- কুসুমিত কামিনী ( ১)
- কুসুমিত কামিনী ( ২)
- কুসুমিত কামিনী ( ৩)
- কুসুমিত কামিনী ( ৪)
- কুসুমিত কামিনী ( ৫ )
- কুসুমিত কামিনী ( ৬ )
- কুসুমিত কামিনী ( ৭ )
শেষরাতের দিকে ছাদ থেকে নেমে ঢুলু ঢুলু চোখে রুমে ঢুকল মাহতিম। বিছানায় তাকিয়েই চোখ কপালে তুলল। দেখল নাক অবধি ঘোমটা টেনে নববধুরূপে জান্নাত এখনো বসে আছে।
জান্নাত বিছানা থেকে নেমেই পা ছুঁয়ে সালাম দিতে গেল তাকে।মুহুর্তেই
ড্যামিট! এসব কি বলেই একটানে পা দুটো সরিয়ে নিল মাহতিম।
মেয়েটি মাহতিমের দিকে চেয়েই তব্দা খেল।
আরেহ ভাইয়া আপনি আমার বর? বিস্মিত চোখে জিজ্ঞেস করলো জান্নাত।
নো। আমি কারো বর নই। আনকালচার! ডিজগাস্টিং! তুমি আমাকে আগে থেকেই চিনতে নাকি?
আপনি আমাকে কয়েকমাস আগেই দুজন বখাটে ছেলেদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
তাহলে আমি চিনলামনা কেন তোমাকে?
আমার তো বোরকা পরা ছিল। মুখ নেকাব দিয়ে ঢাকা ছিল।
একটু থেমে বলল মাহতিম। হুম মনে পড়েছে। এজন্যই বুঝি আমার গলায় ঝুলে পড়ে গেলে? যখন বুঝলে আমি ভালো ছেলে? কিঞ্চিৎ টলতে টলতে বলল মাহতিম।
আজব! আপনি এভাবে আচরণ করছেন কেন? মনে হচ্ছে আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই বিয়ে হয়েছে? আমিতো জানতামইনা কার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে। এইমাত্র আপনাকে দেখলাম। আপনি যে কতটা ভালো তা এই বাসর রাতেই আমার বোঝা হয়ে গিয়েছে। বউকে সারারাত জাগিয়ে রেখে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছেন? আপনি একটা আস্ত খবিশ! টনটনে আদ্র কন্ঠে বলল জান্নাত।
হোয়াট! বলে মাহতিম জান্নাতকে হ্যাঁচকা টেনে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাল। গলা টিপে ধরার চেষ্টা করল। বলল তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আর একটি শব্দ উচ্চারণ করলে তোর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলব আমি।
উহুম! আপনি ম’দ খেয়েছেন মনে হচ্ছে। মুখ থেকে সেটার কেমন গন্ধ পাচ্ছি। আপনিতো দেখি পুরাই নষ্ট। বাদ মা’ল বলা যায়। দাঁড়ান এক্ষুনি আপনার মাকে সব জানাচ্ছি। আমার সাথে দুই নাম্বারি করল।
জান্নাত পরনের মোটা শাড়িটির কুচি উঠিয়ে ধরল। দরজার দিকে পা রাখতেই মাহতিম জান্নাতের হাত টেনে ধরল। জান্নাত সজোরে কামড় বসিয়ে দিল মাহতিমের হাতের উপরে। মাহতিম ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল। রক্তবর্ণ চক্ষুদ্বয় আরো রক্তিম হয়ে উঠল। এবং হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো।
দরজার বাইরে গিয়ে একটু দাঁড়াল জান্নাত। চিন্তা করল এখন সবাই ঘুমিয়ে আছে। থাক সকাল হলেই বলব। নিরুপায় হয়ে রুমে প্রবেশ করলো জান্নাত। দেখল মাহতিম বিছানার মাঝ বরাবর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। অঘোরে নাক ডাকছে। ভ্রুকুটি করে সেদিকে একপলক চাইল জান্নাত। মনে মনে বলল এভাবে কেউ নাক ডাকে এই প্রথম দেখলাম। এটা নাক ডাকা না বাঁশ কাটা।
জান্নাত বিয়ের লাগেজটা খুলে একসেট জামাকাপড় হাতে নিল। দলা পাকিয়ে আসা নীল কষ্টগুলো গলা অবদি এসে আটকে আছে। ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে দিল। যেন কান্নার আওয়াজ চারদেয়াল অতিক্রম করতে না পারে। ঝর্ণার অবিরাম ঝরে পড়া পানির সাথে তার অশ্রুকণাগুলোও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
পরনের সবকিছু বদলে নিল জান্নাত। রুমে এসে মেঝেতে একপাশ করে বিছানা করে নিল। মনে মনে ছোটখালাকে আচ্ছামত ঝেড়ে নিল। এই বিয়ের প্রস্তাব তার খালাই এনেছে। এরপর তার মা সব খোঁজ খবর নিয়েই রাজী হলো বিয়েতে।
ছোটবেলায় খুব বিয়ে পাগলী ছিল জান্নাত। মাকে সারাক্ষণ বিয়ে দাও বিয়ে দাও বলে জ্বালিয়ে মারত। বড় হওয়ার পর চাইতো তার বিয়ে যেন হয় মধুমাসেই। ফলফলাদি তার ভীষণ প্রিয়। নানানরকম ফল খেতে খেতে বরের সাথে দুষ্টমিষ্ট সময় কাটাবে। তার এই অদ্ভুত ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটল। জৈষ্ঠ্যমাস মধুমাস। এ মধুমাসেই তার বিয়ে হলো ঠিকই। কিন্তু বাসরঘরই হলনা তার। ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত শরীরে রাজ্যের ঘুম নেমে এল জান্নাতের।
প্রভাতের স্নিগ্ধ হাওয়া বইতে লাগল চারদিকে। চড়ুই পাখির চঞ্চল কলরব শুরু হলো। জানালা গলিয়ে ভোরের আলো ঠিকরে এলো রুমের ভিতরে। তবুও তার ঘুম ভাঙ্গলনা। মেঝেতে দিঘলকালো চুলগুলো অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জান্নাত উঠে দরজা খুলে দিল।
গুড়মর্নিং সুইট ভাবি।
আপনাকেও গুড়মর্নিং বলে পিটপিট চোখে চেয়ে বলল জান্নাত।
আমাকে চিনতে পারনি এইতো? আমি তোমার খালাত ননদ লুবনা।
একটি টকটকে লাল গোলাপ এগিয়ে ধরে বলল লুবনা।
থ্যাংকস বলে আলতো হাতে গোলাপটি নিল জান্নাত।
আর আমি তোমার নিজের ননদ ঝুনঝুনি? হিঃহিঃহিঃ।
ধরো বলে সে কিছু কামিনী ফুল জান্নাতের হাতের তালুতে গুঁজে দিল।
মুহুর্তেই জান্নাতের মন অনেকখানি ফুরফুরে হয়ে গেল। কামিনী ফুল তার সবচেয়ে প্রিয় ফুল। এ ফুলের সৌরভে সে মাতোয়ারা হয়ে যায় সবসময়।
ঝুনঝুনি? স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল জান্নাত।
আরেহ ঝুনঝুনি মানে নুপুর। বলেই কাঁচভাঙা হাসিতে লুটোপুটি খেল নুপুর ও লুবনা।
তোমরা ভিতরে আস। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
ভিতরে যাওয়ার সময় ঢের পড়ে আছে। তোমার জামাইকে ডাক। আম্মু বলছে নাস্তা খেতে যাওয়ার জন্য। তাই তাড়া দিতে আসলাম।
যাব। আপনার আম্মুকে একটু ডেকে দিবেন। জরুরী দরকার ছিল একটু।
আম্মুতো কাজে ব্যস্ত। একটু লেট হবে।
আচ্ছা তখন আসলেও চলবে।
জান্নাত ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
এই..এই.. শুনছেন বলেও মাহতিমকে জাগাতে ব্যর্থ হলো। উপায়ন্তর না দেখে বেসিন থেকে পানি নিল। কয়েক ফোঁটা পানি মাহতিমের মুখের উপর ছিটিয়ে মারল খাটের সামনে দাঁড়িয়ে।
মাহতিমের ঘুম ছুটে গেল। দেখল সামনে দাঁড়িয়ে জান্নাত। তড়াক করে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসল। আমার মুখে পানির ছিটা কে দিল?
ধমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো মাহতিম।
আমি দিয়েছি। আপনার মা আপনাকে জাগানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। হালকা ভয়ার্ত ও বিরক্তি স্বরে বলল জান্নাত।
মাহতিম ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে ওয়াশরুমে চলে গেল।
মাহতিমের মা মেহনাজ খান তাদের রুমের চাপানো দরজায় টোকা দিল। জান্নাত দরজা খুলেই শ্বাশুড়ির পা ছুঁয়ে বিনম্রভাবে সালাম দিল। তিনি ভিতরে গিয়ে চেয়ারে বসলেন।
কোন অসুবিধা হচ্ছে মা?
আন্টি আপনার ছেলে কি এই বিয়েতে অমত ছিল?
নাতো? কেন এটা বলছ? উদ্বিঘ্ন স্বরে বললেন মেহনাজ।
কিন্তু উনিতো আমার সাথে রাতে বাজে আচরণ করেছে। আমার গলা টিপে ধরেছে। রুমেও ছিলনা। আমি আলাদা ঘুমিয়েছি। বলল উনি আমার স্বামী নয়। সালাম ও নিলনা। আবার আমি নাকি ক্ষ্যাত।
আপনাকে আমি এসব বলতামনা। কিন্তু আপনিই বলেছেন যেকোন সমস্যা হলেই যেন আপনাকে বলি। দ্বিতীয় কাউকে নয়।
মেহনাজ খান অপ্রতিভ হয়ে গেলেন ছেলের সম্পর্কে এসব শুনে। স্নেহময় আদুরে কন্ঠে জান্নাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন খুউব ভালো করেছ আমার কাছে নালিশ করে। আমি দেখছি বিষয়টা। আর আন্টি নয় মা বলবে আজ থেকে আমাকে। কেমন?
আচ্ছা আন্টি। না। আচ্ছা শাশুড়ী মা। আগে যে আন্টি বলছি তাই ওটাই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসছে।
মাহতিম ওয়াশরুমের দরজা খুলেই মাকে দেখে বিব্রতকর হয়ে গেল।
কিরে মাহতিম কি শুনলাম এসব? রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
মা এই বিচ্ছুকে কোথা হতে ধরে আনলে? মুখের লাগাম নেই বললেই চলে। যা মুখে আসে তাই পট করে বলে বসে। কার সাথে কিভাবে চলতে হয় কিছুই জানেনা। ও ওদের বাসায় চলে যাক। যেদিন থেকে আমার মতো করে চলতে পারবে। সেদিনই কেবল এই বাসায় তার পা রাখতে পারবে।
মাহতিম তোর বাবার কান অবধি এই বিষয়টা যাক। সেটা আমি চাইনা। তরল গলায় কথাটা বলেই রুম থেকে চলে গেলেন মেহনাজ খান।
জান্নাত নিবুনিবু সরল চাহনিতে মাহতিমের দিকে আড়চোখে তাকাল। মাহতিম চোয়াল শক্ত করে কড়মড়িয়ে বলল,
তোমার অবস্থা আমি দফারফা করে ফেলব। বেয়াদব কোথাকার। স্বামী স্ত্রীর বিষয় যারা অন্যকে জানায়। তাদের মত গর্দভ আর বেকুব নিয়ে সংসার করা অসম্ভব। কুকুর কোথাকার! আমার হাত কামড়ে কি করেছ?এটা যদি মাকে দেখতাম?
কেউ মানা করেনি। গিয়ে প্রদশর্নী করে আসুন বাসার সব অতিথিকে।
কখন যাবে তোমাদের বাসায়?আমি এটা শুনতে চাই এখন?
কাঠ কাঠ গলায় জানতে চাইলো মাহতিম।
কখন গেলে আপনার সুবিধা হয় মিস্টার মাহতিম?
কুসুমিত কামিনী ( ১)
রেহানা পুতুল
কুসুমিত কামিনী ( ২)
রেহানা পুতুল
কখন যাবে তোমাদের বাসায়? আমি এটা শুনতে চাই এখন?
কাঠ কাঠ গলায় জানতে চাইলো মাহতিম।
কখন গেলে আপনার সুবিধা হয় মিস্টার মাহতিম?
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। মাহতিম দরজা খুলে দিল। জান্নাতের প্রশ্নের জবাব দেওয়া হলনা তার।
মাহতিমের ছোট বোন নুপুর ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়া তোমাদের দুজনের নাস্তা। আম্মু পাঠিয়ে দিয়েছে।
টেবিলে কি প্রবলেম?
সবাইর খাওয়া শেষ। তোমরা দুজন এলেনা। তাই জননী নিয়ে আসতে হুকুম করল।
আচ্ছা। রাখ তাহলে।
নুপুর আপু আমাদের সাথে খাও নাস্তা।
নাগো কিউটি ভাবি। আমি খেয়েছি। আমাকে আপু বলতে হবেনা। আমি তোমার জুনিয়র হব মে বি। ভাইয়া তাইনা?
তা আমি কি জানি?
ওমা! এমন ত্যাড়া আনসার কেন? মনে হয় কেউ তোমাকে এখন ফাঁসীতে ঝুলাবে।
ঝুলাবে কি? ঝুলেইতো গেলাম। এখন বাঁচার চেষ্টা করছি।
ফাজলামো করছ। নাহ? নাস্তা খাও দুজনে সুন্দরভাবে। শাসনের সুরে বলেই চলে গেল মাহতিমের একমাত্র ছোট বোন নুপুর।
মাহতিম পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে কলিজা ভুনা দিয়ে। সাথে কচি শসা ও পেয়াজ খাচ্ছে কামড় দিয়ে। জান্নাত তাদের বাসায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাহতিমের আয়েসী ভঙ্গিতে খাওয়া দেখে তার ক্ষুধা কয়েকগুণে বেড়ে গিয়েছে। রাতেও খায়নি জান্নাত। এখন তবুও খেতে বসছেনা। বেহায়ার মতো কেউ না সাধলে খেতে বসা যায়না। জান্নাত আঁকুপাঁকু করছে খাওয়ার জন্য।
” ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় /পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। “
সুকান্ত ভট্টাচার্যর অমর চরণদুটি এক ঝলকেই মনে পড়ে গেল তার। লজ্জায় খেতেও পারছেনা।
মাহতিম উঠে গেল নাস্তা খেয়ে। বেসিনে হাত ধুয়ে নিতে নিতে বলল,আমি খাওয়ার সময় সাধাসাধি করার মানুষ নই। যার যার ভাগের খাবার সে নিজ দায়িত্বে খাবে। নিজ অধিকারে খাবে।
ক্ষুধা নিবারণের উদ্দেশ্যে জান্নাত নাস্তা খেয়ে নিতে বাধ্য হলো। খেয়েই শশুর শাশুড়ির রুমে চলে গেল। মাহতিমের বাবা রবিউল খান পত্রিকার শিরোনামে চোখ বুলাচ্ছেন। পুত্রবধূকে দেখেই আন্তরিককন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
কিছু বলবে মা?
বাবা আমাদের বাসায় যেতে চাই।
এখন কিভাবে যাবে। বাসা ভরা মেহমান। কাল বিকেলে যেও মাহতিমসহ। এটাইতো সিস্টেম। নুপুর ও যাবে।
আচ্ছা বাবা। তাই হবে।
পাশ থেকে মেহনাজ আদেশ দিয়ে বললেন,
জামা চেঞ্জ করে শাড়ি পরে রেডি হয়ে নাও। নতুন বউকে শাড়িতেই বেশি মানানসই লাগে দেখতে।
আচ্ছা মা বলে নত মস্তকে রুম থেকে বেরিয়ে এলো জান্নাত। নুপুরকে দেখতে পেয়ে ডাক দিল জান্নাত।
কি ভাবি?
তোমার ভাইয়ার সমস্যাটা কি বলতো। উনার আচরণে মনে হচ্ছে এই বিয়েতে উনার মত ছিলনা?
ভাইয়াটা না। উফফস! বিড়বিড় করে বলল নুপুর।
বল নুপুর প্লিজ। সত্যিটা জানলে আমাদের দুজনের জন্যই সুবিধা হবে।
তুমি, তোমার পরিবার বা কাউকে বলবানাতো? প্রমিজ কর।
প্রমিজ বলবনা।
নুপুর জান্নাতের হাত ধরে বাসার পিছনের বারান্দায় নিয়ে গেল। এদিক এদিক অনুসন্ধিৎসু চোখে চাইলো। দেখল আশে পাশে কেউই নেই।
তবুও নারী জাতির সহজাত অভ্যাসমতে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল,
শোন ভাইয়ার জারা নামের একটি মেয়ের সাথে প্রেম ছিল। তারা সেইম এইজ ও ক্লাসমেট ছিল। মেয়েটা ছিল অতি আধুনিক। মর্ডান বলতে যা বোঝায়। ভাইয়া তাকে বিয়েও করতে চেয়েছে। কিন্তু তখন ভাইয়া বেকার ছিল। তাই মেয়েটাকে তার পরিবার অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেয়। ভাইয়া কিন্তু তাকে দুইবছর অপেক্ষা করতে বলেছে। সে চাইলেই অপেক্ষা করতে পারতো। কিন্তু সেও ছিল অর্থলোভী মেয়ে।
তারপর হতেই ভাইয়া মেয়েদেরকে কম বিশ্বাস করে। ছলনাময়ী ভাবে। ভাইয়া রাতদিন নেশার ঘোরে ডুবে থাকে। বিয়েও করতে চায়নি আর কোনদিন। আবার ভাইয়া তোমার মত বোরকা পরা, মুখ ঢাকা অর্থাৎ ধর্মীয় মাইন্ডের মেয়েদের একদম পছন্দ করেনা। গেঁয়ো, আনস্মার্ট ভাবে।
অপরদিকে আব্বু আম্মু চেয়েছে ঠিক তোমার মতই একটি মেয়ে। বস্রের আবরণে যে নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখবে। যার চলাফেরা হবে শালীন। মাধুর্যময়। তবে আকর্ষণীয়! যে কিনা ধীরে ধীরে স্বামীকে স্বাভাবিক জীবন যাপনে নিয়ে আসবে। সেই মেয়েকে ভুলিয়ে দিবে। এই হলো মূল বিষয়। কি পারবেনা তোমার ছন্নছাড়া স্বামীকে আদরে সোহাগে ডুবিয়ে রাখতে? মন্দ জিনিসগুলো থেকে ফিরিয়ে আনতে?
মন্দ জিনিস বলতে?
এই ধরো যেমন,মদ গেলা,একের পর এক সিগারেট ফুঁকা ইত্যাদি।
ইনশাআল্লাহ পারব। তোমাদের সবার সাপোর্ট পেলে। আমাদের সাপোর্ট তোমার সাথে প্রতিটিমুহুর্তেই থাকবে ভাবি।
আমিন।
এবার ক্লিয়ার হলেতো। যাও এবার। যুবক স্বামীকে যুবতী বধুর যৌবনতরঙ্গিত শয্যায় বিশ্রাম নিতে প্রশ্রয় আশ্রয় দাও।
তুমিও এনগেজড নাকি নুপুর?বিপন্ন মুখে হাসির প্রলেপ এঁকে জানতে চাইলো জান্নাত।
হঠাৎ? ভ্রঁকুচকে নেত্রপল্লব উল্টিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো জান্নাত।
তোমার কথা শুনলে যে কেউই এটা ধারণা করবে।
তোমার কথার ফুলচন্দন ফুটুক।
তারমানে তুমি একলা রমনী। সঙ্গী এখনো জোটেনি।
বলেই নুপুরের গাল টিপে দিল অষ্টাদশী নবোঢ়া বধু জান্নাত। রিনরিনিয়ে চাপা হাসির গুঞ্জন তুলে দুলে দুলে চলে গেল।
রুমে প্রবেশ করেই কাচের বড় গ্লাসটি ভরে পানি ঢেলে নিল ওয়াটার পট থেকে। গলা তুলে ঢকঢক করে খেয়ে নিল পুরো এক গ্লাস পানি। যেন বহুদিনের পিপাসিত চাতক পাখি।
সে অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে মাহতিমকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
আমি এক্ষুনি চলে যেতে চেয়েছি। কিন্তু মা বাবা মানা করল যেতে। বলল কাল আপনি নাকি নিয়ে যাবেন আমাকে।
তুমিতো এটাই চেয়েছ। পাজীর পাজি কোথাকার।
আপনার যা ইচ্ছে বলতে পারেন। তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা। আমি বড়দের মান্য করতে জানি। আপনার মতো অভদ্র নই আমি।
সো বিরক্তিকর! তোমার সাথে কথা বলার রুচিবোধ ও আমার নেই।
জান্নাত মাহতিমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চায় জান্নাত। ভাইবোনের কথার মিল থাকে কিনা তা দেখা প্রয়োজন তারজন্য। ভারকন্ঠে জান্নাত জিজ্ঞেস করলো,
আপনার পরিবারের সবাই বলল আপনার মত নিয়েই এই বিয়ে হয়েছে। এটা সত্যি?
হুম সত্যিই।
আপনি নাকি বলছেন পাত্রী দেখতে হবেনা। আপনার পরিবার দেখলেই হবে?
হুম বলছি।
যদি তাই হয়। তাহলে বিয়ের রাত অর্থাৎ গতরাত থেকেই আপনি আমার সাথে এত জঘন্য আচরণ কেন করছেন? তা শুনতে চাই আমি।
বউ তুমি না হয়ে যে কেউ হলে কোন সমস্যাই ছিলনা। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কিড়মিড় করে উত্তর দিল মাহতিম।
অপমানে থমথমে হয়ে গেল জান্নাত। সারামুখ পাংশুটে আকার ধারণ করেছে।
দূর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করলো, মানে?
মানেটা তুমি নিজেকে প্রশ্ন করেই জেনে নাও।
আমিতো জানিনা। বুঝতেছিওনা কিছুই।
আমি সময় হলেই বলব।
নাহ আমি এক্ষুনি শুনতে চাই। মজবুত কন্ঠে বলল জান্নাত।
আগে প্রতি সপ্তাহে কোথায় যেতে তুমি? বোরকার আড়ালে তোমার কুৎসিত রূপ আমার কাছে সেদিনই উন্মোচিত হয়েছে। যেদিন তোমাকে উদ্ধার করেছি বখাটে নামধারী দুটো ছেলের হাত থেকে। বিয়েরদিন কবুল বলার পরই দেখলাম রাস্তার সেই সস্তা তুমিই আমার স্ত্রী হয়ে গেলে।
বজ্রকন্ঠে কথাগুলো বলেই বারান্দায় চলে গেল মাহতিম। মাটির কসমস ফুলের টবটি হাতে নিল। উপরে তুলে সজোরে আছড়ে ফেলল নিচে।
উপস্থিত ঘটনার আকস্মিকতায় জান্নাত হতবাক। নির্বিকার! বাকরুদ্ধ! মাহতিমের বলা কথাগুলো বুলেট গতিতে তার মাথার উপর দিয়ে গেল। মগজে কিছুই গাঁথলনা।
মাহতিমের ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। কোন কৌতুহল ছাড়াই ফোনটি হাতে নিল জান্নাত। দেখল স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম। জারা। রিংটোন বাজতে বাজতে অফ হয়ে গেল। আলুলায়িত বেশে বারান্দায় গিয়ে মাহতিমের পিছনে দাঁড়াল জান্নাত।
চমৎকার! চমৎকার! বলে হাততালি দিয়ে উঠল জান্নাত। আপনার জুড়ি মেলা ভার। নিজের অপকর্ম ঢাকতে অন্যকে কিভাবে ঘায়েল করতে হয় তা আপনার থেকে শেখা যাবে।
কিহহ! বলে মাহতিম মাথা ঘুরিয়ে আগ্রাসী চোখে চাইলো জান্নাতের দিকে। জান্নাত মোবাইলটি মাহতিমের নাক বরাবর ধরল। মাহতিম দেখল জারা কল দিয়েছে। মনে মনে জারাকে বিশ্রী ভাষায় গালি দিল মাহতিম।
চিলের মত ছোঁ মেরে জান্নাতের হাত থেকে কেড়ে নিল নিজের মোবাইলটি। ঘৃনাভরা কন্ঠে বলল,
সো হোয়াট! তোর মত প’তি’তার চেয়ে জারা ঢের ভালো মেয়ে।
চলবে ঃ ২
কুসুমিত কামিনী ( ৩)
রেহানা পুতুল
জান্নাত স্তব্দ হয়ে গেল এত নিকৃষ্ট একটি বিশেষণের তকমা তার কপালে জুড়ল বলে। বিমূঢ় নয়নে চেয়ে রইলো মাহতিমের দিকে। বুকের ভিতর একশো দোযখের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রলম্ভিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” দূর থেকে কারো সম্পর্কে না জেনে আন্দাজে কিছু বলা মূর্খতার পরিচয় বহন করে মাত্র।”
শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায়না। তেমনি এসব লজিক দেখিয়েও সত্য আড়াল করা যায়না। ভ্রুকুটি করে বলল মাহতিম।
আমার সম্পর্কে আপনার ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল।
” সব জানা সবসময় যেমন সত্যি নয়। তেমনি সব দেখাও সব সময় সত্যি নয়। সেই জানা ও দেখার মাঝেও আরো নিগূঢ় সত্য লুকিয়ে থাকে। “
দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। এত দর্শন শোনাতে হবেনা আমাকে।
জান্নাত নিজেকে মাহতিমের দৃষ্টির অগোচরে নিয়ে গেল রুমের ভিতরে। বিছানার চাদর খামচে ধরে দলাই মলাই করে এক করে ফেলল। মাহতিমের তখন আবারও মনে পড়ে গেল সেই কথাগুলো। যেমনটি মনে পড়েছে কবুল বলার পরে জান্নাতকে দেখেই। তারপরেই সে উম্মাদ হয়ে যায়। ঘৃণায় তার বমি আসার উপক্রম হয়েছে৷ সারারাত ছাদে কাটিয়েছে ম’ দ গিলে গিলে। শেষরাতে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে বাসায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে।
কয়েকমাস আগে জান্নাতকে যেই দুটো ছেলের হাত থেকে রক্ষা করেছে সে। তার দুইদিন পর সেই দুটো ছেলের একটার সাথে মাহতিমের আবারও দেখা হয়। সেই ছেলেটা নিজ থেকেই এগিয়ে এলো মাহতিমকে দেখে। প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বলল,
ভাই সেদিনতো আমাদেরকে চড় থাপ্পড় দিয়ে নাকমুখ লাল করে দিলেন। যেই মেয়েটাকে রক্ষা করলেন আমাদের হাত থেকে। সে নিজেই সেধে সেধে বহু পুরুষের বি’ ছা’ না’ য় যায়। তখন আমরা দুই বন্ধু চিন্তা করলাম, ওতো এমনি। আমরাও মজা লুটি একদিন। বুঝলেন ভাই বোরকার আড়ালে এমন সুন্দরী মেয়েরা শরীর বেচাকেনা করে। এরা মুখোশধারী। এরা দেহ পসারিণী।
তোমার কথা বিশ্বাস করিনা আমি। তোমরা নিজেরাই নষ্ট আর পথভ্রষ্ট বলে এমন পর্দানশীল নিষ্পাপ মেয়েকে নিয়ে হীন মন্তব্য করছ। আক্রোশের সাথে বলল মাহতিম।
ভাই প্রমাণ আপনি স্বচক্ষে দেখবেন। পরশু ঠিক সন্ধ্যা ছুইঁ ছুইঁ সময়ে এখানে আসবেন। আমি নিয়ে যাব সেখানে আপনাকে। তখন দেখবেন।
এরপর মাহতিম ঠিক সময়ে সেখানে যায় সেই ছেলের সাথে। এবং দেখে সত্যি সত্যি জান্নাত নামের এই মেয়েটা একটি নিষিদ্ধ পল্লীর চিপা গলির ভিতরে ঢুকে গেল। বের হয়ে এলো একঘন্টা পর। তখন নিজের চোখকে তার অবিশ্বাস করার আর কোন সুযোগই রইলনা। তার দুকান অগ্নী চুল্লীর ন্যায় তপ্ত হয়ে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল।
ভাবনা শেষে মাহতিম আরেকটি মাটির টব আছড়ে ভেঙ্গে ফেলে। সেই আওয়াজ কর্ণকুহরে যেতেই জান্নাত কেঁপে উঠল ছোট্ট শিশুর মতো।
এবার জান্নাত ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। বাথটাবের পাড়ে পা উঠিয়ে বসে পড়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে। ডুব দেয় তার অনাহূত জীবনের সূদুর অতীতে।
হেমন্তের আকাশে সেদিন ঝলমলে সোনা রোদ ছিল। সেই কমলা রঙের রোদে ভীষণ মায়া ছিল। গর্ভ যন্ত্রণা নিয়েও মধুলতা কলতলায় এসেছে মাটির জগটা ভরে নেওয়ার জন্য। তা তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। মাথা তুলে কলপাড় ঘেঁষা চিরহরিৎ কামিনী বৃক্ষটার উপরে নজর বুলায়। অজস্র শুভ্র রঙা কুসুমিত কামিনী ফুল ফুটে আছে। তার কোমল স্নিগ্ধ সুরভিতে চারপাশ সুবাসিত হয়ে আছে। মাটির বুকেও ঝরে পড়ে আছে অজস্র কামিনী ফুল।
প্রসব যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে যেতে সেই কামিনী গাছ তলায় মধুলতা জন্ম দেয় চাঁদের মতো একটি ফুটফুটে কন্যা শিশুর। ঘরে যাওয়ার সময়টুকু হয়নি মধুলতার। কামিনী ফুলের কচি শাখাগুলো দুলে দুলে সদ্য ধরনীতে আসা শিশুটিকে অভিবাদন জানিয়েছিল তখনই।
মধুলতা ক্ষীনকায় চোখে কন্যার মুখপানে চায়। এবং বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,
আজ থেকে তুই আমার কুসুমিত কামিনী মা। এই জগতসংসারে তুই ছাড়া আমার যে আর কেউই রইলোনা। কিন্তু আমি কেমন করে, কিভাবে তোকে বড় করব মা? কিভাবে?
যাদের সাহায্যে কামিনীর জন্ম হয়। সেই নারীগুলো মধুলতা ও তাকে বেড়ার খুপরি ঘরটায় নিয়ে আসল। তড়িঘড়ি করে মধুলতাকে গরম পানি করে দিল খাওয়ার জন্য। শিশুটিকে গোসল করিয়ে একটি নতুন তাওয়েলে পেঁচিয়ে নিল তারা। সবার মাঝে চাপা আনন্দ বিরাজ করছে।
মধ্যবয়স্কা সর্দারনী বাসন্তীবালা মধুলতার দিকে চাইলেন অসহিষ্ণু চোখে। বিষকন্ঠে মধুলতাকে ঝাড়লেন নিজের খায়েশ মিটিয়ে ।
কত করে ইনিয়ে বিনিয়ে কইলাম, ফালায়া দে। রাখিস না। পরে শরীরের আদল নষ্ট হইয়া গ্যালে আর খদ্দর আইবো তোর বিছানায়? এই ভ্রুণের পিতা কে তুই কইতে পারবি মধু? যদি নিদিষ্ট করে বলা যাইতো। তাও না হয় দিলেরে বুঝ দিতি। হ্যারে খুইঁজা বাইর করতি। কত বিদেশী পুরুষও আসে। বিছানা বদল হয় ঘন্টায় ঘন্টায়। কার জন্ম দেওয়া কে জানে। এখন ক্যামনে পালবি এই মাইয়ারে? তোর কামাইর পথ ও যে বন্ধ হইলো।
মধুলতা মেলানো দুঠোঁট ফাঁক করেও মিলিয়ে ফেলল। কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলল কি যেন ভেবেই। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে নির্জীবের ন্যায়।
পাশ থেকে ললিতা নামের মেয়েটি বলল
” খালা আমার মনে হয় এই মাইয়া কোন সুন্দর পুরুষের জন্ম দেওয়া। চাইয়া দেখেন কি সুন্দর। যেন আসমানের পরী ভুল কইরা মাটিতে আইসা পড়ছে।”
ওই অন্য পুরুষ সুন্দর কস? আমাগো মধু আপা কি কম সুন্দর নাকি। এই পল্লীতে খদ্দের আসে বেশী মধু আপার ম’ ধু’ র লোভেই। আমিই পালতাম ওরে। কিন্তুক এইখানে সেই সুযোগ নাই। বেটাদের লগে শোয়া লাগে।
ওদের খোলামেলা কথাবার্তায় সরব হয়ে উঠল শহরের নিষিদ্ধ পল্লীর মধুলতার এক চিলতে খুপরি ঘরখানা।
পাশ থেকে তাদের বলা কথাগুলো সর্দারনী বাসন্তিবালার কানে পৌঁছায়। সে ঝট করেই বলে ফেলে মধুবালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
ওই মধু শোন। যেহেতু জন্ম দিয়াই ফেললি বাচ্চাটারে। ওরে এখন পালক দিয়া দে কারো কাছে। তাহলে খদ্দের আইবো আগের মতো। মাইয়ার খরচ ও চালাইতে পারবি। মাঝেমাঝে কাছেও পাবি মাইয়ারে।
মধুলতা ফ্যালফ্যালিয়ে নিরবে অশ্রুপাত করে ফেলে। নদীর স্রোতধারার ন্যায় কলকলিয়ে সে অশ্রু বয়ে পড়ে দুগালের পাশ ঘেঁষে। বাসন্তীবালা রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে যায়।
দু’মাস গড়িয়ে যায়। খদ্দের আসলে বাচ্চা দেখলেই মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। মধুলতার আয়ের পথ একেবারেই রুদ্ধ। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে মা মেয়েকে চালিয়ে নিচ্ছে কোনরকম করে। বুকের মাঝে লেপ্টে রাখে কামিনীর পুষ্পতুল্য ছোট্ট শরীরটাকে৷ জীবনের উপর আনা সমস্ত খেদ পানি হয়ে যায় নিমিষেই। যখন দেখে তার কামিনী ফুলটা অবিকল উজল চাহনিতে মায়ের মুখপানে চেয়ে আছে।
তার সহকর্মীরা তাকে নানান যুক্তি খন্ডন করে পরামর্শ দিতে লাগল। মেয়েকে অন্যত্র পালক দিয়ে দেওয়ার জন্য। উপায়ন্তর না দেখে মধুলতা নিমরাজি হয়।
দুদিন বাদে ক্ষুদে কাপড় ব্যবসায়ী মিনারা গিয়েছিল সেই পাড়াতে। এখানে তার কিছু নিদিষ্ট কাষ্টমার আছে। এরা সবসময় তার থেকে জামাকাপড় ও শাড়ি কিনে থাকে যারযার বয়স অনুযায়ী। মধুলতার রুমে ঢুকেই কামিনীকে কোলে তুলে নেয় মিনারা। আলুথালু মুখটা আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মিনারা।
প্রসঙ্গত পাশে বসা একজন নারী মধুলতার বর্তমান অবস্থার বিবরণ দেয় মিনারার কাছে। শুনে হায় হায় করে উঠে মিনারা। বুক ভরা দুঃখ নিয়ে বলে,
আমরা স্বামী স্ত্রী কত চেয়েও একটা সন্তানের মুখ দেখতে পেলামনা আজো। বিয়ে হলো দুই যুগ পার হয়ে গেল। আর এর পিতা থেকেও নেই। মধু আপা আপনি চাইলে আপনার মেয়েরে আমার কাছে দেন। পেলেপুষে বড় করে দিব। কোন চাওয়া নাই আমার। আপনার যে কোনো শর্তই মানতে আমি রাজী।
একদিকে নিঃসন্তান মিনারার আকুল আবেদন। আরেকদিকে নিষিদ্ধ পল্লীর সহকর্মীদের বোঝানো। নিজের আয়ের পথ ও বন্ধ। চিন্তা করতেই মধুলতা দ্বিধায় পড়ে যায়। মানসিক দোটানায় দুলতে থাকে ঝড়ে দুলতে থাকা মাঝ দরিয়ার নৌকার মতো।
আলতো করে মেয়ের দুচোখের পাতায় মায়ের অধর দুটো ছোঁয়ায়। মিনারার কথায় সম্মতি জানায়। মিনারা যত্ন করে কোলে তুলে নেয় মধুলতার প্রাণের ধন কুসুমিত কামিনীকে।
সেদিন রাতেই মধুলতার ঘরে আচম্বিতে প্রবেশ করে একজন সুঠামদেহী সুদর্শন পুরুষ। চেনা মুখখানা দেখামাত্রই মধুলতার অধরজুড়ে প্রষ্ফুটিত হলো প্রত্যাশার নির্মল হাসি।
চলবেঃ ৩
কুসুমিত কামিনী ( ৪)
রেহানা পুতুল
সেদিন রাতেই মধুলতার ঘরে আচম্বিতে প্রবেশ করে একজন সুঠামদেহী সুদর্শন পুরুষ। চেনা মুখখানা দেখামাত্রই মধুলতার অধরজুড়ে প্রষ্ফুটিত হলো প্রত্যাশার নির্মল হাসি।
এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার কন্যাসন্তান হয়েছে। একবার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি? আপনি বলছেন এরপর আমাকে বিয়ে করবেন। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবেন। মুক্ত করবেন এই নরকপুরী থেকে। উপহার দিবেন একটি শান্তির জীবন। অনুযোগ নিয়ে একনাগাড়ে মলিনমুখে জিজ্ঞেস করলো মধুলতা।
খালেদ নামের লোকটি একটু চুপ হয়ে রইলো। পরক্ষণেই নিরব কন্ঠে বলল, তোমার কথা অস্বীকার করছিনা। কিন্তু আমি পুত্র সন্তান হলে তোমাকে বিয়ে করতাম। ঘরে তুলে নিতাম। এখনতো আর সম্ভব নয় মধু।
মধুলতা ছ্যানছেনিয়ে উঠলো। অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে ক্রোধ নিয়ে বলল,
এটা কি নিষ্ঠুর বিচার!কি নির্দয় আচরণ? মাত্র কন্যা জন্ম হলো বলেই আপনি বেঈমানী করবেন সাথে? আর সেতো আপনারই ঔরসজাত সন্তান। আমার কি অপরাধ? এখন তাকে আমি কিভাবে পালব? আপনিতো বললেন আপনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আর কাউকেই আপনার মনে ধরেনি। কেবল আমাকেই পছন্দ হলো আপনার। আপনার সাথে সম্পর্কের পর কাউকেই আমি বিছানায় আনিনি নানান মিথ্যা অজুহাতে। আপনিতো তখন বললেন,কোন নিয়ম মানতে হবেনা। আমি চাই তোমার গর্ভে আমার একটা সন্তান আসুক। সমস্যা নেই। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। কি বলেননি এসব?
আমি তখন আবেগের বশে বলেছি। কিন্তু দেখলাম বাস্তবতা অনেক নির্মম। আমার সমাজ তাহলে আমাকে একঘরে করে দিবে। যদি আমি একজন দেহ পসারিণীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিই। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বাচ্চাটার খরচপাতি সব দিব।
লাগবেনা আপনার করুণা বা দয়া। ওকে যখন পৃথিবীর আলো বাতাস আমিই দেখিয়েছি। তখন তাকে বড় ও করতে পারব আমি। এক্ষুনি চলে যান আমার রুম থেকে। আর কোনদিনও আপনার মুখ দেখতে চাইনা আমি।
বাচ্চা এখন কোথায় মধু?
আমার এক বোনের আশ্রয়ে আছে। আমি চাইনা এই পল্লীতে বড় হয়ে সেও আমার মতো আরেকজন মধুলতা হয়ে উঠুক।
আচ্ছা। বলে খালেদ উঠে চলে যায় কিঞ্চিৎ অনুশোচনার ঝাঁপি মাথায় নিয়ে। কিছু টাকা রেখে যায় টেবিলের উপরে মধুলতার অগোচরে।
মিনারা অপ্সরার মতো দেখতে জান্নাতকে ধর্মীয় অনুশাসনে বড় করতে থাকে। সম্ভবপর পর্দা করার অভ্যাস গড়ে তোলে তার মাঝে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়। তার ও মধুলতার সামর্থ্যনুযায়ী পড়াশোনা করাতে থাকে। জান্নাত বড় হলে তার আসল পরিচয় খুলে বলতে বাধ্য হয়। কারণ জান্নাত প্রায় মিনারাকে প্রশ্ন করতো,
আম্মু তুমি আমাকে যে আন্টির কাছে নিয়ে যাও। উনাকে আমার এত মায়া লাগে কেন? উনার কাছে গেলে আসতেই ইচ্ছে করেনা আমার।
জান্নাত সবকিছু শোনার পর মায়ের মুখোমুখি হয়। মধুলতা তার নষ্ট জীবনের গোড়াপত্তন শোনায় মেয়েকে। শুনে জান্নাতের অন্তরখানি দগ্ধ হয় মায়ের জন্য। মায়ের কাছে খালেদের ছবি দেখতে চায়। মধুলতা তার ফোনের গ্যালারি থেকে খালেদের ছবি দেখায়।
তারপর হতেই রোজ সপ্তাহে জান্নাত বোরকা পরে সন্ধ্যার পর আসল মা মধুলতাকে দেখতে চায়। অপেক্ষায় থাকে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার। তখনি মাকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকবে। মিনারা কতবার বলছে তাদের বাসায় থাকার জন্য। কিন্তু মধুলতা যাবেনা কিছুতেই। মাত্র কয়েক হাত দৈর্ঘ্য প্রস্থের চওড়া খুপরি ঘরটায় থেকেই তার জীবন প্রদ্বীপ নিভিয়ে দিতে চায়।
এই ভিতরেই জান্নাতের বিয়ে হয়ে যায় মাহতিমের সাথে দুই পরিবারের পছন্দে। বিয়ের সময় তার জন্মধাত্রী মধুলতাও ছিল সপ্তাহ জুড়ে মিনারার বাসায়। মিনারা মাহতিমের পরিবারের কাছে জান্নাতের পরিচয় বলছে তাদের পালিতা কন্যা। কিন্তু তার মা যে নিষিদ্ধ পল্লীর একজন মধুলতা বা এখনো জীবীত আছে। এটা গোপন করেছে। আবার জান্নাতকে বলছে কোন সমস্যা হবেনা। সে যা বলার পাত্রপক্ষকে বলে নিয়েছে। মা মিনারাকে জান্নাত নিজের জীবনের মতই ভালোবাসে। নয়তো আজ হয়তো তারও পরিচয় হতো মধুলতার মতো। তাই মিনারার পছন্দ ও কথার বাইরে কোন মত প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করেনি জান্নাত।
রসগোল্লা ভাবি কোথায় তুমি?
রুমে ঢুকে নুপুরের জোর ডাকে জান্নাতের কল্পনার সুতো ছিঁড়ে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
এই এসব কি ঢংয়ের ডাক শুরু করেছিস? চেয়ারে বসা থেকে বিরক্ত স্বরে বলল মাহতিম।
ভাবি দেখতে রসগোল্লার মত নয়?
তোর কল্লা। বলে মাহতিম লাঞ্চ করতে বেরিয়ে যায় নুপুরের পাশ কেটে।
পিছন দিয়ে মাহতিমকে ভেংচি কেটে জান্নাতের গলা পেঁচিয়ে ধরল নুপুর। কি তোমার জামাইকে বশে আনতে পারছ সখী?
চেষ্টা করার সুযোগটুকুও যে পাইনি ননদী।
ওহ আচ্ছা। চলো খাবে।
ডাইনিং টেবিলে বসে নানান গল্প গুজবে সবাই খেয়ে উঠল। শেষ বিকেলে সব নিকটজনেরা চলে গেল। সন্ধ্যায় রবিউল মাহতিম ডেকে আদেশ দিলেন জান্নাতকে নিয়ে তার বাবার বাসায় বেড়াতে যেতে ৷ মাহতিম গাইঁগুই শুরু করলেও ধোপে টিকলনা। বাবার কড়া হুকুমে যেতে বাধ্য হলো।
নুপুরকেও জান্নাত অনেক জোরাজোরি করে নিয়ে গেল।
গাড়ি ড্রাইভ করছে মাহতিম। লুকিং গ্লাসের ভিতরে জান্নাতের ঢাকা দুটি চোখ দেখা যাচ্ছে। দুচোখে কাজল আঁকা রয়েছে। যেটা ছোটবেলা থেকেই জান্নাত দেয়। এই অভ্যাসটা মা মধুলতার কাছ থেকে পেয়েছে। মিনারা যখনি কোলে করে জান্নাতকে নিয়ে যেত তার কাছে। তখনি মধুলতা নিজের হাতে তোলা পাড়া কাজলটা মেয়ের দুচোখে লাগিয়ে দিত।
মাহতিম মনে মনে বলছে,
এত মোহনীয় দুটি আঁখি। অথচ স্বভাবে কি বাজে মেয়েটা ছিহ! জারা আমার কাছে ফিরে আসতে চায় এখনো। স্বামীর সাথে এডজাস্ট হচ্ছেনা বলে ডিভোর্সড নিয়ে নিয়েছে। কোন বেবিও হয়নি। আমিও একে ডিভোর্স দিয়ে প্রাণের জারাকেই বিয়ে করে ফেলব।
পৌঁছে গেল তারা বাসাবোতে জান্নাতদের বাসায়। মিনারা ছুটে এলো মেয়ে ও জামাইকে দেখে। তার অসুস্থ স্বামী পিছনের রুমেই শোয়া ছিল। মাহতিম তাদের সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করল। যদিও মাহতিমের এদের উপর প্রচন্ড আক্রোশ। কেমন মা বাবা। বোরকার আড়ালে মেয়ের দুই নাম্বারি কাজের খবর রাখেনা। মাহতিম রাতে ঘুমানোর জন্য জান্নাতের রুমটাই গুছিয়ে মিনারা ঠিক করেছে। আর নুপুর ঘুমাবে তার সাথে।
রাতে খাওয়ার পর্ব শেষে মাহতিম জান্নাতের রুমেই শুয়ে পড়ল। দরজা বন্ধ। জান্নাত মাহতিমের পাশে শোয়ার জন্য চেষ্টা করলে,
খবরদার বলছি আমার পাশে তোমার স্থান নয়। বেশি সিনক্রিয়েট করলে এখুনি বাসায় চলে যাব।
জান্নাত পরিস্থিতি বুঝে চুপ রইলো। চেয়ারে বসে ওড়নার আঁচলের একপাশকে আঙ্গুলে পেঁচিয়ে মোচড়ামুচড়ি করছে। বারান্দাও নেই যে সেখানে গিয়ে ঘুমাবে। পরে খাটের সামনে কাঁথা বিছিয়ে নিল। বুকের ওড়নাটা একপাশে রেখে একটা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নয়তো মশার জন্য ঘুমাতে পারবেনা। প্রায় শেষরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল মাহতিমের। সবুজ ডিম লাইটের আলোয় টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল।
খাটের উপরে শুয়ে গেল আবার। ঘুমন্ত জান্নাতের মুখের উপর না চাইতেই মাহতিমের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। তার নেশাতুর দৃষ্টিতে বন্ধী হয়ে যাচ্ছে জান্নাতের পা হতে মাথা অবধি। মাহতিম কল্পনার আবেশে তলিয়ে যেতে যেতে,
খোদার কি অপূর্ব সৃষ্টি তুমি। এই প্রথম তোমাকে নিবিড়ভাবে দেখছি। ওড়না না থাকায় মেয়েদের সবচেয়ে আবেদনময়ী অঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হলো এখন। এটা এর আগে কখনো উপলব্ধি হয়নি। তিনবছর চুটিয়ে প্রেম করেছি। কিন্তু জারাকে এভাবে দেখার সিচুয়েশন হয়নি। তোমার প্রতি ভাঁজে ভাঁজে অনাবিল মুগ্ধতা। অপার কমনীয়তা।
ঘুমন্ত জান্নাত ওপাশ হতেই জলন্ত কয়েলে পায়ের তালু লেগে গেল। সে আহ! বলে কুঁকিয়ে যেতেই মাহতিম চট করেই নিচে নেমে কয়েল সরিয়ে দিল। জান্নাত জেগে গিয়ে উঠে বসল। ওড়না হাতে নিতেই মাহতিম হ্যাঁচকা টানে ওড়না নিয়ে নিল নিজের হাতে। এখানে শুধু আমিই আছি বলে জান্নাতের পায়ের তালুতে মাহতিম পানি ও ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
তোমাদের ফ্রিজ কোথায়? বরফ বা ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে রাখলে আর ফোসকা পড়বেনা।
আপনার কোন হেল্প বা সহানুভূতি আমি চাইনা। উপরে যান ঘুমিয়ে পড়ুন।
এত তেজ দেখাবানা বলছি আমার সাথে। উপরে আস।ঘুমাবে।
একদম নাহ। মরে গেলেও না। বলে জান্নাত পায়ের গোড়ালি তুলে আইস ট্রে নিয়ে এলো। মাহতিম ট্রে থেকে বরফ টুকরো নিল হাতে। জান্নাতের পা টেনে নিজের উরুর উপর রাখল। বরফ ঘষতে লাগল।
জান্নাত উহু! আহ! বলে কোঁকাচ্ছে আর বলছে আপনি উপরে যান প্লিজ।
যাব। মানবিক দায়িত্ব পালন শেষেই। মনে করনা বউ হিসেবে আদর করে সেবা করছি। তোমাকে উপরে ঘুমাতে দিলে এমন হতনা। সেই অপরাধবোধ থেকেই এমন করছি। ব্যস।
জান্নাত নিচে ঘুমিয়ে রইলো। মাহতিম উপরে উঠে গেলেও তার ভিতরের উম্মাদনা তাকে ঘায়েল করে ফেলছে। না পারছে জান্নাতকে বুকে নিতে না পারছে ছুঁড়ে ফেলে দিতে।
ভোর হতেই টনটন করে মাহতিমের ফোন বেজে উঠল। রিসিভ হতেই,
মাহতিম তোর ফুফা একক্সিডেন্ট করেছে। রক্ত লাগবে। হাসপাতালে যা জলদি।
কোন ফুফা মা?
খালেদ। তোর বড় ফুফা।
চলবেঃ ৪
কুসুমিত কামিনী ( ৫ )
রেহানা পুতুল
মাহতিম তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে নেয়। মিনারার কাছে বলে চলে যায়। জান্নাত ও নুপুর ঘুম থেকে উঠলে মিনারা তাদের সব জানায়।
নুপুর নাস্তা খাওয়ার পর বলে,
ভাবি আমি ফুফাকে দেখতে যাব। তুমি যাবা?
হ্যাঁ মা। তোর ও যাওয়া উচিত। জামাই খুশি হবে। আদেশ দিয়ে বলল মিনারা।
আচ্ছা আম্মু যাব। নুপুর মাহতিমকে ফোন দিয়ে ওয়ার্ড নং জেনে নেয়। তারা হাসপাতালের বারান্দায় যেতেই দেখল
মাহতিমসহ আরো দু একজন হাসপাতালে ছুটাছুটি করছে রক্তের জন্য। কিন্তু নেগেটিভ রক্ত পাওয়া কঠিন। জান্নাতের কানে রক্তের গ্রুপের নাম পৌছানো মাত্রই সে বলে উঠল,
আমার ব্লাডগ্রুপ ‘ ও নেগেটিভ’। আমি আংকেলকে ব্লাড দিব।
মাহতিমসহ সবাই ভীষণ খুশী হয়ে উঠে। কারণ মাহতিমের জীবনে এই খালেদের অবদান রয়েছে।
মাহতিম জান্নাতের হাত ধরে আসো,
বলেই দ্রুত নিয়ে যায় ব্লাড দেওয়া রুমে। রক্ত দেওয়া শেষ হলে মাহতিম জান্নাতকে স্যালাইন ও ডাব এনে খাওয়ায়। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে জান্নাত উঠে বসে। মাহতিমকে বলে আংকেলকে দেখব এখন।
আসো তাহলে।
নুপুর জান্নাতের সাথেই ছিল এতসময়। তাই সেও তার ফুফাকে দেখতে পায়নি। তারা ওয়ার্ডে সিটের পাশে গিয়ে থামল। খালেদ প্রাণহীন পাথরের ন্যায় পড়ে আছে বেডের মাঝে। সব প্রসেসিং শেষ করে খালেদের শরীরে প্রবেশ করছে জান্নাতের শরীরের রক্ত। খালেদের মুখ দেখেই জান্নাতের বুকের ভিতর কেমন খচখচানি শুরু হলো। বেকুব বনে গেল যেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে চাইলো খালেদকে। আস্তে করে বাইরে চলে এলো।
ব্যাগ থেকে মুঠোফোনটা হাতে নিল। মাকে ফোন দিল।
হ্যালো মা তোমার ফোন থেকে আমাকে একটা ছবি এক্ষুনি পাঠাও।
কার ছবি কামিনী?
মিনারা কামিনীকে জান্নাত পরিচয়ে বড় করে তোলে। তাই মধুলতা ছাড়া কেউই কামিনী বলে ডাকেনা তাকে।
আমাকে জন্ম দেওয়া খালেদ নামের জা’নো’য়া’রের।
কি হলোরে মা? তুই এমন হাঁপাচ্ছিস কেন?
অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো মধুলতা।
এত বলার সময় নেই। দ্রুত ছবি দাও বলছি।
ক্যামনে দিব মা?
উফফস! তুমিতো ইমু ছাড়া পারবানা। ইমুতেই দাও। হারিআপ।
মিনিট ব্যবধানেই ছবি চলে আসে। জান্নাত ফের সিটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মোবাইলের ছবি আর বেডে শোয়া লোকের ছবি বারবার দেখে মিলিয়ে নেয়। কাউকে কিছু বলেনা। আস্তে করে মাহতিমের পাশে গিয়ে বলে,
আমার খুব খারাপ লাগছে। বাসায় যাব।
হঠাৎ করে ব্লাড দেওয়াতে তোমার এমন লাগছে। আচ্ছা তুমি আর নুপুর বাসায় চলে যাও। আমি এখানেই আছি।
আচ্ছা। আপনি আংকেলকে যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ করে তুলুন প্লিজ।
তারা দুজন রিকসাযোগে বাসায় চলে যায়। মাহতিমের মা মেহনাজ ও তার বাবা রবিউল ওদের দেখেই এগিয়ে আসে। খালেদের কথা জিজ্ঞেস করে,
আমরা রেডি হচ্ছি যাওয়ার জন্য। এখন কি অবস্থা তোর ফুফার?
আম্মু তোমার বউমা ফুফার জীবনদাতা বলা যায়। যদিও এভাবে বলা উচিত না। কারণ জীবন দেওয়া নেওয়ার মালিক কেবল একজনই। তবুও বলছি এজন্য। কোথাও নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যাচ্ছেনা। তিন ব্যাগের দরকার। দুই ব্যাগ ম্যানেজ হয়েছে। একব্যাগ নিয়েই বিপদ হয়ে গিয়েছে। ব্লাডব্যংক থেকে আনতে আনতে লেট হয়ে যেত। ভাবির সাথে মিলে গেল। কি কাকতালীয় না? আমাদের কারো সাথেই মিললনা। কিন্তু আমাদের ঘরের বউর সাথে মিলে গেল।
মাহতিমের বাবা মা কৃতজ্ঞতার চোখে জান্নাতের দিকে চায়। তাকে বুকে চেপে মাথায় আশীর্বাদের পরশ বুলিয়ে দেয়। এবং বলে,
জানো মা আমাদের পারিবারিক জমিসংক্রান্ত একটা ঘটনায় তোমার এই ফুফা শশুরের বহু ত্যাগ রয়েছে। সে সুস্থ হলে দেখবা তোমাকে মাথায় তুলে আদর করবে। আমার ননদ মানে তোমার ফুফু শ্বাশুড়ি আচমকা মারা যাওয়ার পর সে পাগল হয়ে গিয়েছে। কত মেয়ে দেখালাম। তার মনেই ধরেনা। তাই আর জীবনে বিয়েটাও করলনা। শেষ জীবন যে তার কিভাবে কাটবে আল্লাহ জানে। অন্তত যদি একটা সন্তান ও থাকতো। বলেই গভীর পরিতাপের দম ফেললেন মাহতিমের মা।
আমি রুমে যাই মা? বেশ ক্লান্ত লাগছে রক্ত দেওয়াতে।
হ্যাঁ হ্যাঁ। যাও মা। আমিওনা কি শুরু করেছি।
এটাতো তোমার পুরানা স্বভাব। কোন কাহিনীর একটু রেশ পেলেই শুরু করো ইতিহাসের বয়ান। খোঁচা মেরে হেসে বলল রবিউল।
তারা দুজন গিয়ে হাসপাতালে খালেদকে দেখে আসল।
সেদিন রাতেই জারা ফোন দেয় মাহতিমকে। নাকি নাকি স্বরে বলে,
সুইটহার্ট ওই মেয়েটাকে ডিভোর্সের পিপারেশন নিচ্ছ?
জারা,আমার আপন বড় ফুফা এক্সিডেন্ট করেছে। উনাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। ফোন রাখ।
বারে। তুমিতো বললা তাকে ছেড়ে দিবা।
বলছি সেটা অতীত৷ বর্তমান হলো তাকে আমি ছাড়ছিনা।
হোয়াট! কি কারণে তোমার ডিসিশন চেঞ্জ হলো ডিয়ার? রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জানতে চাইলো জারা।
দেখ জারা, তুমি আমার লাইফের পাস্ট। আর জান্নাত আমার লাইফে প্রেজেন্ট। সো আমি প্রেজেন্ট নিয়ে ভালো থাকতে চাই। আমি তাকে বাসর রাত উপহার দিইনি। চূড়ান্তভাবে ইনসাল্ট করেছি। তবুও সেই মেয়েটাই আমার ফুফাকে ব্লাড দিয়ে বাঁচিয়েছে। ক্যান ইউ ইমাজিন? সে মানুষ হিসেবে কতটা ভালো। ‘ ও নেগেটিভ ‘ ব্লাড টাইমলি ম্যানেজ করা কতটা দুঃসাধ্য। আশাকরি এটা তুমিও অবগত রয়েছ। জান্নাতের মাঝেই খুঁজে নিতে চাই আমার সুখের জান্নাত।
হাউ ফানি বলে ফোনের ওপাশে উদভ্রান্তের ন্যায় কটাক্ষ হাসি হেসে বলল জারা,
এক ব্যাগ রক্ত দিয়েই সেই দুই টাকার সস্তা মেয়েটা তোমার হৃদয় হরণ করে ফেলল? আমি তাকে জানে মে’রে ফেলব কিন্তু।
মুহুর্তেই মাহতিম মোবাইলের সুইচড অফ করে দিল। আর নেয়া যাচ্ছেনা জারা নামের স্বার্থবাদী মেয়েটার আচরণ।
জারা জান্নাতকে নিয়ে নানারকম ফন্দী আঁটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে বনের অভুক্ত শিকারীর ন্যায় । মাহতিম ভাবতে থাকে কিভাবে জান্নাতকে আগলে রাখা যায় নিরাপদে।
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুইঁ ছুইঁ। জান্নাতের মুঠোফোন বেজে উঠল। হ্যালো জান্নাত কি করছ? খেয়েছ?
মাহতিমের আবেগঝরা কন্ঠে জান্নাত বিস্মিত হলনা। কারণ সে তার ফুফাকে রক্ত দিয়েছে আজ দুপুরেই।
হ্যাঁ খেয়েছি। আপনি খেয়েছেন? আপনার ফুফার কি অবস্থা এখন? স্বাভাবিক গলায় জানতে চায় জান্নাত।
হ্যাঁ ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে৷ জ্ঞান ও ফিরেছে বেশ আগেই। তুমি রুমে একা ভয় পেলে বেড শেয়ার করতে পার নুপুরের সাথে।
না আমি ঠিক আছি।
তোমার পায়ে ফোসকা পড়েছে? কয়েলে পড়ল যে পা?
নাহ পড়েনি।
আচ্ছা ঘুমাও। আমি আছি ফুফার কাছেই।
ফোন রেখে জান্নাত বি’ ষা’ ক্ত মন নিয়ে রাতে খালি রুমে পায়চারি করছে৷ তার কাছে মাত্র দুটো অপশন খালেদকে নিয়ে। কিন্তু ক্ষণ ভেবেই একটা পথই বেছে নিল খালেদের জন্য। এটাই খালেদের মতো পুরুষের জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত শাস্তি। যারা নারীকে মানুষ মনে না করে ভোগের বস্তু মনে করে। খেলনা ভেবে খেলাশেষে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নর্দমার কীটের মতো। যার জন্য তার ফুলসজ্জা রজনী কেটেছে উপেক্ষায়, অনাদরে,অপমানে।
তার পরেরদিন জান্নাত ফার্মেসির কথা বলে বিকেলে বাসা থেকে বের হয়। বোরকা পরে মুখ নেকাব দিয়ে ঢেকে নেয় বরাবরের মতই। সত্যতা প্রমাণের জন্য একটি প্যাড কিনে নেয়। নয়তো বাসায় যদি ধরা পড়ে যায়৷ এরপর খুঁজে বের করে কাঁচাবাজারের মার্কেট। চলে যায় দা বটি ছুরির দোকানে। কিনে নেয় একটি ধারালো ছুরি।
দুদিন পরে সন্ধ্যার পরে জান্নাত মাহতিমের সাথে হাসপাতালে যায় খালেদকে দেখতে। জান্নাত কৌশলে মাহতিমকে বলে,
আমি উনার কাছে আছি। আপনি চিকেন স্যুপ নিয়ে আসেন উনার জন্য।
মাহতিম সাথে সাথে বের হয়ে যায় কেবিন থেকে। দরজা বন্ধ করে দেয় ভিতর থেকে জান্নাত। সে মুখের নেকাব বন্ধ রেখেই ব্যাগের ভিতর থেকে বড় ছুরিটি বের করে নেয়। সাথে করে আনা একটি জর্জেট ওড়না দিয়ে খালেদের গলা পেঁচিয়ে ফেলে। খালেদ গোঙানো ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছেনা।
দরজায় আবার টোকা পড়টেই জান্নাত তড়িতেই ছুরিটি লুকিয়ে ফেলে।
মাহতিম বাইরে থেকে জানালা দিয়ে ভিতরের দৃশ্য দেখে ফেলে। জান্নাত দরজা খুলে কাঁপতে কাঁপতে সরে দাঁড়ায়।
মাহতিম জান্নাতের চুলের মুঠি চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বলে,
তুই দেখি শধু নষ্টাই নয়। একজন ডাইনীও। আমার ফুফাকে কেন মারতে যাচ্ছিস?
মাহতিম খালেদের গলা থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলে। খালেদ কাশি দিতে থাকে অনবরত।
জান্নাত ছুরিটি আবার হাতে নেয়। তার মাথায় খু’ন চেপে আছে। শরীরের সমস্ত র’গ দাপাদাপি করছে। মাথার মগজ টগবগ করে ফুটছে। সে রণমূর্তি ধারণ করে ক্ষিপ্রকন্ঠে বলে উঠে,
খবরদার বলছি। একদম চুপ। এই অমানুষের সাথে এখন আপনাকেও খু’ন করে ফেলব আমি। তারপর নিজেই ধরা দিব থানায়।
মাহতিম ও খালেদ অচেনার মতন জান্নাতের দিকে চেয়ে থাকে স্তম্ভিত চোখে।
চলবে ৫
কুসুমিত কামিনী ( ৬ )
রেহানা পুতুল
খবরদার বলছি। একদম চুপ। এই অমানুষের সাথে এখন আপনাকেও খু’ন করে ফেলব আমি। তারপর নিজেই ধরা দিব থানায়।
মাহতিম ও খালেদ অচেনার মতন জান্নাতের দিকে চেয়ে থাকে স্তম্ভিত চোখে। তারা দুজনেই চুপ হয়ে আছে। মাহতিম ফুফার সামনে লজ্জায় ছোট হয়ে গেল। কি ভাববে ফুফা। অথচ ফুফার কাছে কত প্রশংসা করল জান্নাতের। ফুফাও জান্নাতকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেল। আর যখন দেখল,
তখন জান্নাত তার কাছে পরিচিত হলো খারাপ, মেন্টাল হিসেবে।
জান্নাত খালেদের এক হাত টেনে ধরে বলল,
আপনার শরীর কেটে আমার দেওয়া সব রক্ত বের করে ফেলব। আপনি একটা খবিশ,ইতর,পশু,বর্বর। আপনার বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
খালেদ তব্দা খেয়ে গেল আচম্বিতে। কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা তার জান্নাতের এমন উদ্ভট আচরণ।
মাহতিম ঝট করেই জান্নাতের দুহাত পিছমোড়া করে ধরল। হাত থেকে ছুরিটি কেড়ে নিল।
জান্নাত কাঁপা কাঁপা উত্তেজিত কন্ঠে মাহতিমকে অনুনয় করে বলল,
আমাকে ছাড়ুন বলছি। প্লিজ। আমি কেন এমন করছি তার প্রমাণ নিয়ে আসি। আধঘন্টা সময় লাগবে মাত্র।
কিসের প্রমাণ আনবে? তুমি একটা সাইকো। তোমাকে মেন্টাল হসটপিটালে নিয়ে যাব এক্ষুনি।
মাহতিম। ওকে ছেড়ে দাও। যেতে দাও।
শীতল গলায় অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল খালেদ।
মাহতিম দূর্বার কৌতুহলমাখা চোখে খালেদের দিকে চাইল। ছেড়ে দিল জান্নাতকে। জান্নাত ব্যস্তপায়ে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেল।
কি ব্যাপার ফুফা? আপনি ওকে চিনেন? বিস্মিত চোখে জিজ্ঞেস করলো মাহতিম।
একদম না। আমি ওকে চিনি কেবল তোমার স্ত্রী হিসেবে। এবং এই এখন প্রথম দেখলাম ওকে। সেতো পাগল নয় মাহতিম। যেই মেয়েটা আমার জন্য রক্ত দিল স্বেচ্ছায়। এত আন্তরিক হয়ে দেখতেও এলো। তাহলে সে কি কারণে আমার মুখ দেখামাত্রই এমন হিংস্র হয়ে উঠল। এটা জানা জরুরী।
মাহতিম থমকালো কিছুক্ষণ। আপনি ঠিক বলছেন ফুফা। কিন্তু আপনার সাথে তার কিসের এত বিদ্বেষ। সেটাই আমার ব্রেনে ঢুকছেনা। সে ছুরিটা কোথায় পেল? আমাদের বাসায় এমন ছুরি নেই। দেখতে একদম নতুন মনে হচ্ছে।
তাহলে হয়তো আমাকে মারার জন্যই কিনেছে। কিন্তু তুমিতো বের হয়ে গেলে কি আনতে যেন। আবার ফিরে এলে কেন?
আমি নিচে নেমেই প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই দেখলাম মানিব্যাগ নেই। তখন টেবিলে রাখলাম যে নিতে ভুলে গিয়েছি। তাই মানিব্যাগ নিতেই এলাম আবার।
আল্লাহ সর্ব শক্তিমান। তিনি বড়ই দয়ালু। লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল খালেদ।
মাহতিম মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। মাকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত খুলে ফেলল। তার মা অকল্পনীয়ভাবে আশ্চর্য হলো ঘটনার আকস্মিকতা শুনে। তারা তিনজন হাসপাতালে চলে এলো কিছু সময়ের ভিতরেই।
কেবিনে ঢুকে বসল। জান্নাত এখনো আসেনি। তারা খই ফোটার মতো বিরতিহীনভাবে নানান প্রশ্নের ঝড় তুলল নিজেরাই। উত্তর ও হাতড়ে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করল। খালেদকে মাহতিমের মা নানাভাবে বহু প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর বের করতে পারেনি।
কিছুক্ষণ পর জান্নাত ফিরে এলো। সাথে তার মা মধুলতা। রুমে ঢুকেই মধুলতা সালাম দিল মাহতিমের মা বাবাকে। তারা অবাক চোখে চাইলো জান্নাত ও মধুলতার দিকে। জান্নাত কারো সাথে কোন কথাই বললনা। দৃষ্টিতে তার এক সমুদ্র ক্রোধ ও কাঠিন্যতা। সে তার মায়ের হাত ধরে খালেদের বেডের কাছে নিয়ে দাঁড় করালো।
খালেদ শুকনো ঢোক গিলল। গোপনে জিভ ভিজিয়ে নিল। জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,
মধুলতা তুমি!
বাকিরা হরর সিনেমার নিরব দর্শকের মতো হা হয়ে চেয়ে আছে খালেদের দিকে। তারা সবাই একে অপরের সাথে লুকানো দৃষ্টি বিনিময় করছে সংকেতময় ভাষায়।
এই মেয়েটা কে?
যাকে আপনি কন্যা সন্তান বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন। সেই।
মানে?
মানে আমার গর্ভে আপনার জন্ম দেওয়া সন্তান কুসুমিত কামিনী।
খালেদ মৃগী রোগীর মতো থরথর করে কাঁপতে লাগল। বলল তার মানে আমার মেয়ে মাহতিমের স্ত্রী?
বাকিরা এখনো নিঃশ্চুপ হয়ে আছে। বহুকষ্টে নিজেদের ধৈর্যের পরিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে৷ ঘটনার সারমর্ম অনুধাবন করার জন্য অধীর আগ্রহান্বিত হয়ে ওদের বাক্যলাপ শুনছে।
আমার মেয়ে শব্দ দুটো শুনেই জান্নাত বাঘীনির মত গর্জন করে উঠল।
খবরদার বলছি! আপনার জিভ খসে পড়বে আমাকে মেয়ে বলে উচ্চারণ করলে। আপনার একজনের জন্য আমাদের তিন তিনটি জীবন বিপন্নের মুখোমুখি। আপনি আমার মাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিলে সে আর ওখানে থাকতোনা। আমার আশ্রয় হতোনা পিতৃহীনভাবে অন্যের বাসায়। আমি মাকে দেখার জন্য প্রতি সপ্তাহে যেতে হতনা সেখানে। আর সেটা উনি দেখে গিয়ে আমাকে চরমভাবে ভুল বুঝল। আপনার জন্য আমার জীবনে বাসর রাত আসেনি। আপনার জন্য উনিও উপভোগ করতে পারেনি বিয়ের প্রথম রাত। উনার চোখে আমি একজন খারাপ মেয়ে। দোষ উনার নয়। দোষ আপনার।
আমার জীবনে সমস্ত অবদান আমার মা আর পালিতা মা মিনারার। আপনি একটা নর্দমার কীট। ছিহ! কন্যা সন্তানের প্রতি আপনার এত অবজ্ঞা? পুত্র সন্তান জন্ম হয়নি বলে আপনি কথা দিয়েও আমার মাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। কোনদিন কোন খোঁজ খবর নেননি। আপনি মানুষ নামের অমানুষ! আপনার ক্ষমা নেই। ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমার জীবনের আনন্দগুলো? ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমার মায়ের স্বপ্নের একটি সাজানো সংসার?
আমি এখন আমার মাকে এনেছি আপনার কোন করুণা ভিক্ষার জন্য নয়। কেবল আমার স্বামী যে আমাকে সন্দেহ করেছে ভুল বুঝেছে। তার প্রমাণ দিতে। আমি আমার মাকে নিয়ে সারাজীবন একাই বেঁচে থাকব। আমাদের দুজনের জীবনে কাউকেই প্রয়োজন নেই। না আপনাকে। না আপনার মাহতিমকে।
এই বলে জান্নাত তার মায়ের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। মা চলে আস৷ এখানে আর একমূহুর্ত নয়।
খালেদ এতক্ষণ জেলখানার পলাতক আসামীর মতো জান্নাতের করা অপমানগুলো নিরবে হজম করে গেল।
জান্নাতের দিকে চেয়ে আকুতি করে বলল,
মা আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার অন্তত সুযোগ দাও। তুমি স্থির হয়ে একটু বসো। মধু বসনা একটু আমার পাশে।
কোন বসাবসি নেই। এই মা চলো।
রবিউল এবার মুখ খুললেন। শাসনের সুরে বললেন,
বৌমা আশাকরি তুমি আমার কথার অবাধ্য হবেনা। কি করা যায় আমি দেখছি। তুমি শান্ত হও। মাহতিম তুমি বউকে নিয়ে বারান্দায় যাও। খালেদের সাথে আমাদের কিছু কথা আছে।
আমি যাব। নমনীয় স্বরে বলল মধুলতা।
না বোন। আপনি বসেন।
মাহতিম জান্নাতের হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেল। জান্নাতের মাথাকে টেনে যত্ন করে নিজের বুকে চেপে ধরল।
আজব। আমার মাথা ছাড়ুন বলছি।
অসীম বিরক্তি নিয়ে বলল জান্নাত।
মাথা বেশী গরম হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা করতে হলে এই হৃদয় নামক সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখতে হবে। নয়তো বোমার মতো ফুটে উঠবে। পরে আমিসহ উড়ে যাব।
জান্নাত নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল। মাহতিম জান্নাতের আঁখিকোণ হতে নিজের আঙুলের ডগায় দুফোঁটা অশ্রু নিল।
দুহাত জোড় করে জান্নাতের নয়ন সম্মুখে ধরল। প্রেমিক সুলভ নিবেদিত কন্ঠে বলল,
সর্যি ফর অল। প্লিজ আর রাগ জেদ পুষে রেখনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি এক পৃথিবী।
জারা কি তাহলে?
গলায় একরাশ অভিমানের ঝাঁঝ ঢেলে বলল জান্নাত।
আই হেইট জারা। আই লাভ ইউ জান্নাত।
আমি বুঝলামনা খালেদ ভাই। আপনি বিয়ে করলেননা। অথচ উনার কাছে যেতেন। আবার কথা দিয়ে বিয়ে করেননি মেয়ে হলো। সবকিছু নিচু মানুষিকতার কাজ। আপনার দ্বারা এসব কিভাবে সম্ভব! আমিতো চিন্তা করতেই মাথা ভনভন করে উঠছে৷
আমাকে লজ্জা দিবেন না ভাবি। এই বলে খালেদ মধুলতার সাথের বিষয়গুলো তার মত করে সাজিয়ে বলল। এবং মধুলতাকে এই মুহুর্তে বিয়ে করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলো।
কেবিনের ভিতর থেকে ডাক পড়ল মাহতিমের।
জান্নাত ও মাহতিম ভিতরে গেল।
রবিউল একটা কাজী অফিসের ঠিকানা দিয়ে বলল পুত্রকে,
কাজী সাহেবকে নিয়ে আয়। খালেদ আর উনার বিয়ে হবে এক্ষুনি।
নাহ! অসম্ভব! বলে বজ্রকন্ঠে বাধা দিল জান্নাত।
চলবেঃ ৬
কুসুমিত কামিনী ( ৭ )
রেহানা পুতুল
রবিউল একটা কাজী অফিসের ঠিকানা দিয়ে বলল পুত্রকে,
কাজী সাহেবকে নিয়ে আয়। খালেদ আর উনার বিয়ে হবে এক্ষুনি।
নাহ বলে বজ্রকন্ঠে বাধা দিল জান্নাত।
সবাই দৃষ্টি তাক করে চাইল জান্নাতের দিকে।
বৌমা শান্ত হও বলছি। এমন উম্মাদ হলে হবে।
জান্নাত অনুযোগের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শাশুড়ির দিকে।
” কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।
বুঝিবে সে কিসে কি যাতনা বিষে।”
তাই আপনি উপলব্ধি করতে পারছেননা মা। আপনার ননদের হাজব্যান্ড অন্যায় করেছে আমার মায়ের সাথে। আপনার ছেলে অন্যায় করেছে আমার সাথে। আজকেও আমার চুলের মুঠি চেপে ধরছে নিষ্ঠুর দানবের মতন। উনার এটা হাত না লোহার দন্ড। সুতরাং আমিও আর আপনার ছেলের সাথে নাই। টলমল চোখে বলল জান্নাত।
মেহনাজ কিছুই বলতে পারলেন না। কেবলই নিরব ভূমিকা পালন করে গেলেন শান্ত ভঙ্গিতে।
খালেদ মধুলতার দিকে চেয়ে বলল,
তুমি জান্নাতকে বোঝাওনা একটু। আমিতো তোমাকে এখন স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই। ওকে দিতে চাই পিতৃ পরিচয়।
মধুলতা বসা থেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁটের কোণে কটাক্ষ হাসির রেখা টেনে বলল,
কি হবে আমার মেয়েকে বুঝিয়ে সুজিয়ে?
তখন আমার সময় ছিল,পরিবেশ ছিল,বয়স ছিল,মন ছিল, প্রয়োজন ছিল,স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ছিলেন না আপনি।
আজ এসবের কিছুই যে নেই। তাই আপনার ও কোন প্রয়োজন নেই আমাদের মা মেয়ের জীবনে। কেবলই দলা বেঁধে বিষাদের ফেনা সৃষ্টি হবে। যন্ত্রণার বুদবুদ আর দেখতে চাইনা।
তুমি এতকথা কবে থেকে শিখলে মধু? বিষ্পোরিত চোখে বলল খালেদ।
সময়। সময় মানুষকে অনেক কিছুই শিখিয়ে দেয়।
এই কামিনী চল। মধুলতা ও জান্নাত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বেরিয়ে যায় হাসপাতালের কেবিন থেকে ।
মাহতিম রবিউলের দিকে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,বাবা থামাও জান্নাতকে।
রবিউল হাত উঁচিয়ে মাহতিমকে থামালেন। বললেন,
” ক্ষ্যাপানো পাগলকে না ক্ষেপিয়ে তার মত করে যেতে দিতে হয়। সময় হলে সে নিজেই শান্ত হয়ে যায়।”
ওরা চলে যাক৷ যেভাবে থাকতে চায় থাকুক। সময়ের উপর ছেড়ে দাও।
দুইদিন পর খালেদের রিলিজ হয় হাসপাতাল থেকে। সে তার বাসায় চলে যায়। খালি বাসাটাকে নতুন করে সাজায় মধুলতার জন্য। এত সুন্দর মানবিক একটা মেয়ের পিতা হয়েও কি বঞ্চনার দূর্দশাগ্রস্ত জীবন উপহার দিল তাদের মা মেয়েকে। শেইম শেইম! চিন্তা করতেই দমকা বাতাসে গাছপালার মতন ভেঙ্গেচুরে যায় খালেদ।
দুরাশার মাঝেও ক্ষীণ আশার বীজ বুনে খালেদ। অস্থির হয়ে সেই নিষিদ্ধ পল্লীতে যায় মধুলতার খোঁজে৷ কিন্তু সেখানে আর মধুলতা নেই। সর্দারণী বাসন্তীবালা জানাল মিনারার বাসায় উঠতে পারে মধুলতা। তার থেকে মিনারার বাসার ঠিকানা নিল। কিন্তু গিয়ে পুরোদমে হতাশ হলো। সেই বাসা ছেড়ে দিয়েছে কিছুদিন আগেই মিনারা। কারণ মিনারার প্যরালাইজড স্বামী মারা গিয়েছে। জান্নাত তাকে সেভাবে কাছে পায়নি। সে বহুবছর ধরে বিছানাবন্ধী ছিল। আর জান্নাত একটু বড় হয়েই তার আসল পরিচয় জেনে গিয়েছে মিনারার কাছ থেকে। এবং মিনারার স্বামীকে জান্নাত আংকেল বলত সবসময়। কেউই মিনারার নতুন বাসার সন্ধান দিতে পারলনা খালেদকে।
এই ব্যস্ত নগরীতে জীবনের প্রয়োজনে জীবিকার তাগিদে কে কখন কোথায় যায়,কি করে,কেন করে,সেই খবর কেউই রাখেনা।
হতাশ মনে খালেদ ফিরে গেল মাহতিমদের বাসায়। গিয়ে তাদের অনুরোধ করল যেকোন কিছুর বিনিময়ে সে জান্নাতকে ও মধুলতাকে ফিরে পেতে চায়।
জান্নাতকে মাহতিম নিত্য ফোন দেয় মুঠোফোনে। অজস্রবার দেয়। মেসেজ দেয়। বয়েজ রেকর্ড দেয়। কিন্তু জান্নাতের দিক হতে নো রেসপন্স। সামান্যতম সাড়া পায়না। রবিউল ও মেহনাজ পুত্রকে আচ্ছামতে ঝাড়লেন সম্পূর্ণ দোষ দিয়ে। এত নির্মম আচরণ করলে যে কেউই দূরে চলে যাবে।
রবিউল ছেলের দিকে চেয়ে বিজ্ঞের মত করে বললেন,
” আন্দাজ করে কখনো কাউকে ব্লেইম দেওয়া একেবারেই অনুচিত। তুমি তোমার স্থানে দাঁড়িয়ে কল্পনাও করতে পারবেনা সেই মানুষটির জীবনের সত্যতা। “
মাহতিম মাথা নিচু করে থাকে বাবার সামনে। রবিউল ছেলেকে আদেশ দেয়।
একসপ্তাহের ভিতরে যে করেই হোক বউকে বাসায় দেখতে চাই। কিভাবে ম্যানেজ করবে তাকে সেটা তোমার বিষয়। কারণ সে চলে গিয়েছে একমাত্র তোমার উপরে জেদ করেই।
আব্বু ঠিকই বলছে ভাইয়া।
তুই মাঝখান দিয়ে সাইকেল চালাতে আসবিনা। পন্ডিত কোথাকার।
মাহতিম আজ বিকেলে মিনারার নতুন বাসায় গেল অনেককিছু নিয়ে। দেখল সেখানে জান্নাতের মা মধুলতাও আছে। মিনারা অনেক অসুস্থ। জান্নাত ও মাহতিমের জন্য এক রুম খালি করে দেওয়া হলো।
মাহতিম জান্নাতকে সর্যি বলল। তবুই জান্নাত নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই মাহতিমের জীবনে ফেরত যেতে চায়না৷ শুনতে চায়না কারণে অকারণে মিথ্যে অপবাদ।
মাহতিম দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল। জান্নাত খাটের উপরে বসা ছিল কুন্ডলী পাকিয়ে।
মাহতিম জান্নাতের পা দুটো নিচে নামিয়ে নিল। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল জান্নাতের হাঁটু বরাবর। জান্নাতের দুপায়ের পাতায় বলিষ্ঠ হাত,
আমি স্বীকার করছি। সমস্ত দোষ ও ভুল আমার। না জেনে আন্দাজে আর কোনদিন ও তোমাকে ভুল বুঝবনা। প্রমিজ। দেখ অনেক শাস্তি হয়েছে। তুমি না কুসুমিত কামিনী? কি সুন্দর সুগন্ধীময় প্রষ্ফুটিত একটা ফুলের নামে নাম তোমার। অথচ আচরণে তার বিপরীত।
” পরিস্থিতিতে কোমল ও কঠিন হয়। শীতল ও উষ্ণ হয়। ”
ঠোঁট ফুলিয়ে রুষ্ট কন্ঠে বলল জান্নাত।
হ্যাঁ। কিসের শাস্তি পাচ্ছেন আপনি? আমি কি আপনাকে গালমন্দ করেছি। মেরেছি?
অমন করে বলনা প্লিজ। শুধু গায়ে হাত দিয়ে মারাকেই শাস্তি বলে? বিয়ে করেছি সেই কবেই। অথচ আজো আমি একা একা ঘুমাই সঙ্গী ছাড়া। তোমাকে না নিয়ে আজ বাসায় যাবনা।
আমার মিনারা আম্মু অসুস্থ। তাকে রেখে কোথাও যাবনা আমি।
উনাকেও নিয়ে যাব আমাদের সঙ্গে। তোমার মাও আসুক। প্লিজ তবুও চলনা জান্নাত।
জান্নাত রাজী হয় তার দুই মাকে নিয়ে যেত বলল বলে।
তবে মিনারা রাজী হয়না যেতে অসুস্থ শরীরে।
মাহতিমদের বাসায় খালেদ অপেক্ষারত। সাক্ষীসহ কাজী রেডি। জান্নাতের অনুমতিক্রমে মধুবালা বিয়েতে রাজী হয়। এই বয়সে কিসের সাজ বলে বাড়তি কোন সাজ ও আয়োজন ছাড়াই ধর্মীয় ও আইন মোতাবেক বিয়ে সম্পন্ন হয় খালেদ ও মধুলতার।
রবিউল মধুলতাকে খালেদের হাতে তুলে দিয়ে বলে,
আজ হতে বহুবছর আগে আমার ছোটবোনকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। নিয়তি তাকে কেড়ে নিল। উনি আমার বৌমার মা। আমার বোন। আজ আমার এইবোনকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। অমর্যাদা করনা।
কখনই হবেনা দুলাইভাই। খালেদ মাহতিমের হাতে জান্নাতের হাত রেখে অনুরোধ করে বললেন,
বাবা আমি জান্নাতের জন্মদাতা পিতা। তোমার স্বশুর। আমার মেয়েটাকে যত্নে রেখ।
সবার আঁখিকোনে অশ্রু জমা হলো। আনন্দঘন পরিবেশটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।
খালেদ মধুলতাকে নিয়ে চলে গেল তার বাসায়। মাহতিম ও জান্নাতের সুখরজনী কাটল নিবিড় আলিঙ্গনে। উষ্ণতায়।
পরেরদিন জান্নাত মিনারাকে ফোন দিল শরীরের খবর নেওয়ার জন্য। মিনারার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট বেড়ে চলছে ক্রমশ। জান্নাত কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল। মাকে ফোন দিয়ে জানাল। খালেদ মধুলতাকে নিয়ে আসল। জান্নাত গিয়ে মিনারার মুখে একটু পানি দিল। মিনারা আধভাঙ্গা গলায় অস্পষ্ট করে জান্নাতকে ধরে বলল,
মারে সন্তান হওয়ার সাধ মিটেছে তোকে কোলে পেয়ে। আমার আর কোন দুঃখই রইলনা এই দুনিয়াতে। নিজের মাকে পেয়েও এই অভাগী মাকে ভুলে যাসনি। অসম্মান করিসনি। অনাদর করিসনি। এতেই আমার যত শান্তিরে মা। মায়ের কবরটা তুই গিয়ে দেখিস মাঝে মাঝে। তাহলে আমি কবরে ঘুমিয়ে থেকেও বুঝে নিব আমার জান্নাত মা আমার বুকেই আছে।
মিনারার মাথা নিজের কোলে তুলে নিল জান্নাত। আম্মু তোমার কষ্ট হচ্ছে না? তুমি ভালো হয়ে যাবা। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারনা।
মিনারার আপন এক ভাই রয়েছে। সে ডাক্তার নিয়ে এলো খবর পেয়েই। অল্পসময়ের মধ্যেই মিনারা জান্নাতের কোলে শেষ নিঃশ্বাস ফেলল। বিদায় নিল এই মোহমায়ার জগৎ থেকে।
মাহতিমের পরিবারের সবাই এসেছে। তারা মর্মাহত মিনারার মৃত্যুতে। তারচেয়েও বেশি মর্মাহত একজন মিনারাকে হারিয়ে তার পালিত ও আশ্রিত কন্যা জান্নাতের পাঁজরভাঙা আর্তনাদ দেখে। শান্তনার ভাষাই কেউ খুঁজে পাচ্ছেনা। ডুকরে কাঁদছে মধুলতাও। মিনারার সাথে ছিল তার বোন বন্ধুর মতো সম্পর্ক। জান্নাতের এলোমেলো চুলগুলোকে হাতখোঁপা করে দিল তার মা মধুলতা। মেয়েকে ছোট্ট শিশুর মতো বুকে লেপ্টে ধরলেন।
মিনারার দাফনকার্য সম্পন্ন হয়ে গেল মাহতিম, রবিউলদের সহযোগিতায়। জান্নাত মিনারার শোক না কাটিয়ে উঠতেই,শুনতে পেল তার বাবা খালেদ মারাত্মক অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। দুইমাসব্যাপী নানাভাবে চিকিৎসা করিয়েও খালেদকে বাঁচানো গেলনা। অতিরিক্ত সিগারেট পানে মরণব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে তার পাকস্থলীতে।
জীবনের ক্রান্তিলগ্নে পছন্দের মানুষটাকে কাছে পেয়েও হারালো মধুলতা। তার দুচোখ জুড়ে কেবলই আক্ষেপ। কিন্তু নেই কোন শূন্যতা। আজন্ম যাকে বাস করতে হয়েছে পরিবার,প্রিয়জন ছাড়া। নতুন করে তাকে শূন্যতা আঁকড়ে ধরার কোন পথ নেই। তার বেঁচে থাকার ভালো থাকার অবলম্বন একটাই। তার একমাত্র কন্যা কুসুমিত কামিনী।
জান্নাত শোকে, বেদনায় বিপযস্ত। একদিকে মৃত মা মিনারার জন্য। আরেকদিকে জীবিত মা মধুলতার সঙ্গিহীন একলা জীবনের জন্য। মধুলতাকে জান্নাত তার কাছে সারাজীবনের জন্য নিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু মধুলতা নাছোড়বান্দা। মেয়ের জামাইর বাসায় থাকার চেয়ে একা আলাদা থাকা তার জন্য মর্যাদার ও কল্যানের। তাকে দুই রুমের ছোট্ট একটি বাসা নিয়ে দিল রবিউল তাদের বাসার কাছাকাছি।
বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেলেও জান্নাত মানসিল বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। এখানে ওখানে ঝিমানো মুরগীর মত পড়ে থাকে। তাই পরিবারের সবার চাওয়ানুযায়ী মাহতিম জান্নাতকে নিয়ে দুইদিনের জন্য ঢাকার অদূরে গাজীপুরের ‘ অঙ্গনা’ রিসোর্টে ঘুরতে গেল। একটু একটু করে জান্নাতের বির্দীণ মুখে হাসির আভাস ফুটে উঠছে৷
নির্জন নিশুতি রাত। গ্রামীন আবহে তৈরি রিসোর্টের বারান্দায় এসে দাঁড়াল মাহতিম ও জান্নাত। কি মায়া মায়া শীতল পরিবেশ। মৃদুমন্দ সমীরণে উড়ছে রুমের বাতায়ন। দোল খাচ্ছে জান্নাতের বুকের উপরে মেলে থাকা সাদাপাথর খচিত পিনপিনে সাদা ওড়নাটি। আকাশ জুড়ে তারাদের লুকোচুরি খেলা। তার মাঝে ক্ষয়ে আসা রূপোলী চাঁদ। মাহতিম জান্নাতের ওড়নাটি নিজের হাতে পেঁচিয়ে নিল। কপালের উপরে উড়ে আসা অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পাশে গুঁজে দিয়েই জান্নাতের শুকনো অধরদুটিকে ভিজিয়ে দিল নিমিষেই।
একি! ওড়না দেন বলছি। কি অসভ্যতামি হচ্ছে৷ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল জান্নাত।
দেখনা ডিস্টার্ব করছে তোমার ওড়না আমাকে। বারবার মুখের উপরে এসে পরছে৷
এদিক দেন আমি সামলে নিচ্ছি।
আমি সামলে নিলাম যে হয়নি কামিনী?
কিই?
হুম বলে মাহতিম পিছন থেকে জান্নাতকে নিবিড়ভাবে কোমর জড়িয়ে ধরল। সেই বন্ধনকে আরো মজবুত করে বলল,
আজ থেকে তুমি আমারও কুসুমিত কামিনী। এই কয়দিনে দেখলাম সত্যিই তোমার নামটা সার্থক। তুমি ফুলের মতই সুরভিত কোমল।
মাহতিম জান্নাতের ঘাড়ে নিজের চিবুক ঠেকিয়ে ধরল। তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ পেয়ে জান্নাতের সমস্তটা শিহরিত হয়ে উঠল। দুচোখ বুঁজে এলো তার। মাহতিম গুনগুন করে গাইতে লাগল নিজের পছন্দের একটি গান।
“শীতল ও বাতাসে, দেখেছি তোমায়
মেঘ মিলনে চেয়ে রাগ করোনা।
মন চায় তোমায় আজি রাতেএএএ…
বৃষ্টি তো থেমেছে অনেক আগেই
ভিজেছি আমি একাই। আসতো যদি বিভীষিকা, খুঁজেও পেতেনা আমায়।
ভুলে গিয়েছি মনো শত অভিমান
মন চায় তোমায় কাছে পেতেএএ…
শীতল বাতাসে, দেখেছি তোমায়
মেঘ মিলনে চেয়ে রাগ করোনা..”
জান্নাত মাহতিমের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিতে দিতে মিটমিটিয়ে হেসে ফেলল।
কুসুমিত কামিনীর আলতো ছোঁয়ায় বীরদর্পে জেগে উঠল মাহতিমের প্রেমিক সত্তা।
এই আমার কামিনী ফুল। একবার বল ভালোবাসি?
ভালোবাসি আমার মধুলতা মাকে। ভালোবাসি মিনারা আম্মুকে। ভালোবাসি মেহনাজ মা,রবিউল বাবা,নুপুর বোনকে। আর ভালোবাসিইই…
আমার সিরিয়াল এত পরেএএ? বলেই মাহতিম ও জান্নাত খলবলিয়ে হেসে উঠল। দুজনের প্রাণবন্ত চিত্তহরন করা সেই হাসির আওয়াজ রাতের নির্জনতায় হাওয়ার পিঠে চড়ে ভেসে গেল দূর দিগন্তে। অসীম সীমানায়।
( সমাপ্তি )