বেড়াজাল

বেড়াজাল 

শারমিন  আঁচল নিপা

 

 

১ম পর্ব

 

আমি অবিবাহিত কিন্তু প্র্যাগন্যান্ট। এখন হাসপাতালে ভর্তি। শরীরে ক্ষতের দাগে নীল নীল ছোপ হয়ে আছে। কচুরিপানায় যেমন সাদার বিস্তার জুড়ে নীল ছোপ হয় ঠিক তেমনটা আমার শরীরে হয়ে আছে। মাঝে মাঝে নীল ছোপ গাঢ় হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করছে। ব্যথায় নড়তে পারছি না। জীবনের চরম শিখরে এসে এখন থুবরে পড়েছি। 

ঘটনার শুরু মেট্রোমনি গ্রূপ থেকে। আমার আর শুভর  পরিচয় হয়েছিল সেখান থেকেই। শুভই সেই ভয়ানক টর্নেডো যে আমার জীবনে এসে সব তছনছ করে দিয়ে যায়। আর সে পরিচয়েই রূপ নেয় একটা সাইকো থ্রিলার গল্পের। যে গল্পের নায়ক আর ভিলেন একজনেই। কখনও সে নায়কের ভূমিকায় বিরাজ করে কখনও ভিলেন।

জীবনের  বেড়াজাল পার হয়ে হুট করেই পিছুটান মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস নিয়ে মেট্রোমনি গ্রূপে আমার জন্য পাত্র চেয়ে পোস্ট দিয়েছিলাম। আর সে পোস্ট দেখেই সে আমাকে নক করেছিল তার বায়োডাটা সমেত। 

আমি অপ্সরা।  বয়স চব্বিশের কোঠা পার হয়ে পঁচিশে পড়লো। বিয়ের অনেক চেষ্টা বাসা থেকে করেছিল। তবে পুরনো সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে বের হতে না পারায় বিয়ের সিদ্ধান্ত  আর নিতে পারিনি। সাত বছরের সম্পর্ক ছেদের পর দুই বছর কেবল নিজেকে সময় দিয়েছি। এখন আর সে সম্পর্কের কথা মনে হলে খারাপ লাগে না। বরং সৃষ্টিকর্তার নিকট কৃতজ্ঞতা  প্রকাশ করি এটার জন্য যে আমি সে কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে বের হতে পেরেছি। সবমিলিয়ে একটা সুন্দর সংসার বুননের স্বপ্ন দেখতে পারছি। 

এবার ঘটনায় আসা যাক। বিবাহের পোস্ট করার পর অনেক বায়োডাটা এসেছে। সব বায়োডাটা এবং  ছবি চেক করছিলাম। কয়েকজনের বায়োডাটা ভালোই পছন্দ হয়েছে। কথাও হয়েছে। তবে কারও সাথেই মনের মিলটা পাচ্ছিলাম না। এমন সময় মেসেজের রিকুইস্টগুলো চেক করে একটা আইডির দিকে চোখ পড়ল। আইডির নাম নাফিউর রহমান। তিনি একজনের ছবি এবং বায়োডাটা পাঠিয়েছেন। ছবিটা ছিল শুভর। পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি লম্বা। গাল ভর্তি দাঁড়ির সমাবেশ। চুলগুলো বড়ো এবং পনি করা। একটা হাতে ট্যাটু করা। সিক্সপ্যাক আছে কি’না৷ বুঝা যাচ্ছে না। তবে বলিষ্ঠ গড়ন। তাকে দেখেই বসন্তের শীতল হাওয়া যেন আমার শরীরে লাগল। 

বায়োডাটা পড়তে লাগলাম। শুভ আমার থেকে ৬ বছরের বড়ো। পেশায় বিজন্যাসম্যান। একজন সি আইপি। বাবা মারা গেছেন এক বছর আগে।  বাবা মারা যাওয়ার পর সকল দায়িত্ব  তার উপরেই পড়েছে। উনারা দুই ভাই বোন। আর মা গৃহিণী। সবকিছুই ঠিক। তবে পারিবারিক মিলব্যবস্থা  নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ভুগছি। আমাদের পরিবার মধ্যবিত্ত।  তাদের সাথে আমাদের পারিবারিক ম্যাচ হতে না পারে। তাই মেসেজে রিকুইস্ট একসেপ্ট করে মেসেজের রিপ্লাই দিয়ে বললাম

“আমাদের পরিবারের সাথে পাত্রের পরিবারের কোনোরকম মিল হবে বলে মনে হয় না।”

পাল্টা উত্তর আসলো 

“আমরা একটা ভালো মেয়ে চাই। সে সুন্দর করে সংসার করবে আর পাত্রের সাথে ভালো থাকবে। পরিবার এখানে কোনো ইস্যু না।”

আমি পাল্টা মেসেজে উনাদের নম্বর চাইলাম। উনি পাত্রের নম্বর দিয়ে বললেন উনি পাত্রের কোম্পানিতে চাকুরি করে আমি যেন নক দিয়ে উনার কথা বলি। আমি হুম লিখে মেসজের সমাপ্তি ঘটালাম।  

এরপর নম্বরটা নিয়ে ওয়াটসএপে নক করলাম। উনি কিছুক্ষণ  পর রিপ্লাই করলেন। আমাদের কথার শুরু সেখান থেকেই। টুকটাক কথা। তারপর হালকা ভালো লাগা সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত  অনুভূতি। সংসার বুননের নতুন স্বপ্ন। নতুন আকাশে ডানা মেলে উড়ার রঙিন মেলা। 

মাসখানেক কথা হলো আমাদের। উনার ভালো লাগার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত কেয়ার নেওয়ার বিষয়টা। উনি ছিলেন কেয়ারিং।  সময় ও দিত অনেক। স্বভাবত মেয়েরা কেয়ার আর সময় পেলে একদম গলে যায়।

 মেয়েদের গলানোর একমাত্র অস্ত্র  কেয়ার। এটা সব ছেলেরা জানে না। আবার কেউ জানলেও বুঝতে চায় না। তবে শুভ সেটা ভালো করে জানেও আবার বুঝেও। আবার প্রায়োগিক দিক থেকেও সে পটু। সব মিলিয়ে তার কথায় গলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আমার জন্য। 

এক মাস কথা বলার পর কালকে আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার পালা। খুব বেশি পরিকল্পনা নেই।  উনি এসে নিয়ে যাবেন। তারপর কোনো কফিশপে বসব এবং দুজন মিলে গল্প করব। মাঝে মাঝে লাজুক চোখে তাকাব আবার মাথা নুইয়ে ফেলব। ভাবলেই যেন সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠে। কোথাও থেকে যেন বসন্তের কোকিল ডেকে উঠে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে লা’লা’লা’ বাজতে থাকে। 

সকাল সকাল উঠে পড়লাম। এর মধ্যেই উনার কল। আমি ধরতেই বলে উঠলেন

“অপ্সরা বের হও দ্রূত। আমি বাসার নীচে দাঁড়িয়ে আছি।”

আমি কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললাম

“এখন তো বাজে সবে সকাল ছয়টা। এখন বের হব মানে?”

“আরে এত কথা বলো না তো। আমার মিটিং আছে ঐ সময়ে। তাই তোমার সাথে এখনেই দেখা করব। “

আমি আমতা আমতা করে বলতে লাগলাম

“নাহ মানে। এত সকালে তো বের হওয়া কষ্ট।”

“দেখো অপ্সরা কোনো কথা শুনতে চাই না দ্রূত বের হও আমি বাসার নীচে দাঁড়িয়ে  আছি।”

আমি তবুও সে সময়টায় বের হওয়ার সাহস করতে পারলাম না। তাই উনাকে স্পষ্ট করে বলে দিলাম

“আমি পারব না এ মুহুর্তে  বের হতে। আর আপনাকে তো আমি ভালো করে চিনি না। কেন বের হব এত সকালে?”

সে প্রতি উত্তরে তেমন কিছু বলল না। তবে রাগ হয়েছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু এতে আমার করার কিছু ছিল না। আমি ফোনটা কেটে চুপচাপ বসে রইলাম। এর মধ্যেই উনি মেসেজ দিলেন আজকে আর দেখা হবে না। উনি ব্যবস্যার কাজে ময়মনসিংহ  যাবেন। আমিও হুম বলে মেসেজের সমাপ্তি দিলাম। 

এরপর নিজেকে সামলে কিছুক্ষণ  ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো তৈরি হয়ে ভার্সিটি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। তন্মধ্যে  বড়ো মামা কল দিলেন রক্তের জন্য। 

বড়ো মামীর বাচ্চা প্রসব হয়েছে। তাই এ মুহুর্তে  রক্ত লাগবে। আর ও নেগেটিভ রক্ত পাওয়া ভীষণ কঠিন। এদিকে আমার রক্তের গ্রূপ ও নেগেটিভ। তাই আমাকে দ্রূত সেখানে যেতে হবে। আমি আর কিছু ভাবলাম না। সেখানে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে উবারের জন্য অপেক্ষা  করছিলাম। 

এমন সময় মনে হলো কেউ আমার চোখ মুখ চেপে ধরেছে৷ কোনো কিছুই আমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। হাত গুলো কেউ যেন পেছন দিকে গুটিয়ে নিল আর বেঁধে নিল। হাতের ব্যাগটা নিয়ে নিল। আমার শ্বাসনালীর ক্রিয়া যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম।  সে সাথে হার্টবিট ক্রমান্বয়ে হারে বাড়ছে। 

আমাকে ধরে গাড়িতে তুলা হয়েছে বুঝতে পারছিলাম। আমার মোবাইলটা ইতোমধ্যে  বেজে উঠেছে। কেউ একজন মোবাইলটা ধরে  উত্তর দিল রক্ত সময় মতো পৌঁছে যাবে। আমার বুকটা কাঁপতে লাগল। কণ্ঠটা বেশ চেনা চেনা লাগছে। এর আগে কথা বলেছি কি’না মনে পড়ছে না। তবে এটা শুভর কণ্ঠ না এটাও বুঝতে পারছিলাম।  তবে কণ্ঠটা এর আগে শুনেছি। কে হতে পারে মাথায় আসছে না। আর এরকম পরিস্থিতিতে সব গুলিয়ে ফেলাটায় স্বাভাবিক।

 আমি কিডন্যাপ হয়েছি সেটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছি। তবে একজন কিডন্যাপার কেন আমার ফোন ধরে রক্তের ব্যবস্থা করবে সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। তার তো ফোন বন্ধ করে ফেলে দেওয়ার কথা। তা না হলে লোকেশন ট্র্যাক করলে ধরা পড়ে যাবে। কিসব ভাবছি আমি নিজেও বুঝছি না। কিডন্যাপারের বুদ্ধির বিবেচনা করে যাচ্ছি কেন! সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না। 

আমার চোখ মুখ হাত সব বাঁধা তাই কোনো কিছুই করতে বা বলতে পারছি না। তবে শ্বাসকষ্টটা যেন ঝেঁকে ধরেছে। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। সব কথোপকথন আবছা আবছা কানে লাগছে। জানি না কখন জ্ঞান  হারালাম। 

একটা খিলখিল হাসির শব্দ কানে আসলো। লক্ষ্য করলাম আমার হাত,  পা,  মুখ খোলা। আমি ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে তাকালাম। শুভ সামনে দাঁড়ানো। আমার কলিজাটা নড়ে উঠল। তারপর সে যা বলল তা শুনে আমার হার্টবিট দ্রূত গতিতে বাড়তে লাগল। একটা আলোর ঝলকানি আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। সাথে সাথে পুনরায় জ্ঞান  হারালাম। 

জ্ঞান  ফেরার লক্ষ্য করলাম আমি একটা বিছানায় শুয়া। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে পাশে তাকালাম। শুভ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।  তার হাতে ধারালো ছুরি। আমি ঢুক গিলতে গিলতেই তাকে কিছু জিজ্ঞেস  করতে যাব এর মধ্যেই সে আমার তেড়ে এসে আঘাত করল। আর সে সাথে এক নতুন ঘটনার সূচণা হলো।

 

 

 

 

২য় পর্ব

 

ছুরিটা আঘাত হানল আমার পাশেই রাখা একটা বালিশে। বালিশের তুলোগুলো বাতাসে এলোপাতাড়ি  উড়তে লাগল।  সাথে সাথে পুরো ঘরটা আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। সে সাথে গোলাপের পাপড়ি চোখে মুখে এসে ঝাঁপটা দিল। রঙিন বৃষ্টি যেন পুরো রুমটায় হালকা কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ল। দেয়ালের এক পাশে পর্দা টানা হলো। একটা কবুতর তার ঠোঁট দিয়ে দেয়ালে আলতো স্পর্শ করল। আর সাথে সাথে সেটা ধারণ করলো একটা তৈলচিত্রে। সেটা আর কারও না আমারেই। আমি শুভর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। আমাকে বসা থেকে তুলে জড়িয়ে নিল। আমি কেবল স্তব্ধতা অনুভব করছি। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আবারও গরম হতে লাগল। মনে হচ্ছে শিরায় শিরায় আবারও রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। 

মিনিট তিনেক পর শুভ জড়িয়ে ধরা থেকে ছেড়ে আমার দিকে তাকাল। আমি কেবল আশ্চর্য  হচ্ছিলাম। কী হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। সে আমার হাতে একটা রিং পরিয়ে দিয়ে মিষ্টি গলায় বলল

“আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তোমার মামীর রক্ত নিয়ে চিন্তা করো না। সময় মতো রক্ত পোঁছে গেছে। আর উনি সুস্থ আছেন। তোমাকে প্রপোজ করব বলেই এমন সারপ্রাইজের পরিকল্পনা করেছি। অপ্সরা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”

আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না। এমন প্রপোজ, এমন সারপ্রাইজ  এর আগে কেউ পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বিস্ময়ের রেশ যেন কাটছেই না। আমি ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়েই আছি। সে আমার বাহু ডোর দুটো হালকা ঝাঁকিয়ে বলল

“এনিথিং রং?  কথা বলছো না যে?”

আমি নিজেকে একটু স্থিত করে নীরব রইলাম। ভাবতে লাগলাম তাকে কী জবাব দিব!  ভালোবাসি বলব নাকি সময় নিব। কিন্তু শুভর প্রতি না চাইতেও আমি দুর্বল হয়ে গিয়েছি। তাই নীরব গলায় উত্তর দিলাম

“আমিও আপনাকে ভালোবাসি।”

এর মধ্যেই হালকা চিৎকারের শব্দ। চারদিকে তাকিয়ে নিজেই যেন চমকে গেলাম। আর কেউ না আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ডরা আমাকে কংগ্রাচুলেশনস  জানাচ্ছে। আমি আবারও শুভর দিকে তাকালাম। শুভ ভরসা চোখে আমাকে ইশারা করে বলল

“সকালে এরকম কাহিনি না করলে এ সারপ্রাইজ  টা প্রপার ওয়েতে পেতে। তবে একটু ত্যাড়ামি করেছো, তাই সারপ্রাইজের ধরণ পরিবর্তন  করেছি। কেমন লাগছে?”

একটু আগে পর্যন্ত  একটা দ্বিধায় ছিলাম। এখন সব দ্বিধা  কেটে গেল। ভরসার ছোয়া যেন চারপাশ আমাকে ঘিরে ধরল। আমি শুভর দিকে তাকালাম। শুভ ভরসাময় একটা ইশারা দিল। আমি তার ইশারায় পাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম একটা টেবিল সাজানো। তাতে ফুল, আর কেক রাখা। আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। শুভকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। প্রথম ভালোবাসা ভুলার পর আমার জীবনে কোনো ছেলেকে আসতে দেই নি। দ্বিতীয়বারের মতো কেউ আমাকে এত ভালোবাসবে সেটা বুঝতে পারিনি। আমার কান্নাটা ছিল আনন্দের।

আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শুভ আমার চোখের জলটা তার হাতের তালু দিয়ে মুছতে মুছতে বলল

“পাগল মেয়ের মতো কাঁদছো কেন? আর চোখে কাজল পরার দরকার নেই। তুমি না সাজলেই তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগে।”

আমি হালকা হেসে উত্তর দিলাম

“সাজলে বুঝি সুন্দর লাগে না?”

সে প্রতিউত্তরে বলল

“এতই লাগে যে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে  যায়।”

আমি কেবল হেসেই গেলাম। এবার পুরো রুমটায় ভালো করে তাকালাম। একপাশে টেবিল রাখা। সেখানে কেক আর বিভিন্ন ধরণের ফুল রাখা। আমার বরাবরেই সূর্যমুখী ফুল প্রিয়। তাই তিনি পুরো টেবিলটার চারপাশ সূর্যমুখী ফুল দিয়ে সাজিয়েছেন। টেবিলের পাশের দেয়ালটায় তৈলচিত্র করা আমার ছবি। যেটা কবুতরের জাদুর ঠোঁটের ছোয়ায় সাদা দেয়াল রঙিন হয়ে ফুটে উঠেছিল। এর একটু সামনে কিছু লাইটিং করা। পুরো ঘরটা লাভ আকৃতির বেলুন দিয়ে সাজানো। মাঝে মাঝে বেলি ফুলের সুঘ্রাণ নাকে ভেসে উঠছে।  লাইটিং  এর পাশেই মোম রাখা। যেগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

সারপ্রাইজের শেষ এখানেই না। আমি টেবিলে গেলাম কেক কাটতে। তার মধ্যেই একটা তোতা পাখি এসে বলে উঠল কংগ্রাচুলেশনস।  আমি চমকে উঠলাম। এরকম সারপ্রাইজ  আমার জীবনে প্রথম পেলাম। আমি শুধু দীর্ঘ  নিঃশ্বাস নিলাম। তারপর কেক কাটা শেষ করে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম। 

বেলা বেজে গেছে বিকেল পাঁচটা। বাসায় আসার পালা এবার। সকল বন্ধবী আর শুভ মিলে এক গাড়ি করে বাসায় আসলাম। সাথে দুজন কিডন্যাপারও এসেছে। কিডন্যাপার আর কেউ না শুভরেই দুই ছোটো ভাই হাসান এবং রুমেন। 

ভীত ভয় থেকে এক সুন্দর শীতলতা। সত্যিই দিনটা সেদিন সুন্দর গিয়েছিল। তবে সে সুন্দর দিনটায় দিনকে দিনকে বরবাদ হতে লাগল। জীবনের সুখময় অধ্যায়েই কালো রুপ নিয়েছিল। 

সেদিন বাসায় ফেরার পর  শুভর সাথে অনেক কথা হলো। বান্ধবীরাও শুভর বিষয়ে বেশ ইতিবাচক কথা বলতে লাগল। কথায় কথায় শুভর প্রতি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে লাগলাম। আমার কল্পনার বিস্তার জুড়ে কেবল শুভর বসবাস। তাকে নিয়ে এলোমেলো স্বপ্নগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। দিনকে দিন তার যত্ন গুলো আমাকে আরও দুর্বল করে দিল। সে আমার প্রতিটা বিষয় খেয়াল করে। মাঝে মাঝে বাসার নীচে এসে আমাকে দেখে যায়। শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে সময় দেয়। আমাকে নিয়ে চিন্তা করে। আমার ভালোলাগা খারাপ লাগা গুলো সে সবসময় তুলে রাখে। বিশেষ করে আমার কষ্টগুলো সে অনেকটায় লাঘব করে দেয়। সাত বছরের যে গ্লানি আমি বহন করছিলাম সেটা ক্রমশই নিরবিচ্ছিন্ন  হয়ে গেল।

টাইম মেশিনে সময় পার হতে লাগল। আস্তে আস্তে সম্পর্কের দৃঢ়তা বাড়তে লাগল। আজকাল শুভকে ভীষণ উন্মাদ মনে হয়। রাত দুটো, তিনটেয় বাসার নীচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে এক পলক আমাকে দেখবে বলে। আমি থাকি একটা আবাসিক এরিয়াতে। ১৬ তলা এপার্টমেন্টের ১৩ তলায়। সেখান থেকে এত রাত বিরাতে নামা আমার জন্য বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে। তবে নাছোরবান্দা তার জন্য বেশ কয়েকবার লুকিয়েও নেমেছি। যদিও এখন পর্যন্ত  বাসায় ধরা পড়িনি। তবে এভাবে নামতে গিয়ে হার্টবিট ভীষণরকম বাড়তে থাকে।

 প্রথম প্রেম সাত বছরের হলেও আমাদের হাতে গুণা বাইরে দেখা হয়েছিল চার থেকে পাঁচবার। বলতে গেলে সে দেখাগুলোও ছিল প্রয়োজনে। কোনো কাজে বের হলে দেখা হয়েছে। তাছাড়া সে আমাদের জানাশোনা এবং আত্মীয় ছিল তাই বেশিরভাগ সময় তাদের বাসায় নয়তো আমাদের বাসায় দেখা হত। তবে সেটা সবার সামনে চোখাচোখি  পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকত।  

এভাবে লুকিয়ে দেখা, লুকিয়ে প্রেম করা, সবাইকে ফাঁকি দেয়া সেটা শুভর সাথে জড়িয়ে হচ্ছে। আমার পরিবার আমাকে রেখেছিল খুব রেস্ট্রিকটেড  করে। যার দরুণ এমন দুঃসাহসিকতা  এর আগে কখনও করতে পারিনি। তবে শুভর পাল্লায় পড়ে এমন দুঃসাহসিকতাও বেশ সহজ মনে হয়। কারণ শুভ আমার জীবনে সে ভরসার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে আমি একদিকে রেখে পৃথিবীকে অন্যদিকে রাখতে পারব।  শুভ আমার ভেতরে এতটায় জায়গা দখল করে রেখেছে।  আর এভাবেই কাটতে লাগল আমাদের মিষ্টযুগল প্রেম। 

সেদিন রাতে শুভর সাথে কথা বলছিলাম। কথা বলার এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ  পর মোবাইলটা কয়েকবার বাজতে লাগল। ঘুমের মধ্যেই কলটা ধরলাম। সাথে সাথে শুভ বলল বাসার নীচে নামতে। আমি কিছুটা ঘুম ঘুম গলায় হুম বলে ঘুম চোখেই উঠে বাসার নীচে নামলাম। নীচে নেমে যেন আমার শরীর কাঁপতে লাগল। এ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিব বুঝতে পারছিলাম না। 

 

 

৩য় পর্ব

 

 

শুভ দাঁড়িয়ে আছে  হাতে বড়ো বক্স নিয়ে। আমি তার কাছে যেতেই সে আমার দিকে বক্সটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

“বাসায় গিয়ে খুলো।”

আমি ফিসফিস করে বলতে লাগলাম

“এত রাতে এগুলো বাসায় কীভাবে নিব?”

শুভ তড়িৎ  গতিতে বলে উঠল

“আমার জন্য এতটুকু করতে পারবে না। এই তোমার ভালোবাসা?”

আমি আমতা আমতা করতে করতেই সে আবারও বলে উঠল

“অপ্সরা তোমার এ ত্যাড়ামিগুলো আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। তুমি যদি আমার সব কথা শুনতে তাহলে আজকে এত কষ্ট হত না। আমি যা বলব তুমি তা শুনবে তাহলে দুনিয়ায় যা চাও যেভাবে হোক তোমার সামনে হাজির করব।”

“আপনি শুধু শুধু রিয়েক্ট করছেন। এত রাতে এত বড়ো বক্স নিয়ে বাসায় ঢুকা কঠিন। এটা নীচে রেখে যাব নাকি বাসায় নিয়ে যাব বুঝতে পারছি না। আর এখনও আপনার কথা বাসার কেউ জানে না। এটা বুঝেন না আমি আপনার বিয়ে করা বউ না। আপনি মাঝে মাঝে খুব একরোখা হয়ে যান। পরিস্থিতি বুঝতে চান না।”

আমার কথা শুনে শুভর চোখগুলো লাল হয়ে গেল। আমার দিকে রক্তচক্ষু  নিয়ে তাকিয়ে বেশ রাগ গলায় বলে উঠল

“তোরে বলছি বক্স নিয়ে বাসায় যেতে। এরপর তো আর কোনো কথা থাকতে পারে না। তারপরও বেয়াদবের মতো চিল্লাচ্ছিস। সমস্যা কী তোর? আমারে তো তুই ভালোবাসছ। আর ভালোবাসার মানুষের এতটুকু কথা মানতে পারতেছিস না। তুই আমারে ভালোইবাসছ না। যা ইচ্ছা কর। বক্স মন চায় ফেলে দে মন চায় নিয়ে যা। আমি গেলাম।”

শুভর কথা শুনে আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দৃষ্টির বেষ্টনি পার হয়ে সে আমার সামনেই গাড়িতে উঠে চলে গেল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে শুভর এমন ব্যবহারে। যদিও কথাগুলো সে রাগে বলেছে তবে কথাগুলো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না। কেন পারছি না সে কারণও আমার কাছে অজানা। 

আমি চুপচাপ কতক্ষণ  দম নিলাম। তারপর আপুকে কল দিলাম। আপু শুভর ব্যপারে সব জানে। আপুর বাসাও আমার বাসার সাথে। আমি আপুকে কল দিতেই আপু ঘুম চোখে ধরল। আপুকে গড় গড় এক নাগাড়ে সব বলার পর আপু বলল আপুর বাসায় যেতে। আমি বক্সটা কোনোরকম দাড়োয়ানের সাহায্যে লিফটে তুললাম। তারপর সরাসরি আপুর বাসার দিকে  গেলাম। আপুর বাসায় থাকলে আমার কোনো সমস্যা হবে না। মা আমাকে আমার রুমে এত রাতে না দেখলে আপুর বাসায়েই চেক দিবে। আর আপুর বাসায় দেখলে আমার কোনো বিচারও হবে না।

লিফট থেকে নেমে খেয়াল করলাম আপুর বাসার দরজাটা খোলা। যাইহোক দ্রূত আপুর বাসায় গেলাম। আপুর বাসায় ঢুকতেই আপু বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল বক্সের দিকে। আর বলতে লাগল

“এত রাতে শুভ তোর জন্য কী নিয়ে এসেছে? ছেলেটাকে হয়তো বলছিস কিছু আনতে। আর বলতে বলতে ঘুমিয়ে গেছিস।  আর জানিস ছেলেটা তোর প্রতি দুর্বল বেশি। মুখ দিয়ে যা বের করিস নিয়ে আসে। তুইও কম যাস না।”

আপুর কথা শুনে মনে হচ্ছে মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। আমি কিছুটা রেগে উত্তর দিলাম

“আপু থামো তো। আমি এমন কিছুই করিনি। উনি কেমন যেন পাগলের মতো। কখন কী করে নিজেও বুঝে না। এই আমাকে বকে আবার ভালো কথা বলে। এই রেগে যায় আবার নিজে নিজে ঠান্ডা হয়ে যায়। মনে হয় ঝড়ের পূর্বাভাসের গর্জন দিয়ে পরিবেশ শীতল হয়ে গেছে। আমি না আপু উনাকে বুঝতেই পারি না। কেমন যেন অদ্ভুত  লাগে।”

আমার কথা শুনে আপু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল

“অপ্সরা থাম। আগে দেখ বক্সে কী।”

আমি আপুর কথায়  বক্সে কী দেখার জন্য বক্সটা খুললাম। বক্সটা খোলার  সাথে সাথে বিস্মিত হয়ে গেলাম। শিরদাঁড়ায় শীতল কিছু যেন গমন করছে। হাত, পা না চাইতেও থরথর করে কাঁপছে।  পুরো বক্সে আইসক্রিম। আমি এতটাই সারপ্রাইজড হয়েছি যে বর্ণনা করার মতো কোনো শব্দ বা অক্ষর খুঁজে পাচ্ছি না। চুপ হয়ে রইলাম।  আমি শুধু কথায় কথায়  বলেছিলাম আমার খুব আইসক্রিম খেতে মন চাচ্ছে। এ কথাটা বলেও অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই। তারপর বেশ স্বাভাবিকভাবেই ঘুমিয়ে পড়ি। শুভ যে মাথায় সে কথাটা গেঁথে নিবে বুঝতে পারিনি। মানুষটাকে সত্যিই আমি চিনি না। সত্যিই এটা তার ভালোবাসা নাকি নিছক পাগলামি সেটাও অনুধাবন করতে পারি না। কেমন যেন বিষন্ন চিন্তায় ডুবে গেলাম। আপুর কণ্ঠস্বরে আমার ধ্যান ফিরল। 

“এত আইসক্রিম কেন দিয়েছে আবার এ ঠান্ডার মধ্যে। গুণে দেখ তো কয়টা। ছেলেটা সত্যিই পাগল। আমার কাছেও মাঝে মাঝে অদ্ভুত  লাগে।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। খুশি মনে আইসক্রিম গণনাতে লেগে পড়লাম। গুণতে গুণতে লক্ষ্য করলাম শুভ মোট একশত এগারো টা  আইসক্রিম পাঠিয়েছে। আমার বুক কাঁপতে লাগল। আইসক্রিম গুলো গুনছিলাম আর মনে হচ্ছিল আইসক্রিম গণনার সাথে সাথে আমার হার্টের রিদম বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাক সাইডে জোরালে সুর ছাড়া বেহালা বাজছে। আপু আমার অবস্থা দেখে আমার মাথায় একটা ধাক্কা দিয়ে বলল

“অপ্সরা পাগল হয়ে পড়বি নাকি। এতক্ষণ  শুভকে নিয়ে অনেক কটু কথা বলেছিস। এখন এমন করছিস কেন? শুধু শুধু ছেলেটাকে এত রাতে রাগালি। যা সরি বলে দে। ছেলেটা এত রাতে এসেছে তোর ইচ্ছায় পূরণের জন্য। প্রেমিক পুরুষের এ পাগলামি খারাপ না। এ বয়সে এমন উন্মাদ প্রেমিকা পাগল পুরুষ দেখলে ভালোই লাগে”

আপুর কথা শুনে কেবল মুচকি হাসলাম। নিজেকে স্থির করে নিলাম। মোবাইলটা দ্রূত খুঁজতে লাগলাম। তাড়াহুড়োই মোবাইলটা কোথায় রেখেছি সেটাও বুঝতে পারছি না। পাগলের মতো মোবাইলটা খুঁজতে লাগলাম। আপু আবারও আমার মাথায় তার হাতের তিন আঙ্গুল দিয়ে হালকা ধাক্কা দিল। তারপর ইশারা করে আমার পাশে দেখাল। আর বলে উঠল

“তুই শুভকে পাগল বলিস। তুই নিজেই তো এক বদ্ধ পাগল। পাশেই ফোন রেখে পুরো ঘর খুঁজছিস।”

আমি পাশে মোবাইলটা দেখে বোকা বনে গেলাম। মনে মনে বলতে লাগলাম। 

সত্যিই আমি পাগল। ভালোবাসার পাগল। ভালোবাসা পাবার পাগল। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার পাগল। ভালোবাসা আগলে রাখার পাগল। আমি উদ্মাদ  উনার জন্য। আমার উন্মাদনা কেবল উনাকে ঘিরে। আমার কল্পনার দীর্ঘ  বেষ্টনীতে কেবল উনি। কারণ আমি উনাকে ভালোবাসি পাগলের মতো ভালোবাসি। উন্মাদের মতো, নেশার মতো অনুভব করি।

এসব বলতে বলতেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিন অন করে কেঁপে উঠলাম। সাথে সাথে মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল। আপু এ অবস্থা দেখে বেশ বিরক্ত গলায় বলে উঠল

“এমন করছিস কেন?”

আমি আর কিছু বলতে পারছিলাম না। কী বলব সে উত্তরও গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না। নিজেকে বেশ এলোমেলো বেসামাল লাগছে। দম ধরে রইলাম কেবল। কারণ

 

 

 

 

৪র্থ পর্ব

 

কারণ শুভ মেসেজ দিল। 

“আমার মনে হলো তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। মনে হয় আমি তোমাকে হয়তো সবসময় বিরক্ত করি। তাই তোমার জীবন থেকে সরে গেলাম। ভালো থেকো। কোনোদিন ও তোমাকে জ্বালাব না। এখন থেকে তোমার পরিস্থিতি  যে বুঝতে পারবে তার সাথেই থেকো। অপ্সরা তুমি আমার পাগলামি দেখেছো ভালোবাসাটা দেখোনি। আমার ভেতরে তোমার জন্য জেগে উঠা তুফানটা দেখো নি। তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিলাম। ভালো থেকো। আমাদের সম্পর্কের ইতি এখানেই।”

মেসেজটা পড়ে আমার অশ্রু  জল চোখের গন্ডি পার হয়ে গালে পদার্পণ  করেছে। আপু আমার অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে বলল

“কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে বলবি তো?”

আমি কাঁদতে কাঁদতেই উত্তর দিলাম

“শুভ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আপাই। উনি বুঝলো না আমার ভালোবাসাটা। উনি কেবল আমার রাগ আর অভিমানটায় দেখলো। কিন্তু বুকে জমে থাকা ভালোবাসাটা আর দেখেনি। আমি এখন টের পাচ্ছি আমি উনাকে কতটা ভালবোসে ফেলেছি। দম বন্ধ বন্ধ লাগছে আপাই।”

আমার কথা শুনে আপু মুচকি হাসতে লাগল।।আপুর হাসি দেখে আমার রাগটা প্রশমিত হলো। আমি রাগ গলায় বলে উঠলাম

“তুমি হাসছো কেন?”

বলা শেষ করতেই ফোনটা বেজে উঠল। লক্ষ্য করলাম শুভর কল। আপু এবার হাসতে হাসতেই জবাব দিল

“এজন্যই হাসছিলাম। এরকম কত ব্রেকআপ আমার আর তোর দুলা ভাইয়ের হয়েছে হিসাব নেই। যা ফোন ধরে কথা বল এবার। কান্নাকাটি থামা। আমি ঘুম দিতে গেলাম।”

কথাগুলো বলে আপু আইসক্রিম গুলো ফ্রিজে রেখে চলে গেল। আমি চোখের জলটা মুছে শুভর কলটা ধরেই আবারও কেঁদে উঠে বললাম

“আপনি কেন আমাকে ভুল বুঝেন বলবেন? আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। আপনার এ মেসেজ পেয়ে আমি কতটা ব্যহত হয়েছি আপনি জানেন না। আমার কষ্ট,অভিমানগুলো কেন বুঝেন না?”

ভেবেছিলাম শুভ আমার কান্নাটা বুঝবে কিন্তু সে তা না করে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল

“ন্যাকামি কান্নার নাটক করবা না। আমি জানি এগুলো সব অভিনয়। এখন কাছে আসলে দেখা যাবে তোমার চোখে কোনো পানি নেই। অপ্সরা আমি সব বুঝি বুঝছো। তুমি যদি আমাকে ভালোইবাসতা তাহলে আমি ব্লক দেওয়ার পর পাগলের মতো যোগাযোগ  করার চেষ্টা করতে। কিন্তু তুমি একদম নির্বাক, নীরব ছিলে। সত্যি বলতে তুমি আমাকে ভালোইবাসো না।”

শুভর কথা শুনে আমি হতবাক। কান্নাটা আরও বেড়ে গেল। গলাটা আরও ভার হয়ে গেল। কোনো কথায় আর বলতে পারছি না। যত কথা বলছি ততই জড়িয়ে যাচ্ছে সব। কোনো কিছুই মাথায় আসছে না। শুধু কান্নার আওয়াজ হেঁচকি তুলে তুলে আসছে। এবার শুভ বেশ চিৎকার করে বলে উঠল

“অপ্সরা থামো প্লিজ। খুব পেইন হয় এমন শব্দ শুনলে। তুমি আমাকে ভালোবাসো বা না বাসো আমি তো বাসি। তাই তোমার অভিনয়ের কান্নাটাও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। বুকটা ভীষণ ভার লাগছে। চাপা গলায় বললাম

“কী করলে আপনি বিশ্বাস করবেন আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

শুভ এক গলায় বলে উঠল

“এ মুহুর্তে  আমার বাসায় আসো।”

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এটা কখনও সম্ভব না। এমন সময় শুভর বাসায় যাওয়া। বিবেক না বললেও আবেগ ভিন্ন কথা বলছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলাম। 

“এত রাতে আমি কীভাবে আসব? আপনি কেন বুঝতেছেন না? আবেগ বলছে যাও তবে বিবেক বাঁধা দিচ্ছে”

“শুন তোরে এত রাতে আমিই আসতে নিষেধ করতাম। তবে তোর মন পরীক্ষা  করলাম। তুই তো পরীক্ষায় ফেইল করলি।  বাদ দে আমি তো তোরে ভালোবাসি তাই তোর এ কষ্টগুলো হাসিমুখেই মেনে নিলাম। আর শুন এই যে তোরে এত ভালোবাসি এটাকে অন্তত সম্মান করিস। অনেক রাত হয়েছে আইসক্রিম খেতে মন চায়ছে আইসক্রিম খেয়ে ঘুমিয়ে পর। সকালে দেখা হবে। আর কান্না থামা।  দয়াকরে আর কান্না করিস না।”

বলেই কলটা কেটে দিল। আমি শুভকে সত্যিই বুঝাতে পারছিলাম  না আমি তার প্রতি কতটা দুর্বল হয়ে গিয়েছি। কোনোভাবেই আমি তাকে বুঝতে পারি না আমার ভেতরে গড়ে উঠা হাহাকার। সত্যিই কী সে আমাকে ভালোবাসে নাকি তার এটা জেদ। আপুর পাশের রুমটায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। 

খাটের পাশেই একটা ডায়রি রাখা লক্ষ্য করলাম। কী জানি কল্পনা করে লিখতে লাগলাম। লেখা শেষে লক্ষ্য করলাম কিছু বাক্য লিখলাম। জানি না কেন কী কারণে এ বাক্যগুলো লিখেছি। তবে মনে হচ্ছে এটাই যেন আমার ভবিষ্যতের কথা বলে দিচ্ছে৷ বাক্যগুলো হলো

আমি আপনাকে ভালোবেসেছি আর আপনি আমাকে আপনার জেদের হাতিয়ার বানিয়েছেন। সে হাতিয়ারে কখনও আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত  করেছেন। কখনও করেছেন রক্তাক্ত। আমি তবুও আপনাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি।  তবে আপনি আমার বাঁচার নিঃশ্বাসটায় বন্ধ করে দিয়েছেন। যখন আমি একটু নিঃশ্বাস নিতে আপনাকে ভালোবাসা বন্ধ করে দিলাম। তখন আপনার জেদের পাহাড় টা আরও তেজী হয়ে উঠল আর আমাকে ছিন্নভিন্ন  করে দিল।

বাক্যগুলো বারবার পড়তে পড়তে বেশ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলাম। 

মোবাইলের রিংটোন  এর আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। ঘুম ঘুম চোখে লক্ষ্য করলাম শুভ কল দিয়েছি। শুভর নম্বরটা দেখে ঘুমটা যেন উড়ে গেল। দ্রূত ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম। তারপর বেশ স্বচ্ছ গলায় বললাম

“হ্যালো।”

ওপাশ থেকে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হলো। যা আমার বিগলিত মনটাকে খুশি করে দিল। 

“অপ্সরা রাতের জন্য সরি। তোমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কেন জানি না আমি সারারাত ঘুমাতে পারি নি। আমাকে মাফ করে দাও। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো তবে মাঝে মাঝে অনেক ইনসিকিউর ফিল হয় তাই এমন করে বসি।”

“সমস্যা নেই। বিষয়টা আমি বুঝি। আমার ব্যর্থতা যে আমি আপনাকে আমার ভালোবাসা বুঝাতে পারি না। কেন পারি না জানি না। আমি অন্য সব মেয়েদের মতো ছেলেদের মন পড়তে পারি না। তাই হয়তো আপনাকে বুঝাতে পারি না। আমিও সরি।”

শুভর কোমল কথা কানে আসলো

“আমি তোমার বাসার নীচে। আসো একটু বাইরে থেকে ঘুরেও আসি নাস্তাও খেয়ে আসি। শহর থেকে একটু দূরে একটা  নদীর পাড় আছে। সে পাড় ঘেষে সকাল সকাল চালের রুটি আর হাসের মাংস রান্না করে বিক্রি  করা হয়।  চলো সেখান থেকে খাইয়ে নিয়ে আসি। আর রেডি হওয়ার দরকার নেই। যেমন আছো তেমনি বের হয়ে যাও।”

আমি শুভর কথা শুনে দ্রূত কোনোরকমে কুলি আর মুখটা ধুয়ে নীচে নেমে গেলাম। শুভ গাড়িতে বসে আছে। আমিও গাড়িতে উঠলাম। শুভ আমার দিকে তাকিয়ে বলল

“চোখ এত ফুলা কেন?”

মাথা নামিয়ে উত্তর দিলাম

“আপনার জন্য কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনেকক্ষণ  কান্না করেছি তো তাই চোখ ফুলে গেছে। সমস্যা নেই আস্তে আস্তে কমে যাবে।”

“হুম”

শুভ কেন জানি না কথাটা শুনে আর কোনো কথা বলল না। গাড়িতে গান বাজছে। শুভ ড্রাইভ করছে। আমি শুভর কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছি। মনে হচ্ছিল স্বর্গসুখ আমার দুয়ারে এসে ঢলে পড়েছে। তবে সে সুখ যে বিভীষিকায় রূপান্তর নিবে কে জানত। সে বিভীষিকার কড়ালগ্রাস আমাকে নরকে ঠেলে দিল।

 

 

 

৫ম পর্ব

 

 

শুভ আচমকা আমাকে তার কাঁধ থেকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরাল। আমার গালে দুটো চড় দিয়ে আমার চুলগুলো টেনে ধরল। অনাকাঙ্ক্ষিত  আঘাতে আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। কেন এমন করছে সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। বুঝে উঠার আগেই সে বলে উঠল

“আমি তো তোরে ফোন রাখার আগে কাঁদতে নিষেধ করেছিলাম। এরপর তুই কাঁদলি কেন? তুই বলছস তোর আইসক্রিম খেতে মন চায়ছে আমি তোর জন্য আইসক্রিম পাঠালাম। এরপর তুই আইসক্রিম না খেয়ে ঘুমালি কেন? তোরে যে বলি তুই আমারে ভালোবাসছ না এখন বুঝছস কেন বলি? তুই ভালোবাসলে আমার কথা শুনতি। আর তোর টেস্ট মুহুর্তের মধ্যে চেন্জ হয়ে যায়।  এই তোর আইসক্রিম খেতে মন চায় এই তোর মন চায় না। তোর তো ক্ষণে ক্ষণে টেস্ট চেন্জ হয়। এখন দেখা যাবে তোর শুভরে ভালো লাগতেছে কালকেই আবার লাগবে না। তুই যে খারাপ কেন বলি এখন বুঝছস।”

কথাগুলো বলে আমার চুল টেনে ধরল। আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী বলব চিন্তা না করেই বলে উঠলাম 

“আমার গায়ে হাত কেন তুলছেন? কী এমন করেছি আমি? আপনাকে ভালোবাসি এটাই কী অন্যায়?  সমস্যা কী আপনার। আমি বাসায় যাব। আমাকে বাসায় দিয়ে আসেন।”

আমার কথা শুনে শুভ আরও রেগে গিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলো। সাথে সাথে  গাড়িটা এক্সিডেন্ট করলো একটা সিন এন জির সাথে। আমি ধাক্কা খেয়ে সামনের দিকে আঁচড়ে পড়লাম। আমার মুখটা ফেটে রক্ত পরছে। শরীরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেল। কাচ এসে গালে লাগল। দম নিতে ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। ঠোঁট নাড়িয়ে কথাও বলতে পারছি না। আবছা আবছা চোখ চেয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে কী বলেছি জানি না। 

ঝিঁঝিঁ পোকার মতো শব্দ আসছে কানে। শুশু বাতাস যেন কোথায় থেকে কানে এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে। আমি চোখ খোলে তাকালাম। চারপাশটা বড্ড অচেনা। কোনো ফ্যামিলি বাসা সেটা বুঝা যাচ্ছে তবে কার বাসায় সেটা বুঝতে পারছি না। খাটের পাশে টেবিল ল্যাম্পটা হালকা আলোময় হয়ে জ্বলছে। তার পাশেই একটা আলমিরা। খাটের অপর পাশটায় ড্রেসিন টেবিল। সামনের দিকে দেয়ালে একটা টেলিভিশন  ঝুলানো। নীচের দিকটায় ফুলদানি আর ফুলের স্টিক দিয়ে সাজানো। পাশেই একটা ছোটো ফ্রিজ তার উপর কিছু সজ্জাময়ী শো পিস। এর একটু পাশে একটা সোফা যার উপর গিটার দাঁড় করানো। পুরো রুমটা চোখ বুলালাম। তিনটে দরজা। একটা ওয়াশরুমে যাওয়ার আরেকটা বাহিরে যাওয়ার। সোফার পাশটায় বেলকনি যাওয়ার দরজা। আমি কেবল আশ্চর্য  হচ্ছি আমি এখানে কীভাবে আসলাম। হাত পা শরীর অনেক ব্যথা করছে। মনে করার চেষ্টা করছিলাম আমার সাথে কী হয়েছিল তবে কোনোভাবেই যেন মনে করতে পারছি না। মনে করতে গেলেই একটা চাপ আমার মাথায় এসে ব্যথার সঞ্চার  করছে। 

পেট টা খুব মুচরাচ্ছে কেন জানি। ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার।  আমার শরীরটাও বেশ ভার লাগছে। কোনোরকম উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। 

মিনেট পাঁচেক পর ওয়াশরুম থেকে বের হতে নিব। এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম।  আমি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই লক্ষ্য করলাম শুভ। ঠিক তখনি আমার মনে হলো আমি শুভর গাড়িতে ছিলাম। আর উনি আমার গায়ে হাত তুলেছিল। আমি ভয়ার্ত চোখে উনার দিকে তাকালাম। বুঝতে পারলাম আমি শুভর বাসায়।   আমি শুভর দিকে তাকাতেই উনি আমার কাছে আসলো। আমার হাতটা টেনে ধরে বিছানায় বসালো। তারপর সোফার উপর থেকে খাবারের প্লেটটা নিল।  খাবারগুলো নিয়ে আমার মুখের দিকে লোকমা এগিয়ে দিয়ে বলল

“খাও। আর চিন্তা করো না। ডাক্তার বলেছে তোমার সুস্থ হতো এক সপ্তাহ সময় লাগবে। আমি তোমার এক সপ্তাহ যত্ন নিব। মাম্মী আছে, ছোটো বোন আছে তোমার অসুবিধা হবে না। তবে প্লিজ অপ্সরা আমার কথার অবাধ্য হবে না। এই নাও খাবারটা মুখে দাও।”

আমি মুখে খাবারটা নিলেও গিলতে পারছিলাম না। ভয়ে হাত,  পা কাঁপছে। আমি বাসায় যাব কী করে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। আর এখানে সাতদিন থাকলে বাসায় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমি লোকমা মুখে নিয়েই বলে উঠলাম

“আমি এখানে কীভাবে থাকব? বাসায় তো কেউ জানে না। বাসায় জানলে তো আমাকে আর বাসায় ঢুকতে দিবে না। আপনি আমাকে বাসায় নিয়ে যান।”

শুভ আমার কথা শুনে হাসতে লাগল। তার হাসিটার  কারণ আমি বুঝতে পারছি না। আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম

“হাসতেছেন কেন?”

শুভ হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল

“বাসায় টেক্সট করে বলে দিয়েছি তুই তোর বান্ধবীর বাসায় আসছিস। বাসায় ফিরতে সাতদিন সময় লাগবে। তোর বাপ অবশ্য ভয়েজ দিয়েছে তাড়াতাড়ি যেতে।  আমি তারপরও টেক্সট দিয়ে বলেছি তোর আসতে দেরি হবে । সুতরাং  চিন্তা করিস না। সাতদিন পর সুস্থ হয়ে বাসায় যাবি। আর বেশি সমস্যা হলে হোস্টেলে উঠবি। সমস্যা তো দেখছি না আমি। তোর ভরণ পোষণের দায়িত্ব আমার। এত চিন্তা না করে যা বলি তাই শোন।”

আমি শুভর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললাম

“এভাবে এত প্রেসার কেন দিচ্ছেন? আমাকে প্লিজ বাসায় দিয়ে আসেন। আমাকে আর পরে বাসায় ঢুকতে দিবে না। আমি আমার পরিবারকে চিনি। আর  আমি আমার পরিবার ছাড়া থাকতে পারব না। একটু তো আমাকে বুঝেন।”

শুভ আমার কথাটা শুনে ভাতের প্লেটটা ছুড়ে দিয়ে ফেলে দিল। আমার গালটা চেপে ধরে তার কাছে নিয়ে বলল

“তুই যে আমারে ভালোবাসছ না।  এখন বুঝছস কেন বলি? ভালোবাসলে আমার কথা শুনতি। আমার উপর ভরসা রাখতি। তা ‘ না করে তুই তোর পরিবারের দোহাই দিচ্ছিস।”

আমি এবার রাগে বলে উঠলাম

“আপনি থামেন প্লিজ। ভালোবাসা,পাগলামি পসেসিভনেস এক না। আপনি যেটা করছেন সেটা টর্চার, ভালোবাসা না। এরকম টর্চার আমি আর নিতে পারছি না। সমস্যা কী আপনার? আমি আপনাকে ভালোবাসি সেটা তো বুঝেন না উল্টো অত্যাচার করেন। আমি আর নিতে পারছি না। আপনি আপনার মতো থাকেন এবং আপনার মতো কাউকে নিয়ে সুখী হোন। আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন।”

আমার কথা শুনে শুভ আরও রেগে গেল। আমার চুল টেনে ধরে বলে উঠল

“তুই অপ্সরা…. করবি আমার সাথে ব্রেক আপ! তোর সে চান্স নাই। এ সম্পর্কে আমি যা চাইব তাই হবে। এর বাইরে কিছু করলে আমি তোকে তোর পুরো পরিবারকে খুন করে ফেলব। বুঝছিস?”

আমি শুভর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। জোরালো সুরে কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্না দেখে শুভর রূপ বদলে গেল। সে হঠাৎ  করেই আমার পা ধরে মাফ চাইতে চাইতে বলতে লাগল

“অপ্সরা আমাকে মাফ করে দাও।  আমি কেন যেন এমন করে ফেলি। তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কেন যে তোমাকে বুঝাতে পারি না। কী করলে বুঝবে তুমি? বলো?”

আমি আর কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। শরীরটা কাঁপছে।  শুভ আমার দিকে তেড়ে এসে বলতে লাগল

“কী করে বলস না কেন? কী করব? কী রে তোর সমস্যা কোন জায়গায় বল। কথা বলতেছিস না কেন?”

আমার শরীর আরও ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল। এবার ঘটে গেল আরও ভয়ংকর কিছু। আমার নীরবতা যে এত বড়ো খড়া স্রোতের রূপ নিবে কে জানত।

 

 

 

 

৬ষ্ঠ পর্ব

 

শুভ আবারও আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে  তাকাল। তারপর আমার দিকে তেড়ে এসে জোরে চিল্লায়ে বলল

“তোরে যে বললাম বলার জন্য বলছিস না কেন? তুই যদি এক মিনিটের মধ্যে না বলছ তোরে যে আমি কী করব তুই নিজেও বুঝবি না। তোর হাড়গুড় ভেঙ্গে দিব। মেরে ফেলব তোকে। তোর চুপ থাকাটা আমার অসহ্য লাগে।”

আমার ভয়ে বুক কাঁপতে লাগল। জটিল অংকের সমীকরণের মতো সব গুলাতে লাগলাম। উনার রাগ দেখে কোনোরকম ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে লাগলাম 

“আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। ইতিবাচক বললেও রেগে যান, নেতিবাচক বললেও রেগে যান। আমার আপনাকে বুঝতে একটু সময় লাগবে। আমাকে কিছুদিন সময় দিন। এভাবে আমার দিকে তেড়ে আসবেন না। বুক ধুকধুক করে।”

আমার কথা শুনে শুভ এবার দূরে সরে গেল। নিজের মাথা দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে নিজেকে আঘাত করতে লাগল। আমার ভয়টা আরও বেড়ে গেল। আমি বসা থেকে কোনোরকম উঠে গেলাম উনার কাছে। বেশ জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম

“আপনি কি থামবেন? কী শুরু করছেন এগুলো? আপনি কি চান আমি ভয়ে মারা যাই? আমার এসব অত্যাচার লাগে। এরকম করবেন না। আমি আপনাকে ভালোবাসি।  আপনাকে এভাবে শাস্তি দিলে আমি নিজেই কষ্ট পাই। কিছু করা লাগবে না আপনার। আপনি যা বলবেন তাই শুনব। বাসায় যেতে নিষেধ করেছেন তো সেটাও করব। যা হওয়ার তো হয়েছেই। বাসায় জায়গা না দিলে হোস্টেলে উঠব।  সমস্যা তো দেখছি না। আপনি শান্ত হোন দয়াকরে। আমাকে এটা বলুন আপনার বাসায় কী বলেছেন? আমাকে আর আপনাকে আপনার বাসায় একা থাকার অনুমতি কীভাবে দিবে? আপনার মা বোন কী এটা মেনে নিবে?”

শুভ এক বাক্যে জবাব দিল

“আমার বাসা আমি বুঝব। তোকে তো এটা নিয়ে চিন্তা করতে বলিনি। তুই চুপচাপ গিয়ে বস। বুয়াকে বলতেছি রুম পরিষ্কার করে দিয়ে যেতে। আর শোন মাম্মী রুমে আসলে কম্বল মুড়ি দিয়ে থাকবি। বাকিটা আমি বুঝব।”

আমি চুপ করে শুধু মাথা নেড়ে গেলাম। শুভর কথা মতো বিছানায় এসে বসলাম। কিছুক্ষণ  পর শুভ দরজা খুলে সিড়ি বেয়ে নীচে নামল। বুঝতে পারলাম শুভদের বাসা ডুপ্লেক্স সিস্টেম করা। উপরে শুভ থাকে। আর নীচে ও আর ওর ছোটো বোন থাকে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই বুয়া রুমে প্রবেশ করল। বুয়া এসে আড় চোখে আমার দিকে তাকাতে লাগল। আমি ঐসবে পাত্তা দিলাম না। সারা গা আমার জ্বলতেছে। শরীর ব্যথা করতেছে। গা টা ভীষণ গরম হয়ে গেছে। চুপ হয়ে বসে রইলাম শুধু। বুয়া  ভাঙ্গা প্লেটের কাচগুলো তুলে রুম পরিষ্কার করে বের হয়ে গেল। 

এর কিছুক্ষণ  পরেই শুভ আসলো আবার খাবার নিয়ে। আমার দিকে ভাত মাখিয়ে মুখে লোকমা  তুলে দিয়ে খেতে বলল।  আমি কোনো কথা বললাম না, খেয়ে নিলাম। এতে শুভ ভীষণ খুশি। আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি কেবল। এ  মানুষটাকে আমার কেন এত অন্যরকম লাগে। আচ্ছা সব পুরুষেই কী এমন নাকি শুধু শুভই এমন! শুভ এবার প্লেটটা এক পাশে রেখে আমার কপালে হাত দিল। লক্ষ্য করল আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমার অবস্থা দেখে সে ব্যস্ত হয়ে গেল। ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে আসলো। এসে আমাকে ঔষধ দিল খেতে। আমি ঔষধটা খেলাম। মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। একটু ঘুমাতে পারলে হয়তো ভালো লাগত। চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। আস্তে আস্তে চোখে ঘুম এসে ঝেঁকে বসলো। 

একটা উষ্ণ  ছোয়া গায়ে  লাগল। শরীরটা গরম আর শীতও লাগছে। শুভকে কখন জড়িয়ে ধরেছি শক্ত করে খেয়াল নেই। জ্বরের ঘুরে শুভর সাথে একদম লেপ্টে গিয়েছি। 

সকালের শুরু সূচণা হলো। আমি শুভর বুকে শুয়ে আছি। দীর্ঘ  দীর্ঘ  নিঃশ্বাস নিচ্ছি।  কী থেকে কী হচ্ছে কিছুই যেন মিলিয়ে পাচ্ছি না। জ্বরটা কমে এসেছে প্রায়। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠতে যাব শুভ আরও জোরে জড়িয়ে ধরল। তার ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁট দুটোকে আবদ্ধ করে নিল। আমি কেন জানি না বাঁধা দিতে পারছি না। হাত, পা কাঁপতে লাগল। দমটা ভার হচ্ছে। শুভ আরও জোরে জড়িয়ে ধরল। নিমিষেই আমি বদলে গেলাম। বারবার মনে হচ্ছিল আমি তাকে বাঁধা দিই কিন্তু পারছিলাম না। মনে হচ্ছে আমি তো শুভকে ভালোবাসি।  শুভর স্পর্শ আমার কাছে একদম বিরক্ত লাগছে না। আবেগ এসে তাড়া দিল ভীষণভাবে। শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠল। শুভ আমাকে আরও আষ্টেপৃষ্টে  জড়িয়ে ধরল। নিমিষেই যেন দুজন দুজনের সাথে একেবারে মিশে গেলাম। তারপর আবারও নিস্তেজ হয়ে বিছানায় তলিয়ে পড়লাম। চোখ দুটো বন্ধ করে শুভকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। 

কিছুক্ষণ  পর মনে হলো আমি যা করেছি আবেগের বশে ঠিক করেনি। একদম বড়ো ভুল করে ফেলেছি। আমি নিজেকে এখন আর সামলাতে পারছি না। চোখ দিয়ে অজোরে জল পড়ছে। আমি শুভকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম

“আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো? আমি জানি না কেন বিয়ের আগে এমন কাজে সায় দিয়েছি। এখন ভীষণ ভয় করছে আমার। এটা একদম উচিত হয়নি। আমি আপনাকে ভালোবাসি তবে বুঝতে পারি না। কেন জানি না মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে।  কিসের ভয় জানি না। আপনি আমাকে ভালোবাসেন তবে আমার মতো করে না।  আমার না পাওয়া কেবল এটাই।”

শুভ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগল

“আমার কথা শুনবে তাহলেই হবে। আমি যা বলব তাই শুনবে। কথার অবাধ্য হলেই আমার রাগ চেপে যায়। আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি। তোমাকে ছেড়ে যাব না।”

কিছুটা সময় পার হলো। মনে ভীষণ অচেনা আশঙ্কা।  আমার সাথে কী ঘটছে কী হচ্ছে এর শেষেই বা কোথায়? সমীকরণ মিলাতে গেলে বারবার এলোমেলো হচ্ছে। ঘুরপাক খাচ্ছে সময়। একটা কুন্ডলিতে পাঁক খাচ্ছি মনে হয়। 

শুভ বাইরে গিয়েছে নাস্তা আনতে। আমি হাত মুখ ধুয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নিলাম। চুপ গলায় বসে আছি খাটে হেলান দিয়ে। বাসায় কী হচ্ছে এটাই ভাবছি কেবল। চরম দুটানায় পড়ে আছি আমি। মনের অশান্তি কোনোভাবেই যাচ্ছে না। কেবল শূন্যতা আমাকে ঘিরে ধরেছে করুণভাবে। 

শুভ খাবার নিয়ে এসেছে। আমার পাশে বসেই আমার দিকে খাবার এগিয়ে দিল। আমি হু, না কিছুই না বলে খেতে লাগলাম। খেতে খেতে এক পর্যায়ে আর খেতে পারছিলাম না। পেটটা ভরে গিয়েছে। তাই শুভকে আটকে দিয়ে বললাম

“আমি আর খেতে পারছি না। পরে খাব আবার। এখন আর খাব না।”

শুভ প্রতিউত্তরে বলে উঠল

“অপ্সরা ত্যাড়ামি একদম পছন্দ না আমার। এ সবটা খাবার শেষ করবে তারপর যা বলার বলবে।”

আমি সত্যিই আর খেতে পারছিলাম না। তাই শুভকে আবারও বলে উঠলাম

“প্লিজ এখন আর খেতে পারব না। পেট একদম ভরে গেছে। পরে খাব।”

আমার কথা শুনে শুভ রেগে গিয়ে খাবারগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে, আমার গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলল

“তুই কোনোদিনও মানুষ হবি না। তুই যে আমারে ভালোবাসছ বলছ এটা তোর নাটক কেবল। তোরে বারবার বলি আমার কথার বাইরে যাবি না।  তুই তাই করিস। খাওয়া লাগবে না তোর।”

কথাগুলো বলেই শুভ চলে গেল। আমি বসে বসে কেবল কাঁদতে লাগলাম। সত্যিই কী হচ্ছে আমার সাথে আমি বুঝে উঠতে পারছি না। কান্নার এক পর্যায়ে পাশে থাকা কাগজ টা আর কলমটা নিয়ে লিখতে লাগলাম। ছোটো বেলা থেকেই মন খারাপ হলে হাবিজাবি লিখতে বসি। আর এতে মনটা একটু হালকা লাগে। তাই লিখা শুরু করলাম। মন যা চেয়েছে লিখেছি। লিখা শেষে  একবার  চোখ বুলালাম। মনে হলো মনের ভেতরে থাকা সুপ্ত কষ্টগুলোই লিখায় ফুটে উঠেছে।  

আমার মনের মতো কেউ একদিন আমার জীবনে আসবে। সে আমাকে আমার মতো করেই বুঝবে, আমার মতো করেই জীবনকে নিয়ে ভাববে, জীবনকে রঙিন সুতোয় বুনবে।  সে হবে এমন কেউ, জীবনে যাকে পেয়ে গেলে তার হাত ধরে বাঁচতে বড়ো ইচ্ছে করবে। দু-জন মিলে সুখের রাজ্য গড়ব,রঙিন স্বপ্ন দেখব। অনুভূতির বিচরণ জুড়ে বিষন্নতা কাটিয়ে হাসি ফুটবে। ভালোবাসার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম থাকবে না তখন। কোনও সর্বজনীন ব্যাকরণ থাকবে না। কোনো হিসেব সমীকরণ থাকবে না।  খোলা হৃদয়ে ও খোলা আত্মায় চারিদিকে তাকাব; দেখব ঠিক একই রকমের হৃদয় ও আত্মা নিয়ে কোথাও-না-কোথাও কেউ একজন আমার অপেক্ষায় আছে। হয়তো আপনি বদলে গিয়ে তেমন টা হবেন নয়তো নতুন কেউ এসে আপনাকে যুদ্ধে হারিয়ে সে জায়গা দখল করে নিবে। তখন আমি কেবল সুখী হব। জীবন নিয়ে নতুন জীবনের সূচণা করব।

বার কয়েক লাইনগুলো পড়ে কাগজটা পাশে রেখেই শুয়ে পড়লাম।

কিছুক্ষণ  পর দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম।  বুঝতে পারলাম শুভ এসেছে। তাই চুপ করে শুয়েই রইলাম। তবে বুঝতে পারিনি এক কড়াল থাবা আমাকে এসে গ্রাস করে নিবে এত নির্মমভাবে।

 

 

 

 

 

৭ম পর্ব

 

 

শুভ এবার কাছে এসে জোরে জোরে মারতে লাগল। হুটহাট গায়ে হাত তোলার কারণ আমি বুঝতে পারি না। কারণবিহীন সে আমার গায়ে একের পর এক আঘাত দিতে লাগল। কখনও চড়, কখনও লাথি আবার কখনও একের পর এক চুল টান। আমি কেবল নীরব হয়ে আঘাত গুলো সহ্যই করে যাচ্ছি। একটা পর্যায়ে সে নিজেই ক্লান্ত হয়ে গেল। আমি চুপ করে শুয়ে রইলাম। বুকের ভেতরটায় খুব কষ্ট হতে লাগল। উনি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। এবার আমার লেখা সে কাগজটা হাতে নিয়ে ছিড়ে বলতে লাগলেন

“তুই আসলেই আমারে ভালোবাসছ না। ভালোবাসলে আমার জায়গা অন্য কাউকে দখল করার কথা বলতি না। তোর এ লেখার জন্য তুই মাইর খাইছস। তোরে মারলেও তুই শুধরাবি না।”

কথাগুলো বলে শুভ চলে গেল। আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না। এত কষ্ট দেওয়ার পরও আমি শুভর প্রতি ভীষণ দুর্বল।  হয়তো আমিও মানসিক রোগী। নাহয় এ যন্ত্রণার পরও আমি কেন তাকে ঘৃণা করতে পারছি না। আমি শুধু কাঁদতে লাগলাম। আমার কষ্টটা আমাকে ভীষণভাবে প্যারা দিচ্ছে। যন্ত্রণা  আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বাসায় কী হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছি না আমি। ফোনটাও শুভর কাছে। জানি না কাকে কী জবাব দিচ্ছে। এটুকু বুঝে উঠতে পারছিলাম বাসায় যাওয়ার মতো মুখ আমার নেই। সেটা এতক্ষণে কালিমা লিপ্ত হয়ে লেপ্টে গেছে।   

নিজেকে সামলে নিলাম। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। মাতালের মতো কাঁদতে কাঁদতে কখনও ঘুমালাম জানি না। ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন লক্ষ্য করলাম আমি শুভর বুকে। শুভ আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আমি উঠতেই ও আরও জোরে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল

“অপ্সরা আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। ইচ্ছে করে গায়ে  হাত তুলি না। আমার মাথা অনেক গরম হয়ে যায়। আর মাঝে মাঝে এত ত্যাড়ামি করো আমি সহ্য করতে পারি না। সরি বেবি। আমি আর তোমাকে কষ্ট দিব না। আচ্ছা তুমি আমার কাছে কী চাও?”

আমি শুভর কথায় গলে গেলাম। এতক্ষণে তার প্রতি থাকা যে কষ্ট ছিল তা মুছে গেল। যে নির্মমতা আমাকে গ্রাস করেছিল সেটাও নিমিষে কেটে গেল। আমি শুভর বুকে মাথা লুকিয়ে বললাম

“আমি আপনাকে ভালোবাসি এটা সত্য। তবে আমি এ জীবন যাপনের সাথে অভ্যস্ত না। আমি একটা আলাদা পরিবেশে বড়ো হয়েছি আর আপনি আলাদা পরিবেশে। আপনার উপর ভরসা নেই এটা ভুল। তবে আমি আমার পরিবারকেও ভালোবাসি। আমার জন্য আমার পরিবার কষ্ট পাক এটা আমি চাই না। এই যে আমি এখানে পড়ে আছি এটা নিয়ে তো অবশ্যই বাবা মায়ের চিন্তা হচ্ছে। এরকম টা এর আগে কখনও হয়নি। দেখুন আপনার কাছে একটায় চাওয়া আমাকে একটু বুঝুন।”

ভেবেছিলাম শুভ হয়তো আমার কথায় রেগে যাবে। তবে আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে শুভ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল

“আমি তোমার বিষয়টা বুঝি। তবে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ  করতে পারি না। আর শুনো তোমার পরিবারে তুমি ব্যাক করতে পারো কিনা বুঝতেছি না। আমি বড়ো একটা অকাজ করে ফেলেছি। বলেছি তুমি আলাদা থাকতে চাও। পরিবারের সাথে থাকবে না তাই হোস্টেলে উঠে গিয়েছো। তোমার বাবা তোমাকে বলেছে উনি মরে গেলেও যেন আর দেখতে না যাও। এরপর তোমাকে ব্লক করে দিয়েছে। তোমার মা বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে তবে সেটা আমি ধরিনি। যা হবার তো হয়েছেই। আমরা একটা সময় পর বিয়ে করে নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন আপাতত বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। আমি আশেপাশে একটা হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দিব সেখানেই থাকবে। আর এখানে থাকলে তো সমস্যা নেই। অপ্সরা চিন্তিত হবার কিছু নেই আমি তোমার পাশে আছি।”

আমি কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না। একটা বন্দি কারাগারে প্রবেশ করেছি সেটা বুঝতে পারছিলাম। বুকটা হালকা চিনচিন করে ব্যথা করছে তবে নিজেকে সামলে নিয়েছি। সামলে নেওয়া  ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। দীর্ঘ  নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে আছি। মনে মনে ভাবছি সৃষ্টিকর্তা কপালে কী লিখে রেখেছেন জানি না। শুভর সাথে পরিচয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটা সুন্দর সংসার। আর সে সংসার বুননের স্বপ্ন কোনদিকে মোড় নিচ্ছে জানি না। বুকটা ভার হয়ে ভীষণ যন্ত্রণা  করছে। তবে কাঁদতে পারছি না। কান্না যেন আটকে যাচ্ছে। এ মুহুর্তে  পাগলের মতো চিল্লায়ে কাঁদতে পারলে হয়তো হালকা লাগত। তবে সেটা চাইলেও যে অসম্ভব  তা বুঝতে পারছিলাম। 

রাত বারোটা বাজে। শুভ নরম ঠোঁটে গালে চুমু দিয়ে বলে উঠল

“আলমিরাতে দেখো জামা রাখা আছে। একটু ফ্রেশ হয়ে জামাটা পাল্টে নাও। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। দেখিতো তোমার হাত টা।”

এই বলে হাতটা টেনে তার দিকে নিল। নখগুলো ভালো করে পরখ করে বলল

“নখে নেলপলিশ দিলে ভালো লাগবে। দাঁড়াও একটু,আমি নেল পলিশ নিয়ে আসছি। তুমি একটু ফ্রেশ হয়ে ড্রেসটা পাল্টে নাও।”

শুভ রুমের বাইরে গেল। আমি ওয়াশ রুমে। হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। যদিও গায়ে, হাত পায়ে কালো কালো দাগের ছোপ পড়ে আছে। ধরলেই যেন ব্যথার সঞ্চার  হয়। তাই কোনোরকম পানির ঝাপটা দিয়ে ফ্রেশ হলাম। তারপর রুমে এসে গা, হাত, পা মুছে নিলাম। ড্রেসিন টেবিলের সামনে লোশন ছিল তা গায়ে, হাতে মেখে নিলাম। ততক্ষণে শুভ রুমে প্রবেশ করল। পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে  ঘাড়ে একটা চুমু দিয়ে বলে উঠল

“আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।”

এই শুভকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। এ শুভকে দেখলে কেন জানি না রাগী শুভর সাথে মিলাতে পারি না। মনে হয় একই মানুষের মধ্যে দুটো সত্ত্বার বাস। আমি শুভর দিকে ফিরে তাকালাম। শুভ আমাকে জড়িয়ে ধরেই খাটে বসালো। তারপর আমার হাত গুলো টেনে নিয়ে নেল পলিশটা খুলে নখে দিতে লাগল। বেশ যত্ন করে দিচ্ছে সে। আমি শুভর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এ মানুষটাকেই আমি চাই। কিন্তু মাঝে মাঝে কেন শুভ বদলে যায়। অল্পেতে রেগে যায়। বুঝে উঠতে পারি না।  আচ্ছা এটা কী কোনো রোগ নাকি স্বভাবগত সমস্যা। আমি কেবল এ সমীকরণ মিলাতে ব্যস্ত।

দুহাতের নখে লাল নেল পলিশ টকটক করছে। হাত দুটো ভীষণ সুন্দর আর রঙিন লাগছে। শুভ্রতার আভাস মেখে আছে। রক্তাক্ত লাল নেলপলিশ কিসের বার্তা বহন করছে সে সংকেতের ভয়ও কাজ করছে। 

শুভ আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল

“এভাবে তাকিয়ে কী দেখছো?”

“আপনাকে।”

“আমাকে দেখার কী আছে?”

ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করে বলে উঠলাম

“কিছু জিনিস, ব্যক্তি বা বস্তুকে জনম জনম ধরে দেখলেও চোখের তৃষ্ণা  ফুরায় না। হয়তো আমার জীবনে আপনি সেরকমই।”

“কাব্য কবিতা লিখবে নাকি।”

হালকা হেসে জবাব দিলাম

“এত বুদ্ধি কী আর আমার আছে।”

“হয়েছে আর কথা বাড়াতে হবে না। আলমিরা থেকে একটা ড্রেস বের করে পড়ে নাও। আমি একটু নীচে যাচ্ছি। এটা সুবাহ এর নেলপলিশ। ওর রুমে রেখে আসি।”

শুভ হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে নীচে নামতে লাগল। সুবাহ ওর ছোটো বোন। ছবিতে দেখেছি। সামনাসামনি দেখার সুযোগ এখনও মিলে নি। আমি বসা থেকে উঠে আলমিরার দিকে গেলাম। আস্তে করে টেনে আলমিরা খুলে নিজেই বিস্মিত হয়ে গেলাম। এটা কী আমি সত্যি দেখছি নাকি ভুল সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।

 

 

 

 

 

৮ম পর্ব

 

 

পুরো আলমিরা জুড়ে মেয়েদের কাপড়। আলমিরাটা ভালো করে চেক করে বুঝতে পারলাম কাপড়গুলো শুভর বোনের না। কারণ শুভর বোনের সাইজ বড়ো। তবে কাপড়গুলো কার সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। আমি বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে কাপড়গুলো দেখতে লাগলাম। সবগুলো নতুন কাপড় না। কিছু পুরাতন কাপড়ও আছে৷ তবে কাপড়গুলো কার সেটাই বুঝতে পারছি না। এর মধ্যেই শুভ বলে উঠল

“একটা কাপড় পরতে এত দেরি লাগে নাকি?’

আমি হালকা গলায় বললাম

” এত কাপড় কার?”

সে স্থিত গলায় জবাব দিল। 

“আমার ছোটো বোনের। ওর সাইজে হয় না তাই এ আলমিরায় রেখে গেছে। হঠাৎ  করে স্বাস্থ্য  বেড়ে গেছে তাই।  তোমার সাইজ হবে। সুতরাং  যেটা মন চায় সেটা পরে নাও। “

আমি শুধু জোরে নিঃশ্বাস ফেলে সম্মতি জানালাম। এরপর চুপচাপ একটা থ্রি পিস বের করে পরে নিলাম। শুভ এবার আমাকে নিয়ে বের হলো। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু একবার জিজ্ঞেস  করলাম

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

উত্তরে সে বলল ঘুরতে। 

আমি আবারও জিজ্ঞেস  করলাম

“কোথায়?”

উত্তর আসলো

“এই তো  সাজেক যাব।”

আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস  করলাম

“সত্যিই সাজেক যাবেন?”

“হুম। সাজেক গিয়েছো কখনও?”

“নাহ।”

“চলো তাহলে ঘুরতে নিয়ে যাই।”

বলতে বলতেই গাড়ি চলতে লাগল। আমি শুভর কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। চোখ বন্ধ করেই শুভর সাথে কথা বলতে লাগলাম। কথা বলতে বলতেই একটা পর্যায়ে ঘুমিয়ে গেলাম। 

শুভর ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। আমি কোথায় এসেছি বুঝতে পারছি না। শুভর দিকে তাকিয়ে বললাম

“আমরা কী সাজেক চলে এসেছি?”

শুভ মাথা ঝাকিয়ে বলল

“হুম চলে এসেছি।”

আমি বিশ্বাসেই করতে পারছিলাম না যে আমি সাজেক চলে এসেছি। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা। কনকনে হাওয়া বইছে। শীতে কাঁপতে লাগলাম। ঢাকায় যদিও শীতের প্রকোপটা টের পাওয়া যায় না। তবে এখানে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। গাড়িতে যখন উঠেছিলাম তখন একটা সালোয়ার কামিজ আর পাতলা শাল জড়িয়ে নিয়েছিলাম। তবে সাজেকের হাড় কাঁপানো শীতে মনে হচ্ছে আমি কোনো কাপড়েই পরিনি৷ শরীরটা স্তব্দ হয়ে যাচ্ছে ঠান্ডায়। 

শুভ গাড়ি থেকে নেমে রিসোর্ট ভাড়া নেওয়ার ট্রাই করল। তবে এ মুহুর্তে  কোনো রিসোর্টেই খালি নেই। কোনো হোটেলেও রুম নেই। তাই বাধ্য হয়েই গাড়ির ভেতর হিটার ছেড়ে দুজনেই বসে আছি। হাত পা জমে যাচ্ছে পুরো। বরফের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে শরীর। আমি শুভর দিকে তাকিয়ে কাঁপা ঠোঁটে বললাম

“ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। একটু গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করেন।”

শুভ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল

“একটু অপেক্ষা  করো ব্যবস্থা করছি। বাইরে কুয়াশায় ঢেকে  আছে সব। দেখি কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।”

শুভ গাড়ি থেকে নামল। একা আমি গাড়িতে বসে কাঁপতে লাগলাম। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে জমতে লাগল। শরীরে কোনোরকম বল পাচ্ছি না। শিরধারা ঠান্ডা হয়ে গেল। মাথাটা ভনভন করে ঘুরে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত লেগে গেল। 

একটু পর একটা উষ্ণ  অনুভূতি অনুভব করলাম। সারা শরীর আস্তে আস্তে গরম হতে লাগল। চোখটা খুলে লক্ষ্য করলাম শুভ আমাকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। আমি শুভর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এ প্রথম শুভর চোখে একটা ভরসা খুঁজে পাচ্ছি। আমি আমার ঠোঁটগুলো শুভর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। শুভ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট দুটো দখল করে  নিল। 

খানিক পর আমি শুভর বুকে লুটিয়ে পড়লাম। শুভ হালকা ঠোঁটে চেপে চেপে আমার চুলগুলো টানতে লাগল। তারপর নম্র গলায় বলল

“এখানে থাকার মতো কোনো হোটেল পাচ্ছি না আর  কোনো রিসোর্টও খালি নেই। আমরা আজকেই ঢাকায় চলে যাব। তারপর ঠান্ডা কমলে আবার নিয়ে আসব। একটু পর কুয়াশা কমলে রওনা দিব। তোমার তাতে সমস্যা নেই তো?”

আমি মাথা নেড়ে না করলাম। তবে ক্ষুধায় পেট জ্বলতেছিল। তাই কানের কাছে গিয়ে আস্তে গলায় বললাম

“আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। খাবারের ব্যবস্থা করা যাবে কী?”

শুভ মাথা নেড়ে না বলল। আমি মন খারাপ নিয়ে বলে উঠলাম

“আশেপাশে কী খাবারের দোকানও নেই?”

“নাহ।”

চুপ গলায় বসে রইলাম। গাড়ি আবারও চলতে লাগল। কুয়াশার সাগর পার হয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার ধুয়া তখন মলিন হয়ে রোদের চিলিক দিচ্ছে। বেশ সময় লাগল আসতে। তবে ক্ষুধায় মনে হচ্ছে মাথা ঘুরাচ্ছে। 

ঢাকায় আসতে আসতেও রাত হয়ে গেল। রাত বললে ভুল হবে গভীর রাত হয়ে গেল। আশে পাশে কোনো দোকান খোলা নেই যে কিছু খাবা। আমার চোখ শুধু গাড়ির গ্লাসের বাইরে খাবারের দোকান খুঁজছে। শুভ বুঝতে পারছে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাই দ্রূত গাড়ি চালিয়ে বাসায় আসলো। বাসায় এসে খাবারের ব্যবস্থা করল প্রথম। আমি রুমে এসে খাবার পেয়ে গপাগপ খেতে লাগলাম। খাওয়ার এক পর্যায়ে  মনে হলো শুভও তো আমার মতো গতকাল থেকে কিছু খায়নি। আমি এবার অপরাধী চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম

“সরি। “

“সরি কেন?”

“এই যে আমি শুধু খেয়ে যাচ্ছি। আপনিও তো সারাদিন আমার মতো কিছু খাননি। আসেন খেয়ে নিন।”

শুভ হালকা হেসে জবাব দিল

“আমি সাজেকেই খেয়ে নিয়েছিলাম। যখন গরম কাপড় কিনতে নেমেছিলাম।”

শুভর কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। উনি খেয়েছে তবে আমাকে কেন খাওয়ালো না সেটা বুঝতে পারছি না। আমার  চাহুনিতে চরম কৌতুহল দেখে শুভ আবারও বলে উঠল

“অপ্সরা আমি কেবল দেখেছি তুমি ক্ষুধার জ্বালা কেমন সহ্য করতে পারো।”

“কিন্তু কেন?”

“কারণ আজকে আমার অনেক জায়গা সম্পত্তি আছে। একসময় নাও থাকতে পারে। একটা সময় আমার সব শেষ হয়ে যেতে পারে। তখন যদি খেতে না পারো তাহলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কি’না সেটার একটা পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। ক্ষুধায় তো অনেকে পাগলের মতো করে। তুমি কতটা ধৈর্য  ধরতে পারো তারেই একটা পরীক্ষা নিচ্ছিলাম।”

আমার চোখগুলোতে কৌতুহলের ছাপ কেটে বিস্ময় এসে ঝেঁকে বসলো। আমি চুপ করে রইলাম কেবল। খাবার যেটা মুখে ছিল সেটাও গিলতে পারছিলাম না। মানুষটা চায় কী বা মানুষটার মধ্যে চলছে কী? আদৌ কী আমাকে ভালোবাসে নাকি কোনো মোহ আমাকে ঘিরে তার কাজ করছে।  

শুভ আমার চাহনি দেখে আবারও বলে উঠল 

“আজকে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ  আছে।”

“কী সারপ্রাইজ?”

“খাওয়া শেষ করো তারপর বলছি।”

আমি কোনোরকম খাওয়া শেষ করলাম। শুভর সারপ্রাইজ  মানে বড্ড কঠিন কোনো অত্যাচার হবে এটুকু আন্দাজ করতে পারছিলাম।  খাওয়া শেষে শুভ আমার কাছে এসে বলল

“অপ্সরা যা হয়েছে ভুলে যাও। আজকে তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসব। আমাদের পথ আলাদা। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আমার টাইপ না। আমি যেমন মেয়ে চাই তুমি তেমন না। তাই তোমার সাথে এ সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব না। “

আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আমি কান্না গলায় বলে উঠলাম

“এতকিছুর পর আপনি এমন কেন বলছেন। আমি আপনাকে ছাড়া কোথায় যাব? আপনার পায়ে পড়ি আমার সাথে এমন করবেন না। আমি আপনাকে বড্ড ভালোবাসি।”

কিন্তু আমার কাকতি মিনতিতে শুভর কিছু গেল আসলো না। গল্পের মোড় নতুন দিকে মোড় নিল। যে গল্পে শুভ সাইকো ছিল সে গল্পে এখন অপ্সরা সাইকো হলো। 

আচ্ছা তার পর কী ঘটেছিল অপ্সরার জীবনে। হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে আছে মরার মতো। পাশে কেউ নেই না পরিবার না শুভ। শুনা যাক গল্পের নতুন অধ্যায়।

 

 

 

 

 

৯ম পর্ব

 

 

শুভর কথা শুনে অপ্সরা শুভর পায়ে ধরে বসে রইল। শুভর তাতে মন গলল না। অপ্সরাকে নিয়ে অপ্সরার বাসার সামনে নামিয়ে গেল। অপ্সরা ভয়ে চুপসে যেতে লাগল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বাসায় প্রবেশ করল। বাসায় প্রবেশ করতেই অপ্সরার বাবা অপ্সরার দিকে তেড়ে আসলো। অপ্সরাকে ঘরে ঢুকতেই দিল না৷ বাধ্য হয়ে সে বাসা থেকে বরে হয়ে আসলো। সারাদিন গন্তব্যহীন ভাবে শহরের অলিগলি ঘুরল। শুভকে বার কয়েক কল দিল তবে শুভর কোনো উত্তর মিলে নি। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত সে। এখন একটা মাথা গুজার স্থান দরকার যেখানে একটু শান্তি মতো ঘুমাতে পারবে। আপাতত দুটো টিউশন আছে তা দিয়ে প্রতিমাসের খরচ চলে যাবে। কিন্তু রাতটা থাকার জন্য কোনো ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে হবে। 

ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে অপ্সরা তার এক ফ্রেন্ডের বসায় উঠল। সেদিন রাতটা ছটফটাতে ছটফটাতে কাটাল। সকাল হতেই বেরিয়ে পড়ল। সারাদিনে খুঁজে একটা হোস্টেল বের করলো। নিজেকে সামলে নিয়ে হোস্টেলে উঠল। 

রাত আটটা বাজে মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছে। কোনোভাবেই মাথাটা উঠাতে পারছে না সে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বন্ধ চোখের কোণ ঘেষে পানি পড়ছে টলমল করে। মোবাইলটা  টুং করে আওয়াজ করে বেজে উঠল। অপ্সরা হাতে মোবাইলটা নিয়ে লক্ষ্য করল শুভ তাকে মেসেজ দিয়েছে। অপ্সরার বুক কাঁপতে লাগল। মেসেজটা কাঁপা হাতে ওপেন করল। তাতে লেখা ছিল

“বিকাশে টাকা গেছে দেখো। যতদূর জানি তোমার বাবা তোমাকে বাসা থেকে বের করে দিছে।  আপাতত তোমার টিউশন গুলোও চলে যাবে। কারণ আমি তাদের ও টেক্সট করে বলেছিলাম তুমি আর পড়াবে না সুতরাং  চলার মতো টাকা তোমার কাছে নেই সেটা আমি জানি। আর কোন হোস্টেলে উঠেছো সে ঠিকানাও আমি জানি। যাইহোক এ মাস চলবে কী করে? আমি জানি তোমার কষ্ট হবে টাকার জোগান দিতে। তাই টাকাটা পাঠিয়ে দিলাম। মাসে মাসে তোমার ভরণ পোষণের সমস্ত খরচ চলে যাবে তোমার কাছে। যেহেতু আমার জন্য এ অবস্থা সুতরাং আমিই এর সমাধান দিলাম। আর ভুলেও আমাকে টেক্সট, মেসেজ বা তোমার জীবনে ফিরে আসার কথা বলবে না তাহলে চরম খারাপ হবে তোমার সাথে।”

অপ্সরা মেসেজটা পড়ে বিকাশ চেক করল। লক্ষ্য করল ১৫ হাজার টাকা এসেছে তার একাউন্টে। অপ্সরার স্বস্তি লাগছে এখন৷ একাউন্টে টাকা এসেছে তার জন্য না বরং শুভ তাকে এ উছিলায় মেসেজ দিয়েছে তাই। মাথা ব্যথাটা যেন ঔষধ ছাড়ায় কমতে লাগল। বুকের পাথরটাও যেন নামতে লাগল। নিজেকে একটু হালকা লাগছে।  চোখটা বন্ধ করে শুয়ে রইল৷  

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল  তার। আযানের আওয়াজ কানে আসছে। নামাজ পড়া হয় না অনেকদিন যাবত। অনেকদিন বলতে  সপ্তাহখানেক নামাজে দাঁড়ানো হয়নি তার। সহজে নামাজ আদায় থেকে বিরত থাকে না সে। তবে পরিস্থিতির গ্যারাকলে পড়ে সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল তার। নিজের কাছে নিজেকে বেশ অপরাধী লাগছে এখন। দ্রূত শুয়া থেকে উঠে অযু করতে গেল। অযু করে এসেই নামাজে দাঁড়াল। বেশ স্বস্তি নিয়ে ফজরের নামাজটা শেষ করলো। 

মোনাজাত ধরতেই তার ডুকরে কান্না আসলো। চোখ দুটো অশ্রুজলে ভরে গেল। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে সামলাতে পারল। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। রবের কাছে মুখ ফুটে চাওয়ার আগেই যেন তার বুক ফেটে যাচ্ছে কান্নায়। কান্নার এক পর্যায়ে রবের নিকট বলতে লাগল

“হে আমার রব আমি আপনার বান্দা। আমি জানি আমি পাপী। কিন্তু আমার পাপের পাহাড়ের তুলনায় আপনার রহমতের পাহাড় অনেক বড়ো। আমার পাপের থেকেও আপনি ক্ষমাশীল। আমার জীবনে যা হয়েছে তার জন্য হয়তো আমি দোষী। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি কীভাবে এ যন্ত্রণাময় খোপ থেকে বের হব সে পথ আমাকে দেখিয়ে দিন৷ হে আমার রব শুভকে আমি ভালোবাসি তবে তার মনের চাওয়া আমি বুঝতে পারিনা। আমার  জীবনের এ কালো অধ্যায় টা আমি এগিয়ে নিতে চাই না। হে আমার রব শুভ আমার জন্য উত্তম হলে আমার জীবনে তাকে ফিরিয়ে দিন অন্যথায় তাকে সরিয়ে নিন। আল্লাহ আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাপটা করেছি যে পাপের আগুনে এখনও পুড়তেছি। আপনি আমাকে পথ দেখান আমি কোন পথে যাব। আমি এ পাপের পথে যেতে চাই না। হয় এ পাপের পথটা পূণ্যতায় রূপ দিন অন্যথায় আমাকে পূণ্যের পথ দেখান। আর শুভকে তার ভুল গুলো ধরিয়ে দিয়েন। আমাকে দেওয়া প্রতিটা আঘাত তাকে আপনি ফিরিয়ে দিয়েন। তাকে বুঝতে দিয়েন সে যা করেছে সেটা অন্যায়। হে আল্লাহ আমায় আপনি ক্ষমা করুন৷”

মোনাজাতের সমাপ্তি করেও আরও কিছুক্ষণ  কাঁদতে লাগল সে।  কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে গেল। 

সকাল ১১ টা। চোখ দুটো ফুলে রয়েছে। কিছু খাওয়া দরকার। অনলাইনে খাবার অর্ডার করল। তবে এ চিন্তাও ঝেঁকে বসেছে সে কীভাবে চলবে আগামি পথগুলো। টিউশন দুটোও আর নেওয়া সম্ভব না। এ মুহুর্তে  কিছু একটা করতে হবে তাকে। সকল চিন্তা তাকে ঘিরে ধরল। তবুও নিজেকে শক্ত করে নিল। এ মুহুর্তে  এত ভেঙ্গে পড়লে হবে না। আপাতত ১৫ হাজার টাকা আছে তা দিয়ে দিব্যি দুমাস চলে যাবে। এ দুমাসে তাকে অন্য কাজ খুঁজতে হবে। শুভর কথা ভেবে সময় নষ্ট করলে হবে না।  এখন জীবনের মোড় ঘুরাতে হলেও এ প্রসঙ্গ ছেড়ে অন্যদিকে যেতে হবে। আর শুভর টাকাও সময় মতো তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই তার ফোনে কল আসলো। অপ্সরা কল টা ধরতেই বুঝতে পারল খাবার এসেছে। সে দরজা খুলে খাবার টা নিয়ে টাকা পে করে রুমে আসলো। নিজেকে সামলে খেয়ে নিল। 

বেলা যাচ্ছে সে সাথে তার অস্থিরতাও বাড়ছে। কোনোভাবেই সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। বারবার মন চাচ্ছে তার শুভকে একটা কল দিতে।  তবে সে এটাও জানে শুভকে কল দিলে শুভ তাকে ব্লক করে দিবে। তাই মনের কথা না শুনে নিজেকে সংবরণ করে নিল। এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়বে কখনও সে আশা করে নি। 

দিন পার হয়ে রাত হয়ে গেল। রাত বাজে এগারো টা। সেই যে খেয়েছিল এরপর আর খেতে মন চায়নি তার। তবে শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে আছে। নিজেকে আর সামলাতে পারল না। শারীরিক যন্ত্রণা  আর মানসিক অশান্তিতে নিজেকে সংবরণ করার প্রয়োজন বোধ করল না। ফোনটা হাতে নিয়ে শুভকে মেসেজ দিল

“আমার সাথে কেন এমন করলেন আপনি? কী ক্ষতি  করেছি আমি। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। আমি আর খেতে পারছি না। আমাকে এবার ক্ষমা করুন। এ পরিস্থিতিতে আমি টিকতে পারছি না। মরে যেতে মন চাচ্ছে আমার। আমি মরে গেলে আপনি শান্তি পাবেন তো? আমি আর পারছি না।”

মেসেজটা দিয়ে সে আবারও কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে তার বুকে ব্যথা হতে লাগল। ঘন্টাখানেক কাঁদল। বারোটা ছুঁই ছুঁই।  এমন সময় শুভর কল আসলো অপ্সরার ফোনে। অপ্সরা দ্রূত কল ধরতেই শুভ বলে উঠল

“আমি তোর হোস্টেলের সামনে। নীচে নাম। বাকি কথা তোর সাথে পরে বলতেছি। ৫ মিনিট সময় দিলাম নীচে নাম। যেভাবে আছিস ঐভাবে নাম।”

অপ্সরার বুক ধুকধুক করতে লাগল। জানে না কী হতে চলেছে নতুন করে। তবে এ মুহুর্তে  সে দেরি না করেই দ্রূত নীচে নামল। আর নতুন গল্পের বেড়াজালে তলিয়ে পড়ল।

 

 

 

 

 

১০ম পর্ব

 

শুভ নীচে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপ্সরার বুক কাঁপতে লাগল। চোখগুলো হালকা ঝাঁপসাটে হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে একটু সামলে গাড়িতে উঠল। শুভ তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। গাড়ি চালাচ্ছে আপন গতিতে। গাড়িটা মাঝপথে আসতেই শুভর কণ্ঠ থেকে শব্দ নিঃসৃত হলো।

“শুনো অপ্সরা আগে যা হয়েছে ভুলে যাও। চলো নতুন করে সব ঠিক করে নিই। আমি এটুকু বুঝতে পারছি তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তবে আমি জানি আমি ছেড়ে না গেলেও তুমিই আমাকে ছেড়ে যাবা।”

অপ্সরা  একটু দম নিল। দুটানা তাকে ভীষণভাবে গ্রাস করে   আছে। সে বুঝতে পারছে না এ সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাবে নাকি সব ছেড়েছুড়ে পিছিয়ে যাবে। এ সম্পর্ক থাকলেও তার কষ্ট হচ্ছে। আবার ছেড়ে যেতে চাইলেও দম বন্ধ লাগছে। অপ্সরা কোনো কথায় বলছে না। এ নীরবতা জানান দিচ্ছে তার অশান্তি প্রখরতার রূপ নিচ্ছে। 

তেমন কোনো জবাব না দিয়েই গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। গোলাকার চাঁদটা আকাশটাকে আলোকিত করে রেখেছে। এ চাঁদটা দেখে তার ছোটো বেলার কথা মনে পড়ছে। ছোটো বেলায় মায়ের সাথে হাঁটত আর চাঁদের গতি নির্ণয় করত। তখন মনে হত চাঁদটা তার সাথে সাথে চলছে। তবে বড়ো হওয়ার পর বিজ্ঞানের মারপেঁচে অলৌকিক ধারণাগুলো যেন পাল্টে গেছে। এখন খুব করে তার মায়ের কথা মনে পড়ছে। সে কখনও চিন্তা করেনি তার পরিবারকে ছেড়ে আলাদা থাকবে। তাই খারাপ লাগাটা যেন আরও বেশি করে ঝেঁকে ধরেছে। 

কষ্টটা যখন ভার হয়ে যেতে লাগল। তখন শুভর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করে হালকা গলায় বলল

“শুনেন ভালোবাসা জিনিসটা অনেকটা আয়নার মতো। আপনি সেটাকে যত যত্ন করবেন সেটা তত চকচক করবে। অবহেলা করলে সেটা ঝাঁপসা হয়ে অকোজো হয়ে যাবে। আর রাগ করলে সেটা রাগের বিভীষিকায় ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে যাবে। এই যে আমরা ভালোবাসা আগলে রাখার নাম করে চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলে ধরে বসি, এটাই হলো সমস্যা। এক ধরণের ব্যধি। এ ব্যধি একবার নিজের মধ্যে আক্রমণ করলে তখন নিজেও শান্তি পায় না অন্যকেও শান্তিতে থাকতে দেয় না।”

কথাগুলো বলে অপ্সরা চুপ করে রইল। শুভর তখনও কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। চুপ করে আছে। শুভর এ নীরবতা আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। তাই খানিকটা ভয় অপ্সরার লাগছে। এ সময় গাড়িটা থেমে গেল। অপ্সরা দ্রূত চোখ খুলল। সামনের দিকে তাকাল। বুঝতে পারছে না কোথায় এসেছে। শুভর দিকে তাকিয়ে বেশ অনিশ্চিত গলায় বলল

“আমরা কোথায় এসেছি?”

“আমার উপর তোমার ভরসা নেই।”

কথাটা শুনে অপ্সরার সোজাসাপটা উত্তর

“এতকিছুর পর ভরসা করাটাই কষ্টকর। তাই তো এত জিজ্ঞেস  করা। আপনাকে ভালোবাসলেও ভরসা করতে পারি না। এজন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার যদি মন চায় মারতে, মারেন। তবে যা সত্যি তাই বললাম। মিথ্যা বললে আপনাকে ঠকানো হবে।”

কথাগুলো বলে অপ্সরা চুপ হয়ে গেল৷ শুভর মুখের উপর সত্যি কথা বলে তার বেশ শান্তি লাগছে। তবে এটুকু মনে হচ্ছে তার উপর বিভীষিকা এসে হানা দিবে।  তবে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া শুভর দিক থেকে আসলো না। 

রাত বাজে দুটো। চারদিকে অন্ধকার। গাড়ির হেড লাইট দিয়ে এটুকু বুঝা যাচ্ছে সামনে একটা বাড়ি আছে। শুভ গাড়ি থেকে নামলো। অপ্সরাকেও নামতে বলল। অপ্সরা কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে গেল। নামার পর শুভ অপ্সরার হাতটা শক্ত করে ধরে টানতে লাগল সামনের দিকে। অপ্সরা বুঝতে পারছে না, কী করতে চলেছে সে।  শুভ বাড়িটার ভেতর ঢুকলো। অপ্সরা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল

“আমরা এখানে কী করব?”

“থাকব।”

“কিন্তু এখানে কেন?”

“আমি থাকব না তুমি একা এখানে থাকবে। আমি চলে যাব। এটা হচ্ছে আমার কথা না শুনার শাস্তি। এই যে তোমাকে নিষেধ করেছিলাম আমাকে মেসেজ না করতে। আমার কথা তো শুনো নাই,  তাই এই শাস্তি। এরপর তুমি যা চাইবে তাই হবে। যদি বলো বিয়ে করতে করব। ঠিক আছে বেবি ভালো থাকো। কাল রাতে এসে নিয়ে যাব।”

কথাগুলো বলেই অপ্সরাকে রুমে রেখে দরজাটা পেছন দিক দিয়ে আটকে রেখে দিল। ভয়ে বুক ধুকধুক করছে আপ্সরার। সে সাথে শরীরটা কাঁপছে তার। প্রবলভাবে ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হতে লাগল। শুভর প্রতি জমে থাকা সকল ভালোবাসা এখন ক্ষোভে পরিণত হতে লাগল। নিমিষেই বিপরীতমুখী কোনো সত্ত্বা যেন তাকে গ্রাস করে নিল। যে শুভকে পাওয়ার জন্য তার মধ্যে এক অস্থিরতা কাজ করত ঠিক সে শুভর থেকে পালানোর জন্য এখন অস্থিরতা কাজ করছে। 

 রাত আরও ঘনীভূত হতে লাগল। চারপাশ অন্ধকার। হুটহাট আচমকা শব্দ কানে ভেসে আসছে। হতে পারে এটা অপ্সরার মনের ভুল আবার হতে পারে সত্যি। ভূতে ভয় পাওয়ার প্রবণতা তার মধ্যে আছে। সিজোফ্রেনিয়াতেও ভুগেছে সে। প্রথম ব্রেক আপের পর মানসিক অনেক সমস্যায় তাকে ঘিরে ধরেছিল। সেখান থেকে  অনেক কসরত করে নিজেকে স্বাভাবিক  জীবনে এনেছিল। আর সে স্বাভাবিক  জীবনটা তছনছ করতে শুভ নামক এক টর্নেডো জীবনে এসেছিল। 

অপ্সরার মাথায় শুধু এখন এটাই কাজ করছে কীভাবে শুভর থেকে মুক্ত করা যায় নিজেকে। আশেপাশে বিকট আওয়াজ কানে ধেয়ে আসছে। সে সাথে শুভর প্রতি ঘৃনা আরও বেড়ে যাচ্ছে। নিজেকে আর সামলাতে পারল না। চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করল। প্রায় মিনেট পনেরো এভাবে কাঁদল। একটা পর্যায়ে শরীর অসাড় হতে লাগল। বেশিক্ষণ  আর কাঁদতেও পারল না। মাথাটা ভীষণরকম ঘুরাচ্ছে তার। এমন সময় কেউ একজন তার সামনে আসলো। ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে দেখল শুভ। অপ্সরা ভাঙ্গা গলায় শুভর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল

“আমি আপনাকে ভালোবাসার আফিম ভেবেছি আর আপনি আমাকে তাসের তুরুপ ভেবেছেন। আমার ভালোবাসায় সরলতা ছিল আর আপনার ভালোবাসায় ছিল জটিলতা। সে জটিলতার জটিল সমীকরণ মিলাতে গিয়ে আমার জীবনের অনেকটা সময় পার করে আমি আজ নিঃশ্ব, একাকীত্ব। একবার মনে হয় আপনাকে ছেড়ে দূরে চলে যাই আবার পরক্ষণেই মনে হয় দূরে গেলে আমার প্রাণটায় না হনন হয়ে যায়। এ দুটানা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। আমিও চাই একটা সঠিক সিদ্ধান্ত ।  তবে সেটা নিতে পারছি না কোনোভাবেই। আপনি আমাকে হয় ছেড়ে দিন নাহয় আগলে রাখুন। আপনার এই দুটো সত্তার মিশ্রণ আমাকে ভীষণ প্যারা দিচ্ছে। এ অবহেলা আমাকে অনেক যন্ত্রণা  দিচ্ছে। আমাকে এত ভালোবাসতে হবে না যে ভালোবাসা পরবর্তীতে অবহেলায় রূপ নিবে আর আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিবে।”

কথাগুলো মুখে বিড়বিড় করতে করতে অপ্সরা ঢলে পড়ল।

সকাল ১১ টা বাজে। অপ্সরা ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করল সে শুভর বাসায় আর তার হাতে স্যালাইন দেওয়া। অপ্সরার জ্ঞান  ফিরতেই সে ভাবতে লাগল কীভাবে এখান থেকে বের হবে। শুভর সাথে থাকলে সে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যাবে। আর সে রোগ তাকে তিলে তিলে মারবে। আর শুভকে ছাড়লে হয়তো কিছুদিন তার কষ্ট হবে তবে সে কষ্ট মলিন হয়ে এক সময় সুখ এসে হাজির হবে। তাই নিজেকে সামলে নিল। শুভর কোনো মিষ্টতায় সে নিজেকে বিলিয়ে দিবে না। তবে শুভকে রাগানোও যাবে না। এ ভাবনা নিয়েই সে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা  করছে শুভ আসার।

খানিকক্ষণ পর শুভ এসে প্রবেশ করল রুমে।  অপ্সরার পাশে এসে বসলো। তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল

“শরীর ভালো লাগছে?”

অপ্সরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। শুভ এখন বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছে। অপ্সরার হাত তার বুকে নিয়ে বলল

“অপ্সরা আমার একটায় সমস্যা তা হলো  আমার কথার অবাধ্য হলে আমি স্বাভাবিক থাকতে পারি না। আমি তোমাকে ফুলের মতো আগলে রাখব যদি আমার কথা শুনো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমিই তোমাকে অবহেলা করব। আবার আমিই তোমাকে আগলে রাখব। আজকেই তোমাকে বিয়ে করব আমি৷ তুমি কখনও এটা বলতে পারবে না আমি তোমাকে ব্যবহার করে ছেড়ে দিয়েছি। বরং আমি তোমাকে আগলে রাখব হয়তো তুমিই আমাকে ধোঁকা দিবে। তবে যেদিন ধোঁকা দিবে সেদিনেই তোমার জীবনের শেষ দিন হবে। আর আমার পাশে থাকলে দুনিয়ার সকল সুখ তোমার হাতে আসবে।”

কিন্তু শুভকে বিয়ে করার ইচ্ছা মোটেও অপ্সরার জাগছে না। এ অসহনীয় ব্যথা সে সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার নেই। তবে শুভর বিপরীতেও যাওয়া যাবে না। তাই দাবার গুটির উল্টো চাল এবার অপ্সরাকে দিতে হবে। আর সেই চালেই তার কাল হয়ে দাঁড়াল।

 

 

 

 

১১তম পর্ব

 

 

অপ্সরা বিয়েতে অমত করল না আরং হাসি মুখে বলল

“আপনি যা বলবেন আমি তাতেই রাজি। আমার জীবনে যা হারানোর তো হারিয়েছি। পরিবার হারিয়েছি।  থাকার মতো আপনি ছাড়া কেউ নেই। যেদিন বিয়ে করতে বলবেন, করব। আমি আর আপনার কথার বিরুদ্ধে যাব না।”

অপ্সরার কথা শুনে শুভর মুখে খুশির আভা ফুটে উঠল। সে অপ্সরাকে জড়িয়ে ধরে রাখল।  কিছুক্ষণ  পর শুভ অপ্সরার কপালে চুৃমু দিয়ে বলে উঠল,

“তুমি বসো আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

কথাটা স্বল্প পরিসরে বলে সে চলে গেল খাবার আনতে। আর এদিকে অপ্সরার যেন দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। এ রুমে সে আর টিকতে পারছে না। নিজেকে সামলে নিল পালানোর জন্য। এখান থেকে যে করেই হোক পালাতে হবে। যে ভাবনা সে কাজ।  সে আস্তে করে রুমের দরজাটা খুলে নিল। তারপর নীরব পায়ে হাঁটল। সামনে এগিয়ে বাইরে যাওয়ার দরজা পেয়েই অপ্সরা খুলে বরে হয়ে গেল।

সে সময়টায় শুভ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। অপ্সরাকে নীচে তাকিয়ে দেখেই, সে রাগী গলায় জোরে জোরে বলতে লাগল

“তুই কই যাস? তোরে আমি নীচে এসে পিটাবো। তুই তাড়াতাড়ি রুমে আয়। এত না করার পরও তুই আমার কথার অবাধ্য হস। তুই উঠে আয় বলছি।”

অপ্সরা সেদিকে কর্ণপাত করল না। নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা সি এন জি নিয়ে নিল। শুভ বিষয়টা দেখেই ব্যালকনি থেকে সরে আসলো। নীচে নামলো অপ্সরাকে দেখতে। ততক্ষণে অপ্সরা চলে  গেল।

সারা সি এন জি অপ্সরা আল্লাহর নাম ঝপতে ঝপতে আসলো। হোস্টেলে না উঠে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলো। যাতে করে শুভ তাকে স্পর্শও করতে না পারে। সব মিলিয়ে একটা ভীতকর পরিস্থিতি থেকে সে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। 

মোবাইলটা বন্ধ করে রেখেছে সে। তিনদিন পর আজকে মোবাইল অন করলো। সাথে সাথে শুভর রাগান্বিত কণ্ঠ সুরের ভয়েস আর মেসেজ। অপ্সরার বুক কাঁপতে লাগল। তবুও নিজেকে সামলে নিল। সিমটা মোবাইল থেকে বের করে ছুড়ে ফেলে দিল৷ তারপর একটা দীর্ঘ  নিঃশ্বাস নিল। অন্য একটা সিম কিনে হোস্টেলে যোগাযোগ  করে জিনিসপত্র সব অন্যজনের মাধ্যমে আনলো। তারপর নতুন হোস্টেলে উঠল। এ মুহুর্তে  অপ্সরার কাছে যে টাকা আছে তা দিয়ে কেবল তিনমাস চলতে পারবে। তবে এ তিনমাসের মধ্যে তাকে যে করেই হোক একটা কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে গতিতেই সে আগাতে লাগল।

কেটে গেল বিশেক দিন। পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক।  শুভ আর এখন জ্বালায় না। জ্বালায় না বললে ভুল হবে জ্বালানোর সুযোগ পায় না। নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে সে। প্রবল দুর্বলতা কেটে গেছে। সে সাথে পড়ে থাকা টুকরো কিছু মোহ। সবমিলিয়ে আগের চেয়ে ভালো আছে। চাকুরির সন্ধান এখনও মিলে নি। তবে চেষ্টাও তেমন করে নি। আজকাল শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে তার। কেমন জানি শরীরটা ভার ভার লাগে তার। 

আজকে ভীষণ খারাপ লাগছে অপ্সরার। বার তিনেক বমিও হয়েছে। সে সাথে মাথাও ব্যথা। সব মিলিয়ে কেমন যেন ছন্নছাড়া লাগছে তার। হাঠাৎ  করেই তার মাথায় অন্য কিছু ঝেঁকে বসলো। তার মনে হতে লাগল। হয়তো সে প্র্যাগন্যান্ট। 

আর সে সন্দেহ থেকেই আজকে সে প্র্যাগনেন্সি কিট কিনে আনলো। সকাল বেলা টেস্ট করতে হবে। তবে সারা রাত তার ঘুম হয়নি। ছটফট করতে করতে কেটে গেল তার। সকাল বেলা টেস্ট করার পর তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সন্দেহ সত্যিতে রূপান্তরিত হলো। এ বাচ্চা কী করবে সেটাই ভাবছে সে। হয়তো বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হলে, দুনিয়ায় আনতে হলে আবারও শুভর সাথে যোগাযোগ  করতে হবে। মাথাটা ঘুরতে লাগল তার। যে কালো অতীত থেকে সে বের হতে চেয়েছিল সে কালো অতীত যেন তাকে আরও ঘিরে ধরল। 

ঘড়ির কাটায় সকাল ৬ টা ৩০। কাঁপা হাতে মোবাইলটা নিয়ে শুভর নম্বরটা অনেক ভেবে ডায়াল করল। প্রথম বার কল দেওয়ায় সে ধরল না। দ্বিতীয়বার কল দেওয়ার পর শুভ ধরল। ঘুম চোখে হ্যালো বলতেই অপ্সরা কেঁদে দিল। অপ্সরার কান্না শুনে শুভ গম্ভীর গলায় বলে উঠল

“তুমি কাঁদতেছো কেন? কী হয়ছে তোমার?”

অপ্সরা ভাঙ্গা গলায় বলে উঠল

“আমি প্র্যাগন্যান্ট। আমার মাথা কাজ করছে না যে, আমি কী করব। আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে। আপনি তো আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।  এখন করুন।”

ওপাশ থেকে কথামালা ধেয়ে আসলো

“তুই কই আছস আগে ঠিকানা দে। এরপর যা ব্যবস্থা করার করতেছি। আমার বাচ্চা পেটে নিয়ে কই বইসা আছিস।”

অপ্সরা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল

“আমাকে মারবেন না তো? মারলে আমি আসব না। আপনার মারগুলো আমি সহ্য করতে পারি না। খুব কষ্ট হয়।”

শুভ স্মিত গলায় উত্তর দিল

“কিছুই করব না। যা ভুল করার তো করেছো। বেবি ঠিকানাটা দাও। আমি এখনই আসতেছি।”

অপ্সরা কাঁদতে কাঁদতে ঠিাকানা দিল। শুভ কলটা কেটে দিল। ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে গিয়ে, অপ্সরাকে কল করে নামতে বলল। অপ্সরার ভয়ে বুক কাঁপতে লাগল। কাঁপা গলায় বলল

“আমাকে মারবেন না তো?”

“বললাম তো কিছুই করব না।”

অপ্সরার তবুও ভয় লাগতে শুরু করল। ভয়ে ভীত হয়ে নীচে নামল। শুভ গাড়ির দরজা খুলে দিল গাড়িতে উঠার জন্য। অপ্সরা নীরব হয়ে গাড়িতে উঠে গেল। এরপর শুভ গাড়িতে উঠল। গাড়িটা সে স্টার্ট করেই অপ্সরাকে কয়েকটা চড় বসালো। আর রাগে চিৎকার করে বলতে লাগল

“কার বাচ্চা পেটে আছস বল? কার সাথে এ কয়দিন শুইছস? নিশ্চয় ওই পোলা তোরে এখন ছেড়ে চলে গেছে। তাই এ বাচ্চা আমার বলে চালাইয়া দিতাছিস। তোরে আমি ভালোবাসি। বিয়া তো অবশ্যই করব। তবে এ পাপ আগে বিদায় করব। আজকেই তোর এবর্সন করাব। পিল আনব আমি। আর তুই সেটা খাবি।”

অপ্সরা আচমকা চড় খেয়ে তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করেই বলল

“বাচ্চাটার কিছু করব না বলেই আমি আপনার সাথে যোগাযোগ  করেছি। আমাকে এভাবে মারবেন না। আমি অন্য কারও সাথে কিছু করি নি। এ বাচ্চা আপনার।  জন্ম নেওয়ার পর ডি এন এ টেস্ট করার পর দেখেন। যদি বাচ্চা আপনার না হয় তখন যা শাস্তি দেওয়ার দিয়েন। “

শুভ কথাগুলো শুনে আরও জোরে অপ্সরাকে মারতে লাগল।।সারা রাস্তা মারতে মারতে নিয়ে গেল। তারপর অপ্সরার হাত ধরে তাকে টানতে টানতে শুভর ঘরে নিল। এরপর একটা ট্যাবলেট অপ্সরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

“তোর পাপ আমি নিজের নামে নিতে পারব না। তোকে বিয়ে করে দরকার হয় আবার বাচ্চা নিব। এ বাচ্চা আমি রাখব না। ট্যাবলেট টা খেয়ে নে।”

“আমি ট্যাবলেট খাব না। আপনার সাথে আমি যোগাযোগেই করেছি এজন্য যে যাতে করে আমার বাচ্চাটা বেঁচে থাকে। আমি একজন মা। নিজের বাচ্চা আমি নষ্ট করতে পারব না।”

কথাটা বলার সাথে সাথে শুভ একের পর এক কিল, ঘুষি, লাথি দিতে লাগল। অপ্সরা সহ্য করতে না পেরে জোরে চিল্লায়ে উঠল। অপ্সরার চিল্লানো এবার গল্পের নতুন মোড় দিল।

 

 

 

 

 

 

 

১২তম পর্ব

 

 

অপ্সরার চিল্লানো শুনে পাশের বাসা থেকে একজন ভদ্র মহিলা অনবরত দরজা নক করতে লাগল এবং কলিংবেল বাজাতে লাগল। শুভ কলিংবেলের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে  অগত্যা না পেরে দরজা খুলতে গেল। ডুপ্লেক্স সিস্টেম হওয়ায় অপ্সরা ছিল উপরের ফ্লোরে আর শুভ দরজা খুলতে গেছে নীচের ফ্লোরে। এ সুযোগে অপ্সরা নিজেকে সামলে নিল। আস্তে করে রুম থেকে বের হয়ে সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। কিন্তু এ মুহুর্তে  লিফটটা বন্ধ।  তাই বাধ্য হয়ে বেশ কুঁকরাতে কুঁকরাতে সিড়ি দিয়ে নামছে সে। এদিকে শুভ দরজা খুলতেই লক্ষ্য করল পাশের ফ্ল্যাটের আনিতা আন্টি এসেছেন। শুভ বেশ শান্ত গলায় মিসেস আনিতাকে বলল

“আন্টি আপনি? আসেন, ভেতরে আসেন।”

মিসেস আনিতা সন্দেহের দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস  করলেন

“তোমাদের বাসা থেকে মেয়ের চিৎকার শুনা যাচ্ছে। তোমার মা কোথায়? তোমার বউ তো বাসায় থাকে না তাহলে কে এভাবে কান্না করছে?

কথাটা অপ্সরার কানে এসে পৌঁছাল। সে সিঁড়ির এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। শুভ দরজাটা বন্ধ করলেই সে নীচে নামবে। নাহয় এখন নামতে গেলে নির্ঘাত ধরা পড়বে। মিসেস আনিতার কথায় অপ্সরার মনে নতুন প্রশ্নের সঞ্চার  হলো। শুভ কী বিবাহিত? যদি বিবাহিত না হয় তাহলে কেন মিসেস আনিতা বলল শুভর বউ বাসায় থাকে না। এ বাক্যের মার্মার্থটা কী হতে পারে? শুভর আলমিরা ভর্তি করা মেয়েদের জামা কাপড়। যদিও সে বলেছে এটা তার বোনের জামা তবুও একটা কিন্তু থেকে যায়। 

এদিকে শুভ মিসেস আনিতার কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেল। গলাটা একটু নামিয়ে নম্র গলায় বলল

” আন্টি মায়ের ডায়বেটিস বেড়েছে তাই ঘুমুচ্ছে। আপনি হয়তো ভুল শুনেছেন। মেয়ের চিৎকার হয়তো অন্য কোথাও থেকে এসেছে।”

মিসেস আনিতা গম্ভীর গলায় হুম বলে চলে গেলেন। এদিকে শুভর মা, বোন সবকিছু জেনেও চুপ। তিনি জানেন শুভর কর্মকান্ড। অপরাধগুলো জেনেও কোনো প্রতিবাদ করেন না।    হয়তো তিনি ছেলের অধীনে। নাহয় তিনি ছকে কষা অপ্সরার মতোই বেড়াজালে আটকে আছেন। 

শুভ দ্রূত দরজা লাগিয়ে নিল। মাথাটা আরও চড়ে গেল তার। মনে মনে ভেবে নিল অপ্সরার মুখ চেপে ধরে তাকে মারবে। ওর জন্য তাকে এত জবাবদিহি দিতে হলো এটা সে মানতেই পারছে না। ডাইনিং টেবিলে রাখা অর্ধপূর্ণ জগ থেকে, পানি গ্লাসে ঢেলে খেয়ে নিল। তারপর কিছুক্ষণ  ডাইনিং স্পেসে পাইচারি করল। এরপর আস্তে করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। রুমে যেতেই শুভর মাথাটা চড়ে গেল অপ্সরাকে না দেখে। সে পাগলের মতো ওয়াশরুম থেকে শুরু করে প্রতিটা জায়গা খুঁজলো। বুঝতে পারলো অপ্সরা পালিয়েছে। সারা শরীর ঘামতে লাগল তার। অপ্সরাকে ছাড়া তার দম বন্ধ লাগে। যদিও সে অপ্সরাকে আঘাত করে তবু দিনশেষে সে অপ্সরাকে ভালোওবাসে। সে আঘাত করতে চায় না তবে নিজের আচরণ আর রাগের প্রতিকূলেও যেতে পারে না। সবমিলিয়ে শুভর মাথাটা ঘুরতে লাগল। পাগলের মতো সে কাঁদতে লাগল। ছেলেদের কান্না বেশ বোকা বোকা হয়। চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ে তবে মুখে যন্ত্রণাটা প্রকাশ করতে পারে না। 

মিনেট বিশ কেটে গেল। অপ্সরাকে ঠেকানোর চেষ্টা সে করল না। চিন্তা করলো অপ্সরাকে সে ফিরিয়ে আনবে। তবে নিজেকে এর আগে পরিবর্তন  করবে। পূর্বে করে আসা ভুলের পুনরাবৃত্তি আবার সে ঘটাতে চায় না। নিজের মনকে শক্ত করে নিল সে। 

এদিকে অপ্সরা আবারও লুকিয়ে নিল নিজেকে। শরীরটা তার অসাড় হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হলো। আর সেখানেই  চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে সে৷ চোখগুলো বেশ ব্যথা করছে তার। শুভর সাথে কাটানো কালো অধ্যায় তার মনে পড়ছে। পরিবার পাশে নেই, নেই আপন কেউ। এ কঠিন বাস্তবতা কীভাবে পার করবে সে বুঝছে না। 

এ মুহুর্তে  ডাক্তার এসেছে অপ্সরাকে দেখতে। অপ্সরার প্রেসার মাপতে মাপতে বলল

“তোমার বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। আর তোমার পরিবারের কাউকে দেখছি না। তারা কোথায়? তোমার স্বামী কোথায়?”

অপ্সরার চোখ ভারী হয়ে আসলো। চোখের জলটা ফেলে, হালকা গলায় বলল

“আন্টি সত্যি বলব নাকি মিথ্যা?”

“সত্যের থেকে সুন্দর কিছু হয় না মা। আন্টি বলেই যখন ডেকেছো সত্যিটায় বলো।”

অপ্সরার কান্না যেন ঝেঁকে আসলো। কান্নার কারণে কথায় বলতে পারছে না। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কোনোরকম কান্না থামিয়ে পুরো কাহিনি বলে চুপ হয়ে গেল। চোখ বেয়ে কেবল পানি পড়ছে তার। ডাক্তার তাহিরা তার কোমল হাতের স্পর্শে  অপ্সরার চোখের জল মুছে দিয়ে নম্র গলায় বলল

” এ বয়সে তুমি যথেষ্ঠ কষ্ট করেছো। নিজের কিছু ভুলের জন্য পরিবারকেও হারিয়েছো। এখন তো কান্নাকাটি করার সময় না।  মন শক্ত রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়। পড়াশোনা তো ভালোই করেছ। কোনো কাজ দিলে পারবে করতে?”

অপ্সরা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল

“কেন পারব না?  অবশ্যই পারব।”

“শুনো আমার এক মেয়ে এক ছেলে। দুজনেই দেশের বাইরে স্যাটল। আমি এখানেই আছি। তোমার আংকেল গত হয়েছে অনেকদিন হলো। বাসায় একায় থাকা হয়। তুমি নাহয় আমার মেয়ের মতো আপাতত আমার বাসায় থাকো। তারপর নাহয় পরিবার ম্যানেজ করে সময় সুযোগ বুঝে যাবে। আর আমি তোমাকে একটা জবে জয়েন করিয়ে দিব। মন দিয়ে সে কাজ করবে।”

তীব্র হাহাকারের মাঝে এক ফোঁটা পানি যেন কেউ স্পর্শ করাল। অপ্সরা আবেগ গলায় বলে উঠল 

“আপনাকে এ মুহুর্তে  আমার ফেরেশতা মনে হচ্ছে। আল্লাহ কষ্টের পরে স্বস্তি দেন। আর সে স্বস্তিটা হচ্ছে আপনি। এ সময়ে এমন একটা সাপোর্ট কত বড়ো একটা পাওয়া আমি বুঝাতে পারব না। যদিও আমার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। মা হয়ে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা  বেশ প্রখর। এ সন্তানের জন্য আমি শুভর বাসা থেকে পালিয়েছিলাম। আর সে সন্তানকেই আমি হারিয়ে ফেললাম। বাস্তবতা অনেক নির্দয়। এ নির্দয় বাস্তবতা থেকে একটু মুক্তি চাই এতটুকুই।”

ডাক্তার তাহিরা অপ্সরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন

“একটু পর তোমাকে ডিসচার্জ করব। এরপর আমার ড্রাইভার তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবে। আমার যেতে একটু দেরি হবে। আর সেখানে কিছুদিন রেস্ট নিয়ে তারপর তোমাকে কাজে নিয়োগ দিব।”

অপ্সরার যদিও অচেনা একটা বাসায় যেতে ভয় হচ্ছে। তবুও এ মুহুর্তে  শেষ বিশ্বাসটুকু সে করতে চায়। একজন ডাক্তার বয়স্ক মানুষ তো আর মিথ্যা বলবে না। এ সুধারণা নিয়েই সে আশার আলো খোঁজছে। 

ঘন্টা তিনেক পার হলো। সন্ধ্যা সাতটা বাজে। অপ্সরা গাড়িতে করে রওনা দিল। নতুন গন্তব্য। নতুন পথের দিশার খোঁজে। এক চিলতে আলোর খোঁজে। এক মুঠো শীতলতার বৃষ্টির খোঁজে। 

গাড়িটা একটা বিশাল বাড়ির সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভার দরজা খোলে অপ্সরাকে বলল

“আপনি ভেতরে যান। যমুনা আপা আপনাকে আপনার রুম দেখিয়ে দিবে। আর ম্যডামের আসতে রাত এগারোটা বাজবে।”

অপ্সরা অনিশ্চয়তা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। মধ্য বয়স্কা এক মহিলা হালকা হেসে অপ্সরার হাত ধরে বলে উঠল

“ম্যাডাম আপনার কথাই কইছিল তাইলে? আপনি মাশআল্লাহ  সুন্দর। আসেন খালা ভেতরে আসেন। একটু বিশ্রাম করেন। আর আপনার জন্য স্যুপ রান্না করেছি তা খেয়ে নিন।”

অপ্সরার সবকিছু স্বাভাবিকেই লাগছে।  সে ভেতরে গিয়ে খাটে বসলো। খাটের পাশেই স্যুপের বাটি রাখা। সে বাটিটাকে ইশারা করে  আবারও যুমনা বলে উঠল

“আমি পাশের রুমে গেলাম। কিছু লাগলে ডাক দিও। আর এ স্যুপটা খেয়ে নিও। বয়সে অনেক ছোটো তাই তুমি করে বললাম।”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিল অপ্সরা। যমুনা চলে গেল। যমুনার প্রস্থান অনেকক্ষণ  পর্যন্ত  অপ্সরা লক্ষ্য করল। তারপর চুপ করে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে তার বাচ্চাটার কথা মনে হয়ে। কাঁদতে কাঁদতেই এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে গেল।

একটা ধারালো স্পর্শ অপ্সরাকে হানা দিচ্ছে। দুর্বলতার জন্য চোখ খোলে তাকাতে পারছে না সে। অনেকবার তাকানোর চেষ্টা করল, তবে ব্যর্থ হলো। কিন্তু ব্যর্থতার শেষ গ্লানিতে চোখ খোলে চেঁচিয়ে উঠল।

 

 

 

 

১৩তম পর্ব

 

 

তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করল একটা সাদা ধবধবে পার্সিয়ান বিড়াল। বিড়ালটা অপ্সরার চিল্লানো শুনে একদম শান্ত হয়ে বসে পড়ল। অপ্সরা হালকা দম নিল। বুঝতে পারল বিড়ালটায় তাকে হালকা আচড় দিয়েছিল। তাই নিজেকে একটু শান্ত করে, স্থির করে নিল। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে বিড়ালের কাছে গেল। বিড়ালটাকে স্পর্শ করতেই বিড়ালটা তার কোলে উঠে বসলো।

এমন সময় মধ্য বয়স্কা সে মহিলা অপ্সরার চিৎকার শুনে রুমে আসলো। মহিলার নাম বিনিতা। বিনিতা রুমে প্রবেশ করেই অপ্সরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে জিজ্ঞেস  করল

“কী হয়েছে তোমার? এভাবে চেঁচিয়ে উঠলে যে? শরীর খারাপ লাগছে কী?”

অপ্সরা দীর্ঘ  নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু গলায় জবাব দিল

“কিছু না আন্টি। বিড়ালটা আচঁড় দিয়েছে তো। তাই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।”

একথা শুনে বিনিতা হালকা হেসে বলল

“ওর নাম ডোরা। কামড়, আচড় দিলেও সমস্যা  নেই।  ভ্যাকসিন দেওয়া আছে। আর দেখো না তোমার সাথে কীভাবে মিশে আছে। নতুন মানুষ দেখলেই ডোরা গা ঘেষতে থাকে। তোমার অসুবিধা হলে নিয়ে যাই।”

কথাটা বলেই বিড়ালটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো বিনিতা। বিনিতাকে আটকে দিয়ে অপ্সরা বলে উঠল

” না, না, নেওয়া লাগবে না। ও আমার সাথে একদম মিশে আছে। থাকুক কিছুক্ষণ। আচ্ছা আন্টি আসেনি এখনও? কয়টা বাজে?”

“আসবে কিছুক্ষণের  মধ্যেই। রোগীর চাপ থাকলে দেরিতে আসে।  চাপ কম থাকলে আগে চলে আসে। ডাক্তারদের জীবন বুঝেনেই তো। সময়ের কোনো নিশ্চয়তা….। “

পুরো কথাটা শেষও করতে পারল না বিনিতা। এর মধ্যেই কলিংবেলটা বেজে উঠল। বিনিতা কথাটা অসমাপ্ত রেখেই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে দরজামুখী হাঁটতে লাগল আর বলতে লাগল

“মনে হয় ম্যাডাম আসছে। যাই দরজা খুলে দিয়ে আসি। পরে কথা হবে।”

বলতে বলতেই দরজা খুললো সে। ডাক্তার তাহিরা দরজার ওপাশ থেকে বিনিতাকে বলে উঠল

“মেয়েটার কী অবস্থা?  কী করছে?”

বিনিতা নম্র গলায় উৎসাহ কণ্ঠে উত্তর দিল

“ম্যাডাম ভালোই আছে। তবে ডোরাকে দেখে চিৎকার দিছিল। এখন আবার ডোরাকে কোলে নিয়ে বসে আছে।”

“খাওয়া দাওয়া করেছে?”

“হ ম্যাডাম টুকটাক করেছে। আচ্ছা ম্যাডাম উনি কে?”

“আমার মেয়েই বলা যায়। যাইহোক বকবক করবি নাকি আমাকে ঘরে ঢুকতে দিবি। তোদের নিয়ে আর পারি না। সারাক্ষণ  জ্বালানোর মধ্যে থাকিস।”

বিনিতা জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে উঠল

“সরি ম্যাডাম।  আসেন ঘরে আসেন।”

ডাক্তার তাহিরা রুমে প্রবেশ করলো। প্রথমে ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে নিল। তারপর অপ্সরার কাছে আসলো। অপ্সরা তখনও ডোরাকে কোলে নিয়ে বসে ছিল। বিড়ালটাকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। অনেকদিন পর যেন ডোরাকে সে মনের সব কথা বলতে পেরেছে। মানুষ প্রতারণা করলেও প্রাণীরা পাড়ে না। এখনের যুগে মানুষকে বিশ্বাস করার চেয়ে পশুকে বিশ্বাস করা শ্রেয়। তাহিরা লক্ষ্য করল অপ্সরা ডোরার সাথে মৃদু আওয়াজে কথা বলছে। তার বেশ শান্তি লাগছে এমন দৃশ্য দেখে। অপ্সরা কিছুটা স্বাভাবিক  হতে পেরেছে এটাই তার মনে আনন্দ দিতে পেরেছে। সে অপ্সরার দিকে মায়াময় দৃষ্টির বেষ্টনী দিয়ে  তাকিয়ে হালকা গলায় বলল

“ভালো আছো তুমি? এখন শরীর কেমন লাগছে।”

অপ্সরা স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস টেনে জবাব দিল

“এখন অনেকটা ভালো লাগছে।”

“ডোরা তো দেখা যাচ্ছে তোমার সাথে একদম মিশে গেছে।”

“হ্যা আন্টি ডোরা একদম মিশে গেছে আমার সাথে। ডোরা খুব শান্ত, মিশুক বাচ্চা।”

“হুম আমার জীবনের একটা অংশ ডোরা। যাইহোক চলো একসাথে খেয়ে নিবে।”

“কিন্তু আমার যে খেতে ইচ্ছা করছে না।”

“তা বললে হবে নাকি। মন না চায়লেও জোর করে খেতে হবে। চলো আমার সাথে। আর কোনো কথা না।”

অপ্সরা বাধ্য হয়ে ডোরাকে কোল থেকে নামিয়ে ডাক্তার তাহিরার সাথে খেতে বসলো। পুরো টেবিলটা খাবার দিয়ে সাজানো। দুজন মানুষের জন্য এত খাবার দেখে অপ্সরা কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস  করল

“আমরা তো কেবল দুজন মানুষ। এখানে তো পুরো দশজন মানুষের খাবার। এত খাবার কে খাবে?”

ডাক্তার তাহিরা হাসি মুখে জবাব দিলেন

” এ খাবার তুমি আসার জন্য বানানো হয়েছে। আমার মেয়েটা আমার ঘরে প্রথম এসেছে এটুকু আয়োজন তো করায় লাগে। আর আমাদের খাওয়া শেষে বাকি যে খাবার থাকবে সেগুলো কিছু গরীব লোককে ভাগ করে দিব। এটা তুমি আসার খুশিতে করা। আমি অনেক খুশি হয়েছি যে তুমি আমার জীবনে আমার নতুন মেয়ে হয়ে এসেছো। তোমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হোক। যে অধ্যায়ে কেবল সুখ থাকবে। দুঃখ থাকলেও সেটা সহনীয় থাকবে। যেখানে তুমি তোমার হাসির কারণ হবে। জীবনে অনেক বড়ো হবে মেয়ে। বেশি করে খেয়ে নিজেকে সুস্থ করো। মনে রাখবে মনের জোর দিয়ে সব জয় করা সম্ভব।”

অপ্সরার চোখ দিয়ে পানিটা গাল বেয়ে পড়ে ভাতের লোকমার উপর পড়ল। ভাঙা, কান্না গলায় বলে উঠল

“আমার এটুকু সাপোর্টের অনেক দরকার।  আমার জীবনে আপনি একটা আলোকবার্তা আন্টি। আমাকে এভাবে সাহস দেওয়ার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ  থাকব। হ্যা আমি কথা দিচ্ছি৷ আজকের পর আমি কখনও কাঁদব না। এখন থেকে নিজেকে খুশি রাখব।”

“এই তো লক্ষী মেয়ের মতো কথা।”

সেদিনের পর থেকে অপ্সরার জীবনের নতুন মোড় নিল। শুরু হলো নতুন জীবনের পথচলা। আস্তে আস্তে নিজেকে গুছিয়ে নিল। ডাক্তার তাহিরার রেফারেন্সে একটি কোম্পানিতে জয়েন করল। যেখানে তার কাজ টোটাল কমিউনিটি সাইটটা খেয়াল রাখা।

আজকে তার প্রথম অফিস। সকাল সকাল উঠে বেশ পরিপাটি হয়ে অফিসে গেল। জীবনের প্রথম চাকুরি একটু ভয় ভয় তো তার লাগছেই। বেশ ভয় নিয়ে অফিসে ঢুকলো সে। তবে অফিসে ঢুকার পর সবার ব্যবহারে তার ভয়টা কেটে গেল। মনে হচ্ছিল একটা পরিচিত পরিবেশে অবস্থান করছে সে। সারাদিন পুরো কাজটা বুঝে নিল। তার যে  বস সেও বেশ ফ্রেন্ডলি হওয়ায় তার কাজগুলো যেন আরও সহজতর হয়ে গেল। সবমিলিয়ে সারাদিনটা তার বেশ ভালো কেটেছে। 

সারাদিনের ব্যস্তময় অফিস শেষে এবার তার বাসায় ফেরার পালা। বাসায় ফেরার জন্য বের হতে নিলে তাকে পেছন ডাকে তার বস মাহিনুর সাহেব। মাহিনুর সাহেবের ডাকে সাড়া দিয়ে অপ্সরা পেছন ফিরে  বলল

“জি বলেন স্যার।”

“আপনি সবসময় এত চুপচাপ থাকেন কেন? সারাদিন প্রয়োজনের বাইরে একটা কথা বলেন না। মাঝে মাঝে একটু সবার সাথে গল্প করবেন। এ অফিসটা আমার। আমি সব কর্মচারীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে পছন্দ করি। তাই আমার অফিসটা , আমার ব্যবস্যাটা বেশ ভালোবাসায় বড়ো হচ্ছে। আপনি তো আমার খুব কাছের একজন মানুষের পরিচিত। তাই পেছন ডেকে এত কথা বলা। কিছু মনে করবেন না।”

অপ্সরা মাহিনুর সাহেবের কথা শুনে হালকা হেসে জবাব দিল

“আমি কিছু মনে করিনি। আস্তে আস্তে সবার সাথে মিশে যাব। চিন্তা করবেন না স্যার।”

“স্যার ডাকার কোনো দরকার নেই। ভাইয়া ডাকবেন।”

অপ্সরা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। মাহিনুর সাহেব তখন বলে উঠলেন

“এবার যেতে পারেন। আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে।”

অপ্সরা চলে আসলো।

এরপর থেকে অপ্সরার জীবন নতুন রঙ্গে রঙিন হতে গেল। সবকিছুই বেশ ভালো যাচ্ছিল।  মাঝে মাঝে সে তার বাবা মায়ের খোঁজ নিচ্ছে। তাকে ছাড়া তারা যেন মরভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে। অপ্সরা ফিরে যাবে তবে আরেকটু নিজেকে গুছিয়ে। সারাদিন অফিস শেষে নিজেকে সময় দেয়। নিজেকে খুশি রাখার সমস্ত চেষ্টাটায় সে করে। সে সাথে তার বস মাহিনুর সাহেবের সাথে তার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। সবমিলিয়ে সে এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। তবে নিঃশ্বাসে যেন দম বন্ধ করার উপক্রম হলো আবার।

 

 

 

 

 

 

 

১৪তম পর্ব

 

সেদিন অপ্সরা অফিসে ঢুকতেই চমকে উঠল। সামনে শুভ দাঁড়ানো। শুভকে দেখে যদিও তার ভয় লাগছে তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে অফিসে প্রবেশ করল। এদিকে শুভও অপ্সরাকে দেখে চমকে উঠল। সে অপ্সরার খোঁজ নিয়েছে তবে এভাবে দেখা হবে আশা করে নি।  নিজেকে এর মধ্যে অনেকটা পাল্টে নিয়েছে৷ রাগ সংবরণ করতেও শিখে গেছে। এ কয়দিনে অনেকগুলো মানসিক ডাক্তারও সে দেখিয়েছে। অপ্সরা শুভকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কিছুটা রাগান্বিত  গলায় বলে উঠল

“আপনি আমার পেছন পেছন এখানেও চলে এসেছেন? আমার জীবনটা নষ্ট করে আপনার শান্তি মিলেনি?  সবার কাছে আমাকে খারাপ বানিয়েছেন। আমাকে যে আঘাতগুলো করেছেন আমি তো জীবনেও ভুলব না। আমার পিছু কবে ছাড়বেন আপনি? আমাকে মুক্তি দিন। এবার যদি আপনি কিছু করেন আমি থানায় গিয়ে মামলা করে আসব। এখানে যদি কোনোরকম ঝামেলা করেন আমি আপনাকে জেলের ভাত খাওয়াব।”

শুভ অপ্সরাকে হাত নাড়িয়ে বাধা দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলে, অপ্সরা শুভকে আটকে দিয়ে আবারও বলে উঠল

“কী বলতে চান আপনি? এখান থেকে বের হয়ে যান। আপনাকে আমার একদম সহ্য হচ্ছে না। দয়াকরে আপনি আমার সামনে থেকে যান।”

রাগের মাথায় কখন যে অপ্সরার কণ্ঠস্বর উচ্চ হয়ে গেছে, সেটা সে নিজেও খেয়াল করেনি। চিৎকার শুনে অফিসের সবাই সেখানে উপস্থিত হলো। আর এদিকে অপ্সরা আশেপাশে না তাকিয়ে শুভকে আবারও বলে উঠল

“আপনি যাচ্ছেন না কেন?”

এরমধ্যেই মাহিনুর সাহেবের আগমণ। তিনি এসে অপ্সরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল

“অপ্সরা আপনি উনার সাথে এভাবে কথা কেন বলছেন? আপনি তো এ অফিসের টোটাল কমিউনিটি সাইট টা দেখেন। আপনার কমিউনিটি স্কিল এত খারাপ হবে আশা করিনি।”

অপ্সরা রাগের মাথায় উত্তর দিল

“আপনি জানেন না ভাইয়া এ লোকটার জন্য আমি শান্তি পাচ্ছি না। আমার পিছে আঠার মতো লেগে আছে। খুঁজতে খু্ঁজতে এখানেও চলে এসেছে। “

অপ্সরার কথা শুনে মাহিনুর সাহেব কিছুটা বোকা বনে গেল। বুঝতে পারল তার বিজনেস পার্টনার শুভর সাথে অপ্সরার কোনো কানেকশন আছে। তবে সে সেটা সরাসরি না বুঝিয়ে অপ্সরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল

“উনি আমাদের নতুন বিজনেস পার্টনার। আমার সাথে দেখা করার জন্য এসেছে। আপনি উনার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছেন?”

অপ্সরা এবার অবাক চোখে একবার মাহিনুর সাহেবের দিকে তাকাল, আরেকবার শুভর দিকে। সে ভাবতে লাগল তাহলে শুভ এখানে এসেছে কেবল বিজনেসের জন্য। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই বলে উঠল

“আমি বিষয়টা ব্যক্তিগত দিকে নিয়ে গিয়েছিলাম এজন্য সরি। “

মাহিনুর সাহেব তবুও একটু কড়া গলায় বলল

“তাই বলে আপনি অফিসে এভাবে চিল্লাচিল্লি করতে পারেন না।”

মাহিনুর সাহেব আরও কিছু বলতে নিলে শুভ তাতে ব্যাগড়া দিয়ে বলল

“মিস্টার মাহিনুর আমি কিছু মনে করিনি। উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত কিছু বিষয় নিয়ে সমস্যা চলছিল। উনি আমাকে সেজন্য এতগুলো কথা শুনিয়েছে। এখানে একান্তই দোষটা আমার। পূর্বে আমি এমন কিছু অস্বাভাবিক কান্ড করেছি যে, উনার এমন করাটায় স্বাভাবিক। যাইহোক চলুন কাজ নিয়ে বসা যাক।”

শুভর কথা শুনে মাহিনুর সাহেব অফিসে জড়ো হওয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল

“আপনারা কাজ রেখে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান গিয়ে কাজ করুন। আর অপ্সরা আপনি নিজের কাজে মন দিন এবং এক ঘন্টা পর আমার রুমে আসুন। আর মিস্টার শুভ চলুন বসা যাক।”

শুভ আর মাহিনুর সাহেব চলে গেল। অপ্সরার মাথাটা কেমন জানি ঘুরছে। শুভর ব্যবহারটাও আগের থেকে ভিন্ন। সাধারণত শুভ নিজের ঘাড়ে এভাবে দোষ নেওয়ার পাত্র না। আর এত চিল্লাচিল্লির পর সে নিজেকে স্থির রেখেছে, কীভাবে সেটাই ভাবতেছে সে। কেমন যেন সব এলোমেলো লাগছে। অফিসের সবাই ব্যপার টা নিয়ে বেশ আলোচনা,সমালোচনা করছে। বলা চলে রাজনীতির দ্বিতীয় মাঠ অফিস। 

ঘন্টা এক পর শুভ, মাহিনুর সাহেবের রুম থেকে বের হলো। যাওয়ার সময় অপ্সরার হাতে একটা চিঠি দিয়ে গেল। অপ্সরা কোনো কথা বলল না। চিঠিটা নিয়ে ব্যাগে রেখে দিল। এদিকে মাহিনুর সাহেব অপ্সরাকে ডেকে পাঠাল। অপ্সরা রুমে প্রবেশ করতেই তিনি বলে উঠলেন

“চেয়ারটা টেনে বসুন।”

অপ্সরা চেয়ার টেনে বসলো।  মাহিনুর সাহেব অপ্সরার দিকে তাকিয়ে বললেন

“আমি আপনাকে অনেকদিন যাবত একটা কথা বলব বলব করেও বলা হচ্ছিল না। প্রকৃত পক্ষে আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগত। তবে আজকে মিস্টার শুভর মুখে আপনাদের কাহিনি শুনার পর মনে হলো আপনাকে উনি ভীষণ ভালোবাসে। উনার ভুলগুলোর জন্যও উনি লজ্জিত। আপনাদের জন্য শুভ কামনা রইল। “

অপ্সরা পাল্টা কোনো উত্তর দিল না। শুধু মাথা নাড়িয়ে গেল। এরমধ্যে মাহিনুর সাহেব আবার বললেন

“মানুষের জীবনেই তো ভুল হয়। আমার মনে হয় কেউ শুধরালে ভুলগুলোকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। আচ্ছা আপনি এখন যেতে পারেন।”

“হুম।”

আর কোনো কথার বিস্তার ঘটল না। অপ্সরা চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে আসলো। আসার পর থেকে তার ভেতরটায় কেমন যেন লাগছে। যে অতীত থেকে সে বাঁচতে চায় সে অতীতেই যেন সামনে এসে হানা দেয়। অপ্সরা এবার কাঁপা হাতে শুভর চিঠিটা খুললো। তাতে লেখা

“অপ্সরা কথাগুলো মুখেই বলে আসতে পারতাম। তবে এতে তোমার বিরক্তিও ধরে যেতে পারে। আমার উপর রাগ হওয়া অস্বাভাবিক  না। আমি যা করেছি সেটা নিতান্তই ভুল ছিল। আমি আমার ভুলটা অবশ্যই শিকার করি।  তবে আমি আমার ভুলগুলো শুধরিয়েছি এই কয়দিনে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা  করব। তুমি সময় নিয়ে আমাকে উত্তর জানিও।”

অপ্সরা বেশ দোটানায় পড়ে গেল। এতকিছুর পরও একটা ক্ষীণ দুর্বলতা তার কাজ করছে শুভর প্রতি। সব মিলে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। সারাদিন চায়লেও অফিসে মন দিতে পারছে না। অস্থিরতা নিয়ে অফিসটা শেষ করে বাসায় গেল সে। রাতে লাইট বন্ধ করে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথাটা দিয়ে শুয়ে আছে সে। কী করবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না সে। 

হঠাৎ করে লাইট টা জ্বলে উঠল।  আচমকা লাইট জ্বলতে দেখে অপ্সরা মাথা উঁচিয়ে তাকাল। ডাক্তার তাহিরা অপ্সরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস  করল

“কী হয়েছে তোমার? মন খারাপ?”

অপ্সরা হালকা দম নিয়ে  সমস্ত ঘটনা খুলে বলল সাথে আরও বলল

“আমি শুভর মধ্যে তেমন পাগলামি পাইনি। একদম শান্তশিষ্ট। শুভকে এভাবে কখনও আবিষ্কার করব আশাও করিনি। এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না।”

ডাক্তার তাহিরা অপ্সরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল

“আমার কাছেও মনে হয় সে পরিবর্তন  হয়েছে। সে তোমার ঠিকানা আগেই জেনেছিল। আমার কাছ থেকে তোমার খোঁজ নিত। তুমি যে পাগলামির কথাগুলো শেয়ার করেছিলে তার মধ্যে আমি তা পাইনি। মানুষ তো পরিবর্তনশীল।  হয়তো সে শুধরিয়েছে নিজেকে। তারপরও বলব আরও কিছুদিন তুমি তাকে দেখো। এরপর সিদ্ধান্ত  নাও।”

ডাক্তার তাহিরা কথাগুলো বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। অপ্সরার যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এটা ভেবে যে শুভ এতদিন তার খবর জেনেও তার সামনে আসেনি। কোনোরকম পাগলামি করেনি। সবমিলিয়ে সে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত  নিল যে, কাল সে শুভর সাথে দেখা করবে। 

বাইরে হিম শীতল বাতাস। রোদের খড়া গুচিয়ে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। আজকে অফিসে যাবে না মনস্থির করেছে অনেক আগেই। শুভর সাথে দেখা করতে যাবে। তাই বেশ পরিপাটি হয়ে  শুভর সাথে দেখা করার জন্য রওনা দিল সে।

টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। চারদিকে হালকা অন্ধকারের আভা। সেইফ টেইবলের সামনে গেল সে। দূর থেকেই লক্ষ্য করল শুভ দাঁড়িয়ে আছে। শুভকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আস্তে পায়ে হাঁটতে লাগল। বড্ড ভয় কাজ করছে।  ভয়ে বুকটা ধুকধুক করছে। না জানি কী হয়। তবে সকল ভয় নিমিষে ম্লান হয়ে গেল শুভর সামনে যেতেই৷ শুভর ব্যবহারের এত পরিবর্তন  সত্যিই সে আশা করেনি। মিনেট দুয়েক পার হলো তাদের একে অপরকে দেখে আর টুকটাক কথা বলে।

মিনেট দশেক তারা দাঁড়িয়ে রইল। তারপর শুভ অপ্সরাকে এক জায়গায় বসতে বলল আর সে চলে গেল খাবার অর্ডার করতে। সাধারণত শুভর এমন ব্যবহার এর আগে কখনও দেখেনি সে। অপ্সরার দিকে অনেকে তাকাচ্ছে এতে শুভ কোনো ভ্রূক্ষেপ করছে না। সাধারণ মানুষের মতো নিজেকে রেখেছে। খাবার অর্ডার দিয়ে শুভ অপ্সরার মুখোমুখি বসলো। তারপর নম্র গলায় বলল

“তোমার যদি মন সায় দেয় বলতে পারো। আমি তোমাকে বিয়ে করব। একদম সাধারণ মানুষের মতো। তোমার বাসায় গিয়ে সব বলে অনেক আগেই ঠিক করে নিয়েছি। এখন তোমার পরিবার তোমাকে ভুল বুঝবে না। তুমি চায়লেই আমরা এগুতে পারি। জোর নেই কোনো। তবে তোমার উত্তর আশা করছি।”

অপ্সরার হাত, পা কাঁপছে। এত স্বাভাবিক  আচরণ দেখে সে বুঝতে পারলো সত্যিই শুভ পাল্টে গিয়েছে। সে এমনিতেও শুভর প্রতি দু্র্বল ছিল৷ তাই কাঁপা গলায় উত্তর দিল

“আপনি যা চান।”

শুভ অপ্সরার হাতটা টেনে একটা চুমু কেটে কেঁদে দিয়ে বলল

“আমার পাগলামির জন্য আমাদের বাচ্চাটা হারিয়েছি আমরা। জানো অপ্সরা আমার পরিবর্তন  ঠিক সেদিন থেকে এসেছে যেদিন আমি শুনেছিলাম তোমার মাঝে বেড়ে উঠা  প্রাণটা আর নেই। আমাদের সুন্দর সংসার হবে একটা বাচ্চা হবে। আমরা অনেক সুখী হব।”

“আপনি এভাবে কাঁদবেন না দয়াকরে।  আমার কষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। আপনি তো একটা উছিলায় পরিবর্তন  হয়েছে এটাই অনেক।”

তাদের মধ্যে সুন্দর একটা কথোপকথন শেষ হলো। দুজন দুজনের বাসায় আসলো। শুভ অপ্সরার পরিবারকে সবটা বুঝিয়ে অপ্সরাকে নিয়ে এবং ডাক্তার তাহিরাকে নিয়ে তাদের বাসায় দিয়ে আসলো। অপ্সরার পরিবারও বেশ স্বাভাবিকভাবে সব মেনে নিল।

সপ্তাখানেক পর তাদের বিয়ে ঠিক হলো। অপ্সরা প্রতিদিনকার মতো  অফিস করছে। অফিস শেষে বিয়ের শপিং করছে। সবমিলিয়ে তার জীবনের নতুন মোড় ঘুরল। 

আজকে তার বিয়ে। খুব স্বাভাবিক  ভাবেই তাদের বিয়ে হলো। একদম ঘরোয়া পরিবেশে। ডাক্তার তাহিরা,  অপ্সরার বাবা, মা,  অপ্সরাকে, শুভ এবং শুভর মায়ের হাতে তুলে দিল। সমর্পণ পর্ব শেষ করে বিদায় পর্বের সূচণা ঘটল। মাহিনুর সাহেবও বিয়েতে এসেছেন। তবে নিজের চোখে নিজের ভালোবাসার মানুষ অন্য কারও হতে দেখে একটু খারাপ তার লাগছে। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সে। ডাক্তার তাহিরা বিষয়টা বুঝতে পেরে মাহিনুর সাহেবের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল

“সবকিছু দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। পাওয়া, না পাওয়া নিয়েই জীবন। অপ্সরা সুখে থাকলেই তুমি নিজেকে সুখী মনে করবে। কারণ ভালোবাসার মানুষ সুখে থাকাটায় গুরুত্বপূর্ণ  তাকে পাওয়া নয়।”

মাহিনুর সাহেব মুচকি হেসে মাথা নাড়ল কেবল। অপ্সরা এবার গাড়িতে উঠল।  গাড়িটা চলছে। শুভর কাঁধে মাথা রেখে দীর্ঘ  নিঃশ্বাস নিচ্ছে। জীবনে দুঃখের পরে সত্যিই সুখ আসে এটা  সে প্রবলভাবে অনুভব করতে লাগল।

কিছুক্ষণের  মধ্যেই বাসায় পৌঁছাল সে। শুভর মা আর বোন মিলে অপ্সরাকে শুভর রুমে বসিয়ে আসলো। রাত একটা বাজতে চলল অপ্সরা শুভর জন্য অপেক্ষা  করছে। ঠিক একটা বিশে শুভ রুমে প্রবেশ করলো। অপ্সরা শুভর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। শুভ অপ্সরার পাশে বসলো। তার হাত দুটো ধরে বলল

“অনেকক্ষণ  না খেয়ে আছো কিছু খেয়ে নাও। আমি খাবার নিয়ে এসেছি। তোমাদের বাসা থেকে খাবার দিয়ে দিছিল। সেগুলোই দুজন খাব। সবসময় তো আমাকে খাইয়ে দিতে আজকে তোমাকে খাইয়ে দিব। হা করো।”

কথাগুলো বলতে বলতে শুভ লোকমাটা অপ্সরার দিকে বাড়াল। অপ্সরা খাবার খেতে লাগল। মোটামুটি  কয়েক লোকমা খেয়ে তার আর খেতে ইচ্ছা করল না। সে শুভ কে নম্র গলায় বলল

“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

কথাটা বলে সে ভয়ও পাচ্ছে। শুভ আবার পরিবর্তন  হয়ে গায়ে না হাত তুলে দেয়। তবে অপ্সরার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে শুভ বলে উঠল

“ঠিক আছে পরে খেও।”

অপ্সরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শুভ হাত ধুয়ে অপ্সরার সামনে বসতেই অপ্সরার গলা বুক জ্বলতে লাগল। তীব্র কষ্ট হচ্ছে তার। সে শুভর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে একটু পানি দিন।”

শুভ এবার হেসে উঠল। অপ্সরার দিকে তাকিয়ে বলল

“খাবারে  বিষ মিশিয়ে খাইয়েছি তোকে। তোর জন্য আমাকে অনেক নাটক করতে হয়েছে। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ তোকে দিব না এর আগেই তোকে সরিয়ে দিব। অপরূপার মতো আমি তোকে আমাকে ছাড়তে দিব না।”

অপ্সরা কষ্টে কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলল

“অপরুপা কে?”

অপর পাশ থেকে উত্তর আসলো

“আমার প্রথম স্ত্রী।  এর আগে জিজ্ঞেস  করেছিলে না আমার আলমিরায় কার কাপড়? ঐগুলো অপরুপার কাপড়।  আমি তোকে যেভাবে ভালোবেসেছিলাম তাকেও সেভাবে ভালোবেসেছিলাম। সে আমাকে টক্সিক, সাইকো অপবাদ দিয়ে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। তাই আমি নিয়্যত করেছি আমার জীবন থেকে কাউকে যেতে দিব না। দরকার হয় আমার জীবন থেকে তাকে সরিয়ে দিব। তুই ও বেঁচে থাকলে আমাকে ছেড়ে দিতি তাই তোকে শেষ করে দিলাম। তবে তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”

অপ্সরা তীব্র যন্ত্রণায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলল

“আমি বাঁচতে চাই।”

অপ্সরার কথা শুনে শুভ ওর গলা চেপে ধরল। অপ্সরা হাত পা নাড়িয়ে নিজেকে রক্ষার করার চেষ্টা করল। তবে শেষ রক্ষা আর হলো না।  যতক্ষণ  পর্যন্ত  তার নিঃশ্বাস বন্ধ না হলো ততক্ষণ  পর্যন্ত গলা চেপে ধরা হলো। অপ্সরা চোখ উল্টিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ল। শুভ অপ্সরার লাশের পাশে কিছুক্ষণ  বসে রইল। তারপর সারা শরীর মুছে দিল। এরপর সে লাশের সাথে শারিরীক  সম্পর্ক স্থাপন করল। এরপর আলমিরা থেকে ধারালো ছুরি চাপাতি নামিয়ে অপ্সরাকে টুকরো টুকরো করল। সেগুলো একটা বড়ো পলিথিনে আবদ্ধ করল। পুরো ঘর মুছে পরিষ্কার করল। তারপর শরীরের কাটা অংশ গুলো নিয়ে গাড়িতে করে দূরে গেল। ঢাকার অদূরে একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে সে কাটা ছিন্ন ভিন্ন দেহটা পুড়িয়ে ছাই করল। তারপর বাসায় এসে অপরুপার ছবিটা বের করে হাসতে হাসতে বলল

“তোকে ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দিলেও আর কাউকে দিব না।”

সকাল এগারো টা বাজে। শুভ সবাইকে কল দিয়ে অপ্সরাকে খোঁজতে লাগল। কিন্তু অপ্সরার খোঁজ কেউ দিতে পারল না। অপ্সরার পরিবার এবং বাকিরা ভাবলো হয়তো অপ্সরা আবার কোথাও পালিয়েছে। এদিকে একটা চিঠি জানান দিল অপ্সরা স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছে। চিঠিটা যদিও শুভই হাতের লেখা নকল করে লিখেছে। সবাই ভেবে নিয়েছে অপ্সরা স্বেচ্ছায় গিয়েছে। শুভর কান্না দেখে উল্টো শুভকে সন্দেহের পরিবর্তে স্বান্ত্বণা দিতে লাগল।

কেটে গেল পাঁচ থেকে ছয় মাস। অপ্সরার ছাইটাও মাটিতে মিশে গেছে। শুভ এখন আবারও প্রেমে পড়েছে। মেহেরিমাকে তার ভীষণ ভালো লাগে। মেহেরিমার জন্য তার পাগলামু শুরু হয়েছে। হয়তো সে পাগলামোর সে পরিণতি অপ্সরার মতো রূপ নিবে। 

গল্পের শেষে এটাই বলব কারও অভ্যাস সহজে বদলায় না। কাউকে ভালোবাসার আগে তাকে যাচাই করুন। সে সুস্থ কি’না পর্যবেক্ষণ  করুন। তার পাগলামোটা স্বাভাবিক  নাকি অস্বাভাবিক  বিবেচনা করুন তারপর তার সাথে জড়ান। অন্যথায় হয়তো আপনিও হতে পারেন কোনো সাইকো কিলারের গুটি।

সমাপ্ত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।