কাজের বেটি রহিমা

    “কাজের বেটি রহিমা”

    সূচনা পর্ব

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    জীর্ণশীর্ণ দেহের অধিকারী রহিমা। রাস্তা দিয়ে হনহনিয়ে হেটে যাচ্ছে কর্মস্থলে। সামনের গলির মোরের দিকে তিনটা ছেলে দাড়িয়ে। বেশ দেখেই বুঝা যায় বাজে লোক! বয়স অল্পই হবে৷ একটার হাতে সিগারেট ধরানো, আর বাকি দুইটা কথার সাথে সাথে পাশের জনের উড়ানো সিগারেটের ধুয়া খাচ্ছে। রহিমা নিকট দিয়ে হেটে যেতেই তাদের মধ্যে একজন সিটি বাজালো। রাহিমা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের পথে অগ্রসর হলো। রহিমা চোখ ফিরিয়ে নিতেই এবার দুইজন সিটি বাজানো শুরু করলো আরেকজন ভেটকি মাছের মতো ভেটকাচ্ছে! রহিমা এবার তাদের দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বললো,

    “কি ভাই? সমস্যা কি? সিটি বাজান ক্যা? মুতে ধরছে? আশেপাশে টয়লেট নাই?”

    তাদের মধ্যে একজন নির্লজ্জের মতো হেসে বললো,

    “না আফা, টয়লেট নাই।”

    এবার রহিমা তুলনামূলক তেজি কণ্ঠে বললো,

    “হারামজাদা, টয়লেট না থাকলে রাস্তার মাঝখানে বইসা প্রস্রাব কর। মাইয়া মানুষরে ডাকছ ক্যা? মাইয়া লোক দেখলেই মুখ চুলকায়? মুখ বরাবর জুতা মাইরা চুলকানি বন্ধ কইরা দিমু।”

    ছেলেগুলোর মুখের হাসি উড়ে গেছে। হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই রহিমা সামনে থাকা ট্রাফিক পুলিশের উদ্দেশ্যে হাক ছাড়লো,

    “পুলিশ ভাই। এই পুলিশ ভাই। এদিকে আসেন তো একটু! হারামজাদা গুলার মুতামুতির ব্যবস্থা কইরা দিয়া যান।”

    রহিমার ডাকে পুলিশ এদিকে তাকাতেই ছেলেগুলো দ্রুত গলিতে ঢুকে পড়লো। রহিমা হনহনিয়ে আবার হাটতে লাগলো।

    নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে রহিমা। বস্তিতে তার পরিবারের বসবাস। পরিবার বলতে মা আর ছোট বোন আছে। বড় একটা ভাইও আছে তবে বলা যায় থাকতেও নেই! বিয়ের পর নিজের সংসার আলাদা করে নিয়েছে। কিছুদিন যেতেই কাজকর্ম করে নিজের হাত কিছুটা উন্নত হয়েছে এবং শ্বশুর বাড়ি থেকে কিছু অর্থ পেয়ে বস্তি ছেড়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এক টুকরো জমি কিনে সেখানেই ঘর বেঁধেছে। কিনেছে কি না সেটাও নিশ্চিত জানা নেই। কারো মুখে শোনা যায় গৃহস্থালির কাজকর্ম করে বিধায় মালিক থাকার জায়গা দিয়েছে, কারো মুখে শোনা যায় ভাড়া থাকে আবার কারো মুখে শোনা যায় লোনের উপর টাকা নিয়ে কিনেছে জমি। কিন্তু সঠিকটা জানে না রহিমা ও তার মা। জানার প্রয়োজনও মনে করে না। যেদিন সে হাড়ি ভিন্ন করেছিলো সেদিনই রহিমা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছে। কিছুদিন যেতেই যখন সে বললো, বউ বাচ্চা নিয়ে সে নিজেই চলতে পারছে না তাই তাদের ভার নিতে পারবে না। সেদিন থেকে রহিমা তাকে ভাই হিসেবে ত্যাগ করে নিজে উপার্জনের হাল ধরে। মাকেও ভাইয়ের খোঁজ নিতে দেয় না। তখন তার বয়স ছিলো তেরো বছর। আর এখন উনিশ পেরিয়ে বিশ এর দিকে যাচ্ছে৷ তার ভাইও অল্প বয়সেই বিয়ে করে ফেলে। ভার ছেড়ে দেওয়ার পরও কিছুদিন বস্তিতে কাটিয়ে হাত উন্নত হওয়ায় সে বস্তি ছেড়ে চলে যায়। এ পর্যন্ত একবারের জন্যও আসেনি স্বজনদের দেখতে। মাঝেমাঝে রাস্তাঘাটে দেখা যায়, কিন্তু সাক্ষাৎ হয় না।

    রহিমা প্রথমে রাস্তা নির্মাণ কাজে যুক্ত হয়েছিলো। ইট ভেঙে দিতো। অত:পর ময়লার গাড়ি টানার কাজে৷ অত:পর ময়লার ফ্যাক্টরিতে। প্রায় দুবছর তার এসব কাজ চলার পর তা সাধ্যের বাইরে চলে আসে৷ ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়ে, শক্তিসামর্থ্যের অভাব দেখা দেয়। এসব কাজ তার দ্বারা হবে না তাই স্বল্প শক্তির প্রয়োজন এমন কাজ খুজতে লাগলো। পেয়ে গেলো বাড়িতে কাজের বুয়া হিসেবে কাজ। প্রথম যে বাড়িতে প্রবেশ করেছে এখনো সেখানেই আছে। গত চার বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে কাইয়ুম ভিলায়। বেতন মোটামুটি ভালোই পায় যা দ্বারা তার সংসার এবং ছোট বোনের পড়াশোনার খরচ চলে যায় কোনমতে। কিন্তু কিছুদিন আগে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। যার ফলে ওষুধ পথ্যের খরচে হাতটান পড়ে যায়৷ তাই অন্যত্র কাজ খুঁজে আরও একটা বাড়িতে কাজ পায়। কাইয়ুম ভিলায় অর্ধেক বেলা কাজ করার পর যেটুকু সময় অবশিষ্ট থাকে সেটুকু সময় সে ওইবাড়িতে অর্থাৎ হক মঞ্জিলে কাজ করে। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সে মায়ের চিকিৎসা করায় এবং কিছু সঞ্চয় রাখতে পারে। মেয়েটা কাজে যেমন পাকা, কথায় তেমন পটু! একটু চাপাটে স্বভাবের! 

    হাটতে হাটতে রহিমা চলে এলো কাইয়ুম ভিলায়। সময় সকাল সাতটা, আবহাওয়া বেশি গরম না হলেও রহিমা ঘেমে একাকার! কারণ এতোটা পথ অতিক্রম করে এসেছে তারউপর হাটার যে গতি, আট-দশ বছরের বাচ্চা হয়তো দৌড়েও পারবে না তার হাটার সাথে! বাসায় কলিং বেল বাজালে মিসেস মারিয়া কাইয়ুম এসে দরজা খুলে দিলেন। রহিমা সালাম দিলে তিনি সালামের জবাব দিলেন ঠিকই সাথে ঘর্মাক্ত শরীর দেখে প্রতিদিনের মতো তাকে বিশ মিনিট বাইরে দাড়িয়ে থাকতে বললেন। প্রতিদিন তিনি বলে দেন এভাবে হাপিয়ে কাজে না এসে যেন রিকশা করে আসে। কিন্তু এই মেয়ে বড্ড হিসাবি। রিকশা ভাড়ায় খরচ হবে তাই রিকশায় আসে না। মারিয়া কাইয়ুম বলে দিয়েছেন পর্যন্ত, আসার সময় সে রিকশা করে এলে যাওয়ার ভাড়া তিনি দিয়ে দিবেন। কিন্তু না, হিসাবি মেয়ে তাতেও রাজি না! সে দেক আর যে-ই দেক, রিকশা ভাড়া তো যাবেই!

    প্রায় পনেরো মিনিট ধরে রহিমা বাইরে দাড়িয়ে আছে। এমন সময় বাড়ির দারোয়ান লাল মিয়া ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে এসেছে। রহিমাকে বাইরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আটাশ দাত বের করে হাসি দিয়ে বললো,

    “আজকাও তোরে শাস্তি দিছে! কান ধরছ না ক্যা? কান ধর!”

    “দেখ লালু, বেশি বেশি কথা কম কম কইবি। নাইলে লাল মিয়া থেকে নীল মিয়া বানায় দিমু।”

    লাল মিয়া দুই হাতের ব্যাগ এক হাতে নিয়ে রহিমার মাথায় ঠুসি দিয়ে বললো,

    “ছেমরি, তুই আমার নাম নিয়া ভেঙ্গাইলি ক্যা?”

    রহিমা ব্যাথা পেয়ে মাথায় মালিশ করতে করতে কান্নার ভঙ্গিতে ভেতরে হাক ছাড়লো মারিয়া কাইয়ুমের উদ্দেশ্যে, 

    “আম্মা….! আম্মা….!”

    মারিয়া কাইয়ুমকে কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে লাল মিয়া ব্যাগ দরজার পাশে রেখে, ব্যাগের উপর সত্তর টাকা রাখলো। আর পা বাড়ালো দোতলা থেকে নিচ তলায় যাওয়ার জন্য সিড়ির দিকে। সাথে বলতে লাগলো,

    “আম্মা, আশি টাকা ফেরত আইছিলো৷ দশ টাকায় আমি চা বিস্কুট খাইছি।”

    এদিকে রহিমা জিদ্দি কন্ঠে বললো,

    “লালুর বাচ্চা কালু! তুই চা বিস্কুট খাইছোস? না সিগারেট খাইছোস?”

    লাল মিয়া তার কোনো জবাব না দিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেছে। রহিমার মুখে এমন কথাবার্তা শুনে মারিয়া ধমকের সাথে বললো,

    “রাহিমা! এসব কি ধরনের কথাবার্তা! তোকে না বলেছি মুখের ভাষা ঠিক করতে! আমরা কিভাবে কথা বলি সেগুলো ফলো করতে পারিস না!”

    “ফলো তো করতাছি ই আম্মা! তবে এই বেডার লগে কোনো মানুষ ভালো কথা কইতে… না সরি। ভালো কথা বলতে পারবো না। অযথা আমার মাথায় মারছে! আপনাগো দিকে তাকাইয়া খালি কিছু কই না!”

    “অযথা তোকে মেরেছে? এসব ভাষার জন্যই মেরেছে নিশ্চয়ই। মুখের ভাষা ঠিক করবি। আর তুই তার সাথে তুইতোকারি করিস কেন? সে তোর কত বড়, তুই জানিস! না হলেও তো দশ বছরের বড় হবে।”

    “শুনেন আম্মা, বয়স আর উচ্চতা দেখলেই মানুষ বড় হইয়া যায় না। মানুষের মন দেইখা বলতে হয় সে বড় না ছোড। আর আপনারা সবাই যে আমারে দেখতে পারেন না, ওইডা খুব ভালো জানি আমি। কারো সহ্যই হয় না আমারে! সাপোর্ট পামু ক্যামনে! দরকার নাই কারো সাপোর্টের। লাথিঝাটা খাইয়া দুইটা পয়সা রোজগার কইরা পেটে ভাত দিয়া জীবন পাড় করতে পারলেই হইলো।”

    কথা বলতে বলতে সত্তর টাকা মারিয়ার হাতে দিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে হনহন করে কিচেনের দিকে চলে গেলো রহিমা। মেয়েটা বড্ড চঞ্চলতার সাথে ইমোশনাল বানিয়ে ফেলতে পারে মানুষদের সেটা এবাড়ির সবাই জানে। তাই প্রথম প্রথম তার কথায় ইমোশনাল হয়ে থাকলেও এখন কেউই আর ইমোশনাল হয় না। কেউ একটু মজা করে সাপোর্টার হয় আর কেউ মজা করে আরেকটু রাগিয়ে দেয়। যেমনটা করলেন এখন কাইয়ুম সাহেব। ডাইনিং টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন তিনি। রহিমার কথাবার্তা শুনে আর মেজাজ দেখে তিনি একটু সাপোর্টার হতে এলেন। তাই পত্রিকা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তিনি বললেন,

    “রহিমা, তুই চিন্তা করিস না। লাল মিয়াকে মিডিয়ার জগৎ থেকে বহিষ্কার করে দিবো।”

    রহিমা কিচেনে ব্যাগ রেখে আবার বাইরে এসে বললো, 

    “শুনেন খালু, আমি আপনাগো এই সান্ত্বনা চাই না। কারণ আমি সিনেমার নায়িকা না, কোনো সাইড নায়িকা হইয়াও কাজ করি না। মোট কথা সিনেমার সাথে আমার কোনোই সম্পর্ক নাই। আপনে মিডিয়ার লোক হইয়া থাকলে আপনাগো লালু নিয়া থাকেন। লালুরে পত্রিকায় ছাপায় দেন, টিভির ভেতর ঢুকায় দেন, মোবাইলের ভেতর ঢুকায় দেন, সিনেমা হলের দারোয়ান বানায় দেন আমি কোনো কিছুই কইতাম না। আর আম্মা কইছে না শুদ্ধ ভাষায় কথা কইতাম, আমি অত শুদ্ধ আর বিশুদ্ধও কইতে পারতাম না! আমি তো ভালা না, আপনারা ভালা লইয়াই থাইকেন।”

    রহিমা আবার চলে গেলো কিচেনে। ওদিকে মারিয়া দরজা লাগিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে জানালার ধারে দাড়ালো৷ আর নিচে থাকা লাল মিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,

    “লাল মিয়া, তুই রহিমার গায়ে হাত তুলছিস কেন? অপরাধ করলে বুঝিয়ে দিবি। মেয়েদের গায়ে হাত তুলবি কেন! স্বভাব পাল্টা। আর কোনোদিন যেন না শুনি এমন কিছু!”

    এদিকে রহিমা কিচেনে থেকে বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। তবে শব্দ জোরে হলেও কথা স্পষ্ট না। তার বিড়বিড় শুনে কাইয়ুম সাহেব আবার বললেন,

    “তোর আম্মা বকে দিয়েছে লাল মিয়াকে। আবার এমন কিছু করলে লাল মিয়ার বিচারের ব্যবস্থা করবো। তুই কাদিস না রহিমা।”

    রহিমা আবার বেরিয়ে এসে বললো,

    “খালু, শুনেন। আমি অন্যসব মাইয়ার মতো ছিচকাদুনে না যে কথায় কথায় কান্না কইরা বন্যায় ভাসায় দিমু। এই লালুর মতো দশটা লালুরে সোজা করা আমার পক্ষে ব্যাপার না। রাস্তা দিয়া আসার সময়ও তিনটারে দৌড়ানি দিয়া আইছি। খালি আপনাগো দিকে তাকাইয়া ছাইড়া দিলাম লালুরে। হুহ্!”

    হঠাৎ পাশের রুম থেকে চেচানো কণ্ঠে ভেসে এলো,

    “রহিমার বাচ্চা! একটা দিনও তোর জন্য শান্তি মতো ঘুমাতে পারি না! তোর বস্তির সব ঝগড়াঝাটি, বিচার-আচার কি এই বাড়িতে আনতে হবে! আর একটা শব্দ উচ্চারণ করে দেখ তুই। ছয়তলার ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে সোজা পাকা রাস্তায় ফেলে দিবো!”

    বাড়ির ছোট ছেলে আয়ানের ধমকে এবার রহিমা চুপ করে কিচেনে চলে গেলো। এ হচ্ছে আরেক বান্দর। না, এটা কোনো পশু না। এটা মানুষের বাচ্চাই তবে রহিমার মনের উপাধি বান্দর! এ বাড়িতে কাজ করার বর্ষে রহিমা আজও কোনো ভালো কাজ হতে দেখেনি এই বান্দরের দ্বারা। সারাক্ষণ অন্যের কাজে সমালোচনা করা, নিন্দা করা, বকাঝকা করা, সোজা কথা প্যাচিয়ে ত্যাড়া বানানো আর ঘাড় ত্যাড়ামো তার স্বভাব! যদি কেউ বলে ডানে যা, তো সে যাবে বামে! পরিবারের সকল সদস্যকে জ্বালিয়ে মারে সাথে কাজের লোককেও! আর কথায় কথায় রহিমার ডায়ালগ, “শুধু এই কাজের বেটি রহিমা বইলা আপনাগো দিকে তাকাইয়া এখনো কাজ করি আপনাগো বাড়িতে৷ নাইলে কোনো রোবটও টিকতো না! রোবট তো আর পালাইতে পারতো না। হয় দোতলা থেইকা ঝাপ দিয়া আত্মহত্যা করতো, না হয় বাস্ট হইয়া নিজে ফিনিশ হইতো সাথে এই বাড়িও পুড়াইয়া ফিনিশ কইরা যাইতো।”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ২

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    কাইয়ুম আহসানের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে সায়ান মাহমুদ। বেসরকারি কলেজে  চাকরি করে। গতবছর বিয়ে হয়েছে৷ দু সপ্তাহ আগে কন্যা সন্তান হয়েছে। বাড়ির বউ পিংকি এখন বাবার বাড়িতে আছে বাচ্চা নিয়ে। সায়ানও সেখানেই থাকছে বাচ্চা হওয়ার পর। মাঝে মাঝে এ বাড়িতে এসে দেখা করে যায়।

    ছোট ছেলে আয়ান মেহবুব। স্কুল জীবনে ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিলো। তবে কলেজ লাইফে পড়াশোনায় বরবাদ হয়ে গেছে! তিনবার এইচএসসি দিয়েছে! বর্তমানে ভার্সিটির শেষ ধাপে আছে! বিএ কমপ্লিট করতে যাচ্ছে  তাও বছরে বছরে ইম্প্রুভ দিয়ে! স্কুল জীবনের মতো পড়াশোনা করলে এতোদিনে তার মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে যেতো। কিন্তু তা হলো না। পড়াশোনার ইচ্ছে ছেড়েই দিয়েছিলো, তবুও এখন চলছে তার বাবামায়ের ধাক্কায়। 

    মেয়ে মিশকাতুল আয়মান সবার ছোট। বিয়ে দিয়েছে দুই বছর হলো। সাত মাসের একটা বাচ্চাও আছে। তবে পড়াশোনা করছে এখনো। মেডিক্যালে পড়ছে।

    এবাড়িতে রহিমার কাজ, ঘর ঝাড়ু দেয়া, প্রতিদিন ঘর মুছে দেওয়া, থালাবাটি ও হাড়িপাতিল মাজা, সপ্তাহে একদিন আসবাবপত্র মুছে দেওয়া। আর রান্নাবান্না সব মারিয়া কাইয়ুম করে। পিংকি দুএক দিন রান্না করেছিলো কিন্তু তার সব খাবারে সবাই মিষ্টি স্বাদ পায়! যা কারোই রুচিতে আটে না! তাই সে আর রান্না করে না। এবাড়িতে বউ হিসেবে তার কাজ মারিয়া কাইয়ুমের রান্নার কাজে সাহায্য করা। আর নিজেদের কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়া। অতিরিক্ত কাপড়চোপড় সব রহিমা কেচে দেয়। 

    সকালে মারিয়া কাইয়ুম রান্নাবান্না শেষ করে রেখেছে। সকাল সকাল মন মেজাজ খারাপ হওয়ায় রহিমা রাতের এটো থালাবাটি ধুয়ে নিলো বকবক করতে করতে। মারিয়া কাইয়ুম ধমক দিলে চুপ হয় আবার একটু পরই অটোমেটিক তার বকবকানি শুরু হয়!

    মারিয়া কাইয়ুম বেশ কয়েকবার ডেকে এলেন আয়ানকে। কিন্তু আয়ান “উঠছি” বলে আর উঠার নাম নেই! ভার্সিটির ক্লাসের সময় পাড় হবে তখনই তার ঘুম ভাঙবে! ক্লাস করে না ঠিকমতো। মাঝে মাঝে কোচিং-এ যায় এতটুকুই তার পড়াশোনা! মারিয়া কাইয়ুম আজ এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়ানের মুখে মেরে এলেন! এবার হকচকিয়ে উঠে পড়লো আয়ান! মায়ের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বললো,

    “এটা কি করলে আম্মু! আমাকে ভেজাতে গিয়ে তুমি বিছানাটাই ভিজিয়ে দিলে!”

    “বেশ করেছি ভিজিয়েছি! এতো ঘুম কেন তোর চোখে! নামাজ পড়ার জন্য একদিনও ডেকে তোলা যায় না! এখন ভার্সিটির সময়ও স্বপ্নে খেয়ে তারপর উঠবে!”

    “তাই বলে তুমি পানি মারবে!”

    “মারবো না আবার! আজ গ্লাস এনেছি, কাল থেকে বালতি নিয়ে আসবো!”

    “এটা কোনো কথা! এখন বিছানা শুকাবে কি করে!”

    “শুকাতে হবে না। ভেজা বিছানাতেই থাকবি তুই!”

    মারিয়া কাইয়ুম ছেলেকে বকাঝকা করতে করতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। আয়ান ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির জন্য রেডি হলো। অত:পর গোমড়া মুখু হয়ে বেরিয়ে এসে বসলো ডাইনিং টেবিলে৷ কাইয়ুম সাহেব পত্রিকার দিকে ঘাড় নিচু রেখেই চশমার উপর দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে বললো, 

    “আয়ান কি আজও বিছানায় মুতু দিয়েছে? তাই কি বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইছিলো না? স্বভাব পাল্টায়নি এখনো!”

    কিচেনে হাড়িপাতিল গুছিয়ে রাখতে রাখতে রহিমা শব্দ করে হেসে উঠলো আর গ্লাসে পানি নিতে নিতে মারিয়া মুখ চেপে হাসলো। বাবার মস্করায় আয়ান মেজাজী গলায় বলল, 

    “রহিমা! খাবার নিয়ে আয়!”

    মারিয়া পানি পান করে খাবার আনতে গেলো কিচেনে। দুজনেই খাবারের বাটি নিয়ে আসছে। আয়ান প্লেট উল্টো করে আজ নিজেই খাবার তুলে ঝটপট খেয়ে নিচ্ছে। কাইয়ুম সাহেব পত্রিকা রেখে চেয়ার সোজা করে টেবিলমুখী হয়ে বসলেন। অত:পর আয়ানের উদ্দেশ্যে বললেন,

    “প্রতিদিন একই কথা বলি, পড়াশোনা ভালোমতো করো। ফলাফল ভালো হবে। তাই বলে আবার নকল দিয়ে খাতায় ফলাফল ভালো করে এসো না। একটু নিজে চেষ্টা করে পড়াশোনায় মনযোগ দাও। তাহলে শুধু খাতার ফলাফল না, সাথে জীবনের ফলাফলও ভালো হবে। পড়াশোনা বড়ই আরামের কাজ। শুয়ে-বসে করতে পারো। অন্যথায় কোনো কঠিন কাজে তোমাকে লিপ্ত করা হচ্ছে না আপাতত। তুমি শুধু এখন পড়াশোনা করবে।”

    আয়ান খাবার চিবাতে চিবাতে কিছু বলতে গেলে কাইয়ুম সাহেব বাধা দিয়ে বললেন,

    “মুখের খাবার শেষ করে কথা বলো। ভদ্রতা শেখো।”

    আয়ান মুখের খাবার শেষ করে বললো,

    “পড়াশোনা আরামের কাজ? ঘরে বসে বসে তুমি বুঝবে কি দুনিয়াতে পড়াশোনার মতো কষ্টের কাজ আর দু’একটা নেই! কোন আমলে মেট্রিক পাশ করে বসে আছো। এই মেট্রিক পাশ আমিও করেছি। সেটা খুব সহজই ছিলো। কলেজ তো আর পড়নি যে কলেজের চাপ বুঝবে! কলেজ পড়লে বুঝা যায়, আরাম ব্যারাম হতে সময় নেয় না।”

    “আমার সাথে তুলনা করলে তোমার চলবে! আমার সময়ে মেট্রিক পাশ হলে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো চাকরি দেওয়ার জন্য। আর তোমার সময় এম এ পাশ থাকলেও চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যায়!”

    “জুতার তলা ক্ষয় হওয়ার আগেই ফেলে দিবো, সেই চিন্তা তোমাকে করতে হবে না!”

    “তাই নাকি! তা এক জুতা ফেলে আরেক জুতা পাবে কোথেকে শুনি? রোজগার না করলে টাকা আসবে!”

    “এতো টাকা দিয়ে কি হবে! তুমি যেমন তোমার ছয়তলা বাড়ির ভাড়া দিয়ে বসে বসে খাও আমিও খাবো।”

    “বাড়ির ভাড়া দিয়ে বসে বসে খাই সেটা দেখলে, আর এই বাড়িটা যে কোথেকে এলো সেটা দেখলে না?”

    “সেটাও তো দেখছি! ব্যবসা করে তুমি যে ব্যবসায় বড়সড় মাইর খেয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিছো!”

    “তার আগে যে সেই ব্যবসার অবস্থা  বড্ড ভালো ছিলো আর তা থেকেই তোমরা বেঁচে আছো সেটা দেখবে না?”

    “এতোসব দেখে লাভ কি! শেষ ভালো যার, সব ভালো তার – এই নীতি খুব মানি আমি। শেষ পর্যন্ত তো হারিয়ে বসে আছো সেটাই মূখ্য বিষয়। উক্ত নীতি অনুসারে এখন সবটাই আমার ভালো হোক। পকেট ফাঁকা হয়ে গেছে, পাচশো টাকা দাও। নতুবা ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ।”

    “দুদিন আগে দুই হাজার নিয়েছো এখনই পকেট ফাঁকা! এতো বড় ছেলে ইনকাম নেই এক টাকা! দিনে নাকি তার খরচ হয় হাজার টাকা!”

    “হাজার চাই নি তো। পাঁচশো চেয়েছি আজ। না দিলে আমি ভার্সিটি যাবো না, বাসায়ই থাকি আর তুমি ক্লাস করাও৷ আমি বসে বসে তোমার কাছে পড়ি।”

    রহিমা হেসে বললো, 

    “খালু তো ভার্সিটি পড়ে নাই। তো খালুর কাছে কি পড়বেন ছোট ভাইজান? এ বি সি ডি?”

    আয়ান ধমকে বললো,

    “তুই চুপ থাক!”

    আর মারিয়া সামান্য বিরক্তি নিয়ে তাকালো রহিমার দিকে। কেননা তিনি কারো কথার মাঝখানে কথা বলা পছন্দ করেন না। রহিমা বড্ড বেশি কথা বলে। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সে ভুলে যায় এবং বলে ফেলে! এখন রহিমা চুপ! আর কাইয়ুম সাহেব আয়ানের উদ্দেশ্যে বললেন, 

    “পঞ্চাশ টাকা দিবো, বাসে আসা যাওয়া চলবে। রেগুলার তুমি পঞ্চাশ টাকা করে পাবে এখন থেকে। প্রয়োজনে কিন্ডারগার্ডেনের বাচ্চাদের সাথে স্কুল ভ্যানে তুলে পাঠিয়ে দিবো। কিছু পথ ভ্যানে বাকি পথ বাসে কিংবা হেটে। তবুও অতিরিক্ত খরচের জন্য এক টাকাও না!”

    আয়ানের খাওয়া এতোক্ষণে শেষ। সে আজ বেসিনে না গিয়ে প্লেটেই পানি ঢেলে ঝটপট হাত ধুয়ে উঠে যেতে যেতে বললো,

    “তুমিই গিয়ে স্কুলে ভর্তি হও আর স্কুল ভ্যানে করে নিয়মিত স্কুলে যাও। বেকার মানুষ যেহেতু, তোমার পড়াশোনার প্রয়োজন আছে। সাথে আম্মুকেও নিয়ে যেও। সময় ভালো কাটবে।”

    আয়ান রুমে চলে গেলে রহিমা ফিসফিসিয়ে বললো,

    “খালু, আপনের ছোট পোলা আস্ত একটা কামলা। দেখছেন, ক্যামনে গাপুসগুপুস খাইয়া গেলো! যেন বৃষ্টি নামবো তাই ধান কাটতে যাইতাছে জলদি কইরা!”

    মারিয়া কাইয়ুম তার কথা শুনে নিচু স্বরে ধমক দিলেন। আর কাইয়ুম সাহেব তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে ছেলের কথায় হেসে বললেন, 

    “আমি তো পড়ি ই আমার পড়া। অন্য লোকেরা শুধুমাত্র শিরোনাম পড়ে পত্রিকা রেখে দেয়। কিন্তু আমি তা করি না। অক্ষরে অক্ষরে পুরো পত্রিকা পড়ে শেষ করি। দেশের খবরাখবর নিতে হলে ভালোভাবেই নিবো। চালের মাঝে ধান বাছতে গিয়ে শুধু পাথর কেন তুলে আনবো! লেখা তো পড়ার জন্যই ছাপিয়েছে, না কি? তারউপর টাকা দিয়ে কেনা পত্রিকা। তাহলে শুধু শিরোনাম পড়ে কেন রেখে দিবো।”

    রহিমার কথায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করায় রহিমা ভাবলো তার কথা শুনেনি। তাই সে মারিয়ার উদ্দেশ্যে বললো, 

    “আম্মা, খালু দেখি ধ্যান্দা! কানে শুনলো না আমার কথা!”

    মারিয়া কাইয়ুম চোখ পাকিয়ে তাকালো তার দিকে আর রহিমা চুপ হয়ে গেলো৷ কাইয়ুম সাহেবও তাকিয়েছেন কিন্তু কিছু বলার আগেই রহিমা চুপ হয়ে যাওয়ায় আর কিছু বললেন না তিনি। কিন্তু রহিমা মনে মনে বললো,

    “হইছে এইবার! ভালা কথা কানে শুনে না, ধ্যান্দা বলায় খালুর কানে পৌছায় গেছে কথা!” 

    ওদিকে আয়ান নিজের রুম থেকে চেচিয়ে বাবার কথার ভিত্তিতে জবাব দিলো, 

    “হু, তুমি বেশি শিক্ষিত। অনেক পড়ো, আরও পড়ো। পড়ে পড়ে মুখুস্ত করে ফেলো। তারপর খাতা কলম নিয়ে নিজেই পত্রিকা লিখে ফেলো। এবার আমার টাকা দাও।”

    কাইয়ুম সাহেব গলার আওয়াজ কিছুটা উচু করে বললেন, 

    “বেশি শিক্ষিত না হয়ে তোমার মতো গর্দভ হলে চলবে? অল্পবিদ্যা ভয়ংকর, সেটা জানো না? বলবো, ‘পিঠে মশা বসেছে তাকে হত্যা করো।’ আর তুমি কুড়াল এনে মশা হত্যার বদলে বাবা হত্যা করবে। দারুণ না ব্যাপারটা?”

    কথা বলতে বলতে দুইশো টাকা পকেট থেকে বের করে টেবিলে রাখলেন কাইয়ুম সাহেব। ওয়ালেট আর ফোন হাতে রুম থেকে বেরিয়ে আয়ান দুইশো টাকা ওয়ালেটে রাখতে রাখতে হাসিমুখে বললো,

    “একদমই মন্দ না ব্যাপারটা। তবে তার চেয়েও বেশি দারুণ হবে, বাবা যদি কুড়াল কেনায় টাকা খরচ না করে ছেলের পকেটে খরচ করে। বাড়িতে কুড়াল না থাকলেই তো হয়! বাবাও বাঁচলো, ছেলেও বাঁচলো! এখন যেহেতু দুইশো দিলে, পাঁচশো টাকার নোটটা তাহলে সন্ধ্যায় রেডি রেখো। রহিমা দরজা লাগিয়ে দিয়ে যা। কামলার শোধটা পরে তুলবো।”

    বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো আয়ান। এদিকে রহিমা স্তব্ধ! তার গলার স্বর কি এতোটাই উঁচু! আয়ান রুমের ভেতরে থেকে শুনলো কিভাবে তার ফিসফিস! রহিমা দরজা লাগাতে লাগাতে বিড়বিড় করে বললো, 

    “বাপে ধ্যান্দা আর পোলায় ইতর বান্দা! একজনের কানের কাছে কইলে শোনে না। আরেকজন সুদূর থেইক্কা শুইন্না ফেলে! হুহ্! ইতর আয়না, পূরণ হবে না তো আপনের শোধ তোলার বায়না। আপনে ফিরতে ফিরতে আমি বাড়িতে থাকলে তো মনু ময়না!”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ৩

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    আয়ান চলে গেলে কাইয়ুম সাহেব খাওয়ার জন্য প্লেট সামনে নিলেন। এবার শান্তিমত খাওয়া যায়। মারিয়া রহিমাকে ডেকে প্লেট ধরিয়ে দিলেন। রহিমার জন্য আলাদা প্লেট রাখা আছে এখানে। সকালে সে এ বাড়িতে খায়৷ দুপুরে হক মঞ্জিলে আর রাতে নিজ আশ্রমে। রহিমা খাবারের প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেলো। সাথে একটা কাচা মরিচ নিয়ে মেঝেতে বসে খাবার খেয়ে নিলো। 

    রহিমা বাড়ির অন্যান্য কাজকর্ম শেষ করে মাছ কাটতে বসলো। কেটেকুটে পরিষ্কার করে ফ্রিজে তুলে রাখলো৷ অত:পর বসে আছে, দুপুরে তাদের খাওয়া হলে থালাবাটি ধুয়ে তারপর হক মঞ্জিলে যাবে। তাকে বসে থাকতে দেখে মারিয়া বললো, 

    “কাজকর্ম তো শেষই। চলে যা তুই। লাঞ্চের পর দুজন মানুষের প্লেট আমিই ধুয়ে রাখতে পারবো। এখন তো আর রান্না করিনি যে হাড়িপাতিল মাজতে হবে!”

    “চলে যাবো?”

    “হ্যাঁ, যা।”

    “পরে কিন্তু আবার বলতে পারবেন না আমি কাজে ফাঁকি দিয়া দুইটার আগেই চলে গেছি!”

    “বড্ড বেশি কথা বলিস! গেলে যা, না গেলে বসে থাক।”

    “হুহ্! থাক, যাইগা।”

    “এই, যাইগা কি শব্দ?”

    “সরি, আম্মা৷ চলে যাই। আসসালামু আলাইকুম।”

    মারিয়া সালামের জবাব দিয়ে বলে দিলো সাবধানে যেতে। রহিমা চলে গেলো। ভরদুপুরে হাটতে লাগলো হক মঞ্জিলের দিকে। মাঝপথে গলা শুকিয়ে গেছে। রাস্তার ধারে শরবত বিক্রি করছে। রহিমা তার গলাকে দোষারোপ করলো কারণ তার ধারণা লেবুর শরবত দেখে তার গলা শুকিয়ে গেছে! তাই মনে মনে বললো, 

    “মরার গলা! শরবত দেখলেই তোর চুলকানি উঠে! এতো খরচ করাস ক্যা!”

    বলতে বলতে সে ভ্যানের কাছে এসে দাড়িয়ে বললো, 

    “এক গ্লাস লেবুর শরবত দেন তো।”

    কথাটা বলে নিজেই গ্লাস হাতে নিয়ে ভালো পানিতে ধুয়ে এগিয়ে দিলো। তা দেখে বিক্রেতা গ্লাস হাতে নিয়ে বললো, 

    “হুহ্! চেহারার নাই ছুড়ুত, আবার আইছে পরিষ্কারগিরি দেখাইতে!”

    রহিমা ক্ষেপে গিয়ে বললো, 

    “ওই মিয়া! আপনারে আমার চেহারা দেখতে কইছি, না শরবত দিতে কইছি! যান মিয়া বাজে লোক! আপনার শরবত খাইতাম না!”

    রহিমা হনহন করে চলে গেলো। বিক্রেতা পেছন থেকে ডাকছে কারণ শরবত গ্লাসে নিয়ে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু রহিমা পেছনে ফিরে তাকালোই না। বিক্রেতা হয়তো গালি দিচ্ছে তাকে। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে সামনের ভ্যান থেকে শরবত কিনে খেলো। অত:পর হাটতে লাগলো। হক মঞ্জিলে তিন তলায় এসে ফ্ল্যাটের সামনে দাড়ালো সে। কলিং বেল বাজানোর পরপরই দরজা খুলে দিলো সায়মা। ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে সালাম দিলো রহিমা। সায়মাও হাসিমুখেই জবাব দিয়ে বললো, 

    “আজ তুই এতো তারাতাড়ি! আড়াইটা তো বাজেনি! আরও চল্লিশ মিনিটের মতো বাকি।”

    “ওইবাড়িতে কাজ তারাতাড়ি শেষ হইছে, আপা। আসার অনুমতি পাইছি তাই তারাতাড়ি চইলা আইছি।”

    “তোকে না বলেছি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে!”

    “বলি ই তো।”

    “এটা কেমন বলা! কখনো শুদ্ধ আবার কখনো অশুদ্ধ! এমন হলে চলবে না।”

    “ভুলে যাই, আমার কি দোষ।”

    “ভুলে যাওয়াটাই তোর দোষ। ভেতরে আয়।”

    “একটু জিরিয়ে নেই।”

    “জিরিয়ে নিতে হবে না। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নে। তারপর ফ্যানের নিচে বসে থাক।”

    রহিমা ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। সায়মা বললো, 

    “তুই তারাতাড়ি আসায় আমার ভালোই হয়েছে। একটু বাইরে যাবো তোকে নিয়ে।”

    “শপিং করতে যাইবেন?”

    “না, বুক শপে যাবো। কিছু বই আর খাতাপত্র কেনা প্রয়োজন।”

    “ওহ্, আইচ্ছা। আমি তারাতাড়ি কাজ সাইরা নেই।”

    “তোর করার মতো কাজ তেমন কিছুই নেই আজ। আমি ঘর মুছে দিয়েছি। তুই শুধু খাওয়াদাওয়ার পর প্লেটগুলো মেজে রাখিস। আর সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে পারলে মায়ের রান্নার কাজে একটু হেল্প করিস। আর সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট বিষয় তোর এই এলোমেলো ভাষা ঠিক করবি।”

    “এহ! আপনারা না কেমন জানি করেন আমার লগে। ওইবাড়িতে এক আম্মা আর গোলাপি ভাবি! আর এই বাড়িতে এক আম্মা আর আপনি! চারজন মিল্লা যেন একটা স্কুল দিয়া বসছেন! আমি একলা ছাত্রী আর আপনারা চারজন শিক্ষক! আমার লগে আর লাগে কেডা! শুদ্ধ ভাষা শিখতে শিখতে ভাষামন্ত্রী হইয়া যামু!”

    “গোলাপি ভাবিটা আবার কে?”

    “ওইযে, যেই বাড়িত কাজ করি সেই বাড়ির বড় বউ।”

    “এর আগে না নাম বললি পিংকি?”

    “নাম পিংকি। আমি তো বাঙালি মানুষ তাই বাংলা ছাড়া কথা বলি না, তা-ও আপনাগো চাপে পইড়া মাঝে মাঝে সরি আর থ্যাঙ্কিউ! তা জানেনই তো আপা! তাই পিংকির বাংলা গোলাপি ভাবিই ডাকি! হইছে না? ছোট কালে তো পড়তামই, রেড লাল, হোয়াইট সাদা, বেলাক কালা, পিংক গোলাপি!”

    সায়মা হাসতে হাসতে বললো,

    “বেলাক না, ব্লাক। কালা নয়, কাল। তা গোলাপি ভাবি কিছু বলে না তোর মুখে বাংলা নাম শুনে?”

    “আয় হায়! এমনিতেই কোনো কিছু উল্টাপাল্টা করলে শুদ্ধ ভাষায় যেই টাস টাস বকাঝকা করে! তার সামনে আবার বাংলা নাম কমু! আগে পরে কই! তা-ও দুই তিনবার শুইনা ফেলছে আর আচ্ছা ঝাড়ি মারছে!”

    “এসব কেমন ভাষা! একবার ‘বলি’ আরেকবার ‘কই’! এগুলা কি?”

    “আপা, সময় তো লাগবো! আমি কি আর আপনাগো মতো স্কুল কলেজ পড়ছি! মায়ের ভাষা যেমন, তেমনই তো বলমু!”

    “শোন, চেষ্টা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়। তোর মাঝে আমি কোনো চেষ্টাই দেখছি না! তোকে এতো বছর ধরে নাকি ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে, আবার এখানে আসার পর আমিও ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছি তা-ও তুই পারছিস না কেন জানিস? কারণ তোর মাঝে কোনো চেষ্টাই নেই!”

    “করতাছি তো।”

    “এই করাতে চলবে না। আপ্রাণ চেষ্টা কর। যা হাত মুখ ধুয়ে নে। মায়ের নামাজ হয়ে গেলে একসাথে লাঞ্চ করবো।”

    “খালু বাড়িতে নাই?”

    “বাবা দাওয়াতে গেছে।”

    রহিমা হাতমুখ ধুয়ে সায়মার রুমে ফ্যানের নিচে বসে রইলো। 

    হক মঞ্জিলের মালিক আবু সালেহ হক। ছেলেমেয়ে দুজন। ছেলে সায়েম ইশতিয়াক বড়, এইচএসসির পর কর্মসূত্রে আমেরিকা চলে যায় এবং সেখানেই থাকে। মেয়ে সায়মা হক ইতু, অনার্সে অধ্যয়নরত। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু ডিএমসি তে চান্স হয়নি তাই আর পড়লো না। বাবা বলেছে প্রাইভেটে পড়তে, কিন্তু সে পড়লো না৷ তার মতে প্রাইভেটে পড়া মানেই অযথা টাকা নষ্ট করা! 

    আবু সালেহ হক আগে সরকারি চাকরি করতেন।দুবছর ধরে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। বর্তমানে বাড়িভাড়া, পেনশন, ছেলের আয়ে তাদের সংসার বেশ সচ্ছল। এককথায় উচ্চবিত্ত পরিবার। একটি বৃদ্ধাশ্রম চলে তাদের আয় দ্বারা। 

    যদিও বাড়িতে কাজের মেয়ে রাখার তেমন প্রয়োজন ছিলো না, মেয়ের জন্যই কেবল রেখেছেন মিসেস ফারহানা হক। সায়মা কোথাও গেলে সাথে রহিমাকে পাঠান। কেননা বিপদ-আপদের পূর্বাভাস নেই। কখন কি হয়ে যায় সেই ভয় পান তিনি। এমনিতে মেয়ের সময় কাটে ভার্সিটিতে এবং ছাদে তার বাগানে। বাড়িতে থাকাকালীন পুরোটা সময় সঙ্গী হয় মা এবং রহিমা। টুকটাক ঘরের কাজের সাথে বাগানও পরিচর্যা করে রহিমা।

    দুপুরে লাঞ্চ করার সময় তাকে তাদের সাথে টেবিলে খেতে বলা হয়। কিন্তু খায়না সে। তার ভালো লাগে না। মেঝেতে আয়েশ করে বসতেই তার ভালো লাগে।

    দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরপরই দুজন বেরিয়ে গেলো। সায়মাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। কিন্তু তার রিকশায় ভ্রমণ করতে ভালো লাগে। সে রহিমাকে সাথে নিয়ে রিকশাতেই চলে গেলো। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটার পর তারা বাড়ি ফিরবে। এখনো সন্ধ্যা হয়নি, একটু আগে মাত্র আসরের আযান পড়লো। তাই সায়মা রহিমাকে নিয়ে রাস্তার ধারে ফুচকা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ফুটওভারের পাশে দাড়ানো ভ্যান থেকে তারা দুই প্লেট ফুচকা নিলো। আগে রহিমা ফুচকায় কামড় দিয়ে অল্প অল্প করে খেতো। পরে সায়মা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে পুরো ফুচকা একবারে মুখে পুড়ে দিয়ে খেতে হয়। এখন সে সেভাবেই খায়। দুজনের মাঝে এক প্রকার প্রতিযোগিতা চললো। ভার্সিটিতে ফ্রেন্ডের সাথে অন্যথায় রহিমার সাথে সায়মা ফুচকার স্বাদ উপভোগ করে। ফুচকা খাওয়ার সময় ফুটওভারের উপরের দিকে চোখ পড়তেই আয়ানকে দেখতে পেল রহিমা। রেলিংয়ে কনুই ভর দিয়ে নিচের দিকে সামান্য ঝুকে দাড়িয়ে আছে। রহিমার তখন মনে হয়েছিলো আয়ানের দৃষ্টি সায়মার দিকে। কিছুক্ষণ পর আবার তাকালো, এবারও আয়ানের দৃষ্টি নিচের দিকেই কিন্তু সায়মার দিকে কি না তা বুঝতে পারছে না রহিমা। ফুচকা খাওয়া শেষে সায়মা দুই প্যাকেট ঝালমুড়ি নিলো। টাকা পরিশোধ করে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি রহিমার হাতে দিলো আরেকটা নিজের হাতে রেখে কথা বলতে বলতে ফুটওভারে উঠতে লাগলো। তাদের দুজনের কাধেই ব্যাগ আছে। সায়মার কাছে পার্স আর রাহিমা কাছে কাধে নেওয়ার কলেজ ব্যাগ। দুজন ভাগাভাগি করে বইপত্র নিয়েছে ব্যাগে আর হাতে ঝালমুড়ি। ফুট ওভারে উঠার সময়ও রহিমা খেয়াল করলো আয়ান এতোক্ষণ উল্টোপাশ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো আর এখন সোজা হয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ফুটওভারের মুখোমুখি! আয়ানের দৃষ্টি সায়মার দিকেই ছিলো। পরক্ষণে রাহিমা দিকে চোখ পড়তেই ঠোটের মৃদু হাসি আরও প্রশস্ত হয়ে গেলো। রহিমার মতে এটা ইতরমার্কা হাসি! এই ইতরমার্কা হাসির বিপরীতে রহিমা ব্রু কুচকে মুখ মোচড় দিয়ে দ্রুত হাটতে লাগলো। সায়মা তাকে থামিয়ে বললো,

    “আরে! এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেন! দাড়া এখানে বাতাসে দাড়িয়ে ঝালমুড়ি শেষ করে তারপর যাই।”

    ফুটওভারে আয়ানের বিপরীত পাশে তারা রেলিংয়ে কনুই ভর করে দাড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছে আর নিচে ধারাবাহিকভাবে চলাচল করা যানবাহন দেখছে। কিছুক্ষণ পরপর লাল বাতিটা জ্বলা মাত্র গাড়িগুলো থেমে যায় আর অন্যরাস্তার গাড়িগুলো চলতে থাকে। আবার সবুজ বাতি জ্বলে উঠলে গাড়িগুলো দৌড়াতে থাকে। আর নানানরকম হর্নের শব্দ তো আছেই শহরকে মনোরঞ্জন করার জন্য! বাতাসটা খুব ভালো লাগছে সায়মার কাছে। সায়মা নিরবে পরিবেশের মাধুর্য উপলব্ধি করতে থাকলেও রহিমা একটু পরপর পেছনে থাকা আয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। আয়ানকে কখনো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার কখনো পাশে থাকা বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে দেখে। আয়ান রহিমাকে যখনই তাকাতে দেখে, তখনই পা তুলে জুতা দেখায় কিংবা হাতের ফোনটা রহিমার মাথায় মারার ভঙ্গিতে হাত ওঠায়!

    ঝালমুড়ি খাওয়া শেষ হলে সায়মা তাকে বললো, 

    “চল, এবার বাসায় যাওয়া যাক।”

    সায়মা হাটতে লাগলে রহিমা আয়ানের দিকে এক কদম এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে গেলো,

    “রাস্তায় রাস্তায় আড্ডা দেন আর সুন্দরী মেয়ে মানুষের দিকে তাকাইয়া থাকেন খালি? খাড়ান, আম্মার কাছে আপনার লুইচ্চামির বিচার দিয়া লই।”

    কথাটা বলে রহিমা আর এখানে দাড়িয়ে নেই। সায়মা এগিয়ে যাওয়ায় সে দৌড়ে সায়মার কাছে এসে সমান তালে হাটতে লাগলো। পেছন থেকে আবার আয়ান মাথা ফাটাতে আসে কি না সেটা দেখার জন্য একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়েছিলো রহিমা। আয়ান তখন সেখানেই দাড়িয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো রহিমার দিকে। হয়তো রহিমাকে এখন একা সামনে পেলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো আয়ান, এটাই রহিমার ধারণা!

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ৪

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    সবজি কেটেকুটে ফারহানার রান্নার কাজ এগিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে রহিমা। অসুস্থ মা শুয়ে আছে আর ছোট বোন কারিমা ফোন নিয়ে খুচুরখুচুর করছে! তা দেখে রহিমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে! তাই সে বকাঝকা করতে লাগলো কারিমাকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অথচ না বসিয়েছে রান্নাবান্না আর না এনেছে বাইরে থেকে কাপড়চোপড়। সারাদিন পড়ে থাকে ফোন নিয়ে! 

    স্মার্টফোন ইউজ করে কারিমা। কিছুদিন আগে আয়ানকে দিয়ে রহিমাই ফোন কিনিয়েছে। কারিমার নাকি পড়াশোনার জন্য স্মার্টফোন প্রয়োজন। সংসারের দায়ভার যেহেতু তার উপর সেহেতু বোনের প্রয়োজন মেটাতে সে আয়ানের হাতে আড়াই হাজার টাকা দিয়েছিলো দেখেশুনে একটা ফোন কিনে দেওয়ার জন্য। সে তো আর এতসব বুঝে না। আয়ান আরও সাতশো টাকা যুক্ত করে তিন হাজার দুইশো টাকা দিয়ে ফোন কিনে দিয়েছে। সাতশো  যুক্ত করায় পাঁচশো টাকা আবার মায়ের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিলো আয়ান। মেয়েটা ভোর সন্ধ্যা ছুটাছুটি করে তার একটা ফোন প্রয়োজন হতেই পারে সেই ভেবে মারিয়া কাইয়ুম পাঁচশো দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে ফোন তার বোনের জন্য। অবশ্য পরে জেনেছেন সেটা।

    কিন্তু এখন দিনরাত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খুচুরখুচুর করতে দেখে রহিমার মোটেও ভালো লাগে না। যদি জিজ্ঞেস করে, এতো কথা কিসের বন্ধুবান্ধবদের সাথে! তখন কারিমা তাকে বুঝিয়ে দেয় সে পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলছে।

    রহিমা বকাঝকা করলে কারিমা ফোন রেখে বাইরে চলে গেলো কাপড়চোপড় আনতে। রহিমা হাতমুখ ধুয়ে মায়ের পাশে এসে বসলো। মাথায় হাত দিয়ে দেখলো মাথাটা গরম হয়ে আছে। সে মাকে ধরে বসিয়ে বললো,

    “গোসল করছেন, মা?”

    “না রে মা। জ্বর জ্বর লাগে। হেল্লাইগা আইজ করি নাই।”

    “ভাত খাইছেন দুপুরে?”

    “ভাল্লাগে না।”

    রহিমা চুলার পাশে এসে হাড়ি ধরে দেখলো অর্ধেক হাড়ি ভাত নষ্ট হয়ে গেছে। সকালে যে মা বোনকে সাথে নিয়ে খেয়ে গেছে এরপর আর কেউ হাড়ি ধরেনি সে নিশ্চিত! কারিমা কাপড় নিয়ে ঘরে আসতেই রহিমা বললো,

    “দুপুরে ভাত খাস নাই?”

    “না।”

    “ক্যা?”

    “বুবু, আজ রত্নার বাড়িত দাওয়াত আছিলো। আমি তো তাদের বাড়িতেই আছিলাম।”

    “মুড়াইয়া এক্কেবারে হাড়গোড় ভাইঙ্গা ফালামু! ফাজিল কোথাকার! এতো কষ্ট কইরা রোজগার কইরা ভাত আনি! আর ঘরের ভাত নষ্ট কইরা টাকা খরচ কইরা তুই দাওয়াত খাইতে যাস!”

    পরপর এভাবে বকাঝকা করায় কারিমা মেজাজী গলায় বললো,

    “বন্ধুবান্ধবের লগে চলতে গেলে যাওয়া লাগে। এত্তো মেজাজ দেখাইয়ো না।”

    রহিমা ভাতের হাড়ির ঢাকনা কারিমার দিকে ছুড়ে মেরে বললো,

    “হারামির বাচ্চা! সারাদিন যে মায় না খাইয়া রইছে, মায়ের মুখে দুইটা ভাত তুইলা দিতে পারলি না? আইছোস আবার বন্ধুবান্ধব নিয়া চলতে! মা রে একলা ফালাইয়া তুই দাওয়াতে গেলি ক্যামনে? আরেকদিন খালি দেইখা নেই। তারপর তোর বন্ধুবান্ধব ছুটাইতাছি!”

    কারিমা মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো পাশের রুমে। রহিমা বকবক করতে করতে বাটিতে দুই মুঠ চিড়া ভিজিয়ে নিলো আর এক টুকরো গুড় নিলো। তারপর মাকে জোর করেই খায়িয়ে দিলো। অত:পর নষ্ট ভাতে পানি ঢেলে শুটকির ভর্তা বানানোর ব্যবস্থা করলো। এরমাঝে পাশের রুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখেছিলো কারিমা বই খুলে গোমড়া মুখু হয়ে চুপচাপ বসে আছে। দৃষ্টি তার বইয়ের দিকেই। এখন পড়ছে না কিছু ভাবছে তা কেবল সে-ই ভালো জানে!

    আজ ঘরে রাতের খাবার হলো পান্তা ভাত আর শুটকির ভর্তা। ভাত প্রায় গলে গেছে যা কারিমার রুচিতে আটছিলো না। কিন্তু রহিমার হাতে ঠুসি খেয়ে তাকে এই ভাতই গলদকরণ করতে হলো। অযথা অন্ন নষ্ট করবে না তাই রহিমা এই ভাতই পেট পুড়ে খেয়েছে। যদিও কারিমা দুতিন লোকমা গিলেছে। আর তাদের মায়ের খাবার চিড়া গুড়।

    .

    নিত্যদিনের মতো আজও রহিমা কাইয়ুম ভিলায় এসে দেখলো মারিয়া কাইয়ুম চেচামেচি করছে আয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে বলে। কিন্তু তা যেন আয়ানের অভ্যাস হয়ে গেছে। এই চেচামেচিতে তার ঘুম এখন আর ভাঙে না। রহিমা মারিয়া কাইয়ুমের উদ্দেশ্যে বললো, 

    “আম্মা, কান্নাকাটি কইরা কান ঝালাপালা কইরেন না তো! কানের পোকা মইরা যাইতাছে! আপনাগো বাড়িতে পা রাখলে মনে হয় সার্কাস দেখতে আইছি!”

    মারিয়া কাইয়ুম কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললো,

    “তুই চুপ থাক! কানের আবার পোকা কিসের! আর তোর মতো কারণ ছাড়া চেচামেচি করছি আমি!”

    “কারণ আর অকারণ! ভালো কথা কইলে আপনাগো ভাল্লাগে না! অযথা এমনে চেচামেচি কইরা নিজের গলা ব্যাথা করতাছেন, আমাগো কানের পোকাও মাইরা ফালাইতাছেন! এই চেচামেচিতে কি আপনার পোলা আদৌও উঠবো!”

    “আবারও বলে কানের পোকা!”

    “সরি আম্মা। ভুল হইছে। সরি কইছি, তা-ও আপনে শালিকের মতো চেচামেচি কইরেন না। ভাইজানের ঘুম আমি ভাঙাইতাছি।”

    মুখ ফসকে শালিক কথাটা বেরিয়ে গেছে রাহিমার মুখে! রহিমাকে অকারণে বকবক করতে দেখলে পিংকি তাকে এভাবে শালিকের সাথে তুলনা করতো। আর আজ রহিমা মারিয়া কাইয়ুমকে বলে ফেলেছে সেই কথা! নিশ্চয়ই মারিয়া কাইয়ুম তার উপর রেগে যাবেন কথাটা শুনে, তাই রহিমা দ্রুত তার কাছ থেকে কেটে পড়লো। মিটশেফের কাছে এসে সে চাল ডাল বাছাইয়ে ব্যবহার যোগ্য স্টিলের থালাটা হাতে নিলো। মারিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিলো, রহিমা তাকে থামিয়ে দিতে তারাহুরো করে চলতে চলতে বলতে লাগলো, 

    “আম্মা, সরেন সরেন! ঘুম আমি ভাঙাইয়া দিয়া আসি…!”

    কথাটা বলেই রহিমা আয়ানের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্লেটটা রুমের ফ্লোরে আছড়ে ফেললো! এবং ঝনঝন শব্দ হওয়ার সাথে সাথেই সেখান থেকে দৌড়ে কিচেনে চলে এলো। মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক দাত বের করে হেসে রহিমা বললো,

    “এইবার দেখবেন ঘুম ভাইঙ্গা গেছে!”

    এমনি তারাহুরো করে কাইয়ুম সাহেব নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,

    “কিসের শব্দ হলো?”

    রহিমা হাসিমুখে বললো,

    “খালু, ভাইজানের ঘুম ভাঙাইতে প্লেট ঢিল মারছি।”

    কাইয়ুম সাহেব কোমড়ে হাত রেখে দাড়িয়ে ব্রু সামান্য কুচকে বললো,

    “ঘুম ভাঙাতে গিয়ে যে এখন আমার চশমাটা ভেঙে ফেললি! সেটার কি হবে!”

    রহিমা বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো,

    “হায় হায়! কি কন খালু! আমি আপনার চশমা ভাঙ্গি নাই! ভাঙ্গা তো দুরের কথা, ছুইয়াও দেখি নাই! সত্যি কইতাছি! মিথ্যা কইলে ঠাডা পড়বো আমার উপর, ঠাডা!”

    ” হুপ! কি বলিস এসব! আর আমি বলছি নাকি যে তুই আমার চশমা ধরেছিস?”

    “আয় হায়! খালু, আপনে দেখি গিরগিটির মতো রূপ পাল্টান! এই মাত্রই না কইলেন আমি ভাইঙ্গা ফালাইছি! আম্মা, আপনে শুনেন নাই খালু যে কইছে?”

    মারিয়া দাত কিড়মিড়িয়ে বললো,

    “রহিমা, তোর আচরণ আজ খুবই বাজে লাগছে! কার সাথে কিভাবে কি ধরনের কথা বলতে হয়, আজও সেটাই শিখতে পারলি না! এমন বেয়াদব হতে পারিস তুই, আমি ভাবতেও পারিনি!”

    বেয়াদব বলায় রহিমা মুখ মলিন করে চুপ হয়ে গেলো৷ আর সেদিকে কাইয়ুম সাহেব বললেন,

    “মারিয়া, মেয়েটাকে এভাবে বকাঝকা করো না তো। সে বুঝতে ভুল করেছে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। চশমা তুই ভাঙিসনি রহিমা। এমন শব্দ হওয়াতে আমার হাত থেকেই চশমাটা মেঝেতে পড়ে একটা গ্লাস ছুটে গেছে! সেটাই বলতে চাইছিলাম। কারণ শব্দটা তো তুই ই সৃষ্টি করেছিস।”

    “হ খালু, সুন্দরবন আর বান্দরবন ঘুইরা সব দোষ তো আমার উপরেই পড়বো! আপনাগো ভালা করতে গেলেই আমার জ্বালা!”

    রহিমা কিচেনে এসে কাজে হাত দিলো৷ কাইয়ুম সাহেব চলে গেলেন রুমে। মারিয়া রহিমার উদ্দেশ্যে বললো,

    “কাজে আটখানা, চাপায় ষোলোআনা! শব্দের কারণে চশমা তো ভেঙে খালাস, পারলি না এবার ঘুম ভাঙাতে?”

    রহিমা তীব্র মেজাজ নিয়ে স্টিলের গ্লাসটা হাতে নিলো যেটা ড্রাম থেকে চাল নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। কোনো কথা না বলে এবার সে দরজার কাছে না গিয়েই শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গ্লাসটা আয়ানের রুমে ছুড়ে মারলো! ঝনঝন আওয়াজে এবার আয়ান তেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আর দেখতে পেল রহিমা মাত্রই কিচেনের দিকে যাচ্ছে। বুঝতেও বাকি নেই এটা রহিমার কাজ। কিচেনে পা রাখা মাত্রই সে হনহন করে এসে রহিমার হাতটা ধরে ফেললো। তাকে হাত ধরে টেনে ডাইনিং টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

    “আমার রুমে এসব ছুড়ে ফেলার সাহস আসে কোত্থেকে তোর? আজ তো তোর হাতই আলাদা করে দিবো!”

    কথাটা বলেই ছুরি নেওয়ার জন্য টেবিলে রাখা কাটার সেটের উপর হাত দিলো আয়ান৷ এদিকে রহিমা বড়বড় চোখ করে “আম্মা…” বলে চিৎকার করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না! আম্মাকে ডাকার পরিবর্তে তাকে আল্লাহকে ডাকতে হলো! 

    “আল্লাহ…!” বলে জোরে চিৎকার দিতেই দুইদিক থেকে দুজন বেরিয়ে এলো! রহিমার হাত রক্তাক্ত!

    .

    দুপুরে হক মঞ্জিলে এলো রহিমা। সায়মা তার হাতে ব্যান্ডেজ দেখে চমকে উঠে বললো,

    “এই, কি রে! তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন?”

    রহিমা এতোক্ষণ ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও সায়মার কথায় এখন তার কান্না আসছে! সে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

    “আর বইলেন না আপা! গরিবের কপাল যে সবসময় পোড়া কপাল থাকে তা তো জানেনই। দুঃখের মধ্যে কান্দন আসে। এই ব্যান্ডেজ সত্যি সত্যি আপনার চোক্ষে পড়ে থাকলে এইডাও বিশ্বাস করেন, আমি যা কইতাছি একটাও মিথ্যা না।”

    এমনিতেই রহিমার এমন এলোমেলো ভাষা সায়মার কাছে বড্ড বিরক্তিকর। তারউপর একটা ঘটনা বলতে কত প্যাচিয়ে বলে যাচ্ছে কথা, যা সায়মার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না! তবুও সে শোনার জন্য চুপ করে রইলো। যেই রহিমা মূল ঘটনা বলতে যাবে এরই মাঝে ফারহানা হক নিজের রুম থেকে বেরিয়ে রহিমাকে দেখে বিস্মিত কন্ঠে বললেন,

    “হায় আল্লাহ! তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন রহিমা?”

    রাহিমা কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

    “আর কইয়েন না আম্মা! বিশ্বাস করেন আর না করেন! দুঃক্ষের মধ্যে কান্দন আসে! যা বলমু একটাও মিছা না!”

    আবারও একই প্রলাপে সায়মা ধমকের সুরে বললো,

    “এই তুই কি শুরু করেছিস এগুলো? দুঃখের মধ্যে কান্না আসবে না তো হাসি আসবে? হাতে কি হয়েছে সেটা জানতে চাইছি আর তুই দেশ বিদেশ ঘুরে আসছিস এইটুকু ঘটনা বলতে! এক কথায় বললে বল, আর না বলতে চাইলে চুপ থাক।”

    ফারহানা হক মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

    “আহ, সায়মা। বলতে দে তাকে। রহিমা, তুই বল।”

    রহিমা ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, 

    “আম্মা, আপায় আমারে দেখতে পারে না। তাই খালি খ্যাচ খ্যাচ করে আমার লগে! হেইডা আমি জানি। তা-ও আপনে আমার জননীর মতো আগ্রহ নিয়া আমার কাছে জানতে চাইলেন তাই বলি। ঘটনা হইলো গিয়া, আমি যেই বাড়িতে কাজ করি সেই বাড়ির ছোট পোলা কারণবশত আমার উপর রেগে গেছে! আর শাস্তি দিতে আমার হাতটা হুট কইরা ডাইনিং টেবিলে ফালাইয়া চট কইরা চাইপা ধরছে, ছুরি নিতে পুট কইরা কাটার সেটে হাত দিছে। তারপর মুট কইরা হাতে নিয়া কুট কইরা আমার হাতের পিঠে কোপ বসায় দিছে! বিশ্বাস করেন আম্মা, আমার কইলজাটা তখন লাফ দিয়া বাইরে বের হইয়া আবার ব্যাক লাফ দিয়া ভেতরে ঢুকছে!”

    রহিমার কথা শুনে এদিকে মা মেয়ে উভয়েই বিস্মিত! রহিমা হুহু করে কেঁদে উঠে বললো, 

    “আম্মাগো আম্মা! আল্লায় বাঁচাইছে গো আমারে। যার কারণে ছুরির বদলে ভাইজানের হাতে কাটা চামচ উইঠা আইছে! তাই মাত্র চারটা ছিদ্র হইছে হাতে! আর ভাগ্যিস, হাতের রগ গুলা চামচের দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে পইড়া গেছিলো! না হইলে আপনাগো কাজের বেটি রহিমা আজ কাজের বেটি হাত কাটা রহিমা হইয়া যাইতো!”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ৫

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    ঘটনা শুনে ফারহানা হক বিস্ময়ের সাথে বললেন,

    “এতো বড় এক কান্ড ঘটে গেলো, বাড়ির লোকজন কোথায় ছিলো?”

    রহিমা চোখ মুছে স্বাভাবিক গলায় বললো, 

    “বাড়ির মালিক আর মালকিন ছিলো। এই অবস্থা দেইখা মালকিন কিচেন থেকে খুন্তি নিয়ে দৌড়াইয়া আসছে আর মালিক আমার চিৎকার শুনে খালি হাতেই দৌড়ে আসছে।”

    ফারহানা ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, 

    “তারপর মালকিন কি খুন্তি নিয়ে দৌড়ে এসে তোকে আবার মেরেছে?”

    তার মায়ের এমন উক্তিতে সায়মা কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই রহিমা বললো, 

    “আম্মার যে কথা! খুন্তি কি আমারে মারার জন্য আনছে! উনার পোলা যে চিরিয়াখানার এক নম্বর বান্দর, সেইটা কি তাগো অজানা! পোলারেই মারতে আইছে।”

    “তারপর কি হলো? মেরেছে তো অনেকগুলো?”

    “আরে না! কইলাম না, এক নম্বর বান্দর পোলা! আমার হাতে কোপ মাইরা সাথে সাথে দৌড়াইয়া নিজের রুমে ঢুকছে তো ঢুকছেই! খালু আমার হাতে রুমাল প্যাচাইয়া ডাক্তারের কাছে নিয়া গেলো, ব্যান্ডেজ করাইয়া আনলো তারপর বাড়ি ফিরা দেখলাম আম্মায় হাতে খুন্তি নিয়াই চেয়ারে বইসা আছে। তারপর একসাথে খাইতে বইলাম। আমার হাত তো ব্যান্ডেজ করা, তাই আম্মা চামচ দিয়া খাওয়ায় দিলো। তারপর আমার সেবাযত্ন করলো। কয়েকদিনের ছুটি দিলো, কিছু টাকা দিলো, উনার পোলারে বকলো৷ দুপুর হইলো, আমি চইলা আইলাম, এখনো সেই বান্দর রুমের ভেতর বন্দী। ডি জে গান ছাইড়া মনেহয় আবার ঘুমায় রইছে৷”

    ফারহানা হক রাগান্বিত হয়ে বললেন,

    “সাংঘাতিক ছেলে! একে তো পুলিশে দেওয়া দরকার!”

    রহিমা চোখ বড় করে বললো, 

    “আয় হায়! না আম্মা। এইডা কি কন! পুলিশে দিলে ছেলের তো কিছু হইবো না! যা যাওয়ার সব যাইবো বাপের! মানসম্মানও যাইবো, ছেলেকে হাজত থেকে বাহির করতে টাকাকড়িও যাইবো। মাঝখানে বইসা বইসা পুলিশ হাত মোটা করবো। আর এই বান্দর তখন আবার আমারে চান্দের দেশে পাঠায় দিবো। দরকার নাই এইসবের! আমি আমার টিনের ঘরেই ভালা আছি। চালে দুইতিনটা ফুটা আছে, চাঁদ উঠলে ঘরে শুইয়া শুইয়াই দেখা যায়। কি কাম করা লাগবো কন আমারে। কইরা দিয়া তারাতাড়ি বাড়ি ফিরা যাই।”

    হাতের এই অবস্থার জন্য রহিমাকে আর তেমন কোনো কাজ করতে দেওয়া হলো না এ বাড়িতেও। সায়মা যখন বাগানে পানি দিতে যাচ্ছিলো তখন রহিমা এক হাতে শুধু পানির পাত্র এগিয়ে দিচ্ছিলো আর এক হাতে ঘর ঝাড়ু দিয়েছিলো। বাকি সময়টুকু বসে বসে বকবক করেই কেটেছে তার! তবে আজ  সায়মাকে ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে রহিমা। তার বকবকে তেমন বিরক্ত বোধ করেনি। বিকেলে বাগানে পানি দিয়ে ছাদ থেকে এসে যখন হাতমুখ ধুয়ে সায়মার কাছে যাচ্ছিলো তখন দেখলো দরজা ভেতর থেকে লক করা। তবে সায়মার রাগী কণ্ঠ শুনতে পেয়েছে রহিমা। সে কান পেতে শুনার চেষ্টা করলো সায়মার কথাবার্তা। পরক্ষণে বুঝতে পারলো সায়মা তার ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করছে। এটা শুধু ঝগড়া মনে হয়নি তার কাছে। এটা তুমুল ঝগড়া! 

    রহিমা দৌড়ে ফারহানার রুমে এলো। ফারহানার বদলে পেয়ে গেলো আবু সালেহ হককে। তিনি রহিমার উদ্দেশ্যে বললো, 

    “কি রে?”

    “খালু, আম্মা কই?”

    “রান্নাঘরে দেখ।”

    রহিমা দৌড়ে কিচেনে এসে বললো, 

    “আম্মাগো! সর্বনাশ হইয়া গেছে!”

    তারা এতোক্ষণ ছাদে ছিলো বিধায় রহিমার কথায় ফারহানা চমকে উঠেছেন! এক মুহুর্তের জন্য তিনি ভেবে ফেলেছেন ছাদ থেকে বুঝি কোনো অঘটন ঘটে গেছে! তাই তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন,

    “কি হয়েছে?”

    “চুলাচুলি লাগছে!”

    “চুলাচুলি!”

    “হু, আপায় মনে হয় চুলাচুলি লাগছে!”

    “কি বলছিস এসব! সায়মা চুলাচুলি লাগছে! কার সাথে?”

    “বান্ধবীর সাথে।”

    ফারহানা কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন, 

    “বান্ধবী! কোথায়?”

    “ফোনে।”

    ফারহানা পথচলা থামিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন রহিমার দিকে! রহিমা ভেজা বিড়াল ন্যায় বললো, 

    “এমনে তাকান ক্যা? মিছা কথা কই নাই তো। আপায় রুমের ভেতর থেকে ঝগড়া করতাছে। শুধুমাত্র আপার গলাই শোনা যায় তাই ভাবছি ফোনে। বিশ্বাস না হইলে দেইখা আসেন।”

    “তাই বলে তুই এসব বলবি!”

    “ক্যা আম্মা, ফোনে কথা বলা যায়, ছবি তোলা যায়, সরাসরি দেখা যায় তাইলে চুলাচুলি করা যায় না?”

    ফারহানা রাগান্বিত গলায় বললেন, 

    “বেরিয়ে যা। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে। আগামী তিনদিন তুই কাজে আসবি না। তিনদিনেও যদি সুস্থ না হোস তো চারদিন পর আসবি। আর সবার আগে মাথা ঠিক করবি। আমার তো মনে হচ্ছে কাটা চামচ তোর হাতের পিঠে না পড়ে মাথার মগজে দেবে গেছে! নতুবা এমন আলতু ফালতু কথা আসে কোত্থেকে!”

    “আম্মা, ওই বাড়ির আম্মা কইতো পেট থেকে কথা আসে! আর আপনে বলেন মাথা থেকে কথা আসে! দুইজনই শিক্ষিত জননী। কার কথা বিশ্বাস করমু আপনারাই বলেন?”

    “রহিমা, তুই যাবি এখান থেকে!”

    ফারহানা ধমক দেওয়ায় রহিমা বিড়বিড় করতে করতে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসছিলো। এমনি সায়মা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তার চোখেমুখেও রাগ স্পষ্ট। কিন্তু সে স্বাভাবিক গলায় রহিমাকে বললো, 

    “চলে যাচ্ছিস?”

    রহিমা চ্যাটাং চ্যাটাং জবাব দিলো, 

    “হু, যাইগা। কারো মুখের বিষ হইয়া বেশিক্ষণ থাকতে পারতাম না। এই কাজের বেটি রহিমা বইলা শুধুমাত্র আপনাগো দিকে তাকাইয়া আপনাগো বাড়িতে এখনো কাজ কইরা যায়। তবুও বুঝেন না আপনারা।”

    বলতে বলতে রহিমা বেরিয়ে গেছে। সায়মা তার মাকে বললো, 

    “আবার কি বললে যে এতো রেগে গেলো?”

    “তোর পরিচিত কেউ থাকলে বল এই মেয়ের জন্য পাবনা মানসিক হসপিটালে একটা সিট বুকিং করতে। নয়তো দেখবি, আমিই পাগল হয়ে গেছি।”

    সায়মা মৃদু হেসে বললো, 

    “মাথা ঠান্ডা করে এক গ্লাস পানি পান করো আগে। আর রাতের জন্য রান্না আজ আমি করি। ভূনা খিচুড়ি খাবে?”

    “তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে আয়।”

    “আচ্ছা।”

    “এই শোন?”

    “হুম?”

    “কি হয়েছে তোর?”

    “কোথায় কি হলো!”

    “চেহারা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে! রহিমাও আমাকে ভয় পায়িয়ে দিলো কি আজগুবি খবর দিয়ে!”

    “কিসের খবর?”

    “তুই নাকি চুলাচুলি লেগেছিস ফোনে!”

    “মা, তুমি কি বলছো এসব!”

    “রহিমা বললো এসব। আর এজন্যই তো বকা দিলাম তাকে! তা হয়েছে কি শুনি? ফোনে কথা বলছিলি কার সাথে?”

    “ফ্রেন্ডের সাথে।”

    “ঝগড়া করেছিস?”

    “হুম, করেছি একটু।”

    “মীমাংসা হয়েছে?”

    সায়মা আবারও মৃদু হেসে বললো,

    “মাত্র তো ঝগড়া করলাম৷ হয়ে যাবে মীমাংসা। যাও, আগে তুমি পানি পান করো।”

    .

    তিনদিন পর রহিমা হক মঞ্জিলে এসে দেখলো বাড়িতে কাজকর্ম জমে ঘন হয়ে আছে!  রুমের আসবাবপত্র এলোমেলো। বাইরে থেকে লোক আনা হয়েছে উত্তরপশ্চিমের রুমটা ঠিকঠাক করার জন্য। কিছু নতুন আসবাব আনা হয়েছে আর পূর্বে যা ছিলো তার সবটা স্থানান্তর করে সজ্জিত করা হচ্ছে। রহিমা এতোসব দেখতে দেখতে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে। রহিমাকে দেখে সায়মা এগিয়ে এসে বললো, 

    “কি রে, কেমন আছিস তুই। সুস্থ হয়েছিস? হাতের ক্ষত কমেছে?”

    “হেইডা আমি জানি না। ডাক্তার বলতে পারবো আমি কেমন আছি।”

    “সবসময় তোর মুখে এমন উল্টাপাল্টা কথা কেন আসে, আমি বুঝি না সেটা!”

    ” আইচ্ছা, বুঝলে ভালা না বুঝলে আরও ভালা! তা আপনে আমারে বলেন তো আপা, বাড়ি উল্টাপাল্টা হইতাছে ক্যা? নিজের বাড়ি কি ছাইড়া দিতাছেন নাকি? আসবাবপত্র এমন ঠেলাঠেলি লাগছে ক্যা?”

    “না, ভাইয়া আসবে দুদিন পর। ভাইয়ার রুমটা ডেকোরেট করছি।”

    “ওহ! আবার চইলা যাইবো নাকি বিয়া সাদি কইরা থাইকা যাইবো?”

    সায়মা কিছুটা নিচু স্বরে বললো, 

    “চলেই যাবে। বিয়ে সাদি যা করার করেই ফেলেছে। বাচ্চাও আছে।”

    “ও মা! কয় কি! বিদেশি বেডি বিয়া করছে?”

    সায়মা তার উপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,

    “আগে তুই মুখের ভাষা ঠিক কর। তারপর আমার সাথে কথা বলতে আসবি।”

    “আরে আপা! শুনেন শুনেন!”

    সায়মা আর তার কথা শোনার জন্য বসে নেই। ভুলভাল বলার কারণে রহিমা নিজের মাথায় নিজেই ঠুসি দিয়ে ফারহানার সাথে দেখা করলো। অত:পর লোকগুলো আসবাব ঠিক করে চলে গেলে রহিমা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দিলো পুরো বাড়ি। হাত ক্ষত হওয়ায় কাইয়ুম ভিলা থেকে সপ্তাহখানেক ছুটি পেয়েছে বিধায় সায়মা রহিমাকে বলে দিলো কাল যেন একটু তারাতাড়ি আসে। কারণ কাল সে শপিং করতে যাবে।

    সায়মার কথামতো রহিমা সকালে চলে এসেছে হক মঞ্জিলে। নাস্তা করে এসেছে তবুও সায়মা তাকে নাস্তা করতে বাধ্য করলো। অত:পর চলে গেলো বসুন্ধরা শপিং সেন্টারে। ঘুরেফিরে কেনাকাটা করে লাঞ্চ করেছে রেস্টুরেন্টে। আরও কিছু কেনাকাটা বাকি থাকায় লাঞ্চের পর আবারও শোরুমে প্রবেশ করলো। রহিমাকে এক সেট পোশাক কিনে দিয়েছে সায়মা। অত:পর তারা বাড়ি ফেরার জন্য বেরিয়ে আসছিলো। লিফটে চড়ে নামার সময় সায়মা সিড়িতে উঠে গেছে আর হাত থেকে একটা ব্যাগ পড়ে যাওয়ায় রহিমা একটু পেছনে পড়ে গেছে। যার ফলে সায়মা তার থেকে সিড়ির চার ধাপ এগিয়ে। আজও রহিমা আয়ানকে দেখতে পেল এখানে! তারা নামছে আর আয়ান পাশের লিফটে চড়ে উপরে উঠছে। আজ সে একা। আয়ান লিফটের রেলিংয়ে কনুই ভর করে গালে হাত রেখে সায়মার দিকে একমনে তাকিয়ে ছিলো যতক্ষণ পর্যন্ত না সায়মা তাকে অতিক্রম করে নিচে নেমেছে! কিন্তু সায়মার এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পেছনে থেকে রহিমা লক্ষ্য করেছে সম্পূর্ণ বিষয়টি। সায়মা নিচে নেমে যেতেই আয়ান যখনই রহিমাকে দেখতে পেল তখনই যেন চমকে সোজা হয়ে দাড়ালো এবং মাথা চুলকাতে চুলকাতে এদিকসেদিক তাকিয়ে উপরে উঠে গেলো। রাস্তাঘাটে মেয়েদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রহিমা আজও আয়ানের দিকে রেগেমেগে তাকিয়েছিলো! আর রহিমার কাছে ধরা পড়ে যেতেই আয়ানের এমন আচরণ! তবে রহিমা আজ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে! আয়ানের নামে এই বিচারটা দিবেই মারিয়া কাইয়ুমের কাছে!

    .

    পাঁচদিন ছুটি কাটানোর পর আজ ষষ্ঠ দিনে ভাবলো, সে যেহেতু কাজকর্ম করতেই পারে সেহেতু অযথা ছুটি কেন কাটাবে! বরং কাজে যাওয়া যাক। যেই ভাবা, সেই কাজ৷ সকাল সকাল রহিমা চলে এলো কাইয়ুম ভিলায়। তবে দোতলায় উঠতে পারেনি ঠিকমতো! অর্ধেক সিড়ি অতিক্রম করে আসতেই দেখলো মেইন দরজার সামনে আয়ান দাড়িয়ে আছে! তার হাতে দিয়াশলাই! রহিমাকে দেখে আয়ান ইতরমার্কা হাসি দিয়ে একটা কাঠি জ্বালিয়ে আবার ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে বললো,

    “ওয়েলকাম, সকিনার মা রহিমা! আসুন আসুন, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তো আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম! কাল যেহেতু ওবাড়িতে কাজে গেছেন সেহেতু আমি নিশ্চিত ছিলাম এবাড়িতেও আজ আসবেন। তাই তো আপনার জন্য বাতি নিয়ে দাড়িয়ে আছি। কি হলো? সেখানে দাড়িয়ে গেলেন কেন? উপরে আসুন।”

    রহিমা ভয়ে তড়িঘড়ি করে আবার নিচে নামতে গেলে আয়ান ধমকে বললো,

    “একধাপ নিচে নেমে দেখ, সিড়ি থেকে ধাক্কা মেরে পা ভেঙে দিবো।”

    রহিমা কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বললো,

    “এমন করতাছেন ক্যা? আমি কি করছি?”

    আয়ান আবারও ইতরমার্কা হাসি দিয়ে বললো,

    “কিছু করিসনি এখনো। তবে যাতে না করতে পারিস সেজন্যই সাবধান করতে এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে দাড়িয়ে আছি! আমি রাস্তায় রাস্তায় লুইচ্চামি করি তাই না?”

    রহিমা মাথা নেড়ে না করলে আয়ান বললো,

    “উঠে আয় চুপচাপ। আর মুখ একদম লক করা থাকবে। আমার নামে আব্বু আম্মুর কাছে কোনো নালিশ জমা পড়লে তোর চৌদ্দটা বাজিয়ে ছাড়বো। মনে থাকে যেন। ভেতরে যা। কি হলো, দাড়িয়ে আছিস কেন? উপরে আয়!”

    “আপনার সাথে বিশ্বাস নাই।”

    “এখন না এলে বিশ্বাস নতুন করে হারাবি! চুপচাপ উঠে আয়। কিছু করবো না, আয়।”

    রহিমা গোমড়া মুখু হয়ে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এলে আয়ান আরেকটা কাঠি জ্বালাতেই রহিমা ভয়ে থেমে গেছে। আয়ান তাকে দরজা ঠেলে ভেতরে যেতে ইশারা করলে সে আবার চলতে লাগলো। আয়ান কাঠির আগুন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে তার পিছু পিছু ঘরে যেতে যেতে “বড় লোকের বেটিলো” গানের সুর টেনে গান ধরলো, 

    “কাজের বেটি রহিমা, 

    ঝাকড়া মাথার চু…ল!

    আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিবো,

    আবার করলে ভু…ল!”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ৬

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    রহিমা ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই শুনতে পেল নবজাতকের কান্না! সায়ানের রুমের দরজাও খোলা, সায়ানকেও দেখতে পেয়েছে ড্রয়িং রুমে। তার মানে গোলাপি ভাবি বাচ্চা নিয়ে এসে পড়েছে!

    রহিমা বাচ্চাকে দেখার জন্য উৎফুল্ল হয়ে নিজের পার্সটা রাখলো কিচেনে। অত:পর তারাহুরো করে সায়ানের রুমের দিকে যেতে লাগলো। রুমের ভেতর বাচ্চার পাশে পিংকি এবং মারিয়া কাইয়ুম আছে। দরজার কাছে যেতেই পিংকি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

    “এই দাড়া! এখানে আসছিস কেন?”

    “বাবুরে দেখতাম।”

    “গোসল করে এসেছিস?”

    “হু।”

    “এখানে এসে হাতমুখ ধুয়েছিস?”

    রহিমা মাথা দু’দিকে নাড়তেই পিংকি বললো,

    “ভালোভাবে হাতমুখ ধুয়ে আয় আগে।”

    রহিমা কিছুটা বিরক্ত বোধ করলো পিংকির কথায়। তবুও বাবুকে দেখার জন্য সে হাতমুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে গেলো। আয়ান ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেডে জেল নিয়ে খাচ্ছিলো। রহিমা সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই আয়ান বললো,

    “সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বাবুর কাছে যাচ্ছিস? দেখবি এখন আবার বলবে এইটুকু যেতে যেতে ময়লা লেগে গেছে শরীরে।”

    রহিমা তার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সায়ানের রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,

    “বাবুর কান্নার আওয়াজে  আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠছেন না আপনে?”

    আয়ান মুখ চেপে মৃদু হাসলো শুধু। কিন্তু কিছু বললো না। খাওয়াতে ব্যস্ত সে। তবে রহিমা নিশ্চিত, তাকে হুমকি দেওয়ার জন্য নয় বরং বাবুর কান্নাকাটির কারণে আয়ান আজ দ্রুত ঘুম থেকে উঠেছে।

    রহিমা রুমে প্রবেশ করতেই পিংকি তাকে আবারও দাড় করিয়ে দিলো। অত:পর কিছু একটা তার শরীরে স্প্রে করে দিলো এবং একটা বোতল থেকে দুতিন ফোটা তরল পদার্থ তার হাতে ঢেলে দিয়ে বললো হাত মেসাজ করতে। রহিমা তার কথামতো কাজ করতেই ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব করলো। তাই উৎফুল্লতার সাথে জিজ্ঞেস করলো,

    “ভাবি, এইটা কি দিলেন?”

    “হ্যান্ড স্যানিটাইজার।”

    “কি?”

    “হ্যান্ড স্যানিটাইজার।”

    “ওহ্! কিজন্য দিলেন?”

    “তোর হাতে জীবানু আছে, তা দূর করতেই এটা দিলাম।”

    “আমি কিছুক্ষণ আগে সাবান দিয়া মাইজ্জা গোসল করছি আবার এইমাত্র সাবান দিয়া হাতমুখ ধুইছি। তাইলে জীবানু আসে কোত্থেকে!”

    “জীবানু খালি চোখে দেখা যায় না। বাতাসে উড়ে। বুঝতে পেরেছিস!”

    রহিমা মনে মনে বললো,

    “একটু আগে যা কইছেন তা হান্ড্রেড পার্সেন ঠিক কইছেন ছোট ভাইজান! শিক্ষিত নামের এক কুক্ষাত ভাবি এই গোলাপি! হুহ্! কত নমুনা! শুধু বাবুটারে দেখমু বইলা আইছি। নয়তো গোলাপির রংও দেখতে আইতাম না!”

    মনে মনে কথা বলতে বলতে রহিমা মারিয়ার কাছ থেকে বাচ্চাকে কোলে নিলো। বাচ্চার মুখ দেখে রহিমার মুখে উচ্চারিত হলো, “মাশাল্লাহ।”

    ফুটফুটে শিশু দেখতেই তার প্রাণ জুড়িয়ে গেছে! মনে মনে এটাও ভাবলো যে, “বড়লোকের ঘরেই কি আল্লাহ শুধু এমন ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা পাঠায়? গরীবের ঘরে কেন সহজে চোখে পড়ে না?”

    পরক্ষণে আবার ভাবলো,

    “না, বাবা-মা যেমন থাকে বাচ্চারাও তেমন হয়। বাবা মা ফর্সা তো বাচ্চারাও ফর্সা আর বাবা মা কালো তো বাচ্চারাও কালো। আর যদি তা না হয় তো সেটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য।”

    রহিমার কোলে থাকাকালীন মারিয়া কাইয়ুম জিজ্ঞেস করলেন, 

    “তোর হাতের কি অবস্থা, রহিমা? ব্যাথা আছে এখনো?”

    “না, আম্মা। সাইরা গেছে।”

    “ওষুধ খেয়েছিস ঠিকমতো?”

    “হু।”

    “ব্যান্ডেজ খুলবে কবে?”

    “ডাক্তার এক সপ্তাহ রাখতে বলছে।”

    অত:পর মারিয়া কাইয়ুম বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। দুতিন মিনিট পরেই পিংকি বাচ্চাকে নিয়ে নিলো রহিমার কাছ থেকে এবং কাপড়ের ঝুড়ি দেখিয়ে বললো,

    “ভালোই হয়েছে তুই এসে গেছিস। কাল বাড়ি ফিরে যখন শুনলাম তুই ছুটিতে আছিস, তখন খুব বড় টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার তো তেমনভাবে নড়াচড়া নিষিদ্ধ। মা তো বাচ্চাকেই রাখবে। তাহলে ময়লা কাপড়চোপড় কাচবে কে! আগে জানলে আমি আসতামই না এখানে। দ্রুত ধুয়ে দে। অনেকগুলো জমে গেছে।”

    রহিমা ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে কাপড়ের ঝুড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। আর মনে মনে বললো, 

    “হায়রে মানুষ! হাতে যে ব্যান্ডেজ করা, সেইটাও চোখে পড়লো না! কাপড় কি এক হাতে কাচা যায়, সেই আক্কেলও কি নাই!”

    রহিমা কাপড় কেচে বারান্দায় শুকাতে দিলো। হাতের ব্যান্ডেজ ভিজে একাকার। সে অন্য হাতে ব্যান্ডেজ খুলতে খুলতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। মারিয়া কাইয়ুম দেখে বললো,

    “এটা খুলছিস কেন?”

    “ভিজে গেছে, আম্মা।”

    “ভেজালি কেন?”

    “কাজ করতে গেলে কি আর এতোকিছু খেয়াল থাকে!”

    “এখন প্রব্লেম হবে না?”

    “ধুর! কাজের বেটিগো পবলেম আর টবলেম! কাজ করমু, রোজগার করমু, ভাত গিলমু। ব্যাস, দিন শেষ। কি কাজ করা লাগবো বলেন।”

    আয়ানের রুম ঝাড়ু দিতে এসে আয়ানকে রুমে দেখতে পেল রহিমা। আয়ান কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। রহিমা তাকে বললো,

    “ভাইজান কোথায় যান?”

    “কেন?”

    “আমারে একটা ই আইন্না দিবেন?”

    “ই কি?”

    “ই। কি জানি বলে!”

    “আমি কি জানি কি বলে!”

    “ওহ্, ওইযে সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজার!”

    “সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজার! এগুলো দিয়ে তুই কি করবি?”

    “আরে, পোশাক না। ওইযে হাতে দিয়া ঘষা দিয়া যে জীবানু ধ্বংস করে সেই জিনিস। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। বাবুরে কোলে নেওয়ার আগে ভাবি দিলো। নাম মনে রাখতে সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজার মনে রাখছি।”

    “স্যানিটাইজার?”

    “হু। হু। দাম কত?”

    আয়ান হেসে উঠলো এবং বললো,

    “তোর সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজার পড়া লাগবে না। কারণ তোর বেশিরভাগ সময় কাটে চুলোর ধারে! এগুলো ব্যবহার করে চুলোর পাশে গেলে চুম্বকের মতো টেনে আগুন ধরে যাবে। সাথে সাথেই ঠোসা পড়ে তখন টাউজারের পরিবর্তে প্লাজু  হয়ে যাবি।”

    “হায় হায়! কি কন! উপকারের চেয়ে দেখি বেশি যন্ত্রণার জিনিস! থাক, লাগবো না।”

    “তোর হাত দেখি?”

    সেদিনের ঘটনা মনে হাতেই রহিমা হাত থেকে ঝাড়ু ফেলে ঝটপট হাত লুকিয়ে ফেললো। আয়ান তার কান্ড দেখে বললো,

    “হাত লুকাতে বলিনি। দেখাতে বলেছি।”

    “আপনে কই যাইবেন, যান। আমি ঘর ঝাড়ু দিমু।”

    “তুই হাত দেখাবি, নাকি ওই হাতটাও ফুটো করবো?”

    রহিমা দূর থেকেই হাতের পিঠ উল্টে দেখালো। আয়ান দেখে ঠোঁটের কোনে ইতরমার্কা হাসি ফুটিয়ে বললো,

    “সাবধানে থাকিস। পরবর্তীতে পাশের হাতে আটটাও হতে পারে!”

    রহিমা তেজে ঝাড়ু হাতে নিয়ে রুম ঝাড়ু দিতে লাগলো। আয়ান বেরিয়ে গেলো।

    আয়ান সকালে বেরিয়েছিলো আবার দুপুরে বাড়ি ফিরে এসেছে বোন আয়মানকে নিয়ে। বড় ভাইয়ের বাবুকে দেখতে এসেছে আয়মান। এখানে থাকবে কিছুদিন। এমনিতেই বাড়ির কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে রহিমা। আয়মান এলে তার ব্যস্ততা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কারণ আয়মানের বাচ্চারও যথেষ্ট কাজকর্ম করতে হয়! আজ পুরোটা সময় তার ব্যস্ততার মাঝেই কাটলো। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলারও যেন সময় হলো না। 

    ঝটপট কাজ করে দুইটা বাজতেই সে বেরিয়ে গেলো। আর যাইহোক, কাজে যাওয়ার সময়টা মেইনটেইন করার চেষ্টা করে রহিমা।

    গেইট দিয়ে বের হওয়ার সময় লাল মিয়া বিদ্রুপস্বরূপ বলে উঠলো,

    “কি রে পেত্নী! চেহারার এই অবস্থা ক্যান? ভাবিজান ফিরা বুঝি টাইট দিছে আজকা? ফাঁকিবাজ গো এমনে টাইটেই রাখতে হয়।”

    রহিমা বিরক্তির সাথে বললো,

    “ঝগড়া করার মুড নাই। কথা কইবেন না কইলাম!”

    লাল মিয়া দাত কেলিয়ে বললো,

    “মুড ক্যামনে থাকবো! আছাড় মারলে মুড ঠিক থাকবো নাকি! দিছে নাকি দুই চাইরটা মুঙ্গুর!”

    এমনি আয়ান এসে হাজির। শেষ কথা শুনে লাল মিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,

    “সমস্যা কি তোর? রহিমার সাথে তুই প্রায়ই এমন করিস কেন?”

    “কই ভাইজান?”

    “কই মানে! আমি দেখি না নাকি! সবসময় আজেবাজে কথা বলিস, ঝগড়াঝাঁটির চেষ্টা করিস। এই রহিমা, ডিস্টার্ব করে না তোকে?”

    “হু ভাইজান। সবসময় টিতকারী মাইরা কথা কয় এই ব্যাডা!”

    “লাল মিয়া, আরেকদিন যদি এমন কিছু দেখি বা শুনি তবে তোর অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়বো। এখানে থাকতে হলে ভদ্রলোকের ন্যায় থাকবি। মনে থাকে যেন! রহিমা, এরপর যদি লাল মিয়া তোকে ডিস্টার্ব করে তো ডিরেক্টলি আমার কাছে বলবি।”

    লাল মিয়াকে শাসিয়ে আয়ান গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। রহিমাও লাল মিয়াকে ভেঙচি কেটে চলে গেলো। আর লাল মিয়া রহস্যমাখা দৃষ্টিতে তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো!

    রহিমা বেরিয়ে হাটতে শুরু করলো হক মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে। আয়ানও সেই পথেই হাটছিলো ধীর গতিতে। রহিমা ঘনঘন পা ফেলে আয়ানের পাশাপাশি আসতেই আয়ান তার দিকে একটা গিফট বক্স এগিয়ে দিয়ে বললো,

    “এটা রাখ।”

    রহিমা হাটা থামিয়ে বললো,

    “কি?”

    “গিফট।”

    “কি গিফটা?”

    “টিকটিকি, তেলাপোকা, ইঁদুরের বাচ্চা, সাপের বাচ্চা।”

    “হুহ!”

    রহিমা বক্স না নিয়ে ব্রু কুচকে ভেঙচি কেটে আবার সামনে পা ফেলতেই আয়ান ধমকে বললো,

    “ধর!”

    “আমি এগুলা নিমু ক্যা? আপনের দরকার, আপনেই রাখেন!”

    এবার আয়ান স্বাভাবিক গলায় বললো,

    “নে ধর। ওসব নেই। ভালো কিছু আছে। টাকা খরচ করে কেনা। টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই ইঁদুরের বাচ্চা কিনবো না!”

    “ভেতরে যা-ই থাকুক, আমারে গিফট দিবেন ক্যা?”

    “এইবার না লাইনে এসেছিস! শোন, তুই যেহেতু আমার শত্রু। জেনেশুনে নিশ্চয়ই আমার জন্য ভালো কাজ করবি না। কিন্তু তোর নিজের অজান্তেই আমার একটা উপকার করে ফেলেছিস। যার জন্য আমার পকেট খরচ করে কিছু গিফট করলাম। ইচ্ছে তো করছিলো রেস্টুরেন্টে ট্রিটসহ আরও অনেক কিছু দেই। কিন্তু আপাতত আমার পকেট ফাঁকা।”

    আয়ান রহিমার হাতে বক্স ধরিয়ে দিয়ে শার্টে আটকানো সানগ্লাসটি চোখে পড়ে নিলো৷ অত:পর প্যান্টের পকেটে এক হাত রেখে অন্যহাতে ফোন চাপতে চাপতে আবার বাড়ির দিকে চলে এলো। রহিমার কাছে তার চলাফেরা, স্টাইল পুরোই হিরোর মতো। এতোক্ষণ যাবত লাল মিয়া গেইটের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে তাদের কিছু আদানপ্রদান ও কথা বলতে দেখেছে। আয়ানকে ফিরে আসতে দেখে সে দ্রুত সরে এলো।

    এদিকে রহিমা ভাবছে, বক্সের ভেতরে কি সত্যি সত্যিই কোনো সুন্দর গিফট আছে নাকি এই আয়না ভাইজান তাকে ইঁদুরের বাচ্চার মতোই ভয়ংকর কিছু গিফট করেছে! সকালে হাতে আগুন নিয়ে দাড়িয়ে ছিলো তাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য, আর এখন সে সুন্দর গিফট দিবে সেটা কি বিশ্বাস্য! সকাল থেকে এইটুকু সময়ে তার জন্য কি এমন ভালো কাজ করে ফেললো যার ফলে আয়ান তাকে সুন্দর কিছু গিফট করতে আসবে! রাস্তায় দাড়িয়ে কি এখন বক্সটা খুলে দেখবে একবার!

    রহিমা বক্স খুলবে কি খুলবে না তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে ছোট ছোট কদমে হাটছে। পরক্ষণে কাজে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তা মনে হতেই বক্স পার্সে রেখে হনহনিয়ে হাটতে লাগলো।

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ৭

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    হক মঞ্জিলে এসে রহিমা দেখতে পেল সায়েম ইশতিয়াক তার বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি এসে পড়েছে! কিন্তু বাড়িটা কোলাহলের পরিবর্তে নিত্যদিনের চেয়েও বেশি নিরব। বাচ্চার কান্নাকাটির শব্দ নেই। বাড়িতে প্রবেশ করে শুধুমাত্র সায়মাকে দেখতে পেয়েছে। আর সায়মা তাকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে শুরুতেই চুপ থাকতে বলে দিয়েছে। সায়মার ইশারায় রহিমা আন্দাজ করতে পেরেছে যে বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে! রহিমা হক সাহেবের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো আবু সালেহ হক গম্ভীরভাবে খাটে বসে আছেন। আর সোফায় ইশতিয়াক অপরাধী মনোভাবে ব্যথিত হয়ে বাবার সামনে বসে আছে। সে জানতো তার বাবা-মা বিদেশিনী মেনে নিবে না। তাই লুকিয়ে ছিলো এতোদিন। কিন্তু সত্য যে চাপা না থেকে সামনে বেরিয়েই আসে। তাছাড়া পরিবারের কাছে সে-ই বা লুকিয়ে থাকবে কতদিন!

    রহিমা কিচেনের দিকে এগিয়ে দেখলো ফারহানা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। আর সায়মা ঘুরেফিরে এই কাজ সেই কাজ করে যাচ্ছে! রহিমা হাতের পার্স রেখে সায়মার রুমে এসে ফিসফিস করে বললো, 

    “আপা, সবাই এমন নিরব কেন?”

    সায়মা স্বাভাবিক গলায় বললো, 

    “ভাইয়া এসেছে দেখিসনি?”

    “হুম। কিন্তু এতে তো খুশি হওয়ার কথা!”

    “ভাইয়া বিয়ে করে যে লুকিয়েছে তা জানিস না?”

    “ওহ্! বুঝছি! ভাই আসছে তো বউ বাচ্চা সাথে নিয়া আসে নাই?”

    “এসেছে।”

    “দেখলাম না তো!”

    “রুমে আছে। যা, দেখে আয়।”

    রহিমা তড়িঘড়ি করে ইশতিয়াকের রুমের দিকে এলো। দরজা একটুখানি ফাঁক করা। রহিমা ঠেলে আরেকটু ফাঁক করে উঁকি দিতেই দেখলো, খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক বিদেশিনী। পড়নে তাতের শাড়ি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বাংলাদেশি তাঁত। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা! দেহের আকৃতি ও চেহারা লম্বাটে! রহিমার মতোই শুকনো স্বাস্থ্য। তবে বিদেশিনীর উচ্চতার তুলনায় আরেকটু মোটাতাজা হলে স্বাস্থ্য সুন্দর দেখাতো। রহিমাকে উঁকি দিতে দেখে বিদেশিনী মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,

    “ভেতরে এসো।”

    রহিমা দাত বের করে হেসে দরজা পুরোটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,

    “আপনে বাংলা কথা বলতে জানেন?”

    “হ্যাঁ।”

    এদিকে বিদেশিনীর জবাবের আগেই রহিমার মুখ হা হয়ে গেছে! কারণ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেয়েছে সামনে রাখা বড় দোলনায় দুই বাচ্চা! শান্তশিষ্ট ভাবে ঘুমাচ্ছে! রহিমা বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে গেছে ধবধবে ফর্সা বাচ্চাদের দেখে! এতো ফর্সা বাচ্চা হয়, এই প্রথম দেখা! 

    এদিকে বিদেশিনী বললো,

    “তোমার নাম কি?”

    “হু?”

    “তোমার নাম কি?”

    “রহিমা।”

    “নাইস নেম।”

    “মানে কি?”

    “সুন্দর নাম।”

    “ওহ্! থ্যাঙ্কিউ। আপনের নাম কি?”

    “এলেন ইশতিয়াক।”

    রহিমা পেছনে একবার দেখে আবার বিদেশিনীর উদ্দেশ্যে বললো,

    ” কই! আসে নাই তো ইশতিয়াক ভাই।”

    “না, আসেনি। বাবার রুমে আছে।”

    “তাইলে..তাহলে আপনে যে বললেন এলেন ইশতিয়াক!”

    “আমার নাম বলেছি।”

    এলেন এর কথা বুঝতে না পারায় রহিমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। গলাটাও যেন শুকনো লাগছে। সে আরেকবার বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে এলেনের উদ্দেশ্যে বললো,

    “আচ্ছা, আমি যাই।”

    এলেন মাথা সামান্য হেলিয়ে সম্মতি দিলো। রহিমা আবার দরজা চাপিয়ে রেখে দ্রুত পায়ে সায়মার রুমে চলে এলো। সায়মা মেঝেতে বসে খাটে হেলান দিয়ে ফ্যানের বাতাসে চুল শোকাচ্ছে। রহিমা এসেই হাপিয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বললো,

    “আপা, এই গ্লাস দিয়াই খাই। আবার ধুইয়া দিয়া যামু।”

    কথাটা বলে সায়মার জবাবের অপেক্ষা না করে এক নিশ্বাসে পুরো গ্লাসের পানি ঢকঢক করে গিলে ফেললো। অত:পর সায়মার কাছে এসে মেঝেতে বসে পড়লো। সায়মা আশ্চর্য হয়ে এতোক্ষণ যাবত তার কান্ড দেখছিলো। আর এখন জিজ্ঞেস করলো,

    “এমন করছিস কেন? কি হয়েছে তোর?”

    “আপা গো আপা! এই বিদেশি বেডি দেখি ধবধবে সাদা! এত্তো সাদা মানুষ খালি টিভিতেই দেখতাম আর ভাবতাম মেকাপের বদলে আটা মারছে! আজ দেখি সত্যি সত্যিই আছে! আর বাচ্চাগুলা দেখি দুধের মতো সাদা! যেন দুধের সর লাগায় রাখছে চামড়ায়! তা-ও একটা না, দুই দুইট্টা! যেন বিদেশি বিলাইর বাচ্চা! ওইযে, টিভির মধ্যে সাদা সাদা লোমে ভরা তুলতুলে দেখায় যে!”

    রহিমার কথায় সায়মা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই রহিমা চুপ হয়ে গেলো! তার এই ভাষা বড্ড বিরক্তিকর! রহিমা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আবার বললো,

    “আপা, তাগো শরীরে কি টিকটিকির মতো সাদা রক্ত?”

    এবার সায়মা ধমকে উঠে বললো,

    “দূর হো আমার চোখের সামনে থেকে। দূর হো!”

    “আরে আপা, রাগেন ক্যা? না জানলে জানায় দিবেন না?”

    “না জানাবো না। আর একটা কথাও উচ্চারণ করবি না তুই। বের হ রুম থেকে!”

    “আপা..”

    “চুপ। একদম চুপ। যেতে বলেছি।”

    রহিমা মনে মনে ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে গেলো। গম্ভীরমুখে আজ সকল কাজকর্ম করে গেলো। তবে এলেনকে রুম থেকে বের হতে দেখেনি। বাড়ির বাকি সদস্যদেরও তেমন কথাবার্তা বলতে শুনেনি। বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে কান্না করলে সায়মা গিয়েছিলো পাশে। এলেনের খাবারও রুমে দিয়ে এসেছে সায়মা নিজে।

    বিকেলে সায়মা রহিমাকে ডাকলো ছাদে যাওয়ার জন্য। রহিমা হাতে ঝাড়ু নিয়ে ছাদে এলো। প্রথমে ছাদ ঝাড়ু দিলো, পরে সায়মার সাথে গাছে পানি দিতে লাগলো। এমন উল্টাপাল্টা কথা বলার কারণে সায়মা কিছুক্ষণ তাকে জ্ঞান দিলো। অত:পর সায়মার নানান জিজ্ঞাসায় রহিমার মুড ঠিক হলো। কথায় কথায় সে-ও জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলো, এলেন খ্রিস্টধর্মের অনুসারী ছিলো। ইশতিয়াকের সাথে পরিচিত হওয়ার পর সে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছে। অত:পর তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আবু সালেহ হকের রাগ সেখানে, তাদের না জানিয়ে কেন বিয়ে করলো সে! আর বিয়ের পরও কিভাবে এতোদিন লুকিয়ে রাখতে পারলো! আজ বাচ্চা নিয়ে হাজির হওয়ার জন্য সে তার পরিবারকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো! 

    রহিমা আরও জানলো যে, সায়মার ভালো লেগেছে তার ভাবিকে। ফারহানা হকও নারাজ নয় তবে সালেহ হক স্বাভাবিক হলেই তিনিও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারবেন নতুবা এমন গম্ভীরই থাকবেন!

    সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে মায়ের ওষুধ কিনে নিয়ে গেলো রহিমা। অত:পর নিজেদের জন্য রান্নাবান্না তাকেই করতে হলো। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে মনে হলো আয়ানের দেওয়া গিফটের কথা! সে পার্স থেকে বক্সটা বের করে বিছানায় রাখলো। খুলতে গিয়েও একটা অজানা ভয় কাজ করলো মনে! এই ভয়ের কারণ, আয়ান খুবই দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে। তাই তার উপর বিশ্বাসের অভাব আছে! বলা তো যায় না, যদি আবার ইঁদুরের বাচ্চা কিংবা সাপের বাচ্চা ই ভরে দেয় বক্সে! রহিমা বক্সটা বিছানা থেকে মাটিতে নামিয়ে রাখলো। অত:পর একটা মোটা লাঠি এনে পাশে রাখলো। তা দেখে কারিমা বললো,

    “এইটা কি বুবু? আর লাঠি দিয়া কি করবা?”

    “অপারেশন সার্চলাইট।”

    “কিহ!”

    “কিছুনা। খালি তাকাইয়া দেখ।” 

    রহিমা আরও একটা লাঠি এবং চুলার পাশ থেকে বটি নিয়ে এলো। লাঠিটা কারিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

    “আমি এহন বাক্স খুলমু। তুই লাঠি নিয়া প্রস্তুত থাক। যদি দেখিস সাপ বের হইছে তো সাথে সাথে লাঠি চালান দিবি।”

    রহিমার কথায় কারিমা চমকে উঠে লাঠি ফেলে দিয়ে বললো,

    “ও মা! সাপ! আমি পারতাম না!”

    রহিমা লাঠি তুলে আবার তার হাতে দিয়ে বললো, 

    “আরে ভুতির বাচ্চা, সাপ না। লাঠি ধর। আমি বলছি যদি বের হয় তাইলে উড়াধুরা মাইর শুরু করবি।”

    “এইটা কইত্তে আনছো তুমি?”

    “একজনে গিফট করছে।”

    “এতো সুন্দর প্যাকেটের ভিতর সাপ থাকবো নি! গিফটে তো ভালা জিনিস থাকে!”

    “কথা কম! শান্তিতে অপারেশন করতে দে।”

    কারিমা ভেংচি কেটে মনে মনে বললো, 

    “হুহ্! হেয় সারাদিন বকবক করে আর আমি একটু কইলেই বলে কথা কম!” 

    কারিমার হাতে লাঠি ধরিয়ে রহিমা প্রায় তিন ফুট দূরে থেকে হাত বাড়িয়ে বটি দিয়ে আস্তে আস্তে বাক্সটা কাটতে লাগলো আর বিড়বিড় করে “আল্লাহু আকবার” জপতে লাগলো। উপরের আবরন কেটে ভেতরের আবরণও কেটে যাচ্ছে! কাটছে তো কাটছেই কিন্তু শক্ত কিছু উপলব্ধি করতে পারছে না! বটি কেমন যেন আঠালো হয়ে গেলো! যেন আর চলছে না। রহিমা আরও জোরে জোরে পোচ দিতে লাগলো। এক পর্যায়ে প্যাকেট দুই খন্ড! কিন্তু কিছুই বেরিয়ে এলো না! রহিমা প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখলো সাবান! এবার হাতেই পুরো প্যাকেট চিড়ে সাবানের দুই খন্ড একত্রিত করে দেখলো “১ নং পঁচা সাবান”!

    এতো সুন্দর গিফট বক্সে ১ নং পঁচা সাবান দেখে কারিমা লাঠি ফেলে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে! আর রহিমা রেগে আগুন! 

    “ব্যাটা আয়না! তুই যেহেতু সাবানই গিফট দিবি তো একটা লাক্স সাবানই দিতি! এতো ফ্যাশন মারাইয়া পঁচা সাবান ভরতে গেলি ক্যা বাক্সে!  গিফট বক্সের ইজ্জতটাই তো শেষ কইরা দিলি!”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ৮

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    পরেরদিন রহিমা কাইয়ুম ভিলায় যাওয়ার সময় সাবান নিয়ে গেছে সাথে। আয়ানকে ফিরিয়ে দিতে গেলে আয়ান দাত কেলিয়ে বললো,

    “জীবানু দূর করতে সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজারের চেয়ে বেশি উপকারী পঁচা সাবান। বুঝছিস!”

    আয়ান এভাবে দাত কেলিয়েছে বিধায় রহিমার তখন ইচ্ছে করছিলো সাবানটা আয়ানের দাতে নিক্ষেপ করুক। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে তা করেনি। সাবানটা না ফেলে আবার পার্সে রেখে দিয়েছে সে। কাপড় কাচা যাবে।

    তবে কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসার সময় রাস্তায় আজ একটা ব্রেসলেট ঘড়ি দিয়েছে আয়ান। কিন্তু কোনো প্যাকেট করা ছিলো না। রহিমা এটাও নিতে চায়নি। সে ভেঙচি কেটে বলেছে,

    “লাগবো না আমার কিছু! বাড়িত গিয়া দেখমু ঘড়ি নষ্ট!”

    আয়ান তখন হাত উঠিয়ে মাইর দেওয়ার ভঙ্গিতে দাত কিড়মিড়িয়ে বলেছে, 

    “একটা দিবো এখন! ধর, চারশো সত্তর টাকা দাম এটার। একদম নতুন। এই দেখ, ঝকঝক করছে। তবে তারাহুরো করে কিনেছি তাই প্যাকেট নিতেই ভুলে গেছি।”

    কথাটা বলে আয়ান তার হাতে ঘড়ি ধরিয়ে দিয়ে তার আগেই চলে গেছে। আর রহিমা ঘড়িটা উল্টেপাল্টে দেখলো নতুনই। রোদের আলোতে ঝকঝক করছে। সে ঘড়ি হাতে পড়ে হাত ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে হাটতে লাগলো।

    হক মঞ্জিলে এলে সায়মা লক্ষ্য করলো তার হাতটা আজ অস্বাভাবিকভাবে ঝুলছে। ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখতে পেল হাতে ঘড়ি। সায়মা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,

    “ঘড়ি কিনেছিস? দেখি?”

    রহিমা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

    “কিনি নাই। গিফট পাইছি।”

    “তাই নাকি! সুন্দরই ঘড়িটা। কে দিলো গিফট?”

    “আয়না ভাইজান।”

    সায়মা চেহারায় বিরক্তিকর ভাব এনে বললো,

    “কি বললি?”

    “আয়না ভাইজান।”

    “আয়নাটা আবার কে?”

    রহিমা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,

    “ওই যে, সেই বাড়ির ছোট পোলা। নাম আয়ান। সবাই য় এর পরে আ’কার দিয়া ডাকে আর আমি সেই আ’কার তুইলা আইনা ন এর পরে দিছি। তাই আয়ান থেকে হয়ে গেছে আয়না!”

    “চুপ! ফাজিল! নামের উপর বিদ্রুপ করলে গুনাহ হয়। এসব যেন আর না শুনি তোর মুখে।”

    “ভুলে বইলা ফেললে আমার কোন দোষ নাই।”

    “ভুল করাটাই তোর দোষ!”

    “আপা, খালু কি ভাইজানরে মেনে নিছে?”

    “নিয়েছে। তবে ভাইয়ার সাথে তেমন একটা কথা বলে না। কিন্তু বাবুদের কোলে নিয়েছে।”

    “যাক, আলহামদুলিল্লাহ।”

    “হুম, আলহামদুলিল্লাহ।”

    আজ সকাল থেকেই বাসায় বেশ কিছু মেহমান এসেছে ইশতিয়াক ও তার বউ বাচ্চা দেখার জন্য। রহিমা মেহমানদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত ছিলো সারাক্ষণ। সায়মা তার ভাবি ও কাজিনদের সাথে আলাপে ব্যস্ত। রহিমা আজ এইটুকু সময়েই তিনবার ঘর ঝাড়ু দিয়েছে! মেহমান হয়ে আসা বাচ্চাগুলো জুতা নিয়েই ঘরে ঘুরাফেরা খেলাধুলা করছিলো বিধায় বেশি ময়লা হয়েছে। কাজের তাড়ায় আজ রহিমা দুইবার ধাক্কা খেয়েছে এক ছেলের সাথে। ছেলেটা সায়মার খালাতো ভাই। নাম রুমেল। প্রথমবার ধাক্কা খেয়ে রহিমা “সরি” যপে অস্থির! দ্বিতীয়বার যখন ধাক্কা খেলো তখন রহিমার কেন জানি মনে হলো ছেলেটা ইচ্ছে করে ধাক্কা খেয়েছে! কেননা প্রথমবার খেয়াল না থাকলেও দ্বিতীয়বার সে রুমেলকে ফোনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে সচেতনতার সাথে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছিলো। তবুও রুমেল বরাবর না হেটে রহিমার দিকেই চেপে পায়ে পারা দিয়ে ধাক্কা খেলো। তখনও রহিমা সরি বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই রুমেল সরি বলেছে তিন-চার বার! তার ঠোঁটের কোনে তখন এক অদ্ভুত হাসি দেখতে পেয়েছিলো রহিমা! সে যার নামকরণ করেছে লুসি! লুচুর লু আর হাসির সি!

    উক্ত ঘটনার পর থেকে রহিমা কাজের ফাঁকে ফাঁকে নজর রাখছিলো রুমেলের দিকে। রুমেল বেশ কয়েকবার রহিমার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়েছে! তাছাড়া কাজিনদের সাথে যখন দুষ্টুমি ফাজলামো করছে তখনও রহিমা রুমেলের মাঝে মেয়েদের গায়ে পড়া স্বভাব লক্ষ্য করেছে। যা মোটেও পছন্দ হলো না! দেখতেও তার মতে হিরোঞ্চির মতো! গায়ের রঙ ফর্সা, চুলগুলো সামনের দিকেও অনেকটা বড় আর পেছন দিকেও বড় করে ছাগলের লেজের মতো রেখেছে! আর ডানেবামে ছাটাই করা! পোশাকাশাক মাইকেল জ্যাকশানের কথা মনে করিয়ে দিবে! গলায় মোটা চেইন ঝুলানো, এক কানে রিং, হাতে এক গোছা ব্রেসলেট! আধুনিক ছেলেমেয়ের কাছে এসব স্টাইল হিসেবে বিবেচিত হলেও রহিমার কাছে হিরোঞ্চি হিসেবে আখ্যায়িত! তার কাছে আয়ানের স্টাইলটা বেশি না হলেও মোটামুটি ভালো লাগে। যে কিনা এক হাতে একটা ব্রেসলেট আর অন্যহাতে একটা ঘড়ি পড়ে। আর ব্রান্ডের ফ্যাশনেবল জুতা, শার্ট, প্যান্ট। কিন্তু ছেড়াফাড়া স্টাইল না। তবে সানগ্লাসে আবার বাহারি রঙ খুজে।

    অন্যদিকে রহিমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সায়ানের স্টাইল! একদমই মার্জিত! যথেষ্ট স্মার্ট! যে কেউ দেখলেই ধারণা করে নিবে সে একজন শিক্ষক কিংবা সম্মানজনক বা প্রতিষ্ঠিত কোন বিশেষ ব্যক্তি।

    সন্ধ্যায় যখন রহিমা বাড়ি ফিরে আসছিলো তখন সায়মা ও তার কিছু কাজিন বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছে। তারা আজ থেকে যাবে সায়মাদের বাড়িতে। আর যারা চলে যাওয়ার, তারা সন্ধ্যার পূর্বেই চলে গেছে। তারা বের হওয়ার সময় রুমেল সায়মাকে বলেছিলো,

    “সামা, তাকেও নিয়ে নাও সাথে। আমাদের সাথে থাকলে মেবি মোমেন্ট এনজয় করতে পারবে।”

    তখন সায়মা জবাব দিলো,

    “না, তার বাসায় ফিরতে হবে। রহিমা, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তুই বাসায় যা। আর এই সন্ধ্যায় একা একা হেটে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। রিকশা নিয়ে যাবি।”

    রহিমা সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। কিন্তু হেটেই ফিরেছে বাসায়।

    পরদিন দুপুরে রহিমা হক মঞ্জিলে এসে দেখলো সায়মার  কাজিনরা এখানেই আছে। তবে আজ বিকেলে চলে যাবে। রুমেল রহিমাকে দেখেই অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে তুললো মুখে! যা রহিমার মোটেও পছন্দ হলো না! রহিমাকে আসতে দেখে সায়মা বললো ছাদ ঝাড়ু দিয়ে আসতে। গতকাল বাচ্চাগুলো কাগজ ছিড়ে পাতা ছিড়ে নোংরা করে ফেলেছে তার বাগান ও বসায় জায়গা! রহিমা ঝাড়ু নিয়ে চলে গেলো ছাদে। আর সায়মা তার কাজিনদের সাথে কিচেনে ছিলো। তারা নিজেরা আজ নানান খাবারের আয়োজন করছে দুপুরের জন্য। ফারহানা হক রান্নার দিক থেকে অবসরে থাকলেও নাতিদের নিয়ে ব্যস্ত।

    রহিমা ছাদে এসে প্রথমে ফুলের টব থেকে ছেড়া পাতা আর কাগজের টুকরো কুড়িয়ে নিলো। অত:পর ছাদ ঝাড়ু দিতে লাগলো। এমনি রুমেল হাজির। রহিমা ঝাড়ু দিচ্ছে আর রুমেল ময়লার উপর দিয়েই বসার সিটে চলে গেলো। হঠাৎই আসায় রহিমা ভয় পেয়ে গেছে। পরক্ষণে ঝাড়ু ফেলে ঝটপট ওড়না মাথায় দিয়ে ঘোমটা টেনে নিলো রহিমা। রুমেল দুহাত ছড়িয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে সিটে। রহিমা বললো,

    “ভাইজান, ঝাড়ু দিতাছি। এখন উঠেন। এদিক দিয়া ঝাড়ু দিমু।”

    “এটুকু বাদে দাও।”

    “না। বারবার দিতে পারতাম না। একবারে সাফ করমু। উঠেন।”

    রুমেল বসা থেকে উঠে রহিমার দিকে এগিয়ে এলে রহিমা একটু পিছিয়ে গেলো। কিন্তু রুমেল থামেনি। সে আরও এগিয়ে গেছে৷ এবং হাত বাড়িয়ে এক আঙুল দিয়ে রহিমার গাল স্পর্শ করেছে। রহিমা তার হাত ঝাড়ি দিয়ে ছুটিয়ে বললো,

    “ওই মিয়া! গায়ে হাত দেন ক্যা!”

    রুমেল এক গাল হেসে বললো,

    “শুধু গায়ে না, মনেও হাত দিবো। গভীরে স্পর্শ করবো। বাজেট কত?”

    “কিসের বাজেট?”

    “আমার কাজ করার, আমার সাথে টাইম পাস করার বাজেট।”

    “আমি এমনিতেই দুই বাড়িতে কাজ করি। আর কাজ লাগবো না। কাজ করার সময়ও নাই আমার হাতে। দূরে সরেন!”

    রহিমা সিড়ির দিকে আরেকটু পিছিয়ে গেলে রুমেল আরেকটু এগিয়ে রহিমার পেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো,

    “বাড়ি বাড়ি কাজ তো দিনে। আমার কাজ রাতে করলেই হবে।”

    কথাটা বলার সাথে সাথেই রুমেলের গালে সজোরে থাপ্পড় পড়লো। এটা রহিমা দেয়নি। রহিমার দিকে হাত বাড়ানোর সময় পেছন থেকে সায়মা রহিমাকে টেনে সরিয়ে রুমেলকে থাপ্পড় দিয়েছে! রুমেল রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সায়মায় দিকে। আর সায়মা কড়া গলায় বললো,

    “যেখানে সেখানে বদমাশি মানায় না। এটা কেবল নাইট ক্লাবের পার্টিতেই মানায়। তোর মতলব হাসিল করতে হলে সেখানে যা৷ এমন অসহায় মেয়েদের পেছনে লেগেছিস কেন! গতকাল থেকে দেখছি রহিমার প্রতি তোর আসক্তি! লজ্জা করে না মেয়েদের এসব অফার করতে! নিজের চরিত্র তো শেষ করেছিসই! পরিবারের সম্মানটুকুও এবার ধুলোয় মেশাতে চাইছিস! এবার আর ছাড়ছি না তোকে! খালামনির কাছে ইনফর্ম করবো আমি নিজে। রহিমা, নিচে চল।”

    কথাটা বলে সায়মা পেছনে ফিরতেও পারেনি। রুমেল তার হাত ধরে এক টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে গেছে। এবং সাথে সাথেই বাম গালে কিস করেছে! অত:পর মুখে বদমাশি হাসি ফুটিয়ে বললো,

    “অফার তো তোমাকে অনেক আগেই করেছি সুইটহার্ট। তো এসে পড়ো না আমার কাছে! তুমি এলে আর কাউকে লাগে না। আর কাউকে অফার করার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু তুমি আর আমি। জাস্ট কাম, ইন মাই ওয়ার্ল্ড!”

    রুমেল দু’হাতে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। আর সায়মা ছোটার জন্য চেষ্টা করতে করতে প্রায় কান্না করে দিয়েছে। থাপ্পড় দেয়ার কারণে রুমেল মাত্রাতিরিক্ত সাহসের সাথে সায়মাকে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো। যা রহিমা আর দেখতে পারলো না। হাতের ঝাটা ইচ্ছে মতো মেরে যাচ্ছে রুমেলের পিঠে! এতেই সায়মার মুক্তি। মুখে বকার বুলেট ছুড়তে ছুড়তে ঝাড়ু দিয়ে এলোপাথাড়ি মারছে রহিমা। রুমেল সায়মাকে ছেড়ে রহিমার হাত থেকে ঝাড়ু নেওয়ার চেষ্টা করতে গেলে পেছন থেকে সায়মা তার টিশার্ট টেনে ধাক্কা মারলো। একদিকে ঝাটার বারি আরেকদিকে ধাক্কা, টাল সামলাতে না পেরে রুমেল ফ্লোরে পড়ে গেছে। এতে রহিমার জোর আরও বেড়ে গেছে! ঝাটার বারির সাথে লাথিও চলছে বেশ! যার ফলে রুমেল উঠার সুযোগই পাচ্ছে না! চোখেমুখে বারি লাগায় রুমেল চোখ খুলেও তাকাতে পারছে না! উঠবে কিভাবে! কিন্তু রহিমার মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে রুমেলকে ছাদের সাথে পিষে রুমাল বানিয়ে উড়িয়ে দিতে! কিন্তু তার মাঝে এতো শক্তি নেই। থাকলে সেটাই করতো। 

    রহিমার কান্ডে সায়মা হতবাক!  সে দ্রুত রহিমাকে থামানোর চেষ্টা করলো। রহিমাকে টেনে পেছনের দিকে নিয়ে গেলো,

    “রহিমা, থাম। এমন মারতে থাকলে মার্ডার হয়ে যাবে!”

    “আপা ছাড়েন। এই বেডারে আজ দেইক্ষা নিমু! রাইতে কাম করাইবো না দিনে কাম করাইবো হেইডাও বুইজ্জা নিমু। বদমাইশের বাচ্চা! কত্তবড় সাহস! মাইয়া মাইনষের দিকে কুনজর দেয়! নোংরামি করতে আসে! এই নোংরা আবর্জনা আজকা দূর কইরা দিমু! আপা, ছাড়েন আমারে!”

    এদিকে রুমেল চোখ ডলতে ডলতে উঠে দাড়ালো। চোখ খুলে ঠিকমতো তাকাতেই পারছে না সে! নতুবা ব্যাপার ছিলো না তাদের দুইজনকে রপ্ত করা! জান নিয়ে ফেরার সময় শুধু এইটুকু বলে গেলো,

    “সামা, সি ইউ নেক্সট টাইম। এন্ড ফারদার সি ইউর চামচী!”

    রহিমা কথার মানে বুঝতে না পেরে তেজে বললো,

    “আপা, এই হালায় আবার কি কইলো?”

    সায়মা তাকে থামাতে বললো,

    “কিছু না। চুপ!”

    রুমেল সিড়ির কয়েক ধাপ নেমে এলে সায়মা সিড়ির ধারে এসে বললো,

    “ভাগ্য ভালো থাকতে এই মুহূর্তে আমার বাড়ি ত্যাগ কর। ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে সোজা নেমে যা। নতুবা খুব খারাপ হবে তোর সাথে। মাইন্ড ইট!”

    অত:পর রহিমা ফুসতে ফুসতে বাকিটুকু ছাদ ঝাড়ু দিলো এবং সায়মা রেলিংয়ের পাশে দাড়িয়ে রইলো। যখন দেখলো রুমেল ফ্ল্যাটে না গিয়ে সোজা নেমে বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে গেছে তখন সায়মা রহিমাকে বললো,

    “রহিমা, তুই নিচে যা। আর কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। আর পরে রুমেল কিছু জানালে, বাকিটা আমি দেখবো।”

    রহিমা ফ্ল্যাটে চলে এলো আর সায়মা এই ভরদুপুরে ছাদে দাড়িয়ে রইলো প্রাণ জুড়ানোর চেষ্টায়।

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ৯

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    রহিমা ফ্ল্যাটে এসে একের পর এক কাজকর্ম করেই যাচ্ছে। কখনো বাবুদের কাপড়চোপড় ধুয়ে দিচ্ছে, কখনো সায়মার কাজিনদের রান্নার কাজ এগিয়ে দিচ্ছে আবার কখনো থালাবাটি মেজে গুছিয়ে রাখছে টেবিলে। 

    কিছুক্ষণ পর সায়মা ছাদ থেকে নেমে এসেছে। কিন্তু কাজিনদের কাছে না গিয়ে সে নিজের রুমে চলে গেছে৷ কাজিনদের মধ্যে একজন তাকে ডাকতে গেলে শুরু হলো হইচই! মেয়েটি চেচিয়ে খালামনি বলে ডাকতে লাগলো ফারহানা হককে। যার ফলে সায়মার মা সহ বাকিরা ভীড় জমিয়েছে সায়মার রুমে। রহিমা এসে দেখলো সায়মার এক গাল লাল হয়ে আছে। লম্বা লম্বা নখের আঁচড় পড়েছে বেশ কয়েকটা! যা ফুলে স্পষ্ট দৃশ্যমান! রক্তও বের হয়ে আসছে! সায়মার চোখও ভেজা ভেজা! কি হয়েছে তা ফারহানা জিজ্ঞেস করলে সায়মা উত্তর দিলো এলার্জি! কিন্তু কারোই বিশ্বাস হয়নি তার কথা! কারণ এলার্জি হলে শুধুমাত্র এক গালের এই অবস্থা হবে কেন! আর তো কোথাও এমন ক্ষত দেখা যাচ্ছে না! তাছাড়া সায়মা ই বা কাদবে কেন! একেকজন এক এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে কিন্তু সায়মা বারবার বলেই যাচ্ছে তার কিছু হয়নি! এলার্জির কারণে  চুলকে গালের এই অবস্থা করেছে। তবুও কেউ বিশ্বাস না করে জানার চেষ্টা করছিলো বিধায় সায়মা রেগে সবাইকে ধাক্কিয়ে রুম থেকে বের করে দিয়েছে৷ তার মামাতো বোন পরে স্যাভলন আর তুলা নিয়ে এসে ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিয়েছে। রহিমা ছিলো আজ নিরব দর্শক! কেননা সে তো জানতোই সবটা! ইচ্ছে করছিলো সবার সামনে বলে দেক রুমেলের দুশ্চরিত্রতা! কিন্তু সায়মার নিষেধাজ্ঞা থাকায় বললো না সে।

    দুপুরে খাওয়ার সময় সায়মা রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে একসাথে খাওয়ার জন্য। মনের ভেতর যা-ই থাকুক, সবাই মিলে যেই মজাটা করতে যাচ্ছিলো সেটা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। এদিকে বাকিরা রুমেলকে খুজছিলো। কল করে ফোন বন্ধ পাচ্ছে। সুযোগ বুঝে সায়মা জানিয়ে দিলো সে ছাদে যাওয়ার সময় রুমেল তার কাছে বলে তারাহুরো করে বেরিয়ে গেছে যে তার জরুরি কাজ আছে। তাই আর তাদের সাথে থাকতে পারছে না। বাকিরা সায়মার কথা বিশ্বাস করে নিলো। কেউ কেউ রহস্যময়ভাবেও ভাবতে লাগলো হঠাৎ সায়মার এই অবস্থা আর রুমেলের চলে যাওয়া। তবে সেটা মনের ভেতর চাপা পড়ে রইলো।

    এমনিতে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার সংখ্যা ছয়টি। কিন্তু আজ একসাথে খেতে বসেছে বারো জন। রুমেল থাকলে তেরো জন হতো। বাকি আসনের ব্যবস্থা করেছে বিভিন্ন রুমে থাকা চেয়ার টুল দ্বারা। ড্রেসিং টেবিলের টুলটাও বাদ রাখেনি তারা! আরেকজন সোফা সেটের ছোট টি টেবিল উঠিয়ে এনেছে বসার জন্য। সবাইকে একসাথে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে বিধায় বাবুদের দোলনা উঠিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে এনে রাখা হয়েছে। কেননা বাবুরা জেগে আছে। আর পাশে কাউকে না পেলে কান্না করে। এখানে তাদের কথাবার্তা শুনলে আর কান্না করবে না।

    সায়মা খাওয়ার সময় বেশ কিছুক্ষণ মেয়ের গালের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন আবু সালেহ হক। তার চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটা ছোট থেকেই খুব জিদ্দি। এমনিতে চুপচাপ থাকলেও রেগে গেলে কি করে সে নিজেই জানে না! অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে। নতুবা এভাবে নিজের গাল চিড়ে ফেলে কেউ!

    খাওয়ার ফাঁকে হঠাৎই বাবার দিকে নজর পড়তেই সায়মা দৃষ্টি নামিয়ে বিষন্নতার সাথে প্লেটে তাকালো। অত:পর মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজের প্লেট হাতে নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে বাবার কাছে এসে দাড়ালো। এবং বাবার সামনে প্লেট ধরে বললো, 

    “কোনটা নিবে? নাও।”

    আবু সালেহ হক নিশব্দে হেসে অর্ধেক খাওয়া চিকেন শর্মাটা তুলে নিজের প্লেটে নিলেন এবং নিজের প্লেটের আস্ত চিকেন শর্মাটা মেয়ের প্লেটে তুলে দিলেন। সায়মা হাসতে হাসতে নিজের চেয়ারে এসে বসলো। বাকিরা “ওয়াও” বলে অভ্যর্থনা জানালো। আর এলেন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো বাবা মেয়ের কান্ডে! পরক্ষণে ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে মুখে মুচকি হাসি দেখতে পেয়েছে। সায়মা নিজের চেয়ারে বসতেই ইশতিয়াক হাত বাড়িয়ে বাবার দেওয়া শর্মা থেকে অর্ধেক নিয়ে নিলো। সায়মা ব্রু কুচকে ছোটখাটো ধমক দিলো,

    “ভাইয়া!”

    আর ইশতিয়াক হাসিমুখে বললো,

    “তুই একা খাবি কেন! আমার ভাগ আমি ছেড়ে দিবো নাকি!”

    এদিকে আবার সায়মার মামাতো ভাই প্লেট থেকে চিকেন ফ্রাই তুলে নিয়ে নিজের খাওয়া ফ্রাইয়ের হাড্ডি সায়মাকে দিলো! সায়মা রেগে সেই হাড্ডি মামাতো ভাইয়ের শরীরে ঢিল মারলো! এবং বাটি থেকে আরেকটা ফ্রাই নিজের প্লেটে নিলো। এভাবেই কাড়াকাড়ি করে সকলের খাওয়া শেষ হলো। হক সাহেব থাকতে তারা তেমন কাড়াকাড়ি করেনি কিন্তু তিনি খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার পর কোলাহল সৃষ্টি হলো! ইশতিয়াকও পিছিয়ে নেই কোলাহলে! ফারহানা হক শুধু ধমকে যাচ্ছিলেন তাদের। আর রহিমা খেতে খেতে ফারহানা হককে থামিয়ে রাখছিলো। করুক না, প্রতিদিন তো আর করছে না এমন হইচই! আজকের দিনটা এলেন সহ সকলেরই ভালো লাগলো খুব। 

    বিকেলে কাজিনরা সবাই নিজ গন্তব্যে চলে গেলো। বাড়িটা আবারও নিরব হয়ে গেলো। এখন কোলাহল বলতে মাঝে মাঝে দুই বাচ্চার কান্নার শব্দ।

    সন্ধ্যা হতেই রহিমা বাসায় চলে এলো। নিত্যদিনের মতো আজও কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘরে! মা দরজা খুলে দিয়েছে। আর চুলার পাশে বড়ি আর আলু দেখতে পেল। অসুস্থ শরীর নিয়ে মা কাটছিলো নিশ্চয়ই। বাড়িতে পা রাখতেই রহিমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো কারিমার উপর। কোনো কাজকর্মে হাত লাগাতে চায় না মেয়েটা! সারাদিন ফোনে খুচুরখুচুর, বই নিয়ে বসে থাকা আর রূপচর্চায় মগ্ন থাকা। এগুলো কি এই গরিবের ঘরে মানায়! নিজের অবস্থানটা কোথায়, সেটা কেন বুঝতে চায় না সে! সেখানেই রহিমার রাগ! আজ ঘরে এসে দেখলো এই সন্ধ্যা বেলা কারিমা দুই চোখে শসা রেখে মুখে ডাল বাটা লাগিয়ে বসে আছে! খাওয়ার জন্য ডাল হয়না আর সে রূপে লাগিয়ে ডাল নষ্ট করে যাচ্ছে! যা দেখে রহিমার মেজাজ চরম বিগড়ে গেলো! সে তার মাথায় বেশ কয়েকটা ঠুসি দিয়ে বকতে লাগলো!

    ঠুসি ও বকা খেয়ে কারিমা দ্রুত মুখ ধুয়ে এলো। মুখে ডাল লাগিয়েছিলো বিকেলে। পরক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ায় আর মুখ ধোয়া হয়নি! আর ধরা পড়ে গেছে রহিমার কাছে! এখন ঠুসি খেয়ে তার ঘুম ভাঙলো।

    আজ আর রান্না করতে হলো না রহিমাকে। কারণ সায়মা তার পরিবারের জন্য কিছু খাবার দিয়ে দিয়েছে। তাই অর্ধেক ছিলে রাখা আলু তুলে রেখে দিলো। পরিবারের সাথে সাহেবি খাবার খেতে ভালোই লাগলো রহিমার। তারা দুজন হাতে খেলেও কারিমা সাহেবি খাবারে সাহেবি যন্ত্র ব্যবহার করলো। ঝং ধরে যাওয়া ছুড়িটা খুজে কোনোমত ধুয়ে আনলো আর সাথে একটা কাটা চামচ নিলো। অত:পর দুই হাতের দুই যন্ত্র দ্বারা কেটেকুটে খেয়েছে। যদিও রহিমার বিরক্ত লাগছিলো তার আচরণ তবুও কিছু বললো না। বোনের যেহেতু শখ হয়েছে এভাবে খাওয়ার তো খাক।

    রাতের বেলা দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই রহিমা চমকে উঠলো। আয়ানের দেওয়া ঘড়িটায় সময় দেখলো দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। এ সময় কে আসতে পারে! আবারও ঠকঠক শব্দ হলে রহিমা কর্কশ গলায় বললো, 

    “কেডা রে?”

    ওপাশ থেকে জবাব এলো,

    “দরজা খুল।”

    কারিমা ও তার মা সজাগই আছে। রহিমা বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বললো,

    “দরজা খুলতাম ক্যা? কেডা আপনে?”

    “আমি।”

    “আমি কেডা?”

    “দরজা খুলে দেখ।”

    রহিমা হাতে বটি নিয়ে বললো,

    “না, খুলতাম না।”

    “আরে রহিমা! আমি আয়ান।”

    “কোন আয়ান?”

    এবার দরজায় ধুপধাপ শব্দ হয়ে তেজি কন্ঠে উচ্চারিত হলো,

    “দরজা না খুললে দেখবি কিভাবে যে কোন আয়ান!”

    “ওই মিয়া ওই! ধমকান ক্যা? কারিমা, লাঠি হাতে নিয়া খাড়া।”

    ঘরের কোনা থেকে কারিমা দ্রুত মোটা লাঠি হাতে নিলো। অত:পর ভেতর থেকে দরজা খুলতেই আয়ান মুখ বরাবর বটি দেখতে পেল এবং চমকে উঠে দুকদম পিছিয়ে এলো।

    রহিমা আয়ানকে দেখে ব্রু কুচকে বললো, 

    “আপনে!”

    “হ্যাঁ, আমি। বটি নামা!”

    রহিমা বটি না নামিয়েই বললো,

    “আপনে এতো রাতে আইছেন ক্যা?”

    “প্রয়োজন আছে বিধায় এসেছি। বটি নামা আগে।”

    রহিমা বটি নামিয়ে নিলো। ভেতর থেকে লাঠি হাতে কারিমা উঁকি দিয়ে বললো,

    “বুবু, বেডার মাথায় বারি দিমু?”

    আয়ান বিস্মিত আর রহিমা জবাবে বললো,

    “না। হাতে নিয়া খাড়ায় থাক।”

    রহিমা আয়ানকে ভেতরে পর্যন্ত আসতে বললো না। হোক সে যে কোনো পরিচিত বা আত্মীয়। রাতের বেলা ঘরে তিনটা মেয়ে মানুষ, সেখানে কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে দিবে না সে। আয়ান দরজার বাইরে দাড়িয়েই রহিমার উদ্দেশ্যে বললো,

    “তোর মা কেমন আছে?”

    “ভালোই আছে। আপনে আইছেন ক্যা, সেইটা কন।”

    “বাইরে আয় একটু।”

    “না, বাইরে যাইতাম না। এখানে দাড়াইয়াই বলেন।”

    অনেক সহ্য করা হয়েছে রহিমার বর্তমান আচরণ। আর সহ্য করতে পারছে না আয়ান। তাই সে খপ করেই রহিমার হাত ধরে টেনে প্রথমে বটি ঘরে ছুড়ে ফেললো অত:পর রহিমাকে হেচকা টানে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। রহিমা হাত ছুটানোর চেষ্টায় বলতে লাগলো,

    “আরে! করছেন টা কি! হাত ছাড়েন! হাত ছাড়েন! নইলে আমি চিৎকার করমু।”

    “একটা শব্দ করে দেখ, দাত ফেলে দিবো।”

    ওদিকে কারিমা লাঠি হাতে  দরজার কাছে এসে বললো,

    “বুবু, চিৎকার কইরা লোকজন ডাকমু? বেডার মাথায় বারি দিমু?”

    আয়ান পেছনে ফিরে ধমকে বললো,

    “এই মেয়ে! একটা শব্দ করলে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো। চুপচাপ ঘুমা গিয়ে!”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১০

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    আয়ান রহিমাকে টেনে তাদের ঘর থেকে কিছুটা সামনের দিকে নিয়ে এলো। এখান থেকে তাদের ঘরের এক কোনা দেখা যায়। আয়ান রহিমার হাত ছেড়ে বললো,

    “ইতুর কি হয়েছে?”

    “ইতু! ইতু আবার কেডা!”

    “সায়মা। সায়মার কি হয়েছে?”

    “আমি জানতাম! জানতাম আপনে লুইচ্চামি করেন! সত্য বললেই তো দোষ আমার! আপার পেছনে যে আপনে লাগছেন সেইটাও আমি জানি। আর সুন্দরী মাইয়া দেখলেই যে পিছনে পইড়া লাইজ্ঞা থাকেন সেইটাও আমি.. “

    “কানের নিচে একটা দিবো ফাজিল কোথাকার! আমি তোকে কি জিজ্ঞেস করছি আর তুই আমাকে কি জবাব দিচ্ছিস!”

    “ক্যা? আপনে জিগাইবেনই ক্যা আর আমার কানের নিচেই দিবেন ক্যা!”

    “জিজ্ঞেস করেছি জানার জন্য। আর কানের নিচে দিবো অতিরিক্ত কথা বলার জন্য। চুপচাপ বল এবার।”

    “না, কইতাম না কিছু। আপনারে বলমু ক্যা!”

    আয়ানের প্রচুর রাগ হচ্ছে। তবুও সে রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখে শান্ত গলায় বললো,

    “আমাকে যা ভাবার, ভাব। কিন্তু আমি সায়মার পেছনে নতুন লাগিনি। আর না অন্য মেয়ের পেছনে লেগেছি! তুই তাকে চেনার পূর্বেই আমি তাকে চিনি। আর সায়মা আমার বিয়ে করা বউ। বুঝতে পেরেছিস? তুই তাদের বাসায় কাজে যাওয়ার পূর্বেই আমরা বিবাহিত। আর আমার বলার কারণেই তুই তাদের বাসায় কাজে নিযুক্ত হতে পেরেছিস। তার প্রয়োজন ছিলো না কোনো এসিস্ট্যান্ট। কিন্তু তার মায়ের ভয় ছিলো তাকে নিয়ে। বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলো না। তখন তোর অতিরিক্ত কাজের প্রয়োজন পড়ায় আমিই তোর সন্ধান দিয়েছি। আর সায়মা কৌশলে তার মাকে বলেছে তোর কথা। এবং তার মা তোকেই সিলেক্ট করেছে।”

    রহিমা স্তব্ধ আয়ানের কথায়! এ কি শুনছে সে! মুহুর্তেই যেন তার মনে ও চেহারায় বিষন্নতা নেমে এসেছে! তার মুখে আর কোনো শব্দ নেই! ড্যাবড্যাব করে শুধু তাকিয়ে আছে আয়ানের চেহারায়! আয়ান একটু থেমে আবার বলতে লাগলো।

    “জীবনে প্রেম কয়টা করেছি তা তো আমি নিজেও জানি না! আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো আবার সেই গার্লফ্রেন্ডের বয়ফ্রেন্ডও থাকতো! আর আমি প্রেম করতাম তেমন মেয়ে দেখেই যে পূর্বে প্রেম করে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন থাকবে। যাতে আমার প্রেম প্রেম যন্ত্রণা না হয়। কিন্তু সায়মার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি কখনো! তার প্রতি আমার আক্রোশ ইউনিক ছিলো। যা পূর্বে কারো ক্ষেত্রে কখনোই এমনটা অনুভব করিনি। যখন প্রথম পরিচয় তখন সায়মা আমাকে পাত্তা দিতো না। এমনকি কোনো ছেলের সাথেই কথা বলতে দেখা যেতো না। চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। পরবর্তীতে আমার পাগলামোতে সে পটে গেছে। তবে অন্যদের মতো লেলিয়ে পড়েনি। আমাকে আলাদা একটা শাসনে রাখতো সবসময়। তার সেই শাসনকেই আমার কাছে প্রেম বলে মনে হয়েছে। এরপর আর কোনো মেয়ের দিকে আমার দৃষ্টি স্থির হয়নি। তবে সায়মা আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে আজেবাজে কথা বলেছে একবার। এরপর আবার আমি তার কাজিনকে নিয়ে সন্দেহজনক কথা বলেছিলাম। যার ফলে সম্পর্কে কেমন একটা বিচ্ছেদের আভাস পেয়েছিলাম। আর দুজনেই কষ্ট পেয়েছি। সেটাই আমার প্রথম কষ্ট ছিলো কোনো মেয়ের জন্য। তারপর আরেক পাগলামো। একদিন ভার্সিটিতে ক্লাস শেষে সায়মাকে কিছু না জানিয়ে হাত ধরে টেনে কাজী অফিস নিয়ে যাই। সায়মা তখন কোনো জিজ্ঞাসাও করেনি। আমি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছি আর সে চুপচাপ গিয়েছে আমার সাথে। কাজী অফিস এসে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। সায়মা চাইছিলো না এভাবে বিয়ে করতে। কিন্তু একে অপরের উপর সন্দেহে দিন কাটাতে আমিও পারছিলাম না। সায়মাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে নিয়েছি। নিঃসন্দেহে দিন কাটানোর জন্য তারও তখন সেটাই ঠিক মনে হয়েছিলো। ব্যাস হয়ে গেছে বিয়ে। আর আমাদের অবস্থান যার যার বাড়িতে। কিছুদিন আগে আবার ঝগড়া হয়েছিলো। এটা সাংসারিক ঝগড়া। দোষ আশি ভাগ আমার ছিলো৷ আমি চেষ্টা করতাম তার সাথে কথা বলতে কিন্তু সে আমার প্রতি রেগে ছিলো। আমাকে শাস্তি দিতে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে। তারপর যেদিন তোর হাতে চারটা ছিদ্র করলাম সেদিন দুপুরে সে নিজ থেকে আমাকে কল করে আবারও ঝগড়া করেছে। ভয়ংকর ঝগড়া! আর সেই ভয়ংকর ঝগড়ার ফলে আমাদের পূর্বের ঝগড়া মিটমাট হয়ে গেছে। রেগে হোক আর যেভাবেই হোক, কথা বলার সুযোগ হয়েছে আর তাতে মানিয়ে নিতে পেরেছি। এতোদিন তো একটু কথা বলার সুযোগই খুজছিলাম। আর তোর কারণেই সেটা হয়ে গেছে। তাই গিফট দিয়েছি তোকে।”

    রহিমাকে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়ান বললো,

    “বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? মিথ্যে বলছি না আমি। সুযোগ হলে সায়মার কাছেই জিজ্ঞেস করিস।”

    রহিমা বিস্ময়ের সাথে বললো,

    “সংসার না করেই সাংসারিক ঝগড়া!”

    “হ্যাঁ। যতদিন না একত্রে থাকছি ততদিন ফোনে আমাদের সংসার। ইলেক্ট্রনিক সংসার। বুঝলি? আর এখন যা বললাম কেউ যেন তা না জানে। এখন তুই আমাকে বল সায়মার কি হয়েছে?”

    “কই! কিছু হয়নাই তো! সন্ধ্যায় আসার সময়ও আপারে ভালোই দেইখা আসলাম!”

    “কিছু না হলে আজ দুপুর থেকে আমার ফোন রিসিভ করছে না কেন!”

    “আপার কাজিনরা আইছিলো, মজাটজা করছে তাই হয়তো ফোন রিসিভ করতে পারে নাই।”

    “তার কাজিনরা কি এখনো আছে?”

    “না, বিকালে চইলা গেছে।”

    “তাহলে এখনো রিসিভ করছে না কেন! ইভেন, ফোন সুইচ অফ!”

    “আমি ক্যামনে বলমু! ফোনে সমস্যা হইবো হয়তো।”

    “একটু আগে আমি তার বাসার কাছ থেকেও ঘুরে এলাম। তার রুমের লাইট অফ। সে সুস্থ থাকলে এতো তারাতাড়ি তার রুমের লাইট অফ হয় না। দশটার পর ঘুমাতে যায়। তুই সত্যিই তাকে ভালো দেখে এসেছিস তো?”

    “হু।”

    আয়ান চিন্তিত হয়ে নিশ্বাস ফেললো এবং বললো,

    “আচ্ছা যা। সরি তোকে এতো রাতে বিরক্ত করার জন্য। আর শোন, কাল সকালে আগে সায়মার সাথে দেখা করে আসবি। পরে আমাদের বাসায় যাবি। আমি টাকা দিয়ে যাই, রিকশা দিয়ে যাবি।”

    আয়ান পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে টাকা নিচ্ছে। আর রহিমা খুব মনযোগ দিয়ে আয়ানকে দেখলো। আয়ানের মুখভঙ্গি আজ সত্যিই অদ্ভুত! সত্যিই তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে! অন্যদিনের মতো বাদড়ামোটা আজ চেহারায় অনুপস্থিত! সত্যিটা কি তাকে বলে দেওয়া উচিত! না, সায়মা নিষেধ করেছে কাউকে কিছু জানাতে। তাছাড়া জানলে যদি আয়ান আবার সায়মার উপর সন্দেহ আনে!

    আয়ান কিছু টাকা রহিমার হাতে দিয়ে বললো,

    “ঘরে যা। আর মনে করে আগে সায়মার কাছে যাবি।”

    আয়ান নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো আর রহিমা ঘরের দিকে ধীর পায়ে হাটতে লাগলো। বিষয়টা লুকিয়ে নিজের কাছেই ভালো লাগছে না৷ বারবার মনে হচ্ছে আয়ানকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। ওই রুমেল তো সাংঘাতিক বাজে ছেলে! যদি আবার কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে! সে কি এখন আয়ানকে সত্যিটা জানিয়ে দিবে? হয়তো  এতে আয়ান একটা ভালো সমাধান করতে পারবে।

    রহিমা ঝটপট পেছনে ফিরে আর আয়ানকে দেখতে পেল না! সে দৌড়ে সেই পথে গেলো। বাড়ির পথের সরু রাস্তা থেকে বেরিয়ে মোটা রাস্তায় আয়ানকে পেয়ে গেলো। সে “ছোট ভাইজান” বলে হাক ছাড়লো। আয়ান পেছনে ফিরে তাকালো। পাশ দিয়ে যাওয়া লোকজনও তাকিয়ে আছে রহিমার দিকে। কাকে ডাকছে তারা বুঝতে পারেনি। আয়ানকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তারা বুঝে নিয়েছে আয়ানকেই ডাকছে। রহিমা আয়ানকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ধীর পায়ে আবার সরু রাস্তায় প্রবেশ করলো। আয়ান দ্রুত পায়েই এসেছে। রহিমার কাছে এসে বললো,

    “ডাকলি কেন?”

    “আসলে, আপার মন খারাপ। তাই হয়তো আপনের সাথে কথা বলতে চায় না।”

    “মন খারাপ কেন?”

    রহিমা সম্পূর্ণ ঘটনা জানিয়ে দিলো আয়ানকে৷ আয়ান রেগে থাপ্পড় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে বললো,

    “এখন কানের নিচে লাগাই একটা! মিথ্যে বললি কেন তখন!”

    রহিমা বিড়বিড় করে বললো,

    “আপায় কাউরে জানাইতে নিষেধ করছিলো। তাই আপনারেও জানাই নাই।”

    “তো এখন জানালি কেন?”

    “ওই ব্যাটা বড় বদমাইশ! তাই ভাবলাম আপনে হয়তো এর একটা বিহিত করতে পারবেন।”

    “এখন কি তার কাজিনরা কেউ বাসায় আছে?”

    “না।”

    “কাল সকালে তোকে সায়মার কাছে যেতে হবে না। দুপুরেই যাবি। আর যেকোনো ভাবে তাকে মানিয়ে বাসা থেকে বের হবি। গ্রিনল্যান্ড পার্কে যাবি৷ তাও বিকেলের আগে অর্থাৎ দুপুরেই। কিভাবে যাবি আমি জানি না। সেটা কেবল তুই জানবি। নতুবা তোর কপাল খারাপ! আর শোন, আমি বলেছি বা উক্ত ঘটনা আমি জেনেছি এসব কিছুই যেন সায়মা না জানতে পারে। আর আমার সাথে দেখা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তুই আমাকে নিয়ে তার সাথে কোনো কথাই বলবি না। জাস্ট দুপুরের মধ্যে তোদের দুজনকে আমি গ্রিনল্যান্ডে দেখতে চাই। যা, ঘরে যা।”

    এমন হুমকিতে রহিমা হতবাক! করতে এলো উপকার আর দিয়ে গেলো হুমকি! তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ান রাগান্বিত গলায় বললো, 

    “যা!”

    রহিমা বারবার পিছু ফিরতে ফিরতে নিজের ঘরে চলে এলো। এতোক্ষণ পর্যন্ত আয়ান সেখানেই দাড়িয়ে ছিলো। রহিমা ঘরের ভেতর প্রবেশ করলে আয়ান উক্ত স্থান ত্যাগ করলো।

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১১

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    রহিমার রাত আজ অর্ধেক ঘুমে কেটেছে আর অর্ধেক নির্ঘুম! ভেতরটা কেমন যেন ভারি হয়ে আছে! তারউপর সায়মাকে কাল কিভাবে গ্রিন ল্যান্ডে নিয়ে যাবে সেই চিন্তা! এভাবেই কেটে গেছে অর্ধেক রাত। আর শেষ রাতে চোখে ভীড় জমিয়েছে ঘুম।

    পরদিন আয়ানের বাড়িতে কাজ করতে গিয়েও সে অন্যমনস্ক! আজ কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে সে। কয়েকবার কাজে গোলমালও করে ফেলেছে! লাল মিয়া বাজার করে এনে দিয়েছে। মারিয়া কাইয়ুম তাকে মাছ কাটতে বললে সে আস্ত মাছের প্যাকেট ফ্রিজে রাখতে যাচ্ছিলো! মারিয়া কাইয়ুম দ্বিতীয়বার বললে তার ধ্যান ভাঙলো। পরক্ষণে আবার মাছ কেটেকুটে ফ্রিজে রাখার বদলে ডাইনিং টেবিলে ফলের ঝুড়িতে রেখে এসেছে! আয়মান ধমক দেওয়ায় তার হুশ হয়েছে!

    পিংকি বাবুর জামাকাপড় ধুয়ে দিতে বললে সে ধুয়েছে ঠিকই। কিন্তু বারান্দায় শুকাতে দিয়ে ক্লিপে আটকাতে ভুলে গেছে! যার ফলে জামাকাপড় সব বাতাসে উড়ে নিচে পড়ে গেছে! লাল মিয়া দুইটা কুড়িয়ে এনেছে বিধায় পিংকি জানতে পেরেছে রহিমার কাণ্ড। অত:পর রহিমাকে খেতে হলো আচ্ছা রকমের ঝাড়ি! কিন্তু আজ রহিমা কোনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া করেনি। চুপচাপ নিচে এসে কিছু জামাকাপড় খুঁজে খুঁজে কুড়িয়ে এনেছে। যদিও দু চারটা নিখোঁজ!

    রহিমার এমন অন্যমনস্কতায় মারিয়া তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো যে, তার কি হয়েছে! কিন্তু কোনো জবাব দেয়নি রহিমা। আজ চুপচাপ কাজের পর কাজ করে বেরিয়ে গেছে।

    দুপুরে ভাবতে ভাবতেই রাস্তা অতিক্রম করে চলে এলো হক মঞ্জিলে। কলিং বেল বাজালে আজ দরজা খুলে দিলো ফারহানা হক। সে সালাম দিয়ে চুপচাপ ভেতরে প্রবেশ করলো। এমনি চুল খোপা করতে করতে ইশতিয়াকের রুম থেকে বেরিয়ে এলো সায়মা। সায়মাকে দেখে কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলো রহিমা। এই মুহূর্তে তার চেহারা দেখে যে কেউ বলে দিবে সে মনে মনে কিছু ভাবছে। কিন্তু তেমন কিছু বললো না কেউই! নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে সায়মা খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

    “মন খারাপ?”

    রহিমা মলিন মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে মাথা দু’দিকে নাড়লো। অত:পর কিচেনে চলে গেলো। প্রথমে সে সকালের এটো থালাবাটি ধুয়ে নিলো। অত:পর ঘর মুছে দিলো। অত:পর সবাই ঘরে এলে সে টেবিলে প্লেট ও খাবারদাবার এনে গুছিয়ে দিলো। সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। রহিমা নিত্যদিনের মতো মেঝেতে বসেছে। তা-ও প্লেটে আজ অল্প খাবার! তার খেতেই ইচ্ছে করছিলো না। ফারহানা জোরাজুরি করাতে সে অল্প নিয়েছে। আর সায়মা! কাল থেকে যেন তার সকল কর্মকাণ্ডই বন্ধ হয়ে আছে! কাজিনরা থাকতে দুপুরে জোরপূর্বক মজার সাথে খাওয়াদাওয়া করেছিলো। কিন্তু এরপর থেকে বিষন্নতা ও খাবারে অনিহা! রাতে খায়নি কিছুই আর সকালে এক টুকরো রুটি খেয়েছে শুধু! ফারহানা হক বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন মেয়ের অবস্থায়! বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পরেও মুখ ফুটলো না তার মেয়ের! সায়মা অপেক্ষা করছিলো রুমেল কোন কাণ্ড ঘটায় কি-না তা দেখার জন্য। কিন্তু কাল থেকে আজ পর্যন্ত এমন কোনো কিছু হয়নি। হয়তো এদিক থেকে শিক্ষা হয়ে গেছে রুমেলের। এটাই সায়মার ধারণা। পরিস্থিতি যেহেতু নিরব সেহেতু আর কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি সে। কারণ জানাজানি হলে দুই পরিবারের সেই সুমধুর সম্পর্কে ঝামেলা সৃষ্টি হবে। আল্লাহ রুমেলকে সুবুদ্ধি দান করুক এটাই সায়মার প্রত্যাশা। 

    একাধারে কাজকর্ম করে রহিমা সায়মার রুমে এসে বসে আছে। সায়মা ও মনমরা হয়ে বসে ছিলো। রহিমাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে খুব বড়সড় নিশ্বাস ছাড়লো। অত:পর দুজনেই নিরব! কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হওয়ার পর সায়মা জিজ্ঞেস করলো,

    “এমন চুপ করে আছিস কেন? কি হয়েছে তোর? বল আমাকে?”

    “কিছু না আপা।”

    “কিছু তো হয়েছেই। বলবি না আমাকে? আমিও তো কত কিছুই শেয়ার করি তোর সাথে। আমার সাথে শেয়ার কর, দেখবি মন হালকা হবে এবং বিষন্নতা কেটে যাবে।”

    “ভার্সিটি গেছেন আজকা?”

    “উহুম।”

    “আমারে ঘুরতে নিয়া যাইবেন আপা?”

    “চল, ছাদে যাই।”

    “ছাদে না। বাইরে কোথাও চলেন।”

    “বাইরে যাবো না আমি।”

    “ক্যা?”

    “এমনি।”

    “চলেন না যাই।”

    “না, ভালো লাগছে না বাইরে যেতে। চল ছাদে যাই।”

    “না থাক তাইলে।”

    রহিমা বসা থেকে উঠে চলে যাচ্ছিলো। পেছনে ফিরে আবার বললো,

    “আপনেরও মন খারাপ। আমারও মন খারাপ। চলেন বাইরে কোথাও যাই। নিরব পরিবেশে খোলামেলা জায়গায় একটু ঘুইরা চইলা আসমুনে। যাইবেন?”

    সায়মা কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললো,

    “আচ্ছা, রেডি হয়ে আসছি।”

    পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে সায়মা তৈরি হয়ে গেলো। গালের লম্বা দাগ গুলোর জন্য মুখে মাস্ক ব্যবহার করলো। অত:পর রহিমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিরব পরিবেশে হাটবে তাই রহিমাই অফার করলো গ্রিনল্যান্ডে যাওয়ার জন্য। সেটা কোনো পার্ক নয়। কোনো এক ভদ্রলোক বাড়ি করার জন্য জমি কিনেছে। কিন্তু বাড়ি করেনি এখনো। যার ফলে ঘাস লতাপাতা জন্মে সবুজে আচ্ছাদিত। পরবর্তীতে মালিক ঝোপঝাড় কেটে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়েছে সেখানে। এখন সেগুলো বৃহৎ আকৃতির বৃক্ষ হয়েছে। মানুষজন যায়, আড্ডা দেয়, খোলামেলা পরিবেশে ঘুরেফিরে সময় কাটায়। পরিধি ছোট হলেও বেশ মনোরম জায়গা।

    রহিমার কথায় সায়মা এখানেই এলো। দুপুর বেলায় মানুষ নেই। তবে আসরের আযান পড়লেই লোকজন আসতে শুরু করবে। কথা বলতে বলতে শুরু থেকে শেষ প্রান্তে এসেছে তারা। সায়মা ঢালুর দিকে আয়ানকে বসে থাকতে দেখে রহিমার হাত ধরে টানতে লাগলো। রহিমা একটু জোর গলায়ই বললো,

    “আরে আপা! টানেন ক্যা? কই যান!”

    সায়মা ফিসফিসিয়ে বললো,

    “রহিমা চল এখান থেকে। অন্যকোথাও যাই।”

    “ক্যা? কি হইছে?”

    “যেতে বলেছি।”

    এদিকে রহিমার গলা শুনে আয়ান পেছনে ফিরে তাদের দেখতে পেয়েছে। সায়মাকে চলে যাওয়ার জন্য রহিমার হাত ধরে টানতে দেখে আয়ান এক প্রকার দৌড়ে উঠে এলো তাদের কাছে। সায়মার চোখ ইতিমধ্যে ভেজা হয়ে এসেছে। ধাধানো কন্ঠে সে রহিমার উদ্দেশ্যে বলেই যাচ্ছে,

    “রহিমা চল এখান থেকে।”

    আয়ান কিছু না বলে সায়মার মাস্ক খুলতে গেলে সায়মা বাধা দিয়ে বললো,

    “হচ্ছে কি এসব!”

    আয়ান কোনো কথা না বলে সায়মার হাত টেনে সরিয়ে মাস্ক খুলে দিলো। রহিমা সায়মার হাত ছাড়িয়ে তাদের থেকে দুই ফুটের মতো পিছিয়ে গেছে। আয়ান সায়মার গালের দিকে তাকিয়ে আবার চোখে তাকাতেই সায়মা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। আয়ান খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

    “কাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত কতবার ফোন দিয়েছি, রিসিভ করনি কেন? সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত ফোন সুইচঅফ কেন?”

    রহিমার সামনে আয়ান তার সাথে কথা বলছে বিধায় সায়মা একবার রহিমার দিকে তাকাচ্ছে আবার আয়ানের দিকে। কি জবাব দিবে সে, কিছুই বুঝতে পারছে না! এভাবে বারবার রহিমার দিকে তাকাতে দেখে আয়ান কিছুটা ধমকে বললো,

    “তার দিকে কি দেখো! আমার দিকে তাকিয়ে জবাব দাও। ফোন সুইচ অফ কেন তোমার?”

    “আপনি কি বলছেন এসব!”

    “তোমার গালের অবস্থা এমন হলো কি করে?”

    “রহিমা, চলতো।”

    আয়ান সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো সায়মার দাগ পড়া গালে! সায়মা স্তব্ধ আর রহিমা হতবাক! আয়ান রাগান্বিত গলায় বললো,

    “গালের এই অবস্থা করেছো কেন? ওই পিশাচটা ঠোঁট ছুয়ে দিয়েছে বলে?”

    সায়মা কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রহিমার দিকে! তার বুঝতে বাকি নেই রহিমা জানিয়েছে ব্যাপারটা! আয়ান হাত বাড়িয়ে তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে বললো,

    “তার দিকে কি দেখো। আমি কথা বলছি আমাকে দেখো। সে জানে আমাদের ব্যাপারে সব। আমি জানিয়েছি তাকে। আর আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখায় গতকালের ঘটনা জানতে আমিই বাধ্য করেছি তাকে এতোসব বলতে।”

    সায়মা রহিমাকে বললো, 

    “আমাকে মার খাওয়ানোর জন্য ইচ্ছে করে এনেছিস না এখানে?”

    রহিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আয়ান ধমকে বললো,

    “তার সাথে না, কথা আমার সাথে বলো। তোমাকে মাইর দেওয়ার জন্য এখানে নিয়ে আসতে তাকে থ্রেড দিয়েছি আমি। তুমি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছো কেন? সেই ছেলের জন্য? গালের উপর এমন অত্যাচার করেছো কেন? শুধুমাত্র সেই ছেলের জন্য?”

    “হ্যাঁ, করেছি সেই ছেলের জন্য। যেখানে আমার হাসব্যান্ড আমাকে এভাবে স্পর্শ করলো না সেখানে পরপুরুষ কেন স্পর্শ করবে! তাই করেছি এসব। বিশ্বাস করো, আমি কখনোই তাকে প্রশ্রয় দেইনি। সে জবরদস্তি এমন করেছে আমার সাথে। পারলে এই গালটাই কেটে ফেলে দিতাম আমি!”

    কথা বলতে বলতে সায়মা কেদে উঠেছে! আয়ান থাপ্পড় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত দেখিয়ে বললো,

    “আরেকটা লাগাবো এখন। গালে স্পর্শ করেছে তো কি হয়েছে? আগুন ধরে গেছে? ঠোসা পড়ে গেছে? বলদি কোথাকার! সে তোমার সাথে জবরদস্তি করেছে যেহেতু তুমি তার হাত ভেঙে দিতে পারলে না! সে গালে স্পর্শ করেছে যেহেতু তার ঠোঁট কেটে দিতে পারলে না! নিজের গাল কেন কাটলে এভাবে! এগুলো কি করেছো! মেজাজটা তো বিগড়ে যাচ্ছে এখন!”

    সায়মা ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলো। আয়ান থামতেই সে আশেপাশে তাকিয়ে রহিমাকে বললো,

    “রহিমা, তুই অন্যদিকে যা।”

    রহিমা তার কথায় পা বাড়াতেই আয়ান মেজাজী গলায় আবার বললো,

    “না, যাবে না রহিমা। কালকের ঘটনা তো তার সামনেই ঘটেছে না? তাহলে মাইর তো তার সামনেই দেওয়া দরকার। এই রহিমা! দাড়িয়ে থাক তুই এখানে! একটুও নড়বি না!”

    সায়মার রাগ হলো আয়ানের উপর। কারণ এই প্রথম তার ইচ্ছে করছিলো আয়ানকে একবার জড়িয়ে ধরতে। কেননা সে ভাবতেও পারেনি বিষয়টা আয়ান এতোটা সহজভাবে গ্রহণ করবে! আয়ানের প্রতি আজ বড্ড সম্মান জেগেছে মনে। কিন্তু আয়ান জড়িয়ে ধরার সুযোগটা যে তাকে দিলো না। সে দু’হাতে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। আয়ান আবার সায়মাকে বললো,

    “রুমেলের বাসার ঠিকানা দাও।”

    “কেন?”

    “আমি চেয়েছি, তাই।”

    “না।”

    “এখন আমার মেজাজ খারাপ করো না, বলে দিলাম।”

    “এমন করছো কেন তুমি! এই মাত্র না ইজিলি নিলে ব্যাপারটা! তাহলে আবার তার বাড়ির ঠিকানা কেন! আমি কিন্তু কোনো ঝামেলা চাইছি না।”

    “আমি তো ইজিই আছি। তুমি কেন এমন হয়ে আছো! তোমাকে ইজি করতে হলেও আমাকে যেতে হবে তার কাছে। বাসার ঠিকানা দাও। নয়তো ফোন নম্বর দাও আর ছবি দেখাও। এমন অবস্থা করবো এরপর থেকে যেন মেয়েদের বদলে ছেলেদের অফার করতে হয়।”

    “পাগলামো করো না। আমি যথেষ্ট ইজি আছি।”

    আয়ান চিৎকার করে বললো,

    “তাহলে আমার সাথে কথা বলোনি কেন কাল থেকে! তুমি জানো, কাল রাতের বেলা আমি তোমার বাসার সামনে থেকে ঘুরে এসেছি। টেনশনে আমার মাথা কাজ করছিলো না। সেই রাতের বেলাই আবার রহিমার বাসায় ছুটে গিয়েছি তাকে বিরক্ত করতে!”

    তার চিৎকারে রহিমা কেপে উঠেছে আর সায়মা চোখ বন্ধ করে হজম করে নিলো তার রাগ। আয়ান নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টায় দুমিনিট নিরবে হাটাহাটি করলো। সায়মা ও রহিমা এক জায়গাতেই দাড়িয়ে আছে। অত:পর আয়ান তাদের নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। দুইটা রিকশা নিলো। একটাতে সায়মা ও রহিমা অন্যটায় আয়ান একা। চলে এলো রেস্টুরেন্ট। আয়ান নিজের ইচ্ছেমতো খাবার অর্ডার করলো। তারপর সবাই খেয়ে নিলো। বাসা থেকে খেয়ে আসায় তারা দুজন তেমন খেতে পারেনি। বেশিরভাগ আয়ানই শেষ  করলো। খাওয়া শেষে যখন ওয়েটার বিল নিতে এলো তখন আয়ান তার ওয়ালেট বের করলো। অত:পর ওয়ালেট ফাঁক করে সায়মার দিকে ধরলো। তার ওয়ালেটে শুধুমাত্র একটা দশ টাকার নোট! সায়মা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো আর রহিমা হা করে আছে! খেয়েদেয়ে এখন ফাঁকা ওয়ালেট দেখায়! 

    অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও ওয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় কিছুই বললো না সায়মা। চুপচাপ তার পার্স থেকে টাকা বের করে বিল দিয়ে দিলো। ওয়েটার চলে গেলো আর আয়ান মুখে হাসি ফুটিয়ে বোতল থেকে গ্লাসে কোকা কোলা ঢেলে নিলো। এতোক্ষণ চুপ থাকলেও রহিমা এবার হুট করেই বলে উঠলো,

    “আপা, এই রহিমার একটা কথা মাথায় রাইক্ষেন! আপনে মনে কইরেন না যে, কপাল কইরা একটা রাজপুত্র পাইছেন! আসলে, আপনে কপাল কইরা একটা ফকির পুত্র পাইছেন।”

    আয়ান দাতে দাত চেপে বললো,

    “রহিমা, কথা কম বল। না হলে বোতল দিয়ে আজ মাথা ফাটাবো!”

    “ক্যা? কথা কম বলমু ক্যা? উচিত কথা কইলেই খালি আমার শাস্তি? এহন যে গদগদ কইরা খাইলেন, আপায় যদি টাকা না আনতো তাইলে তার বিল দিতেন ক্যামনে? এইটাও তো সম্ভব না যে, বমি কইরা পেট থেইকা সব বাইর কইরা ফেরত দিয়া যামু ব্যাডাগো!”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১২

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    আয়ানের সাথে ঘুরেফিরে শেষ বিকেলে দুজন বাসায় ফিরে এসেছে। দুজনেরই মনটা হালকা হয়েছে। আজ সন্ধ্যার কোনো কাজকর্ম করতে হয়নি রহিমাকে। সে সন্ধ্যার পূর্বেই বাড়ি ফিরে গেছে।

    পরদিন কাইয়ুম ভিলায় গেইট দিয়ে প্রবেশ করার সময় লাল মিয়ার কণ্ঠে তুলনামূলক নিচু স্বরে গান শুনতে পেল রহিমা।

    “ও সকিনা, গেছত কি না ভুইলা আমারে! আমি এহ…..ন! আমি এহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে…!”

    রহিমা লাল মিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে ভবনে চলে গেলো। সেদিন আয়ান লাল মিয়াকে শাসানোর পর থেকে লাল মিয়া আর কথা বলে না রহিমার সাথে। আগে নিজেই পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতো, দুষ্টুমি করতো। আর এখন প্রয়োজনেও কোনো কথা বলে না৷ আর রহিমা তো এমনিতেই তার প্রতি বিরক্ত বোধ করে সবসময়!

    রহিমা চুপচাপ এসে কাজে লেগে গেলো। দুমিনিট পরেই আয়ান ঘরে প্রবেশ করলো গান গাইতে গাইতে। তার মুখেও একই গান!

    “ও সখিনা গেছত কি না ভুইলা আমারে! আমি এখ…ন! আমি এখন রিকশা চালাই ঢাকা শহরে..!”

    রহিমা নিশ্চিত, আয়ান লাল মিয়ার কাছে শুনে এসেছে বিধায় এখন এই গানের সুর টেনেছে। ছেলের গুনগুন শুনে ওদিকে ড্রয়িং রুম থেকে কাইয়ুম সাহেবের কণ্ঠে ভেসে এলো,

    “দাড়াও, তোমাকে রিকশা ই কিনে দিবো। বছরে বছরে অযথা ভার্সিটিতে এতো টাকা খরচ করার কি প্রয়োজন। পড়াশোনা যেহেতু করছো না, রিকশাই কিনে দিবো। খরচের পরিবর্তে আমার আয় হবে।”

    আয়ান তার বাবার উত্তরে বললো,

    “দাও। টাকা দাও। রিকশা কিনে আনি।”

    “টাকা দিবো কেন। আমি নিজেই কিনে আনবো।”

    “চালাবো আমি আর কিনবে তুমি! তা কি করে হয়! ভালো না মন্দ তা যাচাই করে আনবো না!”

    আয়মান ডাইনিং টেবিলে বসে  তার ছেলেকে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলো। ভাই ও বাবার মুখে এমন কথা শুনে শব্দযোগে হেসে উঠলো। আয়ান একটা আপেল নিয়ে তার পাশে এসে বসে বললো,

    “তুই হাসছিস কেন! হুম?”

    “ভাইয়া, তুমি রিকশা চালাতে পারো?”

    “কেন? তুই শিখবি?”

    “না। আমি চড়বো।”

    কথাটা বলে আবারও হেসে উঠলো আয়মান। ওদিকে রহিমার বিড়বিড় শোনা গেলো,

    “আপা, ভাইজানের রিকশায় উঠবেন তো রাস্তা ছাইড়া পাত্তালে যাইবেন! আর নয়তো উড়োজাহাজে সোজা চান্দের দেশে!”

    আয়মান আবারও হেসে উঠলো। আয়ান আজ রহিমার প্রত্যুত্তর না করে আপেল খেতে খেতে মৃদু হাসলো শুধু। কিভাবে করবে প্রত্যুত্তর! আগের মতো উল্লাসিত হয়ে কথা বলেনি রহিমা। যার ফলে প্রত্যুত্তর করার উৎসাহ পেল না আয়ান।

    হক মঞ্জিলে এসে নতুন দৃশ্য দেখতে পেল রহিমা! মেহমান এসেছে সায়মাদের বাড়িতে। এরা তো সায়মার খালা ও খালু! কিছু কথা শুনে বুঝতে পারলো সায়মার বিয়ের আলোচনা চলছে! তা শুনে রহিমা স্তব্ধ! সে দ্রুত সায়মার সাক্ষাতে গেলো। সায়মার রুমে একটা মেয়েকে দেখতে পেল। এ তো রুমেলের বোন! সেদিন এসেছিলো। তারা কার সাথে বিয়ে ঠিক করছে! মেয়েটির জন্য রহিমা সায়মার সাথে কথা বলতে পারলো না। কিন্তু সায়মার চেহারায় ভেসে উঠা বিষন্নতা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সে।

    পরবর্তীতে কাজে লেগে গেলো। কিন্তু পরেও আর কথা বলার সুযোগ হলো না! কারণ মেহমান রাতে যাবে। তাকে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসতে হলো।

    পরেরদিন সায়মার বিয়ের ব্যাপারটা আয়ানকে জানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো রহিমা। কিন্তু আয়ানকে আজ বাসায় পেল না!

    মন ভরা দুঃখ নিয়ে দুপুরে সে হক মঞ্জিলে চলে এলো। আজ তারা সে আসার আগেই খেয়ে নিয়েছে৷ আর সায়মা ঘুমাচ্ছিলো তখন। রহিমা খাবার খেয়ে তার কাজকর্ম করতে থাকলো। ঘুম থেকে উঠে সায়মা রহিমাকে নিয়ে ছাদে এলেই রহিমা তার সাথে  কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। ছাদে পা রাখতেই রহিমার প্রশ্ন, 

    “আপা, আপনের খালা না কাল বিয়ার ব্যাপারে কথা বলছে। বিয়া কি ঠিক হইয়া গেছে?”

    “না।”

    “আলহামদুলিল্লাহ। জানেন, আমি খুব চেষ্টা করছিলাম খবরটা ভাইজানের কাছে দিতে। কিন্তু ভাইজানরে পাই নাই।”

    “আমি কালকেই জানিয়েছি তাকে।”

    রহিমা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে বললো,

    “যাক। ভালোই হইছে। তা বিয়া আটকাইলেন ক্যামনে?”

    “আটকেনি। মনে হয় আরও বেশি এগিয়ে যাচ্ছে।”

    “এক কাজ করেন। পাত্ররে বাড়িতে আনেন কিংবা নিরিবিলি জায়গায় আমন্ত্রণ জানান। জটিল আপ্যায়নে ধোলাই করি। ব্যাটা নিজেই বিয়া ভাইঙ্গা দিবো।”

    সায়মা ব্রু সামান্য কুচকে বললো,

    “তুই কি জানিস না, পাত্র কে?”

    “আমি হইছি কাজের বেটি রহিমা। আমারে কি কেউ এতো কিছু কইবো পার্সোনাল কথাবার্তা! তাছাড়া আপনের সাথে তো কথা বলার সুযোগই পাইলাম না!”

    “পাত্র রুমেল। সে তো ধোলাই আগেই খেয়েছে। আর সেজন্যই পাগল হয়ে গেছে বিয়ে করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”

    “কি! এই বদমাইশ! আপনের লাইগা। খালি আপনের লাইগা সেদিন বাইচ্চা গেছে! আমি তো চাইছিলাম তারে রুমাইল বানাইয়া উড়ায় দিতে! এহন ভালো হইছে না? বিয়াইত্তা বেটির আবার বিয়া!”

    “মুখের ভাষা ঠিক কর।”

    “সরি। ভাইজান জাইন্না কি কইছে?”

    “কি আর বলবে! সে-ও তোর মতো আমাকে বকেছে! দোষ একটাই, কেন আমি তাকে সেদিন এড্রেস দিলাম না!”

    “ভালোই হইছে। তা আপনের বাবামা কি কইলো? তারা রাজি?”

    “রুমেল আমার সমবয়সী। মাত্র দেড় মাসের বড়। সেজন্য বাবা মা রাজি নয়। কিন্তু খালামনি বাবামা কে পাগল করে ফেলছে বিয়ে দেওয়ার জন্য। আর আমি নিশ্চিত, এগুলো সব রুমেলের চালাকি! নিশ্চয়ই সে খালামনিকে প্যারা দিচ্ছে! নতুবা এতো তারাতাড়ি ছেলের বিয়ের কথা অন্তত খালামনি তুলতো না।”

    “বদমাইশটারে আরেকবার ঝাটা পেটা করা উচিত। বিয়ার গেরা মজাইয়া দিতাম!”

    “কি বলিস এসব! চুপ থাক। অন্যের জন্য নিজের মুখ খারাপ করবি না। ওদিকে আরেক চিন্তায় ভালো লাগছে না। কাল সন্ধ্যায় আমাকে বকাঝকা করে রাত এগারোটার দিকে আবার কল করে সান্ত্বনা দিয়ে বললো যেন টেনশন না করি। সে নিজে ব্যবস্থা করে ফেলবে। কে জানি, কি কান্ড করে বসে!”

    “কে কি কান্ড করবো?”

    “কে আবার! তোর আয়না ভাইজান।”

    “তাইলে আর চিন্তা কইরেন না। টেটনায় যেহেতু সান্ত্বনা দিছে নিশ্চিন্তে ঘুমান। সুষ্ঠুভাবে কাজ সম্পাদন হইয়া যাইবো।”

    “এই, টেটনা কি?”

    “যে অতি চালাক, অতি বুদ্ধিমান আর অতিরিক্ত ইতর তারেই টেটনা বলে। না, থুক্কু! তারেই টেটনা বলি।”

    “আরও কত কি বলবি!”

    পরদিন রহিমা কাইয়ুম ভিলায় এসে দেখলো আয়ান ডাইনিং টেবিলের কোনায় বসে আছে। হাতে বিস্কুট। গত কয়েকদিন যাবত সে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠছে। হয়তো বউয়ের চিন্তায় নয়তো ভাতিজির কান্নাকাটিতে! 

    রহিমাকে দেখতেই আয়ান হাতের বিস্কুট প্লেটে রেখে হাত ঝেড়ে বললো,

    “ওহ্! এসেছিস! যা, কাজে লেগে পড়।”

    এমন একটা ভাব প্রকাশ করলো যেন রহিমার জন্যই সে অপেক্ষা করছিলো। রুম থেকে বের হতে হতে সায়ান জবাব দিলো,

    “তা তোমাকে বলতে হবে নাকি! সে তো কাজের জন্যই এসেছে৷”

    বলতে বলতে সায়ান চেয়ার টেনে বসলো। ভাইয়ার কথায় মৃদু হেসে আয়ান টেবিল থেকে নেমে নিজের রুমে চলে গেলো। রহিমা কিচেন থেকে  সায়ানের নাস্তা এনে দিলো। সায়ান খেয়েদেয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতেই আয়ান আবার এসে টেবিলে বসলো। আয়মান পিংকির কাছে। রহিমা আর মারিয়া কিচেনে। আয়ান মারিয়াকে ডাকলো,

    “আম্মু?”

    মারিয়া কিচেন থেকে সাড়া দিলেন,

    “হুম?”

    “আমি বিয়ে করবো।”

    কথাটা বলে কান পেতে আছে মায়ের জবাব শোনার জন্য। জবাবের পরিবর্তে কিচেন থেকে খুন্তি হাতে বেরিয়ে এলো মারিয়া কাইয়ুম! আয়ান টেবিল থেকে লাফ দিয়ে নেমে ড্রয়িং রুমে এসে দরজা চাপিয়ে দিলো। মারিয়া কাইয়ুম টেবিলের কাছ থেকে বললো,

    “পালাস কেন? আয়, তোকে বিয়ে করাচ্ছি!”

    আয়ান দরজা একটুখানি ফাঁক রেখে মাথা বের করে বললো,

    “কিছু হলেই খুন্তি নিয়ে আসো কেন? তোমাদের মেয়েদের কি এই খুন্তি ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নেই!”

    মারিয়া কাইয়ুম কিছু না বলে চোখ পাকিয়ে চলে গেলো। আয়ান এখান থেকেই চেচিয়ে বললো,

    “আমি কিন্তু সিরিয়াস কথা বলছি। সত্যি সত্যিই বিয়ে করবো আমি।”

    পেছন থেকে কাইয়ুম সাহেবের কণ্ঠ ভেসে এলো,

    “আমরাও তো জানি তোমার এখন পুতুল খেলার বয়স নয় যে মিথ্যে মিথ্যে বিয়ে করতে চাইবে।”

    আয়ান পেছনে ফিরে বললো, 

    “ওহ্! তুমি বাসায়ই আছো! তাহলে আর অযথা খুন্তির দৌড়ানি খাচ্ছি কেন! ডিল তো তোমার সাথেই করতে পারি।”

    বলতে বলতে আয়ান সোফায় বসলো আর কাইয়ুম সাহেব উঠে গেলেন। আর আয়ান আবার উঠে বাবার পিছু পিছু যেতে যেতে বললো,

    “আব্বু, তুমিও আমাকে ইগনোর করছো! এমন হলে তো আমাকে সারাজীবন কুমার থেকে যেতে হবে!”

    কাইয়ুম সাহেব ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

    “নাস্তার সময় হয়েছে আমার।”

    “ওহ্, আচ্ছা। রহিমা, আব্বুকে খাবার দে।”

    রহিমা সাড়া দিলো,

    “আইতাছি।”

    আয়ান তার বাবার উদ্দেশ্যে বললো,

    “আব্বু, শোন। তোমরা তো চাও আমি পড়াশোনা করি, ভালো রেজাল্ট করি, অত:পর ইনকাম করি। তাই না?”

    “হু।”

    “তো এবার একটা ফাইনাল ডিল করি তোমার সাথে। তুমি বিয়ে করিয়ে দেও, এরপর দেখবে ভালো পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট, ভালো ইনকাম সব হাজির।”

    “আচ্ছা, আগে করে দেখাও তারপর বিয়ে।”

    “নো! নো! ডিল অফার আমি করছি। দাবি আমার থাকবে। আগে বিয়ে তার পরিবর্তে আমার উক্ত বচন।”

    “আচ্ছা! তোমার বচন যদি মানতে হয় তাহলে এটা বলো যে, আগে বিয়ে করলে বউকে খাওয়াবে কি?”

    “সেই চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তোমার ছয়.. “

    “হ্যাঁ, আমার ছয় তলা বাড়ি আছে তো! আর আমার বাড়ি অথচ চিন্তা আমার করতে হবে না! দারুণ বলেছো।”

    “হুম, সবসময়ই বলি।”

    “লজ্জা করে না, বাপের টাকায় বউ পুষবে! তোমার মানইজ্জত না থাকতে পারে, যে তোমার বউ হয়ে আসবে সে নিশ্চয়ই এতোটা নির্লজ্জ হবে না!”

    “বাড়ি নিয়ে এতো বড়াই তোমার! আচ্ছা যাও! লাগবে না তোমার টাকা। বিয়েটা দিয়ে দাও, বউকে বলবো সে যেন তার বাপের বাড়ি থাকে আর আমি আমার বাপের বাড়ি। এরপর যখন আমি ইনকাম করবো, তখন বউ নিজের বাড়ি নিয়ে আসবো। এবার তো তুমি রাজি?”

    “আমি রাজি? মেয়েটা কি আমার? কোন বাপ কি তার মেয়েকে বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দিবে! বেকুব কোথাকার! বউ যেহেতু বাপের বাড়ি থাকবে, এখনো তো থাকছেই। তো থাকুক। বিয়ে নিয়ে এতো তাড়া কেন তোমার? ইনকামের পরই বিয়ে করবে। একই তো কথা হলো।”

    “এক নয় বাবা, এক নয়! বিবাহিত আর অবিবাহিতের মাঝে তো বিপুল পার্থক্য। শব্দদ্বয়ই বিপরীত। তুমি শুধু ডিল ফাইনাল করো৷ এমন মেয়ে ও মেয়ের বাবার অভাব হবে না দেখো।”

    “মেয়েতো মনে হয় আগেই ঠিক করে রেখেছো!”

    “আরে নাহ! আমি কি ঘটক নাকি! ঠিক করবে তো ঘটক।”

    “আচ্ছা। তো ডাকো ঘটককে। দেখুক পাত্রী। পেয়ে গেলে আর আপত্তি কিসে।”

    “এই হলো বাবার মতো আব্বু।”

    এমনি কিচেন থেকে বেরিয়ে মারিয়া কর্কশ গলায় বললো,

    “ছেলের সাথে কি বাবার মাথাও গেছে! এমন বেতাল ছেলের বিয়ে দিয়ে মেন্টাল হবে তুমি!”

    “আরে, বেতাল ছেলেকে তালে আনতেই তো রাজি হলাম। পেটের জ্বালায় আর বউয়ের ঠেলায় এমনিতেই সোজা হয়ে যাবে৷ আয়ান, মেয়ে দেখো। খুজে পেলে জানিও।”

    মারিয়া রেগেমেগে চলে গেলো আর আয়ান রহিমাকে ডাকলো। রহিমা রুটি আর তরকারির বাটি এনে বললো, 

    “জ্বি ভাইজান?”

    “মেয়ে দেখা শুরু কর।”

    রহিমা বিস্মিত হয়ে বললো, 

    “আমি!”

    “হ্যাঁ, তুই!”

    রহিমা বেশ বুঝতে পারছে আয়ান তাকে তাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলায় যুক্ত করার চেষ্টা করছে। তাই কাইয়ুম সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,

    “বিশ্বাস করেন খালু। আমি কোনো ঘটক না আর জীবনেও ঘটকালি করি নাই। আমি খালি দুই বাড়িতে কাজ করা ছাড়া আর কোনো কাজই করি না। সময় থাকলে তো! তাইলে পাত্রী ক্যামনে আনমু, আপনেই কন!”

    আয়ান দাত কিড়মিড়িয়ে বললো, 

    “আমি কিছু জানিনা। পাত্রী তুই ই খুঁজে আনবি। একশো চুয়াল্লিশ ধারায় আইন জারি করলাম তোর উপর। নয়তো সোজা সেই তোর চান্দের দেশ!”

    হুট করেই আয়মান এসে বললো,

    “ভাইয়া, আমার দুইটা ননদ আছে। একটা আপন আরেকটা ফুপাতো।”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১৩

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    হুট করেই আয়মান এসে বললো,

    “ভাইয়া, আমার দুইটা ননদ আছে। একটা আপন আরেকটা ফুপাতো।”

    আয়ান ব্রু কুচকে বললো,

    “খবরদার, কোনো আত্মীয়ের মাঝে সমন্ধ খুজবি না!”

    “হুহ্!”

    আয়মান ভেঙচি কেটে চলে গেলো।

    আয়ানের চক্রান্তে ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ে শুরু হলো রহিমার ঘটকালি। প্রতিনিয়ত আয়ান নানান বানী তার কানে ঢেলে দিচ্ছে। কিন্তু সায়মার বাবামায়ের কাছে যখনই প্রস্তাব করতে যাবে তখনই সাহস হারিয়ে ফেলে! বলতে যায় বিয়ের ব্যাপারে আর বলে আসে অন্যান্য ব্যাপার! উক্ত মুহুর্তে তার সব গুলিয়ে আসে! জীবনে করেছে না কি ঘটকালি! তারউপর বিবাহিত ছেলেমেয়ের পুনঃবিবাহের ব্যাপার! সাহস আসবে কোথা থেকে!

    ওদিকে রুমেলের সাথেও সায়মার বিয়ে দিতে রাজি নয় ফারহানা। কেননা তারা সমবয়সী। কিন্তু বোনের জোরাজুরিতে কিছুটা ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে ফারহানার মাঝে। তিনি নিশ্চিত, তার মেয়ে সেখানে রাজরানী হয়ে থাকবে। শুধুমাত্র বয়সটাই একটু ভাববার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। সায়মার কাছ থেকে মতামত চাওয়া হলে সায়মা পরিষ্কার জানিয়ে দেয় সে রুমেলকে বিয়ে করবে না। একে তো তার সমবয়সী অন্যথায় কাজিন!

    এমন কনফিউশানের মাঝে কেটে গেলো আরও চারদিন। এদিকে রহিমার অবস্থা নাজেহাল! ওবাড়িতে গেলে আয়ান তাকে ধাক্কায় আর এবাড়িতে এলে সায়মা। দুই দিকের ধাক্কাধাক্কিতে তার পিষে যাওয়ার অবস্থা! কিন্তু ধাক্কাধাক্কিতে কি হবে! সাহস যে যথাস্থানে আসে না! নাহ! আজ সে মনভরা সাহস নিয়ে এসেছে। আজ তাকে বলতেই হবে। আর ভালো লাগছে না উভয়দিকের চাপ! গত চারদিন ধরে তার ঘুম হচ্ছে না ঠিকমতো! এমন চাপ হজম করতে থাকলে তার মরণ না হলেও মরণব্যাধি হবে সে নিশ্চিত! তাই আজ সে সিরিয়াস মুডে প্রবেশ করলো হক মঞ্জিলে। কলিং বেল বাজালে দরজা খুলে দিলো সায়মা। গত চারদিন যাবত সায়মাই দরজা খুলে দিচ্ছে। যেন তার অপেক্ষাতেই দাড়িয়ে থাকে সে। দরজা খুলে সায়মা মুখে হাসির রেখা টানলেও রহিমা গম্ভীর! সে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলো, 

    “আম্মা কই?”

    “কেন! কি হয়েছে?”

    “হয় নাই কিছু তবে হইবো। আম্মা কই?”

    “মা তো নিজের রুমেই আছে। কিন্তু হয়েছে টা কি?”

    “খালু ঘরে আছে?”

    “না, আজ বাবার দাওয়াত আছে৷”

    “খালি আপনের বাবারেই দাওয়াত দেয়! আপনাগো দাওয়াত দেয় না? দাওয়াতে গেলে তো একটাদিন ছুটিতেও থাকতে পারি।”

    “তোর ছুটি দরকার হলে নিয়ে নে।”

    “না, ছুটি দরকার নাই। তবে আপনাগো দরকারে ছুটি দিলে ছুটি কাটাইতে আরাম লাগে।”

    “ভেতরে এসে কথা বল। আর দাওয়াত দিয়েছে আমাদেরও। কিন্তু ছ্যাচড়া দাওয়াত। বাবার বন্ধুর ছেলের সুন্নাতে খাৎনা৷ শুধু বাবাকে, মাকে আর আমাকে দাওয়াত করেছে। আংকেল তো জানতোই ভাইয়া ভাবি এসেছে। তবুও তাদের আবার বাদ রাখলো কেন! তারা কি আলাদা ফ্যামিলির! তাই মা রাগ দেখিয়ে বাবাকে বলেছে দাওয়াতে যাবে না। আমারও প্রোগ্রামে যেতে ভালো লাগে না তারউপর এমন দাওয়াত প্লাস মায়ের রাগ! তাই বাবা একাই গিয়েছে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব রক্ষায়!”

    “এতো বড় হিস্টোরি না শুনাইলেই পারতেন। যা এনার্জি সঞ্চয় কইরা আসছি তা শেষই কইরা দিতাছেন! ধরেন!”

    রহিমা গম্ভীরমুখে কথাগুলো বলে কিচেনে না গিয়ে সায়মার হাতে পার্স ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো ফারহানার রুমে। সায়মা হতবাক তার কর্মে! যেই মেয়ে এ টু জেড খুটিয়ে খুটিয়ে জানার চেষ্টা করে সে আজ এইটুকু কথায় বিরক্ত! তারউপর কি করে তার হাতে পার্স ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো! কত বড় বেয়াদব!  মায়ের সামনে কিছু বলবে না। বেরিয়ে আসুক রুম থেকে। তারপর শিক্ষা দিবে!

    সায়মা তার মায়ের রুমের সামনে অপেক্ষা করছে আর রহিমা বাঘী হয়ে রুমে প্রবেশ করতে গেলেও দরজার ওপারে বিড়াল বনে গেছে! মুহুর্তেই মুখের গম্ভীরতা উধাও হয়ে নিচু স্বর ও মিষ্টি কন্ঠের সৃষ্টি হয়েছে। সে সালাম দিলে ফারহানা সালামের জবাব দিলো। অত:পর রহিমা ইতস্তত বোধ করে বললো,

    “আম্মা, একখান কথা বলি?”

    “কথা বলতে আবার পারমিশন লাগে নাকি তোর! নিষেধ করলেও তো তোর ঠোঁট বিছুর মতো লাফায়!”

    “ইছ! ছি ছি ছি! এমন একটা কীটের সাথে তুলনা দিলেন! এই মুখ মন্ডল আর কারে দেখামু! যাইগা!”

    “ইশ! কত ঢং! কি বলবি, বলে যা।”

    “না মানে কইতাছিলাম কি, আপারে কি এখন বিয়া দিবেন?”

    “বিয়ে হচ্ছে আল্লাহর হাতে। এখন আর তখন কি! আল্লাহ যখন হুকুম করবে তখনই হয়ে যাবে৷”

    “হু। না মানে, কয়দিন ধইরা বিয়ার আলাপ শুনতাছি যে তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।”

    “কেন? বিয়ে নিয়ে হঠাৎ তোর জিজ্ঞাসা কেন?”

    “না মানে যদি বিয়া দেওয়ার ইচ্ছা থাকে তো বলমু।”

    “মেয়ে মানুষ কি আর সারাজীবন ঘরে রেখে দিবো! বিয়ে তো দিবোই।”

    “আপনের বোইন পুতের সাথেই দিবেন?”

    “এসব কি কথা! কিসের বোইন পুত! বোনের ছেলে কিংবা ভাগিনা বল।”

    “যা-ই হোক। বলেন।”

    “বোন তো চাইছেই কিন্তু মেয়ে তো রাজি না! তোর খালুও না করে। তা তুই এসব নিয়ে ভাবছিস কেন?”

    “না, মানে যদি পাত্র আপনাগো ঠিক করা না থাকে তবে একটা পাত্রের সন্ধ্যান দিতাম আরকি। পরিচিত ভালো একটা ছেলে আছে৷ যেমন সুদর্শন তেমন বংশ পরিচয়।”

    “বাসা কোথায়?”

    “ঢাকাতেই।”

    “ছেলে কি করে?”

    “পড়াশোনা আর ঘুরাঘুরি।”

    “কি!”

    “না মানে, পড়াশোনা আর চাকরির জন্য ঘুরাঘুরি করতে লাগছে। ভালো চাকরি পাইলে করবো নয়তো ব্যবসা করবো৷ তাছাড়া বাপের ছয় তলা বাড়ি আছে। ভাড়া দিয়াই হাড়ি ভরা, পেট ভরা, মন ভরা, বাড়ি ভরা, ব্যাংক ভরা। তাছাড়াও বড় ভাই কলেজের প্রফেসার! মোটকথা, বিত্তশালী যারে বলে!”

    “বুঝলাম। বাবা মা আছে?”

    “হু।”

    “তা ছেলে যেহেতু পড়াশোনাই শেষ করেনি, তার তো বিয়ের বয়সই হয়নি! এদিকে আমার মেয়ে পড়াশোনা শেষ করতে যাচ্ছে! এমন হলে মানা যায় না। সমবয়সীর কাছে বিয়ে দিবো না। তারউপর বেকার!”

    “না, বয়স আছে। তবে কিছু সমস্যার কারণে পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে গেছে। খালি আপনে দেখেন একবার। ছেলে দেখলেই পছন্দ হইয়া যাইবো আমার বিশ্বাস। আর বেকার তো সমস্যা না! বাপের টাকা আছে। চাকরি না পাইলে ব্যবসা ধরবো। সেইটা আর কয়দিনের ব্যাপার! বিয়া ঠিক হইতে হইতে ব্যবস্থা কইরা ফেলবো৷ বউ বাচ্চা ঘরে থাকলে অলস ছেলেপুলেও কর্মঠ হইয়া যায়। এইবার মতামত জানাইয়েন। আপনারা চাইলে আমি পাত্রপক্ষ আসতে বলমু।”

    “তোর খালুর সাথে কথা বলে দেখি।”

    রহিমা চলে গেলো। বড় একটা আশা নিয়ে বসে আছে তাদের মতামত পাওয়ার জন্য। সায়মা তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য দরজার বাইরে অপেক্ষা করলেও এখন তাকে নিয়ে নাচতে ইচ্ছে করছে সে বিয়ের কথা বলায়। কিন্তু নাচানাচি অপছন্দ বলে তা করলো না।

    আবু সালেহ হককে জানালে তিনি পাত্রপক্ষকে আসতে বললেন৷ তারা এসে দেখে যাক৷ পছন্দ হলে বাকিটা পরে দেখা যাবে। কথামতো রহিমা কাইয়ুম ভিলায় পাত্রীর সন্ধ্যান দিলো। বাকিটা ম্যানেজ করলো আয়ান।

    দুদিন পর,

    আজ আয়ান, তার মা ও রহিমা এসেছে সায়মাদের বাড়িতে। আয়ানের মা ও সায়মার বাবামায়ের মধ্যে কথাবার্তা হলো। আপায়ন করা হলো। অত:পর সায়মাকে সামনে নিয়ে আসা হলো। আয়ান ও সায়মা দুজনের চেহারায়ই আতঙ্কের ছাপ! আর রহিমার প্রচেষ্টা দুজনের গুন গুলো তুলে ধরার মাধ্যমে বিয়ের কথা পাকা করা। কিন্তু প্রথম দেখাতেই ঘটলো বিপত্তি! কথায় কথায় ফারহানা হক জেনে গেলেন তারা সেই বাড়ির লোক যাদের বাড়িতে রহিমা কাজ করে! কথাটা জানার পরই তিনি বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলেন,

    “রহিমা, তুই তাদের বাড়িতেই কাজ করিস না?”

    “হু আম্মা।”

    “তার মানে, এটাই সেই চিরিয়াখানার এক নম্বর বান্দর , যে তোর হাত ফুটো করে দিয়েছে! জেনেশুনে এমন সাংঘাতিক ছেলের সাথে মেয়ে দিবো না।”

    অত:পর মারিয়া কাইয়ুমের উদ্দেশ্যে বললেন,

    “ভাবি, মনে কষ্ট নিবেন না। রহিমার কাছে প্রায়ই শুনি আপনাদের ব্যাপারে। আপনাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো কিন্তু আপনি তো নিজেই জানেন আপনার ছেলে কতটা সাংঘাতিক। সামান্য কারণে রহিমার হাতের যা অবস্থা করেছে আমি দেখেই হতম্ভিত! আমার মেয়েটা খুবই শান্তশিষ্ট। বিশ্বাস না হলে রহিমার কাছে জেনে নিতে পারেন। তাই আমি আমার মেয়ের জন্য একটা শান্তশিষ্ট ছেলে খুঁজে বিয়ে দিবো।”

    মারিয়া কাইয়ুম গেলেন ক্ষেপে!

    “মুখ সামলে কথা বলুন। আমার ছেলে কোনদিক থেকে আপনার কাছে বানর মনে হলো। আপনার মেয়ে কি খুবই রূপবতী! যারা বেশি মাত্রায় শান্ত থাকে তাদের ভেতর শয়তান  বশত করে। আপনার মেয়ে এমন তো নয় যে ভোলাভালা! কিছু বুঝে না! ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েরা এমন হয় না। সেটা আমাকে বুঝাতে আসবেন না। তারউপর ছেলে আর ছেলের বউ ও তো দেখলাম কেমন! কোথেকে না কোথেকে বিদেশি ধরে এনেছে। অন্যের সম্পর্কে কিছু বলার আগে নিজের দিক দেখুন৷ আয়ান, চলো। আর রহিমা, দ্বিতীয়বার তুই কোনো মেয়ের সন্ধ্যান নিয়ে যাবি তো তোর খবর আছে!”

    কথাটা বলার পর আর এক মুহূর্তও বসে নেই! ছেলে যেমনই হোক, অন্যের মুখে নিজের ছেলের সম্পর্কে কটু কথা শুনে মারিয়া কাইয়ুম বড্ড অপমান বোধ করেছেন। তাই তিনি চলে গেছেন ছেলেকে সাথে নিয়ে। তবে যাওয়ার আগে রহিমার দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন তিনি। এদিকে আয়ান রহিমার উপর ৩৬০° তাপমাত্রায় রাগান্বিত! একমুহূর্তে রহিমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো তার! সে যদি আয়ানের নামে এসব না বলতো তাহলে তো আজ এসব কিছু ঘটতো না! আর সায়মা নিরব দর্শক! না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সইতে! এদিকে হক সাহেব ফারহানা হকের উপর সামান্য বিরক্ত প্রকাশ করে মারিয়া কাইয়ুমকে বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মারিয়া কাইয়ুম থেমে নেই। বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। আর ফারহানা হক বড়সড় নিশ্বাস ফেলে বললো, 

    “কি মানুষরে বাবা! এই মহিলাও কম সাংঘাতিক নয়! যেমন সাংঘাতিক ছেলে তেমন তার মা! রহিমা, আর একদিনও তুই সায়মার জন্য সমন্ধ আনবি না।”

    ফারহানা হক হনহনিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে। তার কথাবার্তায় যে মেহমান অপমানিত হয়েছে সেটা বুঝাতে হক সাহেবও ছুটে গেলেন স্ত্রীর পিছু পিছু। এদিকে সায়মা রাগান্বিত গলায় বললো,

    “এটা কি করলি তুই! না এসব কিছু বলতি মায়ের কাছে আর না এমন কিছু ঘটতো! এখন তো সব বরবাদ হয়ে গেলো!”

    “সবাই খালি আমারে বকেন ক্যা? আমি কি জানতাম নাকি আপনারা আগেই ইয়ে করে বসে আছেন!”

    “ধ্যাৎ!”

    সায়মা মাথার ঘোমটা ফেলে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আর রহিমা ছোট ছোট কদমে কিচেনে!

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১৪

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    কাইয়ুম ভিলায় প্রবেশ করতে রহিমার বুক ধুকপুক করছে। গতকাল যা হয়েছে তার উপর সবাই ক্ষেপে আছে! আজ যদি আক্রমণ করে বসে তখন কি হবে! তাকে কি আর এ বাড়িতে কাজে রাখবে! 

    ধুর! না রাখলে নাই! যা পাওনা আছে তা নিয়া বিদায় হবে। এ বাড়ি থেকে কাজের ছুটি পেলেই তার শান্তি। হোক অন্যত্র বেতন কম। তবুও মনের শান্তি বড় শান্তি। এখানে থাকা মানেই ঝামেলায় জড়িয়ে থাকা। ভালো লাগে না আর ঝামেলা!

    ভাবতে ভাবতে প্রবেশ করেই ফেললো বাড়িতে। মারিয়া তাকে সেসব বিষয়ে কিছুই বলেনি। তবে মুখখানা গম্ভীর। রহিমা চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। আয়ানকে বাড়িতে দেখতে পায়নি আজ। কাইয়ুম সাহেবও নেই বাড়িতে। আয়মান পরশুদিন চলে গেছে। এখন শুধু সায়ান, পিংকি আর মারিয়া কাইয়ুম বাড়িতে। সকালের নাস্তার জন্য রুটি আর সবজি ভাজি করে নিয়েছে মারিয়া। তাই রহিমাকে রান্নার কাজে হাত লাগাতে হলো না। সে ঘর ঝাড়ু দিতে লাগলো। আয়ানের রুম ঝাড়ু দিতে এলে দেখলো বিছানা এলোমেলো। সে বিছানা ঠিক করে ঝাড়ু দিতে লাগলো। খাটের তলায় ঝাড়ু লাগতেই শব্দ হলো কিছুর। রহিমা ঝাড়ু দিয়ে বের করে এনে দেখলো একটা টিনের বোতল! ক্যাপ খোলাই আছে। এটা কিসের বোতল তা বুঝতে নাকের কাছে নিলেই বিশ্রি গন্ধ অনুভব করতে পারলো! রহিমা বোতলের উপর বড় অক্ষরে লেখা মুখুস্ত করে নিলো। পরক্ষণে বোতল যথাস্থানে রেখে দিলো। সারাদিন কাজ করলো আর অক্ষরগুলো মনে মনে যপতে লাগলো মুখুস্ত থাকার জন্য। পরক্ষণে দুপুরে চলে এলো হক মঞ্জিলে। আসার সময় মারিয়া তেজি কন্ঠে বলে দিলেন তাদের ব্যাপারে কোনো কথাবার্তা যেন বাইরে প্রকাশ না করে!

    কিন্তু আয়ানের ব্যাপারটা তো সে জানাবেই সায়মাকে! এবাড়ি আজ জনশূন্য! বেশ কিছুক্ষণ কলিং বেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিলো সায়মা৷ রহিমা ভেতরে প্রবেশ করেই বললো,

    “আম্মা বাড়িতে নাই?”

    “না।”

    “কই গেছে?”

    “মামা বাড়িতে গেছে।”

    “ভাবিও?”

    “হ্যাঁ। সবাই।”

    “আপনে যান নাই ক্যা?”

    “তোর ছুটি কাটাতে হলে চলে যা তুই।”

    “না, যাইতাম না। মামা বাড়িত কোনো প্রোগ্রাম আছে? সবাই গেলো যে!”

    “প্রোগ্রাম আর কি! ওই বদমাইশ উঠেপড়ে লেগেছে! আর তার পক্ষপাতি হয়ে এখন মামা খালা সবাই। এসব ব্যাপার নিয়ে বলতেই বাবা মাকে ডেকেছে মামা। আর ভাইয়া বউ বাচ্চা নিয়ে দেশে এসেছে সেই উদ্দেশ্যে ছোটখাটো আয়োজনও আছে।”

    “ওহ্! আচ্ছা!”

    রহিমা কিচেনে যেতে লাগলে সায়মা বললো,

    “আজ ওদিকে কোনো কাজ নেই। বাসায় না গেলে চল আড্ডা দেই আর টিভি দেখি।”

    অত:পর ড্রয়িং রুমে তারা বাংলা নাটক দেখতে শুরু করলো। দুজন টিভি দেখে হাসতে হাসতে অস্থির! টিভি দেখায় জমে গিয়ে আয়ানের ব্যাপারটা ভুলেই গেছে রহিমা। সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখনো ফিরেনি সায়মার বাড়ির লোকজন। ফারহানা কল করে জিজ্ঞেস করলো রহিমা চলে গেছে নাকি। উত্তরে না জানালে তিনি বললেন তাদের আসতে একটু দেরি হবে। আর ইশতিয়াক আর এলেন থেকে যাবে মামা বাড়ি। অনেকদিন হলো মামা বাড়ি বেড়ায় না সে। তাই মামা মামি জোর করে রেখে দিতে চাইছেন তাদের। কিন্তু সায়মাকে বাড়িতে রেখে যাওয়ায় মিস্টার ও মিসেস হক চলে আসবেন। রহিমা যেন একটু অপেক্ষা করে৷ অর্থাৎ সায়মাকে একা রেখে না যায়। পরে তারা বাড়ি ফিরে এলে সায়মার বাবা রহিমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবেন নতুবা রহিমা চাইলে আজ থেকে যাবে।

    কল কেটে দিলে সায়মা রহিমাকে থেকে যাওয়ার জন্য বললো। কিন্তু তেমন জোর দিলো না। কারণ ওদিকে তার মা অসুস্থ। যদি প্রয়োজন হয়! তবে রহিমাকে রেখে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশিত হলো সায়মার মাঝে। রহিমার ইচ্ছে করছে সায়মার ইচ্ছা পূরণ করতে। কেননা সায়মা একবার তাকে রিকুয়েষ্ট করেছে থাকার জন্য। সায়মার কাছে কারিমার ফোনের নম্বর আছে। রহিমা কল করলো ওদিকের খবর নেওয়ার জন্য। কারিমাকে বললো,

    “মায়ের শরীরটা কি ভালো?”

    “হু।”

    “আমার আসতে দেরি হইবো। রান্নাবান্না বসায় দে। ভাত রান্না কর সাথে আলুর ভর্তা আর ডাল। মা রে জোর কইরা খাওয়াইছ। আর ওষুধ খাওয়াতে ভুলিস না। তার আগে যদি আমি ফিরি তো ফিরলাম ই। আর না ফিরলে না-ও ফিরতে পারি। পরে জানামু। প্রয়োজন পড়লে ফোন দিস।”

    “আইচ্ছা।”

    কল কেটে দিলো রহিমা। সায়মা বললো, 

    “প্রতিদিন কি ডাল আর আলুর ভর্তাই খেয়ে থাকিস?”

    “গরিব মানুষ। গরিবের খাবার আর কি হইবো আপা! ডালই হইলো গরিবের মাংস।”

    “তাই বলে মাছ মাংস একদমই না?”

    “আরে, হ। খাই মাঝে মাঝে।”

    অত:পর তারা দুজন এদিকে রান্নার ব্যবস্থা করতে লাগলো। সারাদিনে এ পর্যন্ত মনে না পড়লেও এখন হুট করেই রহিমার মনে হয়ে গেলো আয়ানের কথা! রহিমা ইতস্তত বোধ করে বললো,

    “আপা, ‘বি ই এ আর’ এ কি হয়?”

    “বি ই এ আর! বিয়ার।”

    “বিয়ার কি?”

    “ভাল্লুক।”

    “বোতলের ভেতর ভাল্লুক থাকে!”

    “মানে?”

    “একটা টিনের বোতলের উপর লেখা ছিলো।”

    “তাহলে সেটা ভাল্লুক নয়। মাদক দ্রব্য।”

    “মাদক! ভাইজান মাদক সেবন করে! ইছ! কি বিশ্রী গন্ধ! আল্লাহ!”

    “ভাইজান মানে!”

    “একটা কথা বলি। রাগ কইরেন না। আপনে ভাইজানের বউ তাই বলতাছি আপনার কাছে। সকালে ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়া খাটের নিচ থেকে বোতল পাইছি৷ নাকের কাছে নিতেই নাড়িভুড়ি উল্টায় গেছে! পরে জিনিসটা কি তা জানার জন্য সারাদিন অক্ষর গুলা মুখুস্ত করছি। একবার চাইছিলাম গোলাপি ভাবির কাছে জানি। কিন্তু যেই বাজে গন্ধ, যদি খারাপ কিছু হয়! তাইলে তো ভাবি আবার খোচাইয়া খোচাইয়া ঘটনা বাইর কইরা ছাড়বো যে আমি এইটা কই দেখছি আর পড়ছি। তাই আর জিজ্ঞেস করি নাই।”

    “আয়ানের রুমে পাওয়া বোতল থেকে তুই সত্যিই এই লেখাটা পড়েছিস?”

    “কইলাম না, সারাদিন মুখুস্ত করছি!”

    সায়মা আয়ানকে কল করতে যাচ্ছিলো। পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে সে তার মায়ের কাছে কল করলো। 

    “মা, তোমরা রওনা দিয়েছো?”

    “না, কিছুক্ষণের মধ্যেই দিবো।”

    “কতদিন পর গেলে, মামারা যেহেতু বলছে থেকে যাও সেখানেই। রহিমা আছে আমার সাথে।”

    “না। তোকে একা রেখে থাকবো নাকি। তুই এলে তো আর এতো টেনশন হতো না।”

    “এতো টেনশন করো না তো। খালামনিরা যেহেতু আছে তুমিও থেকে যাও। বাবাকেও আসতে হবে না। তাছাড়া আমি একা না। রহিমা আছে আমার সাথে। এছাড়াও তোমাদের মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে। ভয় পায় না একা থাকতে।”

    “হু! তোর বাবাকে বললে এখন রাগ করেই চলে যাবেন। বিকেলে বলছিলো আমাকে থাকতে আর তিনি চলে যাবেন।”

    “ধুর! বাবার কাছে ফোন দাও। আমি বুঝিয়ে বলি। তুমিও এসো না, বাবাকেও আসতে দিও না। এক রাতেরই তো ব্যাপার।”

    অত:পর সায়মা তার বাবাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করালো। তার বাবা তাকে ও রহিমাকে সবদিক থেকে সতর্ক করে দিলেন। এরপর আয়ানের কাছে কল করলো সায়মা। আয়ান ফোন রিসিভ করছে না। সে জেদ করে ফোন রেখে দিলো। চুপচাপ রান্না করতে লাগলো সে। চোখে অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে। রহিমা জিজ্ঞেস করলো,

    “আপা, আপনে কাঁদেন ক্যা!”

    “রহিমা, এটা নাড়া দে তো। আমি আসছি।”

    সায়মা চলে গেলো। রহিমা তরকারি নাড়তে লাগলো। নিজেকে শান্ত করে হাতমুখ ধুয়ে প্রায় দশ মিনিট পর সায়মা আবার কিচেনে এলো। এক প্যাকেট নুডলস রান্নার ব্যবস্থা করলো সে। রান্না শেষ করে সন্ধ্যায় টিভি দেখতে দেখতে তারা দুজন নুডলস খেলো। রহিমা আবার কারিমার কাছে কল করে বলে দিলো সে আজ ফিরবে না। তাছাড়া মায়ের সাথেও কথা বললো। 

    ইশার নামাজ পড়ে দুজনেই ডিনার সাড়লো। খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে আয়ানের কল এসেছিলো। সায়মা রিসিভ করেনি। আয়ান একের পর এক কল করে যাচ্ছে। সায়মা ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে। সুইচ অফ করে দিতো কিন্তু মা বাবা একটু পরপর কল করছে বিধায় সুইচ অফ করেনি।

    আয়ান বুঝতে পেরেছে সে রাগ করেছে৷ তাই বারবার কল করার পাশাপাশি সে এস এম এস করলো, “সরি। আব্বুর সাথে মাগরিবের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম মসজিদে। তখন যে সাইলেন্ট করেছিলাম আর নরমাল করতে মনে নেই। কারণ নামাজের পর আব্বুর সাথে জরুরী মিটিং করতে বসেছিলাম আমাদের বিয়ের ব্যাপারে। তারপর আবার আব্বুর সাথে ইশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে  ফ্রেন্ডের সাথে দেখা। বেশি না, অল্প একটু আড্ডা দিয়েছিলাম। তারা আমাকে ছাড়তেই চাইছিলো না তাই ইতুপাখিটার সাথে কথা বলতে পারিনি। এখন তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম আমার ইতুপাখিটা কল করেছে আমাকে! রিসিভ করো না গো একবার।”

    মেসেজ দেওয়ার প্রায় বিশ মিনিট পর সায়মা সিন করেছে। তার পূর্বে ফোন হাতে নেয়নি। এর আগে ফোন হাতে নিয়ে শুধু কল লিস্ট চেক করে দেখেছিলো তার বাবা মা কল দিয়েছে কি-না! এখন মেসেজ পড়ার পর সে কল দিলো। সাথে সাথেই রিসিভ হলো। বুঝতে বাকি নেই আয়ান ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো। রিসিভ করেই আয়ান বলতে লাগলো, 

    “সরি ইতুপাখি। আমি তোমাকে কত্ত ভালোবাসি তা কি তুমি জানো না! শুধু একটু ভুলই তো করে ফেলি। বেশি কিছু তো না। তুমি তো জানোই, কত কষ্ট হয় যখন তোমার একটা কল মিসড হয়ে যায়।”

    আয়ানের এই ন্যাকামো কথা সায়মার বিরক্ত লাগছে আর রহিমার প্রাণ জ্বালা করছে! ভুলের প্রায়শ্চিত্তে মনে মনে বলছে,

    এই জীবনে আর কোনোদিন সে বড় লোকের প্রেমে পড়বে না। তাদের যে গোপনে বউ থাকে সেটা কি তার জানা ছিলো! কতই না পছন্দ করতো ছেলেটাকে! সে বকলে খারাপ লাগতো কিন্তু কখনো তাকে উল্টো বকা দিতো না। সে কখনো কখনো আঘাত করতো, তবে ব্যাথা লাগলেও কষ্ট লাগতো না! তার সকল দুষ্টুমি সহ্য করে নিতো হাস্যকর ভাবে। কখনো খারাপ লাগেনি তার দুষ্টুমি। তখন খুব ভালো লাগলেও এখন মন খুব কাঁদে সেই দুষ্টুমি মনে হলে। এখন আর সহ্য হয় না তার কথাবার্তা। তখন প্রেমের দৃষ্টিতে জবাব দিলেও এখন বাধ্য হয়ে জবাব দেয়! মাঝে মাঝে প্রাণ জ্বালা করে তাদের স্বামী-স্ত্রীর অগোছালো দুষ্ট মিষ্টি সংসার দেখলে!

    এদিকে আয়ানকে থামিয়ে সায়মা বললো,

    “এখন কোথায় আছো তুমি?”

    “রাস্তায়।”

    “এই মুহুর্তে আমার বাসায় এসো।”

    “হা হা হা বউ কি রান্না করে বসে আছে আমার জন্য যে এতো জরুরী তলব!”

    “ফাজলামো রাখো আর এই মুহুর্তে এসো। নতুবা খুব খারাপ হবে!”

    “কি বলছো এসব! তোমার বাবা আর ভাই আমাকে ঝাঝড়া করে ফেলবে।”

    “আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না। এখন আসতে বলেছি তো আসবে। বাসায় কেউ নেই। তারাতাড়ি এসো। দশ মিনিটের মধ্যে আসবে। নতুবা আমি এই রাতে বেরিয়ে যাবো তোমার বাসার উদ্দেশ্যে।”

    কথাটা বলেই কল কেটে দিলো সায়মা। শেষ কথায় সায়মার গলা ধাধিয়ে এসেছে যা স্বাভাবিক মনে হয়নি আয়ানের কাছে। কল ব্যাক করলেও রিসিভ হলো না। তাই সে দ্রুতই রওনা হলো সায়মার বাড়ির উদ্দেশ্যে। দশ বারো মিনিটের মধ্যেই সে হাজির।

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১৫

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    কিছুটা ভয়ে ভয়েই কলিং বেল বাজালো আয়ান। সায়মা কল দিয়ে নিশ্চিত হলো সে এসেছে কিনা। অত:পর দরজা খুলে তার টিশার্ট ধরে টেনে ভেতরে এনে আবার দরজা লক করে দিলো৷ এসময় রহিমাকে এখানে দেখে আয়ান বিস্মিত হলো। সেদিকে তোয়াক্কা না করে সে ঘরে এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে সায়মাকে নানান কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। সায়মা কোনো প্রত্যুত্তর না করে আবার তার টিশার্ট টেনে ধাক্কিয়ে নিজের রুমে নিয়ে দরজা আটকে দিলো। শোনা গেলো সায়মার চেচামেচি! কান্নার সাথে আয়ানের উপর সমস্ত রাগ ঝাড়ছে! আয়ান কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছে না! তবে এটা বেশ বুঝতে পারছে এসবের মূলে রয়েছে কাজের বেটি রহিমা।

    রহিমা ডাইনিং টেবিলের পাশে দাড়িয়ে সায়মার চেচামেচি শুনছিলো। এক পর্যায়ে দেখলো দরজা খুলে ধাক্কিয়ে  রুম থেকে বের করে দিলো আয়ানকে! আবার দরজা লাগিয়ে সে কান্না করছে। আয়ান রহিমার দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। যা দেখে রহিমা কঠিন একটা ঢোক গিললো। কিন্তু আয়ান জিজ্ঞাসা করলো শান্ত গলায়, 

    “বাড়িতে কেউ নেই?”

    “আমি আছি।”

    আয়ান দাতে দাত চেপে বললো,

    “আমি তো আর অন্ধ না। আর কেউ নেই?”

    রহিমা দু’দিকে মাথা নেড়ে “না” জবাব দিলো। আয়ান এবার দরজায় নক করে বললো,

    “ইতু, ওপেন দ্যা ডোর৷ প্লিজ লিসেন, কাল রাতে ঘুম আসছিলো না টেনশনে তাই খেয়ে ফেলছি! বিশ্বাস কর। অনেকদিন যাবত আমি হাতও লাগাইনি। প্লিজ, কান্না করো না। দরজা খুলো।”

    কয়েকবার বলার পরেও দরজা খুললো না। আয়ান আবারও রহিমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,

    “বাড়ির সদস্যগন কি ফিরবে না আজ?”

    রহিমা মাথা নেড়ে না করলে আয়ান বললো,

    “আমার ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।”

    “এহ! আমি পারতাম না।”

    “তোকে তো এখন!”

    “আপাগো…!”

    রহিমা আয়ানের ভয়ে চিৎকার দিতেই সায়মা দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এবং রাগান্বিত কন্ঠে বললো,

    “এখনো যাওনি তুমি! খবরদার, রহিমার সাথে কোন খারাপ হয়েছে তো!”

    এবার আয়ান সুযোগ পেয়ে সায়মাকে সহ ঠেলে রুমে প্রবেশ করলো। সায়মা তাকে বের করে দিতে চাইছিলো কিন্তু এবার আয়ানের জয়। সায়মাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সে আজ এখানে থেকে যাবে। আর রহিমার উদ্দেশ্যে ভেতর থেকে আয়ান বলে দিলো যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে। রহিমা ড্রয়িং রুমে এসে বেশ কিছুক্ষণ  বসে রইলো। অত:পর রুমের লাইট অফ করে দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। যার ফলে বাইরের আলো এসে রুম এখন আচছা অন্ধকার। দুতিন ঘন্টা পর সায়মা রুম থেকে বেরিয়ে রহিমাকে দেখে গেছে এবং মেইনডোর সহ ঘরটাও চেক করে গেছে। সায়মার পিছু পিছু আয়ানও ঘুরেছে। যদি দেখে যাওয়ার বদলে সায়মা তার কাছ থেকে পালায় সেই সন্দেহে। আয়ানের এই কান্ডে মনে মনে হাসি পেলেও প্রকাশ্যে বিরক্তিকর মনোভাব ফুটিয়ে তুলেছে সায়মা।

    সকালে রহিমা ঘুম থেকে উঠে সায়মার রুমের দরজা খোলা দেখলো। “আপা” বলে হাক ছাড়লো কিন্তু সাড়া পেল না। দরজার কাছে এসে দেখলো কেউ নেই ভেতরে। পরক্ষণে দেখলো মেইন দরজা খুলে দুজন কথা বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করছে। সায়মার পড়নে তাতের শাড়ি। যে পোশাক পড়ে তাতেই ভালো মানায়। শাড়িতেও দারুণ লাগছে তবে শাড়ি পরহিতা সায়মাকে দেখে রহিমার মন খারাপ হয়ে গেছে। সে কিছু বলার আগে সায়মা ই বললো,

    “খুজছিলি নাকি? ছাদে গিয়েছিলাম হাটতে।”

    রহিমা বাথরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললো,

    “ছয়টা বাইজা গেছে আমি চইলা যাই৷”

    “থাক না আরও কিছুক্ষণ। নাস্তা রেডি করি, একসাথে খেয়ে তারপর যা। ওবাড়িতে যাওয়া মাত্র দশ মিনিটের ব্যাপার।”

    “আধ ঘন্টা লাগে আমার।”

    “রিকশায় যাবি।”

    রহিমা মুখ ধুয়ে এলো। আয়ান টিভি অন করে সোফায় বসলো। সায়মা চুল খোপা করে রুম থেকে বেরিয়ে আয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,

    “কি খাবে বলো? পরটা ভাজি খাবে না ভুনা খিচুড়ি রান্না করবো?”

    “উহুম।”

    “বিরিয়ানি?”

    “তোমাকে রান্না করতে হবে না। রহিমা করুক।”

    “কেন? তুমি নিশ্চিত নাকি যে আমার রান্না খাওয়ার অযোগ্য হবে?”

    “বউয়ের হাতের রান্না এখন খাবো না।”

    “কি আযব! মানুষ শখ করেও তো খেতে চায়! আর তুমি!”

    “আমার বাড়ি গিয়ে শখ করে প্রতিদিন রান্না করে খায়িয়ো। তার আগে একবারও না।”

    সায়মা কিচেনে গিয়ে খাসির মাংস পানিতে ভিজিয়ে এলো। রহিমা জিজ্ঞেস করলো,

    “আপা, কি রান্না করমু?”

    “বিরিয়ানি।”

    আয়ান জবাব দিলো,

    “যা-ই করার দ্রুত করবি। দশ মিনিটের মধ্যে।”

    রহিমা কিচেনে চলে গেলো। এবং সায়মা এসে আয়ানের কাছে সোফায় বসলে আয়ান বললো,

    “উঠো।”

    “কেন?”

    “উঠতে বলছি, উঠো।”

    সায়মা উঠে পড়লে আয়ান বিপরীত পাশের সোফা দেখিয়ে দিলো বসার জন্য। সায়মা তার কান্ডে রাগ করে এখানে না বসে থেকে রহিমার কাছে চলে গেলো। আয়ান টিভি দেখতে দেখতে তুলনামূলক উঁচু স্বরে বললো,

    “ইতু, তুমি কি জানো? এজ এ লাভার, রহিমা আমাকে পছন্দ করে?”

    আয়ানের কথায় সায়মা বিস্মিত! আর রহিমা হতবাক! সে জানতো তাহলে রহিমা তাকে পছন্দ করে! আর সায়মা তো এমন কিছু ভাবতেও পারেনি! সে রহিমার দিকে তাকাতেই রহিমা হাত দ্রুত চালাতে লাগলো। সায়মা আবার আয়ানের কাছে এসে বিপরীত সোফায় বসে বললো,

    “কি বলছো এসব?”

    আয়ান একই স্বরে বললো,

    “রহিমা আমাকে ভালোবাসে। রেগে আর বেগে, আমি তাকে যেভাবেই আঘাত করি সে কখনো আমাকে রিটার্ন করে না৷ তবে একটু মেজাজ দেখায় আর অভিমান করে। আমি তো এমনই। আর সে এমন আমির প্রেমে পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে সেটা তার কৃতকর্ম প্রকাশ করে দিয়েছে। তুমি কি জানো, তোমার আমার বিয়ের ব্যাপারে শুনে সে কতটা কষ্ট পেয়েছে? আমি তার চেহারা দেখে বুঝে গিয়েছিলাম সেটা। কিন্তু তোমার টেনশনে আমি তাকে উক্ত বিষয়ে সান্ত্বনা পর্যন্ত দিতে পারিনি। সেদিনের পর থেকে তো তাকে আর হাসতেও দেখলাম না। যেখানে সে কারণে অকারণে হাসতো। অযথাই বেশি কথা বলতো, চাপা ও দুষ্টুমিতে মশগুল থাকতো।”

    আয়ানের কথায় সায়মার চেহারায় চিন্তার ছাপ ভেসে উঠলো! আয়ান রহিমার উদ্দেশ্যে বললো, 

    “রহিমা, আমি তোকে সবসময়ই একজন ভালো ফ্রেন্ড মনে করি। ফ্রেন্ডরা যেমন হাসাহাসি, মারামারি করে ঠিক তেমনই! আর তুই বেশি গাল ফোলাতে জানিস তাই তোকে রাগাতে ভীষণ ভালো লাগতো। কিন্তু তোর অস্পষ্ট প্রেম আমার কাছে স্পষ্ট হলেও আমি তোর প্রেমে সাড়া দিতে পারিনি সেজন্য দুঃখিত। সমাজ কিন্তু সেটা মোটেও মানবে না। যদিও আমি সমাজ মানি না। কিন্তু তুই যেই স্থানে নতুন কদম ফেলেছিস আমি আরও অনেক আগেই সেই স্থানে ভ্রমণ করেছি। এখন শুধু স্থান পাকাপোক্ত করা অর্থাৎ দায়িত্ব পালন করার পালা। আমি তোর শত্রুমিত্র হওয়ার প্রেক্ষিতে একটা দোয়া রাখি, খুবই ভালো একজনকে পাবি যার সাথে তুই সেই স্থানে ভ্রমণ করতে পারবি৷ যে তোকে কেয়ার করবে সবসময়। তবে একটা উপদেশ, সমাজ ছাড়াতো আর কেউ চলতে পারে না। সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে মানবে না এমন অর্থাৎ তোর পছন্দের সে যেন বিত্তশালী না হয়। তোর সাথে মানানসই এমন কারো মাঝে ভালোকে পছন্দ করিস যে কখনো তোকে তোর লেভেল দেখাতে পারবে না। বরং সম্মান দিতে জানবে। আর আমি জানি, তুই তোর আপাকে খুব ভালোবাসিস। এখন তোর আপা আমার বউ হওয়ায় আবার তার শত্রু হয়ে যাস না৷ এটা মাথায় রাখিস সে তোর শত্রু না, বরং সে তোর শত্রুর বউ।”

    এখন সবটাই নিরব! সায়মা ভাবনাসহিত নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে আর আয়ান টিভির চ্যানেল পাল্টাতে ব্যস্ত। এদিকে কাজ করতে করতে আয়ানের কথা শুনে ও ভেবে রহিমার দুচোখ থেকে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভেতরটা যেন হঠাৎ করেই পাথর থেকে পাহাড় ন্যায় ভারি হয়ে গেছে। আবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই ভারি অনুভবটা দীর্ঘ নিশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এসেছে। এবং তুলোর মতো হালকা হয়ে গেছে মন! নিজের মনকে শক্ত করে সে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। অত:পর চোখ মুছে ট্রেতে বাটি গুলো তুলে বেরিয়ে আসতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। সায়মা কিছুটা ভরকে গেছে! তার বাবা মা কি এতো সকালেই চলে এলো! সে তো বলেছিলো যেন বিকেলে আসে! দরজার লক ক্যামেরা দিয়ে ওপাশের লোককে দেখে আরও ভরকে গেছে সে! আয়ান ইশারায় জিজ্ঞেস করতেই সে ঠোঁট নাড়িয়ে উচ্চারণ করলো ,”রুমেল!”

    রহিমা আবার কিচেনে এসে ট্রে রেখে দ্রুত বটি হাতে বেরিয়ে এলো। আর আয়ান উঠে সায়মাকে সরিয়ে সে দরজা খুললো। রুমেল একাই আছে। ঘরে অপরিচিত ছেলে দেখে সে বিস্মিত! ছেলের পেছনে দাড়িয়ে সায়মা! আয়ান তার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

    “কি ভাই? কাকে চাই?”

    রুমেল তাকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে ব্রু কুচকে বললো, 

    “আপনি কে?”

    সায়মা আয়ানকে সরিয়ে রুমেলকে ধাক্কা দিয়ে আবার বাইরে ঠেলে দিয়ে বললো, 

    “সে তোর যম। সাহস কি করে হয় আবার এখানে আসার! ভাগ্য ভালো থাকতে থাকতে বিদায় হ। নতুবা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবি না।”

    সাথে সাথেই দরজা লাগিয়ে দিলো সায়মা। আয়ান চাইছিলো কিছু বলতে কিন্তু সায়মা তাকে দরজা খুলতেই দিলো না। সে নিশ্চিত একটা গন্ডগোল বাধিয়ে ছাড়বে আয়ান। তাই রুমেলের সম্মুখীন হতে দিলো না তাকে। রুমেল কিছুক্ষণ সায়মাকে ডেকে ডেকে দরজায় থাপ্পড় আর লাথি দিয়ে চলে গেলো। রহিমা বটি রেখে আবার খাবারের ট্রে নিয়ে এলো। আয়ান ও সায়মা সোফায় বসেছে। তাদের একসাথে দেখলে যে রহিমার কষ্ট হবে আয়ানের সেই ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সায়মা এবার স্বেচ্ছাতেই বিপরীতে বসেছে। রহিমা টেবিলে ট্রে রাখতেই সায়মা বিস্মিত কন্ঠে বললো,

    “এতো তারাতাড়ি শেষ!”

    আয়ান ঢাকনা খুলতে খুলতে বলতে লাগলো,

    “কাজের বেটি রহিমার ম্যাজিক, বুঝলে!”

    তবে কথাটা বলা মাত্রই মেজাজ চড়ে গেলো আয়ানের! ঢাকনা খুলে দেখলো এক প্লেটে কাচা মাংস, এক প্লেটে চাল, এক প্লেটে আদা বাটা, এক প্লেটে মশলা! আয়ান রেগেমেগে বললো,

    “এসব কি!”

    রহিমা জবাব দিলো, 

    “ক্যা? কাজের বেটি রহিমার ম্যাজিক! আপা বলছে বিরিয়ানি রান্না করতে, আর আপনে বলছেন যেন দশ মিনিটে করি। আমি তো দুজনরেই ভালোবাসি। তাই কারো কথাই ফেলতে পারি নাই! দশ মিনিটে এইটুকুর বেশি বিরিয়ানি রান্না করতে পারি নাই। এইবার খান।”

    আয়ান রেগে ঠাস করে ঢাকনা লাগিয়ে দিলো আর সায়মা হেসে কুটিকুটি!

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১৬

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    হক মঞ্জিলে রান্নাবান্না ও নাস্তা করে এবাড়িতে কাজে আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো রহিমার৷ নিত্যদিনের মতো আজও লাল মিয়ার মুখে ছিলো গান! ইদানীং এ যেন তার নেশা হয়ে দাড়িয়েছে। তা-ও গানের কি স্টাইল! যেন ছ্যাকা খেয়ে নেশা হিসেবে গান ধরেছে!

    এদিকে কাজে দেরিতে আসায় পিংকির রাগারাগির সম্মুখীন হলো রহিমা! দোষ নিজের হওয়ায় চুপচাপ সহ্য করে নিলো। নতুবা আলাপির মা গোলাপিকে জিলাপি বানিয়ে দিতো! হ্যাঁ, রহিমা বাবুর নতুন নাম রেখেছে আলাপি। কারণ বাবুটা সারাক্ষণই কান্নাকাটি আর ঘ্যানঘ্যান করে! কিন্তু গোলাপিকে যেমন মনে মনে উচ্চারণ করে, আলাপিকেও ঠিক মনে মনেই উচ্চারণ করে সে।

    আজ আর হক মঞ্জিলে যায়নি রহিমা। কারণ সায়মা আয়ানের সাথে ভার্সিটি যাবে। সেখান থেকে ঘুরতে যাবে। আর বাকি সদস্যরা দুপুরের পর বাড়ি ফিরবে। রহিমা আজ দুপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে এলো। মা একা আছে ঘরে সকালে পান্তাভাত খেয়েছিলো এরপর আর কিছু খায়নি! ঘরে পা দিলেই কারিমার প্রতি অতিরিক্ত মাত্রায় রাগ হয়! অসুস্থ মাকে সে পান্তা ভাত খায়িয়ে রাখলো কিভাবে! সে নাকি আবার দোকান থেকে পরটা এনে খেয়েছে! তবুও পারেনি ক’টা ভাত রান্না করতে! এখন ঘরে নেই বিধায় বেঁচে গেছে। নতুবা রহিমা কষিয়ে কয়েক ঘা লাগাতো! মেয়ে মানুষ, এতো বেখেয়ালি কেন থাকবে! সংসারের কাজগুলো টুকটাক করতে পারে না! হাড়িপাতিলও মাজেনি! স্কুলে চলে গেছে। নিজের রূপচর্চা নিয়ে পড়ে থাকতে পারে কিন্তু সংসারের কাজে না! যা চাইছে প্রায় সাধ্যমতো সবটাই পূরণ করার চেষ্টা করছে রহিমা। তবুও মেয়েটার একটু খেয়াল নেই মা বোনের প্রতি!

    সেই সকালে নাকি বেরিয়েছে এখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তবুও কারিমার ফেরার খবর নেই। সারাদিন রহিমা বকাঝকা করতে করতে কাজকর্ম সারলেও এখন কিছুটা চিন্তা এসে ভীড় জমেছে মাথায়! মাগরিবের আযান পড়লো, রহিমা নামাজ পড়লো। কারিমা এখনও আসছে না! রহিমা তার মাকে একা ঘরে বসিয়ে রেখে সে টর্চ হাতে বেরিয়ে গেলো। কারিমার সহপাঠী পাশের বাড়ির লিমার কাছে এসে জানতে পারলো লিমা আজ স্কুলে যায়নি। তাই কিছু জানে না। তারপর কিছুদূরে আরও একজনের কাছে গেলো। তার কাছে গিয়ে জানতে পারলো দুপুরে কারিমা টিফিন টাইমে পালিয়ে জামশেদ নামের একটি ছেলের সাথে গাড়িতে উঠে গেছে। কোথায় গেছে তা আর জানে না সে। আর কয়েকমাস যাবত জামশেদের সাথে কারিমা প্রেম নামক সম্পর্কে জড়িয়েছে৷ প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সে ঘুরতে যায় তার সাথে। আজ তা প্রকাশ করে দিলো কারিমার বান্ধবী রত্না। রহিমার মাথায় যেন রক্ত জমে গেলো এসব শুনে! ছেলেটাকে চেনে সে। কিন্তু তার বোনটা যে এমন তা জানা ছিলো না! আজ তার কাছে পরিষ্কার, দিনরাত পড়াশোনার জন্য নয়! বরং জামশেদের সাথেই ফোনে খুচুরখুচুর চলতো!

    কারিমার খোঁজে রহিমা দেরি না করে ছুটে গেলো জামশেদের বাড়িতে। হ্যাঁ কারিমা এখানেই আছে৷ কিন্তু যা দেখলো আর কারিমার মুখে যা শুনলো, তা প্রত্যাশিত ছিলো না কভু! কারিমা পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে জামশেদকে। জামশেদের ব্যাকগ্রাউন্ড তাদের থেকেও খারাপ হওয়ায় কারিমা জানতো তার সাথে বিয়ে দিবে না রহিমা ও তার মা। তাই সে পালিয়ে এসেছে। সে এখন থেকে তার শ্বশুর বাড়িতেই থাকবে। তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেন জবরদস্তি না করে রহিমা!

    কারিমা কথাগুলো বলেছিলো তার শ্বাশুড়ির পেছনে দাড়িয়ে। কেননা রহিমার সম্মুখীন হওয়ার সাহস ছিলো না তার মাঝে। কিন্তু রহিমা তাকে এমনি এমনি রেখে আসেনি৷ রেগেমেগে ঘরে ঢুকে পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে পিটিয়ে এসেছে। আর বলে এসেছে যেন কোনদিনও মনে না করে তার মা কিংবা বোন বেঁচে আছে!

    বাড়ি ফিরে মায়ের কোলে মাথা রেখে আজ খুব কেঁদেছে রহিমা! বোনটাকে অনেক ভালোবাসতো। যা আবদার করতো তাই পূরণ করার চেষ্টা করতো। আর বকাঝকা কি এমনি এমনি করতো! তার ভালোর জন্যই তো একটু শাসনে রাখতো! নিজে না খেয়ে মা বোনের খাওয়ার কথা ভাবতো। নিজে মুর্খ থেকে বোনকে শিক্ষিত বানানোর উদ্দেশ্যে স্কুলে পাঠাতো। এই দিলো তার প্রতিদান! জগৎ এতো নিষ্ঠুর কেন!

    তার অসুস্থ মা ও বিভিন্ন গালিগালাজ করলেন কারিমাকে। ছেলেমেয়ের দেয়া কষ্টে ডুকরে কেঁদেছেনও তিনি। আর মাঝরাতে শুরু হলো বুক ব্যাথা! সহ্য করতে পারছেন না তিনি! রহিমা তার মায়ের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেছে! পানি পান করালো, মাথায় পানি দিলো, ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে রাখলো৷ কিন্তু তাতে কি আর ব্যাথা সাড়বে! কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না রহিমার! সে ছুটে গেলো পাশের ঘরের কাকার কাছে। কাকা বললো হসপিটালে নিয়ে যেতে৷ কিন্তু রহিমার একার পক্ষে কি তা সম্ভব! তাছাড়া কাকার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছে তিনি যাবেন না তাদের একটু সাহায্য করতে। তাই আর বললোই না কাকাকে। তবে কাকার ফোনটা চেয়ে নিলো একটা কল করার জন্য। এই মুহূর্তে আয়ান ছাড়া আর কারও কথা মাথায় আসেনি। সে তার পার্স থেকে নোটপ্যাড খুঁজে আয়ানের নম্বরে ডায়াল করলো। প্রথমবার রিসিভ না হলেও দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো আর ঘুমঘুম কণ্ঠ ভেসে এলো। রহিমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মায়ের অবস্থার কথা বললে আয়ান বললো সে আসছে।

    কিছুক্ষণের মধ্যে আয়ান তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে বন্ধুর বাইকে করে চলে এলো রহিমার বাড়ি৷ অত:পর সি এন জি রিজার্ভ করে নিয়ে গেলো হসপিটাল। আসার পূর্বে রহিমা তার মাটির ব্যাংকটা হাতে নিয়েছিলো জমানো টাকা নেওয়ার জন্য। কিন্তু দেখতে পেল মাটির ব্যাংকের উপর সাদা টেপ লাগানো! রহিমা টেপ টেনে তুলে ফেলতেই দেখলো ব্যাংক তিন টুকরো! আর টাকা নেই! আছে শুধু কাচা পয়সাগুলো! বুঝতে বাকি নেই এই অপ্রত্যাশিত কাজটাও কারিমা ই করেছে! নতুবা কেউ টাকা চুরি করে এতোটা সযত্নে টেপ লাগিয়ে ব্যাংক ঠিকমতো রেখে দিবে না। আলমারিতে কারিমার জামাকাপড়ও নেই! বাড়ি থেকে সকল বন্দোবস্ত করেই বেরিয়েছে সকালে! আর সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে! যার ফলে পার্সে রাখা দুতিনশো টাকা নিয়েই তাকে হসপিটাল আসতে হয়েছে। এখানে এসে জানতে পারলো ছোটখাটো স্ট্রোক হয়েছে তার মায়ের। যার ট্রিটমেন্টে কয়েক হাজার টাকা লাগবে যা এখন রহিমার কাছে নেই!

    আয়ান তাকে জিজ্ঞেস করলো, 

    “টাকা আছে কিছু?”

    রহিমা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,

    “ডাক্তারকে বলেন মা রে মাইরা ফালাইতে।”

    আয়ান দাতে দাত চেপে বললো,

    “চুপ! কি বলছিস এসব!”

    রহিমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,

    “কি কইতাম আর! এছাড়া আর কোনো উপায় আছে! দিনরাইত পরিশ্রম কইরা সাত আট হাজারের মতো টাকা জমা রাখছিলাম। মেতরনী সাত সকালে সব লুট কইরা নিয়া এক মেতর ব্যাডার লগে পালায় গিয়া বিয়া বইছে!”

    “কে? তোর ওই বোন?”

    রহিমা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” জবাব দিলে আয়ান বললো,

    “কান্না করিস না। তুই শান্ত হ। দেখি, কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কি না!” 

    আয়ান নিজের পকেটে হাত দিয়ে দেখলো পাঁচ ছয়শোর মতো আছে। অত:পর তার বন্ধুর কাছে থেই দুই হাজার টাকা নিয়ে ভর্তি করালো রহিমার মাকে। বাকি খরচ পড়বে ওষুধপত্র আর কেবিন ভাড়ায়। সকালে বাবার কাছ থেকে নিয়েও ব্যবস্থা করা যাবে।

    সকাল হওয়া পর্যন্ত তিনজন অপেক্ষা করলো এখানে। অন্ধকার কাটিয়ে আলো ফুটতেই আয়ানের বন্ধু চলে গেলো। ঘুম থেকে উঠে আয়ানের সাথে কথা বলে সায়মা জানতে পারলো রহিমার মায়ের খবর। আর সে খবর পাওয়া মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে ছুটে এলো হসপিটাল। কিন্তু এখানে এসে রহিমাকে পায়নি সে। আয়ানকে বসিয়ে রেখে একটা কাজে গেছে রহিমা। সায়মা আয়ানের সাথেই কথাবার্তা বলছে।

    এদিকে রহিমা এসেছে কারিমার বাড়িতে। সাতসকালে চুলের মুঠি ধরে ইচ্ছেমতো মেরে পাঁচ হাজার টাকা উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পেরেছে। বাকিটা নাকি গতকাল খরচ করে ফেলেছে। বউকে বাঁচাতে জামশেদ রহিমাকে ধাক্কা মেরেছিলো। তখন রহিমা ছিটকে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেয়েছে। তবে পুলিশের ভয় দেখিয়ে টাকা উদ্ধার করে ছেড়েছে। টাকা নিয়ে হসপিটাল এসে সায়মাকে দেখতে পেল রহিমা। আজ সে সত্যিই উপলব্ধি করতে পারছে এরা দুজন আসলে তার বন্ধু। খুব কাছের ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিত্তশালী হলেও এরা তার মতো একজন গরিবের বন্ধু! যে কিনা মাঝ রাতেই ছুটে আসে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে আর যে কিনা ঘুম থেকে জেগে খবর পেয়েই ছুটে আসে তার কাছে!

    সায়মা রহিমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো। কান্নাকাটি করতে নিষেধ করলো। আর মুখ দিয়ে যেন আজেবাজে কথা উচ্চারণ না করে সে বিষয়ে সতর্ক করলো। রহিমা আয়ানের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বললো,

    “বোন নামক কলঙ্কিনীর সাথে যুদ্ধ কইরা এগুলো ফিরাইয়া আনতে পারছি। আপনের বন্ধুর টাকা শোধ কইরা দিয়েন। আর বাকিটা ওষুধে হইবো না?”

    “বন্ধুর টাকা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আর বাকিটা মেবি এতেই হয়ে যাবে। টেনশন করিস না।”

    সায়মা বললো,

    “তোর হাত কাটলো কিভাবে?”

    “ওইযে, কইলাম না! যুদ্ধ করছি।”

    “তোর মতো মেয়ে প্রতি ঘরে ঘরে জন্ম নেক৷ আর তোর বোনের মতো মেয়ে পৃথিবী জুড়ে আর একটাও জন্ম না নেক। চল আমার সাথে। ড্রেসিং করিয়ে নিয়ে আসি। অনেকটা কেটে গেছে। নতুবা ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

    রহিমার হাতের কাটা ড্রেসিং করিয়ে আনলে তারা ওয়েটিং রুমে বসে আছে। রাহিমার চেহারাটা একদমই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে৷ আনমনা হয়ে বসে আছে সে। কি ভাবছে কে জানে!

     সায়মা আয়ানের উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বললো,

    “একটা ভালো ছেলে দেখে রহিমার বিয়ে দিয়ে দাও। ক’দিন এভাবে একা একা লড়াই করে যাবে জীবনের সাথে! দেখো, একটা ভালো পাত্র খুজে পাও কি না।”

    আয়ান নিরবে মাথা সামান্য ঝুলিয়ে সম্মতি দিলো যে, সে চেষ্টা করবে।

    অত:পর আয়ান চলে গেলো আর সায়মা রহিমার সাথে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর কাইয়ুম সাহেব এসেছেন। মাস শেষ হওয়ার দুদিন আগেই বেতন দিয়ে গেছেন। তবে তিনি বেশ কয়েকবার সায়মার দিকে তাকিয়েছিলেন। সায়মা তাকে দেখে প্রথমেই সালাম দিয়েছিলো। আর রহিমার কাছে তিনি জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন রহিমা তাদের বাড়িতে কাজ করার পাশাপাশি যে বাড়িতে কাজ করে সেই বাড়ির মেয়ে। তিনিও বুঝে গেছেন আয়ান ও তার মা তাকেই দেখতে গিয়েছে আর আয়ানের পছন্দ হয়েছে এই মেয়েকে।

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১৭

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    পাঁচদিন পর রহিমা কাজে এলো। তার মা এখন আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ। কিন্তু কাজ তো আর বন্ধ রাখতে পারবে না। কাজ বন্ধ করে দিলে অন্ন আসবে কোত্থেকে! তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর দুই বাড়িতে কাজ করবে না। কাজকর্ম ও বেতন বেশি হওয়ায় কাইয়ুম ভিলায় কাজ করবে। কিন্তু হক মঞ্জিলের কাজটা ছেড়ে দিবে। এখন তো আর কারো পড়াশোনা ও ভরনপোষণের খরচ নেই। সুতরাং এতেই চলে যাবে তার মাকে নিয়ে ছোট সংসার। দিনের অর্ধেকটা সময় এখন থেকে অসুস্থ মায়ের জন্য রাখবে।

    কাইয়ুম ভিলায় আসতেই মারিয়া কাইয়ুম জিজ্ঞেস করলো,

    “তোর মা এখন কেমন আছে?”

    “একটু ভালো হইছে, আম্মা।”

    “যাক, টেনশন করিস না। শুধু নামাজ পড়ে পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করিস। সবকিছুর মালিক আল্লাহ।”

    “হু।”

    রহিমার কণ্ঠ শুনে পিংকি রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললো,

    “রহিমা এসেছিস? ভালোই হয়েছে। তোর মা কেমন আছে?”

    “আলহামদুলিল্লাহ।”

    “তোর সেই বোনটা দেখতে আসে মাকে?”

    “না।”

    “হুহ্! বস্তির ছেলেমেয়ে গুলোকে এজন্যই দেখতে পারি না। না আছে আত্মসম্মান, না রাখে পরিবারের খোঁজখবর! পেটে ভাত না চললেও প্রেম চলে ঠিকমতো! আর যারতার সাথে যেখানে সেখানে বশত গড়ে তুলে! কোনো বোধ নেই!”

    পিংকির কথায় রহিমা ক্ষেপে গিয়ে বললো,

    “ভাবি, একজনের জন্যে সকলের উপর আপনে আঙুল তুলতে পারেন না। ভালা খারাপ সব জায়গায়ই আছে।”

    “শোন, একটা ভাত পরিক্ষা করলেই হাড়িভরা ভাতের খবর পাওয়া যায়। আর বস্তিতে তো এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। আজ তোর বোন গেছে, কাল দেখবি পাশের বাসার কেউ চলে গেছে, হতে পারে লালসায় পড়ে তুইও চলে যাবি একসময়! এসবের কি গ্যারান্টি আছে।”

    “হু! বস্তির মানুষ খারাপ, আর আপনারা ধনীলোকেরা খুব ভালা, তাই না? গোপনে গোপনে বিয়া কইরা দুই চাইর সংসার বাধে সেইটা কিছু না! আর বস্তির পোলাপান পালায় গেলেই সেইটা অনেক কিছু! বস্তির মানুষ দুই বিয়া করলে কইবো লুইচ্চা! আর ধনী লোক দুই বিয়া করলে কইবো সামর্থ্য আছে করছে। সুতরাং সেইটা সুন্নত৷ কিন্তু বস্তিতে আর সুন্নত হয় না! আর পিরিতি কম কোনদিক দিয়া! আপনে নিজের কথাই চিন্তা কইরা দেখেন স্কুল ভার্সিটি পাড় করতে করতে কয়টা প্রেম কইরা আসছেন। আর বস্তির পোলাপান করলে দোষ। এইযুগে এমন কোনো ধনী লোক আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়ে নাই যে প্রেম করে নাই!”

    “মুখ সামলে কথা বল, বেয়াদব মেয়ে! বড্ড বেশি চাপা করতে জানিস!”

    “উচিত কথা বললেই বেয়াদব হইয়া যাই আর আপনারা সাধু! দিনরাইত ফোনে সংসার জমান, ঘরের খাবার পঁচাইয়া রেস্টুরেন্টে টাকা ফালান সেইগুলো খুব ভদ্র মানুষের পরিচয়! আপনারা যান রেস্টুরেন্টে আর বস্তির গরিবরা না হয় যায় খোলামেলা পার্কে! তফাত তো এইটুকুই না! তাইলে তারা কেন আজেবাজে হইয়া যায়! আর পালানোর কথা কইলেন না? মানুষ কখন পালায়, জানেন? যখন তার পরিবার তারে শাসনে রাখে এবং বুঝতে পারে সম্পর্ক মানবো না তখন পালাইয়া যায়। যেই শাসনটা আপনাগো ধনী পরিবারে দেখা যায় না! মা বাপের কাছে নির্লজ্জের মতো আইসা সরাসরি জানায় দেয় প্রেম করে, পছন্দের মানুষ আছে! আর বাপ মা কি সুন্দর কইরা মাইনা নিয়া আয়োজন কইরা বিয়া দেয়। এইসব আমাদের বস্তিতে চলে না। কারো সাহস হইবো না, মা বাপের কাছে নির্লজ্জের মতো আইসা এইসব কইতে। আর যদি বলে তো ঝাটার বারি কপাল বরাবর পড়বো। তবে একেবারে নাই যে সেইটাও আমি কইতাম না। কারণ ভালো খারাপ সব জায়গাতেই আছে। আপনাদের ধনী পরিবারেও ভালো খারাপ সব আছে।”

    খুব তেজ নিয়ে কথাগুলো বললো রহিমা। না, সে প্রেম করে পালিয়ে বিয়েকে সাপোর্ট করে না। কিন্তু একজনের জন্য যে পুরো জাতের বদনাম করলো পিংকি তাই সে এভাবে যুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে। একজনের জন্য সবাইকে খারাপ বলবে সেটা তো মেনে নেওয়া যায় না! মৌমাছির দোষ মৌচাকে কেন পড়বে! 

    এতোক্ষণ যাবত দুজনকেই চুপ করতে বলছিলেন মারিয়া। কিন্তু কেউই থামেনি। রহিমার কথা বড্ড লেগেছে পিংকির গায়ে! তাই সে মারিয়ার উদ্দেশ্যে বললো, 

    “মা, দেখেছেন! দেখেছেন কেমন চাপা করছে!”

    “চুপ করো। সবই দেখছি আর সবই শুনছি। তুমিই কম কিসে! কথার শুরুটা তো তুমিই করেছো না! এক ভাত দিয়ে হাড়িভরা ভাতের অবস্থা জানাতে এসেছো। এবার তার স্বাদ নিবে না! ভুল বলেনি তো রহিমা!”

    মারিয়া রহিমাকে না বলে তাকে বলায় পিংকির চোখে পানি টলমল করছে! সে রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,

    “হ্যাঁ, আমিই বেশি বলি! কিন্তু এই মেয়েকে এই বাড়িতে আর কাজে রাখা যাবে না। বাবাকে বলে নতুন কাজের মেয়ে নিয়ে আসবো।”

    “কোথাও যাবে না রহিমা। এবাড়িতেই কাজ করবে সে।”

    “তাহলে আমার জন্য আলাদা কাজের মেয়ে রাখবো।”

    পিংকি রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। রহিমা বিড়বিড় করতে করতে কিচেনের দিকে গেলো। মারিয়া রহিমাকে ধমকে বললেন,

    “একদম চুপ! আর একটা কথাও যেন না শুনি তোর মুখে!”

    রহিমা চুপচাপ কাজ করে গেলো। আজ আয়ানের দেখা পেল না সে। দুদিন আগে তার মাকে দেখতে আয়ান বাসায় গিয়েছিলো। তখনই তার মুখটা কেমন মলিন দেখাচ্ছিলো। কিন্তু কোনো বিষয়ে কিছু বলেনি৷ শুধু মায়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে চলে এসেছিলো। তাছাড়া সায়মার সাথে হসপিটালেই শেষ দেখা ও কথা হয়েছিলো। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। তাদের বিয়ের ব্যাপারস্যাপার কতদূর হলো তা খুব জানতে ইচ্ছে করছে রহিমার। 

    ভাবতে ভাবতে কাজের মধ্যে সময়টা পাড় করলো রহিমা। অত:পর হক মঞ্জিলে এলো। আজই হিসেবনিকেশ মিটিয়ে এবাড়িতে কাজ ছেড়ে দিবে সে। কিন্তু এখানে এসে ঘটলো ভিন্ন কিছু! রহিমা আসতেই সায়মা তাকে ধরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।

    “ভালো আছেন আপা?”

    “আলহামদুলিল্লাহ। তোর মা কেমন আছে?”

    “আগের চেয়ে একটু ভালো। তবে আমি আর কাজ করতে পারতাম না দুই বাড়ি। একটা কাজ ছাড়তে হইবো। জানেনই তো, মা সারাদিন একলা ঘরে পইড়া থাকে।”

    “কি বলছিস তুই! কাজ ছেড়ে দিবি!”

    “হু। মা অসুস্থ না!”

    “কবে ছাড়বি?”

    “এই মাস তো শেষই। আর আইতাম না।”

    “আর ক’টা দিন একটু ম্যানেজ কর। খালামনি আর মামারা ঘিরে ধরেছে বিয়ের জন্য। তারা সবাই চায় আত্মীয়ের মাঝে নতুন আত্মীয়ের সৃষ্টি করতে। মা বাবাও রাজি হয়ে গেছে! কাল নানুবাড়ির লোকজন আসবে কথা পাকা করতে! হয়তো আংটি পড়িয়ে যাবে।”

    “ভাইজানরে কিছু জানান নাই?”

    “জানিয়েছি। সে আরও বেশি টেনশনে আছে! বাধ্য হয়ে বলেছে পালিয়ে যেতে! এটা কি সম্ভব! ভাইয়ার কর্মেই বাবা কতটা কষ্ট পেয়েছে! এবার এমন কিছু হলে দুর্ঘটনা ঘটবে নিশ্চিত! এখন আমার মনে হচ্ছে সেদিন বিয়েটা করাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। তাহলে এতোটা ডিপ্রেশনের সৃষ্টি হতো না। থাকতাম, তার গার্লফ্রেন্ড হয়েই থাকতাম! কারণ সে গার্লফ্রেন্ড বাঁচাতে না এলেও বউকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। বিয়েটা যে কেন করতে গেলাম!”

    সায়মা নিজের মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো খাটে। অত:পর আবার বলতে লাগলো, 

    “জানিস? সেদিন আমার কি হয়েছিলো সত্যিই আমি জানি না! তবে এটা জানি, সতেজ মস্তিষ্কে আমি এই ভুলটা হতে দিতাম না আয়ানকে দিয়ে। তারপরও একটা পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিলাম পরিবারকে মানিয়ে নেওয়ার, সেটাও বিফলে গেলো! আর এই রুমেল যে এমন কিছু করবে আমি ভাবতেও পারিনি! মা তো এতোদিন আমার বিয়ের কথা তুলেইনি! এই বদমাইশটার জন্য সব এলোমেলো হয়ে গেছে! তুই কিছু একটা কর না! যেকোনো ভাবে ভেঙে দে বিয়েটা। আমার আয়ানকে নিয়েও ভয় হয়! আমি নিশ্চিত, কৌশলে কিছু করা সম্ভব না হলে সে পাগলের মতো যেকোনো পদক্ষেপ নিতে দুইবার ভাববে না!”

    রহিমা পড়ে গেলো মুশকিলে! কি করা যায়! বন্ধু হয়ে তার বিপদে তারা পাশে থেকেছে এইমুহূর্তে তাদের বিপদে পিছিয়ে পড়া মোটেও ঠিক হবে না। কিছু একটা করা প্রয়োজন। কিন্তু কি করবে!

    রহিমা চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। ফারহানা হক তাকে দেখে তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো। রহিমা জবাব দিয়ে চলে গেলো কাজে হাত লাগাতে। ভাবছে তো ভাবছেই। ভাবনার শেষ হচ্ছে না৷ ভাবতে ভাবতে বাবুদের কাপড়চোপড় ধুয়ে ঘর মুছে দিলো। সায়মা সেই যে তার রুমে বন্দী হয়েছে বের হয়নি আর। হয়তো কান্না করছে!

    শেষ পর্যন্ত রহিমার ভাবনার ইতি ঘটলো। আর ভাববে না তাদের নিয়ে। লুকোচুরি করে পুতুল বউ খেলা গেলেও সংসার নামক খেলাটা খেলা যায় না। তাই এবার রহিমা সত্যটা জানাতে বাধ্য। পরে যা হবার হবে। ইশতিয়াকের রুম থেকে ফারহানাকে ডেকে ফারহানার রুমে এসে জানিয়ে দিলো সায়মার আর আয়ানের বিয়ের ব্যাপারে। তার সাধ্যমতো যতটা সম্ভব গুছিয়ে বুঝিয়ে বলেছে। তাদের ডিপ্রেশনের কথা জানাতেও বাদ রাখেনি। তাছাড়া রুমেলের ব্যাপারটাও ফাস! ফারহানা স্তব্ধ! এছাড়া আর কোনো ভঙ্গিমা প্রকাশ পায়নি তার চেহারায়! তিনি রহিমার হাত ধরে চলে এলেন সায়মার রুমে। দরজা ভেতর থেকে লক করে উক্ত বিষয়ে সত্যতা যাচাইয়ে সায়মাকে জিজ্ঞেস করতেই সায়মা থমকে গেছে! মাকে জানানো টা কি রহিমার উচিত হয়েছে! এখন সে কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না! তাই সে নিরব! তাকে নিরব থাকতে দেখে ফারহানা ধমকে বললেন,

    “চুপ করে আছিস কেন?”

    সায়মা মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে ধাধানো কন্ঠে বললো,

    “হ্যাঁ, সত্যি।”

    “ছি! একটা বার ভাবলি না আমাদের কথা! এখন তো মেরে মেরে বুঝানোর বয়স রয়ে যায়নি তোর! নিজের ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা অনেক আগেই আয়ত্তে এসে গেছে। এমন একটা ভুল কিভাবে করতে পারলি! তোর বাবা জানতে পারলে ব্যাপারটা কতটা খারাপ হবে ভাবতে পারছিস! ছেলে মাথা কেটেছে আর মেয়ে এবার গলা কাটবে!”

    সায়মা কান্না আর চেপে রাখতে পারছে না! সে কান্নাসহিত বললো,

    “সরি মা! সেসময়ে তোমাদের মেয়ে অবুঝ হয়ে গিয়েছিলো! এমনটা করার কথা কখনোই ভাবিনি। পছন্দটা আস্তে আস্তে মন থেকে উত্তোলিত হয়েছে। আর বিয়েটা হঠাৎ! আমি চাইনি এভাবে তোমাদের অবাধ্য হতে! কষ্ট দেওয়ার কথা তো ভাবিও না কখনো৷ কিন্তু ভুলটা থেকে মুক্ত হতে নিরবে অনেক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিলাম!”

    “এইসব ব্যপারে আর কোনো কথা উচ্চারণ করবি না। চুপচাপ সেই ছেলেকে বল তার পরিবারকে ম্যানেজ করতে। বিয়ে আবার হবে। আর উক্ত বিষয় যেন মাটি চাপা পড়ে যায়। তোর বাবার কানে গেলে খুব খারাপ হবে। আর শোন, মা বাবা সমন্ধ ঠিক করলে যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন নিজেরা দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকে। আর সেই দায়বদ্ধতা হয়ে থাকে মেয়েদের শক্তির উৎস। পিতামাতার মর্যাদায় গর্বিত হয়ে শ্বশুর বাড়িতে মাথা উঁচু করে চলতে পারে। যেই সুযোগটা থেকে তুই বঞ্চিত হলি। নিজের সুখ আর দুঃখের জন্য নিজেই দায়ী থাকবি। সন্তান তো, ফেলে দিতে পারি না।”

    ফারহানা হক চলে গেলেন। সায়মার অনেক কান্না আসছে। মা কষ্ট পেয়েছে ভীষণ। নিজের কাছে সে এখন নিকৃষ্ট সন্তান, যে কি না জন্মদাত্রীকে কষ্ট দিলো!

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব- ১৮

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    রহিমা আজ চুপচাপ কাজ করে গেছে। কখনো মনে হয়েছে কথাটা জানিয়ে দিয়ে ঠিক করেছে আবার সায়মার কষ্ট দেখে কখনো মনে হয়েছে কাজটা ঠিক হয়নি! সায়মার বাবা আর ভাই কেউই আজ বাড়িতে নেই। তখন থেকে সায়মা নিজ রুমে পড়ে পড়ে কান্না করছে আর ফারহানা হক ছেলের ঘরে পড়ে আছে বউ আর নাতিদের নিয়ে। আর রহিমা নিজের ইচ্ছেমতো কাজকর্ম সম্পাদন করে যাচ্ছে।

    আসরের নামাজ আদায় করে শেষ বিকেলে রান্নার জন্য কিচেনে এসেছেন ফারহানা হক। রহিমা সবজি কেটেকুটে রেখেছে। তিনি রহিমার উদ্দেশ্যে বললেন,

    “ছাদে যাসনি?”

    “হু, একলা একলা পানি দিয়া আসছি।”

    “কেন? সায়মা যায়নি?”

    “উহু। আপায় কাঁদতাছে সেই তখন থেকে!”

    ফারহানা ব্রু সামান্য কুচকে তাকালো তার দিকে। অত:পর চুলা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো সায়মার রুমের উদ্দেশ্যে। এখন আবার কেন গেলো তা দেখতে রহিমাও পিছু পিছু ছুটলো। সায়মা গুটিসুটি মেরে দুই হাটু জড়িয়ে ধরে আনমনে বসে আছে ফ্লোরে। কান্না করায় চোখ ভেজা এখনো তবে গড়িয়ে পড়া অশ্রু নেই। ফারহানা রুমে আসতেই সায়মা বসা থেকে উঠে দাড়ালো। মেয়ের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, 

    “কাঁদছিস কেন এখানে বসে বসে? সেই ছেলের কাছে ফোন করিস নি? কি বলেছে সে?”

    সায়মা দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে মলিন মুখে জবাব দিলো,

    “করিনি কল।”

    “করিসনি কেন? কথা বলে আজকের মধ্যেই ম্যানেজ করতে বল৷”

    কথাটা বলে ফারহানা হক আবার চলে গেলেন। সায়মার চোখ থেকে আবারও অশ্রু ঝরছে! মা কখনোই তার সাথে এভাবে কথা বলে না! তবে আজ বলছে কেননা তিনি কষ্ট পেয়েছেন মেয়ের কৃতকর্মে! ফারহানা যাওয়া মাত্র সায়মা দৌড়ে কিচেনে চলে এলো। আর পেছন থেকেই মাকে ঝাপটে ধরে কান্না করতে করতে বারবার বলে যাচ্ছে,

    “সরি মা। সত্যিই জানি না আমার কি হয়েছিলো সেদিন! আমি এমনটা করার কথা ভাবিও নি কখনো! সরি!”

    ফারহানা হক চুলো জ্বালাতে যাচ্ছিলেন। মেয়ের জন্য আর পারলেন না! তিনি চুলা জ্বালানো রেখে আড়ালে চোখ মুছে নিলেন যেটা রহিমার চোখে দৃশ্যমান। মনে পড়ে গেলো ফেলে আসা দিনের কথা! ভাইয়ের দ্বারা যতবার কষ্ট পেয়েছে ততবার এভাবে চোখ মুছে নিয়েছে মা। ছোট বোনটাও যখন এভাবে চলে গেলো হাউমাউ করে কেঁদেছে মা! হোকনা সে যত ভালো আর খারাপ, সন্তানের জন্য মায়ের মন ঠিকই কাঁদে! কে চায় তার সন্তান অন্যায় করুক! কে চায় তার সন্তানের অকল্যাণ হোক! সব মা তো সন্তানের সুখটাই কামনা করে৷ আর কষ্টগুলো নিজের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে রাখতে চায়৷ যদিও কখনো কখনো পাথর ফেটেই বেরিয়ে আসে সেই কষ্ট!

    ফারহানা হক সায়মাকে ছাড়িয়ে মুখোমুখি হয়ে দুহাতে গাল মুছে দিলেন। অত:পর মাথায় চুমু দিয়ে বললেন,

    “এখন কেঁদে কি হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। যেটা করতে বললাম সেটা করো গিয়ে৷ যাও। তোমার সুখ দেখতে চাই আমি।”

    সায়মা আবারও তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপিয়ে রাখলো। ফারহানা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

    “যেতে বললাম না! সায়মা, রান্নার দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। আর একবারও যেন কাঁদতে না দেখি।”

    “আই লাভ ইউ মা।”

    সায়মা নিজের রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আয়ান বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো। কিন্তু মন খারাপ থাকায় সায়মা ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলো। এখন সে ডায়াল করার সাথে সাথেই রিসিভ হলো,

    “কত বস্তা ঘাস কাটলে? যার জন্য তিনঘণ্টা যাবত আমাকে ডায়ালের পর ডায়াল করে যেতে হলো!”

    “ফাজলামো রাখো।”

    “মন খারাপ?”

    “ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার আছে।”

    “আমিও তো ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার জন্যই এতোক্ষণ যাবত কল করে যাচ্ছি!”

    “ওকে, বলো।”

    “আগে বলো, তোমার কি হয়েছে?”

    “ধুর! বললে বলো তো। কিছু হয়নি আমার।”

    “হুম, রুমেলের ব্যাপারটা এবার মাথা থেকে নামিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও। ব্যাটা মাকড়সার জালে আটকে গেছে!”

    “মানে! তুমি কি তার সাথে কিছু করেছো?”

    “আরে! এত জ্বলছে কেন তার জন্য?”

    “আয়ান আমি বারবার নিষেধ করেছি তোমাকে কোনোরকম ঝামেলায় জড়াতে। এভাবে নিজের ক্ষতি করবে তুমি। মেরেছো নাকি তাকে? তার চাচা কিন্তু পুলিশ অফিসার। জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়বে তোমাকে।”

    “আরে! তার চাচা যা-ই হোক, ওসব কিছু করিনি আমি। তাকে তার কর্মের প্যাচে ফেলিয়ে তাল গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছি।”

    “তোমার কথা বুঝতে পারছি না কিছু। সরাসরি বলো।”

    “তার এক্সকে বউ বানিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরিবারে হয়তো তাজ্জব কান্ড হচ্ছে। এবার ঠেলা সামলে নেক রুমেল বাবু।”

    “সিরিয়াসলি! আয়ান, তুমি একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করতে পারো না। রুমেল মোটেও ভালো ছেলে না৷”

    “আরে, সব খোঁজ খবর নিয়েই তো কাজ করলাম। তার এক্সও একই লেভেলের। বন্ধুবান্ধব মিলে অনেক কষ্টে খুঁজে বের করে কাজটা কমপ্লিট করলাম। এবার ঘুম পেয়েছে খুব। তুমিও ঘুমাও আমিও ঘুমাই। গুড আফটারনুন।”

    “বেড আফটারনুন! আমার কথা শোনো আগে। এমনি এমনি ফোন দেইনি আমি।”

    “ঝামেলা শেষ তো, আবার কি?”

    “রহিমা মায়ের কাছে সব বলে দিয়েছে।”

    “হোয়াট!”

    “হুম। মা বলেছে আজকের মধ্যে তুমি নিজের পরিবারকে ম্যানেজ করে কনফার্ম করবে। তোমার পরিবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলে আমাদের আবার বিয়ে হবে। নতুবা কি হবে জানি না আমি।”

    আয়ান হতাশাজনকভাবে বললো,

    “গুড আফটারনুন ফেরত নিলাম। ঘুমাবো না আর।”

    “দ্যাটস গুড। অপেক্ষায় রইলাম তোমার কনফার্মেশনের।”

    তখন থেকে রাত পর্যন্ত বাবার পিছু পিছু ছুটেছে আয়ান। তার পরদিন কাইয়ুম সাহেব হক সাহেবের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করলেন। কেননা সেদিন হসপিটালে দেখে সায়মাকে ভালো লেগেছে কাইয়ুম সাহেবের কাছে। ওদিকে সায়মা আর রুমেলের বিয়েটাও ভেঙে গেল। মহা কান্ড ঘটেছে সেদিন রূমেলের বাড়িতে। মেয়েটি তার বউ বলে পরিচয় দিলে রুমেলের পিতামাতা বকাঝকা করলেন৷ রুমেল অস্বীকার করায় তারা বিয়ে দিয়ে দিলেন। মামারাও উপস্থিত ছিলেন বিয়েতে। আর মামারাই সায়মার পরিবারে জানিয়েছে বিষয়টি। সকাল হতেই আরেক ঘটনা! রুমেল ফেঁসে যাওয়ায় রাতে ইচ্ছেমতো মারধর করে তার বউকে। আর রুমেলের কর্মে রাগান্বিত হয়ে তার বাবাও ইচ্ছেমতো মারে তাকে। এখন স্বামী স্ত্রী উভয়েই হসপিটাল ভর্তি!

    পরবর্তী এক সপ্তাহে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলো দু পরিবারের মাঝে। এখনো ছেলের পড়াশোনা শেষ হয়নি বলে আয়ানের বাবা তারাহুরো না করলেও সায়মার মা নানান অযুহাতে বিয়েটা তারাতাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উনার চেষ্টাতেই বিয়ের দিনতারিখ পাকাপোক্ত হলো। এবার রহিমার শান্তি। অবশেষে কাজটা তার দ্বারা সফল হলো! কিন্তু হক মঞ্জিলের কাজ ছাড়তে পারলো না। বিয়ে পর্যন্ত তাকে আটকে রাখা হবে। তবে রহিমা এখন দুপুরে হক মঞ্জিলে যাওয়ার পূর্বে তার মায়ের সাথে দেখা করে খাবার ও ওষুধ খায়িয়ে আসে। বিয়ে পর্যন্ত এভাবেই চলবে।

    আজ দুপুরে কাইয়ুম ভিলা থেকে বের হওয়ার সময় লাল মিয়াকে গান গাইতে শুনলো  রহিমা। এতোক্ষণ ছিলো না, রহিমাকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখেই সুর টানা শুরু করেছে লাল মিয়া। হনহনিয়ে হেটে রহিমা তার কাছে এসে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। তাকে এভাবে তাকিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে লাল মিয়া সুর থামিয়ে ব্রু কুচকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। রহিমা বললো,

    “থামলেন ক্যা? গাইতে থাকেন।”

    লাল মিয়া বিরক্তির সাথে বললো,

    “তোর কাছে জিগাইয়া গাইমু!”

    “আমার জন্যই তো গান, তাইলে আমার কাছে জিগাইবেন না তো কার কাছে জিগাইবেন? গাওয়া শুরু করেন। আজ পুরাটা শুইনা তারপর যামু।”

    “তোর জন্য গাই মানে! তোর জন্য আমি গান গামু ক্যা? যা ভাগ!”

    “হুহ্! কিছু বুঝি না মনে করছেন? আমার জন্য গান না তো কার জন্য গান? আমি আইলেই আপনে গায়ক হইয়া যান। আর আমি চলে গেলেই আপনে আবার দারোয়ান লালু মিয়া হইয়া যান! আজ যাইতাম না। পুরা গান শুইনাই যামু।”

    “গাইতাম না আমি। দেখি ক্যামনে শুইনা যাস।”

    রহিমা হেসে উঠলো আর লাল মিয়া বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বললো,

    “আমি কোনো কিছু কইলেই গিয়া বিচার দেস, শাসাইয়া যাস আর তুই যে পা পাড়া দিয়া ঝগড়া লাগছ, আমার উপর হাসাহাসি করছ। আমি কার কাছে বিচার দিমু? যাই এহন খালুর কাছে বিচার দেই গিয়া?”

    রহিমা অট্টহাসি থামিয়ে মুখে মৃদু হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

    “পছন্দ করেন আমারে?”

    প্রশ্ন শুনে লাল মিয়ার গলা কিছুটা নরম হয়ে এলো,

    “সেইটা জাইন্না তুই কি করবি? তুই তো ছোট ভাইজানরে পছন্দ করছ।”

    “ছোট ভাইজানের বিয়া ঠিক হইছে জানেন না?”

    “হু, এইটাও তো জানি। ছোট ভাইজান তোরে পছন্দ করে। বিয়ার দিন আসার আগেই হয়তো শুনমু দুইজন বিয়া কইরা আইসা পড়ছস।”

    রহিমা তার কথায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো এবং বললো,

    “আর যদি না করি বিয়া তাইলে আপনে বিয়া করবেন?”

    লাল মিয়া চুপ হয়ে গেছে। তার নয়ন জোরা চকচক করছে। জবাব যেন দৃষ্টিই দিয়ে দিচ্ছে। তবুও রহিমা তার মুখের জবাব পাওয়ার আশায় দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো,

    “করবেন না?”

    “তুই সারাজীবন থাকতে পারবি আমার সাথে?”

    “আপনে রাখতে পারলে পারমু। তবে আমার মা রে সংসারে ঠাঁই দিতে হইবো। মা রে আমি একা ছাড়মু না।”

    লাল মিয়া ওষ্ঠে হাসি রেখে বললো,

    “মায়ের সেবা করতে পারলে তো নিজেরে সৌভাগ্যবান মনে করমু। আঠারো বছর আগে এতিম হইছি, বারো বছর আগে অনাথ হইছি, আর এগারো বছর চলে এই বাড়িতে কাজ শুরু কইরা উপার্জন করতাছি। কিন্তু যাগো দ্বারা এই পৃথিবী দেখলাম উপার্জনের দুইটা ভাত মুখে দিতে পারলাম না। এইটাই আফসোস।”

    “পরিবারের আর কেউ নাই?”

    “চারটা বড় ভাই আছে গ্রামে। বাপের ভিটা নিয়া দুদিন পরপরই মাথা ফাটাফাটি! দেখতে যাইতেও ইচ্ছা করে না। আগে বাপ মা’রে অশান্তিতে রাখছে আজ নিজেরা অশান্তিতে আছে। আমারে বিয়া করলে কিন্তু শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হইবো না তোর। এইটুক ভিটা নিয়া কামড়াকামড়ি আমি করতে পারতাম না। এখানে আছি, ভালা আছি।”

    “আপনে তো এত্তো ব্যাডার সাথে ম্যাচে থাকেন। আমি থাকমু ক্যামনে!”

    “বউ নিয়া কি আর ম্যাচে থাকমু! বাড়ি ভাড়া কইরা নিমু। টাকা জমাইতাছি, সুযোগ হইলে জায়গাজমি কিনা নিমু।”

    রহিমা আর কথা না বলে চলে যাচ্ছিলো তাই লাল মিয়া জিজ্ঞেস করলো,

    “পারবি না থাকতে?”

    রহিমা গেইটের বাইরে দাড়িয়ে বললো,

    “আর জীবনেও কিন্তু সিগারেট খাইতে পারবেন না।”

    “খাই না তো। মাঝে মাঝে দুইএক টান। তুই চাইলে ওইটাও ক্যান্সেল।”

    “অবশ্যই চাই। পান ও খাইতে পারবেন না।”

    “এইটা আর খারাপ কি? মাঝেমধ্যে হইতেই পারে।”

    “না, মাঝেমধ্যেও হইতে পারবো না।”

    “পরে, দেখা যাইবো।”

    “না, পরে দেখাদেখি নাই। সব কথা আগেই পাক্কা।”

    “আইচ্ছা।”

    রহিমা মুখ চেপে হেসে বললো, 

    “তাইলে আমি রাজি আছি। তবে আমার মা আমার গার্জিয়ান। মায়ের সাথে কথা বলতে পারলে আর মা অনুমতি দিলে আমার আপত্তি নাই। মা অনুমতি না দিলে আমিও রাজি না।”

    “এখন কি তুই বাড়ি যাবি?”

    “হু।”

    রহিমা চলে গেলো। সে বাড়িতে আসার দশ মিনিট পরেই কিছু ফলমূল হাতে লাল মিয়া এলো তাদের বাড়িতে। মাত্র মাকে খাওয়ানো শেষ করেছে রহিমা। এমনি লাল মিয়ার আগমন। রহিমা লাল মিয়ার সাথে পরিচয় করালো মাকে। অত:পর লাল মিয়া কথাবার্তা বলে রহিমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইলো। লাল মিয়া সম্পর্কে মুখে জেনে এবং মেয়ের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব দেখে রহিমার মা মত দিলো। কেননা যেহেতু মেয়ের চেনাজানা সেহেতু নতুন করে তার চেনার প্রয়োজন নেই। মেয়েটা ছোট থেকেই লড়াই করছে জীবন নিয়ে। এবার ভালো কারো হাতে তুলে দিতে পারলেই তিনি শান্তি। এই মেয়েকে নিয়েই এখন তার যত চিন্তা।

     

    “কাজের বেটি  রহিমা”

    পর্ব- ১৯

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    লাল মিয়া বাসায় যাওয়ায় আজ হক মঞ্জিলে আসতে দেরি হলো রহিমার। দেরি হয়ে যাওয়ায় আজ সে একটুও বিশ্রাম নেয়নি। ঝটপট কাজে লেগে গেছে। জমে থাকা কাজগুলো করে তারপর বিশ্রাম নিয়ে ড্রয়িং রুমে মেঝেতে বসলো। সেখানে সায়মা, ইশতিয়াক ও এলেন বাচ্চাদের কোলে নিয়ে টিভি দেখছিলো। সায়মা কোলে থাকা বাচ্চাকে ইশতিয়াকের কাছে দিয়ে রহিমাকে ডেকে নিয়ে গেলো,

    “চল এবার, ছাদে যাই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।”

    রহিমা বসা থেকে উঠে সায়মার সাথে ছাদে এলো। গাছে পানি দেওয়া শেষ করে রহিমাকে বললো,

    “গোলাপ গাছের পাশে দাড়া, ছবি তুলি।”

    “এহ! ছবি তোলা লাগবো না। ছবি দিয়া কি হইবো। বাস্তবে পেত্নী মোবাইলে বিউটিফুল ভুত্নি! ভুত্নি মুত্নি ছাইড়া আমারে বাস্তবেই দেখেন।”

    “বড্ড বেশি কথা বলিস! দাড়া চুপচাপ।”

    “ধুর!”

    রহিমা সামান্য বিরক্তি নিয়ে গোলাপ গাছের কাছে দাড়ালো। সায়মা বললো,

    “ওড়না ঠিক কর।”

    রহিমা ওড়ানা ঠিক করলে সায়মা বললো,

    “এমন পেঁচার মতো হয়ে আছিস কেন? হাসি দে একটু!”

    রহিমা দাঁত বের করে “ই” করে রইলো যা দেখে সায়মা বললো, 

    “দাঁত কেলিয়ে আছিস কেন! ঠোঁট মিলিয়ে সুন্দর করে হাসি দে।”

    রহিমা দুই ঠোঁট মিলিয়ে প্রশস্ত করে রইলো। যার ফলে তার জীর্ণশীর্ণ মুখখানার গাল দুটো আর দেখা যাচ্ছে না! সায়মা বিরক্ত হয়ে বললো,

    “মিস্টার বিন এর মতো এমন করে আছিস কেন! সুন্দর করে হাসি দে!”

    কিভাবে হাসবে, তা নিয়ে রহিমা কনফিউশানে পড়ে গেলো! বিভিন্ন ভাবে মুখ নাড়াচাড়া করছে। আজ যেন হাসতেই ভুলে গেছে! সায়মা তার কান্ড দেখে বললো, 

    “এই, তোর হাসতে হবে না। হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক ভাবে থাক। ভুলেও কপাল কুচকাবি না।”

    রহিমা গোমড়া মুখু হয়ে রইলো আর সায়মা এমনিতেই ছবি তুলে নিলো। তাও সেই হাসি নামক জোকারের থেকে ভালো দেখাচ্ছে। দুইটা শুট নেওয়ার পর সায়মা তার চুল ঠিক করে নিজের হাত কানের পেছনে নিয়ে চুল গুজে দেওয়ার ভঙ্গিতে দেখিয়ে বললো,

    “এইভাবে কানের পেছনে হাত রাখ।”

    “কানে ধরতাম ক্যা আপা! আমি কোনো অপরাধ করছি?”

    “না, অপরাধ করিসনি। এটা ছবি তোলার স্টাইল।”

    “ধুর! স্টাইল আর ফিস্টাইল! আরও কত কিছু দেখমু এই জীবনে! আরে, ছোটবেলা মকতবে গেলে পড়া না পারলে ওস্তাদ কানের লতি টাইনা দাড়া করায় রাখতো। এগুলারে স্টাইল বলে না, আপা। এগুলা ন্যাংটা কালের শাস্তি।”

    “আমি তোকে কানের লতি টানতে বলিনি। এভাবে ধর।”

    “সেই একই তো হইলো না! ওস্তাদ কানের লতি টানতে কইছে আর আপনে কানের ডগা! নিচ থেইকা উপরে আইলেই কি শাস্তি স্টাইল হইয়া গেলো!”

    সায়মা তার দিকে তেড়ে এসে একটা গোলাপ ছিড়ে ফেললো এবং রহিমার কানে গুজে দিয়ে বললো,

    “কানে ধরতে হবে না। গোলাপের ডাটায় ধরে রাখ, তাহলেই হবে।”

    সায়মা আবার আগের জায়গায় চলে এলো আর রহিমা বুকে থু থু দিলো। সায়মা যেইভাবে তেড়ে এসেছিলো, সে ভেবছে এই বুঝি তাকে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিবে! সায়মার কথামতো এবার রহিমা কাজ করলো এবং ফটোশুট সুন্দর হলো। অত:পর সায়মা তাকে যেভাবে বসতে বললো, সে ঠিক সেভাবেই বসলো। সায়মা তাকে গাছে থাকা একটা গোলাপের ডাটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,

    “প্রথমে গোলাপটা এভাবে ধরে  মুচকি হেসে গোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকবি। তারপর আমি যখন বলবো তখন গোলাপ থেকে গন্ধ নেওয়ার ভঙ্গিতে থাকবি।”

    সায়মার কথামতো রহিমা প্রথমে গোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকলো। অত:পর যখনই দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে গন্ধ নিতে গেলো তখনই চিৎকার দিয়ে সরে এলো!

    “ও মা গো! কি ঢুকলো গো! আপা গো, নাকে পোক গেছে! এইবার কি হইবো গো!”

    কথাটা বলেই রহিমা নাক ঝেড়ে লাফাতে লাগলো ছাদে! সায়মা প্রথমে থমকে গেলেও তার কথা শুনে ও কান্ড দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! রহিমা লাফাচ্ছে আর সায়মা হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়েছে! রহিমা তার হাসি দেখে বললো,

    “অন্যের দুঃখে হাসতে নাই আপা। সাহায্য করতে হয়। কি করমু তারাতাড়ি বলেন! নাকের ভিতর কেমন জানি লাগতাছে!”

    সায়মা হাসতে হাসতে ছাদের কোনে রাখা ঝাড়ুটা দেখিয়ে বললো,

    “তুই তো বেশ ভালো ঝাড়ু চালাতে পারিস। শলার ঝাড়ুটা নিয়ে নাকের ভেতর ঝাড়ু দে। পোকামাকড় সব দূর হয়ে যাবে।”

    “ধুর আপা! আপনে খুব খা..খা.. হাচ্চু!”

    অবশেষে হাচিতেই রহিমার মুক্তি! নাক থেকে মশা বের হয়ে এসেছে সর্দির সাথে। ওদিকে সায়মা হাসতে হাসতে বললো,

    “আমি কি? খুব খারাপ হাচ্চু? হিহিহি.. “

    তার হাসির উপর রাগ করে রহিমা বললো,

    “আপনি আমার নাকের সর্দি।”

    “ছি! রহিমা!”

    রহিমা পানির ট্যাংক এর কাছে এসে কল ছেড়ে নাকে মুখে পানি ছিটিয়ে এলে সায়মা তাকে নিজের কাছে ডাকলো৷ রহিমাও এসে তার পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়ালো। সায়মা একটা ছেলের ছবি স্ক্রিনে রেখে রহিমার হাতে ফোন দিয়ে বললো,

    “দেখতো পছন্দ হয় কি না?”

    “এই ব্যাডা কেডা?”

    “আরে দেখ না আগে! ওদিকে আরও কয়েকটা আছে। সবগুলো দেখ।”

    রহিমা একে একে ছয়টা পুরুষের ছবি দেখলো। অত:পর বললো,

    “দেখলাম তো আপা।”

    “কোনটাকে পছন্দ হয়েছে?”

    “আল্লাহর সৃষ্টি, সবই ভালা।”

    “সব ভালো হলে চলবে না। একটা পছন্দ কর।”

    “না, সব তো আল্লারই সৃষ্টি। একটারে বেশি সুন্দর কইলে আবার আল্লাহ নারাজ হইবো। তাই আমার সব গুলারেই পছন্দ হইছে।”

    রহিমার কাছ থেকে নির্দিষ্ট পছন্দ খুঁজে না পাওয়ায় সায়মা বিরক্ত বোধ করে বললো,

    “সব গুলোর সাথে তো আর তোর বিয়ে দেওয়া যাবে না। একটা পছন্দ করতে হবে। যেকোনো একটা বল।”

    “কিহ! বিয়া!”

    “বিয়া না। বিয়ে।”

    “সে যাই হোক! আমি বিয়া টিয়া করতাম না। আমার একটারেও পছন্দ হয় নাই। একটাও ভালা না। আপনার ফোন ধরেন! ধরেন!”

    কথা বলতে বলতে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে রহিমা তড়িঘড়ি করে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলো। আর সায়মা পেছন থেকে ডাকতে লাগলো,

    “আরে শোন তো! রহিমা? এখন যে সব অপছন্দ বললি, এখন আল্লাহ নারাজ হবেন না?”

    রহিমা তার কথা শোনার জন্য বসে নেই। হনহনিয়ে নেমে গেছে নিচে। সায়মা এখানে দাড়িয়ে আয়ানকে কল করলো এবং কথা বললো বেশ কিছুক্ষণ।

    .

    পরদিন কাইয়ুম ভিলায় আসার পর আয়ান তাকে নিজের রুমে ডাকলো। রহিমা রুমে যেতেই আয়ান তাকে বসতে বললো,

    “বস এখানে। এবার আমি যা বলবো তা খুব মনযোগ দিয়ে শুনবি। না হলে এবার তোর নাকে ভোমরা ছেড়ে দিবো।”

    গতকালের ঘটনা সায়মা আয়ানকে জানিয়ে দিয়েছে তাই রহিমা ব্রু কুচকে তাকালো আয়ানের দিকে! আয়ান ফোনে সেই ছবিগুলোই বের করে একে একে বলতে লাগলো,

    “তেমন উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্ত ছেলে তোর জন্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে এদের অবস্থা মোটামুটি ভালো। অবস্থা মূল বিষয় না, মূল বিষয় হচ্ছে সে মানুষ হিসেবে কেমন। দেখ, সে একজন শিক্ষক। কিন্ডারগার্ডেনে চাকরি করে৷ ভালো মনের মানুষ। দৈহিক সৌন্দর্য তো দেখতেই পাচ্ছিস। উচ্চতা তোর সমান হবে। আর সে একজন সেলসম্যান। মানে বিক্রয়কর্মী। পন্য অর্ডার করলে বাসায় বাসায় ডেলিভারি দেয়। ইনকাম মোটামুটি ভালোই। কিন্ডারগার্ডেনের শিক্ষকের চেয়ে বেশ ভালো। তোর চেয়ে লম্বাও হবে। আর আমার মতো ভুরি কম! আমি তো খাই বেশি তাও ভুরি বাড়ে না। তবে এই লোক মনে হয় কৃপণ টাইপের। না খেয়ে খেয়ে ফিট থাকার চেষ্টা করে। আমাদের এদিকে প্রায়ই ডেলিভারি দেয়, কখনো রিকশা বা কোনো গাড়িতে আসতে দেখিনি। তোর সাথে মিল আছে বটে। এই দেখ, সে একজন দোকানদার। মুদি দোকান আছে। একটু স্বাস্থ্যবান বটে। দোকানীরা বসে থেকে থেকে যেমন হয় আরকি। তবে মানুষ হিসেবে ভালো। বয়সটা পঁয়ত্রিশের এপারওপার হবে। উচ্চতায় তোর সমান কিংবা দুএক ইঞ্চি শর্ট হতে পারে। ওটা ফ্যাক্ট না। আমার আর ইতুর মধ্যেও তো তেমন একটা তফাত নেই। মাত্র দুএক ইঞ্চি লম্বা আমি। এতে কি আমাদের বেমানান মনে হয়? নিশ্চয়ই না। সবদিক এতো মিলিয়ে পাওয়া যায়না।”

    “ভাইজান, থামেন তো আপনে। আমার এইগুলা একটারেও পছন্দ না। আমি এহন বিয়া করতাম না।”

    “আরে, মাত্র তো তিনটা দেখালাম। সবগুলো দেখ আর ভালো লাগার মতো মনোভাব নিয়ে দেখ নিশ্চয়ই একজনকে পছন্দ হয়ে যাবে।”

    আয়ান আবার বলতে লাগলো। রহিমা বিরক্তির সাথে শুনতে ও দেখতে বাধ্য। ছয়জনের ডিটেইলস বলার পর আয়ান জিজ্ঞেস করলো, 

    “এইবার তোর বিবেক খাটিয়ে বলতো এদের মধ্যে কাকে বেশি ভালো মনে হয়েছে?”

    রহিমা চেহারায় বিষন্নতার ছাপ ফেলে বললো,

    “ভাইজান, এদের একটারেও পছন্দ হয় নাই। এদের চেয়ে শতগুণে ভালা এলিয়েনের মতো দেখতে লম্বা সেই লাল মিয়া। গায়ের রঙ লাল না হইলেও শ্যামলা। সাদাসিধা মানুষ, মনটাও অনেক ভালা। উচ্চতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। আপনের চেয়েও বেশি। দুইজন একসাথে খাড়াইলে মনে হইবো আপনে কলাগাছ আর লাল মিয়া তাল গাছ! আপনে বড় ভাইজানের সাথে খাড়াইলে যেমনটা মনে হয়। তার চেয়ে বড় কথা, আমারে অনেক পছন্দ করে। কাল মা’র সাথে কথা বইলা আইছে বিয়ার ব্যাপারে।”

    “এ!”

    “হু।”

    “তোর মা কি বললো?”

    “মা আমারে জিগাইয়া তথ্য নিছে তারপর আলহামদুলিল্লাহ বলছে।”

    “তলে তলে এতো ডুবে আছিস! শুধু শুধু আমি এতো অস্থির হয়ে ঘটকের মতো ঘুরাফেরা করছি কেন তোর জন্য! যা, ভাগ এখান থেকে।”

    রহিমাকে ভাগতে বলে আয়ান নিজেই তার আগে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কিচেনে এসে ফ্রিজ খুলে একটা আপেল হাতে নিলো। অত:পর ড্রয়িং রুমে বাবার পাশে এসে বসলো। কাইয়ুম সাহেব পত্রিকায় ডুবে আছেন। আয়ান আপেল খেতে খেতে বললো,

    “আব্বু, চৌদ্দ তারিখ রহিমার বিয়েটাও দিয়ে দাও। পাত্র ঠিক করে ফেলছি। বেচারা লাল মিয়া গেইটে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। বিয়েটাও তো করে ফেলা দরকার। চুল দাড়ি পেকে গেলে আবার বাচ্চাকাচ্চা বাবাকে দাদা বলে ডাকবে। তার চেয়ে ভালো লাল মিয়া আর রহিমার বিয়েটা হয়ে যাক। মিয়াও রাজি, বিবিও রাজি৷ তুমি হ্যাঁ বললেই বিয়েটা পড়িয়ে দেয় কাজী!”

    কাইয়ুম সাহেব পত্রিকায় তাকিয়েই নিঃশব্দে হেসে উঠে বললেন,

    “ভালোই তো! রহিমা করছে তোমার ঘটকালি আর তুমি করছো ঘটকের ঘটকালি! লুকিয়ে লুকিয়ে ঘটকালির উপর পিএইচডি করছো নাকি?”

    “বুড়ো কালে নাকি মানুষ শুধু দোষ খুঁজে বেড়ায়। আজ বুঝলাম, তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছো আব্বু। আম্মু কিন্তু আগের মতোই স্ট্রং।”

    “হা হা হা, তাইতো এখনো আগের মতোই খুন্তি নিয়ে দৌড়ায়।”

    “হুম, রাইট।”

     

    “কাজের বেটি রহিমা”

    পর্ব-২০

    (নূর নাফিসা)

    .

    .

    একই দিনে হয়ে গেলো দুইটা বিয়ে। অনুষ্ঠান আয়োজন সব ছিলো আয়ান ও সায়মার বিয়ে উপলক্ষে, শুধু কাজী বিয়ে পড়ালো দুইটা। লাল মিয়া বিয়ের প্রথম তিনদিন শ্বশুর বাড়িতে থাকলো। আজ চতুর্থদিন রহিমা এসেছে মারিয়া কাইয়ুমের সাথে কথা পাকা করতে। গত মাসে পাঁচ তলার একটা ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ায় বাড়ির গেইটে “To Let” সাইনবোর্ডটি ঝুলছে। এতোদিন ধরে লোকজন এলেও ফ্ল্যাট বুকিং বলে লাল মিয়া তাড়িয়ে দিতো গেইট থেকেই। কেননা তার ইচ্ছে এবাড়িতেই একটা ফ্ল্যাট নিবে বউ নিয়ে থাকার জন্য। ভাড়া কিছুটা কমানোর জন্য সে বিয়ের পূর্বে কথাবার্তা বলেনি। বিয়ের কার্যাদি সম্পাদন হলে ঠান্ডা মাথায় কথাবার্তা বলে মাসিক ভাড়া কিছুটা কমিয়ে নিবে। 

    সাইনবোর্ড ঝুলানোর পর থেকে রহিমা প্রতিদিন এসেই  সাইনবোর্ড উল্টে দিতো। লাল মিয়া আবার ঠিক করে রাখতো। নতুবা বাড়ির মালিকেরা দেখলে সমস্যা হতে পারে।

    আজ তাদের মজলিস বসলো। মিস্টার ও মিসেস কাইয়ুম এবং রহিমা ও লাল মিয়া উপস্থিত। লাল মিয়া কথা তুললে কাইয়ুম সাহেব বললেন,

    “ফ্ল্যাট খালি আছে যখন নিয়ে নে তোরাই। সমস্যা কি!”

    লাল মিয়া বললো,

    “খালু, আমার আয়ের ব্যাপারে আপনারা তো জানেনই। ভাড়া একটু কমাইয়া রাইখেন।”

    “আচ্ছা, সেটা সমস্যা নেই। তুই কিছু কমই দিস।”

    রহিমা বলে উঠলো,

    “খালু, কিছু কম না। আমরা দুইজনেই তো আপনাদের বাড়িতে কাম করি। আমি এইখানে থাকলে যখনতখন ডাকলেই আপনাগো কাজ কইরা দিতে পারমু। সেই সুবাদে আমার জন্য কিছু ছাড় দেন আর উনার জন্য কিছু ছাড় দেন।”

    “বললামই তো, কিছু কম দিস তোরা।”

    “কিছু-মিছু না। আমি অর্ধেক কম দিমু। চার হাজারের এক টাকাও বেশি দিতে পারতাম না। এহন আপনেরা রাজি থাকলে বলেন, না হইলে আর কি করার!”

    “আচ্ছা, যা৷ চার হাজারই দিস। খুশিতো এইবার?”

    “হু, গ্যাস পানি আবার কম কম সাপ্লাই দিয়েন না। বাকিদের মতো পুরা সুযোগ সুবিধাই কিন্তু দিবেন।”

    রহিমার কথাবার্তায় মারিয়া ক্ষেপে গিয়ে বললো,

    “এই, যা এখান থেকে। আমি ফ্ল্যাটই ভাড়া দিবো না তোর কাছে। অন্য কোথাও গিয়ে খোঁজ। যা।”

    “উহ! আম্মায় যে করে! থাক! আর কথা কইতাম না। চাবি দিয়া দেন। বিসমিল্লাহ বইলা ফ্ল্যাটে পা রাখি।”

    রহিমা কাজে লেগে গেলো।  সায়মা এখন এবাড়িতেই আছে। সায়মার মা সেদিন আজেবাজে বলায় মারিয়া কাইয়ুম তার সাথে কথা বলে না। অনুষ্ঠান শেষ হলো অথচ এ পর্যন্ত একবারও সায়মার বাড়িতে যায়নি। এবাড়িতেও সায়মাকে কোনো কাজে হাত লাগাতে দেয় না। ইগনোর করেই চলে। সেই সুযোগে পিংকি আলাদা ভাব নিয়ে চলছে। কিন্তু বাকিরা যথেষ্ট সুসম্পর্ক বজায় রাখছে৷ তবে সায়মা থেমে নেই। শ্বাশুড়ির মন জয় করবেই সে। 

    কাজকর্ম শেষ করে দুপুরে রহিমা বেরিয়ে এলো কাইয়ুম ভিলা থেকে। লাল মিয়া গেইটের পাশেই ছিলো। সে বিরক্তির সাথে বসার টুল নিয়ে যাচ্ছে। লাল মিয়া বললো, 

    “আরে! এইটা নিয়া কই যাও!”

    রহিমা গেইটের পাশে টুল রেখে গেইটে ঝুলানো সাইনবোর্ড টেনে নামিয়ে হাতে নিয়ে বললো,

    “এইটা এখনো ঝুলতাছে ক্যা? ফ্ল্যাট বুকিং কইরা নিছি না! দূরে রাখেন!”

    লাল মিয়া হেসে সাইনবোর্ড একপাশে রেখে টুলটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখলো৷ অত:পর রহিমার সাথে বেরিয়ে এলো গেইটের বাইরে। লাঞ্চ করে আবার আসবে সে। কথা বলতে বলতে হাটছে দুজন। লাল মিয়া জিজ্ঞেস করলো, 

    “রহিমা, ছোট ভাইজান তো তোমারে পছন্দ করতো তাইলে বিয়া করলো না ক্যা?”

    “কেডা কইছে এত্তো বেশি কথা! ছোট ভাইজান আমারে পছন্দ করতো না। ছোটভাইজান তো আমারে ফ্রেন্ড মনে কইরা দুষ্টামি করে।”

    “তুমি কি এই দুষ্টামির প্রেমেই পড়ছো?”

    “ক্যা? আপনে বুঝি আমার দুষ্টামির প্রেমে পড়ছেন?”

    “না। আমি তো একটা বাচালের প্রেমে পড়ছি।”

    “আমি বাচাল!”

    “না, কইতরি।”

    রহিমা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো এবং বললো,

    “তাইলে আপনে কইতর।”

    লাল মিয়া হেসে বললো,

    “রোদের পাওয়ার অনেক। বউটা কালি হইয়া যাইতাছে। চলো রিকশায় যাই।”

    রহিমা তার হাত ধরে বললো, 

    “এইটুকু যাইতে রিকশা লাগে! পাইছে এক রিকশা! ঘর থেকে বাইর হইলেই রিকশা নেই, রিকশা নেই। এইটা রিকশা না ছাই! আমার কাছে তো হুইলচেয়ার মনে হয়। পঙ্গুরা চলাচল করবো রিকশা দিয়া। পায়ে আল্লাহ জোর দিছে, অযথা টাকা খরচ করমু ক্যা! হাত ধইরা এইভাবে পাশাপাশি হাটতে যে কি মজা, তা বুঝেন আপনে!”

    “না তো! তুমি বুঝো ক্যামনে?”

    “এই যে, যেমনে হাটতাছি এমনে এমনেই।”

    “পাগলনী একটা!”

    রহিমা তার হাত ঝাড়ি মেরে ছেড়ে দিয়ে বললো,

    “কি! আমি পাগলনী! যান! আপনার হাত ধইরা আর জীবনেও হাটতাম না। একদম আমার পাশাপাশিও হাটবেন না। পিছে থাকেন নয়তো আগে যান।”

    ক্ষেপে গিয়ে রহিমাই হনহনিয়ে তার আগে পা চালালো। লাল মিয়া হেসে দ্রুত পায়ে এসে রহিমার হাত ধরে হাটতে লাগলো। রহিমা ছাড়ানোর চেষ্টা করলে লাল মিয়া আরও চেপে ধরে হাটতে লাগলো। সারা রাস্তা লাল মিয়ার কাছ থেকে হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে করতেই বাড়ি ফিরলো রহিমা।

    পরদিনই ঘরের ছোটখাটো আসবাবপত্র ভ্যানে করে তারা হাজির হলো কাইয়ুম ভিলায়। লাল মিয়া নতুন খাট ও ছোট সুকেচ সহ সাংসারিক কিছু আসবাব কিনে আনলো। প্রায় তিনদিন লেগেছে তাদের ঘর গোছাতে ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে নতুন সংসার সাজাতে। 

    এরপর সূচনা সংসারের। রহিমার সেই বাড়িটা আপাতত এমনি থাকবে। রহিমার মা তাদের সেই ছোট বাড়িটা রাহিমার নামে করে দিবে। তাই আরও কিছু টাকা জমলে লাল মিয়া জমিজমা না কিনে সেখানেই ঘর তুলবে। তখন ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে তারা নিজেদের বাড়িতে থাকবে।

    সায়মা শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে শ্বাশুড়ির মন জয় করতে। তবে বেশিদিন কষ্ট করতে হয়নি তাকে। আয়ানের সাহায্যে সে খুব দ্রুতই মারিয়ার মনে জায়গা করে নিয়েছে। ঘরের কাজকর্ম থেকে তো তাকে দূরেই রাখা হয়েছে তাই সে উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না কিভাবে মারিয়ার মনে জায়গা করে নিবে! কিন্তু আল্লাহর রহমতে উপায় হয়ে গেছে! বিয়ের পর আয়ানের স্বভাব অনেকটা পাল্টে গেছে। আগে ঠিকমতো নামাজ পড়তো না, এখন নিয়মিত পড়ে। আয়ান ঠিকমতো ক্লাস করতো না পড়াশোনায় অমনযোগী ছিলো। কিন্তু এখন সে মনযোগী হয়েছে। মায়ের ছেলে মায়ের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়েছে। হ্যাঁ, সে স্ত্রীর মর্যাদা বাড়িয়ে তুলতে, বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে, সর্বোপরি মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে সে এখন নিজের মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনেছে। যার ফলে তার মা সন্তুষ্ট হয়েছে।  পাশাপাশি ছেলের বউয়ের আচার-ব্যবহারেও মুগ্ধ হয়েছে। মারিয়া তাকে ইগনোর করেছে কিন্তু সায়মা এ নিয়ে কখনো কোনো কটু কথা না বলে নিজের আচরণ মার্জিত রেখেছে। তিনি কথা না বললেও সায়মা তাকে মা বলে ঠিকই ডাকতো, যেকোনো কাজে অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা করতো। তার মাঝে একজন আদর্শ বউ হওয়ার চেষ্টা মারিয়ার নজরে পড়েছে বিধায় এখন তিনি সায়মার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছেন। সায়মার আচার-আচরণ ও আদর্শের কারণে পিংকির সাথেও সায়মার ভাব মোটামুটি ভালোই চলছে। যদিও পিংকি একটু হিংসা করে সায়মার সাথে। তবে ঝগড়াঝাটি থেকে দূরে। ওদিকে সায়মার ভাই আমেরিকা গেলেও এলেন যায়নি। ইশতিয়াক নিজেই তার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কেননা সায়মা না থাকায় বাড়িতে মা একা। সন্তান লালন পালন করে বড় করেছে এখন সন্তান যদি নিজের ভালোর জন্য বাবা-মাকে রেখে দূরে চলে যায়, বাবামা কে সঙ্গ দেওয়ার সময় খুঁজে না পায় তাহলে কিসের সন্তান হলো সে! ছোট থেকে বৃহৎ সকল ধরনের ভুল করেও বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা পেয়েছে সর্বদা৷ না জানিয়ে বিয়ে করেছে তবুও সন্তান দূরে ঠেলে না দিয়ে বউ বাচ্চা সহ মেনে নিয়েছে, সেই বাবা মাকে একা রেখে যেতে নিজের বিবেকে বাধা পেয়েছে ইশতিয়াকের। তাই সে বউ বাচ্চাদের এখানে রেখে গেছে। এমনকি আমেরিকা সকল কিছু বন্দোবস্তো করে নিজেও দেশে এসে কাজ করার পরিকল্পনা করেছে। আর দূরে দূরে নয়, পরিবারের সাথে জীবন কাটাবে।

    আয়ান ও সায়মার চুপিচুপি বিয়ের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে লাল মিয়া ও রহিমাকে নিয়ে তারা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে আয়ান নিজে ট্রিট দিবে বলে। মাঝপথে রহিমা বললো,

    “আপা, ভাইজানের পকেট চেক করছেন তো? প্রতিবার তো ভাইজান গাপুসগুপুস  খাইয়া আপনারে ফাসায় দেয়!”

    সায়মা হেসে বললো,

    “এইবার চান্স নেই। তোর ভাইজানের পকেটই আমার কাছে।”

    “কি! প্যান্টের পকেট ছিড়া ফালাইছেন!”

    “চুপ! প্যান্টের পকেট ছিড়তে যাবো কেন! টাকা কি প্যান্টের পকেটে রাখে নাকি ওয়ালেটে রাখে! ওয়ালেট আমার কাছে।”

    “ওহ্! আমি তো ভাবছি আপনে প্যান্টের পকেটই ছিড়া ফালাইছেন!”

    সায়মা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই রহিমা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তবে হঠাৎ করেই হাসি থেমে গেলো রাস্তার ধারে ইট ভাঙার কাজে কারিমাকে দেখে! কারিমা এখন ইট ভাঙে তার শ্বাশুড়ির সাথে। তার এই দৃশ্য দেখে রহিমা খুব বড়সড় এক নিশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো, 

    “রাখছিলাম তো আরামের জীবনে। আরাম সয় না দেহে? আজ রূপচর্চা কই গেলো? রোদে পুইড়া তো পেতনী হইয়া গেছোস! আমি তো মা রে নিয়া খুব আরামের জায়গায় আছি। আমার স্বামী তো আমারে সাধ্যমতো রানী কইরা রাখার চেষ্টা করতাছে। মা বোনের দেওয়া সুখ সহ্য হয় না কপালে? এইবার অসুখে মর।”

    বাকিটুকু পথ রহিমা চুপচাপই ছিলো। রেস্টুরেন্টে এসে তারা হঠাৎ দেখা পেল রুমেলের! তাকে দেখা মাত্র রহিমার মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। রুমেল কেমন যেন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো তাদের দিকে। আর সাথে সাথেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। আয়ান তাকে দেখে মুখ চেপে হেসেছে আর সায়মা দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। কিন্তু রহিমা এবার চুপ করে নেই৷ সে রুমেলকে ডেকে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে দিলো।

    “কি ভাই? সংসার কেমন চলতাছে? বউ তো সুন্দরীই দেখলাম। আমাগো বিয়াতে আসছিলো। আপনে আসেন নাই ক্যা? এমন কইরা তাকাইয়া আছেন ক্যা? আমারে চিনেন নাই? আমি তো সেই কাজের বেটি রহিমা। ওইযে, ঝাড়ু আর ঝাড়ু!”

    সায়মা দাঁতে দাঁত চেপে রহিমাকে ধমক দিলো আর রহিমা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আয়ানও মিটিমিটি হাসছে। আর রুমেল হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। তার বন্ধুবান্ধবও পিছু ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে গেলো। রহিমা হাসতে হাসতে বললো,

    “আহারে! বেচারার কি কষ্ট! তার কষ্টে আমার মনডায় চায় মাটি থেকে ছাদে ঝাপ দেই।”

    সায়মা বললো,

    “মাটি থেকে ছাদে ঝাপ দিবি নাকি ছাদ থেকে মাটিতে!”

    “ধুর আপা! ছাদ থেকে মাটিতে ঝাপ দিলে আমি বাচমু! দিলে মাটি থেকেই ছাদে ঝাপ দিমু!”

    আয়ান হা হা করে হেসে উঠলো। আর লাল মিয়া তাদের কান্ডকারখানা কিছুই বুঝতে পারলো না। সে নিরব দর্শক ও শ্রোতা।

    এরপর ঝগড়াঝাটি মান অভিমানে সংসার ভালোই চলছিলো। লাল মিয়া কোনো দোষ করলেই রহিমা কাইয়ুম সাহেবের কাছে দৌড়ে আসে বিচার দেওয়ার জন্য। তাদের বিচার করতে করতে কাইয়ুম সাহেব এখন পারিবারিক বিচারক হয়ে উঠেছেন। লাল মিয়ার পাশাপাশি এবাড়ির সদস্যদের নামেও বিচার দিতে ভুলে না রহিমা। তবে রহিমাকে কথায় কথায় রাগিয়ে দেওয়া যেমন আয়ানের স্বভাব ঠিক তেমনই পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করা লাল মিয়ার স্বভাব। রহিমা রাগ করে বসে থাকলে সে-ই আবার পিছু পিছু ঘুরঘুর করে রাগ ভাঙানোর জন্য।

    বছর গড়িয়ে দুষ্টমিষ্টি সংসারে রহিমার কোলে এলো ছোট্ট রাজকন্যা। মেয়ের নামকরণের দিন যখন রহিমা সায়মার কাছে একটা ভালো নাম চাইলো তখন হুট করেই আয়ান বলে উঠলো,

    “রহিমা! নতুন করে নাম নেওয়ার কি আছে! আমি তো অনেক আগেই তোর মেয়ের নাম রেখে দিয়েছি। তুই হচ্ছিস সকিনার মা রহিমা। অর্থাৎ তোর মেয়ের নাম হচ্ছে সকিনা।”

    “আপা দেখেন, ভাইজান কি বলে!”

    “কি বলি মানে! পছন্দ হয়নি আমার দেয়া নাম! আমি কিন্তু সকিনা বলেই ডাকবো।”

    “আপনে যদি সকিনা ডাকেন, তাইলে এই কাজের বেটি রহিমা কিন্তু আপনার মাইয়ারে জিলাপি ডাকবো। আলাপির বোন জিলাপি! আর যদি দুইটা মাইয়া হয়, তাইলে আরেকজনরে ডাকমু আয়নার বেটি ময়না। আর যদি পোলা হয় তাইলে রাখমু ময়নার ভাই মনু মিয়া।”

    আয়ান হা হা করে হেসে বললো,

    “তোর মাথার ঝাকড়া চুল কিন্তু তখন একটাও থাকবে না। আমার দুই মেয়েকেই লাগিয়ে দিবো চুল ছিড়ে গুণতে। আর ছেলেকে লাগিয়ে দিবো তোর মেয়ের পিছু। লাল মিয়াও কিন্তু এই টেকো বউ নিয়ে থাকবে না তখন। সকিনার নতুন মা নিয়ে আসবে।”

    সায়মা বিরক্ত হয়ে বললো,

    “আহ! চুপ থাকো তো! রহিমা, তোর মেয়ের নাম আমি রাখলাম লামিয়া মুনতাহা রাইসা। আমি রাইসা বলেই ডাকবো।”

    “আপা, ভাল্লাগছে নাম! থ্যাঙ্কিউ আপনারে।”

    “ওয়েলকাম।”

    আয়ান বললো, 

    ” ইতু, এটা কি করলে তুমি! রহিমার এক মেয়ের জন্যই তিন নাম রেখে দিলে আমাদের মেয়েদের নাম শর্ট পড়বে না?”

    সায়মা আয়ানের পেটে কনুই মেরে চোখ রাঙালে আয়ান হাসলো।

    আয়ান সবে মাত্র ব্যাংকে ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করেছে। এবছর মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করায় আয়ানের রেজাল্ট ভালো হয়েছে। আর সায়মার রেজাল্ট বরাবরই ভালো কিন্তু মারিয়া তাকে চাকরি করতে দিবে না৷ যেহেতু তাদের পরিবারে অভাব নেই সেহেতু বউদের চাকরি করার প্রয়োজন নেই। কোনো অভাবির জন্য একটা পোস্টই বেঁচে যাবে। অযথা চাকরির পোস্ট পরিপূর্ণ না করে যাদের চাকরির প্রয়োজন আছে, তাদের সুযোগ দেওয়াটাই শ্রেয়। তাই অনার্স শেষ করে এখন সায়মা সংসারী। হয়তো কিছুদিন পর রহিমার মতো তার সংসারেও প্রদীপ জ্বলে উঠবে।

    ঝগড়াঝাটি মান অভিমানে, 

    সেজেছে সংসার, জমেছে সব।

    কাটছে সময়, যাচ্ছে দিন,

    অবশেষে জীবন, হয়েছে রঙিন।

    .

    (সমাপ্ত)

    .

    .

    [বরাবরের মতো গল্প সম্পর্কিত  মন্তব্য আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম। তবে পূর্বেই  বলেছিলাম, এই গল্প নিয়ে আমি আপনাদের প্রশ্ন করবো। তো এবার বলুন,

     

    ★ “কাজের বেটি রহিমা” গল্পের নায়ক নায়িকা কারা?

    .

    বি.দ্রঃ উত্তর সাপেক্ষে আমিও কিছু লিখবো পরবর্তী পোস্টে।]

     

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।