জ্বীন বর ( প্রথম খন্ড )

জ্বীন বর ( প্রথম খন্ড ) । ভাতের সাথে বি’ষ মিশিয়ে নিজের মা’কে খেতে দিয়েছি। নাহ্, তিনি আমার সৎ মা না। তিনি আমার জন্মদাত্রী মা। তবে তাকে মা’রতে চাওয়ার একমাত্র কারন হলো পরকীয়া। ঘরে এতোবড় একজন যুবতী মেয়ে থাকতেও তিনি পরকীয়া করছেন তার দেবরের সাথেই। কাহিনীটা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। আমার বাবা নেহাৎ ভালো মানুষ বলেই এবং চাকরির জন্য বাইরে থাকার কারনেই এখনো এই ঘটনা জানেন না। তবে ছোট থেকে দেখে আসছি মায়ের সাথে কাকার একটা সংযোগ আছে। ছোট ছিলাম বলেই আগে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ ছিল না।  বড় হওয়ার সাথে সাথে এবং সময়ের পরিবর্তনে সবটাই এখন বুঝতে পারছি। 

 

বাবাকে বলে লাভ হবেনা, তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে কখনো অবিশ্বাস করবেন না। তবে ঠকানোর শাস্তি আমার কাছে ক্ষমার যোগ্য না। তাই আটঘাট বেঁধে নেমেছি শাস্তি দিতে। 

সকালে উঠে মা’য়ের কোলে শুয়ে ছিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শেষবারের মায়ের হাতে খাবার খেলাম। বায়না ধরলাম আমিও নিজের হাতে খাইয়ে দিবো। যেই বলা সেই কাজ। নিজের হাতে বি’ষ মিষিয়ে ভাতের দলা পাকিয়ে মুখে পুরে দিলাম। 

 

চোখের সামনেই ছটফট করে দুমড়ে মুচড়ে গেলো শরীরটা মৃ’ত্যু যন্ত্র’নায়। আমি তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলাম। পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে কিছুটা। চোখের সামনে মায়ের মৃ’ত্যু দেখাটা ভয়ংকর। নিশ্বাস আঁটকে আসছে আমার। চোখ দুটো বন্ধ করে মায়ের মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। 

চোখদুটো উল্টে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো আমার মা। নিথর হয়ে গেলো শরীরটা। আমি বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। 

 

রুমের দরজা বন্ধ করে কাকার কাছে গেলাম পায়েসের বাটি নিয়ে। সকালেই আমার জন্য তৈরি করেছিল মা। কাকাকে দিয়ে বললাম “মা পাঠিয়েছে তোমার জন্য।” কাকা একটা মিষ্টি হাসি দিলো। এই হাসির মানে আমি জানি, বুঝি। আমিও পায়ের উপর পা দিয়ে বসে পড়লাম কাকার পাশেই। কাকা চেটেপুটে পায়েসটা শেষ করলো। আমি তাকিয়ে দেখছি, মানুষ মৃ’ত্যুর আগে কিভাবে তৃপ্তি সহকারে খাবার খায়। কে জানে, হয়তো কাকা বুঝেছিল এটাই তার শেষ খাওয়া। 

 

খাওয়ার পরে যা হওয়ার সেটাই হলো। মৃ’ত্যু যন্ত’নায় ছটফট করতে লাগলো। আমি কানে কানে বললাম “একটা সুখের সংসার নষ্ট করার জন্য তুমি এবং আমার মায়ের মতো মহিলাই যথেষ্ট। তোমার প্রিয়তমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি উপরে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, যাও তোমারও যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।” 

 

৩য় নাম্বার মৃ’ত্যুটাও নিজের চোখে দেখলাম। প্রথম খু’নটা ছিল আমার প্রেমিকের। এতো এতো ভালোবাসার পরে শুনলাম অন্য একজনের সাথে তার সম্পর্ক আছে। ব্যাস, মে’রে দিলাম।  তুমি যেই হওনা কেন, আমার কাছে ঠকানোর কোনো মাফ নেই। 

 

বাড়িতে কেউ নেই, বাবার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখলাম। চিঠিতে লেখা ছিল–

প্রিয় বাবা

তুমি হয়তো জানতে না তোমাকে বহু আগে থেকেই ঠকানো হয়েছে। তোমাকে বেশি ভালোবাসার জন্য তোমাকে ঠকানোটা মেনে নিতে পারিনি। তাই তোমার স্ত্রী এবং ছোট ভাইকে মে’রে দিয়েছি। আমি স্বীকার করছি আমি খু’ন করেছি। হয়তো তুমি বা তোমরা আমাকে খুঁজবে। কিন্তু এখানে থাকলে আমার শাস্তি হয়ে যাবে। আমি সেটা চাইনা। তাই আমাকে খুঁজো না। তোমাকে ভালোবাসি বাবা, দুঃখ পেয়ো না। 

ইতি তোমার আদরের মেয়ে 

রোদ 

 

চিঠিটা লিখে বাড়ির পেছনে বড় একটা গর্ত করে লাশ দুটোকে গর্তে রেখে দিলাম। ভালোবেসে ম’রেছে, দুজনের একসাথে থাকার অধিকার আছে। এটাই তো চেয়েছিল তারা। তাই এক কবরেই দুজনকে মাটিচা’পা দিলাম। 

তারপর বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে। দিগবিদিক হয়ে ধান ক্ষেতের আলের পাশ দিয়ে ভোঁ দৌড়। 

 

এক পর্যায়ে বড় রাস্তার পাশে উঠতেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এতো এতো সাহস থাকলেও সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকা আমার সাহসে কুলোয় নি কোনোদিন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি পাশেই একটা ঝোপ নড়ে উঠলো। আমি উঠে হাত পা ঝেড়ে আবার চলা শুরু করলাম কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য ঝোপে নড়াচড়া করা শব্দটা আমার পিছু ছাড়লো না। মনে সাহস নিয়ে শাড়ির আঁচলে বাঁধা কয়টা ময়লা টাকা গুনে সামনে এগিয়ে চললাম। যাওয়ার কোনো যায়গা আপাতত নেই। তাও এই টাকা দিয়ে কয়েকদিন চালিয়ে নিয়ে কোনো কাজ খুঁজে নিবো এমন ভাবনা নিয়েই বেরিয়ে ছিলাম। 

 

হুট করেই পেছন থেকে কারো ডাক পড়লো। আমি তাকাতেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক সুদর্শন যুবক। যদিও চারদিকটা অন্ধকার, কিছু দেখার জো নেই। তাও অন্ধকারে অবয়বে মনে হচ্ছে সুদর্শনই হবে। আমি একটু পিছিয়ে গিয়ে কাঁপা স্বরে বললাম “ক..কে ওখানে?” লোকটা সামনে এগিয়ে এসে কোমল গলায় জবাব দিলো “ভয় পাবেন না, আমি শব্দ।” যাহ্ বাবা, শব্দ আবার কারো নাম হয় নাকি? শুনিনি তো জিন্দিগিতেও। তাও জিজ্ঞেস করলাম “আমাকে ডাকলেন কেন?” শব্দ আবারও ঠান্ডা গলায় বললো “রাত হয়ে যাচ্ছে তো। আপনি কোথায় যাচ্ছেন? এদিকের রাস্তা তো ভালো না। সচরাচর কোনো মানুষ এদিকে আসে না। আপনি কি ভুল করে এই রাস্তায় চলে এসেছেন?” মানুষ আসেনা মানে? আমি কি? উনি কি? উনি নিজেও তো এসেছেন এখানে। 

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম “কে বলেছে আসেনা? আমি এসেছি, আপনি এসেছেন। আর বলছেন আসেনা কেউ?” শব্দ হালকা হেঁসে বললো “আপনি তো খুব পাকা মেয়ে। আপনি তো ভুলে এসেছেন হয়তো, আর আমি এদিকেই থাকি।” আমি আবারও ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম “কই দেখি আপনার বাসা কোথায়? কেউ না আসলে আপনি এখানে থাকেন কিভাবে?” শব্দ বাঁকা হেসে বললো “আমার বাসা নেই, আমি ঝোপঝাড় গাছপালায় থাকি বুঝলে? এখান থেকে চলে যাও, যায়গাটা মোটেও ভালো নয়।” বলেই পেছনে হাঁটা শুরু করলো। আমি ডেকে ডেকে বললাম “আরে আরে শুনে যান, গাছে থাকেন মানে? আপনি কি বাঁ’নর?” শব্দ জবাব দিলো না, একবার তাকিয়ে বিরবির করে চোখের আড়াল হয়ে গেলো। 

 

পরমুহূর্তেই অন্ধকার, চারদিকে নিস্তব্ধ। পোকামাকড়ের ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। নিস্তব্ধতা একদম জেঁকে বসলো। আমি মনে মনে এই অন্ধকার নিস্তব্ধতা থেকে বের হওয়ার জন্য প্রার্থনা করলাম শব্দের সাথে আরেকবার দেখা হোক। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাক আমাকে। 

আশ্চর্য, চোখ খুলতেই দেখি শব্দ দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। 

 

চলবে?…

 

জ্বীন বর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০১

 

গল্পটা থ্রিলার এবং রোমান্টিক দু ধরনেরই হবে। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। আর হ্যাঁ, গল্পের নাম এক মানেই যে গল্পটা আমি চুরি করেছি এমন ভাবনা বাদ দেন।

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০২

আমি মনে মনে এই অন্ধকার নিস্তব্ধতা থেকে বের হওয়ার জন্য প্রার্থনা করলাম শব্দের সাথে আরেকবার দেখা হোক। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাক আমাকে। 

আশ্চর্য, চোখ খুলতেই দেখি শব্দ দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।

আমি চমকে একটু পিছিয়ে গেলাম। আমার ভাবনার সাথে সাথে লোকটা আমার সামনে আসলো কিভাবে? মনের কথা বুঝে যায় নাকি? শব্দের এখানে আসাটাকে নিতান্তই কাকতালীয় হিসেবে ধরে শব্দকে বললাম “আচ্ছা আপনি বললেন না তো আপনি ঝোপঝাড় গাছপালায় কিভাবে থাকেন?” শব্দ বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ আওয়াজ বের করে বললো “কেমন মেয়ে আপনি? এখনো সেখানেই পড়ে আছেন। ডেকেছেন কেন সেটা বলুন, আমার অনেক কাজ আছে।” আমি অবাক হয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে বললাম “আপনাকে কখন ডাকলাম আমি? মোটেই ডাকিনি আমি। আবার ভাব দেখাচ্ছে হুহ্। এই রোদ কারো ভাবের ধার ধারে না।” 

 

শব্দ একপ্রকার রাগ দেখিয়েই ভ্রু কুঁচকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। আবার সেই নিস্তব্ধতা। তবে এবার আর শব্দকে মনে করলাম না। বাড়ি থেকে বের হয়েছি কি কারো উপরে ভরসা করে? নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিবো। যেই পথে রওনা দিয়েছিলাম তার উল্টো পথ ধরেই অন্ধকার হাতড়ে চলা শুরু করলাম। তবে মনে হলো কেউ আমার পিছু নিয়েছে। কেউ একজন আমাকে লক্ষ্য করে আমার আশপাশে থেকেই আমার সাথেই এগিয়ে চলছে। কিন্তু আমার ক্ষতি করছে না। মনে মনে ভয় পেলেও ক্ষতি করছে না দেখে সাহস নিয়ে এগিয়ে চললাম।  

 

উল্টো পথে চলতে গিয়ে আমার গ্রাম থেকে বড় রাস্তায় ওঠার মোড়ে পৌঁছে গেলাম। একবার ভাবলাম বাসায় চলে যাই। কেউ তো জানতেই পারবেনা আমি খু’ন করেছি। বলবো মা আর কাকা পালিয়ে গেছে। আচ্ছা চিঠিটা কি বাবা পেয়ে গেছে? বাবা খুব কাঁদছে? বাবার স্ত্রী, ভাই, সন্তান সব একসাথে হারালো। বাবার দুঃখ হওয়াটা স্বাভাবিক। বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারলে ভালো লাগতো। 

 

সামনের অন্ধকার থেকে ভেসে আসলো  কারো ডাক। বাবার কন্ঠের মতোই। আমি শুকনো গলায় ঢোক গিলে ডাক দিলাম “বাবা, তুমি আছো এখানে? বাবা?” কারো জবাব পেলাম না, কিছুক্ষণ পরে আবার সেই ডাক “রোদ, মা আছিস? কই গেলি তুই?” আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে চেচিয়ে বললাম “বাবা এইতো আমি এখানে, আমাকে খুঁজছো তুমি?” বাবা যেন দুহাত অন্ধকারে বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে বাহুডোরে নিলেন। আমি বাবার স্পর্শ পেয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বাবা আমার হাত ধরে বললো “চল বাড়িতে চল, তোর সাথে কথা আছে।” আমি শক্ত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বললাম “কি কথা বাবা? এখানে বলো, আমি বাড়িতে যাবো না।” বাবা হয়তো আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারলাম না। বললেন “পুলিশ এসেছে রোদ, পুরো গ্রামের মানুষ জেনে গেছে তুই তোর মা এবং কাকাকে খু’ন করেছিস। বাড়িতে চল, পুলিশের কাছে ধরা দিবি। শাস্তি কম হবে, চল।”

 

-আমি যাবোনা বাবা। আমি পুলিশের হাতে ধরা দিবোনা। 

-বেশ, তো আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দে তুই তোর মা’কে কেন মে*রেছিস.

-তোমাকে বললে তুমি কখনোই বিশ্বাস করবে না। তুমি বিশ্বাস করলে আমাকে খু ন করতে হতো না বাবা। 

-কি এমন আছে?

-তোমার আদরের ভাই এবং তোমার আদরের প্রিয়তমা স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল বাবা। সেই প্রথম থেকে ঠকিয়ে আসছে ওরা তোমায়। তোমাকে ঠকানোটা মেনে নিতে পারিনি। তাই নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছি। 

-কাজটা ঠিক করিস নি রোদ। আমাকে বলতে পারতি, দেশে আইন ছিল। কেন নিজের জীবনটা নষ্ট করলি?

-আমার জীবনটা নষ্ট করলাম কিভাবে বাবা?

-পুলিশ আসছে চল। 

-ধরা আমি দিবো না, জোর করো না বাবা। জোর করার ফল ভালো হবেনা। 

-কি করবি তুই?

-তিনটে খু*ন করে এসেছি আমি। নিজের জীবন বাঁচাতে যদি আরো একটা খু*ন করতে হয় তাহলে সেটাই করবো। আমাকে যেতে দেও। 

-আমি বলছি পুলিশের কাছে ধরা দে তুই।

 

বাবা আমার হাত না ছাড়ায় অন্ধকারে পায়ের তলা থেকে ধারালো একটা গাছের ডাল হাতে নিয়ে বসিয়ে দিলাম বাবার শরীরে। কোথায় লেগেছে জানিনা। তবে বাবা চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। আমি এই সুযোগে পালাতে লাগলাম। দূর থেকে শোনা গেলো মানুষের সমাগম। বাবার চিৎকারে তারা এদিকেই ছুটে আসছে। লন্ঠন আর হারিকেনের মৃদু আলোতে আবছা দেখতে পেলাম গাছের ডালটা বাবার কন্ঠ নালিতে ঢুকে গেছে। বাবা ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে একবার রোদ বলে ডেকে শান্ত হয়ে গেলো। তবে কন্ঠ স্বরের আঘাতে ডাকটা বাইরে বের হলো না। 

 

বাবা কি মা*রা গেছে? আমি কি একবার গিয়ে দেখবো? নাহ্, চারদিকে পুলিশ তন্নতন্ন করে আমাকে খুঁজছে। বাবার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পালানোর জন্য দিগবিদিক হয়ে উল্টো পথেই ছুটতে লাগলাম। 

অন্ধকারে শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে দ্বিতীয় বারের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। উঠে বসে ভয়ে ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে গেলাম। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। নাক ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করলাম “এই পথের মাঝে আবার দেয়াল রাখলো কে?” হঠাৎ কারো কথায় চমকে গেলাম। এটা শব্দের কন্ঠ, আমাকে বললো “কি বললে? দেয়াল? আমি দেয়াল? এখানে ঘোরাঘুরি করছো কেন তুমি?” শব্দের কথায় বুকে থু থু দিয়ে কথা বলতে এগিয়ে যেতেই শব্দ আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে গেলো কিছুটা। 

একটা খোলা যায়গায় নিয়ে বললো “এবার বাড়ি চলে যাও, মেয়ে মানুষের বাইরে বাইরে থাকতে নেই রাতে।” 

“আমার বাড়ি নেই, বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি খু*ন করে।” 

শব্দ আমার কথায় চোখ বড় বড় করে অবাক হওয়ার ভং ধরলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অবাক হওয়ার নাটক করছে। এমন মনে হচ্ছে তিনি আগে থেকেই বিষয়টা জানতেন। 

 

চলবে?….

 

কপি করা নিষিদ্ধ। 

গল্পের নাম দেখে অনেকেই বলে আমি কপি করেছি। তারা দয়া করে গল্পটা পড়ে আগে মিল খুঁজে বের করুন। তারপর প্রমান এনে বলবেন।

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০৩

“আমার বাড়ি নেই, বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি খু*ন করে।” 

শব্দ আমার কথায় চোখ বড় বড় করে অবাক হওয়ার ভং ধরলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অবাক হওয়ার নাটক করছে। এমন মনে হচ্ছে তিনি আগে থেকেই বিষয়টা জানতেন।

 

জিভে কামড় দিয়ে শব্দ শুধালেন “কিহ্, তুমি খু*ন করে এসেছো? কাকে কেন?” আমি ভ্রু কুঁচকে জবাব দিলাম “আপনাকে বলতে যাবো কেন? আমি আমার ব্যক্তিগত কথা বাইরের মানুষকে বলতে আগ্রহী নই।” শব্দ পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে বললেন “মানুষকে না বলো, আমাকে কিন্তু বলতেই পারো।” আমি আড়চোখে তাকিয়ে বললাম “কেন আপনি কি মানুষ নন?” এই প্রথম হালকা আলোয় আড়চোখে ভালোভাবে শব্দকে দেখলাম। কাঁঠালি রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়ে আছেন, সাথে মেটে ছাই রঙের একটা চাদর মোড়ানো। এতো গরমেও কেউ চাদর জড়িয়ে থাকে এই অদ্ভুত মানুষটাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। লম্বাচওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী এই সুদর্শনকে দেখে যে কারো এক পলকেই ভালো লেগে যাবে। 

ফর্সা মুখে চাপদাড়ির ফাঁকে ঠোঁটের পাশেই সদ্য আঘাত পাওয়া ক্ষ’ত চিহ্নটা জ্বলজ্বল করছে। 

 

আমি একবার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলাম। অচেনা একটা ছেলের সাথে এতো কথা কিসের? আমি মুখ ঘুরিয়ে শব্দকে বললাম “শুনুন মশাই, আমি যাচ্ছি। আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।” শব্দ বাঁকা হাসলো, এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বললো “আচ্ছা যাও, আর কোনো খু*ন করো না। এবার কিন্তু আর কেউ বাঁচাবে না।” শব্দের কথায় আমার টনক নড়লো। মনে পড়লো কিছুক্ষন আগেই বাবাকে নির্মম ভাবে খু*ন করে এসেছি। কিন্তু আমি তো বাবাকে খু*ন করতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম আঘাত করে পালিয়ে আসতে। 

যেই খু*নের জন্য আমার কোনো অনুশোচনা নেই সেই খু*নের শাস্তি আমি পেতে চাইনি। আমি চেয়েছি মুক্ত আকাশে সদ্য খাঁচা থেকে মুক্ত পাওয়া পাখির মতো ডানা ঝাপটে উড়তে। বাবা কেন আমাকে জোর করলো? আমি তো বাবাকে মা*রতে চাইনি। 

 

আমার মনের অবস্থা হয়তো শব্দ আঁচ করতে পেরেছে। এক পর্যায়ে আমাকে ডেকে বললেন “যা করেছো তার কিছুর জন্য তুমি অনুশোচনা না করলেও কিছু ঘটনার জন্য অনুশোচনা করছো? অনুশোচনা করো না, একটা সময় ঠিকই বুঝতে পারবে ঘটনাটা ঘটে ভালো হয়েছিল। এই কাজটা এখন না করলেও তখন করতে ইচ্ছে হতো।” বলেই উল্টো পথে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটা শুরু করলেন শব্দ। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, বুঝতে পারছিনা শব্দ কি বলে গেলো। কিশোরী মনে এতো এতো সাহস সঞ্চার করে এতো ঘটনা ঘটিয়েও এখন পালাতে ভয় করছে। সারারাত আনমনে হাঁটার পর শেষ রাতের দিকে ঝুম বৃষ্টি হলো। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর না থাকায় অগত্যা বৃষ্টিতে ভিজতে হলো আমাকে। তবে আজকের বৃষ্টি যেন আমাকে ছুঁতে পারছে না। 

 

সকাল সকাল কাক ভেজা হয়ে বড় সড়কে উঠেই এক গাড়ির সাথে জোর ধাক্কা খেয়ে তৃতীয় বারের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মাথায় আঘাত নিয়ে কোনো ভাবে উঠে দাঁড়ালাম। এক হাত নিয়ে মাথা চেপে ধরে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই দেখলাম গাড়ির দরজা খুলে একটা মেয়ে দৌড়ে আসছে। সাদা সেলোয়ার-কামিজ পড়া মেয়েটা আমার সমবয়সী হবে হয়তো। হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরেই বললো “দেখি দেখি, আহারে বেচারি এভাবে কেউ রাস্তা পার হয়? সারা শরীর ভিজে আছে। জ্বর আছে দেখছি শরীরে। কোথায় যাবে বলো? আমি পৌঁছে দিচ্ছি।” আমি আস্তে করে জবাব দিলাম “আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আপনারা চলে যান, আমার কিছু হবেনা।” 

 

মেয়েটা আমার কথায় চোখ বড় বড় করে বললো “সেকি কোথায় যাবে তাহলে তুমি? ভাইয়া, এই ভাইয়া। আরে সারাদিন ফোনে কি করিস বুঝিনা। মেয়েটাকে নিয়ে যাই?” এতক্ষণে আমার গাড়ির দিকে চোখ গেলো। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে মনযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছেন তিনি। মেয়েটার কথায় ছোট্ট করে উত্তর দিলো “ইচ্ছে হলে নে!”

 

মেয়েটা একপ্রকার খুশি হয়ে আমাকে গাড়িতে তুলে নিলো। গাড়িতে থাকা ফাস্ট এইডের বক্স থেকে কপালে ব্যান্ডেজ করে দিলো। বেশ কিছুক্ষন পর গাড়িটা থামলো। গাড়ি থেকে মেয়েটা নেমে বললো “তুমি এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি আর ভাইয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। কলেজে আজকে অনুষ্ঠান আছে তো তাই একটু যেতে হবে। তুমি বসো কেমন?” আমিও মাথা নাড়ালাম। 

 

কোথায় যাচ্ছি কাদের সাথে যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না। এর আগে কখনো শহরে আসা হয়নি। বাবার কাছে অনেকবার বায়না করার পরে বাবা বলেছিল নিয়ে আসবে। সেই সুযোগ তো আর পেলাম না। বাবার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেলো। মায়ের কথাও মনে পড়ছে বেশ। 

 

আমি গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে কলেজের চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলাম৷ হঠাৎ মনে হলো গত রাতের দেখা হওয়া সেই ছেলেটা মানে শব্দকে দেখলাম৷ একনজর দেখার পর ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলো মুখটা। মনের ভুল ভেবে গত রাতের কথা মনে করলাম। ছেলেটাকে অন্ধকারে কয়েকবার মাত্র দেখেছি। ছেলেটা এখানে আসবে কিভাবে? ছেলেটাকে আর কখনো দেখতে পাবো?

 

আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মেয়েটা আর তার ভাই এসে গাড়িতে বসলো। গাড়ি পুনরায় চলতে আরম্ভ করলো। একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদের সাথে ভেতরে গেলাম। এ যেন রাজপ্রাসাদ। গ্রামে প্রতি শুক্রবার মোড়ল কাকার বাড়িতে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিল। সেখানে দেখেছিলাম এমন ঘরবাড়ি। বাস্তবে এমন বাড়িতে আসতে পারবো কল্পনা করিনি। 

 

আমাকে দেখে মধ্যবয়স্কা এক মহিলা এগিয়ে এলেন। এসে বললেন “তুমিই সেই মেয়ে? নাম কি তোমার? ভারি মিষ্টি তো তুমি!” আমি সেই মেয়ে মানে? আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকাতেই মেয়েটা বললো “আমি আম্মুকে কল করে তোমার কথা জানিয়েছি।” আমি শুকনো ঠোঁটে হালকা হেঁসে বললাম “আসসালামু আলাইকুম, আমি রোদ।” মহিলার সাবলীল উত্তর “তোমার নামের মতোই তুমি মিষ্টি। এই হলো আমার মেয়ে ইমা, আর এই হলো আমার ছেলে শুভ্র। যদিও শুভ্র কথা কম বলে। তুমি ওকে শুভ্র ভাই বলে ডাকতে পারো।”

 

আমাদের কথার মাঝেই শুভ্র ভাই বললেন “হয়েছে তোমার পরিচয় পর্ব? এখন আমি যাই?” ছেলেটা এমন কেন? একদম রসকষহীন কাঠখোট্টা নিরামিষ স্বভাবের। 

 

চলবে?…..

 

আমার লেখা গল্পগুলো সবার আগে পেতে এবং গল্প নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করার জন্য আমার গ্রুপে জয়েন করুন। আপনাদেরকে গল্প উপহার দেওয়ার পরিবর্তে এতোটুকু সাহায্য আপনারা করতেই পারেন। 

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০৪

আমাদের কথার মাঝেই শুভ্র ভাই বললেন “হয়েছে তোমার পরিচয় পর্ব? এখন আমি যাই?” ছেলেটা এমন কেন? একদম রসকষহীন কাঠখোট্টা নিরামিষ স্বভাবের। 

মহিলা একটু অপ্রস্তুত হলেন৷ তবুও কিছু বললেন না। হাসিমুখেই ইমাকে বললেন আমাকে নিয়ে ঘরে যেতে। উপরে গিয়ে বাম পাশে পরপর তিনটা ঘর, একটা ইমার একটা শুভ্র ভাইয়ের এবং আরেকটা রুমে তালা দেয়া। আমি রুমটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইমার সাথে রুমে চলে যাই। 

 

আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। গতকাল থেকে কিছু খাইনি। বৃষ্টিতে ভিজে শাড়ী আবার শরীরেই শুকিয়েছে। আমি ধপ করে ফ্লোরে বসলাম। ইমা আমাকে টেনে উপরে বসালো। আলমারি থেকে সাদা একটা জামা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। জামাটা আমার খুব পছন্দ হলো। জামাটা নিয়ে দাঁত বের করে হেঁসে দিলাম। 

 

আমি আগে কখনো জামা পড়িনি। সব সময় গ্রামের শাড়ী পড়েছি। তাই একটু অপ্রস্তুত লাগছে। ইমার মা আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে ইতিমধ্যেই। আমি তাকে দেখে খালাম্মা বলে সম্বোধন করলাম। ঠিক এমন ভাবেই মা আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। মা কেন এমন করলো? নাহলে তো আমরাও সুখী পরিবার হতে পারতাম। আমার চোখের কোনে পানির দেখা মিললো। ইমার মা হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে নিয়ে বললেন “কি হয়েছে মা? মন খারাপ কেন? আমরা আছি তো।” আমি যেন এক ভরসার দেখা পেলাম। 

 

খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই বাইরে কারো হাসাহাসির শব্দ পেলাম। শুভ্র ভাই? নাহ্, তিনি তো এতো হৈ হুল্লোড় করার মানুষ নন। তাহলে কে?

 

তবে হাসাহাসির শব্দ পেয়ে এক লাফে ইমা উঠে বসলো। খুশিতে একপ্রকার আমাকেই জড়িয়ে ধরে বললো “জানো রোদ, নিচে যে এসেছে তাকে আমার খুব ভালো লাগে। আমার মনে হয় তার মতো আর একজন মানুষও আমি পৃথিবীতে দেখিনি। চমৎকার একজন মানুষ।” আমি হালকা হেঁসে বললাম “কে উনি?” ইমা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো “আমার খালাতো ভাই, শব্দ।” কি বললো? শব্দ? বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে এই নাম আর কোথাও শুনিনি। বের হওয়ার পর এই দুবার শুনলাম। ইনিই কি সেই শব্দ? নাহ্, এখানে কিভাবে আসবে?

 

ইমা আমাকে ডেকে বললো “চলো চলো কি ভাবছো। শব্দ ভাইয়াকে দেখবে চলো।” আমার শরীর খারাপের জন্য উঠতে মন চাইলো না। তাই বললাম “তুমি যাওনা, আমি যাবো না। তোমার ভাই’ই তো আরো আসবে দেখতে পারবো তখন।” ইমা আমাকে জোর করলো না। সোজা নিচে চলে গেলো। 

 

কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলো মুখ ভারি করে। ইমার কাছে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করতেই বললো “শব্দ ভাইয়া পায়ে চোট পেয়েছে। হাঁটতে পারছে না ভালো ভাবে। তবে খুশির বিষয় হলো তিনি আমাদের বাড়িতেই কয়েকদিন থাকবে আবার।” আমি আস্তে বললাম “ওহ্ আচ্ছা।” ইমার মন ক্ষুন্ন হলো, আশা করেছিল ইমার ভাইয়ের পায়ে চোট পাওয়া নিয়ে আমি আরো কিছুক্ষণ কথা বলবো। আচ্ছা গতকাল যেই শব্দের সাথে দেখা হয়েছে তিনিও তো খুড়িয়ে হেঁটেছিলেন। 

এলোমেলো মাথায় কি ভাবছি আমি নিজেও জানিনা। এতো ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে শান্ত মতো ঘুমানোর চেষ্টা  করলাম। 

 

মাঝরাতে প্রচন্ড জ্বরে ঘুম ভেঙে যায় আমার। মা মা বলে কয়েকবার ডাক দিয়েও মা’কে পেলাম না। খেয়াল হলো আমি বাড়িতে নেই কিংবা আমার মা নেই। প্রচন্ড পানি পিপাসায় উঠে বসলাম। রুমে হালকা আলোয় রুমের কোথাও পানি দেখতে পেলাম না। অগত্যা পানি খেতে নিচে নামতে হলো আমাকে। ইমার রুমের দুপাশে দুটো রুমেই আলো জ্বলছে। রুমের দরজা দুটোই খোলা। দেখে কিছুটা ভয় হতে লাগলো। মনে সাহস নিয়ে সিড়ি বেয়ে সোজা নিচে নেমে এলাম। উপরে ওঠার সময় নিচের টেবিলে পানি দেখেছিলাম। সেই অনুযায়ী হাতড়ে এগিয়ে গেলাম। পানির গ্লাসের উপর হাত দিতেই মনে হলো কারো হাতের উপর হাত পড়েছে। আমি আঁতকে উঠলাম। 

চিৎকার দিয়ে পেছনে সরে যেতেই কেউ একজন আমার মুখ তার হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো “চুপ চুপ, চিৎকার করছিস কেন ইমা? আমি শব্দ!” আমি থেমে গেলাম। জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে মুখ থেকে টেনে লোকটার হাত সরিয়ে দিলাম। 

 

কথার আওয়াজ পেয়ে কিছু দূর থেকে আরো একটা শব্দ ভেসে আসলো “কি হয়েছে শব্দ? এনিথিং রং?” বলেই লাইট অন করলো। আমি ভয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলাম। শব্দ সোজা শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো “না শুভ্র, ইমা এসেছে নিচে। আমার হাতে হাত লেগে ভয় পেয়েছে।” কিন্তু শুভ্র ভাই আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শুভ্র ভাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শব্দও আমার দিকে তাকালো। আমি শব্দকে দেখে প্রচন্ড অবাক হলাম। শব্দ আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে দাঁত চেপে বললো “তুমি? তুমি ওই মেয়েটা না? এখানে কি করছো তুমি?” আমি কোনো কথা বললাম না। শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি এখনো এক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। বিষয়টা মনে হচ্ছে শব্দের কাছে ভালো লাগলো না। শব্দ খুকখুক করে কাশি দিয়ে শুভ্র ভাইকে বললো “কি হয়েছে শুভ্র? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?” শুভ্র ভাই থতমত খেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “তুমি এতো রাতে এখানে কি করছো?” আমি ভয়ে ভয়ে জবাব দিলাম “আসলে পানি পিপাসা পেয়েছে। রুমে পানি ছিল না তাই নিচে এসেছি।” 

 

শব্দ আমারো আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো “আমি প্রশ্ন করলে মুখ দিয়ে তখন কথা বের হয়না তাইনা?” আমি শব্দের দিকে তাকালাম। আগের দিনের থেকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে ওনাকে। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো শব্দের নিলাভ চোখ দুটো। রাগে নাকটা পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে আছে। আমার হাসি পেলো, হাসলাম না। শুভ্র ভাইয়ের সামনে হাসি দেওয়া রীতিমতো অন্যায়। শুভ্র ভাই না থাকলে শব্দের লাল টমেটো ওয়ালা নাক নিয়ে একদফা অট্টহাসি দিয়ে নিতাম। 

 

শুভ্র ভাই এবার আমাকে বললেন “পানি খেয়ে সোজা উপরে যাও। আর হ্যাঁ, ইমার রুমে ড্রয়ারে জ্বরের ঔষধ আছে খেয়ে নিও।” আমি অবাক হলাম, তিনি কিভাবে জানলেন আমার জ্বর এসেছে। এতো কিছু না ভেবে এক গ্লাস পানি নিয়ে সোজা উপরে চলে গেলাম। শব্দ ঠায় দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করছে রাগে। আমি রুমে যেতে যেতেই শুনতে পেলাম “তোর কাজ তুই কর শুভ্র। আমি পারবো না, আমি গেলাম ঘুমাতে।” পরবর্তীতে শুভ্র ভাইয়ের সাবলীল প্রশ্ন-“তুই মেয়েটাকে চিনিস শব্দ?” শব্দ আমতা আমতা করে বললো “না তো, আমি কিভাবে চিনবো?” শুভ্র আবারও জিজ্ঞেস করলেন “তাহলে মেয়েটার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলি না কেন? তুই তো ভেবেছিলি এখানে ইমা।” 

 

আমি রুমে পৌঁছে গেলাম, শুভ্র ভাই আর শব্দের কথা কিছুই কানে ভেসে আসলো না। ইমার রুমের কোনো ড্রয়ারে ঔষধ পেলাম না। যদিও ঔষধ খাওয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার। তবুও না খেলে সকালে শুভ্র ভাইয়ের কড়া প্রশ্নের মুখে হয়তো পড়তে হতো। তাই একটা চেষ্টা করলাম মাত্র। গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। 

 

শেষরাতের দিকে আমার মনে হলো কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শরীর খারাপ আস্তে আস্তে কমতে শুরু করলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু ভাঙার শব্দে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম আমি আর ইমা। 

পাশে থাকা গ্লাসটা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। তার পাশেই চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে শব্দ। তাহলে শব্দই কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল আমার? নাকি আমার মনের ভুল ছিল? 

 

ইমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই শব্দ বললো “আসলে শুভ্র বললো তোর রুমে ঔষধ আছে সেটাই খুঁজতে এলাম। পেলাম না, হাতে লেগে গ্লাসটা ভেঙে গেছে।” ইমা তাড়াহুড়ো করে উঠে  বললো “কি হয়েছে বলো, তোমার জ্বর এসেছে? ঔষধ দিচ্ছি দাঁড়াও।” শব্দ বাধ্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার এবারও প্রচন্ড হাসি পেলো। হাসার ইচ্ছেটাকে আপাতত বাক্সবন্দি করে থোঁতা মুখ ভোঁতা করে বসে আছি। 

 

শব্দ চলে যেতেই উৎফুল্ল হয়ে ইমা বললো “জানো রোদ শব্দ ভাই আমাকে দেখতেই এসেছিল। আমি জানি ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে। তাই চুপিচুপি আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখতে এসেছে।” ইমার কথায় কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলো আমার। 

 

চলবে?…

 

আগেই বলেছিলাম গল্পটা রোমান্টিক এবং থ্রিলার হবে। আপনারা ধৈর্য্য ধরুন, অনেক রহস্য চাপা পড়ে আছে এখনো।

 

সবার আগে গল্পটি পেতে জয়েন করুন আমার গ্রুপে গল্পসায়র Story by Mst Moni

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০৫

“জানো রোদ শব্দ ভাই আমাকে দেখতেই এসেছিল। আমি জানি ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে। তাই চুপিচুপি আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখতে এসেছে।” ইমার কথায় কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলো আমার। 

তবে এই মন খারাপের কোনো কারন খুঁজে পেলাম না। সকালের দিকে জ্বর কিছুটা কমে এলো। পা টিপে টিপে নিচে নেমে পুরো বাড়িটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। শুভ্র ভাইয়ের রুমের দরজা বন্ধ। হয়তো এখনো ঘুমোচ্ছে। শব্দের রুমের দিকে উঁকি দিতেই দেখলাম পাঞ্জাবি পড়ছে। এই লোকটা পাঞ্জাবি ছাড়া কিছু পড়ে না নাকি? আমি ঘুরে ঘুরে রান্নাঘরে গিয়ে চা বানানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু গ্যাসের চুলা চালু করতে পারছি না। কি এক মসিবতে পড়লাম কে জানে। সবকিছুই দেখি গ্রামের থেকে উল্টো। পেছন থেকে কেউ একজন হাত বাড়িয়ে গ্যাসের চুলা চালু করে এক পাশে রাখা বাদামের বাটি থেকে দুটো বাদাম মুখে দিয়ে বললো “আমার রুমে উঁকি দিয়ে কি দেখা হচ্ছিল?” 

আমি অবাক হয়ে পেছনে ঘুরলাম। সোজা শব্দের থুতনির সাথে মাথাটা লেগে গেলো। ব্যথা জায়গায় ফের আরেকবার ব্যথা পাওয়ায় ককিয়ে উঠলাম। শব্দ বাদাম মুখে নিয়েই ফুঁ দিতে লাগলো। আমি মুখ বাকিয়ে চা বানাতে বানাতে বললাম “এখান থেকে যান। এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন আপনি? কেউ দেখলে কি ভাব্বে?”

 

শব্দ মাথা চুলকে চেয়ারে বসতে বসতে বললো “কেউ আসলে আসুক, আসলে আমাকে দেখতে পাবেই না। উল্টো সবাই তোমাকে পা*গল ভাববে।” মাঝে মাঝে এই ছেলের কথা কিছু মাথায় ঢোকে না আমার। চা বানিয়ে শব্দের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম “নেন চা খান, শুভ্র ভাই কোথায়? তাকে এক কাপ চা দিয়ে আসি।” একপ্রকার থমথমে গলায় শব্দ বললো “এতো তাড়াহুড়ো কিসের? ও এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। শুভ্র চা খায়না।” 

কি বলে শুভ্র ভাই চা খায়না? এ আবার কেমন মানুষ? আমার তো চায়ের কাপে চা খেতে ভালোই লাগেনা। আমার ভালো লাগে মগ ভর্তি করে চা খেতে। 

 

আমি শব্দের থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে বললাম “আপনি কি জানেন শব্দ ভাই ইমা আপনাকে পছন্দ করে?” শব্দ ভাই বললেন “আমি প্রায় সবার মনের কথা বুঝতে পারি তুমি সেটা জানো? কেউ একজন ভালোবাসলেই তো তাকে ভালোবাসা যায় না। দুজনের সম্মতি থাকতে হয়।” কি বলছে? ইমার কোন দিক দিয়ে কম আছে? বলতে গেলে প্রায় সব গুন আছে মেয়েটার। দুধে আলতা গায়ের রং। তাও শব্দ ভাইয়ের সম্মতি হচ্ছে না। 

 

আমাদের কথার মাঝেই শুভ্র ভাই নামলেন। সাদা শার্ট পরিধান করে চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে শব্দ ভাইকে বললেন “কিরে এতো সকালে ঘুম থেকে উঠলি কিভাবে? এই মেয়ে আমাকে এক কাপ চা দেও তো।” শুভ্র ভাইয়ের কথায় আমি বিষম খেলাম। আড়চোখে শব্দ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখমুখ খিঁচে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আমি মুখ বাকিয়ে চা আনতে চলে গেলাম। শব্দ ভাই শুভ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করলো “কিরে কোথাও যাচ্ছিস নাকি? একদম নায়ক সেজে এসেছিস।” শুভ্র ভাই আমতা আমতা করে বললো “যাচ্ছি না, এখন থেকে বাড়িতেও এমন থাকবো তোর কোনো সমস্যা?”

 

আমি এক কাপ চা এনে শুভ্র ভাইয়ের হাতে দিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করতে লাগলাম। শুভ্র ভাই চায়ে চুমুক দিয়ে বললো “ইয়াক কি চা বানিয়েছো এটা কোনো চা হলো? শব্দ এটা কিভাবে খেয়েছিস তুই?” শব্দ ভাই শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে থাকা চায়ের কাপ থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক দিয়ে বললো “কি বলছিস ভাই, সব তো ঠিকঠাকই আছে। আমার তো ভালোই লাগলো।” আমি ভয়ে রাগে উপরে চলে যেতে আরম্ভ করলাম। সিঁড়ি দিয়ে দেখি শুভ্র ভাই খুব আরামেই চা খাচ্ছে। দেখে একটুও বোঝা যাচ্ছে না চা খারাপ হয়েছে। আমাকে শব্দ ভাইয়ের সামনে থেকে সরানোর জন্যই এই নাটকটা তিনি করলেন। ঠিক আছে, আমিও আর শুভ্র ভাইয়ের সামনে যাবো না। 

 

রুমে ঢুকে দেখি ইমা জেগে গেছে। খালাম্মা একপ্রকার হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে এসে ইমাকে বললো “ইমা জলদি তৈরি হয়ে নে। তোকে দেখতে আসবে আজ।” খালাম্মার কথায় আমি এবং ইমা দুজনেই অবাক হলাম। ইমা এখনো এতোটা বড় হয়নি যে বিয়ে দিবে। আমরা সমবয়সী দুজনেই। তার চেয়েও বড় কথা বিয়েতে ইমা রাজি নয়। আমি সোজা খালাম্মাকে বললাম “খালাম্মা মাফ করবেন, একটা কথা বলতাম। ইমা বিয়েতে রাজি নয়। ইমা শব্দ ভাইকে ভালোবাসে।” আর যাই হোক ইমার ভালোবাসাটাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। তাই খালাম্মাকে না বলে পারলাম না। খালাম্মা আমার কথায় চমকে ইমার দিকে তাকালো। প্রচন্ড ক্রোধে খালাম্মা বললেন “কি শুনছি আমি এসব ইমা। তুই শব্দকে ভালোবাসিস? আমি মোটেই বলছি না শব্দ খারাপ ছেলে। আমার কাছে আমার ছেলের থেকেও শব্দ অনেকটা ভালো। তবে শব্দ তো তোকে সবসময় বোন হিসেবে দেখেছে। তোর মনে হয় শব্দ কখনো মানবে?” 

 

একপর্যায়ে ইমা কেঁদেই খালাম্মাকে অনুরোধ করলো। মেয়ের বায়নার কাছে খালাম্মার ক্রোধ টিকলো না। ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি হেসে বাইরে চলে গেলেন খালাম্মা। ইমা আমাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিয়ে বললো “ধন্যবাদ রোদ, আমি কখনোই মা’কে কথাটা বলতে পারতাম না। তোমার মতো স্পষ্টভাষী মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি।” আমিও মুচকি হাসলাম। ইমাকে দেখে ভালো লাগছে। তবে মনের মধ্যে কোনো অজানা এক মন খারাপ বাসা বাঁধতে শুরু করলো। এতো কঠিন একজন মেয়ে হওয়া সত্বেও হাত পা কেঁপে বুকে ব্যথা হতে আরম্ভ হলো।

 

বাড়িতে সবাই জানে ইমাকে আজ দেখতে আসবে। ইমা আর আমি মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন শব্দ ভাইয়ের বাড়ি থেকেই লোকজন আসে। আমি নিচে খালাম্মার সাথে খাবারের আয়োজন করছি। এক ফাঁকে খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম শব্দ ভাইয়ের বাড়ি থেকেই লোকজন আসবে কিনা। খালাম্মা হাসি মুখে বললো “হ্যাঁ, ওই বাড়ির সবাই একদম রাজি। এখনি চলে আসবে দেখিস, ওরা খুবই ভালো।” আমি এক পলক শব্দ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। নীল রঙের পাঞ্জাবিতে আসলেই ভালো লাগছে। কেমন হাসিখুশি ছেলেটা, একটু পরপরই শুভ্র ভাইকে জ্বালাচ্ছেন। 

 

হুট করেই আমার চোখে শব্দ ভাইয়ের চোখ পড়তেই চোখ নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন “কি হয়েছে তাকিয়ে আছো কেন।” আমি কৃত্রিম হাসি দিয়ে কাজে মনোযোগ দিলাম। ইমা শব্দ ভাইয়ের সাথে মিল রেখেই নীল শাড়ি পড়ে নিচে নামলো। ইমাকে আজ একদম বিশ্ব সুন্দরীর মতো লাগছে। ইমা শব্দ ভাইকে দেখেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। ইতিমধ্যেই বাড়িতে মেহমান ভর্তি হয়ে গেলো। শব্দ ভাইয়ের বাড়ির লোকজন এসেছেন। কিন্তু শব্দ ভাই জরুরী কাজে বাইরে চলে গেলেন। 

 

শব্দ ভাইয়ের বাড়ির লোককে দেখেই শুভ্র ভাই একদম লাফিয়ে উঠলেন। হাত থেকে ল্যাপটপ রেখে, চশমাটা একদিকে ছুড়ে মে-রে মেহমানের মধ্য থেকে কয়েকটা মেয়ের সাথে নাচা শুরু করলো। আমি ভাবলাম আচমকাই ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খালাম্মার কানে কানে বললাম “খালাম্মা শুভ্র ভাইয়ের মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? উনি এমন লাফাচ্ছেন কেন?” খালাম্মা মুচকি হেসে বললেন “আরে না মাথা খারাপ হবে কেন? আসলে ছোট বেলা থেকে শুভ্র শব্দের বাড়িতে এবং শব্দ আমাদের বাড়িতে বড় হয়েছে। তাই শুভ্র ওদের পরিবারের সাথে হাসিখুশি থাকতে পারে আর শব্দ আমাদের বাড়িতে হাসিখুশি থাকে। শব্দ আবার ওদের নিজের বাড়িতে শুভ্রের মতো থাকে, শুভ্র যেমন আমাদের বাড়িতে চুপচাপ থাকে তেমন।” 

খালাম্মার কথা আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। মাথা চুলকে শুভ্র ভাইয়ের কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম। নাচানাচি শেষ করে মধ্যবয়স্কা একজনকে জড়িয়ে ধরে বললো “বড় আম্মু কবে দেখেছি তোমাকে বলো তো। কেন আসো না? ছেলেকে ভুলে গেছো এখন?” মহিলাটি শুভ্র ভাইয়ের  মাথায় হাত রেখে বললো “এখন তো একা ঘুমাতে পারিস, বড় আম্মুকে দরকার হয়না। তাই একদম চলে আসলি। নিজেও তো যাস না। তুই কি ছেলে না ওই বাড়ির?” 

 

শুভ্র ভাই সবাইকে নিয়ে বসালো। একটু আগে ফিটফাট থাকা ছেলেটা হুট করেই কেমন অগোছালো হয়ে গেলো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপাল বরাবর চোখের সামনে এসে ঝুলে পড়েছে। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। লাফালাফি করার কারনে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। শার্টের একটা হাতা ফোল্ড করা আরেকটা হাতা একদম চাড়া। দেখতে কেমন অদ্ভুত লাগছে। সেই কখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক নতুন শুভ্র ভাইকে দেখছি। শুভ্র ভাই দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। 

 

কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে এলো সাদা একটা টিশার্ট আর একটা শর্ট প্যান্ট পড়ে। চকলেট বয় টাইপের ছেলেটাকে দেখে জিভে কামড় দিলাম আমি। আগে সিনেমায় তো এমন নায়কই দেখতাম। স্বপ্নও দেখেছি কতশত। 

আমি আড়চোখে দেখে নজর ফিরিয়ে নিলাম। ইমাকে সবার মধ্যে বসিয়ে সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ইমা বার বার লজ্জা মিশ্রিত চিৎকার করে বললো “আহা ছাড় না তোরা, এমন করছিস যেন আগে আমাকে দেখিস নি কখনো। তোদের ভাইয়ের বউ হবো বলে এখন খুঁত বের করছিস।” বলেই লজ্জায় আবারও মুখ ঢাকা দিলো। 

 

বিয়ের দিনতারিখ সব ঠিক করে আজকেই রিং পরিয়ে গেলো ইমাকে। সবাইকে আজকে থাকতে বললেও কেউই থাকলো না। কারন এই বাড়িতে আপাতত শব্দ ভাই আছে। আর সবাই শব্দ ভাইকে জমের মতো ভয় পায়। আমি একবারের জন্যও তাদের সামনে যাইনি। পুরোটা সময় রান্নাঘরেই ছিলাম। 

 

রাত প্রায় ১১ টা, সবাই যে যার রুমে চলে গেছে। আমি রান্নাঘর গুছিয়ে সদর দরজা বন্ধ করতেই দরজায় কারো উপস্থিতিতির টের পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম বিধ্বস্ত অবস্থায় শব্দ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে তার। আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ভেতরে নিয়ে এনে বসালাম। সবাইকে ডাকার জন্য যেতেই শব্দ ভাই বারন করলেন। 

আমি কথা বাড়ালাম না, চুপচাপ শব্দ ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এই অবস্থায় আসলে কি করা বা বলা উচিত সেটা বুঝতে পারছি না। 

 

নিরবতা ভেঙে শব্দ ভাই নিজেই বললো “মেহমান চলে গেছে?” আমি সায় দিয়ে বললাম “হ্যাঁ, ইমাকে রিং পরিয়ে গেছে।” শব্দ ভাই মাথা নাড়িয়ে বললো “ওহ্” আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম “কোথায় গিয়েছিলেন?” শব্দ ভাই হুট করেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো “তোমার সাথে প্রথম যেখানে দেখা হয়েছিল সেখানে।” আমি চোখ বড় বড় করে বললাম “সেখানে কেন গিয়েছিলেন? আপনি না বললেন আপনার বাড়িঘর নেই। তাহলে আপনার পরিবার আসলো কিভাবে?” 

 

শব্দ ভাই মুচকি হেঁসে বললো “পাকা মেয়ে এখনো সেই কথা মনে রেখেছে। আমি যখন মানুষ থাকি তখন পরিবার থাকে। বুঝলে?” আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম “নাহ্ বুঝিনি।” শব্দ ভাই আওয়াজ তুলে হেসে বললো “বুঝতে হবেনা, কখনো যদি কঠিন কোনো সত্য জানতে পারো তাহলে কি নিজেকে সামলাতে পারবে? আমার হাত ধরতে পারবে?” 

 

আমি শব্দ ভাইয়ের জন্য খাবার তৈরি করতে করতে বললাম “আপনার হাত ধরবো কেন শব্দ ভাই? আপনার হাত ধরার মানুষ তো আছে।” শব্দ ভাই গ্লাস থেকে পানি খেতে খেতে বললো “আছে মানে? কে আছে? ইমার কথা বলছো? ওর তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।” আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম “হ্যাঁ তো? বিয়ে করেই তো সারাজীবনের জন্য আপনার হাত ধরছে তাইনা?” শব্দ ভাই অবাক হয়ে বললেন “কি বলছো? কিছু বুঝতে পারছি না।” আমি খাবার সামনে দিয়ে বললাম “আপনি কি আসলেই কিছু বুঝতে পারছেন না? আজ আপনার পরিবারের সবাই এসেই তো আপনার সাথে বিয়ে ঠিক করে গেলো ইমার৷ কিছুই কি জানেন না?”

 

আমরা টেরই পেলাম না উপর থেকে আরো একজন আমাদের নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। আমাদের সমস্ত কথা সে শুনছে। 

 

চলবে?……

 

এবার আস্তে আস্তে সবাই জ্বীনবরের দেখা পাবেন।

 

আমার গল্পটি সবার আগে পেতে এবং গল্প নিয়ে আড্ডা দিতে আমার গ্রুপে জয়েন করুন — গল্পসায়র Story by Mst Moni

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০৬

আমরা টেরই পেলাম না উপর থেকে আরো একজন আমাদের নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। আমাদের সমস্ত কথা সে শুনছে। 

আমি আর কথা বাড়ালাম না। শব্দ ভাইয়ের খাওয়া শেষ হতেই ঘুমাতে চলে গেলাম। ঘুমানোর বেশ কিছুক্ষন পর বাড়িতে শোরগোল শুনতে পেলাম। শোরগোলে আমার এবং ইমার দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায়। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে বাইরে বের হলাম। 

 

শব্দ ভাইয়ের পরিবার এসেছে। এতো রাতে এখানে তাদের উপস্থিতি কেন বোধগম্য হচ্ছে না আমার। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইমার দিকে তাকালে ইমাও ঠোঁট বাঁকিয়ে ইশারা দিলো সে কিছুই বুঝতে পারছে না। শব্দ ভাইয়ের সাথে তার বাবার কথা কাটাকাটি হচ্ছে। কিছুটা দূরেই শুভ্র ভাই শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে সব। মনে হচ্ছে যেই ঝামেলাটা হচ্ছে তাতে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। শুধুমাত্র কিছুক্ষণ পর পর বলছে “আহ্ শব্দ হচ্ছে কি এসব? তুই সোজা তোর ডিসিশন জানিয়ে দিবি। এতো বকাবকির তো কিছু দেখছি না।” তবে শব্দ ভাইয়ের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। শুভ্র ভাইয়ের এমন কথার প্রতুত্তরে শব্দ ভাই বললেন “কেন বকাবকি করবো না শুভ্র? আমি আমার ডিসিশন এখন কেন জানাবো? তারা ডিসিশন নেওয়ার আগে আমাকে কেন একবার জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করেনি ওকে ফাইন, কিন্তু এখন যখন আমি আমার ডিসিশন জানাচ্ছি তখন তোর বড়বাবা আর বড়মা সেটা মানছে না। তাদের সিদ্ধান্ত তারা কথা দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু লাইফটা তো আমার। আমিও তো অন্য কাউকে কথা দিতে পারি নাকি? আমার জীবনে আমার কথা দেওয়াটা কি বেশি প্রাধান্য পাবেনা শুভ্র? ও আমাকে ভুল বুঝছে আমি এখন কি করবো?” 

 

শব্দ ভাইয়ার এই কথাটায় সবাই সমস্বরে বলে উঠলো “ও ভুল বুঝছে মানে? কে ভুল বুঝছে?” সবার প্রশ্নে শব্দ ভাই হকচকিয়ে আমতা আমতা করে বললো “আমার কি কেউ থাকতে পারেনা নাকি? যাইহোক আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।” শব্দ ভাইকে তার পরিবারের সবাই একটু বেশিই ভয় পায়। তাই এতো রাতে তার একটা ফোন কলে সবাই ছুটে এসেছে। শব্দ ভাইয়ের কথার উপরে কেউ কথা বলবে এমন দুঃসাহস কারো নেই। পাশে তাকিয়ে দেখি ইমা কাঁদছে। এই কথাগুলো সে নিজের শুনবে আশাও করেনি। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। 

 

ইমাকে নিয়ে রুমে যাওয়ার সাথে সাথেই ডাক পড়লো আমার। আমি বাইরে গিয়ে দেখি শুভ্র ভাই আমাকে ডাকছে। আমার সাথে আলাদা কথা বলতে চায়। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। এই লোকটাকে আমি সবসময়ই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো “এই মেয়ে, আমি জানিনা তুমি কে? পরিচয়, কোথা থেকে এসেছো কিছুই জানিনা। তবে আমি যেই আন্দাজ করছি তাতে বলা যায় শব্দ তোমার জন্যই বিয়ে করছে না। আমি আমার বোনের কষ্ট দেখতে পারবো না। এর জন্য যদি তোমাকে বিয়ে করে আমার বোনের পথ পরিষ্কার করতে হয় আমি সেটাই করবো। তোমার বিয়ে হয়ে গেলে তো শব্দ কারো আশায় বিয়েটা ভাঙতে পারবে না তাইনা?” আমি অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম। কি বলছেন ইনি এসব? আমার জন্য বিয়ে ভাঙছে? আমি আসলাম মাত্র দুদিন হলো। শব্দ ভাই আমাকে ভালো ভাবে চিনেও না। আমি কি পানিতে ভেসে এসেছি নাকি যে, যে যখন চাইবে এটা সেটা বলে দিবে। আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগার কারনে আমি রেগেই বললাম “আশ্চর্য আপনি আমার দোষ দিচ্ছেন কেন? আমি এখানে এসেছি মাত্র দুদিন। আর খালাম্মাকে আমি নিজেই ইমা আর শব্দ ভাইয়ের কথাটা বলেছি। আপনি ভাবলেন কিভাবে এসব? আমি দরকার হলে এখান থেকে চলে যাবো তাও আপনাকে বিয়ে করবো না আমি। এটা ঠিক আপনার কোনো দিকে কমতি নেই। কিন্তু একটা মানুষকে ভালোবাসার মতো মন মানসিকতা আপনার নেই।” বলেই চলে আসলাম। শুভ্র ভাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো একটু বেশিই বলা হয়ে গেছে। বলবোই তো, কিভাবে বলতে পারেন এগুলো উনি? খল নায়িকা বানিয়ে দিলো আমাকে। উনাকে দেখে আমার কখনো বিয়ে করার মতো বা ভালোবাসার মতো অনুভূতি জন্মায়নি। হ্যাঁ একটা ছেলেকে সুন্দর লাগছে, সেটা দেখে শুধুমাত্র প্রশংসা পর্যন্তই যায় তার সাথে। যার জন্য কোনো অনুভূতি নেই তাকে বিয়ে? অসম্ভব রোদ, অসম্ভব! 

 

শব্দ ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। এ বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাবো। এখানে থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে। আজকেই যাবো শব্দ ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে হুট করেই যেন নিজের ঠিক সামনেই পেয়ে গেলাম শব্দ ভাইকে। ভয় পেয়ে বুকে থু থু দিলাম। ছোটবেলায় নানী-দাদীদের কাছে শুনেছি ভয় পেলে বুকে থু থু দিতে হয়। এতে ভয় কমে যায়। এবারও তার ভিন্ন কিছু হলো না। আমার কান্ড দেখে শব্দ ভাই অট্টহাসি দিলো। আমার ভ্রু যুগল আপনাআপনি কুঁচকে গেলো। জিজ্ঞেস করলাম “আপনি হুটহাট করে উদয় হন কিভাবে? আপনার সাথে আমার কথা আছে।” শব্দ ভাই পকেট থেকে বাদাম বের করে মুখে দিয়ে বললো “বলো আজ সব শুনবো, আজ আমার মন খুব ভালো।” এই ছেলেটা এতো বাদাম কেন খায়? আমি ধমক দিয়ে বললাম “আজকে আমার মন ভালো নেই। আমি বাড়ি থেকে চলে যাবো। আপনি বিয়েটা ভেঙে দিলেন কেন ভাইয়া? শুভ্র ভাইয়ের দাবি আমার জন্য আপনি বিয়ে ভেঙেছেন। সত্যি যদি তাই হয় তাহলে নিজ দায়িত্বে চলে যাবে।” কথাটা শোনার সাথে সাথেই শব্দ ভাইয়ের আসল রুপ দেখা গেলো। আমার সামনে শান্তশিষ্ট হাসিখুশী থাকা ছেলেটা হুট করে গম্ভীর হয়ে গেলো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছেন তিনি। শান্ত ভাবে প্রশ্ন করলো “আর কি বলেছে?” আমি আমতা আমতা করে বললাম “শুভ্র ভাই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।” হুট করেই শব্দ ভাই শান্ত হয়ে গেলো। হাফ ছেড়ে বললো “ওর যদি তোমাকে বিয়ে করতে মন চায় তাহলে করতে পারো তুমি। ছেলেটা ভালো, আমাকে যেমন তুমি কিছুটা ভরসা করো। শুভ্রকে আরো ভরসা করা যায়।” আমার ভাবনাই তাহলে ঠিক ছিল৷ শব্দ ভাই আমার জন্য বিয়ে ভাঙছে না। কেমন একটা বোঝা থেকে যেন মুক্তি পেলাম। তবে আরেক দফা মন খারাপ ঠিকই হলো। আমাকে পেছন থেকে ডেকে বললো “তোমার ভাবনা ঠিক নয় রোদ। আমি তোমার জন্যই বিয়ে ভেঙেছি। তবে ইমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না আমার। কারন ও আমার ছোট বোন। তবে কিছুটা তোমার জন্যও।” আমি চোখমুখ বড় করে হা করে অবাক হয়ে গেলাম। শব্দ ভাই আস্তে উঠে আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন। আমার এখন কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। বিয়েটা আমার জন্য কেন ভেঙেছেন উনি? আমি শুভ্র ভাইকে বিয়ে করবো না। আর এখানে আমি থাকলে বিয়েটাও হবেনা। তাই এদিক ওদিক না চিন্তা করেই বেরিয়ে পড়লাম। 

 

শেষরাতের দিকে কোন রাস্তা দিয়ে কোথায় এসেছি বুঝতে পারছিনা। মনে হয় কোনো গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেছি। হুট করেই যেন আমার উপর কিছু একটা হামলা করলো। তাকিয়ে দেখলাম কালো একটা বিড়াল। বিড়ালটা বারবার আমার মুখের উপর ঝাপিয়ে পড়ছে। আমি হাত দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার বৃথা চেষ্টা করছি। বারবার নিজেকে বুঝাচ্ছি এটা সাধারন একটা বিড়াল মাত্র। কিন্তু ওই যে নানী দাদীর রুপকথার গল্প আমার পিছু ছাড়লো না। মনে হানা দিতে লাগলো “রোদ এটা খারাপ কিছু।” আমি সামনে আগাতে পারলাম না। মনে হচ্ছে কয়েকশত কালো বিড়াল ওত পেতে আছে আমার জন্য। আমি উল্টো পথে রওনা দিলাম। তবে ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছে একই জায়গায় চলে এসেছি। আমি এবার অসহায় হয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। চোখের সামনে দেখলাম বিড়ালটা বড় হতে হতে একটা বিশাল লোমে ভর্তি জন্তুতে পরিনত হচ্ছে। আমি ভয়ে চোখমুখ কুঁচকে বসে আছি। কেন জানিনা ঠিক এই মুহুর্তে শব্দ ভাইয়ের কথা মনে পরছে। বারবার মনো হচ্ছে শব্দ ভাই থাকলে আমি তাকে ভরসা করতে পারতাম। 

 

জন্তুটা আমার উপরে ঝাপিয়ে পড়তেই কেউ একজন ঝাপিয়ে পড়লো জন্তুটার উপর। এক হাত দিয়ে জন্তুটাকে শুন্যে তুলে সামনে আছাড় মারলো। জন্তুটা আর আ*ক্রমণ না করে পালিয়ে গেলো। অন্ধকারে বুঝতে পারছিনা সামনে থাকা ব্যক্তিটা কে। আমার হাত ধরে আমাকে টেনে উঠিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে নিলো। আমি কাচুমাচু করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার সমস্যাটা অপর পাশের লোকটা বুঝতে পেরে ধমক দিয়ে বুকের সাথে আরো চেপে বললো “চুপ, আমি শব্দ।” আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। 

 

জায়গাটা থেকে আমাকে নিয়ে বের হয়ে বললেন “কে বলেছিল বাড়ি থেকে? কে বলেছিল? ৩/৪ টা খু*ন করেছো বলে কি ভাবছো দুনিয়া জয় করে নিয়েছো? সাহস বেশি হয়ে গেছে? মানুষের সাথে পারলেও তুমি এদের সাথে পারবে কখনো? আমি কতো চেষ্টা করতেছি তোমাকে আগলে রাখার আর তুমি? আমাকে না বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে। আমি না এলে কে বাঁচাতো তোমায়? তোমার শুভ্র ভাই?” এতো এতো ধমক দেওয়ার পরেও আমাকে শক্ত করে তিনি বুকের মধ্যেেই আঁটকে রাখলো। আমি আস্তে বললাম “হয়েছো তো, বিপদ কে’টে গেছে। এবার আমাকে ছাড়ুন।” শব্দ ভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে থতমত খেয়ে কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে মাথায় উঠিয়ে দিলো। 

 

হুট করেই আমার হাত টেনে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন “এরপর থেকে কোথাও আমাকে ছাড়া বের হবেনা। শুভ্রর সাথেও না। আমি কাউকে ভরসা করতে পারছি না।” আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম “আমি যে ৩/৪ টা করে খু*ন করেছি আপনি কিভাবে জানলেন শব্দ ভাই?” এবার যেন এই প্রশ্নের উত্তরটা চাপা দিতেই শব্দ ভাই চেচিয়ে উঠে বললো “ভাই ভাই করছো কেন? আমি তোমার কোন জনমের ভাই? ভাই বলবেনা একদম। আমার বোন আছে, আর বোনের দরকার নেই। তুমি বরং শুভ্রকে ভাই বলো। তোমার মুখে শুভ্র ভাইটা দারুন মানায়। শব্দ ভাই একদমই মানায় না।”

 

আমি বিরক্ত নিয়ে শব্দ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। এই ছেলেটা বারবার শুভ্র ভাইকে কেন টানছেন? আমি তো শুভ্র ভাইকে বিয়ে না করার জন্যই পালিয়েছিলাম। সবথেকে বড় কথা উনি জানলো কিভাবে আমি এখানে? অত বড় জন্তুটার সাথেই বা কিভাবে শব্দ ভাই যু*দ্ধ করলেন? জন্তুটা কেন শব্দ ভাইকে দেখে পালিয়ে গেলো? কিছুই মাথায় আসছে না। আসবে কিভাবে? পড়ালেখা করার সময় পড়া থাকতো না মাথায়, এখানে তো কত ভাবনার বিষয়।

 

চলবে?…

 

কালকের পর্ব বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করবো। সবেমাত্র গল্প শুরু হলো, আর আপনারা অধৈর্য্য হচ্ছেন যে রহস্য বের হচ্ছে না কেন। আমি তো গল্প লিখছি, সারাংশসারমর্ম না। 

 

আমার গ্রুপে জয়েন করুন — গল্পসায়র Story by Mst Moni

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০৭

অত বড় জন্তুটার সাথেই বা কিভাবে শব্দ ভাই যু*দ্ধ করলেন? জন্তুটা কেন শব্দ ভাইকে দেখে পালিয়ে গেলো? কিছুই মাথায় আসছে না। আসবে কিভাবে? পড়ালেখা করার সময় পড়া থাকতো না মাথায়, এখানে তো কত ভাবনার বিষয়।

আমি কথা না বাড়িয়ে শব্দ ভাইয়ের সাথে এগিয়ে গেলাম। বাইরে যাওয়াটা এখন আর সম্ভব না। জানিনা ওই কালো বিড়াল, জন্তু এগুলো কি। তবে আমার ক্ষতি হতে পারে এটা নিশ্চিত। তাছাড়াও শব্দ ভাই এখন আমাকে কোথাও যেতে দিবেনা। 

আমাদের যেতে যেতে প্রায় সকাল হয়ে গেছে। বাইরে বাগানে শুভ্র ভাই হাটাহাটি করছে। আমার জানামতে শুভ্র ভাই এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে না। আজ কি হলো বোঝা যাচ্ছে না। 

 

আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে শুভ্র ভাই থমকে গেলো। আমাকে কিছু বলতে গিয়েও শব্দ ভাইকে দেখে কিছু বললেন না। চুপচাপ বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। 

সেদিন সারাদিন শব্দ ভাই আমাকে চোখে চোখে রাখলেন। একবারের জন্যও চোখের আড়াল করলেন না। শুভ্র ভাই এবং শব্দ ভাই ছাড়া আর কেউ জানেই না আমার চলে যাওয়ার বিষয়টা। সন্ধ্যার দিকে শব্দ ভাই কোথায় যেন চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আমাকে বারবার করে বলে গেলেন আমি যেন বাড়ির বাইরে না যাই। আমি আর কিছু বলার সু্যোগ পেলাম না। 

 

ইমা রুম থেকে বেশি বের হয়না। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। খালাম্মাও শব্দ ভাইয়ের বাড়িতে গেছে। বাসায় আমি আর শুভ্র ভাই আছি। টিভির রিমোট চেপে টিভি চালু করে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে শুভ্র ভাইয়ের উপস্থিতি টের পেলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো “রাগ করেছো আমার উপর?” আমি জবাব দিলাম না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললো “বললে না তো, রাগ করেছো কিনা।” আমি টিভির দিকে তাকিয়েই বললাম “করিনি রাগ।” শুভ্র ভাই ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “তাহলে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেনা কেন? বাড়ি থেকে চলে গেলে কেন?” আমি এবার শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম “দুটো প্রশ্নের উত্তরই হলো এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়।” শুভ্র ভাইয়ের মন ক্ষুন্ন হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো “আমাকে তুমি এড়িয়ে চলো কেন? কলেজের প্রায় সব মেয়ে আমার সাথে একটু কথা বলার জন্য ছটফট করতো। আর তুমি আমাকে ইগনোর করছো? ইউ নো রোদ, কখনো কোনো মেয়ে আমাকে এতোটা দুর্বল করতে পারেনি। অথচ একটা শ্যামলা মেয়ে, উসকোখুসকো অবস্থায়, ভেজা ময়লা শরীরে গাড়ির সামনে এসে নিজেকে আমার মনে ধরিয়ে দিলো? দেখো আমি এমন না যে আমি একজনকে পছন্দ করলাম সেই কথাটা আমি মনে মনে চেপে রাখলাম। আমি স্পষ্টভাষী, তাই বলেই দিলাম। আরো আগেই বলতে চেয়েছি পারিনি। তুমি ভাবো তোমাকে আমি সহ্য করতে পারিনা। অথচ আমি সব সময় তোমাকে রাগিয়ে তোমার রাগী মুখটা দেখার জন্য এমন ব্যবহার করতাম। লিসেন, তোমাকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি রোদ। ইউ আর মাইন রোদ।” 

 

আমি এতোক্ষণ শান্ত হয়ে শুভ্র ভাইয়ের কথা শুনলাম। শান্ত হয়ে আবারও বললাম “দেখুন শুভ্র ভাই একজনকে একজনের ভালো লাগতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনি আপনার মতামত জানিয়েছেন। আমি আমারটা জানাই। আপনার জন্য আমার বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই বিশ্বাস করুন। তবে মানতেই হবে আপনি সুপুরুষ। আমি আপনার যোগ্য না, আপনাকে না বলার মতো কোনো যোগ্যতা আমার নেই। তবে আছে, আমার কাছে আমার যোগ্যতা আছে। আমি আপনাকে কেন অন্য কাউকেই বিয়ে করবো না।”

 

আমাদের কথার মধ্যেই শব্দ ভাই আসলেন। আমাকে আর শুভ্র ভাইকে একসাথে বসে থাকতে দেখে শুভ্র ভাই ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তবে বাইরে বুঝতে দিলেন না। শান্ত ভাবে শুভ্র ভাইয়ের পাশে বসে শুভ্র ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন “কি ইয়ং ম্যান, কি কথা হচ্ছে?” শুভ্র ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন “তেমন কিছু না, কোথায় গিয়েছিলি? শব্দ ভাই মাথা চুলকে বললেন ” কাজ ছিল একটু জানিসই তো।” আমি আস্তে উঠে উপরে চলে গেলাম। 

 

রুমে ঢোকার সাথে সাথেই আমাকে বের করে দেয়া হলো। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইমার দিকে তাকালে ইমা বললো “অকৃতজ্ঞ কোথাকার, আমি তোকে নিজের বাসায় নিজের রুমে জায়গা দিয়েছি। আর তুই কি করলি? মাত্র একদিনে আমার থেকে আমার এতো বছরের ভালোবাসা ছিনিয়ে নিলি? কি ভেবেছিলি তলে তলে নোং-রামো করবি আর কিছু জানতে পারবো না? কাল তোদের রং ঢং সব দেখেছি আমি। আশ্রিতা থেকে এতো বড় সাহস হয় কিভাবে? বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। এখানে তোর জায়গা নেই। রাস্তার মেয়ে রাস্তায় গিয়ে থাক।” আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগেই উপস্থিত হলেন শব্দ ও শুভ্র ভাই। শুভ্র ভাই ইমার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলেন। শব্দ ভাই চোখ মুখ লাল করে তাকিয়ে আছে ইমার দিকে। ইমা এবার প্রচন্ড ক্রোধে কেঁদে বললো “তোর জন্য আমার ভাই আমাকে মারলো। যে আমাকে একটা ফুলের টোকাও দেয়নি কখনো।” বলেই মারতে এগিয়ে আসলো। শব্দ ভাই আমাকে ঘুরিয়ে গতরাতের মতোই বাম হাত দিয়ে বুকের মধ্যে আগলে রাখলেন। শান্ত স্বরে বললেন “ইমা আর এক পা আগালে আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা। আমার রোদের গায়ে একটা টোকা দেওয়ার শাস্তি কতোটা হতে পারে সেই বিষয়ে তোর বিন্দুমাত্র ধারনা নেই।” বলেই আমার হাত ধরে নিচে নেমে আসলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমার কোনো জামা কাপড় আছে কিনা, তাহলে যেন গিয়ে নিয়ে আসি। আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলাম নেই কিছু। এবার পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করে শব্দ ভাই বললেন “ওকে চলো, শুভ্র তোদের বাড়িতে আমার এই শেষ আসা।” বলেই আমাকে নিয়ে বের হওয়া শুরু করলেন। শব্দ ভাইয়ের হাত খপ করে ধরে শুভ্র ভাই বললেন “কোথায় যাচ্ছিস ওকে নিয়ে? ওর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই শব্দ। ও এখানে যেই জন্য অপমানিত হয়েছে সেই সম্মান ওকে বিয়ে করে আমি দিবো। এই বাড়িতেই ও থাকবে স্বসম্মানে।” শব্দ ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন “কে বলেছে ওর যাওয়ার যায়গা নেই? আমি কি মরে গেছি? এই আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ এখনো জীবিত শুভ্র। রোদ কি রাজি হয়েছে তোর প্রস্তাবে? তাহলে আমি ওকে রেখে যাবো।” বলেই আমার দিকে তাকালো। আমি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলাম “হইনি রাজি।” 

 

সাদা একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালেন শব্দ ভাই। আমাকে নিয়ে বের হয়ে বাড়িতে ঢুকতে যেতেই বললাম “আমি যাবোনা শব্দ ভাই। আমি কারো ভরসায় বাড়ি থেকে বের হইনি। আমি নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারবো। নিজে কাজ করে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিবো। তাও অন্যের বাড়ি আশ্রিত থেকে এমন নোংরা কথা শুনতে রাজি নই।” শব্দ ভাই এক হাত উঁচু করে বললেন “এক থাপ্পড় দিবো, বেশি বুঝো? এটা আমার বাড়ি এখানে তোমাকে উঁচু গলায় কেউ কথাও বলবে না। তোমার বাইরে যাওয়াটা নিরাপদ না। তোমার বাবা নিজে ওদের কাছে তোমাকে বিক্রি করে গেছেন। ওরা তোমাকে পাগলের মতো খুঁজছে। চলো..” 

 

বিক্রি করে দিছে মানে? কাদের কাছে বিক্রি করেছে? ওরা কারা? আমার বাবাা এমন কাজ করতেই পারেন না। কি বলছে এসব শব্দ ভাই? 

 

চলবে?….

 

প্রচন্ড অসুস্থ, লিখতে পারছিনা। তাই পর্বও বড় করতে পারিনি দুঃখিত। পড়ার কোন জায়গায় কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন। 

 

আমার গ্রুপে জয়েন হন– গল্পসায়র Story by Mst Moni

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০৮

বিক্রি করে দিছে মানে? কাদের কাছে বিক্রি করেছে? ওরা কারা? আমার বাবা এমন কাজ করতেই পারেন না। কি বলছে এসব শব্দ ভাই? 

 

আমার মৌনতা দেখে শব্দ ভাই টেনে সোজা ভেতরে নিয়ে গেলেন। আসলেই এখন আমার যাওয়ার যায়গা নেই। যতটা শুনলাম দেখলাম তাতে বোঝা গেলো আমি বাইরে কিংবা শব্দ ভাইয়ের থেকে দূরে নিরাপদে থাকতে পারবো না। তাই এখানে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই আমার। 

 

ভেতরে ঢুকেই খালাম্মার মুখোমুখি হলাম। আমাকে শব্দ ভাইয়ের সাথে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো। খালাম্মাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই শব্দ ভাই বললেন “ছোট মা রোদ তোমাদের বাড়িতে আর থাকবে না। তোমার মেয়েকে যদি পারো একটু ভদ্রতা শিখতে বলবা। তোমাদের বাড়িতে এই আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ যাবেনা।” খালাম্মার মন খুন্ন হলো। তিনি ফের আবারও কথা বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই শব্দ এক ডাকে সবাইকে জড়ো করলো বসার রুমে। আমাকে মাঝে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো “ও রোদ, আজ থেকে এখানেই থাকবে। এই বাড়িতে আমার যতটুকু সম্মান, রোদকেও যেন ঠিক ততটুকু সম্মান দেওয়া হয়। কেন সম্মান দিবে, কি হিসেবে এই বাড়িতে সে থাকবে সেটা প্রশ্ন করবে না কেউ। আমি বলেছি মানে রোদ এখানেই থাকবে। আর একটা কথা, রোদ এই বাড়ির কাজের মেয়ে না। তাই ওকে দিয়ে কেউ কাজ করাবে না কিংবা কাজের লোকের মতো ব্যবহার করবে না। তোমাদের দরকার হলে আমি আরো দুজন কাজের লোক রেখে দেবো। কিন্তু রোদ একদমই না।” কথা থামিয়ে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো “আমার পাশের রুমটা খালি না? তোর কিছু জামা কাপড় নিয়ে সেখানে আয়। আমি তোকে নতুন নতুন অনেক জামা কাপড় কিনে দিবো বোন। তোর অপছন্দের জামা গুলোই নাহয় নিয়ে আয়। আমি কালকেই তোর আর রোদের জন্য নতুনটা কিনে আনবো।” মেয়েটা হাসি মুখে এক ছুটে চলে গেলো জামা কাপড়  আনতে। 

 

শব্দ ভাই আমাকে নিয়ে রুমে গেলেন। সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু ভয় এবং লজ্জাবোধ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি জামা কাপড় নিয়ে হাজির হলো। এসে শব্দ ভাইয়ের হাতে দিতে দিতে বললো “ভাইয়া এটা কি ভাবি? আমি কিন্তু ভাবির জন্য বেস্ট জামা গুলোই এনেছি।” শব্দ ভাই লজ্জা পেলো। চোখ টিপে বললো “তোর যা খুশি ডাকতেই পারিস।” 

 

সেই রাতে আর কোনো ঝামেলা হলো না। খালাম্মা নিজের বাড়িতে চলে গেছে। সকাল সকাল আমি ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথেই আমার খাতির যত্ন শুরু হলো। স্পেশাল ভাবে খাবার রুমে পাঠানো হলো। এতো এতো খাতির যত্ন দেখে আমার নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। কিন্তু শব্দ ভাইয়ের জন্য কিছু বলতে পারছি না। আমার ক্ষেত্রে এতো বাড়াবাড়ি কেন করছেন সেটাও বুঝতে পারছি না। আমার খাবার খাওয়ার মধ্যেই রুমের মধ্যে লতা খালা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো “মেডাম আপনার রুমে শুভ্র স্যারে আসতে চায়। আমি কি বলবো আসতে?” লতা খালা এখন আমার দেখাশোনা করেন। আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই ধীর পায়ে শুভ্র ভাই এসে একটা চেয়ারে বসলেন। আমি খাবার মুখে নিয়েই বললাম “কেমন আছেন শুভ্র ভাই? খেয়ে এসেছেন? নাকি খাবেন।” শুভ্র ভাই আমার কথায় চমকে তাকালেন। কেমন এলোমেলো লাগছে আজ। একটা গোছালোব্যক্তি এভাবে এক রাতে অগোছালো হয়ে যাবে এটা আশা করা যায় না। আমি শুভ্র ভাইয়ের উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম “আপনার এই অবস্থা কিভাবে হলো শুভ্র ভাই?” আমার কথার জবাব না দিয়ে শুভ্র ভাই পাল্টা প্রশ্ন করলো “বাড়ি ফিরবে না?” আমি চমকে উত্তর দিলাম “কার বাড়ি? আমার কোনো বাড়ি নেই শুভ্র ভাই। আপনি চলে যান।” শুভ্র ভাই আমার কথা কানে না নিয়ে জিজ্ঞেস করলো “তুমি শব্দকে ভালোবাসো রোদ?” আমি মুচকি হেঁসে জবাব দিলাম “ভালোবাসি বললেই কি ভালোবাসা হয় শুভ্র ভাই? না বলেও তো ভালোবাসা যায়। আমি আপনার কাছে আপনার মন রক্ষার্থে বললাম আমি শব্দ ভাইকে ভালোবাসি না কিন্তু আসলে যদি আমি ভালোবেসে থাকি তাহলে কি কিছু করতে পারবেন? তাই ভালো বাসি কিনা এই উত্তরটা দেয়া কি খুব জরুরি? আমি শব্দ ভাইকে ভালোবাসি কিনা জানিনা। তবে ভরসা করি একটু বেশিই।” আমার কথাগুলো সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই শব্দ ভাই আমার রুমে প্রবেশ করলো। আমি এক গাল হেঁসে জিজ্ঞেস করলাম “কোথায় গিয়েছিলেন শব্দ ভাই?” শব্দ ভাই বিছানার উপরে কয়েকটা প্যাকেট রেখে বললো “একটু কাজ ছিল, সেখান থেকে তোমার আর বনুর জন্য ড্রেস নিয়ে আসলাম। খেয়েছো তুমি? শুভ্র কখন এসেছিস? বাসার সবাই ঠিক আছে?” 

 

শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না, নিরবে উঠে আমার দিকে তাকালো। আমার চোখ সোজা শুভ্র ভাইয়ের চোখে পরলো। একি? শুভ্র ভাই কাঁদছে? শুভ্র ভাই আস্তে করে শব্দ ভাইকে বললো “রোদকে সত্যিটা জানিয়ে দে শব্দ। পরে জানতে পারলে কষ্ট বেশি পাবে। সেটা আমি চাইনা শব্দ।” বলেই হাতের কনুই দিয়ে চোখ মুছে জোরে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলেন। শুভ্র ভাইয়ের কান্নাটা অবশ্য শব্দ ভাই খেয়াল করলেন না। তিনি অন্য প্যাকেট গুলো নিয়ে তার বোনের রুমে গেলেন। শুভ্র ভাই চলে গেছে কিনা সেটা দেখতে আমি এক প্রকার দৌড়ে বের হলাম। নাহ্, শুভ্র ভাই গেলেন না। তার জন্যও এই বাড়িতে শব্দ ভাইয়ের পাশের রুম বরাদ্দ। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। 

 

সারাদিন শুভ্র ভাই বের হলেন না রুম থেকে। সন্ধ্যার পর থেকে শব্দ ভাইও উধাও। তিনি যে কখন কোথায় চলে যায় বোঝা মুশকিল। এই বাড়িতে নিয়ম শৃঙ্খলা ভরপুর। কেউ কারো রুম থেকে বের হচ্ছে না৷ আমি শুভ্র ভাইয়ের রুমে উঁকি দিলাম। দেখি টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে নিচু হয়ে আছে। মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি আস্তে ধীরে রুমে প্রবেশ করলাম। শুভ্র ভাই কাঁদছে, একা একা বিরবির করছে। কি বলছে সেটা শোনার জন্য আরো একটু এগিয়ে গেলাম। তবে তার কথাগুলো ছিল এলোমেলো। শুভ্র ভাই বলছেন “আমি তোমাকে অন্য কারো সাথে দেখতে পারছি না, পারবো না। তুমি কি ওকে আসলেই ভালোবাসো? আমাকে কেন ভালোবাসলে না? আমি আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারিনা বলে? আমি মানুষটা এমন কেন? রোদ তুমি বুঝলে না, আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি পারবো না, আমি শব্দের থেকেও কেঁড়ে নিতে পারবো না। আমি কি করবো?” 

 

আমি ডাক দিলাম “শুভ্র ভাই?” শুভ্র ভাই হকচকিয়ে উঠে শার্টের হাতা দিয়ে চোখমুখ মুছে বললো “আরে রোদ কখন এলে? বসো, শব্দ কোথায়?” আমি মুখে হাসি টেনে বললাম “জানিনা উনি কোথায় গেছে। বসবো না, আপনার কিছু লাগবে কিনা দেখতে আসলাম। লাগবে আপনার কিছু?” শুভ্র ভাই মাথা নাড়িয়ে ইশারা দিলো লাগবে না। আমি ঘুরে বেরিয়ে যেতে বললো “রোদ তোমাকে একটা সত্যি বলি। এটা আর চেপে রাখতে পারলাম না। শব্দ আসলে সাধারণ কোনো মানুষ না। শব্দ হলো জ্বীন। সাধারণ জ্বীনও না, একটু বেশিই ভয়ানক জ্বীন।” আমি যেন আকাশ ভেঙে পড়লাম। শুভ্র ভাই যেমন মানুষ তাতে তিনি মজা কিংবা মিথ্যা কথা বলবেন না। তাহলে কি আসলেই জ্বীন শব্দ ভাই? 

 

আমি কিছু না বলে নিজের রুমে চলে আসলাম। স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। একটা জ্বীনের সাথে এতোদিন চলেছি আমি? বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারিনি কখনো। হুট করেই শব্দ ভাই হাজির হলেন। রুমে ঢুকেই আমাকে ডাক দিলেন। আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। শব্দ ভাই সামনে আসতেই আমি পিছিয়ে গেলাম।  শব্দ ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে রোদ? এমন করছো কেন?” আমি কাঁপা স্বরে বললাম “আপনি কে?” শব্দ ভাই দু হাত ছড়িয়ে বললো “এটা কেমন প্রশ্ন? আমি শব্দ!” আমি ভয়ে চিৎকার করে বললাম “না আপনি শব্দ নন, আপনি মানুষ নন। আপনি একজন জ্বীন। আপনি আমার সামনে আর কখনো আসবেন না। আপনি আমাকে এই সত্যিটা লুকিয়েছেন। আমি আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি অথচ আপনি এমনটা করলেন আমার সাথে। ঠকিয়েছেন আমাকে আপনি।” পরিস্থিতি বুঝে শব্দ ভাই আমার সামনেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি যেন ভয়ে আরো কুঁকড়ে গেলাম। ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে শুরু করলাম। হঠাৎ মনে হলো আমাকে কেউ একজন আস্তে ফুঁ দিচ্ছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। আমার কপালে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম। হাত দিয়ে জোরে জোরে কপালে ঘষা দিয়ে বললাম “শব্দ ভাই, আপনি? চলে যান এখনো এখানে কেন আপনি? আমার ভয় করছে, খুব ভয় করছে।” শব্দ ভাই দৃশ্যমান হয়ে আমাকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো “পাগলি আমি যেই হই, যেমনি হই। আমি কি তোমার ক্ষতি করবো? এটা তুমি বিশ্বাস করো?” 

 

চলবে?…

 

প্রচন্ড ঝামেলার মধ্যে আছি। আপনাদের তো আমার দিকটাও দেখতে হবে।

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ০৯

শব্দ ভাই দৃশ্যমান হয়ে আমাকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো “পাগলি আমি যেই হই, যেমনি হই। আমি কি তোমার ক্ষতি করবো? এটা তুমি বিশ্বাস করো?” 

 

দীর্ঘ ৫ দিন আমি শব্দ ভাইয়ের থেকে দূরে দূরে থাকলাম। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওই যে শব্দ ভাইয়ের সুযোগ একটাই, সে মানুষ না সে জ্বীন। কখন কোথায় থাকি কিভাবে যে হুট করে হাজির হয় কিছুই বুঝিনা। তবে আস্তে আস্তে আমার ভয় কেটে যেতে শুরু হলো। পুরো বিষয়টা আমার কাছে ইন্টারেসটিং লাগতে শুরু করলো। এই কয়েকদিন শুভ্র ভাই যতবার আমাকে দেখেছেন শুধু মাত্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। সন্ধ্যায় শব্দ ভাইকে খুঁজতে গিয়ে পেলাম না। বুঝতে পারলাম শব্দ মহাশয় তার গোপন কাজে ব্যস্ত। তিনি সন্ধ্যায় বাড়িতে থাকেন না। যখন আসবেন তখন সোজা আমার কাছেই যাবেন। তাই নিশ্চিন্তে রুমে বসে আছি। আমাকে সন্ধ্যার খাবার দিতে আসায় লতা খালাকে বললাম “খালা একটা সত্যি কথা বলবে?” লতা খালা পান খাওয়া লাল-কালো দাঁত বের করে বললো “হ বলেন মেডাম।” আমি জিজ্ঞেস করলাম “খালা শব্দ ভাই কি এই বাড়ির ছেলে?” লতা খালা হুট করেই মুখের ভাব পরিবর্তন করে বললো “আমি ঠিক জানিনা মেডাম। আমারে এগুলা জিজ্ঞেস করবেন না। খেয়ে নেন আমি আসি।” লতা খালার হুট করে এমন পরিবর্তনে আমি অবাক হলাম। পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবার মধ্যেই শব্দ ভাইয়ের মা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো আমার রুমে। চোখমুখ এক করে রাঙিয়ে বললো “এই যে নবাবজাদী, কোন নবাবের বেটি তুমি হ্যাঁ? আসছো ৭ দিন হলো, একটা বার একটা কাজ করেছো? তুমি এই বাড়ির কে? বসে বসে গিলছো শুধু আমার ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে। এই বাড়িতে কাজ ছাড়া খাবার জুটবে না বলে দিলাম। যাও নিচে যাও, গিয়ে রান্না করো। বাড়িতে মেহমান আসবে যাও।”

 

আমি পুরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। এই বাড়িতে আসার পর অন্তত হাজার বার আমি কাজ করতে চেয়েছি। কিন্তু শব্দ ভাই কোনো ভাবেই আমাকে কাজ করতে দেয়নি। আমি টুকটাক কাজ করতে গেলেও শব্দ ভাইয়ের বকা খেয়েছি। এই বিষয় নিয়ে না ভেবে দৌড়ে সোজা রান্নাঘরে গেলাম। 

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই শব্দ ভাই বাড়িতে ফিরলেন। আমাকে ডাকতে ডাকতে সোজা আমার রুমে গেলেন। কিন্তু আমাকে পেলেন না। শব্দ ভাই ভেবেছিল আমি বাড়িতেই নেই। তিনি দৌড়ে সোজা শুভ্র ভাইয়ের কাছে গেলেন। শুভ্র ভাই জানালেন আমি রান্নাঘরে রান্না করছি। আমাকে রান্না করতে দেখে শব্দ ভাই বেজায় চটে গেলেন। আমি আমতা আমতা করে বললাম “আসলে আন্টি একা পারছিলেন না তাই আমি একটু সাহায্য করলাম। আমি তো এগুলোতে অভ্যস্ত। আমার কষ্ট হবেনা আপনি যান না। আজকে তো মেহমান আসবে আপনি একটু দেখাশোনা করেন।” শব্দ ভাই কোমড়ে হাত ন্যাকামি করে মেয়েলি সুরে বললো “আমার কষ্ট হবেনা আপনি দেখাশোনা করেন।” পরে হুট করেই এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন “বাড়িতে এতো এতো কাজের লোক। তুমি আসার পরে আরো দুজন কাজের লোক বাড়িয়েছি। শুধুমাত্র তুমি রাজরানীর মতো থাকবে বলে। আর তুমি কিনা মেহমানের জন্য রান্না করছো?” আমি ঘুরে তাকিয়ে বললাম “আমাকে এভাবে রাজরানী বানাতে হবেনা। আমাকে আপনার মনের রানী বানালেই হবে।” বলেই জিভে কামড় দিয়ে দুহাত দিয়ে চোখমুখ ঢেকে ফেললাম। শব্দ ভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে দু হাত মাথায় দিয়ে বললো “ও মাই গড তুমি এই কথা বললে? তুমি এটা বললে রোদ? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।” বলেই দু হাত উঁচু করে মুখে মুখে গান গেয়ে নাচা শুরু করলো। 

 

নাচতে নাচতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে পড়লো। শুভ্র ভাই নিচে এসে বসে শব্দ ভাইয়ের কাঁধ চাপড়ে বললেন “কিরে নাচানাচি করছিস কেন?” শব্দ ভাই শুভ্র ভাইকে জেলাস করানোর জন্য বললো “ইয়ে মানে একটএ আধটু রোমাঞ্চ হলো তো সেই খুশিতে।” শুভ্র ভাই ফট করে আমার দিকে তাকালো। আমি দেখেও না দেখার ভং করে কাজ করার বৃথা চেষ্টা করছি। এই লোকটা এতো ঠোঁটকা-টা কেন? একটু রোমাঞ্চ করেছে সেটাও সবার সামনে গিয়ে ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে?

 

শব্দ ভাইয়ের জন্মদিন আজ, সেই জন্যই এতো আয়োজন। তবে শুভ্র ভাই কিংবা শব্দ ভাই নিজেও আমাকে বলে নি। এই শেষ মুহুর্তে শব্দ ভাইয়াকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য বিশেষ কিছু করা সম্ভব না। তাই আজকে সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে শব্দ ভাইকে বলবো আমি তাকে ভালোবাসি। খুশি খুশি মনে সব কাজ শেষ করে অনুষ্ঠানের মধ্যে যেতেই শব্দ ভাইয়ের মা আমার হাত টেনে ধরলো। আমাকে কড়া ভাবে বললো “আমার ইচ্ছে ছিল আমার বোনের মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে হবে। বিয়েটা তোমার জন্য ভেঙে গেছে। আজ আমার পছন্দ করা পাত্রীর সাথে শব্দের আংটিবদল। আশা করছি তুমি সবার সামনে যাবে না। শব্দকে আমি যেভাবেই হোক রাজি করাবো।” আমি মুখে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললান “ঠিক আছে আমি রুমে যাচ্ছি। একদম বের হবোনা আমি, দরজা আঁটকে বসে থাকবে। আয়োজন শেষ হলে আমাকে বলবেন।” বলেই উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটার শক্তি পাচ্ছি না আমি। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে এখনি পড়ে যাবো। এখানে থাকলে শব্দ ভাই ঠিক ঝামেলা করবে। বিয়েতে রাজি হবে না। তাই নিচতলার লতা খালার রুমের জানালা থেকে বের হয়ে অজানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। 

 

রাত প্রায় ১ টা, আমি অনুভূতি শুন্য হয়ে হাঁটছি। আজ কোনো ভয় লাগছে না। ওইদিকের কি খবর আমি জানিনা। হয়তো আন্টি সত্যি সত্যিই শব্দ ভাইকে রাজি করিয়েছেন। শব্দ ভাই হয়তো তার মায়ের কথা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আমাকে কি উনি খুঁজেছে একবারও? জানিনা কিছু আমি, মাথা ভারি হয়ে আছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই মনে হলো আমি জ্ঞান হারাচ্ছি। অন্ধকারে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। 

 

চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম আকাশী রঙের ছাঁদ। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম বদ্ধ একটা ঘর। আগে কখনো আসিনি আমি এখানে। গতকাল অন্ধকারে খালি পায়ে হাঁটার জন্য পায়ে কাটা ফুটেছে। জ্বালা করছে প্রচুর। সেদিকে অবশ্য খেয়াল না দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আসলে আমি কোথায় আছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ। দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ করলাম। কারো কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম “কেউ আছেন? কেউ দরজাটা খুলবেন? কে আঁটকে রেখেছেন আমাকে? শব্দ ভাই আপনি এনেছেন? দরজাটা খুলে দিন না। আর কখনো না বলে বের হবোনা। আমার পানি পিপাসা পেয়েছে একটু পানি দিন না।”

 

কিন্তু এবারও কোনো আওয়াজ পেলাম না। এবার আমার সত্যি ভয় হতে লাগলো। কোথায় এসে ফেঁসে গেলাম আমি। নাহ্ যারাই আঁটকে রাখুক। ভেতরের লুকিয়ে রাখা সেই ভয়ংকর খুনী রোদকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তবে এরা যদি মানুষ না হয়? আচ্ছা শব্দ ভাই তো বলেছিল ওরা আমাকে খুঁজছে। শব্দ ভাই তো জ্বীন, তাহলে এরাও কি জ্বীন? এরাই কি তাহলে আমাকে আঁটকে রেখেছে? আমি কি কখনো মুক্তি পাবো না? আমার বাবা কি তাহলে সত্যিই এদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল? কিন্তু কেন? বাবা আমার সাথে কেন এটা করলো?

 

চলবে?….

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ১০

শব্দ ভাই তো জ্বীন, তাহলে এরাও কি জ্বীন? এরাই কি তাহলে আমাকে আঁটকে রেখেছে? আমি কি কখনো মুক্তি পাবো না? আমার বাবা কি তাহলে সত্যিই এদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল? কিন্তু কেন? বাবা আমার সাথে কেন এটা করলো?

 

অন্যদিকে শব্দ ভাই অনুষ্ঠানে আমাকে দেখতে না পেয়ে লতা খালাকে জিজ্ঞেস করলো। তবে খালা কিছু জানাতে পারলো না। আংটিবদলের কথা শব্দ ভাই জানতেন না। অনুষ্ঠানের মাঝে শব্দ ভাইয়ের মা আংটিবদলের কথা ঘোষনা করতে শব্দ ভাই রেগে গেলেন। তবে এতো এতো মানুষের মধ্যে প্রথমে কিছুই বললেন না। কিন্তু পরবর্তীতে শব্দ ভাই আন্টিকে বুঝাতে না পারার কারনে  লোকজনের সামনেই রাগারাগি শুরু করে দিলেন। এক পর্যায়ে মেহমানদের বাড়ি থেকে বের করে আমাকে খুঁজতে লাগলেন। পুরো বাড়ি খুঁজেও যখন আমাকে পেলেন না তখন বাইরে খোঁজা শুরু করলেন। কিন্তু শব্দ ভাই ব্যর্থ। 

 

শেষে বাসায় ফিরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো “আমি হেরে গেছি রোদ, আমি তোমাকে খুঁজে পেলাম না। আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। কেউ রোদকে এনে দেও প্লিজ। আমি রোদকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি মরে যাবো রোদকে ছাড়া। কেউ রোদকে এনে দেও। রোদ তুমি কোথায়?”

 

শব্দ ভাই শুভ্র ভাইয়ের কাছে গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। শুভ্র ভাই জানালেন তিনি কিছুই জানেন না। তবে তার ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে না যে সে কিছু জানেনা। তাই শব্দ ভাই খুব সাবধানে শুভ্র ভাইয়ের উপরেই নজর রাখছে। শব্দ ভাই জ্বীন হওয়াতে সুবিধা হয়েছে বেশি। তিনি সারাদিন অদৃশ্য হয়ে শুভ্র ভাইয়ের আশেপাশে থাকছে। শুভ্র ভাই অবশ্য মাঝে মাঝে অনুভব করতে পারছে। 

 

আমি প্রায় তিনদিন এখানে বন্দী। খাবারের সময় টেবিলে খাবার চলে আসে আপনাআপনি। খেতে মন চাইছে না। আমি কখনোই বন্দী জীবন যাপন করিনি। মাথায় শুধুমাত্র প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। শব্দ ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। বিয়েটা করে ফেলেছে কিনা জানিনা। আচ্ছা শব্দ ভাই তো জ্বীন। আমাকে খুঁজে বের করা তো কোনো অস্বাভাবিক ব্যপার না তার কাছে। কেন আসলো না? বিয়ে করে কি আমাকে ভুলে গেলো? কেন আসলো না আমাকে নিতে? এ নিয়ে অবশ্য খুব অভিযোগ জমা হলো শব্দ ভাইয়ের প্রতি। 

 

রাতের খাবার টেবিলে দৃশ্যমান হওয়ার সাথে সাথেই আমি উঠে গিয়ে আন্দাজে খপ করে হাত ধরে ফেললাম কারো। কেউ হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি খুব জোরেই হাতটা ধরে চিৎকার করে বললাম “কে আপনি? দেখা দিন, আমাকে এখানে আঁটকে রেখেছেন কেন? কে আপনি?” কারো ফুপিয়ে কাঁদার শব্দ পেলাম। আমি তাও হাতটা ছাড়লাম না। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাতটা ধরে রাখলাম। কিছুক্ষণ পর লোকটা দৃশ্যমান হতে লাগলো। কিন্তু একি? শুভ্র ভাই? 

 

আমার সামনে অপরাধী ভঙ্গিতে বসে আছে শুভ্র ভাই। কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার। শুভ্র ভাইও কোনো কথা বলছে না। কিছুক্ষন পরে আমি নিজেই প্রশ্ন করলাম “কেন শুভ্র ভাই?” শুভ্র ভাই ছোট্ট করে উত্তর দিলেন “তোমাকে আমি চাই রোদ।” আমি মুচকি হেঁসে বললাম “আপনিও জ্বীন?” শুভ্র ভাই মাথা নাড়লেন। আমি নির্ভয়ে বললাম “আমি শব্দ ভাইয়ের কাছে যেতে চাই।” শুভ্র ভাই আহত চোখে আমার দিকে তাকালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “বেশ, চলো তাহলে।” 

 

পায়ের কাটা জায়গায় ঘা হয়ে আছে। হাঁটতে পারছি না। শুভ্র ভাই বুঝতে পেরে বললেন “আমি কোলে নেই?” আমি হালকা হেঁসে বললাম “এতোটা উপকার করতে হবেনা শুভ্র ভাই। আপনি শব্দ ভাইয়ের কাছে আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন এটাই অনেক। আমি পারবো চলুন।”

 

শুভ্র ভাই এগিয়ে চললো। কেমন এজ অদ্ভুত জায়গা। কাঠের বাড়িতে সিড়ি দিয়ে নামতেই ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হলো। আমাকে শুভ্র ভাই বললো “এই বাড়িটায় আমি আর শব্দ ৪ বছর পর্যন্ত ছিলাম। বলতে পারো এটা আমাদেরই বাড়ি।” আমি অবাক হয়ে পুরো বাড়িটা দেখলাম। প্রশ্ন করলাম “তাহলে এখন যেই বাড়িতে থাকেন সেটা?” শুভ্র ভাই বললেন “এনারা আমাদের বাবা মা না। আমরা আসলে জানিনা আমাদের বাবা মা কে। তখন এই জায়গাটা সুন্দর ছিল। যতদূর মনে পড়ে শব্দ এবং আমার পরিবার এখানে ঘুরতে এসে আমাদের পায়। ছোট বাচ্চা ছিলাম, বাবা মাকে না দেখতে পেয়ে কাঁদছিলাম। তাই আমাদের নিয়ে গেলো। দুজনকে দুই পরিবার নিয়ে নিলো। কিন্তু আমি কিংবা  শব্দ কেউ কারো ফ্যামিলিতে খুশি ছিলাম না। তাই একটু বড় হতেই আমি শব্দের বাসায় এবং শব্দ আমার বাসায় থাকলাম। কিন্তু কেউ এখনো জানেনা আমরা কে। শুধু জানে আমরা তাদের ছেলে নই।”

 

আমি প্রশ্ন করলাম “আপনি আর শব্দ ভাই কি দুজনে আপন ভাই?” শুভ্র ভাই নিচু স্বরে বললো “আমি আসলে জানিনা, ছোটবেলার কথা কিছু মনে নেই। বাবা মা থাকলে জানতে পারতাম।” আমার মন খারাপ হলো। এনাদের বাবা মা নেই, কতো আফসোস করে। আর আমার মা ছিলেন..যাহোক সে কথা নাহয় বাদই দিলাম। 

 

মধ্যরাতের দিকে আমরা বাসায় পৌঁছে গেলাম। দরজা খুলে আমাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে একপ্রকার ঝাপিয়ে পরে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো শব্দ ভাই। কতক্ষণ এমন ছিল খেয়াল নেই। একসময় নিজেই ছেড়ে বাহুডোরে রেখে জিজ্ঞেস করলো “ঠিক আছো তুমি? কোথায় ছিলে তুমি? আমাকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?” আমি শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের দৃষ্টি নিচু হয়ে গেলো। শব্দ ভাই অবশ্য সেটা লক্ষ্য করলো। আমি বললাম “আমি জানিনা কোথায় ছিলাম। শুভ্র ভাই আমাকে বের করে এনেছে।” শব্দ ভাই চোখ বড় বড় করে বললো “কিহ্? তার মানে কেউ তোমাকে আঁটকে রেখেছিল? আমার থেকে আমার রোদকে কেড়ে নিতে চেয়েছে? আমি ওর হাত কেটে ফেলবো।” আমি ভয়ে ভয়ে বললাম “থাক না শব্দ ভাই, আপনি এটা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করবেন না। আমি যে ফিরতে পেরেছি এটাই অনেক। চলুন ভেতরে যাই। শুভ্র ভাই আপনি তো খুব ক্লান্ত, খাবার দিবো খাবেন?” শুভ্র ভাই মাথা নাড়িয়ে না জবাব দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। 

 

আমি খুঁড়িয়ে হাটা শুরু করলাম। আমাকে খোঁড়াতে দেখে শব্দ ভাই হুট করেই আমাকে কোলে নিলেন। আমি নামার জন্য অস্থির হতেই শব্দ ভাই বললেন “চুপ থাকো, আমার ঘরওয়ালীকে আমি কোলে নিয়েছি তোমার কি?” আমি অবাক হয়ে বললাম “ঘরওয়ালী?” শব্দ ভাই লজ্জা পেয়ে বললো “হবু ঘরওয়ালী।” 

 

শব্দ ভাইয়ের সামনে এবার আমি অপরাধী ভঙ্গিতে বসে আছি। গম্ভীর হয়ে কয়েকটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললো “কেন চলে গিয়েছিলে রোদ?” আমি জবাব দিলাম না। এবার শব্দ ভাইয়ের ধমক শুনে বললাম “আসলে শুনলাম আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি থাকলে তো ঝামেলা করতেন। তাই চলে গেছি।” শব্দ ভাই দাঁত বের করে বললো “তুমি হয়তো ভুলে গেছো রোদ আমি জ্বীন। আমার কাছে খবর আসে। শুধুমাত্র তুমি কোথায় ছিলে সেটাই জানতে পারিনি কেন যেন। হয়তো এমন কেউ ছিল যার আমার মতোই সমান শক্তি। যাহোক ড্রেস চেঞ্জ করো আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

 

আমি কিছু বলার আগেই শব্দ ভাই অদৃশ্য হয়ে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে এলো। নিজের হাতে খাবার মেখে আমাকে খাওয়ানো শুরু করলো। 

বাবার কথা মনে পড়লো। নির্ভয়ে শব্দ ভাইকে বললাম “আমি বাবাকে মারতে চাইনি শব্দ ভাই।” শব্দ ভাই পানি এগিয়ে দিয়ে বললো “রোদ আমি জানি তুমি আমার পরিচয় জেনে গেছো। আরো অনেক কিছুই আছে যেগুলো তুমি জানো না। তোমার মায়ের পরকীয়া ছিল ঠিকই, তোমার বাবার অন্য একজন বউও আছে। যিনি মানুষ না, আমাদের মতোই। তাকে বিয়ে করার শর্ত ছিল তোমাকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। তোমার বাবা মহিলার রুপে এতোটাই মগ্ন ছিল যে সে কিছু না ভেবেই তোমাকে দিতে রাজি হয়ে গেলো। বিনিময়ে অবশ্য বিপুল পরিমানে টাকা পয়সাও নিয়েছে এবং কাগজে স্বাক্ষর করে তোমাকে বিক্রি করে দিলো। এবার তুমি বলো, তোমার কি এখনো আফসোস হচ্ছে তোমার বাবাকে মারা নিয়ে? আমাকে বিশ্বাস করো তো?”

 

আমার চোখ থেকে পানি পরতে শুরু করলো। আমার বাবাও আমাকে ঠকিয়ে গেলো। আজ বিন্দুমাত্র অনুশোচনা আমার হচ্ছে না। যা করেছি ঠিক করেছি। কিন্তু শব্দ ভাই এতোকিছু জানলো কিভাবে? শব্দ ভাই আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বললো “মহিলাকে আমি চিনি, ওদের পুরো বংশকেই আমি চিনি। আমি কখনো চাইনি তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক। তাই তোমার কাছে আরো অনেক আগে গিয়েছিলাম। একটা শ্যামলা মায়াবতী মেয়ে উঠোনে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে। ব্যাস আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ আঁটকে গেলো সেখানেই। তারপর একবার দুবার করে রোজ দেখতে লাগলাম তারপর একদম নিয়েই এসেছি।”

 

আমি অবাক হয়ে শুধু শুনছি। খাওয়া শেষে আমি বললাম “এবার আপনি যান আমি চেঞ্জ করবো।” শব্দ ভাই আয়েশ করে শুয়ে বললো “আমার সামনেই চেঞ্জ করো।” আমি চোখ বড় বড় করে বললাম “শব্দ ভাই যান না, এখানে চেঞ্জ করার আর কোনো রুম নেই।” শব্দ ভাই তার হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে বললো “নেও এবার চেঞ্জ করো।” আমি নাক ফুলিয়ে বললাম “শব্দ ভাই আপনাকে আমার এই দিক থেকে একদম বিশ্বাস নেই। আপনি যাবেন?” শব্দ ভাই নিরুপায় হয়ে বললো “যাচ্ছি, তবে অদৃশ্য হয়ে যদি এখানে চলে আসি তাহলে কি করবে?” আমি এবার রেগেমেগে বললাম “আমি চেঞ্জই করবো না। এই ময়লা কাপড় নিয়েই থাকবো।” শব্দ ভাই জিভে কামড় দিয়ে বাইরে দৌড় লাগালেন। আমি সত্যি সত্যিই শব্দ ভাইয়ের কথা বিশ্বাস করে চেঞ্জ করলাম না। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেলাম। 

 

শব্দ ভাই গেলেন সোজা শুভ্র ভাইয়ের কাছে। শুভ্র ভাইকে বললেন “কাজটা ঠিক করলি না শুভ্র। রোদকে আমি কতো আগে থেকে ভালোবাসি জানিস? আর তুই? মাত্র দুদিন? রোদকে আঁটকে রেখে দিলি?” 

 

চলবে?…

 

আমার গল্পের গ্রুপে সবাই জয়েন করো– গল্পসায়র Story by Mst Moni

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব স্পেশাল বোনাস

শব্দ ভাই গেলেন সোজা শুভ্র ভাইয়ের কাছে। শুভ্র ভাইকে বললেন “কাজটা ঠিক করলি না শুভ্র। রোদকে আমি কতো আগে থেকে ভালোবাসি জানিস? আর তুই? মাত্র দুদিন? রোদকে আঁটকে রেখে দিলি?” 

 

শুভ্র ভাই কিছুই বললেন না। শুভ্র ভাইকে চুপ থাকতে দেখে শব্দ ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। খুব সকালে বাড়িতে লোকজনের কথার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো আমার। চোখ খুলেই দেখি শব্দ ভাই হাতে হলুদ শাড়ী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পিটপিট করে তাকিয়ে বললাম “শব্দ ভাই? এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমাকে ডাকলেন না কেন?” শব্দ ভাই ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “ঘুমন্ত চেহারা দেখতে মন চাইছিলো। তাই আর ডাকিনি। এখন ওঠো এই শাড়ীটা পড়ে নেও। তারপর নিচে আসো।” শব্দ ভাইয়ের হাতে হলুদ শাড়ী দেখে আমার কলিজা কেঁপে উঠলো। তাহলে কি শব্দ ভাইয়ের বিয়ে আজ? গায়ে হলুদের জন্যই আমাকে শাড়ী পড়তে বলেছে? আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম “শব্দ ভাই আজ আপনার বিয়ে?” শব্দ ভাই লজ্জা পেয়ে বললো “হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি নিচে চলে আসো কেমন? আর আমাকে না বলে যদি আরেকবার বের হও তাহলে বুঝাবো আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ কি জিনিস।” আমি হাত বাড়িয়ে শাড়ীটা হাতে নিয়ে বললাম “আপনি যান আমি আসছি।”

 

শব্দ ভাই চলে গেলেন। ছেলেদের তালবাহানা বোঝা যায়না সহজে। এই তো কাল অব্দিও বললেন আমাকে ভালো বাসেন। আর আজ বিয়ে করছেন উনি। হলুদের শাড়ীতে হাত বুলিয়ে শাড়ীটা পড়ে নিচে আসলাম। এসে দেখি শুভ্র ভাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কি জানেন শব্দ ভাইয়ের কার সাথে বিয়ে হচ্ছে?” শুভ্র ভাই পুতুলের মতো মাথা নাড়িয়ে না ইশারা করলো। আমি অবশ্য ভেতরে কষ্ট রেখেও চওড়া হাসি দিয়ে রেখেছি। 

 

কিছুক্ষণ পরেই একদল মহিলা এসে শব্দ ভাইকে নিয়ে গেলেন। শব্দ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে হলুদ মাখতে চলে গেলো। আমি আমার দৃষ্টি নিচু করে ফেললাম। আর একবারের জন্যও শব্দ ভাইয়ের দিকে তাকাইনি। হলুদ মাখা শেষ হলেই আমি সোজা নিজের রুমে চলে গেলাম। শব্দ ভাই আমাকে ডাকতে ডাকতে ভেতরে প্রবেশ করলো। শব্দ ভাইকে দেখে আপনা আপনি আমার চোখ থেকে পানি পড়ে গেলো। শব্দ ভাই নিজের গাল থেকে কিছুটা হলুদ নিয়ে আমার গালে লাগিয়ে দিয়ে বললো “আমার রোদকে তো দারুন লাগছে হলুদে। কাঁদছো কেন? বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে?” কই শব্দ ভাই তো বললেন উনি সবার মনের কথা একটু হলেও বোঝেন। তাহলে কি আমার মনের কথা বুঝলেন না? কেন আমি কাঁদছি সেটা কি বুঝেও না বুঝার ভং ধরে বিয়ে করছে আবার? আমার অবশ্য অভিমান হলো। তবে একটু নয়, এক আকাশ পরিমানই। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য একজনের হতে দেখা মানে নিজেই নিজের কলিজায় করাত চালিয়ে দেয়া। কিন্তু মেয়েটা কে? কাকে বিয়ে করছে শব্দ ভাই? 

 

সন্ধ্যা নাগাদ সমস্ত আয়োজন শুরু করে শব্দ ভাইয়ের বোনের কাছে সাদা একটা গাউন পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে। বোনু কড়া করে বললো “এটা ভাই পড়তে বলেছে তোমাকে। না পড়লে তো বুঝোই কি করতে পারেন উনি। তাড়াতাড়ি এসো দু মিনিটের মধ্যে।” আমি ফের বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামাটা পড়ে নিলাম। আমার জামা পড়া শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শব্দ ভাই হাজির হলেন। আমি ভয় পেয়ে বুকে থু থু দিয়ে বললাম “কখন কোথায় চলে আসেন আপনি।” শব্দ ভাই আমার থুঁতনি ধরে ভ্রু যুগল বাঁকা করে বললো “আমি তোমাকে সাজাবো রোদ। শেষবারের মতো এভাবে তোমাকে দেখে আমি নিজেই সাজাতে চাই।” আমার চোখ থেকে টপ করে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। 

 

শব্দ ভাই আমাকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিলেন। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি শব্দ ভাইয়ের দিকে। মনে হচ্ছে এটাই বুঝি শেষ দেখা। আমাকে সাজানোর মাঝেই দরজায় সজোরে আঘাত করলো কেউ। আমি ভীত চোখে দরজার দিকে তাকালাম। শব্দ ভাই আমাকে অভয় দিয়ে নিজেই দরজা খুললো। দরজার ওপাশে ইমা দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ছে ইমা। শব্দ ভাই পাত্তা দিলেন না। হাসিমুখে বললেন “আরে ইমা, বিয়ে খেতে চলে এসেছিস?চল আয়!” ইমা সোজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার দিকে। পরমুহূর্তেই মুখ বাকিয়ে চলে গেলো নিচে।  

 

শব্দ ভাই আমাকে ইশারা দিয়ে নিচে যেতে বলে নিজেই চলে গেলেন। ইচ্ছে করছে সব কিছু ভেঙে গুড়িয়ে দেই। আরো কুড়ি বিশেক খুন করে ফেলি। তারপরেও শব্দ ভাইকে আমার চাই মানে চাই। কিন্তু কোনো সুযোগ নেই। আমি একজন ভাসমান মেয়ে। শব্দ ভাইয়ের পরিবার কখনোই মেনে নিবেন না। তাদের কষ্ট দিয়ে তাদের ছেলেকে নিয়ে সংসার করতে আমি পারবো না। যেখানে শব্দ ভাই নিজেই বিয়ে করছেন সেখানে আমি পাগলামি করবো কিভাবে?

 

আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম বিয়ের আসরে। সবার দৃষ্টি আমার দিকে আঁটকে আছে। আমি ইতস্ততবোধ করে শব্দ ভাইয়ের পাশে গিয়েই বসলাম। শব্দ ভাই আমাকে ইশারা করলেন স্টেজের উপরে উঠে বসার। কিছু না ভেবেই রোবটের মতো স্টেজে উঠে বসলাম আমি। কিছুটা দূরেই শুভ্র ভাই চোখমুখ লাল করে বসে আছে। চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে কিছুটা। 

 

কিছুক্ষন পরে কাজী সাহেব আমার পাশে বসে কবুল বলতে বললেন। আমি অন্যমনস্ক হয়ে বউকে খুঁজছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছিনা। শব্দ ভাই আমাকে খোঁচা দিয়ে বললো “কি খুঁজো? কবুল বলো।” আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। শব্দ ভাই ভ্রু কুঁচকে বললো “কবুল না বললে বিয়ে হবেনা তো পাগলী।”এতোক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম আসলে কাহিনী কি হচ্ছে। আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে শব্দ ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। শব্দ ভাই আমার কানে কানে বললো ” সবাই আছে, শরম করছে না তোমার? সবার সামনে জড়িয়ে ধরে আছো। এখনো কতো কি হওয়ার বাকি আছে। এখন ছাড়ো বউ।”

 

আমি লজ্জা পেয়ে ছেড়ে দিয়ে এক নিশ্বাসে তিনবার কবুল বলে ফেললাম। কি যে খুশি লাগছে বলে বোঝানো যাবে না। নিজের মনের মানুষটাকে পেয়ে গেলে বোধহয় এতোটাই খুশি লাগে। মনে হচ্ছে দুদিন খুশিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। শব্দ ভাইয়ের কবুল বলার সাথে সাথে আমি ইমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে দিয়ে ফিক করে হেঁসে দিলাম। তবে শুভ্র ভাইকে কোথাও দেখতে পেলাম না। 

 

চলবে?….

 

গতকাল গল্প দেইনি তাই আজ বোনাস পর্ব দিলাম। রাতে আরো এক পর্ব দেয়া হবে।

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ১১

শব্দ ভাইয়ের কবুল বলার সাথে সাথে আমি ইমার দিকে তাকিয়ে চোখ মে রে দিয়ে ফিক করে হেঁসে দিলাম। তবে শুভ্র ভাইকে কোথাও দেখতে পেলাম না। 

 

সমস্ত আয়োজন শেষে আমাকে বিরাট এক ঘরে নেওয়া হলো। পুরো রুম সাদা বিভিন্ন নাম না জানা ফুলে আবৃত। আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম। বুঝতে পারলাম এটা শব্দ ভাইয়ের রুম।  এই রুমে আমি আগে কখনোই আসিনি। দেয়ালের এক পাশে বড় করে পুরো দেয়াল জুড়ে আমার একটা ছবি টাঙানো আছে। আমি খানিকটা লজ্জা পেলাম। শব্দ ভাইয়ের ভয়ে বাকি হাসি মজা কিছুই করেননি কেউ। আমাকে আর শব্দ ভাইকে ঘরে বসিয়ে সবাই চলে গেলো। শব্দ ভাই ইতস্তত করে বললো “রোদ তুমি একটু বসবে? আমার কিছু কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে প্লিজ। আমি এখনি আসবো, তুমি রাগ করোনা।” আমি শব্দ ভাইয়ের গালে হাত দিয়ে বললাম “আপনি নিশ্চিন্তে যান। এখন আপনি একান্তই আমার, আর কোনো ভয় নেই। সাবধানে যাবেন, আর তাড়াতাড়ি ফিরবেন।” শব্দ ভাই খুশি হয়ে আমার কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলো। 

 

আমি রুম থেকে বের হয়ে পাশে থাকা শুভ্র ভাইয়ের রুমে গেলাম। শুভ্র ভাই কাঁদছে, অনবরত কেঁদেই চলেছে। কিছুক্ষণ পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। আমি তাকে নিরবে ডাক দিলাম “শুভ্র ভাই!” শুভ্র ভাই মাথা তুলে আমাকে বিয়ের সাজে দেখে আরো ইমোশনাল হয়ে গেলো। আমি মুখ বাকিয়ে হেঁসে বললাম “আপনাকে একটা সিক্রেট বলবো শুনবেন? তবে কাউকে বলতে পারবেন না, কথা দিন।” শুভ্র ভাই চোখমুখ মুছে বললো “কি বলবে? আমি এমন নই যে একজনের কথা অন্য জনকে বলবো। আশা করি বুঝতে পেরেছো।”

 

আমি চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা তুলে বসে বললাম “আসলে শুভ্র ভাই, আপনাকে বিয়ে করলে আমার তেমন কোনো লাভ হতোনা। কিন্তু শব্দ ভাইকে বিয়ে করলে আমার লাভটা ১৬ আনাই হতো। তাই আর কি বিয়েটা করে ফেলেছি।” শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললো “কিসের লাভ?” আমি হেঁসে বললাম “আপনি নিতান্তই একজন ভোলা ভালা ইমোশনাল ব্যক্তি। আমার কাজে শব্দ ভাইয়ের মতো একজন রাগী শক্তপোক্ত ব্যক্তিকে প্রয়োজন।” শুভ্র ভাই বেশ আঁটসাঁট হয়ে বসে বললো “মানে?” আমি বাঁকা হেসে বললাম “বাকিটা পরে  বলবো, আমার খেলার একটা গুটি হলো শব্দ ভাই।” বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বের হতে গিয়ে পিছে তাকিয়ে বললাম “তবে এটা সত্যি আমি শব্দ ভাইকে ভালোবাসি। শুধুমাত্র আমার কাজ হাসিলের জন্য তাকেও দরকার। এমনও হতে পারে আমার কাজটা শব্দ ভাই নিজেও করে দিতে পারেন।”

 

প্রায় মধ্যরাতে শব্দ ভাই ফিরলেন। আমও খাটের সাথে হেলান দিয়ে হালকা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে না জাগিয়ে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে। হালকা ঘুম থাকার কারনে অল্পতেই জেগে গেলাম আমি। ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকাতেই দেখি শব্দ ভাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মিষ্টি হাসি দিয়ে বললাম “আপনার কাজ শেষ শব্দ ভাই?” শব্দ ভাই ভ্রু নাচিয়ে বললো “এখনো শব্দ ভাই বলবে? আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে রোদ। এখন অন্তত শব্দ বলে ডাকো।” আমি খিলখিল করে হেসে বললাম “নাহ্, আমি শব্দ ভাই’ই বলবো৷” শব্দ ভাই আড়মোড়া ভেঙে বললেন “তোমার সাথে তর্ক করা বৃথা। তাই কথা বাড়ালাম না। প্রায় অর্ধেক রাত হয়ে গেলো, অথচ অর্ধেক রোমাঞ্চও হলো না।” 

 

কি পড়বেন হুম? বাকিটা আমি বলুম না আমার শরম করে। 

 

পরের দিন সকালে বাড়িতে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনে শব্দ ভাই দৌড়ে বের হলেন বাইরে। আমি তখন ড্রেস চেঞ্জ করছি। তাড়াতাড়ি বের হয়ে রুম থেকে বের হতে যাবো এমন সময় শব্দ ভাই রুমে এসে বললেন “রোদ তুমি একদম বাইরে হবেনা। আমার কথামতো একটুও না। সোনা বউ আমার, আমার কথাটা শোনো। বাইরে আক্রমণ হয়েছে, তুমি বের হবেনা এখান থেকে। আমার সন্দেহ ওরা তোমাকে নিতেই এসেছে। তোমার বিয়ের খবর শুনে ওরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।” আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই শব্দ ভাই দ্রুত নিচে নেমে গেলেন। সাথে সাথে শুভ্র ভাইও নিচে গেলেন। শুভ্র ভাই বাড়ির সবাইকে আলাদা একটা রুমে নিয়ে বন্ধ করে দিলো। 

 

এতো এতো কালো ছায়া আর ভয়ানক জন্তুর সাথে এই দুজন পারবে কিনা আমার সন্দেহ হচ্ছে। তবে নাহ্, খুব সহজেই দুজনেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে শব্দ ভাই এবং শুভ্র ভাই দুজনকেই আঁটকে ফেললো ওরা। শুভ্র ভাই আমাকে ডাক দিতেই শব্দ ভাই বললেন “শুভ্র রোদকে ডাকিস না, ওরা রোদকে নিয়ে যাবে শুভ্র।” কিন্তু শুভ্র ভাই শুনলেন না। আমাকে ফের ডাক দিতেই আমার খেয়াল হলো ওনাদের বাঁচাতে হবে। আমি দৌড়ে উপর থেকে নেমে ঝড়ের গতিতে শব্দ ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে বললাম “চলে যাও এখান থেকে, চলে যাও বলছি। কোন সাহসে এখানে এসেছো তোমরা? আর একটা আঘাত করলে এর ফলাফল ভালো হবেনা। শব্দ ভাই এবং শুভ্র ভাইকে ছেড়ে দেও বলছি।” সাথে সাথে সবাই আমার সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বললো “যা হুকুম মহারানী।” সাথে সাথে বাড়ির বিভিন্ন দরজা জানালা থেকে সবগুলো জ্বীন বের হয়ে গেলো। আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাকে মহারানী বলার বিষয়টা এবং আমার কথায় জ্বীনগুলো চলে যাওয়ার বিষয়টা শব্দ ভাই না খেয়াল করলেও শুভ্র ভাই ঠিক খেয়াল করলেন। শব্দ ভাই তখন আমাকে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছেন। 

 

শব্দ ভাই বাসা থেকে বের হওয়ার পরে শুভ্র ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন “তো মহারানী, আপনাকে এসব জ্বীনেরা মহারানী কেন ডাকছে? আপনার কথা কেনই বা শুনছে?” আমি আমতা আমতা করে বললাম “কই কখন বললো শুভ্র ভাই? আপনিও না কিযে বলেন!” শুভ্র ভাই আমাকে বললেন “আমি ভোলা ভালা বলেই ব্যপারটা খেয়াল করতে পেরেছি। তোমার শক্তপোক্ত বর কিন্তু পারেনি।” আমি হাতে হাত ঘষে বললাম “কি জানেন শুভ্র ভাই, টক্করটা এবার আমার সাথে আপনার হচ্ছে। তবে আপনার সাথে টক্কর কেন নিতে যাবো বলুন তো?  আসলে একটা ঘটনা রয়েছে, আপনাকে বলি শুনুন। জ্বীনদের মধ্যে যারা খারাপ, যারা শয়তানের পূজা করে এদের একটা মুকুট উপহার দেয়া হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল প্রচুর শক্তি। এটা তারা পূজা করে অর্জন করেছিল। তখন এই মুকুটের জন্য প্রয়োজন ছিল একটা নবজাতক শিশু। তাই এদিক ওদিক না খুঁজে আমার বাবা যেহেতু ওদের সাথেই ছিলেন তাই আমাকেই বাছাই করা হয়েছিল। আমি তখন একদম নবজাতক শিশু। আমার হাতে মুকুট দেয়ার পর ওই মুকুট আর অন্য কেউ হাতে নিতে পারেনি। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আমি বড় হলেই ওই মুকুট আমি নিজে দিয়ে আসবো তাদের। আমার বাবা কথাও দিয়েছিলেন। তবে সেই সুযোগ আর তিনি পাননি। এসব কথা অবশ্য আমি ডায়েরি থেকে জেনেছিলাম। মুকুট এখনো আমার কাছেই আছে। তাই মুকুটের সমস্ত শক্তি আমার। রানীর মুকুট আমার কাছে আছে মানে আমিই রানী। তাই আমাকেই ওরা নিতে আসে, আমার থেকে মুকুট নিতে আসে। চাইলে আমিই ওদের আদেশ করে আমার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারি। তবে এখনকার যিনি এই রাজ্যটা পরিচালনা করছেন তিনি সেটা হতে দিবেন না। সব মিলিয়ে আমার পরিবার শেষ করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই এই পথে পা বাড়িয়েছি আমি।”

 

শুভ্র ভাই কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন “তাহলে শব্দকে কিভাবে টার্গেট করলে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “বাবার সাথে শব্দ ভাইয়ের কথা বলতে দেখেছি আমি। তো শব্দ ভাইকে ছাড়া কাউকেই চিনতাম না। তাই শব্দ ভাইয়ের সাথেই যোগাযোগ করার চেষ্টা। কিন্তু বুঝতে পারিনি এই চক্করে ভালোবেসে ফেলবো। তবে আপনি ক্ষমা করবেন আমাকে। আপনার ভালোবাসার মূল্য দিতেই পারিনি আমি। ” শুভ্র ভাই মাথার চুল গুলো ঠিক করে বললেন “তাহলে এই পুরো গল্পের ভিলেন তুমি?” আমি হো হো করে হেঁসে জবাব দিলাম “বলতে পারেন এটাই!”

 

চলবে?…

 

সবাই বেশি বেশি কমেন্ট করেন, আইডি রিচ কমে গেছে 🥺

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ১২

শুভ্র ভাই মাথার চুল গুলো ঠিক করে বললেন “তাহলে এই পুরো গল্পের ভিলেন তুমি?” আমি হো হো করে হেঁসে জবাব দিলাম “বলতে পারেন এটাই!”

 

তবে আমার এই খুশি বেশিক্ষণ টিকলো না। একপ্রকার আমার আর শব্দ ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা পাকানোর জন্যই শুভ্র ভাই পুরো বিষয়টার সাথে আরো মসলা দিয়ে শব্দ ভাইয়ের সামনে তুলে ধরলো। শব্দ ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে নিরবে জিজ্ঞেস করলো পুরো বিষয়টা। পাশে অবশ্য শুভ্র ভাইও ছিলেন। আমি শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকাতেই শুভ্র ভাইয়ের দৃষ্টি নিচু হয়ে গেলো। আমি তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম “এমন কাজ করেন কেন যে চোখে চোখ রাখতেই পারেন না?” আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে শব্দ ভাই বললেন “তোমাকে যা জিজ্ঞেস করছি সেটার উত্তর দেও। শুভ্রকে বকাবকি করবে না।” প্রতুত্তরে আমার চোখ রাঙানি খেয়ে চুপসে গেলো শব্দ ভাই। যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে আবারও জিজ্ঞেস করলেন তিনি। আমার সাবলীল উত্তর “যা শুনেছেন ঠিক শুনেছেন।” শব্দ ভাই কাঁপা গলায় বললো “আমি তোমার মুখ থেকে সমস্ত বিষয়টা শুনতে চাই রোদ।” আমি প্রস্তুত হয়ে বললাম “বেশ তাহলে শুনেন! আপনি আমাকে বলেছিলেন না? আমার বাবা একজন জ্বীন মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন? তার রুপে মুগ্ধ হয়ে আমাকেও বিক্রি করে দিয়েছিলেন তার কাছে? কিসের জন্য বিক্রি করেছিলেন তাতো আপনি জানতেন না। পুরো কাহিনির মধ্যে মুল বিষয়টা হচ্ছে একটা মুকুট। আপনি হয়তো জানেন জ্বীনদের মধ্যে ভাগ আছে। খারাপ জ্বীন, ভালো জ্বীন আরো অনেক অনেক পদের জ্বীন আছে। আপনারা দুজন, আপনি এবং শুভ্র ভাই দুজনেই ভালো জ্বীনদের বংশধর। তবে আমার বাবা যেই নারীর প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি ছিলেন তৎকালীন খারাপ জ্বীনদের রানী। শোনা যায় আমার বাবা সেই জ্বীন মহিলাকে বিয়েও করেছিলেন আমার জন্মের আগেই। তখন তিনি জ্বীনদের রাজ্যেই বসবাস শুরু করেন ওই মহিলার সাথে। তারা শয়তানের পূজারী ছিলেন। শয়তান তাদের উপর খুশি হয়ে একটি মুকুট উপহার দেয়। যেই মুকুটে ছিল প্রচুর শক্তি। যার কাছে এই মুকুট থাকবে সে খারাপ জ্বীনদের রানী হওয়ার যোগ্যতা রাখবে। তবে শর্ত ছিল এই মুকুটটা একজন নবজাতক শিশু, যে হবে একজন মানুষ তার হাতে শয়তান নিজেই তুলে দিবেন। এবং ওই শিশু যদি ইচ্ছে করে খারাপ জ্বীনদের মুকুটটা না দেয় তাহলে খারাপ জ্বীনরা মুকুটটা ছিনিয়ে নিতে পারবেনা। শিশুটার বয়স কেবলমাত্র ১৮ বছর হলেই মুকুটটা সে খারাপ জ্বীনদের দিতে পারবে। তখন জন্ম নিলাম আমি। খবরটা আমার বাবা এবং ওই জ্বীন মহিলার কানে যাওয়ার পর আমাকেই ব্যবহার করলেন তারা। আমার হাতে মুকুটটা দেওয়া হলো। আমার ১৮ বছর হওয়ার অপেক্ষা চললো। বাবা তখন বাসায় যেতেন না। আমার মা লোকমুখে এই কথা শুনে ভেঙে পড়লেন। তখন সঙ্গ দিলেন আমার ছোট কাকা। চললো তাদেরও পরকীয়া প্রেম কাহিনী। এমন পরিবেশে বড় হতে হতে বিষিয়ে উঠেছিল আমার জীবন। অতঃপর আমার পরিবারের সবাইকে আমি নিজের হাতে মেরে দিলাম। এই কথাগুলো আমি মা এবং ছোট কাকাকে মারার পরে চিঠি লিখতে গিয়ে বাবার গোপন ডায়েরিতে পেয়েছিলাম। মুকুটটা একমাত্র আমার কাছেই আছে। তাই সমস্ত খারাপ জ্বীনেরা মুকুটের প্রতি সম্মান দেখাতে আমাকেই মহারানী হিসেবে সম্মান করে। ১৭ বছর হতেই আমাকে আমার বাবা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বিপুল পরিমানে টাকাও নিয়েছিলেন এর মূল্যে। আপনাকে বেশ কয়েকবার বাবার সাথে কথা বলতে দেখেছি। আপনি বললেন না আমি উঠোনে খেলা করছিলাম সেদিন আপনি আমাকে দেখেছিলেন? সেদিন আমিও আপনাকে দেখেছি। চোখের সামনে অদৃশ্য হতে দেখেছি৷ তারপর একদিন দুদিন করে বেশ কয়েকদিন দেখেছি। বুঝেছিলাম আপনি সাধারণ মানুষ নন। ওই মহিলার কাছে পৌঁছানোর জন্য আমার আপনাকে দরকার ছিল। খুব সহজেই পেয়ে গেলাম আপনাকে। চলতে লাগলো আমার নিরব অভিনয়। আপনি এটা বুঝলেন না শব্দ ভাই একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মেয়ে যে তার পরিবারের সবাইকে খুন করতে দুবার ভাবেনি সে কিভাবে হুট করে এতোটা অসহায়, এতোটা ভীতু হয়ে গেল? আপনি তো সব জানতেন বলেন, তাও বুঝলেন না? ভালোবেসে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তাইনা? আপনাকেও ভালোবেসে ফেলেছিলাম আমি। তাই এই কাজে আপনাকে ঠকিয়ে আপনাকে ব্যবহার করতে চাইনি। চেয়েছিলাম শুভ্র ভাইকে ব্যবহার করতে। কিন্তু তিনি তো নিজেই আমাকে ভালোবেসে ইমোশনাল হয়ে দেবদাসের মতো পড়ে আছেন।” 

 

শব্দ ভাই ইমোশনাল হয়ে গেলেন, আস্তে ধীরে জিজ্ঞেস করলো “তার মানে তুমি শুধু আমাকে ব্যবহার করেছিলে রোদ? অথচ আমি তোমাকে ভালোবেসে অন্ধের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি এই সমস্ত কথা শুভ্রকে বলতে পেরেছো। আমাকে বললে না, কেন বলো তো? আমার থেকে শুভ্র আপন তোমার?” আমি দাঁড়িয়ে বললাম “বিষয়টা আপন পরের নয় শব্দ ভাই। আমি আর পারছিলাম না। আপনাদের দুজনের সাহায্য আমার দরকার। আমি চেয়েছি আপনারা জানুন সবটা। নাহলে আমি কখনো বলতাম এগুলো? আমি জানতাম আমাদের দুজনের মধ্যে প্যাঁচ লাগানোর জন্য শুভ্র ভাই আপনার কাছে এগুলো বলবেন। আপনাকে এগুলো কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার কাজটা শুভ্র ভাই সহজ করে দিয়েছে একদম। ধন্যবাদ শুভ্র ভাই!” 

 

আমাদের সামনে শব্দ ভাই আর কিছু বললেন না, সোজা রুমে চলে গেলেন। বুঝতে পারলাম অভিমান করেছে আমার উপর। আমিও তার পেছন পেছন গিয়ে শব্দ ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। আস্তে ফিসফিস করে বললাম “দুঃখিত শব্দ ভাই, রাগ করেন কেন? পরিবারের জন্য এছাড়া আর কোনো পথ ছিল আমার বলুন?” আমার হাত ছাড়িয়ে শব্দ ভাই বললেন “তোমার এই পথের জন্য আমি তোমাকে কিছু বলছিনা রোদ। আমি কি তোমাকে সাহায্য করতাম না? ভালো যখন বেসেছি, তো তোমার কাজে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব। কিন্তু তুমি আমাকে ঠকালে। একজন ভালো জ্বীনের বংশধরের সাথে খারাপ জ্বীনদের রানীর কিভাবে বিয়ে হতে পারে?” আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম “আপনি এই কথা বলছেন শব্দ ভাই? আমি মানুষ হয়ে আপনি জ্বীন জেনেও আপনাকে মেনে নিতে পেরেছি। আর আপনি আমার রানী হওয়ার বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন? আর আমিই যে রানী হয়ে থাকবো সেটা আপনাকে কে বললো?” শব্দ ভাই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো “তুমি তো রাজি হয়েছিলে তোমার স্বার্থের জন্য। নাহলে আমাকে কেন বিয়ে করতে রাজি হবে তুমি বলো?” আমি এবার তেলেবেগুনে জ্বলে বললাম “আপনি আগে ছিলেন অন্ধ, এখন হয়েছেন বুদ্ধু। আমার কাজ আমি একাই করতে পারতাম। আমি জানতাম আমার কাছে মুকুট নেওয়ার জন্য ওরা নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু আপনাকে ভালোবেসেই তো আমি বিয়েটা করেছি। এতে কোনো স্বার্থ ছিল না। আমি মানুষ হয়েও আপনি আমার জ্বীনবর হবেন সেটা ভেবেই আপ্লুত হয়েছিলাম আমি।”

 

শব্দ ভাই চুপসে গিয়ে বললো “হয়েছে এবার আমাকে আবার একটু জড়িয়ে ধরো শক্ত করে। এতো রাগ অভিমান নিয়ে তো আমি থাকতে পারিনা। আমি তোমার পাশে আছি রোদ। তবে একটা শর্ত আমাকে আর ভাই কিংবা আপনি বলে ডাকবা না। এখন থেকে শব্দ এবং তুমি করেই বলবে। নাহলে আমাদের ভবিষ্যতের বাচ্চাকাচ্চাও আমাকে বাবা না বলে ডাকবে ‘তব্দ ভাই” আমি বললাম “তব্দ ভাই?” শব্দ ভাই মাথা নাড়িয়ে হো হো করে হেসে ফেললো। 

 

চলবে?…

 

রাতে আরো এক পর্ব দেওয়া হবে তাই এই পর্ব ছোট করে দেওয়া হলো। আপনারা গল্প বোঝেন নি মানলাম। গল্পে টুইস্ট এসেছে, টুইস্ট তো আমাকে ক্লিয়ার করার সুযোগ দিতে হবে তাইনা? আমি তো এক পর্বে টুইস্ট এনে এক পর্বেই ক্লিয়ার করতে পারিনা। গল্প একঘেয়েমি ভাবে কতদূর টানা যায়? গল্পে টুইস্ট আসবে, ক্লিয়ার হবে তবেই না গল্প হবে। আগের পর্ব না বোঝার কারনেই এই পর্ব বাড়তি লিখতে হয়েছে আমাকে। এবার আশা করি বুঝতে পেরেছেন সবাই। না বুঝলে বলবেন আরো এক পর্ব যোগ করা হবে বুঝানোর জন্য। 

 

বিঃদ্রঃ যারা ডিরেক্ট ১০ এর পরে পর্ব ১১ পড়েছেন তারা কিছুই বুঝবেন না। মাঝে স্পেশাল বোনাস পর্ব দেয়া হয়েছিল সেটা পড়ে নিবেন সবাই। রিচেক না করার কারনে পর্ব ১১ এর শেষের দিকে শব্দের জায়গায় কয়েকবার শুভ্র ব্যবহার করা হয়েছে। সেই জন্য দুঃখিত আমি।

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ১৩

আমাদের ভবিষ্যতের বাচ্চাকাচ্চাও আমাকে বাবা না বলে ডাকবে ‘তব্দ ভাই” আমি বললাম “তব্দ ভাই?” শব্দ ভাই মাথা নাড়িয়ে হো হো করে হেসে ফেললো।

 

ঝামেলা বিহীন দু’দিন কেটে যাওয়ার পরে একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি বাইরে বের হলাম। আমাদের বাড়িরই বাগানে। তবে সন্ধ্যায় বের হওয়াটা ছিল সবথেকে বড় ভুল। পুরো বাগান কালো হয়ে জ্বীনদের আসতে দেখা গেলো। উদ্দেশ্য আমাকে নিয়ে যাওয়া। বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এই কাহিনীর শেষ তো আমাকে করতেই হবে। শেষ করার জন্য এদের সাথে মোকাবিলা করাটা আমার জন্য দরকার। কিন্তু আমি একা এদের সাথে কখনোই পারবো না। দরকার শব্দ ভাই কে। যিনি এই মুহুর্তে কোথায় আছে আমি সেটাও জানিনা। শব্দ ভাই কিংবা শুভ্র ভাইকে বলার সুযোগ আমাকে দেওয়া হলো না। সাথে অবশ্য আমার ননদ ছিল। তিনি গিয়ে শুভ্র ভাইকেই খবর দিলেন। তবে শুভ্র ভাই আসতে আসতে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। শুভ্র এসে আমার নাগাল পেলেন না। 

 

মুখে পানির ঝাঁপটা পেয়ে আমার জ্ঞান ফিরলো। পিটপিট করে তাকাতেই সামনে সারিতে সারিতে বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন বিভৎস চেহারার জ্বীনদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম 

পাশেই মাথা উচু করে বসে আছেন এক সুন্দরী নারী। দেখেই বুঝতে পারলাম ইনিই সেই নারী। চোখের মাঝে প্রতিশোধের আগুন ধপ করে জ্বলে উঠলো।  বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে আবার খুললাম। মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে বললাম “আমাকে এখানে নিয়ে আসার কারন?”মহিলাটি একই ভাবে বসে উত্তর দিলেন ” তুমি হয়তো জানোনা তোমাকে তোমার বাবা বিক্রি করে দিয়েছিলেন আমার কাছে।” তার কথা বলা শেষ করার আগেই আমি হাত উঁচু করে বললাম “থাক সেসব পুরোনো পুথি এখন গাইতে হবেনা। সবটাই আমি জানি। আর দয়া করে ওই লোকটাকে আমার বাবা বলবেন না। লোকটা কেবলমাত্র আপনার দাস ছিল, শুধুমাত্র দাস।” মহিলাটি কথা না বাড়িয়ে আমাকে বললো “তোমাকে জোর করছিনা, আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে তুমি মুকুটটা ফিরিয়ে দেও।” একটা  তাচ্ছিল্যমূলক হাসি দিয়ে বললাম “যদি না দেই?” মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে বললো “চ্যালেঞ্জ নিচ্ছো?” আমি দুহাতের তালু ঘষে বললাম “ধরে নিন সেটাই।” মহিলাটি ফের আমাকে বললেন “তুমি জানো এর পরিনাম কি হবে? আমার কাছে কতো সামন্ত তুমি জানো? তুমি একজন স্বাধারন মানুষ। পুঁচকে একটা মেয়ে। আর এরা? এরা সবাই জ্বীন। এদের বয়স জানো? কারো কারো বয়স ৫০০ বছরেরও বেশি। আমার কাছে কতো ভয়ানক জন্তু আছে তুমি জানো? তোমার কাছে কি আছে?”

 

আমি গগন ফাটিয়ে হো হো করে হেঁসে বললাম “আমার কাছে মুকুট আছে। যেটা নেওয়ার জন্য বিন্দুমাত্র জোর করতে পারবেন না আমাকে। আমার কাছে আমার একজন জ্বীনবর আছে। সে যদি জানে আপনারা তার রোদকে ধরে এনেছেন, এসব জ্বীনগুলো একশত একসাথে শেষ হবে। আমার কাছে সাপোর্ট করার জন্য শুভ্র ভাইয়ের মতো একজন বন্ধু আছে। যিনি আপনাদের প্রত্যেকের প্রতিটি পশমের সাথে হিসেব করে আঘাত করবে।”

 

আজ দুদিন হলো আমাকে আঁটকে রাখা হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে সম্মান আমি পাচ্ছি। এখানে ঘুরছি ফিরছি, খাচ্ছি। শুধুমাত্র বের হতে পারছিনা। ঘুরতে ঘুরতে সেই খোলা মাঠে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে শব্দ ভাই আর আমার দেখা হয়েছিল রাতে। আমার আশেপাশে অবশ্য বেশ কিছু কালো ছায়াকে উড়তে দেখা গেলো। আমি জানি শব্দ ভাই সত্যিই আসবে। বুঝতে পারলাম শব্দ ভাই প্রথমে আমাকে এদিকটায়ই আসতে বারন করেছিল। বলেছিল এই রাস্তাটা ভালো না। 

 

শরীরে ছোট একটা পাথরের টুকরোর আঘাত পেতেই কেউ একজন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আমার এখান থেকে শুধুমাত্র ছাই রঙের চাদরের টুকরো দেখা গেলো। বুঝতে পারলাম শব্দ ভাই এসেছেন। মাথার উপরে উড়তে থাকা পাহারাদার জ্বীনদের বললাম “শোনো আমার প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে। এখনি গিয়ে ঠান্ডা শরবত আনবে। আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি।” মজার বিষয় হলো, একজনকে বলার সাথে সাথে সবাই ছুটলো শরবত আনার জন্য। সবার একটাই লক্ষ্য, আমাকে সন্তুষ্ট করা। 

 

ঝোপের আড়ালে উঁকি দিয়ে বললাম “শব্দ ভাই, এই শব্দ ভাই আপনি এসেছেন?” শব্দ ভাই মুখ দিয়ে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে বললো “ওহ-হো রোদ, কতোবার বলেছি শব্দ ভাই ডাকবে না।” আমি মৃদু ধমক দিয়ে বললাম “এখন এতো রংঢং করার সময় নেই। শুনুন, আপনি সোজা আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঘরের পেছনেই আমার মা এবং কাকাকে পুতে রাখা হয়েছে। তার সামনেই একটা কৃঞ্চচূড়া গাছ। গাছের নিচেই মুকুটটি আছে। আপনি মুকুট নিয়ে এখানে ঢুকলে কেউ কিছু করতে পারবে না। শুভ্র ভাই কোথায়?” শব্দ ভাই হাত জাগিয়ে গাছের আড়ালে দেখিয়ে বললো “আছে থোঁতামুখ ভোতা করে ওইখানে দাঁড়িয়ে আছে। বেচারা তোমাকে দুদিন ধরে না পেয়ে পাগলা পাগলা হয়ে গেছে। আমি তো প্রথমেই জানতাম তুমি এখানে। আচ্ছা আমি যাচ্ছি, উম্মাহহহহ্” আমার কপালে চুমু দিয়ে ঝোপের আড়ালে চলে গেলো শব্দ ভাই। ইতিমধ্যেই জ্বীনেরা শরবত নিয়ে হাজির হলো। বললাম “আমার এখন খেতে মন চাইছে না, নিয়ে যাও।”

 

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই হৈচৈ শুনে খুশি খুশি মনে বাইরে বের হলাম। শব্দকে কেউ স্পর্শও করছে না। এখানে আমি অসন্তুষ্ট হয়ে যাই সেই জন্য। শব্দ ভাই সোজা হেঁটে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমার মাথায় মুকুটটি পড়িয়ে দিয়ে শব্দ ভাই আমার এক পাশে দাঁড়ালো। শুভ্র ভাইকে দেখা গেলো মুখ কাচুমাচু করে আমার অন্যপাশে এসে দাঁড়ালো। জ্বীন মহিলাটি শেষ বারের মতো আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি মুকুটটি তাদের হাতে দিবো কিনা। আমি রাজি হলাম না। শেষে মহিলাটি আমাকে ধরার আদেশ দিলেন। 

 

আমার সামনেই শব্দ ভাই দাঁড়িয়ে নিজের মাথার চুল ঠিক করে বললো “রোদের গায়ে একটা স্পর্শ লাগবে, আমি এক স্পর্শের জন্য একশত জনকে মারবো।” তবুও কোনো এক পাপী বান্দা এসে আমার হাতে স্পর্শ করলো। অমনি বেরিয়ে এলো শব্দ ভাইয়ের আসল চেহারা। কি ভয়ানক, বিভৎস চেহারা। এতো সুন্দর একটা ছেলের পেছনে এমন একটা চেহারা লুকিয়ে ছিল আমি সেটা বুঝতেই পারিনি। 

 

শব্দ ভাই এবং শুভ্র ভাই দুজনেই দুদিকে লড়াই করছে। আমার পাশে এসে মহিলাটি বললেন “লড়াই দেখেছো? মনে তো হচ্ছে না তুমি জিতবে? না জেতা টা-ই স্বাভাবিক। তোমার একা একজন জ্বীনবর তোমাকে বাঁচাবে? তুমি মুকুটটা আমাকে দেও, নাহলে তোমার জ্বীনবরের খেল খতম করে দিবো।” আমি মুচকি হেঁসে বললাম “উনি যেহেতু আমাকে বাঁচাতেই এসেছেন, আপনি কি ভেবেছেন আমি তাকে বাঁচাবো না? আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমার কাছে মুকুটটা আছে। তাই আমার কাছে কিন্তু শক্তিও আছে। তবে শয়তানের শক্তি আমি ব্যবহার করতে চাইনা। দরকার পড়লে কিন্তু নিশ্চয়ই করবো। সাবধান কেমন?”

 

চলবে?….

 

গল্প জ্বীনবর

লেখিকা Mst Moni

পর্ব ১৪ (শেষ)

“আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমার কাছে মুকুটটা আছে। তাই আমার কাছে কিন্তু শক্তিও আছে। তবে শয়তানের শক্তি আমি ব্যবহার করতে চাইনা। দরকার পড়লে কিন্তু নিশ্চয়ই করবো। সাবধান কেমন?”

 

আমার কথার তেজ দেখে পাশেই খাবারের প্লেট থেকে একটা কাঁটাচামচ উঠিয়ে সোজা আমার কণ্ঠনালী বরাবর ধরলেন। খপ করে হাতটা ধরে বললাম “উহুম, একাজ ভুলেও করবেন না। এসব কাজে আমার হাত কিন্তু অনেক পাকা।” মহিলাটি রেগে অন্য হাত দিয়ে ম্যাজিকের মতো আলোর রশ্মি ছুড়ে মারতেই শব্দ ভাই দ্রুত এসে রশ্মিটাকে নিজের হাতের রশ্মি দিয়ে থামিয়ে বললো “রোদকে প্রটেক্ট করার জন্য তার জ্বীনবরই যথেষ্ট। মনে রাখবেন খারাপ শক্তির পতন কিন্তু ভালো শক্তির হাতেই হয়।” 

 

কিছুক্ষন পরেই দেখা গেলো প্রতিটি জ্বীন জন্তুর আকার ধারন করছে। সেরকম যেরকমটা আমি এর আগেও একবার দেখেছি। এবারের লড়াইটা হয়ে গেলো একটু বেশিই ভয়ানক। আমাকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে আমার থুতনি ধরে শব্দ ভাই বললেন “রোদ দেখো আমরা জানি ভালোর জয় হয়। তবে ভালো যখন দূর্বল হয়ে পড়ে। অপর পক্ষ যখন বেশি শক্তিশালী হয় তখন কিছু করার থাকেনা। এদের শয়তান প্রদত্ত ক্ষমতা আছে। জানিনা কি হবে, আমি আর শুভ্র একা। যাই হয়ে যাক না কেন তুমি এখান থেকে নড়বেনা। যদি আমাদের কিছু হয়ে যায় সোজা পালিয়ে যাবে যেখানে ইচ্ছে সেখানে। সবার থেকে দূরে কেমন?” বলে আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে এগিয়ে গেলেন লড়াইয়ে। তবে শব্দ ভাইয়ের খেয়াল ছিল একমাত্র আমার দিকে। কোনো জন্তু এগিয়ে আসতে চাইলেই শব্দ ভাই এসে সেটাকে মেরে ফেলছে৷ 

 

এক পর্যায়ে মহিলাটি আমার পাশে এসে বললেন “তুমি জানো এই দুজনের বাবা মা আমার কাছে বন্দী আছে? এই মুকুটটি অর্জনের পথে বেশি ভালোমানুষি দেখিয়ে ফেলেছিলেন তারা। তাই রেখে দিয়েছি বন্দী করে। এই মুকুট আমার সারাজীবনের কষ্টের ফল। আমি পৃথিবী শাসন করতে পারবো এই মুকুট দিয়ে। তুমি যদি এদের থামতে না বলো তাহলে এদের বাবা মাকে আমি এখনি মেরে দিবো।” আমি ভয়ানক ভাবে চমকে তাকালাম। কি বলছেন ইনি? শব্দ ভাইয়ের বাবা মা বেঁচে আছেন? কিন্তু এর মতো বুদ্ধু আমি একটাও দেখিনি৷ নিজের দূর্বলতার কথা নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন। 

 

মুখে চওড়া হাসি দিয়ে শব্দ ভাইকে ডাক দিলাম “ওগো শুনছোওওও” শব্দ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো “কিরে শুভ্র আমাকে ডাকছে নাকি রে?” শুভ্র ভাই ফোঁস করে উঠে বললো “জামাই তুই, এভাবে কি আমাকে ডাকবে? সর এখান থেকে কাজ করতে দে, কাজের সময়ও এদের রোমাঞ্চ।” শব্দ ভাই লড়াইয়ের মাঝেই বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বললো “হায়েএএ বউ এভাবে ডেকো না, আমি জ্ঞান হারাবো।” আমি চোখ গরম করে বললাম “রাখুন আপনার দুষ্ট মিষ্টি কথা। এদিকে আসুন তাড়াতাড়ি।” শব্দ ভাই এক ছুটে আমার কাছে এসে বললেন “বলো কি বলবে?” আমি জোরে নিশ্বাস নিয়ে বললাম “আমার শশুর শাশুড়ী মানে আপনার আর শুভ্র ভাইয়ের বাবা মা বেঁচে আছেন। আর এখানেই আছেন।” শব্দ ভাই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। আমি ফের বললাম “আরে হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? এই মহিলা বলেছেন তো।”

 

শব্দ ভাই বিষয়টা বুঝতে পারলেন। বিরবির করে বললেন “সারাজীবন শুনেছি সুন্দরীদের মাথায় বুদ্ধি কম থাকে। আজ তার প্রমান পেলাম। ভাগ্যির আমার বউ শ্যামলা।” আমি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললাম “কি বললেন আপনি? আমি সুন্দরী নই? এই মহিলা সুন্দরী?” শব্দ ভাই হাত দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরে হাতে মুকুটটা নিয়ে বললেন “মিস খারাপ মহিলা, আমার বাবা মা’কে আনুন। নাহলে আমি মুকুট আমি এখনি ভেঙে ফেলবো।”

 

মহিলাটি কিঞ্চিৎ ভয় পেলেন। হন্তদন্ত হয়ে আদেশ করলেন শব্দ ভাইয়ের বাবা মা’কে এখানে আনার। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে আমি যেই ছেলেটাকে ভোলাভালা ভেবেছি সেই ছেলেটাই এখন একা হাতে পুরো লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে। 

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনকে ধরে বেঁধে আনা হলো। কি সুন্দর অপরুপ এদের চেহারা। একদম শব্দ এবং শুভ্র ভাইয়ের মতোই। তবে এতোদিনের নির্যাতনে যেন খানিকটা নুইয়ে গেছে। শব্দ ভাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু মনে পড়ছে কিনা বুঝতে পারছিনা। আমি এগিয়ে শব্দ ভাইয়ের মা’কে ধরতেই তিনি হকচকিয়ে গেলেন। ভরসা দিলাম, বললাম “ভয় পাবেন না, আমরা আপনাদের নিয়ে যেতে এসেছি। আপনার ছেলেরাও আছে।” শব্দ ভাইকে ইশারা করলাম, শব্দ ভাই শুভ্র ভাইকে ডাক দিলো “ভাই দেখে যা বাবা-মা!” এই প্রথম শব্দ ভাই শুভ্র ভাইকে ভাই বলে সম্বোধন করেছে। এর আগে সব সময় দুজন দুজনকে নাম ধরেই ডাকতো। 

 

শুভ্র এদিকে তাকাতেই প্রচন্ড জোরে আঘাত পড়লো তার মাথায়। হুমড়ি খেয়ে পড়লো মেঝেতে। শব্দ ভাই দৌড়ে ধরার আগেই একটা মেয়ে চলে আসলো শুভ্র ভাইয়ের পাশে। শুভ্র ভাইকে এক হাত দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে বাহুডোরে রেখে অন্য হাত উঁচু করে জোরে ঘোষণা দিলেন “ব্যাস অনেক হয়েছে। আমি ভবিষ্যৎ রানী এবং তোমাদের বর্তমান মহারানী রোদ তোমাদের আদেশ করছে তোমরা এখনি এই মুহুর্তে প্রস্থান করো। তোমরা আজ থেকে মুক্ত। নিজেরা নিজেদের মতো কারো অনিষ্ট না করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করো।” 

 

সাথে সাথে সব জ্বীনেরা মাথা নত করে প্রস্থান করলো। ইতিমধ্যেই শব্দ ভাই গিয়ে শুভ্র ভাইকে ধরলেন। মেয়েটি শব্দ ভাইয়ের হাতে শুভ্র ভাইকে দিয়ে গেলেন জ্বীন মহিলাটির কাছে। ছলছল চোখে বললো “এখান থেকে চলে যাও মা। নাহলে তুমি মরবে। মুকুট তোমার কখনোই হবেনা। আমি হতে দিবোনা। চলে যাও, তোমাকে ক্ষমা করা হলো।” মহিলাটি সবার দিকে তাকিয়ে মেয়েটির মুখে হাত বুলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। 

 

মেয়েটি চোখ মুছে বললো “আমি মিষ্টি, ইনি আমার মা। তবে আমি এদের মতো নই।চলুন আপনাদের পৌঁছে দেই।” 

শব্দ ভাইয়ের বাবা মা আপাতত কথা বলার অবস্থায় নেই। তাদের যে খুঁজে পাবো সেটাও বুঝিনি। সোজা শব্দ ভাইয়ের বাড়িতেই গেলাম আমরা সবাই। 

 

গিয়ে দেখি আগে থেকে দুই পরিবারের লোকজনই উপস্থিত। শশুর শাশুড়ীকে বসিয়ে দুই পরিবারের সবার কাছেই আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম। তবে ইমা বিষয়টা সহ্য করলো না। তার কথা হলো সে কেন শব্দ ভাইকে পেলো না। আমার জন্যই এতো কিছু হয়েছে। আমি ইমার কানে কানে গিয়ে বললাম “এতো যে শব্দ শব্দ করছো, শব্দ যে জ্বীন তুমি জানো? একটা জ্বীনের সাথে ঘর করতে পারবে সারাজীবন?” ইমা ভয় পেলো। 

 

অবশেষে পুরো সত্যিটা সবার সামনে প্রকাশ করা হলো। আমার জন্য শুভ্র ভাই এবং ইমার মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছিল। শুভ্র ভাই ইমাকে বুকে নিয়ে বললো “সরি বনু, যদিও আমার কোনো রাইট নেই তোকে মারার। তবুও… পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল তো। আর তোরও ভুল ছিল। আমরা তো চলে যাচ্ছি, ভাইকে ভুলে যাবিনা বল?” ইমা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। শুভ্র ভাই কিংবা শব্দ ভাইয়ের যাওয়ার বিষয়টা কেউই মেনে নিতে পারছে না। তবে যেতে হবেই!! 

 

এর মধ্যেই মিষ্টি নামের মেয়েটা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো “আমার একটা প্রস্তাব আছে। রোদ আমার তো যাওয়ার যায়গা বা পরিবার নেই এখন। আপনারা সবাই রাজি থাকলে আমি শুভ্র ভাইকে বিয়ে করে এখানেই থেকে যেতাম। যদিও আগে থেকে আমার শব্দকে পছন্দ ছিল।” আমি চোখ বড় করে শব্দ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শব্দ ভাই এক হাতে কানে ধরে জিভে কামড় দিয়ে বললো “আমি কিছু করিনি বউ।” সবাই সমস্বরে হেঁসে উঠলো। 

 

তবে শুভ্র ভাই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে বিয়ে সে করবে না। তার এমন দেবদাস থাকতেই ভালো লাগে। অবশেষে আমার এবং সবার অনুরোধে বিয়েটা করতে সে রাজি হলো। 

 

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে গেলাম সেই পুরোনো বাড়িতে যেখানে আমাকে শুভ্র ভাই আঁটকে রেখেছিলেন। বাড়িটা পুনরায় মেরামতও করা হয়েছে। ঘরোয়া পরিবেশে শুভ্র ভাই এবং মিষ্টির বিয়েটাও হয়ে গেছে। শব্দ এবং শুভ্র ভাই সারাদিন এখন বাবা মায়ের সাথে সাথে থাকেন। এতো বছরের কাছে না পাওয়ার দুঃখটা আস্তে আস্তে ঘুচে যাচ্ছে। 

 

কয়েকবছর পর—–

 

-রোদ এই রোদ, শব্দ কোথায়? 

-তব্দ ভাই তো বাইলে গেছে চাচু। 

-এই পুঁচকে, শব্দ তোর তব্দ ভাই হয়? 

-হ্যাঁ তো, মা তো দাকে তব্দ ভাই। 

-বাপ হয় তোর, বল বাবা

-না তব্দ ভাই আমাল। 

 

শুভ্র ভাই এবং আমার ছেলের ছেলের কথার মাঝেই আমি চলে আসলাম। আমাকে দেখে শুভ্র ভাই ফের জিজ্ঞেস করলো “শব্দ কোথায় রোদ?” আমার হাতের খুন্তি নাড়িয়ে বললাম “দেবরজি ভাবি বলো আমাকে।” শুভ্র ভাই ফোঁস করে উঠে বললেন “তোমার ছেলে বাপকে বাপ না ডেকে তব্দ ভাই ডাকে সেটা ঠিক করতে পারছো না। আবার আমাকে ভাবি ডাকতে বলছো?” বলেই মুখ বাকিয়ে চলে গেলো। আমি আমার ছেলের কানটা ধরে বললাম “তুই আবার তোর বাবাকে তব্দ ভাই ডাকছিস? আজ আসুক তোর বাবা।” আমার কথা শেষ না হতেই শব্দ ভাইয়ের দেখা মিললো। আমাকে ডেকে বললো “কি রোদ বাবা এসে কি করবে? আজ আবার কি করেছে? কি ইয়ং ম্যান, কি দুষ্টুমি করেছো আবার?” 

 

ছেলে মুখ ফুলিয়ে বললো “দেকো পাপা, মাম্মাম তোমাকে তব্দ ভাই দাকে। আমি দাকলাম তাই আমাতেও বতা দেয়।” বলেই দিলো ভো দৌড়। আমি শাড়ির আঁচল গুজে বললাম “যেমন বাপ তার তেমন ছেলে।” আমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মুখের সামনে মুক এনে বললো “আমার ছেলে? তোমার ছেলে নয়?” আমি ইতস্তত করে বললাম “না, ছাড়ুন কেউ আসবে। আর আপনার পাকা ছেলে আসলে আরো গোলমাল হয়ে যাবে।” শব্দ ভাই একই ভঙ্গিতে বললো “আসুক, ছেলেও তো বিয়ে করে রোমাঞ্চ করবে। শিখতে হবে তো ছেলেকেও। তুমি শব্দ ভাই ডাকো, তোমার ছেলেও ডাকে। তোমার ছেলে তোমার মতোই।” আমি মৃদু ধমক দিয়ে বললাম “চুপ থাকুন, ছেলে শিখবে। অশ্লীল বাপ কোথাকার। সরুন কেউ আসবে এখনি, এটাকে রুম পেয়েছেন?” শব্দ ভাই আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো “আমার বউ আমি রোমাঞ্চ করছি তাতে কার কি?”

 

পাশেই শুভ্র ভাই হেঁটে গিয়ে বললো “আমার সামনেই তোদের রোমাঞ্চ করতে হয় কেন বুঝিনা আমি। সর যা, রুমে যা।” শব্দ ভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা চুলকে রুমে চলে গেলো। আমি দৌড় দিলাম রান্নাঘরে। রান্নাঘরে গিয়ে মিষ্টিকে বললাম শুভ্র ভাই ডাকে। এবার না হয় শুভ্র ভাইকেও রোমাঞ্চ করার সুযোগ করে দিলাম। 

আপনারা কি দেখছেন? বাসায় চলে যান, গল্প শেষ। এতো রোমাঞ্চ দেখা লাগবেনা।

 

—————-সমাপ্ত—————– 

জ্বীন বর ( দ্বিতীয় খন্ড )

গল্পটা বড় করার ইচ্ছে ছিল আরো। কিন্তু গল্প শুরু করার পরেই সব ঝামেলা শুরু। আগামীকাল থেকে নতুন গল্প দেওয়া হবে। আশা করি ভালো লাগবে আপনাদের।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।