- দ্বিতীয় অধ্যায়
- সূচনা পর্ব
- ২য় পর্ব
- ৩য় পর্ব
- ৪র্থ পর্ব
- ৫ম পর্ব
- ৬ষ্ঠ পর্ব
- ৭ম পর্ব
- ৮ম পর্ব
- ৯ম পর্ব
- ১০ম পর্ব
- ১১তম পর্ব
- ১২তম পর্ব
- দ্বিতীয় অধ্যায়
- সূচনা পর্ব
- ২য় পর্ব
- ৩য় পর্ব
- ৪র্থ পর্ব
- ৫ম পর্ব
- ৬ষ্ঠ পর্ব
- ৭ম পর্ব
- ৮ম পর্ব
- ৯ম পর্ব
- ১০ম পর্ব
- ১১তম পর্ব
- ১২তম পর্ব
- ১৩তম পর্ব
- ১৪তম পর্ব
- ১৫তম পর্ব
- ১৬তম পর্ব
- ১৭তম পর্ব
- ১৮তম পর্ব
- ১৯তম পর্ব
- ২০তম পর্ব
- ২১তম পর্ব
- ২২তম পর্ব
- ২৩তম পর্ব
- ২৪তম পর্ব
- ২৫তম পর্ব
- ২৬তম পর্ব
- অন্তিম পর্ব
বুকের উপর ভারী অনুভূতি হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো রিত্তের, দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে ভারী কোনো কিছু বুক চেপে আছে। খুব কষ্টে চোখ মেলে আশেপাশে থাকাতেই খেয়াল করলো, বুকের উপর ঘাপটি মেরে বেড়ালের বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে রয়েছে কেউ। চোখ জোড়া ঝাপসা লাগছে। দ্রুত উঠতে গিয়েই মাথা ঝিম ধরে এলো; কাল রাতের হয়তো একটু বেশি হুইস্কি খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কোনোমতে চোখ খুলে দেখলো মেয়েটি আর কেউ না বরং তার কাগজের স্ত্রী ধারা। একে মাথা প্রচুর ব্যাথা করছে উপরে বুকের উপর ধারাকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। রাগে গা রি রি করছে। এক মূহুর্ত দেরি না করে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো তাকে। ঘুমের মধ্যে আচমকা ধাক্কা খাওয়ায় তাল সামলাতে না পারায় খাট থেকে নিচে পরে গেলো ধারা। ধারার শরীরের অবস্থা দেখে আরোও মেজাজ বিগড়ে গেলো রিত্তের। এলোমেলো শাড়ি, ব্লাউজের হুক খোলা, বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে তড়িৎ গতিতে ধারার কাছে যায় সে, হাত টেনে দাঁড় করিয়ে আলমারির সাথে ঠেসে ধরে। এতো জোরে ধরায় ব্যাথায় কুকড়ে উঠে ধারা। অসহায় দৃষ্টিতে রিত্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে রিত্ত,
– বলেছিলাম তো আমার আশেপাশে দশ হাতের মধ্যে যেনো তোকে না দেখি, তারপরও বেহায়ার মতো কেনো আমার কাছে আছিস। লজ্জা করে না? এতো শরীরের চাহিদা তোর? শরীরের চাহিদা যদি না মিটাতে পারিস তো যা না পতিতালয়ে। দরজা তো খুলেই রেখেছি। যেই দেখেছিস কাল আমার হুস নেই অমনি আমার কাছে শরীর ঘেষাতে এসে পড়েছিস তাই না?
– আ…আমি কিছু করি নি, তুমিই তো………
– চুপ, একদম চুপ, আরেকটা শব্দ শুনলে জানে মেরে ফেলবো।
ধারার মুখ চেপে ধরে রাগে রি রি করতে করতে বললো রিত্ত। এবার নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলো না ধারা। চোখের পানি ছেড়ে দিলো। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। একে মেজাজ খারাপ উপরে ধারার কান্না দেখে যেনো জ্যন্ত কবর দিতে ইচ্ছা করছে তাকে রিত্তের। এক রকম ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পরলো সে। আর ধারা সেখানেই বসে পড়লো। নড়ার শক্তিটুকু নেয় তার। এমন কেনো লোকটা একবার ও কি বুঝতে পারে না তাকে যে পাগলের মতো ভালোবাসে ধারা।
ছয় মাস হয়েছে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে ধারা, এক রকম হুট করেই রিত্তের সাথে বিয়েটা হয়েছে তার। রিত্তের মা সুভাসিনী বেগম অনেকটা জোর করেই রিত্তের সাথে ধারার বিয়েটা দেন। দেনাপাওনা না মেটানোর কারণে ধারার বিয়ের আসর থেকে বর বিয়ে ভেঙে চলে যায়। একমাত্র ভাইয়ের মেয়ের সাথে এতো বড় অন্যায় কিভাবে মেনে নিবেন তিনি। সুভাসিনী বেগমের ভাই সেলিম সাহেব গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার। মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী বলে তাকে ছোট বয়সেই বিয়ের ব্যাবস্থা করেন তিনি। আর খুব শিক্ষিত একটা ছেলে পাওয়াতে তিনি আর অমত করেন নি; উপরে মেম্বারের বখাটে ছেলেটা তো আছেই। মেয়েটা শান্তিতে কলেজেও যেতে পারতো না। ছেলেপক্ষের প্রথমে দাবি ছিলো একটা মোটর বাইক; কিন্তু ধীরে ধীরে তা বাড়তে বাড়তে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। দেনা পাওনার চাপে যখন সেলিম সাহেব কুপোকাত তখন সুভাসিনী বেগম সিদ্ধান্ত নেন ধারাকে নিজের ঘরেই আনবেন বউ করে। রাজ্জাক সাহেবের মৃত্যুর পর থকে সুভাসিনী বেগম রিত্তের বাবা-মার দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তাই ছেলের বিয়ের মতো সিদ্ধান্তও তিনি একা একা নিয়ে ফেললেন; তিনি জানেন ধারার চেয়ে ভালো মেয়ে রিত্ত খুজে পাবে না। আর কি ওই অবস্থায় রিত্তের সাথে ধারার বিয়েটা সেরে ফেলেন তিনি। রিত্তের সম্মতির একবার পরোয়া করেন নি তিনি। তার কাছে তো ধারার সম্মান বাঁচানোটা বেশী জরুরি হয়ে পড়েছিলো তখন। ধারার কাছে এই বিয়েটা যেনো সবকিছু; তখন থেকেই রিত্তকে মনে মনে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নেয় সে। কিন্তু রিত্তের এমন দায়সারা ভাব যেনো কিছুতেই তার মাথায় ঢুকে না। এই ছয়মাস এক রকম দূরে দূরে থেকেই কাটিয়েছে সে। ধারা ভেবেছিলো হয়তো মামাতো বোনকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কাল রাতে তো নিজ থেকে কাছে ডেকে নিয়েছিলো। তাহলে সকালে কেনো আবার এমন রূঢ় আচরণ করছে সে। আচ্ছা, তার কি ধারাকে একদম ই পছন্দ নয়?
সকাল ৯টা,
সুভাসিনী বেগম আর রিত্ত মুখোমুখি বসা ডাইনিং টেবিলে। এখন আর সুভাসিনী বেগমের সাথে না পারতে কথা বলে না রিত্ত। মায়ের উপর চাপা ক্ষোভ তার থেকেই গেছে। একটা অজপাড়াগায়ের অল্প শিক্ষিত আনকালচারড খ্যাত মেয়েকে কি বুঝে নিজের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন তিনি, হোক তার ভাইয়ের মেয়ে। রিত্তর মনে যে অন্য কারোর বাস তা তো অজানা নয় তার; তাহলে কেনো এই অন্যায়টা করলেন তিনি। চুপচাপ নিজের মতো খাচ্ছিলো, ঠিক তখনই খোড়াতে খোড়াতে ডাইনিং টেবিলে এসে হাজির হয় ধারা। চোখ মুখ ভীষণ ফুলে রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর কেঁদেছে মেয়েটা। ধারার চোখ মুখ দেখেই সুভাসিনী বেগম আঁচ করতে পারছেন তার গুণধর পুত্র এই কাজ করেছেন।
– ধারা মা, এভাবে খুড়িয়ে হাটছিস কেনো রে ?
খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন সুভাসিনী বেগম। আমতা আমতা করে পরক্ষণে উত্তর দেয় ধারা,
– বাথরুমে পরে গেসিলাম ফুপু।
ধারার কথা খুব যে তার বিশ্বাস হলো তা কিন্তু নয়। কিন্তু তবুও ধীর গলায় বললেন,
– দেখে চলবি তো নাকি? রিত্ত মেয়েটাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস তো।
– আমার মিটিং আছে মা, ঘরে বসে ড্রাইভার হিসেবে মানুষকে এখান সেখান নিয়ে যাওয়ার ঠেকা যায় নি আমার। যদি তোমার ইচ্ছে হয় তুমি নিয়ে যেতে পারো। আসছি
বলেই রিত্ত সেখান থেকে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়লো। পেশায় আর্কিটেক্ট সে; এসব ফালতু মেয়ের জন্য এক মিনিট সময় তার নেই। ধারা কিছুতেই বুঝে পায় না লোকটা তাকে এতো ঘৃণা করে কেনো! সে যে একদম অশিক্ষিত তাও নয়। এবার ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে সে; সেলিম সাহেব বিয়ের সিদ্ধান্ত না নিলে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যেত সে। এই ছয়মাস শুধু অংক মিলিয়ে মিলিয়ে কাটিয়েছে সে। সুভাসিনী বেগম ছেলেকে বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত, জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়েতে কারোর জোর নেই। ধারার ভাগ্যে সে এবং তার ভাগ্যে ধারাই রয়েছে। কিন্তু রিত্তের জিদের কাছে তাকে হার মানতেই হচ্ছে।
দুপুর ২টা,
খাওয়া দাওয়া শেষে সুভাসিনী বেগমের রুমে বসে পা টিপে দিচ্ছে ধারা তার। ফুপুর সাথে তার সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুত্বের; এই ছয়মাস মায়ের প্রতিরুপ দেখেছে ফুপুর মাঝে। সারাদিন ফুপুর চারপাশেই কাটে তার। এই বাড়িতে মনেই হয় না সে অন্য কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু সমস্যা একটাই; তা হলো রিত্ত। রিত্তকে বুঝতে পারে না সে।
– পায়ের ব্যাথাটা কি কমেছে?
হুট করেই বলে উঠেন সুভাসিনী বেগম। মুচকি হেসে বলে ধারা,
– এখন একদম ই নেই; তুমি একদম ভেবো না তো ফুপু।
– রিত্তকে ফোন দিয়েছিলি?
– দিয়েছিলাম, ব্যাস্ত ব্যাস্ত বলছে। থাক না, সত্যি ব্যস্ত হয়তো।
– আচ্ছা, তুই খুশি তো?
– এটা কেনো বলছো ফুপু?
– রিত্ত তোকে এখনো মেনে নেয় নি তাই না?
– ……………
– আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে, শোন।
রাত ৯টা,
আজ বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে রিত্তের, উপর থেকে কাজের চাপে খাওয়া দাওয়া শিখে উঠেছে। এখন রুমে যেয়ে গা এলিয়ে দিতে পারলে যেনো শান্তি। রুমে ঢুকতেই দেখলো পুরো রুম গোলাপে গোলাপে সাজানো। রুমের এই অবস্থা দেখে মেজাজ আর ঠিক রাখতে পারলো না রিত্ত। জোরে জোরে ধারাকে ডাক দিলে যখন কোনো সারা পায় না, তখন রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় সে। হুট করে পেছন থেকে কেউ একজন জরিয়ে ধরে তাকে। না ফিরেই বুঝতে পারে এই কাজ কার। হাত টা শক্ত করে ধরে টান দিয়ে সামনে আনে তাকে। ধারার পরণে তখন লাল একটি জর্জেটের শাড়ি, খুব সুন্দর করে সেজেছে মেয়েটি। চোখে গাঢ় করে কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। ঢেউ খেলানো চুল গুলো ছেড়ে দিয়েছে। প্রথমে দেখে রিত্ত ও চোখ ফিরাতে পারছিলো না, কিন্তু পর মূহুর্তে যখন মনে পড়লো সামনে থাকা মেয়েটা ধারা তখন রাগ যেনো আর কাবু করতে পারলো না। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারলো তাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– আজ তোর শরীরের সব জ্বালা যদি আমি না মিটাই তবে আমার নাম রিত্ত না।
যে চোখে ভালোবাসাকে কল্পনা করেছিলো সেই চোখ আজ হিংস্রতায় ঘিরা। বেল্টটা খুলেই……………………
চলবে
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
সূচনা পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
২য় পর্ব
– আজ তোর শরীরের সব জ্বালা যদি আমি না মিটাই তবে আমার নাম অনল না। [ অনেকেই রিত্ত নামটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, নামটি নাকি খুব কনফিউজ করছে তাই আমি চেঞ্জ করে দিচ্ছি]
যে চোখে ভালোবাসাকে কল্পনা করেছিলো সেই চোখ আজ হিংস্রতায় ঘিরা। বেল্টটা খুলেই শক্ত করে হাত বেধে দিলো ধারার। একটানে শাড়িটা খুলে ফেললো ধারার। তারপর যা হলো তা যেনো কল্পনার বাহিরে ছিলো ধারার; সুন্দর চেহারার আড়ালের হিংস্রতা দেখে মেয়েটির বুক কেঁপে উঠলো। অনল যেনো নিজের মাঝেই নেই; সব রাগ, বিদ্বেশগুলো ধারার শরীরের উপর দিয়ে মেটাচ্ছিলো। অনলের প্রতি ভালোবাসাগুলো যেনো দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো; যেমন তার শরীরটা যাচ্ছিলো। সেও তো অনলের ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলো; কিন্তু এখানে তো ভালোবাসা নেই, আছে শুধু জেদ, ঘৃণা, কামনা। এটাকেই স্বামীর ভালোবাসা বলে? যদি এটাকে স্বামীর ভালোবাসা বলে চায় ধারা এমন ভালোবাসা। ফুপু বলেছিলো,
– ধারা মা, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা খুব পবিত্র। অনল তোকে এখন মেনে নিচ্ছে না ঠিক ই। কিন্তু একটা সময় দেখবি ঠিক তোকে মেনে নিবে। তোকে ভালোবাসবে, তুই কিন্তু হাল ছাড়বি না। মাঝে মাঝে এটা ছয় দিন হয়, ছয় মাস হয়; আবার ছয় বছর ও হয়। ছেলেটার জেদটা বরাবর ই একটু বেশী। তোকে মানতে চাইছে না। এটা অবশ্য তোর দোষ নয়; আসলে কি বলতো সবার জীবনে কোথাও না কোথাও কিছু আঘাত থেকেই যায়। অনলের ও ছিলো। এই আঘাত গুলো মিটাতে সময় লাগে; তাড়াহুড়ো করলে হিতে বিপরীত হয়। এখন অনল তোকে পছন্দ করে না; কিন্তু যখন তোকে ভালোবাসতে শুরু করবে দেখবি, তোকে বাদে কাউকে চিনবে না। আমার ছেলেটা এমনই রে কি করবো বল। আজ তোকে আমি আমার মনের মতো সাজাবো দেখবি ও তোর থেকে চোখ সরাতেই পারবে না।
সুভাসিনী বেগমের কথা মতোই সে কাজ করেছে। তাহলে এমনটা কেনো হলো? চোখ থেকে নোনাজলগুলি গড়িয়ে পরছে। ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়ে বিছানা আকড়ে সেখানেই পড়ে রইলো সে। শেষ রাতে অনল যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, বিছানার অপর পাশে তখন গা এলিয়ে দেয় সে। নিজের চোখে অনেকটাই নিচে নেমে গেছে সে; যতই রাগ হোক রাগের বসে কোনো মেয়ের সাথে এমন আচারণ হয়তো তার দ্বারা শোভা পায় না। ধারা তার দিকে পিঠ করে তখন শুয়ে ছিলো। উন্মুক্ত পিঠে খামচির, কাধে কামড়ের দাগগুলো স্পষ্ট। মেয়েটি এখনো নীরবে কাঁদছে। একবার চেয়েছিলো মেডিসিন লাগিয়ে দিবে, কিন্তু পর মূহুর্তে মনে হলো
‘থাক সে তার মতো, দোষ তো তারই; সে তো এটাই চেয়েছিলো। যা চেয়েছে তাই তাকে শতগুণ রুপে ফেরত দেয়া হয়েছে‘
বেশি মাথা না ঘামিয়ে ঘুমের অতল গভীরে নিজেকে সপে দিলো অনল। ব্যাথার পরিমাণ যখন হালকা সহনীয় হলো তখন ধারা কোনোমতে বিছানা ত্যাগ করলো। ওয়াশরুমে শাওয়ার ছেড়ে বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসেছিলো; সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে; নিজেকে আর যখন ধরে রাখা সম্ভব হলো না ঠান্ডা পানির স্রোতে নিজেকে এলিয়ে দিলো সে।
সকাল ৯টা,
সূর্যের আলোর প্রখরতায় ঘুম ভেঙে গেলো অনলের। এতো দেরি তার হয় না; আজ এতোটা কিভাবে দেরি হলো নিজেই বুঝছে না। বিছানায় উঠে বসে পাশে তাকাতেই আৎকে উঠলো সে, বিছানাতে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে। নিজের চোখে নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে; রাগ তাকে এতোটা নিজে নামিয়ে আনবে এটা কল্পনা করতেই নিজের প্রতি ঘৃণা তাকে ঝাঝড়া করে দিচ্ছে। আচ্ছা মেয়েটা কোথায়? বাচ্চা মেয়ে কেবল নাকি উনিশে পা দিয়েছে। সংসার, স্বামী এসব ব্যাপার তার কাছে একটা নতুন শব্দ যার অন্তরর্থ বুঝার ক্ষমতা তার নেই। কাল রাতে এমনটা না করলে হয়তো ভালো হতো। নিজের হাত জোড়া দিয়ে মাথা চেপে ধরলো অনল। নিজের চোখে নিজেই যে নিচে নেমে গেছে। ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে গিয়ে গেলো সে। ওয়াশরুমের দরজা ভেড়ানো, পানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখে মেঝেতে ধারার অসার দেহটি পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে হাত দিয়েই শিউরে উঠলো গা। বরফ ঠান্ডা দেহটি কতক্ষণ পানিতে পড়ে রয়েছে হিসেব নেই। শ্বাস চেক করে দেখলো এখনো শ্বাস চলছে। কিন্তু অনেক ধীর গতিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সময় নষ্ট না করে আড়কোল করে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে। কোন মতে একটা কাপড় পড়িয়ে সুভাসিনী বেগমকে খবর দিতে ছুটলো সে।
সুভাসিনী বেগম তখন রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। সাধারণত ৮টার দিকেই ধারা রান্নাঘরে তার কাছে চলে আসে; আজ দেরি হওয়াতে মনে মনে খুশী ই হয়েছিলেন। কাল রাতে ছেলে, ছেলের বউ কেউই ঘর থেকে বের হয় নি। ভেবেছেন হয়তো অনল আর ধারার সম্পর্কটা আগাচ্ছে। ঠিক তখনই হাপাতে হাপাতে এসে পৌছায় অনল। অনলের চোখ মুখ যেনো অন্য কিছু বলছে। কোনো মতে অনল বলে,
– মা, ধা……ধারা।
দুপুর ১টা,
সেলাইন লাগানো অবস্থায় গভীর ঘুমে নিমজ্জিত ধারা। ফ্যামিলি ডাক্তার এবং অনলের বান্ধবী অনন্যা মাহমুদ ধারার চেকাপ করছে। বডি টেম্পারেচার প্রচুর কমে গিয়েছিলো। বেশকিছু ইঞ্জেকশন দেবার পর, তা ঠিক হয়েছে। তারপর ধুম জ্বর এসেছে। সেলাইন লাগিয়ে রেখেছে; সব কিছু মিলিয়ে মানসিক ভাবেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। সুভাসিনী বেগম অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলে অনন্যা বলে,
– আন্টি, একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে যদি পশুর মতো আচরণ করা হয় তাহলে তো এমনই হবার কথা। ভাগ্য ভালো মেয়েটি বেঁচে আছে। যা অবস্থা ছিলো আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হসপিটালাইজড করতে হবে। আন্টি মেয়েটা খুব মেন্টাল ট্রমাতে আছে। যখন জ্ঞান ফিরে আমাকে দেখেও কেঁপে উঠেছিলো। অনল ওর সামনে না যাওয়াটাই ভালো। আপনি সিনিয়র আছেন। আই থিংক আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন।
– ভুলটা আমারই। ভুলেই গেছিলাম; ছেলেটা দিন দিন মানুষ রুপী পশুতে পরিণত হচ্ছে।
– আন্টি আমার প্যাশেন্টস আছে। আমি এখন যাবো।
– হুম।
রুম থেকে বের হতেই দেখে অনল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই জিজ্ঞেস করে,
– ধারা কেমন আছে?
– বেঁচে আছে। কেনো বলতো?
– এভাবে কেনো বলছিস?
– কিভাবে বলবো অনল?
কড়া গলায় বলে উঠলো অনন্যা। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
– একজনের শাস্তি অন্যজনকে দেয়াটা বোধ হয় তোকে মানায় না অনল। মাহির শাস্তি এই মেয়েটাকে দেওয়াটা কি যৌক্তিক। মাহির শাস্তি কেনো বলছি? মানুষের মন সেটা বদলাতে পারে। হ্যা মাহি অন্যায় করেছে, কিন্তু সেটার রাগ এই মেয়েটার জীবনের বিনিময়ে মেটানো খুব পুরুষত্বের প্রমাণ ছিলো বুঝি! তুই তো এমন ছিলি না অনল। তাহলে কেনো? সত্যি বলি, মেয়েটার শরীরের যা পজিশন ছিলো একটু উচুনিচু হলে তোকে আমি জেলে দিতাম। মেয়েটাকে ছয় মাস ধরে দেখে যাচ্ছি, তোকে বিভিন্নভাবে নিজের ভালোবাসার স্বরুপ দেখানোর প্রচেষ্টা ছিলো সে। তুই কিভাবে তার ভালোবাসাটাকে এভাবে পায়ে পিসিয়ে দিলি অনল। ছি!
মাথা নিচু করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে অনল। কথাগুলো তিক্ত হলেও সত্য। মেয়েটি বিভিন্নভাবে নিজের ভালোবাসা তার সামনে প্রকাশ করে এসেছে এই ছয়মাস; সেটা রাত জেগে তার বাসায় আসার অপেক্ষা হোক কিংবা সকালে ঘুম ভাংগার আগে চা নিয়ে হাজির হওয়া। প্রতিদিন তার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখা হোক কিংবা তার পছন্দের খাবার রান্না করার চেষ্টায় নিজের হাত পুরানো হোক। সবকিছু ঠিক থাকলেও মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা তো দূরে থাক ভালোলাগাটুকুও জন্মায় নি অনলের মনে। আড়াই বছর আগের ঘা যে এখনো শুকায় নি তার। অনন্যা বেশ কিছু কথা শুনিয়ে হাটা দিলো তার গন্তব্যে। অনলের মন চাচ্ছে একবার ধারার মুখটা দেখতে। কিন্তু সুভাসিনী বেগম ঠায় বসা তার কাছে। সব চিন্তা বাদ দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সে। সুভাসিনী বেগম ধারার মাথার কাছে বসে রইলো। মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে গেছে, উজ্জ্বল মুখটা মলিনতায় ঘিরে আছে। মায়াবী মুখটা মুর্ছা গেছে এক রাতেই। অনল যখন ধারার কাছে আগাতে যায় তখন ……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
৩য় পর্ব
অনল যখন ধারার কাছে আগাতে গেলো তখন সুভাসিনী বেগম কড়া গলায় বলে উঠেন,
– মেয়েটাকে আধ মরা বানিয়ে শান্তি হচ্ছে না, নাকি পুরোপুরি শেষ করবার আসায় আছিস?
– মা, তুমিও আমাকেই দোষীর ঘরে দাঁড় করাবে?
– না দোষী তো আমি, কাল আমি যদি এই বুদ্ধি না দিতাম তবে ও কোনোদিন তোর ধারে কাছে ঘেষতো না। প্রথমে ওকে আমার কাছে রাখার লোভে তোর সাথে বিয়ে দিয়েছইলাম। ভেবেছি মেয়েটা সুখী হবে, সাথে তোমাকেও সুখী রাখবে। তোমার জীবনের ফাঁকা জায়গা গুলো ভরাট করবে। কিন্তু ছয় মাস ধরে শুধু বঞ্চনা পেয়েছে। স্বামী হিসেবে কি দিয়েছিস ওকে? একটাবার ওকে কি সুযোগ দিয়েছো। না দেও নি অনল। আড়াই বছর আগের ঘটনা তোকে বদলে দিয়েছে জানতাম। তাই বলে এতোটা? যাক গে, আমি তোমার দোষ গুন বিচার করবো না। আমি আমার মেয়েটার ভালোটাই দেখবো। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হতে পারে সেটা ধারার মনের জন্য মারাত্নক কঠোর সিদ্ধান্ত। তবে আমি ধারাকে আর তোমার কাছে রাখবো না। ও আমার রুমে আমার সাথে থাকবে আমার মেয়ে হিসেবে। তুমি তো ডিভোর্স চাচ্ছো বেশ তাই হবে, আমি তোমাদের ডিভোর্স এর জন্য এপ্লিকেশন দিবো। কিন্তু ওকে গ্রামে পাঠাবো না, এখানে আমার কাছে থেকে পড়াশুনা করবে। সেলিমের কাছে গেলে গ্রামের নানা মানুষ নানা কথা বলবে আমি সেটা চাই না। এতে অন্তত তোমার আপত্তি থাকবে না বলো।
– …………………
– কি হলো? মখে মুখে কি তালা দিয়েছো?
– যদি আমার বউ হিসেবেই রাখতে চাও তাকে তবে ডিভোর্সের কি দরকার আছে? আমি নাহয় অফিস থেকে বলে দেশের বাহিরে যাবার চেষ্টাটা আবার শুরু করি?
– না ডিভোর্স তো করাবোই আমি। তোমার তো মুক্তি চাই, আমি মুক্তি দিবো তোমায়। আর আমার মেয়েটাকে পুনরায় তার জীবন গড়ার সুযোগ দিতে হবে। সেটা তো আমি তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারি না।
– তুমি যা ভালো বুঝো¬
এক মূহুর্ত দেরি না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অনল, কেনো জানে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটা হবার কথা ছিলো না, ধারাকে তো তার মোটেই ভালো লাগে না। তাহলে কেনো বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যথা তাকে ঘিরে ধরছে। মার সিদ্ধান্তের সাথে সে একমত, তবে কেনো ধারা চলে যাবার কথা ভাবতেই কেনো দম বন্ধ লাগছে। তবে কি ধারার প্রতি করা অন্যায়ের অনুতাপ অনলের মনে তার জন্য মায়ার সৃষ্টি করেছে। হাহা, কি হাস্যকর কথা। মানুষ তো পাগল বলবে, সে মেয়েকে বারংবার পায়ে ঠেলে চোখে আংগুল দেখিয়ে বুঝাতে চেয়েছিলো আমার জীবনে তোমার ঠায় নাই সেই মেয়ের প্রতি আজ কিনা তার মায়া জন্মেছে। অনলের সব কিছু অসহ্য লাগছে, আচ্ছা মরে গেলে হয়তো এসবের থেকে মুক্তি পাওয়াটা সোজা হতো। কিন্তু সেটাও পারছে না, আত্নহত্যা তো সলুশন না। আরেকটা অবশ্য সলুশন আছে তা হলো নেশায় বুধ থেকে বর্তমান আর অতীতের যন্ত্রনাকে ভুলে থাকা। অনল সেটাই করলো, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ক্লাবে চলে গেলো। সেরাতে আর বেড়ি ফিরলো না।।
১৫দিন পর,
বিকেল ৫টা,
আকাশে মেঘ করেছে, বাদলের ঘনঘটায় জানান দিচ্ছে খুব বৃষ্টি নামবে। ছাদের কিনারায় আঁচল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। আচঁল টা মাটিতে গড়াচ্ছে। শরীরটা সুস্থ হয়েছে বেশ কদিন হলো। অনলের দেখা এই দিন পনেরো মিললো না, মিলবে কিভাবে? অনল তার সামনেই আসে না। সে ফুপুর কাছে থাকে। এতো হেয় হবার পর ও মনটা বারবার ইচ্ছে করে বেহায়ার মতো ছুটে তার কাছে চলে যাই। কিন্তু ফের মনে হয় খামোখা তাকে বিরক্ত করা। ফুপু ফরমান জারি করেছেন, অনলের ধারেকাছে যাতে তাকে না দেখা যায়। তাদের ডিভোর্সের এপ্লাই করা যাচ্ছে না, ধারার বয়স অত্যন্ত কম, কেবল উনিশ। আর বিয়েতে ছয় মাস কেবল হওয়ার জন্য ডিভোর্সের এপ্লিকেশোন করলেও পুনরায় কিছুদিন সাতে থাকার ফরমান জারি করা করে। তাই সুভাসিনী বেগম বলেছেন, ধারার বয়স বাইশ বছর হলে পুনরায় উনি এই ডিভোর্সের চেষ্টা করবে। কথাটা শুনার পর থেকেই ধারার মনটা ভালো নেই। বারবার কান্না পায়, কিন্তু ফুপুর সামনে কাঁদতেও পারে না। রাতে অবশ্য এক দুইবার অনলের ঘরের সামনে ঘুরাফিরা করে তারপর আবার ফিরে আসে দরজা বন্ধ দেখে। এসব ভেবে খোলা আকাশের দিকে এক চিত্তে তাকিয়ে রয়েছিলো সে, বারবার মনে প্রশ্নরা উঁকিঝুকি দেয় অনল কেনো তাকে ভালোবাসে না। সে যে এতো অসুস্থ ছিলো কেনো অনল একবার খোঁজটিও নেই নি। কিশোরী মনের এলোমেলো চিন্তাধারার মাঝে নিজেকে জরিয়ে ফেলেছে সে। হুট করে ঝুম বৃষ্টি নামলো, ঠান্ডা বর্ষার স্রোতে ধারার চোখের অশ্রুধারারা মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। দু হাত পেতে বৃষ্টিকে বদ্ধনয়নে আলিঙ্গনে যখন ব্যস্ত, কেউ যেন তখন ধারার মাথায় একটি ছাতা ধরে। মুখে পানি না পড়ায় কৌতুহলে পেছন ফেরে তাকায় ধারা, ছাতা হাতে তো সাদা শার্ট, কালো জিন্স, চোখে চশমা পড়া একজন পুরুষ; যে কিনা তার স্বামী। এই পনেরো দিনে কি চেহারা বানিয়েছেন, মুখে খোচা খোচা দাঁড়ি, চোখ গর্তে যেনো বহুকাল শান্তির ঘুম হয় নি, আজ চোখে কোনো হিংস্রতা নেই আছে এক সাগর মায়া। ইশ লোকটা কি জানে না, তার এই চেহারাটা দেখলেই ধারার যে খুব বেশি ভালোবাসতে মন চায় তাকে। এমনে ভালোবাসার চরম শিখরে রয়েছে সে।।
– জ্বর থেকে উঠেছিস এক সপ্তাহ ও হয় নি আবার কেনো বৃষ্টিতে ভিজছিস?
-………………
– কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? এভাবে কি দেখছিস?
– তোমাকে
ধারার কথায় খানিকটা চমকে গিয়েছিলো অনল। তারপর নিজেকে সামলে উত্তর দিলো,
– যা, নিচে যা। ভেজা কাপড় বদলে নে, আবার অসুস্থ হবার ধান্দায় আছিস নাকি।
বলে ছাতিটা ধারার হাতে ধরিয়ে চলে যাচ্ছিলো সে। তখন ই ধারা বলে উঠে,
– তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারো না কেনো?
ধারার সরল মনের প্রশ্নটি অনলের পা আটকে ধরে। পেছনে ফিরে দেখে মলিন চিত্তে সেভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এখনো সে। আজ তার চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা টুকু হারিয়ে ফেলেছে অনল। মাথা নিচু করে পুনরায় চলে যেতে নিলে হাত টেনে ধরে ধারা। ধরা গলায় বলে উঠে,
– উত্তর দিলে না যে
– মা, দেখলে বকাবকি করবে? নিচে যা
-এড়িয়ে যাচ্ছো?
– একটা পশুর কাছ থেকে ভালোবাসা চাইছিস? পশুরা যে ভালোবাসতে পারে না। শুধু ক্ষত বিক্ষত করতে পারে।
– উহু তাই যদি হবে, তবে রাতের বেলা আমার বালিশের নিচে চকলেট পাই কেনো?
– অনুতাপ, ক্ষমা পাবার চেষ্টা।
– তাহলে আপন করে নিতে কি বাধছে তোমাকে? কেনো ফুপির কথায় আমাকে ছেড়ে দিতে রাজী হয়েছো?
– তুই বড্ড ছোট, এসব বুঝবি না। আমার কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করলে কেবল কষ্ট টুকু বয়ে বেড়াতে হবে তোকে। একসময় সেই কষ্ট টুকু সহ্যসীমার বাহিরে চলে যাবে। ভালোবাসা একটা নেশা, যার অপরনাম মৃত্যু। আমি যে ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসার জন্য মনের দরজা যে তালা লেগে গেছে। তাই এই দাবিটা আমাকে করিস না। আর এখন তোর বয়স ই বা কি! আমি চলে গেলে দেখবি কিছুদিনেই সব ভুলে যাবি!
– কোথায় যাবে তুমি?
– সিলেট, তারপর হয়তো দেশের বাহিরে।
– কেনো?
– তোকে যে মুক্তি দেয়াটা খুব দরকার। এভাবে কাগজের সম্পর্কটা টেনে কতদিন?
– আমাকে একটা সুযোগ দেয়া যায় না?
– আমি সুযোগ পাবার যোগ্য নই রে। ভালোবাসা আমার জন্য নয়।
– কিন্তু কেনো? আমার দোষটা কোথায়?
– দোষ তোর নয়, দোষ যে আমার। আমি ফুল ভেবে যাকে আমার সর্বস্ব দিয়েছিলাম, সে কাটা রুপে আমাকে রক্তাক্ত করেছে। আমিও তোর মত একজনকে ভালোবাসতে গিয়েছিলাম। আমি যেমন তোর ভালোবাসাটাকে পায়ে পিসিয়ে ফেলেছি সেও সেভাবেই আমার ভালোবাসার বিনিময়ে আমাকে একরাশ অবিশ্বাস, প্রতারণা এবং কষ্ট দিয়েছে।
– আমি যদি জানতে চাই আমাকে বলবে সব কথা?
– তুই আগে ভেজা জামা ছেড়ে আয়। আমার রুমে আছিস, চা খেতে খেতে বলবো।
বলেই ভিজতে ভিজতে বাসার ভেতরে চলে গেলো অনল।
সন্ধ্যা ৭টা,
অনলের বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অনল এবং ধারা। চা হাতে মনোযোগ দিয়ে অনলের কথা শুনছে ধারা। অনল তখন বলতে লাগে আড়াই বছর আগের ঘটনা
আড়াই বছর আগে,
রাত ৯টা,
প্রতিদিনের মতোই অফিস থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মশগুল অনল। মনটা আজ বড্ড বেশি খুশি তার। আজ মাহির জন্মদিন এবং জন্মদিনেই মাহিকে প্রপোজ করবে সে। মাহির সাথে তার সম্পর্ক তিন বছর হতে চললো। মেয়েটিকে পাগলের মতো ভালোবাসে সে। যদি মাহি বলে চাঁদ এনে দিতে তবে সে তাই আনতে পারবে। মাহির পছন্দ হবে এমন একটি রিং কিনেছে সে। বন্ধুদের সাথে পুরো প্লান অনুযায়ী কাজ করা কমপ্লিট। এখন মাহির আসাটাই শুধু বাকি। সময় ঘনিয়ে যাচ্ছে অথচ এখনো সে আসছে না। এই সারপ্রাইজের জন্য সকাল থেকে উইশ ও করে নি। আর তর না সইলে মাহিকে ফোন করে সে। তার তো জানা ছিলো না তার জন্য আরো বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো। ফোন রিসিভ হতেই…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
৪র্থ পর্ব
তার তো জানা ছিলো না তার জন্য আরো বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো। ফোন রিসিভ হতেই মাহি বলে উঠে,
– কেনো ফোন করেছো আমায়?
– কেনো ফোন করেছি মানে? তুমি আসবে না? সবাই অপেক্ষা করছে যে তোমার জন্য।
– সরি অনল আমি আসতে পারবো না। আমি ব্যস্ত আছি।
– ব্যস্ত আছি মানে? আজ তো আসার কথা ছিলো না তোমার?
– ব্যস্ত আছি মানে ব্যস্ত আছি। নেক্সট উইক আমি ইউ.এস.এ যাচ্ছি। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। তাই তোমার ফাও বন্ধুদের আড্ডায় আমি আমি আসতে পারবো না।
– তুমি নেক্সট উইক যাচ্ছো মানে? এটা কবে ডিসাইড হলো?
– সে অনেক কথা, ফোনে বলতে পারবো না। কাল বিকেলে মিট করো সব বলবো।
– …………
– হ্যালো? হ্যালো?
– হ্যাপি বার্থডে। রাখছি।
– অনল আমার কথাটা একবার বুঝতে চেষ্টা করো।
অনল ফোন রেখে দিলো, বন্ধুদের ভুজরুকি বুঝিয়ে সেদিন খালি হাতেই বাড়ি ফিরে গেলো। সারারাত অশান্তিতে কেটেছে, হুট করে কারোর অ্যামেরিকা যাবার প্লান তো রাতারাতি হয় না। তাহলে এক সপ্তাহ পর মাহি চলে যাবে এটা আজ কেনো বললো সে? আগে বলে নি কেনো? বিভিন্ন প্রশ্ন অনলের মাথায় ঘুরপার খাচ্ছে। এখন শুধু কালকের অপেক্ষা। হয়তো কাল সে জানতে পারবে মুল বিষয়টা কি!
সকাল ১১টা,
মুখোমুখি বসে রয়েছে মাহি এবং অনল। কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে মাহিকে জিজ্ঞেস করলো অনল,
– প্লানটা কবে করেছিলে?
– অনেক আগেই করেছি, তোমাকে বলার সুযোগ হয় নি
– সুযোগ হয় নি নাকি বলতে চাও নি
– তুমি জানো আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে কতোটা ডিটারমাইন্ড; তুমি কিভাবে রিয়েক্ট করবে আমার জানা ছিলো না। তাই আমি বলি নি।
– আমি কি কখনো তোমাকে কোনোকিছুতে বাধা দিয়েছি? দেই নি তো। আজ ও দিবো না। কবে ফিরার কথা ভাবছো?
– আমি শিওর না; হয়তো নাও ফিরতে পারি। ওখানে যদি জব পেয়ে স্যাটেল হয়ে যাই নাও ফিরতে পারি
– বুঝলাম, আফটার অল তোমার ভবিষ্যতের ব্যপার। তা আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যতের কি হবে?
– দেখো লং ডিস্টেন্স রিলেশন তো এখন খুব কমন। আমরা না হয় সেটাই মেইনটেইন করবো।
– কতো দিন? কতো মাস? কতো বছর?
– দেখো অনল
– হুম, সব দেখছি। বলো
– এখন আমার ক্যারিয়ার আমার কাছে সব থেকে ইমপোর্টেন্ট।
– ঠিক ই তো একটা তিন বছরের সম্পর্কের জন্য তুমি কি তোমার জীবনের এতো বড় সুযোগ হারাবে নাকি? সমস্যা নাই; আমি অপেক্ষায় থাকবো। যদি আমার কাছে ফেরার ইচ্ছে তোমার হয় আমার মনের দরজা সবসময় খোলা থাকবে।
– অনল
– আজ উঠছি।
বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে যায় অনল। এক সপ্তাহের মধ্যে মাহি অ্যামেরিকা চলে যায়। নিজেকে ভালো রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে থাকে অনল। ধীরে ধীরে সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলে, চুপচাপ নিজেকে একটা গন্ডিতে আটকিয়ে ফেলে। মাহি প্রথম প্রথম যোগাযোগ করলেও ধীরে ধীরে তা বন্ধ করে দেয়। অনলের অবস্থা আরো ও খারাপ হয় যখন জানতে পারে বিদেশে মাহি অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে ফেলেছে। এই সংবাদটি ভেতর ভেতর অনলকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। তখন যেনো এক প্রকার ডিপ্রেশনে চলে যায় অনল। মাহিকে সে প্রচুর ভালোবাসতো; এতোটা যে সে যদি বলে দিন তাহলে অনলের কাছে দিন, সে যদি বলে তো রাত। কয়েকবার সুইসাইড এটেম্প ও করে। ছেলের এমন অবস্থা যেনো একেবারেই মেনে নিতে পারছিলেন না সুভাসিনী বেগম। ছেলের এমন অবস্থা দেখে ধীরে ধীরে তিনিও অসুস্থ হতে থাকেন। সুভাসিনী বেগম যখন হসপিটালে ভর্তি ছিলেন তখন অনন্যা অনলকে বুঝায়। অনলকে সে তখন একটা কথাই বলে,
– যে তোর কথা চিন্তা না করে অন্যকাউকে বিয়ে করে ফেলেছে; তার জন্য কেনো নিজে কষ্ট পাচ্ছিস সাথে নিজের মাকেও কষ্ট দিচ্ছিস। আন্টির এই অবস্থার জন্য অনেকটাই তুই দায়ী।
– ……………
– এমন চলতে থাকলে সত্যি একা হয়ে যাবি অনল। মা আছেন তাকে হারাস না।
তারপর থেকে নিজেকে কোনো মতে সামলায় অনল। সুভাসিনী বেগমের জন্য আবার স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচার কথা ভাবে। তবে তখন থেকেই রাগ, জিদ যেনো শতগুনে বেড়ে যায় অনলের। নিজেকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারে না। ছেলের জীবনটা পুনোরায় সাজাতেই ছয় মাস আগে ধারার সাথে অনলের বিয়ে দেন সুভাসিনী বেগম।
বর্তমান,
অনলের দৃষ্টি বাহিরের দিকে, নিজের জীবনের কালো অধ্যায়টি ধারাকে বলতে পেরে যেনো আজ অন্যরকম শান্তি লাগছে। মনের ভেতরের সকল কষ্টগুলোকে কাউকে বলার সুযোগ তো হয়েছে। ধারার চোখে অশ্রু, কিন্তু অশ্রু গুলো কেনো সে জানে না; অশ্রু কি এজন্য যে অনল অন্য কাউকে ভালোবাসতো নাকি অনলের কষ্ট গুলো আজ সে উপলব্ধি করতে পারছে সে কারণে। বাহিরের দিকে তাকিয়েই অনল বললো,
– তুই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি না কেনো তোকে ভালোবাসতে পারি না, আমার যে কারোর প্রতিই ভালোবাসাটা আসে না। আমি জানি না আর কাউকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবো নাকি।
-…………
– জানিস এমন এক বৃষ্টির রাতে ও আমাকে দেখতে চেয়েছিলো বলে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওর বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পরে কি জ্বর এসেছিলো। হাহা
– উনি জানেন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?
– জানি না, হয়তো।
– এখনো ভালোবাসো তাকে?
– নাহ, একটা সময় ঘৃণা করতাম ওকে। এখন ঘৃণাটাও আসে না। তবে ভালোবাসা নামক জিনিসটার প্রতি বিতৃষ্ণা এসে পড়েছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব ছাড়খার করে দেয়। তাই বলছি ভালোবাসতে যাস না; আমার মতো তোকেও পুড়িয়ে দিবে।
অনলের কথায় মুচকি হেসে ধারা মনে মনে বলে,
– বড্ড দেরি করে ফেললে তুমি, আমি যে ইতিমধ্যে তোমায় ভালোবাসার আগুনে জ্বলছি, পুড়ছি। জানি সেটার পরিনতি কি!
সুভাসিনী বেগমের ডাকে ধারা বাস্তবে আসে। অনলকে কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। অপর দিকে সুভাসিনী বেগম ধারাকে অনলের রুম থেকে বের হতে দেখে বেশ অবাক হন। ভেবেছিলেন সে রাতের পর থেকে মেয়েটা অনলকে ভয় পাবে, তার ধারে কাছে যাবে না। কিন্তু ধারার আচরণের স্বাভাবিকতা দেখে তিনিও অবাক। সেদিন আর ধারাকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না তিনি।
সকাল ৯টা,
ডাইনিং টেবিলে অনল নাস্তা করতে আসলে, সুভাসিনী বেগম তাকে ধীর এবং শক্ত কন্ঠে বলেন,
– তুমি কি বাহিরে যাবার সিদ্ধান্ত পাকাপুক্ত ভাবে নিয়ে নিয়েছো?
– হুম, কাজ চলছে। আমি চেষ্টা করছি; এই সপ্তাহের ভেতর আমাকে জার্মানি পাঠানো হবে।
– যত তাড়াতাড়ি হবে ততোই ভালো। ধারা তোমার প্রতি এমনিতেই দূর্বল হয়ে পড়েছে। আমি চাই না আরো দূর্বল হোক। ছোট বয়স, কিছুদিন পর এমনেই তোমাকে ভুলে যাবে।
– বুঝেছি।
বলেই অনল সেখান থেকে চলে যায়। সুভাসিনী বেগম যা বলেছে তা যে সম্পূর্ণ সঠিক তা খুব ভালো করেই জানে সে। তবুও মেয়েটাকে এভাবে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। কোথাও যেনো ফাকা লাগছে। অনল এবং সুভাসিনী বেগমের কথোপকথন আড়াল থেকে সবটুকু শুনে ধারা। সুভাসিনী বেগমের মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। তাই চুপচাপ নিজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস টুকু মেনে নেয় সে। দিন সাতেক পর অনল জার্মানি চলে যায়। যেদিন অনল চলে গিয়েছিলো ধারা পাগলের মতো আচারণ করা শুরু করেছিলো। অনলের রুমে যেয়ে প্রচুর কেঁদেছে, শেষমেশ অনলের ছেড়ে যাওয়া চিঠিটুকু পায় সে। চিঠিতে লেখা ছিলো,
“ ভেবেছিলাম অনেক কিছু লিখবো। কিন্তু সব কিছু একত্রে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে; তালগোল পাকিয়ে গেছে আমার ভাবনাগুলো। আমি চলে যাচ্ছি, জানি না আর দেখা হবে কিনা। কিন্তু তোকে একটা কথা কোনোদিন বলা হয় নি, তুই অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমি চাই তুই অনেক সুখী হো। আমার ভাঙ্গা জীবনে জরিয়ে হয়তো তুই কোনোদিন সুখী হতে পারতি না। কারণ আমার পক্ষে তোকে ভালোবাসাটা সম্ভব নয়। মা তোর ভালোর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতেই আমাদের মঙ্গল। তোর জন্য আমি ডিভোর্স লেটার সাইন করে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কাগজের সম্পর্কটা কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকলো। মাকে বলিস আমি এখানে সব ফরমালিটি শেষ করে দিয়েছি। আর তোকে বাইশ বছর অবধি এই সম্পর্কের ভেতর থাকতে হবে না। ভালো থাকিস।
ইতি,
অনল “
ধারার কিশোর মনে অনলের চলে যাওয়াটা যত না আঘাত হেনেছিলো তার চেয়ে অধিক আঘাত হেনেছিলো যখন অনলের রেখে যাওয়া ডিভোর্স লেটারটা দেখে। ভেবেছিলো অনল হয়তো তার কাছে কোনো না কোনোদিন ফিরবে। কিন্তু সে আশাটুকুও এখন নেই। সেদিন ধারা কিশোরী মনটা একেবারে বড় হয়ে গিয়েছিলো এক ধাক্কায়।
পাঁচ বছর পর,
এয়ারপোর্টে নেমেই হাসপাতালের দিকে রওনা দিলো অনল। আজ পাঁচ বছর বছর পর সে জার্মানি থেকে ফিরেছে। অবশ্য অনেক আগেই ফিরে আসতো তবে বিভিন্ন কারণে সেটা হয়ে উঠেনি। আজ যেমন পাঁচ বছর পর নিজের মাকে দেখবে ঠিক তেমনি পাঁচ বছর পর ধারাকেও দেখবে। আচ্ছা পুচকে মেয়েটা কি বড় হয়ে গেছে? এখনো আগের মতো ছেলেমানুষী করে? নাক্লি বদলে গেছে? এসব নানা চিন্তা মাথা নিয়ে হাসপাতালে পৌছায় অনল। কেবিনের বাহিরে মামা দাঁড়িয়ে আছেন। গিয়ে সেলিম সাহেবকে সালাম দিয়ে বলে,
– মামা, মা কেমন আছে?
– এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে বাবা। তুমি কি এয়ারপোর্ট থেকেই আসলা?
– জ্বী মামা। মাকে এখন দেখা যাবে?
– হু, যাও দেখা করে আসো।
কেবিনের ভেতর সুভাসিনী বেগম শায়িত ছিলেন। ছেলের পাঁচ বছর দেখে খুশীতে উঠে বসার চেষ্টা করেন তিনি। অনলের চোখ চিকচিক করছে, শান্ত ভাবে মার পাশে বসে সে। পাঁচ বছর পর মা ছেলের মিলনের সাক্ষী দিচ্ছে তাদের অশ্রুগুলো।
– এভাবে কাঁদলে যা একটু ভালো হয়েছিলে আবার অসুস্থ হয়ে যাবে কিন্তু!
পেছন থেকে নারী কন্ঠটি শুনে অনলের ভেতরে এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যায়। অবাক নয়নে পেছন ফিরতেই……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
৫ম পর্ব
– এভাবে কাঁদলে যা একটু ভালো হয়েছিলে আবার অসুস্থ হয়ে যাবে কিন্তু!
পেছন থেকে নারী কন্ঠটি শুনে অনলের ভেতরে এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যায়। অবাক নয়নে পেছন ফিরতেই দেখলো তার সামনে কালো শাড়ি পরিহিতা এক নারী। যার ঢেউ খেলানো মাজা অবধি চুলগুলো বেনুনী করে কাধের এক পাশে ফেলে রেখেছে। হরিণ টানা চোখ গুলো চশমার আড়ালে তার। গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় পাতলা ঠোঁটগুলি যে কোনো পুরুষকেই আকর্ষণ করবে। সামনে দাঁড়ানো নারীটি সেই নারী যার কিশোরী মনটাকে একদিন নিজ হাতে গলাটিপে মেরে ফেলেছিলো অনল। যে উনিশ বছরের কিশোরীর চোখে তার জন্য একসাগর ভালোবাসা দেখতে পেতো; আজ সে নারীর চোখে এক অন্যরকম আকর্ষণ রয়েছে যা অনলকে তলিয়ে দিতে সক্ষম। তার সামনে উনিশ বছরের ধারা নয়; প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে যার মাঝে এক অজানা রহস্য রয়েছে, এক অজানা গভীরতা। অনলের চোখের পলক পড়ছে না, এক দৃষ্টিতে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ধারাকে দেখে সুভাসিনী বেগম গদগদ গলায় বলে উঠেন,
– দেখেছিস বলেছিলাম না আমার ছেলে ঠিক চলে আসবে, তুই তো বিশ্বাস করিস নি।
– হুম হুম বুঝলাম, ঘাট হয়েছে আমার। এবার তো ছেলে এসে পড়েছে এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হও তো বাপু। আর মেন্টাল স্ট্রেস নিতে পারছি না আমি। তুমি সুস্থ হলে আমি একটু ঝাড়া হাত হয়ে ট্যুর দিবো।
– কোথায় যাবি তুই?
– বলবো না, সিক্রেট। তোমার রিপোর্ট ভালো এসেছে, তবে অনন্যা আপু বলেছে আরো খাওয়া দাওয়া করতে হবে। অনল ভাই, এবার কিন্তু তুমি ফুপিকে সামলাবে। আমার কোনো কথা শুনে না সে।
অনল সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধারাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে, মেয়েটা এতো স্বাভাবিক কিভাবে! তার কি কিছুই যায় আসছে না এতো বছর পর অনল ফিরে এসেছে এই ব্যপারটাতে! আর ধারার মুখে ভাই শব্দটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো কাজ করছে। মার সামনে কিছুই বলতে পারছিলো না; তবে ধারার সাথে কথা বলাটা খুবই দরকার। সে কি সত্যি সব কিছু ভুলে গেছে!!
রাত ৯টা,
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে বাসার দিকে রওনা দেয় অনল এবং ধারা। সেলিম সাহেব আগেই চলে গিয়েছেন। এই হাসপাতালে রোগীর সাথে কারোর থাকার পারমিশন নেই। তাই ধারা অনলের সাথেই বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। অনল ও খুব টায়ার্ড, এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই হাসপাতালে গিয়েছিলো। একই ট্যাক্সিতে বাসার দিকে যাচ্ছে তারা; গাড়ি নিজ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ধারার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। এখনো অবধি একবার ও সে অনলের সাথে কথা বলে নি, একবারও জিজ্ঞেস করে নি কেমন আছে অনল। খুব অস্বস্তি লাগছে অনলের। কেনো জানে চাইলেও কথা শুরু করতে পারছে না সে। সত্যি ধারা অনেক বড় হয়ে গেছে। পাশাপাশি বসে রয়েছে দুজন কিন্তু তাদের মনের দূরুত্বটুকু এতো বেশি যে চাইলেও তা কমানো সম্ভব নয়। সারা রাস্তা নিঃশব্দেই তারা বসে থাকে ট্যাক্সিতে, যেনো দুজন অপরিচিত মানুষ।
বাসায় এসে অনলের রুমের দরজাটা খুলে দেয় ধারা। এতোদিন তালাবব্ধ ছিলো রুমটি, সুভাসিনী বেগম অবশ্য প্রতি দু দিন অন্তর অন্তর রুমটি পরিষ্কার করে রাখতেন। এখন তিনি অসুস্থ হওয়ায় ধারাই সে কাজটি করে। ধারা যখন চলে যাচ্ছিলো তখন অনল প্রশ্ন করে বসে,
– ভালো আছিস ধারা?
অনলের প্রশ্নটি খুব কঠিন কোনো প্রশ্ন নয় তবুও কেনো জানে পা আটকে গেলো ধারার। চুপ করে দাঁড়িয়েই ছিলো, তখন অনল আবার ও বলে উঠে,
– বেশ বড় হয়ে গেছিস, এখন আর তোকে পুচকে মেয়ে লাগে না। কি অদ্ভুত না? পাঁচ বছর আগে কতো ছোট না ছিলি তুই?
– পাঁচ বছর নয়, পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন। আজ পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন পর তুমি আমাকে দেখছো। বড় তো হতে হতো। তোমার কিছু লাগলে আমাকে জানিয়ো।
– এড়িয়ে যাচ্ছিস আমাকে?
– না, এড়িয়ে যাবো কেনো?
– তাহলে বললি না যে ভালো আছিস তুই?
– খারাপ তো থাকার কথা নয় আমার। তুমি তো আমাকে ভালো রাখার জন্যই চলে গিয়েছিলে অনল ভাই, আমাকে ফেলে।
শক্ত এবং দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে ধারা। আজ অনলের সামনে এ যেনো অন্য ধারা দাঁড়ানো, যার চোখে শুধুই ক্ষোভের অগ্নি জ্বলজ্বল করছে। ধীর গলায় অনল বলে উঠে,
– আগে তো কখনো ভাই বলতি না।
– আগে সম্পর্কটা অন্য রকম ছিলো, তাই ভাই বলার প্রশ্নই উঠতো না। কিন্তু এখন সম্পর্কটা অন্যরকম, আর তুমি আমার থেকে যথেষ্ট বড় তাই নাম ধরে সম্বোধন করার প্রশ্ন আসছে না। অনেক জার্নি করে এসেছো, আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে ফুপিকে ডিসচার্জ দিবে। সকাল সকাল উঠতে হবে।
– তুই কি ডিভোর্স লেটারটা
– হ্যা, সাবমিট করা হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের কাগজের সম্পর্কটা আর নেই অনল ভাই। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
স্মিত হাসির সাথে কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ধারা। ধারার প্রতিটি কথা অনলের বুকে ছুরির মতো লেগেছে। সত্যি তো এখন আর সে অনলের কাগজের স্ত্রী নেই। তাদের মধ্য এখন আর স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। আর ধারার চোখে তার প্রতি কোনো ভালোবাসার ছিটাফোটাও নেই। এটাই তো চেয়েছিলো অনল। তবে আজ এতোটা কষ্ট লাগছে কেনো। বুকটা এতো ফাঁকা ফাঁকা কেনো লাগছে ঠিক যেমন মাহি চলে যাবার সময় লেগেছিলো। তবে কি সেই উনিশ বছরের কিশোরী মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছে সে! হয়তো অনেক আগেই পড়েছিলো, শুধু অনুভব করতে পারে নি। আজ যখন সেই কিশোরী মেয়েটি তার কিশোরী খোলশটি বদলে চব্বিশ বছরের নারী রুপে তার সামনে হাজির হয়েছে তখন সেই সুপ্ত ভালোবাসার প্রতিটি কণা অনল উপলব্ধি করতে পারছে। বুকের বা পাশের চিনচিন ব্যথাটা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিন্তু এবার সে তার ভালোবাসাকে নিজের থেকে দূরে যেতে দিবে না। পাঁচ বছর আগের সব কয়টি ভুল সে শুধরে নিবে। যত কাঠখোর পুরানো লাগুক সে আবার ধারার মনে নিজের জন্য ভালোবাসার সূচনা করবে, করতে যে হবেই
রাত ২টা,
নিজ ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ধারা। আঁচলটা নিচে গড়াচ্ছে তার, চুলগুলো বেহায়া বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে। আকাশে আজ আবার মেঘ করেছে, তার মনেও আজ পাঁচ বছর পর আজ মেঘ করেছে। লোকটা তার জীবনে আবার ফিরে এসেছে। একটা সময় লোকটাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো সে। কিন্তু সেই ভালোবাসা তাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছে। না জানে কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে। ফুপুর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। দম বন্ধ লাগতো ধারার, মনে হতো এই বুঝি মরে যাবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হতো সে তো ভালোই আছে ধারাকে ছাড়া। তাহলে ধারার এতো কষ্ট পাবার কি মানে! আজ যখন পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন পর সেই মানুষটাকে আবার চোখের সামনে দেখেছিলো, পা যেন আগাতে চাইছিলো না ধারার; কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে হয়তো এই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতো। মানুষটা ঠিক আগের মতোই রয়েছে, সেই চোখ, সেই চেহারা। শুধু আর এখন সে আঠাশ বছরের যুবক নেই, তেত্রিশ বছরের একজন পুরুষ। বয়সটা তার চেহারাতে যে খুব বুঝা যাচ্ছে তা নয়। তবে সময়টা সত্যি অনেক বেশী কেটে গেছে। এখন আর তার প্রতি ভালোবাসাগুলো মুক্ত নয়। মনের বদ্ধ কুঠিরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে ধারা, আর সেই তালার চাবিটা না জানি কোথায় হারিয়ে গেছে; যেমন তার কিশোরী মনটা হারিয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে রওনা হয় সে।
সকাল ৯টা,
সূর্যের প্রখরতা চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো অনলের, চোখ কচলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়লো সে। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমের দিকে আসতেই চোখ আটকে গেলো তার। ডাইনিং টেবিল থেকে রান্নাঘরের ভেতরটা স্পষ্ট। রান্নাঘরে তখন শাড়ি কোমড়ে গুজে ধারা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। চুল খোপা করে ঘাড়ের উপরে তোলা, ঘাড় বেয়ে ঘাম ঝড়ছে, অবাদ্ধ চুল গুলো বারংবার তার কপালে পড়ছে এবং সে তা বারংবার কানের নিচে গুজার চেষ্টায় আছে। ধারাকে বেশ গিন্নি গিন্নি লাগছে অনলের কাছে। এক অজানা আকর্ষণে মনের অজান্তেই ধারার পেছনে এসে দাঁড়ায় অনল। ধারার খেয়াল ই নেই কেউ তাকে এতোটা কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করছে। তার ঘাড়ের ঠিক নিচে গাঢ় কালো তিলটি যেন অনলকে পাগলের মতো কাছে টানছে; খুব ছুয়ে দিতে মন চাচ্ছে অনলের। মনের অজান্তেই যখন তার হাত ধারার ঘাড় স্পর্শ করবে ঠিক তখন……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
৬ষ্ঠ পর্ব
এক অজানা আকর্ষণে মনের অজান্তেই ধারার পেছনে এসে দাঁড়ায় অনল। ধারার খেয়াল ই নেই কেউ তাকে এতোটা কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করছে। তার ঘাড়ের ঠিক নিচে গাঢ় কালো তিলটি যেন অনলকে পাগলের মতো কাছে টানছে; খুব ছুয়ে দিতে মন চাচ্ছে অনলের। মনের অজান্তেই যখন তার হাত ধারার ঘাড় স্পর্শ করবে ঠিক তখন পেছন থেকে সেলিম সাহেব অনলকে ডেকে উঠেন,
– অনল, আপাকে কখন নিতে যাবা?
সেলিম সাহেবের হঠাৎ ডেকে উঠার কারণে অনল অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। হাত সরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়,
– এইতো মামা, তোমার মেয়ে খেতে দিলেই একটু পর বের হবো।
অনলের কথা শুনতে পেরে ধারা পেছন ফিরে দেখে, তার ঠিক পেছনে অনল দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে খানিকটা চমকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে অনলকে জিজ্ঞেস করে,
– কিছু লাগবে তোমার?
– উম………পানি, পানি নিতে এসেছিলাম
– পানি টেবিলে রাখা আছে, এখানে তো সরাসরি কলস থেকে খেতে হবে।
– না মানে, জগটা খেয়াল করি নি।
– ঠিক মাঝ বরাবরই তো রাখা ( উকি দিয়ে জগটা খেয়াল করে)
– তোর ইন্টারোগেশন শেষ হলে খেতে দে, ক্ষুধা লেগেছে।
বলেই কোনো রকমে সেখান থেকে কেটে পরে অনল। ধারা আর কথা বাড়ায় নি, কথায় কথা বাড়বে। সেলিম সাহেবের সামনে শুধু শুধু সকালবেলা সিন ক্রিয়েট করার মানে হয় না। খাওয়া দাওয়া শেষে তারা বেরিয়ে পরে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ধারা একেবারে রেডি হয়ে এসেছে, হাসপাতাল থেকে সরাসরি স্কুলে চলে যাবে সে। ধারা এখন একটি স্কুলে ইংলিশ টিচার হিসেবে কার্যরত রয়েছে। বাচ্চাদের পড়াতে বেশ লাগে তার। গ্রাডুয়েশনের পর পর এই চাকুরিটা শুরু করে সে। সুভাসিনী বেগম অসুস্থ থাকায় এতোদিন যেতে পেরে নি, আজ যেহেতু উনি বাসায় চলে আসছেন তাই আবার জয়েন করছে কাজে ধারা।
সকাল ১১টা,
হাসপাতালের কেবিনে গোছগাছ করে নিচ্ছে ধারা, একটু পর সুভাসিনি বেগমকে নিয়ে চলে যাবে বাসায়। আজ সুভাসিনী বেগমের মন খুবই ভালো; এতোদিন পর বাসায় ফিরবেন তিনি। হসপিটালের খাবার, নিয়ম-নীতির মধ্যে বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অনল নার্সের কাছে থেকে আপডেট নিচ্ছিলো তখন ধারার সুভাসিনী বেগমকে বলা কথাটি তার কানে আসে,
– ফুপু, আমি ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছি। বাবা ফরমালিটি গুলো মিটিয়ে আসলে তোমরা বাড়ি চলে যাও। আমি তাহলে আসছি।
– কোথায় যাচ্ছিস তুই?
নার্সের সাথে কথা বলার ফাকেই ধারার কাছে প্রশ্নটি ছুড়ে দেয় অনল। যে মানুষটার বিগত বছর গুলোতে ধারা কি করেছে তাতে মাথা ব্যথা ছিলো না, আজ হুট করেই তার প্রতি এতো কেয়ার দেখে বেশ অবাক হয় ধারা। নিজের কৌতুহল নিজের মধ্যে রেখে খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয়,
– কোথায় আবার, স্কুলে যাবো।
– স্কুলে কি করতে?
– কি অদ্ভুত, পড়তে নিশ্চয়ই যাবো না। আমি কাজ করি সেখানে।
– হ্যা, অনল তোকে বলা হয় নি, আমাদের ধারা একটা ভালো স্কুলে শিক্ষকতা করে। খুব ভালো পড়ায় ও। (সুভাসিনী বেগম)
– ওহ, তাহলে ওয়েট কর আমি মাকে বাসায় রেখে তোকে ড্রপ করে আসবোনে।
– তার কোনো দরকার নেই, আমি একা একা যাওয়া আসা করতে পারি। ডোন্ট ওয়ারি
– আসবি কখন?
– ছুটি হলে, সাধারণত ৬টা বেজে যায়।
– এড্রেস ম্যাজেস করে দিস, আমি নিতে যাবো নে।
– আরে আজিব তো, আমি একা একা যাতায়াত করতে পারি। বাচ্চা মেয়ে না আমি। এতোদিন একা একা ই আসা যাওয়া করেছি।
– এতো বেশি বকিস কেনো? যা বলছি তাই করবে। আমি যাবো ব্যাস যাবো। ছুটি হলে ম্যাজেস করে দিবি।
রাগে কটমট করতে করতে কথা গুলো অনল বললো। আসার পর থেকে সবকিছুতে মেয়েটা এতো বাড়াবাড়ি করছে যা তার ভালো লাগছে না। এক রত্তি মেয়ের এত তেজ দেখে খুব রাগ লাগছে অনলের। এদিকে অনলের অভারকেয়ারিং ন্যাচার যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ধারার। বিয়ের পর থকে অনলের এক রকম গা ছাড়া স্বভাব ছিলো ধারার প্রতি কিন্তু হুট করেই ধারার প্রতি কেয়ার গুলো যেনো একেবারেই নিতে পারছে না ধারা। ফুপুর সামনে কথা না বাড়ানো শ্রেয় মনে হয়েছে তার। হুম বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো সে সেখান থেকে। ধারা যাওয়ার পর সুভাসিনি বেগম অনলের হাত টেনে ধরে, বসার ইশারা করে তার পাশে। অনল বসলে কোমল স্বরে বলে,
– মেয়েটা অনেক বদলে গেছে রে। সেই ছোট ধারা আর নেই। জেদ বেড়ে গেছে চার-পাঁচ গুন। গতবার কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তোদের জীবনের এতোগুলো বছর আমি নষ্ট করে দিয়েছি। ক্ষমা করতে পেরেছিস তো বাবা।
– কি বলছো মা, দোষ তো তোমার ছিলো না। আমার ছিলো। মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে বাস্তব জ্ঞানটাও হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে এবার আর সেই ভুল করছি না মা। তাতে যদি আমার কাটখড় পুড়াতে হয় আমি রাজী। এবার আর তোমার বউ মাকে কোনো কষ্ট পেতে দিব না আমি।
– সব কি আমাদের ইচ্ছেমত হয় অনল? একতা সময় ধারা তোকে পাওয়ার জন্য পাগল ছিলো, সর্বস্ব দিয়ে তোকে ভালোবাসতো কিন্তু এখন! এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে বাবা। আর সবথেকে বড় কথা তোদের ডিভোর্স লেটারটা কোর্টে সাবমিট হয়ে গেছে। হ্যা, তুই দেশে না থাকার কারণে জাজমেন্ট এখনো পেন্ডিং আছে। তাতে কি খুব কিছু যায় আসবে?
– জাজ জাজমেন্ট দেয় নি?
অবাক নয়নে প্রশ্নটি করে অনল। তখন সুভাসিনী বেগম উত্তর দেন,
– না তুই তো জার্মানি ছিলি। কোর্টের হাজিরা না দিলে তো এটার আইনত কোনো ফলাফল কোর্ট দিতে পারবে না। এক প্রকার জেদের বসেই আমি ডিভোর্স লেটারটা সাবমিট করেছিলাম। তারপর কেনো যেনো খুব খারাপ লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো এটা ভুল। তোরা স্বামী স্ত্রী, সম্পর্ক গড়তে বছর লেগে যায়। কিন্তু একটা কালির খোঁচায় মূহুর্তে সেটা ভেঙ্গে যেতে পারে। এজন্য এই পাঁচ বছরে ৭ বার তোদের হাজিরার ডেট পড়েছিলো। আমি তোকে জানাই নি। এটা ভেবে যে ভেঙ্গে ফেললে তো ভেঙেই যাবে। তখন লাখ চাইলেও জোড়া লাগানো যাবে না। আর তোরা অলরেডি আলাদা ছিলি। তাতেই মেয়েটা এতোটা কষ্ট ভোগ করছিলো। আর যদি একবার ডিভোর্সটা হয়ে যায় তাহলে সেটার মাশুল ওই মেয়েটা সারাজীবন দিবে। আমি চাইছিলাম তুই ওর গুরুত্বটা বুঝিস। তাই তোর থেকে ওকে আলাদা করেছি। আমার ইচ্ছে কোনোদিন তোদের সারাজীবনের জন্য আলাদা করার ছিলো না, তাই তো নানা ইস্যু দেখিয়ে ডিভোর্সটা পিছাচ্ছিলাম। কিন্তু তুই ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিয়ে চলে গেলি। তাই জেদের বসে আমিও সাবমিট করে দিয়েছিলাম।
– তাহলে আর কোনো ইস্যুই নেই মা।
– উহু, সবচেয়ে বড় ইস্যু ধারা। ওর মধ্যে আমি যে পরিবর্তনটা দেখেছি সেটাই সবচেয়ে বড় ইস্যু। তোর প্রতি ওর অভিমানগুলো কিন্তু অনেক গভীর, ওর ঘাগুলো কিন্তু অনেক তাজা। তোর অন্যায়গুলো ও কি আদৌ ক্ষমা করতে পারবে? এতো বছরের জমানো কষ্টগুলো যেগুলো না জানে কত রাতের সমষ্টি সেগুলোর ভার কি তুই নিতে পারবি? পারবি ওর মনে নিজের জায়গা করে নিতে? কারণ সেটা না হলে কিন্তু ও চাইলেই আবার এপ্লিকেশন করে কোর্টে তোদের ফাইলটা তুলতে পারে। তখন তুই হাজিরা দিতে বাধ্য হবি। আর তখন কিন্তু আমাদের হাতে কিচ্ছু থাকবে না।
– মা, আমার যে পারতেই হবে। তোমার ছেলেটা যে আবার ভালোবাসতে শিখেছে। তার তালাবদ্ধ অনুভূতিগুলো যে ডানা মিলতে চাচ্ছে। আমার মনের বদ্ধ কুঠিরে ধীর পায়ে এসে মেয়েটা এতো জোরে আলোরণ সৃষ্টি করেছে যে এখন আমি আমার মনের বদ্ধ কুঠির খুলতে বাদ্ধ হয়েছি। এবার যদি ওকে হারিয়ে ফেলি বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলবো।
অনলের গলা ধরে এসেছে। সুভাসিনী বেগম কাঁদছেন, এটা যে খুশির কান্না। অবশেষে তার পাগল ছেলেটার একটা গতি হয়েছে। এবার হয়তো ধারার এতো বছরের কষ্টের অবসান হবে।
বিকাল ৫.৩০টা,
ধারার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনল। উদ্দেশ্য ধারাকে আজ একাকিত্ব সময় কাটাবে সে। বিয়ের পর থেকে কোনোদিন ধারাকে নিয়ে এক মূহুর্তের জন্য ও ঘুরতে যাওয়া হয় নি তার। আজ সেই সবগুলো কাজ করবে যা আগে কখনোই করে নি সে। কিন্তু যার জন্য এতো প্লান তার ই খবর নেই। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনল। হঠাৎ খেয়াল করলো মেইন গেট থেকে ধারা বের হচ্ছে। কিন্তু পর মূহুর্তে এমন কিছু দেখলো যা দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না অনল। ধারা ……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
৭ম পর্ব
কিন্তু পরমূহুর্তে এমন কিছু দেখলো যা দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না অনল। ধারা তখন একটি ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিলো। ছেলেটি ধারার সমবয়সী হবে, পচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। শ্যাম বর্ণের ছেলেটি ধারার সাথে দিব্যি হেসে হেসে কথা বলছে। ধারা এতো হাসছে মনে হচ্ছে বিশ্বের সবথেকে বড় কমিডিয়ান তার সামনে দাঁড়ানো। মেজাজটা মূহুর্তে চটে গেলো অনলের। কি কেমন কথা বলছে যে অনলকেই দেখতে পাচ্ছে না। অপরদিকে ধারা ক্লাস শেষে বের হতেই দিগন্তের সাথে দেখা। দিগন্ত ছেলেটা ধারার ভার্সিটির সিনিয়র। একই সাথে স্কুলে চাকরি করে তারা। যেমন দেখতে সুন্দর তেমন মার্জিত ব্যবহার। আর ছেলেটার সব থেকে ভালো যে স্বভাবটা ধারার কাছে মনে হয় তা হলো তার মন ভালো করার পদ্ধতি। লেম লেম জোক মেরে সবসময় ধারাকে হাসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে। আর ধারার মন তখন ভালো হতে বাধ্য। দিগন্ত তার সিনিয়র, কলিগের সাথে সাথে একজন খুব ভালো বন্ধু; যে কিনা বিগত চার বছর ধরে তার সাথে আছে। দিগন্তের সাথে দেখা হতেই অটোমেটিক মুখে হাসি ফুটে উঠলো ধারার ঠোঁটে।
– কি ম্যাডাম, লম্বা ছুটি কেমন কাটলো?
– হসপিটাল-বাসা করতে করতে কেটেছে। আপনি কেমন আছেন বলেন?
– আমি তো ভালোই ছিলাম কিন্তু তোমার অনুপস্থিতিতে মনের হালকা অসুস্থ ছিলো। যাক আমার মনের ঔষধ চলে এসেছে।
– এতো ফ্লার্ট করেন কিভাবে? টায়ার্ড হন না?
– এই শোনো এখন টায়ার্ড হয়ে গেলে আর বউ পাওয়া লাগবে না আমার।
– বিবাহিত মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করলে বউ পেয়ে যাবেন?
– আজিব, দেখো আমি তোমার সাথে ফ্লার্ট করি, তুমি ইরিটেট হও। আমার থেকে ছাড়া পাওয়ার একটাই উপায় আমাকে বউ খুজে দেয়া। সো তুমি ইরিটেট হলেও আমাকে বাধ্য হয়ে মেয়ে খুজে দিবে যাতে আমি আর তোমার সাথে ফ্লার্ট না করি।
– কি বুদ্ধি! আই এম শকড।
ধারা যখন দিগন্তের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তখনই তার পাশে এসে দাঁড়ায় অনল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধারাকে জিজ্ঞেস করে,
– আজ কি এখানে থাকার প্লান করে রেখেছিস?
হঠাৎ অনলের কন্ঠস্বর শুনে বেশ খানিকটা চমকে উঠে ধারা। পেছনে ফিরে অনলকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে দেখে অবাক ও হয় সে। একে অনল ঠিক সময়মত এসে হাজির হয়েছে, উপরে রাগী দৃষ্টিতে ধারার দিকে তাকিয়ে আসে যেনো মহাপাপ কিছু একটা ধারা করে ফেলেছে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ধারা বললো,
– দিগন্ত ভাই, আমি আসি আজকে।
– সে ঠিক আছে কিন্তু উনি?
– আমার ফুপাতো ভাই, উনার নাম অনল। অনল ভাই ইনি আমার কলিগ দিগন্ত ভাই।
– হ্যালো।
দিগন্ত হাত বাড়িয়ে দিলে নিজের রাগ কোনোমতে কন্ট্রোল করে হ্যান্ডশেক করে অনল। রাগে গা রি রি করছে। কিন্তু ধারাকে এখন কিছু বলতে পারছে না। ধারার রাগ ভাঙাতে চায় সে, রাগ দেখালে হিতে বিপরীত হবে। তাই কিছু বললো না অনল। হ্যান্ডশেক করেই ধারাকে বললো,
– পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়িতে আয়। মা ওয়েট করছে কখন থেকে
– আচ্ছা, চল। আসি দিগন্ত ভাই।
দিগন্তের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো ধারা। গাড়িতে উঠতে না উঠতেই অনল দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– আমি তোর কোন জনমের ভাই লাগি রে?
– মানে?
– মানে আবার কি! কালকে থেকে দেখছি ভাই ভাই করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিস। আরেকবার যদি ভাই বলিস ত দেখিস
– অনল ভাই, একটা কথা মাথায় ঢুকায়ে রাখো, আমাদের মধ্যে এখন শুধু ফুপাতো-মামাতো ভাই-বোনের সম্পর্কটাই আছে। এছাড়া আর কিছু এক্সপেক্ট করতে যেও না। যেহেতু চলে এসেছো। আমি চাই আমাদের ডিভোর্সটা এবার পাকাপুক্তভাবে হয়ে যাক।
– মানে?
– মানে টা স্পষ্ট। সেবার তুমি আমাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলে, এবার আমি মুক্তি চাচ্ছি।
ধারার কথা শুনে অনলের মুখ শক্ত হয়ে এসেছে। হাত মুঠো বদ্ধ করে রাগ কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, বুকের বা পাশের চিনচিন ব্যাথাটা আবার তিব্রতর হয়ে আসছে। কোনো কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট করলো অনল। প্রচুর দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বাড়ির গেটে এসে গাড়িটা থামালো। গাড়ি থামলে ধারা কোনো কথা না বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। সারা রাস্তা তারা কোনো কথাই বলে নি। অনলের আজ সব প্লান নষ্ট হয়ে গিয়েছে ধারার এক কথায়। বাড়ি এসে সোজাসোজি নিজের রুমে চলে যায় ধারা। অনল ও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্লাবের দিকে। খুব দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। ধারা তাকে নিজের কথা বলার কোনো সুযোগ ই দিচ্ছে না। কিভাবে ধারার সাথে তার কাগজের সম্পর্কটাকে নরমাল সম্পর্কে পরিণতি করবে তা জানা নেই অনলের।
রাত ৮টা,
একের পর এক সিগারেট জ্বালাচ্ছে অনল। নিজের ভেতরের আগুনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না সে। কষ্টগুলো ছুঁচের মত ফুটেই চলেছে।
– লিভার যা একটু ঠিক ছিলো সেটাও কি নষ্ট করে ফেলার ধান্দায় আছিস নাকি?
অনন্যার কথায় পেছনে না ফিরেই বলে উঠে অনল,
– এটা স্মোকিং যোন, তুই এখানেও কেনো ঢুকে পড়েছিস?
– স্মোকিং যোনে নিশ্চয়ই নাচতে আসি নাই। একটি বেনসন দে।
– তুই কবে থেকে স্মোক করিস?
– সে মেলা ইতিহাস। শর্ট কথা ব্রেকাপের পর থেকে।
– ভালো, এক দেবদাসে ভাত পাচ্ছে না। আরেকজন জুটেছে। নে।
বলে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো অনন্যার দিকে। অনন্যা সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে বললো,
– আজ কি ছ্যাকার পরিমাণটা বেশি?
– ধারা আমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছে।
– তো? এটাই তো তুই চেয়েছিলি না? ইভেন তুই নিজে পেপারস এ সাইন করে গেছিস। এখন আবার মন চেঞ্জ?
– ভাই ভুল করেছিলাম, না অন্যায় করেছিলাম। বাট আমার ওকে ছাড়া চলবে না দোস্ত। আমি পারবো না ওকে ছাড়া আবার থাকতে। অনেক থাইকে দেখছি। আর না।
– ওয়াও। হ্যাটস অফ। তুই যখন চেয়েছিস ওকে ছেড়ে চলে গেলি। এখন তুই চাচ্ছিস এক সাথে থাকতে সো ধারার থাকতে হবে। এটা কি ফাজলামি। আর ইউ ফা**** কিডিং মি?
– তো কি করবো আমি? জানি অন্যায় করেছিলাম। কিন্তু এবার সেটাকে শুধরাতে চাইছি। ওকে সেই সব খুশী দিতে চাইছ যা ও ডিসার্ভ করে। একটা সুযোগ কি আমার প্রাপ্য নয়? একটা লাস্ট সুযোগ?
– সেটা ধারা ভালো বলতে পারবে।
– ও কি বলবে, এখন ওর কাছে তো চয়েজ আছে।
– হ্যা?
– আরে একটা চেংড়া ছেলে, ওর কলিগ। মে বি ওকে লাইক করে ডোন্ট নো। খুব ক্লোজ ওরা। আমাকে ছেলেটার সামনে ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। ক্যান ইউ ইমাজিন?
– হাহাহাহা, তুই কি এক্সপেক্ট করিস যে ও তোর মত বুইড়াকে হাসবেন্ড হিসেবে পরিচয় দিবে। শালা তোরে আংকেল বলে নাই তোর ভাগ্য ভালো। কলপ দিয়ে পাকা চুল ঢেকে রাখছোস আবার কথা।
– তুই আমার বন্ধু? আমার মাঝে মাঝে প্রশ্ন উঠে মনে।
– হাহাহা
– হাসবি না, আমি বুইড়া হলে তুই ও বুড়ি। তাও তো আমার বিয়ে হয়েছে, তুই আইবুড়োই থেকে যাবি।
– এই বিয়েশাদী যে আমার জন্য না এটা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। কে বিয়ে করবে বলো এমন স্মোকার, বিনা চালচলনের মেয়েকে?
– সরি রে, আচ্ছা রবিনের সাথে তো তোর বিয়ে ঠিকঠাক ছিলো তাহলে কি হলো?
– শোন, আমার মতো বেহাল্লা মেয়েগুলো গার্লফ্রেন্ড ট্যাগ পাওয়ার ক্যাপাবিলিটি রাখে, স্ত্রী ট্যাগটা আমাদের জন্য না। আমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস তো তোর জানা। বাবা-মা ডিভোর্সড, সারাজীবন উড়ণচন্ডী ছিলাম। এসব কিছুই একেকটা ইস্যু ছিলো। তবে রবিন ছেলেটা অনেক চেষ্টা করেছে, প্রথমে ওর বাবা-মার চিন্তাধারা বদলাতে, তারপর আমাকে বদলাতে, না পেরে নিজেকে বদলাতে। ছেলেটা আমার সাথে সম্পর্কে পিসছিলো। ওর কষ্টগুলো আর নিতে পারছিলাম না। শেষমেশ বাড়ি ছাড়ার কথাও বলে। অনেক ভাবলাম জানিস, এতো গুলো সম্পর্ক ভাঙার থেকে আই গেস এই একটা সম্পর্ক ভাঙা ইজি। তাই আমি ব্রেকাপটা করেছি।
– তুই হ্যাপি তো?
– সিগারেটের সাথে ইয়েস। তবে কি লাইফ কারোর জন্য বসে থাকে না। এই দেখ না ওর সামনের মাসে বিয়ে। তাহলে আমার ডিসিশনটা তো ঠিক ছিলো বল।
অনন্যা কাঁদছে, মেয়েটাকে এই প্রথম কাঁদতে দেখছে অনল। জীবন তাকে ভাঙন বাদে কিছুই দিতে পারে নি। আজও তাই। অনল ও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলাচ্ছে। এরই নাম হয়তো বেঁচে থাকা।
রাত ১১টা,
কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই ঘুম ভেঙে গেলো ধারার। ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুলতেই দেখলো………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
৮ম পর্ব
রাত ১১টা,
কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই ঘুম ভেঙে গেলো ধারার। ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুলতেই দেখলো অনন্যার কাধে ভর দিয়ে অনল দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই সে গরগর করে বলতে লাগলো,
– আমার কোনো দোষ নেই ধারা, আজ তোমার বরের দেবদাসগিরির মাত্রাটা একটু বেশি ছিলো তো। একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। আন্টি কই?
– ফুপু, বাবা সবাই ঘুম।
– এটাকে কই রাখবো?
– এখানে ফেলে রাখেন সকালে নেশা কাটলে নিজে হেটে হেটে যাবে রুমে।
বিরক্তির স্বরে ধারা বলে উঠে। ধারার হাবভাব শুনে অনন্যা বলে,
– এভাবে বলো না বেচারার আজ মনটা ভালো নেই। তুমি একটু সাপোর্ট দিলে রুমে ফেলে আসতে পারি।
– ঠিক আছে আপু।
দাঁতে দাঁত চেপে অনন্যার কথায় রাজী হয় ধারা। কোনোমতে বেড অবধি এনেই অনলকে শুইয়ে দিলো তারা। মোটামোটি খবর হয়ে গিয়েছিলো অনন্যা এবং ধারার, একটা ছয় ফুটের সুঠামদেহী পুরুষ বলে কথা। অনন্যা আর দেরি না করে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। অনন্যা যাবার পর কি মনে করে আবার অনলের রুমে আসলো ধারা। এসেই দেখে সে চুপচাপ বসে রয়েছে। অনলকে বসে থাকতে দেখে খানিকটা চটে গিয়ে ধারা বলে,
– যদি সোবার ই থাকেন তবে অহেতুক ঢং করার কি প্রয়োজন?
– ……………
– কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না যে?
– একটা শেষ সুযোগ কি আমার প্রাপ্য নয় ধারা?
অনলের নির্বিকার প্রশ্ন শুনে ধারা খানিকটা থমকে যায়। অনল তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অনলের চোখ চিকচিক করছে। এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয় ধারা। এই চোখ জোড়া বড্ড ভয়ানক। সাড়ে পাঁচ বছর আগে এই চোখের মায়ার সাগরে নিজেকে তলিয়ে ফেলেছিলো সে। আজ আবার সেই চোখের মায়া তাকে নিজের জালে ধারাকে তলাতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ফিরে কাঁপা কন্ঠে বললো,
– রাত হয়েছে, রেস্ট করুন। এসব কথা বলার কোনো মানে হয় না।
কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই হাত টেনে ধরে অনল। হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আলতো হাতে ধারার মুখটা দু হাতে ধরে উচু করে সে। কোমল কন্ঠে বলে,
– আমাকে একটাবার নিজের কথা বলার সুযোগটুকু ও দিবি না? ফাঁসির আসামীকেও নিজের কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। কাল থেকে তোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি। তুই একটা সুযোগ ও দিচ্ছিস না?
– কি বলবে তুমি? কি বলার আছে? পাঁচ বছর আগে আমাকে সুযোগ দিয়েছিলে তুমি? আমিও তো একটা সুযোগ চেয়েছিলাম। দিয়েছিলে?
কাঁপা কাঁপা স্বরে ধারা বলে উঠে। নোনাজলের রাশি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে। আজ ধারার কন্ঠে অভিমানের ছাপ। অভিমানের পাহাড় যা বিগত পাঁচ বছর ধরে জমে আছে। অনলের শার্টের কলার ধরে বলতে লাগলো,
– কি হলো চুপ করে আছো যে, খুব তো বলেছিলে কথা বলবে। বলো, কেনো চলে গিয়েছিলে? কেনো আমাকে একটা সুযোগ দাও নি। আমার কি দোষ ছিলো? কি দোষ ছিলো আমার? তোমাকে ভালোবাসা আমার দোষ ছিলো? কেনো একা ফেলে গেলে আমাকে। বিইয়ের পর থেকে আমার সাথে তুমি যা যা করেছো আমি সব মেনে নিয়েছি। তোমাকে সময় দিতেও আমি রাজী ছিলাম। তাহলে কেনো চলে গিয়েছিলে?
– তুই তো ভালোভাবেই জানিস আমি কেনো গিয়েছিলাম, যাতে আমার দ্বারা তোর কোনো ক্ষতি না হয়। যাতে তুই কষ্ট না পাস। আমি না গেলে মা তোকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেত
– আমার হয়ে সব ডিসিশন তোমরাই নিয়ে ফেললে? একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আসলে আমি কি চাই? আমাকে কষ্ট না দিতে গিয়ে সবথেকে বড় কষ্ট দিয়ে ফেললে তার বেলায়?
– আই এম সরি। কিন্তু কি করতাম বল? আমার ঘা গুলো এতো তাজা ছিলো যে তোর ভালোবাসাটা মলম হলেও খুব যন্ত্রণা দিতো। প্রতি নিয়ত আমাকে যুদ্ধ করতে হতো। আমি যে পারছিলাম না, ভয় পেতাম। যদি তখন মিথ্যা আশায় তোকে রাখতাম সেটা কি খুব ভালো হতো। যেখানে আমি জানতাম তোকে ভালোবাসাটা আমার জন্য খুব সম্ভব হতো না। মাহির স্মৃতিগুলো কঁটার মতো আমাকে প্রতিনিয়ত ফুট ছিলো। সেখানে তকে জড়ানোটা কি খুব ভালো হতো? সেটা কি অন্যায় হতো না? তোর মাঝে আমি মাহিকে খুঁজতাম, তোকে মাহির জায়গায় ফিট করার চেষ্টা করতাম। সেটা অন্যায় হতো না? তোকে মিথ্যা ভালোবাসার মাঝে, মিথ্যা সম্পর্কের মাঝে কিভাবে রাখতাম বল? তাহলে আমার মাহির মাঝে পার্থক্য কি থাকতো। তখন তুই এই সম্পর্কটাকে টানতে টানতে টায়ার্ড হয়ে পরতি। খুব ভালো হতো সেটা। আমাদের সম্পর্কটা ভুল ছিলো না, সময়টা ভুল ছিলো।
– বেশ মানলাম, সম্পর্কের চাপ তুমি নিতে পারো নি, তাই পালিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু ডিভোর্স পেপারটা। সেটা কেনো সাইন করে গিয়েছিলে? উত্তর দাও
দৃঢ় কন্ঠে ধারা উত্তর চাচ্ছে অনলের কাছে। ধারা কাঁদছে, কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। বারবার ঢুকড়ে ঢুকড়ে কেঁদে উঠছে সে। অনল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। ধারার অশ্রুগুলো অনলকে বড্ড অসহায় করে নিচ্ছে, দূর্বল করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কলিজাটা কেটে যদি তাকে দেখাতে পারতো হয়তো তাহলে নিজের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত হতো। ধারার চোখের পানিতে অনলের শার্টের খানিকটা ভিজে গেছে। ধারার চোখ দুহাতে মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
– আমি খুব দোটানায় ছিলাম ধারা। আমি কি করতাম তখন? তোর সাথে বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারবো কিনা! তোকে কোনোদিন স্ত্রীর মর্যাদাটা দিতে পারবো কিনা সেটাই আমার জানা ছিলো না। সেখানে তোকে একটা খোকলা সম্পর্কে বেধে রাখা আমার নীতির মধ্যে পড়ছিলো না। আমি তোর প্রতি অনুভূতিগুলো কোনো আকার দিতে পারছিলাম না। তখন আমি আমার ভেতর ছিলাম না।
– তাহলে চলেই যখন গেছিলে, ফেরত কেনো এসেছো। কেনো আমার মনটাকে আবার স্বপ্ন দেখিয়ে আবার গুড়োগুড়ো করে ভেঙে দেবার জন্য? এখন কেনো আমাকে মুক্তি দিচ্ছো না।
– ভালোবাসি তোকে তাই। খুব ভালোবাসি, এই পাঁচটা বছর একটা দিন যায় নি আমি তোর কথা ভাবি নি। ভুল করেছিলাম, আমার এলোমেলো অনুভূতি গুলোকে প্রথমে বুঝতে দেরি করেছি, তারপর বুঝার পর সেটাকে মানতে দেরি করেছি। এই ভুলগুলো আমাদের জীবন থেকে পাঁচটা বছর কেঁড়ে নিয়েছে।
– পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন। জানো কতোগুলো দিন হয়, এক হাজার নয়শত আঠাশ দিন। প্রতিটা দিন আমি অপেক্ষা করতাম। এই ভেবে তুমি হয়তো ফিরবে, এই বুঝি আমার কাছে ফিরবে। কতোগুলো রাত নির্ঘু, কেঁটেছে আমার। ফিরিয়ে দিতে পারবে তুমি? আমার প্রতিটা নির্ঘুম রাত ফিরিয়ে দিতে পারবে? আমাদের বিয়ের আজ পাঁচ বছর দশ মাস সতেরো দিন। পারবে এই দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে। আমার জীবনের এই দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে? সেই কিশোরী মনের নিস্পাপ ভালোবাসাটাকে আবার জাগাতে পাঁরবে? পারবে না কিচ্ছু পারবে না। আমি থাকবো না তোমার সাথে। থাকবো না। আর কষ্ট নেওয়ার অবস্থায় আমি নেই।
এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি ধারা। অনলের বুকে মাথা ঠেকিয়ে হিচকি তুলে কাঁদছে সে। বিলাপের পরিমাণ বাড়তেই থাকলো। এতোদিনের অভিমানের পাহাড় আজ গলতে শুরু করেছে। কঠিন থাকতে থাকতে আজ ধারা ক্লান্ত। নিজের সকল অভিযোগ আজ সে অনলকে জানাবে। অনলও পরম যত্নে ধারাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। পুরুষের নাকি কাঁদতে নেই। তাদের কান্না আসে না, কিন্তু যখন কাঁদে সব উলট পালট করে দিতে সক্ষম। আজ অনল কাঁদছে। নিজের ভুলের মাশুল দিচ্ছে। কারণ ধারার প্রতিটা অশ্রুফোঁটা তাকে ভোঁতা ছুরির মতো আঘাত করছে। পারছে না ধারাকে নিজের বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে। একটা সময় কাঁদতে কাঁদতে ওনলের বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো। ধারার কোনো আওয়াজ না পেলে ধারার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আস্তে করে তাকে কোলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো তাকে অনল। ভেজা শার্টটা খুলে ধারার পাশেই মুখ করে শুয়ে পড়লো। নিপুন দৃষ্টিতে ধারাকে দেখে যাচ্ছে অনল। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে রয়েছে তার। চোখের নোনাজল এখনো শুকায় নি; চোখের নিচে লেগে রয়েছে। আস্তে করে ধারার মাথাটা নিজের বুকের উপর রেখে তাকে পরম যত্নে আগলে ধরলো অনল। মেয়েটাকে আর কোনোদিন কাঁদতে দিবে না সে। এটা তার কাছে স্পষ্ট মেয়েটা কাঁদলে বড্ড বেশি অসহায় লাগে, মনে হয় পুরো দুনিয়াটা উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে অনল ও ঘুমের অতল সাগরে তলিয়ে যায়।
সকাল ৭টা,
পাখির কিচিমিচি কানে যেতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো ধারা। মনে হচ্ছে খুব শক্ত কিছুর উপর উবু হয়ে আছে সে। মাথা ব্যথা করছে, চোখ খুলা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। কিসের উপর শুয়ে আছে বুঝার জন্য হাত দিয়ে হাতড়ে যাচ্ছে। চুলের মতো কিছু হাতে পড়লে সেটা টানার চেষ্টা করতে লাগলো সে। হঠাৎ কারোর গগণবিদারী চিৎকার শুনতে পারলে এক লাফে উঠে পড়ে সে। চোখ খুলতেই দেখলো………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
৯ম পর্ব
হঠাৎ কারোর গগণবিদারী চিৎকার শুনতে পারলে এক লাফে উঠে পড়ে সে। চোখ খুলতেই দেখলো অনল রীতিমতো এক হাত কামড়ে আরেকহাত দিয়ে বুক ঢলে যাচ্ছে। অবাক চোখে তার দিকে তাকালে ঝাঁঝালো কন্ঠে অনল বলে উঠে,
– কি দেখছিস এভাবে?
– তুমি এখানে কি করছো?
– আপাতত তোর খামছি খাচ্ছিলাম। আচ্ছা পার্ট টাইমে কি নখ দিয়ে মাটি খুড়িস? উফফফ জ্বলে গেছে আমার বুকটা। দানবী কোথাকার।
– কে বলেছে আমার কাছে আসতে। আবার আমার কাছে আসলে এভাবে খামছি দিবো। সরো এখান থেকে।
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ধারা বলে উঠে। প্রতি উত্তরে অনল ও
বলে উঠে,
– একে সারারাত আমার বুকের উপরে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাইছিস, সকাল হতে না হতেই আমার পশম তুলে দেবার মতো সাংঘাতিক কাজ করেছিস, আমাকে খামছি অবধি দিয়েছিস এখন আমার উপরই রাগ দেখাচ্ছিস।
– হয়ে গেছে? তোমার ফালতু কথা শোনার ইচ্ছে বা সময় আমার নেই।
বলেই উঠে চলে যেতে নিলে ধারার হাত টেনে ধরে অনল। আকুল আকুতির স্বরে বলে উঠে,
– আমাকে শেষ সুযোগটা দিবি না ধারা?
আবারো সেই প্রশ্ন ধারার ভেতরটাকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। নিজের আত্নসম্মান আর ভালোবাসার যুদ্ধে আজ অসহায় সে। অনলকে কি উত্তর দিবে তার জানা নেই। মস্তিষ্ক এবং মনের এই যুদ্ধ প্রতিনিয়ত ধারা পুড়িয়ে যাচ্ছে। না অনলকে ক্ষমা করতে পারছে না অনলকে শাস্তি দিতে পারছে। আচ্ছা একটা শেষ সুযোগ দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে! ধারা চুপ থাকতে দেখে অনল শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
– বেশ এতো কষ্ট করতে হবে না। আমি শুধু এক মাস সময় নিবো। এক মাসের পর ও যদি তোর মনে হয় আমাকে মেনে নিতে তোর কষ্ট হচ্ছে আমি তোর জীবনে বাধা হয়ে আর ধারাবো না। তুই যা চাবি তখন তাই হবে। একটা মাস আমাকে শুধু সময়টা দে।
– এক মাস দিলে কি হবে বলো? আমার জীবনের চলে যাওয়া দিন গুলো তুমি চাইলেও ফেরাতে পারবে না।
– না হয়তো পারবো না। কিন্তু এতটুকু কথা দিতে পারি এই পাঁচ বছর দশ মাস সতেরো দিনের যেই কষ্টের পাহাড় আছে তা ভেঙে গুড়িয়ে সুখের আস্তানা সাজাবো, তোর মনে আবার নিজের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।
অনলের কথা শুনে টিটকারির সুরে ধারা বলে উঠে,
– আমার কষ্টের পাহাড় এতোটাই বেশি যে চাইলেও সেটা কমাতে পারবে না। আমিও দেখতে চাই এই এক মাসে তুমি কি এমন এভারেস্ট জয় করতে পারো। আমি আমার রুমে যাচ্ছি, ফ্রেশ হয়ে ফুপুর কাছে যাও।
কথাটা বলে এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করে ধারা। অনল এক দৃষ্টিতে ধারার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে। এই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো সে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয়গুলো উঁকিঝুকি দিচ্ছে। সত্যি কি মেয়েটাকে সেই সুখগুলো ফেরত দিতে পারবে! আগে একটা চকলেট দিলেই মেয়েটা তার মুক্তোর মতো হাসি দিয়ে সেটা গ্রহণ করতো, এতো আগলে রাখতো মনে হতো কতো না দামী সেই চকলেটটা। তবে এখনের ধারা পুরোই আলাদা। এতোদিনের কষ্টগুলো তাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। এই পাথরে হৃদয়ে পুনরায় ভালোবাসার বীজ বুনা কি সহজ হবে! তার মনের বদ্ধ কুঠিরের তালাটা কি এতো সহজে খোলা যাবে!
সকাল ১১টা,
সুভাসিনী বেগমের রুমে সবাই একজোট হয়েছে। সুভাসিনী বেগম রীতিমতো জিদ ধরে বসে আসেন তাকে গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। ধারা তাকে বুঝাতে পারছে না এখন গ্রামে ট্রাভেল করাটা তার জন্য ঠিক হবে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা। সে গ্রামে যাবে মানে যাবে। বাধ্য হয়ে অনল সিদ্ধান্ত নেয় কাল তারা কুমিল্লা যাবে। সুভাসিনী বেগমের বাবার বাড়ি কুমিল্লার প্রত্যন্ত সিধলাই গ্রামে। প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘন্টার পথ। দুই-তিন দিন ঘুরে আসলে খুব একটা খারাপ হবে না। আর কি এখন আবার ধারার ছুটি নিতে হবে। সুভাসিনী বেগমের রুম থেকে বেরিয়েই দিগন্তকে ফোন করলো ধারা। ফোন রিসিভ হলেই অনুরোধের স্বরে বলে ধারা,
– হ্যালো, দিগন্ত ভাই। একটা ফেবার চাচ্ছিলাম। করতে পারবেন?
– হ্যা, হ্যা বলো। তোমাকে ফেবার করতে আমার কি কখনো আপত্তি ছিলো। বলো
– আমাকে চারদিনের একটা ছুটি ম্যানেজ করে দিতে হবে, পারবেন?
– হঠাৎ? আন্টি কি আবার অসুস্থ?
– না, এবার গ্রামে যাবার বায়না করেছে। তাই একটু ঘুরে আসতে চাচ্ছিলাম
– আচ্ছা সমস্যা নেই; একটা কথা ছিলো ধারা
– জ্বী বলেন
– না থাক তুমি ঘুরে আসো তারপর বলবো
– ঠিক আছে, তাহলে রাখি দিগন্ত ভাই।
দিগন্তের সাথে কথা বলার মাঝেই ফোনটা কেড়ে নেয় অনল। অনলের এমন কাজে প্রচন্ড ক্ষেপে যায় ধারা। অনেকটা ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– এটা কি হলো? কথা বলছিলাম তো নাকি?
ফোনটা কেটে দিয়ে নির্বিকারভাবে বলতে লাগলো অনল,
– কি হবে? এই চেংড়া ছেলের সাথে এতো কিসের কথা তোর? যা যেয়ে ব্যাগ গুছা। ৩টার সময় খেয়ে দেয় রওনা দিবো
– আজিব তো, আমি আবার ছুটি নিচ্ছি, দিগন্ত ভাইকে জানানোর জন্য ই ফোনটা দিয়েছি নাকি?
– অদ্ভুত তুই তোর ছুটি নিবি ওকে জানানোর কি আছে? ওর পি.এ নাকি ও?
– তোমার সাথে কথা বলা আর উলোবনে মুক্ত ছড়ানো অনেকটা এক।
– বুঝেছিস যখন কথা না বলে ব্যাগ গুছা যেয়ে।
– অসহ্য লোক একটা।
বলেই গটগট করে রুমে চলে গেলো ধারা। জানে লোকটার সাথে কথা বললে মেজাজটাই মাঝখান থেকে শুধু খারাপ হবে। দিগন্তকে দেখলেই কিংবা ওর কথা তুললেই অনল তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে এটা বুঝতে বাকি নেই ধারার। অবশ্য এটা যে সে উপভোগ করছে না তাও নয়। বেশ মজা লাগছে অনলকে এভাবে রাগিয়ে তুলতে। এই খুনসুটির ভেতরে অন্যরকম শান্তি লুকিয়ে রয়েছে।
সন্ধ্যা ৭টা,
বাড়ির গেটের সামনে এসে পৌছালো অনলরা। সারা রাস্তা ড্রাইভ করে এসে খুব ক্লান্ত লাগছে অনলের। তিন বছর বাদে আজ ধারা তার বাড়ি ফিরেছে। অনলের জার্মানি যাবার পর একবার এসেছিলো শুধু মাকে দেখতে। নিজের বাড়ি নিজের বাড়ি ই হয়। আজ এতদিন বাদে এসেও কি শান্তি না লাগছে। বিয়ের পর এই প্রথম অনল এখানে পা রেখেছে। গতবার যখন এসেছিলো তখন তাকে জোরপূর্বক ধারার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আজ হিসেবটা উলটো, আজ সে এই ধারাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করছে। বাড়ির গেট খুলতে না খুলতেই ধারার মা অর্থাৎ সুরাইয়া বেগম দৌড়ে জামাইকে বরণ করতে চলে আসেন। বিয়ের পর নিজের হাতে এক বেলাও মেইয়ের জামাইকে মনের তৃপ্তি অনুযায়ী খাওয়াতে পারেন নি তিনি। অনলকে ন্যে যেয়ে বসাতে না বসাতেই আপ্পায়নের ধুম পড়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে নিজের মামীর কান্ড দেখে যাচ্ছে অনল। এই সরবত দিচ্ছে, এই মিষ্টি; উনার যতটুকু সাধ্য সবটুকু নিয়ে অনলের খাতিরদারীর ব্যবস্থা করছেন তিনি। গ্রামের মানুষদের মনের মধ্যে পেঁচটুকু থাকে না। এইজন্য হয়তো তাদের সরল হৃদয়ে ভালোবাসার কমতি থাকে না। কোথাও যেনো অনলের নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছিলো। এই মানুষটা তাকে এতো যত্ন করছে অথচ তার মেয়েকে কতই না কষ্ট পেতে হয়েছে বিয়ের পর থেকে। এসব ভেবে পানিটুকু ও গলায় আটকে যাচ্ছিলো। হুট করেই সুরাইয়া বেগম ধারাকে বলে উঠে,
– মা, আমি তোর রুম গুছায়ে রাখছি। অনল বাবারে তোর রুমে নিয়ে যা।
– আমার রুমে মানে?
– কি কথা কস তুই? তোর রুম ছাড়া আর রুমে থাকবে সে?
সুরাইয়া বেগমের কথায় এটা বুঝতে বাকি নেই ধারার এই মানুষটার সাথে এক রুমে এই কয়দিন থাকতে হবে। গা জ্বলছে ধারার কিন্তু কিছুই করার নেই। এদিকে অনলের খুশি যেনো ধরছে না। এখন শুধু রাতের অপেক্ষা। হঠাৎ অনলের মোবাইলটা বেজে উঠে, মোবাইলের নাম্বারটা চোখে ভাসতেই চোখ মুখের রঙ বদলে গেলো অনলের। তখনই ধারা জিজ্ঞেস করে উঠে……………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
১০ম পর্ব
হঠাৎ অনলের মোবাইলটা বেজে উঠে, মোবাইলের নাম্বারটা চোখে ভাসতেই চোখ মুখের রঙ বদলে গেলো অনলের। তখনই ধারা জিজ্ঞেস করে উঠে,
– ফোনটা বাজছে তো ধরছো না কেনো?
ধারার হঠাৎ প্রশ্নে খানিকটা চমকে উঠলো অনল। পরমূহুর্তে নিজেকে শান্ত রেখে বলে উঠলো,
– অদরকারি ধরে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। বাজতে থাকুক, বাজতে বাজতে থেমে যাবে।
অনলের উত্তরে ধারা আর কথা বাড়ালো না। অনল ফোনটা সাইলেন্ট করে যথারীতি সুরাইয়া বেগমের সাথে আড্ডায় মেতে উঠলো।
রাত ১০টা,
খাওয়া দাওয়া শেষে আড্ডার আসর বসলো ধারাদের বাসায়। সুভাসিনী বেগমের এতোদিন পর আগমনে বাড়ি গমগম করছে। সব চাচাতো ভাইবোনেরা মিলে বেশ আড্ডার রমরমা পরিবেশ তৈরি হয়েছে বাড়িতে। বেশ খানিক বছর পর আজ এই আড্ডায় অনল যোগ দিয়েছে। আড্ডার মাঝেই হুট করে অনলের এক মামা বলে উঠলেন,
– বুঝলা ভাগ্না, এখনই যা জীবন উপভোগ করার এই কয়দিনে করে নেও। আর কিছুদিন পর চাইলেও আর নিজেদের মতো বাঁচতে পারবা না। পাঁচ বছর পর আসলা, এখন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে নিবা এইটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেখো বাচ্চা বড় হইতে হইতেই বুড়ো হয়ে গেলাম। নিজেদের জন্য বাঁচার যে আক্ষেপটা থেকেই গেলো।
– এখনো বাচ্চা নেবার কথা চিন্তা করি নি মামা। ধারার বয়স ই বা কি! এখন বাচ্চা নিলে ওর জীবনটা ওখানেই থেমে যাবে। ও নিজের মতো নিজেকে গড়াক। মাত্রই তো চাকরি পেয়েছে।
– সে কি কথা! এখন যদি এতো চাকরি নিয়ে পরে থাকে সংসার করবে কখন? আর দেখতে গেলে তোমার ও বয়স তো কম হলো না।
– মামা, ধারা ওনেক ছোট এখনো। সবে চব্বিশে পা রেখেছে। এখন তো ওর জন্য পুরো দুনিয়ে পড়ে রয়েছে। এখন যত এক্সপ্লোর করবে ওর জ্ঞান তত বাড়বে, কতোকিছু শিখার জানার আছে ওর। সংসার তো থাকবেই, কিন্তু এখন যদি নিজের জীবনটা না সাজায় তবে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে। আমি চাই না, শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে আমি ওর ফিউচার নষ্ট করতে।
– দেইখো ভাগ্না, সময় চলে গেলে চাইলেও বাচ্চা হওয়াতে পারবা না।
– দরকার হলে এডোপ্ট করবো, একটা দম্পতির জীবনে বাচ্চার বাবা-মা হওয়াটাই সবকিছু না। এখনো আমাদের নিজেদেরকেই চিনা বাকি। আপাতত এসব নিয়ে চিন্তা করছি না। আপনারা গল্প করুন আমি উঠছি।
বলেই অনল সেখান থেকে চলে এলো। এতোক্ষন আড়ালে ধারা সবকিছু শুনেছে। আজ কেনো জানে লোকটার প্রতি সম্মানটা বেড়ে গেলো ধারার মনে। ধারা ভেবেছিলো অনলের হয়তো ধারার ভবিষৎ নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ নেই। ধারার চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে দিলো অনল। সবার সামনে নিজের বউ চাকরি করবার কথা এতো দৃঢ় গলায় বলতে পারে এমন স্বামীর সংখ্যা যে খুব একটা বেশি নয় একথা কারোর অজানা নয়। আজ অনলের কথাগুলো ধারার মনে অন্যরকম শান্তি দিচ্ছে। যা বলার মতো ভাষা ধারার নেই।
তিনদিন পর,
বিকেল ৪টা,
ভাদ্র মাসের আকাশে ধবধবে সাদা মেঘ উড়ছে। রোদের প্রখরতা ততোটা নেই। বরং খুব ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সেই বাতাসের সাথে সাথে ধারার অবাধ্য চুলগুলো পাল্লা দিয়ে বেহায়ার মতো উড়ে যাচ্ছে। ঘাটলার সবথেকে নিচের সিড়িতে বসে ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে সে। ধারাদের বাড়ির এই পুকুরটা বাড়ির ঠিক পেছনে। বাড়ির রুম থেকেই সরাসরি পুকুরের ঘাটলা। কিশোরী থাকতে প্রায় এখানে বসে সময় কাটাতো সে। পুরোনো দিনের স্মৃতি গুলো যেনো চোখের সামনে ভাসছে। হঠাৎ করে কেউ চুলে হাত দিলে কেঁপে উঠলো ধারা। পাশে ফিরে দেখলো বেশ কিছু শিউলি ফুল হাতে নিয়ে অনল বসে রয়েছে তার পাশে, একটা ফুল কানে গুজে দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছে। অবাধ্য চুলের দাপটে ফুলটা খুলে যাচ্ছে বারবার। শেষমেশ খানিকটা চটে গিয়েই বললো,
– পেত্নীর মতো চুল খুলে রেখেছিস কেনো? খোপা করে রাখতে পারিস না?
– তো আমার চুল তোমার কোন পাকা ধানে মই দিচ্ছে?
– জানিস কতো কষ্ট করে ফুলগুলো জোগাড় করেছি? ভেবছিলাম খোপায় পড়িয়ে দিবো
– বুড়ো বয়সে এসব উটকো শখ কোথা থেকে পাও তুমি?
– বয়সটা না শুধু শরীরের হয় মনের না। আচ্ছা খোপা কর।
– ইচ্ছে হলে নিজে করে দেও।
– বেশ
বলেই কোনোমতে খোপাটা বেধে ফুলগুলো খোপায় গুজে দিলো অনল। বাকি ফুলগুলো ধারার হাতে দিয়ে বললো,
– তোকে প্রেম নিবেদন করি প্রতিনিয়ত
প্রতি ক্ষণে,প্রতি মুহূর্তে,প্রতি বেলা।
কারণ,
আমি তোর প্রেমে পরি প্রতি ভোরে
প্রতি সকালে সোনালি রোদ যেমন উঠে
তেমনি আমিও তোর প্রেমে পরি।
আমি তোর প্রেমে পরি সকালের সূর্য্য যেমন খাঁড়া উপরে উঠে প্রতিদিন,
কিরণে পোড়াতে চায় পথ ঘাট,ফাটাতে চায় মাটি
আমিও প্রতি দুপুরে তোর প্রেমে পড়ে পুঁড়ি
তোর প্রেমে পরে বুক ফেঁটে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাক
তবু শান্তি পাই।
আমি তোর প্রেমে পরি শেষ বিকেলে
সূর্য যখন হেলে পড়ে পশ্চিমে
আমিও প্রেম নিবেদন করে তোর বুকে হেলে পড়তে চাই।।
– আজকাল তুমি বুঝি কবি হয়ে গেছো?
– প্রেমে পড়ে বড় বড় মানুষ কবি হয়ে গেলো আমি তো সাধারণ মানুষ মাত্র। সবাই তো গোলাপ দিয়ে প্রেম নিবেদন করে আমি নাহয় শিউলি দিয়েই করলাম।
ধারা কিছু না বলে পরম যত্নে শিউলিগুলো গুছিয়ে রাখলো। অনলের অগোচরেই চোখজোড়া মুছে নিলো। কেনো জানে অনলের বলা প্রতিটা লাইন মনের মাঝে গেঁথে গেছে। নিজেকে আজ খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে ধারার। এতোদিনের ধৈর্যের ফল হয়তো এটা। আজকাল বেহায়া মনটা কেনো যেন আবার নতুন করে এই লোকটার প্রেমে পড়তে চাইছে। হয়তো এতোদিনের ঘাগুলো শুকাতে শুরু করেছে।
রাত ১০টা,
খাওয়া দাওয়ার পর রুমে এসেই দেখলো অনল রুমে নেই। বিছানার উপর শুধু একটা নীল শাড়ি আর এক গোছা রংধনুর মতো চুড়ি রাখা আছে। ধারার বুজতে পারি নেই এই কাজটা কার। পাশেই একটা চিরকুট রাখা। চিরকুটটা খুলতেই চোখে পড়লো,
“ বিয়ের পর তোকে নিয়ে জ্যোৎস্না বিলাশ করার লোভ আজ আর সামলাতে পারছে না তোর এই অপদার্থ বরটা, ঘাটলায় অপেক্ষা করছি। শাড়িটা পছন্দ না হলেও পড়ে আছিস।“
চিরকুটটা পড়ে অজানা একটা আনন্দে চোখমুখ ঝলমল করছিলো ধারার। ঠোঁটে না চাইতেও হাসি ফুটে উঠলো। এই তিনদিনে এমন কিছুই বাদ রাখে নি অনল করতে। প্রতিনিয়ত নতুন করে প্রেমে ফেলবার ধান্দায় রয়েছে সে। এই কয়েক বছরের সুখগুলো যেনো একসাথেই মুঠো করে ধারার আঁচলে ঢেলে দিতে চাইছে সে। আচ্ছা এতো সুখ সহ্য হবে তো ধারার কপালে!
ঘাটলার সিড়িতে বসে রয়েছে অনল। সামনে ডিঙি নৌকা, আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। আজ নৌকায় করে ধারাকে নিয়ে জ্যোৎস্না বিলাসের আয়োজন করেছে সে। গ্রামে না আসলে হয়তো এ সুযোগটা পেতো না। ধারাদের বাড়ির পুকুর দিয়েই এই সময়টা নৌকা করে ঘুরে বেড়ানো যায়। বর্ষার পানি এখনো নামে নি, যার জন্য আশপাশের মাঠ গুলো তলিয়ে আছে। একটা সময় মাহিকে নিয়ে এসব পাগলামির কথা চিন্তা করতো অনল। কিন্তু এখন তার সবটুকু জুড়ে কেবলই ধারার বসবাস। এই কবছরের সব প্রাপ্য সুখগুলো কুড়িয়ে ধারার ঝুড়িতে দিতে চায় অনল। যে দিন গেছে তা ফেরাবার সাধ্য তার নেই, কিন্তু সামনের দিনগুলো রঙ্গিন করার চেষ্টা তো করাই যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছিলো হঠাৎ চুড়ির শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। সামনে তাকাতেই দেখলো নীল শাড়িতে একটা পরী তার দিকে এগিয়ে আসছে। হাত নাড়ানোর সাথে সাথে রুনঝুন আওয়াজে রাতের নীরবতা গুলো মুখরিত হয়ে উঠছিলো। অনল খেয়াল করলো হৃদস্পন্দন গুলো যেনো খুব বেড়ে গিয়েছে তার। সামনে থাকা নারীর প্রেমেই তো সে অজ্ঞান, এই তো সেই নারী যে তাকে আবার ভালোবাসতে শিখিয়েছে আবার বাঁচতে শিখিয়েছে। একটু এগিয়ে হাত বাঁড়িয়ে বললো,
– তোমায় নিয়ে প্রেমের তরী ভাসাতে চাই, আছে কি অনুমতি?
অনলের মুখে তুমিটা শুনে ধারার বেশ লজ্জা লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আজ যেনো নতুন করে দুজন মানুষের প্রেমের অজানা কাব্য রচনা হচ্ছে। সুখগুলো একসাথে ধারার আঁচল ভরিয়ে দিচ্ছিলো। মুচকি হেসে হাত বাঁড়িয়ে দিতেই……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
১১তম পর্ব
মুচকি হেসে হাত বাঁড়িয়ে দিতেই হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো অনল ধারাকে। দু হাত দিয়ে আলতো হাতে ধারার লজ্জায় লাল হওয়া মুখটা খানিকটা উঁচু করে। অনলের নিঃশ্বাস ধারার মুখোমন্ডলে ছিটকে পড়ছে। ধারার চোখ তখন অনলের চোখজোড়ায় স্থির। সেই চোখ আজ ভালোবাসার নেশায় টুইটুম্বুর। যে নেশা ধারাকে ভাসিয়ে নিতেও সক্ষম। অনল ধীরে ধীরে ধারার পাতলা ঠোঁটজোড়াকে নিজের আয়ত্তে করে নিলো। অজানা আবেশেই চোখ বন্ধ হয়ে গেলো ধারার, এ যেনো অন্যরকম নেশা, অন্যরকম অনুভূতি। ধারার ভেতরে উথাল পাথাল করে দিচ্ছিলো এই অনুভুতিগুলো। এক নিমিষেই রক্তগুলো শিরদাড়া বেয়ে উষ্ণ পরশ দিচ্ছিলো। চোখ থেকে অজান্তেই অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর ধারা থেকে একটু দূরে গিয়ে ধারালো অনল। দুষ্ঠু হাসি দিয়ে বললো,
– বাকিটুকু তোলা থাক যেদিন তুই নিজ থেকে আমাকে সেই অধিকার দিবি সেদিনের জন্য।
আস্তে করে ডিঙ্গি নৌকায় ধরে বসালো ধারাকে। নৌকাটায় শুধু ধারার আর অনল ব্যতীত আর কেউ ছিলো না। তাই সংকিত গলায় ধারা তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– নৌকাটা কে চালাবে? মাঝি কই?
– আজ আমার প্রেমেতরীতে তোকে তুলেছি অবশ্যই মাঝি আমি
– এ বাবা? ডুবে গেলে?
– সাঁতার তো পারিস ই, নৌকা উলটালেও সমস্যা নেই। আর আমি তোকে ডুবতে দিবো না।
– তুমি জানো কিভাবে নৌকা চালাতে হয়?
– জানবো না কেনো? এই তিনদিন কি ঘাস কাটছি নাকি!
– তুমি তিনদিন ধরে এটার প্রস্তুতি নিছো?
– তা কি বলতে? ভেবেছিলাম প্রথম রাতেই তোকে নিয়ে বের হবো। পরে ভাবলাম আগে নৌকা চালানোটা শিখে নেই, তারপর একেবারে তোকে চমকে দিবো।
ধারার সামনে এখন যে অনল রয়েছে তাকে বড্ড অচেনা লাগছে ধারার। এতো অন্য মানুষ, যে কিনা তার সবটুকু ভালোবাসা নিয়ে ধারার বেরঙ জীবনটাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। এতোটাও ভালো কেউ বাসতে পারে জানা ছিলো না ধারার। নৌকা চলছে আপন গতিতে, একটা ঝিলের মতো জায়গায় এসে অনল নৌকা বাওয়া থামালো। আশেপাশের মাঠ গুলো এখনো পানির নিচে। যতদূর চোখ যাচ্ছে কেবল ই পানি আর পানি। আর মাথার উপর স্বচ্ছ নীল আকাশ আর মস্ত বড় চাঁদ। চাঁদের আলোতেই পরিবেশটা মনোরোম হয়ে আছে। খুব সাবধানে এসে ধারার পাশে গিয়ে বসে অনল। ধারার হাতটা নিজের হাতের উপর রেখে বলে,
– একদিন এই হাতজোড়াকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলাম। আমি এতোগুলো বছর তোকে অনেক কাঁদিয়েছি। জানি না সেই কষ্টগুলোর কোনো ক্ষমা হয় কিনা। হয়তো না, আমি বলবো না আমাকে ক্ষমা করে দে, বলবো না সব ভুলে যা। শুধু এটুকু বলবো বড্ড বেশি ভালোবাসি তোকে; আমাকে একা করে দিস না কখনো। আমার রক্তে মিশে আছিস তুই, তোকে ছাড়া এক মূহুর্তের কথা ভাবতে ভয় লাগে।
– সারাজীবন এভাবে ভালোবাসবে তো আমাকে?
– শেষ নিঃশ্বাস অবধি; কথা দিচ্ছি। তোকে শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি ভালোবেসে যাবো।
– তবে আজ আবার বলছি, ভালোবাসি তোমাকে
ধারার কথাশুনে অনলের চোখ চিকচিক করছে, হয়তো এখনই অশ্রুগুলো চোখজোড়াকে মুক্তি দিবে। পরম আদরে ধারার কপালে উষ্ণ পরশ দিলো অনল। আজ সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পেয়েছে। এটা যে তার সর্বোচ্চ পাওয়া। আজকের জ্যোৎস্না সাক্ষ্ণী দিচ্ছে তাদের ভালোবাসার পূর্ণতার। পরম যত্নে ধারার পায়ে হাত দিতেই ধারা খানিকটা কেঁপে উঠলো।
– কি করছো?
– আগে তো সারাদিন নুপুর পড়ে থাকতি পায়ে, তোর নুপুরের আওয়াজে ঘর মম করতো। এখন পা খালি থাকে যে?
– জানো না কেনো পরি না? রাগের মাথায় নুপুরগুলো ভেঙে ফেলেছিলে যে!
– এগুলোর কথা বলছিস?
ধারা খেয়াল করলো পকেট থেকে একটা বাক্স অনল বের করেছে। বাক্সের মুখটা খুলতেই ধারার বিষ্ময় উচ্চ শীখরে পৌছায়। অবাক চোখে অনলের মুখ পানে চেয়ে থাকে সে। অনল পরম যত্নে ধারার পায়ে নুপুর গুলো পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
– রাগে মাথায় এগুলো ভেঙে ফেলেছিলাম, পরেরদিন অবশ্য ঠিক করে এনেছিলাম কিন্তু দিতে ইচ্ছে হয় নি। পাঁচ বছর কেটে গেছে; নুপুরগুলো আমার কাছেই গচ্ছিত ছিলো। এই পাঁচটা বছর যখন তোর কথা মনে পড়তো এগুলোকে দেখতাম। এই কয়দিনে দেওয়ার কথা ভাবি নি তা নয়। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আজ নুপুরগুলো তার মালিকের কাছে ফেরত গেলো।
– হয়তো তখন দিলে আমাদের এতোদিন নষ্ট হতো না!
– হয়তো। একটা আবদার করবো রাখবি?
– এতোক্ষণ তবে কি করছিলে?
– হাহাহা, আমাদের কাধে মাথাটা রাখবি? আমার হাতে হাত রেখে জ্যোৎস্না দেখবি?
ধারা কোনো উত্তর না দিয়েই মাথাটা অনলের কাধে রাখলো। একটা মিষ্টি মাতালকরা গন্ধ অনলের নাকে লাগলো, ওর বুঝতে বাকি রইলো না এটা ধারার চুলের মিষ্টি সুভাস। অনল ডান হাতটি দিয়ে ধারার কোমড় চেপে ধরলো, বা হাতে ধারার হাতটি পরম যত্নে ধরলো। অনল এবং ধারার কাছে মনে হচ্ছিলো, যাক না থেমে সময়টা। এভাবে কত সময় কেটে গেলো, তাদের কারোর ই খেয়াল নেই। আজ নাহয় তাদের ভালোবাসার মূহুর্তগুলো সময়কে হার মানাক, দু হাতে সুখ কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ুক দুজন মানব মানবী। ক্ষতি কি!
রাত ৩টা,
ঘাটলার দিকে নৌকা ভিড়ায় অনল। আজকের রাত জীবনে শ্রেষ্ঠ রাতের একটি ছিলো অনল ধারার কাছে। কোনো অভিমান, মনোমালিন্যের ছাপ ছিলো না আজ রাতে। শুধু ভালোবাসার কিছু মূহুর্ত ছিলো। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়ি ছেড়ে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়লো ধারা। গায়ের পাঞ্জাবীটা খুলে টিশার্ট আর শর্টস পড়ে নিলো অনল। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসেই দেখলো ধারা শুয়ে পড়েছে। গ্রামে আসার পর থেকে একই রুমে থাকলেও এক বিছানাতে তারা থাকে নি। ধারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলো অনলের সাথে বেড শেয়ার সে করবে না। নিচে শোয়ার জন্য ধারা জেদ করাতে অনল তাকে বারণ করে। ঘরে কোনো সোফা বা কোনো অন্য শোয়ার ব্যবস্থা না থাকায় অনল নিচে মাদুর পেতে শুয়েছে। তাই আজও কিছু না বলে প্রতিদিনের মতো বালিশটা নিয়ে নিচে মাদুর বিছাতে গেলেই ধারা জিজ্ঞেস করে,
– কি করছো? মাদুর পাতছো কেনো?
– তুই তো বলেছিলে যদি এক রুমে থাকলেও এক বিছানায় তুই আমার সাথে থাকবি না।
– হয়েছে, আর নিচে শুতে হবে না। উপরে আসো, আমিতো তোমার জন্য জায়গা রেখেই শুয়েছি। আসো
অনলের কানে যেনো বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মনের মাঝে এক অজানা খুশি বয়ে যাচ্ছিলো অনলের। মাদুরটা রেখে ধারার পাশে শুয়ে পড়লো। একই বিছানায় আবার পাঁচ বছর পর, ইচ্ছে করছে আবার ধারাতে মিশে যেতে। কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা বাধা যেনো রয়েই গেছে। লোকে সত্যি বলে একবার কোনো সম্পর্কে ফাঁটল ধরলে সেটা সারানো সত্যি কষ্টকর। যেমনটা ঘটছে অনল এবং ধারার মাঝে। কোথাও না কোথাও ধারার দিকে এগুতে গেলে পাঁচ বছর আগের অনলের বিভৎস কাজের কালো স্মৃতিগুলো মনে ভাসছে। তখন আপনাআপনি নিজেকে ধারা থেকে সরিয়ে ফেলতে হচ্ছে অনলের। ধারা তখন অনলের পিঠ করে অপর পাশে মুখ করে শুয়ে ছিলো। একটা সময় আর না পেরে, সে পেছন থেকেই ধারাকে জরিয়ে ধরলো। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ধারা খেয়াল করলো অনল তাকে পেছন থেকে জরিয়ে কাধে মুখ ডুবিয়ে আছে। অনলের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ধারার ভেতরটাও পুড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো তপ্ত নোনাজল ধারার গলা বেয়ে পড়ছে। প্রথমে অবাক হলেও খেয়াল করলো লোকটা কাঁদছে। এবার আর নিজেকে আটকাতে না পেরে অনলের দিকে ফিরে ধারা।
– কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?
– তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম, কিভাবে পারলি এই জানোয়ারটাকে এতো ভালোবাসতে?
– সত্যি বলি? জানি না। আমি সত্যি জানি না।
– অনুতাপেরা খুব পাষন্ড জানিস তো। কুড়ে কুড়ে খায় এই অনুতাপগুলো। আমি এতো অন্যায় করার পর ও এ বাড়ির কাউকে কিচ্ছু জানাস নি কেন?
– এমনি, দরকার পড়ে নি তাই। ভেবেছিলাম যদি ডিভোর্স ফাইনাল হয়ে যায় তবেই জানাবো। খামোখা তাদের সামনে তোমার সম্মানটা নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় নি।
– এখানে আসার পর থেকে আমার লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে রয়েছিলো। খুব অনুতাপ হচ্ছিলো জানিস যখন মামীমা আমাকে এতো আদর আপ্পায়ন করছিলো।
– পুরোনো কথা মনে করে কি হবে বলো? এখন তো আবার নতুন করে নিজেদের সুযোগ দেয়ার বেলা। পুরোনো কথা মনে করলে শুধুমাত্র কষ্টই পেতে হবে। বাদ দেও।
– তোকে মিশিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– আমি কি বাধা দিয়েছি?
– উহু
বলেই পরম যত্নে ধারাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো অনল। যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। দুজন দুজনাতে মিশে কখন যে ঘুমের অতল সাগরে ডুবে গেলো খেয়াল ই ছিলো না।
তিনদিন পর,
সকাল ৮টা,
রান্নাঘরে নাস্তার আয়োজন করছে ধারা। গ্রাম থেকে ফিরেছে দুদিন হয়েছে। ভাঙা সম্পর্কটা জোড়া তো লেগেছে কিন্তু কোথাও যেনো একটা ফাকা জায়গা ধারার অনুভূতি হচ্ছে। সব ঠিক থাকলেও অন্যান্য সম্পর্কের ন্যায় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠে নি তাদের। হয়তো সময়ের সাথে সাথে সেটাও ঠিক হয়ে যাবে। নাস্তার টেবিলে সুভাসিনী বেগম এবং অনলের আগমণ ঘটলে ধারার চিন্তার ভেদ ঘটে। নাস্তা সেরে অনল নিজের রুমে যায়। সব গুছিয়ে ধারাও স্কুলের জন্য রেডি হতে অনলের রুমে যায়। রুমে এসে আলমারি খুলতে নিলে ধারা শুনতে পায় অনলের ফোনটা বেজে যাচ্ছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই আবার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো অনলের। অনলের মুখ দেখে খুব শান্ত ভাবেই ধারা বলে,
– মাহি আপু, এতোদিন যাবৎ তোমাকে ফোন দিচ্ছে। ধরছো না কেনো?
ধারার এমন প্রশ্নে অনলের বিষ্ময়ের সীমা থাকে না। অনলকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার ধারাই ফোনটা রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করতেই……………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
১২তম পর্ব
অনলকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার ধারাই ফোনটা রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে মাহি বলে উঠে,
– ফাইনালি তুমি ফোনটা রিসিভ করলে, প্লিজ অনল আমাকে আমার কথাটা রাখার একটা সুযোগ দাও। আমি জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি কিন্তু দেখো আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি। আর তুমিও এমন একতা রিলেশনে আছো যার কোনো ভিত্তি নেই। আমিও উইলিয়ামের সাথে ডিভোর্সড। তাহলে কেননা আমাদের সম্পর্কটাকে পুনরায় শুরু করা যাক!
– আপু আমি অনল নই, আমি ওর স্ত্রী ধারা।
– তুমি ওর ফোন কেনো ধরেছো? অনল কোথায়?
– অনল আপনার ফোন ধরতে ইচ্ছুক নয় বিধায় ফোনটা আমি ধরেছি। আপনার যদি কোনো কথা থাকে আপনি আমাকে বলতে পারেন।
– আমি যতটুকু জানি তোমার সাথে অনলের সম্পর্কটা ভালো নয়। দেখো অনল আর আমার সম্পর্কটা এখনের নয়, আমি জানি এখনো ও আমাকেই ভালোবাসে। তাই অহেতুক আমাদের মাঝে দেয়াল হয়ে থেকো না
– আপনার বলা শেষ? এবার আমি কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শুনবেন।
– কি বলবে তুমি?
– বয়সে তোমার থেকে অনেক ছোট তাও তোমাকে একটা উপদেশ দেই। একবার যা কোনো জিনিস ভেঙ্গে গেলে তা আর জোড়া লাগে না। সম্পর্কগুলো ঠিক সেরকম। তোমার আর অনলের সম্পর্কটা সাত বছর আগেই ভেঙে গেছে। সেটা তুমি নিজে ভেঙেছো, যখন ওর তোমাকে দরকার ছিলো তুমি নিজেকে ব্যস্ত ছিলে। আজ সাত বছর পর সেই সম্পর্কের দোহায় দিলে সত্যি না হাস্যকর শুনায়। আমি বলি কি চলে তো গিয়েছো এবার অনলের পেছন একেবারেই ছেড়ে দাও। জানো তো আমি কিন্তু গ্রামের মেয়ে, ডানপিটে এখনো যায় নি আমার। কখন কি করে ফেলবো তার ঠিক নেই। রাখছি।
ফোনটা কেটে রাখতে যাবে তখনই পেছন থেকে অনল তাকে জড়িয়ে ধরলো। অনলের এভাবে হুট করে জরিয়ে ধরাটা ধারাকে বেশ অবাক করলো। কৌতুহল বশত ই জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে? অফিস যাবে না?
ধারার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে উত্তর দিলো,
– আমার ডানপিটে বউটাকে আজ আদর করতে মন চাইছে।
– তাই বুঝি? হয়েছে ছাড়ো এবার। রেডি হই, স্কুলে যেতে হবে তো।
– ম্যাডাম, কাল শুক্রবার
– তো?
– উফফফ চল না কোথাও ঘুরে আসি আজকে।
– কোথায় যাবে?
– আমার খুব ইচ্ছে তোকে নিয়ে বিকেলবেলা অন্যান্য কাপলদের মতো ঘুরতে যাওয়া।
– ঠিক আছে তাহলে কাল বিকেলে বের হওয়া যাক। কোথায় নিয়ে যাবে আমায়।
– কালকে আমরা রমনা পার্কে যাবো, সিনেমা দেখবো, আইসক্রিম খাবো। সব করবো যা নরমাল প্রেমিক প্রেমিকারা করে
– আমরা স্বামী-স্ত্রী। প্রেমিক-প্রেমিকা নই।
– তো কি হয়েছে? একদিন হতে তো সমস্যা নেই।
– তা নেই হওয়াই যায়।
তখন ধারার ফোনটা বেজে উঠে, ফোন স্ক্রিনে দিগন্তের নাম দেখে অনল ফোনটা লাউডস্পিকারে দিয়ে ধারার হাতে দেয়। অনলকে দেখেই ধারার বুঝতে বাকি নেই সে ক্ষেপে গেছে। ধারা আমতা আমতা করে বলে,
– হ্যালো
– হ্যালো ধারা, কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?
– আমিও ভালোই আছি। আচ্ছা অনলের সাথে মিটমাট হয়েছে?
– জ্বী ভাইয়া, সব ঠিক হয়ে গেছে।
– বেশ তাহলে আজ কিন্তু অবশ্যই ওকে আসতে বলো। আমরা সবাই অনলের সাথে পরিচিত হবার আশায় আছি। তোমার এতোদিনের লুকায়িত বরটি যে আসলে অনল, এটা জানার পর থেকে আমার ওর সাথে দেখা করার ইচ্ছে আরো বেড়ে গেছে। সেদিন খুব সময়ের জন্য দেখা হয়েছিলো। ঠিক মত কথাও হয় নি।
– আচ্ছা ভাইয়া আমি ওকে বলবো আসতে।
– আচ্ছা, রাখি তবে।
– জ্বী ভাইয়া।
ফোনটা কাটার পর থেকে অনল অবাক চোখে ধারার দিকে তাকিয়ে ছিলো। অনলের কৌতুহলী চেহারা দেখার পর ধারা প্রশ্ন করে,
– কি দেখছো এভাবে?
– দিগন্ত জানে আমার কথা?
– হুম, জানবে না কেনো?
– কবে বলেছিলি ওকে?
– এইতো পরসুদিন। আসলে সেদিন ভালোভাবে কথা কোথায় বলতে দিয়েছিলে তুমি। পরসুদিন কথায় কথায় তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে তোমার পরিচয় ক্লিয়ার করে দিয়েছি।
– ওরে তোর পেটে পেটে এতো শয়তানি? আমি কোথায় ভাবছি এই ছেলেটা না তোকে লাইন মারছে।
– দিগন্ত ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আসছে আমার পেছনে লাইন মারতে। এখন স্কুলে যাবো তো
– আচ্ছা কাল কিন্তু বিকেল ৪টা মনে থাকে যেনো।
– আচ্ছা মনে থাকবে।
পরদিন,
বিকেল ৪টা,
গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছে অনল, অপেক্ষা কখন ধারা আসবে। বাড়ির গেটের দিকে চোখ যেতেই খেয়াল করলো ধারা আসছে। রুনঝুন নুপুরের আওয়াজ ধীরে ধীরে গাঢ়ো হচ্ছে, পরণে তার সাদা শাড়ি। দুধে আলতা গায়ের সাথে শাড়িটা লেগে আছে। অনল নেশাকাতর চোখে ধারার দিকে চেয়ে আছে, পলক পড়ছে না তার। অনলের চাহনী দেখে ধারার লজ্জায় গাল লাল বেগুনী হচ্ছিলো। আর না পেরে ধারা তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? যাবে না?
– আজ আমাকে একেবারে পাগল করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিস দেখছি।
– হয়েছে চলো এবার।
– অগত্যা, আজ নেশাখোরের মতোই গাড়ি চালাতে হবে।
– কেনো?
– জ্বলজ্যান্ত নেশার খনি যে আমার পাশে বসবে।
– ধুর! চলো।
বলে তাড়াতাড়ি গাড়িতে বসে ধারা। অনল হাসতে হাসতে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে। আপন মনে গাড়ি চলছে। ধারা শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে অনলকেই দেখে যাচ্ছে। কালো শার্ট এবং কালো জিন্সে খুব সুন্দর লাগছে তার বরকে। হাতাটা কনুই অবধি বটে রেখেছে, চুলগুলো কপালে পড়ে রয়েছে। আচ্ছা কোনো পুরুষ বুঝি এতো মাতালকরা সুন্দর হয়! হয় তার স্বামীটি এতোটাই সুন্দর। গাড়ি চালাতে চালাতেই অনল মুচকি হেসে বলে,
– এভাবে দেখতে থাকলে কিন্তু আমার নিজেরই লজ্জা লাগবে
– ক…কে দেখছে তোমাকে? গাড়ি চালাও তো
লজ্জায় তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয় ধারা। অনল মুচকি হেসে গাড়ি চালানোতে মন দেয়। শেষ বিকেলের দিকে রমনা পার্কে গিয়ে পৌছায় তারা। আজ মনে হচ্ছিলো এক জোড়া কিশোর কিশোরী তাদের নতুন নতুন প্রেমের সুবাধে ঘুরতে এসেছে। সারা পার্ক হাত ধরে তারা হেটেছে। একটা সময় বাদাম খাওয়ার জিদ করলে অনলকে দৌড়ে গিয়ে তার জন্য বাদাম কিনে আনতে হয়। ধারার ঠোঁটে হাসি যেনো ধরছিলো না। আজ অন্যরকম সুখ ছিলো তার মনে। এতোদিন পর নিজের স্বামীকে নিজের করে পেয়েছিলো সে। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর আইসক্রিম কিনে গাড়িতে উঠে অনল এবং ধারা। গাড়ি চালাতে চালাতে শুধু ধারার দিকে চোখ যাচ্ছিলো অনলের। ধারা তখন পুরো বাচ্চাদের মতো আইসক্রিম খাচ্ছিলো। ধারার বাচ্চামি দেখে অনল বলে উঠে,
– ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।
– আমাকে না দেখে গাড়ি চালাও
অনল ধারার থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তায় চোখ দেয়। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে একটা ট্রাক ব্রেক সামলাতে না পেরে এসে অনলের গাড়িটিকে এতো জোরে ধাক্কা দেয় যে অনল চেয়েও গাড়িটি ব্যালেন্স করতে পারে না। ট্রাকটির ধাক্কায় গাড়িটি নিমেষেই উল্টাতে থাকে। গাড়ির কাঁচগুলো ভেঙে চুড়মার হয়ে যায়। নিমেষেই ধারা এবং অনলের চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে যায়।
১০মাস পর,
স্থানঃ রমনা পার্ক
একটা কাঠের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে রয়েছে অনল এবং ধারা। সামনে কিছু ছোট ছেলেদের দল খেলছে। পড়ন্ত সূর্যের লাল আলোতে ধারার হাত ধরে পাশে বসে বাচ্চাদের খেলার দৃশ্যটি দেখতে খুব ভালো লাগছে অনলের। এই সময়টা পার্কে জনবল বেশি একটা থাকে না। ছুটির দিনগুলোতে এই সময়ে পার্কে বসে থাকতে বেশ লাগে অনলের। পড়ন্ত সূর্যের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে কোমল কন্ঠে বলে,
– আমার কাধে একটু মাথা রাখবি ধারা?
ধারা মুচকি হেসে অনলের কাধে মাথা রেখে বলে,
– তুমি প্রতিদিন এই বাচ্চাদের এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখো?
– একটা অজানা শান্তি দেয় জানিস তো! ছোটো ছোটো বাচ্চাদের হাসি, চঞ্চলতার মাঝে অন্যরকম আনন্দ আছে। ওদের কলরবের মাঝে আমি তোকে খুজি।
– আমি হয়তো তোমাকে সে সুখটা কোনোদিন দিতে পারবো না গো
– সব সুখ সবার কপালে থাকে না, ভাগ্যটা যে খুব পাষন্ড রে।
হঠাৎ একটা ছোট্ট মেয়ে এসে অনলের হাত ঝাকিয়ে বলে,
– ভাইজান আজকেও আপনি একা একা কথা কইতেছেন?
– একা কইরে আমার ধারা যে আমার সাথেই আছে।
– কই পাশে তো কেউ নাই। ধারা ভাবী কই?
বলে অনলের পাশে মেয়েটি বসতেই ধারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সেদিন এক্সিডেন্টে ধারাদের গাড়িটাকে ট্রাকটি সম্পূর্ণ পিসিয়ে ফেলেছিলো। ঘটনাস্থলে মানুষ পৌছাতে পৌছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ধারা এবং অনলকে হসপিটালে নেওয়ার আগেই ধারা এম্বুলেন্সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। অনলের অবস্থাও খুব খারাপ ছিলো, কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়। ১০ দিন পর যখন আই.সি.ইউ থেকে অনলকে বের করা হয় তখন ধারার মৃত্যুর খবর তাকে দেওয়া হয়। ধারার লাশটুকু দেখার ভাগ্য হয় নি অনলের। ধারার মৃত্যুটাকে একদম ই মেনে নিতে পারে নি অনল। পাগল্প্রায় হয়ে কেঁদেছিলো সে সেদিন। এক্সিডেন্টের জন্য মাথায় বেশ চোট পেয়েছিলো অনল। যার কারণে তার vascular dementia হয় যেখানে তার ব্রেইন বাস্তব অবাস্তবের ভেতর পার্থক্য করতে পারছে না। ধারার মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতাকে মানতে না পেরে অটোমেটিক অনলের ব্রেইন ধারাকে হেলুসিনেট করতে থাকে। সুভাসিনী বেগম বারবার অনলকে চিকিৎসা করাতে বলেন, এই রোগের চিকিৎসা না করালে এক না এক সময় পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবে নয়তো মৃত্যুও ঘটতে পারে তার। কিন্তু অনল এক কথা মানা করে দিয়েছে, তার কথা চিকিৎসা করালে ধারাকে আর হ্যালুসিনেট করতে পারবে না। তার ধারণা ধারা শারীরিকভাবে তার সাথে না থাকলেও এই রোগের জন্য সে তাকে দেখতে পাচ্ছে। আর এভাবেই বাকি জীবনটা কাটাবে সে, এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা। ছোট্ট মেয়েটির কথা শুনে মুচকি হেসে বলে,
– খুব পাপী মানুষ কিনা আমি তাই আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন আল্লাহ ওকে। ভালো মানুষদের আল্লাহ পৃথিবীতে বেশি দিন রাখেন না বুঝলি। পৃথিবীর কেউ ওকে দেখতে পারবে না। খুব সুন্দর একটা জায়গায় ও ঘুমিয়ে আছে।
– তাইলে যে কইলেন আপনার সাথেই আছে ধারা ভাবী?
– আছে তো, আমার কল্পনায়, আমার মনে সবসময় ও আছে। আমি চোখ বন্ধ করলেই ওকে দেখতে পাই। যখন কথা বলতে মন চায় বলি। তোর মাথায় ঢুকবে না এটা।
– আজকে বেলি ফুলের মালা নিবেন না?
– আমি কি কখনো নিতে ভুল করি? না নিলে খুব রাগ করবে ও।
বলে প্রতিবারের মতো একটা ১০০ টাকার নোট মেয়েটির হাতে ধরিয়ে একটা মালা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সূর্য ডুবে গেছে, এখনো লাল আভা রয়েছে গেছে আকাশে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে অনল। মনে মনে একটা কবিতা আওড়ে যাচ্ছে,
“এসেছিলে নীল ভালোবাসা নিয়ে
বেরঙ এক প্রেমীর জীবনে
শেষ বিকালের কোনো এক প্রহরে
লাল সূর্যের স্নিগ্ধ রশ্নির ন্যায়
আলোকিত করেছিলে
নিস্তব্ধ নগরী আমারই অগোচরে
নীল প্রেমের বেদনা দিয়ে
চলেই যখন যাবে
ক্ষনিকের জন্য কেনো এলে তবে
হয়তো একদিন নিষ্ঠুর ভাগ্যকে হারাবে
ক্ষুদ্ধ পরাজিত সেই প্রেমী
সেদিন মিলেমিশে একাকার
হয়ে যাবে কাগজের তুমি আমি ”
।।সমাপ্ত।।
মুশফিকা রহমান মৈথি
দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রেগ্ন্যান্সি কিট হাতে বসে আছে ধারা, কিটে দুটো দাগ স্পষ্ট। মাথাটা বেশি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আবেগের তাড়ণায় একটা ভুল করে ফেলেছে। ডান হাত দিয়ে মুখটি চেপে চাপা আর্তনাদ করতে লাগলো ধারা। চোখ থেকে পানি যেনো থামতেই চাচ্ছে না। এতো বড় কিভাবে করে ফেললো। বাবা-মা জানলে জ্যন্ত কবর দিয়ে দিবে তাকে। একজন অবিবাহিত মেয়ে যদি হুট করেই প্রেগ্ন্যান্ট হয়ে যায় ব্যপারটা সমাজ কিংবা ধর্ম কোনো কিছুই মেনে নিবে না। সে তখন হয়ে যাবে কলঙ্কিনী। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না ধারা। কয়েকদিন থেকেই মাথা ঘুরাচ্ছিলো তার, বমি বমি ভাব হচ্ছিলো। পিরিয়ড মিস হলে সন্দেহ হতে থাকে। ধারার সবথেকে ভালো বান্ধবী সারাকে ব্যাপারটা জানালে সে প্রেগ্ন্যান্সি কিট কিনে দিয়ে বলে টেস্ট করে দেখতে। এখন সেটাই করছিলো ধারা। মনের ভয়টাই সত্য হলো, তার মাঝে একটা রক্ত মাংসের মানুষ বেড়ে উঠছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরলো ধারা, এখন কি করবে? হুট করেই মনে হলো তার, দিগন্তকে একবার বললে হয়তো মন্দ হবে না। আর এমনিতেও ওকে জানানোটা এখন খুব বেশি দরকার। তার একটি অংশ ধারার গর্ভে বেড়ে উঠছে। এটা তো তাদের ভালোবাসার প্রতীক, আবগের বশে হলেও তারা একে অপরকে ভালোবেসেই কাছে এসেছিলো। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো ধারা। বসে থাকলে হবে না, একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। এখন ভেঙ্গে পড়লে কিভাবে চলবে! এখনও তো অনেক পথ চলা বাকি, না জানি কত পরীক্ষা বাকি হয়েছে তার জন্য, আর তাকে তো লড়তে হবে তার ভালোবাসার জন্য, নিজের জন্য, নিজের অনাগত সন্তানের জন্য
সকাল ৯টা,
ভার্সিটির বটগাছের নিচে বসে আছে ধারা। বিগত আধা ঘটা ধরে অপেক্ষা করছে দিগন্তের জন্য। অপেক্ষার প্রহর যেনো পার ই হতে চাচ্ছে না। এটা যেনো তার জীবনের সবথেকে দীর্ঘ আধা ঘন্টা। মানুষ যখন নির্বিকার হয়ে বসে থাকে, তখন অতীত বারবার চোখের সামনে হানা দেয়। যেমনটা হচ্ছে ধারার ক্ষেত্রে। ধারা তখন বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রী। এমনই একটা কুয়াশা ঢাকা সকালে ভার্সিটির গেটে দেখা হয়েছিলো দিগন্তের সাথে। দিগন্ত তখন ভূগোলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হঠাৎ বাইকের ধাক্কায় অন্যমনস্ক ধারা খানিকটা ছিটকে পড়েছিলো। এটা অবশ্য, ধারার অন্যমনস্ক হয়ে চলার আর দিগন্তের বাইকের হাই স্পিডের কারণেই হয়েছিলো। অনুশোচনার বশে তাড়াতাড়ি হেলমেট খুলে ছুটে গিয়েছিলো দিগন্ত ধারার কাছে। ধারা তখন নিজের পায়ে ক্ষত সামলাতে ব্যাস্ত ছিলো। পায়ে কি ব্যাথাটাই না পেয়েছিলো। প্রথম দেখাতে সাদা কামিজ, গোলাপি ওড়না পরিহিত গোলগাল পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটিকে মনে ধরেছিলো দিগন্তের। কোমল গলায় তখন তাকে জিজ্ঞেস করে,
– বেশি ব্যাথা লেগেছে? আই এম সরি। তাড়াতে ছিলাম খেয়াল করি নি।
মাথাতুলে সামনে হাটু গেড়ে থাকা শ্যামলা ছেলেটাকে এক নজরে দেখে যাচ্ছিলো ধারা। এতো সুন্দর করেও কি কেউ কথা বলতে পারে? প্রথমে ভেবেছিলো বেশ কড়া করে কটা কথা শুনিয়ে দিবে ধারা। কিন্তু দিগন্তের চোখের দিকে তাকাতেই কেমন যেনো সব গবলেট হয়ে গেছিলো। বকা তো দূরে থাক একটা কড়া কথাও মুখ থেকে বের হয় নি ধারার। উলটো কোনো অজানা কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিলো, লোকটার মুখ থেকে চোখ ই সরছিলো না ধারা।
– এতো কিসের জরুরি তলব তোমার? এই সাতসকালে দৌড়াতে দৌড়েতে আসতে হলো। জানোই শীতের সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গতে চায় না।
দিগন্তের হিনহিনে গলার কাটকাট কথা শুনে কল্পনার থেকে বের হয় ধারা। হ্যা তার সামনে আড়াই বছর আগের দিগন্ত ই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আফসোস একটাই, এখনের দিগন্ত আর তখনের দিগন্তের মাঝে বেশ পার্থক্য। ধারা সেটা বুঝতে যে পারে না সেটা না, তবে এখনও সে দিগন্তকে পাগলের মতোই ভালোবাসে। ধারাক হা করে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রুজোড়া একত্রিত করে টিটকারির স্বরেই বলে,
– আমাকে কি প্রথম দেখছো নাকি? এমন হা করে দেখার মতো রুপ গজিয়েছে নাকি?
– নিজের সন্তানের বাবাকে দেখছি, যে লোকটা কিনা নয় মাস পর একটা জ্বলজ্যান্ত বাচ্চার বাবা হবে তাকে হয়তো হা করে দেখাটা খারাপ কিছু না, তাই না?
ধারার নির্লিপ্ত কন্ঠের কথাটা শুনে দিগন্তের চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না দিগন্ত। অনেকটা ভুত দেখার মতো ঘাবড়ে যায় সে। অস্পষ্ট স্বরে ধারাকে বলে,
– সকাল সকাল কি ফাযলামি করছো তুমি? পাগল টাগল হয়ে গেছো নাকি?
– আমি ফাযলামি করছি না দিগন্ত। আজ সকালেই এক করেছি, আমার মাথায় কিছুই আসছে না। অনেক বড় ভুল অয়ে গেছে দিগন্ত। এখন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না, তাই তোমাকে ফোন করে এখানে আসতে বলেছি
– কি আর করবো, এবোর্শন ছাড়া আর কি উপায় আছে। আমরা কালকে ডাক্তারের কাছে যাবো
দিগন্তের নির্বিকার উত্তরে মাথায় বাজ পড়ে ধারার। কি বলবে কথা হারিয়ে ফেলেছে সে, যতই হোক বাচ্চাটা তাদের দুজনেরই অংশ। তাদের ভালোবাসার নিশানী। দিগন্ত কোনো চিন্তা না করেই কিভাবে বলে দিলো সে বাচ্চাটিকে নষ্ট করে দিবে। দিগন্তের কথাটি শুনে অজান্তেই চোখজোড়া ভিজে আসে ধারার। যদিও কেবল একটি ভ্রুণ তার গর্ভে আছে কিন্তু সেত মা, কিভাবে নিজের জানা সত্ত্বে মেরে ফেলবে বাচ্চাটিকে, আর পাপ তো তারা করেছে; বাচ্চাটি তো নির্দোষ। অনেক কষ্টে ভাঙ্গা গলায় বলে,
– দিগন্ত, কি বলছো তুমি? বাচ্চা নষ্ট করার কথা আমি ভাবতেও পারি না। ও আমাদের
– ধারা বি প্রাকটিক্যাল, আমি তো জানতাম তুমি খুব প্রাকটিক্যাল একজন মানুষ। এখন এমোশোনাল ন্যাকামি করার সময় নয়। আমি এখন মাস্টার্স করছি, চাকরি পাই নি। এখন এই বাচ্চাটাকে রাখা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল দেওয়া। বুঝতে পারছো তুমি? আমাকে এখনই তোমার পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই ধারা। আমার ক্যারিয়ার আছে ভবিষ্যৎ আছে। আর তুমিও একটু ভেবে দেখো তুমি কি রেডি এই বাচ্চার জন্য?
– আসলেই আমার ভাবা উচিত ছিলো
– তাহলে কাল সকালে আমরা ডাক্তারের কাছে যাব, ওকে?
দিগন্তের কথা শুনে স্মিত হেসে ধারা বলে,
– আমার তোমাকে নিয়ে ভাবা উচিত ছিল দিগ, আবেগের বশে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে কি ভুলটাই না করে ফেলেছি। ইশ তখন যদি একটু ভাবতাম
– ধারা
– ব্যাপার না, তোমার এই বাচ্চাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আসি
বলেই ধারা সামনে পা বাড়ায়, পেছনে ফিরে দিগন্তের অনুতাপে ঘেরা মুখটা একবার দেখার ইচ্ছে হলেও নিজেকে সংযত করে। সামনে তার অনেক চলা বাকি, এখন পেছনে তাকালে হয়তো আবার দূর্বল হয়ে পড়বে। চোখের পানি অঝরেই পরছে, কি ভুলটাই না করেছে সে।
রাস্তায় হাটছে ধারা, শরীর যেনো চলতেই চাচ্ছে না ধারার। শরীর ছেড়ে দিয়েছে, মাথাতা ঘুরোচ্ছে। বমিও পাচ্ছে। রোদটা বেশ চড়া হয়ে উঠেছে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। শরীরটা গুলিয়ে আসছে। হঠাৎ বেশ বমি আসায় রাস্তার ধারেই গরগর করে বমি করলো ধারা। যাকে বিশ্বাস করেছিলো, সে আজ বিশ্বাসটাকে এতো নিষ্ঠুরের মতো ভেঙ্গে দিলো এটা যেনো মেতে নিতেই পারছে না ধারা। রাস্তার ধারে একটা পানির বোতল কিনে সেটা দিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলো ধারা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটাকে নিয়ে রাস্তা পার হতে নিলে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায়, সামনে যেনো অন্ধকার ছেয়ে আসে। গাড়ির হর্ণ কানে আসছে, পাশে তাকাতেই দেখে খুব স্পিডে একটি গাড়ি এগিয়ে আসছে। ধারার পা থেমে গেলো, হয়তো এটাই তার পরিণতি। এই ভালো বাবা-মার মুখে কালি মাখার থেকে এই পরিণতিটাকে মাথা পেতে নেওয়াটা হয়তো ঢের ভালো। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো ধারার, তলিয়ে যাচ্ছে সে অন্ধকারের কোঠরে
বিকেল ৫টা,
ধারার যখন চোখ খুলে তখন সে সাদা বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে। সে মরে নি, এখনো বেঁচে আছে। সমাজের নিম্মজীব হয়ে সারাটাজীবন অতিবাহিত করার জন্য সে বেঁচে আছে। পরমূহুর্তেই নিজের কাজে নিজের উপরেই রাগ উঠে ধারার। কি করছিলো সে। একে এক পাপ করেছে, এখন আরো বড় পাপ করতে যাচ্ছিলো। অজান্তেই পেটে হাত চলে গেলো তার।
– সমস্যা নেই, বেঁচে আছে। কোনো ক্ষতি হয় নি
কারোর কড়া কন্ঠ কানে এলে পাশে ফিরে তাকায় ধারা। পাশের ব্যাক্তিটিকে দেখে অটোমেটিক গলা শুকিয়ে যায় তার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। পাশে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগে ধারার। কিছু বলতে যাবে তার আগেই…………
চলবে
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
সূচনা পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
২য় পর্ব
কারোর কড়া কন্ঠ কানে এলে পাশে ফিরে তাকায় ধারা। পাশের ব্যাক্তিটিকে দেখে অটোমেটিক গলা শুকিয়ে যায় তার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। পাশে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগে ধারার। কিছু বলতে যাবে তার আগেই লোকটা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
– অকাম কুকাম করে পেট ফু্লিয়ে রাস্তায় মরতে যাওয়াটা কি এখন তোদের ট্রেন্ড হয়ে গেছে? ভাগ্যিস কাকতালীয়ভাবে গাড়িটা আমার ছিলো। তুই ও বেছে বেছে আমার গাড়ির সামনেই মরতে গিয়েছিলি। তা মরার সিদ্ধান্ত কি জন্য নিয়েছিস? এর বাবা অস্বীকার করেছে নাকি জানিস ই না এই জিনিসের বাবা কে? সমস্যা নেই একটু পর মামা-মামী এসে নিজের হাতেই তোকে মেরে ফেলবে।
লোকটার কথার ছিরি যে কোনো মানুষের মানুষের মেজাজ খারাপ করে দেবার জন্য যথেষ্ট। রাগে, লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো হজম করতে হবে ধারার। লোকটি আর কেউ নয় তার ফুফাতো ভাই অনল। অনলকে কখনোই ধারার খুব একটা ভালো লাগে না। লোকটাকে নিতান্তই খচ্চর লাগে, এই লোকটা নাকি পেশায় ডাক্তার। কিন্তু ধারার মাথায় একটা কথা আসেই না। এতো করোলা মিশ্রিত কথা শোনার পর কোন প্যাশেন্ট আসে তার কাছে। অনলের দোষ অনেক; তার মধ্যে অন্যতম হলো লাগাম ছাড়া কথা বলে, এমন এমন কথা বলবে যেটা একই সাথে কাউকে রাগ এবং লজ্জা দুটো জিনিসের অনুভব করাতে সক্ষম। কিন্তু ধারা তাকে পালটা উত্তর দিতে পারবে না। কারণ প্রথমত অনল তার থেকে বয়সে অনেক বড়, দ্বিতীয়ত ধারা সত্যি মস্ত বড় ভূল করেছে যার জন্য তাকে সমাজের কাছে এর চেয়েও ঘৃণ্য কথা শুনতে হবে। আর যদি একবার তার বাবা জানতে পারে তাহলে তো তার নিস্তার নেই। কাঁপা কাঁপা স্বরে ধারা অনলকে জিজ্ঞেস করে,
– তুমি কি বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছো?
– না জানানোর কোনো কারণ তো আমি খুজে পাই নি। তারা অন দ্যা অয়ে, তবে তোমার কুকর্মের কথা আমি জানাই নি। মামা শুনলে আবার আই.সি.উ তে এডমিট হবেন। তাই ফোনে এতো বড় শকিং নিউজ টা দেই নি
নির্বিকার ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলে দিলো অনল। মোট কথা তার কিছুই যায় আসে না, মামাতো বোন বলে যেটুকু না করলেই নয় সেটুকুই করেছে সে। ধারার বুকটা রীতিমতো ধুকপুক করছে। ব্যাপারটা চাইলেও সে লুকাতে পারবে না মা-বাবার কাছ থেকে। অনল না হয় এখন কিছু বলে নি, কিন্তু তারা হাসপাতালে আসলেই তো সব জেনে যাবে। উফফ মাথাটায় কিছুই ঢুকছে না, বাবার রাগ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে ধারার। ধারার বাবা, সেলিম সাহেব খুব কড়া একজন মানুষ। তার কাছে নিজের আত্নসম্মানের চেয়ে বড় কিছুই নয়। আজ পর্যন্ত সম্মানহানির ভয়ে একটা টাকা ঘুষ খাননি তিনি। ছাব্বিশ বছরের চাকরি জীবনে তার প্রোফাইল একেবারেই নীট এন্ড ক্লিন। আর আট মাস পর রিটায়ার্ড করবেন তিনি। দুই মেয়ে তার অহংকার। সারাজীবন বেশ ছা পোষা জীবন অতিবাহিত করার উদ্দেশ্য একটাই যাতে তার দুই মেয়েকে সব ধরণের ভালো শিক্ষা দিতে পারেন, কোনো কুপ্রবৃত্তি মেয়েদের ছুতেও না পারে। অথচ আজ ধারার একটা ভূল তাকে সারাজীবনের জন্য লজ্জায় মাথা নিচু করে বাঁচতে বাধ্য করবে। কথাটা ভাবতেই হু হু করে কেঁদে উঠে ধারা। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে অঝরে কাঁদতে থাকে সে। যে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে এতোবড় ভূল করলো সেই ভালোবাসা আজ তাকে অস্বীকার করছে, তাকে ইমোশনাল ফুল বলছে। দিগন্তের কথাটা কি মেনে নিলে ঠিক হতো, এবোর্শন করালে কি এই সব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে ধারা!! দ্বিধার একটা সাগরের মাঝে সাতার কাটছে ধারা কি করবে কিছুতেই যেনো বুঝে উঠতে পারছে না।
– এখন ন্যাকা কাঁদা কেঁদে কি হবে? যা কুকাম করার তাতো করেই ফেলেছিস। এখন কেঁদে ভাসালেও কিছুই হবে না। এই কান্নাটা আগে কাঁদলে কাজে দিতো।
অনলের ঠেস মারা কথায় ধারার আরোও কান্না পাচ্ছে। নাক টানতে টানতে কাঁন্নামিশ্রিত গলায় বলে,
– তুমি এমন খচ্চর কেনো অনল ভাই? মানুষ তো শান্তনাও দিতে পারে নাকি!!
– হাহ! এসব শান্তনার মতো ফাউ কাজ আমার দ্বারা কোনো জন্মে হয় নি, হবে ও না। এখন ফ্যাচফ্যাচানি থামা, নয়তো একটা থাপ্পড় মেরে সব কান্না বের করে দিবো।
অনলের ধমকে একেবারেই চুপ হয়ে গেলো ধারা। নিঃশব্দে চোখ থেকে পানি পড়ে যাচ্ছে ধারার। অনলের কেনো যেনো এই কান্না নামক জিনিসটা সহ্য হয় না। বিরক্তিপ্রকাশক শব্দ করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সে। ধারা তখন ও ভবিষ্যতের অপরিণতি ভেবে কেঁদেই যাচ্ছে।
রুম থেকে বের হতেই ধারার বাবা সেলিম সাহেব, মা সুরাইয়া বেগম এবং নিজের মা সুভাসিনী বেগমের সাথে সামনাসামনি হয় অনলের। তারা বেশ হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে পৌছেছেন। মেয়ের এমন এক্সিডেন্টের কথা শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন সেলিম সাহেব এবং সুরাইয়া বেগম। তাই বড় বোন সুভাসিনী বেগমকেও ডেকে এনেছেন তারা। সুভাসিনী বেগম অনলের মা, অনল অবশ্য তাকে এই ব্যাপারটা একদম ই জানায় নি। শুধুশুধু মাকে চিন্তায় ফেলতে চায় নি সে। অনলকে দেখে সেলিম সাহেবের প্রথম প্রশ্ন থাকে,
– ধারার কি অবস্থা? হাড় গোড় ভাঙ্গে নি তো?
– না মামু, কিছু হয় নি তেমন তবে
অনল কিছু বলার আগেই একটি নার্স রিপোর্টের একটা ফাইল নিয়ে অনলের সামনে ধারায়। অনল তার দিকে তাকাতেই সে বলে,
– স্যার, মিস ধারার রিপোর্ট চলে এসেছে। তিনি চাইলে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এবোর্শন করতে পারবেন কিন্তু স্যার কম্পলিকেশন আছে। আপনাকে ডা.মাহির সাথে কথা বলতে হবে।
হুট করে নার্সের এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে যান সেলিম সাহেব। উত্তরের অপেক্ষায় অনলের মুখপানে তাকিয়ে থাকেন তিনি। অনল বেশ অপ্রস্তুতকর অবস্থায় পড়ে গেছে। সে এভাবে এই নিউজটা মোটেই জানাতে চায় নি মামু-মামিমাকে। আসলে এই রিপোর্টটা খানিকক্ষণ আগেই করতে পাঠিয়ে ছিলো সে, ভেবেছিলো এই রিপোর্টটা হাতে পেলে মামু-মামিমাকে ধীরে সুস্থে জানাবে। কিন্তু কোথায় কি! ধুমধাম করে সিনেমার মতো তারা ব্যাপারটা জেনে গেলো। সেলিম সাহেব বেশ ঠান্ডা গলায় অনলকে জিজ্ঞেস করে,
– অনল, নার্স কি বললো? কিসের এবোর্শন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনল বলে,
– মামু কিছু কথা বলবো, ঠান্ডা মাথায় শুনবেন
কেবিনে হাটুতে মুখ গুজে কেঁদেই যাচ্ছে ধারা। নিচের বোকামির উপর নিজের রাগ উঠছে, আবার পরমূহুর্তে নিজেকে বড্ডবেশি অসহায় মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে অথৈ জলে সাতার না পারা অবস্থাতেই পড়ে গেছে। হাসফাস হচ্ছে কিন্তু কুল পাচ্ছে না। বাবা-মা আসলো বলে, অনল তো তাদের সব বলে দিবে তখন কি হবে! এসব চিন্তায় মগ্ন ছিলো ঠিক তখনই কেউ এসে অতর্কিতে তার চুলের মুঠি টেনে সজোরে গালে চড় বসিয়ে দেয়। অবাক নয়নে তাকাতেই দেখে সামনে তার বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখের অশ্রু প্রমাণ দিচ্ছে আজ কতোটা ছোটো হয়ে গেছেন তারা। ধারা কিছু বুঝে উঠার আগেই আবারো আরেক গালে চড় বসিয়ে দেন সুরাইয়া বেগম। গলা চেপে কান্নামিশ্রিত গলায় বলেন,
– হওয়ার সময় মেরে ফেললে আজ এই দিনটা দেখতে হতো না। তুই আজকে মরে যেতে পারলি না। আমাদের ভালোবাসার এমন ফল দিলি তুই? কুলাঙ্গার সন্তার জন্ম দিয়েছি আমি। কত গর্ব করতাম আমি তোকে নিয়ে, ছিঃ
বলেই এলোপাতাড়ি মারতে থাকে ধারাকে। অবস্থা খারাপ দেখে সুভাসিনী বেগম এগিয়ে যান, সুরাইয়া বেগমকে কোনো মতে আটকে রেখে বলে,
– সুরাইয়া এতো বড় মেয়ের গায়ে কি কেউ হাত তুলে নাকি! শান্ত হও তুমি
সুরাইয়া বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে থাকেন। একে অবিবাহিত মেয়ে, সমাজ না জানি কি বলবে মেয়েটাকে নিয়ে। এসব চিন্তা মাথায় আসতেই আরো হু হু করে কেঁদে উঠেন তিনি। সেলিম সাহেব যেনো পাথর হয়ে গেছেন। নিজের মেয়ে এমন একটা কাজ করবে এ যেনো কল্পনার বাহিরে। পা তার কাঁপছে। মাথায় ঘাম জমে আছে। ধুপ করে পাশে থাকা চেয়ারটিতে বসে পড়েন সে। ধারা বাবার চোখে চোখ অবধি রাখতে পারছে না। অনল অবস্থা বেগতিক দেখে ঠান্ডা গলায় বলে,
– মামু, আমরা ধারাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো। ওর সেলাইন শেষ হয়ে গেছে।
রাত ৮টা,
বসার রুমে চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে আছেন সেলিম সাহেব। তার মুখ থেকে একটা কথাও বের হচ্ছে না। সুরাইয়া বেগম আচলে মুখ গুজে কাঁদছেন। সুভাসিনী বেগম তাকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন। অনল অপজিটের সোফায় বসা। চোখ জোড়া মুছে, সুরাইয়া বেগম জোড়ালো গলায় বললেন,
– অনল, আমরা এই সপ্তাহের মধ্যেই এবোর্শন করবো।
– সুরাইয়া এবোর্শন করলে কি এই দাগ মুছে ফেলা সম্ভব?
সুভাসিনী বেগম চিন্তিত গলায় কথাটা বলে উঠে। তার কথা উপেক্ষা করেই সুরাইয়া বেগম বলেন,
– আচ্ছা আপা, আপনার মেয়ে হলে কি করতেন বলুন তো? আমার মেয়ের ভবিষ্যত পড়ে আছে। এই বাচ্চাটা রাখলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
– মামী, এবোর্শন করলে এমন ও হতে পারে ধারা আর কোনোদিন মা হতে পারবে না। কিছু কম্পলিকেশন আছে। আমি আমার কলিগ গাইনোকোলোজিস্ট এর সাথে কথা বলেছি। ও এই কথাটা বললো। এখন আপনাদের ডিসিশন
অনলের এমন কথায় সেলিম সাহেব যেনো আরো ভেঙ্গে পড়েন। সুরাইয়া বেগম তবুও অটল গলায় বলেন,
– তুমি তবুও ব্যাবস্থা করো বাবা
নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বুকে কামড় লাগে ধারার। বাচ্চা নষ্টই যদি করতে হয় তবে তো দিগন্তের কথায় সে রাজী হয়ে যেতো। তার ভুলের শাস্তি এই মাসুম কেনো পাবে। দৌড়ে যেয়ে মায়ের কাছে আছে ধারা। আকুতি স্বরে বলে,
– মা, আমার বাচ্চাকে মেরো না। ওর কি দোষ বলো। এমন নিষ্ঠুর হয়ো না মা। প্লিজ
ধারার অঝরে আকুতি করে কাঁদছে, এই কান্না পাথরের মন গলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সুরাইয়া বেগম তার সিদ্ধান্তে অটল। এখন সেলিম সাহেব মুখ খুলেন,
– আমাদের মান সম্মান তো ধুলায় মিশিয়েছো ই এখন কি আত্নহত্যা করলে শান্তি পাবে তুমি?
সেলিম সাহেবের মুখে এরুপ কথা শুনে একেবারেই চুপ হয়ে যায় ধারা। সুভাসিনী বেগম এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। ধারার এমন আকুতি দেখে মনে মনে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। বেশ ঠান্ডা গলায় বললেন……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
৩য় পর্ব
সুভাসিনী বেগম এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। ধারার এমন আকুতি দেখে মনে মনে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। বেশ ঠান্ডা গলায় বললেন,
– সেলিম, ধারার বাচ্চাকে মেরে ফেলাটা কখনোই কোনো সমাধান নয়। এর চেয়ে বরং ধারার বিয়ের ব্যবস্থা করো। এই সপ্তাহে ধারার বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে।
সুভাসিনী বেগমের এমন কথায় সেলিম সাহেব যেনো অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে যান। তার বড় বোন হুট করেই একটা কথা বলে ফেললেন যা তার বুঝার বেশ বাহিরে। অবাক হয়ে সেলিম সাহেব বলেন,
– আপা, মাথা কি গেছে তোমার? কি বলতেছো? ধারার বিয়ের ব্যবস্থা মানে? এই অবস্থায় কে করবে ওকে বিয়ে? যে জানবে সেই তো কু কথা বলে মুখে থুথু ছিটিয়ে চলে যাবে। আর এমন ছেলে পাবো কই যে সব জেনেও ধারাকে আপন করে নিবে!
– এমন ছেলের সাথেই বিয়ে হবে যে সব কিছু জানবে। দেখো এখন একটা ভুল শুধরাতে যেয়ে আমরা তো নতুন করে ভুল করতে পারি না। আর বাচ্চাটাকে মারার আমরা কে?
সুভাসিনী বেগমের ঘোলাতে কথা সেলিম সাহেব সহ কারোর ই মাথায় ঢুকছে না। অনল তো অবাক নয়নে শুধু তার মাকে দেখে যাচ্ছে। ধারার প্রতি তার মায়ের একটু বেশি টান আছে তা অনলের বেশ ভালোকরেই জানা আছে। কিন্তু টানের কারণে যে পাগলের প্রলাপ দিবে এটা যেনো হজম হচ্ছে না। গলা খাকারি দিয়ে অনল বললো,
– মা, একটু খলসা করে বলবে কি বলতে চাও?
সুভাসিনী বেগম এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠান্ডা গলায় বললেন,
– আমি ধারা মায়ের বিয়ে আমার অনলের সাথে দিতে চাই। তাতে যদি তোমাদের কোনো আপত্তি থাকে তবে বলো?
সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার বক্তব্য সবার ঘাম ধরাতে যথেষ্ট। উনি যতটা স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতে কথাটা বললেন, ততটাই তীব্রগতিতে ধারা এবং অনলের মাথায় বজ্রপাত ঘটলো। অনল এবার যেনো নিশ্চিত হয়ে গেলো তার মা ভাতিজীর শোকে পাগল হয়ে গেছে। নয়তো সব জানা সত্ত্বেও এতো বড় একটা কথা পারতে পারতো না। সেলিম সাহেব পুনরায় অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– আপা, তুমি ভেবে বলতেছো তো? অনলের সাথে বিয়ে এটা কিভাবে সম্ভব?
– আমি সব ভেবেই বলছি। আমি এবং অনল এই বাচ্চার ব্যাপারে সব জানি। আর আমার ছেলে, পাত্র হিসেবে তো খারাপ নয়। এখন তোমাদের আপত্তি থাকলে বলতে পারো
– কিন্তু আপা তুমি অনলের কথাটা একটু ভেবে দেখো। আমার মেয়ের জন্য সে তার জীবনটা কেনো নষ্ট করবে?
– সেটা আমি বুঝে নিবো, তোমরা বিয়ের ব্যাবস্থা করো।
সুভাসিনী বেগমের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলো অনল। তার মার উপরে কখনোই কোনো কথা বলতে পারে নি সে। কিন্তু মার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা যে সুভাসিনী বেগম জানেন না তাও নয় তবুও, তবুও জিদে বসে আছেন। অনল কোনো কথা না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। ওখানে থেকে তার মাকে বুঝানো সম্ভব নয়। সেলিম সাহেবের কি এখন খুশি হওয়া উচিত নাকি চিন্তা করা উচিত বুঝে উঠতে পারছেন না। নিজের বোনের বাড়িতে মেয়েটা বউ হয়ে যাবে এটাতো বেশ আনন্দের সংবাদ। নিজের বোন সব জেনেও তার ছেলের বউ বানাচ্ছে ধারাকে এটা ভেবেই মনে একটা স্বস্তি আভাস হচ্ছে তার কিন্তু অনল সব কিছু জানার পর ও কি ধারাকে মেনে নিবে! সেলিম সাহেব বেশ ভালো করেই জানেন তার বোন একবার বলে ফেলেছেন যখন তখন এই বিয়ে হবেই তবুও একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। ধারা চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না, আজ যদি দিগন্ত তাকে সাপোর্ট করতো তাহলে হয়তো এই দিনটাই দেখতে হতো না। বারবার নিজের মনে একটা চিন্তাই ঘুরছে তার এবং তার বাচ্চার পরিণতিটা কি হবে
রাত ১১টা,
নিজের রুমের সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে অনলের। সব ভেঙ্গে ফেললে হয়তো শান্তি হতো তার। মায়ের উপর মারাত্নক রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। অনলের বাবা রাজ্জাক সাহেবের সাথে সুভাসিনী বেগমের ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে অনলের সব কিছুই তার মা ছিলো। তার কাছে মা সবচেয়ে উপরে। আজ পর্যন্ত মা যা বলে এসেছে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সে। কিন্তু ধারাকে বিয়ে করার কথাটা যেনো মানতেই পারছে না। তার অগোছালো জীবনে কাউকে আনার কথা ভাবতেই পারে না অনল। রাগের বশে ধাপ করে টেবিলের উপর একটা কিল দিয়ে বসলো সে।
– আমার রাগ নির্জীবের উপর ঝেড়ে কি আদৌ শান্তি পাবে?
সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার কথাটা শুনে চমকে উঠে অনল। পেছনে ফিরে দেখে সুভাসিনী বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে মাত্রাতিরিক্ত স্বাভাবিক লাগছে। নিজেকে শান্ত করে অনল জিজ্ঞেস করে,
– তুমি ঘুমাও নি?
– তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো
– আমি বিয়ে করতে পারবো না মা
– কেনো?
সুভাসিনী বেগমের নির্বিকার ভঙ্গিমাতে প্রশ্ন করা দেখে অনল আরো অবাক হয়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোয়াল শক্ত করে বলে,
– তোমার তো অজানা নয় মা, তুমি ধারার জীবন সাজানোর নামে আরো এলোমেলো করে দিচ্ছো। আমি অকে কেনো কাউকেই নিজের জীবনে আসার অনুমতি দিবো না। একজন মৃত মানুষ কখনোই কারোর নবজীবনদাতা হতে পারে না মা। তোমার তো অজানা নয় একথা। আমি তো অনেক আগেই মরে গেছি। এখন আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়
– নবজীবন নাই দিতে পারলো কিন্তু খড়কুটোর মতো বাঁচাতে তো সাহায্য করতে পারে।
অনল অবাক চোখে তাকাতেই তিনি আবার বলেন,
– ধারার এখন অবস্থাটা তোমার অজানা নয়। সে যাকে বিশ্বাস করেছে সে তাকে ঠকিয়েছে। ওই ছেলেটা হয়তো এই বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। নয়তো ধারা একবার হলেও জোর গলায় বলতো আমার বাচ্চার বাবা বেঁচে আছে, তোমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছো কেনো? আমি ধারাকে তোমার সাথে বিয়ে দিচ্ছে একটা কারণে যাতে মেয়েটা সম্মানের সাথে বাঁচতে পারে। তুমি তাকে ভালোবাসবে না, স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না কিন্তু একটা পরিচয় তো দিতেই পারো। তার বাচ্চাটাকে নিজের নাম তো দিতেই পারো। সেটাতেও কি বাঁধা আছে?
– কিন্তু মা?
– এমন ও তো হতে পারে, যে আসছে সে তোমাকে বাঁচতে শিখাবে। নতুন করে উজ্জীবিত হতে উদ্দীপ্ত করবে। হতে পারে না? তোমার আত্নাটা মরে গেছে অনল। কিন্তু সেটা বাঁচবে না এমন কোনো কথা কিন্তু নেই। একটা মানুষ কিন্তু আবার প্রেমে পড়তে পারে, ভালোবাসতে পারে, বাঁচতে পারে। আর এটা আমার শেষ ইচ্ছে বলেও মেনে নিতে পারো। বয়স তো কম হলো না, একটা পুত্রবধু, নাতী পেলে কি খুব খারাপ হবে? আমি জানি, আমাকে তোমার খুব স্বার্থপর মনে হতে পারে। আমি সত্যি ই স্বার্থপর, এক ঢিলে তিন পাখি মারার চেষ্টায় আছি। কি করবো বলো, আমি ও তো মা। ধারার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পেয়েছিলাম। মেয়েটা তার বাচ্চাকে বাঁচাতে চায়। তার জন্য লড়াই করতে চায়। এটা কি খুব অন্যায় দাবি? হ্যা সে ভুল করেছে। হয়তো তার জায়গায় অন্য কেউ হলে এই ভুলটা করতো না কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করাটা হয়তো এতো বড় ভুল ও নয়। সেই মানুষটা তার হাত ছেড়ে দিয়েছে। এটার শাস্তি এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে না নিশ্চয়ই। তাই না? তুমি ভেবে দেখো এক সপ্তাহ তো আছে। তোমার আপত্তি থাকলে আমি অন্য ব্যাবস্থা নিবো।
বলেই সুভাসিনী বেগম নিজের রুমে জন্য পা বাড়ালেন। তার প্রতিটি কথা অনলের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আসলেই কি আবার বাঁচাটা সম্ভব? আবার ভালোবাসাটা সম্ভব?
সকাল ৯টা,
সারারাত নির্ঘুম কেটেছে ধারার। চোখ মুখ ফুলে আছে। চোখগুলো অবিরাম ধারা বর্ষনে ক্লান্ত। শরীরটাও ভালো নেই। এতো চাপ এই সময়ে নেওয়াটা বাচ্চার জন্য ভালো নয়, কিন্তু এমন একটা ভাগ্য যে এতো সুন্দর সময়টা তার গলার কাটা হয়ে গেছে। একটা নারীকে মাতৃত্ব পরিপূর্ণ করে কিন্তু তার দূর্ভাগ্য এতোটাই যে এই মাতৃত্ব তাকে সমাজের কলঙ্কিনীর পরিচয় দিচ্ছে। সুরাইয়া বেগম একবারো তার সাথে কথা বলছেন না। আর সেলিম সাহেব নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। সব দেখছে আর প্রতিক্ষনে হাজারো বার মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করছে ধারা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের হিসাব মিলাতে যখন ব্যস্ত ধারা তখন……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
৪র্থ পর্ব
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের হিসাব মিলাতে যখন ব্যস্ত ধারা তখন পাশ থেকে শুনতে পায়,
– সেদিনও বলেছিলাম যা কুকাম করার তাতো করেই ফেলেছিস। এখন কেঁদে ভাসালেও কিছুই হবে না। তবুও তুই সেই ফ্যাছফ্যাছানি কান্না লাগিয়েই রেখেছিস। সারাটাজীবন আমার এখন তোর এই মরা কান্নাই দেখতে হবে।
অনলের কথা কানে আসতেই পেছন ফিরে তাকায় ধারা। একটা সাদা শার্ট এবং কালো জিন্স পড়ে বেশ আল্লু আর্জুনের মতো পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনল। অনল দেখতে অনেকটাই সাউথের হিরোদের মতো, ছয় ফুট লম্বা, সুঠাম দেহী, শ্যাম বর্ণের একটি ছেলে। যেকোনো মেয়ে দেখলে ক্রাস খেয়ে যেতে পারে। চুলগুলো চোখের উপরে এতো সুন্দর ভাবে পড়ে থাকে যা তাকে আরো হ্যান্ডসাম এর কোটায় ফেলে। এতো সুন্দর মুখে সবচেয়ে মাতাল করা হলো তার উদাসীন চোখ জোড়া। সেখানে কাউকে হারিয়ে ফেলার বেদনা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মুখ খুললেই যে কারোর ইম্প্রেশন খারাপ হয়ে যাবে। ধারার তো মনে হয় তার ফুপি অনলকে কোনোদিন মধুই ছোয়ায় নি। করলার মতো কড়া আর তেতো বুলি শুনতে পাওয়া যায়। মুখটা ঘুরিয়ে দৃষ্টি বাহিরে দিয়ে উদাস কন্ঠে ধারা বলে,
– মজা নিতে এসেছো?
– জীবনটা আমাকে একটা মজা বানিয়ে রেখে দিয়েছে, আমি কার মজা নিবো বল?
অনলের কথাটা খুব যে বোধগম্য হলো তা নয়, কিন্তু উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না ধারার। তার জীবনটাও একটা “জোক অফ দ্যা ইয়ার” হয়ে বসে আছে। সে অন্যের জীবন নিয়ে কি আর চিন্তা করবে আর কি টিপ্পনী দিবে! ধারার উদাসীনতা দেখে অনল আবারও বললো,
– তোর নাগরকে জানিয়েছিস?
– এবোর্শন করাতে বলেছিলো, আমি রাজী হই নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা হলেই ভালো হতো
– করাতে হবে না, ওকে ফোন দিয়ে বলে দিস সামনের সপ্তাহে তোর বিয়ে। বিয়েটা খেয়ে যেতে
– মানে?
ধারার কন্ঠে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে সে জানে না এই বিয়ের ব্যাপারে। অনল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাহিরে শুন্য দৃষ্টি দিয়ে বলে,
– অনেক ভেবেছি, চিরকুমার থাকাটা আমার দ্বারা আর হবে না বুঝলি? এবার সংসারটা করতেই হবে। বাহিরের কোনো পিস ঘাড়ে তুলার থেকে তোকে বিয়ে করাটা সোজা। সাথে ফ্রি বাচ্চা ও আছে। স্কিমটা খারাপ না। আমি ও বিয়ে নামক ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবো তুইও এই সমাজের চোখে সম্মানের সাথে বাঁচতে পারবি। একটা বিয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে দিবে।
অনলের কথাশুনে ধারার নিঃশ্বাস আটকে রাখার জোগাড়। উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে লাগে,
– তুমি ভেবে বলছো তো? তুমি অন্য কারোর পাপের ফসল কেনো নিজের ঘাড়ে বয়ে বেড়াবে? এখন হয়তো তুমি ভাবছো এটা ঝামেলা থেকে তোমাকে মুক্তি দিবে কিন্তু ইন দ্যা এন্ড যখন মানুষ তোমাকে বারবার মনে করিয়ে দিবে এটা তোমার বাচ্চা না, আমি একটা নষ্ট মেয়ে পারবে, পারবে মেনে নিতে? এতো সোজা না অনল ভাই, এতো সোজা না
– আচ্ছা একটা কথা বল তো, মানুষ কি আমাকে দুইবেলা খাওয়াবে? নাকি তারা আমাকে চ্যালচালায়ে বেহেশতে নিয়ে যাবে? শোন এসব মানুষের কথায় আমার কোনো কালে কিচ্ছু যায় আসে নি, আসবে ও না। আমার মাকে যখন বাবা ডিভোর্স দিয়ে অন্য কারো কাছে চলে গেছিলেন আমাকে মানুষ দেখে নি। আমি যখন ড্রাগের অভারডোজ করে আই.সি.উ তে ছিলাম তখন মানুষ আমাকে বাঁচায় নি। সুতরাং এই ঢং এর আলাপ আমাকে দিস না।
ধারার বুঝতে বাকি রইলো না এ মানুষকে বুঝানো তার কম্য নয়। সে যা ভালো বুঝবে তাই করে এসেছে এবং তাই করবে। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো ধারার। ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
– তুমি আমাকে বিয়েটা কেনো করতে চাচ্ছো এখনো সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আমার মতো কলঙ্কিনীকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা অন্ধকারে ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমার ভাগ্যে যা আছে আমি সেটা মাথা পেতে নিয়েছি। প্লিজ আমাকে দয়া করে নিজের জীবনে অভিশাপ ডেকে আনবে না অনল ভাই!
– তুই তো বেশ বড় হয়ে গেছিস ধারা! অবশ্য যে কান্ড ঘটিয়েছিস তাতে এই ব্যাপারটা প্রমাণিত। তুই আমাকে নিয়ে ভাবিস না। তোর সাথে বিয়ে নামক বস্তুটা আমার কাছে কেবল কাগজের একটা সই আর তিন অক্ষরের একটা শব্দ মাত্র। আমার কাছে এই জিনিসের কোনোই মূল্য নেই। থাকবেও না। তোর কাছে এই বিয়েটা যেমন সকল ঝঞ্জাট থেকে পরিত্রাণের উপায়। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। নিছক মায়ের ইচ্ছেটুকু পূরণ করা মাত্র। মা যা বলে সর্বদা মেনে এসেছি, এখনো মানবো। তাই এই বিয়েটাও করবো। কিন্তু চিন্তা করিস না আমার মতো অগোছালো লোকের কাছে এটা একটা কাগজের লিখিত ঠুনকো সম্পর্ক মাত্র। বিয়ের পর আমি কেবল তোর কাগজের স্বামী আর তুই আমার কাগজের স্ত্রী। আমি তোর জীবনে কখনোই হস্তক্ষেপ করবো না তদ্রুপ তুই ও আমার জীবনে কখনোই হস্তক্ষেপ করবি না। আমাদের সম্পর্কটা কেবল এবং কেবল কাগজের। আমরা কাগজের তুমি আমি হয়েই থাকবো।
অনলের ঠান্ডা গলার কথাটা শুনে ধারা আর কথা বাড়ায় না। একটা প্রশান্তি মনে জাগে, সে অন্তত সমাজের হাহাকার থেকে মুক্তি পাবে, তার সন্তানটি বেঁচে থাকবে। অনলের মতো একটা বটবৃক্ষের ছায়া পাবে, তার দূর্ভাগ্যের জীবনে এটা জ্যাকপটের ন্যায়। কিন্তু একটা কাগজের সম্পর্ক টেনে নেওয়াটা সহজ হবে! চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আরো কি কি দেখা বাকি কে জানে
সকাল ১১টা,
ক্যাম্পাসে বাইক পার্ক করে সারাকে খুজতে লাগলো দিগন্ত। আজ দুদিন ধারা তার ফোন রিসিভ করছে না। ব্যাপারটা খুব ভাবাচ্ছে তাকে। যদি ইমোশোনাল হয়ে কোন একটা স্টেপ নিয়ে নেয়, তখন কি করে দিগন্ত। সারা ধারার খুব ভালো বান্ধবী সে ধারা বিষয়ে সব তথ্য রাখে। সারাকে খুজে পেলেই ধারার নিউজ পাবে দিগন্ত। একটা জিনিস মোটেই মাথায় ঢুকছে না তার, একটা বাচ্চাই তো। এতো ইমোশোনাল হওয়ার কি আছে? একবার তার চাকরি হয়ে গেলে, ক্যারিয়ার গড়ে গেলে ধারাকে বিয়ে করে নিবে সে। তখন সারাটা জীবন পরে আছে তাদের। এখন এই খাল কেটে কুমির আনার কোনো মানেই নেই। আর এই বয়সে এই ভুল গুলো হওয়াটা খুব ন্যাচারাল। তাও তো রিলেশনের আড়াই বছর বাদে ধারা তাকে ছুতে দেওয়ার পারমিশোন দিয়েছে, কই তার বন্ধুদের বেলায় তো এমন হয় নি। আসলে এসব ব্যাকডেটেড মেয়ের সাথে প্রেম করলে এমন ই হয়। এখন বাচ্চা রাখার জন্য কান্নাকাটি বাধিয়েছে। দিগন্তের মাথা ফেটে যাচ্ছে, কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সত্যি বলতে সে বেশ ঘাবড়ে গেছে। সে ধারাকে ভালোবাসে, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছে এখন তার নেই। কেবল মাত্র ২৬ বছর তার। এখন কোথায় মজা করার সময়, ইঞ্জয় করার সময়। এখন বিয়ে করা মানেই একটা বোঝা কাধে নেওয়া। ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে সারাকে দেখেই ছুটে যায় দিগন্ত তার কাছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে তাকে বলে,
– সারা, তোমাকেই খুজছিলাম
– কেনো গো দিগন্ত ভাই?
– আচ্ছা ধারা কি কলেজে আসছে না? ওকে আমি দুদিন ধরে খুজে পাচ্ছি না
– ও এই সপ্তাহে কলেজে আসবে না, সামনের সপ্তাহে আসে কি সেটাও বলতে পারছি না
– কেনো বলোতো?
– ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে, এই শুক্রবার ওর বিয়ে
সারার নির্বিকার ভাবে বলা কথাগুলো দিগন্তের কানে যেতেই মাথাটা ফাঁকা হয়ে যায় তার। বিয়ে মানে টা কি? আর ধারা বিয়ে করছে এটা তাকে জানানোটা প্রয়োজন মনে করলো না ধারা। আর এখন ধারার যে অবস্থায় আছে তাতে তাকে কেউ বিয়ে করতে চাওয়ার ই কথা না। এটার একটাই মানে হয় ধারা নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলেছে, এখন নিশ্চয়ই কোনো বড়লোক পটিয়ে তার সাথে বিয়ে করে সুখে সংসার করার কথা চিন্তা করছে। রাগে গা রি রি করছে দিগন্তের। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে সে। এই মূহুর্তে আর দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাচ্ছে না তার। তড়িৎ গতিতে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেলো সে।
বিকেল ৫টা,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ধারা, আগামী পরশু তার এবং অনলের হলুদ। দিগন্তের সাথে একটাবার কথাও হয় নি সেদিনের পর থেকে। শেষবারের জন্য একটাবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। জানাতে ইচ্ছে করছে তার বাচ্চাকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে পেয়েছে ধারা। কথাটা ভাবতেই ফোনটা হাতে নিলো ধারা। এতোদিন ফোন অফ করে রেখেছিলো ধারা। ফোনটা অন করতে না করতেই মোবাইল স্ক্রিনে দিগন্তের নামটি ভেসে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
৫ম পর্ব
শেষবারের জন্য একটাবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। জানাতে ইচ্ছে করছে তার বাচ্চাকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে পেয়েছে ধারা। কথাটা ভাবতেই ফোনটা হাতে নিলো ধারা। এতোদিন ফোন অফ করে রেখেছিলো ধারা। ফোনটা অন করতে না করতেই মোবাইল স্ক্রিনে দিগন্তের নামটি ভেসে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে শুনতে পায়,
– তাহলে অবশেষে ফোনটা রিসিভ করলে
দিগন্তের থমথমে গলার কথাটা শুনার মাত্র চোখের কোনে পানি জমতে লাগলো ধারার। ইচ্ছে করছিলো গলা ছেড়ে কাঁদতে, নালিশ করতে, বলতে দেখো আজ তোমার জন্য আমার কি অবস্থা। কিন্তু পরবর্তীতে দিগন্তের কথাগুলো শুনে সব যেনো গলাতে এসেই আটকে গেলো। ধারার উত্তরের অপেক্ষা না করেই দিগন্ত বলতে লাগলো,
– খুব তো ভালোই আছো, বিয়ে করছো শুনলাম। তা তোমার উড বি বর জানে তো ইউ আর নট ভার্জিন।
– মানে?
– মানেটা খুব সোজা, তুমি যে বিয়ের আগেই অন্য ছেলের বেডে উঠেছো, প্রেগন্যান্ট ও হয়েছো এই কথাগুলো কি তোমার হবু বর জানে? তোমার হবু বরের জন্য আমার সত্যি ই কষ্ট হচ্ছে। বেচারা তোমার সুন্দর মুখটা দেখে বিয়েতে রাজী তো হয়ে গেছে, কিন্তু সে তো জানে না তোমার এই ভালো মানুষী চেহারাটার পেছনে একটা চরিত্রাহীন নারী লুকানো। কি জাদু করে তাকে নিজের জালে ফাসিয়েছো?
দিগন্তের কথাগুলো এক একটা বিষতীরের মতো ধারার হৃদয়ে লাগছে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বেহায়া চোখ গুলো কারোর বাধন শুনতে নারাজ। নিজের মতোই বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। এই মানুষটাকে সে বিশ্বাস করেছিলো, এই মানুষটাকে? বুক থেকে চাপা আর্তনাদ বের হচ্ছে। আবার কোথাও না কোথাও একটা প্রশান্তি ও আছে; সময় থাকতে দিগন্তের চেহারাটা তার দেখা হয়ে গেছে। তার সন্তান নাই চিনলো তার বাবাকে, এমন বাবাকে চেনার চেয়ে না চেনাটাই উত্তম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধারা বললো,
– তুমি কি আমাকে এই কথাগুলো বলতেই ফোন দিয়েছো? আমিতো সেদিন বলেই দিয়েছিলাম, আমাদের নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। তাহলে কেনো ফোন করেছো?
– শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর চাইতে, সেদিন আমার সামনে এতো সতী সাজছিলে, বাচ্চাটাকে তুমি নষ্ট করতে চাও না। তাহলে আজ ঠিক ই বাচ্চাটাকে নষ্ট করে বড়লোক কাউকে বিয়ে করার কথা চিন্তা করছো। শুনেছি সে একজন ভালো ডাক্তার। এটাই যদি তোমার মনে ছিলো তবে আমার সাথে সম্পর্কে জড়ালে কেনো? কেনো আমাকে নিজের মায়ায় বাধলে? আসলে আমার ই ভুল তোমার ইনোসেন্ট মুখটা দেখে কখনো ভাবি ই নি তুমি এতোটা স্বার্থপর হতে পারো। তোমার সরল মুখের পেছনের কুটিল ধারাকে বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
দিগন্তের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, বারবার গলা ধরে আসছে। খুব কষ্ট হচ্ছে যা বলে বুঝাতে পারছে না। চোখগুলো জ্বলছে, বারবার ভিজে আসছে। রাগে, দুঃখে সব তছনছ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ধারা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর নীরবতা ভেঙ্গে ঠান্ডা গলায় বললো,
– তুমি বারবার আমাকে অনুভব করিয়ে দাও আমি আবেগে ভেসে কতোটা বড় ভুল করেছি, ঠিক বলেছো আমি স্বার্থপর, খুব স্বার্থপর। আজ নিজের স্বার্থপরতার কারণে আমার এই পরিণতি। তবে কি জানো আমার মনে কোথাও একটা খারাপ লাগা কাজ করছিলো, তোমাকে ঠকাচ্ছি নাতো এটা ভেবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বেশ করেছি বিয়েতে রাজী হয়ে। যাকে আমি বিশ্বাস করে সর্বস্ব দিতেও পিছ পা হই নি সেই মানুষটা যখন আমাকে নিয়ে এতো বাজে কথা বলতে পারে, তখন আমার সত্যি নিজের উপর ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। কি ভুলটাই না করেছি। যাক আমার মতো কুটিল মেয়ে তোমার জীবনে আর কোনোদিন কোনোকিছুর দাবি নিয়ে দাঁড়াবে না। আশা করি সুখে থাকবে। আর আমার বিয়ে এসো। সত্যি আমি একজন ভালো মানুষকে নিজের জালে ফেলেছি। তাকে দেখেও যেও সাথে বিয়েটাও খেয়ে যেও। রাখছি।
বলেই ফোনটা রেখে দেয় ধারা। সেখানেই ধপ করে বসে পড়ে সে। পেটে হাত দিয়ে ধরা কন্ঠে বলে,
– আমি ওকে কোনোদিন জানতে দিবো না তোর অস্তিত্ব। কোনোদিন না। সে যদি মনে করে তুই নেই, তবে তাই সই। তাই সই
বলেই হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। অপরদিকে রাগে ক্ষোভে হাতে থাকা ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিগন্ত। নিজের ব্যাথিত মনকে কিছুতে শান্ত করতে পারছে না। সব কিছু একটা সপ্তাহে উলট পালট হয়ে গেলো। কেনো যেনো সব কিছু এলোমেলো লাগছে। ধারাকে সে সত্যি ভালোবেসেছিলো, খুব ভালোবেসেছিলো। এমনটা কেনো করলো ধারা এটা ভেবেই বুকটা হু হু করে উঠছে দিগন্তের। চোখটা বন্ধ করলেই সেই শুভ্র নারীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। রাগ উঠছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে দিগন্তের। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে একের পর এক দেয়ালে আঘাত করছে কিন্তু মনকে শান্ত করতে পারছে না। কিছুতেই না
সন্ধ্যা ৭টা,
স্থানঃ ধারাদের বাসা
হলুদের অনুষ্ঠান খুব না হলেও মোটামোটি জাকজমকভাবেই হচ্ছে। সেলিম সাহেবের যদিও এতোটা জাকজমক ভাবে করার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু সুভাসিনী বেগমের একটাই কথা, তার একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা, সে কোনো কমতি রাখবে না। আর ধারার জীবনে ও এই বিয়েটা প্রথমবারই হচ্ছে সুতরাং এসব সাদামাটাভাবে বিয়ের আয়োজন তার একেবারেই পছন্দ হয় নি। সেলিম সাহেবের আপত্তি ছিলো যেহেতু এখন ধর্মীয়ভাবে বিয়েটা গ্রহণযোগ্য নয়, তাই লোক দেখানো আয়োজনের কি দরকার। কিন্তু সুভাসিনী বেগমের কথা তখনের কথা তখন দেখা যাবে, দরকার হলে বাচ্চাটা হবার পর আরো ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দিবেন। সুভাসিনী বেগমের আগ্রহ দেখে অনল ও কোনো আপত্তি জানায় নি। তার মাকে এতোটা খুশি বিগত ক বছরে দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। তার মাকে প্রাণবন্তভাবে হাসতে দেখে তার ও মনে একটা স্বস্তি কাজ করছে, বিয়ের বুদ্ধিটা এতোটাও খারাপ নয়।
ধারার রুমে যেতেই সুভাসিনী বেগম দেখলেন, তার বান্ধবীরা তাকে সাজাতে ব্যস্ত। কাঁচা হলুদ কাতানের শাড়িতে কি অপরুপ লাগছে ধারাকে। ফর্সা গায়ে হলুদ রংটা যেনো মিলে আছে। সুভাসিনী বেগম নিজে পছন্দ করেছেন এই শাড়িটা। চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে দিয়েছে, ঠোটে কড়া লাল লিপস্টিক, গা ভর্তি সাদা ফুলের গহনা। কাল অবধি মেয়েটাকে একটা জ্যন্ত লাশের মতো লাগছিলো তার কাছে। কিন্তু আজ কি মায়াবীটাই না লাগছে। কিন্তু মুখটা তবুও শুকনো করে রেখেছে। অন্যমনস্ক হয়ে জীবনের হিসাব মিলাতে যেনো ব্যস্ত। কাছে যেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
– আমার বউমাটাকে কি মিষ্টি না লাগছে
সুভাসিনী বেগমের কথাটা কর্ণপাত হতেই মাথা তুলে তাকায় ধারা। ছলছল নয়নে তার প্রতি অনুগত প্রকাশ করে সে, আজ তার জন্যই ধারার বাচ্চাটা নতুন জীবন পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছে। সুভাসিনী বেগম মুচকি হাসি দিয়ে বলেন,
– নতুন বউ এর কি কাদতে আছে রে পাগলী
– তুমি এতো ভালো কেনো ফুপি?
সুভাসিনী বেগমের মাজা জড়িয়ে বলে ধারা। সুভাসিনী বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
– আমি ভালো নই রে, খুব স্বার্থপর। নিজের স্বার্থে তোকে আমার ঘরে তুলে নিয়ে যাচ্ছি। বয়স তো কম হলো না, ছেলেটার জীবনটা সাজিয়ে দিতে চাই। আমার বিশ্বাস তুই পারবি ধারা, আমার ইট পাথরের বাড়িটাকে সংসার করে তুলতে। কাঁদিস না। এখনও অনেক লড়াই বাকি
সুভাসিনী বেগমের কথাগুলোর মর্ম ধারার বোধগম্য হলো না। অবাক নয়নে শুধু দেখতে লাগলো তাকে। তার চোখে একটা শুন্যতার ছোঁয়া আছে যা ধারার হৃদয়কেও নাড়িয়ে দিলো
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলে বর, কনেকে একই সাথে স্টেজে আনা হলো। পাশাপাশি বসে রয়েছে অনল, ধারা। আড় চোখে একবার একে অপরকে দেখে নিলো তারা। অনলকে বেশ মানিয়েছে সাদা পাঞ্জাবিতে, তার উপরে একটা কোটি পরা। হাতা কনুই অবধি ফোল্ড করে রেখেছে, হাতে কালো একটা টাইটান ঘড়ি। চুল গুলো বেশ সুন্দর করে স্টাইল করে রেখেছে সে। অনলের সাথে চোখে চোখ পরতেই চোখ সরিয়ে নিলো ধারা। যেনো চোর ধরা পরেছে, এমন লাগছে নিজের কাছে। সবাই একে একে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটি মেয়ে স্টেজে উঠতেই অনলের মুখের ভাব বদলে গেলো। ধারার কাছে মেয়েটিকে বেশ চেনা চেনা লাগছিলো। অনলের গালে হলুদ দেওয়ার সময় ধীর কন্ঠে বললো সে…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
৬ষ্ঠ পর্ব
হঠাৎ একটি মেয়ে স্টেজে উঠতেই অনলের মুখের ভাব বদলে গেলো। ধারার কাছে মেয়েটিকে বেশ চেনা চেনা লাগছিলো। অনলের গালে হলুদ দেওয়ার সময় ধীর কন্ঠে বললো সে,
– তাহলে বিয়েটা করছো! তোমার বিয়েতে দাওয়াতি হিসেবে আসবো ভাবি নি। অভিনন্দন রইলো।
খুব ধীরে বললেও ধারার কানে ঠিক ই গেলো কথাগুলো। মেয়েটির চোখ চিকচিক করছে। যেন এখনই অশ্রুধারাগুলো মুক্তি দিয়ে দিবে তার চোখ জোড়া। অনল নির্বিকারভাবেই বসে রয়েছে। ধারা একবার অনলের মুখ আর একবার মেয়েটির মুখ পানে চাওয়া চাওয়ি করছে। মনের মধ্যে একরকম অস্বস্তি কাজ করছে, মেয়েটির সাথে অনলের কি সম্পর্ক এটা জানার কৌতুহলে মনটা বারবার ব্যাহত হয়ে উঠছে। সে কি তার অনল ভাই এর জীবনে একটি অবাঞ্ছিত কাঁটা রুপে এসেছে! বুঝতে পারছে না। এতো সুন্দর সুপুরুষের কোনো প্রেমিকা থাকবে না এমনটা ভাবাও হয়তো বোকামি হবে।
– ধন্যবাদ আসার জন্য মাহি, ভেবেছিলাম তুমি আসবে না। তুমি আসাতে খুব ভালো লাগলো, আমাদের জন্য দোয়া করো। শামিম, রাফিদরাও এসেছে। তুমি ওদের সাথেই থেকো।
অনলের হাসিমুখে কথাগুলো শুনে আবার চিন্তায় পড়ে গেলো ধারা। লোকটা এমন ভাবে কথা বলছে যেনো মাহি নামক মেয়েটার উপস্থিতি তার কাছে ব্যাপার ই নয়, তার কিছুই যায় আসে না। মাহি মুখে মলিন হাসি একে ধারার উদ্দেশ্যে বললো,
– তুমি অনেক লাকি, অনল ভাই এর মতো একজনকে স্বামী হিসেবে পাচ্ছো। আমরা তো ভেবেছিলাম সারাজীবন একা একা ই কাটিয়ে দিবে সে। খুব জানার ইচ্ছে হয় কি জাদু করেছো সে অনল ভাই পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেলো। অবশ্য কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছি, যাক গে নিজের খেয়াল রেখো সাথে বাবুর ও। মাত্র তিন সপ্তাহ চলছে তো, এই সময় একটু রিস্ক থাকে।
বলেই মাহি স্টেজ থেকে নেমে গেলো। অনল চোয়াল এখনো শক্ত করে বসে রয়েছে, মাহির কথাটাগুলো তার পছন্দ হয় নি। ধারা মাথা নিচু করে আছে, এখন সে মেয়েটিকে চিনতে পেরেছে। মাহি তার কন্সাল্টেড ডাক্তার। তাকে চেকাপ সেই করেছে। কিন্তু হাসি মুখেও কিছু ঠেস মারা কথা বলেদিলো মেয়েটি। তার চোখে অনলের জন্য অন্য অনুভূতি অনুভব করলো ধারা। সে তো মেয়ে, একটা মেয়ের চোখ পড়া এতোটাও কঠিন নয় তার জন্য। খুব ইচ্ছে করছিলো অনলকে কিছু জিজ্ঞেস করতে, কিন্তু অনলের ওই এক দোষ; জিজ্ঞেস করলে ট্যারা কিছু কথা শুনিয়ে দিবে যা একেবারেই সহ্য হবে না অনলের। তাই মুখে কলুপ এটে বসে থাকাই শ্রেয়।
হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে, অতিথিরা সবাই যে যার মতো চলে যাচ্ছে। অনল নিজেই তাদের বিদায় দিচ্ছে। সবাইকে বিদায় দিতে দিতে শামিম, রাফিদ, মাইসার সাথে দেখা। বেশ হাসি তামাশা করলো তারা। এরা তার হাসপাতালের কলিগ। বেশ ভালো সম্পর্ক তাদের সাথে তার। মাহিও আছে তাদের মধ্যা। মাহি একটা কথাও বললো না। সবাই সামনে এগোলে মাহি বলে উঠলো,
– তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো, সময় হবে?
– কাজের কথা? প্যাশেন্ট রিলেটেড?
– নাহ, কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই
অনলের বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটা কি বলতে চায়। সম্মতি জানিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গেলো মাহিকে অনল। বেশ থমথমে গলায় মাহিকে বললো সে,
– বলো, কিসের উত্তর?
– আমি তো ভেবেছিলাম তুমি এমন পুরুষ যে একজনকে ভালোবাসলে যত কিছু হয়ে যাক না কেনো তার জায়গাটা কাউকে দিবে না। কিন্তু এখন তো দেখছি সেরকম কিছুই না
মাহির কথাটা কর্ণপাত হতেই বেশ ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায় অনল। মেয়েটাকে হাজারো বার বুঝালেও কেনো যানে তার মাথায় কিছু ঢুকে না হয়তো। ঠেস মারা কথায় যখন কিছু করতে পারে নি এখন অনলের কাটা ঘায়ে আঘাত করে মেজাজ তুঙ্গে তুলে দিলো অনলের। চোয়াল ক্রমশ শক্ত হতে লাগলো অনলের, চোখগুলো লাল হতে লাগলো। তার অতীতের ক্ষত এখন ও ততোটাই তাজা যতটা তখন ছিলো। মানুষের সামনে স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় থাকলেও এখনো সেই ক্ষত বয়ে বেরোচ্ছে সে। অতীতের সুবর্ণ কথাগুলো মনে পড়তেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো। শুন্যতা তাকে এতোটা কঠোর ভাবে জাকড়ে রেখেছে যে চাইলেও সেখান থেকে বের হতে পারবে না। বেশ ঠান্ডা থমথমে গলায় অনল প্রশ্ন ছুড়লো মাহির দিকে,
– কথাগুলোর মর্ম আমার মোটা মাথায় ঢুকছে না মাহি। তুমি এমনভাবে বিহেভ করছো যেনো আমি তোমাকে চিট করেছি বা তুমি আমার এক্স। এজ এ কলিগ, কথাগুলো বড্ড বেমানান হয়ে যায় না।
অনলের কথায় অনেকটা অপমানিত বোধ হয় মাহির। কথাগুলো সে এভাবে বলতে চায় নি। বারংবার অনলের কাছে তাকে অপমানিত হতে হয়। মাহি অনলের মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র। অনলের প্রতি তার অনুভূতিগুলো বরাবর ই তীব্র ছিলো। সে অনলকে এর আগেও নিজের মনের অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করেছে কিন্তু অনল সবসময়ই নিজের বক্তব্য এ অনড়। নিজের বেহায়াপনায় নিজের ই লজ্জা লাগছে মাহির। চোখ নিচু মাহিকে অনলের ও ভালো লাগছে না। নিজের কন্ঠ স্বাভাবিক করে বলে সে,
– তোমার প্রশ্নটা এখনো করা হয় নি
– ধারাই কেনো? তুমি তো বলেছিলে তোমার মনে কোনো নারীর প্রবেশ ঘটবে না। তাহলে ধারা কেন?
বেহায়ার মতোই ভাঙ্গা কন্ঠে বলে উঠলো মাহি। মানুষকে এই ভালোবাসা নামক হৃদয় হর্ষক শব্দটা অনেকটাই বেহায়ার মতো বানিয়ে দেয়। মাহির ক্ষেত্রেও সেটাই খাটছে। মাহির এমন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে হয়ে পরে অনল। সত্যি ই তো সেতো বলেছিলো কাউকে নিজের মনে ঠায় দিবে না। তার মনে একজন ই থাকবে, কিন্তু আজ ঠিক ই ধারাকে তার বউ এর জায়গা দিতে হচ্ছে। মানু্ষ তো বুঝছে না কি সংঘর্ষ মনের সাথে চলছে অনলের। যদিও মনকে সামলাতে বলছে না সে কখনোই ধারাকে মনে ঠাই দিবে না। কিন্তু একটা সুপ্ত ভয় থেকেই যাচ্ছে।
– কি হলো উত্তর দিচ্ছো না যে? যদি এটাই তোমার সাথী হতে করা লাগতো তবে আমিও তো করতেই পারতাম
মাহির কথাটা শুনে বেশ হতবাক হয়ে যায় অনল। বেশ কড়া কন্ঠেই বলে,
– এজন্য আমি ধারাকে বিয়ে করছি। সে তোমার মতো নিচ চিন্তা করে না। ভালোবাসে বলে কাছে এসেছে। আর কোনোই অন্তমর্ম তার ছিলো না। সে কাছে এসেছে কারণ আমি চেয়েছি। আর একটা কথা, ধারা আমার জীবনে না থাকলেও আমি তোমাকে নিজের ছোট বোনের মতোই দেখতাম। আমার তোমার প্রতি কখনোই কোনো অনুভূতি ছিলো না, হবেও না। রাত অনেক হয়েছে আস্তে পারো।
অনলের কথাগুলোয় পুনরায় অপমানিত বোধ হলো মাহি। তার উত্তর গুলো সে পেয়ে গেছে। মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে মাহির। ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো সে। দরজায় কোনায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো ধারা। মুখ চেপে কান্না আটকালো সে। আজ তার জন্য অনলকে এমন কথাগুলো শুনতে হলো। যে পাপ সে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আজ সেই পাপের অংশীদার অনল নিজেকে দাবি করছে। এই পাপের বোঝাটা সারাটাজীবন তাদের মাঝে থাকবে। সারাটাজীবন অনলের কাছে ছোট হয়ে গেলো ধারা।
– তুই তো মানুষ ভালো না, বউ হওয়ার আগেই টিপিক্যাল বউদের মতো স্পাইগিরি করছিস।
কথাটা কানে আসতেই…..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
৭ম পর্ব
– তুই তো মানুষ ভালো না, বউ হওয়ার আগেই টিপিক্যাল বউদের মতো স্পাইগিরি করছিস।
কথাটা কানে আসতেই চমকে পাশে ফিরে তাকায় ধারা। বুকের উপর হাত বেধে সুক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে অনল। আসলেই তো লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শুনছিলো ধারা। যদিও ইচ্ছেকৃত নয়, কিছুক্ষণ আগে সুভাসিনী বেগম অনলকে খুজছিলেন বিধায় ধারাকে পাঠিয়েছেন তার ছেলেকে ধরে আনতে। অনলকে খুজতে বাগানের কোনায় আসতেই মাহি এবং তার কথোপকথন শুনতে পায়। তখন আর তাদের সামনে যেতে ইচ্ছে হয় নি, লজ্জায় একেই অনলের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না, তার উপরে অনলের এমন কথা শুনে আরো অপ্রীতিকর অবস্থাতে পড়ে যায় ধারা। আমতা আমতা কর বলে,
– না, আসলে
– কি আসলে? আসল কথা তুই আমার স্পাইগিরি করতে আসছিস। তোদের মেয়েদের সমস্যা কিরে? এতো সন্দেহপ্রবণ কেনো? আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতি। না তোর তো সি.আই.ডি এর এ.সি.পি হওয়া লাগবে। আমার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশ সন্দেহ হচ্ছে। কোনো মেয়ের সাথেই তো কথা বলতে দিবি না দেখছি বিয়ের পর। হায় খোদা আমার কি হবে
মাথায় হাত দিয়ে এমন ভাবে কথাগুলো বলছে অনল যেনো সত্যি খুব খারাপ একটা কাজ করে ফেলেছে ধারা। হা করে বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধারা। কি বলবে শব্দ খুজে পাচ্ছে না। নিজের বোকামির উপর নিজের ই রাগ উঠছে, নিজের কপালে জোরে চাটি লাগাতে মন চাচ্ছে। বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই ধারা বললো,
– তুমি ভুল বুঝছো, আমাকে তো ফুপি
– কিহ! লুকিয়ে কথা তুই শুনছিলি, আমার উপর নজরদারি তুই করছিলি আর দোষটা দিচ্ছিস আমার মার। মা বলেছে তোকে এগুলো করতে?
অনলের কথা শুনে আবার ও ভাষাহীন হয়ে যেতে হলো ধারাকে, এই মানুষটাকে বুঝানো অসম্ভব। এখন নিজের মনেই নিজেকে হাজারো বকা দিয়ে নিলো ধারা। এই লোকের এমন বিদিকিচ্ছির স্বভাব জানা সত্ত্বেও প্রতিবার একই ভুল করে ধারা। এই লোকের প্রতি যখন ই একটু কৃতজ্ঞতা বোধ হতে লাগে, যখন ই ভাবে অনলকে সম্মান করবে তখন ই এমন কিছু কথা শুনতে হয় সে অনলের মাথা ভেঙ্গে ফেলতে মনে চায় তার। তার খুব ইচ্ছে দেখার লোকটার মাথায় কি আসলেই ভুষি ভরা কিনা! সবসময় দু কদম বেশি বুঝে।
– তার কত গালাবি, মনে মনে তো গালি দিতে দিতেই মেরে ফেলসিস। কি বউ জুটলোরে বাবা।
অনলের কথা শুনে বেশ চটে গিয়েই বললো ধারা,
– তোমাকে গালাবো কেনো? গালাচ্ছি নিজেকে। নিজের গাধামির জন্য নিজেকে গালাচ্ছি। গাধা না হলে কি বারবার তোমার মতো মোটা বুদ্ধিকে বুঝানোর মতো কাজ করতে যাই। ক্ষেমা দাও, ফুপি তোমাকে ডাকছিলো বিধায় আমার এখানে আসা। তোমার উপর নজরদারি করতে না বয়েই গেলো বুঝলে
বলেই সামনে হাটা দিলো ধারা। মনে মনে অনলের গুষ্টির ষষ্ঠী করছে সে। তার মধ্যেই কানে আসে,
– আমার উপর ই তোর যত চোটপাট, বাহিরের মানুষ যখন দু কথা শোনায় তখন এই তেজ কোথায় যায়?
অবাক নয়নে পেছনে তাকাতেই আবার অনল বলে উঠে,
– কি ভুল বললাম? আর একটু আগে এখানে দাঁড়িয়ে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদছিলি, সেটা কেনো? তেজ দেখানোর বেলায় অনল আর এমনি সময় লবডংকা
– মাহি আপু তো ভুল কিছু বলেন নি।
– সে ভুল কি ঠিক সেটা টো আমি জানতে চাচ্ছি না। আমার বউ হতে যাচ্ছিস এখন খামছি দিতে আসলে কামড়ে দিবি। বাকিটুকু আমি দেখে নিবো। আমি তোকে এই শেষবারের মতো বলছি, এই ফ্যাসফ্যাসানি যদি আরেকবার দেখি না ঠাটিয়ে কান লাল করে দিবো বলে দিচ্ছি। চল মা অপেক্ষা করছেন
বলেই বাড়ির দিকে রওনা দিলো অনল। ধারা অনলের যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। বড় অদ্ভুত এই লোক, এতো রহস্যময়ী এই লোকটা। তার ট্যারা ট্যারা কথাগুলো শুনে মনে অজানা প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে ধারার। কেনো যেনো মনটা খুব সহজেই চাঙ্গা হয়ে গেলো। না জানি কি জাদু আছে লোকটার মাঝে। মন খারাপের রেশটা ঝাড়ি দিয়েই হাওয়া বানিয়ে দেয়। এর সাথে সারা জীবনের পথচলাটা খুব মন্দ হবে না
রাত ১১টা,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ধারা, এলোকেশে মন্দ লাগছে না মেয়েটিকে। বারান্দার গ্রিল ধরে বাহিরের মনোরম প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত। হীম বাতাসে চুল উড়ছে ধারার। নভেম্বরের এই সময়ে বেশ কুয়াশা পড়ে। খুব দ্রুত পৌষে পা রাখবে প্রকৃতি। এই সময়টা খুবই প্রিয় ধারার। আকাশে আজ চিকন শুভ্র চাঁদ উঠেছে। নতুন চাঁদ, আমাবস্যার অন্ধকার কাটিয়ে ক্ষীণ আলোতে প্রকৃতিকে একটা মায়াময় সাজে সাজিয়েছে। অনেকটা তার জীবনের মতো, ঘন কালো আধারের মাঝে অনল এই শুভ্র চাঁদটির ন্যায় তার জীবনকে নতুন রুপ দিয়েছে। আজকাল মনটা বেশ অন্যরকম হয়ে গেছে, মুড সুইং এর জন্য হয়তো এমন হয়। এই ভালো থাকছে আবার থেকে থেকে কান্না পাচ্ছে। কাল অনলের সাথে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। কথাটা ভাবলে একদিকে যেমন নিজের বাচ্চার কথা ভেবে ভালো লাগছে আবার খারাপ লাগছে নিজের আপনদের ফেলে যেতে হবে বিধায় কান্না পাচ্ছে। অবশ্য তার পরিবারের মানুষেরা তাকে পার করতে পারলেই হয়তো বাঁচেন তবুও ধারার খুব খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে নিজের মার কোলে আচড়ে পরে কাঁদতে, কিন্তু আপনজনের সাথে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। চাইলেও তারা তাকে আপন করে নিচ্ছেন না, সেও আগাতে পারছে না। কথাটা ভাবতেই মনটা আবার হু হু করে উঠলো। আনমনেই পেটে হাত চলে গেলো ধারার, মলিন কন্ঠে বলতে লাগলো,
– তুই ও কি আমাকে এমন একা করে দিবি? যখন নিজের পরিচয় জানতে পারবি তুই ও কি আমাকে ভুল বুঝবি?
উত্তর পাবে না জেনেও কথা বলছে। মনের শান্তি, কেউ তো কথা বলছে না, লাবণী, ছোট বোনটাও কথা খুব কম কথা বলে। হয়তো বুঝেও না কি বলতে হবে। শুধু ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। এই দেয়ালটা ভেঙ্গে ফেলতে পারতো! কিন্তু ওই ভাগ্যের পরিহাস। সহ্য করতেই হবে
– ধারা কি ঘুমিয়ে গেছো?
সুরাইয়া বেগমের কন্ঠ কানে আসতেই বারান্দা থেকে রুমে আসে ধারা। বেশ কিছু গয়না, শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ঠোটের কোনায় হাসির রেখা একে ধারা বললো,
– আমার ঘরে আসতে কি এখন তোমার পারমিশন লাগে মা
– না ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছিস কি না
– আসো না মা
ধারার কন্ঠের আকুতি দেখে সুরাইয়া বেগমের চোখ ছলছল করছে। মেয়েটাকে কাল অন্যের হাতে তুলে দিবেন। এই একটা সপ্তাহ তার মুখ দর্শন ও করেন নি। কিন্তু মা তো আর থাকতে পারছিলেন না। নাহয় একটা পাপ করেই ফেলেছে তাই বলে নিজের নাড়ির টানকে অস্বীকার করবেন কিভাবে। সেদিন মেয়েটা তার মা আকড়ে বসেছিলো শুধুমাত্র নিজের অংশকে বাঁচাতে। মেয়েটার মুখটা দেখে মনটা কেঁদে উঠলো। পুতুলের মতো মেয়েটা এই এক সপ্তাহেই কি লাশের মতো হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালির স্তর। মুখটা যেনো শুকিয়ে আছে। হাসতে গেলেও দশবার ভাবে। তবুও নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করলেন না; শক্ত কন্ঠে বললেন,
– এই গয়না গুলো তোমার জন্য গড়িয়েছিলাম। কাল এগুলো পড়বে। আর এই শাড়িটা তোমার ফুপি পছন্দ করেছেন। কালকে এটাই পড়বে তুমি। এই শাড়িগুলো আমার কাছে ছিলো। বেশ কিছু কেনার সুযোগ দেয় নি তোমার ফুপি। তাই এগুলোই সুটকেসে গুছিয়ে নাও।
– আর কিছু বলবে না মা
– ধন্যবাদ, চুপচাপ বিয়ে করার জন্য। অনল ছেলেটা অনেক ভালো, আমরা সারাটাজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ। তোমার বিয়েটা না হলে লাবনীর জন্য ও আমাদের কষ্ট পোহাতে হত। এই বিয়েটা শুধু তোমার বাচ্চাকে প্রাণে বাছাচ্ছে তা নয়, আমাদের সম্মান ও বাচাচ্ছে। ও বাড়িতে ফুপির খেয়াল রেখো। তিনি যে কাজ করছেন, তার জায়গায় আমি হলে এতো মহত্ব দেখাতে পারতাম না। তাকে কোনো কষ্ট পেতে দিও না। এমন কোনো কাজ আবার করো না যাতে তার কাছে আমরা ছোট হয়ে যাই।
সুরাইয়া বেগমের গলা ধরে এসেছে, আর দাঁড়িয়ে থাকলে তার দূর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে। তাই তাড়াতাড়ি জিনিসগুলো খাটের উপর রেখেই বেড়িওয়ে গেলেন তিনি। ধারার মনে এক রকম চাপা কষ্টের আবির্ভাব হলো, সেখান থেকে অভিমান। এই অভিমানের রেশটা নিজের কাছেও একটা দূরত্বের তৈরি করছে। মা-মেয়ের অভিমানের পালা যে কবে শেষ হবে তা হয়তো উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না
পরদিন,
রাত ১২টা,
অনলের রুমে বসে রয়েছে ধারা। বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে ঘন্টা দুয়েক আগে এ বাড়িতে এসেছে সে। লাল বেনারসি পড়ে বধুবেশে অনলের খাটে বসে রয়েছে। যদিও এইটাও সুভাসিনী বেগমের আইডিয়া। ধারা চেয়েছিলো সুভাসিনী বেগমের রুমেই থাকবে। কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতে শাশুড়ির ঘরে বউ থাকছে ব্যাপারটা হাস্যকর। মানুষ তো জানে না এই বিয়েটা কাগজের একটা সই মাত্র। এর মর্ম বর বউ কারোর কাছেই নেই। তবুও সামাজিক জীব হওয়ার দায়ে মানুষ কি ভাবছে সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। বুকটা কেনো জানে টিপটিপ করছে। কেনো সেই উত্তর জানা নেই ধারার। যতই হোক বিয়ে তো হয়েছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে…………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
৮ম পর্ব
বুকটা কেনো জানে টিপটিপ করছে। কেনো সেই উত্তর জানা নেই ধারার। যতই হোক বিয়ে তো হয়েছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে ধারার। দরজা ঠেলে অনল রুমে প্রবেশ করে। অনলকে আজকে বেশ সুন্দর লাগছে, গোল্ডেন শেরোয়ানিতে বেশ মানিয়েছে তাকে। এমনেই মাশাআল্লাহ শারীরিক গঠন তার উপরে বরের সাজসজ্জা তাকে আরোও অসহ্যরকম হ্যান্ডসাম করে তুলেছিলো। অবশ্য ধারাকেও আজ লাল বেনারসীতে বেশ চমৎকা্র লাগছিলো, যেন লালে মোড়া কোনো মায়াবতী। সবার এক কথা ছিলো বিয়েতে বর বউ এর জুটি নাকি অনেক মানিয়েছে। ধারা এক নজরে অনলকে দেখে যাচ্ছে। কেমন জানে বিধ্বস্ত লাগছে, যেনো মনের সাথে হাজারো যুদ্ধ করে সে ক্লান্ত। অনল রুমে প্রবেশ করতেই ধারা ধীর পায়ে তার নিকট এগিয়ে যায়। তাকে দেখতেই অনল ভ্রু কুচকে থমথমে কন্ঠে বলে,
– তুই এই রুমে? আমি তো বলেই ছিলাম তুই মার সাথে থাকবি
অনলের এরুপ কথায় বেশ আমতাআমতা করেই ধারা জানায়,
– আসলে, আমি ফুপিকে বলেছিলাম। কিন্তু উনি বললেন নতুন বউ বাসরের রাতে শাশুড়ির সাথে থাকবে এটা কেমন দেখায়, তাই আজ রাতে এখানে থাকতে বললেন।
ধারার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অনল। অনলের নীরবতা দেখে ধারার পুনরায় তাকে বলে,
– তোমার যদি কোনো সমস্যা থাকে আমি নিচে শুয়ে যাচ্ছি।
– থাবা খাইছোস?
– হ্যা?
অনলের এমন কথায় বেশ হতবাক হয়ে যায় সে। অনলের বিশ্বাস নেই, থাবা মেরেও দিতে পারে। কিন্তু ভুল কি বললো সেটাই তো বুঝতে পারছে না ধারা। গালে হাত দিয়ে অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকে অনলের দিকে এবং জিজ্ঞেস করে,
– কেনো?
এবার অনল ধমকের সুরে বলে,
– বাচ্চার মা হতে যাচ্ছিস বুদ্ধি হবে কবে? ঠান্ডার সময় নিচে শুয়ে ঠান্ডা লাগাবি আর দোষ হবে আমার বউ অত্যাচারের। বুঝি না আমি? যা ফ্রেশ হয়ে খাটে ঘুমা
– তুমি?
– আমার চিন্তা তোর করতে হবে না।
বলেই বারান্দায় চলে যায় অনল। আজ রাত তার ঘুম হবে না, মনটা বেশ অস্থির তার। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত সে। ধারা আর কোনো কথা বলে না, ভারী পোশাক ছেড়ে একটা হালকা সালোয়ার কামিজ পড়ে নেয় সে। অনল তখন একের পর সিগারেটে সুখ টান দিতে ব্যাস্ত। নিজের অস্থিরতা নিকোটিনের ধোয়ায় উড়াতে ব্যস্ত সে। তখন পিছন থেকে ডাক পড়ে,
– তুমি ফ্রেশ হবে না?
কথাটা শুনেই পেছন ফিরে তাকায় অনল। ধারাকে দেখে মনের মাঝের অস্থিরতাটা যেনো দ্বিগুন হয়ে যায়, গোলাপি সালোয়ার কামিজে বেশ মনোমুগ্ধকর লাগছে ধারাকে যেনো কোনো ভাস্কর্যের হাতের নিপুন শিল্প। মুখের কাছে লেগে থাকা পানি গুলো যেনো মুক্তদানার ন্যায় লাগছে। পরক্ষনেই নজর সরিয়ে নিলো অনল। কি করছে সে, দূর্বলতার কোনো স্থান নেই তার মনে। ধারার প্রতি সম্পর্কটা কেবল এবং কেবল কাগজের। কোনো কথা না বলে গটগট করে ওয়াশরুমে চলে যায় অনল। অনলের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না ধারা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। নিজের মনে একটা খচখচানি রয়েই গেলো, অনল কি বিয়ে টা করে পচতাচ্ছে!
রাত ২টা,
ধারা গভীর ঘুমে মগ্ন, অনল তখন ও বারান্দায় বসা। আজকে দিনটার অপেক্ষা পাঁচ বছর আগেও তার ছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে সেদিন রিক্ত হস্তে ফেরত দিয়েছিলো। মনটা আজ হু হু করে উঠছে বারবার। প্রিয়তমার শুন্যতা আজ মনকে ব্যাহত করে তুলছে। দুঃখ ভুলাতে মদের বোতলে হাত বাড়ায় অনল। আচ্ছা মানুষটা না থাকলে কি ভালোবাসাও উবে যায়? চোখ ছলছল করছে অনলের, পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সিক্ত নয়নে দেখতে থাকে। হোমস্ক্রিনে মায়াবী মুখশ্রী ভেসে উঠে। কি কোমল হাসি মেয়েটার, শ্যাম বর্নের এই নারীর বাস অনলের হৃদয়ে সর্বক্ষণ। ছবিটির দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো অনল বলে,
– অনন্যা, আমি তোমাকে দেওয়া কথা রেখেছি, বিয়ে করে নিজের জীবনে একটা পুতুলের মতো বউ এনেছি। কিন্তু আমি যে তোমার স্থান কাউকে দিতে পারবো না। আমার বুকে তোমার জায়গা ছিলো, আছে এবং থাকবে। আমার ভাবনার গহীনে তোমার বিচরণ অনন্যা, অন্য কোনো নারীকে কিভাবে সেই স্থান দিবো অনন্যা। আমি ক্লান্ত, না চাইতেও ধারার প্রতি এক রকম আকর্ষণ কাজ করছে। কি করবো আমি অনন্যা? আমি যে ক্লান্ত। তোমাকে ছাড়া আমার শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়, কাউকে বলতে পারি না। সবাই ভাবে আমি অনেক ভালো আছি। কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারি না আমার ভালো থাকার উপায়টাই আমার কাছে নেই। কেউ বুঝে না অনন্যা। কেনো আমাকে একা করে দিলে তুমি? ভালোবাসি বললেই আমাকে একা হয়ে যেতে হয়। আমি তাই আর কোনো দিন কাউকে ভালোবাস বলবো না, কখনো না
রাতের আধারে অনলের অশ্রুগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। কেউ টের না পেলেও কেউ ঠিক ই সাক্ষী হচ্ছে এই অশ্রুগুলোর। এতো কঠোর মানুষ ও কাঁদতে পারে সেটা তার ধারণা ও ছিলো না। চোখ বুঝে অনলের দুঃখগুলো অনুভব করতে পারছে ধারা। কিন্তু নীরব থেকে মূহুর্ত গুলোর সাক্ষী হলো সে। হয়তো এটাই তাদের ভেতরের সম্পর্কের সুতো। তারা নিজেরাও জানে না তাদের এই সুতো কতোটা মজবুত। এই সুতোটাই হয়তো তাদের সম্পর্কের নতুন আরম্ভ হবে, কে জানে
সূর্যের প্রখর রশ্নি মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় অনলের। মাথাটা টনটন করছে তার। কাল রাতে ইমোশোনাল হয়ে একটু বেশি নেশা করে ফেলেছে সে। চোখ ঢলে উঠে বসে সে। হঠাৎ খেয়াল করলো তার গায়ে একটা চাদর দেওয়া। যতটুকু তার মনে আছে কাল রাতে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। এবং তার কাছে কিছুই ছিলো না। কিন্তু এখানে তার গায়ে চাদর দেওয়া শুধু সেটাই না একটা বালিশে তার মাথা ছিলো। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখে সামনে রাখা মদের বোতল কিংবা এশট্রে টাও নেই। তার অগোচরে এগুলো কে করলো? ধারা। রুমে সে ব্যাতীত কেউ নেই ও। কিন্তু সে তো ঘুমিয়ে ছিলো। উফফফ মাথাটা টনটন করছে, এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না।
– মুখটা ধুয়ে চা খেয়ে নাও
কথাটা শুনে মুখ তুলে তাকালে দেখতে পায় সামনে ধারা কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধারা। নীল শাড়ি পরিহিতা নারীকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। ভেজা এলোকেশে দাঁড়িয়ে আছে সে। অনল ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ধারা বলে,
– মেহমান যতোদিন থাকবেন আমাকে এই রুমেই থাকতে বলেছেন ফুপি। আর একটা কথা মানুষকে তো সারাক্ষণ জ্ঞান দিতে থাকো অথচ ডাক্তার হয়ে নিজের লিভার নিজেই নষ্ট করছো। এটা যদি তোমার প্যাশেন্টরা জানতে পারে, তোমার কাছে আসবে? ভেবে দেখো
বলেই হাটা দিলো ধারা, এই প্রথম অনলকে দু কথা ঠেস মেরে বলতে পেরেছে সে। মজা লাগছে ধারার। সারাটাক্ষণ তাকে খুব ধমকের উপর রাখে লোকটা। কাপে চুমুক দিতে দিতে মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে অনলের। মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হতে লেগেছে। এখন সময়ের প্রতীক্ষা যখন তার জীবনধারার স্বাভাবিকতার
রাত ৮টা,
আজ অনল ধারার বৌভাত। ধারাকে গোলাপী ল্যাহেঙাতে বেশ সুন্দর লাগছে। ধারার পরিবারের সবাই এসেছে শুধু সুরাইয়া বেগম ব্যাতীত। সুভাসিনী বেগম যখন সেলিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রতিউত্তরে তিনি বলেন,
– একটু পর জামাই মেয়ের আসবে সেটার প্রস্তুতি করছে সে।
সুরাইয়া বেগমের না আসার কারণটা সুভাসিনী বেগমের বেশ ভালো করেই জানা। তাই বেশী ঘাটান না তিনি। ধারাকে দেখে লাবণী দৌড়ে যায় তার কাছে, হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,
– আপু কেমন আছিস রে?
– আলহামদুলিল্লাহ, তুই?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– মা কে দেখছি না ( আশেপাশে দেখে)
লাবনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
– আপু তোকে খুব সুন্দর লাগছে
– কথা ঘুরাচ্ছিস?
– না আসলে
– থাক, মায়ের রাগ পড়লেই না হয় তার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো হবে।
– বাদ দে না আপু। আচ্ছা তোর কথা বল, ফুপি, অনলভাই ভালো তো?
– খুব ভালো তারা। এতো ভালো মানুষ হয় নারে?
– আচ্ছা অনল ভাই কই রে? আসার পর থেকে দেখছি না
– অনল ভাই তা কলিগদের সাথে আছে।
– তুই এখনো তাকে ভাই বলেই ডাকবি? সে বুঝি তোর ভাই হয়?
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে লাবনী। ধারাও বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। আসলেই তার মুখ থেকে ভাই বাদে কিছু বের হতে চায় না। তার কি দোষ!
অপরদিকে,
অনলের সব কলিগরাও এসেছে। শামীম, রাফিদরা মজার ছলে অনলকে বলে,
– ভাই, আপনারে তো বিয়ের পর আরো বেশি হ্যান্ডসাম লাগতেছে। ভাবী আপনার প্রেমে মনে হয় প্রতিনিয়ত পড়ে। (শামীম)
– ভাবী কি কম সুন্দর নাকি? (রাফিদ)
– তোদের পগানোর কারণটা কি রে?
– পগাবো কেনো? যাহা বলি সত্য বলি
শামীম বেশ দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে। এর মাঝেই মাইসা বলে উঠে,
– ভাই বলেন না ভাবী আগে প্রপোজ করেছে নাকি আপনি?
– সিক্রেট।
বলেই চোখ টিপ্পনী দেয় অনল। সে বিয়েতেও মাহিকে দেখে নি, আজ ও মাহি আসে নি। তাই কৌতুহল কন্ঠে মাহির কথা জিজ্ঞেস করতেই মাইসা তাকে জানায়,
– মাহি আপুর শরীর ভালো নেই ভাই। তাই আসতে চায় নি। এই দুদিন হাসপাতাল থেকেও ছুটি নিয়েছে সে।
অনল কথাটা শুনে চুপ হয়ে যায়। সে খুব ভালো করেই জানে মাহি জেদের বশে কাজ গুলো করছে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটি কল আসে অনলের ফোনে। নাম্বারটা অচেনা লাগছে অনলের। কলটা রিসিভ করতেই………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
৯ম পর্ব
কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটি কল আসে অনলের ফোনে। নাম্বারটা অচেনা লাগছে অনলের। কলটা রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে অচেনা স্বরের কেউ বলে উঠে,
– আপনার সাথে একান্ত গোপনীয় কথা আছে মিস্টার অনল মাহমুদ। আপনার কি সময় হবে?
– আপনি কে বলছেন? আমি মনে হয় আপনাকে চিনি না। আপনার পরিচয়টা আমাকে দিবেন প্লিজ
বেশ স্বাভাবিক ভাবেই অনল বলে। সে আসলেই অপরপাশের পুরুষালি কন্ঠটিকে চিনতে পারছে না। হুট করে কে এমন একান্ত গোপনীয় কথা তাকে বলতে চায়? অনলের উত্তরের স্বপক্ষে অপজিটের মানুষটি বলে,
– আমাকে আপনি চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনার স্ত্রীর খুব পরিচিত।
– নামটা বলা যায় কি?
– দিগন্ত
অনল নামটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ধারার মুখে নামটি কখনো শুনে নি, কিন্তু কেনো যেন মন বলছে এই ছেলেটা ধারার বাচ্চার বাবা। বেশ ঠান্ডা ভাবে অনল তাকে বলে,
– জ্বী বলুন কি কথা?
– আপনি ধারার সম্পর্কে সব জেনে শুনে কি বিয়েটা করেছেন?
– মানে?
– মানেটা খুব সোজা, আপনার বউ যাকে আপনি সতীসাবিত্রী ভাবছেন সে আসলে তা নয়।
কথাটা কানে যেতেই মাথা গরম হয়ে গেলো অনলের। ধীরে ধীরে কান লাল হতে লাগলো, চোয়াল শক্ত হতে লাগলো। শক্ত কন্ঠে বললো,
– একটু খোলসা করে বলবেন।
– আপনি হয়তো জানেন না আপনার ওয়াইফ কিছুদিন আগে প্রেগন্যান্ট হয়েছিলো, আমার বাচ্চার সাথে।
-……
– বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না? এটাই স্বাভাবিক। নিজের নতুন বউ এর সম্পর্কে এরকম কথা শুনলে যে কারোর মাথা ঘুরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা সত্যি, চাইলে আপনি ওকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। অবশ্য ও যে মেয়ে ও নিশ্চিত চেপে যাবে। আপনার সাথে বিয়ের তাগিদায় সে আমার বাচ্চাটিকে মেরে ফেলেছে। আমি জানি আপনার আমাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আমি একটা কথাও মিথ্যে বলি নি। আপনার ওয়াইফ ভার্জিন নয়। আপনাকে বিশ্বাস করানোর মতো কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি এটা বলতে পারবো তার শরীরে কতটা তিল আছে। এবার নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন।
– আপনি কিভাবে জানলেন যে, আমাকে তারা এতো বড় কথাটা লুকিয়ে গেছে?
এতোক্ষণ চুপ করে দিগন্তের সব কথাগুলো শুনছিলো অনল। কিন্তু দিগন্তের শেষ কথায় যেন মেজাজ তুঙে উঠে যায়। তাই এই প্রশ্নটা বেশ কড়া ভাবেই ছুড়ে মারে অনল। দিগন্ত যেন বেকুব হয়ে যায় প্রশ্নটি শুনে। অনল একটু থেমে বলা শুরু করে,
– আমার নাম যেহেতু আপনি জানেন, তাহলে এটা আমি আশা করতেই পারি আপনি এটাও জানেন সম্পর্কে আমার বউ হওয়ার আগে ধারা আমার মামাতো বোন। এতো বড় ব্যাপারটা যে আমার কাছ থেকে মামা-মামী লুকিয়ে যাবেন না এটাই স্বাভাবিক। আমি আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে দেই আমি সব জানি এব্যাপারে। আর ধারার প্রেগ্ন্যাসির কথাটা আমি ই মামা-মামীকে জানিয়েছিলাম। আর এবোর্শনের কথাটা বলছেন তো। আমি নিজে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম এবোর্শন করাতে।
অনলের কথাটা শুনে দিগন্ত কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। চুপ করে শুধু কথাগুলো হজম করে যাচ্ছিলো। অনল আবার বলতে শুরু করে,
– আসলে কি বলুন তো, আপনাদের মতো ছেলেদের কারণেই মেয়েরা ছেলেদের বিশ্বাস করতে চায় না। আপনাদের মতো মানুষের কারণে মানুষ ভাবে ভালোবাসা মানেই মেয়েদের শরীরের খাজে নিজের কামনা মিটানো। আজ এতো সাহস নিয়ে আমাকে ফোন করে নিজের কৃতিত্ব জাহির করার কারণটা এটাই যে আপনি চেয়েছিলেন আমি যাতে আপনার কথায় এক্সাইটেড হয়ে ধারাকে ছেড়ে দেই। আচ্ছা, যখন হাত ধরার সময়টা আসে তখন কেনো এই সাহস টা থাকে না। পারতেন তো এই সাহসটা দেখিয়ে ধারার হাতটা ধরতে। তাহলে হয়তো আমার ধারার সম্মান বাঁচাতে তাকে বিয়ে করতে হতো না। যাক গে, আপনার কথা আমি শুনেছি। ভালো লাগলো আপনি আমার এতোটা বড় শুভাকাঙ্ক্ষী এটা ভেবে। তবে একটা কথা মাথায় রাখবেন, সামনে থেকে আমাকে আর ফোন করে ডিসটার্ব করবেন না। ধারা ভার্জিন কি না তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি আপনার মতো শরীরের খাজে ভালোবাসা খুজি না।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো অনল। রাগে গা রি রি করছে, দিগন্তকে সামনে পেলে হয়তো মেরেই ফেলতো। এতো বড় কাপুরুষ হয়তো জীবনেও দেখে নি সে। অপরদিকে, দিগন্ত সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই ঠায় বসে পড়লো। তার কাপুরুষত্ব তাকে ধারার কাছ থেকে এতোটা দূর করে দিয়েছে। নিজের মনের ভেতর একটা হাহাকার শুরু হয়েছে তার। এই হাহাকার অগ্নির ফুলকির মতো তাকে জ্বালাচ্ছে, হয়তো সারাটাজীবন জ্বালাবে
ফোনটা রেখে পেছনে ফিরতেই চমকে উঠে অনল। তার পেছনে ধারা দাঁড়িয়ে আছে। ছলছল নয়নে সেক নজরে তাকে দেখে যাচ্ছে। অনলের বুঝতে বাকি রইলো না ধারা তার এবং দিগন্তের কথোপকথন শুনেছে। হয়তো এজন্যই লজ্জা পাচ্ছে। নিজের কৃতকর্মের গ্লানি তার চোখের অশ্রুর রুপ নিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অনল ধীর পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো, মুখের কণায় দুষ্টু হাসি টেনে বললো,
– তুই আমার স্পাইগিরি করা থামাবি না তাই না?
অনলের কথাটা শোনা মাত্র আশেপাশে না দেখেই ধারা তার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। অনলের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা অশ্রুর রুপে প্রকাশ করতে লাগলো৷ ঘটনার আকর্ষিকতায় বেশ অনাক হয়ে গেলো অনল৷ পরক্ষণে নিজেকে সামলে ধারার মাথায় হাত দিয়ে বললো,
– আর কতো কাঁদবি? এমনেই সাকচুন্নির মতো দেখতে, এখন তো সারারা গুলো হয়ে যাবি। মেহমান সব ভেগে যাবে রে।
অনলের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো ধারা। নিজেকে সামলে অনলকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। অনুগত স্বরে বললো,
– তুমি এতো ভালো কেনো অনল ভাই?
– ওমা তুই আমার প্রশংসা করছিস বুঝি? আমি তো ভাবতাম তুই শুধু গালি দিতেই পারিস। মতলব কি রে?
– তোমার মতো মতলব খুজি বেড়াই নাকি আমি?
– তাহলে আজ প্রশংসা করছিস যে?
– ইচ্ছে হলো তাই, আর একটা কথা ধন্যবাদ
– বাব্বাহ মেয়ে এখন ধন্যবাদ দিতেও পারে! তা কেনো বলতো?
– এতোদিন বলতে পারি নি, আজ তোমাকে ধন্যবাদ বলতে খুব ইচ্ছে করছে তাই।
বলেই চোখের পানি মুছে নিলো ধারা। মনের মাঝে একটা প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে ধারার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে ধন্যবাদ বলাটাও কম হবে। সারাটাজীবন তার দাসি হয়ে থাকলেও বোধ হয় এই ঋণ দিতে পারবে না সে। বেশ অনুগত স্বরে বলে উঠে,
– এতো ভালো হওয়ো না অনলভাই, আমি এই ঋণ দিতে পারবো না তোমার।
– এতো বকিস কেনো রে তুই? জানিস তাওকে সকাল বিকাল শুধু চাপড়ানো দরকার। আমি কি তোকে কিছু বলেছি? আমি কি বলেছি তুই আমার ঋণ কিভাবে দিবি? একটা কথা মাথায় রাখবি আমি যা করছি সেটা আমার মায়ের জন্য করছি। আর যে আসছে তার জন্য করছি। তাই ঋণের কথা তো আসবেই না। আরেকবার যদি শুনি না চাপরে গাল লাল করে দিবো।
ধমকের স্বরে গড়গড় করে কথাগুলো বলে হাটা দিলো অনল। ধারা অনলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। লোকটাকে যত দেখে তত অবাক হয়, উপরওয়ালা একে কি দিয়ে বানিয়েছে কে জানে। সারাক্ষণ বকবে সে ধারাকে কিন্তু অন্য কেউ ধারাকে নিয়ে কোনো কথা বললেই ক্ষেপে তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দিবে। একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে লোকটার প্রতি, এটা কেনো সেটা ধারা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। এই ভালোলাগাটা কেবলমাত্র কৃতজ্ঞতার কারণেই। কারণ সে তো অনলকে পছন্দ করে না আর তাকে পছন্দ করাটাও সম্ভব নয়। এই যুক্তিতর্ক দিয়ে ধারা নিজের মনকে বেশ শক্ত করে বুঝেই দিলো। নিজের মনকে বুঝ দিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে হাটা দেয় সে অনুষ্ঠানের দিকে। দুটো আলাদা মানুষের ভাগ্য তাদের এক সম্পর্কে বেধেছে, না জানি এর পরিণতিটা কি রুপ হবে তা তারা কেউ জানে না
সকাল ৯টা,
ধারাদের বাসার ডাইনিং টেবিলে বসা অনল এবং ধারা। সুরাইয়া বেগম জামাই আদরের কমতি করছেন না। এমনেই অনলকে ছেলে হিসেবে তার খুব পছন্দ। এখন তো সে তার জামাই, তাই আদরটাও দ্বিগুণ। ধারা মাথা নিচু করে শুধু খাবারটা গিলছে। সুরাইয়া বেগম এখনো তার সাথে দেইড়া কোনো কথা বলেন নি। এমনকি জিজ্ঞেস ও করেন নি সে কেমন আছে। ধারা তাই চুপচাপ শুধু একটা শৈবালের মতো ডাইনিং টেবিলে বসে রয়েছে। সে শুধু দিন গুনছে কখন এ বাড়ি থেকে যাবে। হঠাৎ……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১০ম পর্ব
সুরাইয়া বেগম এখনো তার সাথে দেইড়া কোনো কথা বলেন নি। এমনকি জিজ্ঞেস ও করেন নি সে কেমন আছে। ধারা তাই চুপচাপ শুধু একটা শৈবালের মতো ডাইনিং টেবিলে বসে রয়েছে। সে শুধু দিন গুনছে কখন এ বাড়ি থেকে যাবে। হঠাৎ অনল বলে উঠলো,
– মামী মা, আপনি আমাকে এতো কিছু সাধছেন, আমার বউ কে তো কিছুই বেড়ে দিচ্ছেন না। আমার বউএর সাথে কি আপনার কোনো ইস্যু আছে?
অনলের এরুপ কথায় বেশ হতচকিত হয়ে যান সুরাইয়া বেগম। ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে অনলের দিকে তাকিয়ে আছে। ধারা এতোক্ষণ মাথা নিচু করে খাচ্ছিলো। অনলের কথা শুনে তড়িৎ গতিতে অনলের মুখের দিকে তাকালো। অনলের বেশ ভাবলেশহীন ভাবেই সুরাইয়া বেগমের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। সুরাইয়া বেগম অনলের প্রশ্নের ধারে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। আমতাআমতা করে বলতে থাকেন,
– হঠাৎ এ কথা বাবা?
– কি করবো বলুন মামী মা, ধারা প্রেগন্যান্ট এ কথাটা জানা সত্ত্বেও ওর খাওয়া দাওয়ার কোনো খেয়াল আপনি করছেন না। তাই বাধ্য হয়ে এই কথাটা বলতে হচ্ছে।
অনলের কথাটা শুনে বেশ লজ্জায় পড়ে যান সুরাইয়া বেগম। কথাটা একেবারেই ভুল বলে নি অনল, ধারার এখন যত্নটা আরো ও বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু ধারা আসার পর থেকে তার যত্ন তো দূরে থাক তার সাথে কথাটাও বলেন নি সুরাইয়া বেগম। তার খাওয়া দাওয়া যত্নের কোনো খেয়াল ই নেই সুরাইয়া বেগমের। অনলের এরুপ কথায় সেলিমের সাহেব ও চুপ হয়ে যান। বাবা হিসেবে এই দায়িত্বটা তার উপরও বর্তায়। হ্যা ধারা ভুল করেছে ঠিক ই কিন্তু তাদের সম্মানের কোনো ঘাটতি অনলের কারণে হয় নি। অথচ সুরাইয়া বেগম এবং সেলিম সাহেব উভয়ই ধারার প্রতি গম্ভীর মনোভাব ধরে রেখেছে। সুরাইয়া বেগমকে চুপ করে থাকতে দেখে অনল ভাবলেশহীন ভাবেই পুনরায় বলে,
– মামী মা, একটা কথা স্পষ্ট করে দেওয়াটা হয়তো ভালো হবে। বেয়াদবি নিবেন না তবে কথাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। ধারা ভুল করেছে এটা যেমন সত্যি, ধারাকে শাস্তি দেবার অধিকার যেমন আপনাদের আছে ঠিক তেমন ধারা এখন প্রেগন্যান্ট, তার যত্নের পরিমাণটা অধিক প্রয়োজন এবং তার এখন আপনাদের মেন্টাল সাপোর্টের প্রয়োজনটা ও অনেকগুণ বেশি হওয়া দরকার এটাও তেমন সত্যি। আপনারা তার প্রতি এখনো ক্ষুদ্ধ হয়ে আছেন, কিন্তু সেটায় কি আপনারা হ্যাপি আছেন নাকি ধারা হ্যাপি আছে। মামু,মামী মা আমি চাই না ধারার কোনো শারীরিক অসুবিধা হোক, এখন আপনাদের এই রূঢ় আচারণ তাকে মেন্টালি ভেঙ্গে ফেলছে। এই আচারণ গুলো আমি বা মা করলে যৌক্তিক হতো। কিন্তু আপনারা কেনো করছেন এটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। ধারা অনেক বড় পাপ করেছে, সেটার গ্লানি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু আপনাদের অবহেলা তাকে আরো ও ভেতরে ভেতরে মেরে ফেলছে। আপনারা যদি আমার বউ এবং বাচ্চার প্রতি এমন মনোভাব ই রাখেন তাহলে আমি আর এবাড়িতে আসবো না এবং আমার বউ বাচ্চাকেও এ বাড়িতে পা রাখতে দিবো না। যদি আমার কথায় আপনারা ক্ষুদ্ধ হয়ে থাকেন তবে আমাকে ক্ষমা করবেন
বলেই নিজে ধারার প্লেটে খাবার বেড়ে দেয় সে। ধারার মুখে কোনো কথা নাই, কৃতজ্ঞতার নজরে শুধু অনলকেই দেখে যাচ্ছে সে। অনল তখন বেশ ধমকের স্বরেই নিচু গলায় বললো,
– আমার মুখে না তাকিয়ে এই সম্পূর্ণ খাবারটা শেষ করো। একটা খাবার যাতে প্লেটে না থাকে।
বলেই একগাদা খাবার ভর্তি প্লেট এগিয়ে দিলো তার সামনে। এতো খাবার ধারা কেনো দুটো ধারাও খেতে পারবে না। ধারা তার দিকে অসহায় চাহনী দিতেই কড়া এক নজর দিয়ে তাকালো অনল তার দিকে তাতেই মোটামুটি কাজ হয়ে গেলো। ধারা কোনো কথা না বলে রোবটের মতো অনলের কথামত খেতে লাগলো। সে জানে যদি অনলের কথা না শুনে কপালে দূর্ভোগ আছে। সেলিম সাহেব এবং সুরাইয়া বেগম বিমুগ্ধ নজরে অনলধারাকে দেখছেন। অনলের মতো জামাই পেয়ে তাদের মন যেনো নিশ্চিন্ত। যেমন পরিস্থিতিতে তাদের বিয়ে হয়েছে সেই পরিস্থিতিতে কেউ যে ধারাকে বিয়ে করবে এটাই যেনো কল্পনার বাহিরে ছিলো তাদের। তার উপরে অনল যেভাবে তার মেয়েকে সহযোগিতা করছে এটা যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আজ অনল ভুল কিছুই বলে নি, তার কথাগুলো তাদের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। সত্যি ই তো এখন রাগ দেখিয়ে কি হবে, যে আসছে তার তো কোনো দোষ নেই। আর ধারার ভুলের শাস্তি সে পাচ্ছে, বিশ্বাস করে যে ভুলটা সে করেছিলো তার কারণে আজ সে নিজের বাচ্চাকে বৈধ বলে দাবি অবধি করতে পারছে না। যে সময়টা সব মেয়েদের কাছে সুখময় মূহুর্ত হয় সেই সময়টা তার গলার কাটা হয়ে গিয়েছিলো। তাই এখন তার উপর ক্ষুদ্ধতা দেখিয়ে মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়া বাদে আর কিছুই হবে না। একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিজেদের আশ্বস্ত করলেন তারা।
আয়নার সামনে হাসপাতালের জন্য তৈরি হচ্ছে অনল। ধারা এক নজরে তাকে দেখেই যাচ্ছে। শ্যাম বর্ণের উচু লম্বা পুরুষটিকে বেশ নিপুণ নজরে দেখে যাচ্ছে সে। নীল শার্টে বেশ মানিয়েছে তাকে। অনলের প্রতি যে মেয়েরা দূর্বল ব্যাপারটা আন্দাজেও আচ করতে পারছে ধারা।
– আমার কি রুপ গজিয়েছে? হঠাৎ এভাবে হা করে দেখার কি হলো?
আয়নার দিকে তাকিয়ে কপালের উপরের চুলগুলো হাত দিয়ে ঠেলে পেছনে সরাতে সরাতে বলে উঠলো অনল। ধারাও চুপ না থেকে কথার পেছনেই বলে উঠলো,
– নিজের জিনিস দেখতে কি কারোর পারমিশন লাগবে? আমার তো মনে হয় না এতে কোনো বিশেষ কারণের দরকার হয়।
ধারার তড়িৎ উত্তরে মুচকি হাসি টেনে পেছনে ফিরলো অনল। গালটা টেনে বলতে লাগলো,
– বেশ পেকেছিস তো, আমার কথার উপরে কথা বলতেও শিখেছিস। এখন আমাকে আর ভয় লাগে না বুঝি?
– ভয় লাগবে কেনো গো?
– ওমা তোর থেকে পাক্কা এগারো বছরের বড় আমি।
– তো?
– তো কি? আমার কথার পিছে কথা বলছিস, সম্মান বলেও তো জিনিস আছে নাকি?
অনলের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো ধারা। যেনো অনল খুব মজার একটা জোক্স বলেছে তাকে। ধারার উচ্ছলতা দেখে অনলের ও ভালো লাগছে। এখন তার মন ভালো থাকাটা অধিক দরকার। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
– থাক আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।
বলে যেতে নিলেই….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১১তম পর্ব
ধারার উচ্ছলতা দেখে অনলের ও ভালো লাগছে। এখন তার মন ভালো থাকাটা অধিক দরকার। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
– থাক আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।
বলে যেতে নিলেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে ভেসে আছে। শব্দের দিকে লক্ষ্য করে অনল এবং ধারার দরজার দিকে তাকাতেই দেখে সুরাইয়া বেগম দাঁড়িয়ে আছেন ফলের প্লেট হাতে। বেশ ইতস্তত ভাবে সুরাইয়া বেগম বলেন,
– আসবো?
অনল হাসিমুখেই তাকে বললো,
– আরে মামী মা, আপনার মেয়ের ঘরে আপনি ঢুকবেন পারমিশনের কি আদৌ দরকার আছে? আসেন না। আচ্ছা আপনি কি তখন আমার কথায় রাগ করেছেন?
– না না রাগ করবো কেন?
বেশ অপ্রস্তুত ভাবেই সুরাইয়া বেগম বলেন। অনল তার ইতস্তত ভাব কাটাতেই বলে উঠে,
– আমার বেয়াদবির জন্য ক্ষমা করে দিবেন মামী মা, বুঝতে পারি নি।
– না না কি যে বলো, বেয়াদবী কোথায় করলে৷
– তাহলে ক্ষমা করেছেন তো
– আরে কি যে বলো তুমি
– তাহলে আমি আসি মামী মা, আসতে রাত হবে। ধারার দিকে খেয়াল রাখবেন প্লিজ আসি। ধারা আসলাম
বলেই বেড়িয়ে পড়ে অনল। ধারা অনলের যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটাকে আজকাল আর অসহ্য লাগছে না, অসহ্য লাগছে না বললে ভুল হবে। লাগছে, তবে ভালো ও লাগছে। তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে সুরাইয়া বেগম বলে উঠেন,
– ফলগুলো খেয়ে নে, জানি তোর ফল পছন্দ না কিন্তু এ সময় ফল, দুধ, মধু এগুলো খেতে হয়।
সুরাইয়া বেগমের কথাটা যেন অমৃত এর মতো কাজ করলো। প্রায় দু সপ্তাহ পর তার মায়ের বুলি শুনছে। এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া হয়তো এ জীবনে তার আর হয় নি। সে কল্পনাও করে নি তার মায়ের সাথে তার সম্পর্ক পুনরায় আগের মতো হবে। ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে ধারা। অনুভূতি গুলো সব গলায় আটকে আছে। কিভাবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আজ শুধু কেঁদে মন হালকা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই পিছ পা না হয়ে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। হু হু করে কাঁদতে শুরু করে সে। সুরাইয়া বেগম ও কাঁদছেন, মেয়েকে কতদিন এভাবে কাছে ডাকেন নি তিনি। কোনো কথা নেই শুধু অশ্রু দিয়েই নিজেদের মান অভিমান গুলোর সমাপ্তি করছে মা-মেয়ে। আসলে কিছু সম্পর্কে কথার প্রয়োজন হয় না। সম্পর্কটাই এমন হয় যে তাতে কিছু না বলেও অনুভুতির প্রকাশ করা যায়। মা-মেয়ে কতোক্ষণ এভাবে অশ্রুপাত করেছেন নিজেরাও জানে না। শুধু নিজেদের মাঝের অদৃশ্য দেয়াল ভাঙ্গতে ব্যস্ত তারা। আজ এই ঘটনা শুধু একজনের চেষ্টায় সম্ভব হয়েছে তা হলো অনল। অনলের প্রতি কৃতজ্ঞতাটা অন্য রুপ নিচ্ছে কিন্তু ধারা নিজেও সেটা বুঝতে পারছে না
বিকেল ৪টা,
সুরাইয়া বেগম জলপাই এর আচার বানাচ্ছেন। ধারার এখন টক খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আর তার জলপাই এর আচারটা খুব ই পছন্দ। যেহেতু শীত কাল তাই সুরাইয়া বেগম ও জলপাই যোগাড় করে আচার বানাতোতে মেতে উঠেছেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে আচার বানাচ্ছেন আর পাশে ধারা কাঁচা জলপাই লবণ দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। তখন হুট করেই সুরাইয়া বেগম বলে উঠলেন,
– অনল তোর অনেক যত্ন করে না রে?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন?
সুরাইয়া বেগমের কথায় বেশ অবাক হয়েই কথাটা বলে ধারা। সুরাইয়া বেগম তখন মুখে হাসি টেনে বলেন,
– চুল আমার হুতাশে পাকে নি। অনলকে ছোট কাল থেকে দেখে এসেছি। পাঁচ বছর আগে যা হয়েছিলো তার পড়ে সে যে বিয়ে করবে এটাই আমরা ভাবতে পারি নি। কিন্তু আমাদের অবাক করে সে তোকে বিয়ে করেছে। তার উপর তোর মাথায় একটা বট গাছের মতো ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই এই প্রশ্নটা করলাম
– মা, একটা কথা বলি?
– হু বল
– অনল ভাইয়ের কাছে তোমরা বেশি কিছু আশা করো না
– কেনো বলতো?
খুন্তিটা পাশে রেখে ধারার দিকে ফিরে সুরাইয়া বেগম কথাটা বলেন। তার প্রশ্নের উত্তর স্বরুপ ধারা বলে,
– অনল ভাই যা করছেন একটা ভালো মানুষ হিসেবে করছেন। আসলে কি বলোতো, জীবন তাকে এতোটা আশাহত করেছে যে সে এখন অন্যের জীবনের আশা হয়ে বাঁচতে চান। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ, সে সত্যি খুব ভালো মানুষ। নয়তো আমার মতো পাপীকে এতো সম্মান দিতো না। কিন্তু এই জিনিসটার সুযোগ নিতে চাই না। আমি তার বোঝ হতে চাই না। ফুপির জন্য সে আমাকে সাহায্য করছেন, আমার বাচ্চাকে নাম দিচ্ছেন ব্যাপার গুলো আমার জন্য মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আমি তো মরে যেতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি ফেরেস্তার মতো আমার জীবনে আসলেন। সত্যি মা, আমি চাইনা তিনি আর কিছু করুক। যা করেছেন বা করবেন তাই আলহামদুলিল্লাহ। আমার আর কিছু চাই না। তুমি হয়তো ভেবেছো সে আমাকে ভালোবাসে বিধায় এতোটা সাহায্য করছে। কিন্তু সত্যি বলতে সে এখনো অতীত থেকে বের হয় নি। আমি জানি না তার অতীতটা কি, বা কেমন, তবে সেই অতীতের জন্যই সে আজ নিজের ভেতরে কুড়ে কুড়ে আছে। তাই আমি শুধু এটুকু জানি আমি তার কাছে কখনো কিছু দাবি করবো না। সে যদি কোনোদিন আমাকে বলে তার পিছু ছেড়ে দিতে আমি হাসি মুখে তা করবো। আমি তার বোঝ হয়ে চাই না। না চাই আমার বাচ্চা সেটা হোক।
ধারার কথা শুনে সুরাইয়া বেগম মুখের কোনায় হাসি টেনে বলেন,
– একটা কথা বলি?
– হ্যা বলো
– কথাটা শোন তারপর বুঝার চেষ্টা করে কাজে লাগানোর চেষ্টা করিস। তোর জীবনে যেমন অনল ফেরেস্তা, অনলের জীবনেও তুই ঔষধির মতো। অনল অনেকটা পালটে গেছে। হয়তো তোর জন্য, বা বাচ্চাটার জন্য বা পরিস্থিতির জন্য। একটা সময় অনল কারোর সাথে ঠিক মুখে কথা বলতো না। বিশেষ করে, ওই ঘটনাটার পর। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা না শুধু বিছানায় সীমাবদ্ধ নয়। সম্পর্কটা বন্ধুত্বের, বোঝাপোড়ার। একসাথে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাওয়ার। অনল আজ তোকে যে সাপোর্ট টা দিচ্ছে সেটা প্রত্যেকটা স্বামীর ই করা উচিত। অনল এই বিয়েটা মানে কিন্তু স্বামী হিসেবে সকল দায়িত্ব সে পালন করে যাচ্ছে। তাই তোকেও বলবো, স্ত্রী হিসেবে তোর দায়িত্বগুলো পালন কর। দেখ তুই জীবনে অনেক ভুল করেছিস, কিন্তু ভুলআনুষের জীবন আটকে রাখে না। তাই অতীতকে ফেলে এগিয়ে যা। অনল যেহেতু তোর অতীত নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, তাই আমি বলবো তুইও ওর অতীতের মাঝে ওকে ঢুবে থাকতে দিস না। স্ত্রী না বন্ধু হয়ে ওর পাশে দাঁড়া। তোরা দুজন অপূর্ণ মানুষই পারবি নিজেদের পূর্ণ করতে। ভেবে দেখিস আমার কথাটা। মা তো তোকে খারাপ বুদ্ধি কখনো দিবো না। অনলের জীবনে বোঝা না বরং বন্ধু হতে চেষ্টা কর। একটা আলো হিসেবে ওর বেরঙ জীবনকে আলোকিত কর। চেষ্টা করে দেখ। দেখবি ঠিক পারবি।
বলেই আবার আচার বানাতে মন দেন সুরাইয়া বেগম। তার কথাগুলো অনেকটাই সুভাসিনী বেগমের সাথে মিলে যাচ্ছে। প্রতিটি কথা ধারাকে মন দিয়ে ভাবাচ্ছে। সে আসলে পারবে অনলের জীবনে বোঝা না হয়ে বন্ধু হয়ে উঠতে! সে কি পারবে এই কাগজের সম্পর্কটা সত্যিকারের স্বামী-স্ত্রীর রুপ দিতে!
রাত ১০টা,
ডাইনিং টেবিলে বসে রয়েছে ধারা। সুরাইয়া বেগমের কথাগুলো শোনার পর থেকে ধারা বেশ চিন্তা করেছে। কৃতজ্ঞতার ক্ষাতিরে হলেও অনলের প্রতি সব দায়িত্ব সে পালন করবে। নয়তো কেবল মাত্র বোঝা ব্যাতীত অনলের জন্য কিছুই হবে না। অনল এখনো বাড়ি ফিরে নি, ফোন করতে চেয়েছিলো কিন্তু অনলের ঝাড়ির ভয়ে ফোন দেয় নি। সময়ের সাথে অপেক্ষার প্রহর টা বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে তার। দৌড়ে দরজা খুলতেই দেখে বিধ্বস্ত অবস্থায় অনল দাঁড়িয়ে আসে। লোকটা সেই সকালে গিয়েছে আর এখন এসেছে। লোকটার এই করুন মুখটা দেখে ধারার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আজকের দিনটা ভালো যায় নি অনলের, হাতের উপর একটা রোগী মারা গেছে। চেষ্টা করেছিলো কিন্তু বাঁচাতে পারে নি। লোকটার বয়স চৌত্রিশের কাছাকাছি, অনলের থেকে বছর তিন বড়। অথচ যায়গায় হার্ট এট্যাক হয়ে মারা গেছে। অনলের হাতে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে অনেকটা ডিস্টার্ভড হয়ে যায় সে। তাই এক মিনিট দেরী না করে বাসায় চলে এসেছে সে। বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ির কলিংবেল টিপতেই ধারা দরজাটা খুলে। নীল শাড়িতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। কেনো যেনো সামনে থাকা রমনীকে দেখে অজান্তেই তার অগোছালো দিনের স্বস্তির পরশ বয়ে গেলো। কিন্তু পর মূহুর্তে কিছু ভেবে গট গট করে ভেতরে চলে গেলো সে। তোয়ালে এবং ট্রাওজার নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে নিলেই ধারা পেছন থেকে বলে উঠে,
– খাবার গরম করি?
কথাটা শুনে পিছনে না ফিরেই বলে,
– আমার খাওয়া নিয়ে তোর ভাবতে হবে না, আমি পরে খেয়ে নিবো।
বলে চলে যেতে নিয়েও আবার থেমে যায়, পেছন ফিরে বলে,
– তুই খেয়েছিস?
ধারা কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে নাবোধক উত্তর দেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনল নিচু গলায় বলে,
– তুই খাবার নিয়ে আয়। টেবিলে বসে খেতে ইচ্ছে করছে না।
বলেই ওয়াশরুমে চলে যায় অনল। সে রাতে অনল তেমন কোনো কথা বলে নি ধারার সাথে। ধারা একবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করে নি। তার মনে হয়েছে অনলকে এখন একটু একাকিত্ব সময় দেওয়া উচিত। রাতটা নিশ্চুপ কাটে তাদের। রাতের নীরবতা তাদের সম্পর্কের মধ্যেও বিরাজমান। এখন সকালের অপেক্ষা।
সকাল ১১টা,
অনলদের বাড়িতে চলে এসেছে অনল-ধারা। সুরাইয়া বেগম এবং সেলিম সাহেব উভয়ের ই মন খারাপ লাগছিলো কিন্তু মা-বাবার তো মেনে নিতেই হবে। মেয়ে তো বড় হলে অন্যের বাড়িতে চলেই যায়। এটাই নিয়তি। অনলের বাড়ি আসার সাথে সাথে সুভাসিনী বেগম তাকে অনলের ঘরে পাঠিয়ে৷ দেন। ধারাও কোনো অমত পোষন করে নি। রুমে যেয়ে দেখে অনল নেই, হয়তো ওয়াশরুমে আছে। আজকেও তার ডিউটি আছে। তাই ধারাও আলমারি খুলে তার কাপড় বের করে দিতে থাকে। হঠাৎ একটি ছবি কাপড়ের ভেতর থেকে নিচে পড়ে যায়। ছবিটা হাতে নিয়ে পাল্টালে দেখে………..
চলবে
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১২তম পর্ব
হঠাৎ একটি ছবি কাপড়ের ভেতর থেকে নিচে পড়ে যায়। ছবিটা হাতে নিয়ে পাল্টালে দেখে একটি হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। মুখে চাঁদের মতো উজ্জ্বল হাসি। হরিণা চোখের শ্যামবর্ণের মেয়েটির কি মায়াবী না চেহারা! এই মায়াবী চেহেরায় যে কেনো নিজেকে ভাসিয়ে দিবে। ছবিটি বেশ যত্ন করে কাগজের ভাজে রাখা। ছবিটির নিচে একটি ডেট দেখা যাচ্ছ তাহলো ০৮.০৯.২০১৪. কে এই মেয়েটি? যার ছবি এতোটা যত্ন করে দেখে দিয়েছে অনল। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটির সাথে তার সম্পর্কটা খুব কাছের। কিন্তু মেয়েটি কে এবং সম্পর্কটা কি তাদের এটাই বুঝে উঠতে পারছে না।
– তোকে আমি বলছিলাম মায়ের ঘরে থাকতে? এখন তো কোন মেহমান নেই তাহলে আমার ঘরে কি করছিস?
শক্ত কন্ঠে অনলের বলা কথাটা কানে আসতেই পেছনে ফিরে তাকায় ধারা। ধারার হাতে ছবিটা দেখতেই চট করে মেজাজ হয়ে যায় অনলের। ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। সাধারণ মুখটায় একটা হিংস্রতায় ভরে উঠলো। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত চেপে থমথমে কন্ঠে বলে,
– আমার আলমারিতে হাত দিয়েছিলি?
হঠাৎ করেই এক ঝাক ভয় মনে এসে ভিড়লো ধারার। অনলের খিটখিটে মেজাজ এবং ঠেস মেরে কথা বলার সাথে আগ থেকে পরিচিত হলেও কেনো জানে এই মূহুর্তে সামনে থাকা মানুষটি একদম ই অচেনা লাগছে ধারার কাছে। আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ক্ষিপ্র গতিতে তার কাছে এসে খপ করে ছবিটা হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় অনল। ধারা উপায়ন্তর না দেখে বলতে লাগে,
– আ…আসলে
– তোর সাহস কি করে হলো আমার জিনিসে হাত দেওয়ার? আমি তোকে পারমিশন দিয়েছি তোকে?
– না, আ…আমি
– তুই কি? লজ্জা লাগে না তোর? এক মিনিট, এক মিনিট। তুই কি এতোদিন আমার ভালো ব্যাবহারের কারণে ভাবছিস আমি তোকে মেনে নিয়েছি? আমার নিজের স্ত্রী হিসেবে মন থেকে মেনে নিয়েছি আমি? তুই কি গাধা? একটু ভালো ব্যাবহার করলেই গলে যাস? কি ভেবেছিস এই কদিন তোর সাথে একটু ভালো ব্যাবহার কি করেছি আমি তোকে ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি? এতো সোজা ভালোবাসা? কান খুলে শুনে নে, তুই শুধু এবং শুধু আমার বাড়িতে আমার বউ হয়ে এসেছিস আমার মা চেয়েছে বলে। আমার মনে কোনোদিন তোর কোনো জায়গা এক মূহুর্তের জন্য ও তৈরি হয় নি। আর কোনোদিন তৈরি ও হবে না।
-…….
– সেদিন তোর বাবা-মার সামনে বড় গলায় তোকে নিজের বউ আর তোর বাচ্চাটাকে নিজের বাচ্চা বলে দাবী করেছি বলে তুই তো দেখি আকাশে উড়ছিস। কি ভেবেছিস আমি তোকে ভালোবাসতে লেগেছে। তোর সত্যি বুদ্ধিজ্ঞানটাও নেই। তোর মত মেয়েকে আমি ভালোবাসতে পারি আদৌ? সেটাকি মানাবে? এখন ই বেড়িয়ে যা আমার রুপ থেকে। নিজের জায়গাটা ভুলে যাস না। তুই মায়ের জন্য এ বাড়ির বউ হতে পারিস। আমার জন্য শুধুমাত্র একজন আশ্রিতা।
অনলের কথা শেষ হবার আগেই মাথা নিচু করে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো ধারা। আর এক মূহুর্ত সেই রুমে থাকাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো। অনলের কথাগুলো মোটেই ভুল নয়, এটা বারবার মানতে চেয়ে নিজেকে বুঝাচ্ছে ধারা। কিন্তু তবু ও মনে হচ্ছে বুকে যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। চোখ গুলো ভিজে আসছে। সত্যি সে বেহায়া কেনো যেচে সেই কাজগুলো করতে গিয়েছিলো। অনলের প্রতিটি শব্দ বিষধার তীরের মতো ধারার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। অবশ্য এটাই তো প্রাপ্য ছিলো তার। তাহলে কেনো এতো খারাপ লাগছে। সে নিজেও জানে না। খুব খারাপ লাগছে শরীরটা যেনো চলতেই চাচ্ছে না। ফুপুর রুমে এসেই গা এলিয়ে দেয় সে। চোখের অশ্রুতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় নিজেও জানে না।
ধারা রুম থেকে চলে যাবার পর হুশ আছে অনলের। রাগের মাথায় মাত্রাছাড়া কথা বলে ফেলেছে সে। হয়তো এতো কড়া কথা না বললেও হতো তার। পাশ ফিরতেই দেখলো খাটের উপর কাপড় বের করা। ধারা হয়তো তার হাসপাতালের যাবার জন্য কাপড় করে দিচ্ছিলো। ছবিটা হয়তো কাপড়ের ভেতর থেকেই বেরিয়ে যায় এসেছে। এই সামান্য কাজের জন্য না জানি কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো তাকে অনল। এতোগুলো কথা কথা বলার কি আদৌ দরকার ছিলো নাকি সেটা উচিত ছিলো। এই রাগটা অনলের বড্ডবেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই আটকাতে পারছে না। সজোরে আলমারিতে আঘাত করে খাটে বসে পড়লো সে। নিজের উপর ধিক্কার হচ্ছে। মেয়েটাকে না জানি কতোটা বেশি কথা শুনিয়ে দিলো সে। অনন্যার ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাঙাস্বরে বলতে লাগলো,
– ভুল করে ফেলেছি অনন্যা, ভুলটা বেশি হয়ে গিয়েছে। ধারাকে বিনা দোষে এতোগুলো কথা বলাটা একদম উচিত হয় নি। কি করবো বলো, ধীরে ধীরে ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম। আর কালকের সেই একই ঘটনা আমার চোখের সামনে আবারো ঘটায় আমি যেনো নিজের মাঝেই ছিলাম না। নিজের অপারগতার সকাল রাগ ধারার উপর ঝেড়ে দিয়েছি। বিশাল বড় ভুল হয়ে গেছে। ওকে আশ্রিতা অবধি বলে দিয়েছি। কিভাবে ওর সামনে দাঁড়াবো অনন্যা। কিভাবে!!
রাত ১০টা,
সারাদিনের খাটাখাটুনির পর বাসায় এসেছে অনল। সারাদিনে একটা কথাই তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে, ধারার কাছে ক্ষমা কোন মুখে চাবে। বাসায় কলিংবেল দিতেই সুভাসিনী বেগম দরজা খুলেন। অনল ভেবেছিলো ধারা দরজা খুলবে। কিন্তু সুভাসিনী বেগম দরজা খোলায় তার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। সুভাসিনী বেগম তাকে দেখেই বলেন,
– ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।
– মা
– কি হয়েছে?
আশেপাশে ভালোভাবে দেখে সে বলে,
– ধারা কোথায়?
– সেটা কি তোমার জানার দরকার আছে?
সুভাসিনী বেগমের কাটকাট কথায় বুঝতে বাকি রইলো না তিনি সব জেনে গেছেন। ধারা কি তাকে বলে দিয়েছে। কিন্তু সে তো এমন মেয়ে না, হাজারো আঘাত করলেও টু শব্দ করে না মেয়েটা। তাহলে!
– ধারা আমাকে কিছুই বলে নি, কিন্তু আমার কান নামক একটা জিনিস আছে। যা দিয়ে আমি বেশ ভালো করেই শুনতে পাই। আর তুমি যখন তাকে চেঁচিয়ে আশ্রিতা বলছিলে আমি খুব ভালো করেই শুনেছি। যাক গে যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।
সুভাসিনী বেগমের কড়া কথায় বেশ বড় সড় ঢোক গিয়ে অনল বলে,
– মা, ধারা কি খেয়েছে?
– হুম, সে এখন ঘুমাচ্ছে। ওর শরীরটা ভালো নেই। জ্বর এসেছে। আমি ঔষধ দিয়েছি। সো তোমার ওকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।
বলেই সুভাসিনী বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। অনলের নিজের মাঝে একটা গ্লানি অনুভব করছে। সে চাইলেও তার ধারে কাছেও ভিড়তে পারবে না। কারণ এখন সুভাসিনী বেগম আছেন। আর তিনি কতটা কড়া ব্যাপারবগুলো অনলের খুব ভালো করেই জানা আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে হাটা দেয় অনল।
এক মাস পর,
ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে অনল-ধারা। এই এক মাসে ধারা যতটা পেরেছে অনলের কাছ থেকে দূরত্ব রাখার চেষ্টা করেছে। অনল কোনোভাবেই সেদিনের পর থেকে ধারার সাথে কথা বলতে পারে নি। ধারা সেই সুযোগটাই দেয় নি। সামনাসামনি বসা অবস্থায় ধারা একটা কথা ও বলছে না অনলের সাথে। মাথা নিচু করে কোনোভাবে খাওয়াটা সারছে। অপরদিকে অনল বারংবার ধারার আশেপাশে ভিড়তে চাইছে। কোথাও না কোথাও ফাকা ফাকা লাগছে। ধারার সাথে খুনসুটি গুলো বেশ মনে পড়ছে তার।
– আজ ধারার চেকাপ, অনল তুমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাও।
– না না, ফুপি অনল ভাইয়ের যাবার প্রয়োজন নেই আমি একাই পারবো
সুভাসিনী বেগমের কথা শোনা মাত্র ধারা তাতে ভেটু দেয়। ধারা কথাটা বলামাত্রই অনল বলে উঠে,
– মা, পনেরো মিনিটের মধ্যে ওকে রেডি হতে বলো। আমার ডিউটি আছে, ওকে চেকাপ করিয়ে দেন আমি যাবো।
বলেই গটগট করে নিজের রুমে চলে যায় অনল। অগত্যা আর কথা বাড়াতে পারলো না ধারা।
রেডি হয়ে যখন বাসা থেকে বের হলো অনল তখন সি.এন.জি ডাকতে ব্যস্ত। ধারাকে আসতে দেখেই সে থেমে গেলো। এগিয়ে এসে কিছু বলতে নিলেই ধারা নিচুস্বরে বললো,
– আমি একাই যেতে পারবো অনল ভাই, কষ্ট করে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ফুপি জানবেন ও না
কথাটা শুনেই অনলের মুখটা ছোট হয়ে গেলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
– তুই কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস?
– এড়িয়ে যাবো কেনো? এখানে এড়িয়ে যাবার কিছুই নেই। সত্যি বলতে, আমি চাই না তোমার উপর বোঝা হয়ে থাকতে। সত্যি নিজের জায়গা ভুলতে বসেছিলাম। একটু ভালো ব্যাবহার করেছো তাই ভাবতে লেগেছিলাম… যাক গে, একজন আশ্রিতাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছো, আমার বাচ্চাকে বাঁচিয়েছো। তাকে নিজের নাম দিয়েছো। সেই উছিলায় তোমার ঘাড়ে চেপে বসাটা আমার উচিত হবে না। তুমি যা করেছো এর চেয়ে বেশি কিছু তোমার কাছে চাওয়াটা উচিত নয়। এতোটা লোভী হওয়াটা আমার উচিত হয় নি। তাই আশ্রিতা হয়ে তোমার উপর আমি বা আমার বাচ্চা বোঝা হতে চাই না।
ধারার প্রতিটা কথা চুপ করে শুনেছে অনল। ধারা কথাগুলো বলে এগিয়ে যেতে নিলে……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১৩তম পর্ব
ধারার প্রতিটা কথা চুপ করে শুনেছে অনল। ধারা কথাগুলো বলে এগিয়ে যেতে নিলে হ্যাচকা টানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে অনল। ঘটনার আকর্ষিকতায় ধারা টাল সামলাতে না পেরে ওর বুকে আছড়ে পড়ে। অনল ও সুন্দর ভাবে তাকে সামলে নেয়। মাথা তুলে অনলের দিকে তাকাতেই বজ্রের মতো কঠিন কন্ঠে তাকে শুনিয়ে দেয়,
– ঠিকভাবে দু কদম চলতে পারে না আসছে একা একা হাসপাতালে যাবে। বেশি পাকামো করিস না। আমি যখন বলেছি আমি দিয়ে যাবো, মানে আমি নিয়ে যাবো। আর একটা কথা শুনলে কান লাল করে দিবো।
অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ধারা। অনল এখনো তার বাধন হালকা করে নি। অনলের দৃষ্টি ধারার আখি বরাবর। কোনো অজানা আকর্ষণে চোখ সরাতে ইচ্ছে হচ্ছে না ধারার। এই লোকটার সমস্যাটা কি সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় আবার অধিকার দেখায়। এই অনুভূতির উত্থান পতনে ধারা বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করা উচিত। কতোক্ষণ অনলের বাহুডোরে ছিলো সেই হিসাবটা সে লাগাতেও যায় নি। সেদিনের রুমের ব্যবহারটা মনে পড়তেই ঝট করে সরে আসলো অনলের কাছ থেকে। ধারার এই আচারণটাই স্বাভাবিক এতে অস্বাভাবিকের কিছুই নেই। চোয়াল শক্ত করে ধারা বললো,
– কি প্রমাণ করতে চাইছো? খুব মহৎ তুমি? যথেষ্ট মহত্বের পরিচয় তো দিয়েছো। এবার আমাকে আর ঋণী করো না। নিজের কাছে নিজে প্রতিনিয়ত ছোট হয়ে যাচ্ছি। আবার তুমি দয়া দেখিয়ে এসব করবে, তারপর আমি আবার পেয়ে বসবো। বলা তো যায় না। আমার মতো মেয়ে
কথা শেষ করার আগে ধারার বাহু চেপে ধরলো অনল। শক্ত হাত দিয়ে বেশ শক্তি প্রয়োগ করেই ধরেছে সে। বেশ অগ্নিদৃষ্টি ধারার দিকে প্রয়োগ করে পূর্বের ন্যায় কড়া কন্ঠেই বললো,
– আর একটা শব্দ যাতে তোর মুখ থেকে না বের হয়। আমি রাস্তায় কোনো সিন ক্রিয়েট চাই না। আমার সময়ের একটা দাম আছে।
– তাই তো বলছি একা চলে যেতে চাচ্ছি।
– বেশি লায়েক হয়ে গেছো তুমি, একটা থাবা দিবো সব লায়েকি ছুটিয়ে দিবো। বুজেছি তোমার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আর আমি তোমার জন্য কিছুই করছি না। আমার নিজের জন্য করছি। সুতরাং আমাকে আমার কাজ করতে দাও।
কড়া ভাষ্যে কথাগুলো বলেই ধারার কোমল হাতটা নিজের মুঠোতে নিয়ে হাটা শুরু করলো। ধারা চেষ্টা করেও পারলো না কিছু করতে। এবার অসম্ভব রাগ হতে লাগলো তার। অনলের খবরদারি স্বভাবে খুবই বিরক্ত সে। অনল নিজেই তাকে তার থেকে দূরে থাকতে বলেছে। অথচ এখন সে আবার নিজেই ধারার জন্য এসব করছে। ধারা নিজের মনকে এই এক মাসে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে নিয়েছে মোটেই সে অনলের প্রতি দূর্বল হবে না। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য পড়াশুনাও শুরু করে দিয়েছে সে। অথচ আবারো নিজের মস্তিস্কের প্রহরীগুলোকে পরাজিত করে হৃদপ্যের মাঝে কবজা করে নিবে অনল। আর অপমানিত হওয়ার মতো সাহস তার নেই। অনল গাড়িতে উঠার আগ অবধি তার হাত ছাড়ে নি। শুধু তাই নয়, সি.এন.জি তে উঠার পর ও ধারা হাত নিজের মুঠোছাড়া করে নি সে। যেনো ছেড়ে দিলেই কোথাও পালিয়ে যাবে ধারা। গাড়িতে একটা কথাও বলে নি ধারা। সে জানে অনলের সাথে কথা বলা মানে অরণ্যে রোধনছাড়া কিছুই হবে না। পাশাপাশি বসা দুজন মানব-মানবীর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। তারা চাইলেও হয়তো এই দূরত্ব মিটাতে পারবে না, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা
ডাক্তারের কেবিনে বসে রয়েছে ধারা এবং অনল। গাইনি চিকিৎসক ডা.ইশরাতের তাদের মুখোমুখি বসা। ডা.ইশরাত অনলের ম্যাডাম। হাসপাতালে সবথেকে ভালো ডাক্তারদের মধ্যে একজন। তিনি খুব যত্ন করে সব টেস্ট করে ধারার। ধারার ওয়েটটা বেশ কম। এই ব্যাপারটা ডাক্তারকে বেশ ভাবাচ্ছে। বাচ্চার গ্রোথ দেখতে আলট্রাসোনোগ্রাফি করাটাও প্রয়োজন। তাই ডা.ইশরাত অনলকে জানালেন,
– অনল, বেবির এখন সাত উইক চলে কিন্তু ধারার ওয়েটটা বেশ কম। আমি তাই আলট্রাসোনো করে দেখবো। তুমি ওকে নিচে নিয়ে যাও। আলট্রাসোনো করে রিপোর্টটা আমাকে দেখিয়ে নিও।
– ম্যাম, আপনি কি খারাপ কিছু এস্যুম করছেন?
– আই ইম নট শিওর। যদি বেবুর হার্ট রেট ঠিক থাকে দেন টেনশনের কিছু নেই। তবে ধারার খাবার দাবার একটু বাড়িয়ে দাও। যদি ওর সাইজ এমন থাকে তাহলে কিন্তু প্রবলেম হবে। আর মেয়ে একটু বেশি খাওয়া দাওয়া করবা। যা খেতে চাবে অনলকে বলবে ও কিনে দিবে। এই সময়টাই সুযোগ। হাসবেন্ডদের নিয়ে খাটিয়ে নেওয়ার। হাহা
ডা.ইশরাতের কথায় মনের মাঝে এক ঝাক শুন্যতা তৈরি হয়। শুধুমাত্র আবেগের বশে সে যে ভুল করেছে সেইটার কারণে আজ সে আশ্রিতা হয়ে রয়েছে অনলের কাছে। কোন অধিকারে কিছু চাইবে। এই বাসার খাবারও গলা থেকে নামে না তার। কিন্তু কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বাবা-মার কাছে যাবে না কারণ তারা তাকে মেনেই নিয়েছে অনলের উদারতার জন্য। এই ছাদটা ব্যতীত কোথাও যাওয়ার সুযোগটাও নেই ধারার। ধারার চিন্তায় ছেদ পড়ে অনলের একটা কথায়,
– ধারার কোনো অযত্ন হবে না ম্যাডাম। ওর খাবারের দায়িত্ব এখন থেকে আমার ম্যাম। চিন্তা করবেন না।
অনলের কথাটা শুনে বেশ অবাক ই হলো। কিছু প্রশ্নের হয়তো উত্তর পাওয়া যায় না। এখন ধারার ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। অনল যত্ন সহকারে তাকে দাঁড় করিয়ে নিচে নিয়ে গেলো। ধারা বাধা দিলেও সে শুনে নি, আলট্রাসোনোগ্রাফী রুমে সে প্রবেশ করেছে। ওখানের কর্মরত মহিলা যখন স্ক্রিনে বাচ্চার অবস্থান দেখছিলো, তখন একটি ক্ষুদ্র ডটের মতো লাগছিলো ভ্রুণটিকে। মাত্র তো সাত উইক,, তবুও বেশ জোড়ালো তার হার্ট বিট। গ্রোথ আশানুরুপ না হলেও বাচ্চাটি সুস্থ আছে। ধারা অশ্রুসিক্ত চোখে ছবিটিকে দেখেই যাচ্ছিলো। হ্যা, এটাই তার বাচ্চা। হোক না অবৈধ, কিন্তু মা-বাচ্চার সম্পর্ক তাও বৈধতা অবৈধতা মানে না। এটা একটা অন্যরকম টান। যা সকল সম্পর্কের উপরে। হঠাৎ খেয়াল করলো অনল এক দৃষ্টিতে ওই ছোট বলটির দিকে তাকিয়ে আছে। অনল নিজেও জানে না এই আকর্ষণটাকে কি বলে। এই ক্ষুদ্র মাংসপিন্ডের হার্টবিট যেনো সরাসরি তার হৃদস্পন্দন দিয়ে অনুভব করতে পারছে। তার সাথে তো বাচ্চাটার কোন যোগসূত্র নেই, তবুও কেনো যেনো মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি তার অনেক কাছের। অনল চোখ যেনো খুশিতে ভরে যাচ্ছে। পাঁচ বছরে এতোটা সুখ তার কখোনোই অনুভব হয় নি। আজ ধারা যতটা বাচ্চাটিকে অনুভব করেছে, অনল ও ততোটাই অনুভব করেছে। হয়তো এইটা তাদের সম্পর্কের যোগ সূত্র
বিকেল ৪.৪৫টা,
সূর্য পশ্চিমে ঢেলে পড়েছে। এখোনের রোদে সাধারণত কোনো উত্তাপ থাকে না। আজ ও তেমন কোনো কোন উত্তাপ নেই রোদের। নদীর ধারে উত্তাপ আরো কম, মিষ্টি রোদ সাথে ঠান্ডা বাতাসের উত্তাল। এর মাঝে বসে আছে অনল ধারা। দুপুরের পর থেকেই জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে অনল। ধারা বারণ করেছিলো কিন্তু কে শোনে কার কথা। আধঘন্টা ধরে এখানেই বসে রয়েছে তারা। এখানে আসার পর অবশ্য ধারার আর যেতে ইচ্ছে হয় নি। প্রকৃতির কাছে নিজেকে সপে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয় জানিস?
অনলের কথাটা কানে আসতেই পাশ ফিরে তাকায় ধারা। অনলের চোখজোড়ায় একরকম শূন্যতা ভর করেছে। চাপা কষ্ট গুলো চোখে ভিড়েছে। পুরুষের কাঁদতে মানা, তাই অশ্রুরুপেও বের হতে পারছে না। কেনো যেনো ধারার ইচ্ছে হলো অভিমান গুলো পিছে রেখে আজ অনলকে শান্তনা দিতে। নদীর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো? জায়গাটা সুন্দর বলে?
– এই জায়গাটা অনন্যার খুব প্রিয় ছিলো।
অনন্যার কথাটা শুনেই অনলের দিকে অবাক নয়নে তাকায় ধারা। অনল তখন ও নদীর দিকেই তাকায়ে আছে। ধারার দিকে না তাকিয়ে বলতে লাগে…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১৪তম পর্ব
অনন্যার কথাটা শুনেই অনলের দিকে অবাক নয়নে তাকায় ধারা। অনল তখন ও নদীর দিকেই তাকায়ে আছে। ধারার দিকে না তাকিয়ে বলতে লাগে,
– এই জায়গায় অনন্যার স্মৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। আমি প্রতিটি কণায় অনন্যার উপস্থিতি টের পাই, অনুভব করি। প্রতিটি নিশ্বাসে যেনো ওর মিষ্টি ঘ্রাণ অনুভব হয়। এই জায়গাটায় আসলে অনন্যাকে আমি খুব কাছে পাই। এতোটা পছন্দের আগে এই এই জায়গাটা ছিলো না, কিন্তু যখন ও আমার কাছে নেই তখন এই জায়গাটাই আমার কাছে সবচেয়ে শান্তির জায়গা হয়ে গেছে।
– অনন্যা আপু কোথায়?
অনলের কথার মাঝেই কথাটা বলে উঠে ধারা। ধারার প্রশ্নে চুপ হয়ে যায় অনল। শব্দগুলো গলাতেই আটকে আছে। নীরবতা ভেঙ্গে বলে,
– একটা গল্প শুনবি? একটু বোরিং, একটু কষ্টের কিন্তু গল্পটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– গল্পটা বললে হালকা হবে তুমি?
– হয়তো, জানি না। তবে বলতে ইচ্ছে করছে খুব।
– হুম শুনবো।
ধারার সম্মতি শুনে ঠোটের কোনায় মলিন হাসি টেনে অনল বলতে শুরু করে। ধারাও মুগ্ধ হয়ে অনলের কথা শুনছে। পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি আলোতে অনল অনলের অতীতের একটি অধ্যায় ধারার সামনে তুলে ধরে। মনের গহীনে এই পাঁচটা বছর এই অধ্যায়টা চেপে রেখেছিলো সে।
সাত বছর আগে,
বর্ষার সকাল, অঝর ধারে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির অক্লান্ত বর্ষণে মিরপুরের রাস্তায় নদী তৈরি হয়েছে। এই বৃষ্টির মাঝে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে অনল। চেষ্টা করে যাচ্ছে একটা সি.এন.জি পাওয়ার জন্য। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্ণশীপ করছে সে। তাই বৃষ্টি মাথায় নিয়েও এই সকালবেলা তাকে জয়েন করতে হবে। এই বৃষ্টির মাঝে সি.এন.জি একে তো পাওয়াই যায় না আর যদি সেটা পাওয়া ও যায় তবুও চড়া তার ভাড়া। প্রায় আধাঘন্টা যাবৎ এই নির্দয় বৃষ্টির মাঝে সে ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা সি.এন.জি আসতে দেখে হাত দিয়ে ইশারা করলো সে। আর রাস্তায় দাঁড়াবে না সে। যা ভাড়া চাবে তাই দিয়ে যাবে। সি.এন.জি ঠিক করে যেই না উঠতে যাবে অমনি একটা মেয়ে ফট করে উঠে বসলো সি.এন.জি তে।
– একি একি, আমার সি.এন.জি তে আপনি উঠছেন কেনো? নামুন বলছি। আমি পুরোটা ভাড়া করেছি।
অনল বেশ ভড়কেই কথাটা বললো। অনলের রাগান্বিত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মেয়েটাও চড়াও হয়ে বললো,
– তো? আপনি কি সি.এন.জিটা কিনে নিয়েছেন? দেখুন এমনেই আমি ভিজে গেছি বৃষ্টির জন্য। আর ছাতাটাও ছিড়ে গেছে। আমি এলিফ্যান্ট রোডের সামনেই নেমে যাবো। আমার ভাড়াটাও আমি দিয়ে দিবো। মামা আমাকে ওখানে নামিয়ে দিয়েন।
মেয়ের এমন ভাবলেশহীন আচারণে অনলের মেজাজ আরোও বিগড়ে গেলো। খানিকটা উলটা ঘুড়তে হবে এখন তার। হাতির ঝিল হয়ে যদি যেতে হয় তাহলে এমনেই একটু বেশি সময় লাগবে। অনল মেয়েটাকে বেশ থমথমে গলায় বললো,
– আমি মেডিকেলে নেমে যাই তারপর আপনি যেয়েন যেখানে যাবার
– আজিব তো সোজা ভাত না খেয়ে আপনি ঘুরে কেনো খাবেন। বেশি তো সময় ও লাগবে না। আমাকে নামিয়ে আপনাকে পৌছে দিবে মামা।
– আজিব তো একে তো আমার ভাড়া কড়া সি.এন.জি তে উঠে বসেছেন উপরে দাপট দেখাচ্ছেন।
– আজিব আমি কি আপনার টাকায় যাচ্ছি?
এক পর্যায়ে ঝগড়াই লেগে গেলো তাদের মধ্যে। কেউ দমে থাকার মতো নয়। শেষমেষ সি.এন.জি এর ড্রাইভার বাধ্য হয়ে বললেন,
– ঝগড়া কইরেন না, একই জায়গায় তো। আপনারা উঠে বসেন আমি পৌছায় দিতাছি। জ্যামে পড়লে আরো দেরি হবে।
অনল আর ঝগড়া চালাতে পারলো না, পরাজিত সৈনিকের মতো, ফুসতে ফুসতে সি.এন.জি তে বসলো। বৃষ্টির কারণে একটু সরে বসলো মেয়েটা। অনলের একটু কাছাকাছি বসাতে অনল খেয়াল করলো একটা মিষ্টি গন্ধ তার নাকে আসছে। পরমূহুর্তে বুঝলো মিষ্টি গন্ধটা মেয়েটার চুল থেকে আসছে। এতোক্ষণে অনল খেয়াল করলো মেয়েটা অপরুপ সুন্দরী। গায়ের রঙটা চাঁপা হলেও মুখটা মায়ায় ভরা। কাজলটানা চোখ জোড়ার প্রেমে যেকোনো ছেলে পড়বে। বৃষ্টির স্নিগ্ধতার মাঝেও মেয়েটির স্নিগ্ধতা অনলের মনকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। পঁচিশ বছরের যুবকের মনে এ যেনো অন্য অনুভূতির আবির্ভাব ঘটলো। পরমূহুর্তেই চোখ সরিয়ে নিলো অনল। এই অবাস্তব অনুভূতিকে মোটেও প্রশ্রয় দিবে না সে। জীবনের মাকে দেখে একটা জিনিস শিখেছে সে ভালোকরে। ভালোবাসা নামক অবাস্তব অনুভূতি তোমাকে শুধু নিঃস্ব ব্যাতীত কিছুই করবে না। সুতরাং এই অনুভূতির কোনো উপস্থিতি তার জীবনে রাখবে না সে। এই সাময়িক মোহকে মোটেও আশ্রয় দিবে না সে। মেয়েটি ক্ষণিকে জন্য তার বসে আছে এটাই বাস্তব। হঠাৎ সি.এন.জি চালকের কথায় ধ্যান ভাঙে অনলের। মেয়েটা নেমে ভাড়া চুকিয়ে অনলের উদ্দেশ্যে বললো,
– আমি কারোর ধার রাখা পছন্দ করি না, আপনার ভাড়াটা সহ দিয়ে দিয়েছি। বিপদে না পড়লে সি.এন.জি নিয়ে মারপিট করতাম না।
– নিজের টাকার গরম দেখাচ্ছেন?
– উহু, টাকার গরম না। এটা আমার আত্নসম্মানে লাগে কারোর ঋণ রাখলে। আর একটা কথা, সাদা কোট পড়ে আছেন পেশায় হয়তো ডাক্তার। একটু হাসতে শিখেন, ভালো লাগবে আপনার রোগীদের।
বলেই ভাঙ্গা ছাতাটা মাথায় দিয়ে ছুটতে লাগে মেয়েটি। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনল। হৃদপিন্ডটা যেনো মাত্রাতিরিক্ত জোড়ে বিট করছে। এটাকেই হয়তো প্রথম দেখার ভালোলাগা বলে
দেখতে দেখতে মাস পার হয়ে যায়, অচেনা মেয়েটি এখনো তার মন এবং মস্তিষ্ক থেকে বের হয় নি। নিঝুম রাতে চখ বুঝলেই মেয়েটার ছবিটা ভাসে তার চোখে অথচ আফসোস মেয়েটির নাম অবধি জানে না সে। অনল ভাবতে শুররু করে মেয়েটাকে হয়তো সে কখনো খুজে পাবে না। কিন্তু সংযোগ বলে একটা জিনিস থাকে। অনল জানতো না যাকে তার মন পাগলের মতো খুজছে সে নিজেই তার সামনে দাঁড়াবে। অনলের এক বন্ধু রবিনের বিয়েতে আবারো মেয়েটির দেখা পায় সে। কৌতুহলের বশে রবিনকে সে জিজ্ঞেস করে,
– রবিন মেয়েটা কে?
– কোন মেয়ে?
– ওই যে লালপরী।
রবিন বেশ কিছুক্ষণ খুজে মেয়েটাকে খুজে পায়। হাসতে হাসতে বলে,
– ও অনন্যা। সীমার বান্ধবী। এক নম্বরের খচ্চর মেয়ে।
– খচ্চর কেনো?
– আসলে খচ্চর হবার কারণ আছে। মামার বাড়িতে মানুষ, মামীটা বেশ দজ্জাল। নিজের পড়াশুনার খরচ নিজেই চালিয়েছে সবসময়, টিউশন করিয়ে। এখন একটা ছোট কম্পানিতে কাজ করে এই সমাজে সারভাইভ করার জন্য যতটা কঠোর হতে হয় ততোটাই কঠোর। মেয়েটার জন্য মাঝে মাঝে করুণা হয়, কিন্তু কেউ সিম্প্যাথি দেখাতে গেলে ধুয়ে দিবে একেবারে।
রবিনের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো অনল। সেদিন কেনো তার ভাড়াটা সহ অনন্যা দিয়ে দিয়েছিলো সেটার ব্যাখ্যা খুব ভালোভাবেই বুঝেছে সে। মেয়েটিকে কেনো যেনো আরো ভালো লাগতে লাগলো অনলের। নিজ থেকেই তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অনন্যার মুখোমুখি হয়ে বলে,
– মিস. সি.এন.জি ভালো আছেন?
কথাটা শুনে অনন্যা বেশ চমকে যায়। অবাক নয়নে অনলের দিকে তাকাতেই সে বলে,
– চিনতে পারছেন না হয়তো?
– আপনাকে চিনবো না? আপনার মতো হুলোমুখোকে কেউ ভুলে?
– আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন
– সত্য বচন বললেই মানুষের অপমান লাগে
বলে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে রাস্তা আটকায় অনল। অনলের পথ আটকানো দেখে অনন্যা চোখ মুখ কুচকে বলে,
– কি চাই?
– এখনো জানি না, আপাতত পরিচিত হতে চাই?
– আপনি কি বুদ্ধিটা হাটুতে নিয়ে বয়ে বেড়ান?
– কেনো?
– দেখছেন আমি আপনাকে ইগনোর করছি তবুও আপনি পরিচয় চাচ্ছেন! আপনার মনে হয় আমি দিবো?
– চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই, চেষ্টা করলে এভারেস্ট পাওয়া যায় এতো শুধু নাম-ঠিকানা। আমি কিন্তু বেশ অধ্যবসায়ী।
কথাটা শুনে অনন্যা পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অনল হার মানে না, রবিনের সাহায্যে অনন্যার পুরো ডাটা বের করে রীতিমতো স্টক করা শুরু করে। কেনো করছে জানে না, শুধু এটা জানে অনন্যাকে দেখতে ভালো লাগে তার। অনন্যার মুখটা দেখলে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যায় সে। অনন্যাও ব্যাপারটা খেয়াল করতে লাগলো। প্রথমে বিরক্ত লাগলো, অনেকবার অনলকে কড়া ভাষ্য ও শুনায় ও সে। কিন্তু লাভের লাগ কিছুই হয় না। এবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে তাকে
বিকেল ৫টা,
পড়ন্ত বিকেলে সেই জায়গাটায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে অনন্যা এবং অনল। হঠাৎ এখানে দেখা করতে বলার কারণটা কি সেটা ভেবে পাচ্ছে না অনল। অনন্যার চোখে আজ অন্যরকম প্রশ্ন ঘুরছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে অনলের দিকে তাকিয়ে আছে। অনল কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অনন্যা কড়া কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
– ভালোবাসেন আমাকে?
অনন্যার প্রশ্নটা খুব কঠিন না কিন্তু অনলের গলা শুকিয়ে যায়। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। চুপ করে মাথা নিচু করে থাকে অনল। অনলের নীরবতা দেখে বেশ স্পষ্ট কন্ঠে অনন্যা বলে,
– আমি বিগত দু মাস ধরে দেখছি আপনি আমাকে স্টক করে যাচ্ছেন, কেনো? যদি বলেন ভালোবাসেন তবে বলবো আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিন। আমার বাবা-মা নেই, মামা বাড়িতে মানুষ। অন্য সব মেয়ের মত ভালোবাসা নামক খেলাতে মত্ত হবার মত সুযোগ কিংবা ইচ্ছে আমার নেই। তাই যদি আমাকে মন থেকে ভালোবেসে থাকেন এবং আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তবে বলে দিন। আমার তাতে আপত্তি নেই। কোথাও না কোথাও আমারও আপনাকে ভালোলাগে। কিন্তু আমি যদি আপনার টাইমপাস হয়ে থাকি তবে বলবো টাইম নষ্ট করবেন না। আমার মনকে আমি সামলে নিবো, কিন্তু আপনার এসব কাজে আমার নামে দূর্নাম ছড়াক সেটা আমি চাই না।
অনন্যা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দিলো। অনল শুধু মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনছিলো। বেশ কিছুক্ষণ কোনো জবাব না পেয়ে অনন্যা বেশ ঠান্ডা গলায় বললো,
– আমি আপনার উত্তর পেয়ে গেছি। আর কখনো আমাকে স্টক করবেন না। আমি যেনো আপনার মুখ ও না দেখি।
বলেই হাটা দিলো অনন্যা। অনল বেকুবের মতো শুধু তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মনটা যেন হাহাকার শুরু করে দিলো অনলের। কিন্তু ভালোবাসা নামক অনুভুতিকে সে স্বীকার করতে নারাজ। হয়তো অনন্যার সাথে পথচলাটা এতোটুকুই ছিলো। তখন……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১৫তম পর্ব
অনল বেকুবের মতো শুধু তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মনটা যেন হাহাকার শুরু করে দিলো অনলের। কিন্তু ভালোবাসা নামক অনুভুতিকে সে স্বীকার করতে নারাজ। হয়তো অনন্যার সাথে পথচলাটা এতোটুকুই ছিলো। তখন তড়িৎগতিতে অনন্যা পেছনে ফিরে আসে এবং ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দেয় অনলের। ঘটনার আকর্ষিকতায় হতচকিত হয়ে যায় অনল। কিভাবে রিয়েক্ট করবে বুঝে উঠার আগেই অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করে ফোস ফোস করতে করতে অনন্যা বলে,
– কাওয়ার্ড কোথাকার, দুই মাস কাজ কাম বাদ দিয়ে আমার পেছনে ঘুরতে পারছিস আর বিয়ে করার বেলায় চুপ করে মাথা নিচু করে আছিস। যদি ভালোই না বাসিস তবে কেনো আমার পেছনে এই দুইটা মাস ঘুর ঘুর করছিস। সকাল নেই সন্ধ্যা নেই আমি চোখের সামনে শুধু তোকেই দেখেছি। অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি তোকে। দুররর! এখন আমি তোকে বাদে কাউকে চিন্তাও করতে পারি না। বেয়াদব কোথাকার, কাপুরুষ। শুনে রাখ কান খুলে বিয়ে তো তোকে আমাকেই করতে হবে। তুই ভালোবাসিস কি না তাতে আমার কিছুই যায় না। বুঝছিস?
আঙুল শাসিয়ে ভাঙ্গা কন্ঠে কথাগুলো বলে অনন্যা। অনল এখনো হা করে ওর কথাই শুনে যাচ্ছে। কি বলবে না বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ খেয়াল করলো অনন্যা কিছু খুজছে। অবাক কন্ঠে তখন জিজ্ঞেস করে,
– কি খুজছো তুমি?
– পাথর, আমার মাথা ফাটাবো। এতোক্ষণ একটা মেয়ে তোর সামনে প্রেম প্রস্তাব দিচ্ছে আর তুই এখনো গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস। এখন একটু সাহস করে মনের কথাটাও বলতে পারিস। তোর মতো ছেলেকে কিভাবে আমি পছন্দ করছি, আল্লাহ। এক কাজ কর তুই তোর মতো থাক, দাঁড়িয়ে থাক। গাধা কোথাকার।
বলতে বলতেই গলা ধরে আসে অনন্যার। অজান্তেই চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো অনন্যার। অনন্যার চোখের পানি কোথাও না কোথাও অনলের ভেতরটাকে অস্থির করে তুললো। বুকের অস্থিরতা তাকে পাগল করে তুলছে। চোখের পানিটা অগোচরেই মুখে পেছনে ফিরে হাটা দিতে নিলেই অনল পেছন থেকে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে। অনলের আলিঙ্গনে অনন্যার পা আটকে যায়। অনলের স্পর্শে যন্ত্রচালিত রোবটের মতো শক্ত হয়ে যায় অনন্যা। হৃদস্পন্দন তীব্রগতিতে বেড়ে যায় তার। অনল ধীর কন্ঠে বলতে শুরু করে,
– এতোক্ষণ যা বলার বলেছো, এখন আমি বলবো তুমি শুনবে। বলবো না আমি তোমাকে ভালোবাসি, কারণ ভালোবাসা নামক বস্তুতে আমার বিশ্বাস নেই। তবে আমার তোমাকে চাই, প্রতি মূহুর্তে, প্রতিটা ক্ষণ। তোমাকে একটা দিন না দেখলে আমার বুকে হাহাকার হয়। সব কাজের মধ্যে তোমার মুখখানা আমার দেখা লাগাই। তোমাকে না দেখলে রাতে ঘুম আসে না। ছটপট করতে থাকি। একটু আগে যখন তুমি চলে যাচ্ছিলো বুকের ভেতর যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। তোমার হাতের মার খেয়েও আমার রাগ উঠে নি, অন্য কেউ হলে তো সেখানেই পুতে ফেলতাম। তোমার চোখের পানি দেখে আমার ভেতর অজানা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এগুলো যদি ভালোবাসা হয় তবে তাই। আমি অন্য ছেলেদের মতো বলবো না তোমাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসি, বলবো না তোমাকে বাদে মরে যাবো, বলবো না তোমার জন্য সব করতে পারি; শুধু একটা কথা বলবো আমার জীবনে তুমি ই প্রথম নারী, হয়তো শেষ নারীও তুমি, তোমার চোখে কখনো দুঃখের ছায়াও ভিড়তে দিবো না। তুমি যখন বলবে তোমাকে বিয়ে করতে আমি রাজি, শুধু একটা কথা যদি কখনো আমার উপর তোমার বিরক্ত হয়ে যাও আমাকে বলে দিও কিন্তু আমাকে চিট করো না। আমি নিতে পারবো না।
অনলের সহজ উক্তির পর অনন্যার বলার কিছুই থাকে না। যা জানতে চেয়েছে সব কিছুর উত্তর তার কথায় নিহীত। ভালোবাসি না বলেই শুরু হয় অনল-অনন্যার ভালোবাসা। কিন্তু এই ভালোবাসার গভীরত্ব এতোটা ছিলো যে কখনোই ভালোবাসি বলতে হয় নি অনলের। অনলের চোখজোড়ার স্বচ্ছতায় নিজের জন্য পাহার সমান ভালোবাসা খুজে নিতো অনন্যা। সময় যেতে থাকে তাদের সম্পর্কের গভীরত্ব বাড়তে থাকে। তাদের সম্পর্কের শুরু যে জায়গা থেকে হয় সেই জায়গাটাই তাদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠে। অনল তার মনের চাপা কষ্টের জানালা অনন্যার কাছে খুলতে থাকে। তার বাবার ছেড়ে যাওয়ার ক্ষতটা অনন্যার হাসির মলমে ভরতে থাকে। অনলের ইন্টার্ণশীপের সময় শেষের দিকে ঘনিয়ে আসে। অনন্যাকে সুভাসিনী বেগমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় অনল। দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়েও ঠিক হয়। তারপর ছোট করে তাদের আকত ও হয়ে যায়। অনলের চাকরির পর মেয়ে তুলে নিবে এই কথাই হয়। দু-দুজনে বেশ সুখী ছিলো কিন্তু ভাগ্যের উপর কারোর হাত থাকে না। আল্লাহ যার জন্য যা লিখে রেখেছেন সেটা হতে বাধ্য। অনন্যার প্রায় কলার বোনের সাইডে ব্যাথা হতো। অসম্ভব ব্যাথা কিন্তু মামীর ভয়ে সে কাউকে বলতো না। একটা সময় ব্যাথাটাকে সহ্য করতে থাকে। রাতে যখন ব্যাথাটা উঠতো গরম ভাব দিয়ে নিজেকে সামলাতো। অনন্যা মামা-মামীকে এব্যাপারে কোনোদিন জানায় নি। তাদের কাছে থাকে বলে তার প্রতিটা সময় খোটা খেতে হয়। এখন তার হাড়ে ব্যাথা কথাটা জানলে আরো কথা শুনতে হবে। আর অনন্যার কাছে এতোটা টাকাও নেই যে সে চিকিৎসা করতে পারবে। কিন্তু হাড়ের ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু তাতে লাভের লাভ হয় নি। অনলকে বলছে না ও চিন্তা করবে বলে। ছেলেটা তার সাথে থাকলে অন্যরকম থাকে, এখন তার সামান্য ব্যাপারে তাকে বিরক্ত করতে চায় না অনন্যা। দেখতে দেখতে অনন্যাকে উঠিয়ে নেবার সময় চলে আসে। ধুম ধাম করে নিজের কাছে নিয়ে আসবে অনল। অনল এবং অনন্যার সম্মতিতে আবারো তাদের বিয়ের আয়োজন হয়।
সকাল ১১টা,
অনন্যা তখন অনলের সাথে দেখা করার জন্য রেডি হচ্ছিলো। আজ শপিং এ যাওয়ার কথা সুভাসিনী বেগমদের সাথে। হঠাৎ কলার বোনের ব্যাথাটা তীব্র হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে তা বাম হাতেও ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। কয়েকদিন ধরে ব্যাথাটা তীব্র রুপ নিয়েছে। যখন ব্যাথা উঠে তখন পাগলের মতো ব্যাথা হতে থাকে। হাতটা চেপে ধরে বসে পড়ে অনন্যা। চোখ থেকে পানি পড়ছে। অসম্ভব ব্যাথা করছে। একটা সময় নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না মামীকে ডাকা শুরু করলো। মামী যখন রুমে আসলেন তখন অনন্যা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো। তাড়াতাড়ি অনলকে ফোন লাগালেন তিনি। অনন্যা তখনো ব্যাথায় কাতর। অনন্যাকে তাড়াতাড়ি অনলের চাকরীরত হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। অনন্যার অবস্থার অবনতি দেখে ইমিডিয়েটলি আই.সি.উ তে ভর্তি করা হলো। অনন্যাকে এভাবে ছটফট করতে দেখে অনলের বুকে কামড় পড়লো। হারিয়ে ফেলবে নাতো অনন্যাকে। হাসপাতালের আই.সি.উ তে কাউকে এলাউ করা হয় না। কিন্তু ওভারটাইম এর উছিলায় প্রতিটা সময় অনল তার কাছে ছিলো। অনন্যার রিপোর্ট আসলে অনলের সিনিয়র ডাক্তাররা তাকে ডেকে পাঠায়,
– স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?
– আসো অনল, বসো।
– জ্বী স্যার।
– তোমার ওয়াইফের রিপোর্টস হয়তো দেখেছো। আমার মনে হচ্ছে ওর হার্টের প্রবলেম রয়েছে। যদিও ট্রপাই নেগেটিভ এসেছে।
– কিন্তু স্যার ও তো কলার বোনে ব্যাথা বলছিলো।
– আই থিংক ওর কিছু ভেইন শুকিয়ে গেছে যার কারণে ওর স্টেবল এনজ্যাইনা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু এখন সেটা আনস্টেবল হয়ে উঠেছে। আমার মতে ওর শুধু ভেইন শুকিয়ে যায় নি। ওর হার্টেও ব্লক থাকতে পারে। কারণ ওর ব্যাথাটা পুরো হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর ওর ব্লাড ক্লট শুরু হয়েছে। আমি এনজিওগ্রাম করতে চাই। এবং কালকেই তুমি পারমিশন দাও।
– স্যার আপনার যা ভালো মনে হয় আপনি করুন
স্যারের কেবিন থেকে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনল। অনন্যা তার রক্তে মিশে আছে। অনন্যাকে ব্যাতীত নিজের অস্তিত্ব ভাবতেই বুক কেঁপে উঠে তার। আল্লাহ কাছে শুধু একটাই দয়া করতে থাকে অনল, যাতে তিনি অনন্যাকে ফেলে যায় তার কাছে। আই.সি.উ কেবিনে তখন ঘুমিয়ে আছে অনন্যা। নিজের চোখ মুখে ধীরে তার কাছে বসে। কি মায়াবী না লাগছে তার মায়াপরীকে। কিভাবে থাকবে ওর কিছু হয়ে গেলে! অনন্যার ক্যানোলা পড়া হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে থাকে,
– প্লিজ সুস্থ হয়ে যাও পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না অনল। চোখের পানি ছেড়ে দিলো সে। অনন্যার হাতে ভেজা অনুভব হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলো অনল তার হাত ধরে বসে রয়েছে। খুব কষ্টে বলে,
– তুমি কাঁদছো?
হুট করে অনন্যার জেগে যাওয়ায় নিজের চোখের পানি মুছে নিলো অনল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
– তুমি উঠে গেলে কেনো? ঘুম হচ্ছে না এখানে?
– কথা ঘুরাচ্ছো অনল? আমার কি খুব বড় রোগ ধরা পড়েছে?
– না না তেমন কিছু না, এইতো কাল পরসুর মধ্যে আমরা বাসায় চলে যাবো।
– তুমি মিথ্যে বলছো তাই না?
– কেনো এটা লাগছে তোমার?
– ভুলে যাচ্ছো অনল আমি তোমার চোখ পড়তে পারি।
– ভুল পড়ছো। কাল একটা টেস্ট আছে এর পরেই আমরা বাসায় যাবো দেখো।
অনন্যা আর কথা বাড়ালো না, কেনো যেনো নিজের মনেও খচখচানি শুরু হয় তার। অনলের শুকনো মুখটা যেনো তাকে আরো ও দূর্বল করে তুলে।
পরদিন,
ডাক্তার কেবিনে,
এনজিওগ্রাম করার পর অনলকে দেখে পাঠায় তার সিনিওর ডাক্তার। অনল যখন তাকে জিজ্ঞেস করে অনন্যার কি অবস্থা, তখন তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন,
– আমি যা এজ্যুম করেছিলাম, অনন্যার একটা করোনারি আর্টারি ৯০% শুকিয়ে গেছে। একটা ভেইন অলরেডি ৫০-৬০% শুকিয়ে গেছে। আরেকটা আর্টারি ৭০-৮০% শুকিয়ে গেছে। এখন যে জায়গা থেকে ব্লাড বের হয় সেগুলোই শুকাতে থাকে তাহলে তো ব্যাথাটা হবেই। অনন্যা এতোদিন ব্যাথাটাকে সহ্য করে গেছে। ও ভেবেছে কলার বোনে ব্যাথা বাট এটা হার্ট কেস। এখন যে পজিশন আমি চাইলেও রিং পড়াতে পারবো না। বেস্ট অপশন সার্জারি। এবার তোমার ডিসিশন।
– স্যার কবে সার্জারি করতে চাচ্ছেন?
– দেখো প্যাশেন্ট স্ট্যবল। তাই আমি সামনের সপ্তাহে করতে চাচ্ছি। টাকা পয়সার ও ব্যাপার আছে। সো তুমিও সময় নাও।
– ওকে স্যার।
কেবিন থেকে বেরিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। এতোটা অসহায় লাগছে যে কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না অনল। মনের ভেতর একটা হাহাকার শুরু হয়, হাজারো ভয় বুকে জমতে থাকে। অনন্যাকে হারানোর ভয়। কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ায় অনল। নিজেকে নিজে বুঝায় যেভাবেই হোক অনন্যাকে তার বাঁচাতেই হবে। চোখ মুখ মুছে অনন্যার কাছে যায় সে। অনন্যার কাছে বসতেই অনন্যা মৃদু গলায় বলে,
– এতো চিন্তা করো না অনল, যা আল্লাহ লিখে রেখেছেন তাই হবে। তুমি লুকালে কি হবে আমি জানি আমার খুব বড় রোগ ধরা পরেছে। অপারেশন লাগবে। তাই না?
-…….
– একটা কথা বলি? এতোকিছু করে কোনো লাভ হবে না। আমার সময় চলে এসেছে।
– তুমি থামবে অনন্যা
বেশ কড়া কন্ঠে বলে উঠলো অনল। অনন্যা মলিন হাসি দিয়ে বললো,
– এখনো বকবে? পরে কিন্তু আফসোস করবে বলে দিচ্ছি। হাহাহা
– প্লিজ অনন্যা থামো না
অনল আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। অনন্যার তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
– আমি এতো সহজে মরব না, এতো কাঁদতে আছে। তুমি কাঁদলে আমি নিজেকে শক্ত কিভাবে রাখবো। আর আমি মরে গেলে না একা থাকার কথা চিন্তাও করবে না। একটা পুতুলের মতো মেয়ে দেখে বিয়ে করবে। ঠিক আছে?
– তুমি যদি এই ফাও কথাই বলতে থাকো তাহলে আমি যাচ্ছি।
বলে উঠে যেতে নিলেই অনন্যা হাতটা টেনে ধরে বলে,
– একটা বার ভালোবাসি বলবে?
করুন গলায় বলা কথাটা অনলের ভেতরটাকে চুরমার করে দেয়। কাঁপা কন্ঠে বলে অনন্যাকে,
– ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি
সেদিন ভালোবাসি কথাটাই অনলের বলাশেশ ভালোবাসি ছিল। রাতের মধ্যেই অনন্যার ব্যাথা শুরু হয়। সকল ঔষধ দেওয়ার পর ও লাভ হয় না। একটা সময় সি.পি.আর দিতে থাকে অনল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। রক্ত, গ্যাজা বের হতে থাকে অনন্যার মুখ থেকে। পালস যখন শেষ হয়ে যায় তখনো অনল সি.পি.আর দিতে থাকে।অনল পাগলের মতো অনন্যাকে সি.পি.আর দিতে দিতে বলতে থাকে,
– অনন্য প্লিজ উঠো, প্লিজ। প্লিজ আমার সাথে ফাজলামি করো না। ভালোবাসি বলতে বলেছিলে, বলেছি তাও কেনো এমন করছো আমার সাথে। উঠো না অনন্যা
অনলের সব কলিগরা বুঝাতে থাকে অনন্যা নেই। কিন্তু অনল মোটেই বুঝতে চায় নি। ভাবে এখনই অনন্যা ব্যাক করবে হয়তো। শেষ মেষ একজন কলিগ গালে চড় বসিয়ে তাকে হুসে আনতে চায়।
– অনল, সি ইজ ডেড। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। সি ইজ ডেড
কথাটা কানে যেতেই ধপ করে বসে পড়ে অনল। অনন্যার মৃত্যুর পর যেনো বাঁচার আগ্রহ টুকু শেষ হয়ে যায়। একমাত্র মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে সে। কিন্তু আত্মাব্যাতীত মানুষ লাশের ন্যায় হয়।
বর্তমান,
অনলের গলা ধরে গেছে। অনল কথা থামিয়ে চুপ করে থাকে। ধারার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। অনলের কথাগুলো শুনে বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হতে থাকে ধারার। হঠাৎ…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১৬তম পর্ব
বর্তমান,
অনলের গলা ধরে গেছে। অনল কথা থামিয়ে চুপ করে থাকে। ধারার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। অনলের কথাগুলো শুনে বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হতে থাকে ধারার। হঠাৎ আনমনেই অনল বলতে থাকে,
– জানিস ধারা, অনন্যা ই প্রথম নারী যাকে আমি “ভালোবাসি” কথাটা বলেছিলাম। এবং সেটাই আমার প্রথম এবং শেষ “ভালোবাসি” বলা ছিলো। অনন্যা সব সময় আমাকে একটা প্রশ্নই জিজ্ঞেস করতো,
“ভালোবাসো”
আমি কখনো সেটার উত্তর দিতে পারতাম না। যখন ও আমায় ছেড়ে চলে গেলো আমি চিৎকার করে ভালোবাসি বলেছি ওকে; কিন্তু ও ফিরে আসলো না। এই হাত দুটোতে ওর নিথর দেহটা ছিলো। আমার নিজেকে তখন পৃথিবীর সবথেকে অপারগ ডাক্তার লাগছিলো। আমি চেয়েও কিছুই করতে পারছিলাম না। এখন বারবার মনে হয় কেনো ভালোবাসি বলতে গেলাম। সেদিন যদি না বলতাম হয়তো অনন্যা আমাকে ছেড়ে যেতো না। ওর অবস্থা বেশ স্টেবল ছিলো জানিস। আমি কি ভুল করেছিলাম যে আল্লাহ অনন্যাকে কেড়ে নিলো। অনন্যা আমার রুক্তে মিশে ছিলো জানিস। ও না অন্য মেয়েদের মতো ছিলো না, আমার চোখ দেখেই বুঝে যেত আমার কোথায় কষ্ট। যেদিন তোর সাথে আমার বিয়ে হয় আমি ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। ও হাসপাতালে ভর্তির সময় শুধু বলতো, ওর কিছু হলে যাতে আমি একা না থাকি, ওর নাকি কষ্ট হবে তাতে। আচ্ছা আমার সাথে এমন কেনো হয় বলতো!!
অনলের পাগলের প্রলাপ গুলো চুপ করে শুনছিলো ধারা। অনলের জীবনের সাথে এতোকিছু হয়েছে ব্যপার গুলো ধারার অজানা ছিলো। তখন ও মাত্র এস.এস.সি পাশ করে কলেজে উঠেছিলো। অনলের কলমা হয়ে গেছে ব্যাপার গুলো তার বাবা-মা জানলেও সে জানতো না। তার অনল ভাই এর বিয়ে ঠিক হয়েছে, ধুমধাম করে বিয়ে হবে ব্যাপারটা তার জানা ছিলো কিন্তু পরে বিয়েটা কেনো হলো না এটা কখনো জানা হয় নি। আসলে যাকে জমের মতো ভয় পেতো তার পারসোনাল ব্যাপারে কখনোই ধারার ইন্টারেস্ট ছিলো না। একবার শুনেও ছিলো অওভার ড্রাগ করে আই.সি.উ তে ভর্তি হয়েছে অনল। ভেবেছিলো অনলের এসব কাজের কারণে বউ পালিয়ে গেছে। এখন সুভাসিনী বেগম এবং সুরাইয়া বেগমের কথাগুলোর মর্ম বুঝতে পারছে। অনলের জীবনে এতো কিছু হয়ে গেছে সেটা না জানার আফসোসটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ধারাকে। তখন অনল ধীর কন্ঠে বলে,
– তোকে আমি কখনোই বিয়ে করতে চাই নি, অনন্যার জায়গা আমি তোকে কেনো কাউকে দিতে পারবো না। কিন্তু মা বলেছিলো তোকে বিয়ে করলে হয়তো আমি বাঁচার কোনো কারণ পাবো। মা সত্যি বলেছিলো। আজ যখন তোর বাচ্চার হার্টবিটটা শুনেছি, তুই ইমাজিন করতে পারবি না আমার বুকের মাঝে কি অনুভব হচ্ছিলো। অনন্যা যাবার পর এই প্রথম আমি সুখ অনুভব করেছিলাম। আবার ইচ্ছে হয়েছিলো আমি কারোর জন্য আমি বাঁচি। তোর বাচ্চাটা যেনো আমার সব দুঃখের মলম, ওকে কেন্দ্র করে আমি বাঁচতে পারবো। তুই আমাকে একটা কথা দিবি? তুই তোর বাচ্চাকে কখনো আমার কাছ থেকে কেড়ে নিস না। আমি ওকে কেন্দ্র করে বাঁচতে চাই ধারা। আমি বাঁচতে চাই।
ধারার হাতদুটো নিজের মুঠোতে নিয়ে কপাল থেকে বলতে থাকে অনল। সে কাঁদছে। সাথে ধারাও। আজ অনলের কষ্টগুলো ধারা অনুভব করছে নিজের হৃদয় দিয়ে। হয়তো এই অশ্রুই তাদের সম্পর্কের সূচনা ঘটাচ্ছে যেখানে দুজন একটা সুতোয় বাধা, ধারার অনাগত সন্তানটি হয়তো তাদের সেই সুতো
রাত ৮টা,
অনল ধারা কেউ ফোন ধরছে না দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন সুভাসিনী বেগম। এমনেই তাদের মধ্যে কিছু ঠিক নেই। এর উপরে সেই দুপুরে বের হয়েছে এখনো ফিরার নাম নাই। টেনশনে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বলা তো যায় না; বিপদের তো হাত পা নেই। আর ধৈর্য ধরতে না পেরে অনলকে ফোন দেন সে। অনল ফোন ধরছে না বলে তার টেনশন যেনো আরো বেড়ে গেছে। না জানি অনল ধারা কোথায় আছে!!
রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে অনল ধারা। দুজনের চোখ মুখ ফুলে রয়েছে। দুঃখের ভার কমিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে তারা। নিতান্ত পরিবহণ না পাওয়ার জন্য হাটা লাগছে তাদের। বহুদিন পর আবার কেঁদেছে অনল। তবে মনটা বেশ হালকা লাগছে। অনল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এই অনুভূতিটা কেনো হচ্ছে? বহুদিন পরে কেঁদেছে বলে নাকি ধারাকে নিজের চাঁপা কষ্ট গুলো খুলে বলেছে বলে; উত্তরটা তার জানা নেই, খুজতেও চায় না অনল। হঠাৎ খেয়াল করলো ধারা রাস্তার এক কোনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। অনল কাছে যেতেই দেখে সে লোভনীয় দৃষ্টিতে ফুচকার ঠেলার দিকে তাকিয়ে আছে। অনল হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
– কি হইছে? পা আটকে গেছে নাকি রাস্তায়? চল হাটি একটা রিক্সা পাইলে উঠে যাবো৷
– অনল ভাই
ধারার মুখের করুণ স্বরে ডাক শুনে পেছনে ফিরে তাকায় অনল। ধারাকে একটা কিউটের ডিব্বা লাগছিলো অনলের কাছে। খুব হাসি পাচ্ছিলো তখন অনলের। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বললো,
– কি হয়েছে?
– আমাকে একটু ফুচকা কিনে দিবে? তোমার তাড়াহুড়োর জন্য পার্সটাও আনি নি। আমার খুব ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে।
চোখ কুচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে অনল বললো,
– কতোটা আনহাইজিনিক জানিস? আমার প্রিন্সেস কোনো আনহাইজিন খাবার খাবে না।
– হ্যা?? কে বলেছে আনহাইজিন? সারাজীবন খেয়ে বড় হলাম কই তখন তো হাইজিন ওর আনহাইজিনের কথা ভাবি নি। আর এক মিনিট মাত্র তো সাত সপ্তাহ এর একটু বেশি হয়েছে বাবুর বয়স। জানলে কি করে সে প্রিন্স না প্রিন্সেস?
– আমি জানি, ও প্রিন্সেস ই হবে। যাক গে জিভ থেকে লোল না ফেলে চল তাড়াতাড়ি। মোবাইলের নেটওয়ার্ক ও নেই। মা টেনসন করবে।
– এক প্লেট ফুচকা, এর পর জোরে জোরে হাটবো। প্রমিস
– একটা ও না। পরে আমাশা হয়ে বাথরুমে দৌড়াতে হবে। আর এখন মিসক্যারেজ হবার চান্স অনেক বেশি। আমি চান্স নিতে চাই না। মাত্র ওর হার্ট বিট পাওয়া গেছে। সি ইজ নট থ্যাট মাচ স্ট্যাবল।
বলেই হাটা শুরু করলো অনল। ধারার খুব ফুচকা খেতে মন চাচ্ছিলো। কিন্তু এই পাজি লোকটা, উফফ সব কিছু তার মতো হওয়া চাই। কেনো বাবা একটু ফুচকা খেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? না তার প্রিন্সেস নাকি আনহাইজিনিক জিনিস খাবে না। ধুররর ভালো লাগে না। এই খচ্চর লোকটা সারাক্ষণ দাদাগিরি করে। ধারার ইচ্ছে হচ্ছিলো অনলের মানিব্যাগটা মেরে ফুচকা খেতে। পরমূহুর্তে মনে হলো, সে যা করবে বাচ্চাও তাই শিখবে। আর নিজের বরের পকেট মারাটা কেমন হয়ে যাবে না!!
– আমাকে গালানো শেষ হলে কষ্ট করে কি হাটবেন?
অনলের কথা কানে আসতেই তাড়াতাড়ি হাটা শুরু করলো ধারা। এই লোক কিভাবে জানে মন ও পরতে পারে। সাংঘাতিক লোক!! লোকটার জন্য মনে মনেও কিছু চিন্তা করা দায় হয়ে উঠেছে ধারার
যখন বাসায় পৌছায় তারা, তখন ঘটির কাটার নটা ছুই ছুই। সুভাসিনী বেগমের কাছে ধুমায় বকা খেতে হয়েছে অনল ধারাকে। এতোক্ষণ চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিলেন তিনি। প্রেগ্ন্যাসির সময় কিছু খাওয়ার ক্রেভিং উঠলে সেটা থামানো অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। ধারার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ফুচকা খাবার ইচ্ছেটা এখনো বেশ প্রবল ভাবে জেকে বসেছে মাথায়। উপরে ফুপির বোকায় আরো মন খারাপ হতে লাগে তার। মুখ কাচুমাচু করে মাথা নিচু করে রাখলে সুভাসিনী বেগম বলেন,
– হয়েছে বর কে বকছি বিধায় তোমার মাথা নিচু করা লাগবে না। রুমে যেয়ে ফ্রেস করে নাও।
ধারাও ভদ্র বাচ্চার মতো রুমে চলে যায়। ফুপিকে তো বোঝাতে পারছে না তার যে ফুচকা খাবার ক্রেভিং উঠছে। ধারার রুমে যাবার পর ই অনল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ছেলেটাকে আজ অন্য রকম লাগছে সুভাসিমী বেগমের। কেনো যেনো মনে বেশ প্রশান্তি লাগছে সুভাসিনী বেগমের। আজ ছেলেটার চোখ মুখে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছের ঝলক ছিলো। তবে কি তার ছেলে অনন্যার স্মৃতিকে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!!
রাত ১১টা,
অনল এখনো ফিরে নি, ধারার বেশ চিন্তা লাগছে। লোকটা সেই বেরিয়েছে এখনো আসার নাম নেই। সুভাসিনী বেগমকে জোর করে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। বেশি রাত জাগা তার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়, বয়স হয়েছে বলে কথা। তাই ধারাই অনলের ফিরার অপেক্ষা করবে। লোকটা ফোন ও নিয়ে যায় নি। চিন্তার প্রহর যেন কাটছেই না। তখনই কেঁচিগেট খোলার শব্দ পায় ধারা। দরজায় বেল বাজার আগেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে যায় সে। অনল তখন কেবল সিড়িতে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় সিড়ি দিয়ে উঠতেই খেয়াল করলো একজন রমনী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো যেনো অনন্যাই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পরমূহুর্তেই চোখের ভুলটা ধরা পড়ে যায়। দরজা ধরে অনন্যা নয় ধারা দাঁড়িয়ে আছে। নীল শাড়িতে মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। নিজের অবাদ্ধ মনকে খুব ক্রে কড়া শাসন করে দিলো অনল। আজকাল মনটা ধারার মাঝে অনন্যাকে খুজছে। এটা তো কখনোই সম্ভব না। ঘরে ঢুকতেই বেশ শাসানো গলায় বলে উঠে ধারা,
– একটু তো বুদ্ধি নিয়ে কাজ করবা নাকি? একটু ফোনটা সাথে নিয়ে গেলে কি হতো। ফুপি চিন্তা করছিলেন। আমি জোর করে তাকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। মানুষের চিন্তা হয় তো নাকি, রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?
তখন ই……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১৭তম পর্ব
নিজের অবাদ্ধ মনকে খুব কড়া শাসন করে দিলো অনল। আজকাল মনটা ধারার মাঝে অনন্যাকে খুজছে। এটা তো কখনোই সম্ভব না। ঘরে ঢুকতেই বেশ শাসানো গলায় বলে উঠে ধারা,
– একটু তো বুদ্ধি নিয়ে কাজ করবা নাকি? একটু ফোনটা সাথে নিয়ে গেলে কি হতো। ফুপি চিন্তা করছিলেন। আমি জোর করে তাকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। মানুষের চিন্তা হয় তো নাকি, রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?
তখনই অনল হাতের বাজারের ব্যাগ ধারার হাতে ধরিয়ে দেয়। হিনহিনে গলায় বলে ধারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– যার জন্য করি চুরি সে বলে চোর, বাহ কি নিষ্ঠুর দুনিয়া। নে নে ধর
– আমার জন্য তুমি চুরি করতে গেছিলে বুঝি? সেখান থেকে এতো এতো বাজার নিয়ে এসেছো।
ধারার কথা শুনে চোখ মুখ খিচে তীক্ষ্ণ গলায় বললো অনল,
– খিক খিক হাসা থামিয়ে খাবার দে, ক্ষিদেয় পেটের ইদুরগুলো নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। আর শোন ।
রান্না ঘরে যেতে যেয়েও থেমে গেল ধারা। পেছন ফিরলে অনল বলে উঠে,
– ফুচকার সব সরঞ্জাম নিয়ে এসেছি। খাওয়ার পর বানিয়ে দিচ্ছি।
– তুমি বানাবে ফুচকা?
– তোমার ওই ঠেলামামার থেকে ভালোই বানাবো। না জানি আদৌ হাত ধোয় কি না। আমার প্রিন্সেসের ব্যাপারে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুই খাবার গরম কর।
বলেই নিজের রুমে রওনা দিলো অনল। ধারার কোনো কথা শোনার অবকাশ আছে তার। সে তো তার মতো করেই ভাববে আর সেভাবেই কাজ করবে। ধারা মুচকি হেটে রান্না ঘরে বাজার গুলো খুলতে লাগলো। এলাহি কান্ড করেছে অনল। ধারার যা কিছু খেতে ভালো লাগে সব কিনে এনেছে। সাথে তেতুল, জলপাই, চালতা। আচার বানানোর কোনো সরঞ্জামের কমতি রাখে নি। ধারার মনে মনে হাসি ই পেলো। লোকটা দু ঘন্টা যাবৎ এই মহান কাজ করেছে। লোকটার উপর মাঝে মাঝে খুব রাগ উঠে ধারার, মনে হয় রাগে মাথাটাই ফাটিয়ে দিবে সে। আবার মাঝে মাঝে এতোটা ভালো লাগে যে বলে বোঝানো যাবে না। যেমনটা এখন লাগছে। এক অজানা ভালোলাগায় মনটা ভরে যাচ্ছে। এটা কি মুড সুইং এর অংশ নাকি অন্য কিছু সে জানে না, হয়তো জানতে চায় ও না।
রাত ১২টা,
রান্নাঘরের টুলের উপর পা উঠিয়ে বসে আছে ধারা। আর সামনে বেশ ঢাল তলোয়ার নিয়ে ফুচকা বানানোর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে অনল। ইউটিউব থেকে ভিডিও দেখে দেখে বানাচ্ছে সে। ধারা যখনই সাহায্য করতে চাইছে তখন বজ্রকন্ঠে বকা শুনতে হচ্ছে। তাই বৃথা চেষ্টা করা থামিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে সে। মটর সিদ্ধ করে আলু সিদ্ধতে দিয়েছে অনল। হঠাৎ দেখলো ধারা রীতিমত হাই তুলছে। ব্যাস হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
– অই আমি এখানে ঘেমে একাকার আর তুই বসে বসে হাই তুলছিস?
অমনি যেই হাইটা বের হতো সেটা আবার ভেতরে নিয়ে ধারা বললো,
– আজিব আমি কি তোমাকে বলেছি গরমের মধ্যে ফুচকা বানাও। আমাকে বকছো কেন? তখন কিনে দিলেই পারতে এখন হাই আসলে আমি কি করবো?
– কি ফাযিল মেয়ে রে তুই? একে কোথায় আমাকে একটু সাহায্য করবি তা না?
– বেশ পাল্টিবাজ তো তুমি অনল ভাই! আমি কি মানা করেছি তোমাকে সাহায্য করতে। আমি তো বলেই ছিলাম দাও আলু গুলো কেটে দেই। কি ধমকটাই না দিলে। এখন আমাকে বকছো।
– হয়েছে হয়েছে বকিস না তো। উট্টিন্না মেয়ে, পরে হাত ফাত কেটে ফেললে? থাক ভাই আমি ই করি। নেহাত আমার মেয়ে খেতে চেয়েছে। নয়তো কখনোই তোর জন্য আমি বানাতাম না।
বলেই পেয়াজ কাটায় মন দিলো অনল। টপ টপ করে তার চোখ থেকে পানি পড়ছে এটা দেখে ধারার বেশ খারাপ লাগতে লাগলো। অমনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ধারা। চুল গুলো খোপা করে অনলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, কড়া কন্ঠে বললো,
– হয়েছে অনেক কেঁদেছো। সরো তো সরো। আমি পেয়াজ কেটে দিচ্ছি। তুমি বাকি কাজ করো।
– তুই পারবি না।
– চুপ, দাও বলছি। সরো। আমাকে কাজ শিখিয়ো না। একে নাকের জল, চোখের জলে একসার। আসছে।
ধমকে কাজ দিলো, অনলের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে একেবারে গিন্নির মতো কাজ করছে ধারা। মাথায় খোপা, কোমড়ে ওড়না গোজা। মাঝে মাঝে অবাদ্ধ ছোট চুলগুলো চোখে মুখে পড়ছে। চুল থেকে ঘামের রেখা ঘাড় অবধি বহমান। নারীর এই প্রতিচ্ছবিটা সবথেকে সুন্দর হয়। অনল অবাক চিত্তে ধারার এই প্রতিচ্ছবি দেখে যাচ্ছে। এক মোহ তার চোখজোড়াকে ঘিরে ধরেছে। কিছুতে চোখজোড়া সরাতে পারছে না। সময়টা যেন থেমে গেছে। অনল নিজের অজান্তেই ধারাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে।
– কি দেখছো?
ধারার অবাক নয়নে করা প্রশ্নে স্বম্বিত ফিরে অনলের। মাথা নাড়িয়ে নেতিবাচক উত্তর দেয় সে। নিজের মনেও একটা প্রশ্ন উদয় হয় আসলে কি দেখে যাচ্ছিলো সে। এতো মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধারাকে দেখার কি আছে! প্রশ্নের উত্তর খুজেও কিছুই হাতে পেলো না অনল। আজকাল মনটা শুধু অবাদ্ধ কাজ করে যাচ্ছে। কখনো ধারার মাঝেই অনন্যাকে খুজতে থাকে তো কখনো কোনো কারণ ব্যাতীত তাকে নিয়ে ভাবতে থাকে। উফফফ কি জ্বালা হয়েছে
ফুচকা বানানো যখন শেষ হলো তখন ঘড়ির কাটা দেড়টা ছুই ছুই। রান্নাঘরের টুলের উপর বসেই বাচ্চাদের মতো ফুচকা খাচ্ছে ধারা। আর সেটা মুখে হাত দিয়ে দেখে যাচ্ছে অনল। এসব খাবারের প্রতি কখনোই কোনো আগ্রহ তার ছিলো না। সে শুধু তার সামনে বসা মেয়েটাকে খেতে দেখেই খুশী। হুট করেই ধারার গালটা টিপে দিলো। ধারা অনলের কেমন কাজে বেশ অবাক হয়েই বললো,
– এটা কি হলো?
– তুই এতো কিউট কেনো বল তো? কে বলবে আর তুই মা হতে চলেছিস? কিছুদিনপর বাচ্চা হলে কি করবি এটাই ভাবছি। বাচ্চা সামলাবে বাচ্চা। হাহাহা
– আমি মোটেই বাচ্চা নই।
– শোন তুই ষাট বছর হয়ে গেলেও না আমার কাছে বাচ্চাই থাকবি ঠিক আছে। মুখ ধুয়ে ঘুমাতে যা। কাল কলেজে আমি তোকে পৌছে দিবো।
– হঠাৎ? আমি তো সারার সাথেই যাই
– আমি বলেছি ব্যাস আমি নিয়ে যাবো। আর কোনো কথা শুনতে চাই না।
বলেই হাটা দিলো অনল। ধারাও আর কথা বাড়ালো না। অনলের সাথে তর্কে জড়ানো মানে নিজের পায়ে কুড়াল দেওয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুভাসিনী বেগমের রুমে হাটা দিলো ধারা। হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো সে। ঠান্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়ায় খারাপ লাগছে না। একটা কথা ভেবে মনে মাঝে সুখ দুঃখের সংমিশ্রণ অনুভূতি হচ্ছে তার। আজ যেই কাজ গুলো দিগন্তের করার কথা ছিলো সেই কাজ গুলো অনল করছে। কি অদ্ভুত না, অবশ্য এটা বেশ ভালো হয়েছে। দিগন্ত এই বাচ্চাটাএর অস্তিত্ব সম্পর্কেই অজানা থাকুক। এটাই হয়তো সবার জন্য ভালো হবে। হঠাৎ করেই একটা ভয় মনে জেকে বসেছে ধারার। যদি কোনোদিন দিগন্ত জেনে যায় বাচ্চাটা বেঁচে আছে এবং সে যদি তার দাবি চেয়ে বসে। কি করবে ধারা!
সময়ের স্রোত বহমান। দেখতে দেখতে মাস পার হতে হতে পাঁচ মাস হয়ে এসেছে। ধারার পেটটাও খানিকটা বড় হয়ে এসেছে। এখন বুঝা যাচ্ছে সে মা হতে চলেছে। অনল আরো বেশী নজরদারী হয়ে উঠেছে বাচ্চাটার প্রতি। এখন আর ভার্সিটি যাওয়া হয় না তার। অনল কথা বলে নিয়েছে স্যারদের সাথে। বাসায় বিশ্রাম করে ধারা। অনল আর ধারার সম্পর্কেও খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। আজকাল ধারার গহীন চিত্তে অনলের বসবাস যেনো সর্বক্ষণ। কিন্তু অনলের সামনে গেলেই সব কিছু গবলেট হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ভয় ও হয়। অনলের কাছে বলতে গেলে হিতে বিপরীত হলে, তাই কিছুই বলা হয়ে উঠে না। আর অনল সে তো নতুন করে বাঁচার চাহিদায় আছে। ধারাকে আজকাল সে যেনো চোখে হারায়। এটা কেনো সে নিজেও জানে না। এটা কি বাচ্চাটার প্রতি ভালোবাসা নাকি ধারার প্রতি দূর্বলতা তার জানা নেই। থাক না সম্পর্কটা এভাবেই অহেতুক প্রশ্নের উত্তর খুজতে গেলে যদি সম্পর্কটাই না থাকে। একবার ভালোবাসি বলে হারিয়েছে অনন্যাকে, ধারাকে হারাতে একেবারেই রাজী নয় সে।
সকাল ৯টা,
নাস্তার টেবিলে বসা সবাই। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ কানে আসায় ধারা দরজাটা খুলতে যায়। দরজাটা খুলতেই দেখে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এবং একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের কাউকেই ধারা চিনে না। অবাক নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১৮তম পর্ব
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ কানে আসায় ধারা দরজাটা খুলতে যায়। দরজাটা খুলতেই দেখে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এবং একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের কাউকেই ধারা চিনে না। অবাক নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে মহিলাটা বেশ খাকারি গলায় বলে উঠেন,
– এটা অনলদের বাসা না?
– জ্বী, আপনারা
– তুমি কে? ভাবী কোথায়?
ধারা কিছু বলে উঠার আগেই সুভাসিনী বেগমের কথা ধারার কানে আসলো,
– কে এসেছে রে ধারা?
ধারার সময় লাগছে দেখে সুভাসিনী বেগম নিজেই উঠে আসলেন। সুভাসিনী বেগমকে দেখেই মহিলাটা বেশ গদগদ হয়ে বললেন,
– ভাবী কেমন আছো গো? কতদিন পরে তোমাকে দেখছি বলো!
বলেই ধারাকে এড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন ভদ্রমহিলা এবং মেয়েটি। সুভাসিনী বেগম ও বেশ অবাক হলেন, যেনো উনি এদের মোটেই আশা করেন নি। অবাক কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলেন,
– সুমনা তুমি হঠাৎ?
– কেনো গো ভাবী আসতে পারি না বুঝি?
– না না সেটা না, আসলে না ফোন না কিছু। তাই অবাক হলাম আর কি। আসো আসো।
– আসলে কি বলো তো ভাবী, অনলের বিয়েতে তো আমি আসতে পারি নি। এখানেও একটা কাজ ছিলো তাই ভাবলাম এক কাজে দুইটা হয়ে যাবে। তা অনলের বউ কোথায় ভাবী?
মহিলা বসতে বসতে কথাগুলো বললেন। সুভাসিনী বেগম মুচকি হাসি হেসে ধারাকে ইশারা করেন। উচ্ছ্বাসিত মনে বলে উঠেন,
– এইতো তোমার অনলের বউ, ধারা। ধারা, ও সুমনা, সম্পর্কে তোর ফুপু শ্বাশুড়ি আর ও হচ্ছে মহুয়া। মহুয়া তোর থেকে বয়সে বড় কিন্তু অনলের থেকে ছোট।
– আসসালামু আলাইকুম।
ধারা খুব ভদ্র ভাবেই সুমনাকে মুখে সালাম দেয়। পায়ে ধরে সালাম করা ব্যাপারটা একেবারেই ধারার পছন্দ নয় উপরে পেটটা বড় হবার কারণে ঝুকতেও পারবে না। তাই মুখেই সালামটা দিলো সে। সুমনা বেগমের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা যেনো তার একেবারেই পছন্দ হয় নি। ভ্রু কুচকে পা থেকে মাথা অবধি নজর তাক করে নিলেন তিনি। ধারার বড় পেটটাই যেনো তাকে বেশি অবাক করছেন। ধারার খানিকটা অস্বস্তি হতে লাগলো। সুভাসিনী বেগম ও ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। তাই ধীর কন্ঠে বললেন,
– আসলে এই সময়ে ঝুকাটা ঠিক হবে না তো তাই।
– আমি যত দূর জানি বিয়ের ছয় মাস হইছে মাত্র। এখনই বউ মা পোহাতি হয়ে গেলো, একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো না ভাবী?
উনার কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে যায় ধারা। মাথাটা অটোমেটিক নিচু হয়ে আসে। সুভাসিনী বেগম ও সুমনা বেগমের এমন হুট করে করা প্রশ্নে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ঠিক তখনই পকেটে হাত গুজে মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়েই অনল বলে উঠে,
– ফুপ্পি, তোমাদের সমস্যাটা ঠিক কোথায় বলোতো? এখন ধারা যদি প্রেগন্যান্ট না হতো তখন জিজ্ঞেস করতে ছয় মাস হয়ে এসেছে খুশির খবর কবে শুনাবে? এখন যখন দেখছো ও প্রেগন্যান্ট, তো কোথায় একটু দোয়া তোয়া করবে। তা না জিজ্ঞেস করছো একটু তারাহুড়ো হয়ে গেলো না। এখন আমরা নবদম্পতি যাবো তো যাবো কই? আর এমনেও আমার তো হবয়স হচ্ছে তাই না, এখন বুড়ো বয়সে ট্যাম নিয়ে ঘুরার ইচ্ছে আমার নেই। যৌবন থাকতে থাকতেই বাচ্চার বাবা হতে চাই। ফুফার মতো চুলে পাক ধরার পর বাচ্চার বাবা হলে দেখা যাবে বাবা কম নানা বেশী লাগবে আমাকে। নো নো সেই রিস্ক আমি নিতে পারবো না। তাই আর কি এই তাড়াহুড়ো।
অনলের হাসিমুখের কথাগুলো শুনে বেচারি সুমনা বেগমের যেনো মুখটা খানিকটা ছোট হয়ে গেলো। মহুয়া যখন হয়েছিলো তখন শফিক সাহেবের প্রায় চুল পেকে গিয়েছিলো। অনল সেটার খোচাটাই দিয়েছে সমনা বেগমকে। সুমনা বেগমের স্বভাব সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানা আছে অনলের। রুম থেকে বের হতেই যখন দেখলো সুমনা বেগম সকাল সকাল এসে টপকেছেন তখন ই ড্রয়িং রুমের দিকে এসে হাজির হয় সে। ধারার অনলের কথা শুনে বেশ হাসি পেলো। কিন্তু ফুপু শ্বাশুড়ির সামনে নতুন বউ খিক খিক করে হাসছে ব্যাপারটা খারাপ তো খারাপ মহা খারাপের পর্যায়ে পড়বে। ঠোটে ঠোট চেপে নিজের হাসিটা আটকে রাখলো সে। অনল এবার বেশ কড়া করেই ধারাকে বলে উঠে,
– এই তোর আক্কেল নাই?
– কেনো আমি কি করলাম?
– খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মনে আছে? এখানে দাঁড়ায় থাকলে কি খাবার গুলো উড়ে উড়ে পেটে ঢুকবে। চল খেতে যাবি। ফুপি তুমি বসো, আমি পিচ্চিটাকে নিয়ে যাচ্ছি। আসলে ওর টাইম টু টাইম ঔষধের ব্যাপার আছে তো।
বলেই ধারার হাত ধরে টেনে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসালো। ধারা শুধু আড় চোখে সুমনা বেগমকে দেখে যাচ্ছে। মহিলা বেশ তীক্ষ্ণ নজরে ধারা আর অনলকে দেখে যাচ্ছেন। অনল সেদিকে তোয়াক্কা না করে নিজ হাতে সব কিছু ধারাকে বেড়ে দিচ্ছে। সুমনা বেগম এবার সুভাসিনী বেগমকে বলতে শুরু করলেন,
– ভাবী একটা কথা বলি কিছু মনে করো না। ছেলেটা একটু বেশী বউ ঘেষা হয়ে উঠেছে তোমার। এখন তো বুঝতেছো না পরে ঠিক ই বুঝবে।
সুমনার বেগমের কথায় সুভাসিনী বেগম বেশ চটে উঠলেন। বেশ থমথমে গলায় বলে উঠলেন,
– এসব কি কথা সুমনা? ধারার এখন শরীরের যা অবস্থা তাতে তোমার মনে হয় না অনলের তাকে বেশী প্রয়োজন। আর স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারটায় বউ ঘেষা ব্যাপারটা আসছে কোথায়?
– আসলে তোমার ভাইয়ের মেয়ে তো তাই তুমি দেখেও না দেখার ভান করছো। অনলের মতি গতি কিন্তু ভালো না বলে দিচ্ছি।
– তাও ভালো বউ ঘেষা হয়েছি, তোমার ভাইয়ের মতো অন্য মেয়ে ঘেষা তো হই নি। এটাই ভালো না ফুপ্পি।
সুমনা বেগমের কথা কানে যেতেই হাসি মুখে কথাটা বলে উঠলো অনল। এবার অনলের কথাটা যেনো সুমনা বেগমের একটু বেশি আতে লাগলো। কিছু বলতে যাবেন তার আগেই সুভাসিনী বেগম বলে উঠলেন,
– এতো দূর ট্রাভেল করে এসেছো। আসো আমার রুমে রেস্ট নিবে চলো। মহুয়া আয় তো সোনা মামী মার সাথে।
সুভাসিনী বেগমের কথায় আর কিছুই বলতে পারলেন না সুমনা বেগম। সুমনা বেগম মনোক্ষুন্ন হয়ে উঠে সুভাসিনী বেগমের সাথে গেলেন। ধারার মনে হলো মানুষটি তাকে একেবারেই পছন্দ করেন নি। বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো সে। সত্যি বলতে অনলের সাথে বিয়ের পর থেকে একবার ও এই বাড়িকে শ্বশুর বাড়ি বলে মনে হয় নি। বরং নিজের বাড়ি ই লেগেছে। কিন্তু সুমনা বেগমের আসার পর থেকে মনে হচ্ছে এবার একটু মেপে চলতে হবে।
– এতো চিন্তা করতে হবে না। যার তোকে ভালো লাগে না তাকে তো আর জোর করে ভালো লাগাতে পারবি না
অনলের কথায় চিন্তায় ছেদ পরে ধারায়। পাশ ফিরে তাকালে দেখে লোকটা নিজ মনে খেয়েই যাচ্ছে। তার সুমনা বেগম কে নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথাই নেই। ধারা খাবার মুখে দিতে দিতে বললো,
– চেষ্টা তো করতেই পারি তাই না?
– লাভ নেই, আমার ফুপ্পিটা একটু এমন ই। তাই বলছি অহেতুক কিছু করতে যাস না। তুই তো আর তার বাড়ির বউ না। আসছে কদিনের জন্য, চুপচাপ থাক। সময় হলে চলে যাবে।
– আচ্ছা তুমি সবসময় কিভাবে আমার মনের কথা জেনে যাও?
ধারার প্রশ্নে মুচকি হাসি হেসে তার গালটা টেনে দিয়ে অনল বলে,
– বয়স তো আর এমনি এমনি হয় নি। যাক গে, রুমে চল ঔষধ আছে। আর ফলগুলো খাস নি কেনো, আমি খাবো নাকি ফল? তোর এসব কারণে আমার প্রিন্সেসটা এতো দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। এখনো কিক অবধি করেনি, খা বলছি।
– আর খেতে পারছি না, আমি তো রাক্ষস না।
পরমূহুর্তেই অনলের অগ্নিদৃষ্টিতে চুপ হয়ে গেলো ধারা। লোকটা কথায় কথায় হুংকার ছাড়ে। ভয় লাগে কিন্তু আবার ভালো লাগে। লোকটাকে আজকাল খুব ভালো লাগে ধারার। ইচ্ছে করে সারাটাদিন শুধু দেখতে। প্রতিনিয়ত মানুষটাকে দেখলে প্রেম প্রেম পায়। কিন্তু মুখে কিছুই বলে উঠতে পারে না সে। ভয় হয়, বলা তো যায় না। ধুম ধাম করে মেরে বসে যদি। অনলের কোনো ভরসা নেই। তার হুংকার শুনলেই ভালোলাগা গুলো গলাতেই আটকে যায় ধারার
রাত ১০টা,
নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখে ধারা বিছানা করছে। ধারা সুভাসিনী বেগমের সাথে থাকতো। কিন্তু হুট করে নিজের রুমে দেখে বেশ হতবাক হয় সে। অবাক হয়েই ধারাকে প্রশ্ন করে বসে সে,
– তুই এই রুমে?
– ও চলে এসেছো তুমি, আমি এখন থেকে কিছুদিন এই রুমেই থাকবো। আসলে ফুপ্পি মহুয়া ত মায়ের রুমে থাকছে। আর ঘরে তো শোবার রুম বেশি নেই প্লাস ফুপ্পি জানেন ও না আমি যে তোমার সাথে থাকি না। জানলে আরো কান্ড করবেন। এমনেই আমার সব কাজে কেনো যেন দোষ খুজেন। এটা জানলে ফুপুকে শুধুশুধু কথা শুনাবেন।
ধারার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। তাই অনল আর কোনো কথা বাড়ালো না। কোথাও কোথাও বেশ অস্বস্তি লাগছিলো অনলের। ধারার সাথে বিয়ের পর থেকে সেভাবে একই রুমে থাকা হয় না কি না। এখন আবার থাকতে হবে দেখে বেশ অস্বস্তি লাগছে অনলের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টাওয়াল আর কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। বিছানাটা গুছিয়ে হেলান দিয়ে বই পড়তে লাগলো ধারা। আজকাল শরীরটা ভারী হয়ে গেছে। একটু চললেই বেশ কষ্ট হয়ে যায়। বাহিরের থেকে স্বাভাবিক থাকলেও কোথাও না কোথাও বুকটা টিপ টিপ করছে। অনলের সাথে একই রুমে থাকবে ব্যাপারটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। অনলের তো ঠিক নেই গতবারের মতো কিছু করলে! ওয়াশরুমের দরজার শব্দে স্বম্বিত ফিরে ধারার। পাশ ফিরে থাকালে দেখে অনল ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। হয়তো গোসল করেছে। চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে, পরনে অলিভ কালারের টিশার্ট আর কালো থ্রি কোয়ার্টার। পা হাটু থেকে উম্মুক্ত বিধায় লোম গুলো দেখা যাচ্ছে। ধারা খেয়াল করলো তার বুকে যেনো কেউ ড্রামপিট বাজাচ্ছে। অনলের চোখে চোখে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সে, যেনো চোর ধরা পরেছে। এখন এই রুমে একেবারেই থাকতে পারবে না সে। তাই ধীর কন্ঠে বললো,
– তুমি খেতে আসো আমি ফুপির কাছে গেলাম
কথাটা বলে তড়িৎ গতিতে উঠতে গেলেই………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
১৯তম পর্ব
ধারা খেয়াল করলো তার বুকে যেনো কেউ ড্রামপিট বাজাচ্ছে। অনলের চোখে চোখে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সে, যেনো চোর ধরা পরেছে। এখন এই রুমে একেবারেই থাকতে পারবে না সে। তাই ধীর কন্ঠে বললো,
– তুমি খেতে আসো আমি ফুপির কাছে গেলাম
কথাটা বলে তড়িৎ গতিতে উঠতে গেলেই পেটে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করলো ধারা। হঠাৎ ব্যাথাটা অনুভব করায় পা দুটো ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললো। ধপ করে মাটিতে পড়ে যেতে নিলে দুটো হাত তাকে আগলে ধরে। ঘটনার আকর্ষিকতায় ধারাও খানিকটা হতভম্ব হয়ে পড়ে। যখন তার হুশ ফিরে যখন দেখে তাকে পেছন থেকে অনল আগলে রেখেছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই অনলের বজ্রকন্ঠ তার কানে আসে,
– আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? আরেকটু হলেই তো পড়ে যেতি। বুদ্ধিটা হাটুতে থাকে নাকি? এখন সাড়ে ছয় মাস চলছে তোর প্রেগন্যান্সির। সাবধান থাকবি তো। আমি তো ভাবতেই পারছি না আমি যদি না সামলাতাম কি হতে চলেছিলো? সারাক্ষন দৌড়াদৌড়ি, আমার কথাগুলো তো কানে যায় না তোর। শান্তি লাগে না খুব আমাকে জ্বালাতে। সারাটাক্ষণ তোদের নিয়ে চিন্তায় থাকি। ইচ্ছে করছে একটা ঠাটিয়ে লাগাই। পাগল ছাগল! একটু আসতে উঠলে কি হতো? আমি কি তোকে খেয়ে ফেলতে ছিলাম? চুপ করে আছিস কেন?
– কি…কিক করেছে
ধারা কথাটা কানে যেতেই অনল যেনো একদম শান্ত হয়ে যায়। ধারা তখন ও পেটে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে, যেনো সেও একটা ঘোরে রয়েছে। অনলের এতো বকাঝকা কিছুই তার কানে যায় নি। অনল আবারো শিওর হবার জন্য শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে?
– তোমার প্রিন্সেস কিক করেছে
– তুই শি…শিওর?
– হ্যা, হাতটা দাও।
বলেই অনলের হাতটা টেনে নিজের পেটে ছোয়ায় ধারা। তার চোখ জোড়া চকচক করছে। অনল যেনো অধীর আগ্রহে ওয়েট করে রয়েছে তার মেয়ের লাথি অনুভব করার জন্য। হঠাৎ কিছু অনুভূতি হতেই চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠে তার। নিমিষেই ধারার উপর যত রাগ ছিলো সব গলে পানি হয়ে যায়। চোখ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলতে থাকে,
– সি কিকড, ধারা সি কিকড। আমার প্রিন্সেস ফার্স্ট টাইম কিক করেছে।
বলেই ধারাকে জড়িয়ে ধরে অনল। হঠাৎ অনলের এমন কাজে ধারা যেনো বরফ ঠান্ডা হয়ে যায়। এক অন্য রকম শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে। হৃদস্পন্দন যেনো বেড়েই চলে, শিরদাড়া বেয়ে যেন উষ্ণ রক্তের প্রবাহ বয়ে যায়। খুশির জোয়ারে অনলের মনেই নেই সে ধারাকে জড়িয়ে ধরে আছে। যখন হুশ আসে তখন তড়িৎ গতিতে তাকে ছেড়ে দেয়। ধারার গালে রক্ত জমতে থাকে। মূহুর্তে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়। পরিবেশ হালকা করতে অনল স্নেহের সাথে ধারার পেটে হাত দিয়ে বলে,
– মাই প্রিন্সেস শুনতে পাচ্ছো, বাবা আজকে অনেক হ্যাপি। আর মাত্র কিছুদিন তারপর তুমি বাবার কাছে চলে আসবে। বাবা আর মেয়ে মিলে তোমার মাম্মামকে জ্বালাবো। তোমার মাম্মামটা অনেক পাজি, সারাক্ষণ বাবাকে টেনসন দেয়। একটু আগেও পাগলামি করেছিলো। তুমি আসলে আমাদের টিমটা ভারী হবে।
– এটা কি হচ্ছে?
মাজায় হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে ধারা বলে উঠে। অনল বেশ ভাবলেশহীন ভাবেই বলে,
– এটা বাবা-মেয়ের কথা। তুমি মাঝে আসবি না
ধারা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। এই লোকটার সাথে সত্যি সে পেরে উঠে না। তবে মনে একটা খুশির ফুলকারি জ্বলছে। অনলের মুখের আনন্দটা যেনো ধারা এই খুশির কারণ। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন, প্রিয় মানুষটাকে আনন্দে দেখলে নিজেও কখন খুশি হয়ে উঠে বুঝে উঠে না মানুষ। আজ যেমন অনলের উচ্ছ্বাসিত মুখটি দেখে ধারার হৃদয়েও শীতল পরশ বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কারোর দরজায় কড়া পড়লে তাদের বাস্তবে পদর্পন হয়। পেছনে তাকাতেই দেখে মহুয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ ইতস্তত ভাবেই মেয়েটা বলে উঠে,
– সরি, আমি বোধ হয় ডিস্টার্ব করে ফেললাম। আসলে মামি মা ডাকছিলেন। আমরা ডাইনিং টেবিলে ওয়েট করছি খেতে আসো তোমরা।
– তোরা খাস নি?
– না, আসলে মা তোমার সাথে খেতে চাচ্ছিলো। আমি যাচ্ছি
বলেই যেতে নিলে ধারা পেছন থেকে ডাক দেয় তাকে। নিজেকে ঠিক করে মহুয়াকে বলে,
– মহুয়া আপু, আমিও যাবো।
ধারার সাথে মহুয়ার তেমন কোনো কথাই হয় নি সারাদিনে। মহুয়া মেয়েটা খুবই চুপচাপ ধরনের মেয়ে। এবার ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে সে। ধারা খুবই অবাক হয় এটা ভেবে যে তার মাঝে সুমনা বেগমের কোনো প্রতিচ্ছিবি ই দেখা যায় না। এই সুযোগে যদি তার সাথে একটু খাতির হয় তো খারাপ হবে না হয়তো। তাই অনলের বাধন ছেড়ে তার সাথে চলে আসে। অনল ও বাধা দেয় না। যেতে যেতেই ধীর কন্ঠে মহুয়া বলে উঠে,
– ধন্যবাদ
– কেনো বলোতো মহুয়া আপু?
– না আসলে অনল ভাইকে অনেকদিন পর এতটা আনন্দিত দেখলাম। তাই, আরও একটা কারণ আছে। সেটা হলো মাকে সহ্য করার জন্য ও ধন্যবাদ। মা একটু এমন ই কিছু মনে করো না। আসলে মায়ের খুব ইচ্ছে ছিলো মামীর কাছে আমার আর অনল ভাই এর বিয়ের কথা বলার। সে আশায় তো পানি পড়লো তাই একটু খিচে আছে। তুমি চিন্তা করো না।
– আচ্ছা ফুপ্পি কি খেতে ভালোবাসে গো?
– রান্না দিয়ে মন জয় করবে?
– চেষ্টা করবো
– তাতে বেশি লাভ হবে না। তবে একটা কাজে লাভ হবে
– কি বলোতো?
– সময় হলে বলবো।
বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিলো মহুয়া। মেয়েটাকে খুব ভালো লেগেছে ধারার। নিজের সমবয়সী কাউকে পেলে কার না ভালো লাগে।
ডাইনিং টেবিলে,
অনল যখন খাবার খেতে ব্যাস্ত তখন ই সুমনা বেগম গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
– ভাবী, অনল আমার কিছু বলার আছে। যদি অনুমতি দেন তো বলি
সুমনা বেগমের এভাবে কথা বলার ধরনে বেশ অবাকই হন সুভাসিনী বেগম। সাধারণত এভাবে সুমনা বেগম কথা বলেন না। যা মুখে আসে তাই বলেন। কিন্তু এভাবে কথা বলার একটা মানে হতে পারে তিনি বেশ গুরুতর কিছু বলবেন হয়তো। অনল খাবার রেখে ভ্রু কুচকে শান্ত গলায় বলে,
– তোমার কথা বলার জন্য কখনো পারমিশন লেগেছে বলে আমার জানা ছিলো না। বলো না কি বলবে।
– কথাটা বেশ গুরুতর তাই এভাবে বলতে চাচ্ছি। আমাকে তোরা কেউ ভূল বুঝিস না। হুট করে ঢাকায় আসার কারন নিয়ে ভাবী বেশ কবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু বলে উঠার সাহস হয়ে উঠে নি। কিন্তু না বলেও পারছি না। তাই আর কি পারমিশন চাচ্ছি।
সুমনা বেগমের কথা শুনে এবার একটু চিন্তিত হয়ে উঠেন সুভাসিনী। কি এমন কথা যা বলতে এতোটা ইতস্তত করছেন সুমনা বেগম। বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই তিনি বলে উঠেন,
– সুমনা ভনিতা না করে বলো না কি কথা, কেনো হুট করে আসা তোমার ঢাকায়?
এবার ধীর কন্ঠে সুমনা বেগম বলতে লাগলেন,
– আমাকে ভুল বুঝো না ভাবী। আসলে আমি ঢাকা এসেছি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে। ভাইয়া দেশে ফিরেছেন।
সুমনা বেগমের কথাটা শোনামাত্র চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অনলের। চোখগুলো মূহুর্তেই রাগের অগ্নিতে জ্বলজ্বল করতে লাগলো। পৃথিবীতে সে যদি কাউকে ঘৃণা নামক জিনিসটা করে থাকে তাহলে সেটা এই লোকটা। সম্পর্কে যিনি তার বাবা হয়। ধারা অনলের মুখের পরিবর্তনটা যেনো আচ করতে পারছে। অনলের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। ধারার বুঝতে বাকি রইলো না সে তার রাগ সংযম করছে। অনলের প্রতিটা কাজের সাথে সে খুব ভালো করেই পরিচিত। হঠাৎ সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার কথাটা তার কানে এলো,
– তোমার ভাইয়া এসেছে, তুমি তার সাথে দেখা করবে। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। এটা নিয়ে আমার রাগ করার তো কিছু নেই সুমনা। এ ব্যাপারটা আমাদের না জানালেও হতো।
– আসলে ভাবী….ব্যাপারটা শুধু এটা নয়। ভাইয়া তোমার আর অনলের সাথে দেখা করতে চায়। সেকারণে
তার কথাটা শেষ হবার আগেই অনল চিৎকার করে বলে উঠে,
– আমরা চাই না তার সাথে দেখা করতে। এতোদিন তো ভালোই ছিলাম আবার কেনো আমাদের জীবনে এসেছে সে। সে তো নিজেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলো অন্য কারোর কাছে। তখন বউ ছেলের কথা মনে ছিলো না? আমার মাকে ডিভোর্স দেওয়ার সময় মনে ছিলো না?
বলেই খাবার ছেড়ে উঠে চলে গেলো সে। সেখানে বসে থাকলে হয়তো মেজাজটা আরো বিগড়ে যেতো অনলের। এমন একটা পরিস্থিতি কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না ধারা। মহুয়া তখন চোখ দিয়ে তাকে ইশারা করে বলে যাতে অনলের সাথে যায়। ধারাও অনলের পিছন রুমে গেলো। অনলের যে রাগ কি করবে তার ঠিক নেই। এদিকে সুভাসিনী বেগম এখনো সেভাবেই ভাবলেশহীন ভাবেই বসে রয়েছেন। বেশ ঠান্ডা গলায় বলেন,
– আমার কাছে কি চাই তার? যা চেয়েছিলেন আমি তো সব দিয়েছি তাকে। তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন স্বামীর দায়িত্ব থেকে, বাবার দায়িত্ব থেকে। আমি দিয়েছি। শুধু তাই নয় আমি আমার সকল দায়িত্ব পালন করেছি। বাড়ির বউ এর, স্ত্রীর, মার, ভাবীর সব দায়িত্ব। বিনিময়ে কি পেয়েছি আমি সুমনা? এখন এতো বছর পর তার আমার কাছে কি চাওয়া আছে। আমি কি দিতে পারি তাকে নতুন করে?
– ক্ষমা
সুমনা বেগমের কথাটা কর্ণপাত হতেই তার দিকে তাকান সুভাসিনী বেগম। তার ঠোঁট জোড়া কাপছে। ছাব্বিশ বছরে ক্ষতটা যেনো তাজা হয়ে উঠেছে। এতো কাঠখড় পুড়িয়ে যা মনের গহীনে পুতে রেখেছিলেন সেটা আবার খুচিয়ে রক্তক্ষরণ করছে হৃদয়ে৷ এতো বছর পর ও মানুষটার কথা শুনলে বুকে কষ্ট আর শুন্যতাগুলো ঘিরে ধরছে। সুমনা বেগম বেশ ধীর গলায় বলেন,
– ভাইয়া বেশ অনুতাপ করছে ভাবী। শেষবারের মতো তোমাদের দেখতে চায়। আচ্ছা ভাবী লোকটা একটা সুযোগ দেওয়া যায় না। অনল না হয় জানে না কিন্তু তুমি তো জানো তোমাদের ছাড়াছাড়ি টা হয় নি। তোমরা এখনো স্বামী স্ত্রী। লোকটা একা একা আর পারছে না ভাবী। হ্যা মানছি তোমার সাথে সে কম অন্যায় করে নি। কিন্তু
– তুমি আমার জায়গায় থাকলে কি করতে সুমনা? শফিক ভাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে? আমি নিঃস্ব সুমনা। তাকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই নেই। ক্ষমাও নেই। অনল যদি তার সাথে দেখা করতে চায় তো ভালো। আমি বাধা দিবো না। ছেলে হয় সে তার। কিন্তু আমি তার সামনে যাবো না। একটা কথা কি জানো, ক্ষমা হয়তো করতাম যদি লোকটা আমার থাকতো। সে তো আমার কখনো ছিলো না। আর সম্পর্কের কথা বলছো। সেটা তো খালি কাগজের। সেটা থাকা বা না থাকাতে আমার কিছুই যায় আসে না সুমনা। আমি আর তাকে মনে জায়গা দিতে পারবো না। তোমাকে আমি কখনো তার বোন মনে করি নি। আমার ছোট বোনের মতো দেখেছি। তাই একটা অনুরোধ করছি, আমার কাছে তাকে নিয়ে কোনো অনুরোধ করো না। রাখতে পারবো না।
বলেই উঠে গেলেন সুভাসিনী বেগম। তার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুমনা বেগম।
অপরদিকে,
নিজের সমস্ত রাগ ধোয়ায় উড়াতে লাগলো অনল। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। পাছে ধারার ক্ষতি হলে। না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনই………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
২০তম পর্ব
নিজের সমস্ত রাগ ধোয়ায় উড়াতে লাগলো অনল। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। পাছে ধারার ক্ষতি হলে। না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনই কারোর উপস্থিতি অনুভব হলে সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে। পেছনে না ফিরেও ধারার উপস্থিতি খুব ভালো করেই অনল অনুভব করতে পারছে। থমথমে গলায় বলে,
– ধোয়ার মাঝে কেনো এসেছিস তুই? জানিস না এটা তোদের জন্য ক্ষতিকর। আর আমি একা থাকতে চাই
অনলের কথার মাঝেই ধারা বলে উঠে,
– আমি আসতে চাই নি, তোমার প্রিন্সেসই জোর করলো। তার বাবার মন মেজাজ খারাপ বিধায় তার ও মন খারাপ। কিন্তু এখন দেখছি এখানে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। থাক আমরা চলে যাই।
কথাটা বলার পরেও বেশ কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকে ধারা। ভেবেছিলো হয়তো অনল থেকে কোনো রেসপন্স পাবে। কিন্তু অনলের কোনো রেসপন্স না পেয়ে রুমের দিকে হাটা দিতে নিলে অনল বলে উঠে,
– একটু এখানে বসবি ধারা?
অনলের শান্ত গলায় বলা কথাটা সরাসরি বুকে যেয়ে লাগে ধারার। কথাটায় যেনো একগুচ্ছ বেদনা ছিলো যা চোখে দেখা না গেলেও খুব ভালো করে অনুভব করছে ধারা। ধীর পায়ে এগিয়ে ধীরে অনলের পাশে মেঝেতে বসে সে। আকাশে থালার ন্যায় বড় চাঁদ উঠেছে। বর্ষার আগাম জানাচ্ছে প্রকৃতি। থেমে থেমে ঝড়ো বাতাস বইছে, কিন্তু একটা বিকট থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারপাশে। ঝড়ের পূর্বাভাস হয়তো। অনলের হৃদয়ের ভেতরেও ক্ষণে ক্ষণে ঝড় উঠছে। কিন্তু সেটা বাহিরে প্রকাশ করতে পারছে না। চোখ মুখ খিচে বাহিরে নজর স্থির করেছে অনল। ধারার নজর অনলের দিকে স্থির। অনলের চোখ পড়তে একটু ভুল হচ্ছে না ধারার। অনলের হৃদয়ের অব্যক্ত কষ্টগুলো যেনো খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারছে সে। দুটো মানুষ পাশাপাশি বসে রয়েছে কিন্তু কারো মাঝে কোনো কথা নেই। শেষমেশ নীরবতা ভেঙ্গে ধীর কন্ঠে বলে,
– কেনো নিজের সাথে যুদ্ধ করছো অনল ভাই?
– নিজের সাথে তো যুদ্ধ করার কিছু নেই, এতোদিন যেহেতু তার অস্তিত্ব আমার জীবনে ছিলো না সেহেতু নতুন করে তাকে জীবনে প্রবেশ করানোর তো কোনো মানে নেই। আমি তার সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করবো না।
– তাহলে এতোটা অস্থির হয়ে আছো কেনো? তোমার চোখের ভাষা আর মুখের ভাষা মিলছে না কেনো? আমি বলি কারণটা? তুমি তার সাথে দেখা করতে চাইছো। ফুপির প্রতি, তোমার প্রতি করা প্রতিটা অন্যায়ের উত্তর চাইছো। কিন্তু তার মুখোমুখি হতে একটা ভয় হচ্ছে তোমার, পাছে তাকে ক্ষমা করার ইচ্ছে জাগলে? তাই না অনল ভাই? আমি কি ভুল বলেছি?
ধারার কথাটা শুনেই চুপ হয়ে যায় অনল। ছলছল নয়নে ধারার দিকে তাকায় সে। ধারার চোখেও আজ অশ্রু। এই অশ্রুটা খুব ছোয়াচে, সেটা সুখের হোক বা দুঃখের; কাউকে অশ্রুসিক্ত দেখলেই আপনাকে অশ্রুপাত করতে বাধ্য করবেই। আপনি তখন অপর মানুষটির অনুভূতিগুলো হৃদয় থেকে উপলদ্ধি করতে পারবেন। ধারার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। অনলের চোখের ধারাগুলো তাকেও কাবু করে ফেলেছে। হুট করেই ধারার কোমড় জড়িয়ে মুখ লুকালো অনল৷ নিজের কষ্টের জোয়ারটাকে বাধ ছেড়ে দিলো। জড়ানো গলায় বলতে থাকে,
– কোনো বাবা এতোটা স্বার্থপর হয় ধারা? আমার বয়সটা কত তখন বল সাত থেকে আট হবে। সেই বয়সটাতে আমাকে বাবা ছাড়া কাটাতে হয়েছে। জানিস ধারা, ক্লাস শেষে যখন বন্ধুদের তাদের বাবারা নিতে আসতো আমিও বাবার জন্য অপেক্ষা করতাম। মাকে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারতাম না, কারণ প্রায় রাতে তাকে কাঁদতে দেখেছি। একদিন মা আমাকে ডেকে বললো, আমাকে তার আর বাবাকে একজনকে বেছ নিতে হবে। বাবা আর মার নাকি ডিভোর্স হচ্ছে। ডিভোর্স মানেটাও বুঝতাম না তখন। শুধু একটা কথা বুঝেছি, হয় মা নয় বাবা। আচ্ছা তুই বলতো ধারা আমার সাথে এমন কেনো হয়। তুই কল্পনাও করতে পারবি না কতটা খারাপ লাগতো। খুব কাঁদতাম আড়ালে যাতে মা না দেখে। তুই বিয়ের আগে আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলি কেনো তোর সাথে আমার জীবনটা জড়াচ্ছি। কেনো তোর অবৈধ বাচ্চাকে আমার নাম দিতে চাচ্ছি। আজ তোকে তার উত্তর দিচ্ছি, আমি চোখের সামনে আরেকটা অনল দেখতে চাই নি। বাবা ব্যতীত কোনো বাচ্চার অবস্থা কেমন হয় আমি খুব ভালো করে জানি। দেখিস আমি মোটেও ওই লোকটার মতো হবো না, আমার প্রিন্সেস্কে খুব আগলে রাখবো। আমি যা পাই নি সব কিছু ওকে দিবো। দেখিস।
ধারার কাপড় ভিজে এসেছে অনলের অশ্রুতে। তবুও ধারা কিছুই বলে নি। চুপচাপ শুধু অনলের অভিযোগ গুলো শুনে গেছে। নীরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো সে। প্রলাপ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো অনল তা নিজেও জানে না। ধারা সেখানে ঠায় বসা। তার কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে অনল। চোখের পানিগুলো এখনো শুকায় নিয়ে। চাঁদের আলোতে মারাত্মক সুন্দর লাগছে অনলকে। জ্যোৎস্নার আলোতে যেনো কোনো স্বর্গীয় দেবদূতের দেয় লাগছে তাকে। শ্যামবর্ণটাও ধারার কাছে সব থেকে পছন্দের হয়ে উঠেছে। কপালে চুলগুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। ভারী প্ললবের চোখগুলো যেনো নিপুন হাতের কোন শিল্প। লোকটার প্রতিটা কণায় যেনো মাদকতা, মায়ার মাদকতা। ইশশ ধারার ভাবতেও লজ্জা লাগছে চোরের মতো নিজের বরকে দেখছে। সময়টা যদি এভাবেই থেমে যেতো খুব খারাপ হতো কি! হয়তো হয়তো না
নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন সুভাসিনী বেগম। দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির। ভেবেছিলেন মনটা অস্থির হবে, কিন্তু অস্বাভাবিক রকম স্থির তার মন। চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। কাঁচাপাকা চুলগুলো বাতাসের তালে উড়ছে। একটা সময় এই চুলে কত না বেলী ফুলের মালা বেধেছিলেন ওই লোকটার জন্য। কিন্তু সে সব কিছুই অতীত। মনটা যে এখনো সেই লোকটার প্রতি বেহায়া নয় তা নয়, কিন্তু আত্নসম্মানের দোহাই দিয়ে মনটাকে আটকে রেখেছেন তিনি। আচ্ছা সেই ভুলগুলো আমরা করি কেনো যে ভুলগুলোকে চাইলেও ক্ষমা করা যায় না। কি দোষ ছিলো সুভাসিনী বেগমের! এটাই যে সে সবকিছু উজার করে রাজ্জাক সাহেবকে ভালোবেসেছিলেন। সেটার প্রতিদান তাকে পেতে হয়েছে। এখন কি চাইলেও সেই ক্ষত ভরা যাবে? ক্ষমা, সেটাতো তার উপর করা যায় যার উপর রাগ থাকে, অভিমান থাকে। আফসোস আজ রাজ্জাক সাহেবের প্রতি তার মনে নেই কোনো মান নেই কোনো অভিমান। আজ রাতটা নির্ঘুম ই কাটবে যেমনটা কেটেছিলো ছাব্বিশ বছর আগে
সকাল ৭টা,
কড়া রোদের কিরণ চোখে পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেলো অনলের। চোখ পিটপিট করে খুলে দেখলো বারান্দার মেঝেতে শুয়ে আছে সে। মাথাটা হালকা নাড়াতেই বুঝতে পারলো তার মাথাটা ধারার কোলে। তাড়াতাড়ি উঠে বসে সে। এবার লক্ষ্য করলো, ধারা ঠায় মেঝেতে বসে মাথা হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। মেয়েটা সারাটারাত এখানেই বসে ছিলো। পরণে সাদা ম্যাক্সি আর লাল ওড়না। পেটটা অসম্ভব বড় হওয়াতে বাসায় সালোয়ার কামিজ আর পড়া হয় না তার। সূর্যমামার বেহায়া রশ্নি তখন ধারা পুতুলের মতো মুখ আর হাতে খেলে যাচ্ছে। কবিরা বলেন ঘুমন্ত নারী নাকি সবথেকে সুন্দরী হয়। সেটার প্রমাণ অনল পাচ্ছে। ধারার ঘুমন্ত মুখটি যেনো তার খরা হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায়। গোলাপের পাঁপড়ির মতো পাতলা ঠোঁটজোড়া যেকোনো পুরুষকে কাবু করে দিতে পারবে। আর ঠিক তার উপরে নজরকাটার মতো তিলটা। নজরকাটা কম নজরকাঁড়া বেশি বলা যায়। অজান্তেই অনলের ওষ্ঠজোড়া ধারা ঠোঁটের কাছে চলে গেলো। যেনো এক ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছে সে। হঠাৎ কি মনে করে কপালে টুপ করে উষ্ণছোয়া দিয়ে দিলো অনল। ঠোটে একটা প্রশান্তির হাসি একে চট করেই কোলে তুলে নিলো ধারাকে। মেয়েটা তখন বিড়ালছানার মতো কারো অনলের বুকে মিশে গেলো। অনল খুব ধীরে ধারাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আজ অনেক বড় কাজ আছে তার। অনেক প্রশ্নের উত্তর খোজা বাকি যে।
বিকেল ৪টা,
আজ অনল ডিউটি নেই, তবুও সেই যে সকালে বেরিয়েছেন এখনো ফিরে নি সে। ধারাকেও বলে বের হয় নি। যখন ধারার ঘুম ভেঙ্গেছে তখন অলরেডি অনল বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে একটা চিরকুট টেবিলে রেখে গিয়েছিলো সে। সেখানে লিখা,
” আমার জন্য খবরদার ওয়েট করবি না। আমার কাজ আছে, কখন আসবো ঠিক নেই। তোর ডায়েট লিষ্ট মার কাছে দেওয়া। যদি এসে শুনি দুধ আর ফল খাবার ব্যাপারে ক্যাত ক্যাত করছিস তো ঠাডায় থাপড়া খাবি। মা যখন যে খেতে দিবে খাবি৷ আর কোনো লাফালাফি করবি না। মহুয়াকে রাখছি তোর নজরদারিতে। যদি শুনছি ট্যা টু করছোস তো খবর আছে। আর শোন না থাক এসে বলবো নে, প্রিন্সেস আর তার মাম্মামের খেয়াল রাখিস।”
চিরকুটটা পড়ে কি সুখের আপ্লুত হওয়া উচিত নাকি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলা উচিত বুঝে উঠতে পারে নি ধারা। কারোর প্রতি এতোটা মিশ্র ফিলিং হওয়া সম্ভব এটা অনলের তার জীবনে প্রবেশের আগে জানা ছিলো না ধারার। সোফাতে বসে মহুয়ার সাথে গল্পে মশগুল ধারা। আজ অবশ্য সুমনা বেগম তার কোনো খুত ধরে নি। ব্যাপারটায় খানিকটা অবাক ও হয়েছে ধারা। কৌতুহল মেটাতেই মহুয়াকে বলে উঠে,
– আচ্ছা, ফুপ্পি কি হয়েছে গো?
– কেনো বলতো?
– আজ আমার সাথে কোনো খোটাখোটি বাধে নি তার। তাই জিজ্ঞেস করলাম
– হাহা, বলেছিলাম না মাকে অন্যভাবে পটাতে হবে।
– মানে?
– মানে হলো, আমার মা বরাবর ই রাজ্জাক মামার প্রতি দূর্বল। সেকারণে অনল ভাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসাটা মারাত্নক। তিনি মামা-মামীর ছাড়াছাড়ি টা কখনো মেনে নেন নি। আজ যখন অনল ভাই সকালে মামার নাম্বার চেয়েছিলো তখন মা যেনো মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি পেয়েছিলেন। অনলভাইকে যখন তার মনোভাব বদলের কারণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে তখন অনল ভাই কি বলেছে জানো?
– কি?
– ধারার জন্য আমি এ কাজ করছি
– কিহ?
– হ্যা! তুমি সাহস না দিলে নাকি সে কখনোই মামার সাথে দেখা করতো না। যদিও এটা ও বলেছে যে সে মামাকে ক্ষমা করবে না। শুধু শেষবারের মতো দেখা করা।
মহুয়ার কথা শুনে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায় ধারা। অবাক হয়ে বলে,
– ফুপি জানে? অনল ভাই ফুপার সাথে দেখা করতে গেছে?
– মামী মার সামনেই কথা হয়েছে। মামী মার রিয়েকশন খুব স্বাভাবিক।
– মহুয়া আপু যা বল তা বল, ফুপাকে ক্ষমা করা যায় না। উনি যা করেছেন। আর যেহেতু ডিভোর্স হয়ে গেছে।
– আরেকটা সিক্রেট শুনবা?
ধারার কথার মাঝেই মহুয়া বলে কথাটা। কৌতুহলে চকচক করে উঠে ধারার চোখ। অধীর হয়ে বলে,
– কি সিক্রেট?
– মামা আর মামীমার ডিভোর্স হয় নি। আর মামাও ওই মহিলাকে বিয়ে টিয়ে করেন নি। এটা অবশ্য মামী মা জানেন না। আসলে মা কথাটা বলতেই পারে নি। এখন মা তোমাকে নিজের দলে ভিড়াতে চান। আসলে মার দোষ ও নেই। মামার শরীরের অবস্থা ভালো নেই। গ্লানির বোঝায় এতোদিন মামী আর অনল ভাই এর কাছ থেকে দূরে থেকেছেন। কিন্তু জীবনের প্রদীপটা নিভতে বসেছে তার। তাই শেষবার এই পরিবার নামক মরীচিকাকে আগলে ধরতে চান তিনি। তাই মা তাকে সাপোর্ট করছেন। আচ্ছা ধারা তোমারও মনে হয় একটা সুযোগ তার প্রাপ্য নয়?
– জানি না মহুয়া আপু, এই সুযোগ পাওয়া উচিত কিংবা অনুচিত এর মাঝে না একটা খুব পাতলা দেয়াল আছে। আমি সত্যি জানি না। আমার মনে হয় ডিসিশনটা অনল ভাই আর ফুপির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। এতে আমাদের না পড়াই ভালো।
মহুয়া আর কথা বাড়ালো না। ধারার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে তাদের ধ্যান ভাঙ্গে। মহুয়া উঠে দরজাটা খুলে। এদিকে নিজের রুম থেকে উঠে আসেন সুভাসিনী বেগম। মনটা কেনো যেনো অস্থির লাগছিলো তার। দরজার কাছে যেতেই পা জোড়া আটকে গেলো তার। দরজার ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ তার কানে আসলো,
– সুভা…..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
২১তম পর্ব
হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে তাদের ধ্যান ভাঙ্গে। মহুয়া উঠে দরজাটা খুলে। এদিকে নিজের রুম থেকে উঠে আসেন সুভাসিনী বেগম। মনটা কেনো যেনো অস্থির লাগছিলো তার। দরজার কাছে যেতেই পা জোড়া আটকে গেলো তার। দরজার ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ তার কানে আসলো,
– সুভা…
কন্ঠটি যে খুব পরিচিত তার। শেষ কবে এই ডাকটা শুনেছিলেন সেটা মনে পড়ছে না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছেন তিনি। অনলের মতোই চোখ,মুখ, দেহের গঠন শুধু বয়সের ছাপ খুব ভালো করেই পড়েছে শরীরে, মুখে। ছ ফুটের লোকটি এখন আর আগের মতো বলিষ্ট নেই, কুজো হয়ে পড়েছে। চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মোটা সোনালী ফ্রেমের চশমায় ঢাকা সেই চিরচেনা মায়াবী চোখ জোড়া। মাথায় সাদা চুলে ঢাকা। মলিন হাসি ঠোটে একে দাঁড়িয়ে আছেন সুভাসিনী বেগমের সামনে লোকটি। লোকটি আর কেউ নন রাজ্জাক সাহেব। ছাব্বিশ বছর পূর্বের রাজ্জাক সাহেবের মতোই সুভাসিনী বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। শুধুমাত্র সময়টা বদলে গেছে। কতগুলো বছর কেটে গেছেন। রাজ্জাক সাহেব ইতস্তত ভাব নিয়ে আবার ডেকে উঠেন,
– সুভা
– উনাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছো অনল? এ কথাতো তোমার সাথে আমার ছিলো না।
সুভাসিনী বেগমের কথা শুনে মাথাটা গ্লানিতে নিচু হয়ে যায়। অনল কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এটাই হয়তো রক্তের টান যা চেয়েও এড়াতে পাড়ে নি। সত্যি বলতে সুভাসিনী বেগমের সাথে দেখা করার জন্য অনেকটা হাতে পায়েই ধরেছিলেন রাজ্জাক সাহেব। জীবনের শেষ ভাগটা একা একা থাকার সাহসটা করে উঠতে পারেন নি। ছাব্বিশটা বছর তো কম নয়। এবার আবার একটা শেষ চেষ্টা করতে চান। অনলের আমতা আমতা করা দেখে কিছুই বললেন না সুভাসিনী বেগম। দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলেন। মাকে এভাবে চলে যেতে দেখে অনল পিছু নিতে চায়। ধারা বাধা দেয়। অসহায় ভাবে ধারার দিকে তাকালে চোখ দিয়ে ইশারা করে মানা করে। সুভাসিনীর হৃদয়ে কি ঝড় চলছে সে তা অনুভব করতে পারছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজ্জাক সাহেবের সামনে যায় সে। ধীর গলায় বলে,
– ফুপা, আসসালামু আলাইকুম। বেয়াদবি নিবেন না তবে আপনার এখানে আসা উচিত হয় নি। এখন এসেই যেহেতু পড়েছেন তাহলে যে কাজে এসেছেন সেটা করুন। তবে সেই কাজে কেউ আপনাকে সাহায্য করবে না। যদি ফুপি আপনাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি ক্ষমা পাবেন নয়তো নয়। যদি ফুপি আপনাকে দয়া করে এ বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয় তবেই আপনি এখানে থাকতে পারবেন।
রাজ্জাক সাহেব মুচকি হাসি হেসে বললেন,
– তুমি ই ধারা?
– জ্বী ফুপা
– দোয়া করি যাতে সুখী হও। আর আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রেখো।
বলেই তিনি সুভাসিনী বেগমের রুমের দিকে হাটা দিলেন। অনল ধুপ করে সোফায় বসে পড়লো। সুমনা বেগম এবং মহুয়ার মুখে কোনো কথা নেই। পরিস্থিতি মূহুর্তেই যেন থমথমে হয়ে উঠেছে। সুভাসিনী বেগম রাজ্জাক সাহেবকে ফিরিয়ে দিবেন নাকি মেনে নিবেন এই চিন্তাটাই সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ধারা ধীর পায়ে অনলের পাশে বসে। তার হাতের উপরে হাত রেখে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
– তুমি তো বলেছিলে, শেষবারের মতো দেখা করতে যাচ্ছো। তাহলে? কি এমন হলো যে বাসায় নিয়ে এলে?
অনল ধারার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। প্রশ্নের উত্তরগুলো তাকে এতোটা ঘাটিয়ে দিবে বুঝে উঠতে পারে নি অনল। কয়েনের যেমন দুটো পিঠ থাকে ঠিক তেমন কিছু কিছু কাহিনীর ও দুটো পার্ট থাকে। এতোদিন সে শুধু সুভাসিনী বেগমের পার্ট টুকু জানতো। আজ যখন রাজ্জাক সাহেবের পার্ট টুকু জেনেছে তখন কেনো যেনো জমা অভিমানগুলো গলে গেলো।
অপরদিকে,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন সুভাসিনী বেগম। বেহায়া মনটা পুনরায় গলতে শুরু করেছে। সুপ্ত অনুভূতি গুলো দাবানলের ন্যায় বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে মনে। ফেলে আসা দিনগুলো মনে হানা দিচ্ছে। সুভাসিনী বেগম ভেবেছিলেন হয়তো মনটা রাজ্জাক সাহেবের প্রতি বিমুখ হয়ে গেছে। কিন্তু তার সামনাসামনি হতেই ভুল প্রমানিত হলো তার ভাবনাগুলো। সূর্যটা পশ্চিমের দিকে ঢেলে পড়ছে। গোধুলির স্নিগ্ধ কিরণ মুখে আছড়ে পড়ছে সুভাসিনী বেগমের। রাজ্জাক সাহেব নীরবে তাকে দেখেই যাচ্ছেন। তার সামনে আঠারো বছরের কিশোরী নয় পঞ্চান্ন বছরের একজন নারী দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে কেশের সুগন্ধে একটা সময় তিনি মত্ত থাকতেন আজ সে কেশ কাঁচাপাকা রঙ্গে ডাকা। পুতুলের মতো যে মুখে নিজের শান্তি খুজছেন আজ তাতে বয়সের ছাপ পড়েছে। চামড়াটা ঝুলে গেছে। সময়টা অনেক বেশি কেটে গেছে। নিজের ভুল সিদ্ধান্ত গুলো, নিজের জেদগুলো আজ তাদের সম্পর্ককে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বয়সের গরমে সেদিন ঠিকভুলের বিচার ভুলে গেছিলেন। জেদের বসে তালাকের কথাও তুলে ফেলেছিলেন। কেনো যে এমনটা করতে গেলেন। এখন নিজেই পশ্চাচ্ছেন। জীবনের শেষ প্রহরে আর ভুল করতে চান না। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। জড়ানো গলায় ধীর স্বরে বললেন,
– সুভা
– কেনো ফিরে এসেছেন?
– আর কত শাস্তি দিবে আমায় সুভা?
– কিসের শাস্তি বলুন তো? আমি আপনাকে কখনোই কোনো শাস্তি দেই নি।
– ক্ষমাও তো করো নি?
এবার মলিন হাসি হেসে তার দিকে তাকান তিনি। এক রাশ অভিমান নিয়ে কঠিন কন্ঠে বলেন সুভাসিনী বেগম,
– দোষটা কি আমার ছিলো? ক্ষমা পাবার মতো কাজ কি আপনি সত্যি করেছেন? নিজের বউ বাচ্চা ফেলে যখন দিনের দিন একজনের কাছে পড়ে ছিলেন তখন তো আপনার এই কথাটা মনে পড়েনি। আজ হঠাৎ ক্ষমার কথা মনে পড়লো। সেদিন তো খুব বড় গলায় বলেছেন আমার মতো নারীর সাথে এক ঘরে থাকবেন না আপনি। তাহলে আজ কেনো এই নারীর ক্ষমার প্রয়োজনীয়তা হলো আপনার?
– তুমি সেদিনও আমাকে ভুল বুঝেছো আজও। সাফিয়ার সাথে আমার তখন ও কোনো সম্পর্ক ছিলো না এখনো নেই। শুধু বন্ধুত্ব ব্যাতীত কোনো সম্পর্ক আমাদের কখনো ছিলো না। সেদিনো তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি। তুমি বুঝো নি। ও অসুস্থ ছিলো বলেই আমি তার সাথে হাসপাতালে ছিলাম।
– তাই তো আমাদের ছেড়ে তাকে বেছে নিয়েছিলেন। আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন সেদিন আমার থেকে মুক্তিটা আপনি চেয়েছিলেন। আমি শুধু আপনার কথা রেখেছিলাম। সকল দায়িত্ব থেকে আপনাকে মুক্তি দিয়েছি। আপনি আমার কখনো ছিলেন ই না। আমি মরীচিকার পেছনে ছুটেছি কেবল।
সুভাসিনী বেগমের গলা কাপছে। ঠিক ভাবে কথাও বলে উঠতে পারছেন না। কোনো নারী তার স্বামীকে অন্য কারোর সাথে ভাগ করে নিতে পারেন না। তার ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছিলো। ছাব্বিশ বছর পূর্বে নিজের সাজানো সংসার ভাঙ্গার ভয়ে রাজ্জাক সাহেবকে বাধা দিয়েছিলেন। রাজ্জাক সাহেবের কলিগ এবং বন্ধু ছিলেন সাফিয়া। তাদের মাঝের বন্ধুত্ব এতোটাই গভীর ছিলো যে মাঝ রাতেও সাফিয়া বেগম রাজ্জাক সাহেবকে ফোন দিতেন। সংসার ভাঙ্গার ভয় মনে জেকে বসেছিলো সুভাসিনীর বেগমের। তাই তাকে বাধা দিতে চাইছিলেন। কিন্তু এই বাধাই তার সংসারকে ভেঙ্গে ফেলবে কখনো বুঝতে পারেন নি। রাগের বশে ঘর ছেড়েছিলেন রাজ্জাক সাহেব। সুভাসিনী বেগম হয়ে গিয়েছিলো তখন একজন সন্দেহপ্রবণ, কন্ট্রোলকারী মহিলা যে তার বন্ধুত্ব সম্পর্ককেও সন্দেহ করে। অনলকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। শুধু নিজের বাবা-মার জন্য পারেন নি। সময়ের সাথে সাথে রাগ,জেদগুলো ঠুনকো হতে লাগলো। আত্নগ্লানিতে ভুগতে লাগলেন রাজ্জাক সাহেব। আমরা রাগের বশে কতোভুলই না করি। ক্ষণসময়ের রাগে প্রিয় মানুষকেও কত কি না বলি। রাগটা পরে গেলে আফসোস করেও কুল পাই না। মাথানিচু করে রাজ্জাক সাহেব বলেন,
– বারবার ফিরতে চেয়েও ফিরতে পারি নি। কিন্তু তোমাদের কখনো ভুলি নি। প্রতিটা মূহুর্ত তোমাদের খোজ নিয়েছি। আচ্ছা তুমি তো জানতে আমি একটু রাগী,
– সে জন্যই আপনার পাঠানো ডিভোর্স পেপারে সাইন করি নি। ভেবেছি হয়তো ফিরবেন। আশা করেছি, অপেক্ষা করেছি। কিন্তু অপেক্ষার বাধটা ভেঙ্গে গেছে। ছাব্বিশটা বছর কেটে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে আছি। যখন আমার আপনাকে খুব দরকার ছিলো তখনই আপনাকে খুজে পাই নি। আচ্ছা কতটা বয়স ছিলো আমার বলুন তো? কি ভুল ছিলো আমার? এটাই যে আপনাকে হারাতে চাই নি। সর্বস্ব দিয়ে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম এটাই তো। ভুল করেছিলাম, সেটার শাস্তি এতোটা কঠিন হবে বুঝি নি। যাক গে, এতোটা সময় আপনার ব্যাতীত আমি কাটিয়েছি, এখন আর নতুন করে স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা বুড়ো চোখে নেই।
– সুভা, একা থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এটা আমার বুড়ো বয়সের ভীমরতি বলো কিংবা মৃত্যুর আগ ইচ্ছে, জীবনের শেষ পর্যায়ে পরিবার নামক সুখটাকে আবার আগলে ধরতে চাই। আচ্ছা সুভা তোমার কি ইচ্ছে হয় না?
রাজ্জাক সাহেবের কথা শুনে চুপ হয়ে যান সুভাসিনী বেগম। মান-অভিমানের এই খেলায় জীবন যে মৃত্যুর দারপ্রান্তে এসেছে এটাই ভুলতে বসেছিলেন। একটা গোলাকধাধার মাঝে পড়ে গেলেন তিনি। আচ্ছা চাইলেই কি ক্ষমা করা যায়? কিছু ভুলকে হয়তো চাইলেও ক্ষমা করা যায় না। কিংবা ক্ষমা করার সময়টা পেরিয়ে যায়।
রাত ৮টা,
সুভাসিনী বেগম ঘরে থাকার পারমিশন তো দিয়েছেন তবে এক রুমে তার কিছুতে থাকবেন না। ধারা চিন্তিত মনে বসে রয়েছে। বুড়ো বয়সে এখন ফুপাকে তো ড্রয়িংরুমে থাকতে হচ্ছে। অনলের কাছ থেকে সব শোনার পর ধারাও তার সিদ্ধান্তে একমত হলো। দোষ হয়তো রাজ্জাক সাহেবের ও ছিলো কিন্তু সুভাসিনী বেগমের ছিলো না এমনটা নয়। আর রাজ্জাক সাহেবের শরীরটাও ভালো নয়। হার্টের রোগ ধরা পড়েছে। লাঙ্গস ও দূর্বল এই অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেওয়াটা ছেলে হিসেবে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো অনলদের বাসাটা অতি ছোট। দুটো রুম আর ড্রয়িং,ডাইনিং। এখন রাজ্জাক সাহেবকে কোথায় রাখবে ধারা বুঝে উঠতে পারছিলো না। তখন অনল একটা রেডিমেট খাট কিনে নিয়ে এসেছে। ফুপি এবং ফুপার সম্পর্কটা ঠিক কিভাবে করা যায় এটাই ভাবছে আর এক বড় বাটি আচার আর তরকারির চামচ নিয়ে খাটের উপর বসে আছে সে। চিন্তা করতে করতে আচার খাচ্ছে। আনমনে আচার খাচ্ছিলো তখন ই রুমে প্রবেশ ঘটে অনলের। ধারার হাতে এতো বড় বাটি দেখে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে,
– তুই আচার খাচ্ছিস নাকি সাঁতার কাঁটছিস?
কথাটা শোনামাত্র তড়িৎ গতিতে অনলের দিকে তাকায় ধারা। অনল তার পাশে বসতে বসতে বলে,
– একেই লিলিফুট, এই হারে খেলে একটা ছোট খাটো ফুটবল হয়ে যাবি। এমনিতেও ফুটবল ই লাগে তোকে।
বলেই গাল টিপে দেয় ধারার। অনলের কথা শুনে বেশ ক্ষেপে যায় ধারা। আচারের বাটিটা ছেড়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
– এই শোনো খোটা দিবে না, একদম খোটা দিবে না। কে বলেছিলো তোমাকে আমাকে এতো এতো দুধ, ডিম খাওয়াতে। ঠুসায় ঠুসায় খাওয়াবা আর এখন একটু আমার পছন্দের জিনিস খেলেই দোষ?
– দেখোছো প্রিন্সেস তোমার মাম্মাম কতোটা ঝগরুটে হয়ে গেছে। সারাক্ষণ এভাবে ঝগড়া করে তোমার বাবার সাথে।
অনলের কথায় একেবারে বেকুব বনে যায় ধারা। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া অনল করলো আর মেয়ের কাছে ধারাকে দোষী বানাচ্ছে। এর সাথে কথা বলা মানেই অহেতুক কষ্ট। মুখ ফুলিয়ে চুপ করে বসে পড়লো ধারা। ধারার মুখ ফুলানো দেখে হো হো করে হেসে উঠে অনল। চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে অনল তখন বললো,
– তুই এতো কিউট কেনো বলতো? আচ্ছা শোন কালকে চেকাপ আছে কিন্তু সকালে। উঠে পরিস। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোলে হবে না।
– নিজে ঘুমায় আমাকে বলছে। দেখা যাবে আমার ই ডাকতে হবে। হাহ।
– ঠিক আছে মহারাণী। আমার ভুল। এই যে কান ধরলাম
অনলের কান ধরা দেখে মূহুর্তেই খিলখিল করে হেসে উঠে ধারা। লোকটাকে যে তার এতো ভালোলাগে বলে বুঝাতে পারবে না। অনল ধারার চঞ্চল হাসিকে মন ভরে দেখে। মেয়েটা ধীরে ধীরে মনে নিজের খুটি বসিয়েছে। মনের গহীনে নিজের বিস্তার করে নিয়েছে। এখন শুধু মনের কথাটা বলা বাকি
সকাল ১১টা,
চেকাপ করিয়ে বের হয়েছে অনল ধারা। বাচ্চা এবং মায়ের রিপোর্টগুলো খুব ভালো এসেছে। তাই অনলের মন বেশ ভালো। রাস্তায় আইসক্রিম দেখেই ধারা আইসক্রিমের জিদ শুরু করলো। একেই কড়ারোদ, উপরে প্রেগ্ন্যাসির সময় একটু বেশি ই গরম লাগে। প্রথমে না করলেও ধারার মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন বাজি ধরতে পারবে অনল। আইসক্রিম তো একটা সামান্য ব্যাপার। বাধ্য হয়ে আইসক্রিম কিনে দিতে হলো। দু হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেতে লাগে ধারা। আর অনল এক দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকে। তখন ই এক জোড়া চোখ ধারাকে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতে থাকে। এক রাশ বেদনা তার চোখে ফুটে উঠে।
ধারাকে বাসায় রেখে ডিউটিতে আসে অনল। মনটা আজ খুব ভালো অনলের; বাবাকে ফিরে পেয়েছে, ধারার শরীরটাও ভালো। এখন শুধু ডেলিভারিতে ঝামেলা না হলেই হয়। হঠাৎ……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
২২তম পর্ব
ধারাকে বাসায় রেখে ডিউটিতে আসে অনল। মনটা আজ খুব ভালো অনলের; বাবাকে ফিরে পেয়েছে, ধারার শরীরটাও ভালো। এখন শুধু ডেলিভারিতে ঝামেলা না হলেই হয়। হঠাৎ একজন অচেনা পুরুষ তার সামনে দাঁড়ায়। পুরুষ বললে ভুল হবে, সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক। কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকে খুতিয়ে দেখে নিলো অনল। শ্যাম বর্ণের একটি যুবক, চুলগুলো উসকো খুসকো হয়ে আছে। চোখযুগল লাল বর্ণ হয়ে ফুলে আছে, চোখের নিচে কালি স্পষ্ট। চোখে মুখে মারাত্নক বিসন্নতা ভর করে আছে যুবকটির। অনল ভাবলো কোনো রোগীর এটেন্ডেন্ট হয়তো। যুবকটি অনলের কৌতুহলী দৃষ্টি দেখে শান্ত স্বরে বললো,
– অনল মাহমুদ?
– জ্বী, কিছু বলবেন?
যুবকটি মলিন হাসি হেসে বলে,
– বলার তো অনেককিছু আছে কিন্তু এই জায়গাটা কথাগুলো বলার জন্য সঠিক নয়। আপনার কি একটু সময় হবে? তাহলে কোথাও বসে কথা যেতো
– আমি আপনাকে চিনতে পারছি না, আপনি কি কোনো প্যাশেন্টের রিলেটিভ?
– জ্বী না, আমি আপনার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা ছিলো। একটু কি বাহিরে যাওয়া যায়?
– সরি, আমি ভেবেছিলাম আপনি রোগীর কেউ। আমি একটু ব্যাস্ত আছি। আমার মনে হয় না আপনার সাথে আমার কোনো জরুরি কথা থাকতে পারে।
বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই যুবকটি একটা কথা বলে যা অনলের পা আটকে দেয়।
– আমি দিগন্ত। ধারার গর্ভে আমার সন্তান ই বেড়ে উঠছে।
দুপুর ১২টা,
কফি শপে মুখোমুখি বসে রয়েছে দিগন্ত এবং অনল। অনলের চোয়াল শক্ত, মুখে তার কোনো কথাই নেই। কি বলবে বুঝছে না। দিগন্ত কফির কাপে একটা চুমুক দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে নীরবতা ভেঙ্গে অনল বললো,
– যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন, আমার সময় নেই।
– ধারাকে আপনি ডিভোর্স দিন।
দিগন্তের ভাবলেশহীন ভাবে বলা কথা শুনে মূহুর্তেই অবাক হয়ে যায় অনল। রাগে গা রি রি করছে। ইচ্ছে করছে দিগন্তে ধরে কিছুক্ষণ কেলাতে। নিজেকে খুব কষ্ট করে সামলে জিজ্ঞেস করে,
– মাথা ঠিক আছে? নেশা টেশা করেন নাকি মশাই। সকাল সকাল মশকরা করছেন কেন?
– আমি মশকরা করছি না, আমি ধারাকে ফিরে পেতে চাই। আমার বাচ্চাকে ফিরে পেতে চাই। জানি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু সময় তো এখনো চলে যায় নি। তাই আপনার কাছে অনুরোধ করতে এসেছি। প্লিজ আমার ধারা আর বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিন।
– আপনি যাকে নিয়ে কথা বলছেন সে আমার ওয়াইফ। আর কোন বাচ্চার কথা বলছেন বলুন তো? ধারার গর্ভের বাচ্চাটিও আমার। সুতরাং অহেতুক নিজের সময় নষ্ট করবেন না।
বলে উঠে যেতে নিলে দিগন্ত বলতে লাগে,
– ধারার গর্ভের বাচ্চার ছয় মাস দু সপ্তাহ চলছে। আর আপনাদের বিয়ের তো ছয় মাস হয়েছে। তাহলে সেটা আপনার বাচ্চা কি করে হয়? অন্যের পাপের ফসলকে নিজের দাম দিতে একবার ও খারাপ লাগছে না আপনার। যাক গে হয়তো ধারার প্রতি দূর্বল হয়ে এই কাজ করছেন। ভেবেছেন এতে করে ধারা হয়তো পটে যাবে। আসলে আমিও তো পুরুষ আমি জানি। আর এতো কিসের স্বামী স্ত্রী হবার বড়াই করছেন? সম্পর্কটা তো কাগজের একটা ঠুনকো সম্পর্ক। না ধারা আপনাকে ভালোবাসে না আপনি। ধারার মতো মেয়েকে কোনো ভদ্র ছেলে ভালোবাসতে পারবে না এটা আমি…..
কথা শেষ করার আগেই অনল বাঘের মতো হিংস্র হয়ে একটা ঘুষি দিয়ে বসে দিগন্তকে। দিগন্তের ঠোঁট ফেটে যায়। অনলের রুদ্র রুপ দেখে একটু ভড়কে যায় দিগন্ত। কফি শপের সবাই তাদের দেখছে। তারা আগ্রহের সাথে এমন ভাবে দেখছে যেনো কোনো নাটকের শুটিং চলছে। কলারটা টেনে দিগন্তকে দাঁড় করায় অনল। বজ্র কন্ঠে বলে,
– একটা বাজে কথা আর নয় দিগন্ত। নয়তো এখানেই পুতে ফেলবো। আজ তোদের মতো ছেলের জন্য না জানি কতো মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। কিছু মেয়ে ব্যতীত সব মেয়েরা আবেগের বশে বিশ্বাস করে নিজের সবচেয়ে দামী জিনিসটা বিসর্জন দেয়৷ কিন্তু যখন তোদের অকামের ফল তাদের গর্ভে বেড়ে উঠে, তখন দায়িত্ব নিতে তোরা ভুলে যাস। ফলটা ওই মেয়েটা আর আর তার পরিবারকে ভুগতে হয়। হয় তাদের আত্নহত্যার পথ বেঁছে নিতে হয় নয়তো ডাস্টবিনে কিছু অপরিণত শিশুর ফিটাস দেখি। আজ আমাকে সে কথাগুলো বলছিলি সেটা ছয় মাস আগে কেনো মনে ছিলো না। যখন ধারা তোকে বলেছিলো তার গর্ভে তোর সন্তান আছে। তোদের কিছু সময়ের ফুর্তি একটা মেয়েকে কলঙ্কিনী করে দেয়। সারা সমাজের ধিক্কার শুনতে হয়। সেদিন আমি ধারার হাত না ধরলে এখন ওর জীবনটাও তেমন হতো। এখন কোন মুখে আমার সামনে এই কথা বলছিস। আর একটা কথা আবার বলছি, আমি তোর মতো শরীরের খাঁজে ভালোবাসা খুজি না। আমি ধারাকে ভালোবাসি, শুধু তাই নয় যে আসছে তাকেও আমি মাথায় করে রাখবো ইনশাআল্লাহ। আমি ওদের আমার কাছ থেকে দূর হতে দিবো না। তাই অহেতুক সময় নষ্ট করবেন না।
বলেই দিগন্তের কলারটা ছেড়ে দেয় অনল। রাগে গা রি রি করছে। দিগন্তের ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছে। ঠোঁটের রক্ত মুছে দিগন্ত বাঁকা হাসি হেসে বলেন,
– ধারার সব ডিসিশন দেখছি আপনি ই নিচ্ছেন। আমি তো আমার ভুল স্বীকার করছি৷ আর আমি ধারাকে অসম্ভব ভালোসি নয়তো ফিরে আসতাম না। সে এই ছয়মাস আপনার ওয়াইফ ছিলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আর আমিও জানি ধারা আমাকে ভালোবাসে। তাই আপনার মনে হচ্ছে না নিজের মহত্ব দেখিয়ে আমাদের দুজনের মাঝে দেয়াল তৈরি করছেন আপনি। আর বাচ্চাটা আমার, আমার রক্ত। একজন বাবাকে তার বাচ্চা থেকে আলাদা রাখার অধিকার কি আপনার আছে? রক্তের একটা টান আছে। পালক বাবা পালক ই হয়।
দিগন্তের কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় অনল। কোনো কথা না বলে কফি শপ থেকে বেড়িয়ে যায়। সে কি কোনো ভুল করছে! ধারাকে দিগন্তের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াটাই কি উচিত হবে? উফফফ মাথাটা এলোমেলো হয়ে আছে তার। ধারাকে নিজের থেকে আলাদা করার চিন্তায় মাথা আরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুকে একটা অজানা চিনিচিনে ব্যাথা হচ্ছে। হাহাকার করছে বুকটা। খুব কষ্ট হচ্ছে কি করবে কিছুই বুঝে উঠছে না, মানুষ নিজের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্বে নিজেই আকড়ে যায়। এ থেকে নিস্তার পাওয়াটা খুব কষ্টকর।
সন্ধ্যা ৭টা,
বাসায় কেবল তিনটে প্রাণী, রাজ্জাক সাহেব, সুভাসিনী বেগম আর ধারা। মহুয়া এবং সুমনা বেগম চলে গিয়েছেন বিকেলে। রাজ্জাক সাহেবের সাথে কোনো কথাই বলেন না সুভাসিনী বেগম। ধারা তাদের মাঝে একটা সেতুবন্ধনের ন্যায় কাজ করছে। রাজ্জাক সাহেবের সাথে অবশ্য ধারার বেশ খাতির হয়েছে। সুভাসিনী বেগমের রাগ ভাঙ্গাতে সব চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। আজ বেলীফুলের মালা নিয়ে এসেছিলেন। যদিও সুভাসিনী বেগম সেটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন। রাজ্জাক সাহেব তবুও হার মানবেন না। ছাব্বিশ বছরের রাগ বলে কথা! ড্রয়িংরুমে বসে এইটা নিয়েই চিন্তা করছিলো ধারা। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে ধারার ধ্যান ভাঙ্গে। ধীর পায়ে যেয়ে দরজাটা খুলতে দেখে দরজার ওপারে অনল দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ধারার পাশ কাটিয়ে নিজ রুমে চলে যায় সে। ধারার মনে অসংখ্য কৌতুহল জাগে কিন্তু চুপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে হচ্ছে।
রাত ১১টা,
ধোঁয়ায় নিজের চিন্তাগুলো উড়াচ্ছে অনল। বারবার দিগন্তের বলা কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। যতই অস্বীকার করুক বাচ্চাটা তো তার, তার রক্ত। রাজ্জাক সাহেবের এতো বড় অন্যায়ের পর ও রক্তের টানকে অস্বীকার করতে পারে নি সে। আচ্ছা ধারা কি এখনো দিগন্তকে ভালোবাসে? হতেই পারে, যার জন্য এতো বড় স্টেপ নিতে সে একবার চিন্তা করে নি। মাথাটা দপদপ করছে। ধারাকে হারাবার কথায় আরো বেশি এলোমেলো হয়ে পড়ছে দিগন্ত।
– কি নিয়ে চিন্তা করছো?
ধারার কথায় হুশ ফিরে অনলের। অনলের করুণ মুখটা দেখে বুকে কামড় পড়ে ধারার। শত যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে সে। অনল একবার বলতে চেয়েছিলো তার পর ও কিছু বললো না। মলিন হাসি হেসে বললো,
– কিছু না, এমনেই কাজ নিয়ে একটু স্ট্রেসড আছি।
– সত্যি?
– হু, তুই ঘুমাতে যা রাত হয়েছে।
কেনো যেনো অনলের কথাতে আশ্বস্ত হতে পারে না ধারা। এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো লুকাচ্ছো, যেখানে এতো স্ট্রেসের পর ও সিগারেট ধরাও না আজ কি এমন হলো সে একটার পর একটা সিগারেট জ্বালাচ্ছো? কি হয়েছে আমাকে বলো
– আচ্ছা ধারা, রক্তের টান কি সব কিছুর উপরে হয়?
– হঠাৎ এ প্রশ্ন?
– এই যে দেখ বাবা এতো বড় ভুল করা সত্ত্বেও আমি তার সামনে যেতেই দূর্বল হয়ে পড়লাম। নিজের রক্ত যদি ভুল করে তবুও কি তার টান মানুষ অগ্রাহ্য করতে পারে?
– অবশ্যই পারে না। যতই হোক রক্ত তো। আর নিজের বাবা-মা ভুল করলেও সন্তান হিসেবে তাদের দোষ ধরাটা আমাদের উচিত নয়। আফটার অল মা-বাবা তারা। তাদের কিছু সিদ্ধান্ত হয়তো আমাদের পছন্দ হয় না, কিন্তু তাদের নিজেরও কিছু এক্সপ্লেনেশন থাকে। আমাদের নিজের দিকটা সবসময় না দেখে তাদের দিকটাও দেখা উচিত। ঠিক না? তুমি ফুপি-ফুপাকে নিয়ে চিন্তা করো নাতো। চলো ঘুমাতে।
বলেই নিজ রুমে চলে যায় ধারা। ধারার কথাগুলো যেনো আরো ঘেটে দেয় অনলকে। একজন বাবা আর সন্তানকে আলাদা করাটা কি সত্যি উচিত হবে। কিন্তু দিগন্ত যা করেছে তার পরে ধারাকে তার কাছে ফিরে যেতে দেওয়া মানে বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তবুও একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে অনলের, বাচ্চাটার জন্য এবং ধারার জন্য।
পাঁচ দিন পর,
একটা পার্কে ঘুরতে নিয়ে এসেছে অনল ধারাকে। বিকেলের দিকে পার্কে এসে ধারার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে। তখন অনল হাটু গেড়ে বললো,
– প্রিন্সেস বাবা যা করছে তোমার এবং তোমার মাম্মামের জন্য। তোমার মাম্মাম যা সিদ্ধান্ত নিবে তোমার বাবা সেটা মেনে নিবে। একটা জিনিস মাথায় রেখো সোনা, তুমি আমার কাছে থাকো বা নাই থাকো আমার কাছে তুমি সবসময় আমার বাচ্চাই থাকবে।
অনলের কথার আগা-মাথা কিছুই যেনো বুঝলো না ধারা। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
২৩তম পর্ব
অনলের কথার আগা-মাথা কিছুই যেনো বুঝলো না ধারা। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই পেছন থেকে একটি কন্ঠ শুনে বেশ ভড়কে যায় ধারা।
– ধারা…
কন্ঠটি ছ মাস পরে শুনছে। পিছনে না ফিরেও খুব ভালোভাবেই মানুষটিকে চিনতে পারছে সে। হাসিমুখটা নিমিষেই পাথরের ন্যায় অনুভুতি শূন্য হয়ে গেলো। এই ভয়টা প্রতিটা সময় কুড়ে কুড়ে খেত তাকে। দিগন্তের মুখোমুখি হতে একেবারেই নারাজ ছিলো সে। অনলের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি তাক করতেই অনল বলে উঠলো,
– আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। যদি বাড়ি ফিরার ইচ্ছে থাকে তো একটা ফোন দিস আর নাহলে আমি কাল ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো।
অনলের কথাটা শুনে মাথায় যেনো বজ্রপাত হয় ধারা। নিমিষেই তার সুখগুলো যেনো কর্পুরের ন্যায় উবে যায়। অনলের কথায় এটুকু স্পষ্ট ধারা এ পথটা তার নিজেরই হাটতে হবে। আজ যে সিদ্ধান্তটা নিবে তার তার নিজেরই নিতে হবে। এতোদিন প্রতিটা লড়াই এ অনল তার ঢাল হয়ে ছিলো আজ সেই ঢালটাও তার সাথে নেই। ধারা অসহায় চোখে অনলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে ফিরলো ধারা। স্থির দৃষ্টিতে স্পষ্ট, জড়তাহীন গলায় বললো,
– কেমন আছো দিগন্ত? এতোদিন পর কি মনে করে?
ধারার কথাটা শুনে অনেকটাই অবাক হলো দিগন্ত। ছয় মাস আগের ধারার আর আজকের ধারার মাঝে যেনো রাত দিন পার্থক্য। এ ধারা যেনো তার ধরা ছোয়ার বাহিরে। একটু এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বললো,
– তোমার কাছে বারে বারে কেনো আসি সে তো তোমার অজানা নয় ধারা।
– অবশ্যই অজানা, তোমার আমার মতো মেয়ের কাছে কি প্রয়োজন সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
– ধারা প্লিজ, এভাবে বলো না। মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু একটা সুযোগ কি আমাকে দেওয়া যায় না? আর তুমিও আমাকে বলো নি যে
– কি বলি নি দিগন্ত?
ভ্রু কুচকে ঝাঝালো কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো ধারা। দিগন্ত ও জোড় দিয়ে বললো,
– এই যে তুমি বাচ্চাটাকে নষ্ট করো নি
– আমি তো এটাও বলি নি যে আমি বাচ্চাটাকে নষ্ট করেছি। তুমি নিজেই সব মনে করে নিয়েছো। তুমি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করো নি। এখন আমাকে দোষ দিচ্ছো প্রতিবারের মতো।
ধারার কথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। দিগন্ত একবার ও সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজনীয়তাবোধ করে নি তখন। শুধু ধারার নামে মিথ্যে আরোপ দিয়ে গিয়েছিলো। আজ নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত দিগন্ত। মাথা নিচু করে বলে,
– আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না ধারা। ভুল আমার ছিলো, তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মেনে নিবো কিন্তু আমাকে আজ ফিরিয়ে দিও না ধারা। তোমাকে ছাড়া আমি যে শূন্য। এই ছয়টা মাস নিজের হৃদয়ের যন্ত্রণায় ভুগেছি আমি। তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না কতোটা কষ্টের মাঝে ছিলাম। কত রাত জেগে কেটেছে তার হিসাব নেই। আমি তোমাকে ছাড়া একটা মূহুর্ত কল্পনা করতে পারি না ধারা। দম বন্ধ লাগে, প্লিজ একটা সুযোগ আমাকে দেও। এই বাচ্চাটা আমার, আমাকে আমার বাচ্চার কাছ থেকে দূর করো না। সেদিন যখন তোমাকে হাসপাতালে দেখেছিলাম সেদিন ই বুকের মাঝে অসংখ্য পাথর উঠে গিয়েছিলো। আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না আমার কতোটা কষ্ট হয়েছিলো যখন ভেবেছি তুমি শুধু বিয়ে করার জন্য আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছো। যখন জানতে পারলাম আমার বাচ্চাটি সুস্থ রয়েছে কতো যে আনন্দ হয়েছে বুঝাতে পারবো না। প্লিজ একটা সুযোগ দাও ধারা। প্লিজ এই সামান্য কাগজের সম্পর্কটাকে আমাদের মাঝে দেয়াল হতে দিও না। প্লিজ
গলা ধরে এসেছে দিগন্তের। কথা বলতে বলতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে সে। চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে। কেনো যেনো আজ তার কান্নায় কষ্ট হচ্ছে না, করুণা হচ্ছে কিন্তু কষ্ট হচ্ছে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– তুমি কি আমাকে ভালোবাসো দিগন্ত?
– এভাবে কেনো বলছো ধারা?
– আমি তোমার অভ্যাস দিগন্ত ভালোবাসা নই। আমি তোমার জিদ, ভালোবাসা নয়। যদি ভালোবাসা হতাম তাহলে মূহুর্তেই পায়ে ঠেলে দিতে না আমায়। আমাকে বেশ্যা বলতেও তোমার মুখে বাধে নি। তুমি যদি আমাকে সত্যি ই ভালোবাসতে তাহলে কখনোই আমার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলতে পারতে না দিগন্ত। আমি তোমার কেবল কামনা। তোমার খারাপটা আমার শুন্যতার জন্য লাগে নি, আমাকে অন্য কারোর সাথে দেখে লেগেছে। আমি তোমার কাছে একটা প্রাইজের মতো। ভালোবাসা এটাকে বলে না। ভালোবাসার মধ্যে কামনা থাকে না। আমাকে কখনো তুমি ভালোই বাসো নি। আমি তোমার চাহিদা ছিলাম। আর আমি ও কতো বোকা তোমার লালসাটাকে ভালোবাসা হিসেবে মেনেছি। আমি মেয়ে নামে কলংক। তুমি আমাকে ভালোবাসলে কখনো কলংকিত করতে না। তুমি কি জানো এই ছয়মাস কিভাবে কেটেছে। জানো না জানার ইচ্ছে ও তোমার নেই। যেদিন তুমি বলেছিলে তুমি বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে পারবে না সেদিন আমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম। অনল ভাই না থাকলে হয়তো মরেই যেতাম। এর পর ও দু এক বার এ চিন্তা আমার মাথায় এসেছিলো। এই বাচ্চাটাকে বাঁচানোর জন্য আমি মা-বাবার পা ধরে কেঁদেছি। সেদিন অনল ভাই না থাকলে হয়তো আমাকে আত্নহত্যা করতে হতো। আর কিসের বাচ্চা বাচ্চা করছো বলোতো? কোন বাচ্চা, যার দায়িত্ব তুমি নিতে চাও নি। কাপুরুষের মতো দায়িত্ব নেবার ভয়ে তাকে মেরে ফেলতে চাইছিলে সেই বাচ্চার দোহাই দিচ্ছো। তুমি আদৌ জানো আমার প্রেগ্ন্যাসির অবস্থা কেমন ছিলো? বাচ্চাটা আদৌ কতটুকু বেড়েছে? আমার শরীরের পজিসন কেমন? না তুমি জানো না। অনল ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো, সে এটাও বলতে পারবে বেবি দিতে কতোটুকু নড়াচড়া করে। সে বাবা না হয়েও বাবার সকল দায়িত্ব পূরণ করেছে। যে সময়টা আমার তোমাকে সব থেকে বেশি দরকার ছিলো তখন সেই মানুষটা আমার পাশে ছিলো, আমার ঢাল হয়ে। আমাদের কুকীর্তির সম্পূর্ণ দায়টা নিজের নামে চালিয়েছেন। আমাকে কেউ যেনো আঘাত না করে সেজন্য আমার সামনে তাকে পেয়েছি তাকে। আর কি বললে কাগজের সম্পর্ক হ্যা আমাদের মাঝে সম্পর্কটা কাগজের। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি। আমার ভাবনার খেলাঘরে তার বসবাস। আজ তোমার কথাগুলো শুনে তোমার প্রতি করুনা হয়েছে কিন্তু তোমার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় নি। আমি তোমার কাছে ফিরবো না। এই কাগজের সম্পর্ক আমার সারাজীবনের অস্তিত্ব। এতোদিন তুমি আমার কাছে যা চেয়েছো আমি দিয়েছি আজ আমি চাচ্ছি। আমি তোমার থেকে মুক্তি চাচ্ছি। আমার বাচ্চা আর আমাকে মুক্তি দাও। আর কখনো আমার সামনে কোনো অহেতুক আবদার করো না। আমি রাখতে পারবো না। আরেকটা কথা, অনল ভাই যদি আমার জীবনে নাও থাকতো তাও আমি তোমার কাছে ফিরতাম না। যদি কোনোদিন অনল ভাই আমাকে ফিরিয়ে দিতে চায় আর আমার যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকে আমি আর আমার বাচ্চা মরে যাবো তাও তোমার কাছে ফিরবো না। আমি বলি কি, তুমি এবার কাউকে সত্যি ভালোবাসার চেষ্টা করো। দেখবে সুখী হবে। আসি দিগন্ত।
দিগন্তের কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাটা দিলো ধারা। আজ মন থেকে একটা ভার করে গেছে। বেশ ফুরফুরে লাগছে মনটা। কিন্তু যখনই ভাবছে অনল তাকে দিগন্তের কাছে ফিরিয়ে দিতে রাজী হয়েছে। তার কাছে শুধু কাগজের স্ত্রী হয়ে থেকে গেলো ধারা। কেনো জোর করলো না সে, কেনো দিগন্তকে এই সুযোগটা দিলো অনল এটা ভাবতেই মনটা কালো মেঘের মতো দুঃখগুলো ভর করছে। এদিকে ধারার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দিগন্ত। বুকটা যেনো ফেটে যাচ্ছে, আজ নিজের কর্মকাণ্ড তাকে ধারার কাছ থেকে এতোটা দূর করে দিয়েছে। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। এক নজরে ধারার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। ধারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো। হাটু গেড়ে এখনো সেখানেই দেখছে সে। বুক থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরোলো।
পার্কের বাহিরে গাড়িতে বসে আছে অনল। মন এবং মস্তিষ্কের যুদ্ধে মস্তিষ্ক হেরে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে ছুটে যাবে ধারার কাছে ছুটে যেয়ে ধারাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হচ্ছে যদি ধারা এখনো তাকে ফোন দেয় নি তবে কি ধারা দিগন্তকে মেনে নিয়েছে। দিগন্তকে সে তো ভালোবাসতো। অনল তো তার কাছে শুধু একটা বটবৃক্ষের ন্যায়। সে তো অনলকে ভালোবাসে না। আর এই সম্পর্কটা তো শুধুমাত্র কাগজের। কাগজের সম্পর্ক কি আদৌ সত্যিকারের সম্পর্কের ন্যায় হয়!! কৃতজ্ঞতা কখনো ভালোবাসা হতে পারে না। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। এখনো যেহেতু ধারা ফোন দেয় নি তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানেই হয় না। না জানি কতো মান-অভিমানের অবসান ঘটছে। বুকে হাজারো ছুরির আঘাত হচ্ছে অনলের। চোখ মুখ মুছে গাড়ি স্টার্ট দিবে তখন…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
২৪তম পর্ব
কাগজের সম্পর্ক কি আদৌ সত্যিকারের সম্পর্কের ন্যায় হয়!! কৃতজ্ঞতা কখনো ভালোবাসা হতে পারে না। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। এখনো যেহেতু ধারা ফোন দেয় নি তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানেই হয় না। না জানি কতো মান-অভিমানের অবসান ঘটছে। বুকে হাজারো ছুরির আঘাত হচ্ছে অনলের। চোখ মুখ মুছে গাড়ি স্টার্ট দিবে তখন মোবাইলটি বেজে উঠে। মোবাইল স্ক্রিনে দিগন্তের নাম্বারটা উঠে রয়েছে। বুকে একরকম চিনচিনে ব্যাথা করে উঠলো অনলের। হেরে গেছে সে, অবশ্য সে তো যুদ্ধ করেই নি। এখানে যুদ্ধ করবেই বা কিভাবে! ধারা তো তার কখনো ছিলোই না। যার আমানত তার কাছেই ফিরে গেছে ধারা। এটাই তো হবার ছিলো। ফোনটি রিসিভ করে কাঁপা স্বরে হ্যালো বলতেই অপরপাশ থেকে তার কানে আসে,
– আপনি জিতে গেছেন অনল। আপনি যুদ্ধ না করেও জিতে গেছেন আর আমি যুদ্ধ করেও হেরে গেলাম।
– মানে?
– মানে টা স্পষ্ট ধারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম ধারা এখনো আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই ছয় মাসে ওর মন, ভাবনার থেকে এভাবে মুছে যাবো। অবশ্য এখানে আমার দোষ ই বেশি; আজ আমার নিজের কাজের জন্যই আমার প্রতি তার ভালোবাসাটা একেবারেই মলিন হয়ে গেছে। আর আপনার নামটা পার্মানেন্টভাবে খোদাই হয়ে গেছে। আমি আর আপনাদের জীবনে বাধা হতে চাই না। তবে একটা আবদার ওদের দেখে রাখবেন প্লিজ। ধারা হয়তো মুখ ফুটে কখনোই আপনাকে কিছু বলবে না তাই হয়তো আপনাকে তার মনের কথাটা বলা হয়ে উঠে নি। আপনি কখনো ওর হাতটা ছাড়বেন না প্লিজ। আমি ওর যোগ্য নই। তাইতো সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর যে আসছে তাকে কখনো বুঝতে দিবেন না যে আপনার সাথে তার রক্তের সম্পর্ক নেই। যদিও আপনাকে বলতে হবে না তবুও আপনার মনে যে দোটানার বীজ আমি বুনেছিলাম সেটাকে গোড়া থেকে উঠিয়ে ফেলুন। আমি কখনোই কোনো অধিকার নিয়ে আপনাদের কাছে আসবো না। আমার শুভকামনা রইলো আপনাদের জন্য। আর একটা কথা কাগজের সম্পর্কটা কাগজে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব সম্পর্কে পরিণত করুন। রাখছি।
দিগন্তের গলা ধরে এসেছে। আর কোনো কথা বলতে পারছে না। ফোনটা রেখে দিলো সে। অনলের উত্তরের অপেক্ষা করলো না। নিজের কথাগুলো বলেই রেখে দিলো সে। দিগন্তের কথাগুলো শুনে মনের সব কালো মেঘগুলো যেনো নিমিষেই সরে গেছে অনলের। তার ধারা তার ই আছে, ধারা তাকে ভালোবাসে। সে তাকে ছেড়ে যায় নি। আর প্রিন্সেসও তার কাছেই থাকবে। মরা মনটা নিমিষেই জীবিত হয়ে উঠেছে। সে ভেবেছিলো আবারও অন্ধকার জীবনে ফিরে যেতে হবে তার। শুন্যতা তাকে গ্রাস করে নিবে। কিন্তু ধারা সকল ভাবনা মিথ্যে প্রমাণ করে তার বেরঙ জীবনকে আবার রঙিন করে দিলো। কিন্তু ধারা তাকে ফোন কেনো করলো না। সে কোথায় আছে। ছুটতে ছুটতে পার্কে গেলো অনল। রীতিমতো পাগলের মতো খুঁজতে থাকে সে ধারাকে। তবে কি ধারা তার উপর অভিমান করেছে? একবার কি ধারাকে আগ থেকে জানিয়ে রাখা উচিত ছিলো। ধারা তো তাকে ভালোবাসে তাহলে কেনো তার কাছে ফিরে আসলো না। ধারার ফোনটাও অফ। কোনোভাবেই রিচ করতে পারছে না। সূর্য পশ্চিমে অস্ত চলে গেছে। আলোটা নিভু নিভু হয়ে এসেছে। ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। ক্লান্ত হয়ে পার্কের মেইন গেটে চলে আসলে খেয়াল করে ফোনটা বেজেই চলেছে। সুভাসিনী বেগম রীতিমতো ফোন করেই যাচ্ছেন। এতোক্ষন খেয়াল ই করে নি অনল। ফোনটা রিসিভ করতেই,
– তোমার বোধবুদ্ধি কি জ্বলাঞ্জলি দিয়েছো। তোমার ফোনেই পাচ্ছিলাম না আমি। কখন থেকে ফোন করছি।
– জরুরি কিছু মা?
– ধারাকে রেখে বাড়ির নিচে রেখে কোথায় গিয়েছো তুমি? সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখনো ফিরছো না যে?
– ধারা বাসায়?
– বাসায় মানে? ও তো আধা ঘন্টা হয়ে গেছে বাসায় এসেছে। ও তো বললো তুমি ওকে বাসার নিচে নামিয়ে দিয়েছো। তোমার নাকি জরুরি কাজ আছে। তুমি কোথায় অনল? আর তুমি ধারাকে একা ছেড়ে দিয়েছো?
সুভাসিনী বেগমের কথায় একদিকে আশ্বস্ত হলেও তার জেরার মুখোমুখি হওয়াতে কথা শুকিয়ে এসেছে অনলের। আমতাআমতা করে বললো,
– আসলে ধারা আমার উপর রাগ করে একাই বাসায় চলে এসেছে।
– কিহ? কি করেছো তুমি?
– একটা বড় ভুল হয়ে গেছে মা। আমি আসছি এখনি।
বলেই ফোনটা রেখে দিলো অনল। সুভাসিনী বেগমকে কোনো কিছু বলার সুযোগ ই দিলো না সে। ফোনটা রাখতেই মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে সুভাসিনী বেগমের। ধারা অনলের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। কাগজের সম্পর্কটা নতুন রুপ নিচ্ছে। যে সম্পর্কে মান-অভিমান, অভিযোগ, রাগ থাকবে। ফোন রেখে ধারার রুমে যাওয়ার আগেই খেয়াল করলেন রান্নাঘর থেকে প্রচুর শব্দ আসছে। তড়িৎ গতিতে রান্নাঘরে যেয়ে দেখলেন চায়ের পাতিল পড়ে একাকার অবস্থা আর রাজ্জাক সাহেবের হাত অনেকটাই পুরে গেছে। তিনি অসহায়ের মতো হাতটা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স ষাটের ঘরে পৌছেছে। দু-একদিন ধরে শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। সুভাসিনী বেগমকে তিনি জানতেও দেন নি। এমনিতেও এতোদিন একা থাকায় নিজের কাজ নিজে করাটা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে রয়েছে তার। তাই সুভাসিনী বেগমকে না জানিয়েই চা বানাতে যাচ্ছিলেন। কাঁপা হাতে ঠিক ব্যালেন্স করে উঠতে পারেন নি বিধায় এই কান্ড হয়েছে। সুভাসিনী বেগমকে দেখে খানিকটা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রাখলেন তিনি। খানিকটা কড়া কন্ঠে সুভাসিনী বেগম বললেন,
– যখন পারেন না একা একা কাজ করতে তাহলে অহেতুক কি দরকার ছিলো এসব করে হাতটা পুড়ানোর? দেখি হাতটা কতোটা পুড়েছে
– আমি তো এতোদিন একা একাই থেকেছি, আমার অভ্যাস আছে। আসলে ব্যালেন্সটা রাখতে পারি নি, হাতটা কাঁপছে। আর ধারাকে এই অবস্থায় কিভাবে বলি?
আমতাআমতা করে রাজ্জাক সাহেব বলেন। এবার যেনো আরো তেজী গলায় বলেন সুভাসিনী বেগম,
– আমি কি মরে গেছিলাম? আমাকে বললে কি হতো?
– যার মুখ দেখতে চাও না তার জন্য অহেতুক কষ্ট করার কি দরকার?
মলিন হাসি হেসে কথা বললেন রাজ্জাক সাহেব। সুভাসিনী বেগম আর কোনো কথা বললেন না। চুপকরে তার হাতটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দেন সুভাসিনী বেগম। জীবনের পাঁচ ভাগের চার ভাগ মান-অভিমানে কেটে গেছে। এই শেষ ভাগটা নাহয় মান-অভিমানের অংকগুলোর হিসেবটা চুকিয়ে দেওয়া যাক। সুভাসিনী বেগম রাজ্জাক সাহেবকে চায়ের কাপটা ধরিয়ে শান্ত গলায় বলেন,
– কিছুদিন পর দাদা-দাদী হবো। এখন এসব পাগলামী গুলো করবেন না। বয়স তো হয়েছে।
– আমাকে ক্ষমা করা যায় না সুভা?
– এখনো আমার ক্ষমায় যায় আসে?
– আসে বলেই হয়তো তোমাদের প্রতি মূহুর্তের খবর নিয়েছি। শুধু সাহসটা করে উঠতে পারি নি। সাহসটা যোগাতে যোগাতে জীবনটা মৃত্যুর দাঁড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মরার আগে শুধু তোমার ক্ষমাটা চাই। জানো সুভা তুমি তো তাও তোমার ছেলেকে নিয়ে সবার মাঝে ছিলে। ছাব্বিশ টা বছর একা একা থাকার বেদনা তুমি হয়তো কল্পনা করতে পারবে না। মরে গেলে হয়তো কেউ টের ও পেতো না আমি নামক মানুষটা মরে গেছি।
রাজ্জাক সাহেবের কথাটা শুনে অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো সুভাসিনী বেগমের। অভিমানী গলায় বললেন,
– আপনাকে কি আমি বলেছিলাম একা থাকতে। যার জন্য ছেড়ে গেছিলেন সে কোথায় ছিলো?
– হাহাহা, সুভা তুমি এখনো সেই কিশোরী টি রয়ে গেলে। সাফিয়া তার জীবনে নাতি পুতি নিয়ে সুখে আছে। ও আমাদের মাঝে কোথাও ছিলোই না। ছিলো শুধু ভুলবুঝাবুঝি।
সুভাসিনী বেগম আর কথা বাড়ালেন না। শুধু শান্ত গলায় বললেন,
– এখন থেকে আর ড্রয়িং রুমে থাকা লাগবে না। এমনেই শরীরটা ভালো নেই আপনার।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ধারা সুভাসিনী বেগমের কাছে এসে হাজির হলো। খানিকটা ভাঙ্গা স্বরে বললো,
– ফুপি আমি তোমার সাথে থাকবো আজ থেকে। ফুপাকে আর ড্রয়িং রুমে থাকা লাগবে না। অনলভাই এর সাথেই উনি থাকতে পারবেন।
রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগম নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ধারা আলাদা রুমে থাকতে চাচ্ছে মানে বড় কিছুই হয়েছে তাদের মাঝে। অনল নিজে যদি ধারার রাগ না ভাঙ্গায় তবে এ রাগটা অভিমানে পরিণত হবে, আর অভিমান ভাঙ্গানো কঠিন নয় অনেক সময় দুষ্কর হয়ে উঠে
সন্ধ্যা ৭.৩০টা,
অনল পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরেছে। ঘরে ঢুকতে বাবা-মার সাথে দেখা হয় তার। সুভাসিনী বেগমকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বলেন,
– তোমার রুমেই আছে সে, চাচ্ছিলো আমার রুমে শিফট করতে। কিন্তু আমি বাধা দিয়েছি। দেখো যদি রাগ ভাঙ্গাতে পারো।
অনল একমিনিট দেরি না করে নিজের রুমে চলে যায়। রুমের কোথাও সে নেই; অনলের বুঝতে বাকি নেই ধারা কোথায় আছে। ধীর পায়ে বারান্দার কাছে যেতেই দেখলো ধারা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো খোলা, দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির। সোডিয়ামের লাইটে তার উদাসীন চোখজোড়া খুব ভালো করেই লক্ষ করতে পারছে অনল। গলা খাকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিলো সে। ধারার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না। এখনো সে তার জায়গায় স্থির। এবার অনল ধীর পায়ে এগিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো; শান্ত গলায় বললো,
– আমাকে ফোন দিলি না যে
– দিলে কি হতো
ধারার নির্বিকার প্রশ্নে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো অনল। ধারার দৃষ্টি এখনো বাহিরের দিকে। অনল বুঝলো ধারা অনেকটাই রেগে রয়েছে। এবার ধীর কন্ঠে বললো,
– তুই আমার উপর রেগে আছিস?
– নাতো, রেগে থাকার মতো তো কিছু হয় নি। তুমি যেটা ঠিক মনে করেছো। এতে রাগ হবার তো কিছু নেই।
– তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি তোর উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই নি। আর সত্যি বলতে ও বাচ্চাটির বাবা। আমি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
অনলের কথা শুনে এবার ঘুরে দাঁড়ালো ধারা। ঝাঝালো এবং কাঁপা স্বরে বললো,
– একবার আমার মতামত টা কি নেয়া যেতো না অনল ভাই? আমি কি চাই সেটা জানার কি কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিলো না। সুন্দর মতো আমাকে মিথ্যে বলে নিয়ে গেলে। আমি তোমার স্ত্রী অনল ভাই, ভালোবাসো নাই বা বাসো আমি তোমার স্ত্রী। হোক না সেটা কাগজের। একজন উটকো লোক এসে বললো আর তুমি আমাকে তার কাছে দিয়ে আসলে।
– ধারা, আমার কথাটা তো শোন
– কি শুনবো হ্যা কি শুনবো? আচ্ছা একটা বার তোমার কি বাধলো না দিগন্তের কাছে আমাকে রেখে যেতে। যদি আমি দিগন্তের কাছে যেতে দিতাম তুমি আসলেই আমাকে ওর কাছে যেতে দিতে। আটকাতে না। ওহ হ্যা আটকাবে কেনো? তুমি তো অনন্যা আপুকে ভালোবাসো। আমি তো তোমার আশ্রিতা। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, যদি আমাদের বোঝা মনে হয় তবে বলে দিও আমরা তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিবো তবে এভাবে যার তার কাছে আমাদের দিয়ে এসো না। আমি এতো ফেলনা নই যে…..
ধারা আর কিছুই বলতে পারলো না, তার আগেই তার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁট দিয়ে দখল করে নিলো অনল। আকর্ষিক ঘটনায়……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
২৫তম পর্ব
ধারা আর কিছুই বলতে পারলো না, তার আগেই তার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁট দিয়ে দখল করে নিলো অনল। আকর্ষিক ঘটনায় মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায় ধারার। উষ্ণ ছোয়ার আবেশের চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসে তার। হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে চলেছে ধারার। শিরদাঁড়ায় যেনো উষ্ণ রক্তের প্রবাহ ছুটে যাচ্ছে। অনল তার অতৃপ্ত হৃদয়ের তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত। সময়টা থেমে গেলে হয়তো মন্দ হতো না। দুজন দুজনের আবেশে কত সময় ছিলো তারা নিজেরাও জানে না। যখন অনলের ঠোঁটের কবল থেকে মুক্তি পেলো তখন চোখজোড়া আর তুলতে পারছিলো না ধারা। রাগ তো দূরের কথা, মুখ থেকে স্বর অবধি বের হচ্ছে না তার। মাটির দিকে চোখ রেখে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। বুকের ভেতর যেনো কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে ধারার৷ গাল দুটো টমেটোর ন্যায় লাল হয়ে আছে। ধারা লাজে রাঙা মুখটা যেনো অনলের আরো বেশি ভালো লাগছে। বাঁকা হাসি দিয়ে দুষ্টুমির স্বরে বলে,
– বড্ড বেশি বকিস তুই, এতো বকলে তো মুখ ব্যাথা হয়ে যাবে। অবশ্য এভাবে মুখ বন্ধ করতে আমার আপত্তি নেই। একচ্যুয়ালি ইট উড বি বেটার ফর মি। প্রতিবার তোর নরম ঠোঁটজোড়ার স্বাদ নিতে পারবো।
– অসভ্য পুরুষমানুষ
– হাহাহা
গগণবিদারী হাসি দিয়ে আলতো হাতে ধারার লাজের রাঙা মুখটা তুলে ধরে অনল। কপালে উষ্ণ পরশ একে ধীর স্বরে বলে,
– আর কখনো এমন ভুল হবে না। এই প্রথম আর এই শেষ। কি করবো বল, আমি তো জানতাম না তুই আমাকে ভালোবাসিস। তোকে আটকে রাখার সাহস করে উঠতে পারি নি।
– কে বলেছে আমি তোমায় ভালোবাসি। একদম ভালোবাসি না তোমায়।
অভিমানী গলায় ধারা কথাটা বলে। অনল ও নাছোড়বান্দা আজ ধারার মুখ থেকে তার মনের কথাটা বের করবেই। আরেকটু কাছে এসে ধীর গলায় বলে,
– তাহলে দিগন্তকে ফিরিয়ে দিলি কেনো?
– এম…এমনি, ও যা করেছে তার পরে ওর কাছে ফিরে যাওয়া মানে নিজের আত্নসম্মানের জলাঞ্জলি দেওয়া। তাই
– আর দিগন্ত যে বললো, তুই নাকি ওকে বলেছিস, তুই আমাকে ভালোবাসিস।
– ও.. ওতো এমনি
– সত্যি?
– হু
অনলের গরম নিঃশ্বাস ধারার মুখমন্ডলে আছড়ে পড়ছে। কথাগুলো সব গলাতেই আটকে যাচ্ছে ধারার। নিঃশ্বাস ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে যাচ্ছে। মুচকি হাসি দিয়ে অনল তখন বললো,
– থাক তোর আমাকে ভালোবাসা লাগবে না। আমার একার ভালোবাসাই আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট। তোর মতো কিপটার ভালোবাসা দিয়ে কাজ নেই। হাহ। একবার ভুল করেছি বলে যে প্রতিবার করবো তার তো মানে নেই। এই যে তোকে আটকে রেখেছি সারাটাজীবন এভাবে আমার সাথে বেধে রাখবো। তুই এখন থেকে চাইলেও ছাড়া পাবি না। আমার কাছেই তোকে থাকতে হবে।
– তাহলে ফিরিয়ে দিচ্ছিলে কেনো?
– আমি দ্বিধাতে ছিলাম ধারা
– আমি কি স্ত্রী হিসেবে এতোটা অযোগ্য যে আমাকে কিছুই বলা যায় না?
– এটাই তো ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো হবে। এই কান ধরছি।
বলে কানে হাত দেয় অনল। অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো ধারা,
– ভালোবাসো আমাকে?
– খুব, তোকে হারাবার যন্ত্রণা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তোকে কতোটা ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি
অজান্তেই চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো ধারার। সুখগুলো এভাবে হাতছানি দিবে সেটা যেনো কল্পনার বাহিরে। কাঁপা স্বরে অশ্রুসিক্ত চোখে বলে সে,
– আমার মতো কলঙ্কিনী তোমাকে কিছুই দিতে পারবে না অনল ভাই। যখন আমার কাছে আসবে
– আমি তোর শরীরকে ভালোবাসি নি ধারা। আচ্ছা, একটা কথা বলতো আমি যদি কোনো বিধবা বা ডিভোর্সী কাউকে বিয়ে করতাম তবে এটাই হয়তো তাই না? ভালোবাসাটা কখনোই অন্যায় না, অন্যায়টা ভালোবাসার নামে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলাটা। ভালোবাসা মানে কখনোই শারীরিক সম্পর্ক নয় ধারা। তোরা মেয়েরা এতোটা বোকা কেনো হোস বলতো? অবশ্য এটা তোদের দোষ না। মানুষ তো জীবন দিয়েও ভালোবাসার মানুষটাকে সুখী করতে চায়। সেখানে শরীর তো তুচ্ছ। তোর বয়স অল্প তাই আবেগের বশে ভুল করে ফেলেছিস। আর আমি তো তোর অতীত জেনে, আমার প্রিন্সেসকে মেনেই তোকে ভালোবেসেছি। তাহলের অতীতের তেতোটুকু বাদ দিয়ে আমরা আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎটাকে সাজাতে পারি না?
– হুম পারি।
– তাহলে আর কখনো নিজেকে কলঙ্কিনী বলবি না। আমার ধারা কলঙ্কিনী নয়। আমার সাথে সারাজীবনের পথটুকু চলবি? শুধু কাগজের স্ত্রী নয়, সত্যিকারের স্ত্রী হয়ে।
অনলের কথাটা শেষ হবার আগেই তাকে জড়িয়ে ধরে ধারা। কাঁপা কন্ঠেই বলে উঠে,
– ভালোবাসি
একটা শব্দ অনলের হৃদয়ে শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। ধারাকে যতটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরা যায় ততোটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। সকল অভিমান,রাগ যেনো গলে জল হয়ে গেলো। এখন শুধু ভালোবাসার স্নিগ্ধতা বিরাজমান নিজেদের মাঝে, এটাই তাদের নতুন পথচলার সূচনা
সময় বহমান, দেখতে দেখতে আরো দু মাস কেটে গেছে। ধারার পেটটা আরো খানিকটা বড় হয়েছে। এখন চলাফিরা করতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। অনল তার ডিউটি সকাল সকাল নিয়ে নিয়েছে। যাতে বেশি সময় ধারাকে দেওয়া যায়। বাচ্চাটা পেটেই বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে। ডিলেভারীর সময় যত ঘনিয়ে আসছে অনলের বুকটা ততো ধরপর করছে। সারাটা রাত জেগে থাকে, এই ভয়ে যে যখন তখন পেইন উঠলে যাতে হাসপাতালে নিতে পারে। ধারাও বেশ যত্নশীল হয়ে উঠেছে। সেও চায় সুস্থভাবে বাচ্চাটার ডেলিভারি হোক। সুভাসিনী বেগম এবং রাজ্জাক সাহেবের সম্পর্কটাও বেশ ভালো হয়ে উঠেছে। এখন শুধু অপেক্ষা একটা ছোট মেহমানের বাসায় আসার।
রাত তিনটা,
বাথরুমে যাবে বিধায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে ধারার। অনল তার পাশে ঘুম। ক্লান্ত অনলের ঘুমন্ত মুখটা ধারার সবথেকে প্রিয়। এমনি সময় হলে হালকা ধাক্কা দিলেই অনলের ঘুম ভেঙ্গে যেতো। কিন্তু আজ কেনো যেনো ইচ্ছে হলো না অনলকে জাগাতে। লোকটা প্রচুর খাটাখাটুনি করে। সারাটাদিন ডিউটি করে রাতে তার জন্য জেগে থাকে, একটু ঘুম তার প্রাপ্য। আজ যেহেতু শান্তিতে ঘুমোচ্ছে, ঘুমাক না। এতোটুকুই তো পথ। ধারা একাই যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। অনলের কপালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে খাট থেকে নামে সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বাথরুমের দিকে। সব ঠিক ই ছিলো, গোলটা বাধলো আসার সময়। বাথরুমের বিটটার দিকে আধার আলোতে চোখ যায় নি ধারার। ম্যাক্সিতে বেধে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে সে। অমনি মুখ থুবড়ে পড়ে যায় সে। আর বাথরুমের বিটটা পেটে যেয়ে লাগে। পেট নিচে করে পড়ায় অসম্ভব ব্যাথা পায় সে। চাপা আর্তনাদ করতে থাকে ধারা। আর্তনাদের শব্দ কানে যেতেই ধরফরিয়ে উঠে যায় অনল। ধরফরিয়ে উঠে বাথরুমের কাছে যেতেই দেখে রক্তে ভেসে যাচ্ছে ধারার ম্যাক্সি। পেটে হাত দিয়ে শুধু চাপা আর্তনাদ করছে ধারা। মৃত্যুকে যেনো সম্মুখে দেখছে সে। অনলের মাথাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফাঁকা হয়ে গেছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে। ধারাকে এই অবস্থায় দেখে যেনো সারা শরীর হিম হয়ে গেছে তার। হাত পা কাঁপছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ছুটে গেলো ধারার কাছে। তাড়াতাড়ি তাকে কোলে তুলে নিলো। চিৎকার করে সুভাসিনী বেগম এবং রাজ্জাক সাহেবকে ডাকলো সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা চলে এলো। ধীরে ধীরে গাড়িতে বসালো ধারাকে। সুভাসিনী বেগমের কোলে ধারাকে শুইয়ে শুধু একটা কথা বললো,
– ধারা চোখ বন্ধ করবি না। একটু সময় দে।আমরা পৌছে যাবো।
বলেই ছুট লাগালো হাসপাতালের দিকে। সময়টা যেনো প্রতি মিনিট এক এক বছর লাগছে অনলের কাছে। অপেক্ষা শুধু তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌছানোর।
ভোর ৪টা,
ধারাকে ওটি তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধারার ডাক্তারকে আনানো হয়েছে। তিনি ধারার পজিসন চেক করছে। বাহিরের সিটে বসে আছে অনল। হাতটা ধারার রক্তে লাল হয়ে আছে। ধারার জ্ঞান ওটিতে যাবার আগ পর্যন্ত ছিলো। অনলের হাতটা শক্ত করে ধরে ছিলো সে। চোখটা বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অনন্যাকে নিয়ে একদিন এভাবেই হাসপাতালের বাহিরে বসে ছিলো। আজ ধারাকে নিয়ে। বুকটা কামড় দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। বুকটা হাহাকার করছে। তখন ই ডা. ইশরাত বের হয়ে আসে। তার মুখটা আশংকায় ছোট হয়ে আছে। তার মুখ দেখেই কিছু একটা আশংকা করতে পারছে অনল। উদ্বিগ্ন হয়ে অনল তার কাছে ছুটে গেলো।
– ম্যাম কি হয়েছে? ধারার অবস্থা এখন কেমন?
– ভালো না অনল। কারোর অবস্থা ভালো না। এখনি অপারেশন করতে হবে। ব্লাড এর দরকার আছে। আর একটা কথা, বেবির পসিজন ভালো না। এখন তোমাকে ডিসিশন নিতে হবে হয় ধারা নয় বেবি।
কথাটা শুনতেই ধপ করে বসে পড়ে অনল। চোখ থেকে পানি পড়ছে। কি করবে এখন সে। এই বাচ্চাটা যে তার এবং ধারার বেঁচে থাকার একটা সূত্র ছিলো। তাদের সম্পর্কের সূত্রপাত ই হয়েছে এই বাচ্চাটার জন্য। আর ধারা তো তার ভালোবাসা। কিভাবে তার প্রিন্সেস আর ধারার মধ্যে বাঁচবে সে। ডা. ইশরাত বেশ জোর গলায় বললেন,
– অনল ফাস্ট ডিসিশন নাও। উই হ্যাভ টু ওপারেট।
– ম্যাম আমি তাদের মধ্যে কিভাবে বাছবো। তারা দুজন আমার কাছে সমানভাবেই জরুরি। দুজনকেই যে আমার চাই ম্যাম। আমি বাঁচতে পারবো না ওদের ছাড়া।
– বাট আমি শিওর নই অনল। বেবির যা পজিশন আমার মনে হয় না দুজনকে বাঁচামো সম্ভব। যদি না আল্লাহ কোনো মিরাকেল করেন।
– ম্যাম আমি কাউকে চুজ করতে পারবো না। প্লিজ ম্যাম, আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করেন ম্যাম।
– ওকে তাহলে তুমি ফর্মে সাইন করে দাও।
বলেই তিনি ভেতরে চলে যান। একজন নার্স এসে একটা ফর্ম নিয়ে এসেছে। অনলের হাত কাঁপছে, সাইন করার সময়। সুভাসিনী বেগম তখন তার ঘাড়ে হাত দেয়। অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে অনল বলে,
– মা, আমার ধারা
– কিচ্ছু হবে না দেখিস, তুই আল্লাহ এর কাছে চা। উনি ই পারবেন তোর ধারাকে ফিরিয়ে দিতে।
সুভাসিনী বেগমের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইন করে দেয় অনল। ওটি তে অপারেশন শুরু হয়। প্রতিটা মূহুর্ত যেনো এক এক ক্রোশ সময় লাগছে অনলের কাছে। নামাযের পাটিতে বসে পাগলের মতো সে বাচ্চাটি এবং ধারার জন্য। অনলের যে দুজনকেই চাই। চারঘন্টা পর ডা.ইশরাত ওটি থেকে বের হয়। উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় অনল। তখন ডা.ইশরাত বলেন…….
চলবে
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
২৬তম পর্ব
চারঘন্টা পর ডা.ইশরাত ওটি থেকে বের হয়। উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় অনল। তখন ডা.ইশরাত বলেন,
– কনগ্রেচুলেশন অনল, মেয়ের বাবা হয়েছো তুমি। নার্স বেবিকে নিয়ে আসছে। বেবি সুস্থ আছে। ব্লাড লেগেছে প্রচুর বাট ইন্টার্নাল আর এক্সটার্নাল কোনো ড্যামেজ হয় নি আল্লাহর রহমতে।
– ম্যাম, আমার স্ত্রী
– অনল ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং ওকে?
– ম্যাম, ইজ সি ওকে? ও ঠিক আছে তো?
– অনল রিল্যাক্স। ঠান্ডা হও। এটা একটা মিরাকেল ই বলতে পারো। আমি ভেবেছিলাম শুধু বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে। কয তোমার স্ত্রীর প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। বাট রাখে আল্লাহ মারে কে! সে বেঁচে আছে, এখনো হোপ আছে। বাট আপাতত জ্ঞান নেই, জ্ঞান না ফিরা অবধি কিছু বলতে পারছি না। এটাও তো কম নয় বলো। আই.সি.উ তে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে ওর।
– ও বেঁচে যাবে তো?
– অনল, ডাক্তারদের ১০% চান্স মানে হিউজ ব্যাপার। প্রথমে ০% ছিলো এখন ১০% তো আছে। দোয়া করো যাতে এই ডেঞ্জার টাইমটা তার কেটে যায়। সে এক রকম কোমাতে আছে। জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছুই বলতে পারছি না। তবে আমি হোপ ছাড়ছি না। আর আজ তোমার ওয়াইফের উইলপাওয়ারের জন্য সে বেঁচে আছে। সো তুমিও হোপ ছেড়ো না। ওকে? ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং। তোমার বেবিকে তো সামলাতে হবে নাকি?
ডা.ইশরাতের কথা শুনে ধপ করে আবার বসে পড়লো অনল। পা জোড়া যেনো জোর হারিয়ে ফেলেছে। ধারা বেঁচে আছে জেনে যতটা খুশি লাগছে যখন মনে হচ্ছে সে কোমাতে মনটা নিমিষেই দুঃখের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু এখন সত্যি ভেঙ্গে পড়ার সময় না। ধারা অন্তত বেঁচে তো আছে। এখনো আশা হারায় নি। এমন ও তো হতে পারে কিছুক্ষণ পর ই সে চোখ খুলবে, খুলে বলবে,
– অনল ভাই, আমি ফিরে এসেছি। ফিরে এসেছি তোমার কাছে। তোমার প্রিন্সেস সহ।
কথাটা ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বের হলো মন থেকে। তখন একটা নার্স সাদা তোয়ালে মোড়া একটা ছোট্ট পরীকে নিয়ে এলো অনলের কাছে। মুখে হাসি একে বললো,
– স্যার আপনার মেয়ে।
অনল বেকুবের মতো বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ছিলো। সুভাসিনী বেগম এবং রাজ্জাক সাহেব তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অনুভূতিগুলো কেমন যেনো গবলেট হয়ে আছে। নতুন প্রাণের আগমণটাকে হাসিমুখে বরণ করার মতো মনটাও নেই। অনল তখন উঠে দাঁড়ায়। আস্তে করে নার্সের হাত থেকে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে নেয়। একটা ছোট্ট ধারা যেনো তার কোলে ছিলো। ধারার মতো মুখ, ধারার মত নাক, কুচকুচে কালো চুল তার মাঝে শুভ্র মুখখানি। শুধু চোখ দুটো হয়েছে দিগন্তের মতো। এব্যাতীত পুরো ধারা। সহস্র চুমু দিয়ে কাঁপা কন্ঠে অনল বললো,
– প্রিন্সেস, তোমার আম্মুটা আমাকে জ্বালানো বন্ধ করলো না। দেখো না, কোথায় তুমি আসছো আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলি হবার কথা। সে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ডোন্ট ওয়ারি। আমরা তাকে ঠিক ঘুম থেকে উঠাব দেখো। পারবো না আমরা? তোমার বাবা অনেক হোপলেস হয়ে গেছে, তুমি একটু আমার সাহস হয়ে থেকো ওকে? এখনো অনেক পথ চলা বাকি যে
বলেই বাচ্চাটাকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে। ছেলেটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে রাজ্জাক সাহেব আর সুভাসিনী বেগম ও চোখের বাধ ছেড়ে দেয়। অনন্যার মৃত্যুর পর সুভাসিনী বেগম কখনোই অনলকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে নি। অনল কাঁদলেও আড়ালে কেঁদেছে, নয়তো শুধু ধারার সামনে। কিন্তু আজ ধারার সামনেও কাঁদার অপশন নেই, এটাকেই হয়তো নিয়তি বলে
সময় যেতে থাকে, জুলাই এর প্রথম সপ্তাহ চলছে। একদিন দুদিন করে দশটা দিন কেটে যায়। ধারার হেলথ এর ডেভেলপমেন্ট হতে থাকে। কিন্তু জ্ঞানটা এখনো ফিরে নি। অনল সারাটাদিন ধারার পাশেই বসে থাকে। ডাক্তার হবার এই এক সুবিধে, আই.সি.উ তে এলাউ করা হয়েছে। আর ও যেহেতু এই হাসপাতালেই কাজ করে তাই সমস্যা হয় নি। মেয়ের নাম রেখেছে অধরা। অনল এবং ধারার মেয়ে অধরা। সারাদিনের সব আপডেট ধারাকে বলে অনল। মেয়েকে ফাঁকে ফাঁকে দেখেও আসে। আই.সি.উ এর বাকি প্যাসেন্টরাও চায় যাতে মেয়েটা জেগে উঠে। আর অনল সে আর কাঁদে না, যতই কষ্ট হোক সে একেবারেই কাঁদে না। শুধু প্রতিক্ষা করে রয়েছে কবে তার বউটি জেগে উঠবে
রাত ২টা,
ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির জন্য বাসায় যাওয়া হয় নি অনলের। রাতেও ক্লান্ত হয় নি আকাশ, বরং তীব্র গতিতে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা হীম বাতাসে চোখটা লেগে এসেছে অনলের। ধারার জেগে উঠার আশার আলোটা ক্ষীণ হচ্ছে আর মনটা ক্লান্ত। হঠাৎ মনে হতে লাগলো তার হাতে ধীর ছোয়া লেগেছে। তন্দ্রা কাটিয়ে চড়াক করে উঠলো অনল। মনের ভুল নাকি সত্যি কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ধারার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ঘুমানোটা অভ্যেস হয়ে গেছে তার। ঘুমের মধ্যেই মনে হলো আংগুলগুলো নড়েছে। এখন এই ছোয়াটা কি ঘুমের মাঝে ভুল করেই অনুভব হলো? এক মন দিয়ে ধারার দিকে খেয়াল করলো। সময় পার হচ্ছে আর অধৈর্য হয়ে পড়েছে অনল। হুট করে মনে হলো ধারার হার্ট বিট ধুম করে কমে যাচ্ছে। পালস রেট যেন কমে যাচ্ছে। বুকটা কামড় দিয়ে উঠলো অনলের। তাড়াতাড়ি ওয়ার্ডবয়কে ডাকলো সে। অনন্যার মতো একই রকম অবস্থা হচ্ছে। কিন্তু রিপোর্টস তো ধারার ঠিক ছিলো। কি হচ্ছে এটা। সময় নষ্ট না করে সি.পি.আর দিতে লাগলো অনল। না হার্ট বিট বাড়ছেই না। বরং কমেই যাচ্ছে। অনল থামলো না। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে সে। একটা সময় চিৎকার করতে লাগলো সে,
– প্লিজ ধারা, আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি মরে যাবো। আমি সত্যি মরে যাবো। ধারা প্লিজ স্টে উইথ মি।
এটা একটা মিরাকেল, হয়তো এটা ভালোবাসার একটা কঠিন পরীক্ষা। আবার ও রাখে আল্লাহ মারে কে। তিড়িক করে চোখ মেললো ধারা। যেনো কেউ পিটিয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। তাড়াতাড়ি অক্সিজেন লেভেল বাড়িয়ে দেয় অনল। হার্টবিট আবার ও নরমাল হয়ে উঠে ধারার। ধারা এভাবে চোখ খুলবে এটা যেনো কল্পনার বাহিরে ছিলো। অনলের এখনো হাত কাঁপছে। তার ধারা চোখ খুলেছে। তার ধারার জ্ঞান ফিরেছে। ফাইনালি, তার ধারা ফিরে এসেছে। ধারা এখনো আশেপাশের জগতে অভ্যস্ত নয়। চোখ দিয়ে আশেপাশে দেখছে আর ধাতস্থ হবার চেষ্টায় আছে সে। মিনিট বিশেক পর অক্সিজেন মাস্কটা নামিয়ে দেয় সে। অনল অশ্রুসিক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার প্রাণটা এতোক্ষণ গলায় আটকে ছিলো। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না সে, ধারার ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। এতোদিনের জমানো কষ্ট গুলো যেনো আর ধরে রাখতে পারলো না। বাহিরে বর্ষনের ন্যায় তার চক্ষুযুগল বর্ষনে ব্যস্ত। ধারার ঘাড় ভিজে যাচ্ছে। ধীর গলায় ধারা বললো,
– ছেলেমানুষের এভাবে কাঁদতে আছে?
– তুই চুপ করে থাক। বেয়াদব মেয়ে, থাপড়ে কান লাল করে দিবো তোর। জানিস কি ভয়টা পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুই ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবি। আমি মরে যেতাম ধারা, সত্যি বলছি। এই মনটা আর ভার নিতে পারবে না। তুই তো জানতি
– অনেক কষ্ট দিয়েছি না?
– অনেক, অনেক, অনেক। আমাকে আর কত জ্বালাবি বল তো?
– যতদিন আল্লাহ হায়াত রেখেছেন
– এভাবে জ্বালাস না, তোর সব আবদার মেনে নিবো। এভাবে ভয় দেখাস না। বয়স তো কম হলো না বল। আমার গলা শুকিয়ে এসেছিলো জানিস
নার্স কিছু বলতে যাবে, ধারা চোখ দিয়ে ইশারা করে। সে জানে তার এই পাগল প্রেমিকটা একটু এমন ই। অনলের পিঠে হাত রেখে বললো,
– তোমার প্রিন্সেস ভালো আছে তো?
ধারার কথায় উঠে বসে অনল। চোখ মুছে ধারার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে। ধীর গলায় বলে,
– বাপকা বেটি পুরো বাপের মতো হয়েছে জানিস, সারাক্ষণ ঘুমায়। খুব তাড়াতাড়ি ইনশাআল্লাহ আমরা তার কাছে যাবো৷ আমি ওর নাম রেখেছি। অধরা।
– অধরা, তুমি জানলে কি করে?
– তোর ডাইরি তে পড়েছিলাম।
– তুমি তো মানুষ ভালো না আমার ডাইরিতে হাত দাও।
– ভালো হইছে। আর কথা বলিস না। একটু রেস্ট কর
– এতোদিন তো তাই করেছি গো, আজ একটু কথা বলতে দাও
এভাবে সারাটারাত ধীরে ধীরে কথা বললো এই দম্পতি। সকালের দিকে ধারা ঘুমালো। তবুও অনল আশ্বস্ত হতে সব রিপোর্ট আবার চেক করালো। যখন সব কিছু নরমাল হলো তখন স্বাভাবিক হলো সে। আর দুদিন হাসপাতালে রাখবে ধারাকে। আজ বিকেলেই নরমাল ওয়ার্ডে শিফট করবে। এখন আর অক্সিজেন লাগছে না ধারা। চলাফেরা হালকা হালকা করছে। ব্লিডিং হচ্ছে বলে শরীরটা দূর্বল। আজ অধরাকে নিয়ে আসবে সে ধারার কাছে। মাতৃত্বের আঁচল থেকে টানা দশটা দিন আলাদা ছিলো বচ্চাটি। দুদিন পর ডাক্তার তাকে চেকাপ করে রিলিজ দিয়ে দেওয়ায় বাসায় নিয়ে গেছিলো অনল। সুরাইয়া বেগম এবং সুভাসিনী বেগম ই দেখেছেন তাকে। এখন বাচ্চাটি তার মায়ের উষ্ণতা পাবে। মায়ের গায়ের গন্ধ ই আলাদা। সেই গন্ধ বাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয়। কি অদ্ভুত একটা দৃশ্যই না হবে, তার বউ এবং মেয়েকে একত্রে কাছে পাবে অনল। এতোদিনের অতৃপ্ত মনটা যেনো তৃপ্ত হবে। আর এখনো যে তার আরো একটি কাজ করা বাকি, সেটা না হয় সময় হলেই জানাবে ধারাকে।
বিকেল ৪টা,
ধারাকে নরমাল ওয়ার্ডে শিফট করা হয়েছে। অধরাকে নিয়ে এসেছে অনল। যখন অধরাকে ধারার কোলে দিলো মেয়েটা একেবারে চুপ করে গায়ের সাথে মিশে ছিলো। আগে একটা সময় ধারা বাচ্চা কোলে নিতে ভয় পেতো, এতো ছোট বাচ্চা যদি পড়ে যায়। আজ ও খুব সাবধানতার সাথে ধরলো। নরম তুলতুলে হাত পা হালকা ছুটাছুটি করছে। ধারার ভয় দেখে অনলও ধারার পেছনে বসলো। পেছন ধরলো তার পরিবারকে। ধারার যেনো বিশ্বাস ই হচ্ছে না, যাকে বাঁচানোর এতো লড়াই তারা করেছে, সেই বাচ্চাটা আজ তার কোলে। আলতো করে চুমু খেলো অধরার কপালে। অনলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ধন্যবাদ
– কষ্ট তো তুই করেছিস, তোকে ধন্যবাদ। আমাকে আমার প্রিন্সেস দেবার জন্য। আমার কাছে ফিরে আসার জন্য।
– তোমাকে ধন্যবাদ, আমার পাশে থাকার জন্য।
মুচকি হাসি হেসে ধারার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো অনল। আবেশে চোখে বন্ধ করে অনলের কাঁধে মাথা রাখলো। এটা যেনো পৃথিবীর সবথেকে শান্তির জায়গা। তার কোলে তার সন্তান। আর তার স্বামী তাকে আগলে রেখেছে। এই সময়টা যদি থেমে যেতো মন্দ হতো না।
সময় বহমান, দিন দিন করে মাস চলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে জুলাই শেষে আগষ্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাস চলে গেছে। নভেম্বর এ পা রেখেছে পৃথিবী। কার্তিক মাস শেষে অগ্রহায়ণ মাস চলে এসেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে ব্যস্ত ঢাকা শহরে। অধরা এখন চার মাস হবে হবে করছে। মজার ব্যাপার, দেখতে দেখতে ধারা এবং অনলের বিয়ের একটা বছর হতে যাচ্ছে। এক বছর আগে এই নভেম্বরেই তাদের বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু স্ত্যি বলতে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটি তাদের মাঝে এখনো তৈরি হয় নি। একই রুমে তো থাকে কিন্তু তাদের মাঝে শারিরীক সম্পর্ক তৈরি হয় নি। আজকাল আজকাল অনলের মাঝে বিস্তর পরিবর্তন দেখা গেছে। হালকা হলেও ধারা উপলব্ধি করতে পারছে। আগে অনল হাসপাতালে যাবার আগে মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ খেলে ধারার কপালে চুমু খেয়ে তারপর যেতো। আসার পর ও একই তার মেয়ের সাথে খেলে, তাকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর ধারাকে সারাটাদিনের সব কথা বলতো। মেয়েও হয়েছে বাবা পাগল, বাবা ছাড়া সে ঘুমাতেও চায় না। মেয়ে ঘুমাবার পর দুজন বারান্দায় বসে কফিহাতে জ্যোৎস্না বিলাষ করতো। কিন্তু আজকাল অনলের যেনো ধারার সাথে কথা অবধি বলার সময় হচ্ছে না। এসে মেয়েকে সময় দিয়েই শেষ। ধারা যখন নিজ থেকে কিছু বলতে যায় তখন একটা অনীহা দেখাচ্ছে। ধারা যেনো কিছুতেই বুঝে উঠছে না কি হচ্ছে। নাহ এভাবে থাকা যায় না। অনলের পরিবর্তনটা যেনো বড্ড বেশি চোখে লাগছে ধারার। রাতের খাবার পর সব গুছিয়ে রুমে আসে ধারা। অধরা তখন অনলের কোলে ঘুম। ধারাকে দেখে অধরাকে খাটে শুইয়ে দেয় অনল। এরপর বারান্দায় চলে যায়। অনলের এই কাজটা যেনো ধারার বড্ড বেশি চোখে লাগছে। সে কি কোনো ভুল করেছে! বুঝে উঠতে পারছে না। ধারাও দেরি না করে অনলের পিছু নিয়ে বারান্দায় আসলো। অনল তখন পকেটে হাত গুজে বাহিরে তাকিয়ে আছে। এবার ধারা আর আর থাকতে পারলো না। বেশ স্পষ্ট স্বরে বললো,
– অনলভাই কি হয়েছে?
– কি হবে?
অনলের নির্বিকার চিত্তে বলা কথাটা যেনো আরো মেজাজ খারাপ করিয়ে দিলো ধারার। হিনহিনে গলায় বললো,
– কি হয়েছে বুঝছো না? তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো?
– এড়িয়ে যাচ্ছি মানে?
– তুমি কদিন ধরেই দেখছি অনেক বদলে গেছো! একটু বলবে কি হয়েছে? আমি কি কোনো দোষ করেছি? আমি যেনো মূহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেছি তোমার কাছে। আমার রান্না তুমি মুখে তুলছো। রাতে ঘুমানোর সময় দেখি তুমি খাটে শুচ্ছো না, ড্রয়িং রুমে চলে যাচ্ছো। আমি কথা বলতে আসলে ঠিক মুখে কথাও বলছো না কি হয়েছে বলবে?
এবার অনল একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
– তুই বুঝতে পারবি আমি বুঝেছিলাম, আসলে লুকিয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারছি না। তুই যেহেতু সত্যিটা জানতে চাচ্ছিস আমি তাহলে বলি, আমি ক্লান্ত ধারা। আমি এই কাগজের সম্পর্কটা টানতে টানতে ক্লান্ত। আমার মুক্তি চাই। কেনো যেনো এই সম্পর্কটাকে আর ভালো লাগছে না।
– মানে?
অধীর কন্ঠে বললো ধারা। তার গলা কাঁপছে। তার সুখের সংসারটাকি এভাবে ভেঙ্গে যাবে? অনল ভাবলেশহীন ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে একটু এগিয়ে আসলো। ধারার মুখোমুখি হয়ে বললো,
……………….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের তুমি আমি
দ্বিতীয় অধ্যায়
অন্তিম পর্ব
অধীর কন্ঠে বললো ধারা। তার গলা কাঁপছে। তার সুখের সংসারটাকি এভাবে ভেঙ্গে যাবে? অনল ভাবলেশহীন ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে একটু এগিয়ে আসলো। ধারার মুখোমুখি হয়ে বললো,
– মানেটা স্পষ্ট আমি এই সম্পর্কে হ্যাপি না। একটা সম্পর্ক যেটা নামে মাত্র সম্পর্ক সেই সম্পর্কটা কতদিন টানা যায় বল? এভাবে আমি আর পারছি না। তাই বলছি কি
– তুমি কি ডিভোর্স চাচ্ছো?
– হ্যা?
– আমি কি দোষ করেছি অনলভাই? তুমি তো বলেছিলে তুমি আমার হাত কখনো ছাড়বে না, তাহলে কি এমন করেছি আমি?
– তুই কিছু করিস নি ধারা, দোষটা আমার। আমি ই বুঝতে পারি নি। আসলে আমাদের সম্পর্কের তো কোনো ভিত্তি ই নাই। একিটা সম্পর্ককে এভাবে টানাটা সত্যি আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।
– আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি নেই? সত্যি কি নেই অনলভাই? আমাদের মাঝে কি ভালোবাসার গভীরত্ব নেই নাকি বোঝাপড়া নেই? তুমি তো বলেছিলে তোমার ভালোবাসা আমাদের দুজনের জন্য এনাফ হবে।
– ভুল বলেছিলাম। এখন আমি আর এভাবে সম্পর্কটা টানতে পারছি না। আমি চাইলেও তোর কাছে আসতে পারছি না। তুই কি সত্যি আমাদের মাঝের অদৃশ্য দেয়ালটা দেখতে পাচ্ছিস না ধারা।
ধারা এবার চুপ মেরে গেলো। সে নিজেও এই দেয়ালটা বুঝতে পারছিলো। কেনো যেনো চাইলেও এই দেয়ালটা ভেদ করা হয় নি তাদের দুজনের। ধারার চোখ ছলছল করছে। হয়তো তার আর অনলের পথচলাটা এটুকুই ছিলো। অনল যখন তার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছে তবে তাই হোক। কাঁপা স্বরে বললো,
– তুমি কি সত্যি মুক্তি চাও?
– হু
– বেশ তাহলে, তোমার যেটা ভালো মনে হবে করো। আমি কাল ই অধরাকে নিয়ে মার বাড়ি চলে যাবো।
– কাল যেতে হবে না, কালকে উকিলের কাছে যাবো। তারপর অধরাকে নিয়ে ও বাড়ি চলে যাস।
ধারা অবাক চোখে অনলকে দেখে যাচ্ছে। যে লোকটা অধরাকে বাদে এক মূহুর্ত থাকতে পারে না আজ সেই লোকটা অধরাকে আটকাতেও চায় নি। টুপ করে পানির কণাটা চোখ থেকে পড়লো ধারার। এর থেকে তো মরে গেলেই ভালো হতো। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়েছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু না সে কাঁদবে না। সে কোনো খেলনা নয় যে বারবার মানুষের খেলার পাত্র হবে। অনল যখন মুক্তি চাচ্ছে তবে তাই হবে। মুক্তি দিবে সে তাকে। মেয়েকে নিয়ে একেবারেই কাল বের হবে। আর এ বাড়ি মুখো হবে না সে। বাবা-মা যদি আশ্রয় দেয় তো ভালো নাহলে সেদিক চোখ যাবে সেখানে চলে যাবে। ধারা কথা বাড়ালো না, ধীর পায়ে রুমে চলে গেলো। মেয়েটাকে কোলের মধ্যে নিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলো। অনলের দিকে পিঠ করে শোয়ায় তার মুখটা দেখতে পাচ্ছে না অনল। সারাটা রাত নির্ঘুম কাটলো ধারার। চোখের পানিটা বাধ মানছে না। ফজরের আযান শুনে উঠে বসলো। মাথায় উল্টোপালটা অনেককিছু ঘুরছে। একবার ভাবলো এখনই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। মুক্তি ই তো অনল চায়। পর মূহুর্তে নামায পড়ে নিজেকে শান্ত করলো। খুব কান্না পাচ্ছে। নিজেকে সামলানোটা দায় হয়ে গেছে। না সে ভেঙ্গে পড়বে না, সেও দেখবে অনল কিভাবে তাকে ডিভোর্স দেয়। তার ভালোবাসা কি এতোটা ঠুনকো। নিজেকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করলো ধারা। এখন শুধু বিকেলের অপেক্ষা।
দুপুর ৩টা,
অধরা দুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে। ধারা তখন বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মৃদু বাতাসে চুল উড়ছে। তখন রুমে অনল আসলো। হিনহিনে গলায় বললো,
– চল উকিলের কাছে যাবার সময় হয়ে এসেছে।
– হুম
ধারার আচারণ বেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কোনো কথা নেই শুধু চুপ করে পুতুলের মতো মাথা নাড়িয়ে রুমে আসলো। অনল ও বাড়তি কথা বললো না। অনল একটা গোলাপি শাড়ি কিনে দিয়েছিলো অধরা হবার পর। সেই শাড়িটাই গায়ে জড়িয়ে নিলো সে। আজ কেনো যেনো খুব সাজতে ইচ্ছে হচ্ছে। অনলের জন্য কখনো সেভাবে সাজা হয় নি। চুলগুলো খোপা বাঁধলো সে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিলো, চোখে গাড় কাজল। বেশ মানিয়েছে সাজটা ধারাকে। সব কাপড় গুছিয়ে নিলো। সাথে অধরার ও। যাবার আগে একবার রুমটা ভালো করে দেখে নিলো সে। এই রুমে কত স্মৃতি না তার আর অনলের। একটা বছরের স্মৃতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ালো গন্তব্যের দিকে। বাহিরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনল। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট কি চমৎকার লাগছে তাকে। লোকটা কি জানে তার এক ঝলক ধারার সারাটাদিনের ভালোথাকার খোরাকি। ধারাকে আসতে দেখে এগিয়ে এসে ব্যাগটা গাড়িতে তুললো সে। অধরা ধারার কোলে ঘুম। অনলকে এক নজরে ধারা দেখে যাচ্ছে, যেনো আগামীর খোরাকি জমাচ্ছে। অনল শুধু আড়চোখে ধারাকে দেখে যাচ্ছে। তবে কিছু বলছে না। ধারাকে সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে। গাড়িতে বসে গাড়িটা স্টার্ট দেয় অনল। ধারা কাঁচের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে। আর অনলকে দেখবে না সে। তাহলে আর তার থেকে আলাদা হতে ইচ্ছে হবে না। বুকটা ক্ষনে ক্ষনে ব্যাথা করছে। দমটা বন্ধ বন্ধ লাগছে। মনটা যে বড্ড বেহায়া।
অনল ধারাদের বাসায় আগে গেলো। অধরা আর ব্যাগ পত্র রেখে এলো। ধারা অবাক হলো তার মা কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। তাহলে কি তিনিও জানেন। অনলকে জিজ্ঞেস করতেই অনল বললো,
– অধরাকে নিয়ে যাবি উকিলের কাছে নাকি? পাগল তুই? ও মামির কাছে থাক। এক ঘন্টার ই তো ব্যাপার। তুই তো ওকে খাওয়েছিস।
ধারা আর কথা বাড়ালো না। গাড়ি আবার ও চলতে লাগলো। যত পথ কাটছে ধারার কষ্টগুলো তত বাড়ছে। মনে হচ্ছে পালিয়ে গেলেই ভালো হতো, অন্তত সম্পর্কটা তো থাকতো। তার দোষটা কোথায় এখনো খুজে পাচ্ছে না। হঠাৎ ব্রেক কষায় হুশ ফিরলো ধারার। খেয়াল করলো তারা একটা হোটেলের সামনে।
– এখানে কি করবো আমরা?
অনলকে জিজ্ঞেস করে বসে সে। অনল বিরক্তি দেখিয়ে বলে,
– উকিল এখানে দেখা করতে বলেছে। আসলে আমার বন্ধু তো। তুই ভেতরে যা আমি পার্ক করে আসতেছি।
অনলের কথা শুনে গাড়ি থেকে নামলো ধারা। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রেস্টুরেন্টের দিকে। রেস্টুরেন্টে পা রাখতেই খটকা লাগলো ধারার। পুরো রেস্টুরেন্টটা সুন্দর করে সাজানো এবং আর স্টাফ বাদে কেউ নেই। পেছনে ফিরতেই দেখে অনল হাটু গেড়ে বসে রয়েছে রিং হাতে। ব্যাপারটা ধাতস্থ হতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো ধারার। অনল ঠোঁটের কোনায় হাসি একে বললো,
– আমি আর কাগজের সম্পর্ক টানতে চাই না ধারা। আমি এই কাগজের সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই। এবার সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাই তোকে, শুধু সমাজের জন্য নয়, শুধু দায় এড়াতে কিংবা আশ্রয়ের জন্য নয়; ভালোবাসার জন্য। করবি আমাকে বিয়ে?
ধারা এবার তেড়ে আসলো অনলের কাছে। কলার চেপে ধরে দাঁড় করায় তাকে। ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দেয়। অনল হা করে তাকিয়ে আসে ধারার দিকে। ভেবেছিলো ধারা হয়তো তাকে জড়িয়ে ধরবে। আসলে বিগত সপ্তাহ থেকে কলিগদের সাথে মিলে এই কাজটা করে সে। এই আইডিয়াটা শামীম তাকে দিয়েছিলো। এভাবে যদি প্রপোজটা করে তাহলে ধারা অবাক হয়ে যাবে। কিন্তু উলটো হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে ধারা বললো,
– ফাজলামি করো তুমি আমার সাথে? ফাজলামি করো? কি ভাবো তুমি আমাকে? কাল সারারাত আমার উপর কি কেটেছে জানো তুমি? এখন আসছো ঢং করতে। তুমি জানো আমি ভেবেছিলাম একবার বাড়িটা ছেড়ে দিবো। তোমার কোনো আইডিয়া আছে। ডিভোর্সের কথা ভাবতেই আমার জাস্ট দুনিয়া নাই হয়ে গেছিলো। খুব আমার থেকে মুক্তি চাই না তোমার? একদিন সত্যি সত্যি হারিয়ে যাবো দেখো
বলতে বলতে কেঁদে দেয় ধারা। অনল তখন তাকে জড়িয়ে ধরে। আর ইচ্ছেমত কিল ঘুষি মারতে থাকে অনলকে ধারা। অনল তখন ধীর গলায় বলে,
– সরি, আমি সত্যি বুঝি নি। একটু এক্ট্রা হয়ে গেছে সরি। এটা আমার আইডিয়া না, শামীম বললো এভাবে বিয়ের প্রপোজালটা দিলে তুই খুশি হবি।
– করবো না বিয়ে তোমাকে, ছাড়ো, ছাড়ো
– সরি সরি। আসলে তোকে সারপ্রাইজ দেবার প্লান ছিলো। কিন্তু প্লানটা গোলমেলে হয়ে গেছে সরি। আর তুই ভাবলি কি করে তোকে ডিভোর্স দেবার কথা ভাববো আমি। তুই আমার নিঃশ্বাসে মিশে আছিস। তোকে ছাড়া একটা মূহুর্ত কাটানো দুষ্কর। ভাবলি কি করে আমি তোকে ডিভোর্স দিবো।
অনল আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধারাকে।ধারাও তার বুকের সাথে মিশে থাকে। কালো অন্ধকার মেঘ সরে যেমন উজ্জ্বল সূর্য দেখা যায়, ধারার হৃদয়ের কালো মেঘ গুলো ও যেনো মূহুর্তে সরে গেলো। একটা অজানা তৃপ্তিতে মনটা ভরে গেলো তার। সেখান থেকে ধারাদের বাড়িতেই রেখে এলো তাকে অনল। যাবার সময় শুধু বললো,
– খুব তাড়াতাড়ি তোকে আমার করে আমার ঘরে নিয়ে যাবো রেডি থাকিস
এক সপ্তাহ পর,
ফুলের বিছানায় বসে রয়েছে ধারা। গায়ে সেই লাল বেনারসি। আজ আবার অনলের বউ হয়ে এ ঘরে বসে আছে। পার্থক্য একটাই এখন আর কাগজের সম্পর্কটা নেই। আছে সত্যিকারে সম্পর্ক। অধরাকে দুধ খাইয়ে সুভাসিনী বেগমের কাছে রেখেছে। সুভাসিনী বেগম আশ্বস্ত করলেন তিনি দেখে রাখবেন নাতনীকে। বুকটা আগের মতোই টিপটিপ করছে। সত্যি বলতে এটাই তো তাদের প্রথম বাসর। দরজা ঠেলার শব্দে মুখ তুলে তাকায় সে। অনল এসেছে, গোল্ডেন শেরওয়ানিতে খুব মানিয়েছে তাকে। অনল পাশে বসতেই বুকের ধুকপুকানি যেনো আরো বেড়ে গেছে। অনল ধীরে হাতটা ধরে ধারার। ধীরগলায় বলে,
– সারারাত পৃথিবীতে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে, স্থির জানি, তুমি দেবে ক্ষমা
তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর
কবিতাটার অর্থ জানিস?
– উহু
লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে ধারা বলে। অনল আলতো হাতে ধারার মুখটা ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তারপর কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে বলে,
– আমি তোর মাঝে বিলীণ হতে চাই, তোর নেশায় মত্ত হতে চাই। তোর সান্নিধ্যে নিজেকে উজার করে দিতে চাই। অনুমতি আছে?
-……
ধারা আর কোনো কথা বলতে পারে নি। বাহিরের আবহাওয়া স্তব্ধ, ধারাও অনলের মাঝে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। রাতের গভীরতার সাথে দুটো দেহের মিলনের গভীরত্ব ও বাড়ছে। নিঃশ্বাসের উম্মাদনা চলছে রুমের মাঝে। দুটো অতৃপ্ত হৃদয় নিজেদের তৃপ্তি মেটাতে ব্যস্ত। এই মিলনে নেই কোনো অন্যায়, নেই কোনো অবৈধতা। আজ যেনো সত্যি কাগজের তুমি আমি কথাটা ঘুচে গেছে। অনল, ধারার সম্পর্কটা আরো গভীর, আরো স্নিগ্ধ। সম্পর্ক কখনোই শুধু শারীরিক হয় না। সম্পর্কটা থাকে মনের। অনল ধারার সম্পর্কটা ছিলো কাগজের। কিন্তু ভালোবাসার কারণেই তাদের সম্পর্কটা কাগজের গন্ডির থেকে বেরিয়ে মনের সম্পর্কতে পরিণত হয়েছে। যেখানে সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে সেখানে শারীরিক চাহিদাটা আসে না। তাই তো ধারার সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও অনলের ভালোবাসার গভীরত্ব ছিলো সুগভীর। আবার অধরার সাথে রক্তের সম্পর্ক না হওয়া সত্ত্বেও অনলের মনের সাথে সে জড়িয়ে আছে। সম্পর্কের এই টানগুলোই মাঝে মাঝে আমরা বুঝি না। আবেগের বশে ভুল করে বসি। কিন্তু এটা ভুলে যাই সব ধারা এবং অধরার জন্য অনল থাকে না। এটাই বাস্তবতা, এটা চিরন্তন সত্যি।
||সমাপ্ত||