আহির…।
সেদিন রাতে সব গুছিয়ে নক্ষত্রকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আকাশ যখন ফোন করে, নীহারিকা ফোনটা ধরে না। পনের মিনিট পর নীহারিকার ফোনটা আসে, “সরি, আমি বাথরুমে ছিলাম। গোসলটা করে নিলাম, সকালে তাড়াহুড়ো আছে। নক্ষত্র ঘুমিয়ে পড়েছে?”
আকাশ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে, “হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার ডিনার কেমন হলো?”
নীহারিকা হেসে বলে, “খুব মজা হয়েছে আজ। সবাই মিলে আজ আহিরকে সিল দিয়েছি, আজকের ডিনারের বিল ওকে গছিয়ে দিয়েছি।”
আকাশের মনটা খারাপ হয়ে যায়, একটু হেসে বলে, “যাক, মজা হলে তো খুব ভালো। আমি ঘুমিয়ে পড়ব নীহারিকা, তুমি ঘুমোবে এখন?”
নীহারিকা ক্লান্ত গলায় বলে, “হ্যাঁ, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কাল সারাদিন খুব বেশি ফোন দিতে পারব না, সাবধানে থেকো।”
নীহারিকা ফোনটা রেখে দেবার পর আকাশ চুপ করে বসে থাকে, কেন যেন মনটা খারাপ লাগছে। বেশ বুঝতে পারছে আজ রাতেও ওর ঘুম আসবে না। আচ্ছা, অন্ধ হয়ে যাবার পর ও কী হীনমন্যতায় ভুগছে? শুধু শুধু নীহারিকাকে সন্দেহ করছে?
পরদিন ওরা বাপ বেটা মিলে রান্না করে, নিচের দারোয়ান জামাল এসে ডিম ভেজে দিয়ে যায়। নীহারিকা মাঝে মাঝেই ফোন করে খবর নেয়।
দুপুরে খেয়েদেয়ে নক্ষত্র যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন আকাশ এসে এফএম রেডিওটা খুলে গান শুনতে থাকে। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই আকাশ উঠে বসে, চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবে। কাজটা করবে কি না ভাবছে, খুব দ্বিধা লাগছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছোটলোক মনটাই জয়ী হয়।
বাসার টি এন্ড টি সেটটা হাত নেয়, এতদিনে ও না দেখেই নম্বর টেপা শিখে গেছে। একটু ভেবে নীহারিকার অফিসের নম্বরটা মনে করে, তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করে, “হ্যালো, মিস. নীহারিকা আছে? ওনার একটা পার্সেল ছিল।”
ওপাশ থেকে একজন বলেন, “সরি, উনি ছুটিতে দেশের বাড়ি গেছেন, ক’দিন পর আসুন।”
আকাশের মাথাটা কাজ করছে না, নীহারিকা ছুটিতে দেশের বাড়ি গেছে কথাটার মানে কী? নীহারিকা তো অফিসের কাজে চিটাগং গেছে। তার মানে নীহারিকা ওকে মিথ্যে বলেছে? নীহারিকা কী আহিরের সাথে কোথাও গেছে? মাথাটা দপদপ করছে আকাশের, হাত পা কেমন যেনো দূর্বল হয়ে আসছে। ওর নীহারিকা ওর আকাশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে!!? যে নীহারিকা ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সেই নীহারিকা চলে যাবে?
আকাশ ভাবে এখুনি নীহারিকাকে ও ফোন করবে, জানতে চাইবে ও কোথায়। ফোন করতে যেয়েও হাতটা থেমে যায়। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, নীহারিকা যদি সব স্বীকার করে নেয়? যদি বলে আহিরকেই ও চায় জীবনে? নক্ষত্রকেও যদি সাথে নিয়ে যায়!? তখন এই পৃথিবীতে ও বাঁচবে কী করে, এই একাকী অন্ধকার জীবনটা ও টেনে নিয়ে যাবে কী করে? ভীষণ দিশেহারা বোধ করে আকাশ, নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় আজ। নাহ, নীহারিকাকে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। আকাশ ভীষণ স্বার্থপরের মতো ভাবে, এমন করেই সব মেনে নিতে হবে হয়ত।
আজ নীহারিকা বাসায় ফিরবে, সকালেই ফোনে জানিয়েছে বিকেল হয়ে যাবে। নক্ষত্র খুব খুশি আজ। কিন্তু আকাশের মনে আজ যেন শ্রাবণের মেঘ ভর করেছে, ও কিছুতেই মনটা ভালো করতে পারছে না। এমন এক বুক কষ্ট নিয়ে ও কেমন করে বেঁচে থাকবে আগামী দিনগুলো?
- #নীহারিকার_জন্য (পর্ব ৩)
নীহারিকা সেদিন বিকেলে বাসায় পৌঁছেই নক্ষত্রকে জড়িয়ে ধরে, অনেক আদর করে দেয়। ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে দিতে দিতে বলে, “কী, আম্মুর জন্য অনেক খারাপ লেগেছে?”
নক্ষত্র মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, আম্মু, তুমি ছাড়া এ কদিন খুব বাজে কেটেছে। তবে আমি আর আব্বু অনেক মজা করে রান্না করেছি।”
নীহারিকা হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “আহা, তোমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। কী করব বলো, হঠাৎ করেই অফিসের কাজটা পড়ে গেল।”
আকাশ শান্ত গলায় বলে, “অসুবিধে নেই, এখন তো তোমার প্রায়ই বাইরে যেতে হবে মনে হচ্ছে।”
নীহারিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তারপর বলে, “প্রায়ই বাইরে যেতে হবে মানে? কে বলল এটা তোমাকে?”
আকাশ এবার নিজেকে সামলে নেয়, তারপর ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে, “না মানে, তুমি তো সিনিয়র হচ্ছ, তাই হয়ত বাইরের ট্যুরগুলো বাড়বে তোমার। ”
নীহারিকা মাথা নেড়ে বলে, “না, এমন হবে না। মাঝে মাঝে হয়ত যেতে হতে পারে। আচ্ছা, আমি দেখি তোমরা দু’জনে মিলে আমার রান্নাঘরের কী অবস্থা করে রেখেছ।”
রাতে সব গুছিয়ে যখন শুতে আসে তখন নীহারিকা খেয়াল করে আকাশ কী যেন ভাবছে। বাসায় আসার পর থেকেই খেয়াল করেছে মুখটা অন্ধকার। আকাশ কী ওর ঢাকার বাইরে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি? নাকি সারাদিন বাসায় বসে থাকতে থাকতে এমন হচ্ছে? নীহারিকা জিজ্ঞেস করতেই আকাশ এড়িয়ে যায়, বলে, “আরে কিছু না, সারাদিন বাসায় বসে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগছে না। কিছু একটা করা দরকার।”
নীহারিকা ভাবে আসলেই আকাশের একটা কিছু করা উচিত। তা না হলে তো ও দিন দিন হতাশায় ডুবে যাবে। কিন্তু ভেবে পায় না একজন অন্ধ মানুষ কী করবে, তাও যে কি না হঠাৎ করেই অন্ধ হয়।
এরপর যত দিন যায় আকাশের মন ততোই খারাপ হতে থাকে। নীহারিকার ফোন ব্যস্ত পেলেই, কিংবা কোনোদিন ফিরতে দেরি হলে বুকটা কষ্টে ভরে যায় আকাশের। মনের ভেতর একটা আগুন জ্বলতেই থাকে, কিন্তু ও নীহারিকাকে কিছুই বলে না।
নাহ, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে, ভাবে আকাশ। সেদিন এফ এম রেডিওটা ছেড়ে এটাই ভাবছিল। ঠিক তখন একজন রেডিও জকির কথায় আকাশ কান খাড়া করে শোনে, “বন্ধুরা, আমরা তোমাদের কাছ থেকে তোমাদের ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শুনতে চাই। যার গল্প আমাদের ভালো লাগবে তার গল্প আমরা লাইভে শোনাব। তাই দেরি না করে তোমার গল্পটা রেকর্ড করে এই ইমেইল ঠিকানায় পাঠিয়ে দাও।”
হঠাৎ করেই আকাশের মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে, ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প বলবে ও। জীবন আজ তাকে এমন বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে যেটা মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের।
সকালে ওরা চলে যাবার পর বিশাল একটা সময় ও বাসাতেই থাকে। এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে। সেদিন আকাশ নক্ষত্রকে বলে মোবাইলে রেকর্ড অপশনটা স্ক্রিনের একটা সুবিধাজনক জায়গায় রাখে। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসে। নীহারিকার সাথে ওর প্রথম পরিচয়, তারপর প্রেম, বিয়ে, ওর অন্ধ হয়ে যাওয়া, নীহারিকার নতুন প্রেম (?), ওর মনের টানাপোড়েন, এগুলো নিয়ে গুছিয়ে ভাবে আকাশ।
পরদিন ওরা চলে যেতেই আকাশ বারান্দায় বসে আস্তে আস্তে সব ঘটনাগুলো খুব সংক্ষেপে বলে যায়। রেকর্ড শেষ হলে আন্দাজে চাপ দিতেই রেকর্ডটা বাজতে থাকে, উম, বাহ ওর গলার ভয়েস তো বেশ ভালো এসেছে, ভাবে আকাশ।
সেদিন নক্ষত্র স্কুল ফিরলে আকাশ বলে, “বাবা, আমাকে একটা সাহায্য করো তো। আমার মোবাইলে আজ একটা রেকর্ড করেছি, ওইটা একটা ইমেইল নাম্বারে পাঠাতে হবে। আর সাথে আমার ফোন নম্বরটা দিতে হবে, পারবি তো?”
নক্ষত্র বেশ বড় বড় ভাব নিয়ে বলে, “বাবা, এটা তো আমার এক সেকেন্ডের কাজ। কই দাও তোমার মোবাইল।”
নক্ষত্র মোবাইলের রেকর্ড অপশনে যেয়ে আজকের ফাইলটা শেয়ার অপশনে যেয়ে মেইল করে দেয়। পুরো কাজটা করতে এক মিনিটও লাগে না।
নক্ষত্র উৎসাহের সাথে বলে, “বাবা, তোমার কাজ হয়ে গেছে।”
আকাশ বিস্ময়ের সাথে বলে, “কী বলিস, এত তাড়াতাড়ি? বাহ, তুই তো বেশ কাজের হয়েছিস। আচ্ছা শোন, তোর মাকে এটা বলিস না, ওকে একটা সারপ্রাইজ দেব।”
এরপর আকাশ দিন গুনতে থাকে। বহুদিন পর মনে একটা উত্তেজনা কাজ করে। মনে হচ্ছে একটা কিছু অন্তত কাজ ও করল। নাহ, আরো কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। সেদিন আকাশ নক্ষত্রকে ডাক দিয়ে বলে, “বাবা, এখন থেকে তুই আমার কাছে বিজ্ঞান আর ইংরেজি পড়বি।”
নক্ষত্র অবাক হয়ে বলে, “সেটা কী করে সম্ভব?”
আকাশ বলে, “শোন, তুই বিজ্ঞান বইটা পড়ে শোনাবি, আর আমি বুঝিয়ে দেব। তোদের বিজ্ঞান তো আমার কাছে জলভাত। ইংরেজিটাও আমি তোকে মুখে মুখে শেখাতে পারব।”
নক্ষত্র খুব মজা পায় এটাতে। উৎসাহের সাথে বই নিয়ে আসে। নক্ষত্র অবাক হয়ে খেয়াল করে বাবা ওকে দারুণ করে বোঝাচ্ছে। স্কুলে ও অনেক কিছুই ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি।
নীহারিকা বাসায় ফিরে দেখে আকাশ নক্ষত্রকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে, খুব অবাক হয়, সাথে সাথে খুব খুশি হয়। যাক, আকাশ যদি এভাবে ব্যস্ত থাকে তাহলে খুব ভালো হয় ওর জন্য।
সেদিন আকাশ সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা করছিল, ঠিক তখন একটা ফোন আসে, “আপনি কী আকাশ বলছেন?”
এপাশ থেকে আকাশ বলে, “জ্বী, বলছি।”
ওপাশ থেকে একজন বলে, “কংগ্রাচুলেশনস, আমি নুসরাত রেডিও ‘ইচ্ছেঘুড়ি’ থেকে বলছি আপনার পাঠানো গল্পটা আমাদের খুব ভালো লেগেছে। আমরা চাচ্ছি আপনাকে দিয়ে একটা কয়েক পর্বের লাইভ শো করব। সপ্তাহে দু’দিন করে। আপনার অবস্থা বিবেচনা করে আমরা আপনাকে বাসা থেকে পিক করে নেব আবার বাসায় পৌঁছে দেব।”
আকাশ ভীষণ খুশি হয়, যাক এতদিনে একটা কাজ পাওয়া গেল। আকাশ একটা অনুরোধ করে যে পুরো গল্পটায় ও ছদ্মনাম ব্যবহার করবে।
সেদিন নীহারিকা বাসায় আসলে আকাশ বলে, “নীহারিকা, সামনের সপ্তাহ থেকে দু’দিন করে আমি সন্ধ্যায় একটু বাইরে যাব। আমার পুরনো কন্সট্রাকশন ফার্মে, দেখি টুকটাক কিছু করা যায় কিনা। তুমি ওই কটা দিন পারলে বাসায় আগে ফিরো।”
নীহারিকা চোখ কপালে তুলে, আকাশ তো দেখি সত্যিই নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। নীহারিকা হেসে বলে, “আমিও চাই তুমি ব্যস্ত থাকো। খুব ভালো করেছ আকাশ।”
নীহারিকার গলায় একটা খুশি টের পায় আকাশ। আচ্ছা, ও বাসার বাইরে থাকলে কী নীহারিকার সুবিধে হয়?
আকাশ প্রথম যেদিন রেডিও ইচ্ছেঘুড়ির অফিসে আসে ততক্ষণে বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। একজন সরাসরি ওকে নুসরাত নামের মেয়েটার কাছে নিয়ে যায়। নুসরাত আকাশকে দেখেই ওঠে দাঁড়িয়ে সামনে এসে সালাম দিয়ে বলে, “আপনি এসেছেন, আমরা ভীষণ খুশি হয়েছি। আপনার গল্পটা খুব হৃদয়স্পর্শী।”
আকাশ একটু সংকোচের সাথে বলে, “আমি কী পারব?”
নুসরাত অভয় দিয়ে বলে, “আপনার রেকর্ডিংটা আমরা শুনেছি, ভীষণ সুন্দর আপনার বাচনভঙ্গি। আপনি চোখ বন্ধ করে শুধু বলে যাবেন।”
আকাশ ম্লান হেসে বলে, “আমি চোখ খোলা রেখে বললেও সমস্যা নেই, আমি তো দেখতেই পাই না।”
নুসরাত লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে, “সরি, আমি আসলে মনের অজান্তে কথাটা বলে ফেলেছি। প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না।”
আকাশ মাথা নেড়ে বলে, “এটা কোন ব্যাপারই না।”
নুসরাত এবার প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলে, “চলুন, আমরা একটু প্রাকটিস করে নেই, হাতে এখনো আধাঘন্টা সময় আছে।”
শোটা যখন শুরু হয় তখন নুসরাত অভিজ্ঞ ঢংয়ে শুরু করে, “সুপ্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন কদম ফুল ফুটেছে, তার মানে বর্ষা চলে এসেছে। এই সুন্দর বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আমারা এমন একটা ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শুনব যা আগে কখনো আপনারা শোনেনি। যিনি এই গল্প বলবেন তিনি একজন দৃষ্টিহীন মানুষ। সংগত কারণেই ছদ্মনামেই উনি গল্পটা বলবেন। আসুন শোনা যাক ভালোবাসার টানাপোড়েনের এক অদ্ভুত গল্প।”
নুসরাত এবার ইশারা করতেই আকাশ একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে শুরু করে, “সালটা ১৯৯৭, জুন মাসের প্রচন্ড গরম পড়েছে।।আমি তখন দুটো বছর পার করে ফেলেছি ঢাকার একটা স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। একদিন দুপুরের দিকে কী একটা কাজে টিএসসির মোড়ে বন্ধুদের সাথে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা জোরে ককটেল ফাটানোর শব্দ পেলাম, দেখি ধোঁয়া উড়ছে। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল দুটো গ্রুপের ছাত্রদের ধাওয়া পালটা ধাওয়া। বন্ধুদের সাথে আমিও দৌড় দিলাম। হঠাৎ খেয়াল করি একটা মেয়ে রাস্তার মাঝে একদম স্ট্যাচু হয়ে আছে। মুহুর্তেই বুঝে ফেললাম মেয়েটা ভীষণ ভয়ে এমন হয়ে গেছে। আমি দেরি না করে মেয়েটার হাত ধরে টান দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম।
দু’জনে দৌড়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে এসে ধপ করে বসে পড়লাম। দু’জনেই জোর হাঁপাচ্ছিলাম। একটু স্বাভাবিক হতেই মেয়েটা হাত ডলতে ডলতে বলল, “এত জোরে কেউ হাত ধরে, ভীষণ ব্যথা করছে, একেবারে দাগ করে ফেলেছেন।”
আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম, কই আমাকে ধন্যবাদ দেবে তা না, আমি হাত কেন অত জোরে ধরেছি তার কৈফিয়ত চাচ্ছে। আমি বিরক্তির সাথে বললাম, “জোরে ধরে না টান দিলে তো আপনি ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকতেন।”
মেয়েটা তখন মিটিমিটি হেসে বলে, “হুম, ঠিক বলেছেন। আচ্ছা চলেন, দৌড়ে ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে। আমি আপনাকে আজ খাওয়াব।”
এভাবেই আমাদের প্রথম পরিচয়। পরে জেনেছিলাম মেয়েটার নাম নীরা (ছদ্মনাম), ঢাকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমার ক্যাম্পাসের কাছেই ছিল ওর ক্যাম্পাস। এরপর যত দিন গেছে আমি আর নীরা ততো কাছে এসেছি…”
এই পর্যায়ে আকাশকে থামিয়ে দিয়ে নুসরাত বলে, “হ্যাঁ, প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, এই ভালোবাসার কাছে আসার গল্পের পরের অংশটুকু শুনব আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।”
নুসরাত এবার হেডসেটটা নামিয়ে হাত বাড়িয়ে আকাশের হাতটা ধরে, উজ্জ্বল চোখে বলে, “আপনি তো দারুণ বলেছেন। এত বেশি লাইভ কমেন্ট এসেছে, আমি এগুলোর উত্তর দিতে দিতে শেষ। মনে হচ্ছে আপনার এই শোটা খুব জমবে।”
আকাশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, হেসে বলে, “আপনি ছিলেন বলে ব্যাপারটা সহজ হয়েছে।”
নুসরাত মাথা নেড়ে বলে, “উহু, আপনার বলার ভঙ্গি খুব সুন্দর। বাই বর্ন আপনি রেডিও জকি।”
নুসরাতের কথাগুলো ভীষণ অনুপ্রাণিত করে আকাশকে। বহুদিন পর একটা কাজ করে প্রশংসা পেলো। মনে হচ্ছে জীবনে বেঁচে থাকার মানে আছে।
এরপর যতদিন যায় আকাশের রেডিও অনুষ্ঠানটা ততো জনপ্রিয় হতে থাকে। আকাশ ধীরে ধীরে নীরার সাথে ক্যাম্পাসের উত্তাল প্রেমের দিনগুলোর কথা বলে। মান অভিমানের নানা রঙের দিনগুলো। এরপর বিয়ে, সংসার। সারা দেশের অসংখ্য মানুষ আকাশের এই ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শোনার জন্য সপ্তাহের এই দুটো দিন অপেক্ষা করে থাকে।
এদিকে নীহারিকা আহিরকে নিয়ে একটা ধন্দের মধ্যে আছে। ছেলেটা মনে মনে ওকে ভীষণ চায়, বুঝতে পারে।
সেদিন অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়ে যায়, নীহারিকা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, আকাশের আজ ওর কনস্ট্রাকশন ফার্মে যাবার কথা। আকাশ মেসেজ দিয়ে লিখেছে “নক্ষত্রকে বাসায় ম্যাথের টিচারের কাছে রেখে গেলাম, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো।”
সাতটা বেজে গেছে, নীহারিকা যখন ব্যাকুল চোখে সিএনজি খুঁজছিল ঠিক তখনই আহিরের গাড়ি দেখতে পায়। এটা যেন অবধারিত হয়ে গেছে। আজ আর দেরি করে না, নীহারিকা দ্রুত পায়ে আহিরের গাড়িতে উঠে পড়ে।
আহির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আজ ম্যাডাম ভাড়া ঠিক না করেই উঠে পড়ল?”
নীহারিকা তাড়া দেবার ভঙ্গিতে বলে, “নক্ষত্র বাসায় একা, শুধু ম্যাথ টিচার আছে। আমাকে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে আহির। প্লিজ আমাকে একটু নামিয়ে দিয়ে আসবে?”
মুহুর্তেই আহিরের মুখটা সিরিয়াস হয়ে যায়, বলে, “অবশ্যই, নক্ষত্র বাসায় একা কেন?”
নীহারিকা আলতো করে বলে, “আকাশ ওর পুরনো ফার্মে কিছু করার চেষ্টা করছে।”
আহির মাথা নেড়ে গাড়িটা ছাড়ে। এফএম রেডিওতে হালকা সুরে গান বাজছে..
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না..”
আহির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, মনের কোথায় যেন একটা ব্যথা টের পায়।
কিছুদূর যেতেই ঝুম বৃষ্টি নামে। আহির হঠাৎ করেই এফএম রেডিওর চ্যানেলটা পালটে বলে, “আরে, এখন একটা দারুণ শো শুরু হবে। প্রতিদিন ভাবি তোমাকে এই শোটার গল্প করব, অফিসে গেলেই ভুলে যাই।”
নীহারিকা অন্যমনস্কভাবে বলে, “কিসের শো?”
আহির বলে, “একজন দৃষ্টিহীন মানুষের ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প। আজ তো দারুণ পর্ব। গল্পের ট্রাজেডি পার্ট শুরু।”
নীহারিকা চোখ তুলে বলে, “তাই?”
নীহারিকার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই শোটা শুরু হয়ে যায়। রেডিও জকি নুসরাতের গলা পাওয়া যায়, “হাই, আমি নুসরাত রেডিও ” ইচ্ছেঘুড়ির” ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগতম। ঢাকায় এখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সাথে আমাদের গল্পকথক আজ আমাদের শোনাবেন তার জীবনে যখন থেকে ভালোবাসার টানাপোড়েন শুরু হলো তার গল্প। আসুন আমরা জানি কী করে শুরু হলো সেই বিরহ পর্ব..”
নুসরাতের কথা শেষ হতেই আকাশ এবার শুরু করে, “প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ। আগের পর্বে জেনেছেন কী করে জীবনে ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে আমি দৃষ্টিহীন হলাম। প্রথম প্রথম আমার এই চোখে দেখতে না পাওয়া আমি মেনে নিতে পারতাম না। এমন কি এতদিন হলো তাও পারিনি। যাই হোক নীরা আমাকে প্রথম দিকে সময় দেবার চেষ্টা করত, ও অফিস থেকে আগেই ফিরে আসত। কিন্তু যত দিন গড়াল, ও যেনো একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগল, মাঝে মাঝেই অফিস থেকে আসতে দেরি হতে লাগল। আর এদিকে আমি তুমুল ব্যস্ত একজন মানুষ হঠাৎ করেই কর্মহীন হয়ে গেলাম। সারাদিন বাসায় থাকি, একটু বাইরে যেতে হলেও অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। নীরা একাই পুরো সংসার সামলায়, আমি কোনো সাহায্য করতে পারি না। খুব খারাপ লাগত।
এর মাঝে একদিন নীরার ফিরতে রাত হয়, সেদিন আমি ওকে যখন জড়িয়ে ধরেছিলাম তখন প্রথম আমার ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শুরু হয়। আপনারা হয়ত বলবেন তা কী করে?
আসলে সেদিন আমি নীরার গায়ে ব্যুলগারির ম্যান ইন ব্ল্যাক পারফিউমের ঘ্রাণ পাই। এই ঘ্রাণটা যেন বলে দেয় নীরা আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। পরে ওকে যখন জিজ্ঞেস করি, তখন ও বলেছিল এমন পারফিউম ও ব্যবহার করে না।
আপনারা হয়ত বলবেন, এমন একটা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলে কী হয়? নাহ, কিছু হয় না। কিন্তু আমি এই পারফিউমের ঘ্রাণ আবার পেয়েছিলাম নীরার কাছের এক কলিগের গায়ে। উম, আপনারা এখনো বলবেন এতে তো কিছুই প্রমাণ হয় না যে নীরা অন্য কারো সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, আসলেই তা বলা যায় না। আমিও তাই ভাবতাম। মনকে বোঝাতাম, আমি ঘরে থাকতে থাকতে, নিজেকে পরনির্ভরশীল ভাবতে ভাবতে হয়ত আমার মনটাই ছোট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমি তখন নিশ্চিত হলাম যে নীরা আর আমার নেই…”
গল্পের এই পর্যায়ে অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যেতেই আহির মুখ দিয়ে আফসোসের একটা শব্দ করে বলে, “আহা, এখানে শেষ হলো। এটা কিছু হইল, ধুর।”
নীহারিকা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, আচ্ছা গলাটা ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। আর নীরা নামে এই পৃথিবীতে একজনই ওকে আদর করে ডাকে, সে হলো আকাশ। হঠাৎ করেই নীহারিকার মনে হয়, আকাশও তো সেদিন ওই পারফিউমের নামটা জিগ্যেস করেছিল। তাহলে এটা কী ওর নিজের জীবনের গল্প? আর সেটা কী আকাশই বলছে??
#নীহারিকার_জন্য (পর্ব ৪)
সেদিন নীহারিকা বাসায় ফিরে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, মনের ভেতর একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রেডিওর এই শোটা সম্পর্কে ও জানতই না। আহিরের কাছে আজ পুরোটা শুনল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার দু’দল ছাত্রদের মাঝে মারামারির সময় আকাশ ওর হাত ধরে টেনে বাঁচিয়েছিল। এই গল্পকথকও সেই কথাই বলেছে। এটা তো ওর আর আকাশের জীবনের কাহিনী, শুধু নামটা পালটে দিয়েছে, নীহারিকাকে নীরা বলেছে।
নীহারিকা ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবে, তারপর আকাশের একজন পরিচিত কলিগ মহসিন ভাই, যে কি না আকাশের ওই কন্সট্রাকশন ফার্মে কাজ করত তাকে ফোন করে। দেখাই যাক আকাশ আসলেই সন্ধ্যা বেলা ওখানেই যায় কি না। ফোন দিতেই ওপাশ থেকে উনি বলেন, “ভাবি, কেমন আছেন? অনেক দিন পর ফোন দিলেন। আকাশ কেমন আছে এখন?”
নীহারিকা নরম গলায় বলে, “এই তো মহসিন ভাই, চলছে আগের মতোই। বোঝেন তো আকাশ হঠাৎ করেই এমন হয়ে গেলো, সারাদিন বাসায় থাকে। একটা কাজ যদি ও পেত ভালো হতো।”
মহসিন ভাই আফসোস করে বলেন, “ভাবি, আমাকে আগে ও ফোন দিত কী করা যায়। আসলে আমাদের এই সেক্টরটা এমন যে সব হাতেকলমে কাজ। তাও আমি ওর জন্য সুবিধাজনক কিছু পেলে বলব।”
নীহারিকা ওনাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা রেখে দেয়।
নীহারিকা এবার পরিস্কার বুঝে যায় আকাশ মিথ্যে বলছে। ও আসলে ওর পুরনো ফার্মে না যেয়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে। তার মানে ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্পের কথক এই আকাশই।
নীহারিকা ভাবে, ব্যুলগারি পারফিউমের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু আজকের শো এর শেষ লাইনটার মানে কী? একদম শেষে গল্পকথক বলল, “কিন্তু এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমি তখন নিশ্চিত হলাম যে নীরা আর আমার নেই…”
কী সেই ঘটনা? নীহারিকা অনেকক্ষন ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় ও একদম স্বাভাবিক থাকবে। আকাশকে একদম বুঝতে দেওয়া যাবে না। পরের শোটাতে ও কি বলে তা জানতেই হবে। এমন কোন ঘটনা যেটা আকাশকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে আমি আর ওর নেই।
সেদিন আকাশ বাসায় ফিরতেই নীহারিকা একদম স্বাভাবিক ব্যবহার করে। বরং একটু দুষ্টুমিও করে। আকাশ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে না যে নীহারিকা ওর রেডিওর ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। রাতে আকাশ যখন ঘুমোয়, নীহারিকা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত মুখটার দিকে।
এরপর ক’টাদিন নীহারিকা অফিসে খুব মনমরা হয়ে থাকে। আহির কিছুতেই বুঝতে পারে না নীহারিকার হঠাৎ কী হলো। এদিকে নীহারিকা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পরের শোটার জন্য।
**********
আজ আকাশ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরে এসেছে রেডিও ইচ্ছেঘুড়িতে। সকালে নীহারিকাই বের করে রেখেছিল, বলল, “আজ তো সন্ধ্যায় তোমার অফিস। তুমি এই পাঞ্জাবিটা পরে যেও।”
খুব অবাক হয়েছিল আকাশ, কিছু বলেনি, শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল।
এদিকে আজ নীহারিকা অফিস থেকে আগেই বের হয়েছে। আহির এগিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু নীহারিকা রাজি হয়নি। আহির একটু দুষ্টুমি করে বলেছিল, “আজ নীল শাড়ি পরে নীহারিকা কোথায় হারিয়ে যায়?”
নীহারিকা মুচকি হেসে বলেছিল, “নীহারিকার নীড় যে আকাশে, সেখানে।”
আহিরের মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ এত কিছু ভাবার সময় নেই। নীহারিকা একটা উবার নিয়ে সোজা চলে আসে রেডিও ইচ্ছেঘুড়ির অফিসের রিসেপশনে। রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করতেই ও বলে, “আসলে আপনাদের ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শোটা আমার ভীষণ প্রিয়। আজ আমি এই শো এর গল্পকথকের সাথে দেখা করতে এসেছি। শো শেষে উনি বের হলেই একটু কথা বলব।”
রিসেপশনিস্ট মেয়েটা হেসে বলে, “প্রতিদিন শো এর সময় কেউ না কেউ ওনার সাথে দেখা করতে আসে। আচ্ছা আপনি বসুন, শোটা এখুনি শুরু হবে।”
নীহারিকা হেডফোন বের করে কানে গুঁজে নিয়ে রেডিও ইচ্ছেঘুড়ি স্টেশনটা ধরে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই নুসরাত বলে, “প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, আজ আমাদের গল্পকথক সেই ঘটনাটি বলবেন যা থেকে ওনার মনে হয়েছিল নীরা আর ওনার নেই। তাহলে আর দেরি নয়, চলুন শোনা যাক সেই টানাপোড়েনের গল্প।”
আকাশ বেশ সহজভাবেই আজ শুরু করে, “আসলে অন্ধ হয়ে যাবার পর আমি দিন দিন মনের দিক থেকে অনেক ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম। নীরাকে হারানোর ভয় তাড়া করে ফিরত। তাই সন্দেহটা বাড়ছিল, ওই পারফিউমের ঘটনার পর একদিন নীরা বলল ও অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাবে। আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু ও যেদিন গেল, সেদিন রাতে ওর সাথে ফোনে কথা বলার সময় আমি ওর সেই কলিগের গলা পাই, যিনি ওই পারফিউমটা ব্যবহার করতেন। নীরা বলল ওকে ডিনারের জন্য ডাকছে। এটা হতেই পারে, অফিসের কলিগরা একসাথে খাবে তাই তো স্বাভাবিক।
প্রিয় শ্রোতা, আমার তখন একটু মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এই মন খারাপটাই যত সময় গেল আমার ভেতর সন্দেহ উস্কে দিল। আমি পরের দিন নীরার অফিসে ছদ্মনামে ফোন দিলে ওরা বলল, নীরা ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি গেছে। এটা শোনার পর আমার নীল আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে যায়। ভীষণ কষ্ট লাগতে থাকে বুকে। তখুনি নীরাকে ফোন দিয়ে সব বলতে গিয়েই বলিনি। কেন জানেন? কারণ হঠাৎ আমার মনে হলো, যদি ও সব স্বীকার করে নেয়? আর যদি ও আমাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন এই পৃথিবীতে আমি কী করে বাঁচব? তখন আমি ভীষণ স্বার্থপরের মতো, একটা ভীতু মানুষের মতো সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ওকে কিছুই বলব না। এই পৃথিবীতে নীরাকে ছাড়া বাঁচা যে অসম্ভব….”
নুসরাত থামিয়ে দিয়ে বলে, “প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, নিশ্চয়ই আপনাদের চোখ আজ জলে ছলছল। আমারও চোখে জল, আজ আমরা গল্প এখানেই শেষ করছি। একটা অনুরোধ, আপনার কাছের মানুষকে আগলে রাখুন, দূরে সরে যেতে দিবেন না।”
এরপর নুসরাতের সাথে কথা বলতে বলতে আকাশ যখন রিসেপশন দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখন নীহারিকা ডাক দিয়ে বলে, “আকাশ, তোমার নীরাকে তুমি নিয়ে যাবে না?”
কোথাও যেনো একটা বাজ পড়ল কিংবা একটা বিশাল হিমবাহ বুঝি ধসে পড়ল। আকাশ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ঘুরে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে বলে, “নীহারিকা, তুমি!!!”
নীহারিকার চোখে জল, পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এসে বলে, “তোমার নীহারিকা তো কখনোই তোমাকে ছেড়ে যায়নি। আমি হয়ত সংসারের চাপে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার নীরা তো তোমারই আছে। তুমি ভীষণ ভুল বুঝেছ আমাকে। হ্যাঁ, সেদিন আমার গায়ে ব্যুলগারি পারফিউমের ঘ্রাণ পেয়েছ, কিন্তু সেটা আমি সেদিন অফিসে আহিরের টেবিলে ছিল তাই দুষ্টমি করে দিয়েছিলাম। এটা আমার অপরাধ? ”
আকাশ হাত চেপে ধরে বলে, “নীহারিকা!”
নীহারিকা চোখ মুছে বলে, “তুমি আমার অফিসে ফোন করেছ, আচ্ছা বলো তো আমার এক্সটেনশন নাম্বার কত?”
আকাশ যন্ত্রচালিত মানুষের মতো বলে, “২১৬।”
নীহারিকা ম্লান হেসে বলে, “হয়নি, ২২৬। আমাদের অফিসে দু’জন নীহারিকা আছে। একজন আমি আরেকজন যিনি তিনি ২১৬ নাম্বারে বসেন। উনি ওই সময়টাতে ছুটিতে ছিলেন দেশের বাড়ি যাবেন বলে। আকাশ, তুমি এমন ভাবলে কী করে আমকে নিয়ে?”
আকাশের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, ভীষণ অনুশোচনায় বলে, “নীহারিকা, চোখটা অন্ধ হয়ে যাবার পর আমার মনটাও দিনে দিনে অন্ধকার হয়ে গেছে। তোমাদের কোনো দায়িত্বই পালন করতে পারিনা, উল্টো আমাকে তোমাদের দেখে রাখতে হয়। সংসারের সমস্ত ঝামেলা তুমি একা সামলাও। তাই মনের দিক থেকে আমি সবসময় ভীষণ ছোট হয়ে থাকি। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও? একটা হীনমন্যতা কুড়ে কুড়ে আমার মনটা খেয়ে ফেলেছে। ভীষণ নিচু মনের মানুষ হয়ে গেছি আমি। আমাকে পারলে ক্ষমা করো।”
এবার নীহারিকা ধরা গলায় বলে, “উহু, আমি এখন বুঝতে পেরেছি, দোষটা আমার। আমিও আসলে হঠাৎ করেই সংসারের এমন চাপে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার মনের খবরটাই নিতে পারিনি। অথচ দূর্ঘটনার পর ডাক্তার বলেছিল, তোমার মানসিক দিকটা খেয়াল রাখতে। এই বয়সে হঠাৎ করে অন্ধত্ব মেনে নেওয়া খুব কঠিন। আকাশ, আমি সারাটা জীবন তোমার আকাশেই থাকতে চাই যেখানে আমাদের নক্ষত্র থাকে।”
আকাশ আর পারে না, সবার সামনেই নীহারিকাকে বুকে টেনে নেয়। নুসরাতসহ সবার চোখেই জল।
একটু পর নুসরাত বলে, “আকাশ ভাই, আপনি অবশ্যই আপনার এই ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্পটা শেষ করবেন। আগামী শোতে আপনার যে ভুল ধারণা ছিল সেটা সবাইকে বলবেন। এটার দরকার আছে, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস বাড়বে।”
আকাশ এবার নীহারিকাকে ছেড়ে বলে, “অবশ্যই বলব, আগামী শোতে নীহারিকার হাত ধরেই আমি আমার গল্প শেষ করব।”
এর কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় রেডিও ইচ্ছেঘুড়ির স্টেশনে আকাশ আর নীহারিকাকে দেখা যায়। ওরা দু’জন দু’জনের হাত ধরে ভালোবাসার টানাপোড়েনের এক আশ্চর্য গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে।
(সমাপ্ত)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৩/০৬/২০২১