শাশুড়িকে খু*ন করে স্বামীর গায়ে হাত তুলছিস এতো সাহস তোকে কে দিয়েছে? বাইরে এখনো আমার মায়ের লাশ পড়ে আছে। কেনো করলি বল? ‘দু’টাকার মেয়ে, তোকে খু*ন করে গুম করতে আমার দু সেকেন্ডও লাগবে না।
স্বামীর মুখে এধরনের কথা শুনতে হবে অধরা কল্পণাও করেনি। লোকটা শান্ত আর ভদ্রলোক। কখনও দরকার ছাড়া অধরার সঙ্গে গত এক বছরে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। যখন যা চেয়েছে পেয়েছে। এই বাড়ির সবাইকে ও নিজের মনে করে। তাছাড়া পাঁচ পাঁচটা ননদদের মধ্যে ও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ওরা ভূলেও অধরার আশেপাশে ঘেঁষে না শুধু শাশুড়ি মা ছাড়া। সেই শাশুড়িকে ও কিভাবে মারতে পারে অধরার মাথায় আসছে না। আজ সন্ধ্যায় শাশুড়িমা ওকে ছাদে ডেকেছিল। কেনো ডেকেছিল সেগুলো ও কাউকে বলতে পারবে না। শাশুড়ি মা ওর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
> এটা ধরো। এর চাইতে বেশি কিছু বলার অধিকার আমার নেই। এটা গোপন রাখবে। এই বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করবে না এমনকি নিজের স্বামীকেও না। নিজের আর তোমার মধ্যে থাকা মহামূল্যবান রত্নের খেয়াল রাখবে। পারলে দ্রুত পালিয়ে যাও। আমার আলমারির ড্রয়ারে কিছু দরকারি জিনিস আছে তোমার কাজে লাগবে। এখন নিচে যাও!দ্রুত।
অধরা কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু হলো না তাঁর আগেই উনি ধমক দিয়ে ওকে নিচে পাঠিয়ে দিলেন। অধরা নিচে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে হৈচৈ পড়ে গেলো। অধরা দৌড়ে গিয়ে দেখলো ওর শাশুড়ি নিচে পড়ে আছে। চারদিকে রক্তের ছড়াছড়ি। কি ভয়ংকর দৃশ্য। অধরা সেখানেই জ্ঞান হারালো। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখতে পেলে ও রুমে শুয়ে আছে আর ওর স্বামী জুবায়ের ফারুকী ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। ওর চোখ খুঁলতে দেরি হলো কিন্তু লোকটার ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়তে দেরি হলো না। গলা আটকে ধরলো। অধরার মনে হলো এখুনি বুঝি মারা যাবে। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে লাথি বসিয়ে দিয়েছিল স্বামী নামক লোকটার বুকে। শক্তিশালী জুবায়েরের সঙ্গে ও পারবে কিভাবে। লোকটা পড়ে গিয়েও আবার উঠে আসলো। অধরা ওই সুযোগ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লো কিন্তু জুবায়ের ওকে টেনে দেয়ালের সঙ্গে আটকে ধরে গাল চেপে ধরলো। অধরা বহুকষ্টে বলল,
> আমি এরকম করিনি বিশ্বাস করুন।আপনার মাকে আমি নিজের মা ভেবেছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।ছেড়ে দিন।
জুবায়ের হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
> ছেঁড়ে দেওয়ার হলে বহু আগেই ছেড়ে দিতাম। তোর ভাগ্য ভালো তোকে দরকার আমার। খুব দরকার। প্রয়োজন শেষ হলে এই পৃথিবী থেকে তোর নাম নিশানা আমি চিরকালের জন্য মুছে দিবো। তুই সুলতান জুবায়ের ফারুকীর নখের যোগ্যও না।
কথাটা বলে জুবায়ের ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দরজা ধপাস করে বন্ধ করে চলে গেলো। অধরা তাল সামলাতে না পেরে ছুটে গিয়ে ফ্লরে পড়লো। খাটের কোনা লেগে কপালের কিছু অংশ কেঁটে গেলো। অধরা কপালে হাত রেখে উঠে বসলো। ব্যাথা আজ শরীরে না মনে লাগছে। শাশুড়ির মৃত্যুর পরে ওর দুনিয়াটা কেমন বদলে গেলো। এতদিন তো ভালোই ছিল। বিয়েটা হয়েছিল পরিবারিক ভাবে। বিয়ের এক মাসের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনাতে ওর বাবা মা মা*রা গিয়েছিল। অধরা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার দরুণ অন্তিম যাত্রার সাক্ষী হতে পারলেও আর কখনও সেখানে ওর পা রাখতে পারেনি। বাবা মাকে ভেবে ও কাঁদবে কষ্ট হবে ভেবে শাশুড়ি ওকে যেতে মানা করতো। আগলে রেখেছিল। যখন যা লেগেছে পেয়েছে। বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার হয়নি। সুলতান জুবায়ের ফারুকী একজন ভালো ব্যবসায়ী আর বেশ প্রভাবশালী লোক। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই কিন্তু সবাই কেমন চুপচাপ। দরকার ছাড়া এই বাড়িতে কোনো শব্দ উচ্চারণ হয়না। পাঁচটা নন্দন সবগুলো বিবাহ উপযুক্ত,এক কথায় আগুন সুন্দরী। যাদের দেখলে মানুষ না ভেবে সবাই পরি ভেবে ভূল করবে। কিন্তু চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। এই মেয়েগুলোও তেমনি একটা অভিশাপ বহন করে। এরা বোবা কথা বলতে পারেনা। আধুনিক পোশাক আর চলন ভঙ্গিতে এদের জুড়িমেলা ভার। অধরা এদের রূপের কাছে কিছুই না। কথাগুলো ভেবে অধরা দ্রুত নিজের শাড়ির আচলে থাকা কাগজটা বের করে চোখের সামনে ধরলো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে,
“বধির বোবা বলবে বাক্য ঝরবে তখন লাল র*ক্ত। ঊষা কালে খুঁলবে দুয়ার শান্ত হবে তিমির দুয়ার”।
একটা ধাঁধা কিন্তু এর মানে কি হতে পারে অধরার জানা নেই। শাশুড়ি মায়ের মুখটা ওর ভীষণ মনে পড়ছে। অধরা কাগজটা দ্রুত লুকিয়ে বেরিয়ে আসলো। এর মধ্যে লা*শ দাফনের সব কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে সবাই সাদা পোশাক পরেছে। মেয়েরা মায়ের চারপাশে চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু সবাই খুব স্বাভাবিক কারো চেখে কোনো পানি নেই। জুবায়ে বাইরে আছে। পুলিশ এসেছে ঘটনার তদন্ত করতে কিন্তু জুবায়ের দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিলো। বেশ কিছু টাকা পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওদেরকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে আসলো। অধরা চুপচাপ শাশুড়ির মাথার কাছে গিয়ে বসলো। ছাঁদ থেকে কিভাবে উনি পড়ে গেলেন বিষয়টা নিয়ে ওর চিন্তা হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলে উনি ইচ্ছে করে লাফ দিয়েছেন। সুইসাইড করবেন ভেবে ওকে ডেকে এতগুলো কথা বলে গেলেন। কিন্তু সুইসাইড করার কারণটা কি ছিল? কিছুক্ষণের মধ্যে অধরার শশুর এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। ভদ্রলোকের দুজন স্ত্রী। উনি ছোট বউয়ের সঙ্গে থাকেন। উনি হন্তদন্ত হয়ে মৃত বউয়ের পাশে বসলেন তারপর অধরার দিকে শীতল নজরে তাঁকালেন। অধরা ভয়ে শিউরে উঠলো। জুবায়ের ওর বাবাকে হয়তো সবটা বলে দিয়েছে। সবাই ওকে ভুল বুঝেছে কিন্তু পুলিশে দিচ্ছে না কেনো? এদের কি দরকারে ও লাগতে পারে? অধরার মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে। একমাত্র শাশুড়ি মা ভরসা ছিল যে ওকে সাহায্য করতে পারতো। গভীর কোনো রহস্যের অতলে ও তলিয়ে যাচ্ছে। মাথায় যন্ত্রণা করছে। শাশুড়ি মা শেষবারের মতো বলেছিল ওর মধ্যে কোনো রত্ন আছে কিন্তু রত্নটা কী? এই রত্নটার জন্যই ওকে হয়তো পুলিশে দেওয়া হচ্ছে না। বাড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে। যদি খু*ন বলে পুলিশকে জানানো হয় তবে অধরা অনায়াসে ফেঁসে যাবে। জেল বা ফাঁসি নিশ্চিত।
বাবা মা সেই সঙ্গে প্রিয় শাশুড়ি মায়ের এই রহস্যময় মৃত্যু ওকে সম্পূর্ণ একা করে দিলো। অধরা নিজেকে সামলাতে পারছে না। এই নিস্তব্ধ বাড়িতে শব্দ করে কাঁদার মতো অধিকার ওর নেই। কান্নাতে গলা আটকে আসছে। অধরা দ্বিতীয়বারের ন্যায় আবার জ্ঞান হারালো।
__________
মধ্য রাতে আধরার জ্ঞান ফিরলো। মুখের উপরে কারো দীর্ঘ উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে। ভয় ওক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আধরা হুট করে চোখ খুলে দেখলো জুবায়ের ওর মুখের উপরে ঝুকে আছে। রুমে আবছা আলো বিরাজ করছে। লোকটার দৃষ্টিতে কোনো রাগ নেই না আছে ঘৃণা। অধরা ডান হাতটা জুবায়ের মুখে রাখতে যেতেই ছেলেটা খপ করে হাতটা ধরে নিয়ে বলল,
> সরি তখন মাথাই কাজ করছিল না।কি বলতে কি বলেছি মনে রেখো না। মৃত্যুতে কারো হাত থাকে না। মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে আগে মতো হয়ে যাও।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল লোকটার কথা শুনে। একজন সন্তান কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি নিজের মাকে ভূলে যেতে পারে? অধরা প্রশ্ন করতে চাইলো কিন্তু পারলো না। জুবায়ের ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো নিজের সঙ্গে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,
> আমাদের ঘরে খুব তাড়াতাড়ি এক টুকরো রত্ন আসতে চলেছে। আমি ওকে কহিনুর বলে ডাকবো। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছো না? এতো আয়োজন শুধু ওর জন্য।
অধরা চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবলো। বিষয়টা সুখের কি দুখের ওর ঠিক মাথায় আসছে না। যেখানে ও মা হয়ে নিজের সন্তানের উপস্থিতি অনুভব করতে পরলো না সেখানে জুবায়ের বাবা হয়ে কিভাবে সব বুঝে গেলো? আর শাশুড়ি মা সেও কিভাবে জানলো? এই গোলক ধাঁধা কিভাবে কাঁটবে কে জানে। জুবায়ের আধা ঘন্টার মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। অধরা সাবধানে উঠে বললো। শাশুড়ির আলমারিটা চেক করা দরকার। কি আছে সেখানে? অধরা সাবধানে উঠে আসলো।পা টিপে টিপে শাশুড়ির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সারা বাড়িটা শুনশান নিরব। অধরা সময় নষ্ট করলো না দ্রুত ভেতরে গিয়ে ড্রয়ার চেক করলো। লাল রঙের একটা কাপড়ের মধ্যে কিছু রাখা আছে ও সেটা তুলে নিয়ে দ্রুত নিজের রুমে ফিরে আসলো। সেটা লুকিয়ে জুবায়েরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। জুবায়ের ঘুমের মধ্যে পাশ ঘুরে অধরাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> পালানোর চেষ্টা করছো বুঝি? এসব করে সময় নষ্ট করোনা। সময় হলে ঠিক মুক্তি পাবে।
অধরার ঢোক গিলল। মনে প্রশ্ন জাগলো জুবায়ের কি সব জেনে গেল?
চলবে
#কহিনুর
কলমে : লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:২
ভোরবেলা চোখ খুঁলে নিজেকে বিছানায় একা আবিস্কার করলো অধরা। জুবায়ের নেই হয়তো উঠে গেছে। গতকাল রাতে ওরকম একটা অদ্ভুত কথা বলে লোকটা আর সাড়াশব্দ করেনি। চুপচাপ ঘুমিয়েছে। এই চুপ থাকাটা অধরার কাছে আরও বিরক্তিকর মনে হয়েছে। কথা বললে অন্তত কিছুটা হলেও জানা যাবে। ধাঁধার মানে হলো কাপড়ের ভাজে রাখা জিনিসপত্রগুলো দেখা দরকার। এই বাড়িতে যতগুলো কাজের লোক আছে তাঁর থেকে দ্বিগুণ রয়েছে সিসি ক্যামেরা। বেডরুমে ক্যামেরা থাকার সম্ভাবনা থাকার কথা না কিন্তু সাবধানের মার নেই। কথাগুলো ভেবে ও আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে নিলো। পরনে আছে মায়ের দেওয়া কালো রঙের সুতি সিল্কের শাড়ি। যদিও অধরা শাড়ি পরে না গতকাল মায়ের কথা প্রচণ্ড মনে হওয়ার দরুন শাড়ি পরেছিল।জুবায়ের কখনও স্ত্রীর রূপের প্রশংসা করে না। ওর জন্য সাজার দরকার হয়না। অধরার বাবা মা ছিলেন বাঙ্গালী। এটা জার্মানির একটা শহর। অধরার জন্ম হয়েছে জার্মানিতে আসার পরে। ওর বাবা নওশাদ বারি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী একজন মানুষ। পড়াশোনার খাতিরে পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে সুদূর জার্মানিতে। এখনে এসে স্বদেশি সহপাঠীর প্রেমে পড়ে তাঁকে বিয়ে করে ফেলেন। পড়াশোনা শেষে এখানেই থেকে গেলেন। উনি পেশায় ছিলেন একজন প্রফেসর। অধরা বাবা মায়ের থেকে ভালো বাংলা বলতে শিখেছিল। লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই একদিন সুলতান পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব গেলো বাড়িতে। তাছাড়া অধরার বাবা চেয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে যেনো কোনো বাঙ্গালী পরিবারে হয়। সুলতান জুবায়ের ফারুকীর পরিবার বাংলাদেশ থেকে এই শহরে বহুকাল আগে এসেছে। ওরা এখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। বোঝা কঠিন ওরা আগে বাঙ্গালী ছিল। এই অর্থসম্পদের পাহাড় এরা কিভাবে রপ্ত করেছে এটা সকলের অজানা। ভালো পরিবার থেকে প্রস্তাব পেয়ে প্রফেসর সাহেব আর অপেক্ষা করলেন না। বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। আয়নার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিল মেয়েটা। গতকাল জুবায়ের বলেছিল ও দু’টাকার মেয়ে। ওর সঙ্গে জুবায়ের ফারুকীর যায় না। স্বামীর থেকে এতবড় কথাটা শোনার পর শক্ত থাকা কঠিন। তবুও ওর তেমন রাগ হচ্ছে না। মনের মধ্যে শাশুড়ি মায়ের মৃত্যু নিয়ে নানারকম কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। আধরা অনমনে আয়নায় নিজের হাতটা রেখে চমকে উঠে হাত ফিরিয়ে নিলো। আবারও হাত ছোঁয়ালো। প্রচণ্ড ঘৃণাতে ওর বমি আসছে। একজন লোক কতটা নিকৃষ্ট হলে নিজের বেডরুমের আয়নায় মধ্যে ক্যামেরা লুকিয়ে রাখতে পারে ওর জানা নেই। প্রায় ও এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ড্রেস ঠিকঠাক করে আবার কখনও চেঞ্জও করেছে। ড্রেসিং টেবিল থেকে বেড খুব ভালো করে দেখা যায়। অধরা দ্রুত বাথরুমে গিয়ে মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে আবারও চেক করতে আয়নায় হাত রাখলো। এখানে কিছু নেই ভেবে স্বস্তি পেলো। ভাবলো লোকটার মাথায় কি চলছে কে জানে। বাবা মা আর শাশুড়ির জন্য ওর প্রাণ কাঁদছে কিন্তু ওকে দুর্বল করছে না। ও যথেষ্ট শক্ত ধাচের মেয়ে। শুধু ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদলে সব সমস্যার সমাধান হবে না। এই বাড়ির রহস্য আর শাশুড়ির এভাবে সুইসাইডের কারণ ওকে বের করতে হবে। কথাগুলো ভেবে ও দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। পূনরায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার সাহস ওর হলো না। হঠাৎ মনে হলো প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। গতকাল দুপুরে শাশুড়ি মায়ের হাতে খেয়েছিল কথাটা ভেবেই ওর চোখ ভিজে উঠলো। আহা ভালো মানুষগুলোর সঙ্গেই বুঝি এমন হয়। অধরা বাইরে বের হতে গেলো কিন্তু হলো না ঝড়ের গতিতে জুবায়ের প্রবেশ করলো। আর ওকে টেনে নিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়লো। অধরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। জুবায়ের ওর ডান গালে হাত রেখে কুটিল হেঁসে বলল,
> শেষবারের মতো তোমাকে স্পর্শ করছি। সত্যি কি জানো? তোমাকে স্পর্শ করতে আমার কেমন জানি অস্বস্তি আর ঘৃণা লাগে। তবুও এটা আমাকে করতে হয়েছে। মনের উপরে জোরজবরদস্তি করে তোমার সঙ্গে থেকেছি কতটা যন্ত্রণা হয়েছে সেটা শুধু আমি আর আমার হৃদয় জানে। তুমি তো কষ্ট পাওনি বরং বেশ উপভোগ করেছো। আমার ঐশ্বর্য আমার ভালোবাসা সবটা। এগুলো তোমার জন্য ছিল না। সবটা ছিল কহিনুরের জন্য।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা বিস্মিত হয়ে লোকটার দিকে তাঁকিয়ে আছে। অপমান বোধ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না এই লোকটা ওকে শুধু ব্যবহার করেছে। অধরা দ্রুত শপথ নিলো এদের পরিকল্পনা ও কিছুতেই সফল হতে দিবে না। দরকার হলে নিজেকে শেষ করে ফেলবে। কথাটা ভেবে ও জুবায়েরকে নিজের উপর থেকে সরানো চেষ্টা করলো যখন পারলো না তখন নাকমুখ কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,
> আমি বোকার মতো ভাবতাম আপনি বুঝি কম কথা বলেন। স্ত্রী হিসেবে আমাকে আপনার ভেবেই কাছে টেনেছেন। কিন্তু না এসব তাহলে মুখোশ ছিল। মুখোশ উন্মোচন হচ্ছে আর মুখ দিয়ে খৈই ফুটছে। আমার প্রাণ থাকতে আমি আপনার কোনো পরিকল্পনা সফল হতে দিচ্ছি না। মনে রাখবেন আমি অবলা না।
জুবায়ের এক দৃষ্টিতে অধরার দিকে তাঁকিয়ে ছিল এতক্ষণ। স্ত্রীর চোখে নিজের প্রতি ঘৃণা দেখে মুখটা সরল করে বলল,
> তুমি সত্যিই বোকা। আমি এতক্ষণ মজা করছিলাম। গতকাল এতকিছু বলেছি তাই ভাবলাম তোমাকে আরও একটু ঘাবড়ে দিয়ে মজা করি। আর আম্মা সুইসাইড করেছে বাবার উপরে রাগ করে। আসলে বাবা দু সপ্তাহ ধরে ছোট মায়ের কাছে আছেন এটা উনি মানতে পারছিলেন না। তুমি ওসব ভূলে যাও। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করো। আমার কহিনুরের যেনো কোনো কষ্ট না হয়।
জুবায়ের কথাগুলো একদমে বলে অধরার কপালে চুমু দিয়ে উঠে বসলো। অধরা এই লোকটার মতিগতি বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে। এই ভালো তো এই খারাপ। জুবায়ের ওকে সুযোগ দিলো না দ্রুত কোলে তুলে বেরিয়ে গেলো। ডাইনিং টেবিলে নানারকম সুস্বাদু খাবার আর ফলের সমাহার।গতকাল থেকে জুবায়েরের বাবা আর উনার দ্বিতীয় স্ত্রী এই বাড়িতে আছেন। ভদ্রমহিলা এখানকার স্থানীয়। ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক আর উন্মুক্ত ড্রেস বড্ড বেশি বেমানান লাগলেও কেউ বিষয়টা পাত্তা দিচ্ছে না। জুবায়ের ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়লো। কেউ কারো দিয়ে তাঁকাচ্ছে না। নিরবে খাচ্ছে। জুবায়েরের বাবা আরমান ফারুকীর বয়সটা নিয়ে বেশ ঘাপলা আছে। তিরিশ বললেও মানা যায় আবার চল্লিশ বা পঞ্চাশ বললেও ভূল হবে না। লোকটা যথেষ্ট ইয়াং। অধরা সেদিকে বেশ ভালো করে লক্ষ করলো। একজন মানুষ গতকাল মারা গেছে কিন্তু এদের মধ্যে কোনো অনুতাপ বা দুঃখ নেই। অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জুবায়ের ওর মুখে খাবার তুলে ধরতেই ও আবারও চমকে উঠলো। গত এক বছরে এই প্রথমবার লোকটা ওর কাছাকাছি থেকে যত্ন নিচ্ছে। রাত ছাড়া তো লোকটাকে পাওয়া যায় না। মাঝেমাঝে রাতেও বাড়িতে ফিরে না। ওকে চমকে যেতে দেখে জুবায়ের ওষ্ঠে হাসি নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলো খেতে। অধরা দ্রুত খেয়ে নিলো। স্বামীর থেকে প্রাপ্ত এইটুকু সুখ হাতছাড়া করা বোকামি হবে। তাছাড়া পৃথিবীর সব স্ত্রী চাই তাঁর স্বামী তাঁকে কেয়ার করুক পাশে থেকে সাপোর্ট করুক। অধরা দ্বিধা ভূলে খাবার খেয়ে নিলো। জুবায়ের আবারও ওকে পূর্বের ন্যায় রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
> আজ থেকে তুমি রুমের বাইরে যাবে না। যদি অসাবধানতাবশত পড়ে যাও বা তোমার কোনো ক্ষতি হয়েছে তাহলে আমার কহিনুর কষ্ট পাবে। তুমি মা হয়ে সেটা কি সহ্য করতে পারবে?
অধরা মাথা নাড়িয়ে না বলল। জুবায়ের হাসি দিয়ে বলল,
> চুপচাপ ঘুমিয়ে যাও। আমি অফিসে যাচ্ছি। যখন যা দরকার হবে শুধু উচ্চারণ করবে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়ে যাবে। ভালো থেকো।
জুবায়ের আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত বেরিয়ে গেলো। অধরা শুয়ে ছিল ও যেতেই উঠে বসলো। শাশুড়ি মায়ের দেওয়া ধাঁধার মানে বের করতে হবে। বারবার কাগজ দেখা বিপদ ভেবে লাইনগুলো মনে রেখেছিল। আধরা ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দহীন ভাবে উচ্চারণ করলো,
“বধির বোবা বলবে বাক্য ঝরবে তখন লাল র*ক্ত। ঊষা কালে খুঁলবে দুয়ার শান্ত হবে তিমির দুয়ার”।
প্রশ্ন জাগলো, বধির বোবা এই বাড়িতে ওর পাঁচটা ননদ আছে ওদেরকে মিন করে লেখা নাতো? এমতো হতে পারে এই বোবো মেয়েগুলো যখন কথা বলবে তখন অন্য কারো রক্ত ঝরবে? আর ঊষাকাল বলতে ভোরবেলা বুঝিয়েছে। অধরা লাফিয়ে উঠলো। ধাঁধার মানে সবটা না বুঝলেও শেষেই লাইনটা বুঝেছে। এই বাড়ির দরজা ভোরবেলায় খোঁলা থাকে যখন সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। মানে শাশুড়িমা ওকে এই বাড়ি থেকে পালানোর রাস্তা বলে গেছে। প্রথম লাইনটার মানে খুব জটিল। যারা জন্ম থেকে বোবা তাঁরা কিভাবে কথা বলবে? যদিওবা বলে তবে রক্ত কেনো ঝরবে? অধরা আর ভাবতে পারলো না। কাপড়ের ভাজে রাখা পুটলিটা বের করতে হলে সিসি ক্যামেরাটা বন্ধ করা জরুরি। কিভাবে সম্ভব কথাটা ভেবে ও ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এলোমেলো ভেবে উঠে বসলো। চুপচাপ পড়ে থাকা মতো মেয়ে ও না। এলোমেলো কিছু ভেবে দ্রুত গোসল করতে বাথরুম চলে গেলো। গোসল শেষ করে টাওয়েল জড়িয়ে বেরিয়ে আসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসলো। আজ ও খানেই চেঞ্জ করবে। পোশাক কয়েকটা বেশি এনেছে সেটা রাখার উত্তম জায়গা হিসেবে ড্রেসিং টেবিলের উপরে ঝুলিয়ে দিয়ে দ্রুত নিচে বসে পড়লো। তাড়াতাড়ি লাল পুটলিটা বের করে দেখে নিলো। সেখানে বেশ কিছু টাকা একটা লকেট দেওয়া চেইন। তাঁতে সুন্দর করে খোঁদাই করা কহিনুর। এক পাশে রাখা আছে ওর পাসপোর্ট। শাশুড়ি আম্মা যে আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিল বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। অধরার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। বারবার ধরা পড়ার ভয় করছে। ও আর বাকীটা দেখতে পারলো না। দ্রুত সেটা লুকিয়ে উঠে দাড়ালো। বাইরে থেকে ঠকঠক আওয়াজ আসছে। ওর দেরী দেখে জুবায়ের ভেতরে এসে ভ্রু কুচকে ফেলল। টাওয়েল পরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে দেখে ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এতক্ষণ লাগে কারো ড্রেস পরতে? তাছাড়া বাথরুম রেখে এখানে কেনো ড্রেস রাখতে হবে। জুবায়ের অফিসে ছিল। গাড়ি নিয়ে ছুটে এসেছে। আয়নার মধ্যে ক্যামেরা আছে মেয়েটা কোনরকম ঠিক পেয়েছে কি বুঝতে পারছে না। অধরা নিজের মতো লোশন নিয়ে হাত পায়ে ম্যাসাজ করতে ব্যস্ত। বুঝতে পেরেছে জুবায়ের ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অধরার ভয় করছে কিন্তু যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হঠাৎ পাশ ফিরে চমকে উঠার ছলে নিজেকে দুহাতে আবৃত করে বলল,
> আপনি হুট করে চলে আসলে কেনো? আমি চেঞ্জ করবো তো।
জুবায়ের কথা বলল না। দ্রুত ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে ড্রেসগুলো এর মুখের উপরে ছুড়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> এধরনের কাজকর্ম আমি পছন্দ করি না। দ্বিতীয়বার যেনো না দেখি। দ্রুত চেঞ্জ করে আসো খেতে হবে।
জুবায়ের ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। মেয়েটা যথেষ্ট চালাক বুঝতে ওর বাকী নেই কিন্তু ও কি করতে চাইছে বোঝতে পারছে না।আর গতকাল মায়ের সঙ্গে ওর কি নিয়ে কথা হয়েছে জানা দরকার। না জানা পযর্ন্ত শান্ত হওয়া মুশকিল। এর মধ্যেই কাজের মেয়েটা খাবার দিয়ে গেলো। অধরা বাইরে আসতেই জুবায়ের চুপচাপ ওকে খেতে দিয়ে বের হলো। অধরা চুপচাপ খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এই বাড়িতে ওর কোনো কাজ নেই। এতদিন শাশুড়ি সঙ্গে ছিল। একাকিত্ব অনুভব হয়নি। আজ হচ্ছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। সারাদিন ধরে ঘুমিয়ে বসে দিন পার করলো। জুবায়ের আর আসেনি। সন্ধ্যার পরে ওর ঘুম ভাঙলো। চুপচাপ ফ্রেস হয়ে বাইরে উঁকি দিলো। ননদগুলোর সঙ্গে কথা বলবে ভেবে বাইরে আসতেই সিঁড়িতে কাজের মেয়েটা ওকে বাঁধা দিয়ে বলল,
> আপনার বাইরে যাওয়া নিষেধ। চলুন ঘরে যায়।
অধরার কথা মেয়েটা শুনলো না। এক প্রকার জোরজবরদস্তি করে রুমে এনে রেখে গেলো। কি অদ্ভুত।ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। বাড়ির সকলের সঙ্গে মেলামেশা না করলে বুঝতে কিভাবে কার মনে কি চলছে।
☆☆☆☆☆☆
নিস্তব্ধ হলরুম চারদিকে অবছা অন্ধকার। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে অধরা। খুব সাবধানে নামতে হচ্ছে। বিস্তির্ণ হলরুমে কয়েকজন মানুষের চাপা কান্নার আওয়াজ হচ্ছে। অধরা দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসলো। এতক্ষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলেও সামান্য আলোর ছিটা এসে সবটা পরিস্কার হয়েগেলো। অধরা চোখ বন্ধ করে খুঁলে একটা ঝটকা খেলো। সামনে ওর বাবা মা আর শাশুড়ি সেই সঙ্গে ওর শশুর মশাই বসে আছে। পায়ে লম্বা করে সিকল পরানো। তাদের শরীর থেকে র*ক্ত গড়িয়ে ফ্লোরে ছোটখাটো একটা স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। অসহায় ভাবে ওরা অধরার দিকে তাঁকিয়ে আছে। মনে হলো সবটা ওর মনের ভূল। সামনে থাকা তিনজন মারা গেছে কিন্তু ওর শশুর তো জীবিত। জীবিত লোক কিভাবে মৃত লোকদের সঙ্গে বন্দি থাকবে? অধরা ভাবতে পারলো না। রাতে ঘুমিয়েছিল হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। ফিসফিস আওয়াজ শুনে বাইরের চুপচাপ উঠে এসেছে। ওর ধ্যান ভাঙলো একটা আওয়াজ শুনে। বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, পালিয়ে যাও। অধরা কান ধরে বাবা মায়ের দিকে ছুটে আসলো। কিন্তু ছুতে পারলো না। সিঁকল টেনে কেউ একজন সবাইকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। অধরা চিৎকার করে জ্ঞান হারালো।
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৩
নিস্তব্ধ বাড়িতে চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। কয়েক জনের দৃষ্টি একজন লোকের দিকে। সেটা হলো জুবায়ের ফারুকী। লোকটা নিজের বাবাকে চিৎকার করে বলছে,
>ওই মেয়েটাকে স্পর্শ করতে আমার ঘৃণা লাগে ড্যাড। তুমি বুঝবে না এই একটা বছর আমি কিভাবে ওর সঙ্গে আছি। তোমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে আমার ভালোবাসাকে আমি ত্যাগ করেছি। মাকে হারিয়েছি। আমি এসব আর পারবো না। জুহিকে আমার এখুনি চাই। ওর ড্যাড ওর বিয়ে ঠিক করেছে। আমি মানতে পারছি না।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে হাতে থাকা গ্লাসটা ফ্লরে ছুড়ে দিতেই বিকট শব্দে কাচের টুকরো গুলো চারদিকে ছড়িয়ে গেলো। অধরা দোতালায় দাঁড়িয়ে আছে। গতকাল রাতে জ্ঞান হারানোর পরে সকালে জ্ঞান ফিরছে। রাতে দেখা ওটা স্বপ্ন কি বাস্তব এখন আর মনে পড়ছে না। পুরোপুরি রহস্য। এই বাড়িতে এই প্রথমবার উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ হচ্ছে। কি নিয়ে ঝগড়া বিষয়টা জানার জন্য ও বাইরে এসেছে। আজ দুদিন ধরে যা হচ্ছে তাঁতে এরকম কিছু হবে অস্বাভাবিক কিছু না তবুও কষ্ট হচ্ছে। প্রচণ্ড কষ্ট। লোকটা কত সুন্দর করে এতদিন ওর সঙ্গে অভিনয় করলো। আধরা বুঝতেই পারছে না এদের এই ঝামেলার মধ্যে ও কিভাবে জড়িয়ে পড়লো। জুবায়ের জুহি নামের মেয়েটাকে পছন্দ করে তাহলে ওকে বিয়ে না করে অধরাকে বিয়ে করেছিল কেনো? কহিনুরের জন্য কিন্তু সেতো জুহিকে বিয়ে করলেও হতো। কি এমন দরকার ছিল যার জন্য ওকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হলো? একদিকে রহস্যের মায়াজাল অন্যদিকে জুবায়েরের দেওয়া আঘাত। বিবাহিত স্ত্রীকে স্পর্শ করতে ওর ঘৃণা লাগে। এতদিন যা কিছু হয়েছে লোকটার নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ভাবতেই অধরার শরীর শিউরে উঠলো। নিজেকে ছোট লাগছে। শাশুড়ি মায়ের মুখটা এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে। উনি থাকলে এসব কিছুই হতো না। জুবায়েরর বাবা আরমান ফারুকীর কথা শুনে ওর ধ্যান ভাঙলো। লোকটা চাপা কন্ঠে বলল,
> উচ্চ শব্দে কথা বলতে মানা করেছিলাম। আজ পযর্ন্ত তোমার কোনো ইচ্ছা আমি অপূর্ণ রেখেছি? রাখিনি তো। আমি জুহির ড্যাডের সঙ্গে কথা বলবো। মাত্র দশটা মাস অপেক্ষা করো। ওই বাচ্চাটাকে পেয়ে গেলে সব আগের মতো হয়ে যাবে। তুমি জুহিকে নিয়ে হ্যাপি থাকবে। আর আমিও হ্যাপি।
জুবায়ের কিছু বললো না। ওর ছোট মা এগিয়ে এসে ছেলেটার হাত ধরে নরম সুরে বললেন,
> বাবা শান্ত রাখো নিজেকে। মম আছে তো সবটা ঠিকঠাক করে দিবে। বিশ্বাস করোনা নিজের মমকে?
জুবায়ের এই মহিলাকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছলো। দৃশ্যটা অধরার হজম হলো না। নিজের মা মারা গেছে তাঁতে লোকটার সামান্যতম দুঃখের ছিটেফোঁটা নেই অথচ গার্লফ্রেন্ডের জন্য সৎ মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কিন্তু কেনো? মেয়েরা সৎ মাকে সহজে মেনে নিতে পারলেও ছেলেরা নিতে পারেনা। মনে হচ্ছে এই মহিলাটাই জুবায়েরের আসল মা। বিষয়টা ভেবে ও কান্না ভূলে গেলো। মনে হলো এটাই ঠিক। এতদিন আরমান ফারুকী বাড়িতে আসতেন না।যখন প্রথম স্ত্রী মারা গেলো ঠিক তখনই বাড়িতে আসলেন দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে। এই পরিবারটাতে জুবায়ের প্রথম মায়ের কোনো ভূমিকা ছিল না। এই ছেলেমেয়ে সবটা এই মহিলার। তাঁর জন্য এদের কোনো দুঃখ হচ্ছে না। তাই জন্য ভদ্রমহিলা ওকে মৃত্যুর আগে এভাবে সাহায্য করতে চেয়েছে। বিষয়টা ভেবে ও দ্রুত রুমে চলে গেলো। চারদিকে শুধু রহস্য আর রহস্যর গন্ধ। মাথা আউলে যাচ্ছে। হঠাৎ জুহির কথা ভেবেই ও মেজাজ খারাপ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জুবায়ের ভেতরে প্রবেশ করলো। অধরা শুধু লোকটার মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকলো। জুবায়ের চুপচাপ ওর পাশে বসে হাতটা ওর কপালে রাখতে যেতেই অধরা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
> প্লিজ স্পর্শ করবেন না।
জুবায়ের ভ্র কুচকে বলল
> কেনো?
> আপনার ছোঁয়া আমার কাছে বিষাক্ত লাগেছে। আমি চাইনা আপনার কখনও আর আমাকে স্পর্শ করেন। তাছাড়া গতকাল আপনি নিজেই বলেছেন আমাকে আর স্পর্শ করবেন না।
জুবায়ের থতমত খেয়ে বসে আছে। ভাবলো বাইরের চেচামেচি কি মেয়েটা শুনতে পেয়েছে? মাথায় ছিল না তখন রাগের জন্য কি না কি বলেছে। এখন আফসোস করতে হচ্ছে। জুবায়ের চোখ বন্ধ করে ভাবলো মেয়েটা কতটুকু জানে ওর বিষয়ে? বুঝতে হবে। ও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
> কেনো এতদিন তো ঠিকই ছিল। শুনো ঝামেলা করোনা। চুপচাপ দেখতে দাও। গতকাল তোমার অনেক জ্বর ছিল। জ্বরের ঘোরে বাইরে চলে গিয়েছিলে। আমি উঠিয়ে এনেছি। মেয়েদের জন্য জিদ মানানসই না।
অধরা চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। ওকে ঠকানো হয়েছে। স্বামী নামক লোকটা ওকে শুধু মাত্র ব্যবহার করেছে তাও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এর চাইতে লজ্জার একজন নারীর কাছে কিবা হতে পারে। রাগে ক্ষোভে অধরার শরীর কাঁপছে চোখে পানি চলে এলো। নিজেকে আজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
> একদম নাটক করবেন না। বংশধর চাই সেই জন্যই আমাকে বিয়ে করেছেন তাই না? সুলতান জুবায়ের ফারুকী আপনার বা আপনার বাবার কোনো পরিকল্পনা আমি সফল হতে দিব না। আমার জীবন থাকতে তো না।
আধর থরথর করে কাঁপছে। জুবায়ের বুঝে গেলো মেয়েটা সব শুনেছে। এখন আর লুকিয়ে কোনো লাভ হবে না। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
> অনেক কিছুই জানো দেখি। ভালো হয়েছে আর লুকিয়ে রাখতে হবে না। আর কি জেনো বলছিলে? শুনো স্ত্রীদের কাজ হচ্ছে বংশধর দেওয়া আর স্বামীর মনোরঞ্জন করা। আমি তো তোমার কাছে শুধু এটাই চেয়েছি। আমার বিশাল এই ঐশ্বর্য ভোগ করছো তুমি । না চাইতে দামি দামি গহনা পোশাক পাচ্ছো এটা তো এমনি এমনি না। জুবায়ের ফারুকী ব্যবসায়ী মানুষ। কিভাবে নিজের আখের গোছাতে হয় ভালোভাবে জানে।
অধরা জ্বলে উঠলো লোকটার কথা শুনে। ওর সামনে থাকা এই মানুষটা পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট মানব বলে মনে হচ্ছে। ঝাঝালো কন্ঠে উত্তর দিলো,
> এই মূহুর্ত থেকে আপনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যান। কখনও আপনার মুখ যেনো আমাকে দেখতে না হয়। ছিঃ আপনি সত্যিই মানুষ না। হৃদয়হীন পাষাণ। কিভাবে পারলেন একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে। মুক্তি দিন আমাকে। আমি চাইনা আপনার ধন সম্পদ আর ঐতিহ্য।
জুবায়ের চোখ বন্ধ করলো। কি একটা ভেবে খুব শান্ত হয়ে বলল,
> দশটা মাস সময় দাও আমি তোমাকে মুক্তি দিব। এই বাচ্চাটা আমাদের খুব দরকার। আচ্ছা আমার মতো ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকাটা কি খুব অবাক হওয়ার মতো কঠিন কাজ? যুবক ছেলেদের গার্লফ্রেন্ড থাকতে নেই? আমি কি জানতাম তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে! জুহিকে ভালোবাসতাম। বাবা ওকে মানেনি। বরং কন্ডিশন চাপিয়ে দিলো তোমাকে বিয়ে করতে হবে আর যত তাড়াতাড়ি তোমার বেবি হবে তত তাড়াতাড়ি আমি তোমার থেকে মুক্তি পাবো। বাচ্চাটা পেয়ে গেলে তোমার মুক্তি হবে সঙ্গে আমারও।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। বোঝালো সে নিজেও ভুক্তভোগী। কিন্তু অধরা মানতে পারলো না। একটা বাচ্চার জন্য ওকে এই বাড়ির বউ করে আনা হয়েছিল। এই বাচ্চাটার মধ্যে কি আছে? এরা এতটা মরিয়া কেনো? অধরা কুটিল হাসলো। প্রাণ থাকতে ও এই বাচ্চাটা ও এদের হাতে দিবে না। যতদিন বাচ্চাটা না হচ্ছে এরা ওর কোনো ক্ষতি করবে না। অধরা পালাবে। সুযোগ পেলেই পালাবে। পালানোর রাস্তা আর দরকারি জিনিসপত্র সবটা হাতের মুঠোয়। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। শাশুড়ি মায়ের রহস্যটা জানা দরকার। কথাগুলো ভেবে ও উত্তর দিলো,
> বুঝলাম। এতোটাই ভালোবাসেন জুহিকে?যে নিজের মায়ের মৃত্যুতে আপনার কষ্ট হয়নি কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের বিয়ের খবর শুনে আপনার কষ্ট হচ্ছে? মায়ের সঙ্গে যে বেইমানি করতে পারে সে স্ত্রীর সঙ্গে করবে তাতে সন্দেহ কিসের? এটা আপনার সঙ্গে মানানসই।
জুবায়ের এবার জ্বলে উঠলো। মেয়েটা না জেনে কথা বলছে। ওর ইচ্ছা হলো ঠাটিয়ে দুটো থাপ্পড় দিতে কিন্তু দিতে পারলো না।। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> আজেবাজে কথা বলবে না। যিনি মারা গেছেন উনি আমার নিজের মা ছিলেন না তবুও আমি উনাকে যথেষ্ট ভালোবাসি শ্রদ্ধা করি। বাড়িতে যিনি আছেন উনি আমার মা।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। যাকে এতদিন নিজের শাশুড়ি ভেবে আসছিল সে আসলে ওর শাশুড়ি না। কিন্তু কে উনি? আর এতদিন এসব ওর থেকে গোপন রাখা হয়েছিল আরও কতো সত্যি আছে এই বাড়িতে? অধরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
> উনি কে ছিলেন? আপনার বাবার সঙ্গে উনার কি সম্পর্ক? আর আপনার বোনেরা ওরা কে?
> বাবারা ছিলেন জমজ দুই ভাই।মারা গেছেন উনি আমার চাচিমা ছিলেন। এই বাড়ি আর অর্থসম্পদ সব আমার চাচার ছিল। চাচার মৃত্যু হয়েছিল হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনাতে। পরে চাচির দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন বাবা। যেহেতু বাবা দেখতে চাচার মতোই ছিল তাই সকলে ভাবতো চাচা বেঁচে আছেন। চাচি তো ঘরবন্দি ছিলেন। বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। বাংলাদেশের থেকে একদম খালি হতে এসেছিলেন। তবে বাবা কখনও দরকার ছাড়া এই বাড়িতে আসতেন না। সম্পত্তি চাচির নামে ছিল। উনার কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। বাবার আমার মায়ের সঙ্গে বিয়ে হলো। যদিও আগে থেকে তাঁরা পরিচিত। আমাদের সব ভাইবোনদের বাবা চাচিমায়ের হাতে তুলে দিলেন। কাগজে কলমে সবটা আমাদের নামে করিয়ে নিলেন। চাচিমাও আমাদের নিজের সন্তানের মতো লালনপানল করেছেন। যাইহোক অনেক জেনে ফেলেছো আর বলতে পারবো না। আপাতত ক্ষমা দাও আর চুপচাপ খাওয়া খেয়ে নাও। প্রমিজ বাচ্চাটা আসলে তোমাকে আর আটকে রাখবো না।
জুবায়ের একদমে নিজের বাবা মায়ের ইতিহাস বর্ণনা করে ফেলল। অধরা চোখ বন্ধ করে বুঝে নিলো এদের বিষয়টা। জুবায়েরকে ওর একদম পছন্দ হচ্ছে না। স্বার্থপর মানুষ একটা। বাচ্চার জন্য কতটা জঘন্য একটা কাজ করেছে তবুও মনে কোনো অনুতাপ নেই। এই লোকটাকে ও ভয়ানক শাস্তি দিবে। গতকাল রাতের দেখা দৃশ্যটার মানে ও এতক্ষণে বুঝতে পারলো। মনে হলো এদের সবাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়নি তো?
☆☆☆☆☆☆
সকালে জুবায়ের বাসা থেকে বেরিয়েছে আর ফিরে আসেনি। বিকেল হতে চলেছে।আজকে হয়তো আসবেও না। জুহির সঙ্গে থাকবেন। এখানে বউ গার্লফ্রেন্ড এসব ডাল ভাতের মতো। একজন ছেলের একাধিক গার্লফ্রেন্ড থাকাটা মনে হয় ফ্যাশান।এতো এতো কাহিনি জানার পরে ও মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। শাশুড়ি মা বলে যাকে জেনে এসেছে তাঁকেই ও শাশুড়ি বলে মানে। জুবায়ের ঠিক নিজের মায়ের মতো। এই বয়সে এসেও ভদ্রমহিলা বাচ্চাদের ড্রেস পরে ঘুরাঘুরি করে। মেয়েগুলোও তাই। কথা বলতে জানলে এরা কি যে করতো আল্লাহ্ ভালো জানেন। হঠাৎ ওর সেই ধাঁধার কথা মনে পড়লো। অধরা চুপচাপ বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা অনাকাঙ্খিত দৃশ্য ওর চোখে পড়লো। বাড়ির গেটের সামনে জুবায়ের এক মেয়ের সঙ্গে গভীর চুম্বনে লিপ্ত। আশেপাশে লোকজন আছে ওরা যেনো ভূলে গেছে। অধরার চোখ ছলছল করে উঠলো। জুবায়েরকে ও ঘৃণা করে তবুও লোকটা ওর স্বামী। ওর গা গুলিয়ে আসলো। দ্রুত বাথরুমে গিয়ে বমি করে দিলো। কয়েকবার বমির পরে শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো।। শরীর হঠাৎ করেই দুর্বল হতে শুরু করেছে। ঘুম হচ্ছে ক্ষুধা বেড়েছে। মাতৃত্বকালিন সমস্যা গুলো দেখা দিচ্ছে। অধরা বাথরুম থেকে বাইরে এসে দেখতে পেলে একজন কাজের মেয়ে ফল কাঁটছে। অধরা দ্রুত মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল,
> আপনি চলে জান আমি কাটতে পারবো।
> স্যারের হুকুম না মানলে শাস্তি আছে ম্যাম।
অধরা কিছু একটা ভেবে পাশে বসে পড়লো। এক টুকরো আপেল মুখে পুরে নিয়ে বলল,
> ও আচ্ছা। আমি পানি খেতে চাই!আনতে পারবে নাকি আমি যবো?
> না না ম্যাম আমি যাচ্ছি।
মেয়েটা দ্রুত উঠে গেলো। অধরা অপেক্ষা করলো না। আয়নার দিকে পেছন ঘুরে ছিল তাই ফল কাটার ছুরিটা দ্রুত নিজের কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফেলল। এটাইতো দরকার ওর। এটা দিয়ে ও জুবায়েরকে খু*ন করে নিজেও সুইসাইড করবে। কহিনুর বলে এই পৃথিবীতে কোনো মেয়ের জন্ম নিবে না। পাপের দুনিয়ায় প্রবেশ করে নিজের মায়ের মতো ভূল কখনও সে করবে না। অধরা নিজের পেটে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলল,” মাম্মাকে ক্ষমা করে দিস মা। জুবায়ের জুহিকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল। মায়ের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য বাড়িতে এনেছে কিন্তু বাবার ধমক শুনে ওকে একা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে। ও বাবা চেয়েছে এই দশটা মাস ও যেনো অধরার পাশাপাশি থাকে। জুবায়ের মুখ থমথমে করে জুহিকে এগিয়ে দিয়ে অধরার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। কেনো জানি মেয়েটার সামনে ওর যেতে ইচ্ছা করছে না। অধরা অধীর অগ্রহে বসে আছে। কাছে আছে চকচকে খঞ্জর। সামনে পেলেই লোকটার বুকে ও এটা বসিয়ে দিবে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে সুলতান জুবায়ের ফারুকী। অধরা নয়ন ভরে দেখবে সেই মৃ*ত্যু।
(চলবে )
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:৪
দরজা খোলার শব্দ শুনে অধরার হাত কেঁপে উঠলো। ভয় পাচ্ছে। খু*ন করবে বললেই তো হয়না সাহসের দরকার হয়। তবুও চেষ্টার ত্রুটি করবে না অধরা। খঞ্জরটা শক্ত করে চেপে ধরে বসে থাকলো। বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙুল সামান্য কেটেও গেলো। জ্বলছে সেই সঙ্গে তরল কিছু গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে। পেটের বাম দিকে চিনচিন করে ব্যাথা করছে। জুবায়ের রুমে ঢুকলো তবে একা না সঙ্গে এক কাজের মেয়েকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা পানি আর কিছু খাবার নিয়ে দাড়ালো। অধরার হাসি পেলো এদের ব্যবহার দেখে। আদর যত্ন করে এরা ওকে বলি দিতে চাইছে। জুবায়ের থমথমে মুখে আশেপাশে তাঁকিয়ে বলল,
> খেতে হবে। তুমি খেতে পারবে নাকি আমি সাহায্য করবো?
অধরা নাক মুখ কুচকে ফেলল। কিছুক্ষণ আগের দৃশ্যটা ওর চোখের সামনে ভাসছে। সেই সঙ্গে লোকটার উপরে ওর ঘৃণা কাজ করছে। অধরা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
> দরকার হবে না। জুবায়ের ফারুকীর হাতের খাবার আমার কাছে বিষ সমতুল্য। এই ঘরে আপনি না আসলে আমি খুশী হবো। ল*ম্প*ট চরিত্র*হীন খু*নি আপনাকে আমি ঘৃণা করি।
অধরা হাতের খঞ্জরটা আরও জোরে চেপে ধরলো। এই মূহুর্ত্তে লোকটার বুকে বসিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো কিন্তু তাঁতে কি হবে? লোকটা মরবে না। অধরা ওর শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে নিজের অবস্থা আরও নড়বড়ে করে ফেলবে। আপাতত খু*নের পরিকল্পনা বাদ দিতে হচ্ছে। জুবায়ের ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। ওর কপালে ভাজা পড়েছে। এই মেয়েটাকে যতবার ছুঁয়ে দিয়েছে ততবার মেয়েটা লজ্জায় কুকড়ে গেছে। মাথা তুলে তাঁকানোর সাহস হয়নি। সব সময় মাথা নিচু করে ওষ্ঠে হাসি রেখেছে কিন্তু আজ এর কোন রূপ এটা? আজকের মেয়েটার সঙ্গে তো জুবায়েরের পরিচয় নেই। একদম আলাদা একজন মানবী। জুবায়েরকে চুপচাপ দেখে অধরা আরও জ্বলে উঠলো। ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
> আমি কোনো লম্পটের মুখ দর্শন করতে চাইনা জুবায়ের। আপনি এখুনি বের হয়ে জান। আপনাকে দেখলে আমার ঘৃণা করে শুনছেন?
জুবায়ের বিরক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে অধরাকে নিজের সঙ্গে চেপে ধরে বলল,
> তোমাকে স্পর্শ করেছি এবার কি করবে? নিজেকে মারবে নাকি আমাকে?
জুবায়ের কথাটা বলে ওকে এক হাতে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতটা অধরার বাম হাতের কব্জি ধরে সামনে তুলে ধরলো। অধরা আগেই খঞ্জর কাপরে মধ্যে ছেড়ে দিয়েছিল। জুবায়ের ওটা পেলো না কিন্তু অধরার কাটা হাতটা দেখতে পেলো। পাশের মেয়েটা এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের মেয়েটাকে যেতে বলে অধরাকে জোর করে বসিয়ে দিলো। হাতের রক্তটা নিজের হাতে মেখে নিয়ে বলল,
> তুমি মারবে না অধরা। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো। জানি মৃত্যুতে কারো হাত থাকে না তবুও মন বলছে যতদিন কহিনুর তোমার মধ্যে থাকবে ততদিন তোমার মৃত্যু হবে না। যদি ভেবে থাকো সুইসাইড করবে তবে ভূল করছো। তোমাকে ঘিরে আছে অদৃশ্য মায়াজাল। তুমি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছো। এভাবে মুক্তির আশা করা বোকামি। চুপচাপ খাওয়া দাওয়া করো। সুস্থ থাকো ও আসলে তোমাকে ছেড়ে দিব।
অধরা এক ঝটকায় নিজের হাতটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল,
> আপনি আমার রুম থেকে বেরিয়ে গেলে খুশী হবো। নিজের খেয়াল রাখতে আমি পারি। জুতা মেরে গরু দান আমার পছন্দ না। অধরা তিল পরিমাণ আঘাত পেলে পাহাড় পরিমাণ ফিরিয়ে দিতে জানে। আমার চোখের প্রতিটা ফোঁটা পানির মূল্য আমি উসুল করে নিবো।
> জিদ করোনা। তুমি কখন থেকে আমাকে নোংরা নোংরা কথা শুনিয়ে যাচ্ছো। আজ পযর্ন্ত তোমাকে আমি কোনো কিছুর জন্য জোরজবরদস্তি করেছি বলো? গায়ে হাত পযর্ন্ত তুলিনি। এখানে অহরহ বিয়ে ডিভোর্স বেবী এসব হয়ে থাকে। এসবে আমি খারাপ কিছু দেখছি না। জুহির আরেকজন বয়ফ্রেন্ড ছিল। আমি জানি তবুও আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি।
> আপনি আর আপনার জুহি দুজনের চরিত্র হচ্ছে ফুলের মতো পবিত্র। আপনাদের চরিত্র তো সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাঙ্গালী বাবা মায়ের রক্ত বইছে। দেশে জন্ম হয়নি তো তাঁতে কি আমার বাবা মা আপনার বাবা মায়ের মতো অমানুষ না। আমাকে ভালো শিক্ষা দিয়েছেন। আপনার মতো ঘরে বউ রেখে বাইরের মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে না।
অধরা অপেক্ষা করলো না। ধাক্কা দিয়ে জুবায়েরকে পিছিয়ে দিলো। ছেলটা পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো। বাবার হুকুমে এতক্ষণ নিজকে শান্ত রাখতে পারলেও এখন আর পারলো না। ছুটে গিয়ে অধরার কাটা হাতটা এক হাতে চেপে ধরে আরেক হাতে ওর মুখটা চেপে ধরে বলল,
> খুব তেজ হয়েছে না? ভেবেছিলাম দূরে থাকবো কিন্তু না। আজ থেকে আমি তোর সঙ্গেই থাকবো। আমার এই দুহাত হাত অবাধে ঘোরাঘুরি করে তোর শরীর পারলে বাঁধা দিস। খুব ঘৃণা করিস না? এটাই হবে তোর শাস্তি।
অধরার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। জুবায়ের ওর গাল ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। ড্রয়ার থেকে ওষুধ বের করে অধরার হাতটা ব্যান্ডেজ করে বেরিয়ে গেলো। অধরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। রাগে দুঃখে আর অপমানে নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে। পাশে পড়ে থাকা খঞ্জরটা তুলে নিয়ে নিজের পেটে চালিয়ে দিতে গেলো কিন্তু হলো না। অদৃশ্য বাধা পেলে। একবার দুবার করে বহুবার করলো না হলো না। কেউ ওকে থামিয়ে দিচ্ছে। মূহুর্ত্তে অধরার কান্না থেমে গেলো। এমন কেনো হচ্ছে? কেউ বাঁধা দিচ্ছে কিন্তু কেনো আর কে?মনে হলো জ্বীন ভূতের খপ্পরে পড়েনি তো? অধরার কৌতূহল আরও বৃদ্ধি পেলো। ভাবলো শুধু শুধু জুবায়েরের সঙ্গে আর ঝামেলা করবে না। স্বামী নামের লোকটাকে আজ থেকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে রহস্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করবে। সত্যিটা জেনে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। জুবায়ের নিজের ধ্বংস নিজে ডেকেছে এখানে ওর কিছু বলার নেই। কথাগুলো ভেবে ও ছুরিটা দিয়ে খপ করে হাতের বাঁধনটা কেটে ফেলল। বেইমানের ছোঁয়া ওর পছন্দ হচ্ছে না। নিজের মতো ওষুধ লাগিয়ে নিয়ে বিছানা ঠিকঠাক করে ফেলল। চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লো। শরীর প্রচণ্ড খারাপ লাগছে। এতক্ষণ শুধু মনের জোরে দাঁড়িয়ে থাকলেও আর হচ্ছে না। ক্লান্তিতে চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসলো।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆
আকাশ থেকে নেমে আসা এক টুকরো চাঁদ অধরার কোলে নেমে আসছে। সোনালী কেশ চোখগুলো হালকা বাদামি আর গায়ের রঙ উজ্জল ফর্সা। গোলাকার মুখোমন্ডল। অধরা কোলে থাকা ছোট্ট বাচ্চাটাক হুহাতে আকড়ে ধরে কপালে ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরলো।ওর চোখে পানি কিন্তু ঠোঁটে লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। অধরা বেশ কয়েকবার মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে উচ্চারণ করলো, কহিনুর আমার কহিনুর। অধরার খুশী বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না কেউ একজন ঝট করে বাচ্চাটাকে নিজের কাছে কেঁড়ে নিলো। অধরা দ্রুত চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়লো। ভালো করে দেখলো এই লোকটা আর কেউ ওর নিজের স্বামী। জুবায়ের মেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। পাশে আছে ওর বাবা মা বোনেরা সবাই। জুবায়েরের বাবা পাশ থেকে একটা ধারালো খঞ্জর ছুড়ে দিয়ে বললেন
> মেরে ফেল ওকে। ওর র*ক্ত দিয়ে মিটে যাবে হাজার বছরের অভিশাপ।
জুবায়ের কাঁপা হাতে ছুরিটা লুফে নিলো। অধরার চোখে পানি। ও অনবরত চিৎকার করছে। বারবার দোহায় দিচ্ছে। নিজের বাচ্চার প্রাণ জুবায়ের নিজে হাতে নিচ্ছে। ধর্মে সইবে না। আল্লাহ্ ঠিক বিচার করবে। জুবায়ের ওর কথায় কান দিলো না। বাচ্চাটাকে সামনে রেখে খঞ্জর শক্ত করে ধরে একটু একটু করে বিধতে গেলো মেয়েটার বুকে কিন্তু পারলো না। হাত কাঁপছে। বারবার অধরার দিকে আর বাচ্চার দিকে তাঁকিয়ে কিছু ভাবছে। শেষ রক্ষা হলো না। পাশ থেকে আরমান ফারুকী ওর হাত থেকে খঞ্জরটা কেড়ে নিয়ে নিজেই হাত চালাতে গেলো। অধরা ছুটে গিয়ে ছুরিটা কেড়ে নিতে চাইলো কিন্তু সেটা বিধলো ওর কোমরে। মূহুর্তে চোখ ঘোলা হয়ে উঠলো। পাশে থাকা ওর সদ্য জন্মানো শিশুর চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো। জুবায়ের হতভম্ব হয়ে দেখলো সবটা। আরমান ফারুকী ছুরিটা বের করে আধরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আবারও বাচ্চা মেয়েটাকে এটাক করতে চাইলো তবে এবারও ব্যার্থ পারলো না। সামনে দাঁড়ালো উনার নিজের ছেলে। ছুরিটা দ্বিতীয়বার বিধেছে জুবায়েরের বুকে। আরমান ফারুকী দ্রুত ছুরি ছেড়ে দিয়ে ছেলের মুখটা দুহাতে আঁকড়ে নিয়ে বললেন,
> এটা কি করলে তুমি? এতদিন যার জন্য অপেক্ষা করলাম তুমি সেটা হতে দিলে না। বিষাক্ত খঞ্জরের আঘাতে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত। কেনো করলে বলো?
জুবায়ের বাবার হাতটা ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে দুহাতে আকড়ে নিয়ে বলল,
> আমি পৃথিবীর সব চাইতে নিকৃষ্ট স্বামী হতে পারি কিন্তু এই পুতুলের মতো মেয়েটার নিকৃষ্ট বাবা হতে পারিনি ড্যাড। ক্ষমা করে দিও। ওকে তুমি পাবে না। আমি জানি আমার মৃত্যু নিশ্চিত কিন্তু আমার কহিনুরের না। সরি ড্যাড।
জুবায়ের আর সুযোগ দিলো না লাফিয়ে পড়লো পাহাড়ের চূড়া থেকে। অধরা জুবায়ের বলে চিৎকার করে উঠলো। শরীরে মৃদু মৃদু কম্পন হচ্ছে। হুট করে ঘুম ভেঙে গেলো। শীতের মধ্যেও শরীর ঘেমেঘেটে একাকার অবস্থা। কি ভয়ংকর স্বপ্ন। অধরা চোখ খুঁলে ঝটকা খেলো। ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে এক সুন্দরী রমনী। রমনীর ওষ্ঠে অমায়িক হাসি। মেয়েটাকে চিনতে ওর অসুবিধা হয়নি। ওর ননদ মারিয়া ফারুকী। অধরা মনে মনে ভাবলো এরা সবাই ওকে ঝটকা দিয়ে মেরে ফেলবে। স্বপ্নে পযর্ন্ত ছাড় দিচ্ছে না। আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখছে। জুবায়েরের মতো নিকৃষ্ট মানুষ যে গার্লফ্রেন্ডকে পাওয়ার জন্য বাবার শর্ত মেনে বিয়ে করে সে কিভাবে নিজের জীবন দিবে তাও অধরার মেয়ের জন্য। স্বপ্ন দেখানো শয়তানের কাজকর্ম বড্ড বেশি ফালতু। অধরা বিরক্ত হলো শয়তানের উপরে। এসব ভেবে উঠে বসলো। প্রথমবার ননদকে নিজের রুমে দেখে ঝটকা একটু বেশি লেগেছে। মেয়েটা যত্ন নিয়ে ফলের থালা নিয়ে বসে আছে ওর পাশে। ওর দিকে ইশারা করলো বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসতে। জুবায়ের বাড়িতে আসেনি। দেয়াল ঘড়িতে সময় দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট। মানে মধ্যরাত। মেয়েটা এতো রাতে ওকে খাওয়াতে এসেছে কিন্তু কেনো? অধরা কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলো,
> বলির পাঠাকে খাতির যত্ন করে মোটাতাজা করছেন? এতো রাতে কষ্ট করে আসলেন কিন্তু আমার ক্ষুধা পাইনি।
অধরার কথা মেয়েটা শুনলো কি বোঝা গেলো না।তবে শুধু মলিন হেসে অধরার হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে তাগিদ দিলো ফ্রেস হওয়ার জন্য। অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দ্রুত উঠে গেলো। ক্ষুধা যে পাইনি এমন না। পেটে রীতিমতো ইদুর দৌড়াচ্ছে। অধরা সময় নষ্ট করলো না। খেয়ে নিলো। মারিয়া ওর হাতটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে নীরবে ওষুধ লাগিয়ে পূনরায় ব্যান্ডেজ করিয়ে দিলো। বিছানা ঠিকঠাক করে চলে গেলো। অধরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। মেয়েটা যদি কথা বলতে পারতো কত ভালোই না হতো। নিজের কষ্ট গুলো শোনানোর মতো এই পৃথিবীতে ওর আপনার কেউ নেই। বাবা মাকে খুব মনে পড়ছে। তাঁরা কি বুঝতে পারছে তাদের আদরের মেয়েটা একদম ভালো নেই। একদম ভালো নেই। কয়েক ফোঁটা পানি অধরার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো।
ল্যাপটপে গভীর দৃষ্টি রেখে বসে আছে জুবায়ের। মেয়েটার প্রতি ওর সহানুভূতি জাগে তবে সেটা সাময়িক। বিয়েটা ওকে জোরজবরদস্তি করে করানো হয়েছে। নিজের উপরে জুলুম করে মেয়েটার সঙ্গে থেকেছে। স্বামীর দ্বায়ীত্ব পালন করেছে। ওর কি দোষ। ও নিজেও তো যন্ত্রণা পাচ্ছে। হুটকরে বিয়ে করিয়ে দিলো। জুহি ছাড়া কাউকে ও সহ্য করতে পারেনা। এই মেয়েটার জন্য ওর জুহিকে কাছে টানতে বিবেকে বাঁধে। জুহির সঙ্গে ওর ক্রমশ দুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে। যেটা ওর সহ্য হচ্ছে না। অধরা কাঁদছে জুবায়েরের দেখছে আর ভাবছে,এর চাইতে হাজারগুন দুঃখ জুবায়েরের হৃদয়কে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করছে। ও নিজে যেখানে ভালো নেই সেখানে পৃথিবীর কেউ ভালো থাকতে পারবে না। এই মেয়েটা না থাকলে ওর আর জুহির মিলনে কেউ বাঁধা হয়ে আসবে না। কতদিন সহ্য করতে হবে কে জানে। কথাগুলো ভেবে ও উঠে গেলো।
☆☆☆☆☆☆
ভোরবেলা নামাজ পড়ে বাইরে বের হলো অধরা। বাকীটা রাত ওর ঘুম হয়নি। শরীর পূর্বের চাইতে ভালো। মন খারাপ ছিল ভোরের সূর্যোদয় দেখে সেটা কেটে গেছে। আজ থেকে রহস্যের সমাধান করতে উঠেপড়ে লাগবে। শাশুড়ির রুমে আবারও যাবে। সেখানে হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। খুব আফসোস হলো নিজের কাছে একটা ফোন নেই ভেবে। থাকলে ভালো হতো। বন্ধু বান্ধবী অনেকেই আছে। তাঁদের থেকে সাহায্য নেওয়া যেতো। কথা গুলো ভেবে ও শাশুড়ির রুমের দরজা খুঁলে ভেতরে প্রবেশ করলো। সেদিনের পর থেকে এই রুমটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। অধরা ভেতরে পা দিয়ে চমকে উঠলো। মেঝেতে র*ক্তা*ক্ত মানুষের মাথার খু*লি পড়ে আছে। অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠলো অধরা। মনে প্রশ্ন জাগলো, এটা কার খু*লি?
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:৫
অধরা দু’পা পিছিয়ে গেলো। কক্ষের ভেতরটা কেমন গুমট আর ধুলাবালিতে পূর্ণ। দুদিন আগেও বেশ পরিস্কার ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কত বছর এখানে কেউ আসেনি। বাড়িতে এতগুলো কাজের লোক অথচ শাশুড়ির এই রুমটা নোংরা হয়ে আছে। তাছাড়া এখানে মানুষের খু*লি কিভাবে আসলো? অধরা ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। রুমের মধ্যে বৃত্ত এঁকে খুলিটা তার মধ্যে রাখা হয়েছে। ফোঁটা ফোঁটা র*ক্ত খুলির উপরে ছড়ানো। অধরা ভয় পাচ্ছে প্রচণ্ড। জীবনে প্রথমবার এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। এই বাড়িতে কোনো যাদু বিদ্যা বা কালো যাদু চর্চা হয় কি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অধরা দ্রুত সবটা পর্যবেক্ষণ করলো। ওয়াশরুমের ট্যাপ থেকে পানি পড়ছে। অধরা দ্রুত পানি বন্ধ করতে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলো ট্যাপ বন্ধ আছে। ও বেরিয়ে আসলো। চুপচাপ আলমারির ড্রয়ার চেক করে নিলো। সেখানে সন্দেহ হয় এমন কিছু খুঁজে পাওয়া গেলো না। সবগুলো কাপড় আর জুয়েলারি দিয়ে ভর্তি। অবশিষ্ট আছে বিছানার চাদর। অধরা বিছানা উল্টাপাল্টা করে দেখার সময় হঠাৎ ওর মনে হলো ওর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অধরার ঘাড়ে তাঁর উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে। অধরা জমে গেলো। পুরো শরীর ফ্রিজ হয়ে গেছে। মৃদু মৃদু পা কাঁপছে । পিছনে ঘুরে তাঁকানোর শক্তি নেই। আড়চোখে দেখার চেষ্টা করলো তাঁতে আবছা কারো আবয়ব দেখে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে ওটা কোনো মেয়ে আবার মনে হচ্ছে ছেলে। অধরা এবার দ্রুত পেছনে ফিরলো কিন্তু কক্ষ শূন্য কেউ নেই। অধরা আর অপেক্ষা করলো না দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। কি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ঢকঢক করে পানি গলাই ঢেলে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। গতকাল ঝামেলার পর থেকে জুবায়ের এই রুমে আর আসেনি। বিষয়টা খারাপ না মোটামুটি ভালো বলা চলে। সকাল দশটা বাঁজতে চলেছে অথচ এই রুমে এখনো খাবার আসেনি এমনটা আজকে নতুন। কেনো আসেনি ওর জানা নেই নাকি এরা ওকে খাবার না দিয়ে মারার চিন্তা করছে আল্লাহ্ ভালো জানে। কথাগুলো ভেবে ও আবারও বাইরে পা বাড়ালো। দোতলা থেকে নিচে তাঁকিয়ে চমকে উঠলো। আবারও সকলে সাদা পোশাক পরেছে নিশ্চয়ই কেউ মারা গেছে। কিন্তু কে?ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমের সোফায় শাশুড়ি শশুর আর ননদেরা চুপচাপ বসে আছে। কাজের মেয়েগুলো টেবিলে খাবার সাজাতে বাস্ত। একজন ভৃত্য খাবার নিয়ে উপরে উঠে আসছে। অধরা মেয়েটার আসার অপেক্ষা করলো। মেয়েটা ওর কাছাকাছি আসতেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
> আজ এতো লেট কেনো করলে? খাবার দিতে মানা করেছে?
মেয়েটার মুখে কোনো হাসি নেই। মুখটা স্বাভাবিক রেখে যেতে যেতে উত্তর দিলো,
> জুহি ম্যাম মামা গেছেন। বাড়িতে শোক চলছে। স্যার অসুস্থ।
কথাটা শুনে অধরার চোখ কপাল থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। জুহির মৃত্যু কিভাবে সম্ভব? আহারে জুবায়ের!ওর জন্য অধরার এবার কষ্ট হলো। ভাবলো যার জন্য এতকিছু করলো সেই থাকলো না। দুদিনের দুনিয়া তবুও মানুষ এমন কেনো করে বুঝি না। ভাগ্য বিধাতা কাউকে ছাড় দেননা এটা না বুঝেই মানুষ জঘন্য পাপ কাজে লিপ্ত হয়। কথাগুলো এলোমেলো ভেবে অধরার মনে প্রশ্ন জাগলো সুস্থ সবল মানুষ হঠাৎ মারা গেলো কীভাবে? কথাটা ভেবে ও প্রশ্ন করলো,
> হঠাৎ কি হয়েছিল জানো?
> মেবি খুন ম্যাম। গতকাল উনার বয়ফ্রেন্ডের বাসা থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সঙ্গে উনার বয়ফ্রেন্ড ছিল। সুইমিংপুলে গলা টিপে মারা হয়েছে। লাশ পানিতে ভাসছিল।
অধরা চোখ বড়বড় করে বলল,
> জুবায়ের ছাড়াও মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড ছিল? একজন মেয়ের একাধিক বয়ফেন্ড, জঘন্য বিষয়। আমার কি মনে হয় জানো? জেলাসি করে জুবায়ের ওদেরকে খু*ন করেছে। নয়তো হঠাৎ করে কে ওদেরকে খু*ন করবে বলো?
> সরি ম্যাম জুবায়ের স্যার রাতে বাড়িতে ছিলেন। আপনার পাশের রুমে। সকালে খবর শুনে উনারা গেছেন দেখতে। লা*শ দেখে স্যার অসুস্থ।
অধরা কিছু একটা ভেবে বলল,
> আচ্ছা তুমি কি এই বাড়িতে অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করেছো? যেমন ধরো ভূতুড়ে কিছু যেগুলো আমরা মুভিতে দেখি। আত্মা বা জ্বীন এসব?
মেয়েটা টেবিলে খাবার রাখছিল হঠাৎ ওর এধরনের প্রশ্ন শুনে চমকে গিয়ে বলল,
> না না ম্যাম এসব দেখিনি। আপনার মনের ভূল। আপনি খেয়ে নিন আমার যেতে হবে।
অধরা চামচ উঠিয়ে নিয়ে খাবার মুখে দিয়ে বলল,
> আমার জন্য এসব অখাদ্য কে আনতে বলেছে রুশি? তোমার স্যারকে বলবে আমি এসব খাবো না। ডিম না এনে তুমি নুডুলস আনবে। ফলের জুস আমি পছন্দ করছি না।
অধরার কন্ঠ দিয়ে একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়লো। ভ্রু কুচকে খাওয়া শেষ করলো। মনের মধ্যে ভয় থাকলেও কেনো জানি জুবায়েরের কথা ভেবে শান্তি লাগছে। লোকটার উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। তবে মেয়েটার মৃত্যু নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে। একজনের পাপের শাস্তি আরেকজন কেনো পাবে এটা ঠিক হলো না।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆
গত এক ঘন্টা জুবায়েরের নিথর শরীর বিছানায় লেপ্টে আছে,অজ্ঞান অবস্থায়। একদিকে বিশ্বাস ভেঙেছে অন্যদিকে প্রিয় মানুষের অকাল মৃত্যু। জুহি ওকে মিথ্যা বলেছিল। পূর্বের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ওর যোগাযোগ নেই বলেছিল কিন্তু এরকম না। বরং ওর থেকেও সেই ছেলেটার সঙ্গে জুহির বেশি ঘনিষ্ঠতা বেশি রয়েছে। ছেলেটার সঙ্গে জুহি প্রায় ওদের বাসাই যাওয়া আসা করতো। যেটা জানার পরে জুবায়ের হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। সেই সঙ্গে হতাশা। মেয়েটা ওকে কিভাবে ঠকাতে পারলো মাথায় আসছে না। এতো এতো ভালোবাসার পরেও মানুষ আবারও কিসের নেশায় আরেকজনের কাছে ছুটে যায় কে জানে। এসব বেঁচে থাকতে জানলে মেয়েটার কপালে দুঃখ ছিল। ঠকানো কাকে বলে থাপ্পড় দিয়ে শিখিয়ে দিতো। বারবার অধরার কথা মনে পড়েছে। জুবায়ের সেই দুঃখে জ্ঞান হারিয়েছে। দুঃখের থেকে রাগ আর অপমানবোধ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। অধরার সামনে দাঁড়ানোর মুখ নেই। মেয়েটাকে ঠকানোর জন্য হয়তো আল্লাহ্ ওকে এরকম শাস্তি দিয়েছে। ডাক্তার এসে দেখে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে ওর জ্ঞান ফিরবে। তবে আপাতত ঘুমানোর দরকার ভেবে ওষুধ দিয়ে গেছেন। মারিয়া ভাইয়ের পাশে মলিন মুখে বসে আছে। ভাইকে ও খুব ভালোবাসে। বোনদের মধ্যে মারিয়ার চেহারাটা বেশি মায়াবী। ছোট হওয়ার দরুন বাবা মা ভাই সবাই ওকে ভালোবাসে। কথা বলতে না পারলেও ওর একটা সিক্রেট বিষয় আছে যেটা শুধু জুবায়ের জানে আর কেউ জানেনা। না জানার কারণ আছে। এই বাড়ির পাঁচ মেয়ের মধ্যে ও জন্ম নিয়েছিল সিঙ্গেল। জুবায়ের ছোট থেকে বোনকে আগলে আগলে বড় করেছে। বিষয়টা যতদিন ওর নজরে আসে ও দ্রুত বোনকে শিখিয়ে নিয়েছে এসব কাউকে না বলতে। বোনটাও ভাইয়ের প্রচণ্ড ভক্ত। ভাই যা বলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা চাই। গতকাল রাতে ভাইয়ের হুকুমে অধরার খাবার আর ওষুধ দিয়ে এসেছে। এই বাড়িতে ও ছাড়া সবাই জমজ। পরিচিতরা এটা নিয়ে বেশ মজা করে তবে এই বাড়ির লোকজন সেটা গায়ে মাখেনা। জুবায়েরের বড় বোন পসরা ফারুকীর বয়ফ্রেন্ড ছিল বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকিও হয়েছিল কিন্তু কপাল গুণে বিয়ের দুদিন আগে সে মারা গেছে।তারপর সব থমকে গেছে। বাকীদের বিয়ের বয়স হয়েছে কিন্তু কি এক অজানা কারণে তাদের বিয়ের বিষয় নিয়ে এই বাড়িতে কেউ আলোচনা করে না। বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ দূর থেকে এই রূপ শুধু অবলোকন করতে পারে ছুঁয়ে দেখার সাধ্য কারো নেই। জুবায়ের পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছে। চেহারা মায়ের মতো বিলেতি। তবে বেশ মেজাজি। কথায় কথায় হুমকি দিতে উস্তাদ। রেগে গিয়ে ভুল করতে দুবার ভাবেনা। আরমান ফারুকী ছেলের থেকে বেশি কিছু পাওয়ার আশা করেন না। উনি এই ছেলেকে দিয়ে জীবনের একটা মাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিয়ে নিবেন। এর চাইতে বেশি দরকার হবে না।
__________________
সারাদিন ঘরে বসে বসে দিন পার হলো অধরার। মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। পাশের রুমে জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ করে সে গার্লফ্রেন্ডর শোকে অসুস্থ। অধরার কাছে এসব নেকামি বলে মনে হচ্ছে। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। মায়ের মতো চাচি মারা গেছে হেলদোল নেই। এদিকে কোথাকার কোন মেয়ে মারা গেছে সেই শোকে বেডা ভিমড়ি খেয়েছে। বিরক্তিতে অধরার চোখমুখ কুচকে আছে। কাজের মেয়েটা বারবার খাবার দিয়ে যাচ্ছে। দেখাশোনা করছে। ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ করেছে। অধরা পাত্তা দিলো না। শাশুড়ি মায়ের লাল রঙের পুটলিটা দেখার ইচ্ছে জাগলো। ভাবলো জুবায়ের পাট হয়ে পড়ে আছে তারমানে ক্যামেরা চললেও চেক করতে দুদিন সময় লাগবে। যা হবে পরে দেখা যাবে ভেবে কৌশলে আবারও কাপড় চেঞ্জ করার বাহানা দেখিয়ে পুটলিটা নিয়ে বসে পড়লো। লকেট সেই সঙ্গে বাংলাদেশ যাওয়ার পাসপোর্ট ভিসা বেশ কিছু টাকা। টাকার নিচে একটা চিত্র।। অধরা চিত্রটাতে পাশাপাপাশি জুবায়েরের দুটো ছবি দেখতে পেলো। একটাতে ওর চোখ খুব স্বাভাবিক লাগছে অন্যটাতে রক্তিম। অধরা বুঝলো না কিছু। যেমন ছিল ঠিক তেমনিভাবে রেখে দিলো। রুমের চাবি আছে ওর কাছে। বাড়ির বাকী রুমগুলোতে তল্লাশি করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি এই বন্দি দশা থেকে মুক্তি নিতে হবে। দেরী হলে ঝামেলা আছে। হাটতে চলত কষ্ট হবে। অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াতে হবে। মাথার উপরে ছায়া নেই। যে ওকে আগলে রাখবে। কথাগুলো ভেবে ও দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। সময় রাত দশটা বেজে আঠারো মিনিট। কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার দিতে আসবে কাজের মেয়েটা। অধরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করলো কিন্তু কাজের মেয়ের পরিবর্তনে মারিয়া আসলো। মেয়েটার মুখে সব সময় মিষ্টি হাসি লেগেই থাকে। অধরা আফসোস করে খাবার শেষ করলো। চুপচাপ মেয়েটা সব গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতেই অধরা দরজা সামান্য খুলে তাঁকিয়ে থাকলো। ওকে সবার শেষে খাবার দেওয়া হয়েছে। অধরাকে নিয়মকানুন মেনে খাওয়ানো হচ্ছে। টাইম দু টাইম। বাইরে চুপচাপ দেখে ও চুপিচুপি বেরিয়ে আসলো। আজ মিশন চলবে নিচের রুমগুলোতে। কথাটা ভেবে ও লম্বা লম্বা পা ফেলে নেমে আসলো। ডাইনিং রুমে কত দিন আসা হয়না ভেবে আশেপাশে ভালো করে লক্ষ্য করল। সিঁড়ির পাশের রুম থেকে আওয়াজ আসছে। মৃদু মৃদু হাসি আর কথাবার্তা হচ্ছে। অধরা চুপিচুপি রুমের জানালা থেকে উঁকি দিয়ে চমকে উঠলো। জুবায়ের বোনদের নিয়ে মনের সুখে গল্প জুড়েছে সেই সঙ্গে মদ গিলছে। পাশাপাশি চার বোন আর ওর বাবা মা আছে।সবগুলো শয়তান এখানে জড় হয়েছে। অধরার কপালে ভাজ পড়লো। জুবায়ের সারাদিন প্রেমিকার বিরহে অজ্ঞান ছিল সবটা ওর ভন্ডামি ছিল। প্রচণ্ড রাগে ওর শরীর জ্বলে উঠলো। হঠাৎ জুবায়ের আশেপাশে তাঁকিয়ে কি একটা ইশারা করলো। আরমার ফারুকী কি বুঝলো জানা সেই উনি বলে উঠলেন,
> আরে কেউ নেই। এখানে নজর কে দিবে অদ্ভুত? টেনশন করোনা।
অধরার বুক কেঁপে উঠলো। ধরা খেয়ে গেলে ঝামেলা হবে। জুবায়ের উঠতে উঠতে ও দৌড়ে উপরে চলল। নিজের রুমে ঢুকতে যাওয়ার আগে পাশের রুম টপকাতে গিয়ে খোঁলা দরজা দিয়ে ঘুমন্ত জুবায়ের মুখ ওর চোখে পড়লো। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে। অধরা থমকে গেলো। পা চলছে না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো। লোকটার দীর্ঘ নিশ্বাস জানান দিচ্ছে ঘুমটা কতটা গভীর। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ও নিচে জুবায়েরকে দেখে এসেছে । ওর আগে ছেলেটা কিভাবে উপরে আসতে পারে, সম্ভব না। প্রশ্ন জাগলো ছেলেটার কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে নাকি দৃষ্টির অগোচরে এই বাড়িতে দুজন জুবায়েরের বসবাস?
(চলবে)
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৬
ঘন নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঠকঠক করে কাঁপছে অধরা। একজোড়া সীতল দৃষ্টি ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে। ওই দৃষ্টিতে বুঝি ওর মৃ*ত্যু লেখা আছে। কালো থাইকাচ ভেদ করে সূর্যের রশ্মি ভেতরে প্রবেশ করেছনা ঠিক তবে আলো ছড়াতে জুড়ি মেলা ভার। অধরার সামনে জুবায়ের ফারুকী দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বের ন্যায় চোখমুখ শক্ত করে নেই তবে চোখে আছে হাজারো অভিযোগ অভিশাপ নাকি ঘৃণা বোঝা মুশকিল। অধরা গতকাল রাতের দৃশ্যটা দেখার পরে চুপচাপ রুমে চলে এসেছে। সারারাত ভেবেছে কিন্তু উত্তর পাইনি। জুবায়েরের যে জমজ ভাই আছে এটা ওকে কখনও বলা হয়নি। এই বাড়িতে সবাইকে দেখেছে কিন্তু ওই লোকটাকে অধরা কখনও দেখেনি। এক বাড়িতে থেকে একটা লোক কিভাবে নিজেকে আড়ালে রাখতে পারে চমকে যাওয়ার মতোই কথা। সারারাত আজেবাজে চিন্তা করে ভোররাতে ঘুমিয়েছিল হঠাৎ জুবায়েরের এসে ওকে জোরজবরদস্তি করে উঠিয়ে দিয়েছে। অধরা ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে যে সামনে দাঁড়িয়ে এটা জুবায়ের নাকি ওর মতো দেখতে সেই ছেলেটা। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মতোভাব বোঝার মতো সামর্থ্য ওর নেই। হঠাৎ আক্রমণে অধরার ধ্যান ভাঙলো। জুবায়ের ওর দু’বাহু শক্ত করে ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল,
> তুমি অভিশাপ দিয়েছিলে না? সব তোমার জন্য হয়েছে। কখনও ক্ষমা কবো না তোমাকে। তোমার জন্য আমার মা আর জুহিকে প্রাণ দিতে হলো।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা হতবাক। লোকটা ছ্যাকা খেয়ে রোগে শোকে দুঃখে পাগল হয়ে গেলো নাকি কে জানে। খু*ন করা বা মা*রার হলে ও প্রথমে জুবায়েরের কথা ভাবতো। লোকটার একটা কেনো একশোটা গার্লফ্রেন্ড থাকুক অধরা সেসব পরোয়া করে না। করবেই বা কেনো?অধরা মুখটা কঠিন করে নিজেকে এক ঝটকায় জুবায়েরের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ভ্রু কুচকে বলল,
> ঠকাতে পারেন আর ঠকতে পারবেন না এটাতো ঠিক না। থাপ্পড় দিবেন অথচ থাপ্পড়ের স্বাদ নিবেন না তাতো হতে দেওয়া যায় না। কেমন লাগছে সুলতান জুবায়ের ফারুকী?
অধরার কন্ঠ থেকে আক্রশ ঝরে পড়ছে। ইচ্ছে করছে লোকটার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে গলা টিপে দিতে কিন্তু ও পারবে না। শক্তিশালী পুরুষটার গলাতে হাত রাখলে ওর এইটুকু হাতে অনায়াসে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। জুবায়ের যথাযথ শান্ত থাকার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। অধরাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ওর গালটা দুহাতে দুমড়ে নিয়ে বলল,
> আমি সুখ না পেলে কাউকে সুখী হতে দিবো না। এতে কেউ আমাকে স্বার্থপর ভাবলেও কিছু যাবে আসবে না। আমাকে দেখে তুমি কটাক্ষ করবে!মজা নিবে আমি সহ্য করবো না।
অধরার মুখে প্রচণ্ড ব্যাথা লাগলো। মনে হলো মুখের হাড় ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়বে। চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। বহু কষ্টে আওয়াজ দিলো,
> মৃত গার্লফ্রেন্ডর রাগটা বুঝি বউয়ের উপরে তুলছেন জুবায়ের ফারুকী? কাপুরুষ কাকে বলে জানেন নিশ্চয়ই? নাকি ব্যাখা করে জানিয়ে দিব।
জুবায়ের খপ করে ওকে ছেড়ে দিলো। মেয়েটা কি ইঙ্গিত করছে বুঝতে সময় লাগলোনা।অযথাই রাগ হচ্ছে শুধু। মনের মধ্যে ভয়ানক জিদ চেপেছে। ইচ্ছে করছে জুহির লা*শ তুলে ইচ্ছে মরো পিটাতে। বদজাত মেয়ে জীবনে ক্ষমা করবে না জুবায়ের ওকে। ওর জন্য এখন কথা শুনতে হচ্ছে। জুবায়ের লাথি দিয়ে সামনে থাকা ট্রি টেবিলটা সরিয়ে দিলো। হুঙ্কার দিয়ে বলল,
> গলা টিপে দিবো আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে। আমাকে রাগাবে না। জুহির জন্য তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম কিন্তু এখন তো সে নেই। আমার তোমার উপরে আর কোনো দায়বদ্ধতা রইল না। সো চুপচাপ থাকবে।
> জানি দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু আপনার রক্ত তার উপরেও কি আপনার দায়বদ্ধতা নেই? বাচ্চাটা কিন্তু আপনার সেটা তো স্বীকার করেন? আপনার সম্মুখীন যদি কেউ আপনার বাচ্চার ক্ষতি করে সেটা মানতে পারবেন তো? ধরুন কহিনুরকে কেউ হত্যা করলো ওর র*ক্ত
অধরা বাকী কথাটা শেষ করতে পারলো না জুবায়ের ওর গলা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> আমার মেয়েকে নিয়ে একদম বাজে কথা বলবে না। বারবার বাক্য দ্বারা আঘাত করে আমার স্পর্শ নিতে চাইছো তুমি? রাগলে আমার স্পর্শ কিন্তু তোমার জন্য একদম ভালো হবে না। ভেবোনা কহিনুরের জন্য তোমাকে ছেড়ে দিব। জানিনা ড্যাড ওকে কেনো চেয়েছে কিন্তু এই মূহুর্ত থেকে ওকে আমার নিজের জন্য চাই। আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে।
জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তারপর কি একটা ভেবে আবারও ফিরে এসে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল
>আমার কাউকে দরকার নেই। কহিনুরকে দরকার নেই আমার। ড্যাড যা বলেছে তাই হবে।
জুবায়ের পূর্বের ন্যায় গটগট করে বেরিয়ে গেলো। অধরা বালিশে মুখ ডুবিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। ভেবেছিল জুবায়েরকে নিয়ে আর ভাববে না নিজের মতো সবটা উদ্ধার করবে কিন্তু লোকটা যে ওকে একটুও শান্তি দিচ্ছে না। ওর মধ্যে যে অশান্তি চলছে সেটা অধরার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অধরা কান্নাকাটির পর্ব শেষ করে রাগে ফুলে উঠলো। ভয়ানক ভাষায় দু’টো গালি দিলো একদম আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে। ভাব দেখালো মিররে মলিন বদন খানি দেখার প্রচেষ্টা করছিল। জুবায়েরকে ও জীবনে ছাড়বে না। শাশুড়ি আম্মা ঠিক বলেছিল কাউকে বিশ্বাস না করতে।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆
জুবায়ের অধরার উপরে রেগে গিয়ে কাঠকাঠ গলাই বাবার সামনে জানিয়ে দিলো ওই মেয়েটাকে ওর এখন আর দরকার নেই। আরমান ফারুকী ছেলের মুখটা দেখে ভয়ানক চটে আছেন দেখে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছেন না। এই ছেলেকে দিয়ে উনার কিছুই হবে না বুঝতে বাকি নেই। থাপ্পর দিতে পারলে শান্তি লাগতো কিন্তু পারবেন না। যেভাবেই হোক হাতে পায়ে ধরতে হবে। বড় কোনো স্বার্থের জন্য এরকম ছোট ছোট ত্যাগ স্বীকার করাই যায়। উনি মুখটা মলিন করার যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন এবং শেষমেশ সফল হলেন। ছলছল চোখে বললেন,
> বাবা জুবায়ের তোমার ড্যাড আজ পযর্ন্ত তোমার থেকে কিছু চেয়েছে বলো? যখন যা চেয়েছো আমি সবটা দিয়ে তোমার আবদার পূরণের চেষ্টা করেছি তাহলে আজ কেনো ড্যাডের কথা ভেবে দশটা মাস অপেক্ষা করছো না। আমি কি ভেবে নিবো আমি পৃথিবীর সব চাইতে হতভাগ্য পিতা?
জোবায়েরর রাগ পড়ে গেলো। সত্যিই তো বাবার জন্য ও এইটুকু পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। সন্তান পিতার ইচ্ছে পূরণ করবে এখানে দোষের কি। তাছাড়া সবটা যে সুখের হবে এমনটা না। পরিবারের কথা ভেবে এসব করাই যায়। তবে কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> কহিনুরকে নিয়ে তুমি কি করতে চাইছো বলবে? বেবি ছেলে না মেয়ে হবে আগেই তুমি জানলে কিভাবে? পৃথিবীতে এতো এতো নাম থাকতে ওর নাম কহিনুর কেনো রাখলে?
জুবায়ের একসঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আরমান ফারুকীর দিকে। উনি অবস্থা বেগতিক দেখে খুকখুক করে কেশে বললেন,
> সবটা তোমার না জানলেও চলবে। সুলতান বংশের মূল্যবান রত্ন সে। তাকে কহিনুর ডাকতে অসুবিধা কিসের? আমার মন বলেছে তোমার মেয়ে হবে ।তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?
জুবায়ের উত্তর দিলো না। চুপচাপ চলে আসলো নিজের রুমে। বড় মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। জুবায়ের চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পরক্ষণেই ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চোখ খুলল। পাশে মারিয়া বসে আছে। জুবায়ের ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> ও ঘরে খোঁজ নিয়েছিস? আমাকে ও ইচ্ছা করে রাগিয়েছে।
মারিয়া হাতের ফোনের নোটবুকে লিখে ওর দিকে ধরলো। লেখা আছে,
> ভাবিকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো? ছেড়ে দাও ড্যাডকে না বলে। আমার কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া।
জুবায়ের চোখ বন্ধ করে বলল,
> ওকে যেতে দিলে অন্যকেউ বন্দী করবে। এখানে আছে ভালো আছে। আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। যা হচ্ছে হতে দে। ড্যাড আমাদের ভালো চান।
মারিয়া কথা বাড়ালো না। চুপচাপ স্থান ত্যাগ করলো। একে বোঝানোর ক্ষমতা ওর নেই। এই বাড়ান যে ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে। বহু বছরের পুরাতন ইতিহাস পূনরায় ফিরে আসতে চলেছে। থমথমে পরিবেশ তার জানান দিচ্ছে।
☆☆☆☆☆
জুবায়েরর এসব পাগলাটে আচরণে অধরা বেশ কষ্ট পেয়েছে। বারবার শুধু বাবা মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল তাই মায়ের দেওয়া কালো রঙের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে অধরা। বাবা মায়ের অন্তিম যাত্রার সময় নিজের বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ওর। মায়ের সুটকেসটা নিয়ে এসেছে। বাবা মায়ের স্মৃতি হিসেবে। কয়েকটা কাপড় আছে। যখনই মাকে মনে পড়ে তখনই একটা শাড়ি ঝটপট পরে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। শাড়ি বের করার সময় হঠাৎ একটা পুরাতন ডাইরি পেয়েছে সেটাই নিয়ে পড়তে বসেছে অধরা। এটা মূলত ওর মায়ের না বাবার ডাইরি। গোটা গোটা অক্ষরে প্রথম পেজে লেখা আছে” কহিনুর “
নিজের বাবার ডাইরিতে এই নামটা দেখে ও চমকে উঠেছে। আগ্রহ নিয়ে পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টাতেই পেলো,
” আমি প্রফেসর নওশাদ বারি, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার দরুণ প্রচন্ড ভালোবাসা পেয়ে ছোট থেকে বড় হয়েছি। সেই আমি কখনও কল্পণাও করিনি বাবা মায়ের থেকে দূরে চলে আসবো। কিন্তু ভাগ্য আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। বাবার অর্থসম্পদের অভাব ছিল না। যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। আমাদের কতগুলো জমি আর কি পরিমাণ অর্থ আছে সেটা আমি কখনও হিসাব করিনি। বাবা সেসব দেখাশোনা করতেন। আমি লেখাপড়া আর বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটাতাম। আমার এই অর্থসম্পদের পাহাড় আমার বাবার নিজের হাতে তৈরী করেছিলেন। কিভাবে করেছেন তা আমার অজানা ছিল জেনেছি পরে। দাঁদা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাঁর আয়ে টুকটাক সংসার চালানোর এবিলিটি ছিল। এটা নিয়ে তাঁর আফসোস ছিল না। আমি উনাকে খুব ভালোবাসতাম। তাঁর মৃত্যুতে আমি ভেঙে পরি।আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তাঁর কয়েক মাস পরের ঘটনা, এক কঠিন সত্যি আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়। যেটা জানার পরে আমার মাথায় কাজ করছিল না। একজন মানুষ কিভাবে এতটা জঘন্য হতে পারে আমার জানা ছিল না। বৃদ্ধ মানুষটা ধুকে ধুকে মা*রা গিয়েছিল শুধু আমার বাবার জন্য। সে স্বার্থের লোভে এই মানুষটার সুখ চিরতরে কেড়ে নিতে দুবার ভাবেনি। আমার দাদিজান জোছনা বিবি কে দাদাজান খুব ভালোবাসেন। বাবা ছিলেন দাদাজানের প্রথম সন্তান। বাবার বয়স যখন আঠারোর উপরে তখন দাঁদিজান জানতে পারেন উনার কোল জুড়ে আবারও কোনো চাঁদের দেখা মিলতে চলছে। দাঁদাজান খুশী হলেন। আল্লাহ্ কাছে শুকরিয়া জানালেন কিন্তু আমার বাবা সবটা উল্টে দিলো। উনি গ্রামের মোড়লের মেয়েকে পছন্দ করতেন। মোড়ল কিছুতেই বাবার সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে মানতে চাইলেন না। কারণ বাবার অবস্থা তখন ভালো ছিল না। বাবা হতাশ হলেন তবে হাল ছাড়লেন না। বাড়িতে আসা কমিয়ে দিলেন। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি নেশা করতেন। কোন এক রাত্রিকালে নেশায় বুদ হয়ে ফিরছিলেন তিনি। ঘন অন্ধকার রাত। খোলা মাঠ পেরিয়ে যখন বিলের রাস্তায় হাটা ধরেছেন ঠিক সেই সময় একটা খোলা জমিতে বসা একজন মানুষের দেখা পেলেন। উনি বাবার নাম ধরে ডেকে সামনে বসতে বললেন। বাবা কৌতুহলবশত বসে পড়লেন। লোকটা বাবাকে শর্টকাট অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার বুদ্ধি দিলেন। যার জন্য উনাকে করতে হবে কালো জাদুর বা পিশাচ সাধনা। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। সাধনার জন্য গর্ভবতী মহিলার জীবন বলি দিতে হবে। সেটা পর কেউ হলে চলবে না। নিজের আপনজনকেই দিতে হবে। বাবার চোখ তখন চকচক করে উঠলো। উনি এক কথায় রাজি। সারারাত দিন লাগিয়ে সাধনা করলেন। হঠাৎ একদিন বাড়িতে দাদিজানের প্রাণ গেলো তবুও ফিরলেন না। গভীর রাতে কেউ একজন দাঁদিজানের কবর খুড়ে খুলি চুরি করলো সেটাও জানলেন না। উনি ফিরলেন সফল হয়ে। তারপর হঠাৎ করে কিভাবে জানি এই বিশাল সম্পদ পেলেন। সঙ্গে পেলেন আমার মাকে। কিন্তু দাদাজন পেলেন সঙ্গী হারানোর হাহাকার। বাকী জীবন মরার মতো বেঁচে ছিলেন। করো সঙ্গে কথা বলতেন না। চুপচাপ ঘরে পড়ে থাকতেন। দাঁদাজানের মৃত্যুর আগের দিন উনি আমাকে সবটা বলে গেলেন।। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। চিরতরে চলে আসার সব ব্যবস্থা করে ফেললাম।কথায় বলে পাপ ছাড়ে না বাপকে ঠিক তেমনই হলো। আমি আসার দুদিন আগে হঠাৎ বাবা আমাকে কাছে ডাকলেন। সীমাহীন ভয় নিয়ে আমার সামনে এক পাথর বের করে ধরলেন। বর্ণনা করলেন সেই পাথরের কাহিনি। ওটা ছিল এই ধনসম্পদের আসল হাতিয়ার। সাধনা শেষে সেই লোকটা বাবাকে এটা দিয়েছিলেন। যতদিন ওটা বাবার কাছে থাকবে ততদিন উনার সম্পদ বাড়তেই থাকবে। আমি ভয়ানক একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী বাবার পাথর চুরি করে দেশ ছাড়লাম। যেই পাথরের জন্য উনি দাদাজনকে কষ্ট দিয়েছেন আমি সেই পাথর উনার থেকে কেড়ে নিলাম। এখানে আসার পর বাড়িতে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। পড়াশোনার সঙ্গে ছোটখাট চাকরি করে আমার ভালোই দিন যাচ্ছিলো। হঠাৎ সহপাঠীর প্রেমে পড়ে ওকে বিয়ে করে জমিয়ে সংসার করতে লাগলাম। ততদিনে আমার লেখাপড়া পাট চুকে গেছে। প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছি । দিনকাল ভালো যাচ্ছিলো কিন্তু হতাশা পিছু ছাড়লো না। বহুকাল অপেক্ষা করলাম সন্তানের মুখ দর্শন করা ভাগ্যে ছিল না বোধহয়। হতাশার মূহুর্তে মানুষ একটা ক্ষীণ আসার দেখা পেলেও বুকবাঁধে। আমিও তাই করলাম। পাথরটা বের করলাম। জানিনা কিছুই শুধু মনে মনে বিড়বিড় করলাম কিন্তু মন মানলো না। সেটা লুকিয়ে ফেললাম। ভাবলাম ওটা আর বের করবো না। কিন্তু হঠাৎ একদিন স্বপ্ন দেখলাম। দাঁদিজানকে যাকে আমি কখনও দেখিনি। ওটা স্বপ্ন নাকি ছিল কল্পণা তাও জানিনা। দাঁদিজান বললেন,নওশাদ ওসব পাথর টাথর ফেলো।আমি নিজেই তোমার মেয়ে হয়ে তোমার কোলে আসবো। আমাকে কিন্তু পূর্বের মতো বলি হতে দিওনা। ওই পাথর তুমি নষ্ট করে দাও। ওর জন্য আমরা সবাই কষ্ট পেলাম। দাঁদিজানের কথার মানে না বুঝেই আমি পাথরটা মসজিদের পাশে থাকা দানবক্সে ফেলে আসলাম। মনে হলো আমার উপর থেকে বোঝা নেমে গেলো। দাঁদিজানের স্বপ্নটা আমি ততটা আমলে নেয়নি কিন্তু সত্যি সত্যি মাস খানেক পরে জানতে পারলাম আমি বাবা হবো। মনটা খুশীতে নেচে উঠলো। কি এক অনুভূতি । আমার আধার কালো সাদামাটা জীবনে ছোট্ট একটা বাবু আসছে। আমি নামও ঠিক করলাম। অধরা যার মধ্যে নাকি আমার দাদিজানের আদলের মিশ্রণ থাকবে। জানিনা দাদিজান কেমন ছিলেন। পাথরের চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম। পৃথিবী আলোকিত করে আমার ছোট্ট পরি আসলো। পরীকে ঘিরে আমাদের ছোট্ট সংসার । কিন্তু আমার অধরা যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিলো সেই সঙ্গে বাড়ছিল ভয়।। একরাতে আবারও স্বপ্ন দেখলাম দাদিজান বলছেন, নওশাদ পাপ তো পিছু ছাড়লো না রে। তোর মেয়ের মধ্যে কহিনুরের শক্তি প্রবেশ করেছে। ওকে বিয়ে দিয়ে দে। সন্তান আসুক কহিনুরের শক্তি নিয়ে তাঁর জন্মহোক।
(চলবে)
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৭
অজানা উত্তেজনাতে কাঁপছে অধরা। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন আর আতঙ্ক। কহিনুর অভিশাপ কি আশির্বাদ আল্লাহ্ ভালো জানে।অধরা একদমে ডাইরির কয়েক পৃষ্ঠা পড়া শেষ করে পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টে সেখান থেকে শুরু করলো,
” অধরার মধ্যে আমি কখনও অদ্ভুত কিছু দেখিনি। স্বপ্ন তো স্বপ্নই হয়। শয়তানের ধোকা ছাড়া কিছু না। আমি সামান্য কারণে আমার বাচ্চা মেয়েটার জীবন নষ্ট করতে পারিনা। আমার একমাত্র মেয়ে যার মুখ দেখে আমার শুভ সকাল শুরু হয়। পারবোনা তাঁর জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে। আমি চাই আমার মেয়েটা পড়াশোনা শিখুক। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের ইচ্ছেতে কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করুক। এতেই আমার শান্তি। কিন্তু এরকম কিছু হলো না। বারবার দাদিজানকে দেখলাম। সেই এক কথা। আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। এতো বছর পরে বাবার খোঁজ নিলাম। ভেবেছিলাম বাংলাদেশ ফিরে গিয়ে উনার কাছ শুনবো এই পাথরের অভিশাপ কিভাবে কাটানো যাবে। কিন্তু পারলাম না। বাবা মারা গেলেন। আমাদের বিশাল সম্পত্তি ততদিনে সব মামা আর মামাতো ভাইয়ের দখলে। মা ওদের সঙ্গেই থাকেন। বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে চিঠি লিখে গেলেন। হাতে পেলাম দুদিন পরে। বাবা চিঠিতে বারবার ক্ষমা চেয়েছেন। যেই সম্পত্তির জন্য উনি নিজের মায়ের প্রান বলি দিলেন সেই সম্পদ এখন পরের মানুষ লুটপাট করছে। মায়ের ভালোবাসা পেয়েও উনি হারিয়েছেন। একমাত্র ছেলে বাড়ি ছাড়া হওয়ার অপরাধে আমার মা,বাবার সঙ্গে কথা বলতেন না। শেষ বয়সে এসে উনি নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। পাথরটা যে আমার কাছে এটা উনি জানেন। পাথরটার সামনে যেনো আমি কোনো আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ না করি হুশিয়ার করেছেন। কিন্তু আমি যে ভূল করেই ফেলেছি। পাথরটা উনি কোনো নদীতে ফেলে দিতে বলেছিলেন। লোকের হাতে পড়লে ঝামেলা হবে। ওই পাথরটার জন্য অনেকেই মুখিয়ে আছে। বাবার চিঠি পড়ে মেয়ের বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় শুরু করলাম। একদিন ভালো পরিবার পেয়ে বিয়েও দিলাম। কিন্তু স্বপ্নের থেকে রক্ষা পেলাম না। দাদিজানের জায়গাই আমি অধরাকে দেখা শুরু করেছি। মেয়েটা বারবার বলছে বাবা আমাকে বলি হতে দিও না। তুমি না দাদিজানকে কথা দিয়েছিলে আমাকে রক্ষা করবে তবে কেনো করছো না? ওরা আমাকে মেরে ফেলবে বাবা। আমার কহিনুরের র*ক্তে কহিনুরের শক্তি ফিরিয়ে নিবে।
এই পযর্ন্তই লেখা ছিল ডাইরিতে। অধরার চোখে পানির ধাঁরা নেমে আসলো। বাবা ওর জন্য কতটা চিন্তিত ছিল বোঝা যাচ্ছে। এই কাহিনী শুরু হয়েছিল বহুকাল আগে থেকে কিন্তু এই বাড়ির সঙ্গে ওই পাথরের কি সম্পর্ক আছে বুঝতে পারলো না। আরমান ফারুকী জেনে বুঝে ওকে এই বাড়িতে এনেছে এটা পরিস্কার। মস্তিষ্ক কাজ করছে ওর। নিজের সঙ্গে বাচ্চাটার জীবনের ঝুঁকি আছে বুঝতে অসুবিধা হলো না। এই বাচ্চাটাকে ওরা মেরে ফেলবে। অধরার শরীর কাঁপছে। কিভাবে রক্ষা করবে নিজের সন্তানকে? সবাই যে স্বার্থপর। শাশুড়ি মাকে ও হাজারটা ধন্যবাদ দিলো। এই বাড়িতে থাকা ওর চলবে না। এই বাড়ির রহস্য ওর পিছনে ছাড়বে না মনে হচ্ছে। অধরা দ্রুত ডাইরি লুকিয়ে ফেলল। হাতে এখনো সময় আছে। ভাবতে হবে।
☆☆☆☆☆☆
বোবা হিসেবে অটিস্টিক স্কুল কলেজে পড়ার কথা ছিল মারিয়া ফারুকীর কিন্তু জুবায়ের কখনও চায়নি ছোট বোনটাকে এভাবে আলাদাভাবে মানুষ করতে। ও নিজ দ্বায়ীত্বে বোনটাকে নরমাল ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই মানুষ করেছে। বোনটাকে ও খুব স্নেহ করে। সব সময় পাশে থাকার চেষ্টা করে। মেয়েটার বুদ্ধিমত্তাটা সাধারণ মেয়েদের মতো না। সহসা সে রাগে না। রাগলেও কাঁদে না। মন খারাপ বিষয়টা একদম এড়িয়ে চলে। জুবায়ের প্রতিদিন বোনকে ইউনিভার্সিটির গেটে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যায়। ক্লাস শেষে বোনকে নিতে আসে। কখনও এর এদিক ওদিক হয়না। আজও ওর ভুল হয়নি। বোনকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। মারিয়া মাথায় মাফলার চাপিয়ে চুপচাপ ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলো। ক্লাসের সামনে ওর সহপাঠীরা জড় হয়েছে। ওকে নিয়ে আলোচনা করছে। কেউ জানেনা আধরা কথা বলতে জানেনা। ওরা ভেবেছে মেয়েটা ইচ্ছে করে সবাইকে অপমান করছে। ক্লাসে যাওয়ার আগে সবাই মিলে ওকে আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিলো। মারিয়া ঠোঁটে হাসি রেখে সবাইকে দেখেছে। চুপচাপ ক্লাস করে যখন বেরিয়ে আসবে ঠিক তখনই পাশ থেকে একটা ছেলে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ছেলেটার চোখেমুখে বিস্ময়। মারিয়া ইশারা করলো কি চাই। ছেলেটা ভ্রু কুচকে বলল,
> কথা বলতে পারো না কিন্তু শুনতে নিশ্চয়ই পারো?
মারিয়া চমকে উঠলো। এই সত্যিটা জুবায়ের ছাড়া কেউ জানেনা। কিন্তু এই ছেলেটা জানলো কিভাবে?
মারিয়া থমকে গিয়ে আবারও হাটতে শুরু করলো। ছেলেটা দমে গেলো না। দ্রুত ওর পিছু নিয়ে বলল,
> ভয় পাচ্ছ তুমি? আমি তোমার ক্ষতি করবো না। আমি জানি তুমি শুনতে পাও। আমি দেখেছি কেউ ডাকলে তুমি সেদিকে তাঁকাও। উচ্চ শব্দ হলে কানে হাত রেখে প্রতিরক্ষা করো। ঠিক বলছি না! বলো তুমি?
ছেলেটা হড়বড় করে কথা বলে চলেছে। মারিয়া দৌড়ে গেলো গেটের দিকে। ছেলেটাও কম যায়না ওর পেছনে ছুটছে। জুবায়ের বোনকে নিতে এসেছিল হঠাৎ ওকে দৌড়াতে দেখে হুট করে গাড়ি থেকে নেমে নিজেও এগিয়ে গেলো। বোনের হাত ধরে পেছনে তাঁকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> কি চাই!ওকে বিরক্ত করছেন কেনো?
ছেলেটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কোনো রকমে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> সরি আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। ও অযথাই আমাকে ভয় পাচ্ছে। বন্ধুত্ব করতে চাইলাম। আসলে ওতো একা থাকে।
জুবায়ের মুখটা কঠিন করে বলল,
> ওর থেকে দূরে থাকবেন। নিজের জন্য ভালো হবে। আমার বোন কথা বলতে পারে না। বন্ধুত্ব করতে চাইলে অন্যদের সঙ্গে করুন।
জুবায়ের আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত ওকে গাড়িতে তুলে বেরিয়ে আসলো। দিন যাচ্ছে সময়টা কঠিন হচ্ছে। সুলতান বাড়ির মেয়েদের জন্য যে ভালোবাসা বিয়ে বা সংসার করা ভাগ্যে নেই। ওরা যেতেই ছেলেটা চোখ বন্ধ করলো। এই মারিয়া ফারুকীকে ওর চাই। যেভাবেই হোক চাই।
☆☆☆☆☆☆☆
ডাইরি পড়ার পরে অধরার দুবার বমি হয়েছে। অতিরিক্ত টেনশনে পেশার কমে গেছে। অশান্তি লাগছে। শরীর বেশ দুর্বল। খেতে ইচ্ছে না হলেও ও খাওয়া বন্ধ করছে না। এই মূহুর্তে শরীর ঠিক রাখা জরুরি। সারাদিন জুবায়ের এই রুমে আসেনি। যখনই আসে তান্ডব করে যায়। অধরা জানে লোকটা না আসলেও ওর উপরে নজর ঠিকই রাখছে। ওর মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে আয়নাটা লাথি দিয়ে ভেঙে দিতে। এই বাড়ি থেকে যাওয়ার দিন ও এই মহান কাজটা ঠিকই করে যাবে। কথাগুলো ভেবে ও বিছানা থেকে উঠে পড়লো। ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে নিয়ে বের হলো। এই বাড়িতে রাত হলে আধার নেমে আসে। আলোর ব্যবহার যদিও এই বাড়িতে খুব কম। এরা কিভাবে এই অবছা আলোতে থাকতে পারে আল্লাহ্ ভালো জানে। অধরা সেদিনের সেই যুবকের খোঁজ করতে নেমেছে। পাশের রুমে জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। অধরা উঁকি দিয়ে দেখে নিলো। ছেলেটা নিচের রুমে ছিল ও সেদিকেই এগিয়ে গেলো। চুপচাপ রুমে ঢুকে পড়লো। কিন্তু আজ এখানে কেউ নেই। নিস্তব্ধ লাগছে। অধরা আশেপাশে তাঁকিয়ে দেখলো। মাঝারি রুম মাঝখানে বড়সড় একটা খাট। দেয়ালের সঙ্গে আলমারিটা লটকানো আছে। রুমটাতে কোনো বেলকনি নেই। অধরা হতাশ হয়ে পড়লো। ফিরে আসতে চাইলো কিন্তু হঠাৎ আলমারির মধ্যে খুট করে শব্দ হতেই ফিরে আসলো। দ্রুত আলমারির দরজা খুলে হতবাক। এখানে আরেকটা দরজা আছে। ও দ্রুত দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। নিচের দিকে সিঁড়ি। অধরা চুপিচুপি নেমে পড়লো। বেশ কিছু সিঁড়ি পার করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলো। এখানে উপরের মতো পাশাপাপাশি তিনটা রুম। রুমে কোন জানালা নেই। অধরা একটা রুমে ঢুকে পড়লো। বিশাল বড় রুম। চারদিকে দামিদামি আসবাবপত্রের ছড়াছড়ি। এখানে কেউ থাকে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। অধরার গা ছমছম করছে। ও আশপাশ যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিল হঠাৎ ওর কাধে কারো নিশ্বাস পড়লো। অধরা চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে অবাক হলো। সেদিনের সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। অধরা ভয়ে কাঁপছে। ছেলেটার মধ্যে কোনো বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
> এখানে কি তোমার? রুমে যাও।
অধরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
> কে আপনি?
ওর প্রশ্ন শুনে ছেলেটা হয়তো মজা পেলো। ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
>কেনো চিনতে অসুবিধা হচ্ছে? আমি সুলতান জুবায়ের ফারুকী,তোমার স্বামী।
অধরা বিরক্ত হলো। জুবায়েরের চালচলন ওর খুব ভালো করে রপ্ত আছে। জুবায়ের কখনও এমন শান্ত থাকে না। অধরার কপালে ভাজ পড়লো। মুখটা কঠিন হয়ে আসলো। রাগে দাঁত চেপে বলল,
> মিথ্যা বলার একটা লিমিট থাকে। আমি জানি আপনি জুবায়ের ফারুকী না তাই ভনিতা রেখে নিজের ফর্মে আসুন। বলুন কে আপনি? এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকার মানে কি? চারদিকে এতো রহস্য ছড়িয়ে কি প্রমাণ করছেন আপনারা?
ছেলেটা ঘাবড়ালো না। প্রাণখুলে হাসলো। ওর মধ্যে না আছে উত্তেজনা আর না আছে সত্যি প্রকাশের ভয়। কোনরকম হাসি থামিয়ে অধরার চোখে দৃষ্টি রেখে বলল,
> মনে আছে সেই তুষারপাতের রাতের কথা? তুমি বন্দী হয়ে আটকে ছিলে নির্জন রাস্তায়। তোমার গায়ে ছিল সাদা শুভ্র পোশাক। আধার কালো রাত্রীর বুক চিরে মনে হয়েছিল তুষারের উপরে কোনো পরি নেমে এসেছিল। আমার হার্ট ধুকপুক করছিল। ভেবেছিলাম একটু ছুয়ে দেখি। কিন্তু পারলাম না। মায়ায় জড়ানো যে আমার জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তোমাকে সাহায্য করেছিলাম। মনে আছে?
অধরা এবার ঢোক গিলল। এসেছিল এক রহস্য ঘাটতে এখানে এসে আরেক ঝামেলায় জড়িয়ে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
> কবে কোথায় কি হয়েছে সেসব আমার মনে নেই। দয়াকরে সেসব এখন টানবেন না। আমি শুনতে ইচ্ছুক না। তাছাড়া আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী। আশাকরি সম্মান করবেন।
অধরার করা শুনলে ছেলেটা আবারও হাসলো। বিড়বিড় করলো” বাঘিনী”। অধরার ভয় করছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। নির্জন এই কক্ষে শুধু একটাই ভরসা। আর যাইহোক এই বাড়ির কেউ ওর ক্ষতি করবে না। এখনো সেই সময় আসেনি। ছেলেটা সোফায় গিয়ে বসতে বসতে বলল,
> অনুমতি থাকলে তোমাকে আমার করতে এক সেকেন্ডও লাগতো না। আফসোস তুমি আমারই ভাইয়ের স্ত্রী। বিষয়টা খুব জঘন্য তাই না? একই জঠরে জন্ম নিয়েও ও কতসুন্দর জীবনযাপন করছে অথচ আমি এই অন্ধকারে সঙ্গী বিহীন। সময় আমারও আসবে। আচ্ছা ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ের অনুমতি আছে তো তাই না?
অধরা জ্বলে উঠলো লোকটার এরকম জঘন্য কথাবার্তা শুনে। ছিঃ এটা কি মানুষ। জুবায়ের খারাপ হোক কিন্তু এতটা জঘন্য না। অধরা চোখমুখ কঠিন করে বলল,
> তাঁর আগে জেনো আমার মৃত্যু হয়। দরকার নেই আপনার পরিচয় জানার। আপনি যে কতটা জঘন্য যেটা বুঝতে আমার বাকি নেই। জুবায়েরের দৃষ্টি চনচল,বদ মেজাজী তবে আপনার মতো ঘৃণ্য না।
> তাই নাকি? কিন্তু ও যে তোমার সঙ্গে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করলো তাঁর বেলা?
> চোখ বন্ধ করে মানুষ বিষ খেয়ে নিতেও দ্বিধা করে না। আমার তো মনে হচ্ছে ওকে দিয়ে আপনারা করিয়ে নিচ্ছেন। প্রয়োজন শেষে ওকে ছুড়ে ফেলতে সময় নিবেন না। যেমন আপনার বাবা করেছিলেন। উনি জমজ ভাইকে সরিয়ে তাঁর জায়গাই নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন। দারুন বুদ্ধি কিন্তু।
ছেলেটা এবার চোখ শক্ত করে নিলো। এই মেয়েটা অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। এতোটা জানার দরকার ছিল না। ও এতক্ষণ মেয়েটাকে মূল বিষয় থেকে সরিয়ে নিতে আজেবাজে বকেছে কিন্তু না মেয়েটার লক্ষ্য ঠিক আছে। ওর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। ঝঙ্কার দিয়ে বলল,
> জুবায়ের রুমে অপেক্ষা করছে। সময় মতো না পৌঁছনোর ফল আশাকরি ভালো হবে না। শুনো বড় মায়ের কক্ষে আর কখনও যাবে না। এতো কৌতূহল ভালো না। আমি তোমাকে রক্ষা করবো প্রমিজ করছি। এখন যাও।
অধরা চুপচাপ চলে আসলো। এই লোকটার সামনে ও দ্বিতীয়বার আর পড়তে চাই না। খারাপ অভদ্র লোক। রুমে গিয়ে আবার জুবায়েরের ঝামেলা। অধরা দৌড়ে উপরে আসলো। ভাবলো জুবায়ের যদি জানতে পারে তবে তান্ডব লাগিয়ে দিবে।
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:৮
হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে কক্ষের দিকে ছুটে আসলো অধরা। হাপ পা ঠকঠক করে কাঁপছে। বাইরে থেকে যতটা সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সবার মোকাবেলা করে আসলে ওর ভেতরটা ততটাই দুর্বল। মন মর্জি হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তন হচ্ছে। এই ভালো তো এই খারাপ। পেটের ডান সাইডে চিনচিন ব্যাথাটাও তীব্রতর হচ্ছে। বাইরে গিয়ে এতক্ষণ যে অঘটন ঘটিয়ে আসলো জুবায়ের জানলে না জানি কি হবে। এরা দুভাই দু’রকমের। একজন ঠান্ডা মাথার আরেকজন উন্মাদ। অধরা কক্ষে প্রবেশ করে হাপিয়ে উঠলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় বসতে গেলো কিন্তু পারলো না। জুনায়েদ যে ওর জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে ওর লক্ষ্য ছিল না। জুবায়েরের চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে। এক টান দিয়ে অধরাকে শক্ত করে ধরে বলল,
> কোথায় গিয়েছিলে?
অধরা ঢোক গিলল। ভয়ে ভয়ে বলল,
> নিচে গিয়েছিলাম। আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে।
কথাটা শুনে জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিলো। তাল সামলাতে না পেরে অধরা বিছানার উপরে ঠাস করে পড়ে গেলো। জুবায়েরের চোখে মুখে বিস্ময়। কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
> ওর সঙ্গে কিভাবে কি? তুমি আমাদের পিছনে ষড়যন্ত্র করছো? এই বাড়ির রহস্য ঘাটতে উঠে পড়ে লেগেছো তাইনা? শুনো মেয়ে নিজের ভালো পাগলেও বুঝে। শান্তিতে খাও ঘুমাও বাচ্চা হোক আমি নিজেই তোমাকে ছেড়ে দিব। একবার যদি ঘরের বাইরে পা বাড়িয়েছো খু*ন করে ফেলবো।
> করে ফেলুন খু*ন, কে আটকে রেখেছে? জুবায়ের ফারুকী একটা স্বার্থপর মানুষের নাম। যে স্বার্থের জন্য নিজের বিবাহিত স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের রক্ত দিয়ে কালো যাদু পিশাচ সাধনার জন্য বলি দিতে চলেছে।
জুবায়ের নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। থাপ্পড় বসিয়ে দিলো অধরার গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> আজেবাজে কথা বলে আমার রাগিয়ে দিতে তোমার ভালো লাগে তাইনা? কতবার বলেছি রাগিওনা আমার কথা শুনছো না।
অধরা এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। দ্রুত টেবিলের উপরে রাখা খঞ্জরটা উঠিয়ে নিজের হাতে একটা টান দিয়ে দিলো। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। ও সেসব তোয়াক্কা করলো না। জুবায়েরের হাতের মুঠোয় খঞ্জরটা তুলে দিয়ে বলল,
> খু*ন করে ফেলুন এভাবে যন্ত্রণা দিয়ে না মেরে। আমি মারা যাচ্ছি বুঝতে পারছেন? আপনাদের স্বার্থের জন্য আমি কেনো যন্ত্রণা পাবো এতে আমার কি লাভ বলুন? খু*ন করে আমাকে মুক্তি দিন আর পারছিনা আমি। একদিকে আপনার বিশ্বাসঘাতকতা অন্যদিকে কহিনুর রহস্য। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
জুবায়ের প্রতিবাদ করলো না। দ্রুত অধরার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বসিয়ে দিলো। অধরা ধস্তাধস্তি করলো হাত ছাড়িয়ে নিতে কিন্তু পারলো না। জুবায়ের জোর করে ওর হাত ব্যান্ডেজ করে চুপচাপ ওর পাশে বসে পড়লো। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> আমি নিরুপায় অধরা। আমি চেয়েও পারছি না তোমাকে মুক্তি দিয়ে। আমি তোমাকে ছেড়ে দিলেও ওরা ছাড়বে না।
অধরা ফুপিয়ে চলেছে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো। হঠাৎ জুবায়েরের কাজে ওর ধ্যান ভাঙলো।ছেলেটা চুপচাপ ওর পায়ে সিঁকল দিয়ে আটকে দিচ্ছে। অধরা চমকে উঠে পা ছাড়িয়ে নিলো কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। জুবায়ের পাশে রাখা কাপড় ভিজিয়ে অধরার মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
> এটাই তোমার জন্য ঠিক আছে। ভেবেছিলাম তোমার থেকে দূরে থাকবো কিন্তু না তোমার তো সহ্য হলো না। স্বামীকে কাছে রাখতে যতসব আজেবাজে কাজকর্ম করছো। আমি আজ থেকে এখানেই থাকবো। আমার নজর তোমার উপরে থাকবে।
জুবায়ের শেষের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে বলল। মেজাজ ওর প্রচণ্ড খারাপ। এই মেয়েটা অতিরিক্ত ঝামেলা করছে। এরকম হলে সব উল্টাপাল্টা হয়ে যাবে। অধরার কান্না থেমে গেছে। নিজের উপরে নিজের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কিভাবে এরকম বোকামি করতে পারলো। জুবায়েরের যে এভাবে ওকে আটকে দিবে কখনও ভাবেনি। এতোটা উত্তেজিত হওয়া উচিত হয়নি। একদম ঠিক হলো না। জুবায়ের ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> বাঘীনি বিড়াল হয়ে গেলো? দম ফুরিয়ে গেলো? আহারে আমার বউ আমার মতোই হয়েছে। এতো মাথা গরম ভালো না বুঝলে। দেখলে তো কিভাবে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলে?
অধরা জ্বলে উঠলো। যা হওয়ার তো হয়েই গেছে এখন আর চুপ থেকে কি হবে। ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
> আপনিও যেমন আপনার ভাইও তেমন। ভেবেছিলাম আপনি উনার থেকে ভালো কিন্তু না। উনি ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ের স্বপ্নে আপনার মৃত্যুর দিন গুনছেন। কোন এক তুষারপাতের রাতে আমাকে সাহায্য করেছিলেন তাঁর শোধ তুলতে চাইছে। চরিত্রের দোষে দুজনেই দুষিত।
জুনায়েদের চোখ জ্বলে উঠলো অধরার কথা শুনে কিন্তু এবার আর প্রতিবাদ করলো না। চুপচাপ ওকে জোর করে শোয়ায়ে দিয়ে ওর পাশে নিজেও শুয়ে পড়লো। শুধু বলল,
> ঘুমাতে দাও আর নিজেও ঘুমাও।
জুবায়ের বালিশে মুখ ঢেকে নিলো। অধরা ভ্রু কুচকে আছে। লোকটার মতিগতি বোঝা মুশকিল। জীবনটা মেগা সিরিয়ালের মতো হয়ে গেছে। প্রতিদিন এক ঘটনা ঘটছে। অধরা বিরক্তি হলো। হাতে যন্ত্রণা করছে। এটা অতিরিক্ত ছিল। খামাখা হাতটা না কাটলেও চলতো। রাগের সময় মাথায় কাজ করছিল না। কথাগুলো ভাবতে ভাতেই ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। ভোরবেলায় চিল্লাচিল্লি আর হৈচৈ শুনে ওর ঘুম ভাঙলো। দ্রুত বসে পড়লো। জুবায়ের এখনো ঘুমিয়ে আছে। অধরা ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
> শুনছেন বাইরে কিছু হচ্ছে?
জুবায়েরে ঘুমঘুম কন্ঠে চোখ বন্ধ করেই বলল,
> হতে দাও। বিরক্ত না করে ঘুমাও।
> কুম্ভকর্ণের মতো না ঘুমিয়ে বাইরে গিয়ে দেখে আসুন। চিৎকার চেচামেচিতে আপনাদের পাপের অট্টালিকা নড়ে উঠছে। ধবংস হলে ঘুমের বারোটা বেজে যাবে। ঘুমানো ঘুচে যাবে জন্মের মতো।
অধরা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে থামলো। জুবায়ের বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলো। এই মেয়েটা সব সময় কথা শোনানোর জন্য মুখিয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই ঝাড়ি দিতে সময় নিবে না। কথাগুলো বিড়বিড় করে ও বেরিয়ে আসলো। বাইরে গিয়ে দেখলো বাড়ির দারোয়ান মালি আর কাজের ছেলেটা একটা ছেলের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেছে। বাড়িতে উচ্চ শব্দে চেচামেচি হচ্ছে। ও দ্রুত গিয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> কি হচ্ছে এখানে?
জুবায়েরের কন্ঠ শুনে ছেলেটা এগিয়ে আসলো। জুবায়ের ভ্রু কুচকে গেলো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। গতকাল এই ছেলেটাকে ও দেখেছিল বোনের সঙ্গে ইউনিভার্সিটির গেটে দেখেছিল। কিন্তু এখানে কেনো এসেছে বুঝতে পারলো না। তাই বিরক্ত হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> বাসা পযর্ন্ত চলে এসেছো? বলেছিলাম না আমার বোন বন্ধুত্ব করবে না তোমার সঙ্গে। তবুও কেনো ঝামেলা করছো?
> দেখুন আমি জানতাম না এটা আপনাদের বাসা। আমি এসেছি অধরা আপুর কাছে। উনার বাবা ছিলেন আমার বাবার বন্ধু। আমি উনার কাছে এসেছি। এর আগেও আমি এসেছিলাম দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এবার অনুমতি না দিলে আমি পুলিশ নিয়ে আসতে বাধ্য হবো।
জুবায়ের মোটেও ঘাবড়ালো না বরং হাসলো। এই মূহুর্তে ছেলেটার মুখে একা শক্তপক্ত ঘুষি দিতে মন চাইছে কিন্তু দেওয়া যাবে না। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। এমনিতেও রুমে অধরাকে আটকে রাখা হয়েছে। এই ছেলেটা যদি পুলিশ আনে ঘটনা বাজে দিকে মোড় নিবে। কিন্তু ছেলেটা ওকে হুমকি দিয়েছে যেটা ও মানতে পারছে না। জুবায়ের ভ্রু নাচিয়ে বলল,
> পুলিশ আনবে আচ্ছা আমি নিজেই ফোন করে বলছি আমার স্ত্রীর নিজের কোনো আত্মীয় নেই অথচ কে না কে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বারবার আমাদের সবাইকে বিরক্ত করছে। খারাপ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। মিস্টার…. কি জানি নাম ?
ছেলেটা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
> আয়াত ইসলাম। দেখুন আমি কিন্তু আজ এমনি এমনি ফিরবো না। ডাকুন ওকে। এক বছর ওর সঙ্গে দেখা করতে দেননি। এই খুন টুন করে গুম করে দেননি তো? আমি সিউর এটাই করেছেন। পাক্কা শয়তানের হাড্ডি আপনারা। আঙ্কেলকে কতবার বলেছিলাম বিয়েটা ভেঙে দিতে।
আয়াত একদমে কথাগুলো বলে থামলো। জুবায়ের যেতে যেতে বলল,
> আসো দেখা করিয়ে দিচ্ছি।
বিড়বিড় করলো,ফালতু লোকজন। এই দুটোই এক। সামনে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিব।আর কিছু না পারলেও মুখ চালাতে পাররে।
জুবায়ের বিরক্ত হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে আয়াত সেসবে পাত্তা দিচ্ছে না। বাড়ি থেকে আসার সময় বাবা মাকে কথা দিয়ে এসেছে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবে। পাশাপাশি বাড়ি ছিল। ওরা এক সঙ্গে বড় হয়েছে। ভাইবোনের মতো মিলমিশ ছিল। হঠাৎ বিয়েটা সব তছনছ করে দিলো। জুবায়ের ওকে নিচে বসিয়ে রেখে উপরে আসলো। অধরা বিছানায় বসে আছে। পায়ে সিঁকলের জন্য ফ্রেস হতে পারছে না। জুবায়ের দ্রুত এসে ওর সিঁকল খুলে দিয়ে গম্ভীর মুখ নিয়ে বলল,
> মুখ খুঁললে কিন্তু খারাপ হবে। তোমাকে কিছু করতে না পারলেও ওকে কিন্তু ছাড়বো না। আমাকে চিনো? মাথা গরম হলে খবর আছে।
অধরা অবাক হলো। সাত সকালে জুবায়ের কাকে মারার হুমকি দিচ্ছে বুঝতে পারলো না। ভ্র কুচকে বলল,
> বুঝতে পারলাম না।
> আয়াত এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। তুমি কয়েকটা ভালো মন্দ কথা বলে ওকে বিদায় করবে। আমি কিন্তু…
> জানি খু*ন করে দিবেন। ওটা ছাড়া তো আর ডাইলগ জানেন না। চলুন দেখা করে আসি।
বুকের মধ্যে চাপা উত্তেজনা চাপিয়ে রাখা মুশকিল। অধরা বেশ খুশী হয়েছে। মনের মধ্যে একটা পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন শুধু বুদ্ধি দিতে কাজ করতে হবে। আল্লাহর উপরে ভরসা করে নিজেকে শান্ত রেখে নিচে নেমে আসলো। আয়াত এতক্ষণ বসে ছিল হঠাৎ অধরাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
> আপু কেমন আছো তুমি? কতদিন দেখা হয়নি। আম্মু তোমার কথা ভেবে কাঁদেন প্রতিদিন। তুমি জানো আম্মু অসুস্থ? তোমাকে দেখতে চেয়েছে। তুমি যাবে না?
অধরার চোখে পানি চলে আসলো। রক্তের সম্পর্ক নেই তবুও ছেলেটা ওকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে। অধরা ওর মাথায় হাত রেখে বসিয়ে দিয়ে বলল,
> যাবো আয়াত নিশ্চয়ই যাবো। আন্টি অসুস্থ আর আমি যাবোনা এমন হয়নাকি। অনেক ভুল হয়েছে আমার। তোদের খবর নেওয়া হয়নি। আসলে আমার তো ফোন নেই। তোর নাম্বার টাও রাখা হয়নি।
জুবায়ের এদের দুজনের কথোপকথনে বিরক্ত হচ্ছে। এই দুটো বাড়ি থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। আটকাবে কিভাবে? না যেতে দিলে তো আবার কাহিনী করবে। ওর বাবা মা আজ বাড়িতে নেই। একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে যেতে মানা করাও যায়না। জুবায়ের পড়ে গেলো বিপদে। যেতে দিবে না বলেও শেষমেশ অধরাকে যেতে দিলো। তবে ওকে একা ছাড়বে না। সঙ্গে ও ছোট বোন আর কাজের মেয়েটাকে সঙ্গে নিলো। ফাঁকি দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। অধরা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এক বছরের বন্দিজীবনের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। ও দ্রুত গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে নিলো। লুকিয়ে শাশুড়ির দেওয়া জিনিসপত্রগুলোও সঙ্গে নিয়েছে। ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হচ্ছে বাবা মায়ের ঘর তল্লাশি করা। সেখানে নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্লু থাকবে। কহিনুরের কাহিনী জেনে নিয়েছে। এবার জুবায়েরেদের পরিবারের কাহিনীটা জানতে পারলে মোটামুটি পালিয়ে গেলেও শান্তি।
☆☆☆☆☆☆☆
সুলতান আরমান ফারুকী ইচ্ছে মতো বাকবকি করছেন বাড়ির সকলের অপরে। উনি জুবায়েরের উপরে বিরক্ত। এই ছেলের জন্য যে উনার ধ্বংস অনিবার্য হতে চলেছে সেটা বুঝতে বাকি নেই। কিভাবে সে ভাইবোনদের ভবিষ্যতের কথা ভূলে গিয়ে বউকে নিয়ে শশুর বাড়িতে যেতে পারে এটা উনার মাথায় আসছে না। এই বাড়ির পাঁটা মেয়ে আর একটা ছেলের ভবিষ্যৎ জুবায়েরের উপরে নির্ভর করছে। এই একটা সুযোগ উনি কত চেয়ে পেয়েছেন সেটা শুধুমাত্র উনি জানেন। বড় ছেলেটা আধার রাতের জীব হয়ে গেছে। আলোতে আসতে পারেনা। মেয়েগুলোর বিয়ের কথা ভাবা যাবেনা। বিয়ে মানে কারো তরতাজা রক্তের গন্ধে সুলতান বাড়ি ভরিয়ে তোলা। এভাবে চললে এই বংশ বিলুপ্ত হতে সময় নিবে না। উনি বারবার জুবায়েরের কাছে ফোন দিচ্ছেন। কিন্তু ছেলেটা ধরছে না। আরমান ফারুকী ফোনটা আছাড় দিলেন। চোখমুখ শক্ত করে ভাবলেন, যাকে দিয়ে কাজ হবে না তাঁর উপরে মায়া রেখে কি হবে? এখন জুবায়ের না থাকলেও চলবে।
(চলবে )
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব৯
নিস্তব্ধ নির্জন কক্ষ, দেয়াল ঘড়িটা খসখস আওয়াজ করে ঘুরছে। দুজন মানুষের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। জানালা ভেদ করে চাঁদের আলো ভেতরে প্রবেশ করে কক্ষের মধ্যে থাকা আধারটা আবছা আলোতে রূপান্তরিত করেছে। জানালার ওপাশে ঘন জঙ্গল। হঠাৎ খুট করে আওয়াজ হয়ে দরজাটা আস্তে করে খুঁলে গেলো। অধরা ঘুমিয়ে ছিল হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে দ্রুত চোখ খুঁলে থাকালো। একটা ছায়া ধীরস্থির ভাবে পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। হুডি চাপানো লোকটার হাতে ঝকঝকে খঞ্জর, আলোতে চকচক করছে। অধরার বুক ধুকপুক করছে। ভাবলো লোকটার উদ্দেশ্য কি? ওকে মারতে চাইছে! কিন্তু কেনো? পাশে জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। অধরা নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। লোকটা যখনই ওর দিকে আক্রমণ করবে ও দ্রুত সরে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিবে। একে হাতেনাতে ধঁরা চাই। উত্তেজনাতে ওর হাত পা কাঁপছে। কিন্তু লোকটা ওর দিকে না গিয়ে সোজাসুজি বাম সাইডে জুবায়েরের দিকে এগিয়ে গেলো। এমনতো না যে আধারের জন্য ওকে চিনতে পারছে না। বেশ ভালো করে চেনা যাচ্ছে। টার্গেট ও নয় জুবায়ের।বিষয়টা খেয়াল হলো ততক্ষণে লোকটা খঞ্জর উঠিয়ে জুবায়েরের বুকে আঘাত করতে গেলো। অধরা তড়িৎ বেগে উঠে বসলো। লোকটার হাত সমেতো খঞ্জরটা ধরে ফেললো। প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি শুরু হলো। অধরার কাটা হাত আরও কিছুটা কেটে গেলো। ব্যাথায় টনটন করছে কিন্তু ও হাত ছাড়লো না। পাশে জুবায়েরের গায়ে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বলল,
> জুবায়ের দ্রুত উঠুন।
জুবায়ের পিটপিট করে চোখ খুঁলে হতভম্ব হয়ে গেলো। ওর বুকের উপরে দুজন ছুরি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। অধরা পারছে না লোকটার শক্তির কাছে। হিমশিম খাচ্ছে। জুবায়ের অপেক্ষা করলো না পা তুলে লোকটার বুক বরাবর লাথি বসিয়ে দিলো। অচেনা লোকটা ছিটকে গিয়ে মেঝেতে পড়লো। অধরা বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। জুবায়ের ওকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে লোকটা হাওয়ার গতিতে বেরিয়ে গেলো। অধরা নিজের সামলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের পিছু নিলো। বাড়ির বাইরের গেট খোঁলা। অগন্তুক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে গেছে। লোকটা আসার সময় সব রাস্তা তৈরী করে এসেছিল। শীতের রাত কেউ একবার রুমে ঢুকলে বাইরে বের হবে না এই ভরসাতে লোকটা এভাবে ভেতরে এসেছে। জুবায়ের লোকটাকে ধরতে না পেরে ফিরে আসলো। গেটের কাছাকাছি অধরার সঙ্গে দেখা হলো। মেয়েটার চোখেমুখে ভয় নেই আছে বিরক্তি। জুবায়েরকে এভাবে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো,
> ধরতে পারলেন না,ফিরে আসলেন কেনো? শুনুন ওই কিলারকে আমার চাই। যেভাবেই হোক। বাইরে সিসি ক্যামেরা আছে। এখানকার প্রতিটা বাড়ির সামনে আপনি ক্যামেরা পাবেন। আমি সবগুলো ফুটেজ দেখতে চাই আপনি ব্যবস্তা করুন। ওকে কে পাঠিয়েছে জানা দরকার।
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। জুবায়ের সেসব পাত্তা না দিয়ে অধরার হাতটা ধরে বিস্মিত হয়ে বলল,
> তোমার হাত কেটেছে? র*ক্ত বন্ধ করতে হবে। তুমি আগে কেনো ডাকলে না?
জুবায়ের হন্তদন্ত হয়ে ওর হাত ধরে ভেতরে ছুটলো। অধরা বিরক্ত হচ্ছে জুবায়েরের উপরে। লোকটা নিজে যখন কষ্ট দিবে তখন কিছু না। এইটুকু কেটেছে তাঁর জন্য উতলা হচ্ছে। কাজের কাজ নেই অকাজের গুণ বেশি। ও জুবায়েরকে মানা কারলো কিন্তু শুনলো না। সকালে আয়াতের সঙ্গে এসেছে ওরা। পাশাপাপাশি দুটো বাড়ি। অধরার ইচ্ছে হয়েছিল বাবা মায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে রাতে ঘুমানোর তাই এই বাড়িতে আছে। বাকিরা আয়াতদের বাড়িতে । অধরা ওদেরকে আনতে চেয়েছিল কিন্তু বহুদিন বাড়িটা পড়েছিল তাই ধুলাবালিতে পূর্ণ হয়ে আছে। পরিস্কার করার সময় ছিল না। একপ্রকার বাধ্য হয়ে জুবায়ের ওকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে এসেছে। জুবায়ের খুব যত্ন নিয়ে অধরার হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল,
> লোকটা কালো হুড়ি চাপিয়ে ছিল। মুখটা দেখতে পেলে ভালো হতো।
অধরা রাগে ফুলে উঠলো। নাকমুখ কুচকে বলল,
> সব আপনার দোষ। কে বলেছিল লাথি বসাতে?। চুপচাপ উঠে লোকটাকে ঝাপটে ধরা যেতো। শুধু আপনার জন্য। মাথায় কিছু নেই আপনার। পুষ্টিজনিত সমস্যা আছে। টুইন বেবি তো সব আপনার ভাইয়ের মাথায় চলে গেছে। এবার বলুন আপনার এমন কোনো শত্রু আছে যে আপনাকে হত্যা করতে চাইতে পারে?
জুবায়ের বিস্মিত হলো অধরার কথা শুনে। ওকে মারতে চাইবে এরকম লোক এখানে কে থাকবে। তাছাড়া ও যতই ঘাড় ত্যাড়া হোক বাইরের লোকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। একটু জেদি কিন্তু খারাপ না। সবাই ওকে পছন্দ করে। ও এতক্ষণ ভেবেছিল লোকটা অধরাকে মারতে এসেছিল। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো,
> মানে কি আমাকে মারতে চাইবে কেনো?
> লোকটা আপনাকে মারতে চেয়েছিল। দেখুন রুমে সামান্য হলেও আলো ছিল। তাছাড়া আমাকে মারতে চাইলে ডান সাইডে এসে আঘাত করতো কিন্তু না। আমি দেখেছি লোকটা দরজা থেকে সোজা আপনার দিকে নজর করে এগিয়ে এসেছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম আমাকে মারবে কিন্তু টোটালি মিথ্যা হলো। জুবায়ের আপনার অগোচরে বাজে একটা খেলা চলছে। আপনাকে ওই লোকটার পযর্ন্ত পৌঁছতে হবে।
জুবায়ের মলিন হাসলো ভয় পেলো না। অধরা না থাকলে এতক্ষণে প্রাণপাখি উড়াল দিতো সন্দেহ নেই। কিন্তু কে করতে পারে এসব?ডানে বামে সন্দেহ হয় কেউ নেই। নিজেকে নিয়ে ওর ভয় নেই। জুবায়ের সেসব পাত্তা দিলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
> আমাকে মারতে চাইবে কেনো তোমার অনুমান ঠিক নেই। দেখো তোমার বাবার কোনো শত্রু ছিল ওরাই প্রতিশোধের জন্য এসেছিল। আমি মৃত্যু দেখে ভয় পাই না। মারতে চাইলে মারবে চলো ঘুমাবে। তোমার শরীর ঠিক থাকা দরকার।
অধরা জ্বলে উঠলো জুবায়েরের এরকম আজেবাজে যুক্তি শুনে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ও ঝট করে জুবায়েরের কলার ধরে টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> ফালতু কথা বলবেন না। আমি আপনাকে একটুও পছন্দ করি না। রাগ হয় আপনাকে দেখলে। আমার রাগের পরিমাণটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শুনুন আমি আমার ভবিষ্যৎ বুঝে গেছি। আমার জীবন সংকটে আছে। জানি সামনে আমার মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু আপনাকে মরলে চলবে না। আমার বাচ্চাটাকে আপনাকে বাঁচাতে হবে। আমার সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তার জন্য ক্ষমা পাবেন শুধু কহিনুর কে রক্ষা করলে। আমি মরে যায়, চলে যায়, যা ইচ্ছা তাই হয়ে যায় কিন্তু আপনাকে বাঁচতে হবে। আমি শপথ নিয়েছি শেষ দেখে ছাড়বো। আপনি আমাকে আটকে রাখতে পারবেন না।
অধরা একদমে কথাগুলো বলে ওকে ছেড়ে দিয়ে কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো। জুবায়ের হতভম্ব হয়ে ভাবছে ওর বলা কথাগুলো। বাবা মা ওকে শুধু উত্তরাধিকার দিতে বলেছিল। বলেছিল এই বাচ্চাটা আসলে বাড়ির সব বিপদ কেটে যাবে। ভাই আলোতে আসতে পারবে। বোনদের বিয়ে হবে কিন্তু বাচ্চাটার ক্ষতি করবে বলেনি। একটা ছোট্ট বাচ্চা তার ক্ষতি কেনো করবেন উনারা? কি রহস্য চলছে ওর অজান্তে? জুবায়ের অপেক্ষা করলো না দ্রুত কক্ষে ফিরে গিয়ে ফোন নিয়ে বেরিয়ে আসলো। কাকে একটা ফোন করলো। রাস্তার পাশের সব গুলো সিসি ক্যামেরা চেক করা জরুরি। লোকটার মুখ দেখতে না পারলেও কোথা থেকে এসেছে এটা জানা যাবে। গাড়ি করে আসলে গাড়ির রঙ বা নাম্বার পাওয়া যাবে। জুবায়ের লোক লাগিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে পাশের বাসাতে খবর দিলো অধরাকে নিয়ে যেতে।
☆☆☆☆☆
অধরাকে সামনে নিয়ে বসে আছে বাড়ির বাকিরা। সকলের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। অয়াতের বাবা শেখর ইসলাম খুব ভয় পেয়েছেন। অধরা চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে ছিল। হঠাৎ কি একটা ভেবে বলল,
> আঙ্কেল বাবা মায়ের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছিল ওটা দেখানো যাবে? দুর্ঘটনার সময় যে গাড়িতে বাবার গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছিল ওটার মালিক কোথায় আঙ্কেল? এই শহরে গাড়ি দুর্ঘটনা হলো আর যে লোকটা দুই দুটো মানুষের প্রাণ নিয়ে নিলো তাঁকে ছেড়ে দিলো পুলিশ। তোমার সন্দেহ হলো না? তুমি কেস রিঅপেন করতে বলো। আমি এখানে যতদিন বা যতটা সময় আছি এর মধ্যে সবটা জানাতে চাই আপনি ব্যবস্থা করুণ। সন্দেহের উপরে না উপযুক্ত প্রমাণ নিয়ে শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করতে চাই আমি।
শেখর ইসলাম কিছুই বুঝতে পারলেন না। পুলিশ বলেছে দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে কোনো লোক ছিল না। এমনকি গাড়িটাও কারো নামে রেজিস্ট্রি ছিল না বিধায় আসল লোককে পাওয়া যায়নি। এর পেছনে কোনো ঘটনা আছে বলে উনার সন্দেহ হচ্ছে না। উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
> মা এটা সাধারণ দুর্ঘটনা বৈকি কিছুই না। তুমি খামাখা টেনশন করছো।
অধরা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বলল,
> আঙ্কেল আমি সন্দেহ করছি না আমি সিউর এটা হত্যা। আপনি প্লিজ সাহায্য করুন। আমি শেষটা দেখতে চাই। চোখের দেখার মধ্যে মাঝেমাঝে ভূল থেকে যায়।
অধরা কথা শেষ করে কক্ষে ফিরে আসলো। মারিয়া ওর খেয়াল রাখছে। কাজের মেয়েটা খাবার নিয়ে ওদের পেছনে পেছনে ছুটছে। জুবায়ের গায়েব। অধরা জানে জুবায়ের রেগে গেছে। এই লোকটাকে একটু রাগিয়ে দিতে পারলে কাজ হার হামেশা হয়ে যাবে। মাথামোটা লোক বুদ্ধি জ্ঞান নেই। অধরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। কয়েকবার ফোন করেছে কিন্তু রিসিভ করছে না।। সারাদিন পার করে গভীর রাতে বাড়ি ফিরলো জুবায়ের। ক্লান্ত শরীর। কক্ষে প্রবেশ করতে লেট হলো কিন্তু বিছানায় শুয়ে পড়তে লেট হলো না। অধরা এতক্ষণ ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। জুবায়ের সেসব পাত্তা দিলো না। অধরা দ্রুত গিয়ে জুবায়ের হাত টেনে বলল,
> অকর্মা, কুম্ভকর্ণ,খারাপ মানুষ আপনি। সারাদিন কোথায় ছিলেন? একটা কাজ দিয়েছি ঠিকঠাক পারেননি। আবার কথায় কথায় হুমকি ধামকি দিতে উস্তাদ। মানছি কাজটা কঠিন তাইবলে ফোন রিসিভ করলেন না কেনো? উত্তর দিন তাড়াতাড়ি।
জুবায়ের চোখ বন্ধ রেখেই মলিন হাসলো। ওর কথা পাত্তা না দিয়ে বলল,
> খেয়েছো তুমি? আসার সময় তোমার দরকারি জিনিসপত্র সব গুছিয়ে এনেছিলে?না আনলে লিস্ট করে রাখো আমি আগামীকাল নিয়ে আসবো। তোমার ড্যাডের বাড়িটা আমি আগামীকাল লোকজন দিয়ে পরিস্কার করে নিবো চিন্তা করো না।
অধরা হতবাক জুবায়েরের কথা শুনে। হঠাৎ পরিবর্তন কেনো বুঝতে পারছে না। ও চোখমুখ কুচকে বলল,
> কি হয়েছে আপনার? আমরাতো দুদিন পরেই ফিরে যাচ্ছি তাহলে এসব করে কি হবে?
> ও বাড়িতে আমরা আর ফিরছি না। প্রশ্ন করে আমাকে বিব্রত করোনা উত্তর দিতে পারবো না। তোমার বাবা মায়ের খুনি বা আমার উপরে আক্রমণকারীর ঠিকানা নিয়েও ঝামেলা করো না। আল্লাহর উপরে ছেড়ে দাও। সৃষ্টিকর্তার রহমত থাকলে আমি তোমাকে রক্ষা করতে যা যা দরকার হয় করবো। জানি আমি ভালো না। বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। না ঠকলে সত্যিই বোঝা যায় না কতটা কষ্ট হয়। এখন ঘুমিয়ে যাও।
জুবায়ের বালিশে উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো। কম্বলটা টেনে মাথা অবধি ঢেকে নিয়ে। অধরা ওর পাশে বসে আছে। যতটুকু জ্ঞান আছে বুঝে নিলো জুবায়ের সবটা জেনে গেছে কিন্তু বলছে না। হয়তো নিজের পরিবারের উপরে আঙুল উঠেছে তাই মানতে পারছে না। অধরা জানে আরমান ফারুকী সহজে ওদেরকে এভাবে ছাড়বে না। খুব তাড়াতাড়ি একটা উপাই বের করে অধরাকে নিয়ে যাবেন। সেদিন জুবায়ের ছিল বলে ও আসতে পেরেছিল নয়তো কখনও পারতো না। সব জায়গাই একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। লোকটা নিজের আপন ভাইকে মেরে সম্পত্তি দখল করেছিল। এবার কি নিজের ছেলেকে মারবেন? কি লাভ এতে?
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১০
সকল প্রকার খারাপ পরিস্থিতি বা অশুভ কোনো সময়ের মধ্যেও ভালো কিছু সময় থাকে যেটা স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকে। তাছাড়া আধার পেরিয়ে আসে রাঙা প্রভাত। কালো রঙ মিলিয়ে গিয়ে সোনালী সূর্য নিয়ে আসে আলো ঝলমলে সকাল। প্রভাতফেরির গানে মুখোমুখি হয়ে যায় পৃথিবী। অধরা ঘুম থেকে উঠে হতভম্ব হয়ে গেছে। গতকাল অনেক রাতে ঘুমানোর ফলে উঠতে লেট হয়েছে। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে। অধরা দ্রুত জানালা দিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে উঁকি দিতেই চোখ ছানাবড়া। জুবায়ের লোকজন লাগিয়ে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করছে। বাড়ির সামনে কয়েকজন গান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার মতলোব কি কে জানে। জুবায়ের সত্যি সত্যি এসব করবে ওর ধারণা ছিল না। ভেবেছিল ঘুমের মধ্যে সব ভূলে যাবে। ও আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখা হলো আয়াতের সঙ্গে। ছেলেটা মুখ ভাব করে আছে ওকে দেখে ঠোঁট উল্টে বলল,
> আপু তোমার বরের মাথা পুরোপুরি গেছে। কতবার বললাম আমাদের সঙ্গে থাকার কথা কিন্তু শুনলো না। সেই তোমাদের বাড়িটা পরিস্কার করতে উঠেপড়ে লেগে গেলো। হয়েছে টা কি বলবে? হঠাৎ পরিবর্তনটা কেমন জানি মানতে কষ্ট হচ্ছে।
অধরা মলিন হেসে আয়াতের কাধে হাত রেখে বলল,
> চিন্তা করিস না আমি সামলে নিবো। মারিয়া কোথায়?
আয়াত মাথা চুলকে বলল,
> তোমার ননদ আমাকে দেখলে পালিয়ে যায়। তোমাদের বাড়িতে আছেন।
> ওর থেকে দূরে থাক ভাই। আমি চাইনা কোনো ঝামেলা হোক। ওরা আমাদের মতো নরমাল না। জানিনা কি রহস্যের ওদের আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে আছে। দূরে থাক তোর ভালো হবে। আমার মতো তোকে কষ্ট পেতে দিতে চাইছি না।
> কিন্তু…
> কোনো কিন্তু না। আমি যাচ্ছি।
অধরা কথাটা বলে অপেক্ষা করলো না। দ্রুত নিজেদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। বাড়িতে পৌঁছাতে ওর কয়েক মিনিট সময় লাগলো। সোফা থেকে শুরু করে জানালার পর্দা পযর্ন্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। একদম ঝকঝকে করে ফেলেছে। অধরা ঘুরে ঘুরে সবটা দেখলো। মনে হচ্ছে সব কালো ছায়া জীবন থেকে দূর হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটা টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে। মারিয়া ওকে সাহায্য করছে। অধরাকে দেখে মারিয়া চমৎকার করে হাসলো। ইশারা করলো সবটা কেমন লাগছে। অধরা বিনিময়ে মিষ্টি করে হেঁসে বলল,
> দারুন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জুবায়ের এসে হাজির। সঙ্গে একগাদা শপিং ব্যাগ। পেছনে পেছনে দুজন লোক এসে আরও কিছু প্যাকেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। জুবায়ের সেসব নিয়ে কক্ষে রেখে এসে ধপ করে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। সামনে রাখা আপেলের টুকরোতে কামড় বসিয়ে বললো,
> মোটামুটি সব ঠিকঠাক। দরকারি জিনিসপত্র কেনাকাটা হয়ে গেছে। আরও লাগলে বলবে।
অধরা ভ্রু কুচকে বলল,
> আপনি তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন এখানে থাকবেন? ফিরে না গেলে আপনার ড্যাড মানবেন তো? দেখুন ঝামেলা করে কি লাভ তারচেয়ে চলুন ফিরে যায়।
জুবায়ের বিরক্ত হলো অধরার কথা শুনে। মেয়টা এতোদিন এখানে আসার জন্য ঝামেলা করছিল এখন এখানে থাকতে চাইছে না। এর মতলব কি কে জানে। কৌতূহল দমিয়ে রেখে উত্তর দিলো,
> ওখানে থাকলে তোমার মাথায় আজেবাজে চিন্তা ঘুরঘুর করে। বাচ্চার জন্য এসব ভালো না। অতিরিক্ত টেনশনে যদি আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয় তখন? যে আসছে সে একটা মানুষের বাচ্চা কোনো ভূতের বাচ্চা না যে সমস্যা হবে না।। ও বাড়ির নাম নিবে না। চুপচাপ খাও আর সকলের সঙ্গে আড্ডা দাও। বাকীটা আমি দেখবো।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা আর ঝামেলা করলো না। এই লোকটার যে তার ছেড়া মাথায় ছিট আছে এটা ওর অজানা নেই। জীবনে তাঁর ভুলের শেষ নেই। মাথা গরম করে আজ পযর্ন্ত যা যা সিদ্ধান্তটা নিয়েছে আজ অবধি সেটা সাকসেস হয়নি। ক্ষেপাটে টাইপের মানুষ। অধরা চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গিয়ে বসলো। বাবা মায়ের রুমটা তালা লাগানো আছে। অধরা কিছু একটা ভেবে চাবিটা তুলে নিয়ে বাবা মায়ের রুমের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। আগের মতোই সাজানো গোছানো আছে। তবে প্রচুর ধুলাবালি। অধরা আলমারির ভেতর থেকে বাবা মায়ের ছবিটা বের করে দেখে নিলো। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। অধরার চোখে পানিতে ছলছল করছে। কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়েও পড়লো। খুনীকে ধরতে পারলে ও তাঁর থেকে জিঞ্জাসা করবে ওকে এতিম করে লোকটার কি এমন লাভ হয়েছে। অধরা ছবিটা রেখে বেশ কিছু জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করলো। ওর বাবা মায়ের ফোন দুটো বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। এক বছর অন করা হয়নি। চার্জও নেই নাকি নষ্ট হয়ে বন্ধ অধরা বুঝতে পারলো না। দ্রুত সেগুলো চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ওর বাবার ফোনের গ্লাস ঠিক নেই। অধরা মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসলো। পরে আবারও আসবে ভাবলো। রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে মায়ের লাল রঙের শাড়িটা সুন্দর করে পরে নিলো। ভাবলো আজ সারাদিন বাবা মায়ের ছবিটা সামনে নিয়ে বন্ধ রুমে বসে থাকবে। মায়ের শাড়ি থেকে মা মা গন্ধ আসছে। অধরা ভাবনা অনুযায়ী মায়ের শাড়ি পরে ছবির ফ্রেম বুকে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পরে বাবা আয়ের ছবিটা বুকে নিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
☆☆☆☆☆☆
ঘন জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক পাহাড়ের টিলা। চারদিকে সবুজের সমারোহ। অধরা নিচে দাঁড়িয়ে ওই টিলার দিকে তাঁকিয়ে আছে। গায়ে শক্তি পাচ্ছে না। টিলা থেকে বাচ্চার আওয়াজ ভেসে আসছে। অধরার মন আনচান করছে বাচ্চাটাকে দেখার জন্য। কিন্তু উপরে কিভাবে উঠবে বুঝতে পারছে। বহুকষ্টে থেমে থেমে ও উপরে উঠে গেলো। হাঁপাতে হাঁপাতে আশপাশে তাকিয়ে দেখলো। দূরে একটা বাচ্চা খেলছে। ওর হাসির শব্দে সারা বনজুড়ে ঝঙ্কার তুলেছে। অধরা আর অপেক্ষা না করে ছুটে গিয়ে বাচটাকে ধরতে গেলো কিন্তু পারলো না। তাঁর আগেই একটা মুখোশধারি লোক ওর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। মূহুর্ত্তের মধ্যে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে গেলো। কোথা থেকে জুবায়ের এসে হাজির হলো। ও বাচ্চাটাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বাঁকা হাসলো। অধরা খেয়াল করলো ওর হাতে ধারালো খঞ্জর। অধরা মনে হলো ওর মতিগতি বুঝতে পেরেছে তাই চিৎকার করে বলল,
> ওকে মারবেন না প্লিজ। জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে যা ইচ্ছা করুন প্লিজ।
জুবায়ের শুনলো না। বাচ্চাটার গলাতে টান দিতে গেলো তখনই জুবায়েরের রূপি আরেকজনের আগমন ঘটলো। ও দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে চাইলো। অধরা ততক্ষণে ছুটে গেলো কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পেছনে থেকে অধরাকে চুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। যেটা ওর কোমরে গিয়ে বিধেছে। অধরা চিনতে পারছে না কোনটা জুবায়ের আর কোনটা ওর ভাই। হঠাৎ ওদের চোখের দিকে তাঁকিয়ে বুঝলো। এতক্ষণ জুবায়ের ভেবে ভূল করছিল ওটা জুবায়ের না। ওর ভাই। লোকটা জুবায়েরের বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়ে লাথি দিয়ে ছুটিতে দিলো। জুবায়ের ছিটকে পড়েছে তবে হাতে এনেছে বাচ্চাটাকে। একদম পাহাড়ের ধারে গিয়ে ও দাঁড়িয়ে আছে। অধরা ঝাপসা চোখে চিৎকার করে বলল,
> আপনি পড়ে যাবেন পিছিয়ে যাবেন না। পড়লে ওকে বাঁচানো যাবে না।
জুবায়ের সেসব পাত্তা দিলো না শুধু মলিন হাসলো। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে উচ্চারণ করলো
> আমি না থাকলেও ও থাকবে। ও আমার অংশ, আমার আত্না। আমার স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষমা পাওয়ার অবলম্বন। ও বাঁচবে তুমি চিন্তা করোনা।
জুবায়ের ধুপ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়লো। অধরা চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। সেদিনের সেই স্বপ্নটা ঘুরেফিরে এক দৃশ্য। একটু পরিবর্তন তবে শেষ পরিণতি তো এক। কি ইঙ্গিত দিচ্ছে এই স্বপ্নটাতে? অধরা প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। সামনে খারাপ দিন আসতে চলেছে বুঝতে পারছে। ভাবলো এটাইকি আমার নিয়তি? এই মূহুর্তে ওর জুবায়েরের কথা খুব মনে পড়ছে । দ্রুত উঠে বসলো। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার যথাযথ চেষ্টা করলো কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারলো না। ঘর থেকে এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে গেলো। কাজের মেয়েটা খাবার রেডি করছে। মারিয়া বই পড়ছে। অধরা সোজাসুজি মারিয়াকে জিঞ্জাসা করলো,
> তোমার ভাইয়া কোথায়?
মারিয়া বাইরে ঈঙ্গিত করতেই অধরা ছুটলো বাইরে। জুবায়ের বাইরে টেবিল চেয়ার দিয়ে সাজিয়েছে। শীতের সকল বা বিকেলে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য। ও সেসব সাজিয়ে গার্ডের সঙ্গে আলাপ করছিল। অধরা ছুটে গিয়ে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মনে হলো এটাই হয়তো শেষবার জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরা। এর পরে আর সুযোগ আসবে না। অন্যদিকে জুবায়ের হতভম্ব মেয়েটার এমন আচরণ দেখে। এক বছর বিবাহিত সংসার জীবনে আগে কখনও জড়িয়ে ধরা বা বউকে বুকে নিয়ে ঘুমানো এসব হয়নি। জুবায়ের ইচ্ছে করে ওকে ইগনোর করতো। কিন্তু আজ কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছে না। পাশের লোকদেরকে ইশারা করলো সরে যেতে। ওরা আদেশ মাত্র চলে গেলো। অধরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। জুবায়ের কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> আরে কাঁদছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে বলো? ডাক্তার ডাকবো?
অধরা কথা বললো না। নির্বিকারভাবে কাঁদছে। জুবায়ের ওকে জোর করে সামনে টেনে আনলো। মুখটা নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> কি হয়েছে না বললে বঝবো কিভাবে? বাঘীনির চোখে পানি আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ সবটা বলো।
অধরা ফুপিয়ে উঠে বলল,
> আমাদের ফিউচার আমি দেখে নিয়েছি বোধহয়। সময় খুব কম। ক্ষমা করবেন আমার ব্যবহারে কষ্ট পেলে। খুব সরি।
অধরা দ্রুত জুবায়েরকে ছেড়ে দিয়ে যেভাবে দৌড়ে এসেছিল সেভাবেই দৌড়ে চলে গেলো। জুবায়ের কিছু সময় তাঁকিয়ে ওর পিছু ছুটলো। অধরা সোজা গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। জুবায়ের বহুবার দরজা ধাক্কা দিয়েও কাজ হলো না। মেয়েটা দরজা খুললো না। জুবায়ের বাধ্য হয়ে নিচে গিয়ে সোফায় বসলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। অধরা সন্ধ্যায় খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা খুলে নেমে আসলো। মনে হলো কিছুই হয়নি। জুবায়ের জিঞ্জাসা করলো কিন্তু ও বলল না। হাসিখুশি মুখে পাশের বাড়িতে আন্টির কাছে চলে গেলো। জুবায়ের কিছু বুঝতে পারলো না তবে উতলা হলো। মেয়েটার জন্য হঠাৎ করেই আজ কেমন টেনশন হচ্ছে। ভালোলাগা কাজ করছে।
☆☆☆☆☆
অধরা আজ নিজের বাড়িতে ফিরে যায়নি। আয়াতদের বাড়িতে আছে। আন্টির সঙ্গে ঘুমাবে বলে রাতে থেকে গেছে। জুবায়ের কয়েকবার এসেছে শেষমেষ নিজেও থেকে গেছে। ও উশখুশ করছে কি হয়েছিল শোনার জন্য। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। জুবায়ের হতাশ হলো। মেয়েটার মাথায় কি ঘুরছে কে জানে। অধরা চুপচাপ খেয়ে রুমে গিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো। আন্টির সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লো। ভোররাতের আগে হঠাৎ খুটখাট আওয়াজে ওর ঘুম ভাঙলো। দ্রুত উঠে বসলো। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সেদিনের ঝামেলার পর থেকে রুমের বাইরে আলো জ্বালানো থাকে। অধরা দরজা দিতে বেরিয়ে আসলো। চুপচাপ মেইন দরজা খুলতেই দেখলো খোলা গেটের সামনে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। নীল রঙের হুড়ি চাপিয়ে গেটে হেলান দিয়ে হাতদুটো ভাজ করে আছে। অধরা একপা দুপা করে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> শীতের মধ্যে এখানে কি করছেন?
অধরা দ্বিতীয়বার জিঞ্জাসা করতে গিয়ে থমকে গেলো।ওর চোখের দিকে তাঁকিয়ে পিছিয়ে আসলো। এটা কিছুতেই জুবায়ের না। স্বপ্নের কথা ভেবে ও ঢোক গিলল। লোকটা ক্রমশ ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১১
পশ্চিম আকাশে চাঁদ বাঁকা হয়ে কিরণ দিচ্ছে। বাড়ির ডান সাইডে থাকা আলোর ছিটা গেট পযর্ন্ত ছড়িয়ে আছে। অধরা ক্রমাগত পিছিয়ে আসছে। সামনের মানবটার দৃষ্টি ওর মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করছে। অধরা পেছনে ফিরে দৌঁড় দিবে সেই সময় লোকটা ওকে থামিয়ে দিলো। বলে উঠলো
> থামো মেয়ে, আমি তোমার ক্ষতি করতে আসিনি। কিছু বলতে এসেছি।
অধরা থমকে গিয়ে ভয়ে ভয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
> শুনতে চাই না আপনার কথা। ধবংস করতে চাইছেন তো আমাকে? আমি এমনিতেই ধবংস হয়ে গেছি।
অধরার কথা শুনে লোকটা হাসলো। ঠোঁট কামড়ে বলল,
> সন্দেহ করে দোষারোপ করা কি উচিৎ হচ্ছে? আমি খারাপ কিছু করেছি দেখেছো আজ অবধি? ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে তুমি খামাখা আমাকে ভয় পাচ্ছো। আমি ছোট থেকেই আলোতে যেতে পারিনা কারণ সূর্যের আলোতে আমার সমস্যা হয়। শরীর লাল হয়ে ফুলে উঠে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। এটা এক ধরনের রোগ। তুমি এই বিষয় নিয়ে সন্দেহ করছো? আর কহিনুরের বিষয়টা ওটা ড্যাড দাদুর থেকে পেয়েছে। দাদু কি সব আজেবাজে কথাবার্তা বলে উনার মাথা খারাপ করে দিয়েছেন। তুমি অযথাই ভয় পাচ্ছো। আমি তোমাকে পছন্দ করি। তোমার ক্ষতি কেনো চাইবো আমি, বলো?
অধরা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। শাশুড়ির শেষ কথাটা বারবার কানের মধ্যে প্রতিধ্বনি করছে। কাউকে বিশ্বাস করা উচিৎ হবে না। তবুও কিছু বলা দরকার তাই বলল,
> আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার স্বামী চেয়েছেন তাই এখানে আছি। এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছু নেই। আপনি কি এগুলো বলতেই এসেছেন?
লোকটা এক’পা দু’পা করে একদম অধরার সামনে এসে থামলো। দৃষ্টি ওর মুখের দিকে। অধরার অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটা হেসে বলল,
> বিশ্বাস করছো না জানি। তবুও আমি চাই তোমরা ফিরে আসো। ভূল ধারনা নিয়ে বসে থেকে কি হবে বলো? নিজের চোখে না দেখলে সেটা নিয়ে চিন্তা করে কি হবে?
অধরা লোকটার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। মনে হলো চিৎকার করে সবটা বলতে কিন্তু পারলো না। কিছু বলতে চাইলো তাঁর আগেই অধরার পেছন থেকে জুবায়ের বলে উঠলো,
> ও এখানেই থাকবে আমার সঙ্গে। বাড়িতে নিতে পারলে আমাকে খুন করে আমার স্ত্রী সন্তানকে নিজের কব্জায় নিতে খুব সুবিধা হবে জানি। কিন্তু কি বলতো আমি আপাতত সেটা চাইছি না। পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর। সবাই নিজের কথা ভাবে আমিও তাঁই ভেবেছি। কহিনুরকে না পেলে তোদের সমস্যা, আমার তো না? তাহলে আমি কেনো তোদের জন্য নিজের স্ত্রী কন্যাকে ত্যাগ করবো? কোন সুখ পাবো মিস্টার জামসেদ ফারুকী? ভালো করে শুনে নিন আপনার আর আপনার ড্যাডের কোনো পরিকল্পনা সফল হচ্ছে না।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। সামনে ওর ভাই জামসেদ ফারুকী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। হয়তো জুবায়েরের থেকে এসব আশা করেনি। জুবায়ের অধার হাতের কব্জি ধরে ফিসফিস করে বলল,
> ভেতরে যাও শীত পড়ছে। আমি কথা বলে আসছি।
অধরা কি করবে বুঝতে পারছে না। থাকা উচিত নাকি চলে যাওয়া উচিৎ? দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা হচ্ছে ওর থাকা শোভা পাচ্ছে না কিন্তু না থাকলে যদি এরা দু’ভাই ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তখন? জুবায়ের ওর সঙ্গে একবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দ্বিতীয়বার করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। করতেই পারে। তাছাড়া ও ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। স্বামী বলে তাঁকে কারণ ছাড়া বিশ্বাস করে ঠকার মনে হয়না। জুবায়েরকে ও আপাতত সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছে। অধরাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুবায়ের আবারও বলে উঠলো,
> কি হচ্ছে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বিশ্বাস করতে পারো শেষবারের মতো।
অধরা কিছু বললো না। চুপচাপ ভেতরে চলে গেলো। জুবায়ের একবার পেছনে তাঁকিয়ে সামনে দৃষ্টি ফিরালো। জামসেদ তখনো চুপচাপ ছিল। অধরাকে যেতে দেখে চাপা কন্ঠে বলল,
> ভাই তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস? শোন আমি কিন্তু ইনোসেন্ট। যা হচ্ছে তাঁর বিন্দুমাত্র আমার হাত নেই। জানিস তো ড্যাড কেমন? দাদু উনার মাথায় আজেবাজে সব ঢুকিয়েছে। তাছাড়া তোর যদি অধরাকে নিয়ে আমাদের এই বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় তাহলে ওকে নিয়ে তুই দাদুর কাছে চল। ওখানে থাকবি। ওখানে দাদু দাদিমা সবাই আছে।
> এখানে থাকলে কি অসুবিধা? তাছাড়া তুই কেনো মাথা ঘামাচ্ছিস? আমার স্ত্রী কোথায় থাকবে সেটা না হয় আমি ভাববো। ড্যাডকে বলিস এসব কু কর্ম ছেড়ে ভালো হয়ে যেতে। আধুনিক যুগে বসবাস করে সেই আদিকালের মতো ফালতু জিনিস নিয়ে উনি পড়ে আছেন। তাছাড়া আমি তো এখন তোদের পথের কাঁটা। উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হলো কিন্তু হলো না। ভাই অযথা সময় নষ্ট করিস না। এবার যা আমি আসছি।
জুবায়ের কথা শেষ করে এক মূহুর্ত আর অপেক্ষা করলো না। হাটতে শুরু করলো। ওকে পেছন থেকে বহুবার ডাকা হলো। জুবায়ের ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে অধরার পাশে গিয়ে বসলো। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। শরীর আগের চেয়ে হালকা ফোলা ফোলা লাগছে। পেটের আকৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরীরের উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে। মেয়েটাকে এতোদিন কেনো যে এভাবে দেখা হলো না এখন বেশ আফসোস হচ্ছে। তখন তো জুহি আর আরমান ফারুকীর জন্য চোখে পট্টি বাঁধা ছিল। জুবায়ের একমনে এসব ভেবে চলেছে। হঠাৎ অধরার কথা শুনে ওর ধ্যান ভাঙলো। অধরা চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলো,
> দেখা শেষ হয়ে থাকলে বলুন উনি সত্যি সত্যি কোনো রোগে আক্রান্ত কিনা?
জুবায়ের থতমত খেয়ে বলল,
> আমি জানিনা। মাম্মা বলেন ও ছোট থেকেই এমন। ওর সুবিধার জন্য লুকিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে।
> লুকিয়ে কেনো? লোকজন উনার অস্তিত্ব জানলে অসুবিধা কি হতো? নাকি অন্যকিছু। ধরুন ওর কাছে এমন কোনো পাওয়ার আছে যেটা আপনার কাছে নেই। আপনাকে খু*ন করে ওকে আপনার জায়গাই প্রতিষ্ঠা করবেন আপনার বাবা। আপনাকে হত্যার পেছনে আরও কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে সেটার খোঁজ করুন। এখানে বসে থেকে কিছু হবে না। চলুন এমন কোথাও যায় সেখানে গিয়ে পুরোপুরি রহস্যের সমাধান জেনে নিতে পারবো। আমাকে নিয়ে টেনশন নেই। বাচ্চা হতে এখনো অনেকটা সময় আছে। ততদিন আমাকে কিছু করবে না। বিপদ আপনাকে নিয়ে। জুবায়ের বসে থাকলে সমস্যা বৃদ্ধি হবে। বুদ্ধি নেই কেনো আপনার?
জুবায়ের অধরার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। এই মেয়েটার বুদ্ধি সত্যিই চমৎকার। ওর ভালো লাগছে অধরা ওকে নিয়ে চিন্তা করছে কিন্তু ওকি আদো মেয়েটার ভরসার যোগ্য? জুবায়ের কিছু একটা ভেবে বলল,
> ওই বাড়িতে পা রাখলেই আমি নিজের মধ্যে থাকি না। জানিনা কি হয় তোমাকে দেখতে পারিনা। রাগ হয় অশান্তি লাগে। আমি না চাইতে তোমার উপরে টর্চার করি। কিছু একটা আছে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। বোঝাতে পারবো না তোমাকে।
অধরা আগ্রহ নিয়ে বলল,
> আপনি তখন নিজের মধ্যে সত্যি থাকেন না। সম্মোহন করা হয়। কারো হাতের পুতুলের মতো আচরণ করেন। যাইহোক এসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। আমি বুদ্ধি বের করছি। আপনি আমাদের যাওয়ার কথা ভাবুন। এখানে ফিরবো একেবারে সব রহস্য জেনে তারপর।
> আমাদের আরেকটি বাড়ি আছে তুমি জানো? সেখানে দাদু আছেন। ভাই বলছিলো ড্যাড এসব দাদুর কথায় করছেন। তুমি যাবে সেখানে?
অধরা একটুও চমকালো না। বাড়ি থাকতেই পারে। কারণ আরমান ফারুকী স্ত্রীকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় সেখানে থাকেন। কিন্তু সেই বাড়িতে কে কে আছে এটা ওর জানা নেই। কখনও বলতে শোনেনি। অধরা সোফায় হেলান দিয়ে বলল,
> যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। আর আপনার ভাইকে একটু বলবেন ভাতৃবধুকে বোনের নজরে দেখলে ভালো হয়। হারাম জিনিসের প্রতি উনার একটু বেশিই আগ্রহ। আমি যতই নিজেকে আড়ালে রাখি উনি সামনে চলে আসছেন।
জুবায়েরের খারাপ লাগছে,রাগ হচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
> সরি। তোমার সন্ধান কিন্তু ওই দিয়েছিল। আমাকে বলেছিল শুধু বিয়ের পরে একটা বাচ্চা হলে তোমাকে ছেড়ে জুহিকে বিয়ে করে নেওয়ার কথা। তাছাড়া তখন আমি ড্যাডের বাধ্য ছিলাম। ভাইবোনদের কথা ভেবেছিলাম।
অধরা ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
> বউরা সব সময় খারাপ হয়না। আপনাদের মতো পুরুষের বিয়ে করা সাজে না। ভাইবোনদের ভালো করতে নিষেধ করছি না তাইবলে নিজের সন্তানকে তাঁদের হাতে তুলে দিবেন এটা কেমন কথা? আপনি জানেন ঘরের শান্তি হচ্ছে স্ত্রী সন্তান। যাইহোক বুঝতে হবে না। রহস্যের সমাধান করে আমাকে ছেড়ে দিয়েন। জুহি তো নেই আত্না ফাত্তা থাকলে ডেকে নিয়ে বিয়ে করে নিয়েন। আমি মেয়েকে নিয়ে থাকবো। তারপর যদি ভালো কাউকে পাই তখন বিয়ে নিয়ে ভাববো। আমি যথেষ্ট সুন্দরী । ছেলের অভাব হবে না। তাছাড়া আপনার ভাই আছেন তো। উনি বারবার আমাকে কু ইঙ্গিত….
অধরা বাকীটা বলতে পারলো না। জুবায়ের ওকে মুখ চপে ধরে রাগে ফুলছে। ভ্রু কুচকে বলল,
> বিশ্বাস ভেঙেছি শাস্তি হিসেবে সারাজীবন এক কক্ষে দুটো বিছানা তৈরী করে ঘুমাবো তবুও চোখের সামনে থাকা চাই। আমি খারাপ মানুষ সারাজীবন খারাপ থাকবো। মারামারি জোরজবরদস্তি সব আমার কাজ। ভালো হতেও চাইছি না। তুমি যদি এসব ফালতু চিন্তা করে থাকো আমিও খারাপ হবো। ভালোবাসা বাসির দিন শেষ। আমাকে দেখতে না চাইলে চোখ বন্ধ করে আমার সামনে ঘুরবে সমস্যা নাই।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে চলে গেলো। অধরা জানতো এমন কিছুই হবে। জুবায়েরকে চিনতে ওর বাকি নিই। একটু চেতিয়ে দিলেই কাজ হয়েছে। যে ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে সেখানে এই মাথা মোটা লোকটাকে নিয়ে গিয়ে বিপদ হবে কি কে জানে।
☆☆☆☆☆☆☆☆
গাড়ি চলছে জুবায়েরের দাদুর বাড়িতে। সকাল সকাল আঙ্কেল আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়েছে অধরা। সঙ্গে আয়াত এসেছে। অধরা ওকে নিতে চাইনি কিন্তু ছেলেটা শুনছে না। যদি কোনো ঝামেলা হয় তাই জোর করে এসেছে। কাজের মেয়েটা আর মারিয়াও আছে। জুবায়ের মারিয়াকে রেখে কোথাও যায়না। বোনকে সঙ্গে রাখে। মেয়েটার মধ্যে কিছু ঝামেলা আছে। আরমান ফারুকী জানলে ঠিকই মেয়েকে নিজের কাজে লাগিয়ে দিবে। সকলের ছোট বোনটাকে ওর বাকী বোনদের থেকে আলাদা রাখে। ওরা বোবা বধির হতে পারে কিন্তু কিভাবে জানি মানুষের সব কথা বুঝে যায়। রাতের আধরে সব পার্টিতেও যায়। কোনো রাত মিস করে না। দীর্ঘ চার ঘন্টা পর গাড়ি থামলো বিশাল এক অট্টালিকার সামনে। বাড়িটার ধুসর রঙের। অধরা গাড়ি থেকে পা নামাতেই মনে হলো পুরো শরীর কেঁপে উঠে পড়ে যাবে। জুবায়ের ওকে ধরে ফেলল। দীর্ঘসময় গাড়িতে থাকার ফলে এমন হচ্ছে। মারিয়া এসে ওর হাত ধরে ইশারা করলো ভেতরে যাওয়ার জন্য। গেটের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে ওদেরকে বরণ করে নিতে। বাড়ির ভেতরটাতে ছোটখাট একটা বাগান দেখা গেলো। আচার্যের বিষয় এখানে কোনো ফুল নেই। অধরাকে রাণীর মতো বরণ করা হচ্ছে এটাই ওকে ভাবাচ্ছে। কয়েকজন মিলে ওকে ভেতরে নিয়ে বসতে দিলো। অধরা বসতেই সিঁড়ি দিয়ে একজন সাদা চুলের বৃদ্ধ লোক নেমে আসলো। অধরা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো।
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব: ১২
আলো ঝলমলে শীতের দুপুর। ধুসর রঙের অট্টালিকার ভেতরটা মোটেও ধুসর রঙের না সাদা রঙের। কেমন অদ্ভুত সব কিছু। ভেতরে দামিদামি আসবাবপত্রের ছড়াছড়ি। অধরার পাশে আয়াত চুপচাপ বসে আছে। ছেলেটা এদের অতিথি সেবায় মুগ্ধ, যেটা ওর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে। জুবায়ের ওদেরকে বসিয়ে দিয়ে কোথায় একটা ঘাপটি মেরেছে। অধরা অনবরত ঢোক গিলছে। জুবায়েরের দাদুর দৃষ্টিটা কেমন কু-ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেমন জানি অদ্ভুত রকম। লোকটার চোখের পাপড়ি গুলো তুলনামূলক ভাবে বেশ বড় আর সাদা রঙের। সাদা পাঞ্জাবীর সঙ্গে লোকটা সাদা রঙের লুঙ্গি পরেছে। ভদ্রলোক যে বাঙালি সেটা উনার পোশাক দেখে বোঝা যাবে কথা বলার দরকার হবে না। অধরার ধ্যান ভাঙলো ভদ্রলোকের কথা শুনে। চমৎকার করে হেসে বলে উঠলেন,
> দাদুভাই কেমন আছো? আমার শরীর ঠিক ছিল না তাই বাংলাদেশ গিয়েছিলাম তাই তোমার সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ হয়নি। তবে কিন্তু তোমাকে আমার কাছেই থাকতে হবে দাদুভাই। কাছ ছাড়া করছি না।
অধরা জোর করে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি দাদুভাই। আপনার কথা আমি জানতাম না। জুবায়ের কখনও বলেননি আপনার কথা। আপনাকে আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছিল কেনো দাদুভাই?
ভদ্রলোক যেনো কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন এমন প্রশ্ন শুনে তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কাকে একটা ডেকে ওদেরকে ফ্রেস হতে কক্ষে নিয়ে যেতে বললেন। জুবায়েরের একটা ফুপি আম্মা আছেন তার এক ছেলে দুই মেয়ে। সবাই এখানে থাকে। মেয়ে দুটো কথা বলতে পারে কি বুঝতে পারলো না। কারণ এখনো পযর্ন্ত ওদের কোনো কথা শোনা যায়নি। জুবায়ের যে মাঝেমাঝেই গায়েব হয়ে যেতো এটাই তাঁর রহস্য। এখানে এসে থাকতো। অধরা ভাবতো অফিসের কাজ বিজি আছেন। আয়াতকে ফুপির ছেলেটা এসে নিয়ে গেলো। অধরা সেদিকে তাঁকিয়ে একটু টেনশন করলো ছেলেটার আবার কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়। অধরা আসার সময় লুকিয়ে ফোন নিয়ে এসেছে যেটা জুবায়ের জানেনা। অধরা ফোনটা নিজের সঙ্গে সঙ্গে রাখবে। যখনই বিপদের ঈঙ্গিত পাবে পুলিশে ফোন করবে। তাছাড়া শাশুড়ির দেওয়া জিনিসপত্রগুলোকে সঙ্গে নিয়েছে। খালি হাতে যুদ্ধে নেমে হেরে যাওয়ার মানে হয়না। এবার যা করবে বুদ্ধি দিয়ে। অধরাকে ওর ফুপি শাশুড়ি রুমে নিয়ে গেলো। একটু পরে কাজের মেয়েটা লাগেজ দিয়ে গেলো। বেশ বড়সড় সাজানো গোছানো কক্ষ। দেয়ালে টাঙানো জুবায়েরের বড় একটা ফ্রেম বন্দি ছবি টাঙানো আছে। অধরা আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলো। হঠাৎ জুবায়েরের কন্ঠ শুনে ও চমকে উঠে পেছনে তাকালো। জুবায়ের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
> ম্যামের পদধুলিতে আমার কক্ষটা ধণ্য হলো। এবার বলুন কেমন লাগছে! পছন্দ হয়েছে?
অধরা মুখে হাত রেখে চিন্তিত হয়ে বলল,
> সব ঠিকঠাক, তবে একটাই সমস্যা সেটা হচ্ছে বেলকনি। এখানে কোনো বেলকনি নেই কেনো? মন খারাপ হলে আমি কোথায় গিয়ে কান্নাকাটি করবো? বাইরের দৃশ্য দেখবো কিভাবে? বেলকনির অবদান আমার জীবনে প্রচুর। এই বেলকনি ছিল বলেই না বর আর বরের গার্লফ্রেন্ড রোমান্টিক সিনটা দেখতে পেয়েছিলাম। এই জানতো জঘন্য খারাপ রুম আপনার।
অধরা হাতের টাওয়েল টা জুবায়েরের দিক ছুড়ে দিয়ে বসে পড়ে পড়লো। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। জুবায়ের হতভম্ব হয়ে গেছে অধরার কথা শুনে। মান ইজ্জতের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকলো না। কোনরকম মাথা চুলকে বলল,
> সরি আসলে জুহি তখন জোর করছিলো। আমি না করতে পারিনি।
অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> হয়েছে হয়েছে, সরি বলতে হবে না। জানি প্রেম ট্রেম করলে এসব হয়ে থাকে। আমিও করবো। ইউনিভার্সিটির একটা ছেলে আমাকে পছন্দ করতো। ছেলেটা এখনো সিঙ্গেল। ভাবছি ঝামেলা শেষ হলে ওর সঙ্গে প্রথমে প্রেম করে তারপর বিয়ে করবো। আমি বেশ ক্লান্ত আছি ঘুমাবো।
জুবায়েরের মেজাজ খারাপ হলো। ছেলেদের সঙ্গে কি মেয়েদের তুলনা চলে? জীবনে প্রথমবার ভুল করেছিল তাও আবার বউয়ের চোখের সামনে। জীবনদশাতে কতবার যে খোঁটা শুনতে হবে আল্লাহ্ ভালো জানে। যে যাইহোক যত ইচ্ছা বলুন সমস্যা নেই কিন্তু তাই বলে আরেক ছেলের সঙ্গে বিয়ে করবে আবার চুমুও খাবে এটা অতিরিক্ত। জুবায়ের একদম মানবে না। ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> যা খাওয়ার আমার সঙ্গে খেতে পারো বাইরের লোকদের দরকার কি। ছেলের নাম ঠিকানা দাও। আমি বের হবো। একদম খু*ন করে ফেলবো ।
অধরা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে হামি ছেড়ে বলল,
> পুরাতন জিনিসের প্রতি আমার আবার আগ্রহ কম। এই জানতো আমি একটু ঘুমাবো। বহুকাজ আছে। বাইরে যাবেন বললেই তো হয়ে যাবে না। এই যে আপনি আর আপনার ভাই টুইন অথচ আপনার সঙ্গে উনার কতো পার্থক্য। উনি রাতে ঘুরাঘুরি করেন দিনে মাটির নিচে।উনার সমস্যাগুলো আপনার হলো না কেনো? দ্রুত খোঁজ নিন। বিষয়টা ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে দরকার হলে ডি এন এ টেস্ট করুন।
জুবায়ের মুখ ভার করলো অধরার কথা শুনে। ও যতই মেয়েটাকে অধিকার দেখিয়ে কথা বলছে মেয়েটা ওকে তত ইগনোর করছে। কাছাকাছি আসার কোনো সুযোগ নেই। মেয়েরা বুঝি এমনিই হয়। ভালোবাসলে মন দিয়ে বাসে আবার ঘৃণা করলে মনেপ্রাণ ভরে ঘৃণা করে। জুবায়ের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। চুপচাপ ফ্রেস হয়ে টাওয়েল রেখে বলল,
> আমি যাচ্ছি কোনো দরকার হলে মারিয়াকে বলবে। নিজের বদ বুদ্ধি খরচ করে কিছু করতে যাবে না। তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই।
অধরা উত্তর দিলো না। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। জুবায়ের হতাশ হলো। কম্বলটা ওর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসলো। এতদিন প্রশ্নটা যে ওর মনে আসেনি এমনটা না। কিন্তু কখনও জানার চেষ্টা করেনি। এবার করতে হবে।
☆☆☆☆
সন্ধ্যার আগ মূহুর্তে ঘুম ভাঙলো অধরার। দুবার কেউ ডেকেছিল কিন্তু এখন সেটা মনে পড়ছে না। অধরা দ্রুত ফ্রেস হয়ে ট্রি টেবিলে রাখা খাবারটা খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। লম্বা বারান্দা দিয়ে হাটতে হাটতে সামনে গিয়ে বারান্দার শেষ প্রান্ত দেখতে পেলো। পশ্চিম দিকে জঙ্গলটা দৃশ্যমান। হঠাৎ সাদা পোশাকে একজন লোকটাকে ও জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে দেখলো। লোকটা চোরের মতো ডানে বামে তাকাচ্ছে। অধরার সন্দেহ হলো তাই ফট করে পেছনের দরজা দিয়ে নেমে আসলো আর লোকটার পিছু নিলো। চারদিকে যে সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্যমামা পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে এটা ওর খেয়াল হলো না। জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেলো। কিছুদূর এসে লোকটাকে আর পেলো না। দূরে একটা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। গাছের ফোকর দিয়ে আলো এসে এখানে ওখানে অন্ধকার কেটে আলো তৈরী করছে। অধরার পা চলছে না। মাঝেমধ্যে হোচট খেলো তবুও হাটা থামলো না। আলোর কাছাকাছি আসতেই দেখলো লোকটা হামু হয়ে কিছু একটা খাচ্ছে। অধরা নিজেকে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল। লোকটা পেছনে ঘুরে ছিল এবার সামনে ঘুরলো। অধরার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই লোকটাকে ও ওই বাড়িতে দেখেছিল। সে যাইহোক লোকটার মুখে আর সাদা পোশাকে র*ক্তের ছোপ ছোপ দাঁগ। সামনে কাচা মাংস আর হাড্ডি চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। অধরা দৃশ্যটা দেখে বমি করে ফেলল। কি জঘন্য লাগছে। শীতের মধ্যেও কুলকুল করে ঘামছে। হঠাৎ পেছন থেকে ঠান্ডা একটা হাত ওর কাঁধ স্পর্শ করলো। অধরা কেপে উঠে পেছনে তাঁকিয়ে হতভম্ব। জুবায়ের ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টিও সামনের লোকটার দিকে। হয়তো এরকম অবিশ্বাস্য দৃশ্য বিশ্বাস করতে পারছে না। অধরা কথা বলতে চাইলো কিন্তু তাঁর আগেই জুবায়ের ধুপ করে হাটু ভেঙে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালো। অধরা বিপদ ভূলে গিয়ে জুবায়েরের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। ফিসফিস করে বলল,
> এই যে শুনছেন? কি হলো আপনার? কথা বলুন। আরে ভয় পাচ্ছেন কেনো আমি আছি তো।
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো।জুবায়ের কথা বলতে পারলো না। অধরার কান্না পাচ্ছে। কি একটা বর জুটেছে কপালে। সারাক্ষণ খু*ন করবো এটা করবো ওটা করবো ডাইলগ মারে এখন কাজের বেলা ভীমড়ি খেয়ে বিপদ আরও বাড়িয়ে দিলো। মেজাজ খারাপ সঙ্গে টেনশন। কিভাবে একে বাড়িতে নিয়ে যাবে ভাবতেই বুক কাঁপছে। এদিকে আধার নেমে এসেছে। জুবায়েরের মাথা নিজের কোলে নিয়ে কেঁদে ফেলল ভয়ে। বিড়বিড় করলো বর না বর্বর। কোথায় বউকে সাহায্য করবে তানা নিজেই ভয়ে অজ্ঞান হয়েছে। আশেপাশের কোথাও পানি থাকলে ঝামেলা ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর জুবায়েরের জ্ঞান ফিরলো। অধরা গাছের ফোকর দিয়ে সামনে তাঁকিয়ে দেখলো সেখানে থাকা লোকটা নেই। এমনকি সেখানে কোনো তাঁর চিহ্ন পযর্ন্ত নেই। জুবায়েরের মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসলো। মাথা ভার ভার লাগছে। অধরা ভ্রু কুচকে বলল,
> আপনি ঠিক আছেন?
জুবায়ের ঠোঁট উল্টে বলল,
> সরি আমি এরকম দৃশ্য কখনও দেখিনি । বাসা থেকে তোমার পিছু পিছু এসেছি। কতবার ডাকলাম তুমি শুনলে না। তারপর এখানে এসে দেখি এই দৃশ্য। আসলে হঠাৎ দেখেছি তো তাঁই সহ্য হয়নি। সারাদিন খালি পেটে।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> এবার থেকে চাপাবাজি কম করবেন। আমি আপনাকে হিরো ভাবতাম এখন দেখি আপনি জিরো। হিরো না হয়ে ভিলেন হতেন তাঁতেও আমি গর্ববোধ করতাম। বাড়িতে চলুন আর একটু হলে লোকটাকে হাতেনাতে ধরতে পারতাম। পরেরবার যদি দেখিনা আমার পিছু নিয়ে ঝামেলা করেছেন তো খু*ন করে ফেলবো। হাঁটতে পারবেন নাকি কোলে নিতে হবে।
জুবায়েরের মুখটা দেখার মতো হলো। কিভাবে কি হয়েছিল কিছুই বুঝতে পারেনি। জীবনে যা কিছু লজ্জাজনক প্রথমবার ঘটছে সবটা বউয়ের সামনে ঘটতে হচ্ছে। আফসোসের শেষ নেই।এমন বেদনা ভরা জীবন নিয়ে সামনে এগোতে হবে কি দুঃখ! জুবায়েরের ধ্যান ভাঙলো অধরার কথা শুনে,
> আসুন কোলে নিচ্ছি। মাটিতে আর কতক্ষণ লুটিয়ে পড়ে থাকবেন?
জুবায়ের দ্রুত উঠে অধরাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির পথে হাটা ধরলো। অধরা হতভম্ব হয়ে জুবায়েরের কাজকর্ম দেখছে। ভ্রু কুচকে বলল,
> হঠাৎ জ্ঞান হারালেন কেনো বলুন তো? ভয়ে নাকি কোনো রহস্য আছে?
> কিসের রহস্য? কোনো রহস্য নেই। শরীর খারাপ নিয়ে বর তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে কোথায় একটু আদর করবে, রোমান্টিক কথাবার্তা বলবে তানা জেরা করছো মেয়ে? আমি সত্যি বলছি জানিনা তখন কি হলো। চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসলো। তোমার কথা মতো হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আগামীকাল রিপোর্ট আসবে। তাছাড়া একটা ঝামেলা হয়েছে তোমাকে বলার সুযোগ পাইনি। আমার উপরে আবারও আক্রমণ করা হয়েছিল। গাড়ি চাপা দেওয়ার চেষ্টা। তেমন কিছু হয়নি। পায়ে আর হাতে লেগেছে। হাসপাতালে দুঘন্টা অচেতন ছিলাম।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা উতলা হয়ে উঠলো। জোর করে কোল থেকে নামতে চাইলো কিন্তু জুবায়ের নামালো না। অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> বাচ্চাদের মতো বুদ্ধি নিয়ে আপনি গোয়েন্দা হবেন? বলেছিলাম নিজের খেয়াল রাখবেন কিন্তু না সব উল্টে দিয়েছেন। আগামীকাল থেকে কাছে সব সময় ক্যামেরা রাখবেন। আমি আপনার পোশাকে ক্যামেরা লুকিয়ে দিবো। আর আশেপাশে গার্ড রাখবেন। আপনি তো আমার কথায় শুনছেন না।
> বুঝতে পারিনি হঠাৎ এরকম ঝামেলা হবে। যাইহোক আগামীকাল থেকে সর্তক থাকবো। শুনো রাতে স্টোর রুম চেক করতে হবে। শরীর খারাপ বা ভয় পেলে কিন্তু সব খতম।
> জানিনা আপনাদের স্টোর রুমে আবার কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। নামিয়ে দিন আমি হাঁটতে পারবো। আপনার শরীর খারাপ। সুস্থ হয়ে উঠুন তারপর না হয় আপনার কোলে চড়েই বিশ্ব ভ্রমণে বের হবো। এখন নামবো।
জুবায়ের ওকে নামালো না। পেছনের দরজা দিয়ে কক্ষে ফিরে একে বিছানায় রেখে নিজেও বসে পড়লো। আঘাত পাওয়া জায়গা থেকে র*ক্ত বের হচ্ছে। অধরা সেটা পরিস্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। টেনশন হচ্ছে সামনে কি অপেক্ষা করছে কে জানে।
(চলবে )
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৩
সময় চলে যায় কিন্তু হৃদয়ে আঘাতের চিহ্ন গুলো রয়ে যায়। কখনও তা ভোলা যায় না। কথায় বলে বাক্য দ্বারা মানুষকে জান্ত দাফন করা যায় কথাটা একদম সত্য। জুবায়েরের ক্ষত জায়গাই ওষুধ লাগাতে গিয়ে ওর পূর্বের করা ব্যবহারগুলো বারবার মনে পড়েছে অধরার। লোকটা কারণ অকারণে ওকে আঘাত করেছে। চোখের পানি ঝরিয়েছে। ক্ষমা মহৎ গুণ তবুও হৃদয় কথা শুনছে না। অধরার এখন কাঁদতে মন চাইছে। পরিস্থিতি কখন কিভাবে বদলে গেলো বুঝতে পারেনি। জুবায়েরকে ও ক্ষমা করুক বা না করুক লোকটাকে রক্ষা করা ওর কর্তব্য। যেকোন সময় ওর জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। কিভাবে ওকে সেভ করা যায় মাথায় আসছে না। বাবা হয়ে নিজের সন্তানের ক্ষতি করতে লোকটার বিবেকে বাঁধছে না। কথাগুলো আনমনে ভেবে চলেছে অধরা। জুবায়েরের যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করে আছে। ওষুধ লাগানো শেষে অধরা জুবায়েরের পাশে বসতে বসতে বলল,
> জ্বর আসতে পারে ওষুধ খাওয়া জরুরী। স্টোর রুমে আজ না গেলে হয়না? আপনার শরীরের যে অবস্থা কিছুক্ষণ পরে বিছানা নিবেন।
জুবায়ের অধরার মুখের সামনে আসা চুল গুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে বলল,
> আমি ঠিক আছি চিন্তা করো না। এইটুকুতে আমার কিছু হবে না। স্টোর রুমের চাবি চুরি করেছি বিষয়টা ধরা পড়ার আগে চেক করে নিতে হবে। আগামীকাল থেকে তুমি দাদুর আশেপাশে ঘুরবে। ভাব জমানোর চেষ্টা করবে।
> আমিও ভেবেছিলাম। তবে লোকটা খুব চতুর সহজে কিছু বলবে বলে মনে হয়না।
> আরে বলবে বলবে,পেটে মাল পানি পড়লে সব বলবে।তুমি এতো ভেবো নাতো। না বললে এমন জিনিস খাওয়াবো না হজম হয়ে যাওয়া বহুকাল আগের খাদ্য পযর্ন্ত বেরিয়ে আসবে।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল জুবায়েরের কথা শুনে। কথাবার্তার কি হাল। ওকে অপমান করে সেদিন দু’টাকার মেয়ে বলেছিল অথচ নিজের কথাবার্তা একদম জাত মাতালদের মতো। অধরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> মুরব্বি মানুষের সঙ্গে একদম আজেবাজে কিছু করার চেষ্টাও করবেন না। বেয়ার টেয়ারে কাজ নেই। বন্ধুত্ব করবো। আপনার মাথায় সত্যিই কিছু নেই।
জুবায়ের নিভে যাওয়া মন নিয়ে বলল,
> আমার ধৈর্য্য কম। হুটহাট কাজকর্ম করে অভ্যাস। তাছাড়া আমি কিন্তু ভালো বুদ্ধি দিয়েছি। বন্ধুত্ব করে সময় কষ্ট করা হবে। তারচেয়ে এক প্যাক সুন্দর মতো পেটে চালান করিয়ে দিবো তখন দেখবে গড়গড় করে সব বেরিয়ে আসছে। শুনো আমি তোমার বয়সে অনেক বড় বুদ্ধিও বেশি আমার উপরে কথা বলবে না।
অধরা চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো। দিনদিন লোকটার বুদ্ধি কমছে নাকি প্রথম থেকেই একরকম কে জানে। আগে ভাবতো জুবায়ের লোকটা খুব বুদ্ধিমান আর গম্ভীর টাইপের কিন্তু না এতো পুরোপুরি তার ছেড়া। অধরা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু হলো না তাঁর আগেই আয়াত ভেতরে প্রবেশ করলো। ছেলেটা চোখেমুখে লজ্জা। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে হয়তো। অধরা বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ওকে বসতে দিয়ে বলল,
> ভাই তোর কোনো অসুবিধা হচ্ছে? সরি ভাই আমি ক্লান্ত ছিলাম তোর খোঁজ নিতে পারিনি। খুব সরি রে।
আয়াত লাজুক হাসলো। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলল,
> না না আপু আমি ঠিক আছি। তোমার শশুর বাড়ির লোকজনগুলো সত্যিই চমৎকার। আমি তো সেদিন না জেনেই আজেবাজে কথা বলেছিলাম। জুবায়ের ভাইয়ার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। রাগের মাথায় সেদিন অনেক খারাপ আচরণ করেছি। আমি সত্যি লজ্জিত।
জুবায়ের বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
> কিছু মনে করিনি এটা স্বাভাবিক ছিল।
কয়েকটা কথা বলে আয়াত বিদায় নিলো। জুবায়ের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেলো। অধরা ওর পাশে বসে আছে। মনের মধ্যে হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। জুবায়েরের উপরে পরপর দুবার হামলা হয়েছে। কতদিন এভাবে বাঁচতে পারবে? একটা সাধারণ ডাইরি করা উচিত ছিল। অধরা দ্রুত উঠে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। ঘরে বসে থেকে কাজ নেই। কিচেনে নিশ্চয়ই রান্না চলছে। অধরা সিদ্ধান্ত নিলো এবার থেকে রান্নাঘর কব্জা করতে হবে। রান্নাঘরে ঢুকতে পারলে বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলার সুযোগ পাবে। কিছু না কিছু তো তখন জানতে পারবে। তাছাড়া আরও একটা ঝামেলা আছে। জুবায়েরকে এই বাড়ির কোনো খাবার খাওয়ানো যাবে না। ওকে অধরা নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে।না পারলে বাইরে থেকে অর্ডার করবে। জুবায়েরের আচরণ পরিবর্তন হওয়ার পিছনে খাবারের ভেতরে ওষুধ মেশানো থাকতে পারে। শুধু সন্দেহর বসে কিছু করা উচিত না তবুও অধরা ফেলে দিতে পারছে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও ডাইনিং রুমে এসে থামলো। রান্নাঘরে ফুপি শাশুড়ি কাজের মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে রান্না করছে। অধরাকে দেখে মারিয়া এগিয়ে আসলো। ওর সঙ্গে আছে জুবায়েরের ফুপি লতিফা ফারুকীর মেয়েটা। অধরা মেয়েটার নাম জানেনা। মারিয়া ওকে ইশারা করে বসতে বললো। অধরা ওষ্ঠে হাসি নিয়ে বলল,
> আসলে মারিয়া তোমার ভাইয়ার একটূ জ্বর এসেছে। আমার হাতে তৈরী সুপ খেতে চেয়ছে। আমি ওর জন্য সুপ তৈরী করতে এসেছি। তুমি বসো আমি পরে আসছি।
অধরা মোটামুটি মিথ্যে বলে দিয়ে কেটে পড়লো। ডাইনিং রুমের শব্দ কিচেন পযর্ন্ত অনায়াসে যায়। অধরাকে দেখে লতিফা ফারুকী ব্যস্ত হলেন। দুঃখজনক বিষয় উনিও কথা বলতে পারেন না। অধরা উনার আকার ইঙ্গিত দেখেই বুঝে গেলো এই বাড়ির মেয়েরা সব বোবা কিন্তু ছেলেরা সবাই কথা বলতে জানে। কি অদ্ভুত মেয়েদের কথা বলার শক্তি নেই কিন্তু কেনো? শাশুড়ি মায়েরা পরের বাড়ির মেয়ে বলে তাঁরা বলতে পারে। অভিশাপ টা হচ্ছে সুলতান পরিবারের উপরে। যেটা কাটাতে এরা কহিনুরের গল্প ফেদেছে। কিন্তু জুবায়েরেকে মারার পিছনে কি থাকতে পারে? মাথা কাজ করছে না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন এসে ভর করছে মাথায়। অধরা কোনরকম নিজেকে স্বাভাবিক করে মলিন হাসলো। হাসিটা বড্ড বেশি দরকার। সহজে ভড়কে গেলে বিপদ ঝপাং করে ঘাড় মটকে ধরবে। স্বাভাবিক থেকে কাজ করতে হবে। অধরা কাজের মেয়েটার সামনে বলল,
> ফুপিকে বলে দিবেন আমি জুবায়েরের জন্য রান্না করতে চাই। ওর জ্বর এসেছে।
মেয়েটা লতিফাকে বুঝিয়ে দিলো। ভদ্রমহিলা বিনিময়ে হাসলো। দরকারী জিনিসপত্র সব ওর সামনে এগিয়ে দিলো। অধরা সময় নষ্ট করলো না। দ্রুত রান্না বসিয়ে দিলো। কাজের মেয়েটা ওকে সাহায্য করছে। অধরা বারবার ফুপিকে দেখছে। ভদ্রমহিলা এক ভাবে ওকে দেখছে কেমন অস্বস্তিকর বিষয়। ওকে এভাবে দেখার কি হলো বুঝতে পারছে না। অধরা দ্রুত চিকেন সুপ করে নিয়ে চলে আসলো। দাদু কোথায় আছে দেখার জন্য আশেপাশের তাকালো, ভদ্রলোক কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে কে জানে। অধরা রুমে আসতেই জুবায়ের চোখ খুলে তাঁকালো। ওর হাতে খাবার দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল। অধরা সেসব পাত্তা দিলো না। একেবারে জুবায়েরের সামনে গিয়ে বসে পড়লো। জুবায়ের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলল,
> তুমি কেনো খাবার আনতে গেলে! আমি যেতাম, তাছাড়া এটা তুমি কি এনেছো? এতবড় হাতির মতো যুবকের জন্য এইটুকু সুপ?এতো পেটের কোনে পড়ে থাকবে।
অধরা বিরক্ত হলো। যথেষ্ট পরিমাণ খাবার এনেছে তবুও পেটুক লোকটা আরও খাওয়ার বায়না করছে। অধরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> ঢং করবেন না চুপচাপ খাবেন। আজ থেকে আমি যা খেতে দিবো তাই খাবেন। অন্য কারো হাতে খাওয়া চলবে না। দ্রুত শেষ করুণ। ওষুধ খেতে হবে। শরীর ঠিকঠাক না হলে স্টোর রুমে আবারও জ্ঞান হারাবেন তখন ঝামেলা।
জুবায়ের মিনমিন করে বলল,
> নিজের হাতেই খেতে হবে নাকি?
> তো আপনাকে হাত ধার দিবে কে? নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে না করলে লোক রাখুন। জুবায়ের ফারুকী আপনাদের বাড়ির মেয়েরা বোবা বিষয়টা কেমন রহস্যজনক না? কারণ জানতে পারলেই রহস্যের অর্ধেক বুঝে যাবো।
জুবায়ের খেতে খেতে বলল,
> বংশগতির ধারা বলতে পারো। আমাদের বংশের মেয়রা কথা বলতে পারেনা। তাপপর আরও একটা বিষয় তুমি জানো না। লতিফা ফুপির জামাইটা কিন্তু স্বাভাবিক না। বছরে একবার এখানে আসেন সাতদিন থাকেন তারপর কোথায় যে গায়েব হয়ে যায় জানিনা। বাড়ির কেউ কিন্তু এটা নিয়ে চিন্তিত না। ভদ্রলোকের চেহারার কোনো পরিবর্তন নেই। ছোট থেকেই যেমন দেখি বড় হয়েও তেমনি।
> কথা বলেছেন উনার সঙ্গে? নাম কি উনার? বাসা কোথায়?
> এক সঙ্গে এতো প্রশ্ন? আঙ্কেল বেশ গম্ভীর টাইপের, কথাবার্তা বিশেষ হয়নি টুকটাক আলাপ হয়েছে। উনার নাম সুলাইমান হক। দেখবে কয়েকদিনের মধ্যে আসবে। উনার আসার সময় হয়ে গেছে। ভদ্রলোকের বাসা কোথায় জানিনা। কেউ বলেনি আর আমারও আগ্রহ নেই।
> আপনাদের বাড়ির সবাই একটু এলিয়েন টাইপের। বাবা কেনো যে এই ঘরে আমার বিয়ে দিলেন এখন আফসোস করতে হচ্ছে। না পেলাম ভালো বর না পলাম ভালো ঘর। আমি পরের বার এমন ভূল করবো না বুঝলেন? দেখেশুনে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করবো।
অধরার কথা শুনে জুবায়েরের রাগ হলো। হাতের চামুচটা ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বাটিতে চুমুক দিয়ে সুপের বাটি খালি করে বলল,
> ফালতু চিন্তা বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসো। বিয়ে বিয়ে করো কেনো? একবারে সখ মিটেনি? যেটুকু খায়েশ আছে আমি পুরণ করে দিবো ইনশাআল্লাহ। দ্রুত চলো।
জুবায়ের তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে পড়লো। ঘরে বেশ সময় পার করে ফেলেছে। বাইরে এতক্ষণে খাওয়া দাও শেষ করে যে যার রুমে নয়তো পার্টির উদ্দেশে বেরিয়ে গেছে। সুযোগ বারবার আসবে না। জুবায়ের অধরার হাতে ধরে কক্ষ ত্যাগ করলো। স্টোর রুমটা বাড়ির গোপনীয় জায়গাই। অধরা জুবায়েরের পেছনে পেছনে হাটছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িটা কেমন ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। স্টোর রুম সিঁড়ি রুমের নিচে অবস্থিত। হঠাৎ করে কেউ বুঝতে পারবে না সিঁড়ির নিচে কোনো রুম আছে। বাইরে থেকে দেখে চেনা বা বোঝা বেশ কঠিন। জবাব ওকে নিয়ে দেয়ালে থাকা সামান্য ছিদ্রে চাবি লাগিয়ে দরজা খুঁলে ফেলল। রঙ দিয়ে সব এক রকম করে রাখা হয়েছে। অধরা অবাক নয়নে জুবায়েরের পেছনে পেছনে ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। বিশালাকার রুমটা বিভিন্ন পুরাতন আসবাবপত্র দিয়ে বোঝাই করা। ধুলাবালি পূর্ণ আলমারির ভেতরে কিছু কাগজপত্র পেলো। ততটা গুরুত্বপূর্ণ না। জুবায়ের সেসব চেক করছে। অধরা সামনে এগিয়ে গিয়ে হালকা চিৎকার করে উঠলো। জুবায়ের দ্রুত এসে ওর মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
> আরে চিৎকার করছো কেনো?
অধরা উত্তর দিলো না। আঙ্গুল উচু করে সামনে ইশারা করলো। জুবায়ের সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে ঝটিকা খেলো। সামনে একটা মাথার খু*লি পড়ে আছে। খুঁ*লিটা একদম টাটকা। ফোঁটা ফোঁটা র*ক্ত লেগে আছে তাঁতে। অধরা ধরা গলাই বলল,
> এরকম একটা দৃশ্য মায়ের রুমে দেখেছিলাম। জুবায়ের খোঁজ নিন নিকটবর্তী কেউ মা*রা গেছে কিনা। চলুন খু*লিটা উঠিয়ে নিয়ে যায়। ডিএনএ টেস্ট করলে খু*লির মালিককে সন্ধান পাওয়া যাবে।
> একদম না। এটা কি কাজে ব্যবহিত হয়েছে না জেনে ঘরে নিলে যদি উল্টোপাল্টা কিছু হয়? কাজটা ঠিক হবে না। একটা ছবি তুলে নিয়ে যেতে পারি।
অধরা কাঁপছে। এই বাড়িতে যা হচ্ছে সেম ওই বাড়িতেও হয়েছিল। হঠাৎ একটা ছায়া আলমারির পেছনে সরতে দেখে অধরা জুবায়েরের হাতটা ধরে ফেলল। বলল,
> আজ চলুন পরে আবার আসবো। আমাদের কেউ ফলো করছে।
জুবায়ের ছায়াটা দেখেছে। ওরা আর সময় নষ্ট করলো না। দ্রুত বেরিয়ে আসলো। রহস্য জানা তো গেলোই না উল্টোপাল্টা দৃশ্য দেখে হয়রানি।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆
জুবায়ের হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট। আসার সময় যতটা আগ্রহ নিয়ে এসেছিল যাওয়ার সময় ততটাই কষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে। কঠিন এক সত্যি ওর সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। হাউমাউ করে কান্না করতে মন চাইছে কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো আর হয়না। এমন কেনো হলো কার জন্য হলো কিছুই মাথায় আসছে না। এতদিনের বিশ্বাস ভরসা ভালোবাসা সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো চোখের নিমিষে। ওর চোখদু’টো জ্বলে উঠলো। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসলো। বাড়িতে পৌছাতে মিনিট দশেক টাইম লাগলো। অধরা বিছানায় হেলান দিয়ে তখন বই পড়ছিল। জুবায়ের হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। অধরা দরজা বন্ধের শব্দ শুনে চমকে উঠলো। ছেলেটার চোখে আগুন। কিছু বুঝে উঠার আগেই ও অধরার গলা চেপে ধরে বলল,
> সব আগে জানতে তাইনা? আমাকে কষ্ট দিতে তোমার মজা লাগে? আমি ম*রে গেলে শান্তি তো? তবে আমি ম*রেই যায়।
অধরা জোরকরে নিজের ছাড়িয়ে নিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,
> আজেবাজে বকছেন কেনো? কি হয়েছে না বলে গলা টিপে দিলেন। ম*রে আপনি না আমি যেতাম।
জুবায়ের থম মেরে বসে থেকে হুট করে অধরাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিয়ে বলল,
> তুমি জানতে বলো আরমান ফারুকী আমার কেউ হয়না? ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার ডিএনএ মিলেনি কেন?
অধরা জুবায়েরের পিটে হাত রেখে ওকে সামনে টেনে নিয়ে বিস্মিত হলো। ছেলেটার চোখ লাল হয়ে উঠেছে। ও কি বলবে বুঝতে পারছে না। বোকার মতো বলল,
> উনি তোমার বাবা না?
(চলবে )
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৪
কিছু সত্য মেনে নিতে কষ্ট হয় তবুও মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। চোখের পানির সঙ্গে ভাসিয়ে দিতে হয় দুঃখগুলোকে। কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা মানতে পারলেও তাঁকে ক্ষমা করা যায় না। জুবায়ের হঠাৎ থমকে গেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। এতকাল যাকে বাবা মা বলে এসেছে হঠাৎ বুঝতে পারলো সব মিথ্যা। মানতে পারছে না।অধরা ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। নিরবতা কাটিয়ে অধরা মুখ খুঁলল। ভয়ে ভয়ে বলল,
> মাথা ঠান্ডা করুণ। আমিও অনাথ বাবা মা নেই। পৃথিবীতে আপনজন বলতে আপনি আর আমাদের বাচ্চাটা ছাড়া কেউ নেই। আমরা নতুন করে আমাদের পরিবার সাজাবো। পারবেন না আমাদের সঙ্গে চলতে?
জুবায়ের বহুকষ্টে বলল,
> খুব পারবো। সরি অনেক। আর মারবো না।তুমি জানো উনার সঙ্গে আমার ডিএনএ মিলেনি কিন্তু ভাইয়ের সঙ্গে মিলেছে। ভাইয়ের ব্লাডে কোনো অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। ও সুস্থ আছে। জানিনা সূর্যের আলোতে ওর কি সমস্যা। ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে।
অধরা জুবায়েরের হাত দুটো নিজের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলল,
> আপনাদের পরিবারিক উকিলের সঙ্গে কথা বলুন। সম্পত্তির উত্তরাধিকার কার নামে চেক করে ফেলুন। যা করবেন গোপনে। আমার বিশ্বাস এগুলো সব আপনার নামে। আর আরমান ফারুকী আপনার ছোট চাচা। আপনি উনার বড় ভাইয়ের ছেলে। দ্রুত ব্যাবস্থা নিন। আপনার নামে যদি কোনো সম্পদ থাকে তবে নতুন করে দলিল করুন। লিখে ফেলুন আপনার কিছু হলে সব অর্থসম্পদ মসজিদ বা সরকারি খাতে চলে যাবে।
জুবায়েরের উত্তর দিলো না। শুয়ে পড়লো। কিছু একটা ভেবে অধরাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর গালাতে মুখ ঢুবিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
> ঘুমাও চিন্তা করো না। আমার কিছু হবে না। যতক্ষণ বেঁচে আছি তোমাদের খেয়াল রাখবো ইনশাআল্লাহ। বাচ্চাটা যেনো আমার মায়ের মতো হয় দোয়া করবে একটু? চোখের সামনে ছিল তাই গুরুত্ব বুঝতে পারিনি। কেনো এমন হলো বলতে পারো?
অধরা কি বলবে বুঝতে পারলো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করলো। বাবা মায়ের কথাগুলো আবারও মনে পড়ছে। বছর খানিক আগেও সব ঠিক ছিল। এতো ত্যাগ বিসর্জন সব কহিনুরের জন্য। মেয়েটা শুভ নাকি অশুভ কিছুই ওদের জানা নেই। কহিনুরের রহস্য কিভাবে জানতে পারবে মাথায় আসছে না। দাদুর রুমটা যদি একবার চেক করা যেতো ভালো হতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। যখন ঘুম ভাঙলো তখন নিজেকে বিছানায় একা পেলো জুবায়ের নেই। অধরা দ্রুত উঠে বসলো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ঠিক নেই। জুবায়ের ওকে না বলে বাইরে গেছে ভেবে টেনশন হচ্ছে। অধরা ফ্রেস হয়ে বাইরে যেতে গেলো তখনই জুবায়ের খাবারের ট্রে নিয়ে হাজির হলো। মুখে হাসির ঝিলিক। মন খারাপের কোনো চিহ্ন নেই। অধরা বেশ অবাক হলো ওর ব্যবহার দেখে। কৌতূহল চাপিয়ে রেখে বলল,
> কোথায় ছিলেন? টেনশন করছি।
জুবায়ের ওকে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর সামনে খাবার নিয়ে বসে পড়লো। প্লেটে খাবার নিয়ে বলল,
> চিন্তা করে ঠিকঠাক খাওয়া হচ্ছে না। বেবীর পুষ্টির দরকার আছে। চুপচাপ খেয়ে আমার উদ্ধার করো। তোমার শশুর মশাইকে জব্দ করার হাতিয়ার পেয়ে গেছি। বিষয়টা যে আমরা জেনে গেছি আরমান ফারুকীকে বুঝতে দিলে চলবে না।
অধরা বিস্মিত হয়ে বলল,
> কি করতে চাইছেন আপনি? শুনুন ভুলভাল কাজের জন্য আপনি আগে থেকেই ফেমাস হয়ে আছেন। নতুন করে নিজের বুদ্ধিতে দুমদাম কিছু করার চেষ্টা করবেন না। আমাকে বলুন সাহায্য করবো।
> তুমি জানো এই সম্পত্তি আমার বাবা সুলতান জাফর ফারুকীর নামে ছিলো। জানিনা কি কারণে উনি সবটা আমার নামে করে দিয়েছিলেন। আমাদের পুরাতন উকিলের সঙ্গে কথা হয়েছে। লোকটা প্রথমে বলতে চাইনি পরে বাধ্য হয়ে বলেছে। আমি লোক দিয়ে উনার ছেলেকে উঠিয়ে এনেছিলাম। সামান্য এইটুকু কাজ, আমি এখানে বসে আধা ঘন্টার মধ্যে শেষ করেছি।
জুবায়ের ভাব নিয়ে কথাগুলো বললো। অধার চোখ কপালে। এই লোকটা যে সরলভাবে কিছুই ভাবতে জানেনা। কি দরকার ছিল কিডন্যাপ করার। ঝামেলার শেষ নেই। অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> ছেড়ে দিয়েছেন তো? সামান্য কাজের জন্য কিডন্যাপ করে ফেললেন? বাচ্চা ছেলেটার যদি কিছু হয়ে যেতো?
> দূর বাচ্চা কোথায় পেলে? দেখো লুকিয়ে চুরিয়ে কয়টা বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে তার ঠিক নেই। ভীষণ দুষ্ট। যাইহোক ছেড়ে দিয়েছি। ভেবেছিলাম তুমি ঘুম থেকে উঠার আগেই কাজটা শেষ করবো। তথ্য জেনেছি এখন আইনি নোটিশ পাঠাবো।আরমান ফারুকী ঝটকা খাবে কেমন বলো?
> আপনার মাথা । একদম ফালতু বুদ্ধি। আপনার কিছু হয়ে গেলে আপনার ভাই এসে সব দখল করবে। এসব বাদ দিয়ে অন্য কিছু ভাবুন।
> আচ্ছা আমার নামের সব কিছু আমি যদি আমার স্ত্রী সন্তানের নামে করিয়ে দেয় তাহলে?
অধরা বিরক্ত হলো, ভ্রু কুচকে বলল,
> আপনার বিপদটা আমার বাচ্চার ঘাড়ে স্থানান্তরিত করতে চাইছেন এসব হবে না।
> আরে বাবা কথা তো শেষ করতে দাও। আমি এখানে উল্লেখ করবো যতদিন আমার বাচ্চার বয়স আঠারো হবে না ততদিন এর দ্বায়ীত্ব আমার স্ত্রীর উপরে থাকবে। তারপর মেয়ের বয়স হলে ও নিজেই নিজের সবটা বুঝে নিবে। তাছাড়া আমার তো আর একটা মেয়ে হবে না। আরও হবে আমি উল্লেখ করবো আমার যতগুলো বেবী হবে সবগুলো সমানুপাতিক সম্পত্তির মালিক হবে।
অধরা চরম বিরক্ত জুবায়েরের উপরে। লোকটা মহা ফাজিল। একটা মেয়ের যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাচ্ছে আবার আরও চাইছে। অধরা থমথমে মুখ নিয়ে বলল,
> সবটা আপনি কহিনুরের নামে করে দিন। ঝামেলা মিটে যাবে। মেয়ে যতদিন পযর্ন্ত বিয়ের উপযুক্ত না হবে ততদিন পযর্ন্ত ওটা আপনি দেখাশোনা করবেন। আর যদি কোনো কারণে কহিনুরের কিছু হয়ে যায় তবে এটা সরকারি ফান্ডে চলে যাবে। একটা শব্দও আর উচ্চারণ করবেন না। বহুত বাজে কথা বলেছেন আর না।
জুবায়ের মুখটা করুন করে পকেট থেকে ফোনটা বের করে উকিলের কাছে ফোন দিয়ে সবটা বুঝিয়ে বলে দিলো। দ্রুত দলিত তৈরি করতে হবে। অধরার ওষ্ঠে হাসি ফুঁটে উঠলো। আরমান ফারুকীর বদ বুদ্ধি গুলোকে ছুটিয়ে দিবে। প্রতারণা খু*ন সব কিছুর জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করবে। হঠাৎ বাইরে থেকে শব্দ শুনে ওর ধ্যান ভাঙলো। বাইরে কিছু একটা নিয়ে চেচামেচি হচ্ছে। অধরা খাবার শেষ করতে পারলো না। উঠে আসতে চাইলো কিন্তু জুবায়ের দিলো না। ওকে বসিয়ে দিয়ে ও নিজের বেরিয়ে আসলো। গতদুদিন ধরে বাড়ির দক্ষিণ সাইডে অবস্থিত এক প্রতিবেশির কাজের মেয়েটা নিখোঁজ আছে। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জুবায়ের বিষয়টা জেনে রুমে এসে অধরাকে বলে দিলো। অধরার কেনো জানি সন্দেহ হচ্ছে। রাতেই ভেবেছিল কেউ নিখোঁজ থাকবে আর তাঁই হলো। এই বাড়ির কেউ কালো যাদুর সঙ্গে যুক্ত আছে। বাবার ডাইরিতে লেখা ছিল কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। তার মানে পরিস্কার এই বাড়ির ঐশ্বর্যের পেছনে মেয়েদের মুখের ভাষাটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমনটা হতেই পারে কিন্তু কে এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত? আরমান ফারুকী নাকি উনার বাবা? অধরার মাথাটা দপদপ করে যন্ত্রণা হচ্ছে। জানালা খোঁলা ছিল বেশ ঠান্ডা বাসাত আসছে। জুবায়ের সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বাইরের দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো,
> অধরা সেই লোকটা!
অধরা চমকে উঠে বিছানা থেকে নেমে আসলো। গতকাল সন্ধ্যায় কাচা মাং*স খেয়েছিল সেই লোকটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের ওকে ছেড়ে বাইরে যেতে চাইলো কিন্তু অধরা দিলো না। ওর হাতটা খপ করে ধরে বলল,
> উনার সঙ্গে আমি কথা বলবো আপনি চুপচাপ শুনবেন। হাঙ্গামা করে সত্যি জানা মুশকিল হবে। আমি কথা বলবো আপনি শুনবেন। চলুন বারান্দা দিয়ে পেছনের গেট দিয়ে বাইরে যায়। আপাতত কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
জুবায়ের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ওর হাতটা ধরে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমে ছোটখাট একটা আড্ডা বসেছে। ফুপির মেয়েগুলো কথা বলতে জানেনা কিন্তু আসর জামাতে উস্তাদ। ইশারা করছে সেটা কাজের মেয়েটা অনুবাদ করছে। অধরা এক নজর সেদিকে দেখে নিলো। দাদু আড্ডার মাঝে বসে আছে। আহা এখনই যদি দাদুর ঘরটা চেক করতে পরতো। অধরার ভাবনার চিরচ্ছেদ হলো সেই লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে। লোকটা ওদেরকে মনে হচ্ছে প্রথমবার দেখেছে। বিস্মিত হচ্ছে আর সরল করে হাসছে। অধরা ভনিতা ছাড়া বলে উঠলো,
> গতকাল সন্ধ্যায় জঙ্গলে কেনো গিয়েছিলেন? কি খেয়েছিলেন উত্তর দিন?
লোকটা ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। মিনমিনে কন্ঠে বলল,
> কি বলছেন ম্যাম আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি গতকাল বিকেলে চলে গিয়েছিলাম এসেছি সকালে। আপনি ভূল দেখেছেন বোধহয়।
জুবায়ের জ্বলে উঠলো। মুঠো শক্ত করে লোকটার মুখ বরাবর আঘাত করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে নিলো। হাত উঠানোর আগেই অধরা ওর পাঁচ আঙ্গুলের মধ্যে নিজের আঙুল চালান করে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> আমি কথা বলছি তো। চুপচাপ দেখুন।
> মিথ্যা বলছে কেনো? থাপ্পড় দিলে বাপ বাপ করে সব বলে দিবে। হাত ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ দেখো।
> আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি। চুপ থাকতে বলেছিনা?
জুবায়ের নিভে গেলো। যতবার জ্বলে উঠে অধরা ততবার ওকে নিভিয়ে ছাড়ে। এই জন্য উকিলের বিষয়টা নিজের বুদ্ধিতে করেছে তাও অধরার অনুপস্থিতিতে। বেশ করেছে কাজটা। আধর ওকে এক পলক দেখে নিয়ে সামানের লোকটাকে বলল,
> সমস্যা নেই আসলে দূর থেকে ভালো দেখতে পারিনি। মনের ভূল ছিল তাই আপনাকে বিরক্ত করেছি। আপনি এবার আসুন।
লোকটা মনে হলো হাপ ছেড়ে বাঁচলো।দ্রুত চলে গেলো।অধরা সেদিকে তাঁকিয়ে আছে। জুবায়ের বিস্মিত হয়ে বলল,
> ছেড়ে দিলে? ওরে তো আমি দেখছি। এমন পিটাবো না সারা জীবনের জন্য মিথ্যা ভূলে যাবে। ওর জন্য আমি অজ্ঞান ছিলাম। বউয়ের খোঁটা শুনেছি।
অধরা ওর কথার পাত্তা দিলো না। চাপা কন্ঠে বলল,
> ওই নর খাদকটা স্বাভাবিক মানুষ কিছুতেই ছিল না। আপনি কি জানেন এই বাড়িতে নর বলি হয়? অসংখ্য নরখাদক আপনাদের বাড়িতে বসবাস করছে এটা কি মানেন? জুবায়ের আয়াতকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন,সেটা এখুনি। দ্রুত করবেন।
জুবায়েরের কপালে চিন্তার রেখা। বুঝতে পারলো না ওর কথাগুলো। দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। কি সাংঘাতিক কথাবার্তা বলছে মেয়েটা। ও কোনরকম নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
> কি বলছো তোমার মাথা ঠিক আছে?
> একদম ঠিক আছে। আপনাদের বাড়ির কেউ একজন কালো যাদু বা শয়তানের উপাসনা করে। গতকাল যে খু*লিটা দেখেছিলাম ওটা পাশের বাড়ির ওই মেয়েটার। খু*লি নিয়ে লা*শটা এই নরখাদকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। প্রমাণ থাকে না।
> এসব করে কিসের লাভ? বুঝিয়ে বলো।
> এখন সময় নেই। পরে আপনাকে বলো। এখন আপনি আয়াতের জন্য গাড়ি নিয়ে আসুন। লোকদিয়ে ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন। এক মিনিট নষ্ট মানে ওর জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি হবে।
জুবায়ের সব কৌতূহল দমিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেলো। আয়াত কিছুতেই এই বাড়ি থেকে যেতে চাইছে না কিন্তু অধরা শুনলো না। এটা ওটা বুঝিয়ে ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। ছেলেটার জন্য ওর দম বন্ধ লাগছিল। এই মৃত্যু পুরীতে থাকা মানে বিষাক্ত জীবন পার করা। জুবায়েরের দাদু বেশ কষ্ট পেয়েছেন ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেওয়াতে। উনি অধরাকে নিজের রুমে ডেকে নিলেন। অধরা প্রথমবার দাদুর রুমে প্রবেশ করলো। জুবায়ের আসতে চেয়েছিল কিন্তু অধরা ওকে উকিলের সঙ্গে কথা বলতে পাঠিয়ে দিয়েছে। হাতে সময় কম। দরজায় পা রাখতেই ভেতর থেকে গম্ভীর কন্ঠে আওয়াজ আসলো,
> কোথায় ছিলে দাদুভাই? সারাদিন খোঁজ পাচ্ছি না। এই বুড়ো মানুষটা সারাদিন তোমাকে প্রচণ্ড মিস করেছে এটা কি তুমি জানো?
অধরা ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে চনচল হয়ে উঠলো। ভেতরে গিয়ে একদম দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মিনমিনে কন্ঠে বলল,
> দাদু জানেন তো আমার অবস্থা!শরীর হঠাৎ হঠাৎ খারাপ হচ্ছে, ঘুম পাচ্ছে।
> তা বটে এই সময়ে এরকম একটু হয়ে থাকে। তুমি চিন্তা করোনা। তোমার পেটে আমাদের সুলতান পরিবারের বিশেষ একজন অতিথি সে। তাঁর কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা সবাই দোয়া করছি।
> আপনারা ছাড়া কে আছে আমার? বাবা মা পরিবার পরিজন কেউ নেই।
> দুঃখ করো না বাবা মা কারো চিরকাল থাকে না। যেই ছেলেটা এসেছিল ওকে কিছুদিন কাছে রাখতে পারতে। ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়ে ঠিক করোনি। শুনেছি এক সঙ্গে বড় হয়েছো। কাছে থাকলে তোমার ভালো লাগতো।
অধরা থমকে গেলো তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ত্রুটি করলো না। ঢোক গিলে বলল,
> আন্টি অসুস্থ ওকে দরকার ছিল বাড়িতে। কয়েকদিন পরে আবারও আসবে।
ভদ্রলোক বিশ্বাস করলো কি ঠিক বোঝা গেলো না। বিছানা থেকে নেমে আলমারির কাছে গিয়ে একটা লাল পুটলি বের করলো। যেটা খুঁলে ভেতর থেকে একটা পুরাতন ডাইরি নিয়ে অধরার সামনে ধরলেন। আর চাপা কন্ঠে বললেন,
> এই ডাইরীটা তোমার। পড়ে আমাকে ফেরত দিবে। এখানে আমাদের বংশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে।
অধরা আগ্রহ নিয়ে ডাইরিটা দ্রুত নিজের হস্তগত করলো। মনে হলো এখুনি না নিলে আর পাবে না। ওর অস্থিরতা দেখে দাদু মৃদু হাসলো। বলল,
> এটা পড়লে তোমার সব কৌতূহল আশাকরি মিটে যাবে।
অধরা ডাইরীর উপরে হাত বুলিয়ে নিলো। উপরে বেশ গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে “কোহিনুর”। ভেতরে কি লেখা আছে কে জানে। অধরা দাদুর চোখে দৃষ্টি রেখে বলল,
> কক্ষে নিয়ে যেতে চাই, দিবেন?
> নিশ্চয়ই, তবে কাউকে দেখাতে পারবে না। নিয়ে যাও সকাল হলে ফেরত দিতে হবে।
অধরা সম্মতি জানিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসলো। কি আছে এই ডাইরীতে?
(চলবে)
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৫
পথিব সকল পাপের মূল হচ্ছে লোভ। ভালো থাকার লোভে মানুষ কতকিছু করে। খারাপ কাজ করতেও পিছপা হয়না। আমি সুলতান রশীদ ফারুকীর একমাত্র পুত্র সুলতান ফারাবি ফারুকী। আমি বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান যদিও আমার আরেকটা বোন আছে। আমার বাবা বেশ প্রভাবশালী জমিদার ।।উত্তরাধিকারসূত্রে আমি বাবার সকল সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ। বোনের জন্য ছিল কিছু নগদ অর্থ আর বক্স বন্ধি স্বর্ণালঙ্কার। এটা নিয়ে বোন বা আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এটাইযে নিয়ম।।আমার বোন আঞ্জুমান ফারুকী যেনো আসমান থেকে নেমে আসা এক টুকরো চাঁদের কণা। প্রণাধিক প্রিয় ছিল আমার ভগ্নি। জলন্ত আগ্নি পিণ্ডের মতো ঝাঝালো ছিল ওর সৌন্দর্য। কন্ঠ ছিল ততধিক মধুর। আমাদের দু’ভাইবো মানুষ হয়েছিলাম কাজের মহিলা রহিমা খালার কাছে। আম্মা বহুকাল ইহজগৎ ছেড়েছেন। বাবা ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আর দ্বিতীয় বিবাহের ঝামেলায় যাননি। ধীরে ধীরে আমরা দু’ভাইবোন বড় হলাম। বোনটা আমার থেকে বেশ ছোট। পরিণত বয়সের আগেই হঠাৎ বাবা আমার বিয়ে ঠিক করলেন উনার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে। বাবার কথা আগ্রহ করার ক্ষমতা কোনকালেই আমার ছিল না। তাছাড়া বিয়ে করবো না বলার মাতো তেমন কোনো কারণও তখন হয়ে উঠেনি। নতুন বধূকে পেয়ে খুব একটা মন খারাপ হয়নি। লাজুক ভঙ্গিতে নব বধূকে বরণ করে নিয়েছিলাম নিজের বক্ষপিঞ্জরে। বেশ ভালোভাবেই চলছিল আমাদের দিনকাল। সারাক্ষণ বউয়ের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসা সহসা দক্ষিণা দোলা দিতো হৃদয়ে।কিন্তু ভালো মূহুর্তগুলো চোখের নিমিষে পার হয়ে যায়। বাবা অসুস্থ হলেন,তাঁর জমিদারির ভার আমার উপরে এসে পড়লো। বিয়ের বছর খানিক হয়নি তখনও। খাজনা আদায় করতে আমাকে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে যাওয়া আসা লাগতে থাকলো। আমি দক্ষ হাতে সবটা সামলাতে থাকলাম। বাবা ভরসাস্থল পেয়ে সুস্থ হয়েও আর কাজকর্ম করলেন না। ছেড়ে দিলেন আমার হাতে। আমি একজন দক্ষ জমিদার বনে গেছি। কোন এক গ্রীষ্মকালের সকালবেলায় বাড়ি থেকে রওনা হলাম দূরের এক গঞ্জে। কয়েকদিনের সফর। সঙ্গে নিয়েছি লাঠিয়াল বাহিনী পালকী আর আমার একমাত্র বিশ্বস্ত কর্মচারী জাফরুল্লাহ শেখরকে। লোকটা আমার নায়েবের কাজ করতো। একদম খাস কর্মচারী যাকে বলে। যখন যা বলেছি প্রশ্ন ছাড়া হাজির করেছে। এমন ছেলেকে পেয়ে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান ছিলাম। যাইহোক টানা একদিন চলল আমাদের পালকী। রাতে তাবু ভিড়িয়ে নিলাম একটা পদ্ম দিঘি সামনে রেখে। যদিও সামান্য দুরুত্ব ছিল তবুও অসুবিধা কিছু হতো না। গ্রামের প্রথমেই পুকুরটা পড়েছে। ভাবলাম পানির অসুবিধা থেকে বাঁচতে এটাই আমাদের উপযুক্ত স্থান। সেদিন রাতটা বেশ ভালোভাবে পার করলাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি লাঠিয়াল বাহিনীকে পাঠিয়ে দিলাম গঞ্জের হাট থেকে খাবার কিনে আনতে। চাল ডাল এনে ওরা রান্না বসিয়ে দিলো। আমি তাবুতে থেকে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। জানিনা কিসের এত ছটফটানি। কোন সর্বনাশের ঈঙ্গিত। আমি তাবু থেকে বেরিয়ে আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম পুকুরের কিনারে। হঠাৎ পানির ঝপঝপ তরঙ্গে আমার দৃষ্টি সেদিকে পতিত হলো। ক্ষণিকের জন্য আমি থমকে গেলাম। দৃষ্টি স্থির হলো। আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো হুর পদ্ম দীঘির পানিতে নেমে এসেছে। আমি দিসা হারা পথিকের ন্যায় এলোমেলো পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে চললাম। হৃদয় পুলকীত হলো মেয়ের রূপের বাহার দেখে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মেয়েটার সম্মুখীন গিয়ে উপস্থিত হলাম। মেয়েটা ততক্ষণে কন্ঠ অবধি পানিতে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলেছে। ভেজা কাপড় আর দীর্ঘ কেশ পল্লব গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। অবশিষ্ট পোশাক পানিতে ভাসমান। মেয়েটা দু’হাতে শরীর ঢাকায় চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যার্থ। দীঘির স্বচ্ছ কাচের ন্যায় পানিতে আমি ওর ঠিকরে পড়া রূপের যাদুতে ঘায়েল । মেয়েটার মিষ্টি কন্ঠস্বরে আমার ধ্যান ভাঙলো,
> কে আপনি? এখানে কোন সাহসে এসেছেন? জানেন না এই পুকুরের আশেপাশে পুরুষের আসা নিষেধ?
মেয়েটা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। আমি ফিচেল হাসলাম। জমিদার ফারাবি ফারুকীকে আটকাবে এমন সাহস এই এলাকায় কার আছে? আমি জমিদার পুত্র নিজের সয়ং জমিদার। যা আমার পছন্দ যা আমি নিতে আগ্রহী সেটা শুধুই আমার। আমি উপলব্দি করলাম দীঘির পানিতে অবস্থান করা ওই জলপরি শুধু আমার সম্পত্তি। শুধুই আমার। ঘরে যে স্ত্রী আছে সেটা বেমালুম ভূলে গিয়ে এই রূপসীর প্রেমে আমি হাবুডুবু খেলাম। মনে হলো আমি মদ্যপান করেছি। এতো নেশা আগে কখনও বুঝিনি। একেই বলে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমার সমস্ত ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সামনের মেয়েটাকে বলে উঠলাম
> এহেন সময়ে তুমি দীঘিতে গোসল করছো মেয়ে? যদি পুরুষেরা আসে তখন? সমাজে মুখ দেখাতে পারবে? একঘরে করবে যে লোকে!
আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটা ভড়কে গেলো। নেত্র পল্লবে নেমে আসলো অশ্রুকণা। দীঘির পানিতে তা মিলেমিশে একাকার। আমি হাসলাম। এটাইতো চেয়েছিলাম আমি। আমাদের মুসলমান সমাজের মেয়েদের বাইরে গোসল করা তো দূর লেখাপড়া করার নিয়ম পযর্ন্ত নেই। উচ্চবিত্তরা খুব সখের বসে বাড়িতে মাস্টার রেখে শেখাতে পারে তবে সেটা খুব সৌখিন। বাংলা উপ্যাস বা গল্প আর আরবি জানতে পারলেই সে উচ্চতর শিক্ষিত মেয়ে। বিয়ের বাজারে এহেন মেয়ের দাম নেই বললেই চলে। মেয়েরা হবে পানির মতো স্বচ্ছ আর তরল । যেখানে রাখবে তেমনি চলতে হবে। যথেষ্ট কারণ আর পর্দা নিয়ে বাইরে যাওয়ায় যায়। কিন্তু এই মেয়েটা এত বাধা নিষেধ অবজ্ঞা করে কিভাবে দীঘিতে নেমেছে বুঝলাম না। কৌতূহল দমিয়ে রেখে বললাম,
> আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলে আমি চলে যাবো। তোমার বলার উপরে নির্ভর করছে আমার যাওয়াটা। যদি ঝটপট না বলো তাহলে এখুনি আমি লোকজন ডেকে তোমাকে দেখাবো।
মেয়েটা চরম ভয়ে মুখটা কুকড়ে ফেলেছে। মেয়েটার মুখ দেখে আমি পৈশাচিক আনন্দ পেলাম। ওই নেত্রের জ্বল শুধু আমার কারণে ঝরবে আর আমার কারণেই বিলুপ্ত হবে। মেয়েটা আমার কথার উত্তর দিতে বাধ্য। আমি দ্বিতীয়বার কিছু বলার আগেই মেয়েটা উত্তর দিলো,
> জ্বী বলুন?
আমি বাঁকা হেসে জিঞ্জাসা করলাম,
> নাম কি তোমার?
> চন্দ্রিমা প্রিয়জনেরা সবাই চন্দ্র বলেই ডাকে।
> বাবার নাম? এই গায়ের কার মেয়ে তুমি?
> আমার বাবা ফকির নিজাম উদ্দিন শেখ। উনি ফকির সন্যাসী মানুষ।
মেয়েটার কথা শুনে আমার হাসিটা আরও দীর্ঘ হলো। সামান্য নিজাম শেখকে হাতের মুঠোয় নিতে আমার তো বাম হাতের খেল। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। উঠে আসার সময় বললাম,
> চন্দ্র তুমি আর কখনও খোলা দীঘির পানিতে ভিজতে আসবে না। তোমার জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।আমার চোখ ঝলসে গেছে তাঁর দায়ভার কে নিবে চন্দ্র? বাড়িতে যাও।
কথাটা বলে আমি পিছনে ফিরলাম না। দ্রুতগতিতে ফিরে এলাম নিজের তাবুতে। নায়েবকে ডেকে নিজের সর্বনাশের কাহিনি বর্ণনা করে বলে দিলাম, পদ্ম দীঘির পানিতে থাকা ওই ভেজা পদ্মটিকে আমার চাই। যেভাবেই হোক ওর বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাও। আমার কথা আগ্রহ করার সাধ্য ছিল না। প্রস্তাব নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লো নায়েব। চন্দ্রের বাবা ফকির সন্যাসী মানুষ জমিদারের পুত্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস ছিল না। গ্রহণ করে নিলেন। আমি পেয়ে গেলাম আমার হৃদয় পটভূমিতে বাসা বাঁধা নতুন পুষ্পকে। সেরাতে আমাদের বিয়ে হলো। ভোরবেলা চন্দ্র কে নিয়ে ফিরলাম কিন্তু ওকে নিজের বাস ভূমিতে তুলতে পারলাম না। জমিদার হওয়ার সুবাদে আমাদের বেশ কিছু মহল ছিল। আমার পছন্দসই এক মহলে ওকে নিয়ে উঠলাম। লাঠিয়াল বাহিনী আর নায়েব কে কঠোর ভাবে নিষেধ করলাম বাড়িতে গিয়ে পাঁচকান না করতে। আমি মেতে উঠলাম চন্দ্রকে নিয়ে। আমার হৃদয় বক্ষের রাণী। যাকে ছাড়া আমি নিশ্বাস নিতেও ভূলে যায়। প্রথম স্ত্রীর কন্দনরত পত্র বাবার আদেশ অবজ্ঞা করে আমি পড়ে থাকলাম চন্দ্রের কাছে। ওর রূপের যাদুতে ঝলসে তখন আমি দিসাহারা। তবে অনুধাবন করলাম এভাবে আর কতদিন? চন্দ্রের জন্য হলেও জমিদারিটা ধরতে হবে। ভালোভাবে বাঁচতে হলে টাকার প্রয়োজন। আমি ওকে রেখে ফিরে এলাম প্রথম স্ত্রীর কাছে। মেয়েটার হাসিখুশি মুখটা ততদিনে মলিন হয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। আমাকে একান্তে পেয়েই লজ্জায় নেত্রদ্বয় বন্ধ করে শুনিয়ে দিলো আমাদের জমিদারিতে নতুন বংশধর আসতে চলেছে। কথাটা আমার কাছে কি যে বিষাদের ছিল সেটা যদি লিখে বোঝাতে পারতাম।আমার চোখের আগুনে মনে হলো সে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। পায়ে ঠেলে বেরিয়ে আসলাম অনাগত সন্তানের মাকে। আমার চন্দ্র ছাড়া এমন অধিকার কারো হতে পারে মানতে পারলাম না। চলে এলাম চন্দ্রের কাছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলো। বাবা আর বোনের দীর্ঘ পত্রের ঘনঘটা লেগেই থাকলো। বোনের পত্রের প্রতিটা লাইন জুড়ে ছিল তাঁর ভাবিমায়ের বিষাদঘন চোখের পানির বর্ণনা। সেসব আমার হৃদয় কুঞ্জে কোনো চিহ্ন আঁকতে পারেনি। সুখের সমুদ্রে গা ভাসিয়ে চন্দ্রকে নিয়ে আমি চন্দ্র বিলাসে মেতে থাকি। চমৎকার মেয়ে ছিল চন্দ্র। সর্বদা সে আমাকে নতুন নতুন রূপে চমকে দিতো। আমি থমকে যেতাম। কিন্তু অচিরেই আমার সমস্ত সুখের অবসান ঘটিয়ে বাবা জেনে গেলেন সবটা। এসব কথা যে ঝড়ো হওয়ায় আগুনের ফুলকির মতো উড়ে বেড়ায়। ধামাচাপা দিতে পারলাম না। বাবা ছিলেন শক্ত ধাচের মানুষ। শক্ত হাতে জমিদারি সামলেছে। উনি পত্র আর লোক পাঠালেন আমার দুয়ারে। হুমকি দিলেন চন্দ্রকে ত্যাগ দিয়ে ফিরে যেতে। নয়তো চন্দ্রের ক্ষতি করতে উনি দু’বার ভাববেন না। আমি থমকে গেলাম। বাবা এক কথার মানুষ। যা ইচ্ছা করে বসবে। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি চন্দ্রেকে আমার প্রথম স্ত্রীর কথা বলে দিলাম। চন্দ্র বিচক্ষণ মানুষ দক্ষ হাতে আমাকে সামলে নিলো। আমাকে বোঝালো। আমি চন্দ্রের জয় জয়কার করলাম। আহা এমন স্ত্রী পেয়ে আমি ধন্য। কিন্তু বাবাকে কি বলে বোঝাই? সেদিন রাতে চন্দ্রের কোলে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে চন্দ্র বিলাস করছিলাম। মনে শতশত ভয় আর অশান্তি দানা বেঁধেছে। সেই মূহুর্তে চন্দ্র আমাকে বলে বসলো,
> আমি জানতাম আপনি সেদিন সেই দীঘির পাড়ে আপনি আসবেন। আপনার হৃদয় বক্ষের এইখানটাতে হাত রাখার অধিকার দিবেন।
আমি চমকে উঠে জিঞ্জাসা করলাম,
> চন্দ্র হেয়ালি করো না। বুঝিয়ে বলো।
> আপনাকে দেখেছিলাম মোড়লের কাচারীতে কোনো একদিন। আমি থমকে গিয়েছিলাম। এমন সুদর্শন যুবককে পাওয়ার লোভ আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর সাহস করা যে বড্ড অন্যায়। কি করবো মাথায় কিছু আসছিল না। বাবা সন্যাসী মানুষ নানারকম বই আর মানুষের যাতায়াত ছিল বাড়িতে। কাকতলীয় ভাবে একটা বই আমার হাতে আসলো। আমি বইটা পড়তে শুরু করলাম। খুব আর্কষণ করেছিল বইটা আমাকে। কালো যাদুর বইটা। আমি শুরু করলাম সাধনা করা। বইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী সব কিছু যখন শেষের পথে সেই সময়ে একজন লোক আমার নিকট উপস্থিত হলেন। জানিনা সে কে?কোনো মানুষ নাকি জ্বীন বা শয়তান! আমাকে একটা পাথর দিয়ে বললেন এই পাথর কোনো সাধারণ পাথর না। এর থেকে যা ইচ্ছা তাই পাওয়া যাবে। তবে এটার বিনিময়ে কিছু খোয়াতে হবে। এই পাথরের গুণে আমি আপনার উপস্থিতি আগেই টের পেয়েছিলাম। চাইতে হলো না কিছুই। উনি আরও বলেছিলেন পাথরের অভিশাপ কাটাতে হলে পাথর মানবির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সব কিছুই ধবংস হয় তেমনি এই পাথরও হবে। তখন জন্ম নিবেন সে।।আমি এখন অবধি কিছুই চাইনি। আপনি চাইতে পারেন। সব বিপদ কেটে যাবে।
চন্দ্রের কথা আমার বিশ্বাস হলো না। অদম্য কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসলো। ওকে নিয়ে আসতে বললাম পাথরটা। ও নিয়ে আসলো। চেয়ে বসলাম নিজের যত ইচ্ছে চাওয়া পাওয়া ছিল। চন্দ্র আমার হাতে একটা কাগজ তুলে ধরলো। সেখানে লেখা ছিল আমার সকল চাওয়ার বিনিময়ে খোয়াতে হবে আমার বংশের সকল মেয়েদের কন্ঠের ভাষা। বছরের পর বছর জন্ম নিবে অপরূপা সুন্দরী কন্যা। তাদের রূপে ঝলসে যাবে যেকোনো যুবকের হৃদয় কিন্তু তাঁরা হবে বোবা বধির। কোনো যুবক ইচ্ছা করলেই তাদেরকে নিজের আয়ত্বে নিতে পারবে না। মানব নিষিদ্ধ মানবী হবে তাঁরা। আমি রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু হবে না।
কিন্তু কাকতলীয়ভাবে পরদিন বাবা আসলেন আমার দুয়ারে। আমাকে আর চন্দ্রকে ফিরিয়ে নিতে। প্রথমে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় খবরগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার প্রথম স্ত্রী সন্তান প্রসবকালে ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করেছে। জন্ম নিয়েছে এক ছেলে। আমি প্রাণাধিক প্রিয় বোনটা হঠাৎ বাক শক্তি হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। তাঁর মুখের মিষ্টি কন্ঠে ভাইজান ডাকটা শোনার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু চন্দ্র ছিল স্বাভাবিক। কি সর্বনাশীনির মোহ মায়ায় জড়িয়ে আমি নিজের ক্ষতি করেছি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বাড়িতে ফিরে ছুটে গিয়ে নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরলাম। স্ত্রীর মুখটা দেখার সৌভাগ্য হলো না। বেচারী স্বামীর দেওয়া লাঞ্ছনা গঞ্জনা হৃদয়ে ধারণ করে পথিব মায়া ত্যাগ করেছে। কি যে কষ্ট হলো। হারিয়ে যাওয়ার পরেই আমি সেই রত্নের মূল্য বুঝতে পারলাম।। চন্দ্রকে দেখলেই তা হুড়মুড় করে বাড়তে থাকলো। বোনটা চুপসে গেছে।একদিন আত্মহত্যা করে বসলো। আমি চন্দ্রকে তাড়িয়ে দিতে পারিনি কারণ ততদিনে সুলতান বংশের অনাগত বংশধরের মা সে। দিন যেতে লাগলো আমার মধ্যে তিক্ততা বাড়লো। ছেলেকে বুকে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। জন্ম নিলো আমার দুই রাজকন্যা। খুশী হওয়ার বদলে আমি হতাশ হলাম। ওদের কন্ঠ যে আমি জন্মের আগেই কেড়ে নিয়েছি। সহ্য করতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম এবার আমার পাপের শাস্তি পাওয়া উচিৎ। ভেঙে পড়া মন আর শরীর নিয়ে আমি এই পথিব জগতে থাকতে চাইনা। পাথরটা গহিন অরণ্যে সমাধিত করলাম। দরকার নেই ওই সর্বনাশিনী পথর আর চন্দ্রের মতো মেয়েকে। ও আমার কাছে বিষাক্ত। কত বছর এভাবে সকলের অভিশাপ কুড়াতে হবে আল্লাহ্ ভালো জানেন।
অধরা এই পযর্ন্ত এসে থামলো। ডাইরীতে লোকটার লেখা শেষ হয়েছে। পরবর্তী পৃষ্ঠাতে জুবায়েরের দাদুর লেখা। উনার বাবা সুইসাইড করেছিলেন। ডাইরীটা উনার সেই চন্দ্র মায়ের থেকে প্রাপ্ত ছিল। জুবায়েরের বাবারা দুই ভাই জমজ। দেখতে হুবহু এক। জমিদারদের আমল ছিল না তবে বেশ জমিজমা অর্থসম্পদ ছিল সুলতানদের কাছে। জুবায়েরের বাবা বেশ ভালো মানুষ ছিলেন অন্যটা ছিল বেয়াড়া। জুবায়েরের বাবা জার্মানিতে এসেছিলেন যুবক বয়সে। এখানে এসে ব্যবসা করতে শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যে ভালো উন্নতি করেন। বিয়ে করেন। আরেকজন তখন বুদ্ধি করতে থাকে কিভাবে ভাইকে সরিয়ে নিজে দখল নিবেন। তাছাড়া উনার ঘরে তখন জন্ম নিয়েছে দু জোড়া বোবা বধির কন্যা। সুলতান বংশের অভিশাপ আর অর্থের লোভেই উনি কালো যাদুর বইটা নিয়েছিলেন।। ডাইরীতে উল্লেখ নেই উনি কালো যাদু শুরু করেছেন। এটা খুঁজে নিতে হবে। হয়তো উনি এসব করে অধরার সম্পর্কে জেনেছেন। ।অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল ডাইরী পড়ে। মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার গল্প পড়লত। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। জুবায়ের এখনো ফিরে আসেনি। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে। অধরার ধ্যান ভাঙলো জুবায়েরের আগমনে। ছেলেটার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ডান হাতের মুঠোয় চকচক করছে ধাঁরালো খঞ্জর। লোকটা ওর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। অধরার সারা শরীর বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। মনে হলো এখনো বুঝি জুবায়ের খঞ্জরটা নিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়বে।
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৬
অধরা ভয়ে পিছিয়ে আসলো। জুবায়ের ক্রমশ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটার হঠাৎ এমন পরিবর্তন নিয়ে ও বেশ চিন্তিত। মনে হলো আবার কিছু হয়ে যায়নি তো? কথাটা ভেবে ও ঢোক গিলল। কতবার নিষেধ করেছিল বাইরের কিছু না খেতে। এই পেটুক ছেলেটা হয়তো দুমদাম খেয়ে নিয়েছে। অধরার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। গুটিসুটি হয়ে বিছানার এক কোনে বসে পড়লো। জুবায়ের লাফ দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসতেই অধরা কেঁপে উঠলো। ভাবলো দৌড়ে পালিয়ে যাবে কিন্তু হলো না। ততক্ষণে জুবায়ের ওকে ঝট করে বিছানায় ফেলে দিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়েছে। অধরা ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। কয়েক মূহুর্ত পর হঠাৎ উষ্ণ অধরের ছোঁয়া ললাটে পেতেই অধরা চোখ খুলে ফেলল। জুবায়ের ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। অধরার ভয়ানক মেজাজ খারাপ হলো। এমনিই ডাইরী পড়ে মাথা আউলে গেছে তার মধ্যে ছেলেটা এসে বেয়াদবি করছে। ফাজিল ছেলে। অধরা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে উঠতে চাইলো কিন্তু জুবায়ের দিলো না। ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে। ঝকঝকে খঞ্জরটা তুলে অধরার কপাল থেকে শুরু করে গল পযর্ন্ত আলতো ছোঁয়া দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> আমি ডাকাতি করতে এসেছি। ভালোবাসা দিবে কিনা বলো? অবশ্য বউ আমার, সেহেতু বউয়ের ভালোবাসা না দিলেও তা আমার। মোটকথা বউয়ের সব কিছু আমার ।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা জ্বলে উঠলো। সিরিয়াস সময়ে এই লোকটা এসেছে মজা করতে। অধরা এবার ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
> জুহি আছে না ওর কাছে গিয়ে ডাকাতি করেন। বেচারীর প্রেমে পড়ে ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গিয়েছিলেন। আপনাদের বংশে আছে তো বউ রেখে সুন্দরীদের পেছনে ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়া। পড়লাম আপনার গোষ্ঠীর এক প্রেমিকের কাহিনি। সব গুলো এক।
জুবায়ের খঞ্জর টা ফেলে দিয়ে উঠে বসলো। মুখটা করুন করে বলল,
> মৃত মানুষকে নিয়ে কিছু বলতে হয়না। তাছাড়া আমার জানিনা কি হয়েছিল তখন অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড করে ফেলতাম। সরি বউ।
অধরা উঠে বসলো। ওড়নাটা ঠিক করে বলল,
> ঠিক আছে ঠিক আছে। ওসব নিয়ে কোনো ঝামেলা করতে চাইনা। আপনার মাথায় সমস্যা সে আমি অজানা নেই। এবার ডাইরীটা দেখুন, এখান থেকে জেনেছি আপনাদের বংশে কহিনুরের ঝামেলাটা কিভাবে ঢুকেছিল। সবটা ছিল একটা মহিলার উচ্চ আকাঙ্ক্ষার ফল। উচ্চ আকাঙ্ক্ষা ভালো তবে নিয়মের বাইরে গিয়ে না। এই ভদ্রমহিলা একজন মানুষকে পাবার জন্য কালো যাদু করে ফেলল কি জঘন্য তাঁর মেন্টালিটি।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে বলল,
> নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আর্কষণ বেশি থাকে উনাকে খারাপ বলো না। আচ্ছা ডাইরী পেলে কিভাবে? বিস্তারিত বলবে কি লেখা আছে?
অধরা জুবায়েরকে মোটামুটি গুছিয়ে সবটা বলে দিলো। দাদু বলেছিল কাউকে না বলতে কিন্তু অধরা সেটা পারলো না। তাছাড়া জুবায়েরের থেকে লুকিয়ে রেখে বিশেষ কোনো সুবিধা হতো না। সব শুনে জুবায়েরের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। বলল,
> অনেক প্রশ্ন কিন্তু পরিস্কার হয়নি। তুমি ভাবো এখানে কহিনুরের জন্ম নিয়ে কোনো কথা উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে পাথর মানবির কথা। ধরো কহিনুরের জন্ম কখন কিভাবে হবে, কিভাবে পাথরের ক্ষমতা ফিরবে কিছুই উল্লেখ নেই।
অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> মেয়েটার রক্তে পাথর প্রাণ ফিরে পাবে। এসব কালো যাদু খুবই ভয়ংকর জিনিস। সাহায্য করার নামে সব কিছু কেড়ে নিতে উস্তাদ। আপনাদের বংশের মেয়েদের জন্য খারাপ লাগছে। একটা বিষয় কিন্তু ক্লিয়ার হয়নি। ডাইরীতে লেখা ছিল মানব নিষিদ্ধ মানবি হবে তাঁরা। যদি মানব নিষিদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে আপনার ফুপা কে? আপনার ফুপির কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে? উনি মানুষ তো?
অধরা উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সত্যি বলতে এই কথাটা ওর আগে মাথায় আসেনি। এখন হঠাৎ খেয়াল হলো। জুবায়ের ডাইরীটা নিয়ে সেই লাইনটা কয়েকবার উচ্চারণ করে বলল,
> এই ফুফাকে আমার বেশ সন্দেহজনক লাগে আগেই বলেছিলাম। আর যাইহোক ভদ্রলোক কিছুতেই মানুষ না। হয় জ্বীন নয়তো পিশাচ। নয়তো এই কহিনুরের সঙ্গে জড়িত কোনো রহস্যময় চরিত্র।
অধরা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল,
> বাদ দিন পরে দেখা যাবে। আগে বলুন উকিলের সঙ্গে কথা হয়েছে?
> সব ঠিকঠাক আছে। নোটিশ পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছি। আশাকরি কোনো ঝামেলা হবে না। ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলা জরুরী। ও হয়তো আমার মতো ভূল করেছে। আরমান ফারুকী যে আমাদের বাবা না এটা ও জানেনা।
অধরা বিরক্ত হলো জুবায়েরের কথা শুনে। নাক মুখ কুচকে বলল,
> একদম ওকে কিছু বলবেন না। ও না জানলেও অসুবিধা নেই। ক্ষতি আপনার হবে ওর না। আরমান ফারুকী ওকে বিশেষ কোনো কাজে ব্যবহার করছে তাই ওকে এতটা কদর করে। ও ওর মতোই থাক সময় হলে সব প্রকাশ পাবে। খেয়েছেন রাতে?
জুবায়ের ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো। মুখটা করুন করে বলল,
> তুমিই তো বললে তোমার হাতের খাবার ছাড়া খাওয়া যাবে না তাহলে এখন বলছো কেনো?
>অপেক্ষা করুন আমি যাচ্ছি। ধন্যবাদ কথা শোনার জন্য। বিপদ ঘাপটি মেরে আছে যখন তখন হামলে পড়বে। সাবধানের মার নেই।
জুবায়েরের চোখ বন্ধ করে বলল,
> বুঝলাম ম্যাম। তুমি দেখেছো আমার সঙ্গে থেকে তোমার কেমন বুদ্ধি বেড়েছে।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। গুরুত্বপূর্ণ কথার মধ্যে কি সব বলছে। বিরক্ত হয়ে বলল,
> কেমন বুদ্ধি জানা আছে। আচ্ছা বলুন তো আপনার ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল আমাদের বিয়ের মাস খানেক আগে। উনার ভাষায়, আমাকে দেখে উনার চোখের এন্টেনা নড়ে গিয়েছিল। ক্রাশ খেয়ে নিজে না বিয়ে করে আপনার সঙ্গে কেনো বিয়ে দিলেন? উনি নিজের বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতেন। প্রশ্ন জাগে না আপনার মনে?
অধরার কথা শুনে জুবায়েরের ভীষন মন খারাপ হলো রাগ ও হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
>তোমার কি এখন আফসোস হচ্ছে? আমি বর হিসেবে দেখতে খারাপ নাকি তোমার অন্যকিছুতে সমস্যা? ভাইয়ের সঙ্গে তুমি জীবনে আর কথা বলবে না। আমার পছন্দ না তুমি বাইরের লোকদের সঙ্গে আলাপচারিতা করো।
> বোকা বোকা কথা বলবেন না। আমি বিষয়টাকে ওরকম ভাবে ভাবিনি। আমি শুধুমাত্র বলতে চেয়েছি লোকটা নিজের পছন্দের মেয়েকে কারণ ছাড়া হাতছাড়া কেনো করলেন? নিজেও বিয়ে করতে পারতেন। নিশ্চয়ই কারণ আছে? আপনার ভাইয়ের মধ্যে ঘাবলা আছে।
> ওকে নিয়ে কোনো কথা হবে না। আমার কিন্তু ভীষন ক্ষুধা পেয়েছে। খেতে দিবে নাকি বাইরে গিয়ে দুম করে খেয়ে আসবো?
অধরা বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসলো। এই ছেলেটা এতদিন বউয়ের সঙ্গে খারাপ খারাপ ব্যবহার করে এখন জেলাস ফিল করছে যেটা একদম বিরক্তিকর। রহস্য উদ্ধারে মন নেই আছে বউ হারিয়ে যাবে সেই চিন্তা নিয়ে। অধরা কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হলো। রাতের ডিনার রেডি হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। জুবায়েরকে হয়তো এখনই ডাকা হবে। অধরা একটা কাজের মেয়ের সাহায্য নিয়ে দ্রুত কয়েকটা রুটি আর ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে রান্না বসিয়ে দিলো। মাংস নেওয়ার সময় চিকেন নাকি সিউর হয়ে নিলো। এই বাড়ির যে অবস্থা দেখা গেলো ফ্রিজে চিকেনের বদলে মানুষের হাত পা রেখে দিয়েছে। কিছুই অস্বাভাবিক না। আধা ঘন্টার মধ্যে ওর রান্না শেষ হলো। দ্রুত খাবার নিয়ে উপরে আসার সময় দাদু ওর রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। অধরা চমকে উঠেছে তবে সেটা বুঝতে দিলো না। ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> কিছু বলবেন?
> বাড়িতে এতো লোকজন থাকতে তুমি রান্না করছো বিষয়টা ভাবাচ্ছে আমাকে।
অধরা ঢোক গিলে বলল,
> জানেন তো দাদু খুব সখ জেগেছে বরকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো। বরের সেবাযত্ন করবো আম্মুরা যেমন করে আরকি। বাঙ্গালী মেয়েরা তো এমনিই করে তাইনা দাদু?
> বেশ ভালো কিন্তু কেমন জানি লাগছে। আচ্ছা যাও।
অধরা অনুমতি পেয়ে আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত উপরে উঠে গেলো। অন্যদিকে রান্নাঘরের পাশ থেকে একজন ওর দিকে লাল লাল চোখে চোখে তাকিয়ে আছে সেটা ও দেখতে পেলো না।
☆☆☆☆☆☆☆☆
গভীর রাত, চারদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। পাশে জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। অধরার কিছুতেই ঘুম আসছে না। পেটের ডান সাইডে চিনচিন করে ব্যাথা করছে। একটু হাঁটতে পারলে হয়তো ভালো লাগবে। কথাটা ভেবে ও চুপচাপ জুবায়েরের পাশ থেকে উঠে আসলো। ছেলেটার ঘুম বেশ গভীর। অধরা দরজা খুঁলে বাইরে পা রাখতেই খেয়াল করলো বারান্দা ধরে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে। পায়ের শব্দের সঙ্গে ঠুকঠাক আওয়াজ হচ্ছে। অধরা কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে গেলো। অজানা উত্তেজনাই শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। অধরা খুব সাবধানে এগোতে থাকলো। দু’তালা বাড়ি, দোতলার কক্ষ গুলো এল আকৃতির লম্বা ভাবে তৈরী। দুপাশ দিয়েই বাইরে যাওয়ার সিঁড়ি। বাড়িটা যেমন অদ্ভুত তেমনি এই বাড়ির প্রতিটা সদস্যও কেমন অদ্ভুত। এখানে থাকা প্রতিটা মানুষের মধ্যে রহস্য খেলা করে। অধরা ভাবতে ভাবতে শেষ সীমান্তে পৌঁছে গেলো। সিঁড়ি ধরে বাইরে নেমেই অধরার চোখ চড়কগাছ। অনেকগুলো লোকজন বাইরে জড় হয়েছে। সকলের দৃষ্টি সামনের দিকে। আকাশে পূর্নিমা চাঁদের জোছনা পৃথিবীতে ঠিকরে পড়ছে। দূর থেকে মানুষগুলোর মুখগুলো ভালো স্পষ্ট না হয়ে কেমন আবছা দেখা যাচ্ছে। অধরা দ্রুতগতিতে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো। এখানে পিনপতন নিরবতা কেউ করো দিকে তাকাচ্ছে না। হঠাৎ ফ্যাচ ফ্যাচ কান্নার আওয়াজে ওর ঘোর কাটলো। সামনে তাঁকিয়ে দেখলো ওর মেঝো ননদ রুশনারা ফারুকী বসে আছে। ওকে ঘিরেই কিছু একটা চলছে। মেয়েটার গলাই মালা পাশের চেয়ারটা খালি। কি হচ্ছে এখানে কে জানে। অধরা কৌতূহলী হয়ে ভাবলো কাউকে জিঞ্জাসা করবে। পরিচিত কেউ নেই তাই সাহস পেলো না। এতগুলো অপরিচিত মানুষ এই বাড়িতে কিভাবে এলো? আশেপাশে দেখে এবার সামনের দিকে তাঁকিয়ে ঝটকা খেলো। রুশনারার এখন আর একা বসে নেই। ওর পাশে একজন অর্ধমানব বসে আছে। যার পায়ের দিকে মানুষের আকৃতি আর মাথার দিকটা পশুর। কি ভয়ংকর দৃশ্য। ভয়ে ওর বুকটা ধুক করে উঠলো। রুশনারা ভয়ে চুপসে আছে। এই অর্ধমানবটা নিজের মালাটা খুলে মেয়েটাকে পরিয়ে দিতেই মেয়েটা ছটফট করতে শুরু করলো। অধরা আর চুপ থাকতে পারলো না। চিৎকার করে বলে উঠলো,
> কি হচ্ছে হচ্ছে এখানে? মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো? এই লোকটা কে?
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। সকলের দৃষ্টি এবার ওর উপরে পতিত হলো। অধরা খেয়াল করলো এখানে অবস্থানকারী সকলেই অর্ধমানবে রূপান্তরিত হয়েছে। ওরা এসে অধরাকে ঘিরে ধরলো। ক্রমশ অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে। অধরা ভয়ে গুটিয়ে গেলো। মনে হচ্ছে সবটা স্বপ্ন। প্রচণ্ড ভয়ে ওর বুক ঢিপঢিপ করছে। বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ধপাস করে পড়ে গেলো।
☆☆☆☆☆☆☆
আলো ঝলমলে সোনালী দিনের সূচনা হয়ে রাতের আধারের সঙ্গে সকল অশুভ কালো ছায়া দূর হয়ে গেছে। চোখে আলোর রশ্মি পড়তেই অধরার ঘুম ভাঙলো। নড়াচড়া করে হামি ছেড়ে উঠে বসলো। মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। বিছানা থেকে নামতে চাইলো কিন্তু হলো না। জুবায়েরের গায়ের নিচে ওর কাপড় অর্ধেক আটকা পড়েছে। অধরা কাপড় টেনে নিতেই জুবায়ের হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসলো। চিন্তিত হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> তুমি ঠিক আছো? শরীর ঠিক লাগছে? কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো? গতকাল রাতে তুমি বাইরের লেনে একা পড়ে ছিলে। ভাগ্য ভালো আমি পেছনে পেছনে গিয়েছিলাম। সারারাত টেনশনে আমি শেষ।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। গতকাল রাতের সবকথা ওর মনে পড়ে গেছে সেই সঙ্গে ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। অধরা ঢোক গিয়ে জুবায়েরকে সবটা খুলে বলল। জুবায়ের বিশ্বাস করলো কি ঠিক বোঝা গেলো না শুধু বলল ফ্রেস হয়ে নিতে। অধরা চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকতেই জুবায়ের বেরিয়ে গেলো। অধরা বাইরে এসে ওকে পেলো না। ধীর পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো। দোতলা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো ডাইনিং রুমের সোফায় ছোটখাট একটা আড্ডা বসেছে। রুশনারার পাশে একজন সুদর্শন যুবক বসে আছে। দুজনের চেহারাই লাজুক হাসি। অধরা নেমে আসলো। ঘটনা কি জানার জন্য। ওকে নামতে দেখে দাদু সরে গিয়ে ওকে বসতে দিয়ে বলল,
> বসো দাদুভাই। তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। এইটা আমার আরেকটা দাদুভাই। আমাদের রুশনারার জামাই গালিব। ওদের বিয়ে হয়েছে তবে অনুষ্ঠান করা হয়নি। ভাবছি ঘরোয়া একটা অনুষ্ঠান করবো। ছেলেটা আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকবে।
অধরা হতবাক হয়ে সামনে বসা যুবকের দিকে তাঁকালো। লোকটার চোখেমুখে খুশির ঝলক কেমন জানি চকচক করছে। অধরা দ্রুত দাদুর দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো। কি হচ্ছে এখানে মাথা আবারও ঘুরছে। এই বাড়ির মেয়েদের তো বিয়ে হয়না। মানব নিষিদ্ধ তাহলে এসব কি? কথাগুলো ভেবে হঠাৎ ওর শরীর খারাপ হচ্ছে। জুবায়ের রান্নাঘরে ছিল। রান্না শেষে কাজের মেয়েকে দিয়ে খাবার রুমে পাঠিয়ে অধরা পাশে এসে বসলো। দাদু জুবায়েরের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> ওকে কক্ষে নিয়ে যাও। মেয়েটার শরীর খারাপ লাগছে। এই সময় এতটা টেনশন শরীরের জন্য ভালো না।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে অধরাকে জিঞ্জাসা করলো,
> তুমি ঠিক আছো? রুমে যাবে?
অধরা কিছু বলতে পারলো না। জুবায়ের দ্রুত ওকে কোলে তুলে নিয়ে কক্ষের দিকে এগিয়ে আসলো। ওকে বিছানায় রেখে পানি খেতে দিলো। অধরা ঢকঢক করে পানিটা গলাই ঢেলে নিয়ে বলল,
> এসব কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আপনার বোনের বিয়ে হয়ে গেলো আপনি জানতেন কিছু? তাছাড়া বড় বোনের বিয়ে না দিয়ে মেজোটার মানে কি?
জুবায়ের কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল,
> ডাইরীর প্রতিটা পাতায় রহস্য লুকিয়ে আছে তুমি ধরতে পারোনি। ডাইরিটা আবারও পড়বে। তাহলে বুঝতে পারবে। অধরা আমাদের মেয়েটার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। ওর পরিণতি কি এমন হবে? মানুষ হয়ে কিভাবে ও এসব শয়তানের সঙ্গে সংসার করবে? অধরা চলো আমরা এই বাচ্চাটাকে এবোর্ট করি। দরকার নেই ওকে পৃথিবীর আলো দেখানোর। ওর কষ্টে আমার মরে যেতে মন চাইবে। বোনদের জন্য কিছু করতে পারিনি কিন্তু ওর জন্য এইটুকু তো পারবো। প্লিজ চলো।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা ভয় পেলো। ছেলেটা এমন ভুলভাল বকছে কেনো? বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে বললেই হলো। কখনও না। দরকার হলে অধরা নিজে মরে যাবে তবুও কহিনুরকে আসতে হবে। এতগুলো মানুষের প্রাণের দাম মিটিয়ে দিতে হবে। হোক সে অশুভ খারাপ কিছু তবুও দিতে হবে। এত বছরের অভিশাপ কাটিয়ে দিতে হবে সুলতান বংশের উপর থেকে। সুলতানা কহিনুর ফারুকী চন্দ্রের করা পাপ নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও মিটিয়ে দিয়ে যাবে। ওর র*ক্তে দিয়ে যদি সকল অভিশাপ কেটে যায় তবে তাইহোক। শেষ চেষ্টা অধরা করবে। কথাগুলো ভেবে ও মুখ খুলল,
> আপনি টেনশন করবেন না। এমন কিছু হওয়ার আগেই আমরা ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো। আমাদের একটা কাজ করতে হবে। এই বাড়ি থেকে ওসব আজেবাজে কাজকর্ম বন্ধ করতে হবে। কালো যাদুর বইটা উদ্ধার করে পুড়িয়ে দিতে হবে। মোটকথা এই বাড়িতে আর কোনো শয়তানের উপাসনা হবে না। মুসলিম তো দূর পৃথিবীর কোনো ধর্মেই নেই শয়তানের উপাসনা করা ভালো কিছু। এসব খারাপ কাজ। খোঁজ নিয়ে দেখুন কোন ব্যাক্তি এই পাপের সঙ্গে জড়িত আছে।
জুবায়েরের অধরার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল,
> খেয়ে শান্ত হয়ে বসো। খোঁজ নিবো তবে তুমি একা কোনো ঝামেলায় জড়াবেনা। আমাকে সঙ্গে নিবে। সারারাত আমার দম আটকে আসছিল। চলো ফিরে যায়। এখানে ভালো লাগছে না।
> ভালো লাগাতে হবে। হাট গুটিয়ে বসে থাকার কোনো মানে হয়না। আপনার বোনের বিয়েটা আটকাতে পারলাম না। ওই শয়তানটাকে তো আমি দেখে নিবো। কিভাবে এই বাড়িতে থাকে সেটাও দেখবো।
জুবায়েরের অধরার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> এমন কেনো তুমি? ভয় পেয়েও পিছিয়ে আসো না। অন্য মেয়ে হলে ঠিক পালিয়ে যেতো।
অধরা ভাব নিয়ে বলল,
> আমি সুলতান জুবায়ের ফারুকীর স্ত্রী। ক্লাবের মেয়েদের ক্রাশের বউ। একটু তো সাহস হতেই হয়।
জুবায়ের তৃপ্তি নিয়ে হাসলো। দিনগুলো ভয়ংকর ভাবে কাটছে তবে খারাপ যাচ্ছে না। ভালো খারাপ মিলিয়ে হিসেবে করলো মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে সব দিক থেকে দারুণ লাগছে। সুখ দুঃখ মিলেই জীবন। খাওয়া শেষ করে অধরা ডাইরী নিয়ে ছুটলো দাদুর কক্ষে।ভয় হচ্ছে নিষেধ সত্ত্বেও এটা ও জুবায়েরকে পড়তে দিয়েছিল। তবে লোকটা যদি ঠিক ধরতে পারে তবে বুঝতে হবে এই লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে। আর না বুঝতে পারলে স্বাভাবিক। দাদু কি বুঝতে পারবে অধরা জুবায়েরকে ডাইরীটা দেখিয়েছে?
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৭
অধরা দাদুর কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিলো। এক বুক সাহস নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভদ্রলোক তখন কিসের একটা বই নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়তেছিল। অধরার পায়ের শব্দ শুনে লোকটা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> এতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যাইহোক ডাইরীটা পড়েছো? একা পড়তে বলেছিলাম।
অধরা ঢোক গিলে বলল,
> পড়েছি কিন্তু কিছু জটিল বিষয় মাথায় ঢুকছে না। উল্লেখিত মানব নিষিদ্ধ মানবিদের বিয়ে হচ্ছে তাঁরা সংসার করছে কিভাবে সম্ভব হলো? কহিনুরের জন্ম নিয়ে খোলামেলা কিছু লেখা নেই। পাথর মানবির জন্ম কবে,কখন হবে বলা হয়নি। বিষয়টা কি আপনি জানেন?
অধরার প্রশ্ন শুনে দাদু মৃদু হাসলেন। মুখটা পূর্বের ন্যায় গম্ভীর করে বললেন,
> পাথরের শক্তি ক্ষয় হয়েছে সেটা তো তুমি নিশ্চয়ই জানো? তুমি নিজে সয়ং কা*লো যাদুর ফসল। তোমার বাবা না চাইতেও তোমাকে চেয়েছিলেন। শেষ চাওয়া ছিল এটা। কা*লো যাদুর শক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
> আপনি কিভাবে জানলেন? আপনি সবটা জানেন তাই না? আমাদের পরিবার সম্পর্কে সবটা কিভাবে জানলেন?
অধরার চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। ওর বাবার সম্পর্কে এই লোকটা সব জানে। ওর এভাবে উত্তেজিত দেখে দাদু বললেন,
> আমি সিউর জানিনা আরমান বলেছিল শুনেছি ওর থেকে। আমার ছেলেটা কিন্তু খারাপ না। পরিবারের ভালো করতে একটু স্বার্থপর হয়েছে। তুমি খামাখা ভয় পাচ্ছো। এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। বাইরের দিকে নজর না দিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবো। বাচ্চার মা হতে চলেছো ওকে আর জুবায়েরকে নিয়ে ভাবো। ভাবার কতকিছু আছে। আমরা আছি বাকীটা ভাবার জন্য।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। লোকটা ঠাণ্ডা মাথায় ওকে হু*ম*কি দিচ্ছে। অধরা চুপচাপ সহ্য করা বা ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে না। ম*রতে ওর ভয় নেই। তবে ম*রলে একা ম*রবে না পাপের এই অট্টালিকার ধ্বংস করে দিয়ে যাবে। কহিনুরকে ও এই পৃথিবীর এক কোণে লুকিয়ে রাখবে। কোনো পাপি তাপির সাধ্য হবে না ওর কাছে গিয়ে নতুন পাপের সূচনা করতে। কথাগুলো ভেবে ও নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। ঘনঘন চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে বলল,
> নিজেকে নিয়েই তো চিন্তা করছি দাদু। আমার স্বামী আর সন্তান ছাড়া কি আছে ভাবার মতো বিষয়? আসলে এই বাড়িতে তো খু*ন খারাপি পিশাচের আনাগোনা। ভয় করে যদি কিছু হয়ে যায়। আচ্ছা দাদু গতকাল রাতে আপনিই বারান্দা ধরে হাটছিলেন তাই না? পায়ের শব্দের সঙ্গে ঠাকঠক আওয়াজ পেলাম। আপনার লাঠির শব্দ মনে হলো। সবাই মিলে কার সঙ্গে রুশনারার বিয়ে দিলেন দাদু? ভদ্রলোক সরি অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক পশুর সঙ্গে বিয়ে বাহ দারুণ সমাধান পেয়েছেন। ডাইরীর এক পৃষ্ঠা ছেড়া ছিল ওটা আপনার কাছে তাই না?
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। দাদুর মধ্যে যথেষ্ট ঝামেলা আছে। ভদ্রলোক বিনা দরকারে নিজের চৌদ্দ পুরুষের ইতিহাস লিপিবদ্ধ ডাইরীটা ওকে কখনও দিবে না। অধরা অতটা বোকা না। ওর মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। বাবা মা ওকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কৌশল শিখিয়েছে। জুবায়েরের দাদুর মুখে চিন্তার ছাপ। উনি বুঝতে পারছেন না অধরা এত কথা কিভাবে জেনেছে। উনি মুখটা কুচকে নিয়ে বললেন,
> দাদুভাই তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো? ডাইরীটা তোমাকে দিয়েছি যাতে বুঝতে পারো সুলতানরা কেনো এই বাচ্চাটাকে এতটা চাইছে। তাছাড়া গতকাল রাতে আমি নিজের কক্ষে ছিলাম। বাইরে কি হয়েছে জানিনা। আর রইল তোমার ডাইরীর পরবর্তী পৃষ্ঠা? ওটা আমি জানিনা। বহুকাল আগের ডাইরী কিভাবে কি হয়েছে জানিনা। এই ডাইরীটা দেখো আগেকার দিনের দতের কালিতে লেখা। কাগজপত্র কিন্তু তখন সস্তা ছিল না। ভদ্রলোক জমিদার ছিলেন বিধায় সমস্যা হয়নি।
অধরা দাদুর একটা কথাও বিশ্বাস করলো না।। ও যেভাবে প্রশ্ন করেছে লোকটা সেসব কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে। খামাখা সময় নষ্ট হচ্ছে। অধরা কথাগুলো ভেবে নিয়ে বলল,
> আচ্ছা দাদু দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। মনে রাখবো আপনার কথা। এখন যায় পরে আসবো।
অধরা কথা শেষ করে আর অপেক্ষা করলো না। হনহন করে বেরিয়ে আসলো। এই বাড়ির সব মানুষ গুলো এক রকম। রহস্য যে কোথায় গিয়ে জটলা খুঁলবে বোঝা যাচ্ছে না। শুরু যখন হয়েছে তার শেষটা তো হবেই, অধরা নিজের হাতে এই সুলতান বংশের নতুন ইতিহাস রচনা করবে। কহিনুরের জীবনে কোনো পাপের চিহ্ন পড়বে না। মশ্রিন জীবন হবে ওর। সাদা শুভ্র ফুলের মতো সৌরভ ছড়াবে। অধরা ওকে নিজের মনের মতো করে বড় করবে। এতটা ভালোবাসা দিবে মেয়েটা যদি কোনো অশুভ খারাপ কিছু হয়েও থাকে তবে ও ভালো হয়ে যাবে। এলোমেলো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে যখন ও নিজের কক্ষে ফিরছিল হঠাৎ ওর পথ আগলে ধরলো গালিব। অধরা হতবাক হয়ে ছেলেটাকে দেখলো। গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই ভ্রু কুচকে ফেলল। এই ছেলেটা সেই অর্ধ*মানব। অধরা দ্রুত নিজের ঘোমটাটা আরও খানিক টেনে নিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> কি চাই?
গালিব ঠোঁট বাঁকা করে হাসলো। অধরার পছন্দ হলো না। দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে আবারও বলল,
> কি চাই আপনার? পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? বোবা নাকি বোবার ভান নিয়েছেন কোনটা?
> সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর বুদ্ধিতে আমি মুগ্ধ। আপনার মন রপ্ত করা বেশ কঠিন। সহজে পড়া যাবে না।
অধরা বিরক্ত হলো। ভয়ানক দুটো গালি দিলো মনে মনে। কিন্তু মুখে উচ্চারণ করতে পারলো না। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> চেষ্টা করার কথা কল্পণাও করবেন না। ধবংস হয়ে যাবেন। আমার চোখে আগুন আছে আর হৃদয়ে আছে বি*ষা*ক্ত খ*ঞ্জ*র। নতুন বিয়ে করেছেন বউ ছেড়ে এখানে এসে আজেবাজে বকছেন লজ্জা থাকা উচিৎ। অবশ্যই মানুষ হলে লজ্জা শরমের বালাই থাকতো। আপনি তো আবার অন্য কিছু। যাইহোক পথ ছাড়ুন। আপনাকে আমি ভয় পাচ্ছি না।
অধরা এক সঙ্গে একগাদা কটুকথা শুনিয়ে দিলো। এমনিতেই দাদুর বিষয় নিয়ে চিন্তিত তার মধ্যে এই ছেলেটা এসে ঝামেলা করছে। অধরা এতগুলো কথা শুনে লোকটার কোনো ভাবান্তর হলো না। বরং মিটিমিটি হাসলো আর বলল,
> ভয় না পেলে আরও মজা। খেলা জমবে। নিস্তব্ধ রজনী শনশন বাতাসে যখন কারো উন্মুক্ত হৃদ*পিণ্ডটা খা*ম*চে তুলে নেওয়া হবে সেই দৃশ্যটা দেখে ভয় পাবেন আপনি। নিশ্চয়ই পাবেন,সেদিন আর দেরী নেই। প্রিয়জনের হৃদ*পিণ্ড ছি*নি*য়ে নিতে দেখতে কেমন লাগবে ভাবতে পারছেন?
অধরা ঢোক গিলল। সবাই আজ ওর সঙ্গে ভয়ংকর কথাবার্তা বলছে। দিনটাই খারাপ। জুবায়েরেকে এখন ওর বড্ড দরকার। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। লোকটা মিষ্টি মিষ্টি করে জা*ন নেওয়ার পাইতারা করছে। অধরাকে চুপচাপ ভাবতে দেখে লোকটা আবারও বলল,
> কি হলো কিছু বলুন?
অধরা চমকে উঠে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। মুখটা কঠিন করে বলল,
> আমি এমন পরিস্থিতি তৈরী হতেই দিব না। প্রিয়জনের প্রাণ নিজের প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবো। আপনি অতিরিক্ত কথা বলেন বাচাল টাইপ। রাস্তা ছাড়বেন নাকি উন্য কিছু করব?
গালিব ভ্রু কুচকে ফেলল। মেয়েটা কি করতে পারে বুঝলো না। অধরা চেয়েছি জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে আসবে কিন্তু তেমন কিছুই করতে হলো না। জুবায়ের এসে হাজির। ও সোজা অধরার হাত ধরে বলল,
> কতক্ষণ অপেক্ষা করছি কক্ষে চলো। আর আপনি ওর রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ভদ্রতা শিখুন কাজে আসবে।
জুবায়ের উত্তরের আশা করলো না। দ্রুত অধরাকে নিয়ে নিজের কক্ষে দরজা বন্ধ করলো। গালিব সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে কোনো রাগ নেই। তৃপ্তি নিয়ে হেসে দাদুর কাছে ছুটলো।
☆☆☆☆☆☆☆☆
অধরা সোফায় বসে আছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। জুবায়ের ধা*রা*লো একটা খ*ঞ্জ*র হাতের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,
> এটা তোমার জন্য কিনেছি। এখনকার মেয়েরা মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরে আর তুমি এটা নিয়ে ঘুরবে। যদি কখনও আমিও তোমার ক্ষতি করতে আসি হৃদ*পিণ্ড বরাবর বসিয়ে দিতে দুবার ভাববে না।
জুবায়ের খ*ঞ্জ*রটা অধরার হাতে দিতেই ও সেটা রেখে দিয়ে বলল,
> আপনার দাদু আমাকে ভয় দেখিয়েছে। আমার কি মনে হয় জানেন ভদ্রলোক এসব করছে। আপনার চাচা উনার হাতের পুতুল। ইস্টোর রুমে যাওয়াটা খুব দরকার। আজ রাতে পারবেন ব্যবস্থা করতে?চাবি আছে?
জুবায়ের কিছু একটা ভেবে পকেট থেকে চাবি বের করে বলল,
> চাবি তৈরী করে নিয়েছি। দাদুর রুমটা একটু চেক করা দরকার ছিল। আচ্ছা গতকাল তো বললে না ডাইরীর পৃষ্ঠা একটা ছিল না? সবতো ঠিকঠাক মনে হলো।
> আরে আপনি ভাবুন হুট করে ডাইরী শেষ কিভাবে হতে পারে? উনি হঠাৎ লেখা থামিয়ে দেওয়ার মানুষ না। এত লম্বা কাহিনি লিখেছেন। যেখানে নিজের দোষটা অকপটে স্বীকার করতে দু’বার ভাবেননি সেখানে শেষে একটা উপদেশ দিবেন না এমন হয়নাকি। ওখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা ছিল তাইতো দাদু ওটা দিতে চাইনি। তাছাড়া দাদু ডাইরীটা আমাকে দিয়েছেন যাতে আমার মনটা নরম হয়। রহস্য জেনে গেছি ভেবে যদি আমি আর কোনো ঝামেলা না করি এসব কারণে উনি পড়তে দিয়েছিলেন। যাইহোক ওই পৃষ্ঠাটা আমাদের উদ্ধার করতে হবে। আর হ্যা এই মহা কাহিনীর ভিলেনকে আমরা না চিনলেও ভিলেন কিন্তু আমাদের চিনে নিয়েছে।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে বলল,
> মানে?
> মানে স্বাভাবিক। স্টোর রুমে সেদিন আমাদের দুজনকে সেই লোকটা দেখে নিয়েছিল তারপর দাদু এই ডাইরীটা আমাকে দিয়েছে।লোকটা দাদুর সঙ্গে যুক্ত আছে। আচ্ছা আপনি বাংলাদেশের গিয়েছেন কখনও?
> বহুবার গেছি। ওখানে আমাদের অফিস আছে। তাছাড়া ছোট থাকতে প্রায় যেতাম। মায়ের সঙ্গে গিয়েছি। জোর করে নিয়ে যেতেন। বড় হয়ে তেমন যাওয়া হয়না। তবে দাদু আরমান ফারুকীর যাওয়া আসা লেগেই থাকে। তুমি জানো গতকাল পুলিশ খোঁজ করছিল আমাকে? মায়ের মৃ*ত্যু নাকি স্বাভাবিক না। আবারও তদন্ত করতে চাইছে।
অধরা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। এতদিন পরে আবারও কেসটা রি অপেন হয়েছে ঠিক হজম হলো না। বলল,
> কিভাবে সম্ভব?
> এখানকার আইনকানুন সস্তা না যে বললেই সব মিটে যাবে। আমি আসল অপরাধীকে ধরার জন্য বাড়িতে কিছু বলিনি। তদন্ত চলছে। আশাকরি দ্রুতই সব সামনে আসবে।
অধরা বেশ খুশি হলো। জুবায়ের এতদিন পরে একটা কাজের কাজ করেছে। সেদিন ছাদে ঠিক কি হয়েছিল জানতে হবে। অপরাধীকে ধরতে না পারলে জানা কঠিন।
☆☆☆☆☆☆
অন্ধকার কক্ষে পিনপতন নিরবতা বিরাজমান। কক্ষের দক্ষিণ দিকে দুজন মানব মানবী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে হাজারো কৌতূহল আর বিস্ময় খেলা করছে। আধার ওদের দুজনকে ঢেকে নিয়েছে। তাছাড়া সামনে আসে বিশালাকার এক পুরাতন আলমারি। কক্ষের মাঝখানে ছোট একটা বৃত্তের মধ্যে মোমবাতি নিভু নিভু করে জ্বলছে। একজন মুখোশধারী মোমবাতির সামনে বসে আছে। চোখ বন্ধ করে কি একটা বিড়বিড় করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কক্ষের দরজা দুমকরে খুঁলে খেলো। দুজন মানবের আগমন ঘটলো। ওরা একা আসেনি। মুখ বেঁধে নিয়ে আসেছে এক মেয়েকে। যদিও মেয়েটার কোনো জ্ঞান নেই। ওরা মেয়েটিকে লোকটার সামনে বসিয়ে দিলো। ক্রমশ মোমবাতির হলুদ আলো লাল আকার ধারণ করলো। অধরা এতক্ষণ জুবায়েরের পাশে দাঁড়িয়ে এসব চুপচাপ দেখছিল। চুপিচুপি স্টোর রুমে আসার দু’মিনিট পরেই এই অদ্ভুত লোকটা এসে হাজির হয়েছে। জুবায়ের ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ওর আরেক হাতে একটা বই আছে।বইটা বহুকাল আগের। যদি পুরোটা পড়া হয়নি। তার আগেই এই লোকগুলো চলে আসলো। অধরার ভয় করছে এই মেয়েটার জন্য। এরা ওর সঙ্গে কি করতে চলেছে কে জানে। পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে। মেয়েটাকে বাঁচানো জরুরী। জুবায়ের পকেটে হাত দিয়ে লাইট বের করলো। উদ্দেশ্য বই টা পুড়িয়ে দিয়ে এদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করা। জুবায়েরের মতিগতি দেখে অধরা ঝট করে বইটা নিজের হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> আপনি লুকিয়ে থাকবেন ওদের সামনে আমি যাবো। ওরা আমার ক্ষতি করতে পারবে না কিন্তু আপনার করবে।
জুবায়ের রজী হলো না। বউকে বিপদে পাঠিয়ে নিজের লুকিয়ে থেকে কাপুরুষের মতো মজা নিবে কখনও না। ও প্রতিবাদ করলো কিন্তু ধোপে টিকলো না। অধরা জুবায়েরের হাত থেকে লাইট নিয়ে বেরিয়ে আসলো। সোজা লোকগুলোর সামনে লাইট জ্বালিয়ে বইটাতে আগুন লাগিয়ে ধ্যান মগ্ন লোকটার সামনে ছুড়ে দিয়ে বলল,
> কে আপনি? কি করতে চাইছেন ওর সঙ্গে?
লোকটা চোখ খুলে আহত হলো পুড়ে বইটা দেখে। বিকট শব্দ করে বলল,
> এটা কি করলে তুমি? এভাবে বইটা পুড়িয়ে দিলে? তোমাকে আমি ছাড়বো না।
লোকটা ছুটে গিয়ে অধরাকে ধরতে গেলো কিন্তু পারলো না। অধরার হাতে থাকা ধা*রা*লো খঞ্জরটা লোকটার বুকে বি*ধে দিলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে সব চুপচাপ। বই পোড়া ধোয়ায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মোমবাতি নিভে গেছে। জুবায়ের দ্রুত বেরিয়ে এসে অধরার হাত ধরলো।মেয়েটা কাঁপছে। জীবনে প্রথমবার এরকম একটা কাজ করেছে। জুবায়ের ওকে দু’হাতে আগলে নিয়ে বলল,
> ভয় নেই আমি আছি। মেয়েটাকে বাইরে নিতে হবে। তুমি একা হাঁটতে পারবে?
অধরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিলো পারবে। তবুও জুবায়েরের সন্দেহ হচ্ছে। ওকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমের সোফায় বসিয়ে দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে আবারও স্টোর রুমে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে বের হলো। অধরা এখনো কাঁপছে। হাতের খ*ঞ্জ*র থেকে ফোটা ফোটা র*ক্ত ঝরছে। জুবায়ের মেয়েটিকে ওর পাশে রেখে খ*ঞ্জ*রটা কেড়ে নিয়ে কিচেনের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে পানি নিয়ে অধরার সামনে ধরলো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। পানি পেয়ে ও সময় নষ্ট করলো না। ঢকঢক করে গলাই ঢেলে নিয়ে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল,
> আমি খু*নি হয়ে গেলাম।
জুবায়ের ওকে সামনে এনে দু’হাতের মুঠোয় মেয়েটার মুখটা নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
> এইটুকুতে ওর কিছুই হয়নি। বরং ওকে চেনার সহজ উপায় পেয়ে গেলাম। আগামীকাল সকালে যার গায়ে আঘাতের চিহ্ন পাবো ভেবে নিভো এই মুখোশ পরা লোকটা সেই। ভয় পাবে না একদম। বাঘনীকে ভয় পেলে মানাই না। এখন মেয়েটার জ্ঞান ফেরানো জরুরী।
অধরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। জুবায়ের ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে মেয়েটার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। জ্ঞান ফিরলো না দেখে কাজের মেয়েদের ডেকে নিয়ে অসলো। ওদেরকে বুঝিয়ে দিলো এই মেয়েটার যত্ন নিতে। আগামীকাল সকালে পরিচয় জেনে ওর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। জুবায়ের অধরাকে নিয়ে কক্ষে ফিরে আসলো। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সকাল হলেই জানা যাবে এই কাজের সঙ্গে সরাসরি কে যুক্ত আছে।
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৮
প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও ঘেমেঘেটে একাকার অধরা। জুবায়ের ওকে বুকে নিয়ে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জীবনে প্রথমবার কাউকে এভাবে আ*ঘা*ত করেছে। লোকটা খারাপ ছিল তাই বলে এভাবে আঘাত করাটা ঠিক হয়নি। জুবায়ের ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। চোখে ঘুম নেই। মেয়েটা এভাবে ভয় পাবে ওর ভাবনার বাইরে ছিল। আগে জানলে কিছুতেই যেতে দিতো না। মেয়েটা ওর একটা কথাও শুনে না রাগ হচ্ছে। এইটুকুতে ভয়ে কুপোকাত। সামনে যে আরও ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। মনে জোর থাকাটা এখন অতি জরুরি। কথাগুলো ভেবে জুবায়ের ওর কপালে ওষ্ঠদ্বয় রেখে বলল,
> সারারাত জেগে থাকবে? যা করেছো বেশ করেছো। লোকগুলো ভালো ছিল না। এমনওতো হতে পারে ওরা মানুষ না। তুমি খামাখা ভয় পাচ্ছো আর আমাকে কষ্ট দিচ্ছো। অধরা সামনে কিন্তু তোমার স্বামীর প্রা*ণ নেওয়ার দৃশ্যটাও তোমাকে দেখতে হতে পারে তখন? এখন থেকে শক্ত হও।
জুবায়েরের বলতে দেরী হলো কিন্তু অধরার উঠে বসতে দেরী হলো না। মুখটা ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
> জঘন্য খারাপ আপনি। দেখছেন আমি ভয় পাচ্ছি কোথায় সান্ত্বনা দিবেন, আদর করবেন তানা ওসব বাজে কথা বলছেন? আপনি সত্যিই খারাপ।
জুবায়ের অধরার মুখটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> আমি ভালো হতেও চাইনা। আমি আমার লক্ষ্মী বউয়ের উড়নচন্ডী বর। মাথা গরম করে যা করতে পারবো শান্ত মাথায় সেটা জীবনেও পারবো না। ধুমদাম অদ্ভুত কাজকর্ম করে তোমাকে চমকে দিব নাজেহাল করবো। তুমি বকবে আমি মজা নিবো বেশ হবে। আচ্ছা আমাদের মেয়েটা কার মতো হবে বলতে পারো? তোমার মতো ছিঁদকাদুনে নাকি আমার মতো ভদ্রলোক? আমার মেয়ে যদিও জানি সে আমার মতোই হবে। তবুও যদি না হয়!ওই হবে তো?
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। মেয়ে কেমন হবে ও এখুনি কিভাবে জানবে। তাছাড়া বাচ্চাদের যা শেখানো হয় বাচ্চারা তাই শিখে। অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> মেয়ে আপনাদের মতোই হবে। সুলতান বংশের মাথার উপরে চড়ে নাচবে এই মেয়ে। আপনি মিলিয়ে নিবেন। হাড়ে হাড়ে চিনি আপনাদের।
> আমিও চাই আমার মেয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে আর কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো গতি নিয়ে ধরণীতে আসুক। ওকে আমি তোমার মতো ভিতুর ডিম তৈরী করবো না। মেয়ের এক চোখে থাকবে আগুন আরেক চোখে থাকবে মমতা। সুলতানদের এতদিনের করা পাপ ধ্বংস করে দিবে। আমিও চেয়েছি ধ্বং*স হোক। আমি মনে প্রাণে ছেয়েছি আমার মেয়ে ধ্বংস হয়ে আসুক।
অধরা মুখ কাচুমাচু করে ফেলল। মেয়েটা না আসতেই কতকিছু। আসলে না জানি কি করবে। বাবা তাঁর মেয়ের জন্য ভাবছে বিষয়টা ভেবেও ওর শান্তি অনুভব হচ্ছে। স্ত্রীর কাছে এর চাইতে বেশিকিছু আর কিবা চাওয়ার থাকে। তবুও কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
> বাচ্চাটাকে আপনি একদম আজেবাজে কিছু শেখাবেন না। আমার বাচ্চাটা হবে খুবই শান্ত। মায়ের মতো ভদ্র। আপনার মতো না।
জুবায়ের মানতে পারলো না। মেয়ে মায়ের মতো হতেই পারে তবে ওর মেয়ে কিছুতেই তাঁর মায়ের মতো হতে পারবে না। সামান্য একটু সাহস দেখিয়ে হাড় হাড্ডি ঠকঠক করে কাঁপিয়ে ভুমিকম্প করে দিচ্ছে। জুবায়ের বেটি হবে হিংস্র। কথায় কথায় লোকের হৃদপিণ্ড কাঁপিয়ে দিবে। সুলতান বংশের রত্ন সে। তাঁর চলন বলন কিছুতেই সাধারণ হবে না। কথাগুলো ভেবেও শান্তি লাগছে ওর। অধরাকে ভয় থেকে বের করতে মূলত ও এতক্ষণ ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করছিল। একটু চিন্তা যে হচ্ছে না তেমন না। কাকে না কাকে মে*রে দিয়েছে লোকটা কে হতে পারে ভাবলো। নিজের ভাই নাকি চাচা নাকি দাদু? সবাইকে সন্দেহ হচ্ছে। সন্দেহের বাইরে কেউ নেই। জুবায়েরকে চুপচাপ ভাবতে দেখে অধরা মুখ খুলল। আবারও পূর্বের মতো ভয়ে ভয়ে বলল,
> কি হয়েছে আপনার? কি ভাবছেন এতো?
> তেমন কিছু না।। দ্রুত আসো ঘুমাতে হবে। একা একা ভয় পাবে তারচেয়ে আমাকে ঝাপটে ধরে চোখ বন্ধ করো। সকালের জন্য আমি অপেক্ষা করছি।
জুবায়ের কথাটা শেষ করে ওকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। মধ্য রাত ঘুম বেশিক্ষণ হবে না। বাইরে মেয়েটাকে রেখে আসা হয়েছে যদিও সকাল পযর্ন্ত বিষয়টা গোপন থাকবে। এই বাড়িতে বাইরের একজন মেয়েকে আনা হয়েছে ভাবতেই বিরক্তিকর লাগছে।
☆☆☆☆☆☆☆
ভোরবেলা দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙলো অধরার। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে শরীর মৃদু কাঁপছে। জুবায়ের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওকে না ডাকলে উঠবে না। অধরা চুপচাপ উঠে এসে দরজা খুঁলে দিলো। দরজার সামনে জুহি দাঁড়িয়ে আছে। অধরার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। দুদিন আগে মা*রা যাওয়া মানুষ হঠাৎ ফিরে এসেছে? অধরা ভয়ে চুপসে গেলো। মেয়েটা ওকে ইগনোর করে হুড়মুড় করে ভেতরে গিয়ে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে ডাকলো। জুবায়ের ঘুমের মধ্যে মেয়েটার হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। অধরার রাগ হচ্ছে না যা হচ্ছে সব কৌতূহল। এই পেত্নী যে মা*রা গিয়ে এভাবে ফিরে আসবে ওর ভাবনার বাইরে ছিল । নাকি এরাও জমজ ছিল ? জুহির হাকডাকে জুবায়ের উঠে বসলো। চোখ খুঁলেই হতভম্ব হয়ে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জুহির দিকে তাঁকিয়ে চমকে গিয়েছে সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অধরা ভাবলো এখুনি বুঝি ছেলেটা ওকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। জুবায়েরের মুখের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো। দ্রুতগতিতে বিছানা থেকে নেমে জুহির গলা টিপে ধরে হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
> তুই মানুষ হোস বা পেত্নী আমার কিছু যায় আসেনা। তোকে যে শিক্ষা দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছি এটাই অনেক। আল্লাহ্ কাছে শুকরিয়া। আমার সঙ্গে গেম খেলার মজা তোকে আমি হাড়ে হাড়ে বোঝাবো। ভেবেছিলাম তোর ক*বের উপরে গিয়ে বো*ম ফেলবো কিন্তু পারিনি অন্যদের কথা ভেবে।
জুবায়েরের শক্তিশালী পেশিশক্তির কাছে জুহির নাজেহাল অবস্থা। গলা বেশ ভালো ভাবেই ধরেছে। অধরা হতভম্ব হয়ে গেলো জুবায়ের কৃতকর্ম দেখে। এই ছেলেটার যে মাথায় সমস্যা সেটা আবারও প্রমাণিত। প্রেমিকার শোকে একদিন কাতর ছিল। প্রেমিকা ফিরে এসেছে সেই খুশীতে কোথায় জড়িয়ে ধরবে তানা গলা টিপে ধরছে। মা*রা যাবে ভেবে অধরা জুবায়েরের হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল,
> ছাড়ুন বলছি। ওকে মা*র*ছেন কেনো? পাগলামি অনেক হয়েছে।
জুবায়ের অধরার কোথা ইগনোর করলো। গলা আরও শক্ত করে ধরেছে। মেয়েটা ছটফট করছে।মেয়েটা যদি জানতো এমন হবে তাহলে হয়তো এখানে আসার কথা কল্পণাও করতো না। অধরা কি করবে বুঝতে পারছে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে জুবায়েরের হাতটা ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
> সুযোগ না দিয়ে মে*রে ফেলবেন? আগে শুনি তারপর যা ইচ্ছে করা যাবে। মৃ*ত মানুষ ফিরে এসেছে জুবায়ের ফারুকী কিভাবে সম্ভব এটা নিয়ে ভাবুন।
অধরার ঝাঝালো কন্ঠ শুনে জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিলো তবে ছেড়ে দেওয়ার আগে লা*থি বসিয়ে দিলো মেয়েটার পেট বরাবর। জুহি ছিটকে গিয়ে পড়লো সোফার উপরে। জুবায়ের হাপাচ্ছে তবুও দমন হলো না। দ্বিতীয়বার মেয়েটার সামনে যেতেই অধরা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখ রাঙিয়ে বলল,
>মাথা ঠান্ডা করুন আমি দেখছি। মা*রা গেলে ঝামেলা পাকিয়ে যাবে।
জুবায়ের আক্ষেপ নিয়ে উত্তর দিলো,
> আমি জানি ও জুহি না। জানিনা ও কে তবে যেই হোক সুযোগ যখন পেয়েছি রাগ মিটিয়ে নিবো। ওরে আমি ভর্তা বানিয়ে খাবো। পিচ*পিচ করে কা*টবো। তুমি ফ্রাই করে দিবা। যদিও ওর মাং*স খাওয়ার অযোগ্য। তবুও ফেলবো না। রাগ মেটানোর জন্য খেয়ে ফেলবো।
জুবায়ের রাগের মাথায় হড়বড় করে যা মুখে আসলো বলে দিলো। অধরা কপাল চাপড়ালো। লোকটা এমন কেনো কে জানে। বুদ্ধি জ্ঞানের বড্ড অভাব। অধরা নাক মুখ কুচকে বলল,
> একটা কথাও আর উচ্চারণ করবেন না। কথা বললে কিন্তু আমি আপনাকে খু*ন করবো। চুপচাপ গিয়ে বসুন। আমি দেখছি কি করা যায়। যে ওকে পাঠিয়েছে কি তাঁর ষড়যন্ত্র সেটা তো বুঝতে দিন।
জুবায়ের বিরক্ত হলো অধরার ধমক শুনে। ওর একেবারেই ইচ্ছে নেই এই মেয়েকে ছেড়ে দেওেয়ার। অন্যদিকে মেয়েটা পড়েছে মহা বিপদে। জা*ন বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। একটুর জন্য বেঁ*চে গেছে। অধরা মেয়েটার মুখের দিকে তাঁকিয়ে ঝটপট পাশে থাকা একটা গ্লাসের পানি মেয়েটার মুখে ছুড়ে দিলো। মেয়েটা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এই ঘরে যে বাঘ আর বাঘিনীর বসবাস এটা ওর জানা ছিল না। অধরা টাওয়েল নিয়ে এসে মেয়েটার মুখ থেকে মেকাপের আস্তরণ উঠিয়ে দিলো। পুরোপুরি উঠলো না তবে বোঝা গেলো কিছুটা। এটা জুহি না পাক্কা সিউর। অধরা বাঁকা হাসলো। মেয়েটার চোখেমুখে ভয় দাঁনা বেঁধেছে। জুবায়েরের চোখে বিস্ময়। অধরা নীরবতা ভেঙে থমথমে মুখ নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> কে পাঠিয়েছে?
মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। জুবায়ের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ছিল । অধরার প্রশ্ন শুনে আবার উঠে আসলো। ওকে উঠতে দেখে ভয় পেয়ে মেয়েটা দ্রুতগতিতে অধরার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললো,
> আমাকে বাঁ*চা*ন। মা*র*বেন না প্লিজ। আমি নিজ ইচ্ছেতে আসিনি। আমাকে আনা হয়েছে। আমি জুহি আপুর ছোট বোন। আপুর সঙ্গে হালকা চেহারার মিল আছে দেখে আপনার শশুর মশাই আমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে এনেছে। আমি আগে জানলে আসতাম না।
মেয়েটা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই হুড়হুড় করে সব গোপন তথ্য বলে দিলো। জুবায়কে এবার থামানো গেলো না। মেয়েটাকে তুলে নিয়ে জোরে আরেকটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দিলো। অধরা গিয়ে ওকে ধরে ফেলল। ভ্রু কুচকে মেজাজ দেখিয়ে বলল,
> একদম ওকে মা*র*বেন না। আপনার ড্যাড এসব করছে। উনাকে গিয়ে প্রশ্ন করুন তারপর ওকে মা?র*বেন। ভালো মুনাফা পেলে সবাই লোভী হয়ে উঠে। আগে শুনুন উনার উদ্দেশ্য কি ছিল। এই মেয়ে বলো কি উদ্দেশ্য নিয়ে তোমাকে ভাড়া করা হয়েছে?
মেয়েটা শব্দ করে কেঁদে উঠে বলল,
> উনার সঙ্গে প্রমের নাটক করে আপনার থেকে আলাদা করতে আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে। আপনার সঙ্গে থেকে উনি বেয়াদব হয়ে উঠেছে। আরমান ফারুকী স্যার আমাকে বলেছিলেন আমাকে দেখলে জুনায়েদ স্যার শান্ত হয়ে যাবেন। উনার সব কথা শুনবেন।
জুবায়েরকে বেয়াদব বলা হয়েছে শুনে ও আবারও জ্বলে উঠলো। তেড়ে আসতে চাইলো কিন্তু অধরা চোখ রাঙিয়ে নিষেধ করলো। মেয়েটা আবারও বলল,
> আমি জানতাম না উনি এরকম আ*ক্র*মণ করে বসবেন। আরমান স্যার মিথ্যা বলে আমাকে পাঠিয়েছে। প্লিজ কিছু করবেন না। অনেক ব্যাথা পাচ্ছি। কখনও আর এমন লোভ করবো না।
অধরা মুখ কাচুমাচু করে বলল,
> প্রথমবার ছিল তাই ক্ষমা করেছি। দ্বিতীয়বার এই সুযোগ পাবেনা। এই বাড়ির দিকে পা রেখেও ঘুমাবে না। যাও
মেয়েটা অনুমতি পেয়ে এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। যেমন হুড়মুড় করে এসেছিল তেমনি দৌড়ে পালিয়ে গেলো। অধরার এবার ভীষণ হাসি পেলো। মেয়েটা কত আশা নিয়ে এসেছিল। ও তো জানেই না জুবায়ের কেমন টাইপের ছেলে। বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে পারেনা। যদি মেয়েটাকে ও সুযোগ দিতো তবে চিত্রটা এখন অন্যরকম হতো। সে যাইহোক আরমান ফারুকী কি করতে চাইছে? উনি যেকোনো উপায়ে আবারও জুবায়েরকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চেয়েছে নাতো? কথাটা ভেবেই ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জুবায়ের অধরার মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> রণক্ষেত্রে পৌঁছে গেছি আর অপেক্ষা করলে চলবে না। যা হবে সামনে সামনে। চলো আরমান ফারুকীর সঙ্গে বোঝাপড়াটা শেষ করে আসি। উনি এখন বাইরে আছে জগিং করছে।
অধরা কিছু বলার আগেই জুবায়ের ওর হাত ধরে বেরিয়ে আসলো। বাড়ির পেছনের বাগানে আরমান ফারুকী নিজের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে জগিং করতে এসেছেন। মাঝেমাঝে গল্প করছে আবার দৌড়াদৌড়িও করছে। জুবায়ের সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। আরমান ফারুকী ওকে দেখে থমকে গিয়ে বলল,
> কিছু বলবে?
জুবায়ের হুঙ্কার দিয়ে বলল,
> বলার মতো অনেক কথায় আছে আপাতত এটা বলুন ওই ফালতু মেয়েটাকে আমাকে কাছে কেনো পাঠিয়েছেন?
আরমান ফারুকী ভ্রু কুচকে চিন্তিত হয়ে বললেন,
> কোন মেয়ে? তুমি কোন মেয়ের কথা বলছো? জুবায়ের মাথা ঠান্ডা করো। তোমার এই হট মেজাজের জন্য বিপদে পড়বে একদিন।
> রাখুন আপনার মেজাজ। ওই মেয়েকে পাঠিয়ে ঠিক করেননি। কি ভেবেছেন আবারও আপনার কথায় উঠবো আর বসবো? কখনও না।
> আরে বাবা আমি সত্যি বলছি আমি এমন করিনি। নিয়ে এসো সেই মেয়েকে আমি কথা বলতে চাই। মেয়েটার কথায় তো হবে না। আমিও কথা বলে দেখি। তুমি দিনদিন বড্ড বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছো। গতকাল আমার নামে নোটিশ পাঠিয়েছো। তোমার সব সম্পত্তি তোমার মেয়ের নামে লিখে দিয়েছো। এসব কি হচ্ছে বলবে? বাচ্চাটার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় ধরো মা*রা যায় তখন সব সরকারি ফান্ডে চলে যাবে। এসব কি পাগলামি বলতো? তোমাকে এসব কে করতে বলেছে? জুবায়ের আমি তোমার ভালো চাই।
আরমান ফারুকীর কথা শুনে অধরা হতবাক হলো। লোকটা ভালো সাজার নাটক করছে নাকি এমনিতেই ভালো কোনটা? জুবায়েরের মাথা গরম ছিল আরও গরম হলো। বাবা হিসেবে এতদিন যাকে সম্মান করেছে হঠাৎ তাঁর গায়ে হাত তোলাটা বেমানান লাগে নয়তো এতক্ষণ অবস্থা খারাপ ছিল। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া তো কথা বলা যাবে না। তাছাড়া সব বলে দিলে লোকটা সতর্ক হয়ে যাবে। অধরা পেছন থেকে জুবায়েরের হাত টেনে ফিসফিস করে বলল,
> যথেষ্ট হয়েছে। আর কোনো ঝামেলা করবেন না। মেয়েটাকে হাজির করুন। তারপর কথা বলবেন।
জুবায়ের কিছু একটা ভেবে ঠান্ডা হলো। আরমান ফারুকী জুবায়েরের হাত ধরে খুব অসহায় কন্ঠ নিয়ে জানালো। উনি এসবের মধ্যে নেই। উনি করুণ মুখে বললেন,
> আমি তোমাদের সকলের ভালো চেয়ে বাবার অনুমতি নিয়ে অধরাকে এই বাড়িতে এনেছিলাম বউ করে। বাবার কাছে শুনেছিলাম কহিনুরের জন্ম হলে আমাদের বাড়ির মেয়েগুলোর জীবন থেকে অভিশাপ কেটে যাবে। বাবা হয়ে এইটুকু চাওয়া কি আমার অপরাধ ছিল? তোমরা অযথা আমাকে ভুল বুঝেছো।
অধরা এখনো ভ্রু কুচকে আছে। এই বাড়িতে যে যাকে পারছে দোষারোপ করে নিজেকে সাধু বানানোর চেষ্টা করছে। দাদু নিজের ছেলেকে দোষ দিলো অন্যদিকে ছেলে দাদুকে দোষ দিচ্ছে। এতকিছুর মধ্যে হঠাৎ মনে হলো গতকাল যে লোকটাকে ছু*রি*কা*ঘা*ত করা হলো সে কোথায় গেলো?
(চলবে )
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৯
পসরা ফারুকী হাসপাতালে কি হয়েছে সেটা বলা হচ্ছে না। জুবায়ের মুখটা থমথমে করে বসে আছে। ছোট থেকে যাকে বোন ভেবে এসেছে সে মোটেই ওর নিজের মায়ের পেটের বোন না বরং কাজিন। তাতে কি!কাজিন বলে কি বোন না? । বাড়িতে কেউ কিছু না বললেও জুবায়ের কিছুটা আচ করতে পেরেছে। কি বলবে কোনো ভাষা এখন আর মুখে আসছে না। অধরা ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ছেলেটার মাথায় কি ঘুরছে। পসরা ফারুকী হাসপাতালে সেট ও কিছুক্ষণ আগে জেনেছে। জানার পর থেকে জুবায়েরের জন্য চিন্তা হচ্ছে। লোকটা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তা ঠিক কিন্তু লোকটার সঙ্গে যে বাড়ির প্রতিটা লোক বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অধরা মনে মনে বহুবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছে যেনো জুবায়েরের উপরে কোনো অভিশাপ না আসে। ও মন থেকে ছেলেটাকে ক্ষমা করেছে। ভাগ্য ওকে এই বাড়িতে টেনে এনেছে সেখানে জুবায়েরকে দোষ দেওয়া বোকামি। অধরার ধ্যান ভাঙলো জুবায়েরের কথা শুনে। জুবায়ের ঘনঘন চোখের পাতা নাড়িয়ে বলল,
> অধরা তোমার কি ব্লাক কালারের শাড়ি আছে? আজ ব্লাক পরবা একটু? না থাকলে বলো আমি অর্ডার করে দিব। বেশি পারফেক্ট ভাবে সাজতে হবে না মোটামুটি হলেও চলবে। মেকাপ তো করোনা ওটার দরকার নেই।
জুবায়েরের এলোমেলো কথা শুনে অধরা অবাক হলো। বিবাহিত জীবনে প্রথমবার জুবায়ের ওকে সাজতে বলেছে কিন্তু কে? অধরা বিস্মিত হয়ে বলল,
> হঠাৎ শাড়ি?
জুবায়ের ওর কথা এড়িয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
> এসো অনুষ্ঠান করে আমরা দুজন শোক পালন করি। বাবা মাকে ভীষণ মনে পড়ছে। আপনজনদের বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে খুব করে কাঁদতে। আমি তো বিশেষ তাই আমার কাজকর্মগুলোও বিশেষ। এসো দুজনে ব্লাক ড্রেস পরে দিনটাকে শোক দিবসে পরিণত করি। কিছু ভালো লাগছে না। আচ্ছা মৃ*ত্যু কি এর চাইতেও ভয়াবহ? তখন কি বুকের মধ্যে এমনভাবে যন্ত্রণা করে? মেয়ে হলে খুব চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম ছেলে বলে হয়তো পারছি না। আচ্ছা তুমি কি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলে? তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইলে কি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে? কি করলে যন্ত্রণা কমে যাবে বলতে পারবে?
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। গতকাল রাতে স্টোর রুমের মুখোশধারী লোকটা পসরা ফারুকী ছিল কথাটা মানতে জুবায়েরের কষ্ট হচ্ছে। বোন এই জঘণ্য কাজের সঙ্গে জড়িত কিন্তু কেনো? হঠাৎ একটা কথা ভেবে অধরা লাফ দিয়ে উঠলো। বলল,
> এই আপনার বোননা বোবা ছিল কথা বলতে জানেনা? ওটা আপনার বোন হতেই পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কেউ আপনার বোনের উপরে দোষ চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। যখন লোকটা আমাকে আঘাত করতে এসেছিল ছিল তখন লোকটা কথা বলেছিল। জানি কিছুটা মেয়েলি কন্ঠ ছিল তবে ওটা মেয়ে ছিল না। পুরুষ ছিল আমি দেখেছি। মুখোশ পরে ছিল কিন্তু তবুও তো বোঝা যায় বলুন? লোকটার বয়স কত এটা ধারণা করতে পারলে মোটামুটি অনুমান করা যেতো। আচ্ছা আপনার ভাই কোথায় বলতে পারেন?
জুবায়েরের কপালে ভাজ পড়লো। অধরা ঠিকই বলেছে। পয়সা কথা বলতে পারেনা। এতক্ষণ খামাখা মন খারাপ করলো। বোনকে হাসপাতালে দেখতে যাবে। অভিমান ছিল সব চলে গিয়ে এখন চিন্তা হচ্ছে। না জানি কি হয়েছে। বাগান থেকে ফেরার সময় খবরটা শুনে কক্ষে এসে দরজা বন্ধ করেছে। গতকাল রাতে যে মেয়েটাকে আনা হয়েছিল তার সঙ্গেও দেখা করতে পারেনি। জুবায়ের হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। অধরাকে বলল,
> চলো নিচে যায়। এখানে বসে থেকে কাজের চাইতে অকাজ বেশি হচ্ছে।
জুবায়ের ওকে সুযোগ দিলো না হাত ধরে হাঁটা ধরলো। একবারে ডাইনিং রুমে গিয়ে থামলো। কাজের মেয়েদের বলে দিলো গতকাল উদ্ধার করা মেয়েটাকে আনতে। আরও একটা অঘটন ঘটেছে। সকালবেলায় আসা জুহির বোন বলে পরিচয় দেওয়া মেয়েটার খোঁজ মিলছে না। জুবায়ের লোক পাঠিয়েছে ওরা বারবার ফোন করছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে মেয়েটা গায়েব কিভাবে হলো মাথায় আসছে না। ওর ভাবনার মধ্যেই কাজের মেয়েরা মেয়েটাকে নিয়ে হাজির হলো। মেয়েটার বয়স কতই বা হবে,খুব বেশি হলেও ষোল সতেরো বা আঠারো। এর চাইতে বেশি না। একদম বাচ্চাদের মতোই ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে।। অধরা মেয়েটার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,
>নাম কি তোমার? বাসার ঠিকানা বলো তোমাকে পৌঁছে দিব আমরা। একটুও ভয় পাবে না ঠিক আছে? পরিচয় বলো।
অধরার কথা শুনে মেয়েটার কান্না থামালো কিন্তু উত্তর দিলো না। সরল চোখে তাঁকিয়ে আছে। জুবায়ের এবার ধমক দিয়ে উঠলো,
> এই মেয়ে কথা বলতে পারো না? দ্রুত ঠিকানা বলো আমি তোমাকে পাঠিয়ে দিব। সময় নষ্ট করো না।
জুবায়েরের ধমক শুনে মেয়েটা পূর্বের ন্যায় আবারও ঠোঁট উল্টে কান্না শুরু করলো। অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> আপনি ধমক মারামারি ছাড়া কি কিছু বুঝেন না? দেখছেন কথা বলছি তার মধ্যে ঝামেলা শুরু করেছেন। আমি দেখছি তো বিষয়টা।
> কি দেখছো তুমি? এভাবে কথা বলবে বলে তোমার মনে হয়? জীবনে বলবে না। এসব বোবার মুখে কিভাবে কথা ফোঁটাতে হয় সে আমার ভালো করে জানা আছে। চুপচাপ দেখো।
জুবায়ের অধরাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই মেয়েটাকে জেরা শুরু করলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। এই মেয়ের কিছু মনে নেই। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁকিয়ে থাকলো। মেয়েটাকে কাজের মেয়েদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে জুবায়ের অধরাকে রেডি হয়ে আসতে বলল। পসরাকে দেখতে হাসপাতালে যেতে হবে। অধরা কক্ষে ফিরে গিয়ে মিনিট দশেক পরে ফিরে আসলো। জুবায়েরের কথা অনুযায়ী ও সত্যি সত্যি ব্লাক কালারের শাড়ি পড়ে বেরিয়েছে। জুবায়ের ডাইনিং রুমে বসে ছিল হঠাৎ সিঁড়িতে ওকে দেখে থমকে গেলো। মুগ্ধ হয়ে দেখলো। ওষ্ঠে হাসি এসে আবার সেটা মিলিয়ে গেলো। লজ্জিত হলো পূর্বে নিজের ব্যবহারের কথাগুলো ভেবে। এই লজ্জার হাত থেকে হয়তো ওর জীবনে নিস্তার নেই। অধরা জুবায়ের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
> আমি চলে এসেছি এবার যাওয়া হোক?
> নিশ্চয়ই কিন্তু আজ শোক দিবস পালন কিন্তু হচ্ছে না। এতো সুন্দরী বউকে নিয়ে শোক পালন করতে আমার বিবেকে বাঁধছে। কি করা যায় বলোতো?
> কিছু করতে হচ্ছে না। আপাতত চলুন সময় নষ্ট করবেন না।
জুবায়েরের উত্তর দিলো না উঠে আসলো। দাদু দোতলায় দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। ওদের দুজনের কাজকর্ম দেখছে। রুশনারা আজকাল বেশি একটা কক্ষের বাইরে আসেনা। সব সময় চুপচাপ থাকে। আগেও আসতো না তেমন তবে এখন বেশি। অধরা সেটা লক্ষ্য করেছে। হয়তো মেয়েটা জানে যার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে সেটা কোনো মানুষ না বরং পি*শা*চ শ*য়*তা*ন। গাড়িতে বসে অধরা চিন্তিত হয়ে জুবায়েরকে বলল,
> একটা বিষয় চিন্তা করুন, মানব নিষিদ্ধ মানবি বলতে কি বুঝানো হয়েছে? এই মেয়েদেরকে কি পি*শা*চ শ*য়*তা*নের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে?
জুবায়েরের থমথমে মুখ নিয়ে বলল,
> হতে পারে। তবে নিশ্চিত ডাইরীটা দিয়ে তোমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তুমি ভাবছো ডাইরী পড়ে তুমি রহস্য জেনে গেছো তাই আর কোনো ঝামেলা করবে না। শুনো এসব যা হচ্ছে সব দাদু করছে আমি নিশ্চিত। ড্যাড ও জড়িত। সবাইকে চলো পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে আমরা অন্য যায়গায় চলে যায়।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থমলো। ওর ধুমধাম কাজকর্ম করতে পছন্দ।কিন্তু সেটা অধরার পছন্দ হলো না। বিরক্তি নিয়ে বলল,
>আপনার মাথা। যতসব বদ বুদ্ধি। আচ্ছা পসরা আপুর না বিয়ে ঠিক হয়েছিল?
> হুম, তুমি জানো ভদ্রলোক হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল বিয়ের দুদিন আগে?অনেকেই ভেবেছে উনি মা*রা গেছেন অথচ লা*শ পাওয়া যায়নি। কি জানি কোন রহস্যের অন্তরালে হারিয়ে গেলেন উনি।
জুবায়ের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে অধরাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। কেবিন খুঁজে পেতে বিশেষ অসুবিধা হলো না। বেডে মেয়েটাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। জুবায়ের বোনের পাশে গিয়ে বসলো। ও বসতেই পসরা চোখ খুঁলে ছলছল দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকলো। জুবায়ের বোনের ডান হাতটা দেখে হতবাক হলো। হাতে ব্যান্ডেজ করা আছে। ওর মনে প্রশ্ন জাগলো বোন কি সু*ই*সা*ইড করতে চেয়েছিল? কিন্তু কেনো? জুবায়ের ভ্রু কুচকে বলল,
> আপু তোমার হাতে কি হয়েছে? আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা কি সত্যিই?
পসরা চোখ বন্ধ করলো। ওর চোখের কোনা দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। অধরা চুপচাপ ভাইবোনের ভাবমূর্তি দেখছে। পসরার সঙ্গে ওর তেমন কোনো ভালো খারাপ সম্পর্ক নেই। গত এক বছরে শুধু শাশুড়ির সঙ্গে মেলামেশা করেছে। বাকিরা ওকে এড়িয়ে যেতো। জুবায়ের নিজেইতো রাত ছাড়া ওর কক্ষে কখনও আসতো না। শাশুড়ি যেটুকু বলেছে ও সেটুকুই জানে । এর মধ্যেই হঠাৎ দরজা খুঁলে এক ভদ্রলোক ভেতরে প্রবেশ করলো। অধরা বুঝতে পারলো না ছেলেটিকে দেখে জুবায়ের চমকে উঠলো। ভ্রু কুচকে বলল,
> করণ ব্রো আপনি এখানে? এতদিন কোথায় ছিলেন?
জুবায়েরের প্রশ্ন শুনে ছেলেটার মুখখানাতে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠলো তবে ভড়কে গেলো না। যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
> আমি সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলাম হুটকরে ড্যাড পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কেমন আছো তুমি? পাশের মেয়েটি কে?
জুবায়ের বোনের হাত ছেড়ে উঠে দাড়ালো। অধরা বুঝতে পারলো জুবায়েরের মুখের ভাব পরিবর্তন হচ্ছে। এখুনি লোকটার মুখের উপরে হামলা করে বসতে পারে। তাই দ্রুতগতিতে জুবায়ের হাতটা ধরে বলল,
> মাথা ঠান্ডা করুন। কোনো ঝামেলা করবেন না। লোকজন চলে আসবে। পুলিশের ঝামেলা হবে।
জুবায়ের বিরক্তি নিয়ে বলল,
> এই ভদ্রলোক আমার বোনকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বিয়ে যখন করতেই পারবে না তাহলে অভিনয় করার কি দরকার ছিল। আমার বোন কথা বলতে পারেনা লোকটাকে বলা হয়েছে তবুও এরকম করলো। এখন দরদ দেখিয়ে দেখতে এসেছে। ওকে মে*রে* পু*তে দিতে মন চাইছে। তুমি না থাকলে সত্যি দেখতে কি হাল করতাম।
জুবায়ের বেশ ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বললো। কিন্তু লোকটার ওষ্ঠে হাসি। মজা পাচ্ছে বলে মনে হলো। অধরা বিস্মিত হয়ে বলল,
> আমি অধরা, জুবায়ের ফারুকীর স্ত্রী। উনার হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। কিন্ত আপনি কাজটা ছিল করেননি। আগেই বলে দিতেন।
ভদ্রলোক সামান্য হেসে বলল,
> পালিয়ে গিয়ে ভূল করেছি সেটা অধিক ভালোবাসা দিয়ে সেটা পূরণ করে ফেলবো। আমি ক্ষমা ছেয়েছি কিন্তু।
> আপু যা বলবে যাই হবে। উনি ক্ষমা করলে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে যে একবার ছেড়ে যায় সে যে বারবার যেতে পারে। নিশ্চয়তা নেই তাই ভয় করছে বিশ্বাস করতে।
> আমাকে যে আসতেই হতো। আমি থাকবো নিশ্চয়ই থাকবো।
অধরা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু জুবায়ের ওকে থামিয়ে দিলো। চুপ থাকতে বলে বোনের পাশে গিয়ে বসলো। পশরাকে বলল,
> ওকে তুমি ডেকেছো?
পসরা মাথা নাড়িয়ে না বলল। ছটফট করছে। লোকটাকে ভয় পাচ্ছে। বোনের এমন কান্ড দেখে জুবায়ের ডাক্তারকে ডেকে নিলো। ভদ্রলোকের আচরণ অধরার সুবিধা লাগলো না। মোটা একটা সোয়েটার জড়িয়ে রেখেছে গায়ে। জুবায়ের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে বোনের থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। হাসপাতালে কঠোরভাবে বলে আসলো বাইরের লোকজনকে কেবিনে আসার অনুমতি না দিতে। পসরা ভাইয়ের হাত ছাড়ছিল না। অধরা বুঝে গেলো এই করণ নামের ভদ্রলোকের জন্য পসরা ভয় পাচ্ছে।আসার সময় হুট করে একটা অঘটন ঘটে গেলো। দরজা দিয়ে বাইরে আসর সময় ভদ্রলোকের সঙ্গে অধরার জোরে একটা ধাক্কা লেগে গেলো। যদিও সেটা সামান্য ছিল কিন্তু লোকটা চিৎকার করে বুকে হাত দিয়ে হামু হয়ে বসে পড়লো। জুবায়ের দৌড়ে এসে অধরাকে ধরে ফেলল। ভদ্রলোকের দিকে তাঁকিয়ে ওরা বোকা বনে গেলো। সামান্য ধাক্কায় লোকটার অবস্থা নাজেহাল। নিশ্বাস নিচ্ছে টেনে টেনে। একজন সিস্টার দৌড়ে এসে ভদ্রলোককে নিয়ে গেলেন। অধরা পিছু ছুঁটে গেলো। কেবিনে কাচের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো নার্স ভদ্রলোকের বুকের কাছের কাপড়টা সরিয়ে দিচ্ছে। অধরার পেছনে পেছনে জুবায়ের এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটার বুকে ব্যান্ডেজ করা। ব্যান্ডেজ র*ক্তে ভিজে উঠেছে। অধরার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসলো। গতকাল স্টোর রুমে এই লোকটা ছিল। কিন্তু পসরা কেনো সুইসাইড করতে গেলো মাথায় ঢুকছে না। অধরা হতাশ হয়ে জুবায়েরের হাত টেনে বেরিয়ে আসলো। এক রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে আরও রহস্য সামনে আসছে। কহিনুর সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা এসেছে কিন্তু এসব ছোটখাট বিষয়গুলোও এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।
☆☆☆☆☆☆
স্টোর রুমে পাওয়া মেয়েটার লা*শ পাওয়া গেছে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে। ছিন্ন*ভিন্ন ব*ডি দড়িতে ঝু*লি,য়ে রাখা হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে এমন একটা দৃশ্য দেখে অবাক হয়েছে অধরা। দিন দুপুরে খু*ন হয়েছে মেয়েটা। পুলিশ এসে লা*শ নিয়ে গেছে। সু*ই*সা*ইড করেছে বলে মনে হচ্ছে। লা*শ পচতে শুরু করেছে। এতো ঠান্ডা আবহাওয়ায় সামান্য কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে লা*শ কিভাবে পচে যাবে বিষয়টা নিয়ে জুবায়ের গভীর চিন্তাভাবনা করছে। বাড়ির পেছনে সিসি ক্যামেরাতে দেখা গেছে মেয়েটা নিজে থেকে গুটি গুটি পায়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা আজকের দৃশ্য না দুদিন আগের চিত্র। পুলিশের ধারণা মেয়েটা দুদিন আগেই মা*রা গেছে। অধরা বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলো কিন্তু অদ্ভুতভাবে সবাই অস্বীকার করলো। কেউ কিছুই জানেনা। যখন ও হতাশ হয়ে ফিরছিল তখন দাদুর সঙ্গে দেখা হলো। লোকটার মুখে সব সময় কেমন দুষ্ট দুষ্ট হাসির রেখা দেখা যায়। অধরা শপথ নিলো এই হাসি ও নিজ দ্বায়ীত্বে মুছে দিবে। অধরাকে ভাবতে দেখে উনি বললেন,
> আইনের ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হবে না তাই কাজের মেয়েগুলো অস্বীকার করছে তুমিও চুপচাপ থাকো। এসব আমি দেখে নিচ্ছি। কার না কার মেয়ে তাঁর জন্য আমি কোনো ঝামেলা চাইনা বাড়িতে।।
দাদুর কথা শুনে অধরার রাগ হলো। ভেবেছিল কড়া করে দুটো কথা শুনিয়ে দিবে কিন্তু পারলো না। গালিব ওর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে শকুনের মতো। অধরা দ্রুত নিচ থেকে উপরে উঠে আসলো। সারাদিন এসব ঝামেলায় পার হয়ে গেলো।
****
গভীর রাত জুবায়ের বাড়িতে নেই।একটা দরকারি কাজে অফিসে আছে। অধরা অপেক্ষা করেছিল কিন্তু ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেলো। প্রচণ্ড টেনশন দুর্বল শরীরের জন্য মোটামুটি ভালো ক্লান্ত ছিল। তাছাড়া পেটের আকৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর ঘুমের মধ্যে ও অনুভব করলো মুখের উপরে কারো গরম নিশ্বাস পড়ছে। কেউ এক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। অধরা ফট করে চোখ খুঁলে ভ্রু কুচকে ফেলল। জুবায়ের ওর দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। অধরা তাঁকাতেই ছেলেটা নিজের হাতটা ওর মুখের উপরে রাখতে গেলো কিন্তু পারলো না অধরা দ্রুত ওর কব্জি ধরে উঠে বসলো। বিরক্ত নিয়ে বলল,
> ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রীর কক্ষে চুপিচুপি এসে কি প্রমাণ করতে চাইছেন? আপনি চরিত্রহীন নাকি সুযোগ সন্ধানী?
(চলবে )
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
অন্তিম পর্ব
অধরার চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুঁটে উঠেছে। জুবায়েরের ভাই জামসেদ ফারুকী ওর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। অধরা ছেলেটার হাতের কব্জি ছেড়ে দিয়ে রাগে ফুলে উঠলো। যেটা দেখে জামসেদ ঠোঁট চেপে হাসলো। অধরা আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
> কি চাই আপনার? কেনো এসেছেন?
জামসেদ বাঁকা হেসে বলল,
> জুবায়েরের সঙ্গে আমার চেহারার কোনো আমিল নেই তবুও তুমি এক পলক দেখে চিনে ফেলেছো ভেরি নাইচ। সত্যিই তুমি চমৎকার একজন মেয়ে। তোমার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতে হয়। জানো তো আমাদের কেউ সহজে চিনতে পারেনা।
> সবার সঙ্গে আমার তুলনা করা নেহায়েত বোকামি ছাড়া কিছুই না।আমার স্বামীর স্পর্শ তার গায়ের গন্ধ আমার আয়ত্বে বেশ আগে থেকে। আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উনার উপস্থিতি রয়েছে তাহলে ভূল কিভাবে হবে শুনি? আশাকরি আপনি নি*র্বো*ধ না। যথেষ্ট জ্ঞান আছে নয়তো নিজের মায়ের পেটের ভাইকে মা*র*তে দুবার এটাক করতে চাইতেন না।
> বেশ ধা*রা*লো তোমার বাক্য। আমি নিজেকে প্রচুর বোঝানোর চেষ্টা করেছি তোমার থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য কিন্তু বিশ্বাস করো পারিনি। তোমার বাকপটুতা আমাকে বারবার মুগ্ধ করে। রূপের থেকেও যেটা মারাত্মক। জুবায়েরের হাত ছেড়ে দিয়ে আমার হাতটা ধরতে পারো। পাক্কা প্রমিজ জীবন থাকতে ছাড়বো না। কদর করবো।
অধরার রাগে শরীর জ্বলে উঠলো।মনে হলো পিপীলিকার পাখা গজাই মরিবার তরে কথাটা একদম সত্যি। লোকটা কতটা বেহায়া কথাবার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। কি করে এমন জঘন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছে ওর মাথায় আসছে না। অধরা ঝঙ্কার দিয়ে বলল,
> জুবায়েরের সঙ্গে আমি সুখী তো আপনার সঙ্গে আমি কিসের নেশায় যাবো শুনি? একবার বলেছেন ঠিক আছে আর যেনো না শুনি। এবার আসুন আপনি। আমি একা থাকতে চাই। কোনো ল*ম্প*টের সঙ্গে কথা বলার মুড নেই।
> আমি অশোভনীয় কিছু বলেছি বা করেছি বলে তো মনে হয়না। তুমি অযথা উত্তেজিত হয়ে আমাকে আজেবাজে কথা বলছো আর খারাপ আচরণ করছো। আমার প্রস্তাবটা লুফে নাও আশাকরি ঠকবে না।
লোকটার কথা শুনে অধরার মেজাজ খারাপ হলো। দ্রুত রুমে থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো কিন্তু পারলো না। ওকে আটকে দেওয়া হলো। জুবায়ের কোনো ফিরছে না অধরা বুঝতে পারছে না। এই লোকটা ওকে ঘরে আটকানোর চেষ্টা করছে। বাইরে নিশ্চয়ই কিছু হচ্ছে। জুবায়েরের জন্য টেনশন হচ্ছে। অধরা এবার নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জামসেদকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমে ছোটখাটো জটলা। অধরা দৌঁড়ে দৌঁড়ে নিচে নেমে দেখলো জুবায়ের জুসের গ্লাস নিয়ে মুখে দিচ্ছে। আরমান ফারুকী সোফায় বসে আছে সঙ্গে দাদুও আছে। অধরা দ্রুত গিয়ে জুবায়েরের হাত থেকে গ্লাসটা টেনে নিয়ে ফেলে দিয়ে বলল,
> খেতে নিষেধ করেছিলাম তবুও শুনলেন না? কি কি খেয়েছেন বলেন? আপনারা আমাকে কি পেয়েছেন? আপনার ভাই আমার কক্ষে এসে আমাকে বিরক্ত করছে আর আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শরবত গিলছেন? ছিঃ লজ্জা করে না নিজের স্ত্রীকে আগলে রাখতে জানেন না আবার নিজেকে স্বামী দাবি করেন? এক পেয়ালা বি*ষ আনুন খেয়ে আপনাকে মুক্তি দিয়ে যায়। আপনারাও শান্তি সঙ্গে আমারও।
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। এতদিন চুপচাপ নিজেকে শান্ত করে রেখেছিল কিন্তু এখন আর পারলো না। মুড খারাপ হচ্ছে। কতক্ষণ সহ্য করা যায়। জুবায়ের হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে। বিষয়টা বুঝতে ওর কয়েক সেকেন্ড লাগলো। অধরা থামতেই জুবায়ের শুরু করলো। সামনে রাখা ট্রি টেবিলটা লা*থি দিয়ে ফেলে দিয়ে উপরে উঠে গেলো। অধরা এবার বুঝলো কাজটা ঠিক হয়নি। জুবায়েরকে শান্ত করা মুশকিল। ও দ্রুত জুবায়েরের পেছনে ছুটলো। দোতলায় জামসেদ দাঁড়িয়ে ছিল জুবায়ের সোজা গিয়ে ওর সোয়েটার টেনে নাক বরাবর ঘু*ষি বসিয়ে দিলো। দু’ভাইয়ের মধ্যে যথারীতি হা,তা*হাতি শুরু হলো। যে যাকে পারছে সমানে মা*রছে। নিচ থেকে সকলে চিৎকার চেচামেচি করছে কিন্তু কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। অধরা দ্রুত গিয়ে জুবায়েরকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। জামসেদ ঘু*ষি দিতে গিয়ে থেমে গেলো অধরার গায়ে লাগবে সেই ভয়ে। জুবায়ের হাপাচ্ছে। ওর ঠোঁট কেঁ*টে র*ক্ত ঝরছে। অধরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে নিজেকে দোষারোপ করছে। জামসেদ রা*গ দেখিয়ে গটগট করে নিচে নেমে যেতেই অধরা জুবায়েরকে নিয়ে কক্ষে ফিরে আসলো। পানির গ্লাস জুবায়েরের দিকে এগিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
> সরি খুব সরি আমি আপনাকে দুঃখ দিয়েছি।আপনি আমাকে দুঃখ দিতে শোধ করে নিন তবুও ঝগড়া ঝামেলা করে নিজের ক্ষতি করবেন না।
জুবায়ের অধরার কথা পাত্তা দিলো না। ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলল,
> ও তোমাকে কি কি বলেছে?
অধরা ঢোক গিলে বলল,
> বাদ দিন শুনতে হবে না। আপনি শান্ত হোন। আমি আপনার খাবার নিয়ে আসছি একটু অপেক্ষা করুণ
অধরা যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না। জুবায়ের ওর হাত ধরে আটকে দিলো। জোর করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> পালিয়ে যাও আগামীকাল ভোর পাঁচটায় তোমার ফ্লাইট। সোজা বাংলাদেশ ঢুকবে। আমার মেয়েকে নিয়ে খুব ভালো থাকবে। ওরা তোমাকে বাঁ*চ*তে দিবে না। রহস্য রহস্য করে মাথা খারাপ করো না। আমি মোটামুটি সবটা জেনে গেছি। মায়ের হ*ত্যা*কারী কে এটাও জেনেছি। তোমার বাবা মা সঙ্গে আমার বাবা মা সবাইকে ও*রা মেরে ফেলেছে। সুলতান বংশে শুধুমাত্র একটা অভিশাপ না অধরা আরও একটা অভিশাপ ছিল যেটা হয়তো ওই ভদ্রলোক ডাইরীর শেষ পৃষ্ঠাতে লিখেছিলেন যেটা আমাদের অগোচরে ছিল। তোমার একটা কথা মাথায় আসেনি বাবা আমাদের দুভাইকে সমানভাবে সম্পত্তি না দিয়ে শুধুমাত্র আমাকে কেনো দিয়েছিলেন?
অধরা অবাক হয়ে মাথা নাড়িয়ে না বলল। এরকম প্রশ্ন ওর আগে মাথায় আসেনি এমনটা না। এসেছিল তবে উত্তর মিলেনি। জুবায়ের একটু থেমে বলল,
> সুলতানদের জমজ ছেলেদের একজনকে শ*য়*তা*নের নামে উৎসর্গ করার কথা উল্লেখ ছিল। পঁচিশ বছর পযর্ন্ত তাদেরকে কোনো নারীর স্পর্শে আসা কঠোরভাবে নিষেধ ছিল কিন্তু ড্যাড সেটা মানতে পারেননি। উনি বাবার আগেই মমকে বিয়ে করে নিলেন। যখন আষ্টেপৃষ্ঠে অভিশাপ উনাকে জড়িয়ে ধরে তখন দাদু উনাকে বাঁচার জন্য বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে ব*লি দেওয়ার বুদ্ধি দিলেন। তখন থেকে বাড়িতে এসব খু*ন খারাপি হচ্ছে। জমজ বাচ্চাদের মধ্যে কোন বাচ্চা শ*য়*তানের উপাসক হবে তাঁর নিশান হিসেবে ওরা এই পঁচিশ বছর দিনে না রাতে চলাফেরা করে। রোদের আলো সহ্য হয়না। বাবা এসব জেনে বুঝে সবটা আমার নামে দিয়েছিলেন। আর ভাইকে একটা অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিলেন কিন্তু ড্যাড কৌশলে ওকে ফিরিয়ে আনেন। বাবার বিরুদ্ধে ছোট থেকে আজেবাজে কথা ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা জানতেন ড্যাড এসব আজেবাজে কাজকর্ম করে। যখন ড্যাডের পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তারপর একদিন সুযোগ বুঝে উনি আমার বাবাকে হত্যা করে নিজে উনার জায়গা দখল করে নিলেন। কেউ টের পেলো না। গতকাল যে লোকটাকে দেখলে আপুর সঙ্গে উনি আপুকে সত্যিই ভালোবাসেন। আপুর জন্য ড্যাডের কথা অনুযায়ী কা*লো যাদুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। কারণ মেয়েটা ছিল অভি*শপ্ত। মানব নিষিদ্ধ মানবি। কিন্তু কি হলো বলতো এতো এতো ঝামেলা করেও কোনো লাভ হলো না। শেষমেশ কহিনুরের খোঁজ চলল। কহিনুর পাথরটা কিন্তু দুবার হাত বদল হয়েছে । আগে এসেছিল আমাদের পরিবারের একজনের কাছে। তারপর যখন সেটা গহীন অরণ্যে সমাধিত করা হয় তখন পাথরের পেছনে থাকা পি*শা*চ আবারও বেরিয়ে পড়ে নতুন ভিকটিমের খোঁজ করতে। ঠিক তখনই তোমার দাদুকে পেয়েছিল। আর সর্বশেষ তোমার বাবার থেকে পাথর তাঁর শক্তি হারিয়েছে কারণ উনি অর্থসম্পদের পরিবর্তে সন্তান চেয়েছিলেন। উনার লোভ ছিল তবে সেটা অর্থের না একটা মাছুম বাচ্চার। তাছাড়া উনি সত্যি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। পাথর প্রথমবার একটা ভালো উদ্দেশ্যে কাজে লেগেছিল। তারপর উনি সেটা মসজিদের দান বক্সে ফেলে দিলেন। ওটা সাধারন পাথর হিসেবে নিলামে উঠেছিল যার দাম ছিল কয়েক কোটি টাকা। আফসোস সেটা বর্তমানে সুলতান জামসেদ ফারুকীর হাতে। উদ্দেশ্য কহিনুরকে হ*ত্যা করে ওর র*ক্ত দিয়ে পাথরের শক্তি ফিরিয়ে নিজেদের অভিশাপ মোচন করার। তাছাড়া পাথর তখন ওদের সব কথা শুনতে বাধ্য হবে। পৃর্বের শক্তি ফিরে পাবে। পাথরের খোঁজ ড্যাড বহুকাল আগেই করেছে কিন্তু পাইনি। তোমার দাদুর কাছে গিয়েছিলেন সেখানেও পাইনি। যখন পাথরের শক্তি ক্ষয় হয়ে গেলো ঠিক তখন তোমার বাবার সন্ধান পেলেন। পরে উনি টার্গেট নিলেন তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিবেন। ভাই তোমাকে দেখিছিল সেতো তুমি জানো। আমি জানতাম না কিছু। বোকার মতো ড্যাম আর দাদুর কথা শুনে যা ইচ্ছা করেছি। তাছাড়া আমাকে বিশেষ একটা শরবত দেওয়া হতো যেটা আমার নেশার মতো ছিল। ওটা নিলে কখন কি করতাম কিছু মাথায় আসতো না। পুরোপুরি ড্যাডের হাতের পুতুল। তুমি জানো না মারিয়া কানে শুনতে পারে। কারণ ও টুইন না। ও কাঁদলে পানির না র*ক্ত ঝেরে। আমার বোন গুলো খারাপ না। বড় বোন আমার জন্য ভয় পাচ্ছে কেনো জানো? আমার ভাই আমাকে মা*রা*র সব পরিকল্পনা করে ফেলেছে। ভাই তোমাকে সেভ করতে চাইছে। কিন্তু দাদু আর ড্যাড চেয়েছে তোমাকে আর আমাদের সন্তানকে এখনি মা*র*তে। ওরা ভাবছে বাচ্চাতো বেশ বড় হয়ে গেছে। ওদের বাচ্চার ব্লা*ডের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে বাচ্চা ছোট বা বড় মেটার করে না। ভাই চাই বাচ্চা স্বাভাবিকভাবে জন্ম হলে তোমাকে বাঁ*চা*তে পারবে। তোমাকে ও খুব পছন্দ করে। যদি অসুবিধা না থাকতো তবে ও নিজেই তোমাকে বিয়ে করে নিতো আমার সঙ্গে জড়াতো না। এইযে আজ তোমার কক্ষে কিন্তু ও এমনি এমনি আসেনি। তোমাকে এখানে থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইছে। তোমার হাতে সময় আছে শুধুমাত্র আজকের রাতটা। মা মা*রা যাওয়ার আগে তোমাকে দু’ লাইনের একটা ধাধা দিয়েছিল ওটার মানে হচ্ছে তুমি এই পি*শাচ পুরি থেকে শুধুমাত্র ভোররাতে বের হতে পারবে যখন ওদের শক্তি কমে আসে। “বধির বোবা বলবে বাক্য ঝরবে তখন লাল র*ক্ত “এটার মানে হচ্ছে কহিনুরের র*ক্ত যখন পাথরের উপরে পড়বে তখন পূণরায় ওর শক্তি ফিরবে তখন আর ওরা কথা বলতে পারবে।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরার বিস্ময় কাটছে না। জুবায়ের এতকিছু কিভাবে জানলো বুঝতে পারছে না। জিঞ্জাসা করলো,
> আপনি এতকিছু কিভাবে জানলেন? মায়ের কথা জানতেন?
জুবায়ের দুহাতে অধরার মুখটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কপালে ওষ্ঠাদ্বয় রেখে বলল,
> তোমার কি মনে হয় আমি কিছু বুঝতে পারবো না? প্রথম থেকেই জানি। মায়ের খু*নটা কে করছে জানো? আমার ভাই নিজ হাতে ছাদ থেকে ধা*ক্কা দিয়েছে। ওই যে খু*লি ছিল দেখেছিলে না ওটা মায়ের ছিল। মা আগে থেকেই বুঝেছিল বেশিদিন আর বাঁ*চ*তে পারবেন না। তাই তোমাকে পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি প্রথম দিনকেই বুঝেছিলাম তুমি কিছু লুকিয়ে রেখেছো। তাই ওটা দেখে নিয়েছি পরে। আমার মম সবটা আমাকে বলেছে। প্রথম থেকে সব।মম চায়নি আমার কিছু হোক। উনি আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন। আমাকে দেখতে কিন্তু মমের মতোই বলো? আমার মেয়েটাও ঠিক বাবার মতো হবে। তুমি ওকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাও। আমার মেয়েকে নিয়ে ভালো থাকবে। নতুনভাবে জীবন শুরু করো। আমি তোমার অনেক ক্ষতি করেছি পারলে ক্ষমা করে দিও। বিশ্বাস ভেঙেছি আমার শাস্তি সামনে অপেক্ষা করছে। তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে পারলে নিশ্চিন্তে ম*র*তে পারবো কষ্ট থাকবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। খুব খুব মনে পড়বে তোমাকে। অল্প কয়েক মাসের পথচলা তোমার সঙ্গে খুব লোভ হচ্ছে তোমাকে কাছে রাখতে, ভালোবাসতে। কিন্তু আমি অপারগ। পারছিনা তোমাকে নিজের করে রাখতে। এখনে থাকলে তোমার পরিণতি ঠিক আমার মায়ের মতো হবে। না নিজের স্বামীকে পাবে না নিজের সন্তানকে পাবে। শুধু দুঃখ ছাড়া কিছু পাবে না।
জুবায়েরের চোখ থেকে পানি ঝরছে। অধরা ফুপিয়ে উঠলো। জুবায়েরেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলল,
> আপনি না গেলে আমি কোথাও যাবো না। যা ইচ্ছে হোক কিছু যায় আসে না। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। খুব খুব ভালোবাসি আপনাকে। আপনি না মানলেও আমি প্রথম থেকে আপনাকে মেনে নিয়েছিলাম। ভালোবেসেছি তাহলে কেনো এই দূরুত্ব? চলুন না আমরা পালিয়ে যায়? কি হবে দুজন এক সঙ্গে থাকলে? আমি কোনো বিচ্ছেদ চাইনি।
অধরা এলোমেলো ভাবে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলল আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। জুবায়েরের চোখে পানি তবে সেটা অধরাকে বুঝতে দিলো না। ওর সামনে আপাতত দুর্বল হতে চাইছে না। বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। ভাইয়ের গায়ে হাত তুলেছে যেকোনো মূহুর্তে ও এসে ঝামেলা করতে পারে। জুবায়ের মলিন হেসে বলল,
> সময় কম এখুনি চলো।যদি বেঁ*চে থাকি ইনশাআল্লাহ আমাদের দেখা হবে। আমি চেষ্টা করবো নিজেকে র*ক্ষা করতে। যদি কখনও দেখা না হয় তবুও ভেবো না আমি তোমার থেকে দূরে আছি। তুমি তো আমার তাইনা? প্লিজ আমার হয়ে থেকো। তোমাকে কারো সঙ্গে দেখার সাহস আমার নেই।
জুবায়ের একদম কথাগুলো বলে থামলো। পকেট থেকে একটা লকেট বের করে অধরার গলাতে পরিয়ে দিয়ে বলল,
> আমাকে মনে পড়লে এটা দেখবে। আমার খুব প্রিয় এই লকেট টা। ছোটবেলাতে মা আমাকে দিয়েছিল। মায়ের কাছে এসব কালেকশন থাকতো। এসব দামি দামি লকেট বা পাথর উনি বনেদি বাড়ির মেয়ে আর বনেদি বাড়ির বউ হওয়ার সুবাদে পেয়েছিলেন কি জানিনা। জন্মদিনের উপহার ছিল। আমি তোমাকে দিলাম। আরও একটা জিনিস আছে।
জুবায়েরের একটা মুকুট বের করে অধরার হাতে দিয়ে বলল,
> আমার রাজকন্যার জন্য রাজ মুকুট। তুমি ওকে দিয়ে দিবা।বলবা ওর বাবা ওকে খুব ভালোবাসে। খুব মিস করে। নিজের প্রা*ণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। ভাগ্য বিধাতা আমাদের সহায় নেই তাই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নিয়ে এই রাতে তোমাকে আমার থেকে দূরে যেতে হচ্ছে। আশা রেখো দেখা হবে একদিন।
জুবায়েরের কন্ঠ ধরে আসছে। চোখের পানি টপটপ করে অধরার মাথার উপরে গিয়ে পড়লো। মেয়েটা কথা বলছে না কিন্তু সমানে ফুপিয়ে যাচ্ছে। ছয় মাসের বাচ্চাটা পেটে নিয়ে কোথায় থাকবে কিভাবে দিন কাঁটবে এসব ওকে কষ্ট দিচ্ছে না। শুধুমাত্র জুবায়েরের জন্য কষ্ট হচ্ছে। লোকটাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে মাথা কাজ করছে না। জীবন এতো নিষ্ঠুর কেনো। ভাগ্যের উপরে খুব করে দোষারোপ করতে মন চাইছে। চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে। অধরা জুবায়েরকে আকড়ে ধরে আছে। দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হয়েছে। ভোররাত হয়ে এসেছে। এখুনি বের হতে হবে। নয়তো পৌচ্ছাতে পারবে না। কথাটা ভেবে জুবায়েরের ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। অধরার মুখটা মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
> চলো বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে। আমি যেতে পারবো না তবে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমার লোক তোমাকে পৌঁছে দিবে। তুমি কোন দেশের উদ্দেশ্যে ফ্লাই করছো এটা আমি ছাড়া কেউ কখনও জানবে না। হয়তো এটাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আর কাঁদবে না। তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। ব্লাক কালার তোমার জন্য নিষিদ্ধ করলাম। এটা কখনও পরবে না। ভয়ানক সুন্দর লাগে তোমাকে। লোকের নজর লেগে যাবে। আমি খুব হিংসুটে স্বামী তাই বউয়ের সৌন্দর্য শুধুমাত্র আমি অবলোকন করবো আর কেউ না।
অধরা শব্দ করে কেঁদে উঠে বলল,
> আমি যাবো না। প্লিজ কোথাও যাবো না। এমন করবেন না। একটু বোঝার চেষ্টা করুন।
জুবায়ের ওকে আবারও নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> এই বিচ্ছেদ টা শুধুমাত্র আমাদের জন্য না। বাবা মা সন্তানের জন্য কতকিছু ত্যাগ করেন। আমরা না হয় এইটুকু করলাম। আমার মেয়েটাকে তুমি বাঁ*চ*তে দাও প্লিজ। অনুরোধ করছি। ওকে বাঁ*চা*তে এইটুকু যন্ত্রণা সহ্য করো। আল্লাহ্ চাইলে একদিন এর চেয়েও সুখ তোমার দুয়ারে এসে হাজির হবে।
জুবায়ের দ্রুত ওকে ছেড়ে দিয়ে ড্রয়ার থেকে অধরার ব্যাগটা বের করে অধরার হাতের কব্জি ধরে কঠিন স্বরে বলল,
>চলার পথে পেছন ফিরতে নেই হোচট খাবে। একদম ভেঙে পড়বে না। মন শক্ত করো। বাঘিনীকে এভাবে ভেঙে পড়তে নেই। চলো।
অধরা হাটতে পারছিল না। ওর পা চলছে না। জুবায়েরের কাজকর্ম ওর মাথায় আসছে না। ফাকা ফাকা লাগছে। জুবায়ের ওকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেলো। সামনের দরজা দিয়ে না গিয়ে বারান্দা ধরে পেছনের গেট দিয়ে ওকে বের করলো। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের শেষবারের মতো অধরাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে গাড়িতে একপ্রকার ঠেলে উঠিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করলো। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছেড়ে দিলো। যতক্ষণ দেখা গেলো ও এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকলো। ঘন্টা খানিকের মধ্যে হয়তো মেয়েটা নিদিষ্ট জায়গাতে পৌঁছে যাবে। ফজরের আযান হচ্ছে। নতুন সূর্য নতুন দিনের সূচনা করবে। সব রহস্য প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু সমাধান মেলেনি। কহিনুর পৃথিবীতে ধ্বংস নিয়ে আসবে কি শান্তি নিয়ে আসবে কেউ জানেনা। যার কথা ভেবে অধরা জুবায়েরের বিচ্ছেদ হলো সে কেমন হবে? সুলতান বংশের অভি*শাপ নিয়ে বোবা বধির নাকি সব অভি*শাপ মুছে দিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে পৃথিবীতে আসবে? এখানে সবকিছু নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। জুবায়েরের বুঝে নিয়েছে এই বিশাল শক্তির কাছে ও বা অধরা অতি তুচ্ছ মানব মাববি মাত্র। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কথাগুলো ভেবে জুবায়ের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। ভেতরে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে এটা ভেবে মোটেও ঘাবড়ে গেলো না। বরং হাসলো। কিছু মৃ*ত্যু সুখের হয়।
সমাপ্ত