- পর্ব ১
- পর্ব২
- পর্ব৩
- পর্ব৪
- পর্ব৫
- পর্ব৬
- পর্ব৭
- পর্ব৮
- পর্ব৯
- পর্ব১০
- পর্ব১১
- পর্ব১২
- পর্ব১৩
- পর্ব১৪
- পর্ব১৫
- পর্ব১৬
- পর্ব১৭
- পর্ব ১৮
- পর্ব১৯
- পর্ব২০
- পর্ব২১
- পর্ব২৩
- পর্ব২৪
- পর্ব২৬
- পর্ব২৬
- পর্ব২৭
- পর্ব২৮
- পর্ব২৯
- সমাপ্তি পর্ব
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব ১
“আপা, আপনার মনটা কি খারাপ? খুব চুপচাপ মনে হচ্ছে।”
“রুমি, আজ আমার ক্লাসটা একদম লাস্ট পিরিয়ডে। আমি কি আমার ক্লাস আওয়ারটা তোমার ক্লাসের সাথে বদলাতে পারি? নয়টা বাজে আমার ফিজিওলোজি ক্লাসটা নিলাম, আর তুমি একটার দিকে তোমার ক্লাসটা নিলে? যদি তোমার কোন সমস্যা না থাকে।”
“শুধু আজকের জন্য আপা?”
“হ্যাঁ, শুধু আজকের জন্য। রোজ রোজ তো আর আগে বের হতে পারব না, তাই ক্লাস আগে পরে যখনই হোক কী আসে যায়। কিন্তু আজ আমার শিডিউল ক্লাসটা তোমার সাথে বদলাতে পারলে একটু আগে বের হতাম। ছেলেটা কাল রাতে শোকেসের সাথে মাথায় বাড়ি দিয়েছে, বেশ খানিকটা কেটেছে জানো, সেলাই লেগেছে তিনটা।
“কী বলেন আপা! এতক্ষণ বলেননি কেন? আর আজ আসলেন কেন? ছুটি নিয়ে নিতেন। এখন কী অবস্থা রুমনের?”
“বললেই কী আর ছুটি নেওয়া যায়, আমার ক্যাজুয়াল লিভ প্রায় শেষ। এরচেয়েও যদি বড়ো কোন ইমার্জেন্সি আসে, সেটা ভেবে ছুটি হাতে রাখলাম। রুমন এখন একটু ভালো, ডাক্তার ঔষধ দিয়েছে, ঘুমাচ্ছে। তোমার ভাইয়া আছে বাসায়।”
“কিভাবে কী হলো আপা?”
“কাল রাত নয়টার দিকে ঘটনাটা ঘটে। রুমন শোকেসের ভেতর থেকে কিছু একটা নিতে চাইছিল, আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম, আর তোমার ভাইয়াও ফোনে ব্যবসায়িক আলাপে ব্যস্ত ছিল। আমার শাশুড়িও বাসায় নেই। ও কয়েকবার এসেছে আমার কাছে আর তোমার ভাইয়ার কাছে, আমি হাতের কাজ ফেলে সাথে সাথে যেতে পারিনি। কিন্তু এই কয়েক মুহূর্তের ভেতর ওর রাগ উঠে যায়। রেগে গিয়ে মাথা বাড়ি মারতে যায় শোকেসে। মাথায় বাড়ি দেওয়ার সময় পিছলে শোকেসের কোনায় বাড়ি লেগে কেটে গেল, না আঘাতটাই বেশি জোরে দিল জানি না, কিন্তু কপাল কেটে রক্তারক্তি অবস্থা।”
“আল্লাহ রহম করুন। আপা কাঁচ ঢুকেনি তো?”
“নাহ্, ও হঠাৎ হঠাৎ এমন রেগে নিজের ক্ষতি করে ফেলে দেখে আমরা বাসায় এমন জিনিস রাখি না এখন। ড্রেসিং টেবিল নেই বাসায়, কাঁচের জিনিস কিছু হাতের কাছে রাখি না। শোকেসের গ্লাসও নেই, পুরো কাঠের পাল্লা।”
“আপা আপনি নয়টার ক্লাস নিয়ে চলে যান। কোন সমস্যা নেই।”
“অনেক অনেক ধন্যবাদ রুমি। জানতাম তুমি না করবে না, তাই অনুরোধ করলাম। আমি যাই তাহলে ক্লাসে, সময় হয়ে এসেছে।”
আপা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কী চিন্তা করে আবার বসলেন।
“কী হয়েছে আপা?”
“রুমি, আর কাউকে বলো না রুমনের কথা। আমি শুধু প্রিন্সিপাল ম্যামকে জানাব। টিচার্স রুমের আর কাউকে বলার ইচ্ছে নেই।। জানোই তো সবার কৌতুহলের শেষ নেই।”
রুমি ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। মরিয়ম আপা আর অপেক্ষা করেন না, ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে, তার আগেই ডিপার্টমেন্টের হেড আর প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে কথা বলে নিতে হবে। যদিও মরিয়ম আপা যথেষ্ট দায়িত্ববান, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কলেজ থেকে আগে আগে চলে যান না, তারপরও রুমনের কারণে হঠাৎ হঠাৎ তার ইমার্জেন্সি চলে আসে। এমনও হয় কলেজে ক্লাস নিতে আসার আগ মুহূর্তে ছুটি নিতে হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে এমন ছুটি নিলেও রুমির মতো কলিগরা সামলে নেন বলে চাকরিটা চালিয়ে যেতে পারছেন। এই চাকরিটা ওনার প্রয়োজন, ছেলেকে অনেক বেশি সময় দিতে হয় বলে ক্লিনিক্যাল সাইড ছেড়ে এসেছেন। এখন শুধু ‘লাইফ কেয়ার ডেন্টাল কলেজ এন্ড হসপিটালে’ ফাস্ট ইয়ারের ফিজিওলজির ক্লাস নেন, দরকার না হলে এই চাকরিটাও করতেন না, কিন্তু এই বেতনটা আপার ছেলের জন্য দরকার। ভালো মানের স্পেশাল চাইল্ড স্কুলগুলো ভীষণ ব্যয়বহুল। মরিয়ম আপার একটাই ছেলে, অটিজম আছে বলে ওর পেছনে অনেক বেশি সময় আর কেয়ার দিতে হয়। এগারো বছর বয়সী রুমন এমনিতে ভীষণ মেধাবী, খুব সুন্দর ছঁবি আঁকে, ক্রাফটিং করে, কিন্তু রেগে গেলে নিজেকে আঘাত করে। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের ভেতর গেলে যদি বিরক্ত হয়, তাহলে খুব অস্থির হয়ে যায়। বিশেষ করে সেই পরিবেশ আর মানুষদের মাঝে, যারা ওর প্রতি অযাচিত কৌতূহল দেখিয়ে ওকে বিরক্ত করে। না হলে রুমন ঘুরতে পছন্দ করে। কলেজ থেকে আয়োজিত পিকনিকে মরিয়ম আপা সবসময় ছেলে আর হ্যাসবেন্ডকে নিয়ে আসেন, রুমনকে কেউ যেন বিরক্ত না করে প্রিন্সিপাল ম্যাম এটা সবাইকে দেখতে বলেন। তারপরও যে মাঝেমাঝে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে না তা নয়। তবে মরিয়ম আপা সামলে নেন, ভীষণ ধৈর্য আপার, সাথে আপার হ্যাসবেন্ডও সাহায্য করেন যথাসম্ভব। আপার চাকরির সময়টা ওনার হ্যাসবেন্ড শিহাব সাহেব বাসায় রুমনের সাথে থাকেন। রুমন বাবা মা ছাড়া অন্য কারো সাথে খুব একটা স্বস্তি বোধ করে না। দাদি রুমনের মর্জির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না, তার উপর যখন থেকে তিনি বুঝতে পেরেছেন রুমন সব সময় এমনি থাকবেন, তখন থেকে তিনি মরিয়ম আপাকে আরেকটা সন্তান নেওয়ার চাপ দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু রুমনের পেছনে ওনার এত সময় চলে যায় যে অন্য আরেকটা বাচ্চা নেওয়ার কথা এখন আর ভাবতে চান না। এই নিয়ে বৌ শাশুড়ির মাঝে অনেকদিন ধরেই ঠান্ডা লড়াই চলছে।
রুমি ক্লাস নিয়ে যখন বের হয় তখন ঘড়িতে প্রায় দুইটা বাজে, কলেজ তখন প্রায় ফাঁকা, আউটডোরে রোগীদের লাইন আর নেই। অল্প কিছু ইন্টার্ন এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কী আলো ঝলমলে তাদের মুখ, ওদের দিকে তাকিয়ে রুমির নিজের দিনগুলো মনে পড়ে যায়, সেই সুন্দর সময়গুলো আর কোনদিন ফিরে আসবে না। শুধু স্মৃতি হয়ে হানা দিবে। রুমি আজ উবারে যাবে, বাসে যাওয়ার এনার্জি নেই। উবার কল করে বসে মোবাইলের রেডিওটা অন করে দেয় রুমি।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২
“হ্যালো লিসেনারস, আপনারা শুনছেন রেডিও মাস্তি, ৮৯.৯ এফএম। আমি আরজে নুসরাত আছি আপনাদেরই সাথে। আজকের আবহাওয়াটা কী রোমান্টিক তাই না? না গরম, না ঠান্ডা, মিষ্টি বাতাস বইছে, কড়া রোদ নেই, বরং যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এমন আবহাওয়ায় প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে রিকশায় ঘুরতে কার না ভালো লাগে। প্রিয়জনের সাথে এমন দিনের রোমান্টিক কোন স্মৃতি থাকলে আমাদের এসএমএস করে জানাতে পারেন। তাছাড়া এখন এই মুহূর্তে চলছে মিক্সড গানের অনুরোধের আয়োজন, অর্থাৎ বাংলা, ইংলিশ বা হিন্দি পছন্দের যেকোন ভাষার গানের জন্য এসএমএস করে অনুরোধ করতে পারেন..…..”
গাড়ি চলতে শুরু করেছে, রুমির কানে কিছু কথা ঢোকে কিছু ঢোকে না। আরজে মেয়েটার গলা কী খুশি খুশি, যেন এই ম্যাসেজগুলো পড়ে সে ভীষণ আনন্দিত। অনেকেই অনেক রোমান্টিক স্মৃতি শেয়ার করছেন। ফ্ল্যাশব্যাকে রুমির মনে পড়ে যায় সেই বিকেলগুলো, হিমেল নিজে ড্রাইভ করতো। মন ভালো থাকলে রুমিকে নিয়ে হাইওয়তে লং ড্রাইভে যেত। হিমেলের সাথে রিকশায় চড়া খুব একটা হয়নি, হিমেল খুব পশ লাইফ লিড করতে চাইত। রোমান্স করলেও তা অভিজাত হয়া চাই তার কাছে। সবসময় টিপটপ থাকা চাই, ক্যাজুয়াল শার্টের সাথে কোন জুতোটা মানাবে, সানগ্লাস পাঞ্জাবির সাথে কখন মানাবে, কখন জিন্স, কখন গ্যাভার্ডিনের প্যান্ট পরতে হবে, এই সব কিছুই হিমেলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দামি পারফিউম তার নেশা। বড় বড় উপলক্ষগুলোতে ফাইভস্টার হোটেলে বুফ লাঞ্চ, বা ডিনার ছাড়া হিমেল চিন্তাও করতে পারত না। অনেক বেশি খরচের হাত তার, তবে অনেক মেয়েরা বোধহয় এমনই পছন্দ করে। নাহলে জেনীর মতো অর্ধেক বয়সী একটা মেয়ে হিমেলের দিকে এমন পতঙ্গের মতো ছুটে যাবে কেন!!”
গান বাজতে শুরু করেছে, আয়ুষ্মান খুরানার নতুন সিনেমার গান, “মাফি”, আয়ুষ্মান মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছে, তার শাস্তিও পেয়েছে, এখন গানে গানে ক্ষমা চাইছে। অনেক নাকি শাস্তি পেয়েছে, এবার ওকে মাফ করে দিক।
“রুমি, আর কত শাস্তি দিবে? It was a mistake, trust me. ঐ বিচ আমার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছিল। Trust me Rumi.”
গানের লাইনগুলোর সাথে স্মৃতিরা রিলের মতো একের পর এক সামনে আসতে থাকে। হিমেল, সুপুরুষ, অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে, পেশায় ডাক্তার। সোশ্যাল মিডিয়ায় রুমি আর হিমেলের জুটি জনপ্রিয়।
“আপু চলে এসেছি, কোন বাসার সামনে থামাব?”
উবারের চালকের ডাকে ধ্যান ভাঙে রুমির।
“ঐ তো, গলির শেষ মাথার বাসাটা।”
বাসায় ঢুকেই এখন কী কী শুনতে হবে জানে রুমি। তিতলির নামে এক ঝুড়ি অভিযোগনামা রুমি ফ্রেশ হওয়ার আগেই ওর কাছে পেশ করা হবে। এমনিতে রুমির আম্মা নাতনিকে ভীষণ ভালোবাসেন, কিন্তু মুখের ভাষায় তিনি বরাবরই রুক্ষ। তাছাড়া এভাবে দিনে ছয় সাত ঘন্টার জন্য দেখাশোনা করার দায়িত্ব তিনি নিতেও চান না। মেয়েটার বয়স সবে আড়াই, চার বছর হলে রুমি একটা স্কুলে দিয়ে দিবে, স্কুল শেষে বাসায় আসার আগে পর্যন্ত মেয়েকে হসপিটালে নিজের কাছেই রাখবে ভেবেছে। তখন হয়তো আম্মার চাপ কমবে, রোজ রোজ একগাদা কথা হজম করতে হবে ন। এখন বেশি ছোট, হসপিটালে সাথে করে ছয়ঘন্টা রাখা সম্ভব না, রুমির বেতনও এত বেশি না যে বাঁধা একজন লোক রাখবে শুধু মেয়েকে দেখার জন্য। মাঝেমাঝে তাই কথার বিষটা তিতা ঔষধ ভেবে হজম করে নিতে হয়।
“রুমি কয়টা বাজে? ঘড়ি দেখছস?”
“দুইটা চল্লিশ আম্মু।”
“তোদের কী আমারে মানুষ মনে হয় না? সারা জীবন কী আমি তোদের টেনে যাব, একটু যদি শান্তি পাইতাম আমি। সময়মতো গোসল, নামাজ, খাওয়া কিছু করতে পারি না।”
“আম্মু তাড়াতাড়ি আসার জন্য বাসে না উঠে উবারে আসলাম। আমার কতগুলো বাড়তি খরচ হলো। দুইটা পর্যন্ত আমার চাকরির সময়, আমি চল্লিশ মিনিটে এসেছি। এই ঢাকা শহরে এর চেয়ে আগে আসতে হলে উড়ে উড়ে আসতে হবে।”
“ঢাকা শহর খালি তুই চিনস, আমি তো চিনি না? দুপুর বেলা জ্যাম থাকে? এইটুকু পথ আসতে দশ মিনিটও লাগে না। এই হলো কপাল, তোদের জন্য খেটে, আবার তোদের কাছেই কথা শুনতে হয়। তোর মেয়ে একটা যে দুষ্ট হইছে, বারান্দায় গিয়ে রশ্মির শখের গাছের পাতা সব ছিঁড়ে ফেলেছে, রশ্মি চিল্লাইয়া শেষ আমার উপর, বিছানায় পানি ঢালছে……”
আম্মা আরও কিছু অপরাধের বর্ণনা দিচ্ছিল, রুমির এসব রোজ শোনার অভ্যাস। এসব শুনতে শুনতেই গোসলের জন্য পা বাড়ায়। তিতলি এখন ঘুমাচ্ছে, যতই দুষ্টুমি করুক, দুপুর একটার ভেতর খেয়ে দুইটার ভেতর ঘুমিয়ে যায়। একবারে বিকেল চারটায় ওঠে। আম্মা যতই বকাঝকা করুক, রুমি জানে তিতলির কোন অযত্ন হয় না। তাই সব কথা চুপচাপ হজম করে। আম্মার কষ্ট হয় বোঝে রুমি, এই বয়সে এতক্ষণ ছোটো একটা বাচ্চা দেখা সহজ নয়। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় ওঠার সামর্থ্য রুমির নেই। প্রাইভেট একটা ডেন্টাল কলেজের লেকচারার কাম মেডিকেল অফিসারের আর বেতন কত, তাও ওদের প্রতিষ্ঠানটা একটা সম্মানজনক স্যালারি দেয়, অধিকাংশ প্রাইভেট মেডিকেলে তো নামকাওয়াস্তে একটা স্যালারি ধরিয়ে দেয়। এফসিপিএসের পার্ট টু টা হয়ে গেলে হয়তো প্রমোশন হবে, তখন বেতন বাড়তে পারে। কিন্তু সে আরও দুইবছর। কিছু পুঁজি ব্যবস্থা করতে পারলে কারও সাথে শেয়ারে চেম্বার দিতে পারতো। কিন্তু সেটাও অন্তত লাখ পাঁচেকের নিচে হবে না। মাসের শুরুতেই বেতনের অর্ধেক তুলে ফেলেছে, এটা মায়ের হাতে দিবে, বাবা মা শুরুতে নিতে না চাইলেও রুমি জোর করেই দেয়। বিয়ের আগে আর বিয়ের পরে বাবার বাড়িতে মেয়েদের অবস্থান বদলে যায়। তাই রশ্মির জন্য যেটা অধিকার, এখন রুমির জন্য সেটাই বাহুল্য।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব৩
“রুমনের কি জ্বর এসেছিল?”
“নাহ্। রুমন এখনো ঘুমাচ্ছে। মরিয়ম, ভালো হয়েছে তুমি চলে এসেছ। আমি তো ভয়ে ছিলাম ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখলে রুমন আবার অস্থির হয়ে যায় কিনা।”
“টানা ঘুম দিচ্ছে দেখি। ডাক্তার কী ঘুমের ঔষধের মাত্রা বেশি দিয়ে দিলেন? এতক্ষণ তো একটানা ঘুমায় না।”
“নাহ্ আমার ফোনে কথা হয়েছে। তিনি বললেন এখন ঘুম রুমনের জন্য ভালো। একটানা ঘুমিয়ে উঠলে ঝরঝরে লাগবে, মাথায় ব্যথাটাও কমে যাবে।”
“শিহাব, থ্যাংক ইউ। তুমি আমাকে আর রুমনকে এত দেখে রাখ, তোমার কথায় মনে শক্তি পাই।”
“মরিয়ম, তুমি তো এমন ভাবে বলেছো যেন আমি বাইরের মানুষ, সাহায্য করে ধন্য করছি! রুমন আমার ছেলে না? তুমি আমার বৌ না? আমি না দেখলে কে দেখবে।”
ভালোবাসায় হঠাৎ মরিয়মের চোখটা আদ্র হয়ে যায়। জীবনে সে অনেক কিছু পায়নি, গাইনিকোলোজিস্ট হওয়ার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু ছেলেকে সময় দিতে ক্লিনিক্যাল লাইন ছাড়তে হয়েছে। এই সব কিছুর ভেতর শিহাবকে স্রষ্টার তরফ থেকে বড়ো এক উপহার মনে হয় মরয়মের।
ডাক্তার মেয়েকে ডাক্তার ছেলের সাথেই বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল মরিয়মের বাবা মায়ের। মরিয়মেরও নিজস্ব কোন পছন্দের মানুষ ছিল না, তাই তারও কোন আপত্তি ছিল না। মরিয়ম তখন সবে মেডিকেল অফিসার হিসেবে একটা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরিতে ঢুকেছে, পাশাপাশি এফসিপিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই হাসপাতালে শিহাব সাহেব এসেছিলেন ওনার মাকে নিয়ে, সুগার লেভেল কমে যাওয়ায় ওনাকে ইমার্জেন্সি ভর্তি করানো হয়। সেইদিন নাইট ডিউটি ছিল মরিয়মের। শান্ত, মিষ্টভাষী আর স্নিগ্ধ চেহারাী অধিকারী মেয়েটার জন্য হঠাৎ মনের ভেতর একটা তোলপাড় সৃষ্টি হয় শিহাবের। তিনদিন পর রিলিজ দিলেও মাকে নিয়ে জোর করে আরও একদিন থেকে যায় শিহাব, উদ্দেশ্য ছিল মরিয়মকে আরেকবার দেখে যাওয়া। মরিয়মের সেদিন ডেঅফ ছিল, পরেরদিন এসেও শিহাব সাহেবের মাকে কেবিনে থাকতে দেখে অবাক হয়, “আপনাদের রিলিজ হয়নি? পেশেন্টকে তো রিলিজ দেওয়ার কথা।”
“জ্বি হয়েছে। আমিই আরেকদিন রাখলাম। আম্মা আরেকটু সুস্থ হোক। বাসায় আমি ছাড়া দেখাশোনার কেউ নেই। তারচেয়ে হাসপাতালে থাকা ভালো।”
“আপনার ভাইবোন কেউ নেই?”
“আছে মা, আমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি রাজশাহী গিয়েছে, ইদ করবে সেখানে। এমনি ঢাকায় থাকে। আমি শিহাবকে মানা করলাম মেয়েকে ডাকতে, নতুন বিয়ে, ওনারা কী ভাবেন কে জানে।”
শিহাবের পক্ষ থেকে মা জবাব দেন।
“হোক নতুন বিয়ে, মায়ের দরকার হলে মেয়ে আসবে।”
এভাবেই মা ছেলের সাথে টুকটাক কথা বলে রুটিন চেকআপ শেষে বের হয়ে যায় মরিয়ম। স্যার রাউন্ডে আসার আগে ফাইলে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হবে, নাহলে কিছু খুঁত পেলে সবার সামনে ঝাড়বে স্যার। রিলিজ পাওয়ার পর চলে যাওয়ার আগে আরেকবার ডক্টরস রুমের কাছে আসে শিহাব, মরিয়ম ভেবেছিল হয়তো আবার প্রেসক্রিপশনের কিছু বুঝতে এসেছেন। কিন্তু মরিয়মকে অবাক করে দিয়ে একটা ভ্যালেন্টাইন কার্ড দেয় শিহাব। চকিতে মরিয়মের মনে পড়ে আগামীকাল চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি।
“এটা কেন?”
“প্লিজ রাগ করবেন না। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই দেওয়া। মাকে নিয়ে খুব অসহায় অবস্থায় হসপিটালে এসেছিলাম। বাবাকে আগেই হারিয়েছি, মায়ের জন্য তাই ভয়টা অনেক বেশি ছিল। সে সময় আপনি আর আপনারা আন্তরিক ভাবে পাশে ছিলেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
কার্ড দিয়ে আর দাঁড়ায় না শিহাব, তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যায়। মরিয়মের ভালোই লাগে। মেডিকেল প্রফশনে রোগীর কাছে পাওয়া ধন্যবাদ বিরাট আনন্দ নিয়ে আসে। যদিও সেই উপলক্ষ খুব কমই পাওয়া যায়, অধিকাংশ সময় বরং ডাক্তার পেশেন্ট সম্পর্কে আর্গুমেন্ট আর অভিযোগই বেশি পেতে হয়। রুমে ঢুকে কার্ডটা খুলতেই একটা চিঠি পায়,
“আপনাকে কী বলে সম্মোধন করা উচিত জানি না। নাম ধরে বলবো নাকি প্রিয় মরিয়ম বলবো? জানি এই চিঠি বা কার্ডের কোন গুরুত্ব আপনার কাছে নেই, আপনার প্রাণিপ্রার্থীর নিশ্চয়ই অভাব নেই। তারপরও মনে হলো মনের কথা না জানালে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এত দ্রুত ভালোবাসা যায় না জানি, সেক্ষেত্রে আপনি হয়তো আমার আকর্ষণকে সাময়িক আবেগ নাম দেবেন, কিন্তু আমি জানি এটা ”love at first sight’.
আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ, বাংলায় অনার্স করেছি, চাকরিতে ঢুকিনি, বরং বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসার হাল ধরেছি। ব্যবসাও বড়ো কিছু না, স্যানিটারি মালামালের দোকান আছে। একটা বোন আছে আর মা। নিতান্ত ছা পোষা মানুষ। যদি ছাপোষা মানুষটার সাথে কখনো এককাপ কফি খেতে ইচ্ছে করে, তাহলে একটা দিন কবিতা ক্যাফেতে একটি বিকেল সময় চাই আপনার কাছে। আমার নাম্বারটা দিলাম নিচে। জানি হয়তো কোনদিন ফোন আসবে না। তারপরও অপেক্ষায় থাকব।”
মরিয়ম দ্রুত চিঠি লুকিয়ে ফেলে, অন্য কোন মেডিকেল অফিসারের চোখে পড়ার আগে কার্ডও ব্যাগে ঢুকায়। ফোন সে করবে না। এনাটমি বইটা খুলে পড়ায় মন দেয়, এফসিপিএস পার্ট ওয়ানের আর বেশি সময় নেই। রাতদিন পড়তে হবে।
“হ্যালো, আমি মরিয়ম।”
“গত তিনদিন যতগুলো আননোন নাম্বারের কল এসেছে, প্রতিটি ফোন আপনি ভেবে রিসিভ করেছি। আমার টান টা এত তীব্র যে আপনাকে টেনে নিয়েই এলো।”
“আপনি সাহিত্যক না ব্যবসায়ী?”
“পেশায় ব্যবসায়ী। সাহিত্য করে পেট চলে না।”
কবিতা ক্যাফেতে একটা বিকেল এনাটমি বইকে ফাঁকি দিয়ে আসতে রাজি হয় মরিয়ম। একটা বিকেল থেকে অনেকগুলো সন্ধ্যা হয়ে যায়। মরিয়মের বাসার কেউ রাজি ছিল না, কিন্তু দীর্ঘদিনের চেষ্টায় দুইহাত এক হয়। আর এখন শিহাব মরিয়মের বাবা মায়ের কাছে নিজেদের ছেলের জায়গা করে নিয়েছে। এই একটা দিকে স্রষ্টা তার কপালটা ভীষণ ভালো করেছেন। দেখতে দেখতে তেরো বছর কেটে গিয়েছে। ভালোবেসে প্রতারিত হতে হয়নি। শাশুড়ির কাছেও মরিয়ম অনেক আদরের ছিল। এমনকি রুমনের সমস্যা ধরা পরার পরও তিনি মরিয়মের পাশে ছিলেন। ইদানীং বয়সের চাপেই হোক, বা বংশধরের আশাতেই হোক, তিনি চান মরিয়ম আর শিহাব আরেকটা সন্তান নিক। রুমনকে তিনি অনেক আদর করেন, ছেলের ঘরের প্রথম নাতি। কিন্তু রুমনকে সারাজীবন অটিজম সাথে নিয়েই চলতে হবে বোঝার পর থেকে তিনি মরিয়মের সাথে আরেকজন নাতি নাতনি পৃথিবীতে আনার জিদ করছেন। ধীরে ধীরে এই বিষয়টা ওনাদের সম্পর্ক নষ্ট করছে।
“মরিয়ম ঠিক আছ? অনেকক্ষণ হলো তুমি বাথরুমে। “
শিহাবের ডাকে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে মরিয়ম। আসলেই কত দেরি হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে বের হয় মরিয়ম। রুমন উঠে গিয়েছে। ওকে খাইয়ে ঔষধ দিয়ে দিয়েছে মরিয়ম। এখন রঙ করছে।
“শিহাব, দোকানে যাবে না আজ?”
“একবারে সন্ধ্যায় যাব। দোকানের ছেলেটাকে আজ সব সামলাতে বললাম। তোমাকে আর রুমনকে সময় দেই আজ। মাও বাসায় নেই, তোমরা একা।”
“মা কবে আসবেন আপার বাসা থেকে? আমার উপর রাগ করে আছেন এখনো তাই না?”
“বয়স হয়েছে, কথায় কথায় তাই অভিমান করে। তুমি কিছু মনে রেখো না প্লিজ। শিলুর বাসায় আর কয়দিন থাকবে, রাগ কমলে চলে আসবে। শিলুর সাথে কথা হয়েছে আমার।”
“আরেকটা সন্তান আমিও নিতে চাই শিহাব, কিন্তু রুমনের পেছনেই আমার সবটুকু সময় চলে যায়। নতুন মানুষটাকে আমি সময় কিভাবে দেব? তাছাড়া এত খরচ।”
“মরিয়ম যার যার রিজিক সে সাথে করেই আনে। তাই খরচের কথা ভেব না। তবে এটা ঠিক তোমার উপর অনেক ধকল যাবে। তাছাড়া সাইত্রিশ বছর বয়স চলছে তোমার, আমার চল্লিশ। এই সময় পরিবার বাড়ানোর সিদ্ধান্তটা কতটুকু সঠিক হবে আমি জানি না।”
রঙ করা শেষে রুমন আবার ঘুম দেয়। ঔষধের প্রভাবে অনেকটাই শান্ত, ঘুমটাও ভালো হচ্ছে। বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছে। এই সময় মরিয়ম বাসায় শাশুড়ির সাথে থাকে, আর শিহাব দোকানে। ওরা দুইজন সময় ভাগ করে নিয়েছে। সকালে মরিয়মের চাকরির সময়টা শিহাব বাসায় থাকে। দুপুরে মরিয়ম এলে, দুপুরের খাবার খেয়ে শিহাব বের হয়ে যায়। একবারে দোকান বন্ধ করে রাতে ফিরে। দু’জনের একসাথে সময় কাটানো হয় না বললেই চলে। আর দশটা দম্পতির মতো ছুটির দিনে একা ঘুরতে বের হয় না, একা শাশুড়ি রুমনকে দেখে রাখতে পারেন না। কোথাও বেড়াতে গেলেও এমন জায়গায় যান, যেখানে রুমন অস্বস্তি বোধ করবে না। বিয়ে, জন্মদিন এধরণের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো এখন একটু এড়িয়েই চলে তারা। এসব জায়গায় অনেক সময় অনেক বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
আজ অনেকদিন পর একটা বিকেল শুধু দু’জনের। শিহাব বসার ঘরে পেপার পড়ছে। মাগরিবের আজানের পর হালকা নাস্তা খেয়ে দোকানের জন্য বের হবে। বেশি সময় থাকবে না, একটু হিসাবপত্র দেখে চলে আসবে। মরিয়ম চা দিয়ে গেল, তাই খাচ্ছে। শিহাবের দিকে দূর থেকে তাকিয়ে মরিয়মের কী মনে হলো জানে না। সালোয়ার কামিজটা বদলে একটা সুতি শাড়ি পরলো। চোখে একটু কাজল, আর গালে একটু পাউডার বুলিয়ে নিল। এই সামান্য সাজেই কেমন স্নিগ্ধ লাগছে। বহুদিন শিহাবের জন্য সাজা হয় না। আজ একটু চমকে দিলে কেমন হয়!
বসার ঘরে মরিয়মকে এই রূপে দেখে অনেকদিন পর যেন নতুন বিয়ের পরপর সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল শিহাবের। কতদিন পর এতটা সময় নিয়ে দু’জনের কাছে আসা হয়েছে। মরিয়মেরও মনে হয়েছে শিহাব দীর্ঘদিন এই সময়টুকুর অপেক্ষায় ছিল। গভীর ভালোবাসায় ডুবে যেতে যেতে মনে হয়, ভালোই হয়েছে আজ বাসায় মা নেই। এভাবে একান্ত সময়টুকু পাওয়া অনেক দরকার ছিল।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব৪
রুমিদের টিচার্স রুমটা টপ ফ্লোরে। পুরোটা ফ্লোরে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের জন্য ছোটো ছোটো কাঁচ ঘেরা রুম করে দেওয়া। আলাদা রুমগুলোর আবার দুই ভাগ, মাঝে কাঁচের পার্টিশন দিয়ে একপাশে হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টের বসার ব্যবস্থা, অন্য পাশে কমন চেয়ার টেবিল দেওয়া সেই বিভাগের অন্য শিক্ষকদের জন্য। সবগুলো রুমের মাঝ বরাবর হল রুমের মতো খোলা জায়গায় বিশাল বড়ো টেবিল দেওয়া, যাতে একসাথে বিশ-পঁচিশ জন বসতে পারেন। এই জায়গাটায় সাধারণত অন্য সময় লেকচারাররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করেন, এমনিতে মাসে একদিন সব শিক্ষকদের নিয়ে এখানেই মিটিং হয়।
লিফটের পাঁচে নামলে শুরুতেই কাঁচঘেরা বড়ো রুম দুটো প্রিন্সিপাল ম্যামের এবং ডিরেক্টর স্যারের, লিফটের পাশেই সিঁড়ি। রুমির মনে হয় এটা কলেজ কতৃপক্ষের ইচ্ছে করে করা, কেননা কেউ দেরি করে আসলে চোখ এড়ানোর উপায় নেই। লিফট বা সিঁড়ি যাই ব্যবহার করুক স্যার, ম্যামের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সময়ের ব্যাপারে সবাই তাই সতর্ক। এরপরও রুমির মাঝেমধ্যেই পাঁচ দশ মিনিট লেট হয়ে যায়। রুমি রোজ ভয়ে থাকে কোনদিন তাকে এরজন্য প্রিন্সিপাল ম্যাম ডেকে পাঠান। আজ তো পুরো পনেরো মিনিট লেট!
সকালে ছয়টার এলার্ম দিলেও সারাদিনের ক্লান্তিতে ছয়টায় ওঠা হয় না রুমির, রোজ সাড়ে ছয়টা বেজে যায় । আজ তো ফজরের নামাজ পড়ে একটু শুলে এমন চোখ লেগে আসে যে উঠতে উঠতে সাতটা বেজে গিয়েছে । এরপর দৌঁড়ে নিজের নাস্তা সারে, হালকা কিছু বক্সে ঢুকিয়ে নেয়, তিতলির নাস্তা রেডি করে বের হতে হতে সাতটা চল্লিশ। সাড়ে সাতটার পরই রাস্তায় জ্যাম, এইটুকু পথ আসতে আটটা পনেরো বেজে গেল।
“রুমি, তোমার শরীর খারাপ নাকি? কেমন ফ্যাকাসে লাগছে।”
“নাহ্ স্যার। আজ দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাড়াহুড়োয় বের হয়েছি। তাই হয়তো এমন লাগছে।”
“আচ্ছা, শুনো প্রিন্সিপাল ম্যাম তোমার খোঁজ করেছিলেন, ক্লাসে যাওয়ার আগে দেখা করে যেও।”
মনে মনে ইন্না-লিল্লাহ পড়ে রুমি। নির্ঘাত দেরি হওয়ার জন্য বকাবকি করবেন। কী বলা যায় ভাবতে ভাবতে লেডিস ওয়াশরুমের দিকে আগায় রুমি, একটু নিজেকে গুছিয়ে ম্যামের রুমে যাওয়া উচিত। চুলে চিরুনি বুলিয়ে, মুখে হালকা ময়েসচারাইজার লাগায়, আর চোখে কাজল। ছিমছাম থাকতেই ভালো লাগে রুমির। আগে সাজের ভীষণ সখ ছিল, সময়ের সাথে সাজের আগ্রহটা মরে গেলেও একটু টিপটপ থাকা এখনো পছন্দ। চিলড্রেন ডিপার্টমেন্টের রৌশন, আর মিতুও আছে ওয়াশরুমে।
-“কী আপু খুব সাজগোজ হচ্ছে?”
-“না মিতু, সাজ কোথায়, আজ বাসা থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেল, চুল আঁচড়ানোর সময়ও পাইনি। এখন তাই ক্লাসে যাওয়ার আগে একটু চুল ঠিক করলাম।”
-“কী বলেন আপু, আপনি থাকেন মায়ের বাসায়, সংসারের চাপ নেই, বাচ্চা দেখে মা বোন। তারপরও সময় পান না!”
-“মিতু, তোমার বেবি হোক, তখন দেখবা সময় কই যায়।”
-“আপু মনে হয় আমার বিয়ে নিয়ে খোঁচা দিলেন। বিয়েই হয়নি বাচ্চা কোথা থেকে আসবে। আর আপনার বিয়ে হলে কী হয়েছে আপু, আমার মতো আপনিও বাবার বাড়িতেই থাকেন।”
এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার রৌশন আপা সক্রিয় হোন, “আরে মিতু, কী বলো? রুমি তোমার বিয়ে নিয়ে খোঁচা দিল কই? ও বললো ভবিষ্যতে তোমার ছোটো বাচ্চা থাকলে বুঝবে যে সময় বাচ্চার পেছনে চলে যায়। এখন আর অযথা কথা না বাড়িয়ে চলো সবাই, ক্লাসের সময় হয়ে গেল আমাদের।”
রুমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে যায়, হঠাৎ মনে পড়ে মোবাইলটা সাবানের স্ট্যান্ডের উপর রেখে এসেছে, মোবাইলটা নিতে ফিরে এসে শুনে রৌশন আপা মিতুকে আস্তে আস্তে বলছেন, “বাদ দেও ওর কথা। ওমন বিয়ে করা আবার ছাড়া ওর মতো মেয়ের জন্য কিছু না। স্বামী নাই, সংসার নাই কার জন্য এত সাজে আমরা বুঝি না? কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টের হাসান জামিল এখনো অবিবাহিত জানো তো। কয়েকদিন দেখেছি আড়ালে কথা বলতে। ঐ দিকেই টোপ ফালানোর চেষ্টায় আছে। অবশ্য বিবাহিত অবিবাহিত কিছু যায় আসে না, দুই নাম্বার বিয়ে যাকে পাবে করবে। আমি তো তাই হায়দারকে চোখে চোখে রাখি। ওর আশেপাশেও ঘুরঘুর করে।”
ঘৃণায় রুমির দুই চোখে জল নেমে আসে। রৌশন আপার মতো সিনিয়র মানুষ এত নোংরা ভাষায় কথা বলতে পারেন! ওনার হ্যাসবেন্ড হায়দার স্যার ওরাল এনাটমির এসোসিয়েট প্রফেসর, রুমির প্রায় বিশ বছরের বড়ো, রুমি এসব কথা চিন্তাও করতে পারে না। অথচ আপা কী অবলীলায় বলে দিলেন। রুমি একপাশে সরে ওনাদের বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করে, নিজেদের কথায় মগ্ন রৌশন আপা আর মিতু রুমিকে খেয়াল করে না। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখটা টিস্যু চেপে মুছে নেয় রুমি, কাজল ঠিক করে। এসব কথার আঘাতে নিজেকে আরও শক্ত করে প্রতিবার। এরা সবাই খুব ভালো করেই জানে রুমি কেন মায়ের বাসায়। সামনাসামনি ভীষণ সহমর্মিতা দেখায়, অথচ পেছনে কী কুৎসিত কথা বলে ওকে নিয়ে। এই হীনম্মন্যতা মেয়েদের মাঝেই বেশি দেখেছে রুমি, পুরুষেরা খারাপ ইশারা করে, আর মেয়েরা করে খারাপ আলোচনা। হিমেলকে ছেড়ে আসার এগারো মাসে পরিচিত মন্ডলের এই নতুন রূপ রুমি এতবার দেখেছে যে এখন আর আগের মতো কষ্ট পায় না।
-“আসসালামু আলাইকুম ম্যাম? আসতে পারি?”
-” আসো রুমি। কেমন আছ?”
-“জ্বি ভালো ম্যাম। স্যরি ম্যাম, আজ পনেরো মিনিট লেট হয়ে গেল। নেক্সট টাইম এমন হবে না।”
-“হ্যাঁ চেষ্টা করবে যেন না হয়। তোমার ক্লাস কখন আজ?”
-“এই তো পাঁচ মিনিট পর।”
-“ঠিক আছে বেশি সময় নেব না তাহলে। যে কারণে ডাকলাম। তুমি তো ‘কনজার্ভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি এন্ড এন্ডোডনটিকস’ এ এফসিপিএস পার্ট টু করছো তাই না?”
-“জ্বি ম্যাম, শেষের দিকে। যদি পাশ করি আরকি।”
-“কলেজের ডিউটির সাথে ট্রেইনিং এ ঝামেলা হয় না?”
-“আমি ম্যাম সময় এডজাস্ট করে নিয়েছি। একটু কষ্ট হয়, শারীরিক ভাবে চাপ যায়। কিন্তু ম্যাম চাকরি আমি ছাড়তে চাই না। আমি যখন চান্স পাই তখন তো এফসিপিএস অনারারি ছিল। এখন যারা চান্স পায় তাদের বিশ হাজার দেয়। আমি কলেজে কিন্তু পূর্ণ মনোযোগ দেই ম্যাম। হয়তো মাঝেমাঝে একটু লেট হয়, এছাড়া কোন অবহেলা করি না।”
-“না,অবহেলা কেন করবে? এটা তো তোমার পেশা, তোমার দায়িত্ব। আমি যে জন্য ডাকলাম তা শোনো। আমাদের কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টে একজন মেডিকেল অফিসার কাম লেকচারার প্রয়োজন। তুমি কী এসডিএম থেকে কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টে যেতে চাও? যেহেতু তুমি এই বিষয়েই পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছে, ভবিষ্যতে প্রমোশন পেতে তোমার সুবিধা হবে। আর এখন ডাবল দায়িত্ব বলে স্যালারিও একটু বেশি পাবে। তবে হ্যাঁ তোমার পরিশ্রম হবে। সরাসরি রোগী দেখতে হবে, স্টুডেন্টদের হাতে কলমে শেখাতে হবে।”
-“অনেক অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। আমি আপনাকে একটু ভেবে জানাচ্ছি। এখন ক্লাসে যাই ম্যাম?”
-“হ্যাঁ যাও। দ্রুত জানিও।”
রুমির খুশিই হওয়া,উচিত, কেননা একে তো নিজের পছন্দের বিষয়ে ঢোকার সুযোগ, আবার স্যালারিও বেশি। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো মনে পড়ে, কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টেই আছেন হাসান জামিল, সবাই শুনলে আবার কী কথা বলে কে জানে!
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব৫
“তাহলে তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছ না তাই তো?”
“জ্বি আপা, কিন্তু আমার বাড়তি বেতন দরকার, তাছাড়া কনজার্ভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি আমার নিজের পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর সাবজেক্ট। এসডিএম পড়ানোর চেয়ে এই বিষয়ে পড়াতে আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো।”
“তাহলে সিদ্ধান্ত কী নেওয়া উচিত তুমিই বলো?”
“সুইচ করা উচিত।”
“অবশ্যই সুইচ করা উচিত। এফসিপিএস পার্ট টু কবে পাশ করবে তার কোন ঠিক নেই। নিজে চেম্বার করতে পারছ না। সামনে মেয়েকে স্কুলে দিলে বাড়তি বেতন অবশ্যই লাগবে। তাহলে তুমি কী শুধু কয়েকজন মানুষের গসিপের ভয়ে পিছিয়ে যাবে রুমি? এত দুর্বল তো তুমি না।”
সিদ্ধান্ত কী নেওয়া উচিত তা রুমিও জানে, তারপরও আপার সাথে ছাদের এককোণে একান্তে কথা বলতে এসেছে, কেননা ওর একটা মানসিক শক্তি দরকার ছিল, একটু মোটিভেশান দরকার ছিল যা মরিয়ম আপা ছাড়া কেউ দিতে পারবে না এই মুহূর্তে। নিজের দুই ছোটো ভাইবোন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, আম্মা আব্বা কথা শোনার আগেই হইচই শুরু করেন, আর অফিসের কাউকে জড়িয়ে কোন কলিগ নোংরা কথা বলেছে শুনলে রুমির আব্বা রেগে দেখা যাবে অফিসেই অভিযোগ করতে চলে আসবেন, শেষে অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। কোন বান্ধবীকে বলেও শান্তি নেই, বন্ধু মহলে গসিপ শুরু হবে। এমনিতেই ডিভোর্সের পর অনেক ক্লোজ ফ্রেন্ড ওকে এড়িয়ে চলে, এদের মনে হয় স্বামীহীনা রুমি ওদের স্বামীকে না চুরি করে নেয়! হাসি পায় রুমির, যে চুরি হওয়ার সে সিন্ধুকের ভেতর থেকেও চুরি হবে, যে হওয়ার না, তাকে ছেড়ে দিলেও নিজেরই থাকবে।
“আপা কী করা দরকার জানি। শুধু করার শক্তিটা পাচ্ছিলাম না। আপনার সাথে কথা বলে সেই শক্তিটা নিলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপা।”
“যাও বোকা মেয়ে। এই সামান্য জিনিসের জন্য ধন্যবাদ লাগবে না। রুমি, হিমেল কী তিতলির ভরণপোষণের টাকা দেয় না?”
“দেয় আপু। আদালত থেকে ঠিক করে দিয়েছিল, মাসে পাঁচ হাজার করে দেওয়ার কথা, তাই দেয়। আমার নিতে ইচ্ছে করে না সামান্য দুইপয়সা, ঘিন্না লাগে। কিন্তু সবাই বলে তিতলির অধিকার, তাই ওর নামে পাঁচ হাজার ডিপিএস করে রেখেছি। মাসে মাসে সেই একাউন্টে জমা হয়। হয়তো কখনো কাজে আসবে। আমার নিজের জন্য এক টাকাও আমি নেই না। কাবিন ছিল আট লাখের, তার অর্ধেক উসুল ধরেছিল। বাকি চার লাখ ডিভোর্সের সময় দিয়ে দিয়েছে। উকিল চেয়েছিল, পুরো আট লাখ আদায় করে দিতে, কিন্তু আমি আর আইনি ঝামেলায় যেতে চাইনি। যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে চেয়েছিলাম।”
“তুমি ঐ টাকাটা দিয়ে তো চেম্বার দিতে পার রুমি।”
“টাকাটা পুরো নেই আপু, চাকরি পেলাম সবে সাত মাস। এর আগের চার মাসের নানা খরচ ওখান থেকে করলাম, একটা কোর্সে বেশকিছু টাকা গেল। বাকি টাকাটা ব্যাংকে রেখেছি, বিপদ আপদে কাজে আসবে। আব্বা অবসরে গিয়েছেন, বোনটার বিয়ে বাকি। টাকা হাতে রাখা দরকার। আমার আর তিতলির খরচের চাপ আম্মা আব্বার উপর দিতে চাই না।”
“মাশাল্লাহ রুমি, তুমি অনেক ম্যাচুয়র একটা মেয়ে।।কারও কোন কথায় মন খারাপ করো না। তুমি জানো তুমি কী, আর এটাই যথেষ্ট।”
মরিয়ম আপার সাথে কথা বলা শেষে প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমে যায় রুমি। নিজের সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেয়। কে কী বললো, তা ভেবে নিজের ক্ষতি করা যাবে না। আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী লাগে রুমির।হিমেলের ধারণা ছিল রুমি মেয়ে নিয়ে একা অসহায় হয়ে যাবে, সব ভুলে আবার তার কাছেই ফিরে আসতে হবে। মেয়েকে নিয়ে যখন বেরিয়ে আসে রুমি, পাশে কাউকে পায়নি, এমনকি নিজের পরিবারকেও না। হিমেলের প্রতারণা মাফ করে আবার নতুন শুরু করাই সবার পরামর্শ ছিল। কিন্তু যেখানে বিশ্বাস শেষ হয়ে যায়, সেখানে নতুন শুরু কী করা যায়! এই সহজ সত্যটাই কেউ বুঝতে রাজি ছিল না।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব৬
যাদের এখন ক্লাস নেই তারা সবাই বড়ো হলরুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছেন। রুমি আজ ইচ্ছে করে বাইরে বসেনি, রুমের ভেতর বসে আছে। ডিপার্টমেন্টের হেড আনিস সাবেত স্যারকেও জানিয়ে দিয়েছে ডিপার্টমেন্ট পরিবর্তনের কথা। স্যার রুমির মতো দায়িত্বশীল একজন সহকর্মী হারিয়ে একটু মন খারাপ করেছেন ঠিক, তবে রুমির ভালো ভবিষ্যতের জন্য অনেক অনেক শুভকামনাও জানিয়েছেন।
সায়েন্স অব ডেন্টাল ম্যাটিরিয়াল সাবজেক্টে আসলেই রুমি আগাতে পারতো না, কেননা এবিষয়ে ওর উচ্চতর ডিগ্রি নেই। সেসময় চাকরিটা খুব প্রয়োজন ছিল বিধায় এই বিষয়েই লেকচারার হিসেবে জয়েন করে। এখন যেহেতু সুযোগ এসেছে, নিজের বিষয়ে যাওয়ার, তখন ওকে আটকানোর কোন মানে হয় না।
“স্যার, নতুন যে আসবে, আমি তাকে সব বুঝিয়ে দেব। কোন কোন চ্যাপ্টার পড়ালাম, কী আমার বাকি ছিল সিলেবাসের সব বুঝিয়ে দিয়ে যাব। আপনাকে কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।”
“এটা ভালো হয় রুমি। হঠাৎ নতুন একজন বছরের মাঝামাঝি আসলে সিলেবাস নিয়ে ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে। তুমি একটু পাশে থেকে দেখিয়ে দিও। অবশ্য যে আসবে সে অনেক সিনিয়র। তারপরও ভালো স্টুডেন্ট মানেই কিন্তু ভালো শিক্ষক নয়। ও ছাত্র খুব ভালো, শিক্ষক কেমন হবে এখনো জানি না। সেক্ষেত্রে তুমি তার সিনিয়র, যেহেতু তুমি আগে পড়ানো শুরু করেছ। তুমি অবশ্যই সাহায্য করবে।”
“কে আসবেন স্যার? আপনি চেনেন মনে হচ্ছে।”
“আরে আমি নাম রেকমেন্ড করেছি, আমি তো চিনবই। বছরের মাঝামাঝি সার্কুলার দিয়ে, পরীক্ষা নিয়ে একজন নিয়োগ দেওয়া সময়সাপেক্ষ। আমার ডিপার্টমেন্টের ক্ষতি হবে, ক্লাস শিডিউল নিয়ে সমস্যা হবে। তাই আমার ছাত্রের নাম সাজেস্ট করলাম। ও University of HongKong থেকে Msc করেছে ডেন্টাল ম্যাটিয়ালে। যদিও লেকচারার পোস্টটা ওর জন্য ঠিক না, তারপরও করতে রাজি হয়েছে আমার কথায়। আশা করি শীঘ্রই প্রমোশন পাবে।”
“ওয়াও স্যার। তাহলে তো একদম যথাযথ লোকই আসছেন। বিষয়ভিত্তিক উচ্চতর পড়াশোনা করা টিচার পেলে স্টুডেন্টদের জন্যই ভালো।”
“হ্যাঁ, তবে ভালো স্যালারি আর সুযোগসুবিধা না দিলে দক্ষ মানুষ ধরে রাখা যাবে না। প্রাইভেট মেডিকেলগুলোর এই একটা দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। যোগ্য ক্যান্ডিডেটকে বাড়তি স্যালারি দিয়ে হলেও নিয়োগ দিতে হবে, না হয়ে কোয়ালিটি ফুল সার্ভিস দেওয়া সম্ভব না। সেক্ষেত্রে আমাদের কলেজ বেশ ভালো, একটা হ্যান্ডসাম স্যালারি দেয়। অনেক প্রাইভেটে নামমাত্র বেতন দেয়, যার জন্য ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা চাকরি করতে উৎসাহী হয় না।”
আনিস সাবেত স্যারের সাথে আলোচনা করতে খুব ভালো লাগে রুমির। ব্যক্তিত্বের অধিকারী, ভদ্র এই মানুষটাকে ফাদার ফিগার মনে হয় এই কলেজে। স্যার একসময় সরকারি ডেন্টালের অধ্যাপক ছিলেন, অবসর গ্রহণের পর এই মেডিকেলের এসডিএম (সায়েন্স অব ডেন্টাল ম্যাটিরিয়াল) এর ডিপার্টমেন্ট হেড হিসেবে দায়িত্ব নেন। বাইরে বসে গসিপ করার চেয়ে স্যারের সাথে আলোচনা করতে বেশি ভালো লাগে। অবশ্য এটা নিয়েও হাসাহাসি হয়, রুমি নাকি তেল মারতে এমন করে, ডিপার্টমেন্টের হেডকে তেল দেওয়ার জন্য অবসরেও বসে বসে কথা শোনে!
মোটামুটি কলিগদের সবাই জেনে গিয়েছে যে রুমি ডিপার্টমেন্ট সুইচ করছে। অধিকাংশই সামনাসামনি শুভকামনা জানিয়েছে, পেছনে কী বলে তাতে রুমির কিছু আসে যায় না। আজ বাসায় যাওয়ার সময় কাচ্চিবিরিয়ানি নিয়ে যাবে রুমি, ওর বেশ পছন্দ।
যদিও এখন টাকা নষ্ট করা ঠিক না, সামনের শুক্রবার রশ্মিকে দেখতে ছেলে পক্ষ আসবে, আম্মার হাতে কিছু টাকা দেওয়া দরকার, যেন বাজার করতে সুবিধা হয়।
রুমির আব্বা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, অবসরে গিয়ে এককালীন একটা এমাউন্ট পেয়েছেন, তবে পেনশন নেই। এমাউন্টার অধিকাংশ ওদের ফ্ল্যাট নিতে চলে গিয়েছে, সামান্য কিছু রেখেছেন ছোটো মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য। রুমির ভাই আদিল এখনো জবে ঢুকেনি, একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, কয়েকটায় রিটেনে সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু ভাইবা পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। বয়সও শেষ হয়ে আসছে, রুমির মতে এখন ভালো একটা জব পেলে ঢুকে যাওয়া উচিত। সরকারি চাকরি করতে করতে বয়স শেষ হয়ে গেলে ভালো প্রাইভেট জবও হবে না।
কিন্তু আদিল ওর কথা গায়ে মাখায় না। একমাত্র ছেলেকে অন্ধ ভাবে রুমির আম্মাও সমর্থন করেন। এই বাসায় এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে আছে রুমি। তার সবকিছুতেই যেন সবাই বিরক্ত হয়, পরামর্শ দিলেও বিরক্ত, মতামত দিলে বিরক্ত, কিছু বললে বলে ‘তুই বেশি বুঝিস বলে আজ তোর এই অবস্থা ‘! কী অবস্থা বলে, সেটা রুমি বোঝে। প্রচন্ড কষ্ট লাগলেও, আপন মানুষের কথা গায়ে মাখতে নেই ভেবে এভয়ড করে যায়। শুধু একাকী নির্ঘুম রাতগুলোয় বালিশ ভিজে ওঠে।
নেবে কী নেবে না, ভাবতে ভাবতে দুই প্যাকেট কাচ্চিবিরিয়ানি কিনে নেয় রুমি। একদিন না হয় একটু বাড়তি খরচই হলো।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব৭
“রুমি কী হয়েছে? কাল খুশি মনে বাসায় গেলে, আজ দেখি আবার মন ভার হয়ে আছে। কেউ কিছু বলেছে? তুমি এইসব বাইরের মানুষের কথায় একদম কান দিও না তো।”
“না আপু, বাইরের মানুষের কথায় আর কষ্ট পাই না, কষ্ট যা পাই এখন নিজের মানুষদের আচরণে।”
“বাসায় কিছু হয়েছে?”
“তেমন কিছু না আপু। আসলে কাল বাসায় যাওয়ার পথে কাচ্চি ওয়ালা থেকে কাচ্চিবিরিয়ানি নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম বাসায় মিষ্টি তেমন কেউ খায় না, কাচ্চিই খাওয়াই, আমারও পছন্দ। খেতে বসলে সবাইকে কলেজের খবরটা বলবো।”
“তারপর?”
“আর কী আপু, বাসায় সেই রোজকার থমথমে পরিবেশ। কেউ জানার আগ্রহও করে নাই কেন আনলাম। আব্বা তো আগেই খেয়ে নেয়। আম্মা খাবে না, কেন খাবে না, সেটারও কোন কারণ নেই। এমনি একটা চাপা জিদ আর রাগ সবসময় আমার উপর। আমার ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা আম্মা আজও মেনে নিতে পারেননি। আমি ঐ সংসারে পরকীয়ার বলি হয়ে মারা গেলেও বোধহয় আম্মা আব্বা এতটা কষ্ট পেত না, যতটা আমার সংসার ভাঙায় পেয়েছে।”
“না না ছিঃ রুমি, এভাবে বলছ কেন! ওনারা কী তোমায় এখনো কম ভালোবাসেন বলো? আসলে যা হয়, চিন্তা থেকে হয়তো ওনারা অভিমান দেখান।”
“অভিমান একটা জিনিস আপু, আর অপমান আলাদা জিনিস। এক বিয়ে হওয়ার পর যেন আমার বাবার বাড়ি, আর আমার বাড়ি নেই। এখানে মেহমান হিসেবে আমি মাথার মনি ছিলাম, আবার মেয়ে হয়ে ফিরে আসায় কেমন গলার কাঁটা হয়ে গিয়েছি।”
মরিয়ম সহসা কী উত্তর দেবে বোঝে না। রুমির জন্য খারাপ লাগে। মানসিক ভাবে খুব খারাপ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বলে হয়তো এমন লাগছে ওর।
রুমি কথ বলে হালকা হতে চায়, নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলা সহজ নয়, বললে দশজনের নয়জনই উল্টো কথা শোনাবে। বাবা মাও যে ভুল হতে পারেন, এইটা যেমন এখনো আমরা স্বীকার করতে রাজি না, তেমনি সহজে কেউ নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে বলতেও চায় না। পরিবারে তার অবস্থান দুর্বল, ভালেবাসা পায় না, এটা জানাতে সবাই কুণ্ঠা বোধ করে। তাই পরিবারের সম্পর্কগুলোর মাঝের ভালোবাসাটাই শুধু সামনে আসে, অভিমানটা খুব কম।
“আপু আপনি হয়তো ভাবছেন কী বলছি আমি। কিন্তু আপনি নিজে এই অবহেলা, তাচ্ছিল্য অনুভব না করলে বুঝবেন না। দৃশ্যত কোন অপরাধ করা ছাড়াই আমি অপরাধী, এমনটাই আমার মনে হয়। বাড়িতে যখন বাবা মায়ের কাছেই মেয়ে মূল্যায়ন পায় না, তখন বাকি সদস্যরা কেন দেবে বলেন? জানেন আপু আমার নেওয়া কাচ্চি আমার ভাই বোনও খায়নি। যদি জিজ্ঞেস করেন কেন খায়নি, তবে বলবো কোন কারণ নেই। শুধুমাত্র আমাকে তাচ্ছিল্য দেখানোই উদ্দেশ্য। দুই বেলা সেই বিরিয়ানি আমি একা বিষের মতো গিলেছি। কারণ নষ্ট হলে এই নিয়ে আরেকদফা কথা শুনব। বাকিটা আজ বক্সে করে নিয়ে এসেছি।”
“শুনো তোমার আম্মা আব্বা বয়স্ক মানুষ। ওনারা ভারী খাবার না খাওয়াই ভালো। রশ্মিকে দেখতে ছেলেপক্ষ আসবে, তাই হয়তো ও ডায়েটের চেষ্টা করছে। আর তোমার ভাইয়ের চাকরি হচ্ছে না, মানসিক চাপে আছে, তার হয়তো মন মর্জি ভালো যাচ্ছে না। এভাবে ভেবে দেখ রুমি। সবকিছু নিজের উপর নিও না প্লিজ। আর ভালো হয়েছে নিয়ে এসেছ, আমি খাব। আমাকে তো খাওয়ালে না।”
“সত্যি খাবেন আপু? খুব খুশি হব।
আপু আপনার সাথে কথা বলে মন হালকা লাগে। তবে এই কথাগুলো আর কাউকে বলবেন না প্লিজ। নিজের পরিবার নিয়ে বিরূপ কথা বলতে কেমন বিব্রত লাগে।”
“নাহ্ বোকা। এই চিনলা আপু কে?”
“চিনেছি বলেই শেয়ার করি আপু। আপু জানোই তো, বেতন পাই মাত্র পঁচিশ হাজার। মাসের শুরুতেই পনেরো হাজার আম্মার হাতে দিয়ে দেই। বাকি দশ হাজারে নিজের আর মেয়ের সব খরচ চালাই। তিতলির বাবার, মেয়ের জন্য মাসে মাসে পাঠানো পাঁচ হাজার টাকা ডিপিএস করা আছে । আর আমার একাউন্টে আছে লাখ দেড়েক টাকা। তিতলির স্কুলে ভর্তি সহ বিপদ আপদের জন্য এই টাকা রাখা। আমি নিজে যত কষ্টই করি না কেন, বাসা থেকে এক টাকাও না নেওয়ার চেষ্টা করি। আব্বা যে অবসরে গিয়েছেন, এই খেয়াল আমার আছে। অথচ বাসার যাবতীয় সমস্যার বয়ানে আম্মা আমাকে টেনে আনে। কাল অন্তত দশবার টাকা পয়সার টানাটানির কথা তুলে হইচই করলেন বাসায়। কয়টা টাকা খরচ করে দুই প্যাকেট কাচ্চি নিয়ে বিশাল অপরাধ করেছি আমি। অথচ এটা আমি সম্পূর্ণ আমার হাতখরচ থেকে কিনেছি। একই ভাবে কোন জামা কাপড় কিনলে রাগ, বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলে রাগ, বিকেলে ঘুমালে রাগ। আপু আমি বোধহয় আপনাকে বুঝাতে পারছি না, ঠিক নিজের বাসায় আমি কতটা একা আর কোণঠাসা অনুভব করি। আমার বোনটা সংসারের একটা কাজ না করলেও সমস্যা নেই, কারণ ও এখনো কুমারী মেয়ে। আমার ভাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গ্লাসে পানিটা ঢেলে না খেলেও অপরাধ নেই। কিন্তু কোনদিন আমি যদি ক্লান্তিতে রাতে আম্মার ঘুমানোর আগে ঘুমিয়ে যাই, তাহলে সকালে আর আম্মার চেহারার দিকে তাকানো যায় না। মুখ ভার করে থাকেন, সাথে কথার খোঁচা চলে, তিনি নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন, এসব চলতেই থাকে। আমিও মাঝেমাঝে না পেরে উত্তর দেই, তখন একটা ঝগড়া লেগে যায়। এইসব কিছু মিলে আমার মাঝে মাঝে ভীষণ হতাশ লাগে আপু।”
রুমিকে কী বলা উচিত, সহসা মরিয়ম তা খুঁজে পায় না। শুধু রুমির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আপার স্নেহের কাছে গলে গিয়ে রুমির জমানো কষ্টগুলো কান্না হয়ে ঝরে। মরিয়ম বাঁধা দেয় না, মাঝেমাঝে মানুষকে কাঁদতে দেওয়া উচিত, এতে মন হালকা হয়।
ক্লাসের ফাঁকে একাকী কথা বলতে হলে মরিয়ম আপা আর রুমি প্রায় ছাদে চলে আসেন। এখন এখানে কেউ নেই, কাঁদলেও তাই পরে রুমিকে বিব্রত হতে হবে না।
“নানু বিয়ানি খাব।”
“বিরিয়ানি নেই নানু ভাই। ভাত দেব। তোমাকে”
জলি বেগমের মনটা খারাপ। মেয়েটার সাথে প্রতিবার কঠিন আচরণ করার পর নিজেরই কষ্ট লাগে। প্রত্যেকবার ভাবেন আর এমন করবেন না, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ একটা চাপা ক্ষোভ সব এলোমেলো করে দেয়। সামনে রশ্মিকে দেখতে মেহমান আসবে। স্বামী রিটায়ার্ড হয়েছেন, ছোটে মেয়েটার হাতে টাকা থাকতে থাকতে বিয়ে দেওয়া দরকার। রুমি তো ভালো ছাত্রী ছিল, তখন স্বামীরও চাকরিও ছিল, সব মিলিয়ে ভালো পেশার ছেলে পেতে সমস্যা হয়নি। ঘর বর সব দেখেই তো মেয়েটার বিয়ে দিলেন, এরপর ছেলের চরিত্র খারাপ হবে তা কে জানতো। তবে পুরুষ মানুষের এমন টুকটাক দোষ থাকে, সব ধরলে সংসার হয় না।
রুমি তো জানে না, ওর বাবা কী ধোয়া তুলসীপাতা ছিল নাকি, অফিসের রিসেপশনিস্টের সাথে কতবার হাতে নাতে ধরেছেন তিনি। কিন্তু সেসব কথা বাইরে যেতে দেননি। বুকে চেপে ধরে সেই স্বামী নিয়েই বিয়ের চৌত্রিশ বছর তিনি কাটিয়ে ফেলেছেন! অথচ আজকালকার মেয়েরা এত অধৈর্য, কোথায় রুমি স্বামীর সব দোষ লুকিয়ে স্বামীকে আঁচলে বাধার চেষ্টা করবে, তা না করে সমাজ জানালো, বিয়ে ভাঙলো। চাকরি বাকরি যাই করুক, মেয়ে সংসার করবে না, এই জিনিস তিনি আজও মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। সমাজের কাছে এই এক ঘটনায় কত ছোটো হয়েছেন। মেয়েটার উপর তাই ওনার চাপা রাগ। বড় মেয়ে ডিভোর্সি, ছোটোমেয়ের বিয়েতে এই নিয়ে কোন ঝামেলা হয় কিনা, সেই চিন্তায় ওনার ঘুম নেই, আর সেখানে মেয়ের কোন হেলদোল নেই, মনের আনন্দে বাসায় বিরিয়ানি নিয়ে আসে! ইচ্ছে করেই তাই খাননি। মেয়ে কষ্ট পেলে পাক, তখন তাই ভেবেছেন। কিন্তু আজ রাগ পড়ে যেতে মন খারাপ লাগছে, এতটা রূঢ় আচরণ না করলেও হতো। মেয়েটা এমনি টাকা নষ্ট করে না, কোন ভালো খবর হয়তো ছিল, তাই বলার চেষ্টা করেছে। নাতনিকে ভাত মেখে খাওয়াতে খাওয়াতে বড়ো মেয়ের জন্য মনটা কেমন কেমন করে ওঠে, কতদিন মেয়েটার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেন না, শুধু রাগ আর রাগ। আজ বাসায় আসলে হাসিমুখে কথা বলবেন।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব৮
চোখ মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে টিচার্স রুমে বসে রুমি। মরিয়ম আপা ইচ্ছে করেই আলাদা বসেছেন, সবসময় একসাথে থেকে সবার চোখে পড়তে চান না, অযথাই দলাদলির লেবাস পেতে হবে। রৌশন আপা না হয় মিতু যে কেউ বলে বসবে, “রুমি আর মরিয়ম আপা তো একদল!” একই সাথে কাজ করা সহকর্মীরা আবার আলাদা আলাদা দল কেন হয় বোঝে না মরিয়ম, এসব তার ভালোও লাগে না। তবে কর্মক্ষেত্রে অদৃশ্য গ্রুপিং আছে, খোঁচাখুঁচিও আছে, আর অফিস পলিটিক্স তো মামুলি ব্যাপার।
রুমি এখনো অফিসিয়ালি নতুন ডিপার্টমেন্টে কাজ শুরু করেনি। মাস শেষ হতে আরও চারদিন বাকি আছে, এই কয়দিনে সবকাজ গুছিয়ে, আগামী মাস থেকে নতুন ডিপার্টমেন্টে কাজ শুরু করবে। মরিয়ম আপার সাথে কথা বলে হালকা লাগে রুমির। দীর্ঘদিনের জমানো কষ্টগুলো কান্নার সাথে ধুয়ে গিয়েছে। মাঝেমাঝে একটা কাঁধ আসলে খুব দরকার হয়, যে কাঁধে মাথা রেখে চোখের পানি ফেলা যায়। একটা সময় একজন নিরব শ্রোতা খুব প্রয়োজন হয়, যে শুধু কথাগুলো শুনবে, কোন পরামর্শ দেবে না, ভুল খুঁজবে না, কথার মাঝে নিজের গল্প নিয়ে বসে যাবে না, শুধু কথাগুলো শুনবে। দুই ভিন্ন বয়সী নারী মরিয়ম আর রুমির নিজেদের এই না বলা কথার সাথীই যেন। একে অপরের কাউকে বলতে না পারা কথাগুলো তারা ভাগ করে নেয় সহজেই।রুমি চেয়ার টেনে বসতেই রৌশন আপা এগিয়ে আসেন,
“রুমি নতুন ডিপার্টমেন্টে যাচ্ছ শুনলাম?”
“জ্বি আপা, ইনশাআল্লাহ।”
“ভালো ভালো। তোমাকে দেখে আসলে শেখার আছে অনেককিছু।”
“কী আপা?”
“এই তো তুমি কারও কথা গায়ে নাও না। ভারী শক্ত মন তোমার। আমরা অনেকেই পারি না, একটু কিছু হলে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যাই।”
“সেটা কী রকম আপা? আমি তো আলাদা কেউ না, খারাপ কথায় কষ্ট আমিও পাই।”
“তা তো পাবেই। কিন্তু না বলছিলাম যে, এই তো কে কী বললো সেগুলো পাত্তা দাও না। নিজের মতো চলো।”
“আপা, কখন থেকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলছেন। পরিষ্কার করে বলেন প্লিজ। কে আবার কী বলে? যা আমি পাত্তা দেই না?”
“না মানে এমনি বললাম। ঐ যে মিতু আছে না, কিসব বললো তোমাকে আর হাসান জামিলকে নিয়ে।”
রুমির মুখের ভেতর তিতা লাগে, একজন সিনিয়র মানুষ কিভাবে এমন অযথা মিথ্যা কথা বলতে পারেন! মিতু মেয়েটা ঠুস ঠাস কথা বলে ঠিক, একটু ঝগড়াটেও, কিন্তু কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টের হাসান জামিলকে নিয়ে মিতু নয়, রৌশন আপা নিজেই রুমিকে জড়িয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলেছিলেন, আর রুমি নিজের কানেই তা শুনেছে। না শুনলে হয়তো রুমি মিতুকেই ভুল বুঝতো।
“আপা, শুধু হাসান জামিল ভাইকে নিয়েই বলেছে? হায়দার স্যারকে নিয়ে বলেনি? বলেনি আমি অযথা হায়দার স্যারের আশেপাশে ঘুরঘুর করি? আপা শোনেন, আমি সব শুনেছি ওয়াসরুমে কী বলেছেন আমার নামে। আমার কথা বাদ দেন, আমি তো না হয় বাজে মেয়ে। কিন্তু নিজের হ্যাসবেন্ডকে জড়িয়ে এসব কথা বলে আপনি ওনার সম্মানও রাখছেন না।”
হায়দার আলী স্যার, রৌশন আপার স্বামী, ওরাল এনাটমি ডিপার্টমেন্টের হেড। স্যারের কথা শুনে রৌশন আপার মুখটা হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে যায়। কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে যান তিনি।
একই কলেজে শিক্ষকতা করলেও, সবার চোখেই স্পষ্ট ধরা পড়ে যে হায়দার স্যার যেমন রৌশন আপাকে বিন্দুমাত্র পছন্দ করেন না, তেমনি রৌশন আপাও স্যারকে সামান্যতম বিশ্বাস করেন না। চাকরির চেয়ে স্যারের দিকে নজর রাখাই যেন আপার প্রধান কাজ, সিনিয়র মানুষ বলে ম্যানেজমেন্টও কিছু বলে না। তবে মাঝেমাঝে আপার কাজ কারবার হাস্যকর পর্যায়ে চলে যায়। কোন মেয়ে কলিগ স্যারের সাথে হেসে কথা বললে সর্বনাশ! মহিলা কোন পিয়ন, আয়া স্যারের রুমে চা নাস্তা নিয়ে যেতে পারে না। সবদিকে আপার সদা সতর্ক দৃষ্টি। আর আপার এই অতিরিক্ত সন্দেহ বাতিক মনোভাব স্যারের আপাকে দিন দিন অপছন্দের মানুষ করার অন্যতম কারণ। স্যারের আগে কোন নারী ঘটিত ঘটনা আছে কিনা রুমি জানা নেই, তবে কলেজে কখনো এমন কিছু চোখে পড়েনি, অথবা আপার সতর্ক চোখ এড়িয়ে স্যার কিছু করার সাহস এখন পান না।
একজন মধ্যবয়সী, দুই সন্তানের মা যে এমন অবসেসিভ হতে পারে, এটা রৌশন আপাকে না দেখলে বোঝাই যেত না। কর্মক্ষেত্রে নিজের সম্মান বাঁচাতে অনেক কিছুই হায়দার স্যার হজম করে যান, তবে মাঝেমাঝে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কয়েকমাস আগে ওরাল এনাটমি ডিপার্টমেন্টের এক মহিলা লেকচারার চাকরি ছাড়ে বলতে গেলে আপার সাথে সমস্যা হয়ে, সেসময় হায়দার স্যার এত রাগ করেছিলেন যে আলাদা থাকা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তিনদিনের ভেতর আপা সুইসাইড করার চেষ্টা করেন। একগাদা ঘুমের ঔষধ খান, তাও আবার কলেজে এসে স্যারের রুমে। এমন নাটকীয় অবস্থা সৃষ্টি হয় সেদিন। এরপর আবার ওনাদের একসাথে থাকা শুরু হয়েছে, স্যার আর আপার দুই ছেলেমেয়ে বাবাকে শাসিয়েছে মায়ের কিছু হলে ওরা মামলা করবে বাবার নামে। স্ত্রী হিসেবে স্যারের সাথে যত অশান্তিই হোক,মা হিসেবে ছেলেমেয়ের কাছে আপা অনন্য, সন্তানেরা তাই মাকেই সাপোর্ট করেছে।
একটা অযথা সন্দেহবাতিক মন যে সংসারকে কেমন বিষিয়ে তুলতে পারে, এই একটা সম্পর্ক দেখলে তার অনেকটুকু ধারণা পাওয়া যায়। তারপরও তাদের সংসার টিকে আছে, বা বলা যায় আপা টিকিয়ে রেখেছেন। ‘হয় মরবেন, না হয় সংসার করবেন, তারপরও ডিভোর্স দেবেন না’, এই কথা রৌশন আপা প্রায় বলেন। এদিক দিয়ে রৌশন আপাকেও কম দৃঢ় মনে হয় না। রুমি তো এভাবে কখনো ভাবেনি, আর তার জন্য বাসায় কত কী শুনতে হয়েছে, আম্মা আব্বা সহ সবাই বলেছেন এত অধৈর্য হলে হবে না, অন্য নারীর আঁচল থেকে স্বামীকে ছিনিয়ে আনতে না পারলে আর কিসের স্ত্রী!!
সবাই ভাবে রুমি শক্ত মনের। কিন্তু রুমির মনটা আসলে শক্ত না, বরং দুর্বল। তাই ভালোবাসার মানুষের এই প্রতারণা সে সইতে পারেনি, কোন ছিনিয়ে আনা আনির ভেতর যাওয়ার শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই ওর ছিল না। আপা যেমন সারাক্ষণ হায়দার স্যারের পেছনে আছে, রুমি ছিল তার উল্টো। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছে হিমেলকে। অতিরিক্ত সন্দেহবাতিক মন যদি ভয়াবহ হয়, তবে অন্ধবিশ্বাসও কম ভয়াবহ না। হিমেলের ছাত্রী জেনি প্রেগন্যান্ট হয়ে গিয়েছিল, অথচ রুমি টেরও পায়নি। সংসার বাচ্চা, পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পড়া, এাব কিছুর ভেতর ওর একবারও মনে হয়নি হিমেলের দিকে নজর দেওয়া দরকার। হিমেলও হয়তো সব চেপে যেতে পারতো, যদি না এবোরেশন করাতে গিয়ে জেনি মরোমরো না হয়ে যেত। এশিয়া মেডিকেল কলেজের মেডিকেল অফিসার কাম লেকচারার হিমেল। জেনি সেই কলেজেরই সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো তখন। কলেজ ছুটির পর, একজন সিনিয়ার স্টাফ নার্সের সাহায্য নিয়ে কলেজের ওটি রুমে গোপনে এমআর করানোর চেষ্টা করে হিমেল। ভয়ে আতংকে বাচ্চা নষ্ট করতে জেনিও রাজি ছিল। কিন্তু প্রায় চারমাস বয়সী ভ্রূণ এমআর করা সহজ ছিল না, কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না, শকে চলে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল জেনির। না চাইলেও ইমার্জেন্সি সাপোর্টে নিতে বাধ্য হয় নার্স। হিমেল রাজি ছিল না, কিন্তু জেনি মারা যেতে পারে ভয় পেয়ে নার্স নিজেই উদ্যোগ নেয়। জেনি বেঁচে গিয়েছিল, তবে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে জরায়ু ফেলে দিয়েছিল ডাক্তার। বেঁচে থাকলেও আর কোনদিন মা হতে পারবে না জেনি। এরপর কলেজ ছেড়ে চলে যায় জেনি, কোথায় আছে কে জানে। চাকরি চলে গিয়েছে সেই সিনিয়র স্টাফ নার্সের। আর কিছুই হয়নি কার!!! হিমেলের।
এমনকি রুমিকেও সবাই পরামর্শ দিয়েছে যে স্বামীকে শোধরাবার, শুধরে সংসার করার। যেন এত বড়ো ঘটনার কারণ একটা বাচ্চা ছেলের মামুলি একটা ভুল, যাতে একটা মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল, এত কেলেঙ্কারি হলো। রুমি যেন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, যে ব্যর্থ স্বামীকে শোধরাতে।
প্রায় নাটক সিনেমায় দেখায় যে ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্ত, চরিত্রহীন প্লে বয়, সংসার বিমুখ উচ্ছনে যাওয়া স্বাামীকে স্ত্রী ভালো করে ফেলে। সমাজে ব্যাপক হিট হয় এইসব কাহিনি। আরে এই না হলো স্ত্রী!!! অথচ বিয়ে কোন পুনর্বাসন কেন্দ্র নয়, কারো বিগড়ে যাওয়া সন্তানকে ঠিক করার কাজ তার স্ত্রীর নয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের বিপথে যাওয়ার দায় তার একান্ত নিজের, তাকে গড়ে তুলতে গিয়ে নিজে নিঃশেষ হওয়ার গল্পগুলো মহত করে দেখানো আর কত দিন চলবে জানে না রুমি।
“রৌশন আপার সাথে লাগা ঠিক হয়নি। আপা তিলকে তাল করতে উস্তাদ রুমি। কী সিনক্রিয়েট করবে ঠিক নেই।”
“মরিয়ম আপু, কী করবো ঐ সময় রাগ উঠে গিয়েছিল। থাক বাদ দেন যা হবে দেখা যাবে। আমি ক্লাসে গেলাম, টিউটোরিয়াল আছে আমার।”
“আচ্ছা, পরে কথা হবে।”
মরিয়ম ক্লাস টেস্টের খাতা গুলো দেখতে মন দেয়। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না আজ দুইদিন। কেমন বমিবমি ভাব, মাথাটা ভার হয়ে আছে। মরিয়ম মনে মনে যা সন্দেহ করছে, মুখে তা আনতে ভয় পায়। শাশুড়ি অভিমান ভুলে আবার বাড়িতে ফিরে এসেছে ঠিক, তবে একটা দূরত্ব নিয়ে চলছে। নতুন নাতি নাতনির মুখ না দেখা পর্যন্ত ওনার শান্তি নেই। তবে মরিয়মের শরীরের পরিবর্তন ওনারও নজর এড়ায়নি। আজ সকালে মরিয়ম যখন বমি করছিল, তখন ছেলে শাহেদের সাথে তিনিও উদ্বেগ দেখান। মরিয়মের যে অতিরিক্ত পরিশ্রম যাচ্ছে সেটা শাশুড়িও স্বীকার করেন। রুমনের পেছনে খাটাখাটুনির পর সংসারের কাজ, চাকরি সব সামলানো সহজ নয়। মরিয়মকে আজ অফিসে আসলেও নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু সামনে ছুটি আরও বেশি দরকার হবে ভেবে মরিয়ম অনেকটা জোর করেই আসে। নিজে নিশ্চিত হওয়ার আগে এখনো স্বামী বা শাশুড়ি কাউকেই কিছু বলেনি। রুমিকে বলবে ভেবেছিল, কিন্তু রুমি নিজেই এত চাপে আছে আজ, দেখে আর নতুন করে নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলতে গেল না। আসলেই মরিয়ম বুঝতে পারছে না, ও কী খুশি হবে, না চিন্তা করবে।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব৯
কলেজের সারাটা দিন আজ ঘটনাবহুল ছিল। কথা হজম করার পর রৌশন আপা কিন্তু শান্তই ছিলেন। অবশ্য ঝড় আসার আগে প্রকৃতির শান্ত রূপও হতে পারে! রুমি অবশ্য অতশত এখন ভাবতে চায় না। যা বলার বলেছে, কী হবে দেখা যাবে, এমনিতে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু উবার বা সিএনজি করে আজ বাসায় ফেরা সম্ভব ছিল না। মাসের শেষ, হাতে আছে মাত্র এক হাজার টাকা। বিলাসিতা করার সুযোগ এখন নেই। বাসে করে বাসায় ফিরতে ফিরতে তিনটার বেশি বেজে গেল। দূরত্ব বেশি না, কিন্তু একেকটা সিগন্যাল পার হতে পনেরো বিশ মিনিট লেগে যায়। আজ আম্মা নির্ঘাত রেগে থাকবে এত দেরির জন্য, রুমি নিজেকে বারবার বোঝায় কোন কথার বাঁকা উত্তর দেবে না, মাথা ঠান্ডা রাখবে। উত্তর দিলে হক না হক যে কথাই রুমি বলুক, পরিস্থিতি খারাপ হবেই।
“আজ এত দেরি যে? তিনটা বিশ বাজে।”
“আম্মা, বাসে এসেছি, অনেক জ্যাম ছিল।”
“রিকশা ভাড়ার জন্য বাড়তি কিছু টাকা হাতে রাখতে পারিস। এই মাস থেকে পনেরো দিস না আমার হাতে, তিন হাজার আলাদা করে ভাড়া রাখ। এত কষ্ট করার মানে হয় না।”
আজ এতদিন পর আম্মা সহজ স্বাভাবিক কথা বলছে দেখে রুমির মনটা ভালো হয়ে যায়। যা কিছু অভিমান ছিল মনে, সব গলে পানি হয়ে গেল যেন।
“লাগবে না আম্মা। আগামী মাসে নতুন ডিপার্টমেন্টের যাব। প্রাকটিকাল ক্লাস নেব, রোগী দেখব। তাই বেতন বাড়বে ইনশাআল্লাহ।”
“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আগে বলিস নাই কেন?”
রুমি আর আম্মাকে গতকালের কথা মনে করিয়ে দেয় না। আম্মাকে হাসিখুশি দেখে ভালো লাগছে। এই কথা মনে করিয়ে দিয়ে মান অভিমান টানার দরকার নেই।
তিতলি ঘুমাচ্ছে, রুমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়, সময় নষ্ট করার সময় নেই।
***
মরিয়ম বাসায় ফিরে দেখে ননদ বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় এসেছে। রুমন কাজিনদের পছন্দ করে, ওরা রুমনকে বিরক্ত করে না। সব বাচ্চারা একসাথে ড্রয়িং করছে।
“কখন আসলে? ফোন দিতে, তাহলে আগে বের হতাম।”
“সমস্যা নেই ভাবি। বাসার কাজ শেষ করতে দেরি হলো, এই একটু আগে ঢুকলাম। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, একসাথে ভাত খাব।”
শিহাব আর শৈলী দুই ভাইবোনই চমৎকার মানুষ। মরিয়মের ভালো লাগে, শাশুড়ি দুই ছেলেমেয়েকে এত ভালো শিক্ষা দিয়ে বড়ো করেছেন। গতানুগতিক ননদ ভাবি কোন্দল ওদের মাঝে নেই। তাই শৈলী আসলে মরিয়মের আতংক না বরং ভালো লাগে। মরিয়ম দ্রুত গোসল করে এসে টেবিলে খাবার দিতে থাকে, শৈলীও ভাবির সাথে হাত লাগায়।
“ভাবি আম্মু সহজ হয়েছে এখন?”
“হ্যাঁ, আগের চেয়ে ভালোই মনে হলো।”
“আমি বুঝিয়েছি আম্মুকে। আসলে বড়ো খালা, ছোটো খালা সবাই মিলে এক কথা বারবার বলায় আম্মুরও মাথায় ঢুকেছে যে ছেলের ঘরে আরেকটা নাতি নাতনি দরকার। না হলে আম্মু রুমনকে কম ভালোবাসে না।”
“আম্মাকে তো আমি চিনি শৈলী। টিপিক্যাল শাশুড়ি তিমি নন। আমাকে মেয়ের মতোই আদর দিয়েছে সবসময়। তাই ওনার অভিমান আমি গায়ে মাখি না। তবে ভয় লাগে, আটত্রিশ বছর বয়স চলছে আমার। এই সময় এত গ্যাপে আরেকটা বেবি নেওয়া সহজ না।”
“শরীর সাপোর্ট না দিলে নিও না। তবে আরকটা ভাই বা বোন হলে রুমনও সঙ্গী পাবে। দেখ না আইরিন আর আয়াশ আসলে রুমন খুশি হয়। বাচ্চারা বাচ্চাদের সঙ্গ পছন্দ করে।”
“আইরিন আর আয়াশ তো বড়ো হয়েছে, অনেক কিছু বোঝে। একদম নিউবর্ন বেবি কি রুমন মেনে নিতে পারবে?”
“অবশ্যই পারবে। রুমন কি আর দশটা বাচ্চা থেকে আলাদা ভাবি? বরং স্পেশাল। দেখবা নিজের ভাই বোনকে ও অনেক বেশি ভালোবাসবে। রুমনের অনুভূতি অনেক বেশি তীব্র।”
রুমন কী আসলেই গ্রহণ করতে পারবে কী না মরিয়মের জাবা নেই। রুমনের চাইল্ড স্পেশালিষ্টের সাথে খুব দ্রুত দেখা করবে ঠিক করে মরিয়ম।
****
তিতলির পাশে শুয়ে রুমিরও চোখ লেগে এসেছিল। ঘুম ভাঙে কলিং বেলের শব্দে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে বিকেল পাঁচটা। রশ্মি দরজা খুলেছে শুনতে পাচ্ছে রুমি। মামীমা এসেছেন। আম্মার হাসিখুশি ভাব আর বেশিক্ষণ থাকবে না ভেবে কষ্ট লাগে রুমির। প্রত্যেকবার মামীমা আসলে তুচ্ছ কিছু না কিছু নিয়ে আম্মা বাসায় তুলকালাম করে ফেলেন, হয় সেদিন, না হয় তার পরেরদিন। আজ কী বিঢয় নিয়ে এসেছে আল্লাহই জানেন।
রুমি উঠে যায় তাড়াতাড়ি। এই অবেলায় ওকে ঘুমাতে দেখলে প্রথম কথাটা এই নিয়ে শুরু হবে। বিছানা থেকে নামার আগেই রুমে চলে আসেন মামী।
“রুমি রে কেমন আছিস?”
“আসসালামু আলাইকুম মামী। আছি মোটামুটি।”
“ঘুমাচ্ছিলি নাকি? ভালো ভালো।”
রুমি প্রমাদ গুনে। কিন্তু আর কিছু বলেন না মামী। রুমির এই একজনই মামী। মামা মামী রুমির আম্মার চেয়ে বয়সে বড়ো। রুমিদের বাসায় মামা মামীর মতামতের বেশ প্রভাব আছে। দুই চাচার সাথে ইদ বা পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন দেখা হয় না, ফুপু নেই। বড়ো খালা আর মামাই তাই পরিবারের বেশি কাছে, নিয়মিত আসা যাওয়া হয়। রুমির আম্মা পরিবারের ছোটো মেয়ে। বড়ো দুই ভাইবোনের মতামত ওনার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সব সময়।
রুমি মুখটা ধুয়ে চা বসাতে যায়। মামী আম্মার রুমে বসেছেন। মামা বাবার সাথে ড্রয়িং রুমে কথা বলছে। রশ্মির জন্য এই বিয়ের প্রস্তাব মামা মামীই এনেছেন। মামার কোন এক বন্ধুর ছেলে। বিবিএ এমবিএ করেছে প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে, এখন একটি বেসরকারি ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার পদে আছে। প্রস্তাব খারাপ না, রশ্মি পড়ালেখায় অতটা ভালো না। ইডেন মহিলা কলেজে অনার্সে পড়ছে, সেটাও যে খুব মন দিয়ে তা নয়। বাবা অবসরে যাওয়ার পর রশ্মির বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছেন।
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১০
রুমি, রশ্মি আর আদিল তিন ভাইবোনকে সহ সবাইকে বড়ো মামা বসার ঘরে ডেকে বসান, ওনার জরুরি কথা আছে। রুমির বাবা মা বয়সে ছোটো বলে তিনি তাদের দুজনকেই নাম ধরে ডাকেন।
“হামিদা, বয়। চা তো খেলাম। বাকি নাস্তা পানি পরে করা যাবে, আগে জরুরি কথা বলে নেই।”
“বলেন ভাই।”
“শুক্রবার রশ্মিকে দেখতে আসাটা একরকম ফর্মালিটি বুঝেছিস। প্রাথমিক কথাবার্তা সব আগেই হয়েছে আমার সাথে। আর সানোয়ার তো আমার সাথে ছেলের অফিস দেখে এসেছে। হামিদাকে বলো নাই সানোয়ার?”
“জ্বি ভাই বলেছি তো। ছেলে নিয়ে আমাদের অপছন্দের কিছু নাই।”
“আলহামদুলিল্লাহ। ছেলের ছোট একভাই আর বড়ো দুইবোন আছে, বোনদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুই দুলাভাই ভালো চাকরি বাকরি করেন। আর ছোটোভাই ইস্ট ওয়েস্ট ভার্সিটিতে পড়ছে। ছেলের বাবাও সানোয়ারের মতো অবসরে গিয়েছেন কয়েক বছর হলো। “
“এসব তো জানি ভাই।”
“হ্যাঁ, জানোস, তাও বল্লাম এটা বোঝানোর জন্য যে আল্লাহর রহমতে প্রস্তাব ভালো। আর প্রাথমিক কথাবার্তায় ওনারাও তোদের পরিবার পছন্দ করেছেন। ছেলের মা বাবা রশ্মির ছবি দেখেছে, ওনারদেরও মেয়ে নিয়ে আপত্তি নাই। এখন শুধু সামনাসামনি দুই পরিবার বসে কথা বলা বাকি। সাথে ছেলে আর পরিবারের বাকিরা একটু মেয়েকে সামনাসামনি দেখে নিল, এই আর কী। শুক্রবার সবকিছু মনের মতো মিললে ওনারা কাবিন করিয়ে যাবেন। অনুষ্ঠান পরে ধীরে সুস্থে হবে।”
হামিদা বেগমের তারপরও চিন্তা যায় না, এত সহজে রশ্মির বিয়ে হবে তা তিনি ভাবেন না। বড়ো ভাই ভাবির প্রতি কৃতজ্ঞ, ওনারা এগিয়ে এসেছেন, সবকিছু নিশ্চয়ই সামলে নিবেন। কিন্তু যদি ছেলেপক্ষ মেয়ে দেখেশুনে কাবিন না করেই চলে যায়, তাহলে কেমন অপমানের বিষয় হবে। কিন্তু বড়ো ভাইকে এই কথা তিনি বলতে পারেন না। তবে রুমির আব্বা, সানোয়ার সাহেবই বলেন, ” ভাই এটা তো ভালো কথা যে ওনারা সরাসরি কাবিন করাতে চান। তবে আল্লাহ না করুক, যদি ওনারা কাবিন না করে চলে যান, তখন আমাদের মেয়ের কেমন নিজেকে ছোটো লাগবে। তাছাড়া একদিনেই এত বড়ো সিদ্ধান্ত কিভাবে নেওয়া যাবে? তারচেয়ে ওনারা ঐদিন শুধু আসুক, মেয়েকে দেখে যাক, আমরাও ছেলে আর ছেলের পরিবার দেখি। তারপর না হয় সবাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেই। এতে কারও উপর কোন চাপ থাকলো না। কাবিন না হয় পরে করা যাবে।”
“আরে পছন্দ হবে না কেন। ওনারা যে খালি রশ্মির ছবি দেখে পছন্দ করেছেন তা তো না। রশ্মিকে কলেজে দুইবোন আড়াল থেকে দেখে এসেছে, খোঁজ খবর নিয়েছে। মনের মতো মনে হয়েছে বলেই তো নিজ থেকে কাবিনের কথা বললেন। এখন আমরা কাবিন করতে না করলে বরং ভাববে ভাব নিচ্ছি। রুমির কথা শুনেও ওরা আগাচ্ছে এটাই তো বড়ো কথা।”
“আমার কী কথা মামা? আমি কী করলাম?”
“না মানে, মেয়ের ইমিডিয়েট বড়ো বোন তালাক নিয়ে বাচ্চাসহ বাড়িতে আছে এই কথা শুনলে অনেকেই আর আগাতে চায় না। সেখানে তারা এটা নিয়ে আপত্তি করেনি, শুধু বলছে শুক্রবার তুই মেয়েকে নিয়ে বাসায় থাকতে না।”
“মানে, বাসায় কেন থাকবে না রুমি আর তিতলি? ওদের অপরাধ কী?” এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার আদিল প্রশ্ন করে।
মামার হয়ে মামীই উত্তর দেন, “আদিল, তোমরা সবাই এমন ভাব করতেছ যেন কিছু বোঝ না। ওরা দশ বারোজন আসবে আত্মীয় স্বজন, সবাই তো আর এক মতের না। অযথা রুমির তালাক নিয়ে কথা হবে, প্রশ্ন হবে, এসবের কী দরকার? শুনো তুমি বড়ো ভাই কোন চাকরি করো না এখনো, তোমাদের বাবা অবসরে গিয়েছেন, এই ফ্ল্যাট ছাড়া বলার মতো কোন সম্পদ নাই, রশ্মিও কোন আহামরি রূপসী বা গুণী না। এরপরও ছেলেপক্ষ নিজ থেকে কাবিন করতে চাইছে, সেটাই তো বড়ো। তোমার মামা আগানোয় এইটা সম্ভব হয়েছে, না হলে এত সহজ না সবকিছু। “
রশ্মি চুপ করে থাকো। ওর বিয়ের কথা হচ্ছে, সেখানে নিজে আগ বাড়িয়ে কিছু বলাটা অশোভনীয়। আর মামীর কথা শুনে আদিল চুপ হয়ে যায়। বলবে না বলবে না করেও রুমি চুপ থাকতে পারে না, তাছাড়া নিজের বোনের কাবিনে থাকতে পারবে না, এ কেমন শর্ত! “মামা আমার বোনের কাবিনে আমি থাকব না? ডিভোর্সি বলে? এই শর্ত আবার আপনারা স্বাভাবিক বলছেন?”
“রুমি মূল অনুষ্ঠানে থাকবি। তখন তো বিয়ে হয়েই যাবে, কে কী বললো না বললো তা নিয়ে সমস্যা হবে না। এই শুক্রবার তুই আমাদের বাসায় চলে যা তিতলিকে নিয়ে।”
রুমি আব্বা আম্মার দিকে তাকায়, রুমি আর তিতলির জন্য কী ওনারাও কিছু বলবেন না! কিন্তু অবসরে যাওয়ার পর সানোয়ার সাহেব মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছেন। আর হামিদা বেগম শুধু শান্তিতে রশ্মির বিয়ে দিতে চান। রুমি নিজেই আবার বলে, “মামা, এত তাড়াহুড়োয় বিয়ে কী ঠিক? আর শুধু ওনাদের শর্ত মতো সব পছন্দ হলেই কাবিন হবে। না হলে ওনারা চলেও যেতে পারেন, এমন একটা পরিস্থিতিতে আগানোর কারণই বা কী? আমাদেরও পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার আছে। আব্বা ঠিকই বলেছেন মামা।”
“আমি তাহলে ভুল বলছি?”
বড়ো মামা রেগে যাচ্ছেন বুঝতে পারছে রুমি, “না মামা। বললাম তাড়াহুড়ো না করাই ভালো।”
“তাড়াহুড়োর কী দেখলি? সব খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে।”
“মামা ছেলে চাকরি করে, ভাইবোন শিক্ষিত এতটুকুই দেখা হয়েছে।”
“আর কী দেখা লাগে?”
“লাগে মামা, ছেলে মেয়ে উভয়ের ব্যাপারেই আরও অনেক কিছু দেখা লাগে। সংসার শুধু চাকরি দিয়ে হয় না।”
“তোর মতো নারীবাদী হলে সংসার এমনিও হয় না।” পাশ থেকে উত্তর দেন মামী।
“নারীবাদী শব্দটা কী গালি মামী? শুনেন আমার বিয়েটাও এভাবেই হয়েছিল, ডাক্তার ছেলে, শিক্ষিত পরিবার, ব্যস ওনারা মেয়ে পছন্দ করেছে, বলো আলহামদুলিল্লাহ। আর বিয়ে হয়ে গেল। ছেলেটার চরিত্র কেমন, মানুষ কেমন সেসব খোঁজ নেওয়ার কথা কেউ ভাবেনি। অথচ সংসার ভাঙার কথা উঠলেই আমি নারীবাদী, তাই সংসার হয়নি!”
“রুমি, হিমেলের যে চারিত্রিক সমস্যা আছে তা আমরা বিয়ের আগে কিভাবে জানব? এটা তোর কপালে লেখা ছিল।”
“এটা মোটেও কপালে লেখা ছিল না। আপনারা কেউ কী হিমেলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলেন যে ওর আচার আচরণ কেমন? হসপিটালে বা কলেজে ছেলে হিসেবে সবাই ওকে কোন চোখে দেখে?”
বড়ো ভাই ভাবির সাথে মুখেমুখে তর্ক করায় হামিদা বেগম বিরক্ত হন। রুমিকে থামতে ইশারা করেন। সানোয়ার সাহেবও রুমিকে থামতে বলেন। কিন্তু রুমির মামী নিজেই উত্তর দেন, “না তোমার মামা সেসব খোঁজ নেয় নাই। এটা দোষ হয়েছে স্বীকার যাচ্ছি। কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রী হিসেবে বাকি খেয়াল তো তোমার রাখার কথা। অথচ স্বামী একজনের পেট বাঁধিয়ে ফেললো আর তুমি টেরও পাওনি। ঐ মেয়ে মরতে না ধরলে কেউ জানতেও পারত না। তখন সুন্দর সংসার করতে হিমেলের সাথে।”
“ঘুরেফিরে দোষ আপনারা আমার কাঁধেই দিবেন। কারো চরিত্র খারাপ হলে তাকে পাহারা দিয়ে রাখব? আর মামী হিমেলের কথা জানাজানি হওয়ার পর যখন আমি তালাক নিতে চাই, তখন কিন্তু আপনি আমাকে খুব সাপোর্ট দিয়েছেন। আমি ভাবছিলাম পরিবারের একজন আমাকে বোঝে। কিন্তু পরে দেখলাম যে না কোন সাপোর্ট না, মজা নেওয়ার জন্যই এমন করেছেন। একদিকে আমাকে বলতেন সংসার করো না এই লম্পটের সাথে, আরেকদিকে আম্মার কান ভারী করতেন আমার নামে। আমি বোকা, বুঝতে অনেক দেরি করেছি। তালাক নেওয়ার পর যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি নেগেটিভ কথা বলেছে সে আপনি মামী।”
“শুনলে হামিদা শুনলে। কত বড়ো বেয়াদব এই মেয়ে। এই তুমি আরও আসবা গায়ে পড়ে ভাগ্নিদের বিয়ে দিতে। এই জন্য না স্বামী আছে না সংসার আছে এই মেয়ের। আমি এখনি চলে যাব, আর কোনদিন যদি এই বাড়িতে এসেছি।”
“আপনি যাবেন কেন। আমি যাব আমার মেয়ে নিয়ে। এই বাসার সবার ঘাড়ে আপদ আমি আর আমার মেয়ে। তাই তো নিজের মাও আমার পাশে দাঁড়ায় না।”
হামিদা বেগম উঠে রুমিকে একটা চড় দিলেন।
বসার ঘর উত্তপ্ত হয়ে যায় অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে। চড় খেলেও চুপ হয় না রুমি, আজ কেন জানি চিল্লাতে চিল্লাতে নিজের অভিযোগগুলো বলে যায় একে একে। মেয়ের মুখে একের পর এক অভিযোগ শুনে হামিদা বেগম আর সানোয়ার সাহেবও অবাক হয়ে যান।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১১
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই, সানোয়ার সাহেব এত রাত পর্যন্ত কখনো জেগে থাকেন না। তিনি চাকরিজীবনের শুরু থেকে সময় মেনে চলা মানুষ। সকাল আটটায় অফিস গিয়ে সন্ধ্যা ছয়টায় বাসায় ফিরতেন, তারপর চা নাস্তা খেয়ে পেপার নিয়ে বসতেন। একঘন্টা পেপার আর এক ঘন্টা খবর দেখার পর রাতের খাবার খেয়ে নিতেন দশটার ভেতর। এগারোটা না বাজতে ঘুম। বেশিরভাগ দিন তিনি একাই খেতেন, হামিদা বেগমের খাওয়ার সময় এলোমেলো, বাসার কাজ শেষে খেতে খেতে বিকেল পাঁচটা, রাতেরটা বারোটা। ছেলেমেয়েরা বড়ো হওয়ার পর তিনি নিজে কখনো শখ করে ডাকেননি, হামিদাও ভাতে তরকারি বাটিতে দিয়ে ছেলেমেয়েদের পাশে বসতেন, না হয় টেলিভিশন দেখতেন। অজান্তেই নিজের বাসাতে নিজের এক আলাদা জগতে যেন বাস করতেন সানোয়ার সাহেব।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বাসার বাজার, সামাজিক অনুষ্ঠান সবকিছু স্ত্রী হামিদাই দেখতেন। সানোয়ার সাহেবের ছোটোবেলায় বাবা মারা যান, আর বিয়ের একবছর পর মা। তিন ভাইয়ের ভেতর তিনিই ছোটো। ওনার মতো বাকি দুই ভাইও অবসর জীবন কাটাচ্ছেন, তারাও নিজেদের সংসার নাতি নাতনি নিয়ে আলাদা জীবনে ব্যস্ত আছেন। এখন ভাইয়ে ভাইয়ে কথা হয় কোন উপলক্ষে সামনে এলে। তিনি নিজেও অবশ্য কখনো সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখার চেষ্টা করেননি। স্ত্রী হামিদাকে তাই বলতে গেলে শ্বশুরবাড়ির ঝুট-ঝামেলায় কখনো পড়তেই হয়নি। সময়ে সময়ে শাশুড়ি, শ্বশুরবাড়ি নিয়ে হামিদার কাছে মেয়ে রুমির করা অভিযোগগুলো বাড়াবাড়ি মনে হওয়া অস্বাভাবিক না। কখনোই তাই রুমি হামিদার কাছে সহমর্মিতা পায়নি। হয়তো তিনি নিজে তা অনুভব না করায় রুমির সমস্যাগুলো বুঝতে পারতেন না। একসময় রুমি কথা শেয়ার করাই বাদ দিয়ে দিয়েছিল। তবে সেই অভিমান যে আজও মনে পুষে রেখেছে রুমি, আজ সন্ধ্যায় তা বুঝতে পেরেছেন সানোয়ার সাহেব আর হামিদা বেগম দু’জনই।
মনে মনে রুমির অভিযোগগুলো আওড়ান সানোয়ার সাহেব। শুধু হামিদাকে না মেয়েটা তো ওনাকেও অভিযুক্ত করেছেন। সত্যিই তো বলেছে রুমি, বাবা হিসেবে সংসারে শুধু আয়ের দিকটা তিনি দেখেছেন, আর সবকিছু থেকে দূরে থেকেছেন। বাবা হিসেবে সন্তানদের কাছাকাছি যাওয়ার কোন ভূমিকা তিনি নিতে চাননি, একটা উদাসীনতা সবসময় ছিল। কেমন নির্লিপ্ত ভাব বজায় রেখেছেন। তার উপর একটা সময় অফিসের রিসেপশনিস্ট রিতার সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক আছে ভেবে নিয়ে হামিদা ভীষণ শাপ দেওয়া শুরু করেছিলেন। লুকিয়ে অফিসে যাওয়া, পিওনকে টাকা দিয়ে পিছনে লাগানো সহ রিতাকে ফোনে হুমকি ধামকি দেওয়া, কোন কিছুই বাকি রাখেননি। তবে হামিদা এই জিনিস কোনদিন ছেলেমেয়ের সামনে তোলেনি এই জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। সংসারের শান্তির জন্য সেই চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে ঢুলেন তিনি, কিন্তু হামিদার সন্দেহ মুক্ত হতে পারেননি। এর তিক্ত প্রভাবে ওনার আর হামিদার সম্পর্ক শীতল হয়ে গিয়েছে বহু আগে। হামিদা অবশ্য কখনোই রুমির মতো ঘর ছেড়ে চলে যায়নি, বরং মনে সন্দেহ আর বিদ্বেষ পুষে রেখে সংসার করে গিয়েছেন। তবে ওনাদের সম্পর্কের মাঝে একটা বিশাল শূণ্যতা আছে। এই সংসারে তাই রুমির মামা খালার প্রভাব যতটুকু আছে, গৃহকর্তা হয়েও তার সিকিভাগও ওনার নিজের নেই। অবসরে যাওয়ার পর তো আরও সরে গিয়েছেন গৃহকর্ম থেকে। এখন দিনের বেশিরভাগ সময় তাবলীগের সহযাত্রীদের সাথে কাটান, পেপার পড়েন, খবর দেখেন। রুমির মেয়েটা ঘরময় দুষ্টুমি করে, হামিদা পেছন পেছন দৌড়ে হয়রান হয়, তিনি কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে আদর করেন, এইটুকুই। একটু কিছুক্ষণ বাচ্চাটাকে সময় দিলে হামিদার একার উপরে সংসার আর নাতনির চাপ আসত না, মেয়েটাকেও তাহলে সেই রাগটা দেখাতেন না হামিদা। রোজ রুমি বাসায় ফিরলে যে হামিদা চাপা জিদ দেখায় তা তিনি দেখেও না দেখার ভান করেন। রুমি কী সত্যি বলেছে! মেয়ে ডিভোর্স নেওয়ায় তিনিও কী বিরক্ত নন! হামিদার মতো তিনিও চেয়েছেন রুমি সংসার করুক, যেখানে হিমেল মাফ চেয়ে সংসার করতে আগ্রহী ছিল। স্বামী ভুল করলে, স্ত্রী মাফ করে সংসার করবে, এই তো হয়, এই তো সমাজের নিয়ম!
“আম্মা থাপ্পড় মারলে কেন? অন্যায় কী বলেছি? মামী আমার নামে উল্টোপাল্টা কথা বলে না বলো? যখনই তুমি একটু স্বাভাবিক হও, তখনই মামী একটা না একটা প্যাঁচ লাগায়। শুরুতে মনে হতো কত সহমর্মি মামী, পরে আস্তে আস্তে বুঝেছি, এটা শুধু একটা মজা মামীর কাছে। এই যে আমাদের ঘরে ঝগড়া হয়, অশান্তি হয়, আমরা পারিবারিক সালিস ডাকি, তাতে মামা মামী প্রধান হয়, এটাই তাদের মজা।”
রুমির বড়োমামাও শান্ত ভাগ্নীর এমন রূপ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, “রুমি আমার সামনে তুই তোর মামীকে নিয়ে এসব বলছিস, ছিঃ। আর দশটা মানুষ থেকে কত আলাদা জুলেখা, কয়জন মহিলা ননদের পরিবারের খেয়াল রাখে? তোমাদের খোঁজ খবর রাখে বলে আজ ও খারাপ হয়ে গেল?”
“খোঁজ খবর রাখা একটা মামা। আর পিছনে লাগা আরেকটা। আমরা কে কী করলাম কী করবো, সেই বিষয়ে সারাক্ষণ আপনাদের রায় নিয়ে চলতে হয়। কেন? আমার আব্বা আম্মা কী নিতু আর মাসুম ভাইয়ের জীবন নিয়ে কোন মন্তব্য করে?”
” না করে না। কারণ ওদের জন্য আমরা যথেষ্ট। ওদের সাথে তোমাদের তুলনা হয়?”
“কোন দিকে হয় না? কী হাতি ঘোড়া? নিতুর বিয়ের সবে একবছর মামা, এখনি এত নিশ্চিত হলেন কিভাবে যে সারাজীবন সংসার টিকবে? আর মাসুম ভাইও আদিলের মতোই বেকার, আপনার দোকান দেখা আলাদা কোন পেশা তো না।”
সেই সময় সানোয়ার সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, “রুমি বেয়াদব মেয়ে, আর একটা কথা বললে থাবড়ে দাঁত ফেলে দেব, শয়তান মেয়ে।”
“বাহ্ আব্বা তুমি কথাও বলতে পার! আমি তো মাঝেমাঝে ভুলেই যাই যে তুমিও আছ। কেন আব্বা, কেন মারবে? আমার অপরাধ কী? তুমিও আলাদা কেউ না। আজ আমি যদি হিমেলের হাতে খুনও হতাম তাও বোধহয় তুমি এত কষ্ট পেতে না, যতটা চলে আসায় পেয়েছ। আমি কী তোমাদের বোঝা? একজন বাইরের মানুষ এসে বলছে আমি আমার বোনের বিয়েতে থাকতে পারব না, অথচ তুমি আর আম্মা চুপচাপ শুনছ। আমাকে আর আমার মেয়েকে ছোটো করতেও বাঁধছে না। আমি কেন লুকাবো? আমি কী পাপ করেছি? শুধু তুমি আর আম্মা না, তোমরা সবাই আমাকে রাতদিন কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ। এগারোটা মাস ধরে আমি সহ্য করছি। কঠিন সময়ে তোমাদের পাশে না পেয়ে শুধু সমালোচনা পাচ্ছি। আমি উঠলে দোষ, বসলে দোষ, সাজলে দোষ, ফেসবুকে ছবি দিলে দোষ। আমার ভাই-বোনগুলো পর্যন্ত আমাকে তাচ্ছিল্য করে তোমাদের দেখে দেখে। টিভি চালিয়ে বসি, রশ্মি হঠাৎ এসে হাত থেকে রিমোট নিয়ে যায়, অথচ আমরা দু’জনই এই বাসার মেয়ে। আদিল উঠতে বসতে এটা ওটা করার হুকুম দেয়। আর আম্মা তো রাতদিন কী এক আজব জিদ দেখায়। এই যে মামী সারাক্ষণ আমার পেছনে পড়ে থাকেন, ছবি দিলেই, আম্মাকে ফোনে বলেন আমি এত ছবি দেই কেন, মানুষ খারাপ বলে। আমি কী ছবি দেই যে মানুষ খারাপ বলে? অথচ মামীর কথায় আম্মা আমাকে উল্টোপাল্টা বলেন। বাসায় আসলেই মামী আম্মাকে বলেন যে, আম্মা আমার বাচ্চা কষ্ট করে কেন দেখে, এখন এই বয়সে রেস্ট দরকার। আমি কী আম্মাকে দিয়ে বাড়তি কোন কাজ করাই? বাধ্য হয়ে অফিসের সময়টুকু রেখে যাই। অফিসে যাওয়ার পর, অফিস থেকে এসে আমি ননস্টপ কাজ করি, তারপরও তোমাদের কেন এত বিরক্তি। একটু টিভি ছাড়লে হইচই করো, বাসায় আসতে দশ মিনিট দেরি হলে হইচই করো। আমি তো তোমাদেরই মেয়ে, কেন তোমাদের কাছে এত অসহ্যকর হয়ে গিয়েছি?”
রুমির কিছু অভিযোগ হয়তো হাস্যকর ছিল, রাগের বশে অনেককিছুই বলেছে। কিন্তু কিছু কথা চরম সত্য ছিল, তা ঠিকই বুঝতে পারছেন সানোয়ার সাহেব। একাকী বসে বসে ভাবেন, নিজের অবহেলায় আর ভুলে সংসারটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। স্ত্রীর সাথে অভিমান পুষে রেখে দূরে থেকেছেন, একসময় সন্তান, সংসার সব অবহেলা করেছেন, দিনশেষে আজ নিজেকে বড়ো নিঃসঙ্গ আর ব্যর্থ মনে হচ্ছে। হামিদা বেগম বুঝবে না জানেন সানোয়ার সাহেব। নিজের ভাইবোনকে হামিদা বেগম অন্ধ বিশ্বাস করেন। সংসারের এই সম্পর্কের ছিঁড়ে যাওয়া সুতো কী আর জোড়া লাগানোর সময় নেই! মনে মনে তাই ভাবেন সানোয়ার সাহেব।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১২
“মরিয়ম আপা, আমি তিতলিকে নিয়ে কাল সকালেই সিফট করতে চাইছি। কর্মজীবী হোস্টেলে কী বাচ্চাসহ রুম দেয়? বা তোমার বাসায় আমরা মা মেয়ে সাবলেট থাকতে পারব? ভাড়া দেব আপু।”
“রুমি কী হলো হঠাৎ? এসব কি কথা?”
“আপা দেখা হলে তখন খুলে বলব, আপাততঃ এতটুকু বলি আগামীকালই মেয়েকে নিয়ে নিরাপদ কোন জায়গায় উঠতে চাই। আপা আমার কোন বান্ধবীর সাথে এখন তেমন সখ্যতা নেই যে সরাসরি তাদের কারও বাসায় ওঠা যাবে। তাছাড়া সবাই এখন বিবাহিত, তাদের শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা হয়তো সহজ ভাবে নেবে না। আপা অন্তত কয়েকদিন কী আপনার বাসায় থাকতে পারব ? তিতলি রুমনকে কোন বিরক্ত করবে না। এরমাঝে বাসা খুঁজে পেলে চলে যাব।”
মরিয়ম সহসা কী জবাব দেবে বোঝে না। শ্বশুরবাড়ি না হোক, শাশুড়ি তো তারও আছে। তিনি কী এটা সহজ ভাবে নেবেন!
“রুমি আমি একটু পর ফোন দিচ্ছি। তুমি কান্না থামাও প্লিজ। ধৈর্য ধরো, আমি জানাচ্ছি।”
রুমি তখন রাগ করে বলে তো দিয়েছে যে মেয়ে নিয়ে আর এক মুহূর্ত থাকবে না। কিন্তু সহসা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে অনুভব করে এই বিশাল শহরে তার হুট করে চলে যাওয়ার কোন নিরাপদ জায়গা নেই। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে অভিমান করে বাবার বাড়ি আসে, কিন্তু বাড়ির বাড়ি থেকে অভিমান করে যাওয়ার জায়গা এত সহজ নয়। মামা চাচা খালা ফুপু সবাই তো বাবার বাড়িরই অংশ, অভিমান করে সেই তাদের কাছেই আশ্রয় চাইতে যাওয়া রুমির পক্ষে এখন সম্ভব না। মামা মামীর সাথে কথাকাটাকাটিতে শুরু হওয়া মনোমালিন্য এতদূর চলে গিয়েছে যে এখন এখান থেকে বের হয়ে খালার বাসায় গেলে সেটা হাস্যকর হবে! আর চাচাদের কারও সাথে অতটা ঘনিষ্ঠতা এখন নেই, তাছাড়া পারিবারিক মহলে সবমিলিয়ে কেমন বিব্রতকর পরিস্থিতি হবে।
স্বামীর সাথে যখন সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, তখন প্রাক্তন স্বামীর আত্মীয় স্বজনদের সাথেও আর কোন সম্পর্ক রাখাটা কেমন জানি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রুমির স্বামী হিমেলের ছোটোখালার বয়স কম, রুমিকে খুব আদর করতেন, বান্ধবীর মতো সম্পর্ক ছিল। হিমেলের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তিনি দুইরাত রুমির সাথে ঘুমিয়েছিলেন। রাতে উঠে যখন রুমি কান্না করতো, খালা শক্ত করে রুমিকে জড়িয়ে ধরতেন। সেই সময়,সেই আলিঙ্গন ভঙ্গুর রুমির যে কতোবড় একটা শক্তি হয়ে পাশে ছিল। ছেলের ঘটনায় বিব্রত হলেও রুমির শাশুড়ি একমাত্র ছেলের বিরুদ্ধে গিয়ে রুমির পাশে দাঁড়াননি। বরং বারবার রুমিকে সব চেপে যেতে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু হিমেলের সাথে ডিভোর্সের পর আর চাইলেও আগের মতো ছোটোখালার শরণাপন্ন হতে পারে না রুমি, এখন যে তিনি প্রাক্তন স্বামীর খালা। তার সাথে সম্পর্ক রাখাটা সমাজের চোখে অশোভনীয়! তাই কোথায় যাবে ভাবতে ভাবতে মরিয়ম আপার কথাই মাথায় আসে রুমির।
****
রুমিকে ফোন দেবে তো বলেছে মরিয়ম আপা কিন্তু ভেবে পায় না শাশুড়ি বা স্বামী শিহাবকে কী বলবে। অবশ্য শাশুড়ি মা খুব খুশি এখন। আজ সন্ধ্যায় মরিয়ম শাশুড়িকে জানিয়েছে যে তিনি আবার মা হতে চলেছেন। দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হওয়ার সংবাদে শাশুড়ি ভীষণ আনন্দিত।
সাঁইত্রিশ বছর বয়সে দ্বিতীয় বার গর্ভধারণ করেছে মরিয়ম, দীর্ঘ বিরতিতে বেশি বয়সে সন্তান নিলে বেশ ঝুঁকি থাকে সন্তান জন্মদানে। আর তাই বাসার সবাই মরিয়মকে একদম বেড রেস্টে থাকতে চাপ দিচ্ছে। দরকার হলে শুরুর তিন মাস অফিস থেকে ছুটি নিতে বলছেন পরিবারের সবাই। শাশুড়ি মা জোর করে রাতের রান্নাও করেছেন। মরিয়মকে খাইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি শুতে পাঠিয়েছেন। মরিয়ম যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারে তাই শিহাব রুমনকে নিয়ে পাশের ঘরে ঘুমিয়েছে। শিহাবও যে নতুন সদস্যের আগমনের সংবাদে ভীষণ খুশি তা বুঝতে পারে মরিয়ম। যদিও একটু অভিমান ছিল, কেন সবার আগে শিহাবকে বলেনি মরিয়ম। রুমনকে নিয়ে মরিয়ম তার মনের ভয়টুকু প্রকাশ করলে অবশ্য অভিমান ভুলে সাহস দিয়েছেন শিহাব। সবার এত যত্ন দেখে কিছুক্ষণের জন্য মরিয়মের মনের দুঃশ্চিন্তার কালো মেঘ সরে গিয়ে খুশি এসেছে। বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমও চলে এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ রুমির ফোন এসে চিন্তায় ফেলে দিল। এখন বাজে প্রায় রাত একটা, এসময় শিহাব বা শাশুড়িকে জাগানো কী ঠিক হবে! আবার রুমিও ওর ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকবে।
কী বলবে মরিময়!
“কার সাথে কথা বললা মরিয়ম?”
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেন শিহাব সাহেবের আম্মা।
“আম্মা, এতরাতে জেগে আছেন?”
“তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম। গভীর রাতে আল্লাহরে ডাকলে আল্লাহ বান্দার উপর খুশি হোন। এতবড় খুশির খবর দিলেন আল্লাহ, শুকরিয়া জানাব না?”
নাতি নাতনির আগমনের খবরে কতটা খুশি হয়েছেন বোঝে মরিয়ম। মাথা নেড়ে শাশুড়ির কথা সায় দেয়।
“বললে না তো কে ফোন দিল? কোন সমস্যা?”
ধীরে ধীরে যতটুকু জানে তা খুলে বলে মরিয়ম। শিহাব সাহেবের আম্মা মরিয়মের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেন। তারপর ধীর কণ্ঠে বলেন,
“না করে দাও বৌ। আমার ছেলে ভালো, তুমি ভালো, ঐ মেয়েও নিশ্চয়ই খুব ভালো। কিন্তু শয়তান খুব খারাপ। সারাক্ষণ কুমন্ত্রণা দেয়। কমবয়সী একটা মেয়ে ঘরে আশ্রয় দেওয়ার চিন্তা যদি তোমার ভালোমানুষি হয়, তবে শয়তান তাকে সতীন বানাতে সময় নিবে না। দিনে দিনে দুনিয়া কম দেখি নাই। এমনিও শিহাবরে সময় দিতে পার না রুমনের জন্য, তারউপর এখন বাচ্চা হবে তোমার। এরপরও একটা কমবয়সী মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ার কথা মাথায় আসে কিভাবে? আমারে খারাপ ভাবলে খারাপ, কিন্তু পরিবারের ভালোমন্দ দেখা আমার কাজ।”
***
টুং করে মেসেজের শব্দ আসে রুমির ফোনে।
“স্যরি রুমি।”
দুই শব্দে অপারগতা জানায় মরিয়ম।
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১৩
“সাহেদা, কাঁদছ কেন?”
“রুমির এত বড় বেয়াদবিটা চোখের সামনে দেখেও এই প্রশ্ন করলে? অবশ্য করবে না কেন, বেয়াদবি করেছে তো আমার ভাইয়ের সাথে, তোমার ভাইয়ের সাথে তো না।”
“আমার তোমার তো কথা না সাহেদা। আর আমার ভাই রুমির কী হয় বলো? চাচা হয় তাই না? তোমার ভাই রুমির মামা হয়। তাহলে দু’জনই গুরুজন, আপনজন। অর্থাৎ চাচা হোক বা মামা কারও সাথেই রুমির বেয়াদবি করা উচিত নয়। তাই ভাগাভাগি করার প্রশ্নই আসে না।”
“এত বুঝলে মেয়েকে শাসন করলে না যে?”
“কারণ মেয়ে শুধু মামা মামীর সাথে তর্ক করেছে তা তো নয়। এর সাথে আরও অনেক ঘটনা আছে।”
“তা তো আছেই। আমাদের নামেও দুনিয়ার অভিযোগ করেছে। অথচ কী না করলাম এই মেয়ের জন্য। ভালো জায়গায় পড়ালেখা করালাম, ধুমধাম করে বিয়ে দিলাম, সেই বিয়ে না টেকার দায় এখন আমাদের দেয়, ওর মামা মামীকে দেয়। তেজ দেখিয়ে ঘর ছেড়েছে রুমি নিজে। আসার পর রুমি আর তিতলির দেখাশোনাও তো আমরা করছি। তারপরও এত অভিযোগ কিসের? “
“আমিও শুরুতে তোমার মতোই ক্ষিপ্ত ছিলাম। এটাই ভাবছিলাম যে কোথায় কম রাখলাম।”
“আমরা কোন কম রাখি নাই। মেয়েই বেয়াদব। এই তেজের জন্য সংসার হয় নাই। ভাবি তো মিথ্যা বলে নাই। এই যে বললো বাড়ি ছেড়ে যাবে। দেখি এখন বাপের বাড়ি ছেড়ে কই যায়। আমি আটকাবো না। দেখুক কে জায়গা দেয় ওকে মেয়ে নিয়ে। দুনিয়া এত সহজ ভাবে, মানুষের কথায় বাপ মা কে শত্রু মনে হয় এখন। সেই মানুষেরা কেউ ওকে জায়গা দেয় কিনা আজ ও দেখবে।”
“কেউ পাশে থাকবে না সাহেদা। কেউ থাকেও না। কিন্তু সেটা বোঝার জন্য মেয়েকে যেতে দিলে আমরা কেমন বাবা মা হলাম? ও যে জায়গায় জায়গায় ফোন দিচ্ছে বারান্দায় বসে আমি ঠিক শুনতে পাচ্ছিলাম। যাওয়ার জায়গা পেলে এতক্ষণে বের হয়ে যেত, আমিও আটকাতাম না হয়তো রাগ থেকে। তবে ভালো হয়েছে ও জায়গা পায়নি। আমারও রাগটা শান্ত হয়ে মাথা পরিষ্কার হয়েছে। এখন পরিষ্কার করে ভাবতে পারছি। শুনো আমরা মেয়েকে পড়ালেখা করালাম, বিয়ে দিলাম সব ঠিক আছে। তারপরও মেয়ের মনে এত কষ্ট কেন আমাদের নিয়ে জানো?”
সাহেদা বেগম চোখ মুছে উঠে বসেন। বহুদিন পর সানোয়ার সাহেব এত কথা বলছেন, একটু অবাকও হয়েছেন সাহেদা বেগম। তাই শোনার ইচ্ছে আছে স্বামী কী বলে, “কেন কষ্ট সেটা আমি জানি না তা কিন্তু না, আমিও জানি রুমির আব্বা। ঐ যে রুমি বললো, আমরা ওর সাথে বিরক্ত দেখাই, আমাদের দেখাদেখি রশ্মি আর আদিলও ওকে সম্মান দেয় না। ওর আত্মীয় স্বজনরা আমাদের জন্য কথা শোনানোর সুযোগ পায়। সব ঠিক আছে। কিন্তু রুমি কী আমাদের দিক টা ভাবে? যদিও রুমি পরিবারের বড় মেয়ে, কিন্তু পরিবারের আগে নিজের জিদটাকেই রাখে।”
“সাহেদা, রুমির জেদটা তো অহেতুক না। ও কী করলে আত্মীয় স্বজনের কাছে আমরা বড় থাকতাম? মাটি কামড়ে সংসার করলে? তুমি সারাজীবন আমাকে সন্দেহ করে সংসার করে সুখে আছ? না আমি সুখে আছি? আর হিমেলের ঘটনা হাতেনাতে প্রমাণ হওয়া, সেখানে আজকের দিনের একটা মেয়ে কিভাবে মেনে নেয়?”
“আমাদের দিন চলে গিয়েছে। সন্দেহ ছিল না সত্য ছিল, আল্লাহ আর তুমি জানো। তবে আমি কিন্তু তিন বাচ্চা বুকে নিয়ে সংসার করে গিয়েছি। নিজে সুখ পেয়েছি কিনা জানি না। বাচ্চাদের তো বঞ্চিত করিনাই।”
“হিমেল তো কয়টা টাকা পাঠিয়ে খালাস।মেয়ের জন্য কোন ভালোবাসা তো দেখি না। দেখলে বুঝতাম রুমি মেয়েকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করছে। শুনো আমরা রুমির সাথে এমন ভাব করতেছি গত কয়েক মাস ধরে যেন ওকে আর তিতলিকে থাকতে দিয়ে দয়া করছি। এটা তো মিথ্যা বলে নাই রুমি। এই যে রোজ রোজ ও বাসায় আসলে তুমি জিদ দেখাও, আমি বিরক্ত মুখ করে থাকি, ও বাসায় ক্লান্ত হয়ে ফিরলে, আমরা তিতলির নামে বিচার দেই। কিন্তু এগুলো হতো যদি রুমি আর দশটা মেয়ের মতো বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসতো? মোটেও না। তখন আমি ওর পছন্দের বাজার আনতাম, তুমি নাতনির জন্য রান্না করতে, আদিল আর রশ্মি ভাগ্নিকে নিয়ে আহ্লাদ করতো। অথচ আমরা সবাই এখন কেমন ব্যবহার করি? আজ রুমি চিল্লাতে চিল্লাতে এগুলো বলেছে বলে বেয়াদব মনে হচ্ছে। কিন্তু কথা তো ভুল না।”
সাহেদা বেগম চুপ করে থাকেন। মনের ভেতর কোথাও না কোথাও তিনিও জানেন, রুমির দীর্ঘদিনের চাপা অভিমান আর কষ্ট আজ অভিযোগ হয়ে বের হয়েছে। তবে তিনি সহসাই জবাব খুঁজে পান, “আমি কী করবো? মাপা টাকা, আদিলটাও চাকরি পেল না, রশ্মির বিয়ে আটকে আছে, সংসারের কাজ। সবকিছু মিলে হাসিমুখে থাকতে তো পারি না। আর তুমি একটা মানুষ বাড়িতে আছ কী নাই তাই বুঝি না। নাতনিটাকে তুমি দেখ?”
সাহেদা বেগম ভেবেছিলেন সানোয়ার সাহেব ঝগড়া করবেন, কিন্তু তা না করে সানোয়ার সাহেব সায় দেন, “সাহেদা তোমার উপর সংসারের অনেক বোঝা, আমি এখন বুঝতে পারছি। আর এমন হবে না। দেখবা সব ঠিক হবে। রুমি তো ওর আর তিতলির খরচ দিচ্ছেই, আমাদের তো চাপ দেয় না। আর এটা রুমির নিজেরও বাসা, বিয়ে হয়েছিল বলে ওকে যেন আমরা পর করে দিলাম। কিন্তু এই শেষ, এমনটা আর করা যাবে না। রশ্মি আর আদিলের সাথে কথা বলতে হবে, ওরা যেন তিতলি আর রুমির সাথে কোন খারাপ ব্যবহার না করে। রুমিকে আমি বলবো, ও মামা মামীর কাছে মাফ চাইবে।”
সানোয়ার সাহেব নিজ থেকে পরিবারের ভালোমন্দের দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন দেখে সাহেদা বেগমের মনটা ভালো হয়ে যায়।
“সাহেদা আরেকটা কথা, রশ্মিকে যারা দেখতে আসবে তারা যদি রুমির ব্যাপারটা মেনে নেয়, তাহলেই যেন সামনে আগায়। এই কথাটা তুমি বড় ভাইকে বলে দিও। এখন অনেক রাত হয়েছে, সকালে আমি রুমির সাথে কথা বলবো।”
*****
রুমি সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি। রাত একটার দিকে মরিয়মের ম্যাসেজটা এসে যেন ওর আত্মবিশ্বাসটা একেবারেই শেষ করে দেয়। এলোমেলো নানা ভাবনা আসে মনে, একবার মনে হয় আত্মহত্যা করবে। কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে ধিক্কার দেয় এমন একটা কথা মনে আসার জন্য। তিতলির এত কিছু বোঝার বয়স হয়নি, তবে সব ঠিক নেই এইটা বুঝেছে। তাই অন্য দিনের মতো খাওয়া নিয়ে বিরক্ত না করে চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে। রুমি খায় নি। সানোয়ার সাহেব বারোটার দিকে দরজা নক করেছিলেন, কিন্তু রুমি জবাব না দেওয়ায় আর ডাকাডাকি করেননি। সকালে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবেন।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১৪
সকালে রুমি দরজা খুলে যখন বের হয়, তার চোখেমুখে রাত জাগার ছাপ স্পষ্ট। ফজরের নামাজ শেষে বেশ খানিকটা সময় কান্না করেছে, এখন মনটা বেশ হালকা লাগছে । আসলে গত কয়েকমাসের জমানো কান্নাগুলো ঝরার অপেক্ষায় ছিল রুমি, আজ জায়নামাজে বসে সেই চোখের পানিই মুক্তো হয়ে যেন ঝরেছে।
এখন ভোর ছয়টা বাজে সবে, রুমি ভেবেছিল কেউ উঠেনি, এই সুযোগে পাউরুটিতে জেলী লাগিয়ে খেয়ে নিবে। কাল রাতে খাওয়া হয়নি। লম্বা সময় খুদা সহ্য হয় না রুমির। রাতে না খেয়ে থাকায় এখন দুনিয়া খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাইরে বের হয়ে দেখে সানোয়ার সাহেব আর সাহেদা বেগম বসে আছেন। এত সকালে বাবা মাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয় রুমি। একটু লজ্জাও লাগে, গতকাল সন্ধ্যায় কতকিছু বলে ফেলেছে, এখন চাইলেও সেগুলো ফেরত আনা যাবে না। এই জন্যই বলে কথা তীরের মতো, একবার বের হলে আর ফেরানো সম্ভব নয়।
“রুমি, আয় চা খা আমাদের সাথে।”
“আব্বা, তোমরা খাও। আমার খিদা নাই। আর আমি ব্যাগ গুছিয়ে রাখছি, তিতলি উঠলে আমরা বের হয়ে যাব।”
সালেহা বেগমের মেজাজ খারাপ হয়, এতকিছুর পরও রুমের এত রাগ উনার ভালো লাগে না তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠেন, “রুমি যথেষ্ট হয়েছে, তোর বেয়াদবি আর নিতে পারছি না। এত দেমাগ ভালো না।”
“আম্মা, তুমি আমার কোন জিনিস টা নিতে পার? সমস্যা নেই আমার দেমাগ নিয়ে আমি চলে যাব, তোমার আর নিতে হবে না।”
“দেখছ, তোমার মেয়ের ব্যবহার দেখেছ? আর তুমি আমাকে বোঝাও ধৈর্য ধরতে। মেয়েকেও মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা বোঝাও। আর রুমি এত যে বড় বড় কথা বলিস, যাওয়ার জায়গা পেলে কাল রাতেই চলে যেতি, দিয়েছে কেউ জায়গা?”
সানোয়ার সাহেব, সাহেদা বেগমকে চোখের ইশারায় কথা বলতে না করেন। কিন্তু তারপরও সাহেদা বেগমের রাগ যায় না, তিনি আশায় ছিলেন রুমি সকালে উঠে বাবা মাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখলে লজ্জিত হবে, হয়তো ক্ষমা চাইবে। কিন্তু রুমি এখনও তেজ দেখাচ্ছে দেখে উনারও আবার রাগ চাঁড়া দিয়ে ওঠে।
সানোয়ার সাহেব মা মেয়ের মাঝে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন, “রুমি, আম্মার সাথে এভাবে কথা বলা কী ঠিক? এত কষ্ট করে তিতলিকে বড় করছো তুমি। কাল যদি তিতলি এভাবে কথা বলে, তখন কেমন লাগবে? আর বসো এখানে, চা না খেলে না খাবে। কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে কথা শোনো।”
এমনিতে সানেয়ার সাহেব ছেলেমেয়েকে তুই করেই বলেন, তবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তুমি বলাই শ্রেয় ভাবেন।বাবার কথায় আদেশের পাশাপাশি আরও কিছু একটা ছিল, রুমি তাই চেয়ার টেনে বসে।
“রুমি, দেখ তোমার সাথে অন্যায় আচরণ হচ্ছে বলে যে অভিযোগ তুমি করেছ তা যেমন সত্যি, তেমনি তোমারও নিজের মাঝে পরিবর্তন আনা দরকার মা। আম্মার সাথে মিলেমিশে থাক। একা একা আমার নাতনিকে নিয়ে কোথায় যাওয়ার দরকার নেই। তুমি কী তিতলির জন্য কোন নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করতে পেরেছ? বলো? যদি পারতে আমি মানা করতাম না। যেহেতু পারনি সেহেতু কোন জিদ দেখাবে না। এইটুকু বাচ্চার কোন বিপদ হলে মা হিসেবে তুমি দায়ী থাকবে। আম্মার সাথে তর্ক না করে বড় মামা মামীকে ফোন দিয়ে মাফ চাও। বড়দের কাছে ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না।”
“এই তোমার সমাধান আব্বা?”
“আমি রশ্মি আর আদিলের সাথে কথা বলবো। রুমি একসাথে থাকলে গেলে অনেক কিছু মন মতো হয় না। কিন্তু রাগ করে বের হয়ে যাওয়া সমাধান না, বিশেষ করে তখন, যখন যাওয়ার জায়গা সীমিত।”
****
মরিয়মের রাতে ভালো ঘুম হয়নি। রুমিকে ফোনে নিষেধ করে দিলেও সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে। রুমি কতটা আশা নিয়ে ওর কাছে কয়েকটা দিন থাকার অনুরোধ করেছে, আর ও এভাবে মানা করে দিল, এই অপরাধবোধ মরিয়মকে শান্তি দিচ্ছিল না। আজ কলেজে আগে আগেই চলে এসেছে মরিয়ম, যদিও শাশুড়ি মা এখন ছুটি নিতে বলেছেন, কিন্তু মরিয়ম যতদিন শরীর ভালো থাকে ছুটি নষ্ট করতে চায় না। মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রেগন্যান্সির সময় নষ্ট করে ফেললে পরে সমস্যা হবে, বাচ্চাকে সময় দিতে পারবে না। শিহাব রাতের ঘটনা কিছু জানতো না, সকালে স্বাভাবিক ভাবেই মরিয়মকে বিদায় দিয়েছে। শিহাবের দিলে তাকিয়ে মরিয়ম একবার ভাবে তার শাশুড়ি বোধহয় ঠিকই বলেছেন, শিহাবকে মরিয়ম সময় দিতে পারে না, কলেজের বাইরের সময়টা ছেলে রুমনের পেছনে চলে যায়, আর এখন তো ও প্রেগন্যান্ট। আসলেই যদি অল্পবয়সী রুমিকে আাসায় জায়গা দিলে কোন কেলেঙ্কারি হতো!!! এই শিহাবই তো ওর ভালোবাসার জায়গা, ভরসার জায়গা।
আবার মনে হয় বিয়ের এতগুলো বছরেও যদি এই বিশ্বাসটুকু না হয়, তাহলে এই প্রেম এই বিয়ের কী মানে থাকে!
*****
রুমি কলেজ আসবে কী আসবে না তা নিয়ে মরিয়ম একটু চিন্তায় ছিল, লিফট থেকে তাই রুমিকে বের হতে দেখে মরিয়মের স্বস্তি লাগে। যদিও রুমির রাতজাগা মলিন চেহারা বলে দেয় কতটা ক্লান্ত রুমি।
“রুমি, তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। সব ঠিক আছে?”
“আছে আপা।” সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় রুমি।
“কাল কী হয়েছিল রুমি?”
“জেনে কী করবেন আপা? বাদ দেন।”
“তুমি আমার উপর কষ্ট পেয়েছে জানি। রুমি তুমি তো জানো না আমিও একটা বড় চাপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।”
“আমার জানার প্রয়োজন নেই আপা। যার যার জীবন তার তার সমস্যা আসলে।।কেউ কারও টা সমাধান করতে পারে না।”
“রুমি তুমি এভাবে বলছো। এখানে তোমার আমার সম্পর্ক কলিগ কম, বোনের মতো বেশি।”
“আমি আপন বোন হলে কাল রাতে একটা ম্যাসেজ দিয়ে না করে দিতে পারতেন আপা?” আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমি ডিপার্ট্মেন্টের দিকে পা বাড়ায়।
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১৫
দেখতে দেখতে শুক্রবার চলে আসে, পাত্রপক্ষ রশ্মির সাথে দেখা করতে আসবে। রুমির বড় মামা ছেলের বাড়িতে জানিয়েছেন যে রুমি মেয়ে নিয়ে এ বাসাতেই থাকে, হুট করে ওকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়াটা সম্ভব না। যারা আসবেন তারা যেন জেনেশুনেই আসেন।
রুমি একটু দুশ্চিন্তায় ছিল, ওনারা না করে দিলে বাসার পরিবেশ আরও খারাপ হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওনারা আসতে সম্মতি জানালে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। রুমি ফোনে মাফ চাইলেও মামীর রাগ এখনো যায়নি, আজকের আয়োজনে তিনি অনুপস্থিত। অথচ এমন কখনো হয় না, যে এই বাসার কোন আয়োজন হয়েছে আর মামী নেই। মামাত ভাইবোনেরাও আসেনি। তবে মামা আর খালা খালু এসেছেন। খালাও ছেলেমেয়ে কাউকে সাথে নিয়ে আসেননি। সানোয়ার সাহেব দুই ভাই ভাইয়ের বৌকেও দাওয়াত দিয়েছেন।
সাহেদা বেগুম শুরুতে গাঁইগুঁই করছিলেন, কিছু ঠিক না হতেই এত বাইরের মানুষকে বলার কী দরকার বলে, কিন্তু সানোয়ার সাহেব ঠান্ডা মাথাতেই জবাব দেন, “সাহেদা রশ্মির মামা খালা সবাই আসবেন, আর চাচারা বাদ থাকবে কেন? ওনারাও নিজেদেরই মানুষ। ভাবিরা অবশ্য কথাবার্তা পাকা হলে মূল অনুষ্ঠানে আসবেন, এখন আর আসবেন না। এখন শুধু বড় ভাই আর মেজো ভাই আসবেন।”
রশ্মির হবু বরের নাম সাদিক, একটি প্রাইভেট ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার পোস্টে আছে। রুমির সমবয়সীই হবে, ত্রিশ চলছে। রুমির ছোটভাই আদিল আর রুমি পিঠাপিঠি বয়সী, আদিলের উনত্রিশ চলছে। আর রশ্মি সাহেদা বেগমের বেশি বয়সের পেটপোঁছা সন্তান, সবে তেইশ শেষ হয়ে চব্বিশে পড়লো। সাদিকের মা বাবার সাথে বিবাহিত দুইবোন, দুলাভাই আর ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছোটভাই এসেছে, অন্য কোন আত্মীয় স্বজন আর সাথে আনেননি তারা। রুমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিল পুরোটা সময়, তবে শেষ পর্যন্ত সব ভালো ভাবেই সম্পন্ন হয়। ওনাদের কথাবার্তায় সবকিছু ইতিবাচক মনে হয়েছে। আগেই কথা হয়েছিল যে হুট করে কাবিন হবে না, দুই পরিবার আগে একে অপরের সাথে পরিচিত হবে, ছেলে মেয়েও একে অপরকে দেখবে। সাদিকের সাথে কথা বলে রুমিরও ভালো লাগে। যথেষ্ট নম্র ভদ্রই মনে হয়েছে, যদিও এইটুকু সময়ের ভেতর কাউকে বোঝা কঠিন।
*****
কলেজে এখন রুমির ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। স্টুডেন্টদের প্রাকটিকাল ক্লাস নিতে হয়, আউটডোরে রোগী দেখতে হয়। আগে অবসরের পুরোটা সময় মরিয়ম আপার সাথে কাটাত, এখন কেন জানি আপার সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না। মরিয়মের প্রেগন্যান্সির কথা রুমি শুনেছে, একটু অপরাধবোধও হচ্ছে কেন আপার সাথে রাগ দেখালো,মরিয়ম আপার সমস্যা কোথায় ছিল সেটা না বোঝার কারণ নেই। অন্তত মানসিক সাপোর্ট দিতে আপা কখনো কার্পণ্য করেননি। নিজের রাগ দেখানোর কথা মনে হলে আরও বেশি বিব্রত লাগে এখন, তাই চাইলেও সহজ হতে পারে না আগের মতো। ক্লাস আর আউটডোরের বাইরে বাকি সময়টা তাই ডিপার্টমেন্টের ভেতরই কাটায়। কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টের লেকচারার হাসান জামিলকে জড়িয়ে নানা মুখরোচক গসিপ যে হয় তা রুমি ভালোই বোঝে। রৌশন আপা তো এমনিতেই ওকে পছন্দ করেন না, আর এখন তো হুটহাট সবার সামনে হেসেহেসে ইঙ্গিত করে কথা বলে ফেলেন, এই তো সেদিনও মিটিং শেষে সবাই যখন একসাথে চা খাচ্ছিল তখন বলে বসেন, “জামিল, নতুন সহকর্মীর সাথে কেমন সময় কাটছে? ভালোই সঙ্গ দিচ্ছ মনে হচ্ছে। রুমি তো তোমাদের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে আমাদের ভুলেই গেল, রুম থেকেই আর বের হয় না।”
আপার রসিকতায় সবাই হাসে, এইসময় উত্তর দিলে প্রত্যেকে রুমি বেয়াদবি করেছে বলবে। কেননা আপা সবার সামনে এমন ভাবে বলেন যেন মজা করছেন। হাসান জামিলও হেসে মাথা নাড়ে, “আপা তারমানে আপনারা রুমি আপার মূল্যায়ন করতে পারেননি, তাই আপার জন্য ভুলে যাওয়া সহজ হয়েছে।”
হাসান জামিলও হালকা কথায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখে। তবে রৌশন আপা এত সহজে দমার পাত্রী নন, রুমির সাথে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা তিনি এত তাড়াতাড়ি ভুলবেন না, রুমির উত্তরগুলো ওনার মনে ভালোই জ্বালা ধরিয়েছিল। আর তাই সুযোগ পেলেই রুমিকেও কথার আঘাত ফিরিয়ে দেন। রুমি জানে না ঠিক কতদিন ভদ্রতা করে চুপ থাকতে পারবে। ওর সমস্যা হচ্ছে সময় থাকতে কথা গুছিয়ে বলতে পারে না, ফলে মনের ভেতর কথার পাহাড় জমতে জমতে হঠাৎ তা বিস্ফোরণ করে।
****
“রুমি আপা, টার্মের আগেই সবগুলো কার্ড শেষ করতে বললেন স্যার।ক্লাস টেস্ট তো বোধহয় আর বাকি নেই।”
“না জামিল ভাই, আমার ক্লাস টেস্ট নেওয়া বাকি নেই। তবে কার্ড আছে দুটো। ডেট দিয়ে দেব স্টুডেন্টদের, টার্মের আগেই শেষ হবে।”
“আপা, আপনার সাথে রৌশন আপার কোন সমস্যা আছে? না মানে রৌশন আপাকে সবসময় আপনার সাথে কেমন করে যেন কথা বলতে দেখি।”
“জামিল ভাই, আপা কি আপনাকে কিছু বলেছে? সত্যি করে বলেন তো। আমি দেখলাম ঐদিন লিফটের বাইরে কথা বলছিলেন।”
জামিল ইতস্তত করে। বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছে না। রৌশন আপা জামিলকে রুমির চরিত্র নিয়ে সাবধান করে দিয়েছেন। আপার মতে রুমি জামিলকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করার তালে আছে। কিন্তু এই কথা তো রুমিকে বলা যাবে না। শুনলে রুমি যেমন ক্ষেপে যাবে, তেমনি রৌশন আপাও সব অস্বীকার যেতে পারেন। ভীষণ অপ্রস্তুত হতে হবে তখন।
“না আপা, তেমন কিছু না। আমার এমনি মনে হলো। আর সেদিন আমরা অন্য কথা বলছিলাম, আপনাকে নিয়ে কিছু না।”
“জামিল ভাই, আমি সত্যি জানি না আমাকে নিয়ে আপার কী সমস্যা। কোন কারণ ছাড়াই আমার পেছনে লেগে থাকেন। সত্যি বলতে আমার এসব একদম ভালো লাগে না। আমি আমার ব্যক্তিগত নানা সমস্যায় এত জর্জরিত আছি যে আপার সাথে যেতে ঝামেলা করার কোন ইচ্ছেই নেই।”
“আপা, আপনি অনেক স্ট্রং মানুষ। এসব ছোটখাটো জিনিসকে মন খারাপ করবেন না। ওনার স্বভাত তো জানেনই। তারপরও মাঝেমাঝে উত্তর দিবেন, আপা যেমন হেসেহেসে বলেন,আপনিও তেমনি হেসেহেসেই উত্তর দিবেন। হাসিতে তো ক্ষতি নেই।”
কথা শেষে মুচকি হাসি দেয় জামিল, এতদিন রুমি খেয়াল করে জামিলের হাসিটা বেশ সুন্দর। চেহারায় পুরুষ সুলভ কাঠিন্যের চেয়ে মায়াটাই বেশি। এমনিতে স্টুডেন্টগুলো স্যারের ভক্ত না। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় রুমি। কলিগের চেয়ে বেশি কিছুর দিকে চিন্তা করাও উচিত না। জামিল বা অন্য কেউ আভাস পেলে হয়তো রুমিকেই হাসির পাত্রী বানাবে। জামিলের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিয়ে খাতা দেখায় মন দেয় রুমি।
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১৬
খাতা দেখে বের হতে হতে রুমির দেরি হয়ে গেল। সামনে সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষা, এই পরীক্ষার উপর নির্ভর করবে কারা কারা প্রফে বসতে পারবে। কলেজের লাইব্রেরিতে তাই ভীর লেগে আছে, সবার মাথার উপর পরীক্ষার চাপ। কলেজ ছুটি হয়ে গেলেও স্টুডেন্টদের আনাগোনা কমেনি। যারা হলে থাকে, তারা লাইব্রেরি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত এখানে পড়ে, অন্য যারা বাইরে থাকে, তারাও যতক্ষণ সম্ভব গ্রুপ স্ট্যাডিতে সময় দেয়।
এই জমজমাট মহলে রুমি খেয়ালই করেনি কখন ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘর পেরিয়েছি। তড়িঘড়ি করে বের হয় রাস্তায়। মেইনরোড থেকে খানিকটা গলির ভেতরে কলেজ। মেইনরোড ভিআইপি রোড হওয়ায় রিকশা চলতে দেয় না। অন্য সময় গলির ভেতরে রিকশা পেলে ভেতর দিয়ে গলির ভেতর দিয়ে রাস্তার অন্য পাশে ওঠে, যেখানে রিকশা চলতে আর বাঁধা নেই। কিন্তু আজ গলিতে রিকশা নেই। গলির ভেতর দিকে হাঁটতে ইচ্ছে করছে না, রিকশা না পেলে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে, তারচেয়ে মেইনরোডে উঠে রাস্তার ঐ পাড়ে গিয়ে রিকশা নেওয়া ভালো মনে হলো। মাসের শেষে উবার ডাকা সম্ভব না।
দ্রুত পা চালায় রুমি, বাসায় ফিরতে দেরি হলে অযথা একটা চাপে পড়তে হয়। কলেজ ছুটি হওয়ার আধা ঘণ্টার ভেতর বাসায় না ঢুকলে জেরার মুখে পড়া লাগে। মায়ের মনে হয় অযথাই দেরি করে,না হয় আড্ডা দেয়। মাকে বুঝাতে পারে না এটা এখন চাকরি, এখানে কলিগ আছে, তাদের সাথে একটা পোষাকি সম্পর্ক আছে। কিন্তু রোজ রোজ আড্ডা দেওয়ার কেউ নেই। রুমির মাঝেমাঝে মনে হয় স্বাধীন হয়েও আসলে ও স্বাধীন কই!
আবার ঠান্ডা মাথায় ভাবলে এটাও বুঝতে পারে যে সে বাসায় ফিরলে তবেই আম্মা রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পান। বয়স হয়েছে, এখন সংসারের কাজ সামলে ছোট একটা বাচ্চাকে সারাক্ষণ রাখা ওনার জন্য সহজ না। তবে ভালো দিক হলো এখন রুমির আব্বা সানোয়ার সাহেবও নাতনির ভালোই দেখাশোনা করেন।
রাস্তায় আজ প্রাইভেট কার ছাড়া অন্য গাড়ি নেই বললেই চলে। পরিবহন ধর্মঘট চলছে, খালি রিকশাও নেই বললেই চলে, দুই একটা যা পায়, কেউ যেতে রাজি নয়, ভরদুপুরে সবার খাওয়ার তাড়া আছে। রুমি ইতি উতি তাকিয়ে রিকশার খোঁজ করতে করতে থাকে, হঠাৎ একটা বাইক পাশে এসে থামে। হেলমেট খুলে হাসান প্রশ্ন করে, “রুমি আপা, রিকশা পাচ্ছেন না?”
হাসানও বোধহয় আজ দেরিতেই বের হয়েছে, তবে রুমির সাথে দেখা হয়নি। হাসানের ক্লাস আজ লাস্ট পিরিয়ডে ছিল। হয়তো ক্লাস শেষে এখন বের হয়েছে।। রুমি ভেবেছিল কলেজের সবাই চলে গিয়েছে।
“না, হাসান ভাই। ভরদুপুরে রাস্তা ফাঁকা প্রায়। তবে পেয়ে যাব, একটু অপেক্ষা করি।”
“আজ রাস্তায় গাড়ি কম, রিকশার ডিমান্ড বেশি। রুমি আপা, সমস্যা না থাকলে বাইকে বসেন, আমি নামিয়ে দেই। আপনি বের হওয়ার সময় খেয়াল করেছি কলেজের গেটে রিকশা পাননি, তখন গেটেই বলতাম, পরে ভাবলাম কলেজের সামনে আপনি বিব্রত হতে পারেন।”
হাসানের এই বিচার বিবেচনাবোধটুকু রুমির ভালো লাগে। কথাবার্তা আর আচার আচরণে বেশ মার্জিত হাসান। তাছাড়া হাসান এতকিছু খেয়াল করেছে ভেবে ভালোই লাগে। রুমির ইচ্ছে করছে বাইকে উঠতে, একে তো হাঁটার শক্তি পাচ্ছে না, তারউপর সময়মতো বাসায় যাওয়ার তাড়া। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো সবকিছু করা যায় না।
“হাসান ভাই, ধন্যবাদ বলার জন্য। কিন্তু রিকশা পেয়ে যাব। একটু দাঁড়াই।”
“আসেন তো আপা। কেউ দেখবে না, সবাই আগেই বের হয়ে গিয়েছে। আপনার এত আনইজি লাগার কিছু নেই।” মিষ্টি করে হাসে হাসান। ছেলেমানুষের হাসিও যে এত সুন্দর হতে পারে আগে কখনো খেয়াল করা হয়নি রুমির, একটু মুগ্ধ চোখেই তাকিয়ে আছে বোধহয়, মনে হতেই দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়।
ইতস্তত করে বাইকে বসে রুমি। মোটরসাইকেলে ওঠার অভিজ্ঞতা তেমন নেই, একটু ভয়ে ভয়ে স্ট্যান্ড আঁকড়ে ধরে। “শক্ত করে ধরেছেন তো? টান দিলে পড়ে যাবেন কিন্তু।”
হাসান যখন বাইক টান দেয়, এক অদ্ভুত ইচ্ছে হঠাৎ জেগে ওঠে রুমির মনে। মনে হয় আজ এখনি ও বাসায় ফিরো না যাক। রোজ তো সেই আটপৌরে জীবন, আজ কী এই চমৎকার বাতাসে ভাসতে ভাসতে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেতে পারে না!
না পারে না, বাস্তবতা বারবার ওকে স্বপ্ন থেকে টেনে নিয়ে আসে। বাসায় ফিরতে হবে, ছোট্ট মেয়েটা অপেক্ষায় আছে, ওর কাছে পৌঁছাতে হবে।
রুমির আবার বিয়ে, নতুন জীবনসঙ্গীর কথা সবাই বললেও তিতলির কথা ভেবে রুমি আগায় না। ওর একটাই ভয়, দ্বিতীয় বিয়ের পর যদি তিতলির জীবনটা আরও কঠিন হয়ে যায়! তাছাড়া এমনি তার কোন সমস্যা হয় না, ব্যস্ততায় একাকিত্বের অনুভূতিও তেমন আসে না। শুধু ইদানীং হাসানের আশেপাশে থাকলে কেমন জানি একটা খালি খালি অনুভূতি হয়। এক অজানা আকর্ষণে না চাইলেও জড়িয়ে যায়। মনকে তো বেঁধে রাখা যায় না, নিজের মতো সে দৌঁড়াতে থাকে।
হিমেলের সাথে রুমির বিয়ে পারিবারিক ভাবেই
হয়েছিল, এই ধরনের কোন অনুভূতি তাই শুরুতে হয়নি। বিয়ের পর ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই সংসার সন্তান হয়েছে, কিন্তু সেখানে সে সুখী ছিল। হিমেল প্রতারণা করছে জানার আগে পর্যন্ত হিমেলকে ভালোবাসে না এই কথাটা একবারও মনে হয়নি। মান অভিমান ঝগড়া সব সংসারেরই অংশ মনে হয়েছিল। হিমেলের দ্বৈত জীবনের সত্য যখন সামনে আসে তখন সব অনুভূতি তেতো এক ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। প্রেম প্রেম অনুভূতি কী তা আসলে কখনোই তাই বোঝা হয়ে ওঠেনি। এখনো হবে না জানে রুমি। হাসানের মতো ছেলের নিশ্চয়ই প্রেমিকা আছে, না থাকলেও সে এক সন্তানের মা রুমির দ্বিতীয় স্বামী নিশ্চয়ই হতে চাইবে না। কথাগুলো মনে হতেই রুমির ভালোলাগার রেশ কেটে যায়।
রুমি বাসার কাছাকাছি এসে বাইক থামায় হাসান। বাসার গেট পর্যন্ত যায় না, হয়তো বুঝতে পেরেছে, গেটে নামালে বিল্ডিং এ অযথাই একটা আলোচনা হবে।তাই একটু আগেই রুমিকে নামিয়ে দেয়। রুমির হাসানের এই ছোটছোট দিকগুলোই ভালো লাগে, অনেক কিছুই বলার আগে বুঝে নেয়। রুমি নিজেই একটু নামিয়ে দিতে বলবে ভেবেছিল, কিন্তু বাসা পর্যন্ত এসে উপরে উঠতে না বলা অভদ্রতা হয়ে যায়। তাই কিভাবে বলবে তাই নিয়ে বিব্রত ছিল। কিন্তু হাসান নিজেই বাইক থামিয়ে বলে, “গলিতে আর ঢুকলাম না। চলে যেতে পারবেন না? আমি এখান থেকেই বাসার দিকে যাব।”
“না না কী বলেন। এতদূর এসেছেন। এই ভরদুপুরে না খেয়ে গেলে হবে না, বাসায় চলেন। দুটো ডালভাত খাবেন।”
“খাবো যখন পোলাও কোরমা খাব। ডালভাত তো রোজ খাই। একদিন দাওয়াত নিয়েই আসব। আজ আসি।”
বাইক স্টার্ট দেয় হাসান। আন্তরিক ভাবেই ধন্যবাদ দিয়ে সামনে আগায় রুমি। মনের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১৭
মরিয়মের ইদানীং শরীর খুব খারাপ লাগে, সবে মাত্র এগারো সপ্তাহ চলছে। এত তাড়াতাড়ি ছুটি নিতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু দীর্ঘ বিরতির পর দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সি, বেশি বয়সের সন্তান, এ সময়ে তাই ছোটো-ছোটো অস্বস্তিকর লক্ষ্মণও হেলাফেলা করা উচিত না। অনেক ভেবে মরিয়ম সিদ্ধান্ত নেয় দুদিন ছুটি নিবে ক্যাজুয়াল লিভ থেকে। বাসায় থেকে রেস্ট নিবে, রুমনকে সময় দিবে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য রুমনকে আর আগের মতো সময় দিতে পারে না, রুমনও কী কিছু বুঝেছে কিনা কে জানে, আগের মতো আর মরিয়ম বাসায় আসলে পেছন পেছন ঘুরে না। আড়াল থেকে মাকে দেখে। বমি, মাথা ঘোরা এসব সমস্যার জন্য মরিয়মের শরীর বেশ খারাপ লাগে, বাসায় থাকলেও শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তবে মরিয়মের ভালো লাগে যে এই সময়টা শাশুড়ি রুমনকে দেখে রাখেন। মরিয়ম মাঝেমাঝে রুমনের ক্লাসের কাজে সাহায্য করতে গেলেও শাশুড়ি মা করতে দেন না। তিনি একটা সুস্থ বাচ্চা র জন্য এত চিন্তা করেন বুঝে মরিয়ম। কিন্তু রুমনের এক্টিভিটিগুলো আগের মতো চর্চা করা হচ্ছে না, ওর বিকাশের জন্য ডাক্তার বেশকিছু নিয়ম চার্ট করে দিয়েছিলেন, এখন সেসব অনিয়মিত হয়ে গিয়েছে। শাশুড়ি এসব এতটা বোঝেন না, করোনায় স্কুলও বন্ধ। একটা স্পেশাল স্কুলে পড়ে রুমন, অনলাইন আসলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চাদের জন্য অতটা সহায়ক হয় না। শিহাব সাহেব ব্যবসায়ীক কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে নিয়ম করে সব দেখা সম্ভব না। মরিয়ম দেখে যে রুমনের এখন সময় কাটে ড্রয়িং করে। এই একটা জিনিস রুমনকে শান্ত করে ধরে রাখে।
অবশ্য রুমন এমনিতেও নিজের জগতে শান্ত চুপচাপ থাকে, যতক্ষণ না কোন কিছু তাকে বিরক্ত করছে। রুমনের অটিজমের ধরনটা “এসপারজার সিন্ড্রোম” নামে পরিচিত। এই ধরনের অটিজমে বাচ্চার বুদ্ধিবৃত্তিতে কোন সমস্যা থাকে না, কথাও মোটামুটি সবই বলতে পারে। তবে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে ততক্ষণ, যতক্ষণ তার মনমতো না হয়। তবে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আছে, যেমন নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, হৈচৈ অনেক সময় রুমনকে অস্থির করে তুলে। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে হঠাৎ মিশতে পারে না, ওরাও রুমনের সাথে সহজ হয় না। ফলে রুমন নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কোন কাজে বারবার বাধা পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আর এই সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ যোগ্য, যদিও সহজ নয়, দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরে আস্তে আস্তে সব শেখাতে হয়। তবে সময়ের সাথে সঠিক যত্ন পেলে এই সিন্ড্রোমের বাচ্চারা বড় হতে হতে আচরণে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যায়, আর দশজনের মতো দৈনন্দিন কাজগুলো করতে পারে। পড়ালেখায় ভালো ফলাফল করতে পারে, যে বিষয়ে দক্ষতা আছে যেমন, গান, ছবি আঁকা এই সব বিষয়ে ভীষণ পারদর্শিতা দেখায়। মরিয়ম আর শিহাবও আশা রাখে একসময় রুমন আর দশজনের মতো নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
“মরিয়ম, তোমার চেহারা কেমন ফ্যাকাশে লাগে কেন? শরীর খারাপ লাগে? কয়দিন ছুটি নিতে বলি, কথা শুনো না।”
“নেব আম্মা। আগামী দুইদিন ছুটি নেব। রুমনকেও সময় দেওয়া হয় না। ছেলেটা একা একা থাকে।”
“একা কই, শিহাব থাকে সকালে। আর আমি তো আছি। তোমার ননদ আসে ফাঁকে ফাঁকে। আর ও তো সারাদিন ছবিই আঁকে, বাইরে তো যায় না, বাসাতেই আছে।”
“হ্যাঁ অনেকদিন হলো রুমনকে পার্কে নেওয়া হচ্ছে না। ডাক্তার বলেছিল ওকে বাইরের শান্ত পরিবেশে নিতে। দেখি শুক্রবার নিয়ে যাব।”
“তোমার এখন এগুলো মাথায় নেওয়ার দরকার নাই। বাচ্চা হবে সাবধানে থাকো। এইসব গাছপালার ভেতর গেলে খারাপ বাতাস লাগে। আগে বাবু সুস্থ ভাবে হোক তারপর দেখা যাবে।”
“আম্মা বাতাস লাগা কুসংস্কার। আর বাবু হতে এখন ছয়মাসের বেশি সময় আছে। সামনে শরীর ভারি হলে বের হতে পারব না।”
“মরিয়ম প্রথম বাচ্চার সময় আমি কিছু আটকাই নাই, যা মন চায় করছো। বাচ্চা পেটে নিয়ে রাতে নাইট ডিউটি করছো, ভরসন্ধ্যায় ঘর থেকে বাইর হইছো। এইবার আমি এসব সহ্য করবো না।”
মরিয়ম বোঝে যে শাশুড়ি রেগে যাচ্ছে। নাতি নাতনির স্বপ্ন যে ওনার মনে ভীষণ চাপ ফেলেছে তা বুঝতে পারছে। হঠাৎ মরিয়মের ভয় লাগে, শাশুড়ির এই অবসেশন রুমনের জন্য কতটা ভালো হবে!
“আম্মা, রুমনের অটিজমের সাথে খারাপ বাতাসের সম্পর্ক নেই। ও মানুষের সাথে মিশতে পারে না, এছাড়া কিন্তু ওর আর কোন সমস্যা নেই। আমরা সাহায্য করলে ও এটাও কাটিয়ে উঠবে। এখন হঠাৎ নতুন মানুষের আগমনে ওকে অবহেলা করা যাবে না। রুমন আমার প্রথম সন্তান। দুই বাচ্চাই আমার কাছে সমান, ওদের আলাদা করে দেখবেন না।”
মরিয়মের শাশুড়ি মনে মনে বিরক্ত হোন। বৌমাকে তিনি ভালোবাসেন, কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে এই জেদ ওনার ভালো লাগে না। দুই কলম ডাক্তারি পড়ে সারাক্ষণ জ্ঞান দেয়। এইজন্য তার বোন বলেছিলেন বেশি শিক্ষিত মেয়ে আনতে না, অবাধ্য হয়। তখন না বুঝলেও এখন তিনি একমত। আরেকটা নাতি নাতনির জন্য কতদিন ধরে মরিয়মকে চেষ্টা করতে বলেছেন, কিন্তু মরিয়ম কানে নেয়নি। শেষে তিনি রাগ করে বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর নরম হয়েছে। এখন এই নাতি বা নাতনি সুস্থ ভাবে দুনিয়ায় আসুক, এই তিনি চান, অথচ মরিয়ম এখনো রুমন রুমন করে অস্থির। তিনি ঠিক করেন মরিয়মকে চাপ না দিয়ে আস্তে আস্তে মন বাচ্চার দিকে ঘুরাবেন, বেশি চাপ দিলে মরিয়ম বেঁকে যেতে পারে। “মরিয়ম রুমন আমারও নাতি। আমি কোন অংশে আমার মেয়ের ঘরের নাতি নাতনির চেয়ে কম আদর করি বলে মনে হয়? তাহলে আরেকজন আসলে রুমনের আদর কমবে এমন ভাবলে কেন? আমরা না হয় আগের দিনের মানুষ, কিন্তু তোমাদের শিক্ষা থাকলে আমাদের দুনিয়া দেখার জ্ঞান আছে। মাঝেমাঝে মুরুব্বিদের কথা শুনলে ছোট হবা না।”
মরিয়ম শাশুড়ির হাত ধরে ফেলে, “আম্মা, মনে কষ্ট নিয়েন না। রুমনকে নিয়ে কথা হলে আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। মাফ করে দেন। আচ্ছা আপনি যেভাবে বলবেন তাই হবে।”
“আচ্ছা, মনে থাকলে হয়। আর তুমি ঘুমাও একটু। রুমন উঠে গেলে ঘুমাতে পারবে না।”
শাশুড়ি উঠে যান, মরিয়ম আস্তে আস্তে ঘুমন্ত রুমনের পাশে গিয়ে বসে। আগে রুমনের ঘুম কম হতো।কিন্তু ইদানীং রোজ বিকেলে রুমনকে ঘুমাতে দেখে মরিয়ম। ও ফেরার আগেই শাহেদ রুমনকে খাইয়ে দিয়ে যায়। মরিয়মের বাসায় আসতে তিনটা বাজে, ও আসলে কিছুক্ষণ রুমনে জেগে থাকতে দেখে, ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে দেখে রুমন ঘুম। এই নিয়মিত ঘুম কি ভালো লক্ষণ কিনা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হবে ভাবে। আনমনে উঠে রুমনের ঔষধের বক্সের দিকে যায় মরিয়ম। ইদানীং শরীর খারাপ থাকায় ঔষধের দিকে মন দেওয়া হয় না। অবশ্য এখন তেমন কোন ঔষধ চলছে না। আগো খিঁচুনি হতো, তার জন্য ঔষধ চলেছিল। কিছু ঔষধ দিয়েছিলেন ডাক্তার কিছুদিন আগে, যখন রুমন রাগ করে নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিল। সেই ঔষধের ডোজও আস্তে আস্তে কমিয়ে বন্ধ করা হবে। বক্স খুলে মরিয়ম অবাক হয়, ঘুমের ঔষধের পাতার কয়েকটা ওষুধ নেই, একটা হাফ ট্যাবলেট খোলা স্লিপে চাপ দিয়ে রাখা। রুমনকে কী দুপুরে ঘুমের ঔষধ হাফ করে দেওয়া হচ্ছে!! শিহাব আসলে জিজ্ঞেস করবে ভাবে মরিয়ম। মনটা খচখচ করে ওঠে, ছেলেকে কী অবহেলা করছে মরিয়ম!
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব ১৮
“বাসায় আসতে পারবে এখন? জরুরি।”
মরিয়মের ম্যাসেজ পেয়ে শিহাব কল করে, কিন্তু মরিয়ম ঠিক করেছে সরাসরি কথা বলবে, ফোনে না। তাই ফোন শিহাবকে বলে, দোকানে সমস্যা না হলে এখনি বাসায় আসতে বলে, জরুরি কথা আছে।
মরিয়ম আজ আর পাশের রুমে যায় না, রুমনের পাশে ঠায় বসে থাকে। ওর খুব ইচ্ছে করছে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে একটু শুয়ে থাকতে। কিন্তু রুমন আর দশজনের মতো না, হঠাৎ আলিঙ্গনে ও সহজ হতে পারে না। ওর অনুমতি নিয়ে ওকে ধরতে হয়, কখনো কখনো ও নিজেই ওকে জড়িয়ে ধরতে বলে। তবে হুটহাট কেউ গায়ে হাত দিলে রুমন বেশ বিরক্ত হয়। তীব্র আলো, উচ্চস্বরের গান, হঠাৎ আলিঙ্গন এই সবকিছুই ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মরিয়মকে শাশুড়ি মা কয়েকবার ডেকে শুতে বলেছেন, কিন্তু মরিয়ম বলেছে ও রুমনের পাশেই থাকবে এখন, শোবে না। শাশুড়ি অবাক হয়েছেন, হঠাৎ কী হলো মরিয়মের।
“মরিয়ম, রুমন উঠলে তখন মন চাইলে ওর সাথে থাকবা। এখন শুধু শুধু বসে আছ কেন? এই না বললা শরীর খারাপ?”
“শিহাব আসবে মা, ওর জন্য অপেক্ষা করি। ও আসলে রেস্ট নেব।”
“শিহাব মাত্র না গেল দোকানে! দুই ঘন্টাও হয়নি, এখন বাসায় আসবে কেন?”
“একটা দরকারে আছে মা।”
“ডাক্তারের ডেট আজ? আমি তো ভাবছি মাসের শেষে ডেট।”
মরিয়ম জবাব দেওয়ার আগেই বেল বাজে। মরিয়মের শাশুড়ি রাবেয়া বেগম দরজা খুলতে যান। মরিয়ম ঔষধের বক্সটা নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। কলিংবেলের শব্দে রুমনও নড়েচড়ে ওঠে।
শিহাব রুমে ঢুকলে মরিয়ম দরজাটা লাগিয়ে দেয়, আপাততঃ শাশুড়ি মায়ের কানে কোন কথা যাক তা চায় না মরিয়ম।
“মরিয়ম এত জরুরি তলব? কিছু হয়েছে?”
“রুমনকে রোজ ঘুমের ঔষধ তুমি দিচ্ছ?
“রোজ ঘুমের ঔষধ! কী বলো? দুপুরে আমি ভাত খাওয়ানোর পর তো কোন ঔষধ দেই না। ওর ঔষধ তো এখন শুধু রাতে একটা। হ্যাঁ একদিন খুব অস্থির হয়ে গিয়েছিল তোমার জন্য, শান্ত করতে পারছিলাম না। ঐ যে তুমি আলট্রা করতে গেলে, সেদিন আম্মা বললো ঘুমের ঔষধ হাফ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।”
“আর তুমি ওকে ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলে?”
“আমি ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছিলাম। স্যার বললেন মাঝেমাঝে ও খুব রেস্টলেস থাকলে, বা একদম ঘুমাতে না চাইলে ঔষধ দিতে পারব।”
“তাই বলে রোজ রোজ ঘুমের ঔষধ দিবা? টানা ঘুমের ঔষধের সাইড এফেক্ট হতে পারে জানো না? এই ঔষধের উপর ওর একটা ডিপেন্ডেন্সি চলে আসবে, ঔষধ ছাড়া ও ঘুমাতে পারবে না, সারাক্ষণ অবসাদে ভুগবে, ঝিমুনি হবে, পানির তৃষ্ণা চলে গিয়ে ডিহাইড্রেশনে ভুগবে। সবচেয়ে বড় কথা ঘুমের ঔষধে ওর এডিকশন হয়ে যাবে। তোমার কাছে এই অবহেলা আশা করিনি।”
“মরিয়ম, আমি না হয় ডাক্তার না, কিন্তু বাচ্চার বাবা তো তাই না? এগারো বছরে আমি কখনো রুমনকে অবহেলা করেছি, না ওর জন্য কোন ক্ষতিকর কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাতের পর রাত যখন রুমন ঘুমাতো না, সুর করে কাঁদত, তখন তোমার সাথে আমিও তোমার সাথে রাত জেগেছি। কখনো বলিনি ওকে সিরাপ খাইয়ে ঘুম পাড়াও। যদিও তখন এই ধরনের পরামর্শ কম পাইনি। তাহলে এখন এতদিন পর কেন বিরক্তি দেখাব? আরেকজন সন্তান আসছে বলে?”
মরিয়ম ঔষধের বক্স খুলে দেখায়, একপাতায় দশটা ঔষধের চারটা শেষ, একটার হাফ আছে। শিহাবও অবাক না হয়ে পারে না। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দ হয়, কেউ কিছু আছড়ে ফেলেছে যেন। দ্রুত দরজা খুলে বের হয় মরিয়ম আর শিহাব, আওয়াজ এসেছে রুমনের রুম থেকে।
“কেন আম্মু যাব না? কেন যাব না? কেন যাব না?”
রুমন একের পর এক জিনিস আছড়ে ফেলছে, মরিয়মের শাশুড়ি রুমের একপাশে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আতংকে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে।
মরিয়ম আর শিহাব রুমনকে জড়িয়ে ধরে, ওর নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলার আগেই থামাতে হবে, রীতিমতো কাঁপছে রুমন।
“এই যে আম্মু বাবা। এই যে আম্মু। তুমি শান্ত হও বাবা। এই যে আম্মু।”
অনেক কষ্টে রুমন শান্ত হয়েছে। বারবার মায়ের কাছে যেতে বাঁধা পাওয়ায় ওর মনে অভিমান বাসা বেঁধেছে, তারউপর এখন নিয়মিত কাউন্সিলিংও হয় না, ওর দিক হতে সবার মনোযোগ সরে যাওয়াটা বেশ প্রভাবিত করেছে রুমনকে। রুমনকে শান্ত করে শুইয়ে দিয়ে যখন বসার ঘরে আসে মরিয়ম আর শিহাব, ঘড়ির কাঁটা তখন নয়টা ছুঁয়েছে। শিহাবের বেন আর দুলাভাইও এসেছেন। ওনাদের শিহাব বা মরিয়ম ডাকেনি, বোধহয় রুমনের দাদীমার কান্না ফোনে শুনে তারা ছুটে এসেছে। শিহাব আর মরিয়ম যে ওনার উপর প্রচন্ড রাগ করেছে তিনি তা বুঝতে পেরেছেন। ওনার ধারণা ছিল ঘুমের ঔষধ অর্ধেক করে খাওয়ালে কোন ক্ষতি নেই, রুমন রোজ বিকেলে ঘুমাবে, মরিয়মও তাহলে ওর পেছন পেছন দৌঁড়াবে না।
“আম্মা আপনি কাজটা ভুল করেছেন। এভাবে ঘুম পাড়ানোর বুদ্ধি আপনার মাথায় আসলো কিভাবে? এই আপনি তো কোনদিন আগে এত বিরক্ত হননি রুমনের উপর। এখন এমন কী হলো যে ওকে আপনি দুপুরে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন?”
শিহাব যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে মাকে প্রশ্ন করে। জাহানারা বেগম বুঝতে পারছেন সবার চোখে তিনি অপরাধী হয়ে গিয়েছেন, ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে, কেন তিনিএমন করলেন। ওনার মেয়েও মায়ের এই কাজে ভীষণ অবাক হয়েছে। মরিয়ম কিছুই বলছে না। একটানা অনেকক্ষণ রুমনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে, এখন প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগছে। কিন্তু সবার সামনে বসে এই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আসলে মরিয়মের কিছুই ভালো লাগছে না, মনে হচ্ছে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়া ভুল হয়েছে। এখনি এসব হচ্ছে, আরেকজন এই দুনিয়ায় আসলে যদি পরিবারের সবাই এভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়, রুমনকে নিয়ে মরিয়ম কী করবে! সে ও কি আর সবার মতো রুমনের উপর থেকে মমতার আঁচল সরিয়ে নেবে!
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব১৯
রুমির কী হয়েছে! টিনএজারদের মতো অবস্থা, মন সদা অস্থির। হাসানের সাথে যতক্ষণ থাকে কী ভীষণ ভালো লাগে, কারণে অকারণে কথা বলতে ইচ্ছে করে, খাতা দেখতে দেখতে একসাথে চা খেতে ভালো লাগে, হাসানের সেন্স অফ হিউমার ওকে মুগ্ধ করে। হাসতে পারা আর হাসাতে পারা বিশাল গুণ, এই দুটোই হাসানের আছে। হাসানের উপস্থিত বুদ্ধি, তার হাসি সবকিছু ধীরে ধীরে রুমিকে মোমের মতো গলিয়ে ফেলছে। প্রেমে পড়ার প্রবল অনুভূতি হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। অথচ সবকিছু বুকের ভেতর বুদবুদ তুলে শেষ, নিজেকে যে হাসানের সামনে প্রকাশ না করার কঠিন সংগ্রামে ব্রত রুমি।
আসলে গত একবছরে নানা চড়াই উৎরাই পাড়ি দিতে গিয়ে বেশ কঠিন মানবীর রূপ ধারণ করেছে রুমি। একা মেয়েমানুষের চলার পথ কঠিন করতে যে সদা একদল মানুষ প্রস্তুত থাকে। যারা ভাবে স্বামীহীনা নারীকে খুব সহজেই বাগে পাওয়া যাবে। তাদের হাত থেকে বাঁচতেই এতটা কাঠিন্যের মোড়কে নিজেকে মুড়িয়েছে যে এখন চাইলেই সহজ হতে পারে না হাসানের সামনে। তাছাড়া রুমি কানকথা ছড়ানোর ভয়ে থাকে, মিতুর মতো অবিবাহিত হলে হয়তো এতটা অস্বস্তি হতো না, কিন্তু রুমির জন্য গালগল্প ছড়ানোটা সহজ। কিছু টের পেলে রৌশন আপাও বড় গলায় বলতে পারবেন, “আমি আগেই বলেছিলাম, এমনই হবে। রুমি তো একটা পুরুষের পেলেই ঝুলে পড়তে রাজি ছিল, সেখানে হাসান তো সোনায় সোহাগা।”
আর তাছাড়া বাঙালি সমাজ এখনো এতটা উদার হয়েছে কই! এখানে এখনো বয়স্ক ডিভোর্সি পাত্রের পরিবার ছেলের দ্বিতীয় বিয়ের সময় কুমারী মেয়ে খোঁজে। আর হাসানের মতো অবিবাহিত ছেলের পরিবার নিশ্চয়ই এক সন্তানসহ রুমিকে সাদরে গ্রহণ করবে না, যদি না হাসানের মনে রুমির জন্য একই রকম তীব্র আবেগ থাকে। আর সেই আবেগ আছে কিনা রুমি জানে না। হাসান সুন্দর করে কথা বলে, মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করে, কোনদিন কলেজে দেরি হয়ে গেলে সবার দৃষ্টি বাঁচিয়ে বাইকে লিফট দেয়। কিন্তু এর কোনটাই এখনো ঠিক প্রেম বলে ধরা দেয় না।
“রুমি আপা, প্রফের বেশ কিছু কাজ আছে। আজ একটু সময় লাগতে পারে, আপনার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে জানি।”
হাসানের ডাকে রুমির ধ্যান ভাঙে, নিজেকে সামলে জবাব দেয়, “প্রফের সময় একটু চাপতো যাবেই। সমস্যা হলো আগের ডিপার্টমেন্টেও সময় দিতে হচ্ছে, রাকিন ভাই তো নতুন জয়েন করেছেন, বেশকিছু টপিকস নিয়ে আলোচনা করতে চাইছেন। স্যারও বলেছেন বছরের এমন সময় জয়েন করেছে, ওনাকে একটু সাহায্য করতে।”
“রাকিন ভাইকে কেমন চুপচাপ মনে হয়, রাশভারী।”
“সবাই কী আপনার মতো হয়, হাসিখুশি।”
“প্রশংসা করলেন, না মজা করলেন আপা? আমরা ভাই এত মেধাবী মানুষ না, এত ডিগ্রি টিগ্রি নাই তো, তাই জ্ঞানী ভাব তাই আসে না। তবে রাকিন ভাই লেকচারার পোস্টে কেন ঢুকলেন এটাই অবাক হলাম।”
“স্যারের সরাসরি ছাত্র তো, তাই স্যারের কথা ফেলতে পারেনি। তবে বেশিদিন লেকচারার থাকবে না, এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে প্রমোশনের ব্যবস্থা হবে।”
“বাহ্, আসতে না আসতে প্রমোশন হবে। ভালোই।”
“জ্বি। তবে রাকিন ভাইকে রাশভারি মনে হলেও লোক ভালো। মাপা কথাবার্তা বলেন এই আরকি।”
“হুম বেশ ভালো, রুমি আপার তাহলে আমাদের ভালো লোক মনে হয় না।”
“আরে ধুর, আমার জন্য সবাই এক।”
“তবে রাকিন ভাইয়ের উপর অনেকের নজর পড়েছে।।মিতু তো ভালোই আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে। চিলড্রেন ডিপার্টমেন্টের আলো আপা নাকি ওনার ছোটবোনের জন্য ভেবেছেন। তবে এই লোক এখনো সিঙ্গেল কেন অবাক তাই হলাম। দেখতে শুনতে তো বেশ স্মার্ট, টাকা পয়সাও আছে। আমাদের মতো হাভাতে না যে মহিলারা ভাই বলেই কাজ চালাবে।”
রুমি শব্দ করেই হেসে দেয়, “হাসান ভাই, আপনি কারও সাথে জড়াতে চান না তাই বলেন। শুধু শুধু ঐ বেচারাকে হিংসা করছেন। মিতু কতদিন ডিপার্টমেন্টে ঘুরে গেল আপনাকে নিয়ে চা খাবে বলে, পাত্তাই দিলেন না। আপনার মনের পথের রাস্তা না পেয়েই তো এখন পথ বদলালো।”
“আপনাকে তো পাত্তা দেই, চা ও খাই রোজ একসাথে, তারপরও আপনি মনের পথ ধরছেন কই? আমাকে রাকিনের মতো যোগ্য মনে হয় না?”
একমুহূর্তের জন্য রুমির হাসি মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। এটা কী ছিল, হাসান কী মজা করেছে, না কিছু বোঝাতে চাইছে! যদিও হাসান কথাটা বলেই পরমুহূর্তে রুম ছেড়ে চলে যায়। রুমি ঠায় বসে থাকে, খাতা গুলো এলোমেলো পড়ে আছে, ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করে যেন রুমিকে জিজ্ঞেস করছে, “রুমি তুমি ঠিক আছ?”
*****
মরিয়ম টানা দশদিন ছুটি নিয়েছিল, কাল ছুটি শেষে। সেইদিনের সেই ঘটনার পর মরিয়ম বাসায় আর কোন রকম উচ্চবাচ্য করেনি। কলেজে রুমনের অসুস্থতার কথা জানিয়ে দশদিনের আর্নিং লিভ নিয়েছে। এই দশদিন সে তার পুরোটা সময় রুমনকে দিয়েছে। মরিয়মের শাশুড়ি দিলারা বেগম মাঝেমাঝে এটা সেটা বলার চেষ্টা করলেও আবার নিজ থেকেই চুপ হয়ে গিয়েছেন। ঘুমের ঔষধের ঘটনা যে পরিবারের কেউ ভালোভাবে নেয়নি, এতটুকু তিনি বুঝতে পারছেন। শিহাব মাকে খুব ভালোবাসে, তাই মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু ছেলের যে অভিমান হয়েছে তা তিনি জানেন। মরিয়মকে আগের মতো চোখে চোখে রেখে ভালোমন্দ বুঝ দিতে পারেন না বলে বেশ অস্থিরতায় ভোগেন। আজ না পেরে মেয়েকে ফোন দিয়েছেন,
“হ্যালো আম্মা, কেমন আছ?”
“এই আল্লাহ রাখছে একরকম। তোমরা সবাই মিলে তো শাস্তি দিতেছ, কেমন আর থাকবো।””
“আমরা কী শাস্তি দিলাম আম্মা?”
“আর বাদ রাখলে কী। আমি কী জানি যে ঘুমের ঔষধ অর্ধেক করে খাওয়ানোও ঠিক না। আর সেই তোমাদের আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার যে রাতের ঘুম নাই হয়ে গিয়েছিল, তখন তোমরাই ডাক্তারের কথামতো আমাকে ঔষধ খেতে বলো নাই? তখন বলছো, আম্মা ঔষধ খেলে আপনার ঘুম হবে, শরীর ভালো লাগবে। আজ এতদিন ধরে রাতে ঘুমের ঔষধ খাই, তখন কেউ বলো নাই এটা খারাপ।”
“আম্মা তোমার বয়স আর রুমনের বয়স এক হলো? আব্বার মৃত্যুর পর না ঘুমিয়ে তুমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলে, তাই ডাক্তার ঔষধ দিয়েছিল। এরপর দেখ এখন নিয়মিত ঔষধ না খেলে তোমার ঘুম হয় না। এই অবস্থা তো এইবয়সেই রুমনের হয়ে যাবে।”
“আমার ভুল হইছে স্বীকার যাই। কিন্তু আমি বুঝি নাই এত কিছু। এখন তো তোর ভাবি সারাদিন ছেলে আগলে পড়ে আছে, যেন আমি শত্রু। অথচ কেউ বলতে পারবে যে নাতিরে কোনদিন অনাদর করছি? ছেলের বৌকে মন্দ বলছি? মরিয়মের বেশি বয়সে বাচ্চা হচ্ছে, আমি যত্নআত্তির কম রাখছি? ও যেন দুপুরে একটু ঘুমাতে পারে সেইজন্য রুমনরে ঘুম পাড়াতে চাইছি। আর কিছু তো না।”
“তোমার উদ্দেশ্য ভালো হলেও, পথ ভুল ছিল আম্মা, যতই ব্যাখ্যা দাও। তুমি ঠিক জানতা যা করছো ঠিক না, না হলে ভাবি না হোক, তুমি ভাইয়াকে ঠিক জিজ্ঞেস করতে যে রুমনকে রোজ ঔষধ দেওয়া যাবে কিনা। এখন যদি জানাজানি না হতো তুমি নিয়মিত ঔষধ দিতে আম্মা। তারউপর তুমি রুমনকে তার মায়ের কাছে যাওয়া থেকে আটকাতে। এটা করে বাচ্চাটার মনে কত চাপ দিয়েছ তুমি। ওর অবসথা তুমি জানো না….”
মেয়েকে কথা শেষ করতে বা দিয়েই ফেন কেটে দেন দিলারা বেগম। সুযোগ পেয়ে সবাই ওনাকে জ্ঞান দিচ্ছে, ভুল ধরছে তাই মনে হচ্ছে এখন। মরিয়মকে রুমনের কাজের চাপ থেকে দূরে রাখতেই তো এসব করেছেন, ছেলের বৌকে তো অত্যাচার করেননি। আর রুমন তো জন্ম থেকেই এমন, মন মতো না হলেও অস্থির হয়ে যায়। সেই জন্য সবাই এভাবে ওনার ভুল ধরবে। এই পরিবারে আগে কখনো এমন হয়নি। বিচক্ষণ বলেই সবাই ওনাকে সম্মান করে, আর আজ সবাই ভালো খারাপের পাট পড়াচ্ছে।
একা একাই রুমে গজগজ করেন দিলারা বেগম।
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২০
দেখতে দেখতে রুমির ছোটবোন রশ্মির বিয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ছোটখাটো আয়োজন হবে, রুমি তাই অফিসের কলিগ কাকে কাকে বলবে বুঝতে পারছে না। যদিও হাসানকে দাওয়াত দিতে খুব ইচ্ছে করছে, দাওয়াত দিতে না পেরে লজ্জাও লাগছে। কিন্তু শুধু হাসানকে দাওয়াত দিলে কলেজে জোর আলোচনা উঠবে, আবার সাথে আরও কয়েকজনকে দাওয়াত দিতে গেলে যাদের বলা হবে না তারা হয়তো সামনাসামনি কিছু বলবে না, কিন্তু রুমিরই ওদের সামনে বিব্রত লাগবে। সব ডিপার্টমেন্টের সবাইকে বলতে গেলে ত্রিশজনের বেশি মেহমান রুমিরই হয়ে যাবে। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়, অন্ততঃ ফাইনাল ইয়ারের সব কলিগদের তো বলা উচিত, যাদের সাথে বছর জুড়ে কাজ করা হয়। কেটে ছেঁটে তেরো জনের লিস্ট করে রুমি।
কপালের টিপটা জায়গামতো বসায়, নীল একরঙা শাড়ির সাথে কালো টিপ, চোখে কাজল, আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধই হয় রুমি। এই লাবণ্য গত একবছরে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, হাসানের সাথে সম্পর্কটা যত সামনে এগুচ্ছে চেহারায় যেন এক সুখ খেলা করছে, নতুন করে জীবন শুরু করতে ইচ্ছে করছে। যদিও সে বা হাসান, কেউই এখনো ভালোবাসি কথাটা উচ্চারণ করেনি, কিন্তু চোখে চোখে রোজ শত কথা বলা হয়ে যায় সবার নজর এড়িয়ে। রুমি জানে তিতলির মনে হিমেলের স্মৃতি আস্তে আস্তে মলিন হয়ে যাচ্ছে, একবছর আগে যখন হিমেলের সাথে ডিভোর্স হয়, তিতলির বয়স তখনো দুই বছরও হয়নি। ডিভোর্সের পর নিয়মিত তিতলির জন্য পাঁচ হাজার টাকা পাঠালেও হিমেল দেখা করতে এসেছে হাতে গোণা কয়েকদিন। শুরুতে তিতলি বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেও, আজকাল চর হিমেলের কথা জানতে চায় না, যপন তিতলির জীবনে কোন বাবার অস্তিত্ব নেই। রুমির তাই বিশ্বাস আছে হাসানের সাথে তিতলির বন্ডিং হতে সমস্যা হবে না। রুমির এই হাসিখুশি পরিবর্তন মা সাহেদা বেগমেরও নজর এড়ায় না, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারেন না। রুমি নিজ থেকে না জানালে এসব নিয়ে কথা কিভাবে বলবেন, তাছাড়া মাথায় এখন ছোট মেয়ের বিয়ের চাপ। তবে মনে মনে দোয়া করেন, ভালো একজন মানুষের সাথে যেন আসলেও এগিয়ে যেতে পারে রুমি, মেয়ে আর নাতনির জীবনটা গুছানো দেখতে চান তিনি।
******
“রুমি কী সুন্দর লাগছে আপনাকে। আমি আসলে কাটখোট্টা মানুষ না হলে আরও সুন্দর করে বলতে পারতাম।”
“রাকিন ভাই, আপনি যথেষ্ট সুন্দর করে বলেছেন। এরচেয়ে বেশি বললে মনে হতো ফ্লার্ট করছেন।”
মিষ্টি করে হাসে রুমি, রাকিনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, এই মেয়ের মাঝে কী জাদু আছে। কী যে ভালো লাগে। ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, পরিশ্রমী, গুণী রুমির প্রতি এই গোপন আকর্ষণ রাকিন গোপনেই রাখে। সতর্ক থাকে যেন রুমির সামনে নিজেকে প্রকাশ না করে ফেলে। রাকিনকে দেখতে চুপচাপ, গুরুগম্ভীর আর নিজের জগতে ব্যস্ত একজন মানুষ মনে হলেও তার পর্যবেক্ষণ শক্তি যথেষ্ট প্রখর। রাকিন বুঝতে পারে রুমির পরিবর্তন তাকে ঘিরে নয়, বরং হাসানকে ঘিরে। হাসান হাসিখুশি, সদালাপী, বুদ্ধিমান, মেয়েরা যেমনটা পছন্দ করে। নিজেকে আড়াল করে রাখা, আড্ডায় নিষ্প্রভ থাকা রাকিনের মতো মানুষগুলোর মন যতই ভালো হোক না কেন, তাদের নিয়ে স্বপ্ন খুব কম মেয়েই দেখে। প্রেমের সময় মেয়েদের পছন্দ বল্গাহরিণের মতো লাগামহীন পুরুষ, আর বিয়ের পর চায় শান্ত পুকুরের মতো মন নিয়ে সেই হরিণটা সংসার করবে। কিন্তু হরিণ কী চাইলেই পুকুর হয়! মন বান্ধা সহজ নয় বলেই তো গান হয়েছে, “আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে….”
“রাকিন ভাই, কোথায় হারিয়ে গেলেন?”
“না, মানে এমনি একটা কথা ভাবছিলাম।” আসলেও কোন খেয়ালে হারিয়ে গিয়েছে রাকিন।
“তাহলে আসছেন তো?”
“কোথায় আসব?”
“এই না দাওয়াত দিলাম! আমার ছোট বোনের বিয়ে।”
“ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ। স্যরি স্যরি আমার আসলে মনটা এলোমেলো। স্যরি।”
“আরে সমস্যা নেই। আচ্ছা আসি ভাইয়া।”
ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই হাসানকে দেখতে পায় রুমি। সাধারণত সালোয়ার কামিজই পরে আসে, আজ শখ করে শাড়ি পরেছে। হাসানের চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখার সূক্ষ্ম ইচ্ছে কাজ করে।
“রুমি, টিপ পরা হারাম। মুসলমান মেয়েদের টিপ লাগানো ঠিক না।”
হাসানের কথায় একটু ধাক্কাই খায় রুমি। আইলাইনার দিয়ে টিপ দিয়েছিল। সবসময় দেয় না, মাঝেমাঝে একটু শখ হয়। হঠাৎ এমন কথায় বিব্রত হয়ে যায়, কী করবে বুঝতে না পেরে ওয়েট টিস্যু দিয়ে ঘষে টিপটা মুছে ফেলে রুমি।
“টিপ তোমার পছন্দ বলেছিলে একদিন। পহেলা বৈশাখে আমি টিপ দিয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে সুন্দর লাগছে।”
“বলেছিলাম তো, আর সুন্দর তো আজও লাগছে। তবে যা ঠিক না তা বাদ দেওয়াই ভালো। অনেকের নজরেও আসে। দেখ না রাকিন ভাই কিভাবে দেখছিল।” রুমি আর কথা বাড়ায় না, কাজে মন দেয়।
******
“রুমি, কাকে কাকে বোনের বিয়েতে দাওয়াত দিলে?”
“রৌশন আপা, ফাইনাল ইয়ারের সব কলিগদের বলেছি। আসবেন আপা, খুশি হবো।”
“প্রেমের বিয়ে?”
“নাহ্ আপা, পারিবারিক বিয়ে। ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে।”
“তোমার কথা জানে ছেলের পরিবার?”
“কী কথা?”
“না মানে এই যে তুমি বাবার বাড়িতে আছ মেয়ে নিয়ে। নাকি বিয়ের পর জানাবে ঠিক করেছ তোমরা?”
রুমি শক্ত হয়ে যায়। রৌশন আপা সুযোগ পেলেই আঘাত করে কথা বলতে পছন্দ করেন। এত নিচু স্বরে হেসে হেসে বুকে শেল বিঁধানো কথা একজন মানুষ কিভাবে বলতে পারে!
“বাবার বাড়িতে থাকা কী কোন অপরাধ আপা? এটা লুকানোরই কী হলো যে আগে পড়ে বলবে? আপনি জান না বাবার বাড়ি? থাকেন না?”
“রাকিন, আমি যাই বেড়াতে, মেহমান হয়ে। রুমির কথা আলাদা।”
“আলাদা কেন আপা? বিয়ের পর বাবার বাড়ি বেড়াতে যান, হয়তো ওনারা আপনাকে মেহমান ভাবে বলে। রুমির মা বাবা মেয়েকে সন্তানই ভাবেন হয়তো, মেহমান না।”
“রাকিন, তুমি দুই মহিলার কথার মাঝখানে নাক ঢুকাচ্ছ কেন? এমনি তো বোমা মারলেও মুখ দিয়ে কথা বের করো না। এখন এত খই ফুটছে? ভালোই রুমি কলেজের পুরুষদের সবাইকে তাহলে নিজের বন্ধু বানিয়েছে, ডিপার্টমেন্টের হেড থেকে জুনিয়র, সবাই রুমি আপা বলতে অজ্ঞান। শুধু মহিলারাই রুমির শত্রু।”
রাকিন উঠে চলে যায়। কনফারেন্সের রুমের বাকিরাও রৌশন আপার উপর বিরক্ত হয়। কোথা থেকে কথা কোথায় গেল। রুমিও নিজেদের ডিপার্টমেন্টের রুমে চলে আসে। পিছুপিছু হাসানও আসে।
“রুমি, মন খারাপ করো না, রৌশন আপাতো জানোই এমন। রাকিন ভাইয়েরও ওনাকে খোঁচানো কী দরকার ছিল। অযথা পাগল খেপানো।”
“আর তোমার কী করা দরকার ছিল? তুমি কেন কখনো কারও সামনে আমার পক্ষ নাও না? আমি ঠিক তোমাকে, আমাদের সম্পর্ককে বুঝতে পারছি ন। এই মনে হয় তুমি অধিকার দেখাচ্ছ, এই মনে হয় তুমি আমি নদীর দুই পাড় যেন, পাশাপাশি আছি, কিন্তু সাথে নয়।”
“কিসব কাব্য করে বলছো। আমি আনন্দপ্রিয় মানুষ। তোমাকে পছন্দ করি, এটা তো অজানা না তোমার। কিন্তু কলেজে সবার সামনে তোমার প্রতি দুর্বলতা দেখালে আমাদের দু’জনের জন্য কাজ করা মুশকিল হবে, আমরা গসিপের বস্তু হবো। এই বন্ধুত্বই তো ভালো।”
“তুমি বন্ধন চাও না?”
“আপাততঃ না। প্লিজ রৌশন আপার জন্য নিজেরা ঝগড়া না করি প্লিজ। আর তোমার ব্যাগে কাজল আছে?”
“কাজল! কেন?”
“আবার টিপ এঁকে নাও। শাড়িতে টিপ ছাড়া তোমাকে কেমন মলিন লাগছে।” মিষ্টি করে হাসে হাসান। কিন্তু প্রতিবারের মতো এইবার এই হাসির তরঙ্গ যেন রুমির মনে দোলা দিয়ে যায় না। আরেকবার কী মানুষ যাচাইয়ে ভুল হচ্ছে!
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২১
মরিয়ম ছুটি নিয়ে নিয়েছে, এখনো ডেলিভারির প্রায় সাড়ে তিনমাস বাকি, কিন্তু মরিয়ম ম্যাটার্নিটি লিভে চলে গিয়েছে। কলেজের সবাই জানে মরিয়মের দ্বিতীয় বাচ্চাটা প্রায় বারো বছর পর হচ্ছে, বয়সও বেশি, এসময় প্রেগন্যান্সি রিস্ক থাকে বেশ, তাই ছুটি পেতে সমস্যা হয়নি। যদিও ডিপার্টমেন্ট বেশ ঝামেলায় পড়েছে হঠাৎ একজন শিক্ষক ছুটিতে যাওয়ায়, কিন্তু মরিয়মের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ছুটি মঞ্জুর হয়েছে।
এখন তো ম্যানেজ হয়েছে কিন্তু ছয়মাস পর কী করবে মরিয়ম জানে না। অসুস্থতার জন্য যতটা না,তারচেয়ে বেশি সাংসারিক কারণে ওকে ছুটি নিতে হয়েছে। রুমনকে ঘিরে শাশুড়ি মায়ের সাথে সম্পর্কটা বেশ শীতল হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক কথাবার্তা, ঘর সংসার সবই হচ্ছে, কিন্তু কোথাও যেন সেই আন্তরিকতাটা নাই হয়ে গিয়েছে। মরিয়ম বরাবরই চাপা স্বভাবের, বোন নেই, ভাই বয়সে বেশ ছোট তারউপর প্রেমের বিয়ে তাই পারিবারিক টানাপোড়েনের কথা নিজের মা বাবার সাথে শেয়ার করে না। মনে হয় শেয়ার করলে যদি শুনতে হয় নিজেই পছন্দ করেছ, এখন ভুগো!
যেন পারিবারিক বিয়েতে কোন সমস্যা হয় না, সমস্যা শুধু নিজে পছন্দ করে করলে হয়! জীবনের তাগিদে বন্ধু বান্ধবেরা সবাই আলাদা হয়ে গিয়েছে, ফেসবুকে যোগাযোগ থাকলেও সবার সাথে একধরনের মানসিক দূরত্ব হয়ে গিয়েছে। একমাত্র রুমির সাথে একটা নির্মল সম্পর্ক ছিল, অসম বয়সের বন্ধুত্ব আর ভরসার জায়গা। কিন্তু কয়েকমাস আগের সেই রাতের পর থেকে রুমি কেমন জানি অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। মরিয়মের খুব ইচ্ছে করে আগের মতো রুমির সাথে মন খুলে কথা বলতে, কিন্তু রুমি দূরে দূরে থাকায় তা সম্ভব হয় না।
এই দমবন্ধ অবস্থায় জীবনের একমাত্র খোলা আকাশ আর শীতল বাতাস হয়ে আছে শিহাব। শিহাব যদি মরিয়মের হাত ধরে না থাকতো, তাহলে এতটা শক্তি নিয়ে পথ চলার সাহস মরিয়ম পেতো না। ইদানীং সকালে উঠলে বেশ খানিকটা সময় ধরে মরিয়মের শরীর খারাপ লাগে। মর্নিং সিকনেসটা অনেক কষ্ট দেয়। সে সময়টা শিহাব বাসায় থাকে, রুমনকে সকালের নাস্তাটা দেয়, স্কুলের জন্য রেডি করে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্কুল খুলেছে, শিহাব রুমনকে স্কুলে নিয়ে যায়। থেরাপিতেও রুমন এখন নিয়মিত যাচ্ছে। রুমন আবার অনেকটা সুস্থির। ডাক্তার স্পষ্টভাবেই বলেছেন আচরণগত সামাজিক মেলামেশার সমস্যা আর হঠাৎ রেগে যাওয়া ছাড়া রুমনের অটিজমের অন্য সমস্যা নেই। পড়াশোনায় সে বেশ ভালো, ছবি আঁকায় অসাধারণ, আর দশটা বাচ্চার চেয়ে সে কোন অংশে কম নয়। রুমনের যেটুকু সমস্যা আছে তা সাথে নিয়েই সে বহুদূর এগিয়ে যেতে পারবে। শুধু প্রয়োজন মনোযোগ আর নার্সিং এর, আশেপাশের মানুষদেরও রুমনের অনুভূতিকে সম্মান দিতে হবে। এই যে রুমন হঠাৎ কারো স্পর্শ করাটা পছন্দ করে না, মিথ্যা বলতে পারে না, মিথ্যে কথা নিতেও পারে না, নিজেকে আড়াল করে হাসিখুশির অভিনয় করতে জানে না, এই জিনিসগুলো আশেপাশের দ্বৈত চরিত্রধারী মানুষদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে রুমন জীবনে চলতে পথের জন্য দরকার যে অভিনয় করা, তা শিখতে পারেনি, পারবেও না। ও নির্মল সত্যের মূর্তি, আর তাকে সেভাবেই মেনে নিতে হবে।
মরিয়ম রুমনকে সাথে নিয়ে একটা ওয়েব সিরিজ দেখে, “দ্য গুড ডক্টর” সিরিজটা রুমন আর মরিয়মের ভীষণ প্রিয়, সেখানে অটিজমে আক্রান্ত একজন ডাক্তারের চরিত্র আছে, ডাক্তার শন। শনের দক্ষতা আর অদম্য মেধা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র অটিজমে থাকায় পদে পদে শনকে যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। ডাক্তার হওয়ার পথটা শনের জন্য সহজ ছিল না, ছোটবেলায় শনের ভাই ছাড়া পরিবারের কেউ ওকে বুঝতে পারত না। শনের মানুষের সাথে মিশতে না পারা, কেউ স্পর্শ করলে প্রতিক্রিয়া দেখানো, স্কুলে খেলাধুলায় অংশ না নেওয়া এই সবকিছুই ওর বাবার কাছে বিরক্তিকর লাগতো, জোর করে এসব করানোর চেষ্টা করতো, যার ফলে বাবার সাথে ওর বিশাল দূরত্ব হয়েছিল, এর মাঝে সবচেয়ে কাছের মানুষ ছোটভাইয়ের মৃত্যু শনকে মানসিক ভাবে ভেঙে দেয়। সে সময় ভঙ্গুর শনের জীবনে এঞ্জেল হয়ে আসেন একজন প্রফেসর, যিনি শনের গডফাদার হয়ে যান, যার সাহায্যে শন মেডিকেল প্রফেশনে আসে।
মরিয়ম ভাবে দিন কী বদল হয়েছে! হয়নি। অটিজম নিয়ে এখনো অনেক পরিবারের অনেক অজ্ঞতা আছে। এখনো মানুষ এই বাচ্চাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে তারজন্য পথটা কঠিন করতে ব্যস্ত হয়। অথচ একটু সাপোর্ট পেলে এরা তাদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে সক্ষম। মরিয়ম আর শিহাব সেই চেষ্টাই করছে, রুমনের চলার পথটা তারা মসৃণ করবেন, তারজন্য সবার সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত, আজ যারা রুমনকে মরিয়মের দুর্বলতা ভাবছে কাল তারাই তা শক্তিরূপে দেখবে। মরিয়ম জানে না রুমন একজন গডফাদারের দেখা পাবে কিনা, কিন্তু তার বাবা মাকে সবসময় পাশেই পাবে।
“আম্মু”
“হ্যাঁ বাবা?”
“এটা তুমি”
রুমন হাতের ছবিটা মেলে ধরে, আপন ভাবনায় মরিয়ম এতটা আচ্ছন্ন হয়েছিল যে রুমন কী আঁকছে খেয়াল করা হয়নি। এখন রুমনের মেলে ধরা ড্রয়িং বুকে শোভা পাচ্ছে একজন মা, যারা চারপাশটা কাঁটাগাছে ভরপুর, মাথায় ফুলের মুকুট নিয়ে মা স্ফীত গর্ভ দুই হাত দিয়ে আগলে রেখেছেন, গর্ভের ভেতর নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে একটা ছোট মানব শিশু।
রুমনের কল্পনা শক্তি দেখে মরিয়ম হতবাক হয়ে যায়, মনের অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ে দুচোখ বেয়ে। রুমনকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, রুমন আড়ষ্ট হয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু মায়ের ভালোবাসা যে অনুভব করছে, সেটা বোঝে মরিয়ম। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে, এই অসময়ে কে আসল ভেবে, চোখ মুখ মুছে দরজা খুলতে যায় মরিয়ম।
“আসসালামু আলাইকুম আপু।”
“রুমি!”
একগাদা ফলমূল হাতে দরজায় রুমিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২৩
রাকিন বারবার চশমাটা ঠিক করার বাহানায় রুমিকে দেখে নিচ্ছে। কী মিষ্টি লাগছে রুমিকে, গোলাপি জামদানীর সাথে হালকা সোনার গয়না, আর মাথার হাত খোঁপায় সাদা বেলীফুল। মুখে যতটুকু প্রসাধনী না হলেই নয়, চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক, দুই হাত ভর্তি একরাশ কাঁচের চুড়ি। সবমিলিয়ে চমৎকার।
আজ রুমির ছোটবোন রশ্মির বিয়ে। রৌশন আপা ছাড়া রুমির কলিগরা মোটামুটি সবাই এসেছেন। রুমি বাবা মায়ের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেয়। হাসান বেশ আগ্রহ নিয়ে রুমির বাড়ির সবার সাথে কথা বলে। রুমির ছোটভাই আদিলের সাথেও পরিচিত হয়। রাকিন বরাবরই চাপা স্বভাবের, কুশল বিনিময় ছাড়া তেমন কিছু তার মুখ দিয়ে বের হয় না। কয়েকবার রুমির সামনে এসে ভেবেছে দুটো প্রশংসার কথা বলবে। কিন্তু গলা শুকিয়ে যায়। তারচেয়ে বরং তিতলির সাথে মেশা রাকিনের জন্য সহজ হয়।
আড় চোখে বারবার রুমিকে দেখতে দেখতে রাকিনের মনে হচ্ছে কতদিন বিয়ে বাড়িতে এত স্নিগ্ধ সুন্দর সাজে কাউকে দেখে না। ইদানীং বিয়ে বাড়িতে আসা প্রত্যেক মেয়ের একই রকম পার্লারের চড়া সাজের প্রলেপ, সেট করা চুল, আর ভারী গয়নার বাহার দেখতে দেখতে কেমন একঘেয়ে লাগে। বৌর সাথে সাথে বাড়ির অন্য মেয়েরাও ব্রাইডাল সাজে ঘুরে বেড়ায়। টিকলি, নোলক আর লেহেঙ্গার ভীরে কে যে কনে, কে যে কনের বোন, তা বোঝা দায়। রুমি তিতলিকেও সুন্দর একটা ফ্রক পরিয়েছে। রাকিনের সাথে তিতলি বেশ মিশে গিয়েছে, এখন রুমির কলিগদের ভীরে তিতলি রাকিনের কোলেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
“মরিয়ম আপু, তুমি এসেছ, এত এত খুশি হয়েছি। আর শিহাব ভাইয়া আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ আপুকে নিয়ে এসেছেন।”
“রুমি তুমি নিজে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছ, না এসে পারি। তবে বেশিক্ষণ থাকব না। রুমনকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর দাদু আর ফুপির কাছে রেখে এসেছি।”
“ওকেও নিয়ে আসতেন আপু। ওর এখানে কোন সমস্যা হতো না, আমি খেয়াল রাখতাম।”
“জানি রুমি। তবে ইচ্ছে করেই আনিনি, এত লোকের ভীর ও পছন্দ করে না। থাক বাদ দাও, তোমার কথা বলো, এত সুন্দর লাগছে, আজ অনেকের নজর ঘুরে ঘুরে তোমার দিকেই আটকে যাচ্ছে।”
“আর নজর আটকানো আপু। যখন আমার সাথে তিতলির কথা শুনবে, নজর ঘুরতে সময় লাগবে না। এই দায়িত্ব সবাই নিতে পারে না।”
মরিয়ম ঘুরে একবার হাসান, আরেকবার রাকিনকে দেখে। হাসান আড্ডায় ব্যস্ত। রাকিন একপাশে বসে তিতলিকে জিলাপি খাওয়াচ্ছে।
“রাকিনকে দেখ। এমনি মুখচোরা, কিন্তু তিতলির সাথে কেমন মিশে গেল।”
“হ্যাঁ আপু, আমিও অবাক।”
সময় গড়িয়ে যায়, বিয়ের আয়োজন ভালো ভাবেই শেষ হয়। কলিগরা একে একে সবাই বিদায় নেয়। হাসানও রুমির কাছে বিদায় নিতে আসে। “রুমি তোমাকে কিন্তু আজ একদম একদম গোলাপি পরী লাগছে।” সেই একই রকম হৃদয় মোচড় দেওয়া মিষ্টি হেসে বলে হাসান।
রুমির মনে অনেক প্রশ্ন আছে, যা সে মরিয়ম আপার বাসা থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, আর রশ্মির বিয়ে শেষে যার জবাব খুঁজবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে হাসানের সামনে তার সেসব কিছুই মনে পড়ে না। তার মনে হয় এই তো সত্য, এই তো সুন্দর। তারপরও কিছু প্রশ্ন করার সময় এসেছে, “হাসান, আব্বা আম্মার সাথে তোমাকে আলাদা করে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। আর তিতলির সাথেও।”
“সবার সাথে পরিচিত তো হয়েছি। নতুন করে কী হবো? আর তিতলি তো রাকিনের সঙ্গই ছাড়ছে না। মানে রাকিন সবাইকে দেখাতে চায় সে বাবাহীন মেয়েকে কত আদর করছে।”
‘বাবাহীন মেয়েকে আদর’ কথাটা রুমির বড় কানে লাগে। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “রাকিন ভাই তো বড়দের সাথে অতটা কথা বলেন না। হয়তো বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। আর বাচ্চারা যেখানে আদর পায় সেখানে যায়। তুমি তো ওভাবে তিতলিকে সময় দাওনি। যাক সে কথা, আমি বলছিলাম অফিসিয়াল ভাবে আমাদের দুই পরিবারে পরিচিত হওয়ার কথা। আমার পরিবারে তোমার, আর তোমার পরিবারে আমার।”
“রুমি, তুমি এক বাচ্চার মা, কোন টিনএজ মেয়ে তো না যে এত অস্থির হচ্ছ। তুমি আমার সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করো, আর আমিও। এর বাইরে অফিসিয়াল দিকে আস্তে আস্তে যাই। আমরা তো একসাথে একান্তে সময়ও কাটাইনি এখনো। রিলেশনে থাকাকালীন যতটা কাছাকাছি আসা দরকার তাও তো আসা হলো না। আমি বুঝতে পারছি দীর্ঘদিন একা থাকায় একটা স্থায়ী সম্পর্কের জন্য তুমি অস্থির হয়ে আছ। কিন্তু তার আগে আমাদের দুজন দুজনকে আরও কাছ থেকে জানা প্রয়োজন, তাই না? চলো কাল তো ছুটির দিন, আমার সাথে বাইকে করে আশুলিয়া যাবে, একান্তে সময় না কাটালে বিশ্বাস আর ভালোবাসা আসবে কি করে। যাবে বলো?”
রুমি সহসা কোন জবাব দেয় না। হাসান জানাতে বলে চলে যায়। রুমি খেয়াল করিনি, কিন্তু রুমির মা সাহেদা বেগম দূর থেকে হাসান আর রুমি দু’জনকেই খুব ভালো করে খেয়াল করছিলেন।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২৪
“হ্যালো আপু?”
“কেমন আছ রুমি?”
“আপু সাক্ষী হবা?”
“কিসের সাক্ষী রুমি?”
“বিয়ের।”
“বিয়ে! কার বিয়ের সাক্ষী? কী হেঁয়ালি করছো রুমি?”
“আপু হাসান আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে।”
“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। অবশেষে হাসান কমিটমেন্টে আসতে রাজি হয়েছে।”
“হ্যাঁ আপু। আমি একটু শক্ত থেকেছি, তাতেই লাইনে এসে গিয়েছে।”
মরিয়ম রুমির চাপা আনন্দ টের পায়। হাসান রুমির জন্য কতটা ভালো তা মরিয়ম জানে না, কিন্তু রুমির চাপা আনন্দ মরিয়মকে ছুঁয়ে যায়।
“রুমি কিভাবে কী হলো? আমি তো জানতাম তুমি হাসানের সাথে আশুলিয়া যেতে মানা করে দিয়েছিলে, এরপর হাসান রাগ করে কথা বলছিল না। তারপর হঠাৎ বিয়ের কথা থেকে আসলো?”
“আপু হাসান ভেবেছিল ও রাগ করলে আমি নরম হয়ে যাব। কিন্তু আমি আমার কথায় অটল ছিলাম। আমি ওর সাথে যেকোন জায়গায় যেতে রাজি, কিন্তু তারজন্য সামাজিক স্বীকৃতি আগে চাই আমার। আজ হঠাৎ করে ও সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে দিলো।”
“ভালোই তাহলে। কিন্তু আমার সাক্ষী হতে হবে কেন? তোমাদের দুই পরিবারের কত মানুষ আছে।”
“আপু আমরা কোর্ট ম্যারেজ করবো এখন। তুমি আর রাকিন ভাই আমার তরফ থেকে দু’জন সাক্ষী হবে।”
মরিয়ম খেতে খেতে রুমির সাথে কথা বলছিল, হঠাৎ রুমির এমন কথা শুনে বিষম খায়। কাশতে কাশতে কয়েক চুমুক পানি খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়।
“রুমি কী বলো এইসব? কোর্ট ম্যারেজ কেন?”
“হাসান পরিবারের একমাত্র ছেলে, ওর মা খুব ইমোশনাল। ওর মায়ের কথা ভেবেই এতদিন আমাদের সম্পর্ক আগাতে পারেনি। এখনো যদি আমাকে বিয়ে করার কথা বলে, তিনি হয়তো কান্নাকাটি করে ওকে আটকে ফেলবে। তাই বিয়ে সেরে তারপর ও বাসায় জানাবে।”
“রুমি তুমি কী একটা উনত্রিশ বছর বয়সের ডাক্তার মেয়ের মতো ম্যাচুরিটি নিয়ে কথা বলছো? আমার মনে হচ্ছে আমি সদ্য ষোল পেরোনো কোন টিনএজের সাথে কথা বলছি। বিয়ের আগে বললে আন্টি কান্নাকাটি করবে, আর হঠাৎ বৌ নিয়ে গেলে খুব সুন্দর কোলে তুলে বরণ করে নেবে?”
“আপাততঃ আমরা তেমন কাউকে জানাব না আপু। সম্পর্কের একটা বৈধ নাম দেব। ও আস্তে আস্তে বাসায় ম্যানেজ করলে তখন ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে তুলে নিবে।”
“রুমি তুমি তোমার জীবনে জটিলতাময় এলোমেলো এক অধ্যায় পার করে এসেছ। হিমেলের প্রতারণা তোমাকে আর তিতলিকে কতটা রক্তাক্ত করেছে তা কী তুমি ভুলে গিয়েছ? নিজের সাথে তিতলির জীবনটা আবার কেন অনিশ্চিত করছো রুমি? আমি এই রুমিকে চিনি না। তুমি কী ভীষণ একাকিত্বে ভুগছো? না বাবার বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছ? না শুধু জৈবিক তাড়না? জৈবিক প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না রুমি, কিন্তু তার মূল্য যেন জীবন দিয়ে চুকাতে না হয়। তোমার এই বোকামির অংশ হতে পারব না।”
“আপু তুমি সব সময় নেগেটিভ বলো না প্লিজ। আমি তোমাকে কতটা পাশে চাই তুমি জানো না, আমার নিজের ভাই বোনের সাহায্য না নিয়ে তোমাকে ফোন দিলাম। প্লিজ আপু আমাকে একা করে দিও না। তিতলির জন্য আমি সবসময় আছি, ওর নিজের বাবার মেয়ের কোন খবর নেই, সেখানে হাসানের কাছে আমি খুব বেশি কিছু আশা করি না। তিতলির দেখাশোনা আমি করবো। আমার নিজের জীবনে শক্ত একটা হাত প্রয়োজন আপু। দেখো আমি ভুল করবো না এইবার। আরেকজন কাকে বলবো মনে হতে রাকিন ভাইয়ের কথা মনে হলো, তিনি সহজেই রাজি হয়েছে। কাল দুপুর একটায় মগবাজার কাজি অফিসে চলে এসো প্লিজ আপু।”
মরিয়ম ফোন রেখে থম মেরে বসে রইলো। আসলেই কী প্রেমে মানুষের বিবেকবুদ্ধি লোপ পায়! না হলে রুমির মতো পোড় খাওয়া মেয়ে এমন প্রস্তাবে রাজি হয়। মরিয়ম স্পষ্ট বুঝতে পারছে হাসান কোবদিন সামনাসামনি দায়িত্ব নেবে না, হয়তো সাময়িক আবেগ কেটে গেলে রুমিকে একা ফেলে চলে যাবে। প্রথমবার পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে একজন ভুল মানুষকে জীবনে এনেছিল রুমি। আর এইবার নিজে পছন্দ করে আরেকটা ভুল মানুষকে জায়গা দিচ্ছে না তো জীবনে। জীবন নিয়ে এ কী জুয়া ধরেছে রুমি।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২৬
রাত নয়টা পঁয়ত্রিশে পাঁচ লাখ টাকা কাবিনে রাকিন আর রুমির বিয়ে হয়ে যায়। কাবিনের টাকা রাকিনের পরিবারই ঠিক করেছে। রাকিন কাবিনের টাকা নগদে পরিশোধ করতে চায়, তাই তার সাধ্য মতো টাকার পরিমাণ রাখার অনুরোধ করেছে। রুমির বাবা মা অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন প্রস্তাব পেয়ে এতটাই অবাক হয়েছেন যে কোন কিছু নিয়ে অতিরিক্ত ঘাটা ঘাঁটি করতে চাইলেন না। রাকিন তার প্রথম বিয়ের কথা শুরুতেই খুলে বলেছে। যেহেতু রুমিরও এটা দ্বিতীয় বিয়ে, তাছাড়া রাকিন হাসান রুমির সম্পর্কে সবকিছু কাছ থেকে জেনেও রুমি আর তিতলিকে খুশী মনে নিজের জীবনের অংশ করতে যখন চাইছে তখন এই বিষয়টা ওনাদের কাছে বড় কোন সমস্যা মনে হয়নি।
যদিও আত্মীয় স্বজনদের হঠাৎ ফোন করে বিয়ের কথা জানাতে সবাই ভীষণ অবাক হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্বল্প সময়ের ভেতর সবাই হাজির হয়েছেন। রুমির মামার আরও বেশি কাবিন ধরার ইচ্ছে ছিল, অন্তত দশলাখ, কিন্তু বোন আর দুলাভাই রাজি দেখে এই নিয়ে কথা বাড়াননি।
রুমির ছোটবোন রশ্মি স্বামীকে নিয়ে এই শর্ট নোটিশে মিরপুর থেকে চলে এসেছে। এছাড়া মামা মামী, আর তিন চাচা চাচীও এসেছেন। রাকিন তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ আটজন মানুষকে আনার ব্যবস্থা করেছে। অল্প সময়ের ভেতর পঁচিশ জন মানুষ নিয়ে খুব ছোট করেই বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হয়ে যায়। রুমির আর পোশাক বদলানো হয়নি, যে লাল বালুচরি শাড়ি পরে আজ হাসানকে বিয়ে করতে কাজী অফিসে গিয়েছিল, সেই লাল বালুচরিতেই রাকিনকে তিনবার কবুল বলে গ্রহণ করে নেয়।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রুমি বিয়ে নিয়ে নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু মরিয়ম আপা আর রুমির আম্মা এমন করে বোঝালেন যে আর না করতে পারেনি। আরও একবার নিজের ভালো থাকাটা অদৃষ্টের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে রুমি। এমনকি রাকিনের আম্মা যখন মাথায় হাত বুলিয়ে বালা দুটি পরিয়ে দেন, তখনও একদম নিশ্চল ছিল সে। সাহেদা বেগম রুমিকে ধরে সবাইকে সালাম করায়।
“রুমি তোমার কথা রাকিন যতটুকু আমাকে বলেছে, আমি বুঝতে পারছি, আমার ছেলেটার মতো তুমিও পরিস্থিতি আর দুর্ভাগ্যের শিকার। তবে মা তোমাদের দু’জনের কাছেই অনুরোধ থাকবে, খুব হুট করে নতুন জীবনে ঢুকলেও হুট করে কোন সিদ্ধান্ত আর নিও না। আমি বহুদিন ধরে রাকিনের পেছনে পরে আছি, কিন্তু জীবনটা আবার গুছিয়ে নিতে ও প্রস্তুত ছিল না। এখন একদম হঠাৎ করে ও তোমার কথা বললো, আমিও না করতে পারিনি। আগেরবার তো নিজে দেখেশুনে বিয়ে দিয়েও ছেলে সুখী হয়নি। এবার নিজের পছন্দে যেহেতু তোমরা দু’জন বিয়ে করছো, আশা করি সুখ খুঁজে পাবে। না পেলেও খোঁজার চেষ্টাটা অন্তত করবে।”
রুমি কোন উত্তর দিতে পারে না, বলা হয় না যে এবারও নিজের পছন্দে নিজের জীবনসঙ্গী বাছাই করছে না ও। আগের বার পরিবার করেছে, আর এইবার বোধহয় অদৃষ্ট। নিতান্তই কলের পুতুলের মতো বসে ছিল রুমি। মরিয়ম আপা আর রশ্মি হালকা মেকআপ দিয়ে ওকে সাজিয়ে দিয়েছে। সাহেদা বেগম একসেট সোনার গয়না বের করে দেন, যেগুলো রুমিরই গয়না, ডিভোর্সের পর ওনার কাছে ছিল। আগের গয়না গুলো দিয়েই আবার বৌ সাজে রুমি।
আদিল দ্রুত লোকাল দোকান থেকে হবু দুলাভাইয়ের জন্য সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ সাদামাটা আয়োজন। কিন্তু রুমি আর রাকিনকে যখন পাশাপাশি বসানো হয় যেন ঘরময় আলো খেলে গেল। দু’জনকে এতটাই মানিয়েছে যে এই সাধারণ সাজেই বর কনেকে অপরূপ লাগছে। ঘরে থাকা আড়ংয়ে কাঠের নকশা করা আয়না যখন সামনে ধরে রুমির মুখটা রাকিনকে দেখানো হয়, রাকিনের মনে হচ্ছিল “পাইলাম, অবশেষে আমি ইহাকে পাইলাম।”
রুমি অবশ্য মুখ তুলে চায় না।
রুমির যেহেতু কিছু গোছানো নেই, তাই আজ রাতটা এই বাসায় থেকে কাল রাকিনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সবাই। কিন্তু রাকিনের আম্মা জেসমিন আক্তার ছেলে বৌ নিয়ে আজই রওনা দিতে চান। নতুন বৌ বরণ করে নিতে ওনার তর সইছে না। শেষ পর্যন্ত ছোট একটা হাত ব্যাগে নিজের আর তিতলির প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস গুছিয়ে নেয় রুমি। সারাদিন মরিয়ম আপা ছায়ার মতো ওর পাশেই ছিল,
“আপু, তোমার এই শরীরে আমার জন্য এত কষ্ট করেছ। কোন একদিন তীব্র অভিমানে তোমাকে বলেছিলাম, আমার বোন হলে বাসায় থাকতে কী না করতে পারতে কিনা। আজ সেই কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমার বোনও বোধহয় আজ আমাকে এভাবে সামলে নিতে পারতো না। ঠিক যেখানে আমার পাশে দাঁড়ানো দরকার ছিল, তুমি সেখানে দাঁড়িয়েছ। তোমার আর ভাইয়ার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন। দোয়া করো সুখী না হই, অন্তত তিতলিকে নিয়ে ভালো যেন থাকি।”
“সুখী হবে রুমি, বিশ্বাস করো, মানুষ চেনার একটা চোখ আছে আমার। আমি শিহাবকে চিনেছিলাম ঠিক ঠিক। আজ রাকিনের মাঝে সেই বহুদিন আগের শিহাবের ছোঁয়াই পাচ্ছি। দেখ ও তোমার হাত ছাড়বে না।”
বিদায় বরাবরই বেদনার, বাবা মা কে ছেড়ে আরেকবার যেতে রুমির হৃদয়ে একই রকম রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বাবা অবসরের পর অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছেন। আদিলটা যেমন স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে, রুমি আর রশ্মির বিদায়ের পর কী নিজের সংসারে মা সাহেদা বেগমের দিনগুলো ভালো কাটবে, আদিল আর আদিলের স্ত্রী কী সব দায়দায়িত্ব নেবে। রুমি কী পারবে দূর থেকে বাবা মায়ের খেয়ালটা রাখতে, আগের মতো মায়ের হাতে কিছু খরচ দিতে। মা মুখে না বলুক, রুমি জানে ঐ সামান্য কয়টা টাকাই সাহেদা বেগমের শক্তি এখন। রাকিন বা তার পরিবার কী বিয়ের পর এতে বাঁধা দেবে! আর তিতলি! তিতলিকে কী ওনারা নিজেদের অংশ রূপে গ্রহণ করবে, না বৈরী পরিস্থিতিতেই ওর শৈশব কাটবে। রাকিন তিতলির বাবা না হোক, অভিভাবক কী অন্তত হবে! এমনই হাজারো প্রশ্ন সাথে নিয়ে বাড়ি ছাড়ে রুমি, কোলে ছোট্ট তিতলি, যে ভীষণ খুশি, অনেকদিন পর সাজুগুজু করে মায়ের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে, সাথে আছে প্রিয় রাকিন আঙ্কেল। নানা নানু যদিও রাকিন আঙ্কেলকে আব্বু বলতে বলেছে, কিন্তু তিতলির মন তা মানতে নারাজ, তার তো আব্বু আছেই, যদিও আব্বু এখন আর দেখা করতে আসে না। তবুও রাকিনকে সে আঙ্কেলই বলবে, আব্বু না।
(যারা আমার লেখা পছন্দ করেন, তারা বইটই এপস হতে আমার সদ্য প্রকাশিত ই-বুক “প্রেম কিংবা দ্রোহ” সংগ্রহ করতে পারেন। দুটি অপ্রকাশিত গল্প রয়েছে ই-বুকে। আশা করি ভালো লাগবে। মূল্য ২৫ টাকা।
যেভাবে বইটই থেকে ই-বুক ক্রয় করবেন:
https://youtube.com/shorts/6NjaAveyh6A?feature=share)
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২৬
রাত নয়টা পঁয়ত্রিশে পাঁচ লাখ টাকা কাবিনে রাকিন আর রুমির বিয়ে হয়ে যায়। কাবিনের টাকা রাকিনের পরিবারই ঠিক করেছে। রাকিন কাবিনের টাকা নগদে পরিশোধ করতে চায়, তাই তার সাধ্য মতো টাকার পরিমাণ রাখার অনুরোধ করেছে। রুমির বাবা মা অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন প্রস্তাব পেয়ে এতটাই অবাক হয়েছেন যে কোন কিছু নিয়ে অতিরিক্ত ঘাটা ঘাঁটি করতে চাইলেন না। রাকিন তার প্রথম বিয়ের কথা শুরুতেই খুলে বলেছে। যেহেতু রুমিরও এটা দ্বিতীয় বিয়ে, তাছাড়া রাকিন হাসান রুমির সম্পর্কে সবকিছু কাছ থেকে জেনেও রুমি আর তিতলিকে খুশী মনে নিজের জীবনের অংশ করতে যখন চাইছে তখন এই বিষয়টা ওনাদের কাছে বড় কোন সমস্যা মনে হয়নি।
যদিও আত্মীয় স্বজনদের হঠাৎ ফোন করে বিয়ের কথা জানাতে সবাই ভীষণ অবাক হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্বল্প সময়ের ভেতর সবাই হাজির হয়েছেন। রুমির মামার আরও বেশি কাবিন ধরার ইচ্ছে ছিল, অন্তত দশলাখ, কিন্তু বোন আর দুলাভাই রাজি দেখে এই নিয়ে কথা বাড়াননি।
রুমির ছোটবোন রশ্মি স্বামীকে নিয়ে এই শর্ট নোটিশে মিরপুর থেকে চলে এসেছে। এছাড়া মামা মামী, আর তিন চাচা চাচীও এসেছেন। রাকিন তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ আটজন মানুষকে আনার ব্যবস্থা করেছে। অল্প সময়ের ভেতর পঁচিশ জন মানুষ নিয়ে খুব ছোট করেই বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হয়ে যায়। রুমির আর পোশাক বদলানো হয়নি, যে লাল বালুচরি শাড়ি পরে আজ হাসানকে বিয়ে করতে কাজী অফিসে গিয়েছিল, সেই লাল বালুচরিতেই রাকিনকে তিনবার কবুল বলে গ্রহণ করে নেয়।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রুমি বিয়ে নিয়ে নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু মরিয়ম আপা আর রুমির আম্মা এমন করে বোঝালেন যে আর না করতে পারেনি। আরও একবার নিজের ভালো থাকাটা অদৃষ্টের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে রুমি। এমনকি রাকিনের আম্মা যখন মাথায় হাত বুলিয়ে বালা দুটি পরিয়ে দেন, তখনও একদম নিশ্চল ছিল সে। সাহেদা বেগম রুমিকে ধরে সবাইকে সালাম করায়।
“রুমি তোমার কথা রাকিন যতটুকু আমাকে বলেছে, আমি বুঝতে পারছি, আমার ছেলেটার মতো তুমিও পরিস্থিতি আর দুর্ভাগ্যের শিকার। তবে মা তোমাদের দু’জনের কাছেই অনুরোধ থাকবে, খুব হুট করে নতুন জীবনে ঢুকলেও হুট করে কোন সিদ্ধান্ত আর নিও না। আমি বহুদিন ধরে রাকিনের পেছনে পরে আছি, কিন্তু জীবনটা আবার গুছিয়ে নিতে ও প্রস্তুত ছিল না। এখন একদম হঠাৎ করে ও তোমার কথা বললো, আমিও না করতে পারিনি। আগেরবার তো নিজে দেখেশুনে বিয়ে দিয়েও ছেলে সুখী হয়নি। এবার নিজের পছন্দে যেহেতু তোমরা দু’জন বিয়ে করছো, আশা করি সুখ খুঁজে পাবে। না পেলেও খোঁজার চেষ্টাটা অন্তত করবে।”
রুমি কোন উত্তর দিতে পারে না, বলা হয় না যে এবারও নিজের পছন্দে নিজের জীবনসঙ্গী বাছাই করছে না ও। আগের বার পরিবার করেছে, আর এইবার বোধহয় অদৃষ্ট। নিতান্তই কলের পুতুলের মতো বসে ছিল রুমি। মরিয়ম আপা আর রশ্মি হালকা মেকআপ দিয়ে ওকে সাজিয়ে দিয়েছে। সাহেদা বেগম একসেট সোনার গয়না বের করে দেন, যেগুলো রুমিরই গয়না, ডিভোর্সের পর ওনার কাছে ছিল। আগের গয়না গুলো দিয়েই আবার বৌ সাজে রুমি।
আদিল দ্রুত লোকাল দোকান থেকে হবু দুলাভাইয়ের জন্য সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ সাদামাটা আয়োজন। কিন্তু রুমি আর রাকিনকে যখন পাশাপাশি বসানো হয় যেন ঘরময় আলো খেলে গেল। দু’জনকে এতটাই মানিয়েছে যে এই সাধারণ সাজেই বর কনেকে অপরূপ লাগছে। ঘরে থাকা আড়ংয়ে কাঠের নকশা করা আয়না যখন সামনে ধরে রুমির মুখটা রাকিনকে দেখানো হয়, রাকিনের মনে হচ্ছিল “পাইলাম, অবশেষে আমি ইহাকে পাইলাম।”
রুমি অবশ্য মুখ তুলে চায় না।
রুমির যেহেতু কিছু গোছানো নেই, তাই আজ রাতটা এই বাসায় থেকে কাল রাকিনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সবাই। কিন্তু রাকিনের আম্মা জেসমিন আক্তার ছেলে বৌ নিয়ে আজই রওনা দিতে চান। নতুন বৌ বরণ করে নিতে ওনার তর সইছে না। শেষ পর্যন্ত ছোট একটা হাত ব্যাগে নিজের আর তিতলির প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস গুছিয়ে নেয় রুমি। সারাদিন মরিয়ম আপা ছায়ার মতো ওর পাশেই ছিল,
“আপু, তোমার এই শরীরে আমার জন্য এত কষ্ট করেছ। কোন একদিন তীব্র অভিমানে তোমাকে বলেছিলাম, আমার বোন হলে বাসায় থাকতে কী না করতে পারতে কিনা। আজ সেই কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমার বোনও বোধহয় আজ আমাকে এভাবে সামলে নিতে পারতো না। ঠিক যেখানে আমার পাশে দাঁড়ানো দরকার ছিল, তুমি সেখানে দাঁড়িয়েছ। তোমার আর ভাইয়ার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন। দোয়া করো সুখী না হই, অন্তত তিতলিকে নিয়ে ভালো যেন থাকি।”
“সুখী হবে রুমি, বিশ্বাস করো, মানুষ চেনার একটা চোখ আছে আমার। আমি শিহাবকে চিনেছিলাম ঠিক ঠিক। আজ রাকিনের মাঝে সেই বহুদিন আগের শিহাবের ছোঁয়াই পাচ্ছি। দেখ ও তোমার হাত ছাড়বে না।”
বিদায় বরাবরই বেদনার, বাবা মা কে ছেড়ে আরেকবার যেতে রুমির হৃদয়ে একই রকম রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বাবা অবসরের পর অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছেন। আদিলটা যেমন স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে, রুমি আর রশ্মির বিদায়ের পর কী নিজের সংসারে মা সাহেদা বেগমের দিনগুলো ভালো কাটবে, আদিল আর আদিলের স্ত্রী কী সব দায়দায়িত্ব নেবে। রুমি কী পারবে দূর থেকে বাবা মায়ের খেয়ালটা রাখতে, আগের মতো মায়ের হাতে কিছু খরচ দিতে। মা মুখে না বলুক, রুমি জানে ঐ সামান্য কয়টা টাকাই সাহেদা বেগমের শক্তি এখন। রাকিন বা তার পরিবার কী বিয়ের পর এতে বাঁধা দেবে! আর তিতলি! তিতলিকে কী ওনারা নিজেদের অংশ রূপে গ্রহণ করবে, না বৈরী পরিস্থিতিতেই ওর শৈশব কাটবে। রাকিন তিতলির বাবা না হোক, অভিভাবক কী অন্তত হবে! এমনই হাজারো প্রশ্ন সাথে নিয়ে বাড়ি ছাড়ে রুমি, কোলে ছোট্ট তিতলি, যে ভীষণ খুশি, অনেকদিন পর সাজুগুজু করে মায়ের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে, সাথে আছে প্রিয় রাকিন আঙ্কেল। নানা নানু যদিও রাকিন আঙ্কেলকে আব্বু বলতে বলেছে, কিন্তু তিতলির মন তা মানতে নারাজ, তার তো আব্বু আছেই, যদিও আব্বু এখন আর দেখা করতে আসে না। তবুও রাকিনকে সে আঙ্কেলই বলবে, আব্বু না।
(যারা আমার লেখা পছন্দ করেন, তারা বইটই এপস হতে আমার সদ্য প্রকাশিত ই-বুক “প্রেম কিংবা দ্রোহ” সংগ্রহ করতে পারেন। দুটি অপ্রকাশিত গল্প রয়েছে ই-বুকে। আশা করি ভালো লাগবে। মূল্য ২৫ টাকা।
যেভাবে বইটই থেকে ই-বুক ক্রয় করবেন:
https://youtube.com/shorts/6NjaAveyh6A?feature=share)
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২৭
গাড়িতে আসতে আসতেই তিতলি ঘুমিয়ে পড়েছে, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা, এত রাত জেগে থাকার অভ্যেস তিতলির নেই, দশটা না বাজতে ঘুমিয়ে পড়ে। তিতলিকে কোলে করেই নতুন জীবন আর বাড়িতে প্রবেশ করে রুমি।
রুমিকে বরণ করা নিয়ে বেশি ঝামেলা করেনি রাকিনের মা আর বড় বোন। রাকিনের বোন সিমি রুমিদের বাসায় যাননি, দুলাভাই গিয়েছেলেন। বোন বাসা গুছিয়ে নিয়েছে এই সময়ে, তিনিই রুমিকে শরবত খাইয়ে বরণ করে নিলেন। তবে রুমির কোলে ঘুমন্ত তিতলিকে দেখে খুব একটা খুশি হয়েছেন বলে মনে হলো না। রুমিকে সোফায় বসিয়ে দিলেন, তিতলি কোলেই ঘুমাচ্ছে।
“তোমার এত বড় মেয়ে আছে জানতাম না। তা এতরাতে কষ্ট করে ওকে সাথে না নিয়ে আসলেও হতো, কাল নানা নানুর সাথে বেড়িয়ে যেত।”
বেড়ানোর কথা কী বললেন আপু ঠিক বুঝলো না রুমি। তাছাড়া তিতলি বেড়াতে আসবে কেন! যেখানে রুমি, সেখানেই তিতলি থাকবে, এই কথা তো আগেই পরিষ্কার করে বলে নিয়েছে। রুমি কিছু বলার আগে রাকিনই উত্তর দেয়, “বেড়াতে আসবে কী আপু, তিতলি তো আমাদের সাথেই থাকবে। আজ বরং ওর কাপড়চোপড় সব আনতে পারিনি, কাল ওর মামা দিয়ে যাবে।”
“ও এখানে থাকবে? কোন রুমে থাকবে? রুম তো মোটে তিনটা। ছোট মানুষ আম্মার সাথে থাকলে রাতে হয়তো বারবার জাগবে, কান্না করবে, তাতে আম্মার ঘুমের সমস্যা হবে। আর গেস্টরুম ব্লক করে ফেললে আমরা আসলে থাকবো কোথায়? না এখন থেকে বেড়াতে এসে রাতে থাকা যাবে না, চলে যেতে হবে।”
“তিতলি আমার সাথে ঘুমাবে, ও কখনো আমাকে ছাড়া থাকেনি আপু।” রুমি নিচু স্বরে জবাব দেয়। প্রথম দিনই কোন তর্কে জড়াতে চায় না। রুমি জানে নতুন নতুন পায়ে পায়ে দোষ ঘুরে বেড়াবে, নতুন বৌয়ের কথা আচার আচরণ সব অতসী কাঁচের নিচে রাখা হবে।
“তোমার সাথে আগে থেকেছে, কারণ তখন তুমি একা ছিলে। কিন্তু এখন তুমি আর রাকিন একসাথে থাকবে। রাতবিরাতে তোমাদের এলোমেলো কাজকারবার কিছু দেখা তো বাচ্চার জন্যও ঠিক না।”
অস্বস্তি আর বিরক্তিতে রুমির গা রিরি করে উঠলো। এই টক্সিক কথাগুলো থেকে কী দুনিয়ার কোথাও গেলে ও শান্তি পাবে না! কী বিশ্রী কথা, ‘এলোমেলো কাজকারবার’।
“সিমি, কী বলতেছিস এসব? আমি সামনে আছি, তোর জামাই আছে, সবার সামনে কী কথা বলা উচিত আর উচিত না তা জানোস না?”
“আম্মা ভুল কী বলছি? এই কথায় এত লজ্জার বা কী আছে? ওরা দুইজনই অভিজ্ঞ, নতুন জামাই বৌ না যে লজ্জায় লাল হবে। আগে থেকে ভাব ভালোবাসা, তাই তো এমন হন্তদন্ত হয়ে বিয়ে। রুমির তো ছেলেমেয়েও হয়ে গিয়েছে, নতুন করে আর লজ্জার বাকি কী আছে?”
“আপু, রুমির একটাই মেয়ে তিতলি।”
” জানি, ছেলেমেয়ে কথার কথা বললাম আরকি। তবে তোকে এতদিন ধরে এত মেয়ে দেখালাম, বিয়ের কথা বললাম, তখন খালি করবো না করবো না করলি। আর এখন হুট করে বাচ্চাসহ রেডিমেড বৌ নিয়ে এসেছিস। আবার এমন ঢং করছিস যেন দুজনই লাজুক লতা।”
“আপা, তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? সমস্যাটা কী? আমি নিজে রুমিকে পছন্দ করেছি। তিতলির কথা জেনেশুনেই করেছি, এবং বলা যায় তিতলি আমাদের বিয়ের একটা কারণ।”
“মাগো, ভালোই তো। তোর আগের বৌ বলতো তুই রোমান্টিক না, রোবট টাইপের, আমরাও তাই ভাবতাম। এখন দেখি তোর ভালোই উন্নতি হয়েছে। আম্মা এইবার আর ছেলে নিজের থাকবে না।”
জেসমিন আক্তার মেয়ের উপর মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হোন, কিন্তু সিমিকে কড়া করে কিছু বললে কেঁদে কেটে মহল খারাপ করবে। এই মেয়েটা কেন এমন করে তিনি বুঝেন না, অথচ কালে কালে বয়স কম হয়নি সিমির, রাকিনের পাঁচ বছরের বড়ো, দুই বাচ্চার মা। তারপরও সবসময় এমন আচরণ।
“আহ্ সিমি এই খুশির সময়ে কী শুরু করলে? রাকিনের ইচ্ছে করেছে বিয়ে করেছে। এতদিন মনের মতো মেয়ে পায় নাই করে নাই। ও এখন আর ছোটো মানুষ না যে সবসময় তোমাদের জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। সেই কখন থেকে অযথা কিসের অভিমান দেখাচ্ছ জানি না। বাসা গুছানোর বাহানা দিয়ে ঐ বাসায় গেলা না, বাচ্চাদেরও দিলে না। তো কী বাসা গুছালে! রাকিনের রুমটাও সাজালে না। আমি না টাকা দিয়ে গেলাম ফুল আনানোর জন্য।” সিমির উপর বিরক্ত হয়ে রাকিনের দুলাভাই সোহেল ধমকে উঠে। সোহেল আগেও দেখেছে, সব খুশির দিনে অযথা একটা ছুতো ধরে অভিমান দেখানো সিমির স্বভাব। শুধু বাবার বাড়ি না, শ্বশুরবাড়িতেও একই কাজ করে। সোহেলের ছোটভাইয়ের শারমানের বিয়েতেও সিমি কম তামাশা করেনি, প্রতিটি ফাংশনে একবার করে রাগ দেখিয়েছে, হলুদের দিন রাগ করে কমিউনিটি সেন্টার থেকে চলে এসেছিল, কারণ শারমানের পরিবার নাকি ওকে সম্মান করে আগে স্টেজে উঠতে দেয়নি! আর এখানে রাগের কারণ হলো রাকিন আগে থেকে কিছু জানায়নি, হঠাৎ করে ফোন দিয়ে সবাইকে বিয়ের কথা বলেছে। এমন হঠাৎ বিয়ের কথা সিমি মেনে নিতে পারেনি, তাই অভিমান করে যায়নি, ভেবেছিল সবাই সাধাসাধি করবে, কিন্তু সিমির স্বভাবের কথা সবারই জানা, তাছাড়া জেসমিন আক্তার মনে মনে স্বস্তি পেয়েছিলেন সিমি যাবে না শুনে। কেননা তিনিও জানেন সিমি গেলে অযথা একটা ভ্যাজাল লাগাবে। রাকিন এতদিনে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, তাই তো রুমির বাচ্চা আছে শুনেও তিনি আপত্তি করেননি।
“এই যে তোমার টাকা। আমি কী ফুল কিনতে এখন শাহবাগ যাব? যতটুকু সম্ভব গুছিয়েছি রুম, বিছানার চাদর বদলে নতুন চাদর দিয়েছি, এমন তাড়াহুড়োর বিয়েতে আর কী সাজাব?”
“দুলাভাই বাদ দিন। আম্মা এককাজ করো, রুমিকে রুমে নিয়ে যাও, ও তিতলিকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিক। আমি আসছি একটু।”
“তুই কই যাস এই রাতে?”
“একটু নিচে যাই। মানা করো না তো, যাব আর আসব।”
রাকিনের রুমটা বেশ বড়, দক্ষিণে খোলা বারান্দা। রুমে এককোণায় একটা কাপড় রাখার স্ট্যান্ড, তাতে রাকিনের কিছু কাপড় ঝুলছে। দেয়ালে আড়ংয়ের একটা আয়না লাগানো যাতে চিরুনি রাখার মতো একটু স্ট্যান্ড করে দেওয়া। পারফিউমের একটা বোতল, একটা নেভিয়া ক্রিম, আর চিরুনি রাখা আছে। একপাশে একটা পড়ার টেবিল আর বুকশেলফ। খাটের পাশে ছোট একটা ওয়ারড্রব। রুমি খুটিয়ে খুটিয়ে পুরোটা রুম দেখলো। খাটের মাঝামাঝি তিতলিকে শুইয়ে দিয়েছে রুমি।
হাতব্যাগ থেকে পোশাক বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়। গোসল করে শাড়ি পাল্টে সালোয়ার কামিজ পরে নিয়েছে, যদিও মেকআপ তেমন কিছু ছিল না, তারপরও সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি কাটাতে শাওয়ার নেওয়ার বিকল্প নেই। গয়না গুলো খুলে হাতব্যাগে রেখে দিয়েছে, শুধু শুধু গয়না পরে নতুন বৌয়ের মতো বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কোনকিছুই আসলে রুমির ইচ্ছে করছে না। যদিও একটু হলেও সাজগোজ করা উচিত, কিছু না হোক বিয়ে যেহেতু হয়েছে রাকিনের সাথে, নিজেকে তাই একটু হলেও গুছিয়ে রাখা উচিত, এমন বৈধব্য বেশ নিশ্চয়ই রাকিনের ভালো লাগবে না।
বিয়ের আগে যদিও নিপাট ভদ্রলোক হয়েই ছিল রাকিন, কিন্তু বিয়ের পর নিজের অধিকার আদায়ে পেছপা কেন হবে। রাকিন কী রুমির ইচ্ছে অনিচ্ছের সম্মান করবে! না আর দশজনের মতো নিজেরটা আদায় করে নিতে উদগ্রীব থাকবে। রুমির মাথায় অনেক কিছু আসলেও কোন কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয় না। যা হয় সহজভাবে গ্রহণ করবে, মনকে তাই বুঝিয়ে নেয়। নিজের ফেসওয়াশটা ব্যাগেই ছিল, তাই দিয়ে মুখ ধুয়ে নিয়েছে। রাকিন এখনো ফিরেনি। খাটে বসে ভেজা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে হিমেলের সাথে বিয়ের দিনের কথা না চাইলেও মনে পড়ে যায় রুমির। কত আয়োজন আর আলোর রোশনাই ছিল সেদিন। সাজানো বাসরঘরে কতরকম ছবি তোলা হয়েছিল। নামকরা পার্লার থেকে সাজ, ভারী গয়না আর লেহেঙ্গায় রাজরানীর বেশ নিয়েছিল যেন রুমি। আর হিমেলেও কম যায়নি, জমকালো শেরওয়ানিতে রুমিকে টক্কর দিয়েছিল। সেদিন রাতে রুমির একঘন্টা লেগেছিল শুধু চুল খুলে মেকআপ তুলতে। পোশাক পাল্টে লাগেজ থেকে রাত পোশাকটা বের করে নিয়েছিল রুমি। সেই নাইট ড্রেসটা হিমেলই পছন্দ করে কিনেছিল। প্রথম বার কাছে আসার এক তীব্র অনুভূতি ছিল সেদিন, লজ্জা পেলেও শরীরে শিহরণ খেলে যাচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে।
অথচ আজ তার কোনকিছুই নেই, না সেই শিহরণ না অনুভূতি। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় ঘরবাড়ি সাজানোর কোন বালাই নেই, তবু বিছানায় একটা পরিষ্কার চাদর বিছানো হয়েছে। এমনিতে রাকিন বেশ পরিপাটি মনে হচ্ছে। রুমে এদিকসেদিক এলোমেলো কাপড় পড়ে নেই, পড়ার টেবিলটা গোছানো, টিপটপ। তিতলিকে শুয়ে দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় রুমি, ভাবে একটু কী পরিপাটি হবে! বেশি কিছু না, ভেজা চুলতো আঁচড়ে নিয়েছে, এখন চোখে একটু কাজল দিলেই হয়। কিন্তু এই সাজটুকু রাকিন যদি তা সম্মতি ভেবে নেয়! তিতলিও এই রুমে আছে, হঠাৎ উঠে গিয়ে আসলেও অপ্রীতিকর কিছু দেখে ফেলবে না তো। যদিও শারীরিক কিছুর বিন্দুমাত্র আগ্রহ এখন নেই রুমির, কিন্তু একাকী কামরায় পূর্ণ অধিকার পাওয়ার পর কতটা নিজেকে সামলে রাখবে রাকিন, তা রুমির জানা নেই। কেননা ভদ্রতার মুখোশ খুলে গেলে ভদ্রলোকেরা ভীষণ ভয়ংকর হয়ে যায়।
“রুমি।” হঠাৎ রাকিনের সম্বোধনে এতটাই চমকে ওঠে, হাত থেকে সশব্দে চিরুনি পরে যায়।
“স্যরি, তোমাকে ভয় পাইয়ে দিলাম বোধহয়।”
“না না ঠিক আছে। আমি একটু অন্যমনষ্ক ছিলাম।” রাকিনের হাতে একরাশ রজনীগন্ধা দেখে মন ভালো হয়ে যায় রুমির। রজনীগন্ধা তার প্রিয় ফুল।
“রুমি, টিচার্স রুমে একদিন বলেছিলে, রজনীগন্ধা তোমার প্রিয় ফুল। তাই নিয়ে এলাম। আর রুম সাজানে হয়নি তা একদিকে ভালোই হয়েছে। আমার মনে হয় একদিনে তোমার মনের উপর যথেষ্ট চাপ পড়েছে। বিয়ের রাতেই বাসর হবে এমন তো কথা নেই। ফুল না ফুটলেও বসন্ত হয়, কিন্তু মন সায় না দিলে ফুলশয্যাও কাঁটার বিছানা মনে হয়। শায়নাকে আমি বুঝিনি, ও আমাকে বুঝেনি। কিন্তু এইবার আমি রুমিকে বুঝতে চাই, চাই রুমিও আমাকে বুঝুক। শরীরটা না হয় তারপরই একে অপরকে পাক।”
****
বাসায় আসার পর থেকে মরিয়ম দেখছে শাশুড়ির মুখটা থমথমে। অবশ্য সেই দুপুর একটায় বের হয়েছিল মরিয়ম, আর ফিরেছে রাত দশটায়। যদিও শিহাব সাথে ছিল, কিন্তু সারাদিন সেজেগুজে বাইরে থাকাটা যে শাশুড়ির ভালো লাগেনি, তা জানে মরিয়ম।
“আম্মা, ভাত খেয়েছেন না?”
“হ্যাঁ। তোমরা?”
“খেয়েছি, রুমির বিয়ে ছিল তো। খেয়েই আসলাম। রুমন খায়নি, ও তো নিজের সময় না হলে যখন তখন খেতে চায় না। এখন খাইয়ে দেব।”
“মরিয়ম, এই বাচ্চাটা সুস্থ হোক চাও না তুমি? কিছু বললে আমি খারাপ হয়ে যাব। কিন্তু এই যে রাত বিরাতে সেজেগুজে বাইরে থেকে আসলে, কতরকম খারাপ বাতাসের আছর হয়।”
“আম্মা, এই বাচ্চাটা সুস্থ হোক মানে কী? রুমন অসুস্থ না, সেও সম্পূর্ণ সুস্থ।”
“মায়ের চোখে খোঁড়া, লুলা, পাগল সব এক। কিন্তু মানুষের চোখে না।”
একমুহূর্তের জন্য মাথায় আগুন ধরে যায় মরিয়মের, মনে থাকে না এখন সে আট মাসের গর্ভবতী।
“আম্মা, আমার বিশ্বাস হয় না আপনিই সেই মানুষ। আপনি না রুমনকে কত আদর করতেন, কেউ রুমনকে খারাপ কিছু বললে ঝগড়া লাগিয়ে দিতেন। আর আজ আপনি ওকে পাগল বলছেন?”
মা আর বৌয়ের উচ্চস্বরের কথা শুনে শিহাব বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে।
“আমি রুমনকে পাগল বললাম কোন সময়। তুমি ইদানীং বেশি বুঝতেছ মরিয়ম। শিহাব দেখ তোর বৌয়ের অবস্থা। এই জিদের জন্য প্রথম বাচ্চার ক্ষতি হলো, এখন এতদিন পর আরেকটা বাচ্চা আসছে, সেটারও ভালো হতে দিবে না।”
“আমি কী আমার বাচ্চার শত্রু মা? কেন ভালো হতে দেব না। আমি ইচ্ছে করে এতদিন বাচ্চা নেইনি। আমার মনে হয়েছিল এমন কিছু হবে। তাই হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে আরেকটা বাচ্চা নিয়ে আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আমার একটা সন্তানই যথেষ্ট ছিল।”
বলতে বলতে চেয়ার আঁকড়ে ধরে বসে যায় মরিয়ম, পেট জুড়ে তীব্র ব্যথার দমক উঠেছে। পা বেয়ে আঠালো তরল বেয়ে পড়ার অনুভূতি হয় মরিয়মের। বুঝতে পারছে পানি ভেঙে গিয়েছে, সময়ের আরও দেড় মাস আগেই।
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২৮
হাসপাতালের বারান্দায় বসে একমনে তসবি গুনছেন মরিয়মের শাশুড়ি মা। শিহাব কখনোই মাকে কড়া কিছু বলতে পারে না। তাছাড়া কখনো বলার প্রয়োজনও হয়নি, সবসময়ই মাকে ভীষণ বুঝদার একজন মানুষ মনে হয়েছে। অথচ মরিয়মের দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সির কথা জানার পর থেকেই মা কেমন অবুঝের মতো আচরণ করছেন। রুমনকে নিয়ে যে ওনার মনে এত কষ্ট ছিল তা শিহাব কখনো বুঝতেই পারেনি। সবসময় এত আদর দিয়েছেন নাতিকে, রুমনের অটিজম ওনার আদরের অন্তরায় ছিল না কখনো। অথচ এই আট মাসে রুমন আর তার দাদির মাঝে স্পষ্ট একটা দূরত্ব চলে এসেছে। রুমন বোকা নয়, ও সব কিছু বোঝে, বরং বেশ ভালোভাবেই বোঝে, তাই দাদির কাছ থেকে ধীরে ধীরে পাওয়া অবহেলাটা অনুভব করে নিজেই সরে গিয়েছে। হাসপাতালেও রুমন তাই শিহাবের গা ঘেঁষে আছে। শিহাবের বোন দুলাভাইও চলে এসেছেন। মরিয়মের মা বাবা ঝগড়ার ঘটনা কিছুই জানে না, ওনারা ভেবেছেন হঠাৎ সময়ের আগে মরিয়মের পানি ভেঙে গিয়েছে, এমনিতেও মরিয়মের প্রেগন্যান্সি, রিস্ক প্রেগন্যান্সি ছিল। শিহাব এই মুহূর্তে হাসপাতালে আর কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি চায় না, তাই ওনাদের কিছু বলেনি। মরিয়মকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে, ইমার্জেন্সি সি সেকশন করতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে হাসপাতালে উপস্থিত সবার মনে শুধু মরিয়মের সুস্থতার দোয়া। মা সুস্থ থাকুক, আর সুস্থ একটা বাবু এই দুনিয়ায় আসুক, এই কামনায় আল্লাহকে ডেকে চলছে সবাই।
****
ভোর ছয়টা না বাজতে রুমির ঘুম ভেঙে যায়। একমুহূর্তের জন্য মনে পড়ে না ও কোথায় আছে, দু মিনিট পর মাথাটা পরিষ্কার হয়। পাশে তাকিয়ে তিতলি আর রাকিনের ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়ে। কী সুন্দর নিষ্পাপ দুটো মুখ যেন, আটপৌরে সাংসারিক জীবনের খুব সাধারণ মায়াময় দৃশ্য। স্বামী, সন্তান নিয়ে সহজ সরল জীবন, যেমনটা সব মেয়ে চায়। কিন্তু সবসময় সহজ কিছু আর সহজ হয়ে ধরা দেয় না। একটা সময় এই দৃশ্যে শুধু হিমেল ছিল, তারপর সে প্রাক্তন হলো। বিচ্ছেদের বহুদিন পরও হঠাৎ হঠাৎ সকালে ঘুম ভাঙলে পাশের বালিশটায় রুমি হিমেলের মুখটা মিস করতো। হিমেলের সাথে তো সে সারাটা জীবন কাটাতে চেয়েছিল, হিমেল যদি পরকীয়ায় না জড়াতো, খুব সহজ একটা জীবনই রুমি আর তিতলি পেতে পারতো। এই যে আবার নতুন করে সবকিছুতে অভ্যস্ত হওয়ার পরীক্ষায় রুমিকে নামতে হতো না। হাসান বা রাকিন কারও নামই জড়াতো না তার জীবনে।
ভাবতে ভাবতে রুমির মনে পড়ে ছুটি নেওয়া দরকার, অন্তত দুইদিন ছুটি নেবে সে। রাকিন ছুটি না নিলে না নিবে, কিন্তু আপাতত রুমি কয়েকদিন হাসানের মুখোমুখি হতে চায় না। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে ফোন অফ, আর অন করা হয়নি। চার্জ শেষ হয়ে ফোনটা বন্ধ হয়ে ছিল। চার্জারটা ব্যাগেই আছে। চার্জার লাগিয়ে ফোনটা অন করতেই একের পর এক নোটিফিকেশন আসতে থাকে রুমির। সাতটা ম্যাসেজ হাসানের নাম্বার থেকেই এসেছে। রুমি না পড়েই ম্যাসেজগুলো ডিলিট করে, তারপর ফোন, ম্যাসেনজার, ফেসবুক সবখানেই ব্লক করে দেয় হাসানকে। যার জীবন থেকে সরে গিয়েছে, তাকে একবারেই ধুয়েমুছে ফেলা দরকার। তুষের আগুনের মতো না হয় তা যেকোনো সময় জ্বলে উঠতে পারে।
প্রতারণা করাটা রুমির রক্তে কখনোই ছিল না, এখনো নেই। রাকিনকে ভালোবাসতে পারুক না পারুক, তাকে ধোঁকা কোনদিন দিবে না। এমন কী রাকিন যদি স্বাভাবিক ভাবে স্বামীর অধিকার চায় তাতেও সে না করবে না, অবশ্যই তার সাথে জোরজবরদস্তি করার অধিকার কারও নেই, কিন্তু রাকিন তার প্রাপ্যটুকু চাইলে সে ফিরিয়ে দিবে না।
নাস্তার টেবিলে রাকিনের কাছে ফোন আসে শিহাবের। তিতলিকে সাথে নিয়েই রাকিন আর রুমি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।
“ভাইয়া কাল রাতের ঘটনা, আর আপনি এখন ফোন দিলেন। আমাদের রাতেই জানালেন না কেন?”
“তোমরা নিজেরাও কত ঝামেলার মাঝে ছিলে। তাই ফোন দিয়ে বিরক্ত করিনি।”
“এটা কোন কথা ভাইয়া, আমাদের জন্য কাল আপনাদের এত ঝামেলা গেল। আর আমরা এত স্বার্থপর যে ফোন দিলে বিরক্ত হবো। আপু কেমন আছে ভাইয়া? বাবুকে NICU তে রেখেছে? “
রুমিকে দেখে বিরক্ত হচ্ছিলেন শিহাবের আম্মা। কেন জানি মরিয়মের সাথে রুমির বন্ধুত্ব ওনার পছন্দ না। এখন হাসপাতালে রুমিকে দেখে বিরক্ত চাপা দিতে পারেন না।
“রুমি না তুমি? দুই দিন পরপর এক কাহিনি করো, আর মরিয়মকে এসবের মাঝে জড়াও। এই তোমার কাহিনির জন্য কাল সারাদিন মরিয়ম বাইরে ছিল। নিজের ছেলের কথা আর কী বলবো, কোনদিন বৌকে ভালোমন্দ বুঝ দেওয়ার সাহস তার হয়নি। কিন্তু বৌমার নিজেরও কোন দায়দায়িত্ব নেই। এই শরীরে না হলে সারাদিন বাইরে থাকে! আমার কোন কথাই শোনে না। এখন নাতিটাকে না হারিয়ে ফেলি।”
শিহাব কাল থেকে চুপ থাকলেও এখন আম্মার কথায় নিজেকে আর আটকাতে পারে না,”আম্মা, ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিচ্ছিলো মরিয়ম, ওর প্রেশার এত হাই ছিল। আর কে দিয়েছে ওকে এত চাপ? তুমি দিয়েছ। যখন থেকে ও প্রেগন্যান্ট হয়েছে, তখন থেকে ওকে বাচ্চা নিয়ে মানসিক চাপের ভেতর রেখেছ। কাল রাতেও আমরা সুস্থ ভাবেই বাসায় ফিরে এসেছিলাম। তুমিই রাগ দেখনো শুরু করলে, রুমনকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলা শুরু করলে, তোমার কথার আঘাতেই মরিয়মের শরীর খারাপ করেছে সাথেসাথে। বাবু বাঁচবে কিনা তা আল্লাহর হাতে, কিন্তু আল্লাহ যদি ওকে আমাদের কোলে নাও দেন, আমি মরিয়ম একটু সুস্থ হলে আমি রুমন আর মরিয়মকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠে যাব।”
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২৯
সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে, আবহাওয়া তাই হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছে। এরই মাঝে একুশ দিন পার হয়েছে। রুমি আর রাকিনের সম্পর্কটা একই জায়গায় থেমে আছে বললে ভুল। শরীরে সম্পর্কটা হয়তো হয়নি, কিন্তু রোজই একটু একটু করে মনের দূরত্ব ঘুচে চলছে। এই তো সেদিন টিচার্স রুমে রৌশন আপার সাথে তাল মিলিয়ে হাসান আর মিতু যখন রুমিকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, যেভাবে ওকে আড়াল করে সামনে দাঁড়াল রাকিন, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
রুমি আর রাকিনের বিয়ের কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। মরিয়মের প্রিম্যাচ্যুর ডেলিভারির কথা জানতে পেরে সহকর্মীরা হসপিটালে ভীর করেছিল, সেখানে সদ্য বিবাহিত রুমি রাকিন জুটিকে আবিষ্কার করে সবাই। রৌশন আপা মাঝেমাঝে রুমির সাথে কখনো হাসান, কখনো রাকিনের নাম জড়িয়ে মুখরোচক আলোচনা করলেও এভাবে বিয়ের খবর সবাইকে অবাক করেছে। তবে বেশিরভাগ মানুষই খুশি হয়েছেন, রুমি আর রাকিনকে ব্যক্তিগত ভাবে অনেকেই পছন্দ করেন। রৌশন আপা আর মিতু মজা পাবে না হিংসা করবে বুঝতে পারছে না, একদিকে তাদের করা গসিপ সত্য হয়ে গেল, অন্য দিকে অজানা কারণে কেমন একটা জ্বালা ধরে মনে। তাই রৌশন আপা আড়ালে আবডালেই না সবার সামনেই বড় গলায় বলতে লাগলেন, “দেখেছ, খুব তো জ্ঞান দিতে তোমরা, এই বলা উচিত না, ঐ বলা উচিত না। মাথার চুল তো আর এমনি পাকেনি। সেই তো ঠিকই কলেজের সেরা এলিজেবল ব্যাচেলরের গলায় মালা দিয়েছে রুমি। হাসানও টার্গেটে ছিল, তার মাঝে যে আগে পটেছে, তার সাথে আর দেরি করেনি।”
মিতুর হিংসেটাও কম নয়, রাকিনের পেছনে কম চেষ্টা তো করেনি, অথচ তার মতো অবিবাহিত মেয়ে বাদ দিয়ে কিনা রাকিন রুমিকে পছন্দ করলো!
এই প্রথম রৌশন আপা আর মিতুর কথার ফোড়নে সায় দেওয়া শুরু করেছে হাসান। ভেতরে ভেতরে অন্তরটা যে তারও জ্বলে যাচ্ছে। যদিও রুমিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কখনোই নিশ্চিত ছিল না হাসান, কিন্তু ভাবেনি এভাবে তার হাতের উপরের জিনিস অন্য কেউ নিয়ে যাবে। খেলায় হেরে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে হাসানের। আর তাই রুমি রাকিন জুটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। রুমির সাথে তার সম্পর্ককে কখনো প্রকাশ্যে কেন আনেনি তাই নিয়ে এখন তার আফসোস হচ্ছে। মরিয়ম আর রাকিন ছাড়া অন্য কেউ জানতো না হাসানের সাথে রুমির ঘনিষ্ঠতার কথা, এই দু’জনের একজন রুমির কাছের মানুষ, আরেকজন তো স্বামীই হয়ে গেল। এখন আফসোস হচ্ছে কলেজের আর এক দু’জন মানুষকে জানালে কী হতো যে সেদিন তার আর রুমির কোর্ট ম্যারেজ করার কথা ছিল, সে ছেড়ে দিয়েছিল বলেই তো রাকিনের গলায় মালা দিলো রুমি। রুমির এভাবে হাসানকে সহজেই ঝেড়ে ফেলাটা হাসানকে তাই পুড়িয়ে দিচ্ছে। রুমিকে ছোট করার প্রবৃত্তিটা সে সামাল দিতে পারছে না। তাই তো সেদিন টিচার্স মিটিং শেষে সবাই যখন রুমি আর রাকিনের কাছে ট্রিট দাবি করে, তখন রৌশন আপা আর মিতু টিপ্পনী কাটতে শুরু করলে সুযোগ বুঝে তাদের সাথে হাসানও তাল মিলাতে থাকে।
রৌশন আপা- “রুমি, একটু কিছু টিপস মিতু আর হাসানকেও দাও। তুমি দুইটা করে ফেললে, বেচারাদের একটাও হলো না।”
মিতু- “রৌশন আপা ঠিকই বলেছেন। রুমি আপুর ক্লাস লাগবে আমার। এখনো ছেলে ভুলানো মন্ত্র জানি না বলে বিয়েটা আটকে আছে। আমার অবশ্য একটা হলেই চলবে, তিনটা চারটা করার শখ নাই।”
রৌশন আপা আর মিতুর কথার মাঝেই তাল মিলায় হাসান, “মিতু আপা, তিনটা চারটা সবাই পারে না। তারজন্য স্পেশাল হতে হয়। আমাদের তো মানুষের এঁটো খাবার খাওয়ার অভ্যেস নেই। তাই এখনো হয়নি। রাকিন ভাই বিদেশ থেকে এসেছেন, ওপেন মাইন্ডের মানুষ, রুমি আপাও এক্সপেরিয়েন্সড। ওনাদের টিউনিং হওয়ারই কথা।”
রৌশন আপা আর মিতুর উপর সবাই কমবেশি এমনিতেও বিরক্ত, এখন হাসানও ওদের সাথে তাল মেলানোয় উপস্থিত অন্যান্যরা বিরক্ত হলেও কলিগ বলে কিছু বলে না। রুমিও ভাবে পাশ কাটিয়ে যাবে, কিন্তু বাদ সাধে রাকিন “হাসান ভাই, দেশের প্রথম শ্রেণীর পেশাজীবি একজন মানুষের মুখের ভাষা এমন হওয়াটা সত্যি দুঃখজনক। আপনার মনোভাবের সাথে একজন অশিক্ষিত বর্বর মানুষের কী পার্থক্য আছে? আপনি ডাক্তার আর সে অশিক্ষিত, এই টুকুই তফাৎ। রুমির দ্বিতীয় বিয়ের কথা আপনারা জানেন, আমারটা জানেন না। অবশ্য জানলেও আপনাদের কথা পরিবর্তন হতো না। মহিলদের নিয়ে স্থুল রসিকতা করা খুব সহজ কিনা।”
একটু অপ্রস্তুত হলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় হাসান,”আরে রাকিন ভাই দেখি রাগ করলেন। আরে আমি তো দুষ্টুমি করেছি। আপনি ভাই মানুষ, রুমি আপা তো আমার কত ভালো বন্ধু সেটা জানেন না? এখন যদিও আমার ভাবি হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু বন্ধুত্ব তো ছিল। বন্ধুর সাথে বন্ধু দুষ্টুমি করতে পারবে না?”
রাকিন হাসানের কথার উওর না দিয়েই রৌশন আপা আর মিতুর দিকে ফিরে, “রৌশন আপা, আপনি গুরুজন। কত সিনিয়র ম্যাম, এসব সস্তা রসিকতা কী আপনার সাথে যায়? যতটুকু জানি স্যার নির্ভেজাল মানুষ, এসব জিনিস পছন্দ করেন না।
আর মিতু তোমার আগে ব্যবহার শিখতে হবে, তাহলে তিনটা চারটা না হোক, একটা বিয়ে অন্তত হবে। সবশেষে তোমাকে বলি রুমি, তুমি এসব কথা পাশ কাটিয়ে যাও দেখে সবাই বলার সাহস পায়। এক্ষুনি তুমি আমার সাথে পরিচালক স্যারের রুমে যাবে। কলেজে সবাই পড়াতে আসে না অন্যের জীবনে নাক গলাতে আসে, তা স্যারকে জিজ্ঞেস করা দরকার।”
পরিচালকের কাছে যাবে শুনে উপস্থিত সবাই রাকিনকে শান্ত করতে লেগে যায়। সিনিয়ররা হাসান আর রৌশন আপাকে দুটো কথাও শুনিয়ে দেন এবার। রাকিন সে সময়ের মতো ঠান্ডা হলেও কথা ঠিকই পরিচালকের কানে যায়। ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে নোটিশ চলে যায়, অফিস চলাকালীন অফিসিয়ালি কথাবার্তা ছাড়া কোন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যেন কোন রকম অশালীন মন্তব্য করা না হয়, অন্যথায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রৌশন আপা আর হাসান কারন দর্শানোর নোটিশও পেয়েছে। আপাতত কলেজে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।
রাকিন আর রুমির মাঝে এখনো তিতলি ঘুমায়। তবে রোজ একসাথে অফিসে আসা যাওয়া করা আর ছুটির দিনে একসাথে বসে চা খাওয়ার অলস বিকেলগুলোয় দু’জনের মাঝের বরফ গলতে শুরু করেছে। প্রথম পদক্ষেপটা যদিও কেউই নিতে পারছে না। রুমি আড়ষ্টতা কাটাতে পারছে না, আর না রাকিন সহজ হতে পারছে। তাদের দৈনন্দিন আর সব কাজের ফাঁকে নিয়ম করে তারা রোজ রামিসাকে দেখতে যায়।
রামিসা মরিয়ম আপার মেয়ে, মাত্র ঊনিশশো গ্রাম ওজন নিয়ে জন্ম নিয়েছে রামিসা। টানা বিশ দিন NICU তে রাখতে হয়েছে। রাকিন আর রুমি রোজ যেত। মরিয়ম আপা রুমিকে ধরে অনেক কান্না করতো, মরিয়মের মনে হতো হয়তো গর্ভধারণের পর থেকে দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সি কখনো সহজ ভাবে গ্রহণ না করায় আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তাই তো বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে চাইছেন। অপরাধবোধে ভুগতো রুমি আর মরিয়মের শাশুড়ি মাও। রুমির মনে হতে মরিয়ম আপার এই অবস্থার জন্য সে দায়ী, আর শাশুড়ি মা অপরাধবোধে ভুগতেন, কারণ ওনার মনে হতো সেদিন রাতে মরিয়মকে এভাবে মনের উপর চাপ দিয়ে কথাগুলো না বললেই পারতেন। শিহাব একবার NICU আরেকবার মরিয়মের কাছে ছুটোছুটি করতো, তার ব্যবসা বাণিজ্য সব মাথায় উঠেছিল, সাথে ছিল রুমনকে সামলানের চাপ। তবে শেষ পর্যন্ত সবার ভালোবাসার জয় হয়েছে। আজ রামিসাকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। রুমি আর রাকিন তাই এই ঝড় বৃষ্টির ভেতরও বের হচ্ছে, শিহাব আর মরিয়মের পাশে থাকতে চায় এই খুশির সময়। তিতলিকে তার নানা নানুর কাছে নামিয়ে দিয়ে হাসপাতালের পথে রওনা দেয় তারা।
(চলবে)
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
সমাপ্তি পর্ব
“রুমি, আর কত কাঁদবে? চোখমুখ তো লাল করে ফেললে।”
“খালাম্মা এত আদর করে কথা বললেন, আমার যে কেমন লেগেছে বোঝাতে পারব না। আমি খুব অপরাধবোধে ভুগতাম জানেন। যতদিন পর্যন্ত রামিসা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে না যাচ্ছিল, ততদিন পর্যন্ত নিজের কাছে অপরাধী হয়ে ছিলাম। আজ যখন খালাম্মা আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষমা চাইলেন, বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেল যেন।”
“খালাম্মাকে আজ আমারও অসাধারণ লেগেছেন। নিঃসন্দেহে ফাইটার মানুষ। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার পর শিহাব ভাই আর ওনার বোনকে একহাতে বড় করেছেন, যোগ্য করে বিয়েশাদি দিয়েছেন। মরিয়ম আপাকেও তিনি ভালোবাসেন। একমাত্র ছেলের বৌ বলে আপাকে ওনার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেননি। কিন্তু ওনার ভুল এটাই ছিল তিনি আর সবার মতো রুমনকে দুর্বল ভেবেছেন। অটিজম নিয়ে আমাদের সচেতনতা অভাব আর অজ্ঞতার কারণে অনেকেই এমনটা ভাবেন। সেজন্য মরিয়ম আপার দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে খালাম্মার মাঝে একটা অবসেশন তৈরি হয়েছিল। যাই হোক সবার সামনে তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেছেন এটা ওনার বয়সী একজন মানুষের জন্য কম কথা না।”
সত্যি আজ এই চমৎকার দৃশ্য মঞ্চায়ন হয়েছে মরিয়ম আপার বাসায়। সবার সামনেই শিহাবের আম্মা ওয়াদা করেছেন আর কখনো নাতি নাতনিকে তিনি আলাদা চোখে দেখবেন না। মরিয়মকে তিনি পথ দেখাবেন, তবে পদে পদে ভুল ধরবেন না।
রামিসাকে নিয়ে মরিয়ম যখন বাসায় প্রবেশ করে, এত চমৎকার করে শিহাবের বোন দুলাভাই তাদের বরণ করে নেন যে বাইরের মানুষ হয়েও রাকিন আর রুমি আবেগ আক্রান্ত হয়ে পরে। সবার মাথায় ছিল এই আয়োজনে রুমনকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করা যাবে না, তাই তো ওয়েলকাম পোস্টারে রামিসাকে রুমনের কোলে রেখে ছবি সাজানো হয়েছে। এই কয়দিন মরিয়মের একটাই চেষ্টা ছিল তাদের জীবনে রামিসার ভূমিকাটা রুমনকে বোঝানো, যেন রুমনের জন্য রামিসাকে গ্রহণ করা সহজ হয়। রুমন এখনো রামিসাকে কোলে নেওয়ার সাহস না করলেও ছোট ছোট হাত পায়ের এই পুতুল বোনকে যে আপন করে নিয়েছে তা তার আচরণেই বোঝা যাচ্ছে। এইভাবে যদি পুরো পরিবার সাথে থাকে তাহলে নতুন এই পরীক্ষায় যে মরিয়ম সফল হবে তা সে আশাবাদী। বারবার করে সবাইকে বুঝিয়ে বলেছে দুষ্টুমির ছলেও কেউ যেন রামিসা রুমনকে মুখোমুখি না দাঁড় করায়। অর্থাৎ কেউ যেন এটা না বলে ‘বোন আসায় রুমনের আদর কমে যাবে, মা সময় দেবে না,বাবা বকবে’।
ছোট ছোট এই দুষ্টুমিগুলো যে একটা বাচ্চার মনে কী পরিমাণ ইনসিকিউরিটি সৃষ্টি করে তা বড়রা বোঝে না। মনের অজান্তেই তারা ভাইবোনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
বিদায়ের আগে মরিয়ম রুমিকে তার রুমে ডেকে নেয়,
“রুমি, এতদিন নিজের সন্তানদের চিন্তায় তোমার দিকে নজরই দিতে পারিনি। ধন্যবাদ রুমি আমার পাশে এইভাবে পুরোটা সময় থাকার জন্য। আমাকে বোনের অভাব পর্যন্ত বুঝতে দাওনি।”
“আপু, আমার চরম খারাপ সময় তুমি আর ভাইয়া ছিলে পাশে। সত্যি বলতে এখনো ঐ রাতের জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এরপর এসব বলে লজ্জা দিও না।”
“রুমি, রাকিনের সাথে যে অদৃশ্য দেয়ালটা তুমি তৈরি করেছ, তা ভাঙতে দেরি করো না। অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না যে সহ্যের শেষ সীমাটুকু কোথায়। আজ আমার শাশুড়ি মা নিজের ভুল বুঝেছেন, আমিও বুঝেছি। কিন্তু আমাদের মান অভিমানের বলি কিন্তু রামিসা হতে পারতো। আর তা হলে শত ক্ষমা চেয়েও আমরা কী নিজেরা নিজেদের মাফ করতে পারতাম? তুমি বুদ্ধিমতি, এর বেশি কিছু বলা লাগবে না জানি। তিতলিকে নানুর বাসা থেকে না আনলে আজ। মাঝে মাঝে ও নানুর বাসায় বেড়াতে যেতেই পারে, তাই না?”
গাড়িতে বসে মরিয়মের কথাগুলো মনে পড়তেই একটা সিদ্ধান্ত নেয় রুমি, রাকিনকে বলে, “রাকিন, তিতলি অনেকদিন পর আমাদের বাসায় গিয়েছে, আম্মা বলছিলেন আজ তিতলিকে ওখানে রাখবেন।”
“তাহলে তোমাকে ঐ বাসায় নামিয়ে দেব? তুমিও থাকবে?”
“নাহ্ এই বৃষ্টির দিনে উল্টো দিকে জার্নি করে না যাই। ক্লান্ত লাগছে, বাসায় যাব। তিতলি নতুন মামীকে নিয়ে ব্যস্ত আছে, কথা হয়েছিল ফোনে।”
“হ্যাঁ, আমারও কথা হয়েছে। জেসমিনের পরিবার বিয়ের আগে যেমন শর্ত দিচ্ছিলেন তাতে সবাই ভয়ে ছিল যে কেমন হয়। কিন্তু মনে হচ্ছে জেসমিন মেয়ে হিসেবে খারাপ না।”
“বিয়ের আগে ওদের সমস্যা আমি আর তিতলি ছিলাম। শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে ওদের আপত্তি ছিল না, কিন্তু আমাকে আর তিতলিকে নিয়ে ছিল। যাক আমি এতটুকুই চাই এই বয়সে আব্বা আম্মা নিশ্চিন্তে থাকুক। অনেক তো ওদের টেনশন দিলাম।”
রাকিন আলতো করে রুমির হাতে হাত রাখে। বাসায় ফিরে দেখে রাকিনের বোন দুলাভাই সবাই বাসায়।
“আসসালামু আলাইকুল ভাইয়া। আসসালামু আলাইকুম আপু। কখন আসলেন আপনারা?”
“এই তো আসলাম। কেন আমরা আসায় খুশি হওনি রুমি?”
সিমি আপুর এই স্বভাবের সাথে এখন পরিচিত রুমি। আপু কোন কথার উত্তর সহজ ভাবে দেবে না। প্রশ্নের উত্তরেও প্রশ্নই করবে। একই গাছের সব ফল কী আর সমান হয়, তাই হয়তো রাকিন আর রাকিনের আম্মা এত চমৎকার মানুষ কিন্তু সিমি আপু বড় জটিল।
“আপু অনেক খুশি হয়েছি। বাচ্চারা কোথায়?”
“ওদের সামনে পরীক্ষা তাই আনিনি। তোমরা কই ছিলে এতক্ষণ? তোমার মেয়ে কই?”
“আপু, আমাদের মেয়ের একটা নাম আছে, ‘তিতলি’। আর তিতলি ওর নানুর বাসায় আছে।”
এই সামান্য কথায় সিমি একটা হৈচৈ ফেলে দিলো। তবে এবার শক্ত হাতে মেয়েকে সামলালেন রাকিনের আম্মা, “সিমি, তুই জামাইবাবাজির সামনে যে এমন করিস, এতে তুই নিজে যেমন ছোট হোস তেমনি আমাদের ছোট করিস। এই বাসা আগে যেমন তোর ছিল, এখনো আছে। রুমি আর তিতলি এই বাসারই অংশ, সবার সাথে মিলেমিশে থাকলে ভালো থাকবি। আজ আমি আছি কাল নাই, তখন এই রুমি আর রাকিনই শুধু তোর আপন মানুষ থাকবে। তোর ভাবি হয়তো আজ নরম, কিন্তু তুই এমন ব্যবহার চালিয়ে গেলে একসময় ভাইয়ের সংসারে অনাহূত হয়ে যাবি। নিজের জায়গাটা নিজে নষ্ট করে পরে ভাবির দোষ দিবি যে বিয়ে করে ভাই আর বোন চেনে না।”
সিমি এই উপদেশেই বদলে গিয়েছে তা হয়তো নয়, তবে তখনকার মতো নিজেকে সামলে নিয়েছে। রাতে সবকিছু গুছিয়ে যখন রুমে আসে রুমি, রাকিন ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। রুমি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শুয়ে পড়ে।
রাকিনের চোখটা একটু লেগে এসেছিল, হঠাৎ মনে হলো কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মনের ভুল ভেবে চোখ বন্ধ করতে চাইলেও নাক টানার শব্দ পায়। শব্দটা পরিচিত, দুপুরে এভাবেই কাঁদছিল রুমি। চকিতে পাশ ফেরে রাকিন। রুমির দুলে দুলে ওঠা শরীরই বলে দিচ্ছে, কাঁদছে রুমি। পিঠের উপর হাত রাখে রাকিন, “রুমি কী হয়েছে? আপুর কথায় এখনো মন খারাপ করে আছ? আম্মুতো আজ ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলেছেন, দরকার হলে আমি আবার কথা বলবো। তুমি এত মন খারাপ করো না।”
রুমি উঠে বসে যায়। রুমিকে দেখে একটা কথা মনে পড়ে রাকিনের, হুমায়ুন আহমেদ বলতেন, কাঁদলে নাকি মেয়েদের সুন্দর লাগে। যদিও রাকিন এই কথার সত্যতা পায়নি। কাঁদলে চোখমুখ ফুলে সবাইকে কেমন অদ্ভুত লাগে। তবে যাকে আমরা ভালোবাসি, তাকে মনে হয় সর্বাবস্থায় সুন্দর লাগে। না হলে এই মুহূর্তে রুমিকে সাক্ষাৎ অপ্সরা কেন মনে হচ্ছে রাকিনের। মনে হচ্ছে কাছে টেনে নিয়ে রুমির দুচোখের সবটুকু জল শুষে নেয়।
“রাকিন, আমি আপুর কথায় কাঁদছি না। এরচেয়ে কঠিন কথা শোনার ও সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু এই অবহেলা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
“কে অবহেলা করলো?”
“তুমি। এই যে একই খাটে, একই সাথে শুয়েও মাঝে একটা কোলবালিশের দেয়াল তুলে রেখেছ। এটা অপমান অবহেলা নয়? তুমি কী বিয়ে করেও চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছ?”
রুমি তুমি করা বলা শুরু করেছে বলে খুশি হবে না, এমন অদ্ভুত অভিযোগ করছে বলে হাসবে, বুঝতে পারে না রাকিন।
“মনে না থাকলে বলি ম্যাডাম, এই দেয়াল আপনারই বানানো। তবে দেয়াল ভাঙার সক্ষমতার পরীক্ষা চাইলে তা এখনি হয়ে যাক।”
রাকিনের বুকে একটা আদুরে বিড়াল হয়ে মিশে যেতে যেতে রুমির মনে হয় জীবনটা ভীষণ সুন্দর, জীবনে সুখের মতো কষ্টও সাময়িক, নিশ্চয়ই কষ্টের পর সুখ আছে।
(সমাপ্তি)