ফিলোফোবিয়া

ফিলোফোবিয়া ( প্রথম খন্ড )

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

 

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

বাবার আবদারে প্রচন্ডরকম ক্ষে*পে উঠল প্রিয়। চেঁচিয়ে বলল,

‘ বড় বোন হয়েছি বলে এই না যে, বিয়ের যৌতুক হয়ে ওর শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে আমাকে।’

জাফর রহমান বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,

‘ আহা! যৌতুক হয়ে যাবি কেন? তোর জন্য তাদের বড় ছেলের সম্বন্ধ এসেছে। বলেছে..’

‘ কি  বলেছে? যদি তাদের বড় ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয় তবেই প্রভাকে ঘরের বউ করবে নয়তো না। তাই তো?’

জাফর সাহেবের মলিন মুখ, অর্থাৎ কথা সত্য। প্রিয় রাগ চেপে শান্ত গলায় বলল,

‘ আব্বা এটাকে সম্বন্ধ না শর্ত বলে। আর আমি কোন ব*লির পাঁঠা নই যে সু*লে চ*ড়ে যাবো।’

‘ছেলের সরকারি চাকরি। ডাক্তার। বিসিএস উত্তির্ন।’

‘ নামের পিছনে বিসিএস শুনেই বুঝি বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছ। তাদের ছেলের জন্য মেয়ের অভাব? নাকি বুড়ো ছেলের জন্য বউ খোঁজা মুশকিল।’

মেয়ের তিক্ত বুলিতে জাফর সাহেব হকচকিয়ে উঠলেন। কি বলা উচিত বুঝতে পারছেন না তিনি। খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে আছে প্রভা। আড়চোখে বোনের দিকে চাইল একবার। মিনমিনিয়ে বলল,

‘ তুই যেমন করে বুড়ো বলছিল উনি মোটেও বয়স্ক নয়। মাত্র টুয়েন্টি নাইন প্লাস।’

খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়। হাত ধুতে ধুতে কর্কশ কন্ঠে বলল,

‘ আমি আগেই জানিয়েছি কোন ডাক্তারকে বিয়ে করব না।’

‘ কেন করবিনা তোর এক্স ডাক্তার বলে?’

মুখ ফুসকে বলে ফেলল প্রভা। পরিবেশ গম্ভীর হলো। জাফর সাহেব মেয়েদের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে।

‘ এমন মেরুদণ্ড ভা*ঙ্গা ছেলের সাথে প্রেম করতে গেলি কেন যার বউ হতে হলে শর্ত মানতে হবে পরিবারের।’

প্রভা তেতে উঠল এবার। আরমানের বি*রুদ্ধে কোন কথা শুনবে না সে। মানুষটা তাকে কত ভালোবাসে। বোনকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

‘ অন্তত তোর এক্সের মত মেরুদণ্ডহীন তো নয়! বিয়ে করার ভয়ে মাঝরাস্তায় পালায়।’

ধমকে উঠল প্রিয়,

‘ মাত্রা ছাড়াচ্ছিস প্রভা!’

‘ ভাইয়ার মত তুইও স্বার্থপর আপু। শুধু নিজেরটাই বুঝিস। তোকে নিয়ে বাবা মায়ের কতটা চিন্তা সেদিকে কখনো লক্ষ করেছিস? শুধু ডাক্তারকে কেন, দুনিয়ার কোন ছেলেকেই বিয়ে করতে পারবিনা তুই। লোকে তোকে ঠিক বলে,  ফিলোফোবিয়ার রোগী! প্রেম ভালোবাসায় ভয়। মানুষিক সমস্যা আছে তোর।’

 ক্রো*ধে আশ্রুতে চিকচিক করছে প্রিয়’র চোখ। ভারী-ভারী নিশ্বাস ফেলে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

‘ বোজা মনে হলে বলে দেও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাই। বিবিএ কমপ্লিট হতে আর এক বছর তারপর এমনিতেই  চাকরি খুঁজে ঢাকার বাহিরে দূরে কোথাও শিফট হয়ে যাবো। আর প্রভা তোকে বলছি, আমি তোর বোন। মা নই যে তোর জন্য নিজের জীবন বিস*র্জন দিবো। এই বিয়ে আমি করব না।’

বলেই হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেল প্রিয়। 

রান্না ঘর থেকে আড়ি পেতে সবটা শুনলেন আমেনা বেগম। বুক চি*ড়ে শ্বাস ফেলল হতাশ। এখন আর তার আশ্চর্য হয়না। এতবছরে এসব কোলাহলে অভস্ত হয়ে গেছেন তিনি। আজকাল তিনবেলা খাবারের মত পারিবারিক কোলাহলটাও যেন ডেইলি রুটিনে যোগ হয়েছে। এসব হৈচৈ ঝামেলা নিয়ে ভাবেন না তিনি। কিন্তু বড় মেয়ের ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে ভীষণ চিন্তা হয়। বয়স তো আর কম হলোনা। প্রেম বিয়ে নিয়ে মেয়েটার এতো বি*রোধ, এত ভয়! আগে তো এমন ছিলনা। হ্ঠাৎ  কি এমন ঘটলো! যে তার সেই হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত মেয়েটাকে এতোটা বদলে দিলো । ঘিরে নিলো শক্তপোক্ত অন্ধকারের তি*ক্ত আদতে।

 

রাত দেড়টা। চারিদিক ডিসেম্বরের কুয়াশায় মাখানো। নিশ্চুপ অন্ধকার। দূরে রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুরদের আনাগোনা। ঘুম নেই প্রিয়’র। বারবার ঝাপসা হচ্ছে চোখ। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে অনবরত। আজ সন্ধ্যায় প্রভার বলা কথা গুলো তার মনে ভীষণ ছাপ ফেলেছে। সত্যি কি সে ফিলোফোবিয়াতে আক্রা*ন্ত? যেই কারণে প্রেম ভালোবাসায় তার ভ*য়! ভালোবাসা নামক অনুভূতির প্রতি এত বেশি ঘৃ*ণা। ছেলেদেরকে এত ভ*য়। কিন্তু কেউ কি জানে এই ফিলোফোবিয়া রোগী হওয়ার পেছনের অজানা সেই ভ*য়ঙ্কর গল্পটা? চোখের আড়ালে বুকে বিঁ*ধে থাকা নির্ম*ম ধারা*লো  সত্যটা!  

আচমকাই চোখের সামনে পুরানো স্মৃতির দ্বীপ জ্ব*লে উঠল। আবছা করে খুব পরিচিত একটা মুখ ভেসে উঠল। ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। স্মৃতির পাতা উল্টে গিয়ে থামলো কোন এক ডিসেম্বরের বিকেলে।

 

অতীত,

 

দুইহাজার এগারো। বছরের শুরুটা বড় আপার বিয়ে নিয়ে যতটা আনন্দ উল্লাসে হয়েছিল, শেষটা ঠিক ততটাই বিষ*ন্নতায় ঘেরা ছিল। সংসার জীবনের মাত্র আটমাসের মাথায় আপার ডিভোর্স। তারপর সমাজের ক’টুকথা আর ডি*প্রেশনে হাঁপিয়ে গিয়ে গলায় দ*ড়ি দিয়ে সুই*সাইট! শুনতে যতটা সহজ শোনাচ্ছ  ঘটনাটা ঠিক ততটাই জোরদার আঘা*ত করে গেছে প্রিয়’র পরিবারকে। চোখের সামনে নিমি*ষেই যেন সব শেষ। সকালে ঘুম ভা*ঙ্গার পর, মাথার উপর নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষের ঝু*লন্ত লা*শ দেখে সহ্য করতে পারেনি প্রিয়। ঘটনাটি প্রিয়’র ছোট্ট মনে ছাপ ফেলে যায় ভ*য়ংকর। সেদিন থেকে ডিপ্রে*শন প্যা*নিক এ*টাক হয়ে গেল নিত্যদিনের সঙ্গী। দিনদিন অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছিলো। প্রিয়’র এমন অবস্থা  দেখে বড় খালা আয়েশা বেগম সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রিয়’কে তার সঙ্গে ইমান্দিপুরে নিয়ে যাবেন। শালির প্রস্তাবে অমত করলেন না জাফর সাহেব। বড় শালির উপর যথেষ্ট ভরসা আছে তার। শিক্ষিকা মানুষ, তার কঠোর নজরদারিতে মেয়ে পথভ্রষ্ট হবেনা। তাছাড়া ডাক্তার বলেছে, পরিবেশ বদল হলে ধীরেধীরে মেয়ে স্বাভাবিক হবে। ছোট মেয়েটা যথেষ্ট স্ট্রং আর ছোট। মেজো মেয়েটা বরাবরই কোমল। সবে কৈশোর কাটিয়ে যৌবনের দিক পা বাড়িয়েছে। মানসিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটছে। বড় বোনের মৃ*ত্যুর সময় একমাত্র সেই পাশে ছিল। সেই থেকেই অনুতপ্ত অনুশোচনায় মানসিক ভাবে অসু*স্থ হয়ে পড়েছে। মেয়ের ভবিষ্যৎ আর মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে, শো*কের ছায়া থেকে বেরিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন জাফর সাহেব। এসব ঝামেলার মাঝে মেয়েকে আর রাখবে না। বড় শালির সাথে ইমান্দিপুরে পাঠাবেন। সেখানে খালার কাছে থেকে পড়াশোনা করবে প্রিয়।

 

ডিসেম্বরের পাঁচ  তারিখ বাবার কথামতো দুপুরের পরপর-ই বড় খালার সাথে ইমান্দিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলো প্রিয়। অনেকদিন পর বদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। গাড়ির জানালায় মাথা হেলিয়ে দূর নভোমণ্ডলের পানে চেয়ে রইল। হিম হাওয়ায় দুলছে অবাধ্য কেশ। আলস্যে লেগে আসছে চোখ। 

শীতকালের বিকাল।  পাঁচটা বাজতে না বাজতেই চারিদিক অন্ধকারে তলিয়ে যেতে শুরু করে। দীর্ঘ জ্যামজট কাটিয়ে তিন ঘন্টার মাথায় গন্তব্যে পৌঁছালো । মিচমিচে কালো পিচ ঢালাইর রাস্তা ধরে গলির শেষ মাথায় দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। এটা প্রিয়’র নানা বাড়ি। মায়েরা তিন বোন। নানা নানী বড় খালা থাকতেন এই বাড়িটায়। ছোট খালা পরিবার সহ দেশের বাহিরে সেটেল্ড। ছোটবেলায় মায়ের সাথে এখানে আসা হতো খুব। নানা নানী মা*রা যাবার পর তেমন আসা হয়না আর। শেষ এসেছিল দুইবছর আগে বড় আপার সাথে গ্রীষ্মের ছুটিতে। পুরো এক সাপ্তাহ ছিল। দু’বছরে এখানকার রাস্তাঘাট পরিবেশ অনেক কিছু পাল্টেছে। আজ বড় আপা  থাকলে দিনটা নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো!  হ্ঠাৎ বড় আপার কথা মনে করে প্রিয়’র মুখ মলিন হয়ে এলো। 

 

‘ আহা! টলির চাকা ভা*ঙ্গবে আস্তে নামাও।’

 বড় খালার আওয়াজে ঘোর কাটল। ড্রাইভার টেক্সি থেকে ব্যাগপত্র নামাচ্ছে। প্রিয়’র হাতে চাবি ধরিয়ে খালা বলল,

‘ যা গিয়ে দরজা খুল আমি ব্যাগপত্র নিয়ে আসছি’

‘ আমার হাতে কিছু দেও নিয়ে যাই’

‘ ভারী ব্যাগ পারবিনা তুই।’

জোর করল প্রিয়, শুনল না খালা। একপ্রকার ঠেলে ভিতরে পাঠাতে চাইল। যেই গেটের দিকে পা বাড়াবে অমনি এক পুরুষালি আওয়াজ কানে এলো। ছেলেটা  খালাকে সালাম জানিয়ে বললেন,

‘কেমন আছেন?’

‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো, তোমার কি খবর?’

‘ ভালো’

 ‘এডমিশন টেস্টের প্রস্তুতি কতদূর?’

‘ এইতো চলছে। কোথাও গিয়েছিলেন?’

‘ হ্যাঁ, ছোট বোনের বাড়িতে।’ 

ছেলেটা ব্যাগপত্র দেখে বলল,

‘ সাহায্য করবো?’

‘ তার দরকার নেই আমরা পারবো। কোথাও যাচ্ছিলে নাকি?’

‘ হ্যাঁ, মোরের মাথায় বাবার সমাবেশ।’

‘ একদিন বিকালে সময় করে এসো চায়ের আড্ডা দিবো।’

‘ আসবো।’

এক গাল হেসে ছেলেটা চলে গেল। ছেলেটা কিছুদূর যেতেই খালা বলতে শুরু করল,

‘ জানিস প্রিয় ও আমাদের পাড়ার সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আমারই ছাত্র। চোখের সামনে বড় হতে দেখা,  ক্লাস টু থেকে সিক্স পর্যন্ত পড়িয়েছি। পড়ালেখায় বেশ তুখোড়। চিনেছিস? ‘

প্রিয় থম মে*রে খালার দিক তাকিয়ে থাকল। সে কি করে চিনবে? খালা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘আরে ভুলে গেলি? সেইবার গ্রীষ্মের ছুটিতে এসে মেলায় হারিয়ে গেলি একটা ছেলে তোকে খুঁজে এনেছিল? শতাব্দ। ওই তো সেই শতাব্দ!’

 প্রিয়’র মনে পড়ল। এই লোকটাকে কি ভুলা যায়? সেই দিনের ধমকের কথা আজীবন ভুলবে না সে। কোনদিন না। কি ঝাড়াই না ঝেড়েছিল তাকে। যদিও সেদিন দোষটা প্রিয়’রই ছিল। হোক! তাই বলে কি এভাবে ধমকাবে? 

প্রথমে ছেলেটাকে চিনতে পারেনি। না চেনার অবশ্য কারণ আছে। আগের থেকে আরো বেশি লম্বা হয়েছে। দুবছরে চেহারায়ও বেশ পরিপক্বতা এসেছে।

খালা গদগদ করে বলতে লাগল,

‘ গতবছর ঢাকা মেডিকেলে ট্রায় করেছে, এক নাম্বারের জন্য চান্স পায়নি। তাই এবার আরো ভালো প্রস্তুতি নিয়ে চেষ্টা করছে। হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ভীষণ ভালো ছেলে। আন্তরিকতা দেখেছিস? ব্যবহারে কোন দম্ভোক্তি অহংকার নাই। কেউ বলবে এখানকার চেয়ারম্যানের ছেলে? এইতো এই পাশের বড় বাড়িটা ওদের। কি ভালো ছেলে। মাই ফেভারেট। ভেরি..ভেরি গুড বয়।’

ছেলেটাকে নিয়ে খালার বাংলা থেকে ইংরেজি অবধি প্রশংসা শুনে খানিক বিরক্ত হলো প্রিয়। এতটা পথ জার্নি করে ছেলেটার প্রশংসা শুনতে এখন একদম ভালো লাগছেনা তার।  বিরক্তির মুখ করে বলল,

‘ বাবা চেয়ারম্যান, এতটাকা। ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য ঘুরছে কেন? কোন প্রাইভেট হাসপাতালে পড়লেই পারে। ঝামেলা শেষ। তাছাড়া ডাক্তারি করে আর কয়টাকা বেতন? বাবার সাথে রাজনীতি করলেই তো হয়।’

ভাগ্নীর মুখে ছাত্রের বি*রুদ্ধে এমন কথা শুনে মোটেও ভালো লাগলো না আয়েশা বেগমের। অনেকটা ঝাঁ*জালো কন্ঠেই উত্তর দিলেন,

‘ বললি তো গণ্ডমূর্খদের মত কথা! ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর প্রাইভেট মেডিকেল এক হলো? আর জীবনে কি টাকাই সব? ডাক্তারি প্রফেশনের মর্ম তুই ফেল্টু কি বুঝবি!’

খালার কথায় মুখ কালো হয়ে এলো প্রিয়’র। সহজে রেগে যাওয়ার মানুষ না তিনি । সে কি এমন বলল? যে রেগে গেল। তার প্রিয় ছাত্রের বিরুদ্ধে বলেছে বলেই কি!

ভ্রু কুঁচকে দূর কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় হাঁটতে থাকা মানুষটার দিকে তাকাল একবার, কালো হুডি পকেটে হাত। বেশ হাঁটছে। মানুষটা কি জানে, তাকে নিয়ে এখানে ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে গেল একখান?

 

চলবে কি?     

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

 

২.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

গত শনিবার ব্যস্ততার ফাঁকে মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখতে জাফর সাহেব ইমান্দিপুর এসেছিলেন। অনেকদিন পর বাবাকে দেখে প্রিয়’র মন ভালো হলেও তা স্থায়ী রইল না বেশিক্ষণ। যেই শুনলো, মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। বুকের ভেতর এক অ*স্বস্তি অ*স্থিরতার ঘুরপাক শুরু হলো। সেই থেকে বাড়ি ফেরার জন্য বায়না ধরল। মেয়ের বায়না কানে তুললেন না জাফর সাহেব। বড় মেয়ের সুই*সাইড নিয়ে এখানো পুলিশ কেস চলছে, সেই সাথে স্ত্রীর দিনরাত কান্নাকাটি! সেখানে এসবকিছু্র মাঝে ভালো থাকবে না প্রিয়। সর্বক্ষণ মেন্টালি ডি*স্টার্ব হবে। তার নরম মনে চাপ পড়বে। মানসিক ভাবে আরো ভেঙ্গে পড়বে। মেয়ের মন খারাপের তো*য়াক্কা করে ভবিষ্যৎ ন*ষ্ট করার মানে হয় না কোন। এখানকার স্কুলে ভর্তি হয়েছে, দুদিন পর ক্লাস। এসময় বাড়ি নিয়ে যাওয়া উচিত হবেনা একদম। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে মেয়েকে রেখে গেলেন তিনি। 

জাফর সাহেব ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পর থেকে প্রিয়’র মন ভার। সারা বিকাল বারান্দায় কা*টিয়ে, সন্ধ্যা নামাল আজ। বছরের শেষ দিন। এইদিনটা বাবা মা বোনদের সাথে কা*টিয়েছে এতবছর। এই প্রথম সবার থেকে এতো দূর, ভীষণ ক*ষ্ট হচ্ছে তার। মন খারাপের ভারী নিশ্বাস ফেলে দূর আকাশে চেয়ে রইল। নি*কষ কালো আঁধারে লাল নীল আলোর মেল।

 সামনে চেয়ারম্যান বাড়িতে থার্টি-ফাস্টের বিশাল আয়োজন। ছাদ থেকে আতসবাজি ফোটানো হচ্ছে। সেই সাথে গানবাজনার উচ্চ আওয়াজ। বাড়ির সামনে বড় পাতিলে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। এলাকার সব বখাটে ছেলেপেলেদের ভীড় সেখানে। কি লোভাতুর তাদের চাহনী!

সাধারণত শহরের পাশের গ্রামগুলো ছোট আকারের হয়। খুব অল্প সময়ই কথা ছড়ায়। গ্রামে নতুন কারো আগমনে সবাই জেনে যায়। প্রিয় ইমান্দিপুর এসেছে একমাস  হতে এখনো বাকি ছয়দিন। এই অল্প সময়েই কথাটা পুরা গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। কখনো গভীর রাতে জানালায় ডি*ল। কখনো আবার বাড়ির সামনে পুরানো জং ধরা ডাকবাক্সে মিলে প্রেমপত্র। এভাবেই চলছে দিন। এইতো গতকালই ঘটলো, চিঠির বাক্সে অজানা কারো  প্রেমপত্র মিলল। খালা দেখে প্রচণ্ড রেগে গেল। পুরো এক ঘন্টা বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  চিঠির ভুলগুলো সার্কেল করল। সবশেষে চিঠি মুড়িয়ে তার ঝাঁ*ঝালো কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বলল, 

‘ দেখেছিস প্রিয় আজকালকার ছেলেপুলেদের লেখাপড়ার কি হাল? লিখেছে তুমি আমার প্রেমীকা হবে? প্রেমিকা বানানে কবে থেকে ই- কারের জায়গায় ঈ- কার হলো। কই আমরা তো কোন জীবনে পড়িনি।  প্রেমপত্র লিখেছে সেখানেও শ’খানেক ভুল! এদের ভবিষ্যৎ কি ভয়ঙ্কররকম খারাপ চিন্তা কর একবার!’

তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর হয়ে বলল আবার, ‘তোর কিন্তু এমন লেখাপড়া করলে চলবে না প্রিয়! মন দিয়ে পড়তে হবে প্রেমপত্রে যেন ভুল না পায় কেউ।’

খালার আচরণে প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল। কোথায় ভেবেছিল কলেজের সবচেয়ে স্ট্রেইট প্রফেসরের বাড়িতে তার নামের প্রেমপত্র এসেছে। খুব করে শাসাবে,  রাগ ঝাড়বে, তাকে বকবে । এই সুযোগে অভিমানের বাহানা করে প্রিয় ঢাকায় চলে যাবে। কিন্তু হলো কি? হলো উল্টো। মাঝেমধ্যে খালাকে দুনিয়ার অষ্টম আশ্চর্য মনে হয় প্রিয়’র। বুঝা বড্ড দায়। মাথায় কখন কি চলে কে জানে! এই ভালো এই মন্দ। 

ভাবনার মাঝে আচমকা সামনের পেন্ডেলে  শতাব্দ নামক সেই লোকটাকে দেখলো। কালো পাঞ্জাবিতে তদারকি করতে ব্যস্ত। তাকে ঘিরে রয়েছে বহু লোকজন। থাকাটাই স্বাভাবিক। বারান্দার বাতিটা  খুব একটা উজ্জ্বল না হলেও অনেকটাই স্পষ্ট। শতাব্দের সাথে প্রিয়’র একবার চোখাচোখি হলো। খুব অল্প সময়ের জন্য। সাথেসাথেই অস্বস্তিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো প্রিয় । মুখ ফিরিয়ে গেটের দিক তাকালো। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিনা বাতাসে দুলছে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাগানবিলাস গাছ। শব্দ হচ্ছে খচখচ। গেটের পাশে চিঠির বাক্সে কারো ছায়া। পুরুষালি কালো ছায়া! অন্ধকারে স্পষ্ট না হলেও চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না প্রিয়’র। মোরের মাথায় কালো করে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রোগা পাতলা সেই বখাটে ছেলেটা। প্রিয়’র উপর কুনজর তার। দুইতিন দিন যাবত জ্বালাচ্ছে ভীষণ। বাড়ির সামনে সকাল বিকাল রাউন্ড দেয় কয়েকবার। এসবে প্রিয় অতিষ্ঠ ভীষণ।

 রাগে বারান্দা ছেড়ে, ভারী মুখ করে ঘরে চলে এলো প্রিয়। ইমান্দিপুর তার একটুও ভালো লাগেনা। চারদিকে সব অচেনা মুখ। কেমন অদ্ভুত তাদের নজর!  ঢাকায় থেকেছে বলে তাকে নিয়ে কানাঘু*ষো কম হয়না পাড়ায়। কাজের খালা এসে প্রায়ই বলে সেসব। হেয়ার কা*ট থেকে কাপড় অবধি এখানকার মানুষের তার সবকিছুতেই জাজমেন্ট। কই ঢাকায় তো এমন ছিলনা। কি ভালো ছিল তাদের সেই প্রতিবেশীরা। 

 

টিভি ছেড়ে বেখেয়ালি চ্যানেল পাল্টাচ্ছে প্রিয়। আচমকা  কনিং বেল বাজল। বির*ক্তির মুখ করে দেয়াল ঘড়ির দিক তাকালো । রাত এগারোটা। এত রাতে কে এলো? ডিনার করে খালা স্টাডি রুমে ঢুকেছে। কলেজের কিছু কাজ বাকি, সেগুলো শেষ করছে। কাজের মাঝে বি*রক্ত করা উচিত হবেনা। রেগে যাবে নিশ্চয়ই। ঘাড় ঘুড়িয়ে স্টাডি রুমের দিক তাকাল একবার। বেলের শব্দ খালা শুনেনি হয়তো। পরপর আরো কয়েকবার কনিং বেল বাজলো। সেই  সাথে দরজা ধাক্কানোর ধুপধাপ আওয়াজ। বিরক্তির ভ*ঙ্গিতে সোফা ছেড়ে উঠলো প্রিয়। দরজা খুলে, বারো, তের বছরের এক ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। এর আগেও ছেলেটাকে দেখেছে। এই পাড়াতেই থাকে। ভীষণ দুষ্টু।  কপাল কুঁচকে এলো প্রিয়’র। রাশভারী আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

‘ এত রাতে কি চাই?’

ফোকলা দাঁত দেখিয়ে ছেলেটা হাসল। হাতে থাকা তারাবাতির প্যাকেট দুইটা এগিয়ে দিলো। প্রিয়’র কপালে গভীর ভাঁজ পড়ল। বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি এইগুলো?’

‘ তারাবাতি।’

‘ কি করবো?’

‘ ভাই পাঠিয়েছে। ফো*টাবেন।’

হতাশ শ্বাস ফেলল প্রিয়। ছেলেটাকে নিশ্চয়ই ওই বাইকয়ালা ব*খাটে লোকটা পাঠিয়েছে। প্রচন্ড রকম  মেজাজ খারাপ হলো। কিছুটা চেঁচিয়েই বলল,

‘ তোমার ভাই থেকে চেয়েছি আমি? যতসব ফালতু লোক। তোমার ভাইকে বলে দিও, এরপর আমাদের বাড়ির আশেপাশে  ঘুরঘুর করতে দেখলে তার মাথা ফা*টাবো।’

‘ মাথা ফা*টাবে বললেই হলো? তুলে আ*ছাড় মারবে। আমার ভাইকে তুমি চিনো? ‘

ছেলেটার কথায় হতবাক প্রিয়। এতটুকু ছেলে কি পাঁকা পাঁকা কথা তার। আরো রেগে গেল,

‘ যেমন গুরু তেমন তার শিষ্য! ব*দ! তাকে বলো পারলে আমার সামনে এসে  দাঁড়াক।’

চেঁচামেচি শুনে আয়েশা বেগম স্টাডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। দরজার কাছে প্রিয়কে দেখে ঝাঁ*ঝালো কন্ঠে আওড়াল সে,

‘ এখানে কি হচ্ছে!’

ছেলেটার দিক চোখ পড়তেই রাশভারি আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

‘ এই রাতে এখানে কি করছ শাদ?’

মুহুর্তে ছেলেটার চোখমুখ পাল্টে গেল। অ*সহায় কাচুমাচু ভাব করে বলল,

‘ বাড়ির আশেপাশে সব বিল্ডিংয়ে ভাইয়া তারাবাতি পাঠিয়েছে। আপাকে দিতে এলাম। আপা রেগে গিয়ে বলল আমার মাথা ফা*টাবে সাথে ভাইয়ারও।’

ছেলের কথা শুনে প্রিয় যেন আকাশ থেকে পড়ল। চট করে কি ভ*য়ঙ্কর মিথ্যা বানিয়ে বলল। সে এই ছেলের মাথা ফাটাবে কখন বলল? প্রিয় কিছু বলবে তার আগেই খালা ধমকে থামিয়ে দিলো। ছেলেটা যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে খালা প্রিয়’র উদ্দেশ্যে বলল,

‘ এসব কেমন আচরণ? তোর তারাবাতি ফো*টানো পছন্দ না তা সুন্দর করে বললেই হতো। শুধু শুধু এসব..’

মুখ মলিন করে নিলো প্রিয়। তার কাচুমাচু মুখ দেখে বড় খালা ছোট নিশ্বাস ফেলল। বোঝানোর সুরে বলল,

‘শুন প্রিয়, আমি জানি তোর এখানে থাকতে ভালো লাগছেনা। এখানকার পরিবেশ পছন্দ হচ্ছেনা। কিন্তু আগামী দুবছর তোকে এখানে থাকতে হবে। এখানে থেকেই স্কুল শেষ করতে হবে। তোর বাবা মা আমি আমরা কেউ তোর খারাপ চাইনা। তোর ভালোর জন্যই এখানে আনা। জানি এখানে এডজাস্ট হতে স*মস্যা হবে। তাই বলে তুই চেষ্টা করবিনা? তুই একবার মন থেকে চেষ্টা কর আমি জানি তুই পারবি। ঢাকার মত স্বাভাবিক হবে সব।’  

 

প্রিয়’র নানা বাড়িটা বেশ পুরানো। কাঠের সিড়ি, তারে টানা টেলিফোন, বাড়ির সামনে ডাকবাক্স, জায়গা জায়গায় ঘুনে ধরা কাঠের দরজা। ছাদ জুড়ে ছোট বড় ফুলের টব। দরজা জানালায় আশি দশকের কারুকাজ। ট্রেডিশনাল ফার্নিচারে সাজানো অপূর্ব ঘর। যেন পুরানো নিদর্শন। নানা যৌবন কালে কাজের সুবাদে বেশ কিছুকাল কলকাতায় ছিলেন, তাই শখ করে সেখানকার বাড়ির নকশার মত বাড়ি গড়িয়ে ছিলেন।  ভেবেছিলেন পরবর্তীতে ছেলে সন্তান হলে যুগের সাথে মিলিয়ে নতুন নকশায় বাড়ি তৈরি করে দিবে। ছেলে সন্তান না হওয়ায় তা হলো না। নানা বাড়িটাও আর সংস্করণ করলো না। বছর তিনেক আগে খালা সামান্য মেরামত করালেও পুরোনো কিছু বদলায়নি। সবটা আগের মতই আছে, নতুনত্বের মৃদু ছোঁয়া লাগিয়েছে শুধু।

দুপুরের শেষ ভাগ। হেলে পড়া সূর্যের কোমল আলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারিদিক। বেতে্র চেয়ারে বসে প্রিয়’র চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে খালা। চোখমুখ আঁধার করে বসে আছে প্রিয়। চুলে তেল লাগানো মোটেও পছন্দ না তার। টিভিতে ক্রমাগত গান চলছে। মধুর গান গুলোও যেন বি*ষাক্ত লাগছে। বিলি কেটে তালুতে তেল লাগাতে লাগাতে খালা বিরক্তির কন্ঠে বলল,

‘ তোদের আজকালকার মেয়েদের লজিক আমার মাথায় ডুকেনা। চুলে তেল না দেওয়া এটা আবার কেমন ফ্যাশন?আমাদের সময় মাথায় তেল লাগানোর জন্য মা চাচিদের পিছুপিছু ঘুরতাম। আর তোদেরকে তুলুতুলু করেও দেওয়া যায় না!’

ঝিমিয়েঝিমিয়ে খালার কথা শুনছিল প্রিয়। ঘুমে চোখ লেগে আসছে বারবার। খালার কথার হু, হা জবাব দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। আবার ছাড়া পাবার অপেক্ষায় ঘড়ির দিকেও তাকাচ্ছে। 

এমন সময় কনিং বেল বাজল। প্রিয়’র মন ফুর ফুরিয়ে উঠল। চোখের ঘুম উধাও মুহূর্তেই। ছাড়া পাবে বুঝি এইবার। ঝটপটে বলল,

‘ কে এসেছে দেখে আসি?’

খালা সরু দৃষ্টিতে তাকাল। গম্ভীর আওয়াজে বলল,

‘ লাগবে না। আমি যাচ্ছি।’

খালা উঠে যেতেই, ধপ করে সোফায় উঠল প্রিয়। দু’পা তুলে আরাম করে বসল। টিভির ভলিউম বাড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল। 

আচমকা পুরুষালি আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে চাইল। শতাব্দ এসেছে। শতাব্দকে দেখে খুব বেশি অবাক হলো না প্রিয়। খালা একা থাকে বলে, প্রায় বিকালেই খালার ছাত্রছাত্রীরা চায়ের আড্ডায় আসেন। ছাদে বারান্দায় জমিয়ে চায়ের আড্ডা গল্প গুজব হয়। শতাব্দকে বসতে বলে খালা চা বানাতে চলে গেলেন। প্রিয় পা নামিয়ে, জামাকাপড় গুছিয়ে ভদ্র হয়ে বসল। আড়চোখে সামনের লোকটার দিক একবার চাইল। সোফায় গা এলিয়ে পায়ের উপর পা উঠিয়ে আরাম করে বই পড়ছে। যেন এই বাড়ি তার। 

বিরক্তির মুখ করে টিভি দেখায় মন দিলো প্রিয়। কিছু সময় যেতেই আচমকা এক গম্ভীর কর্কশ আওয়াজ কানে এলো,

‘ শুনলাম তুমি নাকি মাথা ফা*টাতে খুঁজছ আমায়? তাই মাথাটা ফা*টাতে আসলাম।’

 প্রিয় স্তব্ধ হতভম্ব। গোল বড় বড় চোখে বিমুঢ় চেয়ে। লোকটা অস্বাভাবিক শান্ত। গভীর চোখজোড়া বইয়ের পাতায় তখনো নিবন্ধ। যন্ত্রের মত আটকে আটকে জিজ্ঞেস করলো প্রিয়,

‘ সেদিন তারাবাতি আপনি পাঠিয়েছিলেন?’

বই হতে দৃষ্টি উঠিয়ে গম্ভীর হয়ে চাইল শতাব্দ। উত্তর বুঝতে পেরে ভয়ে ঢোক গিলল প্রিয়। মাথা ঘুরছে। পেট মো*চড়াচ্ছে। সেদিন রাগের মাথায় কত কি না বলল। বি*চ্ছু ছেলেটা সব বলে দিয়েছে নিশ্চয়ই! হয়তো সাথে বাড়িয়ে বলেছে আরো। এখন যদি রেগে গালে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়? প্রিয় উঠে দাঁড়ালো। চোখ বুজে ভীতু গলায় মিনমিনিয়ে কিছু বলল। তারপর এক দৌড়ে রুমে চলে গেল। খালা চা হাতে পিছন থেকে কয়েকবার ডাকলো। দুয়ার খুলল না প্রিয়। না উত্তর দিলো। সারা বিকাল দুয়ার বন্ধ করে ঘরে বসে রইল।

 

চলবে……….

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

 

৩.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

জানুয়ারির প্রথম থেকেই শীতের প্রকো*প চলছে প্রচণ্ড। বছরের প্রথমদিন ক্লাস শুরু হলেও, পুরো পাঁচদিন পর স্কুলে  উপস্থিত হলো প্রিয়। রোজ তার স্কুলে না যাওয়ার নতুন নতুন বাহানায়, খালা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল প্রায়। তার কোন বাহানায় কাজ হয়নি আজ। খালা ধরে বেঁ*ধে স্কুলে এনেছে একপ্রকার। স্কুল মাঠের দিকে তাকাতে চোখ জুড়িয়ে গেল প্রিয়’র। কি বিশাল মাঠ! মাঠের চারপাশে বড় মোটা মোটা গাছ। চারকোনায় চারটি ধবধবে দোতলা ভবন। সোনালী রোদের উপচে আসা আলোতে উজ্জ্বল রঙটা চকচক করছে আরো। একরাশ মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল মন। ঢাকায় এমন বড় সুন্দর মাঠ সচরাচর দেখা যায়না। সেখানকার মাঠগুলো শুরু হতেই শেষ! স্কুল দেখে পছন্দ হয়েছে প্রি’র। চারিপাশে সকল অচেনা মানুষ। আশপাশে ছোটবড় কত ছেলে মেয়ে। কিন্তু কাউকে চিনেনা সে। 

খালার পাশে যেয়ে দাঁড়াল। এই স্কুলের কলেজ শাখায় খালা শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত। সেই সুবাদে প্রায় সকলেই পরিচিত। খালা প্রধান শিক্ষকের অফিস থেকে বেরিয়ে একজন দপ্তরি ডেকে বলল,

‘ নিউ এডমিশন। নবম শ্রেণির ক্লাসটা দেখিয়ে দেও।’

লোকটা বোকাসোকা মুখ করে মাথা নাড়াল। খালা প্রিয়’র উদ্দেশ্যে বলল,

‘ ছুটির পর অপেক্ষা করতে হবেনা। টিউশন আছে আমার। রিকশা ধরে বাড়ি চলে যাবি সোজা।’

বাধ্য মেয়েদের মত মাথা ঝাকালো প্রিয়।

 ‘চিনবি তো?’

‘ হ্যাঁ চিনবো।’

 

দপ্তরির পিছন পিছন ক্লাসে গেল প্রিয়। ক্লাসে পা রাখতেই অদ্ভুত ভী*তিতে বিষিয়ে এলো মন। ছোট ছোট পা ফেলে  ভিতরে ডুকল। কাচুমাচু হয়ে এক খালি বেঞ্চে বসল।  আড়চোখে চারিপাশে তাকালো। কিছু মেয়ে তাকে দেখে ফিসফিস করছে। কখনো আবার কি*টকিটে হাসছে। ভীষণ অ*স্বস্তি লাগছে প্রিয়’র। ক্লাসে এসেছে দশ মিনিট হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা হুড়মুড় করে ঢুকছে। তার বেঞ্চ ডিঙ্গিয়ে পিছনে যাচ্ছে তবুও তার পাশে বসছে না কেউ। পেছন থেকে এক মেয়ের ব্যঙ্গ আওয়াজ কানে এলো হ্ঠাৎ,

‘ দেখ, দেখ ক্লাসে শহুরে ম্যাডাম এসেছে। কাপড়ের ছিড়িটা একবার দেখ! সিনেমার নায়িকা সেজেছে।’

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো প্রিয়’র। নিজের দিক একবার ভালো করে চাইল। তাকে দেখতে খুব বেশি উদ্ভট লাগছে কি? লাগার তো কথা নয়। কি এমন পড়েছে সে? শর্ট কুর্তি আর সিম্পল ব্লাক জিন্স। সাথে লম্বা স্কার্ফও আছে। ঢাকায় সবসময় এভাবেই তো বের হতো। 

আশেপাশে মেয়েদের দিকে চাইল একবার। পুরাতন ছাত্রীরা স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে এসেছে আর নতুনেরা সেলোয়ার কামিজ পড়ে মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা মোড়ানো। পেছন থেকে আবার একজন বলল,

‘ আস্তে বল, শুনেছি  ম্যাডামের আত্মীয়। ঢাকা থেকে এসেছে।’

‘ কোন ম্যাডাম?’

‘ কলেজের আয়শা ম্যাডাম আছে না? উনার। জানলে হেড স্যারের কাছে না*লিশ করবে।’

‘ ওইতো ক্ষমতার জোর। পোশাকেই বুঝা যায় চরিত্রের কি হাল।’

রা*গে তে*তে উঠল প্রিয়। পিছন ফিরে কিছু বলবে তার আগেই কারো প্রতি*বাদী আওয়াজ কানে এলো,

‘ বেশি বাড় বাড়িস না নিলু। তোর চরিত্র যেমন খুব ভালো? তুই যে  বারো*ভাতারি গ্রামের সবাই জানি। ইটের সারির পেছন রিপুইন্নার লগে কি খেল চলে তোমার সেই কথা আমাদের  সবার জানা।’

‘ তুই কি দুধে ধোঁয়া তুলসীপাতা! চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে তোর প্রেম চলছে তা কি সবার অজানা?’

‘ প্রেম করি তোর মত চিপায় চাপায় যাইয়া ন*ষ্টামি করি না?’ 

প্রিয় হা করে মেয়েদের কথা শুনছে। তাদের ভাষার কি ছিড়ি। এই বয়সেই প্রেম? এতো ফাস্ট! মায়ের থেকে শুনেছিল এখানকার  মেয়েরা ভীষণ সভ্য শান্ত। ঘোমটার আড়াল থেকে চুল বের হয় না কারো। এখানকার মেয়েদের সাথে তুলনা করে তাদের তিনবোনকে কত কথাই শুনাতো। এদের এইসব ভাষা যদি মা আজ শুনতো! নি*র্ঘাত জ্ঞান হারাতো।

সামনে দাঁড়ানো  মেয়েটার আওয়াজে ঘোর কা*টল প্রিয়’র।

‘ চাপো, আমি বসবো।’

প্রিয় সরে বসলো। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বেঞ্চে বসতে বসতে মেয়েটা বলল,

‘ এদের ছাড় দিলে আরো সাহস পাবে। নরম পেয়ে আরো যাতবে। শুনোনি শক্তের ভক্ত নরমের য*ম?’

‘ এসবের দরকার ছিল না কোন। আমার জন্য তুমি শুধু শুধু ওদের সাথে ঝা*মেলা বাঁধালে।’

‘ ওরা আমার সাথে ঝা*মেলায় জড়াবে না। কিছু বললে র*ক্ষা আছে? আমি চেয়ারম্যানবাড়ির ভবিষ্যৎ পুত্রবধূ।’

শেষ কথাটা বুক ফুলিয়ে বলল। প্রিয় অবাক হয়ে বলল,

‘ তোমার বিয়ে ঠিক?’

‘ না দুবছর যাবত প্রেম করছি, বিয়েটাও হয়ে যাবে।’

আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল মেয়েটা। প্রিয়  নিখুঁত দৃষ্টিতে মেয়েটাকে পরখ করল, শ্যামলা বর্ণের গোল কাঠামোর মায়াবী মুখ। রোগা পাতলা আহামরি সুন্দরী না হলেও বেশ মিষ্টি।

মেয়েটা জিজ্ঞেস করল,

‘ নাম কি তোমার?’

‘ অশীতা জাফর প্রিয়’

‘ বাহ। ভারী সুন্দর নাম তো!’

‘ তোমার নাম?’

‘ তাসবিয়া তানহা। তুমি ঢাকা থেকে এসেছো?’

‘ হ্যাঁ।’ 

ঢাকার কথা শুনে তানহা খুশিতে গদগদ করে উঠল। চোখেমুখে চমক। একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করল। ক্লাসের ফাঁকে দুইজ্নের অনেক কথা হলো। অল্প সময়েই তানহার সাথে প্রিয়’র বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। 

   

 

 ক্লাস শেষে রিকশায় উঠল প্রিয়। ভরদুপুর। রাস্তাঘাট খুব একটা ব্যস্ত না এখন। কোমল রোদের সাথে শীতের অনুষ্ণ পরশ। ভীষণ ভালো লাগছে তার। গলির মাথায় ঢুকতে  হ্ঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কায় রিকশা থামল। লোহার সাথে প্রিয়’র হাঁটু গিয়ে লাগলো। পায়ে কিছু একটা বিঁধ*ল। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল, বিরক্তির কন্ঠে বলল,

‘ আস্তে মামা। কিভাবে রিকশা চালাচ্ছেন!’

‘ সামনে পোলাপান আইয়া পড়ছে আম্মা।’

আশেপাশে তাকালো প্রিয়।  কেউ নেই।  ঝুঁকে তাকাতেই চাকার নিচে বল দেখতে পেল। নিচে নেমে বলটা হাতে নিতেই বাচ্চাদের হৈচৈ শুনা গেল। বিল্ডিংয়ের পিছন থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসছে। দল বেঁধে প্রিয়’র সামনে দাঁড়ালো। সেই দলের নেতা শাদ নামের সেইদিনের সেই দু*ষ্ট ছেলেটা। প্রিয়’র প্রচুর রা*গ হলো। চেঁচিয়ে বলল,

‘ রাস্তা কি খেলার জায়গা? এখনি তো অঘটন ঘটতো। যদি আমার কিছু হয়ে যেত?’

ছেলেটার চেহারায় বিন্দু মাত্র অপ*রাধবোধ নেই। বেশ স্বাভাবিক খাপছাড়া কন্ঠে বলল,

‘ আমাদের দেরি হচ্ছে বল দেন।’

এতবড় অপরাধ করে কই সরি বলবে। তা না বে*য়াদবি করছে। শাদের কথায় প্রিয়’র আরো বেশি রাগ হলো। রেগে গিয়ে বলল,

‘ তুমি আসলেই একটা বে*য়াদব ছেলে। ভুল করেছ। সরি না বলে হুকুম দিচ্ছ? এই বল আমি দিবোনা। দেখি কি করে নেও!’

‘  ভালোয় ভালোয় বলটা দিয়ে দেন আপু। নয়তো আন্টির কাছে নালিশ করবো।’

ছেলেটার কথায় হতভম্ব প্রিয়। একে দো*ষ করেছে তার উপর তাকেই ভ*য় দেখাচ্ছে? কেমন ঘাড় ব্যাকা ছেলে!

‘ তুমি আস্ত এক ফাজিল ছেলে!’

‘ আর আপনি কি? মাথা ফাটাতে চান খু*নি মেয়ে।’

‘ তোমার সাহস তো দেখছি কম না? এখনি কিন্তু 

‘ কি করবেন আপনি? আপনি আমাকে…..

কথা শেষ করতে পারলো না শাদ। তার আগেই পেছন থেকে কেউ গম্ভীর আওয়াজে ধম*কালো। পেছন ফিরে শতাব্দকে দেখে প্রিয়’র চোখমুখ আরো কুঁচকে গেল। গম্ভীর মুখ করে হুডিতে হাত। ওদের দিকই এগিয়ে আসছে শতাব্দ। কাছাকাছি এসে শাদকে বলল,

‘ উনাকে সরি বল’

‘ কিন্তু ভাই..’

‘ সরি বলতে বলেছি’

ধম*কে উঠল শতাব্দ। মাথা নুয়ে নিলো শাদ। মিনমিনিয়ে বলল,

‘ সরি’

‘ দরকার নেই সরি’র’

প্রিয় ঝাঁঝালো গলায় বলল। মাটিতে বল ছুড়ে ফেলে। ভাড়া মিটিয়ে শতাব্দকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিক হাঁটা দিলো। খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটছে। হাঁটুর সাথে তখন পায়ের গোড়ালিতেও ব্যথা পেয়েছিল। সুচাল তারকাটায় লেগে উপরের চামড়া চি*ড়ে গেছে। চুয়ে চুয়ে র*ক্ত ঝরছে। কিছু দূর যেতেই পেছন থেকে প্রিয়’কে ডাকলো। প্রিয় থামলো। শতাব্দ পাশে এসে বলল,

‘ পা থেকে র*ক্ত ঝরছে। সামনে ফার্মেসি আছে, চলো।’ 

‘ দরকার নেই, বাসায় গিয়ে এন্টিসেপটিক লাগালেই র*ক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।’

নিচের দিক তাকিয়ে ঝটপট উত্তর দিলো প্রিয়।

‘ ক্ষ*ত দেখে মনে হচ্ছে পুরাতন কিছুতে লেগেছে ইনফেকশন  ছড়াবে।’

‘ কিছু হবে না।’

শতাব্দ কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো। ধমকে বলল,

‘ বলছি না ইনফেকশন হবে? আমার কথা মানতে তোমার সম*স্যাটা কোথায়?’ 

কথার পিঠে কোন উত্তর দিলোনা প্রিয়। বাধ্য মেয়ের মত শতাব্দের পেছন পেছন গেল। দুপুর টাইম। ফার্মেসী খোলা। কিন্তু লোক নেই। ফার্মেসীর সামনে একটা বাচ্চা ছেলে চেয়ার পেতে বসে। শতাব্দ জিজ্ঞেস করতেই বলল,

‘ আব্বা বাড়ি গেছে ভাত খাইতে।’

প্রিয় যেন সুযোগ পেলো। অচি*রে বলল,

‘ লাগবেনা। আমার দেরি হচ্ছে। বাসায় চলে যাই।’

বলেই উত্তরের আশা না করে। ঝটপট পা বাড়ালো। শতাব্দ গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ থামো!’

প্রিয় যন্ত্রের মত থেমে গেল। গম্ভীর চড়া আওয়াজে শতাব্দ বলল,

‘যেতে বলেছি?”

‘ উনি আসতে দেরি হবে। আমি নাহয় এখন চলে যাই পরে এ..

‘ চুপচাপ বেঞ্চে গিয়ে বসো। পরে ব্যথা আরো বাড়বে। আমি করে দিচ্ছি।’

‘ আপনি?’

উত্তর দিলো না শতাব্দ। ভেতরে চলে গেল। প্রিয় কাচুমাচু মুখ করে কাঠের বেঞ্চটায় বসলো। মিনিট কয়েক পর শতাব্দ হাতে স্যাভলন ব্যান্ডেজ আর কি কি নিয়ে যেন ফিরে এলো। প্রিয়’র সামনে চেয়ার পেতে বসলো। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়। তুলোয় স্যাভলন লাগিয়ে কাটা জায়গা পরিষ্কার করছে শতাব্দ। প্রিয় ব্যথায় আঁ*তকে উঠল। ভীষণ জ্বলছে। কি ভেবে জানো একবার উপর দিক চাইল শতাব্দ, তারপর ক্ষ*ত স্থানে ফু দিতে দিতে বলল,

‘ এখন একটু জ্বলবে। দাঁত খিচে বসো।’

প্রিয় কিছু বলল না। পায়ে শীতল নিশ্বাস পড়তেই কেমন কুঁ*কড়ে উঠলো হ্ঠাৎ। ছোট ঢোক গিয়ে চোখমুখ শক্ত করে বসলো। ব্যা*ন্ডেজ করতে করতে শতাব্দ  জিজ্ঞেস করল,

‘ তখন শাদ সরি বলছিল না বলে ঝ*গড়া করছিলে। যখন বলল, দরকার নাই বলে চলে এলে।’

প্রিয় মুখ কালো করে বলল,

‘ কারণ ও আপনার ভ*য়ে আমাকে সরি বলেছে। আমার জন্য নয়। কারো দানে দেওয়া সরির আমার দরকার নাই।’

প্রিয়’র উত্তরে গাল বাকিয়ে হাসল শতাব্দ। এই প্রথম লোকটাকে হাসতে দেখলো প্রিয়। কি দারুণ হাসি!  কিছু একটা ভেবে সাথে সাথেই কপাল কুঁচকে নিলো। ব্যান্ডেজ করা  হতেই উঠে দাঁড়ালো প্রিয়। অনুভূতিশূন্য যন্ত্রের মত করে বলল,

‘ ধন্যবাদ।’

বলেই তাড়াতাড়ি করে হাঁটা দিলো। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রিয়’র চলে যাওয়ার দিক নিমিষ চেয়ে রইল শতাব্দ। রাস্তার পাশে বড় বটগাছের ছায়া পড়ছে প্রিয়’র গায়ে। খুরিয়ে খুরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ব্যথায় কুঁ*কড়ে উঠছে, থামছে না তবুও। এতটুকু মেয়ের আত্মনির্ভর হওয়ার অদম্য জেদ।  

সামান্য হাসলো শতাব্দ, ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

 ‘ সুন্দর! অদ্ভুদ সুন্দর।’

 

চলবে……….

  

 

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির) 

 

৪.

 

অল্প কিছুদিনে তানহার সাথে প্রিয়’র বেশ ভাব হয়েছে। সম্পর্কটা তুমি থেকে তুই’য়ে এসে ঠেকেছে। এখানে আসার পর এখন তানহাই তার এক মাত্র বন্ধু। প্রায়ই প্রিয়দের বাসায় আসাযাওয়া হয় তানহার। খালাও তাকে পছন্দ করে বেশ। আজও এসেছে। ছাদে রেলিং-এ হেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে  আছে তানহা। হাতে ধোঁয়া উঠা গরম চা। চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে আঙ্গুল তাক করে, কিছুটা আওয়াজ করে বলল,

‘ প্রিয়! ওই দেখ আমার শ্বশুরবাড়ি।’

তানহার কথায় কান দিলোনা প্রিয়। গরম পিঁয়াজু মুখে পুড়তে ব্যস্ত সে, হাতে থাকা উপন্যাসের বইয়ে দৃষ্টি তার। কিছুটা খাপছাড়া হয়েই বলল,

‘ রোজ দেখছি। এতে নতুন কি?’

‘ উফ। দেখনা একবার’

ধপ করে উপন্যাসের বইটা বন্ধ করল প্রিয়। তানহার দিক ফিরে  তাকালো।বলল,

‘ কি দেখবো? এই নিয়ে তুই আমাদের বাড়ি বারোবার এসেছিস। প্রত্যেকবার এই একই কথা বলেছিস।’

তানহা কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকালো। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

‘ গুনেও রেখেছিস? তুই নিরামিষ! এসবের কি বুঝবি?’

বলেই রেলিং-এর দিক আরো ঝুঁকে পড়ল। প্রিয় আড়চোখে চেয়ারম্যান বাড়ির ছাদে একবার তাকাল। আড্ডা চলছে সেখানে। আসরের মধ্যমণি যে শতাব্দ তা দূর থেকে বুঝাতে অসুবিধা হচ্ছেনা কোন। হ্ঠাৎ তানহা উত্তেজিত হয়ে  উঠল, আবদার করে বলল,  

‘ওরা ওই ছাদে কত মজা করছে। চল যাই?’

প্রিয় হকচকিয়ে উঠল,

‘ পাগল হয়েছিস তুই? খালা জানলে ঠ্যাং ভা*ঙ্গবে।’

‘ ভা*ঙ্গবে না চল।’

‘ এতগুলো ছেলের মাঝে দুই মেয়েজন যেয়ে কি করবো। লোকে খারাপ ভাববে। তাছাড়া সেখানকার কাউকে আমি চিনিনা।’

‘ তুই চিনিস না তো কি হয়েছে, আমিতো চিনি। সে ওই খানে আছে ,ঠিক ম্যানেজ করে নিবে।’

‘ তুই যে ওই শুধু লোকটাকেই দেখতে আমাদের বাড়িতে আসিস তা আমি বেশ জানি। তুই যা, যাবোনা আমি।’

প্রিয় সামান্য রেগে বলল। তানহা চুরি ধরা পড়ার মত করে হেসে ফেলল। চোখেমুখে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের রেখা টেনে সিরিয়াস ভাব নিয়ে বলল,

‘ না তো। আমি শুধু তোর সাথে আড্ডা দিতে আসি।’

‘ হ্যাঁ তুমি কেন আসো তা ভালো করেই জানি। বুঝিনা এই ছেলেটার মধ্যে কি এমন আছে! যার জন্য তুই জান জীবন দিয়ে পাগল। তুই এসেছিস এতক্ষণ হলো, কই লোকটা তোর দিক একবার তাকালোও  না তো!’

প্রিয়’র কথায় তানহা বিরক্ত হলো। কন্ঠে বিরক্তি এঁটে বলল,

‘ বারবার লোক বলবি না তো। তার বয়স কি অত? তোর তাকে পছন্দ না মানলাম! তাই বলে মিথ্যা বলবি প্রিয়? এই নিয়ে কতবার তাকালো। দেখিসনি? শুধু শুধু কি ওকে এত ভালোবাসি? কি সুন্দর ইংরেজ নায়কদের মত চেহারা! দেখ!’

তানহার কথায় শতাব্দের দিক একবার তাকাল প্রিয়। ফর্সা লম্বা, ভালো চেহারার আর পাঁচজন ছেলের মতই সুদর্শন। হয়তো আর পাঁচজন থেকে একটু বেশিই সুদর্শন। কিন্তু আকর্ষণীয় দেখছে না কিছু।

‘ ঠিকঠাক। তবে জান জীবন দিয়ে দেওয়ার মত আহামরি তেমন কিছুও না’

প্রিয়’র কথায়, তানহা উত্তর দিলো,

‘ আমার চোখ দিয়ে দেখ।’

‘ কেন, তোর চোখে কি বিশেষ কোন চশমা লাগানো? আমার চোখ নেই?’

‘ চোখ আছে সেই চোখে প্রেম নেই!’

কিছুক্ষণ থম মেরে রইল। তারপর ঝটপট করে উত্তর দিলো প্রিয় ,

‘ বাজে কথা বন্ধ কর।’

  

 

সময় বহমান। দেখতে দেখতে অর্ধবার্ষিকী চলে এলো। প্রিয়’র টিউটোরিয়াল পরিক্ষার রেজাল্ট বড্ড খারাপ। গণিতে মাত্র তিন নাম্বার, অন্য বিষয় গুলোতে টেনেটুনে কোনোরকমে পাশ। এর মাঝে হুট করে অর্ধবার্ষিকীর রুটিন পেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। আয়েশা বেগম  স্কুলের আশেপাশে কোচিং গুলোতে খোঁজ নিলো। সবগুলো ব্যাচ ফুল। পরিক্ষার দু সাপ্তাহ আগে নতুন ছাত্র ঢোকাবে না কেউ। আয়েশা বেগমের সাহিত্যের নিয়ে পড়াশোনা। কলেজে বাংলার শিক্ষিকা। গণিতে খুব একটা পারদর্শী নন। প্রিয় অর্ধবার্ষিকীতে ফেল করলে, কোথাও মুখ রইবে না তার। লোকে হাসাহাসি করবে। বলবে খালা কলেজের শিক্ষিকা আর ভাগ্নী কি না গণিতে ফেল!  চিন্তায় দিশেহারা  সারা বিকাল কাটালো। সন্ধ্যায় কলিং বেল বাজলো। প্রিয় দরজা খুলে শতাব্দকে দেখল। অবাক হলো কিছুটা। শতাব্দ সচারাচর সন্ধ্যায় আসেনা। তবে আজ? পেছন থেকে খালার চড়া আওয়াজ কানে এলো,

‘ শতাব্দ এসেছে প্রিয়?’

কপাল কুঁচকে শতাব্দের দিক তাকাল। খালার মত করে গলা উঁচিয়ে উত্তর দিলো’ হ্যাঁ এসেছে’। 

দরজা থেকে সরে দাঁড়াল প্রিয়। শতাব্দ ভেতরে ঢুকতেই দরজা লাগিয়ে খালার পাশে সোফায় গিয়ে বসলো। খালা শতাব্দকে দেখে হাসি মুখ করে বলল,

‘ বিকালে ফোন করেছিলাম।’

‘ বাহিরে ছিলাম দেখিনি। কোন দরকার ছিল?’ 

‘ হ্যাঁ, বলছি। তার আগে চা করে আনি?’

‘ মাত্রই খেয়ে এসেছি’

‘ আরেক এক কাপ খেলে কিছু হবেনা।’

খালা চা করতে চলে গেল। প্রিয় মুখ কালো করে বসে রইল। এই লোকটার প্রতি খালার এত আদিখ্যেতা কেন? বাসায় আসলেই খালার চা করতে হবে! না করছে তবুও করতেই হবে। অ*সহ্য। মুখ বাঁকিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে প্রিয়। এর মাঝেই খালা চা বিস্কিটের ট্রে নিয়ে ফিরে এলো। টেবিলে রাখতেই ঝটপট হাতে প্রিয় দুইখানা বিস্কিট তুলে নিলো। খালা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রিয় মিনমিন করে বলল, 

‘ এভাবে দেখছো কেন! দুইটা বিস্কুট-ই তো ।’

আয়েশা বেগম তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। কতবার বলেছে বাড়িতে মেহমান আসলে যেন এমন ছোঁচামো স্বভাব না করে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? কত বুঝায়! যদি একটা কথা শুনতো। মাঝেমধ্যে মনে হয় মেয়েটা তাকে রাগানোর জন্য এসব ইচ্ছাকরে করে। সরু দৃষ্টিতে প্রিয়কে দেখছে শতাব্দ। চোখে সরলতা। শুধু তার জন্যই কেন জানো তিক্ত গম্ভীরতা! মেয়েটা সত্যিই ভীষণ অদ্ভুত। একদম অন্যরকম একজন। 

প্রিয়কে এড়িয়ে খালা শতাব্দকে বলল,

‘ চা ঠান্ডা হচ্ছে শতাব্দ।’

দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো শতাব্দ। চা তুলে কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

‘ আপনি কিছু বলছিলেন।’

আয়েশা বেগম কাচুমাচু হয়ে বলল,

‘ তোমার কাছে একটা আবদার আছে। আবদারটা রাখতে হবে বাবা।’

বলেই আড়চোখে প্রিয়’র দিক তাকাল। মনযোগ দিয়ে প্রিয় তখনো বিস্কুট খেতে ব্যস্ত। বাহিরে অন্ধকার গাড়াচ্ছে তাই জানালা বন্ধ করার বাহানায় প্রিয়’কে অন্যঘরে পাঠালো। প্রিয় যেতেই আয়েশা বেগম কাচুমাচু করতে লাগল।

‘ তুমি তো দূরের কেউ নও। আমাদের আগাগোড়া সবটাই জানো। প্রিয় আমার মেজো বোনের মেজো মেয়ে। ছোট থেকে ঢাকায় থেকেছে। বাবা মা ভাই বোনদের নিয়ে ওদের সিমসাম  সুন্দর পরিবার। বছর দুয়েক আগে প্রিয়’র বড় ভাইকে পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয় কিন্তু সেখানে গিয়ে বিদেশি মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। পরিবারের অমতে বিনা অনুমতিতে বিয়ে করে। প্রিয়’র বাবা শুনে তেজ্য করে ছেলেকে। তার মাঝেই এলাকায় বড় মেয়ের  প্রেমের গুঞ্জন শুরু হলো। জল ঘোলা না করে, দুই পরিবার বসে  দেখে শুনে দুজনের বিয়ে দেয়। সেই বিয়ে বেশি দিন টিকলো না। আটমাস গড়াতেই স্বামীর সাথে বনিবনা অশান্তি ঝামেয়া  প্রিতীর ডিভোর্স হয়। সমাজের কটু কথা সহ্য করতে না পেরে গড়ায় দড়ি দিয়ে সু*ইসাইড করে। যেইরাতে প্রিতী সু*ইসাইড করে প্রিয় তার সাথেই ছিল। সকালে ঘুম ভেঙ্গে  বড় বোনের বিকৃত ঝুলন্ত লাশ দেখে মেয়েটা সহ্য করতে পারেনি। মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পরে। প্যানিক এটাক ফোবিয়া ঘিরে ধরেছে ওকে। ওর ভবিষ্যৎ আর মেন্টাল হেলথের কথা চিন্তা করে ওর বাবা মা আমার সাথে এখানে পাঠিয়েছে। কিন্তু এই পরিবেশে মেয়েটা মানিয়ে নিতে নারাজ। কেমন জানো গম্ভীর রগচটা স্বভাবের হয়ে গেছে। ঢাকায় ফেরার নতুন নতুন বাহানা খুঁজছে রোজ। কখনো অসুস্থ হওয়ার নাটক করে, কখনো আবার আমাকে বিরক্ত করে। মেয়েটা আগে মোটেও এমন ছিলনা। বেশ প্রাণবন্ত মিশুক ছিল কিন্তু সেই ইন্সি*ডেন্টের পর..’

 এতটুকু বলে থামলো আয়েশা বেগম। শতাব্দ নড়েচড়ে বসলো। গম্ভীর হয়ে বসলো,

‘ আপনি কি চাইছেন?’

আয়েশা বেগম একটু চুপ রইল। বয়স কম হলেও শতাব্দ বেশ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন দায়িত্ববান একটা ছেলে। তার উপর বাবা এলাকার চেয়ারম্যান। যদিও ছোট থেকে তার সাথে অন্যরকম সম্পর্ক।  ছেলের মত। তবুও শিক্ষিকা হয়ে এমন আবদার করাটা কি উচিত হবে! যদি তার আত্মসম্মানে লাগে! চুপ থেকে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর নীরবতা ভেঙ্গে গম্ভীর হয়ে বলল,

‘আমি চাই তুমি কিছুদিন প্রিয়কে গার্ড করো।’

শতাব্দের চোখমুখ গম্ভীর হলো। কপালে মৃদু ভাঁজ। 

‘ আমি! কেন?’

‘ তোমার উপর ভরসা আছে। ভীষণ দায়িত্ববান একটা ছেলে তুমি।’

তারপর আবার বলল,

‘জানোই তো এখানকার মানুষের চিন্তাভাবনা। প্রিয়’র চলনবলন খুব একটা ভালো চোখে দেখছেনা তারা। ওর ফ্যামিলি ক্রাইসিস সম্পর্কেও কিছু আঁচ পেয়েছে। বুঝই তো এসব কথা বেশিদিন চাপা থাকেনা। তোমাদের বাড়িতে অনেক ছেলেমেয়ে আছে। বড়দের চিন্তাভাবনাও মুক্ত স্বাধীন। বেশ ওপেন মাইন্ডেড। তাদের সাথে মিশলে পরিবারের একাকীত্ব গুছবে।  হয়তো ও কিছুটা স্বাভাবিক হবে। আর তাছাড়া  তোমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করলে খারাপ চোখে দেখবেনা কেউ,  না  সাহস পাবে।’

মাথা নাড়াল শতাব্দ সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলল,

‘ ভালো চিন্তা। জুবাইদাকে প্রিয়’র সাথে বন্ধুত্ব করতে বলবো।’

আয়েশা বেগম তড়িঘড়ি করে বলল,

‘ আর একটা আবদার আছে আমার’

শতাব্দ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো।

‘ প্রিয়’র টিউটোরিয়াল পরিক্ষার রেজাল্ট বড্ড খারাপ। জেনারেল ম্যাথে ত্রিশে তিন পেয়েছে। টিচার খুঁজছিলাম এর মাঝেই পরিক্ষার রুটিন বেরোলো। দুই সাপ্তাহ পর অর্ধবার্ষিকী। কোন স্যার এখন পড়াতে রাজি হচ্ছেনা। তুমি ম্যাথম্যাটিকসে তুখোড়। সবসময় তোমার নাইন্টি এইট পার্সেন্ট মার্ক ছিল।  এই দুই সাপ্তাহ তুমি যদি একটু এসে দেখিয়ে দিতে!’

‘ আমি?’

‘ খুব বিপদে পড়ে আবদারটা করছি।  রাখতে যদি…..মেয়েটা এবার ফেল করলে কোথাও মুখ দেখাতে পারবোনা আমি।

শেষ কথাটা আয়েশা বেশ চিন্তিত হয়েই বলল। কিছুক্ষণ চুপ রইল শতাব্দ। কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ আমি কাল বিকালে আসবো’

আয়েশা বেগমের চোখ মুখ উজ্জ্বল। সামান্য হেসেই বলল,

‘ দেখো এই দুই সাপ্তাহে পাশ নাম্বার উঠানো যায় কি না। যদিও গাঁধা পিটালে ঘোড়া হয় না! চেষ্টা করো, দেখো।’

 

রাতে খাবার শেষে টিভি দেখছিল প্রিয়। দুধের গ্লাস  হাতে খালা পাশে এসে দাঁড়াল। দুধের গ্লাস দেখতেই নাকমুখ কুঁচকে নিলো প্রিয়। মিনমিন করে বলল,

‘ গন্ধ লাগে, খাবো না।’

আয়শা বেগম কড়া নজরে তাকালো। গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ রোজকার বাহানা।’

‘ খা..লা।’

আয়েশা বেগমের দৃষ্টি আরো গম্ভীর হলো। তা দেখে কাঁদোকাঁদো মুখ করে গ্লাসটা হাতে নিলো প্রিয়। খালা বিরক্তি গলায় বলল,

‘ জানিস খেতে হবে! রোজ এই নাটকটা কেন করিস?’

‘ যদি কোন ছাড় পেয়ে যাই।’

গাল ফুলিয়ে উত্তর দিলো প্রিয়।

খালা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলো। চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বলল,

‘ আগামীকাল রেডি থাকিস। বিকালে শতাব্দ আসবে পড়াতে।’

বিস্মিত হলো প্রিয়। সামান্য  চিৎকার করেই বলল,

‘ কেন? উনি কেন?’

‘ সমস্যা কোথায়?’

নাকে বাজিয়ে মিন মিন করে বলল প্রিয়,

‘ উনাকে আমার একদম ভালো লাগেনা’

‘ ভালো কথা! আমি চিন্তা মুক্ত থাকবো।’

খালা খাপছাড়া কন্ঠে বলল। 

বিরক্ত হলো প্রিয়। ইনিয়েবিনিয়ে বলল,

‘ চেয়ারম্যানের ছেলে আমাদের বাড়িতে এসে পড়াবে। লোকে কি বলবে খালা? তাছাড়া এমন কি কোথাও হয়? তুমিই বলো!’

‘ এসব তোর না ভাবলেও চলবে প্রিয় । লোকে জানবে না। আমার ছাত্র ছিল শতাব্দ,  ভালো সম্পর্ক। এবাড়িতে প্রায়ই ওর আসা যাওয়া হয়। তাছাড়া সারাবছর তো পড়াচ্ছে না। দুই সাপ্তাহ এসে গণিতটা দেখিয়ে দিবে শুধু।

কোন দিক করতে না পেরে হতাশ হলো। ক্ষু*দ্ধ হয়ে চেঁচিয়ে বলল প্রিয়,

‘উনার কাছে আমি পড়বো না খালা।’

খালা আগের মত গম্ভীর কন্ঠেই উত্তর দিলো,

‘ তোর মতামত চাইছিনা। অর্ডার করছি।’

রেগে হাত পা ঝাড়া দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠলো প্রিয়। জিদ ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

‘ এখানে থাকবো না আমি। আমাকে আমার  আব্বা আম্মার কাছে পাঠিয়ে দেও।’  

 

 

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির)

 

৫.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

পরদিন বিকালে ঠিক চারটায় শতাব্দ এলো। প্রিয় তখন বারান্ধার দোলনায় ঝুলছিল। শতাব্দকে দেখেই চোখমুখ কুঁচকে নিলো। পড়বেনা পড়বেনা বলেও, খালার ধমকে পড়ার টেবিলে বসতে হলো। ব্যাগ খুলে গণিত বই বের করে টেবিলে রাখল। খাতা কলমটাও কপাল কুঁচকে এগিয়ে দিলো। বইয়ের প্রথম অধ্যায় বাস্তব সংখ্যা থেকে শতাব্দ পড়ানো শুরু করল। ঘাড় নিচু করে বসে আছে প্রিয়। দৃষ্টি বইয়ের পাতায় থাকলেও মনযোগ অন্য কোথাও। কেন জানি শতাব্দের আশেপাশে থাকলে অদ্ভুত অস্বস্তি হয় তার। চাইলেও স্বাভাবিক থাকতে পারেনা। হয়তো প্রথম পরিচয়টা ভীষণ বিব্রতকর ছিল বলেই। প্রথম পরিচয়ের কথা ভাবতেই, দুই- আড়াই বছর আগের কথা মনে পড়ল। 

তখন সবে ক্লাস সিক্সে পড়ে প্রিয়। সেইবার গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে বোনদের সাথে ইমান্দিপুর এসেছিল। পাশের গ্রামে তখন বিরাট মেলা চলছিল। মেলায় যাওয়ার বায়না ধরলে, খালা সাফ মানা করল। কিন্তু বড় আপা কি তা শুনলো ? নিষি*দ্ধ জিনিসের প্রতি বরাবরই ঝোঁক ছিল তার। ছোট থেকেই ভীষণ দুরন্ত। ‘সেদিনই মেলায় যাবে’  মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো। এখানে আসার পর দাস পাড়ার সিমা’র সাথে বড় আপার বেশ ভালো সখ্যতা হয়েছিল। খালাকে মোরে ফুচকা খাওয়া কথা বলে প্রিয় প্রভা নিয়ে সিমার সাথে পাশের গ্রামে মেলা দেখতে চলে গেল। শহুরে পরিবেশ থেকে একদম ভিন্ন গ্রাম্য মেলা দেখে তিনবোন বেশ উপভোগ করছিল। কিন্তু হ্ঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা ঘটলো। লোকের ধাক্কাধাক্কিতে আচমকা প্রিয়’র হাত ছুটে গেল। চারদিকে অন্ধকার নামতে শুরু হয়েছে তখন। এত লোকের ভীড়ে প্রিয় ভীষণ ঘাবড়ে গেল। একটি পিঠার দোকানের পাশে যেয়ে চুপচাপ দাঁড়ালো। দোকানী অর্ধবয়স্ক লোক। প্রিয়কে ভিতরে এসে বসতে বলল। ভালো মানুষ ভেবে, সামনে বিছিয়ে রাখা বেঞ্চে গিয়ে বসলো প্রিয়। তার পরই মুখোশের আড়ালে লোকটার কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে এলো। প্রিয়’র নাম ঠিকানা জানার বাহানায় গায়ে হাত বোলাতে লাগল। বাড়ি ফেরার চিন্তায় অসচেতন লাপাত্তা প্রিয়’র সেই খেয়াল কি ছিল! এমন সময়ই কেউ এসে লোকটার কলার পেঁচিয়ে ধরল। গলা চেপে চেঁচিয়ে বলল,

‘ বুড়া বয়সে লুইচ্*চামি করছ? বাচ্চা মাইয়া পাইয়া যা ইচ্ছা তাই..কু*ত্তার বাচ্চা।’

বলেই লোকটার ঘাড় চেপে ধরল। লোকটা কাচুমাচু ভ*য়ার্ত মুখ করে বলল,

‘ আমার কোন দোষ নাই। মাইয়াটা হারাইয়া গেছে। তাই…’

‘ তাই সুযোগ নিচ্ছিলি? তোর বিচার চেয়ারম্যান বাড়িতে হইবো।’

ছেলেটা চেয়ারম্যানের লোক বুঝতে বাকি রইল না প্রিয়’র।   সাথে দলবল দেখে আরো ভালো মত নিশ্চিত হলো। ছেলেগুলো দোকানীকে টেনে হিঁ*চড়ে দোকান থেকে নামালো। লোকটা ভ*য়ে কাঁদোকাদো হয়ে বলল,

‘ আমার ভুল হইছে ক্ষমা কইরা দেও বাজান।’

দোকানীর আকুতি দেখে ভীষণ মায়া হলো প্রিয়’র। প্রতিবাদে চেঁচিয়েই বলল,

‘ উনাকে টানছেন কেন আপনারা? ছাড়েন।’

প্রিয় কথায় ছেলেটার যেন আরো রাগ হলো। প্রিয় আগের মত গলা উঁচিয়েই বলল,

‘ ছাড়েন উনাকে। ছা…।

আর কিছু বলার আগেই চড়া গলায় ধমক দিলো ছেলেটা । প্রিয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত চেপে সামনে হাঁটতে লাগল। শতাব্দের বড় বড় পায়ের সাথে মিলিয়ে হাঁটতে পারছেনা প্রিয়। দৌড়ে দৌড়ে আসছে কোন রকম। শক্ত করে ধরায় হাতে নখ ডেবে যাচ্ছে। ব্যথায় কুঁ*কড়ে উঠল প্রিয়। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে চেঁচিয়ে বলল,

‘ আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? হাত ছাড়ুন। ছাড়ছেন না কেন!  আপনি ছেলেধরা! আমি আমার আপার কাছে যাবো। ছাড়েন আমাকে নয়তো মানুষ ডাকবো।’

প্রিয়’র অনবরত বকবকানিতে বিরক্ত হলো ছেলেটা। থেমে গেল।  রেগে পিছন ফিরে জোরে চিৎকার করে বলল,

‘ আর একটা কথা বললে  সত্যি সত্যি মে*রে নদীতে ফেলে দিবো।’

ছেলেটার রাম ধমকে প্রিয় চুপ করলেও। থামলো না চোখের জল। মেলার গেটের সামনে বড় আপাকে দেখে সাহস পেল। ঝারি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে  ছুটে গেল। আপাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল প্রিয়। কিছু বললো না। বাড়ি পৌঁছানো অবধি সারা রাস্তা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদল। 

বাড়ি ফিরে খালার ভয়*ঙ্কর বকুনি শুনলো। সেই সাথে এটাও জানলো তাদের খুঁজে আনতে খালাই ছেলেটাকে পাঠিয়েছিল। ছেলেটার নাম শতাব্দ। 

সেই রাতে প্রিয়’র প্রচন্ড জ্বর হলো। কোনভাবেই  এক’শ দুই’র নিচে নামছিল না। পুরো তিন দিন টানা জ্বর ছিল। চারদিনের দিন জ্বর একটু কমতে গাড়ি ভাড়া করে খালা তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দিলো। এরপর কোনদিন আর ইমান্দিপুরে আসেনি। সেদিন দোকানী নোংরা ভাবে গাঁয়ে ছোঁয়ার ব্যপারটা ধরতে না পারলেও, পরে প্রিয় ঠিক বুঝেছিল। শতাব্দের রেগে যাওয়ার কারণটাও ধরতে পেরেছিল। কিন্তু প্রথম দেখাতেই তার উপর ওইদিন ওইভাবে ক্ষেপে যাওয়া, অধিকার খাটিয়ে ধমকানোর ব্যাপারটা আজো মাথায় ডুকেনি  প্রিয়’র।

শতাব্দের ডাকে ছিটকে উঠল প্রিয়। শতাব্দ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘ আর ইউ অলরাইট?’

কানের পিছনে চুল গুছাতে গুছাতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল প্রিয়। 

‘ এতক্ষণ ধরে ডাকছি উত্তর দিচ্ছো না কেন!’

‘জি?’

‘ বুঝেছ?’

শতাব্দের দিক থম মেরে চেয়ে রইল প্রিয়।অঙ্ক কি বুঝবে তার ধ্যান তো অন্যকোথাও ছিল। আবার জিজ্ঞেস করল শতাব্দ,

‘ বুঝেছ?’

প্রিয় চুপ। মলিন মুখ।ফোঁস করে বিরক্তির শ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল শতাব্দ। কপালে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল,

‘ অন্যসবার সামনে ননস্টপ বকবক করো। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে মুখে কুলুপ এঁটো। কেন? আমার সামনে কথা বলতে সমস্যাটা কোথায়?’

‘ আমার আপনাকে পছন্দ না।’

আচমকা বলে উঠল প্রিয়। যেন উত্তরটা আগে থেকেই তার তৈরি ছিল। পিনপতন নীরব পরিবেশ। সরু দৃষ্টিতে গম্ভীর হয়ে দেখছে শতাব্দ। হাতের তালুতে নখ দিয়ে খুঁ*টাখুঁটি  করছে প্রিয়। দেখতে শান্ত দেখালেও মেয়েটা ভিতর থেকে বড্ড অশান্ত। একবারের জন্যও শতাব্দের দিক তাকাচ্ছেনা। ঝুঁকে থাকা আঁখিপল্লব অস্থির হয়ে অনবরত বিচরণ করছে এদিক সেদিক। কাঠের চেয়ারটা আরেকটু সামনে টেনে আনলো শতাব্দ। প্রিয়’র মুখোমুখি বসলো। গম্ভীর চোখমুখ। রাশভারি আওয়াজ করে বলল,

‘ আমার দিকে তাকাও প্রিয়।’

চোখ তুলে একবার তাকালো প্রিয়। অদ্ভুত অনুভূতিতে মোচড় দিলো বুক। নিশ্বাসের গতি বাড়ল। ভয়ে ছোট ঢোক গিলে, সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো প্রিয়।

 আগের মতই গম্ভির শতাব্দ। মিনিট দু’এক চুপ থেকে বলল,

‘লিসেন, প্রিয়! আমাকে তোমার পছন্দ হওয়া না হওয়া ডাজেন্ট ম্যাটার। ম্যাটার ইজ আমাকে সহ্য করতে হবে তোমার। তুমি করতে বাধ্য!’

‘ আপনার কাছে পড়বোনা আমি।’

নিচের দিক তাকিয়েই প্রিয় মিনমিনিয়ে বলল। ঠোঁট বাকিয়ে তীর্যক হাসলো শতাব্দ। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ তোমার কথায় আমি আসিনি।’

‘ অস্বস্তি হয় আমার’

‘ হোক। এই অস্বস্তিকে আজীবন বইতে হবে তোমার।’

‘ মানে? আজীবন..

কথা কা*টল শতাব্দ। শক্ত গলায় বলল,

‘ বইয়ে মনযোগী হও।’

প্রিয় চোখমুখ কুঁচকে নিলো। ফিসফিস করে কিছু একটা বলতে বলতে বইয়ের পাতা উল্টালো।

 

প্রিয়’র পরিক্ষা চলছে আজ দুইদিন। হল থেকে বেরিয়ে মাঠের দিক তাকালো। বড় বটগাছটার ছায়া তলে জুবাইদাকে বসে থাকতে দেখল। আগে শুধু তানহার সাথে বন্ধুত্ব থাকলেও এখন জুবাইদার সাথেও বেশ ভালো সখ্যতা হয়েছে প্রিয়’র। জুবাইদাকে ক্লাসে দেখলেও কখনোও কথা হয়নি তাদের। হ্ঠাৎ একদিন জুবাইদা তার পাশে এসে বসলো। নিজে থেকে প্রিয়’র সাথে কথা বলতে লাগলো । সেই থেকে আস্তে আস্তে তাদের বন্ধুত্বটাও হয়ে গেল। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় এখন রোজ এক সাথে রিকশায় করে স্কুলে আসাযাওয়া করে দুজন। 

ক্লান্ত ভঙ্গিতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বটগাছ তলায় গিয়ে বসল প্রিয়। এদিক সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ তানহা কোথায়?’

‘ ভাইকে দেখে, বানরের মত নাচতে নাচতে তার পিছনে গেছে।’ 

হাসতে হাসতে উত্তর দিলো জুবাইদা।তারপর আবার প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ পরিক্ষা কেমন হলো?’

‘ ভালো, তোর?’

‘ খুব ভালো। শুননা প্রিয় তোর সাথে কথা ছিল।’

‘ শুনছি বল।’

‘ গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাদের বাগান বাড়িতে পিকনিকের আয়োজন করবে। সবাই যাবে। তুইও চল আমাদের সাথে।’

‘ এই কাঠফাটা গরমে পিকনিক! ফ্রাই হয়ে যাবো ভাই। আর তাছাড়া তোদের ফ্যামিলি পিকনিকে আমি গিয়ে কি করবো।’

‘সবসময় শীতেকালেই  হয়। কিন্তু এই ডিসেম্বরে চাচার নির্বাচন। ব্যস্ত থাকবে সবাই। তাই গ্রীষ্মের ছুটিতে করবে এবার। ঢাকা থেকে ফুপুরাও আসবে। বড়রা কেউ যাবেনা। আমরা চাচাতো ফুফাতো ভাইবোনেরা শুধু। বাস ভাড়া করা হয়েছে।’

প্রিয়’র চোখ কপালে। অবাক ভীষণ। আশ্চর্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ বাস! তোরা চাচাতো ফুফাতো এতজন ভাইবোন?’

জুবাইদা হাতে গুনে উত্তর দিলো,

‘  চার চাচার নয় ছেলে মেয়ে। ছয় ভাই তিন বোন আমরা। তিন ফুফু’র নয় ছেলে মেয়ে। মোট আঠারো জন। বেশ বড় পরিবার আমাদের।’

জুবাইদার কথায় গোল গোল চোখ করে হতভম্ব চেয়ে রইল প্রিয়। বিস্মিত স্বরে বলল,

‘ আঠারো জন?’

প্রিয়’র বিস্মিত মুখখানা উপেক্ষা করে। প্রিয়’র হাত টেনে জুবাইদা আবদার করল আবার,

‘ চল না। টুরিস্ট বাস নিয়েছে। এসিও আছে। গরম লাগবেনা। চল না প্রিয়।’

জুবাইদার বাচ্চামো ভারী আহ্লাদী মুখ দেখে। প্রিয়’র মন একটু নরম হলো। কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল, 

‘ তোর শতাব্দ ভাইও কি যাবে?’

‘ হ্যাঁ। ভাইয়াই তো সব আয়োজন করছে।’

জুবাইদা সরল মনে উত্তর দিলো। প্রিয় শ্বাস টেনে বলল,

‘ যা’ও যাওয়ার কথা ভাবতাম। এখন তো যাবোই না!’

‘ কেন প্রিয়! আমার ভাইদের সাথে তোর সমস্যাটা কোথায়? চল না। তোর জায়গায় তানহা হলে কোনদিনও না করত না। ঠিক যেত।’

‘ তাহলে তানহাকে নিয়েই যা।’

‘পাগল হয়েছিস?  এই ট্রিপের কথা ওকে একদম জানানো যাবেনা। ভাইয়ার নিষেধ। জানালে ঠ্যাং ভাঙ্গবে আমার।’

‘ কেন? সে না খুব ভালোবাসে তানহাকে। সাথে নিয়ে যেতে সমস্যা কোথায়।’

‘ ভালোবাসে ঠিক আছে। কিন্তু সেখানে আমাদের ফুফাতো ভাই বোনেরাও থাকবে। কিছু আঁচ পেলে বাড়িতে এসে আগুন লাগাবে।’

‘ যদি পরিবারের সামনে ভালোবাসার মানুষকে নাই আনতে পারে তাহলে প্রেম করছে কেন?’

‘ সময় আসলে ঠিক আনবে। এখন ছোট না?’

‘ কে ছোট? তোর ভাই?’

জুবাইদা বিরক্তির কন্ঠে বলল,

‘ হ্যাঁ’

ফিক করে হেসে উঠল প্রিয়

‘ এই দামড়া ছেলে ছোট?’

বলেই আবার হাসতে লাগল। প্রিয়কে তার ভাইকে নিয়ে উপহাস করতে দেখে সামান্য রেগে গেল জুবাইদা।বিরক্তি মুখ করে বলল,

‘ গরুর মত হাসবি না প্রিয়।দাঁত দেখানো বন্ধ কর। দেরি হচ্ছে বাড়ি যাবি না?’

জুবাইদার কথায় ধ্যান ফিরল প্রিয়’র। হাত ঘড়ির দিক তাকালো। দুইটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। এত সময় চলে গেল কখন! চারটায় পড়াতে আসবে শতাব্দ। ঝটপট স্কুল থেকে বেরিয়ে রিকশা খুঁজে বাড়ির দিক রওনা হলো দুজন। বাড়ির সামনে এসে, প্রিয় হাত ধরে জুবাইদা কাঁদোকাঁদো আহ্লাদী মুখ করে আবারো বলল,

‘ চল না। ফুফাতো বোনদের সাথে জমে না আমার। তুই গেলে খুব ভালো হয় প্রিয়। প্রিয়… প্রিয়’রে…’

প্রিয় বিরক্তি কন্ঠে বলল,

‘ ডং করে লাভ হবে না জুবু। গোলছিনা আমি। তোর ফ্যামিলি পিকনিক তুই যা।’

 

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির)

 

৬.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

জুবাইদাদের ফ্যামিলি পিকনিকে যাবেনা বলেও শেষমেশ প্রিয়’কে যেতে হলো। গত পরশু পরিক্ষা শেষে জুবাইদা সরাসরি বাড়ি এসেছে। অনেক বুঝিয়ে পড়িয়ে খালাকে রাজি করেছে সে। খালার কথার উপর কোন কথা বলতে পারেনি প্রিয়।চুপচাপ মাথা দুলিয়েছে শুধু। 

বাড়ির সামনে রাস্তাটার কাছে বাস থেমে। নিচ থেকে গলা উঁচিয়ে প্রিয়’কে তাড়া দিচ্ছে জুবাইদা। বারান্দার ফটক দিয়ে মাথা বের করে জবাব দিলো প্রিয়,

‘ দুই মিনিট! আসছি।’

ধুপধাপ সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামলো প্রিয়। খালা সকালে বেরিয়েছে, টিউশনি শেষে বিকেল ফিরবে। সদর দরজায় তালা ঝুলিয়ে ঝরণা আন্টিদের বাড়ি চাবি রেখে গেল। কয়েক কদম আগাতেই জুবাইদাকে দেখলো। বাসের সামনে দাঁড়িয়ে। প্রিয়’কে দেখেই হাত উঁচিয়ে দ্রুত যাওয়ার ইঙ্গিত দিলো। মুখোমুখি হতেই প্রিয়’কে দেখে জুবাইদার চোখ কপালে। সবসময় প্রিয়’কে জিন্স, টপ, শর্ট কুর্তি এসব পড়তে দেখেছে। এই প্রথম সেলোয়ার-কামিজে দেখছে। খোলা চুল। পড়নে ডার্ক রেট সেলোয়ার-কামিজ। চোখে গাঢ় করে কাজল লেপ্টে রেখেছে। ঠোঁটে গোলাপি রঙ্গের আলতো ছোঁয়া কি দারুণ লাগছে মেয়েটাকে। 

জুবাইদাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ এভাবে তাকাবিনা। আমার অস্বস্তি লাগে।’

‘ তোর অস্বস্তিকে ঝেরে ফেল। আমি ছাড়াও এভাবে আরো অনেকে তাকাবে এখন। জানিস কত সুন্দর লাগছে তোকে! সবসময় এভাবে ড্রেসআপ করিস না কেন ? ভাগ্যিস করিস না। নরমালি ওই জিন্স কুর্তিতে দেখে পাড়ার কত ছেলেরা প্রেমের জন্য ঘুরঘুর করে। যদি এই সেলোয়ার-কামিজে একবার  দেখে। মাই গড! প্রেমের জলে হাবুডুবু খেয়ে রোজ তোর বাড়ির সামনে এসে আত্মহ*ত্যা করবে! ‘

জুবাইদা অনবরত বলে যাচ্ছে। চোখ রাঙ্গালো প্রিয়। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বলল,

‘ বাজে বকবকানি বন্ধ করবি? আমি কিন্তু বাড়ি গিয়ে চেঞ্জ করে আসবো! ‘

মুখ কাচুমাচু করে নিলো জুবাইদা। মিনমিন করে বলল,

‘ ভালোমানুষের দিন আর রইল না। আজকাল মানুষের প্রশংসাও হজম হয়না।’

ফিক করে হেসে ফেলল প্রিয়। এমন সময় সমুদ্র ভাইয়ের আওয়াজ পেল। গাড়িতে উঠতে ডাকছে। জুবাইদা প্রিয়’র হাত টেনে বড় বড় পা ফেলতে ফেলতে বলল,

‘ প্রিয়! তাড়াতাড়ি চল। সামনের সিট দখল করতে হবে। নয়তো রাক্ষসী গুলা দখল করে নিবে।’

গাড়িতে চড়তে গিয়ে কপাল কুঁচকে কিছুটা একটা ভাবলো প্রিয়, বোকাসোকা মুখ করে জিজ্ঞেস করল,

‘ রাক্ষসী গুলা আবার কে?’

জুবাইদা পিছন ফিরে প্রিয়’র কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ আমার ফুফাতো বোনেরা।’

 

সমুদ্র আগে থেকেই তাদের জন্য সামনে সিট রেখে দিয়েছে। প্রিয়’রা উঠতেই সিট ছেড়ে বসতে দিলো। ঝটপট করে জানালার পাশের সিটটায় জুবাইদা বসলো। দাঁত বের করে বলল,

‘ প্রকৃতি দেখতে আমার ভালো লাগে। প্লিজ আমি এখন এখানে বসি? ফেরার পথে তুই বসিস। কেমন?’

জুবাইদাকে এমন দাঁত বের করে আকুতি করতে দেখে হেসে ফেলল প্রিয়। মুচকি হেসে মাথা দুলাতে দুলাতে পাশের সিটে বসলো। আড়চোখে আশেপাশে তাকাল। শতাব্দ নেই কোথাও। কৌতূহল জাগলো। জুবাইদাকে জিজ্ঞেস করল,

‘ তোর শতাব্দ ভাই যাবেনা?’

‘ এদিকের কাজ চাপিয়ে দুইদিন আগেই ভাইয়া চলে গেছে। ওইদিকের আয়োজনও তো দেখতে হবে তাকে।’

প্রিয় মনে মনে খুশি হলো। যাক গাড়িতে অন্তত উনার মুখোমুখি হয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হবেনা তার। বুক ফুলিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে যেই গেটের কাছে তাকালো অমনি তার মুখ চুপসে গেল। শাদ নামের সেই বিচ্ছু ছেলেটা। তবে এই ছেলেটাও কি চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে! সারা রাস্তা এই বাঁদরটাকে তার সহ্য করতে হবে? ভেবেই চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এলো প্রিয়’র। সবাই উঠতেই গাড়ি রওনা হলো।

 

পুরো চার ঘন্টা বাস জার্নি করে কমলাপুর পৌছালো তারা। গ্রামে প্রবেশ করতেই প্রিয়’র চোখের ক্লান্তি ভাবটা যেন নিমিষেই  মিশে গেল। মন ভরে এলো মুগ্ধতার ছোঁয়ায়। সবুজের মাঝে সিমসাম ছোট্ট একটি গ্রাম। চারদিকে বড় বড় গাছ। দুইপাশে সবুজের ঢেউ, মাঝ বরাবর ইট গাঁথা পাকারাস্তা। বিমুগ্ধ হয়ে প্রকৃতিতে ডুবে আছে প্রিয়। যেন এটা সবুজের দুনিয়া কোন। কিছুদূর এগিয়ে বড় প্রাচীরের সামনে বাস থামলো। গেটের সামনে থেকে মোটা কালো করে একজন ছুটে এলো। গদগদ কন্ঠে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করল,

‘ কোন অসুবিধা হয় নাইতো বাজান?’

সমুদ্র আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে মাথা নাড়াল। সমুদ্রের ব্যাগ তুলে পিছন পিছন হাঁটছে লোকটা। আশেপাশের কথা বলছে টুকটাক। সমুদ্র শুনছে। মাঝেমধ্যে হু, হা মাথা দোলাচ্ছ। গেটের কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করল সমুদ্র, 

‘ ভাই কই?’

‘ বড় বাজানে তো উপরে।’

‘ দোতলায়?’

‘ হ,  মনে হয় রাইগা আছে। কারে জানি ফোনে বকাবকি করল তারপর ফ্রেশ হইতে উপরে গেল।

 ঢোক গিলল সমুদ্র। ফোনে তার উপরই রাগ ঝারছিল শতাব্দ। এখানে এসে পৌছানোর কথা ছিল এগারোটায়। এখন বাজছে একটা। শতাব্দ কড়া ভাবে বলে দিয়েছিল ঠিক সাতটায় রওনা হতে। কিন্তু তারা রওনা হয়েছে আটটার অনেক পড়ে। যদিও বাড়ির মেয়েদের জন্য দেরি হয়েছে। কিন্তু শতাব্দ কি তা মানবে?  সামনে পড়লেই খুব ঝারবে। ভুলেও সে দোতলার দিক পা বাড়াবেনা আজ। না শতাব্দের সামনে যাবে।

গাড়ি থেকে এক এক করে সবাই নামছে। প্রিয় নেমে জুবাইদার পাশে দাঁড়াল। জুবাইদা ছাড়া আশেপাশে সবাই তার অচেনা। পাশাপাশি কাচুমাচু হয়ে হাঁটছে। গেটে প্রবেশ করতেই প্রিয় বড়সড় ধাক্কা খেল। বাহির থেকে প্রাচীরের উপর ভেসে থাকা বাড়ির মাথাটুকু দেখে ভেবেছিল হয়তো ছোটখাটো কোন বাগান বাড়ি। কিন্তু ভিতরে এসে তার ধারণা পুরোপুরি পাল্টে গেল। সবুজে ডুবে থাকা বিশাল মাঠ। পাশেই  বড় ধবধবে সাদা দোতালা দালান।দুইদিক দিয়ে সিড়ি উঠা বাড়িটা দেখতে অনেকটা পুরানো জমিদার বাড়ির মত। 

বাড়ির ভিতরে এসে আরেক দফা ধাক্কা খেল প্রিয়। বাড়ির বাহিরে যতটা সুন্দর ভিতরেও ঠিক ততটাই মনোরম। কাঠ বেতের ফার্নিচারে সাজানো হল ঘর। যিনি সাজিয়েছেন তার রুচির প্রশংসা করতে হবে। ভীষণ নৈপুণ্যভাবে সাজিয়েছে। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখছে প্রিয়। দুজন মহিলাতে যেয়ে চোখ আটকালো। গ্রাম্য শাড়ি সাজসজ্জায় সবাইকে জলখাবার দিতে ব্যস্ত।

প্রিয় জুবাইদা এক কোনায় গিয়ে বসলো। সামনের টেবিল ভিন্নরকম গ্রাম্য পিঠা খাবারে সাজানো। এত এত জানা, নাম না জানা খাবার ঘ্রাণে প্রিয়’র খুদা বেড়ে গেল। সকাল সকাল না খেয়ে বেরিয়েছে। এতটা পথ জার্নি করে পেটের খুদাটাও বেশ বেড়েছে। ভদ্রতার খাতিরে হাতপা খিঁচে বসে আছে শুধু। কেউ জিজ্ঞেস করলেই খাওয়ায় লেগে পড়বে এখনি। পাশ থেকে জুবাইদার ফুফাতো বোনেদের চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এলো। লেবু গুড়ের শরবত দেখে নাক ছিটকাচ্ছে। সমানে রাখা খাবার গুলোকে আনহাইজেনিং বলে মহিকাদের উপর রাগ ঝারছে।এক্ষুণি বাহির থেকে নতুন খাবার আনাতে বলছে। প্রিয় ভ্রু কুঁচকে দেখছে তাদের। প্রথমে জুবাইদার কথা বিশ্বাস না করলেও, এখন বুঝতে পারছে। সত্যি মেয়ে গুলো বড্ড অহংকারী! ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে সারা রাস্তা গাড়িতে বেশ ঝামেলা করেছে। সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তাদের মুখ ছিটকান দেখে সমুদ্র বেশ কড়া গলায় বলল,

‘ সবাই সমান। তোদেরকে এখানে আলাদাভাবে ট্রিট করা হবেনা। এগুলো খেতে পারলে খা। নাহলে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত না খেয়েই থাক। ‘   

সমুদ্রের কথা শুনে মেয়ে দুটো চোখমুখ কালো করে নিলো। সবাইকে রুম দেখিয়ে দিলো। নিচতলার ঘর গুলো সব দখল। তাই জুবাইদা প্রিয়কে নিয়ে  উপরে চলে গেল। সেখানকার সব ঘর খালি আর নিরিবিলি। আরামে থাকবে তারা। অর্ধেক সিড়ি উঠেই জুবাইদার গাড়িতে ফেলে আসা ব্যাগের কথা মনে পড়ল। প্রিয়কে রুমে যেতে বলে ব্যাগ আনতে চলে গেল। 

 

দরজা খোলা দেখে, সামনের ঘরটায় যেয়ে ডুকল প্রিয়। আবছা দুয়ার ভিড়িয়ে। টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল । এত পথ জার্নি করে গা ম্যাচ ম্যাচ করছে প্রচন্ড। ঘরের সব দরজা জানলা খোলা। দক্ষিণা দমকা হাওয়া সুড়সুড়ে গায়ে এসে পড়ছে। শরীরের থেকে মন অবধি শীতল পরশ দিয়ে যাচ্ছে। আবেশে চোখ বুজে নিলো প্রিয়। এখানে শান্ত পরিবেশটা বেশ ভালো লাগছে। চেঁচামেচি কোলাহল শূন্য শান্ত পরিবেশ। 

আচমকা কোথা থেকে যেন মুখের উপর দুএক ফোঁটা পানির ছিটে পড়ল। চোখ খুলে হতভম্ব প্রিয়। মাথার উপর ঝুঁকে আছে শতাব্দ। খালি গায়ে ভেজা চুলে কপাল ল্যাপ্টানো। তার সরু দৃষ্টিখানা গভীর গম্ভীরভাবে প্রিয়’র দিকেই চেয়ে। ছোট ঢোক গিলল প্রিয়। সবটা এখনো তার চোখের ভুল মনে হচ্ছে যেন। দুইতিনবার অনবরত চোখ বুজলো আর খুলল। উহু, পরিবর্তন হলো না কোন। শতাব্দ আগের মতই গম্ভীর হয়ে চেয়ে। হুস ফিরল প্রিয়’র। ধরফরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হাত পা কাঁপছে তার। শতাব্দকে খালি গায়ে দেখে লজ্জা লাগছে ভীষণ। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। আধো আধো গলায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘ স..সরি। জুবাইদা দরজা খোলা ঘরটায় যেতে বলেছিল। তাই এখানে…  এটা আপনার ঘর জানতাম না। জানলে কখনো আসতাম না।আপ..’

‘ হুসস’

প্রিয়’র ঠোঁটে আঙ্গুল রাখল শতাব্দ। বিস্মিত হতভম্ব প্রিয় দৃষ্টি তুলে তাকাল। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতাব্দ। দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক মায়া। অজানা কোন ঘোর।ধুকপুক করছে প্রিয়’র বুক। নিশ্বাসের দ্রুত উঠানামা। এলোমেলো দক্ষিণা হাওয়ায় উড়ছে প্রিয়’র অবাধ্য কেশ। চোখমুখে ছেয়ে এক অন্যরকম আবেশ। হাত বাড়ালো শতাব্দ। মুখে পড়ন্ত অবাধ্য কেশ গুলো  আলতো করে কানে গুজে দিলো। ঠকঠক কাঁপছে প্রিয়। গাঁ জুড়ে বইছে শীতল রেশ। আরেকটু ঝুঁকল শতাব্দ। প্রিয়’র থুতনি ছুঁয়ে আলতো করে মুখ তুলল। গভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমি কিছু বলেছি?’

দুদিকে মাথা দুলাল প্রিয়।

‘ ভয় পাচ্ছো কেন?’

জিজ্ঞেস করল শতাব্দ। প্রিয়  চুপ। শতাব্দের কথা কানে ঢুকছে না তার। ধ্যান অন্যকোথাও। বাম হাতটা তখনো শতাব্দের হাতের মুঠোয়। অদৃশ্য এক মায়া জালে জড়িয়ে গেছে সে। দৃষ্টি থেমে আছে শতাব্দের অদ্ভুত সুন্দর সেই চোখজোড়ায়। ঘরের নকশি ফটক উপচে আসা সোনালী রোদ এসে পড়ছে শতাব্দের মুখে। কি মায়া, কি ঘোর সেই চোখেতে। আচ্ছা, পৃথিবীটা কি থেমে গেল! এমন মনে হচ্ছে কেন প্রিয়’র? কেন দৃষ্টি সরছে না শতাব্দ থেকে। খানিক পূর্বের তো লজ্জা লাগছিল। সেই লজ্জাটা কোথায় মিয়িয়ে গেল? এ কেমন অদ্ভুত টান। জুবাইদার চেঁচামেচির আওয়াজে প্রিয়’র হুস ফিরল। তাড়াতাড়ি করে হাত ছাড়িয়ে যেতে নিলো। হাত টেনে ধরল শতাব্দ। পিছন ফিরিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ঝুঁকে পড়ল। প্রিয়’র চোখে চোখ রেখে গভীর কন্ঠে বলল,

‘ শুনো মেয়ে! এমন ডার্ক কালার পড়ে, চোখে কাজল লেপ্টে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে  আমার সামনে আসবেনা আর।’

‘ কেন?’ বিবশ প্রিয়, যন্ত্রের মত করে জিজ্ঞেস করল।

‘ মাথা ঝিমঝিম করে, নিশ্বাসের গতি বাড়ে। তখন উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে গেলে কিন্তু দায়ভার থাকবেনা আমার!’

প্রিয় হকচকিয়ে উঠল। কথার গভীরতা না বুঝলেও দৃষ্টির গভীরতা ঠিক বুঝল। কিঞ্চিৎ ভয় হলো মনে। হাত ছাড়ানো জন্য ছটফট করতে লাগল। হাতের বাঁধন সামান্য হালকা হতেই ঘর ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। প্রিয়’র যাওয়ার দিক তাকিয়ে আছে শতাব্দ। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশ।

 

এখান থেকে মাঠের শেষ মাথা দেখতে পারছেনা প্রিয়। পুরোটা জায়গা আলাদা আলাদা করে বিভক্ত। এক এক পাশে এক এক রকম করে সাজানো। কোথাও ফল ফুলের গাছ, কোথাও আবার বিচিত্র নানা রকমের দেশবিদেশি পশুপাখির খামার। শুনেছে নিচের দিকে পুকুর আছে, মাছ চাষ হয় সেখানে। পুরোটা জায়গা ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। পার্ফেক্ট পিকনিক স্পট। এখানে সবকিছুই ভালো ছিল। শুধু চেয়ারম্যান বাড়ি সেই দুই ছেলে শতাব্দ আর শাদকে ছাড়া। শতাব্দ! যাকে দেখে খুব অদ্ভুত অনুভূতি, ভয় হয় প্রিয়’র। আর অন্যদিকে শাদ যার সাথে এক মিনিটের জন্যেও বনে না প্রিয়’র। এখানে এসে দুইতিনবার কথা কাটাকাটি হয়েছে দুজনের। 

বিকেলের পর পরই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। বৃষ্টি শুরু হলে অন্ধকারে গ্রাম থেকে বেরানো মুশকিল। সবাইকে তাড়া দিলো শতাব্দ। এখনি বের হতে হবে।

এতটা পথ জার্নি করতে হবে তাই ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছে সবাই। দোতলা অন্ধকার। সবাই নেমে এসেছে। নিচ তলার সব ওয়াশ রুম ভীড় দেখে, প্রিয় ফ্রেশ হতে বাড়ির পেছনের পুরানো ওয়াশরুমে চলে গেল। পাশেই কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। এখানটা নিরিবিলি।আসবেনা কেউ। আচমকা ওয়াশরুমের লাইটটা বন্ধ হয়ে গেল। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। বাহিরে কারো ছুটে যাওয়ার শব্দ পেল। আওয়াজ করল প্রিয়। উত্তর এলো না কোন।অন্ধকারে দেয়াল হাতিয়ে দরজা খোঁজার চেষ্টা করল। কিছুটা সামনে যেতেই পেয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে দরজার লক খুলে বের হতে চাইল প্রিয়। কিন্তু দেখল, দরজাটা অপরপাশ থেকে বন্ধ। প্রিয় দরজা ধাক্কালো। চিৎকার করে ডাকল।কিন্তু অপর পাশ থেকে উত্তর এলো না কোন। অন্ধকারে প্রিয় ভয় হচ্ছে খুব। মাথাটাও ভনভন করছে। ঝাপসা লাগছে সব। চোখের সামনে বারবার বড় আপার ঝু*লন্ত লা*শের দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। কানের কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ। মনে হচ্ছে কেউ গলা চেপে ধরে রেখেছে। নিশ্বাস নিতে ক*ষ্ট হচ্ছে তার। শরীরটাও অবশ হয়ে এলো। ধপ করে দরজার কাছে বসে পড়ল প্রিয়। নিশ্বাস থেমে থেমে আসছে। আস্তে আস্তে সব অচেতন হয়ে গেল…

 

চলবে………

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

 

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

ঝড়ো হাওয়া বইছে। অন্ধকার হয়ে আছে চারিপাশ। বৃষ্টির দুএক ফোঁটা ভুবন ছুঁইছে। বাসের সামনের সিটটায় গম্ভীর হয়ে বসে আছে শতাব্দ। চোখ বুজে কপালে আঙ্গুল বোলাচ্ছ। রাগ চাপানোর যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছুতেই হচ্ছেনা। জুবাইদা ছাড়া সবাই বাসে উঠেছে। জুবাইদাকে খুঁজতে সমুদ্রকে পাঠিয়েছে। এখন সমুদ্রও দেরি করছে। এদিকে সাতটা বাজতে চলছে। আকাশের অবস্থা খারাপ। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে হবে।খানিক বাদেই জুবাইদাকে নিয়ে সমুদ্র এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে দুইজন বাসে উঠল। শতাব্দকে রাগী গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে থাকতে দেখে। জুবাইদা সমুদ্রের পিছনে মুখ লুকাল। ভীতু কন্ঠে বলল,

‘ ভাই ওয়াশরুমে ছিলাম। ফ্রেশ দেরি হয়েছে।’

শতাব্দ আগের মতই চোখ বুজে। জুবাইদা উত্তরের অপেক্ষায় রইল। শতাব্দ প্রতিক্রিয়া করল না কোন। সমুদ্রের পিছন থেকে বেরিয়ে আশেপাশে চোখ বুলাল জুবাইদা। প্রিয়’কে খুঁজছে। কিন্তু দেখছে না কোথাও। আঁতকে উঠল জুবাইদা। চেঁচিয়ে বলল,

‘ প্রিয় কোথায় সমুদ্র ভাই?’

চট করে চোখ খুলল শতাব্দ। কপাল কুঁচকে পিছনে ফিরল। গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ তোর সাথেই তো ছিল।’

‘ আমার সাথে ছিল না ভাই।’

ধমকে উঠল শতাব্দ,

‘তোর সাথে ছিল না মানে?’

ভয়ে কেঁদে ফেলল জুবাইদা। বিরবির করে বলল,

‘ ভিতরে আমি একা ছিলাম। ও আগেই চলে এসেছিল।’

সমুদ্রের দিকে তাকাল শতাব্দ। চাহনির অর্থ বুঝল সমুদ্র। বলল,

‘ দোতলা নিচতলা সব জায়গায় দেখেছি ভাই। ভিতরে কেউ নাই ।’

আর একমুহূর্ত দেরি না করে, গাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়ল শতাব্দ। পিছন পিছন সমুদ্র জুবাইদা আরো অনেকে গেল। তন্নতন্ন করে পুরো বাড়ি খুঁজল, বাগান খুঁজল। ভেতরে কর্মরত সবাইকে জিজ্ঞেস করল। লাভ হলো না কোন। কোথাও মিলল না প্রিয়। চিন্তায় মাথা ধপধপ করছে শতাব্দের। শরীর কাঁপছে। মাঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলাল। কোথাও নাই প্রিয়।চুল গুলো পিছনে  টানল। ভীষণ ছন্নছাড়া লাগছে। হুট করে মেয়েটা কোথায় চলে গেল? 

সমুদ্র ভয়ে ভয়ে বলল,

‘ ভাই! ও আবার চলে যায়নি তো?’

ক্ষি*প্ত দৃষ্টিতে তাকাল শতাব্দ। সমুদ্র থতমত খেয়ে গেল। আমতাআমতা করে বলল,

‘ না বলছিলাম কি! গাড়ি খুঁজতে গিয়ে যদি গ্রামে ঢুকে যায় আবার!’

জুবাইদা বিরক্ত হলো। কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বলল,

‘ গাড়ি ভিতরে ছিল ও বাহিরে খুঁজতে যাবে কেন?’

সব কিছু বিরক্ত লাগছে শতাব্দের। মাথা চেপে পাশের বেঞ্চটায় বসে পড়ল। মস্তিষ্ক কাজ করছেনা কোন। আচমকা শাদের দিক শতাব্দের চোখ পড়ল। কাচুমাচু হয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে অদ্ভুত ভয়। শতাব্দের খটকা লাগল। শাদকে কাছে ডেকে, ভনিতা বিহীন শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘ প্রিয় কোথায় শাদ।’

আঁ*তকে উঠল শাদ। ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘ আমি জা..জানিনা ভাইজান।’ 

শতাব্দের ক্*ষিপ্ত চাহনিটা আরো গভীর হলো। ক্রো*ধে হাত পা কাঁপছে। চোখ বুজে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল আবার,

‘ আমি জানতে চেয়েছি প্রিয় কোথায়?’

‘ ভাই’

‘ কোথায় প্রিয়?’ ক্ষি*প্ত কন্ঠে গ*র্জিয়ে উঠল শতাব্দ।

গর্জনে কেঁপে উঠল শাদ সহ বাকি সবাই। ভয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল শাদ,

‘ বাড়ির পেছনের ওয়াশরুমে’

মুহূর্তে বাড়ির পেছন দিকে ছুটে গেল শতাব্দ। ওয়াশরুমের দরজা খুলে আলো জ্বালাতেই হতভম্ব হয়ে রইল। ফ্লোরে পড়ে আছে অচেতন প্রিয়। পাশের দেয়ালে র*ক্তের সামান্য ছাপ। কপাল কেটেছে। তাড়াতাড়ি করে প্রিয়’কে কোলে তুলে নিলো শতাব্দ।দ্রুত ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। জুবাইদা পানি নিয়ে এসে শতাব্দের দিক বাড়িয়ে দিলো। পানির গ্লাসটা ধরতে পারছেনা শতাব্দ।হাত কাঁপছে। চোখমুখ ভীষণরকম অশান্ত অস্থির। কোনরকম পানির ছিটা দিয়ে প্রিয়’কে ডাকলো। অচেতন প্রিয় আলতো চোখ খুলল। বিরবিরিয়ে কিছু বলল তারপর আবার চোখ বন্ধ করে নিলো। ড্রেসিং করে কপালে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো শতাব্দ। হল ঘরে অপেক্ষা করছে সবাই। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন্টা খানেক প্রিয়’র পাশে বসে পুরোপুরি জ্ঞান ফিরার অপেক্ষা করল শতাব্দ। প্রিয় অচেতন তখনো। খানিক বাদে একটু নড়েচড়ে উঠল। শতাব্দের দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। একটু স্বাভাবিক হতেই, বসতে চাইল প্রিয়।বাহু ধরে উঠে বসালো শতাব্দ। পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে পুরোটা পানি গিলে নিল। চোখে মুখে এখনো প্রচন্ড ভয়। অস্থির উত্তেজিত হয়ে বলল প্রিয়,

‘ বাড়ি যাবো। এক্ষুনি বাড়ি যাবো আমি।’

বলতে বলতেই বিছানা ছেড়ে নামল। শতাব্দ হাত ধরে আটকালো। বিছানায় বসিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। শান্ত হচ্ছে না প্রিয়। সে আগের মতই ভীত, উত্তেজিত। ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল শতাব্দ,

‘ তুমি ঠিক আছো?’

উপর নিচ মাথা ঝাকাল প্রিয়। আশেপাশে পাশে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ জুবাইদা কই?’

‘ আছে বাহিরে’

‘ আমি বাড়ি যাবো।’ নিথর গলায় আবারো বলল প্রিয়।

খানিক চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল শতাব্দ,

‘ যেতে পারবে?’

 হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। শতাব্দ বাড়ি ফিরার ব্যবস্থা করল। বৃষ্টি কমতে গাড়ি উঠল সবাই। 

শহর আর ইন্দিরাপুরের মাঝামাঝি হাইওয়ের কাছাকাছি হসপিটালটার সামনে বাস থামল। এতরাতে নিঝুম রাস্তায় গাড়ি থামায় কিছুটা অবাক হলো সবাই।

 জুবাইদার ঘাড়ে মাথা এলিয়ে  ঘুমে মগ্ন প্রিয়। আলতো স্বরে কেউ ডাকলো। ভয়ে ছিটকে উঠল প্রিয়। কপাল কুঁচকে সামনে তাকাল। শতাব্দকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।

‘ আমাদের নামতে হবে।’

প্রিয় আশেপাশে তাকালো। গাড়ি হাইওয়েতে থেমে। এখানে কোথায় নামবে? কিছু বুঝে উঠার আগেই শতাব্দ আলতো করে প্রিয়’র হাত টেনে ধরল। সামনের দিক পা বাড়াল। ঘুম থেকে সদ্য জেগে উঠা প্রিয় এসব দেখে হতভম্ব। মন্ত্রমুগ্ধের মত শতাব্দের পিছুপিছু গেল। গাড়ি থেকে নামার সময় শতাব্দ আদেশ স্বরে সমুদ্রকে বলে গেল ‘ সবাইকে ঠিকঠাক নামিয়ে আব্বার গাড়ি নিয়ে এখানে আসবি। আর হ্যাঁ গাড়ি যেন ড্রাইভারই চালায়।’

শেষ কথাটা বেশ শাসিয়েই বলল শতাব্দ। বাধ্য ছেলের মত মাথা ঝাকাল সমুদ্র।

 

চেকআপ শেষে ওয়েটিং রুমের বসে আছে প্রিয়। ঔষধ কিনতে বাহিরে গেছে শতাব্দ। অনেক নিষেধের পরও শুনেনি  সে। জোর করে ডাক্তার দেখিয়ে প্রিয়’কে এখানে বসিয়ে রেখে গেছে। চোখ বুজে কপালে হাত বোলাচ্ছ প্রিয়। অন্ধকারে দেয়ালের ভাঙ্গা ইট লেগে অনেকটাই কেটে গেছে। মাথায় সামান্য আঘাত লেগেছে। প্রচন্ড ব্যথা করছে। 

‘ খুব ব্যথা করছে?’

শতাব্দের ডাকে ঘোর কাটল প্রিয়’র। চোখটা লেগে এসেছিল। নড়েচড়ে বসল। আড়চোখে তাকালো। ঔষধ নিয়ে ফিরে এসেছে শতাব্দ। ক্লান্ত চোখমুখ। বৃষ্টি’র পানিতে গা ভিজে।চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে।

‘ ভিজে গেছেন, ঠান্ডা লাগবে আপনার।’

প্রিয়’র কন্ঠে কিঞ্চিত চিন্তার আবাশ। ফ্যানের নিচে বসল শতাব্দ। ঘাড় থেকে শার্টের কলারটা ছাড়িয়ে পিছন দিকে হেলিয়ে দিলো। বলল,

‘ লাগবেনা। ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে যাবে।’

‘ এসবের দরকার ছিল না কোন।’

উত্তর দিলো না শতাব্দ। ফোন টিপতে ব্যস্ত। খানিক চুপ থেকে  প্রিয় আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,  

‘ আমরা কখন বাড়ি ফিরবো। খালা চিন্তা করছে!’

‘ করছেনা। ফোনে কথা হয়েছে।’

‘ কখন যাবো আমরা?’

‘সমুদ্র গাড়ি নিয়ে আসছে। দশ মিনিট লাগবে।’

ফোনের স্কিনে চোখ রেখে উত্তর দিলো শতাব্দ। খানিক বাদেই সমুদ্র এসে পৌঁছাল। বৃষ্টির বেগ প্রচন্ড। গাড়ি থেকে নামল না আর সমুদ্র।তাড়াতাড়ি করে পিছনে গিয়ে বসলো প্রিয়। পাশেই শতাব্দ। ঝুম বৃষ্টি। অন্ধকার রাস্তা। ওড়না দিয়ে গাঁ ডেকে নিলো প্রিয়। হাতটাও গুটিয়ে ফেলল। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে তার। জ্বর আসছে কি? হয়তো। ঘুমঘুম চোখজোড়া লেগে আসছে বারবার। একটু ঘুমাবে কি? জানালার কাঁচে মাথা হেলিয়ে দিলো প্রিয়। মিনিট দু’একে ঘুমে তলিয়ে গেল। 

গাড়ির ঝাঁকুনিতে জানালার সাথে প্রিয়’র মাথা লাগছে বারবার। ঘুমের ঘোরেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। লক্ষ করল শতাব্দ। প্রিয়’কে কাছে টেনে। আলতো করে মাথাটা শতাব্দের কাধে রাখল। স্বস্তি পেল প্রিয়। কুঁচকে থাকা কপালটা মিয়িয়ে গেল। বেঘোরে আরো গভীর করে শতাব্দকে জড়িয়ে ধরল। আষ্টেপৃষ্টে মিশে, বুকে আলতো করে নাক ঘষল। শতাব্দ সোজা শক্ত হয়ে বসে রইল। বুকের কম্পন বেড়েছে কয়েকগুন। নিশ্বাসের উঠানামাটাও প্রচন্ড। প্রিয়’র গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ বারবার বেকাবু করছে তাকে। কাঁপা কাঁপা হাতটা প্রিয়’র মাথায় চলে গেল আচমকা। চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে। আলতো হাতে মাথা বুলিয়ে দিতে লাগল। জ্বরে তপ্ত প্রিয় বিরবির করে বলল,

‘ আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি আপা। আপা আমাকে নিয়ে যেওনা। আমার ভয়.. করে আপা। আপা।’

ধীরেধীরে বিরবির আওয়াজটা বাড়তে লাগল। উত্তেজিত হচ্ছে প্রিয়।শান্ত করার চেষ্টা করল শতাব্দ। বলল,

‘ শান্ত হও। কেউ নিবেনা তোমায়। আমি আছি।’ 

আবারো বিরবির করতে করতে শান্ত হলো প্রিয়। ঘুমে তলিয়ে গেল। প্রিয়’র ঘুমন্ত মুখপানে নিমিষ চেয়ে আছে শতাব্দ। কাজল লেপ্টানো চোখ, আতুর মুখ। এলোমেলো কেশ। জানালায় জমে থাকা বৃষ্টি কণার আড়াল হতে ল্যাম্পপোস্টের উপচে আসা মৃদু আলো পড়ছে মুখে। ক্লান্তির ছাপ তার রূপের মাধুর্য  ছাপাতে পারেনি একটুও। বরং বেড়েছে আরো। মুখশ্রী জুড়ে এক আদুরে ভাব। কপালে ভেসে থাকা ব্যান্ডেজটা  যেন চন্দ্রতে ফুটে থাকা আঁক। খুব করে জানতে চাইছে মন! ‘আকাশের চাঁদটা বেশি সুন্দর নাকি তার বুকে লুকিয়ে থাকা এই চাঁদটা?’

 

গলির মাথায় এসে নরম স্বরে ডাকল শতাব্দ। পিটপিট করে চোখ মেলল প্রিয়। শতাব্দকে দেখে তড়বড় করে উঠতে চাইল। পারল না। মাথা যন্ত্রণায় নেতিয়ে পড়ল। হাত ধরে গাড়ি থেকে নামাল শতাব্দ। কপালে হাত রেখে জ্বর মাপল। প্রচন্ড জ্বর।ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা প্রিয়। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল শতাব্দ’র। প্রিয়’র গালে হাত রেখে বুঝানোর স্বরে বলল,

‘ বাড়ি গিয়ে এক্ষুনি ঔষধ খেয়ে নিবে।’

জ্বরে মাথা কাজ করছেনা প্রিয়’র। না বুঝেই মাথা ঝাকাল। ততক্ষণে আয়েশা বেগমও চলে এসেছে। মোটা চাদরে জড়িয়ে নিলো প্রিয়’কে। কিছু জিজ্ঞেস করলেন না তিনি। শতাব্দ আগেই ফোনে সব বলেছে। 

‘ কিছু প্রয়োজন হলে ফোন করবেন।’

আয়েশা বেগম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। প্রিয়’কে নিয়ে উপরে চলে গেল। পিছন থেকে স্থির চেয়ে রইল শতাব্দ। বুকের অস্বস্তি অশান্তিটা যেন বাড়ল। শান্তি পাচ্ছেনা কোথাও। সেই রাতে আর ঘুম হলো না তার। বাড়ি ফিরল ভোর চারটায়। 

 

চলবে……….

 

ফিলোফোবিয়া

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির) 

 

৮.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

সেইরাতে পিকনিক থেকে ফিরে পরের দিন সকালেই প্রিয় ঢাকায় চলে গিয়েছিল। মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে জাফর সাহেব ভীষণ ঘাবড়ে যায়। ভোর সকালেই মেয়েকে নিতে চলে আসে ইমান্দিপুরে। পুরো ছুটি ঢাকায় কাটিয়ে গতবিকেলে ফিরেছে প্রিয়। গ্রীষ্মের ছুটি খুব একটা জমেনি তার। বাবা সারাক্ষণ হাসপাতালের কাজে ব্যস্ত ছিল। কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি এবার। 

আগামীকাল থেকে ক্লাস। বইপত্র গোছগাছ করছে প্রিয়। এমন সময়ই বাহির থেকে তানহার আওয়াজ ভেসে এলো। খালার সাথে কথা বলছে। প্রিয়’র ফেরার কথা শুনে সকাল সকালই চলে এসেছে। ছুটে এসে ঝাপটি মেরে জড়িয়ে ধরল। হেসে ফেলল প্রিয়। তানহাকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,

‘ এতো শক্ত করে কেউ জড়িয়ে ধরে। ম*রে যাবো তো ভাই।’  

তানহা ছাড়ল না আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদে গদগদ কন্ঠে বলতে লাগল,

‘ তোকে কতটা মিস করেছি জানিস? এতকিছু হয়ে গেল কিছু জানালি না। কি ভেবেছিস তোরা কেউ না বললে আমি কিছু জানতে পারবো না? ‘

প্রিয় না বুঝার মত করে বলল,’ কি জানানোর কথা বলছিস।’

‘ একদম না বুঝার ভান করবিনা প্রিয়। তোরা পিকনিকে গিয়েছিলি জানিনা আমি? আমি সব জানি। জুবাইদা না হয় কোন কারণে বলেনি। তাই বলে কি তুইও জানাবি না আমায়। আমি কি তোর এতটাই পর?’

শেষ কথা অভিমান জুড়েই বলল তানহা। 

‘ যাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা। জুবাইদার জোরাজোরিতে যেতে হয়েছে শেষমেশ। সরি’

‘ ইট’স ওকে।’

ঠোঁট উল্টে উত্তর দিলো তানহা। কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুই নাকি ওয়াশরুমে আটকা পড়ে গেছিলি। কপালে নাকি লেগেছে খুব। এই কা*টা দাগটা কি সেদিনকার?’

বলেই প্রিয়’র কপালের ভেসে থাকা শুকনো  দাগটার দিক হাত বাড়ালো তানহা। ছুঁয়ে দিয়ে আফসোস সুরে বলল,

‘ ইশ। কতক্ষাণী কেটেছে।’

‘ এত কিছু তুই জানলি কি করে? কে বলল তোকে’ জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল প্রিয়।

‘ কে আর বলবে। সে বলেছে। তোকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়িতে তো সেদিন এত রাত করে বাড়ি ফিরল। বৃষ্টিতে  ভিজে সর্দি জ্বর বাঁধালো।’

প্রিয়’র চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে এলো। তানহার কাছে শতাব্দের এভাবে এক্সকিউজ না দিলেও হতো!  প্রিয় তো বলেনি তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। দেরি করে বাড়ি ফিরতে। শতাব্দই তো  জোর করল। সেই রাতের স্মৃতি পুরোপুরি মনে না থাকলেও। আবছা আবছা মনে আছে প্রিয়’র। সেদিন শতাব্দের যত্ন করা, তাকে নিয়ে চিন্তা করা মনে গভীর দাগ টেনেছে তার। পূর্বের সব খারাপ লাগাগুলো অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভীষণ বাজেভাবে আ*ঘাত করল। তানহার কাছে এভাবে তুচ্ছ অসহায় না বানালেও পারত তাকে। কি প্রমাণ করল। সে ভীষণ দয়ালু? দানবীর! আচমকাই শতাব্দের উপর প্রচন্ড রাগ হলো প্রিয়’র। মনে খারাপ লাগার নতুন দানা বাঁধতে শুরু করল। কেন এমন হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছেনা সে। তানহার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গল। গম্ভীর মুখ করে বলল,

‘ আমি কি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলাম তাদের? তারা জোর করে নিয়ে গেল!’

‘ ওমা! ওদের একটা দায়িত্ব আছে না?  ফ্যামিলি পিকনিকে যেয়ে এমন এক্সিডেন্ট ঘটলো। ওরা সেটা দেখবেনা। আমি বুঝিনা বাপু ওর সাথে তোর সমস্যা কিসের। নাম শুনলেই এমন খ্যাঁক করে উঠিস কেন!’

নাকের ডগা লাল করে। ঝাঁঝাল গলায় উত্তর দিলো প্রিয়,

‘ বুঝতে হবেনা তোকে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পুরুষ তোর বয়ফ্রেন্ড।  কিন্তু আমার তাকে পছন্দ না। পছন্দ না মানে একদমই পছন্দ না।’

প্রিয়’কে রেগে যেতে দেখে তানহা চুপ থাকল। একটু সময় নিয়ে ডাকল,

‘ প্রিয়। শুন না! একটা কথা ছিল।’

প্রিয়’র রাগ তখনো কমেনি। দমেছে একটু। আড়চোখে তানহার দিক তাকালো। বেচারির মুখ চুপসে। কথাটা বলতে যেন ভয় পাচ্ছে সে। চোখ বুজে রাগ দমানোর চেষ্টা করল প্রিয়। বলল,

‘ বল। শুনছি।’

তানহা ভয়ে আমতা আমতা করে বলল,

‘ বলছিলাম কি প্রিয়। অনেকদিন হলো আমাদের কোথাও হয়না। শুনেছি হাইওয়ের আছে নতুন রেস্তোরাঁ হয়েছে। বাহিরের লোকরা এসে করেছে। রেস্তোরাঁর ভিতরে নাকি খুব সুন্দর সাজসজ্জা। চলনা আজ বিকালে যাই আমরা।’

প্রিয় স্পষ্ট স্বরে বলল,

‘ খালা মানবেনা।’

‘ জানতাম তুই এই কথাটা বলবি। তাই আগেই ব্যবস্থা করে এসেছি। তোকে না জানিয়ে আগে আন্টি থেকে পারমিশন নিয়ে নিয়েছি।’

‘তুই রেঁস্তোরার কথা বললি আর খালা রাজি হয়ে গেল?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল প্রিয়।

‘ ধুর। রেস্তোরাঁর কথা বলেছি নাকি?’

‘ তাহলে?’

‘ বলেছি আজ আমার বোনের জন্মদিন। মা দাওয়াত করেছে। বিকালে এসে নিয়ে যাবো তোকে।’

বিরক্ত হলো প্রিয়। ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,

‘ আমি যাবোনা তানহা। ভালো লাগে না আমার।’

শুনল না তানহা। মুখ ছোট করে বলল,

‘  জুবাইদার সাথে পিকনিকে গেলি। এখন আমি যেতে বলছি বলে মানা করছিস। জুবাইদাই তোর সব আমি কিছুনা।’

‘ ইমোশনাল ব্লা*কমেইল করে লাভ হবেনা তানহা। এসব ভালো লাগে না আমার।’

‘ যেতে হবেনা তোকে। কেন যাবি? আমি তোর কে?’

মন খারাপ করে উত্তর দিলো তানহা। আড়চোখে দেখল প্রিয়। ফোঁস করে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ আচ্ছা যাবো। এখন খুশি?’

ফিক করে হেসে ফেলল তানহা। প্রিয়’কে জড়িয়ে ধরে খুশিতে গদগদ করে বলল,

‘ হ্যাঁ। অনেক খুশি। তৈরি থাকবি।বিকাল চারটায় নিতে আসবো আমি।’

আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে চলে গেল তানহা। তানহা চলে যেতেই প্রিয় বারান্দায় গেল। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজে নিলো প্রিয়। বিদুৎ চলে গেছে। বাহিরে দক্ষিণা বাতাস বইছে।কড়া রোদটা গায়ে লাগছেনা তেমন। এই কাঠফাটা গরমে ঠান্ডা আবেশটা বেশ লাগছে। শরীর জুড়ালেও, মন মস্তিস্কটা বড্ড  অশান্ত। এই অশান্তির কেন্দ্রবিন্দু শতাব্দকে ঘিরে। মানুষটাকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছেনা প্রিয়। বাজে অভ্যাস হয়েছে আজকাল। সারাক্ষণ শুধু লোকটাকে নিয়ে ভাবে। তাও যেই সেই ভাবনা না। ভীষণ গভীর চিন্তাভাবনা । চোখ বুঝলেই ভেসে উঠে লোকটার মুখ। ঢাকায় থাকাকালীন ছুটিতে বেশ মনে পড়েছে। দেখার ভীষণ তৃষ্ণা জেগেছে। এসব লক্ষণ মোটেও ভালো ঠেকছেনা প্রিয়’র। শত হোক তানহা ভালোবাসে শতাব্দকে। সেখানে তার প্রতি প্রিয় দুর্বল হয় কি করে! অশান্তি অস্বস্তিতে ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে বুক। এভাবে চলছেনা। চলবেনা!  দ্রুত এসব ছাইপাঁশ আবেগ অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তাকে।

 

বিকাল ঠিক চারটায় রিকশা নিয়ে টিপটপ সেজে তানহা হাজির হয়েছে। রিকশায় বসেই তাড়া দিলো প্রিয়’কে। ঝুমকার হুক লাগাতে লাগাতে প্রিয় রিকশায় চড়ল। প্রিয়কে দেখে তানহা অবাক হলো। চোখ নাচিয়ে বলল,’ বাহ। ট্রেডিশনাল লুকে তো বেশ মানাচ্ছে তোকে। এই কালো বারিশটা কবে কিনলি?’

‘ এবার ছুটিতে মা ধরেবেঁ*ধে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে কিনে দিয়েছে।পুরো কাবার্ড ভর্তি সেলোয়ার-কামিজে। সব গুলোর রঙ বোল্ড আর ডার্ক। শুধু বারিশেরই আটটা কালেকশন আছে। ভাব মা কি পরিমাণ আকৃষ্ট বারিশে।’

চোখেমুখে পড়ন্ত চুল গুলো গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত স্বরে উত্তর দিলো প্রিয়। অবাক হলো তানহা। বিস্মিত কন্ঠে বলল

‘ শুধু বারিশই আটটা!  তাহলে তো এবার ছুটিতে তোর বেশ লাভ হয়েছে। যাই বলিস ডার্ক কালারে বেশ মানায় তোকে। ভীষণ সুন্দরী যে।’

‘ হয়েছে আর তেল মাখতে হবে না আপনার।’

 

পঁচিশ মিনিটের মাথায় রিকশা পৌঁছাল রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর বাহিরে শতাব্দের বাইক দেখে রেগে গেল প্রিয়। অনেকটা চেঁচিয়েই বলল,

‘ তোর বয়ফ্রেন্ডও আসবে বলিসনি তো আগে।’ 

তানহা থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,

‘ ওঁই তো দাওয়াত করেছে তোকে।’

‘ এটা ভালো করিসনি তুই। আগে জানলে আমি কোনদিনই আসতাম না।’

‘ তাই তো বলিনি তোকে।’

প্রিয়’র রাগ বাড়ল। পিছন দিক হাঁটা দিলো। বলল,

‘ আমি এখনি বাড়ি যাবো।’

ছুটে এসে হাত ধরল তানহা।আশেপাশে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে মিনতি স্বরে বলল,’ আশেপাশে সবাই দেখছে। প্লিজ চলে যাস না প্রিয়। আজকেই প্রথম আজকেই শেষ আর কোনদিন মিথ্যা বলবো না তোকে। থেকে যা প্লিজ।’

আশেপাশে তাকালো প্রিয়। সত্যিই লোক দেখছে। বাড়িতে একা যাওয়াটাও ঠিক হবে না এখন। এত তাড়াতাড়ি ফিরে গেলে খালা একশোটা প্রশ্ন করবে। সরু দৃষ্টিতে তানহার দিকে তাকালো। তানহা কাচুমাচু মুখ করে বলল,

‘ এখন কি রাজি করতে তোর পা ধরবো বোন?’

‘ তার প্রয়োজন নেই। মনে থাকে যেন এটাই প্রথম এটাই শেষ।’

বলেই চোখ রাঙ্গালো প্রিয়। 

 

রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকে পেছন থেকে সমুদ্রকে হাত উঁচিয়ে ডাকতে দেখে হতভম্ব প্রিয়। পাল্টা জবাবে তানহাও হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে  ইশারা করছে। আশেপাশের লোকজন তাকিয়ে আছে। তা দেখে তানহার হাত টেনে প্রিয় চাপা স্বরে বলল,

‘ আস্তে, লোকজন দেখছে। এত লাফালাফি করার কি আছে? যেন তোর বর এসেছে।’

‘ বর না হোক বয়ফ্রেন্ড তো এসেছে।’

তানহা খুশিতে গদগদ করে বলল। বিস্মিত দৃষ্টিতে তানহার দিকে তাকাল। বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” এটা তো সমুদ্র ভাই’

‘তো?’

‘তুই বলেছিলি চেয়ারম্যানের ছেলে তোর বয়ফ্রেন্ড।’

‘ হ্যাঁ। সমুদ্র কি চেয়ারম্যানের ছেলে না?’ 

কপাল কুঁচকে উত্তর দিলো তানহা। প্রিয় মাথা ঝারা দিয়ে বোঝানোর স্বরে বলল,

‘ সমুদ্র ভাইয়া তো জুবাইদার ভাই। চেয়ারম্যানের ছেলের শতাব্দ ভাই। যার সাথে তোর প্রেম!’

তানহা বিরক্ত হলো। কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বলল,

‘কি আবল তাবল বকছিস প্রিয়? শতাব্দ ভাইয়ের সাথে আমার প্রেম হবে কেন? দুবছর যাবত সমুদ্রের সাথে আমার প্রেম চলছে। সমুদ্র জুবাইদার জেঠাত ভাই। শতাব্দ ভাই, সমুদ্র আর শাদ তিন জনই চেয়ারম্যানের ছেলে। বুঝেছিস?’

প্রিয় আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময় কাটছে না কোনভাবেই। যেন কোন গোলকধাঁধায় আটকে গেছে সে। তানহার আচমকা ডাকে প্রিয়’র ঘোর কাটল। এতোদিন মাথায় আটকে থাকা ঝটটা  হঠাৎ-ই নাই আর। বুকের অস্বস্তি অস্থিরতাটাও উদাও হয়ে গেল।সারা শরীর জুড়ে শান্তির শীতল হাওয়া বইতে লাগল। ‘শতাব্দ’ মুচকি হেসে বিরবির উচ্চারণ করল। আজ এই অপ্রিয় নামও ভীষণ প্রিয় লাগছে প্রিয়’র।

 

চলবে….

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

 

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

‘ আমি তোমাকে পার্সোনালি সরি বলতে এখানে ডেকেছি। শুনলাম, আমাকে নাকি ভীষণ অপছন্দ করো?’

সমুদ্রের কথায় ভীষণ লজ্জা পেল প্রিয়। আড়চোখে তানহার দিকে তাকালো। নিশ্চয়ই তানহা বলেছে সব! রাগ হচ্ছে ভীষণ। এখন তাদের কি করে বুঝাবে? ভ্রান্তিতে পড়েছিল সে। সমুদ্রকে শতাব্দ ভেবে এসব বলেছে!

 সমুদ্র ফুরফুরে মেজাজে আবার জিজ্ঞেস করল,

‘ আমাদের কোন ঝামেলা হয়েছিল কি? আমার তো মনে পড়ছেনা প্রিয়।’

কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা প্রিয়। কথা এড়াতে বুদ্ধি আটল। অকপট কন্ঠে বলল,

‘সেদিনের জন্য সরি ভাইয়া। আমার কারণে আপনাদের পিকনিকটা নষ্ট হলো।’

‘ তুমি সরি বলছ কেন? সরি আমরা বলবো। শাদ বাঁদরামি না করলে এসব হতো না সেদিন।’

‘মানে’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল প্রিয়।

‘ শাদ বাহির থেকে দরজা আটকিয়েছিল সেদিন। মা আর ভাইয়ের আশকারা পেয়ে পেয়ে ছেলেটা দিনদিন বাঁদরামোর মাত্রা ছাড়াচ্ছে। যদিও এবার ছাড় দেয়নি ভাই। পরের দিন সকালে বেশ কড়া করে শাসিয়েছে। ওর সাথে টোটালি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।’

হতভম্ব প্রিয়। এতকিছু জানতো না সে। সেদিনের ঘটনাটা এক্সি*ডেন্ট ভেবে নিয়েছে। আবার সমুদ্র বলল,

‘ শাদের ওই বা*জেভাবে ফাইজলামোর জন্য মন থেকে সরি।’

‘ তার দরকার নেই কোন।’

‘ দরকার নেই বলছ কেন? অন্তত আমার থেকে সরি ট্রিট তো নিতেই পারো।’

‘ সরি ট্রিট?’

অবাক কন্ঠে বলল প্রিয়। হেসে ফেলল সমুদ্র। বলল,

‘  হ্যাঁ, সরি ট্রিট। গ্রহণ করতে হবে অবশ্যই।’

মৃদু হাসল প্রিয়। সমুদ্রের জোরাজোরিতে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়াল। কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল সমুদ্র,

‘আচ্ছা প্রিয়! আমাকে তোমার অপছন্দ কেন? বললা না তো!। তোমার বান্ধবী রোজ কথা শোনায়। কারণটা কিন্তু আজ বলতে হবে আমায়!’

তানহা চোখমুখ অন্ধকার করে নিলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

‘ নিশ্চয়ই কিছু করেছ। নয়তো অপছন্দ করবে কেন?’

‘ আমি সত্যি কিছু করিনি।’ দুর্বল স্বরে উত্তর দিলো  সমুদ্র।

 তানহা মানলো না। ঠোঁট বাকিয়ে ভেঙ্গচি কাটল। দুজনের মধ্যকার দুরত্বটা আরো বাড়ালো। দূরত্ব কমিয়ে সমুদ্র কাছে ঘেষতে চাইলে। তানহা চেঁচিয়ে উঠল। কন্ঠে ক্রোধ ঢেলে বলল,

‘ একদম ঘেষাঘেষি করবা না! কাছ ঘেষলে এখনি উঠে বাড়ি চলে যাবো।’

অসহায় হয়ে চেয়ে আছে সমুদ্র। দুজনের দিক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়। বাহির থেকে খালি চোখে আমরা যা দেখি তা কখনো পুরো সত্য নয়। এর আড়ালেও লুকিয়ে থাকে আরেকটা সত্য! এতোদিন ভাবতো সমুদ্রের প্রতি তানহাই বেশি দু*র্বল। এখন দেখছে ঘটনা পুরো উল্টো। সমুদ্রই তানহাতে ভীষণরকম দূর্বল। এইটুকু মেয়ে কলেজে পড়ুয়া এতবড় ছেলেটাকে শাসাচ্ছে! নাকানিচু*বানি খাওয়াচ্ছে।

 সমুদ্র অসহায় ভঙ্গিতে প্রিয়’র দিক ইশারা করল। পরিস্থিতী প্রতিকূলে যেতে দেখে ভীতু কন্ঠে আমতাআমতা করে বলল প্রিয়,

‘ আসলে দোষটা আমার। আমি ভেবেছিলাম তোর সাথে শতাব্দ ভাইয়ের সম্পর্ক। যাকে আমার অপছন্দ। উল্টাপাল্টা যা বলতাম সেগুলো শতাব্দ ভাইয়াকে ভেবেই বলতাম।’

প্রিয়’র কথায় সমুদ্র তানহা হতভম্ব। বিস্ময় কাটিয়ে আচমকা কিটকিটে হেসে ফেলল দুজন। কোন ভাবেই হাসি থামছেনা সমুদ্রের। হতবুদ্ধিতে চুপসে গেল প্রিয়। সে এমন কি বলল! 

অনেক কষ্টে সমুদ্র হাসি থামিয়ে বলল,

‘ শতাব্দ ভাই আর প্রেম? যেইদিন আমার ভাই আহসান খাঁন শতাব্দের প্রেম হবে নিশ্চয়ই সেদিন সূর্য উল্টো দিকে উঠবে।’

‘ কেন? উনার কারো সাথে প্রেম হতে পারে না?’ প্রিয় বোকাসোকা মুখে জিজ্ঞেস করে বসলো।

‘ সম্ভব না। ভাই আর প্রেম? এক সুতায় গাঁথা যায় না।’

‘ এমনো তো হতে পারে কোন মেয়ে তাকে ভালোবাসে!’ 

‘ অসম্ভব প্রায়! গুড লুকিং পার্সোনালিটি দেখে পটে গেলেও।  তার রাগ, জেদ, বদ মেজাজ ঠেলার মত কোন মেয়ে এখনো দুনিয়াতে জন্ম হয়নাই।’ 

 মন ছোট হয়ে এলো। শতাব্দকে দেখে তো অতটাও বদমেজাজি মনে হয়না প্রিয়’র। সমুদ্র কি মজা করে বলল? হয়তো। গভীর ভাবনায় ডুব দিলো।

 

তানহার চোখে ডুবে আছে সমুদ্র। সামনে ধোঁয়া উঠা কফির মগ। সময় থমকে আছে অন্যকোথাও। সবটাই যে্ন সুন্দর স্বপ্ন। আচমকা সামনে এসে কেউ দাঁড়াল। ছিটকে উঠল সমুদ্র। সাথেসাথে চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। তোতলানোর সুরে বলল,

‘ ভাই! তু…মি এখানে?’

সর্বদার মতই গম্ভীর শতাব্দ। চোখমুখ স্বাভাবিক ভীষণ। তড়িঘড়ি করে সমুদ্র নিজে থেকেই  বলতে লাগল,

‘ ভাই ও…ও আমার বন্ধু সোহেল আছে না? ওর বোন। এখানে ঘুরতে এসেছে। সোহেল একটু ব্যস্ত তাই ওদের বাসায় নিয়ে যেতে বলল।’

শতাব্দ’ কি বিশ্বাস করল? মাথা তুলে ভীতু দৃষ্টিতে তাকালো সমুদ্র। চোখমুখ আগের মতই স্বাভাবিক। পরিবর্তন নেই কোন!

রেস্তোরাঁর বামপাশে ছোট পুকুরের মত জায়গাটা সুন্দর সাজানো। সেখানে বসে দোলনায় দুলছিল প্রিয়। তানহার ডাকে ভিতরে এসে হতভম্ব সে। শতাব্দ সামনে দাঁড়িয়ে। সমুদ্র ভয়ে কাঁপাকাঁপি করছে। পাশেই কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে তানহা। শতাব্দ গম্ভীর মুখ করে একবার প্রিয়’র দিক তাকালো।  তারপর সমুদ্রের দিক দৃষ্টি রেখে বলল,’ সোসাল সার্ভিস! কই বাসায় তো তোকে দিয়ে পানির গ্লাসটা পর্যন্ত উঠানো যায়না! এদিকে গ্রাম জুড়ে সমাজ সেবা হচ্ছে?’

আমতা আমতা করে সমুদ্র উত্তর দিলো,

‘ সোহেল অনেক করে বলছিল তাই..

থামিয়ে দিলো শতাব্দ শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ গালফ্রেন্ডকে ইম্প্রেস করবি নিজের জিনিস দিয়ে কর। আমার বাইক নিয়ে কেন?’

‘ আস..লে ভাই। হয়েছে কি..’

‘ কিছু শুনতে চাইছিনা। বাড়ি থেকে মিথ্যা বলে বান্ধবীর পাহারাদার হয়ে এসেছ?  

শেষ কথাটা প্রিয়’র উদ্দেশ্যে বলল। নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। কিছু বলবে তার আগেই শতাব্দ রাশভারী হয়ে বলল,

‘  চলো।’

কোথায় যাবে বুঝল না প্রিয়। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। বাধ্য মেয়ের মত তার পিছনে গেল।  যাওয়ার সময় সমুদ্রের উদ্দেশ্যে শতাব্দ কড়া করে বলে গেল, 

‘সাতটার আগে যেন বাইক গ্যারেজে থাকে ।’

বোকার মত মাথা নাড়াল সমুদ্র। শতাব্দের যাওয়ার দিক তাকিয়ে ফিচেল হেসে বলল,

‘ রাজনীতি পড়াশোনার  বাহিরে এই প্রথমবার ভাই কাউকে নিয়ে এতটা সিরিয়াস। তার রাগ জেদ বদমেজাজ ঠেলার লোক এসে গেছে বোধহয়।’

 

রেস্তোরাঁর সামনে রিকশা ডাকতে। বিনাবাক্যে, বাধ্য মেয়ের মত উঠে বসল প্রিয়। পাশ ঘেষে বসল শতাব্দ। মাঝে দুরত্ব রেখে কিছুটা সড়ে বসতে চাইল প্রিয়। বোধহয় পছন্দ হলো না শতাব্দ’র। কোমর টেনে আবারো মিশিয়ে নিলো। আড়চোখে তাকাল প্রিয়। শতাব্দের হাতটা কোমরে তখনো। বেশ স্বাভাবিক সামনের দিক তাকিয়ে আছে শতাব্দ। 

রিকশা চলছে তার আপন গতিতে। নিস্তেজ রোদটা ধীরেধীরে মিয়িয়ে যেয়ে। সন্ধ্যা নামছে। শেষ বিকালের আলোটা তার মুখে এসে পড়ছে। এই প্রথম কাছ থেকে দেখছে শতাব্দকে। এতদিন সাধারণ চোখে দেখে আসা এই মানুষটাকে আজ ভীষণ অসাধারণ লাগছে। হ্ঠাৎ মনে হচ্ছে মানুষটা সুদর্শনের সাথে সাথে মায়ায় জড়ানোর জাদুও জানে। কি মায়া ওই অদ্ভুত সুন্দর চোখে! 

আচমকা প্রিয়’র দিক ফিরল শতাব্দ। সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো প্রিয়। আরো ঝুঁকে বসলো শতাব্দ। প্রিয়’র কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ ডার্ক কালার পড়ে চোখে কাজল লেপ্টে আমার সামনে আসতে বারণ করেছি্লাম। কেন আসলে! এইযে নিশ্বাসের গতি বাড়ছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে এর দায়ভার কে নিবে এখন?’

লজ্জায় ঝুঁকে থাকা আঁখিপাতা মেলে, আড়চোখে তাকাল প্রিয়। চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। বাতাসে আজ মা*দক ছড়িয়ে। ভীষণ মাতাল মাতাল মন। চোখ বুজে আসছে আবেশে। হঠাৎ প্রিয়’র হাতটা নিজের হাতে্র মুঠোয় নিয়ে নিলো শতাব্দ। আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবিয়ে আরো কাছে টেনে নিলো। বুকে জড়িয়ে কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো। গভীর কন্ঠে বলল,

‘ সেদিন ভোরে আমি এসেছিলাম। গাড়িতে চড়ে পিছন ফিরে কেন তাকালেনা একবার! গত সাতদিন কত ছটফট করেছি, কতটা অশান্তিতে ছিলাম তুমি জানো? আমার তোমাকে ছাড়া চলছিল না প্রিয়!’

যন্ত্রের মত শক্ত হয়ে আছে প্রিয়। শরীর কাঁপছে থরথর। বুকের ধুকপুক বেড়েছে শতগুন। নিশ্বাসের উঠানামা ক্রমাগত। সারা অঙ্গ আবেশে ঝড়ঝড়িত। সময়টা কি থেমে গেল? শরীর থেকে মন, নিশ্বাস থেকে মস্তিষ্ক জুড়ে। সমস্তটাই তাকে ঘিরে। কারো স্পর্শ এতটাও গভীর হয় কি? তার চাহনিতে এই স্পর্শে আজ কোন অস্বস্তি নাই! কেন? তবে কি তানহার কথাই মিলে গেল। চোখে প্রেম জমেছে প্রিয়’র! 

 

চলবে………

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১০.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

সকাল থেকে চেয়ারম্যান বাড়িতে হৈচৈ। যার আওয়াজ প্রিয়’দের বাড়িতেও আসছে। বারন্দায় গিয়ে। মাথা বের করে চেয়ারম্যান বাড়ির দিক কয়েকবার তাকাল প্রিয়। কিন্তু কারণ আবিষ্কার করতে পারলো না কোন। হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে।সোফায় পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ল। রান্নাঘর থেকে পেশার কুকারের শুঁশুঁ আওয়াজ আসছে। কাজের খালা রান্না করছে। এমনি সব সময় খালা রান্না করে। মাঝেসাঝে ব্যস্ততায় আ্টকে পড়লে কাজের খালা রান্না করে। সকাল থেকে শরীরটা ম্যাচম্যাচ করছে। তাই আজ স্কুল কামাই করেছে। এখন বাসায় শুয়ে বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। 

মাত্রই চোখ লেগেছে এমন সময় কলিং বেল বাজল।এমন সময় কে এলো? কপাল কুঁচকে বিরক্তির মুখ করে ঢোলতে ঢোলতে দরজার কাছে গেল। দরজা খুলে জুবাইদাকে মিষ্টি’র প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুই এখানে! স্কুলে যাসনি?’

প্রিয়’কে ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। টেবিলার উপর মিষ্টির প্যাকেট রেখে। হাত পা ছড়িয়ে। সোফায় আরাম করে বসলো। ক্লান্ত স্বরে বলল,

‘ হাঁপিয়ে গেছি। এক গ্লাস পানি আনতো প্রিয়।’

‘ কি এমন উদ্ধার করে এসেছিস। যে হাঁপিয়ে গেছিস।’

‘ আগে পানি আন। বলছি।’

কপাল কুঁচকে বিরবির করে পানি আনতে চলে গেল প্রিয়। জুবাইদার হাতে পানির গ্লাসটা দিতেই এক নিশ্বাসে সবটা গিলে নিলো। হাঁপানি থামল। একটু সময় নিয়ে বলল,

‘ আজ শতাব্দ ভাইয়ের মেডিকেলের রেজাল্ট এসেছে। ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। সকাল থেকে বাড়িতে উৎসব চলছে। বড় আব্বা বিশ মণ মিষ্টি আনিয়েছে। খুশিতে সারা গ্রাম বিলি করছে। এসব ফেলে স্কুলে কি মন বসবে? তাই কামাই দিয়েছি আজ।’

শতাব্দের রেজাল্টের খবর শুনে মন নেচে উঠল প্রিয়’র। চোখে মুখে খুশির ঝলক। জুবাইদা খুশিতে গদগদ করে বলল,

‘ সামনের মাস থেকে ক্লাস। ভাইয়া শিফট হবে ঢাকায়। হোস্টেলে থাকবে। এরপর আমাকে পায় কে? শুধু উড়বো আর নাঁচবো।’ 

শতাব্দের শিফট হওয়ার কথাটা শুনে কেন জানি ভালো লাগলো না প্রিয়’র। হাসিখুশি মুখটা নিমিষেই চুপসে গেল। মলিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ ঢাকায় শিফট হবে কেন? ‘

‘ প্রতিদিন এখান থেকে যাতায়াত করা অসম্ভব। তাই সেখানে হোস্টেলেই থাকবে।’

‘ মাত্র তিন- চার ঘন্টার-ই তো পথ এখান থেকে যেতে সমস্যা কোথায়!’প্রিয় ফেকাশে কন্ঠে বলল,

তীর্যক দৃষ্টিতে জুবাইদা বলল,

‘ তিন -চারঘন্টার পথ! তোর কাছে সামান্য মনে হচ্ছে প্রিয়?বছরে শুধু দুই ঈদে কেনাকাটার জন্য ঢাকা যাওয়া হয়। ওই দুইবারে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়। আর ডেইলি তিন- চার ঘন্টা জার্নিটাকে সামান্য বলছিস তুই। তাছাড়া এসব নিয়ে তুই এতো কেন ভাবছিস? ভাইয়াকে তোর অপছন্দ। শিফট হলে তোরই ভালো।’

চুপ করে বসে রইল প্রিয়। জুবাইদাকে কি করে বুঝাবে! তার সমস্যাটা এখন অন্য জায়গায়। আজকাল মানুষটাকে যে চোখে হারায় সে। 

জুবাইদার ডাকে ভাবনাচ্ছেদ হলো প্রিয়। জুবাইদা বলল,

‘ আজ সন্ধ্যায় বাড়িতে ছোটখাটো পার্টির  ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাইয়ার বন্ধুবান্ধবরা আসবে। ছাদে আমরা কাজিনরা খাওয়া দাওয়া গান বাজনার আয়োজন করছি। বড়মা তোকে দাওয়াত করেছে। তোকে কিন্তু আসতেই হবে!’

চুপসে থাকা মুখ নিয়ে।আমতা স্বরে বলল প্রিয়, ‘ তোদের কাজিনদের মাঝে আমি যেয়ে কি করবো?’

জুবাইদা রেগে গেল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,

‘ তুই এমন কেন বলতো? কোথায় যেতে বললে শত তালবাহানা তোর। অতশত বুঝিনা। বড়মা যেতে বলেছে। যেতে হবে তোকে।’

মুখে কোন উত্তর দিলো না প্রিয়। বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়াল শুধু।

 

প্রিয়’র বিছানা জুড়ে কাপড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পড়ার মত একটাও কাপড় দেখছেনা সে। সবগুলো কাপড়ই গাঢ় রঙ্গের। গাঢ় রঙ্গ না পড়ার শতাব্দের কড়া নিষেধ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলমারির ধাপে সাদা রঙ্গের জামাটা মিলল। গত বৈশাখে প্রভার সাথে মিলিয়ে মা জামাটা কিনে দিয়েছিল। রাউন্ড নেক, আর্ট সিল্কের সাদাসিধা সেলোয়ার-কামিজ। সাথে রঙিন দোপাট্টা। সাদা রঙ্গটা খুব একটা পছন্দ না বলে। ভাঁজ খোলেনি এখনো। আজ কোন উপায়ন্তর না পেয়ে এই জামাটাই পড়তে হয়েছে। চুল ছেড়ে খুব সাধারণ ভাবে সাজলো। হালকা লিপস্টিক আর কানে কুন্দনের জয়পুরি ছোট ঝুমকো ঝুলিয়ে নিলো। 

বিকালের পর এই নিয়ে দুবার ডেকে গেছে জুবাইদা। খালাকে বলে ঝটপট বেরিয়ে গেল। চেয়ারম্যান বাড়িতে প্রবেশ করে হতবাক প্রিয়। চারদিকে কি সুন্দর সাজানো। হল ঘর না যেন কোন রাজমহল। ইউনিক সোনালী রঙ্গা ফার্নিচারে সাজানো। এক পাশের দেয়াল ঘেঁষে  বিশাল একুরিয়াম। দেশ বিদেশি সেখানে নানা রকমের মাছ। এমন সুন্দর সুসজ্জিত বাড়ি এর আগে দেখেনি প্রিয়। দুতিন বছর আগে যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে । মিনি নামের তার এক ক্লাসমেট ছিল। তাদের বাড়িতে এমন রাজকীয় আসবাবপত্র দেখেছিল। যদিও এতো সুন্দর কারুকাজের ছিলনা তাতে। এগুলো আরো বেশি ইউনিক আর দামী দেখাচ্ছে। এদিক সেদিক দেখছে প্রিয়। এতবড় বাড়ি!জুবাইদার ঘরটা কোন দিক? 

খানিকক্ষণ এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে অপেক্ষা করল। কাউকে দেখতে না পেয়ে আনুমানিক একদিক হাঁটা ধরল। এমন সময় কেউ ডাকল। পিছন ফিরে তাকালো প্রিয়। ছাই রাঙ্গা বেগুনি পাড়ের শাড়িতে একজন মহিলা দাড়িয়ে।টান টান সুশ্রী চোখমুখ। উজ্জ্বল গাঁয়ের রঙ। কত হবে বয়স? ত্রিশ -বত্রিশ! ঘাবড়ে গেল প্রিয়। তড়িঘড়ি করে সালাম জানাল।

 

ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে। অতিপরিচিত ভঙ্গিতে সালামের উত্তর দিয়ে। তিনি জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন আছো প্রিয়?’

প্রিয় চমকাল। মহিলাটা তার নামও জানে? কি করে? উনার সাথে এর আগে দেখা হয়েছে বলে মনে পড়েছে না তো। অতি বলিষ্ঠ স্বরে উত্তর দিলো সে,

‘ জি ভালো।আপনি..’

কথা কেটে তিনি বললেন,

‘ ভালো। আমি অভিলাষা। শাদ সমুদ্র শতাব্দের আম্মা। জুবাইদা’র বড়মা।’

প্রিয় ‘হা’ করে চেয়ে রইল। কি সুন্দর! দেখতে এখনো কত ইয়াং। প্রিয়’র মত যেইকেউ ভুল করবে। কেউ বলবেই না যে তিন ছেলের আম্মা! নামের মত ব্যক্তিত্বটাও  সুন্দর আর ভারী। 

তিনি আবার বললেন,

‘যতটা শুনেছি! তুমি দেখতে তার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী আর মিষ্টি। চেহারার গড়ল কিছুটা তোমার বড় খালার মত হলেও। রঙরূপে তার থেকেও এক কাঠি উপরে।’ 

লাজুক হাসলো প্রিয়। এই কথাটা মাও বলে প্রায়। যে, সে কিছুটা বড় খালার মত দেখতে। আড়চোখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে প্রিয়। জুবাইদাকে দেখতে পাচ্ছেনা কোথায়। বাড়ি আসতে বলে মেয়েটা কোথায় চলে গেল?

প্রিয়’র বিচলিত চাহনির ভাষা বুঝতে পারল অভিলাষা বেগম।  বিনয়ী সুরে বললেন,

‘ জুবাইদাকে খুঁজছ? ও ছাদে গেছে। এখনি চলে আসবে। তুমি ঘরে যেয়ে বসো।’

রান্না ঘরে থেকে আওয়াজ এলো। অভিলাষা বেগমকে ডাকছে। তিনি সেদিকে পা বাড়াতে পেছন থেকে ডাকল প্রিয়। জড়সড় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল 

‘ জুবাইদার ঘরটা কোন দিক?’

‘ ওইতো সিড়ি দিয়ে যেয়ে দোতলার সামনের ঘরটা।’

অভিলাষা বেগম চলে গেলেন। জড়সড় পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠল প্রিয়। দোতলায় উঠে বিভ্রান্তিতে পড়ল। দুই দিকেই ঘর। কোন দিকে যাবে সে? অনেক ভেবে ডানদিকের ঘরটায় গেল। দরজা ভিড়ানো। টোকা দিবে কি? থাক! কি দরকার। ঘরে তো আর কেউ নেই। 

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল প্রিয়। আবছা অন্ধকার ঘর। বাহিরে সন্ধ্যা নেমেছে। বারান্দায় মিটিমিটি জ্যোতি জ্বলছে। কাঁচের আড়াল থেকে তার আধোআধো আলো এসে ঘরে পড়ছে। সুইচবোর্ড খুঁজল । পেলনা প্রিয়। ছোট ছোট পা ফেলে ভিতর দিকে গেল। অনেক বড় ঘর। অন্য স্বাভাবিক দুই রুমের সমান প্রায়। অন্ধকারে কোনদিকে যাবে! বুঝতে পারছেনা প্রিয়। আচমকা কিছুর সাথে বেধে কার্পেটের উপর পড়ল। এমন সময়ই ওয়াশরুম থেকে কেউ বের হলো। বেড সাইডের লাইটটা জ্বালালো। ততক্ষণে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়েছে প্রিয়। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই হতভম্ব প্রিয়। তয়লা পেঁচিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। ঝটপট পা চালিয়ে। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। তার পূর্বেই শতাব্দ হাত টেনে ধরল। গম্ভীর হয়ে বলল, 

‘ বারান্দায় যেয়ে বসো।’     

বাধ্য মেয়ের মত বারান্দার দিক পা বাড়াল প্রিয়। গুটিসুটি হয়ে চেয়ারটায় গিয়ে বসল।

 মিনিট পাঁচেক পর পেইন রিলিভ স্প্রে হাতে শতাব্দ এলো। কালো টিশার্ট, অফহোয়াইট থ্রিকটার পড়েছে। আঙুল দিয়ে ভেজা চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে প্রিয়’র সামনের চেয়ারটায় বসল। হাত টেনে দেখতে চাইল,

‘দেখি! কোথায় লেগেছে।’

কনুইতে লেগেছে। অনেকটাই নীলাভ হয়ে আছে। রাতে হয়তো ব্যথা বড়বে। আড়চোখে তাকালো প্রিয়। অন্ধকারে মাথার উপর ঝুলতে থাকা হলদেটে আলোটা শতাব্দের মুখে পড়ছে। ফর্সা মুখশ্রীতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাত্র গোসল করে আসায় ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। সরু দৃষ্টিতে তাকালো শতাব্দ। চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো প্রিয়। আমতা আমতা করে বলল,

‘ সরি। আসলে.. জুবাইদার ঘর ভেবে ভুলে চলে এসেছি।’

‘ আমি কৈফিয়ত চেয়েছি?’

দু’দিকে মাথা ঝাকাল প্রিয়। মানে ‘না’। 

‘ তাহলে! এক্সপ্লেইন করছ কেন?’

চুপ করে বসে রইল প্রিয়। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। অবাধ্য কেশগুলো তিরতির করে কাঁপছে। চোখেমুখে লাগছে বারবার। নিমিষ তাকিয়ে আছে শতাব্দ। হাত বাড়িয়ে যত্ন করে কানের পিছে গুছিয়ে দিলো। আলতো স্পর্শে কেঁপে উঠল প্রিয়। অন্যরকম আবেশে বুজে নিলো চোখ। ধুকপুক করছে বুক। থরথর করে কাঁপছে হাতপা। ধীর স্বরে ডাকল শতাব্দ। উত্তর দিলো না। প্রচন্ড ঘামছে প্রিয়। আরেকটু ঝুকে এলো শতাব্দ। আঙুল দিয়ে নাকের ডগার ঘামটা মুছে দিলো। কন্ঠে আদর মিশিয়ে ডাকল। বলল,

‘ প্রিয়! আমার দিক তাকাও।’

পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকাল প্রিয়। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শতাব্দ। কি দারুণ সেই চাহনি! আচ্ছা, কিছুদিন পর সত্যি সত্যি মানুষটা দূরে চলে যাবে? যখন তখন এভাবে দেখা হবে না আর। ভেবেই বুকটা কেঁপে উঠল। অশ্রুতে ভরে এলো চোখ। ঠাহর করল শতাব্দ। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে! হাত কি খুব ব্যথা করছে?’

না সূচক মাথা নাড়াল প্রিয়।

‘ তো?’

প্রিয় অশ্রুভারাক্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে মাথা তুলে তাকালো। ছোট ঢোক গিলল। নিশ্বাস টেনে বলল,

‘ আপনি সত্যি সত্যি ঢাকায় চলে যাবেন?’

ম্লান হাসল শতাব্দ। বলল,

‘ তুমি কি চাও! থেকে যাই ?’

উত্তর দিলো না প্রিয়। নিচের দিক তাকিয়ে চুপ করে রইল। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।

প্রিয়’র হাত টেনে হাতে মুঠোয় নিয়ে নিলো শতাব্দ। গাঢ় করে চুমু দিলো। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে আলতো করে হাতের পিঠ ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ এখনো তুমি অনেক ছোট। তোমার কোমল মন আমার ভালোবাসা, টান সহ্য করতে পারবেনা প্রিয়। তাই এখন আপাতত তোমার থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।’

বুঝল না কিছু। অনেকক্ষণ ধরে চোখে আটকে থাকা জলটা টপ করে প্রিয়’র গালে এসে পড়ল। বুকে অদ্ভুত এক যন্ত্রণা অনুভব করল। বিষিয়ে যাচ্ছে সব। মনে মনে বলল, শতাব্দ পালাচ্ছে! আমি কি এতোটাই অযোগ্য।

প্রিয়’র মনের কথাটা শতাব্দ বুঝল হয়তো। কোমর টেনে কাছে টানল। শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলো। মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে গভীর কন্ঠে বলল,

‘ অযোগ্য নও। তুমি আমার অতি যোগ্য। ভ*য়ানক নেশা। গভীর ঘোর।’

একটু চুপ থেকে গম্ভীর হয়ে বলল,

‘নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তোমাকে পেতে অনেক সাধনা করতে হবে। আপাতত দূরে যাবো, নয়তো এই ভ*য়ঙ্কর প্রেম জ্বা*লিয়ে দিবে তোমায়।’

মাথা উঁচু করে সরল দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়। কি গভীর, নিষ্পাপ সেই চাহনি। মৃদু হাসলো শতাব্দ। কাছে টেনে গভীর চুমু এঁকে দিলো কপালে। আবেশে চোখজোড়া বুজে নিলো প্রিয়।

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির) 

 

১১.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

প্রেমের দরজা খুলো না

ভালোবাসি বলো না

 

তুমি দুরে দুরে আর থেকো না

এ চোখে চেয়ে দেখো না

 

 তোমার প্রেমে আমি প্রজাপ্রতি হবো

ফুলে ফুলে উড়ে ভালোবাসার কথা কবো [২]

 

তুমি আমায় কাছে ডাকোনা

প্রেমের সুরভী মাখো না

 

তুমি দুরে দুরে আর থেকো না

 

টিভির পর্দায় channel16 ভেসে। গান চলছে একের পর এক। তখনকার দিনে বাবা মায়েরা কিশোরীদের খুব একটা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিতোনা। শহরে গুটিকয়েক কিশোরীদের হাতে দেখা গেলেও। গ্রামের দিক অনেকটাই অসাধ্য প্রায়। তখনকার দিনে ইন্টারনেট ওয়াইফাই’য়ের ব্যবহার ছিলনা অত। সকাল বিকাল নতুন জনপ্রিয় হওয়া শিল্পী ইলিয়াস, পূজা, ইমরানদের গান গুলো চ্যানেল সিক্সটিনে চালানো হতো বারবার। 

মনযোগ দিয়ে গানটা শুনছে প্রিয়। গানের প্রত্যেক বাক্য যেন তারই মনবচন। বুকে অভিমানের বরফ জমেছে। সেই যে শতাব্দ ঢাকায় গেল। আজ পনেরদিন কোন খোঁজখবর নাই তার। কথা ছিল প্রতি সাপ্তাহে আসবে একবার। শতাব্দের কথা ভাবতে ভাবতেই ছবির এলবামটা ফ্লোরে আছড়ে রাখলো।

 আজ শুক্রবার। ছুটিরদিন। সেই সাথে ঘরবাড়ি পরিষ্কারেরও দিন। রোজ শুক্রবারের মত সকাল সকাল নাস্তা সেরে খালার সাথে ঘর পরিষ্কারে হাত লাগিয়েছে। বসার ঘরে ছোট কাঠের আলমারিটা খুলেছে আজ। পুরানো কাগজপত্র, দলিলপত্রাদি আছে এখানে। সেই সাথে আছে অনেক আগের ছবির এলবাম। আলমারি পরিষ্কার কর‍তে গিয়ে ভেতর থেকে একটা ছবি ছিটকে পড়ল। বেশ পুরানো। প্রিয় ভ্রু কুঁচকে হাতে নিয়ে দেখল। ছবিতে খালাকে চিনতে পারছে। কিন্তু খালার পাশে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখেনি আগে! কে এই লোক? খালার সাথে কি সম্পর্ক তার? কোন বন্ধু!  প্রিয়’র মনে প্রশ্ন জাগলো। ছবি উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল খালাকে,

‘ খালা। ছবিতে তোমার সাথে এই লোকটা কে?’

খালার ফুরফুরে মেজাজটা দমে গেল হঠাৎ। রাশভারি হয়ে এলো চোখমুখ। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ কেউনা। এসব কিছু ঘাটাঘাটি করতে হবেনা তোকে। আরেকটু পর আজান দিবে। যা গোসল করে নামাজ পড় গিয়ে।’

‘ হাতের কাজটা শেষ করে যাই?’

খালা আগের মত গম্ভীর হয়েই বললেন,

‘ তোকে করতে হবেনা। করছি আমি।’

খালা রেগে গেছে। প্রিয় কথা বাড়ালো না আর। উঠে ঘরে চলে গেল চুপচাপ।

 

বিকালে ছাদে রেলিং-এ পা তুলে বসে ছিল প্রিয়। উদাসীন মন। বাতাসে তিরতির কাঁপছে ওড়নার পাড়। হ্ঠাৎ এমন সময় জুবাইদা তানহার আগমন হলো। দুজনকে দেখে প্রিয় ভ্রু কুঁচকালো।রেলিং থেকে নেমে ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ দুজন জোট বেঁধে এসেছিস। কোন কান্ড বাঁধাবি নিশ্চয়ই। সত্যি সত্যি বল কেন এসেছিস?’

জুবাইদা চেয়ারে গা এলিয়ে। টি টেবিলে পা তুলে দিয়ে বসলো। ভণিতা করে বলল,

‘ কি ঠোঁট কাটা মেয়ে দেখেছিস তানহা? মেহমান এসেছে কই চা বিস্কুট আনবে না। তা না! কেন এসেছি জিজ্ঞেস করছে। বলছি আদবকায়দা কি উঠে গেছে দুনিয়া থেকে?’ 

কথা শেষ হতেই দুজন খিলখিল করে হেসে উঠল। বিরক্ত হলো প্রিয়। এক সকাল থেকে খালার মেজাজ গরম। শুধু শুধু কথা শোনাচ্ছে। তার উপর শতাব্দের চিন্তায় বিকল হয়ে আছে মাথা। এখন এদের ঠাট্টা মশকরাতে আরো মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বলল প্রিয়,

‘ মজা ভালো লাগছে না। বন্ধ কর।’

তানহা জুবাইদার সাথে তাল দিলো। প্রিয়’কে ঠেস মেরে। জুবাইদার মত ভণিতা করে বলল,

‘ আমরা মজার মানুষ ভাই। আমাদের অত প্যারা নাই। যার ভালোবাসার মানুষ দূর শহরে প্যারা নিবে সে।’

হতভম্ব হলো প্রিয়। গোলগোল বিস্মিত চোখে  দু’জনের দিক তাকাল। প্রিয়’র এমন চাহনিতে কিটকিটে হেসে উঠল তারা। জুবাইদা বলল,

‘ তুই কি ভেবেছিস! আমার ভাইয়ের সাথে প্রেম করছিস। তুই না বললে জানবো না আমি? সব দেখেছি। সেদিন ভাইয়ের ওইভাবে রেগে যাওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছি।আরিফ ভাইকে কি ঝাঁরাটাই না ঝাঁরলো। বাপরে! কি দোষ ছিল বেচারা! নরমাল হাই হ্যালো। সামান্য ফ্লাটিং-ই তো করছিল। ‘

বিস্ময় কাটিয়ে চোখে মুখে বিরক্তি রেখা টানল প্রিয়। কন্ঠ রাশভারি করে বলল,

‘ বাজে কথা। উনার সাথে প্রেম করতে যাবো কেন।’

‘ আচ্ছা! তাহলে সেদিন সবাই যাওয়ার পর ছাদে কি চলছিল?’

অবাক হওয়ার ভান করে বলল জুবাইদা। প্রিয় ইনিয়েবিনিয়ে কথা কা*টাতে চাইল। শুনলো না তারা। এটাওটা বলে খোঁচাখুঁচি শুরু করল। কপাল কুঁচকে বসে রইল প্রিয়। জুবাইদা হ্ঠাৎ বলল,

‘ পরশু ভাইয়ের জন্মদিন।’

চমকাল প্রিয়। মন আকুম-বাকুম নেচে উঠল। চোখেমুখে প্রকাশ করল না কিছু। গম্ভীর হয়েই উত্তর দিলো,

‘তো? আমি কি করবো।’

জুবাইদা ভনিতা করে বলল,

‘যদি না জেনে থাকিস তাই জানালাম।’

খানিক চুপ থেকে, আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,

‘ আগামীকাল আসবে  সে?’

‘ তুই জেনে কি করবি? এসবে তোর মাথাব্যথা নাই। তাইনারে প্রিয়?’ 

মুখ ফুলিয়ে বসে রইল প্রিয়। জুবাইদা তানহার সাথে সারা বিকাল আড্ডা দিলো। সন্ধ্যা নামতেই তানহারা চলে গেল।

রাতে পড়ার টেবিলে বসে সেদিনের কথা ভাবছিল প্রিয় । কি ভ*য়টাই না পেয়েছিল! 

চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলেমেয়ে সহ শতাব্দের বন্ধুবান্ধবও উপস্থিত ছিল সেখানে সেদিন। ছাদে মুরগী পোড়াচ্ছিল। সেই সাথে গিটার গান বাজনাও ছিল। ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বেশ জমজমাট ঝমকালো আয়োজন। খাওয়া দাওয়া শেষে। প্রিয় জুবাইদাদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো। এমন সময় শতাব্দের এক বন্ধু এসে পাশে বসলো। প্রথমে স্বভাবিক ‘হাই-হ্যালো’  কুশল বিনিময় করলে পরবর্তীতে বেশ গায়ে পড়ে কথা বলছিল। ব্যপারটা বুঝতে পেরে প্রিয় বিনয়ী ভাবে এড়িয়ে যেতে চাইলে। ছেলেটা আরো বেশি ছলাকলা শুরু করল। প্রিয় ভীষণ বিরক্ত হলো। এক পর্যায় জায়গা ছেড়ে উঠে গেল। ছেলেটাও পিছন পিছন এলো। সরাসরি প্রেম নিবেদন করে বসল। প্রথমদিকে এসব কিছু খেয়াল না করলেও প্রপোজালের ব্যাপারটা চোখে পড়ল শতাব্দের। ক্ষি*প্ত বাঘের মত এগিয়ে আসলো। চোখমুখ ভয়ংকর লাল। দেখে ঘা*বড়ে গেল প্রিয়। ভ*য়ে হাত কচলাতে শুরু করল। হাত পা কাঁপছে অনবরত।

প্রিয়’র দিক রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সামনের ছেলেটার দিক ক্ষি*প্ত হয়ে তাকাতেই। ছেলেটা আমতা আমতা করে বলল,

‘ ভাই এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? শুনলাম জুবাইদার বন্ধু তাই টাইমপাস করছিলাম জাস্ট।’

ছেলেটার কলার চেপে ধরল শতাব্দ। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে ক্রু*দ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ তোর চেনাজানা যেই সেই মেয়ে না ওঁ। প্রিয় ফ্যামিলি মেম্বার। ও আমার। বন্ধু বলে ছাড় দিচ্ছি। অন্যকেউ হলে টেনে চোখ তুললাম।’

ছেলেটা ঘাবড়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। মাথা নুয়ে বেরিয়ে গেল। ভারী ভারী ক্ষিপ্ত নিশ্বাস ফেলছে শতাব্দ। ভয়*ঙ্কর রেগে আছে তখনো। 

ততক্ষণে গানবাজনা বন্ধ হয়ে গেছে সব। এদিকেই তাকিয়ে আছে সবাই। চুপচাপ রেলিং চেপে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। শরীর কাঁপছে থরথর। 

রাত দুইটা তিন পর্যন্ত পার্টি চলবে কথা ছিল। দশটার পর পরই থেমে গেল। পরিস্থিতী দেখে বাতি নিভিয়ে, সবকিছু গুছিয়ে সবাইকে নিয়ে নেমে যাচ্ছিল সমুদ্র। সুযোগ বুঝে প্রিয়ও পা বাড়াল। এমন সময়ই শতাব্দের গম্ভীর গর্জনী কানে এলো,

‘ আমি যেতে বলিনি প্রিয়।’

প্রিয়’র বাড়ন্ত পা’জোড়া থেমে গেল। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এক এক করে সবাই নেমে গেল। মূর্তির মত প্রিয় দাঁড়িয়ে রইল ঠাই! খানিকক্ষণ এভাবেই কাটলো। রেলিং চেপে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। 

রাগ দমিয়ে একটু সময় নিয়ে। পাশে এসে দাঁড়াল শতাব্দ। জোসনা রাত। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। চাঁদের উজ্জ্বল আলো মুখ ছুঁইছে প্রিয়’র। ভীতু ভীতু মুখটা দেখতে মায়াবী ভীষণ। রেলিং -এর উপর রাখা প্রিয়’র হাতটার উপর হাত রাখলো শতাব্দ। আদুরে স্বরে ডাকলো। ভীতু পিটপিট দৃষ্টি  তুলে তাকালো প্রিয়। চোখে চোখ রাখলো। প্রিয়’র চোখমুখে এখনো একরাশ ভয়। আলতো করে তার তুলতুলে গালে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিতে দিতে। শতাব্দ গভীর কন্ঠে বলল,

‘আমি কোন বাঘ ভাল্লুক না। সাধারণ একজন। কিন্তু যদি কেউ আমার পছন্দের জিনিসে নজর দেয়! আমি ভ*য়ানক হিং*স্র হবো। এখানে না থাকলেও তোমার উপর নজর থাকবে আমার। তোমার প্রত্যেক মিনিটের মিনিটের খবর পৌঁছাবে! বি কেয়ারফুল।’

শেষের কথা গুলো অনেকটা শা*সিয়েই বলল শতাব্দ। ঘা*ড়বে গেল প্রিয়। ভ*য়ে চোখমুখ নামিয়ে ফেলল। কোমর টেনে কাছে আনল শতাব্দ। চিবুক তুলে প্রিয়’র চোখ চোখ রেখে বলল,

‘ এই চোখে ভয় না প্রেম দেখতে চাই প্রিয়। অসীম প্রেম। এতটা প্রেম, যতটা আগামী বিরহ ভুলাতে যথেষ্ট।’  

প্রিয় উত্তর দিলোনা কোন। শতাব্দের অদ্ভুত সুন্দর চোখ জোড়ায় চেয়ে রইল শুধু। মনে মনে বলল,’ এতো সুন্দর কেন আপনি? ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেই। একটু ছুঁয়ে দিলে খুব অন্যায় হবে কি!’ 

 

পরের দিন স্কুলে গিয়ে। অনেক তালবাহানা বুঝিয়ে তানহাকে দিয়ে সিম কিনে আনলো প্রিয়। তানহা বুঝল। কিন্তু প্রকাশ করল না কিছু। মিটমিটিয়ে হাসলো শুধু। বাড়ি এসে রাতে খালা ঘুমিয়ে যাবার পর। চুপিচুপি খালার ঘর থেকে মোবাইল আনলো। খালা প্রেসারের রুগী। ঘুমের একটু এদিক সেদিক হলেই সমস্যা। তাই স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমায়। সকাল অবধি টের পাবেনা কোন। তখন রাত এগারোটা ছাপ্পান্ন। মোবাইলে নতুন সিম লাগিয়ে শতাব্দের নাম্বারে ডাইল করল প্রিয়। দুইতিন বার বাজতেই তাড়াতাড়ি করে কেটে দিলো। তার ভয় করছে খুব। এসব কিছু কোনদিন করেনি আগে। হাতপা কাঁপছে অনবরত। দুই তিনবার হাত ফসকে ফোন পড়লো জমিনে । কাঁপাকাঁপি হাতে ফোন তুললো। 

আরেকবার ফোন করবে কি? নাকি ছোট করে একটা ম্যাসেজ পাঠাবে! অনেক ভেবেচিন্তে ম্যাসেজ পাঠানোর সিন্ধান্ত নিলো প্রিয়। কাঁপাকাঁপি হাতে ম্যাসেজ টাইপ করল,

‘ Happy birthday’

চোখ বুজে সেন্ড করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মিনিট দু’এক পরেই শতাব্দের নাম্বার থেকে ফোন এলো। ফোনের শব্দে কেঁপে উঠল প্রিয়। তাড়াতাড়ি করে রিসিভ করে কানে ধরতেই। অপর পাশ থেকে চিরপরিচিত সেই আওয়াজ ভেসে এলো,

‘ কেমন আছো প্রিয়?’

ভড়কে উঠল প্রিয়। বিস্মিত স্বরে বলল,

‘ আ…আপনি কি করে বুঝলেন ‘এটা আমি’?’

শতাব্দ ঠোঁট মেলে হাসলো। বলল,

‘ কোন একভাবে বুঝলাম।’

‘ শুভ জন্মদিন’

‘ থ্যাংক ইউ।’

‘ জেগে ছিলেন?’

‘ হ্যাঁ পড়ছিলাম। নাম্বারটা কার?’

‘ তানহাকে দিয়ে কিনেছি আজ।’

‘ কেন?’

‘ আপনার জন্মদিনে তা….

মুখ ফসকে বলতে যেয়ে থেমে গেল প্রিয়। শতাব্দ হাসলো। বলল,

‘ আমার জন্মদিনের কথা কে জানালো?’

‘ জুবাইদা’ 

‘ ওদের যত বাড়াবাড়ি! বার্থডে সেলিব্রেট করা পছন্দ না আমার। এদের য*ন্ত্রণায় এই দিন বাড়ির বাহিরেই সময় কা*টাই। এতটুকু কারণে এত রাত অবধি জেগে থাকার প্রয়োজন ছিলনা প্রিয়’

প্রিয়’র মন ছোট হয়ে এলো। এত রাত অবধি জেগে থাকাটা দেখল। কেন থাকলো কারণটা দেখলো না শতাব্দ। তাকে উইশ করার জন্যই তো জেগে ছিল। বিরবির করে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,

‘ আপনি আসবেন কাল?’

‘ তুমি কি চাও! আসি?’

 প্রিয় মনে মনে চিৎকার করে বলল, ‘ হ্যাঁ! হ্যাঁ আমি চাই আপনি আসেন। অনেকদিন দেখিনা আপনায়! চোখে তৃষ্ণা জমেছে দেখার।’ মুখে কিছু বলল না। চুপ করে রইল শুধু।

অপর পাশ থেকে আদুরে কন্ঠে ডাকল শতাব্দ। বলল,

‘ প্রিয়! আসলে, বার্থডে গিফট পাবো তো?’

কিছু না বুঝে তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করল প্রিয়, 

‘ কি গিফট চাই আপনার?’

প্রমত্ত কন্ঠে বলল শতাব্দ’ স্পেশাল কিছু।’

 

চলবে…..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১২.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

জুবাইদা পেটের অসুখ বাঁধিয়ে স্কুলে আসেনি আজ। গতকাল বোম্বাই মরিচ দিয়ে গুনে গুনে তিন প্লেট ফুসকা খেয়েছে। অনেক বারণ করেছে প্রিয়। শুনেনি সে। রাত থে্কে প্রচন্ড পেটে ব্যথায় ভুগছে। যা গিলছে সবই উবলে ফেলছে। ডাক্টার দেখিয়ে এখন বেডরেস্টে আছে।

স্কুল শেষে একা বাড়ি ফিরছিল প্রিয়। পথে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে গাড়ি থামানো দেখল। চেয়ারম্যানের অফিসের শাটার খোলা ভর দুপুরে। শতাব্দ কি এসেছে তবে? চোখজোড়া নেচে উঠল খুশিতে। রিকশা অফিসের কাছাকাছি আসতেই মাথা বের করে উঁকি দিলো প্রিয়। শতাব্দের আবছা ঝলক দেখে। লাফিয়ে উঠল। বিরবির করে বলল, ‘ইয়েস! ইয়েস! সে এসেছে। আমার কথা রেখেছে।’

বাড়ির সামনে রিকশা থামলো। তড়িঘড়ি করে নামতে যেয়েও নামলো না প্রিয়। চুল ঠিক করে, কাপড় গুছিয়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আস্তেধীরে নামলো। ভাড়া মিটাতে গিয়ে আড়চোখে তাকালো। ততক্ষণে অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছে শতাব্দ। তার সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জায় মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো। ভাড়া মিটিয়ে তড়িঘড়ি পায়ে গেটের ভিতরে চলে গেল প্রিয়। ঘরে এসে কোনরকম ব্যাগ ফেলে। স্কুল ইউনিফর্ম নিয়েই টানটান শুয়ে পড়ল । ঠোঁটে হাসি, চোখে লজ্জা ভীষণ। বুক কাঁপছে ধুকপুক। বারবার ভাসছে শতাব্দের মুখ। মানুষটাকে কতদিন পর দেখলো! পুরো ষোলো দিন পর এসেছে সে। এই ক’দিন না দেখে কত অভিযোগ পুষেছে। কত অভিমান জমিয়েছে। আজ তার এক চাহনিতেই সব অভিযোগ, অভিমান  নিমিষেই শেষ! তাকে দেখার তৃষ্ণা খাইখাই পু*ড়িয়েছে এতোদিন। কিন্তু আজ! আজ যখন সামনে এসেছে। চোখ তুলে তাকাতে  পারছেনা লজ্জায়। গতরাতে তো ফোনে বেশ গলা উঁচিয়ে ‘আসতে’ বলল। এখন যখন এসেছে অনুভূতিতে মিয়িয়ে যাচ্ছে সে।

কি করে সামনে দাঁড়াবে। উপহার দিবে তাকে!

 উফ! এমন অসহ্য অদ্ভুত অনুভূতি কেন? প্রেম কি এমন অদ্ভুদ-ই হয়! ভেবেই লজ্জায় মুখ লুকালো বালিশে। 

 

শতাব্দের উপহারের কথা মনে পড়তেই। বিছানা ছেড়ে উঠল। ব্যাগ থেকে ঘড়ির বাক্সটা বের করল। আজ সকালে তাড়াতাড়ি স্কুলের জন্য বেরিয়েছিল। ক্লাস শুরু হওয়ার দুঘন্টা আগে। তানহাকে নিয়ে হাইওয়ের কাছাকাছি নতুন মার্কেটটায় গিয়েছিল। তেমন জমজমাট হয়ে উঠেনি এখনো। কিছু দোকান খুলেছে মাত্র। তানহা থেকে শুনেছিল মার্কেটের দোতলায় কয়েকটা ঘড়ির দোকান হয়েছে। বেশ ভালো। কয়েকটা দোকান ঘুরে একটা ঘড়ি পছন্দ হলো। গত ঈদের সালামি ছিল কিছু আর সামান্য  টাকা যোগ করে ঘড়িটা নিলো। যদিও দর কষাকষি তেমন পারেনা প্রিয় । তবুও খানিকক্ষণ দামাদামি করে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে কিনেছে। বেশ সুন্দর রেপিং পেপারে মুড়িয়ে প্যাকেজিং করে এনেছে। মনে মনে সুক্ষ্ম ভয় জ জমলো। সবসময় শতাব্দের হাতে নামীদামী ব্রেন্ডেড ঘড়ি দেখেছে। তার এই সামান্য উপহার পছন্দ করবে কি শতাব্দ? আচ্ছা,উপহার দেওয়ার সময় কোন শুভেচ্ছা বাক্য বলবে কি? না থাক। প্রয়োজন নেই।  দেখা যাবে  বলতে গিয়ে ভয়ে পাকিয়ে ফেলবে সব। তার চেয়ে বরং চিরকুট লিখবে। চট করে উঠে। রঙ্গিন কাগজ কলম নিয়ে বসলো প্রিয়। গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, 

 

‘ হবু ডাক্তার সাহেব,

শুভ জন্মদিন। কেমন আছেন আপনি? নিশ্চয়ই ভীষণ ভালো। বলেছিলেন প্রতি সাপ্তাহে আসবেন একবার। আজ ষোল দিন পর দেখা মিলল আপনার। বড্ড পা*ষাণ আপনি।  আমার কথা কি একবার মনে পড়েনা আপনার?  সারারাত উপহার নিয়ে অনেক ভেবেছি। কি দেওয়া যায় আপনায়! হ্ঠাৎ মনে হলো সময় উদাসীন মানুষটার জন্য ঘড়ি-ই বোধহয় যোগ্য। ঘড়িতে সময় দেখে যদি আমার কথা মনে পড়ে আপনার! পড়বে কি মনে?

ইতি,

আপনার প্রেম রোগে ব্যথিত প্রিয়।

 

জুবাইদার অসুস্থতার কথা শুনে।বিকেলে খালা চিকেন স্যুপ করে দিলো। অফওয়াইট গ্রাউন আর চুড়িদার বেশ চমৎকার তৈরি হয়ে নিলো প্রিয় । ঘর থেকে বের হবার জন্য পা বাড়িয়েও পিছিয়ে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে নিলো একবার। ভীষণ সাদামাটা দেখাচ্ছে। একটু সাজবে কি? চোখে সামান্য কাজল ঘষে, ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগালো হালকা। ঠিকঠাক দেখাচ্ছে এইবার। 

স্যুপের বাটি আর ঘড়ির প্যাকেট নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল সে। 

চেয়ারম্যান বাড়ি এসে। এদিক-সেদিক না দেখে সোজা জুবাইদার ঘরে গেল। বিছানায় কাঁথা মুড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সে। মাথার কাছে বসলো প্রিয়। আলতো স্বরে ডাকতেই পিটপিট চোখ মেলে তাকালো জুবাইদা। একরাতেই ভীষণ দুর্বল দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। খারাপ লাগল প্রিয়’র। বলল,

‘ এখন কেমন লাগছে ?’

‘কিছুটা ভালো। কাল তোর বারণ শুনা দরকার ছিল আমার ।’

আধোআধো চোখ মেলে জুবাইদা বিড়বিড় করে উত্তর দিলো।

‘ শুনলিনা তো। অসুখ বাঁধালি ঠিক।’

‘ ব্যাগে কি?’

প্রিয় হাতের ব্যাগটার দিক এক পলক তাকালো। বলল,

‘ খালা তোর জন্য চিকেন স্যুপ করে পাঠিয়েছে। বলল, শক্তি মিলবে এতে। আর…

‘ আর কি?’

গলা ঝেরে, মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে প্রিয় ভাঙ্গা স্বরে বলল,

‘ আর…আর তার গিফট। ভেবেছিলাম নিজ হাতে দিবো । কিন্তু..সাহস হচ্ছেনা এখন। আমি চলে যাওয়ার পর, তুই যদি…

প্রিয়’র কাঁচুমাচু মুখ দেখে। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া মেলে হাসলো জুবাইদা। হাত গুটিয়ে বলল,

‘ আমি ওইসব  পারবো না ভাই। দেখা যাবে ভাই রে*গে আমাকে মুড়িয়ে এই ব্যাগের ভিতর ভরে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে নিচে।’

ভীতু কন্ঠে বলল প্রিয়,

‘ তাহলে এটা কি সাথে করে বাসায় নিয়ে যাবো?’

‘ এতে রেগে যাবে আরো। তাছাড়া ভাই তোকে দেখা করে যেতে বলেছে। ঘরেই আছে।’

‘ আমি আসবো উনি আগে থেকে জানতো?’

‘ হ্যাঁ। স্কুল শেষে রুমা তানহা এসেছিল। তাদের মুখে শুনেছে।’ 

ভয়ে চোখ জোড়া ছোট হয়ে এলো প্রিয়’র। কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভেবেছিল চুপিচুপি এসে। জুবাইদাকে দেখে তার হাতে উপহার ধরিয়ে চলে যাবে। পুরোপুরি ফেঁ*সে গেছে এখন। 

ভীতু স্বরে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,

‘ দেখা কি করতেই হবে?’

‘ আমাকে বলতে বলেছে আমি বলেছি। বাকিটা তুই আর ভাইয়া জানিস।’

অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল। শতাব্দের সাথে দেখা করবে সে। মনে মনে ভেবে নিলো। কিন্তু কি করে সামনে দাঁড়াবে এখন?

 

ষোলদিন তার বিরহ যন্ত্রণায় কা*টালো। আজ যখন সে এসেছে, ডেকেছে। সাহস হচ্ছেনা সামনে দাঁড়ানোর। লজ্জা, ভয়, অনুভূতি ঝাপটে ধরেছে পা। 

দরজা ভিড়ানো। ঠকঠক আওয়াজ করল। ভেতর থেকে গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো,

‘ ভিতরে এসো।’

 

ছোট ছোট পা ফেলে ভিতরে গেল প্রিয়। সোফায় বসে বই পড়ছিল শতাব্দ। প্রিয়’কে দেখে উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর হয়ে কাছে এসে দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করল। ভারী আওয়াজে কেঁপে উঠল প্রিয়। চোখমুখ খিঁচে নিলো। মুখোমুখি এসে দাঁড়াল শতাব্দ। বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘ ফোনে তো বেশ গলা উঁচিয়ে আসতে বললে। এখন পালাচ্ছ কেন?’ 

কোন উত্তর দিলো না প্রিয়। কাঁপছে থরথর। ঠাহর করল শতাব্দ। হাত টেনে সোফায় নিয়ে বসালো। গ্লাসে পানি ভরে এগিয়ে দিলো। তড়িঘড়ি করে পুরোটা পানি গিলে। ছোট ঢোক গিলল প্রিয়। খানিকক্ষণ পিনপতন নিরবতায় কাটলো। শতাব্দ চেয়ে রইল নিমিষ। ভীতু উত্তেজিত প্রিয়। হাত কচলাচ্ছে বারবার। প্রিয়’র হাত জোড়া টেনে হাতে মুঠোয় নিয়ে নিলো শতাব্দ। আদুরে স্বরে ডাকল। বলল,

‘ আমার দিকে তাকাও প্রিয়।’

প্রিয় শুনেও চোখ উঁচিয়ে তাকালো না। খানিক অপেক্ষা করল শতাব্দ। ডাকলো আবার,

‘ কিছু বলবেনা ?’

এবার একটু সময় নিয়ে মাথা তুলে তাকালো প্রিয়। ছোট ঢোক গিলে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করল। গলার স্বর স্বাভাবিক রকম করে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন আছেন?’

হেসে ফেলল শতাব্দ। ঠোঁট চেপে হাসি থামানো চেষ্টা চালিয়ে । বলল,

‘ এতটা পথ জার্নি করে আসলাম। শুধু এটা শুনার জন্য?’

প্রিয় তড়িঘড়ি করে বলল,

‘ শুভ জন্মদিন।’

‘ আর?’

কি বলবে? খুঁজে পেল না প্রিয়। চোখ নুয়িয়ে নিলো। আড়চোখে  এদিক সেদিক তাকালো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছ বারবার। আঙ্গুল খুঁটাখুঁটি করছে ভয়ে। আচমকা কোমর চেপে কাছে টেনে আনল শতাব্দ। নিজের সাথে গভীর ভাবে মিশিয়ে নিলো। চিবুক ধরে উঁচু করল মুখ। চোখে চোখ ডুবালো। প্রিয়’র নিষ্পাপ চাহনি। মন্ত্রমুগ্ধের মত টানছে তাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বুকে বড্ড অশান্তি হচ্ছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ভীতু স্বরে বলল প্রিয়,

‘ ক..কি করছেন। চলে আসবে কেউ।’

কানে তুললো না শতাব্দ। আরো গভীর ভাবে প্রিয়’কে জড়িয়ে নিলো।  কোমর ছেড়ে পিঠ ছুঁইছে হাত। চাহনিতে গভীর ঘোর। অদম্য নেশা। বলল,

‘ আমার স্পেশাল গিফট চাই প্রিয়।’

শতাব্দের নেশাতুর স্বর। গালে হাত রাখতেই আবেশে চোখ বুজে নিলো প্রিয়। ভীষণ কাছাকাছি দুজন। শতাব্দের গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা নাকে লাগছে প্রিয়’র। শরীর কাঁপছে থরথর। দক্ষিণের ধমকা হাওয়া এসে এলোমেলো করেছে চুল। আদুরে হাতে গুছিয়ে দিলো শতাব্দ। দুগালে হাত রেখে মুখটা উঁচু করে নিলো। আলতো করে গালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠল প্রিয়। সারা শরীর জুড়ে শীতল হাওয়া বইতে লাগল। শিরশির করছে হাতপা। নিশ্বাসের গতি বেড়েছে। বুকের ধুকপুকটাও কয়েক গুন বেড়ে গেছে। গলা শুকিয়ে প্রচন্ড তেষ্টা পাচ্ছে। আচ্ছা, অনুভূতিতে মরে যাবে কি আজ? 

শতাব্দ চোখ গাল কপাল সারা মুখ এলোপাতাড়ি চু*মুতে ভরিয়ে দিচ্ছে। আজ নিজের মধ্যে নেই সে। কোন এক মোহে সম্মোহে জড়িয়ে পড়েছে। প্রিয়’কে এতো কাছে পেয়ে মাথা আউলে গেছে। নিজেকে ভুলে উন্মদের মত আচরণ করছে। আচমকা ঠোঁটের কাছে এসেই থেমে গেল সে। তার ভারী নিশ্বাসে থরথর কাঁপছে প্রিয়। তিরতির করছে ঠোঁট। কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে নিলো। চোখ বুজে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। ঘোর কাটতেই ভারী নিশ্বাস টেনে, খিচে দূরে সরিয়ে আসলো। পাশের সোফায় বসে মাথা চেপে ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলছে শতাব্দ। ঘর জুড়ে নিশ্বাসের শোঁশোঁ আওয়াজ। 

 

সোফা ছেড়ে উঠল শতাব্দ। চোখেমুখে পানি ছিটা দিয়ে খানিক বাদে ফিরে এলো। প্রিয়’র দিক আড়চোখে তাকালো। সোফায় গাঁ এলিয়ে চোখ বুজে ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলছে এখনো। 

প্রিয়’র গিয়ে পাশে বসলো। বুকে জড়িয়ে। একটু সময় নিয়ে আলতো স্বরে ডাকলো। পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকালো প্রিয়। সরল চাহনিতে অদ্ভুত ঘোর, গভীর মোহ। বুকটা কেঁপে উঠল শতাব্দ’র। মনে মনে কয়েক হাজার বার জপলো,’ এই প্রিয় আমার। শুধুই আমার!’

এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে মুখে বলল,

‘ অন্যসবার মত ভদ্র প্রেমিক হয়ে অত নিয়ম বেঁধে ভালোবাসতে পারবো না প্রিয়। অনেকবার চেষ্টা করেছি। হচ্ছেনা। পারছিনা না আমি। তুমি আশেপাশে থাকলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাই হুটহাট।’

শতাব্দের শেষ কথা গুলোতে একরাশ ব্যকুলতা মিশানো। প্রিয়  শতাব্দের দিক নিমিষ চেয়ে রইল। মনে মনে বলল,

‘ নিয়ম বেঁধে ভালোবাসতে বলিনি তো আমি। আপনার হুটহাট পাগলাটে রুপটাই যে আমার পছন্দ।’

কথা এড়াতে মুখে বলল,

‘ এ ক’দিন ব্যস্ত ছিলেন খুব?’

‘ হ্যাঁ ভীষণ। এপার্টমেন্টে শিফট হয়েছি। কেনাকাটা গোছগাছ করতে সময় লেগেছে।’

‘ এপার্টমেন্ট? আপনি তো হোস্টেলে ছিলেন।’

‘ হ্যাঁ সেখানকার কোলাহল পরিবেশ ভালো লাগেনি। তাই ধানমণ্ডি আমাদের এপার্টমেন্টে শিফট হয়েছি।’   

 প্রিয় ছোট ব্যাগটা নিয়ে শতাব্দের দিক এগিয়ে দিলো।বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ এটা আপনার জন্য।’

ব্যাগ খুলে বাক্সটা বের করে। আনবক্সিং করে ঘড়িটা হাতে পড়ে নিলো শতাব্দ। দ্বিধান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,

‘ পছন্দ হয়েছে আপনার?’

‘ ভীষণ। থ্যাংকইউ।’

অমনি চিরকুটে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে এলো শতাব্দের।হাতে নিয়ে পড়ে হেসে ফেলল। বলল,

‘ আড়ালে তো ভীষণ চঞ্চল। খুব বকবক করো। সামনে এলে পালাই পালাই করো কেন?’

লজ্জা পেল প্রিয়। মিয়িয়ে গেল একদম। প্রিয়’র হাত  হাতের মুঠোয় নিয়ে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ চিরকুটের প্রশ্নটা তোলা থাকলো। কোন একদিন উত্তর জানাবো।’ 

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১৩.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

নভেম্বর মাস। শীতের মৃদু আমেজ। জোরেশোরে ইমান্দিপুরে নির্বাচনের আয়োজন চলছে। আজকাল প্রায় প্রতি সাপ্তাহে গ্রামে আসে শতাব্দ। পড়াশোনার পাশাপাশি এদিকটাও দেখছে। বাপ চাচাদের সাথে নির্বাচনের কাজে হাত লাগাচ্ছে। তার সাথে প্রায়ই  চোখেচোখি হয়, চুপিচুপি ফোন কথাও হয়। ‘ভালোবাসি’ প্রকাশ না করলেও। অধিকারবোধটা বরাবরই প্রখর। কিছু সম্পর্ক বোধহয় বেনামিই সুন্দর। আয়োজন করে, ভালোবাসি বলে নাম করণের প্রয়োজন পড়েনা কোন।

প্রিয়’র বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। আজকাল ব্যস্ত খুব। সারাবছর ঝিমিয়ে কাটানোর মাশুল দিচ্ছে এখন। নাকানিচুবানি খেয়ে বই নিয়ে পড়ে থাকে সারাক্ষণ। এর মাঝে বাড়িতে এলো অতিথি’র আগমনী সংবাদ। ছোট খালার বড় ছেলে ‘মজনু ভাই’ আসছে দেশে। বড় আপার সমবয়সী মজনু ভাই। ‘মজনু’ নামটা ছোট খালুর রাখা। হিস্ট্রিকাল  লাভস্টোরিতে গভীর ভক্তি তার। লায়লা মজনু’র প্রেমকাহিনী থেকে অনুপ্রেরিত হয়ে বড় ছেলের নাম মজনু। আর ‘রোমিও জুলিয়েট’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছোট ছেলের নাম ‘রোমিও’ রেখেছেন। যদিও বড় হয়ে মজনু ভাই নাম পাল্টে। মেহতাব রেখেছে। কিন্তু মজনু নামটা খাতায় কলমে ঠিকই রয়ে গেছে। নামটা শুনতে বেশ বিব্রত শোনালেও। মজনু ভাই  দেখতে যথেষ্ট সুদর্শন। শুধু মাথার মধ্যেখানে একটু চুল কম। অনেক বছর দেখেনি তাকে। সেই ছোটবেলায় দেখেছিল একবার। এতবছরে কি চুল যেয়ে টাক বেরিয়েছে এসেছে তার! কি জানি। 

প্রিয় ভাবনা জগতে ডুবে। সামনে বই খুলে উপরের দিক তাকিয়ে কলমের মাথা চাবাচ্ছে। দেখে ক্ষে*পে উঠল খালা। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

‘ কলম লেখা জন্য খাওয়ার জন্য না! এমন করে পড়লে পাশ করতে হবে না আর।’

ভাবনাচ্ছেদ হলো প্রিয়’র। নড়েচড়ে বসলো। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ তুমি শুধু আমাকেই বলো। প্রভা যে দুই সাব্জেক্টে ফেল করলো কই তাকে তো ফোন কিছু বললা না! উল্টো আদর আহ্লাদ করলা’

‘ প্রভা আর তুই এক হলি প্রিয়? ও ক্লাস সিক্সে পড়ে আর তুই সামনে বছর মেট্রিক দিবি। ফেল করলে কোথাও মুখ থাকবে আমাদের?’

‘ অত চিন্তা করো না তো খালা। দেখবে কোনরকম ঠিক পাশ করে যাবো!’

খালা এবার আরো অবাক হলো। হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ শুধু পাশ?’

‘ হ্যাঁ! মেয়েদের এত পড়ে কি হবে। সেইতো শ্বশুরবাড়িতে চুলাই ঠেলবে।’

 খালা রেগে গেল। কট কট করে বলল,

‘ কাউকে সর্বস্র না ভেবে নিজেকে সম্পদ বানা প্রিয়। প্রেম ভালোবাসা বিয়ে এসব খানিকের মোহ। এসব ছাড়াও জীবনে বাঁচা যায়!’

চুপসে গেল প্রিয়। খালা বরাবরই  প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে বিরো্ধী।কিন্তু কেন? কারণটা আজো জানে না সে। ছোট থেকে খালাকে আত্মনির্ভরশীল দেখেছে। কখনো কারো কাছে হাত পাততে দেখেনি। নিজের সকল প্রয়োজন সমস্যা নিজেই মিটিয়েছে। সফল নারী বলাই যায় খালাকে।

প্রিয় বিড়বিড় করে বলল,

‘ তুমি শুধু আমাকেই বলো!’

‘ আর কাকে বলবো। তুই আপন তোকেই তো বলবো!’

‘ আমি আপন আর প্রভা পর? ওকে কেন বলোনা এসব?’

মুখ বেজার করে অভিযোগ করলো প্রিয়। খালা দেখে হেসে ফেলল।বলল,

‘ আচ্ছা, এবার দেখা হলে বলবো। ঠিক আছে?’

 

প্রশ্নপত্র নিয়ে মুখে বাতাস করতে করতে মাঠে এলো প্রিয়। সকালে শীতশীত করলেও এখন ভাপসা গরম ছেড়েছে। বিদুৎ না থাকায় হলে গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার। পরিক্ষা শেষে দূর আমগাছ তলায় তানহা জুবাইদাকে দেখা যাচ্ছে। গলা উঁচিয়ে ডাকলো একবার। শুনেনি তারা। গল্পে মজে। পা চালিয়ে এগিয়ে গেল প্রিয়। কাছাকাছি যেতেই জুবাইদাকে বলতে শুনলো, 

‘ শতাব্দ ভাই কি করে…আসলেই…

প্রিয়’র দিক চোখ পড়তেই। জুবাইদা সাথে সাথে থেমে গেল। তার দৃষ্টি অনুকরণ করে তানহা পিছন ফিরে চাইল। প্রিয়কে দেখে চমকে গেল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ আরে প্রিয়! কখন আসলি। পরিক্ষা কেমন হলো?’

‘ কি বলছিলি তোরা? আমাকে দেখে থেমে গেলি কেন? কি করেছে উনি।’

ভনিতা বিহীন জিজ্ঞেস করল প্রিয়। জোর করে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে কথা এড়াতে তানহা স্বভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ তেমন কিছুনা এমনি….

চোখ পাকালো প্রিয়। শান্ত স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমি সত্যিটা জানতে চেয়েছি ।’

জুবাইদা তানহা দুজন চোখাচোখি করল। একটু সময় নিয়ে। তানহা বিড়বিড় করে বলল,

‘ গতকাল সমুদ্র তোর কথা জিগ্যেস করছিল বারবার। শতাব্দ ভাইয়ের সাথে সম্পর্কে আছিস কিনা, তুই সিরিয়াস কি না। আরো অনেক কিছু। সন্দেহ হলো আমার। প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও। কড়াকড়ি ভাবে জিজ্ঞেস করতেই গড়গড়িয়ে বলতে লাগল। গতকাল বিকালে শতাব্দ ভাইয়ের মোবাইলে ঢাকা থেকে করিয়ে আনা নির্বাচনের পোস্টারের ছবি দেখতে ঘরে গিয়েছিল। শতাব্দ ভাই ওয়াশরুমে ছিল। আচমকা  একটা আইডি থেকে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ এলো। কৌতুহল বশত খুলে দেখে একটা মেয়ে শতাব্দ ভাইকে প্রপোজ করছে। আরো কৌতুহল নিয়ে পুরানো মেসেজ পড়ে বুঝল মেয়েটা শতাব্দ ভাইয়ের সাথে একই মেডিকেলে পড়ছে। ম্যাসেজে গুলো এডাল্ট ছিল খুব। সাথে মেয়েটার এডাল্ট ছবি..

থামিয়ে দিলো প্রিয়। বুকে মোচড়ে উঠেছে হ্ঠাৎ । খাড়া থেকে বসে পড়ল। জলে চিকচিক করছে চোখ। শরীর কাঁপছে থর থর। সামনের সব ঝাপসা দেখছে। অদ্ভুত য*ন্ত্রণায় বিষিয়ে যাচ্*ছে মন। জুবাইদা তানহা পাশে বসল। জুবাইদা বুঝানোর স্বরে বলল,

‘ শতাব্দ ভাইয়ের কোন দোষ….’

উঠে দাঁড়ালো প্রিয়। ধরে আসা কন্ঠে বলল,

‘ বাড়ি যাবো আমি।’

বলেই তড়িঘড়ি পা চালিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল। রিকশা ডেকে বাড়ির দিক রওনা হলো। চোখ ভরে আসছে বারবার। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। শরীর অবশ লাগছে। কান্না পাচ্ছে খুব।

রিকশা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই শতাব্দকে দেখল। লোকজন জমিয়ে মিটিং করছে। বুকের য*ন্ত্রণাটা যেন আরো কয়েক গুন বেড়ে গেল। চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো প্রিয়। ভাড়া মিটিয়ে তড়িঘড়ি করে ভেতরে চলে গেল। পেছন থেকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল শতাব্দ। 

না খেয়ে, না নেয়ে ঘরে দুয়ার দিয়ে কাটালো সারাদিন। বিকালেও ছাদে উঠেনি আজ। সন্ধ্যায় খালা এসে জিজ্ঞেস করতেই হুহু করে কেঁদে উঠল প্রিয়। খালাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমার এখানে ভালো লাগছেনা খালা। বুকে কষ্ট হচ্ছে খুব…. বাড়ি যাবো।’ 

হ্ঠাৎ বুক ব্যথা করছে কেন? উল্টাপাল্টা কিছু খেয়ে পেটে গ্যাস জমলো কি মেয়েটা! আয়েশা বেগম ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো। কয়েকবার কারণ জানতে চাইল। ডাক্টারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলল। প্রিয় সাড়াশব্দ করলো না কোন। কাঁদোকাঁদো গলায় বিড়বিড় করে বলল, ‘ ডাক্টারের কাছে না। মাকে খুব মনে পড়ছে! আমার মায়ের কাছে যাবো।’

আজ পরিক্ষা শেষ হয়েছে। তাই বারণ করলেন না তিনি। সকাল সকাল গাড়ি ভাড়া করে প্রিয়’কে ঢাকায় দিয়ে এলেন।

 

ঢাকায় এসেও ভালো লাগছেনা প্রিয়’র। বাবা মা প্রভা কারো সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে না। শান্তি পাচ্ছেনা কোথাও। তানহার কথা গুলো কানে বাজছে সারাক্ষণ। রাতে মায়ের ফোনে সিম ঢুকালো। অন করতেই, সাথে সাথে ম্যাসেজের টুংটাং আওয়াজে কেঁপে উঠল ফোন। শতাব্দের ম্যাসেজ সব। মিনিট পাঁচেক গড়াতেই শতাব্দের নাম্বার থেকে ফোন এলো। ঝাপসা চোখে ফোনে স্কিনে তাকিয়ে থাকলো প্রিয়। ধরলো না। খানিক বেজে একাই থেমে গেল। শতাব্দের ফোন থেকে ম্যাসেজ এলো,

‘ ইগনোর করছো! কি হয়েছে? সমস্যা কোন? এখানে আসো সামনা সামনি বসি। সবটা শুনে, সমাধান করি। এভাবে পালিয়ে বেড়ালে লাভ হবে না কোন। তোমার ঢাকার বাড়ির ঠিকানা আমার জানা। যদি সেখানে বড়সড় কোন ঝা*মেলা না চাও। ভালোয় ভালোয় কালকের ভেতর ফিরে আসবে ইমান্দিপুরে।’ 

দ্রুত মোবাইল বন্ধ করে সিম খুলে নিলো প্রিয়। হা পা কাঁপছে তার। ম্যাসেজের কথা গুলো স্বাভাবিক দেখালেও। এর ফল কতটা অস্বাভাবিক হতে পারে আন্দাজ করতে পারছে প্রিয়।

 

পরের দিন সকালে বাবার জোরাজোরিতে। বাবার সাথে মজনু ভাইকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গেল। প্রিয়’র ধারণা ঠিক।  এই কয় বছরে চুল গিয়ে টাক বেরিয়ে এসেছে মজনু ভাইয়ের।উঁচা লম্বা বলিষ্ট শরীর, সুন্দর চেহারা সবই ঠিক ছিল। শুধু মাথার টাকটার জন্য সুদর্শন হতে হতে পিছিয়ে গেল বেচারা।  

গাড়িতে বসে দেশে আসার কারণ জানালো মজনু ভাই । ছোট থেকে ইউরোপে বড় হয়েছে। দেশের রীতিনীতির থেকে দীর্ঘকাল  বিচ্ছিন্ন। এখানকার কালচার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অ*গ্যত। তাই এবার লম্বা সময় হাতে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ঘুরে দেখবে। সেই সাথে আরেকটা কারণও আছে। মজনু ভাইয়ের চাচা সোহরাব আলি ইমান্দিপুরের পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে এইবার। সেই নির্বাচন দেখতে আরো তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছে। প্রিয়’র হাসি পেল। মজনু ভাইকে  প্রচণ্ড বুদ্ধিহীন বোকা লোক মনে হলো। নয়তো নির্বাচন দেখার জন্য কেউ এভাবে ছুটে আসবে কেন?

 

মজনু ভাই সবার জন্য বেশ উপহার এনেছে। সারাদিন ভরপুর খাওয়া দাওয়া ব্যস্ততার সাথে কাটলো প্রিয়’র। রাতে সিম খুলতেই শতাব্দের ম্যাসেজ। পাঁচ মিনিট আগে পাঠিয়েছে।,

 

‘ তোমাদের বাড়ির সামনে আছি। তুমি আসবে? নাকি আমি উপরে আসবো!’

 

আঁতকে উঠল প্রিয়। তড়িঘড়ি করে জানালার পর্দা সরিয়ে বাহিরে তাকালো। রাস্তার অপর পাশে গাড়ি থেমে। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে শতাব্দের মুখ ভেসে। ড্রাইভিং সিটে বসে এদিকটাই চেয়ে। ভীষণ এলোমেলো ক্ষে*পে আছে সে। ঘড়ির দিক তাকালো প্রিয়। এগারোটা আটচল্লিশ। ভ*য়ে ঢো্ক গিলল। এতো রাতে কেন এসেছে সে?

 

চলবে…..

 

 

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১৪.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

ফোনের অপর পাশ থেকে ফ্যাচফ্যাচ কান্নার আওয়াজ। গাড়ি্র সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে শতাব্দ। কানে ফোন। শক্ত, গম্ভীর মুখ। প্রিয় কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। থামার নাম নেই কোন। শতাব্দ বিরক্ত হলো। কন্ঠে বিরক্ত ঠেলে বলল,

‘ গত দশ মিনিট ধরে কেঁদে যাচ্ছ। কি হয়েছে বলবে?’

নাক টেনে, এলোমেলো ভাবে চোখমুখ মুছে কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল প্রিয়। একটু সময় নিয়ে। ধরে আসা কন্ঠে বলল,

‘ আপনি উপরে আসবেন না প্লিজ।’

শতাব্দ উত্তর দিলো না কোন। গম্ভীর চোখমুখ নিয়ে কপাল কুঁচকে বসে আছে এখনো। চোখ উঁচিয়ে সামনের বাড়ির বারান্দায় চাইল একবার। অন্ধকার বারান্দায় জড়সড়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়।

প্রিয় কাঁপাকাঁপি কন্ঠে করুন সুরে বলল আবার,

‘ আব্বা জেগে, টের পেলে ভ*য়*ঙ্কর তুল*কালাম লেগে যাবে। আপনি চলে যান প্লিজ।’

রাগ বাড়ল শতাব্দের। সারাদিন না নেয়ে, না খেয়ে নির্বাচনের কাজ সামলে চারঘন্টা জার্নি করে ঝা*মেলা মেটানোর জন্য  ইমান্দিপুর এখানে এলো। আর মেয়েটা তাকে বাবার ভ*য় দেখিয়ে চলে যেতে বলছে? শতাব্দের প্রচন্ড রাগ হলো। ইচ্ছে করল উপর থেকে টেনে নামিয়ে প্রিয়’র দু’গালে দুইটা চড় বসিয়ে দিতে।

‘ তুমি আসবে? নাকি আমি উপরে আসবো!’

শতাব্দের ঠান্ডা আওয়াজ। প্রিয় হতভম্ব হতাশ! কন্ঠে এক রাশ ভী*তি,

‘ আব্বা আম্মা জেগে। বিল্ডিংয়ের নিচে ক্যামেরা লাগানো। দারোয়ান আঙ্কেল পরিচীত। দেখলে আব্বার কাছে নালিশ করবে।’

প্রিয়’র কথা কানে তুলল না শতাব্দ। গাড়ির দরজা খুলে বিল্ডিংয়ের দিক পা বাড়ালো। 

শতাব্দকে বাড়ির দিকে আসতে দেখে। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। চেঁচিয়ে বলল,

‘ আসবেননা প্লিজ। প্লিজ!’

বলতে বলতেই কেঁদে দিলো প্রিয়। শতাব্দ থেমে গেল। অপর পাশ থেকে প্রিয়’র কান্নাভেজা ভী*ত আওয়াজ। চোখ বুজে রাগ চাপানোর চেষ্টা করল শতাব্দ। ভারী শ্বাস ফেলে একটু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। বলল,

‘ এসব আমাকে ইগনোর করার আগে ভাবা উচিত ছিল।’

প্রিয় উত্তর দিলো না কোন। ডুকরে কাঁদছে। এতোক্ষণ টানা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। শতাব্দ শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ কান্না থামাও। ভালো লাগছেনা আমার।’ 

চেষ্টা করল প্রিয়। কান্না থামছে না তার। ভ*য় ভী*তি ঝেঁকে ধরেছে তাকে। ঠাহর করে শতাব্দ। নরম স্বরে বলল,

‘ আসবো না। এবার কান্না থামাও।’

অনেক কষ্ঠে কান্না থামালো প্রিয়র। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল শতাব্দ,

‘ কি হয়েছ? সমস্যা কোথায়! এভাবে ইগনোর করছ কেন?’

প্রিয় চুপ। আওয়াজ করলো না কোন। এবার গম্ভীর গর্জন করে বলল শতাব্দ,

‘ আমাকে ইগনোর করবে আমি চুপচাপ তামাশা দেখবো! এমন ছেলে আমি নই। আমাকে জ্বা*লাতে চাইলে তুমিও সেই আ*গুনে জ্ব*লবে, পু*ড়বে। আমার যা চাই আপো*ষে হোক বা জোর করে আমি ঠিক আদায় করে নেই। শেষ বারের মত জিজ্ঞেস করছি কি হয়েছে প্রিয়?’

উত্তর দিলো না প্রিয়। নিশ্চুপ কাঁদছে শুধু। শতাব্দ উত্তরের আশায় রইল। অপর পাশ থেকে কোন জবাব না পেয়ে রেগে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ এর মাশুল তোমাকে দিতে হবে। ফল বড্ড ভ*য়ঙ্কর হবে।’ 

কট করে ফোন কেটে। ক্রু*দ্ধ পায়ে গাড়ির দিক এগিয়ে গেল। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে বড়সড় কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। তড়িঘড়ি করে গাড়ি চড়ে রওনা হলো সে। প্রিয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। ভেজা চোখ জোড়া রাস্তায় চেয়ে আছে ঠাই। বুক য*ন্ত্রণা করছে খুব। সেই সাথে চেপে ধরেছে আসন্ন ভয়। সেই রাতে ঘুম হলো না আর। নির্ঘুম কা*টলো সারারাত।    

 

 

সকাল দশটায় ঘুম ভাঙ্গল প্রিয়’র। মায়ের বকুনঢুলতে ঢুলতে টেবিলে নাস্তা করতে এসেছে। ছোলার ডালে রুটি ছিঁ*ড়ে খাচ্ছে। মা পাশেই বসে। চপিং বোর্ডে সবজি কা*টছে। হ্ঠাৎ মা গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কয়টা পর্যন্ত রাত জেগেছিস কাল? চোখমুখ এমন ফোলা  দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে প্রিয়।  

 ঘাবড়ে গেল প্রিয়। মা কি কোন কিছু টের পেল? সন্দেহ করছে!চোখমুখ স্বাভাবিক ফুটিয়ে উত্তর দিলো,

‘ কই না তো। অনেক দিন পর বাড়ি এসেছি তাই ভালো ঘুম হয়নি।’

‘ তোর আব্বা সকাল থেকে চিন্তা করছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে, মেয়েটার কি হয়েছে। চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?’ 

‘ ও কিছু না। তুমি আব্বাকে বলে দিও। জায়গা পরিবর্তনে ঘুম কম হওয়ায় এমন দেখাচ্ছে।’

মা কিছু বলল না আর। প্রিয় চায়ের কাপ গোলগোল ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,

‘ দু’একের ভেতর ইমান্দিপুরে ফিরতে চাইছি আম্মা।’

ভড়কে উঠল আমেনা বেগম। বলল,

‘ দুইদিন হলো আসলি। এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি!’

‘  কিছু নোট’স কালেক্টড করতে হবে। কোচিং শুরু হলে পরে সময় পাবোনা আর।’

খানিক চুপ থেকে ধীর আওয়াজে বলল,

‘ বেশ। যা ভালো মনে করিস। কাল মজনু চাচার বাড়িতে যাবে। সাথে করে নিয়ে যেতে বলবো তোকে।’

কথা বাড়ালো না প্রিয়। বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ালো। গাঁ ডাকা দিয়ে এখানে বসে থাকলে চলবে না তার। সমস্যা কমার বদলে আরো বাড়বে। শতাব্দের ভরসা নেই! আবার কখন চলে আসে। যদি বড়সড় কোন ঝা*মেলা করে? তারচেয়ে বরং চলে যাবে। যা হবার সেখানেই হবে। শতাব্দ নিশ্চয়ই চি*বিয়ে খা*বেনা তাকে!

 

পরেরদিন সকাল সকাল ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি প্রিয়। বাবা পরিচীত গাড়ি ঠিক করে দিয়েছে। ইমান্দিপুরের সামনের গ্রামে মজনু ভাইয়ের চাচার বাড়ি। মজনু ভাইকে নামিয়ে প্রিয়’কে ইমান্দিপুরে নিয়ে যাবে গাড়ি। বাবা মাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে চড়ল। সারা রাস্তা গাড়ি ঠিকঠাক চললেও, মজনু ভাইকে নামাতে যেয়ে সমস্যা আটলো। গ্রামের কাছাকাছি যেতেই গাড়ির ইঞ্জিনে ঝা*মেলা দেখা দিলো। সারতে সময় লাগবে অনেক! মজনু ভাই ফোন করলে। তার চাচাতো ভাই শিহাব গাড়ি করে নিতে আসলো তাকে। প্রথমে তাদের সাথে বাড়িতে যেতে না চাইলেও, কোন দিকাদিক না পেয়ে। শিহাব ভাইয়ের জোরাজোরিতে যেতে হলো প্রিয়কে।

 শিহাব ভাইয়ের মা ফরিদা বানু গ্রামের সহজ সরল মানুষ। অতিথি আপ্যায়নে অধীর। অল্পতেই আপন করে নেয় সবাইকে। মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়েছে। শুকনো মুখে যেতে দিবে না প্রিয়’কে। পাশে বসে পাতে উঠিয়ে যত্ন করে খাওয়ালেন দুপুরে। 

বিকালে প্রিয়কে গাড়িতে তুলে দিতে যেতে কেঁদে ফেললেন তিনি। শাড়ির আঁচলে চোখ মুখছে মুছতে বললেন,

‘ আজকের দিনটা থেকে যাও মা।’

‘আরেকদিন এসে থাকবো আন্টি। খালা অপেক্ষা করছে যেতে হবে আজ।’

মৃদু হেসে বিদায় জানিয়ে শিহাবের পাশের সিটে বসল। 

 

গলি’র কাছাকাছি যেতেই ভ*য়ে আঁ*তকে উঠল প্রিয়।  চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে বিশাল সমাবেশের আয়োজন। চেয়ারম্যান সাহেব তদারকি করতে ব্যস্ত । পাশেই দাঁড়িয়ে শতাব্দ। আশেপাশে আরো লোকজন অনেক। মাথায় ওড়না টেনে মুখ লুকাতে চাইল প্রিয়। লাভ হলো না কোন। গাড়ি থেকে নামতেই শতাব্দের তো*পের মুখে পড়ল। তার আ*গুন ঝরা র*ক্তিম চোখমুখ। শিহাবের দিক ঠাহর করে। শিহাবও একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর ছেলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দুজনের মধ্যে চোখেচোখে নীরব যু*দ্ধ চলছে। শতাব্দ রাগ চেপে কোনরকম হাত মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে। শিহাবে ঠোঁটের কোণে উষ্কানি সূচক হাসি। শতাব্দ তে*ড়ে আসতে চাইলে, কাঁধ চাপিয়ে থামিয়ে দিলো চেয়ারম্যান সাহেব। চোখের ইশারায় শান্ত হতে ইঙ্গিত করল। এসবে ঘাবড়ে গেল প্রিয়।  শিহাবকে বিদায় জানিয়ে শতাব্দের দিক তাকাতেই ভ*য়ে কেঁপে উঠল। অ*গ্নি দৃষ্টির ভস্ম করা নজর! ঢোক গিলে মাথা নুয়ে নিলো প্রিয়। ব্যাগ হাতে বড় বড় পা ফেলে ভিতরে গেল দ্রুত। 

সমাবেশ শেষে সন্ধ্যায় প্রিয়দের বাড়ি এলো শতাব্দ। গলার ভাঁজ পেয়ে ভয়ে দরজা আটকে বসে রইল প্রিয়। খালা ডেকে গেল কয়েকবার। মাথা ব্যাথার মিথ্যা বাহানা করে সারা সন্ধ্যা বেরিয়ে এলো না আর। ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করে চলে গেল শতাব্দ।

 রাতে বারান্দায় কাপড় আনতে গিয়ে ভড়কে গেল প্রিয়। সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শতব্দ। অবছা আলোতে ভেসে আছে মুখ। তার আক্*রোশপূর্ণ দৃষ্টি এদিকটাতেই চেয়ে। চোখে ক্রো*ধ। হাতে সিগারেটের জ্ব*লন্ত আ*গুন। নিষ্*ঠুর নি*র্দয় সেই চাহনি। যেন দৃষ্টিতেই জ্বা*লসে দিবে সে। প্রিয় ঘাবড়ে গেল। তড়িঘড়ি পা চালিয়ে ঘরে চলে এলো। বারান্দার দরজা লাগিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলল। মানুষটার সামনে যাবে না আর। একদমই যাবেনা! দেখা যাবে তার ভ*য়*ঙ্কর ভস্ম করা চাহনিতে জ্ব*লসে দিচ্ছে প্রিয়’কে। 

 

ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে আজ। আলসি ভেঙ্গে বিছানা ছাড়ল প্রিয়। প্রতিদিনকার অভ্যাসের ন্যায় আজও আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বারান্ধায় গেল। চোখ কচলে সামনে তাকাতেই শিউরে উঠল। গত রাতের সেই একই জায়গায় শতাব্দ এখনো বসে। দৃষ্টি প্রিয়দের বারান্দায়। ফর্সা মুখশ্রী মুড়ছে আ্ছে। র*ক্তিম ফোলা চোখ। হাতে এখনো সিগারেট জ্বলছে। সারারাত ঘুমায়নি সে? 

তার চোখে এখনো রাগ। ভয়*ঙ্কর রাগ! সময়ের সাথে সাথে যেন আরও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। হাতের কাছে পেলে নিশ্চয়ই তছন*ছ করে ফেলবে! ভেবেই চমকে গেল প্রিয়। ঝটপট পা চালিয়ে ভিতরে চলে এলো।

 দুপুরের আগে জুবাইদা শতাব্দের বার্তা নিয়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘ ভাই ভীষণ রেগে। বোধহয় কাল সারারাত ঘুমায়নি। তোকে দেখা করতে বলেছে। সাথে এটাও বলেছে তুই গেলে কিছু বলবে না। ভাইয়া আসলে বড়সড় ঝা*মেলা হবে।’

‘ কিছু বলবেনা!’ শুনে প্রিয় আরো বেশি চুপসে গেল। সে জানে একবার হাতের কাছে পেলে শতাব্দ তাকে থা*পড়িয়ে অজ্ঞান করে ফেলবে। খু*নও করতে পারে! যা ভ*য়*ঙ্কর রেগে! ভরসা নাই। ভ*য় ছাপিয়ে চোখমুখ স্বাভাবিক করল। গলা টানটান করে বলল,

‘ অনেক কাজ আছে আমার। যাবোনা।’

জুবাইদা চমকে গেল। মলিন মুখ করে বলল,

‘ তোর না হয় জা*নের ভ*য় নেই! আমাদের কেন ফাঁ*সাচ্ছিস?      

কেন এমন করছিস সব জেনে গেছে ভাই।’

প্রিয় চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ কে বলল?’

জুবাইদা মিনমিনিয়ে বলল, ‘ সকালে জিজ্ঞেস করছিল ভাই তাই…’

এতটুকু বলে থামলো।হতাশ শ্বাস ফেলল। বিমূঢ় চেয়ে রইল প্রিয়। এখানে এসে কি নিজের পায়ে নিজে কু*ড়াল মা*রল? কি করবে এখন? শতাব্দের তো*পের থেকে কিভাবে বাঁচবে। পালাবে? যদি ধরে ফেলে। না বের হবেনা আর। বাড়ির বাহিরে এক পাও রাখবেনা সে।

 

কলেজ থেকে ফিরে। খালা শুয়ে আছে ঘরে। অসুস্থ শরীর। প্রেসার বেড়েছে। বিকাল থেকে লোডশেডিং হচ্ছে। চারদিক অন্ধকারে তলিয়ে সন্ধ্যা নামছে। টিমটিমে মোমবাতি জ্বলছে। আলোঅন্ধকারে ছেয়ে আছে ঘর। ‘ঠকঠক’ হ্ঠাৎ দরজায় করাঘাত। বিছানা ছেড়ে দরজার দিক পা বাড়ালো প্রিয়। দরজা খুলে কাউকে দেখলো না বাহিরে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে পিছন ফিরতে ঘাবড়ে গেল সে। সামনে অন্ধকার ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে। যেন ভীষণ রেগে। প্রিয় আওয়াজ করবে। তার আগেই মুখ চেপে ধরলো। গায়ের ওড়না টেনে  মুখ বেঁ*ধে ছায়ামূর্তিটা কোলে তুলে নিলো।

 

( পেজের রিচ ডাউন গল্প পৌঁছালে পরবর্তী পর্বের জন্য অবশ্যই রেসপন্স করবেন)

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১৫.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

কোলে করে ছাদে এনে কাঠের চেয়ারটার উপর ছুঁড়ে ফেলল। হাত মুখ খুলতেই, প্রিয় সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে আসছে শতাব্দ। ভয়ে পা পিছাতে পিছাতে সিঁড়ি কোটার দেয়ালে যেয়ে ঠকলো। খিঁচে চোখমুখ বন্ধ করে নিলো। ভয়ে থরথর কাঁপছে। ধুকপুক করছে বুক। ফোঁসফোঁস রাগী শ্বাস ফেলছে শতাব্দ। নিশ্বাসের গর্জন শুনে রাগের পরিমাণ অনুমান করা যাচ্ছে। আচমকা কাছে এসে এক হাতে কোমর খামচে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিলো প্রিয়’কে। অন্য হাতে শক্ত করে তার চিবুক চেপে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমাকে ইগনোর করা? আমাকে? আমি তোমার ইগনোর ঠেলবার লোক!….বারবার জিজ্ঞেস করেছি। সমস্যা কোথায়? কি হয়েছে। সামনা সামনি বসে সমাধান করি। আমার কথার কোন দাম নেই? তাই না?

প্রিয় চুপ। প্রচণ্ড ভয় করছে তার। শতাব্দের আগুন ঝরা ক্ষিপ্ত নিশ্বাস মুখে পড়তেই। শিরশিরে উঠছে গা। শতাব্দ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

‘ কোনকিছু না শুনে, না বলে হুট করে গায়েব হয়ে যাওয়া। শিহাবের সাথে গাড়ি করে ঘুরা। আমি এসব সহ্য করবো? উহু, খু*ন করে ফেলবো।’

শেষ কথাটা ধমকে বলল শতাব্দ। আঁতকে উঠল প্রিয়। ভয়ে জড়সড় হয়ে দেয়াল ঘেঁষে আরো নিবিড় ভাবে দাঁড়ালো। ঝুঁকে এলো শতাব্দ। প্রিয়’র গাল চেপে ধরল। গম্ভীর কঠিন গলায় বলল,

‘ চোখ খুলো। আমার দিকে তাকাও!’

চোখ খুলল না প্রিয়। আরো শক্ত করে চেপে রইল। শতাব্দের রাগ হলো। প্রচন্ড রাগ। দাঁতে দাঁত চেপে, চাপা কন্ঠে ধমকে বলল,

‘ আমার দিকে তাকাতে বলেছি প্রিয়!’

ওই অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকানোর সাহস নেই প্রিয়’র। চোখ খুলবে না সে। গলায় দলা পাকিয়ে থাকা কান্নাটা বেরিয়ে এলো। ডুকরে কেঁদে ফেলল হ্ঠাৎ। শুনল না শতাব্দ। তার রাগ সপ্তম আকাশে আজ। এই কয়েক দিন মেয়েটা বড্ড বেশি পুড়িয়েছে। গতকাল শিহাবের গাড়িতে আসতে দেখে মাথা বিগড়ে গেছে। প্রিয়’র ভয়, কান্না কোন কিছু চোখে পড়ছেনা তার। কোন এক অসুর ভয় করেছে যেন। প্রিয়’র দু’ কাঁধ চেপে ধরল। চিৎকার করে বলল,

‘ আমাকে নিয়ে খেলতে চাইছ? কি ভেবেছ ছেড়ে দিবো আমি! আমি তোমাকে শে*ষ করে দিবো প্রিয়! বলো কেন? কেন এমন করছ! বলো’

শতাব্দ আরো শক্ত করে চেপে ধরলো ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল প্রিয়। ডুকরে কেঁদে উঠল। চাপা স্বরে চিৎকার করে বলল,

‘ কারণ, আপনি অন্যকারো সাথে জড়িয়ে গেছেন তা সহ্য করতে পারছিলাম না। কষ্ট হচ্ছিলো আমার। বুকে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিলো।’

শতাব্দ থমকে গেল। রাগটা নিমিষেই ধপ করে নিভে গেল । প্রিয় মুখের এই তিন বাক্য অদ্ভুত শান্তি দিচ্ছে তাকে। এই কয়েকদিনের অশান্তি, জ্বা*লাপো*ড়া। পলকেই উধাও হয়ে গেল সব।

অনবরত কেঁদে যাচ্ছে প্রিয়। ভারী ভারী শ্বাস ফেলছে। শতাব্দ বড় নিশ্বাস টেনে এলোমেলো নিজেকে সামলে নিলো। প্রিয়’র হাত টেনে কাঠের চেয়ারটায় বসালো। হাত পা গুটিয়ে। ভয়ে কাচুমাচু হয়ে চেয়ারের সাথে লেগে বসে আছে প্রিয়। জোসনা রাত। চাঁদের আলো এসে মুখ ছুঁইছে তার। ফোলা চোখমুখ ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছে। চোখের পানিতে গাল ভিজে। হাত পা এখনো কাঁপছে। শীতল চাহনিতে সব ঠাহর করল শতাব্দ। প্রিয়’র গা ঘেঁষে বসে বুকে টানতে চাইলে। হাত ঠেকিয়ে বাঁধা দিলো প্রিয়। শুনলো না শতাব্দ। হেঁচকা টান দিয়ে বুকে এনে ফেলল। কোমর চেপে মিশিয়ে নিলো। ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে প্রিয়। চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে তখনো। ডুকরে কাঁদছে। হেঁচকি উঠে গেল। ছাড়া পাবার জন্য হাতপা ছুঁ*ড়াছুঁড়ি করল। ছাড়লো না শতাব্দ। আরো চেপে ধরল। প্রিয়’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। খানিক সময় নিয়ে প্রিয়’র হাত পা ছুঁড়াছুঁড়ি থামলো। শান্ত হলো। একটু চুপ থেকে। শতাব্দ মৃদু শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ ওই মেয়ের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। নামও জানিনা। কেনটিনে সবার একবার প্রপোজ করেছিল রিজেক্ট করছি। কোথা থেকে জানো আইডি জোগাড় করে ম্যাসেজ দিয়েছিল সেদিন। নির্বাচন, ক্লাস চারদিকের ঝামেলায়  ব্যস্ত থাকায় ম্যাসেজ চেক করা হয়নি আর। তুমি চাইলে কনভারসেশন চেক করতে পারো।’

বুক থেকে মাথা উঁচু করে প্রিয় তাকালো একবার। অভিমানী কন্ঠের সরল জিজ্ঞাসা তার,

‘ আমার কাছে বলছেন কেন? আমি কে হই আপনার?’

শতাব্দ প্রিয়’র মুখপানে সরু দৃষ্টিতে চাইল।ঠোঁট মেলে মৃদু হাসল। স্নিগ্ধ শীতল সুরে বলল,

‘ কি শুনতে চাইছ? প্রেমিকা!’

কপাল কুঁচকে চাইল প্রিয়। শতাব্দ আবার বলল,

‘ উহু, তুমি আমার প্রেমিকা নও। তুমি আমার যন্ত্রণা। বুকে বিঁধে থাকা নিবিড় যন্ত্রণা। যা ক্ষণে ক্ষণে শুধু পো*ড়ায়। ভীষণরকম জ্বা*লায়।’

‘ বেনামি সম্পর্কে এ কেমন অধিকার। কে হই আপনার?’

প্রিয়’র কন্ঠে ব্যকুলতা। বেনামি সম্পর্কটার নাম বুনতে অধির আকুলতা, উৎকণ্ঠা! 

প্রিয়’র অস্থির এলোমেলো চোখজোড়ার উন্মাদনা অস্থিরতা ঠাহর করল শতাব্দ। নিমিষ চেয়ে রইল সেই নিদারুণ হরিণটানা আঁখিতে। সরল চাহনি মেয়েটার। নাকমুখ ছেয়ে আছে র*ক্তিম আভায়। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তিরতির। 

অদ্ভুত এক সম্মোহনী মাথা চেপে ধরল। দৃষ্টিতে ঘোর লাগলো। আচমকা ঝুঁকে পড়লো। প্রিয়’র চিবুক উঁচিয়ে ভ*য়ঙ্কর এক কাজ করল। চোখমুখে এলোপাতাড়ি গাঢ় চুমু দিতে লাগলো। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। ওড়নার কোন চেপে শক্ত হয়ে রইল। প্রচন্ড অনুভূতিতে কাঁপছে সে। শিরশির করছে গাঁ। নিশ্বাসের প্রবল উঠানামা। চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। মিনিট পাঁচেক পর থামলো শতাব্দ। ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে বসলো। তার ভারী ভারী তপ্ত নিশ্বাস। প্রিয়’র মুখ ছুঁইছে বারবার। নিশ্বাসে নিশ্বাসে কেঁপে উঠছে প্রিয়। ভ*য়ঙ্কর এই অনুভূতিতে মিয়িয়ে যাচ্ছে সে। আচমকা শতাব্দের গভীর নেশাতুর আওয়াজ ভেসে এলো। ফিসফিসিয়ে সে বলল,

‘ ভালোবাসি প্রিয়।’

কেঁপে উঠল প্রিয়। এই দুইটা শব্দ তার সর্বাঙ্গে কম্পন তুলে দিয়েছে। মন, মস্তিষ্ক আত্মা নাড়িয়ে দিয়েছে। হ্ঠাৎ অজানা কোন কারণে চোখের কোন ভরে এলো। অশ্রু বনে টপ করে গাল গড়ালো। কেন এই অশ্রু? অতি সুখের কারণে!

হিমেল হাওয়ায় ভেসে এলো ফিসফিস আওয়াজ। অত্যন্ত নিবিড় আর বুক ধা*রালো শতাব্দের সেই সুর, 

‘ আমার তোমাকে একদিন দুইদিনের জন্য না অনন্তকালের জন্য চাই প্রিয়। এতটা চাই, যতটা চাইলে তোমার শরীরের এই মিষ্টি ঘ্রাণে মিশে থাকা যায়!’

লজ্জা পেল প্রিয়। শতাব্দের বুকে মুখ লুকালো। শক্ত করে চোখমুখ বুজে নিলো। ফিসফিসিয়ে মনেমনে বলল,

‘ আমার আপনাকে অতটা চাই, যতটা পেলে আপনি শুধু আমার থাকবেন। শুধুই আমার’

আকাশের চাঁদ তারাগুলো কি এখনো তাদের দিক চেয়ে? নাকি লজ্জায় তারই মত মেঘেদের আড়ালে মুখ লুকালো। প্রিয় পিটপিট দৃষ্টি মেলে আকাশ পানে চাইল। এই চাঁদ, এই রাত শুধুই তাদের। আর তাদের ভালোবাসার।  

 

     বর্তমান

>___________<

 

‘ ভালোবাসি প্রিয়’

আঁতকে উঠল প্রিয়। নিশ্বাসের উঠানামা প্রচন্ড। ভয়ে শরীর কাঁপছে। হাতপা থরথর করছে। ঝিমঝিম করছে সব। মাথাটা চক্কর দিলো। হ্ঠাৎ চোখের সামনে সব অন্ধকার হতে লাগলো। প্রিয়কে ঢলে পড়তে দেখে। অরণ্য তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো।  তাড়াতাড়ি করে প্রিয়কে যেয়ে ধরলো। গাছের নিচে বসিয়ে। একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুমি ঠিক আছো?’

হাত মুঠিবদ্ধ। চোখ বুজে উপর নিচ আলতো মাথা ঝাকাল প্রিয়। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। গা গুলিয়ে আসছে। অরণ্য আবার জিজ্ঞেস করল,

‘ পানি খাবে? আনবো?’

প্রিয় আবারো মাথা ঝাকাল। অরণ্য পাশের দোকান থেকে পানি এনে খুলে হাতে দিলো। পুরোটা পানি শেষ করে খানিক চুপ থেকে প্রিয় বলল,

‘ আপনি আমার ভাইয়ের বন্ধু…

অরণ্য কথার ধাঁচ ধরতে পেরে থামিয়ে দিলো। বলল

‘ তুমি অসুস্থ। ওসব কথা থাকনা এখন প্রিয়।’

‘ সবটা এখনি ক্লিয়ার করা প্রয়োজন। আমি চাইনা কোন মিথ্যা আশা পুষে থাকেন আপনি। অরণ্য ভাই ছোট থেকে আপনার আমাদের বাসায় আসা যাওয়া। সবসময় বড় ভাইয়ের চোখে দেখে এসেছি। ভাইয়ের মতই জেনেছি। মনের ভুলেও আপনার সম্পর্কে কখনো এমন ধারণা আসেনি আমার। আর তাছাড়া…

এতটুকু বলে থামলো প্রিয়। নিশ্বাস আটকে আটকে আসছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। একটু সময় নিয়ে বলল আবার,

‘ আর তাছাড়া আমার পক্ষে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব না। বিয়ে প্রেম ভালোবাসা আবেগে জড়ানো মত ইচ্ছা আমার নেই। এসব খানিকে অপ্রয়োজনীয় মোহ। মোহ কেটে গেলে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। ঝকঝকে হয়ে যায় চোখ।’

প্রিয়’র চোখমুখে বিরক্তির তিক্ত আভা। অরণ্য মনযোগ দিয়ে শুনল। কাতর কন্ঠে আবেদন করল,

‘ তোমার অতীতে কি ঘটেছে আমি জানি না। জানতে চাইও না। শুধু তোমাকে চাই। একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না প্রিয়?’

প্রিয় তড়িঘড়ি উত্তর দিলো,

‘ না যায়না। এসব প্রেম বিয়ে সংসার করার মত ফালতু সময় আমার নেই। এসব তিক্ত অসহ্য বাজে জিনিস!’

হতাশ শ্বাস ফেলল। প্রিয়’র চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়। তবুও মেয়েটা তা ছাপানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তিক্ত কথার বুলিতে ভেতরের ভয়টা ঢাকতে চাইছে। অরণ্য বলল,

‘ শুনলাম প্রভার বয়ফ্রেন্ডের ভাইয়ের জন্য তোমার হাত চাইছে। যদি বিয়েই করো তাহলে আমাকে করতে সমস্যা কোথায়? আগামীকাল তোমার হাত চাইলে বাবাকে তোমাদের বাড়িতে পাঠাবো।’

ক্ষেপে উঠল প্রিয়। ক্ষিপ্ত কন্ঠেই বলল,

‘ সোজা কথা বুঝতে পারছেনা না আপনি? আমি বিয়ে করবো না। না আপনাকে, না অন্যকাউকে। এসব প্রেম বিয়ে আমার জন্য নয়। আজকের পর আর কোনদিন আমাকে ফোন করবেন না।’

বলেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বড় বড় ধাপ ফেলে জায়গা ত্যাগ করল। খানিক সামনে এসেই হাঁপিয়ে গেল। বড় গাছ্টার নিচে বসে। বড়বড় শ্বাস ফেলল। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। মাথা ঝিমঝিমানো আরো বাড়ছে। শরীরে শক্তি পাচ্ছেনা কোন। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ইরার নাম্বারে ফোন করল। দুবার বাজতেই অপর পাশ থেকে ফোন তুলল। বলল,

‘ হ্যাঁ প্রিয় বল।’

‘ তুই কোথায়? বাড়িতে?’

‘ হ্যাঁ বাড়িতেই আছি। কেন? কি হয়েছে? তুই কোথায় বলতো!এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?

‘ শরীর খারাপ লাগছে। একা বাড়ি যেতে পাড়বো না বোধহয়। একটু আসবি!’ প্রিয়’র করুণ আকুতি।

‘ তুই কোথায়?’

‘ তোর বাড়ির পাশে লেকের পাড়ে।’

‘ আচ্ছা,  আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।’

পাঁচ মিনিটের ইরা এসে পৌঁছালো। তাড়াতাড়ি রিকশা ডেকে প্রিয়কে তুলল। থরথর কাঁপছে প্রিয়। ঠান্ডা হাত পা। চোখমুখ ফ্যাকাসে। কেমন নেতিয়ে আছে মেয়েটা। আঁতকে জিজ্ঞেস করল ইরা,

‘ এখানে কি করছিলি? জানিস হুটহাট অসুস্থ হয়ে পড়িস। তবুও একা কেন বের হয়েছিস?’

ইরার কাঁধে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে আছে প্রিয়। মিনমিনিয়ে বলল,

‘ অরণ্য ভাই ডেকেছিল।’

‘ তোর ভাইয়ের বন্ধু অরণ্য? কেন ডেকেছে?’

‘ প্রপোজ করতে।’

‘ তুই কি বললি? সবসময়ের মত ‘না’!

প্রিয় চুপ। ইরা আর কথা বাড়ালো না। রিকশা প্রিয় বাড়ির সামনে এসে থামলো। ভাড়া মিটিয়ে দুজন উপরে চলে গেল। দরজা খুলে মেয়েকে দেখে আমেনা বেগম হতভম্ব, ঘাবড়ে গেল। তড়িঘড়ি করে ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে আনলো। ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে উঠল। প্রিয় বিরক্ত হলো বলল,

‘ মা মাথা ধরছে আমার। এটা এখন অস্বাভাবিক কিছুনা। প্রায়ই হয়। কান্না করোনা তো প্লিজ।’

আমেনা বেগম থামলেন না। মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ প্রিয়’র পাশে বসে রইল ইরা। যাওয়ার আগে ইনভিটেশন কার্ড ধরিয়ে বলল,

‘ এমনিতেও বিকালে কার্ড নিয়ে তোদের বাড়িতে আসতাম। এখন যখন আসছিলাম তখন ঝটপট ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। আগামী বুধবার  আমার বোনের মেয়ে অদ্রিজার জন্মদিন। তোকে কিন্তু অবশ্যই আসতে হবে।’

মলিন হাসলো প্রিয়। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। ধীর আওয়াজে বলল, 

‘ আসবো’

মুচকি হেসে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল ইরা। প্রিয় বালিশে গা এলিয়ে আরাম করে বসলো। কার্ডটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে  দেখলো। বেবি পিংক আর হোয়াইট কম্বিনেশনে ভীষণ সুন্দর কার্ড। প্রাচুর্য বাড়াতে উপরে সোনালী রঙের আবরনে ডেকেছে। কভার খুলে ভেতরের কার্ডটা বের করল প্রিয়। কার্ডে চোখ বুলাতে বুলাতে হ্ঠাৎ অভ্যর্থনায় চোখ আটকালো। ‘ Dr. rikta & Dr.khan’ গোটা গোটা অক্ষরে লিখা। কার্ডে Dr. না লাগিয়ে শুধু তাদের নাম লিখলেও লোকেদের চিনতে বোধহয় অসুবিধা হতো না। প্রিয়’র হ্ঠাৎ মনে হলো, এই সমাজ ঠুনকো। এই সমাজের মানুষ তাদের অর্জন লোক সমাজে জাহির করতে পছন্দ করে খুব। Dr. khan নামটা দেখে প্রিয়’র রাগ হলো প্রচন্ড। মাথা যন্ত্রণাটা আবারো নাড়া দিয়ে উঠল। ঝাপসা হয়ে এলো চোখ। ডুব দিলো অনেকবছর আগের সেই অতিতে।

 

   অতীত

>_______<

 

     

  

চলবে………

 

ফিলোফোবিয়া

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১৬.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

পরেরদিন খালার সাথে দেখা করতে মজনু ভাই এলো সকাল সকাল। খালা বেশ ঘটা আয়োজন করেছে। হরেক রকম রান্নাবান্না খাবারদাবার। 

কোচিং শেষে বাড়ি ফিরে হল ঘরে শিহাবকে বসে থাকতে দেখল প্রিয়। ভ্রু কুঁচকে এলো সামান্য। প্রিয়কে দেখে শিহাব উঠে দাঁড়ালো। বিনয়ী স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ এতো দেরি হলো যে? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোমার!’

শিহাবের কন্ঠে স্পষ্ট অধিকারবোধ। যেন অনেক বছরের পরিচীত। প্রিয় বিস্ময় কাটিয়ে সালাম জানিয়ে বলল,

‘ স্যার আসতে দেরি করেছে তাই দেরি। কেমন আছেন আপনি?’

‘ ভালো থাকি কি করে? সারাদিন শুধু তুমি মাথায় ঘুরঘুর করো।’

 কথার অর্থ বুঝল না প্রিয়। গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকলো শুধু। চোখমুখে স্পষ্ট হতভম্ব ফুটে। কথা এড়িয়ে প্রিয় বলল,

‘ আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

ঘরে চলে এলো প্রিয়। গোসল করে বেরিয়ে দেখল তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শিহাব। বিরক্ত হলো প্রিয়। হুট করে তার ঘরে অনুমতি ছাড়া শিহাবের ঢুকে পড়ার ব্যাপারটা একদম পছন্দ হলোনা। বিব্রত হলো খুব। বলল,

‘ আপনি এখানে?’

‘ তোমার অপেক্ষা করছিলাম। লাঞ্চ করবে না?’

কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। শিহাবের কথাবার্তা আচরণ গায়েপড়া লাগছে তার। বিমূঢ় কন্ঠে বলল,

‘ আপনি লাঞ্চ করে ফেলুন। দেরি হবে আমার।’

‘ সমস্যা নেই আমি এখানে বসছি। তুমি তৈরি হও। এক সাথে লাঞ্চ করবো।’

জবাবে কিছু বলল না প্রিয়। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। অমনি খালার আওয়াজ কানে এলো। দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দুপুরের খাবার পর। ছাদ ঘুরে দেখার আবদার করল শিহাব। খালা প্রিয়কে ছাদ ঘুরিয়ে দেখাতে বলল। বিরক্ত হলো প্রিয়। খালার কথার পিঠে অমান্য করার সাধ্যি নাই তার। চোখমুখ অন্ধকার করে শিহাবকে ছাদে নিয়ে গেল। মেহমান কিনা! শিহাব ছাদ ঘুরছিল। ছাদ ঘুরে দেখা মূলত বাহানা ছিল। আসল উদ্দেশ্য প্রিয়’র সাথে সময় কাটানো। 

ছাদের চেয়ারে বসে ছিল প্রিয়। শিহাব সামনের চেয়ারে বসে কথা বলছে অনবরত। নিজেদের নিয়ে বাড়িয়ে চড়িয়ে গপ্পো করে। প্রচন্ড বিরক্তি বিতৃষ্ণা চেপে ধরেছে প্রিয়কে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ শুনছে। ঘুমে চোখজোড়া টলমল করছে। খালার উপর রাগ হচ্ছে খুব। প্রিয়কে না পাঠালে কি হতো! হাই টানতে টানতে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। গতির ভেতর শতাব্দদের গাড়ি ঢুকছে। চোখমুখ নেচে উঠল প্রিয়’র। ঘুমঘুম ভাবটা মুহূর্তেই কেটে গেল। শতাব্দ কি ঢাকা থেকে ফিরল তবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে রেলিং এর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিলো। খয়রি গাড়িটা থেকে শতাব্দ নামছে। প্রচন্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখমুখ মুড়ছে আছে একদম। আচমকা ছাদের দিক চাইল শতাব্দ। প্রিয়’র পাশে শিহাবকে দেখে গম্ভীর করে নিলো মুখ। কপাল কুঁচকে ভিতরে চলে গেল। প্রিয় হতাশ চেয়ে রইল। দুজনকে সন্দিহান দৃষ্টিতে পরখ করলো শিহাব। তাদের মধ্যে  কিছু চলছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তবে কি চেয়ারম্যানের ছেলে শতাব্দের সাথে প্রিয়’র প্রেম চলছে! 

 

আজ নির্বাচন। গ্রাম জুড়ে চাপা উত্তেজনা। এলোমেলো সব। নির্বাচন কেন্দ্র থেকে খবর এসেছে খানিক আগে। ভ*য়ানক গন্ডগোল হয়েছে সেখানে। মা*রামা*রি হা*তাহাতি হচ্ছে কেন্দ্রের বাহিরে। গভীরভাবে আ*হত, র*ক্তাক্ত কয়েকজন। কো*পাকুপি হয়েছে। কারো হাত খুয়েছে, কার পা। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অনেকের জীবন সংকটে। এখনো ঠিকঠাক কারো খবর পাচ্ছেনা। পরিস্থিতী ভীষণ বা*জে। নিয়ন্ত্রণে আনার পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে। শুনে হাতপা কাঁপাকাঁপি শুরু করেছে প্রিয়’র। বুক চেপে ধরেছে ভয়ে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে যাচ্ছে হাজারবার। 

দুপুরে যখন শতাব্দের সাথে কথা হয়েছিল। বলেছে, এই কেন্দ্রের বাহিরে আছে। এখন অবধি সব ঠিক আছে। সব কেন্দ্র মিলিয়ে জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি। তাদের পক্ষে জনগন। পরিস্থীতি ভালো দেখে বিরোধী দল ক্ষেপেছে। এটা ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র।  ঝামেলার আশংকা আছে। তাই ফলাফল অবধি এখানেই থাকবে। তারপর আর কথা হয়নি। একটু আগে চেয়ারম্যান বাড়ির লোকজনকে ছুটাছুটি করে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। সেই থেকে আরো বেশি ভয় করছে। তার আবার কিছু হয়নি তো! ঠিক আছে তো শতাব্দ? 

চিন্তায় মাথা ভার হয়ে আসছে। বারবার চোখ ভরে আসছে। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। বারান্দায় ছুটে যাচ্ছে বারবার। যদি চেয়ারম্যান বাড়ির কাউকে দেখা যায়। কোন একটা খবর পাওয়া যায়! খালার ফোন থেকে ফোন করছে শতাব্দকে তুলছেনা সে। প্রিয়’র চিন্তা আরো বেশি বেড়ে গেল। ভ*য়ে কেঁদেই ফেলল। খালা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। উত্তরে কিছু খুলে বলল না প্রিয়। বিরবির করে শুধু বলল, ‘ শ.শতাব্দ ভাই ঠিক আছে তো খালা?’

আয়েশা বেগম বিমূঢ় চেয়ে রইল। শতাব্দের প্রতি প্রিয়’র এমন চিন্তা, স্পর্শানুভূতি দেখে আশ্চর্যান্বিত সে। ভীষণরকম অস্বাভাবিক লাগছে। এভাবে চিন্তা, ভয়ে কাঁদতে দেখেনি কখনো প্রিয়’কে। হাউমাউ করে কাঁদছে প্রিয়। তবে কি তার সন্দেহ ঠিক। শতাব্দের সাথে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে প্রিয়? আঁতকে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে প্রিয় কাছে গেল। ফ্লোরে বসে হাতপা ছড়িয়ে কাঁদছে প্রিয়। আয়শা বেগম কাছে যেতে কাঁধ ঝাকিয়ে ভনিতা বিহীন জিজ্ঞেস করল,

‘ আমার দিকে তাকা। আমার দিকে তাকা প্রিয়। শুন, কি হয়েছে তোর?’

আয়েশা বেগমের ভয়ার্ত এলোমেলো আওয়াজ। অশ্রু ভরাক্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়। চোখমুখ অশ্রুতে ভিজে। শক্তিহীন নেতিয়ে আছে সে। আয়েশা বেগম আবার জিজ্ঞেস করল,

‘ শতাব্দের সাথে তোর সম্পর্ক কি? প্রেম করছিস?’

প্রিয় উত্তর দিলো না কোন। ডর ভয়ে লজ্জায় মাথা ঝুকে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। খালা চিন্তিত। অধৈর্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি প্রিয়! শতাব্দের সাথে তোর কিসের সম্পর্ক?’

শেষ কথাটা বেশ ধমকে বললেন। এবারো নিশ্চুপ প্রিয়। রেগে গেলেন খালা। কাঁধ ঝাকিয়ে শক্ত ধমকে চেঁচিয়ে বলল,

‘ কিছু জিজ্ঞেস করছি প্রিয়! উত্তর দে! 

খালা রাগে হাত উঁচু করতেই ডুকরে কেঁদে ফেলল প্রিয়। হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠলো। জড়সড় বসে আছে প্রিয়। কান্না ভেজা চাপা কন্ঠে বলল,

‘ আমি তাকে ভালোবাসি খালা।’

আয়েশা বেগম বিস্ময়ের চরম পর্যায়। ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। প্রিয়’র কথা গুলো গরম শিসার মত কানে ঢুকছে তার। কিছু ভেবে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল হ্ঠাৎ। ফিসফিস করে বলল,

‘ এটা হতে পারেনা। তুই শতাব্দকে ভালোবাসতে পারবিনা। এটা অসম্ভব। অসম্ভব!’

এই শীতেও প্রচন্ডরকম ঘামছে সে। ভারী ভারী নিশ্বাস পড়ছে। হাঁপিয়ে উঠেছে। প্রেসার বেড়ে গেল কি? 

একটু সময় নিয়ে শান্ত হলো। রাশভারি কন্ঠে বলল,

‘ এটা সম্ভব না প্রিয়। অসম্ভব। এসব বাদ দে। ভুলে যা শতাব্দকে।’

‘ আমি পারবোনা খালা। ভালোবাসি তাকে।’

প্রিয়’র স্পষ্ট উত্তর। উত্তরে ভড়কে উঠলেন তিনি। প্রিয়’র চোখের দিকে তাকালেন। চোখে আজ কোন ভয় নেই তার। কন্ঠে জড়িয়ে আছে সামান্য লজ্জা, জড়তার প্রলেপ। অদ্ভুত, নিদারুণ সাহস নিয়ে মেয়েটা কথা গুলো বলছে। এইটুকু মেয়ে এত সাহস পাচ্ছে কোথা থেকে? এই সাহসের  কি নাম দিবে? বেয়াদবি! নাকি উঠতি বয়সের চরম বোকামি। তিনি নিজেকে শান্ত করলেন নরম বোঝানোর স্বরে বললেন,

‘ এসব প্রেম, ভালোবাসা খানিকের মোহ সব। এখনো তোর পুরো জীবন পড়ে। অল্পবয়সের সামান্য আবেগে গা ভাসালে সব বি*নাশ হবে। আজীবন ধুকে ধুকে ম*রতে হবে।’

শক্ত বনে বসে আছে প্রিয়। খালার কোন কথা কানে তুলছেনা সে। হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে আয়েশা বেগম উঠে দাঁড়ালো। বললেন,

‘ তুই না বুঝতে চাইলে আমার আর কিছু করার নেই। তোর বাবাকে জানাতে হবে সব। ওদের মেয়ে ভরণপোষণ করে এতবড় করেছে। ভালো ভবিষ্যতের জন্য ভরসা করে আমার কাছে পাঠিয়েছে। বিশ্বাসঘা*তকতা করতে পারবোনা তাদের সাথে। সবটা জানাতে হবে তাদেরকে। তারপর যা করার তারা সিদ্ধান্ত নিবে।’

বলে ঘর থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ালো। প্রিয় আরো জোরে কেঁদে উঠল। হামাগুড়ি দিয়ে তড়িঘড়ি পা জড়িয়ে ধরল।  ঝাপটে ধরে কেঁদে কেঁদে  বলল,

‘ খালা, খালা বাবাকে জানাবেনা প্লিজ। জানাবেনা তুমি। বাবা জানলে ঢাকায় নিয়ে যাবে আমাকে।কোন দিন ইমান্দিপুরে আসতে দিবেনা আর। তুমি যা বলবে সব সেই ভাবে চলবে। আমি তার সাথে কথা বলবোনা। দেখা করবো না। এখানে থেকে শুধু দূর থেকে একটু দেখবো খালা। প্লিজ জানাবেনা বাবাকে।’   

প্রিয়’র কান্নাভেজা এলোমেলো অগোছালো কথায় থমকে গেল খালা। চোখ চিকচিক করছে জলে। অনেক বছর আগের কিশোরী নিজেকে দেখছে। একদিন এমন ভাবেই বাবার পা জড়িয়ে কাউকে চেয়েছে। আকুতি মিনতি করেছে। দুর্বল হয়ে পড়ল সে। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল আবার। কাঁপাকাঁপি  হাতে প্রিয়’র কান্নাভেজা মুখটা তুলল। ভেজা কন্ঠে আওড়াল,

‘ শতাব্দ’ই কেন? এই প্রেম বি*নাশ আনবে।’

‘ আসুক।’

‘ য*ন্ত্রণায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হবি!’

‘ রাজি আছি।’

‘ নিঃ*স্ব করে দিবে সব।’

‘ অভিশাপ দিচ্ছো?’

‘ না, বাস্তবতা দেখাচ্ছি।

‘ এইটুকু যন্ত্রণা পেয়ে যদি তাকে পাওয়া যায়। এই যন্ত্রণাকে হাজারবার কবুল।’

প্রিয়’র ব্যাকুল চোখজোড়ায় করুণ আকুলতা। ব্যর্থ নিশ্বাস ফেলল আয়েশা বেগম। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে ঝরলো। টলমল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের ঘরের দিক পা বাড়ালো। পেছনে বসে রইল প্রিয়। নিশ্চুপ, শব্দহীন অশ্রু ঝরালো।  

 

রাত আটটা বাজতে চলেছে। ঠান্ডা ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে প্রিয় শুয়ে। চোখজোড়া এখনো ভিজে। অশ্রু গাল গড়িয়ে ফ্লোরে ঝরছে টপটপ। বিকালের পর খালার সাথে কথা হয়নি আর। না শতাব্দের কোন খবর পেয়েছে। এক আকাশ হতাশা জুড়ে পড়ে আছে নিমিষ। আচমকা ঢোল বাজনার আওয়াজ ভেসে এলো কানে। এলোমেলো হাতে ওড়না খুঁজে। তড়িঘড়ি উঠে। বারান্দার দিকে ছুটে গেল সে। শতাব্দের বাবা শাহরিয়ার খাঁন তৃতীয় বারের মত বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। ফুলের মালা পড়ে ব্যান্ড, বাজনা নিয়ে আসছে। 

শতাব্দকে দেখছেনা কোথাও। ছটফট করছে প্রিয়। খানিক বাদেই ভীড়ের মধ্যে শতাব্দকে দেখলো। গলায় মালা পড়ে গাড়ির সানরুফ খুলে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে জয়ের হাসি। হাত উঁচিয়। আশেপাশে সবাই বাপ ছেলের ছবি তুলছে। চিন্তা মুক্ত হলো প্রিয়। ছোট শ্বাস ফেলল। হ্ঠাৎ অন্ধকারে শতাব্দের হাতে সাদা ব্যান্ডেজে চোখ আটকাতেই। আঁতকে উঠল প্রিয়। অনেক বড়সড় ব্যান্ডেজ। খুব বেশি আঘা*ত লেগেছে কি?

প্রিয়দের বাড়ির সামনে গাড়ি করে বিজয় মিছিল যাওয়ার সময় চোখাচোখি হলো। প্রিয়’র ফোলাফোলা অশ্রুভেজা চোখমুখ দেখে কপাল কুঁচকে নিলো শতাব্দ। খটকা লাগলো তার। মোবাইল বের করে কল করল প্রিয়’র নাম্বারে।

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১৭.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

 ঘুম থেকে জেগে বাড়ি ভর্তি লোক দেখে হতভম্ব প্রিয়। বলা নেই, কওয়া নেই একদল লোক সুড়সুড় করে বাড়িতে ঢুকছে। হাতে হরেক রকম মিস্টান্ন, ফল ফলাদি সহ আরো অনেক কিছুর ডালা। চোখ পাকিয়ে বিমূঢ় দৃষ্টিতে খালার দিকে তাকালো। খালার চোখমুখেও বিভ্রান্তির ছায়া। কারণটা তারও অজানা। সেখানে তদারকি করা এক লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করল খালা,

‘ আশ্চর্য! এসব কি হচ্ছে? তোমরা কারা? ‘

লোকটা খালার কথাহ তেমন গুরুত্ব দিলো না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ডালার হিসাব নিতে নিতে উত্তরে বলল,

‘ মেজবাহ চেয়ারম্যান এসব পাঠিয়েছে।’

মেজবাহ চেয়ারম্যান মজনু ভাইয়ের চাচা। শিহাবের বাবা। গতকালই তো চেয়ারম্যান নির্বাচনে হারলো। আজই এসব কেন পাঠালো? গভীর ভাবনায় ডুব দিলো। 

অমনি সদর দরজার কড়া নড়ল। হকচকিয়ে উঠল প্রিয়। শিহাব সহ তার পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে। মজনু ভাইও আছে পাশে। গম্ভীর চোখে ঠাহর করল প্রিয়। মোটামুটি সকলেই আ*হত। হাতে পায়ে টুকটাক ব্যান্ডেজ। মজনু ভাইয়ের মাথায় ইয়া বড় ব্যান্ডেজ করা। বেচারার ফসলহীন টাকটা ছিদ্র করল কে? নিশ্চয়ই গতকাল গন্ডগোলে হয়েছে।

প্রিয়’র বিস্ময় কা*টল মেজবাহ সাহেবের আওয়াজে। খালার সাথে কুশল বিনিময় করছে। ভদ্রতার হাসি হেসে আয়েশা বেগম তাদের বসতে বললেন। মেজবাহ সাহেব ভীষণ খোশমেজাজে। চোখমুখ দেখে বুঝবার কায়দা নেই যে গতকাল নির্বাচনে হেরেছে। খানিক এদিক সেদিকের কথা বলে বিনয়ী সুরে জিজ্ঞেস করলেন খালা,

‘ হুট সকাল সকাল আপনারা! মানে…’

মেজবাহ সাহেব বুক ফুলিয়ে বসে আছে। দেড় ইঞ্চি পেটটা ভিতরে টেনে সোজা হয়ে বসলেন। হাস্যোজ্জ্বল চোখমুখ করে বললেন,

‘ আমি অল্প কথার লোক। যা বলার সরাসরি বলতে পছন্দ করি। সেদিন আপনার ভাগ্নী প্রিয়কে দেখে আমার বড় ছেলে শিহাবের মনে ধরেছে। আমার বাড়িওয়ালিরও পছন্দের। আপনাদের বাড়ির দাওয়াত থেকে ফিরে  প্রিয়’কে বিয়ে করবে বলে আবদার করছে ছেলে। আমি বলেছি, বাপ কয়েকদিন ধৈর্য ধর। নির্বাচনের যায় ঝামেলা কাটুক।  ঠান্ডা মাথায় ব্যপারটা দেখবো। এই কয়দিন ঠিক চললেও। গতরাত থেকে ছেলে আমার বেঁকে বসেছে। ভোরেই এখানে এসে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করবে।

 সাথে বাড়িওয়ালিও যোগ দিয়েছে। তাই সকাল সকাল প্রিয়’র হাত চাইতে চলে আসলাম। যদিও আপনার ভাগ্নীকে আহামরি তেমন কিছু আমার লাগেনি। ওইতো দেখতে সুন্দরীই যা। আজকাল বিয়ের বাজারে দেখতে সুন্দর হলেই চলে? বাবার ব্যাংক ব্যালেন্সও থাকতে হয়। তাছাড়া কি আছে বাবার? ওইতো শহরের ডাক্তার। আমাদের সামনে এসব ডাক্তার-ফাক্তার পান্তা ভাত। তবুও ছেলে আর বাড়িওয়ালির পছন্দ। তাই মানা করতে পারিনি। শতহোক এই বিশাল সয় সম্পত্তি সব তো তাদেরই জন্য।’

 

সব শুনে হতভম্ব প্রিয়। ভয় শঙ্কা চেপে ধরেছে মন। সেই সাথে চোখমুখে প্রচন্ড বিরক্তি। প্রিয়’র মনে হলো মেজবাহ সাহেব লোকটা প্রচন্ডরকম অহংকারী আর অশিক্ষিত একটা মানুষ। যার কথা বলার নূন্যতম ভদ্রতা নেই। 

 

মেজবাহ সাহেবের দাম্ভিক কথা বার্তায় আয়েশা বেগমেরও ভালো ঠেকলো না। রাগ হলো খুব। রাগ চাপিয়ে ভদ্রতার হাসি হেসে বললেন,

‘তো  কি করে শিহাব?’ 

‘ আমার ছেলেকে আবার কি করতে হবে? ও কিছু করলে আমার এত এত সম্পত্তি কে খাবে?’ 

মেজবাহ সাহেবের দাম্ভিক আওয়াজ। ঠোঁট মেলে আবারো  হাসলেন আয়েশা বেগম। চোখমুখে চাপা ক্রোধের চমক। খানিক চুপ থেকে বলল,

‘ বেকার আপনার ছেলে? বিয়ের পর বউকে কি খাওয়াবে? বাপের কামাই!’

আয়েশা বেগমের কথায় মেজবাহ সাহেব রেগে গেল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,

‘ বাপের এত আছে ছেলেকে কেন করতে হবে?’

আয়েশা বেগম কথা উত্তরে কিছু বললেন না। চোখ বাঁকিয়ে শিহাবকে জিজ্ঞেস করল সরাসরি

‘ পড়াশোনা কতদূর তোমার? ‘

শিহাব বুক ফুলিয়ে বললেন, ‘ এইট পাশ’

আয়েশা বেগমের হাসিটা আরো গাঢ় হলো। মেজবাহ সাহেবের দিক চোখ ঘুরিয়ে বেশ খোশমেজাজে  বলল,

‘ আমাদের প্রিয় এবার নিউ টেনে। আপনার ছেলে থেকে পড়ালেখায় দুই ক্লাস উপরে। দেখতে শুনতেও মাশাল্লাহ। জানেননি তো আজকাল বিয়ের বাজারে সুন্দরী মেয়েদের কি ডিমান্ড। বড় বড় বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। বাপের কিছু থাক না থাক, মেয়ে সুন্দরী চাই। সেখানে  আপনার ছেলের প্রিয়কে বিয়ে করার মত কি আদৌ কোন যোগ্যতা আছে। বাপের কামাইয়ে আয়েশ করা ছাড়া তো গুন দেখছিনা কোন।’

রেগে গেল মেজবাহ সাহেব। হুঙ্কার দিয়ে বললেন,

‘ এত বড় সাহস আমার পোলারে অপমান।জানেন আমি কে?’

‘ আপনি যেই হোন না কেন। তা দেখার বিষয় না। আমাদের মেয়েকে এমন মেরুদণ্ডহীন ছেলের হাতে দিবো না।’

‘ কাজটা ঠিক করলেন না। এর ফল বড্ড খারাপ হবে।’

‘ দেশে আইন এখনো বেঁচে আছে। কোনকিছু করার চেষ্টা করলে বাপছেলেকে জেলের ঘানি টানতে হবে।’

বলতে বলতে আয়েশা বেগম সোফা ছেড়ে উঠলেন। ঠোঁটে চমৎকার হাসি টেনে মেজবাহ সাহেবের দিক তাকিয়ে বললেন,

‘ যা নিয়ে এসেছেন সাথে করে নিয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ , চুলায় চা করছি খেয়ে যাবেন অবশ্যই।’

মেজবাহ সাহেব তেড়ে হুড়মুড়ে বেরিয়ে গেলেন। প্রিয় খালার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে। মানুষটাকে রোজ নতুন নতুন রূপে দেখছে। কি নিদারুণ সাহস নিয়ে মেজবাহ সাহেবের অপমানের জবাব দিয়েছে। তার মা হলে কি এমন করে ওই লোকটাকে জবাব দিতে পারতো? কোনদিন পারতো না বোধহয়। 

 

সারারাত জেগে জয়ের আনন্দ উল্লাস করে ভোর চারটায় বাড়ি ফিরেছে সবাই। বিছানায় শুতেই চোখ লেগে এসেছে শতাব্দের। গভীর ঘুমে তলিয়ে। আচমকা সমুদ্র এসে ডাকলো। ভ্রু কুঁচকে চোখ মেলল শতাব্দ। মুখ জুড়ে একরাশ বিরক্তি। সমুদ্রের চোখমুখে ভয়। ভাইকে এভাবে জাগাতে চায়নি। কিন্তু ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। না জানালেই নয়। সমুদ্র কাচুমাচু স্বরে বলল,

‘ ভাই..ভাই মেজবাহ চেয়ারম্যান শিহাব এলাকায় এসেছে।’

শতাব্দের কুঁচকানো কপালটা আরো কুঁচকে গেল। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ কোথায়?’

‘ প্রিয়দের বাড়িতে। পুরো পরিবার সহ। বোধহয় সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে।’

তড়াক করে উঠে বসলো শতাব্দ। চিৎকার করে বলল,

‘ ওই বা*স্টার্ডটার এত বড় সাহস! আমার জিনিসে ওর নজর।’

রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে। থরথর কাঁপছে শতাব্দ। মাথা অবশ হয়ে আসছে। নির্বাচনে গো হারা অপমানের শোধ এভাবে নিতে চাইছে শিহাব। শতাব্দের দু*র্বল জায়গায় আঘা*ত করে! 

তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠল শতাব্দ। গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল,

‘ আই উইল কি*ল দ্যাট বাস্*টার্ড।’

ভাইয়ের ক্রোধান্বিত চোখমুখ দেখে ঘাবড়ে গেল সমুদ্র। শান্ত করার চেষ্টায় বলল,

‘ ভাই শান্ত হও। এখন কিছু করলে বড় ঝামেলা বাঁধবে। আগামীকাল বাবার শপথ পাঠের পর না হয় ব্যাপারটা….

জোর ধমকে থামিয়ে দিলো শতাব্দ। রাগে দাঁত চিবাতে চিবাতে বলল,

‘ কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো আমি? আমার জিনিসে নজর দেওয়াত সাহস কি করে হয় ওর! ওকে আজ….

বলতে বলতে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে ধারণা আছে সমুদ্রের। ভীষণ ভয়ংকর। কি থেকে হয়। এবার নিজের উপর রাগ হচ্ছে সমুদ্রের। এখনি ব্যাপারটা ভাইকে কেন জানাতে গেল! উফ! এখন কি থেকে কি হবে কে জানে!

 

বিকালে পাড়ায় পাড়ায় খবর ভাসছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে শতাব্দ শিহাবকে বেদম পি*টানো পিটি*য়েছে। হাত পা অচল। মাথা ফে*টে ভাগ। গুরুতর অবস্থা ছেলেটার। লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ভীষণ সিরিয়াস অবস্থা। কেউকেউ বলেছে, নির্বাচনকে ঘিরে মা*রধর করেছে। কেউ আবার মেয়ে জনিত কারণে বলছে। কথাটা ভাসতে ভাসতে প্রিয়দের বাড়িতে এলো। খালা প্রিয় দুজনেই চিন্তিত। দুইজনের চিন্তা দুই রকম।  

দুদিন পর বিচার সালিশ বসবে। সেখানে নিশ্চয়ই প্রিয়’র নামও উঠবে। লোকে পাঁচকান জানবে। প্রিয়’র বদনাম হবে। চিন্তায় মাথা ফাটছে খালার।

 অন্যদিকে শতাব্দের চিন্তায় বিভোর প্রিয়। মা*রামা*রিতে শতাব্দের কিছু হয়নি তো আবার? ঠিক আছে তো সে। এই যে শিহাবের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ আসলো। তা শুনেই কি এত রেগে!  তার রাগের প্রকো*প কি প্রিয়’র উপরও পড়বে!

 কেউ ঠিক বলেছে, প্রেম সর্বনা*শা। দিন দুনিয়া সব ভুলায়।

 

চিন্তায় চিন্তায় বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামালো। চারিপাশ কালো করে অন্ধকার নামছে। সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিল প্রিয়। এমন সময়ই সদর দরজার কড়া নড়ল। দরজা খোলার জন্য পা বাড়াল। তার আগেই খালা এসে দরজা খুলল। শতাব্দ এসেছে। থেমে গেল প্রিয়। অগোচরে দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। শতাব্দকে ভীষণ এলোমেলো দেখাচ্ছে। চোখজোড়া মাত্রাতিরিক্ত লাল। হাতের ব্যান্ডেজটা র*ক্তে ভিজে। মারামারিতে বোধহয় আবারো লেগেছে। দূর আড়াল থেকে সবটা পরখ করছে প্রিয়। 

এই সময় শতাব্দকে দেখে গম্ভীর হলো আয়েশা বেগম। কপালে চিন্তার ছাপটা আরো গাঢ় হলো। আবার ঝা*মেলা হলো না তো কোন? শতাব্দের বিধস্ত অবস্থায় দেখে চিন্তাটা আরো বাড়ল। ভিতরে এসে বসতে বলল। বিব্রত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ চা করবো?’

‘ হুম, কড়া লিগারে।’

আয়েশা বেগম চা করতে চলে গেলেন। দূর থেকে দেখছে প্রিয়। খালাকে এতো স্বাভাবিক শান্ত দেখে হতভম্ব। গতকালকের ঘটনার পর, শতাব্দের সাথে খালার এমন স্বাভাবিক আচরণ হওয়ার তো কথা নয়। খটকা লাগলো প্রিয়। ভয়ে জড়সড় দাঁড়িয়ে রইল। এর মাঝে শতাব্দের সাথে একবার চোখাচোখিও হলো। ভীষণ শান্ত স্বাভাবিক দৃষ্টি তার। ভিতরে কি চলছে বোঝার কায়দা নাই। প্রিয়’র ভয়টা আরো বাড়ল। এই শান্তি বড় কোন ঝড়ের পূর্বাভাস নয় তো!

খানিক বাদে চায়ের ট্রে হাতে ফিরে এলো খালা। শতাব্দের দিক  এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে সামনের সোফায় যেয়ে বসলো। বলল,

‘ তুমি এই সময় এখানে। সব ঠিক আছে তো।’

আয়েশা বেগম বেশ কায়দা করে কথা বলছে। চোখমুখ স্বাভাবিক ভীষণ।গতকাল সে যে তাদের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছে। সেই কথা ঘুনাক্ষরে আঁচ করতে দিবেনা শতাব্দকে। শতাব্দ চায়ের কাপ উঠিয়ে চুমুক দিলো। বেশ স্বাভাবিক শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি প্রিয়’কে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই।’

আয়েশা বেগম চমকে উঠলেন। চোখমুখে উত্তেজনা সামান্য। বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ আমার থেকে কি রকম উত্তর আশা করছ?’

নড়েচড়ে বসলো শতাব্দ। বেশ ফরমাল হয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ পজিটিভ উত্তরের।’

‘ কেন রাজি হবো? তোমার বাবার অনেক টাকা আছে তাই! নাকি গ্রামের চেয়ারম্যান…

থামিয়ে দিলো শতাব্দ বলল,

‘ কোনটাই না। আমি প্রিয়’কে নিজ যোগ্যতায় অর্জন করতে চাই। প্রিয় এখনো ছোট। আমার মেডিক্যাল কমপ্লিট করে বিসিএস দিতে মোট পাঁচ বছর সময় লাগবে। এই কয়’বছর প্রিয় আপনার কাছে আমার আমানত হয়ে থাকবে। কোন সম্বন্ধ যেন না আসে। আশাকরি, আমার আমানতের খিয়ানত করবেন না আপনি।’

আয়েশা বেগমের গম্ভীর চাহনি। বললেন,

‘ যদি তোমার কথা না রাখি।’

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তীর্যক হাসলো শতাব্দ। শীতল কন্ঠে বলল,

‘ তাহলে ক্ষমতার জোর দেখাতে বাধ্য হবো। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবো আপনার ভাগ্নিকে।’ 

আয়েশা বেগম চমকালো। শতাব্দের দৃষ্টিতে সুপ্ত ক্রো*ধ। চোখজোড়া লাল টকটকে। ভীষণ ভ*য়ঙ্কর! শতাব্দের এই রূপ দেখেনি আগে। ভালোবাসার জন্য এমন পাগলামো। তবে কি শতাব্দ সেই মানুষটা থেকে ভিন্ন!

বিড়বিড় করে বলল শতাব্দ,

‘ আমার প্রিয়কে চাই। মানে চাই। ওকেই লাগবে আমার।’

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১৮.

 

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

দুই গ্রামের লোকজন চেয়ারম্যান মেম্বার সহ সালিশ বসলো। সালিশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঝামেলা মিটিয়ে, মিলমিশ করে নিতে হবে দুজনকে। কিন্তু, শতাব্দ তা মানল না। তুমুল কথাকাটাকাটি হলো সেখানে। এক সময় ক্ষেপে গেল শতাব্দ। আরেক চোট বেদম পিটানো পিটালো শিহাবকে। শতাব্দের এমন রূপ দেখে হতভম্ব চেয়ারম্যান সাহেব। ছেলের এমন রূপ দেখেনি আগে। পরবর্তীতে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছে। 

সালিশে প্রিয়’র নাম তোলার কোন সুযোগ দেয়নি শতাব্দ। তার পূর্বেই গন্ডগোল করে থামিয়ে দিয়েছে সব। 

সারা গ্রামে চাপা গুঞ্জন। ঝামেলা যে কোন মেয়েকে কেন্দ্র করেই হয়েছে তা সকলে নিশ্চিত। গ্রামের আনাচে-কানাচে সেই মেয়েকে নিয়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা কৌতূহল। অজানা সেই রহস্যময়ীকে খোঁজার। চারিদিকে তল্লাশি বার্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

 

শতাব্দের প্রস্তাবে সরাসরি বিরোধিতা  না করলেও, বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে আয়েশা বেগম। যেমন, প্রিয়’র সাথে হুটহাট  দেখা না করা, কথা না বলা, যোগাযোগ  না করা এমন আরো অনেক শর্ত। সেসব শর্ত না মানলেও। বিরোধী তার বিরোধিতাও করেনি শতাব্দ। ইমান্দিপুরে আসা কমিয়ে দিয়েছে আজকাল। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া আসেনা। মাসে বড়জোর দুই-এক দিনের জন্য আসা তার।

 

স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ ফেলে। টানটান হয়ে বিছানায় হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল প্রিয়। আজ থেকে ছুটি শুরু। আগামী বিশদিন ঈদের বন্ধ থাকবে স্কুল। বাবা তা আগে থেকে জানত। গাড়ি পাঠাতে চাইছে বারবার, আজ ইফতারের পর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে বলছে। খালাও তাতে এক মত। তিনি চাইছেন না শতাব্দের সাথে প্রিয়’র দেখা হোক।

অভিমানে মন ভার প্রিয়’র। জলে চিকচিক চোখ। গতরাত থেকে কতবার শতাব্দকে ফোন করছে। কখনো বন্ধ বলছে। কখনো আবার তুলছেনা ফোন। বিরক্ত হলো প্রিয়। শতাব্দ কি পড়াশোনা নিয়ে এতই ব্যস্ত! যে তার ফোন তোলার মত সময় পাচ্ছেনা অন্তত। সে কি আড়ালে এড়াতে চাইছে প্রিয়’কে? কথা না বললেই কি প্রিয়’র আবেগ অনুভূতির উপর কাবু আনতে পারবে সে! 

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল প্রিয়। বিছানা ছেড়ে উঠল। ব্যাগ থেকে মোটা ডায়েরিটা বের করল। ডায়েরি কেটে তার ভেতরে ফোন রেখেছে। ডায়েরি কেটে ফোন রাখার বুদ্ধিটা অবশ্য তানহার। নির্বাচনের পর, ঢাকায় যাওয়ার আগে মোবাইলটা দিয়ে গেছে শতাব্দ। প্রিয়’র ফোন চালানোর উপর নিষিদ্ধ জারি করেছে খালা। তাই  খালা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর, রোজ রাতে শতাব্দের ফোনের আশায় হাতে মোবাইল নিয়ে বসে থাকে প্রিয়। সচরাচর ফোন করেনা শতাব্দ। যখন নিজের আবেগ অনুভূতির উপর খুব বেকাবু হয়ে পড়ে তখনি এলোমেলো হয়ে ফোন করে। আবেগে অনুভূতিতে বেকাবু হয়ে আবোলতাবোল অনেক কিছু বলে। তার অনুভূতি মাখানো বেফাঁস কথাবার্তার সদা হু, হা বলে উত্তর দেয় লজ্জায় জর্জরীত প্রিয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে উথাল-পাতাল ঝড় চলে তার।

ঘড়ির দিক তাকালো প্রিয়। চারটা বাজতে চলছে। সে নিশ্চয়ই ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরেছে। একবার তাকে ফোন করবে কি? 

অনেক ভেবে চিন্তে মোবাইল অন করল। শতাব্দের নাম্বারে কল করল। কয়েকবার রিং বাজতেই ফোন তুলল শতাব্দ।

 

‘ কেমন আছো প্রিয়?’

 

ফোনের অপর পাশে হতে শতাব্দের গভীর আওয়াজ পেয়ে, আবেশে চোখ বুজে নিলো প্রিয়। দুইদিন পর এই আওয়াজটা আবার শুনলো। সারা শরীর জুড়ে এক মৃদু শীতল হাওয়া বয়ে গেল। শতাব্দের প্রশ্নের উত্তর দিলো না প্রিয়। কাঁপাকাঁপি কন্ঠে তড়িঘড়ি করে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ কেমন আছেন? শরীর সুস্থ আছে আপনার? গত দুইদিন ফোন করেননি। কোন খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না। চিন্তা হচ্ছিলো আমার।’

প্রিয়’র কন্ঠে চিন্তা, অস্থিরতা। অপর পাশ হতে নিশ্বাসের দ্রুত  ফোঁসফোঁস আওয়াজ ভেসে আসছে। একটু চুপ থেকে শতাব্দ বলল,

‘ শান্ত হও। আমি সুস্থ আছি। এই দুইদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই যোগাযোগ করতে পারিনি।’

প্রশান্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। নিশ্চিত হলো। একটু শান্তি লাগছে এখন। 

‘ এত আবেগী হলে হয়না প্রিয়। নিজের ইমোশনের উপর কন্ট্রোল আনো।’

শতাব্দের এমন কথায় রাগ হলো প্রিয়’র। একজন মানুষ আচানক দুদিন কোন খোঁজখবর ছাড়া লাপাত্তা হয়ে গেলে তাকে নিয়ে চিন্তা করাটা কি স্বাভাবিক না? কপাল কুঁচকে বলল সে, 

‘ আমি কি করে আমার আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসার উপর নিয়ন্ত্রণ আনবো? এগুলোকে কি আদৌ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়? আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনার জন্য চিন্তা হয় আমার! এটা কি অস্বাভাবিক?’

‘ হ্যাঁ, অস্বাভাবিক!’

ভীষণ কষ্ট পেল প্রিয়। কান্নাভেজা অভিযোগী কন্ঠে বলল,

‘ জানি আপনি আসবেননা তবুও প্রত্যেক  সাপ্তাহ আমি আপনার ফেরার অপেক্ষা করি। জানি ফোন করবেন না। তবুও ভোর অবধি মোবাইল হাতে নিয়ে আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকি। সারাক্ষণ আপনার চিন্তায় বিভোর রই। এসব কি অস্বাভাবিক আবেগ মাত্র! ভালোবাসা না?’

শতাব্দ চুপ। প্রিয় কেঁদে ফেলল এবার। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,

‘ আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট। আমি আপনার মত অত পাথর হৃদয়ের মানুষ না। আমার অনুভূতি গুলো বড্ড বেকাবু। সারাক্ষণ শুধু আপনাকে খোঁজে। আপনার মত অত শক্তপোক্ত মনের আমি নই। আমি চেষ্টা করি পারিনা। পারছি না!’

আজ মনের জমানো সব অভিযোগ ঝেড়ে কেঁদে ফেলল প্রিয়। শতাব্দের এই এড়িয়ে চলা, নিতে পারছেনা সে। খালার শর্ত মানতেই কি এমন এড়িয়ে চলছে সে। কারণ যাইহোক না কেন! শতাব্দের এড়িয়ে চলা মানতে পারবেনা সে। একদম মানতে পারবেনা!

অনবরত কেঁদে যাচ্ছে প্রিয়। নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খুলল শতাব্দ।  অস্থির হয়ে বলল,

‘ স্টপ ক্রায়িং প্রিয়!’ 

শুনল না প্রিয়। অনবরত কেঁদে যাচ্ছে সে। এগ্রেসিভ হয়ে উঠল শতাব্দ বলল,

‘ প্রিয়! আই স্যে স্টপ ক্রায়িং।…….. তুমি কান্না করা বন্ধ করবে? নাকি আমি এসে ঠোঁটে চুমু খেয়ে কান্না বন্ধ করবো?’

শতাব্দের এমন কথা নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। থতমত খেয়ে। আচানক কান্না থামলো তার। স্তব্ধ বসে রইল। অশ্রুকণা এখনো চিকচিক করছে গালে। কোন সারাশব্দ না পেয়ে অপর পাশ থেকে শতাব্দ আবার বলল,

‘আমার অনুভূতি গুলো কতটা গাঢ় তুমি আন্দাজোও করতে পারবেনা প্রিয়। তোমার খালাকে কথা দিয়েছি। দূরে থেকে তোমার অনুভূতির পরিক্ষা নিবো। এটা আসলেই ভালোবাসা নাকি তোমার আবেগ!  যদিও এতে কিছু আশে যায় না আমার। আবেগ হোক বা ভালোবাসা রাজি না থাকলে তুলে আনবো। দূরে থেকে মূলত নিজেকে কন্ট্রোলে আনতে চাইছি। তোমার কাছে গেলে বারবার কন্ট্রোলেস হয়ে যাই কিনা!

 তবে হ্যাঁ, ওনেস্টলি আমি জানতে চাই কি চলছে তোমার মনে। 

তখন কি জানো বলছিলে তুমি? রোজ আমার অপেক্ষা করো।  তোমার আইডিয়া নেই আমার প্রেম কতটা ভ*য়ঙ্কর হতে পারে! তোমার এই ছোট বয়স তা সহ্য করতে পারবেনা প্রিয়।

ছটফটানি কি জিনিস বুঝো?  জানো ক্ষণে ক্ষণে কতটা ছটফট করছি আমি। রোজ সকালে চোখ মেলে  আমার তোমাকে চাই। বিকালে চায়ের কাপের সাথে তোমাকে চাই। গভীর রাতে আষ্টেপৃষ্টে আলিঙ্গন করে তোমাকে নিয়ে ঘুমাতে চাই। তোমার খোলা চুলে মুখ ডুবাতে চাই। এক কথায় আমার বউ চাই……

তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিলো প্রিয়। বুক ধুকপুক করছে এখনো। নিশ্বাসের প্রচন্ড উঠানামা। গাঁ শিরশির করছে এখনো। সাথে সাথে আবারো ফোন এলো। একটু সময় নিয়ে ফোন তুলল প্রিয়। কানে ধরতেই চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। অপর পাশ থেকে শতাব্দের গভীর নেশাতুর আওয়াজ ভেসে এলো,

‘ ভদ্র প্রেমিক হতে চেষ্টা করছিলাম। দিলেনা তো! আমার অভদ্রতা ঠেলার জন্য তৈরি হও প্রিয়। আসছি। এক্ষুনি!’

ফোন কেটেছে শতাব্দ। কানে ফোন নিয়ে এখনো বসে আছে প্রিয়। শরীর তিরতির কাঁপছে এখনো। শতাব্দের নেশাতুর ভ*য়ঙ্কর আওয়াজটা কানে বাজছে এখনো।

 

সন্ধ্যার আজান পড়েছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। টিপটপ তৈরি হয়ে শতাব্দের অপেক্ষায় বসে আছে প্রিয়। ঘড়ি দেখছে বারবার। আচমকা খালা এসে বলল,

‘ ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে নে প্রিয়। তোর বাবা আসছে নিতে।’

হতভম্ব প্রিয়। হকচকিয়ে বলল,

‘ বাবা আসছে মানে? আমার তো দুইদিন পরে যাওয়ার কথা ছিল।’

‘ পাশেই কোথায় জানো তোর বাবার দাওয়াত ছিল। তাই এখন ফোন করে বলল, এদিকে এসেছে যখন একেবারে সাথে করে নিয়ে যাবে তোকে।’

‘ কিন্তু খালা…’

সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো খালা। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বলল,

‘ বাড়ি যাওয়ার জন্য আগে বায়না করতি রোজ। এখন বাড়ির কথা শুনলে এভাবে নাক ছিটকাস কেন?’

প্রিয় আমতা আমতা করে বলল,

‘ এখনো কিছু গোছানো হয়নি তাই…’

খালা থামিয়ে বলল,

‘ হাতেহাতে আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। তোর বাবা চলে আসবে এখনি।’

নেতিয়ে পড়ল প্রিয়। বুক ফেটে কান্না আসছে খুব। কতদিন পর আজ শতাব্দকে দেখবে বলে আশা নিয়ে ছিল। কিন্তু….

 

সারাক্ষণ খালা সাথে ছিল। শতাব্দকে জানানোর সুযোগ হয়নি প্রিয়’র। খানিক বাদেই বাবা চলে এলো। এটা ওটা বলে দেরি করছিল প্রিয়। অবশেষে বাবাকে ঘন্টা খানেক বসিয়ে রেখে মন মরা হয়ে বের হলো। বাড়ি যাওয়া নিয়ে চোখেমুখে কোন উৎসাহ নেই আজ। খালাকে বিদায় জানিয়ে বিষন্ন মন নিয়ে গাড়িতে চড়ল প্রিয়। 

ইমান্দিপুর থেকে বেরিয়ে। গাড়ি হাইওয়ের রাস্তায় ইউটার্ন নেওয়ার সময় হ্ঠাৎ প্রিয়’র চোখ পড়লো পাশের গাড়িতে। শতাব্দ ইমান্দিপুরের দিক ইউটার্ন নিচ্ছে। হাস্যোজ্জ্বল হয়ে এলো প্রিয়’র চোখমুখ। আজ পুরো এক মাস পঁচিশ দিন পর শতাব্দকে দেখলো! গলা উঁচিয়ে একবার ডাকতে চাইল। পাশের সিটে বাবাকে দেখে দমে গেল। চোখ ভরে এলো জলে। ইমান্দিপুরে যেয়ে শতাব্দ নিশ্চয়ই প্রিয়’কে খুঁজবে। প্রিয়’য়কে না পেলে কি রেগে যাবে!

 

চলবে…….

    

    

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

১৯.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

ঢাকায় এসে কোথাও মন বসাতে পারছেনা প্রিয়। সবকিছুতে কেমন অস্বস্তি লাগছে। মাথায় শুধু শতাব্দের কথা ঘুরছে সারাক্ষণ। শতাব্দ কি খুব বেশি রেগে আছে?

রাতের খাবারে আমেনা বেগম বিশাল আয়োজন করেছে। অনেকদিন পর মেয়ে বাড়িতে এসেছে। মেয়ের পছন্দের সব খাবারে টেবিল সাজিয়েছে। পাশে বসে প্লেটে এই আইটেম ওই আইটেম তুলে দিচ্ছে। এত খাবার দেখেই হাঁপিয়ে উঠেছে প্রিয়। কপাল কুঁচকে আওয়াজ করে বলল,

‘ পেট ভরে গেছে মা। আর খাবোনা।’

আমেনা বেগম ভড়কে বললেন,

‘ তোর পছন্দের জিনিস রান্না করেছি সব।মাত্রই তো খেতে বসলি। এত তাড়াতাড়ি পেট ভরে গেল। শরীর ঠিক আছে তো তোর?’

বিরক্ত হলো প্রিয়। বলল,

‘ শরীর পুরোপুরি সুস্থ  মা। দুইজন মানুষের খাবার প্লেটে তুলে দিচ্ছ। এত খাবার এক সাথে খাবো কি করে?’

মেয়ের কথা আমেনা বেগমের বিশ্বাস হলোনা সন্দিহান দৃষ্টিতে চাইল একবার। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ আসার পর থেকে এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে তোর?’

‘ কিছুনা মা। জার্নি করে একটু ক্লান্ত লাগছে। ঘুমাবো।’

আমেনা বেগম আর জোর করলেন না। ঘরে পাঠিয়ে দিলেন মেয়েকে। ঘরে এসে বিছানায় বসলেই বাবা আর প্রভা এলো। প্রিয়’র অনুপস্থিতে এতোদিন  কি কি ঘটেছে উৎসাহ নিয়ে বলছে সব।

 বারবার ঘড়ি দেখছে প্রিয়। শতাব্দের সাথে কথা বলার জন্য উসখুস করছে মন। কারো সামনে বের করতে পারবেনা ফোন। অস্বস্তি চিন্তায় নাজেহাল অবস্থা তার। 

রাত বারটা বাজছে।মাত্রই ঘুমিয়েছে প্রভা। সবাই ঘুমানোর পর ব্যাগ খুলে মোবাইল বের করল প্রিয়। মোবাইল অন করতেই। উঁচু  আওয়াজ হলো। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে অন্ধকার জানালার দিক পা বাড়াল প্রিয়। দ্রুত হাতে ফোন সাইলেন্ট করলো। ঝটপট করে শতাব্দের নাম্বারে ফোন দিলো। রিং হচ্ছে অপর পাশ থেকে তুলছেনা ফোন। আবারো ফোন করলো প্রিয়। বেজে বেজে কেটে গেল। কষ্টে কান্না পেল প্রিয়’র। শতাব্দ কি রেগে আছে তার উপর? এর জন্যই কি ফোন তুলছে না। ডুকরে কেঁদে উঠল হ্ঠাৎ। আচানক পেছন থেকে প্রভার হতভম্ব আওয়াজ ভেসে এলো,

‘ ফোন! কোথা থেকে পেলি আপা? প্রেম করছিস তুই?’

ভয়ে আঁতকে উঠল প্রিয়। চোখমুখ মুছে, তড়িঘড়ি পায়ে প্রভার কাছে এলো। প্রভার মুখ চেপে বলল,

‘ আস্তে আব্বা আম্মা শুনে ফেলবে।’

প্রভা শুনলো না। আগের মত ভড়কে যাওয়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ আপা কতদিন ধরে চলছে এসব। ছেলেটা কোথাকার? ঢাকার নাকি ইমান্দিপুরের? তোর সাথে তার কিভাবে পরিচয়? তাড়াতাড়ি বল আপা’

প্রভার কন্ঠে প্রচন্ড তাড়া, চাপা উত্তেজনা। প্রিয় হাত বাড়িয়ে দিলো। গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ তার আগে আমাকে ছুঁয়ে কথা দিতে হবে কাউকে বলবি না তুই। কাউকে না।’

চোখমুখ ছোট হয়ে এলো প্রভার। আহ্লাদী কন্ঠে বলল,

‘ আমি কি কারো কথা কারো কাছে বলি আপা?’

‘ আলবাত! বিশ্বাস নেই। যদি মায়ের সামনে উবলে ফেলিস।’

‘ আচ্ছা, বলবো না। এবার বলো।’

‘ সে ইমান্দিপুরের। বেশ পাওয়ারফুল ফ্যামিলির বড় ছেলে। নাম শতাব্দ। ঢাকা মেডিকেলে পড়াশোনা করছে।’

প্রভাকে বিস্তারিত কিছু বলল না প্রিয়। প্রভাকে এক পয়সার ভরসা পায়না সে। দেখা যাবে মায়ের কাছে ভালো সাজতে গিয়ে উবলে ফেলেছে সব। শতাব্দের ব্যাপারে বিন্দু মাত্র রিস্ক নিবেনা সে।

প্রভা নেচে উঠল খুশিতে। খুশিতে গদগদ করে বলল,

‘ তার মানে সে ভবিষ্যৎ ডাক্তার। ওয়াও। নিশ্চয়ই ভীষণ হ্যান্ডসাম তাই না আপা? তোকে খুব ভালোবাসে?’

প্রভার দিক গোল গোল চোখ করে তাকালো প্রিয়। চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,

‘ এত জানতে হবেনা তোকে। ছোট ছোট’র মত থাক।’

‘ এটা ঠিক না আপা। তুই আমাকে ভুলভাল বুঝ দিচ্ছিস। বি..

ফোনের ভ্রাইবেশন বেজে উঠল হ্ঠাৎ। অন্ধকারে বারবার আলো নিবছে আর জ্বলছে। কেঁপে উঠল প্রিয় শতাব্দের ফোন কাঁপাকাঁপি হাতে ফোন তুলে কানে ধরতেই অপর পাশ হতে শতাব্দের অস্থির আওয়াজ ভেসে এলো,

‘ আমি তোমাদের বাড়ির সামনে। নিচে আসো। এক্ষুনি!’

‘ কিন্তু….

‘এক্ষুনি নিচে আসছ তুমি! কুইক।’

প্রিয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, ফোনটা কেটে দিল শতাব্দ। ফোন হাতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়। পাশ থেকে প্রভা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে আফা? এমন জমে আছো কেন?’

পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। যন্ত্রের মত করে বলল,

‘ সে এসেছে। আমাকে নিচে যেতে বলছে।’

‘ কি! উনি এখানে এসেছে আপা?’

‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়াল প্রিয়। হতভম্ব হয়ে থাকা প্রভার মুখটা আচমকা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে এলো। লাফিয়ে উঠল। গদগদ করে বলল,

‘ ওয়াও! ভাইয়া কত রোমান্টিক মুভির হিরোদের একদম।’ 

রেগে গেল প্রিয়। প্রভার দিক সরু দৃষ্টিতে চেয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। চিন্তিত হয়ে বলল,

‘ নিচে যাবো কি করে! আব্বা টের পেয়ে যায় যদি?’

‘ ওহো আপা! এত চিন্তা করছিস কেন। আমি আছি না? এক্ষুনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

‘ কিন্তু…

‘ কিন্তুকিন্তু না করে তাড়াতাড়ি নিচে যা। নয়তো তোর হিরো উপরে চলে আসবে আপা।’

ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে চাবি এনে, ধীরপায়ে দরজার দিক এগিয়ে গেল দুবোন। দরজা খুলে দিয়ে প্রভা ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ তুই যা, আমি এদিকটা দেখছি আপা। বারান্দায়ই আছি।’

থতমত মুখে উপর নিচ মাথা ঝাকাল প্রিয়। ভয় চিন্তায় হাতপা থরথর করছে তার। ধীর পায়ে শব্দহীন বেড়িয়ে পড়ল প্রিয়। প্রভা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। রাস্তার ওই পাড়ে মেরুন গাড়ি দাঁড়িয়ে। পাশে একজন পুরুষ মানুষের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। উত্তেজনায় মাথা উঁচিয়ে দেখতে চাইল প্রভা। কিন্তু অন্ধকার হওয়ায় তার চেষ্টা বিফল হলো। দেখতে পেলো না শতাব্দকে।

 

ঘড়িতে রাত সাড়ে বারট।  ঢাকার রাস্তাঘাট এখনো সজাগ। শোঁশোঁ করে গাড়ি চলছে। গায়ে পাতলা চাদর জড়িয়ে, গ্রিন সিগ্ন্যালের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সিগ্ন্যাল পড়তেই দ্রুত পায়ে ছুটে গেল প্রিয়। অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। বিধ্বস্ত মুখ। এলোমেলো চুল। কাছাকাছি যেতেই থমথমে হয়ে গেল প্রিয়। পা জোড়া কাঁপাকাঁপি শুরু করল। রেগে যাবেনা তো শতাব্দ? 

ভয়ে জড়সড় পায়ে শতাব্দের সামনে দাঁড়াল। কাঁপা কাঁপা ভীতু স্বরে বলল,

‘ আ..আমি জানতাম না হুট করে আব্বা এসে ঢাকায় নিয়ে আসবে……আপনাকে ফোন করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পাশে খালা থাকায়.. সরি..’

আচমকা হেঁচকা টান দিয়ে বুকে মিশিয়ে নিলো শতাব্দ। প্রিয় থমকে গেল। ঝটপট করে কথা বলাটা, থেমে গেল হুট করে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্টে মিশিয়ে নিলো শতাব্দ।  উৎকণ্ঠা স্বরে বলল,

‘ অনেক মিস করছি প্রিয়! খুব, খুব, খুব বেশি।’

স্তব্ধ হয়ে গেল প্রিয়। আচানক চারিপাশের সবকিছু থমকে গেল যেন। শক্ত মূর্তি বনে দাঁড়িয়ে রইল। শতাব্দের হাতের বাঁধন আলতো হলো। প্রিয়’কে মুখোমুখি দাঁড় করালো। গাড়ির জানালার কাচ যেয়ে ঠেকলো প্রিয়’র পিঠে। ল্যাম্পপোস্ট থেকে সামান্য দূরে বড় বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা হলদেটে আলোটা প্রিয়’র মুখ ছুঁইছে। তিরতির করে কাঁপছে প্রিয়’র আঁখিপল্লব। অনুভূতি, উত্তেজনায় উসখুস করছে। খোলা কেপ মৃদু বাতাসে থরথর করছে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতাব্দ। দৃষ্টিতে প্রিয়তমাকে কাছে পাওয়ার অসীম তৃষ্ণা। নেশাতুর চোখ জোড়ায় গভীর ঘোর। ধীরেধীরে তা আরো তীব্র হচ্ছে। অজানা কোন ব্যথি’র মত সারা অঙ্গ শুষে মাথায় চড়ছে এখন। নিষিদ্ধ, অবাধ্য এক ইচ্ছা জাগ্রত হলো মনে। আচানক প্রিয়’কে চেপে ধরল। গাড়ির সাথে মিশিয়ে নিলো। ঠোঁট জোড়ায় গভীর করে চুমু দিলো। বিমূঢ় প্রিয়। শক্ত পাথরের মত জমে গেছে সে। সারা শরীর জুড়ে  অদ্ভুত এক অনুভূতি বইছে। বিভ্রান্ত চোখ জোড়া গোল গোল করে চেয়ে। উন্মাদের মত আচরণ করছে শতাব্দ। চোখ গাল কপালে অনবরত ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে। যেন হাজার বছর অপেক্ষা’র পর কোন অমূল্য রত্ন পেয়েছে। অদ্ভুত পাগলাদে তার আচরণ। অসহায় প্রিয় দাঁড়িয়ে। অনুভূতি শরীর ধরধর কাঁপছে। কন্ঠে অচেনা এক তৃষ্ণা জমে। 

বেশ কিছু সময় থামলো শতাব্দ। চোখ বুজে প্রিয়’র কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলল। একটু সময় নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠা স্বরে ডাকলো,

‘ আমার প্রিয়’

কেঁপে উঠল প্রিয়। শতাব্দের এমন অধিকার নিয়ে উৎকন্ঠা আওয়াজটা বুক চিড়ে গেল। অজানা এক আনন্দ মনে যেয়ে ঠেকলো। চোখ বুজে আছে প্রিয়। শতাব্দ আবারো আগের মত ডেকে বলল,

‘  ড্যাম! ঠিক এই ভয়টাই ছিল….আবারো কন্ট্রোলেস…আমি এত নিয়ম বেঁধে ভালোবাসতে পারব না প্রিয়!….চেষ্টা করেছি হচ্ছেনা, পারছিনা। ভদ্রপ্রেমিক হওয়াটা কি খুব জরুরী? পারছিনা তো!  চলো, বিয়ে করে ফেলি? তারপর পুতুল সাজিয়ে চোখের সামনের বসিয়ে রাখবো সারাক্ষণ! যখন ইচ্ছা ধুপধাপ  চুমু খাবো তখন।’

লজ্জায় মিয়িয়ে গেল প্রিয়। চোখজোড়া আরো শক্ত করে বুজে নিলো। মানুষটা এমন বেফাঁস, শিথিল কেন? 

প্রিয়’র কানের পেছন চুল গুজে দিতে দিতে বলল শতাব্দ,

‘ ইমান্দিপুর গিয়ে তোমাকে না পেয়ে মাথা আউলে গেছিল। সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছিল। ঘরে যাওয়া হয়নি। গাড়ি থেকেই ফিরে এসেছি। এই বিরহ যন্ত্রণা আর ভালো লাগেনা প্রিয়। চলো বিয়ে করে ফেলি। এই কাপড়ে, এক্ষুনি!’

শতাব্দের এমন কথায় বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়। ছেলেমানুষী আবদারে ফিক করে হেসে ফেলল। বলল,

‘ আব্বা- মা মানবেনা কখনি।’

ঝুঁকে এলো শতাব্দ। প্রিয়’র আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,

‘ মানিয়ে নিবো আমি।’

শতাব্দের চোখমুখ বেশ সিরিয়াস। প্রিয় সম্মতি দিলে এখনি কাজি অফিসে চলে যাবে। মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো প্রিয়। নিচের দিক তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

‘ বড় আপা কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিল। পরে   অবশ্য জানাজানির পর আনুষ্ঠানিক ভাবে আব্বা তুলে দিয়েছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। আপা মারা যাবার এতদিন পরও তা ভেবে কষ্ট পায় আব্বা। আমি চাইনা আমার জন্য আবারো কষ্ট পাক আব্বা।’

খানিক নীরব থেকে মাথা তুলে তাকালো প্রিয়, শতাব্দের চোখেচোখ রেখে ধরে আসা নিবিড় কন্ঠে বলল,

‘ আমি আপনাকে চাই শতাব্দ। খুব করে চাই। তবে সবার অনুমতি দোয়া নিয়ে আপনাকে পেতে চাই।’

চোখ চিকচিক করছে প্রিয়’র। প্রচন্ড অনুভূতিতে হয়তো। ঠোঁট মেলে হাসলো শতাব্দ। দু’কদম এগিয়ে এলো। প্রিয়’র হাত জোড়া হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘ কথা দিচ্ছি, সবার অনুমতি নিয়ে ঘটা আয়োজন করে লাল শাড়িতে মুড়িয়ে বউ সাজিয়ে ঘরে তুলবো তোমায়।’ 

লজ্জায় মিয়িয়ে গেল প্রিয়। দৃষ্টি সরিয়ে, মাথা নুয়ে নিলো। মনে মনে  বলল,

‘ সেই দিনটার অপেক্ষায় রইলাম’

 

প্রিয়’কে রাস্তা পাড় হতে দেখে, তড়িঘড়ি করে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো প্রভা। দরজা খুলতেই ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল প্রিয়। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ টের পায়নি তো কেউ’

‘ উহু, নজর রেখেছি। দরজা আটকে বারান্দায় ছিলাম এতক্ষণ।’

ফোঁস করে স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। ঘরে যেতেই উত্তেজনায় ঝেঁকে ধরলো প্রভা। টাইপিং মেশিনের মত অনর্গল প্রশ্ন ছুঁড়তে লাগল,

‘ ভাইয়া চলে গেছে? কোথায় যাবে এখন? ইমান্দিপুরে? এত রাতে!… আচ্ছা এতক্ষণ কি বললি তোরা পার্সোনাল কিছু? আমাকে বলা যাবে? আচ্ছা আপা ভাইয়া কি রেগে ছিল? তুমি…

‘ আস্তে প্রভা। ধম ফেল। এত কথা কেউ এক সাথে বলে? শ্বাস আটকে ম*রে যাবি তো।’

মুখ চুপসে নিলো প্রভার। বিড়বিড় করে বলল,

‘ এমন করছ কেন বলো না আপা!’

ছোট নিশ্বাস ফেলল প্রিয়। শান্ত স্বরে বলল,

‘ সে এখন এখানে তার এপার্টমেন্টে গেছে। কাল সকালে ইমান্দিপুর যাবে। রেগে ছিলনা। চিন্তা করছিল একটু। আর সব কথা শুনতে হবে কেন তোর?’

চোখমুখ কুঁচকে নিলো প্রভা। চাদরের নিচ থেকে চকলেটের বক্সটা বের করল প্রিয়। প্রভার দিক এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ সে দিয়েছে, এটা তোর জন্য।’

চকলেট বক্স দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল প্রভা। তড়িঘড়ি হাতে নিয়ে গদগদ কন্ঠে বলল,

‘ ওয়াও! Ferrero Rocher. তাও আবার আটচল্লিশ পিসের! এটা তো অনেক দামী…আমার ভীষণ পছন্দের … ভাইয়া জানলো কি করে?’

‘ আমার জন্য এনেছিল। তোর কথা শুনে তোকে দিতে বলল। আরো বলল, পরেরবার গিফট নিয়ে আসবে তার শালিকার জন্য।’

প্রভা এবার খুশিতে নেচে উঠল। বলল,

‘ আজ দেখতে পারিনি। পরেরবার অবশ্যই ভাইয়াকে সামনা সামনি দেখবো। আর গিফটও নিবো। আচ্ছা আপা, ভাইয়া কি খুব হ্যান্ডসাম? ‘

‘ হুম, খুব।’

‘ কেমন?’

‘ স্বপ্নের রাজপুত্রের মত।’

‘ তোমার স্বপ্নে আসে?’

‘ আসে। এসে, ভীষণ রকম জ্বালায় রোজ।’

ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে চোখ বুজে নিলো প্রিয়। তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে যে! স্বপ্ন জগতে আসবে তো সে? 

 

  

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২০.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

আজ ঈদ। সকাল থেকে বাড়িতে হৈচৈ। ঈদগাহ মাঠ থেকে ফিরে জাফর সাহেব মেয়েদের দেখতে না পেয়ে আওয়াজ দিলেন। ঈদের দিন ছেলে মেয়েরা আনন্দে হুল্লোড়ে মেতে থাকবে এতেই তো উৎসবের আনন্দ আরো দ্বিগুণ হবে। জাফর সাহেবের আওয়াজ শুনে হুড়াহুড়ি করে ছুটে এলো দুই মেয়ে। কার আগে কে সালাম করবে তা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি। প্রিয় দ্রুত সালাম করে তড়াক করে উঠে বাবার সামনে হাত ফেলে বলল,

‘ আব্বা আমার ঈদ সালামি।’

প্রভা কপাল কুঁচকে নিলো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,

‘ আপার আগে আমি এসেছি। আমাকে আগে সালামি দিবে আব্বা।’

‘ তাতে কি! সালাম তো আমি আগে করেছি।’

ভ্রু নাচিয়ে বলল প্রিয়। প্রভা রেগে হাতপা ঝেরে বলল,

‘ ভালো লাগেনা প্রত্যেকবার তুই জিতিস। উফ!’

মুখ ভেঙ্গচি কাটল  প্রিয়। কাঁধ নাচিয়ে বিজয়ের হাসি হাসল। মেয়েদের খুঁনসুটিতে জাফর সাহেব হেসে ফেলল। মেয়েদের হাতে সালামি তুলে দিতেই মেয়েরা খুশিতে নেচে-কুঁদে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। মায়ের কাছ থেকেও তো সালামি আদায় করতে হবে!

 

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মায়ের ঘরে গেল প্রিয়। মা তখন ঘর গোছাতে ব্যস্ত। গলা ঝেড়ে ডাকলো প্রিয়। আমেনা বেগম ঝাড়ু দিতে দিতে মেয়ের দিক এক পলক তাকালেন। জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে প্রিয়। মেয়ের কাচুমাচু মুখ দেখে আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কিছু বলবি!’

প্রিয় যেন সাহস পেল। নীচু গলায় বলল,

‘ কাল দিতীদের বাড়ি আমাকে আর প্রভাকে দাওয়াত করেছে। যদি তুমি বলো….

প্রিয়’র কথা কেটে, আড়ষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আমেনা বেগম,

‘ দিতী কে? তোর ক্লাস সেভেনের বান্ধবী। যার বাবা ওইবার ইলেকশন করেছে?’

মাথা ঝাকাল প্রিয়। আমেনা বেগম একটু চুপ থাকল। তারপর বলল,

‘ নেতার বাড়ি, বখাটেদের ভিড় থাকে সবসময়। যেতে হবে না কোথাও।’

‘ ও অনেক করে বলছে। বাড়িতে কেউ নেই। প্রভাও তো সাথে যাবে।’

আমেনা বেগম সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো মেয়ের দিক।বললেন,

‘ যেতেই হবে?’

উপর নিচ মাথা ঝাঁকাল প্রিয়। আমেনা বেগম বললেন,

‘ গেলে তুই একা, প্রভা যাবেনা।

এতক্ষণ দরজার আড়ালে থেকে সব শুনছিল প্রভা। না যাওয়ার কথা শুনে আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো। মুখ কালো করে। কান্না মত মুখ করে বলল,

‘ কেন মা! আমিও আপার সাথে যাবো।’

‘ প্রিয়’র বন্ধু তুই কেন যাবি?’

প্রভার সুরে তাল মিলিয়ে বলল প্রিয়,

‘ ওকেও দাওয়াত করেছে। সাথে চলুক না মা!’

‘ আগামীকাল তোর আব্বার কলিগ সুহাস আহমেদ পরিবার সহ আসবেন। বাড়ি তোদের কাউকে না পেলে কি ভাববে?’

‘ কিন্তু মা….

‘ আর কোন কথা শুনতে চাইছিনা। প্রিয়’র বন্ধু ও যাক।তুই আমার সাথে বাড়িতে থাকছিস প্রভা।’

কড়াকড়ি করে বললেন আমেনা বেগম। মায়ের কথার পিঠে কথা বলার সাহস পেলনা প্রিয় প্রভা। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল চুপচাপ।

 

সচ্ছ আকাশ। সকালে মেঘ মেঘ গুমোট ভাব থাকলেও এখন একদম উজ্জ্বল আকাশ। ঝলমল করছে প্রকৃতি। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে শতাব্দ। রোদচশমা চোখে। সূর্যের প্রচণ্ড তাপ। তীর্যক আলো পড়ছে চোখেমুখে। ভাপসা গরম ছেড়েছে। পাঞ্জাবির কলারটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিলো শতাব্দ। গাড়ির সামনের কাচের আড়াল থেকে প্রিয়কে দেখা যাচ্ছে। কালো গ্রাউন পড়েছে। এক হাতে হ্যান্ড ব্যাগ অন্যহাতে গ্রাউনের কুচি ধরে এদিকটায় আসছে। কোমর ছোঁয়া খোলা লতানো কেশ। লাজুক চোখমুখ। নিমিষেই অদ্ভুত এক মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল শতাব্দকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল সে। 

 গাড়ির জানালার কাচে টোকা পড়তে ঘোর কাটল শতাব্দের। দরজা খুলে দিলো সে। প্রিয় এসেছে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো প্রিয়। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। হাঁপিয়ে গেছে। ভ্রু কুঁচকে নিলো শতাব্দ। পানির বতলটা এগিয়ে দিলো। ঢকঢক করে এক বতল পানি শেষ করে ফেলল প্রিয়। অনবরত হাপাচ্ছে এখনো।

‘ হাপাচ্ছ কেন? কি হয়েছে?’

একটু সময় নিয়ে প্রিয় উত্তর দিলো,

‘ এলাকার অনেকেই আব্বার পরিচীত। সেই সুবাদে আমাদেরকেও চিনে। যদি কেউ দেখে আব্বাকে বলে দেয় কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।’

‘ প্রভা যাবেনা?’

‘ না, আজ দুপুরে বাসায় মেহমান আসছে। তাই প্রভাকে আসতে দেয়নি মা।’

গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে শতাব্দ জিজ্ঞেস করল,

‘ কোথায় যেতে চাও’

‘ আপনার এপার্টমেন্টে।’

প্রিয়’র অকপট আওয়াজে ভড়কে গেল শতাব্দ। পাশ ফিরে বিমূঢ় দৃষ্টিতে প্রিয়’র দিক তাকালো। প্রিয়’র সহজ সরল অকপট মুখ। আবার জিজ্ঞেস করল,

‘ কোথায় যাবে?’

‘ আপনার এপার্টমেন্টে। কেন?’

কপাল কুঁচকে সরল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল প্রিয়। শতাব্দ হেসে ফেলল বলল,

‘ যা বলছো ভেবে বলছো তো?’

‘ এখানে ভাবাভাবির কি আছে। আপনার এপার্টমেন্টে দেখার খুব ইচ্ছা আমার। তাই আজ যখন সময় সুযোগ পেয়েছি তাই সেখানেই যেতে চাই।’

প্রিয়’র চাহনিতে নিছক সরলতা। সেখানে নেই কোন মিথ্যা অভিনয়, কৃত্রিমতার আশ্রয়। হেসে ফেলল শতাব্দ। বলল,

‘ এতটা সরলতাও ভালো নয় প্রিয়। তুমি আমার সাথে আমার এপার্টমেন্টে যেতে চাইছ!  ভয় করছেনা তোমার? যদি তোমার  ক্ষতি করে ফেলি!’

‘ ক্ষতি করার হলে আগে থেকে সাবধান করেনা কেউ। তাছাড়া আমার আপনার উপর ভরসা আছে!’

‘ কারো উপর এতো ভরসা রাখা ভালোনা প্রিয়। আমার তো নিজের উপর একবিন্দুও ভরসা নেই।’

‘ আপনি যেই কেউ না। আপনি আমার….

এতটুকু বলে থেমে গেল প্রিয়। ঠোঁট মেলে হাসলো শতাব্দ। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমি তোমার?’

প্রিয় চুপ। মুখের সামনে ঝুঁকে এলো শতাব্দ। ধীর আওয়াজে আবার জিজ্ঞেস করল,

‘ আমি তোমার..তার পর কি প্রিয়?’

লজ্জায় মিয়িয়ে যাচ্ছে প্রিয়। বুক ধুকপুক করছে তার। কাচুমাচু হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো। হাত জড়সড় করে শক্ত হয়ে বসে রইল। হেসে দুরে সরে গেল শতাব্দ। গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুমি সত্যি আমার এপার্টমেন্ট দেখতে চাও?’

বাহিরে তাকিয়ে লাজুক মাথা ঝাকাল প্রিয়।

 

শতাব্দের এপার্টমেন্টে এসে হতভম্ব প্রিয়। বাড়িটা কি চমৎকার দেখতে। ভেতরে ওয়েল ফার্নিস্ট। ইমান্দিপুরের বাড়ি থেকে এখানকার এপার্টমেন্টটা আরো বেশি সুন্দর করে সাজানো। দারুণ ফার্নিচার। জমিন মার্বেল পাথরের সাদা ফকফকে টাইলস মোড়ানো। চারিদিকে হরেক রকম লাইটিং আর অভিজাত পূর্ন জিনিসে সাজানো। ভেতরের আয়োজন সাজানো দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে, যিনি সাজিয়েছে নিশ্চয়ই ভীষণ সৌখিন মানুষ তিনি। এতবড় এপার্টমেন্টে শতাব্দ একা থাকে? এখানে বড়সড় পরিবার বেশ আরাম করে থাকতে পারবে নিঃসংকোচ।

সোফায় বসে উসখুস করছে প্রিয়। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে। গলা শোকাচ্ছে তার। শতাব্দকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছে। করবে কি, করবে না তা নিয়ে ভাবছে। প্রিয়’র মনের উসখুস ভাবটা বুঝি বুঝল শতব্দ। জিজ্ঞেস করল,

‘ কিছু বলতে চাও?’

প্রিয় যেন সাহস পেল। হতভম্ব কন্ঠে গড়গড় করে বলতে শুরু করল,

‘ এটা কার এপার্টমেন্ট? এখানে আপনি একা থাকেন?’

‘ বিশ একুশ বছর আগে, দাদাভাই তখন ইমান্দিপুরের চেয়ারম্যান। বাবা যখন নতুন নতুন ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসার সুবাদে বেশিভাগ সময় এখানে থাকতে হতো বাবাকে। তাই আমি আর মা, বাবার সাথে এখানে থাকতাম। এই বিল্ডিংয়ের কাজ চলছিল তখন। বাবার ব্যবসার অবস্থাও বেশ ভালো ছিল। এপার্টমেন্ট গুলো বেশ সস্তা পানির দামে বিক্রি করছিল। তাই বাবা একটা কিনে রেখেছিল। কয়েক বছর এখানে ছিলাম। ইমান্দিপুরে ফিরে যাবার পর এতবছর এমনি পরেছিল। বছর তিনেক আগে রি- ডেকোরেট করা হয়েছে।’

প্রিয় জ্ঞানী ব্যক্তিদের মত মাথা ঝাকিয়ে বলল, ‘ওহ।’

শতাব্দ প্রিয়’রকে অন্যসব ঘর গুলো দেখাতে নিয়ে গেল। সব ঘর খালি পড়ে, তালাবদ্ধ। তালা খুলে এক এক করে দেখাচ্ছে শতাব্দ। সবশেষে শতাব্দের ঘরে ঢুকলে প্রিয় থমকে গেল। চোখমুখে চরম বিস্ময়ের ছাপ। সবকিছু এলোমেলো অগোছালো। কাপড়চোপড় বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বিছানার অবস্থাটাও বেহাল। এত সুন্দর ঘরটার এই কি হাল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রিয়। প্রশ্নসূচক বিমূঢ় দৃষ্টিতে শতাব্দের দিক মাথা তুলে তাকালো। শতাব্দ বলল,

‘ কাজের লোক ছুটে আছে। তাই গোছগাছ করা হয়নি।’

প্রিয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। টেনে বসার ঘরে নিয়ে এলো শতাব্দ। সোফায় আরাম করে বসে। ঘড়ির দিক তাকালো। তিনটা বাজতে চলছে। প্রিয়কে জিজ্ঞেস করল,

‘ ক্ষুধা পায়নি তোমার? আমার কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। সেই ভোরে বাড়ি থেকে নাস্তা করে বেরিয়েছি।’

‘ এত সকালে কেন?’

‘ বন্ধুদের সাথে গেটটুগেদার ছিল।’

‘ ওহ’ ঠোঁট গোল করে বলল প্রিয়।

‘ ক্ষুধা লেগেছে না? কি খাবে বলো?’

প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। ক্ষুধায়  চুঁচুঁ করছে পেট। এক্সাসাইটমেন্টে সকালে নাস্তাটাও করেনি। লজ্জা, জড়তায় ভদ্রতাসূচক বাক্যে মুখে বলল,

‘ ক্ষুধা লাগেনি। পেট ভরা আমার।’

প্রিয়’র জড়তা বুঝল শতাব্দ। বলল,

‘ আমার পছন্দ মত কিছু নিয়ে আসবো। আমি বাহির থেকে লক করে দিয়ে যাচ্ছি। থাকতে পারবে? ভয় পাবেনা তো।’

মাথা নাড়াল প্রিয়। যার অর্থ ভয় পাবেনা। পকেট থেকে অন্যফোনটা বের করে প্রিয়’র হাতে দিয়ে বলল,

‘ ভয় পেলে ফোন করো।’

শতাব্দ বেরিয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে শতাব্দের ঘরে গেল। এলোমেলো সবকিছু দেখে অস্থির লাগছে প্রিয়’র। প্রথমে ঘরের জানালা দরজা খুলে দিলো। তারপর কোমরে ওড়না বেঁধে ঘর গুছাতে নেমে পড়ল। সবকিছু গোছগাছ শেষ করতে গিয়ে ক্লান্ত প্রিয়। হাত পা ছড়িয়ে সোফায় বসে পড়ল। মা এমন গোছগাছ করতে দেখলে, ভীষণ খুশি হতো নিশ্চয়ই! ভেবেই হেসে ফেলল প্রিয়। আচমকা, বিছানার পাশে ছবির ফ্রেমের দিক চোখ আটকালো। হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। চেয়ারম্যান সাহেব, শতাব্দ, তার মা কিন্ত পাশের লোকটাভীষণ চেনা চেনা লাগছে। এর আগে কোথাও কি দেখেছে? কোথায় দেখেছে!

মনে করার চেষ্টা করল প্রিয়। পারছেনা। কোথাও তো অবশ্যই দেখেছে। 

 

বিকালের শেষ প্রহর। মুড়ছে পড়েছে সূর্যের আলো। তাপটা মিলিয়ে মৃদু বাতাস বইছে। র*ক্তবর্ণ সূরটা এখন নেতিয়ে গেছে। গোধূলি লগ্ন প্রায়। সোফায় জড়সড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে প্রিয়। অবাধ্য চুল চোখ ছুঁইছে বারবার। তিরতির কাঁপছে ঠোঁট। মৃদু বাতাসে শীত শীত কি লাগছে? আরো গুটিয়ে নিলো নিজেকে। হঠাৎ কেউ কপাল ছুঁয়ে কানের নিচে চুল গুজে দিলো। কারো অকস্মাৎ স্পর্শে কেঁপে উঠল প্রিয়। ধরফরিয়ে উঠে বসলো। ভড়কে যাওয়া বড়বড় দৃষ্টি মেলে সামনে তাকাতেই চমকাল। হেসে ফেলল শতাব্দ। বলল,

‘ শুভ বিকেল! তোমার কফি।’

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল প্রিয়। নড়েচড়ে উঠে বসলো। চুল ঠিক করতে করতে বলল,

‘ আপনি কখন এলেন?’

‘ অনেকক্ষণ।’

‘ ডাকেননি কেন?’

‘ ইচ্ছা করল না। ঘুমন্ত প্রিয়কে দেখতে ভীষণ মিস্টি লাগছিল।’

মুচকি হাসল প্রিয়। বলল,

‘সরি হুট করে আপনাকে দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম।’

‘ আমার বাড়িতে ঢুকে আমার প্রিয়কে ছোঁয়ার সাধ্যি কার?’

আবারো হাসলো প্রিয়। লজ্জায় মাথা নুয়ে নিলো। সামনের টেবিলে গরম ধোঁয়া উঠা কফি দেখে বলল,

‘ কফি কে করেছে! আপনি?’

‘ রাতবিরেতে কফি খাওয়া’র বদঅভ্যাস তাই….’

এক্সাইটেড হয়ে তড়িঘড়ি করে কফির মগ তুলতে গিয়ে হাতের দিক চোখ পড়লো গাজরা গোলাপের মালা। চমকালো প্রিয়। বিস্মিত দৃষ্টিতে শতাব্দের দিক তাকালো। প্রিয়’র চোখেমুখে খুশির আমেজ উল্লাস স্পষ্ট। 

‘ আপনি কি করে জানলেন আমার গাজরার মালা হাতে পড়তে পছন্দ?’

‘ উম! মনে হলো!’

‘ ধন্যবাদ।’

খুশিতে উজ্জ্বল চোখমুখ নিয়ে বলল।

কফির মগ হাতে তুলে চুমুক দিচ্ছে প্রিয়। নিমিষ চেয়ে রইল শতাব্দ। চোখ জুড়ে  কি নিদারুণ সরলতা, পবিত্রতা। কপালে   পড়ন্ত চুল গুলো গুছিয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা। কোমরে বেঁধে রাখা ওড়না। সাধারণের ভেতর ভীষণ অসাধারণ মেয়েটা। তার আশেপাশে থাকলে কেন এত অগোছালো হয়ে যায় শতাব্দ! তার ব্যক্তিত্ব, অস্তিত্ব ভুলে। নিজেকে ভুলে  অন্য এক শতাব্দ হয়ে যায়। কোন এক অদ্ভুত নেশা টানে। বারবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করে প্রিয়কে। 

শতাব্দকে এমন নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নড়েচড়ে বসলো প্রিয়। কফির কাপ রাখার বাহানায় উঠতে গেলে আচমকাই পেছন থেকে হাত আটকে ধরল শতাব্দ। টেনে তার সামনের টেবিলটায় বসালো। প্রিয়’র কোমর থেকে ওড়নার গিট খুলে গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ এসব কেন করেছ প্রিয়?’

‘ আপনার ঘর অগোছালো ছিল তাই…

চোখ তুলে তাকালো শতাব্দ। প্রিয়’র কথা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল। প্রিয়’র হাত জোড়ায় গভীর করে চুমু দিলো। হাতে পিঠে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিতে দিতে, চোখে চোখ ডুবিয়ে নেশাতুর নিমিষ কন্ঠে বলল,

‘ আমার বউ হয়ে সংসার করতে ইচ্ছা করছে? আমার কিন্তু করছে! এমন কোমরে ওড়না গিট দিয়ে তোমাকে কাজ করতে দেখে, আমার ভীষণ বউ পেতে ইচ্ছা করছে। পাশেই কাজি অফিস। বিয়ে করে নেই! কি বলো?’

বলে চোখ টিপলো শতাব্দ। লজ্জা মিয়িয়ে গেল প্রিয়। চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চাইল। মানুষটা এমন বেফাঁস, লাগামহীন কেন!

 

চলবে………

 

ফিলোফোবিয়া

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২১.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

অন্ধকারে ঘনিয়ে এসেছে চারিপাশ। নভোমণ্ডল নিকষ কালো রূপ নিয়েছে। বিকালের আলো মাড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। শহরের রাস্তাঘাট কৃত্রিম আলোয় সেজে। মেঘ ডাকছে গুরুম গুরুম। বোধহয় ঝুম বৃষ্টি নামবে রাতে। গাড়ি বাড়ির রাস্তায় ঢুকতেই ব্যাগপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে বসলো প্রিয়। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে গাড়ি থামালো শতাব্দ। গাড়ি থেকে নামতে নিলে হাত চেপে আটকালো শতাব্দ। চোখ নাচিয়ে বলল,

‘ বাড়ি যাওয়ার এত তাড়া?’

আশেপাশে ব্যস্ত দৃষ্টিতে চোখ ঘুরালো প্রিয়। চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়। কন্ঠে তাড়া জুড়ে বলল,

‘ অনেক দেরি হয়ে গেছে। আশেপাশের অনেকেই পরিচীত। কেউ দেখলে…..

‘ দেখবেনা কেউ। ঝড়ো হাওয়া ছেড়েছে, দোকানপাট গুছিয়ে বাড়ি যেতে ব্যস্ত সবাই।’

পেছনের সিট থেকে ব্যাগ এনে প্রিয়’র দিক এগিয়ে দিলো। বলল,

‘ তোমার আর প্রভার গিফট।’

হতভম্ব প্রিয়। ব্যাগের ভেতর বেশ দামি ব্যান্ডের পারফিউম আর কয়েকটা চকলেট বক্স। বিমূঢ় কন্ঠে বলল,

‘ এসবের প্রয়োজন ছিল না কোন। এগুলো বেশ দামি। আমি নিতে পারবো না বাসায়।’

বলতে বলে শতাব্দের দিক এগিয়ে দিলো ব্যাগ।সুক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে তাকালো শতাব্দ। আড়ষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ গিফট ফেরত নিবোনা আমি। এখন তুমি বাড়ি নিয়ে যাবে নাকি রাস্তায় ফেলে দিবে এটা তোমার ব্যপার।’

অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়। মলিন কন্ঠে বলল,

‘ কিন্তু…

‘ আমার কথা ঘুরবেনা প্রিয়।’

কথা কেটে বলল শতাব্দ। প্রিয় বাধ্য হয়ে ব্যাগটা নিতে হলো। প্রিয়’র কপালে আসা অবাধ্য কেশ আদুরে হাতে কানের পেছনে গুজে দিলো শতাব্দ। চোখে তার অন্তহীন, নিদারুণ প্রেম। বিবশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,

‘ আবার কবে দেখা হবে?’

‘ খুব দ্রুত। আগামী বুধবার ছোট মামা দেশে ফিরছে। এয়ারপোর্ট থেকে মামাকে পিক করে ইমান্দিপুরে আসছি।’

ভ্রু কুঁচকে নিলো প্রিয়, বলল,

‘ ছোট মামা? কোথায় থাকেন তিনি?’

‘ দুবাইতে ব্যবসা আছে। সেখানেই তার হেড অফিস। মাসের বেশির ভাগ সময়ই সেখানে কাটান। ব্যস্ততার কারণে অনেক বছর ইমান্দিপুরে আসা হয়না তার। এবার আসছে। লুবনার পা ভেঙেছে গতকাল। ফুপু ইমান্দিপুরে আছেন। তাই মামা এবার সরাসরি ইমান্দিপুরে আসছে।’

অবাক হলো প্রিয়। লুবনার পা ভেঙ্গেছে শতাব্দের মামা আসবে কেন? বিমূঢ় সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘ মানে? লুবনার পা ভেঙ্গেছে উনি আসবেন কেন?’

‘ কারণ তিনি লুবনার বাবা। তাই।’

‘ লুবনার বাবা?’ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।

‘ হুম’

ফ্যামিলি পিকনিকে লুবনাকে দেখেছিল প্রিয়। ভীষণ অহংকারী মেয়ে। রাগ ভনিতা সবসময় নাকের আগায়। বাবার এমন অগাধ টাকা আছে বলেই বোধহয় এত অহংকারী মেয়ে। শতাব্দের দিকেও মেয়েটার অদ্ভুতরকম ঝোঁক।

প্রিয় আটকে আসা কন্ঠে বলল,

‘ আমি জানতাম না যে লুবনা আপনার ফুফাতো বোন মামাতো বোন দুইটাই।’

‘ তুমি ইমান্দিপুর কবে ফিরছ?’

‘ রবিবার।মা রেগে আছেন বোধহয়। আজ আসি?’

‘হু’

শতাব্দের নিমিষ চাহনির। নিষ্প্রাণ উত্তর।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল প্রিয়। রাস্তা পাড় হয়ে পেছন ফিরে শতাব্দের দিক তাকালো একবার। মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে  বাড়িতে ঢুকে গেল। পেছন থেকে নিমিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো শতাব্দ। শুরু হলো, লম্বা এক অপেক্ষার প্রহর।

 

বুধবার বিকালে জুবাইদা এলো প্রিয়দের বাড়িতে। সবসময়ের মত নিজের ঘরে শুয়ে উপন্যাসের বই পড়ছিল প্রিয়। জুবাইদা মুখ বাঁকাল। হাঁকডাক দিয়ে বলল,

‘ শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই তোর? কি বইটই নিয়ে পড়ে থাকিস সারাদিন।’

জুবাইদাকে দেখে বই বন্ধ করে উঠে বসলো প্রিয়। চুল হাত খোপা করতে করতে বলল,

‘ এই সময় এখানে যে?’

‘ বড়মা ডেকেছে তোকে।’

প্রিয় নড়েচড়ে বসলো। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমাকে? কেন?’

‘ ছোট ফুফা এসেছে। বাড়িতে ছোটখাটো গেটটুগেদারের আয়োজন করেছে।’

‘ সেখানে আমি যেতে কি করবো?’

‘ ভনিতা না করে চল। নয়তো, ভাই এসে কান টেনে নিয়ে যাবে।’

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়। চাপা উত্তেজনা চোখমুখে। কৌতূহলী কন্ঠে বলল,

‘ সে এসেছে?’

‘ হ্যাঁ, ভাইতো ফুফাকে নিয়ে দুপুরের আগেই চলে এসেছে।’

বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো জুবাইদা। বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়। ঝটপট করে তৈরি হয়ে জুবাইদার সাথে বেরিয়ে গেল।

 

ছাদে ছোট ছোট তোষক বিছানো। ধবধবে সাদা চাদর, কুশন বিছিয়ে। বেশ সুন্দর করে সাজানো। গ্রুপ বেঁধে জায়গায় জায়গায় চায়ের আড্ডা চলছে।  চায়ের সাথে ভাজাপোড়া, বিভিন্ন রকম ফাস্টফুড সহ নাস্তার বিশাল আয়োজন। এখানে এমন আয়োজন দেখে বেশ বিস্মিত প্রিয়। ইংলিশ সিনেমা গুলোতে দেখেছে, লাঞ্চ ও ডিনারের মাঝে এমন চা নাস্তার ব্যবস্থাকে ‘হাইটি’ বলে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে উচ্চবিত্ত বৃটিশদের মধ্যে বেশ প্রচলন ছিল।

জুবাইদার পাশে যেয়ে বসলো প্রিয়। শতাব্দের সাথে একবার চোখাচোখি হলো। ভীষণ ব্যস্ত সে। ছাদের অন্য পাশে ডিনারের জন্য মাটির চুলায় রান্না হচ্ছে। মোটামুটি বেশ বড়সড় আয়োজন। সেসব দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতে ব্যস্ত এখন।

 

ল্যাপটপে বন্ধ করে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন শোয়েব হক। এতদিন পর পরিবারের কাছে এসেছেন সাপ্তাহ দু’একের জন্য। এতেও  ফুরসত নেই কোন। হাজারো কাজ জমে। যদিও এতে তার সমস্যা হচ্ছেনা কোন। ভালোই লাগছে। এতবছর পর ইমান্দিপুর এসেছে। মানসিক শান্তির জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখাটা বেশ প্রয়োজন। আচমকাই চোখ আটকালো সামনের বাড়িটায়। বাগানবিলাসে ডেকে থাকা সেই পুরানো বাড়িটা। আগের মতই এখনো। আচ্ছা, বাড়িটা কি রঙ করেছে? হুম, হয়তো। গেটের সামনে সেই ডাকবাক্স। পুরানো সেই স্মৃতি! কিছুই বদলায়নি। শুধু সময় আর সেই মানুষটা ছাড়া। ভেবেই ব্যথাতুর হাসলো শোয়েব হক।

হঠাৎ, অদ্ভুত এক যন্ত্রণা অনুভব হলো বুকে। অতীতের কিছু স্মৃতি মাথাটা ঝেঁকে ধরলো। চোখ সরিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

 

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ছাদের চারপাশের আলো গুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আড্ডায় মশগুল সবাই। শোয়েব হক ছাদে উঠতেই হৈচৈ শুরু হলো। মামাকে সামনে নিয়ে বসেছে সমুদ্র। দুবাইয়ের শেখদের বিলাসী জীবন নিয়ে বেশ উৎসাহ তার। প্রশ্নের ঝুলি খুলে ঝেঁকে ধরেছে। ভাগিনার এমন কৌতূহল দেখে হেসে ফেলল শোয়েব হক। এক এক করে বলছে সব। কথার ফাঁকে রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়’র দিক চোখ পড়তেই থমকে গেল সে। হতভম্ব চোখমুখ। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এটাও কি সম্ভব! সত্যিই কি সে? তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো শোয়েব হক। প্রিয়’র সামনে যেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ আয়শা?’

আচমকা শোয়েব হককে সামনে দেখে ঘাবড়ে গেল প্রিয়। ঠোঁটে কোনে হাসি টেনে সালাম জানালো। বলল,

‘ উহু, আমি জুবাইদার ফ্রেন্ড। প্রিয়। অশীতা জাফর প্রিয়।’

শোয়েব হকের চোখে মুখে স্পষ্ট হতভম্বের ছাপ এখনো। বিড়বিড় করে বলল,

‘ তুমি হুবহু তারমত দেখতে।’

মিষ্টি হাসলো প্রিয়। বলল,

‘ সবাই তাই-ই বলে। মাও বলে আমি হুবহু খালার মত দেখতে।’

‘ আয়শা তোমার খালা?’ 

‘ হুম।’

শোয়েব হক আচমকা বুকের ভেতর অদ্ভুত কিছু অনুভব করল। কি বলবে এটাকে যন্ত্রণা নাকি ভালোলাগা? আয়েশার মত দেখতে বলেই কি প্রিয়কে এত ভালো লাগছে তার।

দূর থেকে মামার সাথে প্রিয়কে কথা বলতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল  শতাব্দ। মামার অতীত নিয়ে অনেক কথা শুনেছে। কিছু ভালো কিছু ভীষণ নিকৃষ্ট।

 তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলো এদিকে। প্রিয়’র পাশে এসে দাঁড়িয়ে এক হাত মেলে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ ও প্রিয়। আমার প্রিয়!’ 

হ্ঠাৎ শতাব্দকে এমন করে আসতে দেখে ঘাবড়ে গেল প্রিয়। সেই সাথে লজ্জাও পেল। মাথা তুলে আড়চোখে একবার শতাব্দের দিক তাকালো। কেমন জানো অদ্ভুত গম্ভীর চোখ। শতাব্দের চাহনী দেখে কথার ধাঁচ দেখে, শোয়েব হক এখনো বোধহয় ঘোরে। ভাগিনা এমন চাহনি আগে দেখেনি কখনো। ঘোর কাটিয়ে প্রিয়’র দিক চেয়ে বলল সে,

‘ তুমি অনেক সুন্দর। অনেক বেশি। ঠিক তোমার খালার মত।’

শোয়েব হক চলে যেতেই প্রিয়’র মনে পড়লো। উনাকে আগেও দেখেছে। শতাব্দের এপার্টমেন্টে। আর তার আগেও কোথায় যেন দেখেছে? কোথায় দেখেছে?

 

রাতে ডিনারের পর গানবাজনার আয়োজন করেছে। সবাই গোল করে বসে। বড়রা পেছনে বসেছে। প্রিয় জুবাইদার সাথে টুকটাক কথা বলছে। মাঝেমধ্যে  আড়চোখে লাজুক দৃষ্টিতে শতাব্দের দিকেও তাকাচ্ছে। ব্যপারটা শতাব্দের ছোট ফুপু ছবি বেগমের চোখে আটকালো। প্রথম থেকেই প্রিয়কে চোখে চোখে রাখছে। শতাব্দের মাকে ডেকে বললেন,

‘ ভাবি। ও ভাবি। শুনো না।’

অভিলাষা বেগম পিছন ফিরে চাইলেন। বললেন,

‘ হ্যাঁ ছবি বলো। শুনছি।’ 

ছবি বেগম প্রিয়’র দিক তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ তোমাদের কি আন্দাজ জ্ঞান নেই কোন? বাড়িতে এতগুলো জুয়ান ছেলে। যাকে তাকে বাড়ি আনছো কেন?’

আভিলাষা বেগম কপাল কুঁচকে  চাইলেন। বললেন,

‘ কার কথা বলছো ছবি?’

কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে ছবি বেগম উত্তর দিলেন,

‘ ওইযে জুবাইদার বন্ধু! প্রিয়া নাকি প্রিয় কি জানো নাম? যাইহোক মেয়েটা বড্ড চতুর। চোখেচোখে রাখো। পিকনিকেও নাকি অনেক কান্ড বাঁধিয়েছে। লুবনা বলল। ঢাকার মেয়েতো! না জানি কখন তোমার কোন ছেলেকে ফাঁ*সিয়ে ফেলে।’

বিরক্ত হলো অভিলাষা বেগম। কন্ঠে কঠোরতা এনে বলল,

‘ ফাঁ*সালেই ক্ষ*তি কি? মেয়ে না যেন গুড়ের মাছি। কি শান্ত, ভদ্র, সুন্দর! এমন মেয়েকে ছেলের বউ করে আনতে কে’না চায়।’

কথাটা যেন পছন্দ হলোনা ছবি বেগমের। ভাবির মুখের উপর বলতে পারলো না কিছু। বাড়িতে অভিলাষা বেগমের বেশ চলে। এমন কি গ্রামের মানুষজনও বেশ মানে।

 

বাড়ি ফিরে তড়িঘড়ি করে হল ঘরের কাঠের আলমারি খুলে ছবির এলবামটা বের করল। অনেক গুলো ছবির ভেতর সেই কাঙ্খিত ছবিটা পেল। এই ছবিটাই তো এতোদিন খুঁজছিল প্রিয়। খালার পাশে শতাব্দের মামা দাঁড়িয়ে। একই রকম ইউনিফর্ম দুজনের। দেখে মনে হচ্ছে কলেজ জীবনের।

‘ আবারো পুরানো এলবাম ঘাটছিস! কতবার মানা করেছি প্রিয়?’

হ্ঠাৎ খালার গম্ভীর আওয়াজে কেঁপে উঠল প্রিয়। বুকে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করে এক গাল হেসে বলল,

‘ শতাব্দ ভাইয়ার মামা শোয়েব আঙ্কেল তোমার বন্ধু খালা? কখনো বলোনি যে। যাইহোক আজ দুপুরে উনি দুবাই থেকে ফিরেছে। কিছুদিন ইমান্দিপুরেই থাকবে। জিজ্ঞেস করছিল তোমার কথা।’

আয়েশা বেগম কেঁপে উঠলেন। আচমকা তার চোখমুখ পাল্টে গেল। মুখশ্রীতে রাগ ফোটানোর চেষ্টা করল। ভ*য়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ঝাঁঝালো স্বরে বলার চেষ্টা করল,

‘ তুই আবার ওই বাড়িতে গিয়েছিস? কেন গিয়েছিস? আর যাবিনা ওইখানে। কোন দিন যাবিনা।’

‘ কিন্তু খালা…’

‘ আমি কোন তর্ক শুনতে চাইছিনা প্রিয়। ঘরে যা এক্ষুনি।’

হতভম্ব প্রিয় চলে গেল। আয়েশা বেগম সোফায় বসলো। কাঁপাকাঁপি হাতে পানির গ্লাস তুলে ঢকঢক করে পুরোটা পানি শেষ করল। ভীতু কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ সে ফিরে এসেছে। সব বিনা*শ করতে আবার ফিরেছে! কিছুই ছাড়বেনা সে। শেষ করে দিবে সব।’

 

চলবে………

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২২.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

আজ বৃহস্পতিবার। হাফ ক্লাস। স্কুল বারটা নাগাদ ছুটি হয়েছে। শনিবার থেকে টেস্ট পরিক্ষা শুরু। অনেক প্রস্তুতি বাকি এখনো। স্কুল থেকে বেরিয়ে বাজারের দিক গেল প্রিয়। ফটোকপির দোকানে যেত্ব হবে একবার। জুবাইদা থেকে কিছু নোট কালেক্ট করেছে ফটোকপি করতে হবে সেগুলো। নোট কপি করে বের হতেই আচমকা শোয়েব হককে সামনে দেখে।ক ঘাবড়ে গেল প্রথমে, পরবর্তীতে নিজেকে সামলে ঠোঁটের কোনে হাসি ঠেলে সালাম জানায়। শোয়েব হক সালামের উত্তর নিয়ে বেশ সাবলিল স্বরে জিজ্ঞেস করে,

‘ স্কুল থেকে ফিরছ?’

‘ জি আঙ্কেল।’

‘ একাই ফিরছ যে? তোমার খালা…’

‘ খালা দেরিতে ফিরবে। আরো একটা ক্লাস আছে।’

প্রিয়’র উত্তরে যেন হতাশ হলো শোয়েব হক। চাতক পাখির মত আশেপাশে চোখ বুলানোটা ক্ষান্ত হলো। ধীর স্বরে বলল,

‘ ওহ! চলো বাড়ি পৌঁছিয়ে দেই তোমায়।’

মাথা নেড়ে নাচক করল প্রিয়। তড়িঘড়ি কন্ঠে বলল,

‘ তার দরকার নেই আঙ্কেল। এইটুকুই তো পথ। যেতে পারবো আমি।’

শুনল না শোয়েব হক। জোরালো কন্ঠে বলল,

‘ আমি বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। একসাথে যাই।’

কোন দিকাদিক না পেয়ে শোয়েব হকের জোরাজোরিতে রাজি হলো প্রিয়। যেই গাড়িতে উঠতে যাবে অমনি আচমকা পেছন থেকে হেঁচকা টান দিলো। পেছন ফিরে চাইতেই থমকে গেল প্রিয়। শতাব্দ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। শোয়েব হকের দিক তাকিয়ে গম্ভীর শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ প্রিয় আমার সাথে যাচ্ছে। আমি বাড়ি পৌঁছে দিবো ওকে।’

শোয়েব হককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইকে চড়ে বসলো শতাব্দ। প্রিয়’র দিক দৃঢ় দৃষ্টি ফেলে গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ বাইকে উঠো।’

হতভম্ব প্রিয় আশপাশে চোখ ভোলাল। বাজারের মাঝামাঝি একদম। আশেপাশে অনেক পরিচীত লোকজন। কেমন জানো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন তামাশা চলছে কোন। ছোট ঢোক গিলল প্রিয়। কিন্তু কিন্তু করে বলল,

‘ রিকশায় করে যেতে পারবো আমি। আপনি না হয়…’

প্রিয়কে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে জোরালো ধমক দিলো শতাব্দ। রাগী গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ আমি বাইকে উঠতে বলেছি প্রিয়।’

কেঁপে উঠল প্রিয়। তড়িঘড়ি করে বাইকের পেছনে চড়ে বসলো। বাইক চলছে ক্ষিপ্রগতিতে। চোখমুখ চেপে বসে আছে প্রিয়। ভয়ে চোখ মুখ চুপসে গেছে একদম। আশেপাশে কত লোক দেখছে। গ্রামে শতাব্দ বেশ পরিচীত মুখ। তার বাইকের পেছনে এভাবে ঘুরে বেড়ানোটা নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না সবাই। এক হাতে ইউনিফর্মের সাদা স্কার্ফ টেনে মুখ লুকাতে ব্যস্ত সে। ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড  ভীতি কাজ করছে।

বাইক বাড়ির গলিতে না ঢুকে অন্যদিকে যাওয়ায় ঘাবড়ে গেল প্রিয়। বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ বাড়ির রাস্তা তো পেছনে ফেলে এলাম। কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

উত্তর দিলো না শতাব্দ। নিজে গতিতে বাইক চালাতে ব্যস্ত সে। খানিক দূর আমবাগের সামনে বাইক থামলো। গম্ভীর কন্ঠে শতাব্দ বলল,

‘ নামো।’

ভীতি জড়সড় হয়ে বাইক থেকে নামলো প্রিয়। সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসলো। চুপচাপ দুজন। শতাব্দের চোখমুখে স্পর্শ রাগ। কি হয়েছে? একবার কি জিজ্ঞেস করবে! না থাক। যদি রেগে যায় আরো।

রাগে মাথা কিড়মিড় করছে শতাব্দের। নিজেকে শান্ত করার যথাযথ চেষ্টা করছে। পারছেনা! পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল। জ্বালিয়ে, কাঁপাকাঁপি হাতে ঠোঁটে চাপলো।

সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রিয়’র অস্বস্তি হয় খুব। খুকখুক করে কেশে উঠল। ভ্রু কুঁচকে একবার তাকালো শতাব্দ। প্রিয়’র অস্বস্তির কারণটা বোধহয় বুঝল। বেঞ্চ ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।

দূর থেকে তাকিয়ে আছে প্রিয়। এখানে কেন নিয়ে এসেছে শতাব্দ। জানতে উশখুশ করছে মন। সেই সাথে ভয়ও লাগছে। হুট করে শতাব্দের এমন আচরণ। শোয়েব হকের সাথে দেখলে এমন রেগে যায় কেন সে? 

বেশ কিছু সময় নিয়ে মাথা ঠান্ডা করে এসে প্রিয়’র পাশে বসলো।  সূর্যে তখন বরাবর মাথার উপর। মাঝামাঝি দুপুর। মাটি ফেটে যেন গরম ভাপ বের হচ্ছে। চিন্তা, ভয়, গরমে প্রচন্ড ঘামছে প্রিয়। নাকে মুক্তোদানা মত ঘাম চিকচিক করছে। চুল বেয়ে কপালে ঘাম জমেছে। চোখে মুখে অদ্ভুত ভয়। এমন বি*চ্ছিরি গরমে নাজেহাল অবস্থায়ও বেশ নিদারুণ লাগছে মেয়েটাকে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে আলতো হাতে কপাল নাক মুছে দিচ্ছে শতাব্দ। গভীর দৃষ্টিতে আছে প্রিয়। কে বলবে এই দায়িত্ববান মানুষটাই কিছুক্ষণ আগে বাজারে বেশ বড়সড়  তামাশা করে এসেছে! আজকাল শতাব্দকে প্রিয়’র গোলক ধাঁধা মনে হয়। যত গোছাতে যায় তত প্যাঁচিয়ে যায়। যখনি মনে হয় শতাব্দকে সে পুরোপুরি ভাবে জানে, বুঝে তখনি এমন কিছু ঘটে যে, সব নতুন মনে হয়।

পিনপতন নিরবতা চললো খানিক। নিরবতা ভেঙে শতাব্দ বলল,

‘ তুমি মামার সাথে কোন প্রকার কথা বলবে না। মুখোমুখি পড়লে ইগ্নোর করবে।’

প্রিয় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অভিভূত দৃষ্টিতে তাকালো। আড়ষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ কেন? সে কি ভালো মানুষ নয়!’

‘ ভালো। প্রচন্ড ভালো মানুষ। তবে তোমার জন্য নয়। প্রতিটা মানুষের ভালো খারাপ দুইদিক থাকে। আমি চাইনা তার খারাপ দিক তোমার উপর পড়ুক।’

শতাব্দের কথার আগাগোড়া বুঝল না প্রিয়। প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কিন্তু কেন? কোন কার…

‘ কেন, কি কারণ ওইসব জানার সময় এখন না প্রিয়। আমি বলছি তুমি তার সাথে কোন প্রকার কথা বলবেনা। মানে বলবেনা।’

শতাব্দের দৃঢ় আওয়াজ। কন্ঠে রাগ দেখে আর কিছু বলার সাহস পেলনা প্রিয়। চুপ করে রইল। রাগ দমিয়ে খানিক বাদে, শতাব্দ শান্ত স্বরে বলল,

‘ ঢাকায় যাচ্ছি, আগামীকাল ফিরবো।’

মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রিয়। বলল,

‘ আপনার তো ব্রেক তাইনা?’

‘ ক্লাস না কিছু কাজ আছে। যেতে হবে।’

‘ কখন যাচ্ছেন?’

‘ একটু পর।’

‘ ওহ’ ঠোঁট গোল করে আলতো আওয়াজে বলল প্রিয়।

প্রিয়’র গালে হাত রাখলো শতাব্দ। মাথা তুলে, ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চোখে চোখ রাখল প্রিয়। শতাব্দ নিভৃত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই প্রাণবন্ত নিষ্পাপ চোখে। গভীর কন্ঠে আওড়াল শতাব্দ,

‘ নিজের খেয়াল রাখবে।’

হ্ঠাৎ অদ্ভুত অনুভূতি হলো প্রিয়’র। কেমন জানো যন্ত্রণা করছে বুক। ভীষণ ঝাঁজালো অনুভূতি। কেন জানো মনে হচ্ছে দূরে চলে যাচ্ছে শতাব্দ। অনেক দূর। গলায় অজানা এক কষ্ট দলা বাঁধলো। ঝাপসা হয়ে এলো চোখ। চোখের কোণে অশ্রু এসে জমলো।

প্রিয়’কে বাসায় পৌঁছে দিয়ে। গাড়ি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেল শতাব্দ। দূর বারান্দা থেকে তাকিয়ে আছে প্রিয়। অস্বাভাবিক এক ভয় উঁকি দিলো মনে। নিজের মনকে বুঝানো জন্য বলল,

‘ একদিনই তো! চলে আসবে সে।’

 

আগামীকাল থেকে প্রিয়’র টেস্ট পরিক্ষা। জোরেশোরে প্রস্তুতি চলছে। রাত দেড়টা। এখনো প্রিয় ঘরে পড়ার আওয়াজ ভাসছে। আয়েশা বেগম কলেজের পরিক্ষার খাতা নিয়ে বসেছে। হাতে কাজ অনেক, সময় কম। এখন রাত জেগেই সব খাতা দেখে শেষ করতে হবে। আচমকা কলিং বেল বাজলো। আয়েশা বেগম বিরক্ত হলো। গভীর রাতে কে এলো!  দরজা খুলবে কি, খুলবে না তা নিয়ে বিহ্বলে পড়লো। কলিং বেল অনবরত বেজেই যাচ্ছে। এবার বিরক্তির চুড়ান্তে পৌঁছালো আয়েশা বেগম। বিরক্ত হয়ে দরজাটা খুলল। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটাকে দেখেই কেঁপে উঠল আয়েশা বেগম। আতঙ্*কিত চোখ মুখ। কাঁপাকাঁপি কন্ঠে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,’ শোয়েব’

ঘরে ঢুকে ধপ করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো শোয়েব হক। ভয়*ঙ্কর লাল চোখ। আয়েশা বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন শোয়েব হক। রাগী গর্জন দিয়ে বলল,

‘ কেন? আমার সাথে কেন এমন করলে আয়শা।’

শোয়েব হকের গা থেকে বি*চ্ছিরি এক গন্ধ আসছে। ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারছেনা টলমল করছে। শোয়েব কি মদ গিলে এসেছে? ভেবেই নাকে মুখে কাপড় চাপল আয়শা বেগম। গলার স্বর কঠোর করার চেষ্টা করল। বলল,

‘ এখানে কেন এসেছ শোয়েব। আমার বাড়ি থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।’

জোরালো ধমক দিয়ে বলল শোয়েব,

‘ যাবোনা আমি। কি করবে? কি করবে তুমি! গত সতের বছর ধরে তোমাকে ঘৃ*ণা করে এসেছি। আর এখন সত্যি জানার পর পুড়ছি। কেন মিথ্যা বলেছিলে? কেন?’ 

আয়েশা বেগম না বোঝার মত করে বললেন,

‘ কোন মিথ্যার কথা বলছো? ‘

শোয়েব হক রেগে গেলেন আরো। দাঁতে দাঁত চিপে বলল,

‘ তোমার বিয়ে হয়েছে? সুখে আছো খুব? কেন মিথ্যে বলেছিলে সেদিন। সামান্য একটা চিঠি লিখে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে  সব শেষ করে দিলে। তুমি আমার স্ত্রী ছিলে আয়শা।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আয়েশা বেগম। রাগে দাঁত চেপে বলল,

‘ স্ত্রী? কোন স্ত্রীর কথা বলছো শোয়েব। যদি তাই মানতে তাহলে ছবিকে কি করে বিয়ে করলে? তখন আমার কথাটা একবার মনে পড়েনি? তুমি ভালো আছো তোমার বউ সংসার নিয়ে। সেখানে আমি কেন বাঁধা হবো। দূর্বল হবো। তখন আমার মনে হয়েছে তোমাকে মিথ্যা বলে আমি জিতে যাবো। ভালো থাকবো। তাই বলেছি। আর হ্যাঁ তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।’

শোয়েব অসহায় নরম স্বরে বলল,

‘ আমার হাত পা বাঁধা ছিল। আমি বাধ্য ছিলাম। আমার বোনেত সংসার ভাঙ্গার পথে ছিল।’

‘ তাই বলে নিজের সংসার ভেঙ্গে তুমি তা গড়বে? আসলে, সত্যি হচ্ছে তুমি একজন প্রতারক, বেইমান। আগে থেকেই ছবির দিক কু’নজর ছিল তোমার। সুযোগ পেতেই তা কাজে লাগিয়েছ।’

টলমল চোখ নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল আয়েশা বেগম। শোয়েব যেন আরো আহত হলো। আগের মত অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ বিশ্বাস করো আমি আজও তোমাকে….

‘ প্লিজ শোয়েব! বন্ধ করো। এতবছর পুরানো আষাঢ়ের গল্প শুনতে চাইছিনা। পাশের রুমে প্রিয় এখনো জেগে। কোনরকম সিনক্রিয়েট করতে চাইছিনা। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়ে উপকার করো আমার উপর।’

শোয়েব খিলখিল করে হেসে ফেলল। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আয়েশা বেগম। এমন ছন্নছাড়া অগোছালো রূপে দেখেনি আগে। আজ দেখে প্রচন্ড ভয় করছে। প্রচন্ড! মন কু ডাকছে।

হাসি থামিয়ে শোয়েব হক বলল,

‘ সত্যি করে একটা কথা বলোতো! হুবহু তোমার মত দেখতে এই কার্বনকপিটাকে কোথায় পেলে? দেখলাম আমার ভাগিনা সাথে প্রেম করছে। তোমার ভয় করেনা আয়েশা। যদি তোমার মত ঠকতে হয় প্রিয়কে?’

আয়েশা বেগম এবার ভ*য়ঙ্কর রেগে গেলেন। শোয়েব হকের কলার চেপে ধরলো। চিৎকার করে বলল,

‘ আমার সাথে যা হয়েছে। প্রিয়’র সাথে তোমরা তা করার কথা চিন্তা করলে আমার ভ*য়ঙ্কর চণ্ডী রূপ দেখবে। খু*ন করে ফেলবো সবাইকে।’

গাল বাঁকিয়ে হাসল শোয়েব হক। আয়েশার গলা চে*পে ধরল। বলল,

‘ এতটান তো শুধু একজন মায়েরই হয়। সত্যি করে বলতো প্রিয় কি আমার আর তোমার মেয়ে? আমি কেবল সত্যিটাই জানতে চাইছি আয়েশা।’

দম বন্ধ হয়ে আসছে আয়শার। হাত পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে করতে বলল,

‘ তোমার সন্তানকে আমি গর্ভেই মে*রে ফেলেছি। তোমার অংশকে কেন দুনিয়ায় আনবো! কেন? ডিভোর্স পেপারের সাথে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছি। দেখনি? প্রিয় আমার ভাগ্নী। অনেক বেশি প্রিয়। ওর থেকে দূরে থাকো তোমরা।’

‘ শতাব্দ! ও মানবে? কখনোই না! বিয়ে করে ওই পরিবারে আসলে সবকিছুর সম্মোখীন ওকে হতে হবে। প্রতি মূহুর্ত প্রিয়  পুড়বে।’

আয়েশা বেগম এবার নিজের রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। ডুকরে কেঁদে ফেললেন। এলোপাথাড়ি হাত ছুড়াছুড়ি করে শোয়েবের বুকে আঘা*ত করতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘ ও বাচ্চমানুষ , নিষ্পাপ ওকে তোমরা এমন শা*স্তি দিয়ো না। সহ্য করতে পারবেনা ও। শেষ হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে আমার প্রিয়….

 

আচমকা কারো কান্নার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল প্রিয়। আড়াইটা বাজছে ঘড়িতে। পড়তে পড়তে কখন যে টেবিলেই চোখ লেগে গেল। চোখ ঢলতে ঢলতে হল ঘরের দিক গেল। এদিক থেকেই আসছে কান্নার আওয়াজ। হল ঘরে ঢুকে খালাকে শোয়েব হকের পায়ের কাছে দেখে আঁ*তকে উঠল প্রিয়। চোখের সব ঘুম আচমকাই উঁড়ে গেল। বিস্ময়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। এমন সময়ই আবারো কলিং বেল বাজলো। এতো রাতে আবার কে এলো?

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২৩.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

কলিং বেলটা বেজে যাচ্ছে অনবরত। দরজা খুলতেই আচমকা  গালে সজোরে এক থা*প্পড় পড়ল। হতভম্ব প্রিয়। টলমল দৃষ্টিতে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাগী হাঁক ছাড়ছে ছবি বেগম। পেছন চেয়ারম্যান বাড়ির বড়রা সবাই। সোফায় ঢুলে পড়ে আছে শোয়েব হক। নেশায় জ্ঞান হারিয়েছে বোধহয়।

 কি হয়েছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা প্রিয়। ছবি বেগম রাগী ভারী নিশ্বাস ফেলে প্রিয়’র দিক আসছে। চুলের মুঠি ধরতেই ব্যাথাতুর আওয়াজ করে উঠল প্রিয়। অশ্রু গুলো গাল বেয়ে ঝরে পড়লো। আয়শা বেগম ছুটে এলো। ছবি থেকে হাত ঝাড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে। বুকে জড়িয়ে নিলো প্রিয়’কে । ক্রোধান্বিত গর্জন করে বলল,

‘ প্রিয়’র গায়ে হাত তোলার সাহস পেলে কি করে?’

ছবি বেগমের রাগ আরো বেড়ে গেল। চিৎকার করে বলল,

‘ এইসব ছেলেবাজ মেয়েদের কি করবো শুনি? খা**! এক ছেলে দিয়ে হয়না তোর ? এখন বাপের বয়সি ব্যাটাও লাগবে।’

অভিলাষা বেগম ছবিকে চুপ করানোর চেষ্টা করলো।জোরে ধমকালো। বলল,

‘ বুঝেশুনে কথা বলো। কার সম্পর্কে কি বলছো।প্রিয় তোমার মেয়ের বয়সী। এখানে কি হয়েছে আগে ঠান্ডা মাথায় শুনো। তারপর….

অভিলাষা বেগমের কথা কে*টে ছবি বলল,

‘ কি শুনবো ভাবি। এখানে দেখাদেখির কি আছে? এতবছর ধরে তোমার ভাইয়ের সাথে সংসার করছি। তার চরিত্র ভালো করে জানি। মাসের পর মাস দুবাই পড়ে থাকে কেন? এসব কুকাজ করার জন্য। এখানে এসে সুন্দর জুয়ান মেয়ে দেখেছে কুকাজ শুরু করে দিয়েছে। সন্দেহ তো আমার সেদিন ছাদেই হয়েছিল। যখন দুজন হেসে হেসে কথা বলছিল। আর এই বাজে মেয়েকে নিয়ে কি বলবো। মামা ভাগিনা দুইজনের সাথে ফস্টিন…

আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়েশা বেগম প্রচণ্ড জোরে এক চড় দিলো ছবি বেগমের গালে। স্তব্ধ সকলে। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গলো আয়েশা বেগমের। চিৎকার করে বলল,

‘ প্রিয়’র জন্য না। শোয়েব আমার জন্য এখানে এসেছিল। সেই কখন থেকে তোমার সব জ*ঘন্য কথা শুনছি। বলে এই না যে আমরা অপ*রাধী। তোমার স্বামী দুশ্চরিত্রা।’

ছবি যেন নিজের হাবভাব হারিয়ে ফেলল। ক্ষি*প্ত হয়ে আয়েশা বেগমের দিক এগিয়ে আসতে চাইল। অভিলাষা বেগম জুবাইদার মা তাকে আটকালো। রেগে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

‘যেমন খালা তেমন ভাগ্নী। দুইজনই ব্যা*। ভাগ্নী ভাগিনাকে ফাঁসিয়েছে আর খালা মামাকে। রাতবিরেতে বাড়িতে পুরুষ আসে। ব্যা* বাড়ি!’

আয়েশা দাঁতে দাঁত চেপে চিৎকার করে বলল,

‘ তোমাদের বাড়ির ছেলেকে বেঁধে রাখতে পারোনা কেন? আমার ভাগ্নীর পেছনে কেন আসে? তোমার স্বামী রাতবিরেতে মদ খেয়ে মানুষের বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়ে। কেমন স্ত্রী তুমি। নিজের স্বামীকে ধরে রাখতে জানোনা তুমি। আমাদের দিক আঙুল তুলার আগে নিজেদের দিকে তাকাও।’

ছবি রাগে উসখুস করছে। স্বামীকে নিয়ে এখন অতো মাথা ঘামায় না। বিয়ে করেছে। যেদিকেই মুখ দিক না কেন, দিন শেষে সেই ঘরেই আসবে। তার সব রাগ জেদ প্রিয়’র উপর। এই মেয়েটার জন্য শতাব্দের সাথে লুবনার বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে পারছেনা। আজ যে করেই হোক এই মেয়ের কিচ্ছা শেষ করতে হবে। হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো ছবি তেড়ে এলো প্রিয়’র দিক। 

দরজার সাথে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে প্রিয়। কি থেকে কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এত মানুষের ভেতর শুধু একজনকেই খুঁজছে। কোথায় শতাব্দ? আজতো তার ফেরার কথা ছিল। এখানো কি ফিরেনি তবে!

ছবি কাছে এসে প্রিয়’র মুখ চেপে ধরলো। যেই তার গায়ে হাত তুলবে অমনি আচমকা কোথা থেকে যেন শতাব্দ সামনে চলে আসলো। থা*প্পড়টা শতাব্দের উপর পড়ল। পুরো ঘর স্তব্ধ। কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও।  

হাত মুঠিবদ্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। রাগে শরীর কাঁপছে থরথর। রাত দশটায় ইমান্দিপুরে এসে পৌঁছেছে। মাথা ব্যথা থাকায় বিশ্রাম নিচ্ছিলো ঘরে। এদিকে এতো কিছু হয়ে গেল টের পায়নি কোন। মাত্রই সমুদ্র ডেকে এনেছে তাকে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে প্রচন্ড আরেকটু আগে আসলে এতকিছু ঘটতে দিতোনা কখনো।

ছবি বেগম শতাব্দকে দেখে থতমত খেয়ে গেলেন। কিছু বলতে উদ্ভব হলো। অমনি শতাব্দ গর্জন করে উঠল। রাগী গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ ওর দিকে হাত বাড়ালে ভালো হবেনা কারো। অনেক তামাশা করেছেন এবার আপনার মাতাল স্বামীকে নিয়ে বাড়ি যান।’

ছবি বেগম রাগে হুরহুর করে আগে বেড়িয়ে গেলেন। ভাইকে সোফা থেকে তুলল অভিলাষা বেগম। সাহায্যের জন্য সাথে আছে জুবাইদার মা। শতাব্দের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মায়ের দিক রাগী গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শতাব্দ। ছেলের দিক অসহায় করুন দৃষ্টিতে তাকালো অভিলাষা বেগম। 

আস্তে আস্তে ঘর খালি হলো। শতাব্দ যাওয়ার সময় অশ্রু স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়। পিছন ফিরে একবার তাকালো না শতাব্দ।  হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।

এতো রাতে  হৈচৈ শুনে পাড়ার সব লোক জড় হয়েছে। দোতলার সিড়ি অবধি উঠে এসেছে। এতো মানুষ দেখে রাগী চিৎকার করল শতাব্দ,

‘ কি হচ্ছে এখানে। তামাসা?’

সাথে সাথে সব লোক হুরাহুরি করে চলে গেল।

 

সকাল হয়েছে অনেক আগে। বাহিরে উজ্জ্বল আলো। তবুও যেন সবকিছু আঁধারে মাখানো। থেমে গেছে যেন সব। সকাল থেকে গ্রামের অলিতে-গলিতে হাটবাজারে দোকানে কাল রাতেরই চর্চা চলছে। এক কান দুকান হতে সবাই জানে এখন। ছিছি করছে সবাই। প্রিয়দের বাড়িকে ব্যা* বাড়ি বলে উপেক্ষা করছে। এই সমাজটা বড়ই বিচিত্র! সবসময় কি শুধু নারীর দোষই? 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। স্কার্ফ দিয়ে কাল রাতের থাপ্পড়ের দাগ ডাকতে ব্যস্ত। চোখজোড়া ফুলে টকটকে লাল। মাথাটা ভার হয়ে আছে এখনো। বাড়ি থেকে বের হতে ভয় করছে প্রচন্ড, যেতে হবে তবুও। টেস্ট পরিক্ষা আজ। না গেলে দুইবছর কষ্ট বিফলে যাবে সব। 

রেডি হয়ে খালার ঘরে এলো প্রিয়। গতরাত থেকে খালা জানালার পাশে রকিং চেয়ারে বসে আছে এখনো। আলতো করে ডাকলো প্রিয়। উত্তর এলোনা কোন। অপেক্ষা করল প্রিয়। কোন সারাশব্দ না পেয়ে ঘড়ির দিক তাকালো। দেরি হচ্ছে খুব। বেড়িয়ে যেতে হবে এখন। খালাকে নরম স্বরে ডেকে বলল,

‘ পরিক্ষা দিতে যাচ্ছি খালা।’

এবারো উত্তর এলোনা কোন। আগের মত দূর আকাশে তাকিয়ে আছে আয়েশা বেগম। অপেক্ষা করল প্রিয়। কোন সারাশব্দ না পেয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।

 

গলি থেকে বের হবার সময় আশেপাশে চোখ বুলালো। পাড়াপ্রতিবেশিরা সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। যেন কোন বড় অপ*রাধ করে ফেলেছে প্রিয়। তাকে নিয়ে ফিসফিস করছে অনেকেই। মাথা নুয়ে দ্রুত পা চালিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে এলো। রিকশা নিয়ে হুডি তুলে দিলো। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এর আগে এমন জ*ঘন্য পরিস্থীতির স্বীকার হয়নি কখনো।

স্কুলে এসে জুবাইদার সাথে দেখা হলো। ঘন্টা পড়ছে তখন।হলের দিক পা বাড়িয়ে জুবাইদা শুধু এতোটুকু বলল,

‘ ভাই বাড়ি নেই। গতরাতে তুমুল ঝামেলা হয়েছে। ভোর রাতে ভাই চলে গেছে ঢাকায়।’

জুবাইদার মুখে এমন কথা শুনে প্রিয় আরো ঘাবড়ে গেল। কোনরকম পরিক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে শতাব্দের নাম্বারে ফোন করল। বন্ধ বলছে ফোন। চিন্তাটা বেড়ে গেল আরো।

 

কাপড় পাল্টে খালার ঘরে গেল প্রিয়। খালা সকালের মত এখনো সেই চেয়ারে বসে। প্রিয় ডাকল। এবার আয়েশা বেগম সাড়া দিলো। মাথা তুলে তাকালো। আঁতকে উঠল প্রিয়। এক রাতেই ভয়*ঙ্কর হয়ে এসেছে খালার চোখমুখ। ফোলা চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। খালার এই হাল দেখে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে প্রিয়’র। এমন ভেঙ্গে পড়তে কখনো দেখেনি আগে।

আয়েশা বেগম প্রিয়কে নিজের কাছে ডাকলো। প্রিয় কাছে যেতেই। হাত টেনে নিজের সামনে এনে বসালো। প্রিয়’র হাত জোড়া হাতের মুঠোয় নিয়ে গাঢ় করে চুমু দিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেলল হ্ঠাৎ । কেন কাঁদছে বুঝল না প্রিয়। শুধু বুঝল খালার এমন কান্না দেখে তার কষ্ট হচ্ছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আজ প্রিয়’র দিক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মায়েরা যেমন করে তাকিয়ে থাকে ঠিক তেমন। প্রিয়’র হাত মুখ আলতো আদুরে হাতে  ছুঁয়ে দিচ্ছে খালা। ঠিক যেমন নবজাতক শিশুকে ছুঁয়ে দেয় মা। আচমকা বুকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়’র চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আরো জোরে কেঁদে ফেলল। 

বিমূঢ় প্রিয় তাকিয়ে আছে হতভম্ব। খালার এই মমতাময়ী রূপটা দেখেনি কখনো।

খানিক বাদে প্রিয়কে ছাড়ল আয়েশা বেগম। চোখ মুখ মুছে নিজেকে শক্ত করতে চেষ্টা করল। একটু সময় নিয়ে বলল,

‘ আজ তোকে কয়েকটা কথা বলবো। এই কথা গুলো এর আগে কাউকে বলিনি কখনো। না কাউকে কোনদিন বলবো।’

ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রিয়। খালা আবারো বলল,

‘ কথা গুলো আমার কালো অতীত সংক্রান্ত।’

‘ তোমার কালো অতীত?’

‘ হ্যাঁ প্রিয়।আমার কালো অতীত।’

একটু চুপ থেকে ছোট নিশ্বাস ফেলে খালা শুরু করল,

‘ ছোট থেকে আমার বাবার আফসোস ছিল। আমরা তিন বোনের মাঝে একজন ছেলে হলাম না কেন! বাবার রগচটা কথা আর অপমানের ধাঁচে ছোটবেলায়ই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম লেখাপড়া করে অনেক বড় হবো। ছেলের কামাই খেতে পারবেনা বলে বাবা এমন আফসোস করে তো? বড় হয়ে অনেক টাকা কামাবো। যেই ভাবনা সেই কাজ। ছোট থেকে সবসময় ছিল স্টার মার্কস। কলেজ শেষে ঢাকায় এডমিশন হলো। স্বপ্নের খোঁজে পাড়ি জমালাম ঢাকায়। নতুন শহরে এসে চারদিকে সব অচেনা মুখ দেখে ঘাবড়ে গেলাম। সেখানে পরিচীত বলতে কেবল শোয়েবই ছিল। কলেজ জীবনে চিনাজানার সুবাদে পরিচয় ছিল টুকটাক। শোয়েব তখন পড়াশোনার পাশাপাশি শতাব্দের বাবার ব্যবসায় দেখাশোনা করে টুকটাক। নতুন শহরে এসে বিভিন্ন সমস্যা, দরকার  প্রয়োজনে তার সাথে মাঝেসাঝে দেখা হতো। আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল। তারপর ধীরেধীরে প্রেম। পড়াশোনা শোয়েব সবকিছু মিলিয়ে দিন ভালোই চলছিল। হ্ঠাৎ একদিন আমার জীবনে কালবোশেখী ঝড় এলো। কেউ একজন আমাদের সম্পর্কের কথা বাবার কান অবধি পৌঁছেছে। শোয়েবদের আর্থিক অবস্থা তখন দূর্বল। দুলাভাইয়ের ব্যবসায় ছোট চাকরিতে কর্মরত। আমার দাম্ভিক বাবা তা শুনে পণ করলেন। এমন ছোট ঘরে মেয়ে দিবেনা  কখনো! শোয়েবের মা হাত চাইতে এসেছিলেন। মেয়ে দিবেনা বলে তাড়িয়ে দিলেন। পরিস্থীতি ভীষণ খারাপ যাচ্ছিলো। কোন দিকাদিক না পেয়ে। কাউকে কিছু না জানিয়ে  গোপনে বিয়ে করে ফেলি আমরা। হোস্টেলের নাম করে এক রুমের বাসা নিয়ে থাকতে লাগি ঢাকা। ছোট চাকরি করে সবার অগোচরে চড়ুই সংসার সাজাই। সব ঠিকই চলছিল। অমনি একদিন গ্রাম থেকে খবর এলো শোয়েবের মা অসুস্থ। শোয়েব আমাকে ছেড়ে গ্রামে গেল। এরপর অনেকদিন কাটলো। শোয়েবের চিঠি এলোনা কোন। চিন্তায় কোন দিকাদিক না পেয়ে শোয়েবদের গ্রামে গেলাম। সেখানে গিয়েই জীবনের সবচেয়ে বড় আঘা*ত পেলাম। শোয়েব বিয়ে করেছে ছবিকে। আমি দেড় মাসের অন্তসত্বা তখন। শোয়েবের মায়ের পায়ে পড়লাম। আমার আর আমার সন্তানের জীবনের ভিক্ষা চাইলাম। গললেন না তিনি। তার চোখে তখন বড় ঘর থেকে মেয়ে আনার যৌ*তুকের চমক। সারারাত বসে রইলাম উঠানে। কেউ উঁকি দিলোনা একবার। যাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম। সেও মুখ ফিরিয়ে নিলো। হয়তো অর্থসম্পদের মোহে পড়েছিল। পরের দিন ভোর বেলা লোক ডেকে মিথ্যা সালিশ বসিয়ে কুকুরের মত দূরদূর করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলো আমাকে। এরপর আর কোনদিন পিছন ফিরে তাকাইনি শোয়েবের দিকে।’

প্রিয় কাঁদছে। গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে।বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ তোমার গর্ভের সন্তানের কি হয়েছিল?’

আয়েশা মাথা তুলে ছলছল দৃষ্টিতে প্রিয়’র মুখপানে একবার চাইলো। কান্না দলা পাকিয়ে আসলো। ছোট ঢোক গিলে নড়বড়ে আওয়াজটাকে শক্ত করার চেষ্টা করল। বলল,

‘ গ*র্ভে মেরে ফেলেছি তাকে!’

কেঁপে উঠল প্রিয়। গায়ের সব লোম আচমকা কাটাদিয়ে উঠল। 

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২৪.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

গ্রাম জুড়ে আজকাল সেই রাতের চর্চা। আয়েশা বেগম আর প্রিয়কে একঘরে করে দিয়েছে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতী দেখে কলেজ থেকে কিছুদিনের ছুটি নিয়েছেন আয়শা বেগম। এদিকে স্কুলের সবাই বেশ কায়দা করে এড়িয়ে চলছে প্রিয়কে। জুবাইদা তানহা আজকাল দূরে দূরে থাকে। কেন থাকে? তাদের বাড়ি থেকেও কি প্রিয়’র সাথে মিশতে নিষেধ করেছে! হয়তো।

 

আজ পরিক্ষা শেষ। বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকতেই হতভম্ব প্রিয়। খালা তার সব কাপড় গোছগাছ করতে ব্যস্ত। দরজার কাছে দাঁড়ালো প্রিয়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘ খালা! কোথাও কি যাচ্ছি আমরা?’

ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত স্বরে উত্তর দিলো আয়েশা,

‘ আমরা না। শুধু তুই যাচ্ছিস।’

চমকাল প্রিয়। বিহ্বল কন্ঠে বলল,

‘ আমি? কিন্তু কোথায়?’

‘ ঢাকায়। বিকালে তোর বাবা আসবে নিতে।’

এই পরিস্থিতীতে খালাকে একা ফেলে ঢাকায় যেতে একদম অনিচ্ছুক প্রিয়। অনিহা প্রকাশ করল। বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ আমার কোচিং প্রাইভেট সব কামাই যাবে খালা। সামনে পরিক্ষা…

কথা কেটে বলল আয়েশা,

‘ তা নিয়ে ভাবতে হবেনা। তোর কোচিং প্রাইভেটের স্যারদের সাথে কথা হয়েছে। টেস্ট পরিক্ষা শেষ।বাড়িতে থেকে বারবার সিলেবাস রিভিশন দিলেই চলবে এখন।’ 

‘ আমি চলে গেলে তুমি একা কি করে থাকবে খালা?’

‘ তুই আসার আগে আমি একাই থেকেছি।’

‘ সেই সময়কার কথা আলাদা। এই পরিস্থিতীতে এখানে একা কি করে সামলাবে তুমি? তুমিও আমাদের সাথে ঢাকায় চলো। কিছুদিন সেখানেই থাকবে।’

প্রিয়’র চোখমুখে খালাকে নিয়ে গভীর চিন্তা, ভ*য়। এসব থেকে কি বেরিয়ে আসতে পারবে খালা? দুর্বল হয়ে পড়ে প্রিয়’র মুখপানে তাকিয়ে মলিন হাসলো আয়শা। বলল,

‘ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমার সাথে প্যাঁচিয়ে তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট করার কোন মানে হয়না প্রিয়। এমনিতে লোকের মুখে আমাদের বাড়ি এখন ব্যা* বাড়ি নামে পরিচীত।’

শেষ কথাটা বলার সময় আয়েশা বেগমের গলা কেঁপে উঠল। সারাজীবন সৎসাহস নিয়ে বেঁচে। এত মানসম্মান কুড়িয়ে শেষে কিনা ব্যা* নামক নিকৃ*ষ্ট উপাধি পেল?

 

পুরো ঘটনায় বেশ দারুণ ফয়দা হয়েছে ছবি বেগমের। এতদিন যে কথাগুলো ইনিয়েবিনিয়ে বলেছেন। আজকাল বেশ বড় গলায় ভাইয়ের সামনে তুলে ধরছেন সেসব। কথায় কথায় ফ্যাচফ্যাচ কুমিরের কান্না করছে। মেয়ে লুবনার দোহাই  দেখিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে। বারবার বলছে, এমন চরিত্রহীন বাবার মেয়েকে কে বিয়ে করবে? 

আজ সকালে খাবার টেবিলে বেশ কায়দা করে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে লুবনাকে শতাব্দের বউ করে আনার আবদার করলেন। ‘হ্যাঁ ‘ ‘না’ কোন কিছুই বললেন না শাহরিয়ার সাহেব। তবে চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে বোনের কথায় মন গলেছে।  

অভিলাষা বেগম ক্ষিপ্ত গতিতে লাগেজ গোছাচ্ছে। স্ত্রীর অহেতুক রাগের উপর বিরক্ত চেয়ারম্যান সাহেব। কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বললেন,

‘ শুধু শুধু ঝামেলা করার কোন মানে দেখছিনা অভিলাষা।আমি হ্যাঁ না কোনকিছু কি বলেছি?’

আলমারি থেকে কাপড় বের করে ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে  রাগী কন্ঠে উত্তর দিলেন অভিলাষা,

‘ জবাবের বাকি রেখেছ কি? তোমার বোন দৌড়াদৌড়ি করে মেয়ের বিয়ের কেনাকাটায় করছে। তোমার অনুমতি না পেয়েই কি করছে!’

‘ সকালে সেখানে তুমিও ছিলে। যা কথা হয়েছে তোমার সামনেই হয়েছে।’

‘ তোমার মৌনতাই যে সম্মতির লক্ষণ তা তোমার বোন বেশ ভালো করেই জানে।’

‘ যদি সম্মতি দিয়েও থাকি তাতে ক্ষতি কি? তোমার ভাই যা করেছে, এতকিছুর পর আমার কি বলার থাকবে আর? লুবনার ভবিষ্যতের কি হবে?’

‘ আর প্রিয়? ওর কি হবে ভেবেছ একবার! বোন ভাগ্নীর প্রেমে এত অন্ধ হইয়ো না শাহরিয়ার। এখনকার যুগে এসব কথার কেউ ধা*র ধারেনা। অনেক বছর আগে যেই অঘটন ঘটেছে তা পূর্নবৃত্তি করিও না। এবার ধ্বং*স হবে সব।’

শাহরিয়ার স্ত্রী’র দিক শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। গম্ভীর কন্ঠে আওড়ালেন,

‘ ওই মেয়েকে নিয়ে তোমার এত মায়া, চিন্তার কারণ আমি বুঝি। রক্তের টান। তাই না?’

‘ প্রিয়কে দেখে তোমার মায়া হয়না? অথচ মেয়েটার জন্ম কিন্তু চোখের সামনে হয়েছে তোমার।’

শাহরিয়ার সাহেব ছোট নিশ্বাস ফেললেন। সত্যি বলতে মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হয়। কিন্তু বোন ভাগ্নীর জীবন গোছানো বেশি জরুরী আপাতত। দুনিয়ার প্রত্যেক জীবই স্বার্থপর। নিজ স্বার্থটা সবার আগে।

অভিলাষা বেশ একটু ক্ষান্ত হলো। ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল,

‘ এবার আগের ঘটনার পূর্নবৃত্তি হবেনা। শোয়েব ভাই দুর্বল ছিল, শতাব্দ না। তুমি এখনো তোমার ছেলেকে চিনতে পারোনি।  প্রিয়’কে পাওয়ার জন্য যা কিছু করতে হয় সব করবে। যাওয়ার সময় আমাকে স্পষ্ট বলে গেছে, ওর প্রিয়’কে চাই মানে প্রিয়’কেই লাগবে। এখন হোক বা পরে।’ 

স্ত্রীর কথায় আ*তঙ্কিত শাহরিয়ার সাহেব। শতাব্দের রাগ জেদ সম্পর্কে বেশ ভালো মত অবগত সে।

অভিলাষা বেগম বেশ স্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললেন,

‘ তোমাদের বাপ ছেলের ঝামেলায় আমি নেই। স্বামী  সন্তান দুইজনই আমার। কারো একজনের পক্ষ টানতে পারবো না আমি। আর মূলকথা, তোমার ভাগ্নি লুবনাকে পছন্দ না আমার। ভীষণ রকম অপছন্দ। প্রিয়’র সাথে তুলনা করলে দশে শূন্য দিবো। তবুও যদি শতাব্দকে রাজি করিয়ে বিয়ে করাতে পারো তাতেও আপত্তি নেই কোন। আপাতত এইসব ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চাই। শান্তি চাই আমার!’

‘ এত তেজ! কোথায় যাবে? বাপের বাড়িতে। যেই বাড়িটা আমার দয়ায় এই পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে আজ। ভুলে যেও না। তোমার ভাই যা কিছু করতে পেরেছে আমার জন্যই পেরেছে।’

অভিলাষা আহত হলো। শাহরিয়ার এভাবে মুখের উপর তাকে খোটা দিতে পারল? এমনি এমনি তো সব হয়নি। শাহরিয়ার পুঁজি দিয়েছিল শুধু। এরপর ব্যবসা বাণিজ্য  অর্থ সম্পদ যা হয়েছে শোয়েবই করেছে। টলমল চোখে তাকিয়ে আছে অভিলাষা।

শাহরিয়ার আভিলাষাকে এভাবে বলতে চায়নি। রাগের মাথায় মুখ ফুসকে বেরিয়ে গেছে। কিছু বলবে তার আগেই অভিলাষা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ ভুলে যেওনা প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর হাত।  অতীত ঘেঁটে দেখো তোমার খারাপ সময় পাশে শুধু আমিই ছিলাম।’

বলেই লাগেজ উঠিয়ে হুড়হুড় করে বেরিয়ে গেল অভিলাষা বেগম। পেছন থেকে ডাকলো শাহরিয়ার সাহেব। 

‘ গাড়ি নিয়ে যাও ড্রাইভার পৌঁছে দিবে।’

অভিলাষা বেগম সামনে ফিরেই শক্তপোক্ত কন্ঠে বললেন,

‘ মায়ের পেট থেকে গাড়ি নিয়ে বের হইনি। গাড়ি ছাড়া আর আটদশটা সাধারণ মানুষের মত চলতে পারি।’ 

স্ত্রী’র এমন তেজী উত্তরে কি বলবে ভেবে পেলেন না শাহরিয়ার সাহেব। ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর যাওয়ার দিক তাকিয়ে থাকলেন। পুরুষ মানুষ বাহিরে যতবড় বাঘই হোকনা কেন! স্ত্রীর সামনে নিতান্তই ভেজা বিড়াল। 

 

ঢাকায় ফেরার পর থেকেই মনমরা প্রিয়। মন বসছেনা কোথাও। মাথায় হাবিজাবি হাজারো চিন্তা। শতাব্দের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে অনেকবার। হচ্ছেনা। কখনো বন্ধ বলছে। কখনো আবার ফোন তুলছেনা। গতরাতে জুবাইদা ফোন করেছিল চুপিচুপি। বাড়িতে শতাব্দের সাথে লুবনার বিয়ের পাকাপাকি কথা চলছে। এসব থেকে বিরক্ত হয়ে অভিলাষা বেগম বাড়ি ছেড়েছে। আগাগোড়া সবটাই প্রিয় শুনেছে। সেই থেকে অস্থিরতা ঝেঁকে ধরেছে। ছটফট করছে সারাক্ষণ! অনেক ভেবেছে সারারাত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ নেই কোন। শতাব্দকে অন্যকারো সাথে দেখতে পারবেনা কখনো।

 

সকালে প্রভাকে নিয়ে মা স্কুলে চলে যাওয়ার পর। মায়ের ব্যাগ থেকে কিছু খুচরা টাকা আর নিজের কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে  বেরিয়ে পড়ল প্রিয়। শতাব্দের এপার্টমেন্ট গন্তব্য। রাস্তাঘাট সামান্য মনে থাকলেও চৌরাস্তায় এসে গুলিয়ে ফেলল। কোন দিকে যাবে এখন? সিএনজি ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে বারবার। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। আশেপাশে সব অজানা। এতদূর এসে বাড়িতে ফিরে যেতে পারবেনা। কোনদিক যাবে বলতে না পারায় সিএনজি ড্রাইভার রাস্তায় নামিয়ে দিলো। এমন বাজে পরিস্থীতির শিকার হয়নি কখনো। চিন্তা ভয়ে আরো বেশি ঘাবড়ে গেল প্রিয়। ফুটপাতে টঙ্গের দোকান ঘেঁষে দাঁড়ালো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে শতাব্দের নাম্বারে ফোন দিলো। কয়েকবার বেজে কেটে গেল। আবারো ফোন করল প্রিয়। এবার শতাব্দ ফোন তুলল। শতাব্দ কিছু বলবে তার পূর্বেই কান্না ভেজা কন্ঠে প্রিয় বলল,

‘ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। রাস্তা ভুলে গেছি। আপনার বাড়ির সামনে চৌরাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে আছি।’

হতভম্ব শতাব্দ। যেন আকাশ থেকে পড়ল। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা সে। শান্ত কন্ঠে আওড়াল,

‘ সেখানেই দাঁড়াও। আমি আসছি।’

মিনিট দশেক পর একটা বাইক নিয়ে ছুটে এলো শতাব্দ। গায়ে সাদা এপ্রন। তবে কি ক্লাসে ছিল শতাব্দ?

বাইক থেকে নেমে রাগী ক্রো*ধান্বিত দৃষ্টিতে প্রিয়’র দিক তাকালো। চোখ দিয়ে ঝলসে ফেলবে যেন। কাছে এসে নিচে থেকে ব্যাগ তুলল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ বাইকে উঠো দ্রুত।’

বাধ্য মেয়ের মত শতাব্দের বাইকের পেছনে উঠল প্রিয়। শতাব্দ বাইক স্টার্ড করে প্রিয়দের বাড়ির রাস্তায় ঘোরাতেই আঁতকে উঠল প্রিয়। আওয়াজ করে বলল,

‘ বাড়ি যাবো না। আপনার বাড়িতে যাবো আমি।’

পেছন ফিরে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো শতাব্দ। চোখমুখ শক্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে প্রিয়। শতাব্দ শুনলো না। বাইক প্রিয়দের বাড়ির দিক ঘোরালো। স্প্রিডে টান দিতেই চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়। বলল,

‘ আপনি কি নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। নাকি আমি চলন্ত বাইক থেকে রাস্তায় ঝাপ দিবো? ভয় দেখাচ্ছিনা। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ঝাপ দিবো!’

আচমকা বাইক থেমে গেল। পেছন ফিরে তাকালো শতাব্দ। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ কি চাও?’

‘ আপনি এখন আমাকে বিয়ে করবেন। এখন মানে এক্ষুনি!’

সোজাসাপটা জবাব প্রিয়’র। 

  

  

 

চলবে…….

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২৫

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

 

ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি শেষ করল প্রিয়। হাতপা কাঁপছে এখনো। নড়বড়ে কাঁপাকাঁপি হাতে টেবিলের উপর গ্লাসটা রেখে  ছোট নিশ্বাস ফেলল। নিচের দিক তাকিয়ে এক দমে বলল,

‘ বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানলে কোনদিন মেনে নিবেনা। গত কয়েকদিন যাযা হয়েছে তারপর তো এদমই না।তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।’

মুখোমুখি সোফায় বসে আছে শতাব্দ। শান্ত গম্ভীর মুখ। নিমিষ দৃষ্টিতে গভীর ভাবে পরখ করছে প্রিয়কে। ভীত চোখমুখ। হাতপা কাঁপাকাঁপিটাও চোখ পড়ছে শতাব্দের। এতবড় পদক্ষেপ নিয়ে ভীষণ ঘাবড়ে আছে নিশ্চয়ই!

শতাব্দের কোন সারাশব্দ না পেয়ে, উত্তরের অপেক্ষায় মাথা তুলে তাকালো। লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করে।আশান্বিত কন্ঠে বলল,

‘আমাকে বিয়ে করবেন? এখন না হলে আর কোনদিন হবেনা। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।’

শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতাব্দ। চোখেমুখে ভাবান্তর নেই কোন। শান্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘ আমার পক্ষে তোমাকে এখন বিয়ে করা সম্ভব না প্রিয়।’

প্রিয় যেন আকাশ থেকে পড়লো। চোখমুখ জুড়ে হতভম্ব। ভড়কে যাওয়া কন্ঠে আওড়াল,

‘ কিছুদিন আগেই তো আপনি বিয়ের কথা বলছিলেন। আজ..এখন..

‘ তোমার বয়স অল্প। আন্ডার এইট্টিন। এখন বিয়ে করা অসম্ভব।’

‘ আমি জানি, আপনি চাইলেই সব সম্ভব।’

‘ এই মুহূর্তে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’

বলেই মুখ ফিরিয়ে জানালার দিক তাকালো শতাব্দ। 

শতাব্দের আচরণে বরাবরই হতভম্ব প্রিয়। সেইরাতের ঘটনার পর প্রিয়’র সাথে একবারের জন্যও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি শতাব্দ। প্রিয় চেষ্টা করলেও শতাব্দ এড়িয়ে চলতো বেশ। আজও বাসায় আনতে রাজি হচ্ছিলো না প্রথমে। প্রিয় একপ্রকার জিদ করেই এলো। কয়েক সাপ্তাহ আগেও বিয়ের কথা বলছিল। এখন যখন প্রিয় নিজের থেকে বলছে। মুখ ফিরিয়ে নিলো। এটা কোন শতাব্দকে দেখছে প্রিয়? সেই প্রিয় চেনা মানুষটাকে এত অচেনা লাগছে কেন?

চোখ ভরে এলো প্রিয়’র। কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। নিজেকে সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করল। ধীর আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমার সব সম্পর্ক পিছনে ফেলে চলে এসেছি। আপনি ফিরিয়ে দিলে আমি কোথায় যাবো?’ 

শতাব্দ বাহিরে তাকিয়ে এখনো। আগের মতই শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ তোমার বাবাকে ফোন করেছি। আসছেন উনি।’

বিমূঢ় প্রিয়। কান্না আটকে রাখতে পারল না আর। ডুকরে কেঁদে ফেলল। উপরের শক্তপোক্ত খোলসটা চুপসে, নরম সরল প্রিয় বেরিয়ে এলো। ছুটে গিয়ে শতাব্দের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। শতাব্দের হাত ধরে কাঁদছে প্রিয়। অনবরত হাতপা কাঁপছে তার। কান্না ভেজা কন্ঠে আকুতি করল,

‘ কিছুদিন আগে আপনি-ই তো বিয়ের কথা বলেছিলেন। এখন কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন?’

হাত মুঠোবন্দী করে চোখমুখ শক্ত করল শতাব্দ। কন্ঠে কঠিনত্ব এনে বলল,

‘ মজা করেছিলাম!’

হতভম্ব প্রিয়। নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সত্যি কি শতাব্দ সেদিন মজা করেছিল? সেই মজার রেশ ধরেই কি প্রিয় সব ছেড়ে মূর্খের মত ছুটে চলে এলো। আসলেই কি শতাব্দ এমন সস্তা মজা করার লোক! কোনটা সত্য?  সেইদিনের সেই আকুল আবদার। নাকি আজকের এই রুক্ষ হয়ে মুখ ফেরানো। মাথা কাজ করছেনা প্রিয়’র। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বলল,

‘কেন এমন কঠিন হচ্ছেন! কি হয়েছে আপনার। আমি কি করেছি। কেন এভাবে শাস্তি দিচ্ছিলেন। সেই রাতের পর থেকে না কথা বলছেন। না যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। বরাবরই এড়িয়ে চলছেন। বিশ্বাস করুন আমি কিছু করিনি। মিথ্যা বলছে লোকে। আমি খালা কেউই কোনরকম খারাপ কাজ করিনি। শোয়েব আঙ্কেল নিজেই এসেছিলেন। আমরা… ব্যা* না।’

ক্রো*ধান্বিত শতাব্দ ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলছে। চোখেমুখে ভয়*ঙ্কর রাগ। চোখ বুজে রাগ দমানোর চেষ্টা করছে যথাসাধ্য।

শতাব্দের কোন সারাশব্দ না পেয়ে প্রিয়’র প্রচন্ড রাগ হলো। সবকিছু ছেড়ে ছুটে এলো শতাব্দের কাছে আর এখন শতাব্দ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? কেন এমন করছে। লুবনাকে বিয়ে করবে বলে।বুক চিড়ে হাউমাউ চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রিয় দমানোর চেষ্টা করল পারলো না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। মাথা আউলে গেল। ধপ করে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ এখন আর আমাকে ভালো লাগেনা আপনার? মন ভরে গেছে। পুরাতন হয়ে গেছি আমি। নতুন কাউকে চাই? কাকে চাই লুবনাকে চাই। আপনিও আপনার মামার মত। একজনকে দিয়ে মন ভরে গেলে নতুন কাউকে চাই। আমি..

আর কিছু বলবে তার আগেই প্রিয়’র গাল চেপে ধরল শতাব্দ। র*ক্তিম টলমল চোখ। প্রিয়’র চোখে চোখ রেখে। কঠিন গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ তোমার সাথে কি করেছি? বেডে নিয়ে গেছি?’

আজ প্রিয়’র চোখে ডরভয় নেই। শতাব্দের মতই চোখে চোখ রেখে।নির্ভীক কন্ঠে উত্তর দিলো,

‘ বেডে নিতে পারেননি বলে কি আফসোস হচ্ছে! কি ভাবেন  আমাকে ঠকিয়ে লুবনাকে বিয়ে করে ফেলবেন। কেউ কিছু জানবে না? মুখে প্রকাশ না করলেও। ইমান্দিপুরের সবাই জানে আপনার সাথে প্রেমে কথা।’

শতাব্দের রাগ হলো প্রচন্ড। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

‘ লুবনাকে বিয়ে করছি তোমাকে কে বলল?’

প্রিয় জুবাইদার নাম বলতে গিয়ে আটকে গেল। জুবাইদা বারবার সতর্ক করে দিয়েছে। তার নাম যেন শতাব্দকে না বলে। অশ্রু স্নিগ্ধ চোখ জোড়া বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কান্না আটকানোর যথাসম্ভব চেষ্টা চালালো। হলো না। বারবার ভিজে আসছে চোখ। দুহাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ফেলল। ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শতাব্দের সামনে আর শক্তপোক্ত খোলস ধরে থাকতে পারছেনা সে। ভেতরের সহজ সরল ছোট্ট প্রিয় বেরিয়ে এলো। বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ ভালোবাসি শতাব্দ। আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিবেন না। আমি বাড়ি যাবো না। প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না।’

হাউমাউ করে কাঁদছে প্রিয়। শতাব্দকে অন্য কারো সাথে দেখে সহ্য করতে পারবেনা কখনো। প্রথম প্রে্মের বিচ্ছিরি যন্ত্রণা। প্রিয়’র কৈশোর মন সেই ভার সইতে পারছেনা। কষ্ট হচ্ছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার।

 শক্ত পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। চোখমুখ অস্বাভাবিক শক্ত কঠিন।

কলিং বেলের শব্দে কেঁপে উঠল প্রিয়। মাথা তুলে অসহায় দৃষ্টিতে শতাব্দের দিক চাইলো। বিড়বিড় করে বলল,

‘ প্লিজ.. ফিরিয়ে দিবেন না।’

শুনলো না শতাব্দ। দরজা খুলে দিলো। বাহিরে জাফর সাহেব দাঁড়ানো। বাবাকে দেখে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল প্রিয়। লজ্জা ভয়ে মাথা নুয়ে নিলো। বাবার রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো মত অবগত। বড় আপার সময় দেখেছিল। ভয়ে থরথর কাঁপছে প্রিয়।

জাফর সাহেব ভেতরে এলেন। প্রিয়’র ব্যাগ হাতে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ বাড়ি চল প্রিয়।’

জাফর সাহেব যথেষ্ট রাগী মানুষ। বাবার অতি স্বাভাবিক শান্ত কন্ঠে বিমূঢ় প্রিয়। বেশ স্বাভাবিক চোখমুখ তার। যেন আগে থেকেই তিনি জানেন সব।

‘ আব্বা..

প্রিয় কিছু বলতে চেষ্টা করলে থামিয়ে দিলেন তিনি। আগের মত স্বাভাবিক গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ যা বলার বাড়িতে গিয়ে শুনবো। লেট হচ্ছে এখন চল।’

মেয়ের হাত টেনে তুলল জাফর সাহেব। এপার্টমেন্ট থেকে বের হবার সময় শতাব্দের সাথে চোখাচোখি হলো। দুজনের চাহনিতে অদ্ভুত কোন রহস্য।

 দরজার কাছে যেতেই প্রিয় পিছন ফিরে চাইল। অশ্রুসিক্ত অসহায় চাহনিতে শতাব্দের দিক চেয়ে রইল। মনেমনে বলল,

‘ বাবাকে আটকান। আমাকে আপনার কাছে রেখেদিন প্লিজ!’

প্রিয়’র মনের কথা শতাব্দ অবধি পৌঁছালো না। আটকালো না সে। প্রিয়’র যাওয়ার দিক চেয়ে রইল নিমিষ। 

 

 শাওয়ারের নিচে দুঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে আয়েশা। বিষাদপূর্ণ চোখমুখ। পানির সাথে অশ্রু মিশে ঝড়ছে। সব শেষ। এত বছর পরিশ্রম করে যা সম্মান কুড়িয়েছেন আজ সব শেষ। সব! 

পরিস্থিতী সামাল দিতে কলেজ থেকে ব্রেক নিয়েছিল। ছুটি কাটিয়ে আজ কলেজে গিয়েছিলো। প্রথম থেকেই সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। প্রথমে এসবের তোয়াক্কা না করলেও ধীরেধীরে আশেপাশে ফিসফিস কানে আসছে। গ্রামের লোকেরা  তার নামের সাথে ব্যা* তোকমা লাগিয়ে দিয়েছে। এতদিন যেই মানুষ গুলো সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস পেতনা আজ তারা কথা শোনাচ্ছে। সিনিয়র জুনিয়র কলিগ, স্টুডেন্ট সবাই তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে আড়ালে ফিসফিস করছে।গালমন্দ  করছে।

টিফিন টাইমে টিচার রুম মোটামুটি খালি ছিল। রেজাল্ট শিট তৈরি করছিল আয়েশা। এমন সময় টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো প্রদীপ স্যার। তিনি কলেজের একাউন্টিং-এর টিচার। বয়সে আয়েশা বেগমের বেশ জুনিয়র। প্রথমে কৌশল বিনিময় করে কথা বললেও।হঠাৎ  আয়েশা বেগমের কাছে ঝুঁকে এসে কুপ্রস্তাব রাখলো। বলল,

‘ শুনলাম আপনার বাড়িতে নাকি মেয়ে ভাড়া দেন। কতটাকা ঘন্টা? আপনার ভাগ্নীও নাকি এই পেশায় আছে। যত টাকা লাগে আমি দিবো। শুধু আজকের রাতের জন্য প্রিয়কে যদি…..’

কথা শেষ করতে দিলোনা আয়েশা। প্রদীপ স্যারের গালে সজোরে চ*ড় বসালো। অ*গ্নিশিখার মত জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলল,

‘ অমা*নুষ, জা*নোয়ার! মেয়ে বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে কুনজর দিতে লজ্জা করে না তোর? বাড়িতে বউ রেখে ভালোমানুষির মুখোশ পড়ে এসব করে বেড়াস বাহিরে। ছি!’

প্রদীপ গর্জন করে বলল,

‘ ব্যা*গো আবার ভাব। খালা ভাগ্নী যে চেয়ারম্যানের পোলা আর শালারে ফাঁ*সাইছ তা বুঝি আমরা জানি না? কতটাকা দেয় ওরা। আমি আরো বেশি দিবো।’

কলার চেপে ধরল আয়শা বেগম। ক্রো*ধে চোখ ঝলঝল করছে। ততক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে। অনেক লোক জড় হয়েছে সেখানে। লোকজন দেখে ভালো সাজার নাটক করল প্রদীপ। কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

‘ আপনি অনেক সম্মানের ম্যাডাম। আপনার কাছ থেকে এমন কু*প্রস্তাব আশা করিনি। সামান্য কিছু টাকার লোভে প্রিয়কে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ও আমার মেয়ের বয়সী। আমার বাড়িতে বউবাচ্চা আছে। ওর সাথে রাত কাটানো। ছিছি!’

আয়েশা যেন আকাশ থেকে পড়ল। আশেপাশে অন্য স্যার ম্যাডামদের ভেতর গুঞ্জন। এমন হাতাহাতি’র ঘটনা শুনে প্রিন্সিপাল ডাকল রুমে। সারা স্কুল কলেজ জুড়ে তখন চাপা গুঞ্জন। 

প্রিন্সিপালের রুমে আয়েশা নিজের দিক তুলে ধরার চেষ্টা করল। শুনলো না কেউ। পুরো স্টাফ প্রদীপের দলে। আয়েশা  প্রিয়কে নিয়ে আজেবাজে কথা রটিয়েছে ছবি বেগম। এতকিছুর পর কেউ বিশ্বাস করছে না তাকে। সমাজে একা নারীকে কেইবা মানে?

সব শুনে চাকরি থেকে আয়েশা বেগমকে বরখাস্ত করে দিলো প্রিন্সিপাল। এত বছর তিলেতিলে কুড়িয়ে আনা এই মান সম্মান মুহূর্তেই গুড়িয়ে গেল সব। এত মানুষের সামনে জঘন্য অপবাদ অপমানে গা ঘিনঘিনিয়ে উঠল তার। এত বছরের এত পরিশ্রম এত সম্মান বিফলে গেল সব। সেই সাথে প্রিয় নিষ্পাপ সুন্দর গোছানো জীবনটায় দাগ ফেলে দিলো বাজে। নিজে কাছে গোছাতে এনে আউলে দিলো তাকে। দাগ লাগিয়ে দিলো চরিত্রে! 

আরো আধঘন্টা পানিতে ভিজে ঘরে চলে এলো আয়েশা বেগম। কাপড় পাল্টে ভেজা চুল নিয়ে চিঠি লিখতে বসলো টেবিলে। সন্ধ্যায় কাজের খালা এলে। কিছু টাকা দিয়ে চিঠি পোস্ট করতে পাঠালো বাজারে। সেই সাথে বলল,

‘ কাল থেকে আসতে হবে না আর।’

কাজের খালা ঘাবড়ে গেলেন। ভীতি কন্ঠে বললেন,

‘ কেন। আমি কি করছি আফা!’

‘ তুমি কিছু করোনি। আমার শান্তি চাই। দূরে বেড়াতে যাবো আমি।’

‘ কবে ফিরবেন?’

‘ জানিনা।’

অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলো আয়েশা। কাজের খালা আর কথা বাড়ালেন না। চিঠি নিয়ে চলে গেলেন।

রাতে টলমলে শরীর নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরেঘুরে দেখছেন আয়েশা বেগম। নিজ হাতে সাজানো বাড়িটাকে এটাই বুঝি শেষ বারের মত দেখা। সারাজীবন এত আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে এই বয়সে এসে এমন অপবাদ, অপমান সহ্য করছে পারছেনা শরীর মন। ধৈর্যের একটা বয়স সীমা থাকে। সেই বয়স পাড় হয়ে গেলে ধৈর্য  সীমা নিতান্তই নিচে নেমে যায়। সারাজীবন তো শুধু লড়াই করল। কি পেল? না স্বামী পেল, না সংসার হলো। সারাজীবন শুধু ঠকেই গেল। বৈধ হয়েও সমাজের সামনে নিজের সন্তানের পরিচয় আনতে পারলো না। না প্রিয়কে জানাতে পারল তিনিই তার মা। 

নিজের মেয়ের এত কাছে থেকে মা ডাক না শোনার মত আক্ষেপ কষ্ট, য*ন্ত্রণা দুনিয়াতে হতে পারেনা আর। কখনোই না। এমন নিরর্থক জীবন রেখে কি লাভ?

আচ্ছা, প্রিয় যখন সত্যিটা জানবে ক্ষমা করবে কি তাকে?

ভাবতে ভাবতেই শাড়ির ফাঁদে মাথা ঢুকালো । চোখ বুঝে শেষবারের মত প্রিয়’র চেহারাটা মনে করল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ ক্ষমা করে দিস প্রিয়। আমি তোর ভালো মা হতে পারলাম না কখনো।’ 

 

শতাব্দের এপার্টমেন্ট থেকে ফিরে স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রিয়। আজকাল ঘর ছেড়ে বের হয়না কোথাও। এই চার দেয়ালই তার সব।চারপাশের সবকিছু যেন এলোমেলো। এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো। তাকে কেউ কোনকিছু জিজ্ঞেস করল না। না জানতে চাইল। সবকিছু একদম আগের মত স্বাভাবিক যেন। বাবার এই শান্ত স্বভাব প্রিয়কে ভাবাচ্ছে বড্ড। 

আচমকা মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনলো। কান্নার আওয়াজ। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল প্রিয়। ড্রইং রুমে যেতেই হতভম্ব। মা হাত পা ছড়িয়ে ‘আপা, আপা’ বলে কাঁদছে। পাশেই চূর্ণবিচূর্ণ ফোনটা পড়ে।  

বুক মোচড় দিয়ে উঠল প্রিয়’র। মায়ের কাছে ছুটে গেল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। অস্থির লাগছে খুব। মাকে ঝাকিয়ে বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,

‘ মা, কি হয়েছে খালার? ‘

আমেনা বেগম বিড়বিড়িয়ে এলোমেলো কন্ঠে বিলাপ করছে। কি বলছে বুঝল না প্রিয়। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ খালার কি হয়েছে?’

‘ আপা আর নেই প্রিয়। আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। অনেক দূর চলে গেছে…’ 

প্রিয় যেন আকাশ থেকে পড়ল। চোখের সামনে অন্ধকার লাগছে সব। চারিদিক ঘুরছে। মায়ের কথাটা কানে বাজছে বারবার। 

চোখ বুজতে বুজতে বিড়বিড় করে বলল প্রিয়,

‘ খালা নেই? খালা আর নেই…’

বলতে বলতেই মাটিতে অচেতন হয়ে পড়ল। 

 

( গল্পে প্রিয় কিশোরী। সাধারণত কিশোরী মেয়েরা আবেগী হয় বেশি। কারণ এই সময়টাই আবেগের। বিবেক নিয়ে কয়জনই বা বুঝে। তাদের মধ্যে ম্যাচুরিটি বরাবরই অল্প। আশাকরি আপনারা তা বুঝবেন। তবে হ্যাঁ, ইনশাআল্লাহ প্রথম খন্ডের প্রিয়’র সাথে দ্বিতীয় খন্ডের প্রিয়’র অনেক তফাত থাকবে।)

 

চলবে………

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২৬.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

খাটিয়ায় শুয়ে রেখেছে আয়শা বেগমকে। সুশ্রী মুখখানা কালো হয়ে চেহারা ন*ষ্ট হয়ে গেছে। শরীর থেকে পঁচা গন্ধ ছড়াচ্ছে। মারা যাওয়ার দুইদিন পর আশেপাশের লোকজন জেনেছে। দরজা ভেঙ্গে ভিতর ডুকে শোয়ার ঘরে আয়শা বেগমের ঝুলন্ত লা*শ দেখেছে। তারপর সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ফোন করে জানিয়েছেন।

খালার লা*শের সামনে পাথর হয়ে বসে আছে প্রিয়। বিষন্ন চোখমুখ। উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল।চোখ থেকে পানি ঝরছে অনবরত। বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। যেন মাকে হারিয়েছে। খালার কড়াকড়ি শাসনের জন্য ছোট থেকে খালা প্রতি একটু রাগ ছিল। কিন্তু এখানে আসার পর নতুন করে খালাকে জেনেছে। প্রিয়’র কাছে খালা একজন সংগ্রামী নায়িকা। জ*লন্ত অ*গ্নিশিখা। যার ছায়াতলে থাকা প্রতিটি মানুষ বাস্তব শিক্ষায় আলোকিত হয়। প্রিয়’র আদর্শ ছিলো খালা।

খাটিয়া তুলতে লোকজন আসতেই চিৎকার করে উঠল প্রিয়। ঝাপিয়ে পড়লো লা*শের উপর। দুহাতে জড়িয়ে কান্না করতে করতে বলল,

‘ আমার খালা কোথাও যাবেনা! কেউ ছোঁবেন না আমার খালাকে। কেউ না।’

খালার লা*শ জড়িয়ে কাঁদছে প্রিয়। হাউমাউ করে কাঁদছে। 

দূর থেকে মেয়ের দিক তাকিয়ে আছেন জাফর সাহেব। তারা যতই বলুক প্রিয় তাদের সন্তান। কিন্তু মুছে ফেলতে পারবে কি নাড়ির টান! প্রিয় বড় আপার মেয়ে। মস্তিষ্ক না জানলেও। নাড়ের টানে ঠিকই প্রিয় মন কাঁদবে। মা মেয়ের সম্পর্ক যে।

আমেনা বেগম, প্রভা আটকালো প্রিয়’কে। দুদিনে লা*শ। শরীর গলে গেছে। আশেপাশে গন্ধ ছড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি দা*ফন করতে হবে। আশেপাশের লোকজন কাঁধে খাটিয়া তুলে নিয়ে যাচ্ছে। প্রিয় বুক ফাটা চিৎকারে হাউমাউ করে কাঁদছে। যেন তার একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। বুক ফাটা এক চিৎকারে জ্ঞান হারালো প্রিয়।

জ্ঞান ফিরল দাফনের পর। জানাযা শেষে বাড়ি ফিরছে সবাই। আচমকা চোখ পড়ল শোয়েব হকে উপর। মাথা বিগড়ে গেল প্রিয়’র হন্তদন্ত হয়ে উঠে তার সামনে যেয়ে দাঁড়াল। কলার চেপে বলল,

‘ খু*নি। আমার খালাকে খু*ন করেছেন আপনি। আপনি একজন কাপুরষ। টাকা সম্পত্তির লোভে নিজের স্ত্রীকে ছেড়েছেন ছি! কাপুরষ!’

আশেপাশে অনেক লোকজন জমে। অভিলাষা বেগম ছুটে আসে। প্রিয়কে বুঝিয়ে শোয়েব হককে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে। চেঁচিয়ে উঠে প্রিয়। চিৎকার করে বলল,

‘ আমাকে ছোঁবেন না আপনি। আপনারা সবাই মুখোশধারী, খু*নি। সবাই মিলে আমার খালাকে খু*ন করেছেন। এটা আত্মহ*ত্যা না। এটা খু*ন। আমার খালা আত্মবিশ্বাসী, আত্মসম্মানী নারী ছিলেন। আপনারা সবাই  তা কেড়ে নিয়ে খু*ন করেছেন তাকে। আপনাদের বানানো এই  সমাজের প্রত্যেকটা লোক মুখোশধারী। উপরে উপরে সবাই ভালো। ভিতরে জ*ঘন্য শয়*তান। ঘৃ*ণা করি এই সমাজকে। এই সমাজের নিয়মকে। যেখানে একজন নারীকে বাঁচতে দেয়না। সবসময় সব দোষ কেন একজন নারীরই হয়? আমার খালা নির্দোষ ছিল। এই চরিত্রহীন লোকটা সেইরাতে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছিল। এখানে আমার খালার কি দোষ ছিল? শাস্তি কেন তাকে পেতে হলো?’

কাঁদতে কাঁদতে বলল প্রিয়। বাড়ির বারান্দা থেকে সবটা দেখছিল ছবি। প্রিয় শোয়েবকে ঘিরে ধরেছে। তা দেখে ছুটে এসেছে। স্বামীকে নিয়ে সামান্য চিন্তা নেই তার। আগামী নির্বাচনে দাঁড়াবে। সবার সামনে শোয়েব এভাবে হে*নস্তা হলে তার রেপুটেশনেও প্রভাব পড়বে। পলিটিকাল ক্যারিয়ার ব*রবাদ হবে। তেড়ে এলেন তিনি। টেনে হিঁচড়ে শোয়েব হক থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন প্রিয়কে। দাম্ভিক কন্ঠে বললেন,

‘ বাজে মেয়ে। রাস্তাঘাটে এসব শুরু করেছিস। নিজেদের দোষ চাপাতে আমার স্বামীর ঘাড়ে দোষ ঢালছিস। তুইও একটা ব্যা*’ বলেই প্রিয়’র দিক পা বাড়াবে। অমনি সামনে এসে শতাব্দ দাঁড়ালো। আয়েশা বেগমকে কবর দিয়ে মাত্রই বাড়ি ফিরছিল। বাড়ির সামনে এলো লোকজন দেখে ভিড়ে ঠেলে ভিতরে ঢুকে হতভম্ব। প্রিয়’র দিক ছবি বেগম তেড়ে আসছে। গভীর হুংকার দিয়ে শতাব্দ বলল,

‘ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ওদেরকে কিছু বলার আগে নিজের অতীতে তাকান। ব্যা* কে বুঝে যাবেন। ওর দিকে ভুলেও পা বাড়াবেন না।’

শতাব্দকে দেখে প্রিয়’র আরো রাগ বাড়লো। সেদিনের ফিরিয়ে দেওয়া সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেদিন ফিরিয়ে দিয়ে আজ সবার সামনে কি জাহির করতে চাইছে! প্রিয়কে ভালোবাসে? উহু, এমন ভালোবাসা চাইনা। যদি নিজের কাছে রাখতে না পারে তাকে প্রিয়’র চাইনা।

শতাব্দের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো প্রিয়। চোখে মুখে গভীর ঘৃ*ণা। শতাব্দের বুকে আঘা*ত করে বলল,

‘ আপনার দয়া আমার চাইনা। আমার লড়াই আমি একাই লড়তে পাড়বো। আপনিও আপনার মামার মত মুখোশধারী! আপনারা সবাই এক। সেদিন আপনি আমার বাবার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ আমি সবার সামনে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করলাম। সম্পর্ক ভাঙ্গলাম। চাইনা আমার আপনাকে। হিসাব বরাবর।’

বলেই কঠিন শক্ত চোখে ছবি আর শোয়েবের দিক তাকালো। রাগী গর্জনে হুশিয়ারি দিয়ে বলল,

‘ আপনাদের আমি ছাড়বো না। জ্বা*লিয়ে দিবো। আপনার অহংকার, দম্ভ সবকিছু মাটিতে মিলিয়ে দিবো।’

প্রিয়’র দিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভিলাষা বেগম। বাচ্চা মেয়েটা আজ যেন এক জ*লন্ত অ*গ্নিশিখা। হুবহু আয়শার প্রতিচ্ছবি। অনেক বছর আগের সেই ঘটনার পুর্নাবৃত্তি হচ্ছে আবার।

 

 বাড়ি জুড়ে পিনপতন নিরবতা। দিন ফুরিয়ে রাত নেমেছে অনেক আগে। ছেলের ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠল অভিলাষা বেগম। অন্ধকার এলোমেলো ঘরটায় বসে আছে শতাব্দ। বাহিরের ল্যাম্পপোস্টর আলোতে আবছা আলোকিত ঘর। জানাযা থেকে ফিরে সেই একই কাপড়ে বসে আছে সে। উষ্কখুষ্ক চুল। চূর্ণবিচূর্ণ জিনিসপত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘর। তার পরিপাটি গুছানো ছেলেটার এই কি হাল! চোখে ভরে এলো অভিলাষার। ছেলের কাছে গিয়ে আলতো স্বরে ডাকলো,

‘ শতাব্দ, বাবা আমার দিক একবার তাকা।’

কোনরূপ সাড়াশব্দ করলো না শতাব্দ। চোখমুখ কঠিন তার। অভিলাষা বেগম আবার ডাকলো। এবারো কোন সাড়া দিলো না শতাব্দ। ছেলেকে নিশ্চুপ কঠিন দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। ডুকরে কাঁদছেন। সেইদিকে শতাব্দের ভ্রুক্ষেপ নেই কোন রূপ। সে আগের মতই অটল। 

বোনের কান্নার আওয়াজ শুনে শোয়েব ছুটে এলেন। শতাব্দের ঘরে পা রাখতেই হুংকার দিয়ে উঠল শতাব্দ। পাশে পড়ে থাকা কাঁচের ফুলদানিটা তুলে শোয়েব হকের দিক ছুড়ে মারল। শোয়েব হক সরে যেতেই ফুলদানিটা দরজার সাথে লেগে ছিটকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মাটিতে পড়ে। আভিলাষা বেগম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ছেলের দিক তাকিয়ে। ছেলের এমন আ*ক্রোশ আ*ক্রমণ রূপ দেখেনি আগে। এই কোন শতাব্দকে দেখছে সে? আভিলাষা বেগম কিছু বলবে তার পূর্বেই গর্জিয়ে উঠল শতাব্দ। চিৎকার করে বলল,

‘ এই লোকটার জন্য শেষ হয়ে গেছে সব। সব শেষ। নিজের স্ত্রী সন্তানকে পরিচয় দিতে না পারা হেরে যাওয়া কাপুরষ। তোমার ভাইকে কোথাও গিয়ে ম*রে যেতে বলো। নয়তো আমার হাতে খু*ন হবে! এখান থেকে চলে যেতে বলো।’  

অভিলাষা বেগম স্তব্ধ। ছেলের রাগের ভ*য়ঙ্কর তোপ কি করে সামলাবে এখন!

 

খালা মা*রা গেছে আজ তিন মাস। পরিস্থিতী থেকে বেরিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে প্রিয়। এতদিন ঢাকায় থাকলেও পরিক্ষা দিতে ইমান্দিপুরে এসেছে এখন। প্রভা আমেনা বেগম সাথে এসেছে। জাফর সাহেব হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত। সময় পেলে মাঝেসাঝে এসে স্ত্রী সন্তানদের দেখে যাচ্ছেন। পরিক্ষা চার তারিখ শেষ হবার কথা হলেও সারাদেশে রাজনৈতিক অবস্থার জন্য পিছিয়ে গেছে। 

শেষ পরিক্ষা আজ। পরিক্ষা কেন্দ্র ইমান্দিপুরে থেকে আরো ভিতরে। গাড়ি দিয়ে প্রায় দেড়ঘন্টার পথ। মায়ের সাথে এসেছে এতদিন। আগামীকাল ঢাকায় শিফট হয়ে যাবে সবাই। বাড়িতে অনেক কাজ। তাই আজ সাথে বাবা এসেছে। প্রাকটিক্যাল পরিক্ষা শেষ করে গেট থেকে বেরিয়ে বাবাকে খুঁজছিল প্রিয়। গেটের সামনে শতাব্দের মুখোমুখি হলো। কেন এসেছেন উনি? জুবাইদার জন্য! হয়তো। বেশ স্বাভাবিক ভাবে অচেনার মত পাশ কাটিয়ে চলে এলো। রাস্তায় অনেক জ্যামজট। শতশত লোক। আচমকা ভারী শব্দ হলো। পিছনে তাকিয়ে দেখলো দুই স্কুলের ছেলেদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে। দৌড়াদৌড়ি করে মানুষ ছুটে পালাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে দোকানিরা দোকান বন্ধ করছে। রিকশা অটো সব ছুটাছুটি করছে। রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে।  প্রচন্ড ভয় করছে তার। ভিড়ের মধ্যে প্রিয় বাবাকে খুঁজছে। হ্ঠাৎ দা’ চা*পাতি নিয়ে তিনজন মধ্যবয়সী লোককে এদিকে ছুটে আসতে দেখলো। যেন প্রিয়’ই তাদের টার্গেট। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। উল্টো ঘুরে পেছনের দিক ছুটতে লাগলো। লোক গুলো ভিড় ঠেলে তার দিকেই আসছে। অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে তাড়া করছে। আশেপাশের মানুষ থেকে সাহায্য চাইল প্রিয়। কেউ শুনলো না। আপাতত যার‍যার মত পালাতে ব্যস্ত। লোক গুলো বড় বড় ধাপের সাথে প্রিয়’র ছোট ছোট কদম হেরে গেল। কিছু সাথে বেঁধে সামনে পড়ে গেল। হাঁটুর কাপড় ছিড়ে বেরিয়ে এলো পা। কে*টে রক্ত বের হচ্ছে। লোক গুলোকে কাছাকাছি আসতে দেখে। ব্যথা নিয়েই তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। সামনের দিক ছুটে যেতেই লোকগুলো হা*মলে পড়লো। চা*পাতি তুলে মাথার দিক আঘা*ত করবে অমনি পেছন থেকে কেউ তার দিকে ঘুরিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বুকে ঝাপটিয়ে ধরল। ভারী এক শব্দ হলো। প্রিয় অনুভব করল। কোন তরল পদার্থ তার কপাল বেয়ে চোখে পড়ছে। চোখ খুলে মুখে হাত দিতেই ঘাবড়ে গেল, কেঁপে উঠল। লাল টকটকে র*ক্ত। ভীত হতভম্ব প্রিয় কাঁপতে লাগল। মাথা তুলে তাকাতে দেখল শতাব্দ। কপাল ফেটে র*ক্ত ঝরছে টপটপ। বিমূঢ় প্রিয় কাঁপতে কাঁপতে দূরে সরে গেল। সামনে দাঁ চা*পাতি হাতে লোক গুলো শতাব্দকে দেখে ঘাবড়ে গেল। যেন পরিচীত। উল্টো পিছন দিক ছুটতে লাগলো। প্রিয় কিছু বলবে তার আগেই শতাব্দ হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। এক দোকানের কাছে যেতেই জাফর সাহেবকে দেখলো।  চূর্ণবিচূর্ণ গাড়ির পাশে আহ*ত দাঁড়িয়ে। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। বাবার দিক ছুটে গেল। প্রিয় কিছু বলবে তার আগেই শতাব্দ নিজের গাড়ির চাবিটা জাফর সাহেবের দিক এগিয়ে বলল,

‘ কেসের কারণে ওরা কু*ত্তা পাগল হয়ে গেছে। আপনাকেও ছাড়বেনা। বিলাশ নগরের রাস্তা ধরে ঢাকায় চলে যান এক্ষুনি।’

‘ আমেনা প্রভা?’

‘উনাদের কিছু হবেনা। ওদের মেইন টার্গেট প্রিয়। ওকে নিয়ে যান।’ 

‘ তুমি?’

‘ ওরা আমার ক্ষ*তি করবেনা।’

জাফর সাহেব তড়িঘড়ি করে গাড়ি উঠলেন। অনুভূতিহীন নিমিষ তাকিয়ে আছে প্রিয়। কোন কিছু মাথায় ঢুকছেনা তার। বাবা শতাব্দ কি আগের থেকেই পরিচীত!

ভাবনায় ছেদ পড়লো। র*ক্তাক্ত শরীরে ঢলতে ঢলতে শতাব্দ প্রিয়’র সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। র*ক্ত ভেজা হাত জোড়া প্রিয় দু’গালে ছুঁয়ে দিলো। টলমলে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ। গভীর কন্ঠে বলল,

‘আমাদের দেখা না হওয়াটাই বোধহয় ভালো ছিল। আমার প্রেম তোমার কাল হয়ে দাঁড়ালো। কোনদিন এই গ্রামে, আমার কাছে ফিরে আসবেনা আর। কোনদিন না।’

গাড়িতে বসে তাড়া দিচ্ছেন জাফর সাহেব। শতাব্দ ছেড়ে দিলো। ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ যাও!’

প্রিয় যন্ত্রের মত গাড়িতে গিয়ে বসলো। দূর থেকে শতাব্দের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার শরীর র*ক্তে ভিজে। দুর্বল চোখ। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলল। কি বলল? ‘ আমার প্রিয়?’

 

সেই শেষ দেখেছিল শতাব্দকে। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। তারপর আর কো্নো দিন দেখেনি তাকে। না তার নাম শুনেছে। সেই থেকে প্রেম ভালোবাসা বিয়ে এসব অনুভূতিতে বিতৃষ্ণা ঝেঁকে ধরেছে। কোন দিন এসবে জড়াবেনা সে। এতে লোকে যদি ফিলোফোবিক বলে। বলুক! তাতে কি? এর পেছনে ব্যাথাতুর গল্পটা শুধু সেই-ই জানে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, কেন গিয়েছিল ইমান্দিপুরে। কেন দেখা হলো তাদের! শতাব্দের সাথে দেখা না হওয়াতেই বোধহয় ভালো ছিল সবার।

 

(প্রথম খন্ডের সমাপ্তি)

 

ফিলোফোবিয়া ( দ্বিতীয় খন্ড )

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২৭.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

  

‘ বিয়ের মাত্র ছয়দিন বাকি। এসময় ট্যুরে কে যায় আপা?’

প্রভার বিরক্তি ঢালা অভিযোগ সুরে কপাল কুঁচকে তাকালো প্রিয়। চোখমুখ গম্ভীর করে আবার ব্যাগ গোছাতে মনযোগ দিলো। বোনের এমন অনিহা দেখে প্রভা বিরক্ত হলো আরো। উদাস সুরে বলল,

‘ যার সাথে সারাজীবন কাটাবি, অন্তত তার সাথে একবার দেখা কর।’

বড় নিশ্বাস ফেলল প্রিয়। পিছন ফিরে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ ঠিক আছে, দেখা করবো! যদি পছন্দ না হয়? তখন কিন্তু মত ঘুরবে আমার!’

প্রিয়’র রাগী গম্ভীর চোখ। সেই কত তালবাহানা করে রাজি করিয়েছে প্রিয়কে। এখন যদি বিয়ে করবেনা বলে ‘না’ করে দেয়। তখন! প্রিয়’র সাথে সাথে তার বিয়েটাও ভাঙ্গবে। প্রভা ঘাবড়াল। বলল,

‘ আচ্ছা! দেখা না করলি। ফোনে কথা তো বলতে পারিস অন্তত। উনার নাম্বার দিবো আপা?’

‘ প্রয়োজন নেই।’

‘ তোর নাম্বার উনাকে দিবো?’

‘ দরকার নেই।’

নিরাশ হলো প্রভা। হতাশ কন্ঠে বলল, 

‘ তুই এমন অস্বাভাবিক কেন আপা! বারবার গিল্টি ফিল হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে গলায় ছু*রি বিয়ের পিড়িতে বসাচ্ছি তোকে। যা হচ্ছে আর পাঁচটা মানুষের মত স্বাভাবিক ভাবে মেনেনে আপা।’

প্রিয় লাগেজের জিপ আটকে বিছানা থেকে নামিয়ে নিচে রাখলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন কেশ গুলো কাঠের কাঠিতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে উত্তর দিলো,

‘ তোর গিল্টি ফিল হবে, এটাই স্বাভাবিক। বিয়েটা আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হচ্ছে। করতে বাধ্য হচ্ছি একপ্রকার! বিয়ের থেকে অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট জিনিস আছে জীবনে। আপাতত আমার ভার্সিটির ট্যুর!’

হতভম্ব কন্ঠে জিজ্ঞেস করল প্রভা,

‘ ভার্সিটির ট্যুর তোর নিজের বিয়ের থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট?’

প্রিয়’র বেশ স্বাভাবিক চোখমুখ। বলল,

‘ আপাতত তাই-ই! ভার্সিটি লাইফের শেষ ট্যুর। মিস করতে চাইছিনা।’

‘ আর তোর বিয়ের কেনাকাটা?’ কন্ঠে সামান্য ক্রো*ধ ঢেলে জিজ্ঞেস করল প্রভা।

‘ আমার পছন্দ আমার থেকে ভালো জানিস তুই। তাছাড়া হলুদের দিন ভোরে চলে আসবো ঢাকায়।’

ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল প্রভার। অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ তোর মনে হচ্ছেনা তুই বেশি বেশি করছিস আপা? আব্বা জানলে রে*গে যাবে। দুদিন পর থেকে আত্মীয়স্বজন  আসতে শুরু করবে। ওই বাড়ির লোকজন তোর কথা জিজ্ঞেস করলে, তাদের কি জবাব দিবো আমরা?’

প্রিয়’র স্বাভাবিক কন্ঠে সরল উত্তর,

‘ বলবি ট্যুরে গেছি।’

ক্লান্তির শ্বাস ফেলল। গভীর দৃষ্টিতে প্রিয়’র কাজকর্ম দেখছে প্রভা। এতটা এলোমেলো কেন মেয়েটা! সত্যি কি অনুভূতিহীন প্রিয়?

বিরক্তির কন্ঠে বলল,

‘ বিয়ে ভাঙ্গার জন্য যেহেতু উঠেপড়ে লেগেছিস। তাহলে রাজি হলি কেন তখন?’

এবার গম্ভীর হলো প্রিয়। চোখমুখে গম্ভীরতা এঁটে বলল,

‘ বিয়েতে রাজি হওয়ার কারণ তুই বেশ ভালো করেই জানিস প্রভা। বারবার একই প্রশ্নের উত্তর দিতে বিরক্ত লাগে আমার।’

 

প্রিয় কাপড় পাল্টাতে ওয়াশরুমে চলে গেল। প্রভা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। প্রিয়’র এমন ত্যাড়ামো কথাবার্তা অস্বাভাবিক নয়। বিয়ের জন্য প্রভাই বাধ্য করেছে তাকে। প্রিয়’র রে*গে থাকাটা স্বাভাবিক।

মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এলো প্রিয়। প্রভা এতক্ষণে কথা গুছিয়েছে। প্রিয়কে দেখে বেশ হাস্যোজ্জ্বল স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘ ইরা আপুর ভাগ্নির জন্মদিনে উনি ছিল। আরমান বলছিল, তোকে দেখে নাকি ড্যাবড্যাব করে এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিল আপা।’

‘ ওহ আচ্ছা! থাকবে হয়তো। সেই অনুষ্ঠানে শহরের অনেক  চেনাজানা ডাক্তারা ছিল। ইরার বড়বোন আর তার বর ডাক্তার কিনা।’

প্রিয়’র ব্যস্ত গলার সাদাসিধা উত্তর। আবারো নিরাশ হলো প্রভা। সে চাইছে প্রিয়’র মনে সেই মানুষটাকে নিয়ে আগ্রহ জাগুক। কৌতূহলী হয়ে তাকে ফোন করুক। বিয়ের আগে চেনাপরিচয় হোক। কিন্তু হচ্ছে না!  প্রত্যেকবার বেশ স্বাভাবিক ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। 

সুন্দরী হওয়ার সুবাদে কলেজ ভার্সিটি জীবনে কত কত ছেলেরা প্রপোজ করছে প্রিয়কে। অথচ অনুভূতিহীন প্রিয় নিষ্*ঠুর ভাবে রিজেক্ট করেছে সবাইকে। কারো চেহারার দোষ দেখিয়ে! কখনো আবার চরিত্রের দোষ দেখিয়ে। কলেজ ভার্সিটিতে ছেলেদের কাছে ‘অহংকারী, বদমেজাজী’ নামে বেশ পরিচীত সে। একটা আঘা*ত কাউকে এতটা পাল্টে দিতে পারে? প্রিয়কে না দেখলে হয়তো কখনোই প্রভা বুঝতো না।

প্রভা নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে চায়। প্রচন্ডরকম চায়। তাই স্বার্থপরের মত নিজের সুখের জন্য বোনকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু তাই বলে নি*ষ্ঠুর নয় প্রভা। সে চায়, মন থেকে চায় প্রিয় সুখে থাকুক। অতীত ভুলে নতুন করে বাঁচুক। আর পাঁচটা মেয়ের মত স্বাভাবিক ভাবে থাকুক।

 

লাগেজ টেনে ড্রইং রুমে চলে এলো প্রিয়। আমেনা বেগম ঘর বাড়ি পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। দুই মেয়ের বিয়ে। কত আত্মীয়স্বজন আসবে। হাতে শত কাজকাম। প্রিয়কে লাগেজ হাতে দেখে আমেনা বেগম ভড়কে উঠল। হতভম্ব কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ কোথায় যাচ্ছিস প্রিয়?’

‘ কক্সবাজার। ট্যুরে যাচ্ছি মা।’

প্রিয়’র বেশ স্বাভাবিক উত্তর। আমেনা বেগম বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ ট্যুর মানে? বিয়ের মাত্র ছয়দিন বাকি। এখন ট্যুরে যাওয়ার সময়! তোর শ্বশুরবাড়ির লোকদের কি বলবো?’

‘সত্যিটা বলবে।’

মেয়ের উত্তরে বিরক্ত হলো আমেনা বেগম। কন্ঠে ক্রো*ধ ঢেলে বলল,

‘ বিয়ে কি কোন ছেলেখেলা! এমন দায়িত্বহীন কবে থেকে হলি প্রিয়?’

‘ ভার্সিটি জীবনের শেষ ট্যুর। বাঁধা দিও না। হলুদের দিন ভোরে চলে আসবো।’

‘ তোর আব্বাকে কি জবাব দিবো?’

‘ কোন একটা বাহানা দিয়ে কাটিয়ে দিও তো মা।’ প্রিয়’র খাপছাড়া আওয়াজ।

‘ এভাবে জীবন চলে না প্রিয়। পালিয়ে বেড়ালে হবেনা। বিয়ে তোকে করতেই হবে।’

সিরিয়াস হলো প্রিয়। জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বলল,

‘ বিয়ে করতে মানা করলাম কখন? বিয়ে তো আমি করবো। কিন্তু তার আগে যেসব ফর্মালিটি ঝামেলা আছে, সেগুলো থেকে দূরে থাকতে চাইছি আপাতত। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে বিদায় করে চাইছ তো! তোমাদের ইচ্ছা পূর্ণ করবো। হলুদের দিন ভোরে চলে আসবো।’

মেয়ের কন্ঠে জোড়ালো অভিমান। আমেনা বেগম কারণ জানে তার। কি করে মেয়েটাকে বোঝাবে? জীবন যুদ্ধে একা চলা যায়না এতটা পথ। তার জীবন আর সবার মত স্বাভাবিক নয়। পদেপদে বিপ*দের সম্মখীন হয়। যাকে পছন্দ করেছে প্রিয় জন্য যোগ্য পাত্র। বিয়ে দিয়ে তার হাতে তুলে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত  হয়।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিগ্যেস করল প্রিয়,

‘ আব্বা কই মা?’

‘ কোথায় আবার! বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছে।’

‘ ওইযে আব্বার মেডিকেল জুনিয়র যে?’

‘ হ্যাঁ’

‘ আমি বুঝিনা জুনিয়রদের সাথে এত কিসের বন্ধুত্ব।আব্বার বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র জুনিয়র সবার সাথে আমরা পরিচীত। শুধু এই মানুষকে লুকিয়েই রাখে। কেন? এতবছর ধরে তার সাথে সম্পর্ক। অথচ ছেলে নাকি মেয়ে আব্বা তা বলতে নারাজ! 

সকাল সকাল তার সাথে দেখা করতে চলে গেছে। ব্রেকফাস্ট ডেট? এটা কেমন কথা মা। বিষয়টা তুমি ঘেঁটে দেখো তো একটু! নয়তো আমি খোঁজ লাগিয়ে দেখবো।’

প্রভা বোনের দিক চোখ পাকিয়ে তাকালো। পাশ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,

‘ কথা ঘোরানোর জন্য তুই যাতা বলবি আপা? এখন আকাশকুসুম গভীর চিন্তায় ডুবে যাবে মা।’

প্রভার কথার তোয়াক্কা করল না প্রিয়। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

‘ তোর কি মনে হয় আব্বার জুনিয়র বন্ধুকে চিনে না মা? অবশ্যই চিনে। নয়তো এত নিশ্চিন্তে থাকত না। নাজেহাল করে ছাড়তো আব্বার!’

প্রভা জ্ঞানীদের মত মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,

‘ তুই কি করে বুঝলি? আর এই কথা এখন উঠালি কেন?’

‘ প্রথমত মাকে তোর থেকে আমি বেশি চিনি। সেই মানুষটা যেই হোক মা তাকে চিনে। কোনো কারণ বসতো শুধু আমাদের থেকে লুকাতে চাইছে। মা আরো আধঘন্টা জেরা করবে। বাস ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। বাড়ি থেকে বের হবার জন্য আমার মাকে ডিস্ট্রাকড করার প্রয়োজন ছিল। তাই এই প্রসঙ্গ তুলে ভাবমায় রেখে ঝামেলা মুক্ত হয়ে বেরিয়ে যাবো এখন।’

বলেই লাগেজ তুলে সিঁড়ির দিক হাঁটা দিলো প্রিয়। বোনের কথাবার্তা, কর্মকান্ডে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল প্রভা। মনে মনে বলল,

‘ বিয়ের আগে আপা বাড়িতে ফিরে আসবে তো?’

তড়িঘড়ি করে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন করল প্রভা।

 

সময় বড্ড অদ্ভুত। পৃথিবীর সকল আবর্তন পরিবর্তনের কারণ। কখনো জখম দিয়ে কখনো আবার ঔষধ হয়ে দাঁড়ায়। ভোরের আকাশে কালো মেঘ দেখা গেলেও, এখন আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। আকাশ জুড়ে সূরের আলোছায়ার নিদারুণ খেল।

মাত্রই গাড়ি ছেড়েছে। জানালার পাশে বসেছে প্রিয়। দমকা হাওয়ার দুলছে অবাধ্য কেশ। আচমকা মোবাইল বেজে উঠল। ফোন করেছে প্রভা। বিরক্ত হলো প্রিয়। মাত্রই তো বাড়িতে দেখা হলো। আবার কেন ফোন করলো? 

কপাল কুঁচকে ফোন তুলে কানে ধরল। অপর পাশ থেকে প্রভার ব্যস্ত আওয়াজ,

‘ হ্যালো আপা, শুনছিস?’

কন্ঠে বিতৃষ্ণা জুড়ে উত্তর দিলো প্রিয়,

‘ হ্যাঁ বল, শুনছি।’

‘ তোর নাম্বারটা ভাইয়াকে পাঠিয়েছি। ফোন করতে পারে তোকে। গ্রামীণ নাম্বার লাস্টে 630..’

আরকিছু না শুনে চট করে ফোনটা কেটে দিলো। রা*গে গা জ্বলছে তার। নাম্বার দিতে নিষেধ করেছিল প্রভাকে। তবুও কেন দিলো সে। আবারো ফোন এলো। কেটে দিলো প্রিয়। আবার ফোন বাজতেই মোবাইল সুইচ অফ করে ব্যাগে রেখে দিলো।

 

সারাদিন জার্নি করে ভোর চারটায় এসে কক্সবাজার পৌঁছেছে। ফাইনাল ইয়ারের লাস্ট ট্যুর হওয়ায়। ম্যানেজমেন্টের লোকজন বেশ ভালো আয়োজন করেছে। বেশ নামিদামি হোটেলে রুম বুক করেছে। ডাবল বেডের রুম। প্রতিরুমে চারজন করে। সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই সবাই রুম খালি করে বিচের পাড়ে বেরিয়েছে। শুধু প্রিয়’ই রুমে। যাওয়ার সময় ইরা ডেকে গেছে একবার। উত্তরে, নাকেমুখে আরো শক্ত করে চাদর টেনে শুয়ে ছিল প্রিয়। তার ভাষ্যমতে, আগে ঘুম তারপর দুনিয়ার অন্যকিছু। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বিড়বিড় করে ইরা বেরিয়ে গেছে।

গভীর ঘুমে তলিয়ে প্রিয়। আচমকা দরজায় কড়া পড়লো। প্রথমে নড়েচড়ে শুয়ে পড়লেও। পরবর্তীতে ভারী আওয়াজে প্রিয়’র ঘুম ভাঙ্গল। বিরক্ত হয়ে চোখ ঢলতে ঢলতে বিছানা ছেড়ে উঠল। মাথাটা টিসটিস করে ব্যাথা করছে এখনো। দরজা খুলতেই কপাল কুঁচকে নিলো। বাহিরে কেউ নেই। দরজার কাছে বড়সড় গোলাপ ফুলের বুকে। মাথা বের করে আশেপাশে তাকালো। কেউ নেই।

 ঝুঁকে ফুলের বুকেটা হাতে তুলে নিলো। ভিতরে একটা চিরকুট লাগানো। চিরকুটের ভাঁজ খুলে হতভম্ব প্রিয়,

‘ গুড মর্নিং প্রাণপ্রিয়! ঘুমকন্যা ঘুম ভেঙ্গেছে আপনার? কি ভেবেছ শহর ছাড়লেই রেহাই হবে। উহু, আমি যে ছায়ার মত সর্বদাই আশেপাশে আছি তোমার।

ফাইভ ডে’স টু গো! টিক..টক..টিক…টক…’

 

চিরকুট দেখে রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠল প্রিয়। রুম থেকে ওড়না এনে গলায় প্যাঁচিয়ে। স্লিপার পরেই হাঁটা ধরল। রিসেপশনে বসে থাকা মেয়েটার সামনে ফুলের বুকেটা আঁচড়ে ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল,

‘ এই বুকেটা আমার রুমের সামনে কে রেখেছে জানতে পারি?’

মেয়েটা ভদ্র স্বরে উত্তরে বলল,

‘ না ম্যাম। আমাদের হোটেলে এমন সার্ভিস নেই।’

আশাহত হলো প্রিয়। এতবছর যাবত এই অজানা মানুষটার জ্বা*লাতনে অতিষ্ঠ সে। ভেবেছিল রিসেপশন থেকে তথ্য জোগাড় করে ব্যাটাকে হাতে নাতে ধরবে এইবার। কিন্তু মানুষটা মনে হচ্ছে গভীর জলের মাছ। প্রিয়ও কম কিসে? 

ব্যস্ত কন্ঠে বলল আবার,

‘ রুম নাম্বার ২০২ এর সামনের সিসি ক্যামেরা’র ফুটেজ দেখা যাবে কি?’

‘ নো ম্যাম।’

‘ আমি শুধু ফুটেজটা দেখবো একবার।’

‘ সরি ম্যাম। এটা আমাদের হোটেলের রুলসের এগেইনস্ট।’

বিরক্ত হলো প্রিয়। চেঁচিয়ে বলল,

‘ বললাম তো শুধু একবার দেখবো।’

‘ সরি ম্যাম।’

মেয়েটার সাথে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে গেল প্রিয়। সমুদ্রপাড় ঘুরে মাত্রই রুমে ফিরছিল ইরা। রিসিপশনে প্রিয়’র চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এলো। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই প্রিয়’র হাতে ফুলের তোড়া দেখে সবটা বুঝে গেল। কিটকিটে হেসে ফেলল। বলল,

‘ আবার? নিশ্চয়ই গোলাপ ফুলের বাগান আছে লোকটার। তাইতো গোলাপ ফুলের বুকে পাঠায় সবসময়। এতদিন ভাবতাম মানুষটা বাহিরের। এখন মনে হচ্ছে ভার্সিটিরই কেউ। নয়তো পিছুপিছু কেউ কক্সবাজার অবধি আসে? ভাগ্য করে একটা প্রেমিক পেয়েছিস বটে!’

ইরার মজার ছলে কথাবার্তায় বিরক্ত হলো প্রিয়। ফুলের বুকেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলল,

‘ সে যেই হোক না কেন। কয়দিন পর যখন জানবে বিয়ে হয়ে গেছে আমার। এমনি এমনি মাথা থেকে প্রেমের ভূত নেমে যাবে তার।’

বলেই হনহন করে রুমে চলে গেল প্রিয়। পেছন পেছন ইরাও গেল।

রিসেপশনের পাশে ভিআইপি লাউঞ্জ। যাকে নিয়ে পেছনে ছোটখাট যুদ্ধ চলল। সেই মানুষটা বেশ আয়েশ করে চা খাচ্ছে। প্রিয়’র চেঁচামেচি উপভোগ করছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশ। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করল,

‘ আর কিছু লাগবে স্যার?’

‘ মিষ্টি।’

ওয়েটার ভ্রু কুঁচকাল। বুঝলো না। বলল,

‘ সরি স্যার?’

‘ চিনি।চায়ে চিনি কম।’

ওয়েটার চলে গেল। ফোন বের করে প্রিয় নাম্বারে ফোন করলো আবার। এখনো ‘সুইচ অফ’। মানুষটা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।উদাস কন্ঠে বলল,

‘ যতই দুরত্ব বাড়াও না কেন? তুমি শুধু আমারি থাকবে প্রিয়!’

 

( দ্বিতীয় খন্ড নিয়ে আমি প্রচন্ড নার্ভাস। দয়া করে ভালো ,খারাপ যেমন লাগবে মতামত জানাবেন)

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২৮.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

আজ গায়ে হলুদ। ভোর পাঁচটায় বাড়ি ফিরেছে প্রিয়। আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে বাড়ি। চারিদিকে চাপা গুঞ্জন। বিয়েতে মেয়ের মত আছে কি? আমেনা বেগম সকাল থেকে মেয়ের সাফাই গাইতে ব্যস্ত। 

গ্রাম থেকে জাফর সাহেবের ভাইবোনদের পুরো পরিবার এসেছে। আশেপাশের বন্ধুবান্ধব পাড়াপ্রতিবেশি সবাই আমন্ত্রীত। মেয়েদের বিয়েতে ঘটা করে আয়োজন করছেন। বরের বাড়িতে তেমন কোন আয়োজন নেই এখন। ছেলের বাবা মা সহ দশ পনের জন আত্মীয় এসে বিয়ে করিয়ে নিয়ে যাবেন। পরে আস্তেধীরে অনুষ্ঠান করবে।

বেলা দশটায় ঘুম ভাঙ্গল প্রিয়’র। চেয়ারে এক পা তুলে বেশ আয়েশ করে রুটি ছিঁড়ে খাচ্ছিলো। হ্ঠাৎ-ই সামনে এসে দাঁড়াল প্রভা। কোমরের দুপাশে হাত রেখে বলল,

‘ এখন খাচ্ছিস? ওইদিকে মেক-আপ আর্টিস্ট এসে অপেক্ষা করছে। দশটায় এপয়েন্টমেন্ট ছিল আমাদের।’

প্রিয়’র বেশ স্বাভাবিক খাপছাড়া আওয়াজ,

‘ ওহ আচ্ছা। জানতাম না তো আমি!’

বিরক্ত হলো প্রভা। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

‘ নাম্বার বন্ধ থাকলে কি করে জানাবো? দেখ আপা, এমনিতেই বাড়িতে তোর ট্যুরে যাওয়া নিয়ে চাপা গুঞ্জন চলছে। মা সকাল থেকে সেইসব সামলাচ্ছে। এখন নতুন কোন সিনক্রিয়েট করিস না প্লিজ!’

প্রভা খানিকক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করল। প্রিয়’র কোনোরূপ হেলদোল না দেখে ক্ষি*প্ত পায়ে চলে গেল।

 

রাত তিনটা পর্যন্ত বাড়ির ছাদে হলুদের অনুষ্ঠান হলো। পুরোটা সময় প্রিয় মূর্তির মত বসেছিল। আশেপাশে যা ঘটছে কোনকিছুতে কোন প্রকার হেলদোল নেই তার। সবকিছু অসহ্য লাগলেও বাবা মায়ের মুখের দিক তাকিয়ে চুপচাপ মেনে নিচ্ছে। মেক-আপ উঠিয়ে ফ্রেশ হয়ে যেই বিছানায় ঘুমাতে যাবে অমনি কলিং বেল বাজলো। সবাই মাত্রই যার যার ঘরে বিশ্রাম নিতে গেছে। এমন সময় কে এলো? বিরক্ত হলো প্রিয়। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা খুলতেই হতভম্ব। দারোয়ান চাচা এসেছে। বড়সড় একটা লাল গোলাপের বুকে হাতে। বিহ্বল প্রিয়। বুকের মাঝে ছোট একটা চিরকুট। ভাঁজ ভাঙ্গতেই দেখল,

‘ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার জন্য একগুচ্ছ গোলাপ’

 

প্রচন্ড রাগ হলো প্রিয়’র।বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ কে পাঠিয়েছে চাচা?’

‘ একটা ছেলে। গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিচে।’

‘ এখনো আছে?’

‘ হ আম্মা।’

দ্রুত পা চালিয়ে কয়েক সিড়ি নিচে নামল প্রিয়। আচমকা কিছু একটা ভেবে থেমে গেল। দারোয়ান চাচা জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হইলো থাইমা গেলা কেন! যাইবা না ?’

‘ না চাচা। তাকে দেখার ইচ্ছা নাই আমার।’ 

গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল প্রিয়। পিছন ঘুরে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠল। ভিতরে ঢুকার আগে ফুলের বুকেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। ঘরে এসে জানালার পাশে দাঁড়াল। দূর রাস্তা একটা গাড়ি দাঁড়ানো। অন্ধকারে একজন পুরুষালি আভা। এদিকটাই তাকিয়ে আছে যেন লোকটা।

 

কোনার ঘরটায় বউ সাজচ্ছে। সেদিকে যাওয়া নিষেধ। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পা নাচাচ্ছে প্রভা। চোখমুখ জুড়ে চাপা উত্তেজনা। এই দিনটারই তো অপেক্ষা ছিল তার। অবশেষে তার স্বপ্ন পূর্নতা পাচ্ছে। অনেক যুদ্ধের পর ভালোবাসার মানুষটার হতে যাচ্ছে। একদম টিপটপ পার্ফেক্ট দেখতে লাগে যেন তাকে। মেক-আপ আর্টিস্টদের এটা কম, ওইটা বেশি হয়েছে বলে বেশ বিরক্ত করছে। আচমকা প্রিয়’র দিক চোখ যেতেই চেঁচিয়ে উঠল প্রভা। বাজখাঁই আওয়াজে বলল,

‘ বিয়েতে এমন লাইট মেক-আপ কে করে আপা? তুই কি গেস্ট?  তুই হচ্ছে বউ। সবার আকর্ষণ থাকবে তোকে ঘিরে। তুই করবি গ্ল্যামারাস হ্যাভি মেক-আপ।’

মেক-আপ আর্টিস্ট মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলল প্রভা,

‘ ভেস মেক-আপটা আরেকটু হ্যাভি করেন তো আপু।’

প্রিয় বাঁধা দিলো। গম্ভীর মুখ করে বলল,

‘ কেন লাইট মেক-আপ করলে কি তোর ভাসুর আমাকে বিয়ে করবে না? তোর সার্কাস সাজার ইচ্ছা, তুই সাজ। আমাকে প্যাচাবি না একদম।’

প্রভা চুপসে গেল। মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

 

ভারী লেহেঙ্গা পড়ে মুখ ভার করে স্টেজে বসে আছে প্রিয়। চোখমুখে গম্ভীর অন্ধকার। দুইরাত ধরে ঘুম হচ্ছেনা। মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে এখনো। অন্যদিকে প্রভা বেশ হাসিখুশি প্রাণবন্ত। বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলতে ব্যস্ত। দাওয়াতের লোকজন কমেছে। বরযাত্রা চলে আসবে। একটু আগে জাফর সাহেব ফোন করেছে। বলেছে, রাস্তায় আছে।দশ মিনিট লাগবে পৌঁছাতে। জানুয়ারির শুরু। শীতের দাপট এখনো প্রচন্ড। এই শীতেও ঘামছে জাফর সাহেব। কাজের ফাঁকে বারবার প্রিয়’র দিক চাইছে। খানিক বাদে যা ঘটতে পারে তা আশংকা করেই ভয়ে কেঁপে উঠছে। ইতোমধ্যে অনেকই তা লক্ষ করেছে। বেশ কয়েকজন জিজ্ঞেসা ও করেছে। বিয়ে বাড়ির ঝামেলার সামান্য ছুতো দিয়ে এড়িয়ে গেছেন তিনি। 

বাহির থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে। ‘বর এসেছে, বর এসেছে’ বলে বাচ্চারা হুরাহুরি করছে। বরের বাড়ির লোকেদের স্বাগতম করতে এগিয়ে গেলেন জাফর সাহেব।

 

বর এসেছে। বাহিরে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন চলছে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে প্রিয় প্রভাকে স্টেজে নেওয়ার হবে। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে প্রভা। উশখুশ করছে মন। আরমানকে দেখতে কেমন লাগছে? রাজপুত্রের মত কি! স্টেজের দিক উঁকিঝুঁকি করছে বারবার। প্রভার এমন কান্ড দেখে বিরক্ত হলো প্রিয়। খানিক চেঁচিয়ে বলল,

‘ লাজলজ্জা আছে? নাকি বেচে দিয়েছিস সব! কেউ দেখলে কি বলবে প্রভা।’

প্রভার খাপছাড়া আওয়াজ,

‘ যা বলার বলবে। তাতে কি! অনেক যুদ্ধ করে তাকে পেতে যাচ্ছি। রূপকথা মনে হচ্ছে সব। আচ্ছা আপা, রূপকথার ভালোবাসাও কি এমন সুন্দর হয়?’

উদাস হাসলো প্রিয়। মলিন কন্ঠে বলল,

‘ উহু, বড্ড বা*জে জ*ঘন্য হয়। ভালোবাসা অনুভূতিটাই জ*ঘন্য ইলোজিকাল ব্যাপার স্যাপার।’

প্রভার হাসিহাসি মুখটা চুপসে গেল। প্রিয়’র কাছে এমন প্রশ্ন করা, একদম উচিত হয়নি তার। প্রবল উত্তেজনার তাড়নায় কিভাবে জানো করে ফেলল হ্ঠাৎ!

 

কাজি এসেছে। বউদের স্টেজে ডাকছে। বিয়ে পড়ানো হবে এখন। তিন চারজন মেয়ে এসে নিয়ে গেল তাদের। লজ্জায় গদগদ করছে প্রভা। অন্যদিকে প্রিয়’র চোখমুখ অন্ধকার এখনো। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। জোড়ালো ভয় চেপেছে মনে। ধুকপুক করছে বুক।

 প্রথমে স্টেজে বসানো হলো প্রভাকে। দুইজন জন মেয়ে এসে নিয়ে গেল প্রিয়কে। কারো পাশে বসানো হলো তাকে। তখনো প্রিয়’র চোখজোড়া ঝুঁকে আছে অস্বস্তিতে। হাত জোড়া উশখুশ করছে।

‘ কি হয়েছে? খারাপ লাগছে!’ 

 আচমকা কানের কাছে অতিপরিচিত ফিসফিস আওয়াজ বাজলো। ভড়কে উঠল প্রিয়। বিস্ফোরিত দৃষ্টি তুলে পাশের মানুষটার দিক তাকালো। মুহূর্তেই হাতপা কাঁপতে শুরু করল। এতবছর পর এই লোকটা আবার! কেন!

 ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথা। কিছু ভাবতে পারছে না। বুঝতে পারছেনা। কি করবে? কি হচ্ছে! ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে মাথা। বুজে আসছে চোখ। আচমকাই নেতিয়ে পড়ল প্রিয়। পাশের মানুষটার উপর ঢুলে পড়ল।

 

ঘর জুড়ে চাপা গুঞ্জন। কানাঘুষা করছে আশেপাশের লোকজন।সোফায় শুয়িয়ে রেখেছে প্রিয়কে। পাশে বসেই বাতাস করছে আমেনা বেগম। চোখেমুখে চিন্তা ভয়ের ছাপ। মেয়েটার কিছু হলো না তো আবার? 

প্রিয়’র পায়ের কাছে বসে পায়ের পাতা মালিশ করে দিচ্ছে প্রভা। দূরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। চিন্তায় মুখে হাত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। শেষ অবধি তাদের বিয়েটা হবে তো?

বিয়ের পাগড়িটা নিচে পড়ে।অস্থির ক্ষি*প্ত পায়ে ঘর জুড়ে পায়চারি করছে শতাব্দ। ভীষণ এলোমেলো লাগছে। ভিতরে ভিতরে প্রচন্ডরকম নার্ভাসনেস কাজ করছে। চিন্তা, ভয়ে প্রিয়’র পাশে এসে দাঁড়াতে পারছেনা সে। না তাকে ছোঁয়ার সাহস করতে পারছে। আনন প্রিয়’র চেকআপ করে উঠে দাঁড়াতেই। ছুটে এলো এলো শতাব্দ। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে?  সবঠিক?’

শতাব্দের কাঁধে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করল আনন।? 

‘ শান্ত হ, তুই একজন ডাক্তার। অল্পতেই এভাবে অস্থির হলে চলবে না’

আননের সান্ত্বনা সূচক কথাবার্তা শোনার মত মানসিকতা নেই এখন। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল আবার,

‘ ঠিক আছে প্রিয়?’

‘ তেমন কিছু না। প্রেসার লো। ঘুম খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে হয়তো। একটু পরই জ্ঞান ফিরবে।’  

জাফর সাহেব শক্ত পাথর বনে দাঁড়িয়ে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো এতক্ষণ। জ্ঞান ফিরলে রিয়েকশন কি হবে প্রিয়’র! মাথা কাজ করছেনা তার।

 

ঘন্টা খানেক বাদে প্রিয়’র জ্ঞান ফিরল। লোকজন চলে গেছে ততক্ষণে। পিটপিট চোখজোড়া মেলে আশেপাশে তাকালো প্রিয়। তাকে ঘিরে চেয়ারম্যান বাড়ির লোকজন। প্রথমে কিছু না বুঝতে পারলেও। আস্তে আস্তে সব স্পষ্ট হলো। চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। চারদিকে চোখ বুলালো। আ*তঙ্কিত চোখমুখ। সমুদ্রের সাথে প্রভার বিয়ে? কি করে সম্ভব এসব।

দরজার কাছে শতাব্দকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘৃ*ণায় দৃষ্টি  ফিরিয়ে নিলো প্রিয়। ঘৃ*না রাগে শরীর কাঁপছে থরথর। ভারী-ভারী নিশ্বাস ফেলছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে। মাথার ওড়নাটা টেনে খুলে নিচে ছুঁড়ে ফেলল। বাবার দিক মাথা তুলে তাকালো। র*ক্তিম চোখ। সারা মুখ অশ্রুতে ভিজে। ভীষণ অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে তাকে। ঘৃ*ণা মিশ্রিত কাঁপাকাঁপি কন্ঠে বলল,

‘ এই বিয়ে আমি করবোনা। এই লোকটাকে এখান থেকে চলে যেতে বলো আব্বা।’

 

চলবে……….

 

ফিলোফোবিয়া

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

২৯.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

ঘর এখন মোটামুটি খালি। ভীড় কমেছে অনেকক্ষণ। বাহিরে অপেক্ষা করছে সবাই। সোফায় হাত ভড় দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে অগোছালো এলোমেলো প্রিয়। চোখজোড়া অশ্রুভারাক্রান্ত। পানি ঝরছে টপটপ।

 প্রিয়’র সামনে ফ্লোরে পা জড়িয়ে বসে আছে প্রভা। অশ্রুতে ভিজে আছে তার চোখ। মুখশ্রী জুড়ে আ*তঙ্ক ভয়। পিছন ফিরে একবার চাইলো। দরজার সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে জাফর সাহেব।

প্রভা আরো কাছ ঘেষলো। কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই গম্ভীর কন্ঠে বলল প্রিয়,

‘ আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। প্লিজ জোর করবিনা প্রভা! প্লিজ…’

হতাশ হলো প্রভা। অশ্রুভারাক্রান্ত পিটপিট চাহনি। উদাস সুরে বলল,

‘ আপা! আমার কথাটা একবার শুন। আপা..’

কান্না চেপে রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করছে প্রিয়। কাঁপাকাঁপি কন্ঠে বলল,

‘ তোর কোন কথা আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারবেনা প্রভা।’

বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো প্রিয়। প্রভা শান্ত করার চেষ্টা করল। বলল,

‘ শান্ত হ আপা। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর। বরযাত্রী ফেরত গেলে সবার সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবে আব্বা? তোর হাতে সব। প্লিজ…

‘ আমি পারবো না প্রভা! পারবো না। ওই লোকটার সাথে এক ছাদের তলায় থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।’

অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো প্রভা। পেটে হাত রেখে ফিসফিস সুরে বলল,

‘ ওর কথা একবার ভাব। আজ বিয়েটা না হলে, এলোমেলো হয়ে যাবে সব।’

মাথা তুলে অনুভূতিহীন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়। ধীর আওয়াজে বলল,

‘ সরি। পারবো না আমি।’

অনেক আকুতি মিনতি করল। মানলো না প্রিয়। আশাহত হলো প্রভা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

 

প্রাণহীন পাথর হয়ে বসে আছে প্রিয়। জাফর সাহেব মেয়ের পাশে বসলেই। মেয়ের মাথায় হাত রেখতেই, গম্ভীর গর্জন করে উঠল প্রিয়। বলল,

‘ সব জেনে শুনে তুমি কি করে এই কাজটা করতে পারলে আব্বা?’

জাফর সাহেব বিমূঢ়! তপ্ত অনুতপ্ত। কাঁপাকাঁপা হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কান্না আটকে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা তার। ধীর আওয়াজে বললেন,

‘ আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে আদরের তুই। কোনদিন তোর কাছে কোনকিছু চাইনি। আজ একটা জিনিস চাইবো। দিবি মা?’

প্রিয় বাবার দিক মাথা তুলে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়ের চাহনি উপেক্ষা করে জাফর সাহেব বললেন,

‘ শতাব্দকে বিয়েটা করে নে মা।’

হতভম্ব প্রিয়। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। চোখজোড়া থেকে অশ্রু ঝরছে টপটপ। বুক ফেটে চিৎকার আসছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।হাউমাউ করে কাঁদতে চাইছে। পারছেনা। ফুপিয়ে উঠলো প্রিয়। অশ্রুভারাক্রান্ত শক্ত চোখে তাকিয়ে রইল।

জাফর সাহেব আবারো বললেন,

‘ আমি ওয়াদাবদ্ধ। বিয়েটা করে নে মা।’

‘ মেয়ের জীবন থেকে কারো কাছে করা ওয়াদা তোমার কাছে বড় হয়ে গেল আব্বা?’

হতভম্ব কন্ঠে জিজ্ঞেস করল প্রিয়। দৃষ্টি নুয়ে নিলো জাফর সাহেব। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,

‘ মেয়ের জীবনের মূল্য বেশি বলেই ওয়াদাবদ্ধ। বাবার এই আবদারটা রাখবি মা?’ 

স্তব্ধ হয়ে বসে রইল প্রিয়। নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে চারিপাশ। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। আরো কিছুক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে রইল ঠাই। নীরবতা ভেঙ্গে বলল,

‘ ঠিক আছে। বিয়েটা আমি করবো। তোমার পিতৃঋণ চুকিয়ে দিবো। এরপর তোমাদের সাথে আর কোনরকম সম্পর্ক থাকবেনা আমার।’ 

মেয়ের অভিমানী মুখখানায় নিমিষ চেয়ে রইলেন জাফর সাহেব।

 

দরজার বাহিরে পায়চারি করছে শতাব্দ। ভিতরে কি কথা হচ্ছে জানতে হবে তাকে! বিয়ের জন্য রাজি হবে তো প্রিয়? নাহ! এভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকতে পারছেনা আর। 

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো শতাব্দ। জাফর সাহেব শব্দ পেয়ে আলগোছে বেরিয়ে এলো।

দরজা ভিড়িয়ে আলতো পায়ে এগিয়ে গেল শতাব্দ। সোফায় ভড় দিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে প্রিয়। হাঁটু ভাঁজ করে প্রিয়’র সামনে গিয়ে বসলো শতাব্দ। কাঁপাকাঁপা হাতে প্রিয়’র হাত জোড়া জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরল না। থেমে গেল। ভয় হচ্ছে। প্রচন্ড! জীবনের প্রথমবার এমন ভয় করছে তার। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বারবার। কথা গোছানোর চেষ্টা করছে! হচ্ছেনা। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। শতাব্দ থামলো। স্ট্রেস কমানোর জন্য ডিপ ব্রিথিং নিলো। নিজেকে শান্ত করে বলল,

‘ আমি তোমার অপ*রাধী প্রিয়। আমার উপর রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। যত ইচ্ছা রাগ ঝাড়ো। কিন্তু আমাকে ঘৃ*ণা করোনা প্লিজ।’

সাড়াশব্দ নেই কোন। আগের মত মুখ গম্ভীর করে বসে আছে প্রিয়। জলে চিকচিক করছে চোখজোড়া। তীক্ষ্ণ ধা*রালো কিছুর আঘা*ত লাগলো শতাব্দের বুকে। কোথা থেকে জানো অজানা এক সাহস এলো মনে। প্রিয়’র হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ তোমার শক্ত অভিমান করাটা স্বাভাবিক। দৃষ্টির আড়ালেও অনেক কিছু থাকে প্রিয়।তোমাকে সেদিন ফিরিয়ে দেওয়ার পেছনে কারণ ছিল বড়। আমি চাইনি তুমি…’

শতাব্দের হাত ঝাড়ি দিয়ে ফেলল প্রিয়। ঘৃ*ণা মিশ্রিত রক্তিম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বলল,

‘ কারণ যত বড়ই হোক না কেন। এখন তার কোন মূল্য নেই। যেই মানুষটাকে আমার বিপদে পাইনি। সেই মানুষটা কখনোই আমার না। আগের সেই প্রিয় নই আমি। এখন আমি আর অভিমান পুষি না। ঘৃ*ণা করতে জানি।’

প্রিয়’র শক্ত কঠিন কথা গুলো শতাব্দকে নাড়িয়ে দিলো। স্থির, বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রিয়’র মুখপানে। আসলেই, এই কয়েক বছরে সময়ের সাথে সাথে তার প্রিয়ও বদলে গেছে। পুরোটাই!

 

বিয়ে পড়ানো হলো। পুরোটা সময় চোখমুখ গম্ভীর করে বসে রইল প্রিয়। বিদায়ের সময় বাবা মাকে জড়িয়ে প্রচন্ড কাঁদলো প্রভা। প্রিয় একটুও কাঁদল না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গাড়িতে উঠল। শক্ত মুখ করে বসে রইল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল,

‘ জীবনে যত কান্নার কেঁদেছে। আর কোনদিন কাঁদবেনা। কিছু মানুষকে তাদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দেওয়ার পালা এখন।’

শতাব্দ পাশে বসলো। গাড়ি স্টার্ড হলো। গলি থেকে বেরিয়ে গাড়ি হাইওয়ে’তে উঠল। অন্ধকারে তলিয়ে চারিপাশ। আজ কি তবে আমাবস্যা রাত! বাহিরের কৃত্রিম আলো। চলন্ত গাড়িতে পড়ছে তার আবছা আভা। ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকালো শতাব্দ। মুখশ্রী শক্ত, গম্ভীর করে বসে রেখেছে প্রিয়। জানালার কাচ খোলা। সুড়সুড় করে আসা বাতাস লাগছে নাকেমুখে। প্রিয়’র দিক ঝুকতেই শক্ত গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ বিয়ে হয়েছে বলেই যে আমাকে পেয়ে যাবে!  এমন না। আমাকে কোনদিন পাবেন না আপনি।’

ঠোঁট মেলে হাসলো শতাব্দ। বলল,

‘ পেতে হবেনা। তুমি আমার চোখের সামনে থাকবে এতটুকুই যথেষ্ট।’ 

জানালার কাচ বন্ধ করে দিয়ে দূরে সরে বসলো শতাব্দ। গাড়ি এসে শতাব্দের এপার্টমেন্টের সামনে থামলো। জায়গাটা চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলোনা প্রিয়’র। বুক ধক করে উঠল। চোখমুখ শক্ত করে গাড়ি থেকে নামলো প্রিয়। এপার্টমেন্টের দরজা খুলতেই খটখট আওয়াজ করে ভিতরে চলে গেল প্রিয়। বাড়ির আনাচে-কানাচে সবটাই চেনা তার। সোজা শতাব্দের ঘরে যেয়ে ঢুকলো। শতব্দ কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রিয় গম্ভীর ধা*রালো কন্ঠে বলল,

‘ একটু মানসিক শান্তি চাই আমার।’

বলেই শতাব্দের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। হতভম্ব শতাব্দ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাতে প্রিয়’র লাগেজ। মিনিট পাঁচেক এভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। প্রিয়’কে কয়েকবার ডাকলো। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো না কোন। অপেক্ষা করল শতাব্দ। ভেতর থেকে কোনপ্রকার  হেলদোল না পেয়ে। দরজার সামনে লাগেজ রেখে হল ঘরের সোফায় যেয়ে বসলো। দরজার দিক তাকিয়ে হতাশার নিশ্বাস ফেলল।

 

আমাবস্যার গহীন রাত কাটিয়ে। নতুন ভোর নেমেছে ভুবনে। চারিদিক উজ্জ্বল সোনালী আলোয় মাখানো। কাচের দেয়াল বেদ করে আলো এসে পড়লো শতাব্দের চোখে মুখে। পিটপিট দৃষ্টি মেলে নিজেকে সোফায় আবিষ্কার করল। গায়ে এখনো শেরওয়ানি জড়ানো। গতরাতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতে কথা মনে পড়তেই দরজার দিক তাকালো। দরজা খোলা। লাগেজ গায়েব । বাড়ি থেকে চলে গেল না তো প্রিয়? ধড়ফড়িয়ে উঠল শতাব্দ। তড়িঘড়ি পায়ে ঘরে গেল। প্রিয় নেই কোথাও নেই। চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কি করবে, কোথায় খুঁজবে ভেবে নাজেহাল অবস্থা তার। পকেট থেকে ফোন বের করল। জাফর সাহেবের নাম্বারে যেই কল করল অমনি রান্নাঘর থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ পেল। ফোন কেটে সেদিকে যেতেই হতভম্ব শতাব্দ।

 চা করছে প্রিয়। শতাব্দকে দেখেই ঠোঁট মেলে হাসলো প্রিয়। বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ কিছু কথা ছিল। বারান্দায় বসুন চা নিয়ে আসছি।’

শতব্দ যন্ত্রের মত মাথা নাড়ল। বারান্দায় যেয়ে বসলো। খালি বাড়ি। গতরাতে বিয়েবাড়ি থেকেই ইমান্দিপুরে চলে গেছে সবাই। শতাব্দ প্রিয়’কে নিয়ে রওনা হবে আজ।

প্রিয়’র এমন স্বাভাবিক আচরণ বড্ড অস্বাভাবিক লাগছে শতাব্দের। এক রাতে এত পরিবর্তন! মাথায় কি চলছে তার? ভাবনায় ছেদ পড়লো শতাব্দের। চা নিয়ে এসেছে প্রিয়। ট্রে থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে সামনে রাখল।

সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে প্রিয়’কে পরখ করছে শতাব্দ। মেরুন রেড জর্জেট শাড়ি। চোখে গাঢ় করে কাজল লেপ্টানো। শাড়ির সাথে মিলিয়ে দারুণ এক লিপস্টিক লাগিয়েছে ঠোঁটে। গলায় ছোট একটা পেনডেন্ট। খোলা কেশ দুলছে দমকা বাতাসে। কি চমৎকার লাগছে মেয়েটাকে। কি নামে ডাকবে, স্বর্গের পরী নাকি কোন অপ্সরী?

প্রিয় ডাকল।বলল,

‘ আপনি যে জেঠা হচ্ছেন। জানেন?’

ভড়কে উঠল শতাব্দ। সামান্য চেঁচিয়ে বলল,

‘ হোয়ার্ট? জেঠা মানে।

প্রিয়’র বেশ স্বাভাবিক উত্তর,

‘ আপনার ভাইয়ের অনাগত সন্তানের মা হচ্ছে প্রভা।’

‘ তোমাকে কে বলল?’

‘ প্রভা।’

‘ তুমি রিপোর্ট দেখেছ?’

‘ উহু, ও বলেছে।’

‘তুমি বিশ্বাস করে নিলে?’

‘ হ্যাঁ’ সন্দিহান স্বরে উত্তর দিলো প্রিয়।

মৃদু হাসলো শতাব্দ। প্রিয় এখনো আগের মত। যে যা বলছে তাতেই বিশ্বাস করছে। বিয়েতে রাজি করানোর জন্য প্রভা মিথ্যা বলল, প্রিয় বিশ্বাস করে নিলো। ঘেঁটে দেখল না একবার ।

প্রিয় আবারো ডাকল। সন্দিহান সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেন? এটা কি মিথ্যা?’

‘ কি জানো। ওদের ব্যাপার আমি কি করে জানবো।’

‘ সমুদ্র ভাই তানহাকে ভালোবাসতো। প্রভার সাথে কি করে সম্পর্কে জড়ালো? তানহাকে ঠকিয়েছে আপনার ভাই? আপনাদের র*ক্তের ধর্ম নাকি ভালোবাসার মানুষকে ঠকানো!’

কাঠকাঠ দৃষ্টিতে তাকালো শতাব্দ। রাগ হলো প্রচন্ড। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ তোমার কেন মনে হলো সমুদ্র ঠকিয়েছে তানহাকে? উল্টাটাও তো হতে পারে।’

‘ অবিশ্বাস্য। ঠকবাজি আপনাদের রক্*তে মিশানো।’

‘ দুনিয়ার বাকি সবাই সাধু?’

‘ সাধু না হলেও, আপনাদের মত পাল্টিবাজ তো নয়।’

রাগ চেপে ভারী নিশ্বাস ফেলল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা টানলো শতাব্দ। নিজেকে শান্ত করে বলল,

‘ শুনো, তোমার বান্ধবী তানহা ঠকিয়েছে সমুদ্রকে। সম্পর্ক ভেঙ্গেছে আরো অনেকবছর আগে। এখন দুইবাচ্চার মা সে। টিনেজ প্রেম স্কুলের গন্ডীতেই কেটে গেছে। আবেগ কাটিয়ে বিবেকহীন হয়ে অন্যকারো হয়ে গেছে।’ 

স্তব্ধ প্রিয়। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এখনো। শতাব্দ আবারো বলল,

‘ যখন বাবার সাথে ঝামেলা পাকিয়ে, সম্পর্ক ছি*ন্ন করে সমুদ্র ঢাকায় চলে এলো। তখন তাদের দুরত্ব বাড়লো। আস্তেআস্তে তানহা তার ইউএসএ’তে থাকা কাজিনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেল। যখন সমুদ্র জানলো অনেক দেরি হয়েগেছে। বিয়ের কথা পাকাপাকি তখন। বিয়ে আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছে সমুদ্র। আকুতি মিনতি করেছে। তানহা মুখ ফিরে চায়নি। বিয়ে করে ইউএসএ’তে সেটেল্ড হয়ে গেছে। আর সমুদ্র ছন্নছাড়া জীবনে!’

শতাব্দের কথা শুনে চুপচাপ বসে রইল প্রিয়। সবাই এমন অদ্ভুত কেন? ধোয়াশার দুনিয়ায় মুখোশধারী সবাই!

প্রিয় বলল,

‘ প্রভার সাথে পরিচয় হলো কোথায়?’

‘ আমি কি করে জানবো। তোমার সিরিয়াসলি মনে হয়, ওদের লাভ লাইফ নিয়ে ইন্টারেস্ট আছে আমার!’ 

ছোট নিশ্বাস ফেলল প্রিয়। শক্ত গলায় বলল,

‘ আমার থেকে কোনপ্রকার এক্সপেকটেশন রাখবেন না। আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা লোক দেখানো শুধু।’

তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো শতাব্দ। কথাটা পছন্দ হলো না তার। খাটো আওয়াজে বলল,

‘ আচ্ছা?’

‘ ইমান্দিপুরে কখন রওনা হবেন?’

‘ বারটায়।’

চা শেষ করে উঠল প্রিয়। বলল,

‘ চা ঠান্ডা হচ্ছে, খেয়ে নিন।’

শতাব্দ চায়ের কাপ উঁচু করে মুখের কাছাকাছি আনতেই, প্রিয় পিছন ফিরে বলল,

‘ সাবধানে খাবেন। চায়ে ইদুর মা*রার বিষ থাকলেও থাকতে পারে।’

 রহস্যময় হেসে চলে গেল প্রিয়। পেছন থেকে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল শতাব্দ। এতটাও বদলাতে যেতে পারে কেউ?

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৩০.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

অনেক বছর পর আবার সেই চিরচেনা পথ। কিছু কি বদলেছে এই পথে? হ্যাঁ, সবটাই বদলে গেছে। শুধু অনুভূতিটাই পুরানো রয়ে গেছে। জানালার দিক মাথা ঝুঁকে দিলো প্রিয়। মলিন বিকেল। সূর্যের নরম আলোয় ছড়াছড়ি চারিদিক। মৃদু বাতাস। চোখ বুঝে নিলো প্রিয়। বাতাসে যেন মিষ্টি অদ্ভুদ ঘ্রাণ। মুচড়ে উঠলো বুক। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল দুইহাজার এগারো’র সেই বিকেল। উদাস হাসলো প্রিয়। 

আচমকা জোরে হর্ণ বাজলো। গাড়ি ইমান্দিপুর এসে চেয়ারম্যান বাড়ির গলিতে ঢুকছে। শত শত লোকের সমাগম। ভিড় ঠেলে ভিতরে যাচ্ছে। নতুন বউকে দেখতে উদ্রিক্ত সবাই। গাড়ির কাচের ধারে এসে ঝুকে পড়ছে। সজোরে বাজছে ব্যান্ড বাজনার আওয়াজ। কাচের বাহিরের মানুষ গুলো, ‘বড় সাহেব, ‘বড় সাহেব’ বলে চিল্লাচ্ছে। হতভম্ব প্রিয়। শতাব্দকে সবাই ‘বড় সাহেব’ বলছে কেন? এত বছরে কি বিরাট কিছু পরিবর্তন এসেছে ইমান্দিপুরে? 

লোকজনের উদ্রিক্ত আচরণ দেখে, প্রিয় বরাবরই বিমূঢ়, হতভম্ব। একটা সময় এই সমাজের লোকজন তাকে হে*নস্তা করেছিল। ব্যা*শা বলতেও দ্বিধাবোধ করেনি। আজ এই সমাজের সেই মানুষ গুলোই ফুল হাতে নত মাথায় স্বাগতম করতে দাঁড়িয়ে। সময় কি আশ্চর্য! তাইনা?

প্রিয়’র দিক ঝুকে এলো শতাব্দ। কপালের অবাধ্য কেশ গুছিয়ে দিয়ে। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘একদিন যেই সমাজের মানুষ গুলো তোমার দিক আঙুল তুলেছিল, আজ সেই সমাজকে তোমার পদতলে এনে দিয়েছি প্রিয়।’

আশ্চর্যজনক চাহনিতে তাকাল প্রিয়। শতাব্দের দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক চমক। গাড়ির দরজা খোলার আওয়াজে সামনে তাকালো। চেয়ারম্যান সকলে স্বাগতম করতে দাঁড়িয়ে। বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। ঠোঁটের কোণে নিদারুণ রহস্যময় হাসি টেনে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। আশেপাশের লোকজন প্রিয়কে দেখে হতভম্ব। এত গানবাজনার মাঝেও ফিসফিস গুঞ্জন আওয়াজ। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি সকলের।

ব্যাপারটা বেশ ভালোই উপভোগ করছে প্রিয়। কার জন্য, কি কারণে এই মানুষ গুলো তার সামনে নত তা গুরুত্বপূর্ণ না! গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যেই মানুষ গুলো একদিন তার উপর আঙুল তুলেছিল আজ নত মাথায় ঝুকে আছে তারা। এরচেয়ে প্রশান্তি’র কিছু আছে কি? ঠোঁট মেলে চমৎকার হাসলো।বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে সামনের দিক পা বাড়ালো। 

 

চেয়ারম্যান বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অভিলাষা। আবেগাপ্লুত অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ। এই দিনটার জন্য কত বছর অপেক্ষা করেছে। দরজার সামনে আসতেই অভিলাষা বেগম বুকে জড়িয়ে ধরলেন প্রিয়’কে। দু’গাল ছুঁয়ে কপালে চুমু দিলেন। টলমল দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,

‘ চোখের শান্তি! এই দৃশ্য দেখার জন্য কত বছর অপেক্ষা করেছি। অবশেষে পূর্নতা তা পেল।’

গহনার বাক্স থেকে সাতপাল্লার সিতা হারটা বের করে প্রিয়’র গলায় পড়িয়ে দিলো অভিলাষা। মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়।

প্রিয়’র আগমনে চেয়ারম্যান বাড়ির কারো কারো মুখ জ্যোত্স্নার মত হাস্যোজ্জ্বল, কারো আবার অন্ধকার আমাবস্যা কালো! যেমন, শাদ। ছোট থেকেই প্রিয়কে অপছন্দ। কখনো পছন্দ ছিলনা তার। প্রিয় ভাইয়ের বউ রূপে তো একদমই নয়।  

আচমকাই একটা মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়কে।চেহারা না দেখলেও অনুভূতিতে ঠিক চিনলো। মেয়েটা জুবাইদা। ছলছল করে উঠল প্রিয়’র চোখ। এতবছর এই মানুষটাকে খুব মনে করেছে সে।

জুবাইদা অভিযোগ করে বলল,

‘ তোকে অনেক মিস করেছি প্রিয়। অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। খুঁজে পাইনি কোথাও।’

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। কি উত্তর দিবে জুবাইদাকে? যে  ইচ্ছে করে যোগাযোগের কোন পথ খোলা রাখেনি সে। ভার্চুয়ালে ব্লক করে রেখেছিল অতীতের সবাইকে!

চোখ মুছে জুবাইদা গদগদ করে বলল,

‘ ফাইনালি! সত্যি সত্যি তুই আমার ভাবি হয়ে গেছিস প্রিয়। শতাব্দ ভাই কথা রেখেছে, তোকে জয় করে নিয়েছে।’

 শতাব্দের বিজয়ী মুখখানায়, গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়।

    

 

সবে সন্ধ্যা নামছে তখন। বিয়ের খবর কানে আসতেই, মেয়েকে নিয়ে ছুটে এসেছে ছবি বেগম। বাড়িতে এসেই চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করলেন। হাঁকডাক দিয়ে বললেন,

‘ আমি কি তোমাদের খুব পর হয়ে গেছি ভাবি। রাতারাতি দুই ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আনলে, একবার জানানোরও প্রয়োজনবোধ করলে না!’

অভিলাষা জলখাবারের ব্যবস্থা করছিল। বাড়ি ভর্তি মেহমান। এমন সময় ছবি বেগমের এসেই চিৎকার, চেঁচামেচিতে বিরক্ত হলেন। কপালের বিরক্তির রেখা মিলিয়ে। হাতের কাজে মনযোগ দিলেন আবার। ছবি বেগম আরো ক্ষিপ্ত হলো যেন। ডাইনিং টেবিলের কাছে যেয়ে অভিলাষা বেগমের মুখোমুখি হয়ে বললেন,

‘ শতাব্দ, সমুদ্র আমার ভাতিজা। ওদের উপর আমারও অধিকার আছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে কি করে বিয়ে করিয়ে আনলে ভাবি?’

থালায় মিষ্টি তুলতে রাখতে রাখতে বেশ স্বাভাবিক স্বরে বললেন,

‘ বিয়েতে যেন কোন ঝা*মেলা না হয় তাই, শতাব্দ চায়নি কাউকে জানাতে। বিশেষ করে তোমাকে।’

ছবি বেগম হতভম্ব সুরে বললেন,

‘ আমি আমার ভাতিজাদের বিয়েতে ঝা*মেলা করবো ভাবি? আমার সম্পর্কে এই ধারণা শতাব্দে’র! মানছি লুবনার সাথে বিয়ে হচ্ছিলো। বিয়ের দিন আসেনি তোমার ছেলে।হাজার হাজার লোকের সামনে আমার নাক কান কা*টিয়েছে। তাই বলে কি প্রতি*শোধ নিবো? তোমার ছেলের বিয়ে ভাঙ্গবো।’

অভিলাষা শান্ত দৃষ্টিতে চুপচাপ তাকিয়ে। ছবিকে বেশ ভালো করে চিনে। মুখে মধু অন্তরে বিষ। বেশ কৌশল খাটিয়ে কথার জালে পেঁচিয়ে  নিরবে হু*মকি দিচ্ছে। তার এসব হু*মকি ধ*মকি ধার ধারেনা শতাব্দ তা কি এখনো বুঝেনা সে!

অভিলাষা বেগম বেশ নরম স্বরে বললেন,

‘ এসেছ যখন থেকে যাও কয়েকদিন। দুইদিন পর ছেলেদের বৌভাত। আগামীকাল এমনিতেও তোমার ভাইজান দাওয়াত নিয়ে যেত তোমাদের বাড়ি।’

অভিলাষার কথায় তেলে বেগুনে জ্ব*লে উঠল ছবি। যেখানে তার মেয়ের থাকার কথা। সেখানে কোথাকার কোন মেয়ে এসে জুড়ে বসেছে। ঘটা আয়োজন করে তাকে নিয়ে আহ্লাদ করা হবে সেইসব দুচোখে দেখতে হবে। ভেবেই রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠল ছবি। মুখ বাকিয়ে বলল,

‘ কোন বাড়ির মেয়ে বাপপরিচয়, বংশ-বিদ্যা দেখে এনেছ তো? বাপের টাকাপয়সা আছেনি। চেহারা সুরত সুন্দর আছে কিছু! যেখান থেকেই আনো না কেন! আমার লুবনার মত পাঁচেপদে কাউরে পাইবা না। তোমার ছেলে মারাত্*মক একটা ভুল করলো ভাবি। মারাত্*মক ভুল।’

অভিলাষা ঠোঁট মেলে মৃদু হাসলো। বলল,

‘ মেয়ে শতাব্দের পছন্দের। সম্মানিত পরিবারের। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। পাশাপাশি দেশের বেশ পরিচিত শাড়ি ব্রেন্ডের ব্র্যান্ড প্রমোটর। রঙরূপে চোখ ধাধানো সুন্দরী।’

ছবি বেগম চুপসে গেল। কিন্তু দমলো না। গলা উঁচিয়ে বলল,

‘ তাই নাকি! তাহলে তো চমৎকারী মেয়েটাকে দেখতে হয় একবার।’

 

দোতলার সিড়ি কোটার পাশে খালি জায়গাটায় নতুন বউদের বসানো হয়েছে। সেখানেই  মুখ দেখার আয়োজন করেছে। আসার পর থেকে প্রিয় এখানে বসে। একজনের পর একজন। কেউ না কেউ আছে সদা। বসে থাকতে থাকতে কোমরের হাঁড় শিথিল হওয়ার উপক্রম। মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে প্রিয়। এভাবে বসে থাকবে আর কতক্ষণ! 

কিছু প্রশ্ন জেগেছে প্রিয়’র মনে। উত্তর শুধু শতাব্দ’ই জানে। যতক্ষণ না জানতে পারছে, ছটফট করবে সারাক্ষণ। মাঝে দুবার শতাব্দের সাথে চোখাচোখি হয়েছিল। আসার পর থেকে প্রচন্ড ব্যস্ত সে। নিরিবিলি কথা বলার মত সময় নেই তার।

 

শেষ সিড়িতে পা রাখতেই হতভম্ব ছবি বেগম। যেন আকাশ থেকে পড়লেন। যা দেখছে সত্যি!  দুঃস্বপ্ন নয়তো কোন?  আয়শার মেয়ে! ‘প্রিয়’? এতবছর পর আবার সেই মুখ!

 প্রিয়’ই কি শতাব্দের বউ। হুবহু সেই চোখ, সেই মুখ। আয়শার মত তীর্*যক চাহনি তার।

 মাথা আউলে গেল তার। রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠল গা। মনে হলো, প্রচন্ড জোরে কেউ তার গালে থা*প্পড় মা*রলো। কিছু আঘা*তের শব্দ হয়না। ছাপ থাকে শুধু। প্রিয় সেই ছাপ। যতবার প্রিয়কে দেখবে ততবার এই আঘা*তটা অনুভব করবে। এই চেহারাটাকে প্রচন্ডরকম ঘৃ*ণা করে। তার সতীনের মেয়ে তারই বাপের বাড়িতে রাজত্ব করবে? পায়ের উপর পা তুলে রাজধানী হয়ে থাকবে! অতীত আবারো পুর্নাবৃত্তি হচ্ছে। আয়শা তার সাথে যা যা করেছে। এখন ওর মেয়ে লুবনার সাথে একই কাজ করছে। যা লুবনার হওয়ার কথা ছিল। সেখানে প্রিয়’র রাজত্ব। আর যাইহোক প্রিয়’কে সহ্য করবেনা সে। হাজার হোক সতিনের মেয়ে।

কত কারসাজি করে শোয়েবকে হাসিল করেছে। এখন শতাব্দকে নিয়েও কি আবারো একই লড়াই ল*ড়তে হবে! প্রিয় কি আদৌ জানে সে আয়শা আর শোয়েবের মেয়ে। 

অসহ্য, সেদিনই মে*রে ফেলত যদি পথের কা*টা হয়ে শতাব্দ না দাঁড়াত। এখন কিছু করা যাবেনা। ক্ষমতা এখন শতাব্দের হাতে। শাহরিয়ার সাহেব চেয়ারম্যান হলেও পেছন থেকে শতাব্দ সব কলকাঠি নাড়ে। হাতেকাছে ইলেকশন শতাব্দ’র সাহায্যের ভীষণ  প্রয়োজন। এখন কিছু করে, বাড়া ভাতে পানি ঢালবে না সে।

 

ছবি বেগমকে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, উঠে দাঁড়ালো প্রিয়। তির্যক ধা*রালো চাহনি তার। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত রহস্যময় হাসি। যেন আয়শার প্রতিবিম্ব। এগিয়ে এলো প্রিয়, ছবি বেগমকে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ ভাগ্যের লেখা যায়না খন্ডন। বলেছিলাম, জ্বালিয়ে দিবো। আপনার অহং*কার দ*ম্ভ মাটিতে মিলিয়ে দিবো। কথার খেলাফ করি না আমি। অপেক্ষা করুন, দেখুন।’

ছবি বেগম ফুলেফেঁপে উঠলেন। প্রত্যুত্তরে প্রিয় মিষ্টি হাসলো।

 

‘ তোমার সবসময় ওই মেয়েটাকেই পছন্দ ছিল তাই না শতাব্দ ভাই? এই মেয়েটার জন্যই আমাদের বিয়ের দিন আসোনি তুমি। আমার সাথে কেন এমন করলে? কেন?’

গিজগিজ অন্ধকারে লুবনার রাগী গর্জন। ক্রো*ধে উসখুস করছে সে। শতাব্দ শান্ত, স্বাভাবিক। শতাব্দের এমন স্বাভাবিক আচরণ তার রাগ বাড়াচ্ছে আরো। চেঁচিয়ে উঠল সে। বলল,

‘ এই মেয়েটার জন্য হাজার হাজার মানুষের সামনে অপমান হয়েছি। তুমি কি ভাবছ, ছেড়ে দিবো মেয়েটাকে। উহু, খু*ন করে ফেলবো ওকে। আমার ক্রি*মিনাল রেকর্ড তো তোমার জানাই আছে।’

খপ করে লুবনার গলা চেপে ধরলো শতাব্দ। চোখেমুখে ভয়া*নক রাগ। ভ*স্ম করা চাহনি। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ ডোন্ট ডেয়ার। ওর দিক চোখ তুলে তাকালে, আমি কি করতে পারি নিশ্চিত জানা আছে তোর? এতবছর এই দিনটার অপেক্ষা ছিলাম। তাই কোন ঝামেলা চাইছিনা আপাতত। ঊষ্ণচড় রওনা হবি আগামীকাল সকাল সকাল।’

লুবনা কেঁদে ফেলল। বলল,

‘ সেই ছোট থেকে তোমায় ভালোবাসি। আমার সাথে কেন করলে এমন?’

‘ উত্তরটা তোর সত্যিই অজানা?’

লুবনা পিটপিট দৃষ্টিতে তাকালো। শতাব্দ লুবনার গলা ছেড়ে দিলো। রেলিং-এর পাশ ঘেঁষে সিগারেট জ্বা*লিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

‘ রি*ভেঞ্জ অফ নেচার! অপমা*নের বদলে অপ*মান। তোর মা আর তোর জন্য দরকার ছিল তা। প্রিয় শুধু আমার। জন্ম থেকে লিখিত। আমাদের সম্পর্ক ঠিক কত বছর পুরানো তা কল্পনাও করতে পারবেনা কেউ।’

মাথা নেড়ে উঠলো লুবনা। চট করে শতাব্দের হাত চেপে ধরলো। বলল,

‘ ওর থেকে কি কমতি আছে আমার? আমাকে ভালোবাসলে না কেন? ‘

‘ ওর সাথে অন্যকারো তুলনা হয়না। অতুলনীয়! আমার প্রাণপ্রিয়।’

 

আচমকাই ঘরের দরজা খুলল। শতাব্দের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে লুবনা। হাত ঝাড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো শতাব্দ। প্রিয় বেশ স্বাভাবিক। লাগেজ থেকে ফোনের চার্জ বের করতে করতে ব্যস্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ দরজা নক করার দরকার ছিল, সরি! চার্জার নিতে এসেছিলাম। ইউ গাইছ ক্যারি অন।’

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রিয়। হতাশ শ্বাস ফেলল শতাব্দ। প্রিয়’র পেছনে গেল। হাত টেনে থামালো। অস্থির সে। ব্যস্ত স্বরে বলল,

‘ তুমি যেমন ভাবছ, এমন কিছুনা। আসলে..

থামিয়ে দিলো প্রিয়। বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ যেমনই হোক। আই ডোন্ট কেয়ার। অনেস্টলি, আপনি কার সাথে কি করলেন এতে আমার কিছু আসে যায়না। আমার উদ্দেশ্য আপনি নন!’

হাত ছাড়িয়ে চলে গেল প্রিয়। নিমিষ দৃষ্টিতে প্রিয়’র যাওয়ার দিক চেয়ে রইল শতাব্দ।

 

চলবে…….

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৩১.

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

ভোরের আকাশে মেঘের পালকের ছড়াছড়ি। কুয়াশার চাদর কে*টে এক ফালি রোদ্দুর এসে ভুবন ছুঁইছে। ভারী পর্দার আড়াল হতে উজ্জ্বল আলো এসে প্রিয়’র মুখ ছুঁইছে। ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। যেন প্রচন্ড বিরক্ত হলো সে। সরু ঠোঁটের কোণে ক্ষুব্ধতার আভাস। হরিণটানা আঁখিজোড়া পিটপিট করে কাঁপছে। মসৃণ গালে গোলাপি র*ক্তিম আভা ছড়িয়ে। অবাধ্য কেশে কপাল ঢেকে। শতাব্দের এক হাত জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে।

হাত বাড়িয়ে প্রিয়’র কপালে পড়ন্ত কেশ গুছিয়ে দিলো শতাব্দ। গতরাতে ঘুমাতে পারেনি সে। অনেক বছর আগের ফোবিয়াটা প্রিয়’র এখনো আছে। সারারাত ছটফট করে, ভোরের দিক ঘুমিয়েছে। ঘুমের ঘোরে গভীর গোঙানির আওয়াজ। বিড়বিড় করে বলেছে,’আমাকে নিওনা আপা…আমি বাঁচতে চাই। একটু প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই।’ এতবছরেও কোন পরিবর্তন আসেনি। সেই ফোবিয়া থেকে পরিত্রাণ পায়নি। গতরাতে প্রিয়কে দেখে তার  মনে হলো, পুরানো ভয়টা কমেনি বরং বেড়েছে আরো। ধীরেধীরে অন্ধকারের দিক টেনে হিঁচড়ে জড়িয়ে নিচ্ছে। প্রিয়’র দিক ঝুকে এলো শতাব্দ। তার মসৃণ গালে, ঠোঁটে আঙ্গুলের পিঠ ছুঁয়ে আলতো আদর করে দিলো। কপালে গভীর  চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ একদিন সব অন্ধকার কাটিয়ে। উজ্জ্বল ভোর নামবে। তুমি হাসবে, প্রাণ খুলে বাঁচবে আবার।’

নিমিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আচমকা দরজার কড়া নড়ল। দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীর হয়ে তাকালো শতাব্দ। ময়না এসেছে। হাতে চায়ের কাপ। রাশভারি আওয়াজে শতাব্দ বলল,

‘ রেখে যাও।’

চায়ের ট্রে রাখতে রাখতে মৃদু স্বরে বলল ময়না,

‘ ভাইজান। আম্মা বড় ভাবিরে নিচে ডাকছে।’

‘ মাকে বল, প্রিয় অসুস্থ। ঘুমাচ্ছে।’

মাথা নাড়িয়ে চলে গেল ময়না। বাহিরে শোরগোলের আওয়াজ। পিছনের বাগানে লোক জড় হতে শুরু করেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘড়ির দিক তাকালো একবার। আটটা বাজতে পনের মিনিট বাকি। দশ মিনিটে বেরিয়ে যেতে হবে এইবার। চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো শতাব্দ। প্রিয়’র দিক এক পলক চেয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে সবাইকে কড়া ভাবে বলে গেল, প্রিয়’র খেয়াল রাখে যেন।

 

বাহিরে প্রচন্ড শোরগোল কথার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল প্রিয়’র। মাথা ধরছে খুব। মাথা চেপে উঠে বসতেই ময়না ছুটে আসলো। অস্থির হয়ে বলল,

‘ কিছু লাগবো ভাবিজান।’

ঘুম জড়ানো পিটপিট দৃষ্টিতে সামনে তাকালো প্রিয়। দুইদিক আলতো মাথা নাড়িয়ে ‘না’ সূচক ইঙ্গিত দিলো। কর্ণার টেবিল থেকে মোবাইল তুলে তাকাতেই আঁতকে উঠল। নয়টা বিশ। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল,

‘ এত দেরি হয়ে গেছে ডাকোনি কেন আমাকে?’

‘ ভাইজান মানা করছে। বলছে, আপনার খেয়াল রাখি যেন।’

ময়নার মৃদু আওয়াজ। বুক ফুলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। শ্বশুরবাড়ি সকাল সকাল উঠা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ  মাথা ব্যথা নেই তার। বাড়ি ভর্তি মানুষজন সবার সামনে  ঘুম নিয়ে কেউ কিছু বলবে তা শুনতে রাজি না সে।

বাহিরে অনেক মানুষের কিচিরমিচির আওয়াজ। মনে হচ্ছে শত শত মানুষজন এক সাথে জড় হয়েছে। প্রিয়’র সন্দিহান চাহনি। শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ বাহিরে আওয়াজ কিসের?’

‘ আইজ শনিবার। শুক্রবার ভাইজান বাড়ি আইলে ।প্রতি শনিবার পেছনের বাগানে সভা, সালিশ বসে। বড় ভাইজানের কাছে গ্রামের মানুষ বিচার আচার, গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়া আলাপ-আলাপ-আলোচনা করে।’

কপাল কুঁচকে এলো প্রিয়’র। বলল,

‘ বড় ভাইজান? শতাব্দ?’

ময়না হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। প্রিয় সন্দিহান কন্ঠে আওড়াল,

‘ তাহলে চেয়ারম্যান সাহেব?’

‘ চাচাজান এসব এখন আর দেখেনা। বছর কয়েক আগে পাশের গ্রামের লগে বড় মা*রামা*রি হইছিল। খু*নাখু*নি পর্যায় গেছিলো। সেই বিচারে বিরাট ঝামেলা বাঁধছিল। সবটা বড় ভাইজান সামলাইছে তখন। তারপর থাইকা গ্রামের লোকজন সবাই ভাইরে চাচাজান থাইকা বেশি মান্যগণ্য করে। চেয়ারম্যান চাচাজান হইলেও ভাইয়ের কথায় গ্রামের লোকজন চলে।’

রাজনীতিতে তেমন কোন কৌতূহল ছিলনা শতাব্দের। বরাবরই এড়িয়ে চলতে চাইত। পড়াশোনা সেড়ে ঢাকাতেই শিফট হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তাহলে হঠাৎ কেন রাজনীতিতে জুড়ে গেল? গম্ভীর হয়ে ভাবছিল প্রিয়। ময়না ডাকল। কিন্তুকিন্তু করে জিজ্ঞেস করল,

‘ মাথা ব্যথা কমছে? কড়া লিগার দিয়া চা কইরা দিমু ভাবি!’

গহিন ভাবনায় ডুবে থাকা প্রিয় মাথা নাড়াল। মৃদু স্বরে বলল,

‘ আচ্ছা।’ 

 

উষ্ণ চায়ের কাপে গরম ধোঁয়া উড়ছে। সূরের উজ্জ্বল নরম আলো চোখেমুখে পড়ছে। কানে ইয়ারফোন গুজে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে প্রিয়। দৃষ্টি দূর বাগানে। কাঠে ভারী চেয়ারে বসে আছে শতাব্দ। গায়ে কালো পাঞ্জাবি। শীত থেকে পরিত্রাণ পেতে মোটা শাল মুড়িয়ে। চুল গুলো ব্যকব্রাশ করে গোছানো। ফরসা চেহারায় চাপ দাঁড়ি। গম্ভীর চোখমুখ। চেহারায় গভীর পরিবর্তন। এত বছরে অনেক কিছু পরিবর্তনের সাথে শতাব্দের ব্যাক্তিত্বেও বিরাট পরিবর্তন এসেছে।  আগের মত হুটহাট রেগে যায় না এখন। অনেক পরিবর্তন এসেছে। শান্ত হয়ে সামনের জনের সমস্যা শুনছে। ভেবেচিন্তে তারপর প্রতিক্রিয়া করছে। যদিও আগের থেকে আরো বেশি গম্ভীর আর রাশভারি হয়েছে সে। শক্ত চোয়াল, রাগ এখনো আগের মত নাকের ডগায়। নিখাঁদ দৃষ্টিতে দেখছে প্রিয়।

 

‘ বিয়ে করে এনেছে বলে তুমি রাজরানি হয়ে গেছ এমন না। পুরুষ মানুষের মন বদলাতে সময় নেয় না। একবার ছেড়েছিল তোমাকে, আবারো ছাড়বে।কথায় আছে না যে থাকার সে কখনো ছাড়েনা।’

কানের ইয়ারফোন খুলে পেছন ফিরে তাকালো প্রিয়। লুবনা এসেছে। সরু দৃষ্টিতে পরখ করল প্রিয়। র*ক্তিম ফোলা চোখের নিচে কালি জমেছে তার। খোলা উষ্কখুষ্ক চুল। হ্যাংলা শরীর। কালচে ফ্যাকাসে ঠোঁট। 

প্রিয় ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি টেনে বলল,

‘ ঘুরেফিরে বারবার সেই আমার কাছেই আসে। অনেকবছর তো দূরে ছিলাম। কি হলো! কোনকিছু কি বদলালো? তার নজর আমাতেই আবদ্ধ এখনো।’

লুবনা কিড়মিড়িয়ে বলল,

‘ আমাদের বিয়ে হচ্ছিলো।’

কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। খানিক অবাক হলেও চোখেমুখে  ফুটে উঠতে দিলো না তা। আগের মত স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ হয়নি তো! আমার জন্য তোমাকে রিজেক্ট করেছে। ভীষণ বেদনা দায়ক তাইনা?’

‘ এতো অ*হংকার! কি আছে তোমার?’

‘ কেন করবো না অহংকার? আমার জন্য সে তোমাকে রিজেক্ট করেছে এই কারণটা কি যথেষ্ট না!’

‘ রূপের অহংকার করছ? চোখেমুখে এসিড পড়লে এই রূপ থাকবে তো?’

লুবনার ঠান্ডা হু*মকিতে এক চিলতে হাসল প্রিয়। হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ শতাব্দের কাছে আমি ভীষণ দামী। ভীষণ! আমার দিক হাত বাড়ালে তুমি আস্ত থাকবে তো?’

লুবনা দমে গেল। ফুসফুস রাগী শ্বাস ফেলল। কানে ইয়ারফোন গুজলো প্রিয়। লুবনার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চমৎকার হেসে ভ্রু নাচিয়ে ডার্ক হর্স গানের সুর টেনে বলল,

‘ ডোন্ট মেক মি ইউ’র এনিমি।’

লুবনা আরো ক্ষেপে গেল। প্রিয়’র দিক ঝুকে এলো। কালসিটে দাঁত বের করে কিড়মিড়িয়ে বলল,

‘ বিচ’

বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল। 

 

লুবনা যেতেই প্রিয় ফোন বের করে কাউকে টেক্সট করল,

‘ আমরা যা খুঁজছিলাম আই থিংক পেয়ে গেছি। শোয়েব হক আর ছবি বেগমের দুর্বলতা।’

সাথে সাথেই অপর পাশ হতে উত্তর এলো,

‘ কি?’

‘ লুবনা হক।’

‘ লুবনা?’

‘ হ্যাঁ। আমাদের গন্তব্যে লুবনা নিয়ে যাবে।’

‘ বি কেয়ারফুল। টেক কেয়ার।’

মুচকি হাসলো প্রিয়। সব টেক্সট ডিলিট করে দিলো।

 

 

 

বিকালের শেষ প্রহর। চারদিকে ঝিমিয়ে থাকা আলো। প্রকৃতিতে মৃদু হিম হাওয়া বইছে। সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে। বেড়াতে বের হবার বুদ্ধি মূলত প্রভা এঁটেছে। গ্রাম ঘুরে দেখবে বলে। সমুদ্রকে ছলছুতা দিয়ে রাজি করিয়েছে। দুপুরের পরপর সমুদ্র সবাইকে নিয়ে বেরিয়েছে। পশ্চিমের বড় পুকুর পাড়ের ছাউনির নিচে বসে আছে প্রিয়। বাকি সবাই ছবি তুলতে, ঘুরে দেখতে ব্যস্ত। পুকুরটা বোধহয় নতুন খোড়া হয়েছে। পাড়ে বেশ সুন্দর ছোট ছোট ছনের ছাউনি ঘর তোলা আছে। বসার জন্য সিমেন্টের চেয়ার টেবিল বানানো। বিকালে চায়ের আড্ডার জন্য জায়গাটা মন্দ নয়। বাঁধানো পুকুর পাড়ে রঙিন নকশা গুলো নজর কাড়ছে বেশ। পানির কলকল আওয়াজ প্রিয়কে টানছে খুব। উঠে দাঁড়ালো সে। পা বাড়াল সেদিক। কয়েক সিড়ি ডাঙ্গাতেই কেউ বলল,

‘ শেওলা জমেছে, সিড়ি পিচ্ছিল। সামনে পা বাড়িও না।’

পেছন ফিরে তাকালো প্রিয়। শতাব্দ এসেছে। গায়ে লেদার জ্যাকেট। পায়ে ক্যাডস। পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিকটাতেই তাকিয়ে। সাথে আরো দুজন লোক।  ভ্রু কুঁচকে নিলো প্রিয়। শতাব্দের কথা উপেক্ষা করে সামনের দিক পা বাড়াল। দুইধাপ নামতেই পা পিছলে পড়লো। ছুটে এলো শতাব্দ। প্রিয়’কে টেনে তুলল। ছাউনি নিয়ে চেয়ারে বসালো। শাড়িতে কাঁদা মাটি লেগে একাকার। সিড়ির ধাপে ব্যথা পেয়ে হাত চিঁ*ড়ে র*ক্ত ঝরছে। ক্ষেপে গেল শতাব্দ। রাগী গর্জন করে বলল,

‘ সবসময় সবকিছু নিয়ে ত্যাড়ামো করাটা কি জরুরি?’

উত্তর দিলো না প্রিয়। রাশভারি মুখ করে বসে আছে সে। গাড়ি থেকে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ আনিয়ে লাগিয়ে দিলো প্রিয়’র হাতে। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ খুব ব্যথা করছে?’

দুদিকে মাথা নাড়াল প্রিয়। শতাব্দ আবার বলল,

‘ বাড়ি ফিরব। চলো।’

নাচক করল প্রিয়। কপাল কুঁচকে রাশভারি গম্ভীর মুখ করে উত্তর দিলো,

‘ উহু, সামান্য লেগেছে। সবার সাথে যাবো।’

ফস করে শ্বাস ফেলল। শতাব্দ বেশ ভালো করে জানে প্রিয়’কে যা বলবে তার উল্টোটা করবে সে। কিছু বললে শুনবেনা। বরং জেদ ধরে কাঁদা মাটি নিয়ে এখানে বসে দেরি করবে আরো। পানি টিস্যু নিয়ে তার দিক এগিয়ে যেতেই পিছিয়ে গেল প্রিয়। হাত পা গুটিয়ে নিলো। প্রিয়’র আরোধ শুনল না শতাব্দ। এক প্রকার টেনে হাত বের করে। পরিষ্কার করে দিতে লাগল। মুখ ভার করে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো প্রিয়। শতাব্দ বলল,

‘ পুকুরে মানুষ খে*কো  আফ্রিকান মাগুর আছে। যদি পা পিছলে পড়তে কি অবস্থা হতো! ভেবেছ?’

প্রিয় দমলো না। নাক উঁচু করে জবাব দিলো,

‘ সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগানো উচিত ছিল।’

‘ লাগনো আছে। তোমার হয়তো চোখে পড়েনি।’

আশেপাশে তাকাল প্রিয়। পুকুরের সামনে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘পুকুর হতে সাবধান’। 

শতাব্দের সামনে নত হতে প্রিয় নারাজ। গলা উঁচু করে বলল,

‘ আফ্রিকান মাগুর চাষ নি*ষিদ্ধ। এটা ক্রা*ইম।’

‘ আমার শখ আমি করেছি। কোন সমস্যা? বাজারে বিক্রি না করলেই হয়।’

‘ তাহলে এগুলো দিয়ে কি করেন?’ প্রিয়’র প্রশ্নবিদ্ধ আওয়াজ।

‘ মানুষ হ*ত্যা করি।’ শতাব্দের সোজাসাপ্টা উত্তর।

‘ আচ্ছা? তাই! এখন অবধি কতজন মা*রলেন?’

‘ একজন। নতুন তো!’

তাচ্ছিল্য হাসলো প্রিয়। বলল,

‘ কেন মারলেন! আপনাদের কথা মত চলেনি, তাই?’

শতাব্দের স্পষ্ট আওয়াজ,

‘ উহু, এক রাক্ষস প্রেমনগরের রাজকন্যার দিক হাত বাড়িয়েছিল। রাজকন্যার মায়ের কাছে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। সারা রাজ্যের  মানুষের সম্মুখে তাদের অপদস্ত করেছে। পুরো অঞ্চল অপকর্মে জড়িয়ে নিয়েছিল। তাই তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়াটা জরুরী ছিল।’ 

শতাব্দের কথার আগাগোড়া না বুঝলেও, সবটা যে বানানো বেশ ভালো করেই বুঝল। তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

‘ বাহ! বেশ দারুণ গল্প তো। ডাক্তারী, রাজনীতির পাশাপাশি এত ভালো গল্পকার আপনি জানতাম না তো।’

উত্তর এলো না কোন। পানির দিক থেকে চোখ সরিয়ে পেছনে তাকাতেই থমকে গেল প্রিয়। হিম শীতল অদৃশ্য এক অনুভূতিতে জমে গেল। শতাব্দের চাহনিতে কেমন জানো অদ্ভুত এক হিং*স্রতা। কোনো অজানা নেশা। দৃষ্টিতে কিঞ্চিত কোন পরিবর্তন নেই। দৃঢ়ভাবে প্রিয়’র দিক চেয়ে এখনো। 

তবে, কি সত্যিই এমন কিছু ঘটেছে! সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়। বলল,

‘ সত্যি কি কারো খু*ন করেছেন?’

শতাব্দ তখনো আগের মত দৃঢ়ভাবে চেয়ে। প্রিয় ঘামছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। খেয়াল করল শতাব্দ। ফিক করে হাসল। চোখ মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। বলল,

‘ উহু, মজা করছিলাম।’

বুক চিড়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। বিরক্তির চাহনি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়াল। হন হন করে গাড়ির দিক চলে গেল। 

 

প্রভা দূর থেকে পুরো ঘটনা ঠাহর করল। প্রিয় চলে যেতেই প্রভা শতাব্দের মুখোমুখি বসল। তখনো প্রিয়’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শতাব্দ। প্রভার আওয়াজে হুঁশ ফিরল।

 প্রভা বলল,

‘ কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। অনেক বছরের রাগ-জেদ চেপে রাখতে রাখতে আপার এমন রুখা স্বভাব।’

তাচ্ছিল্য হাসল শতাব্দ। ভারী কন্ঠে বলল,

‘ অধিকার আছে তার!’ 

প্রিয় গাড়িতে চড়ে বসেছে ততক্ষণে। রাগ তখনো তার নাকের আগায়। সেদিকে তাকিয়ে মলিন হাসল শতাব্দ। উদাসীন কন্ঠে বলল,

‘ কাঙ্ক্ষিত মানুষটা্র চোখের সামনে থেকেও তাকে না ছুতে পারার যন্ত্রণা কতটা কঠিন হয়! তা বেশ ভালো করে জানে তোমার আপা। তাইতো ক্ষণে ক্ষণে পো*ড়াচ্ছে আমায়।’

খানিক নীরবতা। নীরবতা ভেঙ্গে প্রভা বলল,

‘ অনেক কিছু সহ্য করেছে আপা। অনেক রাত নির্ঘুমে ফুঁপিয়ে কেঁদে কাটিয়েছে। হাউমাউ চিৎকার করে বারবার একটা কথাই জিজ্ঞেস করতো, ‘যারা ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা পায় তারা দেখতে কেমন হয়? তাদের ভাগ্য কি সোনার কলমে লেখা হয়?’

শতাব্দের বুক কেঁপে উঠল। রক্তিম চোখের আ*হত চাহনি। 

অন্ধকার নেমে আসছে। সমুদ্রের হাঁক ডাকে উঠে গেল প্রভা। প্রিয়’র গম্ভীর রুখা মুখখানায় তখনো চেয়ে আছে শতাব্দ। বিরবির উদাসীন আওয়াজে বলল,

‘ আমি ছেড়ে যাইনি প্রিয়। দৃষ্টির আড়ালে থেকেও সর্বদা তোমাতে নজর ছিল।’

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৩২.

 

 (কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

বৌভাত আজ। সকালে পার্লার থেকে লোক এসে দুই বোনকে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। বাহিরে বিরাট ভোজের আয়োজন চলছে। সবাই ব্যস্ত। নতুন বউদের ঘরে বসানো হয়েছে। অতিথি আসতে শুরু করলে নিয়ে যাওয়া হবে।

 

‘ আকাশের চাঁদটা কি ঘরে নেমে এলো আমার! তুমি কোনো পরী নাকি অপ্সরী?’

প্রভা লজ্জায় মিয়িয়ে গেল। চোখ লুকাতে ব্যস্ত। ক্ষান্ত হলো না সমুদ্র। প্রভার চোখে নিমিষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। প্রভার লাজুক চোখজোড়া নুয়ে এলো আরো। কন্ঠে লজ্জা জড়িয়ে বিরবির করে বলল,

‘ এভাবে তাকাবেন না। লজ্জা লাগে আমার।’

 দুষ্টু হাসল সমুদ্র। বলল,

‘ লাগুক সব লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিবো আজ। আজ সারারাত…

সমুদ্রকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে, কান চেপে চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়। আধঘন্টা ধরে দুজনের প্রেমালাপ শুনছে। কেউ কারো থেকে কম যায় না। দুজনই সমপরিমান বেশরম। সামনে প্রিয় বসে আছে যে সেদিকে গুরুত্বই দিচ্ছে না। নিজেদের প্রেমের গীত চালিয়ে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়।

চোখেমুখে বিরক্ত ঢেলে গলা উঁচিয়ে বলল প্রিয়,

‘ গত আধঘন্টা আপনাদের লাভি-ডাবি কথা শুনে আমি ক্লান্ত বিরক্ত। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এমন টিনেজারদের মত কি করে আচরণ করতে পারে? আর প্রভা! আমি না তোর বড় বোন? বড় বোনের সামনে এ কি রকম আচরণ। লজ্জাশরম কি সব বেঁচে এসেছিস বোন!’

প্রিয়’র করুণ আওয়াজ। কথা এড়াতে চাইল প্রভা। এদিক সেদিক তাকিয়ে মাথার ঘুমটা ঠিক করার ভাণ করল। প্রিয় ফস করে শ্বাস ফেলল। হতাশ সুরে বলল,

‘ সরি টু স্যে সমুদ্র ভাই, আপনার কাব্যিক গুণ একদমই নাই। ভীষণ বাজে ছিল আপনার পয়েট্রি লাইন।’

মুখ ছোট হয়ে এলো সমুদ্র’র। তা দেখে প্রভা জ্বলে উঠল। ঝাঁজালো গলায় বলল,

‘ উনি তোর বোন জামাই। উনার সাথে তুই এমন করে কথা বলতে পারিস না আপা।’

‘ আলবাত পারি। বোন জামাইয়ের পাশাপাশি সমুদ্র ভাই আমার দেবর।’

‘ উনি বয়সে বড় তোর।’

‘ তাতে কি! রিশতায় আমি বড়। উনার বড় ভাইয়ের বউ!’

বোনের সাথে তর্কে না পেরে দমে গেল প্রভা। মুখ ভার করে। বিড়বিড়িয়ে প্রিয়’কে গালমন্দ করতে করতে চলে গেল সে। সমুদ্র আফসোস ঠেলে বলল,

‘ দিলে তো আমার বউটাকে রাগিয়ে!’

গুরুত্ব দিলো না প্রিয়। বলল,

‘ ও ব্যাপার না। এটা প্রভার সবসময়কার অভ্যাস। কথায় না পাড়লে উঠে পালায়।’

মৃদু হাসল সমুদ্র। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

‘ তবু্ও, বউটা তো আমার। মান তো ভাঙ্গাতেই হবে। নয়তো দেখা যাবে, কাঁথা বালিশ ছাড়া মেজেতে ঘুমাতে হবে রাতে। রেগে বাঘ হয়ে কোথায় গেল যাই দেখি গিয়ে।’

‘ আপনার সাথে কিছু কথা ছিল সমুদ্র ভাই।’

প্রিয়’র রাশভারি আওয়াজ। বাড়ানো পা’টা পিছিয়ে নিলো সমুদ্র। সামনের সোফায় বসলো। প্রিয়’কে গম্ভীর দেখে, চোখেমুখে গম্ভীরভাব এঁটে বলল,

‘ সিরিয়াস কিছু?’

‘ কিছুটা সিরিয়াস।’

সমুদ্রের কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় হলো। খানিক চুপ থেকে প্রিয় বলল,

‘ তানহার কথা জানে প্রভা?’

তানহার নাম শুনতে সমুদ্রের মুখখানা আরো রাশভারি হয়ে এলো। নীরব হয়ে গেল হ্ঠাৎ। প্রিয় উত্তরের অপেক্ষা করল খানিক। সমুদ্রের কোন জবাব না পেয়ে বলল,

‘ আমার বোনটা বড্ড বোকা সমুদ্র ভাই। যাকে ভালোবাসে নিজের সর্বস্র দিয়ে ভালোবাসে। মান আত্মসম্মান সব ভুলে শুধু সেই মানুষকে নিয়ে ভাববে। দরকার পড়লে তার জন্য জান দিয়ে দিবে। এইযে আমার সাথে দা কুমড়ার সম্পর্ক, সবটাই ওর লোক দেখানো। মনে মনে প্রচন্ড ভালোবাসে আমাকে। প্রকাশ করেনা কিন্তু আমি বুঝি। আমার জীবন গোছানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে ও। বুদ্ধি হাঁটুর গোড়ায়, কিন্তু মন সচ্ছ পরিষ্কার। আপনাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। এক কথায় আপনি বলতে পাগল প্রভা। আমি জানি, আপনাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলা আমার উচিত না। তবুও বলছি, তানহার ব্যাপারটা জানিয়ে দিন। এ বাড়িতে অতীত টানার অনেক মানুষ আছে। অন্যকারো থেকে জানলে কষ্ট পাবে, দুরত্ব বাড়বে।’

গম্ভীর মুখ করে সমুদ্র মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘ প্রভা, আমার আঁধার রাতের আলো। তানহার বিশ্বাসঘা*তকতা যখন আমাকে পুরোপুরি ভেঙ্গে দিয়েছিল। টুকরো টুকরো সেই ভাঙ্গা অংশ গুলো খুঁজে খুঁজে এনে সে জোড়া লাগিয়েছিল। আমি তো এই দিনদুনিয়া, নিজেকে এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম। প্রেম, ভালোবাসা, মানুষ এসবের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল আমার। গভীর নেশার ঘোরে ডুবে গেছিলাম। কিন্তু প্রভা থামেনি! আমার সাথে লড়াই করে সেই নিকৃষ্ট জগৎ থেকে টেনে তুলেছে। নতুন এক জীবন দান দিয়েছে। এই জীবন শুধুই প্রভার। আমার মন প্রাণ, আত্মা, ভালোবাসা সবটাই তার। কথা দিচ্ছি, কখনো দূরত্ব হবে না। সবসময় হাসিখুশি থাকবে প্রভা।’    

হাসলো প্রিয়। বলল,

‘ আপনার উপর ভরসা আছে।’

জবাবে মলিন হেসে চলে গেল সমুদ্র।

 

লেহেঙ্গার স্কার্ট নিয়ে টানাটানি করছে প্রিয়। শক্ত গিট এঁটে গেছে কোমরে। পেট কে*টে পরার উপক্রম। লেহেঙ্গার ভারী ঘের আর পাথরের কারুকাজ নিচের দিক টানছে। তার উপর ফুলে থাকা ক্যানক্যান! সবমিলিয়ে অতিষ্ঠ প্রিয়। বউভাতের জন্য খুব অল্প সময় পেয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো করে এখানেই আশেপাশের দর্জি থেকে লেহেঙ্গা সেলাই করিয়েছে। ফলস্বরূপ ব্লাউজের ফিটিং খুব বাজেরকম এঁটে গেছে। শ্বাস ফেলা দুস্কর মনে হচ্ছে।

টানাটানিতে হাঁপিয়ে উঠল প্রিয়। গ্লাসে পানি ঢেলে ,ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেয়ে নিলো। কোমরে হাত রেখে ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলে জিরিয়ে, আবারো লেগে গেল কাজে। অমনি দরজার কড়া নড়ল। গিট খোলার চেষ্টা করতে করতে প্রিয় গলা উঁচিয়ে বলল,

‘ দরজা খোলা আছে।’

দরজা খুলে কেউ ভেতরে এলো। সেদিকে তাকাল না প্রিয়। সামনের মানুষটা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। লাল টকটকে বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাণপ্রিয়। এত বছর এই দিনটার-ই তো অপেক্ষায় ছিল। বুক ফুলিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল শতাব্দ। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে এখনো। মুগ্ধতার ঘোর কাটেনি তার। এভাবে সময়টা থেমে গেলে খুব একটা মন্দ হয় না! 

প্রিয়’কে অস্থির, বিরক্ত  লেহেঙ্গা’র গিট নিয়ে টানাটানি করতে দেখে শতাব্দ বলল,

‘ কোন সমস্যা! সাহায্য করবো?’

শতাব্দের আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকাল। খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে, দুহাত উঁচিয়ে কপাল কুঁচকে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ লেহেঙ্গা’র গিট শক্ত ভাবে এঁটে গেছে। কোমরে লাগছে। হাতে ফেইক নেইল। চাপ দিতে গেলে খুলে পড়বে। কাউকে ডেকে দিন সাহায্য লাগবে।’

প্রিয়’র কথা কাজে হেসে ফেলল শতাব্দ। আজ অনেক বছর পর আগের সেই পুরনো প্রিয়’কে দেখল। বলল,

‘ আমি করে দিচ্ছি।’

 দু’কদম পিছিয়ে গেল প্রিয়। ঝাঁজাল কন্ঠে বলল,

‘ লাগবেনা। আমি আমি পারবো।’

ততক্ষণে শতাব্দ প্রিয়’র মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। শেরওয়ানির হাতা খানিক গুছিয়ে নিলো। হাঁটু গেড়ে সামনে বসল। আড়চোখে শতাব্দকে দেখছে প্রিয়। গোল্ডেন কারুকাজ করা কালো শেরওয়ানি। চুল গুলো সবসময়ের ব্রাশড ব্যাক করে গোছানো। হরহামেশার মত গম্ভীর মুখশ্রী। প্রিয় জিজ্ঞেস করল,

‘ বৌভাতে কালো শেরওয়ানি কে পরে?’

‘ কেন! সবাইকে যে নেভি ব্লু ব্লেজার পরতে হবে এমন কি কোন বরাদ্দ আছে নাকি?’

‘ বিয়েতে কালো পরাটা অস্বাভাবিক নয় কি?’

‘ আমার জীবনে স্বাভাবিক আছে কি! সবটাই তো অস্বাভাবিক।’

চুপ করে রইল প্রিয়। শতাব্দ জিজ্ঞেস করল,

‘ এই গেটআপে খারাপ লাগছে?’

‘ না।’

‘ ভালো লাগছে?’

‘ না।’ 

‘ আবার প্রেমে পড়ছ?’

‘ না।’ প্রিয়’র ঝাঁজাল কন্ঠে রুখা উত্তর।

ঠোঁট মেলে হাসল শতাব্দ। স্বাভাবিক শান্ত স্বরে বলল,

‘ তাহলে বারবার কেন আড়চোখে তাকাচ্ছ?’

প্রিয় উত্তর দিলো না কোন।লেহেঙ্গার গিট ছাড়িয়ে আলতো করে বেঁধে দিয়ে উঠে দাঁড়াল শতাব্দ। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিমিষ চেয়ে রইল। চোখেতে গভীর ঘোর, মুগ্ধতা ছড়ানো। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো প্রিয়। আচমকা শতাব্দ আরো কাছে চলে এলো। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। ফ্যালফ্যাল চেয়ে আধোআধো কন্ঠে বলল,

‘ ক…কি করছেন?’

জবাবে কিছু বলল না শতাব্দ। চোখে তখনো গভীর ঘোর। আরো কাছে চলে এলো। প্রিয়’র কাজলটানা চোখের কোণে আঙ্গুল ছুঁয়ে কানের পেছনে কালি লাগিয়ে দিলো। নিগূঢ়, গভীর কন্ঠে বলল,

‘ নজর না লাগে যেন আমার চাঁদের গায়ে।’

পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। ফ্যালফ্যাল চাহনি। চোখে এখনো বিস্ময়, ঘোর। তখনি হুড়োহুড়ি কয়েকজন মেয়ে ঢুকলো ঘরে। অতিথি আসতে শুরু করেছে বলে হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগল প্রিয়’কে। প্রিয়’র বিস্মিত দৃষ্টি তখনো শতাব্দতে আটকে।

 

চারিদিকে হাজার হাজার লোকজন। হবে নাই বা কেন? চেয়ারম্যান বাড়ির ভোজের আয়োজন। রাজনীতি জড়ানো অনেকেই এসেছেন। শাহরিয়ার সাহেব বেশ হাস্যোজ্জ্বল মুখে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন পুত্রবধূদের সাথে। প্রিয় প্রভা বেশ বিনয়ী ভাবে কুশল বিনিময় করছে। এত এত লোকের ভিড়ে বাবাকে দেখে অভিমানে ভরে এলো প্রিয়’র চোখ। রুষ্ট হয়ে সরিয়ে নিলো মুখ। আসার পর থেকে জাফর সাহেব অনেকবার প্রিয়’র সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। প্রত্যুত্তরে এড়িয়ে গেছে প্রিয়। প্রভা লক্ষ করল। প্রিয়’র কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ তুই বাড়াবাড়ি করছিস আপা। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে আব্বা। ইচ্ছে করে সবাইকে কেন নিজের থেকে সরিয়ে দিচ্ছিস?’

আচমকা ক্ষেপে উঠল প্রিয়। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বলল,

‘ তুইও দূরে থাক। আমার কাছে এলে জ্ব*লে যাবি সবাই।’

বিরক্তির মুখ করে দূরে সরে গেল প্রভা। 

 

অতিথি বিদায় করে ঘরে ঢুকতেই হতভম্ব সবাই। লুবনা বেশ বড়সড় কান্ড বাঁধিয়ে বসে আছে। শতাব্দের ঘরে যেয়ে ভাঙচুর করে এসেছে। প্রিয়’র জিনিসপত্র সব ফেলে দিয়েছে। সাজানো বাসরঘর লণ্ডভণ্ড করে রেখেছে। ফুলের মালা সব ছিড়ে ফ্লোরে ফেলে তার উপর হাতপা ছড়িয়ে বসে আছে। এলোমেলো চুলে মুখ ডেকে আছে। র*ক্তিম বুজে আসা চোখে গোলগোল চেয়ে। বিরবির করে কিছু বলছে। প্রিয়’কে দেখেই তেড়ে আসতে চাইল। ঘাবড়াল না প্রিয়। লুবনার দিক বিরক্তির মুখ করে চেয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে ড্রা*ক’স নিয়েছে। প্রিয়’র দিক তেড়ে আসতে দেখে রেগে গেল শতাব্দ। ক্ষে*পে লুবনার দিক পা বাড়াল। এর কোন একটা বিহিত করেই ছাড়বে আজ। 

পরিস্থিতী বিপরীত। শতাব্দকে এমন ক্ষে*পতে দেখে ছবি বেগম এসে সামনে দাঁড়াল। হাত জোড় করে সবার থেকে ক্ষমা চাইল। ‘লুবনা অসুস্থ’ তা বলে কথা এড়িয়ে চলে গেল।

 

রাত নেমেছে। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়।  মাথা যন্ত্রণা করলেও চোখে ঘুম নামছে না একদম। হিম শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে গা।

 শতাব্দ ঘরে আসেনি এখনো। বাবার সাথে কথা বলে লুবনার ব্যাপারটা ইতি টানতে গেছে। ঘর জুড়ে আবছা অন্ধকার। ড্রিম লাইটের আলোয় ছেয়ে আছে সামান্য।

আচমকা একজোড়া হাত এসে প্রিয়’র কোমর জড়িয়ে ধরেছে। মুখ গুজেছে ঘাড়ে। পেছনের মানুষটার তপ্ত নিশ্বাস গলায় পড়তেই কেঁপে উঠল প্রিয়। নিজেকে ছাড়ানো যথাসাধ্য চেষ্টা করল। পারলো না! পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে আরো। চোখ বুজে নিগূঢ় আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল শতাব্দ,

‘ নতুন বউকে আদর করব নাকি অভিমানী প্রেমিকার মান ভাঙ্গাবো  প্রিয়?’

সামনের থেকে উত্তর এলো না কোন। প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করল শতাব্দ। কোন উত্তর না পেয়ে, প্রিয়’কে নিজের দিক ফিরালো। নেশাতুর চাহনিতে নিমিষ চেয়ে রইল। দু’গালে হায় ছুঁয়ে বেঘোরে চেয়ে রইল। আবছা আলোতে চন্দ্রসুধা’র মত জ্বলে আছে প্রিয়। টলমল চাহনি তার। অধৈর্য হয়ে উঠল শতাব্দ। অস্থির হয়ে প্রিয়’র দিক ঝুঁকে পড়লো। চোখ বুজে প্রিয়’র গায়ের মাতাল সুবাসে মিলিয়ে যেতে লাগল। ঠোঁট জোড়ায় ছুঁই ছুঁই ভাব। অমনি প্রিয়’র ঝাঁজাল আওয়াজ কানে এলো ,

‘ এইসব ভালোবাসার নাটক এই শরীরি চাহিদার জন্য তাইতো?’

বিতৃষ্ণা নিয়ে চোখ খুলল শতাব্দ। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিলো। প্রিয়’র চোখেমুখে তাচ্ছিল্য। কন্ঠে ক্ষুব্ধ রাগ নিয়ে বলল,

‘ যখন চাহিদা শারিরীক তাহলে বিয়ে, ভালোবাসার নাটক করার কি দরকার ছিল? আমাকে বলতেন চলে যেতাম হোটেলে। অন্তত এই বাধ্যবাধকতার সম্পর্ক থেকে তো মুক্তি মিলতো।’

শতাব্দের মেজাজ বিগড়ে গেল। লাথি মে*রে পাশের টি টেবিলটা দূরে ছু*ড়ে ফেলল। রাগী ধাপ ফেলে প্রিয়’র দিক এগিয়ে এলো। বাহু চেপে ভারী গর্জন করে বলল,

‘ তোমার সত্যি মনে হয় আমার তোমাকে শারিরীক চাহিদার জন্য চাই?’

প্রিয় শক্ত চোখমুখ। উত্তর দিলো না কোন। শতাব্দ চিৎকার করে বলল,

‘ উত্তর দিচ্ছ না কেন?’

প্রিয় কেঁপে উঠল। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। বলল,

‘ হ্যাঁ’

ক্ষেপে উঠল শতাব্দ। ঘর কাঁপা আওয়াজে চেঁচিয়ে বলল,

‘ যদি তাই করার হতো তাহলে কু*ত্তার মত এতবছর পিছনে পড়ে থাকতাম না। বাড়ি থেকে তুলে, হোটেলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ছেড়ে দিতাম। তুই আসলে…..’

প্রিয়’র মুখপানে চেয়ে থেমে গেল শতাব্দ। ফোসফোস শ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। এমন ঘনিষ্ঠ সময়ে প্রিয়’র এমন আচরণ কথাবার্তা মাথা বিগড়ে দিয়েছিল। কোন পুরুষের পক্ষেই এমন পরিস্থিতীতে মাথা ঠান্ডা রাখা সম্ভব না। একটু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে প্রিয়’র দিক এগিয়ে গেল শতাব্দ। প্রিয়’র গালে আলতো হাত রাখল। মলিন দৃষ্টিতে চেয়ে করুণ কন্ঠে বলল,

‘ কি ভাবে ভালোবাসলে আমার সেই প্রিয়কে ফিরে পাবো আবার।’

‘বোধহয় পাবেন না আর। ম*রে গেছে সেই প্রিয়।’

যন্ত্রের মত করে উত্তর দিলো প্রিয়। প্রিয়’র গাল ছেড়ে হতাশ শ্বাস ফেলল শতাব্দ। বলল,

‘ তোমাকে না ছুঁয়ে থাকা যদি আমার ভালোবাসার পরিক্ষা হয়। তাহলে তাই হোক! তুমি আমার নয়ন ডোরে আবদ্ধ এতটুকুই আমার যথেষ্ট।’

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

 

৩৩

 

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

 

নিকষ কালো রাত পেরিয়ে উজ্জ্বল ভোর নেমেছে ভুবনে। কুয়াশার চাদর মাড়িয়ে নরম আলো এসে বারান্দা ছুঁইছে। খানিক পূর্বেই প্রাতঃ ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরেছে শতাব্দ। ময়না এসে চা দিয়ে গেল। বারান্দাটা মোটামুটি বড়সড়, সাজানো। চারিদিক নানারকম ফুল গাছ। মাঝখানে সিলেটি বেতের চেয়ার টেবিল বিছানো আছে এক সেট। ইমান্দিপুর আসলে এখানে বসে সকালের চা খেতে পছন্দ করে। 

আচমকা দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল প্রিয়। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে জেগেছে আজ। এবাড়িতে সবাই বেশ সকালে উঠে। কুয়াশা ঘেরা ভোরে, হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা পানিতে গোসল সেরে একহাত ঘোমটা টেনে ঘুরতে হচ্ছে তাকে। ভেজা চুল বেঁধে রাখায় মাথাটা টিসটিস করছে। 

বিরক্তি নিয়ে মাথা থেকে শাড়ির আঁচল ফেলে চুল মেলে দিয়ে শতাব্দের সামনের চেয়ারে বসলো প্রিয়। রাশভারি আওয়াজ করে বলল,

‘ আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।’

যেন শুনেও শুনলো না শতাব্দ। না শোনার মত করে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রাখলো। প্রিয় লক্ষ্য করল, গতরাতের ঘটনার পর আরো গম্ভীর হয়ে গেছে শতাব্দ। খানিক এড়িয়ে চলতে চাইছে প্রিয়’কে। জবাবের অপেক্ষায় থেকে প্রিয় আবারো বলল,

‘ আপনি কি ব্যস্ত?…কিছু কথা ছিল!’

বইয়ের পাতায় চোখ রেখে আওড়াল শতাব্দ, 

‘ বলো শুনছি।’

প্রিয় ঝটপট করে জিজ্ঞেস করল,

‘ আর কতদিন ছুটি আছে আপনার? ডিউটিতে কবে থেকে জয়েন করছেন।আমরা ঢাকায় ফিরছি কবে?’

‘ সাতদিন ছুটি আছে। বোধহয় না ছুটির দরকার আছে আর। আগামীকাল ঢাকায় ফিরছি। পরশু ডিউটিতে জয়েন করব।’

গম্ভীর হয়ে কিছু চিন্তা করছিল প্রিয়। ভাবনাতুর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ এখান থেকে ঊষ্ণচড় কত দূর?’

প্রিয়’র মুখে ‘ঊষ্ণচড়ের’ নাম শুনে চমকাল শতাব্দ। ঊষ্ণচড় তার নানার বাড়ি। সেখানকার কথা জানতে চাইছে কেন প্রিয়! কপাল কুঁচকে প্রিয়’র দিক তাকাল। প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ কেন?’

শতাব্দের সন্দিহান মুখশ্রী দেখে, প্রিয় চোখেমুখে গম্ভীর ভাব এঁটে নিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিলো,

‘ শাড়ির ফটোশুটের জন্য। কম্পানি জায়গাটা পছন্দ করেছে।’

প্রিয়’র কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না শতাব্দ’র। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ ফসলবিহীন খোলা মাঠে তোমার কম্পানির লোকজন কি সৌন্দর্য দেখল?’

ফেঁসে গেল প্রিয়। একটু চুপ থেকে আটকে আটকে বলল,

‘ আমি কি জানি। আপনি কি বলবেন ঊষ্ণচড় এখান থেকে কতদূর?’

‘ না, বলবো না। কারণ তুমি যাচ্ছ না।’ শতাব্দের রুখা আওয়াজ।’

‘ এখন কি আপনার জন্য আমার কাজ ছেড়ে দিবো? আমার কাজ করা মানসম্মানে লাগছে আপনার?’

‘ আশ্চর্য! আমি তা কখন বললাম। তোমার ভালো লাগে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে চাও করতে পারো। আমার মানসম্মানে বাঁধবে কেন? তুমি ঊষ্ণচড় যাবেনা জাস্ট এতটুকুই।’

‘ আপনার কথা মানতে আমি বাধ্য নই।’

প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো শতাব্দের। প্রিয়’র দিক শক্ত চাহনিতে চেয়ে রইল। ঊষ্ণচড় লুবনাদের বাড়ি। ছবি বেগম সেখানে নেতৃত্ব করছে। হাতে রাজনৈতিক বল আছে। চাইলেই প্রিয়’র ক্ষ*তি করতে পারবে। জেনেশুনে প্রিয়’কে যেতে দিবেনা সেখানে। খানিক চুপ থেকে থমথমে আওয়াজে বলল,

‘ ঝামেলা চাইছিনা কোন। তুমি ঊষ্ণচড় যাচ্ছো না প্রিয়। ব্যাস’

কাঠকাঠ চাহনি নিক্ষেপ করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। 

 

কাজ ছাড়া অলস বসে থেকে কোমর লেগে আসছে প্রভার। কাজের জন্য বাড়িতে লোক আছে দুজন। কোন কিছুতে হাত লাগাতে দেয়না। ঢাকা বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। সকাল থেকে এখন অবধি মাকে তিনবার ফোন করেছে। এখন আবার ফোন করলে নিশ্চয়ই রেগে যাবেন। খানিক ফোন টিপাটিপি করে বিরক্ত হয়ে উঠল প্রভা। বিছানায় ফোন ছুঁড়ে, উঠে দাঁড়ালো। লাগেজের কাপড় বের করে আলমারি গোছাতে লাগল। আচমকা নিচের সারির দিক চোখ গেল। পুরাতন একটা কাঠে বাক্স। ভ্রু কুঁচকে এলো প্রভার। হাতে নিতেই দেখল তালাবদ্ধ। ব্যাপারটা তার মনে ভীষণ কৌতূহল জাগালো। বাক্সটা বিছানায় নামিয়ে, তালার চাবি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিনিট পাঁচেকের ভেতর পেয়ে গেল। আলমারির ডয়ারেই রাখা ছিল। তালা খুলে বাক্স মেলতেই হতভম্ব প্রভা। অনেক গুলো চিঠি আর গিফট। এগুলো কার সমুদ্রের? মনে অদ্ভুত এক ভয় চাপলো। একটা চিঠি হাতে নিলো। কোথা থেকে পড়বে বুঝতে পারছেনা। সব এলোমেলো। কিছু চিঠি ছিঁ*ড়া ফাঁড়াও। প্রভার মাথায় কোনকিছু যেন ভর করল।ব্যস্ত হাতে তড়িঘড়ি করে বাক্সটার ভিতর কিছু খুঁজতে লাগলো। আচমকা কয়েকটা ছবি দেখে থমকে গেল। হাতে তুলে ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল। সমুদ্রের সাথে একটা মেয়ে। কিছু ছবি বেশ ঘনিষ্ঠ। মাথা শূন্য লাগছে প্রভার। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এলো। বুকের ভেতর বিষন্ন ঝড়ে তোলপাড় হতে শুরু করল। বুক চিড়ে হাহাকার চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইল। 

সকালে সমুদ্রের ফুফাতো বোনদের বলা কথা মনে পড়ল। কথায় কথায় তাদের একজন বলছিল, কলেজ লাইফে একটা মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসতো সমুদ্র। যার জন্য ত্যাজ্যপুত্র হতেও রাজি ছিল।’ আরো কিছু বলতে চাইছিল জুবাইদাধমকে থামিয়ে দিয়েছিল। কথাগুলো তখন আমলে নেয়নি প্রভা। হাসিঠাট্টা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। তবে কি সব কথা সত্যি ছিল। এই মেয়েটাই কি সেই! এতদিনের সম্পর্ক তাদের! কই একবার তো বলল না সমুদ্র। এখনো কি মেয়েটাকে ভালোবাসে। তাই বলেই এতো যত্ন করে তার স্মৃতি গুলো গুছিয়ে রেখেছে! ভেবে কেঁদে ফেলল প্রভা। বুকে প্রচন্ডরকম যন্ত্রণা হচ্ছে তার। আজ মনে হচ্ছে সব মিথ্যা। সব! 

 

গ্রামের কিছু কাজে বেরিয়েছিল শতাব্দ। বাড়ি ফিরে, ঘরে প্রিয়’কে না দেখে হাঁকডাক শুরু করল। ময়না পানি নিয়ে ছুটে এলো। শতাব্দ গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ প্রিয় কোথায়?’

নিচু স্বরে উত্তর দিলো ময়না,

‘ বাহিরে গেছে।’

‘ বাহিরে কোথায়?’

‘ জানিনা ভাইজান। বড় আম্মা জানে।’

ক্ষিপ্ত ধাপ ফেলে নিচে নেমে এলো শতাব্দ। অভিলাষা বেগম রান্নাঘরে ছিল। দুপুরের রান্না হচ্ছে। কাজের লোকেদের তদারকি করতে ব্যস্ত। আচমকা রান্নাঘরে ছেলেকে দেখে অবাক হলেন। কিছু বলবেন তার পূর্বেই শতাব্দ জিজ্ঞেস করল,

‘ প্রিয় কোথায় বেরিয়েছে?’

অভিলাষা বেগম স্বাভাবিক উত্তর,

‘ ফটোশুট আছে। বিকালের আগে চলে আসবে বলল।’

‘ কোথায় গেছে জায়গার নাম বলেছে নিশ্চয়ই?’

‘ না, বলল ইউনিট জানে।’

বিরক্ত হলো শতাব্দ। রাগ চেপে জিজ্ঞেস করল,

‘ কোথায় যাচ্ছে তুমি জিজ্ঞেস করবে না! গাড়ি গিয়ে গেছে? ‘

‘ না, বলল কম্পানি থেকে গাড়ি পাঠিয়েছে। বাজার থেকে তুলে নিবে।’

রাগে চেঁচিয়ে উঠল শতাব্দ।বলল,

‘শিট! তাই শুনে তোমরা একাএকা যেতে দিলে?’

হুট করে ছেলেকে এমন রেগে যেতে দেখে অভিলাষা বেগম ঘাবড়ে গেল। অশান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে আব্বা! এমন রেগে যাচ্ছিস কেন। প্রিয়’র সাথে পুরো টিম আছে চলে আসবে।’

রাগ চেপে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করল শতাব্দ। চুলে আঙ্গুল চালিয়ে পেছনে টেনে। স্বাভাবিক কন্ঠ বলল,

‘ তুমি জানো কোথায় গেছে প্রিয়? ঊষ্ণচড়! তোমার ভাইয়ের গ্রামে। ওই হিং*স্র মানুষ গুলোর ভেতর।’

অভিলাষা বেগমের ভয় করতে শুরু করল এইবার। ছবি আর তার মেয়েকে দিয়ে বিন্দু পরিমান ভরসা নেই। তাদের কানে গেলে প্রিয়’র ক্ষ*তি করতে চাইবে নিশ্চয়ই। ছেলেকে শান্ত করতে তিনি বললেন,

‘ প্রিয়’র সাথে পুরো টিম আছে। এতো লোকের ভেতর ক্ষতি করতে পারবেনা কেউ।’

শতাব্দের রাগ আরো বেড়ে গেল। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

‘ ওদের আশায় থাকবো? আমার সন্দেহ মিথ্যা বলেছে প্রিয়। কোন ফটোশুট হচ্ছেনা।ওর মাথায় অন্যকিছু ঘুরছে।একা গিয়েছে ঊষ্ণচড়ে। যদি আমার সন্দেহ একটুও মিলে যায়। সামনে বিপদ আসছে। আর এবার যদি আমার প্রিয়’র কিছু হয়। সম্পর্ক যাইহোক না কেন। কাউকে ছাড়বো না। শাহরিয়ার সাহেব বাঁধা হলে তিনিও ছাড় পাবেনা!’

গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। ছেলের এমন কড়া শাসানিতে থমকে গেল আভিলাষা বেগম। স্বামী ছেলের ফেসাদে সবসময় তাকেই জ্ব*লতে হয়। এইতো সবেমাত্র এতবছরের ঝামেলা বিবাদ কা*টিয়ে বাপছেলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। বিয়ের উছিলায় হলেও, সম্পর্কগুলো সহজ হচ্ছিল। কিন্তু আজ যদি প্রিয়’র সামান্য আঁচড়ও লাগে কাউকে ছাড়বেনা শতাব্দ। সারাজীবনের জন্য সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে যাবে।

 

‘ আজ পনেরদিন তুমি ঊষ্ণচড় এসেছ। আমাকে একবার জানালে না কেন?’

শাদের ক্রো*ধানিত্ব আওয়াজে খানিক কেঁপে উঠল তুরফা। মাথা নত করে বাঁশের বেড়ার দিক চেয়ে রইল। তার মৌনতা শাদের রাগ বাড়াল আরো। অনেকটা চেঁচিয়ে বলল,

‘ আমার কোন কথার কোন দাম নেই? তাইতো!’

তুরফা মৌনতা ভেঙ্গে ধীর স্বরে বলল,

‘ তোমাকে জানানোর প্রয়োজন আছে কি কোন?’

হতাশ হয়ে তাকাল শাদ। এই মেয়েটা কোনদিন তার মন বুঝবে না বলে, কছম কে*টেছে কি! সেই ক্লাস টেন থেকে পেছনে পড়ে আছে। ভালোবাসে! এই সাধারণ কথাটা কি বুঝেনা সে! এভাবে বারবার কেন এড়িয়ে চলে। শাদ শীতল স্বরে বলল,

‘ ভালোবাসি তুরফা।

তুরফা কেঁপে উঠল। মনে মনে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। একটু সময় নিয়ে মাথা উঁচিয়ে, শাদের চোখে চোখ রেখে বলল,

‘ আমাদের মধ্যে কখনো কোন সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না।’

‘ কারনটা কি? দুজন সমবয়সী।’

‘ না, পারিবারিক। আমার পরিবার কখনো মেনে নিবেনা এই সম্পর্ক।’

‘ আমি মানিয়ে নিবো।’

‘ তারা কোনদিন মানবেনা। এক মেয়ে হারিয়েছে, সেই বাড়িতে আরেক মেয়ের বিয়ে দিবেনা।’   

রেগে গেল শাদ। গর্জন করে বলল,

‘ আমার আত্মীয়’র জন্য জীবন গেছে বলে সেই দায়ভার কি আমার? আমি কেন গিভ আপ করব। তাছাড়া খু*নের ব্যপারটা স্পষ্ট হয়নি! ওইটা এ*ক্সিডেন্ট ছিল।’

তেতে উঠল তুরফা। গলা উঁচিয়ে বলল,

‘ আপাকে খু*ন হতে আমি নিজ চোখে দেখেছি।’

‘ অনেকবছর আগের ঘটনা। তুমি তখন ছোট ছিলে। হয়তো দেখার ভুল ছিল!’

আ*হত হলো তুরফা। ছলছল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ভারী আওয়াজে ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,

‘ অতটাও ছোট ছিলাম না যে খু*ন আর এ*ক্সিডেন্টের পার্থক্য বুঝব না। তোমার ফুপুর ছেলে মেয়ে আমার আপাকে অমা*নবিক নি*র্যাতন করছিল। সবকিছু আমার চোখের সামনে হচ্ছিলো। আমি চাইলেও কিছু করতে পারছিলাম না তখন।’

তুরফার কাছে যেয়ে আলতো করে কাঁধে হাত রেখে। বুঝানোর স্বরে বলল শাদ,

‘ তোমার হয়তো ভুল হচ্ছে। রাগ থেকে এসব বলছ। সবাই জানে তোমার আপা পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল।’ 

কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল তুরফা। বলল,

‘ তুমি মানবেনা সেটা আলাদা কথা। তাই বলে তো সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবেনা।’

বড্ড কান্না পাচ্ছে তুরফার। বড়বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করতে চাইল। একটু থেমে কাঠকাঠ কন্ঠে বলল,

‘ ‘ভালোবাসার’ প্রথম শর্ত বিশ্বাস। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালোবাসাও নেই। অনেক আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। তোমার পরিচয় না জেনে বন্ধুত্ব করা মারাত্মক ভুল ছিল। আমার পিছু নিবেনা প্লিজ। কিছুদিনের জন্য দাদীর কাছে এসেছি। ঝামেলা চাইছিনা কোন।’

পেছনে ঘুরে বাড়ির দিক পা বাড়াল তুরফা। শাদ পিছুপিছু হাঁটতে লাগল। তুরফাকে বোঝানোর জন্য। যেই কিছু বলবে অমনি সামনে প্রিয়’কে দেখল। তুরফাদের বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। বিস্ময়ে থমকে গেল শাদ। প্রিয় এখানে কেন? 

মুখোমুখি শাদকে দেখে প্রিয়’ও চমকে উঠল। কপাল কুঁচকে নিলো।

গম্ভীর রুখা আওয়াজে জিজ্ঞেস করল শাদ,

‘ এখানে কি করছেন আপনি?’

‘ আমারও একই প্রশ্ন, তুমি এখানে কি করছ?’

বিরক্ত হলো শাদ। প্রিয়’কে মোটেও তার পছন্দ নয়। আড়ষ্ট মুখ করে জবার দিলো,

‘ আপনাকে বলতে বাধ্য নই।’

ঠোঁট মেলে হাসল প্রিয়। বলল,

‘ আমিও জবাব দিতে বাধ্য নই!’

প্রচন্ডরকম বিরক্ত হলো শাদ। তুরফা প্রিয়কে দেখে হাসিহাসি মুখ করে বলল,

‘ চলে যাচ্ছ আপু। থেকে যাও আজ।’

‘ অন্য একদিন আসবো আবার।’

 

প্রিয়’র সাথে তুরফার এতো ভালো পরিচয় দেখে হতভম্ব শাদ। তুরফাকে জিজ্ঞেস করল,

‘ উনাকে কি করে চিনো?’ 

‘  আপাকে কে না চিনে। সোসাল মিডিয়ার পরিচীত মুখ।তাছাড়াও প্রিয় আপু আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। আপার খালা আমার মায়ের স্কুল ফ্রেন্ড ছিল।’

শাদের দিক তাকিয়ে প্রিয় জিজ্ঞেস করল,

‘ তোমরা একে অপরকে কি করে চিনো?’

তুরফা ‘ফ্রেন্ড’ বলতে যাবে তার পূর্বেই শাদ বলল,

‘ আমার গার্লফ্রেন্ড।’

থমকে গেল তুরফা। ফ্যালফ্যাল করে শাদের দিক চেয়ে রইল। বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রিয়। শাদের স্বভাব হুবহু শতাব্দের মত। স্পষ্টভাষী, বেশরম!  

খানিক চুপ থেকে মিহি হেসে বলল প্রিয়,

‘ তোমরা ভাইদের প্রেমের রাশি ভীষণ বাজে। সবসময় ভিক্টিমের পরিবারের কাউকে ভালোবেসে ফেল।’ 

ফ্যালফ্যালে তাকিয়ে রইল শাদ।

তুরফাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো প্রিয়। ভরদুপুর। রাস্তাঘাট ফাঁকা, যানবাহন নেই কোন। বিরক্ত হলো প্রিয়। আসার সময় অটোরিকশায় এসেছিল। রাস্তা খারাপ হওয়ায় ঝাঁকুনিতে কোমরে হাঁড় খুলে পরার উপক্রম ছিল। শরীর হাতপা ছেড়ে দিয়েছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ওড়নার কোন দিয়ে কপালে ভেসে থাকা ঘাম মুছলো। পা চালিয়ে সামনের দিক হাঁটা ধরল। অমনি একটা অটোরিকশা দেখে হাত বাড়িয়ে থামানো ইশারা করল। ইমান্দিপুর যাওয়ার কথা বললে প্রথমে নাচক করল। পরবর্তীতে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললে রাজি হয়ে গেল। ক্লান্ত প্রিয় যেই অটোরিকশায় উঠবে অবনি হুড়মুড়িয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি এসে থামলো। অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ধুলোবালিতে জমে আছে রাস্তাঘাট। গাড়ির গতির কারণে বাতাসে ধুলোবালি উড়ে অন্ধকার হয়ে এলো চারিপাশ।  ওড়না দিয়ে মুখ চেপে কেশে উঠল প্রিয়।

 গাড়ি থেকে শতাব্দ নেমে প্রিয়’র বাহু চেপে ধরল। চোখেমুখে আ*তঙ্ক ,ভয়।

 হতভম্ব, ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রিয়। শতাব্দের এখানে আসা অপ্রত্যাশিত ছিল। রাগী গর্জন করে বলল শতাব্দ,

‘ তুমি ঠিক আছো! কেউ দেখেনিতো। নিষেধ করেছিলাম। কাউকে কিছু না জানিয়ে একাএকা এখানে এসেছ কেন?’

‘ ওহ! বলে আসার উচিত ছিল।’

প্রিয়’র ভাবলেশহীন উত্তরে হতাশ শ্বাস ফেলল। বলল,

‘আমার কথার কোন দাম নেই? এখানে আসতে কড়াকড়ি নিষেধ করেছিলাম।’

‘ আমিও আসবো বলেছিলাম।’

‘ তুমি এতো জেদি কেন?’

‘ এখানে আমার কাজ ছিল।’

‘ আচ্ছা! কি কাজ? তোমার তো ফটোশুট ছিল। তাই না? টিমমেডরা কোথায়?’

শতাব্দের ক্রোধান্বিত আওয়াজে থতমত খেলো প্রিয়। উত্তরের আশায় চেয়ে আছে শতাব্দ। প্রিয় কি বলবে উত্তর পাচ্ছেনা কোন। শতাব্দের গম্ভীর, ঠান্ডা আওয়াজ,

‘ মাথায় কি চলছে তোমার! কোন ঝামেলায় জড়িও না প্লিজ!আমি স্ট্রং ফিল করতে পারছি সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে ।’

শতাব্দের মুখপানে চেয়ে রইল প্রিয়। অমনি অটো ড্রাইভার তাড়া দিলো। প্রিয় অটোরিকশায় উঠতে নিলে হাত আটকাল শতাব্দ। রাশভারি আওয়াজে বলল,

‘ গাড়িতে উঠো।’

শুনল না প্রিয়। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে শতাব্দ আরো চেপে ধরল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ আমাকে রাগাতে ভালো লাগে তোমার?’

‘ উহু, পৈ*শাচিক আনন্দ পাই।’

হাত ছাড়িয়ে, অটোরিকশায় উঠতে গেলে শতাব্দ ক্ষুব্ধ কন্ঠে আওড়াল,

‘ রাস্তায় সিনক্রিয়েট করতে বাধ্য করোনা!’

শতাব্দের রাগী চোখের চাহনিতে থেমে গেল প্রিয়। অটোরিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল। অটো ড্রাইভার ঘ্যানঘ্যান করায় কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দিলো শতাব্দ।

প্রিয় চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসল। গাড়ি স্টার্ড দিতেই মোবাইল  বেজে উঠল। রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে ছবি বেগমের আওয়াজ ভেসে এলো,

‘ বাজান তুমি নাকি গ্রামে আসছ। কোন কারণ ছিল? ‘

শতাব্দের অকপটে ক্ষুব্ধ আওয়াজ,

‘ প্রিয়কে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছি।’

‘ বাড়িতে আসো। দুপুরের খানা খাইয়া যাও।’

ছবি বেগমের ভালোমানুষি আচরণের কারণ বেশ ভালো করে জানে শতাব্দ। কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বলল,

‘ আপনার মেয়ে গতকাল বাড়িতে যেই কান্ড করে এসেছে তারপর আরো? অসম্ভব! আপনাদের সাথে কোন সম্পর্ক নাই।’

ছবি বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। কথার ধাঁচ দেখে প্রিয় বুঝল ছবি বেগম ফোন করেছিল। শতাব্দ ফোন রাখতেই প্রিয় জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনি এখানে এসেছেন উনি কি করে জানলো?’

‘ এটা ওদের গ্রাম। চারিপাশে সব ওদের লোক। খবর ছড়াতে  সময় লাগে না।’

শতাব্দের চোখেমুখে এখনো ক্রোধ ছড়িয়ে। যেই শতাব্দ রেগে কিছু বলতে যাবে, অমনি প্রিয় গাড়ির রেডিও ছেড়ে দিলো। ক্লান্ত মুখভঙ্গিতে সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজে নিলো। হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শতাব্দ। 

রেডিওতে গান বাজছে,

 

ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়

মেনে নেয় তার পরাজয়

জীবন পড়ে ধূলোতে, হারিয়ে সঞ্চয়

ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়

মেনে নেয় তার পরাজয়

জীবন পড়ে ধূলোতে, হারিয়ে সঞ্চয়

 

যার কথা ভাসে, মেঘলা বাতাসে

তবু সে দূরে তা মানি না (মানি না)

যার কথা ভাসে, মেঘলা বাতাসে

তবু সে দূরে তা মানি না

 

জানি না, কেন তা জানি না

জানি না, কেন তা জানি না…..

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

 

৩৪.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

রাতের খানা সেড়ে ঘরে আসতেই হতভম্ব প্রিয়। আগের থেকেই বিছানায় বসে আছে প্রভা। দরজার সামনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। ভিতরে আসতে সাহস পাচ্ছেনা বুঝি। দুজনের দিক কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল প্রিয়। সকালে খাবার টেবিলে দুজনকে বেশ হাস্যোজ্জ্বল দেখল। হ্ঠাৎ এমন মনমালিন্য কেন? প্রিয়কে আসতে দেখে, প্রভা বিছানা গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত স্বরে বলল,

‘ আজকের রাত আমি এখানে থাকব।’

বিমূঢ় চেয়ে রইল প্রিয়। কিছু বলতে যাবে অমনি ঘরে শতাব্দ এলো। প্রভাকে এসময় এখানে দেখে বরাবরই হতভম্ব শতাব্দ। তার বিস্মিত চোখমুখ দেখে প্রভা বলল,

‘ আগামীকাল আপনারা ঢাকায় চলে যাবেন। আজ রাতটা আমি আপার সাথে থাকব, আপনার গেস্ট রুমে থাকতে সমস্যা হবে শতাব্দ ভাই?’

শতাব্দ চুপ।সমুদ্রের চোখমুখ ঠাহর করে আগেই বুঝতে পেরেছে দুজনের ঝামেলা চলছে।বিস্ময় কাটিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো,

‘ কোন সমস্যা নাই।’

প্রভা বলল,

‘ আচ্ছা। যাওয়ার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকেও নিয়ে যাবেন। ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করেনা যেন!’

উত্তরে শতাব্দ বলল কিছু। ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল।

শতাব্দ চলে যেতেই প্রভা বিছানা থেকে নেমে সমুদ্রের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। হাতপা গুটিয়ে বিছানায় বসতেই প্রিয় জিজ্ঞেস করল,

‘ সমুদ্র ভাই কিছু বলেছে! কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে?’

চোখমুখ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল প্রভা। বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে বলল,

‘ কি হবে। কিছু হয়নি।’

‘ তাহলে ঘর ছেড়ে এখানে এসেছিস কেন?’

‘ চলে যেতে বলছ! চলে যাবো?’

প্রিয় বিরক্ত হলো। রেগে থাকলে উল্টো জবাব দিয়ে ঘাড়ত্যাড়ামো করার অভ্যাস প্রভার। পরে রাগ পড়ে গেলে, নিজে থেকে গড়গড় করে সব বলবে। 

ঘরের লাইট নিভিয়ে, ড্রিম লাইট জ্বা*লিয়ে শুয়ে পড়ল প্রিয়। খানিক বাদেই পাশ থেকে ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে এলো। চমকে উঠল প্রিয়। উঠে প্রভাকে ডাকতেই। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কেঁদে উঠল প্রভা। আদো আদো করে বলল,

‘ ও আমাকে ঠকিয়েছে আপা। অন্য কাউকে ভালোবাসে সে।’

হতভম্ব প্রিয়। বোনের এমন হাউমাউ কান্নায় পাথর হয়ে আছে সে। বরাবর-ই প্রভা হাস্যোজ্জ্বল সরল। এর আগে কখনো এমন করে কান্না করতে দেখেনি সে। বোনের পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রিয় বলল,

‘ শান্ত হ। কি হয়েছে আমাকে বল।’ 

শান্ত হলোনা প্রভা। কান্না জড়ানো ভাঙ্গা আওয়াজে বলল,

‘ সে আমাকে ঠকিয়েছে আপা। ঠকিয়েছে সে!’

বোনকে শান্ত করার চেষ্টা করল প্রিয়। খানিক সময় নিয়ে প্রভার কান্না থামল। কিন্তু ক্ষান্ত হয়নি তখনো। ডুকরে কেঁদে উঠছে একটু পরপর। বোনের অশ্রুভারাক্রান্ত চোখের জল মুছে দিলো প্রিয়। পাশ থেকে এক গ্লাস পানি দিয়ে বলল,

‘ পানিটা খেয়ে নে।’

বাধ্য মেয়ের মত পানির গ্লাস হাতে নিয়ে সবটা পানি শেষ করল প্রভা। কান্নার বেগ অনেকটাই কমেছে এখন। প্রভাকে শান্ত হতে দেখে, প্রিয় বলল,

‘ কি হয়েছে এবার বল।’

একটু চুপ থেকে প্রভা বলল,

‘ আজ সকালে মেধারা বলছিল, সমুদ্র কাউকে ভালোবাসতো। তার জন্য নাকি ত্যাজ্যপুত্র হতেও রাজি ছিল। প্রথমে সেসব কথা আমলে নেইনি। পরবর্তীতে আলমারী গোছাতে গিয়ে একটা বাক্স পেলাম। বাক্সতে…’

প্রভার গলা ধরে এলো। চোখজোড়া জলে ভিজে। একটু সময় নিয়ে আবার বলল,

‘ সেখানে একটা মেয়ের সাথে সমুদ্রের ঘনিষ্ট ছবি। অনেক গুলো চিঠি। অথচ বিয়ের আগে বা সম্পর্ক চলাকালীন সময় ওই মেয়েটার কথা একবারও শুনিনি।’

কথা শেষ করে শক্ত হয়ে বসে রইল প্রভা। চোখ থেকে পানি ঝরছে টপটপ।

প্রিয় বলল, 

‘ সমুদ্র ভাই এক্সসের কথা বলেনি বলে রেগে আছিস? নাকি তার স্মৃতি আগলে রেখেছে বলে রেগে!’

কোন উত্তর দিলো না প্রভা। প্রিয় আবারও বলল,

‘ মেয়েটার নাম তানহা। আমরা এক ক্লাসে পড়তাম। এই এলাকায়’ই বাড়ি তানহার। দুজন দুজনকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসতো। সমুদ্র ভাইয়ের ভালোবাসা সত্যি হলেও তানহার ভালোবাসায় খাঁদ ছিল। তাইতো…’

চেঁচিয়ে উঠল প্রভা। বোনের মুখের ওই মেয়ের নাম, পরিচয় শুনতে বিরক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ কানে বিষ ঢালছে তার। রাগে ফেটে পড়ল প্রভা। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ চুপ কর আপা। ওই মেয়েটাকে নিয়ে কিছু শুনতে চাইনা।’

‘কেন? ‘

‘ বিয়ের মাত্র কয়েকদিন, হঠাৎ জানতে পারলাম আমার স্বামীর প্রেমিকা ছিল। সেই প্রেমিকাকে নিয়ে জানতে কি ভালো লাগার কথা?’

‘ তানহা সমুদ্র ভাইয়ের অতীত ছিল!’

‘ আমার স্বামীর অতীতে অন্যকোন মেয়ে থাকবে কেন? আমার অতীতে তো কোন ছেলে নেই। নিজের মন, প্রাণ সর্বস্র দিয়ে ভালোবেসেছি তাকে।’

‘ এটা কেমন ছেলেমানুষী প্রভা! সমুদ্র ভাই কি জানতো, তানহা তাকে ঠকাবে। ভবিষ্যতে তোর সাথে তার পরিচয় হবে।’

প্রভা চুপ। প্রিয় শান্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ ভাগ্য কখন কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় তা কেউ জানেনা। তানহা সমুদ্র ভাইয়ের অতীত ছিল, তুই বর্তমান। তাকে অন্ধকার জগত থেকে তুলে আনা আলোকধারা। অতীত গোপন রাখারও কোন কারণ আছে। হয়তো সে চায়নি তানহার কথা জানিয়ে তোকে কষ্ট দিতে। বা কালো অতীতকে মনে করতে। সমুদ্র ভাই তোকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে প্রভা। সবকিছু ভুলে সামনে এগিয়ে যা।’

‘ ভুলতে পারছিনা আপা। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা আমি তার জীবনে দ্বিতীয়জন। সে তো আমার একমাত্র, আমি কেন হলাম না!’

প্রভার করুণ আওয়াজ। প্রিয় বোঝানোর কন্ঠে বলল,

‘ অবশ্যই, তুই একমাত্র। তুই তার স্ত্রী। তোর জায়গা কখনো কেউ নিতে পারবেনা। অতীত টেনে কখনো কেউ সুখী হয়না।’

‘ মেয়েটার ছবি, চিঠি এখনো স্বযত্নে রাখা। এসব আমাকে সহ্য করতে বলছিস আপা?’

‘ উহু, সহ্য করতে বলছিনা। তা নিয়ে প্রশ্ন করা, রাগ করার অধিকার অবশ্যই আছে তোর। কিন্তু তার আগে, তাকে তার দিকটা ব্যাখ্যা করার একটা সুযোগ দিতে হবে। মুখোমুখি বসে দুজনের কথা বলতে হবে।’

বোনের দিক ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকল প্রভা। এত রাগী মানুষটার এমন বুঝদার রূপ আছে জানতো না। সব বুঝেও  নিজের এলোমেলো জীবনটা কেন গুছিয়ে নিচ্ছে না। কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করল প্রভা,

‘ তুই কেন শতাব্দ ভাইকে একটা সুযোগ দিচ্ছিস না? মানুষটা তোকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। এত রাগী, গম্ভীর, বদমেজাজী হয়েও তোর করা প্রত্যেকটা অপমান চুপচাপ সহে নেয়। ত্যাড়ামো গুলো মেনে নেয়। তোর জন্য পুরো বাড়ির মানুষের সাথে লড়ে! সবার সামনে বাঘ তোর সামনে ভিজাবিড়াল।তাকে কেন একটু ভালোবাসিস না?’

চুপ করে রইল প্রিয়। উদাসীন কন্ঠে বলল,

‘ আমাদের ব্যাপারটা কমপ্লিকেটেড। এতবছরে ঘেঁটে গেছে সব। আমরা একে অপরের জন্য সুইটেবল না। যতবার কাছাকাছি এসেছি ততবারই চুম্বকের বিকর্ষণ শক্তির মত ছিটকে পড়েছি। বিচ্ছেদ আমাদের নিয়তি। পরিস্থীতি বদলে গেছে, যতই ভালোবাসা থাকুক না কেন। সম্পর্কের বাঁধন আর বাঁধা যাবেনা। আমরা চাইলেও এখন একে অপরকে ভালোবেসে কাছাকাছি থাকতে পারবোনা। কোন না কোনদিন ঘৃ*ণা আমাদের মাঝে আসবেই।’ 

প্রিয়’র কথার আগাগোড়া বুঝল না প্রভা। ভালোবাসা থাকলে ঘৃণা আসবে কেন? কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘ মানে?’

প্রিয় বেখেয়ালি হয়ে কথা গুলো বলেছিল। হুঁশ ফিরতে কথা ঘুরাল। বলল,

‘ এখানে ভালো লাগছেনা! আগামীকাল আমাদের সাথে ঢাকায় ফিরবি? বাবা মায়ের কাছে কিছুদিন থাকবি।’ 

নাকচ করল প্রভা। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিলো,

‘ না আপা। তোর ক্লাস, কাজ আছে তুই যা। আমি কিছুদিন পরে আসব। বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে সবে দুইদিন। দুজন এক সাথে চলে গেলে লোকে কানাঘুষা করবে। বাড়ির সবাই মন খারাপ করবে।’

মলিন হাসল প্রিয়। সে জানতো রাজি হবেনা।  স্বামীর সাথে যতই রাগারাগি থাকুক না কেন, মনের দিক থেকে সরল প্রভা। নিজের দায়িত্ব থেকে কখনো পিছুপা হবেনা। 

দুবোন আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করল। রাত গাঢ় হতে শুয়ে পড়ল। প্রভা ঘুমিয়ে গেছে। চোখে ঘুম নেই প্রিয়’র। নিকষ কালো অন্ধকার ঘরের জানালায় চেয়ে রইল। চাঁদের এক চিলতে আলো ছুঁইছে ঘর। চোখ চিকচিক করছে প্রিয়’র। মনেমনে ফিসফিস করে বলল,

‘ সে আমাকে ভালো না বাসুক! প্রচন্ডরকম ঘৃণা করুক। কারণ আমি জানি ভালোবেসে ঠকলে কতটা কষ্ট হয়।’

 

ভোরের আলো ফুটতেই হৈচৈ পড়েছে চেয়ারম্যান বাড়িতে। বড় ছেলে নতুন বউ নিয়ে ঢাকায় ফিরবে। হরেক রকম রান্না বান্না পিঠাপুলি বানাতে ব্যস্ত সবাই। প্যাকেট করে সাথে করে দিয়ে দিবে ঢাকায়। নতুন বউয়ের বিদায় দেখতে আশেপাশের লোকেরা জড় হয়েছে। অতিথি আপ্যায়নে বাড়ি মেতে। সমুদ্র সকাল থেকে প্রভার পিছুপিছু কথা বলার ফাঁক পেতে ঘুরছে। প্রভা বরাবরের মত এড়িয়ে চলছে। মাথায় এখনো জমে আছে রাগ। সমুদ্রের মুখ দেখে তা বেড়ে যাচ্ছে বারবার। দুপুরের খাবারের জন্য প্রিয়’কে ডাকতে প্রভা উপরে যাচ্ছিল অমনি পেছন থেকে ছুটে এসে সমুদ্র হাত টেনে ধরল। প্রভা হাত ছাড়াতে চাইল। সমুদ্র করুণ স্বরে বলল,

‘ কিছু কথা ছিল। সাথে চলো এক্ষুনি, প্লিজ!’

 বিরক্ত হলো প্রভা। দোতলা সিড়ির ধাপে দাঁড়ানো তারা। রাগী চাপা গলায় বলল,

‘ হাত ছাড়ো। দেখে ফেলবে কেউ।’

সমুদ্রের অকপটে উত্তর,

‘ ছাড়বোনা সাথে চলো।’

ফোস করে শ্বাস ফেলল প্রভা। গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ সবার সামনে ঝামেলা চাইছিনা। আমার রাগ পড়লে সে বিষয়ে কথা বলবো। আমাকে একা থাকতে দেও আপাতত।’

হাত ছাড়িয়ে চলে গেল প্রভা। হতাশ চোখে চেয়ে রইল সমুদ্র।

 

বিকালে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চড়ল প্রিয় শতাব্দ। ঢাকা ফিরতে ফিরতে রাত নামল। এপার্টমেন্টে ঢুকে প্রিয় ড্রাইং রুমে দাঁড়িয়ে পড়ল। গম্ভীর শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ কোনদিকে আমার রুম?’

খানিক বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শতাব্দ। বিস্ময় কাটিয়ে বলল,

‘ আলাদা থাকবে তুমি?’

প্রিয়’র ঋজু অকপটে আওয়াজ,

‘ এটা নিয়ে আমাদের আগেই কথা হয়েছিল।’

শুনেও শুনল না শতাব্দ। সোজাসাপটা কন্ঠে বলল,

‘ আমার ঘরে থাকবে তুমি। ভয় নেই স্পর্শ করব না।’

গলা নরম হয়ে এলো প্রিয়। চোখ জোড়া ভারী। কন্ঠ শক্ত করে বলল,

‘ আমি আলাদা থাকব। আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।’

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল শতাব্দ। বলল,

‘ সিরিয়াসলি! তোমার আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না প্রিয়?’

‘ না! আপনি আমাকে আলাদা ঘর দিবেন নাকি আমি বেরিয়ে যাবো?’

খানিক রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে চাবিটা টি টেবিলের উপর  আছড়ে রেখে চলে গেল শতাব্দ।

চাবি নিয়ে পাশের রুমের দরজা খুলল প্রিয়। অনেকদিনের বন্ধ ঘর এলোমেলো অগোছালো। গোছাতে গোছাতে রাত গভীর হলো। তখনকার ঘটনার পর শতাব্দকে দেখেনি আর। নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে সে।

গভীর রাতে দরজা খুলল শতাব্দ। প্রিয়’র জন্য খাবার সাজিয়ে ঘরে আসতে দেখল ঘুমিয়ে গেছে। পাশে যেয়ে বসল। শরীরে চাদর টেনে দিয়ে। ঘুমন্ত প্রেয়সীর মুখপানে নিমিষ চেয়ে রইল। আদুরে হাতে চুল গুছিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল,

‘ যত ইচ্ছা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো, আমি একটুও রাগ করবোনা প্রাণপ্রিয়। তুমি আমার। তোমার রাগ, জেদ, ভালোবাসা সবটাই আমার। শুধুই আমার।’

প্রিয়’র আদুরে মুখখানা টানছে তাকে। নিমগ্ন হয়ে তার দিক এগিয়ে গেল। কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিলো।

 

চলবে……….

 

ফিলোফোবিয়া

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

 

৩৫.

 

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ)

 

পর্দার আড়াল হতে উপচে আসা রোদ, চোখে পড়তে নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। আধো আধো চোখ মেলে আশেপাশে চাইল। অন্ধকার ঘরে এক ফালি রোদ এসে ছুঁইছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। তড়বড়ে হাতে বিছানায় মোবাইল খুঁজল। বালিশের পাশেই পেল। ঘড়িতে আটটা বাজছে। হেলেদুলে বিছানা ছাড়ল। ফ্রেশ হয়ে আলতো পায়ে শতাব্দের ঘরের সামনে গেল। ঘরে নেই শতাব্দ। এতো সকাল সকাল কোথায় গেল? আনমনা হয়ে ড্রাইং রুমের দিক এলো। কড়াই, খুন্তির আওয়াজে চমকে উঠল। রান্না ঘরে ধোঁয়া উড়ছে। কেউ রান্না করছে। কে করছে? শতাব্দ! আশ্চর্য মুখভঙ্গি নিয়ে সেদিকে পা বাড়াল। রান্নাঘরের দরজার সামনে যেতে চমকে উঠল। সেখানে মাঝবয়েসী একজন মহিলা রান্না করছে।

প্রিয়’র উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনে ফিরলেন তিনি। এক গাল হেসে বলল,

‘ কিছু লাগবো ম্যাডাম?’

হতভম্ব স্বরে প্রশ্ন করল প্রিয়,

‘ আপনি কে?’

কপালের ঘাম মুছে হাসি হাসি মুখ করে বলল,

‘ আমি রহিমা। এই ছুসাইটির দারোয়ানের বউ। অনেক বছর এখানে কাজ করি। রান্নাবান্না, ঘর গোছানো সব করি। পোলাও গোস্ত সব রান্না পারি।’

মাথা নাড়াল প্রিয়। ঠোঁট গোল করে বলল, ‘ওহ’

রহিমা আবারও জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনার কিছু লাগবো ম্যাডাম?’

দুদিকে মাথা নাড়াল প্রিয়। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,

‘ উনি কই?’

‘ কে শতাব্দ স্যার?’

মাথা ঝাঁকাল প্রিয়। রহিমা বলল,

‘ স্যার তো চইলা গেছে।’

অবাক হলো প্রিয়। ঘড়ির দিক চাইল। সবে আটটা বিশ। হতভম্ব হয়ে বলল,

‘ এতো তাড়াতাড়ি!’

‘ স্যার সবসময় এইসময়ই যায়। সকাল বেলা অফিস আদালতের সময় জ্যাম থাকে। তাই তাড়াতাড়ি বাইর হয়।  কেন জানেন না আপনি? কইয়া যায় নাই?’

লজ্জায় পড়ে গেল প্রিয়। নিজের স্বামীর খবর বাড়ির কাজের লোক থেকে শুনতে হয়। চুপ করে রইল। রহিমা মৌনতার কারণ বুঝল হয়তো। বলল,

‘ মন কষাকষি চলতাছে বুঝি। ব্যাপার না নতুন বিয়া হইলে হয়। আমগো বিয়ার বিশ বছর। তেনার সাথে এখনও ঝামেলা হয়। দিনের বেলা হাজার ঝামেলা মা*রামারি কা*টাকা*টি যাই থাকুক রাইতে বিছানায় আইলে মিটা যায়। পুরুষ মানুষ তো।রাগ কইরা আর কতক্ষণ থাকবো।’

লজ্জায় মাখোমাখো হয়ে গেল রহিমা। কথা এড়াতে চাইল প্রিয়। বলল,

‘ উনি নাস্তা করে গেছে?’

‘ এক কাপ চা খাইয়া গেছে শুধু। আপনারে নাস্তা দিমু ম্যাডাম?’

মাথা নাড়াল প্রিয়। রহিমা রান্নাঘরের দিক পা বাড়াল। পেছন থেকে ডাকল প্রিয়। রহিমা থেমে গেল। পিছনে ফিরল। বলল,

‘ কিছু বলবেন ম্যাডাম?’

প্রিয় গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ আমাকে ম্যাডাম বলবেন না। আমার নাম ধরে তুমি করে ডাকবেন খালা।’

ছলছল করে উঠল রহিমার চোখ। ঢাকা শহরে এসেছে এতবছর! আজ অবধি এভাবে বলেনি কেউ। গরিব বলে বড়ঘরের লোকেরা দূরদূর করে তাড়িয়েছে সবসময়। প্রিয়’র মুখে ‘খালা’ ডাক শুনে অদ্ভুত এক টান জন্মাল। মনের কোণে প্রিয়’র প্রতি সম্মানটা আরো বাড়ল। 

 

ক্লাসের জন্য রেডি হয়ে বাহিরে বের হতে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এলো। গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে কিন্তু কিন্তু করে বলল,

‘ স্যার গাড়িতে যেতে বলেছে ম্যাডাম।’ 

কপাল কুঁচকে তাকাল প্রিয়। জিজ্ঞেস করল,

‘ উনি গাড়ি করে যায়নি?’

‘ জি। স্যারকে পৌঁছে দিয়ে মাত্রই ফিরছি।’

‘ ওহ’ 

উবার আসতেই সামনের দিক পা বাড়াল প্রিয়। ড্রাইভার পেছন থেকে ডাকল। কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করল,

‘স্যারকে কি বলব ম্যাডাম?’

‘ আপনার কিছু বলতে হবেনা। যা বলার আপনার স্যারকে আমি বলব।’

বলেই উবারে চড়ে চলে গেল প্রিয়।

 

কেবিনের বাহিরে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা ‘ ডা. আহসান খাঁন শতাব্দ। তখন দুপুর দেড়টা। লাঞ্চ ব্রেক। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে শতাব্দ। চোখমুখ ক্লান্ত ভীষণ। ছুটিতে অনেক কাজ জমেছে। রোগী দেখে আপাতত ভীষণ ক্লান্ত সে। মোবাইল বের করতে, ড্রাইভারের অনেক গুলো মিসকল দেখল। কল ব্যাক করে ড্রাইভারের কাছ থেকে সকালের ঘটনা শুনল। কপালে হাত বুলিয়ে, হতাশ শ্বাস ফেলল শতাব্দ। মাথা ধরছে প্রচন্ড। কিভাবে ফিরে পাবে তার সেই প্রিয়। লোকে নাকি বউ নাচায়? অথচ তার সাথে ঘটছে উল্টো। আজকাল নিজেকে নিরুপায় লাগে প্রচণ্ড। যেখানে পুরো গ্রামের লোক, সিনিয়র, জুনিয়র তার ইশারায় চলে। সেখানে নিজের বউ তার অবাধ্য। জোর খাটিয়ে যদি প্রিয়’কে পাওয়া যেত, কবেই না পেয়ে যেত। কিন্তু তা সম্ভব না। মনের ব্যাপার গুলো ভীষণ নাজুক হয়। এখানে ক্ষমতা, জোরজবরদস্তি কিছুই খাটে না। ভালোবেসে-ই ভালোবাসা পাওয়া যায়। যদিও তা অনিশ্চয়!

কিছু একটা ভেবে মোবাইল হাতে নিলো শতাব্দ। ফেসবুকে লগইন করতেই দেখল নোটিফিকেশন। লাইভে এসেছে প্রিয়।পড়নে ড্রার্ক পিংক ঢাকায় জামদানী শাড়ি। হাত ভর্তি কাচের চুরি। নিদারুণ সেজে ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে। বেশ গুছিয়ে সুন্দর করে মন্তব্যের উত্তর দিচ্ছে,শাড়ির কোয়ালিটি ম্যাটেরিয়াল নিয়ে বলছে। মাঝেমাঝে কথার ফাঁকে আনমনা হাসছে। বিয়ের পর এই প্রথম প্রাণ খুলে হাসতে দেখছে। কি দারুণ লাগছে এই হাস্যোজ্জ্বল প্রিয়’কে। 

মাঝেমধ্যে খুব রাগ হয় শতাব্দের, প্রিয়’র ভিউয়ার’সদের প্রতি প্রচন্ড হিংসা হয়। সবার সাথে হাসছে প্রিয়, কই তার জন্য একটু হাসেনা। তার জন্য কেন সাজে না। কেন তাকে একটু ভালোবাসেনা! 

এক রাশ আক্ষেপ নিয়ে মোবাইলের স্কিনে আঙ্গুল ছোঁয়াল। কন্ঠে আফসোস জুড়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ তুমি আমার হয়েও, আমার হইলা না।’ 

 

সেদিনের পর পুরোপুরি বদলে গেছে প্রভা। আজকাল সমুদ্রের সন্দেহ হয়, ভীষণ চমকায়। সত্যি কি এটা তার-ই প্রভা? কথা বলা বন্ধ করেছে, বিছানা ছেড়েছে, শুধু ঘর ছাড়তে বাকি এখন। সম্ভব হলে ঘরটাও ছেড়ে দিতো বোধহয়। প্রভার এই রুষ্টতা মেনে নিতে পারছেনা সমুদ্র। অনেক তো হলো। আর কত? তার কথা একটাবার শুনুক অন্তত!

আটঘাট বেঁধে শক্ত হয়ে বসল সমুদ্র। যে করেই হোক, সামনা সামনি বসে প্রভার সাথে কথা বলে এর একটা বিহিত টানবে আজ।

রাতের খাবারের পর শাশুড়ীর হাতেহাতে সবকাজ গুছিয়ে ঘর ফিরল প্রভা। চৌকাঠ পাড় হতেই হাতে হেঁচকা টান পড়ল। ভারী আওয়াজে দরজা বন্ধ হলো। সবটা এত দ্রুত ঘটল যে, প্রভা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। শক্ত করে হাত চেপে ঝুকে আছে সমুদ্র। প্রভা হাত ছাড়াতে চাইল। শরীরের সব শক্তি মিলিয়ে ঠেলে সরাতে চাইল। পারল না। আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল সমুদ্র। প্রভা বিরক্তির কন্ঠ জুড়ে বলল,

‘ হাত ছাড়ো লাগছে আমার।’

সমুদ্রের অকপট আওয়াজ,

‘ লাগুক, ছাড়ব না হাত। আমার কথা শুনতে হবে আজ।’

‘ না শুনলে কি করবে তুমি?’ চাপা জিদ এঁটে বলল প্রভা।

‘ তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। তুমি শুনবে।’

প্রভা আরো বেশি রেগে গেল। হাত ঝাড়া দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সমুদ্র। আলতো স্বরে বলল,

‘ এতো ভালোবেসে, যুদ্ধ করে এমন ভবিষ্যৎ কি চেয়েছিলাম আমরা? এমন কিছুর তো কথা ছিলনা প্রভা!’ 

চিকচিক করে উঠল প্রভার চোখ। নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করার চেষ্টা করল। ভাঙ্গা সুরে বলল,

‘ তখন এই লুকোচুরি খেলার কথা যে জানতাম না।’

‘ সে আমার অতীত ছিল।’

‘ আমি তোমার জীবনের দ্বিতীয়জন, মানতে পারছিনা। তাকে এখনো ভালোবাসো? তাই বুঝি তার স্মৃতি আগলে রেখেছ!’ 

‘ আমার কালো অতীত সে। তুমি আমার একমাত্র।’

‘ অনেক দেরি হয়ে গেছে। মানতে পারছিনা আর।’

 চোখমুখে হাত ঢোলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুমি কি চাও এভাবেই চলুক। দুরত্ব বাড়ুক?’

‘ দুরত্ব বাড়িয়ে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়। বাড়ুক না! ক্ষতি কি। ‘

অনড় চেয়ে আছে সমুদ্র। খানিক চুপ থেকে প্রভা আলতো স্বরে বলল,

‘আমার কিছু সময় চাই আপাতত।’

সমুদ্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে, চাদর নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল প্রভা।

 

বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বাজল। দরজা খুলে বিমূঢ় শতাব্দ। অন্ধকারে বিলীন চারিপাশ। তবে কি প্রিয় বাড়ি ফিরেনি? কপাল কুঁচকে আলো জ্বা*লালো। ভেতরে এসে আরো বেশি চমকাল। সব ঘরের আলো বন্ধ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে, প্রিয়’র ফোনে ফোন করল। বাড়িতেই বাজছে কোথাও। মোবাইলের রিংটোনের অনুসরণ করে বারান্দায় গেল। ঝুলন্ত দোলনায় বইয়ের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে প্রিয়। স্বস্তির শ্বাস ফেলল শতাব্দ। এক গাল হাসল। 

বিয়ের এক সাপ্তাহ আগে বারান্দা রিডেকোরেট করিয়েছিল। কিছু গাছ এনেছে আর বড় একটা দোলনা ঝুলিয়েছে। দোলনা ঝুলা প্রিয়’র ভীষণ পছন্দ। ইমান্দিপুর প্রিয়’র নানা বাড়িতে দোলনা ছিল। সেখানে বসে সারাক্ষণ ঝুলতো। প্রিয়’র অবসর সময় এখানে কাটাবে বলে এসব করিয়েছিল। যাক কিছু তো পছন্দ হয়েছে ওর।

কয়েক কদম বাড়িয়ে দোলনার দিক এগিয়ে গেল। বইয়ের উপর মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে প্রিয়। পড়নে এখনো দুপুরে লাইভে পড়া সেই শাড়ি। মুখের মেকআপ তুললেও কাচের চুড়ি খোলা হয়নি। বাতাসে ঝনঝন করে বাজছে। চোখমুখ ক্লান্ত ভীষণ। রাতের খাবার খায়নি নিশ্চয়ই। 

 

কারো ডাকে পিটপিট চোখ মেলল প্রিয়। দুর্বল হাতে ভর দিয়ে, ভারী মাথা তুলে উঠে বসল। পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল! টেরই পায়নি। ঘোলাটে চোখ জোড়া স্পষ্ট করে সামনে তাকাল। শার্টের হাতা ফোল্ড করা, কিচেন এপ্রোন পড়ে দাড়িয়ে আছে শতাব্দ। নড়েচড়ে বসলো প্রিয়। নিজের দিক নজর পড়তেই বড়বড় হয়ে এলো চোখ। কৌটা থেকে বেরিয়ে আসবে যেন। শাড়ির পাড় হাঁটু অবধি ঠেকেছে, বুকের আঁচল খানিক ঝুলে। লজ্জায় চোখজোড়া বুজে এলো। তড়িঘড়ি হাত চালিয়ে শাড়ি ঠিক করল। ধুপধাপ পা ফেলে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ কখন এসেছেন আপনি?’

শতাব্দের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি আভাস। কন্ঠ শান্ত রেখে উত্তর দিলো,

‘ অনেকক্ষণ।’

‘ আমাকে ডাকেননি কেন?’ বিমূঢ় কন্ঠে বলল প্রিয়।

‘ ঘুমাচ্ছিলে। তাই বিরক্ত করিনি। রহিমা আন্টি কখন বেরিয়ে?’

‘ সন্ধ্যায়। যেতে চাচ্ছিল না। রাত হচ্ছিল তাই চলে যেতে বলেছি।’

‘ রাতে খাওয়া হয়েছে?’

‘ না’

‘ আমার আসার অপেক্ষা করছিলে?’

অস্বস্তিতে পড়ল প্রিয়। চোখমুখ স্বাভাবিক রেখে বলল,

‘ না, পড়ছিলাম খাওয়ার খেয়াল ছিলনা।’

হাসল শতাব্দ। বলল,

‘ খাবার রেডি চলো।’

কথা বাড়াল না প্রিয়। কুলি করে, হাত ধুয়ে চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল।আগেই ফ্রিজ থেকে সব নামিয়ে গরম করে টেবিল সেট করে রেখেছে শতাব্দ। কিচেন এপ্রোন খুলে প্রিয়’র সামনা সামনি চেয়ারটায় বসল। চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে প্রিয়। নিগূঢ় হয়ে শতাব্দের দিক চেয়ে আছে। ফোল্ড করা শার্টের হাতা, পরিপাটি মানুষটা সবকিছু গোছগাছ করে রেখেছে। ঠিক যেন জেন্টলম্যান!

 

প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে দিতে প্রিয়’র মুখপানে চাইল শতাব্দ। ভীষণ ক্লান্ত মুখ।  একদিনেই মুরছে গেছে চেহারা। ঘুমে লাল টলমলে হয়ে আছে চোখজোড়া। শতাব্দ বলল,

‘ পড়াশোনা কাজ এক সাথে চালিয়ে নিতে কষ্ট হলে। আপাতত কাজ থেকে ব্রেক নিতে পারো। ফাইনাল এক্সামের পর কন্টিনিউ করিও আবার।’

স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো প্রিয়,

‘ আমার কাজ আমার পরিচয়। প্রিয়’কে কেউ চিনেনা। অশীতা জাফর প্রিয়কে অনেকেই চিনে। যখন আমি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কলেজের পর বিষন্ন ভরা অবসর সময় পাড় করছিলাম, তখন আমার কলেজের প্রত্যাশা ম্যাম তাদের ছোট ব্যাবসা’র মুখ হতে অনুরোধ করলেন। উনার আর তার ছোটবোনের ব্যাবসা। উনাত নামেই ‘প্রত্যাশা শাড়ি ব্র্যান্ড’। প্রথমে রাজি না হলেও, বিষন্নতা গোছাতে রাজি হলাম। শুরুর দিকে শাড়ির মডেল হলেও আস্তে আস্তে লাইভ করতে শুরু করলাম। আমার কনফিডেন্স লেভেল বরাবরই শূন্যের কোটায়। প্রথম লাইভে ভীষণ এলোমেলো, অশান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি হার মেনে নিয়েছিলাম একপ্রকার । প্রত্যাশা ম্যাম তখন সাহস জোগা্ল। এক নতুন আমি’র সাথে আমার পরিচয় হলো।পরবর্তীতে ব্যবসা বড় হলো, ছোট ব্যবসাটা ‘প্রত্যাশা শাড়ি ব্র্যান্ড ‘ নামে পরিচিতী পেল। জনপ্রিয়তার তুখোড়ে পৌঁছাল। আমি হলাম ব্র্যান্ড প্রমোটর। প্রত্যাশা শাড়ি ব্র্যান্ড আমার পরিবারেরই অংশ। যদিও অন্যকাজের তুলনায় আমার কাজটা তুচ্ছ। তবুও আমার কাজই আমার সব।’

‘ কাজ থেকে বিরতি নিবেনা। জ্যামজটের শহর। ক্লাস কাজে দৌড়াদৌড়ি করো। অন্তত গাড়িটা নিয়ে তো যেতে পারো! ‘

‘ প্রয়োজন নেই। এর আগেও আমার জীবন চলছিল। বিলাসবহুল জীবন আমার চাইনা। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত চলতে পছন্দ করি।’

কাঠকাঠ হয়ে চেয়ে রইল শতাব্দ। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ আমার চিন্তা হয়। সারাক্ষণ ব্যাকুল থাকে মন।’

‘ কাজ ফেলে যদি আমার চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করে সারাক্ষণ। সেটা আপনার সমস্যা। আমার না।’

‘ তো তুমি গাড়ি ব্যাবহার করবে না?’

‘ না’ প্রিয়’র রুখা উত্তর।

বিরক্ত হলো শতাব্দ। খাওয়া হলো না আর। রাগ চেপে, আড়ষ্ট হয়ে চেয়ে রইল মুখপানে প্রিয়’র।

 

চলবে………

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

 

৩৬.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

সময় বহমান। কারো জন্য থেমে থাকেনা। দিন ঘুরে রাত নামছে। সাপ্তাহ ঘুরে মাসে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু সম্পর্ক গুলো তখনো এলোমেলো অগোছালো। প্রত্যেক সম্পর্কের ভিন্ন ভিন্ন সমীকরণ। দূর থেকে দেখতে সম্পর্কগুলো একইরকম হলেও, বিচ্ছেদের কারণ গুলো ভিন্ন। কারো কারো মাঝে হাজারো দূরত্ব, কারো আবার এক ছাদের তলায় থেকেও না ছুঁতে পারার আক্ষেপ!

 

ভালোবাসার মাস। চারিদিকে বসন্ত আগমনি গান। ডালে ডালে হলুদ সাদা নানারকম ফুল। প্রকৃতি নতুন রূপে সাজতে মশগুল।

উৎসব মুখর ভার্সিটির আঙ্গিনা। পহেলা ফাল্গুনের আয়োজন চলছে। সিনিয়র জুনিয়র সকলে একত্রে জড় হয়েছে। প্রিয় মুখখানার সন্ধানে চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে। না, এখানে নেই সে।আশেপাশে কোথাও দেখছে না তুরফাকে। প্রচন্ডরকম বিরক্ত হলো শাদ। মোবাইল বের করে ফোন করতে, দেখল বন্ধ। ঢুকছে না ফোন। তুরফা কি আবারো তার নাম্বার ব্লক করেছে? আচমকা শাদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হন্য হয়ে তুরফাকে খুঁজতে শুরু করল। আশেপাশে খোঁজ করে, ক্যানটিনের দিকে পা বাড়াল। সদর দরজায় দাঁড়াতেই তুরফাকে দেখল। পেছনের টেবিলে জড়সড় হয়ে বসে। নোট বানাতে ব্যস্ত। ক্ষিপ্ত পা চালিয়ে তুরফার সামনে চেয়ার টেনে বসল। 

শাদের উপস্থিতি ঠাহর করেও, মাথা তুলে চাইল না তুরফা। সম্পূর্ণ মনযোগ নিয়ে নোট বানাতে ডুবে আছে এখন।

তুরফার গম্ভীর মুখপানে নিমিষ চেয়ে শাদ। এতো এতো কৃত্রিমতার ভীড়ে , কোনরকম প্রসাধনী বিহীন সাদাসিধা সুশ্রী মুখ। মেয়েটার সাধারণ রূপই তাকে আরো বেশি অসামান্য করে বানায়। এইযে মেয়েটার গম্ভীরতা, রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা তাকে কতটা টানে সেই কথাটা কি মেয়েটা জানে? জানেনা। জানলে নিশ্চয়ই এভাবে তাকাত না।

কিছু সময় পিনপতন কাটল।গলা উঁচিয়ে শাদ ডাকল। তুরফা শুনেও, কানে তুলল না। রেগে গেল শাদ। তুরফার সামনের নোট খাতাটা টেনে নিলো। গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ সমস্যা কি তোমার! আমার কথা কানে যাচ্ছে না? ‘

চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে তুরফা কোন উত্তর দিলোনা। শাদের রাগ আরো বাড়ল। শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জার সব জায়গা থেকে ব্লক করেছ। ব্লাকলিষ্টে ফেলে রেখেছ। আমি কি তোমাকে খুব জ্বালাই?’

তুরফা এবার মুখ খুলল। চোখমুখে বিরক্তি এঁটে বলল,

‘ তোমাকে সহ্য হয়না। জাস্ট অসহ্য লাগে আমার!’

শাদ ক্ষে*পে গেল। পা দিয়ে তুরফার টেয়ার টেনে সামনে আনল। ভারী খড়খড় শব্দ হলো। তুরফার মুখের দিক ঝুঁকে গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ কি করেছি আমি? জোর করে চুমু খেয়েছি। নাকি বাজে ভাবে স্পর্শ করেছি?’

রাগে ফেটে পড়ল তুরফা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ দিন দিন অসভ্যতার মাত্রা ছাড়াচ্ছ। কি দারুণ! অপরাধ করে সাধু সাজছ। ছি আমার ভাবতেও অবাক লাগছে। নিজ স্বার্থে এত নিচে নামতে পারো তুমি?’

হতভম্ব শাদ। কন্ঠে বিস্ময় জুড়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ আশ্চর্য! আসার পর থেকে যা মুখে আসছে তাইল বলছ। কি করেছি তা বলবে তো অন্তত।’

অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে রইল তুরফা। রাগে চেচিয়ে বলল,

‘ তোমার তরফদারি করে আমাকে বুঝাতে প্রিয় আপাকে বলোনি?’

বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে শাদ। বিস্ময় কাটিয়ে বলল,

‘ উনাকে আমার হয়ে তরফদারি করতে কেন বলবো?’

‘ মিথ্যা বলবেনা প্লিজ। তুমি না বললে তো আপা এমনি এমনি বলেনি।’

শাদ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি বলেছে উনি?’

তুরফা খানিক চুপ থেকে শিথিল কন্ঠে বলল,

‘ গতরাতে আপার সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল। কথা বলার এক পর্যায় তোমার কথা তুলল। সম্পর্কটা নিয়ে আরেকবার ভাবতে বলল। এসব বলতে তুমিই বলেছ। তাইনা?’

শাদ হতভম্ব, গম্ভীর। প্রিয় সাথে তার দেবর ভাবির হলেও সম্পর্ক হলেও। এখন অবধি ঠিকঠাক ভাবে তার সাথে কথাটা পর্যন্ত বলেনি। সেখানে তার জন্য তুরফার কাছে তরফদারি করতে বলবে! অসম্ভব। শাদ আরো গম্ভীর হয়ে তাকাল। বলল,

‘ তোমার কি সত্যি মনে হয় উনাকে এসব বলেছি? আমি কি এতটাই দুর্বল যে, আমার জন্য আকুতি মিনতী করতে অন্য কাউকে পাঠাব!’

তুরফা চুপ। শাদ আবারো বলল,

‘ আমার আত্মীয় তোমার বোনকে মে*রেছে এই অযুহাত দেখিয়ে সম্পর্ক মানতে চাইছ না। তাহলে উনাকে কেন এত পছন্দ করো? যাকে আপা আপা বলে মুখে ফেনা তুলো সে এখন আমাদের পরিবারেরই একজন।’ 

তেতে গেল তুরফা। রেগে চেয়ার ছেড়ে উঠল। শাদের দিক ঝুঁকে বলল,

‘ তোমার এখনো অযুহাত মনে হয়? এই বিশ্বাস করো আমায়।’

তাচ্ছিল্য হাসল তুরফা। ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,

‘ প্রিয় আপা তোমাদের পরিবারের অংশ হয়েও, তোমাদের কেউনা। এই বিয়ের পেছনে বড় উদ্দেশ্য আছে আপার। সে আমাকে কথা দিয়েছে, ন্যায় বিচার এনে দিবে।’

ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল তুরফা। চেয়ারে হতভম্ব হয়ে বসে রইল শাদ। তুরফার বলা কথা গুলো যদি সত্যি হয়। তাহলে, কি উদ্দেশ্যে এসেছে প্রিয়? কেন-ই বা শতাব্দকে বিয়ে করল।

 

ভার্সিটিতে ক্লাস ছিলনা আজ। সকাল সকাল অফিসে চলে গেছিল। পহেলা ফাল্গুন আজ। বেশ কয়েকটা লাইভ, ইভেন্ট ছিল। সব কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হলো। টি টেবিলে ব্যাগ রেখে, চোখ বুজে গা এলিয়ে দিলো সোফায়। ক্লান্তিতে ম্যাচ ম্যাচ করছে গা। অমনি ভেতর ঘর থেকে শতাব্দ এলো। হাতে ফোন। শতাব্দের আঁচ পেয়ে চোখ খুলল প্রিয়। শতাব্দ ফোন এগিয়ে দিলো। বলল,

‘ তোমার জন্য ফোন।’

ভ্রু কুঁচকে নিলো প্রিয়। ফোন কানে ধরতে অপর পাশ হতে রিক্তা বলল,

‘ কেমন আছো প্রিয়? রাতে ডিনারে তোমরা আসছো তো?’

প্রিয় হতভম্ব দৃষ্টিতে শতাব্দের মুখপানে চাইল। ডিনারের কথা আগে বলেনি শতাব্দ। প্রিয়’র ক্লান্ত চোখমুখ দেখে শতাব্দ রিক্তাকে না করতে যাচ্ছিল, অমনি প্রিয় কথা কে*টে হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলল,

‘ ভালো। আপনি কেমন আছেন? জি আপু আমরা আসছি।’

দুজনের আরো কিছু কথা হলো। কথা শেষে ফোন রাখতে শতাব্দ বলল,

‘ মেডিকেল ফ্রেন্ডদের গেট টুগেদারের আয়োজন। তুমি ক্লান্ত। ডিনারে যাওয়াটা জরুরী না। তুমি যেতে না চাইলে কোন বাহানা দিয়ে স্কিপ করতে পারি।’

‘ স্কিপ করার দরকার নেই। যেতে চাইছি আমি।’

‘ আর ইউ শিয়োর?’

প্রিয় মাথা নাড়াল।

খুব অল্প সময়ে প্রিয় তৈরি হয়ে এলো। ড্রইং রুমে আগে থেকে তৈরি হয়ে প্রিয়’র অপেক্ষায় বসে ছিল শতাব্দ। উঁচু হিলের ঠকঠক আওয়াজে শতাব্দের ঘোর কা*টল। ফোন থেকে চোখ উঁচিয়ে সামনের দিক চাইল। কালো মসলিন শাড়ি পড়ে, চোখে গাঢ় কাজল ল্যাপে, ঠোঁট মেরুন লিপস্টিকে রাঙিয়ে  চমৎকার সেজে। চুলের খোপা ঠিক করতে করতে এদিকে আসছে প্রিয়। মন্ত্রমোহের মত উঠে দাঁড়াল শতাব্দ। প্রিয়’র মুখপানে নিগূঢ় চেয়ে রইল। ছোট ছোট পা চালিয়ে শতাব্দের সামনে এসে দাঁড়াল।

 দু’কদম এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল শতাব্দ। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। চোখজোড়া নামিয়ে নিলো। শতাব্দ আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হলো।প্রিয়’র খোপার ক্লিপ খুলে দিলো। সুড়সুড় করে লম্বা কেশ কোমর গড়িয়ে পড়ল।চুলে আলতো হাত চালিয়ে, ছাড়িয়ে দিলো শতাব্দ। কানের কাছে চুল সরিয়ে, মুখ এনে মৃদু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ নাও পার্ফেক্ট।’

প্রিয় যেন থমকে গেল। ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল।স্মিত হাসল শতাব্দ। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘ তুমি চাইলে ডিনারে না গিয়ে, আমরা এখানে নিজেদের  ব্যক্তিগত  সময় কা*টাতে পারি।’

প্রিয় নড়েচড়ে উঠল। বড়বড় পা চালিয়ে আগে আগে রওনা হলো। পেছন থেকে হেসে ফেলল শতাব্দ।

 

ঢাকার নামীদামী রেস্তোরাঁয় রিজার্ভেশন করা ছিল। সবাই অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। প্রিয়দের যেতে দেরি হলো। রিক্তা    ছাড়া আশেপাশে সকলেই অচেনা। বান্ধুবী ইরার বড় বোন রিক্তা। সেই সুবাদেই রিক্তাকে মোটামুটি চেনা। বন্ধুমহলে সবার সাথে এক এক করে পরিচয় করিয়ে দিলো শতাব্দ। সকলেই প্রিয়’কে দেখে হতভম্ব। মাঝের থেকে অঞ্জন বলে উঠল,

 

‘ এর আগে তোমার সাথে দেখা না হলেও, আমরা সবাই তোমার সাথে পরিচীত। আমাদের কাছে রূপকথার নায়িকা তুমি। হোস্টেলে থাকা কালিন নিয়ম করে রোজ দুইবেলা তোমার গল্প শুনেছি। কি সাহসী, কি অকপটে মেয়ে ছিলে তুমি! ‘

অবাক চোখে শতাব্দের মুখ পানে চাইল প্রিয়। শতাব্দের নিগূঢ় চাহনি, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। পাশ থেকে রিক্তা বলল,

‘ কত আগে থেকে তোমাকে চিনি। অথচ জানতাম না, যে তুমিই আমাদের ডক্টর শতাব্দের প্রাণপ্রিয়! অনেক গল্প শুনেছি তোমার। সত্যি তুমি মনমুগ্ধকর।’

অঞ্জন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কথা কা*টলো শতাব্দ। কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। শতাব্দের লুকোচুরি ধরতে পেরেও সবার সামনে কিছু জিজ্ঞেস করল না প্রিয়।

 

ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা চল্লিশ। অঞ্জনের ঘাড়ে ভর দিয়ে চোখজোড়া ছোট ছোট করে আলতো চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। 

শতাব্দকে ড্রাংক দেখে হতভম্ব প্রিয়। ছেলেরা আলাদা আড্ডা দিচ্ছিল। সেই আড্ডায় ড্রিংকস ছিল জানা ছিলনা প্রিয়’র। শতাব্দের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে চুল ছিড়ে ফেলতে এখন। ক্রু*দ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। অঞ্জন আমতা আমতা করে বলল,

‘ ওর কোন দোষ নেই। বিকাশ! বেটা ফাজিল নতুন জামাই বলে বলে ধরে বেঁধে খাওয়াল। বেটা জানে শতাব্দের পেটে এসব পঁচা পানি সয়না। দু প্যাঁক মা*রতেই হুঁশ হারায়। তবুও এসব।’

এতটুকু বলে থেমে গেল। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রিয়। বাড়ি ফিরবে কি করে এখন? শতাব্দ ড্রাংক, ড্রাইভারকেও সাথে আনেনি। 

অঞ্জন হয়তো বুঝল। বলল,

‘ সমস্যা নেই ভাবি, আমি বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি। ওই রোডেই আমার বাড়ি।’

স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। শতাব্দকে নিয়ে গাড়ির পেছনে সিটে বসলো। প্রিয়’র কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে শতাব্দ। বিড়বিড় করে কিছু বলছে আলতো। রাত বেশি হওয়ায় রাস্তাঘাট খালি প্রায়। মিনিট বিশেকে পৌঁছে গেল বাসায়। শতাব্দকে ঘর অবধি  ছেড়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল অঞ্জন।

অঞ্জন চলে যেতেই সদর দরজা বন্ধ করে শতাব্দের ঘরে এলো। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে শতাব্দ। প্রিয় বিরক্ত হলো। এমন অবস্থা হবে আগে জানলে কখনো যেত না প্রিয়। একজন মানুষের কন্ট্রোল লেভেল এতটা ডাউন  কি করে হয়। 

কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। কোমরে শাড়ির আঁচল গুজে বিছানায় উঠে শতাব্দকে ঠিকঠাক শুয়িয়ে দিলো। পায়ের জুতা খুলে দিয়ে শরীরে চাদর টেনে যেই নিজের ঘরের দিক যেতে পা বাড়াল। অমনি শতাব্দ খপ করে পেছন থেকে হাত টেনে ধরল। বিমূঢ় মুখ নিয়ে প্রিয় পেছনে ফিরল। আধোআধো চোখে চেয়ে আছে শতাব্দ। আচমকা হেঁচকা টান দিলো। প্রিয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শতাব্দের বুকে যেয়ে পড়ল। হতভম্ব প্রিয় তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলে শতাব্দ আরো বেশি চেপে ধরল। কাছাকাছি মুখ এনে নিগূঢ়, মিহি কন্ঠে বলল,

‘ আজকের রাতটা এখানে থেকে যাও।’ 

বড় গোল গোল চোখ করে চেয়ে রইল প্রিয়। শতাব্দের চোখে গভীর ঘোর। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। সুস্থ স্বাভাবিক শতাব্দকেই তার প্রচন্ড ভয় হয়। এখন তো পুরোপুরি বেঘোরে সে। নিজেকে ছাড়ানো যথাসম্ভব চেষ্টা চালাল প্রিয়। কাজ হলো না। আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। স্বাভাবিক থাকলে কয়েকটা কড়া আঘা’ত করে কথা বলে রাগিয়ে, নিজেকে ঠিক ছাড়িয়ে নিতো। কিন্তু এখন রাগিয়ে দেওয়া মোটেও উচিত নয়। হিতের বিপরীত হবে উল্টো। অনেক চেষ্টা চালিয়ে কোন কায়দা করতে পারল না প্রিয়। ভারী-ভারী চোখ তুলে মুখপানে তাকাল শতাব্দ’র। শতাব্দ নাছড়বান্দা নিমিষ চেয়ে। প্রিয় ঢোক গিলল ভীতু স্বরে বলল,

‘ আমাকে ছেড়ে দিন। ঘুম ধরেছে, ঘরে যেয়ে ঘুমাব।’

শতাব্দে গাঢ় আওয়াজ,

‘ এটা কি ঘর না?’

‘ ছাড়ুন। আমি আমার ঘরে যাবো।’

‘ ছাড়বোনা। পারলে ছাড়িয়ে যাও।’

অসহায় হয়ে চেয়ে রইল প্রিয়।

 শতাব্দ বুক থেকে নামিয়ে প্রিয়’কে পাশে শুয়িয়ে কোমরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নিজের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ করে মিশিয়ে নিলো। এবার প্রিয় আরো বেশি ঘাবড়ে গেল। এক ধ্যানে নিগূঢ় চেয়ে আছে শতাব্দ। মনে অদ্ভুত এক অস্বস্তি হতে শুরু করল। থরথর করে কাঁপছে হাতপা। শতাব্দ আরো ঝুঁকে এলো। তার তপ্ত নিশ্বাস মুখে পড়ছে প্রিয়’র। থরথরে কাঁপতে থাকা প্রিয় খানিক সাহস করল। আধোআধো স্বরে বলল,

‘ অস্বস্তি হচ্ছে। এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?’

হাসল শতাব্দ। কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে, প্রিয়’র ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ কেমন করে তাকিয়ে আছি প্রিয়?’

ভয়ে ঢোক গিলল প্রিয়। এই শতাব্দকে কি করে সামলাবে এখন!

 

চলবে…….

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

 

৩৭.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

গভীর রাত। ঘর জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। খোলা জানালা দখিনা বাতাস। আকাশ জুড়ে তারার মেলা। চন্দ্রসুধায় ভুবন ছেয়ে। বারান্দার দোলনা দুলছে, বাতাসে শুভ্র গন্ধরাজের মাদকতা মিলিয়ে।

আঁধারে ডাকা ঘরটায় উষ্ণ নিশ্বাসের ভারী আওয়াজ।চাদর খামচে চোখ বুজে শক্ত শিথিল হয়ে শুয়ে আছে প্রিয়। শতাব্দ তার গলার গভীরে মুখ ডুবিয়ে। উত্তপ্ত নিশ্বাস, ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়ায় কেঁপে উঠছে প্রিয়। সেদিকে কি ধ্যান আছে বেহোঁশ শতাব্দ’র। বুকের গভীরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে প্রিয়’কে। আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। চোখে অঢেল ঘোর, গভীর নেশা মাখিয়ে।

প্রিয় কাঁপছে। হাত পা নড়ছে থরথর। শতাব্দের গাঢ় স্পর্শ তার শক্তপোক্ত আবরণকে ভেঙ্গে, ঘুড়িয়ে, মিলিয়ে দিচ্ছে। খোলস ছাড়িয়ে টেনে আনছে সেই পুরানো দুর্বল প্রিয়’কে।

 কাঁপাকাঁপি হাতটা শতাব্দের ঠোঁটের কাছে ধরল প্রিয়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা সুরে বলল,

‘ প্লি..প্লিজ থামুন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার।’

থেমে গেল শতাব্দ। মাথা উঁচিয়ে মুখপানে চাইল প্রিয়’র। চন্দ্রসুধা এসে তার চোখেমুখে পড়ছে। হরিণটানা চোখজোড়া টলমল করছে। রক্তিম লিপস্টিক ঠোঁটের চারপাশে ছড়িয়ে। অগোছালো কেশ বালিশের উপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে কপালের চুল গুলো গুছিয়ে দিলো শতাব্দ। দুগালে হাত রেখে কপালে গভীর ঠোঁট ছুঁয়িয়ে প্রিয়’র বুকে মাথা রাখল। ঘর জুড়ে পিনপতন নীরবতা। প্রিয় তখনো অস্বাভাবিক রকম অস্থির, কাঁপছে। আকুতির স্বরে বিড়বিড় করে বলল,

‘ এমন কেন করছেন? আপনি বেহোশ! রাত পোহাতে সব ভুলে যাবেন। আমি কি করে ভুলব?’

গলায় নাক ঘোষতে ঘোষতে শতাব্দ নিগূঢ় সুরে বলল,

‘ ভুলতে কে বলেছে? সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে টেনে নেও কাছে।’

‘ কেন অবুঝ হচ্ছেন?’

‘ নিজের বিয়ে করা বউকে আদর করাতে অবুঝের কি দেখলে?’

চাপা রাগ হলো প্রিয়’র। অধৈর্য হয়ে বলল,

‘ আমাকে ছাড়ুন! যেতে দিন।’

শতাব্দের নিমিষ গভীর আওয়াজ,

‘ পারবো না ছাড়তে। ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। তুমি যে সোনার হরিণ!’

প্রিয় চুপ। শতাব্দ বলল,

‘ এতটা বছর আমি ভালো ছিলাম না প্রিয়। একটু ভালো ছিলাম না। তোমার শূন্যতায় আমিও পুড়েছি। আমার সকল সাফল্য তুমিহীন বৃথা। আমার প্রত্যেকটা দিন তুমিহীন ছিল মুশকিল!’

একটু চুপ থেকে আবারো বলতে লাগল,

‘ তোমার আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে আছে প্রিয়?’

প্রিয়’র টলমল চোখ। খানিক সময় নিয়ে ছোট ঢোক গিলে বলল,

‘ মেলায়। আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম।’ 

মৃদু হাসল শতাব্দ। বলল,

‘ উহু তার আগে।’

বিস্মিত স্বরে প্রিয় জিজ্ঞেস করল,

‘  মানে! তার আগে আমাদের কোথায় দেখা হয়েছিল?’

‘ তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম দুইহাজার নয়ের গ্রীষ্মের কোন এক পড়ন্ত বিকালে। ঢাকা থেকে মাত্রই ফিরেছিলাম বাড়িতে। ভাপসা গরমে চারিদিক চৌচির। সূর্যের তাপ তখন কমেছে সবে। চারিদিকে র*ক্তিম আলো ছড়িয়ে। মাথায় ঠান্ডা পানি ঢেলে ফ্রেশ হতে বারান্দায় যেতে হ্ঠাৎ হাসির রোল বাজলো কাছে। আওয়াজের সুত্র খুঁজতে চোখ পড়ল পাশের বাড়ির ছাদে। এক ঝাঁক মেয়ে সেখানে। নাচ গান আড্ডা দিচ্ছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলাম, অমনি চোখ আটকে গেল এক কিশোরীতে। খুব সুন্দর করে হাত পা নাড়িয়ে ক্লাসিকাল ড্যান্স করছে। সাদা গ্রাউনটা গোল হয়ে রাউন্ড রাউন্ড ঘু্রছে, লম্বা খোলা কেশ বাতাসে দুলছে। কয়েক স্টেপ করেই থেমে গেল মেয়েটা। খিলখিল করে হেসে ফেলল। আমি থমকে গেলাম, স্তব্ধ হয়ে বিমূঢ় চেয়ে রইলাম। কতক্ষণ চেয়ে ছিলাম জানিনা। তবে , সেই মুখখানায় চেয়ে নির্দ্বিধায়  এক যুগ কাটিয়ে দেওয়া  যায়। তার আগেও অনেক সুন্দরী দেখেছি। কিন্তু সেই সুশ্রী মুখখানায় অন্যরকম অদ্ভুত টান ছিল। টানা চোখজোড়ায় মাদকতা মেশানো ছিল। সরু ঠোঁটের কোণে ভুবন ভুলানো এক চিলতে হাসি। নির্দ্বিধায় তাকে বলাই যায় অন্যন্য সুন্দরী! হ্ঠাৎ তার সাথে চোখাচোখি হতেই ঘাবড়ে গেল সে। কপাল কুঁচকে মিলিয়ে নিলো হাসি। গুটিসুটি হয়ে কায়দা করে আড়াল করে নিলো নিজেকে। 

সেই মুখখানা আমার মস্তিষ্কে গাঢ় ছাপ এঁকে দিয়েছিল। সেইদিন থেকে আজ অবধি তাকে ভুলতে পারিনি। হ্যাঁ প্রিয়, তুমি হয়তো ভুলে গেছ। কিন্তু আমি কোনদিন সেই বিকালটাকে এক মুহূর্তে’র জন্যেও ভুলতে পারিনি।’ 

শতাব্দের কথা লেগে লেগে আসছে। বুজে আসছে চোখ। প্রিয়’র দিক হাত বাড়াল। মুখ ফিরিয়ে নিলো প্রিয়। চোখের কোনে জল জমেছে তার। কন্ঠ ধরে আসছে। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। কাঁপা কাঁপা সুরে বলল,

‘ কেন এসেছিলেন আমার জীবনে? আপনার ভালোবাসাকে আমার ভয় হয়। প্রচন্ড ভয়!’

শতাব্দের করুন আকুতি,

‘ ভালোবাসি। একটু ভালোবাসো! দেখো, তোমার তৃষ্ণায় ক্ষণে ক্ষণে মরছি প্রিয়।’

‘ অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভালোবাসা হবেনা আর!’

প্রিয়’র চোখের কোন বেয়ে পানি ঝরল। শতাব্দের দূর্বল চোখ বুজে বুজে আসছে। হাত বাড়িয়ে দিলো। প্রিয়’র চোখ মুছতে চাইল তার আগেই বিছানায় ঢলে পড়ল। খানিক বাদে কেশে উঠল। প্রিয়’কে ছেড়ে কাশতে কাশতে উঠে বসল। ফ্লোরে পা রাখতে পড়ে গেল। মুখ ভরে বমি করে মাখিয়ে ফেলল ফ্লোর। হতভম্ব প্রিয়। ধরফড়িয়ে বিছানা থেকে নামল। শতাব্দের পাশে যেয়ে বসলো। আ*তঙ্কিত চোখমুখ। আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,

‘ আপনি ঠিক আছেন?’

হা, না উত্তর দিলো না শতাব্দ। থম মে*রে বসে রইল। প্রিয় বুঝল ঘোর কাটেনি। শরীর দুর্বল। কোনরকম ধরে বুঝিয়ে শতাব্দকে বিছানায় বসালো। পানি এনে শতাব্দকে পরিষ্কার করে কাপড় পাল্টে। ঘর মুছে পরিচ্ছন্ন করে চলে গেল। কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল, শুয়ে পড়েছে শতাব্দ। হাত পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে। তার শীত করছে কি? হয়তো। গায়ে চাদর মেলে দিতে গিয়ে থমকে গেল প্রিয়। জ্বরে পু*ড়ছে গা। তড়িঘড়ি করে কপালে হাত রাখল। প্রচন্ড গরম। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। কি করবে এখন? তাড়াতাড়ি করে ভেজানো কাপড়ে শরীর মুছে দিলো। ঘুমের ঘোরে শতাব্দ প্রিয়কে নিজের কাছে টেনে নিলো। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রাখলো। বাঁধা দিলো না প্রিয়। নিমিষ চেয়ে রইল শতাব্দের ঘুমন্ত মুখখানায়। বিড়বিড় করে বলল,

‘ একবুক ভালোবাসা নিয়ে আমার আঘা*ত সইতে পারবেন তো?’

 পাশে বসে থেকে সারারাত জেগে কপালের জলপট্টি বদলে দিলো। ভোরের দিক শতাব্দের জ্বর নামল।

 

রাতের আঁধার চিড়ে উজ্জ্বল ভোর নেমেছে ভুবনে। রান্নাঘরে টুকটাক আওয়াজ। এক চুলায় চায়ের পানি ফুটছে অন্য চুলায় বেগুন ভাঁজা হচ্ছে। খাবারের ঘ্রাণে ঘর মোমো করছে। ব্যস্ত হাতে প্রিয় বেগুন ভাঁজা উল্টে দিচ্ছে। আচমকা এক জোড়া হাত কোমর চেপে ধরল শক্ত করে। প্রিয় কেঁপে উঠলেও চোখেমুখে বিস্মিয় ফুটতে দিলোনা। বাম হাতে ছাড়াতে চাইল একবার। শতাব্দের শক্তির সাথে পারল না। হাল ছেড়ে শব্দ করে খুন্তি রাখল। পেছনে ফিরে। গম্ভীর মুখ করে শতাব্দের কপালে হাত ছুঁয়ে দেখল। জ্বর নেই এখন। তারপর আবার ঘুরে কাজে হাত লাগালো। শতাব্দ ঠোঁট মেলে হাসলো। আবারো প্রিয়’র কোমর চেপে ধরল। কানের কাছে মুখ এনে আলতো স্বরে বলল,

‘ সরি! হবেনা আর।’  

কন্ঠে রাগ এঁটে প্রিয় বলল,

‘ কন্ট্রোল করতে না জানলে সেই জিনিস না খাওয়াই ভালো।’

দুষ্ট হাসল শতাব্দ। বলল,

‘ সব এনার্জি তো বউ সামলাতেই লেগে যায়। কন্ট্রোল করতে কি করে জানবো।’

রাগী চোখে তাকাল প্রিয়। উত্তর দিলো না কোন। শতাব্দ আশেপাশের তাকিয়ে দেখল, ভুনা খিচুড়ি, আলু গরুর গোস্ত, ভর্তা সব রান্না সাজানো। চুলায় বেগুন ভাঁজা হচ্ছে। সবকিছুই শতাব্দের পছন্দের।

শতাব্দ চমকাল। বিস্ময় সুরে বলল,

‘ এত ভালো রান্না জানো জানতাম না তো।’

প্রিয়’র আড়ষ্ট গম্ভীর উত্তর,

‘ কারণ আপনি জানতেই চাননি কখনো।’

শতাব্দ প্রিয়’র দিক চেয়ে রইল। প্রিয় চুলা বন্ধ করে গোছগাছ করতে করতে বলল,

‘ ফ্রেশ হয়ে আসুন। আপনাকে খাবার দিয়ে, ভার্সিটিতে যাবো।’

শতাব্দের গম্ভীর উত্তর,

‘ তুমি আজ ভার্সিটিতে যাচ্ছো না।’

হতভম্ব প্রিয়,

‘ মানে? যাচ্ছিনা মানে? ‘

‘ আজ সারাদিন তুমি আমার সাথে থাকবে। অসুস্থ স্বামীর, সেবা করবে।’

‘সেবা করতে আমার বয়েই গেছে! ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। সামনে ফাইনাল। নোট কালেক্ট করতে হবে।’

‘ তোমার সব নোট বাড়িতে পোঁছে যাবে।’

ফস করে শ্বাস ফেলল প্রিয়। 

ঘামে ভিজে থাকা প্রিয়’র মুখখানায় চেয়ে আছে শতাব্দ। নাকের ডগায় মুক্তার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সামনের বেবি হেয়ার গুলো ঘেমে কপালে লেগে।  দুকদম এগিয়ে এলো শতাব্দ। আঙ্গুল দিয়ে নাকের ঘাম মুছে দিতে দিতে আলতো আবদার করে বলল,

‘ ভালো লাগছেনা কিছু। আজকের দিনটা আমার সাথে কাটাও না প্রিয়!’

ভ্রু কুঁচকে ছোট ছোট চোখ করে তাকাল প্রিয়। খানিক চেয়ে থেকে হনহনিয়ে চলে গেল।

 

বিকালের শেষ প্রহর। চারিদিকে নিভু নিভু আলো। যান্ত্রিক শহরের কৃত্রিম আলো জ্বলতে শুরু করেছে। দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে প্রিয়। দুপুরের দিকে জ্বর উঠেছিল আবার। ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে এখন। তাই এখন বইখাতা খুলে বসেছে। ক্লাস শেষে ইরা এসেছিল। নোট দিয়ে গেছে। সেই গুলোতে চোখ বুলাচ্ছে। কেউ পাশে বসতে প্রিয়’র ঘোর কাটল। শতাব্দ এসেছে। প্রিয় বইয়ের দিক চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,

‘ জ্বর ছেড়েছে আপনার?’

উত্তরে কিছু বলল না শতাব্দ। প্রিয়’র মুখের সামনে ধরা বইটা টেনে নিলো। কোমর টেনে কাছে এনে প্রিয়’র হাত কপালে রেখে বলল,

‘ তুমি-ই দেখো।’

তড়িঘড়ি করে হাত সরিয়ে নিলো প্রিয়। গম্ভীর মুখ করে দোলনা ছেড়ে উঠে যেতে চাইল। শতাব্দ হাত টেনে ধরল।কোলে বসিয়ে কোমর চেপে শক্ত করে ধরল। প্রিয়’র ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে আলতো স্বরে বলল,

‘ আমাদের একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক হতে পারেনা প্রিয়?’

প্রিয়’র সোজাসাপটা রুখা উত্তর,

‘  না, পারেনা।’

‘ কেন?’

তাচ্ছিল্য হাসল প্রিয়। বলল,

‘ অনেক বছর আগে আমি সব ছেড়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। আমার বিপদের দিনে আপনাকে পাশে পাইনি। এখন আমার আর আপনাকে চাইনা!’

শতাব্দের শান্ত, স্বাভাবিক আওয়াজ,

‘ কারণ কি এতটুকুই? নাকি অন্যকিছু!’

প্রিয় চুপ। তার চঞ্চল চোখ। শতাব্দ তা ঠাহর করল। কিছু বলল না। একটু চুপ থেকে বলল,

‘ সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরী ছিল। আমি চাইনি এতো অল্প বয়সে শেয়াল কুকুরদের মাঝে এসে পড়ো। তখন তুমি সবে কিশোরী। এই অল্প বয়সে আমি কি করে তোমার কাঁধে দায়িত্বের বোজা ফেলি।সেই পুরানো  ইতিহাস আবার রিপিট  করি। তাও তখন, যখন চারিদিকে জ*ঘন্যরকম বি*পদ। আমি নিজে তখন সামান্য মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, আমার হাতে না জোর ছিল, না ছিল আজকের মত এমন ক্ষমতা। তখন তোমাকে নিজের কাছে রাখা মানে, তোমার হ*ত্যা করা। আমি তোমাকে রাস্তায় ছেড়ে দেইনি প্রিয়। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা তোমার বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আজকের এই প্রিয় প্রাপ্তবয়স্ক, স্ট্রং, আত্মনির্ভরশীল। কেউ সহজে ভাঙ্গতে পারবেনা। আর আমার সেইদিনকার সেই প্রিয় ছিল অবুঝ, সরল। আমি কি করে নিজের সুখের জন্য সেই নিষ্পাপ কিশোরী মেয়েটাকে এমন গোলক ধাঁধা এনে আটকাই। তখন আমার মনে হয়েছে,  আমার কাছে থাকার চেয়ে, তোমার বেঁচে থাকাটা বেশি জরুরী। আর তা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। আরো হাজার বারও যদি তোমার ভালোর জন্য এমন করতে হয়। আমি করবো।’

খানিক চুপ থাকল। রাগ চেপে আবারো বলল শতাব্দ,

‘ আর রইল বি*পদের দিনে হাত ছেড়ে দেওয়ার কথা! আমি কখনো এক মুহূর্তের জন্য তোমাকে ছাড়িনি। আমি সবসময় তোমার পাশে ছিলাম। ছায়ার মত। অতীতে খোঁজ করে দেখো কখনো….. কিন্তু একটা আফসোস চিরকাল থাকবে আমার। সেই রাতে তোমার কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। যার জন্য আমি আজও অনুতপ্ত। রোজ সেই অনুতপ্ততার আগুন খাঁখাঁ করে পোঁড়ায়।’

শতাব্দ রাগে শক্ত হয়ে বসে রইল। প্রিয়’র কোমর ছেড়েছে অনেকক্ষণ। 

খানিকক্ষণ নীরবতায় কা*টলো। প্রিয় গম্ভীর জিজ্ঞাসু সুরে বলল,

‘ তাদের ঝামেলা আমার খালার সাথে ছিল। তাহলে আমাকে টার্গেট করল কেন?’

প্রিয়’র মুখপানে গম্ভীর হয়ে চেয়ে রইল শতাব্দ। বলল,

‘ কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই ভালো।’

 

শতাব্দ দোলনা ছেড়ে উঠে গেল। তার যাওয়ার দিক তাকিয়ে, গভীর ভাবনায় ডুবে গেল প্রিয়।

 

চলবে…….

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৩৮.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

যান্ত্রিক শহরের ব্যস্ত পথঘাট। চারদিকে হাজার হাজার লোকজন, কর্মজীবনের ব্যস্ততা। শীতের মায়া অনেক আগে ছেড়ে, চারিদিক কাঠফাটা গরমে মেতেছে । প্রিয় বাড়ি ফিরেছে সবে। কলিং বেল চাপতেই, রহিমা এসে দরজা খুলল। ওড়নার ঝুলে থাকা অংশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভিতরে ঢুকল প্রিয়। সোফায় গা এলিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসল। রহিমা খালা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে প্রিয়’র দিক এগিয়ে দিলো। গালভরা হাসি নিয়ে বলল,

‘ আম্মা স্যারের ছোট ভাই আইছে।’

 পানি শেষ করে টেবিলের উপর গ্লাস রাখতে রাখতে প্রিয় উত্তর দিলো,

‘ কে সমুদ্র ভাই?’

‘ না, একবারে ছোটোটা। কি জানি নাম কইলো…ওহ মনে পড়ছে শাদ।’

প্রিয় ভ্রু কুঁচকে নিলো। শাদ সচরাচর এখানে আসে না। বিয়ের পর থেকে এখন একদমই আসে না। শতাব্দের সাথে কোন জরুরী তলব পড়লে সরাসরি তার হাসপাতালে যায়। 

‘ শতাব্দ বাড়ি নেই, বলেননি?’

‘ কইছি, কিন্তু সে কইলো। স্যারের সাথে না তোমার সাথে দরকার। বারান্দায় অপেক্ষা করতাছে তোমার।’

কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো। প্রিয়’র সাথে শাদের কি দরকার! সোফা ছেড়ে বারান্দার দিক পা বাড়াল প্রিয়। যাওয়ার সময় রহিমা খালাকে জলখাবারের ব্যবস্থা করতে বলল।

 

বারান্দার কাঠের চেয়ারে বসে আছে শাদ। দৃষ্টি ফোনের স্কিনে। প্রিয়’র পায়ের ভাঁজ পেয়ে চোখ তুলে তাকাল। সামনা সামনি চেয়ারটায় বসল প্রিয়। শাদ টেবিলের উপর মোবাইল রাখল। মোবাইলের স্কিনে কয়েক সেকেন্ডে জন্য তুরফার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা ফুটে উঠল। যা চোখ এড়ালো না প্রিয়’র। নীরবতা ভাঙ্গতে প্রিয় বলল,

‘ রাস্তায় জ্যাম ছিল তাই ফিরতে দেরি হলো। অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছিলে! ভীষণ জরুরী কিছু?’ 

শাদ চুপ করে বসে। চোখজোড়া টেবিলে। ভিতরে ভিতরে কথা গোছাচ্ছে। কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। প্রিয় সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। শাদের উত্তর নেই কোন। খানিক অপেক্ষা করে, জোরাল স্বরে বলল,

 ‘হ্ঠাৎ আমার সাথে কি প্রয়োজন! ‘

হ্ঠাৎ শাদ বলে উঠল,

‘ আমার হয়ে তুরফার কাছে তরফদারি করেছেন কেন?’

প্রিয় হতভম্ব। সাথে সাথে কোন উত্তর দিলো না। একটু সময় নিয়ে বলল,

‘ তুরফার কথা ভেবে। তোমার আসেপাশে থাকলে সেভ থাকবে। তোমার ফুপু কিছু  করার আগে কয়েকবার ভাববে।’

ঠোঁট মেলে হাসল শাদ। সামনের দিক ঝুকে আসলো, বলতে শুরু করল,

‘ আপনার এই শক্তপোক্ত কঠিন রূপটা যে লোক দেখানো তা বেশ ভালো করে জানি আমি। বিয়ে মানেন না অথচ শ্বশুর বাড়ি্র মানুষের জন্য টান আপনার। আপনি শুধু তুরফার জন্য না। আমার কথা ভেবে, ওর কাছে আমার প্রেমের তরফদারি করেছেন! তাই না?’

উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল প্রিয়। ঝাঁঝাল গলায় উত্তর দিলো,

‘ হ্যাঁ করেছি তো! শ্বশুরবাড়ির মানুষের প্রতি কোন টান-ফান নেই আমার। আমি এখনো তোমাকে অতটাই অপছন্দ করি। আমি চাইনি আরেকটা প্রিয়’র জন্ম হোক। সেদিন তোমার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা, আহাজারিতে অনেক বছর আগের পুরানো আমি’কে দেখেছি। আমি জানি ভালোবেসে না পাওয়ার যন্ত্রণা কতটা ভ*য়ানক। তাই তুরফাকে বুঝিয়েছি। আমি তোমার ভাইয়ের বউ সেই খাতিরে নয়। চোখে বেঁধেছে।  মানবতার খাতিরে সব করেছি।কারণ আমার মনে হয়েছে তোমার ভালোবাসা খাঁটি।’

হাসল শাদ। খানিক চুপ থেকে বলল,

‘ পৃথিবীতে যদি কাউকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, সেটা হচ্ছে শতাব্দ ভাই। ছোট থেকে আমার রোল মডেল। ভাইয়ের মত চলন, বলন সবকিছু অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। ভাইয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটা হতে চাইতাম। আপনি আসার আগ অবধি ছিলামও। যেই ভাইয়ের জীবনে আপনার আগমন ঘটলো। অমনি সব পাল্টে গেল। ভাইয়ের প্রায়োরিটি লিস্টে আমার দ্বিতীয় স্থান হলো। ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলাম না। মূলত সেই ঈর্ষা থেকেই আপনাকে অপছন্দ, বিরক্ত করা। ফার্ম হাউজে পিকনিকের দিন না বুঝে আপনাকে ওয়াশরুমে বন্ধ করে দেই। এত ভ*য়ঙ্কর কিছু হয়ে যাবে, আমার তা বিন্দু মাত্র আইডিয়া ছিল না। বাড়ি ফিরে ভাইয়ের ভ*য়ঙ্কর তোপের মুখে পড়লাম। সেই থেকেই দুজনের মাঝে শক্তপোক্ত অদৃশ্য একটা দেয়াল দাঁড়াল। সেই দেয়ালের কারণ আপনাকেই মানতাম। আরো বেশি অপছন্দ করতে শুরু করলাম। কিন্তু কলেজে যখন তুরফার সাথে পরিচয় হলো। এত বছর ধরে মেনে আসা মস্তিষ্কের সব থিউরি উল্টেপাল্টে গেল। আমাদের বন্ধুত্ব হলো, বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসায় গড়ালো। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। হ্ঠাৎ তুরফা যখন জানলো আমি ইমান্দিপুরের চেয়ারম্যানের ছেলে, উষ্ণচরের ছবি বেগম আমার ফুপু। অমনি আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। সম্পর্ক ছিন্ন করে দূরে সরিয়ে দিলো। অদ্ভুত ঘৃ*ণার দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে শুরু করল। ওর ভাষ্যমতে লুবনা আপা, লিমন ভাই ওর বড় বোন তদ্রাকে খু*ন করেছে। দুজন টিনেজার কাউকে কি করে খু*ন করতে পারে! যদিও এটা ওর ভুল ধারণা। তুরফা মানতে চাইছেনা।…আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে বারবার। এখন আমি ভাইয়ের ব্যাপারটা খুব করে বুঝতে পারি। কাউকে মনেপ্রাণে ভালোবাসলে সেই মানুষটা প্রায়োরিটি লিস্টের সবচেয়ে চূড়ায় থাকে। তার গায়ে লাগা সামান্য আঘা*ত ও বুকে যেয়ে বিঁধে! এখন আপনাকে অপছন্দ হয়না। চোখে চোখ মিলাতে লজ্জা লাগে। মূলত সেই কারণেই এড়িয়ে চলা। এতবছর অপছন্দ করা মানুষটার মুখোমুখি হয়ে কিভাবে কি বলবো, সেই লজ্জাবোধ থেকেই এমন আড়ষ্ট রুক্ষ আচরণ।’

প্রিয় চুপ থেকে শাদের সবকথা শুনল। শাদ চোখ তুলে তাকাচ্ছেনা। চোখে মুখে ভীষণ অপ*রাধবোধ। খানিক নীরব থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ তোমার সত্যি মনে হয় দুজন টিনেজার কাউকে খু*ন করতে পারেনা? লিমন, লুবনা নিরপরাধ!’

শাদ বিস্ময় চোখে তাকাল। তাচ্ছিল্য হাসল প্রিয়। বলল,

‘ তুমি আইডিয়া করতে পারবেনা, তারা কতবড় অমানুষ, ভয়*ঙ্কর শ*য়তান। মাথায় বড় ঘোমটা টেনে থাকা তোমার ফুপু ছবি বেগম কতটা জ*ঘন্য মহিলা। এক একটা নর্দমার কীট!’

শাদ হতভম্ব, অবাক। চোখে স্পষ্ট কৌতূহল।  সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ আসলেই কি ওরা এমনটা করেছে? কি ঘটেছে স্পষ্ট খুলে বলুন। আর আপনি এসব কি করে জানেন!’

প্রিয় নীরব। শাদের উত্তেজনা কৌতুহল দেখে মুখ খুলল। বলল,

‘ তুরফার বড় বোন তদ্রা আমার সমবয়সী ছিল। দুইহাজার এগারোতে বড় আপার বিয়েতে দেখেছিলাম একবার।তুরফার মা সালেহা আন্টি বড় খালার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। সেই সুবাদে চেনা। সাহেলা আন্টি  মোহসিন আঙ্কেল দুজনই সরকারী হাসপাতালে ডক্টর। ঊষ্ণচর বাড়ি হলেও কাজের তাগিদে ঢাকাতেই থাকতেন। দুইহাজার তেরোতে ছুটিতে তন্দ্রা তুরফাকে দাদির কাছে ঊষ্ণচর বেড়াতে আসে। কোন এক বিকালে বাহিরে নদীর পাড়ে ঘুরতে বের হলে, ঝোপের কাছে কয়েকজন মাদক আসক্ত ছেলে মেয়েকে দেখে। ঘাবড়ে যায় তদ্রা তুরফাকে নিয়ে পিছু ফিরে যেতে নিলে, মাতাল লিমন এসে তদ্রার হাত চেপে ধরে। তদ্রা তুরফাকে পালাতে বলে। ঘাবড়ে যায় ছোট তুরফা।  বোনের হাত ছাড়িয়ে দূর ঝোপের আড়ালে পালায়। ভয়ে কাঁপতে লাগে। বোনকে কি করে বাঁচাবে বুঝে উঠতে পারছিল না ছোট্ট তুরফা। ততক্ষণে চারিদিকে সবাই এসে তদ্রাকে ঘিরে ফেলেছে তখন। তদ্রা হাত ছাড়ানোর জন্য চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে, লুবনা এসে মুখে কাপড় বেঁধে দুই ভাইবোন মিলে টেনে হিঁচড়ে ঝোপের কাছে নিয়ে যায়। গ্রামে ইলেকশন চলছে তখন। তাদের ধারণা ছিল তাদের এসব কাজের কথা তদ্রা গিয়ে গ্রামে ছড়াবে। মাতাল লুবনা লিমন তাদের সঙ্গীদের নিয়ে ট*র্চার করে তদ্রাকে । তদ্রা বারবার ইশারায় বোঝাতে চাইল তারা বুঝেনি, মুখ বেঁধেই নি*র্মম অ*ত্যাচার চালায়। সিগারেটের আগুন দিয়ে জায়গা জায়গা ঝলসে দেয়। বোনের উপর এমন অত্যাচার দেখে সাহায্যের জন্য ঝোপের আড়াল থেকে অগোচরে বেরিয়ে বাড়িতে দাদীর কাছে ছুটে যায় তুরফা। যখন দাদিকে নিয়ে ফিরে আসে আশেপাশে কেউ ছিলনা তখন। চারিদিকে অনেক খোঁজাখুঁজি চলে। রাতে গিয়ে তদ্রার লা*শ পানিতে ভেসে উঠে। লা*শ ময়নাতদ*ন্তের জন্য পাঠাতে রিপোর্ট আসে, ধর্*ষনের পর গলা টি*পে হ*ত্যা করা হয়েছে। আঙ্কেল আন্টি কেস করলে ছবি বেগম ছেলে মেয়েকে বাঁচাতে পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার ক্লিয়ার রাখতে সব জায়গায় টাকা খায়িয়ে পুরো ব্যাপারটা অপমৃ*ত্যু বলে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। আর এই দুনিয়া সত্যের চেয়ে টাকার ভাষায় বেশি চলে। পুরো ব্যাপারটা মাত্র কয়েকদিনের ভেতর ধামাচাপা পড়ে যায়। সাথে ছবি বেগম হুমকিও দেয় যে, যদি এই নিয়ে পরবর্তীতে কোন ঝামেলা করে তাহলে তুরফাকেও ছাড়বেনা তারা। আঙ্কেল আন্টি ন্যায় পাওয়ার সব চেষ্টা বন্ধ করে দেয়। বড় মেয়ের পর ছোট মেয়ে হারাতে চাননি তারা। ‘ 

শাদ স্তব্ধ, হতভম্ব বসে। শাদের বিমূঢ় চাহনি। লুবনা লিমন  ফুপু এমনও করতে পারে! শাদের চাহনীতে প্রিয় বলল,

‘ বিশ্বাস হচ্ছেনা তাইনা? প্রমাণ দেখে নিশ্চয়ই বিশ্বাস হবে?’

 ঘরে যেয়ে একটা ফাইল নিয়ে ফিরে আসলো। শাদের দিক এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ এখানে দেখো তদ্রার মৃ*ত্যুর কারণ স্পষ্ট লেখা। ওই যমজ ভাইবোন, ছবি বেগম অগণিত নির্দোষ মানুষের উপর অত্যা*চার করেছে। লিমনের বিয়েটা কিভাবে হয়েছে নিশ্চয়ই জানো? কুকাজ করতে গিয়ে ধরা না পড়লে ওই গরিব অসহায় মেয়েটাকে বিয়ে করত না কখনো। আর আমা্র আর খালার সাথে যা করেছে তার সবটাই তো জানো।’

ফাইলের দিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে শাদ। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। তুরফার এত বলার পরও তাকে একবার বিশ্বাস করল না। উল্টো তাকে ভুল প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলো। রাগী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল শাদ,

‘ সামনে কি করবেন! কোন প্লান আছে। আমাকে বলুন কি করতে হবে আমাকে।’

‘ তুমি সত্যি সাহায্য করতে চাও?’

শাদের অকপট উত্তর,

‘ তুরফাকে অবিশ্বাস করে অনেক বড় ভুল করেছি। যদি আমার সাহায্যে ওর বোনের ন্যায় বিচার পাওয়া যায়। আমার একটু হলেও শান্তি মিলবে তবে। আপনি শুধু বলুন কি করতে হবে আমাকে!’

শাদের ক্রোধান্বিত মুখখানায় চেয়ে রইল প্রিয়। খানিক চুপ থেকে বলল,

‘সময় আসুক বলব।’

শাদের সাথে প্রিয়’র আরো কিছুক্ষণ কথা হলো। যাওয়ার সময় শাদ পেছনে ফিরে করুন গলায় বলল,

‘ জানিনা সামনে কি হবে। আপনার উদ্দেশ্য কি! আমার ভাই আপনাকে ভালোবাসে। প্রচন্ডরকম, পাগলের মত। এতটা কেউ কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারে, জানতাম না। যদি আপনার বিচ্ছেদের পরিকল্পনা থাকে, বলবো না থেকে যেতে। বললেও মানবেনা, জানি। কারণ আপনার উপরও অ*ন্যায় হয়েছে। তবে এতটুকু আপনাকে বলবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার কাজ শেষ করে দূরে চলে যান। যত সময় যাবে ভাইয়ের ভালোবাসা আরো গাঢ়রূপ নিবে। আপনি চলে গেলে নিজেকে সামলাতে ততটাই কষ্ট হবে। আর আমি আমার ভাইকে সেই নরকের উত্তপ্ত আগুনে পুড়তে দেখতে পারবো না! আমার কষ্ট হবে।’

 

শাদ চলে যাওয়ার পর প্রিয় সারাদিন বসে ভাবলো। নাওয়া খাওয়া হলোনা আর। দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে  থাকলো। শাদের শেষ কথা গুলো মনে গেঁথেছে। সত্যি-ই তো! যত দিন যাবে শতাব্দের অনুভূতি বাড়বে। সেও দিনদিন শতাব্দের প্রতি  দুর্বল হয়ে পড়ছে। এভাবে চলবেনা। যেই উদ্দেশ্যে এসেছে, সেই কাজ সেরে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে। দোলনা ছেড়ে উঠল প্রিয়। এই কয়েক বছর অনেক তল্লাসি করেছে। ঊষ্ণচরে ছবি বেগমের মাদ*ক ব্যাবসার কাগজপত্র গুলো হয়তো এখানেই আছে। যার জন্য ছবি বেগম শতাব্দের সামনে দুর্বল। মাথা নত করে এখনো। যা বলে তাই শুনতে বাধ্য। ইমান্দিপুরের শতাব্দের ঘরে খুঁজেছে,  কিছু মিলেনি সেখানে। এখানে আছে নিশ্চয়ই। শতাব্দ এখন বাড়িতে নেই। ঘর তল্লাসী করার এটাই সুযোগ। তড়িঘড়ি হাতে শতাব্দের ঘরে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। ঘরের কোথাও কোন কিছু নেই। আলমারী খুলে দ্বিতীয় পাল্লায় খোঁজ করতেই পেয়ে গেল। উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠল প্রিয়। যেই ফাইল নিয়ে ফিরে যাবে, অমনি একটা চিঠির খামে প্রিয়’র চোখ আটকাল। তার বাবার নামে চিঠি। প্রেরক বড় খালা আয়শা বেগম।বাবার চিঠি শতাব্দের কাছে কেন? আর খালা-ই বা কেন বাবাকে চিঠি  লিখেছিল।  কিসের চিঠি এটা!  শত চিন্তা-ভাবনা এড়িয়ে চিঠির খাম খুলল প্রিয়।

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৩৯.

 

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

জাফর ভাই,

 

কোথা থেকে শুরু করব, বুঝে উঠতে পারছিনা। আপনাকে আমার অন্ধকার জীবনের উজ্জ্বল আলো বললে ভুল হবেনা। গায়ের চামড়া কে*টে যদি আপনার পায়ের জুতা বানিয়ে দেই তবুও এই ঋণ শোধ করতে পারব না। আমার নিজের কোন ভাই নেই! থাকলে হয়তো আপনার মতই হতো। আমেনা আমি পিঠাপিঠি ছিলাম। ও যতটা আব্বার বাধ্য সন্তান ছিল, আমি ঠিক ততটাই অবাধ্য ছিলাম। বিয়ের ব্যাপারে আমেনাকে আপোষে রাজি করতে পারলেও, আমাকে বাধ্য করতে পারেনি। আমার চোখে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন ছিল। তাই আব্বা বাধ্য হয়ে প্রথমে আমেনাকেই বিয়ের পিড়িতে বসালো। বিয়ের পরপর-ই বড় ভাইয়ের মত আমার পাশে দাঁড়ালেন। আমার লেখাপড়ার স্বপ্ন, ঢাকায় থাকার ব্যাপারে আব্বাকে বুঝিয়ে বললেন। আপনার কারণেই আমার ঢাকায় যেয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় এসে চারদিকের চাকচিক্যময় দুনিয়া দেখে, মোহের ঘোরে পড়লাম। শোয়েবের সাথে গভীর প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম। বাবা মা, বোন সব রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধু তাকেই চাইলাম। দুজনে ঘর বাঁধলাম। সংসার সাজালাম। তখনো জানতাম না আমার এই একটা ভুল, কাল হয়ে দাঁড়াবে আমার। মন প্রাণ সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসলো না। ঠকালো!  গ্রামের যেয়ে ছবিকে বিয়ে করে নিলো। তখন আমি অন্ত: সত্ত্বা। গ্রামে গেলাম। ওর আর ওর মায়ের কাছে কত আহাজারি করলাম। মানলো না! সেদিন প্রচন্ড আঘা*ত পেয়েছিলাম। নিজের প্রতি, গর্ভের সন্তানের প্রতি প্রচন্ড ঘৃ*ণা জন্মায় আমার। আয়নায় নিজেকে দেখতাম আর ভাবতাম এই সন্তান ওই অমানুষ, বেই*মানটার চিহ্ন। ওর বেঁচে থাকার অধিকার নাই কোন। তাই গর্ভপা*ত করবো বলে ঠিক করলাম। ডাক্তার বারবার নিষেধ করল। বলল, এতে আমার প্রাণ যাওয়ার ঝুঁকি আছে। মানলাম না, হাসপাতালে  গেলাম। যেই অপারেশন রুমে ঢুকব অমনি অভিলাষা, শাহরিয়ার সাহেব এলো। তিনি চেয়ারম্যান হয়নি তখনো।অভিলাষা হাজার বুঝাল। আমার গর্ভের বাচ্চার পুরো দায়িত্ব নিতে চাইল। যেই অধিকার আমি পাইনি। সেই অধিকার আমার সন্তানকে দিবে বলে প্রস্তাব রাখল।আমি মানলাম না। গর্ভপা*ত করাতে উঠেপড়ে লাগলাম। বড় ডাক্তার এলো। পুনরায় পরিক্ষা নীরিক্ষা হলো। সব রিপোর্ট দেখে বলল, এইসময় এসে গর্ভপা*ত করা সম্ভব না। তারা কোন প্রকার রিস্ক নিতে পারবেনা। বাধ্য হয়ে বাচ্চাকে আমার রাখতে হলো। অভিলাষা অনেক জোরাজোরি করে নিজের সাথে ঢাকার বাড়িতে নিয়ে গেল। ভাইয়ের পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আমার আর গর্ভের সন্তানের খেয়াল রাখলো। সেই নয় মাস প্রতিটি মুহূর্ত আমি ঘৃণার আগুনে পু*ড়েছি। ওই বিশ্বাস ঘা*তকের চিহ্ন বয়ে ক্ষণে ক্ষণে ম*রেছি। এই সন্তান আমার জীবনের কালোরাতের অভি*শাপ! 

বাচ্চা জন্ম হলো। কন্যসন্তানের মা হলাম। জন্মের পর তার মুখটা পর্যন্ত দেখলাম না। এতিমখানায় দিতে চাইলে, আপনি আমেনা এসে বাঁধ সাজলেন। তৃতীয় সন্তানের চেষ্টায়  তখন সবে মিসক্যারেজ হয়েছিল আমেনার। ভেঙ্গে পড়েছিল আমার বোনটা। গর্ভের সন্তান হারিয়ে এক প্রকার পাগলের মত হয়ে গেছিল। হাসপাতালে দেখতে এসে নবজাতক কন্যাটাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। করুন কন্ঠে আবদার করে বলল, এই বাচ্চাটাকে আমায় দিবে আপা? প্রথমে রাজি না হলেও। বোনের করুন কান্না দেখে রাজি হলাম। শর্ত জুড়ে দিলাম, এই মেয়ে যেন কোনদিন সামনে না আসে আমার। মেয়ের মুখ না দেখেই চলে গেলাম। পড়াশোনা শেষ করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ইমান্দিপুরে ফিরে গেলাম। মাঝে পাঁচ বছর কে*টে গেল।এরই মাঝে একদিন জানতে পারলাম, আপনারা সেই মেয়েটির নাম রেখেছেন ‘প্রিয়’। দেখার  প্রচন্ড ইচ্ছা জাগলো। মনের ভেতর মাতৃত্বের টান জন্মালো। নিজেকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। একপ্রকার ছুটে এলাম ঢাকায়। পাঁচ বছরে, সেই প্রথমবার আমার প্রিয়’কে দেখলাম। ছোট ছোট হাত, পা মায়াভরা মুখ। হুবহু আমার প্রতিরূপ। আমারি ছায়া । বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে চাইলাম। অদ্ভুত ভাবে পারলাম না। চোখ ভিজলো না। কোন এক স্বত্বা ভেতর থেকে আটকালো। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘ ওর কাছে যেও না। ও তোমার না, ওই বিশ্বাসঘা*তক, অমানুষটার চিহ্ন ‘ আমি দূরদূর করে সামনে থেকে তাড়িয়ে দিলাম। নিজেকে নিয়ে ভয় হচ্ছিলো, মেয়েটাকে কাছে পেয়ে রাগের বসে, কোন ক্ষ*তি করে ফেলবো না তো? কোনরকম ছুটে আসি সেদিন। এরপর অনেক দিন আবারো মুখোমুখি হই। ওইবার আর প্রথমবারের মত রাগ হয়না তবে রুখা স্বভাব দেখিয়ে এড়িয়ে যাই। এমন ভাবে চলতে থাকে দিন। প্রিয়’র প্রতি মায়া জন্মালেও লুকিয়ে রাখতাম। যার জন্মের পর চেহারা পর্যন্ত দেখতে চাইনি, এতো বছর পর মায়া বাড়ানোর কি দরকার। থাকনা আপনাদের মেয়ে হয়ে মায়া দেখিয়ে কি লাভ! সবকিছু ঠিক চলছিল। অমনি প্রিতী আত্মহ*ত্যা করল। সেখান থেকে প্রিয় মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে, ভেঙ্গে পড়ল। নিজের মেয়ের এমন দুর্দশা দেখতে পারছিলাম না। প্রথমবার মাতৃত্বের অধিকার খাটালাম। নিজের সাথে ইমান্দিপুর নিয়ে আসলাম। ধীরেধীরে সন্তানের প্রতি মায়া ভালোবাসা অনুভব করলাম। ভেবেছিলাম সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে পারবো প্রিয়’কে। আমি ভুল ছিলাম! ইমান্দিপুর এসে প্রিয় আমার পথেই হাঁটল। ভালোবেসে ফেলল শতাব্দকে। শতাব্দ আমার অপছন্দ না, বেশ পছন্দের। কিন্তু আমি চাইনি প্রিয় সেই জ*ঘন্য অতীত, শোয়েবের মুখোমুখি হোক। অনেক বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, পারিনি। শতাব্দ-ই বোধহয় ছিল তার নিয়তি। অমনি একদিন আষাঢ়ের কালো মেঘ হয়ে শোয়েব ইমান্দিপুর এলো। অনেক বছর পর মুখোমুখি হয়ে ভ*য়ংঙ্ক কান্ড বাঁধালো। আমি কোনদিন চাইনি প্রিয়, শোয়েব দুজন দুজনের পরিচয় জানুক। অভিলাষা চেয়ারম্যান সাহেব কেউ এব্যাপারে কারো সামনে মুখ খুলেনি কোনদিন। কিন্তু শোয়েবের আগমনে সব এলোমেলো ঘটলো। সমাজের সামনে নিজের মেয়ের কলঙ্গ রটালো। আমি সবসময় চেয়েছি প্রিয়’র সুন্দর ভবিষ্যৎ হোক। আত্মনির্ভরশীল, আত্মসম্মানবাদী প্রিয় হোক। কিন্তু আমি পারিনি। পারিনি জাফর ভাই! ওই লোকটা এসে তোলপাড় করে দিয়েছে সব। আজ নিজের আত্মসম্মান, মানমর্যাদা হারিয়ে আমি নিঃস্ব। না পারলাম নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে। না পারলাম ভালো মা হতে। মেয়ের মুখে মা ডাক না শোনার আফসোস থাকবে। সেই সাথে শান্তি মিলবে, আমার মেয়েটা তোমাদের কাছে আছে। ভালো বাবা মা আর গোছানো একটা পরিবার পেয়েছে। আমি আপনার চিরকৃতজ্ঞ।চারদিকে এত মিথ্যা অ*পবাদ নিয়ে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। এই মিছে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে, আমি একটু শান্তি চাই। আমার প্রিয়’র খেয়াল রাখবেন। প্রিয় যেন কখনো না জানতে পারে,  সে এই অভাগী মায়ের মেয়ে।

 

ইতি,

আপনার ছোটবোন আয়শা

 

চিঠি পড়ে হতভম্ব প্রিয়। চোখজোড়া থেকে অশ্রু ঝরছে টপটপ। এতবছর জেনে আসা এই পরিচয়, অস্তিত্ব মিথ্যা সব! সে তার বাবা মায়ের না, শোয়েব হক আর খালার সন্তান! মাথা চক্কর দিলো। থম করে মাটিতে বসে পড়লো। পৃথিবীতে যেই মানুষটাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃ*ণা করে, সেই মানুষটা তার বাবা!  তার জন্মদাত্রী মা তাকে দুনিয়াতে আনতে চায়নি। জন্মের পর মুখটা পর্যন্ত দেখেনি। এতটা ঘৃ*ণা করত! এতটা। সে তার মায়ের জন্য অভিশাপ ছিল চিরকাল। মাথা কাজ করছেনা প্রিয়’র পাথর বনে মাটিতে বসে রইল।

 

রহিমা খালার ফোন পেয়ে, হাসপাতাল থেকে একপ্রকার ছুটে আসলো শতাব্দ। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে প্রিয়। অনেক ডাকাডাকির পরও খুলছেনা। দুয়ারে কয়েকবার করাঘাত করল। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো না কোন। এবার ভয় করতে শুরু করল শতাব্দের।

হন্যহন্য হয়ে ঘরের চাবি খুঁজতে শুরু করল। পেল না। সব চাবি একত্রে বন্ধ ঘরের ভেতরে রাখা। দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকতে, হতভম্ব শতাব্দ। বিছানার পাশে পড়ে আছে রক্*তাক্ত প্রিয়। পাশেই ধারালো ছু*রিটা পড়ে। হাতের কব্জি থেকে গলগল করে র*ক্ত ঝরছে। সেই র*ক্তে ফ্লোর ভিজে। র*ক্তিম মেঝেতে চিঠিটা ভিজে লেপ্টে আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে। কি ঘটেছে বুঝতে বাকি রইল না। দ্রুত পায়ে ছুটে গেল প্রিয়’র কাছে। কাঁপাকাঁপি হাতে ধরতে চাইল। পারছেনা। ভয় হচ্ছে, সে কাঁপছে থরথর। এতএত মানুষকে রক্*তাক্ত দেখেছে। এমন ভ*য়ংকর অনুভূতি হয়নি কখনো। আজ কেন হচ্ছে! তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা র*ক্তাক্ত বলে? 

সাহস করে খাবলে ধরল, বুকে জড়িয়ে নিলো প্রিয়’কে। তখনো   মৃদু শ্বাস চলছে প্রিয়’র। ঘুটঘুটে অন্ধকারে যেন নিভুনিভু দ্বীপ জ্বলে উঠল। গলা হাঁকিয়ে ড্রাইভারকে ডাকল। দ্রুত গাড়ি বের করতে বলে। প্রিয়’কে পাজকোলে তুলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। 

 

ইমার্জেন্সি রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। সারা শরীর র*ক্তে মেখে। চোখেমুখে ভয় আ*তঙ্ক। অধৈর্য হাতপা। ছেলেকে দেখে আঁতকে উঠলেন অভিলাষা। খবর পেয়ে, মেজো ছেলে, ছেলের বউয়ের সাথে ছুটে এসেছে কোনরকম।

শক্তপোক্ত মুখ করে পাথর বনে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। ভেজা চোখ। ধীর পায়ে ছেলের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো অভিলাষা। উষ্কখুষ্ক, অগোছালো চুল। মলিন মুখ। চোখ ভিজে অশ্রু ঝরছে টপটপ। শতাব্দ কাঁদছে! 

ছোট থেকেই শতাব্দ খুব বুঝদার। ভীষণ আলাদা রকম ব্যক্তিত্ব! জীবনের অনেক রকম বাজে পরিস্থীতির সম্মুখীন হতে দেখেছে শতাব্দকে। এর আগে অভিলাষা ছেলেকে এমন ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি কখনো। এ কি হাল হয়েছে তার মজবুত, অত্যুগ্র ছেলেটার!

ছেলের কাঁধে হাত রাখল। মায়ের স্পর্শে নড়েচড়ে উঠল শতাব্দ। অস্থির হয়ে পড়ল। চোখমুখ অন্যরকম, দিশাহীন পাগলের মত। বিলাপ সুরে বিড়বিড় করে বলল,

‘ মা, আমার প্রিয়, আমার প্রিয়!’

অঝোরে অশ্রু ঝরছে। অভিলাষা ছেলের চোখ মুছে দিলো। শান্ত করার চেষ্টা করল। বুঝানোর স্বরে বলতে লাগল,

‘ সামান্য চোট, ঠিক..

কথা কাটল শতাব্দ। গলা উঁচিয়ে, গর্জন করে বলল,

‘ সামান্য? কত খানি কেটেছে। কত র*ক্ত ঝরেছে। প্রিয় সামান্য কেউ না। ও আমার কাছে অসামান্য। ওকে ছাড়া আমার চলবেনা। ম*রে যাবো মা।’

বুঝদার ছেলেটার এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল অভিলাষা। হতভম্ব, বিমূঢ় চেয়ে রইল। প্রিয় শতাব্দের দুর্বলতা মানতো।তবে, প্রাণভোমরা যে তা জানতো না! প্রিয়’র কিছু হলে বাঁচবেনা শতাব্দ। ম*রে যাবে তার ছেলেটা। 

 

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘আপা’ ডেকে হাউমাউ করে কাঁদছে প্রভা। বুকে জড়িয়ে সামলাতে চেষ্টা করল সমুদ্র।

আমেনা বেগম এক কোনায় বসে। স্রষ্টার কাছে হাত তুলে অঝোরে বিলাপ করছে। ভিক্ষা চাইছে মেয়ের জীবন। জাফর সাহেব শক্ত দাঁড়িয়ে ঠাঁই। মনে মনে নিজেকে নিজে বারেবারে প্রশ্ন করছে,

‘ বেঁচে যাবে তো আমার মেয়েটা?’

 

গভীর রাত। বাহিরে সবাই। প্রিয়’কে আইসিইউতে শিফট করেছে।  শরীর থেকে অনেক র*ক্ত ক্ষয় হওয়ায় অবস্থা জটিল। জ্ঞান ফেরার আগ অবধি ডাক্তাররা ঠিকঠাক বলতে পারছেনা কিছু। অঘটন ঘটার আশংকা আছে এখনো। রুমের সামনে থম মেরে বসে আছে শতাব্দ। শুকনো চোখ মুখ। মোবাইল বেজে চলছে অনবরত। ধ্যান ভাঙলো শতাব্দের। ফোন রিসিভ করে কানে ধরল। অপর পাশ থেকে কিছু বলল। শতাব্দ চুপ। উত্তর দিলো না। অপর পাশ হতে অস্থির, উৎকণ্ঠা  আওয়াজ। খানিক নীরব থেকে। শতাব্দ নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,

‘ আমি পরাজিত। রক্ষা করতে পারিনি তাকে। আমার খামখেয়ালিতে, আমার প্রিয় মৃ*ত্যুর সাথে লড়াই করছে।’

 প্রচন্ড আওয়াজ হয়ে ফোনটা সংযোগ বিছিন্ন হলো। ফোনের অপর প্রান্তে টুট, টুট আওয়াজ ভাসছে। 

 

চলবে………..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৪০.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

নিকষ কালো রাত কাটিয়ে এক উজ্জ্বল ভোরের উদয় হলো। চারদিকে ঝলমলে আলো। ব্যস্ত শহর, যানবাহনের ঘটঘট আওয়াজ। ভোর রাতের দিকে জ্ঞান ফিরেছে প্রিয়’র। চোখ মেলে চাইছে না কারো দিকে। হাউমাউ করে কান্না করছে। হাতের ক্যানোলা টেনে খুলে বারিয়ে যেতে চাইছে। ডাক্তার এসে  ই*ঞ্জেকশন দিয়ে কোন রকম শান্ত করেছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে এখন। গত রাত থেকে শতাব্দ একটু নড়েনি। হাত ধরে ঠাঁই বসে আছে প্রিয়’র পাশে। অনড় চেয়ে আছে প্রিয়’র নিষ্প্রাণ মুখখানায়। পৃথিবীতে দুই ধরনের সত্যি আছে। এক, যা দুর্বলকে শক্ত বানায়।দুই, যা শক্ত মানুষকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। 

 

দুপুরের দিক পুরোপুরি জ্ঞান ফিরল প্রিয়’র। চোখ খুলে বাবাকে পাশে দেখলো। সাথেসাথে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। মেয়ের মাথায় জাফর সাহেব হাত বুলিয়ে দিলেন। পাহাড় সমান ভারী হয়ে আছে বুক। মেয়ের অসুস্থ মলিন মুখখানা দেখে বুকটা কেঁপে উঠল। ছোট থেকে ভীষণ আদর আহ্লাদে বড় করেছে মেয়েকে। প্রিয় অন্যকারো মেয়ে কখনো কিঞ্চিত টের পেতে দেয়নি তাকে। জাফর সাহেব আলতো স্বরে ডাকলো। বলল,

‘ বাবার দিক তাকাবিনা মা?’

প্রিয়’র বন্ধ চোখের কোণ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। গম্ভীর জাফর সাহেব। খানিক চুপ থেকে আবারো বললেন,

‘শুধু জন্ম দিয়েই কি বাবা হওয়া যায়। র*ক্তের সম্পর্ক সব! আত্মার সম্পর্ক কিছুনা? তুই আমার মেয়ে। আমাদের প্রিয়। এটাই একমাত্র সত্য বাকি সব মিথ্যা!’

বাবার কথায় হুহু করে কেঁদে উঠল প্রিয়। পাশ ফিরে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। কান্নার বেগ আরো বাড়ল। আমেনা প্রভা কাছে এসে প্রিয়’কে শান্ত করার চেষ্টা করল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলো আমেনা। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,

‘ এই দুহাতে আদর আহ্লাদ ভীষণ যত্নে করে তিলেতিলে মানুষ করেছি তোকে।তুই আমার মেয়ে। আমার প্রিয়। পৃথিবীর যেইকোন সত্যই হোক না কেন! এই সত্যের সামনে সব পরাজিত।’

প্রভা বলল,

‘ তুমি কার মেয়ে, কার কি তাতে আমার কিছু আসেযায় না। তুমি আমার প্রিয় আপা।’

মা বাবা বোনের এমন কথায় প্রিয়’র কান্নার বেগ আরো বাড়ল। অঝোরে কান্না করছে প্রিয়। চোখের জলের সাথে মনের  চাপা কষ্টটা টেনেহিঁচড়ে বের করে দিচ্ছে।

 

ক্যাবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে শতাব্দ। শরীরে গতরাতে সেই র*ক্তমাখা শার্টটা। উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল। চোখেমুখে বিস্তর ক্লান্তি ছড়িয়ে। তবুও ঠাঁই দাঁড়িয়ে। অভিলাষা ছেলের কাঁধে হাত রাখলো। মৃদু আওয়াজে বলল,

‘ জ্ঞান ফিরেছে, ভিতরে যাবিনা।’

শতাব্দের অনড় চাহনি তখনো মুখপানে প্রিয়’র। অনুভূতিহীন নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,

‘ ওর মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস নেই আমার।’

ঝটপট পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। অভিলাষা ছেলের যাওয়ার পথে চেয়ে রইল। তাদের মধ্যেকার এই বিশাল দুরত্ব মিটবে কি আদৌ!

 

দুইদিন হলো প্রিয়’কে হাসপাতাল থেকে ছেড়েছে। ইমান্দিপুর ফিরে যায়নি অভিলাষা। প্রিয়’র কাছে আর কিছুদিন থাকবে বলে ঠিক করেছে। সমুদ্র প্রভাও এখানেই আছে। শতাব্দ ডাক্তারিতে ব্যস্ত, শাদ এখনো পড়াশোনা করছে। তাই বাবার ঢাকার ব্যবসার হাল সমুদ্রকেই ধরতে হচ্ছে। মাস খানেক পর এই বিল্ডিং’এর পাঁচতলার খালি এপার্টমেন্টে উঠছে। এপার্টমেন্ট কেনা হয়েছে অনেক আগেই। এখন আপাতত গোছগাছের কাজ চলছে।

 

বাড়ি ফেরার পর থেকে প্রিয় আগের মতই আলাদা ঘরে উঠেছে। অভিলাষা, প্রভা কেউনাকেউ সবসময় সাথে থাকছে। সেই দিনের ঘটনার পর প্রিয় শতাব্দের কথা হয়নি আর। দুজন দুজনকে খুব সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে চলছে। যদিও নিজের দায়িত্ব কর্তব্য জ্ঞান থেকে বিন্দুমাত্র নড়েনি শতাব্দ।  প্রিয়’র প্রতিটা প্রয়োজন অপ্রয়োজনের ঠিক খেয়াল রাখছে। প্রিয়’র ভালো লাগা, খারাপ লাগা সবদিকে লক্ষ করছে। কিন্তু কাছে যেয়ে অধিকার খাটানোর জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছে। 

তাদের দূরত্বের ব্যপারটা চোখ এড়ায়নি অভিলাষার। এনিয়ে প্রিয়’র সাথে খোলামেলা কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। খানিক স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় আছে তার।

 

দুপুরের কাঠফাটা গরম মাড়িয়ে, বিকালের অনুজ্জ্বল আলোয় চারিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রোদের তাপ অনেকটাই কমে এসেছে। ঢুলে পড়া সূর্যের র*ক্তিম আলো এসে চোখেমুখে লাগছে। বই উঁচিয়ে মুখের সামনে ধরল প্রিয়। রোদের তীব্র  ঝলকানি থেকে চোখ বাঁচাতে চাইল। অমনি কারো পায়ের আওয়াজে পেয়ে পিছনে ফিরল। অভিলাষা এসেছে। চায়ের ট্রে হাতে। 

প্রিয় মৃদু স্বরে বলল,

‘ আপনি কষ্ট করে চা করতে গেলেন কেন! আমাকে বলতেন আমি করে দিতাম।’

ঠোঁট মেলে হাসলো অভিলাষা। কাপে চা ঢেলে প্রিয়’র দিক এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ চা বানানো কষ্টের কি কাজ। এখানে বসে খেয়ে হাতপা জং ধরে যাচ্ছে আমার।’

মৃদু হাসলো প্রিয়। বইয়ের দিক মন দিলো। অভিলাষা জিজ্ঞেস করল,

‘ পরিক্ষা চলছে নাকি?’

‘ না, সামনে ফাইনাল তাই আগের থেকে একটু একটু করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। এমনিতেও অনেক বেশি গ্যাপ পড়ে গেছে।’

প্রিয়’র সাবলীল উত্তর। খানিক চুপ করে রইল অভিলাষা।কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। ফ্রি আছো?’

মুখের সামনের থেকে বই সরিয়ে নড়েচড়ে বসলো প্রিয়।অভিলাষার গম্ভীর চোখমুখ দেখে, ধীর আওয়াজে বলল,

‘ জি আন্টি জরুরী কিছু!’

অভিলাষা মাথা নাড়াল। খানিক চুপ থেকে নীরবতা ভেঙ্গে বলতে লাগলো,

‘ছোট থেকেই আমার ছেলেটা স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড। ভীষণ জেদি। কোন কিছু মাথায় ঢুকলে তা সম্পন্ন না করা অবধি ক্ষান্ত হবেনা সে। ওর সমবয়সী ছেলেরা যেই বয়সে ড্রাইভিং সিটে বসার সাহস পায়না! সেই বয়সে তুখোড় গাড়ি চালায় সে। এগারো বছর বয়স থেকে গাড়ি চালাচ্ছে। জানি বিশ্বাস হচ্ছে না!  কিন্তু সত্যি। আমার শত নিষেধ অমান্য করে গাড়ি চালানো শিখেছে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তার বড্ড ঝোঁক। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলো! আমার কাছে এসে’ তোমাকে চাইল’।সেদিন ছেলের এমন আবদারে হতভম্ব ছিলাম। কথা দিয়েছিলাম, ঠিক সময়ে তাকে তার প্রিয় জিনিসটা এনে দিবো। কারণ আমি জানতাম কারো নিষেধ অমান্য গুনবেনা সে। আবদার অমান্য করলে আরও ক্ষেপে যাবে! আপোষে হোক বা জোর করে ঠিক আদায় করে নিবে তোমাকে।’

 

প্রিয় চুপ।অভিলাষা আবার বলতে শুরু করল,

‘ আমার অবশ্য এতে অমত ছিলোনা কখনো। অনেক আগে থেকেই তোমাকে পছন্দ ছিল আমার। আয়শাকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে পারিনি। তা নিয়ে সবসময় একটা অপ*রাধবোধ অনুশোচনা কাজ করতো আমার। নিজের কাছে রেখে তার আংশিক ক্ষয় পূরণ করতে চাইছিলাম। যেদিন তোমার জন্ম হলো, হাসপাতালে কোলে তুলে নিজের কাছে নিজে কথা দিয়েছিলাম। একদিন তোমাকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলব আমার। যা আয়শার জন্য করতে পারিনি, সেই সব অপূর্ণ ইচ্ছা গুলোকে তোমার জন্য পূর্ণ করব। আয়েশার কাছে বহুবার হাত চেয়েছি তোমার। শতাব্দকে এমনি পছন্দ করলেও বিয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতে নারাজ। আয়েশা কখনোই চায়নি অতীতের মুখোমুখি হও তুমি। যেইদিন রাতে শোয়েব ভাই ওই বিশ্*রী কান্ড ঘটালো। তার পরেরদিন সকালে ঢাকায় ফিরে যায় শতাব্দ। তোমার বাবার সাথে সরাসরি দেখা করে তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখে। শালি আর এক মেয়ের করুণ পরিনতি দেখে হয়তো ঘাবড়ে ছিলেন জাফর ভাই। ঠুকরে দেয় শতাব্দের প্রস্তাবকে। বলে দেয় কালো অতীতের সেই রহস্যগুলোকে। সেই সাথে হাত জোর করে ওয়াদা নেয় শতাব্দ যেন এসব কোনদিন জানতে না দেয় তোমাকে। এটাও বলে যে, ঠিক সময় তোমাকে তার হাতে তুলে দিবে। নিজের সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি যখন শতাব্দের কাছে এসেছিলে, বুকে পাথর রেখে তোমার বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল তোমাকে। ওর ভয় ছিল কখনো সত্যি জেনে ঘৃ*ণা করবেনা তো তাকে? ভাগ্যের পরিহাসে তার সবচেয়ে বড় ভয়টাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। আয়শার মৃ*ত্যুর কারণ জড়িয়ে তুমি ঘৃ*ণা করতে শুরু করলে। আমার ছেলেটা ভেঙ্গে পড়েছিল। ক্ষণে ক্ষণে তপ্ত আগুনে পু*ড়তো। তার বাহিরের শক্ত ব্যক্তিত্ব দেখে অন্যকেউ টের না পেলেও, ওর ভেতরের তপ্ত আগুনের তান্ডব আমি ঠিক বুঝতাম। মা যে তাই হয়তো চোখে পড়তো। এতটা বছর আমার ছেলে ভালো ছিলনা। তোমাকে না পাওয়ার আক্ষেপে ভেতরে ভেতরে নিজেকে জ্বা*লিয়ে পু*ড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছিল।শুধু তোমাকে পাওয়ার জন্য শেষমেশ তার অপছন্দের  নোং*রা রাজনীতিতেও হাত ডোবাল।’

প্রিয় তখনো চুপ। চোখজোড়া ছলছল। অভিলাষা আবার বলল,

‘ আমি তোমাকে অনেক বেশি স্ট্রং ভাবতাম। আফসোস আমার ছেলের এতবছরের অপেক্ষা দুরত্ব বিফল হলো। ও ভয়ে আড়ালে রইল তুমি সেই অঘটন ঘটালে প্রিয়। তোমার এই শক্তপোক্ত আচরণ নিতান্তই ঠুনকো। ভেতর থেকে তুমি এখনো সেই আগেকার দুর্বল প্রিয়’ই রয়ে গেছ। তবে তোমাকে একটা কথা অবশ্যই বলবো। নারীকে কেউ কখনো ভালোবাসে না। হয়তো তার রুপের মোহে জড়ায়, নয়তো গুনের অতলে গড়ায়। যদি কখনো কোন পুরুষ কোন নারীর আত্মাকে ভালোবাসে তাকে আগলে রাখতে হয় প্রিয়। নয়তো একদিন গুড়িয়ে যায় সব! তখন কপাল হাতিয়ে কেঁদে লাভ হয়না কোন। বাকিটা তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, ভালো বুঝবে।’ 

অভিলাষা চলে গেল। থম মেরে বসে রইল প্রিয়। অশ্রু ঝরছে টপটপ। মনে প্রশ্ন হাজারো। চারিদিকে সবকিছু এতো এলোমেলো অগোছালো কেন! তার ভেতরের ব্যপারটা কাউকে কি করে বুঝাবে। কি রকম ভয়*ঙ্কর অন্ধকার অতলের গোলকধাঁধায় ফেঁসে আছে সে।

 

শতাব্দের বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা বাজল। বাড়ি এসে প্রথমে প্রিয়’র ঘরে উঁকি দিলো। অন্ধকারে ডুবে আছে ঘর। ঘুমিয়ে গেছে? হয়তো। সামনের দিক পা বাড়াল না আর। নিজের ঘরের আলো জ্বালাতে চমকে গেল। বিছানার পাশে গা এলিয়ে চোখ বুজে আছে প্রিয়। তীব্র আলো চোখে পড়তে নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। আধোঘুমে চোখ খুলে শতাব্দকে দেখলো। হাত ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখছে। প্রিয়’কে দেখেও, দেখল না যেন শতাব্দ। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল,

‘ শরীর কেমন লাগছে? রাতের খাবার খেয়েছ?’

শতাব্দের দিক বিমূঢ় তাকিয়ে রইল প্রিয়। একবারের জন্যও তার দিক তাকাচ্ছে না শতাব্দ। হাসপাতাল থেকে লক্ষ করছে শতাব্দ তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। প্রিয় উত্তর দিলো না কোন। শার্ট পাল্টে ফ্রেশ হয়ে এলো শতাব্দ। প্রিয়’র মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসল। চোখেচোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে? এত রাতে এখানে কেন।’

শতাব্দের চোখ চোখ রেখেই উত্তর দিলো প্রিয়,

‘ আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।’

‘ বলো, শুনছি!’

প্রিয় খানিক চুপ রইল। নিশ্বাসের গতি বাড়ছে তার। অদ্ভুত এক ভয় কাবু করছে মন। আশেপাশে চেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। বড় বড় শ্বাস টেনে বলল,

‘ খালা মা*রা যাওয়ার রাতে আপনি ইমান্দিপুর এসেছিলেন কেন?’

হতভম্ব শতাব্দ। এতবছর পর সেই রাতের কথা তুলছে কেন প্রিয়? আর সেই রাতের কথা ও’ইবা কি করে জানলো। শতাব্দ গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ তোমার কি মনে হয়? কেন গিয়েছিলাম?’

এমন উত্তরের আশা করেনি প্রিয়। অধৈর্য হয়ে পড়ল। চোখজোড়া টলমল করছে। অস্থির, অধৈর্য কন্ঠে বলল,

‘ আমার কি মনে হয় তাতে কিছু আসেযায় না! এই লুকোচুরির খেলা আমি আর নিতে পারছিনা। সত্যিটা শুনতে চাই। গত দুই বছর ধরে প্রতি মুহূর্ত ছটফট করছি এই উত্তরের আশায়।  সেই  রাতে কেন ছাদের দরজা দিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছিলেন? ভেতরে দুই- দেড় ঘন্টা কি করছিলেন? কেন ছিলেন? তার পরেরদিন কাজের খালাকে ভয় দেখিয়ে টাকা দিয়ে কেন গ্রাম ছাড়া করেছিলেন?’

শতাব্দ গম্ভীর। ঠান্ডা আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুমি এসব কি করে জানো?’

রাগে ফেটে পড়ল প্রিয়। নিজের রাগ দমানোর যথাযথ চেষ্টা চালাল। খানিক সময় নিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল,

‘ দুবছর আগে ঢাকার বাহিরে ফটোশুট ছিল আমার। সেখানে অপ্রত্যাশিত ভাবে কাজের খালার সাথে দেখা হয়। প্রথমে আমাকে দেখে পালাতে চেষ্টা করছিল। আমি আশ্বস্ত করি, তাকে বুঝাই।  পরবর্তীতে তিনি সবকিছু খুলে বললেন আমায়। সেই থেকে আপনার খোঁজখবর নেই। জানতে পারি অনেক দিন ধরে আমার উপর নজর আপনার। বাবার সেই জুনিয়র বন্ধুও আপনি। আপনার কি ধারণা আপনি আমার উপর নজর রাখছিলেন? বাবাকে দিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করেছেন। এখনকার দিনে কোন মেয়ে না জেনে, না শুনে কেউ কাউকে বিয়ে করবে এটা কি আদৌ সম্ভব! 

উহু, আমি নিজের ইচ্ছায় আপনাকে বিয়ে করেছি। আমি জাল  ফেলেছি আপনি ধরা দিয়েছেন। সত্যটা খোঁজার চেষ্টা করেছি। পারছিনা আর। এখন আমার উত্তর চাই! কেন করেছেন এসব?’

শতব্দের বিস্মিত চাহনি। চাপা রাগের শক্ত আওয়াজ,

‘ তোমাকে বলতে আমি বাধ্য নই।’

ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল প্রিয়’র। চিৎকার করে বলল,

‘ আপনি অবশ্যই বাধ্য। সেই রাতে যেই মহিলা মা*রা গেছে অনাঙ্ক্ষিত ভাবে তিনি আমার মা! উনার সাথে কি ঘটেছে। কি হয়েছে তা শুনতে চাই আমি। আর আপনি বলতে বাধ্য!’

 

শতাব্দ চুপ আগের মতই গম্ভীর, রাশভারী। উত্তরের অপেক্ষা করল প্রিয়। শতাব্দের কোন জবাব না পেয়ে। ঠান্ডা, শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি ধরে নিবো আমাকে পাওয়ার জন্য, পথের কাটা সরাতে আপনি উনাকে খু*ন করেছেন!’

আ*হত দৃষ্টিতে তাকাল শতাব্দ। গভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ এই তোমার বিশ্বাস?’

‘ আপনি ভাবতে বাধ্য করছেন আমায়।’

‘ তুমি যেহেতু মেনে নিয়েছ। কোনকিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই আর।’ 

‘ সত্যিটা শুনতে চাই!’

শতাব্দ রাগে চেঁচিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলল,

‘ তোমাকে বলতে বাধ্য নই।’ 

শতাব্দের দিক অনড় চেয়ে রইল প্রিয়। চোখজোড়া থেকে অঝোরে পানি ঝরছে। বুক যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল প্রিয়। কান্নাভেজা শক্ত কন্ঠে বলার চেষ্টা করল,

‘ সত্যিটা জানতে আমি আপনার কাছে এসেছি। কোথাও কিঞ্চিৎ আশা ছিল, ভুল প্রমাণিত হবো। যদি আমার সন্দেহ-ই সঠিক হয়। তবে বিচ্ছেদ চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স দিয়ে মুক্ত করে দিন আমাকে!’

শতাব্দ তেতে উঠল। লা*থি দিয়ে চেয়ারটা দূরে ছুড়ে ফেলল। প্রিয়’র বাহু ধরে বিছানায় ফেলে। উপরে উঠে গেল। প্রিয়’র দিক ঝুঁকে মুখ চেপে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘এতবছর আড়ালে থেকেছি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে এনে, শান্ত স্বাভাবিক ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছি। তোমাকে সময় দিয়েছি ভেবেছিলাম বুঝদার হবে তুমি। ভুল ছিলাম। তুমি আপোষে মানার পাত্রী নও। আমি এখনো সেই পুরানো শতাব্দই আছি। আমাকে রাগিয়ে দিলে তোপ সামলাতে পারবেনা তুমি। ডিভোর্সের কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলো। একটু ভাবো, যেই মানুষটা তোমাকে পেতে এতটা হিং*স্র হয়েছিল। তোমাকে কাছে রাখতে সেই মানুষ কতটা হিং*স্র হতে পারবে!’ 

 

 চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৪১.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

নাইট শিফটের ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরল শতাব্দ। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে চোখজোড়া ফুলে র*ক্তিম। মাথাটাও চিনচিনে ব্যথা করছে। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল, প্রিয়’কে দেখা যাচ্ছেনা কোথাও। সেইরাতের পর আজ এক সাপ্তাহ। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ। শতাব্দ বরাবরই এড়িয়ে চলছে প্রিয়’কে। প্রিয় এখনো তার জিদ এঁটে বসে। সময় গড়াচ্ছে দুজনের ভেতর দুরত্ব বাড়ছে। রাগ, ক্ষো*ভ আরো শক্ত ধারালো রূপ নিচ্ছে। 

পানি নিয়ে এসেছে প্রভা। শতাব্দ পানির গ্লাস হাতে তুলে জিজ্ঞেস করল,

‘ প্রিয় বাড়িতে নেই?’

‘ সকাল সকাল বেরিয়ে আপা।’

‘ ভার্সিটিতে গেছে?’

‘  না, আজ ক্লাস নেই। সমাবেশের নিমন্ত্রণ ছিলো। অতিথি হয়ে গেছে সেখানে।’

থমকে গেল শতাব্দ। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘ রাজনৈতিক সমাবেশে ওর কি কাজ? কোথায় গেছে কিছু বলেছে?’

প্রভার বিহ্বল আওয়াজ,

‘ না যাওয়ার আগে শুধু বলল, ঢাকার বাহিরে একটা সমাবেশ আছে, সেখানে অতিথি হয়ে যাচ্ছে।’ 

প্রচন্ড রাগ হলো শতাব্দের। তড়িঘড়ি করে ফোন বের করে প্রিয়’র অফিসে ফোন করল। সেখান থেকে ঠিকানা জোগাড় করে তড়িঘড়ি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঠিকানাটা ঊষ্ণচরের কাছাকাছি। যদি শতাব্দ ভুল না হয়, সেখানে ছবি বেগমও উপস্থিত। আগামী নির্বাচনের প্রচারণা করতে গিয়েছে। প্রিয় নিশ্চয়ই জানে সব। তাই হয়তো ইচ্ছে করে সেই সমাবেশের অতিথি হয়ে গেছে।

গাড়ি চালাচ্ছে আর বারবার প্রিয়’র নাম্বারে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করছে শতাব্দ। ঢুকছে না। বন্ধ বলছে। রাগে ক্ষো*ভে আছ*ড়ে ফেলল ফোন।

 

সামনে হাজারো মানুষের সমাগম। স্টেজে নেতা-নেতৃবৃন্দ। এসব রাজনৈতিক সমাবেশে আগে কোনদিন আসেনি প্রিয়।প্রত্যাশা ব্যান্ড বেশ পরিচীত হওয়ার সুবাদে প্রত্যাশা ম্যাডামের সাথে রাজনীতি খাতের অনেকেই পরিচীত আছে। উনাকে রিকোয়েস্ট করে এখানকার সমাবেশে অতিথি হয়ে এসেছে প্রিয়। অনেক সাংবাদিক আছে এখানে। তার দেওয়া চাঞ্চল্য ভার্তা সারা দেশে আগুনের গতিতে ছড়াবে। তার কার্জসাধনের জন্য এটাই সঠিক স্থান।

প্রিয়’কে এখানে দেখে ছবি বেগমের চোখমুখের রঙ পাল্টে গেছে। মুখ জুড়ে ভয় আ*তংক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আসার পরপরই লোকজন সব ঠিক করে রেখেছে। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হা*মলা করবে প্রিয়’র উপর। এখানেই সরাসরি খু*ন করবে। এতো লোকের ভিড়ে কাজ করতে সহজ হবে। যা অনেক বছর আগে শতাব্দের জন্য পারেনি। আজ করবে। মিটিয়ে ফেলবে এই জঞ্জাল ঝামেলাকে! 

 

উপস্থাপক প্রিয়’র প্রশংসা করল। মাইকে ডেকে, রাজনীতি নিয়ে বলতে বলল। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল প্রিয়। ছোট ছোট পা ফেলে মাইকের সামনে দাঁড়াল সে। বড়সড় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে। হাতপা প্রচন্ড রকম কাঁপছে। আজ তার জীবনের অপ্রিয় কালো অতীতকে সবার সামনে আনবে। হয়তো আজকের পর সব পাল্টে যাবে। সব সম্পর্ক এলোমেলো হয়ে যাবে। সোসাল মিডিয়ায় ঝড় উঠবে। নানারকম প্রশ্ন, বাজে পরিস্থীতির মুখোমুখি হতে হবে। তার ক্যারিয়ার অস্তিত্ব সব বিলীনের পথে নামবে। হয়তো শতাব্দ চিরকালের জন্য মুখ ফিরিয়ে নিবে। তবুও সে এটা করবে। অনেক বছর আগে যেভাবে তাকে আর তার জন্মদাত্রীকে সারা গ্রামের সামনে চরিত্রহীনা প্রমাণ করে, তাদের মানসম্মান সব ধুলোয় মিশিয়েছে। জীবনের জঘন্য পরিস্থীতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। আজ তার শোধ নিবে। হাজার হাজার মানুষের সামনে তাদের ঠুনকো মান সম্মান সব টেনে খুলবে। তাদের সব অ*ন্যায় অহং*কার মাটিতে মিলিয়ে দিবে।

চোখ বুজে ছোট শ্বাস ফেলল প্রিয়। সূর্যের তীর্যক রশ্মি তার চোখেমুখে পড়ছে। মাথা উঁচু করে সামনের দিক তাকালো। প্রথমে সেখানে উপস্থিত সকল নেতা নেতৃবৃন্দদের প্রসংশা করল। তারপর বর্তমান যুবসমাজে রাজনীতির প্রভাব তুলে ধরল। কায়দা করে বলল,

‘ আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন এখানে উপস্থিত আপনাদের প্রিয় ছবি বেগমের সাথে আমার পারিবারিক সংযোগ আছে। তিনি আমার স্বামীর ফুপু। আমার ফুপু শাশুড়ী!’

সামনের থেকে উচ্ছাসীত উচ্চস্বর ভেসে এলো। সাংবাদিকগণ ক্যামেরা হাতে স্টেজের দিক ধরে। লাইভ ব্রডকাস্ট চলছে। চিন্তিত মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টানল ছবি বেগম।

খানিক চুপ থেকে ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি টেনে প্রিয় আবারো বলল,

‘ সেই সাথে আমাদের আরো একটা সম্পর্ক আছে। তিনি আমার স্টেপ মাদার। আমি শোয়েব হক ও তার প্রথম স্ত্রী আয়শা বেগমের মেয়ে। যদিও আমাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব  চলছে, তাতে কি! আমি চাই উনি যেন আগামী নির্বাচনে জয় হয়। উনার প্রতি আমার শুভকামনা থাকবে।’

চাপা গুঞ্জন হতে শুরু করল। স্টেজে অন্যান্য নেতাকর্মীরা ছবি বেগমকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করছে। সাংবাদিকদের ভেতর চাঞ্চল্য ছড়িয়ে। একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ছে। কোন উত্তর দিলো না প্রিয়। নিজের আসনে ছবি বেগমের পাশে যেয়ে বসলো। তার দিক ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ বিষে বিষ কা*টে। আমার সবচেয়ে অপ্রিয় জ*ঘন্য অতীত আপনাদের কাল হয়ে দাঁড়াবে। আমি আগুন ধরিয়ে দিয়েছি, বাতাস দেওয়ার কাজ সাংবাদিকরা করবে। আর বাদবাকি কাজ পাবলিক আর পুলিশ দেখবে। আমি কথার খেলাফ করিনা। বলেছিলাম জ্বা*লিয়ে দিবো। আপনাদের সব অ*হংকার, দম্ভ মাটিতে মিলিয়ে দিবো! সবে শুরু আরো অনেক কিছু বাকি আছে এখনো!’      

সমাবেশে হৈচৈ শুরু হয়েছে। ছবি বেগমের বিপরীত দলের লোকজন এমনি এক সুযোগের তালা*শ করছিল। জনসাধারণের মাঝে হৈচৈ শুরু করে। দুইদলের লোকজনের হা*তাহাতি শুরু হয়। চারিদিকে বিশৃ*ঙ্খল পরিবেশ। ছবি বেগম ক্রো*ধে টগবগ করছে। সবার আড়লে যেয়ে, ছেলেকে ফোন করে লোকজন জোগাড় করে রাখতে বললেন। ইশারা করতেই যেন, প্রিয় উপর হা*মলা পড়ে। এখানে ভিড়ের মাঝে খু*ন করে। পুলিশ এসে পরিস্থীতি সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। স্টেজ থেকে নামিয়ে গাড়ি অবধি তুলে দিচ্ছে অতিথিদের। প্রিয় নামার সময়, ছবি বেগম লিমনকে ইশারা করল। সাথে সাথে কয়েকজন লম্বা বলিষ্ঠ লোক এসে হা*মলে পড়ল। হাতে মোটা লা*ঠি, ধা*রালো অস্র। পুলিশের লা*ঠি চার্জ ডিঙিয়ে প্রিয় অবধি এলো। টেনে হিঁ*চড়ে প্রিয়’কে ভিড়ে ভেতর নিয়ে গেল। একজোট হয়ে গোল করে  প্রিয়’কে ঘিরে নিলো। যেন পালানোর সুযোগ না পায় কোন। সামনের মানুষটা যে লিমন। মুখ ডেকে রাখলেও বুঝতে বাকি রইল না প্রিয়’র। লা*ঠি ঘোরাত ঘোরাতে এদিকে আসছে। ভয়ে বিহ্বল প্রিয়। শরীর কাঁপছে থরথর। এমন কিছু হতে পারে, বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা তার। মাটিতে পড়ে আছে সে, গা ধুলাবালিতে মেখে। লিমন ক্রো*ধানিত্ব কন্ঠে গর্জিয়ে বলল,

‘ খা*** বাচ্চা। কলিজা কত বড়। আমার মায়ের সাথে ঝামেলা! পাব্লিকের সামনে গলাবাজি করা! আমার বাপের অবৈধ সন্তান। কি চাই? টাকা পয়সা, সম্পত্তি’র ভাগ চাই! এর জন্য এত নাটক। কথায় আছে, পিপীলিকার পাখা গজায় ম*রিবার তরে। আজ এখানেই তোর ম*রণ হইবো। কেউ বাঁচাতে পারবেনা। শতাব্দও আজ নাই!’

চোখের ভয় মিলিয়ে দিয়ে, ঠোঁট মেলে হিং*স্র হাসলো প্রিয়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

‘ ওই কা*পুরুষের এক পয়সাও আমার চাইনা। টাকার না ,ন্যায়ের ভুখা! আমি থাকি আর না থাকি, তোদের পতনের বেশি দেরি নেই!’

 ক্*ষেপে উঠল লিমন। এগিয়ে আসছে তার দিক। চোখ বুজে নিলো। শক্ত হাতে মাটি আঁকড়ে মনে মনে আওড়াল,

‘ সমাপ্তি যদি এখানেই হয় আমার আফসোস নাই। তবে আরেকটু সময় চাই। এই নৃ*শংস অত্যা*চারীদের পতনের সাক্ষী হতে চাই!’

লা*ঠি উঁচিয়ে লিমন মাথায় যেই আঘা*ত করবে অমনি কেউ ভিড় ঠেলে এসে প্রিয়’কে ঝাপটে ধরল। লা*ঠির আঘা*ত তার পিঠে পড়ল। তখনো চোখ বুজে প্রিয়। নাকে তীব্র ঘ্রাণ বাঁধলো। এই ঘ্রাণের সাথে নিবিড় ভাবে পরিচীত প্রিয়। অনুভূতি বলছে, শতাব্দ এসে, ঝাপটে ধরেছে। পিটপিট চোখ খুলল। দৃষ্টি উঁচিয়ে সামনে চাইল। সামনের মানুষটার ক্লান্ত, ভীতিকর মুখখানায় রাগের তীব্র আভাস। তার চিন্তিত হাত প্রিয়’র গাল ছুঁয়ে দিলো। ঘাবড়ানো, ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুমি ঠিক আছো?’

উত্তরে প্রিয় প্রশান্ত হাসলো। ছলছল চোখজোড়া থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। ফিসফিস করে ঠোঁট নাড়াল,

 ‘শতাব্দ! ‘

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে চোখমুখ পাল্টে গেল। শতাব্দের কপালের রগ ভুলে উঠল। চোয়াল শক্ত। ধপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্ষি*প্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে লিমনের পেটে লা*থি মেরে নিচে ফেলল। আশেপাশের বলিষ্ঠ লোকগুলো ভয়ে চেপে গেল। সবাই বেশ ভালো করে চিনে শতাব্দকে। যদিও ইমান্দিপুরে্র চেয়ারম্যান শাহরিয়ার সাহেব, শতাব্দের কথাতেই গ্রামের সকলে উঠেবসে। তার রাজত্ব চলে। শতাব্দের বিরুদ্ধে গেলে হিতের বিপরীত হবে। ঠাই হবেনা কোথাও। ভয়ে যে যার যার মত ছুটতে লাগল। লিমন উঠে প্রতিবাদে প্রহার করতে চাইলে। শতাব্দ তাকে মাটিতে ফেলে এলোপাতাড়ি মা*রতে লাগলো। লিমনের নাক ফে*টে গলগল র*ক্ত ঝরছে। ঠোঁট মুখ থে*বড়ে গেছে। তবুও থামছে না শতাব্দ। ইট তুলে লিমনের মাথায় আঘা*ত করতে চাইল। অমনি পুলিশ এসে ছাড়ালো। শতাব্দ’কে টেনে ধরে দূরে সরালো। শতাব্দ রাগে গরগর করছে তখনো। শরীরের শার্টে র*ক্ত লেগে। 

 

গাড়িতে গুটিসুটি মে*রে বসে আছে প্রিয়। হাত পা এখনো থরথর কাঁপতে। এসি চলছে তবু্ও প্রচন্ড ঘামছে। এর আগে এমন ভয়া’*নক পরিস্থিতীর সম্মোখীন হয়নি কখনো। নিজের অতীত টেনে ওই লোকটার সন্তান বলে জনসম্মুখে পরিচয় দিয়ে গা ঘিনঘিন করছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, সেই সাথে অদ্ভুত বা*জে রকম অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গলায় কান্না ধলা বেঁধে। অদ্ভুত ভাবে চোখ ভিজছে না। কাঁদছে না। বড় বড় শ্বাস টানল প্রিয়। আড়চোখে শতাব্দের দিক তাকাল। শতাব্দ প্রচন্ডরকম শান্ত, স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক আচরণ যেন কালবোশেখী ঝড়ের পূর্বাভাস। খানিক সময় নিলো প্রিয়। খুব স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনি কি করে জানেন আমি এখানে আছি। কে বলল?’

শতাব্দ উত্তর দিলো না। চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। ধীরেধীরে কপালের রগ, চোয়াল শক্ত হচ্ছে। প্রিয় খাটো স্বরে বলল,

‘ ধন্যবাদ!’

শতাব্দ এবার ক্ষে*পে গেল। রাগ নিয়ন্ত্রণের যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল। প্রিয়’র আচরণে দমিয়ে রাখা রাগ অগ্নিগিরি’র মত ফে*টে পড়ল। দ্রুত গতিতে গাড়ি থামালো। রাগে চেচিয়ে বলল,

‘ এত বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে তোমার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। আজ আমার পৌঁছাতে আরেকটু দেরি হলে কি ঘটতে পারত বুঝতে পারছ? এই পরিচয়টা সবার সামনে আনার কি দরকার ছিল। আমার এত বছরের সব চেষ্টা বিফলে গেল। এর ফল কি হবে জানো? না বুঝে না জেনে তুমি মৌচাকে ঢিল মেরেছ। এতদিন শুধু ছবি বেগম তোমার পরিচয় জানতো। এখন সারা দেশ জানবে। তোমাকে ছেড়ে দিবে ওরা? এর ফল কতটা ভয়*ঙ্কর হবে আন্দাজ করতে পারছ? এই পরিচয়ের কথা জেনেই শেষ পরিক্ষার দিন তোমার উপর ছবি বেগম হা*মলা করেছিল। যেন অতীত সেখানেই ধামাচাপা পড়ে! আর তুমি আজ সেই অতীতকেই সবার সামনে টেনে আনলে।’

প্রিয় রাগে চিৎকার করে বলল,

‘ তো ছেড়ে দিতাম ওদের। আমার সাথে যা করেছে ক্ষমা করে দিতাম! বিনা দোষে গ্রামের সবার সামনে ব্যা*শা বনেছি। আমার জন্মদাত্রী মা আত্নহ*ত্যা করেছে। যাকে মা বলে ডাকার সুযোগটা পর্যন্ত পাইনি। আমার জীবনের প্রত্যেকটা সমিকরণ উল্টেপাল্টে দেওয়া মানুষ গুলোকে ছেড়ে দিতাম? উহু, কখনো না। আমি ওদের জ্বা*লিয়ে দিবো। এতটা ভয়ঙ্কর হবো যে, মৃ*ত্যু’র জন্য ভিক্ষা চাইবে ওরা। মানসম্মান, দম্ভ, অহংকার সব মাটিতে মিলিয়ে দিবো। এতে যদি আমাকে ম*রতেও হয় ম*রবো।’

শতাব্দ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে প্রিয়’র দিক এগিয়ে গেল। গালে শুকনো র*ক্ত মাখা হাত রেখে বোঝানোর স্বরে বলল,

‘ তুমি প্রতি*শোধ চাও তো? আমি তোমার সাহায্য করব! ওদের তোমার পায়ের কাছে এনে ফেলবো। শুধু তু্মি সেফ থাকো। আমাকে একটু বিশ্বাস করো!’

গাল থেকে হাত সরিয়ে দিলো প্রিয়। নিমিষ চেয়ে, তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

‘ বিশ্বাস! আপনাকে?’

বলে হেসে ফেলল প্রিয়। চোখজোড়া ছলছল করছে। গলা ধরে আসছে। কান্না চেপে বলল,

‘ আমি আপনাকে কি করে বিশ্বাস করবো শতাব্দ? সবচেয়ে বড় গোলকধাঁধা তো আপনি নিজেই। যার ভেতর আমি ক্ষণে ক্ষণে নিজের অস্তিত্ব হারাচ্ছি। আমি আপনাকে সাহায্য করতে বলিনি। আপনার দয়া আমার চাইনা। 

আপনি সত্যিটা বলবেন না তো। আমিও আর জানতে চাইবো না। তবে শুনে রাখেন আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না!’

শেষের তিনটা শব্দ শতাব্দ’কে ক্ষেপিয়ে দিতে যথেষ্ট। যার জন্য সব সম্পর্ক ভুলিয়ে দিয়েছে। নিজের অস্তিত্ব পছন্দ অপছন্দ সব বিলীন করেছে। সেই মানুষটা তাকে সামান্য বিশ্বাস করতে পারছে না? তেতে গেল শতাব্দ। রাগে গাড়ির স্টিয়ারিং’য়ের উপর পরপর দুইতিনবার বাড়ি মা*রল। মা*রামা*রির সময় কে*টে যাওয়া জায়গাটা থেকে, রক্ত ঝরছে টপটপ। রাগে চুল টেনে পিছনে টানল। ফোসফোস নিশ্বাস ফেলছে। রাগ দমাতে চেষ্টা করল। পারছেনা। আচমকা প্রিয়’র দিক ঝুঁকে এলো। বাহু চেপে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

‘ তোমার কথায় আমি চলবো? শুনো মেয়ে তুমি বিশ্বাস করো আর না করো। তাতে কিছু আসেযায় না আমার। তুমি মানো আর না মানো তুমি আমার কথা শুনতে বাধ্য। প্রয়োজনে যদি জোর খাটাতে হয়, বেঁধে রাখতে হয় তাই করবো। বুঝেছ?’

শতাব্দের শেষ ধমকে কেঁপে উঠল প্রিয়। চোখজোড়া অশ্রুভারাক্রান্ত। এই যেন অন্যকোন শতাব্দ! কি হিং*স্র চাহনি তার। নিশ্বাস ফেলতে পারছেনা। ঘামছে! ভয় পাচ্ছে প্রিয়। চোখজোড়া নিভুনিভু হয়ে আসছে তার। 

প্রিয়’র অ্যাংজাইটির সমস্যাটা কি আবার দেখা দিলো! ঘাবড়ে গেল শতাব্দ। মাথা আউলে গেল। বারকয়েক প্রিয়’কে আলতো স্বরে ডাকল। উত্তর এলো না কোন। ধীরেধীরে ঝুঁকে পড়ছে প্রিয়। শতাব্দ আরো বেশি ঘাবড়ে গেল। আচমকা বুকে টেনে নিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ কিছু হয়নি জান! ডিপ ব্রিথিং নেও। শান্ত হও। আমি আছি। এখানেই, তোমার কাছে!’

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৪২.

 

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

দিনের আলো নিভিয়ে চারিদিক অন্ধকারে ডাকছে। বিকালের অন্তিম প্রহর কাটিয়ে, সন্ধ্যা নামছে ভুবনে। বিছানায় অচেতন পড়ে আছে প্রভা। পাশে বসে নিগূঢ় চেয়ে আছে সমুদ্র। সবার সামনে সবকিছু স্বাভাবিক দেখালেও, ভেতর ভেতরে দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব বিশাল। অনেকবার প্রভাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সে শুনতে নারাজ। এরপর হাল ছেড়ে নিজের মত থাকতে শুরু করেছে সমুদ্র। প্রভার অচঁচল, অন্ধ জেদের সামনে বরাবরই দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবটা সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। আজ দুপুরে টিভি চ্যানেলের নিউজ দেখে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রভা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে জানায়, খাওয়াদাওয়ার, অনিয়ম, মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় প্রেসার লো হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। বাসায় ফিরেছে খানিক পূর্বে, ঘুমের ঔষধ দিয়েছে। ঘুমাচ্ছে।

 

সন্ধ্যার পর ঘুম ভাঙ্গল প্রভার। দুর্বল চোখের পিটপিট চাহনি। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই সমুদ্রকে দেখল। দুহাতে বিছানায় ভর ঠেকিয়ে উঠতে চাইল। আটকালো সমুদ্র। বলল,

‘ অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠছ কেন! কিছু লাগবে? আমি দিচ্ছি।’

কোন উত্তর দিলো না প্রভা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো, একপ্রকার জোর খাটিয়ে বিছানা থেকে নামতে চাইল। তেতে উঠল সমুদ্র। প্রভার হাত চেপে ধরল। ক্রো*ধান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ সমস্যা কি তোমার! কথা বলছি কানে যাচ্ছে না?’

এবারো উত্তর দিলো না প্রভা। ছলছল চোখ নিয়ে হাত ছাড়ানোর জোরালো চেষ্টা চালাল। অকপটে ক্ষেপে আছে সমুদ্র। ছাড়বে না সে। একটা সময় প্রভা ক্লান্ত হয়ে কেঁদে ফেলল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। সমুদ্র হতভম্ব, বিমূঢ়! বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে। 

প্রভা পা ভাঁজ করে বসে, হাউমাউ করে কাঁদছে। সাথে সাথে মুখোমুখি বসে পড়ল সমুদ্র। প্রভার দুগালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে তোমার। এভাবে কাঁদছ কেন?’

সমুদ্রের জিজ্ঞাসায় কান্নার বেগ আরো বাড়ল। কোথাও চাপা পড়ে থাকা অভিমানটা ফুপিয়ে উঠল। সমুদ্রের বুকে মাথা ঠেকাল। টিশার্টে খামচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বিহ্বল সমুদ্র যন্ত্রের মত হাত তুলে, প্রভার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করতে চাইল। প্রভা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে তখনো। সমুদ্র আবারো জিজ্ঞেস করল,

‘ আমি কি এখন তোমার এতই অপছন্দ! যে আমার স্পর্শে য*ন্ত্রণা বেড়ে যায় আরো।’

সমুদ্রের বাঁকা কথায় প্রভার কান্না বেড়ে গেল। সে কি করে বুঝাবে কতটা ভালোবাসে সমুদ্রকে। এই কয়েকদিন সমুদ্রের এড়িয়ে চলা তাকে কতটা যন্ত্র*ণা দিয়েছে। কতটা পু*ড়িয়েছে। হুট করে তানহার কথা জেনে প্রচন্ড আঘা*ত পেয়েছিল প্রভা। মেনে নিতে পারেনি নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার প্রথম প্রেমকে। অভিমান, ইগোর তলে দেবে গিয়েছিল সে। উপচে উঠতে পারছিলনা নিজের জেলেসি, অভিমান থেকে। সমুদ্রকে দেখা মাত্রই পুরানো ঘা’য়ে লবণের ছিঁটা পড়ত।তাই  বারবারই এড়িয়ে চলত। কিন্তু যেই সমুদ্র মুখ ফিরিয়ে নিলো। এড়িয়ে চলতে শুরু করল! অমনি নিজেকে নিঃস্ব মনে হলো। সবকিছু  এলোমেলো হয়ে গেল। ক্ষণে ক্ষণে তপ্ত আগুনে পু*ড়ছিল। রাতের ঘুম, খাওয়া দাওয়া সব উঁড়ে গেল। দিনের পর দিন নির্ঘুম রাত কাটাতে লাগল। অনেকবার নিজের থেকে এগিয়ে সবকিছু মিটমাট করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওইযে ইগো! দেয়াল হয়ে দাঁড়াল। কোনভাবেই মুখোমুখি দাঁড় হতে পারছিলনা সমুদ্রের। শক্ত অভিমান চেপে এড়িয়ে চলছিল। আজ পারছেনা আর। অভিমানের পাথর ঠেলে, ভালোবাসা সুপ্ত চারাগাছের মত মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়েছে। মনের গহিনে হাজারো কন্ঠে স্লোগান তুলছে, আজ নয়তো, কোনদিন নয়! হয়তো হারিয়ে ফেলবে তার ভালোবাসা সমুদ্রকে।

কান্নাভেজা আধোআধো কন্ঠে ফিসফিস করে বলল প্রভা,

‘ ভালোবাসি সমুদ্র! অনেক বেশি ভালোবাসি।’

হতভম্ব সমুদ্র পাথর হয়ে বসে রইল। তার কানে আওয়াজ এলোও মস্তিষ্কে বসতে সময় লাগছে। যা শুনেছে সত্যি তো! 

আচমকা হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে হাসির বিশাল রেখা ফুটে উঠল শক্ত করে বউকে বুকে জড়িয়ে নিলো। জোরালো অকপটে আওয়াজে বলল,

‘ আমিও প্রচন্ড ভালোবাসি বউ। তুমি আমার জীবনের আঁধার রাতের উজ্জ্বল আলো! তোমাতে তুমি শ্রেষ্ঠ। না, তোমার মত কেউ ছিল। না থাকবে কখনো। তুমি আমার একমাত্র’

ছলছল চোখ নিয়ে হেসে ফেলল প্রভা। সমুদ্র কানের কাছে মুখ নিয়ে আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ অতীতের সব স্মৃতি পু*ড়িয়ে দিয়েছি। ছুড়ে ফেলে দিয়েছি আমাদের দূরত্বের সব কারণ। হাজার তানহা আসলেও, আমার প্রভার সামনে ফিকে পড়বে সব!’

সমুদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রাখল প্রভা। অনেক দিন পর আজ শান্তি মিলল। এরচেয়ে মধুর অনুভূতি কি আছে কোথাও! 

 

রাত করে বাড়ি ফিরল প্রিয় শতাব্দ। পথেই প্রভার অসুস্থতার কথা শুনেছিল। জ্যামে আটকে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে তড়িঘড়ি করে বোনের ঘরে গেল প্রিয়। দরজা ভিড়ানো একপ্রকার হুড়মুড়িয়ে ডুকে গেল। ভিতরে ডুকে বেক্কল বনে গেল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে প্রভা। পাশে বসে মুখে ফল তুলে দিচ্ছে সমুদ্র। প্রিয়কে দেখে খানিক দূরে সরে বসলো। লজ্জায় পড়ে গেল প্রিয়। আমতা আমতা করে বলল,

‘ সরি, আসলে দরজা খোলা ছিল। তাই…’

বিব্রত পরিস্থীতি এড়াতে সমুদ্র স্বাভাবিক হয়ে বলল,

‘ সমস্যা নাই। ভিতরে আসো।’

জড়সড় ছোটছোট পা ফেলে প্রিয় ভেতরে গেল। প্রভাকে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছিল? হ্ঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লি কি করে? বেবি ঠিক আছে তো!’

‘ বেবি’র’ কথা জিজ্ঞেস করতেই প্রভা ঘাবড়ে গেল। সমুদ্র চুপচাপ। বিয়ের আগে প্রভা বলেছিল, সে প্রেগন্যান্ট তাই প্রিয় বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিল। বিছানা ছেড়ে উঠল সমুদ্র, কায়দা করে বলল,

‘ তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।’

বাহানা দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। সমুদ্রের যাওয়ার দিক প্রভা অসহায় চেয়ে রইল। সে জানে তার আপাকে। এই মিথ্যা কথার জন্য নিশ্চয়ই রাগে ঘাড় ভাঙবে তার। প্রিয় অস্থির কন্ঠে তাড়া দিয়ে বলল,

‘ কি হলো, বেবি ঠিক আছে তো?’

ছোট ঢোক গিলল প্রভা। আমতা আমতা আওয়াজে বলল,

‘ আমি প্রেগন্যান্ট না আপা। তোকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য মিথ্যা বলেছিলাম।’

চোখমুখ খিঁচে নিলো প্রভা। বোনের ধমক, রাগ ঠেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। প্রিয় চুপ, শান্ত। হতভম্ব চেয়ে আছে। চেহারায় খানিক বিষাদের আভাস। বোনের আওয়াজ না পেয়ে চোখ খুলে তাকালো প্রভা। ধপ করে হাত জড়িয়ে ধরলো। আকুতি স্বরে বলল,

‘ আপা রাগ করো না প্লিজ! তখন কোন উপায় মাথায় আসছিল না। যা মনে হয়েছে হুট করে বলে দিয়েছি।’

প্রিয়’র শান্ত আওয়াজ,

‘ আমি ভাবছিলাম, বাড়ির সবাইকে ভয় করে প্রেগ্ন্যাসির কথা লোকাচ্ছিস।তোদের দুজনের ঝামেলা চলছে, মিটে গেলে জানাবি সবাইকে।’

প্রভার অনুতপ্ত নিস্তেজ স্বর,

‘ সরি আপা, ভুল হয়ে গেছে। রাগ করিও না। আমি তোমাকে মিথ্যা বলতে চাইনি! ঠকাতে চাইনি।’

‘ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঠকে গেলাম।’

প্রভা বোনের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আকুতি জুড়ে বলল,

‘ সরি। প্লিজ রাগ করো না।’

‘ উহু, রাগ করিনি। এমনিতেও আমি তোর কথাতে বিয়ের জন্য রাজি হইনি। আমার উদ্দেশ্য অন্য। হ্যাঁ, সামান্য আপস্যাড হয়েছি। বাড়িতে বাচ্চা আসবে শুনে খুশি হয়ে ছিলাম। কোলে নিবো, আদর করব, সন্তানের মত….’

এতটুকু বলে চুপ হয়ে যায় প্রিয়। খানিক শান্ত থেকে উদাসীন কন্ঠে বলল,

‘ ব্যাপার না। আজ না হয় কাল, বাড়িতে বাচ্চা আসবে। মা হবি তুই। কারো কারো হয়তো মাতৃত্বসুখ অনুভব করার সেই সুযোগটাও নেই।’

বোনের গম্ভীর ছলছল চোখজোড়ায় তাকিয়ে আছে প্রভা। হ্ঠাৎ কি হলো তার। রেগে যাওয়ার বদলে এতটা আবেগী হচ্ছে কেন আপা!

 

সমাবেশে ঝামেলার ব্যাপারটা নিয়ে টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চলছে। ইতোমধ্যে মোটামুটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপারটা ছড়িয়ে গেছে। জল এতটা ঘোলা হতোনা যদি না প্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার না হতো। তার আইডি পেজে নানারকম ম্যাসেজ আসছে। সাংবাদিকরা শোয়েব হকের অতীত বর্তমানের পুরো হিস্ট্রি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। সবার একটাই প্রশ্ন, ‘আসলেই কি শোয়েব হকের প্রথম স্ত্রীর মেয়ে অশীতা জাফর প্রিয়!’

বাড়ি ফিরে শতাব্দের মুখোমুখি হয়নি প্রিয়। আসার পর একের পর এক ফোনে ব্যস্ত। প্রিয়কে সুরক্ষা করতে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছে।

আজকের ব্যাপারটা নিয়েও কেউ কোন কথা বলছেনা। না প্রিয়’কে কিছু জিজ্ঞেস করছে বাড়ির কেউ। অভিলাষা বেগম অনেক আগেই এমন কিছু হবে বলে ধারণা করেছিল। ভাইয়ের দিক আঙুল তুলছে, বা*জে মন্তব্য উঠছে তা নিয়ে কোন আফসোস নেই। বরং তার ভাষ্যমতে এমনটা আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। তারা আরো ভ*য়ানক কিছুর কাম্য!

 

গভীর রাত। শতাব্দের ঘরে আলো জ্বলছে। ভিতর থেকে হু*মকি ধ*মকির আওয়াজ। দরজার কাছে কান পাতল প্রিয়। ভেতর থেকে শতাব্দের ক্রো*ধান্বিত আওয়াজ ভেসে আসছে। কাউকে রাগী স্বরে বলছে,

‘ এতকিছু বুঝিনা আমি! কে মামা, কে ফুপু ! তাতে আমার কি! আমার ওয়াইফকে নিয়ে যেন কোন বা*জে নিউজ না ছাপে। বাকিরা সবাই গোল্লায় যাক। আমার তাতে আসেযায় না কিছু।’

অপর পাশ থেকে কিছু বলল। শুনে শতাব্দ ক্ষে*পে গেল। রাগে দেয়ালে বাড়ি দিলো। সাথে সাথে হাতের কা*টা জায়গা থেকে ফি*নকি দিয়ে র*ক্ত ঝরতে শুরু করল। সেই দিকে খেয়াল নেই শতাব্দের। ফোনে চেঁচিয়ে বলল,

‘ ছবি বেগম যত টাকা দিয়েছে আমি তার ডাবল দিবো। যদি আমার ওয়াইফকে নিয়ে কোন বা*জে নিউজ ছাপে, আমি তোদের অফিসে আ*গুন ধরিয়ে দিবো। মাইন্ড ইট!’

ফোন কে*টে বিছানায় ছু*ড়ে ফেলল। অকথ্য ভাষায় সাংবাদিককে গালি দিতে দিতে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গেল। মাথা বিগড়ে আছে প্রচন্ড। অমনি ঘর থেকে খটখট আওয়াজ ভেসে এলো। ঘাড় ফিরিয়ে একবার চাইল। প্রিয় এসেছে। অস্থির হয়ে, কিছু খুঁজছে। ভীষণ শান্ত দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে নিলো, সামনে তাকালো। মিনিট দুএকের ব্যবধানে প্রিয় ফাস্ট এইড বক্স হাতে বারান্দায় এলো। অকপটে চাহনি, অস্থির আওয়াজ,

‘ বসুন, ওষুধ লাগিয়ে দেই হাতে।’

শতাব্দ যেন শুনেও, শুনলো না। নীরবে সিগারেট ফুঁকছে। প্রিয় আবার বলল,

‘ কতটুকু কে*টেছে! র*ক্ত ঝরছে।’

এবারো শতাব্দ চুপ। প্রিয় উত্তরের অপেক্ষায় রইল। কোন জবাব না পেয়ে। জোর করে হাত টেনে ঘরে আনলো। বিছানায় বসিয়ে, মুখোমুখি বসলো। স্যাভলন দিয়ে কাটা জায়গা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। প্রিয়’র চিন্তিত মুখখানায় নিগূঢ়, নিমিষ চেয়ে আছে শতাব্দ। কন্ঠে অভিযোগ এঁটে প্রিয় বলল,

‘ কতখানি লেগেছে! কা*টা জায়গাটা খোলা রেখেছেন কেন? ইনফেকশন হবে, ব্যথা বাড়বে।’

‘ কিছু হবেনা, হাত ছাড়ো।’

শতাব্দ হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। আটকালো প্রিয়। হাতটা আরো শক্ত করে কোলে উঠিয়ে নিলো। কা*টা জায়গাটা পরিষ্কার করতে মন দিয়ে বলল,

‘ হবে। ইনফেকশন হবে।’

‘ ডাক্তার আমি না তুমি!’

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। বলল,

‘ আপনি! তো? তাই বলে কি ডাক্তারদের ওষুধদের প্রয়োজন হয়না?’

শতাব্দ উত্তর দিলো না কোন। প্রিয় জোর খাটিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। শতাব্দ এক দৃষ্টিতে তখনো চেয়ে। বাতাসে প্রিয়’র অবাধ্য চুল উড়ছে। শতাব্দ হাত বাড়িয়ে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ আজকাল তোমাকে বড্ড অচেনা লাগে প্রিয়। কখনো মনে হয় তুমি শুধু আমার। কখনো আবার ভিন্ন কেউ। এই রহস্যময়ীর এতো রূপ কেন?’

চোখ উচিয়ে তাকালো প্রিয়। শতাব্দের গভীর চাহনি। ব্যথাতুর আ*হত। কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল প্রিয়। হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই, টেনে বসিয়ে দিলো শতাব্দ। কাছে এনে বুকে মিশিয়ে নিলো। রাগী, গম্ভীর মুখ। চোয়াল শক্ত। অকপট কন্ঠে বলল,

‘ সব ইচ্ছা তোমার! যখন ইচ্ছা অধিকার খাটাবা, যখন ইচ্ছা ছেড়ে যাবা। আর আমার? আমার কোন ইচ্ছা, অধিকার নাই।’

প্রিয়’র ভীতু, ভড়কানো মুখ। হাত ছাড়াতে, ছটফট করছে প্রচন্ড। শতাব্দ দমলো না। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিলো। চোখ বুজে, নাকের সাথে নাক ঘোষতে ঘোষতে নিগূঢ় কন্ঠে বলল, 

‘ আমারও তোমার উপর অধিকার খাটাতে ইচ্ছে করে প্রিয়। জোর করে কোলে বসিয়ে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। বুকে জড়িয়ে গভীর রাতে তোমার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আমাকে কেন বাঁধা দেও?’ 

চোখ বুজেই ভীতু ঢোক গিলল প্রিয়। খাল কে*টে কুমির আনাটা কি খুব দরকার ছিল!

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৪৩.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

সমাবেশের ব্যাপারটা তাজা খবর হয়ে নিউজফিড়ে ঘুরঘুর করছে। ছোট বড় বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল গুলো ব্যাপারটা টেনে বড় ইস্যু বানাচ্ছে। আজেবাজে শিরোনাম দিয়ে বিরাট স্ক্যান্ডাল বাঁধাচ্ছে। কিছুকিছু সাংবাদিক প্রিয়’র চরিত্রেও দাগ লাগাচ্ছে। রাত থেকে পরিচীত অপরিচীত অনেকের ফোন আসছে। কেউকেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউ আবার কা*টা ঘাঁ’য়ে ঘাঁটা দিচ্ছে। এসবের জন্য প্রিয় নিজেকে অনেক আগেই প্রস্তুত করে রেখেছে। সত্যিটা সামনে এলে, এমন বিব্রতকর পরিস্থীতির সম্মোখীন হতে হবে। তা সে জানত। হয়তো তার ক্যারিয়ারেও ধস নামবে। তবুও সত্যিটা সামনে আনার দরকার ছিল। অন্তত সবটা শেষ করার জন্য হলেও, এমনটা করার প্রয়োজন ছিল। নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। গতকাল কাজের সুবাদে লাইভে এলে, সেখানে মানুষজন অপ্রস্তুত, বিব্রতকর প্রশ্ন ছুঁ*ড়ে। প্রথমে শান্ত ভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেও, একটা সময় হাল ছেড়ে দেয়। অতিষ্ঠ হয়ে লাইভ থেকে বেরিয়ে আসে। প্রিয়’র মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে, কিছুদিনের জন্য কাজ থেকে ছুটি দিয়েছে প্রত্যাশা ম্যাম।

 

সকাল থেকে বাড়িতে প্রিয়। ক্লাস নেই। শতাব্দের’ও ছুটি আজ। ভোর সকালে বেরিয়েছে কোথাও। পাশের পার্কে জগিং-এ হয়তো। নাস্তা সেরে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছিল প্রিয়। উজ্জ্বল সকালের চকচকে রোদ। ভেজা চুলের আড়াল হতে মুখে এসে লাগছে। চোখ খিঁচে অন্যদিক ঘুরে বসলো প্রিয়। চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতেই বাহিরের হৈচৈ আওয়াজ কানে এসে লাগল। অভিলাষা বেগম কারো উপর চিৎকার করছে। কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। অভিলাষা বেগমকে বরাবরই শান্ত স্বভাবের। কঠোর, বিচক্ষণ মানুষ। অত্যন্ত রেগে গেলেও খুব কায়দা করে শান্ত হয়ে সবকিছু মিটমাট করে। উনার উঁচু আওয়াজ শুনেনি কখনো। চেয়ার ছেড়ে উঠল প্রিয়। বড়বড় পা ফেলে দরজার সামনে দাঁড়াল। এবার পুরুষালি কান্নাভেজা আওয়াজে কানে এলো। ছটফট পা চালিয়ে ড্রইং রুমের দিক এগিয়ে গেল। শোয়েব হককে দেখেই থমকে গেল প্রিয়। দরজা ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল।

 

অভিলাষার সামনে হাত জোর করে কান্না করছে শোয়েব হক। ‘ আমার মেয়েটার সাথে একটাবার দেখা করতে দে বোন’ বলে বারবার কান্নাভেজা আহাজারি করছে। অভিলাষা’র কঠোর শক্ত আওয়াজ,

‘ ও তোমার মেয়ে না ভাই। ও আয়শার মেয়ে। এতবছর যাদের কোন খবর নেওনি। জন্মের আগেই যার মাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিলে তার উপর আবার কিসের অধিকার?’

শোয়েব হকের কান্নাভেজা আওয়াজ,

‘ আমি জানতাম না প্রিয় আমার মেয়ে। আয়শা বলেছিল, গর্ভেই আমার সন্তান মে*রে ফেলেছে।’

তাচ্ছিল্য হাসল অভিলাষা। বলল,

‘ তো কি করবে? তোমার মত কাপুরুষের কাছে সত্যি বলবে? যে একদিন অ*ন্যায় অপমান করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিল তাকে! তুমি মানুষের পর্যায় পড়ো না। তুমি একটা অমানুষ!’

কাতর দৃষ্টিতে তাকাল শোয়েব। নিস্তেজ কন্ঠে আওড়াল,

‘ ছবি আমাকে ফাঁ*সিয়েছিল। তোর সংসার বাঁচাতে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। সত্যিটা জেনেও তুই এভাবে বলছিস?’

অভিলাষা আরো তেতে গেল। চিৎকার করে বলল,

‘ আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার সংসার বাঁচাতে ছবিকে বিয়ে করতে? আর কোন সত্যির কথা বলছো? আমার শ্বশুরের টাকা দেখে তুমি ছবিকে বিয়ে করেছিলে।’

‘ অভিলাষা!’

‘ চেঁচাবে না ভাই। এটা সত্যি। তুমি টাকার লোভে পড়ে আয়শাকে ছেড়ে ছবিকে বিয়ে করেছ। তোমার সব ভালোবাসা অভিনয় ঠুনকো ছিল। যেই মেয়েটা তোমাকে ভালোবেসে নিজের বাড়িঘর সব ছাড়ল। তুমি টাকার মহে পড়ে তাকেই ছেড়ে দিয়েছিলে ভাই। এমনকি যখন তোমার স্ত্রী ওদের গ্রামের লোকের সামনে অপদস্ত করল তুমি চুপ ছিলে। তখন তোমার বীরত্ব কোথায় ছিল? আয়শার মৃ*ত্যু শোকে তুমি এতবছর দেশের বাহিরে ছিলে। তাই বলে মরে যাওনি। যে তুমি আমার সহানুভূতি পাবে!’

শোয়েব হক অস্থির হয়ে পড়ল। তেজি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমার মেয়ে কোথায়? আমি আমার মেয়ের সাথে দেখা করব।’

অভিলাষা বিরক্তি কন্ঠে বলল,

‘ আমার মনে হয়না প্রিয় তোমার সাথে দেখা করবতে চাইবে। তোমাকে যথেষ্ট ঘৃ*ণা করে ওঁ।’

শোয়েব হক তড়িঘড়ি আওয়াজে বলল,

‘ ঘৃ*ণা করলে এত মানুষের সামনে আমার মেয়ে বলে নিজেকে কেন পরিচয় দিবে? ও আমার মেয়ে। অনেক হয়েছে। এতবছর আয়শা আমার থেকে আমার মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছে। আর না। এবার আমি ওকে নিয়ে যাবো সাথে।’

অভিলাষা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

‘ যেই জানলে প্রিয় তোমার মেয়ে অধিকার খাটাতে চলে এলে। যখন আয়শা গ্রামে গিয়ে সম্পর্ক বাঁচাতে আহাজারি করছিল, তখন তোমার এই পিতৃপ্রেম কোথায় ছিল? যখন গ্রামের লোক তোমার মেয়েকে ব্যা* বলছিল তখন কেন চুপ ছিলে? জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। যোগ্যতা লাগে। যা তোমার নাই!’

অনুতপ্তার আগুনে শোয়েব পুড়ছে। চিৎকার করে বলল,

‘ আমি আভাস করেছিলাম প্রিয় আমার মেয়ে। কিন্তু তা যুক্তি’র সামনে বরাবরই পরাজিত। তখন আমি প্রতিবাদ করতে চেয়েও পারিনি। লুবনার ভবিষ্যৎ ভেবে! আমি প্রিয়’কে…’

এদিক সেদিক তাকাতেই শোয়েব চোখ আটকালো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়’তে। থরথর করে কাঁপছে। ভ*য়ে মুখ লুকিয়ে আছে। মেয়ের দিকে ছুটে গেল শোয়েব। হাত বাড়াতেই প্রিয় দু’কদম পিছিয়ে গেল। ভেজা টলমলে ঘৃ*ণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে। 

কেঁদে ফেলল শোয়েব হক। কাঁপা কাঁপা হাত জোড়া উঁচিয়ে মেয়ের দিক এগিয়ে গেল। কান্নাভেজা কাঁপাকাঁপি কন্ঠে প্রিয় বলল,

‘ আমাকে ছুবেন না। আপনাকে ঘৃ*ণা হয় আমার!’

শোয়েব হক থমকে গেল। ব্যথাতুর কাতর দৃষ্টিতে মেয়ের ফিরিয়ে নেওয়া মুখখানায় চেয়ে রইল। কান্নাভেজা অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ আমাকে একটা বাত বলার সুযোগ দে। আমার কথা একবার শুন মা।’

ঘাবড়ে গেল প্রিয়। প্রথমবার নিজের জন্মদাতা পরিচয়ে মানুষটাকে দেখে প্রচন্ড আঘা*ত পেয়েছে হয়তো।হাতপা কাঁপছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঝাড়ি দিয়ে হাত ঠেলে দিলো। অচেতন, উন্মাদের মত আচরণ করছে। চিৎকার করে বলছে,

‘ দুরে থাকুন আমার থেকে।’ 

শোয়েব হক শুনল না। এতবছর পর মেয়ের পরিচয় পেয়ে সাথে সাথে টিকেট কে’টে দেশে এসেছে। মেয়েটাকে একবার জড়িয়ে ধরবে বলে। ফ্লাইটের পুরোটা সময় ছটফট করে কাটিয়েছে। এই সময়টার কত অপেক্ষা করেছে। এখন এই কাঙ্ক্ষিত সময়টায় এসে কি করে পিছিয়ে যাবে সে? 

একপ্রকার বোঝানোর জেদ ধরে এগিয়ে গেল মেয়ের দিকে। প্রিয় হাউমাউ করে কাঁদছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ঠ হচ্ছে তার।  যেই শোয়েব হাত বাড়াবে, অমনি শতাব্দ এসে দাঁড়াল মাঝে। ভয়ে কাঁপতে থাকা প্রিয়কে জড়িয়ে নিলো বুকে। শোয়েবের দিকে আঙুল তাক করে ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠল,

‘ হাত বাড়াবেন না আমার বউয়ের দিকে।’

শোয়েব শুনল না। এগিয়ে আসতে চাইল। প্রিয় যেন আরো ঘাবড়ে গেল। জড়সড় হয়ে শতাব্দের বুকে লেপ্টে রইল। শোয়েবের কাঁধে হাত রেখে বাঁধা দিলো শতাব্দ। মাঝে এক হাত দূরত্ব রাখল। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ আমার বউয়ের থেকে দূরে থাকতে বলেছি।’

‘ প্রিয় আমার মেয়ে। ওর উপর আমার অধিকার বেশি!’

শোয়েবের অকপটে আওয়াজ। শতাব্দ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। প্রিয়’কে ছেড়ে দু’পা এগিয়ে শোয়েবের মুখোমুখি দাঁড়াল। ঝুকে এসে শোয়ের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে গম্ভীর শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ যখন ওদের আপনাকে প্রয়োজন ছিল, তখন এই অধিকার কোথায় ছিল! আপনি বাবা না কাপুরষ। না ভালো স্বামী হতে পেরেছেন, না ভালো বাবা। আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। নয়তো জোর করে বের করতে বাধ্য হবো!’

শোয়েব আ*হত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেই ভাগিনা একটা সময় তার ভক্ত ছিল, আজ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে! নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে অগাধ ঘৃ*ণা। এত ঘৃ*ণা, অভিশাপ নিয়ে কি করে বাঁচবে সে? কোনদিন কি ক্ষমা মিলবে! 

শোয়েব হক বেরিয়ে গেল। 

 

শতাব্দ প্রিয়’কে ঘরে নিয়ে এলো। বিছানায় বসালো। প্রিয়’র তখনো থরথর কাঁপছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। শরীর প্রচন্ড রকম ঠান্ডা। শতাব্দ পানি এগিয়ে দিলো। প্রিয় ঢকঢক করে পুরোটা পানি শেষ করল। প্রিয়’র হাত জোড়া ধরে, হাঁটু গেড়ে মুখোমুখি বসে আছে শতাব্দ। কপাল কুঁচকে চিন্তিত মুখ করে চেয়ে। প্রিয়’র এনজাইটির সমস্যাটা দিনদিন বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে আদৌ কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে প্রিয়? প্রিয়’র অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া মুছে দিতেই। ভীতু কন্ঠে হুড়মুড়িয়ে প্রিয় বলল,

‘ ওই লোকটা কেন ফিরে এলো। কেন এসেছে উনি। উনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলুন। আমার ভয় হয় তাকে! প্রচন্ড ভয়..’

অনবরত অস্থির কন্ঠে, বিড়বিড়িয়ে বলে যাচ্ছে প্রিয়। শ্বাস কষ্ঠ হচ্ছে এখনো। শতাব্দ কাছে এসে জড়িয়ে ধরল। শতাব্দের মুঠোবন্দী হাতটা আরো শক্ত করে খা*মচে ধরল। শতাব্দ কানের কাছে চুমু দিলো। আস্বস্ত স্বরে বলল,

‘ শান্ত হও প্রিয়। আমি আছি। সবঠিক করে দিবো।’

চোখ বুজে শতাব্দকে আরো শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরল প্রিয়। ধীরেধীরে শান্ত হচ্ছে। নিশ্বাসের গতি স্বাভাবিককে নামছে। প্রিয় জানে শতাব্দকে ঠকাচ্ছে সে। এই মানুষটা থেকে তার দূরে থাকা উচিত। কিন্তু পারছেনা। মানুষটা কাছে এলে এমন অদ্ভূতরকম শান্তি লাগে যে, সব ভুলে তাতেই ডুবে থাকে! অনুভূতিরা কি কোনদিন পরিবর্তন হবেনা। বারবার কেন শতাব্দ’তে আটকে যায়।

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির ) 

 

৪৪.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

আজ অনেকদিন পর ক্লাসে এসেছে প্রিয়। পরিস্থীতি আগের তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক হলেও। লোকজনের কানাঘুষা চলছে এখনো। ক্লাস শেষে ইরার সাথে ক্যানটিনের দিকে যাচ্ছিল। আচমকা পেছন থেকে কেউ এসে ধাক্কা দিলো। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে, তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল প্রিয়। হাতের কনুই ছিলেছে, গোড়ালিতে লেগেছে। ইরা ছুটে এসে টেনে তুলল। ব্যথাতুর হাত নিয়ে পেছনে ফিরল প্রিয়। হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। লুবনা এসেছে। রাগে ক্ষো*ভে ফোসফাস করছে। প্রচন্ড বিরক্ত হলো প্রিয়। চেঁচিয়ে বলল,

‘ কি সমস্যা তোমার?’

লুবনা আরো বেশি ফুলেফেঁপে উঠল। ধুপধাপ পা ফেলে প্রিয়’র দিক এগিয়ে গেল। প্রিয়’র চুলের মুঠি ধরল। ছাড়াতে চেষ্টা করল প্রিয়। ইরা এসে আটকাতে চাইলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। লুবনা শরীরের সব শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে প্রিয়’র চুল। রাগে গরগর করে বলল,

‘ রা*ক্ষসী ডাই*নি শতাব্দ’কে ছিনিয়ে মন ভরেনি? এখন আমার বাপকেও তোর চাই! আমার সবকিছু ছিনিয়ে নিতে এসেছিস। কপি ক্যাট, ব্লাডি বিচ, এত সাহস তোর। আজ তোকে খু*ন করেই এই কেচ্ছা শেষ করব। যেমন মা তেমন মেয়ে  দুইটাই খা** ব্যা**’

তেতে উঠল প্রিয়। রেগে জোরে লুবনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। লুবনা তেড়ে আসলে তার হাত মুচড়ে পিঠের সাথে ধরল। বেসামাল হওয়ায় লুবনা নিজেকে ছাড়াতে পারল না। প্রিয় আরো শক্ত ভাবে এঁটে ধরল। রাগে কিড়মিড়িয়ে বলল,

 

‘তোমার কাছে এখন যা যা আছে তা সব আমার হওয়ার কথা ছিল। চাইলেই অধিকার খাটিয়ে, আইন টেনে এক্ষুনি সবকিছু ছিনিয়ে নিতে পারি। কিন্তু তা করব না। যেই লোকটাকে বাপ বলে পরিচয় দিতে আমার রুচিতে বাঁধে। তার কামানো সম্পদে ভাগ বসাবো? এত নিম্ন আত্মসম্মানহীন মেয়ে আমি না। আর রইল শতাব্দের কথা। উনি সবসময় আমার ছিল, আছে আর আমারই থাকবে। অনেক বছর তো আমি ছিলাম না। তখন নিজের করতে পেরেছিলে? পারবেনাও না। কারণ শতাব্দের মন মস্তিষ্ক জুড়ে শুধুই প্রিয়।’

গর্জিয়ে উঠল লুবনা। প্রিয়’কে আঘা*ত করতে চাইল। পারল না। ইরা এসে চেপে ধরল। উশখুশ করছে লুবনা। চড়া ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো প্রিয়। শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ হুশ! আর একটা কথাও না। চেঁচালে জিব ছিঁড়ে ফেলব। অনেক হয়েছে। জীবনে যা অ*ন্যায় করেছ, তার শাস্তি পেতে প্রস্তুত হও। আর মাত্র কয়েকটা দিন। খুব তাড়াতাড়ি চৌদ্দ শিকের ভেতর ঢুকবে তুমি। সেই ব্যবস্থা করে রেখেছি।’

আশেপাশে লোক জমেছে। লুবনাকে ছেড়ে দিলো প্রিয়। ইরার সাথে রিকশা চড়ল। পেছন থেকে লুবনা আ*ক্রোশ পূর্ণ চাহনিতে চেয়ে রইল।

 

ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢুকতে হতভম্ব প্রিয়। পা ঝুলিয়ে, বিছানায় দু’হাত ভর দিয়ে বসে আছে শতাব্দ। চেহারা ভীষণরকম গম্ভীর । এসময় শতাব্দ এখানে দেখবে, আশা করেনি প্রিয়। গতরাতে তার নাইট শিফট ছিল। সাধারণত বাড়ি ফিরে ঘুমে তলিয়ে থাকার কথা। 

এক পলক দেখে, বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। আয়নার সামনে ব্যাগ রাখতেই, পেছন থেকে শতাব্দের গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো,

‘ গতরাতে কোথায় ছিলে প্রিয়?’

কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল প্রিয়। শতাব্দের প্রশ্নে চমকালেও, তা প্রকাশ করল না। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,

‘ বাড়িতে। বাবা মায়ের কাছে।’

শতাব্দ আগের মত গম্ভীর গভীর কন্ঠে আওড়াল,

‘ কেন মিথ্যা বলছ? বাবার সাথে সকালে কথা হয়েছে। তুমি সেখানে ছিলেনা গতরাতে।’

প্রিয় চুপ। শতাব্দ ফোনটা প্রিয়’র দিক এগিয়ে দিলো। যেখানে গতরাতে হোটেলের ছবি গুলো ভেসে উঠল। শান্ত কন্ঠে শতাব্দ জিজ্ঞেস করল,

‘ তোমার সাথে লোকটা কে? গতরাতে পাঁচ তারকা হোটেলে উনার নামে বুক করা রুমে তুমি ছিলে! কেন?’

কানের দুল খুলতে খুলতে তাচ্ছিল্য স্বরে উত্তর দিলো প্রিয়,

‘ লোক লাগিয়ে আমার উপর নজর রাখছেন?’

শতাব্দের শক্ত অকপট আওয়াজ,

‘ তোমার সেফটি’র জন্য দরকার।’

‘ সন্দেহ করছেন?’

‘ সন্দেহ করার মত কাজ নয়কি?’

‘ যদি বলি সে আপনজন?’

ক্ষে*পে উঠল শতাব্দ। প্রিয়’র গাল চেপে ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিলো। রাগী কন্ঠে গরগর করে বলল,

‘ মে*রে ফেলবো! তুমি একান্তই আমার। শুধু আমার প্রিয়। হেয়ালি না, স্পষ্ট উত্তর জানতে চাই।’

শতাব্দের অকপটে রাগী দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে আছে প্রিয়। কি ভয়*ঙ্কর তার রাগ! কেননা তাকে আরেকটু রাগিয়ে দেওয়া যাক! ঠোঁট মেলে হাসল প্রিয়। বলল,

‘ আপনার এক্স ভার্সিটি এসেছিল।’

কপাল কুঁচকে নিলো শতাব্দ,

‘ আমার এক্স?’

‘ লুবনা!’

রেগে গেল শতাব্দ,

‘ ও আমার এক্স না!’

প্রিয় কানে তুলল না। কথা কে*টে বলল,

‘ তুমুল ঝামেলা বাঁধিয়েছে। আমার চুল টেনে অর্ধেক উঠিয়ে ফেলেছে!’

কপালের রগ ফুলে উঠল শতাব্দের। রাগে উশখুশ করছে। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে গম্ভীর গর্জনী দিয়ে বলল,

‘ ওই কু**** অমানুষটার এতো বড় সাহস ওকে আমি…..’

এইটুকু বলে থেমে গেল শতাব্দ। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।  প্রিয়’র হাত টেনে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুমি ঠিক আছো? কোথাও লাগেনি তো!’

হাত ছাড়াতে চাইল প্রিয়। ছাড়ল না শতাব্দ। প্রিয় ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘ আপনার কি ধারণা আমি এতই দুর্বল, যে লুবনা এসে আমাকে মে*রে চলে যাবে। আমি তাকিয়ে দেখবো? আমিও তার হাত মচকে দিয়েছি। দেখেন গিয়ে, কোনো হাসপাতালে পড়ে আছে হয়তো।’

ভ্রু যুগল উঁচিয়ে নিলো শতাব্দ। বলল,

‘ গুড! দ্যাটস মাই গার্ল।’

প্রিয়’র দিক দু’কদম এগিয়ে গেল। আলতো করে থুতনি তুলে চোখে চোখ ডোবাল শতাব্দ। ঠোঁটে আলতো আঙ্গুল ছুঁয়ে দিতে দিতে গভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘আমার প্রিয় অগ্নির মত পবিত্র, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এবার সত্যিটা বলো, ওই লোকটা কে ছিল? কি তোমার উদ্দেশ্য?’

শতাব্দের নেশাতুর গভীর দৃষ্টিতে বিবস চেয়ে আছে প্রিয়। ঠোঁট মেলে কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,

‘ সত্যি জানতে চান?’

‘ হুম’

‘ তাহলে আজ বিকালে চলুন। নিজেই তার সাথে পরিচয় হয়ে নিন।’

প্রিয়’র রহস্যময়ী চাহনি আর কথাবার্তায়, কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল শতাব্দ।

 

ঝিমিয়ে যাওয়া বিকাল। আকাশ জুড়ে কালো মেঘেদের ছড়াছড়ি। বৃষ্টি নামবে কি? হয়তো! গাড়ি এসে গতকালকে পাঁচ তারকা হোটেলের সামনে থামলো। শাড়ির কুচি গোছাতে গোছাতে নেমে দাঁড়াল প্রিয়। গাড়ি পার্কিং করে আসতেই দেখল কারো সাথে ফোনে কথা বলছে প্রিয়। ফোন ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে শতাব্দের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ উনারা লাউঞ্জে আছে, আমাদের যেতে বলেছে।’

প্রিয়’র উচ্ছাসীত মুখখানায় চেয়ে রইল।উত্তরে কিছু বলল না শতাব্দ।

লাউঞ্জে ঢুকে সোজা পেছনের বাগানের পাশে পুলের দিক চলে গেল। সেখানে প্রিয়’র সাথে ছবিতে থাকা সেই লোকটাকে দেখা যাচ্ছে। পাশেই একজন বিদেশিনী মহিলা দাঁড়িয়ে। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল প্রিয়। উচ্ছাসে আবেগাপ্লুত হয়ে বিদেশিনী মহিলাকে আলিংগন করল। হাত মেলানোর উদ্দেশ্যে লোকটা শতাব্দের দিক হাত বাড়িয়ে দিলো, বলল,

‘ হাই, আমি তানিম জাফর প্রিয়’র বড় ভাই। আর ও আমার ওয়াইফ ডক্টর ইডিলি বেথানি জাফর।’

শতাব্দ হতভম্ব। তার মানে উনি জাফর সাহেবের বড় ছেলে তানিম জাফর। আমেরিকায় ছিল এতবছর! পরিবারের বিরুদ্ধে বিদেশিনী বিয়ে করায়, যার সাথে জাফর সাহেব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

বিস্ময় ছাপিয়ে হাত বাড়ালো শতাব্দ। বলল,

‘ আমি ডক্টর আহসান খাঁন শতাব্দ। প্রি..

কথা কাটলো তানিম,

‘ উহু, বলতে হবেনা। আমি জানি, আমার বোনের বর। বোন জামাই! এত ওপেন ইন্ট্রো দিয়ে হবেনা। তুমি আমাদের না চিনলেও আমরা তোমাকে চিনি। প্রিয় তোমার কথা বলে রোজ।’

‘ সত্যি, রোজ বলে প্রিয়?’

ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে প্রিয়’র দিক তাকাল শতাব্দ। কপাল কুঁচকে চোখ ফিরিয়ে নিলো প্রিয়, ইডিলির ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা কথায় মনযোগ দিলো।

 

বিকালের শেষ প্রহর পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। চারিদিক আঁধার করে সন্ধ্যা নেমেছে। মেঘ ডাকছে। প্রিয় আমারা, ইসামের সাথে গল্প গুজবে মগ্ন। আমারা বয়স ছয়বছর, ইসাম সবে কথা আধোআধো কথা বলতে শিখেছে। মাত্র দুদিনেই প্রিয়’র সাথে মিশে গেছে। দূর থেকে তানিম সবটা দেখছে। বোনের বাচ্চাদের প্রতি স্নেহ মমতা দেখে চোখ ভরে এলো। বোনদের প্রতি তানিমের ছোট থেকেই অন্যরকম দুর্বলতা। ছোট থেকেই প্রিয় সবচেয়ে আদরের ছিল। যখন পুরো পরিবার তানিমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। একমাত্র প্রিয়’ই পাশে ছিল। লুকিয়ে-চুরিয়ে যোগাযোগ রাখত। প্রিতীর মৃ*ত্যু সংবাদ শুনে দেশে এসেছিল। জাফর সাহেবের রুষ্টতার কারণে বাড়িতে আসেনি। কবর জিয়ারত করে আমেরিকা ফিরে গিয়েছিল। সেখানে ফিরে মূলত প্রিয়’র থেকেই পরিবারের সব খবরাখবর রাখতো। কিন্তু হ্ঠাৎ একদিন খালার মৃ*ত্যু সংবাদ পেল। সেই সাথে প্রিয়’র মানসিক অবস্থার কথাও জানলো। বরাবরই দূরে থেকেও বোনের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। ধীরেধীরে প্রিয় স্বাভাবিক হলো। হ্ঠাৎ একদিন বলল, তার প্রতি*শোধ চাই। অতীতের কিছু রহস্য উদঘাটন করবে সে। প্রথমে অবাক হলেও, তেমন গুরুত্ব দেয় না। ছেলেমানুষী ভেবে কানে তুলেনি সে। হ্ঠাৎ একদিন খবর এলো ইমান্দিপুরের চেয়ারম্যানের ছেলেকে বিয়ে করেছে প্রিয়। প্রিয়’র উদ্দেশ্য বুঝতে দেরি হলো না তার। প্রিয় ছোট থেকে ভীষণ জেদি। বাঁধা দিলে মানবেনা।যা চায়, তা পেয়েই ক্ষান্ত হয়। তাই বোনের সেফটির জন্য সবরকম ব্যবস্থা করে দেয় সে। মানুষ লাগিয়ে সবরকম তথ্য জোগাড় করে দেয়। নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে প্রিয়। আচমকা প্রিয়’র অসুস্থতার খবর এলো। দ্রুত সেদিকের কামকাজ গুছিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।

 

ছেলেমেয়েদের খিলখিল হাসির শব্দে ধ্যান ভাঙ্গল তানিমের। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসছে প্রিয়। তানিম এসে প্রিয়’র মুখোমুখি চেয়ারটায় বসল। প্রিয় হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলল,

‘ একবছর আগেও কত শান্ত ছিল, এখন তোমার ছেলেমেয়ে যা দুষ্ট হয়েছে না! উফফ। তোমরা কি করে সামলাও বলতো?’

উত্তরে তানিম হাসল। প্রিয় আবারও বলল,

‘ ওই টেবিলে কি নিয়ে কথা চলছে। যেহেতু দুই ডাক্তার বসেছে নিশ্চয়ই রোগ আর রোগী নিয়ে কথা হচ্ছে। এখানে আব্বা বসলে ব্যপারটা আরো জমে যেত। তাই না ভাই?’ 

বাবার কথা শুনতেই তানিমের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা বুজে এলো। তানিমের মলিন মুখের কারণ বুঝল প্রিয়। এতবছর হয়েছে বাবা এখনো রুষ্ট। মেনে নেয়নি তানিম ইডিলিকে। অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে তারা। কিন্তু জাফর সাহেব মানতে নারাজ। এতবছর ধরে সেই আক্ষেপ বয়ে বেড়াচ্ছে তানিম। সচরাচর প্রিয় সেসব কথা তুলে না। আজ হ্ঠাৎ কথায় কথায় বাবার কথা বলে ফেলেছে। খানিক চুপ থেকে প্রিয় বলল,

‘ দেশে এসেছ একবার বাবার সাথে দেখা করবে? হয়তো আমারা ইসামের উছিলায় সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। তোমাদের ক্ষমা করে দেয়!’

তানিমের উদাসীন আওয়াজ,

‘ ক্ষমা করার হলে আগেই করত। মা প্রভা আমার কথা মনে করে?’

‘ রোজ এক বেলা তোমার কথা মনে করে মা কাঁদে।’

‘ আর প্রভা?’

‘ তুমি তো চিনো ওকে, কতটা অকপটে। উপরে শক্ত ভেতরে নরম। বুক ফাটবে তবুও মুখ খুলবেনা।’

মলিন হাসল তানিম। প্রিয় ভাইয়ের হাতে উপর হাত রাখল। বুঝানোর কন্ঠে বলল,

‘ একবার বাবার সাথে সামনা সামনি কথা বলে দেখো-ই না! যদি ঠিক হয় সব।’

তানিম কথা এড়ালো। বলল,

‘ সেসব কথা ছাড় প্রিয়। তোর শরীরের কন্ডিশন এখন কেমন বল। সু*ইসাইড করতে চেয়েছিস? বছর ঘুরলো না, এতবড় একটা মেজর অপারেশন হলো। তোর জীবনের কি কোন মূল্য নাই প্রিয়?’

তাচ্ছিল্য হাসলো প্রিয়। বলল,

‘ আর জীবনের মূল্য! যেখানে পুরোটাই শূন্যতায় পরিপূর্ণ!’ 

‘ এত ভেঙ্গে পরার মত কিছু হয়নি প্রিয়। অসুস্থতা জীবনে আসতেই পারে।…অসুস্থতার ব্যাপারটা কি শতাব্দ জানে?’

‘ না। আর আমি জানাতেও চাইনা।’

অবাক হলো তানিম। ভড়কে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেন?’

প্রিয়’র নিস্তেজ আওয়াজ,

‘ তার ভালোবাসাকে দুর্বলতার হা*তিয়ার বানাতে চাইনা ভাই। আমি অপূর্ণ। আমার অপূর্ণতা তার শূন্যতা বাড়াবে। পূর্নতা আনবেনা কখনো।’

‘ সে তোকে ভালোবাসে প্রিয়!’

‘ শুধু ভালোবাসা দিয়ে সংসার গড়া যায়না ভাই! আমার জরায়ুতে টিউমার ছিল, অপারেশন করা হয়েছে। আমি কখনো মা হতে পারবো না। সব জেনেশুনে তার সাথে কি করে সংসার সাজাই? তার সাথে থেকে আমি তাকে প্রতিমুহূর্ত ঠকাচ্ছি ভাই! সে আমাকে ভালোবাসছে, মনে মনে সংসার সাজাচ্ছে, পরিবার বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। আমি তাকে কি দিচ্ছি? ঠুনকো আশা!’

তানিমের শান্ত উত্তর,

‘ এটাকে ঠকানো বলে না প্রিয়। তোর হাতে কিছু নেই। তুই তাকে ভালোবাসিস অস্বীকার কর‍তে পারবি?’

‘ সবটা আমার হাতেই ভাই! আমি চাইলেই তার থেকে দূরে যেয়ে জীবনটা গুছিয়ে দিতে পারি। আমার জন্য তার জীবনের অনেক সময় নষ্ট করেছে। আর না। তার জীবনে কেউ আসুক তার শূন্য জীবনে পূর্নতা বয়ে আনুক।’

প্রিয়’র আওয়াজ ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসলো। একটু চুপ থেকে আবার বলল,

‘ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তার কাছে ফিরে আসা। নিজের জেদের বসে, প্রতি*শোধ পরায়ন হয়ে আমি তার সাথে বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি ভাই। আমি ভুল ছিলাম ,সে আমাকে ঠকায়নি। এত বছরে কিছুই বদলায়নি। সে এখনো আমাকে ততটাই ভালোবাসে। আগে যতটা ভালোবাসতো। সেই প্রথমবারের মত!’

বোনের ছলছল চাহনি দেখে তানিম বলল,

‘ একবার শতাব্দের সাথে খোলামেলা কথা বল। ওর দিকটা এক..

কথা কাটল প্রিয়। ভাঙ্গা স্বরে বলল,

‘ তাকে কি বোঝাব ভাই? বুঝবেনা সে। আমি যদি তার বুকে ছু*ড়িও ঢুকাই তবুও সে ভালোবাসবে আমায়। তার ভালোবাসা  নিখুঁত, নিস্বার্থ! আমি কি করে স্বার্থপর হই? আমি অপূর্ণ নারী। মা হওয়ার ক্ষমতা নেই। পরিবার গড়ার জোর নেই। সারাজীবনের জন্য তাকে কি করে আফসোসের সাগরে ডুবাই? থাকনা কিছু অপূর্ণ। জীবনের সব চাওয়া  পূর্নতা পাবে তার মানে আছে কি কোন? আমার অপূর্ণতা গুলো শুধু আমার হয়েই থাক।’

‘ আগামী প্লান কি?’

‘ যেই উদ্দেশ্যে এসেছিলাম,  তা সফল করে শতাব্দের জীবন থেকে বেরিয়ে যাবো। হাতেগোনা আর কয়েকদিন। লুবনা লিমনের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে শাদকে লাগিয়েছি। প্রমাণ হাতে আসতেই, প্লান অনুযায়ী সব করে নিজ গন্তব্যে চলে যাবো।’

‘ আর আয়শা খালার ব্যাপারটা?’

‘ কিছু আন্দাজ করতে পারছি। সত্যিটা হয়তো আমাদের কল্পনার বাহিরে। অনাকাঙ্ক্ষিত! আমি এখনো শিয়োর না। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে শতাব্দ অ*ন্যায় কিছু করতে পারেনা।’     

‘ শতাব্দকে ছেড়ে যাওয়াটা সে মানবে?’

এবার সামান্য ঘা*বড়ে গেল প্রিয়। শতাব্দের হিং*স্র স্বভাবের সাথে সে ভালোভাবে পরিচিত। আদৌ শতাব্দ মানবে তো? 

খানিক চুপ থেকে প্রিয় উত্তর দিলো,

‘ আমি মানতে বাধ্য করবো!’

বোনের গম্ভীর মুখপানে চেয়ে আছে তানিম। প্রিয়’র টলমল চোখ। এখনি কেঁদে দিবে যেন। 

প্রসংগ পাল্টালো তানিম,

‘ ইন্ডিয়া যেয়ে আরেকবার চেকআপ করাবি? আমি আর ইডিলিও সাথে যাবো তোর।’

প্রিয়’র অলস আওয়াজ,

‘ দরকার নেই ভাই! আমি সুস্থ আছি। দেশে ডাক্তার দেখাচ্ছি। ভাবি, তার পরিবার আমার জন্য অনেক করেছে। বাড়িতে এখনো জানেনা কেউ। সবাই ভাবে বছর খানেক আগে ইন্ডিয়া ট্রিপে গিয়েছিলাম।এবার গেলে নিশ্চয়ই সন্দেহ করবে! ‘

‘ সন্দেহের কি আছে! বিপদ কে*টেছে, কিন্তু রেগুলার চেকআপটা তো করতে হবে। এমিলি আন্টি সেদিন তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল।’

হাসলো প্রিয় বলল,

‘ ভাবির মায়ের বাড়ি ইন্ডিয়া হওয়ায় ভীষণ সুবিধা হয়েছিল। আবার কখনো ইন্ডিয়া গেলে অবশ্যই এমিলি আন্টির সাথে দেখা করব।’

কথার ফাঁকে তানিম ঘড়ির দিক তাকালো। শতাব্দ ইডিলি এখনো গল্পে মগ্ন। তাদের কথার মূল প্রসংগ রোগ আর রোগীকে ঘিরে। এদিকে ডিনারের টাইম হয়ে এসেছে। বুফেতে রিজার্ভেশন দিতে হবে। তানিম সেদিকে পা বাড়াল। অমনি পেছন থেকে ডাকল প্রিয়। বলল,

‘ তুমি আগে থেকেই জানতে আয়েশা খালা আমার মা। তাই না ভাই?’

তানিম মৃদু হাসলো। শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ তাতে কিছু আসেযায় না। তুই আমার বোন। এটাই সত্য।’

 

(নোট: তানিম প্রভার বড় ভাই যা প্রথম খন্ডে চতুর্থ পর্বে বলা হয়েছিল। প্রিয়’র অপারেশনের ব্যাপারটা তানিম আর তার বউ ইডিলি জানতো। বাড়ির সবাই জানতো প্রিয় ইন্ডিয়া ট্রিপে গিয়েছিল। ইডিলি আমেরিকান হলেও তার মায়ের জন্মসূত্র ইন্ডিয়াতে। পাঠকদের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য )

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

 

৪৫.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

পুরানো খুবলে খুবলে উঠা  মানিব্যাগের ভাঁজ থেকে একটা সাদাকালো ছবি বের করল শোয়েব। চোখের সামনে ভেসে উঠল আয়শার হাস্যোজ্জ্বল চন্দ্রপ্রভা মুখ। আনমনে শোয়েবের  ঠোঁটের কোণে, মৃদু রেখা ভাসলো। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল পুরানো সেই দিন গুলো। গা জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ। আলতো হাতে আয়শার ছবিটায় ছুঁয়ে দিলো। অশ্রুভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে নিমিষ তাকিয়ে রইল। কান্নাভেজা অভিযোগ জুড়ে বলল,

‘ এত অভিমান এত ঘৃ*ণা আয়শা। কেন এমন করলে? আমার অন্যায়ের সাজা নিজেকে কেন দিলে! কেন ছেড়ে গেলে বহুদূরে। তোমার মৃ*ত্যু য*ন্ত্রণার চেয়ে, এই চোখের ঘৃ*ণা সহ্য করা আমার কাছে অনেক বেশি সহজ ছিল। নিজের লোভে সব হারিয়েছি। সারাজীবন শুধু ঘৃ*ণা কুড়িয়েছি। না রইলে তুমি, না রইল প্রিয়। প্রিয় সে যে তোমারি প্রতিচ্ছবি। তোমার মতই গভীর তার ঘৃ*ণার দৃষ্টি।’

বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে শোয়েব বিড়বিড় করছিল। ধুপধাপ পা ফেলে ছবি এলো। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে ভেজা চোখ মেলে তাকাল। ছবিকে দেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে অন্যদিকে তাকালো। 

ছবি বাজখাঁই গলা করে বলল,

‘ উকিলের সাথে দেখা করেছিলে? সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ লিখে দিতে চাইছ ওই মেয়েটাকে? এতবড় সাহস তোমার। আমা্দের ভাগের সম্পত্তি লিখে দিবে ওকে। ওই ফ*কিন্নি’র বাচ্চাকে?’

রাগে চেঁচিয়ে উঠল শোয়েব,

‘ সাবধানে কথা বলো। প্রিয় আমার মেয়ে। আর আমি আমার সম্পত্তি কাকে দিবো, তার কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে কেন?’

ছবি বেগম রাগে গরগর করে উঠলেন। শোয়েবের পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরল। ক্রো*ধে রিরি করে বলল,

‘ অনেক হয়েছে, আর না। আজ যা কিছু আছে সব আমার জন্য। রাস্তার ফকিন্নি ছিলি। কু** ফিরে তাকাত না। আমার বাপ ভাইয়ের টাকা দিয়ে এখানে উঠেছিস। প্রথমে মা, এখন মেয়ে। সারাজীবন ওদের পেছনে কেন দাঁড়াতে হবে আমাকে? ছোট থেকে সবসময় কেন আয়শাই জিতে যায়।এত বছর আমার সাথে সংসার করেছিস, মনে মনে সবসময় শুধু আয়শাকেই চেয়েছিস। কেন? আমি যথেষ্ট ছিলাম না?’

ঝারি দিয়ে হাত ছাড়াল শোয়েব। রাগে গর্জিয়ে উঠল। বলল,

‘ তুমি সবসময় আয়শাকে হিংসা করতে। বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নিয়েও, আয়শার বরাবর কখনোই হতে পারোনি।ওর  যা আছে তোমার তা চাই। তাই তো যখন মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে গ্রামে ফিরলাম, রাতে আমার ঘরে এসে আমাকে ফাঁসিয়েছিলে। লোক শালিস বসিয়ে বিয়ে করলে! তোমার ঈ*ষা সব জ্বা*লিয়ে দিয়েছে।’

‘ এখন সব দোষ আমার? মেয়ের পরিচয় জেনে পিতৃপ্রেম জেগেছে! র*ক্তের ঘ্রাণ টানছে। তাইনা? তুই যে আমার বাপের টাকা দেখে বিয়ে করলি, আয়শাকে ঠকালি। এখন চাপা পড়ে গেল সব? স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। সামনে আমার নির্বাচন ওই মেয়ের জন্য যদি কোন ঝামেলা বাঁধে নিজের হাতে খু*ন করবো ওকে। এবার ছাড় পাবেনা। শতাব্দও বাঁচাতে পারবেনা।  আর যদি তুমি বাঁধা হও, ছাড় দিবোনা তোমাকেও।’

শোয়েব টনটনে আওয়াজ,

‘ তোমার বাপ ভাই যেই টাকা ধার দিয়েছিল, তার তিনগুন ফিরিয়ে দিয়েছি তাদের। এই ব্যবসা সম্পত্তি টাকা পয়সা সব আমার পরিশ্রমে গড়া। আর আমিও দেখবো কিভাবে ক্ষ*তি করো আমার মেয়ের! এবার আয়শার স্বামীর না, প্রিয়’র বাবার মুখোমুখি হবে। একজন বাবা তার সন্তানের জন্য কতটুকু গভীর যেতে পারে, জানো নিশ্চয়ই।’

রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেল শোয়েব। যাওয়ার দিক ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ছবি বেগম। না, এভাবে আর চলবে না। আজকাল বড্ড বেড়ে গেছে শোয়েব। সারাজীবন আয়শাকে স্বামীর সুখ থেকে বঞ্চিত রেখেছে। তার ভালোবাসার শোয়েবের সাথে ঘর বেঁধে দিনের পর দিন তিলে তিলে মে*রেছে। এরচেয়ে ভ*য়ানক প্রতি*শোধ আর কি হতে পারে? এখন আয়শা নেই। ম*রে গেছে। শোয়েবকে দিয়ে এখন আর কাজ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পত্তি ট্রান্সফার করার আগে। রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে হবে তাকে। যতদ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে। 

 

দুপুর মাড়িয়ে বিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ তারকা হোটেলের বিপরীত পাশের রাস্তাটায় গাড়ি থামিয়ে বসে প্রিয় শতাব্দ। দৃষ্টি হোটেলের গেটে। গেটের দিক তাকিয়ে প্রিয় সন্দিহান সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনি শিয়োর বাবা আসবে?’

শতাব্দের আত্মবিশ্বাসী আওয়াজ,

‘ আমি ডেকেছি অবশ্যই আসবে।’

‘ যদি না আসে?’

‘ এক্ষুনি চলে আসবে, নিজ চোখে দেখে নিও।’

অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে প্রিয়। তার অস্থির দৃষ্টি উঁচিয়ে বারবার গেটের দিক তাকাচ্ছে। ঘড়িতে সময় দেখছে। মিনিট দশেক যেতেই, জাফর সাহেবের গাড়ি থামতে দেখল গেটের পাশে। উৎসাহিত হয়ে প্রিয় বলল,

‘ বাবা এসেছে!’

প্রিয়’র মুখপানে একপলক তাকাল শতাব্দ। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘ বলেছিলাম আসবে। ভাইয়াদের লাউঞ্জে আসতে বলেছিলে?’

ঠোঁট মেলে হাসল প্রিয়। বলল,

‘ বলেছি। এবার কি হবে! ভাই আর বাবা মুখোমুখি হবে কিভাবে। আর হলেও যদি বাবা এড়িয়ে যায় ভাইকে।’

‘ থিংক পজিটিভ। উল্টোটাও ঘটতে পারে। হয়তো নাতিনাতনিদের দেখে বাবার মন গলতে পারে।’

প্রিয় ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকালো। কন্ঠে চাপা উত্তেজনা ঠেলে বলল,

‘ প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। বাবার সাথে তানিম ভাইকে সরাসরি দেখা করালেই হতো। এই নাটকীয়তার কি দরকার ছিল। যদি সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় এখন!’

শতাব্দ আশ্বস্ত সুরে বলল,

‘ নাটকীয়তার দরকার ছিল। তানিম ভাইকে বললে রাজি হতো না কখনো। বাবার সামনে দাঁড়ানোর তার সাহস নেই এখনো। কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়া, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হলে তার ট্রু ফিলিংসটা বেরিয়ে আসবে। আর তাছাড়া বাবার সাথে যতবার সময় কাটিয়েছি, বুঝতে পেরেছি ছেলের শূণ্যতা তাকে কতটা খাঁখাঁ করে পো*ড়ায়। তিনি হয়তো কখনো প্রকাশ করবেনা, তবে মনেপ্রাণে চায় ভাইয়া বাড়ি ফিরুক।’

‘ বাবার হয়তো এমনি। স্নেহ, ভালোবাসা আড়ালে রাখতে পছন্দ করেন।’

প্রিয়’র উদাসীন আওয়াজ। ছলছল চোখ। শতাব্দের চোখে পড়ল। কথা এড়াতে বলল,

‘ অনেকক্ষণ হয়েছে, সব ঠিক আছে কিনা ভিতরে গিয়ে দেখবে?’

শতাব্দের আওয়াজে প্রিয়’র ঘোর কাটল। বলল,

‘ চলুন যাই।’

গাড়ি থেকে নেমে দুজন চলে গেল ভিতরে। হোটেলের লাউঞ্জে পৌঁছাতেই বাপ ছেলের আবেগাপ্লুত হয়ে কান্না জড়িত আলিঙ্গন ভেসে উঠল চোখে। টলমল করে উঠল প্রিয়’র চোখ, এই দিনটা দেখার জন্য কতই না অপেক্ষা করেছিল। কাচের বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়। জাফর সাহেব নাতি নাতনিদের কোলে তুলে আদর করছে। চুমু খাচ্ছে। ইডিলি হাত জোড় করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলছে। দূরে থাকায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছেনা। শতাব্দ ডাকল। বলল,

‘ ভিতরে যাবে?’

মৃদু হাসল প্রিয়। শতাব্দের দিক ফিরে তাকাল। বলল,

‘ ইচ্ছে করছে না। এইসময়টা একান্তই বাপ ছেলের। তাদেরই ইঞ্জয় করতে দিন।’

হাস্যোজ্জ্বল মুখ অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখ নিয়ে গাড়িতে বসলো। আজ অনেক দিন পর বুকে প্রশান্তির হাওয়া বইছে। অতি আনন্দে চোখে জল নামছে। এই দিনটার জন্য কতই না অপেক্ষা ছিল। কত শতবার ভাইয়ের আফসোস শুনেছে। আহাজারি কান্না দেখেছে। সবশেষে বাপ ছেলের মিলন তিথি এসেছে।

 চোখে জল দেখে এগিয়ে এলো শতাব্দ। হাত বাড়িয়ে আলতো করে মুছে দিলো। দু’গালে হাত রেখে বলল,

‘ আমার সব খাটনি বৃথা গেল। এই চোখে জল না, আনন্দ দেখতে চেয়েছি।’

হেসে ফেলল প্রিয়। শতাব্দ আবার বলল,

‘ চলো, তোমার মন ভালো করার জায়গায় যাই।’

নাকচ করল না প্রিয়। ঠোঁট মেলে হাসল শুধু। আর কয়েকটা দিনই তো! তারপর পাল্টে যাবে সব। সে শতাব্দের সাথে প্রাণবন্ত হয়ে, খোলা আকাশের নিচে একটু বাঁচতে চায়। প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে চায়। কিছু সুন্দর মুহূর্ত তৈরি করবে, যা ভেবে ভেবে এক জীবন পাড় করা যায়।

 

ইটপাথরের শহর ছেড়ে, কৃত্রিম আলোর আকাশ মাড়িয়ে। গাড়ি গ্রামের মেঠোপথে নেমেছে। নড়বড়ে রাস্তা দিয়ে, নদীর পাড়ে এসে থেমেছে। চারিদিকে অন্ধকার নামছে, কৃত্রিম আলো জ্বলতে শুরু হয়েছে। পাড়ের দিকের মানুষ কমতে শুরু হয়েছে। ঘাটপাড়ে নৌকা থেমেছে। হুড়মুড়িয়ে লোকজন উঠছে। পাশেই ঝালমুড়ি, আচার অন্যসব মুখরোচক খাবার নিয়ে বিক্রেতারা বসেছে। হুড়মুড় করে লোকজন ঝেঁকে ধরেছে। দোকানীদের বেশ বেচাকেনা চলছে। গ্রাম্যজীবনের এক ব্যতিক্রম পরিবেশ। মুহূর্তেই প্রিয়’র মন হালকা হয়ে এলো। 

 গাড়ি থেকে নেমে দুজন নিরিবিলি সিড়ির ধারে সবুজ ঘাসে যেয়ে বসল। নদীর শীতল হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। শরীর মনের ক্লান্তি কোথাও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক শান্তি লাগছে। এলোমেলো বাতাসে শাড়ির আঁচল অগোছালো, চোখে মুখে খোলা কেশের ঝাপটা এসে লাগছে। এলোমেলো বাতাসে  চোখ বুজে আসছে প্রিয়’র। বুকের বা পাশে হাত রেখে আঁচল সামলাতে চেষ্টা করল। আচমকা একজোড়া হাত থামিয়ে দিলো। পিটপিট দৃষ্টি মেলে সামনে তাকাল প্রিয়। শতাব্দের গভীর দৃষ্টির নিমিষ চাহনি। নেশাতুর, অধৈর্য! দৃষ্টি নামিয়ে নিলো প্রিয়। শতাব্দের হাত ঠেলে দিতে চাইল। মানলো না শতাব্দ। প্রিয়’র কোমর টেনে মিশিয়ে নিলো। দমকা হাওয়ায় অগোছালো চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে প্রিয়কে বলল,

‘ তোমার এলোমেলো চুল গুছিয়ে দেওয়ার অধিকার একমাত্র আমার। আর এই অধিকার থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে পারবেনা কখনো!’ 

প্রিয় বিবস হয়ে নিমিষ চেয়ে রইল শতাব্দের চোখে। কি জানো এক অদ্ভুত যাদু আছে এই চাহনিতে। বারবার ডুবে যায় এই মন্ত্রবদ্ধ আঁখিতে।

 

ঘন্টা দুএক নদীর পাড়ে সময় কাটিয়ে। গাড়িতে বসলো দুজন। এতটা সময় এক সাথে থেকে কথা না হলেও, চোখেচোখে কথা হয়েছে দুজনের। কখনো কখনো মুখের কথার চেয়ে চোখের ভাষা অনেক গভীর হয়। হাতের হাওয়াই মিঠাই টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে প্রিয়। এই জিনিসটার প্রতি ছোট থেকে ভীষণরকম দুর্বলতা। একবার ইমান্দিপুরে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে শাদের সাথে ঝগড়া বেঁধেছিল তার। বিক্রেতার কাছে একটাই ‘হাওয়াই মিঠাই’। অথচ ভাগিদার দুজন। একটা সময় ঝামেলা বাড়ে, হাওয়াই মিঠাই নিয়ে টানাটানি শুরু হলে। চেচামেচির আওয়াজ পেয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে শতাব্দ। তখন তাকে প্রচন্ডরকম অপছন্দ ছিল প্রিয়’র। তাকে দেখেই কপাল কুঁচকে বিরক্তির ভঙ্গিতে বাড়ি ফিরে গেছিল। সেই কথাটা এতবছর পর মনে আছে শতাব্দ’র! তাইতো হাওয়াই মিঠাই নিয়ে এলো। 

ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ভেসে উঠল। আনমনে হাওয়াই মিঠাই ছিঁড়ে মুখে দিলো। গাড়ি চলছে অন্ধকার গ্রামের মেঠোপথে। আচমকা গাড়ি থামল। কপাল কুঁচকে পাশে তাকাতেই, শতাব্দ নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আষ্টেপৃষ্টে গভীরে জড়িয়ে নিলো। কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রিয়’র ঠোঁট জোড়া শুষে নিলো। বিহ্বল প্রিয় আবেশে চোখ বুজে নিলো। শতাব্দের এলোমেলো অবাধ্য হাত প্রিয়’র শাড়ির বেঁধ করে ফর্সা কোমর ছুঁয়ে দিলো। আরো শক্ত ভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। অনুভূতিতে ঠকঠক কাঁপছে প্রিয়। নিশ্বাসের গতি উঠানামা করছে বারবার। গলা শুকিয়ে আসছে। মাথা ঝেঁকে বসেছে এলোমেলো অনুভূতিতে। মিনিট কয়েক কা*টল। ঠোঁটের কাছে লেগে থাকা হাওয়াই মিঠাই শুষে নিলো। প্রিয় তখনো ঠকঠক কাঁপছে। শরীর জুড়ে বইছে অদ্ভুত শিহরণ। চোখ ভিজে আসছে ভালো লাগার অনুভূতিতে। খানিক সময় এভাবেই পাড় হলো। শতাব্দের বলিষ্ট বুকে বিড়ালছানার মত চোখ বুজে পড়ে রইল। গায়ের পুরুষালি ঘ্রাণে মগ্ন হয়ে রইল। প্রাণভরে মিষ্টি সুবাসটা টেনে নিচ্ছে মনে। আরো কিছুক্ষণ এভাবে বুকের গভীরে জড়িয়ে রইল নিস্তেজ প্রিয়। আলতো স্বরে ডাকল শতাব্দ। সাড়াশব্দ করল না প্রিয়। লজ্জায় আরো জড়সড় হলো। একটু অপেক্ষা করে বুক থেকে টেনে তুলল শতাব্দ। দু গালে হাত ছুয়ে প্রিয়’র সুশ্রী মুখপানে চেয়ে রইল। নিকষ আঁধারে চন্দ্রসুধার মত চকচক করছে যেন। তার চোখেমুখে পড়ে থাকা চুল গুলো গুছিয়ে দিলো শতাব্দ। সামনের চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে, গালে হাত রেখে মুখখানা উঁচিয়ে ধরল। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শতাব্দ। লজ্জা পাচ্ছে প্রিয়। নিজের স্বামীর সামনে এভাবে লজ্জা পাওয়াটা কি খুব বেশি অস্বাভাবিক? ভাবতে ভাবতেই কপালে উষ্ণ ছোঁয়ার অনুভব হলো। তারপর একএক করে চোখ গাল, ঠোঁট ছাড়িয়ে গলায় এসে থামলো শতাব্দ। শাড়ির আঁচল নিচে নেমে গেছে। ফর্সা কাঁধ, গলা স্পষ্ট ভেসে। শতাব্দের উন্মদনা যেন বাড়ল আরো। প্রমত্ত প্রেমিকের মত ঝাপিয়ে পড়ল। গভীর ভাবে নাক ঘষতে ঘষতে নিষ্প্রাণ, নেশাতুর সুরে বলল,

‘ প্রিয়! এই প্রিয়, ভালোবেসে কি কেউ পাগল হয়? আমি হচ্ছি। ভয়*ঙ্কর রকম কোন অঘটন ঘটাতে চাইছি। তোমাকে ছোঁয়ার তৃষ্ণা পাগল করে দিচ্ছে আমায়। আর তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নাই।’ 

কেঁপে উঠলো প্রিয়। শতাব্দের গভীর আওয়াজ, শিহরণ তুলে দিচ্ছে প্রিয়’র। চোখ বুজেই শতাব্দের চুলে আঙুল ডুবিয়ে শক্ত মুঠিবদ্ধ করে নিলো।

 

( সরি, গল্পের সুবাদে কিছু জিনিস খোলামেলা লেখা হয়েছে। ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল)

 

চলবে……

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

 

৪৬.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

ছুটির দিনটা সাধারণ অলস ভাবেই কাটে প্রিয়’র। অফিসের টুকটাক কাজ সেরে সারাদিন বাড়িতে থাকে। গতরাতে শতাব্দের নাইট ডিউটি ছিল। বাড়ি ফিরে প্রিয় শতাব্দকে নিজের ঘরে দেখলো। বেশ পরিপাটি ভাবে তৈরি হয়ে বসে। খানিক চমকাল প্রিয়। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে, বিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ যাচ্ছেন কোথাও?’

শতাব্দের অকপটে আওয়াজ,

‘ তুমিও সাথে যাচ্ছো।’

প্রিয়’র কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো। সন্দিহান সুরে বলল,

‘ কোথায়? আর কেন?’

শতাব্দের স্বাভাবিক শান্ত আওয়াজ,

‘ আছে কোথাও। ফ্রেশ হয়ে তৈরি হও। ঘন্টা খানেকের ভেতর বের হবো।’

প্রিয় আরো কিছু বলতে চাইল। তার পূর্বেই শতাব্দ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। শতাব্দকে স্বাভাবিক দেখালেও কথার জালে রহস্য মোড়ানো ছিল। যেন কোন কিছু নিয়ে বেশ চিন্তিত।

 

গাড়ি এসে কোন এক নামীদামী বিশাল রেস্তোরাঁর সামনে থামল। সদর দরজার কাছাকাছি যেতেই, শতাব্দ থামল।শঙ্কিত দৃষ্টিতে তার দিক তাকালো প্রিয়। শতাব্দের চোখেমুখে চাপা উত্তেজনা, চিন্তার ভার। বেশ গম্ভীর চিন্তা ভারী কন্ঠে বলল,

‘ লিসেন প্রিয়, একজন তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। যদিও মানুষটাকে আমার প্রচন্ডরকম অপছন্দ। তবুও সে তোমার সাথে কথা বলতে একটা সুযোগ চাইছে। বেশ কয়েকদিন যাবত রিকোয়েস্ট করছে।’

প্রিয়’র টলমল চোখ। শান্ত গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ মানুষটা কি শোয়েব হক?’

কয়েক পলক চেয়ে ছোট শ্বাস ফেলল শতাব্দ। বলল,

‘ হ্যাঁ’

প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না প্রিয়। গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। প্রিয়’র হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো শতাব্দ, অকপট কন্ঠে বলল,

‘ নার্ভাস হবে না। আমি আছি। পাশেই থাকবো।’

প্রিয় চুপ। নিস্তেজ ভঙ্গিতে মাথা নুয়ে নিলো। উত্তরে মাথা নাড়াল একটু।

 

রেস্তোরাঁর ভেতর প্রবেশ করতেই পেছনের সারিতে শোয়েব হককে দেখল। জড়সড়ভাবে বসে আছে তিনি। মুহূর্তেই প্রিয় চোখেমুখে অস্বস্তি ভাব ফুটে উঠল। অপছন্দের মানুষের মুখোমুখি হওয়ার অস্বস্তি। কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। শতাব্দের হাত শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরল। ছোট ছোট পা ফেলে সেদিকে গেল। প্রিয়’কে দেখে শোয়েব হকের ছলছল চোখজোড়ায় হাস্যোজ্জ্বল ভাব ফুটে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়ল। শতাব্দ শোয়েব হকের দিক এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে প্রিয়’কে বলল,

‘ আমি ওইদিকটায় বসছি। তুমি কথা বলো।’

প্রিয় উত্তর দিলো না। হাত ছেড়ে চলে গেল শতাব্দ। প্রিয় জড়সড় হয়ে বসল। মাথা নত। চেহারায় বিরক্তি ভাব।

শোয়েব হক উচ্ছ্বসিত সুরে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন আছো মা।’

উত্তর কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রিয় বলল,

‘ ভালো। কেন ডেকেছেন?’

প্রিয়’র কন্ঠে স্পষ্ট রাগ। শোয়েব নিমিষ চেয়ে রইল, বলল,

‘ বাবার মেয়ের সাথে দেখা করবে। এতে কোন কারণ লাগবে?’

তাচ্ছিল্য হাসল প্রিয়। বলল,

‘ আপনি আমার বাবা নন। আমার বাবা জাফর সাহেব।’

শোয়েব মনটা ছোট হয়ে এলো। চোখ জোড়া টলমল করছে তার। তার মেয়ে তাকে মুখের উপর অস্বীকার করছে, অন্যকাউকে বাবা বলছে। ব্যাপারটা প্রচন্ডরকম যন্ত্র*না দায়ক। শোয়েব হকের করুন আকুতি,

‘ আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না মা?’

‘ কিসের সুযোগ চাইছেন আপনি! জন্ম দিলেই কেউ বাবা হয়ে যায় না। বাবা হতে কঠোর তপ করতে হয়। ছেলেমেয়েদের প্রতি দায়িত্ব থাকতে হয়। যা আমার বাবার আছে। আমার বাবা আমাদের জন্য নিজের সুখ, আরাম আয়েশ সব বিসর্জন দিয়েছে। ভীষণ আদর যত্নে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। ওই মানুষটা আমার দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ। যিনি অন্যের সন্তানকে নিজের ঘরে এনে লালন পালন করেছে। নিজের সবটা উজাড় করে রক্ষা করেছে। আপনার মত কাপুরষ না যে প্রয়োজনের সময় নিজের স্ত্রী, গর্ভের বাচ্চাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। আপনার জন্য আমি এখন সবার সামনে অবৈধ!’

শোয়েব হক আওয়াজ করে উঠল। প্রিয় থামিয়ে দিলো। রাগী চাপাস্বরে বলল,

‘ চেঁচাচ্ছেন কেন? পিতৃহীন সন্তানকে এই ভদ্র সমাজ অবৈধ-ই বলে!’

শোয়েব হকের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল। অনুতপ্ততার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। বলল,

‘ আমি জানতাম না তুমি আমার মেয়ে প্রিয়। আয়শা আমাকে জানায়নি।’

‘ কেন জানাবে? আপনার দয়া ভিক্ষার জন্য? আমার মায়ের আত্মসম্মানবোধ ছিল। আপনার সামান্য দয়া ভিক্ষার জন্য সেই আত্মসম্মানে আঁচ লাগতে দিবেনা কখনো।’

শোয়েব অধৈর্য হয়ে পড়ল। বোঝানোর স্বরে বলল,

‘ আমি অনেক বার আয়শার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি। অনেক মাধ্যমে বারবার। পারিনি। আয়শা নিজেকে ততদিনে ভীষণ কঠোর করে গড়ে ফেলেছিল। আমার চেহারা তো দূর, আওয়াজটাকেও প্রচন্ডরকম ঘৃ*ণা করত। হ্যাঁ আমি আয়শাকে ঠ* কিয়েছি। আমি নিজেও ছবির ষ*ড়যন্ত্রের শিকার ছিলাম। হ্যাঁ আমি গ্রাম থেকে পালিয়ে শহরে চলে আসতে পারতাম। কিন্তু এতে আমার বোনের সংসারে অশান্তি হতো। দুলাভাই ভালো মানুষ। কিন্তু তার বাবা বড্ড দেমা*গি মানুষ ছিলেন। তার দম্ভে সাধারণ আঁচ লাগলেও তিনি কাউকে ছাড়তেন না। সেখানে আমাকে কি করে ছাড়তেন? সব শেষ করে দিতো তিনি। অভিলাষার সংসার ভাঙ্গতো। আর তাছাড়া তখন আমার মনে হয়েছে ছবিকে বিয়ে করে আমি আয়শার সব শখ আশা আকাঙ্খা পূর্ণ করতে পারবো। আমার কাছে টাকা থাকলে আয়শাকে রানি বানিয়ে রাখতে পারবো। টাকার অভাব যে কতটা য*ন্ত্রণা দায়ক ভ*য়ানক তা তুমি কি জানো। এমনও অনেক দিন কেটেছে ন*ষ্ট পান্তা খেয়ে কেটেছে। আয়শা আমার জন্য নিজের পরিবার সুখ আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়ে এসেছিল। আমি তাকে অনাহার, অভাব ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি কখনো। দুজোড়া কাপড়ে বছর কাটাতে হয়েছে। ছিড়া কাপড়ে তালি দিয়েও পড়েছে। আয়শার বি*সর্জন আমাকে ক্ষণে ক্ষণে পো*ড়াত। তখন আমার মাথায় ন্যায় অ*ন্যায় কোন ভেদাভেদ ছিল না। ডা*কাত বনে গেছিলাম। টাকার য*ন্ত্রণা নিবারন করাটা জরুরী ছিল। চেয়েছিলাম ছবিকে বিয়ে করে আয়শাকে নিয়ে দূরে ঘর বাঁধবো যেখানে আয়শার সব সুখ আহ্লাদ পূরণ হবে রানির মত রাখবো। আমাদের সুন্দর একটা গোছানো সংসার হবে। খানিকের জন্য দুরত্ব টানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আয়শা আমার থেকে চিরকালের মত দূরে সরে গেল। আমাকে জানালো আমার সন্তানকে মে*রে ফেলেছে ও। কথাটা শুনে প্রচন্ডরকম আঘা*ত পেয়েছিলাম। চাপা জেদ ধরে বসলো। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু পারলাম না। আয়শাকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি। ছবির সাথে আমার সংসার হলেও এই সংসারে আমি নেই। এই দেশ থেকে, দেশের মানুষ থেকে অনেক দূর দুবাইতে থাকতে শুরু করি।’

প্রিয় শান্ত। চোখ জোড়া অশ্রুভারাক্রান্ত। জড় ভারী কন্ঠে বলল,

‘ অথচ আপনি জানলেন-ই না যে তার সব সুখ ছিল আপনাতে। এই দিন দুনিয়ার চাকচিক্য কখনো সুখী করতে পারেনা কাউকে। যদি না অন্তরে শান্তি মিলে।’

শোয়েব হক উদাসীন কন্ঠে বলল,

‘ আমার অন্তরে কোনদিন শান্তি মিলবেনা। আমি নিজের হাতে সব শান্তি দাফন করে দিয়েছি। আমার সব সুখ শান্তি আয়শার সাথেই শেষ। এই বেঁচে থাকাটা অভিশাপের।’

প্রিয় দৃঢ় কন্ঠের জিজ্ঞাসা,

‘আপনার আমার কাছে এখন কি চাই?’

শোয়েব হক প্রোপার্টি পেপার’স গুলো এগিয়ে দিলো। অনুতপ্ত করুন সুরে বলল,

‘ আমি যা করেছি তা কখনো ক্ষমার যোগ্য না। সেই আশাটাও আমি করছিনা। শুধু বলবো, এই প্রোপার্টি গুলো নেওয়ার অনুরোধ রইল। আমার বুকে জ*লন্ত অগ্নিশিখাটায় একটু স্বস্তির মিলবে।’

তাচ্ছিল্য হাসলো প্রিয়,

‘ আপনার সত্যি মনে হয় এই প্রোপার্টি আমি নিবো। এতটা আত্মসম্মানহীন আমি? ভুলে যাবেন না আমি আয়শার মেয়ে। আমার মায়ের মত আমারো কঠোর আত্মসম্মান, বিবেকবোধ! আপনার সম্পত্তি নেওয়ার চেয়ে আমি না খেয়ে, অভাবে ম*রে যেতে পছন্দ করব। এর কানাকড়িও আমার চাইনা। আমার অল্প আয়ে আমি সন্তুষ্ট। এসব আপনার ক্ষমতা লোভী স্ত্রী আর নেশাখোর ছেলেমেয়েদের জন্য রেখে দিন। কিছুদিন পর ওদেরই প্রয়োজন পড়বে।’

তড়াক করে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল প্রিয়। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আপনার সাথে কোনদিন সাক্ষাৎ না হলে খুশি হবো। আসি।’

অকপটে পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রিয়। শতাব্দ পাশ থেকে উঠে এসে শোয়েবের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ মামা ভাগিনার সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ। আপনি মানবতার খাতিরে দেখা করতে চেয়েছেন, করিয়েছি। আর কোনদিন ওর মুখোমুখি হবেন না। অনেককাল প্রিয় দূরে ছিল আমার। আপাতত সংসারে শান্তি চাই।’

শোয়েব হক নত সুরে বলল,

‘ এই প্রোপার্টি গুলো যদি প্রিয়…

কথা কাটলো শতাব্দ। বলল,

‘ আমার বউকে ভালো রাখার মত যথেষ্ট সামর্থ্য আছে আমার। আপনার চ্যারিটি’র প্রয়োজন নেই।’

‘ আমার মেয়ের খেয়াল রেখো।’

শতাব্দের দৃঢ় আওয়াজ,

‘ ভয় নেই, আমি আপনার মত কাপুরষ নই। স্ত্রীর’র পাশে দাঁড়াতে জানি।’

বড়বড় ধাপ ফেলে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। পার্কিং সাইডে গাড়ির সাথে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। হাত পা কাঁপছে অনবরত। শতাব্দ গাড়ির দরজা খুলতে তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে বসলো। বড়বড় নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত, স্বাভাবিক করতে চাইছে প্রিয়। নির্ভীক দৃষ্টিতে চেয়ে শতাব্দ। প্রিয়’র অস্বাভাবিক চোখমুখ দেখে হাতের উপর হাত রাখল শতাব্দ। আলতো স্বরে ডাকল। বলল,

‘ প্রিয়! তুমি ঠিক আছো?’

তাসের ঘরের মত মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়ল প্রিয়। জাপ্টে পড়ল শতাব্দের বুকে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। চিৎকার করতে করতে বলল,

‘ সব ভেঙ্গে ঘুড়িয়ে এই লোকটা এখন কেন এসেছে শতাব্দ।  কেন এমন পিতৃত্ববোধ জাগ্রত হলো তার। তাকে যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সে আর নেই। কেন বুঝে না, আমার তাকে এখন আর চাইনা। চাইনা আর। ‘

প্রিয়’কে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো শতাব্দ। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করল। বোঝানোর সুরে বলল,

‘ তোমার য*ন্ত্রণার কারণ হতে দেবনা কাউকে আর। আমি আছি, তোমার কাছে।’ 

 

ভারাক্রান্ত মন, পরাজীত হয়ে গাড়িতে চড়ল শোয়েব হক। মেয়েকে পাওয়ার শেষ সুযোগ হাতছাড়া হলো আজ। শতাব্দ আর কোন দিন প্রিয়’র মুখোমুখি হতে দেবে না তাকে। সে বেশ ভালো করে চিনে ভাগিনাকে। প্রিয়’র জন্য কতটা পাগলাটে সে। বয়স স্বভাবে যতই ম্যাচিউর হোক। প্রিয়’র জন্য সকল সীমানা বাঁধাকে ভঙ্গ করে প্রস্তুত। শোয়েব হক এতটুকুতেই খুশি। তার মেয়েটা যোগ্য হাতে। এখন সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। শত ঝড় হোক, বিপত্তি আসুক শতাব্দ আগলে রাখবে প্রিয়’কে। আয়শা বোধহয় এমনি একটা শক্ত, বিশ্বস্ত হাত ভেবে শোয়েবের হাত ধরেছিল। আফসোস, শোয়েব প্র*তারণা করল। জ*ঘন্য ভাবে ঠকালো। যার আফসোস কোনদিন ফুরাবে না। চিরকাল শুধু পো* ড়াবে। এই জীবনে কি মুক্তি মিলবে! অনুতপ্তার জল গাল বেয়ে পড়ল। নির্জন ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই আচমকা একটা বড় ট্রাক এসে ধাক্কা দিলো। গাড়িটা ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে শেষ প্রান্তে ঝুলছে। আয়নার দিকে তাকাল শোয়েব। পেছনের গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে লিমন বসে। ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা দিয়েছে। হতভম্ব হয়ে নিমিষ চেয়ে রইল। তার ছেলে তাকে খু*ন করতে চাইছে। কেন? এই প্রোপার্টি’র জন্য!  প্রিয়কে দিচ্ছে বলে। এই দুনিয়ার নিয়ম। সম্পত্তির জন্য ছেলের হাতে ম*রতে হবে বাবাকে! প্র*তারণার শান্তি প্রতা*রণা। আয়শার সাথে প্*রতারণা করেছে বলেই হয়তো ভাগ্য প্রতি*শোধ নিচ্ছে। তাকে তার ভাগের প্রাপ্য প্রতা*রণা ফিরিয়ে দিচ্ছে। সত্যি বলতে মানুষ নিজের জন্য কবর নিজে খুড়ে। দোষ দেয় ভাগ্যকে। ভাগ্যের কোন দোষ নেই, সে যথাসময়ে মানুষের প্রাপ্যটুকু ফিরিয়ে দেয়। শোয়েব ছলছল অশ্রুভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে । লিমন আরেকটা ধাক্কা দেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে বলছে। শেষ ধাক্কা দিতেই গাড়ি ব্রিজ থেকে খাঁ*দে যেয়ে পড়ে। মুহুর্তেই অন্ধকারে ডেকে যায় সব।

 

চলবে…….

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

 

৪৭.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

গতকাল বিকালে পুলিশ ভাঙ্গা ব্রিজের খাঁদ থেকে শোয়েব হকের গাড়ি উদ্ধার করেছে। ভেতরে শোয়েব ছিল। দেহে প্রাণের স্পন্দন চলছিল। হাসপাতালে ভর্তি আছে,  ধুঁকে ধুঁকে শ্বাস ফেলছে । আভিলাষা বেগম খবর পেয়ে কান্নাকাটি করে হুড়াহুড়ি বেরিয়ে যায়। যতই ঘৃ*ণা, দূরত্ব থাকুক। হাজার হোক শোয়েব তার ভাই। র*ক্তের  টান। প্রিয় স্তব্ধ ছিল।মানুষটাকে তার প্রচন্ডরকম অপছন্দ। ভীষণ ঘৃ*ণা করে। শাস্তি চেয়েছিল, মৃ*ত্যু না!  শোয়েব হক আইসিইউতে আছে। এখনো কোমায়। পুলিশ ভাষ্যমতে এটা এ*ক্সিডেন্ট না। এটেম টু মা*র্ডার। ট্রাকটা অনেক আগে থেকে শোয়েব হকের গাড়ি ফলো করছিল। তাদের সন্দেহ প্রিয়কে। কারণ শোয়েব হক প্রিয়’র সাথেই দেখা করে বাড়ি ফিরছিলেন। তাছাড়া কিছুদিন যাবত চলতে থাকা ঝামেলায় প্রিয়’র দিকেই পুরোপুরি সন্দেহ। ছবি বেগমও প্রিয়কে দো*ষী প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে বারবার। আগুনে ঘি ঢালছে। শতাব্দের হুমকি ধমকিতে চুপ হলেও দমছে না। ভেতরে ভেতরে পুলিশকে দিয়ে প্রিয়কে জিজ্ঞাসা বাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে। শতাব্দ কোনরকম ক্ষমতার জোরে আপাতত ছাড়িয়ে এনেছে। এখন ট্রাক ড্রাইভারকে খোঁজাখুঁজি করছে পুলিশ।

   সারারাত জেলখানা, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে সকালে বাড়ি ফিরেছে প্রিয়। নির্ঘুম, দুশ্চিন্তায় রাত কা*টিয়ে শরীর, মন ভীষণ ক্লান্ত।

ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আনমনেই চোখের কোন গড়িয়ে জল পরে। বুক ভেঙ্গে চূড়ে কান্না আসছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ওই লোকটার জন্য একটু কাঁদলে কি, মায়ের প্রতি খুব বেশি অবিচার হবে তার।

প্রিয় ঘরে এলো শতাব্দ। চোখ বুজে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে প্রিয়। চোখের কোন বেয়ে জল পড়ে বিছানার চাদর ভিজছে। ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে। ফোপাঁচ্ছে। ভেতরের কষ্ট প্রকাশ করতে না পারার য*ন্ত্রণায় ছটফট করছে। বিছানার দিক এগিয়ে গেল শতাব্দ। প্রিয়’র পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে। চোখ খুলে তাকাল প্রিয়। ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই শতাব্দকে দেখল। তড়িঘড়ি হাতে চোখ মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কারো সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবে না কখনো। শতাব্দ উপর দিক তাকিয়ে, গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ চাইলে কাঁদতে পারো। আমি বাঁধা দিবোনা আর তোমার মায়ের সাথেও অন্যায় হবেনা।’

প্রিয় থমকে গেল। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কতক্ষণ। মানুষটা তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ, য*ন্ত্রণা গুলো কি করে বুঝল। আচমকা শতাব্দের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। জাপ্টে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আমি তার শাস্তি চেয়েছিলাম, মৃ*ত্যু চাইনি কখনো।’

‘ জানি প্রিয়! আমাকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।’

‘ আছে। আমি সত্যি এমনটা চাইনি। আ..আমি কিছু করিনি।’

‘ আমি জানি, বিশ্বাস করি।’

বলেই প্রিয়কে বুকে জড়িয়ে ধরল শতাব্দ। হাউমাউ করে কান্না করছে প্রিয়। চোখের জলে বুক ভিজচ্ছে শতাব্দের। বাঁধা দিচ্ছেনা। কাঁদুক, খুব করে কাঁদুক। মন হালকা করুক। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল শতাব্দ। আচমকাই খেয়াল হলো, প্রিয়’র শরীর প্রচন্ডরকম গরম। সারারাত দৌড়াদৌড়ি পেরেশানি ক্লান্তিতে জ্বর আসছে নিশ্চয়ই। ধীরেধীরে নিস্তেজ হচ্ছে প্রিয়। খানিক পর একদম চুপ। ঘাবড়ে গেল শতাব্দ। বুকে থেকে মুখ উঁচিয়ে ডাকল কয়েকবার। উত্তর দিলো না প্রিয়। ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে।

 

শতাব্দের উচ্চ আওয়াজ শুনে জ্ঞান ফিরল প্রিয়’র। ফোনে কারো উপর রাগ ঝারছে। তটবটে রাগী গম্ভীর আওয়াজে বলছে,

‘ ওই ড্রাইভারের স্বীকারোক্তি আমার চাই। মানে চাই। যেই করেই হোক।’

ফোনের অপর পাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। শতাব্দ রেগে গেল আরো। গর্জিয়ে বলল,

‘ কিছু বলছেনা। মানে কি? ওয়েট আমি আসছি।ওর জবানে কতক্ষণ তালা লাগানো থাকে আমিও দেখছি।’

ফোন কে*টে মোবাইলটা একপ্রকার সোফায় ছুঁড়ে ফেলল শতাব্দ। অকপটে পা ফেলে বিছানায় গিয়ে বসল। মাথা চেপে বসল। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

পেছন থেকে প্রিয় ডাকল। বলল,

‘ কি হয়েছে?’

প্রিয়’র ডাকে টনক নড়ল। পেছন ফিরে তাকাল। বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে, কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে প্রিয়। শতাব্দ এগিয়ে গেল। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেশ টেনে সামনের চুল গুলো কানের কাছে গুছিয়ে দিলো। কপালে হাত ছুঁয়ে  আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ জ্বর কমেছে। এখন কেমন লাগছে?’

প্রিয়’র লঘু আওয়াজ,

‘ কিছুটা ভালো।’

একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল আবার,

‘ কোথাও যাবেন?’

‘ হ্যাঁ একটু বের হতে হবে।’

‘ কেন?’

‘ একটা জরুরি কাজ পড়েছে।’

কৌশলে কথাটা এড়াতে চাইছে শতাব্দ। কোনকিছু আর জিজ্ঞেস করল না প্রিয়। শতাব্দ উঠে দাঁড়াল, সোফা থেকে মোবাইল তুলে হাতে নিলো। ঔষধ বের করে বিছানার পাশে রাখতে রাখতে আনমনা হয়ে বলল, 

‘ মা হাসপাতালে, সমুদ্র প্রভা গ্রামে। খালা সাথে থাকবে। খাবার খেয়ে, ঔষধ গুলো খেয়ে নিও।’

বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়াল প্রিয়। পাশে এসে বসল শতাব্দ। কপালে চুমু দিয়ে, গালে আলতো হাত ছুঁয়ে দিয়ে নিগূঢ় সুরে  বলল,

‘ নিজের খেয়াল রেখো। খারাপ লাগলে ফোন করিও, চলে আসবো।’ 

প্রিয়’র শুকনো ঠোঁটে আলতো হাসি। আঁখি পল্লব নাড়িয়ে  আওয়াজহীন উত্তর দিলো। যার অর্থ ‘আচ্ছা’

 

সন্ধ্যা নামছে। বেগতিক বাতাস বইছে। ঘন বর্ষণের পর আবার আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। চারিদিক অন্ধকার। বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। দূর আকাশে তার চোখ। কোন ভাবনায় মশগুল। আচমকা কলিং বেল বাজল। ঘোর কা*টল। ছিটকে উঠল। দ্রুত দরজার দিক পা বাড়াল। নুপুরের রিমিঝি্মি শব্দে ঘর মাতলো। দরজা খুলে দিলো প্রিয়। কাঁক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। চুল থেকে পানি বেয়ে একাকার।

মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে চোখ তুলে তাকাল শতাব্দ। প্রিয়কে দেখে থমকে গেল। পড়নে কুচকুচে কালো শাড়ি, খোলা কেশ। চোখে গাঢ় কাজল লেপ্টে, মেরুন লালে ঠোঁট রাঙিয়ে। ভয়*ঙ্কর সুন্দর, মায়াদেবীর রূপে সেজেছে। সামনে কে? কোন মানবী। নাকি স্বর্গ রাজ্যের অপ্সরী। 

নিশ্বাস খানিকের জন্য থমকে গেল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে নিগূঢ় চেয়ে রইল। আনমনেই  বুকের বাঁ পাশে যেয়ে ঠেকলো হাত। কি বলবে ভুলে গেছে। মুহূর্তেই যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। 

প্রিয়’র ডাকে ঘোর কাটল। নড়েচড়ে উঠল শতাব্দ। কন্ঠে তাড়া দিয়ে প্রিয় বলল,

‘ ঠান্ডা বসে যাবে, তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে নিন।’

কিছু বলল না শতাব্দ। যন্ত্রের মত ভিতরে চলে এলো। প্রিয় শুকনো কাপড় বের করে হাতে ধরিয়ে দিলো। থমথমে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শতাব্দ। এটা সত্যি প্রিয় তো?

বাধ্য ছেলের মত ওয়াশরুমে চলে গেল। মিনিট দশেক পর ফিরল। মাথা মুছতে মুছতে আড়চোখে তাকালো। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। ঘর জুড়ে অন্ধকার মাখানো। সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি এখনো। বেলা শেষের অনুজ্জ্বল আলো। বাতাসে অদ্ভুত মাদকতা মেশানো। দমকা  হাওয়ায় শাড়ির আঁচল উঁড়ছে প্রিয়’র। শাড়ি সরে দুধে-আলতা গা ভেসে। ঝলমলে খোলা কেশ তার চোখেমুখে পড়ছে। হাত উঁচিয়ে চুল গোছাতে চাইল। কাঁচের চুড়ি ঝনঝনিয়ে উঠল। শব্দটা বুকে যেয়ে বিঁধল শতাব্দের। চোখ লাগল গভীর ঘোর। দিন দুনিয়ার সব ভাবনা এড়িয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মত সেদিকে এগিয়ে গেল। শাড়ির আঁচল মাড়িয়ে, পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরল। নাক ঠেকলো, উন্মুক্ত পিঠে। গভীর করে, প্রিয়’র মিষ্টি সুভাস টানতে লাগল। টলটলে শরীর, মাতাল মাতাল মন। আবেশে শতাব্দের বুকে গা এলিয়ে দিলো প্রিয়। নিশ্বাসের গতি দ্রুত, শরীর কম্পন করছে প্রচন্ড। আলতো করে পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে শতাব্দ। পাগল, উন্মাদের মত আরো গভীর করে জাপ্টে ধরল। কানের কাছে মুখ এনে অগোছালো, নিগূঢ় কন্ঠে বলল,

‘ ডার্ক কালার পড়ে, চোখে কাজল লেপ্টে আমার সামনে আসতে বারণ করেছিলাম। এইযে আমি বদ্ধ উন্মাদ হলাম, এর দায়ভার কে নিবে এখন?’

প্রিয় চুপ। তার ঘনঘন নিশ্বাস। প্রিয়’র বাহু টেনে নিজের দিক ফেরাল। দেয়ালের সাথে মিশিয়ে, কপালের সাথে কপাল মিশাল। চোখ বুজে আছে প্রিয়। শতাব্দের উষ্ণ নিশ্বাস মুখে পড়ছে তার। নিমিষ নেশাতুর হয়ে চেয়ে আছে শতাব্দ। অধৈর্য, অস্থির কন্ঠে বলল,  

‘আমার তোমাকে চাই প্রিয়। প্রচন্ড ভাবে চাই।’

প্রিয় উত্তর দিলো না। শতাব্দ অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করল। থরথর কাঁপছে প্রিয়। শতাব্দ ঝুঁকে এলো। আলতো করে প্রিয়’র ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। বাঁধা দিলো না প্রিয়। শতাব্দের পাগলামোতে তাল দিলো। শতাব্দ যেন আশ্বাস পেল। ঝট করে প্রিয়’কে কোলে তুলে নিলো। বিছানার দিক পা বাড়াল। অন্ধকারে মিলিয়ে আসা ঘরে, দুজনের তপ্ত নিশ্বাস ভাসছে। কোন এক স্বর্গিয় সুখে, দুজন প্রেমময় বৈধ সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এতোবছরের অক্লান্ত এক অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটলো। দুজন প্রেমিকের আত্মার পরিতৃপ্তি পেল। তাদের প্রেম ভালোবাসা পূর্ণতা এলো।

 

ঘড়িতে তখন রাত দশটা। অক্লান্ত বর্ষণের পর স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। আকাশ এখন পরিষ্কার। মেঘেরা ঝরে গেছে। গোল ভরাট চাঁদটা, পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। চারিদিক স্পষ্ট। মাত্রই প্রিয় দোলনায় এসে বসেছে। ভেজা চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে। গা শিরশির করছে। স্লিভলেস নাইট গ্রাউনের কটিটা আরো আষ্টেপৃষ্টে গায়ে জড়িয়ে নিলো। অমনি চায়ের কাপ হাতে শতাব্দ এলো। প্রিয়’র পাশে দোলনায় বসল। কাপ এগিয়ে দিয়ে প্রিয়’র উদ্দেশ্যে বলল,

‘ খেয়ে নেও, মাথা ভারী ভাব কমবে।’

চায়ের কাপে চুমুক দিলো প্রিয়। পরিবেশ পিনপতন নীরব। নীরবতা ভাঙ্গল প্রিয়। বলল,

‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’

চায়ের কাপে চুপ দিয়ে উত্তর দিলো শতাব্দ, ‘হু’

একটু চুপ থেকে প্রিয় বলল,

‘ যখন আমি ইমান্দিপুর ছিলাম, শোয়েব হক থেকে আপনি দূরে থাকতে বলতেন কেন? আপনি তো তখনো জানতেন না আমি উনার সন্তান।’

‘ তুমি উনার সন্তান না জানলেও, তোমার চেহারা হুবহু  তোমার মায়ের মত। আমি জানতাম উনার প্রতি দুর্বলতা ছিল, সেই সাথে ভয়া*নক রকম আ*ক্রোশ ছিল। তাই আমার ভয় ছিল, উনার আ*ক্রোশ তোমার উপর না ফেলে আবার। যদি প্রতি*শোধ নেশায় তোমাকে আঘা*ত করে ফেলে। তুমি ছিলে উনার(আয়শার) কন্যা সমান।’

মৃদু হাসল প্রিয়।বলল,

‘ আপনি সবসময় আমার আশেপাশে ছিলেন, তাইনা? আমার কলেজ ভার্সিটির ছেলেদের সবসময় শা*সিয়ে রাখতেন। আপনার জন্যই তারা আমার থেকে দূরেদূরে থাকত। কি ভয় ছিল আপনার? আমি অন্যকারো হয়ে যাবো!’

ঠোঁট মেলে হাসল শতাব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। প্রিয়’র চোখে অদ্ভুত চমক। চোখে চোখ ডুবিয়ে বলল,

‘ উহু, সেই ভয় আমি পাইনা। আমি জানতাম তুমি চিরকাল শুধুই আমার। তোমাকে নয়, এই দুনিয়ার হিং*স্র মানব নামের পশুদের ভয় ছিল। কেউ ক্ষ*তি না করে দেয় আমার সরল প্রিয়’র।’

‘ আর আমার জন্মদিন, প্রত্যেক ইভেন্টে ফ্যানদের নাম করে দামি দামি গিফট, ফুলের বুকে গুলো আপনারই পাঠানো ছিল। সত্যি তো!’

উত্তরে কিছু বলল না শতাব্দ। মুচকি হেসে, চোখ ফিরিয়ে নিলো। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। নিগূঢ়, নিমিষ কন্ঠে বলল,

‘ আমি এক মূহুর্তের জন্যও তোমাকে ভালোবাসা বন্ধ করিনি প্রিয়। তোমার প্রতি ভালোবাসাটা আমার নিশ্বাসের মতই সত্য!’

 

 প্রিয় নিমিষ চেয়ে রইল। এত সুদর্শন, রূপবান, বিচক্ষণ একজন পুরুষ তার প্রেমে অন্ধ, বদ্ধ উম্মদ। সত্যি কি সে এতোটা ভালোবাসার যোগ্য? এই যে সে অপূর্ণ। এই অপূর্ণতা দিয়ে কি মানুষটার ভালোবাসার প্রতুত্তর দিতে পারবে কখনো। একটা সুখী সুন্দর জীবন গড়তে পারবে আদৌ। উহু, তা কখনো সম্ভব না।

 এইযে আজ তার একটুখানি সুখের জন্য মানুষটাকে এলোমেলো করে দিলো। প্রাণ ভরে ভালোবাসলো। তার ভালোবাসার জোয়ারে নিজেকে ভাসালো। এতে কি খুব বেশি অপ*রাধ হয়ে গেল। মানুষটাকে কি ঠকালো!

 কিন্তু এতে তার-ই বা কি করার ছিল! ভাগ্য বড্ড নি*ষ্ঠুর! চিরকাল শুধু তাকেই ঠকালো। যেখানে শতাব্দকে ভালোবেসে, সুখে সংসার সাজানোর কথা ছিল। সেখানে তার অপূর্ণতার জন্য ছেড়ে যেতে হবে। ভালোবাসার মানুষটাকে কি করে একটা অপূর্ণ আফসোসের জীবন দিবে? সত্যি জানার পর শতাব্দ কখনোই প্রিয়কে ছাড়বেনা। বরং আগলে রাখবে কিন্তু ওইযে তার নারীত্বের অপূর্ণতা! সারাজীবন শতাব্দকে পিতা না হওয়ার আফসোসে পোঁ*ড়াবে। তখন সেই দাহন প্রিয় নিজ চোখে কি করে সইবে। পৃথিবীতে কখনো কারো জীবন থেমে থাকেনা। প্রিয়’র জায়গায় নতুন কেউ আসবে। শতাব্দকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসবে। শতাব্দের আদর নিবে, তাকে পূর্ণ করে দিবে। একটা সুন্দর পরিবার হবে তাদের। থাকনা একটা অপূর্ণ প্রিয়’র গল্প। নাইবা পেল শতাব্দকে। চিরদিন এই মধুর রাতের স্মৃতি আগলে বাঁচলো।

  সবকাজ প্রায় শেষ। জাল বিছানো হয়ে গেছে। কালকের দিনটা অন্যরকম হবে। তার এতবছরের প্রতি*শোধ, আক্ষেপ পূর্ণতা পাবে। অপরা*ধীদের শাস্তি মিলবে।  রাত পোহালেই চলে যাবে। তার ভালোবাসার শতাব্দকে চরম ভাবে ঠকিয়ে যাবে। হয়তো চরম ঘৃ*ণা করবে, দূরে ঠেলে দিবে প্রিয়কে। আফসোস নেই এটাই চাইছে সে। যেখানে মানুষ যুগের পর যুগ সত্যিকারের ভালোবাসার অভাবে পু*ড়ে। সেখানে প্রিয় পেয়েও ছেড়ে যাবে। কি নিষ্ঠুরতম ভাগ্য তার। চোখ ভিজে এলো প্রিয়’র। শতাব্দের চোখে বাঁধল। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। কপালে হাত ছুঁয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,

‘ জ্বর আসছে আবার। শরীর ব্যথা করছে? ঔষধ খেতে হবে, ঘরে চলো।’

উত্তরে কিছু বলল না প্রিয়। অপলক তার প্রেমিক পুরুষের দিক চেয়ে রইল। প্রিয়’র কোনরূপ হেলদোল না পেয়ে কোলে তুলে নিলো শতাব্দ। ঘরে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। 

 

গভীর রাত চোখে ঘুম নেই প্রিয়’র। পাশ ফিরে মুখপানে চেয়ে আছে শতাব্দের। এত কাছ থেকে এই মুখখানা দেখার সুযোগ কোনদিন মিলবে কি আর! নিশ্বব্দ কান্নায় চোখ ভিজছে। বুকে প্রচন্ডরকম হাহাকার। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। আলতো হাতে শতাব্দের মুখখানায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ ভালোবাসি শতাব্দ। প্রচন্ডরকম ভালোবাসি। আমি চিরকাল আপনার প্রিয় হয়েই বাঁচবো। হোকনা হাজার মাইলের দূরত্ব।’  

 

চলবে…………

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

 

৪৮.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

শতাব্দ,

 

কোথা থেকে শুরু করি? চিঠিটা যখন আপনার হাতে পৌঁছাবে। এই বাড়ি ছেড়ে আমি অনেক দূরে। জানি আপনি রাগবেন। বিরক্ত হবেন, ঘৃ*ণা করবেন। কিন্তু সত্যি এটাই যে, আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসিনি। আমার ভালোবাসার সমাপ্তি অনেক বছর আগেই হয়েছিল। এইযে আপনার কাছে ফিরে আসাটা, পুরোটাই আমার সাজানো ছিল।সহজ অর্থে নাটক ও বলতে পারেন। একবার আপনি আমাকে ছেড়েছিলেন, আমি আপনাকে নিজের কাছে টেনে, ছেড়ে দিয়ে।শোধ নিলাম। আমার ফিরে আসার পেছনের  কারণটা ছিল রহস্য উদঘাটন। আমি আপনাকে এক মুহূতে’র জন্যও ভালোবাসিনি। গতরাতে আপনার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কা*টানোর পেছনেও উদ্দেশ্য ছিল। মূলত ডিস্ট্রাকড করে। আপনার ফোনে ড্রাইভারের স্বীকারোক্তির ভিডিও নেওয়া। পুলিশ নিশ্চয়ই শাস্তি দিবে, কিন্তু অপরাধীদের আমি আমার মত করে শাস্তি দিতে চাই। আমার মায়ের আত্মহ*ত্যা ছিল না। তাকে খু* ন করা হয়েছিল। শোয়েব হক, ছবি বেগম  এই সমাজ তাকে খু ন করেছে।তাদের তিক্ত ধারালো বুলি আত্মহ*ত্যা করতে বাধ্য করেছে। আইন প্রমাণ চায়। মানহানির কোন কঠোর শাস্তি নাই। তাই আমিও হাল ছাড়িনি। তাদের কঠোর শাস্তি দিতে চেয়েছি। অপমানের বদলে অপমান, হ*ত্যার শাস্তি মৃ*ত্যুদন্ড। ভাইয়া ও তার ডিটেকটিভ বন্ধুর সাহায্যে ছবি বেগম ও তার ছেলেমেয়েদের সব কুকীর্তির প্রমাণ জোগাড় করি। যদিও তা যথেষ্ট ছিলনা। তাই উষ্ণচর যেয়ে তুরফাদের সাথে দেখা করি।  আমি জানতাম ছবি বেগম আঁচ পেলে আমাকে মে*রে ফেলতে চাইবে। তাই ঢাল বানিয়ে আপনার আড়ালে থেকে নিজের কাজ করতে থাকি। কারণ আমি জানতাম আপনাকে ডিঙিয়ে আমার অবধি পৌঁছানোর সাধ্যি নেই তাদের। সহজ কথায় নিজের সেফটির জন্য আমি আপনাকে ব্যবহার করেছি।

হয়তো আপনার ভালোবাসায় কোন খাঁদ ছিলনা। কিন্তু আমার দ্বারা আপনার সাথে থাকা সম্ভব না। একটা প্রশ্নের উত্তর আমার এখনো মিলেনি! সেই রাতে ইমান্দিপুর কেন গিয়েছিলেন আপনি? জানি উত্তরটা আপনি বলবেন না। আমিও আর জানতে চাইব না। তবে হ্যাঁ, কোন কিন্তু নিয়ে আপনার সাথে সংসার সাজাতে পারবো না। যেখানে ভালোবাসার বাস নেই, সেখানে কি করে সংসার সাজাই? জানি, আমাকে খুঁজে বের করা আপনার জন্য কঠিন না। পাতালে লুকালেও খুঁজে বের করবেন। কিন্তু আমি চাইনা আমাদের আবার দেখা হোক। আমার উপর কোনপ্রকার জোর খাটানোর চেষ্টা করলে, আমি অনর্থ ঘটাবো। আর আপনি জানেন এমনটা করতে আমার একটুও হাত কাঁপবেনা। আমাদের জন্য বিচ্ছেদ-ই শ্রেয়।আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারিনি শতাব্দ। ভুলে যান আমাকে। অন্যকারো সাথে নতুন করে সংসার সাজান। আপনি অনেক ভালোবাসার প্রাপ্য। আপনার ভাগের ভালোবাসা গুলো অন্যকারো কাছে তোলা আছে এখনো। পরিশেষে বলল, মাফ করবেন। আমার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করবেন।

 

ইতি

প্রিয়,

 

দেয়ালের পিঠে যেন চিঠির লেখা গুলো ভেসে উঠছে বারবার।বাহিরে উজ্জ্বল দিন হলেও, ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। এলোমেলো চূর্ণবিচূর্ণ ঘর। ভাঙ্গাচুরা জিনিসে চারিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শান্ত অগ্নিগিরি হ্ঠাৎ বিস্ফোরণে যেমন তান্ডব হয়। ঠিক তেমন। শতাব্দের রাগের মাত্রা আজ আসমান ছুঁই ছুঁই। ক্রোধান্বিত গর্জনের ফোঁসফোঁস নিশ্বাস দেয়ালে দেয়ালে বারি খাচ্ছে। চাপা চিৎকার, উত্তেজনা, ক্রোধ তাকে খাঁখাঁ করে পো*ড়াচ্ছে। কোথাও চূর্ণবিচূর্ণ ধা*রালো কিছুতে হাত লেগে অনর্গল র*ক্ত ঝরছে। সে দিকে তার খেয়াল নেই, ধৈর্য যেন সীমা ছেড়েছে। সবকিছু বিনাশ করেই যেন ক্ষান্ত হবে আজ!

 

সারাদেশ তোলপাড়। বাতাসে বাতাসে শুধু একটাই গুঞ্জন’ ছবি বেগম তার সন্তানদের ফাঁ*সি চাই’। ভোর রাতের দিক অজানা এক পেজ থেকে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে লিমন হকের স্বীকারোক্তি আছে যে, সেই আর তার বন্ধুরা মিলে তদ্রাকে ধ*র্ষণ করেছে। নিশ্বাস তখনো চলছিল। দেহে প্রাণ ছিল। তা দেখে লুবনা ঘাবড়ে যায়। গলা টি* পে শ্বাসরোধ করে মে*রে ফেলে। তারপর পানিতে ভাসিয়ে দেয়। যখন লা*শ ভেসে উঠে, তখন ব্যাপারটা কুসংস্কারে ডেকে ফেলে। পানির নিচের খারাপ জিনিস তদ্রাকে মে*রেছে। সেই সাথে গ্রামে চলতে থাকা মা*দক ব্যবসা, চাঁদাবাজি সবকিছুর স্বীকারোক্তি আছে। উষ্ণচরের মানুষের উপর এতবছর অমানবিক নির্যাতন। সেই সাথে শোয়েব হকের এক্সিডেন্টের ব্যাপারটার ও খোলাসা হয়েছে। ড্রাইভারের স্বীকারোক্তি ভিডিও প্রমাণ সহ সব ফাঁস হয়েছে। সবমিলিয়ে তারা পুরোপুরি ফেঁ*সে গেছে। টাকা দিয়েও কোন কাজ হচ্ছেনা। সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলছে বরাবর। মিনিটে মিনিটে শতশত লাইক, শেয়ার হচ্ছে। একটাই দাবি সবার ‘তাদের ফাঁসি চাই’। রাজনৈতিক দলও পিছিয়ে গেছে। ছবি বেগমকে  সাহায্য করার জন্য আশেপাশে কেউ নেই। শাহরিয়ার হক সাহায্যের জন্য মুখের উপর নিষেধ করে দিয়েছেন। এদিকে শতাব্দ ফোন তুলছেনা।  পুলিশ খোঁজাখুঁজি করছে। হাতের কাছে পেলেই এরেস্ট করবে। চারিপাশ থেকে অ*ন্যায়ের শিকড় যেন চেপে ধরেছে ছবিকে। মানুষের হাহাকার অভিশাপ যেন ফলে যাচ্ছে আজ। চারিদিকে শুধু অপমান আর অভিশাপ। এবার তার পালাবার কোন পথ নেই আর।

 

গতরাতে শোয়েব হকের জ্ঞান ফিরেছে। শরীরের ক্ষত অনেক। তবে বিপদ মুক্ত হলেও অভিশাপ ছাড়েনি তাকে। হাঁটা চলার জন্য অক্ষম সে। হার্ট অ্যাটাক করে প্যারালাইজড হয়ে পড়েছে। মুখ বেঁকে গেছে, হাতপা সব অচল। কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারবেনা সে। যতদিন বাঁচবে, এভাবেই তাকে বাঁচতে হবে। অন্যের সাহায্য নিয়ে। আজ সাহায্যে জন্য কেউ নেই স্ত্রী সন্তান সবাই ছেড়ে গেছে। তাদের যতটুকু স্বার্থ ছিল সব গুছিয়ে কে*টে পড়েছে। আপাতত তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। দুদিন ধরে অভিলাষা বেগম একাই  তার সাথে হাসপাতালে আছে।

 আচমকা বাড়ি থেকে ফোন আসতেই নার্সদের দায়িত্ব দিয়ে তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল থেকে অভিলাষা বেরিয়ে গেছে। ওইদিকে বাড়িতে শতাব্দ হট্টগোল কান্ড বাঁধিয়েছে। যাওয়ার আগে বেশ কড়া করে বলে গেছে নার্সকে, কাউকে যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়। এমনিতেও পরিস্থীতি খারাপ। সাংবাদিকরা নতুন খবরের জন্য উসখুস করছে। এখানে এসে তারা ঝামেলা করতে পারে।

অভিলাষা বেরিয়ে যেতেই বোরকা পড়া কেউ এক ভেতরে এলো। নার্স চমকালো। বিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ কে আপনি? পেশেন্টের আত্মীয়।’

বোরকা পরিহীতা মহিলার স্বাভাবিক আওয়াজ,

‘ জি, আমি উনার বন্ধু। উনার সাথে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।’

নার্সের সন্দেহ হলো। বলল,

‘ সরি আমাদের অনুমতি নেই।’

‘ উনার বোনের সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনি চাইলে ফোন করে খোঁজ নিতে পারেন।’

নার্সের যেন খানিক বিশ্বাস হলো এবার। ফোন করে খোঁজ নেওয়ার মত এত সময় আছে কি তার? ছোট ছোট পা ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

নার্স বেরিয়ে যেতেই শোয়েব পাশে চেয়ার টেনে বসল তিনি। মুখের মুখোশ তুলে। আলতো স্বরে ডাকল,

‘ শোয়েব! শোয়েব!’

পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকাল শোয়েব। চাহনি স্পষ্ট হতেই থমকে গেল সে। মৃ*ত মানুষ কি কখনো ফিরে আসে? এটা কি সত্যি সে? নাকি তার আত্মা এসেছে! কুসংস্কার কথাবার্তা মাথা ঝেঁকে ধরেছে। অধৈর্য, অস্থির হয়ে কিছু বলতে চাইল। পারছেনা সে। মুখ থেকে বোবার মত গোঙ্গানি আওয়াজ বেরচ্ছে। মুখ থেকে লালা বেরিয়ে পড়ছে। সামনের মানুষটা টিস্যু দিয়ে মুখে দিলো। শোয়েবের দিক ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ আমাকে চিনতে পেরেছ শোয়েব। আমি আয়শা।’

শোয়েব অধৈর্য্য হলো আরো। হাউমাউ করে খাবলে পড়ল, কিছু বলতে চাইল। পারল না।

আয়শা স্মিত হাসল। বলল,

‘ কি ভাবছ বেঁচে আছি কি করে? হয়তো আজ এই দিনটা দেখাবে বলে, বিধাতা দূত করে সেদিন পাঠিয়েছিল শতাব্দকে। সত্যি বিধাতা মহান। কর্মের ফল এই দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয় সবাইকে। দুনিয়াতে ‘রিভেঞ্জ অব নেচার ‘বলতেও কিছু আছে। যেই মানুষটার জন্য তুমি আমাকে ঠকিয়েছিলে। সেই মানুষটাই তোমার প্রাণ নিতে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ কি অদ্ভুত তাইনা শোয়েব!’

শোয়েব থমকে আছে। চোখজোড়া থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছু বলতে চাইছে। পারছেনা, নিয়তি আজ তাকে বোবা বানিয়ে দিয়েছে। জীবনের অন্তিম সিড়িতে দাঁড়িয়ে, অথচ ক্ষমাটাও চাইতে পারছেনা। কি অদ্ভুত ভাগ্য তার।

আয়শা আবার বলল,

‘তোমাকে দেখে একটু কষ্ট হচ্ছেনা আজ। এসব তোমার প্রাপ্য। একদিন আমাকে ঠকিয়েছিলে। তোমার কারণে আমি নিঃস্ব হয়েছিলাম। নিজের সন্তান, আমার প্রিয়কে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। এই উচ্চ সমাজের চক্ষু লজ্জার ভয়ে মা হয়েও তাকে নিজের কাছে রাখতে পারিনি। খাঁখাঁ করে পুড়েছি প্রতিদিন। আমাদের একটা সুন্দর গোছানো সংসার হওয়ার কথা ছিল অথচ তোমার অর্থলোভ, ধড়িবাজিতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। তবুও তোমার শান্তি মিলেনি! তোমাদের কারণে আমি আর আমার মেয়ে সমাজে ব্যা** বনেছি। শেষমেষ নিজেকে আত্নগোপন করতে বাধ্য হয়েছি।’

শোয়েব কিছু বলতে চাইল। আয়শা তাচ্ছিল্য হাসল। বলল,

‘ কি বলতে চাও? তুমি এসব করতে চাওনি! তোমার কোন যুক্তি -ই আমার কষ্ট যন্ত্রণার সামনে খাটবে না। প্রচন্ড ঘৃ*ণা করি তোমাকে। আর এই ঘৃ*ণাটা তুমিই তৈরি করেছ। নিয়তির জবাব দেখেছ শোয়েব! প্রতি*শোধ আমি কোনদিন চাইনি। অথচ সব এলোমেলো হলো। তোমার স্ত্রী সন্তানদের অপকর্ম বেরিয়ে এলো দুনিয়ার সামনে। নিরীহ মানুষের অভিশাপ ফলেছে। হাজার হাজার মানুষের অপমান ঘৃ*ণায় জর্জরীত হচ্ছে। সাহায্যের জন্য কেউ নাই পাশে। আর এসব কে করেছে জানো? আমার মেয়ে! আমার প্রিয়। আমি জানতাম, একটা বাঘিনী জন্ম দিয়েছি। খানিকের জন্য চুপ থাকলেও, শিকারীদের শিকার ঠিক করবে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে খাবলে ছি*ড়েখুঁড়ে ফেলবে। আজ তোমাকে দেখে আমার একটু কষ্ট হচ্ছেনা শোয়েব। তুমি আমার কাছে অনেক আগেই ম*রে গেছ। যেদিন রাতে বাড়ি এসে হামতাম করলে। তোমার জন্য আমার নিষ্পাপ মেয়ের উপর দাগ লাগল। প্রতিবাদে তুমি চুপ ছিলে।সেদিন থেকেই তুমি আমার কাছে মৃ*ত। এসব তোমার প্রাপ্য ছিল।’

অঝোরে কাঁদছে শোয়েব। নোনা জলে চোখমুখ ভিজে। আয়শার পা ধরে বলতে চাইল, ‘ আমাকে ক্ষমা করো। একটু শান্তি দেও। এই অপ*রাধের দহনে কতকাল পুড়বো আর।’ কিন্তু পারলনা। তার অপ*রাধ ভাষা ছিনিয়ে নিয়েছে আজ।

আজ উঠল মুখের মুখোশ লাগাতে বলল,

‘ আসি আজ। আশাকরি আর কোনদিন দেখা হবেনা আমাদের। আমার মেয়ে থেকে দূরে থাকবে। এই জীবনের অফুরন্ত দুঃখ, বেদনা আর বিষন্নতার জন্য ধন্যবাদ। খোদা করুন কোনজীবনে যেন তোমার সাথে দেখা না হয় আর!’

ধপধপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল আয়শা। র*ক্তিম তার চোখ। কয়েক ফোঁটা পানি যেন গড়িয়ে পড়ল।

যাওয়ার দিকে নিমিষ তাকিয়ে রইল শোয়েব। যেই অর্থ সম্পদের লোভে সে সোনার হরিণ নামক সুখ ছাড়ল। আজ সব ছেড়ে সেই নব্বইদশকে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। সেই রঙিন দিন গুলোতে কি বাঁচা যাবে আবার? অন্তহীন আফসোসের নোনা জল গড়ালো। এই আফসোস যে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বইতে হবে তার। এরচেয়ে মৃ*ত্যু অনেক বেশি সুখের।

 

বাড়ি পৌঁছাতে না, পৌঁছাতে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো অভিলাষার। কোন এক বোরকা পরিহীতা অগ্যত মহিলার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে শোয়েব হক অস্থির। অসুস্থ! অভিলাষা থমকে গেল? অগ্যত মহিলাটাকে কে ছবি নয়তো। পুলিশ মিডিয়ার ভয়ে লুকিয়ে এসেছে। প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না অভিলাষা। ‘আচ্ছা, আসছি’ বলে কে*টে দিলো ফোন। দরজা খুলে তড়িঘড়ি করে ছেলের ঘরে গেল। ঘরে যেতেই থমকে গেল। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। পুরোটা ঘর অগোছালো, এলোমেলো। মাটি, কাচের জিনিস গুলো ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ। ফ্লোরের জায়গায় জায়গায় র*ক্তের ফোঁটা লেগে। এই কি হাল করেছে তার ছেলে। একজন ধৈয্যশীল ম্যাচিউর মানুষটা যখন ধৈর্য হারায়। নিঃস্ব হয়। নিজের সর্বস্ব হারায়। তার অবস্থা বুঝি এমনি হয়! প্রিয়’র জন্য তার নিষ্ঠুর, জেদি ,অবাধ্য ছেলেটা নিজেকে বদলে নিয়েছিল। নিজের সবটা দিয়ে প্রিয়কে চেয়েছিল। আজ সেই প্রিয় কই? পাশে নেই কেন! 

কাচের উপর ঝটপট পা চালিয়ে। ছেলের পাশে বসল। র*ক্তিম দৃষ্টিতে চিঠির দিক এখনো চেয়ে আছে শতাব্দ। হাতে জলন্ত সিগারেট। ফিল্টারে ফ্লোর বিছিয়ে। অভিলাষা ছেলের হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলো। বিষন্ন, অপ্রসন্ন, গম্ভীর ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। কেঁদে ফেলল। কান্নাভেজা কাতর কন্ঠে বলল,

‘  এসব কি আব্বা! কি হয়েছে তোর।’ 

শতাব্দ চুপ, গম্ভীর। দৃষ্টিতে এখনো ক্রোধ জলন্ত। অভিলাষা কান্না কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আবার বলল,

‘ প্রিয় কই?’

শতাব্দ চুপ। ছেলের চুপ থাকাটা অভিলাষার ভেতর নাড়িয়ে দিচ্ছে আরো। ভয় বাড়ছে প্রচন্ড। তিনি নিলেই কারণ খুঁজতে লাগল। শতাব্দের হাতের চিঠিটা টেনে নিলো। পড়তে শুরু করল। থমকে গেল। প্রিয় তার ছেলেটাকে এভাবে ঠকালো? এত ভালোবাসলো, বিনিময়ে এই দিলো! ছি!

অভিলাষা তড়িঘড়ি করে বলল,

‘ কোথায় গেছে প্রিয়? আমি যাবো, বুঝিয়ে আনবো।’

শতাব্দের গম্ভীর আওয়াজ,

‘ আসবেনা ও। ভীষণ জেদি মেয়ে।’

অভিলাষা বিহ্বল সুরে বলল,

‘ তো এখন?’

শতাব্দ দেয়ালে মাথা ঠেকালো। ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে নিলো। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ উড়ছে, উড়তে দাও। সময় হোক, ওর ঘাড়ে ধরে ফিরিয়ে আনবো।’

 

শতাব্দের বাড়ি ছেড়ে প্রিয় নতুন বাড়িতে উঠেছে আজ তিনদিন। বান্ধবী ইরা-ই সব ঠিক করে দিয়েছে। কাউকে যেন নতুন বাড়ির ঠিকানা না দেয়, অনেক খোসামোদ, আকুতি মিনতি করে ইরাকে রাজি করেছে। এক রুম এডজাস্ট বাথরুম, কিচেন ছোট ড্রইং স্পেস সহ ছোটখাটো এপার্টমেন্ট।  জরুরী ভিত্তিতে উঠেছে কোনরকম। প্রথম দিন ইরা রান্না করে নিয়ে এসেছে। এরপর রান্নাবান্না করেনি আর। কিছু ভালো লাগেনা। ঘুম নেই, খুদা নেই। সারাক্ষণ শুধু শতাব্দ ঘুরঘুর করে মাথায়। আচ্ছা শতাব্দ এখন কি করছে? নিশ্চই তাকে ঘৃ*ণা করছে। প্রচন্ডরকম ভাবে। তাইনা? হয়তো তাই সে এখন অবধি তার বাড়িতে এসে হানা দেয়নি। নয়তো এতক্ষণে এসে তোলপাড় করে ফেলত। নিজের বেহায়া মনের উপর রাগ হচ্ছে, খুব। শতাব্দ থেকে দূরেও থাকতে চাইছে। আবার শতাব্দকেও চাইছে। অদ্ভুত দ্বিধাদ্বন্দে ফেঁসেছে।

শুধু বুক ফেটে কান্না আসে। সারাদিন ঘরে কোনায়, এখানে সেখানে বসে শুধু কাঁদে। কতটা অসহায় হলে মানুষ ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও দূরে ঠেলে দেয়! নিজের প্রতি, জীবনের প্রতি সে বিরক্ত! প্রচন্ডরকম বিরক্ত। অশান্তি কেন পিছু ছাড়েনা তার! 

প্রান্তরে দিন ডুবছে। একটু একটু করে অন্ধকার ডাকছে। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে প্রিয় দূর দিগন্তে চেয়ে। আচমকা ঘরের কলিং বেল বাজলো। এই অসময় কে এলো। ইরা? কপাল কুঁচকে দরজার দিক এগিয়ে গেল। দরজার অপর পাশের মানুষটাকে দেখে থমকে গেল। মৃ*ত মানুষ ফিরে আসতে পারে আদৌ! মুখ থেকে অফুটন্ত আওয়াজ বেরিয়ে এলো। বলল,

‘ মা!’

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

 

৪৯.

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ ) 

 

জড়সড় ভাবে বসে আছে প্রিয়। চোখমুখ প্রশ্নবিদ্ধ। চাপা উত্তেজনায় হাত কচলাচ্ছে। মৃ*ত মানুষ কি আদৌ ফিরে আসে! মুখোমুখি সামনের চেয়ারটায় বসে আছে আয়শা। কি স্বাভাবিক তার চোখমুখ। এতবছরে চেহারার কি কোন পরিবর্তন এসেছে? হ্যাঁ। এক বড় অংশের পরিবর্তন এসেছে। বয়স্ক রোগা ভাবটা নেই, গায়ের উজ্জ্বলতা আগের থেকে বেড়েছে। কেউ দেখলে বলবেই না, যে প্রিয় উনার মেয়ে। বোন বলবে। শুধু গলায় মোটা কালো জখমের মত দাগটা চোখে বিঁধছে একটু। পিটপিট দৃষ্টিতে মাকে পরখ করছে প্রিয়। নিজের আসল পরিচয় জানার পর। এই প্রথম মানুষটার সাথে তার মেয়ে হয়ে কথা বলবে। মনে হাজারো প্রশ্ন। অনেক কিছু জানার বাকি আছে এখনো! কিন্তু অদ্ভুতভাবে কিছু বলতে পারছেনা। থমকে গেছে। ধাক্কা সামলাতে সময় লাগছে।

 

কিছুক্ষণ নীরবতায় ডুবে রইল পরিবেশ! নীরবতা গুছিয়ে আয়শা বেগম বললেন,

‘ রাজা অষ্টম হেনরি’র দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যান বোলেইন নিজের সর্বস্ব নিয়ে হেনরিকে ভালোবেসেছিল। পরমা সুন্দরী ক্ষমতাবান নারী হয়েও রাজাকে আটকে রাখতে পারেননি। রাজা জেন সিমুরের রূপে আটকে। ষ*ড়যন্ত্র করে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে রানিকে মুণ্ডু*পাত আদেশ দেয়। নিষ্পাপ অ্যান বোলেইনকে হ*ত্যা করে। সময় কা*টে, তার অনেক বছর পর ইংল্যান্ডের রানি হয় অ্যান বোলেইনের কন্যা রানি প্রথম এলিজাবেথ। ছোট থেকে অবহেলায় বড় হওয়া এলিজাবেথের রানি হওয়াটাই ছিল অ্যান বোলেইনের নীরব প্রতি*শোধ। প্রকৃতি ঠিক তার প্রতি*শোধ নিয়েছিল। রাজা হেনরি কখনো শান্তি পায়নি। পরবর্তীতে জেন সিমুরের পুত্রসন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃ*ত্যু হয়। সবচেয়ে বড় প্র*তিশোধ প্রকৃতি তখন নিলো, যখন সেই পুত্র সন্তানটাও খুব অল্প বয়সে মারা যায়। যেই পুত্র সন্তানের জন্য রাজা হেনরি অ্যান বোলেইনকে দূরে ঠেলে দিলো। সেই পুত্রসন্তান মৃত্যুর পর রাজ্য অ্যান বোলেইনের মেয়ে এলিজাবেথের হলো। প্রকৃতির প্রতি*শোধ কি আশ্চর্য! ‘

 

প্রিয় নিমিষ তাকিয়ে আছে। চাপা জেদ চেপে বলল,

‘ তো এই হিস্টরিকাল কাহিনীর মাধ্যমে কি বোঝাতে চাইছ? আমি এলিজাবেথের মত তোমার কাছে শুধুই প্রতি*শোধের মাধ্যম?’

‘ আমি প্রতি*শোধ নিতে চাইনি প্রিয়। অ*ন্যায়ের বোজ কাউকে ছাড় দেয়না, কোননা কোন ভাবে প্রকৃতি ঠিক প্রতি*শোধ নেয়। তাই ঘুরেফিরে তোর হাতে এমনটা হলো। তাছাড়া আমি জানতাম বাঘিনীকে জন্ম দিয়েছি। খানিকের জন্য ক্ষান্ত হলেও, দমে যাবে না সে। অন্ধকারে উজ্জ্বল সূর্যের মত নিজের আলো ছড়াবে।’

চোখ জলে ভরে এলো প্রিয়’র । ব্যথাতুর কন্ঠে প্রিয় জিজ্ঞেস করল,

‘ আমার অভিমান তোমার উপরও সমপরিমাণ। আমি কি তোমার এতই অপছন্দ ঘৃ*ণার ছিলাম যে মেয়ে বলে স্বীকার করতে তোমার লজ্জা হতো? কেন নিজের পরিচয় বলোনি আমাকে? নিজের আসল পরিচয় জানার আমার কি অধিকার ছিল না?’

আয়শার সহজ স্বাভাবিক আওয়াজ,

‘ অবশ্যই ছিল। কিন্তু আমি চাইনি তোর উপর কোন কলঙ্কের দাগ পড়ুক। এই উচ্চ সমাজের রীতিনীতি বড্ড অদ্ভুত। পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে অ*বৈধ বলেই গণ্য করা হয়। আর এই পরিচয়ের জন্য ওই মানুষটার কাছে নত হবো, তার অ*ন্যায় মেনে নিবো, আমার বিবেক সেই অনুমতি দেয়নি কখনো। যেই জীবনে আত্মসম্মান নাই, অফুরন্ত সুখ থাকলেও সেই জীবন আমার কখনো চাইনা।’

‘ তাই বলে কি আমারও জানার অধিকার ছিল না?’

‘ জেনে কি হতো? কষ্ট বাড়তো। তোর হাস্যোজ্জ্বল জীবন অন্ধকারে ডেকে যেত। সম্পর্কের ভেতর দ্বিধাদ্বন্ধের বসতি বাড়তো। যেখানে আপন পর নামক ভেদাভেদ হতো। এই অশান্তির কি দরকার ছিল! তারচেয়ে বরং যেভাবে চলছিল। চলুক! থাকনা আমার একাকীত্ব, কিছু অপূর্ণ ইচ্ছা। তুই ভালো ছিলি ওইটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।’

‘ আর তোমার বেঁচে থাকার ব্যাপারটা? আমাকে বলার এইটুকু প্রয়োজনবোধ করলে না? প্রতিটা মুহূর্ত আমি অনুতপ্তায় পু*ড়ছিলাম। দিনের পর দিন নিজেকে দোষারোপ করছিলাম। সবসময় মনে হয়েছিল আমি ইমান্দিপুর না গেলে,  শতাব্দের সাথে সম্পর্কে না জড়ালে, এমনটা হতোনা বোধহয়! সব দোষ আমার ছিল।’

বলতে বলতে কয়েক ফোটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল প্রিয়। আয়শা বেগম অনুতপ্ত দৃষ্টিতে মেয়ের দিক তাকিয়ে রইল। সত্যি এটা তার অ*ন্যায় ছিল। প্রিয়’র সাথে একবার যোগাযোগ করার দরকার ছিল অন্তত। কিন্তু তার হাতেই বা কি ছিল। প্রিয় ছোট ছিল।ছবি পাগলা কু** মত তার পেছনে পড়েছিল। আয়শা বেঁচে আছে সামান্য টের পেলেও ঝামেলা হতো। আয়শাকে হাতের কাছে না পেয়ে, প্রিয়’র ক্ষ*তি করতো।  

মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করল। বলল,

‘ এতে তোর কোন দোষ নেই প্রিয়। ভাগ্যটাই এমন ছিল।যদি এসব কারো দোষ থাকে তাহলে সব দোষ শোয়েবের। তার জন্যই আজ আমাদের ছন্নছাড়া বেমিল জীবন। এত দূরত্ব এত কষ্ট। ওই মানুষটা আমার জীবনের নিমিষ কালো অভিশাপ। ওর সাথে যা হয়েছে এসব প্রাপ্য ছিল তার। কাউকে ঠকালে, নিজেও ঠকতে হয়। তাও ভীষণ জঘন্যরকম ভাবে।’

খানিক চুপ থেকে। বিহ্বল কন্ঠে আওড়াল প্রিয়,

‘ তুমি বেঁচে আছো কি করে? বাড়িতে তোমার ঝুলন্ত লা*শ উদ্ধার করা,হয়েছিল। তুমি বেঁচে থাকলে, ওই লা*শ কার ছিল!’

আয়শা খানিক চুপ রইল। নীরবতা গুছিয়ে বলল,

‘ নিষ্*ঠুর সমাজ যখন আমাকে ব্যা** উপাধি দিলো। আত্মহ*ত্যা-ই আমার একমাত্র রাস্তা ছিল। নিজের আত্মসম্মান হারিয়ে এই বিষাক্ত সমাজে নিশ্বাস ফেলতে পারছিলাম না একমুহূর্ত। সেই রাতে শতাব্দ তোর হাত চাইতে আমার কাছে ইমান্দিপুর এসেছিল। তখন সে তোর পরিচয় সম্পর্কে সবটা জানতো। সকালে তোকে জাফর ভাইয়ের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষণেক্ষণে পু*ড়ছিল। আর ওর স্বভাব বরাবরই বেপরোয়া, জেদি অকপট। সময়, ক্ষণ তাকে বাঁধা দিতে পারেনি কখনো। মূলত যেকোন মূল্যেই হোক না কেন! তার প্রিয় চাই। আমার সাথে একপ্রকার দ্বন্দ্ব করতে এসেছিল। কয়েকবার কলিং বেল চেপে কোন প্রতুত্তর না পেয়ে। পেছনের ঘরে জানালায় উঁকি দেয়। আমি তখন দড়িতে ঝুলছিলাম। শেষ নিশ্বাস ফেলছিলাম। তড়িঘড়ি করে ছাদ দিয়ে ভেতর আসে শতাব্দ। দড়ি থেকে কোনরকম নিচে নামায়। আমার শরীর তখন দূর্বল ক্লান্ত। মাথায় আত্মহ*ত্যা কর্তে হবে, ঘুরঘুর করছিল তখনো। শতাব্দ আমাকে থামাল, শান্ত করার চেষ্টা করল। বাড়িতে জেদ করে ঢাকায় চলে যাওয়ায় গ্রামের সাথে ছিল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এদিকটার কোন কিছু সম্পর্কে অবগত ছিলনা তখনো। ধীরেধীরে আমার থেকে সবটা শুনল। আত্মহ*ত্যা বদলে বিকল্প পথ আত্মগোপন করতে বলল। আমি তখন বরাবরই ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ। এই নি*কৃষ্ট সমাজে বাঁচা আমার জন্য অসম্ভব। এই পরিচয় আমার মান সম্মান সব নোংরা ডুবায় ডুবে গেছে। যতই জায়গা পাল্টাই এই অপ*বাদ মুছা যাবেনা কখনো। আর বেঁচে থাকলেও ছবি আমাকে ছাড় দিবেনা একটুও। হয়তো খু*ন করবে নয়তো ব্যা** বানিয়ে রাখবে। তাই শতাব্দের প্রস্তাবে আমি রাজি হই। সেই রাতে ম*র্গ থেকে লাপাত্তা বিনষ্ট লা*শ জোগাড় করে শতাব্দ। সরকারী মেডিকেলের ছাত্র হওয়ায় সবটা জানতো। আমার বান্ধবী সালেহা ও তার স্বামী মোহসীন দুজনই ওই সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার। ওদেরকে তো চিনিস? তুরফার বাবা মা। ওরা ব্যবস্থা করে দেয় সবটা। যেই শহরে জীবন্ত মানুষের কেউ খবর রাখেনা, সেখানে মৃ*ত মানুষের খবর নেয় কয়জন? টাকা দিলেই লা*শ জোগাড় হয়। ভোর রাত অবধি ফোনে সবটা প্লান করি চারজন। ব্যাপারটা অত্যান্ত  টপ সিক্রেট ছিল। রাতে্র অপেক্ষা করি। গভীর রাতে ঢাকা থেকে লা*শ আসতেই তা শোয়ার ঘরে ফ্যানে জুলিয়ে দেই। আমি ঢাকায় শতাব্দের এপার্টমেন্টে চলে যাই। এদিকে মৃ*ত্যুর খবর ছড়ায়। চেহারা নষ্ট শরীরের কাঠামো কাছাকাছি হওয়ায় সন্দেহ হয়নি কারো। এমনকি আমার বোনেরও। কেউ একবারও ভাবেনি ফা*সিতে ঝুলে এভাবে দেহ নষ্ট হয়না। লা*শটা ছিল ম*রণব্যথিতে আক্রান্ত এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারের রোগীর। ম*র্গে সংগ্রহীত ছিল। টাকার অভাবে পরিবার ছুটাতে পারেনি। আমরা জানতাম এটা নিয়ে কেউ পুলিশ কেস হবেনা। যতদ্রুত সম্ভব ধামাচাপা দিবে চাইবে সবাই। ছবি কোনদিন চাইবেনা এসব ঘেটে তার রাজনীতি ক্যারিয়ারে ধস নামাতে। লাপাত্তা মেডিকেলে এতদিন পড়ে থাকা গরীব পরিবারের লা*শটা দাফন হলো। প্রথম দিন শতাব্দকে দেখে ফেলে কাজের খালা। তাই শতাব্দ টাকা পয়সা দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে গ্রাম ছাড়া করে। এদিকে আমি ঢাকায় জায়গা পরিবর্তন করি। শতাব্দ সালেহাদের সাহায্যে নিজের পাসপোর্ট তৈরি করি। ডেট সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রিকরণ না হওয়ায় তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ব্যাংকে মোটামুটি ভালো অঙ্কের সেভিংস থাকায় দেশ ছাড়তে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এতবছর দেশের বাহিরে ছিলাম। রিসেন্টলি, তোর সুই*সাইটের খবর পেয়ে দেশে ফিরেছি।’

হতভম্ব প্রিয়। কেউ ঠিক বলেছে, শিক্ষিত মানুষ ভীষণ ভ*য়ংকর। বুদ্ধির জোরে এরা সত্যমিথ্যা বাঁচা ম*রার মধ্যে থাকা সুক্ষ্ম সুতা সমান জায়গাতে অবাস্তব একটা গল্প বানাতে পারে। কি বিচক্ষণতার সাথে এমন স্ট্রং প্ল্যানিং করেছিল। যা আজ অবধি ঘুনাক্ষরে টের পায়নি কেউ। অথচ একটু উনিশ বিশ হলেই সবটা ঘেটে যেত। এমন ভাবেও পুর্নজন্ম হয়! বেঁচে থাকার একটা সুন্দর সুযোগ পাওয়া যায়। একেই বুঝি বলে মাস্টার প্ল্যান। আর এই প্ল্যানের মাস্টারমাইন্ড শতাব্দ।

স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। চোখজোড়া ছলছল। মুখে হাত চেপে কান্নাভেজা আনন্দের সুরে বলল,

‘ আমি জানতাম আমার শতাব্দ কখনো কোন অ*ন্যায় করতে পারেনা।’

‘ এই বিশ্বাসেই বুঝি তাকে ছেড়ে এসেছিস? তোকে কিছু জানাতে শতাব্দকে আমিই নিষেধ করেছিলাম। আমার কাছে সে ওয়াদাবন্ধ ছিল।’

আয়েশার অকপটে গম্ভীর আওয়াজ। মায়ের দিক তাকালো প্রিয়। বলল,

‘ ছেড়ে আসার কারণটা আমার নিজেস্ব।’

‘ কি কারণ?’

‘ তুমি এসব প্রশ্ন কেন করছ? ব্যাপারটা আমার আর শতাব্দের।’

‘ মেয়ের জীবন নিয়ে আমার জানার অধিকার আছে প্রিয়।’

‘ ওহ! বুঝেছি। তুমি তার তদারকি করে বোঝাতে এসেছ?  তাহলে আজই এলে কেন। এতদিন সামনে আসনি কেন। আর ঠিকানা-ই বা কে দিলো।’

মেয়ের ব্যবহারে হতাশ আয়শা। মেয়েকে হাড়েহাড়ে চিনে সে।এইযে প্রিয়’র চোখমুখের রাগটা বরাবরই ঠুনকো। কথা এড়ানোর জন্যই একান্ত।

আয়শা মেয়েকে বলল,

‘ঠিকানা কোথায় পেয়েছি তা না জানলেও চলবে তোর।’

একটু চুপ থেকে বুঝানোর স্বরে বলল আবার,

 

‘একদিন শতাব্দ থেকে আমিই তোকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। মূলত তোকে শোয়েব থেকে দূরে রাখা আমার উদ্দেশ্য ছিল। আজ আমিই বলছি শতাব্দের মত ছেলে হয়না প্রিয়। ছোট থেকে দেখেছি ওকে। রাগী, জেদি অবাধ্য! অথচ তোর জন্য শান্ত, ধৈর্যশীল, বাধ্য। শোয়েবের মত ঠগবাজদের দুনিয়ায় শতাব্দের মত মানুষ পাওয়াটা ভাগ্য। তোর জন্য ছেলেটাকে প্রতি মূহুর্ত পু*ড়তে দেখেছি। বিচ্ছেদের ক্ষণে বিরহতে ডুবেছিল ছেলেটা। কথা হলে তোকে নিয়ে অফুরন্ত কথা বলত রোজ। ওর প্রতি কথায় অধিকারবোধ জড়ানো। ভীষণ সুন্দর করে বলত, আমার প্রিয়। কাউকে এতটা ভয়*ঙ্কর ভাবেও ভালোবাসা যায়? আমার জানা ছিলনা অন্তত। আড়ালে থেকেও সবটা সময় তোর উপর-ই নজর ছিল। তোর কি মনে হয় লিমনের স্বীকারোক্তি ওইসব প্রমাণ শাদ একাই  জোগাড় করেছে। ওইটুকু ছেলে একা এইসব পারবে।  উহু, শতাব্দ নিজের জোগাড় করে শাদের হাতে দিয়েছে। আর তোকে জানাতে নিষেধ করেছে। তুই ওর থেকে গোপন রাখতে চেয়েছিস, তাই ও আড়াল থেকেই তোর সাহায্য করেছে। পৃথিবীতে একজন মা তার সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আমিও ব্যতিক্রম নই। তবে যদি কেউ শতাব্দের ভালোবাসার সামনে তুলনা করে, তাহলে আমি পরাজিত। ‘

প্রিয়’র অধৈর্য আওয়াজ, 

‘ যতই ভালোবাসুক। তবুও আমার থেকে তার দূরে থাকাটাই শ্রেয়।’

‘ আত্মসম্মান যখন সীমানা পাড় হয়, সেটা আর আত্মসম্মান রয় না। অহংকারে রূপান্তরিত হয়।’

‘ হ্যাঁ, আমি অহংকারী।’

আয়শা আর শান্ত থাকতে পারল না। রাগী কন্ঠে বলল,

‘ এতো ভালোবাসার পর ছেলেটাকে ছেড়ে দিবি প্রিয়! ধরে নিবো তোর মধ্যেও শোয়েবের নি*কৃষ্ট র*ক্ত। কেন শতাব্দের সাথে থাকতে পারবিনা না তুই। কেন?’

চিৎকার করে উঠল প্রিয়,

‘ কারণ আমার সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নাই। আমি অপূর্ণ!’

 

থমকে গেল আয়শা। মেয়ের দিক তাকিয়ে রইল নিমিষ। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল প্রিয়। বলল,

‘ একবছর আগে ট্যুরের কথা বলে ইন্ডিয়াতে গিয়ে টিউমারের অপারেশন করেছি। ভাইয়া ভাবি ছাড়া আর কেউ জানেনা এখনো। সন্তান জন্ম দিতে আমি অক্ষম। এই অপূর্ণতা নিয়ে কি করে সংসার সাজাই? সে যে সকল সুখের কাম্য। তোমার কি মনে হয় তাকে ছেড়ে ভালো আছি ভীষণ। উহু, আমি একটু একটু করে ম*রছি রোজ। তাকে আমি কি করে ভুলব। সেযে আমার প্রথম প্রেম। তার থেকে ভালোবাসার হাতেখড়ি। একজন ফিলোফোবিক রোগীকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। শতাব্দকে বিয়ে করতে যেয়ে আমি থমকে  গেছিলাম মা। বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আদৌ কি আমি ঠিক করছি? বাবা মাকে নিরাপদ রাখতে সবার সামনে সম্পর্ক ছিন্নের নাটক করেছিলাম। সেদিন আমার সব বিষন্নতা কান্না এই বিয়েটাকে ঘিরে ছিল। এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি বোধহয় ভীষণরকম অ*ন্যায় করছি। নিজ স্বার্থে শতাব্দকে ব্যবহার করছি। বিয়ের পর আমি বরাবর তার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি। আমার তিক্ত বুলিতে আঘা*ত করেছি। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সে শুধু ভালোবেসেছে আমায়। হাজার দূরে ঠেলে দিলেও আমাকে ভালোবাসাটাই যেন তার জিদ ছিল। তাই সেইরাতে ইমান্দিপুর কেন গিয়েছিল এই বাহানায় ছেড়ে এসেছি। সত্যি বলতে প্রচন্ডরকম যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। না পারছিলাম তাকে ছাড়তে, না পারছিলাম কাছে থাকতে। কেউনা জানুক। আমিতো জানি আমার কমতি। এই কমতি দিয়ে সংসার বেঁধে আজীবন তাকে কি করে ঠকাই? সে নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছে। আমি কি করে স্বার্থপর হই!’

বলতে বলতে কেঁদে ফেলল প্রিয়। আয়শা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল। আজীবন তার মেয়েটাকেই কেন এত কষ্ট পেতে হয়। যা পেয়েছে। তা কি যথেষ্ট ছিলনা? মা না হতে পারার অভিশাপটা কেন তাকেই পোহাতে হলো। ছলছল চোখ, বুকে আক্ষেপ, চাপা জেদ নিয়ে শুধু আকাশ পানে চেয়ে রইল। এটা বিধাতার কেমন নিয়ম!

 

ধানমন্ডির নামীদামী রেস্টুরেন্টে বসে আছে আয়শা বেগম। সামনে ধোঁয়া উঁড়া কফির মগ, মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে শতাব্দ। ভীষণ অস্থির, অধৈর্য। কফির মগে চুমুক দিতেই, শতাব্দ অকপটে আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন আছে ও? কি বলল? কিছু কি জানতে পেরেছেন?’

শতাব্দের অধৈর্যতা দেখে স্মিত হাসল আয়শা। বলল,

‘ আমি যতটুকু জানি ডাক্তারা শান্ত স্বভাবের হয়। এমন রগচটা অধৈর্য ডাক্তার এই প্রথম দেখছি।’

বিরক্ত হলো শতাব্দ। বলল,

‘ শান্ত থাকার জন্য শান্তির প্রয়োজন, আপনার ফাজিল মেয়ে আমাকে ওইটুকু শান্তি দিয়েছে?’

আয়শা আবারো হাসল। শতাব্দ রেগে গেল,

‘ আপনি হাসছেন? সিরিয়াসলি!’

ছোট শ্বাস ফেলে আবার জিজ্ঞেস করল,

‘ কেন বাড়ি ছেড়েছে কিছু বলল?’

আয়েশা রহস্যময়ী ভঙ্গিতে বলল,

‘ আমার মেয়ের সাথে কি কথা হয়েছে তা তোমাকে বলব কেন?’

শতাব্দ রাগে কিটকিটা হয়ে বলল,

‘ আমি চাইলেই আপনার মেয়েকে ঘাড়ে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি। এতে অশান্তি বাড়বে। আপনার মেয়ে আবারো পালাতে চাইবে। ঝামেলা চাইছিনা। মূল কারণ জেনে সমাধান করতে চাই। আর আপনার মেয়ে তা আমার সামনে কোনদিন স্বীকার করবে না। শত হোক আপনার মেয়ে, আপনারি মত জেদি।’

‘ তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি আমার সামনে আমার মেয়েকে ঘাড়ে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছ। আবার আমাকে জেদি বলছ!’

‘ কারণ মেয়ে অবধি পৌঁছানোর ঠিকানা আমিই দিয়েছি।তাছাড়া আপনি আগে আমার সহযোগী পরে শাশুড়ী। এখন আমার বউকে চাই।’

‘ তুমি বোধহয় দুনিয়াতে একমাত্র জামাই যে বউ পেতে শ্বশুর শাশুড়ীকে হাত করেছে। প্রথমে জাফর ভাই, আর এখন আমি।’

ফোস করে শ্বাস ফেলল শতাব্দ। বলল,

‘ অনেক লেগপুলিং করেছেন মা, এবার আমাকে সত্যিটা বলুন। আমি জানতে ভীষণ অধৈর্য।’

আয়শা বেগম গম্ভীর হলো এবার।  একটু চুপ থেকে গম্ভীরতা এঁটে সবটা শতাব্দকে বলল।

শতাব্দ চুপ, অস্বাভাবিক শান্ত। আয়েশা ডাকল। বলল,

‘এবার সিদ্ধান্ত তোমার। আমার মেয়ের ভালোর জন্য আমি কখনো বলবনা তাকে মেনে নেও। এতে প্রিয়’র অসম্মান।’

রাগে টগবগে উঠলো শতাব্দ। গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ এই ওর বিশ্বাস। এই তুচ্ছ কারণে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। সাহস দেখেছেন, অসুস্থতার কথা লুকালো। ইন্ডিয়া যেয়ে চিকিৎসা করল। আর ওকে কে বলল সামান্য বাচ্চার জন্য আমি আফসোস করব?’

ব্যাপারটা শতাব্দ যে মেনে নিবে তা নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত ছিল। কিন্তু এই রাগের ব্যাপারটা গড়মিল হয়ে গেল। শতাব্দ রাগছে কেন? ভেবেছিল আফসোস করবে। কিন্তু রাগ!

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শতাব্দ। চোখেমুখে ভয়*ঙ্কর রাগ। আয়শা বিহ্বল সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘ কোথায় যাচ্ছ?’

শতাব্দের ঠান্ডা উত্তর,

‘ আপনার মেয়ের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি।’

আয়শা হতভম্ব। পেছন থেকে আরেকবার ডাকল। বলল,

‘ সত্যি যাচ্ছ। বিলটা দিয়ে যেও।’

সামনে এগোতে এগোতে রুখা আওয়াজে উত্তর দিলো শতাব্দ,

‘ অনেক টাকা আছে আপনার। বিদেশি ডলার কিনা!’

হাসল আয়শা। শতাব্দের সাথে বরাবরই ঠোকাঠুকি সম্পর্ক তার। কফির মগে চুমুক দিলো। যে জানে সুরক্ষিত শক্ত হাতে মেয়ে দিয়েছে। সব ঠিক হবে এইবার। ঘাড়ত্যাড়া শতাব্দ তার জেদি প্রিয়কে ফিরিয়ে আনবে ঠিক।

 

গভীর হচ্ছে রাত। ঘন বর্ষন। ঢাকার বাহিরে হওয়ায় এই এলাকায় লোডশেডিং হয় প্রচন্ড। বাড়িতে নতুন উঠায় বিদুতের বিকল্প কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি এখনো। নিভুনিভু মোমবাতি  জ্বলছে। চোখে ঘুম নেই। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। আচমকা দরজার কড়া নড়ল। ঠকঠক। এত রাতে কে আসবে? ভয়ে কেঁপে উঠল প্রিয়। দরজা খুলবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলো। সময়ের সাথে সাথে শব্দ বাড়ছে প্রচন্ড। বিরক্ত হলো প্রিয়। এভাবে শব্দ হলে ঝামেলা হবে, বাড়িওয়ালা অবধি নালিশ গড়াবে। কে এসেছে একবার খুলে দেখবে কি? অনেক ভেবেচিন্তে দরজা অবধি গেল। ‘কে এসেছে’ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল। অপরপাশ থেকে উত্তর এলো না কোন। দরজার পিঠে শব্দ করে যাচ্ছে অনবরত। এবার প্রিয় প্রচন্ডরকম বিরক্ত হলো। রেগে দরজা খুলতেই হতভম্ব। ‘শতাব্দ’ বলেই ভয়ে চমকে গেল প্রিয়। তড়িঘড়ি করে দরজা লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শতাব্দ আটকালো। জোর খাটিয়ে ভিতরে ঢুকল। প্রিয় ভীতু, বিমূঢ়, হতভম্ব। ছোট ঢোক গিলল।

 

চলবে……..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

 

৫০ ( প্রথম অংশ)

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

হতভম্ব, ভীতু, বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়। বাহিরে ঘন বর্ষণ। বৃষ্টির ঝুপঝাপ আওয়াজ। অন্ধকার অনুজ্জ্বল ঘর। মোমবাতির আলোতে নিভুনিভু আলো জ্বলছে।

শতাব্দ বরাবরের মতই গম্ভীর। অস্বাভাবিক শান্ত। নিগূঢ় রাগান্বিত চেয়ে। মনে মনে ঠিক এ ভয়টাই পাচ্ছিলো। শতাব্দের মুখোমুখি হলে নিজেকে কি করে সামলাবে। তার ভয়ঙ্কর ক্রো*ধের তোপ থেকে নিজেকে বাঁচানো কি আদৌ সম্ভব! ঢোক গিলল প্রিয়। হাতপা কাঁপছে অনবরত। ভয়ে পেছন দিক যেতে লাগলো। শতাব্দ আগাচ্ছে। প্রিয় পিছাচ্ছে। একটা সময় বিছানার সাথে লেগে ধপ করে পড়ে গেল। শতাব্দ থামল। তড়িঘড়ি করে প্রিয় শোয়া থেকে উঠে বসলো। ভীতু স্বরে আওড়াল,

‘ আ..আমার কথাটা শু…

প্রিয়’কে কথা শেষ করতে না দিয়ে, ধুপধাপ পায়ে এগিয়ে এলো শতাব্দ। প্রিয়’র কোলে মাথা রেখে। পেটে মুখ গুজে, সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। হতভম্ব প্রিয়। ভেবেছিল দুইচারটা থা*প্পড় পড়বে গালে। অথচ এতো স্বাভাবিক আচরণ! শতাব্দের এই স্বাভাবিক আচরণ-ই প্রিয়’র ভয় বাড়াচ্ছে। খানিক সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল প্রিয়। আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,

‘ কেন এসেছেন?’

শতাব্দের রাগ চাপা অকপটে আওয়াজ,

‘ ঘুমাতে!’

‘ ঢাকা থেকে মধুপুর ঘুমাতে এসেছেন? ঠিকানা কোথায় পেলেন? মা দিয়েছে?’

চোখ বুজে আছে শতাব্দ। নিস্তেজ কন্ঠের গভীর আওয়াজে বলল,

‘ অনেক কাল ঘুম হয়না, মাথায় হাত বুলিয়ে দেও। একটু ঘুমাব!’

শতাব্দের অস্বাভাবিকরকম স্বাভাবিক আচরণে থমকে গেল প্রিয়। জলে ছলছল করছে চোখ। প্রিয় জানে কোন কিছু ঠিক নেই, সবকিছু এলোমেলো। জোর খাটিয়ে শতাব্দ স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছে। যা প্রিয়’কে নিজের কাছে নিজেকে আরো বেশি ছোট করছে, অ*পরাধী, লাগছে। অধৈর্য হলো সে। খানিক চেঁচিয়ে বলল,

‘ কেন জোর করে এমন স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছেন। আমি জানি, আমি অপ*রাধী। বকবেন?  মা*রবেন? রাগ ঝাড়বেন? যা ইচ্ছা করে, চলে যান।’

চোখ বুজেই কপালে আঙুল চালিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে শতাব্দ। অনবরত বলে যাচ্ছে প্রিয়,

‘ চিঠিতে সবকিছু ক্লিয়ার করে দিয়েছি। আমাকে আমার মত একা থাকতে দিন। এখান থেকে চলে যান প্লিজ।’

অনেকক্ষণ যাবত রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাটা নিয়ন্ত্রণহীন হলো এবার। শতাব্দের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল। ক্রোধান্বিত রক্তিম চোখ জোড়া খুলে, তড়াক করে উঠে বসলো। ধাক্*কা দিয়ে প্রিয়’কে বিছানায় ফে*লে। উপরে চড়ে বসল, তার দিক ঝুঁকে তাকালো। ঘর কাঁপানো রাগী আওয়াজচিৎকার করে বলল,

‘ কি চাও তুমি? অশান্তি! শান্তভাবে ডিল করাটা পছন্দ হচ্ছেনা? রেগে দুচারটা থা*প্পড় লাগাই, সেটা ভালো লাগবে?’ 

বিস্ময়ে থমকে গেল প্রিয়। নিমিষ চেয়ে রইল। 

আচমকা রাগে প্রিয়’র গাল চেপে ধরলো শতাব্দ। প্রিয়’র পা জোড়া নিজের পায়ের বেড়া জালে আটকে ধরলো। ঠোঁট জোড়া ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নিলো। শক্ত করে কয়েকটা কামড় বসালো। ছাড়া পাবার জন্য হাতপা ছোড়াছুড়ি করছে প্রিয়। ছাড়ল না শতাব্দ। ওষ্ঠজোড়া আরো আড়ষ্টভাবে জড়িয়ে ধরল। গভীর করে চুমু দিতে লাগল। আস্তে আস্তে গলায় এসে ঠেকল। শক্ত করে কয়েকটা কামড় বসালো। প্রিয় ব্যথাতুর আওয়াজ করল। শুনলো না শতাব্দ। ক্রোধে যেন উন্মদ প্রায়। শতাব্দের পাগলামোতে স্থীর থমকে গেল প্রিয়। শক্ত পাথর বনে ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল। কি থেকে কি হচ্ছে এসব। কারো রাগ প্রকাশের মাধ্যম এমন অমানবিক ভয়ঙ্করও হয়! 

অনেকটা সময় পর থামল শতাব্দ। ঝুঁকে এলো, দাঁতে দাঁত চেপে কিটকিটে আওয়াজে বলল,

‘ আমাকে হু*মকি দেওয়া? আমাকে? কাছে এলে অনর্থ ঘটাবে! এতবড় কলিজা? এইযে চুমু খেলাম। কামড়ে দিলাম। এখন কি করবে শুনি। অনর্থ ঘটাবে! এতই সহজ? চিঠিতে কি জানো লিখেছিলে, অন্যকারো সাথে যেন সংসার সাজাই। অন্যকারো সাথে সংসার সাজালে তাকে রোজ এভাবে আদর করবো, ভালোবাসবো সইতে পারবে তো? আবার নিশ্বাস থেমে যাবেনা তো তোমার!……

প্রিয় চুপ। ফ্যাচফ্যাচ নাক টানছে।শতাব্দ আবার কাছে এলো। গাল চেপে ধরল। বলল,

‘ শুনো মেয়ে আমি গল্প উপন্যাসের নায়কদের মত সাধু নই, যে দূরে সরে যাবো, অন্যকারো সাথে মানিয়ে নিবো। আমার তোমাকেই চাই! না পেলে সব জ্বা*লিয়ে দিবো।’

প্রিয়’র নিভে থাকা আঁখিপল্লব থেকে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে। ঘরে ফোঁসফোঁস ফোঁপানোর আওয়াজ ভাসছে। শতাব্দ থামল। চোখ বুজে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। শান্ত আকুল কন্ঠে বলল,

‘বছরের পর বছর কাটবে, পাঁচ বছর, দশবছর আজীবন। তবুও তোমার শূন্যতা কেউ পূর্ন করতে পারবেনা প্রিয়। এই অনুভূতিতে কোন পরিবর্তন হবে না। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, ভালোবাসি আর সারাজীবন ভালোবেসে যাবো।’

কান্না চেপে রাখতে পারল না প্রিয়। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। উপর থেকে সরে গেল শতাব্দ। পাশে শুয়ে বুকের গভীরে জড়িয়ে নিলো প্রিয়’কে। চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। বলল,

‘আমার ভালোবাসা কি এতটাই দুর্বল প্রিয়? যে এইটুকু ঠুনকো কারণে আমি ঠকে যাবো। কোন বাচ্চাকাচ্চা চাইনা, শুধু আমার প্রিয় হলেই যথেষ্ট!’

থমকে রইল প্রিয়। বুক থেকে মাথা তুলে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। তাহলে তার অসুস্থতার কথা জানে শতাব্দ? 

অশ্রুভেজা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নিমিষ স্বরে বলল,

‘ এখন হয়তো বাচ্চা চাইনা আপনার। পাঁচবছর, দশবছর পর একটা সময় আসবে যখন আপনার বাবা না হওয়ার আফসোস হবে। তখন আপনার সেই আফসোস আমি কি করে সহ্য করবো?’

‘তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার বদলে তোমাকে সন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন হতে হবেনা প্রিয়। ট্রাস্ট মি সন্তান নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। না কখনো হবে। তুমি আমার কাছে থাকবে, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।’

মন সায় দিচ্ছে প্রিয়’র। অধৈর্য্যে হয়ে বলল,

‘ আপনি আমার উপর দয়া করছেন। আপনার দয়া তলে আজীবনের জন্য দেবে যাবো!’

প্রিয়’র দুগালে হাত রেখে উঁচিয়ে ধরল শতাব্দ। দৃষ্টি ঝুকিয়ে রেখেছে প্রিয়। চোখে চোখ মেলানোর চেষ্টা করল শতাব্দ। উৎকণ্ঠা, অধৈর্য হয়ে বলল,

‘ এই প্রিয় একবার আমার দিকে তাকাও, শুধু একবার ভালোবাসি বলো! কথা দিচ্ছি বউ না, চিরকাল রানির আসনে রাখবো।’

দুই লাইনের এই কথা গুলো প্রিয়’র নাছোড়বান্দা জেদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না প্রিয়। শতাব্দের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল, হাউমাউ কান্নায় ভেঙ্গে চিৎকার করে বলল,

‘ ভালোবাসি। সেই প্রথম থেকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসি।’

শতাব্দ তার প্রাণপ্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। চোখবুঁজে তৃপ্তির হাসি হাসল। অবশেষে তার এতবছরে অক্লান্ত সাধনা পূর্নতা পেল। তার প্রাণপ্রিয় পুরোপুরি তার হলো। এখন না আছে বিচ্ছেদ, না আছে কোন দূরত্ব। মনের আকাশের সবটা জুড়ে তার ভালোবাসা আর প্রাণপ্রিয়।

প্রিয়’র ঠোঁট জোড়া, ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নিলো। বাঁধা দিলো না প্রিয়। না সংকোচ করল। আজ দুজন উন্মাদ প্রেমিক প্রেমিকা যেন স্বর্গ পেল। বাঁধাহীন, ভীতিহীন,সংকোচহীন পবিত্র প্রেম। মিলনের গভীর সাগরে তলিয়ে গেল। নিকষ কালো রাত। বাহিরে ঝড়বৃষ্টি। ভেতরে প্রেমময় বর্ষণ।    

 

ভোরের আলো ফুটেছে। জানালার পর্দা না থাকায় তীর্যক আলো এসে চোখে লাগছে। কপাল কুঁচকে নিলো শতাব্দ। উপুড় হয়ে শুয়ে একহাতে ঘুমন্ত প্রিয়’কে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ের পেছনে মুখ ডোবালো। ঘাড়ের কাছে ঘনঘন তপ্ত শ্বাস পড়তে নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। পিটপিট দৃষ্টিতে মেলে তাকাল। ঘুমন্ত শতাব্দ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। শরীরে নড়বার জোর নেই। খানিক চেষ্টা করে থেমে গেল প্রিয়। ঘাড় ফিরিয়ে শতাব্দের দিক তাকালো। ঘুমে তলিয়ে থাকা নিস্পাপ শিশু যেন। তাকে সারারাত জাগিয়ে এখন কুম্ভকর্ণের মত ঘুমানো হচ্ছে? চুলের আগা টেনে শতাব্দের চোখেমুখে ফেলল। সুড়সুড়িতে কেঁপে উঠল শতাব্দ। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

‘ কি হয়েছে প্রিয়?’

দুষ্টু হাসলো প্রিয়। বলল,

‘ ছাড়ুন উঠবো।’

চোখে বুজেই শতাব্দ গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ কেন? আবার পালানোর ফন্দি আঁটছ?’

ঠোঁট মেলে হাসলো প্রিয়। বলল,

‘ উহু, এইযে বাঁধা পড়লাম, এই বাঁধা ছেড়ে কোনদিন যাবোনা আর।কথা দিলাম!’

উত্তরে কিছু বলল না শতাব্দ। প্রিয়কে বুকে জড়িয়ে, হাতের বাঁধন আরো শক্ত করল। শতাব্দের উন্মুক্ত বুকে ধাক্কা দিলো প্রিয়। কন্ঠে আহ্লাদ জুড়ে বলল,

‘ অনেক বেলা হয়েছে উঠব। নাস্তা রেডি করব।’

‘ তুমি হলেই চলবে, নাস্তায় আর কিছু বানানোর দরকার নাই।’

লজ্জায় নুয়ে গেল প্রিয়। শতাব্দের বুকে আঘা*ত করে বলল,

‘ ঠোঁট কা*টা, বেশরম লোক। ছাড়ুন। উঠবো!’

‘ ছাড়তেই হবে? না ছাড়লে হচ্ছেনা?’

মাথা ঝাকালো প্রিয়। শতাব্দ হাত উঁচাতেই, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল প্রিয়। গায়ে শতাব্দের শার্ট জড়ানো। প্রতিদিনকার অভ্যাসের মত ফোন হাতে নিলো। অমনি আয়শার নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো,

 

আমার প্রিয় মা,

 

বরাবরই আমার চিঠি লিখতে পছন্দ। আশি দশকের মানুষ কিনা! তোকে চিঠি দেওয়ার সৌভাগ্য হলোনা। তাই আধুনিক যুগের পন্থাই অবলম্বন করলাম।

আমার কাছে তুই কোনদিন অপছন্দের, লজ্জার ছিলিনা প্রিয়।এই পৃথিবীতে তুই আমার শ্রেষ্ঠ পাওয়া। জানি তোর উপর অনেক অন্যা*য় করেছি। মায়ের মত আগলে রাখতে পারিনি। কিন্তু সদা তোর ভালো চেয়েছি। তুই আমার দুর্বলতা নয়। একমাত্র শক্তি, প্রাণভোমরা প্রিয়। আর আমি জানি আমার প্রাণভোমরা কেবল শতাব্দের কাছেই সুরক্ষিত। এই সমাজ আমার আপনজনের কাছে আমি মৃ*ত। তাই নতুন করে জীবিত হতে চাইনা আর। এই দেশ, সমাজের মানুষের উপর আমি বিরক্ত। এই সমাজের বি*ষাক্ত নিশ্বাসে ক্ষণে ক্ষণে ম*রতে চাইনা আবার। আমি চলে যাচ্ছি। এই দেশ, এই বিষাক্ত সমাজ ছেড়ে, অনেক দূর। একা মানে একাকীত্ব নয়। কখনো কখনো স্বাধীনতাও হয়। চিরকাল ধুকেধুকে ম*রলাম। প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই এবার। জীবনের রঙগুলোকে উপভোগ করতে চাই। দেশবিদেশ ঘুরতে চাই। কোথায় যাচ্ছি জানাতে চাইছিনা। তবে হ্যাঁ, আমি চিরকাল তোর পাশে ছায়া হয়ে রবো। যখনি আমার প্রয়োজন পড়বে চলে আসবো। আমি জানি আমার মেয়ে বাঘিনী। সবরকম পরিস্থীতিতে নিজেকে সামলাতে প্রস্তুত। পরিশেষে একটা কথাই বলবো, তোকে ভীষণরকম ভালোবাসে শতাব্দ। ওর মত আর কেউ হয়না প্রিয়। তাকে বলিও আমি চললাম, কফির বিলটা তুলে রাখলাম। পরেরবার দেখা হলে সুদেআসলে নিয়ে নিবো। সবশেষে নিজের খেয়াল রেখো। আমার মেয়ে, আমার প্রিয়।

 

ইতি 

তোর মা 

 

প্রিয়’র চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। অস্পষ্ট আওয়াজে ‘মা’ শব্দটা বেরিয়ে এলো। আজ কোন আফসোস নেই । না আছে কোন অভিযোগ। মায়ের ভালো থাকাটাই জরুরী একান্ত।

 

চায়ের কাপ নিয়ে শতাব্দের পাশে বসলো প্রিয়। সূরের সোনালী রোদ এসে চোখে মুখে পড়ছে তার। ঠোঁটে ভুবন ভুলানো হাসি তার। সামনে বসে থাকা অপ্সরীর দিক মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল শতাব্দ।স্মিত হেসে  প্রিয়’র এলোমেলো অবাধ্য চুল গুছিয়ে দিলো। প্রিয় হাত উঁচিয়ে হাতের পিঠে চুমু এঁকে বলল,

‘ এবার চলো।’

‘ কোথায়?’

প্রিয়’র বিহ্বল আওয়াজ। শতাব্দ মৃদু হাসলো। গালে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলল,

‘ আমাদের বাড়ি। তোমার ফেলে আসা সংসার অপেক্ষা করছে তোমার।’

 

( গল্প প্রায় শেষ, তবে পরিপূর্ণ নয়। সমাপ্তি হতে আরো একটা পার্ট বাকি। এটা অন্তিম পর্বের প্রথম অংশ। পুরো পার্ট অনেক বেশি বড় যা হয়তো ফেসবুক লাইটে সাপোর্ট করবেনা। তাই দুই অংশে দেওয়া হবে। আগামীকাল আমি ব্যস্ত। পরবর্তী অংশের জন্য অপেক্ষা করুন পরশু দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ)  

 

চলবে…..

 

ফিলোফোবিয়া 

 

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

 

৫০ (শেষাংশ )

 

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

 

গতরাতের ঝড়ের পর এক নতুন সোনালী দিনের আগমন। গত সন্ধ্যায় ছবি বেগম ও তার ছেলেমেয়েকে গুলশানের নিজ ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ আটক করেছে। বর্তমানে খবরটা, হেডলাইন হয়ে নিউজ চ্যানেল গুলোতে ঘুরাঘুরি করছে। তাদের জন্য কিঞ্চিত আফসোস নেই কারো। চেয়ারম্যান শাহরিয়ার সাহেবও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এমন কলঙ্কিনী বোন, ভাগিনা ভাগ্নী থাকার চেয়ে, না থাকাই ভালো। অ*পরাধীরা যেন তাদের প্রাপ্য শাস্তি পায়, তা নিশ্চিত করেছে শতাব্দ। 

শাদের উৎফুল্ল মন। অবশেষে তার আর তুরফার মধ্যেকার সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হবে আজ। সকাল সকাল ক্যাম্পাসে এসেছে। তুরফার জন্য সার্প্রাইজের আয়োজন করছে। ঘটা করে প্রপোজ করবে বলে। তুরফার মনের কথা মুখে স্বীকার করিয়েই ছাড়বে। ক্যাম্পাসের পশ্চিম দিকের লেক পাড়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে। সাদা কাপড় আর লাল গোলাপের ছাদ ছাড়া ঘরের মত বানিয়েছে। দমকা হাওয়ায় সাদা পর্দা গুলো এলোমেলো উড়ছে।

 তুরফাকে আনতে তার বান্ধবী তিশাকে বাড়ি পাঠিয়েছে। ক্যাম্পাস থেকে তুরফার বাড়ি খুব একটা দূর নয়। বিশ মিনিটের পথ। ঘন্টা দুই কা*টলো। অধীর আগ্রহে তাদের আসার অপেক্ষা করছে শাদ। একটা সময় বিরক্ত হয়ে ফোন করবে বলে মোবাইল বের করতেই, দূরে তিশাকে আসতে দেখল। সাথে তুরফা নেই। তিশা একা আসছে কেন? 

চোখ মুছতে মুছতে তিশা সামনে এসে দাঁড়াল। শাদ কপাল কুঁচকে নিলো। বিহ্বল সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘ কাঁদছ কেন? তুরফা কই!’

তিশা চুপ। চোখ মুছতে মুছতে কাঁধে ঝুলানো  ব্যাগটা থেকে একটা চিঠির খাম বের করল। শাদের হাতে ধরিয়ে বলল,

‘ সরি। জানি মানতে কষ্ট হবে। বি স্ট্রং। ‘

বলেই বড়বড় পা ফেলে তিশা চলে গেল। শাদ বিস্মিত হতভম্ব। কাঁপাকাঁপি হাতে খাম খুলে চিঠি বের করল। পড়তে শুরু করল।

 

শাদ,

 

জানি চিঠিটা পড়ার পর তুমি আমার উপর রাগবে, হয়তো ঘৃ*ণাও করতে শুরু করবে। তবুও আজ আমি সত্যিটা বলব। মনের মধ্যে আর কতকাল দাফন করে রাখব? আমি সত্যি ক্লান্ত। আমি জানি তুমি আমার অতীত সম্পর্কে অবগত। প্রিয় আপা বলেছে তোমায়। কিন্তু যদি বলি তুমি যা জানো, তা শুধু মাত্র অর্ধেক সত্য! সেইদিন নদীর পাড়ে লিমন আর তার বন্ধুদের প্রথম নজর আমার উপর ছিল। আমার তখন বয়সী বা কত ছিল। ওইটুকু বয়সের বাচ্চা মেয়েকে দেখে ওই জা*নোয়ার প*শুরুপি অ*মানুষ গুলোর যৌন আকাঙ্খা জেগে গিয়েছিল। ওদের মাদ*কাসক্ত দেখে আমি আর আপা যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম। তখন লিমন আপার থেকে আমাকে  ছাড়িয়ে জঙ্গলের ভেতর ওদের আড্ডাখানায় নিয়ে যাচ্ছিল। আমি জোরাজোরি করলে আমার ফ্রকের শোল্ডার টেনে ধরে ছিড়ে ফেলতে চায়। তদ্রা আপা এসে আটকায়। মাতাল লিমনের হাতে কামড়ায়। আমাকে ছাড়াতে চেষ্টা চালায়। একা হাতে আমাকে ছাড়াতে পারলেও, ততক্ষণে লিমনের বন্ধুরা এসে ঘিরে ফেলে আপাকে। একজন মাতাল সামলানো সহজ কিন্তু চার পাঁচজন মাতালের সাথে একজন কিশোরী মেয়ের পেরে উঠা অসম্ভব। আপা আমাকে পালিয়ে যেতে বলে। আমি ঘাবড়ে যাই, দাদীকে ডাকতে পালিয়ে যাই। কিন্তু যখন মানুষজন নিয়ে ফিরে আসি ততক্ষণে সব শেষ। আপা আশেপাশে কোথাও নেই। লা*শ পাবার পর আব্বা আম্মা যখন কেস করল। ছবি বেগম হু*মকি দিলো। বলল, যদি কোনপ্রকার ঝামেলা তৈরি করে তাহলে আমাকে সমাজের সামনে ধর্*ষিতা প্রমাণ করবে। যদি তার ছেলেমেয়েদের কোনরকম ঝামেলা হয়, আমাকেও বাঁচতে দিবেনা তারা। আমার আব্বা আম্মা পিছিয়ে যায়। পুরোপুরি দমে যায়। যত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ছড়িয়েছিল ততটাই চটজলদি ভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। অবশ্য তখন একবার শতাব্দ ভাই আমাদের বাড়িতে আসে, আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে কেস রিওপেনের কথা বলে। কিন্তু আব্বা আম্মা সাহস পায়না। এটা একটা এক্*সিডেন্ট পানিতে পড়ে মা*রা গেছে বসে কাটিয়ে দেয়। শতাব্দ ভাইকে এইসব ব্যাপারে দূরে থাকতে বলে। তখন অবশ্য শতাব্দ ভাইকে আমি চিনতাম না। জানতাম না তিনিই চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে। আব্বা আম্মার মেডিকেল স্টুডেন্ট বলেই জানতাম। এরপর অনেক বছর কাছে। আমার অপ*রাধবোধ আমাকে তিলেতিলে পো*ড়াতে থাকে। সেদিন আমাকে বাঁচাতে না এলে, আপা আজ জীবিত থাকত। আমি এগ্রে*সিভ প্রতি*শোধ পরায়ণ হয়ে পড়ি। সবসময় মাথাত ঘুরঘুর করত শা*স্তি দিতে হবে। কিন্তু আমি ছিলাম বরাবরই দুর্বল। এসব বড় ব্যাপার গুলো আমার দ্বারা কাম্য নয়। ভাগ্যের ফেরে হ্ঠাৎ একদিন তোমার সাথে দেখা হয়। প্রথম না জানলেও কিছুদিনের ভেতর তোমার পরিচয় জেনে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে করে তোমাকে আমার দিক আকৃষ্ট কবন্ধুত্ব করে প্রেমের মায়ায় জড়াই। পরে পরিচয় জানার নাটক করে দূরত্ব বাড়াই। আমার প্রতি আকৃষ্টতা বাড়াই। আমার একমাত্র টার্গেট ছিল ওই পরিবারে জড়ানো। হোক তা যেকোনো মাধ্যম। ধারণা ছিল পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চেয়ারম্যান পরিবারেরও হাত ছিল। কিন্তু অনেক পরে জানতে পারি আমি ভুল ছিলাম। এসব কিছুতে ছবি বেগমের একার হাত ছিল। তিনি নিজের টাকা ক্ষমতা, জোর খাটিয়ে এসব করেছিল। আর প্রিয় আপাই সবটা ক্লিয়ার করেছিল। সত্যি জেনে আমি দূরে সরে যেতে চাই। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছিল। নাটক করতে করতে কখন যে ভালোবাসায় জড়িয়ে যাই, নিজের ও অজানা ছিল। হয়তো প্রিয় আপার চোখে বেঁধেছিল, তাইতো আমাকে আর তোমাকে জুড়তে চাইছিল। কিন্তু আমি পারছিলাম না। মিথ্যা ছলচাতুরী দিয়ে শুরু করা সম্পর্কে আমি কি করে তোমাকে জড়াই। তাছাড়া ওই মানুষগুলোর প্রতি তিক্ততা আমার কোনদিন কা*টবে না। এত তিক্ততা ঘৃ*ণার মধ্যে আমাদের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠবে কি আদৌ। আমি কি পারতাম নিজের ভালোবাসা গুলোকে ধরে রাখতে? যদি অবেগের মত হাতছানি দিয়ে ভালোবাসার অনুভূতি গুলো আবার মিলিয়ে যেত! আমার ভয় হতে শুরু হয়। নিজের কালো অতীতের স্মৃতি নিয়ে নতুন করে জীবন সাজানো আমার জন্য অসম্ভব ছিল। দোটানায় পড়ে গেছিলাম। নিজের সাথে জড়িয়ে তোমার জীবনটা এলোমেলো করে চাইছিলাম না। তাই আব্বা আম্মার সিদ্ধান্তে আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এখানে থেকে অতীত ভুলানো সম্ভব না। না এই অতীত নিয়ে সামনে আগাতে পারবো কোনদিন। আমার জন্য থেমে থেকো না। অতীত মুছে  সামনে আগাও। আমি কোন আশা রাখছিনা, তুমিও রেখো না। সবার নিয়তি কি প্রিয় আপা শতাব্দ ভাইয়ের মত হয়। আমি চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি তা নাহয় অজানাই থাক।

 

ইতি 

তোমার খানিকক্ষণের প্রেয়সী

 

শাদ বিস্মিত, হতভম্ব। কানের কাছে ঝিরিঝিরি করছে। অসহ্য যন্ত্রণায় মাথা চেপে ধরছে। মস্তিষ্কে অনেক প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কোথায় যাবে, কোথায় খুঁজবে তুরফাকে। ভেবে পাচ্ছেনা সে। তড়িঘড়ি করে মোবাইল বের করল। তিশার নাম্বারে ফোন করল। তিশা রিসিভ করতেই শাদ তড়িঘড়ি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ এই চিঠি তোমার কাছে কে দিয়েছে। তুরফা? ওর ফ্লাইট কখন।’

তিশা চুপ। শাদ ধমক স্বরে বলল,

‘ এখনো কিছু বিগড়ায়নি, তাড়াতাড়ি বলো।’

অপর পাশ থেকে তিশা আমতা আমতা করে বলল,

‘ তুরফা দিয়েছে। আমি যখন ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম, এয়ারপোর্টের জন্য বের হচ্ছিল। দুপুরে ফ্লাইট।’

ফোন কে*টে সাথে সাথে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল শাদ। এয়ারপোর্টে হাজার হাজার মানুষজন। এত মানুষের মাঝে তুরফাকে খুঁজবে কোথায়? হন্য পাগলের মত করে খুঁজতে লাগল। জোর গলায় তুরফার নাম নিয়ে ডাকতে লাগল।আশেপাশের মানুষজন চেয়ে। একজন তৃষ্ণার্ত পাগল প্রেমিক শেষ আশাটুকু আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে। হন্য হয়ে তার প্রেয়সীকে খুঁজছে। তুরফা কোথাও নেই। গার্ড ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইল। জোরাজোরি শুরু করল। গার্ডরা সর্বস্ব দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। শাদ নারাজ। অনবরত পাগলের মত  চিৎকার করে বলছে, ‘ আমাকে যেতে দিন। তুরফা ভেতরে আছে, ওর সাথে করাটা জরুরী খুব।’ 

বারবার আহাজারি করছে। গার্ডরা তাদের নিয়মের বিরুদ্ধে যেতে নারাজ।

মোহসিন সাহেব মাত্রই মেয়েকে শেষ বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। অমনি ভিড় দেখে এগিয়ে গেলেন। চেনা পরিচীত আওয়াজ। গার্ডদের সাথে শাদের ধস্তাধস্তি দেখে থমকে গেলেন তড়িঘড়ি করে ভেতরে গিয়ে আটকালেন। শাদকে মূলত আগে থেকেই চিনে। শতাব্দের সুবাদে পরিচীত। সেই সাথে মেয়ের বন্ধু। 

মোহসিন সাহেবকে দেখে শাদের দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। অতি উৎসাহ, আশা আর আগ্রহ জুড়ে তড়িঘড়ি করে বলল,

‘ তুরফা! আঙ্কেল তুরফা কই?’

মোহসিন সাহেব নীরব। শাদের অধৈর্য অস্থিরতা বাড়লো। অকপটে আওয়াজে বলল,

‘ আঙ্কেল প্লিজ একবার বলুন তুরফা কই। শেষবার, একটাবার ওর সাথে আমার দেখা হওয়াটা দরকার। প্লিজ আঙ্কেল।’

শাদের অনুনয় বিনয় দেখে মোহসিন সাহেবের মন গললো। মেয়ের নিষেধ অমান্য করে বলল,

‘ অনেক দেরি হয়ে গেছে বাবা। ফ্লাইট টেকঅফ করেছে। তুরফা লন্ডনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে।’

শাদ থমকে গেল। নিমিষ চেয়ে রইল। এক মুহূর্তেই যেন তার পুরো দুনিয়া পাল্টে গেল। যার জন্য এত কিছু করল। সে এভাবে তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। শেষবারের মত কথা বলাটারও প্রয়োজন বোধ করল না। এতটা অকৃতজ্ঞ হয় কেউ কখনো। যদি এটাই তার ইচ্ছা হয়। শাদ ফিরে তাকাবে না আর কখনো। যে মানুষটা তাকে এইটুকু চায়না। সেই মানুষটা তার না হোক।

 

নীল গগনে। সাদা মেঘেদের ভেতর বিমান ভাসছে। জানার কাছে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে তুরফা। অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ। ব্যথিত মন। শাদের করুন আকুতি আহাজারি ইমিগ্রেশন থেকে সে দেখেছিল। ততক্ষণে কোন পথ ছিলনা। ফিরে তাকানোর সব পথ বন্ধ করে এসেছে নিজে। কি লাভ হতাশা কষ্ট বাড়িয়ে। যদি তাকে ঘৃ*ণা করে ভালো থাকে শাদ। থাকুক না! তাতে ক্ষ*তি কোথায়। চোখ বুজে নিলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ তুমি জিতে গেছো শাদ। হয়তো ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।’

 

একই ফ্লাইটের বিজনেস ক্লাসে বসে আছে আয়শা বেগম। উইন্ডো সিটে বসে বাহিরে তাকিয়ে। আকাশ থেকে সবকিছু ধুলিকণার মত দেখা যাচ্ছে। সাদা মেঘেদের ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে। অশ্রুভেজা চোখ দিয়ে প্রিয়’র হাস্যোজ্জ্বল ছবিটায় চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশ টেনে বলল,

‘ আমার অপূর্ণ জীবনের মত তোর জীবন না হোক। পৃথিবীর সব পূর্ণতা ভালোবাসা শুধু তোর হোক।’

 

একই ফ্লাইটে দুজন বিষন্নভারী মন নিয়ে বসে। একজন ভালোবাসার মানুষ ফেলে যাচ্ছে, অন্যজন নিজের একমাত্র  সন্তান ছেড়ে। নিয়তির ফেরে দুজনই মাতৃভূমি ছেড়ে বহুদূরে পাড়ি জমাচ্ছে।

 

চার বছর পর,

 

সময় বহমান। পৃথিবীর সব ক্ষত নাকি ভরে উঠে সময়ের নীড়ে। কথাটা কি আদৌ পুরোপুরি সত্যি!

সময় পাল্টেছে। চার বছরে অনেক কিছু বদলেছে। ছবি বেগম ও তার ছেলে মেয়েদের মৃ*ত দন্ড না হলেও। যাবত জীবন কা*রাদণ্ড হয়েছে। টাকা, ক্ষমতা কোনকিছুর জোর বাঁচাতে পারেনি তাদেরকে। জেলের চৌদ্দশিকের ভেতর নিজেদের অ*পরাধের শাস্তি ভোগ করছে। 

শোয়েব হক প্যারালাইজড। অবস্থার সুধার হয়নি বরং দিনদিন আরো খারাপ দিকে যাচ্ছে। আশেপাশে আপনজন কেউ নেই। টাকার দয়ায় নার্সদের দ্বারা ছিটাফোঁটা কোনরকম সেবাযত্নে শ্বাস চলছে। ক্ষণে ক্ষণে মৃ*ত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।

 

চেয়ারম্যান বাড়িতে আমদ ফুর্তি লেগে। বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে। প্রভা মা হচ্ছে। ডেলিভারির সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। বোনের সাথে প্রিয়ও ইমান্দিপুর এসেছে। এখানে মানুষজন অনেক, সেবাযত্নের কমতি হবেনা। সারাক্ষণ সবাই চোখেচোখে রাখবে। সর্বক্ষণ প্রভার সাথে সাথে প্রিয় থাকছে। প্রয়োজন অপ্রয়োজনের দিক খেয়াল রাখছে। বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে সেই উত্তেজনায় দিন গুনছে।

 

‘ পড়াশোনা তো শেষ। সামনে কি করবি। কিছু ভেবেছিস?’

সমুদ্রের জিজ্ঞাসু আওয়াজে নড়েচড়ে উঠল শাদ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উত্তর দিলো,

‘ এখানে ভাবাভাবির কি আছে। রাজনীতিতে যুক্ত হবো অনেক আগেকার সিদ্ধান্ত।’

‘ আর বিয়ে?’

শাদ উত্তর দিলো না কোন। সমুদ্র উত্তরে প্রতিক্ষা করল। শাদের হেলদোল না পেয়ে। আবার বলল,

‘ তোকে নিয়ে আম্মার চিন্তার শেষ নেই। বয়স হচ্ছে।সব সময় প্রেসার হাই থাকে। তাড়াতাড়ি বিয়েশাদি করিয়ে তোর একটা গোছানো সংসার দেখতে চাইছে।’

শাদ বিরক্ত হলো। কন্ঠে রাগ চেপে বলল,

‘ তো এখন কি আমাকে বিয়ে করতে হবে? এসব বিয়েশাদিতে আমার ইন্টারেস্ট নাই। শুধু শুধু টাকা আর সময়ের বরবাদি।’

‘ বেঁচে থাকতে ভালোবাসা জীবন সঙ্গীর প্রয়োজন।’

‘ ভালোবাসা, জীবন সঙ্গী এসব কিছু বাজে কথা। বাঁচার জন্য একমাত্র ক্ষমতা আর টাকার প্রয়োজন। ভালোবাসা নামক দুনিয়াতে কি নেই। সবকিছু আবেগ আর মায়া।’

ছোট ভাইয়ের কথার ধরন দেখে সমুদ্র হতভম্ব, বিরক্ত। তার এসব কথার জন্য লোকে কানাঘুষা করে। তাকে ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্ত পাগলও বলে। সমুদ্র জিদ চেপে বলল,

‘ তাহলে কি লোকের কথা ধরে নিবো? তুই ফিলেফোবিয়ায় আক্রান্ত!’

‘ লোকের কথায় আমার আশেযায় না। বিয়েশাদি ভালোবাসা আমার জীবনে চাইছিনা। যদি তোমরা বাধ্য করো বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হবো।’

‘ হুম*কি দিচ্ছিস?’

‘ না, সত্যি বলছি।’

সমুদ্র প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। হন হনিয়ে চলে যেতে লাগল। শান্ত হওয়াটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অপ*রাধ। যে যা পারে সব দায়িত্ব শান্ত মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়। মা আর প্রিয়’র জোরাজোরিতে শাদকে বিয়ের জন্য বোঝাতে এসেছিল। এখানে এসে উল্টো তার রাগ ঠেলতে হলো। 

সদর দরজা থেকে প্রিয় প্রভা আড়ি পেতে ছিল। সমুদ্রকে রেগে ফিরতে দেখে কি হয়েছে বুঝতে বাকি রইল না আর। তড়িঘড়ি পায়ে প্রিয় সমুদ্রের দিক গেল। উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি বলল শাদ?’

সমুদ্রের রাগী আওয়াজ,

‘ আমি আর বোঝাতে পারবোনা। তোমাদের দেবরকে তোমরা বিয়ে করিয়ে আনো এবার।’

প্রভাকে রেখে প্রিয় গেল এইবার। প্রিয় কি বলবে তা যেন খুব ভালো করেই ঠাহর করতে পারল শাদ। 

প্রিয় কিছু বলার আগেই রাগী তড়িঘড়ি কন্ঠে বলে উঠল শাদ,

‘ ভাবি, আপনার যদি মনে হয় কথা বলে, বিয়ে করার জন্য রাজি করিয়ে ফেলবেন। তাহলে ভুল। আপনারা জোরাজোরি করলে আমি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো।’

‘ বিয়ের জন্য জোরাজোরি করতে আসিনি। একটা প্রশ্ন জানতে এসেছি। তুমি কি তুরফার ফিরে আসার অপেক্ষা করছো?’

খানিক চুপ রইল শাদ। অনেক বছর পর আবার এই নামটা শুনল। টনটন করে মস্তিষ্ক নড়ে উঠল। রাগ জেদ অভিমান কিছু একটা চেপে ধরল। অস্থির স্বরে বলল,

‘ আমি কারো অপেক্ষায় নেই ভাবি। যদি জিজ্ঞেস করেন বিয়েশাদি না করার কারণ। তাহলে বলবো, আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা। অনেস্টলি বলতে আমার ভয় হয় এখন। হাস্যকর হলেও এটাই সত্য। আমি চাইনা কেউ এসে আবার আমাকে ভাঙ্গুক। এতে যদি লোকে আমাকে ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্ত পাগল বলে। বলুক।’

প্রিয় কিছু বলল না আর। যেন কয়েকবছর আগের নিজেকে দেখছে। সেও এমন একটা সময় পাড় করেছে। এসব যন্ত্রণা কষ্ট গুলোর সাথে বেশ ভালো করে অবগত। সময়ের হাতে ছেড়ে দিলো সব। হয়তো কোনদিন কেউ আসবে। শাদকে গুছিয়ে নিবে।

 

রাত প্রায় আটটা। ল্যাপটপের সামনে প্রিয় প্রভা অধীর আগ্রহে বসে। প্রিয়’র ভেতর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। একটা হাসপাতালে ‘সারোগেট মাদারের’ জন্য এপ্লাই করেছিল। আজ রেজাল্ট আসার দিন। রাত আটটায় তারা মেইলে জবাব জানাবে। আচমকা মেইল এলো। প্রিয়’র চোখেমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তড়িঘড়ি করে মেইল খুলতেই মুখখানা চুপসে গেল। ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল। সরি লেটার এসেছে। ধপ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো প্রিয়। একটা বাচ্চার জন্য কতই না হাই হতাশ। বিধাতার কাছে আহাজারি করছে। তার দিক কি উপরওয়ালা চাইবেনা একবার। তার অপূর্ণতা কি পূর্ণতা পাবেনা কোনদিন? 

প্রিয়’র অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ দেখে প্রভা বলল,

‘ কিছু হয়নি আপা। ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই তোমার কোল ভরবে।’

বোনের সামনে কান্না চেপে মাথা ঝাকালো প্রিয়।

 

রাত গভীর। শতাব্দ এসেছে। প্রিয় কয়েকমাস যাবত এখানে প্রভার সাথে আছে। তাই ছুটির দিনগুলো ইমান্দিপুর কা*টায়। ঘরে ঢুকতে চারিপাশ অন্ধকারে বিলীন দেখলো। শব্দহীন ঘরটায় ফোপাঁনোর আওয়াজ পেল। প্রিয় কি কাঁদছে? 

ব্যাগ ফেলে তড়িঘড়ি করে বিছানার দিক গেল। বিছানার পাশের আলো জ্বালাতেই, প্রিয়কে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখল। মুখখানা বালিশে গুজে রেখেছে। হয়তো শতাব্দের পায়ের ভাঁজ পেয়ে কান্না চেপে রাখতে চাইছে । প্রিয়’র চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে আলতো করে ডাকল শতাব্দ। উঠলো না প্রিয়। ঘুমের ভাণ করে পড়ে রইল। কি লুকাতে চাইছে প্রিয়? নিজের কষ্ট গুলোকে। আদৌ কি শতাব্দের থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে। এই বৃথা চেষ্টাই বা কেন করছে?

টেনে প্রিয়কে নিজের দিক ফিরালো। পাজকোলে তুলে  বারান্দার দিক পা বাড়ালো। গভীর রাতের মৃদু হিম হাওয়া বইছে। চারিদিকে শীতল আভাস। প্রিয়কে কোলে করেই চেয়ারে বসলো।বুকের গভীরে প্রিয় মুখ ডোবালো। কান্নার বেগ কমেছে এখন। এই একাকীত্বের মুহূর্তে শতাব্দের আহ্লাদটা খুব প্রয়োজন ছিল যেন। 

চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শতাব্দ। আলতো স্বরে প্রিয়কে বলল,

‘ কেউ কিছু বলেছে প্রিয়?’

প্রিয় চুপ। উত্তরের অপেক্ষায় থেকে শতাব্দ আবার বলল,

‘ কিছু বলবেনা?  আচ্ছা ঠিক আছে, সকালে নাস্তার টেবিলে আমিই সবাইকে জিজ্ঞেস করবো।’

প্রিয়’র ধীর আওয়াজ,

‘ ডাক্তার আহসান খাঁন শতাব্দের বউকে কিছু বলবে। সেই সাহস আদৌ আছে কি কারো? আমার অপূর্ণতাই আমার একমাত্র  বিষন্নতার কারণ।’

‘ মেইল এসেছিল?’

উত্তরে কিছু বলল না প্রিয়। শতাব্দ প্রিয়কে বুকের মাঝে আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়’র কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,

‘ এইটুকু কারণে এত কান্না? ঠিক হয়ে যাবে সব। হাজার বার বলেছি তোমার মলিন মুখ আমায় বড্ড পো*ড়ায়।’

‘ আফসোস হয়না আপনার?’

‘ কেন হবে আফসোস? আমার প্রিয় আমার বুকে জড়ানো এরচেয়ে শান্তি, সুখের আছে কি কিছু? কিছু চাইনা আমার, তুমি থাকলেই সন্তুষ্ট।’

 

____________________

 

অপারেশন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।ভেতরে ডেলিভারি হচ্ছে প্রভার। সমুদ্র চিন্তিত মুখে ঘুরঘুর করছে, শান্ত হয়ে বসতে পারছেনা একটুও। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। প্রিয় চুপচাপ বসে আছে। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ছে। বোনের  চিন্তায় বিষন্ন ক্লান্ত । খানিকক্ষণ পর নার্স সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে দুইটা ফুটফুটে শিশুকন্যা পেঁচিয়ে আনলো। একজনকে সমুদ্রের কোলে দিলো। অন্যজনকে প্রিয় জড়িয়ে নিলো। বাচ্চাটা কোলে নিতেই প্রিয়’র অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মাতৃত্ব যেন মন ছুয়ে দিলো। ভেতর থেকে অদ্ভুত এক টান জন্মালো। কোন এক অদ্ভুত আবেশে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।

বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সমুদ্র নার্সকে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল,

‘ প্রভা কেমন আছে, সুস্থ আছে তো?’

‘ পেশেন্ট সুস্থ। ঘুমাচ্ছে।’

স্থির নিশ্বাস ফেলল সমুদ্র।

 

বিকেলে জ্ঞান ফিরেছে প্রভার। কেবিন জুড়ে ভীড় করেছে সবাই। করবে নাইবা কেন। বাড়িতে প্রথম সন্তান এলো। তাও আবার জোড় কন্যা। কথায় আছে, কন্যারা ভাগ্যলক্ষ্মী হয়।

নার্স বাচ্চাটাকে কোলে দেওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্যও নিজের থেকে আলাদা করেনি প্রিয়। কোলে নিয়ে বোনের পাশে বসে আছে এখনো। 

 চোখ খুলে মা বোনকে পাশে দেখে প্রভার মলিন মুখকানায় আলতো হাসি ফুটলো। প্রিয় আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন লাগছে এখন?’ 

উষ্কখুষ্ক ঠোঁটে মলিন হাসল প্রভা। বলল,

‘ ভালো।’

 প্রিয় বাচ্চাকে আদর করতে করতে কন্ঠে উৎসাহ জুড়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ আমাদের ছোট্ট প্রভা কত বড় হয়ে গেছে দেখেছ মা? আমাদের প্রভারও এখন দুইজন মেয়ে আছে।’

প্রভা হাসলো। বলল,

‘ উহু, আপা একজন।’

থমকে গেল ঘরের সবাই। বিহ্বল কন্ঠে প্রিয় বলল,

‘ একজন! মানে?’

প্রভা মুচকি হেসে আবার বলল,

‘ আমি যখন জানতে পারি আমার গর্ভে দুই সন্তান তখন থেকে আমি আর সমুদ্র সিদ্ধান্ত নেই আমার এক সন্তান আমার আপার।’

চমকে গেল প্রিয়। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিক চাইল। সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে হাসি। প্রিয় বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘ এটা হয় না। অসম্ভব। একজন মায়ের কাছ থেকে আমি কি করে তার সন্তান কেড়ে নিবো। এরা তোর সন্তান। এদের উপর তোর অধিকার।’

শতাব্দ এগিয়ে এলো। বলল,

‘ প্রিয় ঠিক বলছে। এটা সম্ভব না। ওরা তোমাদের সন্তান। ‘

প্রভা অধৈর্য কন্ঠে বলল,

‘ কেন সম্ভব না শতাব্দ ভাই? অনেক বছর আগে খালা তার একমাত্র মেয়েকে আমার সন্তান হারা মায়ের আঁচলে রেখে যায়। আর আমি আমার  প্রিয় আপাকে পাই। আজ অনেক বছর পর আমি খালার সেই ঋণ শোধ করতে চাই, আমার দুই সন্তানের এক সন্তান আমার আপার। ওর উপর আমার কোন দাবি নাই। এখন থেকে ওকে আপনার আর আপার সন্তান বলেই চিনবে সবাই।’

‘ লোকে কি বলবে?’

‘ লোকের কথা আপনি কবে থেকে ধরতে শুরু করলেন শতাব্দ ভাই। আমি চাই আপার কোলের সন্তান আপার কাছে থাক। ওর উপর আমার কোন দাবি, কোন অধিকার নাই। যদি কাগজ কলমে লিখে দিতে হয় তবুও আমরা রাজি।’

সবাই চুপ। প্রভা আবার বলল,

‘ আপা! ওযে তোমার মেয়ে মেনে নিতে অসুবিধা আছে তোমার?’

আবেগ, আনন্দ, অনুভূতিতে কেঁদে উঠল প্রিয়। আজ এই কান্না তার খুশির কান্না। বোনের হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলল,

‘ আমি চিরকাল তোর কৃতজ্ঞ থাকবো বোন।’

‘ তুমি এখন মা। মেয়ের সামনেও এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে আপা?’

কান্নার মাঝে হেসে ফেলল প্রিয়। ঘাড় ফিরিয়ে শতাব্দের দিক চাইল। ছলছল করছে শতাব্দের চোখ। চোখেমুখে অদ্ভুত চমক। এটা কিসের চমক, বাবা হওয়ার কি?

 

চেয়ারম্যান বাড়িতে ঘটা আয়োজন। ধুমধাম করে মেয়েদের নামকরনের উৎসব  করা হলো। মায়েদের নামের সাথে মিলিয়ে  মেয়েদের নাম রাখা হয়েছে। প্রিয়’র মেয়ের নাম ‘ প্রেয়সী’ আর প্রভার মেয়ের নাম ‘ সুপ্রভা’ রাখলো।

 

গভীর রাত। নিস্তেজ চারিপাশ। নিকষ কালো অম্বরে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। চারিদিক উজ্জ্বল আলোয় ছড়িয়ে। তীরতীর বাতাস বইছে। গায়ে ভালোবাসার মাদকতা মাখিয়ে। মেয়েকে বুকে আগলে, শতাব্দের বুকে পিঠ এলিয়ে বসে আছে প্রিয়। প্রিয়’র মাদকতা মেশানো মেঘবরণ কেশে মুখ গুজে আছে শতাব্দ। প্রিয়’র উন্মুক্ত কোমরে হাত বোলাচ্ছে।

 শতাব্দের গায়ের মিষ্টি সুবাসের আবেশে ডুবে থাকা প্রিয় অস্পষ্ট গভীর কন্ঠে বলল,

‘ ধন্যবাদ শতাব্দ। আপনার ভালোবাসায় আমি আজ পরিপূর্ণ। আমার অপূর্ণ, বেরঙের জীবনটায় ভালোবাসার রঙ্গে রাঙিয়ে দেওয়া জন্য আমি আপনার চিরকৃতজ্ঞ।’

চোখ বুজে হাসল শতাব্দ। প্রিয়’র ঘাড়ে আলতো চুমু দিতে দিতে বলল,

‘ তোমার ভালোবাসা সবসময় আমাকে পূর্ন করেছে, আজ বাবা হয়ে আমি যেন পরিপূর্ণ। জীবনে আর কি চাই? আমার সব সুখ যে তোমাতেই। আমার নিশ্বাসের মত তোমাকে ভালোবাসাটাও সত্য। নিশ্বাস ছাড়া যেমন জীবনের মূল্য নেই। প্রিয়কে ছাড়া এই শতাব্দ অমূল্য।’

চোখ খুলে ঘাড় বাকিয়ে চাইল প্রিয়। ঠোঁটের কোণে ভুবন ভুলানো হাসি। চোখে অদ্ভুত মোহিত দীপ্তি। নিগূঢ় কন্ঠে বলল,

‘ ভালোবাসি শতাব্দ। চিরকাল ভালোবাসবো।’

কপালে গভীর চুমু এঁকে দিলো শতাব্দ। স্ত্রী কন্যাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। ঘোর লাগানো, গভীর কন্ঠে বলল,

‘ ভালোবাসি আমার প্রাণপ্রিয়।’  

প্রকৃতি আজভালোবাসার চাদরে মাখিয়ে। চারিপাশ প্রণয় সমুদ্রের অতলে। দূর আকাশের লাজুক চাঁদটা যেন মিটিমিটি হাসছে।

 

____________________

 

একই বাড়ির অন্যপাশে একাকীত্বের ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলছে শাদ। অনেক অভিমান অভিযোগ জড়ানো। কোন এক উড়োখবর কানে এসেছে আজ। বহুবছর পর খুব পরিচীত অজানা কেউ দেশে ফিরেছে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কোন অনুভূতি হচ্ছেনা। না আবেগেরা বাসা বাঁধছে। অনুভূতিহীন ঠাই শুনেছে। 

লোকে বলে ফিলোফোবিক। আসলেই কি সে ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্ত?

 

সমাপ্ত♥

 

সারসংক্ষেপ: ফিলোফোবিয়া’ একটা ফোবিয়ার নাম। গ্রীক শব্দ ‘ফিলো’ অর্থ ‘ভালোবাসা’ আর কোন কিছু নিয়ে অস্বাভাবিক ভীতিকে ‘ফোবিয়া’ বলে। ফিলো আর ফোবিয়া যুক্ত হয়ে পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় ‘ভালোবাসার ভয়’। 

গল্পটা ফিলোফোবিক প্রিয়’র অতীত ও তার ডাক্তার পাগল প্রেমিককে ঘিরে। প্রিয় যার ছিল ভালোবাসায় প্রচন্ডরকম ভয়। দুইহাজার এগারোতে কিশোরী প্রিয় বড় আপার সু*ইসাইডে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে, ডিপ্রেশনে ডুবে থাকে। হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত জীবন থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায়। ব্যাপারটা বাবার চোখে পড়ে তাই, ডাক্তারের পরামর্শে স্থান পরিবর্তনের জন্য ঢাকা থেকে ইমান্দিপুর বড় খালার বাড়িতে পাঠায়। সেখানকার চেয়ারম্যানের ছেলে শতাব্দ। তেজি, গম্ভীর। কারো সামনে নত না হওয়া ছেলেটা ভালোবাসার সামনে ঝুঁকে যায়। রগচটা ছেলেটা প্রেমিকার সামনে জব্দ প্রায়। রূপবতী প্রিয়’র সৌন্দর্য, সরল স্বভাবের গভীরে তলায়। ধ্যানজ্ঞান ভুলে শুধু প্রিয়’কে চায়। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ, ভুল বোঝাবুঝি পাড় করে দুজনের প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। হ্ঠাৎ একদিন তীক্ষ্ণ অতীত এসে হানা দেয়।ভুলবোঝাবুঝি হয় দুজনের। বিচ্ছেদ পর, কে*টে যায় অনেক বছর। শতাব্দের নজর সর্বদাই ছিল প্রিয়’তে। অনেক বছর পর মুখোমুখি হয় দুজনে। অতীতের রহস্য উদঘাটন করতে শতাব্দের সাথে বিয়ের সম্বন্ধে জড়ায়। এতবছর কষ্টে জরজড়ীত থাকা প্রিয়।নিজেকে শক্ত খোলসে ডেকে নেয়। দূরে সরিয়ে দেয় তার প্রিয়তমকে। কিন্তু শতাব্দের অদম্য প্রেম, তা মানতে নারাজ। প্রিয়কে আবার ভালোবাসতে শেখায়। তার ভালোবাসার ভীতিকে হারিয়ে পুরানো অনুভূতিতে আবার মোড়ায়। অতীতের কিছু ভয়ঙ্কর রহস্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। অনেক মান অভিমান, মিলন বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে দুজন জেদি প্রেমিক প্রেমিকার সুখময় প্রেম জীবনের আরম্ভ হয়। যা অনন্তকাল অবধি পাড়ি জমায়। ফিলোফোবিয়া’র দুই অংশ। প্রথমটা প্রেমময়, বিরহ।দ্বিতীয়টা সামান্য থ্রিল একটু সাসপেন্স মিলন- বিচ্ছেদ গড়া। 

 

লেখিকার কথা: গল্পটা প্রিয়’র ফিলোফোবিয়া নিয়ে শুরু হয়েছে। শাদের ফিলোফোবিয়াতে শেষ হয়েছে। শাদ, তুরফা গল্পের সাইড কারেক্টার হলেও তারা যেন শতাব্দ, প্রিয়’র ছায়া ছিল। ওদের ব্যাপারটা ওপেন এন্ডিং দিয়েছি। মিল বিচ্ছেদ সবটা পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম। যদি কখনো ওদের নিয়ে লেখার আগ্রহ হয়। ইনশাআল্লাহ কোন একদিন ওদের নিয়ে আবার লিখবো।

 

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।