- জ্বীন বর ( দ্বিতীয় খন্ড )
- পর্ব ০১
- পর্ব ০২
- পর্ব ০৩.
- পর্ব ০৪.
- পর্ব ০৫.
- পর্ব ০৬.
- পর্ব ০৭.
- পর্ব ০৮.
- পর্ব ০৯.
- পর্ব ১০.
- পর্ব ১১.
- পর্ব ১২.
- পর্ব ১৩.
- পর্ব ১৪.
- পর্ব ১৫.
- পর্ব ১৬.
- পর্ব ১৭.
- পর্ব ১৮.
- পর্ব ১৯.
- পর্ব ২০.
- পর্ব ২১.
- পর্ব ২২.
- পর্ব ২৩.
- পর্ব ২৪. (শেষ)
জ্বীন বর ( দ্বিতীয় খন্ড )
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০১
“
জ্বীন বর ( দ্বিতীয় খন্ড ) ১৭ বছর আগের সেই মায়ের ভাতের সাথে বিষ মিশিয়ে খেতে দেওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে আজ। তবে এবার রোদ তার মা’কে নয়, তার ছেলে কাব্য তার বাবা শব্দের ভাতের সাথে বিষ মিশিয়ে খেতে দিয়েছে। ভেবেছিল শব্দ ঘুনাক্ষরেও টের পাবেনা। তবে জ্বীন হওয়ার দরুন শব্দ আগে থেকেই টের পেয়েছে। নিজের প্রতি অযথা ছেলের এই ঘৃনাটা আগে থেকেই টের পেয়ে আসছে সে।
টেবিলে খেতে বসে শব্দ তার ছেলে কাব্যকে বললো “আমার প্রতি তোমার কোনো ধরনের রাগ আছে?” শব্দ নিয়ম করে প্রতিদিন তার ছেলেকে ডেকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করে। যদিও কাব্য প্রতিবার বিরক্ত হয়। সেটা নিয়ে শব্দের কোনো মাথাব্যথা নেই। আগেরবারের মতোই কাব্য কাচুমাচু হয়ে বললো “না বাবা কোনো রাগ নেই, খাচ্ছো না কেন তুমি? আমি নিজের হাতে তোমার জন্য বানিয়েছি খুশি হওনি?” শব্দ মুচকি হেঁসে হাতে হাত ঘষে বললো “তোমার বিড়ালটা কোথায়? বিলু, বিলু।” কাব্য চমকে জিজ্ঞেস করলো “বিলুকে ডাকছো কেন বাবা?”
শব্দের ডাকে বিলু এক লাফে টেবিলে চলে আসলো। শব্দ বিলুকে কোলে নিয়ে চুমু দিলো। বিলু কাব্যের খুব পছন্দের। সারাদিন রাত বিলুকে নিয়েই পড়ে থাকে। শব্দ কাব্যের দিকে তাকিয়ে নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে বিলুকে খেতে দিলো। কাব্যের চোখ ছলছল করছে। এই বুঝি ঝরনা ধারা উপচে পড়বে। বাবার সামনে খাওয়াতেও বারন করতে পারছে না। বাবা যদি জেনে যায় খাবারে বিষ আছে তাহলে সে এক বিন্দুও ছাড় দিবেনা কাব্যকে। তাই চোখের সামনে বিলুর মৃত্যু দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই কাব্যের।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনের চোখের সামনেই বিড়ালটা ছটফট করে মারা গেলো। শব্দের খারাপ লাগছে বিড়ালটার জন্য। তবে ছেলেকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এটা করতেই হতো। বিড়ালটার মৃত্যুতে বাবার প্রতি ছেলের ঘৃনাটা আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো। শব্দ কাব্যের দিকে ঝুঁকে বললো “মায়ের মতো হয়েছো একদম। কিন্তু লাভ নেই, তোমার এই ক্লাস ওয়ান..টু এর পড়া আমি ১৭ বছর আগেই পড়ে এসেছি। আমার যথেষ্ট এক্সপেরিয়েন্স আছে। তোমার ভুলের জন্যই তোমার পছন্দের জিনিসটাকে কেঁড়ে নিতে বাধ্য হলাম। রান্নাঘরে খাবার রাখা আছে, মিষ্টিকে বলবা খাবার দিয়ে দিবে খেয়ে নিবে। আর হ্যাঁ ভয় নেই, ওই খাবারে বিষ নেই।”
কাব্য চেচিয়ে উঠে বললো “তুমি সব সময় আমার পছন্দের জিনিসগুলো কেড়ে নেও বাবা। তুমি আমার মা’কেও কেড়ে নিয়েছো বাবা। আজকে বিলুকেও কেড়ে নিয়েছো। তোমাকে আমি খুব ঘৃনা করি, খুব।”
শব্দকে আর কোনো কথা বলার সু্যোগ না দিয়ে কাব্য দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। কাব্যের এখন একমাত্র কাজ হলো মায়ের ছবির সামনে বসে মায়ের কাছে নালিশ করা। একটা ফ্রেমে কাব্য, রোদ এবং শব্দের ছবি। এই একটা ছবি ছাড়া আর কোনো ছবি নেই রোদের এই বাড়িতে। তাই কাব্য শব্দের মুখটা মার্কার দিয়ে কালো করে দিয়েছে। বয়স ১৭ হলেও এখনো বাচ্চামো রয়ে গেছে কাব্যের।
শব্দ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুলে দেখতে পেলো সামনে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে। শব্দের কাঁধে হাত রেখে বললো “কাব্যকে সবটা বলে দিলেই পারিস শব্দ।” শব্দ খুব সন্তর্পণে কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করে বললো “নারে, কাব্য এখনো মানুষ। ও নিজে থেকে না জানলে আমি কখনোই জানাবো না ও জ্বীন। আমি চাইনা আমার মতো আমার ছেলের জীবনটাও নষ্ট হোক। ও মানুষ হয়ে থাকলেই বোধহয় বেশি ভালো হবে। আমরা যে জ্বীন সেটাও কখনো জানাস না ওকে কেমন? কখনোই নাহ্!”
বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো শব্দ। মিষ্টি খাবার নিয়ে দৌড়ে এসে বললো “ভাইয়া চলে গেছে? খেয়ে গেলো না তো কিছু।” শুভ্র গম্ভীর কণ্ঠে বললো “রেখে দেও, ক্ষুধা লাগলে টেবিল থেকে খেয়ে নিবে।” মিষ্টি ভ্রু কুঁচকে বললো “ওমাহ্, আজকে আবার গম্ভীর কণ্ঠে কথা বলা হচ্ছে। ঢং দেখে আর বাঁচিনা, সরো।”
মিষ্টি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মিষ্টির হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো শুভ্র। মিষ্টি মুখ হা করে বললো “আরে খাবার।” শুভ্র হাত দিয়ে তুড়ি মেরে খাবারগুলো টেবিলে রেখে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো মিষ্টিকে। মিষ্টি কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বললো “ভাইয়া কি বলেছে মনে নেই? ঘরের মধ্যে কোনো ম্যাজিক চলবে না। বুড়ো হয়েছে তবুও আক্কেল হলো না। বুড়ো বয়সে ভীমরতি।” শুভ্র মিষ্টির মুখের উপরে ফু দিয়ে বললো “কে বুড়ো হয়েছে? এই শুভ্র? তুমি জানো এই শুভ্রের প্রতি এখনো কতো মেয়েরা ক্রাশ খায়? বয়স বেড়েছে তো কি হয়েছে? আমি তো সেই ১৭ বছর আগের মতোই আছি।” মিষ্টি চোখমুখ বাঁকিয়ে বললো “দেখুন মশাই, আমি আপনার বিয়ে করা বউ। আমি আপনার প্রেমিকা নই যে এসব বলে ফের আরো একবার পটিয়ে নিবেন।” শুভ্রর মুখে চওড়া হাসি ফুটলো। ভ্রু যুগল নাচিয়ে বললো “বউ? তাহলে তো যা খুশি তাই করতে পারি।” বলেই মিষ্টিকে চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মিষ্টির ফর্সা গোলাকার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। অতিরিক্ত লজ্জা কিংবা রাগের সময় মিষ্টির মুখটা একদম লাল হয়ে যায়। তাই শুভ্র বেশিরভাগ সময়ই মিষ্টিকে লজ্জা কিংবা রাগিয়ে দেয়। তারপর মুগ্ধ হয়ে মিষ্টিকে দেখে সে।
অন্যদিকে খেলতে খেলতে বাড়ির মধ্যে চলে আসে অভ্র। তাড়াতাড়ি চোখে হাত দিয়ে পা টিপেটিপে শুভ্রর পাশে এসে বললো “পাপা আমি কিছু দেখিনি কিন্তু।” শুভ্র নিশ্চিত মনে “আচ্ছা!” বলে থতমত খেয়ে চোখ বড় বড় করে অদৃশ্য হয়ে গেলো। মিষ্টি এদিক ওদিক তাকিয়ে খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
শব্দ ফিরলো খুব রাত করে। বাড়িতে ইমা এসেছে আজ। শব্দ এখনো বাড়ি ফিরেনি বলে বসে বসে চিন্তা করছে। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। শব্দকে বিয়ে করতে না পারলেও পরবর্তী ১৭ বছর থেকে এই অব্দি সে আর বিয়েই করেনি। রোদের অবর্তমানে সবার দেখাশোনা মাঝে মাঝে ইমা’ই করে। শব্দ বাড়িতে ঢুকে ইমাকে দেখতে পেয়ে বললো “কিরে কখন এসেছিস? এক গ্লাস পানি দে তো।” ইমা তাড়াহুড়ো করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে দেখলো শব্দের পা থেকে রক্ত পড়ছে। শব্দকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই একপ্রকার দৌড়ে ফার্স্ট এইডের বক্স এনে বকাবকি করতে করতে ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগলো ইমা। সে জানে প্রায়ই এমন টুকটাক আঘাত থাকবেই শব্দের।
ইমার কাজে বাঁধা দিয়ে তার হাত খপ করে ধরে ফেললো কাব্য। নাকমুখ কুঁচকে বললো “কতোবার বলেছি আমার বাবার থেকে দূরে থাকতে তোমায়? ছোটমা, ছোটমা কোথায় তুমি?” শব্দের ডাকে মিষ্টি ছুটে এসে কাব্যের মাথায় হাত রেখে বললো “কি হয়েছে আব্বু?” হাত দিয়ে শব্দের পায়ের আঘাত দেখিয়ে দিয়ে বললো “বাবার পায়ে আঘাত লেগেছে, তুমি একটু ব্যান্ডেজ করে দেও।” কাব্যকে ধমক দিয়ে শব্দ বললো “কাব্য কিসব শিখছো তুমি? কি ব্যবহার এগুলো? ও তোমার ফুপি হয় ভুলে যাও কেন?” কাব্য চোখ রাঙিয়ে বললো “আমি কোনোকিছুই ভুলে যাইনা বাবা। সাথে এটাও ভুলিনি আগে তোমার প্রতি কেমন অনুভূতি ছিল ফুপির। তাকে ফুপি হিসেবে যথেষ্ট সম্মান আমি করি। তাই বলে আমি আমার মায়ের জায়গাটা তাকে দিতে পারিনা তাইনা? সে আসবে, ফুপি হিসেবে থাকবে। কিন্তু না, তিনি তো তোমার জন্য জীবনটা উৎসর্গ করেছে। ফুপির বিয়ের সময় তুমি আমার মাকে সরিয়ে ফেললে। সবাইকে জানিয়ে দিলে আমার মা আর ফিরবে না। সেই খুশিতে নাচতে নাচতে ফুপিও বিয়েটা ভেঙে এই অব্দি তোমার আশায় বিয়ে না করে পড়ে আছে। এরপরেও তুমি বলবে উনি আমার মায়ের জায়গা নিতে চান না? আমি বেঁচে থাকতে সেটা কখনোই হবেনা। আমি সবটাই জানি, উনি মায়ের জায়গা নিলে আমি মা’কে কি জবাব দিবো?”
কাব্যের কথা শুনে শব্দের প্রচন্ড রাগ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো “যদি সহ্য করতে না পারো তাহলে মরেই যাও।” বলেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো শব্দ। দিন দিন রোদকে নিয়ে এসব ঝামেলা আর সহ্য হচ্ছে না শব্দের। ইমা মুখ বাকিয়ে নিজের রুমে চলে যেতেই মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে কাব্য হু হু করে কান্না করে দিলো। মিষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো “বাবা আমার উপর আবার রাগ করেছে ছোটমা। আমি মরে গেলেই কি বাবা শান্তি পাবে? আমি কি করবো ছোটমা? তুমি বাবাকে বলো না মাকে এনে দিতে। তাহলেই তো আর কোনো ঝামেলা থাকবে না।”
মিষ্টি কাব্যের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের চোখ মুছে বিরবির করে বললো “কেন এমন করলে রোদ? একবারও তোমার ছেলে, তোমার জ্বীনবরের কথা মনে ছিলনা? তোমাকে হারিয়ে আসলে কেউ ভালো নেই। শব্দ ভাই প্রতি মুহুর্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শব্দ ভাই আর পারছে না। ফিরে এসো রোদ।”
বছরের প্রথম দিন আজ, কাব্যের কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন। কিন্তু তার মোটেই কলেজে ভর্তি হতে মন চায় না। কিন্তু বাবার ভয়ে কিছুই বলতে পারছে না সে৷ সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ শব্দ নিজেই কাব্যকে কলেজে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে। মাকে হারানোর পর কাব্যের কোনো বিষয়েই মাতা ঘামায়নি শব্দ। যাবতীয় সব কাজ শুভ্র করেছে সব সময়। সেটা নিয়ে কাব্য মনে মনে খুশি হলো আজ।
কলেজের সামনে গাড়ি থামতেই কাব্যের বন্ধুরা দৌড়ে আসলো কাব্যের সামনে। প্রথমে শব্দকে দেখে কেউ কোনো কথা না বললেও শব্দ সামনে আগাতেই সবাই বলে উঠলো
-কিরে কাব্য এটা তোর ভাই নাকি?
-আস্তাগফিরুল্লাহ্ কি বলিস এসব?
-তোর মতোই তো চেহারা।
-আমার বাপ তাই আমার মতো চেহারা।
-এটা আঙ্কেল? বয়স তো মনে হচ্ছে ২১, তোর বাবা তার জন্মের পরেই বিয়ে করে ফেলেছিল নাকি?
-বাজে কথা বলবি না, বাবার বয়স ২১ হবে কেন?
-সরি রে কিন্তু দেখে সেটাই মনে হচ্ছে!!
ভর্তির সমস্ত কাজ শেষ হতেই কলেজের প্রিন্সিপাল বললো “আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ, আপনি আপনার স্ত্রীর নাম দেননি কেন?” শব্দ আড় চোখে কাব্যের দিকে তাকিয়ে বললো “কারন আমার স্ত্রী মৃত। একান্তই দেওয়ার প্রয়োজন হলে লিখে দিন মৃত রোদ শাহরিয়ার।” শব্দের কথা শুনে কাব্যের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো “বাবা!!”
চলবে?….
বিঃদ্রঃ গল্পটা পড়ার আগে অবশ্যই সিজন ১ পড়তে হবে, নাহলে বুঝবেন না।
অনেকের প্রশ্ন এখন রোদ কোথায়? সবকিছু পরবর্তী পর্বগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন।
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০২
রাত তিনটা, মুখ গম্ভীর করে বসে আছে শব্দ। সদর দরজাও বন্ধ আছে। তবে হুট করে খোলার আওয়াজ পেয়ে শব্দ অদৃশ্য হয়ে যায়। একটা ১৫১৬ বছরের বাচ্চা মেয়ে পা টিপে টিপে এদিক ওদিক ঘুরে কয়েকবার কপালে জমা ঘাম মুছে নিলো। খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বাম পাশে উঁকি দিতেই দেখলো কাব্য ঘুমাচ্ছে। সাথে সাথে বুকে হাত দিয়ে কাত হয়ে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করে তড়িঘড়ি করে কাব্যের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় মেয়েটি। শব্দ সটান উঠে দাঁড়ালো। নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। একটা মেয়ের এতোটা সাহস হয় কিভাবে? শব্দ অদৃশ্য হয়েই কাব্যের রুমে প্রবেশ করলো। অদৃশ্য হওয়ার দরুন তেমন কোনো সমস্যা তার হলোনা রুমে ঢুকতে। গিয়ে দেখতে পেলো মেয়েটি কাব্যের দিকে তাকিয়ে কাব্যের মাথার পাশে বসে আছে। তবে মেয়েটি স্পষ্ট টের পেলো রুমে কেউ প্রবেশ করেছে। ভয় পেয়ে প্রথমবার এদিক সেদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না মেয়েটি। কিন্তু সন্দেহ তার তখনো যায়নি। পরেরবার তাকাতেই দেখতে পেলো অন্ধকারে কেউ বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শব্দের পা ঠিক হয়নি এখনো, তাই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে।
শব্দকে দেখে একপ্রকার হকচকিয়ে যায় মেয়েটি। শব্দের ইশারা পেয়ে রুমের দরজা খুলে সোজা নিচে নেমে শব্দের সাথে এসে দাঁড়িয়েছে মাথা নিচু করে।
-চাবি কোথায় পেলে?
-চুরি করেছি
-কিভাবে? সদর দরজার তিনটা চাবি আমার, কাব্যের এবং শুভ্রর কাছে থাকে।
-কাব্য কলেজে গেলো তখন চাবি নিয়েছি।
-হুমম, কি মনে করে আমার বাড়িতে? আমার ছেলেকে মারতে এসেছো তুমি?
-আপনি ওর বাবা? আমি ভেবেছিলাম ভাই। আসসালামু আলাইকুম শশুর আব্বা।
-হোয়াট, কি বলছো তুমি? শশুর আব্বা মানে কি?
-ইয়ে মানে কিছু না, আমাকে ছেড়ে দেন। আপনার ছেলেকে আমার অনেককক ভালো লাগে। তাই দেখতে এসেছিলাম। প্লিজ আমি কিছু করিনি, আমাকে মাফ করে দেন।
শব্দকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এক ছুটে দৌড়ে পালালো মেয়েটা। শব্দ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পাগলামি দেখে নিজেই হেঁসে ফেললো। রোজার সাথে নিজের পাগলামির কথা মনে পড়তেই অবচেতন মনে কেঁদে ওঠে শব্দ। যতই শক্তপোক্ত হোক না কেন এই একটা জায়গাতেই শব্দ বেশি দূর্বল।
পরের দিন সকাল হতেই যথারীতি সবাই খাবারের টেবিলে খাবার খেতে আসলো। শব্দের হাতের ডান পাশেই একটা কুকুরকে বসে থাকতে দেখে কাব্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শব্দের দিকে তাকায়। শব্দ জোরেশোরে একটা আলসে ভেঙে বললো “এটা আমার কুকুর, আজ থেকে আমার আগে আমার খাবার ও টেস্ট করবে।” বলেই কাব্যের দিকে আড়চোখে তাকালো। শব্দকে আড়চোখে তাকাতে দেখে কাব্যের অপরাধবোধ হলো। কাব্য উঠে যাবে এমন সময় শব্দ কাব্যকে ডেকে বললো “কাব্য কাল রাতে একটা মেয়ে বাড়িতে ঢুকে সোজা তোমার রুমে গিয়ে তোমার খোঁজ করছিল। আমার ভাবতে অবাক লাগছে আহনাফ শাহরিয়ার শব্দের ছেলে এতো অসচেতন।” কাব্য ফট করে মাথা তুলে বললো “তাহলে আমি যে তোমার ছেলে সেটা ভাবাও বন্ধ করো। তোমার তো আবার আমাকে নিয়েই সব সমস্যা।” বলেই বসা থেকে উঠে কুকুরটার দিকে একবার তাকিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলো।
শব্দের কষ্ট হচ্ছে, গলা দিয়ে ভাত নামছে না। ছেলে এতো বড় হয়ে গেলো কবে? এই তো সেদিনও পরিবারটা কতো ভালো ছিল। কাব্য সারা বাড়ি তব্দ ভাই তব্দ ভাই করে মাথায় তুলে ফেলতো। বাবাকে ছাড়া কোনো কিছু মুখে নিতো না। আর সে কিনা আজ বলছে তাকে আমার ছেলে ভাবা যাবে না? ভাতের লোকমা দলা পাকিয়ে মুখ থেকে বের হতে চাইছে। অবশিষ্ট ভাত ফেলে রেখে উঠে চলে যাওয়ার সময় পেছন থেকে শুভ্র ডেকে বললো “রোদ কোথায় শব্দ? এবার অন্তত রোদকে নিয়ে আয়!” শব্দ পেছনে তাকিয়ে বললো “রোদ আর কখনো আসবে না শুভ্র! তোকে আর কতোবার জানাবো?”
কাব্য কলেজে এসে সবার আগে খোঁজ করে অর্নিকে। অর্নি এখনো কলেজে পৌঁছায়নি। কাব্যের ভাবনা এই কাজ অর্নি ছাড়া কেউ করতে পারেনা। এদিকে অর্নি অপরাধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে একটা মহিলার সামনে। মহিলাটি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো “কোথায় গিয়েছিলে কাল রাতে?” অর্নি জবাব দেয় না। ফের আরো একটা ধমকে থতমত খেয়ে বললো “মাম্মাম আমার একটা ছেলেকে খুব পছন্দ। আমি ওকেই দেখতে গিয়েছিলাম।” মহিলাটি চেয়ার টেনে বসে বললো “হুমম বুঝলাম, ঠিক আছে। তবে তুমি এখনো ছোট অর্নি। যা করছো যতটুকু করছো মাথায় রেখে করো। বেশি বারাবাড়ি করো না। আমি তোমাকে বলছি তোমার বিয়ে ওই ছেলের সাথেই হবে। ছেলের নাম এবং ছেলের বাবার নাম বলতে পারবে?” অর্নি একপ্রকার লাফিয়ে উঠে বললো “মাম্মাম ওর নাম হলো কাব্য শাহরিয়ার, আর ওর বাবার নাম হলো আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ।” নাম দুটো শুনেই মহিলাটি অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অর্নির ডাকে মহিলাটির ধ্যান ফিরলে বলে “আচ্ছা তোমার বিয়ে এই ছেলের সাথেই হবে।”
অর্নি কলেজে পৌঁছেই দেখতে পায় কাব্যকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কাব্যর মেজাজ খারাপ হচ্ছে একটু পর পর। তাই একটু পর পরই মাথায় পানি দিচ্ছে। কপালে লুটিয়ে থাকা চুলগুলো থেকে টুপটুপ করে পানি ঝড়ছে। মুখের আশেপাশে লেগে থাকা পানির ফোঁটা গুলো সাদা চামড়ার সাথে মিশে এক অদ্ভুত আকর্ষণ সৃষ্টি করছে। প্রচন্ড রোদের তেজে চোখ বন্ধ করে বাইকে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে কাব্য।
কাব্যকে দেখতে পেয়ে অর্নি সিনেমার নায়িকাদের স্টাইলে কাব্য বলে ডাক দিয়ে দৌড় লাগায়। কাব্য ফট করে চোখ খুলে ফেলে। নিলাভ চোখ দুটো তখন রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। দূর থেকে অর্নি দৌড়ে এসে কাব্যকে জড়িয়ে ধরে। কাব্য অর্নিকে টেনে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সবার সামনেই সজোরে থাপ্পড় মারে। অর্নি বেগ সহ্য করতে না পেরে দূরে ছিটকে পড়ে। নিজের গাল ধরে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো “মারলে কেন?” কাব্য চোখ রাঙিয়ে বললো “তোমার মতো মেয়েকে মারবো না তো কোলে বসিয়ে আদর করবো? তোমার সাহস হয় কিভাবে একদিনের পরিচয়ে এতো রাতে আমার বাড়িতে ঢোকার? তুমি জানো আমার বাবা কতোটা রাগী? তিনি তার ছেলের সাথে একটুও আপোষ করেন না। সেখানে তুমি রাতে আমার রুমে ঢুকে আমাকে তার চোখে খারাপ বানিয়েছো আবার। আমি সারাজীবন আমার বাবার কাছে খারাপ থেকে গেলাম। আমার সম্মানটা যদি রাখতে তাহলে এই লোকসমাজে থাপ্পড় খেয়ে নিজের সম্মানটা শেষ করতে হতো না। নেক্সট টাইম তোমাকে আমার সামনে যেন না দেখি, রাবিশ!”
অর্নি বুঝতে পারেনা ও কি এমন কাজ করে ফেলেছে। ও তো নিজেই ওর বাবার সাথে কথা বলে এসেছে। কাব্যর বাবা কি তাহলে কাব্যকে বেশি বকা দিয়েছে? নিজের অবচেতন মনে হাজারো প্রশ্নের আঁকিবুঁকি নিয়ে ক্লাসে গিয়ে মাথানিচু করে বসে পরলো। কাব্য আর একবারের জন্যও অর্নির দিকে তাকালো না। একটা বোরিং ক্লাস করে বাড়িতে চলে আসে কাব্য। বাগানে দাদা-দাদিকে বসে থাকতে দেখে মনে হলো সে একবার ওইখানে যাবে। দাদির কোলে মাথা রেখে চোখের পানি ছেড়ে দিলো কাব্য। কাব্যের দাদি কথা বলতে পারেন না। কয়েকবছর আগে স্ট্রোক করে কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন তিনি। তারপর থেকে দাদাও তেমন বেশি কথা বলে না।
বাগানের আরেক পাশেই শুভ্র আর শুভ্রর ছেলে অভ্র খেলছে। শুভ্র কাব্যকে দেখে ডাক দিলো। শুভ্রর দেখাদেখি অভ্রও হাত বাড়িয়ে ডাক দিলো। কাব্যের সাথে এই বাড়ির সবার সম্পর্ক ভালো। শুধুমাত্র শব্দ ছাড়া। কাব্য এক দৌড়ে গিয়ে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলো। শুভ্র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো “আয় খেলবো।”
কিছুক্ষণ পরেই বেলুনকে উড়তে দেখে অভ্র বললো “পাপা আমি উড়বো।” বলার সাথে সাথেই অভ্র উড়তে শুরু করলো। ছেলেকে হাওয়ায় ভাসতে দেখে এক মুহুর্তে ভুলে গিয়েছিল তার ছেলে তার মতোই জ্বীন। কাব্যের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। সে নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না। শুভ্র কাব্যকে দেখে চোখমুখ খিঁচে কাব্যকে বললো “কাব্য পেছনে দেখ!” কাব্য পেছনে তাকাতেই শুভ্র তুড়ি বাজিয়ে অভ্রের পিঠে কয়েকটা বেলুন লাগিয়ে দিলো।
কাব্য পেছনে তাকিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে আবার সামনে তাকালো। শুভ্র হে হে করে হেঁসে বললো “আরে ভয় পাচ্ছিস কেন? ও উড়তে চেয়েছে তাই ওর পিঠে বেলুন লাগিয়ে দিয়েছি এই দেখ।” এবার কাব্য চোখ বড় বড় করে বললো “আরে চাচু এবার তুমি ওকে নামাবে কিভাবে? উড়ে যাচ্ছে তো!” শুভ্র ভ্রু নাচিয়ে বললো “ওহ হ্যাঁ তাইতো, এটা তো আগে ভেবে দেখিনি। চল চল বেলুন ফাটাই। তুই হাত ছড়িয়ে রাখ, ওকে ধরবি কেমন?”
দোতলা থেকে পুরোটা পর্যবেক্ষণ করছিল শব্দ। অনেকদিন পর কাব্যকে স্বাভাবিক দেখে ভালো লাগছে তার। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলো রাস্তার পাশে জঙ্গলের দিকটায় একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। শব্দ সন্তর্পণে আড়াল হয়ে যায়।
অদৃশ্য হয়ে ছায়াটার পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে “কাব্যকে দেখা শেষ?” কালো ছায়াটা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। শব্দ আর কোনো কিছু বলার সু্যোগ না কালো ছায়াটার গলা ধরে এক টান দিলো। সাথে সাথে শরীর থেকে গলাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অবশেষে একটা কালো কাক কা কা করতে করতে মাথা বিহীন হয়ে নিচে পড়ে ছটফট করতে করতে মারা যায়।
শব্দ বাঁকা হেসে বললো “এসব আমার বা হাতের খেল। এসব পাঠিয়ে কোনো লাভ নেই। আমার ছেলের সামনে আমি ঢাল হয়ে দাঁড়াবো।”
চলবে?…
আমি গল্পের কোথায় বলেছি রোদ মারা গেছে? কিংবা কোথায় বলেছি বেঁচে আছে? সবটাই জানতে পারবেন ধৈর্য্য ধরুন। আশা করেছিলাম যথেষ্ট রেসপন্স পাবো। কিন্তু পাইনি, তাই গল্পটা ঠিক কতোটা বড় হবে কিংবা আদৌ বড় হবে কিনা সেটা বুঝতে পারছিনা।
সবাই ফলো করুন– Stories of Mst Moni
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০৩.
মধ্যবয়স্ক মহিলার সামনে ফের আরো একবার অর্নি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সকালে কাব্যের দেয়া থাপ্পড়ের পাঁচ আঙুলের দাগটা এখনো রয়ে গেছে। ফর্সা গালে বেশ এঁটে সেটে বসেছে দাগটা। লুকোতে গিয়েও কোনো লাভ হলো না।
-গালে কি হয়েছে অর্নি?
-কিছু না মাম্মাম!
-আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলছো?
-কাব্য আমাকে ভালোবাসে না মাম্মাম। আজকে থাপ্পড় দিয়েছে আমাকে।
কথাটা শোনা মাত্রই মহিলাটির চোখ রক্তিম বর্ণ ধারন করলো। চোখ রাঙিয়ে বললো “আমি তোমাকে বাড়াবাড়ি করতে বারন করেছিলাম অর্নি। বাড়াবাড়ি করলে তো তার ফল ভোগ করতেই হবে। কাব্য তোমাকে ভালো না বাসলেও তোমাকেই বিয়ে করতে হবে ওর। আমি ওর বাবার সাথে কথা বলবো। ঠিকানাটা আমাকে দেও।” অর্নি মাথা নাড়িয়ে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে মহিলাটির হাতে দিয়ে ভেতরে চলে যায়।
––––––––––––––––––
মস্ত বড় একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে অর্নির মাম্মাম। হাত দিয়ে সদর দরজাটা একবার ছুঁয়ে দেখে হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিলো। ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো দরজা। বাড়ির ভেতরে পা দিতেই শব্দ টের পেয়ে যায় বাড়িতে অন্য কেউ ঢুকেছে। অন্ধকার থাকায় শব্দ চেচিয়ে ওঠে কয়েকবার। তবে অর্নির মা নিরুত্তর। শব্দের চিৎকারে একে একে সবাই এসে জটলা বেঁধেছে নিচে। শব্দ কয়েকবার প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পেলো না। মিষ্টি গিয়ে লাইট অন করতেই সবাই হা হয়ে গেলো। সেই ১৭ বছর আগের কিশোরী কন্যা আজ বয়সের ভাড়ে নিমজ্জিত। সবাই সমস্বরে বলে ওঠে “রোদ!” রোদ সবার দিকে একবার তাকিয়ে সোজা শব্দের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শব্দকে উদ্দেশ্য করে বলে “আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ? আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। সেজন্যই এসেছি আমি, আপনি ফ্রী আছেন?” শব্দের কথা বলার ভাষা নেই। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো শব্দ। শব্দের ইশারায় সবাই ভেতরের ঘরে চলে গেলেও দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে সবাই সবটা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।
রোদকে দেখে শব্দ নিজেকে সামলাতে পারছে না। যথাসম্ভব নিজেকে কঠোর করে রোদের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে শব্দ। বিষয়টা যদিও রোদের কাছে দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছে। তবুও মেয়ের জন্য তিনি সব করতে পারেন। এতোটুকু অপমান তার কাছে কিছুই না। খুক খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে রোদ বললো “মিঃ আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ আপনি কি জানেন আপনার ছেলে কাব্য শাহরিয়ার আমার মেয়ে অর্নিকে আজ অপমান করেছে।” শব্দ নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “জানি!” রোদ চমকে তাকালো “জানেন? তাও আপনার ছেলেকে কিছু বলছেন না?” শব্দ একই ভঙ্গিতে বললো “আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। অন্যায় করলে আমি নিশ্চয়ই শাসন করতাম। আপনার উচিত আপনার মেয়েকে শাসন করা। আপনার থেকে আপনার মেয়ে এই শিক্ষা পেয়েছে এটা আশা করিনি আমি। আপনার মেয়ের সাহস হয় কিভাবে? এতো রাতে আপনার মেয়ে আমার বাসায় আমার ছেলের রুমে ঢোকে। এই মেয়ের আসলেই মান আছে যে অপমান হবে?” শব্দের কথায় রোদ ভড়কে যায়। দ্রুত নিজেকে সামলে বললো “আমার মেয়ে ছোট, আপনার সেটাও বুঝতে হবে। তবে আমার মেয়ের জন্য আমাকেও অপমান করছেন আপনি। এটা কিন্তু আশা করা যায় না।”
দুজনের তর্কবিতর্ক চলছে, কেউ কারো থেকেই কম না। দরজা দিয়ে শুভ্র আর মিষ্টি উঁকি দিয়ে দেখছে। শুভ্র মাথা নাড়াতেই মিষ্টি থুতনিতে ব্যথা পায়। শুভ্রর মাথায় হালকা চাটি দিয়ে আবার দেখায় মনোযোগ দিলো। শুভ্র আনমনেই বলে ওঠে “ভাই আমার এতো বছর বউ ছাড়া থাকতে থাকতে আনরোমান্টিক হয়ে গেছে। এতো বছর পরে রোদের দেখা পেলো তবুও তর্কবিতর্ক করে যাচ্ছে। ভাই আর আমার মানুষ হলো না।” শুভ্রের কথায় মিষ্টি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মিষ্টিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতে দেখে শুভ্রর খেয়াল হলো “ওহ্ সরি, মানুষ হবে কেন?”
অপরদিকে অনেকক্ষণ তর্কবিতর্ক করার পরে রোদ অর্নির সাথে কাব্যের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বরাবরই রোদের বায়নার কাছে শব্দ নিরুপায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। রাজি হয়েও ফট করেই জিজ্ঞেস করলো “মিসেস রোদ শাহরিয়ার অর্নি কি আপনার আপন মেয়ে?” শব্দের মুখে রোদ শাহরিয়ার ডাকটা শুনে রোদের চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। নিজেকে সংযত করে উত্তর দিলো “হ্যাঁ অর্নি আমার নিজের মেয়ে।” শব্দের মন ক্ষুন্ন হলো। এক মুহুর্তে ভেবে নিলো রোদ তাহলে তাকে ছেড়ে গিয়ে নিজের সংসার পেতেছে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো “তাহলে এই বিয়ে কখনোই সম্ভব নয়।” রোদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো “কেন?” শব্দ পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো “আমি মনে করছি সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই। তবুও একান্তই যদি জানতে ইচ্ছুক হন তাহলে সময় আসুক তখন বলবো। এখন আমার বলার কোনো ইচ্ছে নেই। বিয়েটা দেওয়ারও কোনো ইচ্ছে নেই। আপনি যেতে পারেন।”
রোদ একপ্রকার রাগ করেই উঠে চলে যেতে নিতেই শুভ্র রোদ বলে ডেকে দৌড়ে আসলো। রোদ শুভ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো “আপনি কে? আমার নাম ধরে ডাকছেন কেন?” শুভ্র নিজের পরিচয় দিতে ব্যস্ত। কিন্তু রোদ চিনতে পারলো না।
রোদ চলে যেতেই শব্দ কড়া কন্ঠে সবাইকে বলে দিলো “রোদ যে এই বাড়িতে এসেছিল বা অর্নির মা’ই রোদ সেটা যেন কাব্য না জানতে পারে কখনো। রোদ যদি ওর মেয়ের জন্য সব করতে পারে আমিও আমার ছেলের জন্য সব করতে পারবো। অর্নি রোদের আপন মেয়ে হলে তো এই বিয়ে ইহকালেও সম্ভব নয়।”
কোনো ঝামেলা ছাড়াই দুদিন চলে গেলো। অর্নি এই দুদিন কাব্যের সামনে আসেনি। তবে আজ ঘটলো অন্য এক কান্ড। ক্লাসের এতোগুলো চেনা মুখের মধ্যে একটা অচেনা মুখ এসেও উপস্থিত হলো। কাব্যের কখনোই কোনো মেয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল না। তবে আজ পুরো উল্টো হলো। পুরোটা ক্লাস সেই শ্যামবতী অচেনা কিশোরীর দিকে তাকিয়ে ছিল। বিষয়টা সবাই টের পেয়েছে। অর্নি বিষয়টা মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। ক্লাস শেষ হতেই সবাই ক্লাস থেকে বের হলো। অর্নি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটির গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে দিলো। মেয়েটি কিছু বলে ওঠার আগেই কতোগুলো নোংরা কথা ছুড়ে দিলো অর্নি। পুরো ঘটনাটা কাব্য দূর থেকেই পরখ করে নিলো। তবে তখনি কিছু বললো না কাউকে।
অর্নি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি পৌঁছালো। রোদকে গিয়ে চেচিয়ে বললো “তোমাকে একটা কাজ করতে দেয়া হয়েছে সেটা তুমি করতে পারলে না মাম্মাম৷ কাব্যের অন্য মেয়েকে মনে ধরে যাচ্ছে। আর আমি এখানে কি করছি? আমি যেভাবেই হোক কাব্যকে নিজের করে ছাড়বোই। সেটা যদি কাব্যের বাবাকে খুন করেও হয় সেটাও আমি করবো৷” রোদ চোখ রাঙিয়ে বললো “তো করো সেটা, তুমি ভুলে যাও কেন তুমি কে? কাব্যের বাবা আমাকেও অপমান করেছে। উনি হয়তো জানেন না আমি কে। তুমি বুঝিয়ে দিয়ে আসো তুমি কে। তারপর দেখি রাজি না হয়ে কোথায় যায় উনি?”
সবাই ঘুমিয়ে পড়তেই রাতের বেলা চুপিচুপি অর্নি রওনা দিলো কাব্যের বাড়ির দিকে। হাতে থাকা চাবিটা চাঁদের আলোয় চকচক করছে। সন্তর্পণে দরজা খোলার সাথে সাথেই এবারও আগের বারের মতোই শব্দ টের পেয়ে যায়। শব্দ অর্নির সামনে আসতেই অর্নি জিজ্ঞেস করলো “আপনার ছেলেকে আমার চাই। আপনাকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি বিয়ে দিবেন কিনা।” শব্দ গম্ভীর কণ্ঠে বললো “আমার সিদ্ধান্ত আমি তোমার মা’কে জানিয়ে দিয়েছি।” কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই অর্নি প্রচন্ড ক্রোধে নিজের রুমে চলে আসলো। মাটি থেকে কয়েকহাত উপরে উড়ে কালো ছায়ার মতো অবয়ব নিলো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসে উড়ছে। শব্দ ভয় পেলো না। অর্নি এসে শব্দের গলা চেপে ধরে বললো “বিয়ে দিবি কিনা, নাহলে আজকেই তোর আর তোর ছেলের শেষ দিন হবে।”
কথা বলার আওয়াজে কাব্যের ঘুম ভেঙে যায়। নিচে এসে এরকম একটা অবস্থা দেখবে কল্পনা করেনি কাব্য। শব্দ নিশ্বাস নিতে পারছে না। কাব্য দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে অর্নির চুলগুলো ধরে দূরে ছুড়ে মারলো। কাব্যকে দেখে অর্নি নিজের রুপে ফিরে আসলো। অর্নিকে উদ্দেশ্য করে কাব্য বললো “আমার বাবাকে আমি যা খুশি তা বলবো৷ যেটা ইচ্ছে সেটাই করবো। কিন্তু আমার বাবার গায়ে অন্য কারো একটা টোকাও আমি সহ্য করবো না। প্রথমবার তাই ছেড়ে দিলাম। নেক্সট বার এমন হলে ফলাফল খারাপ হবে। চলে যাও এখান থেকে।”
কাব্যের কথা শুনে শব্দের মুখে হাসি ফুটলো। কাব্য রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করতেই এবার শব্দ নিজের রুপে ফিরে আসলো। জ্বীনরুপ নিয়ে এবার অর্নির দিকে ঝুঁকে বললো “তুমিও হয়তো জানো না আমি কে? আমি কতোটা ভয়ংকর হতে পারি সেটা তোমার মা ভালোভাবেই জানে। তবে হয়তো তার কিছুই মনে নেই। চাইলেই তোমার আঘাতটা আমি ঠেকাতে পাারতাম। কিন্তু আমার ছেলেকে তো দেখাতে হতো তোমার আসল পরিচয় কি। বাচ্চা মেয়ের মতো গিয়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ো ঠিক আছে?”
চলবে?….
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০৪.
অর্নির বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়। বাড়ি ফিরতেই দেখে রোদ হাসি হাসি মুখে বসে আছে অর্নির জন্য। রোদকে দেখে অর্নির মুখটা আরো চুপসে যায়। অর্নির চুপসে যাওয়া মুখ দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারে রোদ। কাছে এসে অর্নির কাঁধ ধরে জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে অর্নি?” অর্নি রোদকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে বলে “কাব্যের বাবা মানুষ না মাম্মাম৷ আমাকে উনি শাসিয়েছে। আমার সাথে কেউ কখনো খারাপ ব্যবহার করার সাহস পায়নি। এখন এই মুহুর্তে কাব্য এবং ওর বাবা দুজনেই আমার সাথে এমন করছে। তুমি কিছু করো মাম্মাম।” রোদ চমকে ওঠে। ভুল শুনেছে কিনা সেটা কয়েকবার ভেবে যখন বুঝলো ভুল শুনেনি তখন অর্নিকে ধরে আবারও বলে “তুমি সিওর?” অর্নি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ ইশারা দিয়ে বললো “হ্যাঁ মাম্মাম, উনি জ্বীনরুপে এসেছিলেন আমার সামনে। তবে তুমি নাকি এই বিষয়ে জানো সেটাই উনি বললো। কি জানো তুমি মাম্মাম?”
রোদ আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে বলে “কি বলছো এসব অর্নি। আমি কি করে জানবো? আমি তো ওনাকে দুদিন আগেও চিনতাম না। কেন করছে উনি এসব? আমার মাথায় কিছুই আসছে না। যাইহোক তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি এই দিকটা সামলে নিচ্ছি।” অর্নিকে রুমে পাঠিয়ে রোদ শব্দের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলো শব্দের বাড়িতে। শব্দ যেন রোদের জন্যই অপেক্ষা করেছিল। শব্দ জানে রোদের মাথায় যেটা একবার ঢোকে সেটা সে যেভাবেই হোক মোকাবিলা করেই ছাড়ে। আর একটু আগের ঘটনাটা তো অর্নি নিশ্চয়ই রোদকে গিয়ে জানাবে।
সদর দরজা এতো রাতে খোলা দেখে রোদ কিছুটা অবাক হয়। ভেতরে গিয়ে সামনাসামনি চেয়ার পেতে শব্দকে বসে থাকতে দেখে আরো অবাক হয় রোদ। শব্দের সামনেই আরেকটা চেয়ার পাতা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শব্দ রোদের জন্যই চেয়ার পেতে অপেক্ষা করছিল। রোদ নিঃশব্দে এসে চেয়ারে বসলো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো–
-আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?
-যদি বলি হ্যাঁ?
-কেন?
-কারন আমি জানতাম আপনি আসবেন!
-কিভাবে?
-আমি আপনাকে চিনি, খুব ভালোভাবেই চিনি।
-কিভাবে?
-এতো প্রশ্ন পছন্দ করিনা আমি। কেন এসেছেন?
-একটা প্রশ্নের উত্তরের জন্য।
-প্রশ্নটা কি?
-আপনি জ্বীন, আপনাকে আমি দুদিন আগে থেকেও চিনতাম না। আপনি আমার মেয়েকে বলেছেন আমি নাকি এই বিষয়টা জানি। কিভাবে?
-আসলেই কি দুদিন আগের আগে থেকেও আমাকে চিনতেন না?
-নাহ্
-তাহলে আপনার প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। আপনি চলে যান।
-আপনাকে উত্তর দিতেই হবে।
-আমি সবার কাছে বাধ্য নই, কিছু কিছু স্পেশাল মানুষের কাছেই আমি বাধ্য। আপনি তো আমার স্পেশাল কেউ নন।
-আপনি উত্তর দিবেন না তাই তো?
-নাহ্
-তাহলে আমিও জেনেই ছাড়বো। আপনাকে দেখাবো রোদ কি করতে পারে।
রোদ উঠে চলে যেতেই শব্দ পেছন থেকে ডেকে বললো “আপনার কি কিছুই মনে নেই মিসেস শাহরিয়ার?” রোদ চোখ গরম করে পেছনে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো “আমাকে এই নামে ডাকবেন না মিঃ আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ। আমার কেন যেন জ্বালা হয়, খুব জ্বালা হয়।” শব্দ বাঁকা হাসলো, রোদ সদর দরজা থেকে বের হতে হতে শব্দকে উদ্দেশ্য করে বললো “সদর দরজা রাত বিরাতে এরকম খোলা রাখবেন না। বিপদ হতে পারে। আর এতো রাত অব্দি জেগে থাকবেন না।” শব্দ হাঁক ছেড়ে বললো “আমার পরিবার নিয়ে আপনাকে মাথা না ঘামালেও চলবে। আপনি বরং রাত বিরাতে পরপুরুষের বাড়িতে না এসে নিজের ব্যক্তিগত পুরুষকে সময় দিন।”
———————————–
পরেরদিন সকাল সকাল কাব্য মুখ যথেষ্ট গোমড়া করেই খাবার টেবিলে আসে। দেখলো এখনো কেউ টেবিলে আসেনি। মুচকি হেঁসে পকেট থেকে একটা আধখাওয়া কেক বের করে খাবারের টেবিলের পাশে বসা কুকুরটাকে দিলো। কুকুরটা নিশ্চিন্তে খাবার খেয়ে সেভাবেই শুয়ে রইলো। ইতিমধ্যে সবাই চলে এসেছে টেবিলে। শব্দের প্লেটে মিষ্টি খাবার দিতেই শব্দ আগে কুকুরের মুখে খাবার দিতে গিয়ে দেখলো কুকুরটা ছটফট করছে। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো সাদা লালা। শব্দের বুঝতে মোটেই অসুবিধা হলো না কাজটা কে করেছে। শব্দের রাগ হলোনা। আগে থেকেই বোধহয় জানতো এমন হবে। খাবার খেয়ে উঠে যেতে যেতে কাব্য বললো “আমার পছন্দের জিনিস আমার থেকে কেড়ে নিলে আমিও তার পছন্দের জিনিস কেড়ে নিতে দুবার ভাবিনা।” শব্দ মনে মনে বললো “এটাই তো চেয়েছিলাম আমি।”
বাড়ি থেকে বের হয়ে কাব্যের মনে হলো কাজটা করা একদমই ঠিক হয়নি। একটা নিষ্পাপ কুকুরকে মারাটা উচিৎ হয়নি। কিন্তু বাবাকে তো বোঝাতে হতো পছন্দের জিনিস কেড়ে নেওয়ার কি কষ্ট। কাব্যদের বাড়ি একদম শহর থেকে দূরে। ঘন জঙ্গলে ঘেরা একা একটা বাড়ি। এখানে থাকতে কাব্যের মোটেই ভালো লাগেনা। কিন্তু শব্দের কথার উপরে কোনো কথাও বলতে পারছে না সে। আগে পাশেই একটা স্কুলে পড়ালেখা করলেও কলেজে ওঠার পরে শহরেই যেতে হচ্ছে তার। জঙ্গলের পথটুকু হাঁটতেই মনে হলো কেউ তার পিছু পিছু হাঁটছে। কয়েকবার এদিক ওদিক তাকিয়েও লাভ হলো না। তেমন কিছুই চোখে পড়লো না কাব্যর। অগত্যা নিজের মনের মতো করে চলতে লাগলো সে।
কলেজে গিয়ে চোখ পড়লো গতকালকের দেখা সেই মেয়েটির দিকে। সকালের স্নিগ্ধ আলো মেয়েটির শ্যামলা চেহারায় পড়ায় জীবন্ত স্ট্যাচুর মতো মনে হচ্ছে। আজ কাব্য তাড়াতাড়িই কলেজে এসেছে। মেয়েটির পাশে গিয়ে বসতেই মেয়েটির চেহারা দেখে মায়ের শ্যামলা মুখটার কথা মনে পড়লো কাব্যের। কাব্যকে পাশে বসতে দেখে মেয়েটি একটু সরে বসলো। কাব্য নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো “আপনি ক্লাসে নতুন?” মেয়েটি কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। কাব্য এবার আগ বাড়িয়ে বললো “আমি কাব্য, আপনি?” মেয়েটি কোমল স্বরে জবাব দিলো “আমি ইশমাম।” কাব্যে খুশি হয়ে বললো “আচ্ছা আমি তাহলে ইশু বলে ডাকি?” ইশমাম প্রতুত্তরে হ্যাঁ জানালো।
————————————–
কয়েকদিন আর কোনো ঝামেলা হলো না। কাব্য এবং ইশমামের বন্ধুত্বটা গভীর হচ্ছে। অর্নি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বিষয়টা। শেষে সহ্য করতে না পেরে অর্নি ইশমামকে একা ডেকে নিয়ে বললো “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি নিম্নবিত্ত। তোমার কোনো ধারনা আছে কাব্য কে? ওর বাবার কতো টাকা? ওর কয়টা প্রেমিকা থাকার কথা এটা নিশ্চয়ই বোঝাতে হবেনা তোমাকে। ও তোমাকে জাস্ট ইউজ করছে। তারপর টুপ করে ছুড়ে ফেলে দিবে। এখনো সময় আছে চোখের উপর থেকে অন্ধবিশ্বাসের পট্টিটা সরাও। এই আমাকেই দেখো, আমি কাব্যর জন্য পাগল ছিলাম। যখন দেখলাম ওর চরিত্র খারাপ তখন সরে এলাম। ভাবলাম তোমার মতো একটা নিষ্পাপ মেয়ের ক্ষতি হতে দেই কিভাবে? তাই তোমাকে সত্যিটা জানালাম।”
অর্নির এতোগুলো কথার প্রতুত্তরে ইশমাম জবাব দেয় “একজনের পোশাক দেখে আপনি কিভাবে বলতে পারেন সে কি রকম? আপনার মতো কয়েকজনকে কিনে নেওয়ার ক্ষমতা আমি রাখি। তবে আমার সেটার ইচ্ছে নেই। আমার বাবার প্রচুর টাকাপয়সা থাকলেও আমি আমার বাবার টাকায় আরাম আয়েশ করার মেয়ে নই। আমি সাধারণ থাকতেই পছন্দ করি। একজন সাধারণ বাবা তার মেয়ের প্রতি যতটুকু দায়িত্ব পালন করেন আমিও ততটুকুই আমার বাবার থেকে নেই। কারন আমি আমার নিজের খরচ নিজে চালাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর কি বললেন? কাব্যের প্রেমিকা? যদিও আমি কাব্যের প্রেমিকা নই। তবুও আপনি যেহেতু চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন আমার সাথে তাহলে চ্যালেঞ্জ আমি এক্সেপ্ট করলাম। আগামী দুদিনের মধ্যে কাব্যকে বিয়ে করে আমি আপনার সামনে আসবো।”
প্রথমে যে অর্নি কথাগুলো ইশমামকে বলেছে সেই কথাগুলো কাব্যের কানে যেতে সময় লাগলো না। কাব্যের বন্ধু অতটুকু শুনেই দৌড়ে গিয়ে কাব্যকে সব জানিয়েছে। কাব্য ভেবেছে ইশমামের খারাপ লেগেছে। তাই ইশমামের কাছে এসে কাব্য বললো “অর্নি যেমনটা বলেছে আমি তেমন নই ইশু। আমি আজ অব্দি কোনো মেয়ের প্রতি আগ্রহ দেখাইনি। আমার মেয়ে বন্ধু বলতে তুমিই আছো। আর সেটাও শুধুমাত্র আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে। আমি মনের কথা লুকিয়ে রাখতে পারিনা। তাই সোজাসাপটা বলেই দিলাম। যদি তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো তাহলে চলো আমরা বিয়ে করি। এখন কেউ না জানুক, আমাদের বয়স হবে তখন না হয় সবাই জানবে। আর তো কিছুদিন মাত্র।” ইশমাম ইতস্তত বোধ করে বললো “কিন্তু কাব্য বিয়ে করার জন্য হলেও তো একটা বয়সের দরকার হয়। নাহলে বিয়েটা তো হবেনা।” কাব্য আড়চোখে তাকিয়ে বললো “পৃথিবীতে কোনোকিছুই টাকার থেকে বড় নয়। তুমি রাজি কিনা সেটা বলো।” ইশমাম হালকা মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো।
চলবে?…
রিচেক করা হয়নি, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০৫.
কাজী অফিসে বসে আছে কাব্য ও ইশমাম। উদ্দেশ্য বিয়ে করা। কাজি রাজি না হলেও মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এবং সমস্ত কিছু গোপন থাকবে এই শর্তেই কাজীকে রাজি করানো হয়েছে। সাক্ষী হিসেবে কাব্যর বিশ্বস্ত দুজন বন্ধু ছিল।
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই কাজী অফিস থেকে বের হওয়ার সময় কাব্য খেয়াল করলো কোনো একটা ছায়া দেয়ালের পাশেই আড়াল হয়ে গেলো। কাব্য এতোটাও পাত্তা দিলো না বিষয়টা।
কলেজের চত্বরে বসে আছে কাব্য ও ইশমাম। কাব্য ইশমামকে উদ্দেশ্য করে বললো “প্রেমও করতে দিলে না, ভেবেছিলাম বিয়ের আগে প্রেম করবো। তা আর হলো কই?” ইশমাম লজ্জায় লাল হয়ে বললো “সমস্যা কি বিয়ের পরে প্রেম করবে৷” বলেই মুখে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। কাব্য হি হি করে হেঁসে বললো “তো এখন থাকবে কোথায়? শশুর বাড়ি যাবে নাকি?” ইশমামের মুখটা চুপসে গেলো। বাবার সাথে প্রায়ই রাগারাগি হয় তার। বাড়িতে এক মুহুর্তের জন্যও থাকতে মন চায় না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাই বাবার বাড়িতেই থাকতে হয়। এবার আর বাড়িতে থাকবে না সে। ইতস্তত করে কাব্যকে বললো “তোমার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে আমাকে? আমি বাড়িতে থাকবো না।” কাব্য কিছুটা আঁচ করতে পারলো। কিন্তু বাবাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের কথা কোনোভাবেই জানাতে পারবে না সে। ইশমামের মুখটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো “তুমি একটু ম্যানেজ করতে পারবে না ইশু? বাবাকে বলতে পারবো না, বাবা খুব রাগী। সময় হলে বাবা ঠিক মেনে নিবে৷” ইশু দৃষ্টি নিচু করে জানালো তার কিছুই করার নেই।
অগত্যা ইশমামকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কাব্য। সেদিনের মতো ইশমামকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে এসে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে কাব্য। হুট করেই নিজের রুমে শব্দকে দেখে চমকে ওঠে। শব্দ কখন কোথায় কিভাবে যায় কাব্য বুঝে উঠতে পারেনা। কাব্যর দিকে তাকিয়ে শব্দ জিজ্ঞেস করলো “এতো দেরি হলো কেন আজ তোর? একদম সন্ধ্যা ঠেকিয়ে আসলি যে?” কাব্য মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো “বাবা কলেজটা আমার বাড়ি থেকে খুব দূরে হয়ে যাচ্ছে। তুমি কলেজের আশেপাশে একটা বাড়ি ঠিক করে দিতে পারবে আমার জন্য? আজকে দেখো আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম পথে আসতে। পরে এক জায়গায় বসে ছিলাম তাই দেরি হলো। সামনে আমার পরিক্ষা এমন করলে তো হবেনা বলো?” প্রতুত্তরে শব্দ বললো..
-তোমার গাড়ি আছে শব্দ।
-আমি গাড়িতে চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা বাবা। সবাই ভাবে আমি বেশি বড়লোক। আমার সাথে কেউ মেশে না।
-তাহলে টাকা দিবো অন্যের গাড়ি করে যাবে।
-না বাবা আমি অন্যের গাড়িতে কেন যাবো? ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকবো?
-তোমার কথার যে কোনো যুক্তি নেই সেটা কি বুঝতে পারছো তুমি?
-আমি এতোকিছু জানিনা বাবা। তোমার গাড়ি কিনে দেওয়ার টাকা আছে, আমার ভালোর জন্য কলেজের আশেপাশে একটা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করার টাকা নেই?
-টাকা থাকা না থাকার কথা নয় কাব্য। আমি তোমাকে একা থাকতে দিতে পারবো না।
-আমি তো একা থাকবো না বাবা।
-মানে?
-মানে ভয় করলে বন্ধুদের নিয়ে থাকনো সমস্যা নেই তো। আর এখানেই বেশিরভাগ সময় থাকবো। যেদিন ক্লান্ত লাগবে, বা সমস্যা হবে ওইখানে থাকবো।
-তার মানে তুমি অন্য কোথাও থাকবে?
-হ্যাঁ
-তবে শর্ত হলো আমি যেই বাড়িতে থাকতে বলবো সেখানেই থাকতে হবে। না করতে পারবে না।
-আমি রাজি!
———————————
গভীর রাতে শব্দ খুশি খুশি মনেই বাইরে বের হয়। অর্নির বাড়ি পৌঁছাতে তার এক মুহুর্ত লাগলো না। বাড়ির চারপাশে কোনো সিকিউরিটি নেই। রোদ যে সিকিউরিটি ছাড়া এখানে থাকে সেটা বিশ্বাস হলোনা শব্দের। তবুও খুব সন্তর্পণে বাড়ির ভেতরে ঢুকে রোদের রুমে ঢুকে পড়ে শব্দ। এখানে অদৃশ্য হয়ে ঘোরাফেরাও সমস্যার ব্যাপার। অর্নি নিজে জ্বীনকন্যা। অদৃশ্য হলেও চট করেই ধরে ফেলবে অর্নি৷ তবে তেমন কোনো সমস্যা হলো না।
রোদ ঘুমিয়ে আছে, ঘুমন্ত চেহারায় ফুটে উঠেছে সারাদিনের ক্লান্তি। শব্দের আগের কিশোরী রোদের কথা মনে পড়ে গেলো। শক্তপোক্ত মেয়ে হলেও শব্দের কাছে তার বাচ্চামো ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। রোদের মুখের সোজা উপরে হাত দিয়ে মনে মনে ছুঁয়ে দিলো শব্দ। খুব ইচ্ছে করছিল হাতটা মুখেই ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু পারলো না। রোদকে দেখে শব্দ হু হু করে কেঁদে ফেললো৷ হুট করেই রোদের ঘুম ভেঙে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায়না রোদ। রোদকে জেগে উঠতে দেখে একপ্রকার পালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় শব্দ। রাস্তায় এসে অসহায়ের মতো বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে শব্দ। নিঃশ্বাস নিতে না পারার মতো কষ্ট হচ্ছে শব্দের। একটা সময় জ্ঞান হারায় শব্দ।
শব্দের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ভোররাত। মাথার পাশে বসে আছে শুভ্র। একটু দূরেই অভ্রকে কোলে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মিষ্টি। মাথা চেপে ধরে বসে শুভ্রকে জিজ্ঞেস করলো শব্দের কি হয়েছে। শুভ্র জানায় “একটু আগে রুম থেকে বেরিয়ে মনে হলো তুই বাড়িতে নেই। তুই তো রাতে ঘুমাস না। বাড়ি পাহারা দেস। আজকে পাইনি। তাই ছুটলাম তোকে খুঁজতে। অবশ্যই তুই রোদ ছাড়া আর কারো কাছে যাবিনা। রাস্তায় তোকে পড়ে থাকতে দেখে নিয়ে এসেছি। কি হয়েছিল তোর?” শব্দ মৃদুস্বরে উত্তর দিলো “জানিনা, একটা কথা বলবি শুভ্র?” শুভ্র হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই শব্দ বললো “তোকে কি কখনো রোদ ভালোবেসেছিল? তুই কি এখনো রোদকে ভালোবাসিস? তুই বললে রোদ ফিরে আসবে ভাই? তুই একটু রোদকে বল না।” শুভ্র শব্দের গালে হাত রেখে বললো “দেখ ভাই রোদ কখনোই আমাকে ভালোবাসেনি। রোদ ভালো মেয়ে এই জন্য আমার আর্তনাদে ও কষ্ট পেতো। ওর মনে হতো ও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু মানুষ তার ভালোবাসাকে রেখে অন্য একজনের কাছে কেন যাবে বল? রোদ তো তোকে ভালোবাসতো। তাই তোকে রেখে আমার কাছে আসেনি। আর আমার কথা বলছিস? প্রথম ভালোবাসা মানুষ ভুলতে পারে না। হয়তো মনের কোথাও না কোথাও রোদের জন্য ভালো লাগাটা আছে। কিন্তু ভালোবাসাটা নেই। আর সব মিলিয়ে আমি মিষ্টির সাথে ভালো আছি। মিষ্টি আমার জীবনে না আসলে আমি সত্যি হয়তো রোদের শোকে দেবদাস হয়ে যেতাম। মিষ্টি যেভাবে আমাদের পরিবারটা আগলে রেখেছে অন্য কেউ হলে পারতো না। সেই রোদ চলে যাওয়ার পর ছোট্ট কাব্যকে নিজের মানুষ করেছে। কখনো আমাকে বলেনি আমার বাবু লাগবে। আমি জোর করেছি কিন্তু রাজি হয়নি। কাব্যকে বড় করে তারপরেই নিজের কথা ভেবেছে মেয়েটা। এতোকিছুর পরেও যদি বলি আমি মিষ্টিকে না অন্য কাউকে ভালোবাসি সেটা অন্যায় হবে। কিন্তু সত্যি তো আমি মিষ্টিকেই ভালোবাসি৷”
শব্দের অসুস্থতার কথা কাব্যকে বলা হলো না। খুব সকাল সকাল উঠে কাব্য শব্দের খোঁজ করলো। উদ্দেশ্য হলো নতুন বাড়ির ব্যবস্থা। কাব্য শব্দের রুমে আসতেই শব্দ কাব্যকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললো “তুমি আমার ছেলে, আমি জানি তুমি কোনো ভুল কাজ করবে না। আমি তোমার কাছে খারাপ হতে পারি, তুমি আমার কাছে খারাপ না। তাই নিজের আদর্শ ধরে রেখো। আমাদের বাড়ি থেকে দূরে এবং শহর থেকেও দূরে মানে যাতায়াতের মাঝখানে তোমার জন্য বাড়ি ঠিক করেছি৷ একাই থাকবে পুরো বাড়িতে।” কাব্য খুশি হয়ে শব্দকে জড়িয়ে ধরলো। রোদ যাওয়ার পরে এই প্রথমবার কাব্য শব্দকে জড়িয়ে ধরে। খুশি খুশি মনে কাব্য গিয়ে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে নিলো। শব্দ হালকা হেঁসে নিজের মনেই বললো “তুমি কে তা জানিনা। তবে আমার ছেলেকে যে সুপথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছো এতেই আমি খুশি।”
————————————
আজ সকাল সকাল ইমা আসলো বাড়িতে। প্রায় অনেকদিন পরে, কাব্য রাগারাগি করার পরে এই প্রথম আসলো। কাব্যকে বাড়ি ছাড়তে দেখে বেশ খুশি হয়ে যায় ইমা। কাব্য বাড়ি ছাড়লেই পাকাপোক্ত ভাবে এই বাড়িতে জায়গা করে নিতে পারবে সে। তাই নিজের হাতেই কাব্যের সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা কাব্যের মোটেই ভালো লাগলো না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সবাইকে উদ্দেশ্য করে কাব্য বললো “আমি যাচ্ছি মানে এই নয় যে একেবারে চলে যাচ্ছি। এটা আমার বাড়ি, আমার যখন খুশি আমি আসবো। দিনে একবার হলেও আসবো। এই বাড়ির সবাইকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না। তাই কেউ যদি ভেবে থাকে আমার মায়ের জায়গা আমার অবর্তমানে নিয়ে যাবে সেটা ভুল। মিষ্টি মা, এই সংসারের সব দায়িত্ব তোমার। এক বিন্দুও যেন অন্য কারো হাতে না যায়। চাচু আমার বাবার দায়িত্ব তোমার। নিজের খেয়াল তো নিজে নিতে পারবে না। তাই তোমাকেই এই দায়িত্ব দিলাম। আর বাবা দাদা দাদির দায়িত্ব তোমার।” অভ্রকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে কাব্য বললো “ভাই দুষ্টমি করবে না। আমি তোমার জন্য খেলনা নিয়ে আসবো কেমন?” অভ্র কাব্যকে পাল্টা চুমু দিয়ে বললো “ভাই তুমি তাড়াতাড়ি এসো?”
কাব্য তার নতুন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা একদম একা। ভালোই হলো, কেউ কিছু জানতে পারবেনা এই ভেবে মনে মনে খুশি হয় কাব্য। জিনিসপত্র ভেতরে রেখে সোজা কলেজে যায়। ইশমামকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাব্য। ইশমাম লজ্জা পেয়ে ছাড়াছাড়ির চেষ্টা করতেই কাব্য বলে “আরে আমার বউকে আমি ধরেছি তাতে কার কি? চুপ করে থাকো, এতো নড়াচড়া করছো কেন তুমি?” একইভাবে জড়িয়ে ধরে কাব্য বলে “আজ ক্লাস করতে হবেনা, বাসায় যাও। যা যা প্রয়োজনীয় সব নিয়ে এসো। বাসার ব্যবস্থা বাবা করে দিয়েছেন। আজকেই যাবে আমার সাথে।” ইশমাম কাব্যের বুকের মধ্য থেকে মাথা উঁচু করে বললো “কেন তুমি না বলেছিলে তোমার বাবা খুব রাগী? করলেন না রাগ? তোমার বাবার প্রতি তোমার অযথাই একটা নেগেটিভ ধারনা জন্মেছে।” কাব্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “তুমি বুঝবে না ইশু, সময় আসুক সব জানবে। তবে জানার পরে তুমি অন্তত আমার বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না। আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, তোমার জানার অধিকার আছে শুধুমাত্র এই জন্যই বলবো।”
চলবে?…..
রিচেক করা হয়নি, ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন৷
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০৬.
জঙ্গলের বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘর। ঘরের জিনিসপত্র ঠিক করতে, ফুল নিয়ে এসে ঘর সাজাতে বেশ অনেকটা সময় চলে যায়। আজ কাব্য ও ইশমামের বিয়ের পরে প্রথম রাত। যদিও আগে একরাত গিয়েছে, তবে সেদিন দুজনে আলাদা ছিল। ঘরটা দুজনে মিলে সাজিয়ে দুজনেই খুশি। টোনাটুনির সংসার বলে কথা৷ বিকেলে এসে শুভ্র কাব্যকে খাবার দিয়ে যায়। তখন ইশমাম বাইরে ছিল বলে ধরা পড়েনি। সেই খাবারই দুজনে মিলে ভাগ করে খেয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রাত ১০ টার দিকে সব কাজ শেষ করে দুজনে একজায়গায় নিশ্চিন্তে বসেছে।
ইশমাম আজ সেজেছে, কখনো না সাজলেও আজ কাব্যর জন্য সাজতে বড্ড ইচ্ছে করলো। দুজনে মিলে ছাঁদে গেলো চন্দ্র বিলাশ করতে। মৃদু বাতাসে ইশমামের মুখের উপরের চুল গুলো হালকা উড়ছে সেটাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে কাব্য। এই প্রথম কোনো মেয়ের কোলে মাথা রেখে গল্প করছে কাব্য। ইশমাম কাব্যের মুখের দিকে তাকালেই কাব্যের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। এক হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আবার কথা বলতে শুরু করে কাব্য। আজ তার জীবনের সব জটিলতা বলার সময় এসে গেছে। যা আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারেনি সে।
-বাড়িতে কে কে আছে কাব্য?
-ওমাহ্, তোমাকে বলা হয়নি? কিছু না জেনে শুনেই বিয়ে করে ফেললে? যদিও আমিও জানিনা তোমার বিষয়ে কিছু।
-তাতে কি? আমাকে ভরসা করো না?
-করি তো!
-তাহলে এখন বলো।
-বাড়িতে বাবা, শুভ্র চাচু, মিষ্টি মা, ছোট ভাই, দাদা এবং দাদি আছেন।
-মা?
-মা? আমি জানিনা মা কোথায়?
-আন্টি বেঁচে আছেন?
-তাও জানিনা।
-কি বলছো?
-হুম, আমার যখন পাঁচ বছর তখন দেখলাম একদিন তুমুল ঝগড়া করছে বাবা আর মা। তারপর মা রেগেমেগে চলে গেলো। আমাকে নিয়ে যেতে দেয়নি বাবা। বাবা নাকি ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিল কিন্তু মা আসেন নি। এখন বাবাও জানে না মা কোথায়।
-আর কোনো খোঁজ নেওনি তোমরা?
-নাহ্, আমি তো ছোট ছিলাম। বাবা বাড়ি থেকে মায়ের অস্তিত্ব মুছে দিলেন। যতটুকু আছে তাও আমার জন্যই আছে। আমি মাকে বিলীন হতে দিতে পারবো না। আমি মায়ের আদর ভালোবাসা পাইনি ইশু। বাবা আর খোঁজে নি মা’কে।
-তোমার বাবা তাহলে তোমার মা’কে ভালোবাসতেন না।
-না না তেমন না, বাবা প্রচুর ভালোবাসে মা’কে। প্রেম করে বিয়ে করেছিল দুজনে। বাবা কতো কেঁদেছে মায়ের জন্য। আমাকে আগলে রেখেছে সব সময়। এখনো কাঁদে বাবা, আমি দেখি। তবে মায়ের কথা মনে পড়লে এমনটা মনে হয় বাবা কেন ফিরিয়ে আনলো না। বাবার সব দোষ। তখন বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলি। তবে আমিও বাবাকে ভালোবাসি।
-তোমার উচিৎ তোমার বাবার থেকে দূরে থেকে তোমার বাবাকেও বোঝানো যে কাছের মানুষ দূরে থাকার কি যন্ত্রণা।
-কি বলো তুমি? বাবা ছাড়া আর কে আছে আমার?
-আমি আছিনা? আর কাকে লাগবে বলো তো?
-হুম
-তো? তোমার বাবাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তুমি তোমার বাবার সাথে কথা বলবে না।
-পারবো না এটা আমি।
-আহা করেই দেখো না, তাহলে তোমার বাবা তোমার মায়ের খোঁজ জানলে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে আনবে।
-সত্যি?
-হ্যাঁ
-আচ্ছা চলো ভেতরে যাই!
রুমে গিয়ে কাব্য ইশমামের কপালে চুমু দিয়ে পাশের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইশমাম আঁটকে দেয়। কাব্য ইশমামকে জড়িয়ে ধরে বললো “ইশু আমাদের বিয়ে হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু সমাজ স্বীকৃত হয়নি এখনো। তাছাড়া তুমি আমি দুজনেই ছোট অনেক। সময় হোক?” বলেই কাব্য পাশের রুমে চলে যায়।
অন্যদিকে ইমা কাব্যদের বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। বলতে গেলে একক রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে ইমা। শুভ্র এবং শব্দের বোন বলেই মিষ্টি কিছু বলছে না। তবে ইমা সারাদিন শব্দের সামনে ঘুরঘুর করে। কারনে অকারনে শব্দের রুমে গিয়ে আড্ডা জমায়। বিষয়টা একদমই মিষ্টি মানতে পারছে না। সেও মনে প্রানে চায় রোদ ফিরে আসুক। তাই এই বিষয়টা কাব্যকে জানাবে বলে মনস্থির করলো কাব্য।
সকাল সকাল শব্দ খাবার দিতে যায় কাব্যকে। কলিংবেল বাজানোর সাথে সাথেই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে “কে?” শব্দ এপাশ থেকে উত্তর দেয় “কাব্য আমি, বাবা।” কাব্য খুশি হয়ে দরজা খুলে দেয়। শব্দের মুখটা দেখেই গতকালকের ইশমামের বলা কথাগুলো মনে পড়ে কাব্যের। শব্দের হাত থেকে ছোঁ মেরে খাবারটা নিয়ে বললো “প্রতিদিন তোমাকে খাবার দিতে আসতে হবেনা বাবা। আমাকে টাকা পাঠিয়ে দিবে, আমি নিজে রান্না করে খাবো। তোমার মুখ আমার দেখতে মনে চায় না।” বলেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয় কাব্য।
শব্দ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, ছেলের মুখে এমন একটা কথা শুনতে হবে কল্পনাও করেনি সে। এতোই ঘৃনা করে যে মুখটাও অসহ্য হয়ে উঠেছে। চোখ থেকে টুপ করে পানি পড়লো নিচে। সূর্যের তীব্র তাপে নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো চোখের পানি।
বাড়ি ফেরার পথে শব্দ ভাবলো সে তার চেহারাটাই নষ্ট করে ফেলবে সে। যেন তার ছেলের আর চেহারা দেখে অসহ্য না লাগে।
পথেই শব্দ নিজের জ্বীনরুপে এসে হাত বাড়িয়ে হাতের বড় বড় নখগুলো বের করে নিজের মুখেই আঁচড় কাটতে যায়। পেছন থেকে কারো হাতের টান পেয়ে পেছনে ঘুরে তাকায় শব্দ। নিমিষেই রাগ দুঃখ গলে শান্ত হয়ে যায় শব্দ।
এদিকে খাবার নিয়ে ভেতরে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে কাব্য। ইশমাম দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। সবটা কাব্যের মুখে শোনার পর মুচকি হাসি দিয়ে ইশমাম বলে “যা করেছো বেশ করেছো। ওনার জন্য এটাই ঠিক আছে। চলো খেয়ে নিবে, কলেজে যেতে হবে তো।”
দুজনেই তৈরি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বাড়ির কাজ করতে করতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে যায় ওদের। প্রথম ক্লাস শুরু হওয়াতে কেউই ঢোকেনি ক্লাসে। কলেজের মাঠে বসে আছে কাব্য ও ইশমাম। হুট করেই ওদের পাশে অর্নিকে বসতে দেখে কাব্য কিছুটা দূরে সরে যায়। অর্নি ইশমামের দিকে ঝুঁকে বললো “কি ভয় পেয়ে গেলে নাকি?” ইশমাম অর্নির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো “তুমি যতটা ডেঞ্জারাস তার থেকে দ্বিগুন ডেঞ্জারাস কিন্তু আমি। তুমি দৃশ্যমান থাকো কিংবা অদৃশ্য। জিতবো কিন্তু আমিই।” অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ফের অর্নি প্রশ্ন করে “দুদিন তো হয়ে গেলো, বিয়ে করবে বলেছিলে না?” ইশমাম বিয়ের কথা বলতে যেতেই হাত চেপে ধরে কাব্য। কাব্যের ইশারা পেয়ে বিয়ের কথা লুকিয়ে ইশমাম বললো “সময় হলেই টের পাবে। এতো তাড়া কিসের?” অর্নি তাচ্ছিল্য নিয়ে হেসে বললো “তার আগে যদি কাব্যকে নিয়ে যাই আমি?” ইশমাম দাঁত কপাটি বের করে বললো “চেষ্টা করে দেখতে পারো।”
সামনাসামনি বসে আছে শব্দ এবং রোদ। নিজের ক্ষতি কেন করতে চাইছে শব্দ সেটা বুঝতে পারছে না রোদ। বারবার জিজ্ঞেস করেও ব্যর্থ হচ্ছে রোদ। শব্দের মনের মধ্যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সে কোনোভাবেই রোদকে কাব্যের অবনতির কথা জানাতে পারবে না। কোনো একদিন যদি রোদের সবটা মনে পড়ে তখন শব্দের দিকে যেন আঙুল তুলতে না পারে যে শব্দ তার ছেলেকে সঠিকভাবে তৈরি করতে পারেনি। তাই চুপটি করেই বসে আছে শব্দ।
-মিঃ শাহরিয়ার, আপনি ঠিক আছেন?
-জ্বী হ্যাঁ
-অমন করছিলেন কেন?
-ফ্যামিলি প্রবলেম।
-ওহ আচ্ছা, ফ্যামিলি প্রবলেম হলেই এমন করতে হয়না মিঃ শাহরিয়ার। ধৈর্য্য ধরে ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করবেন।
-হুম, আপনি এই সময়ে এখানে?
-অর্নিকে কলেজে দিতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে আপনাকে দেখলাম।
-একটা কথা জিজ্ঞেস করি? কোনো রেষারেষি থেকে উত্তর দিবেন না। সৎ ভাবে উত্তর দিবেন।
-চেষ্টা করবো, বলুন
-অর্নি আপনার নিজের মেয়ে?
-নাহ্,তবে নিজের মেয়ের থেকে কম ভালোবাসি না আমি।
-তাহলে অর্নি কে?
-আমি জানিনা ও কে, যতটুকু মনে আছে একদিন আমি ঘুম থেকে উঠলাম। বাচ্চার চিৎকার পেলাম বাইরে এসে দেখি অর্নি। তখন ছোট ছিল একদম। তখন থেকেই আমিই ওর মা।
-আপনার মনে হয়নি? যে অর্নিকে কেউ ইচ্ছে করে আপনার কাছে দিয়ে গেছে?
-আমার কোনে শত্রু নেই মিঃ শাহরিয়ার। আর আমার তো কেউ নেই পৃথিবীতে তাই ওকে নিয়েই বাঁচতে আরম্ভ করলাম।
-সত্যিই কি আপনার কেউ নেই?
-আজ আসি মিঃ শাহরিয়ার, এরকম কাজ আর করবেন না।
রোদ চলে যায়, শব্দ রোদের যাওয়ার পথের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনটা খারাপ হলেও রোদের যে নতুন সংসার হয়নি সেটা ভেবেই লুঙ্গি ডান্স দিলো শব্দ। কয়েকবার মুখ দিয়ে শিষ বাজিয়ে খোকাবাবু যায় স্টাইলে নাচতে নাচতে বাড়িতে পৌঁছায় শব্দ।
চলবে?..
রিচেক করা হয়নি, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন৷
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০৭.
দুদিন ধরে শব্দ ঘরের দরজা খুলছে না। বাইরে দাঁড়িয়ে শুভ্র-মিষ্টি সহ বাড়ির সবাই দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। শব্দের যখন মন চাইবে তখনি সে বের হবে। এছাড়া কেউ তাকে রুম থেকে বের করতে পারছে না। প্রথমে সবাই ভেবেছিল কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে তাই বিরক্ত করেনি। কিন্তু কাহিনী ঘটে যাচ্ছে। রুমের ভেতর থেকে কখনো কখনো ভেসে আসছে রোমান্টিক হিন্দি গানের কয়েকটা লাইন। আবার কখনো ভেসে আসছে কোমড় দোলানোর নাচের গান। শুভ্র আছে মহা মুশকিলে, ভাইয়ের কি হয়েছে সেটা সে ভাই হয়ে ধরতে পারছে না। এর থেকে দুঃখের কথা আর হতেই পারেনা। তাই অবশেষে একপ্রকার বাধ্য হয়ে অদৃশ্য হয়ে শব্দের রুমে ঢোকে শুভ্র।
শব্দকে এই অবস্থায় দেখে ফট করে চোখ বন্ধ করে নেয় শুভ্র। ভুল দেখেছে কিনা সেটা ভেবে আবার চোখ পিটপিট করে তাকায় শুভ্র। কিন্তু না যা দেখছে সব সত্যি। এক কোনায় আপাতত খুব যত্ন করে রাখা আছে সাউন্ড বক্স। যেটা দীর্ঘকাল অনাদরে পড়ে ছিল। এদিকে শব্দ রোদের একটা শাড়ী গায়ে জড়িয়ে নেচে যাচ্ছে। কখনো কখনো রোমান্টিক গানে শাড়ীর আঁচল ধরে কাপল ডান্স করছে, আবার কখনো কখনো বাদরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে কোমড় দুলিয়ে উরাধুরা ডান্স করছে। শেষে ভাইয়ের মাথাটা সত্যি সত্যিই পরপারে চলে গেছে কিনা সেটা ভেবে আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখে পানি চলে এলো শুভ্রর।
বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে ধরাম করে শব্দর মাথায় ছুড়ে মারলো। মাথায় হাত দিয়ে মুখ দিয়ে আউচ শব্দ করে বসে পড়ে শব্দ। শুভ্রকে দেখে হ্যাবলার মতো দাঁত বের করে এগিয়ে এসে বললো “আরে ভাই যে, আয় আয় বস।” পরমুহূর্তেই নিজের দিকে তাকিয়ে রোদের শাড়ী গায়ে জড়ানো দেখে দ্রুত শাড়ীটা খুলে বিছানায় ছুড়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যায় শব্দ। শুভ্র কপালে হাত দিয়ে বললো “কি হয়েছে তোর? এগুলো কি?” শব্দ নিজের হাসি আঁটকে রাখতে পারছে না। মুখে হাত দিয়ে মুখ টিপে হেঁসে বললো “আরে খুশির খবর আছে। আমি কি মিছেমিছি এমন করছি? তুই শুনলে তুইও নাচবি।” শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শুভ্রকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতে দেখে শব্দ বললো “কিহ্? বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা শোন তাহলে, রোদ আছেনা? ও আসলে বিয়ে করেনি আর। তার মানে রোদ এখনো আমার বউ। অর্নিও ওর আসল মেয়ে না। কি যে করবো আমি খুশিতে। আসলে আমি বুঝতে পারছিনা কি করবো। আমার এই খুশিটা সেলিব্রেট করবো কিভাবে একটু বলে দে না প্রিয় ভাই।” শুভ্র খিলখিল করে হেঁসে বললো “ভাই তুই দুদিন ধরে সেলিব্রিট করছিস। আর কি আইডিয়া দিবো বল তো তোরে? আর এতো খুশি হচ্ছিস যে? রোদের বিয়ে না হলেই কি তোর কাছে ফিরে আসবে?”
শুভ্রকে বসিয়ে শব্দ নিজে পাশে বসতে বসতে বললো “ভাই তুই তো দেখছি ঘর শত্রু বিভীষণ। ভাইয়ের খুশিতে জল ঢেলে দিচ্ছিস?” শব্দকে টেনে ঘর থেকে বের করে টানতে টানতে বললো “চল কাব্যকে দেখে আসি।” কাব্যর কথা শুনে শব্দের মুখ চুপসে গেলো। হাত ছাড়িয়ে বললো “না রে তুই যা, ও বলেছে আমার মুখ দেখলে ওর ঘৃনা করে।” শুভ্র তবুও শব্দকে টানতে টানতে নিয়েই গেলো। কলিংবেল বাজাতেই অপর পাশ থেকে আওয়াজ আসলো “কে ওখানে?” শুভ্র জবাব দিলো “কাব্য আমি শুভ্র।” কাব্য নাচতে নাচতে এসে দরজা খুলে দিলো। কতদিন পর শুভ্রর সাথে দেখা হচ্ছে তার। খুশি মনে দরজা খুলে সামনে শুভ্রর সাথে শব্দকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো কাব্যর। মুখে প্রকাশ না করে দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলতে আরম্ভ করলো কাব্য। কাব্যকে সরিয়ে শুভ্র হাসিমুখে শব্দের হাত ধরে ভেতরে ঢুকে ঘর দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এবার কাব্যর শুভ্রর উপরেও রাগ হলো। দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললো “কারো পারমিশন না নিয়ে তার বাসায় ঢোকা নিষেধ জানোনা তুমি?” শুভ্র ভাব নিয়ে সোফায় বসে বললো “আমাকে তোর বাবা ভাবিস না যে যা বলবি সব শুনবো। এতো ভালো আমি নই। এতোটাও বড় হয়ে যাস নি যে তোর বাড়িতে ঢুকতে আমার পারমিশন লাগবে। সবথেকে বড় কথা বাড়িটা আমার, তোর নয়। বাড়িতে আর কে থাকে?”
কাব্য আমতা আমতা করে বললো “কেউ না চাচু, একাই থাকি আমি।” শুভ্র বাঁকা হেসে বললো “একা থাকাই ভালো, তবে মিথ্যে ভালো না। তোর ধারনা নেই আমরা দুই ভাই কি পারি। আছিস, থাকতে দিলাম। তবে সাবধানে খেয়াল রেখে থাকবি। বাবাকে কি বলেছিস?” কাব্য মাথা নিচু করে বললো “কই কিছু না তো!” শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “জানিনা তোর কোন মতিভ্রম হয়েছে। আগে তো এমন কথা কখনো বলিস নি। একটা কথা, এতোদিন তোর বাবাকে তুই বলেছিস তাই কিছু বলিনি। তবে আমার ভাইকে কিছু বললে আমি ছেড়ে দিবো না। চল শব্দ যাই!”
দুজনে বের হওয়ার আগে দরজার ওপাশে ইশমামকে দেখতে ভুল করলো না। দুজনে হাঁটছে জঙ্গলের রাস্তা ধরে।
-শব্দ, মেয়েটা কে?
-কাব্যর বউ
-মানে?
-কাব্য বিয়ে করেছে।
-কবে?
-৫ দিন হলো
-জানতি তুই?
-হু
-খোঁজ নিয়েছিস কে?
-নাহ্, নিতে মন চাইলো না। কাব্য ভুল কাজ করবে না। আর এখানেও যদি আমি বাঁধা দেই তাহলে ভাববে আমি ওর সুখ কেঁড়ে নেই।
-তবুও..
-বাদ দে
পেছন থেকে কারো ডাকে থমকে দাঁড়ায় দুজনে। চোখ বড় করে দুজনেই পেছনে তাকায়। রোদ আসছে দৌড়ে। সেই কিশোরী কন্যার মতো পিঠে চুলের গোছা ছড়িয়ে। শুভ্র ফট করে চোখ বন্ধ করে নিয়ে বললো “শব্দ তোর বউয়ের দিকে তুই তাকা। আমার বউ বাচ্চা আছে রে। এখন যদি উল্টা পাল্টা কিছু হয়ে যায় মিষ্টি আমাকে জুস বানিয়ে দিবে রে।” শব্দ নিজের বুকে হাত রেখে শুভ্রর গায়ে হেলান দিয়ে বললো “আরো একবার প্রেমে পড়ে গেলাম। পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী নারী আমার।” রোদ সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো “আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?”
শব্দ আর শুভ্র নিজেদের ঠিক করতে ব্যস্ত। শব্দ কথা বলতে পারছে না। শুভ্রকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করলো কথা বলতে। শুভ্র রোদকে উদ্দেশ্য করে বললো “কাব্যর কাছে গিয়েছিলাম, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?” রোদ ভ্রু কুঁচকে বললো “আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন যে?”
পথের মাঝেই একটা গাছের গুঁড়ির উপরে তিনজনে বসে কথা বলতে লাগলো। তবে শব্দ একটা কথাও বললো না। সে একদম চুপচাপ। শব্দকে কথা বলতে না দেখে রোদ বললো “মিঃ শাহরিয়ার? আপনি ঠিক আছেন? কথা বলছেন না যে?” শুভ্র শব্দের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো “দেখলি আমি এতো কথা বলছি রোদ কানেই নিচ্ছে না। অথচ তুই কথা বলছিস না সেটা নিয়ে মাথাব্যথা ওর।” শব্দ ফের শুভ্রকে খোঁচা মেরে বললো “আরে না না আমি ঠিক আছি। আপনি কোথায় গেলেন?” রোদ প্রতুত্তরে বললো “কলেজে, সামনেই তো প্যারেন্টস মিটিং আছে। অর্নির জন্য যেতে হবে তো আপনি যাবেন না?” শব্দ নিশ্চুপ, ছেলের সামনে রোদ পরলে ছেলেকে সামলানো যাবেনা।
———————————–
এদিকে কাব্যকে সামনে বসিয়ে এক ঘন্টা ধরে বকাবকি করে যাচ্ছে ইশমাম। কারন একটাই, শব্দ ও শুভ্রর সাথে কেন কথা বললো। এক পর্যায়ে কাব্য রেগে গিয়ে বললো “তুমি কি চাইছো বলো তো? আমার বাবার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ মানলাম। কিন্তু আমার চাচু কি করেছে? ছোটবেলা থেকে আমাকে মানুষ করেছে। তাদের ভুলে গিয়ে তোমার এই ৫ দিনের ভালোবাসার জন্য খারাপ ব্যবহার করবো আমি? আমি আমার বাবার কথাও শুনিনা, আর তুমি আমাকে শাসাচ্ছো? ভালোবাসি বলেই কিছু বলছি না আমি। তবে লিমিট ক্রশ করবে না ইশু।” বলেই গটগট করে বাইরে বেরিয়ে যায়। সাংসারিক জীবন এমন জানলে এতো তাড়াতাড়ি বিয়েই করতো না সে। হয়তো এমন কোনো কারনের জন্যই বাবা এবং মায়ের মধ্যে সেদিন ঝগড়া হয়েছিল। সেই দিনটার কথা চোখের সামনে আসতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে কাব্য। মা থাকলে তার জীবনটা, তার পরিবারটা আজ এমন হতো না। একটা সুখী পরিবার থাকতো তাদের।
রাগ করেই বাড়ির দিকে রওনা দেয় কাব্য। আজ থাকুক একা ইশমাম। দেখুক একা থাকতে কেমন লাগে। আজ কিছুতেই ইশমামের কাছে যাবেনা সে। এদিকে রাস্তায় এখনো কথা বলে যাচ্ছে রোদ সহ শুভ্র এবং শব্দ। শব্দ কিছুটা আঁচ করতে পেরে শুভ্রকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। রোদ দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে আপনাদের?” শব্দ আমতা আমতা করে বললো “মিসেসঃ শাহরিয়ার আপনি বাড়ি যান। আমি আপনার সাথে পরে কথা বলবো। আজকে আমাদের একটু কাজ আছে কেমন? যাচ্ছি!”
শুভ্রকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো শব্দ। রোদ কিছু না বুঝেই ঠোঁট উল্টে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলো। রোদ যেতেই শব্দ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। শুভ্র হাত ছাড়িয়ে ধমক দিয়ে বললো “কি হয়েছে? এভাবে টেনে আনলি কেন?” শব্দ চুপিচুপি বললো “কাব্য আসছে।” শব্দের কথা শেষ হওয়ার আগেই কাব্য বাড়ি পৌঁছালো। শব্দের দিকে তাকিয়ে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে কাব্য বললো “সরি চাচু, বাবাকেও সরি বলে দেও আমার পক্ষ থেকে।” শুভ্র খুশি হয়ে কাব্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
————————————-
অন্যদিকে কাব্যর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যায় ইশমাম। ঘুম থেকে উঠে দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফোন হাতে নিয়ে কাব্যকে কল করতেই ফোন বন্ধ পেলো। বাড়ি জঙ্গলের দিকে হওয়াতে ঘর থেকে বের হয়নি ইশমাম।তবে অনুভব করতে লাগলো ঘরে ইশমাম ছাড়াও আরো কেউ আছে। রাতের খাবার খেয়ে রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো ঘরের এক কোনায় সাদা জুব্বা পড়া কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। যাদের শরীর থেকে আলো ছড়াচ্ছে। তারা হাত বাড়িয়ে বললো “কাব্য কোথায়? কাব্যকে নিতে এসেছি আমরা।” ইশমাম ভয়ে জোরে চিৎকার করলো। ইশমামের চিৎকারে লোকগুলো নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। ইশমাম যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিজের মনের ভুল ভেবে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু মাথা থেকে এই ঘটনাটা দূর হচ্ছে না তার। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে যায় ইশমাম। মাঝরাতে বিরক্তিকর আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় ইশমামের। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো রুমের জানালার কাচে রক্ত। কালো একটা বস্তু জিহ্বা দিয়ে চেটে রক্ত গুলো খাচ্ছে এবং বড় বড় নখগুলো দিয়ে আঁচড় কাটছে।
চলবে?…..
রিচেক করা হয়নি, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০৮.
দুদিন ধরে কাব্য ইশমামের কাছে বাড়িতে যাচ্ছে না। কলেজেও দেখা পাচ্ছে না ইশমাম। বাড়িতে থাকতে থাকতে ইশমাম অতিষ্ট হয়ে গেছে। প্রতি রাতেই সাদা জুব্বা পড়া লোকগুলো এসে কাব্যকে চায়। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও পরবর্তীতে দেখা গেলো সবটাই সত্যি। এর মাঝে ইশমাম রুমে ঢুকে দেখতে পেলো নিজেই ফ্যানে ঝুলে আছে। নিজের ঝুলন্ত লাশ দেখে কলিজা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায় ইশমামের। দুদিন ধরে খাওয়া ঘুম সব বাদ দিয়ে দিয়েছে ইশমাম। কাব্যর বাড়ি ইশমাম চেনে না, নাহলে আগেই চলে যেতো সেখানে। ফোন বের করে কাউকে কল করে বললো “আপনি তো বলেছিলেন কোনো সমস্যা হবে না, হলো তো। কাব্যও আসছে না, বাড়িতে গিয়ে বসে আছে। আপনি কোথায়? আমি এখানে থাকবো না। কিহ্? কবে? আচ্ছা ঠিক আছে।”
কলেজে প্যারেন্টস মিটিং আজ, সবাইকেই যেতে হবে। শব্দ প্রথমে যেতে নাকচ করলেও সবার জোড়াজুড়িতে রাজি হলো। তবে কাব্যকে রোদের থেকে যতটা আড়াল করা যায় সে করবে। প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে আছে শব্দ। কাব্যর সাথে রোদের দেখা হলে কাব্যকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। শব্দ ভেবেছিল রোদকে মনে করিয়ে তারপর কাব্যর সামনে আনবে। তা আর হচ্ছে কই? না পড়ছে রোদের কিছু মনে, না হচ্ছে প্ল্যানমতো কিছু।
কলেজে পৌঁছেই অর্নি খুশি খুশি মনে কাব্যকে খুঁজে যাচ্ছে। আজ রোদের সাথে কাব্যের দেখা করিয়েই ছাড়বে অর্নি। কিন্তু কাব্যর দেখা নেই। দূর থেকে কাব্যকে দেখেই অর্নি দৌড়ে সামনে এসে আগে শব্দকে সালাম দিলো। কুশল বিনিময় করে কাব্যকে বললো “কাব্য চলো না, মাম্মাম এসেছে। তোমার সাথে দেখা করবে৷” শব্দ যেন আকাশ থেকে পড়লো। যেটার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হচ্ছে। চোখগুলো বড় বড় করে বললো “না মা তুমি যাও, আমরা আরেকদিন দেখা করবো। আজকে বাড়িতে অনেক কাজ বুঝলে? কয়েকদিন পরেই কাব্যর জন্মদিন। সব ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা না হয় তোমাদের বাসায় ইনভাইট করার সময় তোমার মাম্মামের সাথে দেখা করবো কেমন?” ওইদিন রাতের ঘটনার পর থেকে অর্নি একটু রয়েসয়ে চলে শব্দের থেকে। তাও ভয়ে ভয়ে বললো “না আঙ্কেল, আজকে তো এখানে ঘন্টা খানেকের মতোই মিটিং হবে। একটু সময়ই তো চলুন না আপনারা।” কাব্য একবার অর্নির দিকে তাকাচ্ছে, একবার শব্দের দিকে তাকাচ্ছে। শেষে শব্দ বাধ্য হয়ে বললো “আচ্ছা মিটিং শেষে দেখা করে আসবো কেমন?” অর্নি মাথা নাড়িয়ে মন খারাপ করে চলে যায়।
মিটিংয়ের সময় বেশ অনেকটা দূরত্বে আড়ালে বসলো শব্দ। যদিও রোদ কয়েকবার শব্দকে দেখার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। মিটিং শেষে সবাই বের হওয়ার আগেই শব্দ কাব্যকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। শব্দের এমন ব্যবহারে কাব্য বললো “বাবা তুমি অর্নির মায়ের সাথে দেখা করতে চাইছো না কেন?” শব্দ আড়চোখে তাকিয়ে বললো “অর্নির মা অর্নির সাথে তোমার বিয়ের কথা বলবে। করবে তুমি অর্নিকে বিয়ে? ” কাব্য থতমত খেয়ে বললো “না না আমার বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি? চলো চলো বাসায় চলে যাই।” শব্দ খুশি হলো। কাব্যকে নিয়ে পা বাড়াতেই কোথা থেকে দৌড়ে এসে একপ্রকার হামলে পড়লো অর্নি। আবার রিকুয়েষ্ট করতেই এবার শব্দ চোখ রাঙিয়ে তাকালো অর্নির দিকে। অর্নি ভয় পেয়ে কাব্যর হাত ছেড়ে দেয়। রোদকে আসতে দেখে কাব্যকে নিয়ে শব্দ এক কোনায় ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু একদম শেষ মুহুর্তে কলেজের গেট থেকে অর্নি ও রোদ বের হওয়ার সময় কাব্যর চোখ পড়লো ওদের দিকে। রোদকে দেখে কাব্যের বুকে ঢিপঢিপ করা শুরু হলো। শব্দের হাত ছেড়ে দৌড়ে গেটের দিকে গেলো। তবে গেট থেকে কোন দিকে গেছে সেটা বুঝতে পারছে না কাব্য। কাব্যর পেছনে পেছনে শব্দ দৌড়ে এসে বললো “কি হয়েছে কাব্য? দৌড়ে আসলি যে?” কাব্য পাগলের মতো শব্দকে বললো “বাবা বাবা আমি মাকে দেখেছি। বাবা, মা এখানেই ছিল। অর্নির সাথেই ছিল, বাবা আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি মাকে চিনতে ভুল করবো না বাবা। মা বেঁচে আছে, তুমি মাকে এনে দেও বাবা।” শব্দ নিজেকে সামলাতে পারছে না। কাব্যর কান্নাকাটিতে পুরো কলেজের মানুষ জড়ো হচ্ছে। শব্দ কাব্যকে ধরে জোর করে বাড়ির দিকে নিয়ে আসছে। কাব্য বাড়িতে আসবে না। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে রাস্তায় বসে পড়ে।
শব্দ কাব্যর পাশে বসে কাব্যর মাথায় হাত রাখতেই কাব্য শব্দকে জড়িয়ে ধরে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। শব্দ বললো “রোদের কিছু মনে নেই কাব্য। আমি আরো আগে থেকেই ওকে মনে করানোর চেষ্টা করাচ্ছি। কিন্তু রোদের কিছু মনে নেই। আমি চেয়েছি রোদের সবটা মনে করিয়ে তোর সামনে আনতে। এই এখন যেই কষ্টটা পাচ্ছিস এটা তোকে দিতে চাইনি আমি।” কাব্য কাঁদতে কাঁদতে বললো “মায়ের কিছু মনে নেই কেন বাবা? মা কেন ছেড়ে গেছে আমাদের?” শব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “একটা মুকুটের জন্য। একটা মুকুটের জন্য তোর মায়ের স্মৃতি চলে যাচ্ছে।” কাব্য চোখমুখ মুছে বললো “আমি মায়ের সাথে দেখা করবো। তবে কিছু বলবো না তুমি মনে করানোর আগে। শুধু মা’কে দেখবো।” শব্দ মুচকি হেঁসে কাব্যর কপালে চুমু দিয়ে বললো “এখন কি আমার বাসায় যাবি নাকি তোর বাসায়?” কাব্য উঠে দাঁড়িয়ে বললো “তুমি বাসায় যাও বাবা, আমি একটু ঘুরে আসি। তুমি কিন্তু একা মায়ের সাথে দেখা করবে না। আমাকে নিয়েই যাবে।”
————————————-
সামনাসামনি বসে আছে কাব্য ও ইশমাম। ভয়ে চুপসে আছে মেয়েটি। গত তিনদিন কেন বাড়িতে ফেরেনি কাব্য সেটা নিয়ে তার অভিযোগের শেষ নেই। চোখের তলায় কালো হয়ে আছে। কাব্যের মনে হলো আরো একবার বোধহয় প্রেমে পড়ে গেলো সে। ইশমামকে ছুঁয়ে দিতেই ভয়ে কেঁপে উঠছে সে। কাব্য বার কয়েক বোঝানোর চেষ্টা করলো এটা কাব্য, অন্য কেউ না। ইশমাম বুঝতে পারলেও গত তিন রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো তার পিছু ছাড়ছে না। ইশমামকে বসিয়ে রেখে নিজেই খাবার তৈরি করলো কাব্য। খাবার নিয়ে এসে ইশমামকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো কি ঘটেছে। ইশমাম একে একে সব ঘটনা খুলে বললেও কাব্য বিশ্বাস করলো না। কাব্য ভাবলো কাব্যকে বাড়িতে রাখার জন্যই ইশমাম এমনটা করছে। তবে মুখে সেটা প্রকাশ করলো না। ইশমামের কপালে চুমু দিয়ে বললো “ঘুমিয়ে পড়ো, আমি আজ অনেক ক্লান্ত। ঘুমাতে হবে আমাকে, আমি যাচ্ছি।” কাব্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে টেনে ধরলো ইশমাম। কাব্যকে জড়িয়ে ধরে জানালো সে এই ঘরে একা থাকতে পারবে না। সে কাব্যর সাথেই থাকবে। তবে কাব্য রাজি হলো না। ইশমামের মুখটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো “ইশু বোঝার চেষ্টা করো। আমরা এক জায়গায় থাকতে পারবো না। এটা সম্ভব না!” ইশমাম কোনো কথাই শুনলো না। অগত্যা কাব্যকে ইশমামের রুমেই ঘুমাতে হলো।
ইশমামকে বুকে নিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো “জানো ইশু আমি মা’কে খুঁজে পেয়েছি।” ইশমাম চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো “কি বলছো এসব?” কাব্য হালকা হেঁসে বললো “সত্যি বলছি।” ইশমাম চোখ রাঙিয়ে বললো “ওটা তোমার মা নয়, হয়তো তুমি ভুল মানুষকে পেয়েছো। তোমার মায়ের তো খোঁজই নেই। মরে গেছে কিনা কে জানে।” কাব্য ধমক দিয়ে বললো “ইশু এসব কি কথা? কোনো কথা আঁটকায় না তোমার মুখে? আমি দেখেছি, বাবা বলেছে ওটা আমার মা।” ইশমাম এবার চোখমুখ লাল করে বললো “তোমার বাবাকে তুমি বিশ্বাস করো? ছোট থেকে তোমার পছন্দের কোনো মূল্য দিয়েছে তোমার? আজ একদম বাবা ভালো হয়ে গেলো? তোমার চোখে ভালো সাজার জন্য কোন মহিলাকে তোমার মা সাজিয়ে এনেছে কে জানে?” কাব্য সোজা বুক থেকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো ইশমামকে। চোখ রাঙিয়ে বললো “তোর মতো মেয়ে আমি কখনো দেখিনি। বিয়ের এক সপ্তাহ হয়নি এখনো, শশুর বাড়িতে যাসনি এখনো। এখনি শশুর শাশুড়ীকে নিয়ে তোর এতো সমস্যা? একটা কথা কান খুলে শোন, আমার সাথে থাকতে হলে আমার পরিবারের সাথে মানিয়ে চলতে হবে। আমার সাথে আমার পরিবারের যে সম্পর্কই থাকুক। তোর ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে।”
———————————
রোদের সামনে বসে আছে শব্দ ও শুভ্র। কাব্যের জন্মদিনের দাওয়াত দিতেই এসেছে তারা। রোদ অবাক হয়। যেই লোক কয়েকদিন আগে তার ছেলের সাথে অর্নির বিয়ে দিতে রাজি হয়নি আজ সেই লোক এতো যাতায়াত করছে? কাব্য এখনো পৌঁছাতে পারেনি। তাই শব্দ ও শুভ্রও চুপচাপ বসে আছে। প্রায় বিশ মিনিট পরে দৌড়ে অর্নিদের বাসায় ঢোকে কাব্য। রোদকে একদম কাছ থেকে দেখে সামলাতে পারলো না নিজেকে। রোদের দিকে এগিয়ে যেতেই শুভ্র হাত ধরে টান দিয়ে নিজেদের পাশে কাব্যকে বসিয়ে দাঁত বের করে হাসি দিলো। শুভ্রর দেখাদেখি শব্দও দাঁত বের করে হাসি দিলো। শব্দকে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাব্য শুভ্রর কানে কানে বললো “চাচু, বাবা অমন করে তাকিয়ে আছে কেন মায়ের দিকে?” শুভ্র কানে কানে বললো “তোর বাবা যেমনি হোক বিয়ের পর থেকে রোদের দেখা পেলেই হ্যাবলা হয়ে যায়।” কাব্য কুটকুট করে হেঁসে বললো “ঠিক তোমার মতোই!” শুভ্র মুখটা ছোট করে ধমক দিয়ে বললো “চুপ থাক, একদম বাপের মতো। বাপকা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া।”
চলবে?…
[লেখার সময় পাইনি, তাই এতোটুকুই আজকে। নেক্সট পর্ব বড় করে দিবো। রিচেক করা হয়নি]
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ০৯.
মোবাইলে বেশ জোরেই চেচিয়ে কথা বলছে ইশমাম। ইতিমধ্যেই কাব্য ঘরে ঢুকলো। কাব্যকে দেখে ইশমাম থতমত খেয়ে যায়। ফোনটা হাত থেকে রেখে কাব্যকে জড়িয়ে ধরে বলে “আজ বাড়িতে যাবেনা? যাও বাবার সাথে দেখা করে আসো। আজ ফিরবে? আচ্ছা ইচ্ছে না হলে ফিরতে হবেনা। আমি মেনেজ করে নিবো আজ রাতটা।” কাব্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো। যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে তার। যেই মেয়ে গত রাতেই তার পরিবারের বিরুদ্ধে তাকে ইন্ধন যুগিয়েছে আজ সেই বলে ওই বাড়িতে যেতে। কাব্য মনে মনে ভাবলো গত রাতের দেয়া ধমকগুলো কাজে লেগেছে তাহলে। শুধরে যাচ্ছে ইশমাম। কাব্যও জড়িয়ে ধরেই বললো “তা যাবো এখনি, তোমার সাথেই দেখা করতে এলাম। কার সাথে কথা বলছিলে?” ইশমাম যেন এই প্রশ্নের উত্তর আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল। প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই বললো “বাবার সাথে, দেখলে না চেচিয়ে কথা বললাম। বাবা বাড়িতে যেতে বললো, আমি বললাম যাবো না।” কাব্যও ইশমামের কথা বিশ্বাস করে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। কিছু কিছু সময় আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষদের অন্ধবিশ্বাস করে থাকি। কিন্তু আমরা এটা ভুলে যাই সব মানুষ ভালোবাসার যোগ্য হতে পারেনা। তাই অন্ধবিশ্বাস করাটাও বোকামি।
—————————————
সামনাসামনি বসে আছে ইমা ও ইশমাম। ইমাকে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে ইশমাম বললো “আপনি বলেছিলেন না কাব্যর মা নেই। এখন উড়ে এসে জুড়ে বসলো কিভাবে? আর এসব কি? এই বাড়িতে এসব কি হচ্ছে?” ইমা চোখ রাঙিয়ে বললো “চুপ থাকো, তোমার কথা শুনার জন্য আমি তোমাকে রাখিনি। মালিকের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা বোধহয় ভুলে গেছো তুমি। রোদ কোথা থেকে আসবে? তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আর বাড়িতে কি দেখেছো তুমি?” ইশমাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “ঠিক বলেছেন, আমার দুর্ভাগ্য যে আপনি আমার মালিক। আর আপনার সৌভাগ্য যে আমি আপনার চাকর। রোদ এসেছে, শীঘ্রই টের পাবেন। আপনার দেখা স্বপ্নের সংসার ভাঙতে চলেছে ম্যাম। বাড়িতে যা দেখেছি আপনাকে তো আগেই জানিয়েছি আমি।” ইমা ভয় পেলো, শব্দ যে জ্বীন কিংবা কাব্য যে জ্বীনসন্তান সেটা তো ইশমাম জানেনা৷ অগত্যা কথা পাল্টে বললো “নতুন বাড়িতে এসেছো তাই তোমার ভুল ধারনা হচ্ছে। আমি আসছি, কাজটা ঠিক করে করো। আমি কিন্তু কোনো ফলাফল দেখতে পাচ্ছি না ইশমাম। এমন করলে তোমাকে রাখা তো ঠিক হবেনা। রোদের বিষয়টা আমি সামলে নিচ্ছি। আমার স্বপ্ন শেষ হতে দিবো না আমি। দরকার হলে এবার আমার হাতেই রোদকে মরতে হবে। তোমাকে যেন ছাঁটাই করা না লাগে।” হাতে ব্যাগ নিয়ে বাইরে বের হওয়ার জন্য পা দিতেই পেছন থেকে ইশমাম ডেকে বললো “আমাকে ছাঁটাই করা সহজ নয় ম্যাম। আমি ওই বাড়ির বউ এবং কাব্য আমাকে ভালোবাসে।” ইমা বাঁকা হেসে বললো “একটা প্রবাদ বাক্য শুনেছো? পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে!” প্রতুত্তরে ইশমামও হেঁসে বললো “সেইম টু ইউ ম্যাম।”
—————————————
কাব্যর জন্মদিন আজ, চারদিক খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে অভ্র বলছে “আজ ভাইয়ের বিয়ে, আজ ভাইয়ের বিয়ে।” অভ্রকে যতবার বলা হয় এটা বিয়ে নয়, এটা জন্মদিন। ততবার অভ্র ভুলে গিয়ে নেচে নেচে বলে “আজ ভাইয়ের বিয়ে।” শেষে মিষ্টি হাল ছেড়ে দিয়ে নাকমুখ কুঁচকে বললো “একদম বাপের মতো হয়েছে। জীবনটা তেজপাতা করে দিলো আমার।” কথাটা শুনতে পেয়ে শুভ্র একটানে মিষ্টিকে পাশের রুমে নিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললো “জীবন তেজপাতা করে দিয়েছি আমি? তাহলে তেজপাতার তেজটা একটু বুঝিয়ে দেই?” মিষ্টি কিছু বলার আগেই মিষ্টির ঠোঁটে মিষ্টি একটা চুমু বসিয়ে দেয় শুভ্র। রুমের বাইরে থেকে শব্দ ডাক দিতেই শুভ্র নিজের কপাল চাপড়ে বললো “আরে ভাই নিজে তো বউয়ের অভাবে রোমান্স করতে পারছিস না। আমাকেও রোমান্স করতে দিস না। আমার কি বউ নেই নাকি? তোর মতো বিধবা নাকি?” কথাগুলো অবশ্য শব্দের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। সে সমানে শুভ্রকে ডেকেই চলেছে। অবশেষে মিষ্টি উপায় না পেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। শুভ্র গিয়ে দরজা খুলে দিলো। শব্দ এসে শুভ্রের সাথে কথা বলা শেষ করে ফিরে যাওয়ার সময় বললো “তুই বা তোর বউ বোধহয় ভুলে যাস আমিও জ্বীন। অদৃশ্য হলেও কিন্তু আমি দেখবো। যাইহোক চালিয়ে যাও ব্রাদার।” মিষ্টি লজ্জায় লাল হয়ে জিভে কামড় দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রোদ আসার পরে কাব্য ও শব্দের দূরত্বটা অনেকটা ঘুচে এসেছে। শব্দ আজ বাইরে বের হতে দেয়নি কাব্যকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো অনুষ্ঠান শেষ করেই ইশমামের কাছে যাবে সে। দেহটা এখানে থাকলেও মন যে ইশমামের কাছে পড়ে আছে।
অনুষ্ঠান শুরু করতে সবাই বারবার তাড়া দিচ্ছে। বিশেষ করে ইমা তাড়া দিচ্ছে বেশি। ইমা বুঝতে পারছে না এখনো কার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। কাব্য রাগী চোখে একবার শব্দের দিকে একবার ইমার দিকে তাকাচ্ছে। বারবার শব্দের গায়ে ঢলাঢলিটা একদম ঠিকভাবে নিচ্ছে না কাব্য। শব্দ বিষয়টা বুঝতে পেরে কাব্যকে আস্বস্ত করলো।
কিছুক্ষণ পরেই সাদা একটা সিল্কের শাড়ী পড়ে সাথে কানে লাল গোলাপ গুজে অনুষ্ঠানে হাজির হলো রোদ ও অর্নি। মা মেয়ে আজ দুজনেই একই ড্রেসে হাজির। এতোক্ষণে মনে হলো পুরো অনুষ্ঠানটা জমে উঠেছে। শুভ্র খুশিতে লাফিয়ে উঠে হাত তালি দিতে শুরু করলো। মিষ্টি ছুটে এসে রোদকে জড়িয়ে ধরলো।
শব্দ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের বুকের উপরে হাত দিয়ে বাতাস করতে লাগলো। মনে হলো বুকে আগুন লেগেছে। ইমা রোদকে দেখে যেন এক হাত মাটির নিচে ঢুকে গেলো। প্রচন্ড রাগ ও আতঙ্ক নিয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে রোদকে ওয়েলকাম করলো। ইমার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে এই প্রথম ইমার দিকে হাসি দিলো কাব্য। এর অর্থ হলো “করো আরো ঢলাঢলি, মা এসে গেছে। এবার পারলে মায়ের জায়গাটা নিতে এসো।”
ইমা যখন জানতে পারে রোদের আগের কিছু নেই তখন মনে মনে নতুন ছক আঁকতে শুরু করলো। শব্দের সাথে উদ্ভট ব্যবহার সহ এমন ভাব করতে লাগলো মনে হলো শব্দ ইমার প্রেমিক। তবে তার এই কাহিনী বেশিক্ষণ টিকলো না। ইমার কীর্তিকলাপ দেখে রোদ শব্দকে জিজ্ঞেস করলো “মিঃ শাহরিয়ার আপনি তো বলেছিলেন আপনার ওয়াইফ নেই।” শব্দ মাথা নাড়িয়ে বললো “বলেছিলাম, তবে এখন আছে।” রোদ ভ্রু কুঁচকে বললো “এই ভদ্রমহিলা?” শব্দ পেছনে তাকিয়ে ইমাকে দেখে বললো “কই না তো, কেন?” রোদ ফের প্রশ্ন করলো “তাহলে কি ইনি আপনার প্রেমিকা?” শব্দ উত্তর দিলো “বউয়ের প্যারায় বাঁচিনা আবার কিসের প্রেমিকা? বউ আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।” রোদ হালকা হাসলো, তারপর বললো “আপনার ওয়াইফ কোথায় ডাকুন তাকে।” শব্দ মুগ্ধ হয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো “আমার বউ তো আপনি মিসেস শাহরিয়ার।” রোদ ভ্রু কুঁচকে বললো “আপনি কিছু বললেন? ঠিক শুনতে পেলাম না।” শব্দ আমতা আমতা করে বললো “আপনাকে দেখে দুটো লাইন মনে পরলো। বলি? আচ্ছা বলি, প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।” রোদ চমকে তাকিয়ে বললো “কি বলছেন এসব? আপনি…” রোদকে থামিয়ে শব্দ বলে “জানি জানি, আমার বউয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই রোদ। ভয় নেই, আমি শুধুমাত্র আপনার সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করলাম। চলুন সময় হয়েছে কেক কাটবো।”
অন্যদিকে অর্নি ও কাব্য গল্প করছে। কাব্যের ইচ্ছে করছে অর্নিকে সবটা জানিয়ে দিতে। অর্নিকে যতটা খারাপ মনে করেছিল কাব্য এখন দেখলো ততটাই ভালো অর্নি। সবথেকে বড় কথা কাব্যর ফ্যামিলির বিষয় নিয়ে সে খুব সিরিয়াস। মনে মনে কাব্য ভাবলো “এটাই আমার মায়ের শিক্ষা। তবে কেন যে মাঝে মাঝে খারাও ব্যবহার করে। মানুষ ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কতো কিছুই না করে।” ভালোবাসার কথা মনে আসতেই ইশমামকে মনে পড়ে কাব্যর। একা একা ঘরে কি করছে সেটা ভেবেই অস্থির হচ্ছে কাব্য। শব্দের ডাক আসতেই কেক কাঁটার জন্য চলে যায় কাব্য। সাথে অর্নিও এসে রোদের পাশে দাঁড়ায়।
শব্দ ও রোদকে আলাদা করে মাঝে এসে দাঁড়ায় ইমা। ইমাকে দেখে রোদ আস্তে করে বলে “আপনাকে আমার চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি।” ইমা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো “মিঃ শব্দকে চিনেন কতোদিন হলো? আপনার কি মনে হয় আপনারা আগে থেকে পরিচিত?” রোদ বলে “না তবে তাকে ইচ্ছে করে ইগনোর করতে পারিনা আমি।” ইমা দাঁত গুলো বের করে বললো “তাহলে আমাকেও চিনেন না, প্যারা নেই।” কাব্য কেক কাঁটার আগে একপাশে শব্দ ও আরেক পাশে রোদকে দাঁড় করিয়ে নিজের কাছেই চারদিকে পরিবারের সবাইকে দাঁড় করালো। প্রথমে কেক কে’টে রোদকে খাইয়ে দিয়ে শব্দকে দিলো৷ তারপর ছলছল চোখ নিয়ে রোদকে বললো “আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরবো?” রোদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই রোদকে জড়িয়ে ধরলো কাব্য। জড়িয়ে ধরে আস্তে করে কানের কাছে বললো “তোমাকে ধন্যবাদ মা, আমাকে জন্ম দেওয়ার জন্য। তুমি না থাকলে আজ এই দিনে জন্মদিন পালন করাই হতো না আমার।” কাব্যর পিঠে হাত রেখে রোদ বললো “কি বলছো এসব?” কাব্য চোখ মুছে বললো “আসলে মনে হলো মা’কে জড়িয়ে ধরেছি। তাই বলে ফেললাম, মা তো কাছে নেই আমার তাই। কিছু মনে করবেন না।” [ইসলামে জন্মদিন পালন করার রীতি নেই। গল্পের সামঞ্জস্য রাখার জন্য এই রীতি ব্যবহার করা হলো। কেউ বাজে মন্তব্য করবেন না।]
ইমা রোদকে কেক খাওয়ানোর নাম করে কেক নিয়ে রোদের মুখে মাখিয়ে পুরো সাজগোজ নষ্ট করে দিলো। রোদ অবশ্য পুরো বিষয়টা বুঝতে পারলো। তবে কিছু বললো না। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলো। টেবিলে থাকা ছুড়িটা নিচে পড়ে যেতেই শব্দ নিচু হয়ে সেটা উঠাতে গেলো। ইমাও নিচু হয়ে ওঠানোর ভং ধরে নিজের গালে লেগে থাকা কেকটা শব্দের গালে লাগিয়ে দিলো সবার অলক্ষ্যে। রোদের সেটা দৃষ্টিগোচর হলো না। কেন যেন রোদ এবার নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে সোজা গিয়ে ইমাকে সজোরে থাপ্পড় মেরে দিলো গালে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রোদের দিকে। রোদের সেদিকে খেয়াল নেই। রোদ রাগের মাথায়ই অর্নিকে নিয়ে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। কাব্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করলে শব্দ বললো “রোদ যেতে পারবে, চিন্তা করোনা। অনুষ্ঠান শেষ। তুমি তোমার বাড়িতে চলে যাও। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।” কাব্যের মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। বুঝতে পারলো তার মা যে সে মেয়ে ছিল না। এতোদিনে যেই কাজটা কাব্য করতে গিয়েও থেমে যেতো। সেটা আজ একদিনেই করে ফেললো রোদ। কাব্য খুশি মনে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
—————————————-
কাব্য বাড়ি পৌঁছে দেখে ইশমাম একা একা মুখ গোমড়া করে এখনো কাব্যের জন্য অপেক্ষা করছে। কাব্যর ভালো লাগলো। গিয়ে পেছন থেকে ইশমামকে জড়িয়ে ধরলো। ইশমাম নিজেকে ছাড়িয়ে বললো “এই তোমার আসার সময় হলো বুঝি?” কাব্য নিজের কান ধরে বললো “কি করবো বলো? সবাই ছিল তো, আমি তো আর বলতে পারিনা ঘরে আমার সুন্দরী বউ অপেক্ষা করছে আমাকে যেতে দিন। সরি বউ, আর হবেনা।” ইশমাম মুখ ফুলিয়ে বললো “পরিবার পরিবার আর পরিবার। আমি তোমার পরিবারের কেউ না? চলো আসো!” কাব্য খুশি হয়ে ইশমামকে জড়িয়ে ধরলো।
বিপদ হলো কিছুক্ষণ পরেই। যথারীতি সাদা জুব্বা পড়া লোকগুলো আজকেও আসলো। কাব্যকে দেখে বড় করে সালাম জানায় তারা। কাব্য প্রথমে ভয় পেলেও নিজের প্রতি ওদের সম্মান দেখে সাহস করে জিজ্ঞেস করলো “কি চাই আপনাদের?” লোকগুলো একসাথে বলে ওঠে “আপনাকে।” কাব্য চোখগুলো বড় বড় করে বললো “মানে?” লোকগুলো হেঁসে বললো “আপনার সময় হয়ে এসেছে।” তারপর লোকগুলো চোখের সামনেই অদৃশ্য হয়ে গেলো।
সাথে সাথে কাব্যের নিজের ভেতরে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। পুরো শরীর আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো কষ্ট হচ্ছে। কাব্য ব্যথায় চিৎকার করছে। নিচে ফ্লোরে শুয়ে ছটফট করছে আর পানি চাচ্ছে ইশমামের কাছে। ইশমাম দৌড়ে পানি এনে দাঁড়িয়ে আছে। কাব্য ইশারা করে পানিগুলো গায়ে ঢালতে বললো। পরপর কতোগুলো জগের পানি ঢেলেও কাজ হলো না। কাব্যর মনে হচ্ছে তার নিশ্বাস বের হয়ে যাবে এখন। কোনো মতে হাতে ফোনটা নিয়ে শব্দের নাম্বারে ডায়াল করলো। প্রথমবার রিং হতেই শব্দ কল রিসিভ করলো। কাব্য শুধু একটা কথাই বললো “আমাকে বাঁচাও বাবা, আমি মরে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচাও বাবা, তোমাকে আর মাকে একসাথে নিয়ে বাঁচা হলো না বাবা।” কাব্যর অবস্থা দেখে ইশমাম ঘাবড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ইমা! এদিকে নিথর হয়ে যাচ্ছে কাব্যর শরীর।
চলবে?….
[পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। রিচেক করা হয়নি, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১০.
কাব্যের মাথার কাছে বসে আছে রোদ। কাব্যের জ্ঞান ফিরছে না। পুরো শরীরে বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেছে। ফর্সা শরীরে টকটকে লাল লাল দাঁগ বসে গেছে। শব্দ গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে কাব্যের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছে। রাতে কাব্যের বাড়িতে গিয়ে কাব্যকে খুব খারাপ অবস্থায় পায় শব্দ। সাথে শুভ্র থাকায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছে খুব ভালো ভাবে। পুরো বাড়ি খুঁজেও দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে তারা পেলো না। অগত্যা কাব্যকে নিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা হয়। রোদ বাড়িতে গিয়ে রাগ করার বাড়াবাড়িটা ভালো ভাবেই বুঝতে পারে। তাই ক্ষমা চাওয়ার জন্যই শব্দকে কল করে। কিন্তু কল রিসিভ করে শব্দ কোনো কথাই বলতে পারেনি। বাচ্চাদের মতো সমস্ত কান্না উবে দিলো রোদের কাছে। রোদ কিছু বুঝতে না পেরে বারবার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কি হয়েছে। অবশেষে শুভ্র শব্দের থেকে ফোন নিয়ে বললো “হ্যাঁ রোদ? কাব্য খুব অসুস্থ। ওর কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। পরে কথা বলছি কেমন?” কথাটা শোনামাত্রই রোদ ছুটে চলে আসে শব্দদের বাড়িতে। ফলস্বরূপ এখন কাব্যের মাথার পাশেই বসে আছে রোদ।
অন্যদিকে ইশমামকে সমানে শাসিয়ে যাচ্ছে ইমা। রোখ গরম করে বললো “এটা কোনো কাজের কাজ করলে তুমি? কাব্যর বিপদে তুমি পালিয়ে এলে? এই বিষয়টা যদি সুস্থ হওয়ার পর কাব্যের মনে থাকে তাহলে তোমার প্রতি ওর বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থাকবে? তোমাকে বলা হয়েছিল কাব্যকে তার পরিবার থেকে দূরে দূরে রাখবে। যেন বাবা ছেলের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে আমি শব্দের কাছাকাছি থেকে ওর বউ হতে পারি। পুরো প্ল্যান নষ্ট হয়ে গেলো। কোথা থেকে রোগ উড়ে এসে জুড়ে বসলো। এখন তো আরো পারবো না।” এসব কথা কানে না নিয়ে ইশমাম বলে “তার আগে এটা বলুন কাব্যর কি হয়েছে? ওই বুড়ো লোকগুলো কারা? তারা আসার পরেই এমন হলো। কাব্য কে? ওর কি হয়েছে?” ইমা থতমত খেয়ে বললো “বড্ড প্রশ্ন করো তুমি, তোমাকে জানতে হবেনা। এটা আমাদের ফ্যামিলির বিষয়। তোমাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে তুমি তোমার কাজ করো। প্ল্যানের বাইরে যদি কিছু করেছো তুমি তাহলে বুঝবে তোমার কি হাল হয়৷”
————————————-
কাব্যর জ্ঞান ফিরেছে, চোখ পিটপিট করে চোখের সামনে প্রথমে রোদকে দেখে ঠোঁট চওড়া করে হাসি দেয় কাব্য। রোদ মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কেমন লাগছে এখন?” কাব্য নিজের অজান্তেই বলে “তুমি আছো তো মা, তুমি থাকলে কোনো কষ্ট হয়না আমার। জানো মা ছোটবেলা থেকে যতবার অসুস্থ হয়েছি। পাগলের মতো তোমাকে খুঁজেছি শুধু। আমি তোমার ভালোবাসা কখনো পাইনি মা। কষ্টের সময় তোমাকে কাছে পাইনি, সুখের সময়ও তোমার সাথে সুখ ভাগাভাগি করতে পারিনি। আসলে আমি তো কোনোদিন সুখে ছিলামই না মা। তুমি আমাকে রেখে আর কোথাও যাবেনা মা। আমি আর যেতে দিবো না মা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না মা৷” কাব্যর কথা ঘরের এক কোনায় থাকা কাব্য, রোদ আর শব্দের ছবির ফ্রেমটা সবার অলক্ষ্যে উল্টো করে রাখে শুভ্র। শব্দ এগিয়ে এসে রোদকে উদ্দেশ্য করে বললো “কিছু মনে করবেন না, ও ছোট বেলা থেকে ওর মা’কে কাছে পায়নি। তাই ঘোরের মধ্যে আপনাকে মা বলে ভাবছে। আপনি কিছুক্ষণ ওর পাশে থাকবেন?”
এদিকে অর্নি সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। একবার অভ্রকে ধরে সুরে সুরে কাঁদছে। একবার মিষ্টির কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। একবার কাব্যর পাশে বসে ওর হাত ধরে ধরে কাঁদছে। অর্নির কান্না দেখে কাব্যর মনে পড়লো গত রাতে ইশমাম কিভাবে ওকে একা ফেলে চলে গেছে। কাব্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলো। খুব দ্রুতই সুস্থ হতে হবে তাকে। ইশমামের কাছে ফিরে যেতে হবে তাকে।
কাব্যর অসুস্থতার জন্য শব্দের অনুরোধে রোদ দুদিন এ বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। অর্নি বেশ খুশি হলো। বড় পরিবার পছন্দ হলেও কখনো বড় পরিবারে থাকার সুযোগ সে পায়নি। তাই মনে মনে ভাবলো এই দুদিন ইচ্ছে মতো মজা করবে। যদিও কাব্যর অবস্থা বেশি ভালো নয়। কাব্যকে ভালো রাখাই তার মূল উদ্দেশ্য। মিষ্টি রোদকে তার নির্দিষ্ট রুমে নিয়ে গেলো। সবাই রুম থেকে বের হওয়ার পর কাব্য আস্তে করে শব্দকে ডেকে বললো “বাবা আমার কি হয়েছে? এমন হলো কেন আমার সাথে? ওই লোকগুলোই বা কারা?” শব্দ জানে কথা এখন কোনোভাবেই এড়ানো যাবেনা। তাই কাব্যকে বললো “এখনো সময় আসেনি কাব্য সবকিছু জানার। এর আগে তোমাকে আমি কিছুই বলতে পারবো না। এর জন্য আমাকে খারাপ মনে করো না। আমি তোমার ভালো চাই সব সময়। শুধু এটুকু জেনে রাখো যারা এসেছিল তারা জ্বীন। তবে ভালো জ্বীন। তারা তোমাকে নিতে এসেছিল। কিন্তু জানো তো? ভালোর সাথে সব সময় খারাপ থাকে? এই খারাপই তোমার এই অবস্থা করেছে সুযোগ পেয়ে। আমার উচিত ছিল তোমার সাথে থাকার। এই জন্যই তোমাকে আমি অন্য বাড়িতে থাকতে দেইনি। ও হ্যাঁ, একটা কথা। জ্বীন বিশ্বাস করো তো তুমি?” কাব্য হেঁসে বললো “ওহ্ বাবা, এই আধুনিক যুগে এসেও তুমি এসব ভয়ংকর রুপকথার গল্প বলছো? তুমি জানো আমি কতো ভয় পাই এসব বিষয়? তাও আমাকে ভয় দেখানোর জন্য বলছো তো? যেন আমি ওই বাড়িতে না থাকি? আচ্ছা থাকলাম না, যদি তুমি মাকে এই বাড়িতে পাকাপোক্ত ভাবে রাখতে পারো তাহলে আমিও এই বাড়িতে থাকবো কথা দিলাম। তবুও এসব গল্প বলো না প্লিজ।” শব্দ কাব্যর দিকে তাকিয়ে বললো “তুমি তোমার মাকে ফিরিয়ে আনতে সব করতে পারবে তো?” কাব্য খুশি হয়ে বললো “অবশ্যই বাবা, পৃথিবীতে আমার মায়ের থেকে বড় কেউ নেই কিচ্ছু নেই আমার। আমি সব করবো।” শব্দ ভ্রু কুঁচকে বললো “যদি শর্ত দেয়া হয় অর্নিকে বিয়ে করার পরিবর্তে তুমি তোমার মাকে পাবে। তাহলে করবে তো?” কাব্য চুপ হয়ে গেলো। শব্দ বিষয়টা বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে চলে গেলো।
বিকেলে ডাক্তার এসে দেখে ঔষধ লিখে দিয়ে গেলো। রাতে খেতে বসে রোদের জন্য বরাদ্দ যেই চেয়ারটা রয়েছে সেখানেই রোদকে বসানো হলো। এই চেয়ারে আজ অব্দি রোদ যাওয়ার কাউকে বসতে দেওয়া হয়নি। হুট করেই কোথা থেকে ইমা এসে বসতে বসতে বললো “তা ভাইয়া এটা তো ভাবির চেয়ার। এখানে তো কাউকে বসতে দেও না। এই মহিলাকে বসানোর কাহিনী কি? তোমাদের মধ্যে আসলে কি চলছে বলবে?” পাশেই শুভ্র বসা ছিল। শুভ্র ইমার কানের কাছে আস্তে বললো “তোর ভাগ্য ভালো যে তোকে এখনো আমরা আমাদের বোন হিসেবে দেখি। তোর সাথে যদি ছোটবেলার কিছু স্মৃতি না থাকতো তাহলে ভুলে যেতাম তুই আমার বোন। তবে এবার যদি উল্টা পাল্টা কিছু হয় রোদের সাথে তাহলে ভুলেই যাবো তুই কে। জীবনের মতো এই বাড়িতে আসার শখ মিটে যাবে তোর।” শুভ্রর কথা অবশ্য রোদের কান অব্দি পৌঁছালো না। ইমার কথায় রোদ থমকে যায়। একবার শব্দের দিকে ভাবলো ও নিজেই মনে হয় ভুল করে এই চেয়ারে বসেছে। চেয়ার থেকে উঠতে যেতেই দেখলো ওকে কেউ হাত ধরে বসিয়ে দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলো কাব্য দাঁড়িয়ে আছে। কাব্যকে এই অবস্থায় এখানে দেখে সবাই ভড়কে যায়। তাড়াতাড়ি ধরে চেয়ারে বসিয়ে শব্দ ধমক দেয়। শব্দের ধমক শুনে কাব্য মুখ কাচুমাচু করে বলে “বাবা কিছু হবেনা, শরীরে এক অদ্ভুত শক্তির টের পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমার কিছুই হয়নি। তাই চলে এলাম সবার সাথে সময় কাটাতে।” পরে রোদের দিকে তাকিয়ে রোদের উদ্দেশ্যে বলে “আপনি বসুন আন্টি। আমার মায়ের চেয়ারে আমি কাকে বসাবো সেটা অন্তত বাইরের একটা মেয়ে সিদ্ধান্ত নিবে না৷ এখানে অন্তত ওনার মত নিচু মন মানসিকতার মানুষের বসার অধিকার নেই।” ইমা কাঁদো কাঁদো মুখ করে শব্দের দিকে তাকিয়ে বললো “দেখেছো দেখেছো? যখন আসি তখনি আমাকে অপমান করা হয়।” শব্দ আস্তে করে বলে “অপমান হওয়ার মতো কাজ করিস কেন বুঝিনা আমি।”
শব্দের থেকে পারমিশন কিছু সময়ের জন্য ইশমামকে রাখা বাড়িটাতে যেতে চাইলো কাব্য। শব্দ নাকচ করলেও ইশমামের কথা ভেবে যেতে দিতে রাজি হলো। তবে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আসার নির্দেশ দিলো। কাব্যর পিছু পিছু শব্দ ও শুভ্রও যেতে লাগলো। মেয়েটার বিষয়ে এবার খোঁজ নিতেই হবে। গতরাতে কাব্যকে আনতে গিয়ে মেয়েটাকে খুঁজে পায়নি ওরা। মেয়েটা পালিয়েছে কিনা, বা কেন পালিয়েছে সেটার খোঁজও নিতে হবে। তবে আগে কাব্যর সামনে অদৃশ্য হয়ে ঘোরার সুবিধা থাকলেও এবার কোনো রিস্ক নিতে চাইলো না শব্দ। তাই লুকিয়ে লুকিয়েই সতর্কতা অবলম্বন করে এগিয়ে চললো।
————————————-
খাটের সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে কাব্য। কিছুটা দূরেই বসে সমানে কেঁদে যাচ্ছে ইশমাম। কাব্যর কাছে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না কাব্য। কাব্যর একটাই কথা ইশমাম কাব্যকে একপ্রকার জেদের বশে বিয়ে করেছে। ভালোবেসে নয়। তাই ইশমামকে আর মানতে পারবে না কাব্য। শুভ্র ও শব্দ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যায়নি কেউই। কাব্য বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বললো “আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি ইশু। তোমাকে বিয়ে করেছি কিন্তু ভালোবাসা হয়তো ছিল না। চিনতে পারিনি জানতে পারিনি, শুধু কিছুটা ভালো লাগা ছিল। তোমার তো মনে হয় তাও ছিল না। আমার ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর ভালো লাগাটা ভালোবাসায় পরিনত হবে। তা আর হলো কই? তুমি জেদের বশে বিয়েটা করেছো ইশু। আমাকে শেষ করে দিলে বিশ্বাস করো। আমি এমনটা আশা করিনি। আমি ছোর থেকে কিছু চেয়েই পাইনি। হেরেছি সব সময়, হেরে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে না তোমার সাথে আমার আর কিছু থাকবে। আমার জেতার সময় হয়ে গেছে। জেতার জন্য যা যা করা দরকার সব আমি করবো। তবে যতদিন না সব শেষ হয় স্ত্রীর দায়িত্ব নিবো আমি।” বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় কাব্য। ভালো না বাসলেও কিছু তো ছিল। মানুষ হারানোর কষ্ট আর চায়না কাব্য।
বাড়ি ফিরে সোজা রোদের রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রোদকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে যায় কাব্য। ফোস্কা পড়া জায়গা গুলো তে ব্যথায় চিনচিন করছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেছে ভেবে নিজেই চেষ্টা করলো নিজের গায়ে মলম লাগানোর। বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় কাব্য। দরজায় কারো কাশির আওয়াজ পেয়ে দরজায় তাকায় কাব্য। অর্নিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় দ্রুত শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। অর্নি খিলখিল করে হেঁসে বললো “আসি?” কাব্য মাথা নাড়ায়। অর্নি রুমে এসে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো “কোথায় গিয়েছিলে? ইশমামের কাছে বুঝি?” কাব্য অবাক চোখে তাকায়, জিজ্ঞেস করার আগেই অর্নি উত্তর দেয় “তুমি কি ভেবেছো কাব্য আমি জানিনা? সেদিন আমাকে এক অন্য রুপে তোমার বাবার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে দেখেছিলে। তবে তুমি এতোটাই উত্তেজিত হয়ে গেলে যে আমার আসল রুপটা তুমি খেয়ালই করো নি। আমি চাইলে সব দিক দেখে আসতে পারি নিমিষেই। তোমার আর ইশমামের বিয়ের সময়ও আমি উপস্থিত ছিলাম। খেয়াল করেছিলে কিনা জানিনা। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটার বিয়ে হচ্ছে না দেখলে হয় বলো? ভালোবাসলে পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই বলো। এই যে একটা ভালো বন্ধু হয়ে তোমার সাথে আছি এটাই বা কম কিসে? তবে চিন্তা করো না তোমাদের বিয়ের কথা কাউকে বলিনি আমি। কিন্তু বেশিদিন এটা চাপা থাকবে বলে মনে হয়না। তাই সাবধান কেমন? আমার প্রতি তোমার একটা নেগেটিভ ধারনা তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কারো কোনো ক্ষতি করতাম না। ভেবেছিলাম আঙ্কেল ভয় পেয়ে তোমাকে আমার সাথে বিয়ে দিবে। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য খানিকটা পাগলামি বলতে পারো। দেও মলমটা দেও আমি দিয়ে দিচ্ছি। সমস্যা হবে না তো?” কাব্য চুপচাপ কথাগুলো শুনে গেলো। আসলেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো কাব্য। শুধু শুধু অর্নিকে এতোদিন ভুল ভেবে এসেছে সে। তাও হাসিমুখেই বললো “না না আমি পারবো, তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।” অর্নি কাব্যের গাল টেনে দিয়ে বললো “লজ্জা লাগছে বুঝি? ইশমামের সামনে লজ্জা লাগেনা?” কাব্য লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকে বললো “না না তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন কিছুই হয়নি।” অর্নি কোনো কথা না শুনে হাত থেকে মলম টা নিয়ে ফোস্কাগুলো তে লাগিয়ে দিলো।
—————————————
সকাল সকাল চা নিয়ে শব্দের রুমে গেলো রোদ। সারা ঘরে চেনা জিনিসগুলো দেখে মাথায় ব্যথা হতে শুরু হলো রোদের। প্রতিটি জিনিস ওর খুব চেনা মনে হচ্ছে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে শব্দকে ডাক দিলো “মিঃ শাহরিয়ার উঠুন সকাল হয়ে গেছে তো।” হুট করেই রোদের হাতটা নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে বললো “ওহ্ রোদ আরেকটু ঘুমাতে দেও না, তুমি আর তোমার ছেলে একটুও শুধরোবে না। একটু পরেই তোমার আদরের ছেলে এসে বলবে তব্দ ভাই, তব্দ ভাই ওঠো। তখন আর কে ঘুমাবে বলো? তুমি একটু ঘুমাতে দেও প্রিয়তমা।” শব্দের কথায় রোদ চোখগুলো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এমন একটা রোমান্টিক দৃশ্য রুমে ঢুকেই দেখতে হবে এমনটা কল্পনা করেনি শুভ্র। এক হাত দিয়ে চোখগুলো বন্ধ করে আঙুলের ফাঁকা দিয়ে রোদের ভাবগতি দেখে বাদরের মতো লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে শব্দকে ধাক্কা দিয়ে শব্দের থেকে রোদের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বললো “রোদ কিছু মনে করো না হ্যাঁ?” বলেই শব্দের মাথায় চাটি মেরে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে বললো “এই ওঠ দেখ কি করছিস তুই। আর কয়েকটা দিন সহ্য হয়না তোর। রোদকে সরি বল।” শব্দ চোখ ডলতে ডলতে বললো “কি করেছি আমি? রোদ কোথায়? রোদ আসবে কোথা থেকে? তোকে বলেছিনা ভাই সব সময় রোদের কথা বলবি না। কাব্য ভেঙে পড়ে ওর কথা শুনলেই৷” শুভ্র দ্রুত শব্দের মুখ চেপে আবার মাথায় চাটি মেরে বলে “আরে কি বলছিস এসব, ওইদিকে তাকা। দেখ রোদ দাঁড়িয়ে আছে। কিসব বলছিস ঘুমের ঘোরে এগুলো।” শব্দ অন্যদিকে তাকিয়ে রোদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাঁথা দিয়ে নিজের সমস্ত মুখটা ঢেকে ফেললো। কাঁথার নিচ থেকেই বললো “রোদ সরি কিছু মনে করবেন না। ঘুমের ঘোরে কিনা কি বলে ফেলেছি।”
রোদের কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু মাত্র শব্দের কথাগুলো কঠিনভাবে ঢুকে গেছে মাথায়। কথাগুলো বার বার আওড়াতে আওড়াতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো রোদ। শুভ্র হাঁপ ছেড়ে কাঁড়া মুড়ি দেওয়া অবস্থায়ই শব্দকে চেপে ধরে দুড়ুমদুড়ুম করে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো পিঠে।
রোদ কাব্যের খবর নিতে কাব্যের রুমে গিয়ে দেখলো কাব্য ঘুমিয়ে আছে। মাথায় হাত রাখতেই খেয়াল হলো কাব্যের হাতে শক্ত করে ধরে রাখা একটা ফটো ফ্রেম। কৌতুহলের বশে ফ্রেমটা হাতে নিতেই দেখে নিজের ছবি দেখতে পায় রোদ। প্রচন্ড অবাক হয়ে আরো একবার ভালোকরে তাকালো রোদ। নাহ্, এটা সেই। পাশেই একটা পিচ্চি ছেলে। ছেলেটাকে বড্ড চেনা চেনা লাগছে। চেনা লাগবেই স্বাভাবিক যেহেতু রোদের সাথেই ছবি তুলা। কিন্তু পাশে এটা কে? পাশে থাকা মানুষটা পুরোটা মার্কারের কালো কালি দিয়ে ঢাকা। তাই দেখতে পাচ্ছে না রোদ। প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে কাব্যের পাশে বসে রইলো রোদ। রোদের ছবি এই বাড়িতে কাব্যের কাছে কি করছে? ছোট বাচ্চাটা বা ওই অজ্ঞাত ব্যক্তিটাই বা কে? সকালের শব্দের কথাগুলো দেখে তো মনে হয়নি সে জেনেশুনে এগুলো বলেছে। পুরোনো অভ্যাসের জন্যই কথাগুলো বলেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে রোদ। এই কথাগুলো বলার মানেই বা কি? রোদের সাথে এই বাড়ির কি সম্পর্ক? এগুলোই বসে বসে ভাবছে রোদ।
চলবে?……..
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১১.
রোদের সামনে বসে দু’হাতের তালু সমানে ঘষে যাচ্ছে শব্দ। একপর্যায়ে রোদ বিরক্ত হয়ে কয়েকবার ধমক দিলো। রোদের ধমকে শব্দ চুপসে যায়। রোদ বড় করে নিশ্বাস নিয়ে বললো “আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে মিঃ শাহরিয়ার।” শব্দ মাথা ঝাকিয়ে বললো “বলুন।”
-একটা কথা বলুন আপনার সাথে বা আপনার পরিবারের সাথে আমার আগে থেকে কোনো সম্পর্ক ছিল?
-আপনার কি তেমনটা মনে হয়?
-জ্বী!
-কেন?
-এই যে সকালে ঘুমের ঘোরে কথাগুলো বললেন আমাকে। এটা আপনি জেনেশুনে বলেন নি। পুরোনো অভ্যাসমতে কথা গুলো বলেছেন।
-আর?
-কাব্যের হাতে আমি আমার একটা ছবি দেখেছি। আমার সাথে ছোট একটা বাচ্চা এবং একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি ছিলেন।
-আর?
-আপনার বাড়ির প্রতিটি জিনিস আমার খুব চেনা মনে হয়।
-আর?
-এতো আর আর করছেন কেন? উত্তর দিন আমার।
-এখনো সময় আসেনি রোদ। সময় হলে আমি নিজেই বলবো। এখন বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না।
-করবো, করবো। আমার জানা দরকার।
-আমি অতীতের কোনো কথা মনে করতে পারিনা। আমার মনে হচ্ছে আমার অতীত সম্পর্কে আপনারা কিছু জানেন৷
-বিশ্বাস করবেন?
-হু
-আপনি কাব্যর মা, ছবিতে থাকা বাচ্চাটা কাব্য। আর সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটি আমি।
-কি বলছেন এসব?
-হ্যাঁ
-কিন্তু আমি? আমি কিভাবে?
-যেভাবেই হোক, সে অনেক লম্বা কাহিনী। আর বলতে পারবো না। এটুকু আপাতত থাক? বিশ্বাস করেছেন আপনি?
-হ্যাঁ করেছি, সময় হলে বলবেন।
শব্দ চলে যায়, রোদ রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো “প্ল্যান তাহলে কাজে দিচ্ছে। আপনাকে শেষ করার সুযোগ চলে এসেছে।” শব্দ ভ্রু কুঁচকে বললো “এতো সহজে মেনে নিলো?একজন স্মৃতি হারা মানুষ এতো সহজে তো সবকিছু মেনে নিতে পারেনা। রোদ কি আসলেই শুধরে গেছে? নাকি নতুন কোনো চাল?”
————————————-
কাব্য কিছুটা সুস্থ হয়েছে আগের থেকে। তবে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে ওর মধ্যে। আজকাল দ্বিতীয় বাড়িতে সে নিয়ম করে থাকেনা। যতই রাত হোক বাড়িতে চলে। যদিও প্রতিদিন শব্দের মুখোমুখি হতে হয়। কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রচন্ড বিরক্তিতে কিছু একটা বলে নিজের রুমে চলে যায়। আজও তার হেরফের হলো না। শব্দ জিজ্ঞেস করতেই বললো “বাবা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করা তোমার নেশা হয়ে গেছে? আমাকে একা থাকতে দেও প্লিজ। আমি চাইনা এখন কারো সাথে কথা বলতে।” নিজের ছেলের হুট করে এমন পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না শব্দ। কাব্য নিজের রুমে যেতেই পকেটে থাকা ফোনটা কর্কশ আওয়াজ করে বেজে উঠলো। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠ ভেসে আসতেই মন ক্ষুন্ন হয় কাব্যর
-তোমাকে বলেছি না কাব্য আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যেতে?
-এমন তো কথা ছিল না ইশমাম। কথা হয়েছিল আরো পরে তোমাকে পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।
-আমি কিছু জানিনা, আমি চাই মানে চাই। তোমাকে বিয়ে করেছি তোমার থেকে দূরে থাকতে?
-তোমার কাছে থাকতে তো কোনো অসুবিধা নেই আমার ইশমাম। থাকিনা শুধু তোমার নিজের কর্মকান্ডের জন্য।
-আমি এতো কিছু জানিনা, তুমি বলো নিবে কিনা। নাহলে আমি নিজে তোমার বাবার সাথে দেখা করবো।
-এমন করার কোনো মানে হয় ইশু?
-হ্যাঁ হয়
-একটা কথা বলি? আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল তোকে বিয়ে করা। তোর যা ইচ্ছে কর। তুই বলার পরে যে সমস্যা গুলো হবে সেটা অন্তত তোর যন্ত্রণা থেকে ভালো হবে। রাখ ফোন তুই!
ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে হতাশ হয়ে নিজের কপালে হাত রেখে শুয়ে পড়লো কাব্য। কান্না পাচ্ছে তার। কতো বছর পর মা বাবা একসাথে একটা সুখী পরিবার হতে চলেছে। আর এই ইশমাম কিনা সেটা বারবার ভাঙার চেষ্টা করছে? কিন্তু কেন?
নিজের মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে পেয়ে চোখ খুলে তাকায় কাব্য। রোদকে দেখে হু হু করে কেঁদে ফেলে সে। অনুরোধ করে বলে “আন্টি তোমাকে একটা অনুরোধ করি? তুমি এই বাড়িতে থেকে যাও না প্লিজ?” রোদ মুচকি হেঁসে বললো “মা ডাক।” কাব্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “বাবা তোমাকে সব বলে দিছে মা? আমি তোমাকে মা ডাকতে পারবো?” রোদ মাথা নাড়ায়, ফের বলে “আমি এখানেই থাকবো, তবে একটা শর্তে। অর্নি তোমাকে খুব ভালোবাসে কাব্য। যদি আমাকে রাখতে চাও অর্নিকে বিয়ে করতে হবে তোমার। তবেই আমি থাকবো এখানে।” কাব্যর মুখটা চুপসে যায়। এটা তো সে কখনো করতেই পারবে না। সে তো আগে থেকেই বিবাহিত।
পরের দিন কাব্য সোজা শব্দের কাছে যায়। কাব্যকে দেখে মুখে চওড়া হাসি দিয়ে বলে “আয়, কিছু বলবি?” কাব্য মাথা নিচু করে বললো “মা বললো অর্নিকে বিয়ে করলে মা এখানে থাকবে। তোমার কি মতামত বাবা?” শব্দ কাব্যের কাঁধ ধরে বললো “জীবনটা তোমার আমার নয়। তুমি যেটা ভালো মনে করবে সেটাই করবে। তবে তুমি তো বলেছিলে তোমার মাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সব শর্ত মানতে রাজি তুমি। কোনো সমস্যা?” কাব্য মলিন হেঁসে মাথা নাড়ায়। তারপর হুট করেই শব্দের রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়। শব্দও বের হয় ইশমামের খবর জানতে। মেয়েটির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে তার। সবকিছু ঠিক থাকলে অবশ্যই তিনি অর্নির সাথে বিয়েটা আটকাবে। নাহলে যে তিনটে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।
সারাদিন ইশমামের ব্যাপারে খোঁজ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে শব্দ ও শুভ্র। ইশমামের বাবা হাসপাতালে ভর্তি। প্রতিদিন বিপুল পরিমানে টাকা খরচ হয় তার পেছনে। মুলত সেটার যোগান ইশমাম নিজেই দেয়। কিন্তু কার হয়ে কাজ করছে সেটা ইশমাম নিজেই বলতে পারবে। ইশমাম যে কারো কথায় কাব্যকে বিয়ে করেছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না শব্দের। ছেলের জীবনটা এভাবে নষ্ট হবে সেটা আশা করেনি শব্দ। তাই সিদ্ধান্ত নিলো অর্নির সাথেই কাব্যর বিয়ে দিবে। অন্তত অর্নি কাব্যকে ভালো তো বাসতে পারবে।
শব্দ বাড়িতে ফিরে ঘোষণা করে অর্নির সাথেই কাব্যর বিয়ে হবে। কথাটা শুনেই অর্নি বেশ খানিকটা ঘাবড়ে যায়। শব্দকে ভয় পায় বলে তার মুখের উপর কথা বলেনি অর্নি। শেষে কাব্যর কাছে গিয়ে বিষয়টা বলতেই কাব্য জানায় সে বিয়েতে রাজি। আর সবথেকে বড় সত্যিটাও জানিয়ে দেয়। অর্নিকে উদ্দেশ্য করে বলে “মিসেস রোদ তোমার মা নয় অর্নি সেটা কি তুমি জানো? মিসেস রোদ আমার মা। মিসেস রোদ শাহরিয়ার, আহনাফ শাহরিয়ার শব্দের বউ। আমার মা আমাকে বলেছে তোমাকে বিয়ে করলে ফিরে আসবে। আমি আমার মায়ের জন্য সব করতে পারি অর্নি। আমি জানিনা মা কেন চলে গিয়েছিল। তবে ফিরে যে এসেছে সেটাই অনেক।” কাব্যর কথা বিশ্বাস করতে পারছে না অর্নি। রোদ তার মা নয়? তাহলে কে ওর মা? বাবা মা কে অর্নির? কাব্য তো কোনো ভাবেই মিথ্যা বলবে না। অগত্যা অর্নিকে বিশ্বাস করতে হলো সবটা। কাব্যর কাছে ওর মা’কে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অর্নি সবকিছু করতে রাজি আছে। না পেলো কাব্যর ভালোবাসা বা স্ত্রী অধিকার। তাতে কি? কাব্যকে ভালো তো রাখতে পারবে সে। অর্নি চলে যেতে নিতেই অর্নিকে ডেকে কাব্য জিজ্ঞেস করলো “আমাকে ভালোবাসো তুমি?” অর্নি কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। কাব্য বুঝতে পেরে বললো “আমি সুখী নই অর্নি। ভালোবাসা পাইনি আমি। তুমি কি ভালোবাসা দিতে পারবে আমাকে?” এতোটুকু কথায়ই অর্নির চোখ খুশিতে চিকচিক করে ওঠে।
চলবে?…..
প্রচন্ড ব্যস্ত থাকায় লিখতে পারিনি, তাই ছোট হলো!
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১২.
বাড়িতে ভরপুর আয়োজন। অর্নির বিয়ে আজ। বেশ তাড়াহুড়ো করেই আয়োজন করা হয়েছে। কাব্যই চেয়েছে দ্রুত বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে। তাই কেউ বাঁধা দিলো না। সকাল থেকে অর্নি খুব খুশি। প্রতিটি ছোট ছোট বিষয় এসে কাব্যর সাথে শেয়ার করছে সে। কোন ড্রেস কোন গহনা পড়বে সব কিছু কাব্যকে খুশি মনে দেখাচ্ছে। কাব্য শান্তি পাচ্ছে কিছুটা। সে ভেবেছিল অর্নি সম্পূর্ণ বিপরীত হবে। কিন্তু না, কাব্য যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমনটাই অর্নি।
খবরটা ইশমামের কাছে পৌঁছাতে দেরি হলো না। ইমা তাড়াতাড়ি গিয়ে কাব্যর বিয়ের খবরটা ইশমামের কাছে দিয়ে দিলো। নিজেই সাথে করে ইশমামকে নিয়ে রওনা দিলো শব্দদের বাড়িতে। বিয়ের আসরে ইমার সাথে ইশমামকে দেখে শব্দ বুঝতে পারলো কাজটা আসলে কে করেছে। প্রচন্ড রাগে শব্দের ইচ্ছে করলো এই মুহুর্তে ইমাকে মেরে ফেলতে। তবে তার এই ইচ্ছেটাকে বক্স বন্দী করে আপাতত ছেলের বিয়েতে মন দিলো সে। এতো এতো লোকজনের ভিতরে ইশমাম এসে চিৎকার করে বলছে সে কাব্যের বউ। প্রমাণস্বরূপ হাতে বিয়ের কাগজপত্রও এনেছে সে। কাব্য বিয়ের আসর থেকে উঠে এসে ইশমামের সামনে দাঁড়ালো। তারপর অর্নির দিকে তাকালো একবার। এতোক্ষণ হাসিখুশি থাকা মেয়েটা হুট করে কেমন ভয়ে চুপসে গেলো। নিশ্চয়ই মেয়েটা ভেবেছে কাব্য অর্নিকে এখন বিয়ে করবে না। তবে অর্নিকে চমকে দিয়ে কাব্য ইশমামকে উদ্দেশ্য করে বললো “আমি অস্বীকার তো করিনি তুমি আমার বউ না। আমি শুধু বিয়ে করছি একটা।” ইশমাম কাব্যের শার্ট খামচে ধরে বললো “বড় বউয়ের পারমিশন নিয়েছো তুমি? তোমার কতো বছরের শাস্তি হতে পারে ভেবে দেখেছো একবার?” কাব্য শার্ট ছাড়িয়ে বললো “তাই নাকি? তাহলে তোমার এটাও জানা উচিত কাউকে ঠকিয়ে বিয়ে করার শাস্তিটা কি রকম হতে পারে। আশা করছি আর কিছু বলতে হবে না তোমাকে।” বলেই কাব্য গিয়ে নিজের জন্য রাখা নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লো। ইশমাম বুঝতে পারলো কাব্যকে আটকানো সম্ভব নয়। তাই দৌড়ে শব্দের কাছে এসে বললো “আপনি নাকি মহান বাবা। নিজের ছেলের এই অবনতি হতে দিচ্ছেন আপনি? একটা মেয়ের অসম্মান হচ্ছে সেটা গায়ে লাগছে না আপনার?” শব্দের মাথা এমনিতেও গরম ছিল। ইশমামের কথায় আরো চটে গিয়ে বললো “আমি মহান বাবা বলেই ছেলের জন্য যেটা কল্যানকর সেটা করছি। বাবার দায়িত্ব পালন করছি আমি। বিয়ে করেছো আমাকে জানিয়েছিলে? এখন আমার কাছে এসে তাহলে কান্নাকাটির কোনো মানেই হয় না। আমি তো তোমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু যদি আমার ছেলেকে ভালোবাসতে, তাকে মানসিক শান্তি দিতে পারতে। সারাজীবন সাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করতে পারতে তাহলে আমি এই বিয়ে দিতাম না। কিন্তু তুমি তো এগুলোর কিছুই করবে না। তোমার দরকার টাকার। মেয়ের দায়িত্ব পালন করছো বাবার প্রতি তাইনা? তাও লোক ঠকিয়ে? তোমার বাবা শুনলে শান্তি পাবে সে? তোমার টাকার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে কাব্যকেও প্রয়োজন শেষ হয়ে যাবে তোমার। তখন চলে গেলে আমার ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে। আমার ছেলেটা ছোটবেলা থেকে হারিয়েই এসেছে শুধু। আর এটা হতে দিতে পারিনা আমি। আমার পরিবার ভাঙতে দিতে পারিনা আমি। জানি তোমার অসম্মান হচ্ছে, তাই কাব্য যদি চায় তাহলে তোমার যতদিন টাকার দরকার তুমি কাব্যর স্ত্রীর সম্মানে এই বাড়িতেই থাকতে পারবে। তোমার সময় হলে তুমি চলে যাবে। আশা করছি এর বেশি কিছুর দরকার হবে না তোমার।”
শব্দের মুখে সত্যি কথাগুলো শুনে ইশমামের আর কিছু বলার সাহস রইলো না। যদি তার বাবার দায়িত্ব কাব্য নিজেই নেয় তাহলে ইমার কথা শোনার কোনো দরকারই নেই তার। তাই পরিবারের সবার সাথে বসে অনুষ্ঠানে যোগ দিলো সেও। কিন্তু সমস্যা হলো একটু পরেই। যখন দেখলো কাব্যের সাথে অন্য একটা মেয়ে এবং কাব্য তাকে ভালোবেসে বিয়ে করছে তখন। মনে হচ্ছে ইশমামের কষ্ট হচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না কাউকে। সবার অলক্ষ্যে টুপ করে চোখের পানি পড়ে গেলো ইশমামের। তবে কাব্যের নজর সেটা এড়ায় নি। মনের মধ্যে তীব্র কষ্ট নিয়ে ভালো থাকার আশায়ই সে বিয়ে করছে। কিন্তু বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কাব্যের শ্যামলবতী।
বিয়ের আয়োজন শেষ হলো। পুরো অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলে যেতেই একপ্রকার তেড়ে এসে ইমার গালে সজোরে থাপ্পড় দিলো শব্দ। ইমা ছিটকে দূরে পড়ে গেলো। শুভ্র দৌড়ে এসে শব্দকে থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু আজ যেন শব্দের সাথে সে পারছে না। শেষে রোদ এসে শব্দের সামনে দাঁড়াতেই থেমে গেলো শব্দ। শুভ্র গিয়ে ইমাকে বললো “আমাদের কোনো বোন ছিল না। একমাত্র বোন হিসেবে তোকেই ভালোবেসে এসেছি সবসময়। কিন্তু সেই রোদ আসার পর থেকে এই অব্দি একের পর এক খারাপ কাজ করেই যাচ্ছিস তুই। ভেবেছিলাম শব্দের সংসার হওয়ার পর শুধরে গেছিস। কিন্তু কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না। তোর বিয়ে ঠিক হলো, আমরা দুই ভাই মিলে আদরের বোনের বিয়ে ঠিক করলাম। কিন্তু যখন শুনলি রোদ চলে গেছে শব্দকে ছেড়ে। শব্দের জীবনে রোদ আর কখনো ফিরে আসবে না তখন নিজের বিয়েটাই ভেঙে দিলি শব্দকে বিয়ে করার জন্য। শব্দের মন থেকে রোদের স্মৃতি মুছে যাওয়ার আগেই কাব্য বড় হলো। কাব্যের জন্য রোদের জায়গা নিতে পারলি না তুই। আর তাই কাব্যের জীবনটা নষ্ট করতে এতো বড় চাল ফেললি তুই? ছোট থেকে নিজের হাতে বড় করেছি তাই কিছু বললাম না। চলে যা, আর কখনো আসিস না আমাদের জীবনে। শব্দ তাহলে তোকে ছাড়বে না। চলে যা, আমাদের ভালো থাকতে দে। তুই নিজেও ভালো থাক।” ইমা ফোঁস করে শব্দের দিকে তাকিয়ে বললো “আমি ভালো থাকতে পারিনি মানে তোমরাও পারবে না শব্দ ভাই। কখনোই না, আমার পুরো জীবন শেষ তোমার পিছু ঘুরতে ঘুরতে। তাহলে বাকি জীবনটা নাহয় তোমাদের অনিষ্ট করতেই বেঁচে থাকবো।”
—————————————
ইমার ঝামেলা শেষ হতেই অর্নি আর কাব্যকে নেয়া হলো বাসর ঘরের জন্য। ইশমামের জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হলো। এতো এতো ঝামেলার পরে আর আনন্দ উল্লাস করা হয়নি কারো। অর্নিকে মিষ্টি আর রোদ রুমে দিয়ে গেছে আরো আগেই। আলাদা কোনো বন্ধু কিংবা ভাই না থাকায় শুভ্র নিজেই কাব্যকে নিয়ে আসলো। কাব্যকে খোঁচা দিয়ে হাসি ঠাট্টা করতেই কাব্য বললো “ওহো চাচু, তুমি আমার চাচু। একটু লজ্জা রাখো। আমি এখনো ছোট, কি বলছো এসব?” শুভ্র মুখ বাকিয়ে বললো “এহ ছেলে বিয়ে করেছে, কাল হবে ছেলের বাপ। সে নাকি এখনো ছোট, কি বলে? এই যা তো ভেতরে।”
কাব্য ভিতরে এসে দেখে অর্নি বসে আছে। লাল টুকটুকে শাড়ীর সাথে আলাদা করে ঘোমটা দিয়ে মুখটা ঢাকা আছে। যদিও ঘোমটার উপর থেকেই দেখা যাচ্ছে চেহারা। কাব্য কি বলবে বুঝতে পারছে না। এরকম সময় জীবনে কখনো আসেনি। আগের বারের বিয়ের সময় সেটাকে বাসর রাত না বললেই চলে। সাথে ইশমামের সাথে অনেকটা ফ্রী ছিল, তবে অর্নির বিষয়টা ভিন্ন। কাব্যের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। বারবার ইশমামের কথা মনে পড়ছে। ইশমাম কি কাব্যকে একটুও মনে করছে না তাকে? কাব্যের বিয়েতে কি একটুও কষ্ট পায়নি ইশমাম? এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল হলো কেউ তার পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। খেয়াল হতেই দেখলো অর্নি তার পা ছুঁয়ে সালাম করছে। কাব্য এক হাত পেছনে চলে গিয়ে বললো “পা ছুঁয়ে সালাম করছো কেন?” অর্নি মুখ বাকিয়ে বললো “এটা চিরাচরিত নিয়ম বুঝলে?” তারপর গিয়ে আবার আগের মতোই ঘোমটা দিয়ে বিছানার উপর বসে পড়লো। কাব্য বুঝতে পারলো এখন আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবেনা। অর্নির ঘোমটা তুলতে হবে আগে। তাই ঘোমটা সরিয়ে অর্নিকে এক নজর দেখেই চোখ নামিয়ে ফেলে। তারপর বললো “দেখো অর্নি তুমি জানো আমি তোমাকে এখন ভালোবাসি না। তবে ভালোবাসার উদ্দেশ্যেই বিয়ে করেছি। তুমি আমাকে ভালোবাসো, তুমি পারবে না আমাকে ভালোবাসাতে? আমাকে একটু সময় দেও।” অর্নি মিষ্টি হেঁসে বললো “আমি জানতাম তোমার সময় লাগবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই অপেক্ষাও করতে পারবো। তোমার যতদিন সময় লাগে লাগুক সমস্যা নেই।” [এখানে মুসলিমদের একটা নিয়মের কথা বলা হয়েছে। কেউ এটাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করবেন না। গল্পের সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য দিতে হয়েছে।]
সবকিছু ঠিক হতেই সমস্যা হলো আরো কিছুক্ষণ পরে। সাদা জুব্বা পড়া লোকগুলো আজ এসেছে কাব্যের কাছে। কাব্য এবার ভয় পেয়ে পেছনে সরে যায়। অর্নি সামনে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো “আপনারা?” লোকগুলোর একজন বললো “আমরা কাব্যকে নিতে এসেছি।” অর্নি ভ্রু কুঁচকে বললো “কেন?” লোকটি ফের বললো “ওর ১৮ বছর বয়স হয়ে গেছে। ও আর মনুষ্যদের জীবনের মতো জীবন যাপন করতে পারবে না। আগে ও ওর আসল রুপে থাকার পরে নির্দিষ্ট সময় পরেই মনুষ্য রুপ নিতে পারবে।” অর্নি স্বাভাবিক ভাবে বললো “আমি শব্দ বাবাকে বলবো আপনাদের কথা। তারা আপনার সাথে দেখা করবে। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সে নিজেই নিবে। আপনারা বারবার এভাবে আসবেন না। কাব্য ভয় পায় আপনাদের। আপনারা এখন যেতে পারেন।” অর্নির কথায় সম্মতি দিয়ে লোকগুলো উধাও হয়ে গেলো।
কাব্য এসে অর্নিকে জিজ্ঞেস করলো “এরা কারা বলো তো? আমাকে নিতে চায় কেন এরা?” অর্নি কাব্যের গাল টেনে বললো “তুমি বড় হয়ে গেছো তো তাই। এখনো সময় হয়নি জানার তোমার। আসছে আবার জিজ্ঞেস করতে। যা বলার বাবাই বলবে।” কাব্য সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো “এই বাবাটা কে আবার?” অর্নি চোখ বড় বড় করে বললো “এটা তুমি কি বললে? বাবা কে? এটা শব্দ বাবা জানলে বলবে বিয়ে করতে না করতেই বউয়ের জন্য ছেলে তার বাবাকে ভুলে গেলো।” কাব্য হি হি করে হেঁসে টান হয়ে বিছানায় শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে বললো “ও তব্দ ভাইয়ের কথা বললে?” অর্নি আবারও চোখ বড় বড় করে বললো “এই তব্দ ভাইটা আবার কে?” কাব্য এবার জোরে হা হা করে হেঁসে বললো “জানো মা আমার ছোট বেলায় বাবাকে শব্দ ভাই বলতো। মানে আগের অভ্যাস ছিল তো তাই। আমিও মায়ের দেখা দেখি শব্দ ভাই বলতাম। ছোট ছিলাম বলে শব্দ বলতে পারতাম না। তব্দ চলে আসতো মুখে। এখন অবশ্য বলা হয়না বাবাকে। বলতে পারো এটা বাবার একটা ডাকনাম।” অর্নি মুখে হাত দিয়ে হেঁসে বললো “কালকে তুমি আর আমি বাবাকে তার ডাকনাম বলে একবার ডাক দিবো। দেখবো বাবা কেমন করে ঠিক আছে? আর মাম্মামকেও তো সব মনে করাতে হবে আমাদের বলো?”
কাব্য বিজ্ঞদের মতো করে বললো “তুমি ঠিক বলেছো অর্নি।”
চলবে?….
গতকাল গল্প দিবোনা সেটা জানিয়ে দিয়েছিলাম। গতকাল দিতে পারিনি বলে আজ দু পর্ব দিবো।
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১৩.
প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় বসে আছে শব্দ। এভাবে ভালো সময়ে এসে এতো খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভাবিনি। সাদা জুব্বা পড়া লোকগুলোকে বার বার করে বারন করে দেয়া হয়েছিল যেন কাব্যের সামনে না আসে। সময় হলে সে নিজেই ব্যবস্থা নিবে। কে শোনে কার কথা। তারা চলেই এলো কাব্যের সামনে। এবার বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে। কাব্যকে মিথ্যা কথা বলারও কোনো সুযোগ নেই। অগত্যা কাব্যকে সত্যিটা বলার জন্যই আপাতত প্রস্তুতি নিচ্ছে শব্দ।
জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাব্যকে উদ্দেশ্য করে বললো “জ্বীন বিশ্বাস করিস?”
-এই আধুনিক যুগে?
-হ্যাঁ, এখন যা কিছুই বলবো অবিশ্বাস্য হলেও তোকে বিশ্বাস করতে হবে।
-আচ্ছা বলো শুনি।
-বিশ্বাস করিস?
-করলাম
-আমি জ্বীন।
-কিহ্?
-হ্যাঁ, আমি এবং তোর চাচু শুভ্র দুজনেই জ্বীন। তোর দাদা দাদু, মিষ্টি অভ্র সবাই জ্বীন।
-তাহলে আমি?
-তুইও জ্বীন।
-ওনারা সবাই জানেন যে ওনারা জ্বীন?
-হ্যাঁ
-তাহলে আমি কেন জানিনা?
-কারন তুই এতোদিন মানুষ ছিলি।
-তোমরাও ছিলে নাকি?
-নাহ্ কারন আমার বাবা মা দুজনেই জ্বীন। তুই ছিলি কারন রোদ জ্বীন নাহ্। তাই তোর মধ্যে মানুষ এবং জ্বীন দুটো শক্তিই আছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তোর মধ্যে জ্বীন শক্তি আসার কথা ছিল। সেটা এসেছে তোর জন্মদিনের সময়। তাই সেদিন তোর শরীরে সমস্যা হয়েছিল।
-আমাকে আগে বলো নি কেন?
-আমি জানাতে চাইনি, আমি চাইনি তুই জ্বীন হয়ে আমাদের থেকে দূরে সরে যা। তাই আমিও বলিনি, বাড়ির কাউকেই বলতে দেইনি। তোর জন্য তারা একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো থাকে। কেউ কখনো ভুলেও ম্যাজিক করে না।
-এতোগুলো কথা বললে, আমি বিশ্বাস করবো কিভাবে?
-আগেই বলেছিলাম অবিশ্বাস্য তবে বিশ্বাস করতে হবে৷
-বিশ্বাস করলাম, কিন্তু প্রমান তো দেখাতে হবে।
-কি প্রমান চাস তুই?
-ইম্ম আচ্ছা সব সময় শুনেছি জ্বীনেরা অদৃশ্য হতে পারে। তুমি হয়ে দেখাও।
শব্দ মুচকি হেঁসে চোখের নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে গেলো। কাব্য এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো “বাবা, কই তুমি? আছো?” শব্দ এসে কাব্যের মাথায় টোকা দিলো। কাব্য চারদিক ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞেস করলো “আরে কোথায় তুমি? সামনে এসো, বিশ্বাস করলাম তো।” সাথে সাথে শব্দ দৃশ্যমান হলো। কাব্য অবাক হয়ে শব্দের দিকে তাকিয়ে আছে। যেগুলো কখনো সে বিশ্বাস করেনি। ভুতের ভয়ের মতো জ্বীনদের কথা শুনেও ভয়ে শিউরে উঠতো সেটাই কিনা তার পুরো পরিবার? এতো বছর এতো এতো জ্বীনগুলোর সাথে বসবাস করেছে সে ভাবতেই ভয়ে চুপসে যাচ্ছে সে। তার থেকে বড় কথা সে নিজেও একজন জ্বীন। এটা শুনে নিজেকেই নিজের ভয় লাগছে। আচ্ছা অর্নি কি এই বিষয়ে কিছু জানে? অর্নি জানলে ওর অনুভূতি কেমন হবে? ইশমাম জানলেই বা কেমন হবে? পরিক্ষা করা যাক। এক লাফে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো কাব্য।
দরজায় উঁকি দিয়ে বললো “আসবো?” অর্নি কাব্যর দিকে না তাকিয়েই বললো “এসো, কি হয়েছে ভয় ভয় করছে কেন তোমার?” কি ব্যাপার? অর্নি জানলো কিভাবে আমি ভয়ে আছি? এটা মনে মনে ভাবতেই অর্নি জবাব দেয় “আমি অনেকের মনের কথা বুঝতে পারি। যেই জন্য এসেছো সেটা কি আমিই বলবো নাকি তুমি বলবে?” কাব্য ছোট বাচ্চাদের মতো করে বললো “তুমিই বলো, আমি শুনি?” অর্নি পায়ের উপর পা তুলে বললো “তোমার মনে আছে আমি একদিন তোমাদের বাড়িতে এসেছিলাম? বাবার গলা টিপে ধরেছিলাম?” কাব্য মাথা নেড়ে সায় জানালো। অর্নি বললো “ওইদিন তো তুমি আমাকে আমার আসল রুপে দেখে ফেলেছিলে। সেদিন তুমি যাওয়ার পরে বাবা তার নিজের জ্বীনরুপে এসেছিল আমার সামনে। আমার সেদিন সন্দেহ হয় তুমিও জ্বীন। তবে বাবার কথাগুলো শুনে মনে হলো তুমি নিজেও জানোনা তুমি জ্বীন। তাই বাবার জানানোর আগে আমিও তোমাকে জানাইনি। আমি জেনে শুনেই বিয়ে করেছি তোমাকে।” কাব্য অবাক হয়ে কথাগুলো শুনে বললো “তোমার আসল রুপ মানে? তুমিও জ্বীন?” অর্নি মাথা নাড়ায়। কাব্য ফের জিজ্ঞেস করে “তোমার বাবা মা কে?” অর্নি হালকা হেঁসে বললো “আমি জানিনা তারা কারা। আমি ছোটবেলা থেকে মাম্মামকেই দেখে এসেছি আমার পাশে। যখন আমি বুঝতাম না তখন থেকেই মাম্মামের কাছে আছি আমি। আর কিছুই জানিনা আমি। তবে মাম্মাম আমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।” কাব্য মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বের হতে নিতেই পেছন থেকে অর্নি ডেকে জিজ্ঞেস করলো “ইশমামের কাছে যাচ্ছো?” কাব্য অর্নির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। অর্নির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তাও মুখে চওড়া হাসি নিয়ে বললো “যাও।”
অন্ধকার রুমে বসে আছে ইশমাম। আজ কেন যেন কাঁদতে ইচ্ছে হলো তার। তাই ঘর অন্ধকার করে কাঁদছে সে। কাব্যের ডাক পেয়ে দ্রুত চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। তবে কাব্যের চোখ এড়ালো না বিষয়টা। নিজের হাতে বাতি জ্বালিয়ে ইশমামের পাশে গিয়ে বসলো কাব্য। জিজ্ঞেস করলো–
-কেমন আছো?
-ভালোই, তুমি নিশ্চয়ই অনেক ভালো আছো?
-বলতে পারো সেটাই। কাঁদছো কেন তুমি?
-কাঁদছি না।
-আমি তোমাকে বুঝি।
-বুঝো না, বুঝলে আমাকে ফেলে বিয়ে করতে না।
-কষ্ট হচ্ছে? এমনটা মনে হচ্ছে যে আমি তোমাকে ঠকিয়েছি? ঠকানোর কষ্টটা তাহলে উপলব্ধি করতে পারছো? আমিও ঠকেছি, কষ্ট পেয়েছি। সবার আড়ালে কেঁদেছি। কষ্টটা তুমি দিয়েছিলে।
-আমি ঠকাইনি তোমাকে। এখন মনে হচ্ছে আমি হয়তো সত্যিই ভালোবাসতাম তোমাকে।
-মনে হচ্ছে? কিন্তু ভালোবাসো না।
-বাসি
-আমি বাসিনা।
-অর্নিকে ভালোবাসো?
-চেষ্টা করছি, মেয়েটা আমাকে বড্ড ভালোবাসে। আমি বলতে অজ্ঞান সে। ওকে ভালো না বাসলে ওকে ঠকানো হবে।
-আমাকে ভালোবাসোনি? মানুষের ভালোবাসা তো একবার হয়।
-তোমার উপরে ভালোবাসা জন্মানোর আগেই ঘৃনা জন্মে গেছে। আর ওই একবারের ভালোবাসাটা অর্নির প্রতি দিতে চাই আমি। যাকগে যার জন্য এসেছিলাম। তোমাকে একটা কথা বলার আছে।
-বলো
-ধরো আমাকে পাওয়ার একটা সুযোগ আছে তোমার। তোমার ভাষ্যমতে তুমি আমাকে ভালোবাসো। তুমি তোমার ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য তুমি সেই সুযোগটা নিবে?
-নিবো, বলো।
-জ্বীন বিশ্বাস করো তুমি?
-হ্যাঁ
-তোমাকে বলা হলো তোমাকে জ্বীনদের সাথে থাকতে হবে আমার জন্য।
-ভালোবাসার মানে হলো বেঁচে থেকে পাশে থাকা। জ্বীনদের সাথে থেকে মরবো নাকি আমি?
-তাহলে তুমি থাকবে না?
-না
-যদি বলি আমিই জ্বীন?
বলেই ইশমামের উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইরে চলে গেলো। বাইরে যাওয়ার সময় দরজার পাশে ছায়াটা লক্ষ্য করতে ভুল হলো না। মুচকি হেঁসে এগিয়ে গেলো রোদের রুমের দিকে। রোদ কারো সাথে একটা কথা বলছে। আড়ালে কাব্যকে সে খেয়াল করেনি। কোনো এক অদৃশ্য ব্যক্তির সাথে সে বলছে “আমার কাজ হয়ে গেছে। পথের কাঁটা খুব শীঘ্রই দূর হবে। শব্দকে শেষ করা আমার বাম হাতের খেল। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। হ্যাঁ, হ্যাঁ মুকুট আমার কাছেই সুরক্ষিত আছে।” কাব্য এখনো জানেনা নিজের শক্তি কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাই সে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে দেখতে পায়নি। তবে নিজের মায়ের মুখে নিজের বাবাকে শেষ করার কথাটা সে কোনো ভাবেই মানতে পারছে না।
চলবে?…
আজ সকালে এক পর্ব দিয়েছি, তাই এটা আর বড় করতে পারলাম না। সময় হাতে থাকলেও মাথায় কিছুই আসেনা।
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১৪.
অর্নির সামনে বসে কাচুমাচু করছে কাব্য। এই একটা বিষয় সে মনে চেপে রাখতে পারছে না। বাবাকেও সে জানাবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান সে নিজেই করবে। এখন অর্নির সাথে শেয়ার করাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না কাব্য। কাব্যকে কাচুমাচু করতে দেখে অর্নি জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে চান্দু? অমন হাসফাস করছো কেন?” কাব্য এগিয়ে এসে বললো “তুমি না সবার মনের কথা বুঝতে পারো? এবার বলো কি ভাবছি আমি।” অর্নি হেসে বললো “ভুল বললে, আমি বলেছিলাম প্রায় অনেকের মনের কথা বুঝতে পারি। যেমন ধরো মানুষ, তবে জ্বীনদের পারিনা। কারন আমি যেই শক্তিটা ব্যবহার করে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি ওই শক্তি অন্য জ্বীনদেরও থাকে। ডাই তাদের মনের কথা বুঝা সম্ভব নয়। এখন তো তুমি মানুষ নেই। এখন তোমার মধ্যে জ্বীনশক্তি চলে আসছে। তুমি আমার জ্বীনবর হচ্ছো এখন বুঝলে? এবার ফটাফট বলো তো দেখি কি ভাবছো?”
কাব্য মাথা চুলকে বললো “তোমাকে বলা কি ঠিক হবে? তবে আমি মিথ্যা বলছি না বিশ্বাস করো।” অর্নি এগিয়ে এসে কাব্যর গলা জড়িয়ে ধরে বললো “আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী, তোমার সমস্ত কিছু জানার অধিকার আমার আছে। তোমাকে বিশ্বাস করা আমার কর্তব্য। কোনো ভালো জামাই তার বউকে সহজে মিথ্যা কথা বলেনা। সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করার জন্য সব সময় সত্যি কথাই বলে।” কাব্য ভরসা পেলো। তবুও কাচুমাচু করে বললো “মা বাবাকে মারতে চায় অর্নি। আমি যতটা শুনেছি মা ভালো মানুষ ছিল। কিন্তু বাবার সাথে কেন এমন করছে? আর কি একটা মুকুটের কথা বললো শুনলাম। তুমি কিছু জানো?” অর্নি ভ্রু কুঁচকে বললো “মাম্মাম? এটা কিভাবে সম্ভব? মাম্মাম তো এমন নয়। কোথায় শুনেছো তুমি?” কাব্য উৎসাহ নিয়ে বললো “একটু আগেই মায়ের রুমে যেতে গিয়ে। দেখলাম অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলছে। আমি তো জানিনা কিভাবে শক্তি ব্যবহার করতে হয় তাই অদৃশ্য লোকটাকে দেখিনি।” অর্নি এগিয়ে এসে বললো “কাব্য উনি কিন্তু তোমার মা। তুমি সত্যি বলছো তো? নাহলে পরিবারটা কিন্তু আবার ভাঙতে বসবে।” কাব্য এবার সিরিয়াস হয়েই বললো “আমি সত্যি বলছি অর্নি। পরিবারটা যেন না ভাঙে সেই চেষ্টাই করছি আমি। এর রহস্য আমাকে ভেদ করতেই হবে।” অর্নি চিন্তিত মুখ নিয়ে বললো “বাবাকে বলি? বাবা কিছু একটা করবে।” কাব্য মাথা নাড়ালো, বললো “নাহ্ বাবা অনেকদিন পরে মাকে পেয়েছে। যা করার আমাদেরই করতে হবে। মা কেন পরিবর্তন হয়ে গেলো? কারন কি এসবের? কেন চলে গিয়েছিল আমাদের ছেড়ে? বাবা জানলে কষ্ট পাবে। আবার আমাকে আর মাকে দূরে সরিয়ে দিবে। তুমিও স্বাভাবিক থাকো। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে। বাবার আশেপাশে থাকতে হবে যেন মা বাবার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।” অর্নি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো৷ কাব্যর হাত ধরে বললো “আমি তোমার সাথে আছি। আমিও চাই পরিবারটা একটা সুন্দর পরিবারে পরিনত হোক। আর শোনো, জ্বীনশক্তি ব্যবহার করতে কোনো নিয়মের দরকার হয়না। তুমি মনে মনে ভাববে যে এই শক্তি ব্যবহার করবো আমি। মনের মধ্যে ইচ্ছেটা আনলেই শক্তিটা ব্যবহার হয়ে যাবে। মনে থাকবে? এবার যাও অদৃশ্য হয়ে দেখাও তো।” কাব্য অর্নির কথা মতো ইচ্ছে পোষন করলো, সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। হাত নাড়িয়ে অর্নিকে জিজ্ঞেস করলো “হাই বউ আমাকে দেখা যাচ্ছে? এখানে কয়টা আঙুল বলো তো?” অর্নি হো হো করে হেঁসে বললো “তুমি কি কানামাছি খেলছো আমার সাথে? আর আমার সামনে তুমি অদৃশ্য হলেও আমি দেখবো। কারন আমিও জ্বীন। তুমি অন্য কারো সামনে গিয়ে দেখতে পারো।” কাব্য মাথা চুলকে বললো “কার কাছে যাবো? বাড়িটাই তো জ্বীনদের আস্তানা। যাই ইশমামকে ভয় দেখিয়ে আসি।” বলেই এক লাফে রুম থেকে বেরিয়ে ইশমামের রুমের দিকে গেলো।
এদিকে অর্নি ভাবছে সত্যিই কি কাব্য এগুলো শুনেছে? কাব্য ওর মাকে খুব ভালোবাসে। ও কোনো ভাবেই মায়ের নামে মিথ্যা বলবে না। তাহলে কি মাম্মাম সত্যিই বাবাকে মারতে চাইছে? কিন্তু কেন? এর রহস্য কি?
এদিকে কাব্য যায় ইশমামের রুমে। ইশমাম সহজে রুম থেকে বের হয়না। এই পরিবারের কারো সাথে মিশতেই তার ইচ্ছে হয়না। তাই সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকে। কাব্য ইশমামকে ডাক দিলো, ইশমাম চমকে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। ভাবলো এটা তার মনের ভুল। কিন্তু ফের ডাক শুনেই ফের চমকে উঠে কে কে বলে ডাকতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে ভয় পেয়ে টেবিলে থাকা ফুলের টব আন্দাজে ছুড়ে মারলো। সোজা গিয়ে কাব্যের মাথায় লাগলো। ‘আউচ’ আওয়াজ করে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায় কাব্য। নিজের রুমে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে চেপে ধরলো। কপাল কেটে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কপাল থেকে। অর্নি দৌড়ে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো কাব্যের এই অবস্থা দেখে। অর্নির কান্নায় বাড়ির প্রায় প্রত্যেকে দৌড়ে এলো। অর্নি দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে কপাল থেকে রক্ত মুছে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। কাব্য নিজের থোঁতা মুখ ভোতা করে বসে আছে। আপাতত কান্না রেখে কাব্যের এমন মুখ দেখে অর্নির হাত পা ছুঁড়ে হাসতে মন চাইছে। কিন্তু শব্দের জন্য সেটা করতে পারছে না। তবে শুভ্রের সাথে চোখাচোখি হয়ে অর্নি বেশ কয়েকবার চোখে চোখেই হো হো করে হেসে ফেলেছে। শুভ্র অবশ্য মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে।
শব্দ মুখ গোমড়া করে বললো “এটা স্বাভাবিক, বিয়ের পরে একটু আধটু খেতেই হয়। আমি তো এমন দিন যায়নি যেদিন খুন্তির বারি খাইনি। তুই তো সবে একদিন খেয়েছিস, এতেই এই অবস্থা? ভাগ্য ভালো অর্নি আবার সেবা করছে। এমন যদি আমার বউ হতো। আর আমার অন্য বউয়ের কাছে গিয়ে আমার এই অবস্থা হলে আমার রোদ উল্টো আমাকে সেবা না করে পিটিয়ে নিতো আগে। তোর কপাল ভালো কাব্য, তোর হাসা উচিত।” শব্দের কথায় সবাই জোরে জোরে হাসতে শুরু করে দিলো। এবার আর অর্নি নিজেকে সামলাতে পারলো না। একপ্রকার হাত পা ছড়িয়েই হেসে যাচ্ছে সে। এতো হৈ হুল্লোড়ের আওয়াজ পেয়ে ইশমাম রুম থেকে বের হয়ে উঁকি দেয় কাব্যের রুমে। কাব্যের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে ওঠে ওর। কিন্তু আড়াল থেকে প্রকাশ্যে আসতেও সে পারছে না। মিষ্টি ইশমামকে লক্ষ্য করতেই এগিয়ে এসে ইশমামকে ধরে বললো “কি হলো? তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো ভেতরে এসো।” ইশমাম আসতে না চাইলেও মিষ্টি জোর করেই রুমে নিয়ে চলে এলো।
এতো এতো কথা হাসাহাসির পরেও রোদ একবারের জন্যও এদিকটায় আসেনি। শব্দের সন্দেহ হলো রোদের উপর। তাই রোদকে ডাকার জন্য পা বাড়াতেই কাব্য সেটা খেয়াল করে অর্নিকে ইশারা করলো। অর্নি দ্রুত কাছে এসে বললো “বাবা মাম্মামকে ডাকতে যাচ্ছেন? আপনি দাঁড়ান আমি যাচ্ছি।” শব্দ আর কথা বাড়ালো না।
অর্নি গিয়ে রোদের রুমে টোকা দিলো। ভেতর থেকে কথার আওয়াজ আসছে। কিন্তু দরজার টোকা রোদ খেয়াল করলো না। অগত্যা রোদ কি কথা বলছে সেটা শুনতেই অদৃশ্য হয়ে রুমে ঢুকলো অর্নি।
অর্নিঃ এ কি আপনি? আপনি এখানে মাম্মামের সাথে কেন?
রোদঃ একি অর্নি তুই এখানে, আমাকে না বলে রুমে ঢুকেছিস কেন? কারো রুমে ঢুকলে বলে ঢুকতে হয় জানিস না?
অর্নিঃ আমি তোমার সাথে কথা বলছি না মাম্মাম। এই লোকটাকে বলতে দেও।
অজ্ঞাত লোকঃ আমাকে মহারানী ডেকেছেন।
রোদঃ আমি তোর সাথে কথা বলছি অর্নি। আমার প্রশ্নের জবাব দে আগে।
অর্নিঃ কি জবাব চাও মাম্মাম? আগে তো কখনো তোমার রুমে ঢুকতে অনুমতি নিতে হয়নি। এখন নিতে হবে কেন? মা থেকে শাশুড়ী মা হয়ে গেছো এই জন্য নাকি?
রোদঃ কিসের শাশুড়ী? এই বাড়ি, শব্দ বা কাব্য কাউকে আমার মনে নেই। যা আমার মনে নেই, তার অস্তিত্বও আমার কাছে নেই। এগুলো আমার কাছে নাটক ছাড়া কিছুই না।
অর্নিঃ নাটক? এতো গুলো মানুষ কথা বলছে সব তোমার কাছে নাটক মনে হচ্ছে মাম্মাম? নাটক মনে হলে স্বীকার করে এই বাড়িতে থাকতে রাজি হয়েছো কেন? আমাকেই বা কাব্যের সাথে বিয়ে দিলে কেন?
রোদঃ সব কথার কৈফিয়ত আমি তোকে দিতে রাজি নই। মা বাবা ছাড়াও মা পেয়েছিস, এতো সুন্দর পরিবার পেয়েছিস এটাই কপাল তোর।
অর্নিঃ তোমাকে আর কিছু বলার নেই শাশুড়ী মা। তুমি নিজের মা কেন? শাশুড়ী মা হওয়ারও যোগ্যতা রাখো না। আর এই যে আপনি, মহারানী মানে কি?
অজ্ঞাত লোকঃ উনি আমাদের মহারানী।
রোদঃ চুপ থাকুন আপনি। এখন আপনি যান। পরে আপনার সাথে আমি কথা বলে নিবো।
রোদের কথায় লোকটা চলে যায়। অর্নি নিজের মাথা চেপে ধরে বসে যায়। রোদ অর্নির মাথায় হাত রেখে বললো “এগুলো কাউকে বলিস না অর্নি। মাম্মাম তোকে বড় করেছে। মেয়ের আদর দিয়েছে। তুই আমার পক্ষে থাকবি আমার মেয়ে হয়ে।” অর্নি মাথা তুলে বললো “ছোট বেলা থেকে যদি এমন শিক্ষা দিতে তাহলে তোমার পক্ষে থাকতে পারতাম। ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দিয়েছো কারো সাথে যেন অন্যায় না করি। কারো সাথে যেন বেঈমানী না করি। তাহলে আজ সেই শিক্ষার বিরুদ্ধে কিভাবে যাই বলো তো? আমি আমার পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারবো না। কি রহস্য তোমার মধ্যে জমা আছে সেটাও আমি বের করে ছাড়বো। আমি আমার পরিবারের ক্ষতি হতে দিবো না মাম্মাম।”
কথাটা বলেই চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়াতেই রোদ বললো “আমার উদ্দেশ্য থেকে আমাকে সরিয়ে দিস না। যে আমার পথে বাঁধা হবে তাকেই আমি সরিয়ে দিবো। সেটা যদি তুই হস তাহলেও আমার হাত কাঁপবে না।” শব্দ কিছুটা শুনতে পেলো। এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে ঘাড়ে আঘাত পেয়ে পেছনে তাকিয়ে ভীষন চমকে গিয়ে বলে “তুমি এমনটা করলে?”
চলবে?…..
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১৫.
কাব্যর পাশাপাশি শব্দও মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বসে আছে। দুজনের মুখটাই আপাতত ভোঁতা হয়ে আছে। শব্দ এতো বড় বড় কথা বলে সেই শেষ পর্যন্ত রোদের হাতের বারি খেয়েই মাথা ফাটিয়ে বসে আছে। মাথায় আঘাত পেয়ে চিৎকার করতেই সবাই জড়ো হয় শব্দের কাছে। রোদ অপরাধী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনে। যদিও কাব্য ও অর্নি বুঝতে পেরেছে এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা না। এমন দু একটা আঘাত এখন অহরহ আসবে শব্দের দিকে। ঘটনাটা এখানেই শেষ হলো। বিপত্তি সৃষ্টি হলো রাতে। যেহেতু কাব্য জেনে গেছে এখন সে জ্বীন, তাই সাদা জুব্বা পড়া লোকগুলো আসায় কোনো বাঁধা নেই। বসার ঘরে যখন সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলো ঠিক তখন সাদা জুব্বা পড়া লোকগুলো এসে শব্দকে সালাম দিয়ে রোদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো “আসসালামু আলাইকুম শব্দ ভাই, উনি এখানে কি করছেন? যতটা আমরা জানি তাতে বলতে পারি উনি খারাপ জ্বীনদের রানী। ওনার এখানে থাকাটা তো স্বাভাবিক নয়।” শব্দ নিরবে রোদের দিকে তাকালো। রোদ ভয়ে আছে, প্রচন্ড ভয় যাকে বলে। শব্দ রোদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করলো “আপনারা জানলেন কিভাবে এটা?” লোকগুলো মাথা নিচু করে বললো “ক্ষমা করবেন শব্দ ভাই। আমরা তো মানুষদের মতো জীবনযাপন করিনা। আমরা জ্বীনরাজ্যে বসবাস করি। আপনি তো সেখানে যান না তাই জানেন না। এই তো গত সপ্তাহেও ইনি আমাদের রাজ্যে ছোটখাটো হামলা করেছেন। বেশ কয়েকজন জ্বীন আহত হয়েছে। জ্বীনরাজ্যে এমন কেউ নেই যে এনাকে চিনেন না। এনাকে এখানে দেখে আমরা রীতিমতো অবাকই হয়েছি।” শব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “ইনি আমার স্ত্রী মিসেস রোদ শাহরিয়ার। আমি জানিনা আপনাদের তথ্য কতোটা সঠিক। যদি সঠিক হয় তাহলে জ্বীনরাজ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে আমি অবশ্যই জ্বীনরাজ্যকে রক্ষা করবো। তার পাশাপাশি জ্বীনবর হওয়ায় আমি আমার স্ত্রীকেও রক্ষা করবো। আপনারা কিসের জন্য এসেছেন?” লোকগুলো একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বললো “আপনি তো জ্বীনরাজ্যের নিয়ম কানুন জানেন। নিয়ম অনুযায়ী আপনার ছেলে কাব্য শাহরিয়ারকে কিছুদিন জ্বীনরাজ্যে থাকতে হবে। কারন সে জ্বীনরাজ্যে এখনো প্রবেশ করেনি। তারপর আবার পূর্ন শক্তি পাওয়ার পরে আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আপনি অনুমতি দিলে আমরা নিয়ে যেতে পারি।” শব্দ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো “বেশ, নিয়ম তো আমি লঙ্ঘন করতে পারবো না। তবে হ্যাঁ, আমার ছেলের যেন কিছু না হয়। যদিও আমি প্রতিদিন জ্বীনরাজ্যে যাতায়াত করবো।” লোকগুলো ফের সালাম জানিয়ে কাব্যকে নিতে এগিয়ে যায়। কাব্য হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। সম্পূর্ণ অচেনা এক জায়গায় তার যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না। তারউপর অর্নিকে ছাড়া সে থাকতেই পারবে না। যত জমানো কথা সে অর্নিকে ছাড়া কাউকে বলতে পারেনা। যার কারনে অর্নিকে ছাড়া থাকলে তার মনে হয় পেটে বোমা ফেটে যাবে।
কাব্যের কাচুমাচু দেখে শব্দ জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে? কয়েকদিনের তো ব্যাপার। ভয় পাস না একদম। পুরো রাজ্য ঘুরবি, যা চাইবি সব পাবি।” কাব্য মাথা নিচু করে বললো “আসলে বাবা তা নয়, আমি অর্নিকে ছাড়া থাকতে পাারবো না। তুমি ওনাদের বলো না অর্নিকেও নিতে।” অর্নি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। শব্দ খুকখুক করে কেশে বললো “তো অর্নির যদি যেতে মন চায় তাহলে ও যেতে পারবে। এনাদের নিয়ে যেতে হবে না। অর্নি তুমি যেতে চাও?” অর্নি কোনো কথা বললো না, বরাবরই সে শব্দের সাথে কথা বলতে ভয় পায়। অর্নির মৌনতা দেখে শব্দ অনুমতি দিলো যাওয়ার। তারা সবাই মিলে রওনা দিলো জ্বীনরাজ্যের উদ্দেশ্যে। এই প্রথমবার মাটি থেকে এতো উপরে কোনো উড়োজাহাজ ছাড়া নিজেই উড়ছে কাব্য। ব্যাপারটা তার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে। ভয় করছে বলে অর্নির হাতটা শক্ত করে ধরে রইলো। অর্নি মাঝে মাঝে ধাক্কা দেওয়ার ভং ধরে কাব্যকে নিয়ে মজা করে যাচ্ছে।
এদিকে বাড়িতে রোদ শব্দের মুখোমুখি বসে আছে। বেশ কয়েকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রোদের দিকে শব্দ। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ ধমক দিলো শব্দ। রোদ অগ্নিচোখে তাকিয়ে বললো “আমাকে শাসাচ্ছেন আপনি? আমি কে সেই বিষয়ে কোনো ধারনা আছে আপনার?” শব্দ পায়ের উপর পা তুলে বললো “কোন বেআক্কলে যে তোমাকে ব্যবহার করছে আমাকে মারার জন্য কে জানে। সে ভালো ভাবেই জানে তুমি আমার দূর্বলতা। তার যদি মারার ক্ষমতা থাকতো তাহলে তোমাকে ব্যবহার করতো না। সে ভালো ভাবেই জানে আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ আসলে কে।” রোদ শব্দের ভঙ্গিতে বসে বললো “তা জেনে আমার কোনো কাজ নেই মিঃ শাহরিয়ার। আমার যা মনে নেই, তার অস্তিত্বও আমার কাছে নেই। তাই সেগুলো আমি বিশ্বাসই করিনা। আমি আমার উদ্দেশ্য থেকে এক পা-ও পিছু হটবো না।” শব্দ বাঁকা হেসে বললো “সুন্দরী নারীরা একটু বোকা হয় তাইনা? তারউপর তুমি আমার কাছে বিশ্বের সেরা সুন্দরী। তাহলে তোমার বুদ্ধি কতোটুকু থাকবে সেটা তুমিই বুঝে নেও। রোদ হয়তো ভুলে গেছে তার জ্বীনবরের এক পথ বন্ধ থাকলে অন্য পথ ঠিক খুঁজে নেয়। আমি তোমাকে ঠিক রেখেও আমার জ্বীনরাজ্য, আমাদের সন্তান ও আমাদের পরিবার ঠিক রাখতে পারবো। এটাই আহনাফ শাহরিয়ার শব্দের স্পেশালিটি।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই কাব্য ও অর্নি জ্বীনরাজ্যে পৌঁছে গেলো। জ্বীন হওয়ার সুবাদে সব কাজ এতো তাড়াতাড়ি করা যায় সেটা বুঝতেও পারেনি কাব্য। সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো কাব্যের জন্য। জ্বীনরাজ্যে ঢোকার সীমানায় বড় করে লেখা “জ্বীনরাজ্য, জ্বীনরাজ্যে স্বাগতম। জ্বীন ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ।” ওরা গেট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই সবাই দৃশ্যমান হলো। নানা ধরনের নাম না জানা ফুল দিয়ে সবাই বরন করলো। মনে হচ্ছে রাজার ছেলের আগমন হচ্ছে। জুব্বা পড়া লোকগুলর একজনকে জিজ্ঞেস করলো কাব্য “এনারা এভাবে স্বাগত জানাচ্ছে কেন আমাদের?” লোকটা প্রতুত্তরে বললো “জ্বীনরাজ্যে নতুন জ্বীনদের এভাবে ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। তার উপর আপনারটা একটু স্পেশাল। কারন আপনি আমাদের রাজ্যের রক্ষকের ছেলে।” বাবাকে নিয়ে কাব্যের এখন এই মুহুর্তে ভীষন গর্ববোধ হচ্ছে।
ছোট ছোট খড়ের ঘরগুলো সাজানো চারদিকে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা সৃষ্টি হচ্ছে কাব্যের। অর্নি যদিও আগে এখানে এসেছে। তাই ওর কাছে এগুলো এখন পুরোনো। তাও আলাদা একটা জগতে আসলে কার না ভালো লাগে? কাব্য মুগ্ধ হয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। একটা ঘরের সামনে নিয়ে সাদা জুব্বা পড়া লোকগুলো বললো “এটাই শব্দ ভাইয়ের ঘর। আপনারা এখানেই থাকবেন। বাইরে সবাই সব সময় পাহারা দেওয়ার জন্য আছে। কিছু চাইলেই পেয়ে যাবেন। অনেকটা পথ এসেছেন, একটু বিশ্রাম করুন। আজ ঘুরে দেখবেন, কাল থেকে আপনার প্রশিক্ষণ শুরু।”
কাব্য তো ঘরের মধ্যে গিয়ে লাফালাফি করে যাচ্ছে। এতো সুন্দর অনুভূতি ৪৫ তলা বিল্ডিংয়েও পাওয়া যায় না। বিছানায় লাফিয়ে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। অর্নি মুগ্ধ হয়ে কাব্যের পাগলামি দেখছে। এতো বড় হলো, বিয়ে হলো তাও তার বাচ্চামো যাচ্ছে না। অর্নিকে এভাবে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাব্য এগিয়ে আসে। অর্নিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে দিলো। অর্নি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই কাব্য অর্নির কোমড় শক্ত করে এগিয়ে এনে বললো “আমি আমার বউকে আদর করছি। তোমার কি সমস্যা মিসেস কাব্য শাহরিয়ার? নড়াচড়া করো না, তাহলে কিন্তু আদরটা আরো বেশি হয়ে যাবে।” অর্নি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে বললো “আমি তো সেটাই চাই।” বলেই জিভে কামড় দিলো। কাব্য লাফিয়ে উঠে বললো “কি বললে? আরেকবার বলো বউ। আমি তোমাকে আদর করতে সব সময় প্রস্তুত।”
দুজনের কথার মাঝেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। কাব্য বিরক্ত হয়ে বললো “এই সময়ে আবার কে এলো বিরক্ত করতে?” অর্নি লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বললো “তুমি হানিমুনে আসোনি এখানে। এখানে যার যখন খুশি চলে আসতে পারে।” অর্নি অনুমতি দিলো “ভেতরে আসুন!” দুজন বুড়ো ভদ্রমহিলা বন্ধ দরজা ভেদ করেই ভেতরে আসলো। দুজনকে এক ঘরে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো “তোমরা এক ঘরে কেন? লাজ লজ্জা কিছু নাই নাকি তোমাদের?” কাব্যও মহিলার মতো ভ্রু কুঁচকে একই সুরে বললো “কেন দাদিমা, তুমি বুঝি দাদার সাথে এক ঘরে থাকো না। বিয়ের পর দুজন দুজনের মুখ দেখো নি।” মহিলাটি রেগে বললো “সেটা বিয়ের পরে জায়েজ। এখন কি এক ঘরে?” কাব্য অর্নিকে টেকে বুকে নিয়ে বললো “আমাদের দেখে বিবাহিত মনে হচ্ছে না তোমার?” সবার কথার মধ্যেই শব্দ ঘরে ঢুকলো। শব্দকে দেখে কাব্য ও অর্নি দুজনে ছিটকে দূরে সরে যায়। শব্দকে দেখে বুড়ো মহিলারা এক প্রকার জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিলো। তাদের দুঃখ দূর্দশার কথা বলতে লাগলো কেঁদে কেঁদে। শব্দ তাদেরকে শক্ত করে ধরে বললো “চাচিমা তোমরা কেঁদো না, আমি কথা দিচ্ছি এই রাজ্যের কারো কোনো ক্ষতি হতে দিবো না আমি। ভরসা রাখো তোমাদের ছেলের উপর। এ হলো আমার ছেলে কাব্য আর ছেলের বউ অর্নি। তোমরা দেখে রেখো ওদের।” এবার বুড়ো মহিলারা নরম হয়ে কাব্যর মাথায় হাত রেখে মাথা মুছিয়ে দিলেন। অর্নিকে এক মহিলা দোয়া করলেন “বেঁচে থাকো মা স্বামী সন্তান নিয়ে। তোমার কোল পরিপূর্ণ হোক গোটা দশেক বাচ্চা দিয়ে।” মহিলাটির কথায় অর্নি চোখ বড় বড় করে তাকালো। সবাই চলে যেতেই কাব্য হো হো করে হেঁসে বললো “বউ গোটা দশেক। চলো এখনি কাজ শুরু করে দেই। শুভ কাজে দেরি করতে নেই একদম।”
শব্দ বাইরে গিয়ে চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ শুনে দৌড়ে সেদিকে গেলো। কালো ভয়ানক কিছু ছায়া দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না কাজটি কার হতে পারে। হাতের মুঠো শক্ত করে শব্দ বললো “তোমার সময় শেষ, তোমাকে আমি ছাড়বো না। কোনোভাবেই আর নিস্তার নেই তোমার।”
চলবে?..
গল্পটা হিজিবিজি মনে হচ্ছে?একদম না, এতোদিন রহস্য ঢুকানো হয়েছে গল্পে। এখন রহস্যের জট খোলা হচ্ছে।
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১৬.
শব্দের সামনে অপরাধী ভঙ্গিতে বসে আছে রোদ। শব্দ সমানে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কিন্তু রোদের দিক থেকে কোনো উত্তর সে পাচ্ছে না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রোদের একদম কাছে এসে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বললো “তোমাকে যে প্রশ্ন করেছি উত্তর কি তুমি দিবে? ভুলে যেওনা আমি আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ। আমি চাইলে তোমার এই মুহুর্তে দ্যা এন্ড করে দিতে পারি। কিন্তু আমি তা করছিনা। কারন তুমি আমার বউ। তাই বলে ভেবো না আমি তোমাকে কিছু করবো না বা করতে পারবো না। আমার রাজ্যের প্রতিটি জ্বীনের চোখের পানির মূল্য তোমাকে দিতে হবে মিসেস শাহরিয়ার। উত্তর দেও!” রোদ ভয়ে কেঁপে বললো “আমি সত্যি কিছু করিনি মিঃ শাহরিয়ার। সত্যি বলছি আমি বিশ্বাস করুন। এই বিষয়ে আমি আসলেই কিছু জানিনা।” শব্দ রোদের বসে থাকা চেয়ারে ধাক্কা দিয়ে বললো “তোমার মতো বেঈমানকে বিশ্বাস করতে বলছো? এইতো কয়েকদিন আগে বললে তুমি আমার বউ সেটা তুমি মেনে নিয়েছো। অথচ এখন দেখো, মাত্র একটা সুযোগের অপেক্ষায় এখানে আছো তুমি। কারন হলো আমাকে শেষ করা। আমি আসলে বুঝতে পারছি না তোমাকে কে ব্যবহার করছে।” বলেই গটগট করে রুম থেকে বের হয়ে যায় শব্দ। রোদ অগ্নিবর্ণ ধারন করে চিৎকার করে বললো “কোথায় তুমি? হাজির হও এখনি আমার সামনে।” সাথে সাথে কয়েকজন রোদের সামনে হাজির হয়ে কুর্নিশ জানায়। রোদ একই ভঙ্গিতে বললো “রাখো তোমার কুর্নিশ। কুর্নিশ জানিয়ে কি হবে? রানী ভাবো আমাকে? রানী ভাবলে আমার কথা ছাড়া কাজ কিভাবে করো তোমরা? তোমরা জানো না জ্বীনরাজ্যে এখন কাব্য ও অর্নি আছে? তা জানা সত্ত্বেও তোমরা হামলা করলে। একবারও জিজ্ঞেস করেছো আমাকে? তাহলে আমি কিসের মহারানী তোমাদের?” মাঝে একজন বলে “আমাদের ভুল হয়েছে রানী। তবে আমাদের তো একমাত্র লক্ষ্য ছিল জ্বীনরাজ্য ধ্বংস করা। তো যখন সুযোগ পাবো তখনি তো কাজটা করবো আমরা৷” রোদ ফের ধমক দিয়ে বললো “তোমাদের সুযোগ হয়েছে আমার ছেলে মেয়ে জ্বীনরাজ্যে থাকা অবস্থায়? এবারের মতো ক্ষমা করলাম। পরবর্তীতে কিন্তু এসব আমি একদম সহ্য করবো না। যা করবে সব আমার অনুমতি নিয়ে করবে। এবার যাও আমার চোখের সামনে থেকে।” রোদের কথা মতো সবাই তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো। রোদ থম মেরে বসে কাঁদতে লাগলো। শব্দের কথাগুলো তার বারবার মনে আসছে। কিছুক্ষণ পরে শব্দ রোদের রুমে এসে রোদকে কাঁদতে দেখে। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা অনুভব হয় তার। রোদের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো “সরি বউ, আমার মাথা ঠিক ছিল না। কি না কি বলে ফেলেছি। আমি তো তোমার জ্বীনবর বলো? আমি তো তোমার মনের জ্বীনবর হতে চাই। তুমি দুঃখ পেয়ো না একদম। আমাকে মাফ করে দেও তুমি।” রোদ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। এই দৃশ্যটা দেখে শব্দের সেই কিশোরী রোদের কথা মনে পড়ে যায়।
অন্যদিকে একদিন পার হয়ে গেছে। আজ কাব্যের প্রশিক্ষণের দিন৷ কিন্তু সকাল থেকে একবারের জন্যও সে দরজা খোলেনি। গতকাল বুড়ো মহিলার গোটা দশেক বাচ্চার কথা শুনে আবদার করে আছে তারও বাচ্চা চাই। অর্নি বিরক্ত হয়ে বললো “তাহলে তুমিই প্রেগন্যান্ট হয়ে যাও। আমি কাউকে একটা বলছি তোমাকে যাদু দিয়ে প্রেগন্যান্ট করে দিক।” সেটা নিয়েই রাগ করে দরজা এঁটে বসে আছে সে। না সে বের হচ্ছে, না অর্নিকে বের হতে দিচ্ছে। অর্নিকে নিজের কোলের মধ্যে বসিয়েই বাইরের ডাকাডাকি শুনে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষন পরে ডাকাডাকির যন্ত্রনায় আর থাকতে না পেরে দরজা খুলে দিলো। বুড়ো মহিলাটি কাব্যের কান মুলে দিয়ে বললো “কতো করে ডাকছি সাড়া দিচ্ছো না কেন? ভেতরে কি করছো?” কাব্য মহিলাটির গলায় হাত রেখে বললো “কাল না বলেছিলে গোটা দশেক বাচ্চার কথা? সেটারই পরিকল্পনা করছিলাম। ছক্কা মারতে হবে না?” সবাই কাব্যের কথায় হো হো করে হেঁসে ফেললো। এদিকে অর্নি লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
কাব্যকে নেয়া হলো প্রশিক্ষণের জন্য। কয়েকজন দক্ষ প্রশিক্ষক আনা হলো কাব্যের জন্য। তারা বিভিন্ন কলাকৌশল দেখিয়ে কাব্যকে শিখিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের উঁচু একটা জায়গায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। প্রশিক্ষণের সময় যেন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় তাই এই পদ্ধতি। কাব্যকে দেখতে ছোটবড় সবাই জড়ো হয়েছে। পাশেই হালকা বাতাসে বসে আছে অর্নি। সূর্যের সোনালী আলো অর্নির মুখের উপরে পড়ছে। প্রশিক্ষণের মধ্যে মাঝে মাঝে কাব্য অর্নির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তবে কাহিনী ঘটলো অন্যদিকে। রাজ্যের রাজার মহল থেকে কেউ একজন মুগ্ধ হয়ে অর্নির দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে পাশে থাকা কাজের লোককে বললো “হাসেম আম্মাজানকে গিয়ে বললো আমার বেগম পেয়ে গেছি। তাকে যেন আর পাত্রী দেখতে না হয়।” হাসেম উৎসুক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো “কোথায় ছোট হুজুর? কাকে দেখলেন আপনি?” ছোট হুজুর বিরক্ত হয়ে বললো “উফফ হাসেম, বড্ড কথা বলো তুমি। যাওনা, গিয়ে খবর দেও।” হাসেম এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে দৌড় দিলো। ছোট হুজুরকে সে জমের মতো ভয় পায়। তবে ছোট হুজুর কখনোই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মোটাসোটা মহিলা ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে আসলো ছোট হুজুরের দিকে। পান খেয়ে দাঁত কপাটি কালো করে ফেলেছে সে। চোখে থাকা গোলগোল চশমাটা নাকের মাথায় এসে ঠেকেছে। এতে তার গোলগাল মুখটা আরো গলুমলু লাগছে। এগিয়ে এসে বললো “বাপজান তুমি নাকি বেগম পেয়েছো? কোথায় তোমার বেগম? আমাকেও দেখাও।” ছোট হুজুর খুশিতে মহিলাকে জাপটে ধরে বললো “ওই যে দেখো তোমার ছেলের বেগম। তোমার মহলের ছোট রাজরানী।” মহিলাটি চশমা ঠিক করে অর্নির দিকে তাকিয়ে বললো “মাশাল্লাহ, এতো চমৎকার মেয়ে। মনে হচ্ছে পূর্নিমার চাঁদের আলো আমার ঘরে উঠবে। হাসেম, হাসেম যাও খোঁজ নেও ওই মেয়েটা কে। আগে তো কখনো এখানে দেখিনি।” হাসেম মুখ কাচুমাচু করে বললো “আম্মি হুজুর কোন মেয়ের কথা বলছেন সেটাই তো আমি দেখিনি। তো কার খোঁজ নিবো আমি বলুন তো?” হাসেমের অভিমানী মুখটা দেখে ছোট হুজুর কুটকুট করে হেসে বললো “এসো এসো হাসেম, দেখে যাও তোমার ছোএ হুজুরানীকে।” হাসেম উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে এসে চোখ বড় বড় করে বললো “মাশাল্লাহ ছোট হুজুর, যেমন আপনার রুপ। তেমন ছোট হুজুরানীর রুপ। একদম খাপে খাপ।” ছোট হুজুর হাসেমের কথা মাঝ পথে থামিয়ে বললো “খাপে খাপ, হাসেমের বাপ। এবার যাও, দেরি করো না। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।”
প্রশিক্ষণের কাজ কিছুটা হয়ে এলে বিশ্রামের জন্য সবাই সবার বাড়িতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে আবার শুরু হবে। তাই কাব্য ও অর্নিও ফিরে এলো ঘরে। আসার সাথে সাথে খাবার পৌঁছে যায় ওদের রুমে। কাব্য কোনো ভাবে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসে অর্নির দিকে। অর্নির দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো “আজ তোমার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিনা কেন বলো তো? একদম পাগল বানিয়ে ফেললে যে আমাকে।” বলেই মুখের পাশ দিয়ে চুল গুলো কানের কাছে গুঁজে কানের নিচে একটা চুমু এঁকে দেয় কাব্য। তারপর কিছুক্ষণ অর্নির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। আজ যেন অর্নি নিজেও কাব্যের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে কাব্য অর্নির দিকে তাকাতে পারছে না। লজ্জায় তার মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইছে। চোখ বন্ধ করে পা দুটো দিয়ে লাফালাফি করে কাব্য বললো “অর্নি আমার না খুব লজ্জা লাগছে। তুমি আমার দিকে তাকাবে না প্লিজ।” অর্নি হি হি করে হেসে ফেললো কাব্যের কথায়।
এদিকে শুভ্র শান্ত দৃষ্টিতে সকালের পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে। সকালে তার পড়া হয়নি। মিষ্টিকে ডেকে চা দিতে বলে বললো “দেখেছো? দেশটা একদম রসাতলে গেলো। দেখো দেখো কি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পালিয়ে গেলো প্রেম করে। আমার ছেলে এমন হলে না? পাতাল থেকে খুঁজে এনেও গুলি করে মারতাম।” মিষ্টি হেসে বললো “তোমারও ছেলে আছে, দেখেশুনে রেখো।” শুভ্র দাঁত বের করে বললো “আমার ছেলে একদম আমার মতো হয়েছে। মেয়েদের প্রতি ইন্টারেস্ট কম। বউ ছাড়া কোথাও চোখ দেই না।” ওদের কথার মাঝেই শুনতে পেলো অভ্রের ছোট্ট ছোট্ট বুলি “এসো এসো সাবধানে এসো। জামাটা আমি ধরি? তুমি উঠতে পারবেনা তো। আচ্ছা আসো এই তো। পাপা পাপা, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।” অভ্রের হাত ধরা একটি ছোট্ট মেয়েকে দেখে শুভ্রের চোখগুলো গোল গোল হয়ে গেলো। মিষ্টি মুখে হাত দিয়ে হেসে বললো “একদম বাপের মতো হয়েছে। বাপকা বেটা, সিপাহিকা ঘোড়া।”
চলবে?…..
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১৭.
গাল ফুলিয়ে শুভ্র বসে আছে। শুভ্রের করুন অবস্থা দেখে মিষ্টি মুখ টিপ টিপে হাসছে। মাঝে মধ্যে দু একটা খোঁচা মারা কথা শুনাতেও ছাড়ছে না সে। শুভ্রের দিকে তাকিয়ে অভ্র ভাবুক দৃষ্টিতে চিবুকে আঙুল বুলোচ্ছে। বার কয়েক জিজ্ঞেস করলো “ও পাপা, কথা বলছো না কেন তুমি? আমার বান্ধবীকে ওয়েলকামও করলে না। ব্যাপারটা আমার জন্য দুঃখজনক।” শুভ্র “এহহহহ্” বলে অভ্রর গাল টেনে দিয়ে বললো “কে ও?” অভ্র খুশি হয়ে বললো “আমার বান্ধবী, সামিরা। সামিরা পাপাকে হায় বলো।” সামিরা তার ছোট্ট ছোট্ট হাত নাড়িয়ে হ্যালো বলে দিলো। শুভ্র ঠোঁটে চওড়া হাসি দিলো। ফের অভ্রকে বললো “এতো ছোট বয়সে বান্ধবি নিয়ে আসছিস বাড়িতে?” অভ্র ছোট্ট দাঁতগুলো বের করে বললো “আনবো না? আমাকেও তো বিয়ে করতে হবে।” শুভ্রর থোঁতা মুখটা ভোঁতা হয়ে গেলো ছেলের উত্তর শুনে। মাথায় হাত দিয়ে বললো “এই ছোট বয়সে বিয়ে?” অভ্র দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বললো “হ্যাঁ কাব্য ভাই তো বিয়ে করলো। এবার তো আমার সিরিয়াল।” শুভ্র চোখ মুখ খিঁচে বললো “কাব্য তো বড় হয়েছে, ওর ১৮ বছর হয়েছে। তুই তো এখনো পুঁচকে।” অভ্র নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বললো “তাতে কি? আমি ১৮ বছর পর্যন্ত সামিরার সাথে প্রেম করবো। তারপর বিয়ে করবো। কাব্য ভাইয়া তো ছোটবেলায় সামিরার মতো কিউটি পিউটিকে পায়নি, তাই প্রেম করতে পারেনি। বেচারা কাব্য ভাই!” মিষ্টি রেগে গিয়ে বললো “এই তোরে এতো প্রেম ভালোবাসা শিখিয়েছে কে রে?” অভ্র আঙুল উঁচু করে শুভ্রকে দেখিয়ে বললো “পাপা।”
অন্যদিকে প্রশিক্ষণের কাজ শেষ হলে সন্ধ্যায় কাব্য রেস্ট করছে তার ঘরে। এতো এতো পরিশ্রম সে আগে কখনো করেনি। খাটের এক কোনায় বসে আছে অর্নি। অর্নিকে টেনে নিয়ে নিজের বুকের উপরে শুইয়ে দিয়ে বললো “এতো এতো কষ্ট করতে হয়? তুমিও করেছিলে বুঝি?” অর্নি কাব্যের বুকে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে। মাথা নাড়িয়ে বললো “হ্যাঁ শিখেছি তো। কাল থেকে আর কষ্ট হবেনা দেখো।” বাইরে চেচামেচির আওয়াজ শুনে অর্নি নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে বের হলো। কাব্য বের হলো না। শরীর তার প্রচুর খারাপ। তাই চোখ বন্ধ করে রেস্ট নিচ্ছে সে। অর্নি দরজা খুলতেই সামনে এতো এতো জ্বীনদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো “কোনো দরকার আমাদের কাছে আপনাদের?” কেউ জবাব দিলো না। দূর থেকে হাসেম ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলো “আমার কিছু জানার আছে।” অর্নি সম্মতি দিলো, হাসেম সম্মতি পেয়ে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলো “আপনি কে? আপনার নাম কি? আগে তো কখনো দেখিনি এখানে। নতুন এসেছেন নাকি?” অর্নি হালকা হেসে বললো “আস্তে ধীরে জিজ্ঞেস করুন। একসাথে এতো প্রশ্নের উত্তর দিবো কিভাবে? আমি বলি শুনুন, আমি অর্নি শাহরিয়ার। আমি মানুষের মতোই মানুষদের রাজ্যে বসবাস করি। তাই এখানে আসা হয়না তেমন। প্রশিক্ষণের জন্যই এসেছি। তাই হয়তো দেখেন নি।” অর্নির নামের সাথে শাহরিয়ার শুনে হাসেম আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। অর্নি সবার থেকে অনুমতি নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ফের গিয়ে কাব্যর বুকের উপরে শুয়ে কাব্যের হাত এনে নিজেকে আবদ্ধ করে নিলো। কাব্য আস্তে জিজ্ঞেস করলো “কে এসেছিল?” অর্নি আস্তে জবাব দেয় “চিনিনা তো আমি, এখানের কেউ হবে হয়তো। নতুন দেখছে তাই জিজ্ঞেস করলো আমি কে। এতো কথা বলো না, ঘুমাও তো তুমি।”
হাসেম গিয়ে ছোট হুজুরকে পুরো বিষয়টা জানালো। অর্নি শাহরিয়ার নামটা শুনে ভাবলো অর্নি শব্দের মেয়ে। তাই আরো খুশি হলেন সে। হাসেম কানের কাছে এসে বললো “ছোট হুজুর, হুজুরানী কিন্তু সামনা-সামনি আরো সুন্দর। আর কি মিষ্টি মুখের বুলি।” ছোট হুজুর বুকে হাত দিয়ে বললো “অর্নি শাহরিয়ার! হাসেম অন্যের হবু বউয়ের দিকে নজর দেওয়াটা খারাপ কাজ। তুমি ছোট হুজুরের সামনে খারাপ কাজ করছো?” হাসেম মাথা নাড়িয়ে কয়েকবার না না করলো। ছোট হুজুর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো অন্দরমহলের দিকে। মাকে ডেকে বললো “আম্মাজান, আপনার হবু ছোট বউরানীর নাম অর্নি শাহরিয়ার। শব্দের মেয়ে মনে হচ্ছে। তাহলে এবার বিয়েটা আর আঁটকে যাচ্ছে না তাইনা? আমি একবার মেয়েটার সাথে কথা বলতে চাই।” অন্দরমহল থেকে অনুমতি আসলো যাওয়ার।
আজ পূর্নিমা, রোদ ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তার খেয়াল ছিল না আজ পূর্নিমা। শব্দ রোজকার মতো আজও রোদকে দেখতে যায় শব্দ। রোদের মাথার পাশেই একটা মুকুট জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে। লাল রঙের আলো। শব্দ এগিয়ে যায় সেদিকে। মনে পড়ে এটাই ছিল সেই মুকুট যার জন্য ১৮ বছর আগে ঝামেলা হয়েছিল। শব্দ মুকুটটি ধরতে যাওয়ার আগেই তার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে রোদ। শব্দকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মুকটটি হাতে নিয়ে নিজের মাথায় পড়ে নেয়। সাথে সাথে অদ্ভুত শক্তি চলে আসে। চোখগুলো লাল হয়ে যায়। শব্দ রোদকে ধরার জন্য এগিয়ে আসতেই আবারও একবার ছিটকে পড়ে গেলো শব্দ। শব্দ বুঝতে পারলো সব নষ্টের মূল ছিল এই মুকুট। যার কথা শব্দের আগে মনেই ছিল না। নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই দোষারোপ করছে শব্দ। কোনো ভাবে রুম থেকে বেরিয়ে বের হয়ে যায়। রোদ নিজের মাথায় মুকুটটি নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়। শব্দ পিছু নিতে গেলে শুভ্র শব্দকে আঁটকে দেয়।
পরের দিন সকাল সকাল ছোট হুজুর হাসেমকে নিয়ে পৌঁছে যায় অর্নির ঘরের সামনে। শব্দের ঘর এটা দেখে ছোট হুজুর আরো সিওর হয় অর্নি শব্দের মেয়ে। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই ভেতর থেকে কাব্য দরজা খুলে দেয়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে “কি চাই আপনাদের?” হাসেম আগ বাড়িয়ে বলে “অর্নি শাহরিয়ার আছেন?” কাব্য ছোট হুজুরকে আপাদমস্তক দেখে বললো “আপনি কে?” হাসেম জবাব দেয় “উনি এখানকার রাজপুত্র, রাতুল। আপনি এতো প্রশ্ন করছেন কেন? ডাকুন না ছোট হুজুরানীকে।” কাব্য মুখে বিরবির করে বলে “ছোট হুজুরানীটা আবার কে? অর্নি কি এদের চেনে?” ঘরের ভেতরে তাকিয়ে ডাক দেয় কাব্য। অর্নি চোখ ডলতে ডলতে এগিয়ে আসে দরজার দিকে। সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠায় স্নিগ্ধ চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রাতুল। বিষয়টা কাব্যর মোটেই ভালো লাগলো না। মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অর্নি এসে জিজ্ঞেস করলো “কি চাই? কারা আপনারা?” এবার রাতুল হেসে জবাব দেয় “আমি রাজকুমার রাতুল, আপনার সাথে কথা বলতে চাই অর্নি শাহরিয়ার। আমি কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে পছন্দ করিনা। আমি সোজা ভাবে বলছি। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি আমার বেগম হবেন?” কথাটা শোনার সাথে সাথে অর্নির মুখটা চুপসে যায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য বিয়ে করা জ্বীনবরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো “আপনি কি বলছেন এসব?” এতোকিছুতে কাব্যের রাগ হওয়ার কথা। রেগে দু এক ঘা বসিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। মুখ চেপে হাসি আঁটকে রাখছে সে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে আর না পেরে হি হি করে হেসেই ফেললো। এগিয়ে এসে বললো “আরে হ্যাঁ হ্যাঁ করবে না কেন? অবশ্যই বিয়ে করবে। এই অর্নি বলো তুমি রাজি না? হ্যাঁ রাজি, আপনি এখন যান। বিকেলে আসবেন, আমি অর্নির সাথে আলাদা কথা বলিয়ে দিবো।” বলেই দরজা বন্ধ করে দিলো। বাইরে থেকে হাসেম জিজ্ঞেস করলো “আরে আপনি কে?” কাব্য গলা উঁচু করে বললো “আমি কাব্য শাহরিয়ার!” হাসেম রাতুলকে বললো “ছোট হুজুর, উনি মনে হয় আপনার শালা। চলুন, বিকেলে আসবো আবার।” অর্নি বেজায় রেগে আছে কাব্যের এমন ব্যবহারে। কেন বললো না অর্নি তার বউ। কাব্য হেসেই চলেছে। কাব্যের হাসির শব্দ অর্নির কানে গেলেই অর্নি আরো রেগে ওঠে। তাই কাব্য মুখের ভেতরে কাঁথা ঢুকিয়ে হেসে চলেছে। কিছুক্ষণ পরে অর্নিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো “আমিই মনে হয় একমাত্র জ্বীন যে তার বউয়ের বিয়ে ঠিক করে দিচ্ছে। আমার যে কি হবে! তুমি আবার রাজি হয়ে যেও না। আমি শুধু ছোটখাটো একটা ছ্যাঁকা দিবো ওনাকে। প্রেম করে ছ্যাঁকা দেওয়ার কপাল তো আর হলো না। রাগ করো না রাতুলের হবু বেগম আর আমার লিখিত বেগম।”
চলবে?…
গল্প খুব শীঘ্রই শেষ হতে চলেছে। অনেকে অপেক্ষা করে আছে কতো তাড়াতাড়ি শেষ হবে।
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১৮.
উঁচু ঢিবির উপরে বসে আছে কাব্য। হাতে বেশ কয়েকটা কাঁকর। কাঁকরগুলো কিছুক্ষণ পর পর দূরে ঢিল মারছে। ৭৮ হাত দূরেই অর্নির সাথে দাঁড়িয়ে আছে রাতুল। ভ্রু কুঁচকে নাক ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই চোখের সামনে দেখতে পেলো হাসেমের বড় বড় দাঁতগুলো। সে তার ছোট হুজুরের বিয়ে উপলক্ষে বেশ খুশি। তাই দাঁত বের করে হেসে যাচ্ছে।
অন্যদিকে অর্নির সামনে হাত বাড়িয়ে রাতুল হাঁটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করলো “আমি আপনার মায়ায় পড়েছি। মায়া বলতে বুঝে নিতে পারেন ভালোবাসা। যাকে বলে প্রথম দেখায় ভালোবাসা। সেদিন সূর্যের লাল রশ্মি আপনার মুখের উপর দেখে বড্ড লোভ হলো যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আপনার এই ঘোরলাগা মুখটা দেখে বেঁচে থাকবো। আর কি! চলেই এলাম আপনার কাছে। আপনি দয়া করে এই অধমকে রহম করুন। কি করবেন না?” অর্নি কাচুমাচু করছে। কাব্যের দিকে তাকিয়ে চোখে দুষ্টমি নিয়ে বললো “ওনার সমস্যা না থাকলে আমারও কোনো সমস্যা নেই।” রাতুল ঘুরে কাব্যের দিকে তাকালো। কাব্য কেমন দুঃখী দুঃখী মুখ করে তাকিয়ে আছে। রাতুল বলে “আমার শালা বাবুর আর কি সমস্যা থাকবে? দুলাভাই হিসেবে আমাকে পছন্দ হবেনা? তার মতো আমি সুদর্শন না সেটা ঠিক। কিন্তু একদম ফেলে দেওয়ার মতোও না। আর টাকা পয়সা বলতে, এই রাজ্যের রাজকুমার আমি। সমস্যা হবে কোনো?” কাব্যর মুখটা দেখে অর্নি মনে মনে হাসছে। হুট করেই কাব্য বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে অর্নির হাতটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলো। রাতুল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অর্নির যাওয়ার দিকে৷
বাড়িতে এসে অর্নিকে ভেতরে নিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয় কাব্য। অর্নিকে ছেড়ে দিয়ে গালদুটো ফুলিয়ে বিছানায় হাত পা গুটিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। অর্নি একদম কাছে এসে জিনিস করলো “কি হয়েছে জনাবের?” কাব্য আড়চোখে তাকিয়ে অর্নিকে একবার দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অর্নি ফের জিনিস করলো “রাগ হয়েছে খুব? আমারও হয়েছিল। নিজের বিয়ে করা বউকে অন্য একজনের হাতে তুলে দেওয়ার মজাটা এবার বুঝুন। বেশ হয়েছে, আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি। আপনার বউ আছে আরেকটা। আপনি তাকে নিয়ে থাকবেন। আমি আমার নতুন জামাই নিয়ে থাকবো। কেমন আমার লিখিত জামাই এবং হবু এক্স জামাই।” কাব্য রেগে গিয়ে বললো “কি বললে তুমি? এক্স জামাই আমি?” এবার অর্নি পাল্টা রাগ দেখিয়ে বললো “তো তুমি যে বললে ছোট হুজুরের হবু বেগম। সেটা বলার সময় মনে ছিল না তোমার?” এবার কাব্য একদম বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে কান্না করে অর্নিকে জড়িয়ে ধরলো। অর্নি স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছে আর বলছে “থাক থাক বউ হারিয়ে এতো কাঁদে না।”
রোদের কোনো খবর পাওয়া গেলো না একদিনের মধ্যে। শব্দ অস্থির হয়ে আছে গতকাল থেকেই। কাব্য যদি এসে জানতে পারে রোদ নেই তাহলে সে আবার কাব্যের কাছে দোষী হবে। আবার দূরত্বের সৃষ্টি হবে। এটা সে কোনোভাবেই চায় না। তাই রোদকে খুঁজতে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে সে। তবে শুভ্র বাঁধা দিচ্ছে। শব্দের উপরে রোদ ক্ষেপে আছে। এখন শব্দকে পেলেই কিছু একটা করে দিতে পারে। তাই শুভ্র যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করছে। শব্দ নিরুপায় হয়ে নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছে। কাউকে উঁকি দিতে দেখে বললো “ভেতরে এসো।” ইশমাম ভেতরে এসে মাথানিচু করে দাঁড়ালো। ইশমামকে উদ্দেশ্য করে শব্দ জিজ্ঞেস করলো “কোনো কিছু দরকার? টাকা লাগবে? তোমার বাবার অবস্থা এখন কেমন? আমি এতো ব্যস্ততার মাঝে একদম ভুলে গেছিলাম।” ইশমাম কেঁদে বললো “বাবা, আমার বাবা আর বেঁচে নেই। অবস্থা যথেষ্ট ভালো ছিল। আর দু একদিন পরেই বাড়িতে আনতে পারতাম। কিন্তু হুট করেই মৃত্যু হলো। বুঝতে পারছিনা কেন এমন হলো।” ইশমামের খবরে শব্দ চমকে ইশমামের দিকে তাকায়। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “কষ্ট পেয়ো না, সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করো তিনি যেন ভালো থাকে। সবাইকে তো একদিন যেতেই হবে।” ইশমাম মাথা নাড়িয়ে বললো “আরো কিছু বলার ছিল বাবা, বলবো?” শব্দ সম্মতি দিলো। শব্দের সম্মতি পেয়ে কাচুমাচু হয়ে ইশমাম বললো “বাবা আমার আর কাব্যর বিয়ে তো অনেকদিন হয়ে গেছে। আমরা একসাথে থেকেছি অনেকদিন। আমরা তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। আমি বিশ্বাস করি আমাদের দুজন দুজনের প্রতি এখনো ভালোবাসা আছে। আপনি তো সবই জানেন। আমি টাকার জন্য বিয়েটা করলেও ভালোবেসে ফেলেছি কাব্যকে। আমি ওর সাথেই থাকতে চাই। আমার তো কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই এখন। বিয়ের পরে মেয়েদের স্বামীর কাছেই তো তার ঠিকানা। আপনি আমার উপর অবিচার করবেন না। দেখুন অর্নিকে তো জ্বীনরাজ্যের রাজকুমার বিয়ে করতে চায়। আপনি অর্নিকে তার কাছে বিয়ে দিয়ে দেন। কাব্য তো আমাকে ভালোবাসে। সে অর্নির সাথে সুখী নয় এটা আমার বিশ্বাস। আমাদের দুজনকে আপনি এক করে দেন।” শব্দ হেসে পায়ের উপর পা তুলে বললো “তোমরা মানুষরা খুব বোকা জানো? হতে পারে কাব্যকে ভালোবাসাটা তোমার সত্যি। তবে মিথ্যা বলার বা কিছু লুকোতেও জানো না তোমরা। তুমি ভুলে গেছো তুমি মানুষ। তোমার জ্বীনরাজ্যে ঢোকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ নিয়ে গেলেও ঢুকতে পারবে না। আমি জ্বীন হয়ে, জ্বীনরাজ্যের রক্ষক হয়ে এই খবরগুলো আমার কাছে পৌঁছায়নি। অথচ তুমি মানুষ হয়ে জেনে গেলে? বিষয়টা একটু সন্দেহজনক না? যাইহোক, আমি কারো উপরে অন্যায় করিনা। কাব্য যদি তোমাকে চায়, আমি কথা দিচ্ছি তোমাদের মিলিয়ে দিবো। এবার তুমি যেতে পারো।”
শব্দ আর দেরি না করে সোজা জ্বীনরাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ইশমাম এই খবরটা জানলো কিভাবে? ইশমামের সাথে ইমার যোগাযোগ থাকাটা স্বাভাবিক। তবে ইমা তো জ্বীনরাজ্যে ঢুকতে পারবে না। তাহলে খবরটা কে দিলো? ইশমামের বাবারই বা হঠাৎ কি হলো? কেউ খুন করে ইশমামের সরলতার সুযোগ নিচ্ছে নাকি? এগুলো ভাবতে ভাবতেই জ্বীনরাজ্যে পৌঁছে যায় শব্দ। কাব্যর ঘরের সামনে এসে দরজায় আওয়াজ করলো। ভেতর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে শব্দ আবার আওয়াজ করলো। কাব্য রেগেমেগে দরজা খুলে বললো “ভাই আপনি আর আসবেন না তো, অর্নি আমার বিয়ে করা বউ।” শব্দ চোখ বড় বড় করে বললো “তব্দ ভাই বলার অভ্যাস তোর যাবে না?” শব্দকে দেখে জিভে কামড় দিয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো কাব্য। শব্দ ভেতরে আসতেই অর্নি খুশি হয়ে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো “বাবা আপনি কেমন আছেন? আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে নিয়ে চলুন না।” বলেই কাব্যকে দেখিয়ে জিহ্বা বের করে ভেঙিয়ে দিলো। শব্দ মুচকি হাসলো, অর্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “এটা তো মনের কথা না মা তোমার। আর কয়েকটা দিন থাকো আমি তোমাকে নিয়ে যাবো কেমন?” অর্নি মাথা নাড়ায়। কাব্যকে কাছে ডেকে শব্দ বললো “কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি তোমাকে। ইশমাম এসেছিল, কেঁদে কেঁদে বললো সে তোমাকে ভালোবাসে। তুমিও নাকি তাকে ভালোবাসো। তুমি কি তাকে ভালোবাসো? তার সাথে থাকতে চাও?” কাব্য অবাক হলো, অর্নির দিকে একবার তাকালো। অর্নির মুখটা চুপসে গেছে নিমিষেই। তবে সেটাকে লুকিয়ে মুখে কৃত্রিম ফুটিয়ে নিলো। কাব্য শব্দকে বললো “এটা মানছি ইশমামের উপরে ভালো লাগা ছিল আমার। তবে সেটা এখন নেই বর্তমানে। আমি অর্নিকে ভালোবাসি। আমি ওর সাথেই থাকতে চাই। তুমি ইশমামকে বলে দিও।” শব্দ মাথা নাড়ালো। কাব্যের উত্তরে অর্নির মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো। শব্দ ফের বললো “আরো এক কাহিনি হয়েছে কাব্য। তোমার মা গত রাতেই বাড়ি থেকে বের হয়েছে। যাওয়ার আগে আমাকে আঘাত করেছে। মাথায় মুকুট ছিল একটা। কিন্তু এখন সে কোথায় আছে আমার জানা নেই। আমি খুঁজতে চেয়েছি। তবে তোমার শুভ্র চাচু আমাকে সেই সুযোগ দেয়নি।” কাব্যের এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে আবার তার মাকে হারিয়ে ফেলেছে। অর্নি লাফিয়ে উঠে বললো “আমি জানি মাম্মাম কোথায় আছে। আমি চিনি সেই জায়গাটা। আগে প্রায়ই যেতো সেখানে। আমিও বহুবার গিয়েছি। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারবো৷” শব্দ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কাব্যকে উদ্দেশ্য করে বললো “আরো একটা খবর আছে তোমার জন্য কাব্য। অর্নিকে যে রাজকুমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে সেটা ইশমাম জেনে গেছো। আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে এটা আমি জানতাম না। অথচ ও মানুষ হয়ে খবরটা পেলো। কে জানালো ওকে এই খবরটা? যাই হোক, তোমরা চিন্তা করো না। সবটা আমি সামলে নিচ্ছি। অর্নির বিষয়টা নিয়েও ভেবো না। আমি আছি তোমাদের সাথেই। এখন যাই আমি!
সেদিন আর কোনো ঝামেলা হলো না। তবে রোদের কথা কাব্যের মাথা থেকে গেলো না। পরদিন আবারও দরজা খুলতেই দেখতে পেলো রাজবাড়ির সাজগোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু জ্বীন। কাব্যের বুঝতে বাকি রইলো না বিষয়টা কি ঘটছে। অর্নিকে নিয়ে বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে রানীকে কাব্য বললো ” আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি এখানের রানী। অর্থাৎ রাতুলের মা।” রানী মাথা নাড়ালেন। কাব্য এবার হালকা রেগে বললেন “আমি কাব্য শাহরিয়ার। আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ এর একমাত্র ছেলে। আপনাদের সুবিধার্থে বললাম আহনাফ শাহরিয়ার শব্দের কোনো মেয়ে নেই। অর্নি শাহরিয়ার আমার সদ্য বিয়ে করা বউ। যাকে আপনারা বউ বানানোর স্বপ্ন দেখছেন।” কাব্যের কথায় অবাক হলো রানী। কিন্তু ছেলের ভালোবাসাকে সে এভাবে শেষ হতে দিতে পারেনা। অগত্যা জোর করেই যেভাবেই হোক অর্নিকে নিজের ছেলের বউ বানানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাই হাঁক ছেড়ে বললেন “কাব্য শাহরিয়ারকে আটক করো তোমরা। আর অর্নি শাহরিয়ারকে আমার মহলে নিয়ে চলো। খুব শীঘ্রই আমার ছেলের সাথে তার বিয়ে হবে।”
চলবে?……
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ১৯.
রাতুলের মুখোমুখি বসে আছে শব্দ। তার ছেলেকে বন্দী করার খবরটা তার কাছে পৌঁছাতে দেরি হলো না। এক মুহুর্ত দেরি না করে এক ছুটে চলে এসেছে এখানে। রাতুল শব্দকে আগে কখনো দেখেনি। তাই ঠিক চিনতে পারলো না। শব্দ এখানে থাকেনা। ছোটবেলা থেকেই পাকাপোক্ত ভাবে মানুষের সমাজে থাকা শুরু করে। রাতুলের জন্মের পরে কয়েক মুহুর্ত ছাড়া জ্বীনরাজ্যে আসেনি শব্দ। রাতুল শব্দের নাম শুনেছে অনেকবার। শব্দ রাগে ফুঁসছে, তবে বেশিটা প্রকাশ করছে না সে। তার সামনে রাতুল পায়ের উপর পা তুলে বললো “আপনি কে? শুনলাম আপনি কাব্যর বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন? ওর ভাই নাকি আপনি?” শব্দ রাগী চোখে তাকিয়ে বললো “আপনার সুবিধার্থে জানিয়ে রাখি আমি কাব্যর বাবা। আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ আমি।” রাতুল অবাক হয়ে তাকায়। ভেবেছিল শব্দ আরো বয়স্ক হবে। জ্বীনদের বয়স বেশি হলেও চেহারায় তেমন প্রভাব পড়েনা এটা ঠিক। তবে এতোটা সুদর্শন হবে সেটা বুঝতে পারেনি। পা নামিয়ে থতমত খেয়ে বললো “মাফ করবেন আমি বুঝতে পারিনি। বলুন কি বলবেন।” শব্দ উত্তর দেয় “কাব্যকে আঁটকে রাখার কারন?” রাতুল মাথা নিচু করে বললো “কোনো কারন নেই তেমন। কাব্যকে আম্মাজান আঁটক করেছে। আমার অর্নিকে পেছন হয়েছে। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলাম আমি। তখন আমি জানতাম না অর্নি বিবাহিত। কিন্তু আম্মাজান সেটা জানার সাথে সাথেই অর্নিকে তুলে এনে কাব্যকে আঁটকে দিলো। আমি বুঝানোর চেষ্টা করেছি। তবে তার ভাষ্যমতে তিনি তার ছেলের পছন্দকে এভাবে ভেসে দিতে পারেন না। আপনি আম্মাজানের সাথে কথা বলুন দয়া করে।” শব্দ মাথা নাড়িয়ে বিরবির করে বললো “সব জায়গায় এই মহিলারা নাক গলাবেই। নাক গলানো ছাড়া কি এদের কোনো কাজ নেই?” পরে রাতুলকে উদ্দেশ্য করে বললো “আপনি আপনার আম্মাজানকে ডাকুন। আমি কথা বলবো তার সাথে।” রাতুল সম্মতি জানিয়ে ভেতরে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসলো রাতুলের মা’কে নিয়ে। শব্দকে দেখে দাঁত বের করে হেসে বললো “তা শব্দ সাহেব, কতোদিন পর? কি কারনে এখানে?” শব্দ রাতুলের মায়ের দিকে না তাকিয়েই বললো “আমার ছেলেকে আঁটকে রেখেছেন। তার পরেও আপনি আশা করেন আমি এখানে থাকবো না? আমার এখানে থাকাটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে?” রাতুলের মায়ের অপমানবোধ হলো। মুখ গম্ভীর করে বললো “এটা রাজকীয় বিষয়। এই বিষয়ে আপনাকে কথা বলতে হবেনা। আপনার ছেলে অন্যায় করলে তার শাস্তি তাকে পেতে হবেনা?” শব্দ রয়েসয়ে বললো “ঠিক বলেছেন, অন্যায় করলে শাস্তি তো দিতেই হবে। তবে আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। ছোটবেলা থেকে যেমনি হোক সেই শিক্ষা আমি তাকে দেইনি। বিয়ে করাটা যদি অপরাধ হয় তাহলে আপনারাও সমান দোষে দোষী। আপনাদেরও উচিত আমার ছেলের সাথে জ্বীন কারাগারে থাকা। আর হ্যাঁ, রাজকীয় বিষয়? যখন রাজ্যে হামলা হয় তখন কোথায় থাকে আপনাদের রাজকীয় বিষয়? তখন তো শব্দ শাহরিয়ার সহ পুরো জ্বীনরাজ্যের জ্বীনদের দরকার পরে। আপনারা তো তখন আসেন না। যাইহোক, রাজকীয় বিষয় আপনার শাড়ীর আঁচলে বেঁধে রাখুন। আপাতত আমার ছেলে এবং ছেলের বউকে আমার হাতে তুলে দিন।” রাতুলের মা রাগ দেখিয়ে বললো “যদি ওদের না ছেড়ে দেই?” শব্দ বললো “ভাব দেখাচ্ছেন? আহনাফ শাহরিয়ার শব্দের সাথে ভাব দেখাচ্ছেন? জানেন এর ফল কি হবে? আমি কিন্তু ভালো করেই জানি কিভাবে ছাড়িয়ে নিতে হয়। আপনি আমার কথায় রাজি হচ্ছেন কিনা আমাকে জানান।”
রাতুলের মা বেজায় রেগে জানালেন “না আমি রাজি নই। আমিও দেখি আপনি রাজ্যের রাজার হুকুম অমান্য করে কি করতে পারেন।” শব্দ হাতের তালু ঘষে উঠে দাঁড়িয়ে বললো “আমি ভেবেছিলাম আপনারা রাজ্যের প্রজাদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখেন। তাই এবারের রাজা নির্বাচনের দিকে আমি যেতে রাজি হইনি। তবে আপনাদের অহংকার দেখে আমি সেদিকে যেতে বাধ্য হচ্ছি।” বলেই কারাগারের দিকে রওনা দিলো। প্রতিটি রক্ষী শব্দকে সম্মান করে এগিয়ে আসেনি। বরং তারা কাব্যকে স্বসম্মানে শব্দের হাতে তুলে দেয়। শব্দ কাব্যকে নিয়ে পুনরায় একই জায়গায় এসে রাতুলকে বললো “আমি আশা করছি তুমি তোমার মায়ের মতো ব্যবহার করবে না। অন্দরমহলে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ বলেই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আসতে পারছিনা। তুমি স্বসম্মানে তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও।” রাতুল মাথা নাড়িয়ে দ্রুত অন্দরমহলে চলে যায়। পেছন থেকে রাতুলের মা কয়েকবার ডাক দিলেও রাতুল শুনলো না। অর্নিকে নিয়ে এসে শব্দের হাতে দেওয়ার পরে মনে হলো তার নিজের পরানটা শব্দের হাতে তুলে দিলো। কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় তার নেই। অর্নির যাওয়ার দিকে রাতুল ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো।
রোদকে খুঁজে বের করাটা দরকার। তাই কাব্যকে রেখেই অর্নিকে নিয়ে শব্দ হাজির হয় রোদের গুপ্ত মহলে। জ্বীনরাজ্য ছাড়িয়ে বদ-জ্বীনদের আস্তানায় এই গুপ্ত মহল। রোদ বসে আছে সিংহাসনে। তার মাথায় মুকুট। সমস্ত বদ-জ্বীনেরা তার সামনে বসে মাথা নিচু করে বসে আছে। শব্দ যেতে চাইলে অর্নি শব্দকে টেনে ধরে বললো “বাবা যাবেন না আপনি। এখন এখানে শক্তি দেয়া-নেয়া হচ্ছে। আপনি একা পারবেন না তাদের সাথে। আমরা তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করি। তাদের পরিকল্পনা গুলো শুনি আগে। লুকিয়ে থাকুন কিছুক্ষণ।” শব্দ অর্নির কথামতো লুকিয়ে রইলো। তবে অশুভ শক্তির আশেপাশে শুভ শক্তি আসলে তো ঝামেলা হবেই। অশুভ শক্তির জ্বীনেরা টের পায় তাদের মহলে শুভ শক্তির আগমন। তাই তারা ছোটাছুটি করে খুঁজতে শুরু করে। দুর থেকে রোদের চোখ পড়লো শব্দের চোখের উপর। চোখাচোখি হতেই রোদের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বের হয় “শব্দ!” শব্দ দূর থেকে রোদের মুখে নিজের নাম উচ্চারণ হতে দেখে আবেগি হয়ে যায়। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা পানি। অর্নিকে উদ্দেশ্য করে বললো “অর্নি চলো, এখানে থাকাটা একদম ঠিক হবেনা একদম। তাড়াতাড়ি চলো, আসো।” অর্নির হাত ধরে উড়ে বের হয়ে আসে মহল থেকে। পেছনে ফেলে আসে কিছুটা আবেগ ও ভালোবাসার মানুষটাকে।
বিকেল ঘনিয়ে এসেছে, সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিমাকাশে। শব্দ মাত্রই রওনা হয়েছে মানুষ সমাজের মাঝে। এরই মধ্যে ঘটলো এক কান্ড। চারদিকে হৈচৈ শুরু হয়েছে। একেকজন জ্বীনকে ধরে ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে। চিৎকার শুনে শব্দ এগিয়ে আসলো সামনে। রোদ তার সৈন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জ্বীনরাজ্যে মানুষের প্রবেশ নিষেধ হলেও বদ জ্বীনের রানী হওয়ার সুবাদে জ্বীনরাজ্যে ঢোকার শক্তি রোদ পেয়ে গেছে। তাই হামলাটা শেষে করেই বসলো। তবে মনে হচ্ছে এটা ছোটখাটো ভয় দেখানোর একটা আক্রমন। চূড়ান্ত আক্রমন এখনো বাকি আছে। রোদের মুখোমুখি হয়ে বেশ কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শব্দ। রোদের সাথে এভাবে লড়াই করতে হবে। তবে শব্দ তার প্রতিজ্ঞা ও কর্তব্যের প্রতি সচেতন। প্রথমে চিৎকার করে রোদকে উদ্দেশ্য করে বললো “তুমি চলে যাও রোদ। তুমি জিততে পারবে না। হেরে যাবে তুমি। আর হারার অভ্যাস তোমার নেই। তাই তোমরা চলে যাও সবাই।” রোদ পিছু হটলো না, উল্টো চিৎকার করে বললো “আপনি আমার পথে বাঁধা হবেন না মিঃ শাহরিয়ার। তাহলে আপনাকে শেষ করতেও আমি দুবার ভাববো না।” বলার সাথে সাথেই শুরু হলো আবার আক্রমন৷ শব্দ হাওয়ায় উড়ে ভয়ংকর রুপ নিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। একেকটাকে ছুঁড়ে মারছে এদিক ওদিক। শব্দ এখন নিজের মধ্যে নেই। প্রচন্ড ক্রোধে সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই আঘাত করছে। শব্দের সোজা সামনে রোদ। রোদের উপর আঘাত হানতে পারে ভেবে কাব্য এগিয়ে যেতে চাইলো। তবে অন্য জ্বীনেরা তাকে যেতে দিলো না। তারা জানে শব্দ নিজের মধ্যে থাকেনা।
হুট করেই শব্দের মাথায় এসে শক্ত পাথর লেগে যায়। শব্দ একদম রেগে আরো দ্রুত গতিতে সামনে আগায়। শব্দের হাতের চাবুকে রোদের কপালেও আঘাত লাগে। সাথে সাথে শব্দ শান্ত হয়ে রোদকে বলে “তুমি চলে যাও রোদ। তুমি এখানে টিকতে পারবে না। আমি তোমার জ্বীনবর হয়ে রক্ষা করতে চাই তোমাকে।”
চলবে?….
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ২০.
মাথায় আঘাত নিয়ে বসে আছে শব্দ। তার মন ভালো নেই। কখনো ভুল করেও বকাবকি পর্যন্ত করেনি সে রোদকে। আজ তার জন্য রোদ আঘাত পেয়েছে সেটা সে কোনো ভাবেই মানতে পারছে না। তাই রওনা দিলো রোদকে দেখার উদ্দেশ্যে। শব্দের এমন অবস্থার কথা শুনে শুভ্র মিষ্টিও চলে এসেছে জ্বীনরাজ্যে। শুভ্র শব্দকে যেতে দেওয়ার জন্য কোনো ভাবেই রাজি হচ্ছে না। এক পর্যায়ে শুভ্রকে শব্দ জড়িয়ে ধরে বললো “পৃথিবীর সবথেকে সেরা ভাই যদি বলিস, সেটা নিঃসন্দেহে তুই৷ এটা ঠিক ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হতে পারিনি৷ সব সময় আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা থাকতো কে ভালো হবে সব থেকে। আজ বলছি, আমি হেরে গেছি তোর কাছে। আমি তোর মতো এতো উদার হতে পারিনি। দুজনে ভালোবাসলাম একই মানুষকে। তখন তোকে শত্রু ভাবতে দুবারও চিন্তা করতাম না। দুজনের মধ্যে কতোই না নিরব যুদ্ধ চলেছে। তারপর সেই তুই তোর ভালোবাসাটা বিসর্জন দিয়ে আমার হাতেই তুলে দিলি। অথচ আমি জানতাম আমার থেকে তোর ভালোবাসা ছিল বেশি। যেটা হয়তো কখনো ভুলে থাকা সম্ভব নয়। এখনো রোদকে সেই আগের মতোই মনে আছে তোর। মিষ্টির সামনেই বলছি। মিষ্টিও জানেনা এমন কিন্তু না। এতোকিছু ত্যাগ করার পরেও আজও আমার ভালোটাই চিন্তা করে যাচ্ছিস তুই। এবার আমাকে যেতে দে। রোদের কি অবস্থা সেটা জানতে হবে আমার। আমার কিছু হবেনা, তোরা সবাই আছিস তো।” শব্দের জেদের কাছে হার মেনে এক পর্যায়ে শুভ্র যেতে দিতে রাজি হয়। তবে শব্দকে আগে যেতে দিয়ে কাব্য এবং অর্নিকে নিয়ে নিজেও ছুটলো পিছু পিছু। বাড়িতে অভ্রকে দেখে রাখার জন্য রেখে গেলো মিষ্টিকে।
অভ্র বসে আছে চুপটি করে। এখানে এসে জানতে পারে সে মানুষ না। সে জ্বীন, তবে জ্বীন কাকে বলে সেটা সো জানেনা। মুখ গোমড়া করে থাকার একমাত্র কারন হলো সে মানুষ না হয়েও সামিরাকে পছন্দ করে। নিশ্চয়ই সামিরা এটা জানার পরে অভ্রর সাথে আর কথা বলবে না৷ জ্বীনরাজ্যে আসার কারনে সে সামিরার সাথে যোগাযোগও করতে পারছে না। তাই কারো সাথে কথা না বলে চুপচাপ বসে আছে সে।
শব্দ রোদের গুপ্ত মহলের আশেপাশে ঘুরে দেখছে। চারদিকে পাহারাদার দেখতে না পাওয়ায় রোদের কামড়াটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না তার। উড়ে গিয়ে জানালা বরাবর উঁকি মারতেই দেখলো সব বদ-জ্বীনেরা রোদের কামড়ার সামনে এসে ভীড় করেছে। কারন রোদের আঘাত লেগেছে। সাথে মুকুটের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। রোদের চোখ পড়লো সরাসরি শব্দের জানালায়। শব্দকে লুকিয়ে থাকতে দেখে ভীষন চমকে গেলো। শব্দ ভেবেছিল রোদ হয়তো তাকে ধরিয়ে দিবে। তাও সে পিছু হটলো না। কিন্তু উল্টো হলো। রোদ ভয়ে ভয়ে সবাইকে বললো “আপনারা আপনাদের কামড়ায় চলে যান। আমি এখন বিশ্রাম নিবো। আমার অনুমতি ছাড়া কেউ আমার কামড়ায় আসবেন না।” সবাই মাথা নত করে কুর্নিশ জানিয়ে চলে গেলো। রোদ একপ্রকার দৌড়ে জানালায় এসে শব্দের হাত ধরে বললো “শব্দ ভাই!” শব্দ অবাক হলো। রোদ নাটক করছে কিনা সেটা বুঝতে পারছে না। রোদ শব্দকে টেনে নিজের কামড়ায় নিয়ে গেলো। হুট করেই শব্দকে জড়িয়ে ধরে রোদ বললো “শব্দ ভাই আমি এখানে কি করছি? এরা কি আমাকে আঁটকে রেখেছে? আপনি আমাকে নিতে এসেছেন? আমাকে নিয়ে চলুন না, আমাদের তো বিয়ে করতে হবে।” শব্দ ভ্রু কুঁচকে রোদকে জিজ্ঞেস করলো “কি বলছো তুমি? তোমার কি কিছু মনে নেই?” রোদ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো “কি মনে থাকবে? আমার এখানে ভয় করছে। এদের কি ভয়ানক চেহারা। এরা আমাকে মহারানী বলছে কেন?” শব্দের মাথায় কিছু ঢুকছে না। এখন নাটক হচ্ছে কিনা সেটা বোঝার চেষ্টা করলো। তাও রোদের সাথে তাল মিলানোর জন্য বললো “হ্যাঁ রোদ নিয়ে যাবো তো আমি। তুমি এখানে একটু থাকো। আমি এসে নিয়ে যাবো। তুমি শুধু এদের কথার সাথে তাল মেলাও কেমন? পারবে না?” রোদ খুশিতে লাফিয়ে বললো “পারবো পারবো, আপনি এসে নিয়ে যাবেন তো শব্দ ভাই?” শব্দ মাথা নাড়ালো। শব্দকে একদম কাছে টেনে বললো “আমাকে আগের মতো একটু জড়িয়ে ধরুন তো শব্দ ভাই। একদম শক্ত করে, যেন আপনার হার্টবিট শুনতে পাই।” শব্দ একহাতে বুকের বাম পাশে হৃদপিণ্ডের সোজা রোদের মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেলো। এমন একটা মুহুর্তের জন্য দীর্ঘ ১৩ বছর অপেক্ষা করেছে সে। হোক নাটক, তাও মনের আকাঙ্খা তো মিটলো। রোদ তাড়াতাড়ি শব্দকে ছেড়ে বললো “এখন চলে যান শব্দ ভাই। ওরা দেখে ফেললে সমস্যা হবে আপনার।” শব্দ মাথা নাড়িয়ে জানালা থেকে বের হলো। রোদ হাতটা ধরে বললো “আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য। আমার বিশ্বাস আপনি আমাকে উদ্ধার করবেন।” শব্দের চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো অশ্রু। আদৌ একসাথে থাকা হবে কিনা সেটাও শব্দ জানেনা। হতে পারে এটাই তাদের শেষ দেখা।
শুভ্র মহলের এক দিকে গেলো, কাব্য আর অর্নিকে একদিকে পাঠালো। কাব্য উঁকি দিয়ে আছে জানালায়, অর্নি ঠিক কাব্যর মাথার উপরেই উঁকি দিয়ে আছে। একটা ভয়ানক জ্বীন থেকে কাব্য ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। সাথে সাথে মাথার উপরে অর্নির চিবুকের সাথে বারি খায়। অর্নি চেচিয়ে উঠে চোখ গরম করে তাকায় কাব্যর দিকে। এর অর্থ “আজ বাসায় চলো, বলদামির মজা আমি বুঝাবো।” কাব্য কাচুমাচু হয়ে জিভে কামড় দিয়ে এক হাতে নিজের কান ধরে ইশারায় সরি বললো৷ আবার উড়তে উড়তে এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে গিয়ে সোজা শুভ্রর সাথে ধাক্কা খায় কাব্য। শুভ্রও চোখ গরম করে তাকায়। কাব্য শুভ্রর দিকে না তাকিয়ে অর্নিকে আর শুভ্রকে টেনে সামনে আগাতে লাগলো। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকায় রোদের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা শব্দের সাথে আবার ধাক্কা খায়। এবার শুভ্র আর অর্নি রেগে গিয়ে দুজনে মিলে দিয়ে দিলো দু এক ঘা। রোদ শুভ্রকে দেখতে পেয়ে বললো “শুভ্র ভাই আপনিও এসেছেন।” শুভ্র কিছু না জেনেই ভাবলো শব্দকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো। রোদ পেছন থেকে ডেকে বললো “আরে শুভ্র ভাই, শব্দ ভাইকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?” রোদের মুখে শব্দ ভাই শুনে শুভ্র থমকে যায়। পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বললো “শব্দ ভাই বললে তুমি?” শব্দ মাথা নাড়ালো। শুভ্র দৌড়ে রোদের কাছে গিয়ে বললো “তোমার সব মনে পড়েছে রোদ? এই যে তোমার ছেলে কাব্য। মনে পড়েছে?” রোদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো “এটা কার ছেলে শুভ্র ভাই?” শুভ্র বললো “কেন শব্দের? তোমার মনে নেই?” রোদ ছলছল চোখে তাকিয়ে শব্দকে জিজ্ঞেস “শব্দ ভাই আপনি বিয়ে করেছেন? আপনার ছেলেও আছে? আপনি আমাকে ঠকাতে পারলেন?” শব্দ মাথা চুলকে বিরবির করে বললো “এটার আবার কি হলো? এতোদিন স্মৃতি ছিলনা মানে ছিলই না। এখন মাথার তার কোন জায়গা থেকে কোন জায়গায় গেলো বুঝতেও পারছি না।” রোদ ফুপিয়ে কেঁদে বললো “শব্দ ভাই উত্তর দিবেন? নাহলে কিন্তু আমি শুভ্র ভাইকে বিয়ে করে ফেলবো।” রোদের কথা শুনে শব্দের বিষম পেয়ে যায়, শুভ্র মাথায় হাত দিয়ে বলে “আস্তাগফিরুল্লাহ্ আমার বউ বাচ্চা আছে। এগুলো পাপ, পাপ।” এদিকে অর্নি ও কাব্য দুজন দুজনার মুখের দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। বাবা মায়ের কিশোরী বয়সের প্রেমের দৃশ্য দেখছে এখন চোখের সামনে। শব্দের বিষম খাওয়ার আওয়াজ পেয়ে রোদের কামড়ার দিকে বদ-জ্বীনগুলো দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। রোদ শব্দ এবং শুভ্রকে বললো “এর বদ’লা তো আমি নিবোই হুহ্,প্রেম করেছেন আমার সাথে। বিয়ে করেছেন আরেকজন কে? আমি দরকার হলে ১০ টা সতীনের ঘর করবো। তাও আপনাকেই বিয়ে করবো আমি।”
বাসায় আসার পর থেকে শব্দ গভীর ভাবনায় আছে। শুভ্র জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে অনবরত। হালকা পাতলা রোমান্সের কথা লজ্জায় বলতেও পারছে না এতো বছর পরে। মিষ্টি এলো খুন্তি নিয়ে। শুভ্রর দিকে ছুঁড়ে বললো “তুমি নাকি আবার রোদ আপুকে বিয়ে করতে যাচ্ছো?” শুভ্র অবাক হয়ে হা করে বললো “এ কি বলো? কে বললো তোমাকে এসব কথা? আমি তে বললাম আমার বউ বাচ্চা আছে।” মিষ্টি চোখ রাঙিয়ে বললো “কাব্য বলেছে তো মাত্রই।” শুভ্র এবার দ্বীগুন অবাক হয়ে কাব্যর ঘরের দিকে দৌড় দিয়ে বললো “আজ তোর একদিন কি আমার যেই কয়েকদিন লাগে।”
নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলো দ্রুত। শব্দের কোনো ইচ্ছেই ছিলনা নির্বাচন করার। রাজা যে, সেই থাকবে। কিন্তু কাব্যর বিষয়টা নিয়ে শব্দের মাথা এখনো ঠান্ডা হয়নি। তাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। তবে সেদিন রাতেই রাজার সৈন্যরা এসে রাজার হুকুমে বাধ্য হয়ে শব্দদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সবাই আ’গুনের রুপ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেও কাব্য পারলো না। কারন ওর প্রশিক্ষন শেষ হয়নি। ও জানেনা কিভাবে রুপ নিয়ে হয়। পুরোপুরি শক্তি না আসার কারনে মানুষের রূপটা কিছুটা হলেও ওর ভিতরে থেকে গেছে। তাই আগুনে বেশ কিছুটা ক্ষতি করলো ওর। পিঠের দিকটা পুড়ে গেছে কিছুটা। তবে সব থেকে ভয়ের বিষয় হলো জ্ঞান ফিরছে না কাব্যর। শব্দদের ঘরের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে অন্য জ্বীনদের ঘরে। খড়ের ঘর হওয়ার জন্য নিমিষেই অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে যেতে সময় নিলো না বেশি। শব্দ ওইসব জ্বীনদের রক্ষা করবে নাকি নিজের ছেলেকে বাঁচাবে কিছু বুঝতে পারছে না। শুভ্র কাব্যকে কোলে নিয়ে চেঁচিয়ে বললো “আমি কাব্যকে দেখছি, তুই তোর দায়িত্ব পালন কর।” শব্দ কেঁদে বলে “কাব্যকে বাঁচানো কি আমার দায়িত্ব নয়? ও তো আমার ছেলে।” শুভ্র থেমে গিয়ে বললো “কাব্য কি আমার ছেলে নয়? ওর প্রতি কি আমার কোনো দায়িত্ব নেই?”
চলবে?…
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ২১.
কাব্যর জ্ঞান ফিরছে না, বেশ কিছুটা সময় চলে গেছে। অর্নি কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। কাব্যর মুখের এক পাশে আগুনের তাপ লেগে কালো হয়ে গেছে। জ্ঞান ফিরতে না দেখে শব্দ পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। সকালের আলো ফুটতেই কাব্য চোখ খুললো। চারপাশে সবাইকে দেখতে পেয়ে আবেগে আপ্লূত হয়ে যায় সে। নিজের হাতের মধ্যে অন্য কারো হাতের টের পেতেই সেদিকে তাকালো। অর্নি দু হাত দিয়ে কাব্যর হাত জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কাব্য হাত নাড়াচাড়া করতেই অর্নির ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে কাব্যকে জাগ্রত দেখেই সবাইকে ডাকার জন্য প্রস্তুত হয়। কাব্য ইশারায় সবাইকে ডাকতে বারন করলো। তারপর মিনমিন করে বললো “এদিকে একটু আসবে?” অর্নি ভাবলো কাব্যর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তাই কথা ভালো ভাবে শোনার জন্য মাথাটা কাব্যর মুখের দিকে নিয়ে আসলো। কাব্য এক হাত দিয়ে অর্নির মুখ ছুঁয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কপালে। ইতিমধ্যেই শুভ্র জেগে গেলো। উঠেই এই দৃশ্য দেখে বললো “আস্তাগফিরুল্লাহ্, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই কি দৃশ্য দেখলাম? আমার বউ কই গেলো?” শুভ্রর কথার আওয়াজ পেয়ে অর্নি ছিটকে এক হাত দূরে গিয়ে বসলো। কাব্য চোখ মুখ খিঁচে বললো “তোমার কোনো কাজ নেই? আমাদের রোমান্স দেখলেই তোমার ঢং শুরু হয়।”
শুভ্র তেড়ে এসে বললো “শোন তোর উপরে আমার বদলা নেওয়া বাকি আছে। তুই আমার বউকে বলেছিস আমি তোর মাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি? তোর জন্য আমি এখন উঠতে বসতে বউয়ের হাতে মার খাচ্ছি। সিংহের মতো একটা পুরুষ বউয়ের কাছে হয়ে গেলো বিড়াল।” কাব্য মুখ টিপে হেসে বললো “বাইরেই বা কবে সিংহ ছিলে চাচু তুমি? মিষ্টি মায়ের কাছেও বরাবরই তুমি বিড়াল।” শুভ্র হাতের পেশি দেখিয়ে বললো “তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর কালকে তোকে কেমন বীরের মতো বাঁচিয়ে নিলাম।” এর মধ্যেই শব্দ তড়িঘড়ি করে এসে কাব্যকে দেখে শান্ত হয়ে যায়। শুভ্রের কাঁধ চাপড়ে বললো “একদম তুই তো শ্রেষ্ঠ বীর। কাব্য কখন জ্ঞান ফিরলো?” কাব্য স্বাভাবিক ভাবেই বললো “কাল রাতেই তো।” কাব্যর কথায় সবার মুখ হা হয়ে গেলো। সবাই সমস্বরে বললো “কিহ্? কাল রাতে? অথচ আমরা কাল রাত থেকে চিন্তা করে মরছি জ্ঞান কেন ফিরছে না।” কাব্য ভয়ে ভয়ে বললো “জ্ঞান ফেরার আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। আমার কি দোষ বলো?”
জ্বীনরাজ্যে আজ অনেক জ্বীনের আনাগোনা। ছোট বড় সব জ্বীনেরা ময়দানে হাজির হয়েছে। আজ নির্বাচনের দিন। জ্বীনরাজ্যে রাজা নির্বাচিত হবে। জ্বীনদের মতামত যার দিকে বেশি যাবে সে হয়ে যাবে রাজা। উঁচু ঢিলার উপরে দাঁড়িয়ে আছে শব্দ। চিন্তিত মুখ নিয়ে জ্বীনদের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। জিতবে নাকি হারবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে না। দু দলেই প্রায় সমান জ্বীন রয়েছে। রাজার মুখে বিজয়ের হাসি। কিছুক্ষণ পরেই কাব্য হাজির হয় ময়দানে। দু দলই ভারি দেখে বাবার পাশে সে নিজেও ঢিবির উপরে দাঁড়ালো। রাজার পক্ষের জ্বীনদের মুখ চুপসে আছে। মনে হচ্ছে ভয়ে তারা দল পাল্টে পেলেছে। তাই কাব্য সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো “সম্মানিত জ্বীনগন, আমাকে হয়তো অনেকে চেনেন। আবার অনেকেই চেনেন না। আমি আহনাফ শাহরিয়ার শব্দ-এর ছেলে, কাব্য শাহরিয়ার। এই কিছুদিন হলো জ্বীনরাজ্যে এসেছি। আপনারা সবাই তো বাবাকে চেনেন৷ শুনেছি বাবা এই রাজ্যের রক্ষক। সে যদি রাজ্যের রাজা না হয়েও এই রাজ্যকে রক্ষা করে তাহলে রাজ্যের রাজার কাজ কি? রাজার কি উচিত নয় রাজ্যকে রক্ষা করা? কিন্তু সে তা করছে না। প্রজারা কেমন আছে, কোথায় আছে সেই বিষয়ে তার কোনো খেয়াল নেই। আপনারা সবাই অবগত গতকাল জ্বীনরাজ্যে রাজা নিজেই আক্রমন করেছে। এটা রীতিমতো প্রজাদের উপর নির্যাতন বলা চলে। আপনারা এতো শক্তিশালী হয়েও একজনের অধীনে থেকে নির্যাতিত হবেন এটা আশা করা যায় না। আমার বাবা চিরজীবন আপনাদের একজন অধিনায়ক ছিলো রাজা হওয়ার পরেও শুধুমাত্র অধিনায়ক থাকবে। আপনারা থাকবেন নিজ নিজ জায়গায় স্বাধীন। কারন আমার বাবা নির্যাতন করার জন্য এখানে থাকবেই না। আপনারা যদি অন্য একজনকে রাজা করেন যার ভয় পাচ্ছেন সে কি তখন রাজা থাকবে? তার কি কোনো ক্ষমতা থাকবে আপনাদের নির্যাতন করার? তাই আপনারা ভয় না পেয়ে যাকে খুশি রাজা নির্বাচিত করতে পারেন। আমি জোর করছি না কাউকে।”
কাব্যকে থামিয়ে দিয়ে শব্দ বললো “কি করছিস কাব্য, চুপ থাক।” বাবার ধমক খেয়ে কাব্য থেমে যায়। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজার দল খালি হতে শুরু করলো। সব ধীরে ধীরে এসে জড়ো হলো শব্দের দলে। বাকি পড়ে রইলো রাজার দলে হাসেম ও রাতুল। শেষে ধীর পায়ে রাতুল এসেও শব্দের দলে দাঁড়ালো। চূড়ান্ত হলো শব্দের বিজয়। চারদিকে হৈ হুল্লোড় শুরু হলো। সবাই এসে অভিনন্দন জানালো শব্দকে।
বিকেলেই শব্দরা রাজমহলে চলে যাবে। তাই সব গোছগাছ চলছে। এদিকে একটু পর পর ভাই রাজা হওয়ার আনন্দে শুভ্র নেচে যাচ্ছে। একবার মিষ্টির হাত ধরে ঘুরে যাচ্ছে, একবার অভ্রকে কাঁধে নিয়ে নেচে যাচ্ছে।
কাব্য যাওয়ার জন্য তৈরি হতে আয়নার সামনে যেতেই আঁতকে ওঠে। মুখের এক পাশটা কালো হয়ে আছে। বুঝতে পারলো গত রাতের দূর্ঘটনাটায় এটা হয়েছে। অর্নি কাব্যর কাছে আসতেই কাব্য মুখটা ঢেকে নিলো। বিছানার উপরে রাখা শব্দের চাদরটা গায়ে জড়িয়ে মুখের একপাশটা ঢাকার চেষ্টা করলো। অর্নি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে কাব্য? কি লুকচ্ছ?” কাব্য মাথা নাড়লো। অর্নি জোর করে চাদর সরিয়ে মুখের কালো দিকটা দেখে হেসে ফেললো। বললো “আমি কি এটা দেখিনি? আমার থেকে লুকিয়ে রাখছো তুমি?” কাব্য বিছানায় ধপ করে বসে বললো “তুমি দেখেছো? খারাপ লাগছে না তোমার? তোমার বরের চেহারা এমন হয়ে গেছে, কি বিশ্রী। তোমার উচিত রাতুলকে বিয়ে করে ফেলা। সুন্দর ছেলেটা, আমার মতো বিশ্রী নয়।” অর্নি কাব্যর পাশে বসে কাব্যকে জড়িয়ে ধরে মুখের কালো দিকটায় আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বললো “আমার এমন হলে কি তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে? দিতে না তো? তাহলে আমি কেন দিবো? আর তাছাড়া আমি তো তোমার চেহারা দেখে ভালোবাসিনি। আমি জানতাম তুমি মানুষ। সেটা জেনেও ভালোবেসেছি। আমি কেন যাবো বলো? আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে তোমার কাছে রেখে দেও।” কাব্যকে নিতে এসেই শুভ্র দুজনকে এক সাথে দেখে চোখে হাত দিয়ে দৌড়ে ব্রেক মারলো। কাব্য মাথায় হাত দিয়ে বললো “অমনি অমনি চলে এলে তো? আমি যদি মিষ্টি মাকে কিছু না বলি দেখে নিও।” শুভ্র কাছে এসে কাব্যর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “বাপ আমার তুই ভালো। বাপ আর মায়ের মধ্যে ঝামেলা তৈরি করিস। আমি কি ইচ্ছে করে আসি? আমার আসার সময় আর তোর রোমান্সের সময় এক হলে আমি কি করবো বাপ? আমি ভোলা ভালা একটা মানুষ। না থুক্কু, জ্বীন। তুই আমাকে এভাবে দোষী বানিয়ে দিচ্ছিস। তুই অন্য সময় রোমান্স করতে পারিস না?”
অন্যদিকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরেই শব্দ চলে গেলো রোদের কাছে। রোদ শব্দকে দেখেই লাফাতে শুরু করলো। ভেবেছিল রোদকে নিয়ে আসতে শব্দ গেছে তার কাছে। কিন্তু শব্দ যখন বললো রোদকে কে কন্ট্রোল করছে, এটা শুনেই রোদ থেমে গেছে। শব্দর কাছে এসে বললো “একটা মহিলা এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। আমি তেমন কিছু বলিনি। শুধু তাদের সাথে তাল মিলিয়েছি। একটা কথা বলি? ইমা আপু আছে না? সেও এসেছিল এখানে। আমি কথা বলতে চেয়েছিলাম তবে তিনি আমাকে বললো আপনার থেকে দূরে থাকতে। আমি বুঝতে পারছি কি হচ্ছে এসব। এটা কোন জায়গা?” শব্দ ভ্রু কুঁচকে বললো “ইমা? আর ওই মহিলাকে চিনলে না? কি বলেছিল তোমাকে?” রোদ বললো “কিসের কোন মুকুট মুকুট বললো। আমাকে বললো মুকুট সাবধানে রাখতে। আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। ইমা আপু আপনার কথা জিজ্ঞেস করলো, আমার হিংসা হলো। বললাম আমি জানিনা কিছু খুঁজে নিন।” শব্দ হেসে রোদকে বুকে নিয়ে বললো “বুড়ো হয়ে গেলাম, ছেলে হলো ছেলের বউ হলো। তাও এই বুড়ো বয়সেও আমাকে নিয়ে ভয় তোমার? এখনো কি অন্য কারো হওয়ার বয়স আছে?” শব্দের কথার মাঝেই শব্দের মাথায় ব্যথা অনুভূত হলো। মাথায় হাত দিয়ে দেখলো ব্যথা জায়গায় চটচটে হয়ে আছে রক্তে। বন্ধ হয়ে আসলো শব্দের চোখ। চোখ বন্ধ হওয়ার আগে দেখলো চোখের সামনে রোদের চিন্তিত মুখ।
চলবে?…
জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ২২.
শব্দ চোখ খুলতেই টের পেলো তার হাত বাঁধা। শেকল দিয়ে দু হাত টেনে বাঁধা আছে। জ্বীন হয়েও শেকল থেকে বের হতে পারছে না সে। কারন এটা জ্বীনেরাই বেঁধেছে। অদূরেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রোদ। রোদকে দেখে এই প্রথম শব্দের ঘৃনা হলো। বার বার নাটক করে ঠকিয়ে দিচ্ছে সে শব্দকে। তাই রোদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো শব্দ। বিষয়টা রোদের দৃষ্টিগোচর হলো না।
শুভ্র-কাব্য পরিবার সহ রাজমহলে পৌঁছে গেছে। সব জ্বীনেরা নতুন রাজার আগমন করতে অপেক্ষা করছে। কিন্তু শব্দের দেখা নেই। শব্দকে পুরো জ্বীনরাজ্যেও খুঁজে পাওয়া গেলো না। তাই সবাইকে মহলো রেখে বাধ্য হয়ে শুভ্র ও কাব্য রোদের গুপ্ত মহলের দিকে রওনা দিলো। অভ্রকে বাসায় রেখে মিষ্টি এবং অর্নিও রওনা দিলো সেখানে।
শব্দকে বেঁধে রাখার পর এক এক করে সবাই হাজির হলো সেখানে। প্রথমে ইমা, তারপর সেই মহিলা যিনি রোদের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। যিনি মুকুটের জন্য রোদকে অপহরন করেছিল। কিন্তু তবুও তাকে না মেরে ক্ষমা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি এসে রোদকেই ব্যবহার করেছেন শব্দের বিপক্ষে। এটা ভাবতেই শব্দের শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে আসছে। প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে শব্দ। নিমিষেই বুঝতে পারলো রোদের প্রতি ঘৃনা হওয়াটা অস্বাভাবিক। তাই শব্দ রোদের দিকে আরো একবার তাকালো। রোদ মহারানী হলেও তাকে চলতে হতো এই মহিলার আদেশেই। কিন্তু মুকুট যে তাকে দেওয়া যাবে না সেটা রোদের মাথায় ছিল।
ইমা এগিয়ে এসে শব্দের মুখে একটা আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বললো “কতো বছর কতো অপেক্ষা করার পর তোমাকে পেয়েছি আমি। কতো অপমান সহ্য করেছি তুমি জানো? এগুলো কেন করেছি? তোমাকে ভালোবাসি বলে। অথচ তুমি আমাকে ভালোবাসলেই না। কেন বলো তো? এই রোদের জন্য? রোদ আদৌ তোমাকে ভালোবেসেছিল? আমার মতো করে তো ভালোবাসেনি রোদ। তাও আমাকে কেন ভালোবাসলে না শব্দ ভাই?” শব্দ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বললো “কারন তুই অসুস্থ। তোর এই ভালোবাসা শুধুমাত্র এখন জেদে পরিনত হয়েছে। ভালোবাসা কি জানিস তুই? ভালোবাসা মানে ভালো থাকতে দেয়া। অপর পাশের মানুষটাকে খুশি রাখা। কিন্তু তুই সব সময় স্বার্থপরের মতো নিজেরটাই ভেবে গেছিস। স্বার্থপররা ভালোবাসতে জানেনা বুঝলি? আর রোদ? রোদের নখেরও যোগ্য না তুই। রোদ জানে কিভাবে সবাইকে ভালো বাসতে হয়, ভালো রাখতে হয়।” ইমা রেগে বললো “হয়েছে, তুমি আমাকে প্রথম ভালোবাসলে আমি এমন হতাম না শব্দ ভাই। আমি কি রোদকে আগে নিজের বোনের মতো দেখতাম না? তুমি ওকে ভালোবাসলে, তাই তো ওকে সহ্য হলো না শব্দ ভাই। আমি তো এমন ছিলাম না। আমার সাথেই এমন হলো কেন? রোদের সাথেও তো হতে পারতো।” শব্দ ইমাকে নরম সুরে বললো “জোর করে ভালোবাসা হয়না ইমা। তুই পেরেছিস আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে? তাহলে আমি কিভাবে পারতাম রোদকে রেখে তোকে ভালোবাসতে? ভালোবাসা তো করুনার জিনিস নয় ইমা। তুই আমাকে ভালোবাসিস বলে তোকে করুনা নিয়ে বিয়ে করলে তোকে ঠকানো হতো। আমি তো তোকে ছোটবেলা থেকে শুভ্রর মতো করে ছোট বোন হিসেবে ভালোবেসেছি। আমি তোর ভাই জেনেও যেমন আমার প্রতি তোর ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে, রোদকে দেখেও আমার ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে। ভালোবাসা কখন কার প্রতি হয় বলা মুশকিল ইমা। তুই এমন পাগলামি না করলে আমরাও একটা সুখী পরিবার হতে পারতাম। আর আজ তুই হাত মিলিয়েছিস এই মহিলার সাথে? যে প্রতি পদে পদে আমাকে, আমাদের পরিবারকে শেষ করতে চেয়েছে। তোর ধারনা আছে কতোটা খারাপ ইনি?” ইমা হাত উঁচু করে বললো “হয়েছে, আমি এখানে তোমার নীতিকথা শুনতে আসিনি। উনি কেমন সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। উনি তোমাকে আমার কাছে এনে দিয়েছে এটাই বড় কথা। আজ এখানে বিয়ে হবে। ইনি শয়তানের মাধ্যমে তোমাকে বশ করে আমার সাথে বিয়ে দিবে তোমার।”
ইমার কথা শুনে রোদ চমকে তাকালো। তার শব্দ ভাইয়ের সাথে ইমার বিয়ে হবে জেনে অস্থির হয়ে গেছে সে। মাথা নিচু করে এগিয়ে এসে বললো “ইমা আপু এটা করবেন না। শব্দ ভাই আপনাকে ভালোবাসে না। আমাকে ভালোবাসে, আপনি এমন করতে পারেন না।” ইমা রোদের চিবুক ধরে বললো “ভালোবাসে না, কিন্তু একটু পরেই ভালো বাসবে। দেখতে পারবে সেটা সোনা। তারপর তোমার উপরেও আমার হিংসা থাকবে না। আবার আগের মতোই বোনের নজরে দেখবো তোমায়।” রোদ ছলছল চোখে ইমার দিকে তাকালো। এক মুহুর্ত দেরি না করে সেই মহিলার কাছে গিয়ে বললো “মা আপনি তো যা বলেছেন সব আমি করেছি। আরো করবো, তাও শব্দ ভাইয়ের ক্ষতি করবেন না। উনি ভালো জ্বীন, ওনাকে খারাপ বানাবে না।” শব্দ চেচিয়ে বললো “রোদ কি করছো তুমি? এটা শিখিয়েছি আমি তোমাকে? অন্যায়ের সামনে মাথা নত করছো তুমি। এটা আশা করিনা তোমার কাছ থেকে। সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলেছি। আর আজ তুমি আমার জন্য মাথা নত করে ছোট হচ্ছো? আমার রোদ যেন ছোট না হয় খবরদার। একদম শেষ করে দিবো সব আমি তাহলে।” শব্দের কথা শুনে রোদ নিরবে কাঁদা শুরু করলো। কিছুই করার নেই তার। মনে মনে শুভ্রকে কয়েকবার স্মরণ করলো। আজ শুভ্র থাকলে তার ভাইয়ের এতো বড় ক্ষতি হতে দিতো না।
শব্দ মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো “রোদকে ১৭১৮ বছর ধরে ব্যবহার কিভাবে করছেন?” মহিলা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো “তোমরা ভুল করেছিলে আমাকে মুকুট না দিয়ে। তোমার বউয়ের কাছে ছিল মুকুট। আমি উপাসনা করে সেই মুকুটে খারাপ শক্তি দিয়ে তোমার বউকে পড়িয়ে রাখতাম আড়ালে৷ যার কারনে যত স্মৃতি সব ওই মুকুটের মধ্যে জমা হতে থাকে। আর তোমার বউয়ের মাথা থেকে উধাও হতে থাকে। আস্তে আস্তে সে তোমাকে, তোমার সাথে বিয়ে, তোমার সাথে কাটানো দিনগুলো, বাচ্চা সব ভুলে যেতে থাকে। তোমার সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ফলে সেদিন শেষ ঝগড়ার সময় তোমার প্রতি বেশি রাগ করেই বেরিয়েছিল রোদ। যখন তুমি ফিরিয়ে আনতে গেলে তখন সব স্মৃতিই ওর জমা হলো মুকুটে। আর চিনতে পারলো না তোমাকে রোদ। অস্বীকার করলো তোমাকে এবং তোমার বাচ্চাকে। ভেবেছিলাম এভাবেই ব্যবহার করে যাবো আমি ওকে। কিন্তু কিভাবে আবার তোমার সাথে দেখা হলো জানিনা। যাক ভালোই হয়েছে, এবার পুরো বিষয়টা শেষ হতে শুরু করেছে। ইমাকেও নিয়ে আসলাম মুকুট ব্যবহার করে এই রাজ্যে৷ আর কিছু শুনতে চাও তুমি?” শব্দ হাত ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মনে মনে এখানে একা আসার জন্য পস্তাতে লাগলো।
মহিলা আগুনের কুন্ডলী পাকিয়ে ইমাকে নিয়ে বসেছে। একটা মানুষের খুলির উপরে ইমার হাত কেটে এক ফোঁটা রক্ত নিলো। চারদিকে ধোঁয়া দিয়ে সামনে বসালো রোদকে। রোদের সোজাই শব্দকে বাঁধা। বিভিন্ন ধরনের মন্ত্র উচ্চারণ করে আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে কালো কয়লা।
“কি নকল নানু, আমাকেও একটু যাদু টোনা করুন দেখি। আমি কিন্তু একদম বাবার মতো মহান নই। একবার ছাড় পেলেও দ্বিতীয় বার কিন্তু পাবেন না।” কাব্যের কথায় সবাই পিছু ঘুরে তাকালো। রোদ জানেনা কাব্য কে। তার কিছুই মনে নেই এখন আর৷ কাব্যের পাশেই পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র। মহিলা রোদকে আদেশ করলো রোদ যেন সব সৈন্যদের বলে ওদের আক্রমণ করতে। রোদ করলো না সেটা৷ সে জানে, এটা করলে শব্দকে ছাড়ানো যাবে না। যতই হোক শব্দকে সে ভালোবাসে। উঁচু আওয়াজ করে সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে বললো “এক পাও কেউ আগাবে না এদিকে। এতো বছর মহারানী হিসেবে মেনে আসছো আমাকে সবাই৷ আজও যেন আমার আদেশের বিপক্ষে কাজ না করতে দেখি। তাহলে একেকটার খবর করে দিবো আমি৷” রোদের কথায় সবাই পিছিয়ে গেলো। ইমা ভয়ে ভয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো “রোদের তো স্মৃতি একটুও ছিল না। ও যে শব্দকে ভালোবাসে এটা আসলো কিভাবে?” মহিলাটি বললো “মুকুট কিছুটা ভেঙে গেছে। যার কারনে ওর স্মৃতি ওর কাছে কিছুটা ফিরে এসেছে। এখন এই কারনেই বিপদ হয়ে গেলো আমাদের।” ইমা ফট করে রোদকে বললো “তুমি শব্দকে ভালোবাসো তাইনা? অথচ তুমি অনেক কিছুই জানো না। শব্দ তোমাকে রেখে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। দেখো ওই যে তার ছেলে৷ শব্দকে বাবা বলে ডাকছে দেখো।” রোদ চোয়াল শক্ত করে বললো “ঠিক বলেছো অনেক কিছুই আমি জানিনা। তাই না জেনে আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে দোষী ভাবতে পারিনা। আমি জানি শব্দ ভাই আমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে। এটা যদি তার ছেলেও হয় এর পেছনে অবশ্যই এমন কিছু সত্যি আছে যা আমি জানিনা। আমি জানবো তারপর শব্দ ভাইকে দোষী ভাববো নাকি নির্দোষ ভাববো সেটা ভেবে দেখবো।”
শুভ্র এসে ইমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো “উঠে দাঁড়া, তোকে শেষ বারের মতো দেখি। আমার সেই ছোট্ট নিষ্পাপ বোনটার কোনো আদল তোর মধ্যে খুঁজে পাই কিনা একটু দেখি। কারন আজকের পর থেকে তো তোকে আর কখনো দেখবো না।” ইমা ভয়ে কেঁপে দাঁড়িয়ে বললো “ভাইয়া কি করবে তুমি?” শুভ্র ঠাস করে জবাব দিলো “খুন।” ইমা ফের জিজ্ঞেস করলো “আমাকে ভাইয়া? কিন্তু আমি তো তোমার বোন!” শুভ্র বললো “আজ বলতে বাধ্য হলাম, তুই আপন বোন না আমার। কাজকর্মে সেটা প্রমান করে দিয়েছিস। তোর তো বাঁচার কোনো অধিকারই নেই।”
চলবে?….
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ২৩.
হাতে রক্তাক্ত ছুরিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। ছুরিটা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে টাটকা রক্ত। নিজের চোখের সামনে বড় হতে দেখা বোনটার রক্ত। ছোটবেলা থেকে বোনের সাথে থাকার ভাগ্য হয়নি তার। শব্দ ছিল তাদের বাড়িতে এবং শুভ্র ছিল শব্দের বাড়িতে। কিন্তু বড় হওয়ার পরে তো বোনের সাথেই থেকেছে সব সময়৷ সেই ছোট্ট বোনটা চোখের সামনে এভাবে বিপথে গিয়ে নোংরা মনমানসিকতার হয়ে যাবে ভাবতেই কষ্ট লাগছে শুভ্রর। নিজের চোখের সামনে গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে নিঃশ্বাস বের হয়ে যায় ইমার। আর যাই হোক পদে পদে ইমা প্রমান করেছে তারা আলাদা রক্তের। তাই আলাদা রক্তের প্রতি কোনো ধরনের টান রাখেনি শুভ্র। সব ভুলে নিজের রক্তকে বাঁচানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে সে। যদিও ইমাকে হত্যা করার আগে শব্দ বারবার করে বারন করেছিল। শেকলে বাঁধা না থাকলে হয়তো কখনোই এটা হতে দিতো না শব্দ। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ইমার আকুতি করে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য।
কাব্য গিয়ে এবারে শব্দের হাতের বাঁধন খুলে দিলো। শব্দ দৌড়ে এসে ইমাকে ধরলো। ইমা মারা গেছে আরো আগেই। তাও শেষবারের মতো বোনকে দেখলো শব্দ। শত হোক বোন ছিল তো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে শুভ্রকে দাঁড় করালো শব্দ। রোদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুকুটটি কোথায় আছে। রোদ উত্তর দিলো তার রুমেই আছে মুকুটটি। তবে অদৃশ্য অবস্থায়। যে কেউ সেটা দেখতে পারবে না। তাই আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আগে মহিলার কাহিনী শেষ করে তারপর মুকুটের কাছে যাওয়া হবে। তবে এবার রোদের হুকুম অমান্য করেই সমস্ত বদ-জ্বীনেরা ঝাপিয়ে পড়লো শব্দের উপরে। শুভ্র একেকটাকে দূরে ছুঁড়ে মারছে। তবে এবার যেন এরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাই মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে ওরা তিনজনে। ইতিমধ্যে অর্নি ও মিষ্টি এসেও হাজির হলো এখানে। এতো বছর পরে নিজের চোখের সামনে মিষ্টি নিজের মাকে দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে যায় মিষ্টি। তবে নিজেকে শক্ত করে এগিয়ে গিয়ে বললো “তোমাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলাম মা। তুমি সুযোগের অপব্যবহার করেছো। সেদিন তুমি আমার মা বলে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তবে বেঈমানের ছাড় নেই মা। আমি তোমাকে নিজের হাতে শাস্তি দিবো।” বলেই হাত উঁচু করে নিজের শক্তি ব্যবহার করে তলোয়ার হাতে নিলো মিষ্টি। মিষ্টি জানে কোন অস্ত্রে ঘায়েল হবে তার মা। মহিলা বারবার আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার প্রতিটি পদক্ষেপ ব্যর্থ করে দিচ্ছে অর্নি। মিষ্টি এগিয়ে এলো তলোয়ার নিয়ে। একদম গলার কন্ঠ নালী বরাবর তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলো মিষ্টি। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহুর্ত মায়ের সাথে কাটানো দিনগুলোর কথা স্মরণ করলো। মিষ্টির মা লুটিয়ে পড়লেন নিচে। দুহাত দিয়ে ব্যথায় নিজের গলা চেপে ধরলেন নিজেই। ছটফট করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মিষ্টির মা। নিজের মায়ের লাশের পাশে খানিকটা সময় বসে হুট করেই নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেকে বুঝালো সব ঠিক আছে, কিচ্ছু হয়নি৷ মিষ্টির মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে লড়াই থেমে গেছে। রোদ সামনে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো “আমার হুকুম অমান্য করেও তোমরা লড়াই করেছো। ইচ্ছে করছে তোমাদের কঠিন শাস্তি দিতে। কিন্তু আমি তা করবো না৷ কারন আমি এই জগৎ থেকে বের হয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। তোমরা আজ থেকে স্বাধীন। কারো কথামতো চলতে হবেনা। যাও সবাই মুক্ত।” রোদের কথায় সবাই রোদকে কুর্নিশ করে ছায়া হয়ে মহল থেকে বেরিয়ে যায়।
রোদ সবাইকে নিয়ে নিজের রুমে যায়৷ মুকুটটি দৃশ্যমান করে এবার তুলে দেয় শব্দের হাতে৷ কাব্য রোদের এক অন্য রুপ দেখছে। এতোদিন শব্দের বউ এবং নিজের মায়ের রুপেই দেখে এসেছে। আজ দেখছে শব্দের প্রেমিকা হিসেবে। তাই অর্নির পেছনে দাঁড়িয়ে অর্নির শাড়ীর আঁচল নিজের আঙুলে একবার পেচিয়ে আবার খুলে দিচ্ছে। কাব্যের কাজে অর্নি বিরক্ত হয়ে ঠুস করে গুতা মারে কাব্যের পেটে। কাব্য আউচ আওয়াজ করলে শব্দ ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে?” নিজের ব্যবহারে নিজেই বলদ হয়ে মাথা চুলকে কাব্য বললো “কিছু না বাবা।” পাশ থেকে শুভ্র গম্ভীর কণ্ঠে বললো “বাপ, এখানে একটা মিশনে এসেছি। তোর মায়ের স্মৃতি ফেরাতে হবে বুঝলি? নাহলে তোর চোখের সামনে তোর বাপ-মায়ের আবার বিয়ে দেখবি। কিছুদিন পরে তোর বাচ্চা আসার বয়সে তোর বাপের বাচ্চা এসে যাবে। তাই এই মিশনে এসে অন্তত রোমান্স করিস না।” শুভ্রর পেটে চিমটি কেটে কাব্য বললো “আমাদের একসাথে দেখলেই তোমার কেন মনে হয় আমরা রোমান্স করি?” শুভ্র কাব্যের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো “যখন সামনে পড়িস জড়াজড়ি আর চুমু ছাড়া তো কিছু দেখিনা বাপ।”
শব্দের ধমকে দুজনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। শব্দ বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুকুটটি নিচে রেখে আঘাত করে ভেঙে ফেললো। সাথে সাথে রোদ অজ্ঞান হয়ে যায়। শব্দ রোদকে পাঁজা কোলে নিয়ে জ্বীনরাজ্যের দিকে রওনা দেয়। পেছনে পুরো পরিবার চলতে থাকে তার সাথে।
জ্বীনরাজ্যের সবাই অপেক্ষা করছে শব্দকে স্বাগত জানানোর জন্য। শব্দের সাথে তার বউ এবং তার পুরো পরিবার মহলে প্রবেশ করছে। চারদিক থেকে জয়ধ্বনি এবং স্বাগত স্লোগান শোনা যাচ্ছে। তবে শব্দ দুশ্চিন্তায় আছে রোদকে নিয়ে।
রাজমহলে গিয়ে রোদকে শুইয়ে দিলো শব্দ। বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করার পরে রোদের জ্ঞান ফিরে আসে। শব্দ দ্রুত এসে রোদের পাশে বসে রোদের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো “রোদ তুমি ঠিক আছো? মনে পড়েছে কিছু?” রোদ ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো “আমার কি হয়েছিল শব্দ? সরো তো কতো কাজ পড়ে আছে আমার। আর আমি ঘুমিয়ে আছি। মিষ্টি কোথায় তুই? কাব্য কোথায়?” চারদিক থেকে সবার চিৎকার শুনে বুকে থু থু দিয়ে বললো “সবাই এভাবে চিৎকার করছো কেন?” শব্দ বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়ে বললো “অবশেষে দীর্ঘ ১৩ বছর পর!” রোদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো “কি ১৩ বছর পর?” শব্দ বিষয়টাকে দারুন ভাবে এনজয় করছে। কাব্যকে টেনে নিয়ে রোদের সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো “বলো তো এটা কে?” রোদ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো “এটা কে? চিনতে পারছি না তো।” শব্দ মুখ হা করে বললো “এটা কাব্য রোদ। তোমার-আমার ছেলে কাব্য।” রোদ ভাবলো শব্দ মজা করছে। তাই ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শব্দ রোদের গাল টেনে বললো “তুমি আমি বুড়ো হয়ে গেছি রোদ। তুমি টেরই পেলেনা? অনেক কিছুই ঘটে গেছে যা তুমি জানোই না। তোমার ছেলের বিয়েও হয়ে গেছে। তাও একটা না, দু দুটো।”
সবাই জ্বীনরাজ্যে দুদিন থাকলো। সবাই রোদকে পুরো ঘটনাটা জানালো। জানার পর থেকেই থম মেরে বসে আছে সে। এতোকিছু করে ফেলেছে মনেই নেই তার? সে কিভাবে পারলো শব্দকে এভাবে কষ্ট দিতে। শব্দকে ছাড়াই বা কিভাবে এই ১৩ বছর কাটিয়ে দিলো রোদ? মিষ্টিকে কিছুক্ষণ পর পরই কাছে ডেকে বোনের মতো আদর করছে রোদ। কাব্যকে বড় করেছে সে নিজের সন্তানের মতো।
দুদিন পরে বিকেলে সমাবেশ ডাকা হলো। সমস্ত জ্বীনেরা সমাবেশে হাজির হওয়ার পর শব্দ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো “নির্বাচন করার বা রাজা হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আমি এখনো সব সময় আপনাদের সেই আগের শব্দ হয়েই থাকতে চাই। আমি দূরে থাকলেও সব সময় আপনাদের খেয়াল রাখবো। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম সবার কাছে। কিন্তু এখন আমাদের বিদায় দিতে হবে। আমরা চলে যাবো আমাদের আগের জায়গায়। আমাদের জন্য সবাই দোয়া করবেন।
চলবে?…
আর এক পর্ব আছে, তাই এই পর্ব ছোট করে দিলাম।
গল্প জ্বীনবর(২)
লেখিকা Mst Moni
পর্ব ২৪. (শেষ)
অর্নিকে মনে নেই রোদের, অর্নি বারবার করে মনে করানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু রোদের মনে পড়ছে না। তাই অর্নি দোটানায় ভুগছে মাম্মাম ডাকবে নাকি শাশুড়ী মা। শেষে শব্দ রোদকে সবটা বুঝিয়ে বলার পরে রোদ অনুমতি দিলো মাম্মাম ডাকার জন্যই। অর্নি খুশি সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোদের দুঃখ হচ্ছে এই ভেবে যে ছেলে এতো বড় হলো কিন্তু সে নিজে বড় করতে পারলো না।
মানুষের মাঝে ফিরে আসার পরে আবার এক দূর্ঘটনা ঘটলো। অর্নি আর ইশমাম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। বিকেলেই অর্নি হাওয়া খাওয়ার জন্যই ছাদে উঠেছিল। অর্নিকে একা ছাদে উঠতে দেখে ইশমামও পিছু পিছু উঠলো। ইশমাম অর্নিকে উদ্দেশ্য করে বললো “ভালোবাসা অন্ধ তুমি কি সেটা জানো?” অর্নি মাথা নাড়িয়ে মুচকি হেসে বললো “আমি জানি, কিন্তু তোমার আমি অন্ধ হতে তো চাইনা। অন্ধ হয়ে গেলে কাব্যকে দেখে রাখবো কিভাবে শুনি?” অর্নির মুখে কাব্যের নাম শুনে ইশমাম রেগে যায়। অর্নির গলা চেপে ধরে বললো “কাব্যর নাম তোমার মুখে মানায় না।” পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বললো “আমি কি করতে পারি সেটা তুমি জানো না অর্নি। আমি কাব্যকে পাওয়ার জন্য আমার বাবাকে মেরেছি। যেই বাবাকে বাঁচানোর জন্য এতোদিন লড়াই করেছি। সেই বাবাকেই মেরেছি আমি। কারন আমার বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল অন্য জায়গায়। তো তোমাকে মারতেও হাত কাঁপবে না আমার। নিজের ভালো চাইলে সরে যাও।” অর্নি ছাদের কার্নিশ ধরে বিজয়ের হাসি দিয়ে বললো “আমাকে শাসাচ্ছ তুমি? হয় হয়, প্রেমে ছ্যাকা খেলে এমন একটু আধটু হয়। তোমার তো আবার প্রেম না, সরাসরি বিয়েই। তোমার তো আরো পাগলামি করার কথা। তো কি করবে শুনি?” অর্নির কথায় ইশমাম বুঝলো অর্নি ভালো কথা শুনে কাব্যর জীবন থেকে যাবেনা। যা করার ইশমামকেই করতে হবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে অর্নিকে সোজা ধাক্কা মেরে দিলো ইশমাম। ঠিক সেই মুহুর্তে কাব্য চলে আসে ছাদে। এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে এসে অর্নিকে ধরতে গিয়েও পারলো না। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্নি আকাশে উড়ে ইশমামকে বললো “মানুষের এই এক স্বভাব। রাগে ভুলে যায় সামনের মানুষটা কে, আর নিজে কে। তুমি ভুলে গেছো ইশমাম আমি মানুষ নই। বাবা এতোদিন দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিল। আজকে তোমার লাইফের দ্যা এন্ড করবো আমি।” উড়ে এসেই ইশমামকে থাপ্পড় মেরে দিলো অর্নি। কাব্য রাগে ইশমামের দিকে একবার তাকিয়ে এক হাতে তুলে সোজা নিক্ষেপ করলো নিচে। নিচে পড়ে চোখ মুখ থেঁৎলে যায় ইশমামের।
ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে প্রমান হওয়ায় পুলিশি ঝামেলা আর হলো না। যদিও শব্দ কষ্ট পেয়েছে, নিজের মেয়ের মতোই তো দেখতো ইশমামকে। তবে নিজের ছেলে এবং ছেলের বউয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে তাকে শব্দ ক্ষমা করবে না। নিজের বাবাকে যে মেরে ফেলতে পারে সে অন্তত বেঁচে থাকার অধিকার রাখে না।
—————————————
সবাই জ্বীন রাজ্য থেকে ফিরে এসে মানুষের সাথে থাকা শুরু করেছে। রোদ আগের থেকে আরো স্বাভাবিক হয়েছে। অভ্র এখানে এসেই সামিরার সাথে দেখা করলো।
-সামিরা আমি মানুষ না।
-তাহলে তুমি কি? ভুত?
-ভুত হবো কেন? আমি কি মরে গেছি?
-তাহলে কি তুমি পুতুল?
-আরে আমি পুতুল হবো কেন? আমি তো মানুষ।
-তাহলে বললে যে তুমি মানুষ না।
-ওরেএএ, তুমি তো একদম আমার মায়ের মতো। আব্বুকে সব সময় দৌড়ের উপরে রাখে। আমার কপালও দেখছি আব্বুর মতো। আম্মু ঠিকই বলে, বাপকা বেটা সিপাহিকা ঘোড়া।
-এই তুমি থামবে? তুমি বলো তুমি কি?
-আমি জ্বীন, জ্বীন চিনো?
-না
-আচ্ছা চিনতে হবেনা, বড় হয়ে চিনবে।
-জ্বীন কি খারাপ কিছু?
-নাহ্, খারাপ কেন হবে? তোমার বান্ধবীদের কাছে গর্ব করে বলতে পারবে আমার জামাই জ্বীন।
-জামাই কি আবার?
-থাক বইন মাফ কর, বড় হ বুঝবি।
-বোন বললে আমাকে? আমি থাকবোই না, আম্মুউউউ।
অর্নি রান্নাঘরে যাওয়ার সময় এক টানে দেয়ালের ওপাশে নিয়ে কাব্য অর্নিকে চেপে ধরলো। চুমু দিতে যাবে এমন সময় পাশে হালকা কাশির আওয়াজ শুনলো। চোখ দুটো বন্ধ করে বিরক্তি ভঙ্গিতে বললো “জানতাম তুমিই আসবে। আমার রোমান্স দেখলেই তো তোমার এলার্জি উঠে যায়।” শুভ্র মুখে হাত দিয়ে বললো “তা বাপ এটা কি রোমান্স করার জায়গা? তোমাদের রুম নেই? এখানে তোমার বাপ ভাই আছে জানো না?” অর্নি ইতিমধ্যেই দৌড়ে পালিয়ে গেছে। কাব্য কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে পা দিয়ে কয়েকবার লাফিয়ে বললো “তাই বলে সব সময় তোমার সামনেই কেন? যাও যাও সামনে তোমার বউও আছে। আমি যদি কিছু না করেছি না?…” কাব্যের বাকি কথা না শুনেই শুভ্র সামনে পা বাড়ালো। শুভ্র জানে এখন কাব্য অনেক কিছুই বলবে এখন।
শুভ্র মিষ্টিকে খুঁজছে, সারা বাড়ি খুঁজে অবশেষে পেলো নিজেরই রুমে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো “এই মিষ্টি চলো না ছোট্ট একটা মিষ্টিকে আনি।” মিষ্টি ধমক দিয়ে বললো “একদমই না, আমার ছেলে এখনো ছোট।” শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো “কে বলেছে ছোট? তোমার ছেলে বিয়ে করার জন্য পাত্রী ঠিক করে ফেলেছে। বাড়িতে একটাও প্রিন্সেস নেই। চলো না একটা প্রিন্সেস আনি।” শুভ্রর গাল দুটো টেনে মিষ্টি বললো “তুমি জানলে কিভাবে প্রিন্সেস আসবে?” শুভ্র চিৎ হয়ে শুয়ে বললো “আমি জানি, আমি প্রে করি তো। আর যদিও প্রিন্স হয় তবুও আমি খুশি। শুধু একটা পুচকে চাই আমার।”
রোদ আয়নায় নিজেকে দেখছে। নিজের অজান্তেই কতোটা বুড়ো হয়ে গেছে। শরীর ভাড়ি হয়ে গেছে কতোটা। দূরে গম্ভীর হয়ে রোদকে দেখছে শব্দ। শব্দের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “দেখো শব্দ আমি কতোটা বুড়ী হয়ে গেছি। অথচ তুমি দেখো তুমি সেই ২১ বছরের যুবকই আছো৷ আমাকে তোমার ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক।” শব্দ রোদের কথায় উঠে এসে রোদকে জড়িয়ে ধরে বললো “তুমি আমার কাছে সেই কিশোরীই আছো। ভালোবাসার মানুষ কখনো বুড়ো কিংবা পুরোনো হয়ে যায় না। আমি যে ২১ বছরেরই আছি এটাই তো তোমার জ্বীনবরের সুবিধা। এখনো সবাইকে বলতে পারবে আমার জ্বীনবর অনেক সুন্দর। আমি জ্বীনরক্ষক হয়ে জ্বীনরাজ্য রক্ষা করার পাশাপাশি জ্বীনবর হয়ে তোমাকে রক্ষা করতে পেরেছি এটাই অনেক। আমি তোমার জ্বীনবর হয়ে সারাজীবন বাঁচতে চাই তোমার সাথে।”
—————–সমাপ্ত—————–
যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি এই গল্পটায়। আশা করছি পরের গল্পগুলোতেও এভাবে ভালোবাসা দিবেন সবাই। কেমন হয়েছে সেটা একটু কষ্ট করে বলে যাবেন, এটা তো আশা করতেই পারি। ভালো খারাপ দুটোই বলবেন যেন ভুলগুলো শুধরাতে পারি। আগামীকাল থেকেই নতুন গল্প চলবে। সবাই একটা করে রিভিউ পোস্ট করবেন দয়া করে। ভুল ত্রুটি সব উল্লেখ করে দিবেন।