আগন্তুকের আসক্তি

    – মাত্র ১৬ বছর বয়সী একজন মেয়েকে বিয়ে করছেন লজ্জা করছেনা আপনার?দেশে আইন বলেও একটা কথা আছে।তাছাড়া আপনার বাবা মা কই?বিয়ের সাক্ষি হিসেবে আমার তাদের চাই।আপনার রাস্তার দুই, চারজন বন্ধুকে দিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই।

    তেজীয়ান মেয়েটির এমন চটপটে কথায় চমকে তাকায় আশেপাশের মানুষজন।সহসা বিকট শব্দে ঠাসস করে মেয়েটির গালে একটি চড় পড়ে।ডান গালটায় হাত দিয়ে রক্তলাল চোখে আবার ঘুরে তাকায় মেয়েটি।মেয়েটির নাম ইতিকা।
    গালের অসহ্য ব্যাথায় মনে হচ্ছে ডান গালটি নিমিষেই খসে পড়বে তার।ইতিকার চোখের চাহনী দেখে চড় দেওয়া মহিলাটি ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,

    – ওই মাইয়া এমনে তাকাইয়া কি দেহস?বিয়া হইবো মানে,আইজকাই হইবো।

    ইতিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মহিলাটির দিকে।হঠাৎ হাতে টান পড়ায় নিজের ভার সামলাতে না পেরে মেঝেতে ধপাস করে বসে যায়।ক্রুদ্ধ হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই চোখে পড়ে ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি পরা ছেলেটিকে।একবার নিজের হাত আরেকবার ছেলেটির হাতের দিকে তাকিয়ে হাত ঝাকরা দিতে থাকে সে।কিন্তু না ছেলেটি হাত ছাড়ছেনা।তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার কোন হেলদোল নেই।ইতিকা আবারো রাগ দেখিয়ে উঠে যেতে নেয়, তৎক্ষণাৎ আবারো হাতে টান লাগে।দুহাত ঝাকরা দিয়ে পাশে তাকাতেই কানে আসে গমগম সুরে বলতে থাকা ছেলেটির কথা,

    – আপনার ফুফু যে চড়’টা দিয়েছে সেই চড়টা আমি আবার আপনার বাম গালে রিপিট করবো ।যদি নিজের হবু বরের হাতে চড় না খেতে চান তবে চুপচাপ আমার পাশে বসুন।

    নিজের হবু বর ‘ইনানের’ মুখে এমনটা শুনে রাগ আরো দিগুন বেড়ে গেলো ইতিকার।কিন্তু তা প্রকাশ করার আগেই কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে।ইনান এখনো তার হবু স্ত্রীর হাত ধরে আছে শক্ত করে যেন ছেড়ে দিলেই কিশোরী একছুটে পালিয়ে যাবে।কাজী কবুল বলতে বলায় ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দেয় মেয়েটি।দুপাশে মাথা নাড়িয়ে না করতে থাকে সে বিয়েটি করবে না।কিন্তু কার কথা কে শোনে এক মিনিট অপেক্ষা করাতেই ইতিকার ফুফু আবারো তেড়ে এসে তার চুলের মুঠি চেপে ধরে।নির্দোষ মেয়েটির এমন অত্যাচার দেখে ইনানের বন্ধু সুফিয়া ছুটে এসে ইতিকাকে জড়িয়ে ধরে।সেই মূহুর্তেও ইনান ইতিকার হাত ছাড়েনি।বরং শক্ত করে ধরে আছে।

    সুফিয়া রাগী মুখ করে ইনানের দিকে একবার তাকায়।ইনানের তাতেও হেলদোল নেই বরং সে কাজীকে তাড়া করে বিয়ে পড়ানোর জন্য।

    সুফিয়া মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে কবুল বলার জন্য তোষামোদ করতে থাকে।কিন্তু দৈর্য্যহীন ইনান ক্রুদ্ধ স্বরে ইতিকাকে বলে,

    – এই যে আপনার সমস্যা কি?একটা কবুল বলতে ত্রিশ মিনিট পার করালেন।আমার সময় এতটাই সস্তা নাকি?আজ এখানে এই মূহুর্তে বিয়ে হবে, না হয় সবার গর্দান যাবে অলীদ দ্রুত রামদা নিয়ে আয়।

    ইনানের কথায় কেঁপে উঠে অলীদ।দরজা দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কানে আসে দীর্ঘ প্রতিক্ষার সেই শব্দ ” কবুল ”
    __

    ঘুটঘুটে অন্ধকার গ্রামের রাস্তায় হাটু মুড়ে বসে আছে অলীদ।মাইক্রোর সিটে গা এলিয়ে বসেছে সুফিয়া; তারা নিজেদের মাঝে কথা বলায় ব্যস্ত। এমন সময় সেখানে এগিয়ে আসে ইনান।তখনি একছুটে তার দিকে এগিয়ে আসে অলীদ।

    – শালা তোর মাথায় কি ঘুরছে?দিন দিন সব বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে নাকি?একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছিস।এখনো ১৮ বছর হয়নি তার।
    – তো?

    ইনানের ঘাড় ত্যাড়া জবাবে সুফিয়া বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে।এবং ইনানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

    – দোস্ত আমি মানলাম এটা অজপাড়াগাঁ।এখানে ১৫/১৬ বছরে আহরহ মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে কিন্তু আমাদের শহরের কথা ভাব।একবার মেয়েটাকে নিয়ে গেলে পুলিশ কেসেও ফেঁসে যেতে পারিস।তাছাড়া আঙ্কেল আন্টি কিছুতেই এই বিয়ে মানবে না।

    – তো?এত চাপ নিচ্ছিস কেন?আমি যে বিয়ে করেছি বাবা মা না জানলেও মামু ঠিকি জানে।

    ইনানের কথায় তেতে উঠলো অলীদ,
    – আল্লাহর কসম আঙ্কেল ঠিকি বলে তোর মামু তোর মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছে।না হলে এই মেয়েকে বিয়ের জন্য অনুমতি তিনি কি করে দেয়?

    – সেটা তোকে না জানলেও হবে।সুফু(সুফিয়া) যা গিয়ে দেখ আমার বউটার বিদায় পর্ব শেষ কিনা।আমাদের হাতে সময় নেই অলরেডি রাত একটা বেজে গেছে।

    সুফিয়া সোজা হেটে ইনানের বাড়ির উদ্দেশ্য যেতে থাকে।তার মাথাটা ঘুরছে তার বন্ধু এমন বুঝদার ছেলে কিনা মাত্র ১৬ বছর বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করছে ভাবতেই রাগগুলো মাথা ফেটে বেরিয়ে আসছে।
    .

    বিদায়ের ক্ষণে কারো চোখে জল নেই।সবাই স্বাভাবিক।ইতিকা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে পরনে তার লাল বেনারসি।শুধু তাকে জড়িয়ে ধরে কাদঁছে তার সমবয়সী ফুফাতো বোন মিহি।নিস্তব্দতা ঘুচে দিচ্ছে মেয়েটির কান্না।পরক্ষণে ইতিকার ফুফু এসে মেয়েটির মুখ চেপে ধরে কেননা নিরিবিলি স্তব্দ পরিবেশে সবার হয়তো সন্দেহ হবে আজ ইতিকার বিয়ে।গ্রামের আশেপাশের সবাই এত দল বাধানো মানুষজন দেখে সন্দেহ করলেও ইতিকার ফুফা ‘আকবর’ বলেছেন এরা শহর থেকে এসেছে তার পরিচিত লোকজন।কিন্তু বাড়ির দুই / তিনটে পরিবার ছাড়া কেউ জানেনা আজ ইতিকার বিয়ে।আর সেই দুই/তিন পরিবারের মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ করেছে ইনান।

    শেষ মূহুর্তে ইতকাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয় তার ফুফি ফরিদা।কিন্তু মেয়েটির চোখে জল নেই,নেই কোন বিদায়ের ক্ষণের কষ্ট।চোখে মুখে হতাশার ছাপ।ফরিদার কান্নার শব্দ কমে আসতেই ইতিকা তার কানে ফিসফিস করে বলে,

    – ওয়াসিম আসবে ফুফি দেখে নিও।ওয়াসিম তোমাদের ছাড়বেনা।ওয়াসিমের ভালোবাসা মিথ্যা নয়।
    __

    নিরিবিলি রাস্তা মাড়িয়ে রাত প্রায় চারটার সময় ইনানের গাড়িটি ঢুকলো বারো তলা বিশিষ্ট একটি ফ্লাট বাড়িতে।নয় তলার ফ্লাট টিতে উঠে সুফিয়া ইতিকাকে নিয়ে দরজা খুলে ঘরের ভেতরে ডুকতে নিলেই ইতিকার হাত টেনে পিছিয়ে আনে ইনান।তখনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইনানের দিকে ইতিকা তাকালে ইনান তাকে উপেক্ষা করে সুফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

    – সুফু তুই আগে ঘরে যা।তারপর বরন কর।
    – এই সময় বরন ডালা কোথায় পাবো আমি?
    – ভেতরে সব ব্যবস্থা করা আছে তুই গিয়ে দেখ।

    অলীদ পেছন থেকে ইনানের কথায় ঠোঁট বাঁকায়।তার ধারনা ছিল না ইনান এত অল্প সময়ে এত কিছুর ব্যবস্থা করেছে।

    বরন শেষে ঘরে ঢুকে সবাই।সুফিয়া এবং অলীদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে চারিদিকে।পুরো ঘরটা আর্টিফিশিয়াল ফুল এবং ছোট-ছোট ফেইরি লাইটে সাজানো।অথচ এই বাড়ি থেকে তারা সকাল দশটার পর বেরিয়েছে তখনো এমন কিছু ছিল না।’তার মানে ইতিকাকে বিয়ে করার বিষয়টা কি ইনানের আগের প্লানিং ছিল?আর ভাবতে পারলো না অলীদ চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে।

    ইনান সুফিয়াকে ইশারা করে ইতিকাকে তার রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য।সুফিয়া ইনানের রুমে ডুকতেই যেন আসমান থেকে ধপাস করে পড়ে।রুমটা ছোট ছোট ক্যান্ডেল, প্রদীপ দিয়ে সাজানো তার মাঝে কিছু ফুল।
    ইতিকাকে বিছানায় বসিয়ে সুফিয়া চলে যেতে নিলেই তার হাত টেনে ধরে ইতিকা।

    – আপু?
    – হ্যা বলো।
    – আ..আমি, আমি এখানে থাকবো না।লোকটাকে আমি চিনিনা জানিনা হুট করে জোর করে বিয়ে হয়ে গেলো আর তুলে নিয়ে আসলো।আমি মানতে পারছিনা।
    – তুমি নিজেকে মানিয়ে নাও ইতিকা।ইনানের মাথায় কি ঘুরছে তা আমার বোধগম্য নয়।তার থেকে ভালো কি হচ্ছে দেখে যাও।

    সুফিয়া ইতিকাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

    দরজার বাইরে অলীদের সাথে তর্কে জড়িয়ে আছে ইনান।তখনি সুফিয়া এসে ইনানের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে,
    – সমস্যা কি তোর ইনান?

    – আমার কি সমস্যা হবে?

    – মেয়েটার জন্য দেখছি বাসরো রেডি করে রেখেছিস তার মানে তোর এইসব আগে থেকে প্লানিং ছিল।অথচ আমাদের বলেছিস তুই মেয়েটাকে জাস্ট আজ দেখেছিস আর আজকেই বিয়ে করবি।কিন্তু তোর হাবভাব চাহনীতে অন্যকিছু প্রকাশ পাচ্ছে।

    ইনান একটানে নিজের পাঞ্জাবি সুফিয়ার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়।শান্ত সুরে নির্ভীয় ভাবে বলে,

    – হ্যা একমাস ধরে আমি সবকিছু প্লানিং করেছি।সুযোগ্য সময় পেয়েছি আর বিয়ে করে এনেছি সাক্ষি হিসেবে তোরা ছিলি।
    – তার মানে?
    – কিছু না।যা তোরা ঘুমা।অলীদ তুই তোর রুমে যা আর সুফু তোর জন্য ডানের ঘর রাখা আছে।

    ইনান পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে রুমের দরজা খুলে তখনি কানে আসে তেজীয়ান সুফিয়ার কন্ঠ।

    – খবরদার মেয়েটার সাথে কিছু করবি না।

    – আমার যা ইচ্ছে আমি করবো আর সবটা কি তোকে বলে করবো?

    ইনান রুমে ঢুকে যায়।ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে ঘুরে তাকাতেই আকস্মিক তার বুকে গরম উত্তপ্ত কিছু আবিষ্কার করে।ভালোভাবে পরখ করতে বুঝতে পারে ইতিকা তার দিকে জলন্ত মোম ছুড়ে মেরেছে আর সেই গলন্ত মোম চুইয়ে চুইয়ে কিছুটা তার বুকে লেগেছে।এক চিলতে মৃদ্যু আগুন সহসা তার চামড়া ভেদ করে যেন মাংসে পতিত হচ্ছে।হঠাৎ অসহ্য যন্ত্রণায় চোখটা বন্ধ করে আবার খুলে নেয়।তৎক্ষণাৎ আরেকটি মোম ছুড়ে মারলে ইনান তা ধরে নেয় এবং অন্য হাত দিয়ে ইতিকাকে পেছন থেকে মুছড়ে ধরে।

    – এই মেয়ে সমস্যা কি আপনার?হঠাৎ আমার কাছে বাঘিনী রূপে আসলেন কেন?বাঘিনীর তেজ আমি দুই সেকেন্ডে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারি তার ধারণা আপনার নেই।
    – আমার প্রয়োজন নেই চোর ছ্যাঁচড়ের সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার।
    – কাকে চোর ছ্যাঁচড় বলছেন আপনি?
    – আপনি ছাড়া এই ঘরে আর কেউ তো নেই!তুচ্ছ মানব।

    – আটাশ জন রক্ষক নিয়ে চারটি মাইক্রবাস শান বাজিয়ে আপনার পরিবারকে একপ্রকার অবশ করে বিয়ে করে এনেছি আমাকে কি সামান্য মনে হয় আপনার?এতকিছু হয়ে গেলো অথচ না আপনার পাড়া-প্রতিবেশি সেখানে উপস্থিত আর না কেউ কিছু বলার সাহস পেয়েছে।আমাকে সহজ ভাববেন না আপনি।

    ইনানের প্রত্যুত্তরে ইতিকার অবাক হয়।সত্যিত অজপাড়াগাঁ গ্রামটিতে সামান্য দু’চার জন মেহমান আসলে একঘরের লোক এসে অন্য ঘরে উঁকিঝুঁকি দেয় কিন্তু বিয়ের ভরা মজলিশে কেউ কিচ্ছুটি জানলো না।কে উনি?

    ইতিকার ভাবুক মুখটা দেখে তার চিবুক তুলে ধরে ইনান।কানের সামনে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
    – ভাগ্য বদল শুনেছো কখনো?আজকের পর তোমার ভাগ্য বদল হবে।হয় সূচনা না হয় বিষাক্ত উপসংহার।

    ইনান ইতিকাকে ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।তখনি আয়নায় সেই কিশোরীর প্রতিবিম্ব অগোচর করে ইনান।মেয়েটি হাসছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে।ইতিকা হাসতে হাসতে ইনানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

    – ঘটনা তো উল্টাও হতে পারে, যদি আপনার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়?আমার যা চাই তা কিন্তু আমি নিয়েই ছাড়ি কিন্তু আপনি আমার পূর্ণতাতে বাঁধা দিয়েছেন তাই আপনার প্রাণ বিনাশ করে হলেও আমি আমার পূর্ণতা করে ছাড়বো।

    ইতিকার কথায় গা দুলিয়ে হাসে ইনান।আয়নার দিকে তাকিয়ে ইতিকার চোখে চোখ রেখে কোমড়ে হাত গুজে বলে,

    – তবে তাই হোক!

    #চলবে….

    আগন্তুকের আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১]

    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_অসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ২]

    দুপুরের রোদ জানালার কাঁচ ভেদ করে তীর্যক ভাবে ইনানের চোখে লাগে।সহসা চোখ মুখ কুচকে আড়মোড়া কাটিয়ে উঠে বসে সে।দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সকাল সাড়ে বারোটা বাজতে দেখে আবার ধপাশ করে বিছানায় শুয়ে যায়।পাশে ফিরে তাকাতেই গুটিয়ে শুয়ে থাকা লাল শাড়ি পড়া একটি মেয়েকে দেখে ভরকে যায়।সহসা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়।বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে-নিতে রুমের পরিবেশটা পরখ করে বুঝতে পারে, আরে মেয়েটা তার বিবাহিত স্ত্রী।গতকাল মেয়েটার সাথে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে যায়।তারপর আর মনে নেই।হয়তো ক্লান্ত শরীরে মেয়েটি দুরুক্তি না করে গুটিয়ে শুয়ে যায় ইনানের পাশে।

    আয়নায় নিজেকে ভালোভাবে দেখে নেয় ইনান।গতকালের সাজ পোশাক এখনো আগের মতো আছে।রুম থেকে বের হয়ে সোজা লিভিং রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। অলীদ আর সুফিয়া সেখানেই বসে আছে।ইনানকে আসতে দেখে অলীদ ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তার সন্দেহভাজন দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুচকায় ইনান।

    – তোর সমস্যা কি, এইভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?
    – তোর সাজপোশাক এখনো আগের মতো মানে রাতে কিছু হয়নি?
    – কি হবে?
    – ইয়ে আই মিন…

    অলীদ কথা শেষ করার আগেই তার পিঠে কিল বসায় ইনান।
    – আমাকে কি তোর পাগল মনে হয়?ভুলে যাবি না মেয়েটার সাথে বিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হয়নি তাছাড়া মেয়েটার ভালো মন্দ সব দায়িত্ব আমার।তাই সব দিক বিবেচনা করা একান্ত জরুরি।

    ইনানের কথায় তাল মিলায় সুফিয়া।
    – ঠিক বলেছিস তবে তোর পাঞ্জাবি পুড়লো কি করে?
    – তেমন কিছু না।দুপুর হয়ে এসেছে তোরা তোদের পছন্দ মতো খাবার অর্ডার দে ডেলিভারি ম্যান খাওয়ার দিয়ে যাবে।
    – ওকে তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।

    ইনান উপরে উঠে আবারো নিজের রুমে চলে যায়।ইতিকা এখনো ঘুমিয়ে আছে আগের মতো।ইনান আগে ফ্রেশ হয়ে এসে ইতিকার পাশে বসে।,

    – এই যে শুনছেন।এই মেয়ে,এই যে।

    ইতিকার হুশ নেই।সে এখনো গভীর ঘুমে মগ্ন।সূর্যের আলো তার মুখের সৌন্দর্য যেন বাড়িয়ে দিয়েছে।চেহারার মাঝে সরলতা গ্রাম্য ভাব তার মাঝে বৃদ্ধমান। কিন্তু কে বলবে এই মেয়ের ঘুম ভাঙ্গলে বাঘিনী রূপ ধারন করবে।
    ইনান মেয়েটির হাত আলতো ছুয়ে দেয়।নরম তুলতুলে হাতটা নিজেও ইনানের হাত আঁকড়ে ধরে।ইনান দোটানায় পড়ে যায়।নিজের মাঝে তৈরি হয় ইতস্ত বোধ।সঙ্গে সঙ্গে সে চিটকে সরিয়ে দেয় ইতিকার হাত।আকস্মিক ঝাকরায় ঘুম ভেঙ্গে যায় ইতকার।তার সামনে ইনানকে দেখে লাফিয়ে উঠে বসে।

    – আপনি?
    – আমার রুমে আমি ছাড়া, এই রুমে কাউকে দেখবেন না।যাই হোক ফ্রেশ হয়ে আসুন।ব্যাগে আপনার জামা কাপড় রাখা আছে আর বিকেলের মধ্যে আপনার প্রয়োজনীয় সব চলে আসবে।

    ইনান চলে যায়।ইতিকা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকায় মনের ঘোর কাটলে আবার চোখ সরিয়ে নেয়।

    বেশ কিছুক্ষণ পর ইতিকা ডাইনিং টেবিলের সামনে আসে।তার জন্য এতক্ষণ খাওয়ার টেবিলে অপেক্ষা করছিল সবাই।সুফিয়া ইতিকাকে টেনে ইনানের পাশে বসায়।ইনান আড় চোখে একবার মেয়েটিকে পরখ করে নেয়।আসমানি আর নীল রঙের মিশ্রণে শাড়িটিতে মেয়েটিকে অন্যরকম সৌন্দর্যে আবৃত করে রেখেছে।কোমরের নিচে চুলগুলো চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে।
    সুফিয়া সবার খাবার সার্ভ করে নিজেও বসে যায়।ইতিকার দিকে তাকিয়ে তার ভ্রু-যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে যায়।সবাই হাতে চামচ নিয়ে সহজে খাবার খাচ্ছে কিন্তু ইতিকা এইসবে অভ্যস্ত নয় তাই সবার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আবার নিজের প্লেটের দিকে একবার তাকাচ্ছে তার অবস্থা বুঝতে পেরে সুফিয়া স্মিথ হেসে বলে,

    – ইতিকা তুমি হাত দিয়ে খাও আমিও হাত দিয়েই খাবো।
    – ঠিক আছে আপু।

    মেয়েটির চোখে ভয়ের ছাপ কেটে গেছে।মুচকি হেসে নিজেও খাওয়া শুরু করে।অপর দিকে অলীদ একবার ইনান আরেকবার ইতিকার দিকে তাকাচ্ছে।তার সবকিছু গোজামিল লাগছে।ইনান বরাবরি স্টাইল,ফ্যাশন সচেতন ছেলে।তার সঙ্গে সব ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়া মেয়েদের চলাফেরা তার মাঝে এই গ্রাম্য মেয়েকে বিয়ে করার কারন সে খুঁজে পেলনা।

    __
    দুপুরের পর সুফিয়া তার নিজের বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।সুফিয়া,অলীদ এবং ইনান তিনজনের বন্ধুত্ব একটু বেশি গভীর।অলীদের বাড়ি ঢাকার বাইরে হওয়ায় ভার্সিটিতে আসা যাওয়ার সমস্যা হওয়ায় মেসে থাকতে শুরু করে কিন্তু গত একবছর ইনান তার বাবা-মাকে ছেড়ে এই ফ্লাটে উঠেছে তারপর থেকে ইনানের সঙ্গে এই ফ্লাটে আছে আলীদ।

    বসার রুমে অলীদ এবং ইনান একসঙ্গে বসে আছে তখনি নিরিবিলি পরিবেশটার ছেদ ঘটায় ইনানের ফোনের ভাইব্রেটর। বাড়ির দারোয়ানের নাম্বার দেখে তার মনে সন্দেহের বাতি জ্বলে উঠে।

    – আসসালামু আলাইকুম চাচা বলুন।

    – তুমি নাকি বিয়া করছো?তোমার আব্বা আম্মা আসছে।গেটের সামমে দাঁড়াইয়া আমারে জিগাইলো ইফতিহার ইনান থাহে কোন হানে আমিও দেখাই দিলাম।গত এক বছরে তাদের দেহা পাইলাম না আর আইজগা আইসা পড়ছে তোমার বিয়ার খবর পাইলো কেমনে?
    – তারা এখন কোথায় চাচা?
    – বাগান সাইড পার হইয়া গেসে লিফটে উঠে যাবে যে কোন সময়।

    ইনান আর দেরি করলো না দ্রুত মোবাইলটা ছুড়ে মারে সোফার উপর।অলীদকে বুঝিয়ে দেয় কেউ আসলে দরজা যেন দেরিতে খোলে।
    ইনান ঝটপট নিজের রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়।এদিকে বিছানায় উপড় হয়ে কাঁদছে ইতিকা।লেখনীতে পলি আনান
    হুট করেই তাকে টেনে দাঁড় করায় ছেলেটি।তার শাড়ির ঠিক নেই এদিক সেদিক হয়ে আছে।দ্রুত দুহাতে শাড়ি ঠিক করে ইনানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে।কিন্তু ফালাফল ব্যার্থ।

    কান্নার ফলে রক্তিম ডালিমের মতো চোখ দুটো দেখে বেশ রেগে যায় ইনান কিন্তু তা প্রকাশ করলো না।দ্রুত ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে পাউডার নিয়ে ইতিকার মুখে লাগাতে থাকে।লিপস্টিক দিয়ে রাঙাতে থাকে মেয়েটির ঠোঁট যুগল।
    – এই যে কি করছেন আপনি?পাগল হয়ে গেছেন নাকি?

    ইতিকার ধমক ইনান শুনলো না বরং বডি স্প্রে নিয়ে তার সারা শরীরে স্প্রে করলো।হাতে মোটা মোটা বালাগুলো পড়িয়ে, গলায় চোকার সঙ্গে লম্বা মোটা চেইন পড়িয়ে ক্ষান্ত হলো সে।

    ইতিকা ইনানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ায়।কিন্তু ইনান তাকে তার কাছে টেনে এনে ভেজা চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলে,

    – শুনছেন, আমার মা-বাবা আসবে মানে আপনার শশুড়-শাশুড়ী।নিশ্চিই তাদের দেখে আমার নামে নালিশ দেওয়া শুরু করবেন?

    – অবশ্যই আপনি যে আমায় জোর করে বিয়ে করেছেন তা তাদের জানানো একান্ত জরুরি।

    – এমনটা আপনি ভুলেও করবেন না ফলাফল বেশি ভালো হবে না বলে দিলাম।

    ইনানের ধমকে ইতিকা ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আরো ক্ষিপ্ত হলো,
    – আমাকে আপনি চিনতে পারেননি,কলিজা টেনে ছি-ড়ে ফেলবো আপনার।আমাকে বিয়ে করার স্বাদ মিটিতে তবেই আমি ক্ষান্ত হবো।

    ইনান মাথায় হাত দিয়ে পাইচারি করছে।কিছুক্ষণ আগে অলীদের কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে।অলীদ বলেছিল, গ্রামের মেয়েরা দেখতে সহজ সরল হলেও মোটেও তারা সহজ সরল নয় বরং তাদের মাঝে আলাদা একটি ভাব ধারা আছে।তারা ঝগড়া করতে পটু ইনানের জীবন যে এই মেয়েটা অতিষ্ঠ করে তুলবে তার আগাম বার্তা অলীদ তাকে কয়েক মিনিট আগে দিয়েছে।কিন্তু তার ফলাফল যেন খুব শীঘ্রই পেতে চলেছে ইনান।

    যখন কোন ভাবে ইতিকাকে কবজা করতে পারলো না তখন মিথ্যার আশ্রয়টা নিলো ইনান।

    – একটা কথা বলবো আপনাকে?আমার বাবার হার্টে একটা ফুটো আছে।তিনি যদি জানেন তার ছেলে এইভাবে বিয়ে করেছে তবে তার হার্টের অসুখ বাড়বে যদি তিনি এট্রাক করে বসেন আমার বাবার অসুস্থতার দায় কিন্তু আপনাকে নিতে হবে।”

    ইনানের আফসোস ভঙ্গিমার কথায় দমে গেলো ইতিকা।তীর্যক ভাবে তাকিয়ে ইনানকে বলে,

    – তবে কি করতে হবে আমায়?”

    -বেশি কিছু না শুধু বলবেন আমার আর আপনার রিলেশনের বিয়ে ছিল ব্যস এইটুকুই।

    – রিলেশনে করবো আমি তাও আপনার সাথে?

    ইতিকার ব্যঙ্গ সুরের কথায় হাত মুঠিবদ্ধ করে নিলো ইনান।দাঁতে দাঁত চেপে আরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো ইতিকার উদ্দেশ্য,
    – এর আগে বুঝি প্রেম করেন নি?

    প্রশ্নটা যেন একপ্রকার খোঁচা দেওয়া হলো ইতিকাকে।বুকের বাম পাশটায় আবারো অসহ্য ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।

    ইতিকাকে অন্যমনষ্ক দেখে তার দু’গাল আলতো ভাবে ছুঁয়ে দেয় ইনান।

    – একটা চুমু খেলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে ইতিবউ?

    ইনানের প্রশ্নে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে ইতিকার কপালে।রাগান্বিত স্বরে কিছু বলার আগেই ইনান তার গালে অধর ছোঁয়ায়।হঠাৎ স্পর্শে অন্যরকম শিহরণ বয়ে যায় মেয়েটার মাঝে।

    ইনান সরে আসে তার সামনে থেকে আবার কি মনে করে এগিয়ে যায়।মেয়েটিকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে আয়নার দিকে ইশারা করে,

    – ডানে বামে অতিতে কি হয়েছে ভুলে যান ইতিকা।আর সামনে কি হবে তাও ভাবতে হবে না আপনার।আপনি আজকের পর থেকে মাথায় এটাই ঢুকিয়ে নিন আপনি আমার ‘ইতিবউ’।’
    ইতিকা’ নামটায় ডাকতে পারবো না।তার থেকে ভালো আমি আপনাকে ছোট নামে ডাকি ‘ইতি’ আর আপনি আমার একমাত্র বউ তাই আপনি আমার ‘ইতিবউ’।

    ইতিকা শিউরে উঠলো আয়নার দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে একবার দেখে নিলো কপালের দিকটায় কাটা দাগ, গালের বাম পাশেও কিছু কাটা দাগের চিহ্ন।অদ্ভুত একটা মানুষের বিক্ষিপ্ত এতটা কাটা দাগ কি করে?আর জখম পেলো বা কি করে সে? ইতিকার ভাবনার ছেদ ঘটে ইনানের আবেগী সুরে কন্ঠের।

    – ইতিবউ আপনি কি আমার বাবা’মাকে নিজের বাবা’মায়ের আসনে বসাতে পারবেন?

    #চলবে….
    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ৩]

    কলিং বেলের শব্দে বার বার কেঁপে উঠছে অলীদ তার মাঝে তৈরি হয়েছে ভয়ের সঞ্চার।যতদিন,যতবার ইনানের বাবার সাথে তার দেখা হয়েছে প্রতিবার তাকে বকা শুনতে হয়েছে কখনো কখনো তাকে মারার জন্য তেড়ে এসেছে।তার একমাত্র কারন ইনান কেন তার মামার সঙ্গে রাজনীতিতে মেতে আছে?বন্ধু হিসেবে তারাও তো বোঝাতে পারে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ইনান এভাবে নিজের জীবনটা হেলদোল হীন ভাবে কাটানো উচিত নয়।
    একে একে টানা আঠারো বার কলিংবেল বাজার পর নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে ইনান।

    – সমস্যা কি আলীদ,দরজা খুলছিল না কেন?

    – আব…আমার ভয় লাগছে।

    – দ্রুত দরজা খোল কিচ্ছু হবে না আমি বলছি।

    অলীদ আমতা আমতা করে দরজা খুলতে গেলো।দরজা খুলে দেখে ইনানের বাবা ‘ইব্রাহিম’ আগুনের চুল্লি মুখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

    – আস…আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।

    ইব্রাহিম এবং ইনানের মা ‘নাসরিন’ সালামের জবাব নিলেন না বরং পাশ কাটিয়ে তারা ঘরে ডুকলেন।ইনানের বাবা ডানে বামে না তাকিয়ে ইনানকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সশব্দে চড় লাগায় তার গালে।

    চড়টা এতটাই জোরে লেগেছে ইনানের কান,গাল রক্তিমভাব ছড়িয়ে গেছে।চড়ের শব্দে রুম থেকে ছুটে আসে ইতিকা।মাঝ বয়সী একজোড়া দম্পত্তিকে দেখে তার বুঝতে বাকি নেই এরাই ইনানের বাবা-মা।ইতিকা ভ্রু কুচকে অলীদের দিকে তাকায় অলীদ তাকে ইশারা করছে সালাম করার জন্য।ইতিকা ঝটপট দুজনের পা ছুঁয়ে সালাম করে দাঁড়িয়ে যায়।তার মুখটা হাসি হাসি রেখে বলে,

    – আম্মা-আব্বা আপনারা বসুন।আপনাদের বেশ ক্লান্ত লাগছে।

    ইতিকার দিকে তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারলেন না ইব্রাহিম।নাসরিন মুখে আচঁল গুজে এবার কেঁদেই দিলেন

    – আমার ছেলের মাথায় ব্যামো হয়েছে গো ব্যামো।এই বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়ে করে কি বোঝাতে চাইছে সে?

    ইব্রাহিম এবার ইনানের কলার টেনে আরেকটি চড় বসিয়ে দিলো।পর পর দুটো চড়ে এবার অলীদের মুখের ভাব পালটে এসেছে।ইতিকা কি করবে বুঝতে পারছেনা।ইনানের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।ইব্রাহিম ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসে যান।তার প্রেসার বেড়ে গেছে।এসির মাঝেও সে ঘামছে।

    ডায়নিং টেবিল থেকে পানির গ্লাস এনে ইব্রাহিমের দিকে বাড়িয়ে দিলো ইতিকা।কিন্তু ইব্রাহিম হাতে তুলে নিলেন না।বরং ইতিকাকে আপাদমস্তক একবার দেখে ইনানের উদ্দেশ্য বলে,

    – এই মেয়েকে ছেড়ে দেবে তুমি আর তোমার বিয়ে করার শখ হয়েছে?বেশ আমরা মেয়ে খুঁজে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো।

    – সরি, বিয়ে যখন একবার করেছি তখন ছেড়ে দেওয়ার জন্য করিনি ;সংসার করবো বলেই করেছি।
    – এই বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে সংসার করবে তুমি?মাই গুড নেস।

    – সে বাচ্চা নয় তোমাদের থেকেও সেয়ানা।

    ইনানের কথার উলটা পিঠে আর কথা বললেন না ইব্রাহিম।রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে কিছুক্ষণ পর বলেন,

    – কার অনুমতিতে বিয়ে করেছো তুমি?কে দিয়েছে বিয়ে করার অনুমতি।

    – আমি মামুকে বলেই বিয়ে করেছি।আপনাদের আপত্তি থাকলে আমার বাসা থেকে চলে যান।

    ইনানের কথায় স্পষ্ট রাগ ।ছেলের এমন অপমান সূচক ব্যবহারে চমকে যায় ইব্রাহিম এবং নাসরিন।নিশ্চুপ দু’চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে নাসরিন।তখনি ইনানের বুকে কেউ ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।টাল সামলাতে না পেরে ইনান ছিটকে দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খায়।ইতিকা কোমড়ে হাত গুজে রাগি সুরে তাকিয়ে আছে ইনানের দিকে।

    – খবরদার বলে দিচ্ছি বাবা মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না।দাঁত থাকতে আপনি দাঁতের মর্ম বুঝতে পারছেন না।

    ইতিকার শাসানো কথায় উপস্থিত সবাই নিশ্চুপ অবাক।ইনান কিছু বলার জন্য এগিয়ে আসলে আবারো ইনানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ইতিকা।

    – আম্মা-আব্বাকে সরি বলুন।আমার মতো যদি এতিম হতেন তবে বুঝতে পারতেন দুনিয়া কোন নিয়মে চলে এখন তো বাবা মায়ের হোটেলে চলে তেল মাখাচ্ছেন শরীরে।

    ইনান কি বলবে বুঝতে পারছেনা।তবে ইব্রাহিম এবং নাসরিন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।ইনান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আদেশ সুরে বলে,

    – রুমে যাও ইতিকা।
    – যাবো না।
    – যেতে বলেছি আমি।
    – তো?

    ইতিকার আচরণে রাগ সামলানো দায় হয়ে পড়েছে ইনানের।তাই তাকে টেনে হিচড়ে রুমে বন্দি করে দেয়।আজকের পরিস্থিতিতে তাজ্জব বনে গেছেন ইনানের বাবা মা দুজনেই।তাই দু’বাক্য না করে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

    __
    গায়ের শার্টটা এক টানে ছিড়ে ফেলে ইনান শরীর জুড়ে ভয়ংকর রাগের সঞ্চার হয়েছে।কাকে রেখে কাকে মারবে সে বুঝতে পারছেনা।ইচ্ছে করছে ইতিকাকে দু’চড়ে অচেতন করে দিতে।অলীদ তার দিকে তাকিয়ে আছে চঞ্চল দৃষ্টিতে।

    – অলীদ সিগারেট দে।
    – এ..এখন?
    – দিতে বলেছি দিবি ডোন্ট টক।

    অলীদ সিগারেটটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে।সিগারেট ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই ফোনের স্কিনে তার মামুর নাম্বার দেখে ভ্রু কুচকে গেলো।বিনা বাক্যে ফোন রিসিভ করে জানতে পারে তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছেন।

    .
    বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশটার দিকে বিষন্নতার চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে ইতিকা।নিস্তব্ধত মূহুর্তে হুট করেই সে অনুভব করে তার উন্মুক্ত পেটে কারো নখের আঘাত বেশ তীব্র ভাবে লাগছে।ধীরে ধীরে নখ দেবে যাচ্ছে তার মাংসপিন্ডে।ইতিকা স্থির থাকলো না তড়িৎ গতিতে পেছনে ঘুরে তাকাতেই তার মুখটা কেউ হাতের তালুতে চেপে ধরে।

    – খবরদার চিৎকার করবে না ইতিবউ।

    ইনানের আদেশ বাক্য ইতিকা মান্য করলো না বরং ছুটাছুটি দ্বিগুণ বাড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।তীব্র ব্যাথায় পেটের অংশটা যেন অবশ হয়ে আসছে তার।শ্বাস নেওয়া ধীরে ধীরে কমে আসতেই ইনান একটানে তাকে বক্ষঃস্থল ঝাপটে ধরে।

    – কেমন দিলাম?একটু ছোঁয়ায় কুপকাত।আমার সাথে লাগতে এসো না ইতিবউ, পরিণাম খুব ভয়ংকর হবে।

    – আপনার ছোঁয়া বড্ড বাজে,বিশ্রী,একদম জঘন্য।
    – তবে কি ওয়াসিমের ছোঁয়া সুমিষ্ট ছিল ইতিবউ?

    ইনানের প্রশ্নে বিষ্ফরিত নয়নে তাকায় ইতিকা।বুকের ভেতর ধরাস ধরাস শব্দ আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।শ্বাস উঠা নামার ছন্দটা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।ইনানের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে প্রশ্ন ছোড়ার আগেই কানে আসে ইনানের আদেশ বাক্য।

    – কোন কথা নয়।মুখটা কন্ট্রোল করো।মামু আসছে তোমার দুরুক্তি কথা বার্তা কিঞ্চিৎ পরিমানে তার কানে পৌঁছালেও বিপদ তোমার জীবনে ঘনিয়ে আসবে।তাই বার বার সাবধান করছি নতুন বউয়ের মতো ব্যবহার করো।লজ্জায় নুইয়ে থাকো সাহসিকতার পরিচয় আমি তোমার কাছ থেকে আপতত চাইছি না।দ্রুত শাড়ি ঠিক করে বাইরে এসো।

    ইতিকা তাজ্জব বনে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনানের দিকে। ওয়াসিম’কে কি করে চেনে এই লোকটা?আর জানেই বা কি ভাবে ওয়াসিমের সাথে ইতিকার সম্পর্ক আছে?
    .
    ইনানের মামা বাহরুল ইসলাম বেশ কিছুক্ষণ পরেই ফ্লাটে উপস্থিত হয়।তিনি ইতিকার আচরণে ভালো ভাবেই বুঝে নিয়েছেন মেয়েটি বিয়েতে এখনো রাজি নয়।ইতিকার ত্যাড়ামো স্বভাবটা বেশ ভালো ভাবেই লক্ষ্য করেছেন তিনি।লেখনীতে পলি আনান। এদিকে বাহরুল ইসলামের সামনে ইতিকার এমন দুরক্তি ব্যবহারে লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয় ইনান।ইতিকার হাতে উপহার হিসেবে ভারী গহনার বাক্সটা হাতে তুলে দিতেই তা গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানায় সে।

    এতে বেশ অপ্রতিভ অবস্থায় পড়ে ইনান এবং বাহরুল ইসলাম।যাওয়ার আগে ইনানের মামু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

    – মেয়েটা সুবিধার নয় ইনান।সাবধানে থাকিস গ্রামের মেয়ে তোকে মারতেও দু-বার ভাববে না।আজকের ব্যবহারটা তার কাছে আশা করিনি।

    – তুমি কিছু মনে নিও না মামু সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি সব ঠিকঠাক ভাবে সামলে নেবো।

    – হুম।
    .

    গয়নার বাক্স গুলো বিছানায় ছুড়ে ফেলে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে কাদঁছে ইতিকা।ইনানের মুখে তার প্রেমিক ওয়াসিমের কথা শুনে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তার।দুঃখের জীবনে তার একমাত্র সঙ্গী ওয়াসিম বেশ কয়েকবছর থেকেই তাকে চেনে জানে তবে প্রেমিক হিসেবে সম্পর্কটা মাত্র সাড়ে সাত মাসের।এই সাতমাসে যেন ইতিকার জীবনে নেমে এসেছে স্বর্গীয় সুখ।সেই সুখের ভাটা হয়ে তার জীবনে নতুন করে আগমন ঘটলো “ইফতিহার ইনান” নামক ব্যাক্তিটির।

    সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত ইনান।ইতিকাকে শায়েস্তা করার কোন কলাকৌশল খুঁজে পাচ্ছে না সে।তার অবস্থা বুঝতে পেরে অলীদ ক্ষীণ স্বরে বলে,

    – ইতিকাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করিস না দোস্ত।ছোট মেয়ে হয়তো এইভাবে বিয়েটা মেনে নিতে পারছেন না।

    – ছোট মাই ফুট!কিসের ছোট মেয়ে?এই টুকুনি মেয়ে সাত মাস ধরে প্রেম লীলায় জড়িত আর তোর কাছে তাকে ছোট লাগছে?সে বয়সে ছোট বুদ্ধিতে নয়।

    ইনানের গমগমে কথায় বাকরুদ্ধ অলীদ।সোফায় বসে দু’হাত দিয়ে মুখ ঠেকে কিছুক্ষণ মেঝেতে তাকিয়ে রইলো।তার অবস্থা যে এখন শকে আছে তা বুঝতে পেরে বাঁকা হাসে ইনান।অলীদ স্থির কন্ঠে ইনানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

    – তুই জানিস সে প্রেম করে তবুও মেয়েটাকে বিয়ে করলি কেন?

    – কার সাথে প্রেম করছে আগে সেটা তো শুনবি।

    অলীদ বা’ভ্রুটা কুচকে বলে,

    – কার সাথে?

    – আমাদের পরিচিত মুখ “ওয়াসিম হাসনাত” তার সঙ্গে।

    ইনান হাসতে থাকে।কিন্তু মূহুর্তেই মাথায় রাগের সঞ্চার হয়েছে অলীদের।

    – হোয়াট?তুই পাগল হয়ে গেছিস?নাকি ওয়াসিম পাগল হয়েছে?ক্লাস নাইনে পড়ুয়া একটি মেয়ের সাথে প্রেমে মশগুল ওয়াসিম কুত্তা*টা আর তুই ডাইরেক জোরজবরদস্তির করে বিয়ে করেনিলি।

    – এতকথা তোকে বুঝতে হবে না আগে মেয়েটাকে শায়েস্তা করে আসি।

    – কি করবি তুই?খবরদার বাড়াবাড়ি করবি না বলে দিলাম।

    – অলীদ তুই ভালো করেই জানিস আমি অবাধ্য ছেলে নিজের মর্জি মত চলাফেরা করি সেখানে তুই বারন করলেও আমি তোর কথা শুনবো না।সো গুড বায়।

    – ইনান….

    ইনান একছুটে নিজের বেডরুমে প্রবেশ করে, সেখানে স্থির হয়ে মেঝেতে বসে কাদঁছে ইতিকা।ঢেউখেলানো চুলগুলো একপাশটায় দলাপাকিয়ে আছে যার ফলে তার উন্মুক্ত পিঠ সহজে ইনানের চোখে পড়ে আর তা দেখে স্থির চিত্তে তাকিয়ে রইলো সে।হুট করেই অবাধ্য মন তাকে জানান দিচ্ছে এই মেয়েটি তার বিবাহিত স্ত্রী,তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার অধীকার ইনানের আছে।আর সেই অধীকার প্রশ্রয় দিয়ে ইতিকার কাছে এগিয়ে যায় সে।তখনি তার কানে আসে তার ইতিবউ ফ্যাচফ্যাচ করে কাদঁছে।

    ইনান রাগ জেদ ভুলে ইতিকার সামনে হাটু মুড়ে বসে,
    – কাদঁছেন কেন?

    ইনানের প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায় সে।

    – আপনি এটা কেন করলেন?আমি ওয়াসিমকে ভালোবাসি অথচ আপনি সবটা জেনে আমাকে বিয়ে করেছেন?ওয়াসিমের চেয়ে আমাকে কেউ ভালোবাসতেও পারবে না আর কেউ ভালো রাখতেও পারবেনা।

    নিভন্ত রাগটা চড়া দিয়ে উঠেছে ইনানের মাথায়।কোন স্বামী কখনোই চাইবে না তার স্ত্রী অন্য পুরুষের জন্য তার সামনে চোখের জল বিসর্জন দেবে।

    – আমি তোমার বিবাহিত স্বামী অথচ আমার সামনে তুমি অন্য পুরুষের জন্য চোখের জল ফেলছো?আর এদিকে আমায় ছুড়ে দিচ্ছো অবহেলা।

    – আমি তো এই বিয়ে মানি না সরে যান আমার সামনে থেকে।

    ইতিকা ইনানের বুকে ধাক্কা দিতেই সে কিছুটা দূরে পিছিয়ে যায়।তার আচরণে ইনানের মাঝে অপমান বোধের সৃষ্টি হয়।ইনান একটানে দাঁড় করায় ইতিকাকে।

    – আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

    – আমার সাথে সংসার করার পূর্ব শর্ত হলো তোমার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।

    – আমি আপনার সঙ্গে সংসার করতে চাই না।

    ইনান ইতিকার হাত টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।নব ঘুরাতেই ঝরণার পানি ভিজিয়ে দিতে থাকে তাকে।বেশ কিছুক্ষণ পর ইনান ইতিকাকে বাইরে এনে ফ্লোরে ছুড়ে মারে।

    – আজ আমি বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত পুরো ঘর অন্ধকার থাকবে আর জানলা খুলেও লাভ নেই এত উপরে তোমার ল্যাম্পপোস্টের আলো পৌছাবে না।

    বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায় ইনান।এদিকে নিশ্চুপ চোখ বন্ধ করে রাগ সামলাতে ব্যস্ত ইতিকা।

    #চলবে…
    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ৪]

    – বিয়ের কারনটা এখনো আমাদের তুই ব্যাখ্যা করিস’নি ইনান।এবার তুই সোজাসাপটা বলবি এই বিয়েটা করার কারন কি?

    ওয়াইনের বোতলটা বেশ শব্দ করেই টেবিলের উপর রাখলো ইনান।সুফিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার তার ইচ্ছে নেই তাই আবারো চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছ।

    – প্লিজ এইভাবে চুপ থাকিস না।তুই এমন কেন করলি?এত বেপরোয়া কেন তুই?আঙ্কেল আন্টিকে জানিয়ে হলেও বিয়েটা করতে পারতি।

    ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।বরং অলীদ সুফিয়ার পাশে বসে আফসোস ভঙ্গিতে বলে,

    – আগামীতে কিছু একটা হবে।

    – কী হবে?

    – যুদ্ধ!এই যুদ্ধে তুই আমি দুজনেই ফেঁসে যাবো আর ওই কুত্তা ইনান তো ডাইরেক মারা পড়বে।

    – মানে কি?

    – ইতিকা মেয়েটি আমাদের টপ শত্রু ওয়াসিমের গার্লফ্রেন্ড।

    অলীদের কথা শুনে সারা শরীরে ঝলকানি দিয়ে উঠে সুফিয়ার।দু’হাতে মাথা চেপে ধরে গোপনে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে থাকে।

    – এটা কিভাবে সম্ভব।এই মেয়ে প্রেম করছে?আর মেয়েটার বয়স মাত্র ১৬।আমার জানা মতে ক্লাস নাইনে পড়ছে।

    সুফিয়ার কথায় হো হো করে হেসে উঠে ইনান।হাতের সিগারেট ছুড়ে ফেলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলতে থাকে,

    – মেয়েটা তোর থেকেও দু’গুন বেশি সেয়ানা।ওয়াসিমের কাছে আসতে পারে, হাতে হাত রেখে চলতে পারে আর আমি বিয়ে করায় গায়ে কলঙ্ক লেপ্টে গেছে?

    – বিয়ে করা আর গার্লফ্রেন্ড হওয়া দুইটা কি এক?তোর উপর আমার বিশ্বাস নেই কখন কি করে ফেলবি।

    সুফিয়ার কথায় এবার বেশ রেগে গেলো ইনান।টেবিলের উপর শব্দ করে হাত রেখে বলে,

    – শেট আপ,আমার বউয়ের কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ আমি জানি।তাই তোদের কাছ থেকে জ্ঞান নিতে আসবো না।আরেকটা কথা ইতিকার বয়স ১৬ নয়, ১৭ বছর ১০ মাস।আর ১৬ বছর যে জন্ম নিবন্ধনটা আছে ওটাতে বয়সের হেরফের করা আছে।তার মায়ের মৃত্যুর কারনে পড়াশোনার বাধাগ্রস্ত হয়।কিছু দিন পরেই ইতিকার আঠারো বছর পূর্ণ হবে এখন আশা করি এই বিষয় নিয়ে তোদের মাথা ব্যথা নেই তোদের।

    ইনান আবারো চেয়ারে বসে ওয়াইনের বোতলে চুমুক লাগায়।মাথায় ঝিম ধরে গেছে।সুফিয়া অলীদকে শান্ত থাকতে ইশারা করে।বেশ কিছুক্ষণ তাদের মাঝে নিরবতায় কেটে যায়।

    – সবটা বুঝলাম কিন্তু এত মেয়ের মাঝে ওয়াসিমের গার্লফ্রেন্ডকে বউ বানানোর বিষটি বুঝলাম না।

    – সব কথা বোঝার দরকার নেই তোদের।

    ..

    ফ্লাটের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ভয়েরা আঁকড়ে ধরলো অলীদকে।চারিদিকে অন্ধকার আচ্ছন্ন।এই ফ্লাটে গত এক বছর যাবৎ আছে সে কোনদিন এত অন্ধকার করে রাখেনি ইনান তবে আজ ঘরের লাইটগুলো বন্ধ কেন?তাছাড়া ইতিকা কোথায়?
    ইতিকার কথা মাথায় আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় অলীদ।
    – ভাবী কই?আর ঘর এত অন্ধকার কেন?

    – রুমে আছে।

    – কিন্তু তুই মেইন সুইচ বন্ধ করে গেলি কেন?এত বিতিকিচ্ছি তুই কি করে করিস বলতে পারবি?

    ইনান জবাব দিলো না।হঠাৎ করেই ঘর জুড়ে সব লাইট আগের মতো জ্বলে উঠলো।
    বেশ রাত হয়ে গেছে এতক্ষণে হয়তো ইতিকা ঘুমিয়ে গেছে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইনান বেড রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করতেই থমকে যায়।ভেজা কাপড়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মেয়েটি।দু’গাল রক্তিমভাব ছড়িয়ে আছে।আরক্তনয়নে একপলক তাকায় ইনানের দিকে।
    তার দৃষ্টির ভাবগাম্ভীর্য বুঝতে পেরে গলা খেকিয়ে উঠে ইনান।

    – এত নাটকের মানে কি?আপনি জামা কাপড় চেঞ্জ করেন’নি কেন?মানলাম আমি বকেছি তাই বলে ভেজা শরীরে…

    ইনান এগিয়ে এসে ইতিকাকে ছুঁয়ে দেয়।সারা শরীর প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে আছে।

    – ইতিবউ দ্রুত চেঞ্জ করে আসুন।
    -…………
    – আজব কথা বলছেন না কেন?
    -…….
    – আমি উঠতে বলেছি আপনাকে।

    ইতিকা কথা শুনলো না বরং রাগ দেখিয়ে বসে রইলো।ইনান একটা সময় বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো ভাবে পরখ করে।মেয়েটার উপর বার বার রেগে যাচ্ছে সে, কি করে সামলাবে এই রাগ।লেখনীতে পলি আনান।এদিকে নেশাটা যেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে,মাথাটা ভারী ভারী অনুভব হচ্ছে।

    – লাস্ট বার বলছি আপনি ওয়াশরুমে যাবেন এবং ড্রেস চেঞ্জ করবেন।

    ইতিকা গেলো না।বরং ঠায় বসে রইলো আগের মতো।রাগের মাত্রাটা যোগ হয়েছে এবার বেশামাল ভাবে।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো সে।

    তৎক্ষনাৎ রুম জুড়ে ছড়িয়ে যায় বিকট শব্দ।শব্দের তোড়ে অলীদ বিছানা থেকে এক লাফে উঠে বসে।

    ইতিকা নিরবতা ঘুচে শব্দ করে কেঁদে উঠে।মেঝেতে আয়নার টুকরো গুলো ছড়িয়ে আছে।গলগল করে রক্ত ঝরছে ইনানের ডান হাত থেকে।

    – আপনি এখনো যাবেন না ইতিবউ?

    ইতিকার জামকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।অপরদিকে অলীদ জোরে জোরে দরজায় করাঘাত করছে। রক্তাক্ত হাতটা চোখের সামনে এনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইনান।আফসোস সুরে ফিসফিস করে বলে,

    – আমায় কি একটুও শান্তি দেবেন না ইতিবউ!

    .
    – এই রাগ,জেদ বেহায়াপনা তোর কি কোন দিন কমবে না?বিয়ে হয়েছে এবার একটু শান্ত থাক মানুষের মত ব্যবহার কর তোর আচরণ আমার কাছে রাস্তার কু*ত্তার থেকেও খারাপ লাগে।হাতের কি জঘন্য অবস্থা করেছিস তুই।কাল সকালে ডাক্তারের কাছে যাবি।

    অলীদ রাগ ঝারতে ঝারতে ইনানের হাতে ব্যান্ডেজ করছে।ইতিকা চুপসে দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।রুমের একপাশে কাঁচের ছড়াছড়ি।এই মূহুর্তে তার কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে।লোকটাকে তার আগে থেকেই রাগী কপট মনে হতো কিন্তু এখন একটা পাগলা,উম্মাদ মনে হচ্ছে।রাগ দেখিয়ে কেউ কাঁচে ঘুষি দেয়?এইভাবে হাতের বিশ্রী অবস্থা করে?আর প্রত্যেক বার রাগ দেখিয়েই কি মানুষটার গায়ে এত কাটা-সেলাইয়ের দাগ!মানুষটা আসলেই অদ্ভুত। কিন্তু এই অদ্ভুত মানুষটা কেন তার জীবনে ইতিকা নামক সরল সোজা মেয়েটার জীবন জুড়ে নিয়েছে?

    প্রশ্নগুলো ঘুরে ফিরে ইতিকার মস্তিষ্কে বার বার হানা দিচ্ছে কিন্তু সঠিক উত্তর পাওয়া এখনো হলো না।

    অলীদ ব্যান্ডেজ শেষে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে ইতিকার উপর।

    – ভাবী শুনছেন?

    ‘ভাবী’ শব্দটা শুনেই অপ্রতিভ অবস্থায় পড়ে যায় ইতিকা।ফ্যালফ্যাল চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে অলীদের দিকে।অলীদ গলা ঝেরে আবারো দৃষ্টি রাখে ইতিকার দিকে,

    – ভাবী আপনাকেই বলছি, শুনছেন আপনি?

    – জ..জী বলুন।
    – আপনি আজ পাশের রুমে ঘুমান।গতকাল সুফু যেখানে ঘুমিয়েছে।ইনানকে বরং আজ একা থাকতে দিন।

    অলীদের কথা শেষ হতেই ইনান দুজনের উদ্দেশ্য গম্ভীর স্বরে বলে,

    – বিয়ে করেছি বউকে পাশের রুমে রাখতে নয়।অলীদ তুই এখন রুম থেকে যা।অন্য কেউ যেন ভুলেও এই রুম থেকে যাওয়ার দুঃসাহস না করে, হিতাহিত ফল ভালো হবে না।

    অলীদ উঠে দাঁড়ায় ইতিকাকে থাকতে ইশারা করে নিজে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।

    .
    গভীর রাতে ইনান বারান্দায় বসে আছে।হিমেল হাওয়া শরীরে অন্যরকম শিহরণ জাগিয়ে তুলছে।হাতের টনটন ব্যথা তীব্র ভাবে বৃদ্ধ পেলেও সে একদম স্থির ভাবে সিগারেট ফুঁকছে।এমন কত শত জখম যে সে পেয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।তার তুলনায় এই জখমটি তুচ্ছতম।

    সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় বাইরে।ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটায় প্রবেশ করে বিছানার পাশে টেবিলে রাখা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয়।বেশ খানিকটা আলো আছড়ে পড়ছে ঘুমন্ত ইতিকার মুখে।সেদিকে তাকিয়ে স্মিত হাসতে থাকে ইনান।

    – ইতিবউ আগে তুমি ছিলে আমার টোপ,এরপর অদ্ভুত ভাবে সব পালটে গেলো।এখন সব কিছুর উর্ধে তুমি আমার ভালোবাসা।আর ভালোবাসার যত্ন করতে হয়, না হলে হারিয়ে যায়।আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টায় তোমায় আগলে রাখবো।
    _

    সকাল সকাল ফ্লাটে সুফিয়ার আগমন মোটেও সুবিধা লাগেনি অলীদের কাছে।তার দিকে তাকিয়ে বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়লো অলীদ,

    – তুই এত সকাল এখানে কি করস?
    – ইনান আমায় আসতে বলেছে।
    – কিন্তু কেন?
    – তা জানি না।

    দুজনের মাঝে আবার নিরবতা।কিছুক্ষন পরেই ইনান এসে তাদের সামনে বসে এবং সুফিয়াকে ইশারা করে বলে,

    – ইতিকার দায়িত্ব অর্ধেক তোর উপর ছেড়ে দিলাম।

    – আমার উপর?মানে কি?

    – ইতিকাকে স্কুলে ভর্তি করাবি।এই শহরে চলতে হলে,আমার সঙ্গে থাকতে হলে ঠিক যা যা অভিজ্ঞতা প্রয়োজন সব তোর দায়িত্ব।ওর জন্য আলাদা ম্যাডাম ঠিক করবি পড়ানোর জন্য।

    ইনানের কথা শেষ হওয়ার আগেই চটপট উত্তর দিলো অলীদ।

    – দোস্ত তোর সাথে থাকতে হলে মেয়েটাকে আগে যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা অর্জন কর‍তে হবে।দুই, চারটা লাশ তার সামনে পড়লে যেন অজ্ঞান না হয় তাই কলিজা শক্ত রাখতে হবে।কিন্তু মেয়েটার কাল তোর হাত কাঁটা দেখে যে অবস্থা হয়েছে মনে তো হয়না তোর সাথে যেকোন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে সে টিকে থাকবে।

    – শেট আপ!

    ইনান বেশ জোরেই ধমক দেয় অলীদকে সঙ্গে সঙ্গে চুপসে যায় সে।

    _

    আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করছে ইনান।তাদের বিবাহিত জীবনের অষ্টম দিন আজ।এই কয়েকদিন বেশ ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে তার উপর।ইতিকাকে স্কুল ভর্তি নিয়ে ছিল বেশ তোষামোদ।
    গতকাল থেকেই নতুন স্কুলে পড়াশোনা শুরু হবে তার।
    গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আয়নার দিকে তাকায় ইনান।সেখানে ভেসে উঠে ভেজা চোখ দুটি নিয়ে তাকিয়ে থাকা কিশোরীর দিকে।

    – ইতিবউ কাদঁছেন কেন আপনি ?

    – এই কয়েকদিনে আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভালোর জন্য সব ব্যবস্থা আপনি করছেন কিন্তু আপনি কি এটা ভেবে দেখছেন না,সব কিছু ভালোর জন্য করলেও আপনি আমার ভালো থাকাটাই কেড়ে নিলেন।

    ইতিকার কথায় ইনানের কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়ে।

    – কি সমস্যা আপনার?
    – আপনি ওয়াসিমকে কি করে চেনেন?
    – সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি।
    – ওয়াসিম আমার হবু বর!

    – মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলুন ইতিবউ।সে আপনার প্রাক্তন।ভুলেও স্বামি বানাতে যাবেন না।

    – আপনার আগে সে আমার জীবনে এসেছে আর আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু আপনি মাঝে ডুকে সব ভেস্তে দিয়েছেন।

    – ওহ আচ্ছা তাই নাকি?এতই টান বুঝি প্রেমিকের জন্য?তা বিয়ের সাপ্তাহ পার হয়ে গেলো আপনার প্রেমিক কোথায়?

    – সে দেশের বাইরে আছে।ফ্যামিলি বিজনেসে।

    – ওহ তাই নাকি? নাকি বিয়ে করে সংসার করছে?

    – মানে?

    ইতিকা চমকে তাকায় ইনানের দিকে।ইনান হাসতে হাসতে নিজের ফোন হাতে তুলে ইতিকার সামনে তাক করে।ইতিকা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়।ওয়াসিম একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাসছে।ছবিটি দেখে দোটানায় পড়ে যায় ইতিকা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ইনান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

    – কার জন্য আমাকে অপমান,অবহেলা করছেন?ওয়াসিম বাগদত্তা।বিদেশে সে ফ্যামিলি বিজনেসে যায়নি বরং বিয়ে করতে গেছে।আর তুমি তো ছিলে তার ভো…. থাক আর কিছু বলবো না।মন দিয়ে পড়াশোনা করুন।

    ইনান শার্টের কলার ঠিক করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ঠিক সেই মূহুর্তে মুখে হাত ঘুঁজে কেঁদে দেয় ইতিকা
    ।ইনানের কানে ইতিকার কান্নার শব্দ আসতেই আবারো দৌড়ে রুমে ফিরে আসে,

    – অন্য কোন উপপতির জন্য কাদঁতে হলে রাস্তায় যান।আমার বাসায় এইসব আমি সহ্য করবো না।মাইন্ড ইট।

    ইনানের কথায় কোন হেলদোল নেই ইতিকার বরং আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠে সে।

    #চলবে….
    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌/

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১১]
    _________
    আম্মা রাত নয়টা বেজে গেল তিনি কি তবে আসবেন না?আমার চাওয়া পাওয়ার দাম যে তার কাছে নেই আগেই জানতাম আমি।

    ইতিকার কথায় নাসরিন স্মিথ হাসলেন।হুঠ করে তার চোখ দুটো অশ্রু কণায় ভরে গেছে।ইতিকার দিকে তাকিয়ে আশ্বাস সুরে বলে,

    – আরেকটু দৈর্য্য ধর মা।আসলেও তো আসতে পারে।

    নাসরিনের কথায় বিদ্রুপের হাসি হাসলেন ইনানের বাবা ইব্রাহিম।

    – জন্মদিনে মেয়েটা আবদার করেছিল আজকে অন্তত এই বাড়িতে আসতে কিন্তু সে আসেনি।কোন কুলাঙ্গার জন্ম দিলাম আমরা!ইতিকা মা তুই কেক কাঁ/ট সে আসবে না আর।রাত দশটা পার হয়ে যাচ্ছে।

    তাদের তিনজনের আফসোস দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয় অলীদ এবং সুফিয়া।ইতিকার আবদারেই তারা আজ এখানে এসেছিল কিন্তু ইনান আসেনি।

    – আব্বা আমি কেক কাটবো না। আপনারা কেটে খেয়ে নিন আমি ঘুমাতে গেলাম।

    ইতিকা উঠে দাঁড়ায় দরজার দিকে আরেক পলক তাকিয়ে অভিমান করে নিজের রুমে চলে যায়।

    ইনান আসে বেশ কিছুক্ষণ পরেই।তাকে দেখে বাড়ির সকলেই স্থির মূর্তির ন্যায় তাকিয়ে থাকে।এক পা দু পা এগিয়ে এসে ইব্রাহিমের পা ছুঁয়ে সালাম করে ইনান।কতদিন পর বাবার মুখোমুখি হয়েছে একদম সব রাগ, অভিমান ঝেরে।

    – কেমন আছো বাবা?

    ইফতিহার ইব্রাহিম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না।ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু জল বিসর্জন দিতে থাকেন।বেশ কিছুক্ষণ বাবা, ছেলের কান্না শেষে ইনান সুফিয়াকে ইশারায় বলে ইতিকার কথা।

    – ইতিবউ কোথায় সুফু?

    – তোর বউ অভিমান করে উপরে চলে গেছে।

    – যা নিয়ে আয়।

    বেশ কিছুক্ষণ পর সুফিয়া ইতিকাকে নিয়ে নিচে নামে।ইনানকে দেখে স্থির চিত্তে তাকিয়ে রইলো সে।ইনানো তার সাথে ভাব দেখিয়ে আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলেনি।পুরো অনুষ্ঠানটাই শেষ হয় দুজনের বাক্যহীন ভাবে।
    .
    রাতের গভীরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।ইনান বারান্দায় বসে সিগারেটের ধৌঁয়া উড়াতে ব্যস্ত।কত মাস পর সে ফিরে এসেছে তার কোন ইয়াত্তা নেই।ইতিকা গুটিগুটি পায়ে এসে ইনানের পেছনে দাঁড়ায়।তার অবস্থা বুঝতে পেরে স্থির কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ইনান।

    – কিছু বলবেন ইতিবউ?

    – ন…না।

    – যান ঘুমান।অনেক রাত হয়ে গেছে।

    – আপনি ঘুমাবেন না?

    – আপনার কোলে যদি আমার মাথা রাখার ঠাই হয় তবেই ঘুমাবো।হবে কি?

    ইনানের নিঃসংকোচ আবেদনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইতিকা।’হা’ নাকি ‘না’ কি বলবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।মন তো চাইছিল একবার বলি আসুন আমার কোলে মাথা রেখে চিন্তাহীন,তন্দ্রায় আচ্ছন্ন থাকুন।কিন্তু কোথায় যেন বাঁধা দিল মন।

    নিজের সাথে নিজেই যুক্তিতর্কতে পেরে না উঠে ইতিকা রুমে চলে যায়।অপরদিকে তার এমন সংকোচ অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে ইনান।

    বেশ কিছুক্ষণ পর ইনান রুমে ডুকে।ইতিকা তখনো বসে বসে টেলিভিশন দেখছে মন দিয়ে।ইনান একবার টেলিভিশনের দিকে তাকায় আরেকবার ইতিকার দিকে।টম এন্ড জেরি কার্টুন এত মনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে বুঝলো না সে।
    ইনান ঝটপট ইতিকার কোলে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে শুয়ে যায়।

    – আপনি…
    – এত রাতে জেগে আছেন কেন?আর এই কার্টুন মমনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে?

    – আপনার ঘুম পেয়েছে?বিছানায় ঘুমান।

    – কেন আপনার কোলে ঘুমালে কি জাত চলে যাবে?

    ইতিকা উত্তর দিলো না।আবারো মন বসালো কার্টুনের দিকে।ইনান বিরক্ত হয়ে রিমোট’টা নিয়ে টিভি অফ করে দিলো।

    – ইতিবউ যখন আমি আপনার পাশে থাকবো ধ্যান- ধারণা,মনোনিবেশ সব আমাকে ঘিরে হবে।শুধু আমাকে।বুঝতে পারছেন?

    – কেন এটা কি আপনার সাথে সংসার করার রুলস?

    – যদি বলি তাই।আর এই রুলস সারাজীবনের জন্য মানতে হবে আপনাকে।

    ইতিকা জবাব দিল না।চুপচাপ ইনানের চুলে হাত বুলাতে থাকে।

    – একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?

    -কী প্রশ্ন ইতিবউ?

    – আমাকে সবসময় ‘আপনি’ ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন কেন?শুধুমাত্র গতকাল রাগের মাথায় ‘তুমি’ বলেছিলেন।

    ইতিকার প্রশ্নে লীন হাসে ইনান।

    – তুমি আমায় যেভাবে শাসন করো,ধমক দাও,আদেশ ছুড়ে দাও তাতে মনে হয় তুমি আমার বড়।মনে আছে বিয়ের দিন জলন্ত উত্তপ্ত আগুনের মতো রাগ নিয়ে জানতে চেয়েছিলে মাত্র ১৬ বছর বয়সী একজকে বিয়ে করছেন সাক্ষী হিসেবে আমার মা-বাবা কোথায়। সেদিনি আমি বুঝে নিয়েছি তুমি তো আমাকে এক ইশারায় সোজা করার ক্ষমতা রাখো।প্রথম প্রথম রাগ দেখিয়ে আপনি বলেছি কিন্তু এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

    – তাই নাকি?আমার কোন কথা আপনি কী শুনেন?

    – যদি তোমার কথা না শুনতাম তবে আজ এই বাড়ির চৌকাঠে কখনোই পা মাড়াতাম না।

    – আম্মা ঠিকি বলে বেপরোয়া ছেলেদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া উচিত।বউয়ের মায়ায় পড়ে ঠিকি ঘর সংসারে মনোনিবেশ করবে।

    – তাই নাকি তোমার আম্মা আর কি কি বলেছে?

    – বলেছে বলেছে অনেক কথা বলেছে এবার বালিশে মাথা রাখুন আমি ঘুমাবো।

    – পরে ঘুমাবে আগে আমার কপালে তোমার ওই নরম ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দাও।

    ইনানের বেখাপ্পা কথায় লজ্জায় নুইয়ে যায় ইতিকা।ইনানের নিঃসংকোচ আবেদন সে মান্য করতে নারাজ।

    _

    বাহরুল ইসলাম আজ বেজায় চটে আছেন।এতটাই রেগে আছেন যে ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় পানি ঢালতে ব্যস্ত সে।তার স্ত্রী রোশনী হন্তদন্ত হয়ে রুমে ডুকেন।

    – আরে পাগল হয়ে গেছো তুমি?মাথায় এমন মগ ভর্তি পানি ঢালছো কেন?

    – আমার সব জল্পনা-কল্পনা ধীরে ধীরে মাটি হয়ে যাচ্ছে রোশনী স্থির থাকবো আমি কি করে?

    – কি হচ্ছে, না হচ্ছে তা পরের কথা।নিচে চলো সাহাব ভাইজান এসেছে।

    – হোয়াট?শক্রু আমার ঘরে চলে এসেছে।সাহাব কেন এসেছে কিছু বলেছে তোমায়?

    – না।তোমায় শীঘ্রই নিচে যেতে বলেছে।

    .
    বাহরুল ইসলাম মাথা মুছে নিচে চলে যায়।সাহাব উদ্দিন তাকে দেখে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

    – কেমন আছো বন্ধু?

    – হঠাৎ শক্রু আজ ঘরে?

    – একটা সময় তো বন্ধু ছিলাম।যাই হোক বলেছিলাম গ্রামের মেয়েটাকে মেরে দিতে।না হয় পাচার চক্রের কাছে বেঁচে দিতে।তুই তো জানিস পুলিশ আমার উপর আলাদা নজরদারি রেখেছে চাইলেও কিছু করতে পারবো না।তোর সাহায্য চেয়েছিলাম আর তুই মেয়েটাকে ইনানের বউ করে আনলি।অদ্ভুত!

    – আমার ইচ্ছা ছিল না মেয়েটাকে ইনানের বউ করার।কিন্তু ইনানের জোরাজুরিতে আমিও রাজি হতে বাধ্য হই।মেয়েটা যেমন তোর বিপদ ছিল এখন আমারো বিপদ হয়ে দাড়িয়েছে।এক কথায় আমি খাল কেটে কুমির ঘরে ডুকালাম।

    – বাহরুল ‘ওয়াসিম’ জেনে গেছে ইতিকার বিয়ে হয়ে গেছে।তাও আবার ইনানের সঙ্গে।সে বলেছে খুব শীঘ্রই ঢাকায় ব্যাক করবে।তুই তো জানিস এই ছেলে কতটা জেদি।মেয়েটাকে মেরে দিলে আজ না আমার বিপদ হতো না তোর বিপদ হতো।

    বাহরুল ইসলাম প্রত্যুত্তর করলো না।তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন।কিছুক্ষণ পর সাহাবের দিকে তাকিয়ে সিগারেট মুখে পুরে বলেন,

    – তুই কি কিছু ভেবেছিস?

    – না।

    – আর ভাবতে হবে না তোকে।আমরা খুব শীঘ্রই এই সম্পর্কে গোপন মিটিং এ বসবো।সেখানে ইনান থাকবে না।

    – অবশ্যই।আজ তবে আমি আসি।ভালো থাকিস।
    _

    ক্যানভাসে রংতুলিতে রাঙিয়ে তুলছে সাদা কাগজটি একটি মেয়ে।যার শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই।ক্লিপ দিয়ে চুলগুলোকে আটকে রংতুলিটা মুখে পুরে কিছু একটা ভাবতে থাকে ক্যানভাসে দিকে তাকিয়ে।

    – কি রে মা আসবো?

    বাহরুল ইসলামের কন্ঠে ঘুরে তাকায় রুমু।

    বাহরুল ইসলামের একমাত্র মেয়ে রুমু।যার বৈশিষ্ট্য সবসময় চুপচাপ থাকা।নিজেকে ব্যস্ত রাখে রংতুলির মাঝে।ঝগড়া বিবাদে কখনো জড়িয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।

    – তোমার এই রংতুলির যুদ্ধ কি কখনো থামবেনা রুমু মা?

    – না বাবা, তুমি জানো আমি কতটা ভালোবাসি এই রংতুলি।কিছু বলবে তুমি?

    – তোমায় আগেই বলেছি ইনানকে বাড়ির জামাই করতে চাই।কিন্তু তুমি তো কোন পাত্তাই দিচ্ছো না।

    – আগেই বলেছি বাবা ইনানকে আমার সাথে যায় না।আমার প্রয়োজন শান্তশিষ্ট, আমাকে বুঝতে পারবে এমন ছেলে।আর প্রতিষ্ঠিত একটি ছেলে।কিন্তু ইনান ভাই সব কিছুর বিপরীত।

    – কিন্তু আমাদের তো তাকে পছন্দ মা।

    – বাবা এই সম্পর্কে পরে কথা হবে।এখন আমায় ডিস্টার্ব করো না।

    – ঠিক আছে পরে কথা হবে তবে।

    বাহরুল মুখভার করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।মেয়েটা তার সহজ সরল।তবে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার বিরুদ্ধে এক পা ও ফেলবে না।নিজের ইচ্ছাতেই অনড় সে।

    _

    স্কুলের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ইতিকা এবং ইনান।গাড়ি থেকে নেমে ইনানকে বিদায় দিতেই ইতিকার চোখে পড়ে হাস্যজ্বল চেহারার রাতুলকে।ছেলেটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে।ইতিকা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দু’কদম পিছিয়ে যায়।তখনি কারো বুকের সাথে ধাক্কা লাগে তার।পেছনে ঘুরে ইনানকে দেখে ইতিকার ভেতরটায় আরো ভয়ের সঞ্চার হয়।কিন্তু ইতিকার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমান করে ইনান রাতুলের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

    – হেই রাতুল কি অবস্থা?

    – ভালো ভাইয়া।আপনি কেমন আছেন?

    – হুম ভালো। আমি যাচ্ছি ইতিকাকে ক্লাসে পৌছে দাও।

    – চিন্তা করবেন না ভাইয়া।আমি আছি তো।

    ইতিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইনান এবং রাতুলের দিকে।দুইদিন আগেও যারা সাপ নেউলের মতো ঝগড়ায় মত্ত থাকতো তারা আজ কি করে এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ।

    – আসছি ইতিবউ।

    ইনান ইতিকাকে বিদায় দিয়ে হাটতে শুরু করে।ইতিকা তার প্রশ্নের উত্তরের আশায় এক ছুটে দাঁড়ায় ইনানের সামনে।

    – কি হলো ফিরে আসলে যে?

    – রাতুলের সাথে হঠাৎ এত মেলামেশা বুঝলাম না।

    – তোমার বুঝতে হবে না ইতিবউ।আমার বৈশিষ্ট্য বেইমান বন্ধুদের সাথে শত্রুতা করা আর শক্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা।

    #চলবে…

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১২]
    _________
    হাতে বেশ কয়েকটি শপিং ব্যাগ নিয়ে হেলেদুলে হাটছে সুফিয়া।তার বাম পাশে ইতিকা।অলীদ সামনে সামনে হাটলেও তাদের স্থির হাটায় বিরক্ত সে।

    – এইসব কি? এমনে কেউ হাটে?এমন হেলেদুলে হাটার মানে কি সুফু?

    – আর পারছিনা দোস্ত।তুই দুইটা ব্যাগ নে হাতে।আমার হাত তো ছিড়ে যাবে।

    – আমি কোন শপিং করছি?করলি তোরা দুজনে।তাহলে ব্যাগ নিবিও তোরা দুজনে।আমাকে কি তোদের চামচা লাগে নাকি?

    – আহ চামচা হওয়ার কি আছে?তুই না আমার বন্ধু?

    – আজকের জন্য সব বন্ধুত্ব বাতিল।ওই ইনান শালা কোথায় গেলো আবার?আমাদের একা করে তিনি কোন মহাভারত শুদ্ধ কর‍তে গেল?

    – আমি জানি না।যাই হোক দ্রুত হাট।

    ৩ জনে আবার হাটতে শুরু করে।শপিং মল থেকে বের হয়ে পার্কিং জোনের দিকে এগিয়ে যায় তারা।পার্কিং জোনের দিকে লোক সমাগম তেমন নেই।ইতিকা চাতক পাখির মতো এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে পরিবেশটা।

    – ইতিকা?

    দূর থেকে একটি ছেলর চিৎকারে ঘুরে তাকায় ইতিকা।কিন্তু পেছেনে ঘুরে ওয়াসিমকে দেখতে পাবে সপ্নেও ভাবে নি সে।ওয়াসিম ইতিকার নাগাল পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।এক ছুটে ইতিকার সামনে চলে আসে।আশেপাশে না তাকিয়ে নির্দ্বিধায় ইতিকাকে জড়িয়ে ধরে বক্ষপিঞ্জরে।অপরদিকে ইতিকা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মাথার সবটা যেন খালি খালি লাগছে।কি করবে সে?ওয়াসিমের বক্ষপিঞ্জরে তার ছিল সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।আজ আবার দীর্ঘদিন পর সেই চেনা স্থানে সে ফিরে এসেছে।জড়িয়ে কি ধরবে তাকে একবার?নাকি দূরে সরিয়ে দেবে?
    ইতিকা ভাবনার মাঝেই হাতে থাকা শপিং ব্যাগগুলো আলগা করে ছেড়ে দিলো।ইতিকা আলতো হাতে ওয়াসিমকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।সবটা তার সপ্ন লাগছে।দৃঢ় মনে কখনো ভাবেনি ওয়াসিমকে এইভাবে আরো একবার ছুঁয়ে দিতে পারবে।

    – ক…কোথায় ছিলে তুমি?

    ইতিকার কান্না জড়িত কন্ঠে উত্তর দিলো না ওয়াসিম বরং সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে ইতিকাকে।

    .
    দুপুরের পর ইতিকা অলীদ এবং সুফিয়াকে শপিং এর উদ্দেশ্য বের হয় ইনান।কেনাকাটা শেষে অলীদকে সুফিয়া আর ইতিকার দায়িত্ব দিয়ে সে ফুল দোকানের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।
    কিছুক্ষণ পর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে ফেরে সে।কিন্তু পার্কিং জোনে দাঁড়িয়ে এমন একটা পরিস্থিতি দেখবে সপ্নেও ভাবেনি।হাতে থাকা গুচ্ছগোলাপ গুলো সহসা হাত থেকে মাটিতে পতিত হয়।

    – ইতিবউ!

    ইনানের ডাক ইতিকার কর্ণকুহুরে পৌছালো না।সে এখনো ওয়াসিমের বাহুডোরে বন্ধী।

    অলীদ আর সুফিয়া তাকিয়ে আছে স্থির নয়নে।এই পরিস্থিতে কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না তারা।

    – ইতিকা ভুলে যেওনা তুমি বিবাহিত।ইনান দাঁড়িয়ে আছে পেছনে।

    সুফিয়ার কথায় ছিটকে দূরে সরে যায় ইতিকা।ইনানের দিকে তাকিয়ে সে যেন বর্তমানে ফিরে এসেছে।ওয়াসিমের সামনে থেকে সরে ইনানের পাশে আসতেই ক্রুদ্ধ হয় ইনান।

    – দূরে যান ইতিবউ।আরেকটু কাছে আসলে আমার দুহাত আর স্থির থাকবে না বলে দিলাম।

    – সরি!

    – চুপ,মুখ বন্ধ।

    ইনান ইতিকাকে বেশ শান্ত সুরেই কথাগুলো বলছে।এ যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস।ইনানের কাছে এগিয়ে আসে ওয়াসিম।বেশ কয়েকবার সামনে থাকা ইনান, ইতিকাকে পরখ করে বলে,

    – আমি এসে গেছি তোর নাটক বন্ধ করে ইতিকাকে আমার কাছে ফেরত দে।

    – নাটক কে করছে?আমি নাকি তুই?আমি কি চিনি কে তোর গার্লফ্রেন্ডে।আর না চিনি কে তোর হবু বউ।আমি তো এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছি তার পরিবারকে জেনে। কে তার বয়ফ্রেন্ড আর কে তার এক্স সেই সব জেনে নয়।

    -দেখ ইনান কথা একদম প্যাচাবি না।সবটা যে তুই ইচ্ছে করে করেছিস তা আমি ভালো করেই জানি।ইতিকাকে ফেরত দে।

    – অদ্ভুত কথা তোর।আর বউকে আমি কেন পরপুরুষের কাছে দেব।ভালোয় ভালোয় বলছি সরে যা।

    – তুই নিজে সরে যা আমাদের জীবন থেকে।মাঝখানে এসে কেন সবটা তছনছ করে দিচ্ছিস?

    ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।সে ইতিকাকে ইশারা করে গাড়িতে গিয়ে বসতে।ইতিকাও বিনাবাক্য গাড়ির দিকে পা বাড়ায়।তৎক্ষনাৎ ওয়াসিম তার হাত চেপে ধরে আর বিষটি সহ্য হয়নি ইনানের।সহসা রুষ্ট বাঘের ন্যায় মুছড়ে ধরে ওয়াসিমের শার্টের কলার।

    – অধিকার আগের মতো এক চুল পরিমানেও নেই তোর।আগের ইতিকা ইয়াসমিন তোর যা ইচ্ছা তা ছিল।কিন্তু বর্তমান ইতিকা ইয়াসমিন হলো মিসেস ইফতিহার।যা বলবি সাবধানে। আর যা করবি সাবধানেই করবি।আবার এমন সাহস দেখালে হাত কেঁটে রাস্তার মাঝে ছুড়ে মারবো মাইন্ড ইট।’ইতিকা’ গাড়িতে বসুন।

    ইনানের মুখে ‘ইতিকা’ নামটি শুনেই চমকে তাকায় ইতিকা।যার মুখে ‘ইতিবউ’ শব্দটা মুখোরিত থাকতো সে আজ ইতিকা বলে ডাকছে।
    ইতিকা আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে।
    _

    নিজের রুমে এসে সহসা ওয়াশরুমে প্রবেশ করে ইনান।গায়ের শার্টটা ছুড়ে ফেলে ঝরনার পানিতে ভিজতে থাকে অবিরত।শরীরের শিরায় উপশিরায় রাগের সঞ্চার হয়েছে।চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে ওয়াসিমকে জড়িয়ে ধরার সেই মূহুর্তটা।

    ভয়ে গুটিয়ে থাকা ইতিকা স্থির পায়ে রুমে প্রবেশ করে ইনাকে না দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।কিন্তু পেছন থেকে বজ্রকন্ঠ ইনানের কথা শুনেই লাফিয়ে উঠে সে।

    – ইতিকা ওয়াশরুমে যান।দ্রুত গোসল করবেন আপনি।

    – কিন্তু কেন?

    – পরপুরুষকে ছুঁয়েছেন আশা করি আর কোন কারন জানার প্রয়োজন নেই আপনার।

    .
    দীর্ঘ দিন পর ওয়াসিম দেশে আসায় বাড়িতে বেশ হইহুল্লোর শুরু করে দিয়েছে ওয়াসিমের পরিবারের লোকজন।কিন্তু তার আগুনের চুল্লির মতো মুখখানা দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়।ওয়াসিমের বাবা সাহাব উদ্দিন বেশ রেগেই প্রশ্ন ছুড়েদিলেন তার দিকে,

    -সমস্যা কি তোমার?আমাদের আনন্দের কোন মূল্য নেই তোমার কাছে?একটা মেয়ের জন্য সবাইকে অবজ্ঞা করছো।

    – বাবা আমি স্থির থাকতে পারছিনা।পারছিনা নিজের মনকে শান্তনা কি করে দেবো?তুমি যদি আমায় জোরাজোরি করে বিদেশ না পাঠাতে তবে এমনটা ভুলেও হতো না।

    – তোমার জন্য কি মেয়ের অভাব হবে?একটা গাইয়া মেয়ের জন্য পড়ে আছো কেন?নিজের ব্যাক্তিত্ব ঠিক রেখে চলো।

    – তোমার এসব জ্ঞান আমার ভালোলাগছে না বাবা।আমি উপরে গেলাম।আরেকটা কথা ইতিকা এই বাড়ির বউ হয়ে আসবে এটাই ফাইনাল।

    ওয়াসিম রাগ দেখিয়ে উপরে চলে যায়।সাহাব উদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে।
    _
    গত দুইদিন কোন কথা নেই ইনানের মুখে।ভুলেও ইতিকার সাথে কথা বলেনি।প্রতিবার তাকে উপেক্ষা করে গেছে।ইতিকা বেশ ভালো করেই বুঝেছে ইনান ক্ষেপে আছে।ইতিকার উপর রাগ দেখিয়ে বাড়ির কোন দানাপানি মুখে তুলে নি সে।আর বিষটি বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে নাসরিন এবং ইব্রাহিম।

    বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছে ইনান।গত কয়েনদিন তার বাড়ি ফেরা নিত্যকার অভ্যাস হয়ে গেছে।প্রতিদিন ইতিকা ঘুমিয়ে পড়লেও আজ তন্দ্রাহীন অপেক্ষায় আছে ইনানের আশায়।ইনানকে রুমে আসতে দেখেই প্রশ্ন ছুড়লো ইতিকা।

    – সমস্যা কি আপনার?আমাকে ইগ্নোর করছেন কেন?

    – কে করলো আপনাকে ইগ্নোর?

    – যাকে প্রশ্নটা করেছি সে করছে।

    ইনান এবারো উত্তর দিলো না।রাগ দেখিয়ে শুয়ে পড়লো।ইতিকা তার পাশে বসে বাহুতে মাথা রেখে শুয়ে যায়।

    – দূরে সরুন ইতিবউ আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগছেনা।

    – এমন কেন করছেন আপনি?

    – কোন মুখে এই কথা জিজ্ঞেস করছেন?ওয়াসিমকে জড়িয়ে ধরলেন কেন?

    -ভুল হয়ে গেছে।

    – ভুল হয়েছে গেলে বললেই কি হবে নাকি?আশেপাশে সুফিয়া, অলীদ তার মাঝে আপনি ছিহ!

    ইতিকা নিজের ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত মাথা নামিয়ে নেয়।অপরাধ যে তার মাঝে হয়নি তা কিন্তু না।অপরাধ তার মাঝেও সৃষ্টি হয়েছে আর তা নিয়ে অনুতপ্ত সে।

    – একটা কথা বলুন ইতিকা যদি আপনার সামনে কেউ আমায় জড়িয়ে ধরে,মাথায় চুমু খায় আপনি কি মেনে নেবেন?সহ্য করতে পারবেন সেই মূহুর্তটা?

    ইতিকা শিউরে উঠলো।বিষটি ভাবতেই তার গা কেঁপে উঠছে।বিয়েটা যেমন তেমন হোক ইনানকে যেহেতু সে নিজের স্বামীর স্থানে একবার বসিয়েছে সে তো আর কিছুতেই অন্য মেয়ের সঙ্গে তাকে মেনে নিতে পারবেনা।

    – কথা বলছেন না কেন ইতিবউ?

    – ভুল হয়ে গেছে মাফ করেদিন।

    – একটা জবান দিন তো আমি মানছি আমার সাথে হয়তো আপনি জড়তা নিয়ে থাকেন কিন্তু আমার বাবা, মা তারা তো আপনাকে নিজের মেয়ে চোখেই দেখছে।আদর যত্নে আগলে রাখছে আমাকে ছেড়ে গেলেও তাদেরকে ছাড়তে পারবেন?

    -আমার বাবা- মা নেই।এই বাড়িতে আসার পর বাবা-মা নেই এটা নিয়ে আমার সব অভিযোগ যেন ভুলে গেছি।বর্তমানে তারাই আমার সবকিছু।

    – আর আমি?আমাকেও কি আপন ভাবছেন?

    ইতিকা চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ইনানের দিকে।এই ছেলে যে আজ বেজায় চটে আছে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।

    ইনান ইতিকার এমন নিরব চাহনী কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা।রাগের মাথায় এতক্ষণ শান্ত থাকলেও হুট করেই রাগ দিগুন বেড়েছে।হেঁচকা টেনে ইতিকে কোলে বসায় ইনান।হঠাৎ টানে ইতিকাকেও নিজেকে সামলাতে পারলো না।দড়াম করে বসে যায় ইনানের কোলে।

    – কি করছেন কি?এইভাবে কেউ….

    -চুপ কথা বাড়াবেন না।পরিস্থিতি ভালো নেই ইতিবউ।আর আপনি যদি আমার বিরদ্ধে যান তবে এরপর কি হবে আমি জানিনা।শুধু এটাই জানি আমি ভালো থাকবো না।

    জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে শুচালো কথা গুলোর কোন মানে বুঝে উঠতে পারছেনা ইতিকা।

    – আপনার কি হয়েছে বলবেন আমায়?আমি আপনার এইসব অস্বাভাবিক অচরণ আর নিতে পারছিনা।

    – ওয়াসিম চলে এসেছে। সে আপনাকে নেওয়ার জন্য নানান ছল বাহানা করবে।যদি আপনি তার সাথে চলে যান তখন আমার কি হবে?

    ইতিকা স্তব্দ হয়ে যায়।কি বলবে সে বুঝে উঠতে পারছে না।

    – ওয়াসিমের বউ আছে আমি কেন তার সাথে যাবো?

    – আবেগে পড়ে যেতে পারেন।যেমনটা সেদিন জড়িয়ে ধরেছেন।

    ইনান কথা শেষ করতেই বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ পেলো।অস্বাভাবিক ভাবে গাড়ির হর্নটা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।ইনানের অবচেতন মন জানান দিচ্ছে নিশ্চই ওয়াসিম এসেছে।

    ইতিকাকে সরিয়ে ইনান বারান্দার দরজা ফাঁক করে দৃষ্টি বাইরের দিকে তাক করলো।তার ভাবনাটা তবে সত্যি হয়েছে।ওয়াসিম বাইক নিয়ে এসে বাইরে হর্ন বাজাচ্ছে।

    ইনান ধীরে পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে আসে।ওয়াসিম তার দিকে তাকিয়ে আছে বাইকের উপরে বসে।ইতিকা জড়োসড়ো হয়ে ইনানের পাশে দাঁড়ায়।নিচ থেকে ওয়াসিমকে দেখে তার চক্ষুচড়ক গাছ।

    -ইতিবউ প্লিজ হাগ মি।

    – হাহ!

    – হা হু করার সময় নেই।আমাকে হাগ করুন।

    ইনানের কথায় নড়ে-চড়ে উঠে ইতিকা।ইনানকে সে নিজে থেকে হাগ করবে!কখনোই না মরে গেলেও না।

    ইনান দাঁত কিড়মিড় করে ইতিকার দিকে দৃষ্টি রাখে।

    – কি বলেছি তোমায়?যদি হাগ না করো তবে আমি দোতলা থেকে লাফ দেবো।

    – না মানে….

    – এখন মানে মানে করছো?ওয়াসিমকে কি করে জড়িয়ে ধরেছিলে?

    ইতিকা বিভ্রমে পড়ে গেছে কি করবে সে?মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।তবুও একটু একটু করে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে ইনানের দিকে।ইনান তার হাত টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।এটাই ইনানের জীবনের প্রথম আলিঙ্গন তার ইতিবউকে আদর মিশ্রিত ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরার।ইতিকা জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছে ইনানের বক্ষপিঞ্জরে।অপর দিকে ওয়াসিম ক্রুদ্ধ হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।ইনান হাত ইশারায় ওয়াসিমকে হেরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে।ওয়াসিম আর সেখানে দাড়ালো না।বাইক নিয়ে ছুটে চলে আপন গন্তব্য।

    – ইতিবউ কাঁপছেন কেন?আপনার কাঁপুনিতে আমার শরীরে যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে।

    – ছেড়ে দিন প্লিজ আপনার ছোঁয়া কেমন যেন।

    – কেমন আমার ছোঁয়া?

    – আপনাকে আমি প্রথম বার জড়িয়ে ধরেছি তাই।তাও আবার অপ্রতিভ অবস্থায়।

    – প্রথমবার জড়িয়ে ধরেছো মেনে নিলাম।আর এই আলিঙ্গন যেন আমাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

    ইতিকা প্রত্যুত্তর করলো না।ইনান তার মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।মেয়েটা কেমন যেন দিন দিন অগোছালো নুইয়ে যাচ্ছে ইনানের মাঝে।

    _

    গভীর রাতে ভিডিও কলে সুফিয়ার কান্না দেখতে ব্যস্ত অলীদ।সুফিয়ার ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নায় তেঁতে উঠে অলীদ।

    – সমস্যা কি সুফু?অতীত কেন টানছিস?

    – আমি ওয়াসিমকে ভুলতে পারছি না রে।

    -তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি ওয়াসিম কু*ত্তাটার জন্য তোর চোখে আবার পানিও আসে।

    – ইতিকা যখন ওয়াসিমকে জড়িয়ে ধরেছিল তখন আমার কেমন যে লেগেছিল সেটা শুধু আমি জানি।বিশ্বাস কর আমি মানতে পারছি না।যত যাই হোক ওয়াসিমকে আমি ভালোবাসি।

    – তুই একা বাসিস ওয়াসিমতো আর বাসে না।এইসব বাদ দে সুফু ইনান জানলে আর রক্ষে থাকবে না।

    – আমি কি করবো আমায় বুদ্ধি দে।

    – তুই মর বেয়াদব মেয়ে।রাতবিরেত আমার ঘুম ভেঙ্গে পরপুরুষের জন্য কান্না দেখাতে এসেছিস। ফাউল মাইয়া।

    অলীদ কথা শেষ করেই মুখের উপর ফোনটা কেটে দেয়।

    #চলবে..

    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১৩]

    ________
    স্কুলে ড্রেস পরে আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে ইতিকা।তার আজ মূল লক্ষ্য ইনানকে জব্দ করা।গত কয়েকদিন এই বাড়ির কোন দানাপানি মুখে তুলেনি সে।আর সবটা যে ইতিকার উপর রাগ দেখিয়ে করছে সেই বিষয়ে বেশ ভালোভাবে অবগত ইতিকা।ইতিকাকে বসে থাকতে দেখে বেশ রেগে গেলেন নাসরিন

    – তোর সমস্যা কি? এইভাবে বসে পা দুলাচ্ছিস কেন?স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে।দ্রুত খাওয়ারটা শেষ কর।গরম গরম আলুপরোটা ঠান্ডা হলে ভালো লাগবে না।

    – তোমার ছেলে কই আম্মা?

    – আমার ছেলের দায়িত্ব কী এখন আমার হাতে নাকি?আমার ছেলেটাকে তো তোর ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছি।এবার সব ভালো মন্দ যা করার তুই করবি।

    – কিন্তু তিনি আমার কোন কথাই রাখতে চায় না আম্মা।যদি আমি তার কথা না রাখি রাগ দেখিয়ে, জোর করে হলেও তা করিয়ে ছাড়বেন।

    ইতিকা বিরক্ত মুখ নিয়ে কথা শেষ করলেও নাসরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়ে যায় সে।

    -তুমি মুখ টিপে হাসছো কেন আম্মা?

    – হাসবো না কেন?আমার ছেলেটা তার বাপের মতই হয়েছে।তার বাবাও এই কিসিমের ছিল।

    – মানে?তোমারদের বিয়েটা….

    ইতিকা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভেবেই থেমে গেলো।নাসরিন আবারো হেসে নির্দ্বিধায় বলতে থাকে।

    – তোর শশুড়কে ভয় পাবো না কেন?এলাকার বড় ভাই ছিলেন।শহরে পড়াশোনা করতেন, মাঝে মাঝে গ্রামে যেতেন আর যখন যেতেন সব এলাকার মেয়ে ছেলেদের শাসন করে বেড়াতেন।সবার ভুল ধরতেন।সবাই তাকে যমের মতো ভয় পেতো আমিও পেতাম।একবার হুট করেই শুনি আমাদের বিয়ে দিন তারিখ ঠিক।আমার কোন মত না নিয়েই বিয়ে হয়ে গেলো।তারপর এই মানুষটার সাথে মানিয়ে নিতে আমার বড্ড কষ্ট হয়েছিল।গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।অবশ্য তিনি ছিলেন মিশুক প্রকৃতির আমার সবসময় যত্ন নিতেন।আমি ছিলাম ভীতু প্রকৃতির।আর এখন দেখ আমার কথার প্যাচে ফেলে তাকে কিভাবে ফাসাই।ধীরে ধীরে আমার ছেলেটাকেও কবজা করে দে দেখিনি।

    নাসরিনের শেষ কথায় খিলখিল করে হেসে উঠে ইতিকা।

    – তোমার ছেলেকে শাসন করবো তাও আবার আমি?আমাকে তুলে আছাড় দিবে।

    কথাটা বলেই আবার হাসতে থাকে ইতিকা।

    কাধের দুইপাশে দুটি বেনি পড়ে আছে।কপালের দিকটায় দুগাছি চুল লেপ্টে আছে।সাদার সাথে ছাই রঙা ইউনিফর্মটা যে তার সাথে মানানসই ভাবে এঁটে সেঁটে আছে সেটা কি বুঝতে পারছে ইতিকা?আর মুগ্ধ নয়নে ইনান উপর থেকে আড়ালে তাকিয়ে আছে শাশুড়ী বউমার দিকে।এদের ভাব দেখ মাঝে মাঝে ইনানের হিংসে হয়।কই ইতিকা তো কখনো তার সাথে এতটা মিশে হেসে খেলে কথা বলেনি।প্রতিবারি একটা ভীতু মুখ নিয়ে ইনানের সামনে এসেছে।

    শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নিচে নেমে এলো ইনান।একবার ঘড়ির দিকে আরেকবার ইতিকার দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলো সে।

    – কয়টা বাজে?আপনি এখনো খাওয়ার শেষ করেন নি কেন?

    – একসাথে খাবো বলে অপেক্ষা করছি আপনিও আসুন।

    ইতিকা আর ইনানের কথার মাঝে উঠে চলে যান নাসরিন।তিনি জানেন এখন একটা হালকা পাতলা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।

    – আমি খাবো না ইতিবউ।আপনি খেয়ে নিন আমাদের হাতে সময় কম।

    – আম্মা আমি খাবো না, গেলাম।

    ইতিকা নাসরিনের উদ্দেশ্য কথাটি বলে ঝটপট উঠে পড়ে।ইনান তার কান্ডে কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ করে।

    – সমস্যা কি?কোথায় যাচ্ছেন?খাওয়ারটা শেষ করে তবেই উঠবেন।

    – আপনি যেহেতু খাবেন না আমিও খাবো না

    – আজ আবার নাটক শুরু করেছেন আপনি?

    – নাটকের কী দেখলেন?

    – ইতিবউ কথা বাড়াবে না খেয়ে নিন।

    – আপনি খান আগে।

    ইনান বিরক্ত হয়ে ইতিকার পাশে বসে যায়।আলুপরোটা হাতে নিয়েই বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকায়।

    – সকাল সকাল এই তৈলাক্ত খাবার কেন খাবেন?মা ইতিকার জন্য সালাদ করতে বলো।

    ইনানের কথায় তেতে উঠলো ইতিকা।

    – আমি আম্মাকে বলেছি খাবো তাই তিনি নিজের হাতে করেছেন।আপনিও খাবেন আমিও খাবো।

    ইনান তর্ক করলো না একটুকরো পরোটা মুখে তুলে ইতিকার দিকে তাকালো।

    – একা একা খাচ্ছেন কেন ইতিবউ?আমাকেও খাইয়ে দিতে পারেন।

    তৎক্ষণাৎ ইতিকার বিষম উঠে।কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা।ইনান তাড়াহুড়ো করে হাটু মুড়িয়ে বসে ইতিকার পাশে।পানির গ্লাস নিয়ে মুখে পানি তুলে দেয়।মিসেস নাসরিন এগিয়ে আসতে গিয়েও থেমে যান।ছেলে আর ছেলের বউকে দেখে তিনি মুচকি হেসে সরে যান।

    – ইতিবউ এত তাড়াহুড়ো করে কেন খাচ্ছেন?

    – আপনি কি বললেন?আপনার কথায় আমার বিষম উঠেছে।

    – এই কথায় আপনার বিষম উঠেছে?হাউ ফানি।

    ইতিকা জবাব দিলো না।ইনানের ফোন আসায় সে কিছুটা আড়ালে সরে আসে।

    – হ্যা রাতুল বল।

    – ‘ওয়াসিম হাসনাত’ আপনি যার ছবি দেখিয়েছিলেন আমায়।ওনি আজ সকাল থেকে ইতিকার ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন।

    – তুমি শিওর লোকটা ওয়াসিম?

    – পাক্কা শিওর।আপনার হোয়াটসঅ্যাপে আমি একটা ছবি পাঠিয়েছি লোকটার, চেক করুন।আমার মনে হচ্ছে সে ইতিকাকে খুঁজতে এসেছে।

    – হ্যা তার মূল উদ্দেশ্য এটাই।ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোমায় রাতুল।

    – শুকরিয়া ভাইয়া।

    ইনান ফোন কেটে মোবাইলে কিছু একটা চেক করতে থাকে।ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে এগিয়ে আসে ইতিকার দিকে।

    – আমার একমাত্র ছোট বউ!ইতিবউ আমার কিছু কথা ছিল।

    ইনানের কথার সুর পালটে গেছে।অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে ইনান।ইতিকা পরোটা হাত থেকে রেখে ইনানের দিকে চোখ তুলে তাকায়।

    – হ্যা বলুন।

    – রুমে আসুন।

    – স্কুলে যাবো না?দেরি হয়ে যাচ্ছে।প্রথম পিরিয়ডে আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।

    – বিবাহীত মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস স্বামীর ক্লাস।সব ক্লাস বাদ আজ আপনি আমার ক্লাস করবেন।

    কথা শেষ করেই ঝটকায় ইতিকার হাত টেনে দাঁড় করায় ইনান।মেয়েটিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে টানতে টানতে উপরে নিয়ে যায়।

    .

    অকস্মাৎ একটা মানুষের ভাব পালটে যায় কি করে ভেবে পায় না ইতিকা।ইনান তাকে রুমে ডেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।তার বেনুনির চুল গুলো ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে চুলের ঘ্রাণে মত্ত সে।ইতিকা গুটিয়ে চুপচাপ বসে আছে ভীতগ্রস্ত হয়ে।

    – আ..আপনি এমন করছেন কেন?

    – কেমন করছি ইতিবউ?

    – কেমন যেন মাতাল মাতাল।

    – যেখানে আপনি আমার জীবনে মাদকময় নেশা ছড়িয়ে রেখেছেন, সেখানে আমি একটু নেশা করে মাতাল হলে দোষের কি?

    – এসব কি কথা বলছেন আবল তাবল?আমাকে স্কুল যেতে দেন নি কেন?

    – দুঃখিত বউ এক্সামের আগে আপনার স্কুল যাওয়া বন্ধ।

    ইনানের কথায় নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় ইতিকা।রাগ দেখিয়ে বাঘিনীর ন্যায় বুলি ফোঁটায় মুখে।

    – মানে?

    – কেন বুঝেন নি?সোজাসাপটা বলেছি।এত স্কুল গিয়ে কি হবে।আসুন আদর করি।

    – আমার ভালো লাগছেনা আপনার এইসব নাটক।

    ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।পেছেন ঘুরে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফোন চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।ইতিকা রাগ দেখিয়ে ইনানের পিঠে ঘুষি মারতেই তীব্র ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে সে।
    ইনানের আর্তনাদের থতমত খেয়ে যায় ইতিকা।

    – কি হয়েছে আপনার?

    – কিছু না।

    – মিথ্যা বলছেন কেন?আমাকে দেখান আপনার কি হয়েছে?

    – কিছু না ইতিবউ সরে যান।

    ইনান পালিয়ে বাঁচার জন্য উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত রুম থেকে বের হতে নিলেই ইতিকা তাকে বাধা দেয়।একে একে শার্টের সবকটা বোতাম খুলে পিঠের দিকে তাকাতেই আতঁকে উঠে।
    কালশিটে দাগ ইনানের পিঠে ছড়িয়ে আছে।

    – এসব কি করে হলো?

    – সেদিন বাইকের ব্রেকে সমস্যা হচ্ছিল কিছুতেই কাজ করেনি।অতঃপর ছোট খাটো এক্সিডেন্ট।

    – আমায় বলেননি কেন?

    – আপনাকে কি বলবো ইতিবউ?আপনার চিন্তায় আমার রাত দিন সবটা এক হয়ে যাচ্ছে।অথচ আপনি আমায় পাত্তাই দেন না।

    ইতিকা জবাব দিলো না চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ইনানের পিঠের কালশিটে দাগের দিকে।

    – একটা কথা বলবো ইতিবউ?

    – বলুন

    – চলেন না আমরা স্বাভাবিক ভাবে সংসার শুরু করি। প্রমিস করছি আপনাকে কখনো কষ্ট দেবো না।
    – বাবার ব্যবসায় হাত লাগান আর রাজনীতি ছেড়ে আসুন। পারবেন?

    ইতিকা এমন একটা শর্ত দেবে স্বপ্নেও ভাবেনি ইনান।ইনান রাগ দেখিয়ে ইতিকার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।হঠাৎ কি মনে করে ইতিকার কোমড় টেনে এনে তার সাথে মিশিয়ে নেয়।বন্দী করে তার বাহুডোরে।

    – ইতিবউ আপনিও আমার হবেন।আর রাজনীতিও আমার জীবনে থাকবে একদম সমান সমান ভাবে।
    ___

    ভার্সিটি ক্যাম্পাসে সুফিয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াসিম।সুফিয়া নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলেও জোর খাটালো না।ওয়াসিম তো তার ভালোবাসার মানুষ হোক সেটা একপাক্ষিক।

    – প্লিজ সুফু তোর কথা ইনান শুনবে ইতিকাকে ছেড়ে দিতে বল।

    – তুই পাগল হয়ে গেছিস?যে ছেলে ইতিকার জন্য বহু বছরের পুরোনো ফ্রেন্ডকে অপমান কর‍তে ছাড়েনা সে কী না ইতিকাকে ছাড়বে?

    – আমি এত কথা জানতে চাই না ইতিকাকে আমার চাই।প্লিজ সুফিয়া তুই অন্তত আমার সঙ্গ দে।

    সুফিয়া ঠোঁট বাকিয়ে বিশ্রি ভঙ্গিতে হাসে।

    – একটা এডভাইস দিচ্ছি তোকে।ইতিকার কথা ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করে নে।আমাকেও করতে পারিস তোকে আগেও প্রপোজ করেছিলাম রাজি হলি না।

    সুফিয়ার সিরিয়াস মুডের কথায় তেতে উঠলো ওয়াসিম।ইনানের উপর সব রাগ যেন হুট করেই সুফিয়ার উপর চড়ে উঠেছে।কোন দ্বিধাবোধ ছাড়াই ইতিকার গালে বেশ জোরেই থাপ্পড় মারলো ওয়াসিম।
    লাহমায় স্থির নয়ন যুগলে সিক্ত নোনা জলে ভরে গেছে।ওয়াসিম বিনাবাক্য স্থান ত্যাগ করে।

    কয়েক মিনিট পর অলীদ সুফিয়ার সামনে দাঁড়ায় আগুনের চুল্লির মতো মুখ করে।

    – কাজটা ভালো হলো না সুফিয়া।

    অলীদের স্থির কন্ঠ।

    – কি করেছি আমি?

    – তোর বেহায়াপনার জন্য ওয়াসিমের হাতে চড় খেয়েছিস।আমি আংকেলকে সবটা জানিয়ে দিয়েছি।তিনি আসছেন।

    অলীদের কথায় মুষড়ে উঠে সুফিয়া।

    – তুই পাগল হয়ে গেছিস?বাবাকে কেন বললি সবটা?বাবা আমায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে।তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন আমায় কোন উচিলায় দেশের বাইরে পাঠানোর।এবার কি হবে?আমায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে অলীদ তুই এটা কি করলি?

    – আমি সবটা জেনে বুঝে করেছি।দেশের বাইরে চলে যা পড়াশোনা কর মাথা থেকে কুবুদ্ধি ঝেরে ফেল।

    – আমি যাবো না।
    – যেতে তোকে হবেই।

    #চলবে…

    ®পলি আনান

    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১৪]

    ___________
    নিরিবিলি পরিবেশটায় হঠাৎ ধস্তাধস্তি শব্দে চোখ ছুটে যায় ইতিকার।ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।
    গতকাল মধ্যে রাতে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথায় এক কাপ চা পানের তৃষ্ণা জাগলো তার মনে।ইনান তখন ঘুমন্ত অবস্থায় তার ইতিবউয়ের বাম হাতটা জড়িয়ে রেখেছে।ইতিকা হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে।রক্তিম হয়ে আছে দু’চোখ।হেলেদুলে নিচে নেমে কিচেনে প্রবেশ করে মেয়েটি।পানি নিয়ে চুলায় বসাতে চায়ের পাতার জন্য কৌটা খুঁজতে থাকে।পেয়েও যায় কয়েক মিনিটে।চা বানানো শেষে ছাঁকনি দ্বারা চা ছাঁকতেই অসাবধানতার ফলে উত্তপ্ত সবটা চা ইতিকার হাতে পায়ে পড়ে যায়।অসহ্য ব্যাথায় নিজেকে দমন করতে পারেনি।

    নিরিবিলি পরিবেশটায় তৎক্ষনাৎ “আল্লাহ গো” বলে চিৎকার দিয়ে উঠে।তার চিৎকারটা সর্ব প্রথম নাসরিনের কর্ণকুহুরে প্রবেশ করে।ধরফড়িয়ে উঠে বসেন তিনি।তাড়াহুড়ো করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।তার তাড়াহুড়ো দেখে ইব্রাহিমো স্থির থাকেন’নি সহসা চোখে চশমা এঁটে রুম থেকে বেরিয়ে যান

    চিৎকারে চোখ ছুটে যায় ইনানের।মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে ইতিকাকে খুঁজতে থাকে।ফাঁকা বিছানা দেখেই তড়াক করে উঠে বসে।খালি গায়ে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে সহসা নিচে নেমে যায়।ইতিকার ক্রদন আঁখি যুগল দেখে বুকের বাম পাশটায় মুচড়ে উঠে।

    – ইতিবউ কী হয়েছে আপনার?

    ইতিকা চোখ তুলে তাকায়।গাল ফোলানো কান্নায় যেন আবদার করছে ‘আপনি এসে ছুঁয়ে দিন,সারিয়ে দিন আমার অসুখ’।কিন্তু মুখ দিয়ে টু’শব্দ বের করলো না সে।গাল ফুলিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে কাঁদতে থাকে।

    – মা ইতিবউয়ের হাতে পায়ে মলম দিচ্ছো কেন?কি হয়েছে তার?

    ইনানের অস্থির কন্ঠ।

    – তুই কই থাকিস?মেয়েটার যে গায়ে জ্বর নিয়ে চা করতে রান্না ঘরে এলো আবার সেই চা হাতে পায়ে ফেলে পুড়িয়েছে।তুই কী শান্তির ঘুমে ছিলি?পাশে ছিলি না তার?

    নাসরিনের প্রখর তেজযুক্ত কন্ঠ।

    – মা আমি তো….

    – চুপ কর।হাত কতখানি পুড়ে গেছে দেখ অসভ্য ছেলে।বউয়ের যত্ন নিতে পারিস না আবার আসছে বিয়ে করতে।বিয়ে কী তোর কাছে বউপুতুল খেলা লাগে’রে হতচ্ছাড়া।

    ইনান কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।সে যে উদাম গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকেও হেলদোল নেই তার।অপরদিকে ইব্রাহিম ছেলের শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে তীর্যক দৃষ্টিতে।ইনানের পিঠে, গলায় এতটা আঘাতের চিহ্ন,কেটে যাওয়ার ক্ষত যে স্বাভাবিক নয় তা তিনি ভালো করেই যানেন।রাস্তা ঘাটে গুন্ডা-মাস্তানের মতো চলা ফেরা করলে অবশ্যই এমনটা হবেই।তার ছেলের যে কত শত্রু আশে পাশে বন্ধু বেশে ঘুরছে তার ইয়াত্তা নেই।
    .
    সেদিন রাতটি পার হয়ে গেলো।ইতিকার জ্বর এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।হঠাৎ কাঁপুনি জ্বরে মরণ প্রায় অবস্থা।ইব্রাহিম এবং নাসরিন দুজনেই দূরসম্পর্কের কোন আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর শুনে প্রায় সকালেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যান।তারপর থেকেই ইতিকা এই জ্বর শরীর নিয়ে বাড়িতে একা।অবশ্য তার দেখা শোনার জন্য বাড়ির কাজের মেয়ে রূপসী নিয়োজিত আছে।

    নিরিবিলি পরিবেশে ধস্তাধস্তির শব্দে উঠে দাঁড়ায় সে।বেশ কয়েকবার রূপসীকে ডাকতে থাকলো ভাঙ্গা গলায়।কিন্তু মেয়েটির খোঁজ নেই কোথায় আছে কে জানে!ইতিকা দূর্বল শরীর নিয় দোতলায় নেমে এলো।বাড়ির বাইরে গ্যারেজ থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।এছাড়া বাড়ির বাইরের পরিবেশটা স্বাভাবিক ঠেকলো না তার কাছে।কেমন যেন সবটা এলোমেলো।কোন গার্ড কিংবা সিকিউরিটিকেও দেখা যাচ্ছে না।বেশ আগ্রহ নিয়ে ইতিকা গ্যারেজের সামনে চলে যায়।

    কিন্তু ফ্লোরে রক্তের ছিটে দেখে আতঁকে উঠে সে।ইনানের কুকীর্তির কথা ভেবে মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে।নিজের আগ্রহ বশে আনতে না পেরে গ্যারেজের দরজা ফাঁক করে ইতিকা।তৎক্ষাণাৎ ভাঙ্গা গলায় চিৎকার করে উঠে মেয়েটি।থরথর করে কাঁপতে থাকে তার শরীর।চোখের কোন থেকে ঝরছে টপটপ নেত্র বারী।ইনান আততায়ীর গলায় ছুরি ধরে আছে বেশ গভীর ভাবে।চামড়া ছিলে রক্ত পড়ছে লোকটির।মাটিতে লুটিয়ে আছে চারজন ছেলের আহত দেহ।তাদের শরীরে রক্তে মাখামাখি।
    ইনানের শার্টের একপাশটা ছিড়ে আছে।রক্ত ঝরছে তার বাহু থেকে।ইতিকার দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকাতেই ইনানের হাতে বন্দী ছেলেটা ছুরি’টি নিজ হাতে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ইনানকে।ইতিকা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় সুযোগ সমেত ধারালো ছুরিটি বেশ গভীর ভাবে বাহুতে পোঁচ দেয়।আরেকটি পোঁচ দেয় ইতিকার গলায়।দুটো আঘাতেই গলগল করে ঝরতে থাকে রক্ত।

    ইনান এতক্ষণ স্থির থাকলেও ইতিকার কাতর চিৎকারে হুশ ফিরে তার।

    – শু*য়রের বাচ্চা দাড়া তুই।

    ইনানের গর্জ উঠে।কিন্তু তার ধরা ছোঁয়ার আগেই পালিয়ে যায় ছেলেটি।

    ___
    ঝুম বৃষ্টি চারিদিকে।বৃষ্টির তোড়ে শীত যেনো হুট করেই নেমে পড়েছে শহর জুড়ে।শেষ বিকেল পশ্চিম আকাশে সূর্যটা লালভাব ছড়িয়ে আছে।নয় তলা বিল্ডিংএর বারান্দায় দাড়িয়ে কফি পানে ব্যস্ত ইনান।খুব আলতো ভাবে কফি মগে চুমুক দিয়ে পাশের ছাদে তাকালো সে।এক জোড়া দম্পত্তি চিলেকোঠার ঘরের পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে দুজনে।ইনানের বারান্দা থেকে তাদের ভিউটা বেশ ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে কিন্তু তারা হয়তো বা ইনানকে লক্ষ্য করেনি।দম্পত্তি জোড়ার খুনশুটি দেখে ইনানেরো মনের বাসনা জাগে তার ‘ইতিবউকে’ নিয়ে ভেজার।

    কিন্তু তার প্রাণ প্রিয় স্ত্রী অচেতন হয়ে বিছানায় শয্যা গ্রহন করেছে।
    হঠাৎ মেঘময় আকাশে বিজলি চমকে উঠে।আকাশ চিড়ে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর বজ্রপাতের শব্দ।আর সেই শব্দে অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি লেপ্টে যায় তার স্বামীর বুকে।মেয়েটি বেশ ভালোভাবেই ভয় পেয়েছে।ছেলেটি মেয়েটির মাথায় আশ্বাসের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।নিশ্চই আশ্বাসবাণীও ছুড়ে দিয়েছে মেয়েটির কানে।ইনান তাদের কান্ড দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। ‘মানুষের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে।যদি না থাকে মনে হিংসে বিদ্বেষ।কেননা হিংসাত্মক মানুষের মনে অন্যর সুখ নিশ্চই সহ্য হয়না!’

    ইনান তাদের দিকে তাকিয়ে আরেকবার কফির মগে চুমুক দেয়।ইতিবউ তাকে কখনো কী আপন মনে ভালোবাসবে?নাকি সারাজীবন এমন পাক্কা অভিনয় করে ভালোবেসে যাবে?ইনান তো তার ইতিবউয়ের পথ চেয়ে আছে।

    হঠাৎ আরেকটি বজ্রের শব্দে কেঁপে উঠে ইনান।বজ্রের শব্দ শেষ হতেই কানে আসে হেঁচকির আওয়াজ।নিশ্চই ইতিকার ঘুম ভেঙ্গেছে।ইনান তড়িঘড়ি করে রুমে প্রবেশ করে।ইতিকা চোখ খিঁচে কাদঁছে।চোখের কোনে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা।গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।।ইতিকা যে ঘুমের ঘোরেই কাদঁছে তা বুঝতে পারে ইনান।মেয়েটির পাশে বসে বাম হাতটা আকড়ে ধরে।অন্য হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।
    ইতিকার এখনো জ্বর কমেনি।বরং যেন বেড়েছে।হাতে গলায় মেয়েটির ব্যান্ডেজ।

    ইতিকা চোট পাওয়ার পর তাকে নিয়ে ফ্লাটে চলে আসে ইনান।বাড়িতে আজ কেয়ারটেকার ছাড়া কেউ নেই আর সেই সুযোগে ইতিকাকে আবারো নিজের কাছে নিয়ে আসে সে।
    .

    অলীদের রুমে পার্মিশন ছাড়াই ডুকে যায় ইনান।দ্রুত সিঙ্গেল সোফায় বসে রুষ্ট কন্ঠে বলে,

    – ডাক্তার কি মেডিসিন দিয়েছে?কি স্যালাইন দিয়েছে?ইতিবউ এখনো চোখ খুলতে পারছেনা।জ্বর ধীরে ধীরে বাড়ছে।মেয়েটি ঘুমের ঘোরেই হেঁচকি তুলে কাদঁছে মানে বুঝতে পারছিস অলীদ?তার কতটা কষ্ট হচ্ছে।

    অলীদ বিছানার সাথে হেলান অবস্থায় ইনানের দিকে একপলক তাকালো।ছেলেটা যে অস্থির হয়ে আছে তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।

    – একটু ধৈর্য্য ধর সব ঠিক হয়ে যাবে।তোর শরীরে এত প্রেসার কেন দিচ্ছিস?তুই নিজেও অসুস্থ।যা রেস্ট নে।

    – আমার কোন রেস্ট নেই।অন্তত ওয়াসিমকে পঙ্গু করা ছাড়া স্থির হবো না আমি।

    অলীদ উঠে দাঁড়ায়।জানালার শার্সি ধরে তাকিয়ে থাকে থম মেরে বাইরে বৃষ্টির দিকে।

    – তোকে একটা কথা বলা হয়নি আমার ইনান।

    অলীদের কথায় চকিতে তাকায় সে।স্থির ভঙ্গিতে আবার সোফায় গা এলিয়ে অলীদকে বলে,

    – বল।

    – সুফিয়ার পাগলামো আবার বেড়ে গেছে।মেয়েটা ওয়াসিমের জন্য মনে হয় না নিজের মানসম্মান বজায় রাখবে।সেদিন ভার্সিটিতে ওয়াসিমের হাতে চড় পর্যন্ত খেয়েছে।তবুও তার চোখে মুখে আফসোসের কোন সীমা নেই।

    স্থির রক্ত প্রবাহ যেন এবার অস্থির হয়ে গেছে।অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে রাগটা।ফণি তোলা সাপের মতো ফসফস নিশ্বাসের শব্দ ফেলে উঠে দাঁড়ায় ইনান।সামনে থাকা ছোট্ট টেবিলটাতে জোরে কদমে পদাঘাত করে সরিয়ে দিলো।যেন আজ সারাদিনের রাগ টেবিলটার উপর ঝেরেছে সে।

    – ওই গন্ডারের সাহস হলো কী করে সুফুর গায়ে হাত তোলার?

    ইনানের রাগী আরক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির ভাবে তাকিয়ে আছে অলীদ।

    – এখানে ওয়াসিমের দোষ নেই।বার বার ওয়াসিমের কাছে প্রেম নিবেদন করার মানে কী?ছেলের কী অভাব পড়েছে দেশে?আগেও ঠিক এমন নাটকটাই করেছে।মাঝামাঝিতে ওয়াসিম বিদেশ থাকায় পরিবেশ স্বাভাবিক ছিল তবে এখন আবার একই।

    ইনান শব্দ করে শ্বাস ছাড়ে।দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দৃষ্টি নত করে।

    -ঠিক,আগেও ওয়াসিমকে কিছু করা যেতনা।সুফিয়া লেগে বসতো।শালার এই ছেলের মাঝে কী আছে?আমার ফ্রেন্ড,আমার বউ,সব তার জন্য পাগল অদ্ভুত!

    ইনানের কথা শুনে স্মিথ হাসে অলীদ।

    – ভুল বলছিস ভাই।তোর বউ হওয়ার আগে ইতিকা তার গার্লফ্রেন্ড ছিল।অন্তত যাই হোক ওয়াসিম সত্যি ভালোবাসে ইতিকাকে।আর তুই ইতিকার সঙ্গে যা করছিস তোর মনে হচ্ছে না বেইমানি হচ্ছে?

    – কী করেছি আমি?অজপাড়াগাঁ থেকে মেয়েটাকে এনে সব সুযোগ সুবিধা দিচ্ছি এটাই আমার বেইমানি নাকি ভালোবেসে আগলে রাখছি এটা আমার বেইমানি?তার জীবন বাঁচিয়েছি শত্রুর কবল থেকে আর উপহার দিলাম সাজানো গোছানো সংসার, পরিবার।এটা কি আমার বেইমানি ছিল অলীদ?

    – না।তবে ওয়াসিম যে বিয়ে করেনি কেন মিথ্যা বললি তাকে?এটা তো বেইমানি।

    ইনান কথার উলটো পিঠে আর কথা বললো না।থম মেরে স্থির চিত্তে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে।

    – আর যাই হোক অলীদ ওয়াসিমের কোন ‘প্রিয়’ ব্যাক্তিত্ব আমি টিকতে দেবো না।সব কেড়ে নেবো তার।তোরা অতীতের বিষটি ভুলে যাস কি করে বলবি?আমি তো ভুলতে পারিনা।আমার তো ভাবলে এখনো কান্না পায়।

    অলীদ মাথা নুইয়ে নেয়।তার চোখের কোনে পানির এসেছে আর সেই পানি দেখাতে চায় না ইনানকে,তাই ঘুরে জানালার রিলিং ঘেষে দাঁড়ায়।হাত দিয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি নিয়ে মুখে ছিটে দেয়।এ যেন তার কান্না লুকানোর বৃথা চেষ্টা।

    – আমি কোন কিছু ভুলিনিরে।শুধু সময়ের সাথে সাথে বিষটি ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি।আচ্ছা বাদ দে।যা তুই ভাবীর কাছে।তবে একটা কথা শোন আমি যা করার করে নিয়েছি সুফুর বাবাকে সবটা জানিয়েছি।তিনি ভিসা,পাসপোর্ট রেডি করছেন তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিবেন খুব শীঘ্রই।

    – সে যদি ভালো থাকে তবে তাই হোক।

    ইনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
    ___

    বৃষ্টির গতিক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।কেয়ারটেকারের মাধ্যেমে খবর নিয়ে জানতে পেরেছে ওই বাড়িতে এখনো ইব্রাহিম এবং নাসরিন এখনো এসে পৌছায়নি।তারা নাকি আরো একদিন থেকে আসবেন।
    মধ্যে রাতে ইতিকার বাম হাতটা জড়িয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে ইনান।বাম হাতের ক্যানলার দিকে তাকিয়ে আছে রাশভারী দৃষ্টিতে।ইচ্ছে করছে খুলে ছুড়ে ফেলে দিতে।নিশ্চই ইতিবউয়ের খুব কষ্ট হচ্ছে।

    জ্বরের তোড়ে দু’গাল লালভাব হয়ে আছে।ইনান ইতিকার গালে আলতে করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।শুষ্ক ঠোট যুগলের চামড়া ফেঁটে উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে।ইনান সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।

    – সম্পর্কের চার মাস পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমায় তুমি সেচ্ছায় আজ পর্যন্ত একটা চুমু খেতে দাও নি।কেমন বউ তুমি ইতিবউ?

    ইনান বিড়বিড় করে কথাটি বলে নিজেই হেসে দেয়।বালিশে মাথা রেখে ইতিকাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে ; গায়ের কাঁথা জড়িয়ে ডান হাতে মোবাইলের বাটন চেপে সময়টা দেখে নেয়।রাত তিনটে ছত্রিশ মিনিট।

    __

    ‘সুখ’ শব্দটা যেন ইনানের জীবনে বেমানান।বেশ বেলা করে ঘুম ভেঙ্গে এমন পরিস্থিতি পড়বে কল্পনাও করেনি সে।ইতিকা তার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে।ইনান পাশে বসলেও চিৎকার করে তাকে সরিয়ে দিচ্ছে,
    হুট করেই চেনা মেয়েটি যেন অচেনা হয়ে উঠেছে।এদিকে অলীদো বাসায় নেই।ইনান কি করবে ভেবে উঠতে পারছেনা।ইতিকার শরীরের জ্বর এখন নিয়ন্ত্রণে তবে শরীরের দূর্বলতা এখনো কাটিয়ে উঠেনি।

    -ইতিবউ সমস্যা কি আপনার?

    – আমি বাড়ি যাবো,আমি মিহির কাছে যাবো।

    – হঠাৎ গ্রামে যেত চাইছেন কারন কী?

    – কিছু না আমি এখানে থাকবো না।আমার ভালো লাগছেনা।

    ইতিকার আচরণে কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে ইনানের।মেয়েটি চোখ তুলেও ইনানের দিকে তাকাচ্ছে না।
    ইতিকা কথা শেষ করে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়।ছুটে পালিয়ে বাচঁতে, অসাবধানতার বশে ক্যানলার সুই ছিটকে বেরিয়ে আসে হাত থেকে।তৎক্ষনাৎ রক্ত ঝরতে শুরু করে,সেদিকে তাকিয়ে ইনান ছুটে আসে।ইতিকার ওড়নাটা নিয়ে দ্রুত তার হাতে চেপে ধরে।

    – এত অসাবধান কেন আপনি?কাল এতটা রক্তক্ষরণ হয়েছে আজ আবার….

    ইনান তাড়াহুড়ো করে ইতিকার হাতের রক্ত নিয়ন্ত্রণে আনে।কিন্তু ইতিকার ফের অদ্ভুত আচরণ আবার শুরু।ইনানকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে পালিয়ে বাচঁতে যায়।লাহমায় রাগান্বিত ইনান ইতিকাকে আটকাতে পেছন থেকে ইতিকার চুল টেনে ধরে।কোমর সমান ঢেউ খেলানো চুলগুলোতে টান পড়তেই সহসা দাড়িয়ে যায় সে।

    -আহ লাগছে আমার।

    -লাগুক।এতটা অদ্ভুত আচরণ করার মানে কী?কি হয়েছে আমাকে বলবেন তো!নাকি জ্বরের তোড়ে ব্রেনের ভাজে ভাজে তার ছিড়ে গেছে?

    ইতিকা উত্তর দিলোনা।বরং ঠোঁট খিচে কেঁদে উঠলো শব্দ করে।

    – আমাকে ছাড়ুন প্লিজ।এখানে নিয়ে আসার মানে কী?আমি তো ওই বাড়িতে ছিলাম।তাহলে ফ্লাটে?

    – কেন কোন সমস্যা?আমি নিয়ে এসেছি আপনাকে।নিজের সাথে নিজে আপনি এত জোর খাটাচ্ছেন কেন?আপনি এখনো দূর্বল।

    – আমার যা ইচ্ছা তা হোক।আমাকে গ্রামে দিয়ে আসুন প্লিজ।আমি আর আপনার জীবনে থাকতে চাইনা।

    – আপনার শাশুড়ী আম্মাকে কথা দিয়েছিলেন আমাকে ভালো পথে আনবেন।সাংসারিক বানাবেন।এখন পালিয়ে বাচঁতে চাইছেন কেন ইতিবউ?আর আপনার এত অস্বাভাবিক আচরণ আমার মাথায় ডুকছেনা।

    ইতিকা চুল ছাড়িয়ে ইনানের কাছ থেকে সরে বসে।

    – আপনাকে মানসিক রোগী মনে হয় আমার।কাল কীভাবে ছেলেগুলোকে….উফফ আমি আর ভাবতে পারছিনা।দেখুন আমি সাধারণ গ্রামের মেয়ে আমি চাইনা আর আপনার জীবনের সাথে জড়িয়ে যেতে।তাই আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো।

    ইতিকার কথায় রুষ্ট হয় ইনান।দুচোখ খিচে বন্ধ করে কপাল তর্জনির আঙুল দ্বারা ঘষে বলে,

    – কী বললেন? আবার বলুন।

    – শুনতে পাননি?আমি মুক্তি চাই।স্বামী,স্ত্রী বন্ধন থেকে মুক্তি চাই।

    ইতিকা কথা ইনানের কানে বিষ ফোড়নের মতো আঘাত করেছে।কথার তীরটা যেন তার বুকের বা’পাশটায় তীর্যক ভাবে ঠেকেছে।পকেট থেকে রিভেলবার নিয়ে ইতিকাকে পেছন থেকে মুছড়ে ধরে।মেয়েটির থুতনিতে রিভেলবারের নল ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে তা গলার নিচে নামিয়ে আনে।

    – সরি ইতিবউ, আই নিড ইউ।আমার মৃত্যুর আগে আপনার নিস্তার নেই।কাল কি হলো?আজ কি হলো?সবটা ভুলে যান।আগে যেমন ছিলেন তেমন হয়ে যান প্লিজ।তাছাড়া আপনি অসুস্থ।

    – আমার এখানে ভালো লাগছে না আমাকে কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে রেখে আসুন।

    হঠাৎ ইতিকার কন্ঠ মলিন হয়ে গেছে।তার শান্ত সুরে কথায় স্মিথ হাসে ইনান।

    – সরি সেটাও হবে না।আমার কাছে থাকবেন আপনি।

    – আপনি আমার কোন কথা রাখেন না, কোন কথা মানেন না।অন্তত ওয়াসিম আপনার জায়গায় হলে এতক্ষণে সবটা ছেড়ে আমার কাছেই ছুটে আসতো।

    – ওই জা-নো,য়ারের নাম এখানে আসলো কেন?

    ইনানের কথার ভাব ভঙ্গিতে তেতে উঠলো ইতিকা।

    – সে যাই হোক আপনার মতো অন্তত খুনখারাপি করেনা।

    ইতিকার মুখে এমন কথায় আবারো হাসলো ইনান।

    – শুনোন বউ আপনার বর আর যাই করুক খুন করেনি আজ পর্যন্ত।আর যা মারপিট করেছি সবটা প্রয়োজনে করেছি।কিন্তু আপনার ওয়াসিম প্রাত্তন যে খুনি সেটা কি জানেন?

    ইতিকা ঘাড় ঘুরিয়ে ইনানের দিকে তাকায়।ইনান ইতিকাকে বিছানায় বসিয়ে ল্যাপটপ অন করে।একটি ভিডিও প্লে করে ইশারা করে ইতিকা তাকানোর জন্য।

    ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওয়াসিম একটি ছেলের মাথায় পাথর নিক্ষেপ করে।শেষ পর্যায়ে আট তলার বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ছেলেটিকে ছুড়ে ফেলে দেয়।
    ইতিকা সহসা দুচোখ খিচে বন্ধ করে নেয়।

    – ছেলেটি আমাদের ব্যাচের একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।ওয়াসিমের গুন্ডা গিরির জন্য হেড টিচারের কাছে নালিশ করে।পরবর্তীতে আরো বিভিন্ন ঝগড়ায় পুলিশের দপ্তরে মামলাও করে।যার প্রতিশোধ হিসেবে ওয়াসিম কেড়ে নিলো ছেলেটির জীবন।আর ছেলেটির খুনি সাজানো হলো ওয়াসিমের বাবার দলের একজন চামচা লোককে।যিনি এখনো যাবজ্জীবন কারাদন্ডে আছে।তোমার ওয়াসিম ভালো তবে মুখোশধারী ভালো।
    চাইলে আমি সবটা খোলাসা করতে পারি কিন্তু আমার চাওয়া যে অন্যকিছু।

    ইতিকা নিরুত্তর হয়ে বসে আছে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার।সহজ-সরল জীবনটায় দুইদুইটা দাগি আসামী জীবনে প্রবেশ করেছে।এই জীবন নিয়ে ভবিষ্যত ভাবাও যেন দুষ্কর।

    #চলবে
    ®পলি আনান।

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১৫]

    __________
    – আসসালামু আলাইকুম কাকিমা সুফিয়া কোথায়?তার সাথে দেখা করতে এসেছি।

    গোলগোল চশমার কাচ দিয়ে অলীদের দিকে সুফিয়ার মা তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে।কিছুক্ষণ আগেই তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন।দারোয়ান ফোন করে জানালেন সুফিয়ার বন্ধু অলীদ এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে।তখন বেশ খানেকটা অবাক হন তিনি।কেননা ঘড়িয়ে সবে মাত্র আটটা পাঁচ।এত সকাল সকাল ছেলেটা কি মনে করে আসলো তিনি বুঝতে পারছেন না।

    – কাকিমা সুফিয়া কোথায়?

    অলীদ বেশ জোরেই কথাটা বলে উঠে।সহসা সামনে বসে থাকা অর্ধ বয়স্ক মহিলাটি নড়ে চড়ে বসেন।

    – বাবা তুমি এত সকালে এসেছো তাই ঘাবড়ে গেছি।কোন সমস্যা হয়েছে?

    – না আন্টি কোন সমস্যা না।আসলে আজ আমি বাড়ি যাবো।তাই ভাবলাম সুফুর সাথে দেখা করে যাই।তাছাড়া অনেকদিন হয়েছে আমাদের দেখা হলো না।আন্টি আঙ্কেল কী সত্যি তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে?

    – হ্যা,বাবা।তোমারা তো জানো তিনি এক কথার মানুষ আগেও চেয়েছে সুফিয়াকে দেশের বাইরে পাঠাতে।কিন্তু মেয়ে যেতে চায় নি।এবারো যদি কোন গন্ডগোল করে তবে,হয় তাকে বিদেশ পাঠানো হবে, না হয় বিয়ে দিয়ে দেবেন।মেয়েকে আর এই শহরে একা রাখতে ইচ্ছুক নন তিনি।কোন ইতরের প্রেমে পড়েছে এই মেয়ে ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে।ওয়াসিম ছেলেটার জাত পাত মোটেও সুবিধের নয়।আমাদের সাথে তো কোন দিক দিয়েই যাবে না।

    এতক্ষণ সুফিয়ার মায়ের বলা কোন কথায় কানে ডুকলো না অলীদের।সুফিয়ার বিয়ের কথা শুনেই তার চোখে মুখে যেন ধৌঁয়া উড়ছে।সবটা এলোমেলো লাগছে।
    মেয়েটাকে নিয়ে তার মনে কেন এত অনুভূতি জমা হলো?ইনান যদি যানে তবে নির্ঘাত দু’চার চড় তার গালে বসিয়ে দেবে।কিন্তু কি করবে সে?সুফিয়ার প্রতি অনুভূতি ভালোলাগা থাকলেও সে নিজেই প্রতিবার সবটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গেছে।তার বেস্ট ফ্রেন্ড তার মানে এই নয় যে ভালোবাসতে হবে নিজের বউয়ের মর্যাদা দিতে হবে।আর সুফিয়া জানলেও হয়তো বন্ধুত্বের বন্ধনটা আলগা হয়ে যাবে।তাই প্রতিবার চুপ ছিল সে।কিন্তু ওয়াসিমের জন্য কান্না করা,পাগলামো দেখে মনের কোনে হিংসাত্মক ভাব চলে আসছে।কেন হচ্ছে এমন?

    – আন্টি সুফিয়ার রুমে কি যাবো নাকি সে আসবে?

    – তোমাকেই যেতে হবে।তাকে বাইরে থেকে বন্ধ করে রাখা হয়।

    অলীদে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

    .
    এলোমেলো চুল চোখের সামনে এসে ছুঁয়ে গালে বেয়ে গলায় আছড়ে পড়ে আছে।দু’ঠোঁট উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে।সুফিয়ার দুগালে কেমন যেন আঙুলের ছাপ ভাসমান।অলীদের কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক লাগলো না।

    – সুফু উঠ,আমি এসেছি।

    বাক্যটা সুফিয়ার কর্ণকুহুরে ঠেকলো কী না কে জানে?সে এখনো ঘুমিয়ে আছে একই অঙ্গভঙ্গিতে।

    – এই যে নবাবজাদী উঠুন এবার।গায়ে পানি ঢালতে আমি কিন্তু দু’মিনিটো দেরি করবো না।

    সুফিয়া এখনো ঘুমিয়ে আছে।তার বড় বড় শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ রুমে যেন বার বার প্রতিধ্বনি হচ্ছে।অলীদ কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকলো।মেয়েটার গালে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ।সুফিয়ার গালে হাত দেবে কী দেবে না।ভাবতে ভাবতে নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে যায়।অলীদের সন্দেহের বাতি নিভে যায় খাটের তলায় একটি ঔষুধে পাতা দেখলে,যেটি ঘুমের ঔষুধ।

    অলীদ এবার সব বাঁধা ভুলে সুফিয়ার গালে হাত বুলাতে থাকে।

    – এই সুফু উঠ।সুফু এই সুফু।

    সুফিয়া উঠলো না বরং তার ভারী ভারী নিশ্বাস অলীদের হৃদপিন্ডের গতি বাড়িয়ে তুলছে।দু’বাক্য না ভেবে ঝটকায় সুফিয়াকে কোলে তুলে নেয় অলীদ।দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে গিয়ে ঝরনার নব ছেড়ে দেয়।সুফিয়া এখনো অলীদের বুকে লেপ্টে আছে।পানির ছিটকায় সহসা চোখ খুলে সুফিয়া।হঠাৎ আক্রমণে কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছেনা সে।

    – ঘুমের ওষুধ গিলেছিস কয়টা?

    – কে কে?

    – তোর যম!

    পানির গতিতে চোখে খুলতে পারছেনা সুফিয়া।নিজেকে ভাসমান অনুভব করে ঘাবড়ে গেছে সে।

    – ব..বন্ধ করুন।বন্ধ করুন প্লিজ।

    সুফিয়া অলীদ দুজনেই ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে।অলীদ ঝরনার নব ঘুরিয়ে দেয় সহসা পানির গতিক থেমে গেছে।পিট পিট চোখ তুলে তাকায় সুফিয়া।অলীদকে দেখে আসমান থেকে পড়ার মতো অবস্থা তার।

    – ত..তুই?

    – কার কথা ভেবেছিলি?ওয়াসিম?নাকি তোর হবু বরের কথা?

    – একদম বাজে বকবি না।আমাকে ভিজিয়ে দিলি কেন?

    – তোর ঘুম ভাঙ্গছিল না তাই।এবার বল ঘুমের ওষুধ কয়টা গিলেছিস?

    সুফিয়া মাথা নুইয়ে নেয়।
    অলীদ তাকে চুপচাপ দেখে এবার বেশ ধমকের সুরেই বলে,

    -সুফু কথা বল আমাকে একদম রাগাবিনা। কোলে আছিস আছাড় মারতে বেশ সুবিধা হবে। এক আছাড়া তোর ভালোবাসা কারে কয় ছুটিয়ে দেবো।

    সুফিয়া এবার ঘাবড়ে যায়।দৃষ্টি নত রেখে আমতা আমতা সুরে বলে।

    – দুইটা খেয়েছি।

    – এত কম কেন?আর ছিলনা বুঝি?

    – না ওষুধের খোসায় দুইটাই ছিল।

    অলীদ ফসফস করে শ্বাস ছাড়ছে।দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা কেটে যায়।অলীদ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুফিয়ার দিকে।অপরদিকে সুফিয়া পড়েছে অস্বস্তিতে।এতক্ষণ অলীদের কোলে নিজের অবস্থান দেখতে বড্ড বেমানান লাগছে।

    – আমাকে ছাড় অলীদ।

    অলীদের হুশ ফিরেছে।এবার নিজেই যেন বেকায়দায় পড়েছে সে।লজ্জায় ইচ্ছে করছে এক ছুটে পালিয়ে যেতে।তার অস্বস্তি ভাব বুঝতে পেরে সুফিয়া ঠোঁট বাকা।অলীদ সুফিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।

    – তোর গালে চড় দিয়েছে কে রে সুফু?

    – আর কে মারবে?তোর দাম্ভিক আংকেল মেরেছে।রাগে জিদে তাই তো ওষুধ খেলাম।দাগ বসে গেছে নাকি রে?

    – হুম দু’আঙুলের ছাপ স্পষ্ট।চিন্তা করিস না তোর হবু বর আদর করে সারিয়ে তুলবে।

    – আমার হবু বর?

    – কেন জানিস না আঙ্কেল তোকে বিয়ে দেবেন।পাত্র খুঁজছেন।

    – কবুল বলার আগে আমার শরীর থেকে রুহ চলে যাক।আমিন!

    সুফিয়া রাগান্বিত স্বরে কথাটা বলে থেমে যায়।হঠাৎ দেয়ালের সাথে বেশ জোরে আঘাত লাগে তার।মেয়েটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে অলীদ, তার দু’গাল চেপে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরেছে।

    – আর যদি এই কথা তোর মুখ থেকে বের হয় তবে কসম বাকি গালটাও আর স্বাভাবিক থাকবে না।আমার রাগ,জেদ,শাসন এখনো কিছু দেখিস নি তুই।তোকে সোজা করা আমার সেকেন্ডের কাজ।তাই মাথা থেকে এইসব কু’বুদ্ধি ছেড়ে দে।দুই’সাপ্তাহ পর এক্সাম।পড়াশোনায় মন বসা।

    ফর্সা রক্তিম গাল,আরক্ত দৃষ্টি,দাঁতে দাঁত চেপে অলীদের কথার ভঙ্গিতে ঢোক গিলে সুফিয়া।
    ___

    ইনাকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ তোষামোদ করছে ইতিকা।

    – আপনি আসুন প্লিজ আর দুইদিন বাকি আপনার এক্সামের।কিছুই তো পারেন না একটু পড়তে বসুন।

    – সরে যান ইতিবউ আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।না গেলে মামু ভীষণ রাগ করবে।

    – করুক রাগ তিনি যাই ইচ্ছে তাই করুক আমি আপনাকে ছাড়ছিনা। আপনি পড়তে বসবেন মানে বসবেন।আর এখন রাত এগারোটা বাজে এত রাতে বের হলে আসবেন রাতের দুই,তিনটায় আমি ভালো করেই যানি।আপনার আর পড়া হবে না।

    – আপনার তো আজ এক্সাম শেষ যান চিল করুন আমাকে জ্বালাবে না একদম।

    – আমি আপনাকে জ্বালাই?

    ইনানের কথায় দুচোখ ছোট করে প্রশ্ন করলো ইতিকা।ইনান ব্লেজার গায়ে জড়িয়ে স্মিথ হাসে।

    – অবশ্যই।আমার না পড়লেও চলে।টুকে নিয়ে যাবো খাটি বাংলায় নকল করবো।

    – ছিহহ লজ্জা করেনা?আবার বলছেন নির্দ্বিধায়।আমি আপনার জন্য কত কষ্ট করে সব সাজেশন জোগাড় করেছি দেওয়রজির কাছ থেকে আর আপনি বলছেন নকল করবেন।

    – আমাকে যেতে হবে।

    – আপনাকে আমি বারণ করছি তবুও আপনি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন কেন?

    ইনান আরেকবার ইতিকার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।নিস্তব্দ রুম টায় ভাইব্রেট হতে থাকে ইনানের ফোন।স্কিনে বাহরুল ইসলামের নাম্বার দেখে তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে।

    – হ্যা মামু বলো।

    – তুই কইরে?সবাই বসে আছে।

    -দশ মিনিট আমি আসছি।

    ইনান ফোন রেখে।ইতিকাকে টেনে দাড় করায়।মেয়েটার কপালে থাকা চুলগুলো সরিয়ে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একেঁ দেয়।

    – আমি গেলাম ইতিবউ।দুঃখিত আপনার কথা রাখতে পারলাম না।

    নিগূঢ় রাগটা বাইরে থেকে প্রকাশ করলো না ইতিকা।মানুষটা তার কথা রাখেনি?এই তার ভালোবাসা!এই বাড়িতে থাকা যেন তার কাছে বন্দি জীবন লাগে।শশুড়-শাশুড়ী,স্বামীর ভালোবাসা, আদর, যত্ন পেলেও কোথাও যেন নিজেকে বন্দিনি মনে হয় তার কাছে।আচ্ছা ইনান কী সত্যি তাকে ভালোবাসে?না কী ওয়াসিমের সাথে শত্রুতার বর্শে তাকে বিয়ে করেছে?উত্তর অজানা তার।
    ‘নারী’ জাতীর মন গলানো সবচেয়ে সহজ মাধ্যেম ভালোবাসা।মেয়েরা ভালোবাসায় কাঙাল।একটু আদুরে কথা,আদর যত্ন পেলেই পোষ মেনে যায়।আর সেই কাজটাই কি করেছে ইনান?
    আর ভাবতে পারলো না সে।মাথার ভেতরটায় সব প্রশ্নেরা একসঙ্গে খেলা করছে।

    দ্রুত পা চালিয়ে নিচে নেমে এলো ইতিকা।ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে মন মরা হয়ে বসে আছেন তার শাশুড়ী মিসেস নাসরিন।

    – আম্মা আপনি বসে আছেন কেন?

    – খাবি না রাতে?

    – আপনার ছেলে তো না খেয়ে গেলো আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।আব্বা কি খেয়েছেন?

    – না।

    ইতিকা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লো নাসরিনের পাশে।

    – একটা কথা বলবো আম্মা?

    – বল।

    – আপনার আপন ভাই আপনার ক্ষতি করছে।তবে আড়ালে।আপনার একমাত্র ছেলেকে বখে দিয়েছে।সে এখন এক কথায় অবাধ্য সন্তান।অথচ আপনি আপনার ভাইয়ের সঙ্গ দিচ্ছেন?আব্বা আপনার ভাইকে নিয়ে কিছু বললেই তেতে উঠছেন।আপনি কী কিছু বুঝেন না?নাকি না বোঝার ভান করে আছেন?

    – মা রে আমি আমার সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।ভেবেছি তুই এসেছিস তুই তাকে আচঁলে বেধে নিবি কিন্তু তা আর হলো কই?

    ইতিকা মাথা নুইয়ে নেয়।রক্তিম দুচোখের কোনে পানি জমাট বেঁধে গেছে।

    – আম্মা তিনি আমার কোন কথাই শুনেন না।রাখেন না আমি কী করবো?আজকেও বার বার বারণ করেছি কিন্তু আমার কথায় তিনি সোপর্দ হননি।মামু ফোন করলো তৎক্ষণাৎ চলে গেলেন।

    নাসরিন মনঃক্ষুণ্ণ হলেন।ইতিকার দিকে তাকিয়ে প্রণত হয়ে বলেন,

    – আমার পরিবারের শেষ একজন জীবিত আমার ভাই বাহরুল ইসলাম।তাই তার সাথে জোর খাটিয়ে কিছু করছিনা।এক বছর আগে ভাইজানের সাথে রাগারাগি করায় এবং রাত করে বাড়ি ফেরায় জবাব চাওয়ায় ইনান বাড়ি ছেড়েছে।তাই আমি আর মুখ ফুটে কিছু বলি না।আর….

    দুজনের কথার মাঝেই মিসেস নাসরিনের ফোন বেজে উঠলো।স্কিনে ‘অলীদ’ নামটা দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু-কুচলালো।

    – এত রাতে উনি ফোন করেছে কেন আম্মা?

    – ধরে দেখি।

    মিসেস নাসরিন ফোন ধরলেন তবে অলীদ কথা বলতে চাইলো ইতিকার সাথে।

    – পিচ্চি ভাবী কেমন আছো?

    – আলহামদুলিল্লাহ ভালো দেওরজি।আপনি কেমন আছেন?

    – ভালো।ইনান কোথায় জানো কিছু?

    – মামুর সঙ্গে নাকি কোন মিটিংএ আছেন।

    – হাহ তোমার বর মিটিং এ আছে!সত্যি?এই মাত্র দেখে এলাম গোপন আস্তানায় প্রবেশ করতে।আর সেখানে যাওয়া আমাদের সাধারণ মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ।

    – গোপন আস্তানায় কী হয়?

    – বাহরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যারা আছে তাদের শায়েস্তা করা হয় ইনানের নির্দেশে।এই ছিল তার মিটিং?ছেলেটা বখে যাচ্ছে।প্লিজ কিছু একটা করো।

    -আমি কি করবো, আমার কিছু কি করার আছে?পারলে আপনারা আমায় মুক্তি দিন।

    ইতিকা ফোন কেটে দিলো।নাসরিনের কোলে আছড়ে পড়ে দু’চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে।

    – আম্মা আমায় মাফ করে দিন আমার আর ভালো লাগছেনা কিছু।এমন জীবন আমার দরকার নেই।এককথায় এখন আমি পরবাদিনী।আমার উপর থাকা সকল দাবী,চাওয়া পাওয়া তুলে নিন।আমার বাকিটা জীবন পড়ে আছে আমাকে আমার মতো চলতে দিন।

    নাসরিন ইতিকার দিকে তাকিয়ে আছে হতাশ দৃষ্টিতে।

    – তুই কিছু করতে চাইছিস?

    – হ্যা।

    – তবে যা,তুই মুক্ত।

    ___

    ইতিকার রগচটা ব্যবহারে সস্তব্দ ওয়াসিম।মেয়েটা পালটে গেছে।হুট হাট রেগে যাচ্ছে অদ্ভুত।

    – এত রাতে তুমি এখানে ইতিকা?ইনান কী তোমায় বের করে দিয়েছে?আমার জানা মতে ইনান তোমায় ছাড়ার পাত্র নয়।

    – এত প্রশ্ন করছো কেন ওয়াসিম।আমি যা বলছি তার উত্তর দাও।তোমার বউ কোথায়?

    – আমার বউ?কিসব বাজে বকছো তুমি?আমি বিয়ে করলাম কবে?

    – কেন দেশের বাইরে করেছো।

    – রাবিশ ওটা আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে ছিল।আমার পাশের মেয়েটি আমার ফ্রেন্ড।

    – তাই বলে এত জড়িয়ে ধরবে?ছবিতে আমি স্পষ্ট দেখেছি তোমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলে।

    – আমেরিকার কালচার সম্পর্কে তোমার ধারনা নেই।জড়িয়ে ধরা,কিস করা তাদের কমন অভ্যাস এটা আমাদের দেশ নয়।আমার ফ্রেন্ডকে আমি জড়িয়ে ধরতেই পারি।

    – তার মানে তুমি সত্যি বিয়ে করনি?

    – না।তবে আমার হবু বউ আমার সামনে।

    কথাটি বলেই মৃদ্যু হাসলো ওয়াসিম।কিন্তু ইতিকার মাথা কাজ করছেনা ইনান তাকে মিথ্যা বলেছে।তার সাথে প্রতারণা করেছে।বিয়ের পরদিন বলেছিল ওয়াসিমের আশা যেন ছেড়ে দেয় ওয়াসিম বিবাহিত।তবে?ইনান প্রতিটি কাজে প্রতিটি ধাপে তার সাথে মিথ্যা ছলনা করছে।

    – ইতিকা তোমার চোখে পানি কেন?নিশ্চই আনন্দের,আমার কাছে ফিরে আসার আনন্দের।আই এম সো হ্যাপি তুমি আমার কাছে আবার ফিরে এসেছো।

    ইতিকা ছলছল চোখে স্মিথ হাসলো।

    – যাবে ওয়াসিম?

    – কোথায়?

    – এমন জায়গায় ইফতিহার ইনান যেখানে আমাদের হদিস পাবেনা।তবে তার আগে আমি আমার গ্রামের বাড়ি যেতে চাই।

    – বেশ তবে তাই হোক।

    #চলবে

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১৬]

    ________

    ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখরিত।পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসে আছেন ইনান এবং বাহরুল ইসলাম।কিছুক্ষণ আগেই তারা জগিং করতে পার্কে এসেছে।গতকাল আর বাড়ি ফেরেনি ইনান।বেশ রাত হওয়ায় বাহরুল ইসলাম তাকে নিজের সাথে নিয়ে যান।

    – এবার আমি যাই মামু।কাল রাতে বাড়ি ফিরিনি মা জানলে নির্ঘাত আবার কোন কান্ড বাঁধাবেন।

    – নাস্তা না করে যেতে পারবি না।তোর মামি গরম গরম পরোটা ভাজবে বলেছে আমি তোকে না নিয়ে গেলে ভীষণ রাগ করবে।

    – কিন্তু..

    – চুপ করতো বেশি বকিস না।চল আরেক দৌড় দিয়ে আসি।নাসরিন কিছু বললে আমাকে ফোন করবি আমি তাকে বুঝিয়ে বলবো।
    _

    সূর্যের আলোতে ঝলমলে রোদ্দুর আছড়ে পড়ছে বাগানের দিকে।ইনান ধীর গতিতে এগিয়ে যায় বাগানের দিকে।যদিও বাগানটার এখন আর তেমন যত্ম করা হয় না।তাই অধিকাংশ গাছ পঁচে মরে আছে।ইনান বাগানের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সদ্য ফোঁটা একটি লাল টকটকে গোলাপ দেখতে পায়।গোলাপ হাতে নিয়ে তির্যক দৃষ্টিতে তাকায় তার বারান্দার দিকে।নিশ্চই এই ফুল ইতিকার খোপায় গুজে দিলে সব রাগ, জেদ পানিতে পরিণত হবে।

    পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ইনান।অপর দিকে বাগানের বিপরীত পাশে বাড়ির কাজের মেয়ে রূপসী দাঁড়িয়ে ছিল। ইনান কে বাড়িতে ডুকতে দেখে মাথায় হাত দিয়ে বাড়ির দারোয়ানকে সর্তক সুরে বলে,

    – আইজগা শেষ গো শেষ।আইজগা এই বাইতে একবছর আগে যে তুফান হইছিল আইগজা আবার হেই তুফান হইবো।ইতিকা ভাবী নাই গো নাই এটা হুনলে ইনান ভাইয়ের অবস্থাডা কি হইবো! বুঝবার পারছেন ভাই?
    .

    বাড়ির পরিবেশ একদম নিরিবিলি ইনান তার বেড রুম,বারান্দা,ছাদ,সবটা ঘুরে অবশেষে রান্না ঘরে পা বাড়ায়।

    – মা কেমন আছো?

    – ভালো।

    ইনান রান্না ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।ইতিকাকে না দেখতে পেয়ে কিঞ্চিৎ কপালে ভাজ পড়ে।

    – মা ইতিবউ কোথায়?

    – জানি না।

    – জানি না মানে?সারাদিন সে তোমার সাথেই থাকে আর তুমি বলছো তুমি জানো না।আমার সাথে কি ফাইজলামি করছো?

    কথাটা ইনান একটু জোরেই বললো।

    – দেখ তোর সাথে আমার মা-ছেলের সম্পর্ক।অবশ্য এই যে তুই আমার নাড়ি ছেড়া ধন এইটুকুই এর বেশি কিছু না।তুই তোর মর্জি মতো চলিস।আমি আমার মতো। তোর সাথে ফাইজলামি করার ইচ্ছে কিংবা সময় আমার নেই।

    – কথা এত প্যাচানোর মানে কী?যা বলবে সোজাসাপটা বলবে।

    নাসরিন ঘুরে দাঁড়ায়।কান্নার ফলে দু’চোখ আরক্ত হয়ে আছে।চোখ ফুলে গেছে খানিকটা।দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ইনানের চোখে চোখ রেখে বলে,

    – ইতিকা চলে গেছে কাল রাতেই।

    – চলে গেছে মানে কী?

    ইনানের কাটক্ষের স্বর।

    – কাল সে বলেছিল, এমন বন্দী জীবন তার ভালো লাগছেনা।তাকে এবার অন্তত মুক্ত দেওয়া হোক।

    – কাল কী এমন হয়েছিল যার কারনে ইতিকা চলে যাবে বাড়ি ছেড়ে?

    – তুই তার কথা অবমূল্যায়ন করলি কেন?মেয়েটা রাতে অনেক কান্নাকাটি করেছে।আমি তাকে সোজাসুজি বলেছি তাকে এই বাড়িতে যখন আমি এনেছি তখন মুক্তটাও আমি করে দিলাম।তার যদি ইচ্ছে হয় তবে থাকুক এই বাড়িতে ইচ্ছে না হলে চলে যেতে পারে।তারপর সে চলে যায়।চাইলে বাড়ির সিসি ক্যামেরা চেক করতে পারিস।

    – মা!

    ইনান ধমকে উঠলে রাগটা হঠাৎ করেই মাথায় চড়ে বসেছে।কাকে রেখে কাকে গনধোলায় দেবে বুঝতে পারছে না সে।মিসেস নাসরিন চুপচাপ হাতের কাজ সারছেন।যেন ইনানের দিকে মন দেওয়া সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ।

    – মা তুমি জানো ওয়াসিম বাইরে ওত পেতে আছে।একবার যদি ইতিকাকে পায় তবে, তবে….ওহ গড আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না।

    নাসরিন এবারো প্রত্যুত্তর করলো না।তিনি তার কাজেই ব্যস্ত।ইনান দ্রুত বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে।মেঝেতে পড়ে আছে একটু আগে ছিড়ে নেওয়া সেই ফুলটা।মিসেস নাসরিন মেঝেতে ফুলটা দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।

    – চাইলে তোর জীবনটাও এমন রঙিন,ফোঁটা ফুলের মতো পবিত্র করতে পারতি কিন্তু তুই বখে গেছিস।

    .
    নিকষকালো রাতের আধাঁরে ডুবে আছে শহরখানি।বারো তলার বিল্ডিংএর ছাদে বসে শ্যাম্পেইন এর বোতলে চুমুক দিচ্ছে ইনান।অলীদ তার পাশে বসে আছে থুতনিতে হাত দিয়ে।

    – আর কত গিলবি?এবার তো থাম।নিচে চল ঘুম আসছে আমার।

    অলীদের কথায় ঘুরে তাকায় ইনান।তার পাশে শ্যাম্পেইনের বোতটা ছুড়ে মারে রাগ নিয়ে।সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে ভেঙ্গে যায় বোতলটি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে অলীদ।

    – আব্বে শা’লা কি করছিস?মারবি নাকি আমায়?

    – তোর ঘুম আসছে?অদ্ভুত তোর ঘুম আসছে?আমি গত তিনদিন নির্ঘুমে আছি।এখনো আমার ঘুম আসছে না।আমার ইতিবউ কোথায়?তার হদিস এখনো পেলাম না আমি।

    – নিশ্চই ওয়াসিম নিয়ে গেছে তাকে।এর বাইরে আর কোন অপশন নেই।কেননা ওয়াসিম ছেলেটাও গত তিনদিন থেকে নিখোঁজ।আর ভাবী এই শহরটা চেনে না একমাত্র ওয়াসিম ছাড়া তাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না।চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও খুঁজে পেলাম না অদ্ভুত।

    – ওয়াসিমের সঙ্গে যদি কোন কিছু সত্যি সত্যি হয় সে যদি ওয়াসিমের সঙ্গেই যায় তবে কসম কলিজা টেনে ছি’ড়ে ফেলবো।বেয়াদপ মেয়ে সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি আমাকে বয়কট করে এক্স নিয়ে ভেগে গেছে।

    ইনান মাতাল ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে আরেকটা শ্যাম্পেইনের বোতল ছুড়ে ফেলে।

    অলীদ জানে ইতিকা কোথায় আছে তাই নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছে সে।এতদিন ইনানের পাগলের মতো অবস্থা দেখে বেশ মজা নিয়েছে অলীদ।অন্তত এই ছেলেকে কবজা করতে ইতিকার পালিয়ে যাওয়াটাই মূখ্যম ছিল।ইনানকে রাগাতে মুখ খুললো অলীদ,

    – তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?তোর জন্য মেয়ের অভাব হবে না অন্তত আরেকটা বিয়ে করতে পারবি যে গেছে যেতে দে ইতিকাকে মুছে ফেল মন থেকে।

    অন্ধকারে ঝাপসা চোখে অলীদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছে ইনান।অবশ্য কয়েক মিনিটে খুঁজেও পায়।তৎক্ষণাৎ ক্ষুদার্থ বাঘের ন্যায় ঝাপিয়ে পড়ে অলীদের উপর।হঠাৎ আক্রমণে মেঝেতে গিয়ে ঠেকে দুজনে।অলীদের মেরুদণ্ড যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।অসহ্য ব্যথায় আর্তনাদ করার আগেই ইনান তার গাল চেপে ধরে,

    – সাহস কম না তোর।আমার বউ আমি ছাড়বো মানে কী?এমনি এমনি বিয়ে করিনি।তাকে চাই বলে করেছি।

    – আরে ছ..ছাড় শা*লা।যদি এতই দরদ থাকতো তবে সেদিন ইতিকার কথা রাখলি না কেন?বাড়ির বাইরে গেলি কেনো তার উপর মিথ্যা বলেছিস তুই মিটিং এ আছিস।কিন্তু তুই গোপন আস্তানায় ছিলি।

    অলীদের কথায় হাতের বাধঁন আলগা হয়ে যায় ইনানের।

    – ইতিকা যানলো কী করে আমি মিটিং এ যাইনি।গোপন আস্তানায় গেছি?

    অলীদ এবার থতমত খেয়ে যায়।কি উত্তর দেবে ভেবে পেলনা সে।অপরদিকে মাতাল ইনান ধীরে ধীরে নুইয়ে যাচ্ছে শরীরের শক্তি তার ধীরে ধীরে ইতি টানছে।

    আজ সজ্ঞানে থাকলে সত্যিটা জানলে অলীদের গর্দান নিতেও দু’বার ভাবতো না ইনান।তা ভেবে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে অলীদ।
    _

    ভার্সিটিতে সুফিয়ার সাথে একটু কথা বলার জন্য দীর্ঘক্ষন অপেক্ষায় আছে অলীদ।আজ তাদের এক্সামের শেষ দিন।এবারের এক্সামটা আর দেওয়া হলো না ইনান এবং অলীদের।তবে সুফিয়ার বাবা এক্সামের দরুনে মেয়েকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।যদিও সর্বাবস্থায় তাকে নজরদারীতে রাখা হচ্ছে।

    সুফিয়াকে আসতে দেখে এগিয়ে গেলো অলীদ।

    – হেই এক্সাম কেমন হলো সুফু?

    – কচুপোড়া এক্সাম দিয়েছি।কোন কিছু কমন পড়েনি।সামনের ছেলেটার কাছ থেকে সব দেখে লিখেছি এককথায় ফুল-কপি।

    – বাহ বাহ, এইতো আর্দশ স্টুডেন্ট।তোরা মাইয়ারা এটাই ভালো পারিস।এক্সাম হলে আমাদের মতো অবলা ছেলেদের একটু মিষ্টি কথা বলে পটিয়ে সুন্দর ভাবে পুরো খাতাটা কপি মারতে পারিস।

    অলীদের কথায় তেতে উঠলো সুফিয়া।

    – ঠাটিয়ে দুই চড় দেবো।তোর মতো নাকি রে আমি?আমি ভালো স্টুডেন্ট বাট এক্সামের আগে পড়তে পারিনি তাই এই দশা।

    সুফিয়ার কথার মাঝে এগিয়ে এলো সুফিয়ার গাড়ীর ড্রাইভার।

    – আপা দেরি হয়ে যাচ্ছে বাড়ি চলুন।স্যার আবার রেগে যাবেন।

    সুফিয়া কিছু বলার আগেই অলীদ আপাদমস্তক ছেলেটাকে দেখে নিলো।দেখেই বোঝা যাচ্ছে অবিবাহিত ছেলে।অলীদ সুফিয়ার হাত টেনে পিছিয়ে নিয়ে ছেলেটার সামনে নিজে এগিয়ে আসে।

    – আপনার স্যার কোথায়?

    – অফিসে আছেন।আমাকে বললো আপাকে নিয়ে যেতে।

    – বাড়ি ফিরবে কখন তোমার স্যার?

    – মিটিং আছে বেশ রাত করেই ফিরবেন।

    – তোমার বউ আছে নাকি গার্লফ্রেন্ড?

    এবার অলীদের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় ছেলেটি।চোখ ছোট করে সুফিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবারো অলীদের দিকে তাকায়।

    – গার্লফ্রেন্ড আছে।

    – বাহ বাহ বেশ ভালো।তোমার স্যারের ম্যাডামকে ফোন করে আমি বলে দেবো ওনার মেয়ে আমার সাথে আছে।আর স্যারকে তুমি ফোন করে বলবে সুফিয়া আপাকে তুমি বাড়ি পৌছে দিয়েছো বুঝতে পারেছো?

    – কিন্তু….

    – কোন কিন্তু নয় এই এক হাজার টাকা রাখো। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আজ ঘুরতে যাও।আর যা শিখিয়ে দিয়েছি সবটা বলবে।এবার ফুটো এখান থেকে।

    ছেলেটি বড় বড় পা ফেলে চলে যায়।অপরদিকে সুফিয়া আহাম্মক বনে তাকিয়ে আছে অলীদের দিকে।

    – তুই ছেলেটাকে এক হাজার টাকা দিয়ে দিলি!তোর কী টাকা বেড়ে গেছে নাকি?

    – না আমার টাকা বাড়বে কেন?আমার আবার অত টাকা পয়সা নেই।এক হাজার টাকার নোটটা তোর ছিল।

    – মানে?

    অলীদ সুফিয়ার দিকে পার্সটা ছুড়ে দেয়।

    – নে তোর পার্স।তোর ব্যাগ থেকে নিয়েছি আর টাকা’টাও তোর ছিল।

    সুফিয়া পার্সটা হাতে নিয়ে অলীদের পিঠে কিল বসায়।

    _

    লেকের পাড়ে বাদামের খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত অলীদ।বেশ যত্ন নিয়ে বাদামের খোসা ছাড়ায়ে সুফিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে।যেন এটাই তার বর্তমানে একমাত্র কাজ আর কাজটি সঠিক ভাবে পালন না হলে বিশেষ কোন ক্ষতি হয়ে যাবে।সুফিয়া অলীদের হাত থেকে বাদাম নিয়ে ভ্রু-যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,

    – ঘটনা কী?আজ এত আদর আদর ভাব।

    -“আমি আমার হবু বউকে আদর যত্ন করছি তাতে তোর কী?এবার অফ যা।”

    কথাটি মনে মনে বলে ঠোঁট টিপে হাসে অলীদ।এই কথা তার সামনা সামনি বলার সাহস নেই তার।

    – অলীদ উত্তর দিচ্ছিস না কেন?আর হাসছিস কেন?

    – না এমনি অনেকদিন পর আড্ডা দিচ্ছি তাই আর কি।

    – ইনান কোথায় রে?

    – সে আছে ইতিকাকে খোঁজার জন্য এদিক থেকে সেদিক পাগলের মতো ঘুরছে।শুনেছি আজ ওয়াসিমের সম্পর্কে হালকা পাতলা তথ্য পেয়েছে।ওয়াসিম যে সিলেট আছে সেটা আজ জানলো ইনান।তবে তার সাথে কী ইতিকা আছে কী না তা জানতে পারেনি।

    ‘ওয়াসিমের’ নামটা শুনতেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো সুফিয়ার।তবুও নিজেকে আবার সংযত করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

    – আচ্ছা আমরা কী ইনানের ভালো করছি নাকি মন্দ?ছেলেটা যে রাতদিন এক করে মেয়েটাকে খুঁজছে আর আমরাই যে ইতিকার ব্রেনওয়াশ করে তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছি বিষয়টা যদি সে জানে তবে….বুঝতে পারছিস তুই?

    – ভুলেও এই কথা মুখ থেকে বার করবি না সুফু।ইনান চিলের চোখ নিয়ে ঘোরে বলা তো যায়না আমাদেরো সন্দেহের তালিকায় ফেলে দেবে।

    – হ্যা ঠিক।

    – শোন ইতিভাবী বাড়ি থেকে সেদিন রাতেই বেরিয়ে যায়।আমি ভেবেই নিয়েছিলাম সে হয়তো ফ্লাটে আসবে।আমি গাড়ি নিয়ে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।আমি ভেবে রেখেছি দেখা তো হবেই তখন এক ব্যবস্থা করবো কিন্তু তিনি উলটো পথে হেঁটে গেলেন।আগে ওয়াসিমের সাথে যোগাযোগ করে তার বাড়িতে পৌঁছে যায়।সেদিন রাতে দুজনে গ্রামে চলে যায়।আর ইতিভাবী ওয়াসিমের কাছে সাতদিন সময় চেয়েছে গ্রামে থাকার।আর তত দিন গা ঢাকা দেবেন তিনি।ওয়াসিম তো খুশিতে গদগদ হয়ে কাজের সূত্রে সিলেট চলে গেছে।সাতদিন পর ইতিকা ওয়াসিমের সঙ্গে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে।কিন্তু বোকা ওয়াসিমতো জানে না তার বাবা ‘সাহাব উদ্দিন’কে আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছি। আর তাই তিনি কৌশলে তাকে সিলেট পাঠিয়ে দেয়।আর ইনান যদি ইতিভাবীর শর্তে রাজি থাকে তবেই সে ফিরবে।যদি ইনান নিজের মামুর কথায় এবারো টক্কর দেয় তবে আমাদের আর কিছু করার নেই আমরা ইতিকাকে আড়াল করে দেবো।ইব্রাহিম আঙ্কেল বলেছেন তার বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয় দেবেন।

    – আমি জানি, তুই,আঙ্কেল, আন্টি সবাই ইতিকার বিষয়ে জানি যদি খবরটা ইনান পায় তবে কী হবে?

    – আরেকটা অশান্তি শুরু হবে।তবে যা হচ্ছে হতে দে।

    __

    প্রভাতের আলো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।দিঘির সচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে রমণী।দু’চোখে তার উদাসীনতা।কোন কিছুর পাওয়ার অভিলাষ যে তাকে মুষড়ে দিচ্ছে ভেতরটায় তা প্রকাশ করতে পারছে না সে।বিস্তীর্ণ দিঘিটায় ফুটে আছে কচুরিপানার ফুল।দিঘির শেষ প্রান্তে আকাশ চিড়ে বেরিয়ে আসছে উত্তপ্ত রক্তিম লালের দিনমণি’টা।সেদিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রমণী।দিঘির জলে দু’পা নাড়িয়ে তৃপ্ত হচ্ছে বারংবার।মাথায় ঘোমটা টা সরিয়ে কোমড় সমান ঢেউ খেলানো চুলগুলো একপাশে আছড়ে রাখে।এই সময় এইদিকটায় কেউ আসে না বললেই চলে।গ্রামের বাড়িটায় উঠান শেষে একটি বড় পরিস্কার পুকুর আছে সেই পুকুরটাই ব্যবহার করে সবাই।অপরদিকে এই দিঘিটি ইতিকার ফুফির ঘর থেকে কিছুটা দূরেই।দিঘির পাড়ে বেশ কয়েকটা পাটাতন রয়েছে যার কারনে ইতিকার বসতে বেশ সুবিধাই হয়।

    ওয়াসিমের কাছ থেকে সাতদিনের সময় নিয়েছে ইতিকা।যার মধ্যে পাঁচদিন পূর্ণ।আজ ষষ্ঠ দিন শুরু।অপরদিকে ইনান প্রায় চারবার এসেছে এই বাড়িতে প্রতি বারি ইতিকা পালিয়ে ছিল রান্না ঘরের ভাঙ্গা আলমারিটার পেছনে।সে ইনানের কাছে কিছুতেই ধরা দেবে না।
    তবে ইনানকে যে তার চাই, খুব করে চাই।দিঘির জলে হাত ভেজালো ইতিকা।উদাস কন্ঠে একটি গান আওড়ালো।

    “প্রেমে পড়া বারণ
    কারণে অকারণ,
    আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।

    প্রেমে পড়া বারণ
    কারণে অকারণ,
    আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।

    তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
    তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
    সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়ে ছিল,
    দাওনি তুমি আমায় সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ।”

    অকস্মাৎ ইতিকা অনুভব করে তার উন্মুক্ত পিঠে কেউ ঠোঁটের স্পর্শ করেছে।উত্তেজিত হয়ে কিছু বলার আগেই ব্যাক্তিটি পেছন থেকে তার দু’বাহু চেপে ধরে।এবং গভীর ভাবে অধর ছোঁয়াতে থাকে।মেয়েটি উপায়ান্তর
    না পেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে স্বচ্ছ দঘির জলে।বেশ দূরে না যাওয়ায় মাটির স্পর্শ পায় সে।তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে কপালের দিকে আছড়ে পড়া চুলগুলো পেঁছনে ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে তাকায়।সামনের মানবটিকে দেখে বাক্য হীন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে।

    .

    গত কয়েকদিন যখন নিজের বউকে খুঁজতে খুঁজতে পাগলের মতো অবস্থা তখন নিরুপায় হয়ে আবারো গ্রামে ফিরে আসে ইনান।এবার বাড়িতে সোজাসুজি প্রবেশ না করে।পেছনের রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে।হঠাৎ চোখে পড়ে দিঘির পাটাতনে বসে আছে একটি মেয়ে।তাকিয়ে আয়ে আছে অনাবিল দিঘির জলে।দূর থেকেই ইনান চেনে নেয় এটাই তার ইতিবউ।বেশ কিছুক্ষণ ইতিকার পাশে শব্দহীন বসে ছিল সে।যখনি ইতিকা গান আওড়ালো নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না।উন্মুক্ত পিঠে মাথা নুইয়ে অধর স্পশে ব্যস্ত সে।

    – আপনি?

    ইতিকার প্রশ্নে উত্তর দিলো না ইনান।হলুদ বর্ণের সূর্যটা ধীরে ধীরে আলো ছড়িয়েছে ব্যাপক।হলুদ,কমলার মিশ্রিত আলো ইতিকার চুলে, গালে ছুঁয়ে দিচ্ছে যেন আদুরে ভাবে।

    – দেখলেন ইতিবউ চলে গিয়ে কী লাভ হলো, সেই তো আমি আপনার সামনে হাজির।

    ইতিকা এখনো নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারেনি।অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বিধস্ত পুরুষটার দিকে।

    – উঠে আসুন।আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।

    – আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাবো না।আমি আমার ভিটেমাটিতে পড়ে থাকবো।

    – সিরিয়াসলি আপনার ভিটেমাটি?আপনার ফুফা-ফুপিকে এক ইশারা করলে এক্ষুনি বের করে দেবে।তার থেকে ভালো উঠে আসুন।সম্মানের সাথে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।

    – সম্মান তো একবার ভাঙ্গেননি বার বার ভেঙ্গেছেন।আপনাকে শর্ত দিয়েছি বাইরে এইভাবে চলাফেরা বন্ধ করুন।বাবার ব্যবসায় হাত লাগান।অযথা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছেন।

    – এত কথা শুনতে চাই না ইতিবউ চলুন আমার সাথে।যা করেছেন তার জন্য আপনাকে মাফ করেছি এটাই অনেক।

    – যাবো না আমি। আপনার যেদিকে ইচ্ছে আপনি চলে যান।আর আমায় শান্তিতে বাচঁতে দিন।

    – শান্তি?আমায় ছাড়া না আপনার শান্তি হবে আর না আমার শান্তি হবে।উঠে আসুন।

    – উঠবো না।

    – আমি কি ঝাপ দেবো?আমি কিন্তু সাঁতার জানি জানি।

    ইতিকা উঠলো না সে এখনো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।ইনান ইতিকার কান্ড বুঝতে পেরে পাটাতনে বসে যায়।অপরদিকে ইতিকা ঠোঁট বাকিয়ে সাঁতার কেটে একটু মাঝামাঝিতে চলে যায়।ডুব সাঁতারে পানি থেকে লাফিয়ে উঠতেই ইতিকার দিকে তাকিয়ে ইনান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।এ যেন জলপরী।সর্বাঙ্গ দেহে জলে টইটুম্বুর।নাক ঠোঁট চুইয়ে চুইয়ে পানি টপটপ করে পড়ছে দিঘির জলে।ইতিকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে সূর্যের দিকে তাকায়।কিছুটা এগিয়ে এসে কচুরিপানার ফুল ছিড়ে কানে গুজে নেয়।ইনান তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

    – আমার সর্বাঙ্গসুন্দরী বউ।এত স্নিগ্ধ এতটা কোমলমতী তোমায় আগে লাগেনি।আজ তো আমার দিঘির অগাধ জলের উপর ঈর্ষা হচ্ছে।আমার কোমলমতীকে ছোঁয়ার ভাগ্য তার হয়েছে।অথচ আমি কে?আমাকে রাখে দূরে আড়ালে তার ভালোবাসার আবডালে।

    ইতিকা ঘুরে তাকিয়ে ইনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

    – ফিরে যান।আমি ফিরবো না আপনার সঙ্গে।

    – আমার কী একটাই অপরাধ?আমি মামুর সঙ্গ দিচ্ছি বলে?

    – যদি বলি হ্যা তাই!আপনি আপনার মামুর সঙ্গতা ছেড়ে দিন।আমি কিন্তু আত্মীয়তা ছাড়তে বলেনি স্রেফ সঙ্গতা,রাজনীতি, মারামারি গুলো ছাড়তে বলেছি।

    ইনান উঠে দাঁড়ায়।হঠাৎ তার রাগ মাথা চড়া দিয়ে বেড়েছে।তাকে যেতে দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে ইতিকা।হাতে এক কোষ জল নিয়ে ছুড়ে দেয় ইনানের দিকে।জলের স্পর্শে ঘুরে তাকায় ইনান।ইতিকা কোমড়ে হাত গুজে বলে,

    – অন্তত একটা কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি।আমি যা বলি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা ওয়াসিম ছাড়া এই ভুবনে কেউ করেনি।ছেলেটা মন্দ হলেও আমার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।

    ইতিকা ঘুরে দাঁড়ায়, হলুদ সূর্যটার দিকে তাকিয়ে থাকে চোখ কুচকে।অপরদিকে ইনানের কাছে ইতিকার কথাগুলো ছিল আগুনে ঘি ঢালার মতো।রাগে হন্তদন্ত হয়ে মাঝ পথে থেমে যায় ইনান।পকেটে বেশ শব্দ করে ভাইব্রেট হচ্ছে ফোন।নাসরিনের নাম্বার দেখে দ্রুত ফোন রিসিভ করে সে।

    – হ্যা মা বলো।

    – তুই কোথায়? এদিকে যে কান্ডো ঘটে গেছে।

    – কি হয়েছে?

    – তোর মামু আংটি নিয়ে বেশ কয়েকজন মুরব্বি নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছে।আজ নাকি তোর আর রুমুর এনগেজমেন্ট হবে।ইতিকা যেহেতু চলেই গেছে তবে আর দেরি নয় ‘রুমু’র সাথেই তোর বিয়ে দিতে চায় ভাইজান।তোর বাপ রেগে বোম হয়ে আছে। আমার শেষ কথার এক কথা মা হয়ে ছেলের খারাপ চাইবো না।ইতিকা ছাড়া এই বাড়িতে অন্য কেউ বউ হয়ে এলে তোকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করতে দুইবার ভাববো না।আমি আমার ভাইকে বিশ্বাস করি না এটা মাথায় রাখিস।

    নাসরিন খট করে ফোনটা কেটে দিলেন।একের পর এক ঝামেলা তাকে বিষিয়ে তুলছে।ইতিকাকে ছাড়া সে থাকতে পারবেনা অপর দিকে আজ একা বাড়ি ফিরলে ঝামেলায় পড়বে।কী করবে সে?তার মায়ের বলা শেষ কথাটা ভাবিয়ে তুলছে তাকে।

    ইনান অলীদের নাম্বারে কল করে কিছুটা স্থির কন্ঠে বলে,

    – আমি ইতিবউকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমার এখন কী করা উচিত?

    – বলদের মতো কথা বলিস কেন?এইসব ভংচং ছাড় ইতিভাবীকে নিয়ে থাক।দেখবি সুখে থাকবি।

    ইনান ফোন অফ করে আবারো দিঘির পাড়ে যায়।ইতিকা অন্যদিকে মুখ করে কচুরিপানার ফুল ছিড়তে ব্যস্ত।

    – ইতিবউ আমি যদি আপনার সব কথা মেনে নি তবে কি ফিরে আসবেন?

    – অবশ্যই।

    – তবে বেশ কবুল!আপনার সব শর্ত কবুল!

    ইতিকা ঘাবড়ে গেলো।হঠাৎ ইনাকে এত নার্ভাস লাগছে কেন।ইনান ছটফট করে পানিতে নেমে যায়।ইতিকাকে ইশারা করে এগিয়ে আসত।ইতিকাও জড়বস্তুর ন্যায় মুঠো ভর্তি কচুরিপানার ফুল নিয়ে এগিয়ে এলো ইনানের কাছে।ইনান ফুলগুলো নিজ হাতে তুলে নেয়।ইতিকার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ে।ফুল গুলো বাড়িয়ে এক গাল হাসি দিয়ে বলে,

    – হাজার’টা জড়তা ভুলে আমি আপনার কাছে, আমার জীবন সমর্পণ করিলাম ইতিবউ!
    #চলবে….

    ®পলি আনান

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১৭ ]

    ________
    দ্বিপ্রহরে নীল আকাশটা হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে আছে তার সাথে ভারী বর্ষণ।আধাঁর পরিবেশে ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাচ্ছে মেঘের গুম গুম শব্দ।ইনান শার্টের হাতা ভাজ করে বারান্দা থেকে মাথা তুলে একবার আকাশটা দেখে নিলো।না,বৃষ্টি থামার নাম নেই।আজ যেন আকাশ উত্তাল হয়েছে ধরণি ভিজিয়ে সতেজ করার বাহানায়।সকালে ইতিকাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলেও ইতিকার ফুফা,ফুফি কিছুতেই বাড়ি ফিরতে দিলেন না।তারা দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনে মত্ত হয়ে উঠলেন।আহার গ্রহণ শেষে শহরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো ইতিকা।হঠাৎ ভারী বর্ষণ শুরু।তারপরেই তারা বন্দি।

    – একটা কথা ছিল!

    ইতিকার ভরাট কন্ঠ শুনে ঘুরে তাকায় ইনান।ইতিকা দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে।

    – বলুন।
    – ওয়াসিম কোথায় আছে কিছু জানেন কী?গত তিনদিন তার কোন খোঁজ পাচ্ছি না।

    ‘ওয়াসিম’ নামটা শুনতেই ইনানের সর্বাঙ্গ যেন ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।এত মায়া কেন ছেলেটার জন্য?কিসের এত আকুলতা?

    – আপনার তো দেখছি সবার জন্যই মাথা ব্যাথা হয় একমাত্র আমি ছাড়া।

    ইনান শান্ত সুরে কথাটা বললেও তার কন্ঠে যে কতটা রাগ মিশ্রিত ছিল তা ইতিকা ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছে।
    সে হালকা করে ঢোক গিলে ইনানের দিকে তাকালো।

    – আসলে তার সাথেই গ্রামে এসেছি এরপর দুইদিন কথা হয়েছে গত তিনদিন কোন কথা হয়নি তাই।তাছাড়া সে আমার উপকার করেছে।আর তার খোঁজ খবর যদি আমি না রাখি বেইমানি হয়ে যাচ্ছে না বিষয়টা।

    ইতিকার সহজ স্বীকারোক্তি তবে রাগ লাগলো ইনানের।দু’হাতের মুঠো করে এগিয়ে গেলো ইতিকার দিকে।ইতিকা মাথা নুইয়েই দু’কদম পিছিয়ে যায়।
    তাদের অবস্থানের মাঝে আর সামান্য ব্যবধান আছে বলা চলে।ইনান বাজখাঁই গলায় কিছু বলার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় ইতিকার সমবয়সী ফুফাতো বোন মিহি।

    – ইতিকা আম্মা তোকে ডাকে…

    ইতিকা ইনানকে ঠেলে সরে যায়।দ্রুত মাথায় ঘোমটা টেনে বারান্দা পার করে ঘরে প্রবেশ করে।

    মিহি থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে ইনানের দিকে।সে বুঝতে পারেনি ইতিকা এবং ইনান দুজনে এত কাছে ছিল এইভাবে।যদি বুঝতো তবে ভুলেও এইদিকটায় পা বাড়াতো না।

    – মিহি এদিকে আসো।

    ইনানের ডাক শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে।

    – কিছু বলবেন দুলাভাই?

    ‘দুলাভাই’ ডাকটা শুনে মনে কেমন যেন উড়ু-উড়ু করছে ইনানের।তার ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস পাওয়া গেল।একহাত কোমড়ে দিয়ে, অন্য হাত দিয়ে সামনে থাকা চুলগুলো বেশ স্টাইল করে পেছনে সরিয়ে ঘুরে তাকালো সে।বুকের বাম পাশটায় আবেগী ভঙ্গিতে হাত দিয়ে নিজেও বিড়বিড় করে বলে, ‘দুলাভাই’।

    – দুলাভাই কিছু বলবেন?

    ইনান আবারো ঘুরে তাকায়।হাত ইশারায় ডাকতে থাকে মিহিকে।

    – আমাকে এত ভয় পাও কেন?সবসময় দূরে দূরে থাকো।অদ্ভুত আমাকে দেখলেও ছুটে পালিয়ে যাও।

    – কই, আমি আবার কখন পালালাম?

    – মিথ্যা বলছো আমার সঙ্গে?

    মিহি এবার থতমত খেয়ে যায়।মিনমিনিয়ে চোখ ছোট করে বলে,

    – বিয়ের দিন যে ভয়ংকর পরিস্থিতি নিয়ে এসেছেন।গাড়িতে করে রামদা,পিস্তল ভাবতেই আমার ভয় লাগে।

    মিহির এমন প্রত্যুত্তরি আশা করছিল ইনান।মুখে গম্ভীর্য ভাব রেখে বলে,

    – আমি ছেলেটা খারাপ নই।আর এখন আরো ভালো হয় যাবো তোমার বোনের পবিত্র ছোঁয়া পেয়েছি কীনা!আমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে পারো।যাই হোক একটা প্রশ্ন করি তোমায়।আমার সোজাসাপটা উত্তর চাই।

    – জি বলুন।

    – এই কয়েকদিন আমার অনুপস্থিতিতে ইতিবউ কী আমায় মিস করেছে?তোমায় কিছু বলেছে সেই ব্যাপারে?

    – রাতদিন এক করে কেঁদেছে।নির্ঘুম রজনি পার করেছে।খাওয়াদাওয়া তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল।এবার আপনি বুঝেনিন সে কী আপনাকে মিস করেছিল!

    – আমার জন্য নাকি ওয়াসিমের জন্য কেঁদেছিল?বিশ্বাস করবো কী করে?

    – বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্পূর্ণ আপনার বিষয়।আমি সত্যটাই বলেছি।এর বাইরে আমার আর কিছু বলার নেই দুলাভাই।
    __

    টিনের চালায় ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।বিদ্যুৎ নেই বিকেলের পর থেকে।ঘরে লন্ঠনের লাল টিমটিমে আলোর পাশে বসে আছে ইনান।ইতিকার সাথে আর খুব একটা কথা হয়নি অবশ্য মেয়েটাই কেমন যেন দূরত্ব নিয়ে চলছে কিন্তু কেন বুঝতে পারছেনা সে।প্রায় সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে।আকাশের হাক ধীরে ধীরে ক্রমশ বেড়েই চলছে।ইতিকা রুমে ডুকলো ভেজা চুল নিয়ে।গায়ে তার এক রঙা লাল শাড়ি।শাড়িটির কিনারায় বেগুনি সুতার কাজ।লন্ঠনের টিমটিমে আলোতেও বেশ দেখতে লাগছে মেয়েটাকে।

    – আপনি থাকতে পারবেন তো এই খাটে?আপনার রুমের খাটের মতো আমার খাট কিন্তু নরম নয়,বেশ শক্ত।তাছাড়া টিনের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে।স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে আপনার থাকতে নিশ্চই অসুবিধে হবে।আমি মাফ চে…..

    ইতিকা কথা শেষ করার আগেই ইনান তার হাত টেনে কাছে বসিয়ে দেয়।ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে মত্ত হয়ে যায় ভেজাচুলের ঘ্রাণে।ইতিকা চোখ বাকিয়ে তাকায় ইনানের দিকে, ছেলেটা যে এখন প্রমত্ত হয়ে আছে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।

    – কিছু বলছেন না যে?

    – চুল ভেজা কেন?গোসল করেছো এই রাতে?

    – না, না আসলে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলাম একটা কাজে; ভিজে গেছি তাই একেবারে পুকুর থেকে গোসল করে এসেছি।

    – একা কেন গেলে?আমাকে নিয়ে যেতে দু’জনে একসাথে ভিজতাম।

    – এটা আপনার শহর নয় রোমান্টিক মুড নিয়ে আমাকে সহ ভিজবেন এটা গ্রাম।আমরা স্বামী-স্ত্রী হলেও সবাই কুবাদ রটিয়ে দেবে।

    ইনান খানিকটা সরে গেলো ইতিকার পাশ থেকে।থম মেরে বসে রইলো হারিকেনের দিকে তাকিয়ে। ইতিকা বুঝতে পারছেনা হঠাৎ কি হলো ছেলেটার।

    – রেগে গেলেন কেন?আমি কি ভুল বলেছি?

    – ওয়াসিমের সাথে যখন প্রেম করতে তখন কী তোমার গ্রামের মানুষ কুবাদ রটায় নি?

    ইতিকা নড়ে উঠলো।প্রতিটি কথার ভাজে ভাজে ওয়াসিমের কথা না তুললে মনে হয় ই ছেলের শান্তি নেই।

    – ওয়াসিমের সাথে আমার প্রেম গ্রামের সবাই জানতো।তাছাড়া আমাদের দেখা হতো খুব কম।যত বার দেখা করেছি মিহি দূর থেকেই আমাদের পাহারা দিয়েছে।আরেকটা কথা আপনার কথা বার্তার ধাঁচে অন্য কিছু প্রকাশ পাচ্ছে।আমি প্রেম করেছি এই না যে সতিত্ব বিলিন করেছি।ওয়াসিম শুধু একবার আমার হাত ছোঁয়ার অনুমতি পেয়েছে এছাড়া বেশি কিছু নয়।

    কথাগুলো শেষ করে উঠে চলে গেলো ইতিকা।এখানে আর বসে থাকার মতো কোন যুক্তি পেলনা সে।

    .

    টিনের ফাঁক দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস ডুকছে রুমে।লন্ঠনের টিমটিমে আলোতে তাকিয়ে আছে ইতিকা।দুচোখ ঘুমহীন, মাথায় চেপে আছে হাজারটা চিন্তা।পাশে শুয়ে আছে ইনান।বৃষ্টির গতিক থেমে গেছে প্রায় অনেক্ষণ যাবৎ দূর থেকে কানে আসছে আকাশের গুমগুম শব্দ।হঠৎ দমকা বাতাস শুরু।

    লন্ঠনের তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় নিভে গেছে তৎক্ষণাৎ। আকাশের ডাক হঠাৎ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।মেঘের গর্জনে যেন পুরো ঘরটাই নড়ে উঠছে।ইতিকা ভয় পেয়ে যায়।আকঁড়ে ধরে গায়ের কাঁথাটা।আকাশের প্রতিধ্বনিকে মাতিয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু।গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো ইতিকার।অন্ধকার রুম, তার সাথে আকাশের এমন বিভৎস ডাকে দু’আঙুল কানে গুজে দিলো।তাতেও কোন লাভ নেই আজ বজ্রপাত যেন তাকে ভয় দেখাতে প্রস্তুত।এমন ভীতকর পরিস্থিতি কান্নার মত অবস্থা ইতিকার।আজ যদি পাশে মিহি থাকতো তবে তাত হাতটা জড়িয়ে রাখতো দুজনে মিলে কথার তালে ভয়টা কাটিয়ে তুলতো।তবে এখন পাশে আছে ইনান যাকে সে চাইলেও ছুঁয়ে দিতে পারবেনা।বলতেও পারবেনা আমার ভয় লাগছে জড়িয়ে নিন আমায় আপনার বক্ষপিঞ্জরে।মানুষটা কি শান্তিতে ঘুমাচ্ছে?

    আকস্মিক অন্ধকার রুমটা বিদ্যুৎ চমকানিতে আলোকিত হয়ে যায়।আকাশ থেকে আছড়ে পড়ে বজ্রপাত তৎক্ষণাৎ যেন কেঁপে উঠে ধরণি।ইতিকা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়।সহসা পেছন থেকে কেউ তার ঘাড়ে বেশ জোরেই দেয় টান দেয়।কিছু বুঝে উঠার আগেই ইনানের বক্ষপিঞ্জিরায় আড়াল হয়ে যায় সে।

    – ভয় পাবেন অথচ মুখ ফুটে বলবেন না।বললে কি জাত চলে যাবে?

    ইতিকা কথার উলটো পিঠে আর কথা খুঁজে পেল না।কিছু বলতে যাবে তার আগেই কপালে অনুভব করে উষ্ণ ছোঁয়ার ইনান বেশ গভীর ভাবে তার কপালে অধর ছুঁয়ে দিয়েছে।

    – যখনি ভয় পাবে?একা একা লাগবে,নিঃসঙ্গতায় ভুগবে,আর কাদঁতে ইচ্ছে হবে, চলে এসো এই রগচটা মানুষটার বক্ষঃস্থলে যে তোমায় সঙ্গ দিতে সর্বদা প্রস্তুত।

    ইতিকা মাথা তুলে তাকাতে চাইলো ইনানের দিকে।কিন্তু অন্ধকার ঘরটায় রগচটা ব্যাক্তিটার মুখ দেখতে পেলো না।ক্রমশ বাড়তে থাকে বিদ্যুৎ ঝলকানি ইতিকাও গুটিয়ে যায় ইনানে বক্ষঃস্থলে।ভয়টা যেন নিমিষে পতিত হয়েছে তার মন থেকে।

    ____

    বসার ঘরে বেশ চিন্তিত মুখ নিয়ে সিগারেট টানতে ব্যস্ত বাহরুল ইসলাম।তার সামনে বসে আছে ইফতিহার ইনান।

    – তুমি তাহলে ওই মেয়েটার জন্য নিজের মামুর প্রস্তাব নাকচ করলে বাহ এই ছিল এতদিনে কোলে পিঠে মানুষ করার ফল।

    – রুমুকে আমি নিজের বোনের চোখে দেখি মামু তার সাথে বিয়ের প্রসঙ্গ এলো কি করে?

    – আমি তো আর তোমায় নিজের ছেলে ভাবি নি।আমি নিজের বাড়ির জামাই করার আশায় ছিলাম।

    ইনান ফস করে শ্বাস ছাড়লো।মাথাটা কিঞ্চিৎ নুইয়ে সহসা কথার পিঠ ঘুরিয়ে দিলো।

    – আরেকটা কথা ছিল মামু।আমি তোমার কাজটা ছেড়ে দিচ্ছি।রাজনীতির পথে আর হাটছি না।ভাবছি এবার নিজেই কিছু একটা করবো।

    ইনানের কথা শুনে বাহরুল ইসলামের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়েছে।

    – কি বলছো এইসব?ভবিষ্যত পদ তোমাকে দেবো বলে ঠিক করে রেখেছি আর তুমি!

    – একদম ঠিক বলছি আমি।দুঃখিত মামু অন্য কাউকে আমার স্থানে বসিয়ে নাও।আমার থেকেও যোগ্য মানুষ পাবে তুমি।

    বাহরুল ইসলাম কিছু একটা ভাবলেন।চোখে মুখে তার অদ্ভুত হাসির ঝলক দেখা মিললো।

    – বেশ তবে তুমি তোমার মতো চলো আমি তোমার স্থানে ‘ওয়াসিম’কে মনোনীত করলাম।

    বাহরুল ইসলামের এমন একটি কথা কিছুতেই আশা করেনি ইনান।হঠাৎ রাগটা যেন মাথা চড়ে বসেছে।

    – ওয়াসিম!শক্রুকে আজকাল দলে ঢোকানোর জন্য এত দিশেহারা হয়ে গেলে কেন তুমি?বুঝতে পারছিনা আমি তোমার মতিগতি।

    – আপন যখন পর হয় তখন বন্ধু শত্রু হলে কী সমস্যা?আমি তো কোন খুঁত খুঁজে পাইনি।

    ইনান আর এক মূহুর্তেও দাড়ালো না।বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো বসার ঘর থেকে। সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবটা।

    _

    অলীদের পাশে বসে তিরতির করে কাঁপছে ইতিকা।হাতে তার অলীদের ফোন।ফোনের বিপরীত থেকে শোনা যাচ্ছে কর্কশ কন্ঠের ওয়াসিমের কথা যে কী না এক নাগাড়ে বকে যাচ্ছে ইতিকাকে।

    – এবার থামো ওয়াসিম।তোমার যুক্তিহীন তর্ক বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ হজম করছি।

    – আমার কথা তোমার কাছে যুক্তিহীন?সাতদিন সময় চেয়েছো তুমি আমি দিয়েছিলাম আর ছয় দিনের দিন সুর সুর করে চলে আসলে ইনানের হাত ধরে বাহ বাহ।এই ছিলো তোমার মনে!

    – যা হয়েছে ভুলে যাও আমি আমার রাস্তায় তুমি তোমার।

    – এত সহজ নয়।এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো।

    – যা ইচ্ছে হয় দেখো আমি আমার রাস্তা বেছে নিয়েছি আর এটাই শেষ কথা।

    ইতিকা কথাটা বলে ডান হাতের উলটো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয়।হঠাৎ দরজার সামনে থেকে কানে আসে চেনা পরিচিত কারো কন্ঠ।যা শুনে অলীদ এবং ইতিকা দুজনেই চমকে যায়,

    – কার সাথে কথা বলছেন ইতিবউ?

    #চলবে….

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১৮]

    _________
    সকালে অফিসে এসে বেশ খানিকটা চমকে যান মি.ইব্রাহিম।আফিসটা সাজানো হয়েছে আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে।অপরদিকে অফিসের ম্যানেজার সাহেবের দেখা নেই।সবাই আজ কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে।তিনি সব কিছু উপেক্ষা করে নিজের কেবিনে প্রবেশ করেন।তৎক্ষণাৎ বেলুন ফাটানোর শব্দে কেঁপে উঠলেন।অবাক পানে পাশে তাকাতে ইনানে মুখটা দেখে তিনি থ বনে যান।
    কেননা গত দেড় বছর যাবৎ ইনান এই অফিসে প্রবেশ করেনি অথচ আজ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

    – শুভ জন্মদিন বাবা!

    – জন্মদিন?

    মি.ইব্রাহিম বেশ চমকে গেলেন।

    – আহ বাবা,কাজের চাপে সব ভুলে গেলে আজ তোমার জন্মদিন।তাই স্বল্প আয়োজন করলাম।আসো আসো কেকটা কাটো।

    ইনান তার বাবাকে টেনে টেবিলের সামনে দাঁড় করালো।মেনেজার ইশারা করতে একে একে সব কর্মচারি সেখানে ভিড় জমায়।মি.ইব্রাহিম ইনানের হাত ধরে কেকটা কাটলেন বেশ কিছুক্ষণ সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে সবাই সবার কাজে ফিরে যায়।

    – তোমার প্লানিং কী?হঠাৎ আমার অফিসে হানা দিয়েছো কেন।নিশ্চই তোমার মামু পাঠিয়েছে আমার বিরুদ্ধে রেষারেষি করতে।

    – আহ বাবা ভুল বুঝছো কেন?আমি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি।শুধু শুধু…

    – রাজনীতি!তোমরা কী রাজনীতি করতে?তোমরা করতে মাস্তানি।তোমাদের কর্মকান্ডকে কেউ রাজনীতি বলবেনা।তোমার মামু তো তোমায় চামচা হিসেবে রেখেছে যাও চামচা গিরি করো।

    – বাবা প্লিজ, আমার এখন এইসব কথা শুনতে ভালো লাগছেনা।আমি আজ থেকে তোমার অফিসে বসবো।তুমি আমায় একটু একটু করে সব কাজ শিখিয়ে দেবে।

    – হঠাৎ আমার পরিশ্রমের গড়া এই ব্যবসার পেছনে পড়লে যে?

    মি.ইব্রাহিমর কথার মারপ্যাঁচে বিরক্ত হয়ে যায় ইনান।

    – বাবা আমাকে একবার সুযোগ দাও।আমি সবটা ঠিক করে দেবো।বদলে যাবো প্লিজ বাবা একটা সুযোগ।

    – তোমার কি ধারনা তুমি শান্তিতে বাচঁতে পারবে?আশেপাশে যা শত্রু আছে এবার হামলে পড়বে তোমার উপর, নিজেকে বাচাঁনোর মতো কোন পরিস্থিতি পাবেনা তুমি।আর বর্তমানে সবচেয়ে বড় শত্রু তোমার মামু।তার অপকর্মের সবটাই তুমি যানো।আর তুমি মুখ খোলা মানে তার কত বড় ক্ষতি আশা করি বুঝতে পারছো?

    – দেখো বাবা যা হবে ভালোর জন্য হবে।আমি অস্ত্র জমা দিয়েছি এই নয় যে অস্ত্র চালানো ভুলে গেছি।রাজনীতির পথ থেকে বেরিয়ে আসলেও আমি কিন্তু টেকনিক ভুলে যাইনি।বাই দা ওয়ে আর দেরি করো না তুমি দ্রুত বাড়ি ফিরে যাও বাবা।

    – বাড়ি ফিরবো! কিন্তু কেন?

    – আজ সারাদিন মায়ের সাথে ঘুরবে যেখানে ইচ্ছে যাবে কেউ বাধা দেবে না।দেরি করছো কেন জলদি যাও।

    – আমার অনেক কাজ আছে অফিসে অন্যদিন যাবো।

    – আহ বাবা মেনেজার আঙ্কেল আমায় সব কাজ বুঝিয়ে দেবেন।তুমি যাও তো দ্রুত বাড়ি যাও।

    ইনান দ্রুত তার বাবাকে নিয়ে অফিসের বাইরে চলে যায়।গাড়িতে উঠিয়ে ড্রাইভারকে ইশারা করে বাড়ি উদ্দেশ্য রওনা দেওয়ার জন্য মূহুর্তেই গাড়িটি শান বাজিয়ে ধুলি উড়িয়ে ছুটে চলে তার আপন গন্তব্য।

    .

    রাত প্রায় বারোটা।অফিসের কাজ বুঝতে বুঝতে বেশ সময় চলে গেছে আজ ইনানের।কিছুক্ষণ পর ইনান লক্ষ্য করে তার পেছনে একটি ট্রাক তাকে ফলো করছে বিষটি বুঝতে পেরে গাড়ির স্প্রিড বাড়িয়ে দেয় সে।মূহুর্তে ট্রাকের স্প্রিডো বেড়ে যায়।ইনানের বুঝতে আর বাকি নেই শত্রুপক্ষ একা পেয়ে তাকে মারতে চেষ্টা চালাচ্ছা ইনান গাড়ির স্প্রিড বাড়িয়ে দিয়ে একটি তিন রাস্তার মুখে চলে গেলো।গাড়ি ডানে ঘুরিয়ে পেছনের ট্রাক ডাইভারকে বোকা বানিয়ে বামে রাস্তায় সরিয়ে নিলো গাড়িটি মূহুর্তেই ফুল স্প্রিডে ইনান ট্রাক ডাইভারের নাগালের বাইরে চলে যায়।

    এবারের মতো নিজের জয় জেনে ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি রেখে ফুটে উঠলো তার।

    .

    গায়ে কাঁথা জড়িতে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে ইতিকা।ইনান ওয়াশরুম থেকে একবার আড় চোখে তাকালো তার দিকে।ইতিকা যে অভিনয় করছে বুঝতে পেরে বাকা হাসলো সে।ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুলগুলো ব্রাশ করে আরেকবার আড় চোখে তাকালো ইতিকার দিকে।ইতিকার দুষ্টু বুদ্ধি বুঝতে পেরে ইনান বলে,

    – চোর চুরি করছে অথচ পর্দার নিচে তার পা দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত!এতে আর চুরির মজা হলো।আপনি ঘুমিয়ে আছেন ইতিবউ কিন্তু আমি আয়নায় আপনার জাগ্রত মুখখানা দেখছি আশ্চর্য এটা কী অতি ভালোবাসার টান?

    ইনান কথাটা বলেই ঘুরে তাকালো।ইতিকা কাঁথা আকড়ে ধরে ঠোঁট খিচে হাসছে।ছেলেটা ঝটপট এগিয়ে গিয়ে কাঁথা সহ ইতিকাকে কোলে তুলে নেয়।

    – লুকিয়ে লুকিয়ে কী আমায় দেখছেন?

    – এই ঘরে তো আপনি ছাড়া আর কেউ নেই।

    – আমায় লুকিয়ে দেখার কিছু নেই ইতিবউ।আমাকে সামনা সামনি ভরা অনুভূতি চোখ নিয়ে দেখবেন।

    – অন্তরালে লুকিয়ে প্রিয় মানুষটিকে দেখার অনুভূতি আর সামনা সামনি দেখার অনুভূতির মাঝে আকাশ পাতাল তফাত।আড়ালে একদৃষ্টিতে আমি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখবো একটু লাজুক হাসবো।যাকে বলে একপাক্ষিক অনুভূতি।আমাকে আমার মতো অনুভব কর‍তে দিন।

    – সামনা সামনি দেখলে কী হবে ইতিবউ?

    – যদি বলি আমার সবচেয়ে বেশি সংকোচ আপনার চোখে চোখ রাখা।আপনার চোখের গভীরতা আমি বুঝিনা।আর তাকালেও আমি হারিয়ে যাই নির্নিমিত্ত।

    ইনান ইতিকাকে আরেকটু কাছে টেনে আনে।কপালে অধর ছুইয়ে ফিসফিস করে বলে,

    – আমার চোখের দিকে তাকান।

    – তাকাবো না।

    – তাকাতে বলেছি আমি,তাকান।

    – না তাকাবো না।

    – না তাকালে ফেল দিবো কিন্তু।

    – দিলে দিন তবুও আমি তাকাবো না।

    – এক থেকে তিন গুনবো তার মধ্যে না তাকালে সত্যি ফেলে দিবো।

    – বললাম তো তাকাবো না।

    – এক…

    – তাকাবো না।

    – দুই।

    – তাকাবো না।

    – তিন।

    -তাকাবো ন……

    ইতিকা ভেবেছিল ইনান হয়তো তাকে ফেলে দেবে না।কিন্তু তার আশায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছে ইফতিহার ইনান।সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় ছুড়ে ফেলে ইতিকাকে।আকস্মিক ছুড়ে ফেলায় হতচকিত ইতিকা।কোমড়ে যেন টান পড়েছে ব্যাথায় সঙ্গে সঙ্গে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে সে।ইনানের সৎবিৎ ফিরতেই ইতিকার পাশে শটান হয়ে শুয়ে পড়ে।

    – একদম নাটক করবে না ইতিবউ আমার বিছানা নরম তুলতুলে পড়লে কারো কোমড় ভাঙ্গবে না আমি নিশ্চিত।

    – আমি ব্যাথা পেয়েছি।

    – একটু ব্যাথা পাওয়াই যায় সমস্যা নাই।তোমাকে না কাল নতুন ক্লাসে ভর্তি করালাম?দশম শ্রেনীতে উঠেছো মন দিয়ে পড়ো।এসএসসি’তে আমি ভালো জিপি চাই।

    – পড়বো না আমি আপনি আমায় ব্যাথা দিয়েছেন।

    – না পড়লে ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে দেবো।বুড়ি মেয়ে বয়স তো কম না আঠারো হয়ে গেছে অথচ এই সময় দশমে পড়ছো লজ্জা লাগে না?

    – লজ্জা লাগবে কেন?আমি কি ফেল করেছি নাকি?আমি আমার দারিদ্র্যতার কারনে পড়তে পারিনি।যাই হোক সরে যান আমি ঘুমাবো।

    – তুমি ঘুমালে আমাকে খাইয়ে দেবে কে?

    ইনান কথাটি বলেই উঠে দাঁড়ায়।তোড়জোড় করে ইতিকাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

    __

    ভালোবাসা খুনশুটি জড়িয়ে কেটে গেছে প্রায় তিন মাস।ইতিকা ইনানের সম্পর্ক এখন গভীর।ইনান তার বাবার সঙ্গে সামলে যাচ্ছে অফিসের সব কাজ অপরদিকে সুফিয়ার বিয়ের জন্য তোড়জোড় লাগিয়ে দিয়েছে তার বাবা।প্রতিটি বিয়ের পাত্রকে সম্মানের সহিত বিদায় করেছে ‘অলীদ’ যদিও বিষটি সুফিয়া নিজেও জানে না।

    – দোস্ত এবার নতুন পাত্র পক্ষ আসছে আমার কী হবে?ইনানকে প্লিজ বল কিছু একটা করতে।

    সুফিয়া কান্নারত অবস্থায় ফোন করে বসলো অলীদকে।

    – বিয়ে করে ফেল সুফু।ওই ওয়াসিম হা’রামদাজার চেয়েও ভালো ছেলে দেখে আঙ্কেল তোকে বিয়ে দেবে।সুখী হবি আমি জানি।

    – একটা থাপ্পড়ে আমি তোর সব দাঁত উপড়ে ফেলবো আর যদি ওয়াসিমের সম্পর্কে কিছু বলতে শুনি।

    – ওয়াসিমকে কিছু বললেই রেগে যাচ্ছিস!তার মানে আজকের হা’মলা টা তুই করিয়েছিস আমাদের উপর।

    – হা’মলা! কিসের হা’মলা কী বলছিস তুই?

    – ওয়াসিমের লোক আজ আমার আর ইনানের উপর এট্রাক করেছে।হাসপাতালে ভর্তি আমরা।কেউ যানে না কাউকে জানাবিনা খবরদার।সবাইকে বলেছি আমরা আজ ঢাকার বাইরে একটু ঘুরতে যাচ্ছি।

    – ম..মানে তোদের বেশি ক্ষতি হয়েছে নাকি?কি হয়েছে আমায় বল প্লিজ।

    অলীদ ফস করে শ্বাস ছাড়লো।ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ইনানের দিকে তাকালো বেচারার হাতে, পায়ে, মুখে ব্যান্ডেজ মোড়ানো।

    – বেশি কিছু হয়নি।আমার বাম পা টা ভেঙ্গেছে ইনানের একটা হাত ভেঙ্গেছে আর গাল কেটে গেছে।আমারো সেম অবস্থা।

    – এত কিছু হয়ে গেলো আর তুই বলছিস কিছু হয়নি।দাড়া আমি এক্ষুনি আসছি।

    – আসছি মানে?কাউকে কিছু জানাবি না খবরদার।

    অলীদ কথা শেষ করার আগেই সুফিয়া ফোনটা কেটে দেয়।ইনানের পাশে তাকিয়ে বেশ কয়েকটা ঢোক গিলে বেচারা।ইনান বারন করেছিল কাউকে কিছু না জানাতে আর সুফিয়া নিশ্চিত সবাইকে পাবলিসিটি করে ছাড়বে।ঘুমন্ত ইনান একবার যদি যেনে যায় অলীদ এত বড় মিস্টেক করেছে তবে কি হবে?

    .

    কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে ইনানের।ছোট ছোট চোখ করে তাকাতেই সামনে ভেসে উঠে মিসেস নাসরিনের কান্নায় ভেঙ্গে পড়া মুখখানা।আরেকটু ঘুরে তাকাতেই খেয়াল করে ইতিকাকে, মেয়েটি মুখে ওড়না গুজে চুপচাপ কেঁদে যাচ্ছে।অলীদের পাশে বসে আছে সুফিয়া।মি.ইব্রাহিম গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলের দিকে তাকিয়ে।
    ইনান হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

    – তোমরা এখানে?

    ইনানের প্রশ্নে মিসেস নাসরিম ভীষণ রেগে গেলেন,

    – ভেবেছিলি কী?আমাদের মিথ্যা বলে পার পেয়ে যাবি?হাত পায়ের কি বিভৎস অবস্থা।এমন অবস্থা তোর কে করেছে বাপ?বল আমায়।

    – বাদ দাও মা এইসব।যা হওয়ার হয়েছে।

    – আমার কসম লাগে সত্যিটা বল।আমার ছেলের গায়ে হাত তুলেছে আমি কি করে চুপ থাকবো?আমার কলিজা পুড়ে যাচ্ছে সেটা তুই বুঝবি না।

    – শুধু শুধু এইসব শুনে আর লাভ নেই যা হওয়ার হয়েছে।

    – চুপ কর তুই।অলীদ বাবা তুমি বলো কে করেছে তোমাদের এই হাল?

    অলীদ চমকে উঠলো।ইনানের দিকে আড় চোখে তাকালে তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে।ছেলেটা কেমন হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

    ইনানের চাহনী বুঝতে পেরে ধমকে উঠেন ইব্রাহিম।অবশেষে সবার জোরাজোরিতে মুখ খুললো অলীদ।

    – আঙ্কেল আমাদের উপরে হামলা ওয়াসিমের লোক করেছে আর বর্তমানে ওয়াসিমের দল আর বাহরুল ইসলামের দল এক জোট হয়ে কাজ করছে আশা করি বাকিটা আপনারা বুঝতে পারছেন!।

    ___

    সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে।রাতের আকাশে আজ তারার দেখা নেই।বিষন্ন মন নিয়ে নিজের ভাইয়ের বাড়িতে প্রবেশ করলেন নাসরিন।চোখের কোনে জমে আছে চিকচিক জল কণা।তাকে দেখে এগিয়ে আসলো রুমু।

    – ফুফুমা তুমি? হঠাৎ আমাদের বাড়িতে।

    – কেমন আছিস?

    – ভালো তুমি কেমন আছো?

    – ভালো।ভাবি-ভাইজান কোথায়?

    – সবাই দোতলায় চলো আমার সাথে।

    – নাহ!ভাইজানকে নিচে আসতে বল আমার কিছু কথা আছে বলে চলে যাবো।

    নাসরিনের বিষণ্ণ মুখের কথা শুনে চুপসে যায় রুমু।

    – ফুফুমা কি হয়েছে তোমার?

    – কিছু না তোর বাবাকে ডাক।

    রুমু দাড়ালো না ছুটে চলে যায় তার বাবাকে ডাকার উদ্দেশ্য।
    .

    – কিরে কেমন আছিস নাসরিন?

    – ভালো থাকতে কি তুমি দিয়েছো ভাইজান?তোমার অশান্তির আগুনে পুড়ছিতো আজ বেশ কয়েক বছর।

    নাসরিনের সহজ স্বীকারোক্তিতে চোখ তুলে তাকায় বাহরুল ইসলাম।সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে তাড়া দেখিয়ে বলে,

    – কী বলতে এসেছিস তাড়াতাড়ি বল।সামনে নির্বাচন আমার হাতে সময় নেই।

    – আজ ইনানের উপর হা’মলা না করলেও পারতে।মায়া দয়া বলেও একটা কথা আছে।

    – তোর ছেলে যা করেছে সেখানে আমি তো তাকে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছি অন্য কেউ হলে এতক্ষনে কবরে পাঠিয়ে দিতো।

    – ভাই তোমার পায়ে ধরতেও রাজি আছি শুধু আমার ছেলের গলার কাঁটা হয়ে থেকো না তুমি।মুক্তি দাও তাকে এবার।

    – থাকবো না বন্ধুত্ব করে নেবো আগের মতো, যদি রুমুকে তোর বাড়ির বউ করিস।

    – সম্ভব না।

    – আমারো সম্ভব না তোর ছেলেকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া।

    – তুই না আমার রক্তের ভাই বেইমানি কি করে করিস?

    – আচ্ছা একটা অপশন দিচ্ছি আব্বা মারা যাওয়ার আগে তোকে যে জমি আর বাড়িটা দিয়ে গেছে সেটা আমার নামে করে দে।

    বাহরুল ইসলামের এমন কথায় বিমূঢ় হয়ে গেলেন নাসরিন।

    – ছিহ ভাইজান অতীতের লোভ আপনাকে এখনো ছাড়েনি।সেই হিংসা এখনো কাজ করে আপনার মাঝে?যার দরুনে আব্বার দেওয়া শেষ স্মৃতি টুকু কেড়ে নিতে উঠে পড়ে লেগেছেন।

    – ঠিক আছে তাহলে তুই তোর ছেলেকে হারাবি আমার কিছু করার নেই।তাকে আমি সেফটি দিতে পারবো না।নবাবগঞ্জের ২১ বিঘে জমি আর বড়ো বাড়িটা আমার নামে করে দে।তাহলে সব হেরেসমেন্ট থেকে মুক্তি পাবি।

    – বেশ দলিল তৈরি করুন আমি প্রস্তুত আছি।

    নাসরিন উঠে চলে গেলেন একবার পেছনে ঘুরে তাকালেন না বাহরুল ইসলামের দিকে।যদি তাকাতেন তবে ঠিকি দেখতেন বাহরুল ইসলামের চোখে মুখে শ’য়তানি হাসির ঝলক।

    #চলবে..
    ®পলি আনান

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ১৯]

    ___________
    – তুই এখানে?

    রান্না ঘরের কাজ সেরে পেছেনে ঘুরে তাকাতে রুমুকে দেখে হোচঁট খেলেন মিসেস নাসরিন।

    – কতদিন হলো তোমাদের দেখিনা ফুফুমা আর ইনান ভাইয়াও আমাদের বাড়িতে আসেনা তাই চলে এসেছি।তাছাড়া ইনান ভাইয়ের বৌ’কে এখনো আমার সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

    রুমু থামলো, মিসেস নাসরিন এই প্রসঙ্গে আর কোন প্রশ্ন করলেন না।তিনি রান্না ঘরের বাহানায় নিজেকে ব্যস্ত করে তুললেন।

    – ফুফুমা?

    – বল।

    – সেদিন বাবার সাথে রাগারাগি করলে আর আমাদের বাড়িতে গেলে না।প্রায় চার মাস তোমাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই।কি এমন হয়েছে ফুফুমা যার কারনে তোমরা সবাই দূরে দূরে থাকছো।

    – কিছু না রুমু।ইতিকা রুমেই আছে তুই দেখা করে আয়।

    রুমু দাঁড়ালো না।হাই হিলের ঠক ঠক শব্দে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।সেদিন বাহরুল ইসলামের সাথে ততর্কবিতর্কের পর কেটে গেছে চারমাস।দুবাড়ির কারো সঙ্গে এখন কারো যোগাযোগ নেই।বাহরুল ইসলামো থেমে গেছে এখন আর ইনানের বিপক্ষে কার্যসিদ্ধি করেন না।অপরদিকে ওয়াসিমো ইতিকার অপেক্ষায় নেই।সে মেতে আছে খালি মাঠে বিপক্ষ দল ছাড়া একাই জয় হাতড়ানোর লোভে।

    – কিরে কেমন আছিস ভাইয়া?

    দরজার পাশে রুমুর কন্ঠ শুনে চমকে তাকায় ইনান।অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্য তৈরি হচ্ছিলো সে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইতিকা।

    – হঠাৎ তুই এই বাড়িতে?

    – কতদিন হলো তোর সাথে আড্ডা দিচ্ছি না তাছাড়া তোর বউকে এখনো দেখিনি।

    রুমু কোন ভনিতা ছাড়াই রুমে প্রবেশ করে।ছিমছাম গড়নের মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে চোখ বুলায় সে।গায়ের রঙ খুব একটা ফর্সা নয় তার ফোলা ফোলা গাল দুটতেই তাকে কোমলমতী লাগছে।বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে মেয়েটি তাকিয়ে আছে অস্থির দৃষ্টিতে।

    – ও কে ভাইয়া?ইতিকা?

    – হুম ইতিকা ইয়াসমিন।তোর ভাবী।

    রুমু এগিয়ে ইতিকার হাতটা টেনে কাছে আনলো।

    – বাহ তুমি তো খুব মিষ্টি মেয়ে।এমনি এমনি এক ঢিলে দুই পাখি মারো নি।

    রুমুর কথায় চোখ ছোট করে তাকায় ইনান।ইতিকা রুমুর কথার মানে বুঝতে না পেরে মিনমিনিয়ে বলে,

    – মানে?

    – আহ ঠাট্টা করছিলাম।তুমি তো ঠাট্টাও বুঝোনা।

    – তোরা থাক আমি অফিসে গেলাম।ইতিবউ সাবধানে থাকবেন।

    ইনান শেষ কথাটি বলে বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে যায়।অফিসে আজ তার বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

    .

    নীল সাদা মেঘে ঢেকে থাকা আকাশের দিকে এক চিলতে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ইতিকা।হাতে তার বাগান থেকে তুলে আনা গুচ্ছ গোলাপ ফুল।তার এই দৃশ্যকে রঙতুলির মাধ্যেমে ফুটিয়ে তুলছে রুমু।চারিদিকে বাতাসের শনশন ধ্বনি সূয্যিমামা যেন হেসে হেসে রোদের ঝলক দিচ্ছে ইতিকার চোখে মুখে।

    – রুমু’পু আর কতক্ষণ এইভাবে থাকবো?সূর্যের রশ্মিতে চোখ জ্বালপোড়া করছে।আমার শরীরের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে।

    – এই তুমি না গ্রামের মেয়ে?মফস্‌সল হলে মানা যেত। শুনেছি একদম অজপাড়াগাঁয়ে তোমার বাড়ি।তাহলে ঝড়,বৃষ্টি,রোদ তোমার তো মানিয়ে নেওয়ার কথা।এত ভংচং করছো কেন?চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।

    রুমু কথাটি বলে মৃদ্যু হাসলো।সকালে আসার পর থেকে ইতিকাকে নানান বাহানায় হাসি তামাশার ছলে অপমান করছে সে।অবশ্য অপমান গুলো ইতিকার গায়ে লাগলেও রুমুর মতোই নিজেও হেসে উড়িতে দিচ্ছে।সকাল থেকে যে অপমানের ছলনাপূর্ণ অভিনয় শুরু এখন শেষ বিকেল।

    – নাও তোমার ছবি শেষ।আসো দেখে যাও।

    ইতিকা এগিয়ে গেলো।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে।অদ্ভুত রকম সৌন্দর্য ঘিরে আছে ছবিটাতে।

    – এত সুন্দর ছবি!আর আমাকেও একদম নিখুঁত লাগছে।সবটাই সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে ছবিতে।

    ইতিকা তৃপ্তির হাসি দিয়ে কথাটি বললো।রুমু রঙতুলি,ক্যানভাস গোছানোর কাজে লেগে পড়ে, আনমনে খানিকটার অবজ্ঞা সুরে ইতিকাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,

    – যানো ইতিকা আমার একটা ফ্রেন্ড ইনান ভাইয়া বলতেই পাগল ছিল এককথায় যাকে বলে ঘোরতর পাগল।আমাদের বাড়িতে যখন যখন ভাইয়া আসতো তখনি সে ছুটে চলে আসতো আর নানান বাহানা খুঁজতো কথা বলার কিন্তু ভাইয়াকে তাকে পাত্তা দিতো না।

    – মেয়েটা বুঝি খুব সুন্দরী ছিল?

    – অবশ্যই।ইনান ভাইয়ার পাশে দাড়ালে দুজনকে রাজযোটক লাগতো।তবে দেখলে মানুষের রুচি কতটা নিম্নমানের।ইনান ভাই শেষে কী না তোমায় বিয়ে করলো!মাই গড। আর ওয়াসিম ভাই সে নিজেও তোমার জন্য সবার বিরুদ্ধে যু’দ্ধ ঘোষণা করে দিচ্ছে উফফ ভাবা যায় এগুলা।

    ইতিকা চুপসে গেলো।তার ভেতরটা ভেঙ্গে চুরে যাচ্ছে।নিজের উপর নিজেরি বারংবার অপরাধ বোধ তৈরি হচ্ছে।

    – আসলে আমার কী মনে হয় যানো ইতিকা?ওয়াসিমের উপর রাগ দেখিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইনান তোমায় বিয়ে করেছে।এই যে বউ বর খেলছো এটা জাস্ট একটা নাটক।
    সুযোগ সমেত তোমায় ছুড়ে ফেলে দেবে।

    – প্রতিশোধ! কিসের প্রতিশোধ?

    – তা আমি কি করে যানবো।কিছু একটা তো অতীত আছে তাদের মাঝে।শুনেছি তোমার কারনে নাকি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছে?আরে ইয়ার যে ছেলে টানা পাচঁ/ছয় বছর এই লাইনে জড়িত সে একটি মেয়ের কারনে সব ছেড়ে দেবে?অদ্ভুত! আর যাই হোক আমার এইসব বিশ্বাস হয় না।সংসার টিকবে কি টিকবে না তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই।আমি গেলাম গো সূর্য ডুবে যাচ্ছে।তুমি আবার ইনানকে কিছু বলো না।

    – আপনি যান আপু,আল্লাহ হাফেজ।

    রুমু যাওয়ার আগে আলতো ভাবে ইতিকাকে জড়িয়ে ধরলো এ যেন কাটা গায়ে মলম মেখে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

    রক্তিম আকাশটায় মৃদ্যু বাতাসে গাছের পাতা দুলছে।দুলছে ইতিকার খোলা চুল।হাতে মুঠোয় থাকা লাল গোলাপ গুলো ছুড়ে দেয় আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের ভাসমান অবস্থা থেকে পতিত হওয়া সেই গোলাপ গুলোর দিকে।আজ ইতিকার মনটাও এমন ভাবে পতিত হয়েছে।অনুভূতিরা থেমে গেছে, সবটা বিষাক্ত বিষাদময় লাগছে।ডুবে যাওয়া রক্তিম সূর্যের আশেপাশে বেশ দলাপাকানো পাখির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।তারা নীড়ে ফিরছে।
    ফিরতে হবে ইতিকাকেও তাই চোখের কোনে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে নিচে চলে যায়।

    __

    রাত দশটার পর বাড়ি ফিরে আসে ইনান।ক্লান্ত শরীরটা মূহুর্তেই এলিয়ে দেয় সোফায়।আড় চোখে ইতিকার দিকে তাকালো আজ মেয়েটাকে কেমন চুপচাপ লাগছে।হয়তো পড়ছে তাই।ইনান ক্লজেট থেকে জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দাঁড়ায় ইতিকার পাশে।

    – পড়া শেষ হয়নি এখনো?

    – না।

    – আচ্ছা পড়ুন।

    ইনান ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে, কিছুক্ষণ পর রূপসী এসে ডেকে যায় ডিনার টেবিলে যাওয়ার জন্য কিন্তু ইতিকা খাবেনা বলে নাকচ করে দেয়।তাতে বেশ খানিকটা অবাক হয় ইনান।

    – আফা আমনে সইন্ধার সময়েও কিছু খাইলেন না।এহনো ভাত খাইবেন না খালাজান হুনলে আমারে ধমকাইয়া আবার পাডাইবো আমনে খাইতে আইয়েন।

    – আমি খাবো না।তুমি আম্মাকে বলে দাও।

    – শরীর কী খারাফ আমনের?এমন বেরাজ হইয়া গেলেন কেন আইজকা?

    – তুমি যাবে?নাকি আমি উঠে যাবো পড়া ছেড়ে।

    ইতিকার কথার গম্ভীরতায় সন্দেহের বাতি জ্বলে উঠে ইনানের মনে।ইনান রূপসীকে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করতে সে চলে যায়।ইনান উঠে এসে ইতিকার সামনে দাঁড়ায়।

    – খাবে চলুন।পরে পড়লেও চলবে।

    – খাবো না আমি খিদে নেই।

    – হঠাৎ খিদে কেন?কার সাথে কি খেয়েছে?

    – আপনার খাওয়ার হলে আপনি খেয়ে আসুন আমার সাথে জোরাজোরি করবেন না।জোরজবরদস্তির আমার ভালো লাগছে না আর।

    ইতিকা যতটা সহজে কথাটা বলে দিয়েছে ঠিক ততটা সহযে কথাটা হজম করতে পারলো না ইনান।ইতিকার দিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আঙুল নাচিতে শান্ত সুরে বলে,

    – আমি ছাদে যাচ্ছি ঠিক দশ মিনিট পর ফিরে এসে তোমায় যেন রুমে না দেখি।নিচে যাবে সবার সঙ্গে ডিনার টেবিলে বসবে।

    .
    শুনশান নিরবতার রাত।নিয়নবাতির আলোয় আলোকিত চারিদিক।দূর থেকে কোথায় যেন স্লো ভলিউমে গান চলছে ইনান ভালোভাবে পরিবেশটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে অলীদকে ফোন করে,

    – কিরে এত রাতে ফোন করেছিস কোন সমস্যা ইনান?

    – হুম,ইতিকা কেমন যেন বিহেভ করছে।আমার সন্দেহ লাগছে রুমু আজ এই বাড়িতে এসেছিল নিশ্চই গন্ডগোল পাকিয়েছে।

    – নিশ্চই আউল,ফাউল কথা কানে বিষমন্ত্র হিসেবে ঢেলে দিয়েছে। ওয়াসিম আমাদের রাস্তা থেকে সরে গেছে তবে হঠাৎ রুমু পেছনে পড়লো কেন?যাই হোক মাথাটা ঠান্ডা রাখ।

    – মাথা আমি ঠান্ডা রাখবো কী করে?যার জন্য আমার সব কিছু সে নিজেই আমার সাথে তিরিক্ষি মেজাজ দেখাচ্ছে।

    – তুই মাথা ঠান্ডা রাখ।আর আমি কাল আসবো ভাবীর সাথে কথা বলবো চিন্তা করিস না।
    – হুম।গুড নাইট।

    ইনান বেশ কিছুক্ষণ পর নিচে গেলো ইতিকাকে এখনো পড়ার টেবিলে দেখে, মাথা যেন হুট করে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে গরম হয়ে গেছে।

    – আপনি এখনো এখানে?নিচে যেতে বলেছি আমি।

    – আপনার খাওয়ার ইচ্ছা হলে আপনি খান আমার ইচ্ছে নেই।

    ইতিকার এমন ঠাট কথায় কিঞ্চিৎ রেগে গেলো ইনান।ঝটকায় ইতিকাকে দাঁড় করিয়ে মুখোমুখি কাছে আনলো।

    – চোখ মুখ এমন ফোলা কেন?কেউ কিছু বলেছে ইতিবউ?

    ইনানের কন্ঠ কোমল,আদুরে।ইতিকা পালিয়ে বাচঁতে কথা কাটিয়ে নেয়।

    – কে আমায় কী বলবে?আমার কিছু হয়নি এমনিতেই মাথা ব্যাথা করছে।

    – আবার মিথ্যা?এই চোখ আমি চিনি।এই চোখের ভাষা আমি বুঝি আমার সাথে মিথ্যা বলে লাভ নেই ইতিবউ।

    ইতিকা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।সত্যটা আড়াল করতে, নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ঝটকায় সরিয়ে দিলো ইনানে হাত।বাধঁন থেকে মুক্ত হয়ে সরে যেতেই ইনান উলটো তাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরলো।দুজনের মাঝে আর মাত্র সামান্য ব্যবধান।ইনান এক হাত পকেটে গুজে অন্য হাত দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।দৃষ্টি তার ইতিকার মুখের দিকে।

    – দীর্ঘ দেড়মাস আমি আপনাকে নিয়ে গোপনে বহুদর্শিতা করেছি।আপনার হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া সবটা বুঝেছি।কখন আপনি কী করতে চান কিংবা আপনার মনে কি চলে তার কিঞ্চিৎ হলেও আমি বুঝে ফেলি।। এরপর আমাদের বিয়ে হলো প্রায় একটা বছর কেটে গেছে।আপনি যে দিন দিন আমার আসক্তি হয়ে উঠেছেন তা কী জানেন আপনি ইতিবউ?আমায় মিথ্যা বলেন কেন?

    ইতিকা মাথা নুইয়ে নেয়,তার শরীর কাঁপছে।ইনানের আচরণ শান্ত তবে কেমন যেন অস্বাভাবিক।ইতিকার উত্তর না পেয়ে ইনান ইতিকার মাথায় হাত রাখলো চুল গুলোতে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলে,

    – আমার চোখে নিজেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন,কি ভেবেছিলেন আমি বুঝিনা?আপনাকে পাই না পাই সেই বিচারবিবেচনা পরে হবে।কিন্তু আপনাকে যে আমার লাগবে, যে করে হোক লাগবে মানে লাগবেই।তা আমি বুঝেছি তখনি যখন আপনি আমায় ছেড়ে এই বাড়িতে পড়ে ছিলেন।চট্রগ্রাম থেকে ফেরার পর আপনাকে ফ্লাটে না পেয়ে আমার ইচ্ছে করছিল সব কিছু ভেঙ্গেচুরে দিতে।চট্রগ্রাম থেকে আমি যে কতটা আকুলতা নিয়ে ফিরে এসেছি সেটা একমাত্র অলীদ যানে।তারপর সব ভুলে আপনার কথা মত আমি এই বাড়িতে ফিরে আসি।কিন্তু রাজনীতি ছাড়তে পারিনি।তারপর আবারো চলে গেলেন আর গেলেনো যখন ওয়াসিমের হাত ধরে যাওয়া কি খুব প্রয়োজন ছিল ইতিবউ?

    ইনান কথাটি বলে খামছে ধরে ইতিকার চুল।ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে সে।ছয়/সাত মাস আগের কথা কেনই বা তুলছে ইনান।আর ওয়াসিমের সাথে যাওয়ার জন্য ইনান তাকে বিশেষ ভাবে কিচ্ছু বলেনি।কেনই বা বলেনি সেটা নিয়েও ভয় ছিল ইতিকার মনে।কিন্তু আজ হঠাৎ ইনানের এমন আচরণে ঘবড়ে গেছে ইতিকা।

    – বিশ্বাস করেন ইতিবউ যাস্ট একবার আপনাকে যদি খুঁজে পেতাম কি কি করবো সব ভেবে রেখেছিলাম।আপনাকে নিয়ে আমি দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্লানিং করেছি গোপনে।দীর্ঘ পাচঁদিন পাগলের মতো খুঁজেছি কিন্তু পেলাম না।তারপর যখন সেদিন রাতে মা আপনার সঙ্গে মোবাইলে বারান্দায় চুপিচুপি কথা বলছিল আমি বুঝে গেলাম সবটা তাদের প্লান।যার সাথে জড়িয়ে আছে সুফিয়া,অলীদ,বাবা। শুধু বোকা হলো ওয়াসিম, ভেবেছিল সে আপনাকে পেয়ে গেছে। আর বেকুব হয়ে ছিলাম আমি,যে কী না পাগলে মতো খুঁজছি আপনাকে।তারপর দিন আমার আরেকটি প্রাপ্তির সূচনা হলো,আমার ইতিবউকে পেয়ে গেলাম।সব ছেড়ে দিলাম।আসলে কী জানো ইতিকা যেখানে বাবা, মা,সুফিয়া,অলীদ তুমি তোমরা সবাই চাও আমি রাজনীতি ছেড়ে দি সেখানে আমার ঘাড়ত্যাড়ামো করা কিঞ্চিৎও মানায় না।

    ইতিকা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।সে ভেবেছিল ইনান সত্যিটা জানেনা।দুই’চারটা ঢোক গিয়ে তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটে বলে,

    – এই জন্যই কী আমায় এই সম্পর্কে একটু কিছুও বলেন নি?একটু শাসনো করলেন না।আমি তো ভেবেছিলাম রাতুলের মতো নাক ফাটিয়ে দেবেন।

    – যাস্ট মে’রে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল আমার কিন্তু থেমে ছিলাম চুপ ছিলাম।আর এখনো চুপ আছি।যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে আর যা হবে ভালোর জন্য হবে।

    দীর্ঘক্ষণ পর ইতিকা হাসলো।ইনানের গলায় হাত ঝুলিয়ে বলে,

    – তবে কে জিতে গেলো মি. ইফতিহার ইনান?শেষ জিত’টা আমারি হলো।

    – মানে?

    – বিয়ের দিন রাতের কথা মনে নেই আপনার?

    ইনান অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।তার দৃষ্টি নত করে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো বিয়ের দিন রাতের কথা।যেদিন ছিল দু’জন দুজনের বিপক্ষে।

    ~~অতীত…

    – ভাগ্য বদল শুনেছো কখনো?আজকের পর তোমার ভাগ্য বদল হবে।হয় সূচনা না হয় বিষাক্ত উপসংহার।

    ইনান ইতিকাকে ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।তখনি আয়নায় সেই কিশোরীর প্রতিবিম্ব অগোচর করে ইনান।মেয়েটি হাসছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে।ইতিকা হাসতে হাসতে ইনানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

    – ঘটনা তো উল্টাও হতে পারে, যদি আপনার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়?আমার যা চাই তা কিন্তু আমি নিয়েই ছাড়ি কিন্তু আপনি আমার পূর্ণতাতে বাঁধা দিয়েছেন তাই আপনার প্রাণ বিনাশ করে হলেও আমি আমার পূর্ণতা করে ছাড়বো।

    ইতিকার কথায় খিটমিট করে হাসে ইনান।আয়নার দিকে তাকিয়ে ইতিকার চোখে চোখ রেখে কোমড়ে হাত গুজে বলে,

    – তবে তাই হোক!

    বাস্তবে ফিরে এসে ইনান ইতিকার দু’গালে আলতো করে হাত রাখে।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,

    – না আমি জয়ী হলাম আর না আপনি জয়ী হলেন।তখন আপনার চাওয়া ছিল ওয়াসিমকে পাওয়া। আমাকে নাশ করে হলেও আপনি ওয়াসিমকে চেয়েছেন।আর আমার চাওয়া ছিল আপনাদের আলাদা করা ব্যস এটুকুই।

    ‘আলাদা করা’ বাক্যটা শুনেই হতভম্ব ইতিকা।তার শরীর কাঁপছে।হুট করে রুমুর কথা মনে পড়ে গেলো।তখন রুমু বলেছিল ওয়াসিমের উপর জেদ ধরেই তাকে বিয়ে করেছে ইনান।তবে কী ইনানে সব নাটক ছলাকলা।

    মূহুর্তেই ইতিকার সব আশা ভালোবাসায় যেন মুষড়ে গেছে।দু’চোখ ভিজে গেছে নোনাজলে।

    – একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?

    ইতিকার প্রশ্নে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় ইনান।

    – আপনি ওয়াসিমের সাথে জেদ ধরে আমায় বিয়ে করেছেন তাই না?আমায় নিয়ে কেন খেলছেন?আমি হতদরিদ্র এতিম বলে?

    সহসা মাথা চড়া দিয়ে রাগ উঠেছে ইনানের।রক্তিম চোখে ইতিকার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে দুগাল চেপে ধরে তার।

    – শুনো মেয়ে যা ছিল তা অতীত।বর্তমানে আমি আপনার জন্য সব করছি আপনাকে খুশী করতে নিজের চাওয়া পাওয়া ভুলে যাচ্ছি তারপরেও যদি এমন প্রসঙ্গ উঠে তবে আমার রাগ কোন আসমানে উঠে তা কী বুঝতে পারেন?

    – আমি তো আপনার জীবনে নিতান্তই একজন আগন্তুক ব্যাক্তি।

    ইতিকা কথাটি বলে আবারো দৃষ্টি নত করে।ইনান তার চিবুক উপরে তুলে নেয়।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

    – সেই আগন্তুক এখন আমার আসক্তি।

    #চলবে…..
    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ২০]

    ________
    সময়টা প্রাতঃকাল চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত।আধাঁরকে পেছনে ফেলে সূর্য্যি মামা আলো নিয়ে উঠছে।ঘরের দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো মিহি।হাতে তার ছাই।দাঁত মাজতে মাজতে এগিয়ে গেলো দিঘির পাড়ে।বেশ কিছুক্ষণ পর হাত মুখ ধুয়ে উঠে এলো সে।চোখের সামনে স্থির নয়নের মানবকে দেখে শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেছে।

    – ওয়াসিম ভাই আপনি এখানে?

    – কেমন আছিস?

    – জি ভালো ভাইয়া।

    বেশ শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো মিহি।

    – তোর বাবা কোথায়?

    – বাপজান তো ভোরেই বাজারে গেলেন।

    – তোর সাথে কিছু কথা আছে।নদীর পাড়ে আয়।

    – ন..নদীর পাড়ে কেন?এখানে বলেন,ঘরে চলেন অন্তত।

    – না নদীর পাড়েই বলবো দ্রুত আয় দেরি করিস না কিন্তু।

    ওয়াসিমের শান্ত কন্ঠ।মিহি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
    __

    দিন দিন মনে কেমন যেন ঘুনপোকারা বাসা বাধঁছে, যা ধীরে ধীরে বিনষ্ট করছে অন্তঃকরণ।অনুভূতিরা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।একটু চিৎকার দিয়ে কাদঁতে পারাদ যেন জো নেই।কাদঁবেই বা কি করে রমণীর আজকাল কাদঁতেও আজ্ঞার প্রয়োজন।এছাড়া কান্না তার জন্য নিষিদ্ধ।আর যদিও চোখের কার্নিশ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে তবে আর রক্ষে নেই।ইনান,নাসরিন সবাই চিৎকার চেচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলবে।এই যে এখন একটু কাদঁতে চাইছে ইতিকা কিন্তু কাদঁতে পারছেনা সে।

    তাকে হতে হবে পাথরের মতো শক্ত।হাতের কফি মগটায় একটু খানি ফুঁ দিয়ে চুমুক বসালো।তার পাশে রুমু, যে কী না আগের দিনের মত হাজারটা নিন্দাসূচক বাক্য ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি ধাপে বার বার বুঝিয়ে দিতে চাইছে ইতিকা ইনানের জন্য নয়!গ্রাম্য মেয়ে মানানসই বিষয়টা তার মাঝে নেই।ইতিকা সব কথা হজম করছে নির্বাক ভঙ্গিতে।

    আকস্মিক মেঝেতে কাচঁ ভাঙ্গার শব্দে কেঁপে উঠলো ইতিকা।ভাবনার জগৎ ছেদ হতেই লাফিয়ে উঠে সে।সহসা চোখের সামনে ভেসে উঠে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা।মূহুর্তেই কানে আসে ঠাস ঠাস শব্দের প্রতিধ্বনি।হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পলকহীন ভাবে।আরেকটি চড়ের শব্দে সৎবিৎ ফিরলো ইতিকার।ততক্ষণেও ইনান থেমে নেই।ইচ্ছে মত রুমুর গালে থাপ্পড় দিতে থাকে।ইতিকা লাহমায় রুমুকে সরিয়ে আনে হিংস্ররূপির মানুষটার কাছ থেকে।যার দৃষ্টিতে মায়া-দয়ার ছিটেফোঁটা ও নেই।আরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে ক্রুদ্ধ হয়ে।

    – সামনে থেকে সরে যান ইতিবউ।

    – যাবো না আমি।রুমুকে মারছেন কেন?

    – তার কৈফয়ত আপনাকে দিতে বাধ্য নই।

    – বেশ তবে আমিও সরবো না।

    ইতিকার দৃঢ় প্রত্যয়।তবে সেটা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।ইনান ঝটকায় সরিয়ে দিলো ইতিকাকে।এতটাই জোরে ছুড়ে মারে মেয়েটি তৎক্ষণাৎ মেঝেতে পড়ে যায়।হাতের তালুর অংশে খানিকটা ছিলে গেছে।তবুও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবারো ছুটে আসতে নেয় রুমুর কাছে।অতি অল্প সময়ের মধ্যে অলীদ তার হাত ধরে নেয়।এবং ইনানের সম্মতি পেয়ে তাকে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে আনে।

    .

    কাঁপা-কাঁপা হাতে অলীদের হাত থেকে দ্রুত পানির গ্লাসটি হাতে তুলে নেয় মেয়েটি।ঠকঠক করে কাঁপছে তার শরীর।নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে।গলার স্বর বসে গেছে।দ্রুত পানি পান করে চোখ তুলে তাকায় মেয়েটি অলীদ টিস্যু বাড়িয়ে দেয় তার দিকে।ঠোঁট থেকে গলায় জামাকাপড়ে পানি পড়ে সবটা ভিজে আছে।

    – এত অস্থির হচ্ছেন কেন ভাবী?

    – অস্থির!অস্থির হবো না আমি?উনি ম..মেয়েটা মারছেন কেন?

    – কাল সে আপনাকে কী বলেছিল?

    -ক…কই কিছু না।আমরা তো শুধু….

    – চুপ করেন ভাবী।আজ আমরা অনেক্ষণ যাবৎ আপনাদের আড়ালে ছিলাম।রুমু যে কথার ধাচে আপনাকে বার বার অপমান করেছে সেটা আপনি বুঝেও না বুঝার ভান করে ছিলেন।কাল কী বলেছে সেটা আমরা জানি না।তবে আজকে যে মেয়ে এতটা হেয় করেছে আপনাকে কাল যে করেনি তার নিশ্চয়তা কী?

    – তাই বলে এত গুলো থাপ্পড়!

    – রুমুকে আমি তার ছোট বেলা থেকে চিনি মেয়েটি অতিসাধারণ।সারাদিন রঙতুলি তার আঁকিবুঁকি,পেইন্টিং নিয়ে সে ব্যস্ত।কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ তোমার পেছনে লাগলো কেন বুঝলাম না।নিশ্চই ওয়াসিমের চাল।

    – ওয়াসিম?

    – আপনাকে যেদিন গ্রামে ইনান ফিরিয়ে আনতে যায় সেদিন ওর মামার বাড়ির সবাই এসেছিল, ইনান এবং রুমুর বিয়ের সম্বোধন নিয়ে।কিন্তু ইনানের পক্ষ থেকে সব নাকচ করা হয়েছে।বিষয়টি একদিক দিয়ে অপমান জনক তাই হয়তো এমন করছ সে।তাছাড়া ইনান এবং রুমুর বিয়ে হলে আপনাকে পাওয়া সহজ হয়ে যেত ওয়াসিমের।

    ইতিকা ফস করে শ্বাস ছাড়লো।খোলা চুলগুলোকে মুষ্টিবদ্ধ করে দ্রুত খোপা করে দৃষ্টি নত করলো অলিদের দিকে,

    – কিন্তু রুমুর কথা গুলো মিথ্যা নয় অলীদ ভাই।ইনানের সঙ্গে আমাকে কী যায়?সে কোথায় আর আমি কোথায়?তাছাড়া বিয়েটা যে ওয়াসিমের উপর প্রতিশোধ নিতে করা হয়েছে তা আমি বুঝতে পারছি।

    ইতিকা কথাটি বলে চুপ রয়ে যায়।অলীদের ললাটে ভাজ পড়ে কিঞ্চিৎ।ঠোঁটে তার অবজ্ঞার হাসি।উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে চলে যায়, দরজাটাকে ভিড়ে আবারো বসে যায় ইতিকার সামনে।

    – একটা গল্প শুনাই আপনাকে ভাবী মন দিয়ে শুনবেন।

    – এই মূহুর্তে গল্প বলতে এসেছেন! আপনি ফাইজলামি করছেন নাকি ভাই?

    ইতিকার কথায় পাত্তা দিলো না অলীদ।বরং সে বলতে শুরু করে,

    – এক ব্যস্ত শহরে চার বন্ধুর বসবাস।যদিও একজন ঢাকার বাইরে থাকতো তবুও সে ঢাকাতেই আলাদা ফ্লাটে থাকতো কেননা পড়াশোনা তার ঢাকাতেই চলমান।হঠাৎ এক কালো অধ্যায় তাদের আলাদা করে দেয়।ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল চারজন বন্ধু।তার মধ্যে একযোগে রইলো বাকি তিন বন্ধু।আরেকজন ছিল পিশাচ রূপি।বেশ কয়েক বছর পর শোনা যায় গ্রামের কোন মেয়েকে নাকি সে ভালোবেসেছে!এতে পিশাচের পরিবার কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।সর্বশেষ পিচাশের পরিবার একটি ছলাকলা কৌশল করলো।পিশাচকে পাঠিয়ে দিলো দেশের বাইরে।আর বাকি তিন বন্ধুর মাঝে যে মধ্যেমণি তার পরিবারের একজনের সাথে ডিল করা হয়েছে মেয়েটিকে মারার।যোগ সূত্রে মধ্যেমণিকে বলা হয় মেয়েটিকে মারার জন্য।মধ্যেমণি কৌশল এঁটে মেয়েটির সম্পর্কে দেড়মাস যাবৎ অবগত হলো।পরিশেষে মধ্যেমণি ছেলেটি এটাই বুঝলো মেয়েটির তো কোন দোষ নেই!সে নিতান্তই একজন নির্দোষ ভুক্তভোগী।সে চেয়েছিল ভালোবাসা একটুকু আশ্রয়।মেয়েটির ছিল না কোন নির্দিষ্ট পরিবার।ছেলেটি পড়ে গেলো এক মায়াঘোরে।সবাইকে উপেক্ষা করে মেয়েটিকে নানান বাহানায় ভয়ভীতি দেখিয়ে বিয়ে করে আনলো।আর মেয়েটিকে দিলো একটি পরিবার নতুন করে নিশ্চিন্ত মনে বাঁচার সুযোগ।কিন্তু সব কিছুর মাঝে মেয়েটি আজীবন ছেলেটিকে দোষারোপ করে গেলো।কেননা এই বিয়ের কারনে সে তার ভালোবাসা হারিয়েছে।অবশ্য মেয়েটিরো দোষ কী?অন্তরালের সত্যিটা সে যানে না।

    অলীদ তর্জনির আঙুল দিয়ে ললাট ঘষতে থাকে বুকের ভেতটায় ধুক ধুক শব্দ ক্রমশ বাড়ছে।ভ্যাপসা গরমে শরীরের চামড়া জ্বলে উঠছে।হুট করেই সুফিয়ার কথা মনে পড়ে গেলো।ইসস মেয়েটাকে দেখছেনা কতদিন হয়ে গেলো।শার্টের হাতা ফোল্ড করে তাকালো ইতিকার দিকে।মেয়েটির চোখের কার্নিশ বেয়ে নেত্রবারী গড়িয়ে পড়ছে।তবে কী এই গল্পের সর্বশেষটা বুঝতে পেরেছে।তা ভেবেই ঠোঁটের কোনে যেন বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে উঠলো অলীদের।

    – অলীদ ভাই সবটা মাথার উপর দিয়ে গেলো গল্পটাতে কোথাও যেন আমি জড়িয়ে আছি একটু বুঝিয়ে বলুন প্লিজ।

    অলীদ স্মিথ হাসলো।

    – ওয়াসিমের বাবা বাহরুল ইসলামের সঙ্গে ডিল করেছিল তোমায় মারবে।যদিও তাদের দুজনের মাঝে চলছিল শত্রুতা কিন্তু তোমায় মারলে ওয়াসিম তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে তাই দুজনে আবার আগের মতো বন্ধু হওয়ার সিধান্ত নেয়।ওয়াসিমের বাবা আর ইনানের মামু তারা আগে থেকেই বন্ধু ছিল।রাজনীতির কলকবজায় তারা বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যায়।মাঝখানে বখরির গরু হলে তুমি।কিন্তু ইনান তোমায় বাঁচিয়ে দিলো।ইনানের মত যদি না পাল্টাতো তবে এতদিন তোমায় আর এই পৃথিবির আলো দেখতে হতো না।

    অলীদ থেমে গেলো।চেয়ে রইলো ইতিকার পানে।

    ইনান ইতিকাকে বিয়ে করার কারণটা নিয়ে ইতিকার মাঝে ছিল নানান মতবাদ সন্দেহ।আজ সবটা জেনে সে স্তম্ভিত।অলীদের দিকে একটু তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে,

    – অলীদ ভাই আরেক গ্লাস পানি দিন।
    __

    – কী ভাবছিস এত? রুমুর বিয়ের কথা ভাবছিস না কি রে তুই?

    সাহাব উদ্দীনের কথায় মুখ তুলে তাকায় বাহরুল ইসলাম।হাতে থাকা সিগারেট’টায় আরেকটি টান দিয়ে ধোয়া উড়িয়ে দিলেন চিন্তিত মনে।

    – আপদত মেয়ে বিয়ে করছেনা।আর চেয়েছিলাম ইনানের সঙ্গে বিয়ে, কিন্তু….

    – এত চাপ নিচ্ছিস কেন তুই?ইনানের জমি,বাড়ি সবটাই তো পেলি এবার শুধু ভালো এবং বড় ঘর দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দে।আমার মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গেলো।ওয়াসিম আর ওই গ্রামের মেয়েটাকে নিয়ে পড়ে নেই।ওই মেয়ে তার রাস্তায় আমার ছেলে তার নিজের রাস্তায়।এবার আমি নিশ্চিন্ত মনে আছি।

    সাহাব উদ্দীনের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলেন বাহরুল।

    – ঠিক বলেছিস।তবে আমি অন্য চিন্তায় আছি ইতিকাকে নিয়ে ব্লাকমেইল করে আমার শত্রু পক্ষ না আবার ইনানের মুখ থেকে আমার বিরুদ্ধে সব প্রমান জোগাড় করে নেয়।

    – আমাদের মূলমন্ত্র একটাই যতদিন আমাদের দলে আছে ততদিন তার পৃথিবির আলো দেখার অধিকার আছে।আমাদের দল থেকে বের হওয়া আর পৃথিবির আলো দেখার আশা করা বোকামি।যাস্ট পিষে মে’রে ফেলতাম।কিন্তু ইনানের কেসটা অন্যরকম।যাই হোক ছেলেটা তোর ভাগীনা।

    – এই একটাই দূর্বলতা আমার।তাই তো ছেলেটাকে এখনো বাচিঁয়ে রেখেছি।
    তবে আমার বিরুদ্ধে এখনো কোন কাজ করেনি।শুধু একবার আমার বিরুদ্ধে রেষারেষি হোক তবেই চিরতরে পরপারের বাসিন্দা করে ছাড়বো।

    বাহরুল ইসলামের কথায় ঠোঁট বাকিয়ে হাসতে থাকে সাহাব উদ্দীন।

    .

    কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতালে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ইতিকা,ইনান এবং অলীদ।সুফিয়ার সুইসাইডের কথা শুনে বুকের ভেতরটায় মুষড়ে উঠে অলীদের।বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সুফিয়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছে তাদের।করিডোরে চেয়ারে বসে নিশ্চুপ চোখের জল ফেলছেন সুফিয়ার মা।

    ইনান তাড়াহুড়ো করে কেবিনে প্রবেশ করে তার পেছনে অলীদ এবং ইতিকা।

    – মরতে শখ হয়েছে?এত নিম্ন মানের বিষ পেলি কোথায়?আমাকে বলতি একদম হাই পাওয়ারের বিষ এনে দিতাম।এক ডোজেই যথেষ্ট।

    ইনানের স্থির চিত্তের কথায় চমকে তাকায় সুফিয়া।ইনানের চোখে চোখ রাখতেই দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কোন কথা আসছে না তার।গলার কোথাও যেন কাঁটা বিধে আছে।ইনানের আরক্ত দৃষ্টির রুষ্ট কন্ঠে সে হতবাক।

    – কিরে তাকিয়ে কী দেখছিস?জানিস না এখন’কার বিষে ফরমালিন মেশানো থাকে।বর্তমান সময়ের বিষ খেলে সর্বোচ্চ হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবি তবে মরবি না।

    ইনানের কথার যৌক্তিকতা খুঁজে পেলো না অলীদ।ইতিকা বাক্যহীন তাকিয়ে আছে অবাক পানে।অলীদ গলা ঝেরে কেশে এগিয়ে গেলো সুফিয়ার কাছে।

    – এমনটা করলি কেন সুফিয়া?আমাকে বললে এবারো বিয়েটা ভেঙ্গে দিতাম।অন্তত এর আগে বারোটা বিয়ে ভেঙ্গেছি এবারের টাও ভাঙ্গতাম।তাই বলে তুই সুইসাইড করতে যাবি।

    – বাবা হুট করে দুপুরে এসে বললেন সন্ধ্যার পর এঙ্গেজমেন্ট।তোমার বন্ধুদের চাইলে ইনভাইট করতে পারো।আমার মাথা কাজ করছিলো না।বাবাকে বার বার বলেছি ওয়াসিমের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করো কিন্তু বাবা শুনলেন না।বরং আমার গায়ে হাত তুললেন তাই…..

    – তাই বলে মরবি?ওই ছেলের মাঝে কী আছে সুফিয়া?আঙ্কেল তো তোকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেনা।কিন্তু তোর ওই নোংরা চরিত্রের ওয়াসিমকেই চাই। একটা মানুষের জীবনে সবচেয়ে বাজে অধ্যায় কী জানিস?ভুল মানুষের প্রেমে পড়া,সেই মানুষটাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা।আর যা তুই বর্তমানে করছিস।এখনো সুযোগ আছে নিজেকে সামলেনে।ওয়াসিমের সাথে নিজের জীবন জড়ানো মানে জাস্ট তুই শেষ হয়ে যাবি।

    ইনান কথাটি বলেই শব্দ করে শ্বাস ছাড়লো।তার পাশে ইতিকা তাকিয়ে আছে অবাক পানে।তার পায়ের নিচের মাটিটা যেন সরে গেছে।ফিসফিস করে আনমনে বলে,

    – আপু ওয়াসিমকে ভালোবাসে!

    .
    মেয়ের সুইসাইডের আকস্মিক পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েন সুফিয়ার বাবা।অবশেষে কোন উপায়ন্তর না পেয়ে ওয়াসিমের সাথে সাক্ষাৎ করেন তিনি।ওয়াসিমের বাবাকে সবটা জানানো হলে তিনি নির্দ্বিধায় সুফিয়াকে বাড়ির পুত্রবধূ করতে রাজি হয়ে গেলেন।

    সুফিয়ার বেডের পাশে ইনান,অলীদ,ইতিকা সহ তার বাড়ির সকলেই উপস্থির।হঠাৎ করে কেবিনে প্রবেশ করে সুফিয়ার বাবার সঙ্গে ওয়াসিম।
    ওয়াসিমকে দেখেই কর্তব্যবিমূঢ় ইনান,অলীদ ইতিকা।ওয়াসিম এগিয়ে আসে সুফিয়ার কাছে কোন ভনিতা ছাড়াই বলে,

    – তুই এত পাগল এই মূর্খ,বেয়াদব ছেলেটার জন্য?সুইসাইড করতে গেলি কেন বোকা মেয়ে।আমি কী তোকে কম ভালোবাসি নাকি?ছোট থেকেই তোকে দেখছি।চিন্তা করিস না।এবার যা হবে ঠিক ঠাক হবে দু’দিন পরেই আমাদের বিয়ে।দ্রুত সুস্থ হয়ে যা।

    ওয়াসিমের শান্ত স্বরের কথায় অশান্ত হয়ে পড়ে অলীদ।অস্বাভাবিক ভাবে হঠাৎ করেই সে ঘামছে।দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজেকে একা করে নেয়।অস্থিরতা মাথায় চেপে বসেছে।পরিস্থিতি সবটা তার হাতের বাইরে চলে গেছে।
    অপরদিকে ওয়াসিমের দিকে তীর্যক ভাবে তাকিয়ে আছে ইতিকা।ওয়াসিম আড় চোখে একবার দেখে নিলো ইতিকাকে।

    উপস্থিত পাঁচজন মানবের মনে আজ পাঁচ রকমের অনুভূতি।কেউ বা চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে প্রশ্নের উত্তর চেয়ে।কেউ বা হারানো প্রাপ্তির খুশিতে বাক্যহীন।আর কেউ ভালোবাসা হারানোর ভয়ে বিবর্ণ পরিস্থিতিতে।

    #চলবে…..
    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ২১]

    _________
    মধ্যাহ্ন সময়টাতে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে বিয়ে বাড়ি।স্বল্প আয়োজনে রিসোর্টে বিয়ের সকল কার্যক্রম শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন সুফিয়ার বাবা মোস্তাফিজ।মেয়ের ঠোঁটে হাসি দেখে আনন্দ ফিরে পেলেও মানসিক ভাবে একদম ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি।অশিষ্ট একটি ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে ভবিষ্যত জীবন কোন পর্যায়ে যাবে ভাবতেই গা শিউরে উঠছে তার।হালকা হিমেল হাওয়ার সাথে আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।চারিদিকে লাইটিং এর ব্যবস্থা এছাড়াও আর্টিফিশিয়াল ফুলের সাহায্য সাজানো হচ্ছে পুরো রিসোট।অলীদ শার্টের হাতা ফোল্ড করে এগিয়ে গেলো মি.মোস্তাফিজের সামনে।

    – আঙ্কেল সুফিয়া কোথায়?

    – সম্ভবত তার রুমেই আছে।একবার গিয়ে দেখে আসো।

    অলীদ মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।দু’চারটা রুম খোজাখুজি করে স্বল্প সময়ে পেয়ে গেলো সুফিয়ার রুম।মেয়েটির হাতে গায়ে হলুদের শাড়ি সহ ফুলের গয়না।পাশে বসে আছে কয়েকজন বিউটিশিয়ান।

    – সুফু আসবো?

    – হ্যা আয়।

    অলীদ রুমে প্রবেশ করে বারান্দায় চলে গেলো।তার পেছনে এগিয়ে এলো।সুফিয়া।

    – বিয়েটা তাহলে করছিস।একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারনে তোকে সারাজীবন কাদঁতে হবে রে।এখনো সময় আছে বিয়েটা ক্যান্সেল কর।

    অলীদের কথায় বেশ রেগে গেলো মেয়েটি।কিছু বলার আগেই তার দু’হাত টেনে নিলো অলীদ।হাতের তালুতে বেশ নজর কাড়া মেহেদী ডিজাইন করা হয়েছে।মাঝে অবস্থান করছে ওয়াসিমের নাম।বিষয়টি অলীদের নজরে আসতেই অন্তঃকরণ থেকে চাপা ব্যাথার অনুভব হলো।সুফিয়াকে দু’বাক্য করার সুযোগ না দিয়ে মাথা নুইয়ে বলে,

    – ভালো থাকিস।এই বিয়ের প্রসঙ্গে আমার আর কিচ্ছু বলার নেই।
    .

    গায়ে হলুদের শাড়ির কুচি ঠিক করে মাথা তুলে ইনানের দিকে তাকায় ইতিকা।ছেলেটির চোখ,মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।বড্ড উশকোখুশকো দেখাচ্ছে তাকে।

    – আপনি রেডি হচ্ছেন না কেন?আম্মা তাড়া দিয়ে গেলো দ্রুত তৈরি হতে।

    – আমি রুমেই থাকবো ভালো লাগছে না আমার।আপনিও যেতে পারবেন না ইতিবউ।

    ইনানের কথায় বেশ চমকে যায় ইতিকা।

    – আমি যাবো না মানে?আমি কেন যাবো না?

    – ওয়াসিম বিয়ে করছে,আপনার কী কষ্ট হচ্ছে না?

    – না হচ্ছে না।হবে কেন?যে গেছে তাকে নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই।

    ইতিকা আবারো শাড়ি ঠিক কর‍তে
    মনোযোগী হয়।ইনান তার দিকে তাকিয়ে আছে প্রমত্ত দৃষ্টিতে।হাতে থাকা সিগারেটটা ট্রেতে রেখে এগিয়ে যায় ইতিকার দিকে।পকেটে হাত দিয়ে ইতিকাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে ব্যস্ত সে।

    – কিছু কী বলবেন?

    ইতিকার প্রশ্নে সৎবিৎ ফেরে তার।খানিকটা এগিয়ে এসে ইতিকার ঘাড়ে থুতনি রেখে শুধালো।

    – হুম অনেক কিছু।শাড়িটা খুলে রাখুন ইতিবউ পড়ার দরকার নেই।

    – কি সব বলছে আপনি?অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাচ্ছে আম্মা তাড়া দিয়ে গেলো।

    – তুমিও অনুষ্ঠানে যাবে না আমিও যাবো না।আজ আমরা এখানে এই রুমে মধুচন্দ্রিমা কাটাবো।আর সাক্ষি থাকবে ওই যে খোলা আকাশের চাঁদটা।

    ইতিকা ঘাবড়ে গেলো।ছিটকে দূরে সরে শাড়ির আচঁলটা গায়ে ভালো ভাবে টেনে নিলো।

    – ক..কিসব বলছেন?

    – কেন কী বলেছি আমি?দেখো ওয়াসিমের গায়ে হলুদ দেখার আমার কোন শখ নেই।আর আমি তো তোমাকে ওখানে যেতে দেবো না।কখনোই না।

    – ওয়াসিমকে টানছেন কেন?সুফিয়া আপুর বিয়ে আর আমরা তার দাওয়াতেই এসেছি।

    – চুপ!আগে স্বামী ভক্তি করো।স্বামী ভক্তি পরম ভক্তি।

    ইতিকা থেমে গেলো।ইনান তার সামনে এগিয়েছে এসে চুলের খোপা ছেড়ে দেয়।কাঁচা ফুলের গাজরা খুলে হাতে মুড়িয়ে নেয়।নাকের সামনে এনে গাঢ় শ্বাস নিয়ে একপলক তাকায় ইতিকার দিকে।

    – আপনার হঠাৎ কি হয়েছে এমন করছেন কেন?

    – জিন ভর করেছে।জিনের কাতুকুতুতে আপনার সাথে এমন করছি।

    ইনান উগ্র কন্ঠে কথাটি বলে দূরে সরে যায়।ইতিকা ফিক করে হেসে ইনানের হাত জড়িয়ে ধরে।

    – আমাকে যেতে দিন মিহি অপেক্ষা করছে।

    – মিহি আপনার জন্য অপেক্ষা নয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

    – মানে?

    ইতিকার কথার উত্তর দিল না ইনান।হাতে ফোন নিয়ে কাউকে যেন ফোন করলো কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় টোকা পড়লে এগিয়ে গেলো ইনান।হাতে তার একটি হলুদের কৌটা।মিহিকে দরজার বাইরে থেকে খানিকটা দেখতে পেলো ইতিকা।ইনান দরজার বন্ধ করে ইতিকার পাশে এসে দাড়ালো।ঠিক তখনো ইতিকা কিছু একটা ভাবছে।তার চিন্তিত মুখ দেখে শুধালো ইনান,

    – এই ইতিবউ কী ভাবছেন?

    – মিহির কী হলো?সেদিন সুফিয়া বার বার রিকুয়েষ্ট করেছে বিয়েতে আসার জন্য কিন্তু সে প্রতিবারি নাকচ করে।আর যখন এলো তখন এত চুপচাপ নিরিবিলি।দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে সে।

    – আমারো তাই মনে হচ্ছে গতবার তাকে দেখেছিলাম চঞ্চল একটি মেয়ে কিন্তু এবার কেমন যেন হয়ে গেলো।

    ইতিকার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।ইনান তার কাছে খানিকটা ঝুকে গালে, গলায় হলুদ মাখিয়ে দিলো।তার কান্ডে ভড়কে যায় ইতিকা।তোড়জোড় করে সরে ইনানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

    – কি করলেন আপনি?আমার সাজপোশাক সব নষ্ট করে দিলেন।

    – রেগে যাচ্ছেন কেন ইতিবউ?আমি তো আপনাকে এই রুমের বাইরে এক পাও যেতে দেবো না।তার থেকে ভালো আমার সাথে হলুদ সন্ধ্যা পালন করুন।আসুন বউ কাছে আসুন।

    কথাটি বলে খিটমিট করে হাসতে থাকে ইনান।ইতিকার বেশ রাগ লাগলো।ডানে বামে কিছু একটা খুজঁতে থাকে ইনান তখনো হাসছে।হুট করে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে চমকে তাকায় ইনান।তৎক্ষণাৎ বাম হাতে কামড়ের অনুভব করতেই ছিটকে পড়ে।ইতিকা তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইনানের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়।

    – ইতিবউ আমার লাগছে।

    – লাগুক অনেক সহ্য করেছি আপনার জ্বালাতন আর পারবো না।

    ইনান আবারো খিটমিট হেসে উঠে।কায়দা করে ইতিকার চুলের ভেতর হাত ডুকিয়ে ঝাপটে ধরে তাকে।সহসা ইতিকা অনুভব করে তার কানের লতিতে তীব্র ব্যাথার।চিৎকার দেওয়ার আগেই ইনান তার মুখে হাত দিয়ে খামচে ধরে।

    – কার সাথে ঝগড়া করতে এসেছেন ইতিবউ?
    ইফতিহার ইনানের সাথে পাঙ্গা নিয়ে কখনোই পারবেন না।

    – আর ভালোবাসায়?ভালোবাসায় তো হারিয়ে দিলাম তাকে।মজনু বানিয়ে ছেড়েছি।

    ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।আড় চোখে নির্বাক ভঙ্গিতে তাকায় ইতিকার দিকে।ইতিকা শাড়ি ঠিক করতে করতে সরে যেতে নিলে ইনান পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরে,

    – একটু পাশে বসুন ইতিবউ।বাইরের এত আয়োজন আমার ভালো লাগছে না।কেমন যেন সবটা ধোয়াশা উলট পালট লাগছে।কি হচ্ছে কেন হচ্ছে!

    ইনানের মন খারাপ দেখে ইতিকা এগিয়ে আসলো।বিছানায় বসে ইনানের হাত টেনে বসতে ইশারা করে।ইনানো পাশে বসে ইতিকার ঘাড়ে মাথা রাখে।ইতিকা পরম যত্নে ইনানের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।

    – একটা কথা না বলে পারছিনা।আপনি আমার কথাটা শুনুন।

    – বলুন ইতিবউ।

    – আজ যদি আমরা বাইরে না যাই,ইগো নিয়ে বসে থাকি তবে দেখবেন সবাই কিন্তু খারাপ ভাববে আর সবচেয়ে খারাপ লাগা তৈরি হবে সুফু আপুর মনে।প্লিজ চলুন।আর আপনি কী আমায় নিয়ে ভয় পাচ্ছেন?

    ইনান দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।ঘাড় থেকে মাথা তুলে তাকায় ইতিকার চোখের দিকে।

    – ওয়াসিমকে দেখে যদি আপনার অতীত মনে পড়ে যায়?যদি খারাপ লাগা তৈরি হয় তখন তো আমায় দোষারোপ করবেন।

    – এই ইতিকার জীবনে যদি কেউ থাকতে হয় তাহলে একমাত্র ইফতিহার ইনানি থাকবে।আমি অতীত ভাবতে চাই না।আমাকে ভবিষ্যত ভাবতে দিন।একটা কথা বলি?’আপনাকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি গুলো আমার জীবনে সবচেয়ে দামি।’ কিন্তু বিয়ের পরেও আমরা ঝগড়া করেছি,কাছে এসেছি একে অপরজনকে ছুঁয়ে দেখেছি কিন্তু তখনকার চেতনাটা এখনকার মতো তৃষ্ণাতুর হয়নি।

    ইনান স্মিত হাসে।প্রমত্ত ঘোরে তাকিয়ে থাকে ইতিকার দিকে।চিবুকটা খানিকটা তুলে অধর ছুয়ে দেয় ইতিকার গালে।কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

    – আগে তো অনুভূতি নিয়ে কাছে আসেন’নি।এসেছিলেন অভিনয়,দায়িত্ব আর অনুরাগ নিয়ে।

    _

    সাউন্ড বক্সের তীব্র শব্দে এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়েছে ইনানের।চারিদিকে গোচর করেও দেখা মিললো না অলীদের।রিসোর্টের সব রুমে সর্তকতা চাহনীতে গোচর করলো সে।না ওয়াসিম কিংবা অলীদ কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।একটি রুমে বেশ ফুল সহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র রাখা।সেখান থেকে পরিচিয় কারো কন্ঠ পাওয়া যাচ্ছে।ইনান সজাগ হয়ে এগিয়ে গেলো।ওয়াসিমের কন্ঠো শুনে দরজায় আড়ি পাতলো বেশ সতর্কতার সাথে।রুমটায় ওয়াসিম এবং তার মায়ের মাঝে বেশ তর্কা বিবাদ লেগে আছে।

    – প্লিজ মা এমন ইগো ধরে বসে থেকো না।সবার সাথে মিলেমিশে চলো।

    – পারবো না আমি ওই মেয়েকে কিছুতেই আমি আমার বাড়ির বউ করবো না।

    – আহ!সুফিয়াকি দেখতে খারাপ?বরং ছোট থেকেই তাকে চেনো তুমি।তাদের পরিবারের সাথেও সখ্যতা।

    ওয়াসিমের কথায় তেতে উঠলেন মিনা বেগম।চোখে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে।তার রাগ দেখে ওয়াসিম ঘাবড়ে গেলো।ডান হাতে গাল চুলকে নিজেকে স্থির রেখে এগিয়ে গেলো মিনা বেগেমের সামনে।

    – দেখো মা তুমি তো যানো আমি প্রিয়মকে কতটা ভালোবাসি।আমেরিকা সেটেল হয়ে যাবো তিন/চার বছর পর।আর এই কয়েকবছর আমি সুফিয়ার সঙ্গে কাটাবো।সুফিয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া মানে ইতিকা এবং ইনানকে সামনা সামনি পাওয়া।আর যাই হোক আমি বেঁচে থাকতে ইতিকা অন্তত শান্তিতে ঘর বাধঁতে পারবে না।তাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আমি এই দেশ ছাড়বো।

    মিনা বেগেম যেন স্থির হলেন।চুপচাপ দৃষ্টি আবব্ধ করলেন মেঝের দিকে।ওয়াসিম তার মায়ের নিরবতাকে সম্মতি ভেবে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে।

    – লক্ষি মা আমার যাও প্লিজ।সবার সাথে মিলে মিশে চলো।

    অদৃশ্য নিকষ কালো ধোয়ার মতো ঘিরে আছে ইনানের চোখ।সবটা পানসে লাগছে তার।একদিকে সুফিয়ার পাগলামো অন্যদিকে ওয়াসিমের বেইমানি কী করবে সে?এই মূহুর্তে বিয়ে ভাঙ্গা মানে সুফিয়া আবার আত্মহনন করবে।
    ইনান পড়ে গেছে গোলকধাঁধায়।
    .
    রঙবেরঙের লাইটিং আর্টিফিশিয়াল ফুল,সহ গাছের তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে স্টেজ।বিভিন্ন রকম লাইটিং এ সমারোহ পরিবেশটা।সুফিয়া স্টেজে বসে আছে তার পাশে ওয়াসিম।দুজনের ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস।ইনান সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকায় বিড়বিড় করে বলে,

    – উহহ হাসি একদম উতলায়া পড়ছে।অসভ্যর দল।

    ইনান তার চাহনী সরিয়ে নেয়।পাশে তাকিয়ে অলীদকে দেখে ভড়কে যায়।ছেলেটার চোখ মুখ অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে আছে।আরক্ত হয়ে আছে তার দু’চোখ।

    – অলীদ তোর এমন বেহাল দশা কেন?

    ইনানের প্রশ্নে চমকে তাকায় অলীদ।নিজেকে আড়াল করতে চেয়েও পারলো না।ঠোটের কোনে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলে,

    – তেমন কিছু না আসলে এর্লাজিটা বেড়েছে।

    – তোর এর্লাজি আছে?কই আগে তো এমন কথা বলিস নি।আমার সঙ্গে এত বছর ছিলি অথচ….

    ইনানের কাছে পালিয়ে বাচঁতে দ্রুত শুধালো অলীদ,

    – তুই থাক আমি একটু আসছি।

    অলীদ দ্রুত পা চালিয়ে বিদায় হলো।অপরদিকে ইনানের সবটা এলোমেলো লাগছে।স্টেজের সামনে রাতুলকে দেখে ইশারায় ডাক দিলো সে।ইনান কিছু বলার আগেই রাতুল শুধালো,

    – তোমাকেই খুঁজছিলাম ভাই।অলীদ ভাইয়ার আজ কী হয়েছে?তার চোখ মুখ এমন লাগছে কেন।মনে হচ্ছে ভীষণ কান্না করেছে।তাছাড়া তোমাদের সাথে আমার পরিচয়টা অল্প সময়ের হলেও অলীদ ভাইয়ের এমন পরিস্থিতি আমি আগে দেখিনি।ভাইয়া কী কোন কারনে আফসেট?

    – আমি জানিনা রাতুল।আমার কাছেও সন্দেহ লাগছে।

    – আই থিং অলীদ ভাই সুফিয়া আপুকে ভালোবাসে।আবার নাও হতে পারে।

    মূহুর্তেই ইনানের সব ধাঁধার সমাধান যেনো পেয়ে গেলো।চকচক করে উঠলো তার অক্ষি যুগল কিন্তু মূহুর্তেই চুপসে গেলো।বুকের ভেতরটায় কেউ যেন শব্দ করে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করেছে।

    – ঠিক বলেছিস তুই।আমি পাক্কা শিওর তবে আমাদের হাতে এখন সময় নেই বোকা ছেলে আগে শুধু একটি বার আমায় বলতো সব ব্যবস্থা করে দিতাম।

    ইনানের কথা শুনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো রাতুল।ঠোঁটের কোনে অবজ্ঞার হাসি রেখে বলে,

    – যার মনে যাকে চায়,যার নয়নে যার জন্য তৃষ্ণা জাগে তার তাকেই লাগে।অন্য কারো ভালোবাসায় সেই তৃষ্ণা কখনোই মিটে না।

    রাতুল থামলো।সুফিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,

    – ইনান ভাই তুমি কিছুই ঠিক কর‍তে পারতে না।কারন সুফিয়া আপুর মনে অলীদ ভাইয়ের জন্য তেমন কোন ফিলিং ছিল না।

    মূহুর্তে ইনানের কাছে তার নিজেকে সবচেয়ে বড় নিরর্থক এবং বোকা একজন ব্যাক্তি মনে হলো।যে কী না চোখের সামনে তার দুই কলিজার বন্ধুর ধীরে ধীরে জীবন ধ্বংস হতে দেখছে।তবে কী তার কিছুই করার নেই।

    _

    গভীর ঘুমে মগ্ন ইতিকা।আবদ্ধ সে ইনানের বাহুডোরে।বেনুনির ঢিলে হওয়ায় খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালের উপর।অন্ধকার রুমটায় চাঁদের কোমল আলো আলোকিত করছে ইতিকার মুখখানা।লেখনীতে পলি আনান।এই নিকষ কালো অন্ধকারে ঘুম নেই ইনানে দু’চোখে।ইতিকার গালে কপালে কিছুক্ষণ পর পর অধর ছুঁয়ে দিচ্ছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আলতো করে যেন যেকোন মূহুর্তে কেউ নিয়ে যাবে তার ইতিবউকে।ইতিকার কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে চিলতে হাসে ইনান।

    – আজ দুটি চাঁদ আমার গোচরে।একটি আমার নাগালে আরেকটি আকাশ পানে।

    হঠাৎ নিরব স্তব্দ রুমটায় প্রবল ভাবে ভাইব্রেট হতে থাকে ইনানের ফোন।মোবাইলে সময় দেখেই চমকে যায় সে এত রাতে অচেনা একটি নাম্বার থেকে ফোন আসায় দ্বিধায় পড়ে যায়।

    – হ্যালো কে বলছেন?

    – ই..ইনান ভাই আমি মিহি।

    – মিহি তুই এত রাতে ফোন করলি কেন?আর এই নাম্বারটা কার?

    – এ..এটা আম্মার নতুন নাম্বার।আপনি একটু রিসোর্টের বাইরে আসুন ভাই।দোহায় লাগে।

    – এত রাতে….

    – কসম লাগে ভাই আমি বিপদে আছি আপনি না বাঁচালে কেউ আমার সহায় হবে না।ইতিকাকে কিচ্ছু যানাবেন না প্লিজ!

    ইনান দ্বিধা দ্বন্দে ভুগতে থাকে।তবুও মিহির আবদারে নিজেকে সায় দেয়।বেরিয়ে পড়ে দ্রুত রুম থেকে আর যাওয়ার আগে বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্দি করে যায় তার ইতিবউকে।
    .

    রাস্তার ধারে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।যার শরীর কাঁপছে থরথর করে।ইনানকে দেখে হাত দিয়ে ডেকে ইশারা করে কাছে ডাকে। ইনান তার অবস্থা দেখে এগিয়ে যায় তৎক্ষণাৎ ছিটকে দূরে সরে যায় মিহি।

    – ভ..ভাইয়া আমাকে ছুবেন না।আমি অপবিত্র।

    – এই মেয়ে মাথায় কি সমস্যা দেখা দিয়েছে কি বলছো এইসব?

    – আত্মহত্যা করা ছাড়া আমি কোন পথ পাচ্ছিনা ভাইয়া তবুও আজ কেন যানি বার বার আপনার কথা মনে পড়ছে।আপনাকে কথাগুলো না জানালে আমার সাথে যা হয়েছে বাকিদের সাথেও হয়তো তাই হতো।

    ইনান ঘাবড়ে গেলো।আশে পাশে তাকিয়ে মিহিকে ইশারা করে গাড়িতে বসতে।মিহিও বাক্য ব্যয় না করে গাড়ি চড়ে বসে।

    দুজনে বেশ খানিকটা পথ গিয়ে গাড়ি থামায়।ইনান চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মিহির দিকে।

    – এবার বলো মিহি কী হয়েছে তোমার সাথে?আর কাল থেকে তোমায় আফসেট দেখাচ্ছে কেন?

    – আ..আমি ধ… ধ’র্ষ’ণ হয়েছি ভাইয়া আমি একজন ধ’র্ষি’তা।

    কথাটা বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মিহি।ইনানের চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ।এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।

    – হোয়াট?পাগল হয়ে গেছো তুমি এইসব কি পাগলের প্রলাপ বকছো?

    – ভাইয়া আমাকে বিশ্বাস করুন আমি সত্যিটা বলছি।আপনাকে বলা ছাড়া আর কাউকে বলার মতো আমি সুযোগ পাইনি কিংবা সাহস পাইনি।একটা মানুষ কী করে এত নিম্নমানের হতে পারে ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে।অন্তত ইতিকার জন্য হলেও আপনাকে সত্যিটা জানতে হবে।

    – মিহি শক্ত হও কি হয়েছে আমায় খুলে বলো।আর কে করেছে তোমার সাথে এমন?

    – ওয়াসিম!

    ওয়াসিম নামটা শুনতেই ইনানের বাক শক্তি যেন লুপ্ত হয়েছে।হতবাক দৃষ্টি ধীরে ধীরে আরক্ত হতে থাকে।

    – সবটা খুলে বলো আমায় মিহি।

    – প্রথম দিন সেদিন সকালে….

    ~অতীত

    সময়টা প্রাতঃকাল চারিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত।আধাঁরকে পেছনে ফেলে সূর্য্যি মামা আলো নিয়ে উঠছে।ঘরের দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো মিহি।হাতে তার ছাই।দাঁত মাজতে মাজতে এগিয়ে গেলো দিঘির পাড়ে।বেশ কিছুক্ষণ পর হাত মুখ ধুয়ে উঠে এলো সে।চোখের সামনে স্থির নয়নের মানবকে দেখে শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেছে।

    – ওয়াসিম ভাই আপনি এখানে?

    – কেমন আছিস?

    – জি ভালো ভাইয়া।

    বেশ শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো মিহি।

    – তোর বাবা কোথায়?

    – বাপজান তো ভোরেই বাজারে গেলেন।

    – তোর সাথে কিছু কথা আছে।নদীর পাড়ে আয়।

    – ন..নদীর পাড়ে কেন?এখানে বলেন,ঘরে চলেন অন্তত।

    – না নদীর পাড়েই বলবো দ্রুত আয় দেরি করিস না কিন্তু।

    ওয়াসিমের শান্ত কন্ঠ।মিহি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।

    অতীতের কথা বলে থেমে গেলো মিহি।দু’ঠোট তার কাঁপছে।

    ইনান সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
    – তারপর কী হয়েছে?

    – আমি নদীর পাড়ে গেলে আমাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়।তারপর নিরিবিলি একটি জায়গায় নিয়ে…..

    মিহি কেঁদে উঠলো।ইনান গাড়িতে হেলান দিয়ে তার রাগ দমনে ব্যস্ত।

    – ওয়াসিম আমাকে শর্ত দিয়েছিল কাউকে কিছু বললে আব্বা+আম্মাকে মে’রে ফেলবে।তাই আমি কাউকে কিচ্ছু বলিনি।এইভাবে সময় কাটতে থাকে আমিও নিজেকে নিয়ে অপরাধী হিসেবে ভুগতে থাকি।নিজের উপর যখন নিজেই বিরক্ত হয়ে যাই তখন বেচে থাকা খুব কষ্ট কর হয়ে যায়।
    আজ গায়ে হলুদ শেষে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন তখন আমার হাত, মুখ, বেধে আবারো তুলে আনে ওয়াসিম।নিয়ে যায় একটি আস্তানায়।যতটুকু দেখেছি আস্তানাটি মাটির নিচে।

    – মাটির নিচে!

    ইনান বেশ ধমকের সুরে কথাটি বলে তখনি ঘাবড়ে যায় মিহি।চমকে তাকায় ইনানের দিকে।

    – হ্যা ভাইয়া মাটির নিচে।

    – ওই আস্তানাটা আমার।মামুর দলে থাকাকালীন স্পেশাল সিকিউরিটি নিয়ে আমি আস্তানাটি তৈরি করি।কিন্তু সব ছেড়ে আসায় আস্তানার দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলাম মামুকে।এখন হয়তো সেটি ইনানের দখলে।

    – হ্যা ওই আস্তানায় নিয়ে যায় আমাকে আবারো।কিন্তু যখন আমায় হুমকি দিলো ইতিকার সম্পর্কে তখন আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি।যা করার করে দিয়েছি।

    – ইতিকাকে নিয়ে কী হুমকি দিয়েছে তোমায়?

    – আমার সাথে যা হয়েছে তা আরো বাজে ভাবে ইতিকার সাথে হবে অন্তত ইতিকাকে কোন ভাবেই ছাড়বে না।

    মূহুর্তেই ইনানের দমানো রাগটা দিগুন বেড়ে যায়।জোরে জোরে ফস ফস করে শ্বাস নিয়ে।ঠোঁট কামড়ে বলে।

    – কু’ত্তাটা কোথায় আছে এখন?

    – সে নেই ভাইয়া।আমি..আমি তাকে মে’রে ফেলেছি।

    – মানে?সত্যি?

    -স..সত্যি ভাইয়া আমি লোহার পাত দিয়ে মাথার পেছনে বাড়ি মারতেই সে ঘুরে পড়ে।নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি একে একে বেশ কয়েকবার আঘাত করি তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।আর রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে রেখে চলে এসেছি আমি।আমি যা করেছি তা নিয়ে অনুতপ্ত নই।বরং আমার মতো কোন মেয়ের সম্মান হারানোর আগে সেই মেয়েদের বাঁচিয়ে দিলাম।এবার আমি মরলেও শান্তি পাবো।আমি তো বেশি দিন হয়তো বাচঁবো না।কেননা অপরাধ বোধ আমায় বাচঁতে দেবে না।

    মিহি ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে থাকে।ইনান দিশেহারা হয়ে পড়েছে কি করবে সে ভাবে কুল পাচ্ছেনা।মিহি কী সবটা সত্যি বলছে নাকি লুকিয়ে আছে অন্য কিছু!

    #চলবে…
    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ২২]

    __________
    টিমটিমে লাইটের আলোয় রক্তাক্ত দেহখানি পড়ে আছে ওয়াসিমের।মাথাটা বিভৎস ভাবে থেতলে আছে।ইনান খুটিয়ে খুটিয়ে লাশটা দেখতে ব্যস্ত তার পাশেই মিহি থরথর করে কাঁপছে।ইনান আস্তানার অন্য একটি রুমে প্রবেশ করে।সেই রুমের পাশেই একটি ওয়াশরুম।দ্রুত ওয়াশরুমে প্রবেশ করে ছেলেটি হাত মুখ ধুয়ে নেয়।আয়নায় নিজের ক্লান্ত ছাপের মুখটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বেশ কিছুক্ষণ পর তার ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস পাওয়া যায়।আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে বলে,

    – মামু আমায় রাজনীতির একটা পর্যায় শিখেয়েছে যেখানে আমাকে হতে হবে স্বার্থপর, পাষাণ।এতদিন এই বিষয়গুলো নিয়ে আফসোস করলেও আজ কিঞ্চিৎ পরিমানেও আফসোস হচ্ছে না।একটু পর যা হবে ভালোর জন্য হবে।অন্তত এই ক্ষেত্রে পাষাণ হয়ে মস্ত বড়ো উপকার হলো আমার।

    ইনান থামে, দেয়ালের সাথে হাত ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ে।নিজের ভেতরটায় কেমন বিবশ হয়ে আসছে।নিজের সাথে নিজেই হিসাব মেলাতে পারছেনা সে।আয়নার সামনে আবারো ঘুরে তাকায় ছেলেটি।ভালো ভাবে দৃষ্টি রেখে আপন মনে বলে,

    – লিসেন ইনান তুই তো ওয়াসিমকে মারিস নি।তাহলে তোর দোষ আসার প্রশ্নই আসেনা।তাছাড়া একটি পবিত্র মেয়েকে অপবিত্র করেছে সেই শাস্তিত তাকে পেতেই হবে।আমাকে এমন একটা কাজ করতে হবে যেখানে ওয়াসিম মৃত এটাও কেউ জানবে না।মিহি ধ’র্ষি’তা এটাও কেউ যানবেনা।

    ইনান মুখে হাত দিয়ে থেমে যায়।তর্জনির আঙুল দিয়ে কপাল ঘষে বেশ রোষ নিয়ে বলে,

    – কুত্তার লেজ কখনো সোজা হয় না।তবে যাই করেছিস একটা দিক দিয়ে তুই ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত,তোর কারনেই আমি ইতিবউয়ের দেখা পেয়েছি।তোর কারনে যে মেয়েকে মা’রতে আমি দীর্ঘ দেড় মাস পরিকল্পণা করেছি আজ আবার তাকে বাঁচাতে তোর লাশ গুম করবো আমি।এক ঢিলে তুই পাখি মারার বুদ্ধিটা তোর কাছ থেকে শিখেছিলাম রে।
    .
    একটি চেয়ারে বসে নিশ্চুপ কাদঁছে মিহি।তার পাশে এসে দাঁড়ায় ইনান।মিহির মাথায় হাত রেখে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলে,

    – মিহি এখন যা হবে তা আমাদের সবার জন্য ভালো।তোমার আমার ইতিকা কিংবা সবার জন্য।দেখো ওয়াসিম আর বেঁচে নেই এটা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশের তদন্তে তোমার নাম জড়িয়ে যাবে।তাছাড়া তোমার সাথে যা হয়েছে সেই অন্যয়টা কেউ দেখবে না বরং ওয়াসিমকে মারার দায়ে তোমারে হেরেসমেন্ট করবে সবাই।

    – ত..তবে আমি এখন কী করবো ভাইয়া?নিজের উপর নিজেরি ঘৃণা হচ্ছে বেঁচে থাকার মতো কোন পর্যায় আমার কাছে নেই।

    মিহির কথায় রুষ্ট হলো ইনান।হাত উচিতে মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বল,

    – যা হয়েছে সব ওয়াসিমের দোষ তোমার তো তাতে কোন দোষ নেই।নিজেকে অপরাধী ভাবা বন্ধ করো।আর এখন যা হবে তা যেন কেউ না জানে একদম কেউ না।আমার ফ্রেন্ড তোমার মা-বাবা কাউকে কিচ্ছুটি বলবে না।

    মিহি নিশ্চুপ মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।মূহুর্তেই ইনানের চোখে মুখে হিংস্রতার আভাস পাওয়া যায়।

    কিছু সময় পর আস্তানায় মধ্যে বয়স্ক একজন লোক প্রবেশ করে।যার চেহারায় উষ্কখুষ্ক ভাব।ভড়ভড় করে বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে মদের গন্ধ।ইনান তাকে দেখে এগিয়ে গেলো।

    – অজয় বাবু কেমন আছেন?

    – আরে কর্তা যে হঠাৎ এই আস্তানায়?কার লা’শ কাটতে হইবো খালি কন আমারে।তয় আপনি তো কখনো কোন লা’শ কা’টানোর নির্দেশ দেন না।যা কাটায় সব বাহরুল কর্তার নির্দেশে করা হয়।আইজগা আপনার তলব পাইয়া আমি সত্যি চমকে গেছি।

    লোকটা হেলেদুলে কথাটি বলে পিটপিট চোখ করে তাকায় ইনানের দিকে।ইনান সৌজন্য মূলক হাসি হেসে হাত ঘড়ির দিকে তাকায়।রাত প্রায় সাড়ে আড়াইটা বেজে গেছে।

    – অজয় বাবু ওই যে লা’শটা দেখতে পারছেন ছেলেটাকে তো আপনি চেনেন?

    – আরে ও…ওয়াসিম না?ওর কি হইছে কর্তা?

    – ওয়াসিম আর নেই।আপনাকে একটা অফার করছি লাশটা কেটে আমাদের নদীর পাড়ে যে চিতা আছে সেখানে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন এবং সব কাজ গোপনে কর‍তে হবে।কাজটা শেষ করলে দশ লক্ষ টাকা পাবেন।আপনি জানেন আমি কথার খেলাপ করি না।

    ইনানের এমন প্রস্তাবে শিউরে উঠলো মিহি।ইনানের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।অপর দিকে অজয় বাবু এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে তার দু’চোখ চকচক করে উঠে।যার কাজ লা’শ কাটা তার কাছে ওয়াসিমের লা’শ কা’টা নিতান্তই তুচ্ছ কাজ আর এই কাজের জন্য দশ লক্ষ টাকা পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা তার।

    – আপনি চিন্তা কইরেন না কর্তা আমি লা’শটা কাইটা গোপনে চিতায় নিয়ে যাবো কেউ কিচ্ছুটি জানবে না।এমন কী বাহরুল কর্তাও না।আর আস্তানা থেকে বাইর হওনের আগে সব পরিষ্কার কইরা রাখমু কেউ কিচ্ছু বুঝবো না।

    ইনান একচিলতে হাসি দিয়ে ইশারা করলো অজয় বাবুকে মূহুর্তেই তিনি টানতে টানতে ওয়াসিমের লা’শটা অন্য একটি রুমে নিয়ে যায়।মিহি ধড়ফড়িয়ে এসে ইনানকে হালকা করে ধাক্কা দেয়।

    – প..পাগল হয়ে গেছেন আপনি ভাইয়া?ওয়াসিমের লা’শ কাটবেন চিতায় নেবেন।

    – এটা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।তুমি যদি ঘাবাড়ে যাও শক্ত না হও আমারো আর কিছু করার থাকবে না।আরেকটা কথা মাথায় রেখো ওয়াসিমকে আমি মারিনি মেরেছো তুমি!সম্পূর্ণ দোষ তোমার উপর পড়বে।

    মিহি থেমে গেলো।কোন এক গোলক ধাধায় সে পিষে মরছে।পুড়ে যাচ্ছে তার অন্তঃকরণ।
    .

    বিষণ্ণ রাত্রি।শ্বশান ঘাটের সামনে উপস্থিত ইনান এবং মিহি।আকাশের বিদ্যুত চমকানিতে বিদঘুটে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।শ্বশান ঘাটের পাশে বেশ কয়েকটি কুকুর হাক পরিবেশটা আরো ভয়ংকর করে তুলছে।অজয় বাবু ওয়াসিমের লা;শটা একাই বহন করে ক্লান্ত হয়ে গেছেন।অতিরিক্ত মদ্য পানে দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই।

    – ক..র্তা এবার কী করবো পুড়িয়ে ফেলবো নাকি?

    ইনান দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।চারিদিকের হিমেল হাওয়াতেও সে ঘামছে প্রচন্ড।জীবনে এমন একটি পরিস্থিতি আসবে কখনো ভাবেনি সে।তবে আজ যা হচ্ছে তা নিয়ে মোটেও অনুতপ্ত নয় ছেলেটি।

    – না উত্তর দিকে যে জঙ্গলটা আছে সেখানে মাটি চাপা দিয়ে দাও।

    – কি কইতাছেন কর্তা?লা’শটা যে ভাবে কাটছি কেউ বুঝবো না এটা কার লাশ যদি চিতায় পোড়ান তবে একদম সব প্রমান দূর হইয়া যাইতো।

    – যা বলেছি তাই করুন অজয় বাবু।দ্রুত গর্ত করুন ফজরের আযান দিয়ে দেবে কিছুক্ষণ পর তখন কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে।

    অজয় বাবু বিনাবাক্য স্থান ত্যাগ করলো।দ্রুত মাটি খুঁড়ে ওয়াসিমের লা’শটা পুঁতে রাখে। মাটি চাপা দিয়ে পুরোনো গাছের ডাল, পাতা খড়কুটোর স্তুপ সাজায়।কেউ বিন্দু পরিমানেও সন্দেহ করতে পারবেনা এই জঙ্গলে কারো লা’শ পুঁতে রাখা হয়েছে।সবটা কাজ ইনান দক্ষ্য হাতে শেষ করে।অজয় বাবু ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘাটে ফিরে গেলেন।গায়ে লেগে থাকা র’ক্তের জামাটা খুলে অন্য একটি ব্যাগ থেকে নতুন জামা পড়ে ইনানের সামনে হাজির হয়।

    – কর্তা সব কাজ শেষ চলুন এখান থেকে চলে যাই তবেই আর কেউ আমাদের সন্দেহ করতে পারবেনা।

    – হুম আপনি আপনার মতো করে চলে যান।আর টাকাটা কাল সকালে পাঠিয়ে দেবো।এই নিন মদটা গলায় ঢেলে সব ভয় দূর করুন।

    ইনান অজয় বাবুর দিকে একটি মদের বোতল এগিয়ে দিলেন।মূহুর্তেই লোকটির দুচোখ যেন চকচক করে উঠে।বোতলটি হাতে তুলে স্মিথ হাসেন।

    নিরানন্দ পরিবেশটায় বজ্রপাতের শব্দ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।ওয়াসিমের মৃত্যুটা যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা মিহি।সে বাক্যহীন তাকিয়ে আছে মাথা নুইয়ে।ইনান তার অবস্থা বুঝতে পেরে শান্ত সুরে বলে,

    – রিসোর্টে ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে যাবে।আর কাল যা যা হবে তাতে ভুলেও মুখ খুলবে না।নিজেকে স্থির এবং চুপচাপ রাখবে।বাকিটা আমি সামলে নেবো।

    মিহি মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।ইনান পকেট থেকে ওয়াসিমের ফোনটা হাতে তুলে নেয়।তার ফোন থেকে প্রথমেই খুদে বার্তা পাঠায় সুফিয়ার উদ্দেশ্য।যেখানে লেখা ছিল,

    ” বিয়েটা আমি করতে পারবো না।এই মূহুর্তে দেশ ছাড়ছি আমি।ভালো থাকিস।”

    সুফিয়ার নাম্বারে মেসেজ সেন্ড হতে দ্বিতীয় মেসেজটি করা হয় সাহাব উদ্দীনের নিকট।

    “বাবা আমি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।বিয়েটা কর‍তে পারবো না নিজের যত্ম নেবে মায়ের খেয়াল রাখবে”

    খুদে বার্তা পাঠানো শেষে ইনান সিমটা খুলে ভেঙ্গে ফেলে দেয় মাঝ পুকুরে।
    .

    ফজরের আযানের ধ্বনিতে মুখোরিত চারিদিক।রিসোর্টে ফিরে ইনান রুমে প্রবেশ করে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। গোসল শেষে গা এলিয়ে দেয় ইতিকার পাশে।ক্লান্ত শরীরটা বিবশ হয়ে দু’চোখ সহসা বন্ধ করে নিলো।

    সবার চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো ইনান এবং ইতিকার।বাইরে চিৎকার দিয়ে কাঁদছে সুফিয়া।দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সকাল আটটা বাজতে দেখে বিরক্তে মুখ কুচকে নেয় সে।ইতিকা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে নিলেই ইনান পেছন থেকে হাত খামচে ধরে,

    – কোথায় যাচ্ছেন ইতিবউ?

    – বাইরে কেউ কাঁদছে ছাড়ুন আমায়।

    – অপেক্ষা করুন আমিও আসছি।

    – দূর ছাড়ুন তো।

    ইতিকা ইনানের হাত ছাড়িয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।তার বুকের ভেতরটায় দুরু দুরু করছে।বিয়ে বাড়ির ভরা মজলিশে কার কী হয়েছে ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।ইতিকা পৌছে সুফিয়াকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পায়।মেয়েটির মাথা কোলে নিয়ে কাঁদছে তার মা।পাশে দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর দৃষ্টিতে ওয়াসিমের বাবা মা।ভরা মজলিশে ছেলেটা মুখে চুনকালি লাগিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হলো ভেবে কুল পাচ্ছেনা তারা।ইতিকা জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে নাসরিনের কাছে এগিয়ে আসে।

    – আম্মা কী হয়েছে?আন্টিরা কাদঁছেন কেন?

    – ওয়াসিম চলে গেছেরে মা।এই মেয়েটাকে এখন কে বিয়ে করবে এই মূহুর্তে।

    – চলে গেছে মানে?

    – ঘুম থেকে উঠে সুফিয়া একটি মেসেজ পায় যেখানে লেখা ছিল ওয়াসিম তাকে বিয়ে করতে পারবেনা।সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।একই বার্তা তার বাবা মায়ের ফোনেও পাঠায়।

    – হায় আল্লাহ কি বলছো এইসব।সুফু আপুর এখন কী হবে?

    – সেটাই তো ভাবছি আমি।

    অন্তঃকরণের ভেতরটা মুষড়ে উঠলো ইতিকার।ক্রদনরত সুফিয়ার স্বচ্ছল মুখখানা দেখে দু’চোখ ভিজে উঠলো।

    অপরদিকে দরজায় হেলান দিয়ে সবার অবস্থা দেখছে ইনান।মিহির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চুপ থাকতে ইশারা করে সে।অলীদ ছুটে আসে ইনানের কাছে।

    – এসব কী হচ্ছে?ওয়াসিম চলে গেছে এদিকে সুফিয়া সেন্সলেস হয়ে গেছে।

    – কেন তোর কষ্ট হচ্ছে খুব?

    – ফাজলামো করিস না ইনান।সুফিয়া আমাদের ফ্রেন্ড তার ভালো মন্দ দেখাত দায়িত্ব আমাদেরো আছে।

    – ভালো মন্দ দেখার আমাদের দায়িত্ব ছিলো বলেই বার বার বারন করেছিলাম ওয়াসিমের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় নিয়ে চলতে কিন্তু সে সবটা ঘেটে ঘ করে দিয়েছে।সব কাজে ঘাড় ত্যাড়ামো মানায় না।সে কী অতিত ভুলে গেছে?এমন ধর্ষ……

    – হিসস থাম ইনান।ভরা বাড়ি আস্তে কথা বল।সেটা অতীত ছিল।

    ইনান থেমে গেলো মুখে যেন কুলুপএঁটে নিয়েছে।

    ওয়াসিম কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় তা দেখার জন্য রিসোর্টের সব সিসি ক্যামেরা চেক করে বাহরুল ইসলামের লোকজন।কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো রাত বারোটার পর সব সিসি ক্যামেরা গুলো অফ হয়ে যায়। যার কারনে ওয়াসিম কোন হদিস পাওয়া গেলো না।ইনান বিষটি নিয়ে প্রথমে ভয়ে থাকলেও পরবর্তীতে নিশ্চিন্ত মনে হাসতে থাকে।সবার সামনে সন্তপ্ত অবস্থায় থেকে মনে মনে বলে,

    – মানুষ নিজের জালে নিজেই অদ্ভুত ভাবে ফেঁসে যায়।যেমনটা আজ তোর সাথে হয়েছে ওয়াসিম।সিসি ক্যামেরা অকেজো করেছিস মিহিকে তুলে আনতে কিন্তু দেখ মিহি আমি আমরা দুজনেই বেঁচে গেলাম কেউ যানলো না আমরা কখন বাড়ি ফিরেছি।আর কখন বেরিয়েছি।
    _

    সারাদিন গড়িয়ে রাত ফিরে এলো এখনো কেউ সিধান্ত নিতে পারেনি সুফিয়ার কী হবে?মেয়েটি ওয়াসিমকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা বলে জেদ ধরে বসে আছে।অপর দিকে সুফিয়ার বাবা মোস্তাফিজ ইনানের বাবার হাত ধরে নিশ্চুপ কেঁদে যাচ্ছে।তার কান্নায় ইনানের কাছে ফিরে এলেন ইব্রাহিম।

    – কি রে কী করবো আমরা?সুফিয়া মেয়েটার জীবন এইভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমরা চুপচাপ শুধু কি দেখে যাবো?

    -বাবা আমি আগেও এই মেয়েকে বারন করেছিলাম ওয়াসিমের মতো ঠকবাজ ছেলেকে বিয়ে না করাই উত্তম শুনেনি সে আমার কথা।

    – যা হয়েছে তা শেষ এখন কী হবে সেটা নিয়েই ভাব।অলীদের সাথে যদি সুফিয়ার বিয়েটা হয় তবে কেমন হবে?

    মূহুর্তেই প্রতিপন্ন হলো ইনান।হারানো প্রাপ্তি ফিরে পাওয়ার আনন্দে মাথা নেড়ে সায় দেয়।

    – তুমি আঙ্কেলের সাথে কথা বলো বাবা।আঙ্কেল চাইলে অবশ্যই বিয়েটা হবে।

    .

    ভারী বর্ষণে গুমরা পরিবেশ।ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে যে যার রুমে ফিরে যায়।ওয়াসিমের সাথে এখনো যোগাযোগ করার সুযোগ পায়নি কেউ।এক প্রকার হু’মকি ধমকানি তে সুফিয়াকে বিয়েতে রাজি করান তার বাবা মা।অবশেষে অলীদের সম্মোতিতে বিয়েটা সম্পূর্ণ করা হয়।

    রিসোর্টের বিশাল বড় ছাদহীন চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে অলীদ।সুফিয়ার রুমে ঢোকার মত সাহস আজ সে পাচ্ছেনা।বিয়ের পর নব বধূর হাতে দু’টো চড় তার গালে পড়ে গেছে।এগুলো ভাবা যায়!কবুল বলার ঘন্টা খানেক পর বউয়ের হাতে ঠাস ঠাস করে দু’টো চড় গালে পড়বে তাও কাঁদতে বারন করায়।

    ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শে চমকে তাকায় সে।ইনানকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।

    – এত রাতে এখানে কী অলীদ?আজকের আবহাওয়াটা সুন্দর।বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাক অতীতের আত্মগ্লানী।যা রুমে যা।

    – যাওয়া যাবে না সুফু মারবে।

    ‘মারবে’ শব্দটা শুনেই ভ্রু কুচকায় ইনান।

    – মারবে মানে?কী বলছিস এইসব।

    অলীদ চুপসে যায়।ইনান তার অবস্থা বুঝতে পেরে আশ্বাস সুরে বলে,

    – মারবে না।তুই চুপচাপ রুমে যা আগে।মানিয়ে নে দোস্ত।মেয়েটা যে বোকামি করেছে তুই এখন বুঝিয়ে দে সে ওয়াসিমের থেকেও বেটার কাউকে জীবনে পেয়েছে।

    মূহুর্তেই অলীদের ঠোঁটের কোনে হাসি রেখা ফুটে উঠেছে।

    .
    ইনানকে খুঁজতে খুঁজতে বিরক্ত ইতিকা।বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ ছেলেটার দেখা নেই।অলীদেরো খোঁজ নেই সে নিশ্চই বউয়ের আচঁলে মুখ লুকিয়েছে।কারো দেখা না পেয়ে ইতিকা যখন রুমের যেতে নেয় তখনি দেখা হয় রাতুলের সঙ্গে।

    – এই রাতুল ভাইয়া।

    রাতুল ঘুরে তাকায় ইতিকাকে দেখে গাঢ় শ্বাস ছাড়ে।

    – তোমাকেই খুঁজছিলাম ভাবী।ইনান ভাই বলেছেন তুমি যেন রুমে থাকো।তিনি একটু বাইরে বেরিয়েছেন।

    – এই বৃষ্টির মাঝে বাইরে কেন গেলো?

    – আমি জানি না।আসো ভাবী আজ একটু আড্ডা দিয়ে সময় কাটাই।অলীদ ভাই নেই আজ একা একা লাগছে।

    রাতুলের কথায় সায় জানায় ইতিকা।মূহুর্তেই রাতুলের মাথায় শ’য়তানি বুদ্ধি খেলে যায়।বিড়বিড় করে আপন মনে বলে,

    – শ্লা ধান্দা বাজ।একটা সময় তোর বউয়ের পেছনে না যেনে ঘুর ঘুর করায় আমাকে উত্তম-মাধ্যম কেলানি দিয়েছিস।আর এখন তোর বউয়ের সিকিউরিটি বানিয়েছিস আমায়!দাড়া আজ নাস্তানাবুদ করে ছাড়বো তোকে।
    _

    ভারী বর্ষণের সাথে সাথে আকাশের হাক ক্রমশ বেড়ে চলছে।ইনান রিসোর্টে নিজের রুমে ফিরে আসে।অন্ধকার রুম দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয় সে।লাইট জ্বালাতেই চোখের সামনে গোচর হয় উবু হয়ে শুয়ে থাকা ইতিকার মুখ।রুমের চারিদিকে উটকো গন্ধ নাকে আসতেই ভ্রু কুচকে যায় তার।

    – ইতিবউ?এই ইতিবউ?

    – উহহ
    – এই মেয়ে মদ গিলেছিস তুই?কোথায় পেলি মদ?

    ইনানের ধমকে চোখ পিটপিট করে তাকায় ইতিকা।

    – আমায় আপনি তুই করে বলছেন?বকছেন কেন আমায়?

    – ইতিবউ এইসব ছাইপাঁশ কেন গিলেছেন? কে দিয়েছে আপনাকে এইসব।

    – বলবো না।

    – নাটক করছেন আমার সাথে?

    – না বলবো না।

    – দুটো চড় লাগিয়ে সব ভং চং ছুটিয়ে দেবো।

    – আপনি আমায় মারবেন?আমি চলে যাবো ওয়াসিমের কাছে।

    ইতিকা নেশার ঘোরে কথাটি বলে মুখ গোমড়া করে রাখে।ইনান তার মেয়েটির হাত টেনে বক্ষপিঞ্জরে জড়িয়ে ধরে।

    – ওয়াসিমের কাছে যাবে মানে?ওয়াসিম এখন কবর বাসী।তার কাছে আমি তোমায় কিছুতেই যেতে দেবো না।

    – উহহ ছাড়ুন।

    – আমি ধরেছি বলে আজ বেঁচে গেছো ইতিবউ।যদি আমি এখনো আমার দৃঢ়তা ভালোবাসা নিয়ে জড়িয়ে না রাখতাম তোমায় তবে তুমিও খসে যেতে নোলকের মতো।

    – এই আপনার চোখে পানি কেন?

    ইতিকা ইনানের গালে হাত ছুঁয়ে দেয়।ইনানের চোখের পানি বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মুছে বুকে মাথা রেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।

    – তোমাতে আসক্ত হওয়ার আগে আমি অন্য একজনের মায়ায় পড়েছিলাম ইতিবউ।আর সেটা নিতান্তই আমার অতীত।সেই অতীতের রোষ ধরেই আজ এত কিছু।সময়টা আমরা যখন নতুন কলেজে উঠলাম।আমার সাথে ওয়াসিম,সুফিয়া,অলীদ।আমরা চার বন্ধু ছিলাম এক সুতায় এক টানে।আমাদের বাড়ির ড্রাইভার চাচার মেয়ে নোলক।টাকার অভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ প্রায়।যেহেতু আমাদের বাড়িতে কোন মেয়ে নেই তাই বাবা মায়ের মেয়েদের প্রতি আলাদা টান ছিল।সুফিয়াকেও খুব আদর করতেন তারা।মা দায়িত্ব নিলেন নোলকের পড়াশোনার।আর সেই সূত্রে নোলক আমাদের বাড়ি থাকতো মাঝে মাঝে।নোলক ছিল ফর্সা নজর কাড়া সুন্দরী।যে কেউ তার প্রতি সহযে আকর্ষিত হতো।আমিও হয়েছিলাম তবে রুপে নয় তার কথার জাদুতে।সবার সঙ্গে মন ভুলানো হাসিতে কথা জমিয়ে রাখতো।তাকেও নতুন দশম শ্রেনীতে ভর্তি করা হলো সবটা ভালোই চলছিল আমিও দিন দিন নোলকের প্রতি দূর্বল হয়ে গেলাম।
    অপরদিকে পাড়ার কিছু বাজে ছেলের সাথে ওয়াসিমের মেলামেশা বেড়ে যায়।এই নিয়ে তার সঙ্গে আমাদের বহুবার ঝগড়া হয়েছে কিন্তু ছেলেটি শোধরায় নি।পাড়ার সেই বাজে ছেলে গুলো নোলককে উত্ত্যক্ত করতো সুযোগ পেলেই।এই নিয়ে আমার সাথে তাদের অনেক বার ঝগড়াও হয়েছে।কেটে গেলো বেশ কয়েকমাস, ভালো মন্দ সব কিছু নিয়ে আমরা সুখেই ছিলাম কিন্তু ওয়াসিম সেই ভালোর মাঝে বিষ নিয়ে ফিরলো।সুযোগ বুঝে পাড়ার ছেলে গুলোর হাতে নোলককে তুলে দেয়।তারপর মেয়েটার সাথে চলতে থাকে পাশবিক নির্যাতন।সব ছেলে এবং ওয়াসিম সহ তাকে ধ’র্ষ’ন করে।সবটা জানাজানি হলে আমি যেন সব হারিয়ে ফেলেছিলাম।অন্ধাকার গহিনে হারিয়ে যাচ্ছিলাম বারংবার।তাদের বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে গিয়ে কোন লাভ হয়নি বরং মেয়ের শোকে স্ট্রোক করে মারা যান ড্রাইভার চাচা।এই বিষটি দাগ ফেলে দেয় অলীদ এবং সুফিয়ার মনে।তারপর থেকে আমারা আলাদা।

    ইনান থেমে যায় তার গলা ধরে আসছে তবুও বিড়বিড় করে বলে,

    – ওয়াসিমের স্বভাব চরিত্র খারাপ মেনে নিলাম তাই বলে সুফিয়াকেও তার জালে ফাসাবে।মেয়েটা বোকা ওয়াসিমের পাল্লায় পড়ছে।তারপর খোঁজ পেলাম ওয়াসিমের প্রেমিকা তুমি চাইলেই মেরে ফেলতে পারতাম কিন্তু মারিনি তার একমাত্র কারন আমি চেয়েছিলাম আমাকে আর তোমাকে দেখে ওয়াসিম জ্বলে পুড়ে যাবে।তাছাড়া নির্দোষ একটা মেয়েকে মারার মতো কলিজা এখনো আমার হয়নি।সব কিছুর উদ্ধে আমি তোমায় রক্ষা করতে পেরেছি এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া।

    ইনানের গাল বেয়ে চিবুক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।ইতিকা তার বুকের সাথে লেপ্টে অবচেতন অবস্থায়।ইনান তার কপালে অধঁর ছুঁইয়ে কিঞ্চিৎ হাসে।

    – সত্যিটা তোমাকে জানতে হবে না ইতিবউ।এমন কি ওয়াসিম কোথায় আছে তার হদিসো কেউ জানবেনা।কেননা সব প্রমান ভ্যানিশ করে দিয়েছি।

    উক্ত কথাটি বলে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে ছেলেটি আর ভাবতে থাকে সেই বিষন্ন রাতের কথা।

    তখন অজয় বাবুর হাতে যে মদের বোতলটি তুলে দেয় ইনান, তার সাথে বিষের মিশ্রণ ছিল।অজয় বাবু শ্বাশান ঘাট পার করে মদের বোতল মুখে দিয়ে বেশ কয়েক চুমুক গিলতেই মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন।তার মৃত্যুতে ওয়াসিমের লা’শকে টুকরো টুকরো করার সব প্রমান হারিয়ে যায়।আর রইলো বাকি মিহি।নিজেকে বাঁচাতে নিজ স্বার্থে কখনো মুখ খুলবে না সে। বিষটি খুব ভালো করেই জানে ইনান।

    পৃথিবিটা স্বার্থের।প্রত্যকটা ভালোবাসার মানুষ আমার স্বার্থের।আমার স্বার্থের তাড়নায় আমি তাদের ভালোবাসি।

    ইতিকার ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে ইনান দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।ললাটে অধর ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বলে,

    – তোমার জানা, শোনা, দেখার আড়ালেও অনেক কিছু দৃষ্টির অগোচরে ছিল।

    #চলবে

    ®️পলি আনান

    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ২৩]

    __________
    – মিহিকে এই বাড়িতে নিয়ে আসলে কেমন হয়?

    প্রশ্নটি সহজ গলায় ইনান বললেও ইতিকার কানে যেন কথাটি শোনা মাত্রই বিস্ফোরণ
    হয়েছে।গোল গোল চোখ নিয়ে বেশ অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো মেয়েটি।

    – এমন করছেন কেন ইতিবউ?মিহিকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখলে সমস্যা কোথায়?

    – তাকে রাখবোই বা কেন?হঠাৎ মিহির জন্য দরদ উতরাই উতরাই পড়ছে কেন?

    – বোকা মেয়ে আমি কী খারাপ কোন সিধান্ত নিয়েছি নাকি?আপনারা একসাথে থাকবেন, আমাদের বাড়িটাও জমাট হবে।সবাই মিলেমিশে একসাথে বাঁচার মাঝে আনন্দ আছে ইতিবউ!

    ইনান কথাটি বলে পেয়ালায় চুমুক বসালো।তার ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস এখনো ছড়িয়ে আছে।ইতিকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে চোখ ছোট করে।শত হলেও ইনানের মুখে একথা মানায় না।

    – এই কথা আপনার মুখে মানায় না ইফতিহার ইনান।

    ইতিকা বেশ তেজ নিয়ে কথাটি বললো।হাতের পেয়ালাটা টি-টেবিলে রেখে শুধালো ইনান,

    – মানায় না?কিন্তু কেন ইতিবউ?

    – আব্বা-আম্মাকে ছেড়ে আপনি এক বছর আলাদা ছিলেন।তখন কী আপনার কোন পরিবার ছিল?নাকি এত উল্লাস ছিল?রাতে নেশায় বুদ হয়ে পড়ে থাকতেন আর দিনে মারামারি, মিটিং,মিছিলে যোগদান এটাই তো ছিল আপনার জীবন।

    – তখন তো আমার জীবনে আপনি ছিলেন না ইতিবউ।

    ইতিকা ফস করে শ্বাস ছাড়লো।ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে হাতে চিরুনি তুলে নিলো।আপন মনে চুল আছড়াতে ব্যস্ত সে।ইনান যে তার দিকে তাকিয়ে আছে ঘোরে সেদিকেও দৃষ্টি রাখলো না মেয়েটি।

    – ইগ্নোর করছেন আমায়?

    – না তো।

    – মনে তো হচ্ছে ইগ্নোর করছেন।

    – যদি করি তবে কী করবেন শুনি?

    ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।ইতিকাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডোবালো।

    – আমাকে ইগ্নোর করে লাভ নেই ইতিবউ।এইজীবনে আমার বাবা ছাড়া কেউ আমায় ইগ্নোর করে শান্তি পায়নি।আপনিও পাবেন না।বাবার সাথে অতীতে তো কথাই বলতাম না দুজন দুজনকে ইগ্নোর করে চলতাম।

    – বাবা মায়ের প্রতি এত অনাদর আসে কী করে আপনার?যদি আমার মতো এতিম হতেন তবেই বুঝতেন কেউ তো আর দাঁত থাকতে দাঁতের মজা বুঝেনা।

    – আমার জীবনের সেই স্বচ্ছ দর্পন আপনি যে আমার ভালো – মন্দের ঘোলাটে আয়নাটা ভেঙ্গেচুরে স্বচ্ছ দর্পনে মুখ দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন।

    ইতিকা স্মিথ হাসে।ইনানের হাতের তালুতে শব্দ করে চুমু খায়।
    .

    দিন দিন শরীরটা নুইয়ে পড়ছে ইব্রাহিমের।আগের মতো চঞ্চল চিত্তে চলাফেরা নেই তার।বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই কাটান।পুত্র বউয়ের আদর শাসন যত্নে বেশ ভালো কাটছে তার দিন।ব্যবসার দায় ভার সবটা পড়েছে ইনানের উপর।ছেলেটাও একা হাতে সবটা সামলে নিচ্ছে নিখুঁত ভাবে।নিজের সংসারের এমন সুখ দেখলে মাঝে মাঝে আফসোস হয় বছর খানিক আগে এই সুখ কেন আসেনি?হাতের পত্রিকাটা রেখে চায়ের পেয়ালা তুলে দিলেন ইব্রাহিম।এক চুমুক মুখে তুলতেই বিরক্তে দু’চোখ কুচকে নেন।বেশ রাগ নিয়ে হাঁকডাক দেন নাসরিনের উদ্দেশ্য।

    – এই ইনানের মা তোমায় আমি বলেছিলাম চায়ে একটু হলেও চিনি দেবে।আর তুমি কি করলে?এই চা মুখে তোলার অযোগ্য।

    নাসরিন রান্না ঘর থেকে একবার দেখে নিলেন ইব্রাহিমকে।নিত্যদিন সকালে তাদের চায়ের চিনি দেওয়া বিষয়টি নিয়ে ঝগড়া শোরগোল লেগে যায়।তাই প্রতিদিনের মতো আজকেও তিনি চুপচাপ হজম করছেন।চায়ের পেয়ালাটা রেখেব বিড়বিড় করে আপন মনে বকতে লাগলেন ইব্রাহিম।

    – আমার ভালো কেউ দেখে না।সবাই আমার বিরোধিতা করছে।এই চা মুখে নিলেই আমার সারাটা জীবন বৃথা মনে হয়।

    – আব্বা চিনি আপনার জন্য বিষ!আপনি কী বার বার বিষয়টা ভুলে যান?

    ইতিকার গম্ভীর প্রশ্নে চোখ তুলে তাকায় ইব্রাহিম।মেয়েটা কোমড়ে হাত গুজে বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।যেন পান থেকে চুন খসে গেসে।

    – আমি ভুলে যাবো কেন?সব মনে আছে তারপরেও এই চা আমি মুখ তুলতে পারছিনা রে মা।

    ইতিকা ইব্রাহিমের পাশে বসে যায়।জড়িয়ে ধরে তার বাম হাত,মাথা এলিয়ে দেয় বাহুতে।

    – আব্বা আপনাকে বাচঁতে হবে, সুস্থ হতে হবে।আমাদের জন্য অন্তত।তাই আমাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা আপনার কতর্ব্য।

    ইব্রাহিম বেশ যত্ন করে ইতিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।চায়ের পেয়ালায় চুমুক বসিয়ে তৃপ্তি সহকারে তা পান করেন।

    – তুই আমার ঘরের চন্দ্রমণি।আমার ঘরের আলো তুই।তোর কথা আমি ফেলতে পারবো না।

    মূহুর্তেই টেলিভিশনের একটি নিউজে চোখ আটকে যায় ইব্রাহিমের।ব্রেকিং নিউজ হিসেবে হেডলাইনটি বেশ বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা।
    ” বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা কর্মী সাহাব উদ্দীনকে তার নিজ বাসভবন থেকে আটক করেছে র‍্যাব।তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ মাদক পাচার সহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।”

    নিউজটা দেখে ইব্রাহিম বাকরুদ্ধ হয়ে যান।ইতিকা তার চাহনী লক্ষ্য করতেই অবাক হয়ে যায়।মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে,

    – ওয়াসিমের বাবা গ্রেফতার!

    বাক্যটি কর্ণকুহুরে ঠেকতেই এগিয়ে এলেন নাসরিন।তার চোখে মুখে বেশ খুশির ঝলক দেখা গেলো।

    – দেখলে ইনানের বাপ সত্যর জয় হয়।অনেক জালিয়ে খেয়েছে এরা।ব্যবসা সম্পত্তি কোন কিছুতেই শান্তি দেয় নি এরা।আর আজ নিজেরাই ফেঁসে গেলো।

    – সবটা তো বুঝলাম কিন্তু একবছর পূর্ণ হতে চলেছে ওয়াসিমের কোন খোঁজ খবর পাওয়া গেলোনা।পুলিশ কেস করেও কোন তথ্য মেলেনি।ছেলেটা হঠাৎ কোথায় নিরুদ্দেশ হলো।

    ইব্রাহিম বেশ চিন্তিত মুখে কথাটি বলেন।ইনান পেছন থেকে কথাটি শুনে বাকা হাসে।মনে মনে বলে,

    – যা হয় ভালোর জন্য হয়।আর যা করেছি ভালোর জন্য করেছি।

    .
    – এই দ্রুত উঠ আর ঘুমিয়ে থাকিস না।সকাল এগারোটা বাজে।

    সুফিয়ার ধাক্কায় ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে অলীদ।পিট পিট চোখ করে তাকায় তার দিকে।মেয়েটির এলোমেলো চুল মুখ ছুঁয়ে পড়ছে।চোখে মুখে পড়ে আছে বিরক্তির রেষ।
    অলীদ খপ করে তার হাত জড়িয়ে ধরে হেঁচকা টেনে বিছানায় ছুড়ে ফেলে।সুফয়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে আবারো ঘুমের ভান করে শুয়ে যায়।

    – অলীদ ছাড় আমায়।এখন রোমান্স করার সময় নয়।বাবা বাজার পাঠিয়েছেন।আজ বুয়া আসবে না।সবটা আমাদের করতে হবে।

    অলীদ শুনলো না বরং আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো সুফিয়াকে।সুফিয়া বিরক্ত হয়ে ছেলেটার চুল টেনে ধরে আকস্মিক ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে অলীদ।

    – আহ!মেরে ফেলবি আমায়?একটু আদর করতে গেলেও তোর গাঁইগুঁই শুরু হয়।

    – কাজ আছে অলীদ উঠ প্লিজ। বাবা এক গাদা বাজার পাঠিয়েছেন।মাছ – মাংস সবটা কেটেকুটে পরিষ্কার কিন্তু আমাদের করতে হবে।

    অলীদ উঠে বসে বিরক্তে কপাল কুচকে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।সুফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বেশ জোরে জোরে বকতে থাকে এবং দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায়,

    – এই হিটলার শশুড় যার কপালে জুটবে তার আর শত্রুর প্রয়োজন হয়না।আজ অফিসের অফ ডে কই একটু ঘুমাবো বউ নিয়ে সময় কাটাবো তা না করে আমার বারোটা বাজাতে প্রস্তুত তিনি।ভাগ্যিস তোর বাপ, অন্য কারো বাপ হলে এতক্ষণে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তাম।

    সুফিয়ার ললাটে ভাঁজ পড়ে।চোখ মুখ ছোট করে অলীদের হাতঘড়িটা হাতের সামনে পেয়ে ছুড়ে মারে।তৎক্ষনাৎ বিকট শব্দে ঘড়িটি ভেঙ্গে কাঁচ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।শব্দ পেয়ে ওয়াশরুম থেকে জোরকদমে ছুটে আসে অলীদ।সুফিয়ার আগুনের চুল্লির সদৃশ মুখটা দেখে চুপসে যায় ছেলেটি।

    – এটা ঠিক করেছিস তুই?আমার কত প্রিয় ঘড়ি ভাঙ্গলি কেন?উনিশ থেকে বিশ হলেই তুই সব ভাঙ্গা শুরু করে দিস।আল্লাহ যানে কোন দিন আমায় গলা টিপে মে’রে ফেলিস।

    অলীদ কথাটা বলেই দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে মূহুর্তেই আরেকটি কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে মৃদ্যু কেঁপে উঠে।চোখ তুলে তাকাতেই দেখে তার ছোট্ট একুরিয়াম টা ভেঙ্গে মেঝেতে পড়ে আছে। মাছগুলো খলবলিয়ে থেমে যায়।নিভন্ত রাগটা মূহুর্তে মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে অলীদের।সুফিয়ার হাতটা টেনে ধরে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।সুফিয়াও কম যায় না পেছন থেকে অলীদকে কিল ঘুষি মেরেই চলেছে।

    বার্থ টবে সুফিফার মাথা পানিতে চেপে ধরে অলীদ।সব রাগ আজ যেন সে মিটিয়ে নিচ্ছে।সুফিয়ার ছটফটানো দেখে মূহুর্তেই মাথা তুলে নেয়।নাকে মুখে পানি প্রবেশ করায় বেশামাল ভাবে কাশতে শুরু করে মেয়েটি।

    – সরি সুফু তুই আমার রাগটাই বাড়িয়ে দিয়েছিস।নাক জ্বলছে?এই পানি খেয়েছিস নাকি বেশি?

    সুফিয়া হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠে।নাকের ভেতরটায় অসহ্যকর জ্বালছে।অলীদ দিশেহারা হয়ে পড়েছে।সুফিয়ার চুল,মুখ মুছে দাড় করায় কিছু বলার আগেই সুফিয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।ক্রন্দন চোখে তাকিয়ে মূহুর্তেই বেরিয়ে যায় ওয়াশরুম থেকে।অলীদ মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো নির্বেদ দৃষ্টিতে।

    সুফিয়া আর অলীদের বিয়ে হয়েছে এক বছর হতে চললো।এই এক বছরে অলীদ অনুভব করেছে আগের সুফিয়া আর বর্তমানের সুফিয়ার মাঝে আকাশ পাতাল তফাত।আগের মেয়েটি ছিল শান্ত শিষ্ট চঞ্চল।আর বর্তমানে মেয়েটি রাগি রুক্ষ।সব সময় রগচটা মেজাজ নিয়ে পড়ে থাকে।তবে সে ভালোবাসায় বড্ড পোষ মানে।শত ঝগড়ার মাঝেও অলীদ আগলে নিলে সবটা ভুলে যায়।
    সুফিয়ার বাবার ব্যবসার সিংহভাগ দায়িত্ব অলীদের।মোস্তাফিজ মেয়ে জামাইয়ের যত্নে কোন ক্রুটি রাখেন না।যখন যা প্রয়োজন সবটা না চাইতেই হাজির করেন।দুজনের মেলবন্ধন যেন রাজযোটক।

    .
    বছর ঘুরে আবার ফিরে এলো সেই বৃষ্টি।দেয়াল ঘড়ির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে চোখে পড়ে রাত বারোটা বাজতে আর মাত্র দুই মিনিট আছে।ব্যাস তখনি বিবাহিত জীবনের একবছর পূর্ণ হবে অলীদ এবং সুফিয়ার।কিন্তু বধূ রাগ করে মটকা মেরে শুয়ে আছে।অলীদ নিঃশব্দে প্রবেশ করলো তার রুমে।মেয়েটি যে ঘুমের অভিনয় করছে তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।ছেলেটি রান্না ঘরে প্রবেশ করে দ্রুত চা বসায়।পানি ফুটতে অন্য পাত্র থেকে ঠান্ডা পানি হাতে ঢেলে চিৎকার করতে থাকে,এতটাই জোরের চিৎকার সুফিয়া দু’রুম দূর থেকে সবটা শুনতে পায়।

    – ও মা হাত পুড়ে গেলো গো।আমার হাত….

    সুফিয়া উঠে বসে অলীদের কিছু হলো ভেবে ছুটে চলে যায় কিচেনে।

    – এই কী হয়েছে তোর?

    – আমার হাত পুড়ে গেছে।

    সুফিয়া এগিয়ে গেলো অলীদের হাত ধরতেই চোখ ছোট করে তাকায় তার দিকে।মেয়েটির চাহনী দেখে অলীদের ভেতরটা শুকিয়ে আসে নিশ্চই বুঝে গেছে সবটা।

    – ঠান্ডা পানি ঢেলে এইসব নাটক করার মানে কী?আমার মান ভাঙ্গাতে এসেছিস?নাকি অন্যকিছু।

    – আহ! আমার রূপবতী বউ, আমার গুনবতী বউ,আমার বুদ্ধিমান বউ সবটা বুঝে নিয়েছে তাইতো এত ভালোবাসি তোমায়!

    – ভালো ভালো কথা বলে আমার মান ভাঙ্গাবি?

    – তোমার কোন মান আছে নাকি?

    অলীদের মুখ ফসকে কথাটা বের হয়ে যায়।দ্রুত গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।সুফিয়া দ্বিমত না করে চুপচাপ রান্না ঘর ছেড়ে চলে যায়।মেয়েটির ঠান্ডা মস্তিষ্ক নিশ্চই কোন উলটা পাল্টাল কাহিনি আকঁছে।

    অলীদ তার পেছন পেছন এগিয়ে গেলে সুফিয়া কোন কথাই বললো না।

    – সুফু রাগ করেছিস?এত রেগে যাস কেন সবসময়?ভুলে যাস কেন আমরা ফ্রেন্ড আমাদের মাঝে আগেও ঝগড়া খুনশুটি হয়েছে।এখনো হবে তাই বলে এত বাযে রিয়েক্ট করার কোন মানে হয়না।আমার দিক থেকে আমি সরি।তখন মাথা ঠিক ছিল না তাই..

    – ইটস ওকে।

    – আয় কাছে আয় একটু আদর সোহাগ করে দি।আজ হুজুরের কাছ থেকে দোয়া শিখে এসেছি যেটা পড়ে ফুঁ দিলে বউরা লাঠির মতো সোজা হয়ে যাবে।

    অলিদের কথা শুনে নিঃশব্দে হাসলো সুফিয়া।কাছে এসে জাপটে ধরে অলীদকে।অলীদ হাসিমুখ জড়িয়ে ধরে মেয়েটির কপালে অধর ছুঁয়ে দেয়।

    – শুভ বিবাহ বার্ষিকী বউ।এইভাবে আরো আরো যুগ যুগ ঝগড়া করিস।তবে ছেড়ে যাবি না ভুলেও।

    #চলবে…..

    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ২৪]

    ________
    অলস দুপুর।রোদে দাপটে ঘেমে একাকার ইনান।তার সামনে বসে আছে ওয়াসিম।ছেলেটার ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত হাসি।পানির গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শুধালো ছেলেটি,

    – নে পানি।এত ঘমছিস কেন ইনান?

    – তুই এখানে?

    ইনানের প্রশ্নের উত্তর দিলো না ছেলেটি বরং হেলদোল ছাড়া গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে।নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে।মৃদ্যু বাতাসে উড়ছে তার কপাল ছুঁয়ে থাকা চুলগুলো।অন্তরালে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,

    – পাহাড়ে এসেছিস ঘুরতে ভালো কথা।ইতিকাকে আনলি কেন?তোর তো শত্রুর অভাব নেই ধর তোরা দুজনেই ঘুরছিস হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ইতিকাকে ধাক্কা দিলো তখন কী হবে?

    ইনান ঘাবড়ে গেলো।চটজলদি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে থাকে।তার দুই হাত থরথর করে কাঁপছে, সেদিকে তাকিয়ে বেশ শব্দ করেই হেসে দিলো ওয়াসিম।

    – কিরে ভয় পেয়ে গেলি?আরে আমি তো উদাহরণ দিলাম।এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

    – একদম হাসবি না তোর হাসি আমার কাছে বিদঘুটে লাগে।তুই এখানে কি করে এলি ওয়াসিম?তুই তো…..

    – মরে গেছি তাই তো?মরেছি তো কি হয়েছে আমি তো আর তোদের জল্পনাকল্পনা থেকে মুক্তি পাইনি।তোরাই আমায় ডেকে আনছিস বারংবার।যাই হোক চলে যাবো শেষ আবদার যদি রাখিস।

    – কী?

    – ইতিকাকে নিয়ে যাই?

    ইনান চমকে যায়।অদ্ভুত অনুভূতি খেলে যাচ্ছে তার ভেতরটায়।শ্বাস প্রশ্বাস চালচলন যেন থেমে গেছে।ওয়াসিমের বিদঘুটে হাসিটাও তার ভেতরটা নাড়িয়ে তুলছে।ওয়াসিমকে হাসতে দেখে রেগে যায় ছেলেটি যার দরুনে দুজনের মাঝে শুরু হয় ধস্তাধস্তির।একটি পর্যায়ে ইনানের ধাক্কা লেগে পাহাড় থেকে ছিটকে পড়ে ওয়াসিম।

    মূহুর্তে ওয়াসিমের নাম ডেকে লাফিয়ে উঠে ইনান।চোখের ঘুম ভাঙ্গতেই চারিদিকে পরখ করে নেয় সে।সারা শরীর ঘেমে করুন অবস্থা।শরীরটা যেন ধীরে ধীরে বিবশ হয়ে আসছে।হাত নাড়ানোর শক্তি টুকু তার মাঝে নেই আজ।চোখ বুলিয়ে দেয়াল ঘড়িয়ে সকাল সাড়ে সাতটা বাজতে দেখে হাতের বাম পাশটায় তীর্যক ভাবে তাকায়।ইতিকাকে পাশে না পেয়ে বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠে।ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বিছানা থেকে নেমে যায়।দ্রুত পা খুড়িয়ে হাটতে হাটতে ডাক পাঠায় ইতিকার উদ্দেশ্য।

    – ইতিবউ কোথায় আপনি?ইতিবউ!

    অলীদ এবং সুফিয়ার বিবাহ বার্ষিকী শেষে গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিল ইতিকা এবং ইনান।গ্রামের বাড়ির পরিস্থিতি সব কিছু স্বাভাবিক থাকলেও স্বাভাবিক নেই মিহি।মেয়টি দিন দিন কেমন যেন নিগূঢ় হয়ে যাচ্ছে তোর চোখে মুখে ছেঁয়ে আছে মলিনতা।চঞ্চল মেয়েটি হুট করেই চুপচাপ হয়ে যাওয়ার কারন খুঁজে পেলো না ইতিকা।ইনান বার বার চাইছিল মেয়েটা ঢাকায় ফিরে আসুক।ব্যস্ত হয়ে পড়ুক এই জনবহুল শহরে।অতীত ভুলে ভবিষ্যৎ জীবনটাকে প্রাধান্য দিক কিন্তু অতীত ভুলতে নারাজ মেয়েটি।

    সে বার গ্রামে ফিরে এসে আর গ্রামে যাওয়া হলো না ইতিকার।কেটে গেলো প্রায় দেড় বছরের মতো।ব্যস্ত সময় পার করছে ইতিকা এবং ইনান।ব্যবসার সাথে পড়াশোনার সফলতার আশায় ছুটছে ছেলেটি।তার সাথে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টাই কড়া পাহাড়ায় রাখছে তার ইতিবউয়ের।শত্রু পক্ষের ভয় এখনো কাটেনি।সুযোগ বুঝেই হামলে পড়ছে।

    অপরদিকে সাহাব উদ্দীনের জেল থেকে এখনো মুক্তি মেলেনি।সব ভয়ে জড়ো হয়ে রাজনৈতিক পথ থেকে চিরতরে মুক্তি নিয়েছেন বাহরুল ইসলাম।সেই গোপন আস্তানা ভেঙ্গে চুরে সব প্রমান লুটপাট করেছেন।বর্তমানে স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে দেশের বাইরে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।অবশ্য যাওয়া আগে নাসরিনের কাছ থেকে নেওয়া সেই জমি আর বাড়ির দলিল ফিরেয়ে দিয়ে যান তিনি।
    .
    দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে বারংবার।শরীরটা থরথর করে কাঁপছে ছেলেটির।তার কোলেই চেতনাহীন পড়ে আছে তার প্রিয়তমা স্ত্রী।পাশে কাদঁছেন নাসরিন।রূপসী পানির ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক কিন্তু ইতিকার চোখ খোলার নাম নেই।

    – মা খবরটা কখন পেলে?আর আমাকে ঘুম থেকে তুলোনি কেন?

    – আমি তো তোর বাবার সাথে কথা বলছিলাম।মেয়েটা রান্না ঘরেই ছিল হঠাৎ চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম।তারপর থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দেয়।গ্রাম থেকে নাকি তার ফুফি আম্মা ফোন করেছে মিহি নাকি ‘আত্মহত্যা’করেছে এই কথা টুকু বলেই সহসা ঘুরে পড়ে যায়।

    ইনান চমকে তাকায়।বুকের ভেতর হৃদযন্ত্রটার ধুকপুক শব্দ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।হাত পা ধীরে ধীরে হিম হয়ে যাচ্ছে।গলা শুকিয়ে চৌচির।

    – মা তুমি ঠিক শুনেছো মিহি নেই?

    – তুই নিজেই একবার ফোন করে দেখ গ্রামের বাড়ির পরিস্থিতি কি।

    – আমি ফোন করছি, তোমরা দ্রুত ইতিকার জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করো।

    _

    মিহির আত্মহত্যা গ্রামে চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি তৈরি করেছে নির্বাক হয়ে গেছে তার মা – বাবা।কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ নিয়ে যায়।ইনানের হাতে একটি কাগজ।হাতের লেখাগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কাঁপা-কাঁপা হাতেই চিঠিটা সম্পূর্ণ করেছে।কিছুক্ষণ আগেই চিঠিটা তার রুমের টেবিল ক্লথের নিচে পাওয়া যায়।একজন পুলিশ এগিয়ে আসে ইনানের দিকে এবং চিঠিটি দেওয়ার জন্য ইশারা করে।ইনানো নির্দ্বিধায় চিঠিটি ফেরত দেয়।সবার আড়ালে হয়ে ছেলেটি দিঘির পাড়ে দাড়ায় পকেট থেকে ফোন নিয়ে দ্রুত গ্যালারিতে প্রবেশ করে।
    কিছুক্ষণ আগে চিঠিটি পাওয়ার সাথে সাথে ইনান ছবি তুলে নেয়।

    ক্লান্ত চোখে নিয়ে দিঘির থই থই জলে তাকিয়ে আছে ইনান।চিঠিটা পড়তে তার বড্ড ভয় হচ্ছে।মেয়েটা যে ডিপ্রেশন থেকেই এমন একটা সিধান্ত নিয়েছে তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।আড়াই বছর আগে ঘটে যাওয়ার কাহিনিটা তো আর মিথ্যা নয়।সবটা ভুলে গেলেও গায়ে যে কলঙ্ক লেগেছে সেটা কিছুতেই মুছতে পারবেনা মেয়েটি।

    ইনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাটাতনে বসে পড়ে।মোবাইলের ব্রাইটনেস বাড়িয়ে সহসা চিঠিটি পড়া শুরু করে,

    শুরুতে ক্ষমা চেয়ে নিলাম আমার বাবা মায়ের কাছে।জানি আমার এমন সিদ্ধান্ততে আপনাদের বড় একটা ধাক্কা সামলাতে হবে।কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।নিজের মনের বিরুদ্ধে হাজার বার যুদ্ধ করেছি তবুও আমি সফল হয়নি।আসলে নিজের কাছে যখন নিজেই বিরক্তির কারন হয়ে যাই তখন আর কারো কোন সহানুভূতি কাজে আসেনা।শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে।ওয়াসিম নামের নিষ্পাপ ভাবা যুবকটিকে যারা হন্যে হয়ে খুঁজছে সবাই, বলা চলে আমার জীবন ধ্বংস করার জন্য ছেলেটি একমাত্র দায়ী।ওয়াসিমকে আমি ভাইয়ের নজরেই দেখতাম।আমার নজর আর তার সেই শেয়ালের নজর যে কখনোই এক ছিলনা তা আমি মোটেও বুঝতে পারিনি। আমাকে তুলে নিয়ে ধ’র্ষ’ণ করেন তিনি,বিষয়টি আমি লুকিয়ে গেলাম সবার আড়ালে।নিজের উপর তৈরি হতে থাকে ঘৃণা তবুও বেঁচে রইলাম।অবশেষে গ্রাম ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্য রওনা হলাম সুফিয়া আপুর বিয়ে উপলক্ষ্য।তাতেও বাঁধা হয়ে দাড়ালো ওয়াসিম।আমাকে গোপন একটি আস্তানায় তুলে নিয়ে পুনরায় ধ’র্ষ’ণ করার চেষ্টা করে।মনে আছে সেদিন ওয়াসিম নিরুদ্দেশ হওয়ার পর রিসোর্টের একটাও সিসি টিভি ক্যামেরা কাজ করছিলনা।সব গুলো এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।ক্যামেরা গুলো সেদিন অফ করে দেয় ওয়াসিম নিজেই।কেননা আমাকে রুম থেকে তুলে আনার বিষয়টি সবার কাছে প্রকাশ্য চলে আসবে বলে আর নিজেই জালে নিজেই ফেসে গেলো বেচারা।সেদিন রাতের সব জেদ,রাগ,ক্ষোভ,ভয় দূর করতে হাতে তুলে নিলাম লোহার রড।বেশ কয়েকবার মাথায় আঘাত করার পর নিস্তব্ধ হয়ে যায় ছেলেটি।ঠিক তখনো আমার মাঝে ভয় কাজ করেনি।বরং আনন্দ কাজ করেছে।লা’শটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম এক ঘোরে।আর জীবনের হিসাব কষতে ব্যস্ত আমি।বাস্তবতায় ফিরে এসে ভয়েরা ঘিরে ধরে আমায়।জলজ্যান্ত মানুষটা আমার সামনে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে যাকে কি না মেরেছি আমি নিজেই!কি করবো,কোন সিদ্ধান্ততে উপনীত হবো,কাকে বোঝাবো কোন উত্তর আমি খুঁজে পাইনি।হঠাৎ আশার আলো হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো একজন।যার সাহায্যে আমি ওয়াসিমের লা’শটা গুম করতে সক্ষম হই।আপনারা নিশ্চই ভাবছেন কার সাহায্য আমি লাশ গুম করেছি?ভেবে কাজ নেই যিনি আমাকে সাহায্য করেছেন তিনি সেদিন রাতেই গত হয়েছেন।বেঁচে ছিলাম একমাত্র আমি।ওয়াসিমের ফোন থেকে যে মেসেজ গুলো পাঠানো হয় সবার কাছে সেই মেসেজ গুলো আমি নিজেই পাঠিয়ে ছিলাম।আমার কাজে আমি ঠিক তখনো আফসোস করিনি কেননা সুফিয়া আপু সেদিন বেঁচে যায়।এমন নোংরা চরিত্রের মানুষের সাথে ঘর বাঁধা মোটেও সমীচীন নয়।কিন্তু আমি বাঁচতে পারলাম না।প্রতিটি দিন আমি অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছে।ক্রমশ একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছি।কলঙ্কের কালি আমি মুছতে পারিনি আমার মাঝ থেকে, তাই সর্বশেষ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।আমাকে নিয়ে আর কারো আফসোস না করলেও চলবে।হয়তো এটি আমার ‘মায়ের’ পাপের শাস্তি আমি ভোগ করছি।কেননা একটা সময় ইতিকাকেও আমার মা বাজার পণ্যর ন্যায় বিক্রির জন্য লাগামছাড়া ছুটে চলেছিল আর আজ সেই শাস্তি আমি পেয়েছি।যাই হোক শেষ একমাস দেখলাম আমার মা আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন কোন এক বড় লোক বাপের পুত্রের সঙ্গে।কিন্তু আমি বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত নই।আর কোন দিন প্রস্তুত হতাম কি না আমার জানা নেই।অন্তত যাই হোক এমন কলঙ্ক নিয়ে এই সমাজ আমায় কিছুতেই মানবেনা।লাল শাড়ি,গহনা মুড়িয়ে আমাকে সাজানোর বেশ শখ ছিল আমার মায়ের,কিন্তু তা আর হলো কই!
    লাল শাড়ি অঙ্গে ধারণ করার আগে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে নেওয়া মন্দ নয়।সমাপ্তিটাই তো সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত।হোক না সেটা চিরতরে বিদায়ের মুহূর্ত!

    চোখের নোনা জল বেশ কিছুক্ষণ বাধ মানলেও আর যেন বাধ মানছেনা ইনানের চোখে।এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সে আগেও পড়েছে কই তাই বলে তো এতটাও কষ্ট হয়নি।মাথার ভেতরটায় সবটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।মিহি যাবার আগে সবটা পরিষ্কার করে গেছে ওয়াসিমকে হত্যার দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে কিন্তু কোথাও ইনানকে ইঙ্গিত করে কিছু লেখা নেই।বর্তমানে সম্পূর্ণ নির্দোষ ইনান।এত চঞ্চল একটি মেয়ে ধীরে ধীরে নিপাতনে হারিয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি ছেলেটি।এইতো এখনো মনে পড়ে সেদিনের কথা বড় বড় চোখ নিয়ে ইনানকে ‘দুলাভাই’ বলে সম্বোধন করেছিল।এখন হয়তো আর কেউ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলবেনা, ‘আপনাকে আমি ভয় পাই দুলাভাই।বিয়ের দিন যে রামদা নিয়ে এসেছেন ভাবতেও আমার ভয়ে গলা শুকায়’।
    মায়া আবেগটা অদ্ভুত কাছে থাকলে অনুভব করি না।বুঝেও বুঝিনা,গুরুত্ব না দিয়ে আপন কাজে ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়ি।কিন্তু ছেড়ে গেলেই এত নোনা জল আসে কেন?এত কষ্ট লাগে কেন?ফিরে তো পাবো না।এত কাদঁছি কেন!

    ইনান ডান হাত উঠিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় তৎক্ষণাৎ কানে আসে সুফিয়ার কন্ঠ।

    – ই..ইনান।

    সুফিয়ার ডাকে ঘুরে তাকায় ইনান।

    – হ্যা বল।

    – শুনলাম ওয়াসিম মারা গেছে সেদিন রাতেই!

    – কেন তোর কি আফসোস হচ্ছে?
    নাকি অন্য….

    – মোটেও না।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।অন্তত আমার দিক দিয়ে যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে আমি যাকে পেয়েছি সে আমায় যতটুকু বুঝে আর যতটুকু যত্ন নেয়,এতটা ভালো হয়তো কেউ আমায় কখনো রাখতো না।তবুও আফসোস হচ্ছে আঙ্কেল আন্টির জন্য।আর মিহি!অল্পবয়সী একটি মেয়ে।কোথা থেকে কি হয়ে গেলো?আমার মাথা কাজ করছে না।

    – ইতিবউ কোথায়?

    – নাসরিন আন্টির সাথেই আছেন।মেয়েটা ভেঙ্গে পড়েছে রে।

    ইনানের মুখ থেকে আর কোন বাক্য ব্যয় হলো না কপালে হাত ঘষে কান্না আড়াল করতে ব্যস্ত সে।

    #চলবে….

    ❌কার্টাসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    #আগন্তুকের_আসক্তি
    #পলি_আনান
    [পর্ব সংখ্যা ২৫ <শেষ>]

    _________
    গুটি গুটি পা ফেলে চপল পায়ে দৌড়াতে ব্যস্ত দুটি বাচ্চা।হেলেদুলে হেটে দুজনেই ছুটে চলে তাদের বাবাইয়ের রুমে।ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বেশ মনোযোগ সহকারে কাজ করছে ইনান।রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়েই চমকে তাকায় সে।

    – ইশাত,ইফাত ওখানে কী করছো?কাছে এসো বাবাইয়ের।

    বাচ্চা দুটি অনুমতি পেয়ে ছুটে চলে লাগামছাড়া।দুজনেই এক ছুটে লাফিয়ে উঠে তাদের বাবার কোলে।ইনানো দুজনকে দু’পাশে বসিয়ে হাতে চকলেট ধরিয়ে দেয়।গালে এঁকে দেয় ভালোবাসার পরশ।

    – বাবাই থুমি খুব্ভালো।মাম্মাল পতা।

    ইফাতের কথা শুনে ভ্রু কুচকায় ইনান।তার গালটা আলতো ভাবে টেনে শাসন সুরে বলে,

    – কে বলেছে মাম্মাম পঁচা?চকলেট না দিলে সবাই পঁচা আর দিলেই ভালো।বাহ বাহ এই বাচ্চাগুলো দেখছি দুনিয়ার নিয়মনীতি শিখে নিয়েছে।

    ইনানের বচনভঙ্গিতে আবারো খিলখিল করে হেঁসে উঠে বাঁচ্চা মেয়ে দুটি।তৎক্ষণাৎ রুমে প্রবেশ করে ইতিকা।

    – কিরে ইশাত ইফাত তোরা এখানে?তোদের দাদুমনি খুঁজছেন ছুটে যা দ্রুত।

    ইতিকার তাড়া দেখানো হাত ভঙ্গিতে চোখ পিটপিট করে তাকায় ইফাত।

    – খেন মাম্মাম?

    – এত প্রশ্ন কেন ইফাত যাও দ্রুত।

    ইফাত এবং ইশাত গেলো না বরং দৃঢ় হয়ে বসে রইলো তাদের বাবার কোলে।ইতিকা এবার বেজায় চটে গেছে।রাগের মাথায় এগিয়ে এসে ইনানের কোল থেকে তাদের নিচে নামিয়ে রাখে।

    – আরে কি করছেন কী ইতিবউ?ওদের নামিয়ে দিচ্ছেন কেন?

    – এই বাবাইয়ের ইতিবও আমালের নামাচো খেন?

    ইশাতের রগচটা প্রশ্নে চমকে তাকায় ইতিকা।ইনান ঠোঁট খিচে হাসছে।তিন মা মেয়ের ঝগড়া নতুন কিছু নয়।প্রতিদিনি তাদের খুনশুটি লেগেই থাকে।

    ইতিকা বেশ রাগ নিয়ে কাদো কাদো সুরে শুধালো,

    – তোরা যে তোদের বাবাইকে সারাদিন নিজেদের জিম্মায় বন্দি করে রাখিস সে তো আমার খোঁজ নেয় না।সব আদর ভালোবাসা তোদের জন্য আর আমার ভালোবাসার নদীটাতো শুকিয়ে মরে গেছে।যা দাদুমনি ডাকছে তোদের।চকলেট দেবে হয়তো।

    ইফাত ইশাত আবারো চপল পায়ে ছুটে চলে।দুজনেই বেজায় দুষ্টু।তবে ইশাত একটু বেশি রাগি।ইনান এবং ইতিকার ঘর আলো করে এসেছে জমজ দুই মেয়ে ইশাত এবং ইফাত।দুজনের বয়স প্রায় তিন বছর।ঝগড়া খুনশুটিতে সময়টা বেশ ভালোই যাচ্ছে তাদের।

    ইতিকা ক্লান্ত মাথাটা এলিয়ে দিলো ইনানের গায়ের উপর।মুখ দিয়ে একটা বাক্য না করে চুপচাপ ইনানের হৃদযন্ত্রের শব্দ শুনতে ব্যস্ত।

    – ইতিবউ ক্লান্ত লাগছে শরীর?এত কাজ করতে কে বলে আপনাকে?এত কাজের লোক এই বাড়িতে কেন আছে তবে!

    – আমার সংসার আমি কাজ করবো না তো কে করবে?আপনি তো এখন আর আমায় ভালোবাসেন না।কেমন জানি দূরে দূরে থাকেন।

    – তাই নাকি?তাহলে আমি যে সারাদিন খেটেখুটে মরছি, তবুও রাতদিন যার চিন্তায় বিভোর থাকছি সে কে?

    – আমি তো জানি না নতুন কাউকে পেয়েছেন হয়তো!

    – আমার জীবনে আগন্তুক একজন ছিল একজন আছে আর একজনি থাকবে।সে হলো আমার ইতিবউ!

    – মানিনা মিথ্যা বলছেন।

    – একটুও না।আসলে বুড়া হইয়া যাচ্ছি তো তাই আর আগের মতো আমারে পছন্দ না আপনার তাই এমন বাহানা বানান।

    ইনানের কথায় শব্দ করে হেসে উঠে ইতিকা।দুজনে মাঝ কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা।নিরবতা ঘুচে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ইতিকা,

    – আমাকে চাকরি করতে দেবেন?

    ইতিকার কথা শুনেই ইনানে কপালে ভাঁজ পড়লো।রেগে গেলো মূহুর্তেই।

    – চাকরি?চাকরির কথা আসছে কেন এখানে?

    – আমারো তো কিছু করার ইচ্ছা আছে তাছাড়া ইফাত-ইশাত এখন বড় হয়েছে আব্বা আম্মার কাছেও তারা থাকবে আমি একটা জব কি খুঁজবো?

    – এসব কুবুদ্ধি কে দিচ্ছে আপনাকে? সুফিয়া চাকরি করছে?সে তো আপনার থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিজের বাচ্চা সংসার নিয়ে পড়ে আছে।এই সময় চাকরি করা মানে বাচ্চাদের সময় দিতে পারবেন না।

    – প্লিজ রেগে যাবেন না আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন।

    – কোন বোঝা বুঝি নাই।আমি চাকরি করতে দেবো না এটাই ফাইনাল।

    ইতিকা ছিটকে সরে যায় ইনানের কাছ থেকে।ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করছে বারংবার।ইনানের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সহসা।তখনি রুমে প্রতিধ্বনি হলো কিছু ভাঙ্গার শব্দ।ইতিকা ভীতকর চাহনীতে তাকাতেই খেয়াল করে ইনানের ল্যাপটপটা পড়ে আছে মেঝেতে।ভয়ে ইতিকার দু’ঠোঁট কাঁপছে বেসামাল গতিতে।ইনানের হাবভাব মোটেও সুবিধার নয়।গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।ইতিকা ভয় পেয়ে যায় যার দরুনে ছুটে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা চালায়।কিন্তু দু’কদম যেতেই পেছন থেকে হাতটা খপ করে ধরে নেয় ইনান।

    – কোথায় যাচ্ছেন?

    – ছাড়ুন আমায়।এখানে থাকার ইচ্ছে নেই আমার।

    -কিন্তু এখান থেকে তো যেতে দেবো না আমি।আপনার শশুড় শাশুড়ী কানে ফোড়ন কাটবেন?যেখানে আমি এই ইফতিহার ইনান সম্মতি দেয় নি সেখানে কারো সুপারিশ কাজে আসবে না।

    ইতিকা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য বেশ ছোটাছুটি শুরু করে দেয়।দু’চোখ দিয়ে তার অনবরত পানি ঝরছে ইনানের অস্বাভাবিক রাগের কারনটা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না সে।

    – ছেড়ে দিন চলে যাবো।থাকবো না আর আপনার সাথে।

    – কোথায় যাবেন ইতিবউ?

    – যেখানেই যাই আপনার কাছে আর ফিরবো না।

    ইতিকার কথা শুনে ইনান ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো।আরেকটু কাছে টেনে নিলো ইতিকাকে।মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে বলে,

    – আপনি জানেন না ইতিবউ এখনো আমার কত ভয় কাজ করে মনে।অতীতের শত্রুপক্ষ এখনো পিছু ছাড়েনি আমার।সবাই আপনাকেই বেছে নেয় আমাকে ব্লাক মেইল করার জন্য সেখানে আমি কি করে আপনাকে বাইরে চাকরির উদ্দেশ্য পাঠাবো।যেখানেই থাকেন আমার অন্তরালে নিরাপত্তা সবসময় আপনার ছায়া হয়ে থাকে।কিন্তু তবুও যে ভয় আমার কাটে না।হয়তো বা কাটবেও না কখনো।
    .

    গভীর রাত চারিদিকে বর্ষণমন্দ্রিত।বাতাসের শো শো শব্দ কানে আসলেও আবার তা বৃষ্টির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে।বিছানার একদম কিনারায় রেগে ঘুমিয়ে আছে ইতিকা।ঝগড়ার পর আর দুজনের মাঝে কথা হয় নি।ইশাত-ইফাত দুজনেই আজ দাদুমনির সাথে ঘুম দিয়েছে।ইনান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে।অলীদকে ফোন করবে কি করবে না ভেবেই ফোন করে বসলো দ্রুত।

    – হ্যালো অলীদ ঘুমিয়ে পড়েছিস?

    – আরে ব্যাডা ঘুম থেকে তুইলা জিগাস ঘুমাইয়া গেসি কি না।মদ খাইসত?ভাবী কিছু কয় নাই?

    – একটা চড় দিবো, আগে কথা শুন।তোর বউ বাচ্চা কই?

    – আমার বউ,আমার বাচ্চা মেয়েটা আমার পাশেই আছে কি বলবি বল।

    – ইতিকার মাথায় চাকরির ভুতটা কী তোরা ডুকিয়েছিস?

    – চাকরি!কিসব বলছিস ভুলেও না।আমি তো বরং সুফুকে উঠতে বসতে চড় লাগাই সে নিজেও চাকরি করতে চায় কিন্তু আমি ভাই দিবো না;করতে হলে আরো দুই তিন বছর পরে করো তবে এখন নয়।

    – তার মানে সুফিয়া এই বুদ্ধি মাথায় ঠেসে দিয়েছে।রীতিমতো আমার ঘরে ঝগড়া চলছে ভাই কেউ কারো সাথে কথা বলছি না।

    ইনান ফস করে শ্বাস ছাড়লো, বারান্দায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টির পানি হাতে তুলে নেয়।

    – এত চাপ নিস না ইনান।চাকরি করতে দে তবে তোর অফিসে ডানে বামে ভুলেও নড়তে দিবিনা।

    – গুড আইডিয়া।
    .

    ঘুমন্ত মুখটায় বৃষ্টির ঝাপটা পড়তেই সহসা চোখ খোলে ইতিকা।নিজেকে ভাসমান খোলা আকাশের নিচে দেখে বুকের ভেতরটায় মুষড়ে উঠে।

    – ভায় পাচ্ছো কেন ইতিবউ এই যে আমি।

    ইতিকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।ইনানের কোলে নিজের অবস্থান বুঝে ঠোঁট বাকিয়ে মনে মনে বিশ্রি একটি গালি ছুড়ে দেয়।

    – ছাদে কেন এনেছেন?ছাড়ুন আমায়।

    – লাফালাফি করলে কিন্তু আপনাকে ছাদে রেখে তালা ঝুলিয়ে আমি নিচে চলে যাবো।বাই দা ওয়ে আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।

    – কি সেটা?

    – চাকরি করার অনুমতি দিলাম তবে সেটা একমাত্র আমার অফিসে।চলবে?

    – চলবে মানে দৌড়াবে।

    ইতিকাকে কোল থেমে নামিয়ে দেয় ইনান।দুজনেই ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টি স্নানে।ইনান জারিয়ে আছে তার ইতিকার মাঝে দুজনের মাঝে ব্যবধাব ঘুচে গেছে বহু আগেই।তবুও নিত্যুনতুন ভাবে একে অপরকে ভালোবেসে যায় নতুন করে।নিরিবিলি রাতে শুধু বৃষ্টির শব্দটাই কানে আসছে তাদের।ইনান আগলে নেয় ইতিকাকে জড়িয়ে নেয় আলতো হাতে।

    – শুরুটা মনে আছে ইতিবউ?তখন আপনি কতটা ছোট ছিলেন।তখনকার চাহনী ছিল প্রখর।সেই ছোট্ট ইতিকা এখন আমার বাচ্চার মা।

    – আপনি কী বড় ছিলেন নাকি?ইঁচড়েপাকা ছেলে গুন্ডার দল নিয়ে ছুটে গেলেন বিয়ে করতে।

    ইতিকার আড়চোখের চাহনীতে শব্দ করে হেঁসে দেয় ইনান।বৃষ্টিতে জুবুথুবু শরীরে ইতিকাকে জড়িয়ে নেয় আরো শক্ত বন্ধনীতে।
    ইতিকা কিছু একটা ভেবে ইনানের পিঠে কিল বসায়।আচমকা আঘাতে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে,

    – আহ ইতিবউ মারছেন কেন?

    – মানে আছে কি বলেছিলেন বিয়ের পর দিন?

    – কি বলেছিলাম?

    – বেশ রাগ নিয়ে আমার মাথায় পানি ঢালতে নিয়ে গেছেন আর বলেছিলেন ‘আমার সাথে সংসার করার পূর্ব শর্ত হলো তোমার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।’ সেদিন আমায় অন্ধকার রুমে বন্দি করে চলে যান।কম কষ্ট দেননি আমায়।

    – আপনিও কম তর্ক বির্তে জড়িয়ে পড়েননি ইতিবউ।ছোট্ট মেয়ে আমার সাথে পান থেকে চুন খসলেই তর্কে জড়াতেন।

    – তো এখন এই তর্ক বাজ ছোট্ট মেয়েকে সহ্য করছেন কী করে?

    ইনান ইতিকার কপালে অঁধর ছোঁয়ায়।কোমড়ে হাত জড়াতেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠে মেয়েটি।ভেজা চোখ নিয়ে ইনানের চোখে চোখ রাখতেই আবারো মাথা সরিয়ে নেয়।

    – যদি বলি এই তর্কবাজ মেয়েটাকেই আমার চাই সারাজীবনের জন্য?আর ছোট্ট সেয়ানা মেয়েটা যে কিনা ইফতিহার ইনানের মতো মানুষকে পালটে দিতে পারে।তুমি আমার জীবনের সেই আসক্তি যা ছাড়া আমি ছন্নছাড়া।এই আসক্তিতে কোন ক্ষতি নেই।সবটাই ভালো দিক।অন্তত এই আগন্তুক আমার জীবনে আরো বেশ কয়েক বছর আগে এলেও পারতো কিন্তু আসেনি!

    – আর নোলক?নোলক তো ছিল অতীতে!

    ইতিকার মুখে নোলকের কথা শুনে ঘাবড়ে যায় ইনান।অলীদ-সুফিয়ার বিয়ের দিন সেই রাতে নেশায় ডুবে থাকা ইতিকাকে নোলকের ঘটনা বলেছিল সে।তবে কী সবটা জেনে গেছে ইতিকা?আর ওয়াসিমকে মারার বিষয়টা?

    মূহুর্তেই রোমাঞ্চকর পরিবেশটা ইনানের কাছে বিদঘুটে লাগতে শুরু করে।ভয়ে তার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।তার অস্থিরতা দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে ইতিকা।

    – ভয় পাচ্ছেন কেন?আমি সবটা জানি!

    – জ..জানেন মানে?ক..কি কি জানেন আপনি?

    – আমাকে আম্মা সব বলেছে নোলক কি করে মারা গেছে আমি সব জানি।আপনি শান্ত হোন যে চলে যাওয়ার সে চলে গেছে আর ওয়াসিম এতটা জঘন্য কাজ করেছিল আমি ভাবতেও পারছিনা।এখন তো আপনার কোন ভয় নেই না আছে ওয়াসিম আর না আছে ফিরে আসার মতো নোলক এখন শুধু আমরা আমরা।ভয় পাবেন না ইনান, আপনার ইতিবউ আপনার সাথেই থাকবে।

    ইতিকার মুখে কথা গুলো শুনে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো ইনান।আবারো জড়িতে ধরলো ইতিকাকে তার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির সঙ্গে।মনের ভেতর এখনো তার ভয় কাজ করে ইতিকা যদি হারিয়ে যায় তবে কী হবে?আবারো কী ছন্ন ছাড়া হয়ে যাবে ইনান।

    ইতিকা আগলে নেয় ইনানকে ঠোঁটের কোনে তার তৃপ্তির হাসি।বৃষ্টিতে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে অতীতের কথা।অতীত বর্তমান হিসাব কষে সে যেন আজ জয়ী।

    – ইফতিহার ইনান আপনার কাছে বিয়েটা ছিল একান্ত আমায় বাঁচানোর উদ্দেশ্য কিন্তু আমার কাছে বিয়েটা ছিল আপনাকে আমার উপযুক্ত বর এবং আমার শশুড় শাশুড়ীর যোগ্য সন্তান গড়ে তোলার তাড়না।ওয়াসিমের সাথে সর্ম্পকে যাওয়ার চার মাসের মাথায় বেশ বড়লোক কোন বাড়ির বউ করার জন্য সেই বাড়ির কর্তী প্রস্তাব পাঠান আর তিনি ছিলেন আপনার মা।আমার তো সাদা মনে কাঁদা নেই তাই আমি নির্দ্বিধায় গোপনে আমার আর ওয়াসিমের সম্পর্কের কথাটি জানাই।সেদিন তিনি আমায় নোলকের কথা বলেন এবং ওয়াসিমের কুর্তীর কথা জানান।আমার কাছে কোন উপায় ছিল না ঠিক তখনো ওয়াসিমকে ছেড়ে আসার।তাই আপনার মা আমায় সব কলাকৌশল শিখিয়ে দেন।তিনি নিজেই ওয়াসিমের বাবা মায়ের কাছে জানিয়ে দেন ওয়াসিম গ্রামের কোন মেয়ের সাথে প্রেম করছে আর সেটা নিয়ে পড়ে যায় হইচই।অপর দিকে আপনি আমায় মারা জন্য যখন অনুসন্ধানে ব্যস্ত তখন নিজেই অদ্ভুত ভাবে নিজেই বিয়ে করলেন।আর বিয়ের পর স্টেপ বাই স্টেপ আপনাকে আমি বাড়ি ফিরিয়েছি, বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিতে বলেছি,রাজনৈতিক ছাড়াতে বাধ্য করেছি।সব কিছু সবার জন্য ভালো হলেও একমাত্র আমার কলিজার টুকরা মিহির জন্য শেষটা ভালো হয়নি।আর সেই আফসোস আমার কোন দিন শেষ হবে না।আমি আপনার এই আগন্তুক মেয়েটি অন্যর পরিবারে বোঝা হলেও আপনাদের পরিবারে রাজরানী।

    ইতিকার ভাবনায় ফোড়ন কাটে ইনানের কথায়।এতক্ষন অতীতে বিভোর ছিল মেয়েটি।

    – ইতিবউ কোথায় হারিয়ে গেলেন?

    – না না কিছু না।চলুন নিচে যাই।

    .

    ভোরের আলো ফুটতে দেরি নেই আর।ফজরের নামাজ শেষ করে বারান্দায় দাঁড়ালো ইতিকা।ইনান এখনো ঘুমে বিভোর।বারান্দার দোলনায় চোখ বুলাতেই ইতিকার চোখে পড়ে ইনানের নোট খাতা।এই খাতায় প্রায় সময় ইনান তার কাজের হিসাব নিকাশ করে কিন্তু এত দরকারি খাতাটা দোলনায় দেখে বিরক্ত হয় সে।খাতাটি তুলতেই তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি চিরকুট।বেশ কৌতূহল নিয়ে চিরকুটটি পড়তে থাকে সে,

    ‘হঠাৎ সাদা আকাশে কালো মেঘের আলাপন,
    গুমোট পরিবেশ রয়ে যায় দীর্ঘক্ষণ!
    বৃষ্টি নামবে বলেও নামে নি,
    উষ্ণতাহীন পরিবেশ আসবে বলেও আসেনি!তারপর খেলে যায় এক আচমকা ঝড়, নেমে এলো প্রলয়!
    অকস্মাৎ আগন্তুক বৃষ্টির দেখা মিললো।শীতল হলো পরিবেশ, নেমে এলো নির্মলতা।আর সেই নির্মলতাকে আকঁড়ে ধরতেই আসক্তি তৈরি হলো।
    আগন্তুকের আসক্তি আমায় মুষড়ে দিলো সব দিক থেকে।আজ আমি যেন শেকলহীন এক অদৃশ্য জালে বন্দি।আগন্তুকের আসক্তিতে ভুগছি আমি।

    ইতিকা মৃদ্যু হেসে চিরকুটটা রেখে দেয়।চোখের কোনে তার জল এমন অটুট থাকুক তার ভালোবাসার সংসার।

    _

    বেশ কয়েকদিন পর।অফিসের কাজে ব্যস্ত ইনান।বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়ে রাত দিন কাজ করে চলছে সে।তার জানা মতে ইতিকা বেশ কয়েকমাস পর অফিসের কাজে জয়েন হবে।তাই এই মূহুর্তে প্যারা নেই ভেবেই নিজের কাজ সামলাচ্ছে সে।কেবিনে ডেস্কটপ বসে ফাইল চেক করতে ব্যস্ত সে।সেই মূহুর্তে কেবিনে প্রবেশ করে তার মেনেজার।

    – স্যার আজ আপনার নতুন পি.এ জয়েন করার কথা তিনি এসেছেন।

    – হুম শুনলাম বাবা নাকি তাকে ঠিক করেছে!ডাকুন তাকে।

    – ওকে স্যার।

    ইনান ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।পানির গ্লাসটা হাতে তুলে এক ঢোক গিলতেই কেবিনে প্রবেশ করলো নতুন পি.এ এবং মেনেজার।

    – স্যার আপনার নতুন পি.এ ইতিকা মেম।

    নামটা শুনতেই ইনানের মুখের পানি নাকে উঠে যায়।চোখ উলটে তাকাতেই চোখে পড়ে ফর্মাল ড্রেসের একটি মেয়েকে।যাকে দেখতে মোটেও গৃহিণী মনে হচ্ছে না।এই অফিসিয়াল ড্রেসটা যেন তার জন্যই তৈরি।

    – তুমি আমার পিএ?বাবা….

    ইনান কথা শেষ করার আগেই মেনেজার রুম থেকে চলে যান।তার ঠোঁটের কোনে হাসি লেগে আছে।বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইনান।ইতিকা এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে ইনানের কাছে।

    – তো স্যার বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?

    – বাহ ঘরে আপনি বাইরেও আপনি। আমার জীবনটাই এখন ইতিবউ ময়।

    – অফিসে ইতিবউ ডাকবেন না প্লিজ!

    – কেন?

    – আমার আদর আদর লাগে!

    ইতিকার লজ্জায় লাল হওয়া মুখ ইনান তাকিয়ে আছে আহাম্মক বনে।

    ~ সমাপ্ত 🌺

    ®পলি আনান

    ❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।