গ্রামের নাম আনন্দপুর ( চতুর্থ খন্ড )

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৬১

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

৫ তারকা হোটেলর ভিতর প্রবেশ করলো রায়হান আর নিপা। এইটা নিচ তালা। চারপাশে বেশ কয়েকজন বসে আছে। কেউ ফোন দেখছে, কেউবা পেপার পড়ছে। রায়হান একহাতে নিপার হাত ধরে আরেকহাতে লাগেজ ধরে এগিয়ে যায় রিসিপসনের দিকে। চারপাশ বেশ সৌন্দর্যমন্ডিত। দূরে দেওয়ালে ৫ টা ঘড়ি বিভিন্ন দেশের সময় দেখাচ্ছে। রায়হান এসে রিসিপসনের সামনে দাঁড়ায়। রিসিপসনের ওপাশে থাকা এক কালো কোর্ট পরিহিত হোটেল ইম্পয়ি বলে উঠে,

– আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। হোটেল ইম্পেরিয়াল এ আপনাদের স্বাগতম। 

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি আজ সকালে অনলাইনে একটা রুম বুক করে রেখেছিলাম। ইউজার নেইম রায়হান খাঁন দেওয়া। 

– জ্বী স্যার। আমি এখুনি চেক করছি‌।

হোটেল ইম্প্লয়ি তার সামনে থাকা কম্পিউটারে কিছু একটা টাইপ করে। রায়হানের হাত ধরে থাকা নিপা চারপাশ মাথা ঘুড়িয়ে দেখছে। আশপাশ বেশ গোছানো আর সাজানো। ৫ তারকা হোটেল। এখানে থাকা নিশ্চই বেশ ব্যায়বহুল হবে ,,! 

ইম্প্লয়ি কম্পিউটার চেক করে বলে,

– হ্যা স্যার। আপনি একটা সিঙ্গেল বেডের রুম বুক করেছিলেন। (একটু নিচে হেলে একটা কার্ড বের করে রায়হানের হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে) এই নিন স্যার, রুম নং ২০২ এর চাবি। 

– থ্যাংকস। 

– ইউ আর ওয়েলকাম স্যার। (মাথা ঘুরিয়ে একটু ডান দিকে নিয়ে আওয়াজ বাড়িয়ে) এই রতন ,,! স্যার দের ল্যাগেজ ২০২ এ দিয়ে আয়। (রায়হানের দিকে ফিরে) হ্যাভ এ নাইস টূর স্যার এন্ড ম্যাডাম। 

– হমম। 

একজন হোটেল কর্মী এগিয়ে আসে। এসে রায়হানের পাশে থাকা ব্যাগ টা হাতে নেয়। চলে যেতে থাকে সিড়ির দিকে। রায়হান নিপার হাত ধরে। তারা দুইজন চলে যেতে থাকে লিফটের দিকে। 

 

দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে রায়হান। তার পিছু পিছু ঘরে আসে নিপা। হোটেল কর্মী তাদের ব্যাগ টা রুমে রেখে দিয়েই চলে যায়। রুমটা বেশ গোছানো ছিলো। একটা বড় বেড। তার সামনাসামনি বিপরীত পার্শ্বের দেয়ালে একটা বড় টিভি লাগানো। বিছানার পার্শে একটা টেবিল। সেখানে কিছু বইয়ের শো পিস রাখা। বিছানার মাথার পার্শে উপরের দেয়ালে একটা বড় চিত্রকর্ম আঁকা। নিপা চারপাশে ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখছে। রায়হান দরজা লাগিয়ে দিলো। নিপা রুম দেখতে দেখতে হাসি মুখে বলে,

– রুমটা অনেক সুন্দর,,! 

– হ্যা। ঐযে ঐদিকে ব্যালকনি আছে। গিয়ে দেখো। ভালো একটা ভিউ পাবে সমুদ্রের। 

নিপা রায়হানের কথা শুনে সেদিকে এগিয়ে যায়। ব্যালকনির দরজা সম্পূর্ণ গ্লাসের। সে দরজা দুটোকে টেনে খুলে। একটা ছোট্ট ব্যালকনি বারান্দা। সে ব্যালকনি থেকে দাঁড়িয়ে সামনে তাকানো মাত্রই অবাক হয়ে যায়। এখান থেকে সমুদ্র সৈকত বেশ দারুন ভাবে উপভোগ করা যাচ্ছিলো। তারা ৪ তালায়। এই হোটেল টার সামনে কিছু ছোট ছোট দোকান আর তারপরই সমুদ্রের পাড় শুরু। সমুদ্রের ঢেওয়ের শব্দ এখান থেকে শোনা যাচ্ছে। 

সময় টা সন্ধ্যা। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। নিপা তাড়াতাড়ি রায়হানকে ডাক দিলো এখানে আসার জন্য। রায়হান ব্যালকনিতে চলে আসে। নিপা তার হাত ধরে টেনে তার পাশে দাঁড় করায়। আনন্দ মুখ নিয়ে বলতে থাকে। 

– দেখো দেখো সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে ,,! 

– হ্যা। দারুন টা দৃশ্য টা ,,! 

 

নিপা রায়হানের হাত জড়িয়ে ধরে। তার হাতের মাংসপেশিতে আলতো করে মাথা রাখে। ধীর গলায় বলে,

– তুমি যে পাশে আছো, তাই এই সূর্যাস্ত আরো বেশি সুন্দর লাগছে। 

রায়হান একটা ছোট্ট হাসি দেয়। নিপার কপালে চুমু খায়। নিপার মাথায় তার মাথা রেখে বলে,

– আমার মিষ্টি বউটা ,,! 

 

দুইজনেই সূর্যাস্ত উপভোগ করতে থাকে। আকাশ খানা হলদেটে বর্ণ ধারণ করেছে। থালার মতো সূর্য টা সমুদ্রের মাঝে যেন ডুবে যাচ্ছে। সেই অর্ধ ডুবন্ত সূর্যের সামনে দিয়ে কিছু নিড়ে ফেরা পাখি উড়ে যায়। সূর্য ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ টা ডুবে যায় সমুদ্রের অতলে। 

 

    ঘরে চলে আসে দুজনেই। নিপা এসে বিছানায় বসে। বিছানার তোশকটা একদম নরম, তুলতুলে। রায়হান এসে নিপার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে,

– যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও। অনেকটা রাস্তা জার্নি করলে তো। 

– তুমি যাও আগে। আমি এখানে একটু বসে থাকবো। এই বিছানায় শুতেও নিশ্চয়ই অনেক আরাম পাওয়া যাবে। 

বলেই গা এলিয়ে দেয় নিপা। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। রায়হান বলে,

– তাইলে আমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি আগে। 

নিপা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। শুয়ে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে রায়হানের দিকে। রায়হান তার পকেট থেকে ফোন বের করে। বের করে অন করার চেষ্টা করে। কিন্তু ফোন বন্ধ। রায়হান ফোনটাকে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে বলে,

– চার্জে দিয়োতো। বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ই ১২% ছিলো। এখন একদম বন্ধ হয়ে আছে। বাবাকে ফোন দিয়ে বলতাম যে আমরা পৌছাইছি। 

– আমার ফোনটা আছে তো। ঐটা দিয়ে ফোন দাও। 

– তোমার টায় তো নতুন সিম। আমার আর তোমার বাড়ির লোকদের নাম্বার ছাড়া কারো নাম্বার নাই। আর আমার তো বাবার নাম্বার টাও মুখস্থ নাই। 

– আচ্ছা আমি চার্জে দিচ্ছি। পরে ফোন অন হইলে কল দিয়ো। 

– ঠিক আছে। 

রায়হান চলে যেতে থাকে ওয়াশরুমের দিকে। রুমের সাথে এটাচ ওয়াশরুম আছে। রায়হান ওয়াশরুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। 

 

নিপা বিছানা থেকে উঠলো। এভাবে শুয়ে থাকলে তো হবে না। রাত হয়ে যাচ্ছে। রায়হান বেড়োলে তাকেও ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে। বাস জার্নি আগে এতোটা করেনি সে। সেই দিনাজপুর থেকে কক্সবাজার। এতোটা রাস্তা বাস জার্নি করে কিছুটা খারাপ লাগছে এখন। তখন সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ক্লান্তিটা যেন এক মুহুর্তের জন্য হলেও উধাও হয়ে গিয়েছিলো। তবে এখন বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ায় মাথাটা কিছুটা ধরেছে। 

নিপা গিয়ে ফ্লোরে থাকা ব্যাগ টা নিলো। ব্যাগ টা সোজা করে চেইন খুললো। এখন গোসল করে কী পড়া যায় সেটা খুঁজছে সে। একটা থ্রী পিস বের করে নিলো। শাড়ি এনেছে একটা। তবে এখন শাড়ি পড়ার আর সামলানোর মতো এনার্জি বা ইচ্ছা কোনটাই তার নেই। 

নিপা এক সবুজ থ্রী পিস বের করে নিলো। তখনই তার চোখ গেলো সেই কাপড়ের বক্সটার উপর। এটা সবার শেষে ব্যাগে ঢুকাইছিলো তাই উপরের দিকেই ছিলো। নিপা তা দেখা মাত্রই লজ্জায় লাল হয়ে যায়। পিছনে ফিরে ওয়াশরুমের দিকে দেখে। রায়হান এখানো ভিতরেই আছে। নিপা আবার সামনে তাকায়। কাপড়ের বক্সটা বাকি কাপড়ের ভিতরে ঢুকিয়ে রাখে। বিরবির করে বলে,

– রায়হানের একদম লজ্জা নাই। খালি এসব হাতে পাইলেই হইছে। আমাকে না পড়ায় আর ছাড়বেনা। (একটু থেমে নিজের মাথা নিজেই ধরে) আর তুই এতো লজ্জা পাইতেছিস ক্যান,,! ও তো তোরই জামাই ! অন্য লোক তো না !  ধ্যাত ,,! 

নিজের মাথায় নিজেই হাত দিয়ে থাপড় দিয়ে ব্যাগের চেইন আটকিয়ে রেখে দিতে থাকে সে। লজ্জায় মুখ খানা তার এখনো লাল টুসটুসে হয়ে আছে। থ্রী পিস হাতে নিয়ে উঠে পড়ে। চলে যায় বিছানার দিকে। 

 

_____

 

সন্ধ্যা তারার নিচে বসা দুই পাগল পাগলী কথা বলছে একে অপরের সাথে। আকাশ আজও বেশ পরিস্কার। হালকা জোছনা পড়েছে। সুমু দুটো রুটি হাতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পড়নে লায়লার জামাটা। মুখে ওড়না দেওয়া। কাল রাতে ও লায়লার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়েছিলো। লায়লা তার কাছে থাকা ৫০ টা টাকা সুমুকে দিয়েছিলো। সেটা দিয়েই আজ সে দুটো রুটি কিনেছে। এই পাগল পাগলির একে অপরের প্রতি ভালোবাসাটা যেন আবারো তার দেখতে মন চাইছে। 

 

পাগলীর মাথা থেকে উকুন বেছে দিচ্ছিলো পাগলটা। আলো নেই তেমন। এদিকটা অন্ধকার। তবুও তারা নিজেদের মন মতো কাজ করছে। সুমু এসে তাদের পাশে দাঁড়ায়। মুখের উপর থেকে ওড়না খানা সড়াবার আগে পিছন ফিরে আশপাশটা ভালোভাবে দেখে নেয়। সামনে ফিরে তাদের দিকে রুটি দুটো এগিয়ে দেয় সে। মুখের ওড়না খানা নামানো মাত্রই পাগল পাগলী চিনতে পেরে যায় সুমুকে। পাগলী পাগলকে বলে,

– রাজা,,! এইডা কাইলকার মাইডা না ,,! দেখ আবার আইছে আমাগো লাইগা রুটি নিয়া। 

– হ রাণী। এইডা কাইলকার ঐ মাইয়াডাই। 

– আজ দুটো এনেছি তোমাদের জন্য। হয়তো তোমাদের সম্পূর্ণ খুদা মিটবে না। আমি লায়লাকে আজ বলবো ভাত বেশি করে আনতে। রাতে এসে তোমাদেরও ভাত দিয়ে যাবো। কেমন ! 

– রাজা, মাইয়াডা আমাগো ভাতও দিবো। মাইয়াডার মন অনেক ভালা, তাইনা রাজা ,,! 

– হ রাণী। তুমি ঠিক কইছো। মাইয়াডার মন অনেক ভালা। সবাই যদি এমন কইরা আমাগোর লগে কথা কইতো ,,! (মন খারাপ করে) ঐ দোকানদার গুলা খালি আমাগোরে মারতে আহে‌। 

– আচ্ছা আর মারবেনা। নাও। রুটি গুলা খাও। 

দুই পাগল পাগলী রুটি দুটো হাতে নেয়। পাগলীটা তার রুটি টা পাগলের রুটির সাথে বদলে নেয়। মুখে হাসি। পাগলটাও তার টা দিয়ে পাগলির টা নেয়। প্যাকেট থেকে বের করে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে খেতে থাকে তারা। লায়লা তাদের পাশেই হাঁটু গেড়ে বসা। এদিকের ২-৩ টে দোকান বন্ধ থাকায় পাগল পাগলী দুটোর এদিকটায় আশ্রয় হয়েছে। নাইলে তাদের এখান থেকেও হয়তো কেউ না কেউ খেদিয়ে দিতো। 

সুমু বলে,

– আচ্ছা যখন বৃষ্টি হয়, তখন তোমরা কোথায় থাকো ,,! 

খেতে খেতে পাগলিটা সুমুর দিকে তাকায়। বলে,

– যহন বৃষ্টি আহে তহন মুই আর রাজা বন্ধ দোকান গুলার সামনে গিয়া খারাই। মাঝে মাঝে মাহাজন খারাইতে দেয়। মাঝে মাঝে আমাগোরে তাড়ায়া দেয়। তহন আমরা দুইজন মিল্লা কোনো গাছের নিচে গিয়া খারাই। 

– তোমাদের বাসা নাই। তোমরা কী আগে থেকেই একসাথে ছিলে? 

– না। আমি রাজারে রেলস্টেশনে খুঁইজা পাইছিলাম। রাজা অসুস্থ আছিলো। ঐদিন রাইতে রাজার অনেক জ্বর আইছিলো। আমি আমার পোটলা থেইকা কাথা বাইর কইরা অর উপরে দিছিলাম। সারারাইত অর লগে আছিলাম। আমি খাওন পাইলে অর লগে ভাগাভাগি কইরা খাইতাম। আমার রাজারে হেইদিনের পর থেইকাই ভালা লাইগা যায়। তারপর থেইকা আমি আর অরে ছাইড়া যাইনাই। তাইনা রাজা ,,! হি হি হি! 

– হ রাণী। তুমি আমারে ছাইড়া আর যাইও না। আমি তোমারে ছাড়া মইরা যামু। 

– আমি কোত্থাও যামুনা রাজা। 

দুই পাগল পাগলী হাসি খুশি খেয়ে নিতে থাকে রুটি টা। সুমু

তার স্মৃতি বিচরণ করতে থাকে। আজ বিকেলেও সে একজনকে দেখেছে। সাদা পাঞ্জাবি পড়া এক সুদর্শন যুবক। হাতে ফুলের তোড়া ছিলো। মাথার চুল গুলো সুন্দর করে আঁচড়ানো। চেহারায় একটা ম্লিন ভাব ছিলো। ছেলেটার থেকে তখন যে সে চোখই সড়াতে পারছিলো না। এখনও ছেলেটার মুখয়ব তার হ্রদয়ের আয়নায় ভাসছে ,,! 

ধীর গলায় সুমু বিরবির করে বলে উঠে,

– উনি কে ছিলেন ,,! এই গ্রামে হয়তো বেড়াতে এসেছিলেন। তার পোশাক দেখে তো তাই মনে হলো। (একটু থেমে) আচ্ছা উনার নাম কি,,! আমি কী আবার কোনসময় তার দেখা পাবো না ,,! 

পাগল পাগলীর হঠাৎ কথায় সুমুর ঘোর ভাঙে। পাগলিটা পাগলকে বলছিলো,

– রাজা, রুটিতে ক্রিমও আছে। অনেক মজা না রুটিডা ,,! 

– হ রাণী। অনেক মজা। আমার রুটির ক্রিম ডা খাইবা তুমি ,,! 

– না। তুই তোর ডা খা। আমি আমার ডা খাই। তুই কম খাইলে পরে তহন অসুস্থ হইয়া যাইবি ,,! 

– আইচ্ছা রাণী। 

 

সুমু তাদের দেখে এক ম্লিন হাসি দেয়। এই জুটিটা কতো সুন্দর। তারও যদি একটা মানুষ হয়, খুব যত্নে রাখবে সে তাকে। একদম মনের মধ্যে রেখে দিবে সারাজীবন,,! রাতের চাঁদের আলোয় তার স্বপ্ন যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে ,,! আশপাশের ঝি ঝি পোকার ডাক, রাতের সৌন্দর্য যেন দিগুন বাড়িয়ে দেয়। তখনই সুমুর কানের কাছে ছোট্ট আকৃতি নিয়ে ভেসে উঠে হনুফা। সুমুর কানের কাছে গিয়ে বলতে থাকে,

– ঐ, শুননা ,,! 

– তুই,,! কেন আসছিস। কী হইছে ,,! 

– আমাকে একটা রুটি কিনে দে না। ওরা বলতেছে রুটি টা বলে অনেক মজার। ক্রিমও বলে আছে‌। আমিও খাবো। আমাকে একটু দিতে বলনা। 

– চুপ থাক। তুই এইসব খাইতে পারবিনা‌। সর এখন কানের কাছ থেকে‌।

হনুফা মুখ গোমড়া করে। বলে,

– তুই আমাকে কিচ্ছু খাইতে দিস না। 

– তুই না ভূত। তুই কীভাবে খাবি ,,! 

– আমার তাও খাইতে মন চাইতেছে। দেখ, ওরা কত মজা করে খাইতাছে। দেনা আমারে একটা রুটি কিনে ,,!

– তুই গেলি আমার কানের পাশ থেকে ,,! নাইলে কিন্তু দিবো একটা ,,! 

– কী দিবা ,,! 

– মাইর। এমনে করে মাইর। 

বলেই হাত দিয়ে কানের পাশে থাকা হনুফার ধোঁয়াটাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় সুমু। হনুফা পালিয়ে যায়। সুমু তা দেখে একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে পাগল পাগলির দিকে চায়। দেখে ওরা এখনো খাচ্ছে। সুমু তাদের বলে,

– আচ্ছা তোমরা তাইলে খাও। আমি আবার রাতে আসবো তোমাদের জন্য ভাত নিয়ে।

– আইচ্ছা। তুমি ভালো থাইকো। 

– আচ্ছা। 

সুমু উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে থাকে। আকাশের উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় তার মন খানা তিরিং বিরিং ই করছে বটে। হনুফা আবার তার দু কানের সামনে মাছির মতো ভনভন করতে থাকে। সুমুও তার এমন দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি দেখে মুচকি হাসে।

 

       চৌড়চকের উত্তররের রাস্তাটার পাশে থাকা ক্লিনিক থেকে বেড়িয়ে এলো ফুলমতি, সামিহা,দিথী আর শিউলি বেগম। এই ক্লিনিকে আফাজ ভর্তি। এই ক্লিনিকটাকে আপনারা আগেও দেখেছিলেন। সেই ১৯৯৮ সালে যখন তাসনুভাকে এখানে তার ভাইয়েরা চেকআপে জন্য এনেছিলো তখন। এই ক্লিনিকটা বেশ পুরোনো। এই গ্রামে এটা আর খান বাড়িই কেবলমাত্র দোতল ইমারত। তাছাড়া আর কোন দিতল ভবন নেই এই গ্রামে। এই ক্লিনিকটার নাম ‘রেজারিও ক্লিনিক’। এইটা বানিয়েছিলেন নজরুল সাহেবের দাদা। তার দাদার পত্নির নামে এই ক্লিনিকের নামকরণ করা। তার পত্নি খ্রিষ্টান ছিলেন। 

 

শিউলি বেগম,দিথীরা ক্লিনিক থেকে বেড়িয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। বাজারে বেশ ভিড়। ব্যাটারিচালিত ভ্যান, অটো সব আরোহী নিয়ে যাচ্ছে আর আসছে। শিউলি বেগম রা একটু সাইড হয়ে দাড়ান। ভিড় টা একটু কমলে বাড়ির দিকে পা এগোবেন। দিথী তার পাশে দাঁড়ানো। ঐদিকে সামিহা আর ফুলমতি একে অপরের সাথে কথা বলছে কী বিষয় নিয়ে জানি। শিউলি বেগম দিথীকে ধীর গলায় বলে উঠেন,

– আফাজের কথা অর মা বাপরে কইতেও ডর লাগতাছে। পোলাডা নিপার ননদ রে এতো পাগলের মতো ভালোবাসে এইডা আমরা কেউই বুঝতে পারিনাই‌।

– হ্যা মা। আফাজ ও তো মাত্র এই ৩-৪ দিন ই ছিলো এইখানে। একয়দিনেই আলিশাকে ভালোবেসে ফেলছে ও। 

– ভালোবাসা হইতে সময় লাগেনা মা। একমিনিটেও হইতে পারে, আবার এক সেকেন্ডেও হইতে পারে। দেখছো আফাজের হাত কেমন ফাইটা গেছে,,! ডাক্তার তো কইলো প্রেশারও লো। সেলাইন দিছে। জ্ঞান ফিরলেই আলিশা আলিশা কইয়া চিৎকার করতাছে। ইনজেকশন দিয়া ঘুম পাড়াইয়া রাহোন ছাড়া ওরে শান্ত করা যাইতাছে না। এই সব এহন আমি আমার ভাইরে কেমনে কই ,,! ফোন দিতেও ভয় লাগতাছে আমার।

– সব ঠিক হয়ে যাবে মা। চিন্তা করিয়েন না। আফাজের মা-বাবারা বলে সৈয়দপুর গেছে। ইকরা আর আফাজ এখনো রংপুরেই আছে এটাই ওরা জানে। আপনি ফোন করে বলিয়েন না। পড়ে ওরা টেনশন করবে। আফাজ সুস্থ হলে কয়দিন এবাড়িতেই থাক। তারপর নাহয় ওকে রংপুর পাঠিয়ে দিয়েন। 

– হ। এইডাই করা লাগবো। আফাজের শরীরও দুর্বল। ডাক্তার তো কইলো যাউ ভাত নাইলে সাবু খাওয়াইতে। রাইতে লায়লা সহ আমি আইয়া ওরে সাবু খাওয়াইয়া যামু। (একটু থেমে) আর এদিকে আমার মতিন ডা যে হেই সকালে গন্জে গেছে আর কী ফিরার কোনো খোঁজখবর আছে ,,! গ্রামে দুই দুইডা নৃশংস খুন হইয়া গেলো। তার কানে কী এহনো খবর পৌছায় নাই ,,! 

– আব্বা মনে হয় দিনাজপুর শহরে গেছে। গন্জে থাকলে এতোক্ষণে খবর পায় যাওয়ার কথা। 

– অর তো খালি পৌরসভা অফিস আর গন্জ বাজার। এই দুইডা ছাড়া কী অর আর ঘরবাড়ি আছে ,,! বাড়িত মাইয়া পোলার কী হয় হোক। অয় ঐদিকে যাইয়া পৌরসভা অফিসে বইয়া থাকবো। আমারও হইছে সব জ্বালা। 

– আচ্ছা রাগ করিওনা মা। আব্বা ঠিক চলে আসবে। চলেন বাসার দিকে এগোই। বাতাস করতেছে খুব এদিক। 

– হ লও। এই সামিহা, ফুলমতি লও। তাড়াতাড়ি বাসা যাইতে হইবো। 

– দিথী,,,,! (পিছন থেকে শাহারিয়ার ডাক ভেসে আসে। দিথী সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে তাকায়। দেখে একটা ব্যাটারি চালিত ভ্যানে করে শাহারিয়া আসছে। কাল যে বিকালে আহনাফকে নিয়ে ঢাকার জন্য বেড়িয়েছিলো এই আজ ফিরলো। 

 

ভ্যান টা এসে দিথীদের পাশেই থামে। শাহারিয়া সেখান থেকে নামে। ভ্যান টা চলে যায়। শাহারিয়া দিথীকে দেখেই তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দিথী তাকে ছোট্ট একটা আলিঙ্গন করে। তার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

– এতোদেরি হলো কেনো ,,! 

– আর বলিও না। আসতে চাইছিলাম রাতের ট্রেনে। কিন্তু না, ট্রেনই পাইলাম না। তাই সকালের ট্রেনে আসতে হইলো। তোমার এখানে কী করো। মাও তো দেখি এখানে। ব্যাপার কী। 

– তোর বউরে বাজারে কেজি দরে বেচতে আইছিলাম। (শিউলি বেগম)

– হেইস। কি যে বলোনা মা। (দিথীর দিকে ফিরে) এখানে এতো রাতে কেনো ,,! 

– আফাজ ক্লিনিকে ভর্তি। 

– আফাজ ? ওকে তো কাল ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসলাম। ওরতো রংপুরে থাকার কথা। 

– হ্যা রংপুর গেছিলো। তারপর আবার ফিরে আসছে। গ্রামে অনেক কিছু ঘটে গেছে আজকে। 

– মানে বুঝলাম না কিছু। কী হইছে। কোন সিরিয়াস কিছু,,!

– হ্যা। তুমি চলো, একসাথে যেতে যেতে বলছি। (মৃদু গলায় বলে দিথী) 

– আচ্ছা চলো। দুপুরের খাওয়া ঠিকমতো করছিলা ,,! 

– হমম। 

দিথী শাহারিয়ার একহাত জড়িয়ে ধরে তার পাশে একসাথে হেঁটে হেঁটে আসতে থাকে। শাহারিয়াও তার কাঁধে হাত রেখে তার থেকে সব কথা শুনতে থাকে। পিছুপিছু শিউলি বেগম, সামিহা আর ফুলমতি যেতে থাকে। তারা তিনজন যেন শাহারিয়া আর দিথীকে দেখে তাদের নিয়েই একে অপরের সাথে কথা বলছিলো। 

বাজারের এক দোকানের সামনে হতে মুখে ওড়না চেপে শাহারিয়া আর দিথীকে যেতে দেখে সুমু। তার থেকে আর মাত্র ৮-৯ হাত দূরেই তারা। সুমু শাহারিয়া আর দিথীর এমন সুন্দর মিল দেখে মৃদু হাসে। তার মনে হতে থাকে দিথীর মতো সেও একদিন কারো হাত জড়িয়ে ধরে এভাবে হাঁটবে। আর কেউ একজন তার কাঁধে হাত রেখে তাকে আরো আগলে নেবে। সুমুকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে তার পাশে উদয় হয় হনুফা। বলতে থাকে,

– চল বাড়ি যাই ,,! 

– হমম যাচ্ছি। (একটু হেঁসে ম্লিন গলায়) দেখ হনুফা। ওরা দুজন কতসুন্দর একে অপরের সাথে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। 

– হ্যা। যাচ্ছে তো। কিন্তু তাতে আমাদের কি। ঐ দিথীকে তো আমাদের মেরে ফেলতে হবে। আর ওর কাছ থেকে আংটিটা ছিনিয়ে নিতে হবে। নাইলে যে দিথী আর বাকি তিনজন মিলে আসুভেকে ধ্বংস করে দিবে। তোমাকে মেরে ফেলবে। 

সুমু চকিতে হনুফার দিকে ফিরে তাকায়। বলে,

– আমাকে কেনো ওরা মেরে ফেলবে ,,! আমি তো কিছুই করিনি। যা করেছে সব আসুভে নামের ঐ খারাপ আত্মাটাই করেছে। 

– আসুভে করলেও তোমার উপর তাদের ধারনা এই যে তোমার মাঝেও কোন না কোন শক্তি আছে। যা দিয়ে তুমি ওদের ক্ষতি করতে পারো। তাই ওরা তার আগেই তোমারে আর আসুভেকে মারে ফেলবে।

– কিন্তু তুইই তো কাল বললি যে আমার মধ্যে কোন খারাপ শক্তি নেই। আমি একজন স্বাধারণ মানুষ। 

– হ্যা তুই স্বাধারণই তো। কিন্তু ওরা যে তা জানেনা। 

– তারমানে ওরা আমাকে ভুল ভাবছে,,! 

– হ্যা। 

সুমু কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে যায়। সে আর হনুফা দাঁড়িয়ে ছিলো জঙ্গলে যাওয়ার রাস্তাটার মুখের সামনে। সুমু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,

– আচ্ছা আসুভে যদি মারা যায়, তাইলে তোর আর তান্ত্রিকের কী হবে ,,! 

– আমার কিছু হবে না। আমি শুধু তখন কোন কিছু করতে পারবোনা। শুধু তুইই আমাকে তখন দেখতে পাবি। আর তান্ত্রিক মারা যাবে। কারণ ওর সাথে আসুভের জীবন রেখা জড়ায় আছে। 

– আচ্ছা হনুফা। ধর আসুভে আমার শরীরে প্রবেশ করলো না। তুই আর আমি এভাবেই এখনকার মতো স্বাধারণ হয়ে রয়ে গেলাম। তখন কী তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি ,,! 

– না। আমি ক্যন যাবো। তুমি ছাড়া যে আমার কোন বন্ধু নাই।

সুমু, হনুফার কথা শুনে আরো কিছু ভাবে। ভাবতে ভাবতে পা বাড়ায় রাস্তাটার দিকে। যেতে থাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে। হনুফা সুমুর কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে তার সামনে ঘুর ঘুর করতে থাকে। বলতে থাকে,

– তোর কী মন খারাপ,,! 

– জানিস আমার না একটা ছেলেকে খুব ভালো লাগছে ,,! (মাথা নিচু করেই ম্লিন গলায় বলে সুমু)

– একটা ছেলেকে ভালো লাগছে ,,! কে সে ,,! কোথায় থাকে ,,! আমাকে বলো বলো ,,! (সুমুর সামনে ঘুর ঘুর করতে করতে বলে হনুফা)

– নাম জানিনা। ছেলেটা ফর্সা। গালে হালকা চাপ দাড়ি। চোখ আর চোখের পাপড়ি গুলা ঘন কালো। (মাথা তুলে) আর জানিস, ও সাদা পান্জাবি পড়ে ছিলো। হাতে ফুলও ছিলো। 

– কী বলিস ,,! তুই ওকে কোথায় দেখছিলি ,,! 

– আমি বিকেলে যখন বাইরে বেড়িয়েছিলাম তখন তাকে দেখেছি। তবে তার নাম জানিনা। 

– আয় হায় ,,! (লজ্জা মুখে) তুই প্রেমে পড়ছিস ,,! 

– ধুর ,,! তেমন কিছুনা ,,! 

– তাইলে তাইলে ,,! 

– যাহ্ তোকে বলবোনা। 

– এই বলোনা বলোনা। আমিও একটা ছেলের সাথে প্রেম করবো। তোমার মুখ থেকে শুনে এখন আমারো পছন্দ হয়ে গেছে ছেলেটাকে। আমি ছেলেটাকে দেখবো। 

– একদমই না। ঐ ছেলেটা শুধু আমার। তোকে দিবো ক্যানো ,,! তুই চকলেট, রুটি যা ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারিস। কিন্তু আমি ওকে দিবো না না না। 

– এই দেওনা দেওনা। আমিও প্রেম করবো। 

– সর। আমার সামনে থেকে সর। 

সুমু হনুফাকে সড়িয়ে দিয়ে আগে আগে যেতে থাকে। হনুফা তার পাশে পাশে ঘুর ঘুর করতে করতে আবদার করতে থাকে। আজও আকাশে গোল থালার মতো উজ্জ্বল চাদ খানা উঠেছে। আর সেই জোছনার আলোয় এই কিশোরী সুমুর চারপাশে জীনির মতো ঘুরঘুর করতে থাকা হনুফাকে দেখতে বেশ লাগছে। যেন এক প্রদীপ থেকে বেড়োনো জ্বীন আবদার করছে তার মালিকের সাথে ,,!

 

____

 

বিছানায় বসে টিভি দেখছে রায়হান। পড়নে একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার। টিভিতে ফুটবল খেলা দেখছে সে। ডেনমার্ক তার পছন্দের টিম। তাই ডেনমার্ক আর বেলজিয়ামের খেলাটা রিপ্লে দেখছিলো সে। নিপা গোসল খানার দরজা খুল্লো। খুলে বেড়িয়ে আসলো। রায়হান টিভির দিকে থেকে একবার নিপার দিকে হালকা তাকিয়ে আবার টিভির দিকে চোখ নিয়েছিলো। তাতেই যেন সে হঠাৎ চমকে উঠলো। সে আবার চোখ ফিরিয়ে নিপার দিকে তাকালো। 

নিপা গোসল খানা থেকে বের হয়। পড়নে টিয়া পাখির মতো সবুজ এক থ্রী পিস। মুখ খানা যেন এক শুভ্রতার ছোঁয়া। তাকে দেখতে যেনো আরো আগের থেকেও অনেক সুন্দর আর ফ্রেশ লাগছে। নিপা তার ভেজা চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে ফিরে তাকায় রায়হানের দিকে। রায়হান এক নয়নে তার দিকে চেয়ে ছিলো। নিপা কিছুটা ভ্রু কুঁচকিয়ে হাত নাড়িয়ে ইশারা দেয় তাকে। রায়হান যেনো ঘোরেই চলে গিয়েছে। নিপা তা দেখে এক মুচকি হাসি দিয়ে ভেজা চুল গুলো মুছতে থাকে। রায়হান এক পানে চেয়ে বলে উঠে,

– তোমাকে আমি যতবার দেখি ততবারই নতুন লাগে ,,! তোমার রুপের বাহারে আমি বারবার মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি,,! এতো মায়া ভরা চেহারা ,,! (বুকের বা পাশে হাত দিয়ে) এই খান টা যেন আমার মুহূর্তেই রঙিন হয়ে গেলো ,,! 

নিপা তা শুনে এক মুচকি হাসি দেয়। গিয়ে দাঁড়ায় ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে। গামছা দিয়ে চুল মুছতে থাকে। রায়হান বিছানা থেকে নেমে পড়ে। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় নিপার পিছনে। মাথা হেলিয়ে আয়নায় দেখতে থাকে নিপাল মুখখানা। নিপা তা দেখে আমার একটা সুন্দর হাসি দেয়। রায়হান গুন গুন করতে করতে এগিয়ে আসে। এসে পিছন থেকে নিপার দুই কোমড়ে হাত রাখে। নিপার কাঁধে মুখ রাখে। কাঁধে একটা ছোট্ট চুমু খায়। নিপা চুলের সুবাস তার নাকে লাগছিলো। এ যেন মন মাতানো ঘ্রাণ ,,! রায়হান নিপার কাঁধে থুতুনি রেখে খালি গলায় গান ধরে,

 

আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন

 

কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে

 

ফুটবে যখন ফুল বকুল শাঁখে

ভ্রমর যে এসেছিলো জানবে লোকে

,

,

নিপাকে ঘুড়িয়ে নিজের সামনে করে নেয় রায়হান

,

,

মনটি তোমার কেন দুরুদুরু কাঁপছে

মনের মানুষ কি গো, চেনা চেনা লাগছে

তুমি কি তারে কাছে ডাকবে

হৃদয়ের কাছে সে রয় অলোকে

হঠাৎ যখন তুমি দেখবে তাকে

শরমে নয়ন কি গো রাখবে ঢেকে,,

 

আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন

 

কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে

ফুটবে যখন ফুল বকুল শাঁখে

ভ্রমর যে এসেছিলো জানবে লোকে

 

নিপা রায়হানের কোলে মুখ লুকায়। এতো রোমান্টিক গান শুনে যে সেও রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে। তার শরম লাগছে। রায়হানকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে নিপা। রায়হানও নিপার কাঁধে নাক ডুবিয়ে দেয়। নিপা রায়হানের দুই পায়ের উপর পা দেয়। রায়হান নিপার চুলের সুবাসে হারিয়ে যাচ্ছিলো। নিপাকে এভাবে জড়িয়ে ধরার অনুভুতি যে ভাষাহীন। এটা ভাষায় ব্যাক্ত করার মতো না। নিপাও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলো। নিপার গাঁয়ের গন্ধ যেন তার এক চেনা রাজকন্যার প্রতিরূপ হিসেবে ধরা দেয়। রায়হান ফিরে এক পা দু পা করে বিছানার দিকে এগোয়। পিছনে টিভির সাউন্ড অফ করা। নিপা রায়হানের উপর দুই পা রাখায় তার পায়ের সাথে সাথে সে নিজেও চলছিলো। বিছানার কাছে এসে থেমে যায় রায়হান। নিপার মুখ খানা তার বুক হতে ধরে সামনে নেয়। নিপার চোখ দুইখানা ছলছল করছে। সে যেন কুসুম কোমল কোন ফুলের মতো। ঝাপটে ধরলেই যেন ভেঙে যাবে ,,! রায়হান তার ছলছল চোখ দুখানা চুমু খায়। চোখের পাপড়ির জল গুলো তার ঠোঁট ভিজিয়ে দেয়। রায়হান ধীর গলায় বলে,

– খোলা আকাশে মেঘ রা যেমন স্বাধীন,

তোমার আকাশ প্রান্তরে আমিও তেমন সীমাহীন,

তোমার মায়ায় এভাবেই আমাকে সারাজীবন জড়িয়ে রেখো ,,! 

স্রোতোসিনীর অববাহিকায় যেন এই ক্ষুদ্র মাঝি চিরকাল রয়ে যেতে পারে ,,! কথা দিচ্ছি, মৃত্যুকালের আগ অব্দি তোমায় আমার বুকের বা পাশটায় খুব যত্নের সাথে রেখে দিবো। 

মৃত্যুর পরেও আমি যেন তোমাকেই পাই। শুধু তোমাকেই,,!

রায়হান নিপার কপালের সাথে তার কপাল খানা রাখে। নিপার চোখে চোখ রেখে বলে,

– ভালোবাসি তোমায়,,! অনেক ভালোবাসি,,! 

 

নিপা চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। রায়হান তাকে এতোটা ভালোবাসা দিয়েছে যে সে বাকরুদ্ধ। নিপা রায়হানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রায়হানের পিঠখানা শক্ত করে চেপে ধরে। ছেড়ে দিলে এই বুঝি হারিয়ে যাবে। রায়হান তার কাঁধে চুমু খেয়ে তার ভেজা চুলের মাঝে নাক ডুবায়। খুব আগলে ধরে রাখতে থাকে নিপাকে। খুব যত্ন করে রেখে দেয় তার শরীরের সাথে।

তাদের ঘরে এসেছিলো জান্নাতি বাগানের সুবাস। এই প্রথম নিপা তার সবটুকু জুড়ে রায়হানকে অনুভব করেছিলো। রায়হানের ছোঁয়া তার খুব করে পেতে মন চাইছিলো। ভিতরটা যেন অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রায়হানের দেহের সাথে মিলে একাকার হয়ে যেতে চাইছিলো। রায়হান তাকে নিয়ে বিছানায় পড়ে যায়। দুজন দুজনকে আবারো নতুন ভাবে চিনতে থাকে। নিজের করে নিতে থাকে তাদের সবটুকু দিয়ে। 

 

______

 

– তুই কেনো ওদের দুইজনকে মারতে গেলি ,,! মারার আগে আমাকে একবার জিগাবার প্রয়োজন বোধ করলি না ,,! 

– আমি না মারলে যে সুরাইয়া, নিপাকে সব বলে দিতো ,,! নিপাতো এখন এটাও জানে যে তুমি মানুষের মাংস খাও। বাকিটুকু বলে দিলে তোমার এই লুকানো সাম্রাজ্য থাকতো ,,! রায়হান জানতে পারলে সব তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার করে দেবে তোমার এই সুখ, সাম্রাজ্য,,! 

– সোনালী ,,! আওয়াজ নিচে। রায়হান যেনো এইসব কোনো ভাবেই জানতে না পারে। 

– আমি সুরাইয়াকে তো এইজন্যই মেরে ফেলছি। পথের কাঁটা নিপাকেও সড়িয়ে দিবো। 

– চুপ, একদম চুপ। (মুখ বেঁকিয়ে) নিপাকে মারতে যাবে,,! এতো সহজ না ,,!  রায়হান নিপার জন্য সবকিছু করতে পারে। ও নিপার জন্য আমাকে মারতেও দু বার ভাববে না। 

– বাহ,,! ছেলে তার বাপকে মেরে ফেলবে আর তার বাপ চুপচাপ বসে দেখবে। (দাঁতে দাঁত চেপে) ঐ টাকেও এইসব সম্পর্কে বলোনাই কেনো ,,! রাফসান যেমন এতকিছু জানে ও জানে না কেনো,,! কীসের এতো আদিখেতা ওর প্রতি হ্যা ,,! ও কী যে ওকে সবসময় ভালো রাখতে চাও ,,! 

– ও আমার নয়ন মণি। ও আমার প্রাণ। আমি ওর মাঝে আমার রাবেয়াকে খুঁজে পাই। আমার প্রথম ভালোবাসাকে খুঁজে পাই। আমার বাবা জোর করে আমাকে এই লাইনে আনছে। নাইলে, নাইলে আমি আজ একটা সুখি সংসার করতে পারতাম। 

– রাবেয়া কে ? 

– ক,কেউ না। ও এখন আমার কেউ না।

কথাটা বলতে গিয়ে নজরুল সাহেবের গলা লেগে লেগে আসছিলো। নজরুল সাহেব তার কন্ঠ স্বাভাবিক করে আবার বলেন। 

– আমার সবকিছুই এখন রায়হান। আমি রায়হানকে আমাদের থেকে আলাদা করে দিবো। ও আলাদা থাক। ও ওর ভালোবাসাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে আমাদের বিজনেস দেখা শোনা করুক। আমি, আমি শুধু এটাই চাই। 

– বাহ,, ! নিজের বড় ছেলের প্রতি কোন দরদ নাই আর ছোট ছেলের প্রতি এতো দরদ ,,! 

– আমি তোর মুখ থেকে কোন কথা শুনতে চাই না। তুই আমাকে না বলে আলিশা আর সুরাইয়াকে মেরে ফেললি ,,! আলিশা তো কিছুই জানতো না। ওকে কেনো মারতে গেলি,,? এখন থানা পুলিশ হবে। কেস হবে। পুলিশ তদন্ত করতে আসবে। (রাগে কটমট হয়ে) ওরা যদি কোনমতে এই আস্তানার খবর পায় তাইলে কিন্তু আমি তোকে ছাড়বোনা। একদম শেষ করে ফেলবো ,,!

বলেই হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নজরুল। যাওয়ার সময় অনেক জোড়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে যায়। সোনালী নজরুলের রাগ দেখে চেয়ারে বসে পড়ে। টেবিলে জোরে এক ঘুষি মারে। রাগের চোখ নিয়ে দরজার দিকে তাকায়। বলে,

– আমি ওর ভালোর জন্য মারতে গেলাম আর আমারেই তেজ দেখাইতে আসে ,,! দেখাক। যত তেজ দেখাবার দেখাক। ওর সময় তো ফুরায় আসতেছে। প্রতিশোধ না নিয়ে তো আমি যাচ্ছিনা ,,! (টেবিলে জোড়ে এক ঘুষি দিয়ে) আমি নিজ হাতে এই খান বাড়ি ধ্বংস করবো। এই ফ্যামিলির বিজনেস, সম্মান সব ধুলায় মিশায় দিবো। এই সোনালীকে তুই চিনিস নাই। সুচ হয়ে ঢুকবো, আর ফাল হয়ে সব তছনছ করে বেড়োবো ,,! তাতে যদি নিজের সবটুকুও সপে দেওয়া লাগে, আমি তা দিতেও দু বার ভাববো না। 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ) 

পর্ব :: ৬২

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

(১৮+ এলার্ট)

 

সূর্যস্নাত রোদ জানালা দিয়ে এসে পড়েছে বিছানায়। নিপার ঘুম ভাঙে। চোখের পাতা গুলো ধীরে ধীরে মেলতে থাকে। সূর্যের আলোখানা বেলকনির জানালা দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। আবহাওয়া মৃদু ঠান্ডা। নিপা উঠে বসে। সাদা চাদর খানা তার বুকের উপর উব্ধি দেওয়া। আড়মোরা ভাঙতে ভাঙতে হাত দুটো উপরে তোলে। ঘুম বেশ ভালোই হয়েছে। কাল রাতে ডিনার করেই শুয়ে পড়েছিলো তারা। নিপা পাশে চেয়ে তাকায়। দেখে রায়হান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চাদর খানা তার নাভি বরাবর। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকায় বুকের লোমকূপ গুলো রোদের আলোয় চিকচিক করছে। নিপার ঘুমঘুম চোখে রায়হানকে দেখে এক ম্লিন হাসি হাসে। মাথার দিক থেকে রায়হানের ফোন খানা হাতে নেয়। নিয়ে ফ্রন্ট ক্যামেরা ওপেন করে। নিজের মুখয়ব ক্যামেরায় দেখে। খোলা চুল গুলো হাত দিয়ে কানের ওপাশে দিয়ে দেয়। মুখে ঘুম ঘুম ভাব এখনো কাটেনি। নিপা হেলে রায়হানের কাছে আসে। রায়হানের গালে একটা ছোট্ট চুমু খায়। চাপ দাড়ি গুলো কাল তার গালে শরীরে বেশ খোঁচা দিয়েছে। অবশ্য এতে সে ব্যাথীত হয়নি, বরং সুখই অনুভব করেছে। নিপা রায়হানের গালে ঠোঁট লাগিয়ে আরেক হাতে ফোনখানা উঁচিয়ে ধরে একটা সেলফি নেয়। গাল থেকে ঠোঁট দুটো সড়িয়ে এবার নিজের গালের সাথে রায়হানের গাল লাগিয়ে এক হাসি মুখ করে আরেকটা সেলফি নেয়। নিজের জিহ্বা হালকা একটু বের করে আরেকটা সেলফি নেয়। হেঁসে ফেলে সে। রায়হানকে ঘুমন্ত অবস্থায় বেশ কিউট লাগছে। রায়হান জেগে থাকলে নিশ্চয়ই তাকে জড়িয়ে ধরে আবার চুমু খেতো। নিপা এবার রায়হান বুকে মাথা রাখে। আরেকটা সেলফি নেয় এভাবেই। এই বুকটাই যেন তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। এই বুকে মাথা রেখেই কাল ঘুমিয়েছিলো সে। প্রিয়জনের বুকে মাথা রেখে ঘুমানোতে আলাদা প্রশান্তি আছে। নির্মল আনন্দ আছে। 

 নিপা উঠে বসে। ফোনে তোলা ছবি গুলো দেখতে থাকে। তার বুক বরাবর সাদা চাদর খানা আর রায়হানের উদাম বুক, ছবি গুলো বেশ সুন্দর উঠেছে। নিপা ছবি গুলো দেখতে দেখতে ফোনের নোটিফিকেশন উইনডো টা নামায়। দেখে ৭ টা মিসড কল। আব্বু নামে সেভ করা নাম্বার থেকে কাল রাতে ফোন এসেছে। নিপা ট্যাপ করে নটিফিকেশন টায়। কিন্তু ফোন লক থাকায় ভিতরে ঢুকতে পারে না। নিপা মনে মনে ভাবে,

 ‘নিশ্চিত ও ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখছিলো। এইজন্য এতোবার ফোন দিছে আমরা বুঝতেই পারিনি। নিজের সুন্দর সময় কেউই নষ্ট করতে চায় না। আর আমার রায়হান হলে তো কথাই নাই ,,!’

 নিপা ফোনটা আবার মাথার পাশে রেখে দেয়। রায়হানের উপর কাঁথা খানা টেনে দিয়ে ঘুরে নেমে যাওয়ার জন্য বিছানা থেকে পা নামায়। মাথার দিকে থাকা ওড়ানাটা হাতে নেয়। এটা দিয়ে দেহ মুড়িয়ে গোসল খানায় ঢুকবে সে। বিছানা থেকে উঠতে যাবে তখনই পিছন থেকে তার হাত রায়হান ধরে নেয়। নিপা পিছন ফিরে তাকায়, সাথে সাথেই হেঁচকা টান মেরে রায়হান নিপাকে তার কোলের উপর এনে ফেলে। নিপা লজ্জা মুখো করে বলে,

 – তুমি জেগে ছিলা ,,! 

 – হমম। তোমার চুমু মিস না করার জন্য একটু ঘুমের অভিনয় করছিলাম আরকি। (ঘুম ঘুম গলায় বলে রায়হান)

 – ছাড়ো এখন। আমি গোসলে যাবো। 

 – পরে যাইয়ো। আসো আরেকটু ঘুমাই।

 – না না। অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘড়িতে দেখো, ৯ টা বাজে। 

 – বাজুক। আমাদের কেউ ডিসটার্ব করতে আসবেনা। আসো আরেকটু আদর করি তোমায়। 

 – যাও। এখন কোন আদর সোহাগ না। ফ্রেশ হইতে হবে ছাড়ো। 

 – না ছাড়বোনা। এভাবে বুকে জড়িয়ে রাখবো সারাজীবন। 

 – তা রেখো, কিন্ত এভাবে বেশিক্ষণ থাকতে নেই। গোসল করতে হবে। ছাড়ো। আর তুমিও উঠো। 

 – আরেকটু ঘুমাই আমরা,,!

 – না। আর একটুও না। উঠো। আর রিসিপসনে কল দিয়ে বলো বিছানার চাদর পাঠাতে। গোসল করে এসে বদলে দিতে হবে। 

 – সে পরে দেখা যাবে। আগে আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরে থাকি। আমার সুবাটা যে অনেক তুলতুলে,,! 

 – হইছে ছাড়ো এখন। আমার শরীরটাকে তো চেপে ধরে তোমার শরীরের ভিতরেই নিয়ে যাবা। 

 – তুমি তো আমার ভিতরেই আছো। তুমি যে আমার আত্মার আত্মীয়। তোমায় ছাড়া একটা ছোট্ট মুহুর্ত অসীম মনে হয় আমার কাছে। (নিপার চুল গুলো মুখের উপর নিয়ে) আহ, এই মনমাতানো সুবাসে আমি আবার পাগল হতে চাই ,,! 

 – হইয়ো। কেউ তো ধরে রাখতেছেনা। চলো তো উঠো। 

 – আগে চুমু খাও। তারপর ভেবে দেখবো। 

 – খেলাম তো। 

 – আরো খাও। গালে তোমার পাপড়ির মতো ঠোঁট দুখানা আমার সকল শিরা উপশিরার রক্ত হিম করে দেয়। আমার গায়ে যেন সুখের নদী বয়ে যায়। দেও না আর দু’টো। 

 – শুধু দুটোই কিন্তু ,,! 

 – হম, দুটোই দেও। একটা এই গালে,(ঠোঁট দেখিয়ে) আরেকটা এইখানে।

 – না না ওখানে না। আমি শুধু গালে দিবো। 

 – না দিলে আর ছাড়বোনা। এভাবেই আজ সারাদিন তোমায় জড়িয়ে ধরে রাখবো। 

 – ছোট্ট করে দিয়েই কিন্তু আমি উঠে যাবো। আর তুমিও আমার সাথে উঠবা। বুঝছো।

 – তুমি চুমু খেলে আমি সব করবো। 

 – চোখ বন্ধ করো। 

 – কেনো। চোখ বুজে কী করবো। 

 – আমি বন্ধ করতে বলেছি করো। 

বলেই নিপা তার হাত দিয়ে রায়হানের চোখ দুটো চেপে ধরে আলতো করে। তার ঠোঁট দুটো এগিয়ে নিয়ে রায়হানের ঠোঁটের কাছে আনে। নিজেও চোখ বুজে রায়হানের ঠোঁটের উপর আলতো করে ছোঁয়া দেয়। দুই ঠোঁট দিয়ে চুমু খেয়ে রায়হানের নিচের ঠোঁট খানা চুষে দেয়। রায়হান ঠোট ভিজে যায়। নিপা নিজের ঠোঁট দুখানা তুলে নিতেই যায় তখনই রায়হান হাত দিয়ে নিপা ঘাড় চেপে ধরে তার ঠোঁটে গভীর ভাবে চুমু খেতে থাকে। নিপা উঠে যেতে চাচ্ছিলো রায়হানের উপর থেকে। রায়হান আরো ওকে ধরে নিজের গাঁয়ের উপর শুইয়ে দেয়। খুব গভীর ভাবে চুমু খেতে থাকে নিপাকে। কাঁথা খানা তাদের মাথার উপর ফেলে দেয়। দিয়ে আবারো ছোট্ট সময়ের জন্য সুখ রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার পায়তারা করতে থাকে রায়হান। সূর্যের আলো বিছানায় এসে তাদের সাদা কাঁথার উপর পড়ছে। সেই আলোতে দুই আত্মার আত্মীয়তা ভীষণ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

 

_____

 

জঙ্গলের মাঝের রাস্তা। পুরোনো আমলে তৈরি হওয়ায় পাকা রাস্তাটার কিছু কিছু যায়গা একটু খয় হয়েছে। রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে আসছে সুমু। গায়ে একটা শাল চাদর জড়ানো। এদিকে আবার ঠান্ডা পড়েছে কিছুটা। চারপাশে গাছ গুলো যেন কুয়াশা নামক শাল গায়ে জড়িয়ে বসে আছে। শিশির বিন্দু জমেছে গাছের পাতা গুলোয়। মাঝে মাঝে দু চার বিন্দু একসাথে হয়ে পাতা থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে। তেমনি এক ফোঁটা এসে পড়লো সুমুর মাথায়। চুল ভেদ করে ঠান্ডা শিশির মাথার শিয়রে পৌঁছানো মাত্র সুমু উপরে মুখ তুলে তাকায়। রাস্তার একপাশ ধরে হেঁটে চললে এই এক ব্যাপার। গাছের ডালে থাকা পক্ষীর মল আর গাছের পাতায় থাকা শিশির। সব এসে মাথায় পড়ে। সুমু আবার হাঁটতে শুরু করে। তার মুখ খানা একটু গম্ভীর। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। চোখের পর্দায় বারংবার খালি সেই যুবকের মুখখানাই ভেসে উঠছিলো। ঘুম যেন‌ তার চোখ থেকে চলে গিয়েছিলো অন্যকারো চোখে। হ্রদয়টা যেন খুব করে অনুভব করছিলো কাউকে। ভিতরটা নিঃসঙ্গতার অতলে হারিয়ে যাচ্ছিলো বারবার। এ কেমন অনুভূতি। আগে তো কখনো তার ভিতরে এমন অনুভুতির জানান পায়নি সে। ঐ ছেলেটার কী জাদুকাঠি আছে,,! যে তাকে সেই জাদুকাঠির পরশে বশ করে ফেলেছে,! না, কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। আরেকবার দেখা না পেলে যেন সে ছটফট করতে করতেই প্রাণ হারাবে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এতোটা আকর্ষণ বোধয় এই প্রথম জাগ্রত হয়েছে তার মাঝে। এটা কী ভালোলাগা না ভালোবাসা? জানেনা সে। তার ছোট্ট মনের ডিকশনারি এসবের উত্তর দিতে পারছেনা। সে এখনো কিশোরী। ১৭ থেকে ১৮ তে পা দিবে। এই ‌বয়সে বুঝি এসব অস্বাভাবিক কিছুই নয়,!

সুমু এক গাছের সামনে থেমে যায়। আর হাঁটতে ইচ্ছে করছেনা তার। একটু বসে না জিরুলেই নয়। সুমু বসে পরে রাস্তার পাশে থাকা এক বড় বট গাছের নিচে। মাটিটা শুকনো। তাও কিছু পাতা একখানে করে সেগুলোর উপর বসেছে সে। আশেপাশের গাছ পালা থেকে নানা পোকামাকড়ের ডাক, পাখির কলতান সুর ভেসে আসছে। এখনো সূর্য ঘুম থেকে উঠেনি। মেঘের আড়ালে হয়তো কাপড়-চোপড় পড়ে রেডি হচ্ছে আলো দেবার জন্য। সুমু গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকে। পাশে পাওয়া একটা ছোট্ট ভাল হাতে নিয়ে সেথা হতে পাতা ছিঁড়তে থাকে। তার সামনে আলাদিনের জীনের মতো আবির্ভূত হয় হনুফা। সুমু সামনে তাকিয়ে হনুফাকে একবার দেখে। হনুফা ঘুরে ঘুরে চুপচাপ বসে থাকা সুমুকে পর্যবেক্ষণ করে। সুমু চুপচাপ হাত দিয়ে পাতা ছিঁড়ছে। হনুফা বলে উঠে,

– কিরে, তুই চুপচাপ কেন।

– ভাল্লাগে না। 

– কী ভাল্লাগেনা ,,! ঐ ছেলেটাকে ,,!  তোর ভালো না লাগলে আমাকে দিয়ে দে। আমি ওকে নিয়ে যাই। 

– কচু দেবো তোকে। ঐ ছেলেটা শুধু আমার আর আমারই থাকবে। 

– এই, শুননা।

– কী। 

– আমি তোর শাল চাদরের ভিতর ঢুকি! আমার বাইরে শীত করতেছে। (দুই হাত দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে ধরার ভং করে) উরি বাবা,, কী ঠান্ডা। আমাকে তোর শালের ভিতর যায়গা দে না। 

– তুই তো ভূত। তোর আবার ঠান্ডা গরম আছে নাকি। যা ঐদিকে পাতা-পুতো জড়ো করে আগুন জ্বালায় তাপ নে। 

– না বাপু। আগুনে আমার ডর করে। তোর শাল টার ভিতরেই ঢুকে যাই। 

বলেই বাইরে থেকে অদৃশ্য হয়ে একদম শালের ভিতরে গিয়ে দৃশ্যমান হয় হনুফা। শাল টা একপাশে কিছুটা ফুলে গেছে। তারমানে ঐখানটায় হনুফা আশ্রয় নিয়েছে। সুমু শালের চাদর খুলে দিয়ে বলতে থাকে,

– পালা এখান থেকে। আমার গরম নষ্ট করতে আসছিস। এমনিতে এতো ঠান্ডা তার মাঝে ও ভাগ বসাইতে আসছে। 

– দিলিনা তো থাকতে ,,! তুই খুব বদ। একদম আমাকে কিছু দিতে চাস না। (বলেই হনুফা বেড়িয়ে যায়) 

– হ্যা আমি বদ। এইবার হইছে! এখন তুই যা। আমার কিছু ভাল্লাগতেছেনা।

– ফল খাবি ,,! 

– ফল ? ফল কই পাবি। 

– আগে বলনা খাবি নাকি। 

– লায়লা তো আজ সকালের নাস্তা দিয়ে যায় নি। খিদা লাগছে হালকা একটু। 

– তাইলে দাড়া আমি ফল নিয়ে আসতেছি। 

– কই থেকে আনবি তুই। 

– কালকের বাজার টা আছেনা। ঐখানে একটা ফলের দোকান দেখছিলাম। লাল টুকটুকে আপেল, টসটসা কমলা, আরো কতো কি। তুই এখানেই থাক। আমি একটা আপেল আর একটা কমলা নিয়ে আসতেছি।

– কিন্তু টাকা ,,!

– আমি চুপচাপ লুকিয়ে নিয়ে আসবো। কেউ টের পাবেনা! 

– সাবধানে আনিস। ধরা পড়িস না যেনো আবার।

– ধরা পড়লেই বা কী। আমি বাতাসের গতিতে পালিয়ে যাবো। কেউ আমায় ছুঁতে পারলে তো ধরবে ,,! 

– হইছে যা এখন। মেলা পটর পটর করিস তুই। 

– তোর ভাতার পটর পটর করে। তুই পটর পটর করিস। 

– তোরে আমি জুতা পিটা করবো শালী। (বলেই পায়ের জুতোটা খুলে হনুফার দিকে ফিকে মারার জন্য হাত তুলে, হনুফা দিকবিদিক না দেখেই রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। সুমু তার যাওয়ার পথে জুতা ফিকে মারে। হনুফা পালিয়ে যায়। সুমু আবার হাঁটু জড়ো করে বসে। হাতদুটো একসাথে করে গাছের গায়ে হেলান দেয়। একফোঁটা শিশির বিন্দু এসে তার কপালে পড়ে। নিপা উপর মুখ করে এক ছোট্ট মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

– এই হনুফাটাও না, অনেক পাজি,,! 

 

_____

 

রায়হান গোসল খানা থেকে বেড়োয়। নিপা নিচে ব্যাগের চেইন খুলে কাপড় বের করছিলো। সময় এখন ১০ টা। নিপা আগেই গোসল করে বের হয়েছে। ভেজা চুল গুলো মেলে দিয়েছে কাঁধে যেন শুকিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। রায়হান গামছা পড়ে গোসল খানা থেকে বেড়িয়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়। হাত দুখানা দিয়ে দেহ জড়িয়ে ধরে বলে,

– সুবা, ভিতরের পানি দেখি অনেক ঠান্ডা। 

– হ্যা। একটু ঠান্ডা। (লাগেজের পাশ থেকে উঠে) নাও, তোমার কাপড়। ট্রাউজার আর টি শার্ট ই পড়ো এখন। পড়ে যখন বাইরে যাবা তখন জিন্স পড়িও। 

– আচ্ছা দেও এখন। এগুলাই পড়ি। (কাপড় গুলো হাতে নেয় রায়হান)

– হোটেলের লোক আসছিলো। সকালের ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেছে। 

– ব্যাগ দেয়নি কোনো ? 

– কিসের ব্যাগ? 

– একটা বড় ব্যাগ দেওয়ার কথা। আজকে আমরা ঘুরতে বেড়োবো। 

– ঘুরতে যাওয়ার সাথে ব্যাগের কি সম্পর্ক। 

– ঐ বাগে তাঁবু আছে। আমরা খাগড়াছড়ি যাবো আজ। ঐখানে এক পাহাড়ে উঠে তাঁবু খাটিয়ে রাত থাকবো। 

– পাহাড়ে তাঁবু বানিয়ে রাত থাকবো ,! কী বলতেছো এসব! ঐখানে কীভাবে ঘুমাবো। 

– ট্যুর দেওনাই আগে কখনো এইজন্য এই কথা বলছো। আমি কলেজে থাকতে অনেকবার ট্যুরে এসেছিলাম বন্ধু বান্ধবদের সাথে। খাগড়াছড়ির একটা পাহাড়ে সবাই মিলে তাঁবু বানিয়ে রাত কাটিয়েছিলাম। রাতের বেলা কত যে মনোরম দৃশ্যের দেখা পাওয়া যায়,! আজকে চলো, দেখবে অনেক ভালো লাগবে। 

– জন্তু জানোয়ার যদি আক্রমণ করে ,,! 

– আমরা যেই পাহাড়ে গেছিলাম ঐখানে কিছু বানর ছাড়া আর কোন জংলি, জানোয়ার নাই। নির্ভয়ে থাকতে পারবা। আর আমি তো আছিই। তোমার কিছু হওয়ার আগে নিজের জান দিয়ে দিবো। তাও একটা ফুলের টোকা তোমার গাঁয়ে পড়তে দিবো না। 

নিপা রায়হানের শেষ কথাটা শুনে একটা হাসি মুখ করে।  রায়হান আবারো বলে উঠে,

– আচ্ছা শোনো। আমরা নাস্তা করেই বেড়োবো। যেতে যেতে বেশ সময় লাগবে। তোমার জিন্স আছে ? 

– না। আমি জিন্স পড়িনা। 

– আচ্ছা তাইলে প্লাজু তো আছে। প্লাজু সাথে একটা গোল জামা পড়িও। আর শীতের কাপড় তো আনা হয়েছে না, ঐগুলা বের করো। বড় ব্যাগটা আসার কথা। ঐটার ভিতর নিয়ে নিবো। 

– আচ্ছা ঠিক আছে। 

নিপা কথা বলে তার নজর নিচের দিকে দেয় দেখে রায়হান এখানে তার সামনেই কাপড় বদলাতে শুরু করে দিছে। নিপা এক লজ্জা মিশ্রিত মুখ নিয়ে রায়হানের দিকে চায় তারপরই অপর পাশে ফিরে। ব্যাগের দিকে চলে যায়। বলে,

– তুমিও না ,,! একদম শরম নাই। 

– বউয়ের সামনে লজ্জা শরমের কী আছে। 

– হইছে থামো। (একটু থেমে স্বাভাবিক গলায়) শশুর আব্বা ফোন দিয়েছিলো তোমার ফোনে। তুমি তো কাল রাতে ফোন সাইলেন্ট করে রাখে দিছিলা। আমি আজ সকালে উঠে দেখি ৭ টা মিসড কল। তুমি কল দাও। পড়ে নাইলে কি না কি মনে করবে। 

– ও হ্যা, বাবাকে পড়ে আমিই কল দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভুলে গেছি। দাঁড়াও এখুনি দিচ্ছি। 

রায়হান ট্রাউজার টা পড়ে বিছানার পাশ থেকে ফোনটা হাতে নেয়। নিপা তার বাইরে যাওয়ার কাপড় আর শীতের কাপড় গুলো বের করে হাতে নিয়ে এনে বিছানায় রাখে। রায়হান তার বাবার নাম্বারে ফোন দিয়ে কানে উঠায়। রিং হচ্ছে। রিং হচ্ছে। রিং হচ্ছে,,,,,,, না বাবা ফোন তুলছে না। রায়হান ফোনটা কান থেকে নামিয়ে আবার কল দেয়। রিং হচ্ছে। কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না। রায়হান ফোনটা কানের কাছে কিছুক্ষণ রেখে আবার নামিয়ে নেয়। বলে,

– ফোন তুলছে না তো। 

– হয়তো ব্যাস্ত আছেন। 

– হতে পারে। (একটু থেমে) আচ্ছা শোনো, আমাকে জিন্স বের করে দাও। ঘড়িতে তো সাড়ে ১০ টা বেজে যাচ্ছে। কাপড় পড়ে খেয়ে বেড়িয়ে পড়বো। 

– এইযে এখানে আছে সব কাপড়। পড়ে নাও। 

– তুমিও রেডি হয়ে নাও। তোমার তো সময় লাগবে আরো। 

– আচ্ছা তাইলে তুমি থাকো, আমি চেন্জ করে আসছি। আর ঐ টেবিলে খাবার গুলো আছে। আমি এসে বেড়ে দিচ্ছি।

– কই যাও।

– কেনো চেন্জ করতে। ওয়াশরুমে।

– চেন্জ করার জন্য ওয়াশরুমে যাওয়া লাগে,,! এখানেই করো। 

– হমম, তোমার মতো বেহায়া না ,,! যে এখানে চেন্জ করতে যাবো। 

– রাতে একসাথে ঘুমিয়ে এখন বলতেছো আমার সামনে চেন্জ করা যাবেনা। এইটা কেমন কথা। 

– এইটা এমনই কথা। (লজ্জা মুখে) তুমি বহুত পঁচা রায়হান। তোমার সামনে আমি দিনেদুপুরে ড্রেস চেঞ্জ করবো ,,! না না। আমি নাই,,!

বলেই হন হন করে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায় নিপা।

– সুবা,,, এই সুবা,,, চলে গেলো। আমরা জামাই বউ, আর ওর নাকি এখনো লজ্জা করে। আমার ফুলটার যে কবে লজ্জা ভাঙবে ,,! খালি লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

ঘরের কলিংবেল বেজে উঠে। রায়হান তোয়ালে টা গাঁয়ে জড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কে না কে আসছে এভাবে খালি গায়ে যাওয়া তো ঠিক না। প্যান্ট আছে নিচে, কিন্তু উপরটা যে ফাঁকা।

রায়হান দরজা খুলে। ওপাশ থেকে ডেলিভারি ম্যান তাকে একটা বড় ক্যাম্পিং ব্যাগ দেয়। রায়হান সেটা নিয়ে ভিতরে রাখে। ডেলিভারি ম্যান তার খাতায় সই করতে বলে। রায়হান কলম টা নিয়ে সই করে দেয়। ডেলিভারি ম্যান তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায়। রায়হান দরজা লাগিয়ে দেয়।

 

ভিতরে এসে ফ্লোরে থাকা ব্যাগটা খুলে। দেখতে থাকে ভিতরে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। বিছানায় নিপার রেখে যাওয়া শীতের কাপড় গুলো ঢুকিয়ে রাখতে থাকে সেই ব্যাগের ভিতর। কাপড় গুলো ঢুকিয়ে রেখে উঠে টিভির রিমোট দিয়ে টিভি ছেড়ে দেয়। দিয়ে বিছানায় বসে টিভি দেখতে শুরু করে।

 

_____

 

সুরাইয়া বেগমের রুম। নিচে ফ্লোরে রক্তের ছোপ শুকিয়েছে। তবে তা এখনো পরিষ্কার করা হয়নি। আলিশার ডেড বডিটা যেখানে পড়েছিলো সেখানে চক দিয়ে তার বডি টা যেভাবে ছিলো তার আকৃতি আঁকা। এদিকে বিছানার কাছে সুরাইয়া বেগমের মাথা বিহীন লাশটা যেভাবে ছিলো সেখানে তেমন ভাবে চক দিয়ে আঁকা। একজন কনস্টেবল এসবের ছবি তুলছে। পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখছে রিয়াদ। হাতে হ্যান্ড গ্লাভস। বইটা বন্ধ করে টেবিলে রাখলো সে। পিছনে ফিরে কনস্টেবলদের দেখলো। আরেকজন কনস্টেবল সুরাইয়া বেগমের লাশটা যেখানে ছিলো সেখান টা দেখছে। রিয়াদ বিছানার কাছে এসে হেলে বসে। বিছানায় যেখানে বেশি রক্ত লেখেছিলো সেখান টায় আঙ্গুল দিয়ে ছোঁয়। রক্ত একদম শুকিয়ে গিয়েছে। তাজা রক্ত কতটা ঘন হয় তা সে এখন দেখছে। এভাবে রক্তরন্জিত কেস খুব কমই পেয়েছিলো সে। উঠে দাঁড়ায় রিয়াদ। দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কে এদের এতোটা নিষ্ঠুর ভাবে খুন করতে পারে। খুনির কী শত্রুতা ছিলো এই দুইজন মা মেয়ের সাথে। তখনই তার পিছন থেকে এক কনস্টেবল ডাক দেয়,

– স্যার,,! 

রিয়াদ পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে কনস্টেবল এক জোড়া হাই হিল জুতো ধরে রয়েছে। রিয়াদ বলে,

– কার জুতা ? 

– জানিনা স্যার। খাটের নিচে ছিলো এইগুলা। রক্তও লাগে আছে স্যার। 

– খাটের নিচে ছিলো ? (রিয়াদ কৌতুহলি হয়ে এগিয়ে যায়। গিয়ে হেলে বসে কনস্টেবলের সামনে। জুতো জোড়া হাতে নেয়। এক জুতার হিলের অংশে কিছুটা মাংসও লেগে আছে। জুতো জোড়ায়ও বেশ ভালো রকমই রক্ত লাগে আছে। রিয়াদ কৌতুহলি হয়ে কনস্টেবলকে বলে,

– জুতা গুলা কার হতে পারে নয়ন,,! 

– স্যার। মনে তো হয় খুনির। 

– তাইলে কী খুনি একজন মেয়ে ? একজন মেয়ে কীভাবে এই দুই মা মেয়েকে একই সাথে এতোটা নিষ্ঠুর ভাবে মারতে পারে ,,! 

– হয়তো মেয়েই হবে স্যার। দেখেন জুতা গুলার রক্তের ছাপ দেখে এমন মনে হচ্ছে উপর থেকে রক্ত ছিটকে পড়েছে। আর লাশ দুইটার মধ্যে একটার হাত ফুটো করা ছিলো। আর এখানেরও একটা হিলের সুচোলো অংশে মাংস লেগে আছে। 

– মানুষ এতোটা নির্দয় হয় কিভাবে,,! খুন গুলা করতে একবারও বুক কাপলো না ,,! 

– আজকালকার মানুষ টাকার জন্য সবকিছু করতে পারে স্যার। 

– হমম। টাকা, এই টাকাই সম্পর্ক গড়ে দিতে পারে আবার দুনিয়া ছাড়াও করতে পারে। (একটু থেমে) আচ্ছা আমি এখন দিনাজপুর শহরে যাবো একটু। লাশ গুলার পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট আনতে হবে। আর তার সাথে একজন ডাক্তারকে নিয়েও আসতে হবে এই রক্ত গুলার স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য। তুমি আর সবুজ এখানেই থাকবা। আমি না আসা পর্যন্ত যাবানা। আর কাউকেই এই ঘরে ঢুকতে দিবানা। বুঝছো আমি কী বলছি ? 

– ওকে স্যার। সব বুঝে গেছি। 

– হুমম। বি কেয়ারফুল। 

রিয়াদ হাতে থাকা টুপিটা মাথায় পড়ে চলে যেতে থাকে। কনস্টেবল আবার দেখতে থাকে ঘরে কিছু আছে কি না। 

 

রিয়াদ দরজা দিয়ে বেড়োনো মাত্রই এক মহিলাকে দরজার আড়ালে দেখতে পায়। রিয়াদ ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে তাকায়। মহিলাটা ছিলো সাথী বেগম। রিয়াদ অবাক গলায় বলে উঠে,

– আপনি ? আপনি কে? এখানে কী করছিলেন? 

– আ,আমি সাথী। এমনিই এখানে দাঁড়ায়ছিলাম। 

– সাথী ? কোন সাথী ? আপনি এই বাড়ির কেউ ? 

– হ,হ্যা। আমি এই বাড়ির ছোট বউ। 

– যারা খুন হয়েছে তারা আপনার কী হয় ?

– সুরাইয়া আমার ননদ ছিলো। 

– যার মাথা ছিলোনা সে ? 

সাথী বেগম মাথা নাড়ায়। তার চোখ মুখে ভয় স্পষ্ট। কিছুটা কাঁদো কাঁদো ভাব। রিয়াদ আবার বলে,

– আপনি কী শাহেদ চাচার বউ ? 

সাথী বেগম আবার মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে।

– আপনার কী মনে হয়। এদেরকে কে মারতে পারে ? 

সাথী বেগম ছলছল চোখ নিয়ে রিয়াদের দিকে তাকায়। তার মন চাইছে সব বলে দিতে। কিন্তু তার ভয় হচ্ছে। তার ছেলেটার যদি তখন কিছু হয়ে যায়। সাথী পিছন ফিরে করিডোরের মুখের দিকে তাকায়। দেখে সুমনা বেগম ডায়নিং টেবিলের ওখান থেকে এক নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাথী বেগমের বুক হঠাৎ কেঁপে উঠে। সাথে সাথেই সাথী সামনে তাকিয়ে মুখে ওড়না চেপে বলে,

– জানিনা। আমি, আমি কিচ্ছু জানিনা। 

বলেই সেখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে থাকেন। কোমরের ব্যাথা থাকায় তিনি দৌড়াতে পারছিলেন না। তবুও যতটা তাড়াতাড়ি হাঁটা যায় তিনি পা চালিয়ে যেতে থাকেন। রিয়াদ অবাক চোখে চেয়ে থাকে সাথী বেগমের দিকে। বিরবির করে বলে,

– উনি এতো ভয় পেয়ে ছিলেন কেনো ,,! এমন মনে হলো যেনো উনি কিছু একটা আমায় বলতে চাইছেন ,,! 

 

____

 

খাঁন বাড়ির পিছনের সাতরঙা পুকুর। পুকুরে গোসল করছে রাফসান। আকাশ পরিষ্কার। হালকা রোদ উঠেছে। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সোনালী। হাতে গামছা, আর লুঙ্গি। সোনালীর পড়নে খয়েরী রঙের থ্রী পিস। রাফসান পুকুরে আরেকটা ডুব দিলো। বুদবুদ ভেসে উঠলো পানির উপরে। সোনালী পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে একবার চেয়ে আবার পুকুরের দিকে তাকায়। রাফসান ডুব দিয়ে উঠে। পুকুরের মাঝে ভাসতে থাকে। বলে,

– সোনালী, তুমিও আসো। 

– আপনি গোসল করেন। আমি পড়ে একলা গোসল করে নিবো। 

– আরে আসো আসো। মজা হবে। 

– না। আপনিই মজা করেন।

– কাপড় এনেছো ,,! 

– হ্যা। হাতেই আছে। 

– দাঁড়াও তাইলে আমি পাড়ে আসছি। তুমি যেহেতু আসবেনা। একলা একলা বেশিক্ষণ গোসল করে মজা নাই‌

বলেই রাফসান এক ডুব দেয় পুকুরে। সাঁতরে এসে পুকুর পাড়ের কাছে ভেসে উঠে। পুকুর পাড় টা সিঁড়ি দিয়ে বাঁধানো। পুকুর টাও এই বাড়ির মতোই বেশ পুরোনো আমলের। রাফসান সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে। পড়নে কিছু নেই। সোনালী তার দিকে একবার নজর দিয়েই গামছাটা ফিকে মারে। রাফসান গামছাটা ধরে। শরীর মুছতে থাকে। কিন্তু গায়ে জড়ায় না। সোনালীও তেমন একটা অস্বস্তি বোধ করেনা। এগিয়ে যায় রাফসানের দিকে। এগিয়ে গিয়ে তাকে লুঙ্গিটা দেয়। রাফসান লুঙ্গি টা হাতে নেয়। বলে,

– তুমিও আসতা। মজা করতাম। 

– আমি বাইরে যাবো। কাজ আছে।

– আব্বা কাজ দিছে ? 

– হমম।

 রাফসান গামছা দিয়ে শরীর টা কিছুটা মুছে গামছাটা সোনালীর হাতে দেয়। তার হাত থেকে লুঙ্গিটা নেওয়ার সময় তার স্তনে হাত দেয়। সোনালী তার হাত ছাড়িয়ে দেয়। রাফসান হাসছে। লুঙ্গিটা নিয়ে পড়তে থাকে। বলে,

– তোমার যে অভিনয়,,! আমি তো প্রথম বার ধরতেই পারিনাই। আমি একবার এভাবে হাত দিছিলাম মনে আছে ? ঐযে রাস্তায়। তুমি সে কি কান্না। কেউ যদি ঐ দৃশ্যটা দেখতো, আর ওদের যদি আমি বলতাম যে তুমি বেশ্যা। বিশ্বাসই করতো না। 

– আমি বেশ্যা না। 

– হ্যা জানি। তবে তোমার চলন ভঙিমা পশ্চিমাদের মতো। সর্টস, জিন্স, এসব গ্রামের মেয়েরা তো দূর, শহরের গুলা পড়তেও ১০ বার ভাবে। 

– তাড়াতাড়ি শরীর মুছে দিনাজপুর শহরে যান। উনি বলেছেন তাড়াতাড়ি যেতে। 

– কে ? আব্বা ? 

– হম। আর যাওয়ার সময় টালি খাতাটা নিয়ে যেতে বলছে।  আপাতত এইকয়দিন নিচের ঘরের কাজ কম থাকবে। ততদিনে বাকি কাজ আগায় নিতে বলছে। 

– আচ্ছা ঠিক আছে। 

– আর বাড়িতে পুলিশ আছে। উনি বলছেন খুব সাবধানের সহিত চলতে,আর কথা বলতে। পুলিশ যেন মার্ডার কেস বা নিচের ঘর কোন বিষয়েই না জানতে পারে। 

– বাবা ওদের টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারে না ! তাইলে তো ঝামেলা মিটেই যায়।

– আমাদের গ্রামের অফিসার কাজে হাত দিছে। আর আপনি জানেনই যে গ্রামে আমাদের সম্মান কতটা উপরে ,,! অন্য পুলিশ হলে উনি ঠিকই ম্যানেজ করে নিতেন। 

– হম। (একটু থেমে) আচ্ছা আজকে রাতে আমার ঘরে আসিও। 

– কেনো ? 

– আনন্দ করবো। 

– উনি বিষয়টা জানলে কিন্ত,,,,,,

– আরে আব্বা জানবে না। খালি কয়েক ঘন্টারই তো ব্যাপার। মোটা অংকের বখসিস পাবা ,,! 

– আমি অন্য মেয়ে এনে দিবো। আমি যেতে পারবোনা। 

– ক্যান। তুমি আসলে সমস্যা কোথায়,,! আর (সোনালীকে আপাদমস্তক দেখে) তোমার রুপ আমার মনে ধরছে খুব। একবার টেস্ট না করলে যে আমার জীবন বৃথা,,! 

– ১ লাখ লাগবে। পারবেন দিতে ,,! 

– আরে বাপরে,,! এতো ,,! 

– ভার্জিন ,,! 

– সত্যি? 

– হম।

– কয়েক কিস্তিতে টাকাটা পরিশোধ করা যায় না ,,! 

– আগে টাকা, পড়ে কাজ। আর কাজ টাও আমার মর্জি অনুযায়ী যায়গায় হবে। 

– হেইস। কাজটাও তোমার পছন্দের যায়গায় হবে ,,! আমার রুমে হবে না ,,! 

– না। যদি ইচ্ছা থাকে তো আমাকে বিকেলের মধ্যে বলবেন। আর যদি না থাকে তো (একটা থেমে) নাই। 

বলেই সোনালী চলে যেতে ধরে। তখনই রাফসান তার হাত ধরে ফেলে। সোনালী ফিরে তাকায়। মুখে গাম্ভীর্যতা। রাফসান বলে,

– বিকালে টাকা পেয়ে যাবা। কোথায় আসতে হবে বলো।

কথাটা শুনেই সোনালী শুনেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক রহস্যময় হাসি। এক গভীর চাহনি দেয় রাফসানের দিকে। বলে,

– দম আছে ,,! 

রাফসান সোনালীকে হেঁচকা টান দিয়ে কাছে টানে, তার কপাল সোনালীর কপালের সাথে লাগায়। সোনালীর কাঁধে দুই হাত দিয়ে ধীর গলায় বলে,

– তা না হয় যায়গা মতো দেখবে ,,!  

 

_______

 

– কাল বাদে পরসু অমাবস্যা। এই অমাবস্যার জন্যই কিন্তু আমাদের এতো অপেক্ষা,,! (তানিয়া)

– পরসুদিন ২১ তারিখ? (দিথী)

– হ্যা। (একটু থেমে) সেইদিন অমাবস্যার আঁধারে চারপাশে ছেয়ে যাবে। আসুভে সহ সব খারাপ শক্তি গুলো একে একে জেগে উঠবে। আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। আমাদের খুব সাবধানে কাজটা শেষ করতে হবে। নাইলে কিন্তু দেহের প্রাণ টা পর্যন্ত যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ,,! 

– শুধু ঐ আংটিটা ছাড়া আমাদের কাছে কোন আর হাতিয়ার নেই ? (সামিহা)

– না। শুধু ঐ আংটিটাই আমাদের একমাত্র সম্বল। ঐটা দিয়েই আসুভে নামক খারাপ আত্মাটাকে আমাদের ধ্বংস করতে হবে। চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। 

– আসুভে তখনই তার শক্তি ব্যবহার করতে পারবে যখন সে ঐ পুর্নজন্ম হওয়া মেয়েটার গায়ে প্রবেশ করতে পারবে তাই না ,,! 

– হ্যা। তখনই সে পূর্ণ শক্তি লাভ করবে। 

– আচ্ছা আমরা যদি মেয়েটাকে মেরে ফেলি ,,! তবে তো আর আসুভে দেহে প্রবেশ করতে পারবেনা,,! (সামিহা)

– ওকে মারা এতো সহজ না। আসুভে সহ তান্ত্রিক ওকে সবসময় প্রটেক্ট করবে। ওর গাঁয়ে একটা স্পর্শও লাগতে দিবেনা।

– তাইলে এখন আমাদের উপায় ,,! 

– ঐ ছেলেটা কী চলে গেছে ? 

– কোনটা ? আহনাফ ? 

– হ্যা। 

– পরসুদিন চলে গেছে। 

– ওর গাঁয়ের এক ফোঁটা রক্ত লাগবে। ওর গাঁয়ের এক ফোঁটা, সামিহার গাঁয়ের একফোঁটা আর,,,,,

– আর রাশেদের গাঁয়ের একফোঁটা। 

– হম। এই তিনজনের রক্ত দিয়ে আংটিটাকে ভিজাতে হবে। সাথে দিথী, তোমারও রক্ত লাগবে। 

– কিন্ত আহনাফকে আমি এখন কীভাবে পাবো ,,! ওতো ঢাকায়।

– তোমার মা’কে বলো। উনি এনে দিবেন। 

– আচ্ছা। (একটু থেমে) ঐদিন মা বলেছিলো আমার পায়েশে বিষ মিশানো আছে। তাই তোমার শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্রটা পড়েই সেটা খাই। তান্ত্রিক আমাকে মারার জন্য ওর দলবল সবাইকে লেলিয়ে দিছে আমার পিছনে। 

– তোমার মা বলেনি বিষ কে মিশিয়েছিলো ? 

– না। বলেনি। শুধু বলেছে বিষ আছে, মন্ত্র পড়ে খেতে। 

– এখন তাইলে আমাদের কী করা উচিত? (সামিহা)

– এখন অমাবস্যার অপেক্ষা করা ছাড়া আর আমাদের কাছে কোন পথ নেই। আমাদের সুযোগ খুঁজতে হবে ঐ মেয়েটাকে মারার জন্য। ঐ মেয়েটা এখন নিশ্চয়ই খাবার খাওয়ার জন্য ঐ বাড়ি থেকে বের হয়। ও এখন মানুষ। ওরো আমাদের মতোই খিদা লাগবে। আমাদের চোখকান খোলা রাখতে হবে। যখনই আমরা তাকে বাগে পাবো। একদম খেলা শেষ করে দিতে হবে। 

– হমম। বুঝতে পেরেছি। (একটু থেমে) আচ্ছা মেয়েটা যদি নিজে থেকে এসব পিছিয়ে যায়, তখন ? (দিথী)

– মেয়েটা কেনো নিজে থেকে পিছে হটবে ? কীসের জন্য হটবে ? ওর তো কোন পিছুটান নাই। ও পিছু হটবে না। 

– ওহ,,। আচ্ছা ঠিক আছে আমি মা’কে বলবো রক্ত নিয়ে আসতে। আর তার সাথে (তখনই জানালার দিকে নজর যায় দিথীর। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,

– কে ওখানে ,,,,,! 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ) 

পর্ব:: ৬৩

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

– এখন অমাবস্যার অপেক্ষা করা ছাড়া আর আমাদের কাছে কোন পথ নেই। আমাদের সুযোগ খুঁজতে হবে ঐ মেয়েটাকে মারার জন্য। ঐ মেয়েটা এখন নিশ্চয়ই খাবার খাওয়ার জন্য ঐ বাড়ি থেকে বের হয়। ও এখন মানুষ। ওরো আমাদের মতোই খিদা লাগবে। আমাদের চোখকান খোলা রাখতে হবে। যখনই আমরা তাকে বাগে পাবো। একদম খেলা শেষ করে দিতে হবে। 

– হমম। বুঝতে পেরেছি। (একটু থেমে) আচ্ছা মেয়েটা যদি নিজে থেকে এসব পিছিয়ে যায়, তখন ? (দিথী)

– মেয়েটা কেনো নিজে থেকে পিছে হটবে ? কীসের জন্য হটবে ? ওর তো কোন পিছুটান নাই। ও পিছু হটবে না। 

– ওহ,,। আচ্ছা ঠিক আছে আমি মা’কে বলবো রক্ত নিয়ে আসতে। আর তার সাথে (তখনই জানালার দিকে নজর যায় দিথীর। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,

– কে ওখানে ,,,,,! 

সাথে সাথেই উপস্থিত ৩ জন চকিতে জানালার দিকে তাকায়। দিথী বিছানা থেকে উঠে হনহন করে এগিয়ে যায় জানালার দিকে। গিয়ে জানালার পর্দাটা সড়ায়। দেখে কেউ নাই। পিছন থেকে তানিয়া বলে,

– কেউ ছিলো ওখানে ? 

– আমি একজনের ছায়া দেখছিলাম মনে হলো। 

– ছেলে না মেয়ে ? 

– ততটাও বুঝতে পারিনি। হয়তো মেয়ে হবে‌।

– তাইলে নিশ্চিত হনুফা কারো শরীরে প্রবেশ করে জানালার পাশে এসে আমাদের কথা শুনছিলো। সে তো এখন আর এই ঘরে ঢুকতে পারেনা, এইজন্য এইরকম করে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শুনতে আসছে। 

দিথী জানালার দিক থেকে চলে আসে। তার মুখে কিছুটা চিন্তার ছাপ। সে যেন জানতো কে এসেছিলো জানালার ওপাশে। আর যে এসেছিলো সে যে দিথীর মাথা ব্যাথার কারণ তাও দিথীর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দিথী এসে বিছানায় বসে। তানিয়া আবার তাকে কিছু বলতেই যাবে তখনই ঘরের দরজায় কারো কড়াঘাতের আওয়াজ আসে। দিথী চমকে উঠে। তবে বাকিরা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলো ব্যাপার টা। আবার দরজায় কড়াঘাত। ভেসে আসলো শেফালীর কন্ঠ,

– তানিয়া আফা, খালাম্মা আপনাগোরে নাস্তা খাইতে আইতে কইছে‌। 

– যাচ্ছি,,, (দিথীর দিকে ফিরে) এসব নিয়ে তাইলে পরে আলাপ করা যাবে কেমন ,,! 

– ঠিক আছে। আর আমার বাবাকেউ একটু দেখে যেতে হবে‌। ২ দিন পর শাহারিয়ার সাথে চলে যাবো। পরে কখন আসতে পারি ঠিক নেই। 

– আচ্ছা চলো। 

দিথী বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। চেয়ারে বসে থাকা সামিহা উঠে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে। বিছানা হতে তানিয়া আর কানিজও নেমে যায়। দিথী সবার শেষে ঘর থেকে বের হয়। আর বের হওয়ার আগে এক নজর দেয় জানালার দিকে। দিয়েই আবার পিছনে ফিরে চলে যায় ঘরের বাইরে। 

জানালার বাইরের দিক। উপরের গাছের পাতা নিচে পড়ে জমে স্তুপে পরিণত হয়েছে। একজনের পায়ের জুতো দেখা যায়। এক জোড়া কালো বুট। সেই জুতো পড়া ব্যাক্তি হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতে থাকে। তার হাত থেকে একটা আধ খাওয়া সিগারেট মাটিতে পড়ে যায়।

 

_____

 

বাস থেকে নামলো নিপা আর রায়হান। উপরের হালকা রোদের ঝিলিক এসে পড়ছে তাদের উপর। এইটা খাগড়াছড়ির মহালছড়ি বাসস্ট্যান্ড। সময়টা এখন দুপুর। তারা ১১ টার দিকেই রেডি হয়ে হোটেল থেকে বেড়িয়ে পড়েছিলো। এখানে বাসে করে আসতে আসতে দুপুর ২ টো বেজে গেছে। বাসের কন্ডাক্টর কেবিন থেকে বড় ব্যাগটা নামিয়ে দেয়। রায়হান সেটা ধরে একটু ঝেড়ে কাঁধে নিয়ে নেয়। বাস টা চলে যায়। ব্যাগ টা লম্বার দিক দিয়ে বেশ বড়ই বলা যায়। পাহাড়ে আরোহণের সময় আরোহীরা যেই ব্যাকপ্যাক ইউজ করে দেখতে প্রায় তেমনি। রায়হানের মাথায় একটা ক্যাপ, পড়নে একটা লাল রঙের টি শার্ট আর খয়েরি রঙের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। নিপার পড়নে একটা গোল জামা আর প্লাজু। মাথায় হিজাব করেছে সে। রায়হান নিপার হাত ধরে। এগিয়ে যেতে থাকে একটা হোটেলের দিকে। খাওয়া দাওয়া করে তারপর রওনা দিবে পাহাড়ের উপরে উঠার জন্য। এদিকটায় বাস স্ট্যান্ডের পাশেই একটা হোটেল রয়েছে। নামটাও একটু আনকমন। ‘হোটেল ভুরিভোজ’। রায়হান আর নিপা সেটাতে গিয়েই তাদের খাওয়া দাওয়া সেড়ে নেয়। 

 

কিছুক্ষণ পর,

হোটেল থেকে বেড়োয় তারা দুজন। রায়হান নিপার হাত ধরে। দু’জন হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে সামনে থাকা গাড়ি স্ট্যান্ডের দিকে। কিছুটা সামনে এগোতেই তারা পেয়ে যায় গাড়ির স্ট্যান্ড। এই গাড়ি গুলো পাহাড়ী পথ ধরে উপরে গিয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চলে যায়। তারপর অপর পাহাড়ের পৃষ্ঠদেশে পৌছে দেয়। রায়হান একটা গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়িতে বেশকয়েকজন পর্যটক উঠেছিলো। গাড়ি গুলাকে এখানের লোকেরা ‘চান্দের গাড়ি’ বলে। এমনিতে দেখতে শহরে চলা লেগুনার বড় ভাইদের মতো লাগে গাড়ি গুলোকে। পিছনের দিকে বসার যায়গা থাকে। দুই সাড়িতে লোকজন বসে। একেক সাড়িতে ৬ জন এর বেশি বসা যায় না। নিপা আগে উঠে গিয়ে বসলো।  নিপার পাশে একটা মেয়ে বসা ছিলো। পোশাক দেখে এখানকার লোক মনে হয়না। হয়তো পর্যটক হিসেবে এসেছে। মেয়েটা ফোন টিপছে। রায়হান গাড়ির লোকদের বলে দিলো যে সে কোথায় নামবে। বলে তাদের দুইজনের ভাড়া আগেই দিয়ে উঠে পড়ে সে। উঠে নিপার পাশে গিয়ে বসে। আর ১ জন হলেই ১২ জন হয়ে যাবে। তখন গাড়ি ছাড়বে। গাড়ির লোকেরা উপরের ছাওনিটা খুলে দিলো। চান্দের গাড়ির উপরের ছাওনিটা একটা মোটা প্লাস্টিকের কভারের মতো। বৃষ্টি আসলে দিয়ে দেয় আবার বৃষ্টি না থাকলে খোলা রাখে। এতে চারপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য গুলো বেশ দারুন ভাবে উপভোগ করা যায়। 

আরেকটা মেয়েও উঠে পড়ে গাড়িতে। মোট ১২ জন হয়ে যায়। গাড়ির কন্ডাক্টর সামনে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসে আর গাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে। আবহাওয়া খুব বেশি গরম না। এখানে বলে দুই তিন দিন আগেও বেশ শীত আর কুয়াশা ছিলো। কিন্তু আজ দিয়ে ২ দিন হলো রোদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তাই ঠান্ডার অনুভূতি টা খুব বেশি হচ্ছে না। গাড়ি চলতে চলতে প্রবেশ করলো পাহাড়ী পথে মুখে। পথ টা পাহাড়ের চারপাশ দিয়ে ঘুড়ে উপরের দিকে চলে গেছে‌। গাড়িটা খুব জোড়ে চলছে না। একটা মধ্যম স্পিড বজায় রেখে চলছে। ধীরে ধীরে গাড়িটা উর্ধমুখী হয়। অর্ধাৎ তাদের গাড়ি এখন পাহাড়ী পথ দিয়ে উপরে উঠা শুরু করেছে। নিপা চারপাশ মাথা ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছে। তার মুখ হাসৌজ্জল। এইরকম পরিবেশে সে এই প্রথম ঘুড়তে আসলো। পাহাড়ি বনভূমির গাছপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মাটিতে রোদ এসে পড়ছে। পাখি উড়ছে এক গাছ থেকে আরেক গাছে। নিপা পিছনে ফিরে দেখে তারা বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেছে। আস্তে আস্তে নিচের ভূমির বস্তু গুলো ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। দূরে অনেক পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের চূড়া মেঘ দিয়ে আবৃত। তাদের মাথার উপরের সূর্য টাও এক পেঁজা তুলোর মতো মেঘের আড়ালে মুখ লুকায়। নিপা রায়হানের হাত জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আর চারপাশ দেখছে। রায়হান বলে দিচ্ছে কোন পাহাড়ের নাম কি। এখানে কোন কোন অধিবাসী থাকে। নিপা সেই কথা গুলো মন দিয়ে শুনছে আর দেখছে। গাড়ি থেকে নিপা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকা কিছু চাকমা নারীদেরও দেখা পায়। উপরে লাল রঙের বড় ব্লাউজ, আর নিচে লুঙ্গির মতো এক ভারি কাপড় পরা। নিপা আঙ্গুল দিয়ে সেগুলো রায়হানকে দেখায়। রায়হান দেখে। নিপাকে বলে সেই চাকমাদের খাদ্য ভাস আর তাদের উৎসব সম্পর্কে। নিপা বেশ আগ্রহের সহীত শুনে। রায়হান নিপাকে বলে দাড়াতে, এখানে দাঁড়ানোও যায়। গাড়িতে থাকা কয়েকজন দাড়িয়েও আশপাশের ভিউ নিচ্ছিলো। নিপাও দাড়িয়ে একবার দেখতে চায়। উঠে দাঁড়ায়। তবে তার একটু ভয় হচ্ছিলো, তাই সে রায়হানের কাঁধ শক্ত করে এক হাত দিয়ে ধরে। উপরে ছাওনির লোহার মাঝ দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। বাতাসে তার হিজাবের নিচের প্রান্ত উড়ছে। পাগলা দখিনা বাতাস এসে মুখে বাড়ি খাচ্ছে। নিপার নিঃশ্বাস নিতে যেনো একটু কষ্টই হয়ে যায়। নিপা মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে। এইবার সে আরো ভালো ভিউ পাচ্ছিলো। পাশ ফিরে দেখে পাহাড়ের নিচের গ্রাম আর ঘর গুলা খুব খুব ছোট দেখাচ্ছে। দূরের মেঘে ঢাকা পাহাড় গুলোকেও ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছিলো। হঠাৎ গাড়িটা চলন্ত অবস্থায় একটু ঝাকুনি দিয়ে উঠে। নিপা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি আবার বসে যায়। রায়হানকে জড়িয়ে ধরে। তার মনে হচ্ছিলো আরেকটূ হলেই যেন সে গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পাহাড়ের খাদের কিনারায় হারিয়ে যেতো। রায়হান তাকে ভালোভাবে এক হাতে আলিঙ্গন করে ধরে রাখে। আরেক হাত দিয়ে সে উপরের লোহা ধরে ছিলো। নিপা বেশ ভয় পেয়েছে। রায়হান তাকে শান্ত করায়। বলে যে ‘ভয়ের কিছু নাই। কেউ পড়বেনা এখান থেকে।’ নিপা তাও এখানো বসে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সময়টা বেশ ভালো কাটে দুজনের। গাড়ি চলে যায় পাহাড়ের চারপাশ ঘেড়া রাস্তা গুলো দিয়ে। 

 

_______

 

মেম্বার বাড়ির আঙিনা থেকে বারান্দায় উঠলো দিথী। মাথার চুল গুলো ভেজা। গোসল করে আঙিনায় চুল ঝাড়ছিলো ও এতোক্ষণ। ও বাড়ি থেকে আসতে আসতে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। এসেই গোসল করে নিলো। আজ রোদ উঠেছে কিছুটা। তবে আকাশে মেঘও আছে। দিথী বারান্দায় উঠে একটা চেয়ার টেনে বসে। হাতের নখ গুলো দেখতে থাকে। ওর নখ গুলো লম্বা লম্বা। যত্ন করে এতোটা বাড়িয়েছে সে। নেইলপলিশ করেনি। নেইলপলিশ টা ওবাড়ি থেকে আনাও হয়নি‌‌। দিথী নখ গুলো দেখে হাত নামাতেই দেখে আঙিনা দিয়ে শিউলি বেগম আর লায়লা আসছে। শিউলি বেগমের হাতে একটা টিফিন বাটি। তারা গিয়েছিলো ক্লিনিকে। আফাজের জন্য খাবার নিয়ে। তবে তাদের মুখ মলিন। দিথী তাদের দেখে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় বারান্দার দরজার দিকে‌। শিউলি বেগমের হাত থেকে টিফিন বাটিটা নেয়। বলে,

– মা, খাবার খায়নি ? 

– না গো মা, আফাজ কিচ্ছুই খাইতাছে না। কথাও কয়না। 

– খালি চুপচাপ কান্দে ভাবি। আমার অনেক মায়া লাগতেছিলো তারে দেইখা। (লায়লা)

– মনে যে অনেক বড় আঘাত পাইছে, ঐজন্য পাথর হয়ে গেছে। 

– শাহারিয়া কই ? 

– গোসলে গেছে মা। 

– তুমি কহন আইলা ঐ বাড়ি থেইকা ?

– এইতো মা এসে গোসল করে বের হলাম। 

– আচ্ছা তাইলে খাইতে আহো। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগতাছে না। আফাজের এমন অবস্থা আগে আমি কহনো দেহি নাই‌। পোলাডা একদম নিভা গেছে। চোখ গুলা সবসময় ভিজা। আলিশারে মনে হয় অনেক ভালোবাসতো। 

– হয়তো। ভালোবাসার মানুষের লাশ নিজ চোখে দেখার ব্যাথা যে অনেক মা ,,! 

– আচ্ছা আহো টেবিলে। খাবার বাইড়া দিতাছি খাইয়া লও। শাহারিয়াও চইলা আইবো ততক্ষণে গোসল দিয়া। 

– ঠিক আছে মা। 

শিউলি বেগম চলে যান তার ঘরের দিকে। তার পিছু পিছু বারান্দায় উঠে লায়লা। লায়লা দিথীর দিকে তাকিয়ে বলে,

– ভাবি, আপনের লগে আমার কিছু কথা আছে। 

– কী কথা ? 

– আহেন, কইতাছি। 

লায়লা দিথীর হাত ধরে তাদের ঘরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। দিথীর বুঝে আসেনা হঠাৎ লায়লা তাকে কী বলার জন্য তার ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লায়লা টেবিল পেড়িয়ে দিথীকে নিয়ে তার ঘরের দরজার সামনে আসে। দিথীকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়। দরজায় পর্দা ফেলে দেয়। 

 

______

 

চান্দের গাড়ি এসে থামে পাহাড়ের একটা যায়গায়। এটা বলতে গেলে মাঝপথই বলা যায়। পাহাড়ের এই উচ্চতায় কিছুটা সমতল যায়গা আছে। যায়গাটা গাছপালা দিয়ে ঘেড়া। রায়হান নিপা নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। চান্দের গাড়িটা আবার চলে যেতে থাকে। নিপা রায়হানের হাত ধরে আছে। রায়হান নিপাকে নিয়ে রাস্তা থেকে গাছপালা গুলোর পাশ টায় এসে দাঁড়ায়। নিপা বলে,

– পড়ে তখন কীভাবে ফিরবো ? 

– কাল সকালে যখন আরো গাড়ি এই রাস্তা দিয়ে নিচের দিকে যাবে তখন সেটায় উঠে পড়বো। 

– কিন্তু সব গাড়িই তো ফুল থাকে। আমাদের দুইজনের তো যায়গা মিলবে না। 

– আমার নিচের পরিচিত কয়েকজন ড্রাইভার আছে। ফোন দিলে খালি গাড়িও পাঠিয়ে দিবে। চিন্তা করোনা। চলো এগিয়ে যাই। 

নিপা আর কিছু বলেনা। রায়হান নিপার হাত ধরে এগিয়ে গাছপালার অংশটায় ঢুকে। গাছপালার ঘনত্ব বেশি একটা নেই। ৪-৫ ফিট দূরে দূরে একেকটা গাছ। গাছ গুলোর মধ্যে কিছু নীম গাছ, কিছুবা মেহগনি গাছ। সাথে নাম না জানা আরো অনেক গাছ। নিপা চারপাশ দেখতে দেখতে রায়হানের হাত ধরে ভিতরে এগোচ্ছে। সময়টা বিকেল। আলো তাই কমে এসেছে প্রায়। গাছপালা গুলোর বেশ খানিকটা ভিতরে আসায় পাখির কিচিরমিচির ডাক ভালো রকমই শোনা যাচ্ছে। নিপার চোখে পড়ে দূরে। দেখে এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে যাচ্ছে দুই বানর। এইরকম পরিবেশে সে এই প্রথম এলো। 

রায়হান নিপাকে নিয়ে একটা যায়গায় এসে থামে। এখান টা কিছুটা ফাঁকা। দেখে মনে হচ্ছে আগে গাছ ছিলো তবে পরে কোন কারণে গাছ গুলো কেটে ফেলা হয়েছে বা মরে গিয়েছে। রায়হান তার কাঁধ থেকে ব্যাগ টা নামায়। এক বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিপা বলে,

– এখানে থাকবো আমরা ? 

– হ্যা। এইখানে থাকবো। আগে যখন বন্ধুদের সাথে এসেছিলাম, তখন এখানেই ছিলাম। 

– কয়জন ছিলা তখন তোমরা ? 

– এইতো ৫-৬ জন। দুইটা তাঁবু বানিয়ে ছিলাম তখন। 

– এইখানে আগে গাছ ছিলো ? 

– হ্যা। এই যায়গায় বজ্রপাত হইছিলো। এইজন্য এখানকার কয়েকটা গাছ জ্বলে যায়। তারপর থেকে এখানে আর গাছ জন্মায়নি। শুধু ঘাস আছে। 

– আমার তো ভয় হচ্ছে। না জানি কখন আবার হারিয়ে যাই এই গাছপালার মাঝে।

– আরে হারাবেনা হারাবেনা। এই গাছপালার অংশটুকু আয়তনে খুবই কম। পাহাড়ের মাঝামাঝিতে ছোট্ট একটা সমতল যায়গা বলতে পারো এটাকে। (একটু থেমে মাথার উপরের দিকে তাকিয়ে) একটু পরেই রাত নামবে। তাঁবু বানিয়ে ফেলতে হবে আমাদের। আসো কাজে হাত লাগাও। 

নিপা এগিয়ে আসে। রায়হান ব্যাগের চেইন খুলে তাঁবু বের করে। দড়ি, হাতুড়ি আর বড় বড় লোহার পিন বের করে। রায়হানের কাছে এসে হেলে বসে নিপা। রায়হান ব্যাগ থেকে কী কী বের করছে তা সে দেখছে। তাঁবু বানানোর প্রায় সব জিনিস গুলো বের করে নিয়ে রায়হান তাঁবুর এক কোন নিয়ে একটু এগিয়ে যায়। নিপাও সাথে সাথে এগোয়। একটা যায়গায় ঘাস গুলো হাত দিয়ে কিছুটা তুলে দেয় রায়হান। তুলে দিয়ে তাঁবুর এক কোন গাড়ার জন্য লোহার লোহার পিন সেখানে ধরে। তারপর নিপাকে বলে,

– হাতুড়ি মারতে পারবা ? 

– যদি তোমার হাতে লেগে যায় ! 

– আচ্ছা তাইলে তুমি এখানটায় ধরো। শক্ত করে ধরবে কিন্তু। 

– ঠিক আছে। 

রায়হান সেই লোহার পিনটা নিপাকে ধরতে দেয়। নিপা শক্ত করে ধরে। রায়হান হাতুড়ি দিয়ে পিনটার মাথায় বাড়ি দিতে থাকে জোরে জোরে। নিপার হাতও তাতে কিছুটা কেপে কেপে উঠছে। নিপা মাথা উঠিয়ে কর্মঠ রায়হানের মুখ খানা দেখে। রায়হানের সম্পূর্ণ মনযোগ কাজের দিকে। হালকা ঘাম বেড়িয়েছে কপালে। নিপা এক মিষ্টি স্মাইল দিয়ে নিচের দিকে তাকায়। ভালো করে ধরে থাকে লোহার পিনটা। রায়হান বেশ কয়েকবার হাতুড়ি দিয়ে পিটানোর পর লোহাটা ভালোভাবে মাটি ভেদ করে ঢুকে। রায়হান আর নিপা উঠে দাঁড়ায়। রায়হান কোমরে হাত দিয়ে বলে,

– মাটিটা শক্ত হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি লোহাটা ঢুকছেই না ,,! 

– এভাবে করেই বাকি ৩ কোন গাড়তে হবে ? 

– হ্যা। চলো আরেকটা কোন গেড়ে ফেলি। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা নামবে। তখন অন্ধকারে কিছুই করা যাবেনা। চলো।

নিপাও মাথা নাড়িয়ে রায়হানের সাথে অন্য আরেক কোন ধরতে আরেকপাশে চলে যায়। দুইজন মিলে তাঁবু বানিয়ে ফেলতে থাকে। 

 

কিছুক্ষণ পর,

তাঁবুর অবশিষ্ট শেষ কোনের লোহাটায় শেষ বারের মত ঠুকে রায়হান। তাঁবুর চারটা কোনই রেডি। রায়হান আর নিপা উঠে দাঁড়ায়। রায়হান বেশ ঘেমে গিয়েছে। এখন শীতকাল, তবুও এদিকে ভ্যাপসা গরম করছে। রায়হান হেলে তাঁবুর মাঝের গেইটচেইন খুলে। দেখে ভিতরেও সব ঠিকঠাক। নিপাও হেলে রায়হানের পাশ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ভিতরে দেখতে থাকে। দুইজনের শোয়ার জন্য যায়গাটা মন্দ নয় কিন্তু,,! নিপা বলে,

– এমনিই এখানে শুয়ে পড়বো ? 

– না। ব্যাগে পাতলা তোষক আছে, ওটা বিছিয়ে দিয়ে তারপর শুবো। ঘাসের উপর তাঁবুর প্লাস্টিক, আর তার উপর পাতলা তোষক। একদম ঠিকঠাক। 

দুইজনই মাথা বের করে তাঁবু থেকে। বসে পড়ে ঘাস গুলোর উপরেই। রায়হান চারপাশে দেখতে থাকে। নিপা তার হিজাব খানা ঠিকঠাক করে। রায়হান বলে,

– আমি আগুন জালাবার জন্য কিছু জোগাড় করে আনি। তারপর আগুন জ্বালিয়ে একসাথে সূর্যাস্ত দেখতে যাবো। 

– আমিও তোমার সাথে যাবো। আমার একলা থাকতে ভয় লাগতেছে।

– আরে কীসের ভয়। কোন ভয় নাই। আমি তো এই আশেপাশেই থাকবো। 

– তারপরও, আমি এই যায়গা চিনিনা। আমাকে একা ফেলে যেওনা। 

– কিন্তু তখন বানররা এখানে এসে তাঁবুর প্লাস্টিক ছিঁড়ে ফেলবে যে। (একটু থেমে) আচ্ছা দাঁড়াও,

বলেই উঠে দাঁড়ায় রায়হান। এগিয়ে গিয়ে ব্যাগের সামনে হেলে বসে কিছু একটা বের করতে থাকে। নিপা তার পায়ে উঠা একটা ছোট্ট পোকা হাত দিয়ে ফেলে দেয়। রায়হান ডাক দেয় সামনে থেকে,

– সুবা,,! 

নিপা সামনে ফিরে তাকায়। তখনই দেখে তার দিকে কী জানি একটা কালো জিনিস ফিকে দিয়েছে রায়হান। নিপা দ্রুত সেটা ক্যাচ ধরে নেয়। দেখা এটা একটা ওয়াকিটকি। সে সেটা নিয়ে ভালোভাবে দেখতে যাবে, তখনই ওয়াকিটকি থেকে রায়হানের কথা ভেসে আসে। 

– সুবা, শুনতে পাচ্ছো আমায়,,! 

– হ্যা, শুনতে পাচ্ছি।

– এটা দিয়ে আমরা কথা বলতে পারবো একে অপরের সাথে। এটা ১০০ মিটারের মধ্যে কাজ করবে। এখানে ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। তাই ফোন করে তো যোগাযোগ করা যাবেনা। তাই এটা দিয়ে আমরা কথা বলবো। 

– কীভাবে কথা বলে এটা দিয়ে ! 

– এটার মধ্যে থাকা লাল বাটন টা প্রেস করে দিয়ে মুখের সামনে আনে কথা বলবে। আর এখানে থাকা স্পিকার দিয়ে আমার কথা শুনতে পাবে। 

– আচ্ছা ঠিক আছে। 

– আমি কিছু খড়কুটো কিংবা কাঠ জোগাড় করে আনছি। তুমি তাঁবুর ভিতরে গিয়ে বসো, কেমন! 

– তাড়াতাড়ি চলে আসিও,,! আমার একলা থাকতে ভয় করছে।

– আমি এই যাবো আর আসবো। তুমি তাঁবুর ভিতরে গিয়ে বসো।

 

নিপা সামনে মুখ তুলে তাকায়। কিছুটা সামনে থাকা রায়হান হাত উঠিয়ে একটা থাম্পস আপ জানায়। নিপা কপালে চিন্তার ভাঁজ। মুখে কিছুটা ভয়। 

রায়হান ব্যাগের ওখান থেকে উঠে চলে যেতে থাকে গাছপালা গুলোর দিকে। এখানে সামনের যেকোনো গাছের মোটা কয়েকটা ডাল ভাঙতে পারলেই কাজ চলে যাবে। রাতে ক্যাম্প ফায়ার না জ্বালালে ক্যাম্পিংয়ের যেন মজাটাই আসবে না। তখনই তার ওয়াকিটকি তে নিপার ম্লিন গলা ভেসে আসে,

– রায়হান,,,

রায়হান থেমে পিছন ফিরে তাকায়। দেখে নিপা তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে এক ভয় ভয় মুখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান তার ওয়াকিটকি টা মুখে কাছে নিয়ে বলে,

– ভিতরে বসো, আমি খালি যাবো আর আসবো।  

বলেই এক হাসি মুখ করে নিপাকে আস্বস্ত করে রায়হান। চলে যেতে থাকে আগুন জ্বালানোর জন্য জ্বালানি জোগাড় করতে। 

 

নিপা ক্যাম্পের চেইনদরজা খুলে ভিতরে ঢুকে। চেইন লাগিয়ে দেয়। এখনো পাতলা তোষক গুলো এখানে বিছানো হয়নি। তাই খালি প্লাস্টিকের উপর বসে আসে সে। চারপাশ থেকেই দিনের আলো ক্রমে ক্রমে নিভে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। গাছ থেকে দু-একটা শুকনো পাতা এসে পড়ে তাবুর উপরিভাগে। সেই শব্দেও যেন নিপা আঁতকে উঠে। এরকম অচেনা যায়গায় একলা থাকতে কেনো যানি তার ভয় করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি কিছু খারাপ মানুষ এসে তাকে তুলে নিয়ে গেলো। তাকে রায়হানের কাছ থেকে আলাদা করে দিলো। নানারকম দুশ্চিন্তা আসছে তার মাথায়। নিপা নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। হাতের ওয়াকিটকি টা ভালো করে দেখতে থাকে। দেখে বেশ পুরোনোই মনে হচ্ছে। হালকা স্ক্র্যাচ ও আছে ওয়াকিটকি টার গায়ে। নিপা তার হিজাব টা হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে দেয়। পায়ে নূপুর পড়ে এসেছিলো সে। নুপুর গুলো একবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে সোজা হয়ে বসে। মনের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্যেও বাড়ির কথা ভেসে উঠে। আলিশা তাকে ঝিনুক আর মুক্তার মালা নিয়ে যেতে বলেছিলো। সেগুলোতো এখনো কিনাই হয়নি। কাল কিনে নিতে হবে। পড়ে নাহলে বাড়ি গেলে মেয়েটা মন খারাপ করবে। বলবে তার জন্য জিনিস গুলা আনলো না। নিপা ভাবে আলিশার জন্য ঝিনুক, মুক্তোর মালার সাথে সাথে একটা কারুকাজ করা হাতে বানানো টুপিও নিবে। পাহাড়ে উঠার আগে এক দোকানে অনেক হাতে তৈরি কারুকার্য করা জিনিস দেখেছিলো সে। আর আলিশার কথা শুনে সে এটা এতোদিনে বুঝতে পেরেছে যে আলিশার সৌখিন জিনিসের প্রতি ঝোঁক বেশি। এইগুলো ও নিশ্চয়ই পছন্দ করবে। 

হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ আসে নিপার কানে। নিপার মেরুদন্ড সোজা হয়ে যায়। কেউ একজন হেঁটে হেঁটে এদিকেই আসছে মনে হচ্ছে। তবে আওয়াজ টা মৃদু। তারমানে এখনো কাছাকাছি আসেনি। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে দুইজন হেঁটে আসছে। শুকনো পাতায় পা পড়লে যেমন আওয়াজ হয় ঠিক তেমন আওয়াজ। নিপার বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। রায়হান টাও এখনো আসলো না। কে না কে এদিকে আসছে। যদি ওরা খারাপ লোক হয় তখন ,,! আওয়াজ শুনে নিপা এইবার বুঝতে পারে আওয়াজ দুটো। সেগুলাও একসাথে না, দুদিক থেকে আসছে। একটা যেইদিকে গেলে রাস্তায় উঠা যায় ঐদিক থেকে, আরেকটা ভিতরের দিক থেকে। দুই দিক থেকে দুইজনের হেঁটে আসার আওয়াজ। আওয়াজ গুলা ক্রমশ কাছাকাছি আসছে। নিপা ঘামছে। হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছার ব্যার্থ চেষ্টা করে সে। হাত টাও যে কাঁপছে। হঠাৎ একজনের পায়ের আওয়াজ আসা থেমে যায়। খুব কাছে এসেই যেন সেটা থেমে গেছে। কিন্তু ভিতরের জঙ্গলের দিক থেকে আওয়াজ টা এখনো আসছে। নিপা একটু এগিয়ে তাঁবুর চেইনটা হালকা নামায়। সেই ছোট্ট ফাঁকা দিয়ে চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করে যে লোকটা কে, তখনই যেন তার সবটুকু জমিয়ে রাখা দম ফুস করে নাক মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে। রায়হানই ছিলো এদিকের টা। নিপা তাড়াতাড়ি চেইন গেইট টা খুলে তাঁবু থেকে বেড়িয়ে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে রায়হানের দিকে এগিয়ে যায়। 

রায়হান কিছু কাঠ এনে ব্যাগের পাশে রাখে। উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দুই হাত কোমরে দিয়ে কাঠ গুলো দেখতে থাকে আর ভাবে এগুলো দিয়ে হবে কি না। তখনই নিপা এসে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে। রায়হান এমন কিছুর জন্য একটু অপ্রস্তুতই ছিলো বটে। রায়হান পিছন ফিরে তাকায়। দেখে নিপা ভয়ে ঘেমে শেষ। রায়হান হাত দিয়ে তার মুখের ঘাম মুছে দেয়। বলে,

– এতো ঘামে গেছো ,,! 

– জানো আমার কতো ভয় হচ্ছিলো! কেউ একজন রাস্তার দিক থেকে এদিকে আসছিলো, আমি হাঁটার আওয়াজ পেয়েছি। 

– কে আসবে এখানে। এখানকার ক্যাম্পিংয়ের যায়গা তো আমি আর আমার বন্ধুরা ছাড়া কেউ জানেনা। 

– আমি নিজ কানে শুনেছি। ঐ পায়ের আওয়াজ টা হঠাৎ থেমে গিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাদের এখানে এসে আমাদের দেখছে। 

– আরে না সুবা। হয়তো বেশি স্ট্রেস এ ছিলে, তাই ভুল শুনেছো। চারপাশ তাকিয়ে দেখো। গাছপালা গুলো তো ফাঁকা ফাঁকা। কেউ নেই আমরা দুজন ছাড়া। 

নিপা চারপাশে একবার চোখ বুলায়। দেখে চারিদিকে গাছ ছাড়া তেমন কিছু একটা চোখে পড়ছেনা। নিপা সামনে ফিরে আবার রায়হানকে জড়িয়ে ধরে। বলতে থাকে

– তুমি আর আমাকে একলা রেখে যাবানা। আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম তুমি জানো ! 

– আচ্ছা এখন আমি আসছি তো। কিচ্ছু হবেনা। (নিপাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে) চলো সূর্যাস্ত দেখতে যাই। সন্ধ্যা হয়েছে তো বেশ খানিকক্ষণ হলো। সূর্য এতোক্ষণে ডুবতে শুরু করেছে। 

– বাদর যদি আসে ,,! 

– অন্ধকার হতে শুরু করছে না, ওরা এখন ওদের গাছে গাছে গিয়ে চুপচাপ থাকবে। রাতের বেলা ওরা আর বাদরামি করবে না। চলো। 

নিপার কাঁধে হাত রেখে তাকে পাশে নিয়ে রায়হান চলে যেতে থাকে রাস্তার দিকে। বলতে থাকে এইখানে আগে যখন এসেছিলো তখনকার এক মজার ঘটনা। নিপার মনযোগ এখানে নেই। মন বারবার খালি বোঝার চেষ্টা করছে যে আরেকটা পায়ের আওয়াজ কার ছিলো। 

নিপা রায়হান রা তাঁবু ছেড়ে চলে যায় রাস্তার দিকে। দুইজন পাশপাশি হাটছে, নিপার কাঁধে রায়হানের হাত। তখনই কিছুটা দূরে এক গাছের আড়ালে দাঁড়ানো একজনের ছায়ামুর্তি দেখা যায়।

 

রায়হান নিপা গাছপালার অংশ থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় চলে আসে। তারা রাস্তা পার হয় না। এইপাশে থেকেই সোজা চোখ ফেলে। দূরের পাহাড় গুলোর মাঝে অর্ধেক সূর্য ডুবে গিয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় থাকা ঘন সাদা মেঘ যেন সূর্ঘটাকে আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী হতে। নিপা রায়হানের কাঁধে মাথা রাখে। তার মন এখন সময়টাকে অনুভব করতে চায়। রায়হান নিপার কাঁধে হাত রেখে তাকে আরো কাছে টেনে নেয়। প্রিয়জনের সাথে কাটানো এমন সুন্দর মুহুর্ত গুলোকে যেন স্বপ্নের মতো রঙিন এক দুনিয়া মনে হয়। এ দৃশ্য যেন চোখ জুড়িয়ে দেয়,এই বসুন্ধরার ভুবন ভোলানো রূপ কেমন তার জানান দেয়। রায়হান আরেকহাত দিয়ে নিপার হাত ধরে। ধীর গলায় বলে,

– সূর্যটাও আজ আমাদের ভালোবাসার সাক্ষি হলো। 

– হম, পৃথিবীর বুক থেকে সূর্য চলে গেলেও আমার দুনিয়া সবসময় তুমি আলোকিত করে রেখো, কেমন,,! 

– আমি তো সবসময় তোমার চাঁদ, সূর্য হয়েই থাকবো। তবে কখনো অস্ত যাবোনা। সবসময় তোমার আকাশে ভালোবাসার রঙিন আলো ছড়াবো, স্নিগ্ধ মধুর জোছনায় হারাবো। 

– আমার বর টা যেমন সুন্দর গায়ক, তেমনি সুন্দর কাব্যেও বের করে তার ঝুলি থেকে। 

– আর ভালোবাসা, সেটা দিয়ে যে আমার ঝুলি ভর্তি!

– ঐটায় তো শুধু আমার ভাগ। আমি যখন মন ঝুলি থেকে একটু একটু করে নিবো। 

– নিও, আর আমায় তোমার সাথে চিরজনম রেখো দিও ,,! 

– রাখবোই তো। তোমার বুকে মাথা রাখার লোভ কী আমি কখনো সামলাতে পারি,,! (এক হাত দিয়ে রায়হানের বুক ছুঁয়ে) এটাই যেন আমার শেষ আশ্রয়স্থল হয়। এটাই যেন আমার সুখের আশ্রয়স্থল হয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত টাও যেন আমি তোমার বুকে মাথা রেখেই কাটাতে পারি।(একটু থেমে ধীর গলায়) চলোনা ঐ মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াই ,,! 

– গোধূলি বেলায় মেঘ ভেলায়, ভাসবো দুজন, মাতবো খেলায় ,,,! 

নিপা ছোট্ট হাঁসি দেয়। রায়হানও সুন্দর এক হাসৌজ্জল মুখ করে। নিপা রায়হানের কাঁধে মাথা রেখে উপভোগ করতে থাকে এই সুন্দর সময়টাকে। স্বর্নাক্ষরে লিখে রাখে এই দিনটাকে তার স্মৃতির রুপালি পাতায়,,! 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৬৪

 (বোনাস পর্ব 🟢)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

আহনাফ কেবিনে প্রবেশ করলো। আফরিনের মা এই কেবিনেই এডমিট আছে। আহনাফ ভিতরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিলো। আফরিন তার মা’কে স্যূপ খাওয়াচ্ছিলো। আফরিনের পাশে দাঁড়ানো এক নার্স তাদের দেখছিলো। আহনাফ গিয়ে আফরিনের পাশে দাঁড়ায়। আফরিন স্যুপ খাওয়াতে খাওয়াতে আহনাফের দিকে ফিরে তাকায়। আবার তার মায়ের দিকে ফিরে তাকে স্যুপ খাওয়াতে থাকে। আহনাফের উপস্থিতি দেখে নার্সটা চলে যায়। তাকে রাখা হয়েছিলো রুগির কাছে সবসময় থাকার জন্য। কিন্তু এখন দুই দুইজন মানুষ এসেছে তাই সে চলে গিয়েছে। 

আহনাফ একটা চেয়ার টেনে আফরিনের পাশে বসে। আফরিনও একটা চেয়ারে বসেই বেডে থাকা তার মা’কে স্যুপ খাওয়াচ্ছিলো। আহনাফ স্বাভাবিক গলায় বলে উঠে,

– মাথার চুল গুলো সব পড়ে গেছে উনার। 

– হ। নার্স আফায় কইলো থেরাপি দিলে বলে এরম হয়। (ধীর গলায় আফরিন বলে)

– হ্যা, থেরাপি দিলে মাথার চুল পড়ে যায়। এখন উনার শরীর আগের থেকে ভালো মনে হচ্ছে। 

– কিছুডা। তয় মায়ে কথা কয় না। সবসময় চুপচাপ এমনে হেলান দিয়া বইসা থাকে। নাইলে শুইয়া থাকে। 

– আরেকটু সুস্থ হোক। তখন দেখবে ঠিক কথা বলছে। তুমি দুপুরে খাইছো ? 

– হ। 

– আমার বাসায় একটু কাজ ছিলো তাই দুপুরে বাসায় যেতে হয়েছিলো। (একটু থেমে) তোমার মা সুস্থ হলে তোমরা দুইজন আমাদের বাসায় থাকবে, কেমন,,! 

আফরিন ফিরে তাকায়। হাতে স্যুপের বাটিটা হালকা একটু কেঁপে উঠে। তার মুখে অবাক আর সাথে করুণ অনুনয় স্পষ্ট। আহনাফ আবার বলে,

– তোমার মা’কে আর ৩ টা থেরাপি দিলেই তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। তখন তোমরা আমাদের বাসায় চলে আসবে। আর সেখানেই থাকবে। 

আফরিন তার মায়ের দিকে মুখ ঘুড়ায়। তার মায়ের মুখে স্যুপ তুলে দিতে দিতে বলে,

– আমি আম্মারে লইয়া বস্তিতে যামুগা। আপনাগো উপর বোঝা হইয়া থাকতে চাইনা আমরা। এমনিতেই আপনাগোরে মেলা কষ্ট দিছি। আর না। 

– আরে কী বলছো। কীসের কষ্ট। আমরা কোন কষ্ট পাইনি। আর বোঝা কেনো হতে যাবে। তুমি আমার বাসায় আমার বন্ধু হিসেবে উঠবে। আমাদের বাসায় আমি আর আমার মা ছাড়া কেউ থাকেনা। মাঝে মাঝে খালামণি আসে, এই আরকি। তোমাদের কোন সমস্যা হবে না।

– আপনাগো মতো বড়লোক গো ইমারত আমাগো মতো গরীবের সইবো না। আমরা টিনের চালের নিচে থাইকা বড় হইছি। ইমারত আমাগো কাছে সপন। 

– আরে কিচ্ছু হবেনা। তুমি আমার মায়ের কাছে অনেক আদরে থাকবা।

– আপনারা আমাগো লাইগা অনেক করছেন। আপনাগো বাড়িত উইঠা আপনাগো আর কষ্ট বাড়াইতে চাই না। 

– আরে কেনো কষ্ট হবে বলোতো। তুমি আমার আত্মীয় হিসেবেই উঠলে। জানি তোমার আত্মসম্মানে কিছুটা বাঁধছে, তবুও এখন তোমার মা’কে নিয়ে বস্তিতে তোমাদের থাকাটা ঠিক হবে না। ঐ অস্যাস্থকর পরিবেশে উনি আবার অসুস্থ হয়ে যাবেন। 

– তাই বইলা আমি তো আপনাগো ঘাড়ে বইসা সারাজীবন ঋণি হইয়া থাকতে পারিনা, তাই না ,,! 

– আচ্ছা তাইলে আমার মায়ের ব্যবসায় হাত লাগাইয়ো। আমার মা মুক্তাবাংলা মার্কেটে ৪ টা কাপড় আর টেইলার্সের দোকান পরিচালনা করেন। তুমি মায়ের সাথে সেগুলো দেখা শোনা করিও। তাইলে তো আর কোন সমস্যা নেই। আর ধরে নাও তুমি আমার এক বিশেষ আত্মীয়। (ধীর গলায়) যে আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার তাড়না আমার কখনো জাগবেনা,,! 

– মানে। 

– কিছু না। তুমি আর তোমার মা আমাদের বাসাতেই উঠছো এটাই ফাইনাল। আমি আজ দুপুরে মা’কে বলেও আসছি। 

– আমি যদি সেলাইয়ের কাজ শিখতে পারতাম, তয় সেইডা কইরাই আপনাগো ঋণের কিছুডা হইলেও মিটাইতাম। আপনেরা আমার মরণ জন্ত্রনায় ভুগতে থাকা মা ডারে বাচাইছেন। আমাগো মতো গরীবরে এই বড়লোক গো হাসপাতালে আনছেন। আমি আপনাগো কাছে চিরজীবনের লাইগা ঋণী হইয়া থাকলাম। 

– আরে তেমন কিছুনাতো। তুমি আমাদের বাসায় যাওয়ার পর আমার মায়ের সাথে ব্যবসায়ীক দিক টা দেখবে। আমাদের কাপড়, আর সেলাইয়ের ব্যবসা। তোমার আত্মসম্মান বোধের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই গুলা সামলানোতে মায়ের হেল্প করিও। তাতে তোমার মনেও কোন খুদ থাকবে না। আর আমিও তোমাকে,,,,,,,

– আমারে কী ,,! 

– না, কিছুনা। তোমার মা কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও। 

– মায়ে এহন ঘুমাইবো না। একদম মাঝরাতে ঘুমাইবো। আর যহন যাইগা থাকে, সারাদিন এমনে চাইয়া চাইয়া দেহে চারপাইশ। 

– হমম,, উনার শরীর আগের থেকে অনেক টা উন্নত হয়েছে। নার্স তো বলেছিলো তোমার মায়ের উন্নতির সম্ভাবনা ২-৩ শতাংশের মতো। লাস্ট স্টেজের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন তিনি। ভাগ্যেস স্যার নতুন কিছু দামী দামী থেরাপি দিতে বলে গেলেন। তাই তোমার মায়ের ক্যান্সার টা লাস্ট স্টেজে যাওয়ার আগেই কমতে শুরু করেছে। 

– হ। আইচ্ছা উনি আপনের কী হয় ? 

– কে ? শাহারিয়া স্যার ? 

– হ। 

– উনি আমার স্যার। উনার অধীনে আমি গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করি। একটা কেস সূত্রে উনার-সাথে-আমার,,,,,,

শেষের কথা গুলো বলতে গিয়ে আহনাফের গলার স্বর নিম্ন হয়ে যায়। চোখ মুখ অবাক হয়ে যায়। হঠাৎ আবার বলে উঠে,

– এতোদিন ব্লাক রন্জুর কেস টার বিষয় তো মাথাতেই ছিলোনা। স্যার গেলো তার বোনের বিয়ে দিতে। নিজেও বিয়ে করে এখনো গ্রামেই আছে। এদিকে আমিও পড়ে গেছি আশরিফ নামের নতুন চিন্তায়। মানে এতোদিন এতোসব কিছু যেন আমার আর স্যারের মাথা থেকে রন্জূ কেস টাই ভুলিয়ে দিয়েছিলো। 

– কে রঞ্জু ? 

– রন্জু একজন বড় কিডনাপার। অনেক মেয়েদের সে কিডন্যাপ করে। খবর আছে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সাথে তার অনেক বড় সংযুক্তি আছে। 

– ওহ,,

– আচ্ছা তুমি তোমার মা’কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি একটু আসছি। 

বলেই চেয়ার থেকে উঠে পড়ে আহনাফ। চলে যেতে থাকে। তখনই পিছন থেকে আফরিন ডাকে,

– রাইতে আর আইবেন না ? 

আহনাফ পিছন ফিরে তাকায়। বলে,

– আসবো। আমি বাসা থেকে রন্জুর কেস ফাইল গুলো নিয়ে আসি। এখানে বসে সেগুলো দেখবো। 

– ও, আইচ্ছা ঠিক আছে। 

আহনাফে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে চলে যায় দরজা খুলে বাইরে। আফরিন তার মায়ের দিক ফিরে তার মায়ের মুখে আরেক চামচ স্যুপ তুলে দেয়। তার মা এক নজরে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের মণি গুলো যেন থমকে আছে তার। আফরিন তার মা’কে সম্পূর্ণ স্যুপ টা খাইয়ে খালি বাটিটা পাশের টেবিলে রেখে দেয়।

 

_____

 

আনন্দপুরের চৌরচক মোড়। লোকজন ছুটোছুটি করছে। অটো, ভ্যান গুলো তাড়াতাড়ি তাদের বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। ছোটখাটো একটা হইহুল্লোড়ই লেগে গেছে বলা যায়। ঝড়ো বাতাস উঠেছে। মাগরিবের আযান পড়েছে একটু আগে। আকাশ ছেয়ে গেছে কালো বাদলে। ঝড়ো হাওয়ায় ধুলা,বালু রাস্তায় থাকা পলিথিন সব উড়ছে। সুমু, পাগল পাগলিকে নিয়ে দৌড়ে ক্লিনিকের সামনে বর্ধিত ছাওনির দিকে আসছে। বাতাসে তার চোখ মুখে বালি ঢুকে যাওয়ার উপক্রম। হাত দিয়ে মুখ কিছুটা ঢেকে পাগল পাগলিকে নিয়ে দৌড়ে আসতে থাকে সে। সে ধরেছে পাগল টার হাত। পাগলটা ধরেছে পাগলিটার হাত। পাগলিটা কোলে একটা পটলা ধরে রয়েছে। পাগলির শাড়ির আঁচল টা হাওয়ায় উড়ছে। তারা তিনজনই দৌড়ে এসে ক্লিনিকে মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্লিনিকের মূল দরজার সামনে বর্ধিত ইট,পাথরের তৈরি একটা ছাওনি আছে। তারা এসে সেখান টাতেই আশ্রয় নেয়। দূরে বিকট আওয়াজে বজ্রপাত হচ্ছে। এখন ডিসেম্বর মাস। শীতের সময়। তবুও যেন গ্রীষ্মের কালবৈশাখী এসে পড়েছে আনন্দপুরে। 

ছাওনির এক কোনার বসে পাগল আর পাগলীটা। সুমু দরজার দিকটায় একটা উকি দিয়ে আবার তাদের দিকে এগোয়। পাগলীটা বজ্রপাতের শব্দে ভয় পাচ্ছিলো। তাই সে পাগল টাকে জড়িয়ে ধরে তার কোলে মুখ লুকিয়ে বসে ছিলো। সুমু তাদের সামনে এসে বলে,

– ভিতরে চলো। বৃষ্টি শুরু হলে পানির ছিটে লাগবে। পড়ে তখন জ্বর আসবে। 

– না, আমরা ভিতরে যামুনা। আমরা, আমরা এহানেই থাকমু। 

– আরে ভিতরে চলো। এখানে থাকলে ভিজে যাবা বললাম তো। 

– না না। আমরা যামুনা। 

– আচ্ছা তাইলে তুমি তোমার রাণীকে শক্ত করে ধরে রাখো। ও আকাশ ফাঁটার শব্দে ভয় পাচ্ছে।

– আ,আমি আছি। ওরে আমি জড়ায়া ধইরা রাখছি।

– হ্যা এভাবে জড়ায় ধরে রাখো। আজকে মনে হয় অনেক বৃষ্টি আসবে। 

বলেই সুমু চৌড়চকের দিকে তাকায়। মাঝখানে থাকা বড় মূর্তিটাও যেন বাতাসে নড়ে উঠছে, এতো জোড়ে জোড়ে বাতাস বইছে। সব্জির দোকানদাররা মোটা প্লাস্টিক দিয়ে তাদের সব্জি ঢেকে দিতে ব্যস্ত। এতো জোড়ে বাতাস বইছে যে ৩-৪ জন মিলে প্লাস্টিক বাঁধতে হচ্ছে কাঁচা শাক, সবজির পাটাতনের উপর। দোকানপাট গুলোর সাটার নামিয়ে তালা মারতে ব্যস্ত মুদির দোকানদারেরা। মাঠ চড়ানো ছাগল আর গরু গুলো ছুটে ছুটে যাচ্ছে। তাদের গলায় বাঁধা দড়ি গুলো মাটিতে পড়ে ময়লা ধূলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। পিছে পিছে তাদের মালিক ছুট লাগিয়েছে। এক প্রকায় হট্টগোল লেগে গেছে চৌড়চকে। দিনের আলো একদম ফুরিয়ে এসেছে। কিছু ঘন কালো মেঘ এদিকেই ছুটে আসছে দ্রুত গতিতে। সুমুর চোখের আড়াল হয়না সেই মেঘ। বাতাস এসে তার খোলা চুল গুলোকে উড়িয়ে শুন্যৈ নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সে দেখে হনুফা ঝড়ো বাতাসের মাঝে দৃশ্যমান হয়েছে। বাতাসে উড়ে আসা একটা পলিথিন হনুফার মাথায় ঢুকেছে। সে তিড়িংবিড়িং করে এদিক সেদিক হাওয়ায় ছুটছে। সুমু তা দেখেই হেঁসে ফেলে। সে বুঝতে পেরেছে হনুফা এই আবহাওয়াতেও মজার মুডে আছে। বড় বড় বৃষ্টির ফোটা পড়তে শুরু করে আকাশ থেকে। বিশাল, বিশাল বজ্রপাতের শব্দ যেন কান ঝালাপালা করে দিতে থাকে। 

 

      আফাজ বেডে শুয়ে আছে। তার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। সে কাঁদছে। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। গাঁয়ে এখন অন্য কাপড়। রক্ত ভেজা পান্জাবি কালই খুলে রেখেছিলো শিউলি বেগম। হয়তো বাড়িও নিয়ে গিয়েছে। সেটা খুলে শাহারিয়ার কাপড় পরিয়ে দিয়ে গেছে। আফাজ তার বাম হাত উঠিয়ে চোখ মুছার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তার চোখের পানি যে কোন বাঁধা মানছে না। বারবার আলিশার লাশটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তার প্রাণসখীর লাশ, ক্ষতবিক্ষত শরীর। দুইদিন আগেও কত সুন্দর কথা বললো তার সাথে।হাত ধরে এদিক ছুটে বেড়েলো দু’জন, অথচ মাত্র একটা দিন, একটা দিন সব বদলে দিলো। 

আফাজের এই রুম টা ক্লিনিকের দোতলায়। রুমে শুধু একটা বেড, যেটায় আফাজ শুয়ে আছে। বেডের পাশে একটা ছোট টেবিল। আর দেওয়ালের উত্তর কোণে আছে একটা টেবিল। আফাজের বেডের অপর পার্শ্বে একটা জানালা। জানালার কপাট গুলো বাতাসে বারবার খোলা-লাগা করছে। ঝড়ো বাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে রুমের মধ্যে। হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়। পুরো ঘর অন্ধকারে ছেয়ে যায়। গ্রামে ঝড়বৃষ্টি মানেই কারেন্ট উধাও। জানালা দিয়ে বাইরে মৃদু দিনের আলোয় ঘরকে অস্পষ্ট আলোকিত করেছে। আফাজের কাছে যেন এই ঘরটা কোন আঁধারের গহীন অরণ্যে লাগছে। বুকের মধ্যে থাকা ব্যাথাটা তার সর্বাঙ্গ অসার করে দিচ্ছে। আলিশার শেহওরান বলে ডাক দেওয়া তার কানে ভেসে আসছে। কিন্তু না। এটা তো শুধু একটা ভ্রম, শ্রুতিভ্রম। আশপাশ যে তার কাছে আবার নির্জন হয়ে উঠে। হয়ে উঠে এক বিষাদের কান্ডারি। কানে ভেসে আসে বিষাদ সুরে ভরা কিছু লাইন ,,,

 

অন্ধকার ঘরে, কাগজের টুকরো ছিঁড়ে

কেটে যায় আমার সময়

তুমি গেছো চলে

যাওনি বিস্মৃতির অতলে

যেমন শুকনো ফুল বইয়ের মাঝে রয়ে যায়

 

রেখেছিলাম তোমায় আমার হৃদয় গভীরে

তবু চলে গেলে, এই সাজানো বাগান ছেড়ে

আমি রয়েছি তোমার অপেক্ষায়…

 

নিকষ কালো এই আঁধারে

স্মৃতিরা সব খেলা করে

রয় শুধু নির্জনতা

নির্জনতায় আমি একা

একবার শুধু চোখ মেলো

দেখো আজ পথে জ্বালি আলো

তুমি আবার আসবে ফিরে

বিশ্বাসটুকু দু’হাতে আঁকড়ে ধরে।

,

,

,

 

কিছু পুরোনো গান

কিছু পুরোনো ছবির অ্যালবাম

এসবই আমার সাথী হয়ে রয়

 

কাকডাকা ভোরে

যখন সূর্য ঢুকে ঘরে

কালো পর্দায় বাধা পেয়ে সরে যায়

আমার এ জগত বড় আগলে রাখে আমায়

তবু মাঝে মাঝে মনে হয়

মৃত্যুই কি শ্রেয় নয়

আমি রয়েছি তোমার অপেক্ষায়

 

নিকষ কালো এই আঁধারে

স্মৃতিরা সব খেলা করে

রয় শুধু নির্জনতা

নির্জনতায় আমি একা

একবার শুধু চোখ মেলো

দেখো আজ পথে জ্বালি আলো

তুমি আবার আসবে ফিরে

বিশ্বাসটুকু দু’হাতে আঁকড়ে ধরে

 

আফাজ জোড়ে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,

– আলিশা, ভ্রমর আমার। তোরে আমি অনেক ভালোবাসি রে,,! অনেক ভালোবাসি। কেনো আমায় ফেলে চলে গেলি। আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। চিরতরে মুছে গেলো আমার জলন্ত শিখার প্রদীপ। আয়না ফিরে। আমি তোকে অনেক আগলে রাখবো। অনেক আদরে রাখবো। একটা বার ফিরে আয়,,,! 

কান্নার অশ্রজল বাঁধ মানেনা। অঝোর ধারায় বৃষ্টির মতো ঝড়তে থাকে আফাজের চোখ বেয়ে। তার কান্না শুনে যেন আশাপাশে থাকা মৃত আত্মারও কেঁদে উঠছে। পুরো ঘর কান্নায় ভারি হয়ে উঠে। আফাজের আকুতি, চিৎকার কানে এসে জানান দিচ্ছে বিচ্ছেদের সুর কতটা কষ্টদায়ক, কতটা বেদনাদায়ক হয়। আফাজের ডান হাত অসার। সেই হাত তার ফেটে গিয়েছে। সেটায় সেলাইন লাগানো। আফাজ দুই হাত উপরে তুলে তার কল্পনাতিত আলিশাকে ছোঁয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তার বুকের ভিতরের ছিন্ন ভিন্ন ব্যাথা গুলো তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আফাজ হাত নামিয়ে ফেলে। কাঁদতে থাকে তার প্রিয়তমাকে স্মৃতির পাতায় প্রজলিত করে। 

এক জোড়া পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে। করিডোর দিয়ে কেউ হেঁটে আফাজের রুমের দিকেই আসছে। সাথে ছোট্ট এক আলোয় দৃশমান হচ্ছে। আওয়াজ কানে এসে ঠেকতেই আফাজ ছলছল চোখ গুলো নিয়ে দরজার দিকে মুখ ফিরে তাকায়। এক মেয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। মেয়েটার হাতে জ্বলতে থাকা এক লম্বা মোমবাতি ঘরকে কিছুটা মৃদু আলোকিত করে তোলে। মোমবাতির আলোয় মেয়েটার চোখ দুটো চিকচিক করছে। চুল গুলো কোমর অব্দি তার। মৃদু হাওয়ায় উড়ছে সেগুলো।‌  মোমবাতির জ্বলতে থাকা আলোক শিখা কিছুটা নড়ে উঠে। আফাজ অস্পষ্ট ছলছল চোখে সেই নারীকে পরিলক্ষিত করে। বাম হাত খানা বাড়িয়ে সেই অবয়বকে ছুঁতে চায়। এটা নিশ্চয়ই তার আলিশা। তার আলিশা আবার তার কাছে ফিরে এসেছে। আফাজ বা হাত খানা কিছুটা উঠিয়ে তার ভেজা কন্ঠে ডাকতে থাকে,

– আলিশা, আমার আলিশা। ত,তুমি এসেছো ,,! 

তখনই সেই মেয়ে হতে এক ধীর আওয়াজ ভেসে আসে,

– আ,আমি আলিশা না। আমি সুমু। সামিয়া বিনতে সুমু। 

আফাজ আবার আশাহত হয়ে ভেঙে পড়ে। কাঁদতে থাকে। সুমু ধীর পায়ে ভিতরে এগিয়ে আসে। জানালার কপাট খানা বারবার খোলা বন্ধ হচ্ছে বাতাসে। কিছুটা ঝড়ো হাওয়ার মোমবাতির আলোক শিখা নড়ে উঠতে থাকে। সুমু এসে আফাজের বেডের পাশে দাঁড়ায়। মোমবাতির আলোটা আফাজের মুখ অব্দি পৌঁছায়। আলিশার আগ্রহ ভরা চোখ গুলো সেই চেহারা দেখেই প্রকম্পিত হয়ে উঠে। তার বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। তার সারাদেহের মরা কোষ গুলো আবার জীবন ফিরে পায়। এই মোমবাতির অনির্বাণ শিখায় সে কাকে দেখতে পেলো ,,! তার চোখ ভুল দেখছে নাতো ,,! এটা তো সেই যুবক। যার ছবি খানা তার অন্তরের আয়নায় সয়নে-সপনে ভাসে। রাতের ঘুম গুলো চোখ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে যায়। উনি এখানে ভর্তি কেনো ? উনি এভাবে কাঁদছেন কেনো ? কী হয়েছে উনার ? এক গাঁদা প্রশ্ন যেন মনের দরজায় এসে কড়া নাড়তে থাকে। সুমু এক ঢোক গিলে। হাতে থাকা মোমবাতি টা আফাজের বেডের পাশে থাকা টেবিল টায় রাখে। মোমবাতির আলো অস্থীর। জানালা দিয়ে ঢুকতে থাকা ঝড়ো হাওয়া তাকে নানা ভঙিতে নাচিয়ে তুলছে। সুমু ধীর পায়ে বিছানার অপর পার্শ্বে যায়। খোলা-বন্ধ হতে থাকা জানালার কপাট গুলো লাগিয়ে ছিটকিনি তুলে দেয়। পিছন ফিরে তাকায়। আফাজ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। মোমবাতির ম্লিন আলোয়া এই দুই নরনারীকে বেশ ভালোভাবেই অবলোকন করা যায়। একজন স্মৃতি হাতড়ে কষ্টের নদীতে বৈঠা বাইছে। আরেকজন কৌতুহলের সাগরে পাল তোলা নৌকা নিয়ে তীর খুঁজে ফিরছে। 

সুমু এসে বিছানার আরেকপাশে দাঁড়ায়। যেপাশ টায় ছোট্ট টেবিল আছে সে পাশটায়। সুমুর মনে থাকা প্রশ্ন গুলো আর বাঁধ মানেনা। বেড়িয়ে আসে মুখ দিয়ে সশব্দে। 

– আপনি কাঁদছেন কেনো !

আফাজ ছলছল চোখ নিয়ে সুমুর দিকে তাকায়। সুমু আবার বলে,

– আপনাকে কে কষ্ট দিয়েছে,! আমাকে বলুন। (একটু থেমে ধীর গলায়) আ, আলিশা কে! 

শেষ প্রশ্নটা করার সময় সুমুর বুকে ঝড় উঠে মেঘ গর্জন করে। তার বুকখানা কাঁপছে। আফাজের কান্না ভেজা গলা দিয়ে আওয়াজ বেড়িয়ে আসে,

– আলিশা আমার ছোট্ট ফুল। আমার মন বাগানে আসা প্রথমো-শেষ ফুল। 

– আলিশার কী হয়েছে ? 

– মেরে ফেলেছে ওকে। আমার ফুলটাকে প্রফুষ্টিত হতে দেয়নি ওরা। ঝড়ে পড়েছে আমার বাগান থেকে। পাপড়িহীন হয়ে। 

বলেই কাঁদতে থাকে আফাজ। সুমুর বুকের ঝড় যেন এখনো আগের মতোই বইছে। সুমুর কৌতুহল তাকে দিয়ে আবার প্রশ্ন করায়। 

– ভালোবাসতেন ওকে! 

– নিজের থেকেও বেশি। এই ভুবনের সবকিছুর থেকেও বেশি। 

সুমু নিজের মনটাকে যেন প্রস্তুত করে ফেলেছিলো এমন কিছু শোনার জন্য। সুমু এক ঢোক গিলে। তার লেগে লেগে আসা গলাটাকে খুলে আবার ধীর কন্ঠে বলে,

– আ,আপনি কাঁদবেন না। এভাবে কাঁদা আপনাকে মানায় না। 

আফাজ কিছু বলেনা। এক দৃষ্টে উপরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। 

সুমু বলে,

– সবাইকে তো একদিন না একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যেতেই হয়। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। 

আফাজ আবারো নিশ্চুপ। শুধু তার ম্লিন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। 

– জীবন কখনো থেমে থাকেনা। যে চলে গিয়েছে তাকে তো কখনো ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। তাই বলে কী আপনি সারাজীবন ওর জন্য কাঁদতেই থাকবেন,! 

– ও আমার বিশেষ একজন ছিলো। আমার প্রাণ ভোমরা ছিলো। 

কান্না ভেজা গলার স্বর গুলো কিছুটা বিষাদের সুর নিয়ে সুমুর কানে এসে ঠেকে। সুমু নিজের মন কে শান্ত করে। বিরবির করে বলে,

– রং হীন জীবনকে রংতুলির আঁচড়ে রঙিন করার দায়িত্ব টা না হয় আমিই নিলাম ,,! 

আফাজের কান অব্দি সুমুর সেই ক্ষীণ আওয়াজ পৌঁছায়নি। আস্তে আস্তে আফাজের চোখ বুজে আসতে থাকে। ঘরে থাকা কান্নার আওয়াজ নিভে যেতে থাকে। সব ‌নিশ্চুপ হয়ে যায়। সুমু আফাজের দিকে মুখ তুলে তাকায়। দেখে আফাজ চোখ বুজেছে। একদম নিথর হয়ে গেছে। কোন শব্দ নেই। কিছুক্ষণের জন্যও যেনো সুমুর দম আটকে আসে। সুমু তাড়াতাড়ি বিছানায় থাকা আফাজের বাম হাতটা ধরে। পালস চলছে। তার মানে কোন খারাপ কিছু হয়নি। তবে, তবে হাত যেনো জলন্ত আগুনের মতো উত্তপ্ত। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সুমুর পায়ের তলা থেকে মাটি সড়ে যাওয়ার উপক্রম। সুমু তাড়াতাড়ি দরজার দিকে ফিরে ডাকতে থাকে,

– ডাক্তার,,,,,, নার্স,,,,,,, প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন। কেউ কি আছে ,,,,, ডাক্তার ,,,,,,,,

না। কারো সাড়া শব্দ শোনা যাচ্ছে না। বাইরে ঝড়বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। নিশ্চই ডাক্তার নার্স বাড়ি ফিরে গিয়েছে। এই রকম রুগী ফেলে তারা চলে যেতে পারলো ,,! সুমু কী করবে বুঝতে পারেনা। সে অস্থীর হয়ে যায়। রুমের মধ্যে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। তার ভিতর টা যেন উৎকণ্ঠিত, ছটফট করছে। উত্তর পাশের দেওয়ালের দিকে থাকা বড় টেবিলের কাছে একটা ১ লিটারের খাওয়ার পানির বোতল দেখতে পায় সুমু। ছুটে সেখানে যায়। বোতলে অর্ধেকের বেশি পানি ছিলো। সুমু তাড়াতাড়ি সেই বোতল টা হাতে নেয়। খুঁজতে থাকে কোন এক পাত্র। সেই টেবিলেই একটা ঔষধ বক্স খুঁজে পায় সে। বক্সের ঢাকনা খুলে সব গুলো ঔষধ টেবিলের উপরেই ঢেলে রেখে ছুটে চলে আসে বিছানার কাছে। মোমবাতি রাখা বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিল টায়। সেই মোমবাতির পাশেই সেই প্লাস্টিকের ছোট্ট বক্সটা রাখে সুমু। হাটু গেড়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। বোতল থেকে পানি ঢালতে থাকে বক্সে। বেশ কিছুটা পানি ঢেলে তার ওড়নাটা গা থেকে খুলে। ওড়নার এক প্রান্ত হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়তে থাকে। বেশ শক্ত। তবুও খুব জোড় দিয়ে টান দেয়। ওড়নার একপ্রান্তের কাপড় ‌টুকু ছিঁড়ে ফেলে। তার বুকের হ্রদপিন্ড উঠানামা করছে। যেন এই বুঝি লাফাতে লাফাতে দেহ থেকে পড়ে যাবে। ওড়না থেকে ছেঁড়া অংশটুকু সেই বক্সের পানিতে ভিজায়। ভালোকরে ভিজিয়ে পানি চিপে ফেলে। উঠে দাঁড়ায়। আফাজের কপালে রাখে ভেজা কাপড় টা। শরীরে অনেক তাপ। তার কাছে এখন আর এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আফাজের কপালে কাপড় খানা ভালভাবে দিয়ে পায়ের দিকে থাকা কাঁথাটা তুলে দিতে থাকে আফাজের গলা অব্দি। বাইরের বজ্রপাত শোনা যায়। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। সই সই করে বয়ে চলা বাতাস আর পানির ঝাপটা এসে জানালার কাঠের কপাটে শব্দ ‌তুলছে। সুমু আফাজের কপাল থেকে কাপড়টা তুলে। ভেজা কাপড়টা যেনো মুহুর্তেই গরম হয়ে গেলো। সুমু আবার সেই কাপড়টাকে ভিজিয়ে নিয়ে চিপে আফাজের কপালে দেয়। আফাজের শরীরটা কাঁপছে। হ্যা, আসলেই কাঁপছে। বোধহয় খুব ঠান্ডা লাগছে তার। এমনিতেই শীতকাল চলছে তার উপর এমন বর্ষা বাদলের রাত। আবহাওয়া যেন আরো বেশি ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। সুমু আশেপাশে দেখে আর কোন কাপড় পায় না। শুধু এই পাতলা কাঁথাটা ছাড়া বিছানায় আর কিছু নেই। সুমু তার ওড়নাটাও কাঁথার উপর দিয়ে দেয়। নিচে গিয়ে কারো কাছে সাহায্য চাইবে কি না তা ভাবতে থাকে। কিন্তু নিচে তো পাগল পাগলি ছাড়া আর কোন মানুষ নেই। যারা ছাওনিতে এসে দাঁড়িয়েছিলো তারাও চলে গেছে বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময়ই। ক্লিনিকে মনে হয় খালি রুগিরাই আছে একলা। এই গ্রামের ডাক্তার নার্সরাও এমন দায়সারাভাবে রুগিদের ফেলে চলে গিয়েছে। সুমু পায়চারি করছে। বারবার ভাবছে কি করা যায়। সে এসে আবার আফাজের কপালের কাপড় টা নতুন করে ভিজিয়ে চিপে আবার কপালে রেখে দেয়। আবার বেডের পাশে পায়চারি করতে থাকে। তখনই তার সামনে উদয় হয় হনুফা। সে সুমুকে এমন অস্থির দেখে বলে উঠে,

– কীরে, তুই এমন উতলা ক্যান ? কী হইছে ? 

– হনুফা, ঐযে ঐ উনি। উনার জ্বর আসছে। শরীর কাঁপতেছে। আমি কি করবো বুঝতেছিনা। তুই কোথা থেকে আমাকে মোটা কাঁথা বা কম্বল এনে দিতে পারবি ,,! 

– আমি, আমি কই পাবো,,! 

– দেখ না কোথাও থেকে যদি আনতে পারিস। প্লিজ দেখ না। উনার শরীর আরো খারাপ হয়ে যাবে নাইলে। 

– আচ্ছা তাইলে তুই থাক। আমি দেখি কোথাও কাঁথা কম্বল পাই কিনা। 

– হ্যা একটু দেখ।

হনুফা গায়েব হয়ে যায়। সুমু আবার গিয়ে আফাজের কপালের কাপড় টা ভিজিয়ে বদলে দেয়। আবার পায়চারি করতে থাকে। এভাবে করলে তো দেহের তাপ কমবে না। শরীরে যদি গরম কিছু চাপা না দেওয়া যায়। তাইলে তো উনার আরো ঠান্ডা লাগবে। জ্বর আরো বাড়বে। সুমু পায়চারি করছে আর ভাবছে এখন তার কী করা উচিত। কি করলে আফাজের শরীর সে গরম রাখতে পারবে। তখনই হঠাৎ তার মস্তিষ্ক অন্য কিছুর জানান দেয়। সুমু পায়চারি থামিয়ে দেয়। পিছন ফিরে আফাজের কাঁপতে থাকা দেহটার দিকে তাকায়। সুমু এক ঢোক গিলে। তার মস্তিষ্ক এখন তাকে যেই সিদ্ধান্ত এনে উপনিত করলো তা করতে যেন তার সর্বাঙ্গে এক আলাদা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সুমু ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। তার হাত পা গুলো এক অজানা কারণে কাঁপছে। এই প্রথম বার তার এমন অনুভূতি হচ্ছে। তার মস্তিষ্কে এক নতুন সেল গঠন হচ্ছে। সুমু গিয়ে আফাজের বেডের পাশে দাঁড়ায়। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। তার মন যেন সায় দিচ্ছে আবার দিচ্ছেও না। তার ৫ ইন্দিয় যেন দোটনায় পড়ে গেছে। কী করবে কী করবেনা সেই সিদ্ধান্তে অটল হতে পারছেনা। হঠাৎ সুমু হেলে আফাজের বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। চোখ বুজে ফেলে। তার হ্রদপিন্ডের ধুকপুকানি যেন ধীরে ধীরে শান্ত শীতল হয়ে যাচ্ছে। সুমু তার উষ্ণতা দিয়ে আফাজের শরীর চেপে ধরে। নতুন এক অনুভূতি হচ্ছে তার। বাইরে এক জোড়ে বজ্রপাত হয়। সুমু আরো শক্ত করে চেপে ধরে আফাজকে। তার বুকে নিজের মাথা রেখে আফাজের বুকের ধুকপুক ধুকপুক শব্দ শুনে। সুমুর চুল গুলো আফাজের মুখের কিছুটা অংশে পড়েছিলো। মোমবাতির মৃদু আলোয় যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনার সাক্ষী হলো ঘরে থাকা মৃত আত্মারা। মোমবাতির আলোক শিখা কিছুটা নড়ে উঠলো। দুজনের জড়িয়ে ধরে থাকার ছায়াটাও যেন দেয়ালে দুলে উঠলো ,,,! 

 

_______

 

কাঠের দরজায় করাঘাতের শব্দ। সোনালী বিছানা থেকে নামে। দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ঘরটা কাঁচা খরের ঘর। বাইরে বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ আসছে। ঘরের টেবিলে জ্বলছে একটা লন্ঠন। সেই আলোতেই ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠেছে।বাইরের বৃষ্টির শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কোন বিরান জঙ্গলের মাঝে ঘরটা একা দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ে তারপর মাটিতে নেমে আসছে। 

সোনালী দরজা খুলে দেয়। তার মুখ ফুটে উঠে এক দুষ্টু হাসি। একটা টাকার বান্ডিল ছুড়ে মারে কেউ তার দিকে। সোনালী সেইটা ক্যাচ ধরে। দরজা মেলে দেয়। রাফসান ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। হাতে থাকা ছাতাটা বন্ধ করে ঘরের মেঝেতে ফেলে দেয়। সোনালী টাকার বান্ডিল টার ঘ্রাণ নেয়। নিয়ে রাফসানের দিকে এক গভীর চাহনিতে তাকায়। আঙ্গুল দিকে তাকে ডাকতে থাকে। রাফসান তার গায়ের জ্যাকেট টা খুলে ছুড়ে মারে মাটিতে। পিছনে ফিরে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিতে থাকে। সোনালী এসে বিছানার পাশে থাকা একটা টেবিলের ড্রয়ারে টাকার বান্ডিল টা রাখে। রেখে বিছানায় বসে। রাফসান দরজা লাগিয়ে এসে বিছানার সামনে দাঁড়ায়। তার মাথার চুল গুলো হালকা ভিজা। বাইরে বৃষ্টির মধ্যে আসতে গিয়ে ভিজে গিয়েছে হয়তো‌। সোনালী পা তুলে বিছানায় বসে। পড়নে এক হালকা স্লিভ শাড়ি। শাড়ির একপাশ থেকে আরেকপাশের বিষয়বস্তু একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাফসানের গায়ে এক সাদা শার্ট। ছোপ ছোপ পানি লেগে কিছু যায়গা ভিজে গিয়েছে। বিশাল দেহি শরীরের সাথে যেন ফুল হাতা সাদা শার্টটা লেপ্টে গিয়েছে। সোনালী এক আধখোলা চোখ নিয়ে অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাফসানের দিকে। রাফসান এক ম্লিন হাসি দিয়ে বলে,

– তো চলো, বৃষ্টির মুখোর রাত টা এবার উপভোগ করা যাক ,,! 

সোনালী এক দুষ্টু হাসি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। রাফসান বিছানায় উঠার জন্য প্রস্তুত হয়। তখনই সোনালী গড়িয়ে বিছানায় উবুর হয়ে শুতে। তার পিঠ থেকে খোলা চুল গুলো হাত দিয়ে সড়িয়ে দেয়। ব্লাউজের ফিতা গুলো ছাড়া আর কিছুই নেই পিঠে। খোলা উদ্যম পিঠ আর কোমর যেন রাফসানকে খুব টানছে। রাফসান তার শার্টের বোতাম খুলে ফেলে। শার্ট ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো এক কিশোরী হরিণীর উপর। বাইরে এক বড় বাজ পড়ার শব্দ ভেসে আসে। সাথে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। দূরে থাকা এক টেবিলে বইয়ের থাকের মাঝে এক মোবাইল ফোন রাখা। সেখানকার ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ হতে থাকে সোনালী আর রাফসানের প্রতিটি উষ্ণতম মুহূর্ত ,,,! 

 

______

 

খাবারের খালি ক্যান টা রায়হানের সামনে রাখে নিপা। পানির বোতল টা হাতে নিয়ে মুখে চুমুক দেয়। সামনে ক্যাম্প ফায়ার জ্বলছে। আকাশ পরিষ্কার। জোছনা রাত। দূর হতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একটা জোনাকি পোকা আলো জ্বেলে তাদের সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। রায়হানও তার খালি খাবারের ক্যান টা রাখে নিপার ক্যানটার পাশে। এলুমিনিয়াম ক্যানের প্রকিয়াজাত করা খাবার খাচ্ছিলো তারা দুজন। খাবার গুলো ব্যাগেই ছিলো। নিপা পানির ঢোক গিলে বোতল টা রায়হানকে দেয়। রায়হান বোতল নিয়ে চুমুক দেয়। নিপা বলতে থাকে,

– ক্যানের খাবার এই প্রথম খাইলাম। একদম ভালো না। সাদামাটা। 

রায়হান বোতল টা মুখ থেকে নামায়। পানির ঢোক গিলে বলে,

– ক্যানের খাবার গুলো এরকমই হয়। তবে এগুলাতে পুষ্টি আছে অনেক। এই ক্যান খেয়েই তুমি ১ মাস বেঁচে থাকতে পারবা। 

– ১ মাস! আমি এখনই খাইতে পারতেছিলাম না ঠিকমতো সেই যায়গায় ১ মাস খালি এগুলো খেয়ে কাটানো ,! আমার দ্বারা সম্ভব না বাপু। 

– আমার সয়ে গেছে। আগে বন্ধুদের সাথে যখন এসেছিলাম তখন মাংস পুড়িয়ে খেয়েছিলাম। আর সাথে এই ক্যানের খাবার। আমার তো পোড়া মাংসের চেয়ে এই ক্যানের স্বাদই ঢের ভালো লাগে। 

– খালি ক্যান গুলা কী করবা এখন ? 

– এইযে এভাবে আগুনে ফেলে দিবো। এই গুলা অনেকক্ষণ ধরে জ্বলবে। 

– আচ্ছা তুমি বসো, আমি আমার সোয়েটার টা নিয়ে আসছি। ঠান্ডা লাগতেছে আমার। 

– তোমার উঠতে হবেনা। আমিই যাচ্ছি। আমার আরেকটা জিনিস আনতে হবে। 

– আচ্ছা ঠিক আছে। 

রায়হান উঠে যায়। নিপা পানির বোতলের ছিপিটা লাগিয়ে দিয়ে পাশে রাখে। আগুনের খুব বেশি সামনে বসে নেই তারা। তাদের থেকে দেড় দুই হাত দূরে আগুন টা জ্বলছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বেড়েছে। মাঝে মাঝে কিছু বানরের চিঁ চ্যাঁ আওয়াজও ভেসে আসছে দূরের গাছপালা থেকে। নিপা হাটু দুটো জড়ো করে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে। রায়হান চলে আসে। নিপাকে তার সোয়েটার টা দেয়। নিপা দেখে রায়হান একটা ছোট্ট গিটার নিয়ে এলো ব্যাগ থেকে। রায়হান নিপার পাশে বসে। নিপা বলে,

– এইটা কখন আনলা ? 

– এইটা ব্যাগেই ছিলো। তবে এইটা আমার টা না। আমার টা তো বাসায়। ব্যাগটা আমার বন্ধুর। এই গিটার টাও ওর। দেখোনা এইটা ছোট। আমার টা তো বড়। 

– হ্যা তোমার টা এইটার থেকে বড়। আমি আরো ভাবলাম তোমার মনে হয় দুইটা গিটার। 

– না না। একটাই। এইটা আমার বন্ধু পারভেজের। 

– তোমার বন্ধুও কী গান করে ?

– আমাদের সার্কেলে ৪ জনই আমরা গানের সাথে জড়িত। কলেজে থাকার সময় তো আমাদের একটা ব্যান্ডও বানাইছিলাম। কিন্তু পড়ে আর মিউজিকের সাথে কো অপারেট করা হয়নি আমার। পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় হাত দিয়েছি। (গিটার আঙ্গুল দিয়ে একটা টান দিয়ে) এই সময়টা গান গাওয়ার জন্য পারফেক্ট। দেখো সামনে ক্যাম্প ফায়ার জ্বলছে। পাশে তুমি বসে আছো। উপরে গোলগাল চাঁদটা জোছনা ছড়াচ্ছে। এই রকম ভাইব আর কোথাও পাবেনা। 

 

নিপা সোয়েটার পড়ে নেয়। নিয়ে রায়হানের সাথে কাছাকাছি হয়ে বসে। রায়হানের এক হাত জড়িয়ে ধরে। রায়হান তার সামনে থাকা আরেকটা খালি ক্যান আগুনের দিকে দিয়ে দেয়। কিছু ফুলকি আকাশে উড়ে মিলিয়ে যায়। রায়হান বলে,

– শুরু করি তাইলে ,,! 

– কোন গান টা গাইবে ,,! 

– যেটা আমার প্রথম মাথায় এসেছিলো তোমায় দেখে ,,! 

নিপা একটা মুচকি হাসি দেয়। রায়হান গিটারের হাতের আঙ্গুল বোলায়। সুর তুলতে থাকে এই নিদারুণ প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে। নিপা রায়হানের কাঁধে মাথা রেখে তার হাত জড়িয়ে ধরে এক দৃষ্টে ক্যাম্পফায়ারের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই ক্যাম্পফায়ারের আলোতে তাদের দুইজনের মুখয়ব জলমলিয়ে উঠছে। রায়হান গান ধরে,

 

আমার একলা আকাশ

থমকে গেছে

রাতের স্রোতে ভেসে

শুধু তোমায় ভালবেসে

 

আমার দিনগুলো

সব রঙ চিনেছে

তোমার কাছে এসে

শুধু তোমায় ভালবেসে

 

তুমি চোখ মেললেই

ফুল ফুটেছে

আমার ছাদে এসে

ভোরের শিশির

ঠোট ছুঁয়ে যায়

তোমায় ভালবেসে

 

আমার একলা আকাশ থমকে গেছে

রাতের স্রোতে ভেসে

শুধু তোমায় ভালবেসে

,

,

আমার ক্লান্ত মন ঘর খুঁজেছে যখন

আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম

শুধু তোমার টেলিফোন

 

ঘর ভরা দুপুর

আমার একলা থাকার সুর

রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম

তুমি কোথায় কতদূর

 

আমার বেসুরে গীটার সুর বেঁধেছে,

তোমার কাছে এসে

শুধু তোমায় ভালবেসে

আমার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে

তোমার হাসি হেসে

শুধু তোমায় ভালবেসে

 

রায়হান গিটারের সুর থামায়। নিপার চোখ গুলো ক্যাম্পফায়ারের আগুনের আলোয় চিকচিক করছে। নিপা রায়হানের কাঁধ থেকে মাথা উঠায়। রায়হান বলে,

– কেমন ছিলো ,,! 

– অসাধারণ,,! আমি তোমার গানে হারিয়ে গিয়েছিলাম,,! 

– বুঝতে হবে। আমি আমাদের ব্যান্ডের মেইন ভোকালিস্ট ছিলাম। আর আজ তোমার প্রেমেতে গায়ক তকমায় আবার নিজেকে ভাসালাম। 

– ছোট বেলা থেকেই তুমি গান গাইতে ,,!

– না। কলেজে উঠার পর থেকে গানের যাত্রা শুরু। আচ্ছা শুনো এখন, আমি তোমার জন্য যেই গান টা লিখেছিলাম সেটা গাই। 

– তুমি আমার জন্য গান লিখেছো ,,!

– হ্যা। তোমায় চিঠি পাঠানোর পর থেক আজকের এই রাত পর্যন্ত। তোমায় আমি যতটা চিনেছি, যতটা উপলব্ধি করতে পেরেছি, যতটা ভালোবাসার সাগরে ভেলা ভাসিয়েছি সব আমার গানে আমি লিখেছি। সুর দিয়েছি। অপেক্ষায় ছিলাম দুজনে যখন একসাথে এক সুন্দর পরিবেশে থাকবো তখন তোমায় গেয়ে শুনাবো। আজকেই সেই দিন। 

– প্লিজ শোনাও। আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে ,,! আমার প্রিয় আমার জন্য গান লিখেছে ,,,! প্লিজ শোনাও। 

– আচ্ছা তাইলে ঠিক আবার আগের মতো আমার হাত জড়িয়ে ধরো। কাঁধে মাথা রাখো,,! 

নিপা সাথে সাথে আবার রায়হানের হাত জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখে। খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে দুজন। আকাশে ছোট এক পেজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে যায়। চাঁদ খানা তার আড়াল হতে উঁকি দেয়। নিপা চোখ বুজে। রায়হান গিটারের সুর বাঁধে তার মায়ার বাঁধনে। গাইতে শুরু করে তার প্রিয়তমার জন্য লেখা প্রথম গান,

 

তুমি আমার নওতো সুখ

তুমি সুখের বেদনা,

সব স্বপ্নের রং হয়নাতো 

বেদনার মতো নয় রঙা,

জীবনের সব কথা নয়

আমি জীবনটাকেই বলতে চাই,

হয়তো দু’বাক্য নয়

সেতো ভালোবাসার কাব্য কয়,

আমি কবি নই

তবু কাব্যের ভাষাই বলবো আজ,,,

,

,

তুমি বললে আজ দু’জনে 

নীল রঙা বৃষ্টিতে ভিজবো,

রোদেলা দুপুরে একসাথে 

নতুন সুরে গান গাইবো,

,

,

আমি কবি নই

তবু কাব্যের ভাষাই বলবো আজ,

তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে 

স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই,

তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে 

স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই,,,

,

,

তুমি বললে আজ দুজনে 

সাত রঙা প্রজাপতি ধরবো,

নোনা বালিচরেতে একসাথে 

আকাশের সমুদ্র স্নান দেখবো,

গোধুলির আলো আঁধারিতে ঊর্মির সাথে দুজনা

নীলের বুকে আজ হারাবো,,,

 

আমি কবি নই

তবু কাব্যের ভাষাই বলবো আজ,

তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে 

স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই,

তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে 

স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই,,,,

 

নিপা চোখ খুলে। সে যেনো হারিয়ে গিয়েছিলো কোনো রঙিন স্বপ্নের রাজ্যে। গানের প্রতিটা লাইন সে অনুভব করতে পারছিলো। সুরের সাগরে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছিলো তার মন। রায়হান গানটা কতটা আবেগ দিয়ে লিখেছে,,! রায়হান গিটার থেকে আঙ্গুল উঠায়। আশেপাশের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মাঝে নিরবতা ভেঙ্গে বলে,

– আমার সুবাটার কী গানটা পছন্দ হয়েছে ,,! 

নিপা কিছু বলে না। হঠাৎ জড়িয়ে ধরে রায়হানকে। ও কাঁদছে। রায়হান অবাক হয়। বলে,

– কী হয়েছে,,! সুবা তুমি কাঁদছো কেনো ,,! 

নিপা আরো শক্ত করে রায়হানকে জড়িয়ে ধরে থাকে। তার চোখের জল গুলো রায়হানের কাঁধে পড়ছিলো। রায়হান নিপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে আরো ভালোভাবে আলিঙ্গিত করে নেয়। নিপা কান্না ভেজা কন্ঠে বলে,

– তোমার এতোটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য আমি নই ,,! আমার ভয় হয়। আমি যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি ,,! তুমি, তুমি সবসময় আমার হয়ে থেকো। সবসময়। 

– আরে বোকা। কাদেনা তো। আমি তো তোমার সাথেই আছি। তোমার অনেক কাছে আছি। তোমায় ছেড়ে জনম,জন্মান্তরেও যাবো না।

– আমার মনে হয় আমি যেন তোমার ভালোবাসায় মরে যাই। তোমায় হাতে আমি আমার হৃদয়টা উঠিয়ে দেই। তোমার ভালোবাসা আমার অনেক আপন করে নিয়েছে। প্রিয়জন থেকে প্রয়োজন। সব হয়ে উঠতে চাই আমি তোমার। সবসময় তোমায় ভালোবাসায় আমায় এভাবেই জড়িয়ে রেখো ,,! আমায় আগলে রেখো ,,! 

– আচ্ছা আচ্ছা কান্না থামাও এখন। আমি তো আছি। সবসময় তোমার কাছেই আছি। আর থাকবোও। আর কেদোনা। 

রায়হান তার কোল থেকে নিপাকে উঠায়। মেয়েটার চোখ দুটো ভিজা। এখনো কাঁদছে। রায়হান নিপার কপালে আর দুই চোখের পাতায় চুমু খায়। তার মুখের উপর থেকে চুল গুলো সড়িয়ে কানের পাশে রাখে। বলে,

– তুমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। আমি সবসময় তোমায় আমার অঙ্গে অঙ্গে বেঁধে রাখবো। ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিবো। আমার ভালোবাসা, আমার স্রোতোসিনী। 

নিপা ছলছল চোখ নিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। রায়হানকে আবার জড়িয়ে ধরে। রায়হান তাকে আলিঙ্গনে বেঁধে রাখে। নিপাকে এতোটা ঘনিষ্ঠ ভাবে রায়হান আলিঙ্গন করেছিলো যে নিপার হৃদস্পন্দন সে তার দেহে অনুভব করছিলো। যেন দুই হ্রদয় এক প্রান্তরে এসে মিলে একাকার হয়ে গিয়েছে। রায়হান নিপাকে বলে,

– ঘুম ধরেছে ,,! 

– উমম, কিছুটা। 

– চলো ঘুম পাড়ানির গান বলে তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দেই। 

– আমি এভাবেই থাকবো। তোমাকে জড়িয়ে ধরে। 

– কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ো। তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গান গাইবো। 

– ঘুমিয়ে গেলে আমাকে কিন্তু কোলে করে তাঁবুতে দিয়ে আসতে হবে। 

– আমি তো সেই কোলে নেওয়ার লোভেই তোমায় এখন ঘুম পাড়িয়ে দিবো ,,,! 

– দুষ্টু,,,! 

নিপা রায়হানের কোল থেকে মাথা উঠায়। একটা মিষ্টি হাসি দেয়। রায়হানের কোলে মাথা রেখে শোয়। দুই হাত দিয়ে রায়হানের কোমর জড়িয়ে ধরে। পেটে একটা ছোট চুমু খায়। রায়হান তা দেখে এক ছোট্ট হাসি হেসে তার মাথায় হাত রাখে। চুলে বুলি কেটে দিতে থাকে। নিপার মাথার হিজাব টা খাওয়ার সময়ই খুলে রেখেছিলো সে। রায়হান নিপার মাথায় এক হাত রেখে আরেক হাত দিয়ে নিপার তুলতুলে গালে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। নিপা মুচকি হাসে। রায়হান নিপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গান ধরে। আকাশের জোছনায় তারাকারাজিরাও ঝলমলিয়ে উঠে,

,

,

খোলা চোখ খানা কর বন্ধ

বাতাসের ঠান্ডা গন্ধ,

বয়ে বেড়ায় ঘরেরও বাহিরে,,

আসো ছোট্ট একটা গান করি

যাতে ঘুম পাড়ানি মাসি এসে পাশে,

বসে হাতখানা দিবে কপাল ভরে,,

 

ভয় নেই আছি আমি পাশে,

হাতখানা ধরে আছি হেসে,

কোলেতে আমার মাথা তোমার..

অন্ধকার রাত, নিশ্চুপ সব,

জোনাকির দল আজো জেগে আছে,

তারা হয়তো অপেক্ষায় তোমার ঘুমের

 

হাতে রেখে হাত দেখে ঘড়ি,

বসে অপেক্ষা করি,

কবে হবে কাল, ফুটবে সকাল,,

 

আয় ঘুম চুম্বন দে

তার সারা কপালে,

যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়,

আয় চাঁদমামা কাছে আয়,

যাতে অন্ধকার না হয়,

আলোমাখা কপালেতে টিপ টা দে যাতে,

কিছু আলোকিত হয়,

সে যাতে ভয়, না, পায়,,

,

,

 

পরী আয় তার দুই হাত ধরে

নিয়ে যা স্বপ্নের খেলাঘরে

যেথা মিলবে তার সুখের ঠিকানা,,

তারাদল ছুটে আয় এখানে

তার ঘুমখানা যাতে না ভাঙে তাই

নিয়ে যা তাকে স্বর্গের বিছানায়,,

যদি দেখো সেথা আমায়,

বসে গান তোমায় শোনায়

তুমি মিষ্টি এক চুমু খেয়ো মোর গালে,,

 

অন্ধকার রাত নিশ্চুপ সব

জোনাকির দল আজো জেগে আছে,

তারা হয়তো অপেক্ষায় তোমার ঘুমের,,

 

হাতে রেখে হাত দেখে ঘড়ি,

বসে অপেক্ষা করি,

কবে হবে কাল, ফুটবে সকাল,,

 

আয় ঘুম চুম্বন দে

তার সারা কপালে,

যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়,

আয় চাঁদমামা কাছে আয়,

যাতে অন্ধকার না হয়,

আলোমাখা কপালেতে টিপ টা দে যাতে,

কিছু আলোকিত হয়, আহা …………. আহা………….

 

নিপা চোখ বুজে পাড়ি দিয়েছে ঘুম রাজ্যে। সারাদিন জার্নি করায় হয়তো চোখের কোনে থাকা ঘুম সারা চোখের পাতায় ছেয়ে গিয়েছে। রায়হান নিপার দিকে তাকায়। মেয়েটা ঘুমালে যেনো আরো কিউট লাগে। রায়হান আবার হাত দিয়ে গাল গুলো ছোঁয়। একদম নরম তুলতুলে গাল। রায়হান নিপার কপালে এক ছোট্ট চুমু খায়। গিটার টাকে ওখানে রেখেই নিপাকে দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে নেয়। বিশাল দেহি রায়হানের কাছে যেন নিপাকে তুলার পুতুল মনে হচ্ছে। মেয়েটা এতো নরম কেনো ,,! নিপার লম্বা চুল গুলো ঝুলছে, হালকা বাতাসে দুলছে। চাঁদের জোছনা ঘুমন্ত মুখে এসে পড়ে শুভ্রতার আলো ছড়াচ্ছে। রায়হান তাকে কোলে নিয়ে চলে যায় তাঁবুর দিকে। আকাশের উজ্জ্বল চাদ খানাও আলো দিতে দিতে বোধয় আজ ক্লান্ত। সেও চলে যায় মেঘের আড়ালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে। নিচে শুধু জ্বলতে থাকে ক্যাম্প ফায়ারের আগুন। আর তার কিছু দূরে পড়ে থাকে রায়হানের ছোট্ট গিটার টা। 

 

দূরে থাকা কোন এক লোক হেঁটে হেঁটে চলে যায় রাস্তার দিকে। এতোক্ষণ বোধহয় সে নজর দারির সাথে সাথে নিপার আর রায়হানের সুন্দর মুহুর্তটাকেও উপভোগ করছিলো ,,! 

 

____

 

আফাজের ঘুম ভাঙে। নিজেকে আবিষ্কার করে সেই ক্লিনিকের রুমের ছোট্ট বিছানাটায়। বাইরের বৃষ্টির আওয়াজ তার কানে এসে পৌঁছায়। শরীর দুর্বল লাগছে। মাথা ঘুরে পাশ ফিরে তাকাতেই সে থমকে যায়। একটা মেয়ে তার হাতের মাংসপেশিতে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। ফ্লোরে বসে তার হাতের মাংসপেশিতে মাথা দিয়েছে সেই মেয়ে। টেবিলে জ্বলতে থাকা মোম টা অর্ধেকে এসে নেমেছে। সেই মোমের জলন্ত শিখায় মেয়েটার ঘুমন্ত মলনি মুখ খানা উজ্জ্বল চাঁদ হিসেবে ধরা দেয় আফাজের চোখে। আফাজ তার কপালে এক ভাঁজ করা কাপড় আবিষ্কার করে। কাপড় টা তার কপাল থেকে উঠিয়ে দেখে একটা ছেঁড়া কাপড়। তার শরীরে কাঁথা তুলে দেওয়া। সাথে একটা পাতলা ওড়নাও দেখে সে। হাতে নেওয়া কাপড় টা আর ওড়নার কাপড় টা একই। সে আবার মেয়েটার ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকায়। টেবিলে দেখতে পায় সচ্ছ পানির বোতল আর তার পাশে থাকা বক্সটায় পানি। সে এখন কিছুটা বুঝতে পারে। তার হয়তো জ্বর এসেছিলো। সে এখন যেন জ্বর থেকে উঠে আস্তে আস্তে তার হারানো জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে। একটা মেয়ে এসেছিলো এই ঘরে। ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে আফাজ আবার তাকায়। এইটাই তো সেই মেয়েটা। মেয়েটা তার সেবা করলো ,,! কেনো করলো ! মেয়েটা কী হয় তার ,,! আফাজ মেয়েটার মুখের উপরে চলে আসা দু একটা চুলকে ফুঁ দিয়ে সড়িয়ে দেয়। তার কাছে যেন মনে হতে থাকে আলিশা ঘুমিয়ে আছে তার হাতে বাহুবলে, আলিশার মতোই মেয়েটা ছোট্ট। ফর্সা চেহারা তার। জ্ঞান হারাবার আগে যখন মোমবাতি নিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো তখন মোমের আলোয় মেয়েটার চিকচিকে চোখ গুলো দেখেছিলো সে। আফাজ কিছু বলে না। মেয়েটাকেও ডাক দেয় না। তার মন থেকে মেয়েটার মুখয়ব সড়ে গিয়ে আলিশার মুখয়ব ভেসে উঠে। এমনই তো একটা মিষ্টি ফুল ছিলো আলিশা। মিষ্টি মেয়েটার কথা গুলো মনে পড়তেই আফাজের ভিতর টা খাঁ খাঁ করে উঠে। তার সবটুকু ভালোবাসা জুড়ে শুধু আলিশাই ছিলো। আর আলিশাই থাকবে। সে কখনোই আর কাউকে সেই যায়গায় বসাতে পারবেনা। তার মন অন্য আর কাউকে মেনে নিতে পারবেনা সেই আসনে। আফাজের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু। তখনই হঠাৎ দেখে তার বাহুবলে মাথা রাখা মেয়েটি নড়ে উঠেছে। সে চকিতে সেদিকে তাকায়। মেয়েটা ঘুমের মধ্যেই নড়ে আফাজের বুকে কনুইরেখে গলায় হাত রাখে। নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় তারপর। আফাজের বাম হাতে মাথা রেখেছিলো সেই মেয়েটা। আর ডান হাতটা তার অবশ। সে মেয়েটাকে উঠিয়ে দিতে পারছিলোনা। তার মনই কেনো জানি চাইছিলোনা। তবে মেয়েটার হাতের আঙ্গুল গুলো তার গলায় ত্বকে লেগেছিলো। তবে তা এক ভিন্ন স্পর্ষ হিসেবেই তার মস্তিষ্ক সনাক্ত করে। আফাজ তার চোখ বুজে। আলিশার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাইরের বৃষ্টির আওয়াজে ঘরে থাকা মোমের আলোয় এই দুই নরনারীকে যেন খুব আপন মনে হয়,,! তাদের পরিচয় যেন ছিলো পূর্বজন্মের ,,,! 

 

______

 

ব্রেকিং নিউজ,,,

খাগড়াছড়ির পাগলাপিড়, আর মহালছড়িতে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছে স্থানীয় চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের নারী ও শিশু সহ ৫৭ জন। আহত শতাধিক। আক্রমণকারী জঙ্গিরা মহালছড়ি আর পাগলাপিড় অঞ্চলের সব পাহাড় আর যায়গা নিজেদের দখলে করে নিয়েছে। খাগড়াছড়ির সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পুলিশ আর বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের সাথে জঙ্গিদের কয়েকদফা গুলি বিনিময় হয়েছে। আমরা আরো বিস্তারিত জানার জন্য যুক্ত হচ্ছি আমাদের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি কমল দে’র সাথে। কমল, আপনি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন ,,! হঠাৎ এই জঙ্গি হামলা কী করে হলো? মৃতের সংখ্যা কী আরো বাড়তে পারে ? 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৬৫

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

সকালের এক নতুন অরুনোদয় ঢাকা পড়ে মেঘের আড়ালে। হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে শেষ রাত থেকে। তাঁবুর ভিতরে রায়হানকে জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে নিপা। উপর থেকে ২-১ ফোঁটা বৃষ্টির পানি এসে তাঁবুর গাঁয়ে পড়ছে। ওয়াটার প্রুফ তাঁবু হওয়ায় ভিতরে পানি ঢুকেনি। মাঝে মাঝে ঠান্ডা বাতাসে গাছের পাতা গুলো দুলে উঠছে। বাইরে থেকে আসছে গোলাগুলির আওয়াজ। সকালের আলো ফোটার আগেই এই গুলির আওয়াজ রায়হান আর নিপার ধরীত্রিতে আঁধার নামিয়ে দিয়েছে। নিপা অনেক ভয় পাচ্ছে। রায়হানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। রায়হানের মুখেও চিন্তার ছাপ। হঠাৎ এতো গুলি বিনিময়ের আওয়াজ আসছে কেনো ? পাহাড়ের নিচে হচ্ছে টাই বা কী ? আর আজই হতে হলো ! নিপাকে নিয়ে সে একটু ঘুরতে এসেছিলো কিন্ত সব আবহ এই গুলির আওয়াজে ভয়ের কুপ জমিয়ে দিয়েছে তাদের মনে। রায়হান নিজের মুখের উপর থেকে ভয়ের মেঘ কাটাবার সিদ্ধান্ত নেয়। নাইলে যে নিপার ভয়টা সে দূর করতে পারবেনা। নিপা তার উপর নির্ভর করে আছে। নিজে ভেঙে পড়লে তো হবেনা। রায়হান গলা ঝেড়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে,

– খিদা লাগছে তোমার ,,! 

– আ, আমার কোন খিদা লাগেনি। আমার ভয় লাগছে। খুব ভয় লাগছে। নিচে কিসের গোলাগুলি হচ্ছে, আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

– আরে ভয় পেয়ো না। তেমন কিছু না। হয়তো কোন রাজনৈতিক বিষয়। মিছিল মিটিং এ পুলিশ রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে না! এটা ঐটারই শব্দ। ভয় পাইয়ো না। আমি আছিতো। 

– তারপরও, তারপরও আমার ভয় লাগছে। আমাদের, আমাদের কিছু হয়ে যাবে না তো ! তোমার কিছু হলে কিন্তু আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো। 

– আরে পাগলি কিছু হয়নি। আমি আছি তো তোমার সাথে। তোমার আমার কারো কিচ্ছু হবেনা। আমি আছি কী জন্য হ্যা ,,! ভয় পেয়োনা। (একটু থেমে) আচ্ছা দাঁড়াও আমি একটু বাইরের পরিস্থিতি দেখে আসি। 

– নাআআআআ। একদম না।‌ (রায়হানের উপর হামলে পড়ে) তোমাকে আমি একদম যেতে দিবো না। 

– আমি খালি রাস্তার এখান থেকে দেখেই চলে আসবো। 

– না, তোমাকে দেখতে যেতে হবেনা। তুমি আমার সাথে থাকো। আমার, আমার (কাঁদো কাঁদো হয়ে) ভয় করতেছে খুব। 

– আরে আরে কাঁদছো কেনো ! তেমন কিছুই হয়নি তো। আচ্ছা আচ্ছা আমি এখানেই আছি, বাইরে যাবোনা। (একটু থেমে বিরবির করে) এই গেন্জাম লাগারও সময় পাইলো না। আমি সুবাকে নিয়ে যেদিন বেড়াতে আসলাম সেদিনই গেন্জাম লাগতে হলো। 

নিপা কন্ঠ খাদে ফেলে বলে,

– আমরা এখান থেকে বেড়োনোর পর সোজা বাড়ি চলে যাবো। এখানে আর থাকবো না। 

– আরে কী বলো কী। কোন না কোন ঝামেলার জন্য আমাদের ট্রিপ ক্যান্সাল করবো ! না না। একদমই না। আমি আরো আজকে সেইন্টমার্টিন যাওয়ার প্ল্যান করে রাখছি। সুবা তুমি চিন্তা করতেছো কেনো। নিচের গ্যান্জাম তো উপরে আসবেনা। আর আমার কাছে, আমার কাছে এইটা আছে। (কোমর থেকে এক পিস্তল বের করে রায়হান। নিপা তা দেখেই আর ভয় পেয়ে রায়হানকে ছেড়ে পিছিয়ে যায়। রায়হান আস্বস্তের সুরে বলে,

– আরে ভয় পাইয়ো না। এইটার লাইসেন্স করা আছে। কোন দরকার লাগতে পারে ভেবে আনছিলাম। যদি কেউ তোমার আর আমার উপর কিছু করতে আসে এটা দিয়ে তাদের শরীর ঝাঝড়া করে দিবো। 

– র, রায়হান। তুমি বন্দুক সাথে নিয়ে ঘুরো ,,! 

– তো কী হইছে ! তুমি আমি একযায়গায় ঘুরতে আসবো, আমাদের সেইফটি কে নিশ্চিত করবে ! আমাদের টা আমাদেরকেই দেখতে হবে। এখন আসো তো কাছে। এতক্ষণ কত জোড়ে চেপে জড়িয়ে ধরেছিলা। এখন আবার থাকো। 

– তুমি এখনো মজার মুডে আছো রায়হান। আমার ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। 

– আরে কিছু হবেনা তো। এইটা তো আছেই। ধরে দেখো, এইটা খেলনা না। আসল কিন্তু। (বলেই নিপার দিকে বন্দুকটা এগিয়ে দেয় রায়হান। নিপা ভয়ে আরো পিছিয়ে গিয়ে বলতে থাকে,

– দূরে সড়াও ঐটা, আমার থেকে দূরে সড়াও। 

– আচ্ছা আমি তাইলে আবার এটাকে যায়গা মতো রেখে দিলাম। এবার তো কাছে আসো। আমার কোলে উঠে বসে থাকো। এখন তো একসাথে বসে থাকা ছাড়া আর আমাদের কিছু করার নাই। 

নিপা ভয়ে ভয়ে কাছে আসে। এসে রায়হানের পাশে বসে। রায়হান মৃদু হাসে। নিপার বুক যেন ধুকধুক ধুকধুক করছে। উপর থেকে পাতায় জমা বৃষ্টির পানি ফোঁটা ফোঁটা হয়ে এসে তাঁবুতে পড়ছে। হঠাৎ গোলাগুলির আওয়াজ আসা বন্ধ হয়ে যায়। হইহুল্লোড়ের আওয়াজও পাওয়া যায় না। নিপা রায়হানের কাঁধ থেকে মাথা উঠায়। চারপাশে মুখ ঘুড়িয়ে বলতে থাকে,

– রায়হান, গুলির আওয়াজ হঠাৎ থেমে গেলো।

– হ্যা। মনে হয় পুলিশ ওদের ধরে ফেলেছে। 

– কাদের ? 

– ইয়ে মানে যারা আরকি হড্ডগোল করছিলো। তাদের। (কিছুটা নার্ভাসের সুরে কথাটা বলে রায়হান)

– আমার পানির পিপাসা পেয়েছে। পানির বোতল টা দেওতো।

রায়হান তার পাশে থাকা পানির বোতল টা হাতে নেয়। কিন্তু বোতল একদম খালি। বোতলে এক ফোঁটাও পানি অবশিষ্ট নেই। রায়হান নিপাকে বোতল দেখিয়ে বলে,

– এইটার পানি তো শেষ। দাঁড়াও আমি বাইরের ব্যাগ থেকে আরেকটা বোতল আনছি। ব্যাগে আরো বোতল থাকার কথা। 

– না, তুমি যাবেনা। বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি পানি খাবো না।

– আরে বাচ্চাদের মতো করছো কেনো ? গোলাগুলি তো থেমে গেছে। এখন আবার কীসের ভয়। আর ব্যাগটা তো আগুন যেখানে ধরিয়েছিলাম ঐখানেই আছে। ভয়ের কিছু নাই। 

– তুমি যেওনা। আমার এখনো ভয় করতেছে। 

– আচ্ছা এখন কীসের ভয় হচ্ছে তোমার বলোতো ! না আছে গুলির শব্দ, না আছে অন্য কিছু। আমি তো এখন নিচে কিংবা রাস্তার দিকে যাচ্ছি না। ব্যাগটা থেকে পানির বোতল নিয়েই চলে আসবো। 

নিপা রায়হানের কথা গুলো শুনে ভয়ে ভয়ে তার হাত ছেড়ে দেয়। রায়হান তাঁবুর চেইন খুলে। বাইরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ কিছুটা মেঘলা। আবহাওয়া ভয়ঙ্কর সুন্দর, কিন্ত সকালের এই গুলাগুলি সব রোমান্টিক আবহ ভেস্তে দিয়েছে। রায়হান মনে মনে সেই হড্ডগোল সৃষ্টিকারি লোকজনের জন্য কিছু গালি ছুড়ে দিয়ে তাঁবু থেকে বেড়োয়। নিপা তাঁবুর গেইট দিয়ে মাথা বের করে বসে আছে। চোখ,মুখে ভয়ের ছাপ। রায়হান উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে হেঁটে ব্যাগের দিকে যেতে থাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হওয়ায় কিছুটা কর্দমাক্ত হয়েছে ঘাসঘেরা ভূমিটা। রায়হান হেঁটে গিয়ে ব্যাগের পাশে দাঁড়ায়। ব্যাগের কিছুটা সামনেই তারা ক্যাম্পফায়ার জালিয়েছিলো। কিন্তু শেষ রাতে আসা বৃষ্টিতে তা নিভে গেছে। রায়হান হেলে ব্যাগের চেইন খুলে। সেখান থেকে পানির ‌বোতল বের করতে থাকে। নিপা তাঁবুর গেইট থেকে মুখ বের করে চেয়ে আছে রায়হানের দিকে। হঠাৎ কয়েকজন লোকের কাঁদা মাড়িয়ে দৌড়ে আসার শব্দ। রায়হান এলার্ট হয়ে যায়। নিপা শব্দ শুনেই ভয়ে দ্রুত তাঁবু থেকে বের হয়। রায়হান তাঁবুর দিকে ফিরে তাকায়। নিপা তাঁবু থেকে বেড়িয়ে পিছনে ফিরে দেখে কিছু মুখে কালো কাপড় বাঁধা লোক গাছপালা দিয়ে ছুটে এই খালি যায়গার দিকে দৌড়ে আসছে। তাদের সকলের হাতে বড় বড় অস্ত্র। লোকগুলো গাছপালার অংশ থেকে বেড়িয়েই তাদের বন্দুক উঠিয়ে নিপার দিকে তাক করে ধরে। নিপা তাদের দেখে ভয়ে এক জোড়ে চিৎকার দেয়। লোকগুলোর মধ্যে একজন নিপাকে গুলি করতে যাবেই তখনই এক গুলি এসে তার বুক এফোড় ওফোড় করে দেয়। লোকটা ধপ করে পড়ে যায়। বাকি লোকগুলো সামনে চেয়ে দেখে, রায়হান ব্যাগের পাশে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে তার পিস্তল ধরে রেখেছে। বাকিরা রায়হান দিকে নিশানা করতেই রায়হান এগিয়ে আসতে থাকে আর একে একে ট্রিগার চেপে গুলি ছুড়তে থাকে। রায়হান আর তাদের গুলি বিনিময়ের মাঝেই নিপা দুই হাতে কান চেপে চিৎকার করতে করতে রায়হানের দিকে ছুটে আসে। রায়হান নিপাকে জোড়ে চিৎকার দিয়ে থামতে বলে। নিপা না থেমেই দৌড়ে আসতে থাকে, তখনই রায়হান দৌড়ে এক ডিগবাজী খেয়ে সেই বন্দুকধারীদের পা উদ্দেশ্য করে গুলি চালাতে থাকে। সেই জঙ্গিদের ছোড়া এক গুলি নিপার হাতের কনুইয়ের খুব কাছ দিয়ে চলে যায় অদূর গন্তব্যে। নিপার হাতে সেই গুলির ছোঁয়া লাগেনা। নিপা দৌড়ে এগিয়ে আসে রায়হানের কাছে। রায়হান উঠে দাঁড়িয়ে নিপাকে এক হাত দিয়ে তার বুকে জড়িয়ে ধরে এক দক্ষ শুটারের মতো সব গুলো লোকের শরীরে গুলি বিধিয়ে দেয়। সবার দেহ মাটিতে একে একে লুটিয়ে পড়ে। চারপাশ মুহুর্তেই মধ্যৈই যেন শান্ত হয়ে যায়। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। আশপাশের আবহাওয়া কালো মেঘে ঢেকে যায়। রায়হান তার পিস্তল ধরা হাত নামায়। তাঁবুর সামনে পড়ে আছে সেই বন্দুক ধারীদের ঝাঝড়া দেহ, নিপাকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে রায়হান এক দৃষ্টে চেয়ে আছে সেদিকে। চোখে উত্তপ্ত আগুন রেখা। নিপা রায়হানের বুকে কাঁদছে। উপর থেকে নেমে আসা বৃষ্টি দুজনকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। রায়হানের আরেকহাতে থাকা পিস্তলের নল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি পড়ে যাচ্ছে ভেজা ঘাসের আড়ালে। আকাশে বিজলী চমকিয়ে উঠে।

 

_____

 

রিয়াদ আর তার দুই কনস্টেবল প্রবেশ করে সুরাইয়া বেগমের রুমে। রুমে তালা লাগিয়ে রেখে দিয়ে গিয়েছিলো রিয়াদ। পুলিশি তদন্ত যতদিন না শেষ হচ্ছে এই ঘর তাদের দায়িত্ব থাকবে।

 

ভিতরে ঢুকেই চারপাশ ঘুরে দেখতে থাকে রিয়াদ। জানালাটা খোলা। বাইরের হালকা আলো এসে ঘরে পড়ছে। এক কনস্টেবল লাইটের সুইচ গুলো জ্বালিয়ে দেয়। এসে রিয়াদের পাশে দাঁড়ায়। রিয়াদ বলে,

– এই রুমের যা কিছু আছে সবকিছু নেড়েচেড়ে দেখো। কেউ মারার হুমকি মুলক কিছু দিয়েছিলো কী না তাইলে জানা যাবে। বিশেষ করে আলমারী, বিছানা আর এই টেবিল দুটো। এইগুলো ভালোভাবে সার্চ করো। ওকে!

– ওকে স্যার হয়ে যাবে। 

– হমম, আমি একটু অন্দরমহলে গিয়ে বাকিদের সাথে কথা বলে আসি। (বিরবির করে) এই বাড়ির মধ্যে কিছুতো সমস্যা আছে, নাইলে দুইজন মারা গেলো অথচ সবাই এতোটা স্বাভাবিক! যেনো কিছুই হয়নি। বিশেষ করে বাড়ির কর্তা আর তার বউ। (একটু থেমে) কিছু না কিছু তো চলছেই এ বাড়িতে। সেটা কী, তা আমাকে জানতেই হবে।

– কিছু বললেন স্যার ? 

– না। কিছুনা। কোথাও কিছু পেলে তাড়াতাড়ি আমাকে ইনফর্ম করবে, আমি অন্দরমহলেই আছি। 

– ওকে স্যার। 

রিয়াদ ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে হাতে থাকা টুপিটা মাথায় পড়ে চলে যায়। ঘরে যেই দুই যায়গায় লাশ পড়ে ছিলো সেখানটায় এখনো চক দিয়ে মার্ক করা আছে। দুই কনস্টেবল সুজন আর নয়ন চারপাশ খোঁজা শুরু করে। সুজন দেখতে থাকে খাটের তোষক উল্টিয়ে তার নিচ টায়। আর নয়ন আসে পড়ার টেবিলটার কাছ। বই গুলো অগোছালো। নয়ন বই গুলো হাতে নিয়ে পৃষ্ঠার উড়িয়ে দেখতে থাকে ভিতরে কোন কাগজ বা এমনকিছু আছে কী না। বইয়ে কিছু না পেয়ে বইটা রেখে দেয় সে। টেবিলে থাকা অন্য বইগুলো হাত দিয়ে টেনে সামনে নেয়। তখনই তার হাত লেগে কলমদানিটা মাটিতে পড়ে যায়। নয়ন মুখ দিয়ে বিরক্তসূচক ‘চ’ শব্দটি বের করে। হেলে মাটি থেকে কলমদানি আর কলম গুলো উঠাতে থাকে। তখনই একটা মোটা খয়েরি রঙের কলম দেখে সে কিছুটা অবাক হয়। কলম টাকে তুলে চোখের কাছে এনে দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ দেখার পর তার চোখ,মুখ বড় হয়ে যায়। আরে এটাতো পেন ক্যামেরা। এটায় তো ক্যামেরা লাগানো ! 

‘ এই পেন ক্যামেরা এহানে কেমনে আইলো! তারমানে কী এইডা এইহানে আগে থেইকাই কেউ রাইখা গেছিলো! ‘ বলা মাত্রই সে তার মুখ তুলে তাকায়। দেখতে থাকে সুজন কী করছে। দেখে ও এখন বিছানা ছেড়ে অপর পাশের বইয়ের থাকের মাঝ দিকে গেছে। নয়ন সাথে সাথে পেন ক্যামেরাটা তার পকেটে ঢুকায়। চারপাশে এমনভাবে নজর দিয়ে দেখতে থাকে যে কেউ তাকে দেখলো কী না। যেন সে চোরের মতো কোন জিনিস সাপ্টে নিয়েছে। নয়ন বাকি স্বাধারণ কলমসহ কলম দানিটা উঠিয়ে টেবিলে রেখে দেয়। দিয়ে চলে যায় আলমারির দিকে। 

 

     রিয়াদ করিডোর দিয়ে বেড়িয়ে এসে অন্দরমহলে দাঁড়ালো। অন্দরমহলের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলো আঁখি, সুমনা বেগম, আর সোনালি। রিয়াদ এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। চারপাশে একবার তাকিয়ে আবার তাদের দিকে ফিরে। বলে,

– যেইসময় এই মার্ডার গুলো হয়েছিলো তখন আপনার কোথায় ছিলেন ? 

– আ,আমি বাইরে ছিলাম। এতিম খানায় গিয়েছিলাম, বাচ্চাগুলোকে দেখতে। (সুমনা বেগম) 

– আর তুমি ? 

– আ,আমি রান্না ঘরে পাক করতাছিলাম। খালাম্মা আমারে রাইন্ধা রাখতে কইছিলো, হেয় বলে এতিম খানায় যাইবো। আমি রান্না করোনের সময় কেউ যানি আইয়া আমার মুখ পিছন থেইকা চাইপা ধরছিলো। তারপর, তারপর আর আমার কিছু মনে নাই। (সুমনা বেগমের দিকে তাকিয়ে) পরে খালাম্মা আমার মুহে পানি ছিটাইয়া আমার জ্ঞান ফিরাইছে, আর দেহি আমি রান্নাঘরের ফ্লোরে হুইয়া আছি।

– তারমানে তোমাকে বেহুঁশ করে তারপর এই কাজ টা করেছে ওরা! (একটু থেমে সোনালীর দিকে ফিরে) তুমি উত্তর পাড়ার সোনালী না ?

– হ্যা। 

– তোমাকে আমি ঐদিনও এই বাড়িতে দেখছিলাম। আজও এই বাড়িতে দেখতেছি। ঘটনা কী ? এই বাড়িতে এতো আসাযাওয়া ? 

– আ, আমি,,,,

– ও আমার হবু বউ হতে চলেছে। তাই ইদানিং ওকে এই বাড়িতেই দেখছেন। 

রাফসানের ধীর কন্ঠি কথা শুনে সবাই পিছনে ফিরে সিড়ির দিকে তাকায়। রাফসান হেঁটে হেঁটে সিড়ি দিয়ে নামে। এসে সোনালীর পাশে দাঁড়ায়। রিয়াদ কিছুটা অবাকই হয়। রাফসান সোনালীর কাঁধে হাত রেখে বলে,

– ওর আর আমার বিয়ের কথা চলতেছে। তাই এবাড়িতে একটু আধটু আসে। কিছু জিগাবার থাকলে আমাকে বলো।

– তুমি রাফসান না ? ঢাকা থেকে কবে এসেছো ? 

– ২ সপ্তাহ হবে আসার।

– রায়হানের বিয়েতে তো তোমাকে দেখলাম না! 

– আমি যাইনি, তাই দেখেননি। 

– কোথায় ছিলা সেই রাতে ! (কিছুটা সন্দেহের সুরে প্রশ্নটা করে রিয়াদ) 

– আজব, আমি ঐদিন রাতে কোথায় থাকি না থাকি তা দিয়ে আপনার কী! আপনি আসছেন আলিশাদের মার্ডার কেস সলভ করতে, করেন। সেটা নিয়ে মাথা ঘামান। এ ব্যাতীত অন্য কিছু কিন্তু আপনি জিগ্যেস করতে পারেন না! (ধীর গলায়) আপনার সেই অধিকার নেই! 

রায়হানের কথা গুলোর সুর রিয়াদের কাছে কাটার মতো লাগে। রাফসানের মুখ ভঙ্গিতে কিছুটা শয়তানি হাসি ফুটে উঠেছিলো রিয়াদকে কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়ার পর। 

 রিয়াদ আর কিছু বলেনা। রায়হানের দিকে একবার কঠিন ভাবে তাকিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়, তখনই দেখে অন্দরমহলের দরজা পেড়িয়ে বাড়িতে ঢুকছে সাদিক (২২)। সাদিক সাথী বেগম, আর শাহেদের ছেলে। রিয়াদ থেমে দাঁড়ালো।  সাদিক এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। হাতে একটা ব্যাগ। সাদিক রিয়াদকে চিনতো। তাই সে স্বাভাবিক ভাবেই রিয়াদকে দেখে বলে উঠে,

– রিয়াদ ভাই না ! কেমন আছেন। 

– ভালো। তুমি কোথায় ছিলা একয়দিন ! তোমাকে তো এই বাড়িতে ক’দিন দেখলাম না! 

– আমি তো ঢাকায় গেছিলাম। রাফসান ভাই আমারে পাঠাইছিলো। 

– একয়দিনে এ বাড়িতে কী ঘটে গেছে তা সম্মন্ধে তোমাকে কেউ কিছু জানায় নি ? 

– কী বিষয়ে। আমাকে তো একয়দিন এ বাড়ি থেকে কেউই ফোন দেয়নি মা ছাড়া। আর মা তো তেমন কিছু বলেনি। কিছু হইছে নাকি। 

রিয়াদ এক ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

– ঘরে গিয়ে তোমার মায়ের থেকে জিগ্গেস করে নিও। (পিছনে ফিরে রাফসানের দিকে এক নজর দিয়ে) আমি এখন যাচ্ছি, তবে পড়ে আবার আসবো। আর জিগ্গাসাবাদ ! রিয়াদ খুব ভালো করে জানে কোন থেরাপি কাদেরকে দিতে হয়। (ধীর গলায়) আগে কেস, তারপর সম্পর্ক ! 

বলেই এক ছোট্ট মুচকি হাঁসি দিয়ে চলে যেতে থাকে রিয়াদ। রাফসানের কাঁটা যেন তার গাঁয়েই আবার বিধিয়ে দিয়ে গেলো যাওয়ার আগে। রাফসান রাগান্বিত হয় এতে। সাদিক এদের সবকিছু দেখে যেনো কিছু বুজতে পারেনা। সে সরল মনে সুমনা বেগমকে জিগ্গেস করে,

– কী হইছে চাচিআম্মু! রিয়াদ ভাই এখানে কেনো আসছিলো?

সুমনা কোন উত্তর না দিয়েই হনহন করে চলে যায় রান্না ঘরের দিকে। সুমনা বেগমের এমন ইগনোর করাটা সাদিকের কেমন জানি লাগে। বাকিদের তাই সে আর কিছু বলে না। হাতে থাকা ব্যাগটা নিয়ে চলে যায় দ্বিতীয় করিডোরের দিকে। আঁখিও চলে যায় রান্নাঘরের দিকে। অন্দরমহলে শুধু দাঁড়িয়ে রয় রাফসান আর সোনালী‌। রাফসান দাঁত কটমট করে অন্দরমহলের দরজার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,

– তোর পুলিশ গিরি একদম ছুটায় দিবো খা*** বাচ্চা। আমাকে দেমাগ দেখাইতে আসিস ! 

বলেই ফ্লোরের কার্পেটে এক জোড়ে লাত্থি দেয় রাফসান। রেগেমেগে সে একদম লাল। সোনালী তার কাঁধে এক হাত রাখে। ধীর গলায় বলে,

– বেশি বারাবারি করতে যাইয়েন না। উনি কিন্তু একজন পুলিশ !

– ঐ দুই টাকার পুলিশ আমার কোন বা* ছিড়ে আমি দেখি ! ওর কেস সলভ করার খুব শখ উঠছে না! ওর চাকরি থাকলে তো কেস সলভ করবে। ওর চাকরির যদি আমি ১২ টা না বাজাইছি ! 

– আচ্ছা এবার শান্ত হন। (একটু থেমে) উনি বলে গেছেন নিচের মাল গুলো প্যাকেট করতে। চলুন। 

রাফসান সোনালীর দিকে ফিরে। সোনালী একটা হলুদ রঙের থ্রী পিস পড়ে ছিলো। রাফসান সোনালীকে দেখে ও তার মলিন কথা শুনে নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করে। ফিরে আবার অন্দরমহলের চৌকাঠের দিকে চায়। সোনালী রাফসানের হাত ধরে। ধীর গলায় বলে ‘চলুন’। রাফসানও সোনালীর এক কাঁধে হাত দিয়ে তাকে নিয়ে চলে যেতে থাকে অন্দরমহলের দরজার দিকে। নিজের রাগকে প্রশমিত করতে থাকে সে।

 রান্নাঘরের দরজার আড়াল হতে তাদের সব কথা শুনে ফেলে আঁখি। তখনই আঁখির পিছনে এসে দাঁড়ায় সুমনা বেগম। তিনি কিছু বলেন না। শুধু চুপচাপ আঁখির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে এক রহস্যময় হাসি!

 

_____

 

ক্লিনিকের দোতলা করিডোর। ২০২ নাম্বার রুমে এডমিট আছে আফাজ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওড়না মুখে চেপে আফাজকে চুপি চুপি দেখছে সুমু।

 সকালে ঘুম ভাঙার পর সে নিজেকে আফাজের হাতে মাথা রাখা অবস্থায় দেখে। আফাজ তখন ঘুমাচ্ছিলো, সুমু তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে তখন চলে এসেছিলো। আফাজের জ্বর অনেকটা কমে গিয়েছিলো তখন। আফাজের গাঁয়ের উপর থাকা ওড়নাটা হাতে নিয়ে সে বের হয়ে এই দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েছে, কখন আফাজের ঘুম ভাঙবে আর সে গিয়ে কথা বলবে। কিন্তু আফাজ এখনো ঘুমাচ্ছে। 

 করিডোর দিয়ে কারো হেঁটে আসার আওয়াজ পায় সুমু। তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে দেখে একটা নার্স এদিকেই আসছে‌। সুমু সোজা হয়ে দাঁড়ায়। নার্সটা দরজার সামনে আসতেই সুমু তাকে হাত দিয়ে আটকায়, ভিতরে ঢুকতে দেয় না। নার্সটা একটু বিরক্ত হয়ে বলে,

 – কী হইলো কী ! হাত নামান‌। আমার ভিতরে যাইতে হইবো। 

 – কাল রাতে কোথায় ছিলেন ? ক্লিনিকে রুগি রেখে একদম লাপাত্তা! 

 – কেডা কইছে আমি ছিলাম না ! আ,আমি তো কাইল এই রুমেই আছিলাম। পেসেন্টের দেখা শুনা করছিলাম। 

 – কাল রাতে কে ছিলো আর কী করছে তা আমার খুব ভালোভাবে জানা আছে। (একটু থেমে) উনার জ্বর আসছে, ভিতরে গিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিন। 

 – রুগির জ্বর আইছে কি না আইছে তা আপনি কেমনে জানলেন ! 

 – কারণ কাল রাতে আপনি না, আমিই ছিলাম। জ্বরে শরীর কতটা গরম হইছিলো জানেন ! 

 – আপনে রুগির কী হন যে আমারে কথা শুনাইতাছেন ! 

 – আমি রুগির অনেক কিছু হই। বেশি কথা না বাড়ায় ভিতরে যায় ঔষধ দেন। নাইলে একবার ক্লিনিকে কম্প্লেইন দিলে, চাকরির মাগনা টাকা খাওয়া বের হয়ে যাবে একদম! 

 – কেমন মানুষ রে বাবা ! কী সব কইতাছে এইসব ! 

বলেই নার্স রুমের ভিতরে চলে যায়। সুমু আড়াল হতে দেখতে থাকে আফাজকে। তখনই তার কানে আরো কারো জানি কথা ভেসে আসে। সে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে দিথী, শিউলি বেগম আর লায়লা আসছে এদিকে। সুমু তাড়াতাড়ি তার মুখ ঢেকে ফেলে ওড়না দিয়ে। আগে খালি মুখ চেপে ছিলো। এখন ঘোমটার মতো করে ওড়নাটা নিয়ে চোখ দুইটা বাদে পুরো মুখটাকেই আড়াল করে নেয় সে। দিথী, শিউলি বেগম রা সিড়ি দিয়ে উঠে করিডোর দিয়ে হেঁটে এদিকেই আসতে থাকে। সুমুও এগিয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য তাদেরকে পাশ কাটিয়ে নিচে চলে যাওয়া। সুমু দিথী আর শিউলি বেগম দের কাছাকাছি চলে আসে। শিউলি বেগমের হাতে ছিলো টিফিন বাটি, তিনি লায়লার সাথে কি নিয়ে যানি কথা বলতে বলতে আসছিলেন। সুমু তাদের পাশ‌ কাটিয়ে হেঁটে যায়। যাওয়ার সময় তার আর দিথীর চোখাচোখি হয়। সুমু চোখ নামিয়ে নেয়। চলে যায় সামনের সিড়ির দিকে। দিথী পিছন ফিরে সুমুর যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে। সে কিছুটা অবাকও হয়। সুমু সিড়ির কাছে যাওয়ার পর মুখ ঘুড়িয়ে করিডোরের দিকে তাকায়, দেখে শিউলি বেগম আর লায়লা ঘরের ভিতরে চলে গেলেও দিথী বাইরে দাঁড়িয়ে ঠিক তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সুমু চকিতে মুখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি সিড়ি দিয়ে নেমে যায়। দিথীকেও রুমের ভিতর থেকে শিউলি বেগম ডাক দেন। তাই দিথীও রুমের ভিতর চলে যায়।

 

_____

 

ক্রুজ শিপের বসার প্রান্তে একলা বসে রয়েছে নিপা। মন খারাপ তার। তারা এখন সেইন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে। 

 

জঙ্গী সন্ত্রাসীদের গুলি করার কিছুক্ষণ পর সেখানে পুলিশ এসে উপস্থিত হয়েছিলো। জঙ্গীদের মধ্যে শুধু একজন মারা গিয়েছিল। আর বাকি সবারই হাত,পায়ে গুলি লেগেছিলো। পুলিশ তাদের আহত অবস্থায় গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। রায়হানের কাছে লাইসেন্স বন্দুক থাকায় তাকে বেশি একটা জেরা করেনি পুলিশ। বরংচ সেই জঙ্গীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে। রায়হান ভেবেছিলো একজন কে যে মেরেছে তার জন্য হয়তো তাকে পুলিশের সাথে যেতে হবে। কিন্তু অফিসার হারুন উর রশীদ রায়হানকে এই বিষয়ে কিছুই বলেননি। রায়হান আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। আর জঙ্গীদের মারার অর্ডারই তাদের কাছে ছিলো। সেখানে তারা একজন বাদে বাকিদের জীবিত উদ্ধার করছে। তাই রায়হানকে তারা বেশি কিছু না বলেই সেখান থেকে যেতে দেয়। 

 

তখনকার পর থেকে নিপা একপ্রকার মানসিক ট্রমাতেই পৌছে গেছে বলা যায়। সে চুপচাপ। তারা সেখান থেকে হোটেলে এসে ফ্রেশ হয়ে টেকনাফে এসেছিলো। টেকনাফ থেকে ক্রুজ শিপে উঠেছে। এখনো ক্রুজ শিপেই আছে তারা। 

রায়হান পশ্চিমের ডেক থেকে হেঁটে হেঁটে নিপার কাছে আসে। রায়হান নিপার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার কাঁধে হাত রাখে। নিপা তো হঠাৎ ভয় পেয়ে চিৎকারই করে ফেলছিলো প্রায়, তখনই রায়হান তার মুখ আলতো করে চেপে ধরে তার পাশের চেয়ারে বসে। বলে,

– আমি আমি। কোন চোর ডাকাত না। 

– এভাবে হঠাৎ করে আসো কেনো। আসার আগে তো একটু গলা ঝেড়ে আসতে পারো! 

– না মানে আমি ভাবলাম তুমি আবার কাঁদছো নাকি তাই একবারে এসে তোমার কাঁধে হাত রেখেছি। (একটু থেমে) তুমি এখনো সেই ঘটনা নিয়ে পড়ে আছো! আরে বাবা সেটাকে নিছক দুর্ঘটনা মনে করে মন থেকে উড়িয়ে দেও না। আমরা এখানে ঘুড়তে এসেছি। আনন্দ করো। 

– আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। আমাকে একা ছেড়ে দাও। 

– আমার সাথে চলো। ঐদিকে শিপের বাকি যাত্রীরা পাখিদের কত সুন্দর খাবার খাওয়াচ্ছে, দেখবে চলো‌।

– আমি যাবোনা। তুমি যাও।

– নিজে থেকে না উঠলে কোলে করে নিয়ে যাবো কিন্তু! 

– রায়হান! আমার মন চাইছেনা যেতে। 

– আরে একবার আমার সাথে এসেই দেখোনা। পাখি গুলাকে তুমিও খাবার দিও। ওরা তোমার হাত থেকেও খাবার খাবে। আসোতো আসো।

 রায়হান নিপাকে টেনে তুলে। নিপার মুড একদম অফ। নিপা গা ছাড়া ভাব করে আবার বসে পড়তে চায় তখনই রায়হান তাকে কোলে নিতে উদ্যত হয় অমনি নিপা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হাত দিয়ে কোলে নিতে মানা করে। ওখানে নিশ্চয়ই অনেক মানুষ আছে, সবার সামনে সে লজ্জায় পড়তে চায় না। রায়হান নিপার হাত ধরে তাকে সাইড ডেকের দিকে নিয়ে যায়।

 

  এদিকটা জাহাজের ডান পার্শ্বের প্রান্ত। এই করিডোরের একপাশে কিছু রুমে যাওয়ার দরজা আরেকপাশে জাহাজের রেলিং। সেখানে দাঁড়িয়ে শিপের বেশিরভাগ যাত্রী খাবার খাওয়াচ্ছে। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে রেলিংয়ের ওপাসে উড়ছে। যাত্রীদের হাত থেকে চিপস আর বিস্কুট উড়ে এসে মুখে নিয়ে নিচ্ছে। নিপা আর রায়হান সাইড ডেকে চলে আসে। সময়টা বিকেল সাড়ে তিনটা। সূর্য পুব আকাশে হেলেছে কিছুটা। আকাশে খন্ড খন্ড মেঘ আর চারপাশে নীল সমুদ্র। তার মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে থাকা পাখি যাত্রীদের হাত থেকে খাবার ঠোকর ঠোকর দিয়ে খাচ্ছে। রায়হান একটা চিপসের প্যাকেট কিনে নিপাকে কিছু চিপস দেয়। তাকে এগিয়ে দেয় সেই যাত্রীগুলোর সামনে। আবহাওয়া নিপার মনটাকে কিছুটা ভালো করে তুলে। সে এগিয়ে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়ায়। ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ায় পাখিদের উদ্দেশ্য করে। দূরে থেকে রায়হান তার ফোনের ক্যামেরা অন করে কিছু সুন্দর মুহুর্ত ফ্রেম বন্দি করতে রেডি হয়ে যায়। একটা পাখি এসে নিপার হাত থেকে এক টুকরো চিপস নিয়ে ছো মেরে উড়ে যায়। নিপা ভয়ও পায় হাসতেও থাকে। তার আনন্দ লাগছে। রায়হানও নিপার এই মুহুর্তটা ফ্রেম বন্দি করে ফেলে। নীল শাড়িতে নিপাকে দারুন মিষ্টি লাগছিলো। তখনই এক পাখি এসে নিপার হাতের উপর বসে। বসে হাতের চিপস গুলো খেতে থাকে। নিপা আনন্দ মুখ নিয়ে রায়হানকে বলতে থাকে,

– আমার হাতে পাখি বসছে ! আমার, আমার সুড়সুড়ি লাগতেছে!!

– এভাবেই থাকো! ছবি গুলা খুব সুন্দর উঠতেছে ! 

পাখিটা কিছু চিপস খেয়ে উড়ে চলে যায়। নিপা সেটাকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। নিপার হাতে চিপস কমে এসেছিলো। রায়হান প্যাকেট টা নিয়ে নিপার কাছে যায়। নিপার হাতে চিপস দেওয়ার আগে নিপার কাঁধে হাত রাখে। নিপার পাশে দাঁড়িয়ে যায়। নিপার হাসি মুখ খানা যেন কিছু বুঝে উঠার আগেই রায়হান ফোন সামনে তুলে খ্যাচাক করে একটা সুন্দর সেলফি তুলে ফেলে। পিছনে পাখির ঝাঁক,নীল সমুদ্র, আর বাদলবিলাস। সাথে নীল শাড়িতে থাকা অর্ধাঙ্গিনীর মুখে সুন্দর হাসি আর রায়হানের নীল-সাদা শার্টে জড়ানো হ্যান্ডসামনেস, সবমিলিয়ে ছবিটা যেন দারুন উঠে! নিপা আর রায়হান সময় টাকে বেশ উপভোগ করতে থাকে। জাহাজ চলে যায় এই বিশাল সমুদ্রের মাঝে ঢেউয়ের তালে তালে। 

 

___

 

নীলগিরি জঙ্গল। আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকায় গাছপালা ঘেড়া এই জঙ্গলটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন লাগছে। চারপাশে পাখি আর বয়ে যাওয়া বাতাসের কলতান। 

নয়ন দাঁড়িয়ে আছে গাছপালা ঘেড়া এই জঙ্গলটার একটা মধ্যবর্তী ফাঁকা যায়গায়। যায়গাটা দু হাত মতো ফাঁকা। তার পড়নে এখন সিভিল ড্রেস। তারমানে এখানে সে কোন পুলিশি কাজে আসেনি। সে যেন কারো অপেক্ষায় ছিলো এখানে। সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় গাছপালার পাতায় জমা পানি টোপ টোপ করে মাঝে মাঝে তার মাথার উপর এসে পড়ছে। আবহাওয়াটা দারুন ঠান্ডা। 

কারো হেঁটে আসার আওয়াজ পাওয়া যায়। নয়ন কিছুটা ভ্রু কুঁচকে চারপাশে তাকায়। তখনই দেখে এক হলুদ থ্রীপিস পড়া কেউ এদিকে আসছে। আরেকটু সামনে আসতেই মেয়েটার চেহারা দৃশ্যমান হয়। মেয়েটা সোনালী। 

সোনালী হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসে ফাঁকা যায়গাটায়। নয়ন তার দুই হাত পকেট থেকে বের করে। সোনালী এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– কী জন্য ডেকেছিস ! নতুন কোনো খবর আছে ! 

– ম্যাডাম, এইবার এমন এক জিনিস আপনার লাইগা আনছি যে আপনে দেখলেই খুশি হইয়া যাইবেন।

– কি জিনিস? 

নয়ন তার পকেটে হাত ঢুকায়। পকেট থেকে একটা কলম বের করে। এগিয়ে দেয় সোনালীর দিকে। সোনালী কলমটা হাতে নেয়। বলে,

– কী এটা ? 

– ক্যামেরা পেন ম্যাডাম! মার্ডারের রুমে পাইছি!

– কিহহ! 

– হ ম্যাডাম। ঐ রুমে এইডা ছিলো। আপনে কইছিলেন না যে কোন প্রমাণ বা কোন সন্দেহজনক কিছু পাইলে আপনারে দিয়া দিতে, আমি এরলাইগা এইডা রিয়াদ স্যার রে না দেখাইয়া ডিরেক্ট আপনার হাতে সমর্পণ করছি। 

– এটা ঐ ঘরে ছিলো ! আর আমি কি না !!!

– কী ম্যাডাম ! আপনি খুশি হন নাই! আমি ভাবলাম আপনি এইডা দেইখা খুশি হইবেন।

– মামুর ব্যাটা তুই তো আমারে মরতে মরতে বাচাইছিস। দেখিস আরো কিছু ঐ ঘরে আছে কিনা। যা পাবি একদম আমাকে এনে দিবি। 

– আইচ্ছা ম্যাডাম। আমি আইনা দিমু নে। (বিরবির করে) জুতা জোড়া যদি সুজন না পাইয়া আমি পাইতাম তাইলে ঐডাও আইনা দিতাম।

– কী বিরবির করতেছিস রে? 

 নয়ন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে

– না মানে ম্যাডাম, আমার বখশিশ টা ! 

– হমম, দিচ্ছি। 

সোনালি তার হাত ব্যাগ টার চেইন খুলে কলমটা ভিতরে রাখে। কিছু টাকা বের করে নয়নকে দেয়। নয়ন ভক্তি সহকারে সেগুলো গ্রহণ করে। সোনালী বলে,

– যা এখন। পড়ে কোন কাজ পড়লে আবার তোকে ডেকে নিবো।

– আইচ্ছা ম্যাডাম।

নয়ন চলে যেতে থাকে। আশপাশে পড়া টোপ টোপ পানি যেন নিরবতা ভেঙ্গে শব্দ তুলছে। নিচের মাটি কর্দমাক্ত। সোনালী তার হাত ব্যাগের চেইন লাগিয়ে দিতে থাকে। বিরবির করে বলে,

– নিশ্চিত এইটা নিপা রাখছিলো। নয়নকে যদি হাত না করতাম তাইলে আমার কী অবস্থা হইতো ! (একটু থেমে) ওরো দিন ঘনায় আসতেছে। হানিমুন মারাইতে গেছে না এখন ! আসুক খালি একবার ! ওর গোয়েন্দাগিরি আমি ছুটায় দিবো।

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৬৬

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

সেইন্টমার্টিন সমুদ্র পাড়। আকাশের সূর্য খানা পশ্চিমে কিছুটা ঢলে পড়েছে। রায়হান নিপা বসেছে সমুদ্র সৈকতে থাকা প্লাস্টিক বেড গুলোয়। দুটো বেডে ভাড়া নিয়েছে তারা। উপরে ছাতাও আছে। বেড দুটো পাশাপাশি। নিপার আকাশী-নীল শাড়ি খানায় বাতাস বেশ জোড়েই লাগছে। রায়হানের গায়ে সাদা শার্ট, আর থ্রী-কোয়ার্টার প্যান্ট। মাথায় গোল কাউহ্যাট টুপি। নিপা বসে সমুদ্র সৈকতের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকটায় লোকের সংখ্যা একটু কম। রায়হান হেলান দিয়ে বেডে রেষ্ট নিচ্ছে। আজ সারাদিন একটু বেশিই জার্নি হয়ে গেছে। খাগড়াছড়ি থেকে কক্সবাজার, সেখান থেকে টেকনাফ, আবার সেখান থেকে জাহাজে চড়ে সেইন্টমার্টিন। 

রায়হান চোখের চশমা টা হালকা তুলে নিপাকে দেখে। নিপা একনজরে সমুদ্রের দিকে চেয়ে ছিলো। মুখে মলিন ভাব। রায়হান শোয়া হতে উঠে সোজা হয়ে বসে। চোখের সানগ্লাসটা খুলে হাতে নেয়। নিপা রায়হানের দিকে ফিরে তাকায়। বাতাসে তার চুল গুলো উড়ে খালি বারংবার মুখের সামনে চলে আসছিলো। নিপা হাত দিয়ে চুল গুলো সড়িয়ে কানের পার্শ্বে রাখে। বলে,

– ঘুমাচ্ছিলা নাকি! 

– না। এমনিই একটু গা এলিয়ে দিয়েছিলাম।

সমুদ্রের দিকে ফিরে নিপা বলে,

– খুব বাতাস করতেছে তাই না।

– সমুদ্র সৈকতে এমন একটু আধটু বাতাস থাকেই। (একটু থেমে সানগ্লাসটা শার্টে ঘষতে ঘষতে) কিছু খাবে ? 

– কী খাবো। 

রায়হান মুখ ফিরিয়ে চারপাশ দেখে। কিছুটা সামনে এক ডাবের ভ্যান দেখা যাচ্ছে। লোকজন নেই তার সামনে। শুধু বিক্রেতা আছেন। রায়হান আবার নিপার দিকে ফিরে। বলে,

– ঐযে ডাব। ডাব খাবা ? 

– নিলে নাও

– (পিছনে ফিরে) এই ডাব,,,,,,,,ডাব,,,, এদিকে আসো,,,

ডাবওয়ালা রায়হানের ডাক শুনতে পায়। সে তার ভ্যান রেখে গলায় থাকা গামছায় হাত মুছতে মুছতে রায়হানদের দিকে এগিয়ে আসে। 

  কাছে আসতেই রায়হান বলে,

– ডাব কতো ? 

– স্যার একটা ৬০ দুইটা ১০০।

– দুইটা নিলে কম কেনো ? 

– স্যার এইহানে বেশিরভাগ মানুষ জোড়ায়-জোড়ায় ঘুরতে আহে। এরলাইগা দুইডা ডাব নিলে একটু কম রাহি। 

– একটা দাও। 

– একটা নিবা ? (নিপা বলে)

– হ্যা একটা দিয়েই আমাদের হয়ে যাবে। (ডাবওয়ালার দিকে ফিরে) একটা ডাব দাও আর দুইটা স্ট্র দাও। 

– জে আইচ্ছা স্যার। 

বলেই ডাবওয়ালা চলে যায় ডাব কেটে আনতে। রায়হান নিপার দিকে ফিরে তাকায়। দেখে তার গাল গুলা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। রায়হান মাথার টুপি টা খুলে হাতে নিয়ে বলে,

– একসাথে খাইলে, মহব্বত বাড়ে বুচ্ছো। 

নিপা কিছু বলে না। দুইহাত কোলে একসাথে করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চুল গুলো বারবার বাতাসে উড়ে মুখের সামনে এসে পড়ছে। নিপা এবার আর চুল সড়ায় না। হাত দুটো একখানে করে বসে থাকে। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ অবশ্য তার কানকে বেশ প্রশান্তিও দিচ্ছিলো। 

 

ডাবওয়ালা ডাব নিয়ে আসে। রায়হান টাকাটা দিয়ে ডাব হাতে নেয়। দুইটা স্ট্র দিয়েছে দোকানদার। রায়হান নিপার দিকে ফিরে বেড থেকে পা নামায়। বলে,

– এপাশে ফিরো। 

– তুমি খাও। আমি খাবো না। 

– দুইজনই খাবো। (চারপাশে দেখে) তেমন কেউ তো নাই। এপাশে ফিরো। 

নিপাকে একহাতে ধরে তার দিকে ফিরতে বলে রায়হান। নিপা লজ্জা মাখা মুখটা নিয়ে তার দিকে ফিরে। রায়হান ডাবটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। নিপা হাতে নেয়। সে এখনো লজ্জা পাচ্ছে। রায়হান নিপাকে একটা স্ট্র মুখে নিতে বলে। নিপা কিছুটা কাচুমাচু হয়েই স্ট্র টা মুখে নেয়। ডাবের পানি খেতে থাকে। তখনই রায়হানও সামনে এগিয়ে এসে আরেকটা স্ট্র তে মুখ লাগায়। নিপা উঠে যেতে চাইছিলো তখনই রায়হান তার পায়ের মাংসপেশি ধরে উঠতে বাঁধা দেয়।

 নিপা রায়হান দুজনই একসাথে ডাবের পানি খেতে থাকে। দুইজনের চোখ একদম বরাবর। রায়হান নিপার কপালের সাথে নিজের কপাল লাগিয়ে দেয়। তাদের কিছুটা পাশ দিয়ে যাওয়া ফেড়িওয়ালাটাও যেনো কিছুক্ষণের জন্য হাঁক থামিয়ে দিয়ে তাদেরকে দেখতে থাকে। নিপা উঠে যেতে চাইছিলো। কিন্তু রায়হান তাকে যেতে দিচ্ছেনা। রায়হান ধীরে ধীরে খাচ্ছে আর নিপার চোখে তাকিয়ে আছে। নিপা বেশ লজ্জা পাচ্ছিলো এমন খোলামেলা যায়গায় একসাথে এভাবে খেতে। নিপা কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বেশি বেশি করে টানতে থাকে। যাতে ডাবের পানিটা তাড়াতাড়ি শেষ হয় আর ও এই লাজুক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পায়। রায়হান তো ছিলো এক ঘোরে। সোজা নিপার চোখে তাকিয়ে ছিলো। প্রেয়সীর চোখের ভাষা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ ভাষা। এই চোখের ভাষা যেনো কেবল সঙ্গীর জন্যই লেখা!

 

  ডাবের পানি শেষ হয়ে যায়। রায়হান তো ধীরে ধীরে খাচ্ছিলো কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে শেষ হলো তাই সে বুঝতে পারেনা। নিপা এইবার মুখ ছাড়িয়ে নেয় স্ট্র থেকে। রায়হান স্ট্র টানতে থাকে তার বেডে বসে। কিন্তু না। ডাব একদম খালি হয়ে গেছে। রায়হান ডাবটা মুখ থেকে নামিয়ে পিছনে ফিরে ডাব ওয়ালার উদ্দেশ্য হাঁক ছাড়ে,

– এই, কী ডাব দিলি। এতো তাড়াতাড়ি শেষ! 

দূর থেকে ডাবওয়ালা বলে,

– স্যার বড় দেইখাই তো দিছিলাম। 

– এইটা বড় ? আমি চুমুক দিতে না দিতেই খালি হয়ে গেলো! 

– বাদ দাও। পরে আরো খাওয়া যাবে। (নিপা)

রায়হান নিপার দিকে ফিরে। নিপা রায়হানের মুড বদলানোর জন্য আঙ্গুল দিয়ে সমুদ্র সৈকতের ঢেউ আসা প্রান্তরটা দেখিয়ে বলে,

– চলো ওখানটাতে যাই, আমার ঢেউয়ে পা ভিজাতে মন চাইছে। 

– পড়ে যাচ্ছি। আগে আসো একটা গান ধরি। এই সুন্দর সমুদ্র তটে একটা গান না ধরলেই যেন নয়। 

– কী গান ধরবে এখন! সন্ধ্যা হয়ে আসতেছে তো। 

– সন্ধ্যাকে নিয়েই নাইলে গাই। 

রায়হান ডাব ফেলে দিয়ে তার প্লাস্টিক বেডের মাথার পাশ টা হতে ছোট্ট গিটার টা হাতে নেয়। নিপাকে বলে তার দিকে মুখ করে বসতে। নিপাও ইতস্তত বোধ না করে সেভাবেই বসে। রায়হান গিটারের তারে সুর বাঁধে। 

 

আবার এলো যে সন্ধ্যা

শুধু দুজনে,,

চলো না ঘুরে আসি অজানাতে

যেখানে নদী এসে থেমে গেছে,,

আবার এলো যে সন্ধ্যা

শুধু দুজনে

চলো না ঘুরে আসি অজানাতে

যেখানে নদী এসে থেমে গেছে,,

,

,

 

ঝাউবনে হাওয়াগুলো খেলছে,

সাঁওতালি মেয়েগুলো চলছে

লাল লাল শাড়ীগুলো উড়ছে

তার সাথে মন মোর দুলছে,,

 

ঐ দুর আকাশের প্রান্তে,

সাত রঙা মেঘ গুলো উড়ছে

ঐ দুর আকাশের প্রান্তে,

সাত রঙা মেঘ গুলো উড়ছে

 

আবার এলো যে সন্ধ্যা

শুধু দুজনে,,

,

,

 

এই বুঝি বয়ে গেল সন্ধ্যা,

ভেবে যায় কি জানি কি মনটা

পাখিগুলো নীড়ে ফিরে চলছে

গানে গানে কি যে কথা বলছে,,

 

ভাবি শুধু এখানেই থাকবো,

ফিরে যেতে মন নাহি চাইছে

আবার এলো যে সন্ধ্যা

শুধু দুজনে

চলো না ঘুরে আসি অজানাতে

যেখানে নদী এসে থেমে গেছে

চলো না ঘুরে আসি অজানাতে

যেখানে নদী এসে থেমে গেছে

আবার এলো যে সন্ধ্যা

শুধু দুজনে,,,,

 

গান ‌শেষ হওয়া মাত্র চঞ্চল গাঙচিলের মতো নিপা উঠে দৌড় দেয়। হাসতে থাকে। রায়হান নিপার হাসিখুশি মুখটা দেখেই বুঝে যায় নিপার মন আনন্দে নেচেছে। সেও গিটার টা রেখে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়াতে শুরু করে নিপার পিছু পিছু।

 নিপা একহাত দিয়ে কোমড়ের শাড়ির গোছা ধরেছে। ছুটছে আর হাসছে। তার যেন দৌড়ে গিয়ে ঢেওয়ে পা ভিজাতে মন চাইছে। রায়হান তার পিছু পিছু দৌড়ে আসছে। তার টুপিটা হাত থেকে সমুদ্র তটেই পড়ে যায়। নিপা সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছে এসে আড়াআড়ি ভাবে দৌড়াতে থাকে। ঢেউ গুলো এসে তার পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। শাড়ির লম্বা আঁচল খানা হাওয়ায় উড়ছে। সমুদ্রের নরম বালুচরে রায়হানও পা ভিজায়। সে খুব জোরে দৌড়ায় না, শুধু নিপার পিছু পিছু থাকার চেষ্টা করে। হাত দিয়ে নিপাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। নিপা হাসছে আর দৌড়ে যাচ্ছে। আকাশের উজ্জ্বল সূর্য সমুদ্রের গভীরে অর্ধেক ডুবে গিয়েছে। পেজা তুলোর ন্যায় মেঘ তার সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। সমুদ্র সৈকতে সেই নয়নাভিরাম দৃশ্যের সামনে দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে দুই নর-নারী। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে আবার সেই গান,,

 ” আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে,,,! “

 

_____

 

সোনালী ছাতাটা অন্দরমহলের দরজার সামনে রেখে ভিতরে প্রবেশ করলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাতের আঁধার নেমেছে হলো কিছুক্ষণ। অন্দরমহলের ঝাড়বাতিটা জ্বলছে। এখানে এখন কেউ নেই। একদম ফাঁকা। সোনালী হেঁটে হেঁটে এসে মাঝখান টায় দাঁড়ায়। ভাবছে একটু উপরের তলায় যাবে। তখনই দেখে উপরের তলা থেকে নজরুল সাহেব আর শাহেদ সাহেব কথা বলতে বলতে নামছে। বিজনেস বিষয়ক কথা। সোনালী আর সেদিকটায় পা বাড়ায় না। চলে যায় রান্না ঘরের দিকে। নজরুল আর শাহেদ এসে নিচের সোফা গুলোয় বসে। 

 

সোনালী রান্না ঘরে ঢুকে দেখে সুমনা বেগম চা বানাচ্ছেন। সোনালী গিয়ে সুমনা বেগমের পাশে দাঁড়ায়। বলে,

– আঁখি কই ? 

– ও সাথীর ঘরে। সাথীর পিঠের ব্যাথা আরো বাড়ছে। 

– লাল চা না দুধ চা ? 

– লাল চা। দুধ চা রায়হান ছাড়া এই বাড়ির কেউ খায়না। 

– আমার জন্যও একটু বানাইয়ো। বাইরে বৃষ্টি হইতেছে। এইসময় গরম গরম চা হইলে বেশ‌ জমবে।

– চিনির বোয়ম টা দে।

সোনালী একটু পাশ ফিরে পিছনে যায়। থাক থেকে চিনির বোয়ম আর সাথে একটা বিষ্কুটের বোয়মও নিয়ে আসে। চিনির বোয়মটা সুমনা বেগমকে দিয়ে বিস্কুটের বোয়ম খুলে বিস্কুট খেতে থাকে। সুমনা বেগম গরম পানি চায়ের কাপে ঢালতে থাকে। সোনালী বিস্কুট খেতে খেতে বলে,

– শাহেদ আর ওর ছেলে সাদিককে বাড়ির ঐ বিষয় সম্পর্কে জানায় না কেনো ? 

– আমার শশুরই জানায় নি। আর শাহেদ তো উনার ছোট, ভিতুও। ওর দাঁড়া এইসব কাজ সম্ভব না। 

– তাইলে ওর ছেলে সাদিক, ঐটাকে তো আমরা দলে নিতে পারতাম। 

– সাদিক ওর মায়ের দিকটায় গেছে। ও এসব কাজে জড়াতে রাজি হবেনা। 

– আমার টায় চিনি কম দিয়ো। বেশি চিনি খাইলে আবার ফিগার নষ্ট হবে। 

– ইশশ্,,আসছে আমার কারিনা কাপুর রে! এতো ফিগার বানায় কী করবি! নায়িকাতে নাম দিবি নাকি। 

– তুমি বুঝবানা এইসব। নায়িকাতে নাম দিলেই নায়িকা হওয়া যায় নাকি। আমি তো হবো খলনায়িকা। একটা ভাবসাব লাগবে না! 

– কার খলনায়িকা হবি তুই ! 

– পরে শুনিও। আগে যাও চা দিয়ে আসো ওদেরকে। ইদানিং তো ফিডের ব্যবসা চাঙ্গে উঠতেছে। একের পর এক অর্ডার বাতিল হইতেছে। 

– এইটা বাতিল হইলেই কি। নিচের কাজ দিয়ে তো এইটার ৫ গুণ টাকা আসে। 

– সমাজের লোকের চোখে চশমা তো পড়াইতে হবে নাকি! ঐ চশমার জন্য হইলেও ফিডের বিজনেসে মনযোগ বাড়ানো দরকার। 

– হইছে। তোকে এইসব নিয়ে ভাবতে হবেনা। যার ব্যবসা সে ভাববে। তোর কাপটা নে। আমি বাকি গুলা ওদেরকে দিয়ে আসি। 

– যাও যাও। (মুচকি হেসে) দুধ চা চাইলে ওখানেই বের দিয়ে দিয়ো। 

– চুপ, খালি উল্টাপাল্টা কথা। ভালো হইলি না আর তুই!

সুমনা বেগম চলে যেতে থাকেন চায়ের ট্রে নিয়ে। যাওয়ার সময় মুখ ভেংচি দেন সোনালীকে। সোনালী পা তুলে সুমনার পিছনে আলতো করে লাত্থির মতোন দেয়। সুমনা বেগম রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। সোনালী ফিরে তার কাপটা হাতে নেয়। এক ছোট্ট চুমুক দেয়। আর সাথে আনা বিষ্কিট খেতে থাকে। 

খেতে খেতে বিরবির করে বলে,

– আমি, আমি এই খাঁন বাড়ির খলনায়িকা! দিন আসুক, টের পাবা!

 

_____

 

সিড়ি দিয়ে ক্লিনিকের দোতলায় উঠলো সুমু। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। শরীর হালকা ভিজে গিয়েছে। ক্লিনিকের সামনের ছাওনির নিচে পাগল আর পাগলিকে খাবার খাইয়ে আসলো ও। কাল রাতে হনুফাকে যে মোটা কাঁথা-কম্বল আনতে বলেছিলো সেই হনুফা একটু আগে কোথাকার কোন ছোট বাচ্চার কাছ থেকে যে কাঁথা চুরি করে আনছে কে জানে। কাথায় প্রস্রাব প্রস্রাব গন্ধ লেগে ছিলো। ঐ কাঁথা আবার সুমুকে রাতে দিতে আসছিলো। কিন্তু সুমুকে ঘুমানো অবস্থায় দেখে ঐ কাঁথা নিয়ে গিয়ে পাগল পাগলিকে দিয়ে এসেছে। পাগল-পাগলিও ঐটা জড়িয়ে ধরে সারারাত ছিলো। এই নিয়ে হনুফাকে দু কথা শুনিয়ে আসলো সুমু। মন টা একটু চড়ে আছে। তবে পা উপরের করিডোরে রাখতেই সেই রৃঢ়তা যেন মলিন হয়ে যায়। আফাজকে সকালের পর থেকে আর দেখতে আসেনি সে। আফাজ নিশ্চয়ই এখন জেগে আছে। গিয়ে একবার দেখতে মন চাইছে। সুমু হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যায় আফাজের রুমের দিকে। করিডোরের শেষ প্রান্তের খোলা জানালা দিয়ে দখিনা ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। সুমু কিছুটা ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। আফাজের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো সুমু। দরজায় পর্দা দেওয়া। পর্দাটা একটু টেনে আড়াল হতে সুমু ভিতরে নজর দেয়। দেখে আফাজ শুয়ে আছে। তবে চোখ মেলা‌। উপরের সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে। চোখের কোণে পানি। সুমু বিরবির করে বলে উঠে ‘ উনি এখনো কাঁদছেন!’ 

কথাটা বোধহয় সুমুর কান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো। আফাজ অব্দি সেই কথা যায়নি। আফাজের কোন নড়াচড়া নেই। যেন এক শক্ত পাথর। আর পাথর ফেটে বিষাদ সিন্ধু বেড়িয়ে আসছে।

 

 সুমু ভিতরে যাবে বলে ঠিক করে। তার মন ভিতরে যেতে উতলা হচ্ছে কেনো জানি। সুমু পা বাড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে। আফাজ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। ঘরের মাঝে একটা লাইট জ্বলছে আজ। সেই লাইটের আলোয় আজ সে সুমুকে ভালোভাবে দেখে। মেয়েটার বয়স হবে বোধহয় ১৭ কি ১৮। গাঁয়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা। মাথার চুল গুলো কপালের দিকে একটু কম। ছেলেদের মতো করে একপাশে কিছু চুল সেতি করা। পড়নের কাপড় টা দেখে আফাজ চিনে যায় যে এটা লায়লার কাপড়। ওড়নার কিছু যায়গায় ছোট ছোট ফুটো হয়ে আছে।

  সুমু হেঁটে এসে ঘরের মাঝখানটায় দাঁড়ায়। দুই হাত একখানে করে আঙ্গুল খোটাতে থাকে। ও একটু নার্ভাস‌। আফাজ তার ঘাড় সোজা করে আবার উপরের সিলিংয়ের দিকে তাকায়। বা হাত টা উঠিয়ে চোখের পানি মুছে। সুমু মাথা তুলে আফাজের দিকে চায়। মৃদু গলায় বলে উঠে,

– আপনার জ্বর কমেছে। 

আফাজ ঘাড় না ঘুড়িয়েই স্বাভাবিক গলায় বলে,

– কিছুটা। 

– আপনার হাতে কী হয়েছে। ড,ডান হাতটায় ব্যান্ডেজ করা যে। 

– ব্যাথা পেয়েছি। ফেটে গেছে চামড়া। 

– আমাকে চিনতে পেরেছেন! আমি, আমি ঐদিন আপনার সাথে রাস্তায় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। 

আফাজ সুমু কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তাকে আবার এক পলক দেখেই ঘাড় সোজা করে নেয়। ধীর সন্তস্ত গলায় বলে,

– কেনো এসেছো এখানে। 

– এ,এমনিই।

– তুমি কী ফুফুর কোন আত্মীয়। 

– কোন ফুফু।

আফাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। মৃদু গলায় বলে,

– তুমি এই গ্রামে কার বাসায় এসে উঠেছো। 

– আ,আমি এই গ্রামেরই মেয়ে। 

– তোমার দেহের রং, কথার ভঙিমা, কোনটাই তো গ্রামের সাথে যায়না। শহুরে ছোঁয়া তোমার গাঁয়ে বহমান। 

– ন,না মানে এই গ্রামে কয়েকদিন হলো এসেছি। 

– তাইলে যে বললে এই গাঁয়েরই মেয়ে‌। 

– আমার মা এই গ্রামের। 

– এই ক্লিনিকে কী তোমার কেউ ভর্তি আছে? 

– হ্যা। মানে না। আ,আমার কেউ ভর্তি নেই। 

– কাল আমার সেবা করেছিলে কেনো। 

কথাটা শোনা মাত্রই সুমু চকিতে মাথা তুলে তাকায় আফাজের দিকে। তার বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সে এক ঢোক গিলে। হঠাৎ কেনো জানি তার দেহে অস্বাভাবিক পরিবর্তন সে লক্ষ্য করে। হাত দিয়ে আরেকহাতের আঙ্গুল জোড়ে জোড়ে খোটাতে থাকে। আফাজ মৃদু গলায় আবার বলে,

– তোমার মাথার ক্লিপটা বিছানাতেই পড়ে গিয়েছিলো। এই নাও। 

সুমু তার মাথায় হাত দেয়। সখের বসে তিনটে ছোট ছোট ক্লিপ দিয়েছিলো সে মাথার চুলে। সেগুলোর মধ্যে একটা বিছানাতেই কাল পড়ে গেছিলো! সুমু ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে আফাজের হাত থেকে ক্লিপ টা নেয়। নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে আবার ঘরের মাঝখানটায় এসে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে থাকে। তার মাথায় কিছু আসছেনা। সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। তার চোখ অস্থির। বুকের ভেতরটা কাঁপছে। আফাজ ধীর গলায় আবার বলে উঠে,

– এই যুগে তো কেউ স্বার্থ ছাড়া এক ফোঁটা পানিও এগিয়ে দেয়না। সেইখানে তুমি এক অপরিচিতা হয়ে কাল সারারাত আমার সেবা করলে। কী চাও তুমি আমার কাছে! 

সুমু আফাজের কথা শুনে মনে মনে বলে,

‘ যদি বলি আপনাকে,,! আপনার ভালোবাসাকে,,!’ 

আফাজ সুমুকে চুপচাপ থাকতে দেখে আবার বলে,

– চুপ করে আছো যে ! 

– ন,না মানে আমি কাল মোমবাতি নিয়ে এই করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলাম। ত,তখন আপনার কান্নার আওয়াজ শুনে এই ঘরে আসি।

তারপর আর কিছু বলতে পারেনা সুমু। সে একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। আফাজও ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকায়। বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টি আবহাওয়াটাকে বেশ মনমুগ্ধকর করে তুলছিল। কিন্তু তাও বিষাদের বর্ষা হিসেবে নিমে আসে আফাজের বুকে। আজ এই বৃষ্টিটা সেও উপভোগ করতে পারতো। আলিশার সাথে। আলিশা এক রংধনু হয়ে তার আকাশ রাঙিয়ে দিতো। মেঘে ঢাকা বাদল হয়ে তার ধরীত্রীতে শ্রাবণ ধারার বর্ষণ ঘটাতে পারতো। কিন্তু তা সবই এখন কল্পনা। মানুষ বোধহয় কল্পনাতেই তার পূর্নতা খুঁজে পায়। বাস্তব জীবন তো মাত্র অপূর্ণতার কান্ডারি,,,! 

দুজনে মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা থাকে। সুমু চুপচাপ ঘরের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে। আর আফাজ বেডে শুয়ে আছে। বাইরের হালকা বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছু কোন আওয়াজ নেই। সুমু মুখ তুলে চেয়ে তাকায় আফাজের দিকে। আফাজ মুখ জানালার দিকে করে এখনো বৃষ্টি দেখছিলো। সুমু ভাবে এখন আফাজকে একলা ছেড়ে দেওয়া উচিত। পড়ে যখন আফাজ ঘুমাবে তখন এসে একবার দেখে যাবে। সুমু ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তখনই আফাজের ম্লিন কন্ঠ ভেসে আসে। 

‘আমায় একটু পানি খাওয়াতে পারবে?’

সুমু সাথে সাথেই থেমে গিয়ে চকিতে ফিরে তাকায়। আফাজ জানালার দিকে মুখ করে কথাটা বলেছিলো। এখন সে ধীরে ধীরে তার মুখ ঘুড়িয়ে সুমুর দিকে ফিরে তাকায়। বলে,

‘যদি তোমার কোন দরকারি কাজ থাকে তবে যেতে পারো ‘

– না না। আমার কোন কাজ নেই। আমি এখনি পানি দিচ্ছি আপনাকে। 

সুমুর শরীর যেন প্রাণ ফিরে পায়। হন্তদন্ত হয়ে রুমে পানি খুঁজতে থাকে। তখনই সে দেখে ঘরের কোনের টেবিলটায় পানির বোতল রাখা। হয়তো এক লিটারের বোতল হবে ওটা। কালও এমন একটা বোতল থেকে পানি ঢেলে আফাজের কপালে ভেজা কাপড় দিয়েছিলো। পানির বোতল গুলো মনে হয় শিউলি বেগমরা এনে রাখেন। 

সুমু তাড়াতাড়ি পানির বোতলটা হাতে নিয়ে চলে আসে। এসে বিছানার পাশে দাঁড়ায়। আফাজ উঠে বসার চেষ্টা করে। সুমু পানির বোতলটা বিছানার পাশের টেবিলটায় রেখে আফাজের পাশে বিছানায় বসে। আফাজকে ধরে টেনে তুলে দিতে থাকে। আফাজের শরীর অনেক দুর্বল। নার্সের থেকে সে শুনেছে আফাজ খাবার খায়নি এ দুইদিন ঠিকমতো। কাল রাতে আবার জ্বরও এসেছিলো। 

সুমু আফাজকে ধরে কিছুটা উঠিয়ে মাথার বালিশটাকে বিছানার প্রান্তে সোজা করে রাখে। আফাজকে ধরে পিছিয়ে সেই বালিশে হেলান দিয়ে দেয়। আফাজের শরীর বেশ ভারি হলেও সুমুর গায়ে যেন হঠাৎ অবিনশ্বর শক্তি চলে এসেছিলো। হয়তো এটা আফাজের প্রতি তার অনুভূতির আবেশ! 

আফাজকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেওয়ার পর বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিল টা হতে সুমু পানির বোতলটা নেয়। বোতলের ছিপি খুলে বোতলটা আফাজের মুখের সামনে ধরে। আফাজ নিজের সচল বাম হাতটা উঠিয়ে সুমুর হাত থেকে বোতলটা নিয়ে নিজে নিজেই পানিটা খেতে থাকে। সুমুও বোতলটা ছেড়ে দেয় তার হাতে। এতে একটু আশাহত হয় সুমু। ভেবেছিলো নিজ হাতে আফাজকে পানি খাইয়ে দিবে। কিন্তু আফাজই বোতলটা তার হাত থেকে নিয়ে নিলো। আফাজ বেশ খানিকটা পানি খেয়ে বোতল টা সুমুকে দেয়। সুমু তাড়াতাড়ি বোতলটা হাতে নেয়। ছিপি লাগিয়ে নিজের কোলেই রাখে বোতলটাকে। আফাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিলো বিছানার অপর পার্শের জানালার দিকে। বৃষ্টি দেখছিলো সে। সুমুও আফাজকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে মনে বলে,

‘ একদিন হয়তো আপনি আর আমি বৃষ্টিকে খুব, খুব কাছ থেকে উপভোগ করবো!’ 

সুমুর মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠে। হয়তো একদিন এই ইচ্ছাটা তার পূর্নতা পাবে, নয়তো এটাও রয়ে যাবে কল্পনাতিত এক ছোট্ট সুখ হিসেবে। 

আফাজ কিছুক্ষণ পর বলে উঠে,

– আমি একটু একলা থাকতে চাই। তুমি যাওয়ার সময় দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যেও। 

সুমুর কানে কথাটা যাওয়ার সাথে সাথেই যেন তার মুখের চওড়া হাসি বাতাসে মিলিয়ে যায়। সে চেয়েছিলো আফাজের পাশে আর কিছুক্ষণ বসে থাকতে। কিন্তু আফাজ চাইছেনা। সুমু কিছু না বলেই বিছানা থেকে উঠে যায়। চলে যেতে থাকে। যাওয়ার সময় একটু থেমে পিছু ফিরে তাকায় সে আফাজের দিকে। শার্ট, আর কাঁথা ঢাকা নেওয়া আফাজের মাঝে সেই সাদা পান্জাবি পড়া আফাজের রক্তজবা ফুল হাতে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য কল্পনা করে। মনের সুরে তাল মিলিয়ে বিরবির করে বলে,

‘ একদিন হয়তো পুরো পৃথিবী আমাদের হবে!’ 

সুমু সামনে ফিরে। ঘর থেকে চলে যেতে থাকে। হাতে পানির বোতলটাও আছে। ঘর থেকে বের হয়ে দরজা খানিকটা টেনে দেয়। করিডোরে দাঁড়িয়ে বোতলের ছিপিটা খুলে। এই বোতলে মুখ লাগিয়ে একটু আগে আফাজ পানি খেয়েছিলো। সুমুও বোতলে চুমুক দেয়। কয়েক ঢোক পানি পান করে মুখ থেকে বোতলটা নামায়। মুখে একটা হাসৌজ্জল প্রতিরূপ ফুটে উঠে। বোতলের ছিপি টা লাগিয়ে সেটাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বেশ মনান্দেই দৌড়ে চলে যেতে থাকে সিড়ির দিকে। তখনই সেখানে উদয় হয় হনুফা। উড়ে উড়ে যেতে থাকে সুমুর পিছনে। সুমুকে ডেকে ডেকে বলতে থাকে,

– এই এই আমাকেও পানি দে, আমারও পিপাসা লাগছে। 

সুমুর কানে হনুফার কথা পৌছালেও মস্তিষ্ক তা গ্রহণ করেনা। কারণ তার পুরো মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে আফাজ নামক এক রঙিন অধ্যায় ঘুড়ছিলো। 

 

____ 

 

শাহারিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। মনে হয় আহনাফ ফোন দিয়েছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে এবার। সারাদিন অল্প অল্প করে বৃষ্টি হয়েছে আজ আনন্দপুরে। আকাশ সবসময় মেঘলা ছিলো। ঠান্ডাটা তাই একটু বেড়েছে বইকি। 

 

দিথী তার ঘর থেকে বেড়োলো। হাতে থাকা পায়েশের বাটিটা ডায়নিং টেবিলে রাখলো। বৃষ্টির দিকে পায়েশ, দই এসব খেতে দিথীর বেশ ভালো লাগে। তার উপর শিউলি বেগমের বানানো পায়েশ। খেতে দারুনের থেকেও দারুন। দিথী এগিয়ে যায় বেসিনে হাত ধোয়ার জন্য। হাতের তিন আঙুলে বেশ খানিকটা পায়েশ লেগেছিলো। সেগুলো চেটে খেতে যাবেই তখনই তার চোখে পড়ে শাহারিয়াকে। শাহারিয়া ফোনে কথা বলছে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। আকাশে ছোট খাটো একটা বিজলী চমকিয়ে উঠে। দিথী হাতের পায়েশ গুলো আর চেটে খায় না। হাত নামিয়ে এগিয়ে যায় শাহারিয়ার দিকে। মুখে মুচকি হাঁসি।

 

শাহারিয়ার পিছনে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে যে শাহারিয়া কার সাথে কথা বলছে। শাহারিয়া বাইরের দিকে মুখ করে থাকায় দিথী যে এসেছে তা সে টের পায়নি। দিথী কথা শুনতে পাচ্ছে না। সে আরেকটু কাছে যায়, তখনই তার স্পর্শ শাহারিয়ার গায়ে লাগে। শাহারিয়া পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে দিথী দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো পিছনে নিয়ে ঢুলছে আর হাসছে। শাহারিয়া ফোনের অপর প্রান্তের লোকটাকে বলে,

‘ আচ্ছা রাখ, আমি পরে তোকে কল ব্যাক করছি।’ 

শাহারিয়া ফোনটা কান থেকে নামায়। পকেটে রেখে বলে,

– তুমি? তুমি এখানে কী করতেছিলা! 

– তোমার উপর গুপ্তচর গিরী করতেছিলাম। ভাগ্যেস ফোনের অপরপার্শে আহনাফের গলা পাইছি বলে বাঁচে গেছো। নাইলে তোমাকে ধরে দিতাম একদম!

– আহনাফই ফোন দিছিলো। আফরিনের মায়ের বিষয়ে বলছিলো। (একটু থেমে) তুমি মায়ের সাথে আফাজের খাবার নিয়ে যাওনি। 

– না। মা এখনো তার ঘরে সাজতেছে। 

– মা এখন বের হবে তাতেও সাজা লাগবে! মায়ের সাজগোজ আর গেলো না!

– আচ্ছা বাদ দাও। এখন বলো বৃষ্টিতে তোমার কী কী করতে ইচ্ছে করে। 

– আমার! আমি তো ঢাকায় থাকতে খালি সারাদিন ঘুমাইতাম যখন বৃষ্টি হইতো। আর এখানে আসলেও ঘুমানোই হয়। 

– এইজন্য তো তোমাকে আমি আজ সারাদিন খুঁজে পাইনা। এতো ঘুম ক্যান তোমার! 

– বৃষ্টি আসলেই কেনো জানি ঘুম পায় খুব। (বলেই হাই তুলতে থাকে শাহারিয়া)

– হইছে ঢং বাদ দাও। তোমার ঘুম আমি ছুটাবো। (একটু থেমে) এদিকে কাল সারারাত বৃষ্টি হইছিলো। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নাই। 

– কেন ? শরীর খারাপ করলো নাকি তোমার আবার! 

– আমার মন খারাপ। বিয়ে করছি কিন্তু ঘরে বর নাই। 

– খালি তো কালকের দিনটাই। তারপর তো আমরা চলে যাবো। তখন আর আফসোস করতে হবেনা। 

– হইছে আফসোস বাদ দাও। (হাসিমুখে) পায়েশ খাবা! 

– পায়েশ! তুমিই মনে হয় পায়েশের বাটি সাফ করে দিছো। আমার জন্য আর রাখছো কই! 

– তোমার জন্য বেশি মিষ্টি দেওয়া পায়েশ রাখছি। এখন অল্প খাও, শ্রীমঙ্গলে গিয়ে তখন বেশি বেশি খাইয়ো। 

– তুমি আর মা, তোমাদের দুইজনের মুখ আর ঠিক হইলো না। 

– মুখ ঠিক করা বাদ দাও। (হাত দুটো সামনে এনে দেখিয়ে) এই যে পায়েশ। এইটুকুই আজকে তোমার জন্য আছে। 

– তোমার আঙুলে লাগা পায়েশ আমাকে দিচ্ছো,,! কেন আমার জন্য বাটিতে একটু রাখে দিলেই তো পারতা। 

– কিন্তু তাতে তো তুমি বেশি মিষ্টি স্বাদ পাইতা না! 

– এখন তোমার আঙুল থেকে খাইলে বেশি মিষ্টি স্বাদ পাবো!

দিথী সাথে সাথে এক চোখ টিপ মেরে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। শাহারিয়া দুই হাত নিজ কোমরে দিয়ে বলে,

– এতো খুশি ক্যান‌ আজকে! 

– আগে পায়েশ খাও তারপর বলতেছি। 

দিথী তার তিন আঙুল উপরে তুলে। শাহারিয়ার মুখের দিকে এগিয়ে দেয়। শাহারিয়াও সেই তিন আঙুল ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। দিথী আঙুল তিনটে শাহারিয়ার মুখের সামনে নিয়ে যায়। শাহারিয়া আঙ্গুল গুলো মুখে নিতে যাবেই তখনই দিথী তার আঙ্গুল গুলো টেনে নিয়ে নিজের জিহ্বা দিতে চেটে নেয়। শাহারিয়া ভ্যাবাকচেকা খেয়ে যায়। সে কিছু বুঝে উঠার চেষ্টা করবে তখনই দেখে, দিথী তার সেই পায়েশ মাখা জিহ্বা মুখ থেকে আলতো করে বের করে শাহারিয়ার মুখের কাছে এগিয়ে আসছে। শাহারিয়ার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। কী সাংঘাতিক বিষয়! দিথী পায়েশ মাখা আঙ্গুল গুলো তার জিহ্বা দিয়ে চেটে সেই জিহ্বা শাহারিয়ার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে চুষে নেওয়ার জন্য! শাহারিয়া এক ঢোক গিলে। এই বৃষ্টিতে দিথী এতো গরম কেনো হয়ে গেলো! দিথী চোখ দিয়ে ইশারা করে তার জিহ্বায় নরম পরশ বোলানোর আহ্বান করে। দিথীর চাহনি দেখে যেন শাহারিয়া নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা। তার ভিতরের পুরুষত্ব যেন দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। শাহারিয়া হঠাৎ দিথী পায়েশ মাখা জিহ্বা নিজের ঠোঁটের ভিতরে নিয়ে নেয়। দুইহাত দিয়ে দিথীকে খুব জোড়ে জড়িয়ে ধরে। এই পায়েশের স্বাদ যেন অমৃত! দিথীও শাহারিয়াকে জড়িয়ে ধরে শাহায়িয়ার সাথে কো-অপরেট করে। বাইরে বিজলী চমকিয়ে উঠে। 

 

   ডেসিন টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছেন শিউলি বেগম। বিছানায় শুয়ে আছেন মতিন মেম্বার। শিউলি বেগমকে পাশ থেকে দেখছেন তিনি। শিউলি বেগম তাকে আড় চোখে দেখে এক মুখ বাকানি দেন। দিয়ে আবার আয়না দেখে দেখে চেয়ারে বসে চুল আঁচড়াতে থাকেন। মতিন মেম্বার শোয়া হতে উঠে বসেন। চশমাটা চোখে পড়ে নেন। বসে শিউলি বেগমের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন,

– ও শিউলি বেগম। আহো না ঘুমাই। 

– ঘুমাইবা না কী করবা হেইডা আমার জানা আছে। 

– হাচা কইতাছি শুধু ঘুমামু তোমারে ধইরা। কতদিন হইলা গেলো তোমারে ধইরা ঘুমাই না। 

– কতদিন আর কই হইলো। মাত্র তো ৫-৬ ডা দিন ঘুমাও নাই।

– আমার ধারে ৫ দিন ৫ বছরের লাহান কাটছে। তোমারে ছাড়া ঘুমাইতে ভালা লাগেনা গো। আহো না আইজ একলগে ঘুমাই। বাইরে কত সুন্দর বৃষ্টি পড়তাছে। একরম একটা আবহাওয়াতে আমার খুব ঠান্ডা লাগতাছে(দূই হাতে শরীর জড়িয়ে ধরে) উড়ি বাবা, কী শীত,,! আহো না শিউলি বেগম। 

– বুইড়া বয়সে ভীমরতি উডছে তোমার! আমি পারমুনা। কোলবালিশ আছে, ঐডা ধইরা ঘুমাও। 

– কোলবালিশ কী আর আমার শিউলি বেগমের লাহান নরম হইবো। আহো না ঘুমাই। 

– কইছি না পারমুনা। আমারে ক্লিনিক যাইতে হইবো আফাজের লাইগা ভাত নিয়া। তুমি চুপচাপ ঘুমাও। (একটু থেমে স্বাভাবিক গলায়) কাইলকা ২১ তারিখ। তারপরে তোমার পোলা বউমা নিয়া গেলেগা তহন আমুনে তোমার লগে ঘুমাইতে। 

– আরো ১ টা রাইত! আহা, যদি আইজকাই ২১ তারিখ হইতো। কতো ভালো হইতো। তোমারে ধইরা ঘুমায়া যাইতাম। 

– আমি যাওয়ার সময় ফুলমতিরে কইয়া যামুনে, অয় তোমারে ভাত বাইড়া দিবো। খাইয়া ডিরেক্ট হুইয়া পড়বা। 

– আইজ বউডার হাতে খানাও খাইতে পারুম না। কী অভাইগ্গা কপাল আমার! 

– হ অভাগাই। এহন চুপচাপ বই নিয়া পড়তে বহো। আমার ধারে তোমার লগে কথা কওয়ার টাইম নাই। 

বলেই চেয়ার থেকে উঠে চলে যেতে থাকে শিউলি বেগম। মতিন মেম্বার বলতে থাকেন,

– আরে যাইয়ো না গো। আরেকটু থাহো, তোমারে দেইখা পরাণ ডারে একটু জুড়াই, ও শিউলি বেগম,,,! 

 

শিউলি বেগম ঘর থেকে বাইরে চলে আসেন। মাথার চুল গুলো হাত বেনি করতে করতে এগিয়ে আসেন। তখনই তার চোখ পরে দূরে। দেখেন বারান্দায় শাহারিয়া আর দিথী চোখ বুঝে চুমুতে মেতে আছে। শিউলি বেগম বিরবির করে বলেন,

– ভিতরে এক মুরগা চেচাইতাছে, এইদিকে আরেক মুরগা-মুরগির চুমাচুমির হাট বহাইছে। আইজ এগোরেই দেখমু, কতক্ষন এমনে লাইগ্গা থাকতে পারে।

বলেই ডায়নিং টেবিলের সামনে থেকে একটা চেয়ার হাতে নেন শিউলি বেগম। টেবিলে থাকা ফ্লাক্স থেকে এক কাপে চা ঢেলে নেন। এক হাতে চা আরেক হাতে চেয়ার নিয়ে এগিয়ে যান তাদের সামনে। দুইজনেই চোখ বন্ধ করে কিস করতে থাকায় তারা শিউলি বেগমকে দেখেনি। শিউলি বেগম তাদের থেকে ২ হাত দূরে চেয়ারটাকে নিঃশব্দে রাখেন। সেটায় বসেন। পায়ের উপর পা তুলে গরম চায়ে চুমুক দেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে মৃদু বিজলী চমকিয়ে উঠছে। শিউলি বেগম চায়ে চুমুক দেন আর তাকিয়ে দেখতে থাকেন শাহারিয়া আর দিথীর গভীর চুম্বন।

 দুইজনের হাত যে কোন দেশ থেকে কোন দেশে যায় তা যেন চায়ে চুমুক দেওয়া শিউলি বেগম ছাড়া আর কারো চোখেই পড়ে না। শিউলি বেগম এবার একটু শব্দ করে চায়ে চুমুক দেন। তারপর মুখ দিয়ে মৃদু আওয়াজ বের করেন, ‘ আহহ্! চা ডা আইজ মেলা ট্যাশ করতাছে!’

হঠাৎ কথার শব্দে শাহারিয়ার চোখ খুলে যায়। তাদের থেকে দুইহাত দূরে বসা শিউলি বেগমের এক নজরে চেয়ে থাকা দেখে তৎক্ষণাৎ সে দিথীকে ধাক্কা দিয়ে তার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। দিথী কিছুটা বিরক্ত হয়। শাহারিয়াকে বলতে থাকে,

‘ এই ছাড়লা কেনো। আমার কতো ভালো লাগতেছিলো। আসো আরো পায়েশ খাও। সব তোমার। সব খেয়ে নেও।’ 

শাহারিয়া দিথীর কথার কোন উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঠোট মুছে পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। ঘরের দিকের পথে শিউলি বেগম বসা। শাহারিয়া দৌড়ে ছুট লাগায় বেসিনের পাশে গোসল খানার দিকে। দিথী শাহারিয়ার ছুটে যাওয়া দেখেও কিছু বুঝতে পারেনা। সে আধখোলা চোখ নিয়ে বিরক্তির সহীত বলতে থাকে,

‘ এই কই যাও। এখন কী গোসল করার সময় নাকি। সকালে ডাকলাম একসাথে গোসল করার জন্য, তখন তো আসলানা।’

– আম্মা জান। আমারে একটু পায়েশ দেও। আমিও খাই। 

দিথী চোখ বড় বড় করে তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে শিউলি বেগম চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছেন। মুখে হাসির রেখা চওড়া তার। দিথী কী বলবে, কী করবে বুঝে পায়না। হাত উঠিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে। শিউলি বেগম সুর নিয়ে বলেন,

– আহো আম্মাজান, একলগে চা খাই।

– না মানে মা, আমি আরকি একটু,,,

– হ, একটু পায়েশ দেওয়া নেওয়া করতাছিলা আরকি।

– আর হবেনা মা। মাফ করে দাও। 

– না,না। তোমরা তো খালি পায়েশ দেওয়া নেওয়া করছো। যেহানে সেহানে তো হাত দেও নাই। 

দিথী জিহ্বা কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কী বেইজ্জতি টাই না হইতে হইলো এখন! শিউলি বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। চায়ের কাপ নিয়ে দিথীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে একহাতে কাপের প্রিচ ধরে আরেক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে কাঁধ দিয়ে দিথীকে এক ছোট্ট ধাক্কা দেন। দিথী তার মাথার আউলা,ঝাউলা চুলে হাত রেখে লজ্জায় লাল হয়ে যেতে থাকে। শিউলি বেগম মুখ থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলতে থাকেন,

– হইছে আর শরম পাওয়া লাগবো না। ঘরে যাইয়া তাড়াতাড়ি কাপড় বদলাইয়া লও। আফাজের ওহানে যাইতে হইবো। 

– মা সরি, আর হবেনা এরকম। 

– হ বুজ্জি বুজ্জি। এহন যাও। গিয়া রেডি হও, বাইর হওয়া লাগবো। বৃষ্টি ডা এহন একটু কমছে। নাইলে পড়ে আবার বাড়লে যাইতে পারুম না। 

– জি আচ্ছা ঠিক আছে মা। 

বলেই ঘরের দিকে ছুট লাগায় দিথী। শিউলি বেগম তা দেখেই কী হাঁসি। দিথী আর শাহারিয়ার ধরা খাওয়ার পর মুখটা মনে করে যেনো আরো হাসি পাচ্ছে শিউলি বেগমের। হাতে চায়ের কাপ আর প্রিচ নিয়ে চলে যেতে থাকেন ঘরের দিকে। এগিয়ে এসে ডায়নিং টেবিলে চায়ের কাপটা রাখেন। রেখে ঘরে ঢুকতেই যাবেন তখনই হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়। বারান্দা, ঘর সব অন্ধকার হয়ে যায়। মতিন মেম্বার ঘর থেকে চেচাতে চেচাতে বেড়িয়ে আসতে থাকে,

– শিউলি বেগম, ও শিউলি বেগম। ঘরদোর দি সব অন্ধকার হইয়া গেলো। লাইট কোনহানে রাখছে কে জানে। শিউলি বেগম, ও শিউলি বেগম। 

বলতে বলতে বারান্দায় বের হন মতিন মেম্বার। তখনই গোসলখানার দরজা খুলে বের হয় শাহারিয়া। কারেন্ট যাওয়াতে ঐখানটাও অন্ধকার হয়ে গেছে। গোসল খানার দরজা খোলার শব্দ শুনে মতিন ভাবেন শিউলি বেগম বোধহয় ঐদিকে আছে। 

‘ শিউলি বেগম, তুমি এতো রাইতে গোসল করতে গেছো ক্যান’ 

বলতে বলতে এগিয়ে যেতে থাকেন সেদিকে। বাইরে বৃষ্টির বেগ কিছুটা বেরে যায়। মতিন মেম্বার বেশ কিছুটা এগিয়ে যান। হঠাৎ কিছু একটার সাথে উস্টা খেয়ে হড়মুড়িয়ে পড়ে যান ফ্লোরে। অমনি বিজলী চমকিয়ে উঠে।

‘মরছে মরছে মুরগাডায় মরছে’ বলেই শিউলি বেগম হাসিতে ফেটে পড়েন। তার রেখে আসা চেয়ারটার উপরে হুড়মুড়িয়ে পরে গেছে মতিন মেম্বার। শাহারিয়া তা দেখেই এগিয়ে আসে ধরতে। শিউলি বেগমের বারান্দা কাঁপানো হাসিতে দিথী,লায়লা, ফুলমতি সবাই বারান্দায় চলে আসে। ফুলমতি টর্চ নিয়ে এসেছিলো। শাহারিয়া মতিন মেম্বারকে ধরে উঠায়। শিউলি বেগম হাঁসতে হাঁসতে এগিয়ে আসেন মতিন মেম্বারের দিকে। মতিন মেম্বার বোধহয় কোমরে ব্যাথা পেয়েছেন। শিউলি বেগম তাকে ধরে সোজা করেন। হাঁসি আঁটকে রাখতে জান, কিন্তু তা মুখ ফেটে আবার বেড়িয়ে আসে। তার হাসিতে যেন বাকিদেরও হাসি পেয়ে উঠে। শাহারিয়া হাসেনা। সে তার বাবাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে বাবাকে বলতে থাকে,

‘ তোমার আর আমার, দুইজনের খবর করার জন্য এরকম একটা বউই যথেষ্ট!’ 

 

____

 

নীলগিরি জঙ্গল। বৃষ্টি ভেজা আঁধার রাতে যেনো এই জঙ্গলটাকে আরো বেশি ভয়ানক লাগে। বৃষ্টি হওয়ায় জঙ্গলের ভিতরের মাটি কাদায় মাখামাখি হওয়ার মতো অবস্থা। চারপাশ ঘন গাছপালায় ঘেড়া। এক লোক দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে দিকবিদিক না দেখে। তার পিছু পিছু দৌড়ে আসছে কিছু বন্দুকধারীর লোক। হাতে লম্বা বন্দুক। যেমনটা রন্জু সেইদিনের ভিডিওতে জুডাসের রক্ষীদের হাতে দেখেছিলো ঠিক তেমন। অচেনা লোকটা প্রাণপনে ছুটে এই জঙ্গল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। চারপাশে সুচোলো ডাল পালায় তার হাতের চামড়া ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। তখনই এক গুলি এসে লাগে তার গায়ে। ছিটকে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে সে মাটিতে। রক্ষীরা এসে তার গাঁয়ের উপর অনবরত গুলি করতে থাকে। লোকটা শেষ চিৎকার টাও করতে পারেনি। পুরো শরীর গুলিতে ঝাঝড়া করে দেয় রক্ষীরা। রক্তে মাটি ভিজে যায়। গুলি করার পর সেই লাশটাকে কাঁধে তুলে নেয় ওখানকারই এক রক্ষী। নিয়ে চলে যেতে থাকে জঙ্গলের আরো গভীর অংশে।

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৬৭

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

(((((আজকের পর্ব টা মন দিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বেন। কিছু নতুন জিনিস জানতে পারবেন))))

 

সমুদ্র তটের থেকে কিছুটা দূরে উঁচু এক যায়গায় একটা কাঠের বাড়ি ভাড়া নিয়েছে রায়হান আর নিপা। বাড়িটা এখানকার আবাসিক লোকদের। কাঠের বাড়িটার সবকিছুই কাঠের তৈরি। রায়হানদের রুমটার সাথে একটা বারান্দা-ব্যালকনিও আছে। 

 

নিপা বারান্দারি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। দরজা খুলে বারান্দায় প্রবেশ করলো রায়হান। আকাশ পরিষ্কার। কিছুটা জোছনা পড়েছে। দূরের সমুদ্র সেই জোছনার আলোতে কিছুটা দৃশ্যমান। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নিপাকে যেনো এক মায়াবী রাজ্যের রাজকুমারী লাগছে। খয়েরি রঙের শাড়ি। খোলা চুল কোমড় অব্দি এসে ঠেকেছে। মাঝে মাঝে বয়ে যাওয়া হালকা হাওয়ায় চুল গুলো মৃদু দোল খেয়ে উঠছে। বাড়ির পাশ থেকে কোন এক নাম না জানা ফুলের চাপা সুবাস ভেসে আসছে। চারপাশে আবহকে যেন মনকে মোহময় করে তুলছে। রায়হান দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় নিপার কাছে। জোছনা রাতের রূপসী কণ্যার রূপ ছুঁয়ে দিতে মন চাইছে আলতো করে। নিপার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় রায়হান। হাত দুটো হালকা ভাবে কোমরের অংশে রেখে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে একটা ছোট্ট চুমু খায়। নিপা রায়হানের স্পর্শ চিনতে ভুল করেনি। এই ছোঁয়া যে তার জনম, জন্মান্তরের চেনা। রায়হান তার থুতনি নিপার কাঁধে রেখে তার সাথেই দূরের সমুদ্র,আকাশে চোখ দেয়। হাত দুটো আরো এগিয়ে আনে নরম তুলতুলে পেটের মাঝে। প্রেয়সীর গাঁয়ের গন্ধ সে খুব কাছ থেকে নিতে পারছিলো। নিপা মৃদু গলায় বলে,

– আকাশ টা সুন্দর না! 

– আকাশের থেকেও আজ আমার সুবাটা বেশি সুন্দর। অনেক সুন্দর। 

বলেই নিপার ঘাড়ে আরো একটা ছোট্ট চুমু খায় রায়হান। রায়হানের গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো নিপার ঘাড়ে বেশ সুরসুরি দিচ্ছিলো। নিপা মৃদু হেসে বলে,

– হয়েছে ছাড়ো, আমার কাতুকুতু লাগছে। 

– তা একটু লাগলে মন্দ হয়না। 

নিপার পেট টায় আলতো করে হাত দিয়ে নিজের দেহের সাথে চেপে ধরে রায়হান। নিপা নিজেকে রায়হানের থেকে ছাড়াতে যায়। কিন্তু পারে আর কই! 

রায়হান ধীর কন্ঠে বলে,

– আল্লাহ তোমাকে কী দিয়ে বানিয়েছে বলোতো! তুমি এতো নরম কেনো! তোমার গায়ে হাত দিলেই যেন মনে হয় কোন ফুলের পাপড়ি ধরেছি। আমার একটা শিমুল তুলার কোলবালিশ ছিলো। ঐটাকেই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নরম ভাবতাম। কিন্তু তোমাকে কাছে পাওয়ার পর থেকে তোমার চেয়ে নরম,সফট আর কিছুই আমি এই পৃথিবীতে পাইনি। 

– এতো প্রশংসা! 

– প্রেয়সীর রুপের প্রশংসা হাজার বার করা যায়। 

– আর আমিও তোমার মতো শক্ত দেহের কাউকে দেখিনি। তুমি হাত ধরে টানলে মনে হয় এই বুঝি হাত টা কনুই থেকে ছুটে গেলো। 

– এরপর থেকে তাইলে ধীরে ধীরে টেনে তোমায় নিজের করে নিবো। 

নিপা এক ছোট্ট মুচকি হাসি দিয়ে সামনের দিকে তাকায়। সমুদ্র ঢেউয়ের কলতান শব্দ এখান থেকে শোনা যাচ্ছিলো। ঢেউয়ের সাথে আসা সাদা ফেলা গুলাও জোছনা আলোয় কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছিলো। রায়হান তার গালের সাথে নিপার গাল লাগিয়ে বলে,

– আমাকে একটা ছোট্ট সুবা দেওনা।

– এখনই! আর কয়টা মাস যাক। 

– না আমার ছোট্ট সুবা খুব তাড়াতাড়ি চাই। সারাদিন বাবা বাবা করে বাড়ি মাথায় তুলবে। আমি তার জন্য অনেক খেলনা আর চকলেট আনবো। অফিস থেকে ফিরার পর আমার কোলে দৌড়ে ছুটে আসবে। (একটু থেমে) আমার একটা ছোট্ট সুবা চাইই চাই। 

– যদি ছোট্ট রায়হান হয়! 

– না। আমার সুবাই চাই। তোমার মতো কিউট একটা সুবা। 

– তোমার মতো দুষ্টু না হলেই হয়। 

রায়হান নিপাকে ঘুড়িয়ে তার দিকে ফিরায়। তার দুই কাঁধে হাত দেয়। বলে,

– আমি দুষ্টু! 

– তা নয় তো কী। সবসময় খালি দুষ্টামি মাথায় ঘুরে তোমায়। 

– আমি আবার কী দুষ্টামি করছি। 

– তুমিই ভালো জানো। 

– নিজের বউয়ের সাথে দুষ্টুমি করবো না তো জরিনাদের সাথে করতে যাবো নাকি! 

নিপা তখনই রায়হান মুখ চেপে ধরে। সে কিছুটা অস্থীর মতো হয়ে যায়। বলে,

– আমি ছাড়া তুমি আর কাউকেও ছোবে না। 

রায়হান নিপার হাত সড়িয়ে তার কপালে কপাল লাগিয়ে মৃদু গলায় বলে,

– আমি যে শুধুই তোমাতে আসক্ত। তুমিই আমার নেশা, তুমি আমায় এক টুকরো আশা। তোমায় ছাড়া যে একমুহুর্ত থাকাও দায়! 

– বাপরে, এতো ভালোবাসা! 

– ভালো তো অনেকটা বাসি। বুক চিরে দেখাতে বললে এখনি দেখাচ্ছি! 

– না থাক। লাগবেনা। এমনিতেই তুমি আমার হিরো। 

রায়হান মুচকি হাসি দিয়ে এক নজরে তাকিয়ে থাকে নিপার দুই চোখে। এই দুই চোখ যেনো তার কাছে মায়াবী সাম্রাজ্য। রায়হান ধীর গলায় বলে,

– জানো তোমার ঐ দুই চোখ মহাবিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নক্ষত্র! তুমি যে আমার পূর্নতা। তোমার চোখের অনন্ত মায়া আমাকে প্রভাবিত করে! 

– মায়াবিনী হতে পেরেছি তাইলে! 

– তুমি আমার মায়াবিনী, অর্ধাঙ্গিনী, স্রোতোসিনী। সব সব সব। 

নিপাকে জড়িয়ে ধরে রায়হান। নিপাও তার দু হাত দিয়ে রায়হানকে আলিঙ্গন করতে কৃপনতা করে না। রায়হান নিপার গাঁয়ের সুঘ্রাণ নিয়ে দূরের সাগর প্রান্তরে চায়। দু একটা জোনাকি পড়া উড়ছে বারান্দার রেলিং ধরে। রায়হান নিপার উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘পূর্নিমা সন্ধায়,

তোমার রজনীগন্ধায়,

রূপসাগরের পাড়ের পানে

উদাসী মন ধায়..’

 

 নিপা রায়হানকে এভাবেই জড়িয়ে রেখে চোখ বুঁজে। রায়হানের বুকের হৃদস্পন্দন যেন নিম নিম হয়ে আসছিলো। বুকে কান রাখায় সে খুব ভালোভাবেই শুনতে পাচ্ছিলো। নিপা চোখ খুলে ফেলে। রায়হানকে ছেড়ে দেয়। রায়হান কিছুটা অবাক হয়ে বলে,

 – কী হলো! 

 – এভাবে তো সারাজীবন ধরে রাখতে পারবে, কিন্তু এতো সুন্দর জোছনা রাত, এই রাত কে আমি মিস করতে চাই না। চলো রাতের আকাশ দেখি। 

রায়হান আবার নিপার কাঁধে দু হাত রাখে। বলে,

 – রাতের আকাশ দেখে কী করবো। ঐ আকাশের চাঁদের থেকে আমার আকাশের চাঁদ বেশি সুন্দর। আমি তো আমার চাঁদ বউ টাকেই দেখবো। 

 – দেখিও। চলে তো যাচ্ছিনা কোথাও। আসো একসাথে আকাশ দেখি। 

বলেই রায়হানের হাত দুটো কাঁধ হতে নামিয়ে দিয়ে এক হাত ধরে টেনে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়ায় দুজন। নিপা আঙুল উঠিয়ে দূরের গোলগাল চাঁদটাকে দেখাতে থাকে। রায়হান সেই চাঁদের দিকে না তাকিয়ে নিপার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে আবার নিপার দিকেই তাকিয়ে থাকে। নিপা রায়হানের কাঁধে মেরে তাকে আকাশ দেখতে বলে,‌ তার হাত জড়িয়ে ধরে টেনে তার কাছাকাছি করে আকাশের দিকে চোখ রাখে। রায়হানও এবার জোছনা রাতের আকাশের স্নিগ্ধতায় গা ভাসায়। এরকম রাত অনেক সুন্দর সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকে। অনেক নতুন নতুন গল্প গাঁথা যায় এই রাতের তারার মেলা দিয়ে। রায়হান খালি গলায় গান ধরে বসে। নিপা একবার রায়হানের দিকে মিষ্টি মুখে ফিরে তাকায়। আবার দূরের আকাশের দিকে চায়। 

 

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,

আমি হয়ে গেছি তারা 

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,

আমি হয়ে গেছি তারা 

 

এই জীবন ছিল,

নদীর মতো গতিহারা

এই জীবন ছিল,

নদীর মতো গতিহারা, দিশাহারা

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,

আমি হয়ে গেছি তারা

 

আগে ছিল শুধু পরিচয়,

পরে হলো মন বিনিময়

,

,

আগে ছিল শুধু পরিচয়,

পরে হলো মন বিনিময় 

শুভ লগ্নে হয়ে গেল শুভ পরিণয়,

শুভ লগ্নে হয়ে গেল শুভ পরিণয়।

 

আজ যখনই ডাকি,

জানি তুমি দিবে সাড়া

এই জীবন ছিলো,

নদীর মতো গতিহারা, দিশাহারা

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,

আমি হয়ে গেছি তারা

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,

আমি হয়ে গেছি তারা।

 

গানে নতুন করে এলো সুর,

এ যেন আগের চেয়ে সুমধুর

নিয়ে এলে আমায় তুমি আজ বহুদূর,

নিয়ে এলে আমায় তুমি আজ বহুদূর।

 

বয়ে চলেছে যে তাই,

ভালবাসার একধারা।

এই জীবন ছিলো,

নদীর মতো গতিহারা, দিশাহারা।

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,

আমি হয়ে গেছি তারা

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,

আমি হয়ে গেছি তারা

হুম…. আমি হয়ে গেছি তারা,,

 

____

 

নতুন এক সূর্যদয় এনে দিলো নতুন এক দিনের মুগ্ধতা। পাখিরা নীড় ছেড়ে উড়াল দিলো খাবারের খোঁজে। গ্রামের এক নতুন সকাল নতুন এক অনুভূতির আবেশ বয়ে আনে। 

 

সকাল ৮ টা। দিথী তার বাসার আঙিনার পেড়িয়ে বারান্দার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বারান্দায় কিছু মুরগি তার বাচ্চাদের দিকে খাবার খুঁজে ফিরছে। একপাশে রাখা টবের ফুল গুলো পানির ছোঁয়ায় সতেজ হয়েছে। আজ বৃষ্টি নেই। তবে কাল যা হয়েছে তা একদম প্রকৃতিকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। 

দিথী বারান্দার দরজা দিয়ে উপরে উঠতেই তার সাথে দেখা হয় শেফালীর। দিথী বলে,

– মা কই রে। 

– খালাম্মায় তো খালুর ঘরে। 

– নিবিড় স্কুলে গেছে ? 

– হ। একটু আগেই বাইর হইলো। 

– সামিহা, তানিয়া আপু, ওরা কই। 

– আপনার ঘরে বইয়া আছে। আমি একটু আগে নাস্তা দিয়া আইলাম। 

– আচ্ছা ঠিক আছে তুই যা। মা’কে বলিস আজ বাবাকে ডাক্তার দেখতে আসবে। ঘরের অবস্থা যেনো ঠিক ঠাক রাখে। 

– জে আইচ্ছা। 

দিথী শেফালীকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তার ঘরের দিকে। শেফালী দিথীকে একটু বেশি তাড়াহুড়োয় দেখে আর কিছু বলে না। ঠোঁট উল্টিয়ে চলে যেতে থাকে রান্নাঘরের দিকে।

 

   ঘরের ভিতর বিছানায় গোল হয়ে বসে একটা বই পড়ছে তানিয়া, কানিজ, আর সামিহা। দিথী ঘরে প্রবেশ করে। করে দরজা চাপিয়ে দেয়। দিথীর উপস্থিতি লক্ষ্য করে বিছানায় থাকা তিনজনই মুখ তুলে তাকায়। দিথী কিছুটা অস্থির। দিথী এসে তার পড়ার টেবিলের সামনে থাকা চেয়ার টা টেনে বিছানার সামনে বসে। বলে,

– কতদূর কি জানতে পারলে? 

– প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছি। রক্ত আনছো? (তানিয়া)

– হ্যা। এইযে। এখানে রাশেদের টাও আছে। আয়ান হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে সে অসুস্থ। আমাদের সাথে আজকের রাতে নীলগিরি তে যাওয়ার শক্তি, কিংবা মানসিক অবস্থা কোনটাই তার নেই। তাই মা’কে বলে তার রক্তও নিয়ে এসেছি। 

দিথী তার হাত ব্যাগ টার চেইন খুলে দুটো রক্তের সিসি বের করে বিছানায় তানিয়ার সামনে রাখে। চেইন লাগিয়ে ব্যাগ টাকে নিজের কোলে রাখে। তানিয়া বলে,

– কোন আক্রমণ হয়েছিলো নাকি এই কয়েকদিন তোমার উপর ? 

– না। কোন কিছুই হয়নি। ঐ বাড়িতে তো সাদা পাউডার ছিটিয়ে দিছো। ওরা আসলে না কিছু করবে। 

– আমাদের এখানেও কোন কিছু হয়নি। বুঝলাম না ওরা আমাদের কিছু করছেনা কেনো!

– আচ্ছা বাদ দাও। বইয়ে কী লেখা আছে। কীভাবে কী করতে হবে? 

– বইয়ে লেখা আছে আসুভে আজ রাত ঠিক ১২ টায় ঐ মেয়ে মানে সুমুর শরীরে প্রবেশ করবে। আজ কিন্তু আবার অমাবস্যা। অমাবস্যা মানেই কিন্তু সব খারাপ শক্তিদের বলয় বেড়ে যাওয়া। আমাদের কিন্তু খুব সাবধানে থাকতে হবে। 

– তা থাকা যাবে। আসুভেকে ধ্বংস করার জন্য কী কি করতে হবে ? 

– আসুভেকে সুমুর দেহে প্রবেশ করানোর জন্য তান্ত্রিক যোগ্য শুরু করবে। পুজোর আয়োজন করবে। সেই বাড়িটা কিন্ত সব খারাপ আত্মা দারা বেষ্টিত থাকবে। তাই ভিতরে যাওয়াটা একটু কঠিন হবে। রাত যখন ঠিক ১২ টা বাজবে তখন আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে যাবে। আসুভের কাছে ২ মিনিট সময় থাকবে সুমুর দেহে প্রবেশ করার জন্য। এই দুই মিনিটের মধ্যেই আমাদেরকে সুমুকে মেরে টুকরো টুকরো করতে হবে। তারপর তার দেহের রক্তে আংটি ডুবিয়ে সাথে তোমাদের ৪ পুনর্জন্মের রক্ত ঢেলে সেই আংটিটা দিথীকে পড়তে হবে। দিথী মধ্যাঙ্গুলিতে সেটা পড়ার পর পরই আংটি থেকে এক উজ্জ্বল আলো বেড়িয়ে আসবে। আর তখনই আংটিটাকে সেই তান্ত্রিকের দিকে তাক করে ধরতে হবে। আংটির আলো তান্ত্রিককে চিরতরে ধ্বংস করে দিবে আর সাথে সাথে আসুভেও চিরতরে মুছে যাবে ইতিহাসের পাতা থেকে। 

– তান্ত্রিককে কেনো মারতে হবে ? আমাদের তো আসুভেকে মারার কথা। (সামিহা)

– তান্ত্রিকের জীবন রেখার সাথে আসুভের জীবন রেখা জড়িত। যেটা আমরা আগে জানতাম না। এই বইয়ে (আদরি আসুভে বইটা দেখিয়ে) এই বইয়ে আগে থেকেই সবকিছু লেখা ছিলোনা। সময় যত গিয়েছে, লেখা গুলো নিজে থেকেই পাতায় ভেসে উঠেছে। যার ফলে আমরা আগে তান্ত্রিককের জীবন রেখা আর আসুভের জীবন রেখা যে একটাই তা জানতাম না। আগে জানলে তো তান্ত্রিককে মারলেই সব খেলা খতম হয়ে যেতো। 

– তান্ত্রিক তো আসুভেকে বানায়নি। তাইলে তান্ত্রিকের জীবন রেখা আর আসুভের জীবন রেখা এক কী করে হলো ? (কানিজ) 

– তান্ত্রিকের মাধ্যমেই কিন্তু আসুভে এই পৃথিবীতে আবার উন্মুক্ত হতে পেড়েছিলো ঐ বদ্ধ পাথর টা থেকে। পাথরের গাঁয়ে লেখে দেওয়া ছিলো যেই এই পাথর টা ছুবে তার সাথে আসুভের জীবন রেখা মিলিত হয়ে যাবে। আর আসুভেকে জীবন এনে দেওয়ার জন্য সে ততদিন পর্যন্ত জীবিত থাকবে যতদিন না শেষ সময়ে এই বইয়ের মাধ্যমে কেউ সম্পূর্ণ বিষয়টা জেনে যায় এবং তাকে মেরে ফেলে। 

– তারমানে আগে আমাদের সুমুকে মেরে তার রক্তে আংটি ‌ডুবিয়ে তারপর বাকিদের রক্ত মিশিয়ে তান্ত্রিককে হত্যা করতে হবে? (দিথী)

– হ্যা। এরকম টাই করতে হবে। 

– আচ্ছা আমাকে বইটা দাও। 

– কী করবা ? 

– দেও আমাকে, আমি একটু পড়ে দেখবো। 

– আমাদের সবটুকু পড়া শেষ হয়নি তো। 

– আমি বাকিটা পড়ে তোমাদের বলে দিবোনে। বইটা আমাকে দাও। 

তানিয়া বইটা বন্ধ করে তা দিথীর হাতে দিয়ে দেয়। দিথী বইটা নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে চেয়ার টা হাত দিয়ে টেনে তার পড়ার টেবিলের সামনে রাখে। বইটা পড়ার টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে বইটা মনযোগ দিয়ে পড়তে থাকে। তানিয়া, কানিজ, সামিহা দিথী এমন অস্থিরতার কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। তারা আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে যে কীভাবে কী করবে না করবে। 

দিথী দুই হাত দিয়ে কপাল ধরে পড়ায় মনোযোগ দেয়। পুরোনো বইটার কাগজ গুলোও বেশ পুরোনো। রক্ত লাল অক্ষর গুলোকে একদম মস্তিকে খোদাই করে রেখে দেওয়াতে মশগুল হয়ে যায় সে। 

 

____

 

নীলগিরি জঙ্গলের মাঝের সেই বাড়িটা। যেটা আগে তাসনুবার শ্বশুর বাড়ি ছিলো। আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় রোদ উঠোনে এসে পড়েছে। ঘরে তান্ত্রিক আজ রাতের পুজার প্রস্তুত নিচ্ছে। ঘরের কিছুটা সাইডে একটা টিউবওয়েল পাড় আছে। সেখান টায় সুমুকে গোসল করাচ্ছে হনুফা। কলাপাতার পর্দা দিয়ে ঘেড়া সেই টিউবওয়েল পাড়টা। চারপাশের গাছপালা থেকে নানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। 

 

সুমুর চোখে পানি। সে কাঁদছে। তান্ত্রিককের কাছ থেকে আজ সে জানতে পেরেছে যদি আসুভে তার দেহে প্রবেশ করে ফেলে সে আর কখনো স্বাভাবিক মানুষ হতে পারবেনা। এখনকার সব ঘটনা তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে যাবে। তার মস্তিষ্ক চলে যাবে আসুভে নামের এক খারাপ আত্মার দখলে। চিরকাল এভাবেই এই অনন্ত অসীম বিশ্বে সে এক খারাপ আত্মার দেহ হিসেবেই রয়ে যাবে। হনুফা, সুমুর মাথায় পানি ঢেলে তাকে গোসল করাতে থাকে। সুমুর বুকের ভিতর টা খাঁ খাঁ করে উঠছে। সে কী আফাজকে একবার শেষ চোখের দেখা দেখতে পারবেনা! আফাজের মায়ায় সে কেনো জড়ালো। বিচ্ছেদের সুর এতোটা কষ্টদায়ক হয়! তার ভিতর টা যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। প্রথম দেখায় ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। সবটুকুই এক নিমিষে শেষ হয়ে যাবে! আফাজ তার প্রথম ভালোবাসা ছিলো। প্রথম আবেগ ছিলো!

সুমু হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তার মন বলছে এক ছুটে আফাজের কাছে চলে যেতে। এই পৃথিবীর সবকিছু উপেক্ষা করে আফাজের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে চিৎকার করে বলতে ‘ ভালোবাসি, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি ‘ 

 

সুমুর হাউমাউ কান্না ঘর থেকে শুনতে পায় তান্ত্রিক। বেশ অবাক হন তিনি। সুমু কেনো কাঁদছে? তার তো আরো খুশি হবার কথা। সে অবিনশ্বর শক্তি পাবে। মৃত্যুকে হার মানিয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। তাও কেনো কাঁদছে ও? 

তখনই হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করে লায়লা। হাতে খাবারের বাটি। লায়লাকে দেখেই তান্ত্রিক বলে উঠে,

– তুই ? 

– হ আমি। খাওন নিয়া আইছিলাম সুমু আফার লাইগা। 

– সুমু গোসল খানায় আছে। গোসল করছে। 

– আইচ্ছা আমি তাইলে তারে দেইখা আহি। 

– কী দেখতে যাবি তুই ? 

– ভালো মতো গোসল করতাছে কী না। দরকার পড়লে আমি একটু শরীর ঘইসা দিমু। 

– হ্যা দে। আজকের পর থেকে আর খাবার আনতে হবে না তোকে। তুই তোর সোনাদানা আজ রাতের পর পেয়ে যাবি। 

– হাচা কইতাছেন! 

– হমম। যা গিয়ে সুমুকে ভালোভাবে গোসল করিয়ে দে। 

– আইচ্ছা। আমি অহনি যাইতাছি। 

সুমু এক ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। হাতের টিফিন বাটিটাও সাথে করে নিয়ে যায়।  তান্ত্রিক আবার সামনে ফিরে তার জোগাড়,যন্ত কতদূর এগুলো তা পরখ করতে থাকে। 

 

লায়লা বারান্দা থেকে নেমে এগিয়ে যায় সেদিকে। সুমুর কান্নার আওয়াজ তার কানে এসে পৌঁছায়। তবে তাতে সে কোন রিয়েক্ট করে না। কলাপাতা সড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে। সুমুর পাশে গিয়ে বসে। সুমু লায়লাকে দেখে তাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। লায়লা তৎক্ষণাৎ কিছু বলেনা। হনুফার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মুখেও বিষন্নতার ছায়া। আজকের পর থেকে হনুফাও আসুভে আত্মার বসে চলে যাবে। সব স্বাধীনতা চলে যাবে তার। 

লায়লা সুমু্কে তার কোল থেকে উঠায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ আছে কি না। তারপর কিছু একটা বলা শুরু করে। 

 

_____

 

রাতুল মায়াদের রুম। রাতুল ঘরের দরজার সাইডে আয়না ঝুলিয়ে সেখানে দেখে দেখে মাথায় চুল কালো করছে। পিছনে বিছানায় বসে আছে মায়া। বাইরের আবহাওয়া এখন খানিকটা মেঘাচ্ছন্ন। একটু আগে অবশ্য ভালোই রোদ ছিলো। ঘরের পাশে নিমগাছ থাকায় ঘরটা এমনিতেই ঠান্ডা। তারউপর শীতকাল চলতেছে আবার বৃষ্টিও হচ্ছে। ঘরের অবস্থা ডিপ ফ্রিজের মতো হয়ে যাচ্ছে প্রায়। মায়া বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মা মেলে দিয়ে আছে। তার পেট ফুলেছে বইকি। ৬ মাস চলছে। কিছুদিন পরই নতুন অতিথি আসতে চলেছে এই মাষ্টার বাড়িতে। মায়া কাঁথাটা নিজের উপর টেনে নিয়ে রাতুলকে বলে,

– রিয়াদকে সকালে নাস্তা দিছিলা ? 

– হ্যা দিছি তো। খায় তারপর থানায় গেছে। 

– আমার সারাদিন এভাবে বসে থাকতে ভাললাগে না। একটু ঘুরতেও নিয়েও যাও না‌।

– এই অবস্থায় কোথায় ঘুরতে যাবা। আর বাইরেও তো আবহাওয়া তেমন একটা ভালো না। আমাদের কুট্টুস আসুক, তারপর তিনজন মিলে একসাথে ঘুরতে যাবো। 

– হমম। ততদিন আমার এভাবে বসে থাকতে থাকতে পিঠ-কোমর এক হয়ে যাক। 

– হবেনা হবেনা। আমি আছি। মাঝে মাঝে স্কুল মাঠ থেকে ঘুড়িয়ে আনবো তোমায়। এখন তো বৃষ্টি হইছে বলে একটু কাঁদা। বৃষ্টি কমুক। রোদ যেদিন ভালো উঠবে ঐদিন নিয়ে যাবো। 

– তোমার সপ্তাহে সপ্তাহে এতো চুল কালি করতে হয় কেনো। দাড়িও এতো তাড়াতাড়ি বড় হয় যায়। 

– দাড়িটা আজকে সেভ করবো নাকি?

– করলে করো। মুখের দাড়ি তো কালো না, সাদা সাদা হয়ে বের হচ্ছে। দাড়ি রাখলে ঐটাকেও তখন কালি করতে হবে। 

– বয়স কী আর কম হইলো। চুল-টুল সব পেকে যাচ্ছে। 

– তাই বলে এভাবে! সপ্তাহে তোমার একবার করে কালি করতেই হয়। আমার বাবা এমন চুল কালি করতো সপ্তাহে সপ্তাহে। তুমিও কিনা তার জামাই হয়ে এমন সপ্তাহে সপ্তাহে কালির দোকান নিয়ে বসো। 

– তোমার বাবার বয়স কতো। 

– আমি কি সঠিক টা জানি নাকি। হবে ৪৬-৪৭। 

– তাইলে তোমার বাবা আমার থেকে ১ বছরে বড়। 

– মানে ? 

– আমার বয়স ৪৫। 

– হমম। তুমি বললা আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম। 

– সত্যি আমার বয়স ৪৫। (পিছনে ফিরে) এইজন্য তো সপ্তাহে একবার কালি করতে হয়। 

– তাইলে আমার বয়সও ৫০। তোমার থেকে আমি ৫ বছরের বড়ো। হুঁ,,

– আরে আমি মজা করতেছিনা। সত্যি আমার বয়স ৪৫। 

– আমিও মজা করতেছিনা। আমার বয়সও ৫০। 

– তোমার তো হবে ২১ নাইলে ২২। (সামনে আয়নার দিকে ফিরে) আমার আসলেই ৪৫। তুমি চাইলে আমার বার্থ সার্টিফিকেট দেখতে পারো। 

– রাতুল তুমি সিরিয়াস! তোমার ৪৫ বছর কিভাবে হয়। তোমার বয়স তো ৩০-৩২। মজা করিওনা একদম। 

– আমি সিরিয়াসলিই বলতেছি। তোমার সাথে মজা কেনো করতে যাবো। আমার বয়স আসলেই ৪৫। 

– তোমার জন্ম সাল কতো? 

– ১২ই জুলাই ১৯৭৫। 

– রাতুল সত্যি সত্যিই তোমার ৪৫ বছর বয়স ? 

– আরে বাবা হ্যা। সত্যিই ৪৫। 

– তাইলে রিয়াদের বয়স কতো ? ওর তো ২৫-২৬ হওয়ার কথা। 

– হ্যা ওর ২৫। 

– তোমার ৪৫ ওর ২৫। মানে টা কী। দুইজনের বয়সে ২০ বছরের পার্থ্যক্য ? 

– ও আমার নিজের ভাই না। 

কথাটা শোনা মাত্রই যেন মায়া আকাশ থেকে পড়লো। তার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। উৎসুক,উৎদিপ্ত হয়ে সে বলে,

– রিয়াদ তোমার আপন ভাই না ? 

– না। ওকে মা-বাবা এতিম খানা থেকে দত্তক নিয়েছিলো। 

– রাতুল তুমি আজকে কী মুডে আছো বলোতো? একটু আগে বললা তোমার বয়স ৪৫, এখন আরো বলতেছো রিয়াদ তোমার ভাই না। সকাল বেলা উঠে চা বেশি খেয়ে নেশা করে ফেলেছো নাকি।

– সত্যিই রিয়াদ আমার ভাই না। আমি হওয়ার পর থেকে আর মা-বাবার কোন সন্তান হয়নি। কিন্তু তারা খুব করে একটা ছেলে চাইছিলেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে জানায় আমার মায়ের শরীরে এক কঠিন রোগ বাসা বেঁধেছে। আগে কম ছিলো, ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়ার আর সন্তান নিতে পারবেন না তিনি। তাই পড়ে তখন বাবা-মা গিয়ে রিয়াদকে এতিম খানা থেকে দত্তক নিয়ে আসে। তখন রিয়াদের বয়স ৩ কী ৪ হবে। তাই ওর ছোট বেলার কথা মনে নেই। বাবা চেয়েছিলো আমাকে শিক্ষক বানাবেন আর আমার ছোট ভাইকে পুলিশ বা আর্মি। পরে মায়ের অসুখ টার জন্য আর সন্তান না নিতে পেরে রিয়াদকে নিয়ে আসেন। আর ওকে ওভাবেই গড়ে তুলেন যেন তাকে পুলিশ করতে পারেন। আমার বাবা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার থাকা অবস্থাতেই আমি ২২ বছর বয়সে টিচার হিসেবে স্কুলে যোগ দেই। আর তখন থেকে এখন পর্যন্ত এই স্কুলেই আছি। চাকরির বয়স আর কতো হলো (হাতের আঙ্গুলে গুনে গুনে) ২৩ বছর। ২৩ বছর হলো আমার এই চাকরির। 

– রিয়াদ জানেনা এই কথা গুলো ? 

– না। তুমি ওকে বলিও না আবার। খুব ছোট বেলায় ওকে নিয়ে আসছিলো তাই ওর এই কথা মনে নাই। ও জানে যে আমিই ওর আপন ভাই। তুমি বলতে যাইয়ো না এইসব।

– তোমার বয়সের রহস্য কি ? তুমি তো তাইলে আমার বাবার বয়সীই হলে বলা যায়। তুমি বাবার সাথে বিয়ে করলে আজ আমার মতো একটা মেয়ে থাকতো তোমার। 

– ছেলেও থাকতে পারতো। কিন্তু আগে এই বিয়ে সাদিতে আমার মন বসতো না। ভাবতাম বিয়ে করে কী হবে। এমনিই জীবন কাটায় দিবো। 

– তাইলে আমাকে কেনো বিয়ে করলা ? 

– আরে রাগ করতেছো কেনো। আগে কী আর ভালোবাসা বুঝতাম! বাবা-মা ছোট থেকে ঘর বন্দি করে মানুষ করেছে। মেয়ে মানুষ দেখলেই আগে ভয় পাইতাম। আর বিয়ে মানুষ কেনো করে তা আমি এই স্কুলে চাকরি নেওয়ার ৫ বছর পর জানতে পারছি। বাবার স্কুলে কোন মেয়ে শিক্ষক ছিলো না। স্কুল-বাড়ি ছাড়া আর কোথাও আমার পায়ের ধুলা পড়তো না। বন্ধু বান্ধব ও ছিলোনা আমার। বলতে পারো আমার বিকাশ হইছে দেরি করে। এইজন্য বিয়েটা করতে এতো দেরি হয়ে গেছে। 

– তাইলে তোমাকে দেখতে এতো কম বয়সী লাগে কেনো ? আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যে তোমার বয়স ৪৫। লাইক সিরিয়াসলি! 

– শিউলি চাচিকে দেখোনা। তারও তো বয়স হইছে। কিন্তু তাকে আর তার মেয়ে নিপাকে পাশপাশি দাঁড়ালে যে কেউ বোন ভাববে। এমনকি ঐযে শাহারিয়া আছেনা। ওকে আর ওর এই মাকে পাশপাশি দাড়ায় দিলে তুমি বলবা শাহারিয়া বড় আর শিউলি চাচি তার ছোট বোন। অনেকেরই শরীর বয়সের সাথে সাথে তাল মিলায় না। আবার অনেক কে দেখবা বয়স ২০ কিন্তু দেখতে ৪ বাচ্চার বাপের মতো লাগে। আমার খালি এই দাড়ি, চুল গুলাই বয়সের সাথে গেছে। তাছাড়া বাকি সব এখনো জোয়ানই আছে। সাথে ঐটাও। হে হে হে। 

– চুপ। আউল-ফাউল কথা খালি‌‌।

– আচ্ছা বাদ দেও এসব। গোসল করবা নাকি আজকে? বৃষ্টি তো নাই। (দরজার দিকে উঁকি দিয়ে) অবশ্য আকাশ একটু মেঘলা।

– টিউবওয়েল এর পানি অনেক ঠান্ডা। যেদিন রোদ উঠবে ঐদিন গোসল করবো। 

– আমি পানি গরম দিতেছি তাইলে। কালকেও গোসল করোনাই‌। এখন তোমাকে সর্বোচ্চ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। দুই দুই দিন গোসল না করে থাকা যাবেনা। শোনো নাই ডাক্তার আপা কী বলছিলো ? গরম পানি দিয়ে হইলেও দুইটা ডুব দেওয়ায় দিতে‌।

– এখন তুমি আবার গরম পানি করতে যাবা! 

– নিজের বউয়ের জন্যই তো করতে যাচ্ছি। এতে আরো সওয়াব বাড়বে আমার। 

– হমম। বউ না মেয়ে। সময়মতো বিয়ে করলে তো আমার বয়সী মেয়ে থাকতো একটা। 

– যা গেছে বাদ দেও না। আমি যদি না বলতাম তাইলে কি তুমি জানতে পারতা আমার বয়স ৪৫ ? বলছি, এখন এইটা নিয়ে খোটাখুটি শুরু। 

– আচ্ছা আর খোটা দিবো না। তোমার চুল কালি শেষ হইলে তারপর আমাকে নিয়ে যাইয়ো। রান্না-বান্নাও আজ বাকি। 

– আমি সুপার ম্যানের মতো সব সেকেন্ডের মধ্যে করে ফেলবো। তুমি খালি পায়ের উপর পা দিয়ে খাবা আর ঘুমাবা। 

– এরকম বর কয় জনের কপালে জুটে! 

– কিরকম।

– এইযে এতো কেয়ারিং, এতো দেখভাল করে। আমার বান্ধবী গুলার বর তো ওদের কে দিয়ে মাঠে পর্যন্ত সেচ দেওয়ায়। আর এদিকে আমি, বসে থাকে থাকে বিছানা গরম করতেছি। 

– সব ছেলেই কী এক হয় নাকি। কিছু কিছু আলাদাও হয়। 

– আর আমি সেই আলাদা স্পেশাল একজনকেই পাইলাম।

– বটে বটে। স্পেশালই পাইছো! হা হা হা। 

রাতুলের সাথে সাথে মায়াও হাঁসতে থাকে। দুইজনের মাঝে মনের মিলটা বেশ দারুন ভাবেই হয়েছে বলা যায়। বাইরের আকাশের মেঘ প্রায় কেটে গিয়েছে। রোদ পড়তে শুরু করেছে উঠোনে। আঙিনার রশিতে মেলে দেওয়া কিছু কাপড়। নিচে ৩-৪ টে হাঁস দল বেঁধে প্যাক-প্যাক করতে করতে চলে যায় পুকুরে যাওয়ার জন্য। 

 

____

 

কাঠের বাড়িটার বাইরে কিছু ছোট বাচ্চা খেলা করছে। এদিকটা সমুদ্র থেকে দূরে হলেও বালূ দিয়ে ভর্তি। ছোট বাচ্চারা ফুটবল খেলছিলো। রোদ উঠেছে বেশ। সূর্যের তেজে গাঁয়ের ঘাম ছুটে যাওয়ার উপক্রম।

 

নিপা কাপড় গুছাচ্ছে। রায়হান ঘরে প্রবেশ করলো। এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো। নিপার কাপড় গোছানো দেখতে থাকলো। নিপা ভাঁজ করা কাপড় ব্যাগে রাখতে রাখতে বলে,

– এখান থেকে কী আবার হোটেলে যাবো। 

– হ্যা। ওখান থেকে বাকি ব্যাগ নিয়ে ফিরে যাবো বাসা। দুপুরের বাস। 

– এই শার্টটায় তো কাল ময়লা ভরাইছো। এইটা কী করবো। 

– আমাকে দাও এই বাসার লোকদের দিয়ে দেই। ওরা পড়বে। 

– কত দিয়ে ভাড়া নিছো এইরুম। 

– এইটার ভাড়া বেশিই পড়ছে বলা যায়। তবে হোটেলের থেকে বেশি না। কাঠের বাসায় সমুদ্র সৈকতের পাড়ে থাকার মজা হোটেলের ইট পাথরের দেয়ালের মাঝে পাবানা। তাই এই ফ্যামিলি বাসা ভাড়া নিছি। (একটু থেমে) ওরা খাইতে ডাকতেছে। চলো গিয়ে খেয়ে নেই। তারপর বেড়োবো। 

– বাসায় ফোন দিয়ে জানাইছো? 

– আল্লাহ,,! (বলেই মাথায় হাত দিয়ে দেয় রায়হান) 

– কী হইলো। 

– আমার ফোন। 

– হ্যা ফোন। কি হইছে ঐটার।

– আমার ফোনটা আমি কোথায় ফেলে আসছি।

– হোটেলে রাখে আসছো নাকি আবার ? 

– না না। আমি ঐটা নিয়ে পাহাড়ের দিকে গেছিলাম কিন্তু,,,,,,,

– কিন্ত কি ? 

– ঐটা মনে হয়ে পাহাড়েই আছে। 

– কী বলো। তাঁবু, ব্যাগ সব তো আমাদের কাছে। (ব্যাগ গুলো দেখিয়ে) এইযে। ফোনটাও এগুলোর ভিতরেই আছে হয়তো।

– না না। ফোনটা আমার শার্টের পকেটে ছিলো। (একটু থেমে) ও ও ও। এইবার বুঝছি। 

– কী।

– আমি যখন ডিগবাজি দিয়ে এগিয়ে এসে গুলি ছুড়েছিলাম তখন হয়তো ঐটা আমার পকেট থেকে ঐ বন গুলোর মাঝের সড়ে গেছে।

– কী বলো কী! ফোন ফেলে আসছো ওখানে ? তাড়াতাড়ি চলো। ফোনটা কেউ নিয়ে যাবে নাকি আবার। তুমি তো বললা কেউ ঐ যায়গাটা চিনেনা। হয়তো কেউ নিয়ে যায় নি। চলো।

– থাক। বাদ দাও। নতুন ফোন নিয়ে নিবোনে। 

– নতুন ফোন নিবা মানে। এইটা কতো দামী ফোন ছিলো। আর সেটা না নিয়েই চলে যাবা! চলো যায় নিয়ে আসি। (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) বাসে উঠতে এখনো ৩ ঘন্টা সময় আছে। 

– আরে কিছু হবেনা। আরেকটা কিনে নিবো। এতো জার্নি করতে ভালো লাগে না। 

– বাসায় বাবাদের ফোন দিয়ে জানিয়ে দেও। আমার ফোন টা নাও‌।

– তোমার এই নতুন ফোনে তো আমার নাম্বার আর তোমার বাসার নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার নাই। 

– তোমার বাবার নাম্বার তোমার মুখস্থ নাই? 

– না মানে, মুখস্থ করা হয়নি আরকি।

– মানুষ না কী তুমি! আমার বাড়ির সবার নাম্বার আমার মুখস্থ। আর তুমি তোমার বাবার নাম্বার টাও মুখস্থ রাখোনাই।

– বাদ দেও। চলো খেয়ে নেই। ওরা আর কতখন ধরে খাবার নিয়ে বসে থাকবে। চলো। 

– কী রান্না করছে ? 

– সামুদ্রিক মাছ আর ওদের একটা আলাদা নিজস্ব একটা ডিশ। ঐটার নাম আমি জানিনা। তবে দেখলাম বাশের সাদা নরম অংশ দিয়ে বানানো।

– চলো, দেখি কেমন। 

– ব্যাগের চেইন লাগায় যাও। বাসায় ছোট্ট বাচ্চা আছে। এখানে আসে টানাটানি করবে। 

– তোমার মতো দুষ্ট নাকি ওরা। 

– এইযে খালি দুষ্ট, দুষ্ট বলো বলেই আমি দুষ্টামি করি।

– তাইলে এরপর থেকে ভালো বলবো। দেখি কতটা ভালো হইতে পারো। 

– ঠিক আছে দেখিও। আসো এখন। 

নিপা ব্যাগের চেইন লাগিয়ে সেটার হাতল ধরে বিছানা থেকে নিচে নামিয়ে রাখে। রায়হান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিপা ব্যাগ রেখে আসে। রায়হান তার কোমরে একহাত নিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। নিপা হাত ছাড়িয়ে ঠাঁস করে রায়হান পিঠিতে মারে। রায়হান পিঠি ঘষতে ঘষতে নিপার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। 

 

_____

 

দুপুর বেলা। মেম্বার বাড়ির আঙিনায় বসে আছেন শিউলি বেগম। একটা টুলে বসেছেন তিনি আর তার পিছনে একটা চেয়ার নিয়ে বসেছে ফুলমতি। ফুলমতি শিউলি বেগমের মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে। আকাশের রোদের ঝিলিক ভালো রকমই পড়েছে। শিউলি বেগম গোসল করে এসে প্রায় প্রতিদিন এভাবে তেল মাখিয়ে নেন চুলে। ফুলমতিও তেল দিয়ে দেয় প্রতিদিন। বাড়িতে এখন শুধু শাহারিয়া আছে। সে ঘরে কী যে করছে কে জানে‌। মতিন মেম্বার গেছেন গন্জে। লায়লাও বাড়ি নেই। দিথীও গেছে তার বাবার বাসায়। বেশ ফাঁকা আজ বাড়িটা। 

 

গেইট দিয়ে প্রবেশ করলো একটা মেয়ে। বয়স ২০ কী ২১। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা। পড়নে লালচে খয়রি রঙয়ের একটা থ্রীপিস। গাঁয়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা। মুখের আকৃতি গোলাগাল। মেয়েটা হেঁটে এসে আঙিনায় দাঁড়ায়। শিউলি বেগম সেদিকে খেয়াল করেন নি। তিনি মাথা নিচু করে আধখোলা চোখে ফুলমতিকে বলছিলেন,

– এইপাশটায় একটু ভালা কইরা তেল দে। 

মেয়েটা এক হালকা মৃদু গলায় বলে উঠে,

– আসসালামুয়ালাইকুম। 

মেয়েটার গলার আওয়াজ শুনে ফুলমতি আর শিউলি বেগম সেদিক মুখ তুলে তাকায়। মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখে তারা। মেয়েটাকে দেখে এই গ্রামের কেউ বল তো মনে হচ্ছে না। শিউলি বেগম বলেন,

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। 

– আচ্ছা এটাকি মেম্বার বাড়ি ? 

– হ। এইডা মেম্বার বাড়ি। আমি মেম্বারের বউ। তুমি কেডা ? কাউরে খুজতাছো ? 

– আ, আমার নাম শিমলা আক্তার মোনালিকা। 

– শিমলা মইচ! 

– না শিমলা আমার নাম। 

– কার মাইয়া তুমি ? তোমার আব্বার নাম কী ? এই গ্রামে তোমারে আগে দেখছি বইলা তো মনে হয় না। 

– জি আমি এই গ্রামে নতুন এসেছি। আমার বাবাকে আপনি চিনবেন না। উনি এই গ্রামের না। 

– ওহহ। তুমি কী আমার পোলার লগে দেহা করতে আইছো ? 

– জি আমি কারো সাথে দেখা করতে আসিনি। (একটু ইতস্তত গলায়) আমি প্রাইভেট পড়াতে চাই। এই বাড়িতে কী এমন কোন ছোট বাচ্চা বা ছেলে আছে ? 

– আমাগো বাড়িত তো কোন গুড়াগাড়া নাই। অবশ্য পোলা মাইয়া বিয়া দিছি। ওগো গুড়াগাড়া হইলে তহন পড়াইতে আইয়ো। 

– আচ্ছা তাইলে কাজের লোক, কাজের লোক লাগবে কী! আমি ঘর মোছা, কাপড় ধোঁয়া, রান্না সব পাড়ি। 

– না না। তাও লাগবো না। আমার দুই মাইয়া ফুলমতি আর লায়লা আছে। 

– আচ্ছা তাইলে বাগানের মালি! আপনাদের পিছনের বাগানের মালি হিসেবে আমাকে রাখতে পারেন। আমি বাগানের দেখাশোনা ভালো পাড়ি। 

– বাগান আমি নিজেই দেইখা রাখি। (একটু থেমে অবাক কন্ঠে) তুমি কাম খুজতাছো ক্যা। তোমারে দেইখা তো ভালো ঘরের শিক্ষিত মাইয়া মনে হইতাছে। 

– জি মানে, আমার কাজের দরকার ছিলো। যদি আমাকে কোন কাজ দিতেন, খুবই উপকৃত হতাম। 

ফুলমতি তা শুনেই শিউলি বেগমের কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে,

– চাচি, অপরিচিত কাউরে রাইখেন না। এমনিতেই গ্রামের পরিস্থিতি ভালা না। আপনি কন তারে ইসহাক চাচা নাইলে আরো কারো বাড়ি গিয়া কাম লইতে।

শিউলি বেগম ফুলমতি কথা গুলো শুনে সোজা হয়ে বসে মেয়েটাকে বলতে থাকে,

– তোমার নাম ডা জানি কী কইলা! 

– শিমলা আক্তার মোনালিকা। 

– ওহ, মোনালিকা। তুমি এক কাম করো। দক্ষিণ পাড়া চইলা যাও। একটা বড় আম বাগান পাইবা সেইহানে। আম বাগানের পাশে এক বড় বাড়ি আছে। ঐহানে গিয়া কও। ওরা তোমারে কাম দিতে পারবো। 

– জি আপনাদের এখানে কোন কাজ পাওয়া যাবে না ?

– না আমাগো বাড়িত এমনিই অনেক লোক আছে। এহন আপাতত কোন কামের লোকই লাগবো না। 

– ওহ,, আচ্ছা ঠিক আছে। (বলেই মেয়েটা চলে যেতে হবে থাকে। শিউলি বেগম হাঁক দিয়ে বলে উঠেন,

– যদি পথ ভুইলা যাও তাইলে রাস্তার যে কাউরে জিগায়া নিও তে ইসহাক চাচার বাড়ি কোনডা। ওরা দেহাইয়া দিবো। 

– জি আচ্ছা। ঠিক আছে। 

মেয়েটা মুখ গোমড়া করে চলে যেতে থাকে। যাওয়ার সময় এক ছোট্ট নজরে পুরো বাড়িটাকে আবারো ভালোভাবে পরখ করে নেয়। চলে যায় তারপর।

শিউলি বেগম সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে ফুলমতিকে বলেন,

– এতো সুন্দর মাইয়া কাম খুজতে আইছিলো ক্যান! 

– আমিও তো বুঝতাছিনা। আর গ্রামে দেখছেন না একের পর এক অঘটন ঘটতাছে। এমন অপরিচিত কাউরে কাম দেওয়া ঠিক না। 

– হ। আইচ্ছা বাদ দে। তুই এহন গোসলে যা। তোর চাচায় খাইতে আইবো একটু পর। আমি এহানে বইয়া আরেকটু রোদ তাপি। দুইদিন এই মরার বৃষ্টি ডার লাইগা একটু রোদও তাপতে পারি নাই। 

– আইচ্ছা চাচি। আমি গেলাম তাইলে। তেলের বোতল ডা নিয়া যামু!

– হ নিয়া যা। আর শুন, তোর শাহারিয়া ভাই রে কইস তো গোসল দিবো নাকি। দিলে তাড়াতাড়ি গোসল কইরা উঠতে কবি। 

– আইচ্ছা চাচি ঠিক আছে। 

ফুলমতি চেয়ার থেকেই উঠে তেলের বোতল হাতে চলে যেতে থাকে। শিউলি বেগম টুল থেকে উঠে চেয়ারে বসেন। পা উঠিয়ে টুলে রাখেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে পা নাচাতে থাকেন। গুন গুন করে গান ধরেন,,

‘ খাইরোন লো,, তোর লম্বা মাথার কেশ,

 চিরোল দাঁতে হাসি দিয়া পাগল করলি দেশ 

 খাইরোন লো,,,! হা হা হা!! আমার কোকিল কন্ঠি গান শুইনা না আবার আমার ময়না পাখিডা পুকুরে ঝাপায়া পড়ে! হা হা হা!! ‘

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৬৮

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

পড়ন্ত বিকেল। আসরের আযান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আকাশ কিছুটা পরিষ্কার। সূর্যের আলো তেমন একটা নেই। খাঁন বাড়ির সামনের রাস্তা। একটা সাইকেল চলে গেলো বেল বাজাতে বাজাতে। রিয়াদ বাইক নিয়ে এসে থামলো খাঁন বাড়ির বড় গেইটের সামনে। বাইকটাকে সাইডে স্ট্যান্ড করে বাইক থেকে নামলো। শরীরে পুলিশি পোশাক। বড় গেইটের সাইডে ছোট একটা গেইট আছে। যেটা দিয়ে বাড়ির লোকেরা আসা-যাওয়া করে। রিয়াদ বাইকের চাবিটা হাতে নিয়ে চলে যায় সেদিকে। 

গেইটে শব্দ করতেই গেইট খুলে দেয় দারোয়ান রহিম চাচা। রিয়াদ ভিতরে প্রবেশ করে। চারপাশ দেখতে থাকে। এই গেইট দিয়ে প্রবেশের পর কিছুটা হেঁটে ফাঁকা যায়গাটা পেড়িয়ে অন্দরমহলে যেতে হয়। রিয়াদ ভিতরে আসার পর পরই দাড়োয়ান দরজা লাগিয়ে দেয়। রিয়াদ পিছনে ফিরেই দাড়োয়ান রহিম চাচাকে দেখে। রহিম চাচা দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে তার চেয়ারে বসেছে। রিয়াদ এগিয়ে যায়। গিয়ে রহিম চাচার সামনে দাঁড়ায়। বলে,

– বাড়িতে এখন কে কে আছে ? 

– একটু আগেই স্যার আর সোনালী আফায় আইছে। লগে রাফসান ভাইও আছিলো। 

– স্যার টা কে ? নজরুল চাচা ? 

– হ। হেরা আইছে। শাহেদ স্যারে আহেনাই। হেয় ছাড়া বাকি সবাই বাইত্তে আছে। 

– সে কোথায়? 

– মনে তো হয় দিনাজপুরেই আছে। হেয় রাইতে বাড়ি আহে। 

– মানে প্রতিদিনই রাতে বাড়ি ফিরে ? 

– হ। রাইতে আহে প্রতিদিন। 

– তার ছেলে, সাদিক। ও কী বাসায় না বাইরে ? 

– সাদিক ভাইয়ায় বাড়িতেই আছে। 

– এর পর থেকে কে কোন সময় আসা যাওয়া করে এটার একটা লিস্ট আমাকে দিয়েন। ঠিক আছে ? 

– জে আইচ্ছা।

রিয়াদ ফিরে চলে যেতে থাকে বাড়ির অন্দরমহলের গেইটের দিকে। রহিম চাচা আবার বসে পড়েন তার চেয়ার টায়। রিয়াদ কী জানি মনে করে থেমে যায়। অবাক হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়‌। তৎক্ষণাৎ এগিয়ে আসে আবার রহিম চাচার কাছে। রহিম চাচা রিয়াদকে দেখে আবার দাঁড়িয়ে যায়। রিয়াদ হন্তদন্ত হয়ে বলে,

– আচ্ছা যেইদিন খুন গুলা হইছিলো ঐদিন আপনি এখানে ছিলেন ? 

– হ। আমারে তো সবসময় এহানে থাকতে হয়। রাইতের বেলাও এহানে বইসা বইসা ঝিমাই। 

– সেদিন কী অপরিচিত কেউ বাড়িতে আসছিলো ? মানে এমন কেউ যাকে আপনি চিনেননা, বা এই বাড়িতে আগে আসেনি এমন কেউ ? 

– না। ঐদিন তো তেমন কেউরে আইতে দেহিনাই! 

– আচ্ছা ঐদিন দুপুর বেলা, এই ধরেন ১২ টা থেকে ২ টার মধ্যে এই বাড়িতে কে কে এসেছিলো বা কে কে বাহিরে গেছিলো সেটা মনে আছে আপনার ? একটু মনে করার চেষ্টা করেন না কে কে ঐদিন ১২ টা থেকে ২ টার মধ্যে আসা যাওয়া করছিলো? 

– নতুন কেউ তো আওয়া যাওমা করে নাই। তয় প্রতিদিনের লাহান ম্যাডাম বাড়ি আইছিলো ঐসময়। 

– কোন ম্যাডাম ? 

– সুমনা ম্যাডামে। প্রতিদিন হেয় ঐসময় এতিম খানা থেইকা বাড়ি আহে। তয়,,,

– তবে, তবে কী ? 

– তয় ম্যাডামরে ঐদিন একটু আলাদা আলাদা লাগতাছিলো।

– আলাদা বলতে ? 

– ম্যাডাম বাইরে গেলে সবসময় বোরখা পিন্ধা যায়। হেইদিনও গেছিলো, তয় বাড়ি ফিরার সময় তার পায়ে লম্বা লম্বা জুতা দেখছিলাম। আমার যতদূর মনে ফরে আফায় লম্বা জুতা পড়তো না। 

– আপনি তার চেহারা দেখেননি ? 

– চেহারা কেমনে দেখমু কন। ম্যাডামে তো মুহে কালো কাপড় দিতো বোরখার লগে। চেহারা, হাত কিছুই দেহা যাইতো না। 

– লম্বা জুতা মানে হিল জুতা ? হিল জুতার কথা বলছেন আপনি ? 

– হ। ঐ জুতা ডিরে মনে হয় হিল জুতাই কয়। 

– এই তাইলে খুনি ছিলো! আপনি কাউকে না দেখে এমনি এমনিই ঢুকতে দিয়ে দিলেন ? 

– আমি কী করুম কন। ঐসময় তো ম্যাডামের আওয়ার সময় ছিলো। আমি তো ম্যাডাম ভাইবা তারে দরজা খুইলা দিছি। 

– উফফ,, আপনাকে যে এখন আমার কী করতে মন চাচ্ছে না! 

– আমার কী দোষ। আমি তো আমার কাম ডাই করছি খালি। আমি কী আগে দেখছি নাকি যে ম্যাডামের পায়ের লম্বা জুতা। আমি তো হেয় ভিতরে আওয়ার পর দেখছি।

– হইছে থামেন। আর কথা বলে আমার মাথাডা খাইয়েন না। এরপর থেকে ম্যাডাম হোক আর যেই হোক। বোরখা পড়া যেই ঢুকতে চাইবে তার চেহারা দেখে তবে ভিতরে ঢুকতে দিবেন। বুঝেছেন? 

– জে আইচ্ছা। এরপরের থে চেহারা দেইখা ভিতরে ঢুহামু।

রিয়াদ চলে যেতে ধরে। দারোয়ানের কথা গুলা যেনো তার মাথায় রাগ চড়িয়ে দিলো। বোরখা পড়ে আসছে মানেই কী সবসময় একই মানুষ হবে নাকি। অন্য লোকও তো হইতে পারে। রিয়াদ হেঁটে হেঁটে অন্দরমহলের দরজার দিকে যেতে থাকে।

 বাড়ির বাগানের পার্শ্বে যাওয়ার দিকের দেওয়াল। আড়াল হতে দুটো চোখ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে। রিয়াদ অন্দরমহলে ঢুকে যাওয়ার পর পরই সেই দুই চোখ আবার দেয়ালের আড়াল হতে সড়ে যায়। 

 

রিয়াদ ভিতরে আসে। অন্দর মহলের উপরের ঝাড়বাতিটা যেনো এক টুকরো অতীতকে সাক্ষী করে রয়ে গেছে। অন্দরমহলে কেউ নেই। রিয়াদ হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে মাঝখান টায় দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে। দেয়ালে ঝুলতে থাকা রাজ চিত্রকর্ম গুলো বাড়িটাকে আরো উজ্জীবিত করে তুলেছে। সোফা গুলো সাজানো। সোফার বিপরীতে থাকা ডায়নিং টেবিল টাও পরিপাটি করে সাজানো। রিয়াদের কানে শব্দ আসে রান্না ঘরের দিক থেকে। তৎক্ষণাৎ সে ফিরে তাকায় সেদিকে। এগিয়ে যায়। রান্নাঘরের সামনে আসতেই দেখে এই বাড়ির কাজের মেয়ে আঁখি থালাবাসন ধুচ্ছে। রিয়াদ রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– এই বাড়ির বাকি সবাই কোথায় ? 

আঁখি রিয়াদের উপস্থিতি টের পায়নি। তাই হঠাৎ কথায় সে যেন চমকে উঠে। ফিরে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে তার নিজের বুকে থু থু দিতে থাকে। রিয়াদ বলে,

– এতো ভয় পাওয়ার কী আছে। তোমাকে তো ধরে নিয়ে যাচ্ছি না। বাড়ির সবাই কোথায় ? (চারপাশে তাকিয়ে) বাড়িটা এমন লাগছে যেনো কেউই নেই। গম্ভীর, গোমট হয়ে আছে। 

– খালাম্মায় উপরের তলায় আছে। ঘুমাইতাছে। 

– আর নজরুল চাচা ? উনি কোথায়? 

– হেয় তো বাড়ি আহেনাই। 

– বাড়ি আসেনাই মানে ? আমি তো একটু আগেই,,,,,,( কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় রিয়াদ। বেশ অবাক হয় সে।) 

– খালু বাড়ি আহেনাই। রাফসান ভাইজান, সোনালী আফামণি কেউ বাড়িত নাই। শাহেদ খালুও রাতে আইবো। সাথী খালা আর সাদিক ভাইজান ঘুমাইতাছে ঘরে। ডাক দিমু তাগোরে ? 

– না থাক। ডাক দেওয়া লাগবেনা। (বিরবির করে) এই তিনজন তো বলে বাড়ি ফিরলো, তাইলে এই মেয়ে কেনো বলতেছে যে বাড়িতে আসে নাই! 

– কিছু কইলেন! 

– না, তেমন কিছুনা। আচ্ছা তোমার কী কাউকে সন্দেহ হয় ? 

– কীয়ের সন্দেহ ? 

– এইযে খুন গুলো যে হলো। এই বিষয়ে কাকে সন্দেহ হয় তোমার। 

– বাড়ির হগল মানুষই ভালা। হেরা কেন মারতে যাইবো আলিশা আফারে। সবাই উল্টা অনেক আদর করতো তারে। 

– তারমানে বলছো যে খুনি বাইরের কেউ ? 

– এতো নিষ্ঠুর কইরা খুন আমাগো বাড়ির কেউ ক্যান করতে যাইবো! 

– স্বার্থ থাকলে করতেও পারে!

– আমি ঐসব জানিনা। তয় আমার ধারে এই বাড়ির কাউরে সন্দেহ হয়না। আর গেরামের অবস্থা এমনিতেই ভালা না। এই রকম খুন খারাবি আগেও কম হয় নাই। 

রিয়াদ আর কিছু বলে না। বাড়ির সবার মেজাজই দেখি আজ একটু চড়ে আছে। সবাই যেন কোন কিছু নিয়ে বিরক্ত। রিয়াদ চলে যেতে থাকে। যাওয়ার সময় চারপাশে নজর দিয়ে অন্দরমহলকে একবার দেখে নেয়। মনে মনে বলে

‘ কিছু তো আছেই, যেটা আমার অগোচরে হচ্ছে। সেটা কী? বের করতে হবে রিয়াদ, বের করতে হবে ‘

 

_____

 

আফাজ জানালার পাশ থেকে মুখ ঘুড়িয়ে সোজা উপরের সিলিংয়ের দিকে তাকায়। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। এই রুমটায় সে বড়ই নিঃসঙ্গ, সাথে বুক ভরা অপূরনীয় ব্যাথা, যন্ত্রনা। সবকিছু কেমন যেন বিষাদ হয়ে তার কাছে ঠেকছে। জগতে যেন সে একদম নিঃসঙ্গ, একাকি হয়ে গেছে। মুখ ফিরিয়ে তাকায় দরজার দিকে। না, আজ সে মেয়েটা আসেনি। অন্যান্য দিন তো দরজার পর্দার আড়াল হতে বেশ উঁকি দিয়ে দেখতো তাকে। কিন্তু আজ সেই দরজার আড়ালে কারও পায়ের ছোঁয়া পড়েনি। আফাজ হয়তো এই জন্যই নিঃসঙ্গতা অনুভব করছে। তবে মেয়েটার প্রতি তার কোন টান নেই। উল্টো আরো সন্দেহ হয়। আলিশার মৃত্যুর সাথে মেয়েটা কোনভাবে জড়িয়ে নেই তো?? রইতেও পারে। এই জগতে মুখোশ চেনা যে বড়ই দায়। আফাজ আর ভাবতে চায় না। সে একটু বিশ্রাম নিতে চায়। আলিশার স্মৃতিচারণ করতে চায় স্বপ্নের রাজ্যে গিয়ে। হয়তো দেখা মিলতেও পারে কোন এক রঙিন সূর্যাস্তের! নয়তো আবার আঁধার কালোর বিচ্ছেদ যন্ত্রনা!

 

_____

 

দিথী ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে থাকা সবাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘড়িতে সময় রাত ৯ টা। আশপাশের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বেড়েছে। আকাশ কিছুটা মেঘলা। দিথীকে ঘরে ঢুকতে দেখেই তানিয়া, সামিহা, তার দিকে এক নজর দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিতে যায় তখনই আবার অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকায়। আপাদমস্তক দিথীকে দেখে। দিথীকে আজ সম্পূর্ণ আলাদা কেউ একজন মনে হচ্ছিলো, জিন্স, টি শার্ট আর মাথার বিনুনি করা চুল। যেন কোন বিদেশী এক মেয়ের সাজে সেজেছে সে। তানিয়া তো অবাক কন্ঠে বলেই ফেলে,

– দিথী, এভাবে যাবে ? 

– হমম। তোমাদের কতদূর কী এগোলো ? 

– আমাদের কাজ প্রায় শেষ। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। 

– সামিহা, ওড়নাটা দে তো। 

সামিহা অবাক চোখ নিয়েই নিজের পিছন থেকে দিথীর রেখে যাওয়া ওড়নাটা তাকে দেয়। দিথী সেটা হাতে নিয়ে তার বুকের উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে কোমর, পিঠ পেচিয়ে এনে আবার কোমরে গুঁজে দেয়। অনেকটা গৃহিণীরা যেমন ভাবে ওড়না পেঁচিয়ে রান্না করতে যায় তেমন। সামিহা এখনো অবাক হয়েই তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার কাছে যেন অচেনা,অজানা একজন লাগছিলো দিথীকে। দিথী একটা চেয়ার টেনে বসে। তানিয়া বিছানায় থাকা রক্তের শিশি গুলো তার হাতে দেয়। দিথী তা নিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখে। তানিয়া সামিহাকে একটা ছুরি দেয়। বলে,

– এটা মন্ত্র পড়া ছুরি। কোন কালো ধোঁয়া তোমাকে আক্রমণ করতে আসলে তুমি এই ছুড়ি দিয়ে সেই কালো ধোঁয়াকে আঘাত করবে। এমন ভেবে আঘাত করবে যেনো সেটা একটা মানুষ। আর দিথী, (একটা ছুরি এগিয়ে দিয়ে) এটা তোমার। তোমার টা বেশি ধারালো। এটা দিয়েই তুমি সুমুর উপর আক্রমণ করবে। আমাদের প্ল্যান হচ্ছে আমি আর সামিহা বাকি আত্মাদের আটকাবো আর তুমি গিয়ে সুমুকে মারবে। তুমি কুংফু, কারাতে জানো। তুমি তাদের একলাই সামলাতে পারবে। আর হ্যা, ১২ টা বাজা মাত্রই তুমি আংটিটা রক্তে চুবিয়ে তান্ত্রিককের দিকে তুলে ধরবে। বুঝতে পেরেছো ? 

– ঠিক আছে। 

– বইয়ের শেষাংশে কী কী লেখা ছিলো ? সারা বিকাল ধরে তো তুমি একলাই পড়লে। আমাদেরকে তো পড়তেই দিলেনা।

– তেমন কিছু ছিলো না। মারার কথাই বলা ছিলো। আর মারার পর রক্ত মাখা আংটিটাকে আগুনে ফেলে দিতে বলছে সেখানে। 

– তাইলে আংটিটা খুলে তুমি আগুনে ফেলে দিয়ো তারপর। 

– আমার কাজ কী ? (কানিজ)

– তুই আমাদের সাথে যাবিনা। তুই বাসাতেই থাকবি। 

– কেনো ? আমিও যাই তোমাদের সাথে। 

– না। দিথী, সামিহা, আমি, আমরা এই বিষয় টার সাথে জড়িত, আমাদের কিছু হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য, অনেকেই আছে। আমাদের আঘাত শোষণ করার ক্ষমতাও তোর থেকে বেশি। তাই তোকে নিয়ে গিয়ে রিস্কে ফেলতে চাই না আমি। তুই বাসাতেই থাক। আঙ্কেল-আন্টি আছে ওদের দেখে রাখবি। 

– আমিও ওদের সাথে ফাইট করতে চাইছিলাম। 

– বললাম না। তোর জীবনে সংশয় আছে। আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার তুষার আছে, দিথীর আছে তার মা, সামিহার আছে তার দাদু। তোর রক্ষার জন্য কিন্তু কোন অলৌকিক শক্তি নাই‌। বিষয়টা বুঝ, ছোট না তুই। 

কানিজ আর কিছু বলেনা। মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। দিথী গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

– কখন বের হচ্ছি আমরা ? 

– একটু পরই। আমি বইটা আর আংটিটাকে আমার ঝোলায় নিয়ে নেই। তারপর একসাথে বেড়োবো। 

দিথী তার হাতে থাকা সেই লম্বা ছুরি টাকে দেখে। ছুরিটা আলোয় চকচক করে উঠছিলো। ছুরিটাকে তানিয়ার দেওয়া প্যাকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাড়ায় সে। কোমরের ভাঁজে ছুরিটা প্যাকেট সহ রেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। সামিহা দিথীর যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে। এই দিথীর আজ সকাল থেকে হলোটা কী! এতো গম্ভীর, চুপচাপ হয়ে থাকতেছে! সামিহা উঠে যায়। তানিয়া,কানিজ কে বোঝাচ্ছিলো যে বাসায় যদি কোনক্রমে কোন আক্রমণ হয় তাইলে কী করা লাগবে সেগুলো। সামিহা তাদের দিকে একবার তাকিয়েই উঠে চলে যায়। 

ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখে দিথী বারান্দা থেকে আঙিনায় নেমেছে। উত্তরের ছোট খরের ঘর টার দিকে যাচ্ছে। সামিহাও পিছু পিছু যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দ্রুত বারান্দা থেকে দৌড়ে গ্রিলের দরজার দিকে যায়। বারান্দা থেকে নেমে আঙিনা দিয়ে ছুট লাগায় সেই ঘরের দিকে। 

 

দিথী খরের ঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। দরজাটা ভিড়িয়ে দেয়। সামিহা এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে দরজার ছোট্ট ফাকা অংশটা দিয়ে ভিতরে তাকায়। দেখে দিথী এক বড় কাঠের চাকু দিয়ে প্রাকটিস করছে। এমন ভাবে চাকু দিয়ে অংগভঙি করছে যেন সে অনেক জনকে মারছে। সামিহা এক নজরে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মনে মনে এই দিথীর সাথে তার শান্ত, সরল দিথীকে মিলানোর চেষ্টা করে। ঘরের দিথী প্র্যাকটিস করতে করতে হঠাৎ একটা সময় বলে উঠে,

– ওখানে দাঁড়িয়ে না দেখে ভিতরে আয়। আমার থেকে কিছু মুভ্স শিখে নে। 

সামিহা যেন চমকে উঠে। সে তাড়াতাড়ি সড়ে যেতে গিয়ে উঁচু কিছুটা পা আঁটকে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায়। দিথী ঘরের দরজা খুলে দাঁড়ায়। উপরে থেকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে,

– এতো দুর্বল হইলে হবে! আরো শক্ত হইতে হবে। আঘাত করতে শিখতে হবে। উঠ। 

সামিহা দিথীর হাত ধরে না। ভয়ে ভয়ে নিজেই একলা একলা উঠতে থাকে। দিথীকে তার কেনো জানি ভয় লাগছে। দিথীর অনেক কিছুই সে এই বাড়িতে আসার পর জেনেছে। নাইলে যে কেউ বাইরে থেকে তাকে লাজুক আর শান্তশিষ্ট মেয়ে হিসেবেই জানে। দিথী একটা ছোট্ট মুচকি হাসি দিয়ে ঘরে চলে যায়। সামিহা উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে ছুট লাগায় ঘরের দিকে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে কিছুটা। মনে হয় আজও আবহাওয়া তার অন্য রূপ নিয়ে হাজির হবে। 

 

_____

 

শাহারিয়া ঘর থেকে কানে ফোন নিয়ে বেড়িয়ে এলো। কারো সাথে কথা বলছিলো কিন্তু নেট সমস্যার কারণে কথা শোনা যাচ্ছিলো না। শাহারিয়া হ্যালো হ্যালো করতে করতে বারান্দা থেকে আঙিনার নামে। আঙিনার মাঝখান টায় গিয়ে কানে ফোন তুলে আবার হ্যালো হ্যালো করতে থাকে। কিছুটা বাতাস উঠেছিলো। আকাশও ঘন মেঘে ঢেকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ বাড়ির কারেন্ট চলে যায়। শিউলি বেগম টর্চ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বারান্দায় বের হন। কারেন্টের বংশকে উদ্দেশ্য করে কয়েকটা গালি ছুড়ে দেন। শাহারিয়া কান থেকে ফোনটা নামায়। কলও কেটে গিয়েছে ততক্ষণে। শিউলি বেগম টর্চ লাইট ঘুড়িয়ে শাহারিয়ার চোখে মারে। শাহারিয়া হাত উঁচিয়ে মুখের সামনে ধরে তা থেকে নিজের চোখ বাঁচানোর চেষ্টা করে। শিউলি বেগমর মুড কিছুটা চড়ে ছিলো এই অসময়ে কারেন্ট যাওয়ার জন্য। তিনি সেই সুরেই শাহারিয়াকে বলেন,

– তুই আঙিনার মধ্যে কী করোস। ঘরে আয়। 

– ফোন দিয়েছিলাম ঢাকায়। কিন্তু ফোন ঢুকলেও নেট সমস্যার কারণে কিছু শোনা যাচ্ছে না। 

– তোর শোনা লাগতো না। ঘরে আয় তুই। কারেন্টের লোকরে ফোন দে। ফোন দিয়া আমার হাতে ফোনডা দে। কারেন্টের গুষ্টি আমি আইজ উদ্ধার করমু। টিভিতে মিঠাই দেখতে বইছি আর এহনি বালের কারেন্ট ডারে যাওয়া লাগবো।

– মিঠাই আবার কেমনে দেখে। মিঠাই তো খায়। 

– আরে ছেঁড়া জী বাংলার মিঠাই নাটকের কথা কইছি। বাপের লাহান বেশি বুজোস ক্যা। তুই তাড়াতাড়ি কারেন্টের লোকরে ফোন দে। নাইলে কিন্তু আইজ বাড়িত আগুন লাগায়া দিমু। সারাদিন রাইন্ধা-বাইড়া রাইতের বেলা একটু নাটক দেখতে বইছি আর তহনই কারেন্ট ডারে যাওয়া লাগবো। কী হইলো তুই ফোন দেস না ক্যা। তাড়াতাড়ি ফোন ডা দিয়া আমার হাতে দে।  

– ট,টাকা নাই মা।

– তোর বাপের জমি বেচ। জমি বেইচা ফোনে টাকা ভর। 

– আরে আরে মা ঠান্ডা হও। পড়ে ফোনে দেখে নিও আজকের পর্ব টা। 

– আমি ফোনে দেখতে পারুম না। আমি টিভিতেই দেহুম। 

– টর্চ টা নামাও। চোখে লাগতেছে। 

শিউলি বেগম টর্চটা নিচে নামায়। শাহারিয়া বলে,

– আকাশের অবস্থা ভালো না। এইজন্য মনে হয় কারেন্ট গেছে।

– আর এই বালের আকাশ টারও দুইদিন পর পর যে কী হয়, খালি বৃষ্টি আইতেই থাহে। 

– আচ্ছা মা ঘরে যাও। কারেন্ট আসুক, তখন টিভি দেখিও। দিথী কই। সকাল থেকে দেখতেছিনা

– ঐডা গেছে তোর হউর বাড়ি। 

– মানে ? 

– অর বাপের বাড়ি গেছে,,,,,!!! (চিল্লিয়ে বলেন শিউলি বেগম)

– তাই বলে এখনো নাই। 

– আইজ ২১ তারিখ তুই জানোস না ? 

– তোমরাও কীসব কুসংস্কার নিয়ে পড়ে আছো। সকাল থেকে ও নাই। এখনো ওর কাজ শেষ হয়নাই ? 

– তুই গিয়া দেখ গা। আমারে জিগাইতাছোস ক্যা। 

– ঘরে আব্বা আছে ? 

– গেছে বাথরুমে আমার গুষ্টি উদ্ধার করতে। 

– লাইট দিয়ে আসো। 

– ঐডা অন্ধকারেই থাহুক। কতদিন ধইরা কইতাছি আইপিএস নিতে। এহন যহন লসনাই আন্ধারেই বইয়া থাক। 

– এ শিউলি বেগম, লাইট লইয়া আহো,,,,! আন্ধারে বদনা খুঁইজা পাইতাছি না,,,,,! (বাথরুম থেকে মতিন মেম্বারের আওয়াজ ভেসে আসে)

– তোমার বদনা পাওয়া লাগবো না। আইপিএস লওনাই এহন এইডা তোমার শাস্তি। 

– মশা কামড়াইতাছে গো শিউলি বেগম। আর কতহুন এমনে বইয়া থাকমু। 

– যতহুন না আমার রাগ মিটা যাইবো ততহুন ভিতরে বইয়া মশাগো লগে গল্প করো। (শাহারিয়ার দিকে ফিরে) এই তুই যা, যাইয়া তোর বউরে লইয়া আয়। 

– আর বাবা। 

– ঐডা ঐহানে মশার কামড় খাউক, তোরে যেইহানে যাইতে কইছি ঐহানে যা।

শাহারিয়া আর কিছু বলে না। যানে যে শিউলি বেগমের সাথে সে কথাতেও পারবেনা। দুঃখ তো হচ্ছে তার বাবার জন্য। এমনিতেই এখন শিউলি বেগমের মাথা চড়ে আছে। মনে হয়না মতিন রে এতো সহজে ছাড়বে। শাহারিয়া এক প্রকার দৌড়েই চলে যায় ওখান থেকে। বাথরুম থেকে শুধু মতিন মেম্বারে ডাক ভেসে আসে। আর শিউলি বেগম আঙিনায় চুপচাপ পায়চারি করতে থাকে। হালকা বাতাস উঠে। চারপাশের গাছের পাতা গুলো সেই বাতাসে নড়ে উঠে।

 

_____

 

তান্ত্রিকের বাড়িটায় আজ একপ্রকার উৎসবের আমেজ। তবে তা যে শুধু মাত্র অসুভ আত্মাদের জন্য তা বলার বাকি রাখে না। বাড়ির আঙিনায় একটা কাঠের খাট রাখা হয়েছে। সেখানে সুমুকে শক্ত করে বেঁধে শুইয়ে রাখা। তার হাত দুটো বিছানার উপরের দুই কোনে আর পা দুটো বিছানার নিচের দুই কোনের সাথে বাঁধা। তার শরীর টাকে X এর মতো খাটের উপর বেঁধে রাখা হয়েছে। সুমু তার শরীরটাকে একদমই নাড়াতে পারছে না। তার চারপাশে একে পর এক মোমবাতি রেখে গোল এক বৃত্ত তৈরি করা হয়েছে। তার বিছানার মাথার দিকটায় কিছুটা সামনে আগুনের কুন্ডলি জ্বলছে। তান্ত্রিক তার বিছানার চারপাশে গোল করে দেওয়া মোমবাতির চারপাশে ঘুরছে, মুখ দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। আকাশের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। সুমুর ঠিক সোজা উপরে ঘন মেঘ গোল হয়ে কুন্ডুলি পাকাতে ধরেছে। মাঝে মাঝে সেই মেঘে মৃদু বিজলি চমকিয়ে উঠছে। সুমু কাঁদছে। তার চোখের কোন দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে কোন শব্দ করতে পারছেনা। তার মুখ দিয়ে কোন কথা আসছেনা। হয়তো তান্ত্রিকের কোন এক জাদুতেই তার এই অবস্থা হয়েছে। হনুফাও এখন তান্ত্রিকের বসে চলে গিয়েছে। সেও এখন নিজ জ্ঞানে নেই। এখন সে এক খারাপ আত্মায় পরিনত হয়ে গেছে। তান্ত্রিক সুমুর চারপাশে কয়েকবার প্রদক্ষীণ করে এসে আগুনের কুন্ডুলির সামনে বসে। আজ তার পোশাক-আশাকও একদম এক আসল তান্ত্রিকের মতো। লাল জামা, গলায় পুঁথির মালা। মাথার চুল ঝট করে বাঁধা। তান্ত্রিক আগুনের কুন্ডুলিতে কিছু একটা ছিটিয়ে দেয়। আগুনের শিখা লম্বা হয়ে উঠে। তান্তিক মন্ত্র পড়তে শুরু করে,

 

– নাসুবো নাসুবো ইংকাকে নাহুবো নাহুবো ইংকাকে। হে অসুভ শক্তি রা, ফিরে এসো। ফিরে এসো তোমাদের মালিক কে তার দেহে প্রবেশ করতে সাহায্য করো। এই যায়গা তোমাদের বলয়ে নিরাপদ করে ফেলো। ফিরে এসো!!! 

 

আকাশের ঘনিভূত হওয়া মেঘের কুন্ডুলি থেকে এক বিশাল কালো ধোঁয়া বেড়িয়ে আসে। এসে খুদ্র খুদ্র অংশে ভাগ হয়ে এই বাড়ির চারপাশে গোল নিরাপত্তা বলয় বানিয়ে ফেলে। তান্তিক দুই হাত উপরে তুলে আগুনকে আরো প্রসারিত হতে বলে। মুঠ করে থাকা হাত থেকে কিছু একটা আগুনে ফেলে। আগুনের শিখা আরো লম্বা হয়ে যায়। সুমু এসব দেখে খুব ভয় পাচ্ছে তার বোবা মুখ কিছু শব্দ করতে না পারলেও তার বুক কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। সে এখান থেকে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু কিছুই যে সে করতে পারছেনা, কিছুই না। 

 

    জঙ্গলের মাঝের রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে দিথী, তানিয়া, আর সামিহা। তারা দূর থেকে সেই বাড়ির উপর গোল হয়ে ঘুরতে থাকা ঘন মেঘের কুন্ডলি দেখতে পায়। এদিকের আবহাওয়াও ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বাতাস বইছে। হয়তো বৃষ্টি বা ঝড় নামবে। দিথী তার হাত উঠিয়ে হাত ঘড়িতে দেখে সাড়ে ১১ টা বাজে। সময় বেশি নেই। তারা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতা গুলো বাতাসে এদিক ওদিক উড়ছে। আকাশে বিজলী চমকিয়ে উঠছে।

 

      শাহারিয়া প্রবেশ করে চেয়ারম্যান বাড়িতে। অর্থাৎ দিথীদের বাসায়। আকাশের অবস্থা খারাপ দেখে তার মন ভালো ঠেকছে না। দিথীর জন্য বেশ চিন্তা হচ্ছে। শাহারিয়া তাড়াতাড়ি হেঁটে এসে আঙিনায় দাঁড়ায়। দেখতে পায় একজনকে মেয়েকে। মেয়েটা বারান্দার দরজার সামনে পায়চারি করছিলো। শাহারিয়া বলে

– দিথী, না অন্য কেউ ? 

মেয়েটা পায়চারি থামিয়ে দেয়। চারপাশ অন্ধকার থাকায় মেয়েটা কিছু দেখতে পাচ্ছিলো না। তবে গলা শুনে কোন খারাপ কেউ হবে বলেও তো মনে হয় না। মেয়েটা বলে,

– আমি কানিজ, কানিজ ফাতেমা অর্দা। 

– কানিজ ? ওহ কানিজ আপু। আমি শাহারিয়া। দিথী কী ঘরে ? আমি ওকে নিতে আসছিলাম।

– না। দিথী তো নীলগিরি জঙ্গলের দিকে গেছে। 

– কি ? ও এতো রাতে জঙ্গলের দিকটায় কেনো গেছে? 

– আজ রাতে আসুভের জীবন ফিরে পাওয়ার কথা। তাই ওদেরকে আজ রাতেই কাজ সাড়তে হতো। 

– কী সব কুসংস্কার নিয়ে তোমরা পড়ে আছো। এসব কিছুরই বিজ্ঞান সম্মত উত্তর নেই। (একটু থেমে) ও নীলগিরির দিকে গেছে ? 

– হ্যা। 

– আচ্ছা আমি গেলাম।

– নীলগিরির মাঝে যে রাস্তাটা গেছে ঐখানকার পুরান বাড়িটায় গেছে। 

– পুরান বাড়িটা ? কোন পুরান বাড়ি ? 

– একটাই তো বাড়ি আছে ওখানে। 

– কিন্ত ওখানে তো এক বৃদ্ধ থাকে। আমি আর রিয়াদ একবার সেখানে গেছিলাম। 

– ওখানে বৃদ্ধ না। তান্ত্রিক আর সুমু নামের একটা মেয়ে থাকে। ঐখানেই দিথীরা গিয়েছে। 

– তারমানে বৃদ্ধটাও একটা আত্মা ছিলো! কী যে হচ্ছে এসব। আচ্ছা আমি গেলাম। 

বলেই শাহারিয়া ছুটে দৌড়ে আঙিনা থেকে গেইটের দিকে চলে যায়। কানিজ তার যাওয়ার পান থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার বারান্দার সামনে পায়চারি করতে থাকে। তার কেনো জানি টেনশন হচ্ছে। মন বলছে কিছু একটা হবে। কিন্তু কী হবে! তাই যে তার অজানা। 

 

      দিথী, সামিহা, তানিয়া বাড়িটার কাছে চলে আসে। বাতাস এবার বেশ জোড়েই উঠেছে। আশেপাশের গাছ গুলো দোল খেয়ে একপাশ হতে অন্যপাশে যাচ্ছে। অমাবস্যার রাত হওয়ায় চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে হতে কিছু লাল লাল চোখ বাড়ির দিকটা হতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দিথী সবাইকে এলার্ট হয়ে যেতে বলে। সবাই সতর্ক হয়ে যায়। তখনই কিছু লাল চোখ ওলা প্রাণী তাদের দিকে এগিয়ে আসে। প্রাণী গুলো ছিলো কুকুরের থেকে আকারে বড়। আর হিংস্র। তবে যে এগুলোর অস্তিত্ব বাস্তব জগতে নেই এবং এগুলো যে খারাপ আত্মা সেগুলো বুঝতে বেগ পেতে হয়নি দিথীদের। দিথী তার কোমর থেকে ছুরি টা বের করে কুংফু স্টাইলে রেডি হয়ে যায়। তেড়ে যায় সেই বুনো লাল চোখা কালো রঙয়ের প্রাণী গুলোর দিকে। গিয়েই ঝাঁপিয়ে পরে। একটার চোখে ছুরি ঢুকিয়ে সেটা থেকে বের করে আরেকটার শরীরে ছুরি ঢুকায়। কনুই দিয়ে আঘাত করে একটাকে ফেলে দেয়। ছুরি টা বের করে ছুঁড়ে মারে তার দিকে তেড়ে ছুটে আসা আরেকটার দিকে। ছুরি গিয়ে তার মাথায় লাগে। অচেতন দেহ নিয়ে সেটা এসে দিথীর পায়ের সামনে ঠেকে। দিথী সেটা থেকে ছুরি তুলে নিয়ে আরেকটার কাঁধে হাত রেখে লাফিয়ে উঠে বুট জুতো পড়া পা দিয়ে আরো দুইটার মুখ বরাবর জোড়ে এক লাথি মারে। সেগুলো ছিটকে পড়ে যায়। দিথী তেড়ে যেতে থাকে বাড়িটার দিকে। পিছনে তানিয়া, সামিহা আরো কিছু ভালো আত্মারা সেই সব খারাপ আত্মাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে করে এগিয়ে আসছে। 

বাড়ির গেটের সামনে আসা মাত্রই এক কঙ্কাল এসে দাঁড়ায় দিথীর সামনে। দিথী এতে এক ফোঁটাও ভয় পায় না। উল্টো চুপচাপ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং একটা পর্যায়ে সে হেলে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু দিথী কেনো ঝুঁকে পড়লো তা কঙ্কল টা বুঝে উঠতে না উঠতেই আরেকটা কঙ্কাল দিথীর হেলে থাকা কাঁধের সাথে ধাক্কা খেয়ে সামনের কঙ্কালের উপর এসে পড়ে। তারমানে পিছন থেকেও আক্রমণ আসছিলো, কিন্তু দিথী আগে ভাগে বুঝে ফেলায় সে হেলে যায় আর তাদের আক্রমণ তাদের উপরে গিয়েই পড়ে। দিথী পাশে পড়ে থাকা বড় এক ইট হাতে নিয়ে সাথে সাথে পিছনে ফিরে একজন মাথায় সজোরে আঘাত করে। সেটাও একটা কঙ্কাল ছিলো, যেটা দৌড়ে এসেছিলো পড়ে। কঙ্কাল টার খুলি মাঝ বরাবর ফেটে যায়‌। দিথীর ঠোঁটের কোনে এক ছোট্ট মুচকি হাসি ফুটে উঠে। তখনই তার হাত ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠে। এটা সে সেট করেছিলো যাতে ১২ টা বাজার যে ৫ মিনিট বাকি আছে তা বুঝতে পারে। দিথী তাড়াতাড়ি মুখ ঘুড়িয়ে দরজার দিকে ফিরে। দরজায় এক সজোরে লাথি দেয়। টিনের দরজা টা ভেঙ্গে ভিতরে গিয়ে পড়ে। তার পিছনে চলে আসে সামিহা আর তানিয়া। তারা দুজনেই হাপাচ্ছে। দিথী সামনের দিকে তাকায়। দরজা অপর প্রান্তে ছিলো অসংখ্য কালো ধোঁয়ার তৈরি মানব। সবার চোখ লাল। দিথী এক মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠে,

– The war has just begin,,! 

বলেই ছুরি নিয়ে এক জোড়ে চিৎকার দিতে দিতে তেড়ে যায় সেদিকে। তার পিছু পিছু দৌড়ে আসে তানিয়া আর সামিহাও। তাদের ভিতরে চলে এসেছিলো কিছু শুভ আত্মা, তাই তারাও তাদের শরীরে দারুন বল পাচ্ছিলো। দিথী দৌড়ে যেতে যেতে তার পকেট থেকে এক ছোট্ট লেজার পয়েন্টার বের করে। হাতে নিয়ে সেটাতে আঙ্গুল দিয়ে টিপে, সাথে সাথেই সেটা লেজার তলোয়ার হয়ে যায়। দৌড়ে গিয়ে সেটা দিয়ে একসাথে ৩ টা ধোঁয়া মানবের মাথা আলাদা করে দেয়। তলোয়ার ঘুড়িয়ে আরো দু জনের দেহের অর্ধেক কেটে দেয়। এই লেজার তলোয়ার দেখে সামিহা আর তানিয়া অবাক হয়েছিলো। কারণ এটা তো তাদের দেওয়া না। তাইলে এটা দিথী কোথায় পেলো। আর এটা দিয়ে সে ধোঁয়া মানব গুলাকে মারছেই বা কীভাবে! তবে এখন অতো ভাবার সময় নেই। এখন লড়ে যেতে হবে তাদের। সামিহা আর তানিয়াও তাদের হাতে থাকা ছুরি দিয়ে যতটা পারছে লড়ে যাচ্ছে। দিথী আরো ৫ জনকে একসাথে ঘায়েল করে আরেকটার কাঁধে হাত দিয়ে লাফিয়ে উঠে এক ঘুর্ণন দিয়ে চারপাশে থাকা ৩০-৪০ টা ধোঁয়া মানবকে একসাথে একদম ভস্মিভূত করে ফেলে। যায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। দিথী উপর থেকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে পড়ে। এক হাতে তলোয়ার। মুখ তুলে চায় সামনে। সামনে মাত্র একটা বাঁধা। এক বড় দৈত্যা দানব। দিথী এক মুচকি হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে। দৈত্যাটা দিথীকে আক্রমণ করার জন্য ছুটে আসে। দিথী এক চুলও নড়ে না। এই ফাইট টা হচ্ছিলো বাড়িতে ঢুকার গলির মাঝে। অর্থাৎ একপাশে বাড়ির দেওয়াল অন্য পাশে গাছপালা। এবং এর মাঝের গলির মধ্যে দিথীকে আক্রমণ করতে ছুটে আসছিলো দানবটা। দিথী এখনো একচুলও নড়ে না। দানব টা তার কাছে চলে এসে তাকে হাত দিয়ে আঘাত করতে যাবেই তখনই দিথী তার দুই পা দুইদিকে ফাঁক করে বসে পড়ে। দানব তাকে ছুঁতে না পেরে তার মাথার উপরে দিয়ে হাওয়ায় ভেসে যেতে থাকে। সবকিছু যেন ধীর গতির হয়ে যায়। দিথী ঠিক এই মুহুর্তেই তার লেজার তলোয়ার দৈত্য দানবের পেট দিয়ে ঢুকিয়ে মাথা দিয়ে বের করে দেয়। আর তলোয়ার টা ছেড়ে দেয়। নীল বর্ণের রক্ত বের হতে থাকে দানবের শরীর থেকে। দানব টা গতিতে থাকায় ছিটকে গিয়ে সামনে গড়িয়ে পড়ে। আর এক বিষ্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। দিথী উঠে দাঁড়ায়। তার হাত ঘড়ি উচিয়ে ধরে। দেখে ১১ টা ৬৯। ১২ টা বাজতে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। দিথীর পিছনে এসে দাঁড়ায় সামিহা, তানিয়া। দিথী দৌড়ে গলি পাড় করে বাড়ির আঙিনার দিকে চলে আসে। দিথীর পিছু পিছু সামিহা, তানিয়ারাও আসতে যায় তবে তারা দিথীর গতির সাথে তাল মিলাতে পারে না। কিছুটা পিছিয়ে পড়ায় আবারো তাদের উপর ধোঁয়া মানব গুলো আক্রমণ করে বসে। 

 

দিথী এসে আঙিনার দাঁড়ায়। তান্ত্রিক জোড়ে জোড়ে আগুনের সামনে বসে মন্ত্র পড়ছিলো। বিছানায় ছটফট করছিলো সুমু। তার মুখ টা দেখে যেনো দিথীর মায়া হচ্ছিলো। এক অদৃশ্য বস্তু তার মুখের উপর রাখা ছিলো। তাই সুমু বোবার মতো হয়ে গিয়েছিলে। চারপাশের অবস্থা খারাপ হয়ে উঠে। ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। যেনো কোন টর্নেডো নামছে। আশেপাশের গাছ গুলো যেন শিকড় ছেড়ে উড়ে যাবে এমন অবস্থা। দিথী শরীরেও খুব জোড়ে হাওয়া লাগছিলো। মোমবাতি গুলোর আগুন দুলছিলো তবে নিভছিলো না। তান্ত্রিকের সামনের আগুনটাও যেন নৃত্য শিল্পীর মতো নেচে উঠছিলো বাতাসে। এক বড় বাজ পড়ে জঙ্গলের কোথাও একটা। বিকট ‌শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। দিথী কানে হাত দেয়। তার ঘড়িতে টাইমার বেজে উঠে। ১২ টা বেজে গেছে। উপরে তাকায় দিথী। সুমুর দেহ বরাবর উপরে আকাশে তৈরি হওয়া ঘন মেঘের কুন্ডুলির মাঝ থেকে এক উজ্জ্বল কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। নিচে নেমে আসছিলো। সেটার আকার কতো বড় তা বর্ণনা করার মতো না। 

 

দূর থেকে জঙ্গলের মাঝের রাস্তা দিয়ে হেটে আসা শাহারিয়ার চোখের বাইরে যায়না এই দৃশ্য। দূর থেকে বেশ উজ্জ্বল লাগছিলো সেই কালো ধোঁয়া টাকে। সেটা ক্রমশ নিচে নেমে আসছিলো। শাহারিয়া তা দেখে এক ঢোক গিলে ।

 

তানিয়া চিৎকার করতে থাকে। সুমুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দিথীকে বলতে থাকে সুমুকে মেরে ফেলতে। মেরে শরীর টুকরো টুকরো করে দিতে। দিথী সেই কথা শুনতে পায়। সামিহা আর তানিয়াকে ধোঁয়া মানব রা আটকে রেখেছিলো। দিথী তার পকেট থেকে ছুরি টা বের করে। তানিয়া বলতে থাকে। ‘ মেরে ফেলো ‌দিথী, মেরে ফেলো। এই যুদ্ধে আমাদের জয়ি হতেই হবে।’ দিথী ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। উপর থেকে নামা কালো ধোঁয়াটা প্রায় অনেকটা নেমে এসেছে আকাশ থেকে। সুমু মাথা নাড়িয়ে না করছে তাকে মারতে। তার অশ্রভরা চোখ দুটো যেন বলছে সে বাঁচতে চায়। সে বাচতে চায়। দিথী তার ছুরি টা হাতে তুলে। তুলে চোখ বন্ধ করে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘ এই অধ্যায়ের, এখানেই সমাপ্তি হবে। এখানেই,,,! ‘ বলেই রক্তচক্ষুর মতো চোখ খুলে তাকায় সুমুর দিকে। তার আরেকটা হাত ঢুকায় তার পকেটে। সুমু মাথা নাড়িয়ে না করছিলো। দূরে থাকা সামিহা,তানিয়াদের চিৎকার ভেসে আসছিলো। দিথী যেন চলে যায় এক অন্য মুডে, তার এক বিশেষ মুডে। সব কিছুই যেন ধীর গতির হয়ে যায় মুহূর্তেই। এমনকি উপর থেকে নেমে আসা কালো ধোঁয়াটাও। আসলে সব ধীর গতীর হয়নি। দিথী সুপার ফাস্ট হয়ে গেছে। দিথী তৎক্ষণাৎ তার পকেট থেকে আংটি পড়া হাতটা বের করে। হাতের সাথে বের করা শিশি গুলো উপরে ফিকে দেয়। দিয়ে আরেকহাত দিয়ে তার হাতের আঙুলের চামড়া কেটে দেয়। যেই আঙুলে আংটি পড়া ছিলো সেই আঙ্গুলেরই চামড়া কাটে। এতে তার রক্তে আংটি ভিজে যায়। সে চোখের পলকে দৌড়ে গিয়ে সুমুর খাটে এক পা রেখে লাফ দিয়ে উপরে উঠে। উপর থেকে নিচে পড়তে থাকা কাঁচের রক্তে শিশি গুলোকে আংটি পড়া হাতটা দিয়ে মুঠ করে এক জোড়ে ঘুসি মারে। ঘুসিতে সব শিশি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সব রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় তার আংটি পড়া হাত। দিথী হাওয়াতেই ডিগবাজী দিয়ে নিচে নামতে থাকে। সবাই স্লো মোশনে তাকে দেখতে থাকে। দিথী তার আঙ্গুল তাক করে ধরে তান্ত্রিকের উপর। এক বড় আলোক রশ্মি সঞ্চারিত হয় আংটিতে। এক গুচ্ছ আলো একসাথে হয়ে সোজা তড়িৎ গতিতে গিয়ে মন্ত্র পড়তে থাকা তান্ত্রিকের শরীর এফোড় ওফোড় করে দেয়। তান্ত্রিক কাপতে থাকে। এমন মনে হচ্ছে যেন সে কয়েক হাজার ভোল্টের শক খাচ্ছে। এক বিরাট আলো বেড়িয়ে আসে তার বুক থেকে। তান্ত্রিক চিৎকার করতে থাকে। এক জোড়ে বড় বিষ্ফোরণ ঘটে তার শরীরের। দিথী নিচে পড়ে যায় হাঁটু গেড়ে। তান্ত্রিকের পুরো শরীর টুকরো টুকরো আতশবাজির মতো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আকাশ থেকে নামতে থাকা কালো ধোঁয়াটাকে আকাশের কুন্ডূলি আবার শুষে নিতে থাকে। কালো উজ্জ্বল ধোয়াটা ছটফট করছিলো। যেন সে মরতে চায় না। কিন্তু সে যে আর বাঁচতে পারে না। সম্পূর্ণ কালো ধোঁয়াটাকে টেনে নেয় সেই আকাশের মেঘের কুন্ডুলি। নিঃশেষ হয়ে যায় সবকিছু। শেষ হয় আসুভে অধ্যায়ের। দিথী উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার চোখ মুখে ফুটে উঠে এক বিজয়ের হাঁসি। পিছনে কিছুদূরে থাকা সামিহা, তানিয়াদের ছেড়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় ধোঁয়া মানব গুলো। তাদের আনন্দ উল্লাসে চারপাশ যেন পরিস্ফুটিত হয়। প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়। আকাশের মেঘ কেটে যেতে থাকে। হঠাৎ দিথীর চোখ বুঁজে আসতে থাকে, তার কাছে কেমন যেনো সব অন্ধকার হয়ে আসছে। ঝাপসা হয়ে আসছে। সে নিজের শরীরের বল হারায়। সে দাঁড়ানো হতে পড়ে যেতে নেয় তখনই যেন এক দমকা বাতাসের মতো এসে হাজির হয় শাহারিয়া। শাহারিয়ার কোলেই ঢলে পড়ে দিথী। চোখ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় তার। সবকিছু অন্ধকার হয়ে ঠেকে তার কাছে। দিথী জ্ঞান হারায়।

 

বেশ কিছুক্ষণ পর,,,

 

চোখের পাতা নড়ছে। আস্তে আস্তে তা খুলছে। তার চারপাশে উৎসুক হয়ে থাকা মুখ গুলো দিথীর কাছে অস্পষ্ট হয়ে ঠেকে। দিথী সম্পূর্ণ চোখ মেলে তাকাবার চেষ্টা করে। আর সবার আগেই চোখে পরে তার প্রিয়তমর মুখ। শাহারিয়া বেশ চিন্তিত ছিলো। দিথী নিজেকে আবিষ্কার করে এক নতুন ঘরে। ঘরটা ছিলো সুমুর। এই বাড়িতে সুমু যেই ঘরটায় এইকয়দিন ছিলো সেটা। দিথী উঠে বসতে চেষ্টা করে। শাহারিয়া তাকে ধরে উঠে বসাতে থাকে। দিথী কিছুটা উঠে বসে। একটু পিছিয়ে যায়। পিছনে শাহারিয়া ছিলো। সে একটু পিছিয়ে গিয়েই শাহারিয়ার কোলে আবার ঢলে পড়ে। তাকে যতটা পাড়ে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। শাহারিয়াও দিথীর দূর্বল শরীরটাকে তার কোলে ভালো ভাবে আগলে নেয়। দিথী এতোক্ষণ শাহারিয়ার পায়ের মাংসপেশিতে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিলো। তার পাশে উৎসুক হয়ে বসে থাকা সামিহা,তানিয়া এখন অন্য দিকে তাকিয়ে গলা ঝাড়ছে। দূরে এক বেঞ্চে বসে আছে সুমু আর হনুফা। সুমুও‌ যেন প্রতিক্ষায় ছিলো কখন দিথীর জ্ঞান‌ ফিরবে। হনুফা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সে এখন আর খারাপ ধোঁয়া নয়। সে এখন ভালো সাদা ধোঁয়া। 

 

দিথী বসে থাকা শাহারিয়ার কোলে হেলান দিয়ে ছিলো। তার কেটে যাওয়া আঙ্গুলটায় শাহারিয়ার শার্টের ছেঁড়া অংশ বাঁধা। তানিয়া এবার একটু জোড়ে গলা ঝেড়ে বলে,

– বাড়ি গিয়ে সারাদিন কোলে ঘুমিয়ে থেকো। আজকের পর থেকে আর বাঁধা নেই। 

দিথী ধীর গলায় বলে,

– এই প্রথম আমি তার কোলে মাথা রেখে আছি। ওর বুকটাই তো আমার প্রধান দুর্বলতা। (বলেই আরো আগলে ধরে শাহারিয়াকে) 

– তানিয়া আপুর কাছ থেকে শুনলাম তুমি বলে দারুন ফাইট করছো আজকে! (শাহারিয়া)

– কিছুটা। 

– এইটাকে কিছুটা বলতেছো! এরকম ফাইট আমি বিদেশী মুভিতে দেখছিলাম। কিন্তু দিথী, তুমি সুমুকে না মেড়েই কীভাবে আংটিটা সচল করতে পারলে ? সুমুর রক্ত ছাড়া তো আংটিটা কাজ করার কথা না। আর তোমার রক্ত তো শিশিতেই ছিলো। তাইলে তুমি হাত কাটতে গেলা কেনো ? (তানিয়া)

দিথি একটু সোজা হয়ে বসে। তার চোখ আধখোলা। দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব বেশি ক্লান্ত। তবুও সে বলতে ‌শুরু করে,

– আমার রক্তের শিশির যায়গায় সুমুর রক্তের শিশি ছিলো। 

– সুমুর রক্তের শিশি ? কে দিয়েছিলো ? 

তখনই ঘরের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। সুমু আর দিথী ছাড়া সবাই অবাক হয়। তানিয়া ধীর গলায় বলে,

– ক,কে ? 

– আমি। আমি লায়লা।

– লায়লা!! মানে কী!! (শাহারিয়া অবাক হয়ে বলে)

– সুমু, দরজাটা খুলে দাও। (দিথী) 

সুমু বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। লায়লা ভিতরে আসে। এসে দেখে দিথী বসে আছে শাহারিয়ার কোলে। ফ্লোরে তানিয়া আর সামিহাও বসে আছে। লায়লা ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। এতোক্ষণ একটা মোমবাতি তাদের আলো দিচ্ছিলো। লায়লা তার ঝোলা থেকে একটা চার্জার লাইট বের করে ঘরটাকে ফকফকা আলোয় ভরিয়ে দেয়। দিয়ে গিয়ে সুমুর পাশে বেঞ্চে বসে। তানিয়া বলে,

– লায়লা এখানে কেনো ? 

– কী রে লায়লা! সোনা দানা নিবিনা! হা হা হা! (দিথী হাসতে থাকে)

– কিসের সোনাদানা ? (তানিয়া)

– তোমাদের সব প্রথম থেকে বলতে হবে। (শাহারিয়ার দিকে ফিরে) ভাত খেয়ে আসছো ?

– আমি তোমার চিন্তায় বাচিনা, আর ভাত খাইতে যাবো। 

– খিদা লাগছে নাকি ? 

– না। কেনো? 

– তাইলে কাহিনী বলা শুরু করি। বাসায় গিয়ে একসাথে খাবো। কেমন! 

– কাহিনী আবার কী? 

– দিথী, তুমি কী কিছু আমাদের থেকে লুকাইছো ? (তানিয়া)

– অনেক কিছু লুকাইছি। কীরে লায়লা। সব বলি ? 

– হ আফা। আপনেই কন

দিথী শাহারিয়ার কারো কাছে বসে বলতে শুরু করে,

‘ সুমু নামের এই মেয়েটার যে কোন শক্তি ছিলোনা, তা আমি অনেক আগেই বুঝছিলাম। যেদিন সুমুর আসল পরিচয় আমরা পাই ঐদিনই। কারণ সুমু ধরা পড়ার পর কিন্ত কোন অলৌকিক শক্তির ব্যবহার করে কিংবা আমাদের মেরে তারপর পালায়নি। সে একটা ধোঁয়ার বল ছুড়ে দিয়ে তারপর পালিয়ে ছিলো। আমি তখন সুমুকে নিয়ে এতোটা মাথা ঘামাইনি। তারপর আসলো আহনাফ। ও যেদিন আসে ঐদিন ওর আর শাহারিয়ার উপর হনুফার আত্মা আক্রমণ করে। অবশ্য তখন হনুফা নিজের মধ্যে ছিলোনা। ও তখন তান্তিকের বসে ছিলো। তো সেদিন যখন শাহারিয়া আর আহনাফ বেঁচে যায় সেদিন আহনাফ বাড়িতে ঢুকার সময় দূরে থাকা সুমুকে দেখেছিলো। সুমু যথেষ্ট দূরে থেকে তার উপর নজর রেখেছিলো। আমি আহনাফের সাথে আলাদা কথা বলেছিলাম তার ফ্যামিলি নিয়ে। মানে ও যে আমাদের পুনর্জন্মের একজন জানার পর কথা বলেছিলাম। সেদিন এসব জানতে পারি। তারপর আমার মনে কিছূ প্রশ্ন জাগে। সুমুর যদি শক্তি না থেকে থাকে তাইলে তো সে নিশ্চয়ই মানুষ। আর তারও তো খাবারের প্রয়োজন হয়। হনুফা তাই যেখান সেখান থেকে খাবার চুরি করে এনে সুমুকে খাওয়াতো। হনুফাকে শুধু তান্ত্রিক তখনই নিজের বসে করতো যখন কারো শরীরে তাকে প্রবেশ করাতে হতো, তাছাড়া সবসময় হনুফা হাসিখুশি আর দুষ্টু মিষ্টি আত্মা হিসেবেই নিজের আত্মপ্রকাশ করতো। (একটু থেমে) একদিন হনুফা লায়লা রান্না ঘরে থাকা অবস্থায় খাবার চুরি করতে আসছিলো। তখন সে ধরা পড়ে যায়। তবে লায়লা তাকে কোন ইচ্ছাপূরণ কারী জ্বীন ভেবে তাড়িয়ে না দিয়ে তাকে আরো খাবার দেয় যাতে সে লায়লার ইচ্ছা পূরণ করে। তো লায়লা সোনার দুল, গহনা এসব পড়তে চাইতো। এই কথা সে হনুফাকেও বলে। হনুফা তেমন কিছু না বলে চলে যায়। কিন্তু লায়লা আর হনুফা এটা লক্ষ্য করেনি যে আমি তখন রান্নাঘরে আসতে গিয়ে তাদের কথা শুনে ফেলেছি। আমি তাঁরপর ভিতরে এসে লায়লাকে তেমন কিছু বলি না। শুধু বলি ঘরে আসতে, কথা আছে। আমি ঘরে চলে যাই তারপর। ও কিছু একটা কাজ সেড়ে আসতে আসতে আমি এদিকে আমার পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলাম। আমি ভেবেছিলাম সুমু নামের মেয়েটাকে যদি কোন ভাবে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে আসুভে অধ্যায় থেকে আলাদা করতে পারি তাইলে তো আমাদেরই লাভ। আসুভে তখন দেহ পেতোনা। আর সুমু নামের মেয়েটাকে পড়ে দরকার পড়লে নতুন একটা জীবনও দিতাম। সেই ভেবে আমি পড়ে ঘরে লায়লাকে বলি আমি তাকে কিছু স্বর্ণ দিবো যদি সে আমার কিছু কাজ করে দেয়। তারপর আমি সব তাকে খুলে বলি। বলি যে সুমুকে কোনভাবে বাইরের জগতে বা আমার সাথে এনে পারলে দেখা করাতে। লায়লাও সেই কাজে লেগে যায়। সে বলে তার সোনা লাগবে তাই সে তান্তিকের সাথে কাজ করবে। তান্ত্রিকও অত না ভেবে আমাকে সহজে মারতে পারবে ঠিক করে লায়লাকে দলে নিয়ে নেয়। লায়লার কাজ ছিলো আমার খাবারে বিষ দেওয়া, যা লায়লা কোনোসময়ই আমার খাবারে দেয়নি। আমি এমন ঢং করতাম যেন হনুফা বুঝে আমি আগে জেনেছি আর মন্ত্র পড়ে খেয়েছি তাই আমার কিছু হয়নি। এইতো গেলো প্রথম ভাগ। মানে সুমুর গল্পের প্রথম ভাগ। তারপর যখন একদিন লায়লার মুখ থেকে এটা জানতে পারি যে সুমু বাইরের জগতের সাথে মিলামেশা করছে, চৌরচক বাজারের দুই পাগল পাগলীকে দেখা শোনা করছে তখন থেকে বুঝতে পারি সুমু আসলেই ভালো একটা মেয়ে। সেও একদম স্বাভাবিক মানুষ, তার মন পাষন্ড না। আর তোমরা হয়তো জানো যে সুমু আমারই মেয়ে। যদিও সেটা পূর্বজন্মের। তবুও বলতে গেলে আমারই রক্তের সে। আমারও টান ‌ছিলো ওর প্রতি। ও যদি ভালো হতে চায় আমি অবশ্যই তাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনবো। আর তানিয়া আপু, তুমি না বলেছিলা সুমুর তো কোন টান নেই। সে কেনো ভালো জগতে ফিরবে। আমি তো সুমুর মনের অবস্থা জানতে পারতাম না। তাই লায়লাকে পাঠাই। এতোদিনে লায়লা, সুমু আর হনুফার ভালো বন্ধুও হয়ে যায়। লায়লা তারপর সেদিন ফিরে আসে সেই তথ্য নিয়ে। আর এসে আমাকে নিয়ে ঘরে চলে যায় সেসব বলতে। সুমু তার দাঁড়া বলে পাঠিয়েছিলো সে আসুভের দেহ হিসেবে থেকে যেতে চায় না। সে স্বাভাবিক মানুষ হয়ে বাঁচতে চায়। তার আরেকটা টানের দিক আমি হনুফার থেকে জানতে পারি পরে। হনুফার সাথেও আমার কাল কথা হয়েছিলো। আর সুমু কী জন্য আসুভের পথ ছেড়ে স্বাধারণ পথে ফিরে আসতে চায় তার প্রধান কারণ জানতে পারি। আর তাই সুমুকে সাহায্য করবো বলে সিদ্ধান্ত নিই।

– প্রধান কারণ টা কী ছিলো? (তানিয়া) 

দিথী সুমুর দিকে তাকায়। সুমু তাকে ইশারায় না করছিলো বলতে। দিথী চোখে চোখে তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

– তা না হয় অজানাই থাক। পরে একদিন বলবো।

– তুই সুমুর রক্ত ছাড়া আংটি সচল করলি কিভাবে? (সামিহা)

– আমি সুমুর রক্ত নিয়েছি তো। আজ সকালে আমি তোমাদের কাছ থেকে বইটা নিয়ে কিছুক্ষণ পড়ার পর বাইরে গিয়েছিলাম মনে আছে ? তখন আমি লায়লাকে বলি সুমুর রক্ত আনতে। তাকে একটা শিশিও দিয়ে দেই আমি। লায়লা সকালের খাবার আনার নাম করে এই বাড়িতে আসে, আর দেখে সুমু গোসলখানায় কাঁদছে। সে গোসল খানায় যায়। সুমুকে সব বোঝায় আর তার থেকে রক্ত নিয়ে আসে। আর আমি তারপর আমার রক্তের শিশি টাকে সুমুর রক্তের শিশির সাথে বদলে দেই আর আংটিটা ব্যাবহার করার জন্য আমার আঙ্গুলের চামড়া কেটে আমার গরম রক্ত আর বাকি রক্ত ব্যবহার করে আংটি ‌সচল করি। 

– বইটা তুমি যে একলা নিয়ে পড়েছিলে। সেটা কেনো ? আর কী লেখা ছিলো সেই বইয়ের শেষাংশে! (তানিয়া)

– যখন তুমি বললে যে সময় যখন আসবে বইয়ে লেখা নিজে থেকে উঠে যাবে যে পরবর্তীতে কী কী করতে হবে কিংবা কী কী হবে। তো সেই হিসেবে সুমুকে যদি আমি বাঁচাতে চাই সেটা বই সমর্থন করে কী না, আসুভের সাথে সুমুর লাইফও কানেক্টেড কী না সেটা দেখার জন্যই আমি বইটা নিয়ে শেষের অংশটা একান্তে পড়েছিলাম। বইয়ের শেষে এটাই লেখা ছিলো যে সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সেই দেহ টা বেঁচে থাকবে এবং একজন মানুষ হিসেবে তার বাকি জীবন টুকু অতিবাহিত করবে। 

– আগে বলোনি কেনো তাইলে আমাদের? 

– আমি চাচ্ছিলাম বিষয়টা গোপন রেখেই সম্পন্ন করতে। যদি তান্ত্রিক কোন ভাবে যেনে যেতো তাইলে তো সব পাশার দান উল্টে যেতো‌।

– তো এখন সুমু্ কোথায় থাকবে। কার বাড়িতে উঠবে ও ? 

– ওকে তোমার বাসায় রেখে দিলে কেমন হয় ? (শাহারিয়াকে বলে দিথী)

– মা কিছু বলবে না। 

– তাইলে ও মেম্বার বাড়িতেই উঠবে। আর মাও ওকে অনেক আদর করবে। আমি মা’কে কিছু কথা বলে রাখবো। তাইলে মা আসল জিনিস টা বুঝতে পারবে, মানাও করবে না। আর কাল তো আমরা চলেই যাবো। ঘর ফাঁকা যেনো না হয় এই জন্য নতুন জোড়া কে একসাথে করে দিয়ে যাবো‌।

– নতুন জোড়া মানে ? (শাহারিয়া)

– পরে বলবো তোমাকে। কেমন!

– আচ্ছা এইযে এতো পরিকল্পনা, প্ল্যান, এতোকিছু ভাবলা কখন তুমি! 

– তোমাকে যখন জড়িয়ে ধরি তখন আমার মাথায় সব বুদ্ধি আপনা-আপনিই চলে আসে। (বলছি শাহারিয়াকে জড়িয়ে ধরে দিথী। বেঞ্চে বসে থাকা হনুফা বলে উঠে,

– দিথী আফা, আমিও আপনার জামাইকে জড়ায় ধরি! 

– তোর জন্য পাত্র দেখে রাখবোনে। ঐটাকে জড়ায় ধরিস। হা হা হা!!!

উপস্থিত সবাই হেঁসে উঠে। হনুফা লজ্জা মুখ করে সুমুর কোলে মুখ লুকায়। এক বিভীষিকাময় অধ্যায় শেষে এই হাঁসি টুকু যেন একটা প্রশান্তির হাঁসি হিসেবে ধরা দেয় তাদের কাছে। নীলগিরি জঙ্গলের মুখ থেকে মুখে যায় অন্যতম এক কলঙ্কময় অধ্যায়। সুমুর জীবনে শুরু হয় এক নতুন পথচলা! সূচনা হয় এক নতুন অধ্যায়ের! আকাশের মেঘের মতো সুমুর মন থেকেও বিষাদের ছায়া কেটে যায়। মেঘের আড়াল হতে উঁকি দেয় নতুন ইচ্ছের সূর্যদয়!! 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৬৯

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

গভীর রাত। কুয়াশাচ্ছন্ন চারপাশ। মাঝে মাঝে গুটি কয়েক হুতুম পেঁচার ডাক একসাথে শোনা যাচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকারা বোধহয় ডাকাডাকি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কুয়াশা ভেদ করে এক প্রাইভেট কার হেডলাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে আসছে। কাঁচা রাস্তায় গাড়িটা মাঝে মাঝে কিছুটা দুলে উঠছে। খাঁন বাড়ির সামনের বড় গেইট খানার সামনে থাকা এক ইঁদুর তা দেখে ভয়ে দৌড়ে পালালো। গাড়িটা এসে থামলো খাঁন বাড়ির বড় গেইটের সামনে। হেডলাইটের আলো ছাড়া চারপাশ একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমাবস্যার রাত বলে কথা, জোছনা আজ আর ঘর থেকে বেড়োবে না। 

গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো রায়হান। ড্রাইভারের দরজা খুলে একজন বেড়িয়ে পিছনে ডিক্কির দিকে চলে গেলো ব্যাগ নামাতে। নিপাও গাড়ির অপর পার্শের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। প্রচন্ড শীত পড়েছে। রাত হয়তো এখন দেড় টা কী দুটো বাজবে। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো তাদের। ড্রাইভার ডিক্কি থেকে তাদের ব্যাগটা নামিয়ে রায়হানের পাশে এনে রাখলো। রায়হান ভাড়া পরিশোধ করে দিলো। নিপা রায়হানের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত জড়িয়ে ধরে আছে। শীতের কাপড় পড়েনি সে। শুধু শাড়িতে কী আর শরীরে গরম ধরে! 

ড্রাইভার ভাড়া নিয়ে চলে যায় গাড়ির দরজার দিকে। রায়হান সামনে ফিরে বাড়ির বড় গেটের ঠিক পাশের ছোট গেইটটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ধীর কন্ঠি এক আওয়াজে ডাকতে থাকে,

– রহিম চাচা, ও রহিম চাচা। ঘুমাইছো নাকি। একটু দরজাটা খুলোতো। আমি রায়হান। ও রহিম চাচা। 

(দরজার ভিতরের পার্শ্ব)

রহিম চাচা দরজার পাশে এক চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ ডাকে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়ান। ঘুম মাখা কাপো কাপো গলায় বলেন,

– কে কে! কে ডাকে! ‘

– রহিম চাচা, আমি। 

– আমি কে ? (দরজার দিকে ফিরে) আমি কে ? 

– আপনি তো রহিম চাচা। আমি রায়হান। দরজাটা খুলে দেন। 

– রায়হান? (হাত ঘড়ি উঠিয়ে দেখে) এতো রাইতে রায়হান বাবাজি কইত্থে আইবো?

– রহিম চাচা আমি যে আমার বউয়ের সাথে ঘুরতে গেছিলাম। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে। দরজাটা খুলেন।

রহিম চাচা হাই তুলতে তুলতে দরজার হেজবল খুলতে থাকেন। কাঁচা ঘুম নষ্ট হওয়ার কারণে যে তার মুখে বিরক্তি ভাব চলে এসেছে তা আর বুঝার বাকি নেই। রহিম চাচা দরজা খুলে দেয়। রায়হান নিপার হাত ধরে ভিতরে প্রবেশ করে। রহিম চাচা দেখেন সত্যি সত্যিই রায়হান। তিনি তাড়াতাড়ি করে দরজার বাইরে থাকা ব্যাগটা ধরে ভিতরে এনে রাখেন। বলতে থাকেন,

– এ, এতো রাইতে আইলা যে বাজান।

– ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেলো। দুপুরে গাড়িতে উঠছিলাম তো। 

– ওহ,, বাড়ির সবাইতো ঘুমাইতাছে। 

– হ্যা জানি। আপনিও ঘুমান। অসময়ে ঘুমের ডিসটার্ব করলাম আপনার। 

– না না বাজান। সমস্যা নাই। 

রায়হান একহাতে ব্যাগের হাতল ধরে আরেক হাতে নিপার হাত ধরে চলে যেতে থাকে অন্দরমহলের দরজার দিকে। রহিম চাচা আবার তার চেয়ারে বসে পড়েন ঘুমানোর জন্য। রহিম চাচা আর রায়হানের সম্পর্ক ভালো। তাই বাড়ির বাকিদের স্যার, ভাইজান ডাকলেও রায়হানকে তিনি বাজান বলে ডাকেন।

 

অন্দরমহলের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় নিপা রায়হান। নিপা রায়হানকে চাবি বের করতে দেখে অবাক হয়ে বলে,

– চাবি কেনো বের করতেছো! আঁখিকে ফোন দাও। ও দরজা খুলে দিবে। আর দরজা তো ভিতর থেকে লাগানো। বাইরে থেকে চাবি দিয়ে কী করবে তুমি।

– দেখতে থাকো কী করি। 

রায়হান চাবিটা হাতে নিয়ে দরজার চাবির কোঠরে প্রবেশ করিয়ে উল্টো দিকে ঘুরাতেই থাকে। একে একে তিন পাক সম্পুর্ন হয় আর তখনই দরজা খুলে যায়। নিপা অবাক নয়নে রায়হানের দিকে তাকায়। রায়হান বলে,

– এটাই হচ্ছে ট্রিক।

– কীভাবে কী করলা ? 

– বাড়ির সবার কাছেই এই চাবিটা আছে। দরজা যদি উল্টা পাশে লাগানো থাকে তাইলে বাইরে থেকে চাবি টা ঢুকিয়ে উল্টো পাশে ৩ বার ঘুড়ালে দরজা খুলে যাবে। এই নিয়মটা বাড়ির সবাই জানে। তুমি জানতেনা এখন জেনে রাখো। (একটু থেমে) চলো, বাড়ির সবার ঐদিকে অর্ধেক ঘুম দেওয়া শেষ। 

– হমম চলো। 

নিপা, রায়হান ভিতরে চলে আসে। কেউ একজন পাশ থেকে দরজার দিকে আসতে থাকে। কিন্তু নিপা রায়হানকে দেখে সে হঠাৎ থেমে যায়। তার চলার ভঙিমা আগে ছিলো স্বাভাবিক, এখন নিপা রায়হানদের দেখে সে বাড়ির দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পরে। 

রায়হান পিছনে ফিরে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। অন্দরমহলের মাঝের ঝাড়বাতিটার আলো এখন নিম নিম করে রাখা। অনেকটা ডিম লাইটের আলোর মতোন। তাই চারপাশ বেশ কিছুটা হলেও দৃশ্যমান ছিলো। রায়হান নিপার হাত ধরে আর ব্যাগ ধরে নিঃশব্দে হেঁটে চলে যায় সিড়ির দিকে। নিপা চারপাশ মাথা ঘুড়িয়ে দেখতে দেখতে রায়হানের সাথে চলে যায়। 

 

      উপর তলার করিডোর পেড়িয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে ঠেকে দুজন। রায়হান তার পকেট থেকে এই ঘরের চাবি বের করতে থাকে। এই ঘরের চাবি শুধুমাত্র মাত্র তার কাছেই আছে। রায়হান চাবি দিয়ে দরজা খুলতে হবে থাকে। তার পাশে দাঁড়ানো নিপা হাই তুলছে। ঘুম পেয়েছে তার। জার্নি করে এতো রাতে ফিরা এই প্রথম হলো তার। রায়হান দরজা খুলে ফেলে। ব্যাগ টা হাতে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে লাইট জ্বালিয়ে দেয়। নিপাও প্রবেশ করতে যাবেই তখনই তার নজর পড়ে নিচে। একটা সাদা ভাঁজ করা কাগজ পড়ে আছে দরজার ভিতরের কোনে। কেউ যেন বন্ধ দরজার নিচের ফাঁক-ফোকর দিয়ে কাগজ টা ঢুকিয়ে রেখে চলে গেছে। নিপা তৎক্ষণাৎ হেলে সেই কাগজ টা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভিতর থেকে রায়হানের ডাক আসে।

– কই, ভিতরে আসো। 

নিপা আর কাগজ টা খুলে দেখে না। চোখ ভালোভাবে মেলে কাগজ টা হাতে মুঠ করে ঘরে প্রবেশ করে। 

 

ঘরের সবকিছুই ঠিক তেমনটাই আছে যেমনটা ওরা যাওয়ার আগে রেখে গেছিলো। বিছানা পত্র সব গোছানো। রায়হান বিছানায় বসে পায়ের মুজা গুলো খুলতে থাকে। নিপা এসে ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কানের দুল গুলো খুলে রাখতে থাকে। রায়হান মুজা খুলে সেগুলো বিছানায় রেখে বলে,

– গোসল করবা ? 

– এতো রাতে এতো ঠান্ডায় গোসল!

– এতোটা রাস্তা জার্নি করে আসলাম যে। 

– এমনি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিবো। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব। 

– আচ্ছা তাইলে আমি যাই, একটা ডুব দিয়ে আসি। গোসল না করলে এই শরীরে আমার ঘুম ধরবে না। 

নিপা কানের দুল খুলতে খুলতে পিছনে ফিরে বলে,

– তাড়াতাড়ি বের হবা কিন্তু। এমনিই পানি ঠান্ডা। জ্বর,সর্দি ধরবে তখন।

– খালি যাবো আর একটা ডুব দিয়েই চলে আসবো। তুমি শাড়ি পড়েই ঘুমাবা নাকি! 

– হ্যা, শাড়ি আমি সামলাইতে পারিনা আর এইটা পড়ে ঘুমাইতে যাবো। (সামনে আয়নার দিকে ফিরে) চেন্জ করে তারপর শুবো। তুমি যাও। রাত অনেক হইছে। আমার ঘুম ধরছে। 

– আচ্ছা ঠিক আছে। আর খিদা লাগছে নাকি! এখন যে খাবার গুলো নিয়ে আসলাম ঐগুলা খাও নাইলে। 

– না, এখন খাওয়ার মন নাই। ঐগুলা কাল আলিশা আর আমি ভাগ করে খেয়ে নিবোনে। তুমি যাও।

– আচ্ছা। 

রায়হান আলনা থেকে গামছাটা হাতে নিয়ে চলে যায় গোসল খানার দিকে। গোসল খানায় ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিপা কানের দুল, গলার হালকা গহনা আর হাতের চুড়ি গুলো খুলে ডেসিন টেবিলের উপর রেখে বিছানায় বসে পড়ে। অনেক ঠান্ডা লাগতেছে। মন বলতেছে এখনি শুয়ে কম্বল ঢাকা নিয়ে ঘুমায় যাইতে। তখনই নিপার কাগজটার কথা মনে পড়ে। ডেসিন টেবিলের উপর কাগজ টা একটু আগে রেখেছিলো সে। বিছানা থেকে উঠে ডেসিন টেবিলের উপর থেকে কাগজ টা হাতে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাগজ টা খুলে। সাদা কাগজের উপর কালো কালির কলম দিয়ে একটা নকশা আঁকা ছিলো। কিছু গাছ, একটা বাড়ি, একটা পুকুর, আর আশপাশ দিয়ে যাওয়ার রাস্তা গুলো। আর একটা যায়গায় লাল কালির কলম দিয়ে ছোট্ট ক্রস চিহ্ন আঁকা। নিপা সাথে সাথে মুখ তুলে আয়নার দিকে তাকায়। এটা কীসের ম্যাপ! দেখে তো মনে হচ্ছে এই বাড়িরই। কিন্তু এই লাল ক্রস দেওয়া যায়গাটা! এইটা দাঁড়া কী বুঝাইছে! আলিশার মা তাকে এই নকশাটা দিলো নাকি আবার! কিন্তু তিনি তো ঘর থেকে বের হোন না। তাইলে কী আলিশার দাঁড়া এটা আমার ঘরের দরজার নিচ দিয়ে ভিতরে ফেলে দিতে বলছেন! না, আলিশা এসব বিষয়ে জানেনা। সে তো তার মা যে ভালো তাও জানেনা। তাইলে! তাইলে কে রাখতে পারে!

রায়হান ভিতর থেকে ডাক দেয়,

– সুবা, তোমার চেন্জ হয়েছে! আমার গোসল শেষ। 

– না,,, আরেকটু দাঁড়াও। আমার হয়ে এসেছে।

বলেই নিপা কাগজ টাকে ভাঁজ করতে থাকে। এইটা নিয়ে কাল সকালে মাথা ঘামানো যাবে। এমনিতেই এতো রাস্তা বাসে এসে তার মাথা ঝিম ঝিম করতেছে। নিপা ভাঁজ করা কাগজটা তার হাত ব্যাগে রেখে হাত ব্যাগ টা ডেসিন টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখে। তাড়াতাড়ি চেন্জ করে নিতে হবে। ঘুমও ধরছে। রায়হান আবার বের হয়ে অন্য অবস্থায় দেখলে রোমান্টিক মুডে চলে গিয়ে তার ঘুমের বারোটা বাজাবে। নিপা ব্যাগ থেকে প্লাজু, থ্রী পিস বের করে শাড়ি খুলে বদলে নিতে থাকে। 

 

ব্যালকনির বাইরের প্রান্ত হতে এক হুতুম পেঁচা তাকিয়ে থাকে ঘরের দিকে। মনে হয় পেঁচাটা ছেলে পেঁচা, তাই নজর না সড়িয়ে নিপার কাপড় বদলানো দেখতেছে। আকাশের চাঁদ আজ আকাশ থেকে ছুটি নিয়ে ঘুরতে গেছে। কিছু খন্ড খন্ড মেঘ শুধু অভাগার মতো আকাশ তটে এদিকে-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

 

_____

 

আরেকটা নতুন সূর্যদয়, আরেকটা নতুন সকাল। পাখিদের জন্য আবার একটি কর্মব্যস্ত দিন শুরু। অর্ধ থালার মতো সূর্য উঠে পুব আকাশে। মাঠ, ঘাট, পথ, প্রান্তর সব আলোকিত করে তুলে। কৃষকরা কাঁধে লাঙল আর গরু নিয়ে ছুট লাগায় তাদের কৃষিক্ষেতের দিকে। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা দলবেঁধে স্কুলে যেতে থাকে। দু একটা সাইকেলে করে কিছু মানুষ চলে যায় তাদের কর্মস্থলে।

 

        দিথীর ঘুম ভাঙ্গে। জানালা দিয়ে এক টুকরো সোনালী আলো এসে তার মুখে যে পড়েছে। দিথীর ঘুম ঘুম চোখ দুটো মেলে যায়। পাশ থেকে চিৎ হয়ে শোয়।

কাল রাত ৩ টার দিকে বাড়ি ফিরেছিলো তারা। তানিয়া সামিহারা ওবাড়িতে চলে যায়। আর দিথী, শাহারিয়া, সুমু এইবাড়িতে চলে আসে। ভাগ্গেস শিউলি বেগম তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। নাইলে সারারাত বোধহয় বাইরেই থাকতে হতো। দিথী শিউলি বেগমের সাথে না শুয়ে কাল রাতে শাহারিয়ার সাথে শুয়েছিলো। আর সুমুকে শিউলি বেগমের সাথে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। ২১ তারিখের কাজও শেষ, তাই শিউলি বেগমও না করেন নি। দিথী, শাহারিয়া আর সুমু খেয়ে সবাই নিজ নিজ কক্ষে চলে যায় ঘুমাতে। দিথীও ঐ এক কাপড়েই এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তবে তার আর শাহারিয়ার মিটআপ হয়নি। দিথী ক্লান্ত ছিলো। ও শুধু শাহারিয়াকে জড়িয়ে ধরে তার ক্লান্তি টাকে প্রশান্তির ঘুমে রূপ দিতে চেয়েছিলো। শাহারিয়াও তাকে ঠিক সেভাবেই সঙ্গ দেয়। দিথী কাল সারাটা রাত শাহারিয়ার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। অবশ্য তার মাথাটা এখন বিছানার বালিশেই। শাহারিয়া হয়তো আগে উঠে গেছে। 

দিথী চিৎ হয়ে শুয়ে চারপাশে চোখ দিতেই শাহারিয়াকে দেখতে পায়। শাহারিয়া বিছানার পায়ের দিকটায় ফ্লোরে ব্যায়াম করছিলো। কোমরের ব্যায়াম। দিথী উঠে বসে। হাই তুলতে তুলতে আড়মোরা ভাঙতে থাকে। শাহারিয়াও ব্যায়াম থামিয়ে দিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে দিথী উঠে গেছে। সেও এসে বিছানায় বসে। গায়ে সেন্টো গেন্জি নিচে ট্রাউজার। দিথী আড়মোরা ভেঙে সোজা হয়ে বসে। তার চোখ গুলো এখনো আলভোলা হয়ে আছে। শাহারিয়া বলে,

– ঘুম ভাঙলো তাইলে শেষ পর্যন্ত তোমার। 

– তুমি উঠে গেছো বলে ভাঙছে। নাইলে, (হাই তুলতে তুলতে) নাইলে আরো ঘুমাইতাম।

– আমি তো উঠছি সেই ভোরে। এখন কয়টা বাজে দেখছো? (ঘড়ির দিকে ফিরে) ৯ টা ১৫ বাজে গেছে। 

দিথীও ঘড়ির দিকে তাকায়। আসোলেই আজ সে বেশ বেলা করেই উঠেছে। দিথী তার গাঁয়ের কাপড় টেনেটুনে ঠিক করে মাথার উপরের দিক থেকে ওড়নাটা নিতে থাকে। শাহারিয়ার বলে,

– মা দুইবার ডাকতে এসেও ফিরে গেছে। কাল রাতে দেরি করে ঘুমাইছো। ক্লান্ত শরীর। তাই আমিও ডাকিনাই‌। 

– তোমার শরীর অনেক গরম।

– কার ? 

– তোমার। (আধখোলা চোখে মাতাল কন্ঠে বলে দিথী) 

– প্রথম ঘুমাইছো এইজন্য মনে হইতেছে। যাও এখন, ফ্রেশ হয়ে নাও। ঐদিকে নাস্তার পালা শেষ হয়ে দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত চলতেছে। 

দিথী তার দুই হাত বাড়িয়ে দেয়। যেন সে কোলে উঠতে চাইছে। শাহারিয়া বলে,

– এখন কোলে উঠার সময় নাকি। উঠো, মা আবার ডাকতে চলে আসবে। 

দিথী মাথা নাড়িয়ে না করে হাত দুটো তুলেই ধরে রাখে। সে কোলে উঠবেই। শাহারিয়াও আর না করেনা। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দিথীর কাছে এসে দাঁড়ায়। দিথী তার উপর থেকে কাঁথা সড়িয়ে রাখে। হাত দুটো এখনো উচিয়ে ধরে আছে। শাহারিয়া তাকে কোলে উঠিয়ে বিছানা থেকে নামায়‌। দিথীও কোলে উঠে দুই হাত আর দুই পা দিয়ে শাহারিয়ার শরীর পেচিয়ে ধরে। যেন কোন পোকা তার শিকারকে পেঁচিয়ে ধরছে। শাহারিয়া তাকে কোলে করে নিয়ে দরজার দিকে যায়। দিথীর ওজন খুব বেশি একটা ছিলোনা। দিথীর শারীরিক গঠন মধ্যম। লম্বাও খুব বেশি না। শাহারিয়ার গলা পর্যন্ত। ওজন হবে ঐ ৫০ এর মতো। 

শাহারিয়া দিথীকে নিয়ে দরজার সামনে এসে তাকে নামিয়ে দিতে নেয়। কিন্তু দিথী নামতে রাজি না। সে আরো জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ হয়ে থাকে। শাহারিয়া বলে,

– বাইরে মা-বাবা আছে বউ। তাদের সামনে এভাবে কোলে করে যাওয়া যায় নাকি! আজ তো চলে যাবো আমরা। ওখানে গিয়ে তখন সারাদিন কোলে উঠে বসে থেকো। 

দিথী কিছু বলেনা। ও নামতেই চাইছে না। শাহারিয়া আবার বলে,

– মা দেখে ফেললে তখন আরো মজা নিবে বউ। নামোনা প্লিজ। আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। ফ্রেশ হও। তখন ঘরে এসে কোলে বসে থেকো! 

দিথী এবার শাহারিয়ার কোল থেকে নামে। তার চোখের ঘুম ঘুম ভাব টা কিছুটা কেটেছে। শাহারিয়া বিছানা থেকে ওড়নাটা এনে দিয়ে তার বুকের উপর ভালোভাবে দিয়ে দেয়। বলে,

– এখন ফ্রেশ হয়ে মুখ ধুয়ে নাও। তারপর একসাথে নাস্তা খাবো। 

– তুমি নাস্তা খাওনি ? 

– না। সকালে উঠে আজকে জগিংয়ে বেড়িয়েছিলাম। একটু আগে এসে দেখি উঠোনাই। ভাবলাম একসাথে খাবো। তাই ঘরেও ব্যায়াম করতে শুরু করে দিছিলাম।

– আসো তাইলে আমার সাথে। আমি ফ্রেশ হয়ে নেই। তারপর একসাথে খাবো। 

– চলো।

দুইজনেই ঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যায়। ঘরে শুধু পড়ে থাকে অগোছালো জড়ো হয়ে থাকা বিছানা আর বিছানার চাদর।

 

         মতিন মেম্বার বারান্দার দু’কদম সিড়ি বেয়ে নিচে আঙিনায় নামলেন। পড়নে সাদা পান্জাবি তার উপর খয়েরি কুর্তি। পায়ে চামড়ার জুতো। আকাশ আজ বেশ পরিস্কার। এইরকম সকাল স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর। রান্না ঘরের পাশের খড়িরঘরের সাথে লাগানো কাঁঠাল গাছটায় বোধহয় পাখির বাচ্চা ফুটেছে। সকাল থেকেই পাখির কিচিরমিচির শব্দে বাড়ি মুখর। মতিন মেম্বার পিছনে ফিরে হাঁক দিয়ে বলতে থাকেন,

– শিউলি বেগম,,,, আমি গেলাম। দুপুরে খাইতে নাও আইতে পারি। তোমরা খাইয়া লইও। 

মতিন মেম্বারের ডাক শুনে শিউলি বেগমের ঘর থেকে ঘুম ঘুম চোখে বেড়িয়ে আসে সুমু। মতিন মেম্বার হাঁক দিয়ে পিছনে ফিরতে যাবেনই তখনই সুমুকে দেখে আবার দরজার দিকে তাকান। তিনি বেশ অবাকই হন। সুমুও কিছুটা ভয়ে ভয়ে ছিলো। চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে মনে হয় একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। মতিন মেম্বার মাথা চুলকাতে চুলকাতে অবাক গলায় বলেন,

– আমার শিউলি বেগম এক রাইতের মইধ্যে এতো পিচ্চি কেমনে হইয়া গেলো! না না। এইডা আমার শিউলি বেগম না। মনে হয় তো বউমা। কিন্তু আমার পোলার বউ হঠাৎ একরাইতে মাঝে এতো ফর্সা কেমনে হইয়া গেলো! পোলা কী আমার দুইডা বিয়া করলোনি আবার! 

তখনই পিছনের রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন শিউলি বেগম। শাড়ির আঁচল কোমরে বাধা। সেই আঁচল টা কোমর থেকে খুলে হাত মুছতে মুছতে মতিন মেম্বারের পিছনে এসে দাঁড়ান তিনি। বলেন,

– কী হইছে কী! চেচাইতাছো ক্যা!

মতিন মেম্বার পিছনে ফিরে তাকান। শিউলি বেগমকে দেখে বলতে থাকেন,

– ঐযে ঐ মাইয়ায় কেডা! আগে দেখছি বইলা তো মনে হয়না। শাহারিয়ায় নি আবার দুইডা বিয়া করলো!

– কেডা! সুমু! অয় তো আমার মাইয়া। 

– মাইয়া মানে! 

– কাইল রাইতে ডেলিভারি হইছে অর। তোমার নতুন মাইয়া।

– কী সব যাতা কইতাছো! একরাইতে মধ্যে তাইলে এতো বড় কেমনে হইলো!

– তোমার পেড যেমনে খাওনের পর হঠাৎ বড় হইয়া যায় এমনে হইছে। হা হা হা! 

– হাসি থামাও। খালি সবসময় হাহাহিহি করতেই থাহো। মাইয়াডা কেডা? (পিছনে ফিরে) এই মাইয়া, তোমার নাম কী ? কইত্তে আইছো! তোমার বাপের নাম কী ! 

– জ,জ্বী আমার নাম সুমু। সামিয়া বিনতে সুমু। 

– কইত্তে আইছো! 

শিউলি বেগম মতিন মেম্বারকে তার দিকে ফিরিয়ে বলেন,

– আমার এই পেডের থে আইছে। এহন তুমি যেহানে যাইতাছিলা যাও। অয় আমার নতুন মাইয়া। ওরে আমি আকাশের থে পাইছি। এইবার হইছে! এহন যাও। অয় আইজ থে এইবাড়িতই থাকবো। 

– থাকবো না হয় বুঝলাম। কিন্তু অর মা-বাপে যে অরে তহন খুঁইজা বেড়াইবো!

– তোমারে আমি সব পড়ে বুঝায় কমুনে। তুমি অহন যাও তো। আর হুনো হুনো। আইজ বিকালে শাহারিয়ারা চইলা যাইবো। তুমি শৈশবের হাতে খাসির মাংস কিন্না পাডায় দিবা। 

– শৈশব কই। আহেনাই এহনো অয়! 

– না। তোমার লোকের খবর আমি জানমু কেমনে। আর হুনো। তুমিও দুপুরে চইলা আইবা। আইজ সবাই একলগে খামু আমরা। পরে কহন শাহারিয়া আহে না আহে। আর শৈশবরেও আইনো। মাংস দেইখা শুইনা কিনবা। আইজ সকালে জবাই হওয়া কচি খাসিডার মাংস আনবা। বুজ্জো কী কইছি! 

– আইচ্ছা ঠিকআছে। আমি দুপুরে আইয়া পড়মুনে। তুমি ওগো সবকিছু দেইখা শুইনা গুছায়া দিয়ো। আমি গেলাম।

– হ যাও। 

মতিন মেম্বার চলে যেতে থাকেন আঙিনা পেড়িয়ে দরজার দিকে। শিউলি বেগম সুমুর দিকে ফিরে বলেন,

– উডছো। যাও যাইয়া ফ্রেশ হইয়া নাও। ঐদিকে বেসিন আছে। বাথরুমও ঐদিকেই।

– আচ্ছা। 

– আইচ্ছা তুমি যাও। ততক্ষণে আমি পায়েশ টা একটু গরম কইরা আনতাছি। 

বলেই শিউলি বেগম চলে যান রান্নাঘরের দিকে। সুমু এখনো লায়লার কাপড়েই আছে। দিথী আর শাহারিয়া চলে আসে কথা বলতে বলতে। সুমুর সামনে এসে দাড়াতেই দিথী, শাহারিয়ার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকায়। বলে,

– কখন উঠলি!

– একটু আগেই উঠলাম আপু।

– ঘুম কেমন হইছে! মা তোর উপর আবার পা-টা তুলে দিছিলো নাকি! 

সুমু মাথা নাড়িয়ে না বলে। দিথী হাসিমুখে বলে,

– ঘুমাইলে মায়ের কোন হুঁশ থাকেনা। চল ফ্রেশ হয়ে নেই। বেলা অনেক হইলো।

সুমু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। দিথী সুমুকে নিয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে। শাহারিয়া চলে যায় বারান্দার বিপরীত পার্শ্বে। অর্থাৎ ডায়নিং টেবিলের দিকে। আকাশে কিছু পাখি দল বেঁধে উড়ে চলে যায়।

 

      রান্নাঘরে রান্না করছেন শিউলি বেগম। মাটির চুলায় ভাতের হাঁড়ি বসিয়েছেন। গ্যাসের চুলাও আছে পাশের টেবিলে। তবে সেখানে শুধু তরকারি রান্না করেন। পিড়িতে বসে ভাতের চুলায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে পাশের মাটির চুলা টায় পায়েশের পাত্র বসান। সেই সকাল সকাল রান্না করেছিলেন। এখনো দিথী, শাহারিয়া, সুমু নাস্তা করেনি। তাই আবার গরম করতে হচ্ছে। লায়লা আর ফুলমতি বাড়ির পিছনের বাগানটায় আছে। তাদেরকে গাছ গুলোতে পানি দিতে পাঠিয়েছেন শিউলি বেগম।

হঠাৎ শিউলি বেগমের পিছন উদয় হয় হনুফা। চোখ বড় বড় করে ললুভ দৃষ্টি নিয়ে শিউলি বেগমের কাঁধের পাশে মুখ এনে ধোঁয়া ওঠা পায়েশ দেখতে থাকে। শিউলি বেগমের সেদিকে খেয়াল ছিলোনা। তিনি আনমনে পায়েশ গরম করছিলেন। তখনই তার কাঁধের উপর মুখ রাখা হনুফা বলে উঠে,

– বইন, আমি একটু পায়েশ খাই! 

– পায়েশ গরম হোক আগে। তারপর। (বলেই শিউলি বেগম পিছনে ফিরে তাকান। আর অমনি হনুফাকে দেখে এক চিৎকার দিয়ে পিছনে ছিটকে পড়ে পিছিয়ে যান। হনুফাও শিউলি বেগমের চিৎকারে ভয় পেয়ে রান্না ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। শিউলি বেগম চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন,

– এই, ভূত ভূত। রান্নাঘরে ভূত আইছে।(একটু থেমে চারপাশ দেখে) এইডা কী আছিলো! কইত্তে আইলো! 

তখনই আবার শিউলি বেগমের কাঁধের পাশে হনুফা উদয় হয়। বলে,

– আমি ভূত না। আমার নাম হনুফা। হনুফা মতি। 

তখনই শিউলি বেগম আবার তার কাঁধের দিকে দেখে ভয়ে উঠে দৌড় দেন। রান্না ঘর থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে আসেন। হনুফা শিউলি বেগমকে এতো ভয় পেতে দেখে কিছুই বুজতে পারেনা। সে দরজার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চুলার পায়েশের দিকে তাকায়। পায়েশ দেখে তার মুখ দিয়ে যেনো লালা পড়তে থাকে।সে পায়েশের পাতিল ছুঁতে যায় অমনি তার হাতে গরম ছ্যাকা লাগে। ভয়ে ছিটকে পিছনে পড়ে যায়। দিকবিদিক না দেখে রান্না ঘর থেকে পালবার পথ খুঁজে। দরজা দিয়ে পালিয়ে যায় বাইরে। রান্না ঘরের একপাশের সব বোয়ম-টয়ম উল্টে পড়ে থাকে মেঝেতে। যেন কোন ঝড় বয়ে গেলো রান্না ঘরের উপর দিয়ে।

 

____

 

নিপা বিছানা গোছাচ্ছে। রায়হান মাত্রই বেড়িয়ে গেলো অফিসে যাওয়ার জন্য। নিজের অফিস, তাই বলে যে যখন ইচ্ছে তখন যাবে, তা না। রায়হান বেশ শৃঙ্খল ভাবেই সবকিছু মেইনটেইন করে, তা হোক ঘর, হোক বাহির। তার সময়ানুবর্তিতার প্রশংসা যেন না করলেই নয়। নিপা বিছানা গুছিয়ে চলে গেলো ঘরের কোনে রাখা ব্যাগ টার দিকে। আলিশার জিনিস গুলো গিয়ে তাকে দিয়ে আসা উচিত। আলিশাকে আজ সকাল থেকে দেখেনি নিপা। হয়তো জানেই না যে নিপারা এসেছে। নিপা ব্যাগ থেকে পুঁথির মালা, একটা গোল টুপি, আরেকটা জামা বের করে। জামাটা ঐখানকার আঞ্চলিক নারীদের পোশাক। আলিশা তো বেশ সৌখিন একটা মেয়ে। নিশ্চয়ই সে এটা পছন্দ করবে। নিপা সেগুলো হাতে নিয়ে দাড়াতেই কারো চিল্লানোর আওয়াজ পায়। নিপা ভ্রু কুঁচকে চারপাশে তাকায়‌। না আওয়াজ টা এই ঘর থেকে না। নিচের অন্দরমহল থেকে আসছে‌। গলাটাও তো রায়হানের। নিচ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ কেনো আসছে ? কিছু আবার হইলো নাকি! নিশ্চয়ই রায়হানকে তার বাবা বকতেছে। ফোন দিছে ফোন ধরেনাই যে। নিপা তাড়াতাড়ি জিনিস গুলো বিছানায় রেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।

 

    রায়হানের চোখ রক্ত লাল, ছলছল করছে চোখগুলো। নজরুল সাহেবের সাথে সে তর্কে জড়িয়ে পড়েছে। রায়হান আবার জোড়ে চিৎকার দিয়ে বলে,

– বাসায় এতো গুলা মানুষ থাকতে কীভাবে কেউ এসে খুন করতে পারে! বাড়ির মানুষ গুলা কী ঐসময় ঘাস কাটতে গেছিলো! 

– রায়হান,, চিৎকার করিস না। বাড়িতে তখন আমি, রাফসান, শাহেদ, সাদিক কেউ ছিলাম না। আর আখিকেও অজ্ঞান করে ফেলে কাজ টা করছে। আমরা তো পরে বাসা এসে দেখি এই অবস্থা। 

– কেনো বাসায় তোমার বউ ছিলোনা? তার কানে কী একবারো আওয়াজ যায়নাই ? 

– রায়হান,,,,,! কথা ঠিক করে বল। তোর মা হয় মা!

– আমি মানি না। আমি কাউকে মা মানিনা। যে আমাকে জন্ম দিতে পারে সে কখনোই আমার পায়ে গরম লোহা বসাইতে পারে না।

– রায়হান,,,,,, চোপ। আর একটা কথাও বলবিনা তুই। 

রায়হান রক্ত লাল চোখের পানি মুছে। আবার কটমট গলায় বলে,

– আলিশাকে কে মারছে! তার মা’কে কে মারছে! 

– আমি জানিনা। আমি কিচ্ছু জানিনা। 

– কেনো জানোনা! কেনো জানোনা তুমি! (কাঁদতে কাঁদতে)  আলিশা আমার ছোট বোন ছিলো। ভাইয়া ভাইয়া ডাক দিয়ে আমার কান ঝালাপালা করে দিতো। (একটূ থেমে) তোমাকে মামা বলে ডাকতো। মামা,,,,! ছোট্ট ফুলের মতো বোনটাকে কে মারলো! তোমার কী একবারো ভিতরটা কাঁদে উঠেনি! এতোটা পাষাণ ভাবে কীভাবে আছো হ্যা! কীভাবে আছো! 

সাদিক এসে রায়হানকে ধরে। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসায়। রায়হান এখনো ছলছল রক্ত চোখ নিয়ে নজরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে ছিলো। 

 

   উপর থেকে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে সব কথা গুলো শুনে নিপা। যে যেন আরেকটু হলেই পা ফসকে গড়িয়ে পড়তো। এটা কী শুনলো সে! আলিশা মারা গেছে! আলিশা মারা গেছে ? ২ দিন আগেও তো ফুটফুটে মেয়েটা তাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিদায় জানালো। একটা সুন্দর হাসি দিতে দিতে তাকে হাত নাড়লো। সেই মেয়েটা মারা গেছে! নিপার ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট লাগতে থাকে। ওর আলিশাকে একলা ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি। কী হতো আর কয়টা দিন পর ঘুরতে গেলে! কী হতো! নিপাও কান্নায় ভেঙে পড়ে। অন্দরমহলে থাকা সোনালী যায় তার দিকে। নজরুল সাহেব এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। আঁখি মুখে ওড়না চেপে কাঁদছে। তবে এখানে নেই সুমনা বেগম। তিনি যেন মনের সুখে রান্না ঘরে রান্না করছেন। এসব যেন তার কাছে ন্যাকা কান্না লাগছে। 

সোনালী গিয়ে নিপাকে ধরে। নিপা মাঝ সিড়িতেই বসে পড়ে। সোনালী তার পাশে বসে তাকে শান্ত করতে থাকে। সোনালীর মুখভঙ্গি এমন ছিলো যে সেও আঁখির মতো আলিশার মৃত্যুতে মন খারাপ করে আছে। তারও কষ্ট হচ্ছে আলিশাদের জন্য। সোনালীর অভিনয় যেন কোন পাকা অভিনেতাকেও হার মানায়। নিপা একবার ছলছল চোখ গুলো নিয়ে সোনালীকে দেখে। সোনালীকে সে চিনতো না। তবুও এই বাড়ির কোন সদস্য ভেবে সে তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। সোনালীও তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। বলতে থাকে ‘ আর কেদোনা, পৃথিবীতে সবাই চিরকাল থেকে যায় না। আর কেদোনা। কিচ্ছু হয়নি। ‘ নিপা এইবার শব্দ করে কাঁদতে থাকে। তার মন যে আলিশার হঠাৎ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেনা। আলিশা তার জন্যই মারা গেছে। সে নিজেকেই এর জন্য দোষী ভাবতে থাকে।

সোফা থেকে নিপার কান্না শুনে উপরে তাকায় রায়হান আর সাদিক। নিপাকে এভাবে কাঁদতে আগে কখনো দেখেনি রায়হান। হয়তো আলিশাকে তার মতোই খুব আপন করে নিয়েছিলো নিপা। আলিশা মেয়েটাই তো ছিলো পরিস্ফুটিত এক রঙিন ফুলের মতো। যে কেউ যে তার মায়ায় বিঁধে তাকে আপন করে নিতে বাধ্য। নিপা, রায়হান তো তাকে ছোট্ট আদুরে বোন হিসেবে নিয়েই এতোটা কষ্ট পাচ্ছে, সে যায়গায় আলিশাকে ভালোবাসা সেই মানুষটা! সে তো বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় ছটফট করছে, আমৃত্যু যন্ত্রনা যে তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বড্ড আফসোস থেকে যাবে তার, নিজ মুখে বলা ভালোবাসার কথাটা আলিশার কানে না পৌছানোর, আফসোস থেকে যাবে একটা বার সেই দুই নয়ন ছোঁয়া ভালোবাসা না পাওয়ার! ভালোবাসা মানেই কলঙ্ক বাঁধা এক মুঠোসুখ, ভালোবাসা মানেই বিষাদ ঘেরা সহিষ্ণু বিমোহুক!!

 

________

 

রিয়াদ থানা থেকে বের হয়। সে অস্থির, উৎদিপ্ত। ফোন এসেছিলো দিনাজপুর থেকে, আলিশা আর সুরাইয়া বেগমের লাশ যেই ফরেনসিক ল্যাবে রাখা হয়েছিলো সেখান থেকে নাকি কে বা কারা লাশ দুটো চুরি করে নিয়ে গেছে। লাশের সাথে থাকা কিছু এভিডেন্সও নাকি পাওয়া যাচ্ছেনা। ফরেনসিক ল্যাবের দুই ডাক্তার বাঁধা দিতে যাওয়ায় তাদেরকেও আহত করেছে দুর্বৃত্তরা।

 রিয়াদ বাইকে উঠে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে সেখানে যেতে হবে। খুন হওয়া লাশ চুরি হয়ে যাওয়া মানে জল অনেক দূর গড়াবে। উপরের লোক, মিডিয়া সবাই হলাও করে এটা প্রচার করবে। রিয়াদ আর এক মুহুর্তও দেরি করে না। বাইক নিয়ে সজোরে ছুটে যায়। তখনই এক এসইউভি কার সেই গ্রামের কাঁচা রাস্তা হতে তার বাইকের পিছু নেয়। গাড়ির গ্লাস গুলো কালো ছিলো, তাই ভিতরের কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। গাড়িটা বাইকটাকে ফলো করতে করতে চলে যায়। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করে, যেন আবার কোন অসুভ কিছুর বার্তা বয়ে আনছে! কোন খারাপ কিছু ঘটার ইঙ্গিত দিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে কাউকে। থানার সামনের রাস্তা আবার শুনশান আর নিশ্চুপ হয়ে যায়। শুধু কাঁচা রাস্তায় রয়ে যায় বড় গাড়িটার ফেলে যাওয়া মোটা চাকার দাগ!!!

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

 

 

 

 

 

 

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭০ (১ম ভাগ)

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

দুপুর বেলা। রোদ উঠেছে আজ বেশ। আকাশে তেমন একটা মেঘের দেখাও নেই। শুধু মাঝে মাঝে হালকা একটু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। 

ফুলমতি দুটো তরকারির বাটি হাতে আঙিনা থেকে বারান্দায় উঠলো। ডায়নিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন শিউলি বেগম। ফুলমতি গিয়ে বাটি গুলো টেবিলে রাখে। মতিন মেম্বার এসে বসেন চেয়ারে। শাহারিয়া, দিথী, সুমু বেসিনের দিকে হাত ধুচ্ছে। আফাজ ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে ডায়নিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো।

আজ সকাল ১১ টার দিকেই আফাজকে ক্লিনিক থেকে নিয়ে আসে শাহারিয়া আর শৈশব। আফাজ যে এখন পুরোপুরি সুস্থ তা নয়। ডান হাতের চোট এখনো সাড়েনি। ডান হাতটা ব্যান্ডেজ করে গলার সাথে ঝোলানো। আফাজ এখনো মানসিক দিক দিয়েও আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠেনি। তবে উন্নতি ঘটেছে। 

শিউলি বেগম টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে পিছনে ফিরে তাকান। দেখেন আফাজ রুম থেকে এসেছে। শিউলি বেগম তার পাশের চেয়ার টা টেনে বলতে থাকেন,

– এহানে বহো। তোমারে কতখোন আগে ডাইকা পাঠাইছিলাম, আর তুমি এহন আইলা। (একটু থেমে) তুমি তো খাসির মাংস পছন্দ করোনা। তোমার লাইগা পড়ে গরুর মাংস আনাইছি। 

আফাজ চেয়ারে বসে পড়ে। মাথা নিচু করে থাকে। তার মন এখনো বিষন্ন। শিউলি বেগম বাকি চেয়ার গুলোর সামনে প্লেট দিয়ে দেন। দিয়ে আফাজের প্লেট টা তুলে সোজা করেন। ভাত তুলে দিতে থাকেন। দিথী, শাহারিয়া আর সুমুও চলে আসে। দিথী শাহারিয়া বসে পড়ে। সুমু বসতেই যাবে তখনই তার চোখ পড়ে আফাজের দিকে। তার হৃদস্পন্দন যেন ক্ষানিক্ষনের জন্যও থেমে থেমে আসছিলো। আফাজ এখানে কী করছে! আফাজ কী এই বাড়ির কেউ! তাদের যে এভাবে আবার দেখা হয়ে যাবে সুমু ভাবেনি। সে আরো আজ বিকালে ক্লিনিকে যাওয়ার চিন্তা করছিলো। শিউলি বেগম সুমুকে চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে বলেন,

– আরে খাড়াইয়া আছো ক্যা। বহো‌। ঐ চেয়ারটাতেই বহো।

শিউলি বেগম কথাটা বলা শেষ করে আফাজের ভাত উঠিয়ে দিতে থাকেন। আফাজ মাথা উঁচিয়ে প্লেটের দিকে তাকায়। তখনই তার নজর পড়ে ঠিক তার সোজাসুজি টেবিলের অন্য প্রান্তে। এটা ঐ মেয়েটা না! হ্যা। ঐ মেয়েটাই। ও এখানে কী করে! আফাজ শব্দ করে বলে উঠে,

– তুমি ? 

সুমুর বুকের স্পন্দন যেন হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। সে কী বলবে, ভেবে পায় না। তখনই শিউলি বেগম আফাজকে বলেন,

– তুমি সুমুরে চিনো!

আফাজ মুখ নামিয়ে প্লেটের দিকে তাকায়। ধীর গলায় বলে,

– হ্যা। 

– আয়হায়, তোমাগো দেহা হইলো কোনে! 

আফাজ মুখ তুলে সুমুর দিকে তাকায়। সুমুর চোখ গুলো ভয়ার্ত। কোটরে জল ছল ছল করছে যেনো। আফাজ মুখ নামিয়ে নিয়ে বলে,

– রাস্তায় দেখেছিলাম একদিন। 

– ওহহ , তাই কও। সুমু আমার মাইয়া। আমার মতোই সুন্দরীও হইছে তাই না! 

– হমম। 

শিউলি বেগম কথা বলতে বলতে শাহারিয়া আর দিথীর প্লেটের ভাত উঠিয়ে দেন। শাহারিয়া আর দিথী পাশপাশি বলেছিলো। মতিন মেম্বার এসে বসলেন শিউলি বেগমের পাশের চেয়ারটায়। টেবিলের লম্বা দুই প্রান্তের এক পাশে বসেছে সুমু আরেক পাশে আফাজ। আর আফাজের পাশে দাড়িয়ে আছেন শিউলি বেগম। তার পাশের চেয়ারে বসেছেন মতিন মেম্বার আর তারপর একটা চেয়ার ফাঁকা, পরের চেয়ার গুলোতে শাহারিয়া আর দিথী। 

ফাঁকা চেয়ারটায় এসে শৈশব বসলো। শিউলি বেগম তার পাতেও ভাত উঠিয়ে দেন। লায়লা আর ফুলমতি বাকি তরকারির বাটি গুলো এনে বাকিদের মাংস উঠিয়ে দিতে থাকে। শিউলি বেগম এক বাটি থেকে মাংস আর আলু ভাজি আফাজের পাতে উঠিয়ে নিয়ে প্লেটটা নিজ হাতে নেন। ভাত মেখে আফাজকে খাইয়ে দিতে থাকেন। আফাজের ডান হাত টা এখনো ব্যান্ডেজ করে গলার সাথেই ঝোলানো। সে তো নিজ হাতে খেতে পারবেনা। আফাজ মুখে ভাতের নলা নিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। বাকিরাও খাওয়া শুরু করেছে। তবে সুমু চুপচাপ। তার পাতে সব এসেছে, কিন্তু সে শুধু হাত দিয়ে ভাত নেড়েই যাচ্ছে। আর তার সামনাসামনি টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা আফাজকে দেখছে। শিউলি বেগম আফাজকে আরেক নলা ভাত মুখে তুলে দিয়েই সুমুর দিকে তাকান। সুমু তাড়াতাড়ি নজর নামিয়ে নেয়। ভাতের নলা মুখে তুলতে যায়, তখনই শিউলি বেগম বলেন,

– কী,,! তোমারেও খাওয়াইয়া দেওয়া লাগবো নাকি! 

সুমু মাথা নাড়িয়ে না বলে। দিথী সুমুর পাশে বসেছিলো। সে সুমুর পাতে আরেক টুকরো মাংস উঠিয়ে দেয়। 

শিউলি বেগম ভাত মেখে আফাজকে খাইয়ে দিতে দিতে শৈশবকে বলেন,

– কীরে, রান্ধা কেমন হইছে! 

– হ চাচি‌। (খেতে খেতে) রান্ধা অনেক ভালা হইছে। আপনে খুব ভালা রান্ধেন। 

– হ। তোর তাইলে ভালাই লাগছে। (আফাজকে আরেক নলা দিয়ে) এদিকে তোগো মেম্বার সাব, হের মনে হয় ভালা লাগে নাই। না!!

– আরে আরে না। রান্না ভালা হইছে তো। আমি তো খাইতে খাইতে দমই নিতে পারতাছিনা। তোমার রান্নার প্রশংসা যতই করমু ততই কম হইবো। 

– হ্যা মা। রান্না তোমার অনেক ভালো হইছে। (শাহারিয়া)

– হ, বুঝলাম। আমার দিন তারমানে ফুরায়া আইছে। (কিছুটা আক্ষেপের সুরে) 

– মানে! কীসের দিন ফুরায়া আইছে! (মতিন)

– আইজ সব দিথী রানছে। হের রান্না তোমাগো এতো ভালা লাগছে! আমার বেলায় কারো মুখ দিয়া কতা ফুটেনা, মনে হয় রান্ধা ছাইড়া দিয়া সন্ন্যাসী হওয়া লাগবো। 

– আরে আরে না না শিউলি বেগম। ত,তোমার রান্নাও তো ভালা হয়। আ,আমি তো এমনিই কইছিলাম। না মানে এই রান্নাও মজা হইছে। কিন্তু তোমার ডা আরো বেশি মজার। 

– তারমানে এই রান্না কম মজার হইছে! 

– হ, মানে না। মজা হইছে কিন্তু তোমার ডা তো অমৃত। ঐ রান্নার স্বাদ কী আমি ভুইলা যাইতে পারি। 

– বুজ্জো দিথী, তোমাগো মেম্বারসাব তেল দিতে ভালাই জানে। রান্না আইজ সবগুলা আমিই করছি। খালি একটু চেক দিতাছিলাম যে তুমি কার বেলা কী কও। আর দিথী আইজ চইলা যাইবো, ওরে আমি রান্না ঘরে পাঠাইতে যামু কোন দুঃখে! 

মতিন মেম্বার তাড়াতাড়ি মাথা নামিয়ে কোন মতে গিলতে থাকেন। সবার সামনে কেমন একটা অবস্থায় ফেলে দিলো তাকে! দিথী মুচকি হেঁসে তার খাবার খেতে থাকে। পাশে ফিরে সুমুকে দেখে, এখনো সে আবার ভাত নেড়ে যাচ্ছে। দিথী সুমুর হাত নাড়িয়ে বলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে। সুমু দিথীর ছোঁয়া পাওয়ার সাথে সাথে মুখ নামিয়ে নিয়ে ভাত খেতে থাকে। 

শাহারিয়া একটা মাংস তার প্লেট থেকে দিথীর প্লেটে উঠিয়ে দেয়। দিথী বলে,

– আমার আছেতো, তুমি খাও।

– মচমচে হাড় আছে ঐটায়। তোমার তো মচমচে হাড় পছন্দ। 

দিথী একটা মুচকি হাসি দিয়ে তার খাবারের দিকে তাকায়। শাহারিয়াও না, কিচ্ছু ভুলেনা। ছোট থেকে ছোট কথা গুলো পর্যন্ত ওর মনে আছে। 

 

মতিন মেম্বার খেতে খেতে মাথা উঠিয়ে দেখেন সবাই এখন চুপচাপ খাচ্ছে। আফাজও মুখে ভাতের নলা নিয়ে মাথা নিচু করে চিবোচ্ছে। মতিন মেম্বার শিউলি বেগমের দিকে মুখ বাড়িয়ে আঁ করেন। যেন শিউলি বেগম তাকে এক নলা ভাত খাইয়ে দেয়। শিউলি বেগম তা দেখেই একটা ছোটখাটো মুচকি হাসি দেন। তিনি আফাজের প্লেট থেকে একটা হাড় উঠিয়ে দিয়ে মতিন মেম্বারের মুখে দিয়ে দেন। মতিন মেম্বার ভালোভাবে দেখেননি। মুখে নিয়ে চিবোতে যাবার সময়ই তার দাঁতের মাড়ি গুলা যেন বলে উঠে ‘ ভাই, বুড়া বয়সে দাঁত গুলা তোর এমনিই পড়বে। তারপর আবার তুই হাড্ডি চাবাইতে গেলি ক্যান! ‘ 

মতিন মেম্বার সাথে সাথে মুখ পাশে ফিরিয়ে হাড় মুখ থেকে ফেলে দেন। কাশতে থাকেন। দাঁত গুলোতে ব্যাথা ধরায় দিছে রে! শিউলি বেগম হাঁসতে হাঁসতে শেষ। বাকিরা মুখ তুলে বুঝার চেষ্টা করতেছে যে, হঠাৎ হইলো টা কী এখানে! লায়লা এক গ্লাস পানি এনে মতিন মেম্বারকে দেন। মতিন মেম্বার পানি খেতে থাকেন। শিউলি বেগম আরেক নলা ভাত মতিনের মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলেন,

– আর খাইবা ভাত! নেও হা করো তোমারে খাওয়াই দেই! হা হা হা!!!

সবাই হাসতে থাকে। সবাই যেন বুঝেছে ব্যাপার টা আসলে কী হয়েছে। তবে আফাজ আর সুমু হাসেনা। আফাজ চুপচাপ মুখ নিচের দিকে করে ছিলো। আর সুমু তাকে এক নজরে দেখছিলো। হাত দিয়ে ভাত নেড়ে যাচ্ছিলো। তার যে খাবারের প্রতি খুদা নেই। তবে মনে ছিলো অন্য এক খুদা। এই খুদা তার প্রিয়জনকে দেখবার খুদা। হঠাৎ সুমুর পাশে টেবিলের নিচে উদয় হয় হনুফা। সে মাথা উঠিয়ে চারপাশ দেখে। সবাই হাসতেছে, কিন্তু সুমু সোজা সামনের ছেলেটাকে দেখছে‌। হনুফা চুপিচুপি হাত টা উঠিয়ে সুমুর পাত থেকে সব মাংস নিয়ে নেয়। নিয়েই আবার টেবিলের নিচে ডুব দেয়। টেবিলের নিচে ফ্লোরে বসে সব মাংস গুলো একসাথে মুখে পুরে দেয়। তার মুখে ফুলে যেনো টেনিস বল হয়ে যায়। মুখে মাংস চিবোতে চিবোতে হাতে লেগে থাকা ঝোল গুলো চেটে চেটে খেতে থাকে। রান্না আসলেই অনেক ভালো হয়েছে!!

 

আঙিনার কোনায় থাকা কাঁঠাল গাছ টার পাখির বাসায় মা পাখি ফিরে আসে। এসে বাচ্চাদের মুখে খাবার দিতে থাকে। আকাশের সূর্য চলে যায় এক খন্ড মেঘের আড়ালে।

 

____

 

বড় একটা ল্যাবের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ আর ওসি হাফিজুর রহমান। ল্যাবের যন্ত্রপাতি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। টেস্টটিউবের শিশি গুলো ভেঙে ফ্লোরে পড়ে আছে। কিছু রক্তও পড়ে আছে ফ্লোরে। যেই বেডে আলিশা আর সুরাইয়া বেগমের লাশ দুটো রাখা হয়েছিলো সেই বেড দুটোও উল্টে পড়ে আছে। রিয়াদ হেলে নিচের ফ্লোরে পড়ে থাকা রক্তটা আঙুল দিয়ে ছোঁয়। উঠে দাঁড়িয়ে দুই আঙুল দিয়ে রক্তটা ঘষে। তার পিছন থেকে ওসি হাফিজুর বলেন,

– ফরেনসিক দুই ডাক্তারের রক্ত এটা। খুব খারাপ ভাবে তাদের আহত করা হয়েছে। 

– রক্ত টাও একদম তাজা। (পিছনে ফিরে) নিচে সিকিউরিটি গার্ড থাকার পরও আগন্তক ভিতরে কীভাবে আসতে পারলো? 

– তাদের মুখে স্প্রে করে অজ্ঞান করা হয়েছিলো। আমরা এসে তাদের কেউ হসপিটালে পাঠায়েছি।

– লাশ তো আর হাতে করে নিয়ে যেতে পারবেনা যে কেউ! নিশ্চয়ই সাথে এম্বুলেন্স এনেছিলো ওরা। 

– হয়তোবা। 

 

রিয়াদ চারপাশ দেখতে থাকে। দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর ছবি ঝুলছে। বড় বড় রসায়নের চার্ট ঝুলছে। রিয়াদের চোখ যায় ঘরের কোনে। একটা সিসি টিভি ক্যামেরা লাগানো সেই কোনটায়। রিয়াদ পিছনে ফিরে বলে,

– এই ক্যামেরার ফুটেজ কোথায় পাওয়া যাবে? 

– কিন্ত ক্যামেরাতে তো গুলি করা হয়েছে। 

– হ্যা, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেটার সামনে এসে আগন্তুক দাড়িয়েছে আর বন্দুককের হাত তুলেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তো কিছু সিন তো ক্যামেরায় ধরা পড়েছে! 

– হ্যা ততটুকু ফুটেজ পাওয়া সম্ভব‌। 

– এভিডেন্সও সব নিয়ে গেছে তাই না! 

– হ্যা। এভিডেন্সও কিছু পাওয়া যায়নি। তবে এই ল্যাবের কম্পিউটারে কিছু ইনফরমেশন ছিলো। 

– যেমন?

– লাশ গুলোর শরীরে আঘাত করা হয়েছে লম্বা ছুরি দিয়ে। আর খুব বেশি রক্ত ক্ষরণের কারণে ১৭ বছর বয়সী মেয়েটার মৃত্যু হয়েছে। আর,

– আর কি ?

– আর যিনি বয়স্ক ছিলেন তার রক্তে ড্রাগ পাওয়া গেছে।

– ড্রাগ ? (অবাক হয় রিয়াদ)

– হ্যা ড্রাগ। ফিলোফিসিয়াম ড্রাগ। এটা দিয়ে যেকোন মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনে জমা থাকা ডাটা ধীরে ধীরে মুছে ফেলা যায়। এমনকি স্মৃতি শক্তি পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলা যায় এটা প্রয়োগের মাধ্যমে। 

– এটা তো বেশ দামি একটা ড্রাগ! 

– হ্যা। এইটার অস্তিত্ব বয়স্ক মহিলার শরীরে পাওয়া গেছে। এই তথ্য গুলাই কম্পিউটারের 405 নং ফোল্ডারে ছিলো। দুর্বৃত্তরা হয়তো জানতো না এই বিষয়ে। তাই কম্পিউটার টার বেশি ক্ষতি করেনি তারা। 

– হমম। বেশ ইন্টারেস্টিং। (পায়চারি করে সামনে এগিয়ে এসে) সুরাইয়া বেগমের শরীরে ড্রাগ! তিনি কী তাইলে ড্রাগস নিতেন! কেস টা ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে! 

– উনার নাম সুরাইয়া বেগম ছিলো ? 

পিছনে ফিরে রিয়াদ। বলে,

– হ্যা। সুরাইয়া বেগম। কেনো চিনেন নাকি ? 

– না। আমার অর্ধাঙ্গিনীর নাম সুরাইয়া তো। তাই বললাম। 

– ওহহ। আচ্ছা সিসি টিভি ফুটেজ কালেক্ট করার ব্যবস্থা করেন। আমি একটু এখান টায় দেখি, কিছু পাই কিনা। 

– ঠিক আছে। আমি নিচে সিকিউরিটি রুমে আছি। কাজ শেষ হলে ওখানে চলে আসবেন।

– ঠিক আছে। 

ওসি হাফিজুর চলে যান দরজার দিকে। রিয়াদ আবার সামনের দিকে ফিরে। বিরবির করে বলতে থাকে

‘ সুরাইয়া বেগম ড্রাগ কেনো নিতো ? এই ড্রাগ নিয়েই কী কোন হেরফের হয়েছিলো, যার জেরে তাকে আর আলিশাকে খুন করা হলো! ঐদিকে ওবাড়ির রাফসানকেও তেমন একটা ভালো ঠেকছে না। এইসবের পিছনে ওর হাত থাকলেও থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। খাঁন বাড়িতে একবার যেতে হবে। ও বাড়ির মানুষদের এতোটা স্বাভাবিক থাকা আমার সুবিধার ঠেকছে না। কিছু তো আছে, যা আমার চোখে পড়ছে না। কিন্তু সেটা কী! ‘

 

রিয়াদ ভাবতে ভাবতে পায়চারি করতে থাকে। নিচে থাকা রক্ত তার পায়ের জুতার অগ্রভাগে লাগে। সামনেই সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। রিয়াদ ভাবতে ভাবতে চারপাশে একবার নজর দিয়ে দেখতে থাকে। মেঝেতে চোখ দেয়। সুক্ষ নজরে দেখতে থাকে সবদিক। 

 

____

 

নিপা ব্যাকনিতে বসে আছে। মনে বিষন্নতা। আকাশ টাও একটু মেঘলা হয়েছে। হয়তো রাতে বৃষ্টি আসবে। ব্যালকনির দূরের গাছটাও কেমন যেনো মরার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস নেই। চারপাশ একদম নিস্তব্ধ। নিপা তার কোল থেকে আলিশার জন্য আনা জিনিস গুলো হাতে নেয়। ভিতর থেকে কান্নারা বেড়িয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ করেই আলিশার এমন চলে যাওয়া, সে যেন মেনে নিতে পারছেনা। বারংবার নিজেকে দোষী ভাবছে। সুরাইয়া বেগম তাকে বলেছিলো আলিশাকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে, আলাদা থাকতে। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আলিশার প্রাণ সংশয় আছে। সে কেনো এই বিষয়টাকে গুরুত্বের সহীত নিলো না। নিপা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে। আলিশার জন্য আনা টুপিটা পাশের টেবিলে রেখে দেয়। তার মনে হঠাৎ কিছু কথার উদয় হয়। 

– আচ্ছা ঐদিন যে আমাদের কথা জানালার আড়াল থেকে শুনেছিলো সেই কী মেরেছে? কে ছিলো সেদিন জানালার বাইরে ? শাশুড়ি মা! কিন্তু তিনি কেনো ঘরের লোকেদেরই মারবেন! সুরাইয়া আন্টি আমাকে সেই কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারেননি। (তৎক্ষণাৎ নিপার চোখ মুখ বড় হয়ে যায়। সে যেনো কোন কিছু একটা ভেবে অনেক অবাক হয়। বিরবির করে বলে,

– আমার পেন ক্যামেরা! ঐটা তো আমি ঐদিন ঘরে রেখে এসেছিলাম আলমারিতে কী আছে সেটা দেখার জন্য। সেটায় কী খুন গুলোর ফুটেজ রেকর্ড হয়েছে! 

নিপা তৎক্ষণাৎ তার কোলের জিনিস গুলো হাতে নিয়ে পাশের চেয়ার টায় রেখে দেয়। উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে ব্যালকনি থেকে ঘরে আসে। তাকে গিয়ে সেই পেন ক্যামেরাটা আনতেই হবে। সেটা থেকে সে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পাবে। তখনই ঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে রায়হান। নিপা দাঁড়িয়ে যায়। রায়হান ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিপাকে অস্থির দেখে সে বলে উঠে,

– সুবা, কী হয়েছে! 

– র, রায়হান। রায়হান আমি একটু ঐ ঘরে যেতে চাই। 

– কোন ঘরে ? 

– আলিশাদের ঘরে। 

– ঐ ঘর তো তালা দেওয়া। পুলিশ আসে তারা মেরে দিয়ে গেছে। 

– তালা দেওয়া! 

– হ্যা। কেনো ? ঐ ঘরে তো এখন আমাদের কাউকেই ঢুকতে দিবেনা। তোমাকেও না। ওদের তদন্ত না শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু বলতেও পারবোনা। 

– তুমি কোনভাবে ঐ ঘরের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওনা। ঐ ঘরে,,,,,,

কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় নিপা। তার ফোন বাজছে। রায়হান গিয়ে বিছানা থেকে নিপার ফোনটা হাতে নেয়। নিয়ে নিপার সামনে এসে তাকে দেয়। বলে,

– তোমার ভাইয়া ফোন দিছে মনে হয়। নেও। কথা বলো। 

নিপা ফোনটা হাতে নেয়। এখন আবার তার ভাইয়া ফোন দিতে গেলো কেনো! নিপা আর সাতপাঁচ না ভেবে ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলে। 

– ভ,ভাইয়া। আসসালামুয়ালাইকুম। 

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস রে। 

– এ,এইতো ভাইয়া ভালো। তোমরা? 

– হ্যা আছি ভালোই। কোথায় তুই ? বাসাতে ? 

– হ্যা ভাইয়া বাসাতেই। 

– আচ্ছা তাইলে বাইরের গেটের সামনে আয়, আমি আর দিথী আসছি। তোর সাথে একটু দেখা করতাম।

– জ,জ্বী ভাইয়া আসছি। 

– আচ্ছা আয়।

নিপা কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নেয়। রায়হান কিছুটা উৎসুক হয়ে বলে,

– কী বললো? 

– ভাইয়া নিচে আসছে। দেখা করতে।

– অন্দরমহল থেকে তো আমি মাত্রই আসলাম। তোমার ভাইয়াকে তো দেখলাম না!

– ও সরি। ভাইয়া গেটের বাইরে আছে। অন্দরমহলে আসেনি। 

– গেটের দিকে! তুমি ভিতরে আসতে বললানা,

– মাথায় ছিলোনা আমার। 

– থাকবেনা তো। চলো। 

রায়হান নিপার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে দিয়ে চলে যায়।

 

       খাঁন বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দিথীর সাথে কথা বলছে শাহারিয়া। আকাশ কিছুটা মেঘলা। এখন একটু ঠান্ডা বাতাসও বইছে। রাস্তা দিয়ে একট সাইকেল চলে যায়। খাঁন বাড়ির বড় গেইটটার পাশের ছোট গেইটটা খোলার আওয়াজ আসে। শাহারিয়া আর দিথী পিছনে ফিরে তাকায়। নিপা আর রায়হান বেড়িয়ে আসে। শাহারিয়ারা বড় গেইটটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিপা আর রায়হান শাহারিয়াদের সামনে আসে। নিপা শাহারিয়াকে ছোট করে জড়িয়ে ধরে। 

– কবে আসলি! 

– এইতো ভাইয়া কাল রাতে। 

– আমি আর তোর ভাবি চলে যাচ্ছি। (নিপাকে ছাড়িয়ে নিয়ে) আজ সন্ধ্যায় ট্রেন। 

– চলে যাবা! আর কটা দিন থাকতা!

– এইবার আসে মেলাদিন থাকলাম। ঐদিকে কাজ গুলো সব আহনাফকে সামলাইতে হচ্ছে, স্যার আবার শুনলে রাগ করবে। এতোদিন ছুটি কাটাইছি এই, সেই, বলবে। তাই যাইতে হইতেছে।

– আবার কবে আসবা।

– ঠিক নাই‌। কাজের চাপ বাড়লে আসা হবেনা তেমন একটা। (রায়হানের দিকে তাকিয়ে) বাড়ির খুন গুলার কোন কুলকিনারা বের হয়েছে! 

– না‌ ভাইয়া। রিয়াদ ভাই দেখতেছে। 

– নিপাকে নিয়ে সাবধানে থাকিও। গ্রামের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হইতেছে। পারলে ঢাকা চলে যেও। (নিপার গালে হাত রেখে) সাবধানে থাকবি কিন্তু। আর ঘরে একলা থাকলে সবসময় দরজা লাগিয়ে রাখবি। অপরিচিত কারো গলা পেলে একদম দরজা খুলবি না। 

– ভাইয়া আমি আছি একয়দিন বাসায়। আমি ওর সাথে সবসময় থাকবো। আপনারা ভিতরে আসেন। একটু চা নাস্তা খেয়ে যান। (রায়হান)

শাহারিয়া হাত ঘড়ি উঠায়। রায়হানকে বলে,

– সময় তো বেশি একটা নাই। দিথীর বাবার বাসায় গেছিলাম। ওখানেই দেরি হয়ে গেলো। পরে কোন একদিন। 

– আবার কখন না কখন আসেন! 

– দেখা যাক। আমি তো আর হারিয়ে যাচ্ছিনা। সিলেটে আসলে আমাদের ওখানে আসিও।

– জি আচ্ছা ভাইয়া। 

– কোন দরকার পড়লে ফোন দিস। এখন নতুন জীবন শুরু করছিস। একদম ছেলে মানুষি করবি না কেমন! 

– ঠিক আছে ভাইয়া। (নিপার মন খারাপ হয়। তার চোখ কিছুটা ছলছল করছে। দিথী বলে,

– চলো তাইলে। বাসায় যায় ব্যাগ গুছাইতে হবে। 

– বনু, গেলাম হ্যা। ভালোভাবে থাকিস। রায়হান, আমার বোনটা কিন্তু এখন তোমার আমানত। যত্নে রেখো! 

– জি আচ্ছা ভাইয়া। আসসালামুয়ালাইকুম। 

– ওয়ালাইকুমুস সালাম।

শাহারিয়ারা বিদায় নিয়ে চলে যেতে থাকে। নিপা রায়হানের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে থাকে। তার মন যেন কেমন করছিলো। শাহারিয়া যদিও তার সৎ ভাই, তবুও সবসময় আপন বোনের মতো তাকে স্নেহ করেছে, আগলে রেখেছে। আগেও তো শাহারিয়া ঢাকা যেতো। তখন তো এতো খারাপ লাগতো না। তবে আজ কোনো লাগছে। নিপা ছলছল চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। 

শাহারিয়া দিথীর সাথে হেঁটে যেতে যেতে একবার পিছনে ফিরে তাকায়। নিপা আর রায়হানকে একসাথে পাশপাশি দেখে একটা ছোট্ট হাসি দেয়। তার বোনটা সুখি হোক, ভালোভাবে নতুন জীবনে স্থায়ী হোক, মন থেকে তার শুধু এটাই চাওয়া। শাহারিয়া হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায় তাদের। সামনে ফিরে চলে যেতে থাকে। 

আকাশ আজ রঙিন হয়নি। কালো মেঘের ছায়া সাজিয়ে গর্জন করে উঠেছিলো কয়েকবার। হয়তো কারো জীবনে নামবে এমন কালো মেঘ, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী না হোক। না হোক কারো বেদনার কারণ।

 

_____

 

আহনাফ হসপিটালের রুমে প্রবেশ করে। হাতে এক গাট্টি ফাইল-পত্র। ভিতরে প্রবেশ করেই দরজাটা চাপিয়ে দেয়। পেসেন্টের বেডের দিকে চোখ দিতেই দেখে আফরিন নেই। তৎক্ষণাৎ চারপাশ দেখতে থাকে। দেখে আফরিন রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা ছিলো হসপিটালের ৫ তলায়। জানালা দিয়ে নিচের রোডের ভিউ হয়তো ভালোই দেখা যায়। আহনাফ গিয়ে বেডের সামনে থাকা দুটো চেয়ারের মাঝে একটায় বসে। ফাইল গুলো বিছানার ফাঁকা যায়গাটায় রাখে। ফাইল রাখার শব্দ মৃদু হলেও তা আফরিনের কান অব্দি ঠিকই পৌছায়। আফরিন পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে আহনাফ এসেছে। সে জানালার পাশ থেকে ফিরে হেঁটে আসতে থাকে বিছানার দিকে। এসে বিছানার পাশে থাকা আরেকটা চেয়ারে বসে। আফরিনের মা ঘুমাচ্ছিলো। আহনাফ ফাইল গুলো গুনে দেখতে থাকে। আফরিনের দিকে একবার চেয়ে আবার ফাইল গুনতে থাকে। আহনাফ বলে,

– দুপুরে নার্স আসছিলো ? 

– হ। আইছিলো। 

– আমি নার্সকে টাকা দিয়ে গেছিলাম। আজ ফিরতে একটু দেরি হতো তাই ফোন দিয়ে বলেছিলাম তোমার জন্য খাবার কিনে তোমাকে এনে দিয়ে যেতে‌। দিছিলো তো না।

– হ। দিছিলো। (একটু থেমে) এডি কী ? 

– কোন গুলো? এগুলো ? এগুলো ফাইল। কেস ফাইল। ঐ যে রন্জুর ফাইল নিয়ে বলছিলাম না ঐদিন, ঐ কেস ফাইল। (একটু থেমে) ঐদিন তো ফাইল গুলা স্যারের কেবিন থেকে আনতে পারিনি। আজ স্যারকে ফোনে বলে নিয়ে আসলাম। 

– আপনে এডি এহন মুখস্থ করবেন।

– না না। কীসের মুখস্থ। ফাইল গুলা দেখে রন্জুর করা কাজ গুলো ভালোভাবে পড়ে দেখবো। কতগুলা মেয়েকে সে কিডন্যাপ করেছে। কোথা থেকে কিভাবে করেছে এগুলোই। 

– হেয় কী মাইয়া পাচার করে! 

– মনে তো হয় তাই। কমবয়সী মেয়েদেরকে নিয়ে গিয়ে তা থেকে তো এই ব্যবসা টাই হয়। 

– ঐদিন যে সর্দারনিরে একটা গাড়ি আইয়া তুইলা নিয়া গেলো, হেইডাও কী রন্জু করছিলো? 

– আ্যঁ, তা তো সঠিক জানিনা, গাড়ির নাম্বার প্লেট ঢাকা ছিলো। আর গাড়িটাও সাধারণ মাইক্রো ছিলো। রন্জু তো সবসময় কালো রঙের মাইক্রোতে করে তার মেয়ে ধরার কাজ চালায়। বেশীরভাগ কেসে এমনি তথ্য পাওয়া গেছে। 

– গাড়ি ধুইতেও দিবার পারে। এরলাইগা হয়তো অন্য গাড়িতে কইরা নিয়া গেছিলো। 

– গাড়ি ধোঁয়া,,,,,,, হমম। কথাটা খারাপ বলোনাই। Out of the line, But right!

– কী কইলেন। আমি ইংরেজি বুঝিনা।

– মানে তুমি লাইনের বাইরে গিয়ে ভাবছো, কিন্তু সঠিক টাই ভাবছো।‌ হইলেও হইতে পারে। আচ্ছা বাদ দেও, গাড়ি নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। ফাইল চেক করবা! করলে নেও একটা। (আহনাফ একটা ফাইল আফরিনের দিকে এগিয়ে দেয়। আফরিন বলে,

– আমি তো ফড়ালেহা পারিনা। কহনো ইসকুলে যাইনাই।

– 1, 2 ও পড়ো নাই ? 

– না। আমাগো চাইল আনতেই নুন ফুরায়, আরো ফড়ালেহা। 

– তোমার মা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেই আমি তোমাকে পড়ানো শুরু করবো। 

– আম্মায় আইজ সকালে আপনারে খুঁজছিলো। 

– খুঁজছিলো? কেনো ? 

– আমারে কয়নাই। খালি কইছিলো আপনে আছেন না নাই। 

– আজ সকালে আসতে পারিনাই। সকালে উঠে গেছিলাম কাওরান বাজার, একটা ব্যাংকের সিসি টিভি ফুটেজ আনতে। তারপর সেখান থেকে বাসা ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। 

– কি আনতে গেছিলেন! 

– সিসি ক্যামেরার ভিডিও। কয়দিন আগে কাওরান বাজারের মোড়ে ৩ টা মেয়েকে অনেক গুলো টাকার সাথে কারা যেনো ফেলে গেছিলো। খুব সকাল সকাল হওয়ায় মসজিদ থেকে বেড়োনো দুই-একজন দেখছিলো। তবে পরে আর মেয়েগুলাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটা ব্যাংক ছিলো কিছুটা দূরে। হয়তো ঐটার সিসি ক্যামেরায় কিছু যদি ধরা পড়ে থাকে, তাই আনতে গেছিলাম। শাহারিয়া স্যারকে জানাইছিলাম। স্যারই বলছে গিয়ে ফুটেজ গুলো নিয়ে আসতে। 

– আপনার স্যার এহনো আহেনাই। 

– না। তবে আজ ফিরার কথা। (হাত উঠিয়ে ঘড়ি দেখে) আজকে রাত ৭ টার ট্রেন উনার। শ্রীমঙ্গলে কাল সকালে পৌছাবেন, তারপর ঢাকা এসে আমার কাছ থেকে ফুটেজ আর বাকি ইনফরমেশন নিয়ে যাবেন। 

– আপনেও হের লগে গোয়েন্দাতে চাখরি করেন না! 

– হ্যা। আমিও স্যারের সাথে। বলতে পারো সারের পিএস। মানে পার্সোনাল সেক্রেটারী আরকি। 

আফরিন তার মায়ের উপরে ভালোভাবে কাঁথা তুলে দেয়। দিয়ে আবার চেয়ারে বসে। তার মায়ের হাত টা কাঁথা থেকে বেড়িয়ে ছিলো। আফরিন তার মায়ের হাতে খসখসে উঠে যাওয়া চামড়া গুলো আস্তে আস্তে তুলে দিতে থাকে। আহনাফ তা একবার দেখে আবার ফাইল দেখাতে মনযোগ দেয়। একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে মনযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। জানালা দিয়ে বাইরে আলো ক্রমেই নিভে আসতে থাকে। অর্থাৎ সন্ধ্যা নেমেছে। অবশ্য রুমে কয়েকটা সাদা বাল্ব জ্বলছে। বাইরের আলো কমলেও ঘরের উজ্জলতা কমেনি। আহনাফ আর আফরিন, দুইজন তাদের কাজে মনোনিবেশ করে। 

 

((( এই পর্বের ২য় ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে)))

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭০ (২য় ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

((( এই পর্বের ১ম ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে)))

 

শিউলি বেগমের রুম। ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে কালো বোরখা পড়ে দাঁড়িয়ে আছে দিথী। বোরখার মাঝখান টায় গাঢ় খয়রি রং। শিউলি বেগম দিথীকে হিজাব পড়িয়ে দিচ্ছেন। দিথী বোরখা পড়ার অভ্যাস নেই তেমন একটা। হিজাবও আজ সে প্রথম পড়ছে। শিউলি বেগম দিথী পিছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হিজাব ঠিক মতো পড়িয়ে দিচ্ছেন। মুখে দাঁত দিয়ে চেপে রাখা সেফটিপিন টা হাতে নিয়ে হিজাবের পিছনের প্রথম জয়েন্টে লাগিয়ে দেন। বলতে থাকেন,

– ঐহানে যাইয়া একদম ঝগড়া কাচাল কইরো না। মিল্লামিশা থাইকো। শাহারিয়া যা কইবো তা হুইনো। ঐহানে তো বলে আলাদা একটা বাড়ি কিনছে হুনলাম। শাহারিয়া যহন অফিসে থাকবো তহন একলা একলা বাড়ির বাইরে যাইয়োনা। রুটিন কইরা নিবা। প্রতিদিন সকাল সকাল উঠবা আর রাইতে তাড়াতাড়ি ঘুমায়া যাইবা। পোলাডা আমার রান্না-বান্না একদম পারেনা। এরলাইগাই বিয়াডা তাড়াতাড়ি দিলাম। সকাল ১১ ডা ১২ ডার মইধ্যে রান্ধা শেষ কইরা গোসল কইরা নিবা। ঠিক আছে! 

– আচ্ছা মা। 

– শাহারিয়ার ঐহানে কিন্তু তুমি ছাড়া আর কেউ নাই। তুমিই হইলা অর সব। ঐহানে তুমিই অর বউ, তুমিই অর মা, তুমিই অর বোন, তুমিই অর বান্ধবী। অরে সঙ্গ দিয়ো। একলা একলা থাকতে থাকতে এহন দেহোনা, বাড়িত আইলে খালি ঘরে ঢুইহা থাহে। (একটু থেমে) তোমার জীবনে এহন দেইখা দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু। মাইয়াগো জীবন ৩ অধ্যায় থাহে। এক, যহন হেয় ছোট থেইকা বড় হয়। তহন হেয় থাহে কিশোরী, তারপর কুমারী হইয়া যাওনের পর হের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু। এইহানে অর পরিচয় বউ। একজন পুরুষের সঙ্গিনী। আর তারপর, জীবনের শেষ অধ্যায়, মা। এই বয়সে অয় ওর পেডের সন্তান ডিরে লালন পালন করে। পুরুষের কাম হইলো বিয়ার পর নারীর একজন উপযুগী স্বামী হইয়া উডা। তার বউ যহন প্রেগন্যান্ট হইবো, তহন তারে মানষিক দিক দিয়া সাপোর্ট দেওয়া। একটা মাইয়া যহন মা হওয়ার দারপ্রান্তে থাহে, তহন তার শারীরিক দিকের থেইকা বেশি প্রয়োজন তার মানষিক সাপোর্ট। এইসময় তার মনে অনেক ভয় জাগে, নানা চিন্তা মাথায় ঘুরে। স্বামীর ভালবাসা, আর সাপোর্ট তহন তার মনোবল শক্ত করে। তারে ভাইঙ্গা যাইতে দেয় না। তুমি এহন বউ হইছো। কয়েকদিন পর মা হইবা। শাহারিয়া অর বাপের মতোই হইছে। অয় তোমারে অনেক আগলাইয়া রাখবো। তোমারে অয় ভালোবাইসা বিয়া করছে। অয় অর ভালোবাসারে ঠিকই যত্নে রাখবো‌।

– আব্বা আপনার অনেক কেয়ার করতো, তাই না মা।

– হ, তা আর কইতে। আমি একটু অসুস্থ হইলেই পাগলের মতো হইয়া যাইতো। ডাক্তারের পর ডাক্তার আনতো।রাত যাইগা আমার পাশে বইসা থাকতো। তোমার আব্বায় এমনিতে যত কঠিন, আবার ততই নরম। 

– শাহারিয়ার কোন মেয়েলী বিষয় নিয়ে ঝামেলা আছে নাকি মা! 

– না না। অর এমন কোন কেস নাই। তারপরও, পোলা মানুষের কথা কওয়া যায় না। হেগো মন বদলাইতে সময় নিবোনা। তুমি ওরে নিজের আঁচলে বাইন্ধা রাখবা। তোমার উপর অয় সন্তুষ্ট থাকলে আর কোন মাইয়ার দিকে চোখ তুইলা তাকাইবো না। 

– আমি চেষ্টা করবো মা। 

– হ। পুরুষ মানুষ হইলো লম্বা রেসের ঘোড়া। হেগোরে একই সাথে পরিবার আর আপন মানুষ গুলারে আগলায় রাখতে হয়। শাহারিয়া যহন অফিস শেষ কইরা ক্লান্ত শরীর নিয়া বাড়ি ফিরবো, তহন তারে সাদরে গ্রহণ করবা। তার ক্লান্তি ডারে তোমার প্রশান্তির ছোঁয়া দিয়া নাই কইরা দিবা। ভালোবাসা যত দিবা, তত পাইবা। এইহানে লাভ ছাড়া ‌লস নাই। আর যহন শাহারিয়া রাইগা থাকবো তহন চেষ্টা করবা তার পছন্দের খাওন রান্না করার। অর লগে সুন্দর সুন্দর কথা কওয়ার। দেখবা রাগ গইলা পানি হইয়া গেছে। 

– ঠিক আছে মা। 

– আমার দিকে ফিরো। দেহি সামনে হিজাব ঠিক ঠাক হইছে না নাই। 

দিথী ঘুরে শিউলি বেগমের দিকে ফিরে। শিউলি বেগম মাথার হিজাব টা দেখে যেখান টায় একটু কম পড়েছে সেখান টায় টেনে টুনে ঠিক করে দিতে থাকেন। বলেন,

– ওহানে যাইয়া আবার আমাগোরে ভুইলা যাইয়োনা। শাহারিয়ারে কইয়ো তোমার আব্বার ফোনে ভিডিও কল দিতে। কথা কমুনে তহন। (একটু থেমে) মুহে ক্রিম দিবানা! 

– দিছি মা। 

– ওহহ। ভালো। তোমার আব্বারে দেখতে গেছিলা! 

– হ্যা মা। বিকালে গিয়ে আব্বার সাথে দেখা করে আসছি। নিপা আর দুলাভাইয়ের সাথেও দেখা করছি। 

– মাইয়াডারে যে কই বিয়া দিলাম। দিনে দুপুরে বাড়িতে ঢুইকা খুনি দুই দুইডা খুন কইরা গেলো। সারাদিন মাইয়াডার লাইগা চিন্তা হয়। 

– কিচ্ছু হবেনা মা। দুলাভাই আপনার ছেলের মতোই পালোয়ান। কেউকে নিপার কাছে ভিড়তে দিবেনা।

– তেমনি যেন হয় মা। (একটু থেমে হিজাব পুরোপুরি ঠিক করে দিয়ে) এহন ঠিকঠাক। মাস্ক পড়বা নাকি ? পড়লে পড়ো।

– না মা। মুখ ঘামে যায় তখন। 

– নাতি নাতনি জলদি লইয়া লইয়ো। এহন জোয়ান থাকতে থাকতেই আমরা তাইলে একটু কোলে লইয়া ঘুরতে পারমু। পরে নাইলে, কোমল আর বাতের বিষ (ব্যাথা) ধরলে আর কোলে নিয়া ঘুরা যাইবো না।

দিথী খানিকটা লজ্জা পায়। মাথা নামিয়ে নেয়। মুখে মুচকি হাঁসি। গাল গুলো লাল হয়ে গেছে। শিউলি বেগম দিথীর মুখ তুলে বলতে থাকেন,

– আয় হায়, এতো শরম পাইতাছো ক্যান! শরম তো পাইবো আমার পোলায়। তোমার যে কারেন্ট!!!! হা হা হা!!

দিথীও মুচকি হাসি হাসতে থাকে। সে একটু বেশিই আকৃষ্ট হয় বোধহয় শাহারিয়ার প্রতি। শিউলি বেগম হাসি থামিয়ে দিথীকে আয়নার দিকে ফিরিয়ে তাকে একবার দেখিয়ে নিতে থাকেন। 

শাহারিয়ার ডাক শোনা যায় বাইরে থেকে,

– মা, তোমাদের হইছে! সময় তো বেশি নাই। বের হইতে হবে।

– হ হইছে হইছে। (দিথীকে তার দিকে ফিরিয়ে) ডাকতাছে, চলো।

 

    শিউলি বেগম আর দিথী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো শৈশব, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো শাহারিয়া। শাহারিয়ার পড়নে ফরমাল শার্ট, আর জিন্স প্যান্ট। পায়ে কালো জুতো। বেশ সুন্দর লাগছে তাকে। শাহারিয়া দিথীকে এই প্রথম হিজাব আর বোরখায় দেখলো। আরাবিয়ান মেয়েদের মতো লাগছে দিথীকে। মেয়েরা বোধহয় বোরখা আর হিজাবেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। শিউলি বেগম দিথীকে ছেড়ে শাহারিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। শাহারিয়ার ঘোর ভাঙে। শিউলি বেগম শাড়ির আঁচলের কোনটা হাতে উঠিয়ে বলতে থাকেন,

– আবার কপালে আর ভ্রুতে পাউডার লাগায়া রাখছে। তুই বড় হইবি কবে রে শাহারিয়া। কয়দিন পর বাচ্চার বাপ হইবি, আর এহনো মুহে পাউডার টা ঠিকমতো মিশাইতে পারোস না! এদিক আয়। 

শাহারিয়া শিউলি বেগমের সামনে আসে। শিউলি বেগম উচ্চতায় শাহারিয়ার কাঁধ পর্যন্ত। হাত উঁচিয়ে শাড়ির আঁচলের কোন দিয়ে শাহারিয়ার চোখের ভ্রু আর কপালের পাউডার মিশিয়ে দিতে থাকেন। ছোট থেকেই কোথাও বেড়োতে গেলে শাহারিয়া পাউডার দিতে যাবে। আর মুখে এভাবে লাগিয়ে রাখবে। শিউলি বেগম কপাল আর ভ্রুয়ের পাউডার মুছে দেন। শার্টের কাঁধের অংশ টেনে দেন, শার্টের নিচের দিকেও হালকা টেনে টুনে দেন। বলতে থাকেন,

– টিফিন বাটিতে ভাত আছে। যাইয়া পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে তো সকাল হইবো। রাতে খিদা লাগলে খাইয়া নিবি। ফোন দিবি মাঝে মাঝে। বাইরে গেলে তো বাড়ির কথা ভুইলাই যাস। আর মাঝে মাঝে আওয়ার চেষ্টা করবি। একবার গেলে তো ৪-৫ বছরও তোর পায়ের ধুলা পড়েনা এবাড়িত। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক মতো করবি। বউডার লগে মিল্লামিশা থাকবি। 

– আচ্ছা আচ্ছা মা সব ঠিক আছে। এখন যাই। সময় যে বেশি নাই। 

– তোরে তো ধইরা রাখমুনা। যাবিই তো। শৈশব,,,, তোর চাচায় ভ্যান অটো কিছু আনছে ? 

– চাচি বাইরে চাচা খাড়ায়া আছে। অটো আনছে।

– যা ব্যাগ টা নিয়া যা। আহো তোমারও আহো।

শৈশব ব্যাগটা নিয়ে আগে আগে চলে যায়। শাহারিয়া বারান্দা থেকে আঙিনায় নামে। দিথীকে নিয়ে তার পিছু শিউলি বেগমও আঙিনায় নামেন। চলে যেতে থাকেন। সুমু আর ফুলমতিও তাদের ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দা থেকে আঙিনায় নেমে যেতে থাকে। লায়লা হয়তো পিছনের বাগানে আছে। আফাজ ঘরে ঘুমাচ্ছিলো। 

 

      বাড়ির গেইট দিয়ে বের হয় সবাই। তবে ফুলমতি আর সুমু বাড়ির গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারা সামনে এগোয় না। অটোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মতিন মেম্বার বলেন,

– এতোক্ষণে তোমাগো আওয়ার সময় হইলো। সন্ধ্যা নাইমা গেছে। তাড়াতাড়ি স্টেশন যাইতে হইবো তো। 

– মাইয়া, পোলারে একটু সাজায়া দিমু না। (দিথীর দিকে ফিরে) যাও উডো।

দিথী আর শাহারিয়া গিয়ে অটোর একদম পিছনের সিট গুলোয় বসে। সেই সিট গুলোর সামনাসামনি থাকা সিট টায় মতিন মেম্বার বসেন। উপরের হাতল ধরে শৈশবকে বলেন,

– শৈশব ব্যাগটা সামনে রাখ‌‌। তুই বাড়িত থাহিস, আমি ওগোরে ট্রেনে উঠায় দিয়া আইতাছি।

– আইচ্ছা মেম্বার সাব।

শৈশব ব্যাগটা সামনের অটো ড্রাইভারের পাশে রাখে। অটো চলতে শুরু করে। দিথী আর শাহারিয়া বিদায় জানায় শিউলি বেগমকে। শিউলি বেগম মুখে আঁচল চেপে কান্নারত মুখটা ঢাকেন। হাত উঠিয়ে তাদের বিদায় জানান। শাহারিয়া তার পেটে ধরা সন্তান না হলেও শাহারিয়াকে তিনি ছোট থেকে নিজের অংশ ভেবেই বড় করেছেন। আগলে রেখেছেন। চেষ্টা করেছেন মায়ের অভাব পূরণ করার। এখন ছেলেটা বড় হয়ে গেলেও মায়াটা আগের মতোই রয়ে গেছে। 

দরজার আড়াল হতে দাঁড়িয়ে থাকা সুমু নতুন কিছুর সাক্ষি হয়। এই রকম দৃশ্য তার কাছে নিতান্তই নতুন। তবে দিথী চলে যাওয়ায় তার কিছুটা খারাপ লাগছে। নতুন বাড়িতে নতুন এক পরিবেশে সে এখন প্রায় একলাই বলা যায়। তার বন্ধু হিসেবে শুধু হনুফা আর লায়লাই আছে। তখনই সুমুর মনে পড়ে, লায়লা আর হনুফা কই!!!

 

   মেম্বার বাড়ির পিছনের ফুল বাগান। বাগানের একপাশের বসার যায়গাটায় লুডু খেলতেছে হনুফা আর লায়লা। হনুফা গুটি চালে। কৌটায় পুরে দান দেওয়ার জন্য পুটি টা লায়লাকে দেয়। লায়লা পুটি চালে। তার আসে ৩। সে চালাকি করে ৩ ঘরের যায়গায় ৪ ঘর আগায়। আর হনুফার গুটিটাকে খেয়ে দেয়। আনন্দ উল্লাস করতে থাকে লায়লা। হনুফা মুখে আঙ্গুল দিয়ে গুনতে থাকে ৩ ঘর দিলে তো তার গুটির পিছনে পড়ার কথা। তাইলে তার গুটি কেমনে খাইলো!

– বন্দু, তুমি চিটিং করছো। তোমার গুটি আমার গুটির পিছনে থাকার কথা। তুমি আমার গুটি তাইলে ক্যান খাইসো।

– না না বন্দু, আই কীয়ের চিটিং করতাম। এইডা সাইন্স। তুই সাইন্স বুঝোস না বইলা তোর গোনায় ভুল হইছে।

– না না আমি এই খেলা মানিনা। তুমি চিটিং করছো। তুমি চিটিং করছো।

– আই কোন চিটিং করিনাই। তুই ভুল গুনছোস! 

– না না এই খেলা আমি মানিনা। 

– হনুফা তোর মানাই লাগবো। এইডাই সাইন্স।

– না আমি মানি না মানি না।

বলেই লায়লার সাথে মারামারি লাগায় হনুফা। হনুফাকে লায়লা ছুঁতে পারছিলো। লায়লা হনুফার চুল ধরে টানে, হনুফা লায়লার জামা ধরে টানে। দুইজনের মাঝে কঠিন মাইর হয়। তবে তা যে শুধু মজার ছলে দুই বন্ধুর মারামারি, তা আমাদের বুঝতে বাকি রয়না।

আকাশের মেঘ গুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। সূর্য অস্ত গেছে। শুধু হালকা মৃদু দিনের আলোই কেবল অবশিষ্ট আছে। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আযান। রাস্তা দিয়ে মুসল্লিরা মাথায় টুপি পড়তে পড়তে হন হন করে ছুটে যায় মসজিদের দিকে।

 

____

 

রিয়াদ কাপড় ভাঁজ করছে। দিনাজপুর থেকে একটু আগেই বাসা ফিরলো। গোসল করে এসে এখনো গামছা পেঁচিয়েই আছে। মাথার চুল গুলো ভিজা, এলোমেলো। এখন আর সে কাপড় চোপড় সব বিছানায় এনে খুলে রাখে না। ভাঁজ করে আলনায় রাখে। 

পুলিশ ইউনিফর্ম টাও ভাঁজ করে গিয়ে আলনায় রেখে আসলো সে। খিদা লাগছে, দুপুরে বাইরে হালকা নাস্তা খেয়েছিলো, সেই খাওয়ায় কী এতোক্ষণ থাকা যায়! ভাইয়াকে বলে আসলো ভাত রান্না হইলে গরম গরম ভাত দিতে। তার ভাই রাতুল এখন রান্না ঘরে, রাতের খাবার রান্না করছে। 

রিয়াদ আলনা থেকে একটা লুঙ্গি হাতে নিয়ে চলে আসে বিছানার কাছাকাছি। গামছার উপরই লুঙ্গি পড়তে থাকে। দাঁত দিয়ে লুঙ্গির এক প্রান্ত চেপে ধরে ভিতরের গামছা খুলে উপর দিয়ে বের করে নেয়। ভেজা গামছাটা বিছানার কোনে রেখে লুঙ্গির গিট্টু ঠিক করে বেঁধে দিতে থাকে। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠে। ফোনটা ছিলো বিছানার পাশের টেবিলটায়‌। রিয়াদ বিছানার কোনে রাখা গামছাটা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে। টেবিলের সামনে এসে ফোনটা হাতে নেয়। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল। শেষে ৯০৬। তার পরিচিত কারোর নাম্বার বলে তো মনে হচ্ছে না। রিয়াদ কল টা রিসিভ করে কানে তুলে। ওপাস থেকে একটা নমনীয় মেয়েলী কন্ঠ ভেসে আসে। 

– আসসালামুয়ালাইকুম।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। কে? 

– আ,আমি ইকরা। 

– ইকরা ? ও ও, ইকরা‌! কেমন আছো! 

– চিনতে পারছেন তাইলে। হ্যা আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ? 

– আমিও ভালো আছি। আমার নাম্বার কোথায় পেলে ? 

– ফুফুর কাছ থেকে নিয়েছি। 

– চাচি দিছে? 

– হ্যা। আজ সকালে নিয়েছি। আপনি বলেছিলেন আমাকে কল দিবেন, হয়তো কেসের চাপে ভুলে গিয়েছেন। তাই আমিই দিলাম। 

– বাহ, তো আমাকে এখনো আপনি করে বলছো কেনো! তুমি করে বলো, আমি কী এখনো তোমার আপনি রয়ে গেছি? তুমি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিনি ? 

– তা তো করেছেন। আচ্ছা তুমি করেই বলবো এরপর থেকে। 

– আঙ্কেল আংটি কেমন আছে ? সৈয়দপুর থেকে ফিরেনি ? 

– মা এখনো ফিরেনি। মামার অবস্থা বেশি একটা ভালো না। আর বাবা চট্রগ্রাম চলে গেছে। বাসায় বলতে গেলে আমি একা। আফাজ তো মনে হয় ফুফুর বাসা চলে গেছে। 

– তোমার বাবা চট্রগ্রামে, ওখানে তোমাদের আত্মীয় আছে নাকি ? 

– না না, আমাদের ট্রেডিং ব্যবসা। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বাবার দোকান আছে। পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করে। 

– ওহ। আফাজের বিষয়টা শুনো নাই ? 

– না তো। কী হইছে আফাজের ? 

রিয়াদ একটু থামে। তার উচিত না এসব এখন বলা। তখন আবার টেনশন করে যদি। রিয়াদ আবার বলে,

– না, তেমন কিছুনা। আফাজ এখানে আসছে এটা জানো কী না তাই বলছিলাম।

– হ্যা জানি। ও যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছিলো। কিন্তু ওর তো ২ দিন পরই ফিরে আসার কথা ছিলো। কিন্তু ৫ দিন চলে গেলো, এখনো মনে হয় ফুফুর বাড়িতে আছে। 

– হ্যা এখানেই আছে। তুমি একলা কীভাবে আছো? ভয় করেনা ? 

– তেমন একটা করেনা। মা যাওয়ার আগে বানু খালাকে বলে গেছিলেন আমাদের সাথেই থাকতে। বানু খালাই এখন আছেন। তিনিই রান্না করেন। আমাদের অনেক দিনের কাজের বুয়া উনি, খালা বলেই ডাকি আমরা সবাই। 

– ওহহ। তো কলেজ যাও না ? (বিছানায় বসে) পরীক্ষা তো আর কয়েকদিন পরেই। 

– আমাদের এদিকে ২ দিন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। যাইতে মন চায় না। বাসা তেই পড়তে বসি। 

– ঠিক মতো পড়িও। আর দেখি আমি এই সপ্তাহে একদিন তোমাদের ওখানে ঘুরতে যাবো। 

– আসিও। রংপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা নিয়ে কোতোয়ালি পাড়ায় চলে আসবা, ৪ নং রোডের ৩ নাম্বার বাড়িটায় দোতলায় আমরা ভাড়া থাকি। ‘বহুব্রীহি’ নাম বাড়িটার। সামনে লেখা আছে। তুমি আসার আগে আমাকে জানাইয়ো। 

– আচ্ছা। যাওয়ার আগে জানাবোনে। তো এখন বলো দিনকাল কেমন যায়, সারাদিন তো একলা একলা থাকতে ভাল্লাগে ? 

– লাগে কিছুটা, টিভি দেখি শুয়ে থাকি পড়ি,,,,,,,,,,,

রিয়াদ আর ইকরা কথা বলতে থাকে। দুইজনের মুখেই হাসি। ফোনে এই প্রথম আলাপা তাদের। রিয়াদ, খাঁন বাড়ির ব্যস্ততা, কয়দিন আগে পাওয়া দুইটা লাশের কেস সবমিলিয়ে একটু বেশিই ব্যাস্ত ছিলো। তবে তার মাথার ভার এখন নেমে গেছে বলা যায়। প্রিয় মানুষের সাথে সময় কাটানো, কথা বলা মস্তিষ্কে এক বিশেষ হরমোন নিঃসরণ করে। যা আমাদের আনন্দ কিংবা প্রশান্তির অনুভূতি দেয়। 

বাড়ির বাইরে থেকে জানালায় আড়ি পেতে তাদের কথা শুনতে থাকে রাতুল আর মায়া। তাদের রিয়াদ যে নতুন নতুন প্রেমে পড়ছে তা আর তাদের বুঝতে বাকি রয় না।

 

_____

 

ট্রেনের বগিতে উঠে পড়ে শাহারিয়া আর দিথী। শাহারিয়ার হাতে ব্যাগ। ট্রেন ছেড়ে দিতে আর মাত্র ২ মিনিট বাকি। মতিন মেম্বার তাদের উঠিয়ে দিয়ে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে দিথী আর শাহারিয়াকে দেন,

– লাগবে না বাবা। তুমি এগুলা দিয়ে বাসায় মায়ের জন্য ফল কিনে নিয়ে যাইয়ো।

– তুই ধরতো। (দিথীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে) বউমা নেও। কিছু কিন্না খাইয়ো। দুইজনে মিল্লা মিশা থাইকো। আমি দেহি তোমার শাশুড়িরে লইয়া একদিন তোমাগো বাসায় আমুনে। শাহারিয়া, বউমার লগে বকাঝকা করিস না। গোয়েন্দা হইছোস সাবধানে থাকবি, খুব বেশি রিস্কের মিশনে যাইস না। জীবনের দাম টাহার থে বেশি। 

– আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। তোমরাও ঠিক ঠাক মতো থাকিও। আর ঐযে নতুন মেয়েটা আসছে না, ওকেও নিজের মেয়ের মতোই দেখো। ওর বাবা-মা নাই। এতিম। ওকে তোমাদের কাছেই রেখো।

– আইচ্ছা ঠিক আছে। তে আমি গেলাম। তোরা পৌছাইয়া ফোন দিস।

– আচ্ছা বাবা। আসসালামুয়ালাইকুম।

– আসসালামুয়ালাইকুম আব্বা। (দিথী)

– ওয়ালাইকুমুস সালাম, ওয়ালাইকুমুস সালাম। 

মতিন মেম্বার হাত নাড়িয়ে বিদায় জানান। শাহারিয়া আর দিথীও বিদায় জানিয়ে বগির ভিতরে চলে যায়। আসলে শাহারিয়া গ্রাম থেকে একবার বাইরে গেলে ৫-৬ বছর আর সে ফিরেনা। সেই ১৭ বছর বয়স থেকে যে বাইরে পড়ালেখার জন্য গেছে তারপর একদম পড়া শেষ করে চাকরি নিয়ে তারপর ফিরছে, তারপর গেছে এই কয়দিন আগে নোমানের সিরিয়াল কিলিং কেস টার জন্য গ্রামে ফিরেছে। ওর গ্রামে আসা খুব খুবই কম হয়। এর জন্য যখন সে চলে যায় তখন তাকে এতোটা স্নেহ দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দেন মতিন মেম্বার। শিউলি বেগমেরও মন কাঁদে, ছেলে এমন চাকরি করে যে হয়তো পরবর্তীতে তার সাথে আর নাও দেখা হতে পারে। মানুষের হায়াত-ময়োতের কথা তো বলা যায় না। 

দিথী, শাহারিয়া বগির কেবিন গুলার সামনে দিয়ে যেতে থাকে। তাদের কেবিন B24। কিছুটা সামনে এগোতেই তারা পেয়ে যায়। একজন ট্রেনের কর্মী ছিলো বগিতে। তিনি টিকিট চেক করে দরজা খুলে দেন। ব্যাগটা কেবিনের ভিতরে এনে দেন। কেবিনটা ৪ জনের। মানে ৪ জনকে শেয়ারে থাকতে হয়। নিচে দুই পাশে দুইটা বিছানা, ঠিক তার উপরে দুইটা বিছানা। শাহারিয়া কারো সাথে শেয়ার করতে চাইনি তাই সম্পূর্ণ কেবিনটা নিজেই ভাড়া নিয়ে নিয়েছে। এসি কেবিন, তবে ঠান্ডার সময় হিটারেরও ব্যবস্থা আছে। ট্রেনের কর্মী তাদেরকে পানির বোতল, বিছানার চাদর সহ সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। শাহারিয়া একপাশের বিছানাটায় ব্যাগ টা রাখে। দিথী অপর পাশের বিছানটা অর্থাৎ হাতের ডান পাশের টায় বসে। শাহারিয়া কেবিনের দরজা লাগিয়ে দেয়। দিয়ে এসে দিথীর পাশে বসে। কেবিনের জানালা গুলো খোলা যায় না। একদম সিল করা সেগুলো। শুধু গ্লাসের এপাশ থেকে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়‌। ট্রেন চলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতে থাকে। দিথী শাহারিয়ার পাশে বসেই জানালা দিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই প্রথম এই গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে সে। নতুন জীবনের , নতুন পথচলা শুরু করতে চলেছে সে। এখন তার সবটুকুই শুধু তার স্বামী শাহারিয়া। সেই তার আনন্দ, সেই তার বেদনা। সেই তার সবকিছু। ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। গতি বাড়ায়। বাইরে কুয়াশা পড়েছে, তবে কেবিনে গরম করছে। দিথী শাহারিয়ার দিকে ফিরে বলে,

– বোরখাটা খুলে রাখি ? 

– কেনো? 

– গরম লাগছে। এখানে তো তুমি ছাড়া কেউ নাই। দরজাও ভিতর থেকে লাগানো। আমার গরম লাগছে। 

– এসিটা ছেড়ে দেই ? 

– না না। তখন আরো বেশি ঠান্ডা লাগবে। বোরখা পড়ে আমার অভ্যাস নাই। এইজন্যই বদ্ধ কেবিনে গরম লাগতেছে। 

– আচ্ছা তাইলে খুলো। 

দিথী উঠে যায় শাহারিয়ার পাশ থেকে। শাহারিয়া তার ফোনটা পকেট থেকে বের করে ট্রেনের চার্জিং সকেটে চার্জে দিয়ে দেয়। দিথী কেবিনে মাঝে দাঁড়িয়ে বোরখা খুলতে থাকে। বোরখার নিচে থ্রী পিস ছিলো। বোরখা খুলে আরেকপাশের বিছানা, যেটায় ব্যাগটা ছিলো তার পাশে রাখে। তবে মাথার হিজাব টা খুলেনা। পরে তখন যদি হিজাব একলা একলা পড়তে না পারে! 

হিজাব মাথায় থ্রীপিস পড়ে এসে শাহারিয়ার পাশে বসে দিথী। তার বাম কাঁধে মাথা রাখে। শাহারিয়া বলে,

– ঘুম পাচ্ছে ? 

– কিছুটা।

– ঘুমাও তাইলে। আমি জেগে আছি। পৌছাইতে পৌছাইতে কাল সকাল হবে। এক ঘুমে রাত পাড় করে দিতে পারো। 

– তোমার জীবনে কোন মেয়ে এসেছিলো! (ধির গলায় বলে দিথী)

– হঠাৎ এই কথা ? 

– বলোনা। আমি তোমার জীবনে আসার আগে, কেউ কী ছিলো! (দিথী কন্ঠ ঠান্ডা। সে শাহারিয়ার কাঁধে মাথা রেখে কথা গুলো বলছে)

– টিনএইজ, মানে ১৬-১৭ বছর বয়সে মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হতাম, তবে আমার কোন প্রেমিকা ছিলো না। আমি ধীরে ধীরে যতই ম্যাচিউর হয়েছি, নিজের মনে নিজে পণ করেছি কোন প্রেম করবো না। একদম যাকে বিয়ে করবো তার সাথে বিয়ের পর প্রেম করবো। তার জন্য সবটুকু ভালোবাসা, সবটুকু মায়া জমিয়ে রাখবো। 

– আমাকেও তো প্রেম করেই বিয়ে করলে।

– তোমার মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। হয়তো আল্লাহ তোমাকেই আমার কপালে লিখে রেখেছিলেন তাই আমি তোমাতে আকৃষ্ট হয়েছি! 

– তাইলে এখন আমি তোমার প্রেমিকা না বউ! 

– তুমি আমার দুইটাই। তুমি আমার ভালো বন্ধুও। তোমার আমার বয়সের ডিফারেন্স খুব বেশি না। এই ৫-৬ বছর। বন্ধু তো হওয়াই যায়। এমন তো না যে আমি বুড়ো আর তুমি কিশোরী! দুইজনই ম্যাচিউর হয়েছি আমরা।

– কতটা ভালোবাসো আমাকে! 

– যতটা ভালবাসা একজনের হ্রদয়ের উৎপন্ন হয়, তার চেয়েও বেশি। 

– আমি তো দেখতে ফর্সা নই। রুপও তেমন একটা নেই আমার। তোমার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারবোতো!

– সুন্দরী তো নটী রাও হয়। দেহ বিলিয়ে টাকা আয় করে। তাই বলে মানুষ কী ওদের ভালোবাসে ? ব্যবহার করেই তো তাদের রাস্তায় ছুড়ে ফেলে। তোমায় আমি দেহের রং দেখে ভালোবাসিনি, তোমার নারীত্বকে ভালোবেসেছি। ভালোবাসা বুঝেনা দেহের রং, মানেনা কোন বয়সের সং। ভালোবাসা মানেই মনের আস্থা, এক বন্ধুর সাথে চলা এক আধখোলা রাস্তা! 

– গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে কাব্যের পাতায় নাম লিখাবে বুঝি! 

– নিজের মানুষটার জন্য হাজারো কাব্য রচনা করা যায়।

বলেই দিথীর দিকে ফিরে তাকায় শাহারিয়া। দিথী এখন কিছুটা লজ্জা পাচ্ছিলো। সে যে একজন নারী তা উপলব্ধি করতে পারছিলো। দিথী তার নজর নামিয়ে নেয়। শাহারিয়া একটা মুচকি হাসি দিয়ে তাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। দিথীও দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শাহারিয়াকে। দিথীর মাথায় হাত বুলিয়ে তার সাথে গল্পে মজে উঠে শাহারিয়া। দিথী তার পাশে বসে তার বুকে মাথা রেখে, আলিঙ্গন করে শাহারিয়ার গল্প শুনতে থাকে। শাহারিয়ার হৃদস্পন্দনও তার কানে আসছিলো। সে নিজেকে ভাসিয়েছিলো শাহারিয়ার ভালোবাসায়। দুইজনই মেতে উঠে প্রেমময় আলাপনে।

ট্রেন চলে যায় ঘন কুয়াশা ভেদ করে মাঠ,ঘাট, প্রান্তর দিয়ে। হুইসেল বাজিয়ে এই নিস্তব্ধ রাতের মাঝে জানান দেয় তার অস্তিত্বকে। আকাশের চাঁদ ঢাকা পড়ে যায় কুয়াশার চাঁদরে। জোছনা বোধহয় আজ কুয়াশার সাথে পালিয়ে গেছে, তাই চারপাশ খুব বেশি আলোকিত হয়নি। আঁধার ঠেলেই ট্রেন চলে যায়, ঝকঝক ঝকঝক শব্দ করে, সুদূর এক গন্তব্যের উদ্দেশ্য,,!!!

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( কেমন লাগলো আজকের পর্ব টা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আর গল্পের কোন বিষয় না বুঝলে বা মনে কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে করতে পারেন। আমি উত্তর দিবো। তবে ভবিষ্যতে কী হবে তা বাদে। অতীতে ঘটে গিয়েছে কিন্তু বুঝতে পারেন নি এমন কোন প্রশ্ন থাকলে বলবেন। আর অবশ্যই আজকের পর্বটা কেমন হয়েছে তা জানাতে ভুলবেন না 😊। সরি লেইট করে আপলোড দেওয়ার জন্য। কাল আর পরসুও পর্ব পাবেন ❤️)

 

 গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭০ (২য় ভাগ)

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭১

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

শেষ রাত। এখনো ফজরের আযান দেয়নি। কিছুক্ষণ পর হয়তোবা দিবে। রায়হান ব্যালকনির গ্লাসের দরজার সামনে একহাত রেখে দাঁড়িয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। তার গলার আওয়াজ নিম্ন। ব্যালকনির নিচ থেকে সদ্য ফোঁটা নতুন ফুলের সুবাস ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের সাথে ভিতরে প্রবেশ করছে। এই সুঘ্রাণ অনেক গুলো আগরবাতির থেকেও তীব্র। রায়হান কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নেয়। ফোনটা কেটে পিছনে ফিরে দেখে নিপা উঠেছে কি না। না। নিপা এখনো ঘুমাচ্ছে। তার গাঁয়ে কম্বল দেওয়া। রায়হান ফোনটা পকেটে রেখে ব্যালকনির দরজা দিয়ে বাইরে তাকায়। কিছু একটা ভাবতে থাকে। তাকে দেখে কিছুটা চিন্তিতই মনে হচ্ছে। রায়হান বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবার পর বিরবির করে নিজে নিজেই বলে উঠে,

‘ আলিশা আর ফুফুকে কারা মারলো ? এমন খুন-খারাবি, তাও আমাদের বাড়িতে! কোন কন্টাক্ট এজেন্ট ? নাকি অন্য কিছু আছে এইখুন গুলোর পিছনে ? আলিশাদের সাথে কারো কিইবা শত্রুতা থাকতে পারে ? নাকি আমাদের কমিউনিটির কেউ এই কাজের সাথে যুক্ত ? আমাকে ভয় দেখাইতে চায়! না আমাকে সাবধান করতে চায়! কোনটা ? ‘

রায়হান আবার পিছনে ফিরে নিপার ঘুমন্ত শরীরটাকে দেখে। সামনে ফিরে গ্লাসের দরজাটায় মাথা ঠুকে চোখ বন্ধ করে। তার বোধহয় কোন কিছুর জন্য চিন্তা হচ্ছে। রায়হান তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। তার রাগ হচ্ছে নিজের উপর। সে কেনো এই লাইনে আসলো! সে কী পারতোনা একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো থাকতে! কেনো আসলো সে! রায়হান ছোট খাটো একটা ঘুষিই মেরে বসে দেয়ালে। তবে সেই ঘুষির শব্দ খুবই ক্ষিণ ছিলো। নিপা উঠেনি। রায়হান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চোখে কোনে আসা মৃদু জল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে। চলে যেতে থাকে ওয়াশরুমের দিকে‌‌। ওয়াশরুমের ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। ব্যালকনির দরজা একটা কপাট খোলাই ছিলো। সেই দরজা দিয়ে ফুলের সুবাস ভরা বাতাস বয়ে এসে ঘরকে আরো ঠান্ডা করে দিচ্ছিলো। বাইরে কুয়াশা। ভোরের দিকে কুয়াশা আরো বেশি পড়ে। দূরের কোন এক মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আযান।

 

____

 

ভোরবেলা। লতাপাতায় আচ্ছাদিত নীলগিরির ঘন গাছপালার অংশটায় এখনো খুব ভালো ভাবে আলো পড়েনি। আশপাশে কিছুটা কুয়াশা আর নিচের লম্বা লম্বা ঘাসে শিশির জমেছে। পাখি কিচিরমিচির করছে। এক গাছের ডাল থেকে অন্য গাছের ডালে উড়ে যাচ্ছে। 

একটা অর্ধগলিত লাশ পড়ে আছে এক গাছের সাথে হেলান দেওয়া অবস্থায়। মেয়েটার মুখের কিছুটা অংশ পচে গিয়েছে। মেয়েটার শরীর উলঙ্গ। পাশেই কিছুটা দূরে কিছু কাপড় পড়ে আছে। কিছুদিন আগে বৃষ্টি হওয়ায় স্যাতস্যাতে পরিবেশে লাশটা তাড়াতাড়িই পচতে ধরেছে। লাশটা দেখে এই গ্রামের কারো মনে হয়না। তবে দূরে থাকা কাদামাটির কাপড় গুলো যেন সাক্ষী দিয়ে বলছে এটা সেই মেয়ে যে বেশ কয়েকদিন আগে রাফসানের শিকার হয়েছিলো। রাফসান তাকে ধর্ষণ করে মেরে এখানে ফেলে গিয়েছিলো। মেয়েটার দেহের কিছু অংশ পচে গলে খসে পড়েছে। নাড়ি-ভুড়ি বেড়িয়ে এসেছে। বিভিন্ন কিট এসে খেতে শুরু করেছে সেই পঁচা দেহটাকে। যদি এটা ফাঁকা যায়গা হতো তাইলে এতোদিনে শকুন এই লাশ খেয়ে সাফ করে ফেলতো। কিন্তু জঙ্গলের এদিকটা ঘন হওয়ায় কিট পতঙ্গ ছাড়া আর কারোরই খাবার হিসেবে প্রাধান্য পায়নি লাশটা। 

কিছু মানুষের হেঁটে আসার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। গাছের সুচোলো ডাল-পালা হাতের ছুরি দিয়ে কাটতে কাটতে কারা যেনো এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে হালকা কুয়াশার মাঝে দৃশ্যমান হয় তারা। লোকগুলো ছিলো জুডাসের রক্ষী। পড়নে আনসারদের মতোই পোশাক তবে তার রং উজ্জ্বল বাদামী। পায়ে বুট জুতো। কাঁধে লম্বা নল ওলা রাইফেল‌। ৩ জন লোক ছিলো সেখানে। তারা সবাই মুখে রুমাল চেপে এগিয়ে আসে। লাশ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ভেসে আসছে‌। কাছাকাছি আসতেই এই পঁচা গলা লাশ দেখে একজনের বমি পর্যন্ত চলে আসে। সাইডে গিয়ে সে বমি করে। বাকি দুজন লাশটার কিছুটা কাছে এসে লাশ টাকে দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে একজন আরেকজনকে বলে,

– এইটা কার লাশ ? 

– বসের আদেশে মারা হইছে বলে তো মনে হইতেছে না। এই মেয়ে কে ? 

– এই মেয়ে কে তা চিন্তার বিষয় না। চিন্তার বিষয় এদিকে মানুষের চলাচল বাড়ছে। বসকে বিষয়টা জানাইতে হবে। নাইলে যে কেউ আমাদের আস্তানা খুঁজে ফেলতে পারবে। 

– হমম। 

তখনই দূরের বমি করা লোকটা তাদের ডাকতে থাকে,

– D1, D3 এদিকে আসেন। এইদিকে কিছু কাপড় চোপড় পড়ে আছে। 

– কই, চলোতো দেখি। 

দুইজন হেঁটে হেঁটে সেই আরেকজনের দিকে যায়। এদিকটা হালকা একটু ফাঁকা ছিলো। অনেক গুলো পাতার মাঝে কাঁদার দলায় আটকে থাকা কিছু জামা কাপড় খুঁজে পায় তারা। একজন এগিয়ে গিয়ে সেই জামা কাপড় কাঁদার মাঝ থেকে উঠায়। দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়েটার কাপড়। একটা হাত ব্যাগও আছে। হাত ব্যাগ টা পিছনে আরেকজনের দিকে ছুঁড়ে দেয় সামনের জন। পিছনের লোকটা সেটা নিয়ে হাত দিয়ে উপরের কাঁদা ঝাড়ে ফেলে। চেইন খুলে। ভিতরে কিছু ভেজা কাগজ ছিলো। সাথে একটা আইডি কার্ড। দেখে মনে হচ্ছে কোন সংস্থার আইডি কার্ড। আইডি কার্ড টা বের করে হাতে নেয় লোকটা। সেখানে যা লেখা ছিলো তা পড়তে থাকে। 

‘ লয়েল লরেন্স হাসপাতাল। জোহরাতুন্নেসা মারিয়া। 1st শিফট এর নার্স। এই এইটা তো একটা নার্সের আইডি কার্ড। আর আইডি কার্ডের ছবির সাথে মেয়েটার অর্ধেক চেহারা মিলতেছে।’

সামনে থাকা দুইজন এগিয়ে আসে। এসে আইডি কার্ড টা হাতে নিয়ে দেখে। আসলেই মেয়েটা নার্স ছিলো। তবে রয়েল  লরেন্স হাসপাতাল টা তো রংপুর সদরে। এতো দূর থেকে মেয়েটা এখানে কেনো আসলো। আর কিইবা হয়েছিলো তার সাথে ? 

১ম ব্যাক্তি বলে উঠে,

– লাশ টাকে কী নিয়ে যাবো ? 

– মাথা খারাপ? ঐটা ধরতে গেলে হাড় থেকে সব মাংস খসে পড়বে। আর যে বাজে গন্ধ। নিয়ে যায় কি করবো আমরা। 

– বসের যদি দরকার পড়ে। 

– বসের মারা যাওয়া মেয়ে দিয়ে কী কাজ। বসের লাগবে জিন্দা মেয়ে। এইটাকে এখানেই রাখ। কয়দিন পর এমনিই পচে মাটিতে মিশে যাবে। 

– কবর দিয়ে দিলে কেমন হয় ? 

– তোর দিতে চাইলে তুই খুড়ে তারপর দে। ঐ লাশ ধরতে গেলেই সব মাখামাখি হয়ে যাবে। লাশের অবস্থা আরেকটু ভালো হইলে দেওয়া যাইতো। ঐটাকে ওখানেই রাখ। চল, বস রাউন্ডে পাঠাইছে, আমাদের রাউন্ড দেওয়া শেষ। বাকিরা এতোক্ষণ রাউন্ড দিয়ে ফিরেও গেছে মনে হয়। চল।

যেই লোকটার হাতে আইডি কার্ড আর ব্যাগটা ছিলো সেই লোকটা কার্ড আর ব্যাগটা লাশের গায়ে ছুড়ে মারে। সেই মৃদু আঘাতে লাশের মুখের অপর পার্শে থাকা চোখ টাও কোটর থেকে খুলে পড়ে। বেশ ভয়ঙ্করও লাগছিলো লাশটাকে দেখতে এবার। তিনজন মানুষ চলে যেতে থাকে। গাছের পাতায় জমা শিশির একসাথে জমা হয়ে পানির ফোঁটা হিসেবে লাশটার মাথায় পড়ে। পড়েই যেন তা পচে যাওয়া মাংসের ভিতরে হারিয়ে যায়। লাশের বুক থেকে হাতের দিকের পঁচা মাংসটাও খসে পড়ে যায় হাড় থেকে। চারপাশ আবার পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর হয়ে যায়। গাছের পাতা গুলো দখিনা বাতাসে মৃদু নড়ে উঠে।

 

____

 

খাঁন বাড়ির পিছনের পুকুর। সময় এখন সকাল ৭ টা। সোনালী একলা একলা এই ঠান্ডা পুকুরের জলে গোসল করছে। একটা শাড়ির পেডিকোট তার বুক থেকে শুরু করে হাঁটু পর্যন্ত বাঁধা। তাই তার দেহটাকে কারো নজর থেকে বাঁচাচ্ছে। তবে এখানে কেউ ছিলোও না। এইসময় টায় পুকুরের দিকে কেউ আসেও না। সবাই নাস্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সোনালী সাঁতার জানতো। সে সাঁতরে একপাশ হতে অন্য পাশ যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে পানির নিচে গিয়ে আবার কিছুক্ষণ পর উঠছিলো। 

ঘরের জানালা দিয়ে সবকিছু দেখে রাফসান। হাতে সিগারেট জ্বলছে। তার রুমের এই জানালা একদম পুকুর বরাবর। সম্পূর্ণ পুকুর টাই সে এখান থেকে দেখতে পারে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলো আর সোনালীর গোসল দেখছিলো। তার চোখে ললুভ দৃষ্টি। সিগারেটের ধোঁয়া উপরে ছেড়ে দিয়ে বিরবির করে বলতে থাকে,

– এই মেয়েটাকে নিজের বউ বানাইলেও মন্দ হয়না। এতো রুপ, এতো মোহ আর কারো শরীরে আমি পাইনাই। একটাকে তো দ্বিতীয় বারের বেশি ইউজ করার ইচ্ছাই জাগতো না। কিন্তু এই সোনালী, একে এখনো দেখে কিশোরী আর কুমারী লাগতেছে। কে বলবে এ আমার সাথে কয়দিন আগে রাত কাটাইছে। (একটু থেমে) সোনালীকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে রে, বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে। কী নাই আমার। এই খাঁন গ্রুপের সম্পূর্ণ টাই আমার নামে আছে। বিজনেসে আর কারো ভাগ নাই। সোনালীর কী এতোটাতে পোষাবে না! (সিগারেটের ধোঁয়া উপরে ছেড়ে দিয়ে) পোষাবে পোষাবে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় খাঁন গ্রুপের সম্পত্তির দাম তো আর কম না‌। সবটুকু দিয়ে হইলেও আমার সোনালীকেই চাই। এর প্রতি আমার দুর্বলতা কখনোই কমবে না। বউ করে নিলে তো আর বাঁধা থাকবে না। যখন মন তখনই,,,,, হি হি হা হা হা!!! তখনই হা হা হা!! 

রাফসান হাসতে থাকে। তবে তার হাসির শব্দ ঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। 

সোনালী পুকুর পাড়ে ভেজা শরীরে উঠে দাঁড়ায়। ফর্সা গায়ের বরণ, মুখ দেখে যেন মনে হচ্ছে কোন নায়িকা। ভেজা চুল গুলো হাত দিয়ে কানের পাশে এনে রাখে। গোলাপি পাপড়ির মতো ভেজা ঠোঁট গুলো গুলো দেখে যে কোনো পুরুষেরই লোভ লাগবে। রাফসান যেন সোনালিকে দেখেই আরো থ হয়ে। সোনালী যেন সোনার মতোই চকচক করে উঠছিলো। সোনালী পুকুর পাড়ে উঠে পাড়ে থাকা তার শুকনো কাপড় গুলো হাতে নেয়। নিয়ে ঝাড়তে থাকে। রাফসান সিগারেট ফেলে দিয়ে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। তার চোখ বড় বড়। মন অস্থির, উৎদিপ্ত। তখনই সোনালী ফিরে তার দিকে তাকায়। দোতলার রুমের জানালায় যে রাফসান দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে এটা যেনো সোনালী বুঝতে পেরেছিলো। সোনালী রাফসানের দিকে ফিরে এক দুষ্টু চাহনির সাথে মুচকি হাসি দেয়। রাফসান পাগলা ঘোড়ার মতো জানালার গ্রিল ধরে লাফাতে থাকে। সোনালীকে ও সামনে পেলে চাবিয়ে চাবিয়ে খেয়ে ফেললেও যেন ওর মনের তৃষ্ণা মিটবে না। সোনালী তার নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে হাত উঠিয়ে রাফসানকে মধ্যাঙ্গুলি দেখায়। রাফসান তা দেখেই আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এই উত্তেজিত রাগের উত্তেজিত না। এই উত্তেজনা পুরুষত্বের। রাফসান দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়‌। তার গন্তব্যে যে এখন পুকুর পাড়ে যাওয়া আর সোনালীকে নিয়ে পুকুরের জলে হাবুডুবু খাওয়া, তা বুঝতে আর বাকি রয়না। রাফসানের রুম নিস্তব্ধ-নিরব হয়ে পড়ে থাকে। 

 

_____

 

রাশেদ আঙিনার গামছাটা কাঁধে নিয়ে নেয়। হাতে কোদাল। পড়নে লুঙ্গি আর একটা ফুটোয় ভরা সেন্ডো গেঞ্জি। 

 

আয়ানের খোঁজ না পেয়ে রাশেদের মানুষিক অবস্থা বলার মতো না। টানা তিনদিন সে হতাশা আর বিষন্নতায় ভুগেছে। থানায় বারবার গিয়েছে আয়ানের ছোট্ট একটা খোঁজ আনার জন্য। কিন্তু পায়নি। থানার কোন লোকই তাকে আয়ানের খোঁজ দিতে পারেনি। রাশেদ এখন প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছে। সে যে কম চেষ্টা করেনি তা নয়। আয়ান হারিয়ে যাওয়ার পর টানা ১ সপ্তাহ সে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আয়ানের খোঁজ করেছে। কেউ আয়ানকে দেখেছে কী না, আয়ান কারো বাসা এসেছিলো কী না সব জানতে চেয়েছে। কিন্তু কোন খবর পায়নি। অটো ওয়ালা মঈনুল কেউ একজন মেরে পালিয়েছে। পুলিশ থাকা সত্তেও তারা সেই খুনিকে ধরতে পারেনি। সবমিলিয়ে রাশেদ এই দুদিন আগ পর্যন্ত হতাশা আর বিষাদগ্রস্ততায় ডুবে ছিলো। পরে তার সয্যাশায়ী মা-বাবার মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে শক্ত করেছে। সে বসে থাকলে তো সংসার চলবে না। সেই কেবল এখন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার সাথে তাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছিলো শম্পা। শম্পা সেই মেয়েটা, যাকে রেলস্টেশন থেকে রাশেদ বাঁচিয়ে এনেছিলো। মেয়েটার বয়স ১৩ কী ১৪। তবে ঘরের সব কাজ নিজ হাতে সামলায়। রাশেদের বাবা-মায়ের দেখাশোনা, রান্না-বান্না সব নিজে করে। সাথে রাশেদকেও সে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে।

 

রাশেদ গামছা কাঁধে কোদাল নিয়ে যেতে উদ্যত হয় তখনই রান্না ঘরের দরজা থেকে তাকে পিছু ডাকে শম্পা। রাশেদ থেমে যায়‌। পিছন ফিরে তাকায়। শম্পা রান্না ঘরের দরজা থেকে নেমে তার দিকে আসতে থাকে। হেংলা পাতলা গায়ের গড়ন তার। পড়নে পুরোনো এক থ্রী পিস। 

রাশেদের সামনে এসে দাঁড়ায় শম্পা। বলে,

– আইজ আকবর চাচাগো খেতে যাইতাছেন না! 

– হ্যা। তাদের খেতে। 

– আমি খাওন লইয়া আমুনে ১১ ডা ১২ ডার দিক। আর,

– আর কি‌‌।

– চাচা চাচি গো ঔষধ ফুরায়া আইছিলো। কাইল পর্যন্ত চলবো। বিকালে ফিরা গন্জে যাইয়া ঔষধ লইয়া আইয়েন।

– ঠিক আছে। তুমি রান্না শেষ করে গোসল করে নিও। মা-বাবাকে খাইয়ে দিয়ো। আর সাথে, (একটু থেমে) আর সাথে নিজেও খেয়ে নিও। 

শম্পা মাথা নিচু করে আচ্ছা বলে। রাশেদে চলে যেতে থাকে।

 শম্পা আঙিনার মাঝে একলা দাঁড়িয়ে থাকে। রাশেদকে সে বড় ভাইয়ের চোখে দেখেনি আজো। সে রাশেদকে তার হিরো হিসেবে দেখে। তাকে সেদিন রেল স্টেশন থেকে যেভাবে ফাইট করে বাঁচিয়েছিল, তা একজন হিরোর দাঁড়াই সম্ভব বটে।

শম্বা ফিরে চলে যেতে থাকে রান্না ঘরের দিকে। ভাত হয়ে গেছে। এখন আলু সিদ্ধ আর ডাল রাধা বাকি তার। 

কাঁচা বাড়ি গুলোর মাঝে উঠোনটায় বেশ ভালোই রোদ পড়েছে। উঠোনের একপাশে মুরগি তার ছোট ছোট ছানা দের নিয়ে খাবার খুঁজতে থাকে। আশপাশের গাছপালা হতে পাখির কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসে।

 

____

 

রিয়াদ বাইক নিয়ে এসে থামে খাঁন বাড়ির গেটের সামনে। পড়নে তার পুলিশি পোশাক। বেশ রোদ উঠেছে আজ। কাঁচা রাস্তা তপ্ত রোদে কাঠের তক্তার মতো শক্ত হয়ে গেছে। রিয়াদ বাইক টা সাইডে স্ট্যান্ড করে বাইক থেকে নামে। বাড়ির পাশের ছোট গেইট টা খোলাই ছিলো। রিয়াদ হাত ঘড়ি উঠায়। দেখে সাড়ে ১০ টা বাজে। আজ তাকে এক যায়গায় যেতে হবে‌, তাই সকাল সকালই চলে আসলো এ বাড়িতে। 

বাড়ির বড় গেইটের পাশে থাকা খোলা ছোট গেইট টা দিয়ে রিয়াদ ভিতরে প্রবেশ করে। ভিতরে ঢুকেই দেখে দাড়োয়ান রহিম চাচা চেয়ারে বসে লাঠি হাতে ঘুমাচ্ছে। রিয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বাড়িতে খুন হয়ে গেছে, এখন সিকিউরিটি বাড়াবে কিনা উল্টো দিনের বেলাও ঘুমাইতেছে! রিয়াদ এগিমে যায় রহিম চাচাকে ধমকিয়ে উঠানোর জন্য। তখনই কিছু একটা মনে পড়ায় সে আর এগোয় না। সামনে ফিরে চলে যায় অন্দরমহলের গেটের দিকে। 

 

       সুরাইয়া বেগমের রুমের দরজার তালা খোলার শব্দ পাওয়া যায়। কেউ একজন তালা খুলে দরজার হেজবল খুলছে। এবং দরজাটা মেলে দেয়। লোকটা রিয়াদই ছিলো। দরজার পর একটা লম্বা ফিতা টাঙানো। রিয়াদ সেই ফিতা ডিঙিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। এর আগে যতবারই সে এই রুমে তার কনস্টেবলদের সার্চ করতে বলেছিল, কনস্টেবল রা শুধু ঐ লম্বা হিল জুতা জোড়া ছাড়া আর কিছুই তাকে এনে দিতে পারেনি। রুমে টায় আরকি কিছুই নাই! রিয়াদ আজকে এইজন্য নিজেই আসছে সার্চ করার জন্য। কিছু না কিছু তো থাকবেই এই রুমে। রিয়াদ শুরু করে পড়ার টেবিল টা দিয়ে। এতো গুলা বইয়ের পাতা উল্টে দেখার মতো সময় বা ধৈর্য কোনটাই এখন তার নেই। তাই বই গুলো সড়িয়ে সড়িয়ে তার ফাঁক ফোকরে কিছু আছে কি না তাই দেখতে থাকে। কলম দানি টেবিলে উল্টিয়ে সেখানে কিছু আছে নাকি তা দেখে। টেবিল ঘড়িটাও নাড়িয়ে ঝাকিয়ে দেখে। সুরাইয়া বেগমের শরীরে ড্রাগ পাওয়া গেছে। সেই ড্রাগ তিনি ঘরের কোথায় সংরক্ষণ করতেন? নিশ্চয়ই এমন কিছুর ভিতরেই রেখেছেন যা আমাদের চোখের সামনে আছে কিন্তু আমরা সন্দেহ করবো না। রিয়াদ টেবিল ঘড়িটা রেখে পড়ার টেবিলে থাকা একটা ঝুড়ি টেবিলে উবুর করে ফেলে দেয়। সেখানে থাকা জিনিস গুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে। না, এখানেও কিছু নেই। রিয়াদ দুই হাত কোমরে দিয়ে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। তখনই তার চোখ যায় আলমারির দিকে। আলমারিতে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। সে আলমারির সামনে এসে আলমারিটা খুলে। এটা সেদিনই চাবি দিয়ে খুলে রেখে গিয়েছিলো সে। তাই আজ হাতল ধরে টানতেই আলমারির দুই কপাট খুলে যায়। রিয়াদ আলমারির ভিতরে কাপড় গুলো সড়িয়ে সড়িয়ে দেখতে থাকে। সুরাইয়া বেগম আর আলিশার কাপড় এগুলো। শাড়ি, থ্রী পিস, লেহেঙ্গ সহ আরো অনেক কাপড়। রিয়াদ সব কাপড় নেড়ে দেখার পর ভিতরে থাকা একটা ড্রয়ার খুলে। ড্রয়ারের ভিতর অনেক কাগজ পত্র রাখা। রিয়াদ ড্রয়ার টাকেই আলমারি থেকে বের করে সেটা নিয়ে বিছানায় এসে বসে। একপাশে চাদরটা উঠিয়ে দিয়ে তোষকের উপর সব উবুড় করে ঢালে দেয়। নিচে এখনো রক্তের দাগ আছে। চাদরেও রক্তের দাগ। এগুলো কিছুই পরিষ্কার করা হয়নি। যতদিন না কেস সলভ হচ্ছে এসব পরিষ্কার করাও হবেনা। 

 রিয়াদ সব নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে। অনেক সমিতির সঞ্চয় কাগজ, ইলেকট্রিক বিলের কাগজ সহ আরো অনেক কাগজ। তারমানে সুরাইয়া বেগম টাকা জমাতেন। নিজের মেয়ের ভালো ভবিষ্যতের জন্য যেকোন মা’ই সঞ্চয় করবে, যখন আরো তার স্বামী মৃত থাকে আর পরিবার তাকে একঘুরে করে দেয় তখন তো এটা একপ্রকার মায়ের কাছে ফরজ কাজই হয়ে দাঁড়ায়। 

 রিয়াদ সব কাগজ উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে একটা ছবি এলবাম পায়। বেশ পুরোনো এলবাম। ছবি গুলো রঙিন, তবে দেখে মনে হচ্ছে ১৯ দশকের দিকে তোলা। রিয়াদ ছবি গুলো উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে। বেশির ভাগ ছবি আলিশা আর সুরাইয়া বেগমের। আর এই বাড়ির কর্তা দের। নজরুল সাহেবের যুবক কালের ছবিও আছে এতে। রিয়াদ একেকটা ছবি ভালোভাবে দেখে দেখে পাল্টাতে থাকে। তখনই একটা আলাদা ছবি সে পায়। ছবিটা উল্টো পাশে ঘুড়িয়ে এলবামে রাখা ছিলো। ছবিতে ৪ জন ছিলো। রিয়াদ ছবিটা এলবাম থেকে বের করে সোজা করে। মন দিয়ে দেখতে থাকে। তখনই সে বেশ অবাক হয়ে যায়। অবাক কন্ঠে বলে উঠে,

 – আরে, এটা এডভোকেট মশিউর রহমান না! ইনার মার্ডার কেস নিয়ে তো বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইছিলো। আমার মনে আছে, আমি তখন কলেজে পড়তাম। ইনাকে চলন্ত ট্রেনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো। উনার পাশে তো দেখি সুরাইয়া বেগম দাঁড়ানো। (ছবিটা নামিয়ে অবাক হয়ে) তাইলে কী সুরাইয়া বেগম আর ব্যারিষ্টার মশিউর স্বামী স্ত্রী ছিলেন ? (ছবিটা উঠিয়ে দেখতে দেখতে) সুরাইয়া বেগম পাশে দাঁড়ানো ৪ বছর বয়সী মেয়েটাকে তো আলিশা মনে হচ্ছে। হম, আলিশার চেহারার সাথে মিল আছে। আলিশা ছোট বেলাও সুন্দর ছিলো। (একটু থেমে) কিন্ত এটা! এটা কে ? সুরাইয়া বেগম কাকে কোলে নিয়ে আছেন ? দেখে তো দেড়-দুইয়ের মতো বয়স মনে হচ্ছে। (ছবি নামিয়ে অবাক গলায়) তাইলে আলিশারা দুইবোন ছিলো ? (ছবি উঠিয়ে) হ্যা, হ্যা। এটা মেয়েই। ছেলে না। চেহারা তো তার বাবার মতোই হয়েছে। হাতে একটা দাগও আছে। মনে হয় কাঁটা গিয়েছে বা আঘাত পাওয়ার দাগ। 

রিয়াদ ছবিটা উল্টিয়ে আবার সোজা করে। তখনই সে আবার অবাক হয়ে ছবিটা উল্টায়। ছবির পিছনে কিছু লেখা ছিলো। রিয়াদ অবাক হয়ে পড়তে থাকে,

‘ এই বাড়ির কিছু অতীত আছে, যা বংশ পরম্পরায় হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এই অতীত কারো জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি, আনবেও না। আকাশ পাতাল তো নাম মাত্র, নরক রয়েছে আমাদেরই মাঝে। খুঁজে বের করতে তো পারবে সেই, যে বুঝবে তাদের অক্ষ মতে ‘ 

রিয়াদ অবাক হয়ে সামনে তাকায়। বিরবির করে বলে,

– এই লেখার মানে কী ? এতো দেখতেছি আবার নোমানের কেসের মতো ছন্দ। তবে এই ছন্দ একটু কঠিন। সুরাইয়া বেগম এই ছন্দ লিখেছেন ? তিনি কেনো ছন্দ লিখতে গেলেন ? সরাসরিও তো লিখতে পারতেন। শাহারিয়াও বউ নিয়ে পালাইলো আর ছন্দ আসে হাজির। আমি পাগল হয়ে যাবো বাপ, এতো এতো রহস্য, ধুরর,,,,,

 

_____

 

চা বাগানের জেলা সিলেট। পাহাড়ে পাহাড়ে বাগান, গাছ সবমিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অন্যতম লীলাভূমি। শ্রীমঙ্গল সিলেটের একটা যায়গা। এইখানটায় মানুষের ঘরবাড়ির তুলনায় পাহাড় আর চায়ের বাগানের সংখ্যা বেশি। 

 

একটা গাড়ি ঢুকে ছোট্ট রাস্তা দিয়ে। এই যায়গাটা সমতল ভুমি থেকে ৫০ মিটার উঁচুতে। সামনেই নিরহরি বাজার। সেই বাজার থেকে যেই রাস্তাটা চলে গিয়েছে তা ধরে ৫০০-৬০০ মিটার সামনে গেলেই এই ছোট রাস্তাটা পড়ে বড় রাস্তার বা পাশে। এই রাস্তা দিয়ে যেতে হয় এখানে প্রকৃতির মাঝে বানানো একমাত্র বাড়িটায়। 

 

গাড়ি এসে থামে ‘বলাকাবিলাস’ এর সামনে। বাড়িটার নামই বলাকা বিলাস। চারপাশে গাছপালা। মাঝে সুউচু প্রাচীর ঘেরা এই বাড়িটা যেনো এক গোল সবুজ বাগান ভূমির মাঝের বৃত্ত। শাহারিয়া, দিথী গাড়ি থেকে নামে। গাড়ির ড্রাইভার রুমান তার দরজা খুলে নেমে ডিক্কি খুলতে যায়। দিথী গাড়ি থেকে নেমেই এক বিষ্ময় নজরে চেয়ে থাকে বাড়িটার দিকে। বাড়িটা খুব বেশি বড় নয়। দোতলা। শহুরে ম্যানশন বাড়ি গুলোর মতো। বাড়ির দোতলার ঠিক মাঝখানটায় একটা গোল ব্যালকনি বারান্দা। তার দুই পাশে দুই ঘরের জানালা। সেই ব্যালকনি বারান্দার নিচেই বাড়িতে প্রবেশ করার দুয়ার। বাড়িটা সম্পূর্ণ সাদা রঙের। হয়তো একয়দিনের মধ্যে রং করা হয়েছে। আকাশ টা মেঘলা। শ্রীমঙ্গলে বেশিরভাগ সময়ই বৃষ্টি হয়। শীতকাল তবুও বৃষ্টি হয়। কুয়াশা তো আছেই। 

শাহারিয়া ব্যাগ টা রুমানের কাছ থেকে নিয়ে নেয়। তাকে বলে,

– গাড়ি নিয়ে বাজারে যা, হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আয়। আমি বিকালের দিকে বেড়োবো। 

– ঠিক আছে স্যার। 

রুমান গাড়ির ড্রাইভারের দরজা খুলে চড়ে বসে। গাড়িটাকে ব্যাকে নিয়ে চলে যেতে থাকে। 

শাহারিয়া এসে দাঁড়ায় দিথীর পাশে। দিথীর হাত ধরে বলে,

– চলো। বাড়ির সামনের ফাঁকা যায়গাটা আরো সুন্দর। 

 শাহারিয়া আরা দিথী বাড়ির প্রাচীরের গেটের সামনে আসে দাঁড়ায়। শাহারিয়া গেটে শব্দ করে। ডাক দেয়,

– বুধু চাচা। বুধু চাচা।

দরজা খুলে দেয় এক বয়স্ক লোক। শাহারিয়াকে দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। শাহারিয়া আর দিথী ভিতরে প্রবেশ করে। 

এই গেইট থেকে বাড়ির ভিতরে ঢুকার গেইট পর্যন্ত যায়গাটার ঘাস ছেটে সাদা পথ বানানো। বাড়ির সামনের ফাঁকা যায়গাটা, অর্থাৎ বাড়ি থেকে বাড়ির প্রাচীর পর্যন্ত ফাঁকা যায়গাটায় সুন্দর সুন্দর সবুজ ঘাস গজিয়েছে। বাড়ির ডান পাশের ফাঁকা যায়গাটায় একটা দোলনা আছে। আর দোলনাটার একটু সামনেই একটা গাছ। গাছ টার নাম চেরি ব্লসম। গাছের সব গুলো পাতা গোলাপী। এই গাছ তো বিদেশী গাছ। এই গাছ এখানে কী করে! দিথী শাহারিয়ার দিকে ফিরে অবাক গলায় বলে,

– ঐটা বিদেশী গাছ না! আমি মুভিতে দেখছিলাম এমন গাছ।

– হ্যা। ঐটা জাপানি গাছ। চেরি ব্লসম। শুধু শীত কালেই এই গাছে গোলপী পাতা আসে। আর বাকি ১০ মাস কোন পাতাই ধরে না। এই গাছ থেকে সারাদিন পাতা উড়বে। আবার যতগুলো পাতা উড়বে ততগুলো রাতে গজিয়েও যাবে। একটা পাতা ধরে দেখো। ফুলের পাপড়ির মতো নরম।

দিথী উড়ে যেতে থাকা একটা পাতাকে ধরে। আসলেই এই পাতা পাপড়ির মতোই নরম। গাছটা তার কাছে অনেক সুন্দর লাগে। এই গাছ টা যেনো এই বাড়িটার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। দিথীকে নিয়ে শাহারিয়া বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। চাবি দিয়ে বড় কাঠের দুয়ার খানা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। 

 

     বাড়ির নিচে ডায়নিং আর ড্রয়িং রুম। ড্রয়িং রুমে সোফা আর সিড়ি আছে‌। সেই সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে হয়। দোতলায় ৩ টা রুম। মাঝে একটা আর দুই পাশে দুইটা। দিথী আর শাহারিয়া মাজের রুমটাতেই ঢুকে। রুমে মাঝে একটা বেড। সাদা চাদর বিছানো তাতে। বেডের পাশের একটা ছোট্ট টেবিল। তাতে টেবিল ল্যাম্প রাখা। নিচে কার্পেট বিছানো। উপরে ছোট্ট একটা ঝাড়বাতি। দিথী রুমে এসেই চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। শাহারিয়া ব্যাগটা রাখে। বিছানায় গিয়ে বসে। দিথী রুম থেকে বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় যায়। এইটাই সেই বাড়ির মাঝের গোল বারান্দা। রেলিং গুলো ডিজাইন করা। দিথী রেলিং ধরে চারপাশে নজর দেয়। চেরি ব্লসম গাছের গোলপী পাপড়ি উড়ে যাচ্ছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। দূরের পাহাড় গুলো দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের গাঁয়ে চা বাগান। কিছু ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরিও আছে সেই বাগান গুলোর মাঝে। এখান থেকে চারপাশের প্রকৃতির দৃশ্য বেশ উপভোগ্য ছিলো। 

ঘর থেকে শাহারিয়া ডাকে,

– বউজান, ঘরে আসেন। 

দিথী ভ্রু কুঁচকায়। বউজান বলে কাকে ডাকলো ? দিথী তাড়াতাড়ি পিছনে ফিরে দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে। শাহারিয়া ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলছিলো। দিথী এসে বলে,

– এই বউজানটা কে ? 

– তুমি। তুমিই বউজান। 

– কী অদ্ভুত নাম!

– তুমিই আমার বউ, আবার তুমিই আমার জান। দুইটা একসাথে করে ডাকলাম, বউজান!

দিথী বিছানায় বসে পড়ে। বিছানা বেশ তুলতুলে। দিথী বসে লাফাতে লাফাতে বলে,

– অনেক নরম তাই না! 

– হ্যা। গোসল করবানা! ঐযে ঐদিকে গোসল খানা। যাও গিয়ে গোসল করে নাও। 

– গোসল কী আমি একলা করবো নাকি। (দাঁড়িয়ে শাহারিয়ার পিছনে টুকি দিয়ে) তোমাকে সাথে নিয়ে করবো! হি হি হি।

– হিজাব টা খুলে রাখো। পড়ে ভিজে গেলে খুলতে পারবানা।

– তুমি খুলে দেও। 

বলেই দিথী এসে শাহারিয়ার সামনে দাঁড়ায়। শাহারিয়া দিথীর হিজাবের পিন গুলো খুলে খুলে ডেসিন টেবিলে রাখে। দিথী হিজাব খুলে ফেলে। মাথার চুল গুলো মেলে দিয়ে ঝাড়তে থাকে। শাহারিয়া তার শার্ট খুলে বিছানার একপাশ টায় রাখে। দিথী তার বোরখা খুলে ফেলে। খুলে সেটা ফ্লোরে ফেলে দিয়ে শাহারিয়ার পিঠিতে লাফ দিয়ে চড়ে বসে। শাহারিয়ার গলা ধরে ঝুলে থাকে। শাহারিয়া টাল সামলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বলে,

– এভাবে হঠাৎ করে কেউ চড়ে! আরেকটু হইলেই দুইজন ধপাস করে পড়ে যেতাম। 

– চলো চলো গোসলে চলো। আজ আর কেউ নাই বাঁধা দেওয়ায়। একসাথে দুইজন গোসল করবো। 

– আজ আমার বোধহয় আর রক্ষে নাই! 

– নাইই তো। চলো চলো। 

শাহারিয়া মানিব্যাগটা বিছানায় রেখে দিথীকে পিঠে নিয়েই চলে যায় গোসল খানার দিকে। দিথীর মুখে হাসি। শাহারিয়া কবিতা কাটতে কাটতে ঢুলে ঢুলে তাক নিয়ে গোসল খানায় চলে যায়। যদিও আবহাওয়া ঠান্ডা। তবুও এখন তাদের কাছে গোসল টা উষ্ণ ধারা। এই উষ্ণ ধারার প্রবাহ এতোটাই গরম যে তা আর বর্ণনাতিত না!!!

 

_____

 

গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে শম্পা। এখানকার আকাশ আবার রৌদ্রজ্জ্বল। মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। দূরে মাঠে কিছু লোক কাজ করছে। সেখানে রাশেদও আছে। শম্পা রাশেদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। ছোট গামলায় ভাত, তার উপরের বাটিতে ডিম ভাজি, আলুর ভর্তা, ডাল আর দু-তিনটে কাঁচা মরিচ। গামলাটার উপর তরকারির বাটি গুলো রাখা। গামছা দিয়ে সেই গামলা বেঁধে একহাতে কোমরের সাথে ধরেছে। আরেক হাতে একটা স্টিলের জগ আর মগ ধরেছে। যেনো কোন বউ তার কৃষক স্বামীর জন্য জমিতে ভাত নিয়ে যাচ্ছে। শম্পা মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। মুখ টা মলিন, স্বাভাবিক। পড়নে এখনো সেই পুরোনো থ্রি পিস টাই।

সেই রাস্তার আরেক পাশ থেকে হেঁটে আসছে রিয়াদ। পড়নে কালো পাঞ্জাবি। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও একটা যাচ্ছে সে। মাঝে মাঝে ঘড়ি উঠিয়ে সময় দেখছে আর হাঁটছে। তার মধ্যে তেমন একটাও ব্যস্ততা নেই। স্বাভাবিক গতিতেই হাঁটছে। বাইক নিয়ে বেড়োয়নি আজ। বাইক বাসায় রেখে এসেছে। 

শম্পা আর রিয়াদ প্রায় সামনাসামনি কাছাকাছি চলে আসে। শম্পা আর পাঁচটা ছেলে দেখলে যেমন স্বাভাবিক থাকে তেমনি আছে। রিয়াদকে সে দেখে আবার সামনের পথের দিকে নয়ন ঘুড়িয়েছে। তবে রিয়াদ শম্পাকে দেখে একটু অবাকই হয়। মেয়েটাকে আগে এই গ্রামে দেখেছে বলে তো মনে হয়না। গায়ের রং দেখে তেমন গরীব ঘরেরও মনে হয়না, তবে গাঁয়ের পুরোনো থ্রীপিস তো বলছে অন্য কথা। রিয়াদের সামনাসামনি আসতেই শম্পাকে রিয়াদ থামায়। শম্পা একটু অবাক হয়েই রিয়াদের দিকে তাকায়। রোদ পড়ছিলো তার মুখে। তাই চোখ গুলো একটু সরু সরু করেই তাকায়। রিয়াদ বলে,

– তুমি এই গ্রামের কেউ না হরিশপুরের কেউ ? 

– আমি এই গেরামেই থাহি। 

– আগে তো কখনো দেখিনি তোমায় ? 

শম্পা নিজের নজর নামিয়ে নেয়। ধীর গলায় বলে,

– আমি ২ সাপ্তা আগেই এই গেরামে আইছি।

– কার বাসায় আসছো ? 

শম্পা মুখ তুলে তাকায়। বলে,

– উনার বাসায়।

– উনি কে ? 

– র, রাশেদ। রাশেদ নাম হের।

– রাশেদের বাসায় আসছো ? তুমি ওর কোন আত্মীয়? 

– জে মানে না। (মাথা নিচু করে ধীর গলায়) আমারে হেয় আশ্রয় দিছে।

রিয়াদ কিছু একটা বলতেই যাবে তখনই শম্পা যেই হাতে গামছা বাঁধা ভাতের গামলাটা কোমরের সাথে ধরে ছিলো সেই হাত টার দিকে তাকায়। রিয়াদ অনেক অবাক হয়। তার চোখ মুখ বড় বড় হয়ে যায়। অবাক কন্ঠে বলে,

– এই দাগ! এই দাগ কীসের ? 

– কোনডা? এইডা ? এইডা আমার ছুডু বেলায় হইছিলো। কেমনে হইছিলো তা জানিনা, তয় কেউ কয় জন্ম দাগ, কেউ কয় ছোট বেলায় কাইট্টা গেছিলো হেই দাগ। 

রিয়াদ ২ পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। এক ঢোক গিলে। বড় বড় চোখ নিয়ে সামনে তাকায়। বলে,

– এই দাগ তো আমি ছবিতে আলিশার ছোট বোনের হাতে দেখছিলাম! 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( শম্পাই তাইলে আলিশার ছোট বোন? সে কীভাবে বেঁচে গিয়েছিল? কী হতে চলেছে এরপর? গল্প নিয়ে আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে ভুলবেন না। সরি লেইট করে আপলোড করার জন্য 😓 কালও পর্ব পাবেন ❤️)

 

 গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭১

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭২

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– এই দাগ! এই দাগ কীসের ? 

– কোনডা? এইডা ? এইডা আমার ছুডু বেলায় হইছিলো। কেমনে হইছিলো তা জানিনা, তয় কেউ কয় জন্ম দাগ, কেউ কয় ছোট বেলায় কাইট্টা গেছিলো হেই দাগ। 

রিয়াদ ২ পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। এক ঢোক গিলে। বড় বড় চোখ নিয়ে সামনে তাকায়। বলে,

– এই দাগ তো আমি ছবিতে আলিশার ছোট বোনের হাতে দেখছিলাম! 

– আলিশা কেডা? 

রিয়াদ শম্পার দিকে তাকায় বলে,

– আলিশাকে তুমি চিনোনা ? 

– না তো। এই নামে কাউরে চিনি বইলা তো মনে হইতাছে না।

– ত, তোমাকে রাশেদ তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে ? 

শম্পা মাথা নিচু করে। ধীর গলায় বলে,

– হ। আমি হের বাইত্তেই থাহি। 

– তার আগে তুমি কোথায় থাকতা ? তোমার বাবা-মা ? ওরা কোথায় ? 

শম্পা মাথা উঠিয়ে কিছুটা লেগে আসা গলায় বলে,

– আমি দিনাজপুর রেইল ইস্টিশনে থাকতাম মায়ের লগে। আমার মায়ে পাগলি ছিলো। দুইজন মিল্লা ভিক্ষা কইরা খাইতাম। (মাথা নামিয়ে) ১ মাইস আগে আমার মায়ে ট্রেনে কাটা পইড়া মইরা যায়। আমার বাপ কেডা আমি জানতাম না। তারপর থে একলা একলাই ইস্টিশনে থাকতাম। একদিন কিছু খারাপ পোলা আমারে বাজে কথা কইয়া আমারে ধইরা তুইলা নিতে চাইছিলো, হেইসময় উনি আইয়া আমারে বাঁচান। (একটু থেমে) আর আমারে হের বাড়ির আইনা থাকতে দেন। 

– উনি কে ? রাশেদ ? 

– হ। 

– কিন্তু এই দাগ, এই দাগ ভুল হতেই পারেনা। একদম এই দাগই আমি আলিশার ছোট বোনের হাতে দেখেছি। তোমার বয়সও আলিশার ছোট বোনের মতোই হওয়ার কথা। কিন্তু তুমি রেলস্টেশনে কীভাবে বড়ো হলে ? 

– আপনের কথা আমি কিছুই বুঝতাছিনা। এই দাগ আমার ছুডু বেলার থেই আছিলো। এই দাগ দেইখা আপনি এমন কেন করতাছেন ? 

রিয়াদ শম্পার কথাকে প্রাধান্য না দিয়েই বিরবির করে বলতে থাকে,

– এযে আলিশার বোন এটা কিভাবে প্রমাণ করবো ? ডিএনএ টেস্ট? হ্যা হ্যা। ও যদি আলিশার বোন হয় তাইলে ওর ডিএনএ আর আলিশাদের ডিএনএ ম্যাচ করবে। কিন্তু বডি তো চুরি হয়ে গেছে। তাইলে! 

– কি কইতাছেন বিরবির কইরা‌। আমারে যাইতে দেন। হেয় আমার লাইগা অপেক্ষা করতাছে। সকালে কিচ্ছু খাইয়া বাইর হয়নাই। আপনের লগে কথা কইতে কইতে আমার ভাত সব ঠান্ডা হইয়া যাইবো। আমি গেলাম। 

– দাঁড়াও দাঁড়াও দাঁড়াও। (শম্পাকে থামিয়ে) ত, তোমার একটা চুল আমাকে ছিঁড়ে দাও। 

– চুল! ক্যান, চুল ছিঁড়া দিমু ক্যান! আপনে চুল দিয়া কী করবেন ? 

– কাজ আছে। তুমি একটা চুল ছিঁড়ে দাও। নাইলে দাঁড়াও আমিই একটা ছিঁড়ে নিচ্ছি। 

– খারান খারান। আপনে কেডা। আপনারে আমি চিনিনা জানিনা, আমারে ছুইতে আইবেন না। 

– আরে আমি এই গ্রামের থানার ওসি। আমার নাম রিয়াদ। আমি এই চুল নিয়ে কী করেছি তা একদিন তোমাদের বাসা গিয়ে বলে আসবো। তুমি শুধু আমাকে একটা চুল দেও।

– আমার দুই হাতই তো বন্ধ।

– গামলাটা আমার হাতে দেও। 

বলেই রিয়াদ শম্পার হাত থেকে গামলাটা নিয়ে নেয়। শম্পা কিছুই বুঝতে পারছিলো না। কী হচ্ছে, কেনো হচ্ছে আর কেনই বা কেউ একজন তার চুল চাইছে। শম্পা তার আরেক হাতের জগ টা নিচে রেখে তার মাথা থেকে একটা চুল ছিঁড়ে রিয়াদকে দেয়। রিয়াদ সেটা নেয়। রিয়াদের হাত থেকে শম্পা গামলাটা নিয়ে নেয়। হেলে নিচে রাখা পানির জগ টাও নিয়ে নেয়। রিয়াদ হন্তদন্ত হয়ে বলে,

– আমি যে তোমার চুল নিয়েছি তা আপাতত রাশেদকে বলোনা। আমি একদিন তোমাদের বাসা যেয়ে সব তোমাদের খুলে বলবো। ঠিক আছে ? 

শম্পা আর কিছু বলেনা। হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। রিয়াদ চলে যায় শম্পার পাশ দিয়ে। হাতে থাকা চুল টা পেচিয়ে তার পান্জাবির সাইড পকেটে যত্নের সহিত রাখে। শম্পা পিছনে ফিরে রিয়াদের যাওয়ার পানে একবার দেখে। তারপর ঠোঁট উল্টে আবার সামনে ফিরে। চলে যেতে থাকে খাবার নিয়ে এই তপ্ত রোদের মাঝে। 

 

_______

 

সুমু গোসলখানা থেকে বেড়োলো। গাঁয়ে নতুন কাপড়, মাথায় ভেজা চুল। এই প্রথম কোন গোসলখানায় ঝড়না দিয়ে গোসল করলো সে। মুখে শুভ্রতার ছোঁয়া যেন তাকে নতুন করে জীবিত করে তুলেছে। হাতে থাকা গামছাটা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে হেঁটে যেতে থাকে বারান্দা দিয়ে। মুখ মলিন। মুখে হাসি নেই। এখনও সে এইবাড়ির সাথে নিজেকে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারেনি। সে একটু ইনট্রোভার্ট টাইপের বলা যায়। একলা থাকতে বেশি পছন্দ করে। 

বারান্দার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় সুমু। আঙিনার মাঝখান টায় শিউলি বেগম বসে আছেন। আর তার মাথায় তেল দিচ্ছে ফুলমতি। রোদ উঠেছে আজ ভালো রকমই। সুমু বারান্দা থেকে আঙিনায় নামে। গিয়ে আঙিনার রশিতে ভেজা গামছাটা মেলে দেয়। তাকে দেখেই শিউলি বেগম বলে উঠেন,

– গোসল হইছে তোমার!

– জ্বী আন্টি। হয়েছে। 

– আন্টি কারে কও! আমি তোমার আন্টি লাগিনি! 

– স,সরি। আসলে আমার মাথায় আর কিছু আসছিলো না। 

– আমারে চাচি নাইলে মা কইতে পারো। যেইডা ইচ্ছা আরকি। (পিছনে বসে থাকা ফুলমতিকে বিরবির করে) তুই যা। গিয়া গোসল ডা দিয়া আয়। দুপুর হইয়া আইছে ভাত খাইতে হইবো, খিদা লাগছে। 

– জে আইচ্ছা চাচি। 

ফুলমতি মোড়া থেকে উঠে হাতের তেলের বোতলটা মোড়ায় রেখে চলে যায়। শিউলি বেগম টুল থেকে উঠে মোড়ায় থাকা তেলের বোতলটা হাতে নিয়ে মোড়ায় বসেন। সুমুকে ডাকতে থাকেন,

– আহো, এদিকে আহো। 

সুমু ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। শিউলি বেগম তাকে তার সামনে থাকা টুল টায় বসতে বলেন। সুমু একটু ইতস্তত বোধ করছিলো। শিউলি বেগম আবার বলেন,

– আরে আমি তোমারে খাইয়া ফেলমুনা তো।‌ বহো বহো।

সুমু ধীর পায়ে এসে শিউলি বেগমের সামনে থাকা টুল টায় বসে। শিউলি বেগম মোড়াটাকে একটু টেনে সুমুর পিঠের কাছাকাছি হয়ে বসে। সুমুর খোলা চুল গুলো নিজের পায়ের রানের উপর নিয়ে বলেন,

– তোমার চুল গুলা অনেক লম্বা। যত্ন নিয়ো। আমি তেল মাখায়া দেই! 

– জ,জী দেন। 

শিউলি বেগম তার কোলে থাকা তেলের বোতলটা খুলে হাতে হালকা তেল নেন। মাথার চুল গুলো ভেজা ছিলো তাই চুল গুলো নিজের দুই পায়ের রানের উপর মেলে দিয়ে মাথার মাঝের সিতি টায় তেল দিয়ে দিতে থাকেন। আস্তে আস্তে মাসাজ করে দেন। সুমুর বেশ ভালোই লাগছিলো। আরামে চোখ যেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিউলি বেগম হাসি মুখে বলেন,

– আরাম লাগতাছে না! 

– হ্যা। ভালো লাগছে। 

– তেল ডার বাস(গন্ধ) ও সুন্দর। তোমার চাচায় দিনাজপুর থেইকা আনছে। 

– সকালে যিনি পান্জাবি আর কুরতা পড়ে বের হলেন উনি ? 

– হ। আমার বুইড়া জামাই হা হা হা!! 

সুমু একটা স্মাইলি ফেইস করে। শিউলি বেগম আবার বলেন,

– দিথীর কাছ থে আমি সবকিছু শুনছি। তুমি আমাগোরে নিজের আপন কেউ ভাবতে পারো। আমরা কেউ তোমার কোন ক্ষতি চাইমুনা। (একটু থেমে) তোমার আগের জন্মে নাম নূপুর ছিলা তাই না! 

– হ্যা। নূপুর।

– তোমাগো ঐ বাড়ির বুড়া ডা তাইলে,

– তান্ত্রিক। বয়স্ক লোকের ছদ্মবেশে থাকতেন। 

– আমার বাজান আর রিয়াদ একবার নোমানের কেসের সময় ঐ বাড়িত গেছিলো বলে। তহন ঐ বুইড়া তান্তিকরে দেখছিলো। হেরা কী আর জানতো তান্তিকই আসল কলকাঠি নাড়তাছে।

– হমম।

– শাহারিয়া বাড়ি আইয়া এইসব নিয়া আলোচনা করছিলো। হেইসময় হুনছিলাম। (একটু থেমে) আফাজরে ভালোবাসো! 

হঠাৎ এই কথার জন্য যেনো সুমু অপ্রস্তুত ছিলো। তার বুক যেন‌ লাফিয়ে উঠেছে কথাটা শুনে। সে হঠাৎ কী উত্তর দিবে ভেবে পায় না। শিউলি বেগম আবার বলেন,

– ভয় পাইয়োনা। আমি কাউরে কমুনা। আফাজের বিষয়ডা দিথী আমারে কইয়া গেছে। তুমি আসলেই আফাজরে ভালোবাসো কিনা তাই জিগাইতাছি। সত্যিই ভালোবাসো! 

সুমু মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বলে। শিউলি বেগম সুমুর মাথায় তেল মালিশ করতে করতে বলেন,

– আফাজের মনের অবস্থা এহন ভালা না। এহন তার মনে শুধু ঐ মাইয়া ছাড়া আর কিছুই নাই। তুমি চাইলেও হঠাৎ কইরা তার মন ঘুরাইতে পারবানা। তুমি চেষ্টা করো তার বন্ধু হওয়ার। যাইচা যাইচা ওর লগে কথা কবা। একদম ডরাইবা না। আফাজ তো আর তোমারে বকা দিবো না। তুমি অর আস্তে আস্তে ভালো বন্ধু হও। অরে মানসিক দিক দিয়া সাপোর্ট দেও। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হইলে তহন বন্ধু থেইকা বর কইরা ফেইলো কেমন! 

বলেই শিউলি বেগম মৃদু হাসেন। সুমু লজ্জা পায়। সে চুপচাপ থাকে। শিউলি বেগম হাতে আরেকটু তেল নেন। হাসি থামিয়ে সুমু্র চুলের অগ্রভাগের দিকে মাখিয়ে দিতে থাকেন। সুমুর কাছে বিষয়টা বেশ ভালো লাগে। যেন তার মা তার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। সুমু একটা ম্লিন হাসি দিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকায়। পেঁজা তুলোর মত মেঘ উড়ে যাচ্ছে। আকাশ টা আজ বেশ সুন্দরই লাগছে তার কাছে। হয়তো এই আকাশ টা রঙিন করার মানুষটাও একদিন তাকে আদর করে মাথায় তেল দিয়ে দিবে!!!

 

____

 

নিপা সাথী বেগমের রুমে প্রবেশ করে। সাথী বিছানায় বসে জানালার দিকে এক পানে চেয়ে ছিলেন। বাইরের পুকুরে রোদ পড়েছে। গাছ গুলোও বাতাসে মৃদু নড়ে উঠছে। নিপা ঘরে ঢুকে একটু গলা ঝেড়ে বলে,

– আসবো!!

সাথী বেগম যেন চমকে উঠে পিছনে তাকান। দেখেন নিপা। তিনি বুকে হাত দিয়ে বলেন,

– ভয় পাওয়ায় দিছিলা একদম! আসো। 

নিপা ঘরে ঢুকেই আসবো বলেছিলো। সাথী অত কিছু খেয়ালই করেননি। হয়তো তিনি অন্যমনস্ক ছিলেন। নিপা এসে বিছানায় বসে। হালকা রোদ পড়েছিলো বিছানায়। সময়টা দুপুর। কিছুক্ষণ আগেই যোহরের আযান দিয়েছে। নিপার দিকে মুখ করে বসেন সাথী। কোলে মাথার বালিশ রাখা। নিপা বলে,

– এই প্রথম এই ঘরে আসলাম। আপনি নাকি অসুস্থ।

– মেরুদন্ডের হাড় ভেঙেছিলো আমার ৪ মাস আগে। এখন কিছুটা জোড়া লেগেছে, তবে একয়দিন থেকে ব্যাথা বাড়ছে একটু। রায়হান বাইরে গেছে ? 

– না। ও গোসলে। আমি ভাবলাম আপনার সাথে কখনো দেখা করতে আসা হয়নি তাই একটু দেখা করে আসি। 

– আমিই তোমার ওখানে যাইতে চাইছিলাম। কিন্তু ব্যাথা বাড়ায় আর একয়দিন বিছানা থেকে একদম নামতে পারিনি। সাদিক টাও সারাদিন ওর আব্বুর সাথে অফিসে থাকে। একলা একলা কোথাও যেতেও পারিনা। 

– আচ্ছা আপনি কি ঐদিন কোন আওয়াজ বা চিৎকার শুনেছিলেন? 

সাথী বেগম হঠাৎ এই কথায় একটু ইতস্তত বোধ করেন। এক ঢোক গিলেন। বলেন,

– ক,কোনদিন ? 

– যেদিন আলিশা আর সুরাইয়া বেগম খুন হয়েছিলো, সেদিন! আপনার সামনের করিডোরেই তাদের রুম। আপনি কোন চিৎকার বা কথা শুনতে পাননি ? 

– আ,আমি। আমি ঐসময় ঘুমাইছিলাম। ত, তেমন কোন আওয়াজ পাইনি। 

– আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আপনি কিছু আমার থেকে লুকাচ্ছেন! 

কথা শুনেই সাথী বেগমের বুকটা যেন লাফিয়ে উঠলো‌। তিনি ঘামছেন। গলায় ঢোক গিলেন। নিপা আজ প্রথম তার সাথে দেখা করতে এসেছে আর এসেই এমন জেড়া করা শুরু! বিষয় টার জন্য সাথী বেগম একদমই অপ্রস্তত ছিলেন। নিপা সাথী বেগমকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলে,

– আপনি ঐদিন আলিশা আর সুরাইয়া আন্টির গলা ছাড়া আর কার গলা শুনেছিলেন! 

– ব,বউমা। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা জিনিস দিচ্ছি। 

বলেই কোলের বালিশ টা সড়িয়ে রেখে বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হন সাথী। তিনি ব্যাথা পাচ্ছিলেন তাই নিপা তাকে নামতে সাহায্য করে। সাথী বেগম বিছানা থেকে নেমে দূরের একটা টেবিলের দিকে যান। টেবিল টা ঘরের কোনে রাখা। তিনি সেখানে থাকা একটা ঝুড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে আসেন বিছানার কাছে। নিপা অবাক হয়ে খালি দেখছে সাথী বেগম কী কী করছেন। 

সাথী বেগম ঝুড়ি টা এনে বিছানার উপর রাখেন। নিজেও উঠে বসেন। ঝুড়িটায় কিছু একটা খুঁজতে থাকেন তিনি। নিপা বসে বসে একবার ঝুড়ির দিকে দেখছে একবার সাথী বেগমের দিকে দেখছে। সাথী বেগম ঝুড়ি টা বিছানার উপরেই উল্টিয়ে দেন। নিপা কিছুটা পিছিয়ে বসে। সাথী ঝুড়ি থেকে একটা বাঁধা পলিথিনে কিছু একটা বের করেন। করে নিপার দিকে দেন। নিপা অবাক চোখে খালি দেখছিলো। পলিথিন টা হাতে নেয় সে। সাথী বাকি জিনিস গুলো আবার ঝুড়িতে উঠিয়ে রাখতে থাকেন একে একে। নিপা বাঁধা পলিথিন টা ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখে বলে,

– এটা কী ? 

– খুলে দেখো। 

নিপা পলিথিনের বান টা খুলতে থাকে। খুলে দেখে ভিতরে এক ভাঙা মোবাইল। নিপা ভাঙা মোবাইল টা বের করে। বেশ দামী মোবাইল মনে হচ্ছে। টাচ ফেটে দুইভাগ, মাদারবোর্ড, ব্যাটারী সব আলাদা হয়ে গেছে। সাথী বেগম মাথা না উঠিয়েই বলেন,

– এইটা আমি রায়হানের জানালার নিচে বাড়ির বাইরের দিকটায় পেয়েছিলাম। রায়হানকে দিবো দিবো করে আর দেওয়া হয়নি। সিম, মেমরি কার্ডও আছে। রায়হানের লাগতে পারে এগুলো। তুমি গিয়ে ওকে দিয়ে দিয়ো। 

– এটা রায়হানের ফোন ? 

– হ্যা। ওর ফোন। তুমি ঘরে গিয়ে ওকে দিয়ে দিয়ো। 

নিপা ভাঙা ফোনটা ভালোভাবে দেখে। ফোনের অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক জোড়ে আছাড় মেরে ভাঙা হয়েছে। রায়হান এমন ভাবে কেনো ভাঙলো ফোনটা ? 

সাথী বেগম ঝুড়িটা নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ান। ঝুড়িটা গিয়ে ঘরের টেবিলের কোনে রেখে আসেন। নিপা ফোনটা নিয়েই বিছানা থেকে উঠে যায়। তার মাথা থেকে যেনো একটু আগের ঘটনাটা প্রায় চলেই গিয়েছে। নিপা হনহন করে ঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যায়। টেবিলের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সাথী বেগম আড়চোখে তার চলে যাওয়াটাকে দেখে। তিনি যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। 

 

_____

 

ইকরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করছে। এটা তার ঘর। বিছানায় একটা বড় টেডি মানে পুতুল রাখা। বিছানার চাদরে, কোলবালিশে কার্টুনের ছবি। দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন কার্টুনের ছবি টাঙানো। ইকরা কার্টুনের ক্যারেক্টার গুলো বেশ পছন্দ করে। যেই যেই কার্টুন গুলা তার ভালো লাগে সেগুলো দিয়েই সে ঘর সাজিয়ে ফেলে।

 ইকরা শোয়া হতে উঠে বসে। বাসায় সে আর বানু খালা ছাড়া কেউ নেই। তাই প্লাজু আর টি শার্টই পড়ে আছে। ইকরা ফোনের দিক থেকে নজর না উঠিয়ে হাঁক দিয়ে বলে উঠে,

– খালা,,,! মা ফোন দিছিলো তোমার ফোনে ? 

তার ঘরের পরের ঘরটা ডায়নিং রুম। সেই রুম থেকে একটা বয়স্ক মহিলার কন্ঠ ভেসে আসে,

– না খালাম্মা, তোমার মায়ে ফোন দেয় নাই। নুডুলস দিমু, নুডুলস খাইবা ? 

– একটা ম্যাগি করে দেও। ভাত খাইতে ইচ্ছা করেনা আজকে।

– দুপুরে খালি নুডুলস খাইয়া থাকবা! তোমার মায়ে শুনলে তো বকবো। 

– মা কে আমি বলবোনা। তুমি ম্যাগি করে দাও। আজ ভাত খাইতে মন চাচ্ছেনা।

– আইচ্ছা ঠিক আছে। 

 

ইকরা আবার ফোনে ফেসবুকে স্ক্রল করতে থাকে। একলা একলা বাড়িতে এই ফোন আর টিভিই তার সম্বল। হঠাৎ তার ফোনে ফোন আসে। ইকরা উপর থেকে নটিফিকেশন নামিয়ে দেখে রিয়াদ ফোন দিয়েছে। ইকরা বেশ অবাক আর তার সাথে আনন্দিতও হয়। তাড়াতাড়ি উঠে সোজা হয়ে বিছানায় বসে। কল টা রিসিভ করে কানে তুলে। ওপাস থেকে ইকরার কন্ঠ ভেসে আসে।

– হ্যালো, ইকরা! 

– হ্যা বলো। 

– কী করো। 

– এইতো বাসায় বসে আছি। তুমি এইসময় ফোন দিলা যে! (গোমড়া মুখে) প্রতিদিন তো এইসময় তোমার কেস থাকে, আজ নাই! 

– আছে, কিন্ত আজ ঐসব বাদ। তুমি এখন কোথায়? 

– আমি ? আমি তো বাসায়। কেনো ? তুমি আসবা নাকি আজকে ? 

– জানালার সামনে এসে দাঁড়াও। 

– জানালা?

ইকরা তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নামে। জানালার সামনে এসে পর্দা সড়িয়ে নিচের দিকে তাকায়। দেখে রিয়াদ তাদের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একহাতে কিছু ব্যাগ আর একহাতে কানে ফোন ধরে রয়েছে। ইকরা রিয়াদকে দেখে অনেক অবাক হয়। সাথে দাড়ুন খুশিও হয়। সে এক লাফ দিয়ে উঠে। আনন্দিত গলায় বলে,

– তুমি! আমার তো বিশ্বাসই হইতেছে না। দাঁড়াও দাঁড়াও আমি এখনি নিচে আসতেছি। 

বলেই তাড়াতাড়ি বিছানার কাছে এসে ওড়নাটা হাতে নিয়ে দৌড়ে ছুট লাগায় নিচে যাওয়ার জন্য। তার মুখে হাসি যেন আর ধরে না!!

 

      রিয়াদকে ধরে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে ইকরা। সে অনেক অনেক খুশি। রিয়াদ চারপাশ দেখতে দেখতে বিছানার সামনে এসে দাঁড়ায়। ইকরা রিয়াদের হাত ছেড়ে দিয়ে তাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে। আবার ছেড়ে দিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলতে থাকে,

– তুমি আসছো আমার এখনো বিশ্বাস হইতেছে না। একদম সারপ্রাইজড হয়ে গেছি আমি। 

– সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই তো না বলে আসছি। এই নেও। (রিয়াদ তার সাথে আনা কিছু শপিং ব্যাগ ইকরাকে দেয়। ইকরা হাতে নিয়ে অবাক সুরে বলে,

– এগুলা কী ? 

– দেখোইনা খুলে। 

বলেই রিয়াদ বিছানায় বসে পড়ে। ইকরাও বিছানায় বসে শপিং ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকায়। ভিতর থেকে বের করে এক নীল শাড়ি। তার চোখ মুখ সব যেন চাঁদের মতো বড় বড় হয়ে উঠেছিলো। মুখের হাসি যেন বাঁধ মানেনা। 

– এ,এটা আমার জন্য!

– তো কী আমাকে পড়তে বলতেছো! তোমার জন্যই আনছি। বাকি গুলাও দেখো! 

– আরো আছে! 

ইকরা শাড়িটা বিছানায় আস্তে করে রেখে দিয়ে আবার ব্যাগে হাত ঢুকায়। একমুঠো রঙিন রেশমী চুড়ি বের করে। ইকরা খুশিতে রিয়াদের দিকে চায়। রিয়াদ মুচকি হাসি দেয়। ইকরা সেগুলো বের করে রাখা শাড়ির উপর রেখে ব্যাগে আবার হাত ঢুকায়। এক ঝোড়া কানের ঝুমকা, মাথার কাঁটা-ক্লিপ, গোলাপী লিপস্টিক, আর কাজল বের করে। সাথে একটা মেহেদীও‌ ছিলো। ইকরা যেন খুশিতে আত্মহারা। এতো এতো কিছু রিয়াদ তার জন্য এনেছে! নীল রং পছন্দ তার, সেই নীল রঙের শাড়ি আর রেশমি চুড়ি এনেছে। ইকরা আবার রিয়াদকে জড়িয়ে ধরে। আবার ছেড়ে দিয়ে আনন্দ, উৎদিপ্ত মুখে বলে,

– এতো কিছু সব আমার জন্য! 

– হ্যা হ্যা সব তোমার। এখন যাও, এগুলো পড়ে রেডি হয়ে নাও, আজ ঘুরতে বেড়োবো।

– সত্যি! আমি,আমি এখনি পড়ে আসতেছি এগুলো। (বলেই শাড়িটা হাতে নিয়েই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তখনই রিয়াদের কাছে এসে তার গালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে বলে) উম্মাহ,,, এই নেও তোমার গিফট! 

– হায়!!! মেরা দিল খুস হুয়া!!! হা হা হা!!

রিয়াদ আর ইকরা দুজনেই হাঁসতে থাকে। ইকরা হাঁসতে হাঁসতে চলে যায় আলমারির দিকে। সেখান থেকে তার সাদা রঙের একটা ব্লাউজ বের করে নেয়। নীল শাড়ির সাথে সাদা ব্লাউজ মানাবে ভালো। ব্লাউজ নিয়ে দৌড় লাগায় ওয়াশরুমের দিকে চেন্জ করে নেওয়ার জন্য। ইকরার এমন ছেলে মানুষী দেখে রিয়াদ বেশ আনন্দ পাচ্ছিলো। ইকরা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগাবার আগ মুহুর্তে আরেকটা উড়ন্ত চুমু দেয় রিয়াদের দিকে। রিয়াদ সেই উড়ন্ত চুমু হাত দিয়ে ধরে তার বুকে লাগিয়ে নেয়।চোখ বুঝে ফেলে। ইকরা তা দেখে হাসতে থাকে। ভিতরে ঢুকে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। রিয়াদের মুখের হাসৌজ্জলতা এখনো কমেনি। ইকরাকে এতো খুশি সে আগে কখনো দেখেনি। সে ভেবেছিলো আরো কি কি আনা যায় ইকরার জন্য, কিন্তু এগুলো ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় আসছিলো না। তাই এগুলা নিয়েই চলে এসেছে। অনেক হয়েছে কেস আর রহস্য, এবার একটু নিজের মতো করে নিজের মানুষটার সাথে সময় কাটানো যাক!! রিয়াদ চারপাশ ঘুরে ঘুরে ইকরার রুম টা দেখতে থাকে। মেয়েটা বোধহয় খুব বেশি কার্টুন দেখে। এইজন্য ঘর এসবের ছবি দিয়ে ভরে রেখেছে। বিছানায় একটা টেডি বেয়ারও পায় রিয়াদ। বিছানায় শুয়ে পড়ে বুকের উপর নেয় সেই টেডি টাকে। বলতে থাকে,

– ও, তাইলে ম্যাডামের টেডিও পছন্দ! এরপর তাইলে আসার সময় বড় দেখে একটা টেডি আনতে হবে। 

বলেই নাক দিয়ে টেডির পেটে গুঁতোগুতি করতে থাকে রিয়াদ। রিয়াদের এই রূপ টা হয়তো এই প্রথম দেখা গেলো। সবসময় কেস নিয়ে দৌড়াইতে দৌড়াতেই হয়তো এই আবেগ টা তার মনের ঘরে সুপ্তই থেকে গিয়েছিলো। এখন তার একটা মানুষ হইছে, মানুষ টার মুখে হাসি দেখলেই যে তার অনেক অনেক ভালো লাগে!!!

 

_____

 

শাহারিয়া আর দিথী ডায়নিং টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। গোসল করে এসেই তারা খেতে বসেছে। ড্রাইভার রুমানকে আগেই খাবার আনতে পাঠিয়েছিলো শাহারিয়া। তাই তাদের গোসল করা হতে হতেই খাবার চলে এসেছে। 

ডায়নিং রুমটাও যথেষ্ট সাজানো গোছানো। মাঝের বড় ডায়নিং টেবিল টা গ্লাসের। মাঝে কিছু ফল ঝুড়িতে রাখা। কাঁচের গ্লাস, কাঁচের জগ সব সাজিয়ে রাখা। একসাথে ৮ জন খেতে পারবে এই টেবিলটায়। রুমের কোন গুলোয় আর্টিফিসিয়াল টব আর গাছ রাখা। উপরের সিলিং থেকে কিছু আর্টিফিসিয়াল ফুল ঝুলছে। বেশ সুন্দর লাগছে‌।

 

দিথী, শাহারিয়া পাশাপাশিই খেতে বসেছে। দিথী ভেজা চুল গুলো পিঠে মেলে দেওয়া। পড়নে থ্রি পিস। শাহারিয়ার পড়নে ফরমাল টি শার্ট। দিথী খেতে খেতে তরকারি বাটিটা টেনে বলে,

– মাংস দিবো আর! 

– এগুলাই হবে। তুমি নিলে নাও। এটা বাড়িতে রান্না করা খাবার। নির্ধিদায় যত ইচ্ছা খেতে পারো। 

– কার বাড়িতে রান্না করা! 

– রুমান, ঐযে ড্রাইভারটা দেখলানা, ওর মা রান্না করছে। এই সামনেই একটা গ্রাম আছে, সেখানেই থাকে ওরা। 

– গাড়িটা তোমার? 

– হ্যা। একটাই গাড়ি আমার। ঢাকায় থাকতে নিছিলাম। তোমাকে নিয়ে একদিন লং ড্রাইভে বেড়োবো কেমন!

– তুমিও গাড়ি চালাতে পারো ? 

– হ্যা। তুমিও পাড়ো নাকি? 

– পারি কিছুটা। শিখেছিলাম আগে।

– পানির জগ টা একটু এদিকে দেও তো।

দিথী পানির জগটা হাতে নিয়ে শাহারিয়ার গ্লাসে পানি ঢেলে দেয়। দিথী বলে,

– ঝাল হইছে না খুব! 

– হমম। ঝাল লাগতেছে। এতো ঝাল খাওয়ার অভ্যাস নাই আমার। 

– তাইলে পানি খাওয়া লাগবেনা। (শাহারিয়ার হাত ধরে) এইটা খাও। 

বলেই শাহারিয়ার ঠোঁটে একটা ছোট্ট চুমু খায় দিথী। শাহারিয়া যেন হকচক খেয়ে যায়। দিথী হঠাৎ তাকে চুমু খাবে সে কল্পনাও করেনি। দিথী চুমু দিয়ে আবার ঠিক করে বসে নিজের খাবার খেতে থাকে। শাহারিয়া এখনো অবাক চোখে দিথীর দিকে তাকিয়ে আছে। দিথী বলে,

– ঝাল কমেনাই! 

– হ,হ্যা। কমবে না আরো। যেই মিষ্টি দিছো, কোন ঝালই টিকতে পারবেনা।

– তাইলে এখন খাওয়া শুরু করো। এমন ভাবে অবাক হইলা যেনো কোন ভূত তোমাকে চুমু দিছে। 

শাহারিয়া সামনে ফিরে। বলে,

– মাঝে মাঝে তো মনে হয় তুমি জীন পরী। এতো এতো রোমান্স তোমার কীভাবে আসে! 

– পড়ে বোঝাবোনে কীভাবে আসে। ভাজি নিবা! 

– না থাক। ভাজি টা তেমন ভালো লাগে নাই। 

– আমারও। আচ্ছা রাতে কী রান্না করবো। এই বাড়িতে ফ্রিজ কোথায়? 

– ও তোমাকে তো কিচেন দেখাইতেই ভুলে গেছি। এই রুম থেকে বেড়িয়ে হাতের ডান পাশে কিচেন। ওখানে সব আছে। আর কী খাবা, ফ্রিজে তো কিছু নাই। আজকে আনতে হবে।

– মাছ আনিও। মাংস খাইতে খাইতে মুখ ধরে গেছে। 

– ছোট মাছ না বড় ?

– বড় গুলাই আনিও। ছোট মাছ বাছার সময় নাই। 

– আমি তাইলে মাছ কিনে রুমানের দাঁড়া পাঠায় দিবো। সাথে তরি-তরকারি কী নিবো ? 

– ফুলকপি নিও, সাথে গাজর, আলু, টমেটো, এগুলাই। 

– আমি খেয়ে নামাজ পড়ে বেড়োবো। তুমি ঘুমাইলে ঘুমাইয়ো, নাইলে টিভি দেখিও। ড্রয়িং রুমে টিভি আছে। 

– কই যাবা তুমি ? 

– সিলেট শহরে। ওখানে যেই সিবিআইয়ের শাখা অফিস টা আছে ওখানে। একয়দিন তো কাজে একদমই মন দেওয়া হয়নাই। আহনাফ কী পাইলো না ‌পাইলো এইসব যায় দেখতে হবে। 

– আহনাফ আসছে নাকি ওখানে? 

– না ও ফ্যাক্স করে পাঠাইছে রিপোর্ট গুলা। ঐগুলাই আনতে যাবো। এশার আগেই বাসা চলে আসবো। তুমি চিন্তা করিও না। 

– আচ্ছা বাইরে যেই বুড়োটা ছিলো, উনি খাবেন না ? 

– রুমান ওকেও খাবার দিয়ে গেছে। উনি দরজার পাশেই বসে খাচ্ছেন হয়তো। 

– উনি কী একলা ? মানে উনার ফ্যামিলি নাই ?

– আছে। উনিও রুমান যেই গ্রামে থাকে ওখানকারই স্থানীয়। কেনো? 

– উনাকে বাদ দিয়ে দাও।

– বাদ দিয়ে দিবো! 

– হ্যা।

– কেনো ? 

– এইবাড়িতে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ থাকবেনা।

– এই বাড়িতে তো উনি থাকেন না। গেটের পাশে যে একটা কুঠুরি আছে, ওখানে থাকেন উনি।

– তারপরও, বাদ দিয়ে দাও। রাতের বেলা আজব আজব শব্দ শুনে তখন ভয় পাবেন।

– কোন শব্দ? এখানে তো ভূত-তুত নাই। 

– তুমি জ্বীন, আমি পরী। আমাদের দুইজনের শব্দেই ভয় পাবে। 

– তোমার কথার মাথা-কল্লা কিছুই বুঝতেছি না। 

– এই রাতের বেলা কী মন ভরে একটু চিৎকারও করতে পারবোনা হ্যা! উনি থাকলে আমার মনে একটা খুদ থাকবে, উনি শব্দ শুনে, চিৎকার শুনে কী ভাববেন না ভাববেন এসব। তুমি,তুমি বাদ করে দাও। এতো বুঝাইতে পারবোনা।

শাহারিয়া মুখের ভাত গুলো না চিবিয়েই গোল গোল চোখ করে থ হয়ে দিথীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এইটা মেয়ে না অন্য কিছু, কী জিনিস বিয়ে করলো ও!! রাত বিরাতের চিৎকার যেনো না শুনে এইজন্য বাড়ির দারোয়ানকে তাড়ায় দিতে বলতেছে!! 

– এভাবে তাকায় আছো কেনো! আমার মুখে কী সোনা লাগে আছে নাকি! 

– তোমার মুখে সোনা লাগে আছে কী না জানিনা কিন্তু আমার কপাল টা যে সোনা দিয়ে গড়া তা এখন বুঝতে পারতেছি! 

– মানে! 

– কিছুনা। 

বলেই শাহারিয়া মুখের ভাত চিবোতে চিবোতে প্লেটের দিকে মুখ করে। একটু পর ধীর গলায় বলে,

– পরে তখন একলা একলা তুমি বাসায় থাকবা, আর আমি বাইরে। তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে! দাড়োয়ানটা থাকুক। 

– না থাকবেনা। কে আসবে হ্যা! যেই আসবে আমার কিছু করতে ওরে আমি কাটে কুচি কুচি করে রান্না করে গরুর মাংস বলে তোমাকে খাওয়ায় দিবো। আমাকে চিনেনা! আমার বলে ক্ষতি করতে আসবে হুঁ!!

– বুঝলাম,

– কী ? 

– তুমি একটা কঠিন জিনিস! 

– জিনিস কী হ্যা! মাল বলো মাল! হা হা হা!!! একদিন ড্রাইভার রুমানকে বলিও (ভঙ ধরে) মাল টাকে গাড়িতে তোল! হা হা হা!!

শাহারিয়া আর কিছু বলেনা। চুপচাপ প্লেটের দিকে মুখ করে ভাত গিলতে থাকে। এই দিথীটা যেন শিউলি বেগমের লাইট ভার্সন। এই দুইজনের মুখ আর বাইডেনের সুখ, কখন যে ছুটা শুরু করবে কেউ ধরতেই পারবে না! 

 

   শাহারিয়ার খাওয়া শেষ হয়ে যায়। সে এটো প্লেট নিয়েই টেবিল থেকে উঠে যায়। দিথী খাওয়া এখনো শেষ হয়নি। সে আস্তে ধীরে আরাম করে খাচ্ছিলো। শাহারিয়ার ঐ গোল গোল চোখ ওলা অবাক মুখ টা মনে পড়তেই দিথী হেঁসে উঠে। মুখটা দেখার মতো ছিলো। সেও মনে হয় একটু বেশিই বলে ফেলছে। নিজেই নিজের মাথায় মারে দিথী। বেশি দুষ্ট হয়ে গেছে ও!!!

 

____

 

টিউলিপ বোটানিক্যাল গার্ডেন। আকাশ মেঘলা করেছে। হয়তোবা বৃষ্টি নামবে। বাতাস করছে বেশ ভালোই। সময়টা বিকেলের কাছাকাছি। আশপাশে বেশ অনেকেই ঘুরাঘুরি করছে। এদিকটায় একটা লম্বা বড় রাস্তার মতো আছে। রাস্তার সাইড ধরে অনেক গুলো ছোট ছোট দোকান বসেছে। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ দোকানের সংখ্যা কম। আজ সকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি হয়েছিলো। তাই লোকজনও কম এসেছে।

 

রিয়াদ আর ইকরা একটা ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইকরার পড়নে নীল শাড়ি, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, কানে ঝুমকা ঝুলছে, হাতে রেশমি চুড়ি। মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা, চোখে হালকা কাজল। দারুন সুন্দরী লাগছে তাকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ। কালো পাঞ্জাবিতে তাকে ইকরার পারফেক্ট সঙ্গিই লাগছে বটে!!

ফুলের দোকান থেকে ইকরাকে একটা বেলি ফুলের হাতমালা কিনে হাতের চুড়ির সামনের অংশে পড়িয়ে দেয় রিয়াদ। একটা হলুদ গাঁদা ফুল ইকরার খোঁপায় পড়িয়ে দেয়। ইকরা বলে সে এক গুচ্ছ কদম ফুলও নিবে। তাও নিয়ে দেয় তাকে রিয়াদ। ফুল কিনার পালা শেষ। ইকরা রিয়াদকে নিয়ে যেতে থাকে হাওয়াই মিঠাইয়ের স্টলের দিকে। সেখানে ভিড় তেমন একটা ছিলোই না। ইকরা রিয়াদকে নিয়ে সেখানে এসে দাঁড়িয়ে হাওয়াই মিঠাই খেতে চায়। রিয়াদও দুটো হাওয়াই মিঠাই নেয়। পলিথিন সড়িয়ে ছোট্ট ছোট্ট করে হাওয়াই মিঠাই ছিড়ে ইকরাকে খাইয়ে দিতে থাকে। ইকরার মুখে হাসি। আলতো করে মুখে নিয়ে রিয়াদকেও সে তার টা থেকে ছিঁড়ে খাইয়ে দেয়। বাতাস করছিলো বেশ। আকাশের অবস্থাও ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। ইকরা রিয়াদকে নিয়ে চলে যায় হাওয়াই মিঠাইয়ের পাশে থাকা আইসক্রিমের স্টলের দিকে। আইসক্রিম খাওয়ার বাহানা ধরে রিয়াদের কাছে। রিয়াদ হাসি মুখে ইকরার এই আবদার টাও পূরণ করে। ইকরার পছন্দ অনুযায়ী তাঁকে একটা কোণ আইসক্রিম কিনে দেয়। বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছিলো তাও ইকরার ইচ্ছে টাকেই রিয়াদ প্রাধান্য দিয়ে তাকে আইসক্রিম কিনে দেয়। ইকরা আইসক্রিম খুলে খেতে থাকে। তার ঠোঁট মেখে যায় আইসক্রিমের অংশ দিয়ে। রিয়াদ আলতো করে ইকরার ঠোঁট থেকে আইসক্রিম আঙুলে নিয়ে নিজের মুখে ঢুকিয়ে নেয়। ইকরা রিয়াদকে তার আইসক্রিমটা থেকে কিছুটা খেতে বলে, রিয়াদ না করে। ইকরা তাও তার মুখের দিকে আইসক্রিম টা বাড়িয়ে দেয়। রিয়াদ একটা ছোট্ট বাইট নেয়। ইকরা মুচকি হাসে। রিয়াদ যে পাশটায় খেয়েছে সেও সে পাশটায় কামড় দেয়। রিয়াদ আইসক্রিম থেকে একটু ক্রিম আঙ্গুলে নিয়ে ইকরার নাকে লাগিয়ে দেয়। হাসতে থাকে। ইকরা চোখ সরু সরু করে তাকায়। আবার আইসক্রিম খেতে থাকে। খাওয়া শেষ হতে না হতেই ঝুম বৃষ্টি নামে। চারপাশে লোকজন দৌড়ে রাস্তার সাইডে থাকা ছাওনি গুলার নিচে দাঁড়াতে থাকে। রিয়াদও ইকরার মাথার উপর একহাত দিয়ে তাকে নিয়ে ছুটে যায় ছাউনির দিকে। ইকরাও ছোট বেলার মতো দৌড়ে রিয়াদের সাথে ছাউনির দিকে যায়। সে বেশ আনন্দ পাচ্ছিলো। রিয়াদ আর ইকরা এসে ছাওনির সামনের দিকটাতেই দাঁড়ায়। বেশ ভালোমতোই বৃষ্টি নেমেছে। বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে আকাশ গর্জন করে উঠছে। বৃষ্টির হালকা ঝাপটা কখনো কখনো এসে রিয়াদ ইকরার উপরও পড়ছে। রিয়াদ ইকরাকে তার বুকের একপাশের সাথে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইকরা রিয়াদ বুকে একহাত দিয়ে কী যেনো আর্ট করছিলো। আর্ট করতে করতে রিয়াদের পাঞ্জাবির বোতাম গুলো নেড়ে নেড়ে দেখছিলো।

 বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে। তবে এতোটাও কমেনি যে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হাঁটা যাবে। হঠাৎ ইকরা রিয়াদের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তাকে বলে,

– এই এই, চলোনা বৃষ্টিতে ভিজি! 

– না না, ঠান্ডা লাগে যাবে তখন তোমার।

– আরে একদিনই তো ভিজবো, চলোনা চলোনা! 

– কিন্তু,,,,,

রিয়াদকে আর কিছু বলতে দেয় না ইকরা। রিয়াদের হাত ধরে ছাউনি থেকে নেমে যায়। রিয়াদও কিছু বলার সুযোগ পায় না। ইকরা রিয়াদকে নিয়ে এসে একদম রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়ায়। এই রাস্তা এমনি এই উদ্যানের মাঝে হাঁটার বড় রাস্তা। এটা দিয়ে কোন গাড়ি চলাচল করেনা।

ইকরা রিয়াদকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে উপরের দিকে মুখ করে। বৃষ্টির বেগ হালকা কমে যায়। তবে তা দেহকে ভিজিয়ে দেওয়ার জন্য আর নতুন কাব্যের সূচনা করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। ইকরা উপরে মুখ করে চোখ বন্ধ করে। এক হাতে গুচ্ছ কদম ফুল আর আরেক হাত দুই পাশে মেলে দিয়ে বৃষ্টির ধারাকে উপভোগ করতে থাকে। বৃষ্টির ফোঁটা এসে তার চোখের বন্ধ পাতায় পড়ে, গালে পড়ে, গড়িয়ে গাল বেয়ে নিচে পড়ে যায়। তার সামনে দাঁড়ানো রিয়াদ দুই হাত নিজের কোলে একসাথে করে। দেখতে থাকে ইকরাকে এক নতুন রূপে, নতুন আঙ্গিকে!! তার মুখে ফুটে উঠে এক সুন্দর হাসি। 

ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে গান, ‘ এক গুচ্ছ কদম হাতে, ভিজতে চাই তোমার সাথে!!! ‘

 

____

 

নিপা বিছানায় বসে তার ফোন সুইচ অফ করছে। ঘরে এখন সে ছাড়া আর কেউ নেই। রায়হান একটু নিচে যাবে বললো। এই সুযোগে নিপা একটা কাজ করতে চায়। সে রায়হানের যেই ভাঙা ফোনটা সাথীর কাছ থেকে পেয়েছে সেই ফোনের সিম আর মেমরি কার্ড নিজের ফোনে লাগিয়ে দেখতে চায়। এমনিতে ও রায়হানের ফোন ধরেনা, তবে আজ কেনো জানি তার মন এই সিম আর মেমরিতে কি আছে তা দেখতে চাইছে।

নিপা ফোন অফ করে সিম ইজেক্টর দিয়ে ফোনের সিম কার্ড ট্রে বের করে। সেখানে আগে থেকেই তার একটা জিপি সিম ছিলো। সে আরেকটা সিমের যায়গায় রায়হানের ভাঙা ফোন থেকে পাওয়া রবি সিমটা বসায়। মেমরি কার্ডের যায়গায় মেমরি কার্ড বসায়। সিম কার্ড ট্রে টা সাবধানে তার ফোনের ভিতরে ঢুকায়। দরজার দিকে চেয়ে দেখে রায়হান আসলো কী না। না রায়হান আসেনি। নিপা ট্রে টা সম্পূর্ণ ঢুকিয়ে ফোনটার পাওয়ার বাটন চেপে সুইচ অন করে।

ফোনটা অন হয়। ডিসপ্লেতে উঠে “Realme” লেখা লোগো। ফোনটা খুলে যায়। নিপা তাড়াতাড়ি কলার সেটিংসে যায়। এই সিম দিয়ে রায়হান কার সাথে কথা বলেছে না বলেছে তা দেখতে। কিন্তু না। রায়হানের সিমটা অফ বলছে। কলার লিস্টে শুধু তার সিমের কল লিস্ট। সে রায়হানের সিমটা দিয়ে কল দিয়ে চেক করতে চায়, তখনই একটা মেয়েলী কন্ঠে ভেসে আসে। বলে যে, এই সিমটার নাম্বার তুলে নেওয়া হয়েছে। মানে আরকি এই সিমের নাম্বার অন্য কার্ডে চালু, তাই এই কার্ড দিয়ে ফোন যাচ্ছে না, কলার লিস্টও ফাঁকা। নিপা ভাবে যে মেমরিতে হয়তো কিছু থাকতে পারে। নিপা ফোনের ফাইল ম্যানেজারে ঢুকে। মেমরিটা ৬৪ জিবি। এর মাঝে ১০ জিবি ফুল। এই ১০ জিবি কী কী রাখছে রায়হান! 

নিপা মেমরির ভিতরে ঢুকে। দেখে বিভিন্ন ফাইল রাখা। বেশিরভাগই ভিডিও। তাদের কম্পানির যেই বিজ্ঞাপন ভিডিও বেড়িয়েছে সেগুলো। নিপা ভিডিও ফোল্ডার থেকে বের হয়ে ফটোস এ ঢুকে। সেখানেও তার ছবি আর রায়হানের ছবি ছাড়া আর ছবি নেই। এগুলা সেই ছবি যেগুলা সে মাঝে মাঝে রায়হানকে হোয়াটসঅ্যাপে দিতো, আর দেখা হলে তুলতো। মাত্র ৪৯ টা ছবি। আর কোন ছবি নাই। নিপা সেই ফোল্ডার থেকে বেড়িয়ে অডিও ফোল্ডারে যায়। সেখানে বেশ কিছু ফোন রেকর্ডিং রাখা। 

‘ কল রেকর্ডিং! দেখিতো রায়হান কার কার সাথে কথা বলতো! ‘

বলেই নিপা রেকর্ডিং চালূ করে দেয়। একটা মেয়ে আর রায়হানের কথা বার্তা। মেয়েটা রায়হানকে কোন কাজ সম্পর্কে বলছিলো। হঠাৎ দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে ফেলে রায়হান। 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( কী হতে চলেছে এরপর? নিপার কৌতুহলই কী তার সংসারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে? গল্প নিয়ে গঠনমূলক মন্তব্য করুন। আমি রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করবো ❤️)

 

 গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭২

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৩

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

(১৮+ এলার্ট)

 

‘ কল রেকর্ডিং! দেখিতো রায়হান কার কার সাথে কথা বলতো! ‘

বলেই নিপা রেকর্ডিং চালূ করে দেয়। একটা মেয়ে আর রায়হানের কথা বার্তা। মেয়েটা রায়হানকে কোন কাজ সম্পর্কে বলছিলো। হঠাৎ দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে ফেলে রায়হান। নিপা চমকে উঠে। হাত থেকে তার মোবাইল টা ছিটকে ফ্লোরে পড়ে যায়। ফোনের ডিসপ্লে ফেটে যায়। ফোন সুইচ অফ হয়ে সাউন্ড আসা বন্ধ হয়ে যায়। নিপা ভয়ার্ত চোখ নিয়ে একবার ফোনের দিকে তাকায়, তারপর ফিরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রায়হানের দিকে তাকায়। এক ঢোক গিলে। রায়হান এখনো ঠাঁয় দরজা ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না ভিতরে কী হচ্ছে। নিপা ঘামছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। রায়হান বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। নিপার বুকের ঢুকপুকানি বেড়ে যায়। রায়হানের চাহনিটা এখন এমন লাগছিলো যে নিপা কোন বড়সড় অপরাধ করে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। রায়হান নিপার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিপার ভয়ার্ত মুখটা একবার দেখে ফ্লোরে পড়ে যাওয়া ফোনটা উঠায়। উঠিয়ে দেখতে থাকে। টাচ মাঝ দিয়ে ফেটে গেছে। ফোনটাও অফ হয়ে গেছে। রায়হান ফোনটা হাতে নিয়ে নিপাকে অবাক গলায় বলে,

– ফোনটা পড়লো কীভাবে! 

– এ,এমনিই হাত। হাত ফসকে পড়ে গেলো। 

– তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেনো? (চারপাশে নজর ঘুড়িয়ে) ভূত-তুত দেখে ফেলেছো নাকি! ঘরে তো ভূত নাই। এতো ঘামতেছো কেনো ? 

– ক,কই। কই ঘামতেছি। (বলতে বলতে মুখের ঘাম হাত দিয়ে মুছে নিপা) 

– সুবা, কোন সমস্যা ? তুমি এমন করছো কেনো ? 

– ন,না। কোন সমস্যা না। আমি,আমি ঠিক আছি। 

তখনই রায়হানের নজর যায় বিছানার দিকে। নিপার পাশে কিছু ভাঙা মোবাইলের টুকরো পড়ে আছে। রায়হান নিপার পাশে বসে ভাঙা মোবাইলের টুকরো গুলো হাতে নেয়। নিপা ভয়ে অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কোন অজানা ভয় তাকে ঘিরে রেখেছে, বারবার মনে হচ্ছে ও কোন স্পর্শকাতর যায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে। রায়হান ভাঙা মোবাইলের টুকরো গুলো হাতে নিয়ে বলে,

– এটা তো আমার মোবাইল! কোথায় পেলে এটা! 

– ন,নিচে। নিচে বাগানে। 

– বাগানে ? ওহ,, হয়তো ব্যালকনি থেকে যে পড়ে গেছিলো ঐ মোবাইল টা। নিচে নামে পড়ে আর খোঁজা হয়নি। (একটু থেমে) আচ্ছা বাদ দেও। নিচে আঁখি বিকালের নাস্তা বানাচ্ছে। তুমি কী নাস্তা খাবা ? নুডুলস করতে বলবো না পাস্তা ? 

– য,যেকোন একটা। 

– হ্যা, তো কোনটা। তোমার এখন কোনটা খেতে মন চাচ্ছে? আমি নিচে গিয়ে আঁখিকে ঐটাই বলবো রাঁধতে। 

– ন,নুডুলস। নুডুলস ই বলো। 

– আচ্ছা ঠিক আছে। আর তোমার ফোনটা মনে হয় আর অন হবেনা। রাতে নতুন ফোন এনে দিবো। চলো এখন, নিচে কেউ নাই, বাবা, ভাইয়ারা আসতে রাত হতে পারে। আমরা গিয়ে ডায়নিং টেবিলেই খেয়ে নেই। 

– আ, আচ্ছা ঠিক আছে। 

– চলো। 

রায়হান বিছানা থেকে উঠে ভাঙা ফোনের টুকরো গুলো বিছানায় থাকা পলিথিন টায় ঢুকিয়ে বাঁধে। নিপার হাত ধরে তাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে থাকে তার সাথে। নিপা বলে,

– এইটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ? 

– বাইরে ফেলে দিবো। ভাঙাচোরা জিনিস ঘরে রাখতে নাই, তাইলে বলে অভাব-অনটন বাড়ে। মানে লোকের মুখে শোনা কথা আরকি। চলো। 

রায়হান নিপার হাত ধরে দরজার দিকে চলে যায়, যাওয়ার সময় নিপার ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে নিপাকে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। নিপা বাধ্যের মতো চুপচাপ রায়হানের সাথে যাচ্ছিলো। মনে মনে ভাবছিলো,

” আমি কী মিছে মিছেই রায়হানদের উপর সন্দেহ করছি! ঐ মেয়েটা হয়তো এ বাড়িরই কেউ। রায়হানের উপর এই বিশ্বাসটা অন্তত আমার আছে যে ও অন্য কোন মেয়েতে আসক্ত হবে না।” 

করিডোর থেকে সিড়ির দিকে চলে যায় দুজন। নিপা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিতে থাকে। একটু আগে কিচ্ছু হয়নি তার সাথে, কিচ্ছু হয়নি!

 

____

 

সন্ধ্যা বেলা। এখনো ঝিড়ঝিড়ে বৃষ্টি পড়ছে। রিকশায় রিয়াদ আর ইকরা বাসার দিকে রওনা দিয়েছে। দুইজনেই ভিজে চুপচুপ। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়াও তেমন একটা নেই। দু’পাশের দোকান পাট গুলোও বন্ধ। এদিকটা শহরাঞ্চল। তাই মাঝে মাঝে দু একটা মোটরসাইকেলকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। আকাশ মাঝে মাঝে গর্জন করে উঠছে। রিকশার হুড খোলা। ইকরাই হুড খুলে রাখতে বলেছে। এতোক্ষণ ভিজেছে, আরেকটু নাহয় জিজলো। চলন্ত রিকশায় ঠান্ডা বাতাস এসে দু’জনেরই শরীর শিউরে তুলছে। ইকরার ঠোঁট মৃদু কাঁপছে। সে রিয়াদের এক হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে আছে। হাতে এখনো সেই গুচ্ছ কদম ফুলের তোড়াটা। সেটাও কিছুটা ভিজে গেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি কণা এখনো কদমের গাঁয়ে লেগে আছে। ইকরার চোখ মুখ সাদাটে বর্ণ ধারণ করেছে। সারা বিকেল টাই তারা বৃষ্টিতে ভিজেছিলো। রিয়াদ বলে উঠে,

– বেশি ঠান্ডা লাগছে! 

– ন,না। ত, তেমন বেশি না।

– আগেই বলেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে, এখন যদি জ্বর আসে! 

– তুমি তো আছো। জ্বর আসলে আসুক, আমি থোরাই জ্বরকে ভয় পাই! 

– পুলিশকে তো ভয় পেতে! আর এখন দেখো, পুলিশের সাথেই প্রেম করছো। 

– স,সব পুলিশ আর তুমি কী এক! তুমি তো,তুমি তো স্পেশাল। আমার জন্য স্পেশাল।

– তোমাদের বাড়ির রোডে চায়ের দোকান আছে ? 

– ছোট্ট একটা চায়ের টং আছে। ক, কেনো? 

– তাইলে রিকশা থেকে নেমে সেখানে দুইজন গরম গরম চা খাবো। শরীরে একটু গরম ধরবে।

– তুমি থাকলে আমার আর চা লাগবেনা। তুমিই আমার গরম চা, তুমিই আমার হিটার!

– বাহ, প্রিয়জনের প্রয়োজন হতে পেরেছি তাইলে! 

– প্রয়োজন টা ক্ষণস্থায়ী থাক, প্রিয়জনটা চিরকাল রয়ে যাক!

– হমম, ঠিক আছে। চিরকাল রয়ে যাবো। কিন্তু ম্যাডাম, আজ যে আমাকে চলে যেতে হবে। বাসায় তো জানে আমি এখনো কেসের পিছনে দৌড়াইতেছি। 

– বাসায় ফোন দিয়ে বলো কেস বলছে ওর সাথে আজকে রাতে তোমাকে থাকতে‌। 

– না না, আমি এখন তোমার সাথে থাকতে পারিনা। আমরা এখনো আনম্যারিড। এখন একসাথে থাকা অসম্ভব। 

– কিছু হবেনা। বানু খালাকে আমি অন্য ঘরে থাকতে বলবো। 

– ইকরা! মার খাবা কিন্তু! বলছি না এখন একসাথে থাকা যাবেনা। আমি কী হারিয়ে যাচ্ছি নাকি। (একটু থেমে) তোমার মা-বাবা আসুক, আমি ভাইয়াকে নিয়ে আসবো একদিন। তখন কথা পাকাপাকি হলে বিয়ে করে সারাদিন আমার সাথে থাকিও। কিন্তু এখন, একদমই না।

ইকরা কিছুটা বাহানার সুরে বলে,

– আজ রাতে যদি আমার জ্বর আসে, তখন আমাকে কে দেখবে! 

– তোমার বানু খাল দেখবে! উনিতো কোথাও চলে যাচ্ছেন না। 

– তুমি তাইলে চলেই যাবা।

– ভাইয়া,ভাবি চিন্তা করবে আমি না ফিরলে। তুমি মন খারাপ করিও না। আমি আবার আসবো। (একটু থেমে) এটাই তোমাদের রোডের চায়ের দোকান না! এই মামা এখানেই দাঁড়ান। (ইকরার দিকে ফিরে) এটাই তো ? 

– হুমম।

– তাইলে নামো। গরম চায়ে চুমুক দিলে ঠান্ডা কাটে যাবে। সামনেই তো তোমাদের বাসা। হেঁটে হেঁটেই যাওয়া যাবে। 

ইকরা রিকশা থেকে নামে। রিয়াদও নেমে রিকশাওলাকে ভাড়া পরিশোধ করে দেয়। রিকশা ওলা মামা চলে যায় তার রিকশা নিয়ে। 

আকাশের বৃষ্টি এখন থেমেছে। তবে মেঘের ঘনঘটা বলছে আরো বৃষ্টি নামানোর জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। রিয়াদ আর ইকরা চায়ের টংয়ের সামনে দাঁড়ায়। দোকানে কোন কাস্টমার ছিলো না। রিয়াদ টং দোকান থেকে দুটো চা নেয়। এখানে আবার মাটির ভাঁড়ে চা দেয়। রিয়াদ একটা ইকরাকে দেয়। ভালোই ধোঁয়া উঠছিলো চা থেকে। দুজনেই চায়ে ছোট্ট চুমুক দেয়। গপ্পের ঝুড়ি বের করে বসে দুজন। কথার মাঝে মাঝে হাসতেও থাকে। এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় ধোঁয়া উঠা মাটির ভাঁড়ে চা, হালকা ঠান্ডা বাতাস, আর একজন নিজের মানুষ, আহা! আহা! আর কি চাই!!

 

_______

 

শাহারিয়ার গাড়ি এসে থামলো বাড়ির মেইন গেটের সামনে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে শ্রীমঙ্গলে। মাঝে মাঝে ইয়া বড় বড় বিজলী চমকিয়ে উঠছে। শাহারিয়ার ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। বলেছিলো এশার আগেই ফিরবে। কিন্ত না, ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টা পাড় হয়ে গেলো। এরকম ঝড়বৃষ্টির রাতে বাড়িতে দিথী একা, আবার ভয় পাচ্ছে নাকি কে জানে! দাড়োয়ানটাকে বিকেলে অফিসে যাওয়ার সময়ই চলে যেতে বলেছিলো শাহারিয়া। তাই দাড়োয়ান টাও নেই। 

ড্রাইভার রুমান ছাতা হাতে ড্রাইভিং সিট থেকে বের হয়। বের হয়ে ঘুরে এসে গাড়ির অপর প্রান্তে এসে শাহারিয়ার দরজাটা খুলে দেয়। ছাতাটা শাহারিয়ার হাতে দিয়ে দেয়। শাহারিয়া গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। গাড়ির ভিতরে বসে যা আন্দাজ করেছিলো এই বৃষ্টি তো তার চেয়েও বেশি জোরে পড়ছে। শাহারিয়া রুমানকে জোরে জোরে বলে,

– তুই গাড়ি নিয়ে ফিরে যা। কাল সকালে ফোন দিবো। তখন চলে আসিস।

– আচ্ছা স্যার। ঠিক আছে।

রুমান গাড়ির ড্রাইভারের পাশের দরজার দিকে চলে যায়। শাহারিয়া ছাতা হাতে বাড়ির খোলা মেইন গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়িটাকে এখান থেকে দেখতে যেনো কোন ভূতুড়ে বাংলো মনে হচ্ছে। বাড়িতে কারেন্টও নেই। বৃষ্টি হলে কারেন্টের আর খবর পাওয়া যায় না। শাহারিয়া হেঁটে হেঁটে ঘাসের মাঝের সাদা অংশটা দিয়ে বাড়ির দরজার দিকে যেতে থাকে। বৃষ্টির বেগ অনেক বেশি ছিলো। দমকা হাওয়ায় তার শরীরে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছিলো। সাদা ফরমাল শার্টটা কিছু যায়গায় ছোপ,ছোপ পানি লেগে ভিজেও যায়। এক হাতে অফিস ব্যাগ, আরেক হাতে ছাতা। শাহারিয়া দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির দরজা দিকে যায়।

 

   দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। হাতের ছাতাটা বন্ধ ঘরে ঘরের কোনে রাখে। দরজাটা খোলাই ছিলো।  শাহারিয়া ভিতরে ঢুকে দেখে চারপাশ ঘোর অন্ধকার। শুধু মাঝে মাঝে বিজলী চমকে উঠলে সেই আলো জানালার গ্লাস দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে। দিথী নিশ্চয়ই ঘরের কোণে চুপচাপ বসে আছে। একলা মেয়েটা এরকম অন্ধকার বাড়িতে একা। শাহারিয়ার উচিত ছিলো আরো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরা। শাহারিয়া দরজা লাগিয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে সামনে আগায়। রুমটা ড্রয়িং রুম। শাহারিয়া ডাকতে থাকে,

– বউজান,,,, বউজান,,,, আমি আসছি। সরি লেইট করার জন্য। তুমি কি উপরের ঘরে আছো! বউজান,,,,

তখনই হঠাৎ নুপুরের শব্দ ভেসে আসে উপর থেকে। শাহারিয়া সিড়ির দিকে তাকায়। সিড়ি দিয়ে উপর থেকে নেমে আসছিলো দিথী। পড়নে হালকা লাল শাড়ি, হাতাকাটা ব্লাউজ। দুইহাত দিয়ে সামনে একটা লম্বা মোমবাতি ধরে আছে। ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে। শাড়ির আঁচলটা হাওয়ায় মৃদু উড়ছে। শাহারিয়া দিথীকে এমন ভাবে দেখে থ হয়ে যায়। দেখে মনে হচ্ছে যেনো এক ভূতুড়ে বাংলোতে এক অশরীরী প্রেতাত্মা উপর থেকে নিচে নামছে। দিথীর পায়ের নুপুরের শব্দ এই নিস্তব ঘরে প্রতিফলিত হচ্ছে। ঘরে ঠান্ডা বাতাসের সাথে একটা সুঘ্রাণ ভেসে আসতে থাকে। এক চাপা ফুলের ঘ্রাণ। দিথী নেমে এসে শাহারিয়ার সামনে দাঁড়ায়। বাইরে এক বড় বিজলী চমকিয়ে উঠে। কাঁচের জানালা দিয়ে সেই আলো খানিকক্ষণের জন্য ঘরকে আলোকিত করে চলে যায়। দিথী মুখ তুলে তাকায় শাহারিয়ার দিকে। চোখে হালকা কাজল দিয়েছে। মাথার চুল গুলো খোলা, মৃদু হাওয়ায় সেগুলো দুলছে। হাতে লাল চুড়ি। কোমরে ঝুলছে রুপালি বিছা। মোমবাতির আলোয় দিথীর শ্যাম সুন্দর মুখ খানা হ্রদয় জুড়িয়ে দেওয়ার মতো। শাহারিয়া আধভেজা শরীরে দিথীর সামনে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের মধ্যে পিনপন নিরবতা।

 শাহারিয়া তার ঘোর কাটিয়ে তুলে নিরবতা ভেঙে বলে,

– ত, তুমি! স,সরি আসতে একটু লেইট হয়ে গেলো। 

– একটু না শাহারিয়ার সাহেব, আপনি অনেক টা লেইট করে ফেলছেন! 

– ন,না মানে স,সরি। আর হবেনা এমন লেইট। (একটু থেমে) ত,তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি। 

বলেই হাতের ব্যাগটা নিয়ে পাশের বড় টেবিল টায় রাখে শাহারিয়া। ব্যাগের চেইন খুলে কিছু একটা বের করতে থাকে। ভয়ে যেন তার শরীর কাঁপছে। দিথীকে বাড়িতে এসে সে এভাবে দেখবে কখনো ভাবেনি। ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করে। বক্স নিয়ে এসে দিথীর সামনে দাঁড়ায়। দিথী এখনো আগের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। যেনো কোন ভয়ংকর সুন্দরী নারীর মুর্তি দাড়িয়ে আছে শাহারিয়ার সামনে। শাহারিয়া ছোট বক্সটার কভার খুলে ফেলে দেয়। ভিতরে ছিলো একটা রিং বক্স। শাহারিয়া সেটা খুলে দিথীর দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,

– এটা তোমার জন্য। আমার এক কলিগ তার বউয়ের জন্য ডায়মন্ড রিং নিচ্ছিলো, আমি ভাবলাম তোমার জন্যও একটা নেই। তোমার তো আংটি অনেক পছন্দ। তার থেকে আমার টা বেশি বড়। ৮ ক্যারেটের। ডায়মন্ড নেকলেস এই শোরুমে ছিলোনা, নাইলে ওটাও আনতাম। ঢাকা গেলে তোমার জন্য সেটা নিয়ে আসবো। 

দিথী শাহারিয়ার হাতে থাকা রিং বক্সটার দিকে তাকায়। রিংটা বেশ সুন্দর। মোমবাতির আলো সেটায় পড়ে চিকচিক করে উঠছিলো। দিথী রিং থেকে নজর উঠিয়ে শাহারিয়ার দিকে তাকায়। শাহারিয়ার যেনো সেই দুই চোখের চাহনি দেখে গলা শুকিয়ে আসছিলো। ভিতর থেকে কথা বেড়োচ্ছিলো না। তারপরও খুব কষ্টে কাপো কাপো গলায় বলে উঠে,

– এ,এইটা কিনতেই দেরি হয়ে গেছিলো। দ,দাঁড়াও আমি তোমায় পড়িয়ে দিচ্ছি। 

বলেই দিথীর এক হাত ধরে সেটায় বক্সটা দিয়ে দিতে যায়, অমনি দিথী হাত টেনে নেয়। শাহারিয়া অবাক হয়। দিথী কী খুশি হয়নি ? দিথী এখনো আগের চাহনিতেই তাকিয়ে ছিলো। শাহারিয়া বুঝে উঠতে চেষ্টা করে আসলে দিথী তার চাহনী দিয়ে কী বলছে? তখনই তার মাথা খুলে যায়। ও বুঝতে পারে আংটিটা দিথী পড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। শাহারিয়া রিং বক্স থেকে আংটিটা বের করে। বক্সটা ফেলে দেয়। আংটিটা নিয়ে দিথীর সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে। দিথী এবার নিজে থেকেই তার এক হাত বাড়িয়ে দেয়। আরেক হাতে তার মোমবাতি ধরা। সেই আলোয় চারপাশ খানিকটা আলোকিত হয়েছে। শাহারিয়া দিথীর হাতে আংটিটা পড়িয়ে দেয়। নিজের ভয় টুকু দূড়ে সড়িয়ে রেখে স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘আই লাভ ইউ বউজান,,! তুমি আমার জীবনের,প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। তোমার মাঝে তাইতো আমার,জীবনের শত আশা..!’ 

বলেই দিথীর হাতের উল্টো পিঠে একটা চুমু খায়। দিথীর চোখ যেনো বুজে আসছিলো হাতে পড়া সেই উষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়ায়। চারপাশ মোহময় হয়ে উঠে। হাওয়ায় ভাসতে থাকা চাপা ফুলের সুবাস আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। শাহারিয়া উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে এখন ভয় কিছুটা কম। দিথী চোখ মেলে শাহারিয়ার দিকে তাকায়। ধীর গলায় বলে,

– তুমি জানো আমি কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম! তুমি আসবে বলে গোলাপ গাঁথায় কত শত আবেগ জমিয়ে রেখেছিলাম! এতো দেরি কেনো করলে! 

– রাস্তায় কিছুটা জ্যাম ছিলো। আর, এটা কিনতে কিনতেও দেরি হয়ে গিয়েছিলো। সরি, এরপর থেকে আর দেরি হবেনা। 

– আমায় কেমন লাগছে! 

– একদম সদ্য ফোঁটা নতুন গোলাপের পাপড়ির মতো সুন্দর! 

– এই সৌন্দর্যটাকে ছুঁয়ে দেও! নিজের করে নাও! 

– ক,কিন্ত! 

– আজ কোন কিন্ত নয়। এই বৃষ্টি ভেজা রাত, এই মোহময় আবহ, সব আজ আমাদের এক করে দিতে চাইছে! তুমি কেনো বিমুখ হচ্ছো! 

– আ,আমার। আমার কথাটা তো শো,,,,,,

 দিথী শাহারিয়ার মুখ তার হাত দিয়ে আলতো করে চেপে ধরে। মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইঙ্গিত দেয়। মলিন গলায় বলে,

– আজ কোন বাক্য নয়, কোন কাব্য নয়। আজ শুধু তুমি আমার, আমি তোমার। (একটু থেমে ধীর মলিন গলায়) তুমি কী আমার হবে! শুধু আমার! 

দিথীর চোখের চাহনি ছিলো অনেক আকাঙ্ক্ষায় সমৃদ্ধ। সেই চোখের ভাষা শাহারিয়া বুঝতে পারছিলো। তারও মন চাইছিলো দিথীকে নিজের করে নিতে। মন বাগানের আবেগ গুলো একে একে ফুটতে শুরু করে। দিথী শাহারিয়ার চুপচাপ থাকা দেখে তার কাছে এগিয়ে আসে। খুব কাছে। মোমবাতি ধরা বাম হাতটা একপাশে রেখে শাহারিয়ার মুখ থেকে তার হাত উঠিয়ে শাহারিয়ার চোখের উপর রাখে। খুব কাছাকাছি আসে। পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে শাহারিয়ার ঠোঁটের কাছাকাছি নিজের ঠোঁট আনে। শাহারিয়ার দিকে এক পলক চেয়েই চোখ বন্ধ করে তার নিচের ঠোঁট টা আলতো করে চুষে দেয়। নিচের ঠোঁট টা ছেড়ে দিয়ে উপরের ঠোঁটটা চুষতে থাকে। চুমু খেতে থাকে। শাহারিয়া আর নিজেকে আটকাতে পারেনা। দুই হাত দিয়ে দিথীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকে। পুরো শরীর কলঙ্কের ছোঁয়ার পৃষ্ঠ করে দিতে থাকে। দিথী এই প্রথম শাহারিয়ার ছোঁয়াতে হারিয়ে যাচ্ছিলো। শাহারিয়া দিথী ঠোঁট দুটো চুষে নিজের মুখের ভিতর নিয়ে যেতে থাকে। দিথীর হাত থেকে মোমবাতিটা পড়ে যায়। ফ্লোরে পড়া মাত্রই তা হাওয়ার তোড়ে নিভে যায়। দিথীকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকে শাহারিয়া। দিথীর ঠোঁটে কামড় দিতে থাকে। এই পাপড়ি তুল্য ঠোঁট দুটোকে মিশিয়ে দিতে থাকে নিজের ঠোঁটের সাথে। হঠাৎ দিথী শাহারিয়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। হাঁপাতে থাকে। দুইজনের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। দিথী, শাহারিয়ার চোখের দিকে আড়দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। শাহারিয়ার বক্ষস্থলএ যেনো ঝড় তুলে দেয় সেই চাহনি। সে আবার দিথীর এক হাত ধরে হেঁচকা টেনে তার শরীরের সাথে লেপ্টে নেয়। তার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে দেয়। দিথী চোখ বুঁজে সুখের সাগরে ভাসতে থাকে। শাহারিয়া দিথী ঘাড়ে আলতো করে কামড় দেয়। দিথী মোহময় গলায় শব্দ করে উঠে, ‘আহহ…’। শাহারিয়া ঘাড় থেকে মুখ ঘুরিয়ে দিথীর গলায় চুমু খেতে থাকে। তার দেহ হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে থাকে। দিথী আবার তাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। হাপাতে থাকা দিথীর বক্ষস্থল উঠানামা করছে। দিথী বারবার তাকে উত্তেজিত করে ছাড়িয়ে নিচ্ছিলো যেন শাহারিয়া নিজের আসল পুরুষত্বের রুপে ফিরে আসে‌‌। শাহারিয়াও আর একমুহুর্ত দেরি না করে দিথীকে দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে নেয়। এগিয়ে যায় সিড়ির দিকে। কোলে থাকা দিথী মুখ বাড়িয়ে আবার তার ঠোঁট শাহারিয়ার ঠোঁটে ডুবিয়ে দেয়। বাইরের আকাশে জোড়ে জোড়ে বিজলী চমকিয়ে উঠে। শাহারিয়া দিথীকে কোলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে। দু’জন দু’জনের ঠোঁটের মাধুর্যতা গ্রহণে ডুবে ছিলো। দিথীর নুপুর পড়া পা গুলো শাহারিয়ার কোলে একসাথে দুলছিলো। নিচে ফ্লোরে পড়ে থাকে নিভে যাওয়া মোমবাতি আর আংটির বক্স।

 দুই আত্মা এই প্রথম বার মিশে এক হয়। জান্নাতি বাগানের সুবাস এসেছিলো তাদের ঘরে। সুখ সাগরে ডুবে যায় তারা দুজন, যেই সাগরে নেই তীর, নেই কোন জোয়ার, আছে শুধু সর্গীয় সুখ, সর্গীয় প্রশ্বাসের আঁধার! 

 

______

 

সুমুকে একটা খাবার সাজানো প্লেট ধরিয়ে দেন শিউলি বেগম। রাতের খাবারের সময় হয়ে এসেছে। আকাশ খারাপ, যেকোনো সময় কারেন্ট চলে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি খাবারের পালা শেষ করতে পারলেই যেন শিউলি বেগম বাঁচেন। তিনি আফাজের জন্য খাবার সাজিয়ে সেই প্লেট সুমুকে দেন। সুমু প্লেট টা হাতে নেয়। শিউলি বেগম বলেন,

– ঘরে যাইয়া অরে খাওয়াইয়া দেও। যহন, তহন কারেন্ট চইলা যাইতে পারে। পরে তহন আন্ধারে কিছু করা যাইবো না। আমি তোমার খাবার আলাদা উঠায়া রাখতাছি। পরে ঘরে আইয়া খাইয়া নিও। (সামনে ফিরে হাঁক দিয়ে) এই ফুলমতি, জগে পানি আন, পানি নাই। 

– জী, মা আমি-কীভাবে-উনাকে,,,, মানে,,,, আমার কেমন জানি লাগছে। 

– কিছু হইবো না। তুমি কইবা আমি এদিকে সবাইরে তুইলা দিতাছি, নাইলে আমিই যাইতাম। তাইলে আর কিছু কইবো না।

– উনি যদি আমার হাতে না খাইয়ে নিতে চান, তখন ? 

– আরে কিচ্ছু হইবো না। অর ডান হাতে ব্যাথা, চাইলেও নিজে খাইতে পারবোনা। তুমি যাইয়া নিজে থেইকা কথা কবা। (আঙিনার দিকে তাকিয়ে) তাড়াতাড়ি যাও, কারেন্ট চইলা যাইবো নাইলে। অরে খাওয়াইয়া প্লেট নিয়া আইয়ো। পানির জগ আর গ্লাস ও ঘরেই টেবিলে রাহা আছে। 

– আচ্ছা। 

ধীর গলায় বলেই প্লেট হাতে আফাজের ঘরের দিকে চলে যেতে থাকে সুমু। শিউলি বেগম টেবিলের প্লেট গুলোয় ভাত উঠিয়ে দিতে থাকে। মতিন মেম্বার এসে চেয়ারে বসেন। তিনি বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আসলেন। ফুলমতি জগ ভরা পানি টিউবওয়েল পাড় থেকে এনে টেবিলে রাখে। লায়লার খবর নাই, নিশ্চিত ঘরে হনুফার সাথে ক্যারাম,লুডু খেলতেছে।

 

   সুমু আফাজের ঘরের দরজার সামনে চলে আসে। দরজার সামনে পর্দা দেওয়া। তার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। ইতস্তত বোধ করছে। তার হাতে কি আফাজ খাইয়ে নিবে ? পরে যদি বকা দেন উনি ? না। এতো ভয় পাওয়া যাবেনা। শিউলি বেগম সকালে কী বলেছিলো মনে নেই! যেচে যেচে কথা বলতে হবে, তার বন্ধু হইতে হবে। এইজন্যই হয়তো আজ শিউলি বেগম তার হাতে ভাত পাঠিয়েছে আফাজের ঘরে‌। সুমু আর কিছু ভাবেনা। এক জোড়ে শ্বাস নিয়ে পর্দা সড়িয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ভিতরে আফাজ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিলো। কোমর পর্যন্ত কাঁথা তোলা। বাম হাতে বই। ডান হাত কাঁধের সাথে ব‌্যান্ডেজ করে ঝোলানো। আফাজ বই থেকে নজর সরিয়ে সুমুর দিকে তাকায়। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে সুমু। হাতে ভাতের প্লেট। পড়নে গোল জামা। আফাজ সুমুকে এক পলক দেখেই আবার বইয়ের দিকে চোখ দেয়। সুমুর এখনো কেমন জানি লাগছিলো। তারপরও সে মনে এক মুঠো সাহস সঞ্চয় করে হেঁটে হেঁটে এসে বিছানার সামনে দাঁড়ায়। ভাতের প্লেট হাতেই বিছানায় বসে। আফাজ এখনো বইয়ের দিকেই চেয়ে আছে‌। আফাজ যেনো সুমুকে দেখতে চাইছিলো না। সুমু বইটার দিকে তাকায়। বইটার নাম ‘ শেষ বিকেল ‘। হয়তো রোমান্টিক কোন উপন্যাস হবে। ‘উনার না প্রিয়জন মারা গেছে! তাইলে রোমান্টিক উপন্যাস পড়ছে কেনো ?’ কথাটা সুমুর মনে উঁকি দিতেই সে শব্দ করে বলে উঠে,

– বই পড়ছেন ? 

– হমম,

– মা খাবার পাঠিয়েছিলো। বললো কারেন্ট চলে যেতে পারে তাই তাড়াতাড়ি আপনাকে দিয়ে আসতে। মা, বাবাকে ভাত দিচ্ছেন তাই নিজে আসতে পারেন নি। 

আফাজ বইটা মুখের উপর থেকে সড়ায়। সুমুকে আবার এক পলক দেখে বইটা সামনে এনে বইয়ে চোখ রাখে। সুমু বুঝতে পারে যে আফাজ তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তবুও তাকে নিজে থেকেই কথা বলে যেতে হবে। সুমু আবার বলে,

– খেয়ে নিন। খাবার টা নাইলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। (চারপাশ তাকিয়ে) কারেন্ট চলে যেতে পারে। তখন অন্ধকারে কীভাবে খাবেন। 

– আমি খাবো না। খাবার টা নিয়ে যাও‌।

– মা শুনলে রাগ করবেন। আপনার শরীর দুর্বল, এইসময় আপনাকে সময়মতো খাবার খেতে হবে। 

– আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আর যেই হাতে খাবো সেই হাতও অচল। (একটু থেমে) তুমি খাবার গুলো নিয়ে যাও। 

– আপনি যদি কিছু না মনে করেন, তবে আমি আপনাকে খাইয়ে দেই! না মানে আপনি তো নিজে থেকে খেতে পারবেন না। মা’ও বাবাকে ছেড়ে আসতে পারবে না। (একটু থেমে) আমি খাইয়ে দেই! 

আফাজের মুখ থেকে কোন উত্তর নেই। একনজরে এখনো বইয়ের দিকে চেয়ে আছে। সুমু আবার বলে,

– খাওয়া শেষ হলে তখন নাহয় বইটা পড়বেন! নাইলে আপনি বইটা আমাকে দিতে পারেন, খাওয়া শেষ হলে আমিই আপনাকে পড়ে শোনাবো। আমি ভালো আবৃত্তি করতে পারি। 

কথাটা শোনা মাত্রই আফাজ বইটা সড়িয়ে অবাক চোখে সুমুর দিকে তাকায়। তার আলিশার কথা মনে পড়ে যায়। যেদিন আলিশা তাকে বইটা দিয়েছিলো সেদিন আলিশা বলেছিলো সে খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারে। আজ আফাজ চলে যাবে বিধায় “শেষ বিকেল” বইটা পুরোটা আবৃত্তি করে শোনাতে পারছেনা। তাই গল্পটার মূলভাব সে বলেছিলো আফাজকে। আফাজ যেন খানিকক্ষণের জন্যও অতীত সময়ে পাড়ি জমায়। স্মৃতিচারণ করে আলিশার। আলিশাও তাকে এই বইটা পুরোটা আবৃত্তি করে শোনাতে চেয়েছিলো। 

সুমু আফাজকে চুপচাপ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়। বলে,

– কিছু বলবেন ? 

আফাজ মাথা নাড়িয়ে না বলে। সুমু বলে,

– আমি আপনাকে খাইয়ে দেই ? 

আফাজ বইটা বন্ধ করে তার কোলে রাখে। একটু সোজা হয়ে বসে। সুমু বুঝতে পারে আফাজ তাকে অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। সুমু খুশি হয়। প্লেট টা বিছানায় রেখেই উঠে দাঁড়ায়। বিছানার পাশে লাগানো ছোট্ট টেবিল টায় গ্লাস আর জগ রাখা। সে জগ টা দিয়ে হাতে অল্প পানি নিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। আগেই হাত ধুয়ে এসেছিলো, তাও হালকা একটু ভিজিয়ে নিলো। এসে বসে বিছানায়। খাবারের প্লেট টা হাতে নেয়। একটু এগিয়ে বসে। ভাত মাখতে থাকে। তার বেশ ভালো লাগছে। আফাজকে ভাত খাওয়াতে পারছে সে। ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর মুহুর্তই একদিন বড় কোন উপলক্ষ তৈরি করবে। এটাই সুমুর বিশ্বাস। সুমু ভাত মেখে নলা করে আফাজের মুখের সামনে ধরে। আফাজ মুখ ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকায়। তার মুখে তেমন খুশির রেখা ছিলোনা। মুখ তার মলিন। সুমুর হাত থেকে ভাত মুখে নিয়ে নেয় সে। মাথা নিচু করে খেয়ে নিতে থাকে। সুমু আবার নলা বানাতে থাকে। ভাতের সাথে তরকারিতে ছিলো মাছ, শিম ভাজি আর আলুর ভর্তা। আজ পাতে কোন মাংস নেই। সুমু বলে,

– লবণ ঠিকঠাক হয়েছে তরকারিতে ? 

– হমম। 

– মায়ের হাতের রান্না তো। অনেক সুন্দর হয়। 

– ফুফু তোমার মা হয় ? 

– হ্যা। নিজের না। তবে আমি তাকে মা বলেই সম্বোধন করি।

– তোমাকে আগে তো এবাড়িতে দেখিনি। তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন? 

– আমার গল্প এই বইয়ের থেকেও বড়। একদিন সময় করে বলবোনে।- তোমার বাবা-মা নেই ? 

– আমার নিজের মা কে, তা শুনলে আপনিও হাসবেন। বিশ্বাস হবে না আপনার। 

– কে তোমার আপন মা ? 

– দিথী আপু। উনিই আমার নিজের মা। যদিও উনরা পূর্বজন্ম, তবুও উনাকে মা বলাই যায়। 

– ভাবির মেয়ে এতো বড়! ভাবি আর তুমি তো ১-২ বছরের ছোট বড় বোধহয়। তুমি ভাবির মেয়ে কী করে হও ?

– ঐতো বললাম না, আমার গল্প অনেক বড়। একদিন সময় নিয়ে আপনাকে শোনাবো। আপাতত খেয়ে নিন, তারপর আপনাকে আপনার বই পড়ে শোনাচ্ছি। 

আফাজ আরেক নলা ভাত মুখে নিয়ে অন্য দিকে মুখ করে খেতে থাকে। খেতে খেতে বলে,

– তুমি আলিশাকে চিনো ? 

এমন কথায় কিছুটা মন খারাপ হয় সুমুর, তবে তার চেহারায় তা ফুটে উঠেনি। সুমু বলে,

– মায়ের থেকে আমি সবটা শুনেছি। 

– সেও তোমার বয়সিই ছিলো। তোমার মতোই নিজে থেকে যেচে কথা বলতো।

সুমু আফাজের কথা শুনে মনে মনে ভাবে, ‘ এইটা আমার মুখোশ, আমি মোটেও এমন নই। মায়ের বলাতে এমন রূপ ধরেছি, বাস্তবতা ভিন্ন ‘ 

আফাজ আবার বলে,

– এই দুনিয়া এখন আমার কাছে বিষাদ সিন্ধু। আমার কোন কিছুই ভালো লাগেনা। সব অমানিশা আমায় ঘিরে ধরেছে। আলো দেখানো সেই মেয়েটা আজ নেই। তার স্মৃতি গুলো আমাকে ভীষণ ব্যাথা দেয়, ভীষণ!

– আপনি যা ভাবছেন বাস্তবতা মোটেই তা নয়। জীবনের বিষাদময় অধ্যায়টাকে হাতড়ে বেড়ালে, তা তো আপনার ভিতর টাকে ছাড়খাড় করে দিবেই। অথচ দেখুন, বাইরের রঙিন দুনিয়াটা আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছে, কিন্তু আপনিই তা আঁকড়ে ধরতে ধরতে বিমুখ।

– আমার কাছে এই দুনিয়া এক বদ্ধ কুঠুরি। কোন রং নেই এতে, (ধীর গলায়) কোন রং নেই। 

সুমু কিছু বলেনা। সে চুপচাপ থেকেই আরেক নলা ভাত আফাজকে খাইয়ে দেয়। জানে সে হঠাৎই এসে সবকিছু পরিবর্তন করতে পারবে না। সময় প্রয়োজন, সাধনা প্রয়োজন। সুমু মনে মনে বলে,

” একদিন আমি ঠিক আপনার এই সাদা কালো আকাশটা রঙিন রংধনুর আদলে ভরিয়ে তুলবো। সব অতীত ভুলিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখাবো। আমি জানিনা তা করতে আমার কত বছর,কত যুগ অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কথা দিলাম, আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবো। এখন নাহয় ভালোবাসাটা একপাক্ষিকই রইলো!” 

 

_____

 

গভীর রাত। হুতুম পেঁচা থেকে শুরু করে পাখ-পাখালি সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আকাশের চাঁদ আজ ঘন মেঘে ঢাকা। কিছুক্ষণ আগে মুষল ধারে বর্ষণ দিয়ে মেঘ গুলোও এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। 

 

রায়হান নিপাদের রুম। নিপা চিৎ হয়ে ঘুমুচ্ছে। আর রায়হান পাশ ফিরে। দুইজনে একই কাঁথার নিচে। ঘরে পিনপন নিরবতা। ব্যালকনির দরজাটাও বন্ধ। হঠাৎ রায়হান পাশ থেকে ফিরে সোজা হয়। সে ঘুমায় নি। অথচ এতোক্ষণ তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে যেনো ঘুমিয়ে আছে। রায়হান আড় চোখে নিপাকে দেখে। নিপা ঘুমিয়ে আছে। রায়হান হাত উঠিয়ে তার চোখের সামনে নাড়ায়। না, নিপা ঘুমুচ্ছে। রায়হান উঠে বিছানায় বসে। কাঁথা সড়িয়ে নিপার পাশে ঠিকঠাক মতোন রাখে। বিছানার মাথার পাশ টা থেকে নিপার ফোন আর তার ফোনটা নেয়। নিপার ফোনটা তখনকার পর থেকে আর অন হয়নি। রায়হান ফোন দুটো নিয়ে সোজা হয়ে বসে। নিপার দিকে ফিরে দেখে একবার, তারপর আবার সামনে ফিরে। তার পকেট থেকে সিম ট্রে ইজেক্টর বের করে। নিপার ফোনের সিমের ট্রে খুলতে থাকে। পিছনে ফিরে নিপার দিকে একপলক চেয়েই আবার সামনে তাকায়। ফোন থেকে সিমের ট্রে বের করে মেমরি কার্ড টা খুলে নেয়। তার পকেট থেকে আরেকটা মেমরি কার্ড বের করে সেটা ফোনে লাগিয়ে দেয়। সিম ট্রে ফোনে ঢুকিয়ে রাখে। মাথা ঘুড়িয়ে একবার নিপার ঘুমন্ত শরীরটাকে দেখে। আবার সামনে ফিরে তাকায়। ফোনটার ভিতর সিম ট্রে ঢুকিয়ে রেখে নিপার ফোনটা বিছানার মাথার পাশে রাখে। সোজা হয়ে বসে। যেই মেমরি কার্ড টা নিপার ফোন থেকে বের করেছিলো সেটা ভেঙে দু টুকরো করে ফেলে। টুকরো দুটো তার পকেটে রাখে। তার ফোনটা অন করে। হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে একজনকে মেসেজ করে,

‘ আমি আজ মিটিংয়ে আসতে পারবোনা। পারভেজকে বলো, ও আমার কাজ গুলা লেখে রাখবে। ‘

মেসেজ টা সেন্ট করে দেয়। দিয়ে ফোনটা অফ করে মাথার পাশে রাখে। নিপার পাশে শুয়ে পড়ে। নিপার ঘুমন্ত দেহটাকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে। বিরবির করে বলে,

‘ আমি কোনদিন চাইনা তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও। এইটুকু তাই গোপন করতেই হলো আমাকে। তোমায় যে অনেক ভালোবাসি সুবা, অনেক ভালোবাসি ‘ বলেই নিপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে রায়হান। তার কান্নায় শব্দ ছিলোনা। একদম নিঃশব্দ ছিলো সেই কান্না। ছেলে মানুষকে হঠাৎ এভাবে কাঁদতে বোধহয় খুব কমই দেখা যায়। 

ফ্লাসব্যাকে দেখাতে পাই,

নিপা যখন রায়হানের ভাঙা ফোন থেকে সিম আর মেমরি কার্ড বের করেছিলো তখনই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে গিয়েও থেমে যায় রায়হান। কারণ নিপা তখন অপরাধীর মতো চারপাশ দেখছিলো আর কি জানি করছিলো। রায়হান ভাবলো ‘ও কী করছে ?’ পরক্ষনেই ও ওর ভাঙা ফোনটাকে নিপার পাশে বিছানায় দেখে। আর একটু পরই নিপার ফোন থেকে ওর আর এক মেয়ের কলরেকর্ডিং চলতে থাকে। রায়হান এখন বুঝে যায় যে নিপা কতদূর পর্যন্ত হাতড়ে ফেলেছে। রায়হান আর এক মুহুর্ত দেরি না করে ইচ্ছে করে জোড়ে শব্দ করে ভিতরে প্রবেশ করে। যাতে নিপা ভয়ে ফোনটা ফেলে দেয়। আর হয়ও তাই। নিপা বেশ ভয় পেয়ে ছিলো। তবে রায়হান পড়ে বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবেই হ্যান্ডেল করে। আর নিপাও পরবর্তীতে তার কৌতুহল টাকে মনের বিশ্বাসের সাথে মিলিয়ে সবকিছু ভুলে যায়। রায়হান পরে আর নিপাকে একলা থাকতে দেয়নি। বিকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত নিপার সাথে সাথে থেকেছে। নিপার মন যেনো সেদিকে না যায় সে জন্য গানের পসরা সাজিয়েও বসেছে‌। নিপাকে সে সবকিছু জানতে দিতে চায়না। সে চায়না তার নিপা তাকে ঘৃণা করে তার থেকে সড়ে যাক।

 

ঘর আবার আগের মতো নিস্তব্দ হয়ে যায়। রায়হান নিপাকে জড়িয়ে ধরেই চোখ বুজে। বাইরের বাগানে ফোঁটা নতুন ফুলের সুবাস আসে। তার মানে দিনের প্রথম প্রহর শুরু হয়েছে। ফুলেদের পাপড়ি মেলে ধরার উপযুক্ত সময় যাকে বলা যায় আরকি। 

 

_____

 

সেই বদ্ধ ঘর। উপরে লাল আলো জ্বলছে। চারপাশ সেই আলোয় আলোকিত। দূরে টেবিলে চেয়ারে বসে আছে কেউ, তার সামনে সুন্দর, সুসজ্জিত খাবার টেবিল। তবে প্লেটে খাবার এখনো আসেনি। খাবার তো এদিকে তৈরি করছে একজন। স্টেচারে আজ নতুন শিকারের রক্ত। সোনালী আজ এক নতুন মেয়েকে শিকার করেছে। মেয়েটা ছোট। ৭ কী ৮ বছর বয়স। মেয়েটাকে মারার বোধহয় কিছুক্ষণ হয়েছে। মেয়েটার চোখ এখনো খোলা পড়ে আছে। চোখে ছিলো মায়া, আকুতি,মিনতির ছাপ। সোনালী মেয়েটার বুকটা মাঝখান দিয়ে কাটে। কলিজাটা বের করার জন্য সবকিছুর মাঝে হাত ঢুকিয়ে দেয়। অনেক দিন হলো মন মতো খাওয়া হয়নি। আজ খাবে, তবে সে একলা নয় পিছনের টেবিলের দিকটায় বসে আছে নজরুল সাহেব। তিনিও বেশ ক্ষুধার্ত। 

সোনালী মেয়েটার শরীর থেকে কলিজাটা বের করে। ছুরি দিয়ে কেটে ছাড়িয়ে নিতে থাকে দেহের বাকি অন্ত্র থেকে। কলিজটা বের করেই কাঁচা অবস্থায় এক কামড় বসিয়ে দেয়। খেতে থাকে। কলিজাটা এখনো গরম হয়ে আছে। রক্ত টাও দারুন গরম। সোনালী খেতে খেতে পিছনে ফিরে বলে,

– আজকের জিনিস সেই মজার। খাইতেই থাকবা, আর খাইতেই থাকবা। 

বলেই সামনে ফিরে সোনালী। তার চোখ মুখ যেনো নিমেষেই রুঢ় হয়ে যায়। চোখ দুটো রক্ত লাল হয়ে যায়। রাগে যেনো সে জ্বলে উঠছিলো। তার যেন অতীতের কিছু জিনিস হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিলো। সোনালী আরেকহাতে থাকা ছুরিটা মেয়েটার লাশে খুব জোরে গেঁথে দেয়। দাঁত কটমট করে সামনে তাকিয়ে বলে

‘ যেমন ভাবে আমার মা’কে খাইছিলা,,,,! ‘ 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( গল্প কোন দিকে মোড় নিবে এরপর ? মনে থাকা সকল প্রশ্ন জানাতে পারেন কমেন্টে। আর এখনকার কয়েকটা পর্বে একটু রহস্যের পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসে ফোকাস করা হবে, বোরিং যেনো না লাগে তাই আমি রহস্য টাও রাখবো‌। তবে পরিমাণে একটু কম। তবে আর কয়েকটা পর্ব মাত্র, তারপরই শুরু হবে সব খোলাসা হওয়া। আমি গল্পের পর্ব সংখ্যা কমিয়ে এনেছি। আগে যেখানে বলেছিলাম ১২০-১৩০, সেখানে এখন ১০০ পর্ব হবে কিনা সেই চিন্তায় আছি। ৯০ পর্বও না হইতে পারে। গল্প শেষের দিকে চলে আসছে। আর নরম পর্ব দিচ্ছি বলে সিন বাদ দিয়ে দিয়ে পড়তে চাইলে নিজ দায়িত্বে পড়বেন, কারণ এই গল্পে দেওয়া প্রত্যেকটা সিনের তাৎপর্য মূল প্লটের সাথে জড়িয়ে আছে। মিস করলে শেষে যায় সব মাথার উপর দিয়ে যাবে। তখন আমাকে আর কিছু বলতে পারবেন না 🙂। প্লটটা একটা মাথার ব্রেইনের মতো। শরীরের সবটুকুর উপর যেমন ব্রেইন টার ভূমিকা আছে, মেইন প্লটের সাথে তেমনি প্রত্যেকটা চরিত্র, প্রত্যেকটা রহস্যের যোগসূত্র আছে।)

 

 গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৩

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৪ (১ম পর্ব)

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

রাতের শেষ প্রহর। আকাশের মেঘ বৃষ্টি থামিয়ে এখন জিরুচ্ছে। তবে বৃষ্টির ফলে ধরিত্রীতে নেমে আসা ঠান্ডা আবহ এখনো বহমান। বাইরের চেরি ব্লসম গাছটা থেকে মৃদু সুবাস বেড়িয়েছে। হয়তো নতুন পাতা গজিয়েছে। 

কোরআনের মধুর তেলাওয়াতের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে দিথীর। তার চোখের পাতা গুলো নড়ে উঠে। গাঁয়ে গলা পর্যন্ত কাঁথা তোলা। দিথী পাশ ফিরে শুয়ে ছিলো। মধুর তেলাওয়াতের শব্দ এখনো তার কানে আসছিলো। দিথী চিত হয়ে শোয়। দেখে পাশে শাহারিয়া নেই। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্প টা থেকে মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতেই দিথী দেখতে পায় একজন নিচে কার্পেটে বসে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করছে। সে পশ্চিমে মুখ করে ছিলো। অর্থাৎ দিথী তার পিছন টুকু দেখতে পায় শুধু। দিথী উঠে বসে। বুঝে উঠতে চেষ্টা করে টুপি পড়ে নিচে তেলোয়াত করতে থাকা লোকটা কী শাহারিয়া ? শাহারিয়া এতো সুন্দর কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে পারে ? এতো সুর ধরে, এতো টান বজায় রেখে! শাহারিয়ার তেলোয়াত যেনো দিথীর কানকে প্রশমিত করে ফেলছিলো। মন-মস্তিস্কে নতুন করে উজ্জীবিত করে তুলছিলো। দিথী কাঁথা টাকে তার দেহের সাথে জড়িয়ে নেয়। শাহারিয়ার তেলাওয়াত শুনতে থাকে বসে বসে। চোখ তার আধবোজা। ঘুমের রেশ কিছুটা কাটলেও পুরোটা কাটেনি। দিথী দুই হাত দিয়ে চোখ কচলায়। চোখ কচলিয়ে হাত দুটো উপরে তুলে আড়মোরা ভাঙতে থাকে। আজ অনেক তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো তারা। কাল রাতের জার্নির ক্লান্তি আর আজ রাতের মাধুর্যতা মিলিয়ে দুজনের এই ঘুম টুকু দরকার ছিলো। দিথী তার গাঁয়ে গোল করে বিছানায় পাতলা সাদা কাঁথাটা জড়িয়ে নেয়। যেন খুলে পড়ে না যায় সেজন্য উপরের প্রান্ত টা বেঁধে দেয়। বিছানার প্রান্তে এসে দুই পা নামিয়ে বসে। শাহারিয়া কিছুটা সামনেই একটা জায়নামাজে বসে তেলোয়াত করছিলো। দিথী বেশ আগ্রহ নিয়েই তা শুনতে থাকে। 

 

    শাহারিয়া থামে। কোরআন শরীফ টা বন্ধ করে পিছনে ফিরে তাকায়‌। দেখে দিথী বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে দুই হাতে গাল ধরে চোখ বুজে আছে। শাহারিয়ার থেমে যাওয়াতে দিথী চোখ খুলে। ঘুম মিশ্রিত গলায় বলে,

– থামলে কেনো ? অনেক সুন্দর হচ্ছিলো তোহ্।

– উঠছো তুমি! 

– হ্যা। 

– কখন উঠলা ? 

– একটু আগেই। তুমি আবার পড়োনা। শুনতে অনেক ভালো লাগছে। 

– আমি পড়তেছি, তুমি যাও। গিয়ে গোসল করে নাও। গিজারে গরম পানি করে রাখছি। 

– বৃষ্টি থামে গেছে ? (বলেই চারপাশে তাকায় দিথী)

– হ্যা, সেই কখন থামছে! আমি ৩ টার দিকে উঠছিলাম তখনই থামে গেছে। 

– তুমি এতো আগে উঠছো কেনো ? 

– ঘুম ভাঙে গেছিলো তখন। ঘুমও ধরতেছিলো না। এইজন্য উঠে গোসল করে তাহাজ্জুদ পড়ে কোরআন পড়ছিলাম। তুমি গিয়ে গোসলটা করে নেও। এই শরীরে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। 

– কোন শরীরে হ্যা!! হে হে হে!

– তুমিই ভালো জানো। (সামনে ফিরে কোরআন শরীফটা আবার রেহেলে উঠিয়ে) যাও। গোসল করে নাও। একটু পর আযান দিবে একসাথে নামাজ পড়বো। 

– নামাজ! 

শাহারিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। বলে,

– হ্যা নামাজ। কেনো?

– না কিছুনা। 

দিথী বিছানা থেকে নামে। গাঁয়ে চাদর টা ভালোভাবে জড়িয়ে বেঁধে দিয়েছে ও। এগিয়ে এসে শাহারিয়ার পাশে ফ্লোরে দুই হাঁটু গেড়ে বসে। কোরআন শরীফ টা দেখে। বেশ মোটা ছিলো। আকারের দিক দিয়েও বড়ই বলা যায়‌। শাহারিয়া বলে,

– কী দেখছো! 

– তুমি কোরআন পড়তে পারো ? 

– হ্যা পারি তো। কেনো, তুমি পারোনা ? 

দিথী একটু গোমড়া মুখে বলে,

– না। শিখা হয়নি। তোমার তেলোয়াত তো অনেক সুন্দর হয়। টিভিতে যে তেলোয়াত করতো রোযার মাসে, একদম ঐরকম। 

– ঐআরকি ছোট থেকেই চেষ্টা করতে করতে হয়ে গেছে। 

– তুমি পাঞ্জাবি পড়ছো কেনো! সকাল সকাল হুজুর সাজে গেছো দেখি! 

– আমি নামাজ পড়ার সময় পাঞ্জাবি পড়ে পড়ার চেষ্টা করি। সুন্নত তো। আমল করে নিলে আমারই সওয়াব।

– তো আজ এতো ধার্মিক বনে গেলা যে! আগে তো তোমাকে নামাজ পড়তেও দেখছি বলে মনে পড়েনা।

– আমি সবসময় এমনি ছিলাম। শুধু বাড়িতে গেলে আমার রুটিন বদলে যেতো। আমি ওখানেও নামাজ পড়তাম। তবে তুমি আমার ঘরেই তো সবসময় আসতে না। দেখতা কীভাবে। 

– তারপরও। সেই তুমি আর এই তুমির মাঝে অনেক পার্থক্য। 

– আসল ব্যাক্তিত্ব ছাড়া তুমি যেটা সবার সামনে প্রকাশ করবে সেটাই তোমার মুখোশ। ধরে নাও সে বাড়িতে আমি মুখোশ পরিহিত কেউ ছিলাম,,! 

– হমম। মুখোশ রুপি মানব!! হি হি হি!

– মুখোশ কী তুমিও কম পড়ছো নাকি! 

কথাটা শুনেই যেন মুহুর্তের মধ্যেই দিথীর মুখ থ হয়ে যায়। মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। অবাক হয়ে কাপো কাপো গলায় বলে,

– আ,আমি আবার ক,কী মুখোশ পড়লাম।

– বিয়ের আগে ছিলা লজ্জাবতী আর বিয়ের পরে আমাকেই এখন রয়ে সয়ে থাকতে হইতেছে। এইযে তোমার এই রুপটা লুকায় রাখছিলা। সবসময় স্বাধারণ মেয়েদের থেকেও বেশি লজ্জা পাইতা।

– ও তাই বলো। 

– কেনো ? অন্য কোন মুখোশ আছে নাকি আরো ? 

– কী যে বলো। আর, আর কি মুখোশ থাকবে। 

– আচ্ছা তবে এখন যাও। আমার আর একটু বাকি আছে। এই পারা টা শেষ করেই উঠবো। 

দিথী তার মুখরেখা পরিবর্তন করে ফেলে। স্বাভাবিক করে একটু দুষ্টুমির মুডে চলে যায়। শাহারিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

– জানো, মা বলেছিলো তুমি আসল যায়গায় ঠিক ছক্কা মেরে দিবে, আজ বুঝলাম কেনো বলেছিলো। হি হি হি! (মুচকি হাসতে থাকে দিথী) 

– নাউযুবিল্লাহ বউ! কীসব বলতেছো! য,যাও গিয়ে গোসল করে নাও। স,সবসময় খালি পাকা পাকা কথা।

– আমি পেকে গেছি। তুমি আমাকে ফরমালিন দিয়ে পাকায় দিছো, হা হা হা! 

হাঁসতে হাঁসতে দিথী উঠে দাঁড়ায়। কাঁথাটাকে শরীরের সাথে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে চলে যায় আলমারির দিকে। শাহারিয়া আবারো মনে হয় লজ্জা পাইছে। দিথীও তো ওকে লজ্জায় ফেলতেই চায়। দিথী আলমারি খুলে কাপড় নিয়ে নেয়। আলমারির দরজা লাগিয়ে দিয়ে গোসল খানার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে,

– গামছাটা কোথায় ? 

– ভিতরেই আছে। আর শোনো। মেসওয়াক করে নিও। আমি মেসওয়াক করে ঐটা তোমার জন্য রাখে আসছি। 

– মেসওয়াক কি ? 

– গাছের একটা বাকল। ঐটা দিয়ে দাঁত, মুখ পরিষ্কার করতে হয়, ফ্রেশ হতে হয়। আমি মেসওয়াক করে বাকলটা তোমার জন্য রাখে আসছি। গামছার সাইডের থাক টায় দেখিয়ো। পায় যাবা। 

– বাহ, স্বামীর দেখি প্রেম বাড়তেছে! এক মেসওয়াকে দু’জন ব্রাশ করবো! মন্দ না মন্দ না। মিল মহব্বত বাড়বে আরো! হি হি হি। 

শাহারিয়া একটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি মুখ করে আবার কোরআন শরীফের দিকে তাকায়। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কোরআন শরীফ খুলে আবারো তেলাওয়াত করার জন্য। দিথী গাঁয়ের কাঁথাটা খুলে গোসল খানার দরজার সামনে রেখেই খালি গাঁয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। দরজা লাগিয়ে দেয়। 

 

বেশ কিছুক্ষণ পর,,,

 

দিথী গোসল খানার দরজা খুলে। ভিতর থেকে বালতিতে পানি পড়ার শব্দ আসতেছে। দিথী গামছা দিয়ে মাথার ভেজা চুল মুছতে মুছতে গোসল খানা থেকে বেড়িয়ে আসে। দেখে শাহারিয়া তার জায়নামাজ টার পাশে আরেকটা জায়নামাজ বিছিয়েছে‌। এটাতেও তারটার মতো কারুকাজ করা। দিথী গোসল খানার দরজাটা সামনে থেকে লাগিয়ে দিয়ে গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে। শাহারিয়ার সামনে দাঁড়ায়। শাহারিয়া জায়নামাজ বিছাতে বিছাতে সামনে চেয়ে বলে,

– গোসল শেষ ? 

– হ্যা। 

– ভালো করে গোসল করছোতো! এখন কিন্তু ফরজ গোসল ছিলো তোমার।

– না খারাপ করে করছি। আসো আমাকে আরেকবার গোসল করায় দাও! হা হা হা! 

– তুমি একদম মায়ের মতো। মজা করতে বেশি পছন্দ করো। 

– মজা ছাড়া লাইফটা সাদামাটা। সবসময় চিল এ থাকতে হয় বুঝছো! 

– হ্যা বুঝছি। এখন আসো। আযান দিয়ে দিছে একটু আগেই। ফজরের ওয়াক্ত পার হয়ে যাওয়ার আগেই নামাজ টা পড়ে নেই। 

– ভেজা চুলে নামাজ পড়া যাবে! 

– হ্যা অবশ্যই যাবে। কেনো যাবেনা। ঐযে চেয়ারের উপর একটা হিজাব বের করে রাখছি। ঐটা পড়ে নাও। হিজাব মাথায় দিয়ে নামাজে দাড়াবা এখন থেকে। 

– হিজাব পড়তে তো অনেক সময় লাগবে! 

– আরে এইটা ঐরকম না। এইটায় ফিতা বাঁধতে হয়। এদিকে নিয়ে আসো, আমি পড়ায় দিচ্ছি।

দিথী মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে যায় চেয়ারের দিকে। সেখানে হিজাবটা ছিলো। হয়তো শাহারিয়া আলমারি থেকে বের করে রেখেছে। দিথী হিজাবটা নিয়ে শাহারিয়ার কাছে চলে আসে। শাহারিয়া জায়নামাজ বিছানো শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দিথী হাত থেকে হিজাবটা নিয়ে তার মাথায় পড়িয়ে দিয়ে গলার দিকের ফিতাটা বেঁধে দেয়। দিথী মুখটা একটু উঁচু করে রেখেছিলো যাতে বাঁধতে অসুবিধা না হয়। শাহারিয়া ওকে পড়িয়ে দিয়ে জায়নামাজে চলে যায়। দিথীকেও আসার আহ্বান করে। শাহারিয়ার জায়নামাজ টা থেকে দিথীর টা একটু পিছিয়ে রাখা ছিলো। দিথী এসে তার জায়নামাজে দাঁড়ায়। দুইজনের টাই পাশাপাশি। শাহারিয়া তার জায়নামাজে দাঁড়িয়ে বলে,

– আগে সুন্নত পড়ো তারপর একসাথে ফরজ পড়বো। 

বলেই শাহারিয়া সামনে তাকায়। নিয়ত করতে থাকে। তখনই দিথী অনুনয় সুরে বলে,

– শুনো না।

শাহারিয়া ফিরে তাকায়। বলে,

– কী ? 

– আমি না অনেকদিন থেকে নামাজ পড়িনি। নিয়তে যেন কী বলতে হয় ? আর সুরা কী কী পড়তে হবে ? 

– নিয়ত মনে নাই! 

দিথী কিছুটা ধীর গলায় বলে,

– না। তুমি একবার বলে দাও, আর ভুলবো না। মুখস্থ করে রাখবো। 

– আচ্ছা তুমি তাইলে বাংলাতেই নিয়ত ধরো। ভুলবানা তাইলে আর। সামনে ফিরে বলবা ‘ আমি কিবলা মুখি হয়ে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়ার জন্য নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবার ‘। বলেই হাত দুটো তুলে কাঁধের কাছে নিয়ে তারপর নামিয়ে হাত বাধবা।

– এভাবে! 

দিথী শাহারিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী করে দেখায়। কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠিয়ে তারপর নামিয়ে পেটে হাত বাঁধে। শাহারিয়া বলে,

– না না। পেটে হাত না। তোমাদের বুকে হাত বাঁধতে হয়। আমাদের নাভি বরাবর। (দিথীর হাত ধরে যেখানে রাখতে হবে সেখানে রেখে) এখানে হাত বাধবা।

– তারপর আলহামদুলিল্লাহ হি রাব্বিল আল-আমিন সুরা পড়বো, আর কী সুরা পড়বো ? 

– তোমার কী কী সুরা মুখস্থ আছে ? 

– আমার তো এইটা ছাড়া,,,,, (কিছুটা ভেবে),,,, এইটা ছাড়া আর দুইটা সুরা মুখস্থ আছে। ঐযে ‘কুলহু আল্লাহু আহাদ’ টা, আর ‘ইন্না আতাইনা কাল কাউসার’ টা। আর কোন সুরা মনে নাই। 

– সূরা ইখলাস আর কাউসার! সবচেয়ে ছোট ছোট সুরা গুলা মুখস্থ রাখছো!

– আরো ছিলো। অনেক দিন থেকে নামাজ পড়িনা এইজন্য ভুলে গেছি।

– আচ্ছা তাইলে এই দুইটার একটা প্রথম রুকূর আগে পড়বা। তারপর রুকূ করবা সিজদাহে যাবা। তারপর আবার উঠে দাঁড়ায় ফাতিহা পড়ে বাকি আরেকটা পড়বা, তারপর রুকু, সিজদাহ‌। নিয়ত ধরে কিন্ত সানা পড়তে হয়। সানা মুখস্থ আছে তো ?

– হ্যা ঐটা মুখস্থ আছে। আর এগুলা পরে শেষ করে তারপর বসে যে তিনটা জিনিস পড়তে হয় ঐগুলা পড়বো ? 

– মনে আছে ঐগুলা ? আত্তাহিয়াতু,দরুদ আর দোয়া মাসুরা। এই তিনটা পড়বা।

– হ্যা মুখস্থ আছে। এই গুলা পড়তে পারবো।

– তাইলে হাত যে বুকে বাঁধতে হয় এইটা মনে নাই কেনো! 

– না মানে আমি প্রথম থেকেই পেটে হাত বাধতাম। কেউ আমাকে বলেনি বুকে হাত বাঁধার কথা। 

– আচ্ছা বাদ দেও। এখন তো জানলা কোথায় হাত বাঁধতে হবে, এখন থেকে ওখানেই বাধবা। সুন্নত পড়ো, তারপর ফজর পড়বো‌।

– ‘আমি কিবলা মুখি হয়ে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়ার জন্য নিয়ত করলাম’ এটাই বলবো তাই না। 

– হ্যা। নেও এবার ঠিক মতো দাঁড়িয়ে নামাজ শুরু করো। 

বলেই শাহারিয়া সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে একটুও বিরক্ত হয়নি দিথীকে নামাজ শিখাতে গিয়ে। আগে দিথী ভুল জানতো এখন শুধু সে তা শুধরে দিয়েছে। স্বামী হিসেবে তার কর্তব্যই তো স্ত্রীকে সাহায্য করা, ভুল গুলো শুধরে দেওয়া।

দুইজনেই সুন্নত পড়ে নিতে থাকে। দিথী, শাহারিয়ার একটু পর পর রুকু সিজদায় যায়। যেনো সে শাহারিয়াকে দেখে দেখেই নামাজ পড়ছিলো। 

 

কিছু সময় পর,,,

 

সুন্নত পড়া হয়ে গেলে দিথী আর শাহারিয়া আবার উঠে দাঁড়ায়। এবার ফরজ টা পড়বে। শাহারিয়া দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দিথীর দিকে ফিরে। বলে,

– এইবার ফরজ। এইবার তোমাকে সুরা পড়তে হবেনা। শুধু বৈঠকে বসলে ঐ তিনটা জিনিস পড়বা। 

– এখন বলবোনা ? 

– না। আর নিয়তের সময় বলবা ‘ আমি কিবলা মুখি হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে ফজরের দুই রাকাত ফরজ নামাজ পড়ার জন্য নিয়ত করলাম আল্লাহ্ আকবার ‘ বলে হাত উঠাবা।

– তুমি ইমাম!

– এখন জামাতে পড়বো দুইজন, আমি ইমামতি করবো। তাই তোমাকে ইমাম কথাটা যুক্ত করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী একসাথে নামাজ পড়লে স্বামী ফরজ নামাজ গুলোর ইমামতি করতে পারবে। সোজা হয়ে ভালোভাবে দাঁড়াও। 

– ঠিক আছে।

দিথী ঠিকঠাক মতো দাঁড়ায়। শাহারিয়া তাকবির দিতে থাকে। দিথী চুপচাপ তার তাকবীরটা শুনে। তাকবির শেষ হয়ে নিচে জায়নামাজের দিকে মাথা নিচু করে শাহারিয়া নিয়ত ধরে। দিথীও তার দেখা দেখি নিয়ত করে হাত উঠিয়ে তারপর বুকের উপর বাঁধে। শাহারিয়া সুরা পড়া শুরু করে। দিথী হাত বেঁধে মনযোগ দিয়ে শাহারিয়ার সুরা তেলোয়াত শুনতে থাকে। কেনো জানি তার এই সুর, এই টান, এই মধুময় তেলোয়াত খুব ভালো লাগছে। যখনই শুনছে তখনই তার মস্তিষ্ক একদম ঠান্ডা,শীতল হয়ে আসছে। এই অনুভূতি আগে কখনো হয়নি তার। শাহারিয়া রুকুতে যায়‌। দিথীও তার দেখাদেখি রুকতে যায়। তারপর উঠে দাঁড়ায়। তারপর সিজদাহে যায়। দিথীও তাই করে। দু’জন জামাতে নামাজ পড়ে নিতে থাকে।

 

      শাহারিয়া সালাম ফিরায়। দিথীও তার মতো করেই দুইপাশে সালাম ফিরিয়ে আল্লাহু আকবার, আসতাগফিরুল্লাহ পড়তে থাকে। শাহারিয়া হাত তুলে মোনাজাত ধরে। দিথীও তাই করে। সে হাত দুটো একখানে করে মুখের খুব কাছে এনে চোখ বুঝে মোনাজাত করে। তারপর উঠিয়ে শাহারিয়ার সাথে সাথেই চুমু খেয়ে নেয়। শাহারিয়া পিছনে ফিরে তাকায়। বলে,

– এভাবে সবসময় নামাজ পড়ে নিবা। আমি না থাকলে, অফিসে গেলে একলা একলা পড়ে নিবা। ঠিক আছে ? 

– আচ্ছা। 

শাহরিয়া জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দিথীও উঠে। দুইজনই জায়নামাজ ভাঁজ করতে থাকে। বাইরে থেকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তারমানে বোধহয় আলো ফুটতে শুরু করেছে। শাহারিয়া দিথীর হাত থেকে ভাঁজ করা জায়নামাজ টা নিয়ে চলে যায় আলমারির দিকে। আলমারি খুলে ভিতরে রেখে দেয়। দিথী তার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তার মাথায় এখনো হিজবা ছিলো। শাহারিয়া এখনো টুপি আর পান্জাবিতেই ছিলো। শাহারিয়া আলমারি লাগিয়ে পিছনে ফিরে।দিথী বলে,

– আজ অফিস যাবা ?

– হমম। ৮ টার দিকে বের হবো।

– নাস্তা বানাতে যাই তাইলে! 

– এতো সকালে নাস্তা বানায় কী করবা। (দেওয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) এখন ৬ টা বাজে। আরো অনেক সময় আছে। চলো নিচে যাই।

– টিভি দেখবো ? 

– না না। বাইরে যাবো। বাইরের আবহাওয়া দেখবো। ভোর বেলার বাতাস একদম পিওর, তোমাকে রিফ্রেশ করে দিবে‌, আর সকাল শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হেঁটে দেখিও, অনেক ভালো লাগবে। 

– বৃষ্টি হইছে না, কাঁদা হয়ে আছে তো।

– না, বৃষ্টি থামছে সেই মাঝরাতে। আর পানি থাকবেনা। এইটা উঁচু জায়গা। বৃষ্টি হওয়ার কিছুক্ষণ পর পানি সব নেমে গিয়ে আবার আগের মতো হয়ে যাবে। চলো এখন। 

– হিজাব টা খুলে রাখে যাই।

– না খুলিও না। এভাবেই তোমাকে বেশি সুন্দর লাগে। মনে হইতেছে যেনো আরাবিয়ান বউ বিয়ে করছি! হা হা হা!

– হইছে হাঁসতে হবে না। চলো।

দিথী শাহারিয়াকে নিয়ে চলে যায় দরজা দিকে। দুইজন মিলে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। 

 

     বাড়ির মূল দরজা দিয়ে বাইরে চলে আসে দুজন। আকাশের আলো এখনো পুরোপুরি ফুটেনি। নীলচে আভায় চারপাশ আলোকিত হয়েছে। দূরের পাহাড় গুলো কুয়াশায় ঘেরা, চেরি ব্লসম গাছ টা থেকে নতুন পাতা উড়তে শুরু করেছে। আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর। দিথী শাহারিয়াকে বলে দোলনার দিকে যেতে। শাহারিয়াও তাকে নিয়ে চলে যায় দোলনার দিকে। বাড়ির ডান পাশ টায় বেশি ফাঁকা যায়গা বাম পাশের তুলনায়। এইখানে বাড়ি আর বাড়ির প্রাচীরের মাঝে ফাঁকা যায়গাটায় ঘাসের মাঠ। ঘাস গুলো বড় বড় না। ছোটই আছে বলা যায়। চেড়ি ব্লসম গাছটা বাড়ির সাথে লাগানো প্রায়। আর গাছটার কিছুটা পাশেই দোলনাটা। দিথী আর শাহারিয়া গিয়ে বসে সেটায়। দোলনা হালকা দুলে উঠে। দিথী নিজের পা দোলাতে থাকে। শাহারিয়া বলে,

– বাড়িটা কেমন লাগছে! 

দিথী হাসিমুখেই শাহায়িয়ার দিকে তাকায়। বলে,

– অনেক সুন্দর। এই দোলনা সহ নিছো এইজন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ! 

– ধন্যবাদ দিয়ে আমার পোষাবে না। (আঙ্গুল দিয়ে নিজের গাল দেখিয়ে) এইখানে একটা পাপ্পি দেও! 

– আরে! তুমি একরাতের মধ্যে এতো রোমান্টিক হয়ে গেলা যে!

– একটু আধটু হইতে হয়। 

– গালে কেনো, ঠোটেই নাও। 

বলেই শাহারিয়ার মুখ ধরে তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে ঠোঁটে একটা ছোট্ট চুমু দেয় দিথী। দিয়ে আবার ঠিকমতো বসে পা দোলাতে থাকে। হাসতে থাকে। শাহারিয়া বলে,

– তুমি এতো এগ্রেসিভ! তোমার রোমান্টিক মুডে এইজন্য নিজেকে কন্ট্রোল রাখি। নাইলে দুইজনই একই রকম তাল মিলাইতে থাকলে বাড়ি-টারি সব ভেঙে ফেলবো তখন! 

– ভাঙতেও পারো। তোমার যে,,,,,,,,,! (বাকিটা না বলে হাত মুঠ করে মুখের সামনে এনে দুইবার গলা ঝাড়ে দিথী)

শাহারিয়া তা দেখে মৃদু হাসে। হাসি থামিয়ে বলতে থাকে,

– তোমার সবটুকু পূরণ করা আমার কর্তব্য। আমি শুধু আমার কর্তব্য টুকু পালন করছি। 

– তাই! ভালোবাসা থেকে কিছু করোনি! 

– ভালোবাসা থেকে করেছি বলেই তুমি খুশি আছো। 

– কিযে বললা, আমার মাথায় কিছুই ঢুকলো না। আচ্ছা বাদ দাও। (আংটিটা দেখতে দেখতে) এতো দামী আংটি কীভাবে কিনলা! এতো সুন্দর বাড়ি, গাড়ি এতোসব কিছু সরকারি চাকরি করে কিনা তো এতো সহজ না!

– আমার বেতনের বাইরেও আউট ইনকাম আছে। আর আমি ৩য় গ্রেডে বেতন পাই। সংখ্যার খাতায় তা নিহাতই কম না! আর এতোদিন যে চাকরি করতেছি একলা একলা আর কতই বা খরচ করছি। আমি তো সঞ্চয় করে রাখছি ভবিষ্যতের জন্য। বিয়ে করবো, আমাদের বাবু হবে, ভবিষ্যত বউকে সুখে রাখতে হবে, সব চিন্তা করেই টাকা জমাইছি।

– বাপরে! জামাই দেখি আমার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে রাখছে! 

– রাখবোনা! যে আমার নিজস্ব মানুষ হিসেবে আসবে তাকে আমি আমার সাধ্যমতো সর্বোচ্চ সুখে রাখার চেষ্টা করবো।

– তো আগে কি নিবো! ছেলে না মেয়ে? 

– আমরা কী আর বাছাই করতে পারি! আল্লাহ যা দিবে তাতেই খুশি।

– আমার তো দরকার একটা ছোট্ট পুতুলের মতো ছেলে। ওকে আমি বড় করে ডাক্তার বানাবো। আমাদের দুইজনের কিছু হইলে যেনো ও আমাদের চিকিৎসা করতে পারে।

– এতোদূর ভাবে ফেলছো! বিয়ের তো মাত্র কয়েকদিনই হইলো।

– চিন্তা করে রাখা ভালো। চলো ঘাসের উপর হাঁটি। তুমি হাটানোর জন্য নিয়ে আসলা আর এখন এভাবে বসায় রাখছো। 

– আমি কী তোমাকে এখানে আনছি! তুমিই তো দোলনার দিকে আসতে চাইলা।

– এখন দোলনা বাদ। দুইজন মিলে খালি পায়ে হাটবো। 

বলেই দিথী দোলনা থেকে নেমে দাঁড়ায়। পায়ের জুতা গুলো খুলে সেখানেই রাখে। শাহারিয়ার হাত ধরে তাকেও নামায়। শাহারিয়াও জুতা খুলে রাখে। দিথী আগে গিয়ে ঘাসের অংশের উপর দাঁড়ায়। আসলেই শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে দাঁড়াতে অনেক আরাম! হালকা শিরশির করছে অবশ্য পায়ের পাতায়, তবুও ফিলিং টা অনেক সুন্দর। দিথী শাহারিয়াকে ডাকে। শাহারিয়াও চলে আসে। দিথীর বাম পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ায়। শাহারিয়ার দিথীর পাশাপাশি আসে। দিথী হাত বাড়িয়ে দেয়। শাহারিয়া তার হাত ধরে। দু’জন মিলে শিশির ভেজা নরম ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটতে থাকে। শাহারিয়া, দিথীকে আরো কাছে নিয়ে হাঁটতে থাকে। দিথীর হাতের আঙুল ধরে। দিথী বেশ উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত। সে আরেক হাত উঁচিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দূরের পাহাড়ের চূড়া দেখাতে থাকে শাহারিয়াকে। সেই চূড়ার উপর থেকে মেঘের পরদ ধীরে ধীরে সড়ে যাচ্ছিলো। শাহারিয়াও সেদিকে তাকিয়ে দেখে। দুজনে মিলে কথা, হাসিতে মেতে উঠে। চেরি ব্লসম গাছ থেকে উড়ে আসা গোলাপী পাতা গুলো তাদের উপর পড়তে থাকে। হালকা ঠান্ডা বাতাসে বয়ে যায়। দিথীকে হিজাব আর শাহারিয়াকে টুপি পাঞ্জাবিতে দেখে যেনো মনে হচ্ছিলো দুইজন দুইজনার জন্য সৃষ্টি। আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিরাও যেনো দিনের প্রথম দূত হিসেবে তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। 

ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে গান,

 

” হয়তো তোমারই জন্য

হয়েছি প্রেমে যে বন্য,,

জানি তুমি অনন্য

আশার হাত বাড়াই,,

 

যদি কখনো একান্তে

চেয়েছি তোমায় জানতে,,

শুরু থেকে শেষ প্রান্তে

ছুটে ছুটে গেছি তাই,,, “

 

_____

 

(((২য় ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে)))

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৪ (১ম পর্ব)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৪ (২য় ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

(((১ম ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে)))

 

সুমু ওয়াশরুম থেকে বেড়োলো। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত মুখ ধুতে থাকে সে। বাড়ির আঙিনায় হালকা কুয়াশা পড়েছে। পাখিরা কাঁঠাল গাছটায় কিচিরমিচির করছে। সময় এখন সকাল ৭ টা। সুমু মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে মুখের ঘুম ঘুম ভাবটা কাটায়। ব্রাশ নেয়। পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ নিয়ে পেস্ট টা যায়গা মতো রেখে দেয়। বেসিনের আয়নায় নিজের দাঁত দেখে দেখে ব্রাশ করতে শুরু করে। এভাবেই প্রতি সকালে ব্রাশ করে সে। নায়িকাদের মতো সাদা ঝকঝকে দাঁত বানাতে হবে তাকে। নিজের কোন দিক দিয়ে যেনো কমতি না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে শুরু করেছে সে। তখনই বেসিনের আয়নায় দেখে দূরে বারান্দার মাঝের ঘর টা থেকে আফাজ বেরোচ্ছে। সুমুর যেন হঠাৎই নিজের খুব ভালো লাগা শুরু হয়। তার ঘুম কেটে যায়। মনে নতুন নতুন ফুল ফোটার আভাস পায়। আফাজ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দার একটা চেয়ারে বসে। বসে আঙিনার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। সুমু তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে নিতে থাকে। ব্রাশ করে গিয়ে সে আফাজকে নাস্তা দিবে। 

মুখের ফেনা বেসিনে ফেলে তাড়াতাড়ি কল ছেড়ে কুলি করে নিতে থাকে। মুখে পানি নিয়ে কুলি করে আর আয়না দিয়ে পিছনে দূরে বসে থাকা আফাজকে দেখে। কুলি করা শেষ করে মুখে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ব্রাশ যায়গায় রেখে দেয়। পিছনে ফিরে বারান্দার রশিতে ঝুলতে থাকা গামছায় হাত মুখ মুছে। মুখের ভাব বের করে দেখে তে মুখের গন্ধ সম্পূর্ণ রূপে গিয়েছে কী না। হ্যা। মুখ এখন টোটালি ফ্রেশ। সুমু হাত মুখ ভালোভাবে মুছে নিয়ে চলে যায় আফাজের দিকে।

 

আফাজ আনমনে আঙিনার দিকে চেয়ে ছিলো। তার মুখ বরাবরের মতোই গম্ভীর। চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুম হয়নি। মনে যেই ক্ষত তার সৃষ্টি হয়েছে, এই ক্ষত নিয়ে সে ঘুমাবেই বা কী করে। এই যন্ত্রনা তাকে ভুলে থাকতে দেয়না, সবসময় তাকে আঁধার শিখায় নিমজ্জিত করে রাখে। 

সুমু এসে তার সামনে দাঁড়ায়। দুই হাত একখানে করে নখ খোটাতে খোটাতে বলে,

– আপনি উঠেছেন! 

– হমম। 

– ব্রাশ করে নিবেন চলেন, বাসি মুখে বেশিক্ষণ থাকতে নেই। 

– পরে যাচ্ছি। 

– আমি ব্রাশ আর পেস্ট এনে দেই! আপনি চাইলে আমি আপনাকে ব্রাশও করিয়ে দিতে পারি।

– আমার দুই হাত এখনো অচল হয়ে যায়নি যে ব্রাশ টাও নিজ হাতে করতে পারবোনা। আমি নিজে গিয়ে ব্রাশ করে নিবো

সুমু হতাশ হয়। ধীর গলায় বলে,

– ঠিক আছে। 

তখনই শিউলি বেগম রান্না ঘয থেকে বেড়িয়ে আসেন। আঙিনা পেড়িয়ে বারান্দায় উঠেন। আফাজকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

– উঠছো! আমি তোমার কাছেই আইতাছিলাম।

– আমার কাছে! 

– হ। তোমার মায়ে ফোন দিছিলো আইজ সকালে। তারে আমি কী কমু? সবকিছু কইয়া দিমু না অন্য কিছু কমু? আমি ফোন ধরি নাই। ভাবলাম তোমারে না কইয়া জানানো ঠিক না। তোমার মারে এহন কী কমু।

– তুমি মা’কে বলে দেও আমার সেমিস্টার পরীক্ষা আসতে আরো ৫ মাস বাকি। আমি কয়েকদিন ছুটি কাটাতে চাই। মা আর কিছু বলবেনা। 

– তোমার হাতের বিষয়,,,,,,

– মা’কে বললে মা চিন্তা করবে। এইসব বলার দরকার নেই। 

– আইচ্ছা। মুখ ধুইছো! 

– না। 

– মুখ ধুইয়া নাও। আমি নাস্তা দিতাছি। 

বলেই শিউলি বেগম চলে যান টেবিলের দিকে। আফাজও চেয়ার থেকে উঠে চলে যায় বেসিনের দিকে। সুমু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয় একলা। সে যতই যেচে যেচে আফাজের সাথে মিশতে চাইছে ততই আফাজ তাকে ইগনোর করছে। তবে সুমুও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। সে নিজের টা ঠিকই আদায় করে নিবে। সেও চলে যায় বারান্দার টেবিলের দিকে। আফাজের নাস্তা রেডি করে দিতে। 

আনন্দ পুরে আজ অনেক দিন পর কুয়াশার দেখা মিললো। এখন কুয়াশা যে কবে কাটবে, আর কবে মানুষ স্বাভাবিক কাজে বেড়োবে সেটা কুয়াশা আর তার ভাই-ব্রাদার রাই যানে!!!

 

_____

 

রিয়াদ তার ঘর থেকে বের হয়‌। সময় সকাল ১১ টা। হালকা রোদ পড়েছে উঠোনে। রিয়াদের গায়ে পুলিশি ড্রেস। কাল বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা বেজে গেছিলো। ভিজা শরীরে এতোক্ষণ থাকায় তার সর্দিও ধরেছে একটু। 

রিয়াদ আঙিনার কোনে যায়। বাইকটা সকালে নামিয়ে সেখানেই রেখেছিল। বাইকটার স্ট্যান্ড উঠিয়ে হাত দিয়ে টেনে সেখান থেকে ঘুড়িয়ে নিতে থাকে দরজার দিকে। রান্নাঘরের দরজা থেকে রাতুল রিয়াদকে দেখেই হাঁক দিয়ে ডেকে উঠে,

– রিয়াদ, কই যাইতেছিস!

– কই আবার থানায়।

রাতুল রান্না ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিয়াদকে বলে,

– আজকে তোর ভাবিরে নিয়ে আমি একটু ক্লিনিকে যামু চেকাপ করতে। দুপুরে বাইরে খায় নিস।

– আচ্ছা ঠিক আছে‌। তোমাদের ফিরতে রাত হবে নাকি আবার! 

– না। সন্ধার মধ্যেই আসে পড়বো। 

– দিনাজপুর নিয়ে যাবা! 

– হ। তুই যাওয়ার সময় তোর বেলাল চাচারে বলিস তো ভ্যান নিয়ে ১২ টা, সাড়ে ১২ টার দিকে আসতে, ওর ভ্যানেই যাইতাম।

– আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বলে যাবোনে। 

রাতুল চলে যায় রান্না ঘরের ভিতরে। রিয়াদ বাইকটা ঘুড়িয়ে ফেলছে বাড়ির গেটের দিকে। বাইকে উঠে বসে সে। বাইক স্টার্ট করতে যাবে তখনই তার ফোন বেজে উঠে। 

‘ উফফ এই যে শুরু হইছে ফোন আসা। এখন সারাদিন এই কেস ঐ কেস করে বেলা কাটবে।’ 

বলেই রিয়াদ ফোনটা পকেট থেকে বের করে। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ফোন এসেছে। ওখানে রিয়াদ কয়দিন আগে পাওয়া লাশ দুটো পাঠিয়ে দিয়েছিলো। হয়তো সেগুলোর বিষয়েই জানানোর জন্য ফোন দিয়েছে। রিয়াদ ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলে। ওপাস থেকে এক মধ্যবসয়ী লোকের কন্ঠ ভেসে আসে। 

– আসসালামুয়ালাইকুম রিয়াদ।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। তারেক ডাক্তার না! 

– হ্যা। আমিই। তুমি যে কয়েকদিন আগে মর্গে দুইটা লাশ পাঠাইছিলা ঐ দুইটার মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। 

– পরিচয় পাওয়া গেছে ? কোনটার ? 

– যেইটা প্রেগন্যান্ট ছিলো ঐটার। মেয়েটা রংপুরের একটা প্রাইভেট হসপিটালের নার্স ছিলো। নাম হাবিবা। 

– হাবিবা! 

– হ্যা হাবিবা। সে কিছুদিন আগেই ডাক্তারি পড়া শেষ করে প্রাইভেট হাসপাতালে নতুন জব নিয়েছিলো। ওখানেই কাছের একটা হোস্টেলে থাকতো। মেয়ের পরিবার বলছে মেয়েটা অবিবাহিত। তাদের মেয়ে যে ৭ মাসের প্রেগন্যান্ট তাও তারা জানতো না। 

– পরিবার জানতো না! মেয়েটা তার পরিবারকে জানায়নি এই বিষয়ে ?

– মেয়ের পরিবার তো তাই বলছে। তারা এই বিষয়ে জানেনা। মেয়ের পরিবার রংপুর মিঠাপুকুর থানায় মিসিং রিপোর্ট করেছিলো কয়েকদিন আগে। তুমি মিঠাপুকুর থানায় গেলে এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে পারবা। 

– প্রাইভেট হাসপাতাল টার নাম কী ? 

– রয়েল লরেন্স হাসপাতাল। 

– রয়েল লরেন্স হাসপাতাল!!!! 

– হ্যা। আর আরেকটা যে মেয়ে ছিলো, শরীর যে খুবই বেশি ক্ষতবিক্ষত করা, তার পরিচয় না পাওয়া গেলেও তার বিষয়ে আপডেট আছে। 

– কী আপডেট ? 

– মেয়েটার শরীরে অনেক ড্রাগের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মেয়েটা খুব বেশি ড্রাগ এডিক্টেড ছিলো। 

– ড্রাগস! 

– হ্যা। ফিলোফিসিয়াম, কোকেন, হেরোইন, ফেনসিডিল এমন কোন ড্রাগ নাই যে আমরা তার দেহ থেকে পাইনি। মেয়েটা এভাবে ড্রাগ নিতে থাকলে আর কয়েকমাসের মধ্যেই এমনিই মারা যেতো। 

– এতো ড্রাগ মেয়েটা কোথায় পেলো! 

– আমি এখন কী করে যানবো, এসব বের করা তো তোমার কাজ। আমি যা পেয়েছিলাম তা তোমাকে জানিয়ে দিলাম। 

– ধন্যবাদ ভাইয়া। আর কোন আপডেট থাকলে জানাইয়েন। কেস যতদিন না শেষ হচ্ছে পরিবারের কাছে তো লাশ হস্তান্তর করা যাবে না। মর্গেই রাখতে হবে।

– হ্যা। আমি লাশ গুলো ফ্রোজেন রুমে রাখছি তুমি এদিকটা নিয়ে ভেবোনা। 

– আচ্ছা ভাইয়া। পরবর্তীতে দরকার পড়লে কল দিবো।

– ঠিক আছে। 

রিয়াদ ফোনটা কান থেকে নামায়। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছে এই পুলিশ লাইনে এসে। একটা গ্রামের থানার ওসি হয়েও এতো এতো রহস্যময় কেস তাকে হ্যান্ডেল করতে হবে জানলে পুলিশ হওয়া তো দূরের কথা, থানার আশাপাশেও ঘুরাঘুরি করতো না। 

‘ আলিশা, সুরাইয়াদের লাশের চুরি যাওয়া। ঘরে ঢুকে এই দু’জনকে দিনে দুপুরে খুন করা। দুইটা অজানা লাশ। তাও আবার তাদের পাওয়া গেছে গাইবান্ধায়। মারা গেছে বলে আনন্দ পুরে। ওদের মধ্যে একজনের বাসা আবার রংপুর। তো বাপ তুই রংপুরেই মরতি। সেইখান থেকে তোকে এই আনন্দপুরেই আসে মরতে হইলো! আবার আরেকজন টন টন গাঁজা গিলে আনন্দ পুরে আসছে মরতে। দুইদিন পর তো এমনিই মরতিরে বইন! ক্যান আমারে পাগল করার জন্য এইগ্রামে আসে মরতে গেলি,,,! মন টা চাইতেছে ইকরাকে নিয়ে যেদিক দুইচোখ যায় চলে যাই। এতো প্যারা আর ভাল্লাগে না। “

 

____

 

নিপা গোসল খানা থেকে বের হলো। এখন দুপুর। রোদ্রৌজ্জল দিন। সকালে ঠান্ডা পড়লেও এখন আবহাওয়া বেশ গরম। নিপা গোসল খানা থেকে বের হয়েই ব্যালকনির দিকে তাকায়। রায়হান সেই ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে গিটার হাতে বসে আছে। তার পিছনে নিচ থেকে বেয়ে উঠা গাছের পাতারা মৃদু হওয়ায় দুলছে। রায়হান যেনো নিপারই বের হওয়ার অপেক্ষা করছিলো এতোক্ষণ। নিপাকে দেখেই রায়হান তার গিটারের তারে সুর বুনে, সুরের বেড়াজালে এই দুপুর টাকে গানময় করে তোলে।

 

“তোমার জন্য

সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল

উদাস দুপুরে রাগ বসন্ত গাইবে সোনালী চিল,,,

তোমার যত ভুল সব নিমিষে হবে ফুল

তবু ভালবাসি শুধু তোমায় নিশিদিন সারা বেলা

 

তোমার জন্য

সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল

উদাস দুপুরে রাগ বসন্ত গাইবে সোনালী চিল”

 

(নিপা এসে দাঁড়ায় ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে। ভেজা চুল গুলো থেকে গামছা সড়িয়ে হাতে ধরে থাকে। রায়হান তার পিছনে এসে দাঁড়ায়। ভেজা চুল গুলো হাতে উঠিয়ে নেয়। নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে থাকে। মুখ তুলে আয়নার দিকে তাকায়। নিপার প্রতিবিম্ব দেখতে থাকে।)

 

“তোমার জন্য মরুর বুকে আবেশ ছড়াবে সবুজ

তোমার জন্য শান্ত নদীটা হয়ে যাবে আরো অবুঝ ,,

তোমার যত ভুল সব নিমিষে হবে ফুল

তবু ভালবাসি শুধু তোমায় নিশিদিন সারা বেলা,,

 

তোমার জন্য

সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল

উদাস দুপুরে রাগ বসন্ত গাইবে সোনালী চিল,,”

 

(নিপা ‌লজ্জা পেয়ে বিছানায় বসে পড়ে। রায়হান নিপার হাতের গামছাটা নেয়। গামছার দুই প্রান্ত ধরে তা দিয়ে নিপাকে জড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। নিপার কপালে কপাল রাখে। নিপার লজ্জা মাখা মুখে হাসির ছটা।)

 

“তোমার জন্য রাতের মহাকাল হাজার তারা ঝিকমিক

দস্যু ছেলেটা পথ হারিয়ে হাটবে দ্বিকবিদ্বিক,,,

তোমার যত ভুল সব নিমিষে হবে ফুল

তবু ভালবাসি শুধু তোমায় নিশিদিন সারা বেলা,,

 

তোমার জন্য

সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল

উদাস দুপুরে রাগ বসন্ত গাইবে সোনালী চিল

দি রি রা রি রা রি রারা,,, ও,,,,, দি রি রা রি রা রি রারা,, ও,,,,,,”

 

নিপা রায়হানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে যায়। দৌড়ে চলে যেতে নেয়, তখনই রায়হান নিপার হাত ধরে ফেলে। আস্তে আস্তে টেনে নিজের কাছে আনে। নিপা রায়হানের কাছে আসতেই লজ্জায় রায়হানকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দেয়। শাড়ির কুচি হাত দিয়ে ধরে দৌড়ে চলে যায় ব্যালকনির দিকে। খোলা চুল গুলো হাওয়ায় মৃদু উড়তে থাকে‌। রায়হানও বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। একহাত মাথার চুলে দিয়ে মুচকি হাসি হাসে। মনে ছিলো তার নিপাকে ভালোবাসায় সিক্ত করার চেষ্টা। নিপার জীবন থেকে সে ব্যাতীত বাকি সব কিছু ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা। নিপাকে নিয়ে সে শান্তির নীড়ে চিরস্থায়ী ভালোবাসা স্থাপন করতে চায়। যদিও সে জানেনা এতে সে কতটা সফল।

 

______

 

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ। সোনালী কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্য। পড়নে একটা গোল জামা আর জিন্স। মাথায় হিজাব‌। কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ। তার পরীক্ষা চলছে। শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সে। ভালো একটা রেজাল্ট নিয়ে এখান থেকে বের হতে পারলেই নার্সিং এ চাকরি নিতে পারবে ও। 

সময়টা এখন দুপুরের শেষ প্রহর। পরীক্ষা কিছু সকালে আছে, কিছু আবার দুপুর ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত। আজকে দুপুরে শুরু হয়েছিলো পরীক্ষা। সোনালী এখন মেডিকেল কলেজের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়ির জন্য। তার কোন বন্ধু বান্ধব নেই। একলা আসে একলা যায়। তবে তার সহপাঠীরা তাকে খুব শান্ত-শিষ্ট আর লাজুক মেয়ে হিসেবেই চিনে। কিন্তু সে যে কত গভীর জলের মাছ তা কোন স্বাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা মুশকিলই নয় অসম্ভবই বলা যায়। 

একটা বাইক এসে থামে তার সামনে। সোনালী কিছুটা পিছিয়ে দাঁড়ায় প্রথমে। বাইকার হেলমেট পড়ে ছিলো। সোনালী প্রথমে চিনতে পারেনি। তাই সে স্বাভাবিক মেয়েদের মতোই অবাক হওয়ার ভঙ ধরে। কিন্তু যখন সেই বাইকার তার হেলমেট খুলে, সোনালী তাকে চিনতে পারে। রাফসান এসেছে বাইক নিয়ে। সোনালী একটা মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। রাফসান বলে,

– তোমাকে আমি আজও চিনে উঠতে পারিনা। এই এক সত্তার মধ্যে এতো রূপ, কীভাবে কী! 

– আমিই আমাকে চিনতে পারিনা, তুমি চিনবা কীভাবে। 

– পরীক্ষা ছিলো ? 

– হ্যা। 

– কেমন হয়েছে! 

– বরাবরের মতোই। 

– ভালো ? 

– হ্যা। 

– পিছনে উঠো।

– কেনো ? 

– বাসায় পৌঁছে দেই। একটা বড় রাইড দেই। এখন আবার এটা বলিও না যে বাইকে নিয়ে ঘুরতে চাইলেও টাকা দেওয়া লাগবে।

– টাকা দিতে হবেনা। তবে রাইড যদি দিতে চাও, সেইক্ষেত্রে এতোক্ষণ এমনি এমনিই বসে থাকতে তো আর পারিনা।

– দিনাজপুর চলো।(হাত উঠিয়ে ঘড়ি দেখে) দুপুর তো প্রায় শেষ। তাও দেখি, ‘নিলনোর’ রেস্টুরেন্টে বিড়িয়ানী পাওয়া যাইতে পারে। ওখানে গিয়ে বিড়িয়ানী খাওয়াবো।

– যদি বিড়িয়ানী শেষ হয়ে যায়, তখন! 

– তাইলে তুমি অন্য যা খাইতে চাইবা তাই খাওয়াবো।

– সত্যি তো! 

– আবার জিগায়! নেও উঠো এখন। লোকজন বাড়তেছে।

সোনালী একটা মুচকি হাসি দিয়ে কাঁধের ব্যাগ খুলে হাতে নেয়। বাইকে উঠে বসতে ধরে, তখনই রাফসান বলে,

– দুইপাশে পা দিয়ে বসো। 

সোনালী ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসে। রাফসান কী তার খাওয়ানোর পিছনে খরচ করবে! সেইটাও এই রাইডে মজা নিয়ে সুদে আসলে উঠিয়ে নিবে‌। সোনালী দুইপাশে পা দিয়েই উঠে বসে। ব্যাগটা কাঁধে পড়ে নেয়।  রায়হান বলে,

– কাছে আসে বসো। স্পিড বাড়াইলে পড়ে যাবা।

– কতটা কাছে! এতোটা! 

বলেই সোনালী খুব কাছে এসে রাফসান পিঠের উপর হেলান দেয়। সোনালীর স্পর্শ পেয়েই রাফসান যেনো খুশিতে মেতে উঠে। বাইক স্টার্ট করে‌। গিয়ার ফুল দিয়ে দেয়‌। বাইক নিয়ে চলে যায় মেডিকেল কলেজ গেইট ত্যাগ করে।

 রাফসান চাইছিলোই এমনটা। সোনালীর বুকের ছোঁয়া তার পিঠে পড়ুক, কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ব্যায় তো করতেই হবে। সোনালীকে তাই খাওয়ানোর জন্য রাজী হয়েছিলো রাফসান। 

বাইক সজোরে চলে যেতে থাকে। অটো, লোকাল বাস সব ওভারটেক করে হাই স্পিডে যেতে থাকে। সোনালী তার মাথার হিজাব খুলে দেয়। বাতাস সেই হিজাব উড়ে রাস্তার কোথাও একটা পড়ে যায়। মাথার ক্লিপ খুলে মাথার চুল গুলোকে মেলে দেয়। খোলা চুল গুলো হাওয়ায় উড়তে থাকে। সোনালীর বেশ ভালো লাগছিলো। সোনালী আবার রাফসানের পিঠের উপর হেলান দিয়ে তার কাঁধে মুখ রাখে। নিজের দুই হাত রাফসানের বুকের কাছে নিয়ে যায়। রাফসানের বুক টিপতে থাকে। রাফসান হাসতে থাকে। সোনালীও মুচকি হাসতে হাসতে রাফসানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

– মজা লাগতেছে! 

– ঠিক এমনটা তোমার সাথে করতে পারলে আরো বেশি মজা লাগতো! 

– বিয়ে করে নাও তাইলে! আমি তখন বাইক চালাবো আর তুমি পিছনে বসে এমন করবা!!

– ইশশশ!!! সোনালী!! তুমি কেনো এতো আগুন জান!!! উফফ, আমার মনটা চাইতেছে এখনি বিয়ে করে নিতে। চলো কাজী অফিস, আজকেই বিয়ে করবো তোমাকে!

– এতো তাড়া কিসের বেইব! 

– আমাকে বেইব বললা! (উত্তেজিত হয়ে) আমাকে বেইব বললা!!! উফফ!! আমার ভিতর টা যে পরিমাণ লাফাইতেছে! মন চাইতেছে বাইক নিয়ে সোজা তোমার আস্তানায় চলে যাই। এক রাউন্ড না হইলে যেন আমার মনের আগুন নিভভে না। 

– মানা কে করছে! (রাফসানের কানের খুব কাছে এসে তার কানের লতিতে একটা ছোট কামড় দিয়ে) আজ রাতে আমি একদম ফ্রি! 

– সত্যি!! সত্যি!! আমি আজ রাতে তোমাকে নিয়ে আবার খেলায় মাততে চাই! কত নিবা খালি বলো। আজ রাতে শাপ লুডু খেলে বোর্ড ভেঙে ফেলবো। 

– কত আর, ৫ লাখ! 

কথাটা শুনেই যেন রাফসানের উত্তেজনা ফিকে হয়ে যায়। তার ফুলতে থাকা পুরুষত্ব যেন চুপসে যায়। বিড়ালের মতো মেও মেও করে বলে,

– এতো টাকা নিবা জান! একটু ছাড় দেওয়া যায় না! 

– ৬ লাখ।

– আরে কী,,,,,

– ৭ লাখ! 

– আরে আমাকে,,,,,

– ৮ লাখ! 

– পায়ে ধরি প্লিজ থামো,,,,

– ৯ লাখ! 

– ফাইনাল ফাইনাল। এইবার থামো। আর বাড়াইয়োনা। (একটু থেমে করণ গলায়) বাচ্চেকি জান লোগি ক্যায়া!

– বাচ্চা! তুমি বাচ্চা!! বাচ্চার এতো খাওয়ার শখ যাগে ক্যান তাইলে!!

– তোমার আগুন যে আমাকে বারবার খাইতে বাধ্য করে।

– তাইলে ৯ লাখ ফাইনাল?

– আমি হুট করে এতো টাকা কীভাবে,,,,,, ধুর!

তখনই সোনালী রাফসানকে তার শরীরের সাথে খুব জোড়ে চেপে ধরে। একহাত বাড়িয়ে তার নিচের অংশে দেয়। রাফসানের চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। পিছন থেকে সোনালী বলে,

– ৯ লাখ কী খুব বেশি হয়ে গেছে বাবু!

রাফসান চোখ বড় বড় করে উত্তেজিত হয়ে হাসি মুখে বলে,

– না! কে বললো বেশি। তুমি বললে আরো ১ লাখ বাড়ায় দেই। ১০ লাখ দেই।

– তুমি দিতে চাইলে আমি কী আর না করতে পারি! ১০ লাখই দিয়ো বাবু! 

বলেই রাফসানের নিচের যায়গা হতে হাত সড়িয়ে নেয় সোনালী। তবে রাফসানকে এখনো সে জড়িয়ে ধরে ছিলো। এভাবে আরেটু রাখলে যদি রাফসান আরো নরম হয়। 

তবে রাফসান তা না হয়ে উল্টো তার হুঁশে চলে আসে। এখন সে বুঝতে পারে, যে সে খুশির উত্তেজনায় কী বলে ফেলছে! এক রাতের জন্য ১০ লাখ দিতে হবে এখন! সোনালিও এমন কিছু করলো, তার পুরুষ মন যেন লাফিয়ে উঠছিলো। রাফসান এখন একটু বাইকের গতি কমিয়ে দেয়। গলার স্বর একটু কঠিন-স্বাভাবিক করে। বলে,

– তুমি অনেক সেয়ানা! 

– একটু আধটু হইতে হয়। লাভ তো তোমারও আছে।

– তাই বলে এতো নিবা! 

– জিনিস কী কম দিবো তোমায়! আর বিয়েটা করে নিলে তো তখন আর টাকা দিতে হবেনা। যখন মন তখনই হাত ধরে নিয়ে গিয়ে,,,,,,,

– হ্য বলো বলো। বাকিটা বলো।

– বাকিটা শুনতে হইলেও টাকা দেওয়া লাগবে।

– আমি বাপ তোমাকে বিয়ে না করা পর্যন্ত মনে হয় এই টাকার জ্বালা থেকে মুক্তি পাবো না। এখনি চলো বিয়ে করে নেই।

– না।

– এখন করলে সমস্যা কোথায় ? 

– ১ মাস পর। 

– কেনো কেনো এক মাস পর কেনো? 

– আমার পরীক্ষা আরো ১ মাস চলবে। তারপর বিয়ে।

– এতো পরীক্ষা দিয়ে কী করবা। আমার বউ হবা, সারাদিন খাবা, খাওয়াবা আর ঘুমাবা।

– আমি বলছি একমাস পর মানে একমাস পরই। বেশি কথা বললে বিয়ের অফার ক্লোজ করে দিবো কিন্তু!

– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। ১ মাস পড়েই করিও। কিন্তু বিয়ের অফার বন্ধ করিও না। তোমার এই রূপ, এই হটনেস!! আহাহা! আমি পাগল হয়ে যাবো!

– হবাই তো। (একটু থেমে স্বাভাবিক গলায়) উনি যেই কাজ দিয়েছিলো হয়েছে সেটা ? 

– কে ? বাবা ? 

– হ্যা। 

– আমি একটু আগে মাল বুঝিয়ে দিয়ে আসছি। 

– আজকের কাজ তাইলে শেষ ? 

– না, নরসিংদীর গাড়িতে মাল দেওয়া হয়নি। রাতে দিবো ঐটায়। আচ্ছা জান, একটা কথা আমার এখন মনে পড়লো। তুমি বাবার রুমে সবসময় কী করো ? মাকেও ঢুকতে দেও না বলে ? 

– উনি মানা করেছেন সুমনা আপুকে ভিতরে ঢুকতে দিতে। সুমনা আপুর সাথে উনার দুইদিন আগে ঝামেলা হয়েছে।

– কী নিয়ে?

– আলিশার বিষয়টা নিয়ে।

– বাবা প্রতিদিন বাচ্চার মাংস খায় এখন! 

– হমম। 

– ভালোভাবে কেটে রান্না করে দিও। কাঁচা খাওয়াইয়ো না। তোমরা যে ঐগুলা কীভাবে খাও! দেখলেই বমি বমি লাগে। এইজন্য আমি বাবার রুমে যাইনা‌। চারপাশে হাড়,গোড় মাথার খুলি! ইশশ্!! ভাবলেই গা শির শির করে উঠে। 

– এইজন্যই তো বাবা আমাকে ছাড়া আর কাউকে ঐ তার ঘরে ঢুকতে দেন না। 

– নিচের টার কথা বলতেছো না? 

– তো কী। উপরের টা তো উনার শোয়ার ঘর। বার বার এতো ডিটেইলসে বলা লাগে ক্যান! 

– আমি বারবার গুলায়ে ফেলি।

– সামনে দেখে গাড়ি চালাও। যেই জোরে চালাইতেছো কখন না জানি কোথাও লাগায় দেও।

– বাইক চালানোতে আমার, ২০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে‌।

বলেই আরো বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে একটা ট্রাককে ওভারটেক করে চলে যায়। বাতাস এবার খুব জোরে এসে সোনালীর মুখে লাগছিলো। চুল গুলো হাওয়ায় উড়াউড়ি করছিলো। বাইক চলে যায় রাস্তার মাঝ দিয়ে ১০০ এর কাছাকাছি গতিতে!!

 

____

 

দিথী এসে বসলো বারান্দার চেয়ারে। এইটা বাড়ির মাঝখানে থাকা ব্যালকনি বারান্দা। শোয়ার ঘর থেকে এটায় আসার দরজা। দিথী হাতে মোটা একটা বই। বইটার নাম “মকছুদুল মমিনিন”। বইটা সকালে যাওয়ার সময় তাকে দিয়ে গেছিলো শাহারিয়া। বইটায় নামাজ শিক্ষা থেকে শুরু করে ইসলামিক অনেক কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা করা আছে। দুনিয়াবি জীবনে কাজে লাগবে এমন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা আছে। দিথী বইটা নিয়ে চেয়ারে বসে। বাড়িতে সে একা। এখন সময়টা বিকেল। দিথীর ফ্রি টাইম বলা যায়। কোন কাজ নেই এখন ওর হাতে। তাই বইটা এখনই পড়বে বলে ঠিক করে সে। হালকা রোদ এসে পড়েছে বাড়ির নিচের ঘাস বাগান টায়। এই বারান্দাটা দোতলায় হওয়ায় আর উপরে ছাওনি থাকায় এখানে রোদের ঝিলিক নেই। দিথী বইটা খুলে বইয়ের সুচি পত্রে আঙ্গুল ঘোরাতে থাকে। সে একটা জিনিস খুঁজছিলো এখানে। খুঁজতে খুঁজতে সে পেয়েও যায়। 

‘ দাম্পত্য জীবন, পেইজ নং ৪২৮ ‘ 

বলেই পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে ৪২৮ নং পেইজের দিকে যেতে থাকে সে। দিথী দেখতে চাইছিলো স্বামীর মন যুগিয়ে চলা, তাকে সবসময় হাসিখুশি রাখার জন্য তার কী কী করা উচিত। একজন স্বামীর জীবনে তার স্ত্রীর ভূমিকা গুলো কী কী, সে আদেও সেগুলো পালন করেছে কী না তা দেখতে চায়।

পেইজ উল্টিয়ে উল্টিয়ে ৪২৮ এ চলে আসে সে। সেখানে অনেক বড় বর্ণনা দেওয়া। দিথী হালকা করে চোখ বুলিয়ে যায় সেগুলোর উপর দিয়ে। এখান থেকে হালকা ধারনা নিয়ে আবার চলে যাবে নামাজ শিক্ষা অধ্যায়ে। কিছু সুরা মুখস্থ করতে হবে তাকে। আসরের আযান এখনো দেয়নি, দিতে খানিকক্ষণ দেরি আছে। তার আগেই এই প্যারা টুকু পরে, সুরা মুখস্থ করে নিতে হবে। যাতে আসরের নামাজে সেই সুরা গুলা পড়তে পারে। 

 

দিথী সেই পেইজে খুঁজতে খুঁজতে একটা প্যারা পেয়ে যায়। যেখানে পয়েন্ট আকারে দেওয়া ছিলো স্বামীকে খুশি রাখার জন্য স্ত্রীর প্রাথমিক করণীয় গুলো।

দিথী পড়তে শুরু করে মনযোগ দিয়ে,

‘ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মেলবন্ধন তৈরি করা এবং বজায় রাখার জন্য স্বামীর যেমন কিছু কর্তব্য আছে, স্ত্রীরও তেমন কিছু কর্তব্য আছে। স্ত্রী সবসময় চেষ্টা করবে স্বামীর মন যুগিয়ে চলার, পাশাপাশি সে যেই কাজ গুলো করতে পারে,

১, সবসময় পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকা।

২, খুশবু ব্যবহার করা।

৩, স্বামীর সাথে সবসময় নরম সুরে কথা বলা। 

৪, স্বামীর কথাকে প্রাধান্য দেওয়া, সম্মান করা। 

৫, স্বামীর সব খায়েসাদ তার স্ত্রী ব্যাতীত কোন নারী পুরা করতে পারবেনা, ইসলাম অনুযায়ী স্বামীর হক রয়েছে শুধু মাত্র তার স্ত্রীর উপরই। তাই স্ত্রীর উচিত তার স্বামীর চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা সবসময় পূরণ করার চেষ্টা করা।

আমি তো এটা করি। ও‌ নিশ্চই আমার উপর এই ব্যাপারে সন্তুষ্ট! আচ্ছা দেখি তারপর কী বলছে,

৬, স্বামীকে মাঝে মাঝে তার পছন্দের খানা তৈরি করে খাওয়ানো।

৭, স্বামী তার স্ত্রীর কাছে এক পুষ্ট-সবুজ গাছের মতো। যতই সে তার গাছের যত্ন নিবে ততই সেই গাছ থেকে সে ফলাফল পাবে। তার উপর ছায়া দিবে, ঝড়-ঝন্জায় তাকে রক্ষা করবে। বৃষ্টির সময় ঢাল হয়ে দাঁড়াবে, আর ফল হিসেবে তার শরীরের রক্ত পানি করা উপার্জন দিয়ে তার স্ত্রীকে খুশি রাখবে। তাই কখনোই স্বামীর সাথে অহেতুক রাগারাগী ও ঝগড়া করা উচিত নয়। এতে আল্লাহ তায়ালা নারাজ হন।

আমি ওর সারে ঝগড়া করিনা। আর করবোও না। ওর সাথে আমি কেনই বা ঝগড়া করবো! ওর জন্যে আমি ভালোবাসা কী তা বুঝেছি। মায়া, আবেগ সবকিছু উপলব্ধি করেছি। আমি বোধহয় ওকে সত্যিই অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। আমার বাবার পাশপাশি এখন আমার আরেকজন কাছের মানুষ হয়েছে। ওকে আমি সবসময় কাছে রাখবো, নিজের করে রাখবো। “

 

বাড়ির নিচে মেইন গেইটের আড়াল হতে এক আগন্তুক নজর রাখছে দিথীর উপর। তার মাথায় টুপি দেওয়া। মুখে কালো সার্জিক্যাল মাস্ক। পড়নে ছিলো মোটা জ্যাকেট আর কালো জিন্স প্যান্ট। সেই পান্টের পায়ের দিকটা কিছুটা ফোলা ফোলা। যেনো কোন পিস্তল লুকানো রয়েছে সেখানে।

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( কী হতে চলেছে এরপর? দিথীর কিছু হয়ে যাবেনা তো! গল্প নিয়ে আপনার মন্তব্য জানাতে পারেন কমেন্টে। পরবর্তী পর্বে কিছু জিনিসের খোলাসা হবে তাই আজকের পর্বটা একটু নরম নরম দেওয়া হইলো। পরবর্তী পর্ব আসছে কাল 😉)

 

গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৪ (২য় ভাগ)

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৫

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

সন্ধ্যা বেলা। আকাশ পরিষ্কার। কিছুক্ষণ আগে মাগরিবের আযান পড়েছে। দিগন্তের উজ্জ্বল তম অধ্যায় শেষে আঁধার নেমেছে ধরিত্রীতে। রিয়াদ এসে থামলো একটা থানার বড় গেইটের সামনে। থানার নাম “মিঠাপুকুর মডেল থানা, মিঠাপুকুর, রংপুর”। রিয়াদ ভ্যান থেকে নামে। গাঁয়ে পুলিশি  পোশাক। ভ্যানের ভাড়া পরিশোধ করে দিয়ে গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। ভ্যানওয়ালা তার ভ্যান নিয়ে চলে যায়। 

 

রিয়াদ দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ওসির রুমে। ভিতরে রুমের মাঝে এক বড় টেবিলের ওপাসে বসে আছেন ওসি ফাহাদ চৌধুরী। বয়স ৫০+। মাথার চুল হালকা পেকেছে। তিনি টেবিলে কোন এক ফাইলে কি যেনো লেখছিলেন। রিয়াদ গিয়ে টেবিলের সামনে থাকা দুটো চেয়ারের একটার পাশে দাঁড়ায়। ওসি ফাহাদ দৃষ্টি তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকান রিয়াদের দিকে। রিয়াদ বলে,

– আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। আমি রিয়াদ। আনন্দপুর থানার ওসি। 

– রিয়াদ ? ও হো ঐ রিয়াদ। 

– হ্যা স্যার। ঐযে হাবিবা নামের মেয়েটার বিষয়!

– হ্যা হ্যা বুঝতে পেরেছি‌। বসো।

– জী, ধন্যবাদ স্যার। 

রিয়াদ একটা চেয়ারে বসে পড়ে। ওসি ফাহাদ তার লেখালেখি বন্ধ করে ফাইল টা একজন কনস্টেবলকে নিয়ে যেতে বলে। একজন কনস্টেবল এসে সেই ফাইল নিয়ে যায়। রিয়াদ কিছুটা ইতস্তত বোধ করছে। শুনেছে, ওসি ফাহাদ অনেক কড়া একজন অফিসার। এখন তাকে কেসের বিষয়ে কতটা কো-অপরেট করতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। রিয়াদ একটু গলা ঝেড়ে নেয়। বলে,

– স্যার। হাবিবার সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছিলাম।

– হাবিবাকে তুমি চিনো নাকি ? 

– ন,না স্যার। আমি কীভাবে চিনবো। ঐযে তারেক ভাইয়া আমাকে বললো, মেয়েটার নাম হাবিবা।

– ওহহ। তো এখন কী জানতে চাও, কেস টা তোমারই হওয়ার কথা, ড্রাইভারের ভাস্যমতে ও আনন্দপুর থেকে এসেছে আর ওর গাড়িতে হাবিবার লাশ। তারমানে তো লাশ টা সে আনন্দ পুর থেকেই এনেছে, আর কেস টাও তোমারই হয়। 

– হ,হ্যা স্যার। আমারই হয়। আপনি যদি কিছু ইনফরমেশন দিয়ে আমাকে হেল্প করতেন, না মানে মেয়েটা এই মিঠাপুকুরেরই। ওর বিষয়ে তথ্যদি তো আমি আপনি ছাড়া আর কারো কাছ থেকে পাবোনা।

– হ্যা, বলো কী ইনফরমেশন লাগবে। (কনস্টেবলের দিকে ফিরে) তুহিন, ঐ ৪০৯ নাম্বার ফাইল টা দেতো।

– আইচ্ছা স্যার।

তুহিন নামের কনস্টেবল ফাইল নিয়ে আসে ফাইলের সেলফ থেকে। এনে ওসি ফাহাদকে দেয়। ওসি ফাহাদ চোখে একটা চশমা পড়ে নিয়ে, ফাইল টা খুলে পাতা উল্টিয়ে দেখতে থাকে। রিয়াদ একটু স্বাভাবিক গলায় বলে,

– স্যার, হাবিবা কী করতো জানি! 

– একটা প্রাইভেট হাসপাতালের নার্স ছিলো। 

– রয়েল লরেন্স হাসপাতাল, তাই না! 

– হমম।

– ওর কোন বন্ধু, অথবা বান্ধবীর কাছ থেকে কী এমন কোন তথ্য পাওয়া গেছে ? মানে কোন ছেলের সাথে রিলেশনে ছিলো, বা এমন কিছু ? 

– না। ওহোহো, রিয়াদ। একটা জিনিস তোমাকে বলা হয়নি। হাবিবার খুব কাছের বন্ধু মারিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাবিবা হারিয়ে যাওয়ার ২ দিন পর থেকে বলে মারিয়া নিখোঁজ। আমার তো মনে হয় এই মারিয়াই হাবিবাকে মেরে গা ঢাকা দিয়েছে।

– দুইজনই কী একই কলেজের ছিলো ? 

– হ্যা। একই কলেজে, সাথে একি হাসপাতালেও নার্সের চাকরি করতো। 

– আচ্ছা হাবিবার পরিবারকে ফোনে কোন হুমকি, বা এমন কিছু দেওয়া হয়েছিলো? 

– না। এমন কিছু হয়েছে বলে তার পরিবার আমাদের জানায়নি।

– তারা দুইজন কী একি হোস্টেলে থাকতো ? 

– হ্যা। দুইজনই একই হোস্টেলেও থাকতো। 

রিয়াদ কিছুটা চুপচাপ হয়। কিছু ভাবতে থাকে। ওসি ফাহাদ ফাইল থেকে চোখ সোজা করে রিয়াদকে একবার দেখে আবার ফাইলে তাকায়। রিয়াদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলে,

– স্যার, আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে মারিয়া হাবিবাকে খুন করেনি।

– কেনো? কেনো এই কথা মনে হলো তোমার? 

– কারণ, হাবিবা মারিয়া গায়েব হওয়ার দুইদিন পর বলে গায়েব হয়েছিলো। সে যদি মার্ডারই করতো তাইলে সে সাথে সাথে গাঁ ঢাকা দিলোনা কেনো। 

– খারাপ বলোনাই। কিন্তু মারিয়ার উপর থেকে সব সন্দেহ একনিমিষে সড়িয়ে ফেলাও যায় না। হোস্টেলের বাকি মেয়েদের ভাস্যমতে মারিয়া আর হাবিবার ঝগড়া হয়েছিলো হাবিবার নিখোঁজের আগের রাতে। সবাই ভাবছে, হয়তো কোন ভালোবাসার মানুষ নিয়ে ঝগড়া, মানে একই ছেলেকে দুইজন ভালোবাসতো। এখন বাকিটা কদ্দুর কী, (চেয়ারে হেলান দিয়ে) তা কেস না শেষ হওয়া পর্যন্ত জানা যাবেনা। 

– হমম। আমাদের গ্রামেও এই দুইজনের কোন আত্মীয় নেই। না আছে কোন বন্ধু বান্ধবের বাসা। তারপরও যে কেনো হাবিবা আমাদের গ্রামে গেলো সেটা এখন পর্যন্ত রহস্য। 

– রহস্য তো সব কেসেই থাকবে। ব্যাপার না। (একটু থেমে টেবিলে থাকা একটা কলম হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে) তুমি তো ঐ থানার নতুন ওসি তাই না ?

– আনন্দ পুর থানা ? হ্যা আমি নতুন। ১ বছর হলো জয়েন করেছি। 

– কতগুলা কেস সলভ করেছো এই পর্যন্ত ? 

– এইতো স্যার, ৮ টার মতো। 

– কতগুলোর মধ্যে ৮ টা ? 

রিয়াদ মাথা নিচু করে। ধীর গলায় বলে,

– ১৪ টার মধ্যে। 

ওসি ফাহাদ মৃদু হাসে। বলে,

– এখনো কাঁচা আছো তাইলে। ১৪ টার মধ্যে ৮ টা। খুব খারাপ না, আবার মোটামুটিও না। (সোজা হয়ে বসে) এই কেস টা সলভ করো। দেখো কী পাও। তোমার উপর তো আর আমার মতো হাজার টা কেসের চাপ নেই, ধীরে ধীরে চাপ পড়লে,(মাথার চুল ধরে দেখিয়ে) এইযে চুল দেখছোনা! এইগুলার মতো সাদা হয়ে যাবে। হে হে হে!

ওসি ফাহাদ হাসতে থাকেন। রিয়াদ তার কথায় কিছুটা অপমানের গন্ধ পায়। তবে সে কিছু বলেনা। চুপচাপ থাকে। কথার উত্তর কথায় না, সে কাজে করে দেখাবে। হঠাৎ রিয়াদের ফোন বেজে উঠে। রিয়াদ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে তারেক ডাক্তার কল দিয়েছে। ওসি ফাহাদ তার পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবল তুহিনের সাথে কী যেনো নিয়ে কথা বলতে থাকে। রিয়াদের তাদের দিকে একবার দেখেই ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলে। ওপাস থেকে তারেক ডাক্তার বলেন,

– রিয়াদ, বিজি নাকি ? 

– না ভাইয়া। কোন আপডেট ?

– হ্যা। একটা বিষয় জানানোর ছিলো। ঐযে তুমি আজ সকালে এসে আমাকে একটা চুল দিয়ে গেলেনা! আর সাথে একটা রক্তের স্যাম্পল। ঐ দুইটার ডিএনএ ম্যাচ করেছে। 

– ম্যাচ করেছে! 

– হ্যা। দুইটার ডিএনএ ম্যাচ করেছে। 

– তারমানে ঐ মেয়েটা সুরাইয়া বেগমেরই ছোট মেয়ে! 

– কে সুরাইয়া বেগম? ঐযে কয়দিন আগে যে মা মেয়ে সহ খুন হলো ঐ সুরাইয়া বেগম? 

– হ্যা ভাইয়া। 

– কিন্ত উনার তো আর মেয়ে ছিলোনা‌।

– ভাইয়া আমি পরে গিয়ে তোমাকে সব বলছি। এখন একটু রংপুর এসেছি। থানায় আছি। 

– আচ্ছা ঠিক আছে পরে ফোন দিয়ো।

রিয়াদ ফোনটা কান থেকে নামায়। নামিয়ে পকেটে রাখে। ওসি ফাহাদের চশমাটা চোখ থেকে নাকের দিকে নামানো ছিলো। তিনি ঐ ভাবেই তুহিনের সাথে কথা বলার মাঝে রিয়াদের দিকে নজর দিয়ে বলেন,

– আরো নতুন কেস ? 

– না স্যার। তেমন কিছুনা। (একটু থেমে) আচ্ছা স্যার। এডভোকেট মশিউর রহমান। রংপুর জেলা দায়রা জজ আদালতে যে কর্মরত ছিলেন। উনার কেস ফাইল টা কী রংপুর থানায় পাওয়া যাবে ? 

– মশিউর রহমান? উনার কেস ফাইল তো মনে হয় আমার কাছেই আছে। কেনো ? 

– স্যার উনার স্ত্রী আর এক মেয়েকে খুন করা হয়েছে। সেই কেস টাও আমিই দেখছি। এই কেস ফাইলটাও একটু দেখতে চাইছিলাম। পুরোনো কোন শত্রু কিংবা মশিউর রহমানের মার্ডারের সাথে এই কেসের কোন সংযোগ আছে কি না তা একটু পর্যবেক্ষণ করে দেখতাম।

– উনার কেস টা তো আনসলভড ছিলো। খুনি কে তা শনাক্ত করা যায়নি। 

– তথ্য গুলা যদি এই কেসে কাজে লেগে যায় আরকি, ফাইলটার এক কপি দিলে ভালো হতো, আমি পরে এসে ফেরত দিয়ে যেতাম।

– হমম। আচ্ছা ঠিক আছে। (কনস্টেবলের দিকে ফিরে) স্টোর রুমে ২০০৯ এর সেলফে দেখতো। ফাইলের সামনে এডভোকেট মশিউর রহমান লেখা আছে।

– জী স্যার। দেখতাছি। 

কনস্টেবল তুহিন চলে যায়। রিয়াদ চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। ওসি ফাহাদ তার অন্য এক কেসের ফাইল টেবিলের কোন থেকে নিয়ে খুলে দেখতে থাকেন। রিয়াদ মনে সব মিলাতে চেষ্টা করে। হাবিবা আর মারিয়ার ঝগড়া হয়েছিলো হাবিবার লাশ পাওয়ার আগের দিন। তারপর পরের দিন রাতে গাইবান্ধা থেকে হাবিবার লাশ পাওয়া গেলো। আর তার দুইদিন পর থেকে মারিয়া নিখোঁজ! তাদের মধ্যে কি আসলেই কোন প্রেমিক নিয়ে কোন ঝামেলা হয়েছিলো? না অন্য কিছু আছে এর পিছনে ? “কাল আবার আসতে হবে এখানে। এসে হোস্টেলে গিয়ে বাকি মেয়েদের সাথে কথা বলতে হবে। তাদের দুইজনের কথা কিছু না কিছু তো শুনেছিলোই তারা।”

মনে মনে ভেবেই রিয়াদ ওসি ফাহাদকে বলে,

– স্যার। হাবিবা আর মারিয়া কোন হোস্টেলে থাকতো জানি ? 

– ওরা রংপুর পলিটেকনিক কলেজে ছাত্রী হোস্টেলে ভাড়া থাকতো। যদিও তারা এই ইনিস্টিটিউডের ছাত্রী ছিলোনা, তবুও তারা ওখানে কম দামে রুম ভাড়া নিয়ে থাকতো। ওখানকার ছাত্রী হোস্টেল পরিচালনাকারী আমাকে এইটুকুই বলেছে। 

– রংপুর পলিটেকনিক ছাত্রী হোস্টেল!!!

রিয়াদ অবাক হয়ে ভাবতে থাকে। সবকিছু যেনো একটা আরেকটার সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। এই পলিটেকনিকে তো আবার আফাজ পড়ে। যদিও ছাত্রী হোস্টেলের ভিতরে কী হয়, না হয় তা আফাজের জানার কথা না। তবুও, সব কিছু যেন একটা জালের মতো জড়িয়ে আছে। কোন এক খাদ্য জাল স্বরূপ!!!

 

_____

 

শাহারিয়ার গাড়ি এসে থামলো ‘বলাকা বিলাস’ এর সামনে। শাহারিয়া গাড়ি থেকে নামলো। চারপাশ অন্ধকার। শুধু বাড়ির গেইটের সামনে একটা বাতি জ্বলছে। এদিকটায় সেই বাতির আলোতেই কিছুটা দৃশ্যমান। 

শাহারিয়া গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকে। ড্রাইভার রুমানকে বলে দেয় কাল সময় মতো চলে আসতে ‌। রুমানও সম্মতি জানিয়ে চলে যায় গাড়ির ভিতর। গাড়ি স্টার্ট করে ব্যাকে নিয়ে যেতে থাকে। 

শাহারিয়া বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে ঢুকে, ঘাস বাগানের মাঝের সোজা সাদা অংশটা দিয়ে বাড়ির দরজার দিকে চলে যায়। আশপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার হালকা ডাক শোনা যাচ্ছে। সকাল থেকে বৃষ্টি হয়নি। উল্টো রোদ উঠেছিলো। তাই একটু আশপাশের শুস্কতা বেড়েছে। 

শাহারিয়া বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কলিং বেল বাজায়। তার এক হাতে অফিস ব্যাগ। আরেক হাতে পলিথিনে কী জানি এনেছে। দিথী দরজা খুলে দেয়‌। শাহারিয়া ভিতরে প্রবেশ করে। দিথীর এক হাতে খুন্তি ছিলো। পড়নে থ্রি পিস। ওড়নাটা উপরের দিকে পেঁচিয়ে কোমরে এনে গুজে রেখেছে। একদম পাকা গৃহিণীর মতো লাগছে তাকে। শাহারিয়া ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দিথীকে দেখে। তার বেশ ভালো লাগে তার বউকে এমন গৃহিণী রুপে দেখে। দিথী দরজা লাগিয়ে দেয়। শাহারিয়া এসে ড্রয়িং রুমের সোফার সামনে দাঁড়ায়। দিথী তার সামনে আসতেই দিথীর হাতে পলিথিনের প্যাকেট টা দেয়। দিথী হাতে নিয়ে অবাক চোখে খুলে ভিতরে দেখে। বলে,

– কী এটা? 

– জিলাপি। গরম গরম আছে‌। খায় দেখতে পারো। এইখানের বিখ্যাত জিলাপি। 

– জিলাপি আনছো! বাহ! আমারো খাইতে মন চাইতেছিলো। ভাবলাম ফোন করে বলবো। কিন্তু দেখি তুমিই নিয়ে আসছো। 

– হমম। 

শাহারিয়া সোফায় বসে। পায়ের মোজা খুলতে থাকে। মোজা খুলতে খুলতে নাকে সে কিছু একটা গন্ধ পায়। এই গন্ধ টা ঘরে ঢুকার সময় খেয়াল করেনি সে। শাহারিয়া এক পায়ের মুজা খুলে হাতে নিয়ে বলে,

– ঘরে পারফিউম দিছো ? 

– কেনো ? 

– ঘরে খুব কড়া একটা পারফিউমের স্মেল আসতেছে। 

দিথী জিলাপিতে একটা কামড় দিয়েই চোখ বুজে ফেলে। বিরবির করে বলে।

– একটু বেশিই মেখে ফেলছি মনে হয়!  

– মানে ? 

– কিছুনা। তুমিও খাও। নেও।

দিথী তার কামড় দেওয়া জিলাপি টাই শাহারিয়াকে দেয়। শাহারিয়া আরেক পায়ের মুজা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়ায়। বলে

– হাত ময়লা। হাত ধুয়ে আসি। 

– যাওয়া লাগবেনা। আমার হাত আছে কি করতে! 

বলেই শাহারিয়াকে নিজেই জিলাপি খাইয়ে দেয় দিথী। শাহারিয়া বেশ বড়সড় এক কামড় দিয়েই মুখ টেনে নেয়। খেতে খেতে বলে,

– গুড়ের জিলাপি অনেক দিন পর পাইলাম। 

– গ্রামেতো পাওয়াই যায়না মেলা ছাড়া। আমিও অনেক দিন থেকে খাইনি। গোসল করবা ? 

– না। রাতে গোসল করার অভ্যাস নাই আমার। এমনি হাত মুখ ধুয়ে নিবো।

– দাঁড়াও তোমার শার্ট টা খুলে দিচ্ছি। অনেক ঘামে গেছো। 

– আজকে দুপুরের পর থেকে যে গরম পড়ল! ঘামে একদম শেষ!

দিথী হাতের জিলাপির পলিথিন আর খুন্তিটা সোফার সামনের টেবিল টায় রাখে। হাতে থাকা বাকি জিলাপিটা মুখে পুরে দেয়। এসে শাহারিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তার শার্টের বোতাম গুলো খুলে দিতে থাকে। শাহারিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে মনে মনে বাহবা দেয়। ভাবে বউ আজকে এতো কেয়ারিং হয়ে গেলো যে! 

দিথী শার্টের সব বোতাম খুলে শার্টের দুই প্রান্ত ধরে খুলে দিতে যায় তখনই তার হাত শাহারিয়ার গাঁয়ে লাগে। শাহারিয়া মুখ দিয়ে মৃদু আওয়াজ বের হয়। বলে,

– আহহ্! আস্তে খুলো।

– কেনো ? শরীরে কোথাও ব্যাথা পাইছো নাকি! 

– আমার বুকের ছাতির অবস্থা তো শেষ। কামড় দিয়ে দিয়ে আর আঁচড় কাটে তো দাগ বসায় দিছো। 

– কী বলো! (একটু থেমে) কই দেখি।

বলেই শাহারিয়ার শার্টটা খুলে তার সেন্ডো গেন্জি টা উঠায়‌। দেখে শাহারিয়ার শরীরে কামড় আর আঁচড়ের দাগে লাল হয়ে আছে। দিথী তা দেখেই অবাক হয়ে একবার শাহারিয়ার দিকে তাকায় আবার তার শরীরের দিকে তাকায়। আঙ্গুল বাড়িয়ে শাহারিয়ার বুকের নিচের অংশে কামড় দেওয়া যায়গাটায় হালকা ছুঁতেই যেনো শাহারিয়া মৃদু লাফিয়ে উঠে‌। বলে,

– ধরিও না। খুব ব্যাথা!

– সরি, আসলে আমি তখন হুঁশে ছিলাম না। 

– তোমার নখ গুলো এতো লম্বা রাখছো ক্যানো। কাটে ফেলিও। নাইলে এইবার তো একদম চামড়া সহ সব তুলে ফেলবা। 

– সরি, আমি এখনি গরম পানি করে স্যাভলন মিশিয়ে যায়গা গুলো পরিষ্কার করে দিচ্ছি।

– এতো রাতে গরম পানি করার দরকার নাই‌। (একটু থেমে) কী জানি পুরার গন্ধ আসতেছে না!

– পুরার গন্ধ! ও পুরার গন্ধ!!! আমি রান্না ঘরে তরকারি বসায় আসছি। হায়হায়, গেলো গেলো গেলো, সব পুরে গেলো।

বলেই সোফার সামনের টেবিল থেকে খুন্তি হাতে নিয়েই দৌড় লাগায় রান্না ঘরের দিকে‌। শাহারিয়া মৃদু হাসে।  দিথী এখনো যেন ছোটই আছে‌। একদম বাচ্চাদের মতো তিড়িংবিড়িং করতেছে। 

শাহারিয়া হাতের মুজা গুলা ঝেড়ে নেয়। তার খুলে রাখা শার্টটা আর ব্যাগটা সোফা থেকে হাতে নেয়। চলে যেতে থাকে সিড়ি বেয়ে উপরের ঘরে। ড্রয়িং রুম আবার নিস্তব্দ হয়ে রয়।

 

______

 

১৯ জুলাই ২০০৬

 

আষাঢ়ের শেষ সময় হলেও বৃষ্টির ধারা এখনো মুষলধারেই পড়ছে। তিতাস কমিউটার ট্রেন। ট্রেন টা রংপুর থেকে দিনাজপুর যাচ্ছে। ট্রেনের বগি গুলো প্রায় ফাঁকা। কোন কোন বগিতে ২-৩ জন দেখা যাচ্ছে, তো কোন বগি সম্পূর্ণ ফাঁকা। বাইরে বেশ জোড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ট্রেন টা কিছুক্ষণ আগে চিলাহাটি স্টেশন পাড় হয়ে এলো। ‘ট’ বগিতে থাকা ৫ জনের মধ্যে ৩ জনই সেখানে নেমে গিয়েছে। ট্রেনের ভিতরে দুটো মাত্র লাইট জ্বলছে। তাও আবার বগির মাঝামাঝিতে। সেই আলোয় বগির প্রায় শেষাংশে বসে থাকা মশিউর রহমান ও তার কোলে থাকা ৩ বছর বয়সী মেয়ে আয়েশাকে ঝাঁপসা ভাবেই দেখা যাচ্ছে। এদিকটায় আলো বেশি আসছে না। জানালার কাঁচ নামিয়ে দেওয়া। বাইরে মাঝে মাঝে বিজলী চমকিয়ে উঠলে মশিউর রহমান জানালার এপাশ থেকেই সেই গর্জন করে উঠা আকাশ দেখছেন। কোলে আয়েশা ঘুমিয়ে রয়েছে। মশিউর রহমান রংপুর থেকে দিনাজপুর যাচ্ছিলেন, তার স্ত্রীর কাছে। তার স্ত্রীর নাম সুরাইয়া পারভীন নোভা। তাদের বিয়ে হয়েছে হলো ১০ বছর। তার এক মেয়ে আলিশা রহমান হিমি এখনো তার মায়ের কাছেই আছে। আর মশিউর রহমান তার ছোট মেয়ে আয়েশাকে নিয়ে এসেছিলেন তার বাসায়। মানে আয়েশার দাদু বাসায়। আয়েশা প্রথম ২ সপ্তাহ মা ছাড়া থাকলেও এখন খুব কাঁদে, সারাদিন তার মা’কে খুঁজে ফিরে। তাই আয়েশাকে নিয়ে আজই দিনাজপুর যাবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি। মশিউর রহমান হাত ঘড়ি উঠান। দেখেন রাত ১০ টা ৪৫ বাজে। পৌছাইতে পৌছাইতে হয়তো রাত সাড়ে ১১ টা বাজতে পারে। মশিউর তার কোলে থাকা ঘুমন্ত আয়েশাকে দেখে। ঘুমালে এই ছোট্ট পরীটাকে দারুন সুন্দরী লাগে। আয়েশা একদম তার মতো হয়েছে। মুখের গঠন, গাঁয়ের রং সবই তার পেয়েছে। হাঁটতে শিখেছে আয়েশা। বয়স যদিও ৩। তাও কিছুটা হাঁটতে পারে। মশিউর আয়েশাকে কোলে আরো ভালোভাবে নিয়ে কাঁথাটা ঠিক করে দেন। কমিউটার ট্রেন গুলার সিট বেশ শক্ত।তাই আয়েশাকে তার কোলেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন। বগিতে শুধু এখন তারাই অবশিষ্ট রয়েছে। বগিটা মাঝে মাঝে একটু বেশিই দুলে উঠছে মনে হয়। ট্রেন পূর্ণ গতিতে চলছে, তার উপর ফাঁকা বগি, তাই হয়তো এমন হচ্ছে। হঠাৎ মশিউর কিছু মানুষের বুট জুতোর শব্দ পান। তিনি চকিতে সামনে মুখ তুলে তাকান। ৩-৪ জন মুখে রুমাল বাঁধা ছেলে সামনের বগি থেকে এই বগিতে ঢুকেছে। সিট বাই সিট চেক করে করে আসছে। বগির মাঝে জ্বলতে থাকা আলোয় শেষ প্রান্তে বসে থাকা মশিউরকে তারা হয়তো দেখেনি। মশিউর কিছুটা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ছেলে গুলাকে দেখে তার ভালো লাগছে না কেনো জানি। ছেলে গুলা আস্তে আস্তে সিট বাই সিট চেক করতে করতে মশিউরের সামনের সিট পর্যন্ত চলে আসে। মশিউর আয়েশাকে ভালোভাবে কোলে নিয়ে আয়েশার ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো একসাথে করে রাখে। ছেলেগুলো তার সিটের সামনে চলে আসে। এসে তাকে কিছুক্ষণ দেখে। মশিউর মাথা নিচু করে আয়েশার দিকে চেয়ে ছিলো। তার কেনো যানি কিছু গরবর মনে হচ্ছিলো। ভয়ও লাগছিলো। তিনি একহাত উঠিয়ে চোখের হালকা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করেন। ছেলে গুলোর মধ্যে একটা ছেলে বলে উঠে,

– এইযে, এইদিকে তাকান। 

মশিউর ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়। ছেলেরা মশিউর কে দেখে বলে।

– ছবিডা বাইর কর তো। মনে তো হইতাছে এইডাই।

– ছবি দেহার কী দরকার। ডিরেক্ট ধর না।

– এই আপনারা কারা ? (মশিউর)

– তোরে কইছি ছবি বাইর করতে ছবি বাইর কর। যারে মারতে কইছে হেয় ছাড়া আর কারো যেনো কিছু না হয় এইডাও কিন্তু কইয়া দিছে। ছবি মিললে তারপর বাকি কাম। (২য় ছেলেকে বলে ১ম ছেলে)

– আ, আপনারা এসব কী বলছেন ? আপনারা কারা ? কী চান ?

– একদম চোপ। কোন কথা কবিনা।

তিনজনের মধ্যে একজন ছেলে তার পকেট থেকে একটা ছবি বের করে। তারপর ছবিটা সামনে ধরে মশিউরের চেহারার সাথে মিলায়। মশিউরের ঘাম ঝড়ছিলো গাল বেয়ে। ও বুঝে উঠতে পারছিলো না এরা কীজন্য তার কাছেই এসেছে। ছবির সাথে চেহারা মিলায় ছবি ধরে থাকা ছেলেটা বলে,

– বস, এই হালায়ই মশিউর। 

– তাইলে দেরি করতাছোস ক্যা। গান ডা বাইর কর। 

– এই আপনারা কী বলতেছেন! কীসের গান ? 

দুইজন ছেলে মশিউরকে ধরে। তাকে সিট থেকে উঠায়। মশিউর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। তার হাত থেকে ঘুমন্ত আয়েশার দেহ ফ্লোরে পড়ে যায়। আয়েশার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কেঁদে উঠে। ছেলেদের মধ্যে একজন বলে উঠে,

– আগে বাচ্চা ডারে মারমু না লোকটারে ? 

– তোরে অত ভাবতে কইছি ? তাড়াতাড়ি গুলি চালা।

– আমারে ছাড়ো। কে তোমরা। ছাড়ো আমাকে। 

– তোরে উপরে পাডাইতে আইছি। চুপচাপ আল্লা-বিল্লা কর। এই মাসুদ গুলি চালা। 

মশিউর সব বুঝে যায়। তাকে আর আয়েশাকে মারতে এসেছে এরা। মশিউর প্রাণ পনে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। যেই দুইজন তাকে ধরেছিলো তারাও যেনো মশিউরের সাথে সহজে পেড়ে উঠছিলো না। ট্রেন সজোরে চলছে। নিচে আয়েশা কাঁদছে। পরিস্থিতি যেন বিভীষিকাময় হয়ে উঠে। তখনই মশিউর তার হাতের কনুই দিয়ে এক ঝটকায় একজনকে সিটের উপরে ফেলে দেয়। হাত দিয়ে ঘুষি দিয়ে আরেকজনকে আরেকপাশের সিটের উপরে ফেলে দেয়। সামনে গুলি ধরা লোকটা চিৎকার করে থামতে বলছিলো। নাইলে সে গুলি চালিয়ে দিবে। তখনই মশিউর তার সিট থেকে ব্যাগ টা নিয়ে জোড়ে ছুরে মারে গুলি ধরে থাকা লোকটার উপর। লোকটার হাত থেকে বন্দুক পড়ে যায়। মশিউর তাড়াতাড়ি করে নিচে পড়ে থাকা আয়েশাকে কোনমতে কোলে নিয়ে জোড়ে ছুটতে থাকে। পিছন থেকে সেই তিনজন ছেলে আবার একসাথে উঠে দাঁড়ায়। যেই ছেলেটা গুলি ধরে ছিলো তাকে বাকি দুইজন গালাগাল দিয়ে নিচ থেকে বন্দুক তুলে মশিউরের পিছনে দৌড় লাগায়।

 

মশিউর প্রাণ পনে ছুটছে বগির মাঝ দিয়ে। এক বগি পার করে আরেক বগিতে চলে আসে। সে ছুটছে। পিছন থেকে সেই তিনজনের লিডার গুলি ছুড়ছে। গুলি এসে লাগে এক সিটের কোনায়। আবার গুলি ছোড়ে গুলি এসে লাগে আরেক সিটের হাতলে। মশিউর প্রাণপনে ছুটছে আর ছুটছে। সে আরেকটা বগিতে চলে আসে। সেই তিনজন বেশ পিছিয়ে পড়েছিলো মশিউরের সাথে দৌড়ে। মশিউর দুইবগির মাঝখানের অংশে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার দিকে তাকায়। তার কি করা উচিত তার মাথায় কাজ করছে না। সে নিজে না বাঁচুক, অন্তত তার ছোট্ট মেয়ে আয়েশাকে ও বাঁচাতে চায়। তখন সে দেখে পরের বগির শুরুতে বাথরুম আছে। মশিউর দ্রুত সেই বাথরুমের কাছে যায়। গিয়ে আয়েশাকে বাথরুমের ফ্লোরে কাঁথা সহ শুইয়ে রাখে। তার কপালে একটা চুমু দেয়। মশিউরের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আয়েশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

‘ বড় হয়ে তোর বাবার খুনিদের খুঁজে বের করিস মা। তাদের শাস্তি দিস। তোকে তোর মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারলাম না আমি, পৌছে দিতে পারলাম না। ‘

তখনই তার কানে সেই তিনজনের দৌড়ে আসার শব্দ কানে আসে। মশিউর তার মেয়েকে শেষবারের মতো চুমু খেয়ে অশ্রু ভেজা চোখ নিয়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। ভিতরে ৫ বছরের ছোট্ট আয়েশা কাঁদছিলো। মশিউর তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেড়িয়ে বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয়। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে। তার শার্ট খুলতে থাকে। ফুল হাতা শার্ট খুলে এগিয়ে যেই বগিতে বাথরুম নেই সেই বগির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সে জানে একজন নিরস্ত্র কখনোই সেই অস্ত্র সজ্জিত মানুষগুলোর হাত থেকে বাঁচতে পারবেনা। সে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সেই তিনজন এই বগিতে চলে আসে। তারা গুলি তাক করে ধরে মশিউরের উপর। মশিউর তখনই তার শার্ট টা হাতে মুড়িয়ে গোল করে তার দুইহাতে এমন ভাবে ধরে যেনো কোলে আয়েশা আছে। আর তখনই সে ট্রেনের দরজা দিয়ে সেটা বাইরে ফেলে দেয়। চিৎকার করে বলে,

– মাফ করে দিস মা। তোকে আমি নিজ হাতে ফেলে দিলাম। আমি তোর ঝাঝড়া শরীর কিছুতেই দেখতে পারতাম না, কিছুতেই না। 

তখনই সেই ছেলেদের ছোড়া গুলি এসে লাগে মশিউরের গায়ে। ছেলেরা অনবরত গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসে। গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় মশিউরের শরীরে। তার সাদা সেন্ডো গেন্জি রক্তে রক্তাক্ত হয়ে যায়। ধপ করে লুটিয়ে পড়ে তার দেহ‌। মশিউর সেখানেই মারা যায়। তিনজন গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় মশিউরের লাশের সামনে। মশিউরের শরীরে আরো গুলি করে। তখনই তাদের লিভারের পাশে দাঁড়ানো এক ছেলে বলে,

– বস মাইয়াডারে অয় বাইরে ফালায়া দিলো! 

– তাই তো দেখলাম। যাই হোক। ঐডায় বাঁচবো নাকি। কাইল দেখবি ঐডা নিচে পইড়া আরো খারাপ ভাবে মরছে। 

– আইচ্ছা বস ঠিক আছে। 

তখনই আয়েশার কান্নার আওয়াজ তাদের ৩ জনের মধ্যে একজন মৃদু ভাবে শুনতে পায়। তার মনে হচ্ছিলো যে খুব দূর থেকে কোন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসছে। সে তার লিডার কে এই কথা বলতেই যাবে, তখনই দেখে অপর বগি থেকে ট্রেনের টিটি সহ কয়েকজন দৌড়ে এদিকেই আসছে। তা দেখেই লিডারের পাশের জন বলে উঠে,- বস, কয়েকজন এদিকেই আইতাছে। ওগোরেও গুলি কইরা ঝাঝড়া কইরা দেন।

– চুপ,,,। স্যার কইছে শুধু এই দুইজনরেই মারতে, আর কারো শরীরে একটা টোকাও যেন না পরে। তাড়াতাড়ি দৌড়া, এগো হাতে ধরা দেওয়া যাইবোনা। তাড়াতাড়ি দৌড়া।

বলেই লিডার দৌড়ে বগির যেইদিকটা দিয়ে এসেছিলো সেইদিকে দৌড়াতে থাকে। লোকজন রাও দৌড়ে এগিয়ে আসে। ৩ জন ছেলে দৌড়ে যাওয়ার আগে মশিউরের রক্তাক্ত দেহ লাথি দিয়ে ট্রেনের দরজা দিয়ে গড়িয়ে বাইরে ফেলে দেয়। চলন্ত ট্রেন থেকে তা পড়ে যায় বাইরে। 

লোকেরা দৌড়ে এসে এখানে শুধু রক্ত ছাড়া আর কিছুই পায়না। তারা আবার দৌড়ে সেই ছেলে গুলোকে ধাওয়া করতে করতে ছেলেরা যেইদিকে গেছে সেদিকেই চলে যায়। তারা তাড়াহুড়োয় থাকায় আয়েশার কান্না আওয়াজ শুনতে পায়নি। বগি গুলো একদম জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে রয়। আর কেউ এই বগির পাশ দিয়ে যায় নি সেই রাতে। লোক গুলো ছেলেদের ধরতে পারেনি। ছেলেরা কোন বগিতে গিয়ে যে লুকিয়েছিলো, না কি করেছিলো তা তারা আর জানতে পারেনি। 

ট্রেন এখন একটা ছোট্ট ব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছে। বাইরের বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে। আয়েশার কান্নার আওয়াজও কিছুটা কমে এসেছে। ট্রেন ছুটে চলে যায় তার গন্তব্যের পানে!!

 

পরদিন সকালে,,,

 

তিতাস কমিউটার ট্রেনটা দিনাজপুর রেলস্টেশনের ৪ নং প্লাটফর্মে দাড়িয়ে আছে। এই ট্রেন টা আবার এখান থেকে সন্ধায় রওনা দিবে। এখন সকাল ৯ টা। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে তাই পরিবেশ টা একটু সতেজ। হালকা রোদও উঠেছে। এই প্লাটফর্ম টায় এখন লোকজনের যাতায়াত নেই। এইসময় সবাই ব্যাস্ত ১ আর ২ নং প্লাটফর্মে। 

ট্রেনের বগির নিচে নিচে খাবার খুঁজে ফিরছে জরিনা পাগলি। এই স্টেশনেই থাকে সে। মাথার চুল গুলো উসকোখুসকো। পড়নে ছেঁড়াফাটা একটা জামা। গাঁয়ে একটা চাদর জড়ানো। সেটাতেও শ’খানেক ফুটো। প্রতিদিন সে থেমে থাকা লোকাল, ইন্টার সিটি ট্রেন গুলাতে আসে। যাত্রীরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন আধ খাওয়া খাবার বা প্যাকেট ফেলে যায়। 

জরিনা পাগলি সেসব সংগ্রহ করে তার খুদা মিটায়। তার কাঁধে থাকা পুঁটলিতে করে সেগুলো নিয়ে যায়। সে একের পর এক সিটের নিচ খুঁজে খুঁজে আসছে। এক হাত দিয়ে মাথার উসকোখুসকো চুল চুলকাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে বগির শেষ প্রান্তে চলে আসে। তখনই তার ‌কানে আসে এক বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। পাগলীটা প্রথমে তা গুরুত্ব দেয় না। সে বগির শেষ সিট গুলার নিচের খাবার খোঁজে, কিন্ত পায় না। সে এই বগি খোঁজা শেষ করে পড়ের বগিতে যাওয়ার জন্য পা চালায়। সে একটু খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটছিল, যেনো তার পায়ে কেউ মেরেছে। সে বগির দরজার সামনে পড়ে থাকা মশিউরের রক্ত মারিয়ে সামনের বগিতে চলে যায়। সে এই বগিতে ঢুকার পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ তার কানে আরো ভালোভাবে আসে। বাচ্চাটা কাঁদছিলো আর আম্মু, আম্মু বলে ডাকছিলো। পাগলী টা বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কান পাতে দরজায়। কান্নার শব্দটা ভিতর থেকে আসছে। পাগলিটা সবসময় হাসিখুশি থাকে। এখনো তার মুখে হাসি। মাথা চুলকাতে চুলকাতে আরেক হাত দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ছিটকিনিটা শক্ত থাকায় সে পারেনা। সে ভাবে কে না কে কাঁদছে, তার দেখার কি আছে। সে চলে যেতে নেয়। কিন্তু আবার কী যেনো মনে করে দরজার সামনে আসে। এইবার মাথা চুলকানো বাদ দিয়ে দুই হাত দিয়ে দরজার ছিটকিনি খোলার চেষ্টা করে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর সে খুলতে পারে। দরজা খুলে ভিতরে তাকায়, দেখে একটা ছোট বাচ্চা কাঁদছে। তার শরীর কিছুটা ভিজে ছিলো। কাঁথা থেকে সে বাথরুমের ফ্লোরে উবুড় হয়ে কাঁদছিলো। জরিনা পাগলি হেলে বসে। একহাত দিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে আবার। আরেকহাত দিয়ে বাচ্চা মেয়েটাকে উবুড় থেকে চিৎ করে শোয়ায়। মেয়েটা ফুলের মতো সুন্দর ছিলো। গুলুমুলুও ছিলো কিছুটা। ছোট্ট মেয়েটার কান্না দেখে পাগলীর কেমন জানি লাগে। তার মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠে। পাগলীটা ছোট্ট মেয়েটার পেটের কাপড়টা ঠিক করে টেনে দেয়। বলে,

– এই মাইয়া, কানতাছো ক্যা, তোমার খিদা লাগছে! এই মাইয়া! 

আয়েশা ছোট্ট হওয়ায় সে শুধু আম্মু আর আব্বু কথাটা ছাড়া কিছুই বলতে পারেনা। সে শুধু কাঁদছে। পাগলীটা তার পোটলাটা কাঁধ থেকে নামায়। সেখান থেকে তার কাল রাতে রেখে দেওয়া আধ খাওয়া পাউরুটি টা আয়েশার কান্নারত মুখের সামনে ধরে। বলে,

– খাইবা! এই রুটিডা অনেক মজা। 

আয়েশা এখনো কাঁদছিলো। বারবার আম্মু,আম্মু করছিলো। পাগলীটা সেই রুটিটা আয়েশার মুখের সামনে থেকে নিয়ে নেয়। আয়েশা খাচ্ছে না। পাগলীটাই সেই আধখাওয়া রুটিতে একটা কামড় দিয়ে বাকি রুটি তার পোটলাতে রেখে দেয়। রুটি খেতে খেতে আয়েশাকে ধরে কোলে তুলে নেয়। নিচে পরে থাকা ভেজা কাথাটা তুলে ঐটা দিয়েই আয়েশাকে জড়িয়ে নেয়।বলে,

– কাঁন্দেনা, কাঁন্দেনা! কানলে তু্তু আইবো! কান্দেনা! 

আয়েশার কান্না তাতেও থামেনা। পাগলীটা আয়েশাকে নিয়ে চলে যেতে ধরে। আজ ও খাবার খুঁজতে এসে যা পেলো, তা হয়তো তার মনটাকে আরো ভালো করে তুলেছে। পাগলীটা আয়েশাকে কোলে ধরেই ট্রেন থেকে নেমে যায়।

 

প্লাটফর্মে,,,

 

পাগলীটা ৫ নং প্লাটফর্মে তার যায়গায় বসে আছে। এইখান টায় সে সহ আরো কিছু ভিক্ষুক আর পাগল থাকে। সবাই ছেঁড়া কাঁথা, বালিশ দিয়ে কোনমতে শোয়ার মতো যায়গা করে রেখেছে। জরিনা পাগলী তার যায়গায় আয়েশাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো। আয়েশা এখনো কাঁদছিল। পাগলীটা তার কান্না থামাবার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্ত আয়েশার কান্না থামেনি। পাগলিটাও চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। বারবার মাথা চুলকাচ্ছে। তখনই সেই প্লাটফর্মের পরিচ্ছন্ন কর্মী আবুল এসে তার সামনে দাঁড়ায়। সে পাগলীটাকে বলে,

– কীরে জরিনা, এই বাচ্চা ডারে কই পাইলি! 

– এইডা আমার বাইচ্চা। তুই যা এহান থে। 

– তোর বাচ্চা! তোর বাচ্চা কী আসমান থে আইলো! এই বাচ্চার বাপ কেডায়! 

– আমিই অর বাপ,আমিই অর মা! 

এই থেকে শুরু। জরিনা তারপর থেকে আয়েশাকে মানুষ করতে থাকে। সে সম্পূর্ণ ভাবে পাগলী ছিলনা। তার মাথা কিছুটা বিগরানো ছিলো বিধায় সবাই তাকে জরিনা পাগলি বলতো। বয়সও যে তার খুব একটা বেশি তাও না। এই ধরুন ২৫-২৬ এর মতো। জরিনা আয়েশার জন্য যেখান সেখান থেকে চুরি করে খাবার এনে খাওয়াতো। মাঝে মাঝে তো এরজন্য মারও খেতে হয়েছে তাকে। তবুও সে আয়েশাকে নিজের সন্তানের মতো করে বড় করতে থাকে। সে যেন আয়েশার মধ্যে এক আলাদা মায়া খুঁজে পেয়েছিলো। 

আয়েশাও ধীরে ধীরে বড় হয়। মায়ের সাথেই তারপর সে ভিক্ষা করতে থাকে। কোনদিন কোন এক প্যাসেন্জারের মুখে শম্পা নাম শুনেছিলো জরিনা পাগলি। তারপর থেকেই সে আয়েশাকে শম্পা বলে ডাকে। আর আয়েশাও নিজেকে শম্পা বলেই চিনে, আর জরিনাই যে তার মা সেটাই সে বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মানে। জরিনা খুব আগলে রেখেছিলো শম্পাকে। কোন পরাশক্তি শম্পাকে ছুঁয়েও দেখতে পারেনি। এভাবে করেই একের পর এক বছর অতিবাহিত হতে থাকে। শম্পা বড় হতে থাকে। চারপাশ বুঝে উঠতে থাকে। তার মা জরিনা ধীরে ধীরে অচল হয়ে পরে। শরীরে বাঁধে নানা রোগের বাসা। শম্পাই তখন ভিক্ষা করে, কুলির মতো প্যাসেন্জার দের মাল টেনে দিয়ে যে দু পয়সা পেতো, তা দিয়েই মা মেয়ে দিনানিপাত করতো। 

 

দেখতে দেখতে ২০২০ সাল চলে আসে। শম্পার বয়স এখন ১৪। প্রতিদিনকার মতোই তার মাকে রেখে গিয়েছিলো দু’টো পয়সা রোজগার করার জন্য। এক প্যাসেন্জারের মাল মাথায় নিয়ে ট্রেন অব্দি পৌছে দিচ্ছিলো। তখনই শুনতে পায় এক আত্মচিৎকার। তার মাথা থেকে ব্যাগটা পড়ে যায়। এক চলন্ত গতিশীল ট্রেনে তার মা কাঁটা পড়ে। শরীর খন্ড বিখন্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রেললাইনের চারপাশে। শম্পা সেদিন খুব কেঁদেছিলো। প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে সামলাতে পারেনি। চিৎকার করে সে ডেকে উঠেছিলো ‘ মা‌,,, মা,,, ‘ বলে। ছোট থেকে যাকে মা জেনে এসেছে, যার সান্নিধ্য বড় হয়েছে তার এমন খন্ড বিখন্ড লাশ শম্পার ভিতর টাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। তার মা নিজে থেকে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেয়নি। শম্পার প্রতি কুনজর দেওয়া কিছু ছেলে জোর করে তার মা’কে ধরে এনে ফেলে দিয়েছিলো চলন্ত ট্রেনের সামনে। তাদের সামনে এই একমাত্র বাঁধাই ছিলো শম্পা অব্দি পৌঁছানোর। এবং তারা এই বাঁধা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়। পুলিশ আসে। পাগলী নিজে থেকে ট্রেনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই ভেবে লাশ নিয়ে যায়। কেস ক্লোজ করে দেয়। শম্পা একা হয়ে যায়। একলা একলা সে অনেক কষ্টে দিন গুলো কাটায়। একদিন বৃষ্টি ভেজা বিকেলে সেই পিশাচ গুলো আসে শম্পাকে ভোগ করতে। সেদিন খুব বৃষ্টি ছিলো। শম্পা ঠান্ডায় গুটি সুটি হয়ে তাদের যায়গায় বসে ছিলো। মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় তেমন লোক ছিলোনা। সেই পিশাচ রুপি মানুষ গুলা চলে আসে শম্পা কাছে। শম্পা খুব ভয় পেয়ে ছিলো। তারা এসে শম্পাকে টেনে ধরে উঠায়। স্টেশনের পাশের জঙ্গলে নিয়ে যেতে চায়। শম্পা খুব কষ্টে তাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়াতে থাকে প্লাটফর্ম বরাবর। ছেলেগুলোও দৌড় দেয় তার পিছু। 

রাশেদ স্টেশনে এসেছিলো কাজ খুঁজতে। স্টেশনে পরিচ্ছন্নতা কর্মী লাগবে বলে সে শুনেছিলো। কিন্তু এখন এসে অফিস রুম থেকে শুনলো সেই পদে লোক নেওয়া হয়ে গিয়েছে। রাশেদ মন খারাপ করে সেই কক্ষ থেকে বের হয়। তখনই এক মেয়ে এসে তার বুকে ধাক্কা খেয়ে রাশেদকে নিয়ে পড়ে যায়। রাশেদ মেয়েটাকে ভালোভাবে দেখেনি। মেয়েটার মুখে কান্না কান্না ভাব। মেয়েটা রাশেদের কাছে সাহায্য চায় সেই লোক গুলার হাত থেকে। রাশেদ শম্পাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এদিকটায় আরো প্যাসেন্জার সহ লোকজন থাকায় সেই খারাপ ছেলেগুলো এদিকে আসার সাহস পায় না। চলে যায় তারা। রাশেদ শম্পার কাছ থেকে সবকিছু শুনে। ভাবে এখানে শম্পা একলা থাকা নিরাপদ নয়। তাই সে শম্পাকে বলে তাদের বাসায় যেতে। রাশেদ তার পরিবার সম্পর্কেও সব খুলে বলে। শম্পার মন প্রথম প্রথম কেমন করলেও পরবর্তীতে সে রাজী হয়। রাশেদ তাকে নিয়ে চলে আসে তাদের বাড়িতে। শম্পাকে উপহার দেয় একটা নতুন জীবন। যদিও শম্পা এখনো জানেনা যে সে কত বড় লোক ঘরের মেয়ে। তার অতীত তার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে বিধায় তার জীবন এতোটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তবে শম্পা এখনো তার মা’য়ের স্মৃতি হাতরে গভীর রাতে কাঁদে। মা হিসেবে তো সে জরিনা পাগলীকেই জানে। তাই এই পাগলি মা’টাকে নিয়েই কষ্টে কাঁদে। রাশেদ শম্পার থাকার জন্য তাকে আলাদা ঘর দিয়েছে। যেই ঘরে তার বোন রিয়া থাকতো, সেই ঘরটা। তবে সে শম্পাকে নিজের ছোট বোনের মতো বড় করতে চায়। তবে শম্পা যে দেখে তাকে অন্য চোখে। তা কী রাশেদ জানে!! হয়তোবা জানেনা। তবে সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলে যায়, হয়তো একদিন বদলাবে রাশেদ,শম্পার সম্পর্কটাও!! 

 

 চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( গল্প কেমন লাগছে? কোন কোন চরিত্রকে নিয়ে কী মনে হচ্ছে? জানাতে পারেন কমেন্টে।‌ কিছু চরিত্র এখন একটু অতিরিক্ত মাখানো লাগতে পারে, তবে সবকিছুই গল্পের জন্য করা। গল্পে যাই হবে, ধরে নিবেন এর পিছনে কোন না কোন রহস্য রয়েছে 😉। পরবর্তী পর্বেও আরেকটা রহস্য খোলাসা করে হবে‌। Stay tuned,,,)

 

গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৫

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৬ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

নিপা ব্যালকনির গ্লাসের উপর থেকে পর্দা সড়ালো। এক মুঠো রোদ্দুর এসে পড়লো ঘুমন্ত রায়হান মুখে। রায়হানের চোখের পাতা মৃদু নড়ে উঠে। নিপা পিছন ফিরে তাকায়। আলো তার মাঝে বাঁধা পেয়ে তাকে এই আলোর ছায়া মানবী করে তুলে। রায়হান উবুড় হয়ে শুয়ে ছিলো। পিঠের অর্ধেক পর্যন্ত কাঁথা তোলা। নিপার পড়নে নতুন শাড়ি। মাথার চুল ভিজা‌। হাতে গামছা‌। নিপা হেঁটে হেঁটে বিছানার কাছে আসে। রায়হানের মুখে আলো পড়লেও সে ঘুম থেকে উঠেনি। নিপা বিছানার পাশে এসে রায়হানকে নাড়িয়ে দিয়ে ডাকতে থাকে,

– এই, উঠো। (থেমে) রায়হান, উঠো।

রায়হান কিছুটা নড়ে উঠে, আবার চুপচাপ হয়ে যায়। অর্থাৎ আবার ঘুমাচ্ছে। নিপা এইবার আরো জোড়ে রায়হানকে নাড়িয়ে দেয়। বলে,

– এই বেদ্দপ ছেলে, উঠো। সকাল ১০ টা বাজে।

রায়হান নড়ে উঠে‌। ঘুম ঘুম গলায় বলে,

– কী শুরু করলা সাতসকালে। (উবুড় থেকে চিৎ হতে হতে) আমি আরেকটু ঘুমাবো।

– অনেক ঘুমাইছো। বেশি ঘুমাইলে ভুড়ি বাড়ে যাবে তখন। উঠো।

– তুমিও আসো, একসাথে ঘুমাই। (পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বুজে) কোন তো কাজ নাই। সারাদিন বসে বসে থাকার চেয়ে ভালো দুইজন মিলে ঘুমায় থাকি‌।

– হ্যা, আমার তো আর কাম-কাজ নাই যে সারাদিন তোমার সাথে ঘুমায় থাকবো। 

– কী কাজ আছে তোমার। সারাদিন তো আমার সাথে ঘরেই বসে থাকো। (একটু থেমে) সুবা, আসো তুমি আমি আরেকটা ঘুম দেই। 

– ঘুম না, মাইর দিবো মাইর। উঠো তাড়াতাড়ি। উফফ, এতো ভাড়ি ক্যান তুমি, ধরে সোজা করা যায় না।

– আমার শরীর কী তোমার মতো তুলার বস্তা! 

– হইছে উঠোতো। আজকে একটু ও বাড়িতে যাবো। উঠো।

– কোন বাড়ি। আমার শশুর বাড়ি ? 

– হ্যা। বাসা তো এখন প্রায় খালিই। ভাইয়ারা চলে গেছে। আমরাও তো সারাদিন বসে বসে থাকি। এরচেয়ে ভালো ও বাসা গিয়ে ঘুরে আসি। 

– আচ্ছা সে যাওয়া যাবেনে। এখন ঘুমাই।

তখনই দরজায় কারো কড়া নাড়ার আওয়াজে আসে। নিপা কিছুটা চমকেই উঠে। হঠাৎ কে আসলো! নিপা অবাক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

– কে ?

– আমি, আমি আঁখি। আপনাগো লাইগা নাস্তা আনছিলাম।

– আচ্ছা খুলতেছি, (রায়হানের দিকে ফিরে) ঐ যে নাস্তা দিতেও চলে আসছে। তোমার এখনো ঘুম ভাঙেনা।

 

নিপা চলে যায় দরজার কাছে। দরজা খুলে দেয়। ওপাসে আঁখি দাঁড়িয়ে ছিলো একটা ট্রে তে চা-নাস্তা নিয়ে। নিপা ট্রে টা আঁখির হাত থেকে নিয়ে নেয়। আঁখি রুমে একটু উঁকি মেরে বলে,

– ভাইজান অহনো উডে নাই! 

– তোর ভাইজানের ঘুমনেশা ধরছে। মাইর দেওয়া হয়নি তো, এইজন্য এক কথায় তাড়াতাড়ি উঠেনা। তুই নাস্তা খাইছিস ? 

– হ ভাবি। আমি খাইছি। 

– নিচ থেকে সকাল থেকেই কীসের শব্দ আসতেছে রে ? 

– নিচ থেইকা ? সোফা লড়াইতাছে। নতুন সোফা আনছে, ঐগুলি সেট করতাছে। 

– নতুন সোফা! 

– হ।‌ আইচ্ছা আমি গেলাম ভাবি। চুলায় রান্না বহাইয়া আইছি।

– আচ্ছা যা।

আঁখি চলে যায়। নিপা দরজা লাগিয়ে ভিতরে চলে আসে। ডেসিন টেবিলের উপর চা-নাস্তার ট্রে টা রাখে। নিপা এগিয়ে গিয়ে রায়হানকে আবার ধরে ডাকতে থাকে। তার হাত ধরে টেনে উঠাতে থাকে। 

– এই তুমি উঠলা! নাইলে কিন্তু গরম চা ঢালে দিবো তোমার উপর।

– সকাল সকাল যে তুমি কী শুরু করছো, উফফ। বিয়ের পর সকাল বেলা একদম ঘুমাইতে দেওনা।

রায়হান শোয়া হতে উঠে বসে। হাই তুলতে থাকে। নিপা এক কাপ চা নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে থাকার রায়হানের হাতে দেয়। আর রায়হানের মাথার দিকটা থেকে তার ফোনটা নেয়। রায়হান কোনমতে চায়ের কাপ,প্রিচ দুইহাতে ধরে ছিলো। নিপা দাঁড়িয়ে তার ফোনের ভিডিও ক্যামেরা অন করে রায়হানকে ভিডিও করতে থাকে। বলে,

– খাও খাও। চা’টা খাও।

– সকাল সকাল হাতে কাপ ধরায় দিলা! কোনদিন না প্লেট ধরায় দিয়ে বলো, যাও কয়টা টাকা নিয়ে আসো!

বলেই হাই তুলতে থাকে রায়হান। নিপা আবার তাকে চা খেতে বলতে থাকে। ঘুমে আলাভোলা হয়ে থাকা রায়হান চায়ে চুমুক দেয়। তার এক চোখ এখনো বন্ধ, আরেক চোখ আধখোলা। মনে হয় সারারাত নেশা-পানি খায়ে এখন মাতাল-মাতাল হয়ে আছে। নিপা রায়হানকে এমন অবস্থায় ভিডিও করতে থাকে, আর মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। রায়হান মুখে ছোট্ট একটা চায়ের চুমুক নেয়। আর সেই এক আধখোলা চোখ নিয়ে নিপার ভিডিও করার দিকে তাকায় বলে,

– চায়ে চিনি বরাবরের মতোই কম। সুবা, তুমি এক চুমুক দেওতো। তোমার ঐ বিশেষ চিনি ছাড়া এই চা বিস্বাদ।

– হইছে ধং! চায়ে চিনি হওয়া লাগবেনা তুমি এমনিই গিলো।

– বউ আমারে কী ভিডিও-টিডিও করতেছে। সকাল সকাল (হাই তুলতে তুলতে) চিনি ছাড়া কোন যে চা ধরায় দিছে।

নিপা হাসতে থাকে। রায়হানের এমন ঘুমে আলাভোলা হয়ে থাকা কথা গুলো তার সেই মজার লাগে। রায়হান ওভাবেই বসে কোনমতে চায়ে চুমুক দেয়। আর নিপা কিছুদূরে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে ভিডিও করতে থাকে।

 

    অন্দরমহলে কাজ করছে কয়েকজন লোক। তাদের মধ্যে দুইজন পুরান সোফাটা ধরে নিয়ে যেতে থাকে। তাদের সব কাজ তদারকি করছিলেন নজরুল সাহেব। সেই কাজ করা লোক গুলোর মাঝে লালু,সালুও আছে‌। লালু সালু যেই ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতো সেই দোকান থেকেই নজরুল সাহেব নতুন সোফা কিনেছেন। অবশ্য আগে অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন। আজ সেই সোফা গুলা লালু,সালু সহ আরো কয়েকজন ডেলিভারি দিতে এসেছে। লালু কার্পেট উঠিয়ে সোফা রাখার যায়গাটা ঝাড়ু দিচ্ছে। সালু বাইরে গেছে বাকি কয়েকজনের সাথে নতুন সোফা ভিতরে আনতে। লালু ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে সব ময়লা গুলো সাইড করে রাখে। দরজা দিয়ে সালু আর ২-৩ জন মিলে নতুন সোফাটাকে ভিতরে আনতে থাকে। এইটা ৩ জনের বসার সোফা। বেশ ভারি। লালুও কিছুটা এগিয়ে যায়। তাদের সাথে হাত লাগায়। নজরুল সাহেব দূরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, খুব সাবধানে এনে রাখতে। জোড়ে যেনো না রাখে।বাকিরাও সেই অনুযায়ী কাজ করে। সোফার যায়গায় এনে সোফাটাকে খুব আস্তে করে নামিয়ে রাখে। যায়গা অনুযায়ী টেনে টুনে বসাতে থাকে। তখনই উপর থেকে সিড়ি বেয়ে নেমে আসে রাফসান। পড়নে ধূসর রঙের শার্ট, আর কালো প্যান্ট। এদিকে কাজ করতে করতে সালু এক পলক সিড়ির দিকে দিয়েই আবার কাজের দিকে তাকায়। তখনই আবার অবাক হয়ে সিড়ির দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে রাফসানকে দেখতে থাকে। রাফসান উপর থেকে নেমে এসে নজরুল সাহেবের পাশে দাঁড়ায়। লালু, সালুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার হাতে মারে, বলে কাজে হাত লাগাতে। সালুও লালুর সাথে কাজে হাত লাগায়। 

 রাফসান তার বাবাকে বলে,

 – নতুন সোফা! 

 – হমম। 

 – আগের গুলা কী করবা।

 – ঐগুলা বাদ। ঘুন খাইছে। সেই পুরানা আমলের জিনিস। আর কতো থাকবে। নতুন গুলা কেমন হইছে!

 – ভালোই। 

 – তোর ঘরের বিছানা বদলাবি ? 

 – না। যেইটা আছে ঐটাই ভালো। 

 – আমার ঘরের আর তোর শাহেদ চাচ্চুর ঘরের টা আজ বদলে নিবো। ঐ গুলাও পুরান হয়ে গেছে। 

 – ভালো, বদলাও। আসবা কখন ? 

 – কোথায় ? 

 – দিনাজপুরে।

 – দুপুরের পরে যাবো। তুই যা। তোর চাচ্চু আছে। নতুন বায়ার আসার কথা। মাল পছন্দ হইলে ডিল ফাইনাল করে ফেলবি। দাম ২ এর নিচে কমাবি না।

 – ঠিক আছে। গেলাম আমি। 

 – যা।

রাফসান চলে যেতে থাকে। সালু কাজ করতে করতে আবার রাফসানের যাওয়ার দিকে তাকায়। রাফসানকে যেনো তার খুব চেনা চেনা লাগছিলো। এই শরীর, এই প্যান্ট, আগে কোথায় যানি সে দেখেছে। তখনই নজরুল সাহেবের কথায় তার ঘোর ভাঙে।

– উত্তরের দিকে একটু বাড়ায় দেও। দক্ষিণে ঠিকঠাক আছে। 

সালু কথা শুনেই সেইদিক থেকে চোখ সড়িয়ে নেয়। সোফা টেনে নজরুল সাহেবের কথা অনুযায়ী দিতে থাকে। 

উপরের ঝাড় বাতিটা হালকা বাতাসে মৃদু নড়ে উঠে। উপর থেকে নিচে থাকা নজরুল সাহেব আবার বাকিদের পাখির চোখে বেশ‌ ভালোই দেখা যাচ্ছে। 

 

_____

 

রংপুর পলিটেকনিক ছাত্রী হল। সময় এখন সকাল ১১ টা। এইদিকটায় রোদ উঠেনি। আকাশ কিছুটা মেঘলা। মাঝে মাঝে জোড়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। 

রিয়াদ রুম নং ২১২ থেকে বেড়োলো। এই রুমেই হাবিবা আর মারিয়া ভাড়া নিয়ে থাকতো। রিয়াদের সাথে এখান কার স্থানীয় থানার দুইজন কনস্টেবলও রুম থেকে বের হয়। রুমটা দোতলায়। রুমের সামনে বারান্দায় বেশ কয়েকজন ছাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার পড়েই হালকা গ্রীল। সেই দিয়ে বাইরের দৃশ্য যেমন উপভোগ করা যায় তেমনি আলো বাতাসও ভিতরে আসে। 

রিয়াদ রুম থেকে বেড়িয়েই এই হলের পরিচালককে খুঁজতে থাকে,

– হল পরিচালনার দায়িত্বে কে আছে ? 

মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন মধ্যবয়সী মহিলা এগিয়ে আসে। রিয়াদের সামনে দাঁড়ায়। বলে,

– আমি। আমিই দেখাশোনা করি।

– ওরা এই পলিটেকনিকের ছাত্রী না হওয়ার পরও এখানে কীভাবে থাকতো ?

মহিলাটা মাথা নিচু করে। মিনমিনে গলায় বলে,

– ন,না মানে স্যার। ওরা ভাড়া দিয়ে থাকতো। 

– এইটা কী আবাসিক হোটেল? যে বাইরের লোক ভাড়া দিয়ে থাকবে! 

– স,স্যার এই রুমের ছাত্রী চলে গেছে। ফাকাই পড়ে ছিলো। তাই আরকি,,, (বলেই চুপচাপ হয়ে যায় সেই মহিলাটা)

– ওদের মাঝে যে ঝগড়া হইছিলো এই তথ্যটা কে দিছিলো ? 

ভিড়ের মাঝে এক ২০-২১ বছর বয়সী মেয়ে হাত তুলে এগিয়ে আসে। মুখে কিছুটা ভয়ের ছাপ। রিয়াদের সামনে এসে দাঁড়াতেই রিয়াদ বলে,

– তোমার নাম ? 

– সন্জি, সন্জি আক্তার।

– এই পলিটেকনিকেই পড়ো ? 

– জ,জী হ্যা। সিভিল ইন্জিনিয়ারিং, ৬ষ্ঠ সেমিস্টার। 

– মারিয়া আর হাবিবা কতদিন ধরে এখানে থাকতো ? 

– প্রায় ১ বছর। 

– এতোদিন! তুমি ওদের পাশের রুমের কেউ ? 

– জী হ্যা। 

– ওদের সাথে কেউ দেখা করতে আসতো ? মানে কোন ছেলে বা এমন কেউ ! 

– না। ছাত্রী হলে ছেলেদের আসা নিষিদ্ধ। ছেলেদের গেট থেকেই বিদায় করে দেওয়া হয়। 

– তাইলে কোন মেয়ে ? 

– না। ওরা সবসময় এক ঘরে হয়ে থাকতো। বাকিদের সাথে তেমন একটা কথা বলতো না। 

– রান্না বান্নাও নিজেরাই করতো। ভিতরে স্টোভের চুলা দেখলাম।

– হ্যা। 

– হাবিবা যে প্রেগন্যান্ট ছিলো, তা তোমরা জানতে না ? 

– ও প্রেগন্যান্ট ছিলো!! 

মেয়েটা সহ উপস্থিত বাকিরা বেশ অবাক হয়। একে অপরের সাথে বিরবির করে কথা বলতে থাকে। রিয়াদ তাদের থামতে বলে। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে বলে,

– হাবিবা ৭ মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো, আর তোমরা বলতেছো জানোনা! মেয়েটাকে এমনিতে দেখলেই তো যে কেউ বলবে পেটে বাচ্চা আছে। 

– স্যার। হাবিবা বিগত ৫-৬ মাস থেকে ঘরেই থাকতো। ও বাইরে বের হতো না। মারিয়াই অফিস যেতো, আর দিন শেষে ফিরতো।

– এদের দুইজনের মাঝে আবার লেসবিয়ান টাইপ কোন বিষয় ছিলো নাকি! 

– না না স্যার। এমন কিছুই ছিলোনা। মারিয়া নামাজ পড়তো, পর্দা করতো। 

– হমম। আচ্ছা তো তাদের মাঝে কী নিয়ে ঝগড়া হয় ? মানে তোমরা কোন কথা বা এমন কিছু শুনতে পেয়েছিলে ? 

– না স্যার। মারিয়া আর হাবিবা বেশ ভালোই বন্ধু ছিলো। তাদের মাঝে ঝগড়া তেমন একটা হতো না।‌ তবে ঐদিন তাদের রুম থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পাই আমরা। ঘর থেকে বের হয়ে এদিকে আসতে আসতেই দেখি মারিয়া ঘর থেকে হনহন করে বেড়িয়ে চলে যাচ্ছে। আর তখনই ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেওয়ার শব্দ।

– তারমানে হাবিবা দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলো। আর তোমরা ভিতরে যেতে পারোনি।

– না স্যার। আমরা আর ভিতরে যেতে পারিনি। অবশ্য কয়েকবার দরজা ধাক্কিয়ে ছিলাম, কিন্তু ভিতর থেকে হাবিবা বলে চলে যেতে। আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসি। 

– হাবিবা কত তারিখ থেকে নিখোঁজ ছিলো ? 

– হাবিবাকে বেড়িয়ে যেতে দাড়োয়ান দেখেছিলো। ঐদিন ১৪ তারিখ ছিলো নারে ? 

– হ্যা হ্যা ১৪ তারিখই। (ওখান কার একজন মেয়ে বলে)

সন্জি রিয়াদের দিকে ফিরে বলে,

– ১৪ তারিখ।

– আর তাদের মধ্যে ঝগড়া হইছিলো কবে ? 

– ১৪ তারিখই। তাদের মাঝে ঝগড়া হয়েছিলো সন্ধ্যার দিকে। ঐ রাতেই হাবিবাকে হলের গেইট দিয়ে বের হতে দেখেছিলো দাড়োয়ান।

– তাইলে মারিয়া কবে নিখোঁজ হয়েছিলো? 

– তার দুইদিন পর। ১৬ তারিখ।

রিয়াদ কিছুটা হেঁটে এগিয়ে আসে। কপালে চিন্তার ভাঁজ প্রসারিত হয় তার। দুই হাত কোমরে রেখে বলে,

– ঝগড়া হয় ১৪ তারিখ, সেদিন চলে যায় হাবিবা, আর তার দুইদিন পর বেড়িয়ে যায় মারিয়াও অর্থাৎ ১৬ তারিখ! কী নিয়ে তাদের মাঝে ঝগড়া হতে পারে! তাদের দুইজনের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে এই ঝগড়ার মূল বিষয়বস্তু টাই দায়ী নয়তো!

 

_______

 

১২ই ডিসেম্বর ২০২০,,,

 

একটা রুম। বেশ বড় না, মাঝারি আকৃতির। মাঝে কিছুটা ফাঁকা যায়গা। দুইপাশে দুইটা খাট। ঘরে তেমন কিছু একটা নেই। একটা ছোট্ট রেক, আর দুইটা বড় বড় কাপড়ের ব্যাগ। ঘরের এক কোনে একটা স্টোভ চুলা। চুলায় ভাত বসানো। চুলার পার্শে একটা ছোট কড়াই রাখা, কড়াইয়ে ঢাকনা দেওয়া। 

বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো মারিয়া। বাথরুমের দরজার ছিটকিনি সামনে দিয়ে লাগিয়ে দিলো। ঘরের মাঝ বরাবর ঝুলতে থাকা গামছায় এসে হাত মুছতে থাকে সে। তখনই দেখে পাশের বিছানায় বসা হাবিবা তার বড় কাপড়ের ব্যাগ খুলে তার ভিতরে কী যেনো করছে। মারিয়া গামছায় হাত মুখ মুছতে মুছতে হাবিবাকে বলে,

– নতুন কাপড় বাইর করতেছিস! 

– না। 

– তাইলে! 

– কাপড় ঢুকাচ্ছি।

মারিয়া গামছা রশি থেকে হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে মারিয়ার বিছানার দিকে। মুখ,গলার পানি মুছতে মুছতে দেখে হাবিবা ব্যাগে কাপড় ঢুকাইতেছে। তাও আবার ঘরের পড়নের কাপড় গুলা। মারিয়া বলে,

– পুরান কাপড় গুলা ব্যাগে ঢুকাইতেছিস ক্যান! বাড়ি যাবি নাকি ? 

– না। 

– তাইলে ? 

– রাফসানের সাথে দেখা করতে যাবো ঠিক করছি। 

– রাফসান ? ঐ রাফসান ? যে তোর,,,,,,

– হ্যা, যে আমার বাচ্চার বাপ সেই রাফসান। 

– হাবিবা, তুই অসুস্থ? মানে তোর মাথা ঠিক আছে তো ? কী বলতেছিস এইসব উল্টাপাল্টা? তুই না বলছিলি তুই রাফসানকে ভুলে যাবি। ও না ‌তোর সারে চিট করছে ? 

– হ্যা বলছিলাম ভুলে যাবো। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! বাড়িতে কেউ জানেন আমার প্রেগন্যান্টের বিষয়ে। দেখতে দেখতে ৭ মাস হয়ে গেলো। এভাবে আর কত! যে কয়দিন পর জন্ম নিতে চলেছে তাকে আমি কীভাবে সবার থেকে লুকিয়ে রাখবো ? হলের বাকিরা বিষয়টা জানতে পারলে তোকে আমাকে দুইজনকেই বের করে দিবে। সমাজকে আমি কী বলবো ? এই বাচ্চার বাপ কে ? 

– হাবিবা শান্ত হ। তুই একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর। রাফসান নিজে থেকেই তোর সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করছে। ওর কাছে এতোদিন পর গেলে কী ও তোকে আবার গ্রহণ করবে ? 

– ও করবে। অবশ্যই করবে। আমার ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিলোনা। ওই আমাকে ভুল বুঝেছে। আর কষ্ট পেয়ে আমার থেকে সড়ে গিয়েছে। এতে আমার তো কোন দোষ নেই। সব দোষ ঐ রাসেলের। ও আমাকে পছন্দ করতো তাই আমার নামে রাফসানের কানে খারাপ কথা দিয়েছে। রাফসান আমাকে ভুল বুঝেছে। আমি রাফসানের কাছে গিয়ে ওকে সব বুঝিয়ে বলবো। আমাদের সেই কলেজ থেকে প্রেম। এতোদিনের ভালোবাসা মিথ্যে হতে পারেনা! ও নিশ্চয়ই এখনো আমার জন্য কাঁদে। ও আমাকে সত্যিই অনেক ভালোবাসতো।

– হাবিবা আমি তোকে কতবার বলবো, রাসেলকে দিয়ে ঐ রাফসানই এই গেমটা খেলছে। ও উল্টা তোর চোখে ধুলা দিয়ে রাসেলকে খারাপ বানায় নিজের ইমেজ ভালো রেখে মানে মানে কেটে পড়ছে। ও শুধু তোকে ব্যাবহার করছে দোস্ত, বুঝার চেষ্টা কর।

– আমি কিচ্ছু বুঝতে চাইনা। আমি, আমি এই সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবো ? কেউ আমাকে মেনে নিবে না। না পরিবার আমাকে গ্রহণ করবে, না সমাজ গ্রহণ করবে। রাফসান কোন গেম খেলেনি। তুইই আমাকে প্রথম থেকে ভুল বুঝিয়েছিস। রাফসান অনেক ভালো একটা ছেলে। (সামনে ফিরে কাপড় গুছাতে গুছাতে) আমি কালই যাবো রাফসানের কাছে। 

– না তুই যাবিনা। ও তোকে তো মেনে নিতে চাইবেই না, উল্টো তোকে অপমান, অপদস্থ করবে। তুই কোথাও যাবিনা। 

– মারিয়া, তুই বেশি বেশি করে ফেলতেছিস কিন্তু। তুই রাফসানকে ভালোবাসতি এইজন্য আমাকে ওর সাথে সহ্য করতে পারতি না। এখন ইতিহাস বাইর করলে কিন্তু,,,,,

– ঐ থার্ড ক্লাস প্লেবয় টাকে আমি ভালো বাসতে যাবো! তুই এইটা ভাবলি কী করে। ও তোকে শুধু ব্যবহার করছে। খেয়ে যাস্ট ছেড়ে দিছে। ঐদিকে গিয়ে দেখ আরো কত মেয়ের জীবন নষ্ট করে বসে আছে ও। তোর জন্য ওর জীবনে এখন টাইম, আর মূল্য কোনটাই নাই। 

– আছে না নাই সেটা আমি বুঝবো। তোকে তো মাথা ঘামাইতে কেউ বলেনি! 

– হাবিবা, তুই কিন্তু লিমিট ক্লস করে ফেলতেছিস। চুপচাপ ব্যাগ রেখে বিছানায় শুয়ে থাক। তুই ওর কাছে যাবিনা মানে যাবিনা। 

– ১০০ বার যাবো। নিজের ভাগ্যে কেউ জুটেনা এইজন্য অন্যের সুখে গা জ্বলে তাইনা! 

– হাবিবা!!!! খুব বেশি করে ফেলতেছিস কিন্তু তুই!! 

– তুই কয়টা টাকা আনে আমাকে খাওয়াতেছিস বলে কী আমার মাথা কিনে নিছিস নাকি ? তোর কেনা গোলাম আমি! যে উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবো। কোথাও যাবো কি না যাবো তোকে বলে যাবো! 

– তুই আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করে হলেও ওর সাথে গিয়ে দেখা করবি ? 

– আমি ওর সাথে যে কোন মূল্যে দেখা করবোই করবো। আমি ওর সাথে দেখা করে ওকে মানায় নিলে তো তোর ক্ষতি। এতো বড় বাড়িতে আমি থাকবো, পায়ের উপর পা তুলে খাবো! তোর তো এইগুলা ভাবে হিংসা হয় না! জীবনে বড়লোক ঘরের তো দূর, একটা গরীব ঘরের ছেলে পটাইতে পারিস নাই। আসলে তো রূপই নাই। কালো মেয়ের উপর আবার কোন ছেলে মুখ তুলে তাকাইতে যাবে! ছেলেদের চয়েস কী এতোই খারাপ!!

মারিয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। চোখ লাল হয়ে গেছে। যাকে এতোগুলা দিন দেখে রাখলো, যাকে নিজের আপন বোন ভাবলো সেই কিনা তাকে এগুলা কথা শুনালো! হাবিবা ব্যাগ গুছিয়ে ব্যাগের চেইন লাগায়। মারিয়া রাগে,দুঃখে হনহন করে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। হাবিবা ব্যাগটা আস্তে করে তুলে বিছানা থেকে নিচে নামিয়ে রাখে। মুখ ভেংচে বলে,

– দুনিয়ায় কেউ কারো সুখ দেখতে পারেনা। নিজে কোন ছেলেকে আকৃষ্ট করতে পারেনা, এইজন্য আমাকেও কোন ছেলের সাথে থাকতে দিবেনা। (একটু থেমে) কালো মেয়ে, কুৎসিত মেয়ে। থুউউ,,,! 

 

১৪ ই ডিসেম্বর ২০২০,,,

 

নীলগিরি জঙ্গল।‌ সময়টা রাত। হয়তো ১০ টা কী ১১ টা হবে। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পাকা রাস্তাটার সাইডে কিছুটা সামনে গাছপালায় ঘেরা একটা ছোট্ট ফাঁকা যায়গা। এই যায়গাটা রাস্তা থেকে কিছুটা ভিতরে। বাইরের রাস্তাটা দিয়ে আরেকটু এগোলেই তান্তিকের বাড়ি।‌ দূরে গান বাজনার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নিপা-রায়হানের বিয়ে হচ্ছে। 

 

ফাঁকা যায়গাটায় একসাইডে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কিছুটা পাশেই একটা বড় ব্যাগ। মেয়েটার থেকে কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাফসান। সে দুই হাত কোমরে দিয়ে রেখেছে। তার চোখে মুখে বিরক্তি। কিছুটা পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা হাবিবা। পড়নে একটা থ্রীপিস। হাবিবার চোখে পানি। হাত উঠিয়ে সে তার চোখের পানি মুছে। ধীর গলায় বলে,

– আমি তোমার জন্য সব ছেড়ে এসেছি রাফসান। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। তুমি না আমাকে ভালোবাসো! 

রাফসান পিছনে ফিরে তাকায়। বলে,

– রাসেলের সাথে তোমার না সম্পর্ক! ওর কাছে যাও! আমার কাছে কেনো আসছো। (একটু থেমে) হয়তো তোমার ঐ সন্তানের বাবা রাসেলই।

– এসব কী বলছো রাফসান। এই বাচ্চার বাবা তুমি। আর কেউ না। আমার দেহে শুধু তোমার ছোঁয়া পড়েছিলো। আর কেউ আমার দেহ ছোঁয়নি।

– আমি বিশ্বাস করিনা। এখন ঐ রাসেল তোমার বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চায়না বলে আমার গলায় ঘন্টা পড়াইতে আসছো! এই ছেলে আমার না। তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, কোন সম্পর্ক!

– এভাবে বলোনা রাফসান। আমি সত্যি বলছি রাসেল আমাকে ভালোবাসে না। তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তুমি ভুল বুজছো আমাকে। 

– আমি ভুল না সঠিক, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। চলে যাও তুমি। তুমি আমার কেউ না। 

– তুমিই না আমাকে বলেছিলে সারাজীবন একসাথে থাকার কথা। ভালোবাসা দিয়ে আমার জীবন টা রঙিন করেছিলে! তাইলে এখন কেনো সেসব কথা তোমার কাছে ফিকে পড়ে যাচ্ছে! তুমি কী সত্যিই আমার সাথে ছলনা করেছিলে! 

– হ্যা হ্যা করেছি। ছলনাই করছি। কী করবে এখন আমায়। মারবে! কাটবে! যা খুশি তাই করো। আমি এই বাচ্চার দায়িত্ব নয় নিতে পারবোনা। 

– রাফসান,,,, ত,তুমি সত্যিই,,,

– হ্যা। আমি ছলনা করছি। রাসেলকে আমিই বলছি তোমাকে নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগাইতে। আমি এসে যেনো তোমাদের দুইজনকে এক ঘরে পাই আর তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি। এবার হয়েছে! এবার খুশি! চলে যাও এখান থেকে। আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। যাস্ট গেট লস্ট।

– রাফসান, তুমি আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে,,, ছিঃ রাফসান ছিঃ। তুমি এতো খারাপ, তুমি এতো নিকৃষ্ট! তুমি শুধু আমাকে ভোগ করার জন্য প্রেমের অভিনয় করেছিলে! (একটু থেমে ছলছল চোখে) আমার প্রতি কী তোমার এতটুকুও ভালোবাসা জন্মায়নি! 

– না জন্মায়নি। এই রাফসান কাউকে কখনো ভালোবাসেনি, আর বাসবেও না। এই রাফসানের চাই খালি দেহ, দেহ যতদিন ভালো লাগবে, ততদিন তার দাম এই রাফসানের কাছে থাকবে। খুদা শেষ, রাফসান তাকে ছুঁড়ে ফেলতে দু’বার ভাববে না।

হাবিবা এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে রাফসানের সামনে বসে পড়ে। রাফসানের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ভেজা কন্ঠে অনুনয় করে বলে,

– দয়া করো রাফসান। আমার প্রতি একটু দয়া করো। আমি এই বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবো। আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। একটুতো দয়া করো।

রাফসান পা দিয়ে ছিটকিয়ে ফেলে দেয় হাবিবাকে। 

– যা,,, তোর মতো কত মেয়ে আসলো আর গেলো। হুঁ,, ও নাকি আসছে আমার বউ হইতে!

হাবিবা কিছুটা দূরে পড়ে যায়। ফিরে রাফসানের দিকে চায়‌। তার চোখ থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। হাত দিয়ে দু চোখের পানি মুছে হাবিবা। নিজের কন্ঠ কঠিন করে বলে,

– তুমি আমাকে মেনে নিবে না! 

– না। তোর মতো মেয়ে আমার হাতের ময়লা। ফু দিলেই উড়ে যাবে,, হা হা হা!!

– আমি পুলিশের কাছে যাবে, যা যা করা লাগে সব করবো। আমি আমার অধিকার আদায় করেই ছাড়বো।

রাফসান রেগে যায়। অস্থীর হয়ে বলে,

– কী বললি! আরেকবার বল আরেকবার বল!

– আমি থানায় যাবো। 

রাফসান এগিয়ে এসে জোড়ে হাবিবার পেটে একটা লাথি দেয়। হাবিবা মাটিতে শুয়ে পড়ে। ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। রাফসান আবার তার পাশে এসে পা দিয়ে আরো একটা লাথি দেয়। হাবিবা কুকিয়ে উঠে। ব্যাথায় চিৎকার দিতে থাকে। রাফসান কর্কষ গলায় বলে,

– আমাকে থানার ভয় দেখাইস! এই রাফসান খানকে! তোর বাচ্চা কীভাবে বাঁচে আমি খালি এইটাই দেখবো।

মাটিতে ব্যাথায় কাতরাতে থাকা হাবিবা কান্না করে ফেলে। তার প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সে ব্যাথায় কাঁদতে কাঁদতে রাফসানকে চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,

– কুকুর তুই একটা, তুই কুকুরের থেকেও অধম,, ও মা! আঁ,,,,

ব্যাথায় কাতরাতে থাকে হাবিবা। রাফসানের মাথায় রাগ চড়ে যায়। একটা মেয়ে তাকে কুকুর বললো! রাফসান রাগের মাথায় অস্থীর হয়ে পড়ে। পায়চারি করতে করতে আরো দুইটা লাত্থি দেয় হাবিবার পেটে। হাবিবার যেন জান বেড়িয়ে আসছিলো। তার রক্ত পড়তে থাকে। কাপড় ভিজে যায়। রাফসান এখনো ক্ষান্ত হয়না। তার কোমর থেকে বন্দুক বের করে হাবিবার সোজা পেট বরাবর তাক করে ধরে। হাবিবার ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায়। রাফসান সাথে সাথেই বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দেয়। একে একে তিনটা গুলি চালায়। রক্ত ছিটকে পড়ে চারপাশে। হাবিবার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। রাফসানের দিকে শেষবার তাকায় সে। যেই মানুষটাকে সে ভালোবাসতো, সেই মানুষটাই তার পেটে গুলি চালিয়েছে। রক্ত মাখা এক হাত হাবিবা শেষ বারের মতো রাফসানের দিকে তুলে। তখনই রাফসান আরো দুটো গুলি করে। হাবিবা পেট থেকে আরো রক্ত ছিটকে বেড়িয়ে আসে। হাবিবার হাত মাটিতে পড়ে যায়। মারা যায় সে। রাফসান বন্দুক নামায়। এখন তার শান্তি লাগছিলো। সে হাসছিলো। জোড়ে জোড়ে হাসছিলো। পৈশাচিক আনন্দে তার মন নাচতে থাকে। রাফসান গুলিটা তার কোমরের ভাজে রাখে। হাবিবার মৃত দেহটার পাশে এসে পা তুলে সেই পেটের উপর আরো জোড়ে একটা লাথি দেয়। বলে,

– যা এইবার পুলিশের কাছে! হা হা হা! রাফসানকে ভয় দেখাইতে আসছে! পুলিশের ভয়!! হা হা হা!!

 

বেশ কিছুক্ষণ পর,

রাফসান নিলগিরি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। কারো জন্য অপেক্ষা করছে। তখনই আমরা আঁধার ভেদ করে একজন লোককে ছুটে আসতে দেখি। রাফসান ফোনের লাইট জালায়। লোকটা সামনে আসতেই দেখি সে আর কেউ নয়, খাঁন বাড়ির দারোয়ান রহিম চাচা! রাফসান তাকে বলে,

– ভিতরে আসো। একটা লাশ আছে কাঁধে করে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে রেখে আসবা। 

রহিম চাচা ভয় পেয়ে যায়। লাশের কথা শুনে নয়, লাশটাকে নিয়ে যে এই রাতের বেলা ঘন জঙ্গলের ভিতর যেতে হবে তা শুনে। সে বলে উঠে,

– আমি লাশটা নিয়া ভিতরে রাইতে পারুম না। আপনে লাশটা দেন আমি অন্য কোনহানে ফালায়া দিয়া আহি।

– ক্যান ভিতরে গেলে কী হবে।

– ভিতরে যাইতে ডর করে। 

– নে, এই যে লাশ। একদম এমন যায়গায় ফেলবি যেনো কেউ খুঁজে না পায়।

– আইচ্ছা ঠিক আছে। 

রহিম চাচা এগিয়ে গিয়ে হাবিবার লাশটা কাঁধে নেয়। বলে উঠে,

– উরে বাবা, কী ভারি! 

– হোক, একটু আধটু ভারি হইলে কিছু হয়না। (একটা বড় নোট দিয়ে) এইনে, চলবে তো!

– হ। এইডা দিয়াই চলবো। আমি অহনি লাশটারে ফালায়া দিয়া আইতাছি।

বলেই প্রায় দৌড়ে লাশটাকে নিয়ে চলে যান রহিম চাচা। রাফসান ভিতরে এসে দেখে যে কিছু ফেলে গিয়েছে কি না। তখনই দেখে ব্যাগটা এখনো এখানেই পড়ে আছে। রাফসান ভাবে এই ব্যাগটার কী করা ‌উচিত। তখনই মনে পড়ে তার লাইটারের কথা। লাইটার বের করে আগুন ধরিয়ে দেয় সেই ব্যাগ টায়। আগুনে দাউ দাউ করে ফাঁকা যায়গাটার মাঝে জ্বলতে থাকে ব্যাগটা। রাফসান তখনই মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,

– লাশটাকেও তো জালায় দিতে পারতাম! ধ্যাত, আগে ক্যান মনে আসলো না। রহিম চাচা তো মনে হয় অনেক দূর চলে গেছে। যাক গে। যা হইছে হইছে। লাশ টা ভালো একটা যায়গায় ফেললেই হইলো।

 

আনন্দপুর গ্রামের রাস্তা,

আকাশে হালকা জোছনা। নিচে চলে গেছে একটা কাঁচা রাস্তা। হাবিবার লাশ কাঁধে করে নিয়ে আসছে রহিম চাচা। গন্তব্য দূরের এক কুয়ায় লাশটাকে ফেলে দেওয়া। তখনই সে সামনে একটা ট্রাক দেখতে পায়। একটা মেয়ে সেই ট্রাকের পিছন থেকে হেঁটে হেঁটে এদিকেই আসছে। রহিম চাচা রাস্তা থেকে নেমে পড়েন। গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। একটা মেয়ে চলে যায় রাস্তাটা দিয়ে। রহিম চাচাকে সেই মেয়েটা দেখেনি। রহিম চাচা কিছুক্ষণ পর লাশটাকে নিয়ে রাস্তায় উঠেন। লাশটা কাঁধে নিয়ে ছুটতে থাকেন। সেই মিনিট্রাকের কাছাকাছি আসতেই দেখেন এইটা তাদের গ্রামেরই একজনের ট্রাক। বিরবির করে বলেন,

– আরে কালুর ট্রাক না! নিশ্চিত সবজি নিয়া ঢাকা যাইতাছে। এই লাশের যে উজন। এইডা নিয়া কুয়া পর্যন্ত যাইতে যাইতে আমিই না উপরে চইলা যাই। লাশটারে ট্রাকেই ফালায়া দেই। পরে কিছু হইলে কালু ফাসবো। আমার কী! 

 

রহিম চাচা ট্রাকের পিছনে চলে আসেন। কাঁধের লাশটাকে বহুত কষ্টে ট্রাকের পিছনে ফেলে দেন। তবে তিনি শব্দ পাননি তেমন একটা। এমন মনে হলো লাশটা যেনো কোন নরম জিনিসের উপর পড়েছে। রহিম চাচা আর বেশি ভাবেন না। দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকেন।

মিনি ট্রাকের কিছুটা সামনের ছোট্ট ঝোপঝাড় থেকে বের হয় ট্রাকের ড্রাইভার কালু। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো আর যায়গা পায়নি সে। গাড়ির দরজার সামনে এসে গাড়িতে উঠে পড়ে। দিনাজপুর শহরে তার হেলপার অপেক্ষা করতেছে। ওকে নিয়ে রওনা দিতে হবে ঢাকার উদ্দেশে। সবজি যেগুলা আছে ঐগুলা নাইলে পচে যাওয়ার ভয় আছে। কালু তার মিনি ট্রাক স্টার্ট করে। চলে যায় ট্রাক নিয়ে এই কাঁচা রাস্তার মাঝ দিয়ে। যেই রাস্তার দুইপাশেই যদ্দুর চোখ যায় ফসলি খেত আর খেত। হালকা কুয়াশা নামতে শুরু করে। চাঁদ এক খন্ড মেঘের আড়ালে পারি জমায়।

 

১৬ই ডিসেম্বর ২০২০,,,

বিজয় দিবসের ছুটি থাকায় আজ হাসপাতালে যায়নি মারিয়া। ঘরে সে বারবার পায়চারি করে যাচ্ছে। এখন সকাল ১০ টা। বাইরের আবহাওয়া হালকা মেঘলা। হাবিবা যতই তাকে অপমান করুক না কেনো, সে হাবিবাকে নিজের বোনের মতো আগলে রেখেছিলো। দুই দিন হয়ে গেলো হাবিবার কোন খোঁজ নেই। ও ঠিক আছে তো! রায়হানকে মারিয়ার সুবিধা মনে হচ্ছে না। বিগত দুইদিন থেকে তাকেও মেসেজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু মারিয়া রিপ্লাই দেয়নি। তবে আজ সকালে উঠে শুধু এটা রিপ্লাইয়ে বলেছিলো ‘ হাবিবা কোথায়? ও ঠিক আছে তো! ‘ এর রিপ্লাইয়ে রাফসান বলে ‘ এসেই দেখে যাওনা ‘। মারিয়ার চিন্তা বেড়ে যায় এতে। রাফসানকে ও কলেজ থেকে চিনে। মারিয়া শ্যামলা হলেও রাফসানের কুনজর তার উপরেও ছিলো। শুধু মারিয়াই সবসময় তাকে এড়িয়ে যেতো। রাফসান তার সামান্য হাত ধরার চেষ্টা করলেও সিন ক্রিয়েট করতো। তাই রাফসান তাকে তেজি মেয়ে বলেই বারংবার সম্বোধন করে। 

আজ হাবিবার জন্য তার চিন্তা হচ্ছে। হাবিবার কিছু হয়ে যায়নি তো! মারিয়া রেডি হয়। সে শুনেছে রাফসান দিনাজপুরে থাকে। গ্রাম টার নাম আনন্দপুর না কী যেনো একটা। আজ সে যাবে। গিয়ে হাবিবাকে নিয়ে আসবে। হাবিবা যতই তাকে দূরে ঠেলে দিকনা কেনো! সে বারবার তার কাছে ফিরে আসবে। তার মনে হয়না হাবিবাকে রাফসান মেনে নিয়েছে। রাফসান এমন কাজ করার ছেলে নয়!

মারিয়া তার হাত ব্যাগে গাড়ি ভাড়ার টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পরে ঘর থেকে। দরজা বন্ধ করে ভালোভাবে তালা মেরে দেয়। চলে যায় হলের নিচের দিকে।

 

মারিয়া তারপর এসেছিলো আনন্দ পুরে। কিন্তু আর বেঁচে ফিরতে পারেনি।‌ রাফসান তাকে শিকার করে ভোগ করেছে। মারিয়ার তেজ রাফসানের ভোগের মাত্রাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল। মারিয়া যন্তনায় কাতরাতে কাতরাতে মারা যায় সেই নিলগিরির সুবিশাল গাছপালা গুলোর মাঝে। তার লাশটা পচেঁ খসে এখন সেখানকার কিট দের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। তার হাত ব্যাগে থাকা পরিচয় কার্ডটা আজও তার কঙ্কাল দেহের উপর পরে আছে। আদেও কী মারিয়াকে কেউ খুঁজতে সেখানে যাবে! যাবেনা হয়তো। তার মৃত্যুই তাকে এই আনন্দ পুরে এনেছে। মৃত্যুর কাছেই সে হার মেনে বিদায় নিয়েছে, এই রং বেরঙের দুনিয়া হতে!

 

______

 

((((২য় ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে)))

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৬ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৬ (২য় ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

রাত ৮ টা। শাহারিয়ার গাড়ি শহরের রাস্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সিলেটে আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। এখনো বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মাঝে মাঝে দূরে বাজ পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। শাহারিয়া গাড়িতে বসেই জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের ভেজা রাস্তা, আধখোলা দোকানপাট দেখছে। রাস্তায় জ্যাম নেই। তবুও গাড়িটা খুব জোড়ে চলছে না। একটা নির্দিষ্ট গতি বজায় রেখেই চলছে। শাহারিয়ার ফোন বেজে উঠে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে সে। দেখে দিথী ফোন দিয়েছে। শাহারিয়া ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলে। ওপাস থেকে দিথী বলে,

– কই তুমি! 

– আমি? গাড়িতে আছি। কেনো ? 

– আসতে আর কতক্ষন লাগবে ? 

– এইতো পৌঁছে যাবো। আর ২০-২২ মিনিট। 

– তাড়াতাড়ি আসো। খিচুড়ি রান্না করেছি। সাথে বেগুন ভাজা আর ডিম ভাজা। 

– বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি!! আহা! 

– হ্যা। তাড়াতাড়ি আসো, নাইলে খিচুড়ি আর আমি দুইটাই ঠান্ডা হয়ে যাবো।

শাহারিয়া ঢোক গিলে। ভয়ে যেনো গলা শুকিয়ে আসার অবস্থা। শাহারিয়া বলে,

– আমার তো এখন বাড়ি যাইতেও ভয় করতেছে। 

– ভয় কীসের। তোমাকে তো আর খায় ফেলতেছি না। উল্টা তো তুমিই আমাকে,,,,,,

– থামো থামো বউজান। আর কিছু বলা লাগবেনা। আমি আসতেছি। 

– হমম আসো। আর পারলে আচার আনিও। আমের আচার।

– আচার খাবা ? আচ্ছা নিয়ে আসবো তাইলে। ঘরে কোন শাক সবজি লাগবে নাকি ? 

– না। তেমন কিছু লাগবেনা। আপাতত তুমি হইলেই চলবে।

– যাইতেছি যাইতেছি! একটু সবুর করো।

– আচ্ছা। রাখলাম।

দিথী ফোন কেটে দেয়। শাহারিয়া কান থেকে ফোনটা নামায়। এক ঢোক গিলে। ভয়ে মন চাইতেছে আবার অফিস চলে যাইতে। দিথী এতো বেশি রোমান্টিক হয়ে যায় এই বৃষ্টির দিন গুলাতে! বাবাগো বাবা!!

সামনে থেকে ড্রাইভার রুমান বলে,

– স্যার। কিছু হইছে! আপনারে এতো চিন্তিত দেখা যাচ্ছে যে।

– না তেমন কিছু না। (হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে) গাড়ি ঘুরাও। বাজারে যাইতে হবে। কিছু জিনিস নেওয়া বাকি আছে। 

– আচ্ছা ঠিক আছে স্যার। 

গাড়ি চলে যেতে থাকে। সামনে হয়তোবা ইউ টার্ন আছে। সেটা দিয়ে ঘুরে অপর রাস্তা দিয়ে বাজারের দিকে যাবে তারা। আকাশ মৃদু গর্জন করে উঠে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়তে থাকে। রাস্তার পাশের গাছ গুলো বৃষ্টিতে সজীব হয়ে উঠেছে।

 

____

 

চারপাশ গাছপালা দারা আবৃত্ত। গাছগুলো একটা হতে আরেকটার মাঝে বেশ ভালো রকমই ফাঁকা যায়গা রয়েছে। সামনে থেকে এক তীর্যক সাদা আলোক রশ্মি আসছে। সেই আলোয় চারপাশ আলোকিত। আশপাশে ঘুরে ফিরছে ছোট্ট ছোট্ট মেঘমালা। এক গোল যায়গার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে আফাজ। কিছুটা দূর দিয়ে দু’তিনটে সাদা খরগোশ দৌড়ে গেলো। আফাজ বুঝে উঠার চেষ্টা করছে যে সে কোথায় আছে। আশপাশে অনেক পাখির কলতান, দূর থেকে নদীর ঢেউয়ের শব্দও ভেসে আসছে। তবে আফাজ কোন নদী খুঁজে পায়না। চারপাশে এক বিশেষ গাছের বনাঞ্চল। গাছের পাতা গুলোও সাদা সাদা। কিছু পাতা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আফাজ এই ফাঁকা যায়গাটার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখছে আর চিনার চেষ্টা করছে। তখনই হঠাৎ কারো পায়ের নূপুরের আওয়াজ। ঝুমুর ঝুমুর শব্দে কেউ হেঁটে এগিয়ে আসছে। আফাজ পিছনে ফিরে তাকায়। এক নারী বেড়িয়ে আসে গাছপালার মাঝ থেকে। গাঁয়ে সাদা শাড়ি। শাড়ির আঁচল মাটি ছুঁয়েছে। গাঁয়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা। আফাজ ধীরে ধীরে নিচ থেকে চোখ উঠায়। মেয়েটার হাতে সাদা চুড়ির গোছা। মেয়েটা দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে বোধহয়। আফাজ ধীরে ধীরে নয়ন তুলে মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়। তার কালো পৃথিবীটা যেনো মুহুর্তেই রঙিন হয়ে উঠে। এটা যে আলিশা, তার আলিশা। আফাজের মুখের হাসি চওড়া হয়ে যায়। তার চোখে আনন্দ অস্রু চলে আসে। হাত বাড়ায় আলিশার দিকে। আলিশা একটা সুন্দর হাসি দিয়েই শাড়ির কুচি হাত দিয়ে ধরে দৌড়ে যেতে থাকে। আফাজ তার পিছু পিছু দৌড়ায়। ডাকতে থাকে আলিশাকে।

 আলিশা গাছ গুলোর মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া এক পথে দৌড়ে যায়। আফাজও তার পিছু পিছু দৌড়ে আসে। কিছু সাদা কবুতর এক সাথে উড়ে যায়। তাদের সাদা পালক গুলো বাতাসে উড়ে এসে আলিশার উপর পড়ে, কিছু পালক আফাজের উপরেও পড়ে। আলিশা দৌড়ে যাচ্ছিলো, হাসছিলো। আফাজও দৌড়ে তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছিলো। তার ভীষণ ইচ্ছে করছিলো আলিশাকে বুকে জড়িয়ে তার ভালোবাসার কথাটা বলে দিতে। তাদের আশপাশে ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট ছোট্ট কিছু মেঘমালা তাদের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। আলিশা সেই মেঘ ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। আফাজের চোখ থেকে সুখ অশ্রু গাল বেয়ে ঝড়ে পড়ে। তা কোন এক কবুতরের পালকের উপর পড়ে নিচে হারিয়ে যায়। এ যেনো কোন স্বর্গ পথে দুই মানব, মানবী দৌড়ে যাচ্ছে। দৌড়ে যাচ্ছে তাদের ভালোবাসার প্রথম প্রহরের আলোর দিকে। হঠাৎ গাছের অংশের ভিতর থেকে কালো কাপড় পড়া একজন বেড়িয়ে আসে। তার মুখ অর্ধেক কালো টুপির আড়ালে ঢাকা। শরীর সবটুকু কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। সে আলিশার সামনে বের হয়েই আলিশাকে ধরে নেয়। আফাজ থেমে যায়। কে তার আলিশার পথ রোধ করলো! তখনই সেই কালো কাপড় পড়া একজন আলিশার চুলের মুঠি ধরে। আফাজ ভয় পেয়ে যায়। সে আবার দৌড়াতে যাবেই তখনই কোথা ছেকে যেনো কিছু কালো পোশাক ধারী লোক এসে তাকেও ধরে নেয়। তাদের কারোরই মুখ দেখা যাচ্ছিলো না। আফাজ তাদের থেকে ছোটার চেষ্টা করে। আলিশা এক হাত দিয়ে তার মাথার দিকটায় ধরে আরেক হাত বাড়িয়ে আফাজের কাছে বাঁচার আকুতি করছিলো। আফাজ সব শক্তি দিয়েও এই লোক গুলার থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছিলো না। তখনই আলিশাকে ধরে থাকা সেই লোক একটা লম্বা ছুরি বের করে তার কোমর থেকে। আফাজ চিৎকার করে উঠে। থামতে বলে সেই লোকটাকে। তখনই লোকটা পুরো ছুরিটা আলিশার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। আফাজের জোড়ে আলিশা বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। লোকটা ছুরি টা বের করে আবার ঢুকায় আলিশার পেটে। আলিশা সাদা শাড়ি লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। আফাজকেও ধরে রাখা সেই লোক গুলো মারতে থাকে কোন লাঠি জাতীয় বস্তু দিয়ে। আফাজ এই ব্যাথার থেকেও বেশি ব্যাথা পাচ্ছিলো আলিশার রক্তাক্ত দেহটাকে দেখে। আলিশার পাশে দাঁড়ানো লোকটা ছুরি দিয়ে বারবার, বারবার আলিশার পেটে আঘাত করছিলো। আলিশাকে জখম করছিলো। এবং একটা পর্যায়ে আলিশাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আলিশার পেটে গর্তের মতো হয়ে যায়। আলিশা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আফাজকেও আহত করে কালো লোক গুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। আফাজ মাটিতে পড়ে যায়। আহত শরীর নিয়ে মাটি ঘেসে ঘেসেই এগিয়ে যেতে চায় আলিশার কাছে। আলিশা উবুড় হয়ে পড়ে ছিলো। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো। সে হাত বাড়িয়ে রেখেছিলো আফাজের দিকে। কষ্ট জর্জরিত গলায় ভেজা কন্ঠে বলে উঠে,

‘ শেহওরান। আ,আমার শেহওরান…! ‘ 

তখনই এক কালো কাপড় পড়া কেউ এসে আলিশার বাড়িয়ে রাখা হাতটায় তার হাই হিল জুতো দিয়ে আঘাত করে। হিল তার হাত ভেদ করে মাটিতে গিয়ে ঠেকে। লোকটা তার হাতের ছুরিটা পুরোটা আলিশার দেহে গেথে দেয়। আফাজ এক জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে আলিশা বলে।

তখনই আফাজের ঘুম ভেঙে যায়। সে একদমে উঠে বসে। চারপাশ তাকিয়ে দেখে সে তার ঘরে। সে আলিশা আলিশা বলে বারবার তাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু না ঘরে আলিশা নেই। আফাজ বুঝে উঠে যে এটা একটা স্বপ্ন ছিলো। এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোড়ে বিছানায় একটা ঘুষি মারে। চিৎকার করে উঠে। আলিশাকে কতটা কষ্ট দিয়ে মেরেছে তারা, কতটা কষ্ট দিয়ে! আফাজ সহ্য করতে পারছেনা। মাথা হেলিয়ে দুই হাত দিয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তার মন বলছে এখনি এই ইহলোক ত্যাগ করে আলিশার কাছে চলে যেতে। আলিশা ছাড়া যে আফাজ নিঃস্ব। একদম নিঃস্ব। 

 

আফাজ মাথা তুলে। হাত দিয়ে চোখ মুছতে থাকে। তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। আলিশার ‌খুনিকে না মেরে ও কিছুতেই মরতে চায় না। আলিশাকে যেভাবে মেরেছিলো তার থেকেও বেশি কষ্ট দিয়ে মারবে ও। আফাজ বিছানা থেকে দুই পা নামায়। তার হাত কিছুটা ব্যাথা করছে। হাতে এখন ব্যান্ডেজ নেই। তবে ফেটে যাওয়ার দাগ এখনো তাজা। 

আফাজ বিছানা থেকে নেমে চলে যায় টেবিলের দিকে। টেবিলে তার ব্যাগ টা আছে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে। ব্যাগের চেইন খুলতে থাকে। ব্যাগ থেকে বের করে আলিশার সেই ড্রয়িং বুকটা। তার কেনো জানি খুব কান্না পাচ্ছে। চোখের অশ্রুরা বাঁধা মানতে চাইছেনা। ভালোবাসার স্বাদ এতোটা বিস্বাদও হয়! 

আফাজ ড্রয়িং খাতা নিয়ে এসে বিছানায় বসে। খাতাটায় একটা চুমু খায়। এটায় যে আলিশার হাতের ছোঁয়া আছে। ভালোবাসার ছোঁয়া আছে। আফাজ ড্রয়িং খাতাটা খুলে। বাকি সব পেইজ উল্টিয়ে উল্টিয়ে ও চলে আসে সব শেষ ছবিটায়। ছবিটা আলিশা তাকে ভেবে একেছিলো। এক লাল ‌শাড়ি পড়া মেয়ে আর তার পিছনে দাঁড়ানো এক সাদা পাঞ্জাবি পড়া ছেলে। দুইজনের মুখেই হাসি। মেয়েটার খোঁপায় জবা ফুল, দুই হাত দিয়ে কানের দুল ঠিক করছে। পিছনে দাঁড়ানো ছেলেটা মেয়েটার দুই কাঁধে হাত দিয়ে রয়েছে। আলিশার ভাবনায় এতোটাই রঙিন ছিলো তারা দু’জন! কী হতো তাদের মিলন হলে! আফাজের জীবনের সবকিছুর পূর্ণতা পেলেও তার ভালোবাসা কেনো অপূর্ণ রয়ে গেলো! আফাজের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে খাতার পেজের কোনে। আফাজ চোখ মুছে। যতই ও চোখ মুছছে ততই তা ভিজে যাচ্ছে। আফাজ খাতাটা বন্ধ করে। বুকের সাথে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে আলিশাকে ভালোবাসার কথা জানায়। নিজ মুখে সে বলতে পারলোনা এই কথাটা। আলিশা শুনতে পারলোনা তার প্রিয়র মুখের সেই বিশেষ সম্পর্কের বাক্যটা। আফাজের কান্নারা বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসে। নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সে। হঠাৎ দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ।‌ আফাজ ভেজা চোখ নিয়ে দরজার দিকে তাকায়। আবার কেউ কড়া নাড়ছে। আফাজ চোখ মুছে। ভেজা গলায় বলে,

– কে? 

– আমি। আমি সুমু। দ,দরজা খুলুন।

আফাজ চোখের পানি দুই হাতে মুছতে থাকে। সুমু আবার দরজা শব্দ করে বলে।

– আপনি, আপনি কাঁদছেন কেনো ? কী হয়েছে আপনার? দরজা খুলুন প্লিজ।

আফাজ তার হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। দেখে রাত ২ টো বাজে। আফাজ এক মৃদু ঢোক গিলে স্বাভাবিক গলায় বলে,

– এতো রাতে, এতো রাতে তুমি আমার দরজার সামনে কী করো।

– আমি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। আপনি কাঁদছেন কেনো। (দরজায় শব্দ করে) দরজাটা খুলে দিন প্লিজ।

আফাজ তার কোল থেকে ড্রয়িং বইটা পাশের টেবিলে রাখে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখ, মুখ হাত দিয়ে মুছে নিতে থাকে। দরজার সামনে এসে দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়। সুমু হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে আসে। তার চোখে, মুখে চিন্তারা ছুটোছুটি করছে। সে আফাজের সামনে এসে দাড়িয়ে ঘরের চারপাশ দেখে। আফাজকে বলে,

– কী হয়েছিলো আপনার। আপনি, আপনি কাঁদছিলেন কেনো! 

– কিছু হয়নি। তুমি যাও। গিয়ে ঘুমিয়ে পরো।‌

– কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন! বা এমনকিছু! 

– না। কিছু না। তুমি যাও। কিচ্ছু হয়নি।

সুমু আফাজকে একবার দেখে। ধীর গলায় বলে,

– আলিশার কথা মনে পড়ছিলো ? 

আফাজ সুমুর দিকে মুখ তুলে তাকায়। সে কিছু বলেনা। চুপচাপ থাকে। সুমু বলে,

– মন খারাপ করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। (একটু থেমে) বাইরে যাবেন! 

– আমি ওয়াশরুমে যাবোনা। 

– না না। আঙিনায় যাবেন! আজ জোছনা পড়েছে। কুয়াশাও তেমন একটা নেই। রাতের সুন্দর আকাশ দেখলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। 

– আমার বাইরে যেতে মন চাইছে না।

– আরে আসুন তো। জোছনা রাতের আকাশ কখনো দেখেছিলেন! দেখেননি। আগে দেখুন, তারপর বলবেন সুন্দর না খারাপ। 

আফাজ কিছু একটা বলতে চায়, তার আগেই সুমু আফাজকের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। আফাজও কেনো জানি না করতে পারে না। সেও সুমুর সাথে সাথেই চলে যায়।

 

     আঙিনার একপাশটায় দাঁড়িয়ে আছে আফাজ আর সুমু। আজ জোছনা রাত ছিলো। আকাশের তারাকারাজিরাও ঝলমলিয়ে উঠছিলো। আকাশে কোন মেঘ নেই। কুয়াশা পড়েছে, তবে তা হালকা। সুমু বাড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে উপরে চেয়ে থাকে। আফাজ দেয়ালের সাথেই দাড়িয়ে আছে। বাড়ির আঙিনা জোছনার আলোয় মৃদু আলোকিত হয়েছে। মাঝে মাঝে দু একটা জোনাকি পোকা আলোর খেলা ছড়িয়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। দুইজনের মাঝেই নিস্তব্দতা। কেউ কথা বলেনা। দুইজনই আকাশের দিকে মুখ করে রয়েছে। তবে একজন বিষাদের ছায়া থেকে বাঁচতে, আরেকজন নতুন গানে সুর বুনতে। দুইজনের মাঝের নিরবতা ভাঙিয়ে সুমু বলে উঠে,

– মানুষের জীবন কত বিচিত্রময়, কেউবা পেয়েও হারায়। কেউ পাওয়ার টানে ছুটে বেড়ায়‌।

আফাজ স্বাভাবিক গলায়ই বলে উঠে,

– চাইলেই তো সব কিছু পাওয়া যায়না। আমার বেলায় যেমন আমি আলিশাকে পাইনি।

– তবে অন্য কারো চাওয়া তো পূরণ করতে পারেন! 

আফাজ অবাক হয়। আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সুমুর দিকে তাকায় বলে।

– মানে ? 

– কিছুনা। (একটু থেমে উৎসুক হয়ে) ঐযে দেখুন, চাঁদের পাশে দুটো তারা কেমন মিলেমিশে আছে। 

আফাজ সেদিকে তাকায়। সেও বাড়ির দেওয়ালের সাথেই হেলান দেয়। বলে,

– সেই তারা দুটো আমি আর আমার প্রিয়তমা হতে পারতাম! 

সুমু বিরবির করে বলে,

– পারতাম নয়, পেরেছেন। পাশাপাশিই আছি আমরা।

– কিছু বললে!

– কই নাতো। 

– তোমার জীবনে প্রেম এসেছিলো! 

– প্রেম তো শব্দ মাত্র, অনুভূতির বিস্তৃতি তার চেয়েও বিশাল! 

– মনের মানুষ আছে তাইলে! 

– হ্যা। একজন আছে। তবে সে জানেনা যে আমি তাকে ভালোবাসি। 

– তাকে বলোনি ভালোবাসার কথা! 

– না। (দীর্ঘ শ্বাস ফেলে) বলা হয়নি সেই কথা।‌ তবে বলবো বলে ঠিক করে রেখেছি।

– বলে ফেলিও। মানুষের জীবন, কখন কী হয়ে যায়। আমার আলিশাকেও আমি আমার ভালোবাসার কথাটা জানাতে পারিনি। আফসোস, আমি যদি তাকে সেই দিনই বলে দিতে পারতাম! তাইলে হয়তো তার সেই হাসি মুখ খানা আমার এই বুকটাকে রঙিন করে তুলতো।‌

– আমিও বলবো। বেশি দেরি করবো না। তবে সে যদি আমায় না চায় (একটু থেমে) তবে! 

– নিজের করে নিবে! ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসা দিয়েই নিজের করে নিতে হয়, বেলা ফুরোনোর আগে ভালোবাসার কথাটা জানিয়ে দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে নিতে হয়।‌ 

সুমু ম্লীন হাসে। সেও তো আফাজকে নিজের করেই নিতে চায়। ভালোবাসা তার কাছে অফুরন্ত রয়েছে। 

 

আবার বেশকিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে তারা। তাদের মধ্যে নিরবতা ভাঙিয়ে এবার আফাজ বলে,

– ঘুমাবে না! 

– এতো সুন্দর রাত রেখে ঘুমাতে কার মন চাইবে! 

– তোমার মনে তো আনন্দের ঢেউ বইছে, কিন্ত আমার মন যে আলিশার নোঙরে পড়ে আছে। মেয়েটার মায়া আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনা, জানিনা আদেও পারবো কিনা। 

– মানুষ চাইলে সব পারে। চেষ্টা করেই দেখুন না।

– ভালোবাসার আবেগ কে ভোলা কী এতোটাই সহজ! 

সুমু কিছুটা চুপ হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ম্লিন গলায় বলে,

– আপনি আর কখনো বিয়ে করবেন না! 

– আমার জীবনে এখন শুধু লক্ষ্য আলিশার খুনিকে বের করা। তাকে নিজ হাতে মেরে ফেলা। জীবনে এই কাজ টা করেই মৃত্যুকে বরণ করতে চাই। আর কোন মেয়েকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে চাইনা। কারো জীবন নষ্ট করতে চাইনা। আমার দ্বারা আর কাউকে মনের সেই বিশেষ আসনে বসানো সম্ভব না। যদি মা-বাবা জোড় করেও কারো সাথে আমার বিয়ে দেয়, সেই মেয়েটা হবে সবচেয়ে অভাগা, সে তার স্বামীর ভালোবাসা পাবেনা। সবসময় তাকে এড়িয়ে চলার যন্ত্রনা সইতে হবে। আর যাই হোক, সুখী কেউই হতে পারবোনা।‌

আফাজ কথাটা বলেই এই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সুমু চুপচাপ হয়ে গেছে কথাগুলো শুনে। তার মুখে বলার মতো কোন শব্দ বা অক্ষর নেই। আফাজ বলে,

– আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি গেলাম। তুমিও ঘুমিয়ে যেও। (একটু থেমে ধীর গলায়) বেশি রাত জেগে থাকলে শরীর খারাপ করবে।

বলেই আফাজ চলে যায় বারান্দার দিকে। সুমু এক হতাশ নয়নে চেয়ে থাকে সেই পানে। আফাজকে কী সে নিজের করে পাবেনা!  ভালোবাসার উপসংহারটাকে সে বিষাদময় করতে চায়না। সূচনা তার ফিকে হলেও উপসংহারটাকে সে রংতুলির আলোয় রঙিন করে তুলতে চায়। সুমু নয়ন তুলে আকাশের চাঁদের দিকে তাকায়। ম্লিন গলায় বলে,

‘ হাজার বছর এমনি করে, আকাশের চাঁদটা আলো দেবে। আমার পাশে ক্লান্ত ছায়া, আজীবন রয়ে যাবে। তবু এই অসহায় আমি। ভালবাসবো আপনাকে, শুধু আপনাকে ‘ 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( গল্প কেমন লাগছে? কোন চরিত্রকে নিয়ে কী মনে হচ্ছে? জানান কমেন্টে। সরি লেইট করে আপলোড দেওয়ার জন্য। রিভিসন দিতে দিতে দেরি হয়ে গেছে 😿। তবে আপনাদের জন্য সুখবর হচ্ছে আমরা গল্পের ডেন্জেরাস পর্যায়ে চলে এসেছি। পরবর্তী পর্ব থেকে শুরু হবে গল্পের নতুন অধ্যায়, যাতে থাকবে আনন্দ পুরের রহস্য উন্মোচন করার সবটুকু প্রচেষ্টা! রেডি থাকুন আপনারা 😉)

 

গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৬ (২য় ভাগ)

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৭ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

১ মাস পর,,,

২৯শে জানুয়ারি ২০২০

 

“রাজধানীর মালিবাগে এক ব্যবসায়ী ও ৩ পথচারীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। আনুমানিক রাত ২ টা থেকে ৩ টার দিকে এই ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। এই নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে বিরাজ করছে ভীতিকর পরিস্থিতি। পুলিশ লাশ গুলোকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠিয়েছে। আমরা আরো বিস্তারিত জানার জন্য যুক্ত হচ্ছি আমাদের প্রতিনিধি নিতিশ রানার সাথে। নিতিশ, আপনি আমাদের শুনতে পাচ্ছেন!”

 

টিভিতে এই খবর দেখেই যেনো আফরিনের বুক কেঁপে উঠে। খুনাখুনি, হত্যা এই বিষয় গুলাকে যে মারাত্মক ভয় পায়। আফরিন তার হাতে থাকা রিমোট দিয়ে চ্যানেল পাল্টে দেয়। 

 

আফরিন আহনাফদের বাসায় এসেছে ১৫ দিন হলো। তার মা এখন অনেক টাই সুস্থ। হাঁটাচলা তেমন করতে পারেন না। তবে শরীরে বাঁধা ক্যান্সার এখন নির্মূল হয়েছে। আহনাফদের ফ্ল্যাটে ৪ টা রুম। একটায় আহনাফের মা থাকে, একটায় আহনাফ আর একটা আফরিন আর তার মা থাকে। আরেকটা রুম রান্না ঘর। আফরিন রাবেয়া বেগমের রুমে বসে টিভি দেখছিল। এই রুমে একটা মাঝারি আকৃতির বিছানা, তার মাঝে একটু ফাঁকা যায়গা দিয়ে দূরে সকেস। তার উপরই টিভিটা রাখা। সকেসের পাশে আলমারি, আর ডেসিন টেবিল। আফরিন বিছানায় বসে দুই পা ঝুলিয়ে টিভি দেখছে। 

ঘরে প্রবেশ করে আহনাফ। সময় এখন সকাল ১১ টা। আহনাফ আফরিনের সামনে দিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ডেসিন টেবিলের সামনে। চিরুনি নিয়ে চুল গুলো হালকা আঁচড়ে নিতে থাকে। পিছনে ফিরে বিছানায় বসে থাকা আফরিনকে একবার দেখে। আবার সামনে আয়নার দিকে ফিরে বলে,

– তোমার মা উঠেনাই! 

আফরিন টিভির দিক থেকে নজর সড়িয়ে আহনাফের দিকে তাকায়। বলে,

– না। মা’য়ে এহনো ঘুমাইতাছে।

– সকালের ঔষধ গুলা খাইছে ? ঘুম থেকে উঠায় নাস্তা দিয়ে ঔষধ খাওয়ায় দেও। পরে তো দুপুরের সময়ের ঔষধের সাথে ক্রস কাট হয়ে যাবে।

– মানে!

– মানে দুপুরের ঔষধ আর সকালের ঔষধ তো তখন প্রায় একই সাথে খাওয়া হয়ে যাবে। তোমার মা’কে ডাক দিয়ে নাস্তা খাওয়ায় ঔষধ খাওয়ায় দেও। (একটু থেমে) মা চলে গেছে ?

– হ। একটু আগেই বাইর হইলো। আপনারে কইতে কইছে টেবিলের রেকসিনের নিচে টাকা রাহা আছে, ঐহান থে নিয়া যাইতে।

– ওহ, আচ্ছা নিয়ে নিবো। 

– আপনে অফিসে যাইতাছেন!

আহনাফ ফিরে আফরিনের দিকে। বলে,

– হ্যা। আজ একটু দেরি করেই যাচ্ছি। (সামনে ফিরে) আজ রাতে সিলেট যাইতে হবে। রন্জুর কেস নিয়ে স্যারকে জানাইতে হবে। রন্জুকে খুব তাড়াতাড়িই ধরে ফেলবো আমরা। 

– ঐ রন্জু! যার পিছনে আপনে আর আপনার স্যার এতোদিন ছুটতাছিলছন! 

– হ্যা। খবর শুনো নাই! কাল রাতে চার চারটা খুন হইছে। একজন ব্যবসায়ী আর ৩ পথচারী মেয়ে। শরীর কোপায় ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলছে। 

– রন্জু করছে এই কাম! 

– মনে তো হইতেছে রন্জুরই কাজ। (চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আফরিনের দিকে ফিরে) যেই ৩ জন পথচারী ছিলো, ঐ তিনজন মেয়েরই খোঁজে এতোদিন ছিলাম আমরা। মেয়ে গুলা নিজেদের পরিচয় পাল্টে ঐখানে পিঠা বেচতো। (সামনে ফিরে) মেয়ে গুলাকেই মারে ফেলছে। 

– আমরাও একসময় পিঠা বেচতাম। আগের শীতেও বেচছি। এইবারের শীত আমাগো লাইগা আগেরবার গুলার মতো অভিশাপ হইয়া আহেনাই, (মলিন গলায়) আশির্বাদ হইয়া আইছে। 

– হমম। নাস্তা খাইছো!‌ মা রান্না ঘরে নাস্তা বানায় রাখে গেছে। গিয়ে খেয়ে নাও। (ডেসিন টেবিলের দিক থেকে আফরিনের দিকে এসে) আর আজ রাতে পরের পৃষ্ঠার পড়া গুলা পড়ে রাখবা। আমি হয়তো ২ দিন থাকতে পারি সিলেটে। যদি কোন পড়া না বুঝো, মায়ের কাছ থেকে শিখায় নিয়ো। ঠিক আছে? 

– আপনে এহনি রওনা দিতাছেন নাকি! 

– না। আমি সন্ধ্যায় দিবো। কিন্তু তখন থাকবো তালের উপর। তোমাকে বলতে যদি মনে না থাকে। (একটু থেমে) আসো বাইরের দরজাটা লাগায় দেও। আমি বের হবো। 

আফরিন বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। আহনাফ চলে যেতে থাকে রুমের দরজা দিয়ে বাইরে। আফরিনও তার পিছু পিছু চলে যায়।

 

   ফ্ল্যাটের সবগুলো রুমে যাওয়ার আগের একটা ছোট্ট ফাঁকা যায়গা। এইটাকে ছোট্ট একটা রুম বললেও ভুল হবেনা। এইটা দিয়ে ফ্ল্যাটের মূল দরজার সাথে বাকি দরজা গুলার সংযোগ। মূল দরজা দিয়ে ঢুকলেই ভিতরের ৪ টা রুমের দরজা এখানে। আহনাফ এক রুমের দরজা দিয়ে বের হয়ে এখানে আসে। জুতার রেক এখানেই রাখা। আহনাফ তার জুতা গুলো নামিয়ে পড়ে নিতে থাকে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আফরিন। দুই হাতে এক করে সামনে রেখেছে। হাতে রিমুট ধরে আছে। আহনাফ জুতা পড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পা ঠিক ঠাক করে নিতে নিতে বলে,

– মা আসবে দুপুরের দিকে। তুমি অচেনা কারো গলা পাইলে দরজা খুলিও না। এইসময় টায় খালারা কেউ আসেনা। আমি বা মা যদি গলার আওয়াজ দেই তবেই দরজা খুলবা। দেশের অবস্থা ভালো না। কে কোন মতলব নিয়ে ঘরে ঢুকার চেষ্টা করে,,,, (একটু থেমে) তোমার মা’কে উঠিয়ে ওষুধ গুলো দিয়ে দাও। 

আফরিন মাথা হেলিয়ে বলে

– আইচ্ছা।

আহনাফ এগিয়ে গিয়ে মূল বড় কাঠের দরজাটা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। আফরিন তাকে বিদায় জানিয়ে দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দেয়। আহনাফ খুব ভালো। সবসময় তাকে উপদেশ দেয়। আফরিনেরও ভালো লাগে বাধ্য মেয়ের মতো আহনাফের উপদেশ গুলো শুনতে। আফরিন রিমুট হাতে চলে যায় তার মা যেই রুমে ঘুমাচ্ছে ঐ রুমে‌। তার মা’কে উঠিয়ে দিতে হবে। ঔষধ গুলো খুব বেশি পাওয়ারের, তাই ঘুম ইদানিং একটু বেশিই হচ্ছে তার মায়ের। আফরিন চলে যায় তার মায়ের রুমে।

 

_____

 

একটা রুম। রুমে নানারকম টেক গ্যাজেট/জিনিসপত্র রাখা। দূরে পিছনে অনেক তার, আর বড় বড় মনিটর স্ক্রিন দেয়ালে লাগানো। দেখে মনে হচ্ছে কয়েকটা সিসি টিভি ক্যামেরার লাইভ ফুটেজ সেখানে চালু করা। উপরে নীল আলো জ্বলছে। রুমের এক পাশে একটা কম্পিউটারের সামনে বসে আছে একজন। তার পড়নে কালো শার্ট। শার্টের বুকের দিকটায় সেই লোগোটা দেওয়া, যেটা রঞ্জুর জ্যাকেটে দেওয়া থাকতো। অর্থাৎ লোকটা রন্জুর লোক। তার আন্ডারেই কাজ করে। 

লোকটা তার সামনে থাকা কম্পিউটারেও একটা সিসিটিভি ফুটেজ দেখছিলো। তবে এটা লাইভ ফুটেজ না। এখন দিন, কিন্তু ফুটেজ টা রাতের। এটা রাজধানীর মালিবাগে ঘটে যাওয়া খুন গুলোর সিসি টিভি ফুটেজ। ফুটেজ টা কাছেরই একটা ব্যাংকের সিসি টিভি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়েছে। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ী খালেদ মোশাররফ তার টাকা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে নামছেন। পাশেই ফুটপাত। সময়টা এখন রাত ১২ টা। এইদিকটায় তেমন কোন লোকজন নেই, প্রায় শুনশান। ফুটপাতে ৩ মেয়ে তাদের পিঠা বানানোর চুলা আর সরঞ্জাম সব গোছগাছ করছে। শীতের সময় এখন। তাই শহরের দিকে রাস্তার পাশে এমন ছোট খাটো পিঠার দোকান বসে। এটাও তেমনি একটা ছোট দোকান। মেয়ে গুলা সব জিনিস গোছগাছ করে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। তখনই দুইটা মোটরসাইকেলে করে দুই দুই, চার জন এসে থামে সেই ব্যবসায়ী খালেদের সামনে। হাতে দেশীয় অস্ত্র। বাইক থেকে হুরমুর করে নামে দু’জন। খালেদ তাদের থেকে পালাতে যাবেই তখনই একজন হাতে থাকা বড় চাপাতি দিয়ে এক কোপ দেয় লোকটা যেই হাতে টাকার ব্যাগ ধরে ছিলো ঐ হাতে। হাত টা সাথে সাথেই শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যায়। লোকটা এক চিৎকার দিয়ে মাটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে। বাইক থেকে আরো দু জন নেমে নেমে তাদের হাতে থাকা বড় বড় দা দিয়ে কোপাতে থাকে লোকটাকে। লোকটা জোড়ে জোড়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। বাঁচার আকুতি করতে থাকে। তখনই দূর থেকে সেই তিনজন মেয়ে এই দৃশ্য দেখে ফেলে। তাঁরা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে ছুটে পালাতে থাকে। বাইকে আসা দুইজন জন দাঁ আর চাপাতি নিয়ে দৌড় লাগায় সেই মেয়ে গুলোর পিছনে। তারপর আর তাদের দেখা যায় না। তারা ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরের অংশটায় চলে যায়। এদিকে ব্যবসায়ী লোকটার শরীর খন্ড বিখন্ড হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। টাকার ব্যাগ নিয়ে বাকি ২ জন দুই বাইকে উঠে। যেইদিকে মেয়েদের পিছনে ২ জন দৌড়ে গেছে সজোরে বাইক চালিয়ে সেদিকে চলে যায়। ফুটেজ চলা বন্ধ হয়ে যায়। 

 

কম্পিউটারে বসে থাকা লোকটা এক বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভিডিও ফাইলটা থেকে বের হয়ে আসে। বিরবির করে বলে,

– মেয়ে ৩টাকেও ছাড়লো না। কী দরকার ছিলো মেয়ে গুলাকে মারার! এই টিএনটি গ্যাংটা খুব বেশি বেশিই করতেছে। মেয়ে গুলো কত সুন্দর নরমাল লাইফে ফিরে গেছিলো। (একটু থেমে) রন্জু স্যারকে একটা ফোন দেই। স্যারই এই গ্যাংয়ের কিছু একটা করুক। নির্দোষ মেয়েগুলাকে কতটা নিষ্ঠুর ভাবে মারছে! ছিঃ,,, 

লোকটা পকেট থেকে ফোন বের করে। রন্জুর নাম্বার বের করে ফোন দিয়ে কানে উঠায়। কিছুক্ষণ রিং হয়। লোকটা টেবিলে আঙুল দিয়ে টকটক করতে থাকে। রন্জু ফোন উঠায় না। লোকটা মুখ দিয়ে ‘চ’সূচক বিরক্তি প্রকাশ করে ফোনটা কান থেকে নামায়। আবার ফোন দেয়। কানে তুলে রঞ্জুর ফোন ধরার অপেক্ষা করতে থাকে। রিং হয়, রিং হয়।রন্জু ফোন উঠায়। লোকটা গলার স্বর নামিয়ে বলে,

– স,স্যার, আসসালামুয়ালাইকুম। দুঃখিত আপনাকে অসময়ে ফোন দিয়ে বিরক্ত করার জন্য। 

– হ্যা বলো তামিম। আমি ফাঁকা আছি।

– স্যার, কাল রাতের খুন গুলা সম্পর্কে শুনছেন! সেইখানের যে ৩ পথচারী মেয়ে ছিলো তারা আমাদের থেকে নতুন জীবন পাওয়া ৩ মেয়ে। তারা পিঠা বেচতো লেকপুর মোড়ে। তাদেরকেও বিনা দোষে মেরে ফেলছে স্যার। আমি সিসি টিভি ফুটেজ কালেক্ট করে দেখছি। 

– আমাদের থেকে জীবন পাওয়া ৩ মেয়ে ? ঐ যে দৌলতপুরের বিষয়টা? 

– হ্যা স্যার। দৌলতপুর থেকে যে মেয়ে গুলাকে আনছিলেন, ঐখান থেকে যে ৩ জনকে আমরা ছেড়ে দিলাম, ওদেরকে মেরে ফেলছে স্যার।

– কারা মারছে।

– স্যার একটা কিশোর গ্যাং। নাম টিএনটি গ্যাং। সবার বয়স ১৭-২০ এর মধ্যে স্যার। আপনি কিছু একটা করেন স্যার। ওরা আগেও এমন টাকা ছিনতাই করতে গিয়ে নির্দোষ লোকদের মেরে ফেলছে।

– এই কিশোর গ্যাংয়ের পুরো ডিটেইলস আমাকে মেইল করো। কোথায় এদের আস্তানা, তাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড এভরিথিং।

– ও,ওকে স্যার। আমি এখনি সব খুঁটিনাটি বের করে আপনাকে মেইল করছি স্যার।

– ওকে। আর এরপর ফোন দেওয়ার আগে মেসেজ করবে। আমি সবসময় একলা থাকিনা। ঘরে ও থাকে। আমি ফাঁকা থাকলে তোমাকে কল ব্যাক করবো। বুঝতে পারছো!

– জী জী ঠিক আছে স্যার। আমি এরপর থেকে ফোন দেওয়ার আগে মেসেজ দিবো।

– হমম। রাখো। 

– ওকে স্যার। আসসালামুয়ালাইকুম। 

তামিম কান থেকে ফোনটা নামায়। বাপরে বাপ। রন্জুর সাথে কথা বলতে গেলে যেনো বুকটা নিজে থেকেই লাফাইতে শুরু করে। করবে না আবার, একটু কাজের হেরফের হইলেই যে তখন তার শরীরের কিডনী চোখ গুলা আর তার থাকবে না। 

তামিম ফোনটা পকেটে রেখে কম্পিউটারে কাজ শুরু করে দেয়। তাদের যত ইনফরমার আছে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এখন তাকে। যোগাযোগ করে এই টিএনটি গ্যাংয়ের সব মেম্বারসের চুল ছেঁড়া বিশ্লেষণ করতে হবে। তামিম কম্পিউটারে তার কাজ শুরু করে দেয়। এইটা হয়তোবা কন্ট্রোল রুম। চারপাশে বড় বড় যন্ত্রাংশ দেখে তো সেরকমই মনে হয়। 

 

___

 

নিপা গোসল খানা থেকে বের হলো। গরম পড়েছে এদিকে খুব আজ। তাই গোসলটা সেরে ফেললো। গোসল খানা থেকে বের হয়েই দেখে রায়হান ব্যালকনির দিকটা থেকে ঘরের ভিতর আসছে। তার এক হাত পকেটে। নিপা গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে। রায়হান তার পকেট থেকে ফোনটা বের করে বিছানায় রাখে। হাত ঘড়িটাও খুলে রাখতে থাকে। নিপা চুল মুছতে মুছতে রায়হানকে বলে,

– গোসল করবানা! 

– পরে করবো।

– পরে কখন করবা। আমি বালতিতে পানি ছেড়ে দিয়ে আসছি। যাও গোসল টা করে নাও।

– পানি যে ঠান্ডা!

– এই কাঠপোড়া গরমে তোমার গরম পানি লাগবে নাকি! 

রায়হান যেনো কোন এক ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসে। চারপাশ অবাক হয়ে দেখে বলে, 

– ও, আজকে গরম পড়ছে! আমার খেয়ালই ছিলোনা। 

– থাকবে নাতো। দুপুর হয়ে গেছে। গোসল করে নাও যাও। আঁখি খাবার নিয়ে আসবে, পরে তখন তুমি দৌড়াবা গোসল করতে। প্রতিদিন এই একি কাহিনী করো।

রায়হান তার হাত ঘড়ি খুলে বিছানার মাথার দিকটায় রাখে। উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, এগিয়ে এসে নিপার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– গামছাটা দেও। 

নিপা তার হাতের গামছাটা রায়হানকে দেয়। রায়হান তা কাঁধে নিয়েই গোসল খানার দিকে চলে যেতে থাকে। নিপা লক্ষ্য করে, কোন কারণে হয়তো রায়হানের মুড অফ হয়ে আছে। মুখে চিন্তার ভাঁজ তার। রায়হান গামছা নিয়ে গোসলখানার দিকে যেতেই যাবে, তখনই থেমে বলে উঠে,

– আজকে সন্ধ্যার দিকে একটু বেড়োতে পারি। 

– কেনো? তুমি তো অফিস তেমন একটা যাও না। আর গেলেও সকালে যাও। রাতের বেলা একলা থাকবো আমি!

– দরজা লাগিয়ে রাখিও। তেমন কিছু হবেনা। একটা দরকারি কাজ পড়েছে তাই যেতে হচ্ছে। 

নিপা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

– ঠিক আছে। কিন্তু বেশি রাত করে ফিরিওনা আবার। বাইক নিয়ে যাবা ? 

– না। 

– শ্যাম্পু দিতে চাইলে শ্যাম্পু দিয়ো। পাশের ট্রে টায় রাখা আছে।

– ঠিক আছে‌।

রায়হান গোসল খানায় ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিপা দুই হাত হালকা তুলে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

– রায়হানের আবার কী হইলো! হয়তো কোন বিষয় নিয়ে মন খারাপ। যাকগে, ওর কাপড় গুলা বের করে রাখি। গোসল করে আসে নাইলে কাপড় কই কাপড় কই করবে।

বলেই নিপা এগিয়ে যায় আলমারির দিকে। বিছানার ওপাসটায় আলমারি। নিপা তার ভিজা চুল গুলা একটা ঝাড়া দিয়ে মেলে দেয় হাত দিয়ে। আলমারির সামনে এসে আলমারির দরজা খুলে। ভিতরে টাঙানো রায়হানের ব্লেজার গুলা সড়িয়ে সড়িয়ে ভাঁজ করা কাপড় দেখতে থাকে। বিরবির করে বলে,

– এইযে, আমি কালকে কাপড় গুলা ভাঁজ করে রাখলাম আর আজকেই সব আউলা-ঝাউলা। ও একটা কাপড় আস্তে করে টান দিয়ে বের করতে পারেনা! এতো বড় হইছে তাও ছোট দের মতো করে। 

নিপা সব কাপড় গুলা একখানে করে হাতে নেয়। বলে,

– এখন আবার গোছানো লাগবে এগুলা। বিছানায় বসলে বিছানার চাদর জড়ো করে, খাইতে বসলে ভাত ফেলায়, মানে রায়হান কী আর বড় হবেনা! কয়দিন পর বাচ্চার বাপ হবে, এখনো ওর বাচ্চাগিরিটাই গেলো না।

নিপা কাপড় গুলো একসাথে করে নেয়। পাশে কিছু পুরান কাপড়ও ছিলো। ঐগুলা রায়হান পড়তো না। তবুও ঐগুলা অগোছালো থাকায় নিপা ঐগুলাও দুই হাত দিয়ে ধরে সব কাপড় বের করে নেয় আলমারি থেকে। নিয়ে এনে বিছানায় রাখে। তখনই সে পিছন ফিরে তাকায়। তার কেনো জানি মনে হলো ফ্লোরে কিছু একটা পড়েছে। নিপা কাপড় গুলো সব হাত থেকে বিছানায় রেখে এগিয়ে আসে। ফ্লোরে একটা ভাঁজ করা কাগজ পড়ে আছে। নিপা হেলে কাগজটা উঠায়। কাগজে ধুলো জমে গেছে। একহাত দিয়ে কাগজ টা হালকা ঝেড়ে কাগজের ভাঁজ খুলতে থাকে। কাগজটা খুলার পর তাতে থাকা জিনিস টা দেখার পর পরই যেনো নিপার চোখ মুখ বড় হয়ে যায়। এইটা তো সেই নকশা! নিপা এটা কতদিন ধরে খুঁজছিলো! কিন্তু পায়নি। ও এইটা ওর হাত ব্যাগে রেখেছিলো। পরে একদিন বের করেছিলো দেখার জন্য। কিন্তু রায়হান চলে আসায় আর ভালোভাবে দেখা হয়নি। তারপর যে সে কোথায় রেখেছিলো আর মনে করতে পারেনি। অনেক খুঁজেছিলো। কিন্তু পায়নি। কাগজ টা আলমারিতে ছিলো তাইলে! তাও আবার রায়হানের পুরোনো কাপড়ের মাঝে! নিপা কাগজটা থেকে মুখ তুলে সামনে তাকায়। ভ্রু উচিয়ে বলে,

‘ এটা রায়হান কেনো লুকাতে গেলো! নাকি অন্য কেউ লুকিয়েছে! কিন্তু ঘরে তো আঁখি ছাড়া কেউ আসেনা। আর আঁখি আসলেও সে তো আলমারির দিকে যায়না। তাহলে! নাকি আমিই ভুলে ওখান টায় রেখেছিলাম! আর এই কাগজটাতেই বা এটা কিসের নকশা! যা আমার থেকে বারবার হারিয়েও ফিরে আসছে!!! ‘

 

_____

 

পরন্ত বিকেল। আকাশে মেঘ জমেছে কিছুটা। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে পাশের চেরি ব্লসম গাছ টা থেকে। দোতলার মাঝের গোল ব্যালকনি বারান্দায় বসে আছে শাহারিয়া আর দিথী‌। দিথী একটা টুলে বসে বই পড়ছে। তার ঠিক পিছনেই শাহারিয়া চেয়ার নিয়ে বসেছে। দিথীর চুল গুলো পায়ের রানের উপর রেখে বেনি করে দিচ্ছে। দিথীর হাতে একটা ইসলামিক বই। বেশ মনযোগ দিয়েই পড়ছে ও। শাহারিয়া দিথীর প্রায় অর্ধেক চুল বেনুনি করে ফেলছে। শাহারিয়া মৃদু গলায় বলে,

– বউজান।

– হমম। 

– তোমার চুল গুলা একদম মায়ের মতো, অনেক লম্বা। 

– হমম। মা বলতো, তার চুল গুলাও নাকি অনেক লম্বা ছিলো আগে। এখন কেটে ফেলছে বলে‌।

– হ্যা। মায়ের চুল আগে কোমর পর্যন্ত ছিলো। ঠিক এখন যেমন তোমার আছে ওরকম। দেখতে একদম ঘন কালো। তোমার চুল গুলার মতো।

– তোমার চুল গুলার থেকেও বেশি কালো! 

– আমার গুলা! ঐগুলা আর কই এতো কালো‌। তোমার গুলা বেশি কালো। (একটু থেমে) আমি সেই কলেজ থেকে চুল কালি করি। আমার চুল গুলা কেনো জানি তাড়াতাড়ি পাকে যাইতো ছোট থেকেই।

– চুলে কেউ মধু দিছিলো নাকি! 

– কে জানে। মনে নাই এমন কিছু। (একটু থেমে) তোমার সিঁথিটা সুন্দর। লম্বা একটা সিঁথি। মা বলতো যাদের সিঁথি লম্বা হয় তাদের নাকি দূরে বিয়ে হয়। আবার যেই ছেলেদের মাথায় দুইটা গোল বৃত্ত থাকে তাদের বলে দুইটা বউ হয়। এখন দেখতেছি সবই ভুল।

– ভুল কেনো ? 

– এইযে, তুমি তো একই গ্রামের আমাকে বিয়ে করছো। কই আর দূরে হইলো। আর আমার মাথায় দুইটা গোল আছে, কিন্তু বউজান, সে তো শুধু মাত্র তুমিই! 

দিথী মৃদু হাসে। বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলে,

– বিয়ে করার ইচ্ছা আছে নাকি আরো ? 

– নাহ্। মাথা খারাপ। মন যা বাঁধার ঐটাতো একজনের সাথেই বাঁধছি। মন ভাগাভাগি করতে পারবোনা।

দিথী বই পড়তে পড়তে একটা লাইন আঙ্গুল দিয়ে শাহারিয়াকে দেখায়। বলে,

– এইখানে কী বলছে ? 

– কোনটা ? 

শাহারিয়া মুখ বাড়িয়ে দেখে। বিরবির করে লাইনটা মনে মনে পড়ে। তারপর বলে,

– ‘কুল্লু নাফ্সিন্ যা-য়িকাতুল্ মাওত্’। এটার অর্থ হলো প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এটা কোরআন শরীফের সূরা আল ইমরানের একটা আয়াত। ১৮৫ না ১৮৬ নাম্বার আয়াত জানি।

দিথী কিছুটা ধীর মলিন গলায় বলে

– আমি আর তুমিও একদিন মারা যাবো তাই না! 

– হ্যা। মৃত্যু হলো চিরন্তন সত্য। এটা হবেই। এটা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। 

দিথী সামনে তাকায়। অনড় দৃষ্টি তার। কিছুটা মন খারাপ করেই বলে,

– মৃত্যুর পরের জীবন, তখন আমরা জান্নাত-জাহান্নামে চলে যাবো।

– হ্যা। সেটাই চিরস্থায়ী আবাস আমাদের। 

– তুমি জান্নাতে যাবে, তাই না! 

– এইটা আমি কী করে বলবো। এটা তো আল্লাহ তায়ালা জানেন। আর যে দুনিয়াতে যেমন করবে তেমনই ফল পাবে। নেকির পাল্লা ভারি হলে জান্নাত তার জন্য পুরস্কার স্বরূপ থাকবে। 

দিথী বইয়ের দিকে তাকায়। পৃষ্ঠার নিচের দিকটায় জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা দেওয়া ছিলো। দিথী চুপচাপ কিছুক্ষণ সেটা পড়ে। শাহারিয়া তার মাথায় বিনুনি করে দিতে থাকে। সেই ভেজা চুল নিয়ে বসেছিলো দু’জন আড়াইটা-তিনটার দিকে। এখন বিকাল ৫ টা বেজে গেছে। দিথীর চুল শুকিয়ে তাতে হালকা তেল দিয়ে এখন বিনুনি করে দিচ্ছে শাহারিয়া। 

দিথী বেশ কিছুক্ষণ পড়ার পর বলে উঠে,

– আচ্ছা, এখানে লেখা আছে কোন পুরুষ যদি জান্নাতে যায়, তার জন্য বলে ৭২ জন হুর-পরী থাকবে। এটাকি সত্য ?

– হ্যা এটা সত্যি। একেকজন পুরুষদের জন্য ৭২ টা করে হুর পরী থাকবে। কেনো ? 

– ইহকালে সেই পুরুষ টা যার সাথে সারাজীবন কাটিয়েছে, বিয়ে করেছে, সে কী তার স্বামীর সাথে জান্নাতে থাকতে পারবেনা ? 

– ইসলামী বিভিন্ন কিতাবে উঠে আসছে যে কোন নেককার নারী যদি জান্নাতে যায়, এবং তার স্বামীও যদি জান্নাত পায়, তাহলে সেই নারী তার স্বামীকেই জান্নাতে নিজের সঙ্গী হিসেবে পাবে। আর সে তার স্বামীর সাথে থাকা হুর পরী দের নেতা হবে। 

– আমরা দুইজন যদি জান্নাতে যাই, তাইলে আমি তোমাকে পাবো! 

– দুইজনের নেকি বেশি থাকলে অবশ্যই জান্নাত পাবো। আল্লাহ যা বলেছেন সেই হিসেবে তো এটাই দাঁড়ায়।

– তাইলে তখন আমি তোমার হুর-পরীদের নেতা হয়ে ওদের ভাগিয়ে দিবো। তুমি শুধু আমার থাকবা। তোমাকে আমি আর কারো হতে দিবোনা।

– হুর গুলাকে ভাগিয়ে দিবা! কী বলো এইসব!

– তুমি এতোক্ষণ যা বললে তা যদি সব সত্যি হয় আর আমরা যদি জান্নাতে যেতে পারি তাইলে আমি এমনটাই করবো। তুমি শুধু আমার স্বামী হয়েই থাকবে। ইহকালেও, পরকালেও।

– ঠিক আছে। আমার আপত্তি নেই। তোমাকে পেয়ে এমনিতেও আমি অনেক খুশি। 

দিথী হাসি মুখ করে বইয়ের দিকে তাকায়। পড়তে থাকে বইটা। শাহারিয়ার বেনুনি করা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শাহারিয়া বলে,

– কালকে আহনাফ আসবে। দক্ষিণের রুমটা খুলে দিতে হবে। 

– আহনাফ আসবে ? কেনো ? 

– ঐযে রন্জুর বিষয়টা নিয়ে। ও বলে কী তদন্ত করে বের করছে। এদিকে তো আমি সিলেটের একটা মার্ডার কেস নিয়ে এতো দিন ব্যাস্ত ছিলাম। তাই রন্জুর কেস নিয়ে মাথা ঘামাতে পারিনি। এই দুইদিন হলো এই কেস শেষ করার। এখন তেমন হাতে আর কোন কাজও নাই। ঐদিকে ও বলে কি মিলাইছে, ঐ অনুযায়ী গেলে বলে আমরা খুব তাড়াতাড়িই রন্জুকে ধরতে পারবো। ঐজন্যই আরকি আসতেছে‌।

– ফ্রিজ থেকে মাংস বের করবো ? 

– না। ও মাংসের থেকে মাছ বেশি পছন্দ করে। মাছ আছেনা ফ্রিজে? ঐটা বের করিও।

দিথী ঠোঁট উল্টে বলে,

– ঠিক আছে!

 

শাহারিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। দিথী ইদানিং অনেক পাল্টে গেছে। ও আগের মতো আর ছেলেমানুষী করে না। যখন ফাঁকা থাকে তখন ইসলামিক বই পড়ে। আগের মতো চঞ্চলও নেই ও। বেশ শান্ত হয়ে গেছে। শাহারিয়া স্বাভাবিক গলায় বলে,

– বউজান।

– হমম,,

– তুমি অনেক বদলে গেছো।

দিথী বই থেকে মাথা না তুলেই বলে,

– যেমন! 

– যেমন আগের মতো দুষ্টামি করো না। ভদ্র মেয়ের মতো থাকো, এই আরকি। 

– কেনো আগের আমি তোমার বেশি পছন্দ ছিলো! 

– তুমি যেমনই থাকো না কেনো। তুমি আমার কাছে সবসময়ই প্রিয়। (একটু থেমে) তবুও, আগে তোমার বিহেবিয়্যার ছিলো টিন এইজ দের মতো। আর এখন, এক পরিণত নারীর মতো। যে স্বামীর প্রতি সবসময় যত্নবান, আর সহমর্মি।

– মানুষ বদলায়, পরিবেশ তাকে বদলে দেয়। কখনো মানুষ স্বার্থের লোভে বদলায়, কখনো বা নিজ বিবেক, ভালোবাসা, আবেগ, এসবের জন্য বদলায়। আমি এমন হয়েই থাকতে চাই। নিজ সত্বাকে ধারণ করে, নিজ রুপে। (হাসিমুখে) একমাত্র তোমার বউজান হয়ে! 

দিথীর শেষ কথাটা যেনো অন্য সুর হয়ে ঠেকে শাহারিয়ার কাছে। কথাটার প্রথম টা ছিলো যেনো আক্ষেপে মোরা। আর শেষটা, নিজ শান্তির অনুভূতি আবেশ। শাহারিয়া দিথীকে আর কিছু বলেনা। চুল বেনুনি করা শেষ করে। বেনুনি করা চুল দিথীর সামনে রাখে। দিথীর মাথার সিঁথির মাঝবরাবর একটা ছোট্ট চুমু খায়। দিথী ম্লিন হাসে। তার এই হাসিটায় ছিলো অনেক কিছু পাওয়ার হাসি, সুখের আশায় থাকা বুকটাকে আবেগে বাঁধার খুশি! 

 

____

 

সন্ধ্যা নেমেছে হলো অনেকক্ষণ। চারপাশে আঁধার নেমেছে। দূরের কোন এক মাইক থেকে ওয়াজ মাহফিলের বক্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। আনন্দ মোহন কলেজ মাঠে ওয়াজ হচ্ছে। মেম্বার বাড়ির আঙিনায়, আর বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে দেয় সুমু। তার পড়নে খয়েরী রঙের একটা থ্রী পিস। এই এক মাসে তার চেহারায় বেশ ভালো রকমই পরিবর্তন এসেছে। স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। কিছু চুল একপাশে এখন সেতি করে রাখে। কিছুটা ফর্সাও হয়েছে, যদিও আগে থেকেই সাদা চামড়ার অধিকারী ছিলো, তবুও মাঝে কিছুদিন রোদে ঘুরে ঘুরে একটু শ্যাম বর্ণের হয়ে গিয়েছিলো। এখন আবার আগের মতো ফর্সা হয়ে গেছে। 

সুমু লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বারান্দার গ্রিল দরজার দিকে আসে। শিউলি বেগম রান্না ঘরে, তিনি নাস্তা বানাচ্ছেন। ফুলমতি গিয়েছে বাড়ির পিছনের দিকে। বাড়ির পিছনে একপাশে ছোট যায়গায় লাউ-কুমরোর গাছ লাগিয়েছিলো তারা। সেখান থেকে লাউ কেটে আনতে। লায়লা আর হনুফা গেছে ওয়াজ শুনতে। দুইটাই দিন দিন যেনো ছোট বাচ্চা হয়ে উঠছে। হনুফা বাইরে গেলে বাকিদের চোখে অদৃশ্য হিসেবে ধরা দেয়। তখন শুধু লায়লাই তাকে দেখতে পায়। আর বাসায় এলে তখন সে বাকিদের সামনেও আসে। হনুফাকে এখন আর ভয় পাননা শিউলি বেগম। হনুফাও এখন খাবার খায় মাঝে মাঝে, যদিও সে সাদা আত্মা, বা জ্বীনই বলা যায়। তবুও মাঝে মাঝে মাংস খায়। পুরান কালে যেমন পেতনিরা মাছ খেতো, তেমনি হনুফা নতুন কালের পেতনি ভূত, ওর খালি মাংস হইলেই হইছে। লুকায় লুকায় খায় ফেলবে। সুমু এই নিয়ে বকা ঝকা করতে গেলে আরো উল্টা তাকেই ভয় দেখায়। বলে যে আফাজের বিষয়ে গ্রামে সবাইকে বলে বেড়াবে। সুমুও আর তাই বকাবকি তেমন একটা করে না। 

 

সুমু বারান্দার গ্রিল দরজা ছেড়ে ভিতরে রুমে দিকে চলে যেতে নেয়, তখনই বাড়ির মূল গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকে আফাজ আর মতিন মেম্বার। আফাজের হাত এখন ঠিক হয়ে গেছে। তবে সে মানসিক দিক দিয়ে আগের মতোই রয়ে গেছে। সারাদিন ঘরে মনমরা হয়ে বসে থাকে। এইজন্য মতিন মেম্বার তাকে নিয়ে মাঝে মধ্যে একটু বের হন। বিকালে বেড়িয়েছিলো দু’জন। এখন বাড়ি ফিরলো তারা। মতিন মেম্বার আর আফাজ কথা বলতে বলতে আঙিনা পেড়িয়ে বারান্দার সামনে চলে আসে। মতিন মেম্বার জুতা খুলে আগে উপরে উঠেন। তার ঘরের দিকে চলে যান। সুমু গিয়ে দরজার একপাশে দাঁড়ায়। আফাজ জুতা খুলে ভিতরে উঠার সাথে সাথেই তার হাসি মুখখানা বেজার হয়ে যায় সুমুকে দেখে। আফাজ ইদানিং কেনো জানি সুমুকে এড়িয়ে যায়। সুমুকে দেখলেই মুখ কালো করে থাকে। আফাজ বারান্দায় উঠতেই সুমু উৎসুক হয়ে বলে উঠে,

‘ ওয়াজ শুনতে গিয়েছিলেন! ‘

আফাজ কিছু বলে না। সুমুর পাশ দিয়ে উঠে চলে যেতে নেয় তখনই সুমু আবার বলে উঠে,

‘ নাস্তা করবেন এখন! মা নাস্তা বানাচ্ছে। হলে আমি নিয়ে যাবো আপনার ঘরে! ‘

আফাজ কন্ঠ ভারি করে বলে,

‘ আমি খেয়ে এসেছি। কিছু খাবোনা ‘ 

‘ অল্প খান, মা রান্না করেছে। আমি নিয়ে আসবো! ‘

‘  আমি একটু একলা থাকতে চাই। (সোজা সামনে তাকিয়ে) তুমি না আসলেই বেশি খুশি হবো ‘

বলেই আফাজ হনহন করে চলে যায় তার ঘরের দিকে। সুমুর খারাপ লাগে খুব। আফাজ ইদানিং ওকে খুব আঘাত দিয়ে কথা বলে। অবহেলা করে। সুমু তারপরও নির্লজ্জের মতো আফাজের পিছন ঘুর ঘুর করে। সুমুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ওড়নার কোন দিয়ে চোখের পানি মুছে সে। শিউলি বেগম নাস্তার বাটি হাতে আঙিনা থেকে বারান্দায় উঠেন। তিনি আঙিনায় দাঁড়িয়ে আফাজ আর সুমুর কথা শুনেছেন। শিউলি বেগম এসে সুমুর পাশে দাঁড়ান। সুমু তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে থাকে। শিউলি বেগম একহাতে বাটি ধরে আরেক হাত দিয়ে সুমুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ম্লিন গলায় বলেন,

‘ পুরুষ মানুষ এমনই মা। ওরা ভালোবাসা দিয়া পাগল করতে পারে, আবার আঘাত দিয়া চুরমার কইরা দিতে জানে। কষ্ট পাইয়ো না। সব ঠিক হইয়া যাইবো। ‘

‘ মা, আমি কী উনার মনের মতো হতে পারবোনা! উনি কেনো আমার সাথে এমন করছেন! ‘

‘ কাঁইন্দো না মা। অয় অর নিজের মধ্যে নাই। অয় অর ভালোবাসারে নিয়া পইড়া আছে। তুমি ভাইঙ্গা পইড়ো না। আফাজ এহানে আছে আলিশার খুনিরে ধরার লাইগা। তুমি এরপর ওরকাছে যাইয়া কইয়ো তুমিও আলিশার খুনিরে খুঁইজা বাইর করতে অরে সাহায্য করবা। অয় যদি কয় তোমারে লাগবোনা, তুমি কইবা তুমি অর বন্ধু হইয়া অরে সাহায্য করতে চাও। আর কিছুই না। দেইখো, অয় মানবো। আস্তে আস্তে বন্ধু হও, তারপর নিজেদের মধ্যে সবকিছু শেয়ার করো। আস্তে আস্তে সব ঠিক হইয়া যাইবো। ‘

সুমু কিছু বলে না। সে শিউলি বেগম জড়িয়ে ধরে থাকে। শিউলি বেগম তাকে তার থেকে ছাড়িয়ে ডায়নিং টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে থাকেন। তিনি বাটিতে করে নুডুলস এনেছিলেন। তবে আফাজ যেহেতু খেয়ে এসেছে, তাই সুমুকেই এটা খাইয়ে দিবেন। 

বাইরের আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। হালকা বাতাস বয়ে যায়। দূরে কিছু কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। হয়তো তারা আনন্দ পুর ভিজিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

 

______

 

((২য় ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে))

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৭ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৭ (২য় ভাগ)

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া 

 

((১ম ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে))

 

সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা। নিপা ব্যালকনির রেলিংয়ের সাথে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দেয়। চারপাশ নিস্তব্দ। কোন শব্দ নেই। নিচের বাগানের দিকটাও অন্ধকার। এদিকের লাইট টা বোধহয় ফিউজ হয়েছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা করেছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। মাঝে মাঝে এক পশলা দখিনা হাওয়া এসে নিপার খোলা চুল গুলো উড়িয়ে তার মুখের সামনে আনছে। রায়হান বাসায় নেই। বেড়িয়েছে সেই বিকেলে। বলেছে ফিরতে মাঝ রাতও হতে পারে। তাই খেয়ে-দেয়ে দরজা এঁটে নিপাকে শুয়ে পড়তে বলেছে। নিপা এখন একটু অন্যমনস্ক। এক দৃষ্টে সামনের অসীমে তাকিয়ে কিছু ভাবছে আর ধোঁয়া ওঠা চায়ে কিছুক্ষণ পর পর চুমুক দিচ্ছে। পাশের লম্বা গাছটা থেকে পাখির শব্দও তেমন একটা শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ! নিপা চকিতে ফিরে তাকায় নিচের বাগানের দিকে। দেখতে পায় পিছনের পুকুরের দিক থেকে কেউ বা কারা যেনো টর্চ লাইট হাতে এগিয়ে আসছে বাগানের দিকে। তারা সেই পথ ধরেই এগিয়ে আসছে যেই পথে এমনি সচরাচর সবাই বাড়ির পিছনের দিকে যায়। নিপা কী মনে করে যানি তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে রেলিং ধরেই বসে পড়ে। রেলিংয়ের খুটির ফাঁক ফোকর দিয়ে তাদের দেখতে থাকে। একটা লোক টর্চ লাইট হাতে বাগানের সাইড দিয়ে যাওয়া পথ টার দিকে এগিয়ে আসছিলো। সাথে ছিলো একটা মেয়ে! মেয়েটা থ্রী পিস পড়া। মুখটা দেখা যায়না, মুখে ওড়না দিয়ে ঘোমটার মতোন দেওয়া। সামনের লোকটা টর্চ দিয়ে চারপাশ দেখছিলো আর এগিয়ে আসছিলো। তখনই হঠাৎ লোকটা টর্চ তাক করে নিপাদের ব্যালকনির দিকে‌। নিপা তৎক্ষণাৎ বসে থাকা হতে পিছিয়ে যায় নিঃশব্দে। উপরে দেখেই লোকটা আবার টর্চ ঘুরায়। নিপা আবার ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে। রেলিংয়ের খুটির ফাঁক দিয়ে নিচে তাদের দিকে দৃষ্টি তাক করে। দেখে লোকটা আর কেউ নয়, তার শশুর নজরুল খাঁন। তবে সাথের মেয়েটা তাইলে কে ? তার শাশুড়ি মা বলে তো মনে হচ্ছে না। মেয়েটাকে দেখে তার বয়সীই মনে হচ্ছে। নজরুল আর সেই মেয়েটা বাগানের পাশের রাস্তাটা দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় নজরুল সাহেব বারবার চারপাশে টর্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলেন। যেনো তিনি কোন অপরাধ করে চোরের মতো ভয়ে পালাচ্ছেন। নিপা ধীরে ধীরে তাদের চলে যাওয়াটাকে দেখে। নজরুল আর সেই মেয়ে বাগানের পাশের রাস্তাটা দিয়ে বাড়ির সামনের দিকে চলে যায়‌। নিপা বসা হতে উঠে দাঁড়ায়। ভাগ্যেস চায়ের কাপে চা ফুরিয়ে এসেছিলো। নাইলে গরম চা সবটুকুই যে তার উপর পড়ে যেতো বসার সময়। নিপা চায়ের কাপটা ব্যালকনিতে থাকা ছোট্ট টেবিল টায় রাখে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচের দুইপাশ টা দেখে। এখন আর কেউ নেই। আবার আগের মতো নিস্তব্দতা নেমে এসেছে। নিপা ভাবে,

 ‘ দেখে তো আমার শশুর আব্বাই মনে হলো। উনি এই রাতে পিছনে কোথায় গিয়েছিলেন ? ‘

তখনই নিপার মনে পরে যায় সকালে পাওয়া নকশাটার কথা। সেই নকশাটা, যেটা ১ মাস আগে সে পেয়েছিলো ঘরের দরজার সামনে। কিন্তু এই ১ মাস কেমন করে যেনো নকশাটা তার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো, আর আজ সে সকালে রায়হানের পুরান কাপড়ের ভাঁজের মাঝে পেয়েছে। নিপা ব্যালকনি থেকে ঘরে আসে। সে একটু অস্থির। এসে ডেসিন টেবিলের দিকটায় যায়। ডেসিন টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানের নিচের ২য় ড্রয়ার টা খুলে। সেটা থেকে একটা বোয়ম বের করে। বোয়ম না, বলা যায় ঘামাচি পাওডারের বোতল। নিপা সেটা বের করে ড্রয়ার লাগিয়ে দেয়। ঘামাচি পাওডারের বড় মুখটা এক হাতে ধরে, আর বাকি অংশ টা আরেক হাতে ধরে জোরে আলাদা করার চেষ্টা করে। প্রথম চেষ্টায় না পারলেও দ্বিতীয় চেষ্টায় তা খুলে যায়। পাউডার ছিটকে পড়ে চারপাশে। দিনের বেলা ধীরে সুস্থে খুলেছিলো তাই পাউডার বাইরে ছিটকে পড়েনি। কিন্তু এখন সে একটু বেশিই অস্থির। তার ভিতর টা যেনো দৌড়াদৌড়ি করছে। নিপা সেই বোতল থেকে তার নকশাটা বের করে। এর থেকে লুকানোর ভালো যায়গা তার মাথায় আসেনি। তাই এখানেই রেখেছিলো নকশাটাকে। নিপা তার গাঁয়ের পাউডার হাত দিয়ে ঝেড়ে বিছানায় বসে। নকশার ভাঁজ খুলে। নকশাটা A4 প্যাপারে হাতে-কলমে আঁকা ছিলো। নকশায় একটা বড় প্রাচীর এর মাঝে একটা মাঝারি আকৃতির চার কোনা চতুর্ভুজ আঁকা, তার পাশে আরেকটা ছোট চতুর্ভুজ, সেই খানে ছোট ছোট ফুল আঁকা। এই দুই চতুর্ভুজের মাঝে একটা ছোট রাস্তা আঁকা। রাস্তা চলে গেছে পিছনের দিকে। পিছনে একটা বড় চারকোনা আকৃতির জিনিস আঁকা। সেই জিনিসটার বা পাশে একটু ফাঁকা যায়গা। সেখানে তিনটা গাছ। সেই তিনটা গাছের মধ্যে মাঝের গাছটায় একটা ক্রস চিহ্ন দেওয়া। নিপা নকশা থেকে মুখ তুলে সামনে তাকায়। সে অবাক হয়। সে প্রথম ভেবেছিলো নকশাটায় হয়তো এই বাড়ির ভিতরের বর্ণনা দেওয়া। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে এই পুরো বাড়ির সিমানার উপর নকশাটা করা। নিপা আবার নকশার দিকে তাকায়। ছোট ছোট ফুল আঁকা চতুর্ভুজ টা দিয়ে নিশ্চয়ই বাগান টাকে বুঝানো হয়েছে। আর বাগানের পাশে এই বাড়িটাকে। মাঝের রাস্তাটা নিশ্চয়ই পিছনে যাওয়ার রাস্তা। আর পিছনের বড় চার কোনা জিনিসটা পুকুর। কিন্তু পুকরের বাম পাশে তো ও ছোট খাটো ময়লার ভাগাড় দেখেছিলো। আর সেই ময়লার ভাগাড় পেড়িয়েই তিনটা বড় বড় আম গাছ। এই তিন টা আম গাছই কী এখানে আঁকা! নিপা মোটে দুইবার পিছনের পুকুরের দিকে গেছিলো এই এক মাসের মধ্যে। রায়হানই তাকে নিয়ে গিয়েছিলো, যখন বাড়িতে তেমন কেউ থাকতো না। 

নিপা নকশাটা ভাঁজ করতে থাকে। সে এখনি যাবে এই ২য় গাছটার কাছে‌। কী থাকতে পারে এখানে? কোন লুকানো সিন্দুক ? না, এই নকশা তো রাজার আমলের না। পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে কেউ হাতে এঁকেছে কলম দিয়ে। আচ্ছা কেউ তার সাথে মজা করছে না তো? না না। কেনো কেউ তার সাথে মজা করতে যাবে। এই বাসায় তো বাচ্চা বা টিনএইজ বয়সী কেউ নেই। নিশ্চয়ই কেউ ইঙ্গিতে তাকে কিছু বুঝাতে চেয়েছিলো, কিন্ত সে না বুঝায় তাকে নকশা পাঠিয়েছে‌। নিপা নকশাটা ভাঁজ করে নেয়। বিছানা থেকে উঠা দাঁড়ায়। তাকে টর্চ লাইট জোগাড় করতে হবে একটা। পিছনে অনেক অন্ধকার। বাগানের লাইট টাও ফিউজ। টর্চ লাইট ছাড়া এই ঘোর অন্ধকারে সে যেতে পারবেনা। নিপা ফ্লোরে পায়চারি করতে থাকে। সে অস্থির, চঞ্চল। এর চেয়ে যাওয়ার ভালো সময় আর দ্বিতীয়টা পাবেনা সে। রায়হান বাসায় নেই। নজরুল সাহেবেকেও চলে যেতে দেখলো। সাথী তার ঘরে আছেন, আঁখি আর তার শাশুড়ি সুমনা রান্না করছেন। আর বাকিদের এখনো দিনাজপুরে অফিসে থাকার কথা। নিচের সুমনা বেগমের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনমতে সে বেড়োতে পারলেই আর কোন বাঁধা নেই। কিন্তু এখন টর্চ পাবে কোথায় সে ? 

নিপা ঘরের কোনে আসে। এদিকে একটা কাটুন রাখা। হেলে বসে সেটা উবুড় করে ঢেলে দেয়। সেখানে অনেক পুরোনো জিনিস ছিলো। কিন্তু টর্চ ছিলোনা। নিপা নেড়েচেড়ে দেখে, না এখানে নেই। নিপা উঠে দাঁড়ায়। এক হাত দিয়ে অন্য হাতে ঘুষি মারে‌। সামনে এগিয়ে গিয়ে ডেসিন টেবিলের ড্রয়ার গুলা খুলে খুলে দেখে। না, এগুলাতেও নেই। নিপা উঠে দাঁড়ায়। আঁখিকে ফোন দিবে ? কিন্তু আঁখিতো সুমনা বেগমের সাথে রান্না করছে। সুমনা বেগম যদি তখন কোন কিছু আন্দাজ করে ফেলে! নিপা পায়চারি করতে থাকে। ভাবতে থাকে টর্চ ছাড়া আর কীভাবে আলোর ব্যবস্থা করে যাওয়া যায়। তখনই হঠাৎ তার কী যানি একটা মনে পড়ে। সে তৎক্ষণাৎ বিছানায় উপর উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে সামানের আলমারির উপরের দিকে দেখতে থাকে।

 ‘ঐযে, ঐযে একটা টর্চ দেখা যাচ্ছে’ ,বলেই নিপা বিছানা থেকে তড়িঘরি করে নামে। আলমারির উপরের দিক ও এমনিতে নাগাল পাবেনা। তাই তাড়াতাড়ি ব্যালকনিতে গিয়ে একটা বেতের চেয়ার নিয়ে আসে। এনে আলমারির সাইডে রেখে ওটার উপর উঠে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে হস্তিয়ে দেখতে থাকে। তখনই তার হাতে লেগে যায় টর্চটি। তাড়াতাড়ি টর্চ টা নিয়ে চেয়ার থেকে নামে। টর্চ টা পুরাতন ছিলো। ধূলোবালি জমেছে তার উপর। নিপা হাত দিয়ে সামনের কাঁচের অংশটা কিছুটা মুছে সুইচ টিপ দেয়। হমম হালকা চার্জ আছে। তবে আলো কম। এই দিয়েই চলে যাবে। এখন চার্জে দেওয়ার সময় নেই। বাইরে যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে। বৃষ্টি নামলে তখন আর যেতে পারবেনা সে। নিপা এসে ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ওড়নাটাকে ভালোভাবে মাথার দিক থেকে বুকের উপর ভালোভাবে পেঁচিয়ে নেয়। অনেকটা ঘোমটার মতো করে। যাতে সে ওড়নার ঘোমটা টেনে মুখ লুকাতে পারে। কামিজ টা টেনে টুনে ঠিকঠাক করে দেয়। হাতে সেই ভাঁজ করা কাগজ আর টর্চ লাইট। ঘরের ফ্যানের সুইচ অফ করে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় নিপা। দরজা লাগিয়ে দেয় বাইরে থেকে। 

 

      সিড়ি দিয়ে নামছে নিপা। তার পায়ের একেকটা কদম খুবই ধীর-সন্তস্ত। বলা যায় একেবারে নিঃশব্দে নামছে সে। বাড়িটাও একদম নিরব। যেনো কোন ভূতুড়ে বাড়ি। উপরের বড় দেওয়াল ঘড়ির কাঁটার টিক টিক আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজই নেই। নিপা সিড়ির প্রায় নিচের দিকে চলে আসে। এখান থেকে ওর হাতের ডান দিকে রান্না ঘর আর অন্দরমহলের ডায়নিং টেবিল। নিপা উঁকি দেয় সেদিকে। কেউ নেই বাইরে। হয়তো আঁখি আর সুমনা বেগম রান্না ঘরে। নিপা ধীরে ধীরে পা চালিয়ে নামতে থাকে। তখনই হঠাৎ সুমনা বেগম রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। নিপা তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে সিড়ির দু কদম উপরে উঠে যায়। সিড়ির সাইডের দিকে বড় বড় লম্বা লাল,কমলা কাপড় ঝোলানো ছিলো। সেই কাপড়ের আড়াল হওয়ায় সুমনা বেগম নিপাকে দেখতে পাননি। নিপা দুই চোখ বাড়িয়ে দেখতে থাকে সুমনা বেগম কি করছেন। দেখে সুমনা বেগম রান্না ঘর থেকে একটা বাটি এনে ডায়নিং টেবিলে রাখছে। তার উপর একটা ঢাকনা ঢাকা দিয়েই শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আবার রান্না ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। নিপা ধীরে ধীরে পা নামায়। আস্তে আস্তে নেমে আসে নিচের বাকি ৫-৬ কদম সিড়ি। এক হাতে ওড়নার ঘোমটা টেনে অর্ধেক মুখ চেপে ধরেছে। আরেক হাত দিয়ে টর্চ আর ভাঁজ করা কাগজটা নিচের ওড়নার আড়ালে লুকিয়েছে। নিপা সিড়ি থেকে নামে চারপাশ দেখে। না। এখন আর কেউ নেই। নিপা এক লম্বা শ্বাস নিয়েই এক দৌড় লাগায় সোজা অন্দরমহলের মূল দরজার দিকে। এমন জোড়ে দৌড় দেয় যেনো পিছনে তার হাজার হাজার প্রেত আত্মা ছুটছে। নিপা এক দৌড়ে চলে যায় অন্দরমহলের দরজার বাইরে। 

 

______

 

শাহারিয়া কিচেনে প্রবেশ করে। এ বাড়ির কিচেন টাও শহুরে কিচেনের মতো। সব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। চুলা গুলা গ্লাসের। তার মাঝে ডিজাইন করা। পিছনে সেলফ। রান্না ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলেই হাতের বা পাশে ফ্রিজ। শাহারিয়া এগিয়ে যায়। দিথী রান্না করছিলো চুলার সামনে দাঁড়িয়ে। শাহারিয়ার দিকে দিথী একবার ফিরে তাকায়। আবার চুলার দিকে তাকিয়ে খুন্তি নাড়তে থাকে। শাহারিয়া এগিয়ে এসে দিথীর পাশে দাঁড়ায়। কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

– বউজান, কী রান্না করতেছো ? 

– টমেটো দিয়ে ইলিশ মাছ। 

– এখন তো পিঁয়াজ মরিচ ভাজতেছো।

– হ্যা। আগে এটা বাদামী করে তারপর বাকি গুলা দিবো। তোমার কাজ শেষ ? 

– হ্যা শেষ। আজকের মতো আর কোন কেসের এনালাইসিস বাকি নাই। ওগুলা ভাজা মাছ!

– হমম।‌

শাহারিয়া দিথীর একপাশ হতে আরেকপাশে যায়। একটা কাঁচের বাটিতে ভাজা ইলিশ মাছ রাখা ছিলো। শাহারিয়া সেখান থেকে একটা ঠুমা নিতে যায় তখনই গরম ছ্যাকা লেগে হাত টেনে নেয়। দিথী বলে উঠে,

– আরে আরে মাত্র ভাঁজে রাখলাম। গরম তো অনেক। 

– আগে বলবানা। 

– নিচের গুলা নেও। উপরের গুলা খালি তেল থেকে উঠাইলাম একটু আগে। 

শাহারিয়া বাটির সাইডের দিক থেকে একটা ছোট্ট ঠুমা উঠিয়ে নেয়। এটাও হালকা কুসুম গরম ছিলো। শাহারিয়া সেটা হাতে নিয়ে ফু দিতে দিতে দিথীর অপর পাশে এসে দাঁড়ায়। মাছে ছোট্ট একটা কামড় বসায়। দিথী খুন্তি নাড়তে নাড়তে বলে,

– আস্তে খাও, কাঁটা গলায় লাগবে।

– ভাজা মাছ, বড় কাঁটা ছাড়া বাকি সবটা এমনিই চাবায় ফেলবো। তুমি খাবা! নেও! 

শাহারিয়া মাছের টুকরাটা দিথীর মুখের সামনে ধরে। দিথী ছোট্ট একটা কামড় দেয়। শাহারিয়া দিথীর মুখের সামনে থেকে মাছ টা নিয়ে সেও একটা কামড় দেয়। খেতে খেতে বলে,

– ঐদিন বেশ কম দামেই পাইছিলাম মাছ গুলা। ছিলোই অল্প। বেশি থাকলে সবগুলা নিয়ে আসতাম।

– কয়টা বাজে এখন! রান্না শেষ করে নামাজ পড়া লাগবে। আরো বামের ঘর টা পরিস্কার করা বাকি।

– আমি ঘর পরিস্কার করে ফেলছি তোহ। অফিসের কাজ আমার কত আগেই শেষ হয়ে গেছিলো। কাজ শেষ করে ঘর পরিস্কার করে এখানে আসলাম। (হাত উঠিয়ে ঘড়ি দেখে) এখন ৮ টা ৫ বাজে। 

– ঘর পরিস্কার করে ফেলেছো! 

– তো করবো না! বসেই তো ছিলাম। তুমি রান্না করবা, তারপর আবার আসে ঘরদোর পরিস্কার করবা। চাপ হয়ে যাবেনা তখন! আমি একটু কাজ আগায় দিলাম। (বলেই মাছে আরেকটা কামড় দিয়ে খেতে থাকে) 

– রান্নাটা পারলে তো এইটাও করতে দিতানা আমাকে।

– ঠিক বলছো। এই রান্নাটাই শুধু আমার শিখা হইলো না। ঐদিকে আমি চোর ডাকাত রান্না করতে পারলেও কড়াইয়ে সবজি মাছ রান্না করতে পারিনা।

– এ আর এমন কি জিনিস। এইযে দেখো পেঁয়াজ বাদামি হয়ে গেছে। এখন লবণ হলুদ দিবা, তারপর কিছুক্ষণ নাড়ে টমেটো গুলা দিয়ে দিবা। 

– মাছই তো ভাজতে পারিনা। মাছ খালি পুরা যায়।

– তুমি তো আগে মনে হয় একবার মাছ ভাজতে গেছিলা না ঢাকায় থাকতে! 

– হ্যা। ঐযে প্রথম বার ফোনে কথা বলার সময় বলছিলাম। মাছ আমার সব পুরে কালা কালা হয়ে গেছিলো।

– তুমি তো মনে হয় মাছ তেলে দিয়ে গেছো তোমার ফাইল দেখতে। ঐজন্য এমন হইছে।

– আসলেই। আমি এমনটাই করছিলাম। তুমি জানলা কীভাবে! 

দিথী ভং ধরে বলে,

– উড়ে উড়ে আসে দেখছি! (একটু থেমে) কাজ যখন যেইটা করবা তখন সেইটায় মন দিবা। তাইলে দেখবা খুব সুন্দর ভাবে তোমার কাজ হয়ে গেছে। আর ১০ টা কাজ একসাথে করতে যাবা, দেখবা কোনটাই মন মতো হবেনা। 

– আমার দাঁড়া এই রান্না বান্না তাও সম্ভব না বাপু। আমি চোর ডাকাত ধরবো, আর খাবো ঘুমাবো।

– রান্না বান্নাও শিখে রাখো। (ম্লিন গলায়) আমি কী চিরকাল থাকবো নাকি!

– মানে! কী বলতেছো এইসব!

– ঠিকই তো বলতেছি। আমি কী সবসময় থাকবো! কাল সকালের সূর্য আমার দেখা হবে কি না সেই গ্যারান্টি কে দিতে পারবে বলো! আমাদের হায়াত, এই আছে এই নাই।

শাহারিয়া চুপচাপ হয়ে যায়। তার মন খুব খারাপ হয়েছে বোধহয়। সে ম্লিন গলায় বলে,

– এমন কথা বলিও না। আমি, আমি তোমাকে ছাড়া একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারিনা।

– আরে আরে মন খারাপ করতেছো কেনো। আমি এখন তো তোমার সাথে আছি তাই না! নেও এদিকে দেখো। পেঁয়াজ মরিচ ভাজা শেষ এখন টমেটো গুলা দিবো। টমেটো দিয়ে ভালো করে নাড়তে হবে কিন্তু। নাইলে লাগে যাবে। 

শাহারিয়া দিথীর কিছুটা পিছনে এসে দাঁড়ায়। তাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখে। দিথী কিছুটা অবাক হয়‌। শাহারিয়া ধীর গলায় বলে,

‘ তুমি আমার কাছে যুদ্ধে জয়ী সাত রাজার ধন, আমি কখনো তোমাকে হারিয়ে ফেলতে চাইনা। আমার মনের জোছনা, আমি কাউকে দিবোনা। ‘ 

‘ আরে বাবা আমি আছিতো, আমি ঐটা কথার কথা বললাম। চলে যাইনি এখনো। তুমি দেখি ইমোশনাল হয়ে গেলা। ‘

‘ তোমায় ছাড়া যেখানে একটা মুহুর্ত আমি ভাবতে পারিনা, সেখানে পুরোটা জীবন,,,, (একটু থেমে) আমি ভস্য হয়ে যাবো। ‘

‘ আচ্ছা আচ্ছা স্বাভাবিক হও এখন। এই দেখো এদিকে, এখন হালকা পানি দিবা, নেড়েচেড়ে তারপর মাছ গুলা দিয়ে দিবা। তারপর,,,,

শাহারিয়া দিথীর কাঁধে একটা ছোট্ট চুমু খায়। দিথী বাকিটা বলে না আর। সামনে ফিরে ম্লিন হাসি দিয়ে রান্না শেষ করে নিতে থাকে। শাহারিয়া চুপচাপ ছিলো বেশ কিছুক্ষণ। সে দিথীকে জড়িয়ে ধরে ততক্ষণ ছিলো যতক্ষণ না রান্না শেষ হয়। দিথীও তেমন না করেনি শাহারিয়াকে। এই স্পর্শ প্রথম প্রথম তার ঘৃনা লাগলেও, এখন সে এই স্পর্শ কে নিজের মাঝে আতস্ত করে নিয়েছে, তার আপনজনের স্পর্শ হিসেবে!

 

____

 

নিপা টর্চ জ্বালায়। সে বাড়ির বা পাশে চলে এসেছে। এদিকটায় একপাশে বাগান, আরেকপাশে দোতলায় তাদের রুমের ব্যালকনি। নিপা ধীরে ধীরে বাগান আর বাড়ির মাঝে থাকা ছোট্ট পথটা ধরে এগিয়ে যায়‌। টর্চ লাইটের আলো খুব বেশি একটা তীর্যক না। বেশি দূরের জিনিস দেখা যায় না। নিপা টর্চ চারপাশে ফেলে দেখতে দেখতে এগিয়ে যায়। আকাশ মাঝে মৃদু গর্জন করে উঠছে। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নিপা এগিয়ে যায়‌। বাগান থেকে নাম না যানা কোন এক ফুলের সুবাস এসে তার নাকে লাগে‌। গন্ধটা মোহময় ছিলো। নিপা সেদিকে মন দেয়না। পথ ধরে ধরে পা চালায়। 

বাড়ির পিছনের দিকটায় চলে আসে সে। হাতের ডানে কিছুটা দূরেই পুকুর টা। বাতাসে পুকুরের ঢেউ খেলার শব্দ এখান থেকে শোনা যাচ্ছিলো। নিপার কেনো জানি ভয় ভয় লাগছিলো। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশ মেঘলা, শো শো করে মাঝে মাঝে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। জিনিসটা যেনো তার গাঁয়ে কাঁটার মতো লাগছিলো। নিপা আরো কিছুটা সামনে আগায়। পিছন ফিরে তাকায়। বাড়িটাকে রাতের আঁধারে দেখতে যেনো কোন পুরোনো দানব মনে হচ্ছে। এক ভৌতিক রাজবাড়ীর মতো লাগছে। নিপার চোখ যায় বাড়ির বাম কোনের কোন এক রুমের জানালার দিকে‌‌। কোন এক ছায়া মানবী দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তার খোলা চুল গুলো হাওয়ায় উড়ছে। সেই ছায়া মানবী যেনো সেখান থেকে নিপাকেই দেখছিলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। নিপা এক ঢোক গিলে। ভয়ে তার গাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। এ আবার কোন অতৃপ্ত আত্মা নয়তো! নিপা মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকায়। চলে যেতে থাকে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়া মানবী সড়ে যায় জানালা থেকে। 

নিপা বেশ কিছুটা এগিয়ে আসে। বাড়ি আর পুকুরের মাঝে ভালোই একটা ফাঁকা যায়গা আছে। তবে সে সেদিকটায় যায়না। সে যায় পুকুরের বাম পাশের দিকটায়। দূর থেকে গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ ভেসে আসছে। এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরেই মেইন রোড। এখান থেকে সেই রোডের গাড়ির হর্ণের আওয়াজ গুলো মৃদু শুনতে পাওয়া যায়। নিপা দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। তার কী সামনে এগোনো উচিচ ? তার কিছুটা সামনেই ময়লার ভাগাড়। আর তা পেড়িয়েই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে তিনটা মোটা মোটা আম গাছ। নিপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, ‘ আচ্ছা, রায়হান কী এই বিষয়ে জানে ? মানে এই নকশা যেখানে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে সেইখান সম্পর্কে? (একটু থেমে) জানতেও পারে। নকশাটা তার কাপড়ের মাঝ থেকেই আমি পেয়েছি। হয়তো সে বিষয় টা আমার থেকে লুকোতে চাইছিলো! কী এমন জিনিস যা আমার থেকে লুকোতে চাইবে সে! ‘ তখনই হঠাৎ নিপা টের পায় সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে। সে তাড়াতাড়ি যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেখান থেকে লাফাতে লাফাতে সড়ে যায়‌। সে এক লাল পিপড়ার ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে ছিলো এতোক্ষণ। তার পা দুটোয় যেনো হাজার হাজার সুচ ফোঁটার যন্তনা হতে থাকে। নিপা লাফাতে লাফাতে দুই হাত দিয়ে পা ঝাড়তে থাকে। তার হাতেও কিছু পিঁপড়া লেগে যায়। সেগুলোও কামড়াতে থাকে। নিপা যন্ত্রনায় মুখ দিয়ে শব্দ করে উঠে, ‘ ও মা রে,, ইশশ। শেষ করে দিলো সব, সব কামড়ায় শেষ করে দিলো। ‘ 

নিপা হাত দিয়ে দুই পায়ের পিঁপড়া ঝেড়ে লাইট আর কাগজ নিয়ে কোনমতে দৌড় লাগায় পুকুর ঘাটের দিকে।

 

            নিপা পুকুর পাড়ের সিঁড়ির শেষ প্রান্তে পা ধুচ্ছে। ঠান্ডা পানি টা যেনো তার জলতে থাকা দুই পা’কে মৃদু প্রশান্তি এনে দেয়। লাইট আর কাগজ টা পাড়েরই দুই কদম সিড়ি উপরে রাখা। সেইটার আলোটাও নিপার দিকে করে রাখা। নিপা তার দুই পা হাঁটু পর্যন্ত আর দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত ভালো ভাবে ধুয়ে নেয়। সব পিঁপড়া পানিতে চলে গেছে, কিন্ত কামড়ানোর যায়গা গুলো খুব জলছে। পায়ের কিছু যায়গায় ফুলতেও শুরু করেছে। নিপার নিজের উপরই নিজের রাগ হতে থাকে। কেনো ঐখানে দাঁড়ায় চিন্তা ভাবনা করতে গেছিলো! দাঁড়ানোর আগে একবার দেখলোও না! আকাশ মৃদু চমকে উঠে। দূরে বোধহয় কোথাও বাজ পড়লো। নিপা পুকুর পাড় থেকে উঠে দাঁড়ায়। জ্বালা কিছুটা কমেছে, তবে একদম সেড়ে যায়নি। লাল পিঁপড়ার কামড়ের ব্যাথা কী এতো তাড়াতাড়ি যায়! নিপা উঠে দাঁড়ায়। জুতা পড়ে নিয়ে পাড়ের দুই কদম সিঁড়ি উপরে আসে। সেখানে রাখা টর্চ আর কাগজ টা হাতে নেয়। নিয়ে পুকুরের ঘাটের সব গুলো সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠে আসে। তখনই হঠাৎ বাড়ির কারেন্ট চলে যায়। বাড়ি একদম অন্ধকার হয়ে যায়। যেই দুই একটা জানালা থেকে আলো আসছিলো তাও আসা বন্ধ হয়ে যায়। বাতাসের বেগও কিছুটা বাড়ে। নিপা আর এক মুহুর্তও দেরি করে না। এগিয়ে যায় পুকুরের বা পাশের ফাঁকা যায়গায় থাকা গাছ গুলোর দিকে। এগিয়ে আসতে আসতে লাইট দিয়ে দেখে সেই লাল পিঁপড়ার ঢিবিটাকে। পিঁপড়ারা এখন কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছিলো। ঢিবির কিছুটা সামনে থাকা ময়লার ভাগাড় থেকে মোটা লাইন করে খাবার আনছে ওরা। এইজন্যই এখানে ঢিবি গড়েছে। নিপা খুব সাবধানে তাদের ঢিবি পাড় করে এগিয়ে আসে‌। এসে পা ঝাড়তে থাকে। যদি কোন পিঁপড়া আবার উঠে থাকে তাইলে যেনো সেগুলো পড়ে যায়‌। নিপা এগিয়ে যায়। ময়লার ভাগাড় পাড় করে। সামনে এগিয়ে এসে দেখে এই তিনগাছের যায়গাটা পরিস্কার করা। এইখানে যেনো কারো নিয়মিত চলাচল রয়েছে। নিপা এগিয়ে যায়। প্রথম আম গাছ টা দেখে। গাছ টা দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির মতো এটাও বেশ পুরোনো। তাই মোটাও অনেক। প্রথম গাছটা পাড় করে সে দ্বিতীয় গাছের সামনে এসে দাঁড়ায়। এই গাছ টাও ঠিক আগের মতোই। তেমন কোন লক্ষ্য নিও পরিবর্তন নেই। নিপা এই গাছ টার গোড়ার চারপাশ ভালোভাবে ঘুরে ঘুরে দেখে। না, এখানে তো তেমন কিছুই নেই। মাটি টাও শক্তই। নরম যদি হতো তাইলে হাত দিয়ে খুড়ে দেখতো। কিন্তু মাটি খুব শক্ত। কোদাল ছাড়া হাত দিয়ে খুড়তে পারবেনা সে। নিপা দ্বিতীয় গাছ টা পাড় করেই উল্টো হয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে তৃতীয় গাছটায় দিকে। সে মুখ করে ছিলো দ্বিতীয় গাছটার দিকে। গাছটাকে এদিক থেকে দেখে যদি কিছু পায়। সে পিছিয়ে যেতে থাকে, যেতে থাকে। হঠাৎ কোন এক শক্ত জিনিসে তার পা লেগে উল্টো হয়ে ধপাস করে পিছনে পড়ে যায়। লাইট হাত থেকে ছিটকে কোথাও একটা পড়ে যায়। সাথে সাথেই লাইট টা অফ হয়ে যায়। হয়তো শক্ত কোন কিছুর সাথে লাইট টা বাড়ি খেয়ে অফ হয়ে গেছে। নিপা এই ঘন কালো অন্ধকারের মাঝে হাত দিয়ে হস্তিয়ে লাইট টা খুঁজতে থাকে। সে উঠে দাঁড়াতে পারছিলো না। পাশেই এক হাত দূরে পুকুর। দাঁড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে যদি পা ফসকে একবার পুকুরের কাছে চলে যায় তাইলে খাড়া ভাবে ধপাস করে নিচে পানিতে পড়ে যাবে। নিপা হাত দিয়ে বারবার খুঁজেও লাইট টা পায়না। লাইট ছাড়া সে ফিরবে কী করে। চারপাশ যে ঘন ঘুটঘুটে অন্ধকার। তখনই হঠাৎ করো আসার আওয়াজ শোনা যায়। নিপা ফিরে তাকায়। দেখে দুইজন লোক বাগানের রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে এদিকেই আসছে‌। তাদের হাতে টর্চ জ্বলছে। নিপা ভয় পেয়ে যায়‌। সেই লোক গুলা যদি এদিকে আসে তাইলে তো সে ধরা পড়ে যাবে। নিপা কোনমতে হামাগুড়ি দিয়ে তৃতীয় গাছটার দিকে চলে যায়। সেই গাছ টা ধরে সেই গাছের পিছনে লুকায়। লোক দুইজন বাগানের পাশের পথ থেকে বেড়িয়ে এদিকেই আসতে থাকে। ময়লার ভাগাড়ের পাশ দিয়ে চলে আসে তারা। নিপা ভয়ে গাছটার সাথে একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়‌। চুপ হয়ে যায়। লোক দুটো এগিয়ে এসে দ্বিতীয় গাছটার সামনে দাঁড়ায়। নিপা ৩ নাম্বার গাছ টার আড়াল হতে এক চোখ বের করে সেদিকে তাকায়‌। লোক দুইজন আর কেউ নয়! তার শশুর নজরুল খাঁন, আর তাদের বাড়ির দাড়োয়ান রহিম চাচা। নজরুল সাহেব আর রহিম চাচা দ্বিতীয় গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন,

– ভিতর থেকে ৪ বস্তা নিয়ে আসবি। বাইরে রাফসান গাড়ি নিয়ে আসছে, ঐ গাড়িতে দিয়ে দিবি। বুঝছিস ? 

– যে আইচ্ছা স্যার। রানা, আর রতন কী গেছেগা ? 

– না। ওরা নিচে আছে। তুই গিয়ে ওদের থেকে বস্তা বুজে নিবি। ওরা প্যাকেট করে রাখছে। 

– আইচ্ছা ঠিক আছে‌। আইজ রাইতে খালি এই ৪ বস্তাই! 

– এখন আপাতত ৪ বস্তাই নিয়ে যা। (চারপাশ দেখে) বৃষ্টি নামতে পারে। পরে নাইলে আর নেওয়া যাবেনা। নাটোরের বায়ারকে এই মাল আজ রাতের মধ্যেই পাঠাইতে হবে। পরে বৃষ্টি থামলে বাকি মাল বাইর করবি। 

– যে আইচ্ছা ঠিক আছে। 

– যা এখন। এই নে চাবি। হারাইস না আবার।

– না না হারামু না। 

নজরুল সাহেবের থেকে চাবিটা নেয় রহিম চাচা। তিনি গাছটার গোড়ার দিকে হেলে বসতে থাকেন। নিপা তার পরের গাছটা থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখছে। তার ভয় হচ্ছে। গাল বেয়ে চপচপ করে ঘাম পড়ছে। রহিম চাচা গাছের গোড়ার দিকে হাত বাড়ান, নিপা চোখ বড় বড় করে তাকায়। যেনো সে খুব বড় কিছু দেখতে চলেছে। দাড়োয়ান গাছের গোড়ায় হাত দেয়। তখনই আবার হাত সড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিপা এমন হঠাৎ দাঁড়ানো দেখে আবার গাছের আড়ালে চলে যায়। দাড়োয়ান রহিম চাচা , নজরুলকে বলেন,

– আমি তো গামছা আনতেই ভুইলা গেছি। 

– গামছা দিয়ে কী করবি তুই ?

– গামছা মাথায় দিয়া তারপর বস্তাডি উঠাইতে হইবো না! নাইলে তো এতো ভাড়ি বস্তায় আমার মাথা,ঘাড় সব ভাইঙা যাইবো। 

– এতোক্ষণ কী করতেছিলি। তোকে বলতেছি যে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে, আর তুই এইটা আনিস নাই ঐটা আনিস নাই! 

– স্যার আমি খালি যামু আর আমু। আপনে চিন্তা কইরেন না। 

বলেই রহিম চাচা চলে যেতে নেয়। নিপা তার গাছের আড়াল থেকে চোখ বের করে তাদের দেখতে থাকে। নজরুল সাহেবও তাকে বকতে বকতে টর্চ হাতে রহিমের পিছু পিছু যেতে থাকেন। নিপা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে। তার মাথার উপর থেকে যেনো হাজার টন বোঝা নেমে গেছে। হঠাৎ নজরুল সাহেব ফিরে টর্চ তুলে তৃতীয় গাছটার দিকে ফেলেন। নিপা তৎক্ষণাৎ মাথা টেনে নেয়। রহিম চাচা বলে উঠে,

– কী হইলো স্যার। কোন সমস্যা! 

– দাঁড়া তো একমিনিট।

বলেই নজরুল সাহেব আবার এদিকেই আসতে থাকেন। টর্চ টাও তৃতীয় গাছের দিকেই তাক করে রেখেছিলেন। নিপা ভয়ে চুপসে যায়। তার উপস্থিতি কী কোনভাবে নজরুল সাহেব বুঝে গেলেন! নিপার বুকের ধুকপুকানি বাড়তে থাকে। নিপা এক হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে। তার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দকেও থামিয়ে দিতে চায় সে। নজরুল সাহেব দ্বিতীয় গাছটা পাড় হয়ে তৃতীয় গাছের দিকে এগিয়ে আসে‌ন নিপা তার ডান কাধ দিয়ে গাছের সাথে আড়াআড়ি ভাবে হেলান দিয়ে ছিলো, যাতে তাকে একটুও না দেখা যায়‌। নজরুল সাহেব আরো কাছে চলে আসেন। তার টর্চের আলোটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। নিপা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। নজরুল সাহেব এসে তৃতীয় গাছটার সামনে দাঁড়ান। একপাশে নিপা, আরেক পাশে নজরুল সাহেব। মাঝে মোটা এক আম গাছের শরীর। আম গাছটা যেনো দুই পৃথিবীকে মাঝ থেকে আলাদা করে রেখেছে। পিছন থেকে রহিম চাচা অবাক হয়ে নজরুল সাহেবকে দেখছিলো। নজরুল হাত বাড়িয়ে গাছের গুঁড়ির কিছু একটা ধরেন। পিছন থেকে রহিম চাচা বলে উঠে,

– কী ওহানে! 

– গুলি। এখানে গুলি কীভাবে আসলো! 

পিছনে থাকা নিপা চোখ খুলে ফেলে। 

রহিম চাচা বলে,

– গুলি তো আপনার আর রাফসান দাদার ধারে আছে। আপনারা ছাড়া তো আমরা কেউ গুলি হাতে নেইনা। 

– তাইলে রাফসান গুলি করছে? তাইলে এই খানে এই গাছে কেনো করলো! 

– কে জানে! আমি ঐসব জানিনা। 

নজরুল সাহেব পিছনে ফিরে একবার রহিম চাচাকে দেখেন, আবার সামনে ফিরে গুলির সেল টাকে দেখেন। কিছু একটা ভাবেন। পিছনে ফিরেন। ধীরে ধীরে পা চালিয়ে চলে যেতে থাকেন এই গাছের সামনে থেকে। নিপা জুতার আওয়াজ পায়। মানে হয়তো নজরুল সাহেব চলে যাচ্ছেন। নিপা ভয়ে ভয়ে তার অস্থীর এক চোখের মণি গাছের আড়াল থেকে বের করে। দেখে আসলেই এবার নজরুল সাহেব আর রহিম চাচা চলে যাচ্ছে। নিপার যেনো আরেকটু হলেই জান বেড়িয়ে যেতো। এইরকম অবস্থায় সে আগে আর কখনোই পড়েনি। নজরুল আর রহিম চাচা ময়লার ভাগাড় পেড়িয়ে চলে যান বাগানের পাশের রাস্তাটার দিকে‌‌। নিপা গাছের আড়াল থেকে কিছুটা বেড়িয়ে আসে। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। অনেক গোয়েন্দা গিরি হয়েছে এবার। একটুর জন্য ও নজরুলের হাতে ধরা পড়েনি। নিপা গাছের আড়াল থেকে বেড়োতে যায় তখনই কিছু একটা তার পায়ে লাগে। শব্দ শুনে মনে হলো প্লাস্টিক কিছু। নিপা হেলে অন্ধকারের মধ্যে হাত দিয়ে খুঁজে দেখতে থাকে কী লাগলো পায়ে। তখনই এক বড় বিজলী চমকিয়ে উঠে। সেই খানিকক্ষণের আলোতে যে দেখে তার পায়ের সামনে একটা প্লাস্টিকের খেলনা ছিলো আর তার থেকে কিছুটা সামনেই তার টর্চ টা পড়ে আছে। নিপা তাড়াতাড়ি খেলনা বাদ দিয়ে টর্চ টা হাতিয়ে নেয়। আকাশে আবার বিজলী চমকিয়ে উঠে। এবার মনে হয় আসলেই ঝড় নামবে। নিপা টর্চ টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে টর্চ টা অন করতে চায়। সুইচ টিপে। কিন্তু টর্চ টা জলছিলো না।

 নিপা হাত দিয়ে টর্চের গায়ে দু-তিনটা বাড়ি মারে। টর্চ টা মৃদু জ্বলে উঠে। নিপা সেই আলোতেই সেখান থেকে বের হয়ে আসতে থাকে। বাতাসের বেগ এবার বেশ বেড়ে গিয়েছিলো। নিপার কামিজ, ওড়নার আঁচল সব উড়তে থাকে। সামনে থেকে কিছু ধূলোবালিও উড়ে আসতে থাকে। নিপা ওড়না দিয়ে তার চোখ দুটোকে সেই ধুলোর হাত থেকে কোনমতে বাঁচায়। দৌড়ে টর্চ নিয়ে চলে যায় বাগানের পাশের রাস্তাটা দিয়ে। 

আবার এক বড় বিজলী চমকিয়ে উঠে। সেই আলোতে বাড়ির জানালা, যেটায় নিপা একজনকে দেখেছিলো সেখানে এখন আবার কাউকে দেখা যায়। সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো নিপার দৌড়ে যাওয়ার দিকে। তার চুল গুলো হাওয়ায় উড়ছিলো। যেনো কোন রুপময়ী এক অতৃপ্ত আত্মা হিসেবে সে নিজেকে জানান দিচ্ছে!!!

 

____

 

একটা গোডাউন ঘর। দূরে কিছু মালামাল রাখা। একপাশে দাড়িপাল্লার মেশিন রাখা। কারেন্ট নেই। চারপাশ মৃদু অন্ধকার। গোডাউনের একপাশ টায় তাশ খেলছে ৪-৫ জন। তাদের সামনেই জ্বলছে ২ টা মোম। পাশেই মদের বোতল। এক জন তার গ্লাসের সবটুকু মদ মুখে ঢেলে নিয়ে তাশ চালে। সবাই মাতাল হয়ে ছিলো। কারো গায়ে সেন্ডো গেন্জি। কেউ বা খালি গায়ে আছে। সবার বসয়ই ১৭-২০ এর মধ্যে। ওখানে থাকা একজন মাতল কন্ঠে বলে উঠে,

– এই মিরাজ, তোর ভাইরে ক, আমারে হারায়া দেহাইতে। এই ল, আমার চাল,,! 

– মিরাজ, তোর ভাইরে কইয়া দে, এই লাবু সবসময় জিত্তা সবার আগে থাহে। আমার চালে সবাই থারোয় মুইতা দিবো, দেখ!

বলেই তার কার্ড চালে লাবু। সেখানে থাকা বাকি ৪ জন তা দেখেই বেশ অবাক হয়। আবার হেসেও ফেলে। মাতাল হয়ে তারা যেনো বুঝছেই না হাসতে হবে না অবাক হইতে হবে। একজন বলে উঠে,

– এই ল আমার চাইল।

তখনই গোডাউনের বড় দরজা শব্দ করে উঠে। তাশ খেলতে থাকা ৫ জনের মধ্যে তিনজন তাদের তাশ মিলাতে ব্যস্ত ছিলো। মাতাল মাতাল চোখ নিয়ে কার্ড দেখছিলো। আবার সেদিকটা থেকে শব্দ আসায় বাকি দুইজন মুখ ঘুড়িয়ে তাকায়। তারা একটু কম নেশা করেছিলো। তাদের দু জনের মধ্যে একজন বলে,

– বিজয়, দেখতো কেডা আইছে। 

– আমি যামুনা, আমারে চাল দিতে হইবো। আপনে জান। 

– তোরা ছোটডি দিন দিন কথা শুনছ না। তোগোরে মাথায় তুইলা আমার লাভ কী হইলো! 

বিজয় নামের ছেলেটা আর কথা বলে না। সে তার চাল চালতে থাকে। লোকটা বলে উঠে,

– আমি কারে কী কইতাছি! আমার কথাই তো হুনতাছেনা অয়। আমারেই মনে হয় দেখতে যাইতে হইবো। (আবার দরজা শব্দ হয়) আরে আইতাছি রে বাপ আইতাছি। নিশ্চিত রাহুল আইছে আরো মদের বোতল নিয়া। এই মাতাল গুলার খালি মদ লাগে। টাকা ছিনতাই করবো, আর মদ গিলবো।

 

    বিলাপ বকতে বকতে লোকটা গোডাউনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা এখনো অপর প্রান্ত থেকে কেউ শব্দ করে যাচ্ছিলো। লোকটা দরজার সামনে এসে হাতল ধরে মাতাল কন্ঠে বলে,

– আরে খুলতাছিরে বাপ খুলতাছি, একটু সবুরও করতে পারোস না! 

লোকটা দরজা খুলে দেয়। বাইরে তখনই বিজলী চমকিয়ে উঠে। দরজার অপর প্রান্তে থাকা লোকটার পিছন থেকে সেই বিজলীর তীর্যক আলো এসে ভিতরের মাতাল লোকের চোখে মুখে পড়ে। মাতাল লোকটা চোখের সামনে হাত দিয়ে সেই আলো থেকে চোখ কে বাঁচায়। দরজার অপর পাশে থাকা লোকটা একটা কালো হুডি পড়ে ছিলো। হাতে ছিলো একটা লম্বা কুড়াল, হুডির টুপি টা তার মুখের নাক পর্রন্ত ঢাকা দেওয়া। অর্থাৎ লোকটা আর কেউ নয়। দি গ্রেট ব্লাক রন্জু!!

মাতাল লোকটা বলে উঠে।

‘এই, তুই কে?’ তখনই তার চোখ যায় রন্জুর হাতে ধরে থাকা কুড়ালের দিকে। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠে ‘ এই তুই কে, কে তুই! ‘ পিছনে ফিরে বাকিদের ডাক দিতে নেয়. ‘ এই মিরাজ, বিজয় পা,,,,, বাকি টা বলার আগেই রন্জু তার কুড়ালের এক কোপে লোকটার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মাথা ছিটকে পরে যায় দূরে। মাথা বিহীন দেহ থেকে পিচকারি মতো রক্ত বেড়োতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে সেটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রঞ্জু ভিতরে ঢুকে। কুড়াল উঁচিয়ে রক্ত মাখা কুড়ালের দিকে দেখে। এগিয়ে যেতে থাকে।

 

    গোডাউনের কোনে বসে তাশ খেলতে থাকা বাকিরা এখনো তাদের মুডেই ছিলো। তারা এখনো বুঝে উঠেনি যে তাদের যম আসছে। সেখানে থাকা একজন তার কার্ড চালে। তার পিছনে এসে দাঁড়ায় এক ছায়া। সে সেটা টের পায়নি‌। সামনে মোমবাতি জ্বলছিলো। সেই আলোয় পিছনের অবয়বকে বুঝে উঠতে পারা এই মাতাল দের জন্য মুশকিল ছিলো। হঠাৎ এক কুড়ালের কোপ পরে সেই লোকটার ঘাড়ে।‌ মাথা উড়ে গিয়ে পরে দূড়ে কোথাও। পিচকারির মতো রক্ত ছিটকে পরে বাকিদের মুখে। মাথা বিহীন বসে থাকা দেহটা কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যায়। বাকিরা মুখ তুলে তাকায়। তাদের নেশা কেটে যায়‌। সবাই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কেউ কেউ তাদের অস্ত্র খুঁজতে চলে যায়। দৌড়ে পালানোর সময় রন্জু একজনকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দেয়। সে পড়ে যায় নিচে। তার গাঁয়ে ছিলো সেন্টো গেন্জি। রন্জু এসে তার পেটের উপর বুট জুতো পড়া পা রাখে। কুড়াল ধরে তার গলার সমান সমান করে। বলে,

 ‘ কেনো মেরেছিলি ঐ মেয়ে গুলাকে! একটা বারও বুক কাঁপে নাই তোদের! ‘ 

 লোকটা দুই হাত তুলে ক্ষমা চাইতে থাকে রন্জুর কাছে, তখনই কুড়ালের এক কোপে তার বুক চৌচির করে দেয় রন্জু। দাপাদাপি করতে করতে মারা যায় সেই লোক। দূর থেকে একজন দৌড়ে আসতে থাকে দাঁ নিয়ে রন্জুকে মারতে। রন্জু লাশটার উপর থেকে নেমে দাঁড়ায়। তার হাতের কুড়াল টা মাটিতে ফেলে দেয়। পিছনে না তাকিয়ে সে তার হাতে পড়া রক্ত মুছে দিতে থাকে। পিছনের দাঁ হাতে লোকটা তার কাছাকাছি এসে তাকে আক্রমণ করতেই যাবে তখনই রন্জু পিছনের দিকে হেলে যায়। দাঁ তার মুখের ৫ আঙ্গুল উপর দিয়ে সামনে চলে যায়। অমনি রন্জু লোকটার হাত ধরে তার হাঁটুর সাথে জোরে বারি মেরে ভেঙে ফেলে। আর সাথে সাথেই নিচে ফ্লোরে শুয়ে নিচের কুড়াল টা হাতে নিয়ে ছুড়ে মারে তার আরেকপাশ থেকে দৌড়ে আসা আরেকজনের দিকে। কুড়াল গিয়ে তার পেট চিড়ে পিছন দিয়ে বের হয়‌। ধপ করে মাটিতে পড়ে যায় সেই লোক। রন্জু উঠে দাঁড়ায়। ভাঙা হাত নিয়ে সামনেই একজন মাটিতে কাতরাচ্ছে। রন্জু হাতে দাঁ উঠায়। এগিয়ে এসে লোকটার সামনে দাঁড়ায়। বলে,

 ‘ মেয়ে গুলাকে মারতে খুব আনন্দ লাগছিলো না তোদের! খুব আনন্দ! ‘ বলেই দা দিয়ে এক কোপ দেয় লোকটার হাঁটুতে। হাঁটু টা অর্ধেকের বেশি কেটে যায়। কিছু অংশ লেগে থাকে শুধু দেহের সাথে। রন্জু সেই পা টা ধরে হেঁচকা টান মেরে রগ চিড়ে পা টাকে আলাদা করে দেয়। লোকটা ব্যাথায় চিৎকার করতে থাকে। হাত দিয়ে ফ্লোরে জোড়ে জোড়ে দাপাদাপি করতে থাকে। রন্জু বলে,

 ‘ ওরা যতটা কষ্ট পাইছিলো, ততটা কষ্ট তোরাও পাবি। শরীর কেটে কেটে টুকরো করছিলি না ওদের! টুকরো করছিলি না!!! ‘ চিৎকার করে বলেই দাঁ উঠিয়ে এক জোড়ে কোপ দেয় লোকটার নাভির নিচের অংশটায়। লোকটা চিৎকার করে উঠে। রন্জু দা উঠিয়ে আবার কোপ দেয় লোকটার পেটে। পেট চিড়ে যায়। নাড়ি ভুরি বেড়িয়ে আসে। রন্জু আবার দা উঠিয়ে কোপ দিতেই যাবে তখনই কারো পায়ের আওয়াজ শুনে হেলে পড়ে আর পিছন থেকে দৌড়ে আসা একজন রন্জুকে কুড়াল দিয়ে দুই ভাগ করতে এসে উল্টো সেই কুড়াল দিয়ে আঘাত করে ফেলে সামনে থাকা অপর লোকটাকে। লোকটার মাথাটার নাক থেকে বাকি ‌উপরের অংশ কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রঞ্জু হেলে সাইডে একটা চেয়ারের উপরের পড়েছিলো। এতে তার কাঁধে কিছুটা ব্যাথা লাগে। সে সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার টা এক হাতে তুলে কুড়াল হাতে থাকা লোকটার বুকে এক সজোরে বাড়ি মারে। চেয়ার ফেটে চৌচির হয়ে যায়। লোকটার বুকের উপরের চামড়া মাংস সেই আঘাতে ফেটে যায়।‌ হাত থেকে কুড়ালটা পড়ে যায়। লোকটা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। রন্জু তার পকেট থেকে একটা শিশি বের করে। এগিয়ে আসে। লোকটার দিকে। আসতে আসতে বলে,

 ‘ মেয়ে গুলাকে এতোটা কষ্ট দিয়ে কেনো মারলি তোরা! রেপ করলি, শরীরে এসিড মারলি, তারপর জিবীত অবস্থায় কুপিয়ে, হাত পা কেটে দিলি! মায়া দয়া হয়নাই না মনে তোদের! খুব আনন্দ পাইছিলি! এখন আবারো আনন্দ পা! খুব আনন্দ! অনেক আনন্দ!!! ‘

বলেই রন্জু হেলে বসে পড়ে। জখম হয়ে পড়ে থাকা লোকটার প্যান্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলে। ভিতরের আন্ডার ওয়ার ছিড়ে ফেলে। লোকটার চেয়ারের আঘাতে এক প্রকার অবশ হয়ে গিয়েছিলো। তার গাঁয়ে যেনো রন্জুর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো ‌শক্তিটাও ছিলোনা। রন্জু তার নিচের সবকিছু ছিঁড়ে ফেলে। তার হাতে থাকা কাঁচের বোতলের ঢাকনা টা খুলতে থাকে। বোতলটা উপরে তুলে আসতে আসতে তার লিঙ্গে তরল কিছু ঢালতে থাকে। সেই তরল জিনিস আর কিছু নয়, ছিলো গরম এসিড।‌ লোকটার সেই যায়গাটাতে এসিড পড়তেই যেন তার জান বেড়িয়ে আসে। জোড়ে জোড়ে চিৎকার করতে থাকে। লোকটা তার অবশ শরীরকে নাড়াতে পারছিলো না। দাপাদাপিও করতে পারেনা সে। তার লজ্জা স্থান এসিডে পুরে ঝলসে যায়। সে চিৎকার করতে করতে যেনো গলা ফাটিয়ে ফেলছিলো। রন্জু অর্ধেক এসিড তার লজ্জা স্থানে ঢেলে বাকি এসিড টুকু তার গলায় ঢালতে থাকে। গলার চামড়া পুড়ে সেই এসিড গর্ত করে গলার ভিতরে চলে যায়। লোকটার চিৎকার নিভে আসছিলো। তার চোখ গুলা বড় বড় হয়ে ছিলো। মাথা বারবার এদিক ওদিক নাড়াচ্ছিলো। রন্জু এক হাত দিয়ে তার নাড়াতে থাকা মাথাটা শক্ত করে ধরে ফেলে যাতে লোকটা মাথা না নাড়াতে পারে। রন্জু বাকি এসিড টুকু লোকটার খোলা দুই চোখে ঢেলে দেয়। লোকটা যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। তার শরীর কয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়। এক করুন মৃ্ত্য হয় লোকটার। রন্জু উঠে দাঁড়ায়। তার ডান কাঁধে হাত দেয়। ডান হাত টা ঘুরাতে থাকে। চেয়ারের মোটা অংশটা তখন লেগেছিলো। রন্জু তার হাত ঘুড়িয়ে ব্যায়াম করতে করতে চলে যায় দরজার দিকে। গোডাউনের এক প্রান্তে এখনো জ্বলে ছিলো সেই মেমবাতি দু’টো। এদিক সেদিক পড়ে থাকে গ্যাংয়ের বাকি লোকদের লাশ। রন্জু দরজা দিয়ে বের হয়ে চলে যায়। বাইরে এক বড় বিজলী চমকিয়ে উঠে। 

 

_____

 

দিনাজপুর শহর। এখন রাত ৩ টা। যায়গাটা শহরের ৪ রাস্তার মোড়ে। বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ হলো। রাস্তা কিছুটা ভিজে আছে। সামনে চত্তরের মাঝখানের বড় পাখির অবয়বটা দেখা যাচ্ছে। অবয়বের নামেই এই চার রাস্তার মোড়ের নাম হয়েছে চড়ুই চত্তর।

 একটা কন্টিনার ট্রাকে মাল লোড করছে কিছু শ্রমিক। তার সামনে দাঁড়িয়ে তা তদারকি করছেন নজরুল সাহেব। বারবার হাত উঠিয়ে ঘড়ি দেখছেন। তিনি একটু চিন্তিত। সাথে অস্থির, উৎদিপ্ত। তার কাছে যেনো সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। কন্টিনার ট্রাক টা যেই গোডাউনের সামনে দাঁড়ায় ছিলো সেই গোডাউন থেকে বের হয়ে আসে রহিম চাচা। গামছায় হাত মুছতে মুছতে এসে নজরুল সাহেবের পাশে দাঁড়ান।  নজরুল সাহেব হন্তদন্ত হয়ে বলেন,

– রাফসান কই! ওকে আমি বলছিলাম না যে সাড়ে ৩ টার মধ্যে প্রথম চালান যাবে। ও আমাকে সেই রাত ৯ টার দিকে বলে গেলো একটু কাজে যাচ্ছে। ওর কাজ এখনো শেষ হয়নাই! কী কাজ করতে গেছে ও!

– স্যার। রাফসান দাদায় আইছে। আমি এই খবর টা দেওয়ার লাইগাই আপনার ধারে আইছিলাম।

– কই রাফসান। ওর কান দুইটা আমি টানে ছিড়াই। কাজ রাখে গেছে কেমন ও!

গোডাউন থেকে বের হয়ে আসে রাফসান। তার মাথা নিচু করা। নজরুল সাহেব তাকে দেখেই রাগের মাথায় বলতে থাকেন,

– এই হারামীর বাচ্চা। তোর কাজে মন আছে না নাই। কয়টা বাজে এখন! সাড়ে ৩ টার মধ্যে মাল খালাস করতে হবে, গাড়ির এদিকে না দেখে কই গেছিলি তুই!

– না মানে বাবা আমার একটা জরুরী কাজ ছিলো।

– তোর আর কী জরুরি কাজ হ্যা! আর কী জরুরি কাজ! এইখানে তোর থাকার কথা ছিলো, আর তোর কোন খোঁজ খবরই নাই! 

– বাবা আমি তো তোমাকে বলেই গেছিলাম।

– আর একটা কথাও বলবিনা। তাড়াতাড়ি এখানে দাঁড়া। (কুলিদের দিকে তাকিয়ে) ভিতরের দিকের অবস্থা যে কী হইতেছে কে জানে, এরা পা চালায় মাল গুলা গাড়িতে লোড করেনা কেনো ? 

বলতে বলতেই গোডাউনের দরজার দিকে যেতে উদ্যত হন নজরুল সাহেব। রাফসান তার ডান কাঁধে হাত দিয়ে ছিলো। ডান কাঁধটা ম্যাসাজ করতে করতে এসে ট্রাকের সাইডে দাঁড়ায়। রহিম চাচা রাফসানকে দেখে বলে উঠে,

– তোমার কাঁধে কী হইছে! 

রহিমের কথা শুনে যেতে থাকা নজরুল থেমে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে রাফসান তার ডান কাঁধ হাত দিয়ে ধরে ছিলো। একটু পর প্য ম্যাসাজ করছিলো। নজরুল ওখান থেকেই চিৎকার দিয়ে বলেন,

‘ তোর কাঁধে কী হইছে ? কই গেছিলি তুই ? ‘

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( গল্পের এ পর্যায়ে এসে কী মনে হচ্ছে আপনার? কী হবে এরপর? কাল পরসু পর্ব পাবেন। বড় করেই পাবেন। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আপনারা শুধু ধৈর্য ধরুন। গল্প শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে, সব রহস্য ভালোভাবে খোলাসা করার দায়িত্ব আমার 😉)

 

গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৭ (২য় ভাগ)

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৮ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

– আর একটা কথাও বলবিনা। তাড়াতাড়ি এখানে দাঁড়া। (কুলিদের দিকে তাকিয়ে) ভিতরের দিকের অবস্থা যে কী হইতেছে কে জানে, এরা পা চালায় মাল গুলা গাড়িতে লোড করেনা কেনো ? 

বলতে বলতেই গোডাউনের দরজার দিকে যেতে উদ্যত হন নজরুল সাহেব। রাফসান তার ডান কাঁধে হাত দিয়ে ছিলো। ডান কাঁধটা ম্যাসাজ করতে করতে এসে ট্রাকের সাইডে দাঁড়ায়। রহিম চাচা রাফসানকে দেখে বলে উঠে,

– তোমার কাঁধে কী হইছে! 

রহিমের কথা শুনে যেতে থাকা নজরুল থেমে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে রাফসান তার ডান কাঁধ হাত দিয়ে ধরে ছিলো। একটু পর পর ম্যাসাজ করছিলো। নজরুল ওখান থেকেই চিৎকার দিয়ে বলেন,

‘ তোর কাঁধে কী হইছে ? কই গেছিলি তুই ? ‘

রাফসান কিছুটা নার্ভাস হয়ে উত্তর দেয়,

‘ ব,বাইক নিয়ে আসার সময় পড়ে গেছিলাম। ‘

‘ পড়বিই তো। বাইক নিয়া পড়বি, বিছানা ভাঙে পড়বি আরো কত কী। কোনদিন যে আমার বিজনেস ডুবায় দিয়ে বলিস (ভং ধরে) আব্বা! আমি বিজনেস থেকে পড়ে গেছি!! যত্তসব পাগল আসে আমার কপালে জুটছে। ‘

নজরুল সাহেব চলে যান গোডাউনের ভিতরে। রায়হান হাত ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে ম্যাসাজ করতে করতে ট্রাকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কুলিদের উদ্দেশ্য কড়া গলায় হাঁক দিয়ে বলে,

‘ তাড়াতাড়ি পা চালা। বাসা থেকে গিলে আসিস নাই নাকি! ‘

পাশে দাঁড়িয়ে দাড়োয়ান রহিম চাচা তাকে চুপচাপ দেখতে থাকে। দূর থেকে ভেসে আসে শিয়ালের বাঁধ ভাঙা চিৎকার। আকাশের এক ফালি চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে। 

 

____

 

সকালের প্রথম প্রহর। বাইরে নিলচে আভার মতো দিনের আলো ফুটতে ধরেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এক চাপা সুবাস ভেসে আসছে বাইরে থেকে। কখনো সেটা তীব্র, কখনো বা সেটা হালকা মোহময়। 

শাহারিয়া কোরআন তেলাওয়াত করছে। তার পড়নে পান্জাবি টুপি। তার পাশের জায়নামাজে বসে দিথী তার কাঁধে হেলান দিয়ে তার তেলোয়াত শুনছে। তার চোখ বন্ধ। সে যেনো এই তেলোয়াতের সুরে হারিয়ে গিয়েছে‌। কোরআনের একেকটা হরফের টান, তার মনটাকে প্রশমিত করে দিচ্ছে। দিথীর মাথায় হিজাব। ঘরে বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিল টায় টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। সেটার আলোও তীর্যক নয়। হালকা করে রাখা।

শাহারিয়া পড়তে পড়তে থামে‌। কোরআন শরীফ বন্ধ করতে নেয়, তখনই দিথী চোখ খুলে। শাহারিয়ার কাঁধে মাথা রাখা অবস্থায়েই বলে,

‘ থামলে যে! আরেকটু পড়ো! ‘

‘ বাইরে আলো ফুটেছে তো। নামাজ শেষ করার পর থেকে পড়ছি। আরো শুনতে ইচ্ছে করছে নাকি তোমার! ‘

‘ তোমার কোরআন তেলাওয়াত শুনার আগ্রহ আমার কখনোই কমবে না। আমার সকাল টা অসম্পূর্ণ তোমার মধুর কন্ঠের তেলোয়াত ছাড়া। আরেকটু পড়ো। আজ তো শুক্রবার। অফিস নেই। ‘

‘ আচ্ছা ঠিক আছে। (একটু থেমে) তোমার মনে হয় তেলোয়াত শুনতে অনেক ভালো লাগে, তাইনা! ‘

‘ হ্যা। অনেক ভালো লাগে। তেলোয়াত শুনার সময় মনে হয় আমার ভিতর টা যেনো ঠান্ডা হয়ে গেলো। মাথার উপর থেকে হাজারো চিন্তা নেমে গেলো। ‘ 

শাহারিয়া এক ম্লিন হাসে। বিসমিল্লাহ বলে কোরআন শরীফ খুলে। যেখান থেকে থেমে ছিলো ঠিক ওখান থেকেই পড়তে শুরু করে। দিথী আবার শাহারিয়ার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঁজে। এই সুর তাকে অন্য এক দুনিয়ায় নিয়ে যায়। যেই দুনিয়ায় কোন পাপের সাম্রাজ্য নেই। কোন মুখোশের পরিচ্ছেদ নেই। আছে শুধু এক সুখ, শান্তির নীড়। আর এক সুন্দর পরকাল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা! 

 

______

 

সকাল ৮ টা। আনন্দপুরের আকাশে এখনো সূর্যের দেখা মিলেনি। আকাশ সকাল থেকেই সাদা মেঘে ঢেকে আছে। তবে মনে হয়না এই মেঘ বৃষ্টি নামাবে। মাঝে মাঝে হালকা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সকালের দিকটায় হালকা কুয়াশাও পড়েছে আজ। শীতকাল চলে যাচ্ছে। তাই ঠান্ডার তীব্রতা কম, তবে নেই যে তা বলা যায় না। 

নিপা ব্যালকনির চেয়ারে বসে আছে। সামনের টেবিল একটা খাতায় কী জানি লেখা-লেখি, আর্ট করছে। সে কিছু একটা মিলানোর চেষ্টা করছে‌। ঘরে ঘুমিয়ে আছে রায়হান। সাদা চাদর তার কাপড় ছাড়া শরীর টাকে বুক পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। কাল মাঝরাতে রায়হান ফিরেছিলো। রায়হান নেই বলে নিপা ঘুমায়নি। বসে বসে বই পড়েছিলো। রায়হান রাতে এসে দরজা নক করায় সে খুলে দেয়। রায়হান একটু ধীরে ধীরে হাঁটছিল। মাঝে মাঝে হাত চরকির মতো ঘুড়িয়েছিলো। নিপা জিগ্গেস করেছিলো সে তার হাতে ব্যাথা পেয়েছে কি না। তবে রায়হান সেই কথার জবাব দেয় নি। ফ্লোরে পড়ে ৩-৪ টে পুশ আপ দিয়েছিলো। নিপা হঠাৎ রায়হানের এমন কর্মকান্ড দেখে কিছুই বুজে উঠতে পারেনি। সে আবার জিজ্ঞেস করায় রায়হান বলে তার পিঠির উপর বসতে। সে তাকে নিয়েই পুশ আপ দিতে চায়। নিপা মোটেও রায়হানের এমন আজগুবি কথায় রোমান্টিকতা খুঁজে পায়নি। পরবর্তীতে রায়হানের দ্বিতীয় বার বলায়, সে রায়হানের পিঠে উঠে বসেছিলো। রায়হান তাকে নিয়ে ১০-১২ খানা পুশ আপ দিয়ে ফ্লোরের কার্পেটের ‌উপর ধপ করে শুয়ে পড়েছিলো। নিপা তো ভয় পেয়ে যায়। সাথে সাথেই রায়হান পিঠ থেকে উঠে যায়। রায়হান ব্যাথা পেলো নাকি আবার! কিন্তু নিপাকে পরমুহূর্তেই অবাক করে দিয়ে রায়হান হাসি মুখে উঠে দাঁড়ায়। তার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। রায়হানের এমন দুই ধরনের আচরণ নিপা বুঝে উঠেনি। হয়তো ভেবেছে খুব রাত করে ফিরেছে তাই ঘুমে এমন করছে। আগে কখনো এমন করতে দেখেনি, তাই এই নিয়ে নিপার মনে তেমন কোন দানাও বাঁধেনি। 

 

   নিপা টেবিলে একটা কাগজে কিছু লিখে মিলানোর চেষ্টা করছিলো। মাঝে মাঝে পাশের কাঠাল গাছ টা থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। সকালে নিচের বাগানে তার শাশুড়ি মা এসে পানি দিয়ে গেছিলো। নিপা তাকে খালি উপর থেকে দেখেছে। কথা বলেনি‌।

নিপা কাগজ উপর থেকে কলম টা উঠিয়ে কলমের পিছন টা দাঁত দিয়ে কামড়াতে কামড়াতে কিছু একটা ভাবে। আবার সে খাতায় লিখে। কাল সে একটা খেলনা দেখতে পেয়েছিলো সেখানে। বাসায় তো কোন বাচ্চা নেই। তাইলে ঐ খেলনা কোথা থেকে আসবে ওখানে! আর এই দ্বিতীয় আম গাছ টার রহস্যই বা কী! দাড়োয়ান রহিম চাচা গাছের গোড়ার হাত দিয়ে কী জানি একটা করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একটুর জন্য করলেন না। গাছের গোড়ায় কী কোন কিছু আছে! কী থাকতে পারে! নিপা আজ সকাল থেকে এই খাতা কলম নিয়ে বসে এগুলোই ভাবছে। কাল রাতে দেখা সেই ছায়া মানবীও তার ভাবনার বাইরে নেই। রায়হানকে জিগাবে বলে সেই কথাটা সে মনের সেলফে তুলে রেখেছে। 

রায়হান নড়ে উঠে। পাশ থেকে চিৎ হয়ে শোয়। হাত দুটো উপরে তুলে শরীরের আড়মোরা ভাঙতে থাকে। নিপা রায়হানের দিকে তাকায়। রায়হান আড়মোড়া ভেঙে হাত টা পাশে দেয়। খুঁজে দেখে নিপা নেই। রায়হান ঘুম ঘুম চোখেই উঠে বসে। তখনই নিপা ব্যালকনি থেকে বলে,

‘ আমি এখানে। ‘

রায়হান ঘুম ঘুম চোখ দুটো হাত দিয়ে কচলায়। ঘুমের ভারি গলায় বলে,

‘ তুমি ওখানে কী করো। আর (চারপাশ দেখে) কয়টা বাজে এখন। ‘

‘ ৮ টা, সাড়ে ৮ টা মনে হয়। ‘

‘ ৮ টা বাজে গেছে! আগে ডাকবানা! ‘

‘ রাতে দেরি করে আসলা তাই ভাবলাম একটু ঘুমাও। সারাদিন তো ঘরেই বসে থাকো। উঠে আর কইবা যাবা! ‘

‘ আমার একটু রংপুর যাইতে হইতো। (হাই তুলতে তুলতে) আমার এক বন্ধুর বাসায়। ‘

‘ বিকালে যাইয়ো। এখন রেডি হয়ে যাইতে যাইতেই তো ১১ টার মতো বাজে যাবে। আর আজকে তো শুক্রবার। নামাজের দিন। নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খায়ে বাইর হইয়ো। ‘ 

‘ ঠিক আছে। তুমি সকাল সকাল ওখানে কী করো। পড়তে বসছো নাকি! তুমি না বলছিলা পড়া থেকে বাঁচার জন্য তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলবা। এখন দেখি নিজে নিজেই পড়তে বসে গেছো। ‘

‘ পড়া লেখা না। আমি অন্য কাজ করতেছি। তুমি যাও। ফ্রেস হয়ে নাও। আঁখি সেই কখন আসে নাস্তা দিয়ে গেছে। চা তো এতোক্ষণে শরবত হয়ে গেছে। ‘

‘ শরবত হোক আর চা, তুমি খাওয়ায় দিলে আমার কাছে সবই গরম। হি হি হি। ‘

‘ সকাল সকাল উঠেই শুরু করে দিছো!! যাও ফ্রেস হও যাও! ‘

‘ উঠতেছি ম্যাডাম উঠতেছি, ঘুম টা (হাই তুলতে তুলতে) খুব ভালো হইলো। ‘ 

বলেই রায়হান আলাভোলা চোখে নিপার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিপা তা দেখে মুচকি হাসে। সামনে ফিরে খাতায় বাকি জিনিস গুলা কলম দিয়ে লেখে নিতে থাকে। মিলাতে থাকে। 

পাখির কিচিরমিচির ডাক বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো বড় পাখি দুটো নীড় ছেড়ে খাবারের খোঁজে উড়াল দিয়েছে। নিচের বাগান থেকে নতুন ফোঁটা ফুলের সুবাস আসতে থাকে। শীতের কুয়াশারা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে‌।

 

_____

 

সকাল ১১ টা। মেম্বার বাড়িতে ছোটখাটো কাজের ধুম পড়েছে। আজ বাড়ির সব ঘর গুলো পরিস্কার করছে সবাই। হালকা রোদ পড়েছে উঠোনে। উঠোনের রশি গুলায় কিছু কাপড় টাঙানো।

 হনুফা আর লায়লা এক কাগজের থাক হাতে বারান্দা থেকে আঙিনায় নামে। বাড়ির দেয়াল ঘেসে সেগুলো নিচে রেখে দেয়। আবার চলে যায় কাগজ আনতে। শিউলি বেগম মাস্ক মুখে কাঁশতে কাঁশতে বেড়িয়ে আসেন মতিন মেম্বারের ঘর থেকে। বারান্দার গ্রিলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের মাস্ক খুলেন। কাঁশতে থাকেন। গলা ঝেড়ে থুতু ফেলেন বাইরের সাইডে। বিরক্তির সুরে বলেন,

‘ এই ঘরটায় তো সব মরুভূমির ধুলা আইসা জমা হইছে। এতো মইলা, বাবাগো বাবা। ‘ 

সুমু রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। নাক-মুখ ওড়না দিয়ে চেপে নেয়। বাড়ির ভিতর থেকে টন কে টন ধূলা বের হচ্ছে। সুমু রান্না ঘরে বসে এতোক্ষণ পানি গরম করছিলো। কাপড় ভিজাবে তাই। শিউলি বেগমের সামনে এগিয়ে আসে সুমু। বলে,

‘ মা, এতো ধুলা কই থেকে বাইর হইতেছে! ‘

‘ ঐযে, ঐ পাডার ঘর থে। কত বছর যে হইলো অর ঘর অয় পরিস্কার করতে দেয় না। আইজ পরিস্কার করতে গেছি আলমারির পিছনে কী ধুলা, ভিতরে যত কাগজ, বই আছিলো ঐ গুলার কথা আর নাই কই। ‘

‘ বাবা তো বাইরে গেছেন। যদি বাড়িতে এসে শুনেন আপনি পরিস্কার করছেন, আর যদি বকে! ‘

‘ অয় বকবো আমারে! ঘরে এতোডি,, (হাঁচি দেন শিউলি বেগম। শাড়ির আঁচলে নাক,মুখ মুছেন) ধুলায় নাক মুখ মোর সব গেলো। ‘

বারান্দা থেকে নেমে আঙিনার মাঝে এসে দাঁড়ান শিউলি বেগম। সুমুও তার পিছু পিছু এসে দাঁড়ায়। শিউলি বেগম বলেন,

‘ অয় বকতে আইলে অরেই যাইত্তা ধরমু। এতো মইলা ঘরে নিয়া কেমন ঘুমাইবো! ‘

 

লায়লা আর হনুফা আরো দুই থাক কাগজ, খাতা বের করে ঘর থেকে। বারান্দা দিয়ে নেমে নিচে এনে রাখে। হনুফা খাতা গুলো রেখেই লায়লার কানিজ ধরে এক টান দেয়। লায়লা ওকে মারতেই যাবে ও অমনি হাওয়ায় দৌড়ে বারান্দার দিকে চলে যায়। 

 

শিউলি বেগম গলা ঝেড়ে মুখে থুতু আনেন। একটু এগিয়ে গিয়ে কোনার দিকে থুতু ফেলে আসেন। এসে সুমুর সামনে দাঁড়ান। সুমু বলে,

‘ উনি কী উনার ঘরেই আছেন! ‘

‘ হ। দরজা লাগাইয়া আছে। ‘

‘ এখনো ঘুমাচ্ছেন! ‘

‘ আরে না। হয়তো এমনি হুইয়া আছে। সকালে নাস্তা দিয়া আইলাম না! ‘

‘ ও হ্যা। আর মা‌‌। ঐ যে বা,,,,,’

বাকিটা বলার আগেই বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে কারো আসার শব্দ পায় সুমু আর শিউলি বেগম। ভাঙারি ওয়ালার মতো হাঁক দিতে দিতে বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ায় এক মেয়ে। শিউলি বেগম আর সুমু অবাক হয়ে সেই মেয়েটাকে দেখে। মেয়েটার মাথায় ঝুড়ি। পড়নে থ্রী পিস। ওড়না বুকের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে কোমরে গুঁজে দেওয়া। মেয়েটা হাঁক দিচ্ছিলো,

‘ পুরান খাতা, বই বিক্রি করতে পারেন। নষ্ট চেয়ার,টেবিল বিক্রি করতে পারেন। পুরান খাতা, বই,,,,

‘ এই মাইয়া থামো। আমরা শুনছি তো। তারপরও চিল্লাইতাছো ক্যা। ‘

‘ আপনাগো ধারে কী কোন পুরাতন খাতা, বই আছে! থাকলে বিক্রি করতে পারেন। আমি ভাঙারি ওয়ালি। সখিনা ভাঙারি ওয়ালি! ‘

শিউলি বেগম তা শুনেই জোড়ে হেঁসে উঠেন। হাসতে হাসতে সুমুর পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘ সখিনা ভাঙারি ওয়ালি হা হা হা!!! ‘

মেয়েটা বলে,

‘ জে, আমার নাম সখিনা। এরলাইগা আমারে লোকে সখিনা ভাঙারি ওয়ালি কয়। ‘

সুমুর ঠোঁটে মুখে হাসির প্রতিচ্ছবি। তবে সে শব্দ করে হাসেনা। শিউলি বেগম এখনো তার উপর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন। সুমু শিউলি বেগমকে সোজা করে দাঁড় করায়। সে মেয়েটার দিকে আবার তাকায়। মেয়েটা একটা হাসৌজ্জল মুখ করে। সুমুর বারবার নামটা শুনে হাঁসি পাচ্ছিলো। পরক্ষনেই সে মেয়েটাকে ভালো করে দেখতেই তার মুখের হাঁসি যেনো উবে যায়। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে না! হ্যা। এই মেয়েটাকে সে আগেও কোথাও একটা দেখেছে। শিউলি বেগমের হাঁসি কমেছে। তবুও যখনি তিনি সুমুর কাধ থেকে মুখ উঠিয়ে মেয়েটার দিকে দেখছেন, আবার হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছেন। সুমু শিউলি বেগমকে শক্ত করে ধরে সোজা করায়। অবাক চেয়ারায় বলে,

‘ মা, মা এইটা ঐ মেয়ে না! ‘

শিউলি বেগম আস্তে আস্তে হাসি থামাতে থাকেন। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সুমুকে বলেন,

‘ কোন মাইয়া! ‘

‘ ঐ যে একবার যে আমাদের বাসায় এসেছিল! শিমলা না কী যেনো নাম! ‘

শিউলি বেগম সুমুর থেকে কথাটা শুনেই হাঁসি একদম থামিয়ে দেন। ঝুড়ি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখেন। বলেন,

‘ হ হ। ঐযে একবার আইছিলো! কাম খুজতে! ঐ মাইয়াডা না! মুহে কালি মাইখা কালা হইয়া আইছে বইলা চিনতে পারি নাই। ‘

‘ আমিও মা। প্রথম প্রথম আমিও চিনতে পারিনাই। ‘

শিউলি বেগম কন্ঠ কঠিন করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলেন,

‘ তোমার নাম না শিমলা! তুমি না আমাগো বাড়িত কাম খুঁজতে আইছিলা! ‘

মেয়েটার মুখের প্রতিচ্ছবি বদলে যায়। কিছুটা নার্ভাসনেস ফুটে উঠে তার মুখে। সে জোড় করে হাসার চেষ্টা করে। বলে,

‘ ও হ্যা। আমি, আমি বোধহয় আপনাদের এখানে একবার এসেছিলাম। অনেক দিন আগে হয়তোবা। এইজন্য মনে নাই। ‘

‘ তুমি এহন ভাঙারি কিনো! ক্যান, তোমারে তো আমি মনে হয় ইসহাক গো বাড়িত কাম লইতে যাইতে কইছিলাম। ওরা তোমারে কাম দেয় নাই! ‘

‘ না মানে, উনারা বললেন উনাদের বাসায় কাজের লোক আছে। তাই নিবেন না। ‘

‘ তোমার পুরা নাম ডা কও তো। শিমলা তারপর কী যেন! ‘

‘ শিমলা আক্তার মোনালিকা ‘

‘ হ হ। এই নামই কইছিলা তহন। তুমি মুহে এমন কালো রং ক্যান মাখছো! তুমি তো ফর্সা আছিলা! ‘

‘ জ্বী মানে, (কিছুটা ভেবে) ছেলেদের। ছেলেদের মনে কখন কী থাকে। এইজন্য, এইজন্য নিজেকে কুৎসিত রাখছি। যাতে কারো খারাপ নজরে না পরি আরকি। ‘

‘ তো এহানে ক্যান আইছো! ‘

মেয়েটা নার্ভাস হয়েই বলে,

‘ ভাঙারি! ভাঙারি কিনতে। আপনাদের বাসা থেকে ধুলো উড়তেছিলো, তাই ভাবলাম হয়তো ঘর পরিস্কার করছেন। তাই আসলাম পুরাতন কাগজ, খাতা কিনতে। (বাড়ির দেয়ালের সাথে রাখা কাগজের থাক দেখিয়ে) ঐগুলা আমার কাছে কেজি দরে বিক্রি করতে পারেন। আমি ভালো দাম দিবো। ‘

‘ ঐহানে তো বেশীর ভাগই খাতা। খাতা কত কইরা কেজি! ‘

‘ খাতা! খাতা ৫০ টাকা কেজি। আর বই ৩০ টাকা। ‘

শিউলি বেগম অবাক হয়ে সুমুর দিকে ফিরে বলেন,

‘ খাতার দাম দি বাইড়া গেছে মনে হয়। এইডি বেইচ্চা লাই কী কও! ‘

‘ বেঁচে দিবা! ‘

‘ হ। এইহানে তো ৮-১০ কেজির মতো হইবো। ভালোই টাকা আইবো। ঐডা দিয়া বাজারে গিয়া ক্লিপ কাঁটা কিন্না আনমু! (মুখ চেপে হেসে) তোমার চাচায় আমারে কাঁটা ক্লিপে দেইখা খুশি হইবো! ‘ বলেই কাঁধ দিয়ে সুমুকে একটা ছোট্ট ধাক্কা দেন শিউলি বেগম।

সুমু বলে,

‘ তাও বাবাকে একবার জিগায় নেওয়া ভালো ছিলোনা! ‘

তখনই বাড়ির গেইট দিয়ে কারো ভিতরে আসার আওয়াজ পাওয়া যায়। কাঁশতে কাঁশতে কেউ একজন এগিয়ে এসে আঙিনায় দাঁড়ায়। শিউলি বেগম দেখেন সেটা মতিন মেম্বার। মতিন মেম্বার মুখের সামনে হাত দিয়ে ধুলা সড়াতে সড়াতে বলেন,

‘ এতো ধুলা আইলো কইত্তে হ্যা! শিউলি বেগম। কই তুমি,,,,,(পাশের খাতার থাক দেখে অবাক হয়ে) এইডি কেডা বাইর করছে! শিউলি বেগম! এডি তুমি ক্যান বাইর করছো! ‘

শিউলি বেগম সুমুকে ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে আসেন। মতিন মেম্বারের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি রেগে গেছেন। মতিন মেম্বার এগিয়ে এসে খাতার থাক গুলো ধরতে যান, তখনই শিউলি বেগম তার হাত ধরে নেন। বলেন,

‘ এইডি আর ঘরে যাইবোনা। এইডি আমি বেইচ্চা দিছি। ‘

‘ তুমি আমারে না কইয়া আমার ঘর পরিস্কার করতে গেছো ক্যা! তোমারে না কইছি আলমারি না খুলতে! এডি এক্ষনি ঘরে লও। ‘

‘ পারুম না। এডি আমি ৫০ টাকা কেজি দরে বেইচ্চা দিমু। ঐযে লোক খাড়ায়া আছে। তুমি যাও তো এহান থে, যাও! ‘

মতিন মেম্বার শিউলি বেগমের কথায় উল্টো আরো রেগে যান। তিনি নিজে থেকেই খাতা গুলো উঠাতে ধরেন। শিউলি বেগম বলেন,

‘ আরে কইলাম তো এইডি বেইচ্চা দিছি। তুমি এইডি ছাইড়া দেও। ঐদিকে গোসল করতে যাও, আযান দিয়া দিবো। ‘ 

মতিন মেম্বার খাতা গুলো ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। তিনি শিউলি বেগমকে কয়েকটা উঁচু কথা শুনাতে চান, তখনই কি ভেবে যেনো আর বলেন না। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ থাকার চেষ্টা করেন। শিউলি বেগম তাকে দেখে হাসি মুখে বলেন,

‘ হিহি, তুমি এমন করতাছো ক্যা! পেড খারাপ নি তোমার! ‘

মতিন মেম্বার তার মাথার চুল গুলো একবার ধরে চোখ খুলে ধীর স্বাভাবিক গলায় বলেন,

‘ ঐ ভাঙারি ওয়ালা তোমারে কত দিতে চাইছে! ‘

‘ ৫০ টাহা কেজি। ক্যান! ‘ 

‘ তোমার যত টাকা লাগে আমি দিমু। সব ডি ঘরে তুলো। ‘ 

‘ কী কও তুমি এইসব। এইডি তো পুরান খাতা। ঘরে নিয়া কী করবা। এর চেয়ে ভালো বেইচ্চা দেও। ‘

মতিন মেম্বারের নিজের রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করে ঠান্ডা গলায় বলেন,

‘ কইলাম না এডি ঘরে নিতে। ঘরে নিয়া রাইখা দেও। (ঘরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে) এই লায়লা, ফুলমতি এডি ঘরে নেতো। (সুমুর দিকে ফিরে) সুমু মা। তুই আয়তো। একটু আমার লগে হাত লাগা। ‘

সুমু কিছুই বুঝে উঠছিলো না। সে চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসে এগুলো উঠানোর জন্য। তখনই ভাঙারি ওয়ালি মেয়েটা বলে উঠে,

‘ কেজি ১০০ করে দিবো। আন্টি, আপনি সব আমাকে দিয়ে দেন। ‘ 

শিউলি বেগম তা শুনেই মতিন মেম্বারকে অনুনয় গলায় বলে,

‘ ঐ যে দেখছো। ১০০ কইরা দিবো। এইবার তো দিয়া দেও। তোমার টাকা খরচ করা লাগবোনা তাইলে। ‘

‘ তোমার যত লাগবো তুমি আমার থে নিবা। যা যা কিনা চাইবা সব দিমু। তাড়াতাড়ি এগুলি ঘরে লও। ‘ 

তখনই বারান্দা থেকে লায়লা, আর ফুলমতি নেমে আসে। হনুফা হয়তো এখনো ভিতরেই। লায়লা আর ফুলমতি এসে মতিন মেম্বারের সামনে দাঁড়ায়। তারা উৎসুক হয়ে এখানকার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলো। তখনই মতিন মেম্বার বলে উঠেন,

‘ মা, এডি নিয়া ঘরে রাইখা আয়তো। (শিউলি বেগমের হাত ধরে) আর শিউলি বেগম, তুমি আমার লগে চলো। ‘

পিছন থেকে মেয়েটা বলে উঠে,

‘ কেজি ২০০ করে দিবো। ‘ 

‘ ঐযে দেহো আরো বাড়াইছে। মাইনা যাও না। ‘

‘ আর একটা কথাও কইবানা। চলো। ‘

শিউলি বেগমকে টেনে বারান্দার দিকে নিয়ে যেতে থাকেন মতিন মেম্বার। লায়লা, সুমু, ফুলমতি সব গুলো খাতার থাক হাতে নিয়ে পিছূ পিছু যায়। ভাঙারি ওয়ালি মেয়েটা চিল্লায় বলতে থাকে,

‘ ৫০০ দিবো, ১০০০ দিবো। আন্টি,,,, আন্টি আপনি বললে ৫০০০ করে কেজি দিবো। আমাকে সব গুলা দিয়ে দেন। আন্টি,,,,,! ‘

মতিন মেম্বার শিউলি বেগমকে নিয়ে বারান্দা দিয়ে উঠে ঘরে চলে যায়। লায়লা, সুমু, ফুলমতি পিছনে ফিরে মেয়েটার চিল্লানো দেখে আবার সামনে তাকিয়ে বারান্দায় উঠে ভিতরের দিকে চলে যায়। আঙিনা ফাঁকা হয়ে যায়। মেয়েটা মাথা থেকে ঝুড়ি মাটিতে ফেলে সেটায় বিরক্তি সূচক লাত্থি মারে। ‘ ধ্যাত, হাত থেকে ছুটে গেলো! ‘ 

বলেই মেয়েটা বিরক্ত হয়ে ঝুড়ি ফেলেই চলে যেতে ধরে। তখনই হনুফা অদৃশ্য হয়ে তার পিছনে আসে। নিচ থেকে ঝুড়ি টা উঠিয়ে উল্টো করে মেয়েটার মাথায় দিয়ে সাথে সাথেই তাকে এক জোড়ে ধাক্কা দিয়ে সামনে ফেলে দেয়। মেয়েটা হুমড়ি খেয়ে সামনে গড়িয়ে পড়ে। হনুফা মুখ চেপে হাঁসতে হাঁসতে উড়ে পালায়। মেয়েটা মাটিতে দুইটা ডিগবাজি খেয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে। মাথা থেকে ঝুড়িটা সড়িয়ে চারপাশ দেখে। কেউ নেই। মেয়েটা তৎক্ষণাৎ রাগের মাথায় উঠে দাঁড়ায়‌। ঝুড়িটা দুইহাত দিয়ে ধরে হাঁটুর সাথে বাড়ি মেরে ভেঙে ফেলে। ভাঙা টুকরো দুটো ছুঁড়ে ফেলে হন হন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। হনুফা এইদিকে মুখ চেপে হাসতে হাসতে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। 

বাড়ির বাইরের দিকটা শান্ত হলেও ভিতর থেকে মতিন মেম্বার আর শিউলি বেগমের তর্কাতর্কির আওয়াজ আসতে থাকে। আকাশে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায়। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে জুম্মার আযান।

 

_____

 

দুপুরের প্রথম প্রহর। বাইরে সূর্যের তাপ মৃদু বেড়েছে। আযান পড়েছে হলো অনেকক্ষণ। শাহারিয়া ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে সেন্ডো গেন্জি। আর কালো জিন্স প্যান্ট। ঘরের বিছানা ভালোভাবে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখা। জানালা দিয়ে বাইরের মৃদু হাওয়ায় আসছে। জানালর পর্দা গুলো নড়ে উঠছে। 

দিথী ঘরে প্রবেশ করে। হাতে কালো পাঞ্জাবি। তার পড়নে থ্রি পিস। ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা। শাহারিয়া আয়নার দিকে মুখ করে ছিলো। দিথী এসে তার পিছনে দাঁড়ায়। শাহারিয়া আয়নায় দিথীকে দেখতে পায়। পিছনে ফিরে। দুই হাত নিজ কোমরে দিয়ে বলে,

‘ আমি কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করতেছি! তুমি নাই! ‘

‘ পান্জাবি টা স্ত্রী করছিলাম। নেও মাথা আগাও। ‘

দিথী পান্জাবি টা হাত দিয়ে জরো করে পান্জাবির গলার ফুটোটায় ধরে। শাহারিয়া মাথা এগিয়ে দেয়। দিথী তার পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শাহারিয়াকে পান্জাবিটা পড়িয়ে দেয়। পান্জাবির হাতায় শাহারিয়ার ডান হাত ঢুকিয়ে দিতে থাকে। তারপর একই ভাবে তার বাম হাত পান্জাবির বাম হাতায় ঢুকিয়ে দেয়। যেমন টা ছোট বেলায় শাহারিয়াকে তার মা আদর করে তাকে পড়িয়ে দিয়েছিলো। দিথী পান্জাবির দুই সাইড টেনে নিচে নামায়। হাতা গুলো নিয়ে সেগুলোর বোতাম লাগিয়ে দেয়। শাহারিয়া চুপচাপ দেখে। তার মুখে ফুটে উঠে ছোট্ট হাসি। দিথী শাহারিয়ার এক হাতার বোতাম লাগিয়ে আরেক হাত উঠায়। সেটার বোতাম লাগিয়ে দেয়। শাহারিয়া বলে,

‘ আহনাফ কই! ও রেডি হয়নাই এখনো! ‘

‘ ওকে দেখলাম গোসল করতে যেতে। হয়তো এতোক্ষণে গোসল শেষ করে বেড়িয়েও গেছে। ‘

দিথী শাহারিয়ার পাঞ্জাবির বুকের বোতাম গুলো লাগিয়ে দিতে থাকে। শাহারিয়া আয়নার দিকে তাকায়। দেখে দিথী খুব মনযোগ দিয়েই বোতাম গুলো লাগিয়ে দিচ্ছে। দিথীর টানা টানা চোখ দুটো যেনো খুব সুক্ষ্য, ধীরে বোতামের দিকে চেয়ে আছে। দিথীকে এভাবে দেখতে দারুন লাগছে। 

দিথী বুকের বোতাম গুলো লাগিয়ে শাহারিয়াকে আপাদমস্তক দেখে। হাতা গুলো মুড়িয়ে দিয়েছে শাহারিয়া। কালো পাঞ্জাবি আর কালো জিন্স এ বেশ দারুন লাগছে তাকে। দিথী শাহারিয়ার বুকের বা পাশটায় হাত দিয়ে আলতো করে মুছে। সেখানে একটা ছোট্ট চুমু খায়। বলে,

‘ কারো নজর না লাগুক। আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ, সবসময় আমার হয়ে থাকুক! 

‘ আর এই সুদর্শন পুরুষ টাই কিনা এক শ্যামময়ী নারীর মায়ায় পড়েছে! ‘

‘ শ্যামবর্ণকে অবহেলিত বলছো! ‘

‘ মোটেই না। (দিথীর কপালে কপাল রেখে) শ্যামবর্ণী মানুষ, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। আর আমার দেখা সবার সেরা হলে তুমি। ‘ 

‘ ভাগ্যবতী বলতে পারি তাইলে নিজেকে! ‘

‘ হ্যা, তা বলতেই পারো। সাথে আমিও নিজেকে ভাগ্যবান বলে দাবী করতে পারি! ‘

দিথী মৃদু হাসে। শাহারিয়া দিথীর গাল থেকে চুল গুলো হাত দিয়ে সড়িয়ে তার কানের পাশে রাখে। তার দুই গাল ধরে। কপালে একটা ছোট্ট চুমু খায়। দিথীকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। এক বিমোহিত গলায় বলে,

‘ একজন রাজা অসম্পূর্ণ তার রাণীকে ছাড়া । তুমিই আমার রাজ্যের রাণী। আমার সাত সমুদ্র পাড়ের ভালোবাসা, আমার নীলচে তারার নীলাঞ্জনা। (ধীর গলায়) তুমি, আমার বউজান! ‘

 

______

 

((২য় ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে 👇))

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৮ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৮ (২য় ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

((১ম ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে 👇))

 

মেম্বার বাড়ির ধুলো এখন কমেছে। পরিস্কারের পালাও শেষ হয়েছে। এক মুঠো রোদ্দুর এস পড়েছে আঙিনায়। লায়লা আর ফুলমতি ধুয়ে আনা কাপড় গুলো আঙিনার রশিতে মেলে দিচ্ছে। শিউলি বেগম ময়লা শাড়িতেই বাড়ির পিছন থেকে রান্না ঘরের সামনের রাস্তা দিয়ে আঙিনায় আসেন। হাতে একটা মাঝারি আকৃতির কুমড়ো। রান্না এখনো বসানো হয়নি। এটা কেটে রেখে গোসলে যাবেন। লায়লা আর ফুলমতি মিলে রান্না করে ফেলবে। 

সুমু ডায়নিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসে নখ দিয়ে টেবিলের উপর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আনমনে কিছু একটা করছে। শিউলি বেগমের রুম থেকে বেড়িয়ে এলো মতিন মেম্বার আর আফাজ। মতিন মেম্বারের পড়নে সবুজ পান্জাবি আর কুর্তা। আফাজের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। সুমু প্রথম প্রথম সেদিকে খেয়াল করেনি। তখনই মতিন মেম্বার শিউলি বেগমকে হাঁক দিয়ে বলেন,

‘ শিউলি বেগম,,, আমি আফাজরে লইয়া নামাজে গেলাম। ‘

শিউলি বেগম আঙিনা থেকে বারান্দায় উঠেন। বলেন। 

‘ যাও। আর মসজিদে জিলাপি দিলে কিন্তু বাড়ি লইয়া আইবা। নাইলে তোমার ভাত নাই। ‘ 

‘ জিলাপি না দিলে আমি কী করুম! ‘

‘ জিলাপি ঠিকই দেয়। তুমি আওয়ার সময় ইচ্ছা কইরা খাইয়া লও। আফাজ, তোর ফুফায় জিলাপি যদি খাইয়া লয়, তুই আমারে আইয়া কবি। ‘

‘ আইচ্ছা বাবা নিয়া আমু। আর ঘরদোর যা পরিস্কার করছো করছো। এহন আর ঐডি নাড়তে যাইয়ো না। ‘

‘ ঠিক আছে। ‘

মতিন মেম্বার আর আফাজ বারান্দা থেকে নেমে চলে যেতে নেয়। শিউলি বেগম ময়লা কাপড়েই তার ঘরে চলে যান। সুমু দৌড়ে আসে। এসে বারান্দার গ্রিল দরজা ধরে দাঁড়ায়। আফাজকে সাদা পাঞ্জাবিতে ঠিক সেই প্রথম দিনের মতো লাগছিলো। শুধু হাতে ফুলের তোড়াটা নেই। সুমু এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে আফাজের যাওয়ার পানে। তার মরুভূমির মনে যেন এক পশলা বৃষ্টি নেমে আসে। আফাজকে সে যতই দেখে, তবুও তার দেখার তৃষ্ণা মিটে না। সুমু এক কোমল নয়নে চেয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,

‘ দূর হতে আমি তারে সাধীব। গোপনে বিরহ ডোরে বাধিব! ‘

 

____

 

পরন্ত বিকেল। আকাশের সূর্য টা একদিকে হেলে পড়েছে। দূরের কিছু পাহাড়ের চা বাগানে ছোট ছোট পোকা তূল্য মানুষদের দেখা যাচ্ছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। শাহারিয়া আর আহনাফ বাড়ির গোল ব্যালকনি বারান্দায় বসেছে চেয়ার নিয়ে। সামনে একটা কাঁচের টেবিল রাখা। দিথী একটা ট্রে নিয়ে হাজির হয়। ট্রে থেকে দুটো চায়ের কাপ টেবিলে রেখে চলে যায়। আহনাফ আর শাহারিয়া রন্জুর কেস নিয়ে আলোচনা করছিলো। শাহারিয়া বলে,

– যদি এই তথ্য ভুল হয়! তখন ? 

– স্যার এই তথ্য ভুল হওয়ার কোন চান্সই নাই‌। আমাদের এক ইনফরমার খবর দিয়েছে এই বিষয়ে। সে বলেছে মৌলভীবাজারে এক বড় গোডাউনে রন্জুর আস্তানা। সেখান থেকেই ও সব কাজ কর্ম করে। 

– তথ্য সঠিক তো! পড়ে তখন গিয়ে যেনো আরো ভুল না বের হয়! 

– একদম সঠিক তথ্য স্যার। আজ রাতে এক কন্টিনার ট্রাকে করে মেয়েদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার কথা। সেই মেয়েদের মাঝে আমাদের ইনফরমারও আছে।

– ইনফরমার মেয়েদের সাথে মিশে আছে! 

– হ্যা স্যার। খুলনা থেকে মেয়েগুলাকে মৌলভীবাজারে আনা হচ্ছে। আজকে রাতেই সেখানে রেড দেই! আমরা এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর পাবোনা স্যার।

– যেই রঞ্জুকে এতো বছরে ধরা গেলো না! তার ঠিকানা এতো সহজেই পেয়ে গেলা! আমার তো কিছু গন্ডগোল লাগতেছে।

– কোন গন্ডগোল হবে না স্যার। খবর একদম পাকা। মৌলভীবাজারেই রন্জূর আস্তানা।

– আজ রাতে মিশন দিবো বলছো! 

– হ্যা স্যার। আজ রাতেই দেন। রন্জু শুধু মাঝে মাঝে সেখানে আসে। আবার চলে যায়। আজ রাতে যেহেতু মেয়ের চালান যাচ্ছে সেই হিসেবে তার থাকার কথা। 

– হমম। একটু পরিকল্পনা করে নেওয়া দরকার আমাদের। হুটহাট করে কিছু করা যাবেনা। 

– আমরা আবার ছদ্মবেশ ধরবো!

– না। আমরা কীসের ছদ্মবেশ ধরবো। আমাদের এভাবেই যেতে হবে। 

– কিন্তু স্যার ওখানে তো টপ সিকিউরিটি থাকে। কীভাবে কী করবেন! 

– ধোঁয়া গ্রেনেট ব্যবহার করবো! আর সঙ্গে তো অস্ত্র থাকবেই। এক ভ্যান ফোর্স নিয়ে গেলে ওরা বাকিদের সাথে গোলাগুলিতে ব্যাস্ত থাকবে আর আমরা গোডাউনের ভিতরে গিয়ে রন্জুর সাথে সাক্ষাৎ করবো! 

– সাক্ষাত করবেন মানে! 

– মানে ওর হাতে হাত কড়া পড়াবো। সিলেট জেলা পুলিশের ওখানে ফোন দেও।‌ ফোন দিয়ে বলো আমাদের যেই অনুযায়ী পুলিশ লাগবে সেই অনুযায়ী পুলিশ যেনো রেডি রাখে। 

– কয়টায় বেড়োবো স্যার!

– এখন কয়টা বাজে! (হাত উঠিয়ে ঘড়ি দেখে) এখন বিকেল ৪ টা। আমরা সন্ধার দিকে বেড়োবো। মৌলভীবাজার যাইতে যাইতে সময় লাগবে। তুমি ফোন করে ফোর্স রেডি রাখতে বলো।

– এখনি ফোন করছি স্যার।

আহনাফ চেয়ার থেকে উঠে যায়। শাহারিয়া টেবিলে খোলা পড়ে থাকা ফাইলটা হাতে নেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফাইলটা দেখতে থাকে।

আহনাফ কিছুটা এগিয়ে এসে তার ফোনে নাম্বার উঠিয়ে ফোন দেয়। কিছুক্ষণ রিং হয়। কল রিসিভ করার সাথে সাথেই বলে উঠে,

– হ্যালো! আমি কী ওসি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে কথা বলছি! 

 

_____

 

সন্ধ্যা ৬ টা। রায়হান রেডি হচ্ছে। সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার পরে নেয় সে। নিপা আলমারির সামনে কাপড় হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে রায়হানকে দেখছে। রায়হান যেনো কোন কাজের জন্য খুব তাড়াহুড়োয় আছে। নিপা তার হাতের কাপড় গুলো বিছানায় রাখে। বলে,

‘ তুমি এভাবে রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছো! আমাকে কিছু বলছোও না! ‘

‘ অফিশিয়াল কাজে যাচ্ছি। আর কিছুই না। আজ রাতে ফিরবো না। কাল সকালে আসবো। কালও না আসতে পারি। একয়দিন একটু কাজের চাপ আছে। ‘

‘ ঢাকা যাচ্ছো তুমি ? ‘

‘ হ্যা। আঁখিকে বলে দিয়েছি ও আজ রাতে তোমার সাথে শুবে। অপরিচিত কেউ দরজা খুলতে বললে খুলবানা। এমনকি বাবা,মা ওরাও যদি দরজা খুলতে বলে, তাও খুলবানা। আমি ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছি। কয়েকদিন পর সেখানে চলে যাবো। ‘

‘ হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত! ‘

রায়হান এগিয়ে এসে নিপার পাশ থেকে তার ট্রাউজার টা নেয়। সেখানকার পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করতে করতে বলে,

‘ সব তোমায় পরে খুলে বলবো সুবা। তুমি একটু সাবধানে থেকো। (নিপার পাশে এসে বসে হাত ঘড়ি পড়তে পড়তে) আজ রাতে বাইরে কোথাও যেওনা। ঘরে থেকো। ‘

‘ বাইরে কোথাও বলতে! ‘

‘ তোমার কৌতুহল সম্পর্কে আমি জানি। একটু খুট,খাট শব্দ পাইলেই ঘর থেকে বের হয়ে খুঁজতে থাকবা কোথায় শব্দ হইলো। (একটু থেমে) আমি না আসা পর্যন্ত কোথাও বের হবেনা। ‘

‘ ঠিক আছে। ‘

রায়হান হাত ঘড়ি পড়ে হাত ঝেড়ে নেয়। উঠে দাঁড়ায়। নিপাও বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রায়হান নিজের কাপড় সব ঠিক আছে কিনা তা দেখতে থাকে। নিপা দুইহাত এক করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ। রায়হান তার ব্লেজার ঠিক করে নিপার দিকে তাকায়। দেখে নিপা ইতস্তত বোধ করছে। চেহারায় চিন্তারা ফুটে উঠেছে। রায়হান নিপার কাছে এসে তার কাঁধে হাত রাখে। মুখের ভঙিমা নরম করে। ঠান্ডা গলায় বলে,

‘ আমার এই কাজ টা খুব জরুরী, তাই যাচ্ছি। নাইলে তোমার মায়া ছেড়ে পুরো একটা রাত সুদূরে কাটানো,,,,(একটু থেমে)  আমি পারতাম না। পারবো না। আমার কাজ গুলো খুব দ্রুতই শেষ হবে। তারপর আমি শুধু তোমাকে নিয়ে এক নতুন অধ্যায়ে পদার্পণ করতে চাই। শুধু তোমাকে নিয়ে। সাবধানে থেকো কেমন! ‘

নিপার চোখে মুখে ভয়। তার কেনো জানি কিছুই ভালো লাগছে না। রায়হানের কথা গুলাও তার কাছে ভালো ঠেকেনা। রায়হান নিপাকে চোখে চোখে আশ্বস্ত করে। নিশ্চয়তা দেয় কোন কিছুর। নিপা সেই ভাষা পড়তে পারে। সেও চোখে চোখে সম্মতি জানায়। রায়হান নিপাকে ছোট্ট একটা আলিঙ্গন করে। 

 

বিছানা থেকে কালো ব্যাগ টা নিয়ে নিপার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় রায়হান। নিপা দাঁড়িয়ে রয় ঘরের মাঝে। রায়হান ইদানিং কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে। সে যেনো রায়হানের দুই রূপের সম্মুখিন হচ্ছে। নিপা মনে মনে শুধু এটাই চায়, তাদের জীবনে যেনো কোন কালো ছায়া নেমে না আসে। সবকিছু যেনো ঠিক থাকে। 

 

_____

 

রাত ৩ টা। আশপাশ নিরব। এক লম্বা গোডাউন ঘর দাঁড়িয়ে আছে এক বড় বাশ বাগানের মাঝে। গোডাউনের সামনে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে সুদূরে। আকাশ পরিষ্কার। জোছনা রাত। রাস্তা দিয়ে গোডাউনের দিকে এগিয়ে আসছে একটা গাড়ি বহর। গাড়িটা ছিলো কন্টেনার ট্রাক। আর তার আগে পিছে ৩-৪ টে মাইক্রো। গাড়ি বহর এসে থামে গোডাউনের সামনে। অস্ত্রধারী দুইজন এগিয়ে আসে। পুরো গাড়ি বহরকে একবার দেখে। তারপর বড় গেইট খুলে দেয়। গাড়ি গুলো একে একে ঢুকে পড়ে ভিতরে‌। অস্ত্রধারী দুইজন চারপাশ দেখে দরজা বন্ধ করে দেয়। 

 

রাস্তার মাঝ দিয়ে দুটো পুলিশ ভ্যান আসছে। তবে উপরের লাল-নীল বাতি জ্বলছে না। আর কোন সাইরেনেরও আওয়াজ নেই। গাড়ি গুলা গোডাউনের কিছুটা দূরেই থেমে যায়‌। গাড়ি থেকে শাহারিয়া, আহনাফ ও বাকি পুলিশ রা নামে। সবার হাতেই বন্দুক। শাহারিয়ার পড়নে সাদা শার্ট, আর আহনাফের পড়নে খয়েরি শার্ট। এরা দুইজনই শুধু সিভিল ড্রেসে আছে‌। বাকি সবাই পুলিশি ড্রেসে‌। 

শাহারিয়া সবার আগে আগে যাচ্ছে। তার পিছন পিছন বাকিরা এগোচ্ছে। এগোতে এগোতে তারা গোডাউনের সামনের মেইন গেইটের কাছাকাছি আসে‌। শাহারিয়া সবাইকে হাতের ইশারায় থামতে বলে। সে তার পকেট থেকে একটা গ্রেনেড বের করে। পিন খুলে ছুঁড়ে মানে গেটের সামনে অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিতে থাকা লোকদের উপর। গ্রেনেড টা তাদের পায়ের কাছে এসে পড়তেই তা থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। লোক দুইজন কিছু বুঝে উঠার আগেই ধোঁয়ার প্রভাবে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। শাহারিয়া হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে বাকিদের এগিয়ে আসতে বলে। বাকিরাও তার পিছু পিছু আসে। 

মেইন গেইটটা সামনে দিয়ে লাগানো ছিলো। শাহারিয়া আর আহনাফ মিলে নিঃশব্দে গেইটের হাতল ধরে খুলে। গেইট টা হালকা ফাঁকা করে শাহারিয়া ভিতরের দিকে তাকায়। দেখে কন্টেনার ট্রাক টা দাঁড়িয়ে আছে। তবে আশেপাশে আর তেমন কেউই নেই। শাহারিয়া, আহনাফ অবাক হয়। এরা গেলো কোথায়! তারা ভিতরে ঢুকে পরে নিঃশব্দে। তাদের পিছন পিছন অস্ত্র সজ্জিত পুলিশ রাও চলে আসে। শাহারিয়া আহনাফ আগে আগে এগোয়। কন্টিনার ট্রাক টার কাছে আসে। কান লাগায়। ভিতর থেকে প্রাণের অস্তিত্ব টের পায়। শাহারিয়া কয়েকজন পুলিশকে এখান থেকে মেয়েদের বের করতে বলে। আর বাকি পুলিশ গুলো আর আহনাফকে সাথে নিয়ে চুপি চুপি এগিয়ে যায়‌ সামনে। কন্টিনারের সামনে সাড়ি বন্ধ ভাবে তিনটা মাইক্রো দাঁড়ানো। আশ্চর্যের বিষয় মাইক্রোতেও কেউ নেই। শাহারিয়া তার বন্দুক বের করে। সেটায় সাইলেন্সার লাগানো ছিলো। বন্দুক দুই হাতে ধরে নিচের দিকে রেখে এগিয়ে যায় ধীর কদমে। মাইক্রো গুলো পার করে গোডাউনের মূল দরজার কাছে চলে আসে। শাহারিয়া হাত দিয়ে বাকি পুলিশ দের ছড়িয়েই যেতে বলে। তার পিছনে আহনাফ দাঁড়ানো। আহনাফ শাহারিয়া আর ৫-৬ জন পুলিশ ভিতরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। শাহারিয়া ইশারায় আহনাফকে বন্দুক দুই হাতে ধরতে বলে। আহনাফ রেডি হয়ে যায়‌। শাহারিয়া ‘ মুভ ‘ বলেই তৎক্ষণাৎ দরজা এক পা দিয়ে লাথি দেয়। দরজাটা ভিড়িয়ে দেওয়া ছিলো ঝট করেই খুলে যায়। শাহারিয়া আহনাফ আর বাকিরা ভিতরে চলে আসে। এসেই দেখে আরেক দৃশ্য। ভিতরে দুইপাশে সাড়ি বদ্ধ হয়ে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রন্জুর লোকেরা। গোডাউনের ঠিক মাঝখান টায় একটা রাজকীয় চেয়ারে বসে আছে রন্জু। তবে শাহারিয়াদের দিকে ফিরে না। তাদের বিপরীতে মুখ করে। হাতে কলম ঘুরাচ্ছে সে। শাহারিয়া আহনাফরা যেনো বোকা বনে যায়। বাইরে থেকে আসতে থাকে গুলির আওয়াজ। তাদের সাথে যেই পুলিশেরা এসেছিলো তাদের চিৎকারের আওয়াজ। শাহারিয়া আহনাফ এবার বুঝতে পারে যে বাইরে কেনো এতো কম সিকিউরিটি ছিলো। তখনই রন্জু হাঁসতে থাকে। জোড়ে জোড়ে হাঁসতে থাকে। হাতে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

‘ কী খবর শাহারিয়া,,! শেষ পর্যন্ত এসেই গেলে তুমি হ্যা! ‘

‘ তুই, তুই এতো সহজে ধরা দিবি ভাবতে পারিনি। আমাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা তোর কখনোই সফল হবেনা রন্জু! ‘ 

বলেই শাহারিয়া রন্জুর দিকে গুলি তুলে তাক করে সাথে সাথেই রন্জুর দলের সবাই তাদের মেশিন গান তুলে তাক করে শাহারিয়ার দিকে। পিছনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে কয়েকজন রন্জুর লোক। তারা শাহারিয়াদের সাথে থাকা পুলিশদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গোডাউনের ভিতর থেকে নিয়ে যায়। রন্জু হাঁসতে থাকে। বলে,

‘ ওরা মেহমান। ওদের বাইরে নিয়ে খাতির করুক একটু! আসল কাজ তো আমার তোদের দুইটার সাথে। খুব আমার পিছনে পড়ছিলি না! খুব! এখন তো তুই চাইলেও কিছু করতে পারবি না। তুই একটা গুলি ছুড়বি, আর আমার লোকেরা হাজার গুলি ছুড়ে তোর শরীর ঝাঝড়া করে দিবে। একটু চালাক হওয়ার চেষ্টা কর ম্যান! এতো বোকা মাথা নিয়ে কীভাবে তুই গোয়েন্দা হোস, আমার বুঝে আসেনা! 

আহনাফ গলা উঁচিয়ে বলে,

‘ আমার স্যার বোকা না‌। আপনি বোকা! আপনার খোঁজ এই পর্যন্ত আমরা ছাড়া কিন্তু আর কেউ বের করতে পারেনি! ‘

‘ এই রন্জু নিজে থেকে না চাইলে কেউ তার খোঁজ পাবেনা। ইশশ্, আহনাফ। তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবছিলা না! ভাবছিলা যেইখানে শাহারিয়া, তোমার তথাকথিত স্যারই আমার ঠিকানা পায়নি। সেখানে তুমি আমার ঠিকানা পেয়ে গেলা! খুব আনন্দ হইছিলো না তোমার! ‘

‘ তারমানে তুই ইচ্ছে করে তোর ঠিকানা আমাদের দিয়েছিস! ‘

‘ ইয়েস ম্যান! আমিই সব খেলাটা খেলেছি। আর ঐযে তোদের লেডি ইনফরমার! সেও আমারই লোক! তাইনা সিমিন! ‘

তখনই শাহারিয়া আর আহনাফ দেখে রন্জুর লোকদের আড়াল হতে বেড়িয়ে আসছে তাদের ইনফরমান সিমিন। মানে যে বলেছিলো সে কন্টিনারে করে এখানে আসছে আর এখানেই রন্জুর আস্তানা। আর এই সিমিন আর কেউ নয়। রন্জুর দলের সেই মেয়ে ডাক্তার। সিমিন আড়াল হতে বেড়িয়ে এসে হাসতে থাকে। আহনাফের খুব রাগ হয়। সে কিনা এই মেয়েকে বিশ্বাস করেছিলো! সিমিন হাঁসতে হাঁসতে গিয়ে রন্জুর চেয়ারের পাশে দাঁড়ায়। রন্জু এখনো শাহারিয়াদের বিপরীতে মুখ করে ছিলো। রন্জু বলে উঠে,

‘ ভেরি ব্যাড শাহারিয়া। তোকে তো আমি বুদ্ধিমান ভাবছিলাম। আর তুইই কিনা আহনাফের মতো একটা কাঁচা খেলোয়াড়ের কথায় আমার আস্তানায় আসতে রাজি হয়ে গেলি! ভেরি ভেরি ব্যাড! ‘ 

‘ তুই মেয়েদের কেনো কিডন্যাপ করিস! এতো মেয়েদের দিয়ে তুই কী করিস! ‘

‘ উ হুঁ,,, এতো কৌতুহল ভালো নয় শাহারিয়া। সবকিছুর কারণ আগে ভাগে জানতে নেই। যখন তোর উপরেও সিমিন তার জিনিস নিয়ে কাজ শুরু করবে, তখন তুই নিজেই বুঝে যাবি। হা হা হা! ‘ 

রন্জু হাঁসতে থাকে। হঠাৎ তার হাসার মাঝেই শাহারিয়া হাঁসতে শুরু করে। জোরে জোরে হাসতে থাকে। আহনাফ অবাক হয়। সিমিন সহ রন্জুর বাকি সদস্যরাও অবাক হয়। রন্জু তার হাঁসি থামিয়ে কঠিন গলায় বলে,

‘ খুব হাসি পাচ্ছে না! খুব হাঁসি! মন তো বলতেছে তোর শরীর থেকে এখনি সবকিছু খুলে নেই। ‘

শাহারিয়া হাঁসতে হাঁসতে বলে,

‘ রন্জু, তুই আমাকে হাসাইলি ভাই। আমাকে হাসাইলি। তুই কিনা আবার বড় মাফিয়া হিসেবে নিজেকে দাবী করিস! হা হা হা! ও বলে বড় মাফিয়া। ওর থেকে আমাদের গ্রামের নান্টু চোরও ভালো আছে। অন্তত ও মেয়ের মতো নিজের চেহারা লুকায় না! হা হা হা! ‘

আহনাফ ভয় ভয় গলায় বলে,

‘ স্যার, আপনি হাসতেছেন কেনো! ওদের সামনে আমরা একদম নগন্য। আপনি থামুন স্যার, থামুন। ‘

শাহারিয়া হাঁসতে হাঁসতে বলে,

‘ রন্জু একটা মেয়ে। ও পর্দা করে চলে সবসময়। এইজন্যই তো ওর চেহারা ও দেখায় না! হা হা হা! ‘

রন্জু রেগে যায় এতে। সে কর্কশ কন্ঠে বলে,

‘ শাহারিয়া, বেশি হাসিস না কিন্তু! বেশি খুশি ভালো না। উল্টা তুই এটা যেনে রাখ, এই রন্জুকে দেখার মতো সাহস আর শক্তি, কোনটাই তোর নাই। ‘

‘ ও আচ্ছা! হা হা হা! ‘

অস্ত্র ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই যেনো শাহারিয়ার এই হাসির মানে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তারা উল্টো আরো একে অপরের সাথে এই নিয়ে কথা বলতে থাকে। শাহারিয়া আরো জোড়ে হাঁসতে হাঁসতে বলে,

‘ তোর লোক গুলাকে দেখ। এগুলাকে বিয়ে কে করবে! মুখে কী কালো রং মাখে আছে! হা হা হা! যেমন মালিক তেমন দাস! হা হা হা! ‘

এই কথায় রন্জুর লোকেরা একে অপরের দিকে তাকায়। দেখতে থাকে তাদের চেহারা গুলো। তারা একটু অন্য মনস্ক হতেই শাহারিয়া তার গুলিটা উঠিয়ে সাথে সাথে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড় দেয়। আহনাফ কিছু বুঝে উঠে না। সেই গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড়াতে থাকে। গুলি গিয়ে লোকদের গায়ে বিঁধতে থাকে। তারা লুটিয়ে পবে মাটিতে। যে কয়জন বেঁচে যাচ্ছিলো তারা শাহারিয়াদের উপর ঠিক মতো নিশানা করতে পারছিলো না তাদের দৌড়ানোর কারণে। শাহারিয়াদের গুলি এসে কারো বুকে লাগে, কারো পেটে লাগে। লুটিয়ে পড়তে থাকে সবাই একে একে। সিমিন ভয় পেয়ে যায়। সে রন্জু সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রন্জু এখনো নিশ্চিন্তে আগের মতো সেভাবেই বসে ছিলো। সিমিন এসে তার সামনে হেলে বসে কিছু একটা বলতে থাকে। 

এদিকে শাহারিয়া এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছে আর দিকবিদিক না দেখেই দৌড়াচ্ছে। রন্জুর লোকদের ছোড়া গুলি তার খুব কাছ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। আহনাফ তো জীবনের মায়া প্রায় ছেড়েই দিয়ে শাহারিয়ার মতো গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড়াচ্ছে। তখনই হঠাৎ রন্জু তার হাতে একটা চুটকি বাজায় আর সাথে সাথেই রন্জুর সব লোকেরা মাটিতে শুয়ে পড়ে। শাহারিয়া আর আহনাফ হঠাৎ এটা দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। তারা রঞ্জুর লোকদের দেখতে থাকে। এমন সময় রন্জুর সামনে বসে পড়া সিমিন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার গুলি তাক করে ধরে শাহারিয়ার উপর। শাহারিয়া অন্যদিকে দেখে দৌড়াচ্ছিলো তাই সে সামনে দেখেনি। আহনাফ দেখতে পায় সিমিন কে গুলি হাতে দাঁড়াতে। আহনাফ চিৎকার করে উঠে শাহারিয়াকে সামনে দেখতে বলে। শাহায়িয়া সামনে তাকায় আর সাথে সাথেই সিমিন গুলির ট্রিগারে চাপ দেয়। গুলি এসে লাগে শাহারিয়ার বুকে। আহনাফ চিৎকার দিয়ে উঠে। সিমিন আরো দুটো গুলি ছোঁড়ে। গুলি গুলো লাগে শাহারিয়ার বুকের বা পাশে। রক্তে লাল হয়ে যায় তার সাদা শার্ট। দৌড়াতে দৌড়াতে লুটিয়ে পড়ে সে মাটিতে। আহনাফ সাথে সাথে সিমিনের দিকে বন্দুক তোলে। ট্রিগার চেপে একের পর এক গুলি করতেই। সিমিনের বুকে এসে লাগে গুলি গুলো। ঝাঝড়া হয়ে তার দেহ রন্জুর উপরই ধপ করে পড়ে যায়। আহনাফ দৌড়ে এসে শাহারিয়ার রক্তাক্ত দেহটার সামনে বসে। শাহারিয়াকে সে ধরতেই যাবে তখনই রন্জু একটা গ্রেনেডের পিন খুলে পিছনে ছুড়ে মারে। আহনাফ সেই আঘাত বুঝে উঠার আগেই এক বিকট শব্দ। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( আপনাদের মনের মধ্যে যা কথা উঁকি দিচ্ছে  সেসকল বক্তব্য কমেন্টে জানাতে পারেন। কালকেও পর্ব পাবেন ❤️)

 

গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৮ (২য় ভাগ)

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৭৯

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

((( সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ‼️‼️এই পর্বে উচ্চ মাত্রার এডাল্ট ডায়লগ, ১৮+ সিন ও কাপড়ের বর্ণনা রয়েছে। গল্পের চিত্রনাট্যের ডিমান্ড অনুযায়ী বিষয় গুলো আমাকে দিতে হয়েছে। কেউ রোযা রেখে পড়তে চাইলে আগে কয়েকবার ভেবে নিন। রোযা হালকা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এমন সিন দেওয়ার জন্য। তবে এটাই এই উপন্যাসের শেষ ১৮+ এলার্ট। আর কোন এলার্টের সিন পরবর্তী কোন পর্বে পাবেন না। আমি আগেই আপনাদের সতর্ক করে দিলাম, পরে মোরে কেউ গালি দিয়েন না 😿)))

 

আহনাফের চোখ খুলছে। তার চোখে পাতা গুলো ভারি হয়ে আসছে। চোখের পলক ফেলে আবার সে ভালোভাবে তাকানোর চেষ্টা করে। তার কাছে সবকিছু অস্পষ্ট ঝাঁপসা হিসেবে ধরা দেয়। তার মুখে কেউ পানির ফোয়ারা ছেটায়‌। তার চোখের পাতা নড়ে উঠে। আহনাফ সম্পুর্ন চোখ মেলে দেয়। নিজেকে আবিষ্কার করে একটা ঘরে‌। সে চারপাশ তাকায়। এটা তো শাহারিয়ার বাড়ি। সে এখানে এসে যেই রুমে উঠেছিলো সেই রুম। আহনাফ মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখার চেষ্টা করে, তখনই সে দেখে তার পাশে উতলা হয়ে বসে আছে দিথী। চোখ মুখে পেরেশানির ছাপ। আহনাফ উঠে বসতে চেষ্টা করে। দিথী তাড়াতাড়ি তার হাতের পানির গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে আহনাফের কাঁধ ধরে। তাকে ধরে সোজা হয়ে উঠতে সাহায্য করে। দিথী উতলা, উৎদিপ্ত। আহনাফ উঠে বসে এক হাত দিয়ে তার মাথা ধরে। মাথা খুব ঝিমঝিম করছে তার। ভারি ভারি লাগছে‌। দিথী আহনাফকে নাড়িয়ে দিয়ে উৎসুক গলায় বলে,

‘ আহনাফ, আহনাফ। তোমার স্যার কোথায়! ও,ও কোথায়! ‘ 

আহনাফ চারপাশে দেখে। সে ভাবে সে তো ঢাকায় তার মায়ের কাছে ছিলো। এখানে কী করে আসলো। পরক্ষনেই তার মনে একে একে সবকিছু আসতে থাকে। আহনাফের চোখ মুখ বড় হয়ে যায়। সে হন্তদন্ত হয়ে চারপাশ দেখে। অস্থীর গলায় বলে,

‘ ভাবি, ভাবি আমি এখানে আসলাম কী করে! আর স্যার! ওহ নো,,,! স্যার তো,,,,,’

‘ হ্যা বলো। শাহারিয়া কোথায়। ওকে আমি বারবার ফোন দিচ্ছি। ও ফোন উঠাচ্ছে না কেনো। আহনাফ আমার শাহারিয়া কোথায়! ‘

‘ ভাবি, ভাবি আমি এখানে কী করে আসলাম। আমি,আমিতো সেই গোডাউন ঘরে ছিলাম। ‘

‘ আজ সকালে উঠে আমি দেখি উঠোনে কেউ একজন শুয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দেখি তুমি শুয়ে আছো। আমি তোমাকে জাগানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি চোখ খুলছিলে না। ড্রাইভার রুমান আসে কিছুক্ষণ পর। ও আর আমি মিলে তোমাকে ঘরে এনেছি। (উতলা হয়ে) এই আহনাফ, আমার শাহারিয়া কোথায়! ও কি সকাল সকাল আবার অফিস চলে গেছে নাকি! আমি ফোন দিতেছি ফোন টাও ধরতেছে না। ‘

আহনাফ চুপ হয়ে যায়। সে কীভাবে বলবে শাহারিয়ার গাঁয়ে গুলি লাগার কথা! দিথী বারবার তাকে নাড়িয়ে নাড়িয়ে একই কথা জিগ্যেস করছে‌। আহনাফ এক ঢোক গিলে। ভাবে, বলে দেওয়া উচিত। উনি স্যারের ওয়াইফ। দিথী আবার উৎকন্ঠায় ভরা সুরে বলে,

‘ এই আহনাফ, তুমি চুপ করে কেনো আছো। ও কোথায়! শাহারিয়া কোথায়। ও তো আমাকে না বলে কোথাও যায়না। (একটু থেমে) ও কী আনন্দ পুরে চলে গেছে! ‘

‘ ইয়ে মানে, ভাবি। স্যার,,,,,, (একটু থেমে ধীর গলায়) স্যারের গায়ে,, স্যারের গাঁয়ে গুলি লাগছে। ‘

কথাটা শুনেই দিথী আহনাফের হাত ছেড়ে দেয়। আহনাফ পাশ ফিরে তাকায়। দিথী একদম থমকে যায়। আহনাফ করুণ গলায় বলে,

‘ স্যারকে ওরা, স্যারকে ওরা গুলি করেছে ভাবি। বুকে তিন তিনটা গুলি করেছে। ‘ 

দিথীর যেনো নিঃশ্বাস থেমে থেমে আসছিলো। তার চোখ ভিজে আসে। সে আহনাফের দিকে একবার দেখে। আহনাফ অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। দিথী মাথায় হাত দেয়। তার গাল বেয়ে চোখের পানি পড়তে থাকে। হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো এলোমেলো করতে থাকে। আহনাফ দিথীকে শান্ত করার জন্য দিথীকে ধরতে যায়। দিথী তখনই আহনাফের হাত ছিটকিয়ে সড়িয়ে দেয়। দিথীর মুখ থেকে যেনো কোন কথা বের হচ্ছিলো না। আহনাফ ম্লিন গলায় বলে,

‘ ভাবি, ভাবি রন্জুর লোক স্যারকে, গুলি করেছে। ‘

দিথী তার মাথায় দুই হাতে দিয়ে বিছানায় মাথা নিচু করে ফেলে। তার কান্নাকে যেনো সে থামাতে পারছেনা। জোরে চিৎকার দিতে থাকে দিথী। বিছানায় ঘুষি মারতে থাকে। পাগলের মতো কান্না করতে থাকে। চিৎকার দিতে থাকে। আহনাফ দিথীর এমন হঠাৎ আচরণে ভয় পেয়ে যায়। সে দিথীকে কী সামলাবে নিজেই ভয়ে পিছিয়ে যায়। দিথী চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। বিছানার পাশের একটা চেয়ারে বসে ছিলো সে। দিথী চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। বেতের চেয়ারটা লাত্থি মেরে ভেঙে ফেলে। টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে টেবিলের উপর সজোরে আঘাত করে। গ্লাসের মাঝ দিয়ে ফেটে দুইভাগ হয়ে যায়। দিথী চিৎকার করে বলতে থাকে,

‘ রন্জু,,,, রন্জুকে আমি ছিন্নভিন্ন করে ফেলবো। টুকরো টুকরো করে ফেলবো। আঁ,,,,,,, (কাঁদতে কাঁদতে) আমার শাহারিয়া। আমার শাহারিয়াকে ও গুলি করেছে। (চিৎকার করে উঠে) আমি রন্জুকে শেষ করে ফেলবো,,,, শেষ করে ফেলবো,,,,, ‘

বলেই ভাঙা গ্লাস হাতে নিয়েই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দিথী। আহনাফ তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামে। সেও কোন কিছু না ভেবেই দৌড় লাগায় দিথীর পিছন পিছন। দুইজনেই যেনো বাতাসের বেগে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়‌। ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকে টুকরো টুকরো কাঁচ। সাথে ছিলো রক্ত। দিথীর হাত কেটেছে গ্লাস ভাঙার সময়। সেই রক্তের ফোঁটা নিচে পড়ে আছে। ঘর মানবশূন্য নিরব হয়ে রয়।

 

______

 

সকাল ৮ টা। হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। আকাশ সাদা মেঘে ঢাকা। কিছুক্ষণ পর পর দখিনা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। 

 

বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে বসে রয়েছে রাফসান। হাতে ছোট ছোট পাথর। একটু পর পর একটা একটা করে পাথর পুকুরে ছুড়ে মারছে সে। পুকুরে সেই পাথর গুলো পড়ে মৃদু শব্দ আর পাশপাশি ছোট ছোট ঢেউয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। রাফসান যেনো কারো জন্য অপেক্ষা করছিলো। তার মুখয়ব দেখে, তাইই বোঝা যায়। দূরের মেইন রোড থেকে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ মৃদু শোনা যায়।

 

ময়লার ভাগাড় পেড়িয়ে পুকুরের দিকটায় চলে আসে সোনালী। ভেজা হাত ওড়নায় মুছতে থাকে। সোনালী ঠিক তেমনটাই আছে যেমনটা এক মাস আগে ছিলো। শুধু হালকা একটু ফর্সা হয়েছে সে। তাকে আসতে দেখেই পুকুর পাড় থেকে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় রাফসান। হাতের সব নুড়ি+পাথর সেখানেই ফেলে দেয়। প্যান্ট হাত দিয়ে ঝেড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতে থাকে। সোনালী পুকুর পাড়ের একপাশ টায় দাঁড়িয়ে হাত মুছছে। রাফসান পুকুর ঘাট থেকে উঠে এগিয়ে আসে সোনালীর দিকে। সোনালী একবার পাশ ফিরে দেখে আবার সামনে ফিরে একেকটা আঙ্গুল ওড়না দিয়ে মুছতে থাকে। রাফসান এসে সোনালীর পাশে দাঁড়ায়। বলে,

‘ তোমার আসতে এতো দেড়ি হইলো! আমি কতক্ষন থেকে অপেক্ষা করতেছিলাম! ‘

সোনালী একটু ভং ধরে বলে 

‘ ক্যান সাহেব, আমারে দিয়া আপনের কী কাম! ‘

‘ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো। তোমার মতো আধুনিক মেয়ের মুখে গ্রামের ভাষা মানায় না। ‘

‘ ও আচ্ছা! আমি আধুনিক! ‘

‘ অবশ্যই। আর আমরা কখন যাচ্ছি! ‘

‘ কোথায়! ‘

‘ কোথায় আবার। কাজী অফিস! আজকে তো আমাদের বিয়ে! ‘

‘ ভুলোনাই তাইলে! ‘

‘ আমি ভুলবো! আবার এই কথা! (একটু থেমে) এই একটা মাস আমি তোমাকে ছুইতে পারি নাই। তুমি ইচ্ছা ইচ্ছা করে পেট,পিঠি, বুক বের করে শাড়ি পড়ে খালি আমার সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছো। চাইলেও ধরতে পাড়ি নাই। বিয়ের আগে ১ মাস তুমি এইসব শর্ত দিয়ে আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিছো। আর আমি বিয়ের কথা ভুলে যাবো! হ্যাহ! ‘

‘ তো বিয়েটা তাইলে তুমি করবাই! ‘

‘ আবার জিগায়। চলো কাজী অফিস। আমি যা যা লাগে সব রেডি করে রাখছি। বাবাকেও বলে রাখছি। ‘ 

সোনালী অবাক হয়ে বলে,

‘ উনি কিছু বলেন নাই! ‘

‘ কী বলবে আর। ছোটটা বিয়ে করে খাট কাপাইতেছে। আর বড়টা কি আজীবন কুমার থাকবে নাকি। আব্বা চুপচাপ ছিলো। মানে ধরে নেও সম্মতি দিছে। ‘

‘ আজ রাতে আসিও। তখন,,,’

সোনালীর কথা থামিয়ে দিয়েই রাফসান বলে,

‘ আজ রাতে আসিও মানে! বিয়ে করবো বিয়ে। আবার টাকার ধান্দায় চলে গেছো নাকি তুমি! ‘

‘ আমার কথা শেষ হওয়ার আগে এরপর থেকে কথা বললে লাত্থি দিয়ে তোমার মিটার বক্স ভাঙ্গে দিবো! ‘ 

‘ আচ্ছা আচ্ছা সরি। বলো। তোমার পুরা কথাটা বলো। ‘

‘ বিয়ে হবে আজ রাতে। আর বিয়ের পর ডিরেক্ট বাসর। ‘

রাফসানের চোখ মুখ যেনো ফুলের মতো ফুটে উঠে‌। ভ্রু উচিয়ে বলে,

‘ তোমারও দেখি শখ জাগছে জান! ‘

‘ জাগছে না জাগাবো, সেটা যায়গা মতো টের পাবা। (একটু থেমে) বিয়ের কাগজ সব রেডি করা থাকবে। তুমি আর আমি শুধু সাইন করবো।ব্যাস, বিয়ে শেষ। ‘

‘ আর কাজী! ‘

‘ বিয়ের কাজীও আমি, বউও আমি। বিয়ে করতে চাইলে করো, নাইলে আমাকে দেখে দেখে হাত মাড়েই জীবন পাড় করোগে। ‘

রাফসান গলা ঝাড়ে। ধীর গলায় বলে,

‘ কী বলতেছো এইসব। আস্তে বলো, কেউ শুনে ফেলবে। ‘

‘ শুনলে শুনবে, আমার কী। এখন তুমি কী বিয়ে করতে চাও! না আমি বাবার ঠিক করা মকবুলের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসবো। কোনটা! ‘

‘ কোন মকবুল! ঐ ঠোঁট কাঁটা গাইয়ে মহিষ টা! তোমার বাপের চোখে কী আমার মতো হ্যান্ডসাম পাত্র চোখে পড়ে না! ‘

‘ আমার আব্বাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবা। বাপ,বাপ করবানা।’

‘ আচ্ছা ঠিক আছে বাদ দেও এই বিষয়। তাইলে আজ রাতে আমাদের বিয়ে! ‘

‘ তোমার ইচ্ছে করলে আসিও না করলে নাই। কাগজ আমি রেডি রাখবো। আজ রাতে তোমার সাথে বিয়ে হইলে হবে, নাইলে আমি কাল মকবুলের সাথে বিয়ে করে চলে যাবো। তারপর বসে বসে তুমি আমার **** এর যায়গায় নিজের আঙ্গুল চুষিও। ‘

‘ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আজকে রাতে চলে আসবো। তোমার ঐ জঙ্গলের মাঝের ঘরটায় তো না! ‘

‘ হমম। আসার সময় পান্জাবি পড়ে বর সাজে আসিও। এই শার্ট প্যান্ট পরে হুলো বাদড়ের মতো ধ্যাং ধ্যাং করে চলে আসিও না আবার। ‘

‘ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। ‘ 

বলেই রাফসান সোনালীকে ধরতে যায় তখনই সোনালী আঙ্গুল তুলে একদম মুর্তির মতো রাফসানকে থামিয়ে দেয়। রাফসান একটু হতাশ হয়। বলে,

‘ ঠিক আছে। রাতে সব সুদে আসলে উঠিয়ে নিবো। গেলাম। ‘

‘ কই! ‘

‘ আব্বু ফিড মিলে যাইতে বলছে। আমি এতোক্ষণ ঐদিকে না যায় তোমার জন্য দাঁড়ায় আছি। ‘

‘ আচ্ছা যাও। ‘

রাফসান একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে চলে যেতে থাকে বাগানের পাশের রাস্তাটা দিয়ে। সোনালী তার হাত মুছা শেষ করে ওড়নাটা গায়ে ঠিক ঠাক করে দেয়। এতোক্ষণ রাফসানের সামনে ইচ্ছা করেই ওড়নাটা অগোছালো করে রেখেছিলো সে। 

রাফসান বাগানের পাশ দিয়ে চলে যায়। তখনই সেই বাগানের মোটা কাঁঠাল গাছের আড়াল হতে বেড়িয়ে আসে নিপা। অর্ধেক মুখে ঘোমটা টেনে ধরেছে। সোনালী ওড়না ঠিক করে গুন গুন করে চলে যেতেই নেয় তখনই সে দেখে নিপা বাগানের পাশের পথে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালী সৌজন্যমূলক হাঁসি দেয়। নিপা এগিয়ে আসে। এসে সোনালীর সামনে দাঁড়ায়। সোনালী দুই হাত এক করে, নখ খোটাতে থাকে। মুখে হালকা নার্ভাসনেস। নিপা তার মুখের উপর থেকে ওড়না হালকা সড়িয়ে বলে,

‘ আপু, তুমি এখানে! ‘

‘ এ,এইযে একটু পুকুর পাড়ে গেছিলাম আরকি। ত,তুমি এতো সকাল সকাল নিচে যে। এমনিতে তো, ঘর থেকে বের হও না, তাই আরকি বলছি। ‘

সোনালী হাসি মুখ করে চেয়ে থাকে নিপার দিকে। তবে নিপা ছিলো অন্য মুডে। তার চোখ সরু সরু। সে সোনালীকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। ভারি গলায় বলে,

‘ সকাল সকাল পুকুর পাড়ে কী করতে আসছিলা! ‘

‘ আ,,, মানে পুকুর পাড়ে বসলে আরকি মন ভালো হয়ে যায়। এইজন্য। হি হি। ‘

‘ কিন্তু আমি তো দেখলাম আমার দেবর পুকুর পাড়ে ছিলো। আর তুমি ময়লার ভাগাড়ের ওপাস থেকে আসলা। ওপাসে কী করতে গেছিলা! ‘ 

‘ ওপাসে! এমনিই আরকি। তেমন কিছুনা। আম গাছে কেমন ফল ধরতে পারে, এইটাই দেখতে গেছিলাম আরকি। ‘ 

‘ তোমরা আজকে বিয়ে করবে! ‘

‘ আ,,, হ্যা। ওর আর আমার প্রেমের সম্পর্ক দুই বছর ধরে। বলতেছে বিয়ে টা করেই ফেলবে। এইনিয়েই কথা বলছিলাম আরকি। ‘

‘ ভালো। বিয়ে করে খাঁন বাড়িতে থাকলে অন্তত মানুষ এটা বলা বন্ধ করবে যে তুমি এই বাড়ির কাজের মেয়ে নও‌, বউ। ‘

বলেই সোনালীর পাশ দিয়ে হেঁটে পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায় নিপা। নিপা যাওয়ার পর পরই সোনালী তার মুখটা কঠিন করে ফেলে। রাগান্বিত গলায় বিরবির করে বলে,

 ‘ আমি কাজের মেয়ে! তুই কাজের মেয়ে শালি। তোকে নেহাতই নকশাটা দিছি বলে এখন কিছু বললাম না। খাঁন বাড়ির সব বের কর। তোর জামাই জেলে যাক, তারপর তোর ব্যাপার টা দেখতেছি। চার-পাঁচ টার সামনে ফেলে দিলে, একদম খুবলে খুবলে খাবে তোকে। এই সোনালীর সাথে পাড়ে উঠা এতোই সহজ! কী মনে করিস আমি কিছুই জানিনা! আমার ছায়া দেখে তো ঐদিন রাতে ভূত ভাবছিলি। (একটু থেমে) এই ভূতই তোর জীবন অন্ধকার করে দিবে। খাঁন বাড়ির লোকেরাই এই বাড়ির জন্য কাল হবে, আর তোর মৃত্যুর কারণ হবি তুই নিজে। ‘

 

_____

 

দুপুর ১ টা। রিয়াদ গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে তার ঘরে আসলো। বাইরে আজ অনেক রোদ উঠেছে। বেশ গরম করছে। এইনিয়ে দুইবার গোসল করলো আজ ও। রিয়াদের পড়নে লুঙ্গি। গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিছানায় বসলো ও। বিছানার পাশের টেবিলটায় আগের সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও নতুন যোগ হয়েছে ইকরার একটা ফটোফ্রেম। ১৫ দিন হলো রিয়াদ আর ইকরার কাবিন হওয়ার। দুই পরিবারের সম্মতিতেই কাবিন নামা করা হয়েছে। ইকরার পরীক্ষা শেষ হলে তখন অনুষ্ঠান করে ইকরাকে এবাড়িতে বউ হিসেবে নিয়ে আসবে রাতুল রা। ইকরা অনেক খুশি হয়েছিলো যখন দেখেছে তার বাবা-মা তার পছন্দ করা ছেলের সাথেই তার বিয়ে ঠিক করছে। করারই কথা।  পুলিশের চাকরি করে। সরকারি চাকরির পাত্র হইলে তো আর মেয়ের বাড়ির গার্জিয়ানের কোন কথাই নাই‌। বিনা শর্তে তারা মেয়ে তুলে দিতে প্রস্তুত। এইদিকে ইকরা, রিয়াদও দুইজন দুইজনকে আগে থেকে পছন্দ করতো। তাই বলা যায় তাদের ভালোবাসার পূর্ণতা হিসেবে বিয়েই কাছে এসে ধরা দিয়েছে! 

 

রিয়াদের ঘরে প্রবেশ করলো রাতুল। হাতে ভাতের প্লেট আর পানির গ্লাস। রাতুল এসে রিয়াদের বিছানায় প্লেট টা রাখে। আর গ্লাসটা টেবিলে রেখে দেয়। রিয়াদ মাথা মুছতে মুছতে বলে,

‘ মায়া ভাবি কী ঘুমাইতেছে! ‘

‘ না। ক্যান! ‘

‘ ভাবিকে বলো না ফোনটা একটু দিতে। ইকরাকে ফোন দিবো না। এমনি থানায় ফোন দিবো। ‘

‘ তুই আমার ফোন দিয়ে ফোন দে। তোর ভাবি না সময় বাঁধে দিছে কথা বলার। সারাদিনে ৪ ঘন্টা তুই ইকরা সাথে ফোনে কথা বলাতে পারবি। আর তুই সেই ৪ ঘন্টা আজকে সকালেই শেষ করছিস। তোর হাতে আর ফোন আসবো না আজকে। ‘

‘ একটু লুকায় আনে দেও না। ভাল লাগতেছেনা একলা একলা থাকতে। ‘

‘ আমি পারুম না। তোর ভাবি দিবো আমারে মাইর। সকালে এতো কথা কইতে কে কইছিলো। একটু রইয়া সইয়াও তো কথা কইতে পারতি। ‘

‘ কাল থেকে মাথায় রাখবো ভাইয়া। তোমার ফোনটা একটু দেও। মাত্র ৫ মিনিট কথা বলবো। ‘

‘ আমার ফোনে টাকা নাই। ভাত খায়ে থানায় যাবি না ঘুমাবি ঘুমা। ‘

‘ আমি তোমাকে টাকা দিচ্ছি। একটু দেওনা। ‘

‘ ফোন দিলে তো তোর আর হুঁশ থাকেনা। (লুঙ্গির গিট্টু থেকে বাটন ফোন বের করে) নে। শুধু ৫ মিনিট কথা কইবি। (আশপাশ দেখে) তাড়াতাড়ি কর, তোর ভাবি হুট কইরা আইয়া পড়বো।

রিয়াদ রাতুলের থেকে ফোনটা হাতে নেয়। সে খুব খুশি। তার ভাইয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনে নাম্বার উঠাতে থাকে। নাম্বার উঠিয়ে কল দেয়। রাতুল এইদিকে ঘরের মাঝে দাঁড়ায় অন্যদিকে মুখ করে আছে। রিয়াদ কানে ফোন ধরে রাখে। ফোনটা ওয়েটিং বলতেছে। তারমানে ইকরা অন্য কারো সাথে কথা বলছে এখন। রিয়াদ ফোনটা কান থেকে নামায়। আবার ডায়াল করে কল দেয়। তার মুখে হতাশার ছায়া নেমে আসে। আবার ওয়েটিং বলতেছে। সে ফোনটা কান থেকে নামায়। তখনই মায়া ভাবির গলার আওয়াজ পায় তারা দুজন। রিয়াদ তাড়াতাড়ি করে ফোনটা রাতুলকে দিয়ে দেয়। রাতুল কোনমতে ফোনটা নিয়ে লুঙ্গির গোছা খুলে ঐখানে রাখতে থাকে। তখনই ঘরে চলে আসে মায়া। রাতুল ভয়ে তাড়াতাড়ি লুঙ্গির গিট্টু বাঁধতে বাঁধতে চলে যেতে নেয় তখনই লুঙ্গির সাথে পায়ে পা লেগে লুঙ্গি টান খেয়ে খুলে পড়ে যায়। ফোন কানে ধরে রাখা মায়া তা দেখেই জোড়ে হেঁসে উঠে। রিয়াদ সাথে সাথে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মায়া ফোনে যার সাথে কথা বলছিলো সে ফোনের অপর পাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করে জানতে চাইছিলো কীসের জন্য মায়া হাসতেছে। রাতুল কোনমতে লুঙ্গি উঠিয়ে ঘর থেকে হনহন করে বেড়িয়ে যায়। মায়া হাসতে হাসতে এসে বিছানায় বসে। রিয়াদও লজ্জাজনক অবস্থায় পড়ে যায়। ভাবির সামনে ভাইয়ার লুঙ্গি ফাঁস! না জানি তার ভাইয়ার অবস্থা এখন কেমন! 

ফোনের অপর পাশে ইকরার গলা পেয়ে রিয়াদ তাড়াতাড়ি হাঁসতে থাকা মায়ার হাত থেকে ফোনটা নিতে যায়। মায়া ফোনটা দেয় না। হাঁসি থামাতে থাকে। বলে,

‘ ওহহ,, আজকে অনেক হাসলাম। তোমার ভাইয়া তোমাকে ফোন দিতে আসে কী অবস্থাতেই না পড়লো হা হা হা! ‘

‘ ভাবি, তুমি ইকরার সাথে কথা বলতেছো। ফোনটা দেওনা, আমিও একটু কথা বলি। ‘

‘ উঁহু। তুমি তোমার সময় শেষ করিয়া ফেলিছো। (ফোনটা কানে উঠিয়ে) হ্যা ইকরা, তোমার দেবর, মানে আমার জামাই, রিয়াদকে ফোন দিতে আসে নিজেরই লুঙ্গি খুলে ফেলছে। হা হা হা। ‘

ফোনের অপর পাশ থেকে,

‘ কী বলো মায়া আপু!! হা হা হা। খুব লজ্জা পাইছে মনে হয় ভাইয়া। ‘

‘ তা আর বলতে। গাল গুলা লাল হয়ে গেছিলো। ‘

রিয়াদ বলে,

‘ ইকরা,,, মায়া ভাবি তোমার সাথে আমাকে কথা বলতে দিচ্ছে না। তুমি একটু বুঝাও না ভাবিকে। ‘

ফোনের ওপাস থেকে,

‘ ভাবি আমাকে বলে তুমি নাকি থানায় যাওনা, সারাদিন বলে খালি ফোন আর চিঠি নিয়ে পড়ে থাকো! ‘

‘ না মানে ইকরা, ফোনে মনের ভাব সব প্রকাশ করতে পারি না। আর এই মায়াভাবি, যখনই তোমার সাথে কথা বলতে যাই তখনই গুপ্তচর গিরি করে। (মায়া রিয়াদের কাঁধে হাত দিয়ে মারে) এইজন্য চিঠি লেখি গো। ‘

‘ ইকরা। ও খুব বেশি পাকে গেছে না! খুব প্রেম কাব্য নিবেদন করে না তোমাকে! ‘

ফোনের ওপাশ থেকে ইকরা বলে

‘ ঐ আরকি একটু আধটু ভাবি। ‘

‘ একটু! ওর প্রেমের আলাপ শুনে তো আমারই আফসোস হয়। আমার মাষ্টারটা আমাকে এভাবে প্রেম নিবেদন করতে পারলোনা আজ পর্যন্ত। ‘

রিয়াদ বলে,

‘ ভাবি, আমি ভাইয়াকে প্রেমের ছন্দ শিখায় দিবো। এখন একটু দেওনা ফোনটা। একটু কথা বলি। আমার হাঁসফাঁস লাগতেছে ওর সাথে কথা না বলে। ‘

‘ কী বলো ইকরা। ফোনটা দিবো? ‘

‘ দিয়ে দেও ভাবি। দেখি তোমার বাঁদর ভাইটা আমাকে কী বলতে চায়। ‘

মায়া ফোনটা রিয়াদের দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,

‘ নে ধর। শুধু ১০ মিনিট কথা বলবি। ১০ মিনিট পর আমি আসে ফোন নিয়ে যাবো। ‘

‘ তুমি এখানেই বসো। আমি বাইরে থেকে কথা বলে আসতেছি। ‘

রিয়াদ ফোন নিয়েই ভো দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। মায়া তা হাসতে থাকে। বলে,

‘ একদম ওর ভাইয়ের মতো হইছে। কথা না বলে থাকতে পারেনা। ‘

 

    রিয়াদ দৌড়ে এসে দাঁড়ায় বাড়ির বাইরের আঙিনার কোনে লাউ মাচার কাছে। মাচার উপর এক কোনে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ফোনের অপর প্রান্তের ইকরাকে বলে,

‘ আর বলিও না। অনেক কষ্টে ফোনটা পাইছি। ‘

‘ তুমি কী এখন তোমার থানা,কেস সব বাদ দিয়ে এই ফোন নিয়েই পড়ছো! ‘

‘ আমার কেসের চাপ কখনোই কমবে না। এরচেয়ে ভালো আমি তোমার সাথে কথা বলে আমার মনটা ঠান্ডা করি। কী এক জাদু যে করছো আমার উপর। প্রতিটা মুহুর্ত তোমাকে ছাড়া খালি খালি লাগে। ‘

‘ লাগবেই তো। চলে আসো আমার এখানে। তাইলে আর খালি লাগবে না। ‘

‘ যাবো। এইকয়েকদিনের মধ্যৈই যাবো। আমার জন্য গরম চা রেডি করে রাখিও, আমি তোমার জন্য এক বুক ভালোবাসা নিয়ে আসবো। ‘

‘ হইছে হইছে। আগের বার চায়ের সাথে তো কাপটা পর্যন্ত খায় ফেলতে নিছিলা। ‘

‘ তোমার চায়ে যে স্বাদ পাই, কাপ সহ খায় ফেলতে মন চায়। তো বলো, কী কী গিফট লাগবে তোমার! কী কী নিয়ে যাবো। ‘

‘ আমার একটা নীল টেডি বিয়ার লাগবে, এত্তোগুলা ক্যাটবেরি চকলেট, আইসক্রিম,,,,,,,,,,,,

 

ফোনালাপে মেতে উঠে দুজন। একে অপরের সাথে কথা বলতে ধরলে যেনো তারা দিন-দুনিয়া ভুলে যায়। প্রিয়ের সাথে তবুও হাজার কথা বলা যায়, হাজারো আবেগ, ভালোবাসা, ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। যা এই বিশেষ মানুষ ছাড়া আর কারো সাথেই করা যায় না। আকাশের সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে ঢলে পড়তে থাকে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায় আকাশ দিয়ে। 

 

____

 

সন্ধ্যা ৭ টা। আহনাফ একটা প্লেট আর একটা পানির গ্লাস হাতে দিথীর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিতরে দিথী ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। বিছানায় বসে দুই হাঁটু ভাঁজ করে মাথা গুঁজে আছে। পড়নের শাড়িটাও যেনো কান্নার পানিতে ভিজে যেতে ধরেছে। আহনাফ ভিতরে প্রবেশ করে। 

 

তখন দিথীকে অনেক কষ্টে শান্ত করেছিলো আহনাফ। দিথীর সাথে পেড় উঠতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। দিথীর তখন এতোটাই রাগ আর যেদ উঠেছিলো যে, সে যেনো রন্জুকে আস্ত চাবিয়ে খাবে। তার প্রিয়র দেহ থেকে রক্ত জড়ানো রন্জুর রক্তে সে গোসল করে তবেই ক্ষান্ত হবে। দিথীকে শান্ত করার সময় জোড়াজুড়িতে আহনাফের হাত কেটে যায়। রক্ত পড়েছিলো অনেক। আহনাফ সাথে সাথেই দিথীকে ছেড়ে দিয়েছিলো। দিথী আহনাফের রক্ত পড়া দেখে সেখানেই বসে পড়ে। গ্লাস ছুড়ে মেরে কাঁদছিলো সে। তার জন্য আহনাফও আঘাত পেলো, তার শাহারিয়াকে ওরা নিয়ে গেলো। সব যেনো তার কাছে বিভীষিকা হয়ে ধরা দিচ্ছিলো। আহনাফ পড়ে দিথীকে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঘরে আনে। শাহারিয়া হয়তো বেঁচে আছে এই শান্তনা দেয় সে দিথীকে। সেই তখন থেকেই দিথী যে ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি। আহনাফ শুধু যোহর, আসর, আর মাগরিবের নামাজ পড়তে দেখেছিলো দিথীকে। কেঁদে কেঁদে দোয়া করতে শুনেছিলো পাশের ঘর থেকে। তার আর তখন এই ঘরে আসার সাহস হয়ে উঠেনি। এখন সে কিছু হালকা খাবার এনেছে। পাউরুটি আর বিস্কুট। সকাল থেকেই দিথী না খেয়ে আছে। আহনাফের মাথাও কাজ করছে না। হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেলো কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা সে। 

 

   আহনাফ গিয়ে দিথীর বিছানার পাশের টেবিলে খাবার প্লেট টা রাখে। একটা চেয়ার টেনে বিছানার কাছে বসে। দিথী মাথা উঠায়। তার চোখ মুখ কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে গিয়েছে। দিথী এখনো ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলো। আহনাফ এক ঢোক গিলে। ম্লিন গলায় বলে,

‘ ভাবি, খাবার আনছিলাম আপনার জন্য। একটু কিছু মুখে দেন। ‘

দিথী কিছু বলেনা। সে আমার দুই ভাঁজ করা হাঁটুতে মাথা গুঁজে দিয়ে কাঁদতে থাকে। আহনাফ টেবিল থেকে প্লেট টা হাতে নেয়। দিথীর পাশে বিছানায় রাখে। আহনাফেরও মন খারাপ। তার নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। তার স্যার তাকে আপন ভাইয়ের মতো স্নেহ করতো। সেই স্যারের রক্তাক্ত লাশ যেনো তার কাছে তার বড় ভাইয়ের লাশ। আহনাফ পানির গ্লাস টা টেবিল থেকে নেয়। ধীর গলায় আবার বলে,

‘ ভাবি। আপনি সকাল থেকে কিছু খাননি। এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। স্যারের কিছু হবেনা ভাবি। আল্লাহ নিশ্চয়ই তারে বাঁচায় রাখছে। একটু কিছু মুখে দেন। ‘

দিথী মাথা উঠায়। কান্নারত মুখটা তার একদম করুন। আহনাফ বলে,

‘ আমি স্যারকে খুঁজে বের করবো। হোক জীবিত, (ধীর গলায়) হোক মৃত। আপনি একটু কিছু খান। ভাইয়া কষ্ট পাবেন। আমি পাউরুটি আর বিস্কুটই পাইছি রান্না ঘর থেকে। এগুলা খেয়ে নিন। ‘

দিথী কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

‘ ও বেঁচে আছে তাই না আহনাফ। ও বেঁচে আছে। আমাকে আবার এসে বউজান বলে ডাকবে। আমাকে জড়িয়ে ধরবে। ওকে বেঁচে থাকতেই হবে। থাকতেই হবে। ‘

‘ ভাবি ধৈর্য ধরেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই উনাকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। একটু শান্ত হোন। খাবার গুলো খেয়ে নিন। আমি আমার যত জ্ঞান আছে সবটুকু লাগিয়ে স্যারকে খোঁজার চেষ্টা করবো। আপনি প্লিজ খেয়ে নিন। স্যার আসে যদি শুনে আপনি না খেয়ে ছিলেন, উনি খুব কষ্ট পাবেন। ‘

দিথী ছলছল চোখ নিয়ে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। দিথীকে আশ্বাস দেয় শাহারিয়া হয়তো বেঁচে আছে। আহনাফ খাবারের প্লেট টা এগিয়ে দেয়। বলে,

‘ আমি বাইরে আছি ভাবি। আমি এখনি থানায় ফোন দিয়ে সকল টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিয়ে স্যারের ফোনের লোকশন ট্রাক করার ব্যবস্থা করছি। আপনি খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আপনি দূর্বল হয়ে পড়বেন নাইলে। স্যার খুব কষ্ট পাবেন। ‘

দিথী খাবারের প্লেট টা কোনমতে হাতে নেয়। হাত কাঁপছে তার। সে একদম বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে মানসিক দিক দিয়ে। সকাল থেকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও শুকিয়ে গিয়েছে।

আহনাফ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। দিথী একটা পাউরুটি নিয়ে কোনমতে তাতে ছোট একটা কামড় দেয়। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল এসে পড়ে পাউরুটিতে।

 

    আহনাফ বাইরে চলে আসে। দরজা হালকা টেনে ভিড়িয়ে দেয়। বাইরে এসে তাড়াতাড়ি ফোন বের করে। তার মুখের অবয়ব কঠিন করে। ফোনে নাম্বার ডায়াল করে কল দিয়ে কানে তোলে। কিছুক্ষণ রিং হয়। তারপর অপর প্রান্তের লোক ফোন ধরে। আহনাফ কড়া গলায় বলে,

– শাহারিয়া স্যারের এসিস্ট্যান্ট আহনাফ বলছি। এখনি স্যারের ২টা নাম্বারই ট্র্যাক করো। লাস্ট কোথায় গিয়ে নাম্বারের লোকেশন থেমেছে সব ইনফরমেশন আমাকে দেও। ফাস্ট।

 

______

 

একটা ঘর। ঘরটা কাঁচা। গ্রামের কাঁচা ঘর গুলো যেমন হয় ঠিক তেমন। ঘরটা বিশাল এক জঙ্গলের মাঝে। জঙ্গলটা নীলগিরি। ঘরের ভিতরটা সুন্দর করে সাজানো। একপাশে খাট রাখা। সেটাও ফুল দিয়ে সাজানো। খাটের সাথে লাগানো একটা ছোট টেবিল। ঘরের আরেকপাশে লম্বা একটা বড় টেবিল। সেখানে অনেক মদের বোতল রাখা। কিছু বইও থাক করে রাখা। টেবিলের অপর পাশ আর ঘরের বেড়ার মাঝের ছোট্ট ফাঁকা অংশটায় ছোট ছোট অনেক হাড় পড়ে আছে। হাড় গুলো খুবই ছোট। দেখে মুরগির হাড় মনে হলেও এগুলো আসলে মানুষের হাড়। ১ থেকে ৩ বছর বয়সী বাচ্চাদের হাড়।

বিছানায় বসে আছে রাফসান। পড়নে শেরওয়ানি। মাথায় টোপর। একদম বর সাজে সেজে রয়েছে সে। অপেক্ষা করছে একজনের। ঘরের দরজা খুলে যায়। বাইরে অন্ধকার। তারমানে সময়টা এখন রাতের বেলা। হাই হিল পায়ে এক মেয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। হিল টা ছিলো কালো রঙের। হিলের ফিটা গুলো মেয়েটার হাঁটু পর্যন্ত পেচিয়ে বাধা। কালো ফিতা গুলো যেনো এক সাদা পা’কে পেঁচিয়ে ধরে হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে। জুতার হিল গুলা খুবই লম্বা। রাফসান তার নয়ন সোনালীর দিকে দিতেই যেন তার ভিতরে উথাল-পাতাল শুরু হয়ে। চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। হাত দিয়ে চেপে ধরে সে তার লজ্জাস্থান। জিহ্বা বের করে তার ঠোঁটে ভিজিয়ে নেয় এমন ভাবে, যেনো খুবই সুস্বাদু কোন খাবার দেখে ফেলেছে সে। সোনালী ভিতরে আসে। তার পড়নে ছিলো আমেরিকান‌ বিকিনি। হাতে কনুই পর্যন্ত কালো হাত মুজা। বুক আর নিচের লজ্জা স্থান ঢাকা সরু চিকন কাপড় দারা। বাকি সব খোলামেলা। পেটে নাভির সাইডে একটা সাপের ট্যাটু আঁকা। খোলা চুল গুলো যেন তার ফাঁকা পিঠিটাকে ঢেকে রেখেছে। ডান পায়ের রানেও একটা সাপের ট্যাটু আঁকা। বুক আর নিচ ছাড়া তার শরীরের বাকি সব খোলা উদ্যম। রাফসান তো সোনালীকে দেখেই পাগলা তেজি ঘোড়ার মতো বিছানায় লাফাতে থাকে। সোনালী ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। তার হাই হিল গুলো মাটিতে পড়ার পর পরই “খট খট” শব্দ করছে। রাফসান এক ঢোক গিলে। এ যেনো জলন্ত কোন মানবী তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। এই আগুনের এতোই ঝাঁঝ, যে যেকেউ পুরে ছাড়খাড় হয়ে যাবে। সোনালী এসে রাফসান সামনে দাঁড়ায়। একটু বুক হেলিয়ে হাত নাড়িয়ে বিমোহন গলায় বলে,

‘ হাই হ্যান্ডসাম! ‘

‘ উফফফফ,,, সোনালী মাই ডেয়ার!!! আমি তোমার জন্য তোমার দাস হয়ে যেতেও রাজি জান!!! উফফফ এইটা নাকি আমার বউ!! ভেবেই ভিতর টা যে কি লাফালাফি করতেছে!!!! ‘

বলেই নিজের হাত দিয়ে নিজেরই বুক থাপরাতে থাকে রাফসান। সোনালী একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে হালকা গলায় বলে,

‘ আগুনে তো তোমাকে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দিবোই জান! আগে তো বিয়ে টা হোক। দাঁড়াও আমি তোমার জন্য ড্রিকংস নিয়ে আসছি। ড্রিকংস ছাড়া কী আর জমে বলো! ‘

বলেই সোনালী এক চোখ টিপ্পনি দেয় রাফসানকে। রাফসান যেনো বিছানায় প্রান্তে বসে পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছিলো। সোনালী মুচকি হেসে চলে যেতে থাকে ঘরের অপর প্রান্তে থাকা বড় টেবিল টার দিকে। রাফসান ললুভ দৃষ্টিতে সোনালীকে পিছন থেকে আপাদমস্তক দেখছিলো। সোনালী এসে টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। দুইটা ড্রিংকস এর গ্লাস সামনে এগিয়ে নেয়। বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে ফিরে তাকায় রাফসানের দিকে। দাঁত দিয়ে বিয়ারের বোতলের কক টেনে ফেলে দেয়। দুষ্টু হাসি দেয়। রাফসান খালি হাত দিয়ে বিছানায় দাপাদাপি করছিলো। ইংরেজি কিছু উত্তপ্ত শব্দ ছুড়ে দিচ্ছিলো সোনালীর দিকে। সোনালী রাফসানের দিক থেকে ফিরে টেবিলের দিকে তাকায়। হাতের বেয়ারের বোতল টা টেবিলে রেখে এক হাত দিয়ে তার পিঠির খোলা চুল গুলো টেনে সামনে আনে। রাফসান ললুভ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সোনালীর সাদা ধবধবে ফাঁকা নরম পিঠ টায় একটা ব্রা ফিতা ছাড়া আর কিছু নেই। রাফসান বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে খুশিতে। এই খুশি ভাষায় বলার মতো না। 

সোনালী বেয়ারের বোতল হাতে নিয়ে সেখান থেকে গ্লাসে মদ ঢালতে থাকে। দুই গ্লাসে ঢেলে নিয়ে সে হালকা পিছনে ফিরে রাফসানকে দেখে। রাফসান শুয়ে পড়ে বিছানায় হাত দিয়ে দাপাচ্ছিলো। সোনালী সামনে ফিরে। বোতল টা রেখে তার বুকের ব্রা’য়ের ভিতর থেকে একটা মোড়ানো কাগজ বের করে। কাগজের ভাঁজ খুলতে থাকে। ভিতরে ছিলো ৩-৪ টে গোল গোল টেবলেট। সোনালী সব গুলো টেবলেট একসাথে একটা গ্লাসে ঢেলে দেয়। টেবলেট গুলো গ্লাসে পড়ার সাথে সাথেই গলে যেতে থাকে। বুদবুদ উঠতে থাকে। সোনালী গ্লাসটাকে একটু নাড়িয়ে নেয়। সব টেবলেট খুব দ্রুতই মিশে যায়। সোনালী ড্রিংকসের গ্লাস দুটো হাতে নেয়। পিছন ফিরে রাফসানের দিকে যেতে থাকে। মুখে নিয়ে আসে আবার আগের সেই দুষ্টু হাসি। রাফসান সোনালীকে আসতে দেখেই উঠে বসে। তার চোখ মুখ উৎফুল্ল, উৎদিপ্ত। রাফসান পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে ছিলো। সোনালী একটা গ্লাস রাফসানকে দেয়। রাফসান গ্লাসটা নেয়। সোনালী রাফসানের পায়ের রানের উপরই বসে পড়ে। রাফসানের গলা এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। সোনালীর উদ্যম শরীর রাফসানের দেহের পশম গুলোকেও যেনো দাঁড়িয়ে দিচ্ছিলো। সোনালী আলতো করে ড্রিংকসের গ্লাসে চুমুক দেয়। রাফসানও তার গ্লাসের বিয়ার এক ঢোকে খেয়ে নিতে থাকে। এক ঢোকে সবটুকু খেয়ে গ্লাসটা ছুড়ে ফেলে ফ্লোরে। তখনই সোনালী তার গ্লাস থেকে নিজের মুখে বিয়ার নিয়ে রাফসানের ঠোঁটের কাছাকাছি আসে। রাফসানের গাল দিয়ে ঘাম পড়তে শুরু করে। এই মেয়ের গরম যেনো এই শীতের রাতেও ঘাম ছুটিয়ে দেয়। সোনালী রাফসানের ঠোটের সাথে ঠোঁট লাগায়। তার মুখের বিয়ার রাফসানের মুখে পাঠিয়ে দেয়। রাফসান সোনালীকে ছুঁতে যায়। সোনালী বাঁধা দেয়। সবটুকু বিয়ার রাফসানের মুখে পাঠিয়ে দেওয়ার পর রাফসানের ঠোট থেকে নিজের ঠোঁট সড়ায়। হালকা গলায় বলে,

‘ আগে বিয়ে হবে, তারপর তুমি আমাকে ছুঁবে। ‘

‘ প্লিজ তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করো। আমি আর কন্ট্রোল করতে পারছিনা। ‘

‘ এখনি কাগজ আনছি, দাঁড়াও। ‘

সোনালী রাফসানের কোল থেকে উঠে। নেমে দাঁড়ায়। বিছানার পাশের টেবিলটায় একটা সাউন্ড বক্স ছিলো। সোনালী সেখানে গান ছাড়তে থাকে। এদিকে রাফসানের নেশা ধরে যেতে থাকে। তার চোখ খালি বারবার বুঝে বুঝে আসছিলো। তারপরও সে মাতাল কন্ঠে সোনালী সোনালী ডাক পাড়ছিলো। সোনালী সাউন্ড বক্সে গান ছেড়ে দেয়। নিজে চলে যায় বড় টেবিল টার দিকে। সাউন্ড বক্সে গান বাজতে থাকে,

 

“আমার মনটা যে আজ এলোমেলো কী করি বলোনা

চারিপাশে দেখি শুধু রূপসী ললনা,

ওদের মাঝে পাইনা খুঁজে আমার প্রিয়ার মুখখানি,,,

একটু হালকা মেরেছি ভাই লাল পানি

একটু হালকা মেরেছি ভাই লাল পানি “

 

সোনালী গিয়ে টেবিলের উপর থাকা একটা ব্যাগ থেকে কিছু প্যাপারস বের করে। সাথে একটা কলম। ব্যাগের চেইন লাগিয়ে পিছনে ফিরে রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসান এখন ফুল নেশায় চলে গিয়েছিলো। আলভোলা হয়ে গানের তালে তালে লাফাচ্ছিলো। সোনালীও গানের তালে তালে দেহ দুলাতে দুলাতে এগিয়ে আসে রাফসানের কাছে। এসে এক লাফ দিয়ে রাফসানের কোলে বসে পড়ে। রাফসানের গলায় চুমু খায়। কামড় দেয়। রাফসানও সোনালীকে চুমু খেতে নেয় তখনই সোনালী বলে উঠে,

‘ উঁহু,, আগে বিয়ে, তারপর বাকি কাজ! ‘

রাফসান মাতাল কন্ঠে বলতে থাকে,

‘ জান, তাড়াতাড়ি বিয়ে করায় দেও। আমি তোমার হাতে শহীদ হয়ে যেতে চাই। উম্মাহ,,,! ‘

রাফসান একটা ফ্লাইং কিস দেয় সোনালীকে। সোনালী সেটা গ্রহণ করেই নিজের বুকে হাত দিয়ে দেয়। রাফসানের উত্তেজনা চরমে। সোনালী তাড়াতাড়ি কাগজ টা পাশের ছোট্ট টেবিল টায় রাখে। কলমটা রাফসানকে দেয়। বলে,

‘ এইযে, আমাদের রেজিস্ট্রি পেপার। এটায় সাইন করে দিলেই তুমি আমার, আমি তোমার!! ‘

রাফসান মাতাল গলায় বলে,

‘ দেও দেও। সাইন টাইন করে এইসব ঝামেলা দূর করে দেই। তাড়াতাড়ি, দেও ‘

সোনালী রাফসানকে দেখিয়ে দেয় কোথায় কোথায় সাইন করতে হবে। রাফসান নেশাক্ত হয়ে থাকলেও তাড়াতাড়ি সাইন গুলো করে দিতে থাকে। উপরের পেপারে সাইন হয়ে গেলে সোনালী ঐ পেপার উঠিয়ে তার নিচের গুলাতেও সাইন করিয়ে নিতে থাকে। রাফসানও‌ সব পেপারে একে একে সাইন করে দেয়। সব পেপারে সাইন করা শেষ হয়। সোনালী সব পেপার গুলো নিয়ে নেয়। সাথে রাফসানের থেকে কলম টাও নিয়ে নেয়। রাফসান সোনালীর বুকে হাত দেয়। নিচের খায়েশ মিটাতে থাকে হাতের বলে। সোনালী রাফসানের উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য সুখশব্দ বের করে মুখ দিয়ে। রাফসানের উত্তেজনা যেনো বাঁধ ভেঙে সোনালীকে ভিজিয়ে দিতে চায়। সোনালী বিমোহন গলায় বলে,

‘ দাঁড়াও, আমি কাগজ গুলা রেখে আসি, তারপর যত মন চায় ****। ঠিক আছে! ‘

‘ বেইবি তাড়াতাড়ি যাও। তাড়াতাড়ি। ‘

সোনালী রাফসানের কোল থেকে উঠে যায়। উঠে গিয়ে পেপার গুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে আসে টেবিলের দিকে। তার মুখে ফুটে উঠে বিজয়ের হাসি। তার এতোদিনের পরিশ্রম, শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে। সোনালী কাগজ গুলো নিয়ে টেবিলের সামনে আসে। কাগজে দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ মিষ্টার রাফসান খাঁন! পাতা ফাঁদে তাইলে আপনি পা দিয়েই দিলেন! এইবার শুরু হবে সোনালীর আসল চাল। সেই চালে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে পুরো খাঁন বাড়ি। একে একে সবকিছুর প্রতিশোধ নিবো আমি। তখন ছোট ছিলাম, তাই কিছু করতে পারিনি। এখন! এখন পুরো খাঁন বাড়ির কর্তাদের আমি নাচাই! (একটু থেমে) নজরুল খাঁন, রেডি থাকো আমার প্রথম চালের জন্য। আর রাফসান! (মাথা ঘুরিয়ে পিছনে দেখে) খুব খেলতে চাও না তুমি! আসো এইবার! খেলা, হবে!! 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( সম্মানিত ভাই ও বোনেরা। আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। মাফ করে দেন আমাকে। সোনালী চরিত্র টাকে যেভাবে আমি প্রথম থেকেই তুলে ধরছি, সেইহিসাবে এইরকম সিনটা এইখানে দিতেই হইতো। আর কোন ১৮+ সিন পাবেন না এই গল্পে। এটাই লাস্ট ছিলো। গল্প নিয়ে আপনাদের মতামত জানাতে পারেন। পরবর্তী পর্ব আসছে বৃহস্পতিবার। অবশ্যই সেটা বিশেষ পর্ব!)

 

গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৭৯

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৮০ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

সকাল ১১ টা। অন্যান্য দিনের মতো আজ রোদ তেমন তেজ দেখিয়ে উঠেনি। চারপাশ এখনো কুয়াশার চাদরে ঢাকা। উপরের সাদা মেঘের আড়াল হতে কখনো বা সূয্যি মামার মুখচ্ছবি দেখা যাচ্ছে কখনো বা নতুন বউয়ের মতো মেঘের আড়ালে গিয়ে বসে রইছে। 

রাতুল আর মায়া বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। মায়া ৭ মাসের প্রেগন্যান্ট। পেট ফুলেছে বেশ অনেকটা। মায়া এক হাত তার পেটে দিয়ে রয়েছে‌। আরেক হাত রাতুলের কাঁধে। রাতুল মায়াকে ভালোভাবে ধরে তাকে নিয়ে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়‌। মায়াকে নিয়ে রাতুল গিয়েছিলো চৌড়চক বাজারের ক্লিনিক টায়। সকাল বেলা মায়ার বেশ কয়েকবার বমি হয়েছিলো। তাই দেখাতে নিয়ে গেছিলো। 

রাতুল এক হাত দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দরজা মেলে দেয়। মায়ার কাঁধে হাত দিয়ে তার ভর টুকু নিজের কাঁধে নিয়ে ২ কদম সিড়ি বেয়ে মায়াকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। মায়া হয়তোবা ব্যাথা পাচ্ছিলো খানিকটা। তার মুখের ভঙিমায় তা বেশ স্পষ্ট। মায়াকে নিয়ে রাতুল চলে আসে বিছানার কাছে। মায়াকে আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে দেয়। বিছানার বালিশ গুলা একদিকে করে মায়ার পা গুলো ধরে বিছানার উপরে আস্তে করে তুলে দেয়। মায়া শুতে চায় তবে রাতুল তাকে বলে হেলান দিয়ে বসে থাকতে। একটা বালিশ বিছানার সাথে সোজা করে রেখে মায়াকে ধরে বালিশের কাছে পিছিয়ে বসায়। মায়া হেলান দেয়। রাতুল নিচ থেকে কাঁথা টা মায়ার উপর দিয়ে দিতে যায়, তখনই মায়া বলে,

‘ গরম লাগতেছে। কাঁথা দিয়োনা। ‘ 

‘ গরম কই। বাইরে কুয়াশা আর তুমি গরম-গরম করতেছো। ঠান্ডা লাগলে তখন বুঝবা। ‘ 

রাতুল কাঁথাটা মায়ার বুক অব্দি টেনে দেয়। মায়া বলে,

‘ ফ্যান টা ছেড়ে দেও তাইলে। আমার আসলেই খুব গরম লাগতেছে। ‘

রাতুল বিছানার পাশের টেবিলে থাকা একটা ছোট ৫ ইন্চির চার্জার ফ্যান টা চালু করে মায়ার দিকে মুখ করে টেবিলের প্রান্ত টায় রাখে। সেটা থেকে মৃদু বাতাস আসছিলো। তবে তা শুধু মায়ার মুখে আর গলাতেই এসে পড়ছিলো। রাতুল উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে। বলে,

‘ কী খাবা এখন বলো, ডিম সেদ্ধ, দুধ, ভেজিটেবল স্যুপ, চিকেন স্যুপ, ক্ষীর, পায়েশ, সেমাই,,,,,

‘ আরে থামো থামো। হোটেল মেছিয়ারদের মতো দেখি খালি এক দমে বলতেই আছো। ‘

‘ আচ্ছা তাইলে তুমিই বলো কী খাবা। আমি বানায় নিয়ে আসতেছি। ‘

‘ দুধ-ডিম আমার গন্ধ লাগে। এগুলা খাবো না। (একটু থেমে) ফ্রিজে কী মাংস আছে! একটু রান্না করে দিতা, ভাত খাইতাম তাইলে। ‘

‘ কী মাংস খাবা ? গরুর, না খাসির, না মুরগির, না,,,

মায়া রাতুলের কথা থামিয়ে দিয়ে ভং ধরে বলে,

‘ তোমার মাংসটাই রান্না করো! ঐটা দিয়েই ভাত খাই! এতো এতো মেনু কে বলতে বলছে তোমাকে। (একটু থেমে) আমার খাসির মাংস খাইতে মন চাইতেছে। কিন্তু ফ্রিজে তো মনে হয় খাসির মাংস নাই। 

‘ ফ্রিজে নাই তো কী হইছে। বাজারে তো আছে। আমি এখনি কেরানি দুলালকে ফোন দিতেছি। ওই মাংস কিনে আনে দিবে। ‘

বলেই লুঙ্গির গোছা খুলে সেখান থেকে বাটন ফোন টা বের করতে থাকে রাতুল। মায়া একবার সেদিকে তাকায় আরেকবার রাতুলের দিকে তাকায়। বলে,

‘ তুমি রান্না করতে পারবা তো! আমার ফোনটা নিয়ে যাও। ইউটিউব দেখে দেখে রান্না করে নিও। ‘

‘ আগে আমার হাতের মাংস রান্না খায়েই দেখোনা। আর কে বলছে, আমি রান্না পারিনা। তুমি আসার আগে তো এই আমিই সব রান্না-বান্না করতাম। তুমি দাঁড়াও, আমি দুলালকে ফোন দিতেছি, আর তোমার জন্য স্যূপ-ট্যূপ কিছু একটা বানায় আনতছি। মাংস আনতে আনতে আর রান্না করতে করতে,,,! ততক্ষণ বসে না থাকে স্যূপ খাও। ভালো লাগবে।‌ ‘

‘ স্যূপ আমার কাছে একদমই স্বাদের লাগে না। ‘

‘ না লাগলেও খাইতে হবে। এখন তোমার আর আমাদের কুটুসের দরকার অনেক পুষ্টি। এইজন্য সবসময় বেশি বেশি করে খাইতে হবে। তুমি দাঁড়াও। আমি এখনি স্যূপ বানায় আনতেছি। ‘

বলেই চলে যেতে উদ্যত হয় রাতুল স্যার। তখনই মায়া ডাকে বলে,

‘ আমার একলা একলা থাকতে ভালো লাগেনা। আরেকটু থাকো! ‘

‘ আমি স্যূপ টা বানায় আনি, তখন তোমাকে খাওয়ায় দিবো আর গল্প করবো, ঠিক আছে! ‘

‘ তাও তুমি আমাকে খাওয়ায়েই ছাড়বা। ‘

‘ এখন তোমার কাজ হচ্ছে খালি খাওয়া আর ঘুমানো। আর আমার কাজ হচ্ছে তোমার যা ফাই-ফরমায়েশ আছে, সব পালন করা। বুঝতে পারিয়ছো রাণী! ‘

‘ হ্যা বুঝছি স্যার। যান। বেশি করে বানায় আনবেন, আপনাকেও কয়েক চামচ ধরে ধরে গিলাবো। ‘

‘ বেশি করে আনতে বলছো মানে তোমার খিদা বেশি লাগছে। আমি এখনি বেশি করে আনতেছি। ‘

‘ আরে না না। আল্লাহ আমি এতো খাইতে পারবোনা। রাতুল, শুনো,, এই রাতুল,,,! (রাতুল স্যার চলে যায়) ধ্যাত, এমনিতেই খাইতে পারিনা, ও আরো বেশি করে আনতে গেছে। ধুরর,,, পোয়াতি হইলে এতো খাবার খাইতে হবে আগে জানলে, হইতামই না! ‘

 

মায়া মুখ ফুলিয়ে হাতের উপর হাত রেখে হেলান দিয়ে বসে থাকে। ঘরের জানালা খোলা। বাইরের হালকা ঠান্ডা আবহ ঘরে আসছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে গুটি কয়েক পাখির কিচিরমিচির ডাক। 

 

_____

 

বিকেল ৩ টা। আহনাফ বাড়ির গোল ব্যালকনি বারান্দায় বারবার পায়চারি করে যাচ্ছে। কারো সাথে কথা বলার জন্য ফোন দিয়ে ফোনটা কানে ধরে রয়েছে। এদিকটায় আজকে হালকা রোদ। আকাশ পরিষ্কার। তবে মাঝে মাঝে বেশ জোড়ে বাতাস বইছে। 

আহনাফের কল টা অপর পাশের ব্যাক্তি উঠায়। আহনাফ হন্তদন্ত হয়ে কথা বলতে শুরু করে। আহনাফের কথা বলার শব্দ পেয়ে দিথী তার রুম থেকে ছুটে আসে। এসে ব্যালকনির দরজার সামনে দাঁড়ায়। দিথীর মুখখানা একদম শুকিয়ে গেছে। গাল বেয়ে পড়া পানির দাগ শুকিয়ে বসে গেছে। চোখ গুলো ভেজা ভেজা। গাঁয়ে এখনো কালকের সেই বাসি কাপড়। দিথী উদগ্রীব হয়ে আহনাফের পায়চারির দিকে তাকিয়ে থাকে। আহনাফ যার সাথে কথা বলছিলো হঠাৎ তার সাথে চিল্লিয়ে উঠে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করতে থাকে। দিথী ভয়ে কিছুই বুঝে উঠে না। আজ সকাল থেকে সে শুধু অপেক্ষা করে আছে শাহারিয়ার একটা খোঁজ পাওয়ার আসায়। কিন্তু না, কোন খোঁজ আসছে না। শাহারিয়া নামক অধ্যায় টা যেনো ধীরে ধীরে মুছে যেতে ধরেছে তার জীবন থেকে। তবে দিথীর মনে এখনো আশা বেঁচে আছে, হয়তো কোন খবর আসবে। হয়তো! 

আহনাফ ফোনটা কান থেকে নামায়। রাগে তার চোখ মুখ লাল। সে পাশ ফিরে দিথীকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই তার মুখয়ব শীতল করে ফেলে। দিথী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। আহনাফের সামনে দাঁড়িয়ে উৎসুক হয়ে বলতে থাকে,

‘ আহনাফ, আহনাফ ওর কোন খবর পেলে! ও ঠিক আছে তো।’

 

আহনাফ চুপচাপ হয়ে রয়‌। দিথী আবার উতলা হয়ে জিগ্গেস করে,

‘ কী হলো আহনাফ, চুপ করে আছো কেনো। আমার শাহারিয়া ঠিক আছে তো! ও সুস্থ আছে তো! বলো আহনাফ বলো। কিছুতো বলো। আমার শাহারিয়া কোথায়। আমার শাহারিয়া কোথায়,,,,! ‘

বলেই দিথী কান্না করে ফেলে। আহনাফ কী বলে বুঝে উঠে না। ও যে খবর পেলো তা দিথীকে বললে সে তো আরো ভেঙে পড়বে। তখন কীভাবে সামলাবে ও! আহনাফ আর কিছু ভাবেনা। বলে দেয় সবটুকু। 

‘ ভাবি, স্যারের নাম্বার দুইটাই বন্ধ। লাস্ট লোকশন সেই গোডাউনেই। তারপর, তারপর আর সিগন্যাল পাওয়া যায়নি। ‘

‘ মিথ্যা বলছো তুমি। মিথ্যা, মিথ্যা সব মিথ্যা। ‘

বলেই কাঁদতে কাঁদতে দিথী পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালে পিঠ লাগায়। মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘ আমার শাহারিয়া আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। আমার স্বপ্ন, আমার আশা, ভেঙে যেতে পারে না। ভেঙে যেতে পারে না। ‘

‘ ভাবি। আপনি শক্ত হোন‌। স্যার নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। এই দুই নাম্বারের লোকেশন পাওয়া যায়নি তো কী হয়েছে। আমরা আমাদের হাল ছাড়বো না। যেভাবেই হোক স্যারকে খুঁজে বের করবোই। ‘

দিথীর কান্না থামেনা। সে চোখ বুজে কাঁদতে থাকে। এইসব কিছু যদি স্বপ্ন হতো। স্বপ্ন ভাঙলেই সে আবার শাহারিয়াকে জড়িয়ে ধরতে পারতো। কিন্তু এইসব তো স্বপ্ন নয়। সবই বাস্তব। সবই সত্য।

আহনাফ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। সে কিছু একটা ভাবে। দিথীর কান্নারা তাকে খুব গভীর ভাবে স্পর্শ করে। একটা মেয়ে তার স্বামীকে কতটা ভালোবাসলে এমন শোকে কাতর হয়ে যেতে পারে! আহনাফ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলে উঠে,

‘ ভাবি,‌ ভাবি একটু শান্ত হোন। আচ্ছা স্যারের কী এই দুটো নাম্বার ছাড়া আর নাম্বার আছে, মানে আগে চালাতো কিন্ত এখন চালায় না। এমন কোন নাম্বার! যদি থেকে থাকে সেটা আমায় দিন। আমি সেটাও ট্র্যাক করতে চাই। যদি কোন ক্লু পাওয়া যায়! ‘

দিথী চোখ খুলে। আহনাফের দিকে তাকায়। কান্না থামাতে থাকে। হাত দিয়ে চোখ মুখ মুছে।  আহনাফ আবার বলে,

‘ একটু মনে করে দেখুন না। এমন কোন নাম্বার, যেটা শুধু আপনাকেই স্যার দিয়েছিলেন। ‘

দিথী কান্না থামিয়ে ভেজা গলায় বলে,

‘ নাম্বার, হ্যা নাম্বার। একটা নাম্বার আছে। ও আমাকে ঐ নাম্বার দিয়ে ফোন দিতো প্রথম প্রথম। কিন্তু পরে ঐ নাম্বার টা দিয়ে আমি ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। ‘

‘ নাম্বার টা দিন ভাবি। আমি এইটারও লোকেশন ট্র্যাকিংয়ে দেই। যদি কোন ফল পাওয়া যায়! ‘

‘ ঐ নাম্বার টা আমার মুখস্থ আছে। আমি, আমি বলছি। ‘

‘ দাঁড়ান ভাবি। আমি ফোনের ডায়ালার টা বের করি। (একটু থেমে) হ্যা এবার বলুন। ‘

 

দিথী নাম্বার টা বলে। আহনাফও তাড়াতাড়ি নাম্বার টা উঠিয়ে নেয়। উঠিয়ে সেই নাম্বারে কল দেয়। রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে। কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না। আহনাফ আর দিথীর মনে আবারো ছোট্ট আশারা দানা বাঁধতে থাকে। আহনাফ তাড়াতাড়ি সেই নাম্বার টা তার অফিসে পাঠিয়ে দেয়। ট্র্যাক করতে বলে। দিথী উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নতুন কোন খবরের জন্য। অফিস থেকে জানায় একটু সময় লাগবে তাদের লোকেশন খুঁজে পেতে। লোকেশন পেলেই ওরা জানিয়ে দিবে। আহনাফ ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বিষয়টা দিথীকে জানিয়ে দেয়। দিথীর মুখে মৃদু খুশির ছটা ফুটে উঠে।  ও তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে চলে যায়, ওযু করে ২ রাকায়াত নফল নামাজ পড়বে জন্য। আহনাফ বারান্দায় পায়চারী করতে করতে ফোনে কথা বলতে থাকে। আকাশের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ে।

 

____

 

ইকরা ঘরে পড়তে বসেছে। পড়ার টেবিল টা বিছানার কাছে হওয়া সত্ত্বেও সে বিছানাতেই বসেছে। তার পরীক্ষা শুরু আর মাত্র কয়েকদিন পরই। আফাজ পলিটেকনিক লাইনে পড়লেও ইকরা জেনারেল লাইনের শিক্ষার্থী। আফাজের পরীক্ষা আসতে আরো ৩ মাস দেরি। কিন্তু ইকরার পরীক্ষা আর মাত্র ৩ দিন পর। 

ইকরা পড়ছে। হাতে কলম ঘুরাচ্ছে আর বিভিন্ন লাইন মাঝে মাঝে সেই কলম দিয়ে দাগিয়ে রাখছে। তখনই রান্না ঘর থেকে তার মা তাকে ডাক দেয়,

‘ ইকরা,,, তোর ফোনে তোর আব্বু টাকা পাঠাইছে! ‘

ইকরার পড়া থেকে মনযোগ নষ্ট হয়। তবে বিরক্তি প্রকাশ না করে স্বাভাবিক গলায় বলে উঠে,

‘ না মা। এখনো দেয়নি। ‘

‘ মাসের শেষ, সদাই পাতিও কিনা লাগবে। তোর পরীক্ষা শুরু হবে, এখনো টাকা পাঠায় নাই! তোর আব্বুরে আজকে রাতে ফোন দিসতো। ‘

‘ ঠিক আছে মা। রান্না শেষ তোমার! ‘

‘ না। ক্যান! ‘

‘ এমনিই। বানু খালাকে একটু পাঠাও তো। আমার কলেজ ড্রেস গুলো নিয়ে যাক, ধুয়ে দিক। ‘

‘ শুতার সময় মুতার কাম মনে পড়ে তোর! সকাল থেকে কী করছিলি! তখন বলিস নাই ক্যান! ‘

‘ মনে ছিলোনা মা।‌ কাপড় গুলা ভিজায় দিতে বলো, পরে আমিই গিয়ে ধুয়ে দিবো।’

‘ বানু সবজি কাটতেছে। পরে ভিজায় ধুয়ে দিবেনে। তুই তোর পড়া শেষ কর। ‘

‘ আচ্ছা মা, ঠিক আছে। ‘

ইকরা আবার বইয়ের দিকে তাকায়। এখন সন্ধার দিকে ওর কাপড় গুলার কথা মনে পড়লো। রিয়াদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে সময় চলে যায়, সে হুঁশ থাকেনা ওর। ইকরা আবার পড়তে শুরু করে। বায়োলজি বইয়ে পড়ার শেষ নাই। এই প্রাণীর নাম, ঐ প্রাণীর নাম। বিরক্তি লাগলেও ইকরার কিছু করার নাই। হঠাৎ এক লাল ফোঁটা বইয়ের পাতার উপর পরে। ইকরার অবাক হয়। আঙ্গুল দিয়ে সেই লাল তরল জিনিসটা নিয়ে চোখের সামনে এনে দেখতে থাকে। হঠাৎ অবাক কন্ঠে বলে উঠে,

‘আরে! এ তো রক্ত!’ 

তার নাকের দিকটাও ভিজা ভিজা লাগতে থাকে। ইকরা নাকের নিচে হাত দেয়। নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে! ইকরা ভয় পেয়ে যায়। এর আগেও এমন ভাবে কয়েকবার রক্ত বেড়িয়েছিলো তার। সে বিছানা থেকে নামতে যায় তখনই হঠাৎ মাথাটা ঝিম মেরে উঠে। ইকরা মাথায় হাত দেয়। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করে উঠে তার। ইকরার চোখে সব ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। ধপ করে বিছানাতেই পড়ে যায় ইকরা। চোখ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। জ্ঞান হারায় সে।‌

 

______

 

দিথী জায়নামাজ টা ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ায়। ২ ঘন্টা পেড়িয়ে গেলো কোন খবর এলো না। দিথীর মনের আশাটা যে তাতে নিভে গিয়েছে তাও নয়। সে বিশ্বাস করে শাহারিয়ার কিছু হয়নি। নিশ্চয়ই কোন অলৌকিক পন্থায় তার শাহারিয়া বেঁচে গেছে। দিথী তার মায়ের সাহায্যও নিতে পারছেনা। আসুভে অধ্যায় শেষ হওয়ার পর থেকে তার মা আর কখনো তাকে দেখা দেননি। হয়তো তার মায়ের আত্মা মুক্তি পেয়েছে। আর হয়তো কখনো দেখা পাবেনা সে তার মায়ের। 

 

দিথী জায়নামাজ টা বিছানায় রাখে। তার শরীর খুব দূর্বল লাগছে। চোখ মুখ জড়ো জড়ো হয়ে এসেছে। কাল সারারাত ঘুমায় নি। আজ সারাদিন কেঁদেছে। এখনো চোখ ভিজা। শরীর একদম কাহিল হয়ে গিয়েছে তার। তখনই বাইরের ব্যালকনি থেকে আহনাফের ডাক। ‘ ভাবি,,, ভাবি,,, ‘ বলতে বলতে আহনাফ দৌড়ে ঘরে ভিতর আসে। দিথী উৎসুক হয়ে তাড়াতাড়ি বিছানার দিকটা থেকে দরজার দিকে যায়। আহনাফ অস্থির। তার গলা যেনো শুকিয়ে আসছে। চোখ মুখে উত্তেজনার ছোঁয়া। দিথী হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। আহনাফ শ্বাস নিতে থাকে জোড়ে জোড়ে। হাতে ফোন। দিথী বলতে থাকে,

‘ আহনাফ, আহনাফ ওর কোন খবর! ও ঠিক আছে তো! ‘

আহনাফ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

‘ ভাবি। এই নাম্বারের, এই নাম্বারের লোকেশন পাওয়া গেছে। হবিগঞ্জের এক পুরোনো রাজবাড়ীতে স্যারের ফোনের লোকেশন দেখাচ্ছে। ‘

‘ তার মানে, তার মানে নিশ্চয়ই ওর কিছু হয়নি। ‘

‘ হ্যা ভাবি। আমি বলেছিলাম না স্যারের কিচ্ছু হবেনা। ‘

‘ আহনাফ, তুমি প্লিজ সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি ওখানে যেতে চাই। প্লিজ। ‘

‘ ভাবি, ভাবি আপনাদের ড্রাইভার কই! ওর নাম্বার টা আপনার কাছে আছে! ‘

‘ হ্যা আছে। ‘

বলেই দিথী তাড়াতাড়ি তার বিছানার কাছে আসে। মাথার দিক থেকে তার ফোনটা নিয়ে এসে লক খুলে নাম্বার বের করে ফোনটা আহনাফকে দিয়ে দেয়। আহনাফ দিথীর ফোনটা থেকে নাম্বার তার ফোনে উঠায়। কল দিয়ে কানে তুলে। রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে। ফোনটা ড্রাইভার রুমান তুলে ফেলে। আহনাফ হন্তদন্ত হয়ে বলে,

‘ হ্যালো, হ্যালো! আমি স্যারের সেক্রেটারি বলছিলাম। আপনি স্যারের ড্রাইভার না! ‘

‘ হ্যা। আমিই ড্রাইভার। কেনো কি হয়েছে! ‘

‘ আপনি কোথায় এখন! প্লিজ একটু বাসায় আসুন। আমি আর ভাবি এক যায়গায় যাবো। ‘

‘ সিলেটেই কোথাও! না বাইরে! ‘

‘ বাইরে। হবিগঞ্জের দিকে। একটু নিয়ে যেতে পারবেন আমাদের! ‘

‘ আচ্ছা আমি তেল ভরে আসতেছি। ‘

‘ জী আচ্ছা। একটু তাড়াতাড়ি আসবেন প্লিজ। ‘

‘ ঠিক আছে। ‘

আহনাফ কান থেকে ফোনটা নামায়। উৎসুক হয়ে পাশের দিথীকে কিছু বলতে যায় তখনই দেখে তার পাশে দিথী নেই। আহনাফ চারপাশ ঘুরে দেখে। না, ঘরে দিথী নেই। একমুহুর্তের মধ্যে দিথী কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো! 

তখনই হঠাৎ, দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দিথী। হাতে লম্বা বড় চাকু। আহনাফ তা দেখেই ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে। দিথী মুখয়ব ছিলো রাগান্বিত লাল। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছিলো সে। আহনাফ ভয়ে কাঁপো কাপো গলায় বলে উঠে,

‘ ভ,ভাবি! আপনি এ,এমন ভাবে কেনো তাকিয়ে আছেন! আর, আর এই ছুরি! আ, আমি। আমি তো কিছু করিনি ভাবি। যা করেছে র,রন্জু করেছে। ‘

দিথী কঠিন গলায় বলে,

‘ এই ছুরিটা রন্জুর জন্যই। ও আমার প্রিয়কে নিয়ে যেতে চেয়েছিল না! এই ছুরি দিয়ে ওকে কেটে, টুকরো টুকরো করে ওর রক্ত দিয়ে আমি গোসল করবো। ও এই দিথীকে চিনেনাই। এই দিথী নিজের আপন মানুষের জন্য কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, সেটা আজ ও বুঝবে। রন্জুর কলিজা আমি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবো। ওর শরীরের একেকটা টুকরো আমি খুব নিখুঁত ভাবে কাটবো। খুব নিখুঁত ভাবে! ‘

দিথী তার ছুরি টা উঁচিয়ে সেটার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে। দিথীর এই রুপটা আহনাফের আত্মাটাকেও যেনো কাঁপিয়ে তুলছিলো। দিথীর সরু চোখ গুলোয় এতোটা প্রতিশোধ পরায়ণতা আগে কখনোই দেখেনি সে। দেখবে কী করে। দিথীকে আর কতটাই বা চিনে সে! 

 

_____

 

রাত ৯ টা। খাঁন বাড়ির অন্দরমহলের উপরে ঝাড়বাতিটা আলো ছড়াচ্ছে। অন্দরমহলের একপাশের ডায়নিং টেবিলে খাবার আনছে সুমনা বেগম আর আঁখি। রাতের খাবারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। বাড়ির কর্তা-পু্রুষেরা সবাই যে যার ঘরে। 

 

সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছে সোনালী। পড়নে লাল শাড়ি। হাতে লাল চুড়ি। কোমরে বিছা। খোঁপায় লাল ফুল। হাতের চুড়ি গুলো মাঝে মাঝে বেজে উঠছে। পায়ে হিল জুতো, তবে এই হিল ততটাও উঁচা না। মধ্যম উঁচা বলা যায়। সোনালী যেনো একদম বাঙালি নারীর মতো সেজেগুজে নিচে নামছে। সুমনা, আঁখি দুইজনেই পিছনে ফিরে তাকায়। সোনালী এমন ভাবে নামছিলো যেনো এই বাড়ির কর্তী সে। সুমনা বেশ অবাক হয় সোনালীকে এমন রুপে দেখে। রাফসান আজ সকালেই সোনালীকে বউ হিসেবে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছে। তখন শুধু শাড়ি পড়া থাকলেও এখন সোনালীর এতো রুপ দেখে সুমনা বেগমের কিছুই মাথায় ঢুকেনা। সোনালী নেমে এসে সুমনার সামনে দাঁড়ায়। হাতের চুড়ি গুলো একটু সড়িয়ে হাত চুলকাতে থাকে। আঁখি চলে যায় রান্না ঘরের দিকে বাকি তরকারি গুলো আনতে। সুমনা সোনালীকে বলেন,

‘ আজকে এতো সাজছিস যে! কোথাও ঘুরতে যাবি নাকি! ‘

‘ আমি এই বাড়ির কাজের লোক নাকি! যে তোর মতো পুরান শাড়ি আর ম্যারমেরা কাপড় পরে থাকবো! নতুন বউ আমি, নতুন বউ। আমিও যদি তোর মতোই এমন এবড়া,ছেবড়া কাপড় পরে থাকি, তখন তো লোকজন আমাকেও বাড়ির চাকরই বলবে রে! ‘

‘ সোনালী! মুখ সামলে কথা বল কিন্তু! তুই কাকে চাকর বলছিস জানিস! এই আমিই কিন্ত তোকে পথ দেখায় এতোদূর আনছি। আর তুই বাড়িতে বউ হয়ে আসে পল্টি নিয়ে নিলি! ‘

‘ কীসের পল্টি! আর তুইবা কে, তোর মতো কাজের লোকদের জন্য আমার কাছে টাইম নাই। টেবিলে বসতেছি, তাড়াতাড়ি খাবার দে। ‘ 

‘ দিবোনা খাবার। নিজে নিয়ে তারপর গিল। ভাঙা বিছানায় শুয়ে এখন একটু বড় বাড়িতে আসছে তো! এইজন্য শরীরে হাওয়া লাগে গেছে উনার, হুঁ! ‘

‘ হাওয়া আমার লাগছে না তোর লাগবে, এইটা কাল সকালেই বুঝতে পারবি। চাকর হয়ে মালকিনের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তাও দেখি জানিস না! ‘

‘ সোনালী! তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করে ফেলতেছিস। বাবুকে এখনি ডাক দিয়ে তোর নামে এমন এমন সব কথা বলবোনা, একদম লাত্থি দিয়ে তোকে ছুড়ে ফেলে দিবে। ‘

‘ ডাক। ডাক তোর বাবুকে। তোর বাবু এখন আমার পোষা কুকুর। ওরে আমি উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। যদি বলি তোকে কেটে আমার জন্য রান্না করে আনতে, (সুমনার কাছে এসে চোখে চোখ রেখে) ও কিন্ত দ্বিতীয় বার ভাববে না! ‘

‘ সোনালীর বাচ্চা,,,,! ‘

সুমনা বেগম সোনালীকে থাপ্পড় দিতে যান তখনই সোনালী তার হাত ধরে ফেলে। হাত উল্টো করে বাকিয়ে দেয়। সুমনা বেগম ব্যাথা পেতে থাকেন। সোনালীকে হাতটা ছেড়ে দিতে বলেন। সোনালী হাত টা অমন বেঁকিয়ে ধরেই হাসি মুখে বলে,

‘ তোর চোখ গুলো কেটে খাওয়া, আমার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র! ‘

বলেই সুমনার হাতটা ছেড়ে দেয় সোনালী। সুমনা এই নতুন সোনালীকে চিনে উঠতে পারেন না। সোনালী বাড়িতে বউ হয়ে এসেই রূপ বদলে নিলো! সোনালী মুচকি হাসতে হাসতে গিয়ে ডায়নিং টেবিলে বসে। সুমনা বেগম সোনালীর শেষ কথাটাকে হজম করতে পারেননা। সোনালীকে উনি চিনেন। সোনালী যা একবার বলে তা যেকোনো মূল্যে করে। তাইলে কী তারও চোখ! সুমনা বেগম ভয়ে ভয়ে তার চোখ দুটো ধরেন। তখনই পিছনে ডায়নিং টেবিলে বসে নিজ গ্লাসে পানি ঢালতে থাকা সোনালী বলে,

‘ আজ রাতে তোকে কেঁটে রান্না করলে কেমন হয়, সুমনা! ‘

 

______

 

রাত ১ টা। একটা ঘন জঙ্গল। তবে এটা নিলগিরি জঙ্গল নয়। অন্য এক জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলে এক পুরোনো রাস্তা। আশেপাশে ঘন লম্বা লম্বা গাছ পালা। আকাশ খারাপ। হয়তোবা বৃষ্টি নামবে। মাঝে মাঝে দূরে বাজ পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জোড়ে জোড়ে বাতাস বইছে। একটা গাড়ি সজোরে চলে যায় সেই জঙ্গলের মাঝের রাস্তাটা দিয়ে। 

 

   একটা পোড়াবাড়ি। বাড়িটার চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। কিছু বাদুর গোল করে উড়ছে ঠিক বাড়িটার উপর। দূরে আকাশে বিজলী চমকিয়ে উঠে। বাড়িটার সামনের রাস্তায় একটা গাড়ি এসে থামে। এটা সেই গাড়িটাই যেটা ঘন জঙ্গলের মাঝে সজোরে ছুটছিলো। গাড়িটার দরজা খুলে নেমে আসে দিথী আর আহনাফ। দুইজনেই পোড়া বাড়িটার দিকে ফিরে তাকায়। এ বাড়িটার নাম রজেন্দ্রমোহন দূর্গ। যদিও বাড়িটা দূর্গের মতো অতোটাও বড় না, তবুও এটাকে দূর্গ বলেই ডাকে সবাই। আহনাফের হাতে ফোন। ফোনের ডিসপ্লেতে একটা রেড ডট আর একটা সবুজ ডট দেখা যাচ্ছে। ডট দুটো খুবই কাছাকাছি। অর্থাৎ রেড ডট টা শাহারিয়ার ফোনের লোকেশন। আর সবুজ ডট টা তাদের লোকেশন। আহনাফ পিছনে ফিরে ড্রাইভার রুমানকে চলে যেতে বলে। রুমানও গাড়ি নিয়ে চলে যায়। দিথী আর আহনাফ এগিয়ে আসে দুর্গের মূল দরজার সামনে। দরজাটা লোহার। জং ধরেছে। শেওলাও জমেছে। বাতাস বইছে বেশ জোরে জোরেই। দিথীর পড়নে প্লাজু আর একটা গোল থ্রী পিস। দিথী তার উড়তে থাকা ওড়নাটাকে গা থেকে খুলে। আহনাফ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দিথী ওড়নাটাকে পিঠির পিছন থেকে বুকের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে কোমরের ওখান টায় শক্ত করে বাঁধে। হাত বাড়ায় আহনাফের দিকে। আহনাফ ছুরিটা দেয় থাকে। দিথী ছুরি নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। এগিয়ে আসে। আহনাফও দিথীর পিছু পিছু এগিয়ে যায়। দিথী এসে লোহার দরজাটা দুই হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খুলে দেয়। বেশ শব্দ করেই দরজাটা খুলে যায়। আশপাশের পরিবেশে কেমন যেনো গা ছমছমে ভাব। আহনাফ এমন পরিবেশে আগে কখনো আসেনি। তার মনের ভিতর থেকে ভয়ে উঁকি দিতে থাকে। তবে দিথী ছিলো ‌শক্ত। তার চোখ মুখে ছিলো প্রতিশোধ নেয়ার আকাঙ্ক্ষা। দিথী আর আহনাফ এগিয়ে যায়। বাড়িটার সামনে দুইপাশে বড় দুটো গাছ। গাছে কোন পাতা নেই। খালি ডাল আর কান্ড। যেনো সেটা কোন গাছের কঙ্কাল। দিথী এগিয়ে এসে দাঁড়ায় বাড়ির ফটকের সামনে। এই দরজাটা কাঠের। বেশ কারুকাজও করা তাতে। দেখেই মনে হচ্ছে এই দরজা অনেক অনেক বছরের পুরোনো। দিথী দরজায় একটা ধাক্কা দেয় হাত দিয়ে। দরজা খুলে না। দিথী আরেকটা ধাক্কা দেয় হাত দিয়ে, না তাও খুলেনা। দিথী এইবার বিরক্ত হয়ে পিছিয়ে গিয়ে জোড়ে পা দিয়ে এক লাত্থি মারে দরজার মাঝ বরারর। দরজা ভেঙে ভিতরে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে। আহনাফ চোখ বড় বড় করে দিথীকে দেখছিলো। এটা মেয়ে না পালোয়ান! সে নিজেও তো লাত্থি দিয়ে দরজা ভাঙা তো দূর খুলতে পারতো কী না সেই সন্দেহ আছে নিজের উপর আছে। সেই যায়গায় দিথী কিনা! 

   দিথী আর আহনাফ বাড়িটার ভিতরে ঢুকতেই নেয় তখনই কতগুলো বাদুড় একসাথে উড়ে বেড়িয়ে আসে ভিতর থেকে। দিথী সাথে সাথে সড়ে দাঁড়ায়। এদিকে আহনাফ কিছু বুঝে উঠার আগেই বাদুড় গুলো তার মুখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে থাকে। আহনাফ হাত দিয়ে সেগুলোর থেকে নিজের মুখকে বাঁচানোর চেষ্টা করে তখনই দিথী তার শার্ট ধরে টেনে তাকেও দরজার সাইডে নিয়ে আসে। বাদুড় গুলো সব বেড়িয়ে যায়। দিথী দরজার আড়াল হতে বাড়ির ভিতরটায় চোখ রাখে। ভিতরটায় ছিলো আবছা অন্ধকার। দিথী তার ফোন বের করে। ফ্লাশ জ্বালিয়ে ভিতরে যেতে থাকে। আহনাফও তাড়াতাড়ি তার ফোনের ফ্লাস জালিয়ে দিথীর পিছন পিছন বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে। এই বাড়িটার ভিতরে ছিলো বড় একটা অন্দরমহল। উপরে পুরোনো মাকরশার জালে মাখা ঝাড়বাতি ঝুলছে। মাঝ দিয়ে বড় সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায় যাওয়ার জন্য। দিথী এগিয়ে আসে। আহনাফ এবার অনেক ভয় পাচ্ছিলো। মুখ দিয়ে বিরবির করে সূরা বলতে বলতে সেও দিথীর একদম পিছন পিছন হাঁটতে থাকে। ছোট থেকেই সে ভূত জিনিসটাকে মারাত্মক ভয় পায়। সেই যায়গায় কিনা একটা পোড়া বাড়িতে আসতে হলো তাকে! 

দিথী এগিয়ে এসে দাঁড়ায় সিঁড়ির সামনে। ফ্লাশ লাইটের আলো দিয়ে চারপাশ দেখতে থাকে। বড় বড় মুর্তি রাখা ছিলো আশেপাশে। আহনাফ তো একটা মুর্তির মুখে আলো ফেলতেই সেটাকে দেখে ভয়ে দিথীর কাছে চলে আসে। দিথী মেয়ে না হলে নিশ্চিত ও কোলে চড়ে বসতো। কিন্তু মেয়ে বিধায় শত ভয়ের মধ্যেও সে এমনটা করতে পারছে না। তাকে সাহস জুগিয়ে হলেও দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। দিথী হেঁটে হেঁটে চারপাশ টা দেখে। তেমন কিছুই পায়না। এইখানে রন্জুর আস্তানা কী আসলেই থাকতে পারে! এখন তো তার এটা নিয়েও সন্দেহ হচ্ছে। সে ভাবে উপরের তলায় গিয়ে একবার দেখা যাক। আহনাফকে ইশারায় ডাকে। আহনাফও কোনমতে চলে আসে ভয়ে ভয়ে দিথীর পিছন পিছন। দিথী সিঁড়ির কাছে আসতেই সে সিড়ির দুইপাশের হাতল গুলো দেখতে থাকে। সে এমন ভাবে দেখছিলো যেনো সে কোন কিছু পেয়েছে। সাথে সাথে সে সিড়ির বাম হাতলের দিক যায়। হাতলের শেষ প্রান্তে যেই গোলকের মতো একটা জিনিস থাকে সেটা ধরে। ধরে নাড়াচাড়া করে দেখতে থাকে। না এটা নড়ছে না। দিথী এটাকে ঘুরাবার চেষ্টা করে। তখনই দেখে এটা ডান দিকে ঘুরে যায়। দিথীও জোরে ঘুরাতে থাকে, তখনই শব্দ করে সিঁড়িটা ভাজ হয়ে উপরে উঠে যায়। আহনাফতো ভয়ে দিথীর পিছন এসে দিথীর কাঁধের পিছনে মুক লুকায়। দিথী ধীর গলায় আহনাফকে বলে,

‘ কোন ভূত নেই। আমিই হাতল ঘুড়িয়ে এটা করেছি। ‘ 

আহনাফ সামনে তাকায়। দেখে দিথী হাতলের গোলক টা হাত দিয়ে ঘুড়িয়েই সিঁড়িটাকে মাঝ দিয়ে ভাঁজ করেছে। দিথী সামনে তাকায়। দেখে সিঁড়ি ভাঁজ হয়ে তার মাঝ দিয়ে সোজা একটা রাস্তা চলে গেছে। দিথী হাতল টা ছেড়ে দিয়ে সেদিকে এগোয়। আহনাফ তার বন্দুক টা কোমরের ভাঁজ থেকে বের করে। কাঁপো কাপো দুই হাত দিয়ে সেটাকে কোনমতে ধরে। এগিয়ে যেতে থাকে। 

তারা দুইজন এই রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগোনোর পরই সামনে আলোর মুখ দেখতে পায়। একটা করিডোর। উপর দিয়ে নিলচে আলো জ্বলছে। করিডোর টা সোজা চলে গেছে। দুইপাশে রুমের দরজা। করিডোরের শেষ প্রান্ত দেখা যায় না। তারমানে করিডোরটা অনেক বড়। দিথী আহনাফকে এলার্ট হয়ে যেতে বলে। আহনাফ তার ফোনটা পকেটে রেখে দুই হাত দিয়ে বন্দুক ধরে রেডি হয়ে নেয়। তার পায়ের হাঁটু এখনো ভয়ে কাঁপছে। সে যেনো স্বাভাবিক হতেই পারছেনা। দিথী আহনাফকে বলে করিডোরের ডান পাশের দরজা গুলোয় কান পাততে, আর সে বাম পাশের গুলোয় কান পাতবে। যেটা থেকেই শব্দ বা কথার আওয়াজ পাবে সেটার ভিতরেই ঢুকে চেক করবে। আহনাফ সম্মতি জানায়। দুইজনে করিডোরের দুইপাশের দরজা গুলোর মাঝে কানে পেতে পেতে চেক করতে করতে যেতে থাকে। করিডোরের উপরে কোনে থাকা একটা সিসি টিভি ক্যামেরার তাদের দেখতে থাকে। 

 

দিথী আর আহনাফ বেশ কয়েকটা দরজা পার করে এসেছে। কিন্তু কোন আওয়াজ পায়নি।‌ এখানে কী শাহারিয়া নেই! নাকি কোন রুমে তাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে। দিথী মাথায় বারবার এই প্রশ্নটা উঁকি দিতে থাকে। তার এখন কী করা উচিত তাও সে ভেবে পায় না। তখনই সে দেখে তাদের থেকে সামনে আর ৪ রুম পরের রুমটার দরজাটা হালকা খোলা। সেটার ভিতর দিয়ে সাদা আলো বেড়িয়ে আসছে। দিথী ইশারায় আহনাফকে ডাকে। আহনাফ দেখতে পায়। দিথীর দিকে চলে আসে। দিথী ইশারায় সেই দরজাটাকে দেখায়। আহনাফের কানের সামনে ফিসফিস করে বলে,

‘ ঐযে দেখো, ঐ ঘরটা ‌খোলা। মানুষের কথারও আওয়াজ আসতেছে। ‘

আহনাফ তা শুনেই ইশারায় বলে, তারা কী এখন সেখানে যাবে! দিথী মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। আহনাফ একটা ঢোক গিলে। তার কেনো যানি সবকিছু সুবিধার লাগছে না। আবার তারা কোন ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে না তো! 

দিথী আহনাফ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেই দরজার দিকে। এই দরজার উপরেও সিসি টিভি ক্যামেরা ছিলো। সেগুলোও যেনো দিথী আর আহনাফকে দেখছিলো। দিথী আর আহনাফ এসে দাঁড়ায় দরজার পাশে। দিথী দরজার আড়াল থেকে তার এক চোখ রুমের ভিতরে। আহনাফও আড়াল হতে ভিতরের দিকে তাকায়। ঘরের উপরের সাদা বাতি জ্বলছিলো। সেই আলোয় একটা টেবিল দৃশ্যমান। টেবিলের বামে আর ডানে চেয়ারে বসে আছে দুই ব্যাক্তি। আর টেবিলের সামনের দিকটায়। মানে দরজার দিকটায় একটা চেয়ারে বাঁধা ছিলো একজন‌ লোক। তার গাঁয়ে কোন কাপড় নেই। লোকটার মুখ দিথীদের বিপরীতে করে রাখা। আর সেই লোকটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রন্জু! তার পড়নে কালো হুডি আর কালো জিন্স প্যান্ট। রন্জুর এক হাতে বন্দুক ধরে রাখা। রন্জুও দিথীদের বিপরীতে মুখ করে দাঁড়িয়ে বাকি দুইজনের কথা শুনছিলো। দিথী ঘরের চারপাশে তাকায়। দেখে ঘরের এক কোনে কিছু কাপড় পরে আছে। আরে! ওখানে শাহারিয়ার সেই শার্ট টাও আছে, যেটা পড়ে সে আহনাফের সাথে বেড়িয়েছিলো। শার্টে এখনো রক্তের দাগ স্পষ্ট। দিথীর মনে রাগ আসতে থাকে। তখনই দেখে টেবিলের বা’পাশের লোকটা, খালি গায়ে থাকা লোকটাকে জোড়ে জোড়ে চড় থাপ্পর মারে। দিথী মনে হতে থাকে ঐ খালি গাঁয়ের লোকটাই যেনো তার শাহারিয়া। তার শাহারিয়াকে ওরা এভাবে বেঁধে রেখেছে! এভাবে মারছে! এদিকে আহনাফ তো ভয়ে তার নজর সড়িয়ে নেয় দরজার আড়াল থেকে। তখনই হঠাৎ দিথী আহনাফের হাতের বন্দূক টা কেড়ে নেয়। আহনাফ ‌কিছু বুঝে উঠার আগেই দিথী এক হাতে ছুরি আর একহাতে বন্দুক নিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জোরে এক লাত্থি মারে দরজা গায়ে। সাথে সাথেই কাঠের দরজাটা শব্দ করে সম্পূর্ণটা খুলে যায়। দিথী দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বন্দুক উঁচিয়ে তাক করে ধরে রন্জুর মাথা বরাবর। আরেক হাতের ছুড়িটা বাকি লোক দুইজনের দিকে ছুঁড়ে মারা জন্য প্রস্তুত হয়। বন্দুকের ট্রিগারে আঙ্গুল দেয়। রঞ্জুর শরীরে গুলি বিধিয়ে দিতে যাবেই তখনই রন্জু ফিরে তাকায়। এবার আর রন্জুর মুখ হুডির টুপির আড়ালে ছিলোনা। রন্জুর মুখটা দেখার সাথে সাথেই যেনো দিথী আর আহনাফের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। দিথীর হাত থেকে বন্দুক,ছুরি পড়ে যায়। আহনাফ থ হয়ে যায়। রন্জু আর কেউ নয়। দিথীর প্রেম পুরুষ শাহারিয়া নিজেই!

 

(((২য় ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে 👇)))

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৮০ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৮১ (২য় ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

দিথী নাস্তার প্লেট হাতে সোফার রুমে প্রবেশ করে। সোফায় বসে টিভি দেখছিলো আহনাফ আর শাহারিয়া। টিভিটা দেয়ালে লাগানো। টিভিতে সিআইডি চলছে। দিনের বেলা সনি আটে সিআইডি হয়না তাই ইউটিউব থেকেই ছেড়েছে শাহারিয়া। দিথী নাস্তার প্লেট দুটো নিয়ে এসে সোফার সামনের টেবিল টায় রাখে। শাহারিয়ার সোফার উপর পা তুলে বসে ছিলো, দিথীকে দেখেই পা নামিয়ে বসে। আহনাফও সোজা হয়ে বসে। নাস্তার প্লেটের উপর থেকে ঢাকা উঠিয়ে দিথী একটা প্লেট আহনাফকে দেয়। আরেকটা শাহারিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়। প্লেটে ৩ টা পরোটা আর ডিম ভাজা ছিলো। শাহারিয়া তার প্লেট টা নিয়েই বলে,

‘ তোমার টা ? ‘

‘ আমি রান্না ঘরে খেয়ে নিবো। ‘

‘ তোমার রান্না ঘরে খাওয়া লাগবেনা। এখানে নিয়ে আসো। একসাথে খাবো। ‘

‘ এখানে,,,! ‘

‘ হ্যা আনো। এইযে আমার পাশে বসবা। সোফা তোমার জন্য ফাঁকা রাখছি। ‘

‘ হইছে! ঢং! ‘

দিথী লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে চলে যায় তার খাবার আনতে। শাহারিয়া হাঁসতে হাঁসতে পরোটা মুখে দেয়। আহনাফ চুপচাপ কোনোকিছু না দেখার ভান করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। মানে সে যেনো ছোট বাচ্চা, কিছুই বুঝেনা। শাহারিয়া আহনাফকে এমন ভাবে দেখে তার পায়ের রানে আস্তে করে মারে। আহনাফ খেতে খেতে শাহারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

‘ হ্যা স্যার,, বলেন। ‘

‘ বলতো টিভিতে দয়া একটু আগে কী ডায়লগ দিলো! ‘

‘ কী ডায়লগ দিছে! ঐতো, ঐতো বললো যে,,,,,! ‘

‘ হ্যা কী বললো! ‘

‘ ঐতো বললো ড,সারিকাকে নাকি তার ভালো লাগে! ‘

‘ অভিনয় টাও ঠিক মতো করতে পারিস না হ্যা! (আহনাফের পায়ে আরেকটা মেরে) সারিকাকে দয়া পছন্দ করে না অভিজিৎ পছন্দ করে! তোর ভাবির কথা শুনতে গিয়ে তো সব উল্টায় ফেলছিস হ্যা! হা হা হা! ‘

‘ না মানে স্যার! ‘

শাহারিয়া হাসতে থাকে। বলে

‘ হইছে হইছে বুঝছি। নে খা এখন। ‘

আহনাফ কিছুটা লজ্জা পায়। তার স্যার ঠিকই ধরে ফেলছে তার কাঁচা অভিনয়। আহনাফ স্বাভাবিক হয়। বলে,

‘ স্যার! ‘

শাহারিয়ার টিভির দিক থেকে ফিরে বলে,

‘ হ্যা বল। ‘

‘ স্যার আমি একটু ঢাকা যেতে চাচ্ছিলাম। ‘

‘ ঢাকা! কেনো ? ‘

‘ মায়ের জ্বর। আফরিন ফোন দিছিলো আজ সকালে। এমনিতেই ওর মা’ই এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি, তার উপর আমার মায়ের জ্বর। একলা একটা মেয়ে, সব সামলাতে পারছেনা স্যার। যদি যাওয়ার অনুমতি টা দিতেন! ‘

‘ অনুমতি নেওয়ার কি আছে। এখন তো কোন কাজই নাই। এখন শুধু তোমাকে অভিনয় করতে হবে। মানে আমি যে হারায় গেছি আর তোমরা দুঃখে আছো এই অভিনয়‌। (একটু থেমে) যেই রঞ্জু কেসের জন্য এতো কাঠখড় পুরানো সেই রন্জু তোমার সামনে বসে এখন নাস্তা খাইতেছে। হে হে হে! এখন তো আর তেমন কোন কাজই নাই। ‘

বলেই শাহারিয়া টিভির দিকে তাকায়। নাস্তা খেতে থাকে। আহনাফ বলে,

‘ স্যার তাইলে আমি আজকেই রওনা দেই! ‘

‘ হ্যা দেও। তবে একটা কাজ করা বাকি তোমার। নাস্তা শেষ করে বাইরে গিয়ে রুমানের সাথে ৫-৬ দিনের বাজার করে নিয়ে আসিও। আমি এখন বাইরে সবার কাছেই কিন্ত মৃত বা গুম হওয়া একজন। আমার এখন বাইরে যাওয়াটা উচিত হবেনা। ‘

‘ আচ্ছা স্যার ঠিক আছে। আমি বাজার করে এনে রাখবো। ‘

‘ রুমানের কাছে টাকা আছে। ওর কাছ থেকে নিয়ে নিও। ‘

‘ আচ্ছা স্যার। ‘

দিথী প্রবেশ করে সোফার রুমে। তার হাতেও নাস্তার প্লেট। সে প্লেট নিয়ে এসে আলাদা সিংগেল একটা সোফায় বসতে যায় তখনই শাহারিয়া তাকে তার পাশেই বসতে বলে, দিথী চোখ দিয়ে ইশারায় আহনাফকে দেখায়। শাহারিয়া মাথা নাড়িয়ে বলে কিচ্ছু হবেনা। তবুও দিথী আর শাহারিয়ার পাশে বসে না। চোখ সরু সরু করে শাহারিয়াকে ইশারায় বলে দেয় পড়ে বসবে। বলেই দিথী সিঙ্গেল একটা সোফায় বসে পড়ে। শাহারিয়া মুচকি হেসে টিভির দিকে তাকায়। তিনজন মিলে টিভি দেখতে দেখতে নাস্তা করতে থাকে। শাহারিয়া মাঝে মাঝে দিথীর দিকেও তাকায়। দিথী তা বুঝে কিন্তু টিভির দিক থেকে মুখ ঘুড়িয়ে শাহারিয়ার দিকে তাকায় না। মাঝখান দিয়ে আহনাফ পড়ে যায় লজ্জায়। সে খালি চুপচাপ সামনে টিভির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি পরোটা খেয়ে এই খান থেকে তার ঘরে পালানোর চিন্তা করতে থাকে। 

 

____

 

খাঁন বাড়ির সামনে অনেক মানুষের জটলা। বাড়ির বড় মেইন গেইট খোলা। বাড়ির বাইরের রাস্তায় তিনটে পুলিশ ভ্যান দাঁড়ানো। দিনাজপুর থেকেও কিছু পুলিশ এসেছে এখানে। 

 

মতিন মেম্বার আর শিউলি বেগম কোনমতে ভিড় ঠেলে বাড়ির ভিতরে আসেন। শিউলি বেগম মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদছেন। মতিন তার হাত শক্ত করে ধরে তাদের মেয়ের খোঁজ করছে। তারা এগিয়ে আসে। এদিকটাতেও লোকের সমাগম বেশ। তখনই তারা দেখে, বাড়ির অন্দরমহলের ভিতর থেকে পুলিশরা একে একে বাড়ির কর্তাদের হাতে হ্যান্ডকাপ ও কোমড়ে দড়ি পড়িয়ে বের করছে। সবার সামনেই নজরুল সাহেব। তিনি মাথা নিচু করে আছেন। তার পাশে একজন কনস্টেবল। মতিন মেম্বার রাগান্বিত হয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো তাকে মারতে ছুটে যান। তিনি ভাবছিলেন তার মেয়েরও বোধহয় ক্ষতি করেছে এই নজরুল। তখনই পুলিশের কয়েকজন কনস্টেবল এসে মতিন মেম্বারকে ধরেন। তাকে সামলান। নজরুল সাহেব একদম মাথা উঠান নি। তাকে নিয়ে যায় কনস্টেবল রা। তখনই তার পিছন পিছন বাড়ির অন্দরমহল থেকে বের করা হয় শাহেদ আর সাদিক কে। তারা দুইজন বারবার পুলিশ দের বোঝানোর চেষ্টা করছিলো যে তারা কিছু করেনি। তারা এইসব বিষয়ে কিচ্ছু জানে না। তবুও তাদের এরেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশেরা। শিউলি বেগম গিয়ে অন্দরমহলের দরজার সামনে দাঁড়ান। আশেপাশে কিছু মহিলা দাঁড়ানো। তারা বলাবলি করতে থাকে একে অপরের সাথে,

‘ এগোরে আমরা কতো ভালা জানি, আর এরাই কিনা এইসব কাম করতো! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ‘

‘ হ। নিজের বউডারে পর্যন্ত মাইরা খাইয়া ফেললো! এইডা কোন মানুষ না জানোয়ার গো ভাবি! এগোরে আমরা কতো ভালা জানতাম! আর ভালা মানুষের মুখোশ পইড়া এরা মানুষের মাংস খাইতো! আমার তো ভাইবাই গা গুলায়া আইতাছে। ‘

‘ ছোট ছোট বাচ্চাডিরে বলে ধইরা আইনা খাইতো। আল্লাহ, কত যে মায়ের কোল খালি করছে এই নজরুল! আল্লাহ তুমি হেই মা’গোরে ধৈর্য্য ধরার তৈফিক দেও গো আল্লাহ। ‘

তখনই শিউলি বেগম তাদেরকে কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞেস করেন,

‘ আমার, আমার মাইয়াডারে তোমার কেউ দেখছো মরিয়ম! ‘

‘ না গো দেহি নাই শিউলী। কে জানে তোমার মাইয়াডারেও নি আবার নজরুলে,,,,,! ‘

‘ না,,,, এমন কইয়ো না। আমার নিপার কিছু হয়নাই। অর কিছু হয়নাই। ‘ 

তখনই তিনি অন্দরমহলের ভিতর থেকে নিপার কথা শুনতে পান। তিনি তাড়াতাড়ি অন্দরমহলের দরজার সামনে দাঁড়ান। ভিতরে যেতে চাইলে পুলিশ তাকে বাধা দেয়। তখনই ভিতর থেকে কোমড়ে দড়ি পড়া হাতে হাত কড়া দেওয়া রায়হানকে বের করে আনে কনস্টেবল। নিপা রায়হানের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো। বারবার পুলিশদের বলছিলো রায়হানকে ছেড়ে দিতে। রায়হানও নিপাকে বারবার ভেজা গলায় বলছিলো সে কিছু করেনি। সে এসবের সাথে নেই। নিপাও তার রায়হানকে ছাড়তে নারাজ। সে বারবার রায়হানকে টেনে টেনে পুলিশ দের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো। হাউমাউ করে কাঁদছিলো। তখনই এক পুলিশ কনস্টেবল এসে জোড়ে ধাক্কা দিয়ে নিপাকে ফেলে দেয়। নিপা পড়ে যায়। সেই কনস্টেবল টা এসে নিপা পায়ে সজোরে লাত্থি মারে। নিপা মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। রায়হানের মস্তিকে সাথে সাথেই যেনো রক্ত উঠে যায়। সে সাথে সাথেই পিছনে ফিরে চিৎকার দিয়ে উঠে জোড়ে এক ঘুষি মারে কনস্টেবলের মুখে। কনস্টেবলের নাকটা সম্পূর্ণ ভেঙে রক্ত বেড়িয়ে আসে। কনস্টেবল ছিটকে পড়ে বাড়ির দেওয়ালের সাথে। রায়হান তার শরীরের দড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলে। গিয়ে সেই কনস্টেবলকে লাত্থি দিতে থাকে। ঘুষি মারতে থাকে। পাশে পড়ে থাকা একটা বড় ইট উঠিয়ে সেই কনস্টেবলের মাথায় মারতে যায় তখনই কিছু কনস্টেবল এসে তাকে ধরে ফেলে। রায়হান যেনো পাগল, উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো। তার সুবার গায়ে এই লোক লাত্থি মেরেছে! সে এই কনস্টেবলকে ছাড়বে না। রায়হান তেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সেই কনস্টেবলের দিকে। ৬-৭ জন অন্য কনস্টেবল একসাথে ধরেও যেনো তাকে সামলাতে পারছিলো না।‌ এক হইহুল্লোড় পড়ে যায় বাড়ির সামনে।‌ রিয়াদ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে আসে না। সে চায়না এখানে তার অন্তর্ভুক্তি। তখনই আরো কিছু কনস্টেবল এসে রায়হানকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। রায়হান ঐ কনস্টেবলকে যা ঘুষি আর লাত্থি মেরছে তাতেই সে গুরুতর আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। এদিকে নিপাকে ধরে উঠায় শিউলি বেগম সহ আরো কিছু মহিলা। নিপা কাঁদছিলো। ছলছল চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো রায়হানের দিকে। রায়হানকে কনস্টেবলরা নিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠায়।  গাড়িটা বাড়ির বাইরে ছিলো। নিপা তার মা’কে জড়িয়ে ধরে। খুব কাঁদতে থাকে। বাড়ির অন্দরমহলের ভিতর থেকেও কান্নার আওয়াজ আসে। সাথী বেগমের কান্নার আওয়াজ। তিনি তার ছেলে আর স্বামীকে বারবার ছেড়ে দিতে বললেও পুলিশেরা ছাড়েনি‌। সাথীর সাথে আঁখিকে এই বাড়িতে রেখে বাকি কর্তাদের গাড়িতে তুলে পুলিশ। তবে তারা রাফসানকে পায়নি।

 

নিপাকে শান্ত করতে থাকে তার মা। নিপা কাঁদতে কাঁদতে তার মা’কে জড়িয়ে বলে,

‘ মা, আমার রায়হান কিছু করেনি। ও নির্দোষ। ও নির্দোষ। ‘

‘ কান্দিস নারে মা। হয়, এমন হয়। ওরা সবাই নরখাদকরে মা। ওরা কেউ মানুষ না। ‘

নিপা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘ আমার রায়হান,, আমার রায়হান এমন টা কেনো করলো। ও কেনো করলো। মানুষ কেনো এতো ছদ্মবেশী হয় মা। কেনো হয়। ‘

শিউলি বেগম কিছু বলেন না। নিপাকে বুকে জড়িয়ে তাকে শান্ত করতে থাকেন। নিপা কাঁদতে থাকে অঝোর ধারায়। আরো কিছু মহিলা ভিতরে চলে যায় সাথী বেগমকে শান্ত করার জন্য। মতিন মেম্বার শান্ত হয়েছেন। তিনি এই গ্রামের মেম্বার। তার মেজাজ হারানো উচিত হয়নি। তিনি দূরে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে পুলিশ ওসির কাছে ক্ষমা চান তার কাজের জন্য। 

 

এদিকে বাড়ির পিছন থেকে একে একে লাশ আনতে থাকে পুলিশ কনস্টেবলরা। কয়েকটা এম্বুলেন্সও চলে আসে বাড়ির সামনে। পুলিশরা ভিড়ের মাঝে রাস্তা করে দেয়। কনস্টেবলরা একে একে লাশ নিয়ে যেতে থাকে।

 

   বাড়ির দক্ষিণের ফাঁকা যায়গাটায় দাঁড়িয়েছেন মতিন মেম্বার, রিয়াদ আর দিনাজপুর জেলা পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার। জয়দেব কুমারকে মতিন মেম্বার অনুনম সুরে বলেন,

‘ সরি ওসি সাব। আমার মাইয়ারে আমি এই বাড়িতে বিয়া দিছিলাম। আমি ভাবছিলাম আমার মাইয়ারেও ওরা,,,,, এরলাইগা একটু মেজাজ হারাইছিলাম। ‘

‘ এরপর থেকে একটু সতর্ক থাকবেন। (রিয়াদের দিকে ফিরে) ভিতরে কত গুলো লাশ দেখেছো! ‘

‘ অনেক গুলো স্যার। সব ছোট বাচ্চাদের। কয়েকজন ছেলেকে আমরা আটক করেছি। ‘

‘ আচ্ছা এই যায়গার বিষয়ে খবর আজ সকালে তোমাকে কে দিয়েছিলো! ‘

‘ জানিনা স্যার। সকালে একটা চিঠি আর একটা পেনড্রাইভ পাই আমরা থানায়। চিঠি খুলতেই এইযায়গার বিস্তারিত আর পেনড্রাইভে বাচ্চাদের মারার ভিডিও পাই। ‘

‘ তারমানে এই যায়গারই কেউ জিনিস টা আমাদের কাছে ফাঁস করেছে! কিন্তু সেটা কে! ‘ 

‘ খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরকে স্যার। আর স্যার, আপনি জানি খান পোল্ট্রি ফিড নিয়ে কী বলছিলেন তখন! ‘

‘ এই নজরুল খাঁন, তার পোল্ট্রি ফিডের বস্তার মাঝে ছোট ছোট বাচ্চাদের কাটা মাংস সাপ্লাই করতো দেশের আরো নরখাদকের কাছে। সাথে ড্রাগসেরও কারবার ছিলো এদের। ‘

‘ এতো মারাত্মক বিষয় স্যার! ‘

‘ হমম। তা আর বলতে। ঐদিকে রাজশাহীতে আমাদের এক ইউনিট গিয়েছে ওখানকার এক ব্যবসায়ীকে ধরতে। খাঁন পোল্ট্রি ফিড এখন তার নামে। নজরুল হয়তো বুঝতে পেরেছিলো যে তাকে ধরে ফেলা হবে। তাই সে তার কম্পানি বেঁচে দেশ থেকে পালানোর চিন্তা করছিলো। ভাগ্যেস আমাদের কাছে ইনফরমেশন গুলা এসেছিলো! ‘ 

‘ হমম স্যার। সেই ব্যবসায়ীকে ধরলে এদের সাথেই আরো কেউ আছে কী না তা জানা যাবে। ‘

‘ রিয়াদ, তুমি গিয়ে ঐদিকে কতগুলো লাশ বের হলো তার লিস্ট করো। আর মেম্বার সাব, আপনি আমাদের সাথে আসুন। আপনার মেয়ে এই বাড়ির বউ ছিলো। আপনাকে সেইজন্য জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা নিয়ে যাচ্ছি। (এক কনস্টেবলের দিকে ফিরে) এই শামীম, সবাইকে গাড়িতে তুলছে! ‘

‘ জ্বী স্যার। ‘

‘ মেম্বার সাব। আসেন। ‘

মতিন মেম্বারকে নিয়ে গাড়ি বহরের দিকে চলে যেতে থাকেন ওসি জয়দেব। মতিন মেম্বার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সাথে যান।

 

   খাঁন বাড়ির বাইরের দিক। অনেক লোকের কোলাহল বাইরে। তাদের মধ্যে থেকে এক বোরখা পড়া মেয়ে হেঁটে সাইডে আসে। সে তার মুখের উপর থেকে বোরখার কালো কাপড় টা তুলে। সে ছিলো সোনালী। রাফসানের কাছ থেকে খাঁন গ্রুপ অফ ইন্ড্রাস্টিজ কিনে নিয়ে সেটা আবার নজরুল খানেরই বায়ারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে মোটা দামে। আর তারপর দুই পক্ষেরই সব ফাঁস করে দিয়েছে। সুমনাকেও মেরে ফেলছে। সোনালী সবকিছু ভেবে একটা শয়তানি হাসি দেয়। বিরবির করে বলে

‘ সবাই ধরা পড়লো। রাফসান বোধহয় গাঁ ধাকা দিছে না! ওকেও ধরা পড়তে হবে। (একটু থেমে) এখন আমার কাজ হচ্ছে নজরুল আর রাফসানের সাথে করা গোপন ভিডিও গুলো ফাঁস করা। এইবার দেখি, তোরা মুখ কীভাবে দেখাস এই সমাজে! টাকা দিয়ে যদি বেরও হয়ে আসিস এই পর্ণ* ভিডিওর জন্য আজীবন ছিঃ ছিঃ করে যাবে লোকজন তোদের। (থেমে) এই সোনালীর সাথে মাইন্ড গেমে পারে উঠা, এতো সহজ না!!! হ্যাহ!! তোদের মতো বেকুপদের দশদিন আর এই সোনালীর একদিন!!!

 

_______

 

তালুকদার বাড়ি। হয়তো ভাবছেন এটা আবার কাদের বাসা! আরমানকে মনে আছে আপনাদের নিশ্চয়ই! সেই আরমান, যে নোমানের বোন নুপুরকে মেরে ফেলেছিলো। নোমানের বউ রিয়ার সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলো। অর্থাৎ আয়ানের আসল বাবা আরমান। সে তালুকদার বাড়ির ছেলে। তার বাবার নাম ইসহাক তালুকদার। 

 

তালুকদার বাড়ি অতটা বড় নয়। মেম্বার বাড়ির মতোই দেখতে কিছুটা। শুধু মাঝ দিয়ে বাড়িটা বাঁকানো, মানো ইংরেজি অক্ষর L এর মতো। বাড়ির ছেলে আরমান আর তার ছোট বোন আনিকার অকাল মৃত্যুতে আরমানের মা জোহরা বেগম বেশকিছুদিন শোকে কাতর ছিলেন। এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন। বাড়িতে এখন তিনজন থাকে। ইসহাক তালুকদার, তার পত্নী অর্থাৎ মৃত আরমান-আনিকার মা জোহরা ও তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে উর্মি। মেয়েটা শুধু দিনে এসে রান্না করে দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে জোহরা বেগম তাকে থাকতে বললে থাকে, নাইলে সে তার বাসায় যায়। বাসায় তার ছোট ভাই আর মা আছে। তার বাবা ছোট বেলায় মারা গিয়েছে।

 

এখন সময়টা দুপুরের কাছাকাছি।‌ হালকা রোদ উঠেছে। আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখা যাচ্ছে। ইসহাক তালুকদার তার রুমের আলমারি খুলে কিছু একটা খুঁজছেন। বেশ অনেক পুরোনো কাগজ, ফাইল বের করেছেন আলমারি থেকে। সেগুলো তার পায়ের পাশেই পড়ে আছে। ঘরে প্রবেশ করেন জোহরা বেগম। তার মুখ শুকনো। গাঁয়ে শাড়ি। মাথার চুল গুলো হালকা পাকা। তিনি এগিয়ে এসে ইসহাক সাহেবের পাশে দাঁড়ান। উঁকি মেরে আলমারির ভিতরে দেখেন। ইসহাক সাহব তার ঘাড়ের উপর কারো উপস্থিতি টের পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আলমারি থেকে মাথা বের করে নেন। জোহরা বেগম সড়ে যান

বলেন,

‘ কী খুজতেজো এভাবে! ‘

‘ ক,কী কিছুনা। তুমি এখানে, কিছু বলবা! ‘

‘ গ্রামের খবর শুনোনাই! তোমার বন্ধু, নজরুলের বাসা থেকে কী কী উদ্ধার হইছে! তাদেরকে যে পুলিশ নিয়ে গেছে! ‘

‘ কখন নিয়ে গেলো! ‘

বলেই পান্জাবির কাপড় টা উঠিয়ে মুখের ঘাম মুছতে থাকেন ইসহাক সাহেব। জোহরা বেগম অবাক হন। বলেন,

‘ তুমি এতো ঘামতেছো কেনো! কোন সমস্যা! ‘

‘ ন,না তেমন কিছুনা। আর তারপর কী হইলো। নজরুলকে কেন ধরে নিয়ে গেছে! ‘

‘ ওদের বাড়ির পাতাল থেকে অনেক বাচ্চার লাশ পাওয়া গেছে। তোমার বন্ধু বলে নরখাদক ছিলো! ‘

‘ নরখাদক! ‘ 

‘ হ্যা। তুমিও জানতেনা নাকি! ‘

‘ ন,না জানতাম না। আচ্ছা তুমি যাও। আমি যাচ্ছি একটু পর। ‘

বলেই আবার আলমারির ভিতর থেকে কি যেনো খুঁজে বের করতে লেগে যান ইসহাক সাহেব। জোহরা বেগম কিছুই বুঝে উঠেন না। তিনি চলে যেতে থাকেন ঘর থেকে। ইসহাক সাহেব বেশ পুরোনো খাতা, ফাইলের মাঝে কিছু একটা খুঁজছিলেন। এবং হঠাৎ তিনি আলমারির ভিতর থেকে একটা হলুদ ফাইল বের করেন। সেটা নিয়ে সড়ে আসেন। তার মুখে কিছুটা স্বস্তির রেখা। হয়তো এই ফাইল টাই খুঁজছিলেন তিনি। ইসহাক সাহেব তাড়াতাড়ি সেটা বিছানার উপর রেখে দিয়ে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দেন। তাড়াতাড়ি জানালার কাছে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দেন। যেনো তিনি কোন গুপ্ত জিনিস খুলতে চলেছেন, যা তিনি আর কাউকেই দেখাতে চাননা! 

 

_______

 

রংপুর মেডিকেল কলেজ। ২০৪ নং কেবিনের বাইরের চেয়ারে বসে আছেন ইকরার মা মৌসুমী হালদার। তার পাশেই তাদের বাসার কাজ করেন যে খালা, বানু খালা, তিনি বসে আছেন। তাদের দুইজনের মুখের চিন্তার ভাঁজ। কয়েকজন নার্স চলে যায় করিডোর দিয়ে। ইকরা খুব অসুস্থ। সে হাসপাতালে ভর্তি। কাল হঠাৎ ঘরে গিয়ে মৌসুমী বেগম তার মেয়েকে অচেতন অবস্থায় পান। পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু ইকরার জ্ঞান ফিরেনি। তাদের পরিচিত এক ডাক্তার এসে কাল রাতে ইকরাকে দেখে। তাদেরকে জানায় ইকরাকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করাতে। কোন জটিল রোগ হয়েছে তার। মৌসুমী বেগম একলা কী করবেন ভেবে পাননা। আফাজও নেই। তার স্বামীও নেই। তার স্বামী ব্যবসা করেন চট্টগ্রামে। ফোন দিলে তার স্বামী জানান আজ সকালেই ক্লিনিকে ভর্তি করাতে। টাকাও পাঠান কিছু।  মৌসুমী বেগম তার মেয়েটাকে নিয়ে কোনমতে রাতটা পাড় করেই সকাল সকাল এনে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করান। ইকরার কাল রাতে সেন্স ফিরলেও সকালে আবার সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলো। এখনো পর্যন্ত ভিতরে ডাক্তার নার্সেরা আছেন। তারা সকাল থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। মাঝে মাঝে দু-একজন নার্স বেড়িয়েছিলো। তবে মৌসুমী বেগমের সাথে তারা কথা বলেনি। মৌসুমী বেগম আর বানু খালা ইকরারা চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে পড়ে রয়েছেন এখানে, কখন ডাক্তার বের হবে আর তারা ইকরার খবর পাবেন। রিয়াদ কাল রাতে বিষয়টা জানতে পারে। সে আজ সকালেই চলে আসতে চেয়েছিল এখানে। তখনই খান বাড়ির সব খোলাসা হয় আর বড় বড় অফিসার আনন্দপুরে আসায় রিয়াদ আর আসতে পারেনি। রিয়াদ একটু পর পর ফোন দিয়ে তার শাশুড়ি মায়ের থেকে ইকরার খোঁজ-খবর নিচ্ছে। সে বলেছে আজ রাতে যেভাবেই হোক সে আসবে। মৌসুমী বেগমও তাকে ফাঁকা হলে চলে আসতে বলেছেন।

 

বেশ কিছুক্ষণ পর,,,

 

কেবিনের দরজা খুলে যায়। মৌসুমী বেগম আর বানু খালা তৎক্ষণাৎ বসার যায়গা থেকে উঠে আসেন। ভিতর থেকে বের হন ডাক্তার আজাদ। তিনি হাতে ধরে থাকা স্থেতোস্কোপ যন্ত্রটা গলায় ঝুলান। মৌসুমী বেগম উৎসুক হয়ে তার কাছে এসে বলেন,

‘ ডাক্তার, ডাক্তার আমার মেয়ে,,,,’

‘ ২৪ ঘন্টা না পেড়োনো অব্দি আমরা কিছু বলতে পারছিনা। (একটু থেমে) তবে একটা বিষয়, আচ্ছা আপনাদের মেয়ের যে নাক দিয়ে রক্ত পড়তো, তা আপনারা জানতেন না! ‘

‘ হ্যা জানতাম। তবে দুই একবার দেখেছিলাম। ভাবছিলাম হয়তো আঘাত পেয়েছে তাই পড়ছে। ‘

‘ আর তার এ্যাপেনটিসাইড ব্যাথার বিষয়ে! ‘

‘ এ্যাপেনটিসাইডের ব্যাথা? ওর এ্যাপেনটিসাইডের ব্যাথা আছে! ‘

‘ হ্যা। কেনো ও আপনাদের বলেনি! ‘

‘ না। (বানুর দিকে ফিরে) কখনো কী বলছিলো! না ডাক্তার এমন কিছুতো বলেনি। ‘

‘ আপনাদের মেয়েটা হয়তো চাপা স্বভাবের। ওর ব্রেইনে টিউমার ধরা পড়েছে। সাথে এ্যাপেনটিসাইড বেশ ফুলে গিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এ্যাপেনটিসাইডের অপারেশন করাতে হবে। আর, ব্রেইন টিউমার টাও বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। আমরা স্ক্যান করে দেখেছি। ‘

‘ কী বলছেন ডাক্তার সাব। ওর, ওর অসুখ এতোটা বেরে গেছে! ‘

‘ হ্যা।‌ আপনারা রিসিপসনে টাকা জমা দিন। আজ রাতের মধ্যেই তার এ্যাপেনটিসাইডের অপারেশন করতে হবে। আর ব্রেইন টিউমার টার সম্পর্কে আমরা এখনো সঠিক কিছু বলতে পারছিনা। ঐটা খুব বড় হয়ে গিয়েছে এটাই শুধু আমরা স্ক্যান রিপোর্টে দেখেছি। আপনাদের আরো অনেক আগে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন ছিলো। ‘

মৌসুমী বেগম কাঁদো কাঁদো হয়ে বানু খালাকে ধরেন। বলতে থাকেন, 

‘ বানু, বানুরে,,, আমার মেয়েটা বাঁচবে তো। ওর এতো রোগ কীভাবে হয়ে গেলো! ‘

‘ ভেঙে পড়বেন না। ধৈর্য ধরুন। আপাতত এ্যাপেনটিসাইডের অপারেশন করাটা জরুরি। এটার ব্যাথার জন্যই ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। আপনারা রিসিপসনে গিয়ে টাকার বিষয়টা নিয়ে কথা বলুন। ‘

বলেই ডাক্তার আজাদ চলে যেতে ধরেন তখনই বানু খালা তাকে ডেকে বলে উঠেন, 

‘ অপারেশনে কত টাকা লাগতে পারে! ‘

‘ ১ লাখের মতো। আপনারা রিসিপসনে কথা বলুন। সবকিছু ইন-ডিটেইলসে ধরা বলে দিবে। ‘

বলেই ডাক্তার আজাদ চলে যায়। মৌসুমী বেগম, বানু খালাকে ধরে কাঁদতে থাকেন। বানু খালা মৌসুমী বেগমকে শান্ত করতে থাকেন। কেবিনের দরজার মাঝে একটা কাঁচের গোল অংশ ছিলো। যা দিয়ে ভিতরের দিকটা দেখা যাচ্ছিলো। এতোক্ষণ পর্দা টানা থাকায় তারা ভিতরটা দেখতে পারেনি। তবে তারা এখন দেখতে পাচ্ছে। তাদের ইকরাকে দেখছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেনো বেডে ঘুমাচ্ছে। তার মুখ মলিন। সবসময় হাসিখুশিতে থাকা মেয়েটার আজ সকাল থেকেই জ্ঞান নেই। বানু খালা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন ইকরার সুস্থতার জন্য। 

ভিতরে শুয়ে থাকা ইকরার পাশের মনিটর টায় তার হার্ডবিট দেখা যাচ্ছিলো। সেটা বেশ ধীরে ধীরে কাপছিলো। ভিতরে কেউ নেই এখন। ইকরার বেডের পাশের জানালাটা খোলা। খোলা সেই জানালাটার পর্দাটা দখিনের বাতাসে নড়ে উঠে। ইকরার চুল সাইড থেকে উড়ে কিছুটা তার মুখের উপর চলে আসে। ইকরা যে চোখ বুজেছে, এই চোখ কী আর ‌আদেও খুলবে! রিয়াদ কি আবার তার প্রেয়সীর হাস্যোজ্জল মুখখানা দেখতে পাবে! নাকি সাদার মাঝে কালো বসিয়ে, বিদায় নিবে ইকরা! 

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

( গল্পের এই পর্যায়ে এসে কী মনে হচ্ছে? কী হতে চলেছে এরপর? আপনার মতামত জানাতে পারেন কমেন্টে ❤️। কালকেও পর্ব পাবেন ❤️)

 

গল্প নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন আমার গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 👇

https://www.facebook.com/groups/743016887019277/?ref=share_group_link

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৮১ (২য় ভাগ)

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।