মায়ারণ্যে

    ★বিয়ে হয়েও আজ কুমারী থেকে গেল মায়া। 

    বিষন্নতায় ঘেরা কালো রাতে ছাদের এক কোণায় দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে, এলোমেলো ভাবে অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছে মায়া। চেহারায় নববধূর সাজ থাকলেও, তার শরীরে বধূর শাড়ীটা নেই। সেটা যে এখন অন্য কারোর অঙ্গে শোভা পাচ্ছে। এইতো ঘন্টা খানিক হলো তার সদ্য বিয়ে করা বর আর বরযাত্রীরা চলে গেছে এই বাড়ি থেকে। তবে মায়ার সৌভাগ্য হয়নি তাদের সাথে যাওয়ার। তাই বলে এই না যে তারা খালি হাতে যাচ্ছে। তাদের সাথে তাদের বাড়ির বউ ঠিকই যাচ্ছে। আর সেই বউটা হলো মায়ার মামাত বোন রিয়া। 

     

    মায়ার জীবনে এমন একটা দিনও আসবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি মায়া। শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনের ছক কষছে সে। আর বারবারই শেষে এসে শূন্য ছাড়া আর কিছুক্ষণ পাচ্ছে না মায়া। উনিশ বছরের এই কষ্টে জর্জরিত গ্লানি ভরা জীবনে খুব একটা সুখের আশা সে করেওনি। শুধু সামান্য একটা চাওয়াই ছিল তার। তা হলো, নিজের ওপর থেকে এই আশ্রিতা নামটা ঘোচানোর আশা। 

     

    হ্যাঁ আশ্রিতা। মায়ার বয়স যখন দুবছর তখনই একটা এক্সিডেন্টে ওর মা বাবা মারা যায়। আর মায়াকে এই পৃথিবীতে একা রেখে চলে যায় তারা। ছোট্ট মায়াকে আপন করে নেওয়ার মতো কেউই ছিলনা। মায়ার বাবা ছিল এতিম।তার কোন আত্মীয় স্বজন ছিলনা। তাই বাবার পক্ষ থেকে কেউই ছিল না মায়ার। শেষমেশ মায়ার মামা দয়া করে মায়ার দায়িত্ব নেন। আর মায়াকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। মায়ার মামা ওকে আপন করে নিলেও ওর মামি কখনোই ওকে আপন ভাবতে পারেনি। মামি তার কথা আর কাজে সবসময় মায়াকে মনে করিয়ে দিতো যে, মায়া শুধুই একটা আশ্রিতা । সে এবাড়ির আশ্রিতা ছাড়া আর কিছুই না। ধীরে ধীরে মায়াও এটা মন মস্তিষ্কে ভালো করে গেঁথে নিয়েছে যে সে শুধুই এবাড়ির একজন আশ্রিতা। তাইতো সে মুখ বুজে সবই মেনে নিতো। আশ্রিতা দের যে কিছু বলতে নেই। এরা আমাকে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছে এটাই তো অনেক। 

     

    তবুও মায়ার মনে একটা ছোট্ট আশা ছিল। একদিন এমন একটা ঘর পাবে যেখানে সে আশ্রিতা থাকবে না।সেটা হবে তার নিজের ঘর। তারও একটা পরিবার হবে। যে পরিবারে সে আশ্রিতা না, বরং নিজের পরিবারের সদস্য হয়ে থাকবে। মায়া ভাবতো বিয়ের পরে ওর স্বামীর বাড়িই হবে সেই ঠিকানা। যেখানে ও আশ্রিতা হয়ে থাকবেনা। যেখানে কেউ ওকে আশ্রিতা বলবেনা। ও তখন সত্যিকারের একটা পরিবার পাবে।

     

    মায়ার সেই সীমিত আশাটুকুও আজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এমনটা কেন হলো ওর সাথে? ও কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিল জীবন থেকে? একটা আপন ঘরই তো চেয়েছিল। ওর নিজের একটা পরিবার চেয়েছিল। সেই আশাটাকে এভাবে ভেঙে না দিলে কি অনেক ক্ষতি হয়ে যেত? এমনতা না যে ও এই বিয়ে করতে চেয়েছিল। তাহলে বিয়ের নামে আমাকে এভাবে খেলার পুতুল না বানালেই হতো না? 

    মায়া ভাবতে লাগলো কিভাবে ওর সাথে বিয়ে নামক এক নিষ্ঠুর মজা হলো। 

     

    আজ মায়ার মামাত বোন রিয়ার বিয়ে ছিল। তিনদিন আগেই বরপক্ষ রিয়াকে দেখে বিয়ের দিনতারিখ সব ঠিক করে যায়। মায়া তখন ভার্সিটিতে ছিল। পরে ও বাসায় আসলে সব জানতে পারে। আর আজ সারা বাড়ি বিয়ের ধুমধাম চলছিল। সন্ধ্যা অবদি সবকিছু ঠিকই ছিল। মায়া ওর মামির কথামতো ঘরের ভেতরই বসে ছিল। ওর মামি বলেছিল ও যেন বিয়ে বাড়ির লোকজনের সামনে না আসে। তাই মায়াও বাইরে আসেনি। রাত দশটার দিকে হঠাৎ মামা আর মামি ওর রুমে আসে। মায়া ওদের দেখে একটু অবাক হয়ে বললো। 

    –মামা মামি,আপনারা এখানে? 

     

    মায়ার মামি শিউলি বেগম মায়ার মামা তারেক রহমানের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু বলার ইশারা করতেই তারেক রহমান মায়ার সামনে এসে করুন সুরে বললো। 

    –মায়া মা, অনেক বড়ো একটা বিপদ হয়ে গেছে মা। এখন একমাত্র তুই আমাদের রক্ষা করতে পারিস। নাহলে আজ আমার মানইজ্জত সব ধুলোয় মিশে যাবে। 

     

    মায়া চিন্তিত সুরে বললো। 

    –কি হয়েছে মামা? এমন করে বলছেন কেন? 

     

    –মারে রিয়াকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। পার্লার থেকে কোথায় যেন চলে গেছে। ফোনও বন্ধ করে রেখেছে।  ওদিকে বরপক্ষ চলে এসেছে। বারবার রিয়াকে বিয়ে পড়ানোর জন্য নিয়ে যেতে বলছে। এখন আমি কি করবো? উনাদের কে যদি বলি মেয়ে পালিয়েছে, তাহলে ভরা মজলিশে আমার আর আমার বংশের মুখে চুলকানি মারবে সবাই। এখন এই মুহূর্তে শুধু তুইই আমাদের বাঁচাতে পারবি। 

     

    মায়া ভ্রু কুঁচকে বললো। 

    –আ আমি? আমি কিভাবে বাঁচাব?

     

    এবার শিউলি বেগম বলে উঠলো। 

    –তুই রিয়ার জায়গায় বউ সেজে ঘোমটা টেনে বসে থাক। আর কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে আসলে রিয়ার জায়গায় তুই কবুল বলে দিবি ব্যাস। 

     

    মায়া হতভম্ব হয়ে বললো। 

    –কি কি বলছেন এসব? আ আমি কবুল বলবো মানে?  না না এটা সম্ভব না। এটাতো সোজাসুজি ধোকা দেওয়া হবে উনাদের। এতবড় অন্যায় আমি করতে পারবোনা।  

     

    শিউলি বেগম চোয়াল শক্ত করে বললো। 

    –ওও খুব নীতিগিরি দেখানো হচ্ছে তাইনা? আমরা তোকে সারাজীবন খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করলাম। আর আজ আমাদের বিপদে তোকে সাহায্য করতে বলছি আর তুই নীতিগিরি দেখাচ্ছিস? এই তোর উপকারের প্রতিদান? 

     

    তারেক রহমান শিউলি বেগম কে হালকা ধমকের সুরে বললো। 

    –আহ তুমি চুপ করোতো। আমিতো বলছি তাইনা।

     

    তারেক রহমান এবার মায়ার হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বললো। 

    –দেখ মা আমি জানি তোর সাথে অনেক বড়ো অন্যায় করছি।কিম্তু আর কোন উপায় নেই।  এই মুহূর্তে একমাত্র তুইই আমাদের বাঁচাতে পারিস। তোর এই বুড়ো মামাটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাদের কথাটা মেনে নে। আমার এতবছরের মান সম্মান এভাবে সবার সামনে ধুলোয় মিশে গেলে, আমার মরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। 

     

    মায়া ওর মামার এমন করুন দশা দেখতে পারলো না। এই বাড়িতে একটু হলেও শুধু এই লোকটাই ওকে স্নেহ করে। অতিরিক্ত না করলেও যতটুকু পারে মায়ার ভালো মন্দের খেয়াল রাখার চেষ্টা করে। আর মায়াও তারেক রহমান কে নিজের বাবার মতোই দেখে। তাই সেই মানুষ টার আকুতির সামনে হেরে গেল মায়া। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের মন মেরে মামার খাতিরে ওদের কথায় রাজি হয়ে গেল। 

     

    শিউলি বেগম তাড়াতাড়ি করে কোনরকমে মায়াকে বউ সাজিয়ে দিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে ওকে বাইরে এনে বরের পাশে বসিয়ে দিল। যদিও এসবে শিউলি বেগম ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে। রিয়াকে সামনে পেলে থাপড়িয়ে গাল লাল করে দিতো। আজ এখানে ওর বসার কথা ছিল। অথচ এই আশ্রিতাকে ওর জায়গায় বসাতে হচ্ছে। ভাবতেই রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে শিউলি বেগমের।

     

    বরের পাশে বসাতেই মায়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। শরীরের শক্তি হ্রাস পাচ্ছে ওর। ভেতরে চলছে তুমুল কম্পন। একটু পরেই কাজী সাহেব এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। প্রথমে বরের বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। এরপর মায়াকে কবুল বলতে বলা হলো। মায়ার সামনে যেন পুরো পৃথিবী ঘুরতে লাগলো। ও কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকক্ষণ হলো মায়াকে কবুল বলতে বলা হয়েছে, কিন্তু কিছুই বলছে না।  সবাই কেমন একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তখন তারেক রহমান মায়ার কাছে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে কবুল বলতে বললো। শেষমেশ মায়া কবুল বলেই দিল। ঘোমটার আড়ালে চোখ দিয়ে অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়লো মায়ার। এর পরিণতি কি হবে তা চিন্তা করতেই মায়ার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠছে।

     

     তখনই হঠাৎ নিজের হাতের ওপর কারোর স্পর্শ অনুভব করলো মায়া। মাথা নিচু অবস্থায় হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো কোন পুরুষের হাত ওর হাতের ওপর। তারমানে এটা উনি? কথাটা ভাবতেই মায়ার আগে থেকেই কম্পনরত শরীর টা আরও কেঁপে উঠল। ঘোমটার ভেতর থেকেই আরচোখে একবার পাশের বর নামের লোকটির দিকে তাকালো মায়া। ঘোমটার আড়ালে আবছা আবছা বুঝতে পারলো লোকটার মুখে প্রাপ্তির হাসি। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিল মায়া। উনি নিশ্চয় আমাকে রিয়া ভেবে এতো খুশি হচ্ছেন। যখন সত্যি টা জানতে পারবেন তখন কি হবে? ভাবতেই ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে মায়ার। মায়া আস্তে করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। নিজেকে আজ অনেক বড়ো অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। 

     

    বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসলে মায়ার মামা মামী কিছু কাজের কথা বলে মায়াকে ধরে আবার বাসার ভেতর নিয়ে গেল । বাসার ভেতর এসে রুমে ঢুকতেই ওরা তিনজনই অবাক হয়ে গেল। কারণ রুমে রিয়া বসে আছে। মাথায় ওর ব্যান্ডেজ করা। রিয়ার মা এগিয়ে গিয়ে রিয়ার হাত ধরে এক ঝটকায় উঠে দাড় করিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো। 

    –কোথায় গিয়েছিলি তুই হ্যাঁ?  নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে কোথায় গিয়েছিলি তুই হ্যাঁ? এখানে আমাদের কি অবস্থা হয়েছে তুই জানিস? 

     

    রিয়া বলে উঠলো। 

    –আরে কে বলেছে আমি পালিয়েছি? আমি কেন পালাতে যাবো? আরে পার্লার থেকে ফেরার পথে আমার এক্সিডেন্ট হয়ে যায়। তাইতো আমি আসতে পারিনি। দেখছনা মাথায় ব্যান্ডেজ। আরে আমার বান্ধবী সুমাও তো আমার সাথেই ছিল। ওই তো আমাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে এলো। বাসায় লোকজন আছে দেখে আমি পেছনের দরজা দিয়ে এসেছি। 

     

    রিয়ার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। যেহেতু রিয়ার কথামতো ওর কোন দোষ নেই তাই ওকে কিছু বলতেও পারছে না। রিয়া এবার মায়াকে বধূবেশে দেখে কপাল কুঁচকে বললো। 

    –মা ও বধূবেশে কি করছে? তোমরা ওকে বউ সাজিয়েছ কেন? এক মিনিট, তোমরা আবার আমার জায়গায় ওকে বসিয়ে দাওনি তো?

     

    রিয়ার মা রিয়াকে সব খুলে বললো। সব শুনে রিয়া উত্তেজিত হয়ে বললো।

    –হোয়াট? তারমানে সত্যি সত্যিই তোমরা আমার জায়গায় ওকে বসিয়ে দিয়েছ? তোমরা কি করে পারলে এমনটা করতে? আমার জায়গা ওই আশ্রিতাকে দিয়ে দিলে?  এখন আমার কি হবে?

     

    –রিয়া মা শান্ত হ। ওইসময় আমাদের আর কোন উপায় ছিলনা। বরপক্ষ কনের জন্য অপেক্ষা করছিল। আর তোকেও পাচ্ছিলাম না। সত্যি টা বলে দিলে সবার সামনে অপমানিত হতে হতো। তাই আর উপায় না পেয়ে এইকাজ করতে হলো। 

    রিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বললো। 

    –বাহ্ নিজের মেয়েকে খুঁজে না বের করে ওই আশ্রিতাকে আমার জায়গায় বসিয়ে দিলে। এই তোমাদের সমাধান। তোমরা কি ভেবেছ এতে সব ঠিক হয়ে যাবে? আরে ঠিক না বরং আরও খারাপ হয়ে যাবে। যখন সবাই সত্যি টা জানতে পারবে তখন কি হবে একবারও ভেবে দেখেছ? আরে আমার কি হবে? আমার তো বদনাম হয়ে যাবে। এরপর কে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে? আচ্ছা আমার কথা নাহয় বাদই দিলাম। একবারও ভেবেছ যখন ওই বাড়ির লোকজন সত্যি টা জেনে যাবে তখন কি হবে? তারাতো আমাকে ভেবে ওকে নিয়ে যাবে। কিন্তু যখন ওর চেহারা দেখতে পাবে তখন কি হবে? তাও যদি বউটা সুন্দর হতো তাও একটা কথা ছিল। কিন্তু আমার মতো সুন্দরী মেয়ের জায়গায় যখন  ওই কালি কুৎসিত মায়াকে দেখবে তখন কি হবে ভেবে দেখেছ? আরে ওদের মতো উচ্চ পরিবার কখনো এই কালি মায়াকে নিজেদের বউ হিসেবে মেনে নিবে না।

     

    রিয়ার কথাগুলো মায়ার বুকে তীরের মতো বিঁধছে। ঠিকিতো বলেছে রিয়া। আমার মতো কালো মেয়েকে কে তাদের ঘরের বউ হিসেবে মেনে নিতে চাইবে। আর এই ভয়েই আমি বিয়েতে রাজি হতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু এখন কি হবে? মায়ার ভাবনার মাঝেই রিয়া আবারও বলে উঠলো। 

    –আরে ওরা অনেক উচ্চ পরিবার। সত্যি টা জানলে ওরা তোমাদের ওপর কেইস করে দিতে একসেকেন্ডও ভাববে না। তোমাদের ফ্রড কেসে ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিবে।

     

    রিয়ার কথায় ওর মা বাবা সত্যিই ভাবনায় পড়ে গেল। আসলেই তো এতকিছু তো ওরা ভেবেই দেখেনি।রিয়ার কথায় যুক্তি আছে। ওরা রেগে গিয়ে এমনটা করতেই পারে। এখন কি হবে?  রিয়ার মা তারেক রহমানের দিকে তাকিয়ে বললো। 

    –এই শুনছ রিয়া তো ঠিকই বলছে। ওর জায়গায় মায়ার মতো কালো মেয়েকে দেখে তারা নিশ্চয় অসম্ভব রেগে যাবে। তখন ওরা আমাদের সাথে কি করবে তা আল্লাহই জানে। আর আমরা তো ওনাদের ক্ষমতার সামনে কিছুই না। 

     

    তারেক রহমান চিন্তিত সুরে বললো। 

    –কিন্তু এখন আর কিবা করতে পারি আমরা?

     

    রিয়া বলে উঠলো। 

    –একটা উপায় আছে। যে উপায়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কেও কিছু জানবেও না।

     

    তারেক রহমান বললো।

    –কি উপায়? 

     

    –মায়াকে তো আর ওরা কেও দেখেনি তাইনা? ওরাতো জানে ঘোমটার নিচে আমিই আছি। তাই বলছি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার আমাকে মায়ার জায়গায় বসিয়ে দাও। তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না। 

     

    রিয়ার কথায় মায়া চমকে গেল। ওর এখন কি রিয়্যাকশন দেওয়া উচিত তা ভেবে পাচ্ছে না ও। 

    তারেক রহমানও চমকে উঠে বললো। 

    –কি বলছিস এসব?  পাগল হয়ে গেছিস?  আরে মায়ার বিয়ে হয়েছে ওই ছেলের সাথে। তাহলে মায়ার জায়গায় তোকে কিভাবে পাঠাবো? 

     

    শিউলি বেগম এবার বলে উঠলো। 

    –আরে রাগছ কেন? রিয়া ঠিকিতো বলেছে। এটাই একমাত্র বাঁচার উপায়। দেখ ওরাতো রিয়াকেই ওবাড়ির বউ করতে চেয়েছিল তাইনা? তাহলে রিয়াকে পেলে আর ওদের কোন সমস্যা হবে না। আর আমার মেয়েটারও বদনাম হবে না। 

     

    –আর মায়ার কি হবে হ্যাঁ?  ওর জীবন টা বুঝি নষ্ট হবে না? 

     

    –না নষ্ট হবে না। আরে আমরা ছাড়া তো আর কেউ কিছু জানেও না। তাহলে কিভাবে ওর জীবন নষ্ট হবে। আমরা বরং ওকে দেখেশুনে অন্য কোন ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেব।তাহলে তো আর কোন সমস্যা নেই তাইনা?

     

    রিয়া বলে উঠলো । 

    –হ্যাঁ বাবা। এতেই আরও ওর ভালো হবে।কারণ ওই বাড়িতে ওকে কেও মেনে নিবে না। তখন ওরজন্য আরও বেশি খারাপ হবে। পরবর্তীতে ওকে আর অন্য কোথাও বিয়েও দেওয়া যাবে না। তারচেয়ে ভালো আমার কথা মেনে নাও। এইকথা শুধু আমাদের মাঝেই  থাকবে। এতে আমাদেরও ভালো। আর ওদেরও।

     

    রিয়ার কথায় তারেক রহমান ভাবনায় পড়ে গেল। রিয়ার কথায় যুক্তিতো আছে। কিন্তু এটা কি ঠিক হবে। শিউলি বেগম তারেক রহমানের হাত ধরে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললো।

    –দেখ এতো ভাবনা চিন্তার দরকার নেই। রিয়া একদম ঠিক বলছে। এতেই সবার ভালো হবে। নাহলে কিন্তু আমার মেয়েরও ক্ষতি হবে আর তোমার ভাগ্নিরও।

     

    তারেক রহমান বলে উঠলো। 

    –কিন্তু একটা কুমারী মেয়েকে কিভাবে পরপুরুষের বউ হিসেবে পাঠিয়ে দেব? তুমি একবারও এ বিষয়ে ভেবে দেখেছ?

     

    –আরে এটা কোন ব্যাপার না। আমি রিয়াকে বুঝিয়ে দেব যে ও যেন কোন বাহানা দিয়ে ওই ছেলের সাথে আবার বিয়ে করে নেয়। তার আগে যেন দুরত্ব বজায় রাখে।

     

    –কিন্তু…. 

     

    –আর কিন্তু কিন্তু করোনা। এটাই সবার জন্য ভালো হবে।  তুমি যেয়ে মায়ার সাথে কথা বলো।

     

    মায়া এতক্ষণ ধরে নীরব দর্শকের মতো এদের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে। এরা ওর জীবনের ফয়সালা করছে, অথচ ওর কাছে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করছে না।  নিজেকে যেন অনুভূতিহীন জড়বস্তু মনে হচ্ছে ওর। 

    একটু পরে তারেক রহমান মায়ার সামনে এসে দাঁড়াল। কেমন অসহায় চোখে মায়ার দিকে তাকালো। এই চাহনির অর্থ বুঝতে মায়ার খুব একটা বেগ পেতে হলো না। সে ভালোই বুঝতে পারছে তার মামা কি বলতে চাইছে। তাই মায়া নিজেই বলে উঠলো। 

    –আপনাদের যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করেন। আমাকে নিয়ে ভাববেন না। 

     

    তারেক রহমান মায়ার দুই হাত ধরে অপরাধী সুরে বললো। 

    — আমাকে মাফ করে দিস মা। আমি জানি তোর সাথে অনেক অন্যায় করছি। কিন্তু এছাড়া যে আর উপায় নেই। আর তোরও এতে ভালো হবে। তুই তো বুঝতেই পারছিস তোকে ও বাড়ির কেউ মেনে নিবে না। তাই এই কথা আমাদের মাঝে থাকাই ভালো হবে।

     

    মায়া বলে উঠলো। 

    –কি করছেন মামা। আপনি গুরুজন, এভাবে মাফ চেয়ে আমাকে ছোট করবেন না। আপনি যা করতে চাচ্ছেন করুন। আমার কোন সমস্যা নেই। 

     

    ব্যাস এটাই শোনার অপেক্ষায় ছিল রিয়া আর ওর মা। মায়া রাজি হতেই তাড়াতাড়ি করে তারেক রহমান কে বাইরে যেতে বললো।তারপর মায়ার শাড়ী খুলে রিয়াকে পড়িয়ে দিল। রিয়াকে রেডি করতে করতে ওর মা ওকে বলতে লাগলো। 

    –শোন তুই কোন একটা বাহানায় জামাইর সাথে আবার বিয়ে করে নিস। তার আগে যেন কোনভাবেই কাছে আসতে দিসনা।

     

    রিয়া একটা বাঁকা হাসি দিল। ওর মাতো জানেই না যে, সে কবেই তার সতিত্ব হারিয়ে বসে আছে। এসব ওর জন্য কোন ব্যাপারই না। তবুও ওর মাকে আস্বস্ত করার জন্য বললো।

    –তুমি টেনশন নিও না মা। তোমার মেয়ে অনেক চালাক। দেখবে এক তুড়ি বাজিয়ে ওকে বিয়ে করতে রাজি করিয়ে ফেলবো।

     

    মায়া আর এসব শুনতে পারছেনা। দরজা খুলে দ্রুত ওখান থেকে বেড়িয়ে ছাঁদে চলে এলো। তখন থেকে ওভাবেই বসে আছে। নিজের শেষ আশাটুকুও হারিয়ে নিজেকে নিস্ব মনে হচ্ছে ওর। মাঝে মাঝে চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করে। আমি কেন বেঁচে আছি? বাবা মা আমাকেও কেন নিয়ে গেলে না তোমার সাথে? এই অভিশপ্ত জীবনের চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে আজ সত্যি সত্যিই এই জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে নিতাম।

     

    মায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এতক্ষণে নিশ্চয় আমার নামমাত্র স্বামী আর রিয়াকে বাসর ঘরে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছা ওই লোকটা কি বুঝতে পারবে তার সামনে যে আছে সে তার বউ না? নিজের ভাবনার ওপর তিরস্কার করে মনে মনে বললো, কেন বুঝতে পারবে? তুই কি তার প্রেমিকা নাকি যে সে বুঝতে পারবে? সেতো কখনো তোকে চোখেই দেখেনি। আরে রিয়ার মতো সুন্দরী মেয়ে সামনে পেয়ে অন্য কিছুর কথা কেন ভাববে কেউ? আর তোর মতো কালির কথা তো কখনোই ভাববে না। মানুষ সুন্দরের পূজারী। সব ছেলের মতোই সেও সুন্দর বউ পেয়ে নিশ্চয় তাতে মেতে উঠেছে। হয়তো সে এখন রিয়ার মোহে ডুব দিচ্ছে। 

     

    কথাগুলো ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে আসছে মায়ার। পেটের নাড়ী উল্টে আসছে। আর বসে থাকতে পারলোনা মায়া। মুখ হাত চেপে ধরে দৌড়ে নিজের রুমে এসে, ওয়াশরুমে ঢুকে বেসিনে গড়গড় করে বমি করে দিল। বমি করে ক্লান্ত শরীরে শাওয়ার ছেড়ে ধপ করে শাওয়ারের নিচে বসে পড়লো। শাওয়ারের পানিতে মুখের সব সাজ ধুয়ে যাচ্ছে। তবে ওর দুঃখগুলো কি ধুয়ে যাবে এই পানিতে? আসবে কি ওর জীবনে নতুন ভোরের আলো? 

     

    চলবে…..

     

    #মায়ারণ্যে

    #লেখিকা-মেহরুমা নূর

    #প্রথম পর্ব 

     

    #মায়ারণ্য

    #লেখিকা-মেহরুমা নূর

    #পর্ব-২

     

    ★একঝাক কাজিনদের আবদার পুরণ করে শেষমেশ নিজের বাসর ঘরে ঢোকার সুযোগ পেল অরণ্য। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো বেডের ওপর ওর বউ ঘোমটা টেনে বসে আছে। অরণ্যের হৃৎস্পন্দন দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করলো। কাঙ্ক্ষিত খুশির দমকা হাওয়ায় ভরে গেল মনটা। আজ ফাইনালি অরণ্য ওর সন্ধ্যামালতীকে দেখতে পাবে। শুধু দেখতেই না হাত বাড়িয়ে ছুঁতেও পারবে। এখন যে সে তার বউ।তার পুরো অধিকার আছে এই মেয়েটার ওপর। কথাগুলো ভাবতেই মনের ভেতর অনুভূতিরা ডানা মেলে উড়ছে।

     

    অরণ্য দরজা লাগিয়ে দিয়ে বেডের কাছে এসে মেয়েটার মুখোমুখি হয়ে বসলো।ঠোঁটে ঝুলছে তার প্রাপ্তির হাসি। রাজ্যের উৎসাহ আর খুশির সহিত মেয়েটার ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে উপরে তুললো অরণ্য। ঘোমটা পুরোপুরি তুলে মেয়েটার মুখদর্শন করলো সে। তবে রিয়াকে দেখে কেমন যেন ভ্রু কুঁচকে আসলো অরণ্যের। হঠাৎই ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসিটা গায়েব হয়ে গেল ওর। যদিও মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী। তবুও কেন যেন কিছু একটা মিসিং লাগছে অরণ্যের কাছে। মনের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে। ব্যাপার টা অরণ্যের নিজেরও বোধগম্য হচ্ছে না। মেয়েটা তো সুন্দরী, তাহলে ওর এমন লাগছে কেন? ও কল্পনাতে ওর সন্ধ্যামালতীর যে চেহারা এঁকেছিল, এই মেয়েটার সাথে তার কোন মিল নেই। তাই হয়তো এমন লাগছে। অরণ্য রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর চোখ দুটোও অন্যরকম। ওর সন্ধ্যা মালতীর মতো না। নাকি আজ সরাসরি দেখছি বলে এমন লাগছে? এসব ভাবতে ভাবতে অরণ্য হঠাৎই বলে উঠলো। 

    –তুমি কি সত্যিই আমার বউ?

     

    অরণ্যের কথায় রিয়া চমকে তাকালো ওর দিকে। উনি এভাবে বলছেন কেন? উনি কি সব বুঝে গেল নাকি? এখন কি হবে? ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে ওর। কোনরকমে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো। 

    –এ এটা আবার কেমন কথা? 

     

    অরণ্য ফট করে কথাটা বলে নিজেই থতমত খেয়ে গেল। এমন একটা কথা বলা যে ঠিক হয়নি তা বুঝতে পারছে ও। তাই জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো। 

    –সরি। আসলে একটু নার্ভাস হয়ে গেছিলাম তো, তাই কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। আচ্ছা যাক বাদ দাও এসব। তুমি নিশ্চয় টায়ার্ড হয়ে গেছ। যাও এসব শাড়ী গহনা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এসো। 

     

    রিয়া মাথা নেড়ে উঠে গিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। 

     

    অরণ্যের এদিকে হঠাৎ করেই কেমন যেন অস্থির লাগছে। এতক্ষণ ওর মনে থাকা খুশিটা কেমন যেন চুপসে গেল।  এমনটা কেন হচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না ও। ওতো কতো আশায় ছিল, আজ ওর সন্ধ্যামালতীকে দেখবে। তার প্রতি ওর অনুভূতি গুলোর কথা বলবে। তাহলে এমন কেন লাগছে? কেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটা আমার সন্ধ্যামালতী না। নাহ আমি হয়তো একটু বেশিই ভাবছি। হয়তো সামনাসামনি দেখছি তাই এমন মনে হচ্ছে।মনকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেটা খুব একটা কাজে আসছেনা অরণ্যের। অরণ্যের কেমন দমবন্ধকর লাগছে। তাই ও ফ্রেশ হাওয়া নেওয়ার জন্য বেলকনিতে আসলো। বেলকনিতে রাখা আরাম করার বড়ো হেলানো চেয়ারে বসে পড়লো। হেলান দিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরালো অরণ্য। সবসময় সিগারেট খায়না অরণ্য। তবে মাঝে মধ্যে টেনশন হলে দুই একটা খায়। সিগারেট টানতে টানতে ভাবতে লাগলো কিভাবে সন্ধ্যামালতীর দেখা পেয়েছিল অরণ্য। 

     

    গত দুমাস পূর্বে নিউইয়র্ক থেকে নিজের সব স্টাডি কমপ্লিট করে দেশে ফিরেছে অরণ্য মেহরাব। দেশে ফিরে নিজের ফ্যামিলি বিজনেসে জয়েন করে অরণ্য। এদিকে অরণ্যের পরিবারের সবাই ওর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে। অরণ্যও ওর পরিবারের খুশির জন্য রাজি হয়ে যায়।  অরণ্যের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে দেয়। এতো এতো মেয়ে দেখে তবে অরণ্যের কোন মেয়ে তেমন পছন্দই হয়না। 

     

    অরণ্য আজ পর্যন্ত কখনো কোন প্রেমের সম্পর্কে জড়াইনি। এমন না যে ও প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করেনা বা এগুলুতে বিশ্বাস করে না। আসলে ও আজ পর্যন্ত ওর মনমতো কাওকে পাইনি। যাকে নিজের প্রেমিকা বা বউ বানানোর ইচ্ছা জাগবে। ওর আশেপাশে যত মেয়ে দেখেছে সবার ওপর শুধু কৃত্রিমতার ছাপ।আজ পর্যন্ত যতগুলো মেয়ে ওর জীবনে আসতে চেয়েছে, সবই শুধু অরণ্যের বাহ্যিক সৌন্দর্য আর ওর আর্থিক অবস্থানের জন্য চেয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত কোন মেয়েই ওর মনকে ছুঁতে পারেনি। 

     

    অরণ্য এমন কাওকে চায় যার মন হবে নিস্পাপ, পবিত্র। যার মাঝে থাকবেনা কোন কৃত্রিমতার ছাপ। চেহারা ফুরফুরে সুন্দর না হলেও চলবে।  তবে তার মনটা যেন সুন্দর হয়। এমনিতেও ধবধবে সাদা মেয়ে তেমন পছন্দ না অরণ্যের। যদিও সে নিজেও ফর্সা। তবে এতো বছর বিদেশে সাদা মানুষের ভীড়ে থেকে থেকে কেমন যেন একটা অনিহা সৃষ্টি হয়ে গেছে ওর। অরণ্য ওর কল্পনায় মনে মনে নিজের ভবিষ্যত প্রিয়তমার আবছা একটা চেহারা বানিয়েছে। যেখানে মেয়েটা হবে শ্যামল বর্নের। তার চোখ দুটো বড় আর টানাটানা হবে। তার চোখের ভাষায় হাজার তাঁরা খেলা করবে। তার চেহারায় থাকবে প্রচুর মায়া। আর তার মনটা হবে ফুলের মতোই স্নিগ্ধ। 

     

    তবে ওর ফ্যামিলি যেসব মেয়ে দেখায় তাদের কাওকেই ওর সেই কল্প কন্যার মতো দেখায় না। তাইতো ওর মনেও ধরে না। পরিবারের সবাইও একটা হতাশই ভেতর পরে যায়। ছেলের বিয়ে নিয়ে তারা টেনশনে পড়ে যান।

     

    এমনই একদিন একটা মেয়ে দেখে ফিরছিল অরণ্য। একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল মেয়ের সাথে কথা বলতে। প্রতিবারের মতোই এই মেয়েও ওর পছন্দ হয়নি। অরণ্য গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে,এতো কৃত্রিমতার ভীড়ে কোথাও কি ওর মনের মতো কেউ নেই? যাকে এক নজর দেখেই মনে হবে, হ্যা এই সে। এসব ভাবতে ভাবতে একটা সিগনালের সামনে এসে দাঁড়াল অরণ্যের গাড়ি। চারিদিকে সন্ধ্যার আভাস নেমে এসেছে। 

     

    অরণ্য আনমনেই রাস্তার পাশে তাকাতেই একটা দৃশ্য দেখে ওর চোখ সেখানে আটকে গেল। অরণ্য দেখলো একটা বোরখা পড়া মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখনই ওর সামনে রাস্তায় এক শিশুকে বসে কাঁদতে দেখলো। শিশুটা একজন ভিখারিনীর। ভিখারিনী শিশুটাকে রেখে রাস্তার গাড়িওয়ালাদের কাছে গিয়ে ভিক্ষা চাইছে। আর শিশুটা বসে বসে কাঁদছে। ওই বোরখা পড়া মেয়েটা শিশুটার কাছে গিয়ে শিশুটাকে কোলে তুলে নিয়ে শিশুটাকে আদর করতে লাগলো। বিষয় টা দেখে অরণ্য অনেক টা অবাক হলো। আজকাল কার দিনে যেখানে সবাই এসব রাস্তার নোংরা বাচ্চাদের দেখলে নাক কুঁচকে নেয়। সেখানে এই মেয়েটা কত সুন্দর অনায়াসে শিশুটাকে কোলে তুলে নিল। অরণ্য আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখতে লাগলো। 

     

    মেয়েটা এবার বাচ্চাটাকে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের এক ব্রেঞ্চের ওপর বসিয়ে দিল। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পানির বোতল বের করে শিশুটির মুখ ধুইয়ে দিল। শিশুটিকে কিছু একটা বললো মেয়েটা,তখন শিশুটিও মাথা ঝাকিয়ে কি যেন বললো। অরণ্য সেসব শুনতে পেল না। তবে ওদের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলো মেয়েটা হয়তো শিশুটিকে কিছু খাবে নাকি তাই জিজ্ঞেস করেছে, আর শিশুটিও খেতে চাচ্ছে। মেয়েটা ওর ব্যাগের ভেতর থেকে পার্স বের করে চেক করছে। তবে পার্সে হাত দিয়ে দেখলো তেমন টাকা নেই হয়তো। তবুও যা আছে তাই দিয়েই শিশুটিকে একটা পাওয়ারুটি আর কলা কিনে দিল। শিশুটি খাবার দেখে অনেক খুশিমনে সেগুলো নিয়ে খেতে লাগলো। মেয়েটা শিশুটির দিকে তাকিয়ে ওর খাওয়া দেখছে।  মুখে হিজাব বাঁধার কারণে মেয়েটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তবে মেয়েটার চোখের ভাষায় বোঝা যাচ্ছে শিশুটিকে খেতে দেখে তার মনে যেন এক পরম আনন্দ হচ্ছে। 

     

    বিষয় টা দেখে অরণ্য সত্যিই মুগ্ধ হলো। একটা ক্ষুদার্থ শিশুকে খাইয়েও যে পরম আনন্দ পাওয়া যায়। তা এই মেয়েটাকে না দেখলে হয়তো জানতই না। অরণ্য হঠাৎ মোবাইল বের করে সেই মুহূর্তের একটা ছবি তুলে নিল। নিজের এহেন কাজে নিজেই অবাক হলো অরণ্য। সে আজপর্যন্ত এমন কাজ কখনোই করেনি। কারও বিনা অনুমতিতে ছবি তোলাটা একটা অনৈতিক কাজ। আর যদি কোনো মেয়ে হয় তাহলে তো আরও বেশি অনৈতিক কাজ। এটা জানা সত্বেও কিভাবে এমন কাজ করে ফেললো ও? কি হয়ে গেল হঠাৎ করে আমার?

     

    অরণ্য দেখলো একটু পরে শিশুটির মা ওখানে এলো। তার বাচ্চার এভাবে যত্ন নেওয়া দেখে সে মেয়েটার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন। মেয়েটি ওর পার্সের যা অবশিষ্ট সামান্য কিছু টাকা ছিল সেটাও শিশুটির মায়ের হাতে দিয়ে দিল। তারপর শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে হাঁটা ধরলো৷ তখনই পেছন থেকে আসা হর্নের শব্দে অরণ্যের ধ্যান ভাঙ্গলো। অরণ্য সামনে তাকিয়ে দেখলো সিগনাল গ্রীন হয়ে গেছে। অরণ্য তাড়াতাড়ি করে গাড়ি টা একপাশের দিকে চাপিয়ে নিল। তারপর রাস্তার পাশ ঘেঁষে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে মেয়েটাকে ফলো করতে লাগলো। 

     

    ও এসব কেন করছে তা নিজেও জানে না। তবে কেন যেন মেয়েটাকে নিয়ে কৌতুহল বাড়ছে ওর মনে। মেয়েটাকে নিয়ে আরও জানতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ওর। কিছুটা পথ যেতেই অরণ্য দেখলো মেয়েটা রাস্তায় এক বৃদ্ধ লোকের হাত ধরে তাকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করছে। বৃদ্ধ লোকটা খুশী হয়ে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিল। তারপর আবার হাঁটতে লাগলো মেয়েটা। কিছুদূর গিয়ে একজন গর্ভবতী মহিলাকে অনেক গুলো বাজারের ব্যাগ নিয়ে যেতে দেখে মেয়েটি তার ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে তাকে সাহায্য করলো। এভাবে যেতে যেতে মেয়েটি সব অসহায় ব্যাক্তিদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে । অরণ্য যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে মেয়েটাকে দেখে। এখনকার দিনেও এমন পবিত্র মনের মানুষ কেউ আছে সেটা দেখে অরণ্যের মনে এক অজানা অনুভূতিরা হানা দিল। তাহলে কি এই সেই মেয়ে যাকে আমি খুঁজে চলেছি? কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতর হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল অরণ্যের। ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক প্রাপ্তির হাসির রেখা। ইয়েস ইয়েস ফাইনালি আমি পেয়ে গেছি। পেয়ে গেছি আমি আমার কল্পকন্যাকে। সি ইজ দা ওয়ান। আমার সন্ধ্যামালতী।

     

    অরণ্য যখনই ভাবলো ও গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটার কাছে কথা বলতে যাবে। তখনই হঠাৎ দেখলো মেয়েটা সামনের দোতলা একটা বাসার গেটের ভেতর ঢুকে গেল। অরণ্য একটু আপসোস করে মনে মনে বললো, ধ্যাৎ মেয়েটার সাথে তো কথাই বলতে পারলাম না। এখন মেয়েটার সম্পর্কে জানবো কি করে? অরণ্য দেখলো গেটের কাছে একটা দাড়োয়ান দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্য গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে দারোয়ানর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।মেয়েটার সম্পর্কে একেবারে সরাসরি জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। এতে সমস্যা হতে পারে। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আগে কখনোই পরেনি ও। কিন্তু কথা না বললেও তো মেয়েটার সম্পর্কে জানতে পারবোনা। তাই কোনরকমে গলা খাঁকারি দিয়ে দারোয়ানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো। 

    –আচ্ছা এই বাড়িটা কার?

     

    দারোয়ান বলে উঠলো। 

    — আপনাকে কেন বলবো?  আপনি কে? 

     

    অরণ্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো। 

    –আমার পরিচয় টা বেশি জরুরি নাকি তোমার লাভ টা?

    কথাটা বলে অরণ্য একটা এক হাজার টাকার নোট দারোয়ানের হাতে গুঁজে দিল। দারোয়ানকে আর পায় কে। দারোয়ান দাঁত কেলিয়ে বললো।

    –জ্বি এইটা তারেক রহমানের বাড়ি স্যার? 

     

    –আচ্ছা একটু আগে যে মেয়েটা ঢুকলো, ওই মেয়েটা কে? 

     

    –স্যার আমিতো আইজকা নতুন জয়েন করছি। তাই ওতো ভালো করে জানিনা। তবে শুনছি তারেক স্যারের নাকি একটা মেয়ে আছে। ওই আপাই হবে। 

     

    অরণ্য আর কিছু না বলে ওখান থেকে চলে এলো। সেদিন বাড়িতে এসে সারারাত শুধু সেই সন্ধ্যামালতীর কথাই ভেবেছে। সারারাত একফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি ও। মেয়েটার চেহারা কল্পনা করতেই ওর সেই কল্প কন্যার সাথে কেমন মিলে যাচ্ছে। অরণ্য বুঝতে পারছে ও ওর সন্ধ্যামালতীর প্রেমে পড়ে গেছে। না দেখেও কারোর প্রেমে পড়া যায় তা ওই মেয়েটাকে না দেখলে হয়তো জানতেই পারতো না। তখনই অরণ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, বিয়ে করলে সে এই মেয়েকেই করবে। এই সন্ধ্যামালতীই হবে ওর জীবন সঙ্গী। ওর প্রিয়তমা মনের রাণী। 

     

    পরেরদিন অরণ্য ওর বড়ো বোন ইরিনকে সবকিছু খুলে বলে। ইরিন সব শুনে অনেক খুশী হয়ে যায়। আর বাড়ির সবাইকে বলে কথাটা। সবাই আনন্দে আত্মহারা। শেষমেশ তাদের ছেলের কাওকে পছন্দ হয়েছে। তাই ওরা আর দেরি করতে চায়না। পরেরদিনই অরণ্যের মা বাবা আর চাচা চাচী অরণ্যের বলা ঠিকানা অনুযায়ী সেই বাড়ি পৌঁছে যায়। মেয়ে দেখে তাদেরও পছন্দ হয়। মেয়ের মা বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তারাও সানন্দে রাজি হয়ে যান। পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে ছেলে মেয়ে দেখানোর পর্ব সারতে একটা ডেট দেওয়া হয়। সেদিন অরণ্য সহ বাকি সবাইও যাবে মেয়ে দেখে বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করতে। 

     

    তবে সেই দিনে হঠাৎ অরণ্যের বিজনেসের একটা জরুরি কাজ চলে আসে।যার জন্য ওকে তিনদিনের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে। তাই অরণ্য মেয়ে দেখতে যেতে পারবেনা। এটা শুনে বাকি সবাই ডেট পিছিয়ে দিতে চায়। তবে অরণ্য ভাবে নিয়তি হয়তো এটাই চায়। তাহলে তাই হোক। আমি আমার সন্ধ্যামালতীকে একেবারে আমার বধূ রুপেই দেখবো। বিয়ের রাতে যখন প্রথম বার ওর সন্ধ্যামালতীর মুখদর্শন করবে সেই মুহূর্ত টা হবে সবচেয়ে অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। তাই এর আগে আর তাকে দেখবো না আমি। এসব ভেবে অরণ্য ওর ফ্যামিলিকে বলে তারা গিয়ে যেন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলে। ও দেশে ফিরেই বিয়ে করবে। অরণ্যের কথামতো ওর পরিবার তাই করে। ওরা গিয়ে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে আসে। ওরা অরণ্যের ফোনে মেয়ের ছবি পাঠাতে চায়। তবে অরণ্য তাতেও মানা করে দেয়। সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে সে কোনভাবেই বিয়ের আগে তার সন্ধ্যামালতীকে দেখবে না। এমনকি ফোনেও কথা বলবে না। একেবারে বিয়ে করেই দেখবে।

     

    ব্যাপার টা হয়তো অনেকের কাছে ছেলেমানুষী বা ফিল্মি মনে হবে। তবে অরণ্য এই ব্যাপার টা এনজয় করতে চায়। সবাই তো দেখে বিয়ে করে। তবে ও না দেখেই বিয়ে করতে চায়। এটাতেও এক অন্য রকম অনুভূতি আছে। প্রিয়তমাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা মনে পুষে রাখা। সেই মুহূর্ত টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা। আর ফাইনালি সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত টা আসা। এটার মজাই অন্যরকম। যেটা সব মানুষ বুঝতে পারবে না। 

     

    আর সেই ভাবনা অনুযায়ী অরণ্য তিনদিন পরে দেশে ফিরে আজ বিয়ের পীড়িতে বসে পড়ে। 

     

    তবে আজ যখন সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত টা এসেছে তাহলে এমন লাগছে কেন আমার? কেন কিছু একটা মিসিং লাগছে আমার? না দেখে বিয়ে করে কোন ভুল করলাম নাতো? কিন্তু আমি তো কনফার্ম হওয়ার জন্য আপুর কাছে সন্ধ্যামালতীর সেই ছবিটা দিয়েছিলাম। যাতে কনফার্ম হয় যে রিয়াই সেই সন্ধ্যামালতী। আর আপু বলেছিল রিয়ার মা নাকি ছবি দেখে বলেছিল ছবির মেয়েটাই নাকি রিয়া। তাইতো আমিও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাহলে আজ কেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটা আমার সেই সন্ধ্যামালতী নয়? বিয়ের সময় যখন ওকে আমার পাশে বসানো হলো, তখনও তো মনে হলো যেন সন্ধ্যামালতী আমার পাশেই আছে। তাকে ফিল করতে পারছিলাম আমি। তার হাতটা ধরতেই যেন অনুভূতি গুলো নাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাহলে এখন এমন লাগছে কেন? যাকে না দেখে ফিল করতে পারি, তাকে সরাসরি দেখে ফিল করতে পারছিনা কেন?  নাহ আমি হয়তো একটু বেশিই ভাবছি। হতে পারে এই প্রথম সরাসরি দেখছি তাই এমন লাগছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। 

     

    হঠাৎ পেছন থেকে রিয়ার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো অরণ্যের। রিয়া বলে উঠলো। 

    –আপনি এখানে কি করছেন? ভেতরে আসবেন না? 

     

    অরণ্য পেছনে তাকিয়ে দেখলো রিয়া একটা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার লেগিস পড়েছে। রিয়ার এমন পোশাক দেখে অরণ্যের ভ্রু কুঁচকে এলো। ওতো ভেবেছিল ওর সন্ধ্যামালতী প্রচুর লাজুক স্বভাবের হবে। কিন্তু এর ভেতর তো লজ্জার ল ও দেখছিনা। যে মেয়ে বাইরে বোরখা পরে বের হয়। সে মেয়ে এতো মডার্ন হয় কিভাবে? অরণ্যের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে ও ওর বউ না অন্য কোন মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্য কোনরকমে বলে উঠলো। 

    –তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি আসছি একটু পরে। 

     

    অরণ্যের কথায় রিয়া মনে মনে একটু অবাক হলো। চোখের সামনে ওর মতো এতো সুন্দর মেয়েকে দেখেও এমন চুপচাপ আছে কেন উনি? ওতো ভেবেছিল নিজের রুপের জালে ফাঁসিয়ে অরণ্যকে কোন বাহানায় বিয়ের কথা বলবে। কিন্তু এতো কোন ইন্টারেস্টই দেখাচ্ছে না। অগত্যা রিয়া রুমে এসে বেডে শুয়ে পড়লো।

     

    অরণ্য একটু পরে আসার কথা বললেও সে ওখানেই বসে রইল।ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না।  ওর সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও। এমনই এলোমেলো ভাবনার মাঝেই একসময় ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে পড়লো অরণ্য। 

    ____

     

    মায়া দুর্বলচিত্তে উঠে দাঁড়িয়ে কোনরকমে কাপড় চেঞ্জ করে বেডে এসে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়লো। অশান্ত চোখের পাতায় ঘুমের লেশমাত্র নেই। বারবার শুধু চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো ভাসছে। নিয়তির এই নির্মম খেলায় নিজেকে কোন রঙ্গমঞ্চের পুতুল মনে হচ্ছে। না চাইতেও শুধু মনের মাঝে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। তার স্বামী নামক পুরুষ টা কি এখন রিয়াতে মেতে আছে? স্বামী?  হ্যাঁ হাস্যকর হলেও এটাই সত্যি। আর কেউ না জানুক সেতো ঠিকই যে ওই লোকটা তার নামমাত্র হলেও তার স্বামী। 

     

    মায়া ভাবছে তখনকার কথা। বিয়ের আসর থেকে ওকে যখন বাসার ভেতর আনা হয়। রিয়া তখনও ফিরে আসেনি। মায়ার মামী মায়াকে ওর রুমে গিয়ে যা লাগবে গুছিয়ে নিতে বলে। মায়াও সেই কথা মতো নিজের রুমে চলে আসে। কিন্তু রুমে এসে মায়া কিছুতেই শান্তি পায় না। অস্থিরতা আর ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে। বারবার শুধু মাথায় একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যেভাবে বিয়েটা হলো সেটা কি আদৌ জায়েজ হয়েছে?  আর যদি জায়েজ না হয়ে থাকে তাহলে একটা পরপুরুষের সাথে একসাথে একই রুমে? না না এটা আমি কিছুতেই করতে পারবো না। কখনোই না। এখন আমি কি করবো?  এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে মায়া অস্থির হয়ে পায়চারী করতে থাকে। 

     

    হঠাৎ তখনই ওর এক চাচা ( মায়ার বাবার চাচাত ভাই) মায়ার রুমে আসে। রিয়ার বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল সে। যাওয়ার আগে মায়ার সাথে দেখা করার জন্য আসে। ছোট বেলা থেকেই মায়াকে তিনি অনেক স্নেহ করেন। মাঝে মধ্যে এসে মায়াকে দেখে যান। এতিম মেয়েটির জন্য তার বড্ড মায়া হয়। 

    কিন্তু রুমে ঢুকে মায়াকে এভাবে বঁধু বেশে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। মায়ার কাছে এসে এসবের কারণ জিজ্ঞেস করেন। 

     

    মায়ার চাচাকে দেখে হঠাৎ মায়া একটা পথ খুঁজে পায়। মায়ার চাচা একজন ইমাম। মায়া ওর চাচাকে সবকিছু খুলে বলেন। তখন মায়ার চাচা রেগে গিয়ে মায়ার মামার সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু মায়া অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে মানান,যে এই কথা জানাজানি হয়ে গেলে ওর আর মামার দুজনেরই ক্ষতি হবে। মায়ার মামা সবকিছু শুনে বলেন। 

    –কিন্তু এই বিয়ে তো জায়েজ হয়নি। কারণ বরের সামনে তো তোমার নাম নেওয়া হয়নি। 

     

    মায়া অনুনয়ের সুরে বললো। 

    –তাহলে চাচা আপনিই কিছু করেন যাতে বিয়েটা জায়েজ হয়ে যায়। প্লিজ চাচা আপনার পায়ে পরছি। আমাকে পাপের হাত থেকে রক্ষা করুন। 

     

    মায়ার জন্য অনেক মায়া হয় ওর চাচার। সে ভাবে হয়তো একদিক দিয়ে ভালোই হবে। মা বাবা মরা মেয়েটা একটা ভালো সংসার পাবে। তাই অনেক চিন্তা ভাবনার পর ওর চাচা বললেন।

    –ঠিক আছে মা আমি কিছু করছি তুই চিন্তা করিস না। হয়তো আমাকে কিছু মিথ্যে বলে পাপের ভাগিদার হতে হবে। তবুও তোর জন্য আমি এটা করবো।

     

    কথাটা বলে ওর চাচা বাইরে বের হয়ে যায়। কিছু একটা ভেবে অরণ্যের বাবাকে একপাশে  ডেকে বললেন। 

    — বিয়াই মশাই একটা কথা ছিল। আসলে আমাদের গ্রামের একটা রিত আছে। একবার বিয়ে পড়ানোর পর ওই রীত অনুযায়ী আবার বিয়ে পড়ালে স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন অনেক সুখী হয়। এটা আমাদের মান্যতা। তাই আপনারা কিছু মনে না করলে আমরা ওই রীত অনুযায়ী আবার বিয়ে পড়াতাম। 

     

    অরণ্যের বাবা হাসিমুখে বললেন।

    –হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই কেন নয়। এতে যদি ওদের দাম্পত্য জীবন সুখী হয় তাহলে তো করা উচিত। 

    –ধন্যবাদ বিয়াই সাহেব। তাহলে আপনি একটু অরণ্যকে বাসার ভেতর নিয়ে আসবেন?  আসলে রীতটা একটু একাকী ভাবেই করতে হয়। শুধু দুজন সাক্ষী হলেই হবে। 

     

    –আচ্ছা ঠিক আছে। আমি অরণ্যকে ওর ভাই সাহিল আর বন্ধু ইহানের সাথে পাঠাচ্ছি। 

     

    সেই কথা অনুযায়ী একটু পরেই সাহিল আর ইহান মিলে অরণ্যকে বাসার ভেতর একটা রুমে নিয়ে আসে। অরণ্যকে বসিয়ে দিয়ে সাহিল আর ইহান একটু খানি দূরে দাঁড়িয়ে ওরা ওদের মতো ফোনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। মায়ার চাচা নিজের ফোনে কিছু দোয়াদরুদ চালু করে দিয়ে অরণ্যের হাতে দিয়ে শুনতে বলে।ইচ্ছে করেই বলিউম টা বেশি বাড়িয়ে দেয়।  অরণ্য এসব দেখে একটু অবাক হলেও আপাতত কিছু বলে না। ভাবে হয়তো এটাই তাদের প্রথা হবে। মায়ার চাচা বিয়ে পড়ানো শুরু করে। মায়ার বাবার বাড়ি আর নানার বাড়ি একই গ্রামে। আর নিয়তিরই হয়তো কোনো লিলা, তাইতো ভাগ্যক্রমে মায়ার বাবার নামও তারেক। যদিও উনার ডাকনাম আলাদা ছিল।কিন্তু খাতা কলমে উনার নামও তারেক। তাইতো মায়া ওর মামাকে বাবার মতোই ভালোবাসে।

     

    মায়ার চাচা বিয়ে পড়ানো শুরু করে। গ্রাম আর বাবার নাম এক হওয়ায় সেগুলো স্বাভাবিক ভাবেই চলে। শুধু মায়ার নামের সময় একটু বুদ্ধি করে বলে।যেহেতু রিয়া আর মায়া একই রকম শোনায় তাই মায়ার ম টা একটু আস্তে করে বলে। আর য়া টা স্বাভাবিক সুরে বলে। ফোনের আওয়াজের জন্য অরণ্য বা বাকিরা ব্যাপার টা বুঝতে পারে না। শেষে কবুল বলতে বললে অরণ্য কবুল বলে দেয়। মায়ার মামা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

     

     তারপর সাহিল আর ইহানকে সাথে নিয়ে মায়ার রুমে আসে। মায়া আবারও ঘোমটা টেনে বসে আছে। ওদের সামনে আবারও বিয়ে পড়ানো হয়। অতঃপর মায়াও কবুল বলে দেয়। আর এভাবেই সত্যি সত্যিই ওদের বিয়েটা হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পরেই রিয়া চলে আসে আর মায়ার জীবন টা এভাবেই এলোমেলো হয়ে যায়। মায়ার চাচা বিয়ে পড়ানোর পরেই চলে যায়।তাই সে আর এসব জানতে পারে না।

     

    মায়ার এখন নিজের ওই কাজের জন্য আপসোস হচ্ছে। আগে জানলে সে কখনোই ওভাবে বিয়ে টা পাকাপোক্ত করতো না। তাহলে আজ ওকে এভাবে অসহায়ত্বের শিকার হতে হতো না। না না ওসব আর ভাবা যাবে না। মন থেকে সব মুছে ফেলতে হবে। সে আমার কিছুই না। ওটা শুধু আমার জীবনের একটা মিথ্যে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। আমি ভুলে যেতে চাই এই ভয়ংকর স্বপ্নকে। হ্যাঁ ভুলে যাবো সবকিছু। 

     

    চলবে………. 

     

     

    #মায়ারণ্যে

    #লেখিকা- মেহরুমা নূর 

    #পর্ব-৩

     

    ★ সকালের ঝলমলে রোদ চোখে পড়তেই অরণ্যের ঘুম ভেঙে গেল। অরণ্য কপাল কুঁচকে চোখ মেলে তাকালো। মাথাটা হালকা এদিক ওদিক ঘুড়িয়ে দেখলো ও ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে আছে। অরণ্য আস্তে করে উঠে রুমে এলো। রুমে এসে দেখলো রিয়া বিছানার উপর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটাকে যতবারই দেখছে কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে ওর। নিজের বউয়ের সামনে এমন কেন লাগছে সেটারই কারণ খুঁজে পাচ্ছে না অরণ্য। সবকিছু ঠিক হয়েও কেন এতো বেঠিক লাগছে?  নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হচ্ছে ও। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।  একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাবার্ড থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে। 

     

    অরণ্যেদের পরিবার এমনিতেই অনেক বড়ো। তারওপর বিয়ের জন্য আরও মেহমানে ভরে গেছে। সারাবড়ি শুধু মানুষের শোরগোল ।

     

    অরণ্যের পরিবারের পরিচয়টা দেওয়া যাক। তো সবার বড়ো হলো অরণ্যের বাবা রায়হান হোসেন। তারা তিন ভাই বোন। সবার বড়ো রায়হান হোসনে, তার ছোট ভাই সাজ্জাদ হোসেন, আর তার ছোট বোন রাবেয়া। রায়হান হোসেনের স্ত্রী তনিমা বেগম, তাদের দুই ছেলেমেয়ে, ইরিন আর অরণ্য। সাজ্জাদ হোসেনের স্ত্রী এলিসা, তাদের একটাই মেয়ে সারা। রাবেয়ার স্বামী ইমাদ রহমান, তাদের দুই ছেলেমেয়ে সাহিল আর রাইসা। এরা সবাই একসাথেই এবাড়িতে থাকে।

     

    অরণ্যের বড়ো বোন ইরিন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ফুলদানিতে ফুল সাজাচ্ছে। তখনই অরণ্যের বেস্ট ফ্রেন্ড ইহান ধপ করে ইরিনের গা ঘেঁষে হেলান দিয়ে বসে পড়ে বললো।

    –গুড মর্নিং ইরাবতী। 

     

    ইহান ছোটবেলা থেকেই ইরিন কে ইরাবতী বলেই ডাকে। ইরিন অরণ্যের দুবছরের বড়ো হলেও ইহান ইরিনকে সবসময় তুমি বলেই সম্বোধন করে। ইরিনেরও অভ্যাস হয়ে গেছে তাই সেও কিছু মনে করে না। তাই ইরিনও মুচকি হেসে বললো। 

    –গুড মর্নিং। ঘুম ভাঙলো তোমাদের। 

     

    ইহান দুষ্টুমি করে বললো। 

    –হাহ্ আর ঘুম। আমার বন্ধু বিয়া কইরা বাসর কইরা ফালাইলো। আর আমরা এখনো সিঙ্গেল থাইকা গেলাম।  এই দুঃখে কি আর ঘুম আসে? এই অধমের কপালে কবে বউ জুটবে? 

     

    ইহানের কথায় ইরিন মুচকি হেসে বললো।

    –চিন্তা করোনা তুমিও একদিন তোমার মনমতো বউ পেয়ে যাবে। 

     

    ইহান এবার ইরিনের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো। 

    –সত্যিতো?  আমার মনমতো বউ পাবো?

     

    ইরিন ইহানের দিকে না তাকিয়ে ওর কাজ করতে করতেই বললো।

    –হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই পাবে।

    ইরিন ইহানের দিকে তাকালে হয়তো দেখতে পেত ইহানের চোখের ভাষা। যে ভাষায় হাজারো না বলা অনুভূতিরা খেলা করছে। 

    ইহান ফুলদানি থেকে একটা হলুদ জারবেরা ফুল নিয়ে ইরিনের কানে গুঁজে দিয়ে বললো। 

    –ওয়াও হেব্বি লাগছে তোমাকে ইরাবতী। একদম নায়িকা সাবানা। 

    কথাটা বলে ইহান ফোন বের করে ফট করে ইরিনের একটা ছবি তুলে নিল। 

     

    সবসময়ের মতো ইরিন ইহানের কথা মজা ভেবে হেঁসে উড়িয়ে দিল। ইহানের চাহনি যে অন্য কথা বলছে সেটা আজও বুঝতে পারলো না ইরিন। কখনো বুঝাতে পারবে কিনা সেটাও জানে না ইহান।

     

    একটু পরে অরণ্যের চাচী এলিসা নিচে এসে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে কাজের মেয়ে মিনাকে ডাক দিয়ে বললো।

    –এই মিনা শোন, আমার বরটা(ঘরটা) না অনেক ময়লা হয়ে গেছে বরটাকে একটু মেরে(ঝেড়ে) দে।

     

    এলিসার কথায় বেচারি মিনা তব্দা খেয়ে গেল। অটো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এলিসার পাশেই তার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন বসে চা খাচ্ছিল। এলিসার কথায় বেচারার চা নাকে মুখে উঠে কাশতে শুরু করে দিল। বাকি সবাই শুধু মুকটিপে হাসছে। এলিসা আরও বলে উঠলো। 

    –আচ্ছা শোন প্রথমে বরটার চুলগুলো (ঝুলগুলো) ঝেড়ে দিবি। তারপর বরটাকে মেরে নিচে মুছে দিবি ঠিক আছে? 

     

    মিনা বেচারি এতো শক খেয়ে ওর হাতে থাকা চায়ের ট্রেটা ঠাস করে নিচে পরে গেল। ইরিন তখন বলে উঠলো। 

    –এই মিনা তুই এতোদিন হলো আমাদের বাড়িতে আছিস,এখনো চাচীর কথায় এতো চমকে যাস কেন?

     

    তখনই সাহিল এসে সোফায় বসে হাসিমুখে বলে উঠলো। 

    –হ্যারে মিনা, তুই কি জানিস না এলিসা মামী হলো আমাদের ফিরাঙ্গি মামী? তাইতো মাঝে মধ্যে উল্টো পাল্টা বাংলা বলে ফেলে।

     

    সাহিলের কথায় সবাই হেঁসে দিল। এলিসা বেচারি বুঝতে পারলো সে আবারও কোন ভুল বাংলা বলে ফেলেছে। তাই সে একটু লজ্জায় পড়ে গেল। সাহিল দুষ্টুমি করে বলে উঠলো। 

    –সাজ্জাদ মামা তুমি কিন্তু একটা গ্রেট কাজ করছো। ব্রিটিশদের কাছ থেকে একটু হলেও প্রতিশোধ নিয়েছ। বিদেশে গিয়ে তাদেরই দেশের মেয়েকে পটিয়ে নিয়ে এসেছ। এটা কি কম কথা নাকি। আমিতো তোমার পাঙ্খা হয়ে গেছি। আজ থেকেই তুমি আমার আইকন।

     

    সাহিলের প্রসংশায় সাজ্জাদ হোসেন যেন ফুলে বেলুন হয়ে গেল। গর্বে তার বুকটা ফুলে যেন ফুটবল হয়ে গেল। আর বাকি সবাই মুখ টিপে হাসছে। 

     

    একটু পরে সারা এসে চেয়ার টান দিয়ে বসে ওর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো।

    –মাম্মা ক্ষুদা লেগেছে। তাড়াতাড়ি খেতে দাওনা। ক্ষুদায় পেটে ইঁদুর বিড়াল দৌড়াদৌড়ি করছে। 

     

    তখনই সাহিল বিশেষ টিপুনি করে বলে উঠলো। 

    –এই চশমিশ আর কতো খাবি? একটু কম খা।  এইটুকুন পিচ্চি মেয়ে এত খাবার রাখিস কই? দিনদিন খেয়ে খেয়ে তো বেলুন হয়ে যাচ্ছিস। কবে আবার দেখা যাবে ফটাস করে ফেটে যাবি।

     

    সাহিলের কথায় সারার ভীষণ রাগ হলো। সাথে খারাপও লাগলো প্রচুর। খুব কান্না পাচ্ছে ওর। খাওয়ার কথার চেয়ে বেশি খারাপ লাগলো ওকে চশমিশ বলায়। কেও ওকে চশমিশ বললে ওর ভীষণ রাগ লাগে। আর এই লোকটা শুধু বারবার ওকে এটাই বলে। যেদিন বিদেশ থেকে ফিরেছে সেদিনও ওকে দেখে চশমিশ বলেছিল। সেদিন থেকেই সাহিলকে অসহ্য লাগে ওর। যতটা পারে সাহিলের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে।  আর আজকে তো ওর খাবার নিয়েও কথা বলছে। রাগে গা রি রি করছে। মন চাচ্ছে মাথায় একটা বারি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতে। অসহ্য লোক একটা। সারা রাগে নিজের নাক টেনে চশমাটা ঠিক করে উঠে চলে যেতে নিলেই অরণ্যের মা তনিমা বেগম এসে বললো।

    –কি হয়েছে সারা মা চলে যাচ্ছিস কেন? নাস্তা করবি না?

     

    সারা অভিমানী সুরে বললো। 

    –না বড় মা। আমি খাবো না। আমার খাওয়া কারোর চোখের বিষ হয়ে গেছে।  তোমরা বরং তাকেই বেশি করে খাওয়াও। 

     

    তনিমা বেগম আদুরে গলায় বললো। 

    –আমার সারা মামনিকে কে কি বললো হ্যাঁ? খবরদার আমার সারা মামনীকে কেউ কিছু বললে তার খাওয়া বন্ধ করে দিবো আমি। 

     

    ইহান বাঁকা হেসে সাহিলের উদ্দেশ্যে বললো।

    –লে ভাই তোর আজকে উপস থাকতে হবে মনে হচ্ছে। 

     

    সাহিল শুধু একটা রহস্যময়ী হাসি দিল।  তনিমা বেগম সারাকে অনেক বুজিয়ে সুঝিয়ে আবার খেতে বসালো। নিজের হাতে সারাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। বাড়ির সবগুলো ছেলেমেয়ের চেয়ে সারা তার ফেবারিট। মেয়েটাকে তার খুব ভালো লাগে। কি সুন্দর সাদা দুধ মালাইয়ের মতো দেখতে। টোকা দিলেই যেন রক্ত বের হবে। একদম ফরেনার দের মতো। ফরেনার মা বলে হয়তো এমন হয়েছে। 

     

    একটু পরে অরণ্যও নিচে নেমে এলো। সোফায় বসতেই সাহিল আর ইহান ওর দিকে কেমন দুষ্টু চোখে তাকিয়ে স্ক্যানিং করতে লাগলো। অরণ্য সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো। 

    –কিরে তোরা এভাবে তাকিয়ে আসিছ কেন?

     

    ইহান দুষ্টু সুরে বললো। 

    –কিরে ভাই কেমন পারফরম্যান্স দিলি? শরীরে তো কোন স্ক্রাচ দেখিনা। এতো স্মুধলি কেমনে করলি? আমাদেরও একটু টিপস দে।

     

    অরণ্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো। 

    –আমার শরীরে না থাকুক তোদের শরীরে নির্ঘাত স্ক্রাচ পরে যাবে।তাও পারমানেন্টলি। তাই নিজেদের বাঁচাতে চাইলে ফালতু পেঁচাল বন্ধ কর।

     

    অরণ্যের হুমকিতে ওরা দুজন একটু দমে গেল। তনিমা বেগম বলে উঠলেন।

    –কিরে অরণ্য বৌমা কোথায়? ও নাস্তা করবে না?

     

    অরণ্য বললো।

    –ওতো এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।

     

    ইরিন বলে উঠলো। 

    –আচ্ছা আমি ডেকে নিয়ে আসছি ওকে। 

     

    ইরিন যেতেই সাহিল এবার দুষ্টু হেসে বললো। 

    –কি ব্যাপার ভাই, কেমন পারফরম্যান্স দিলা যে ভাবি বিছানা থেকেই উঠতে পারছে না? 

    কথাটা বলে সাহিল ইহানের হাতের ওপর তালি বাজিয়ে হাসতে লাগলো। 

     

    অন্য সময় হলে হয়তো অরণ্যও এদের সাথে হাসাহাসি করতো।তবে আজ এদের কথায় চরম বিরক্ত হচ্ছে ও। এখন এদের কিভাবে বুঝাবে যে ওরা যা ভাবছে তার কিছুই হয়নি।

     

    ইরিন অরণ্যের দরজার সামনে এসে দুই তিনবার নক করলো। ভেতর থেকে কোন আওয়াজ না পেয়ে ইরিন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখলো রিয়া এখনো হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ইরিন আরেকটা জিনিস খেয়াল করে দেখলো,অরণ্যের পাশের বিছানা একদম গোছানো আছে। বালিশটা দেখেও মনে হচ্ছে রাতে এর ওপর কেউ শোয়নি। আর রিয়াকে দেখেও মনে হচ্ছে না ওদের ভেতর কোনরকম শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। বিষয় টা দেখে ইরিনের একটু সন্দেহ হলো। তবে আপাতত সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে রিয়াকে ডাকায় ব্যস্ত হলো। রিয়াকে কয়েকবার ডাক দেওয়ার পর রিয়া একটু নড়েচড়ে উঠে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললো।

    –উফফ মা এতো ডাকছ কেন? ঘুমুতে দাওনা। 

     

    ইরিন মুচকি হেসে বললো। 

    –আমি তোমার মা না। তোমার ননদ। এবার উঠে নাস্তা করে নাও। নিচে সবাই ডাকছে তোমাকে।

     

    রিয়া এবার এক ঝটকায় উঠে বসলো। ওতো ভুলেই গিয়েছিল যে ও এখন শশুরবাড়িতে আছে। রিয়া ইরিনের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো। 

    –সরি আসলে বুঝতে পারিনি।

     

    ইরিন মুচকি হেসে বললো। 

    –ইটস ওকে। এতো টেনশনের কিছু নেই। তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। সবাই নাস্তার টেবিলে তোমার অপেক্ষা করছে। আসলে আমাদের পরিবারের সবাই একসাথেই খাবার খাই। এটাই এবাড়ির নিয়ম। আমি যাই তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো কেমন?

     

    রিয়া মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। ইরিন চলে যেতেই রিয়া বিরক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো। –সকাল সকাল আমার ঘুমটা ভেঙে দিল।আমিতো দশটার আগে ঘুম থেকেই উঠি না৷ ঘুম থেকে উঠিয়ে আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে,যত্তসব।

     

    একটু পরে সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসলো নাস্তা করতে। রিয়াও তখন নিচে নেমে এলো। রিয়া একটা গোল জামার সাথে লেগিস পড়েছে।ব্যাপার টা অরণ্যের মা তনিমার তেমন পছন্দ হলোনা। বিয়ের প্রথম দিন বাড়ির বউয়েরা শাড়ী পরবে তবেই না নতুন বউ মনে হবে। তবুও তনিমা বেগম কিছু বললেন না। এবাড়িতে নতুন এসেছে তাই মেয়েটা হয়তো বুঝতে পারেনি। এখুনি এতো স্ট্রিক্ট হওয়া ঠিক হবে না। কথাটা ভেবে তনিমা বেগম আর কিছু বললেন না। তবে অরণ্যের ফুপি রাবেয়া চুপ করে রইলেন না। তিনি স্বভাবতই একটু মুখফোড় টাইপের। তাই মুখের ওপরই বলে উঠলেন।

    –বাড়ির নতুন বউ হয়ে এভাবে বাচ্চাদের মতো জামাকাপড় পড়ে ঘুরছ কেন? শাড়ীর কি অভাব পড়েছে নাকি? নাকি শাড়ী পরতেই জানোনা?

     

    রাবেয়ার কথায় রিয়ার ভেতরে ভেতরে রাগ লাগলেও সেটা বুঝতে না দিয়ে বলে উঠলো। 

    –আসলে আমি বুঝতে পারিনি। বাসায় এসব পরেই অভ্যাস তো তাই। 

     

    –ঠিক আছে। কিন্তু পরবর্তীতে কিন্তু খেয়াল রাখবে। আপাতত নতুন নতুন কিছুদিন তো শাড়ী পরো। তারপর নাহয় তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী পড়বে। আমরা এতটাও স্ট্রিক্ট না।

     

    রাবেয়ার কথায় রিয়ার ভেতরে ভেতরে খুব রাগ লাগলো। আর এই বাড়িতে এতো মানুষ কেন? এতো বড়ো পরিবার এদের তাতো জানাই ছিলনা। এতলোক একসাথে থাকে কিভাবে এরা? আমার তো এখন থেকেই বিরক্ত লাগছে। একবার শুধু অরণ্যকে কোনরকমে কাবু করতে পারলেই হয়। তারপর ওকে বলবো এবাড়ি থেকে আলাদা থাকতে। 

    ____

     

    বিকাল ৪ টা 

    অরণ্য ছাঁদে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। রুমের ভেতর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল ওর। রিয়া তখন ওর কাছে ঘেঁষে কথা বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অরণ্যের প্রচুর অস্বস্তি লাগছিল। ও চেয়েও কেন যেন মেয়েটার সাথে কম্ফোর্টেবল হতে পারছে না। ও কতকিছু ভেবে রেখেছিল ওর সন্ধ্যামালতীর জন্য। অথচ এখন সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে ওর। কিন্তু এর কোন কারণই খুঁজে পাচ্ছে না ও। 

     

    হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে তাকালো অরণ্য। তাকিয়ে দেখলো ইরিন এসে বসেছে ওর পাশে। ইরিন অরণ্যের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো। 

    –কি হয়েছে অরু?  এখানে এভাবে একা একা বসে আছিস কেন? সব ঠিক আছে তো? 

     

    অরণ্য জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো। 

    –কি আবার হবে আপু। আমি একদম ঠিক আছি।

     

    –তাহলে নতুন বউকে রেখে এখানে একা একা কি করছিস হ্যাঁ? 

     

    অরণ্য ইরিনের পায়ের ওপর মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে বললো।

    — আরে এমনি। নিচে অনেক শোরগোল হচ্ছিল। তাই একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে উপরে আসলাম। আর তোমাদের নতুন বউ তো রিসিপশনের জন্য রেডি হচ্ছে। সেখানে আমি কি করবো? তাই একাই বসে আছি।

     

    ইরিন অরণ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো। 

    –সব ঠিক হলেই ভালো অরু। তুইতো আমাদের গর্ব। সবচেয়ে বেশি বাবার গর্ব। তুইতো জানিসই আমার কারণে বাবার মানসম্মানের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমিতো আর হয়তো কোনদিনও বাবার নজরে উঠতে পারবোনা। কিন্তু তুই কখনো এমন কিছু করিস না যাতে বাবা নিরাশ হয়। 

     

    অরণ্য বুঝতে পারছে ইরিন এসব কেন বলছে। অরণ্য তখন নিউইয়র্কে ছিল। ইরিন একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছিল। তবে বাবা ছেলেটাকে পছন্দ করেনি। বাবার মতে ছেলেটা ভালো ছিলোনা। তবে ইরিন তখন প্রেমে এতোটাই মাতোয়ারা হয়েছিল, যে ওর বাকি দুনিয়ার কোন হুশই ছিলনা। তাইতো সবার বিপক্ষে গিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ওই ছেলেটার সাথে বিয়ে করে। বিয়ের পরেই ওই ছেলের আসল রুপ দেখতে পায় ইরিন। ছেলেটা  মদ খাজা খেয়ে দিনরাত ইরিনের ওপর অত্যাচার করে।ইরিন তখন ওর ভুল বুঝতে পারে। তবে অপরাধ বোধের কারণে বাড়িতে আসার সাহস পায়না। অতঃপর পাঁচ মাস পরে একদিন ইরিন বিধ্বস্ত অবস্থায় অরণ্য দের বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছায়। সেদিন ইরিনের অমন অবস্থা দেখে সবার রুহ কেঁপে উঠেছিল। যেমনই হোক নিজের মেয়ের এমন অবস্থা দেখে তারেক রহমানও আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি। সেদিনই ওই বদমাইশ কে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয় ওরা। তারপর ওর সাথে ডিভোর্স পেপারেও সাইন করিয়ে নেয়। সেই থেকে ইরিন তার কাজের জন্য এখনও অপরাধ বোধে ভোগে। ওর বাবার সাথে এখনও চোখ মেলাতে পারে না ইরিন। 

     

    অরণ্য ইরিনের মাইন্ড ডিসট্রাক করার জন্য বললো।

    –ওহহো আপু তুমি কি একটা কথাই সবসময় টেনে নিয়ে বসে থাকো। বাদ দাও তো ওসব কথা। যা হবার তা হয়ে গেছে। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয়। এখন অতীত কে বারবার মনে করে কি লাভ? ওসব ভুলে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করো। ইহানের ভাষায়, চিল মারো।

     

    ইরিন মুচকি হেসে বললো। 

    –আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চল রেডি হয়ে নে একটু পরেই রিসিপশনের জন্য বের হতে হবে। 

     

    –ঠিক আছে চল।

    _____

     

    রাত ৮ টা

    রিসিপশন পার্টি জমে উঠেছে। সব মেহমানরা চলে এসেছে ।অরণ্য আর রিয়া স্টেজে বসে আছে পাশাপাশি। কাল থেকে এই পর্যন্ত অরণ্য বোধহয় গোনা তিনটা কি চারটা কথা বলেছে রিয়ার সাথে। অরণ্যের এমন বিহেভিয়ারে রিয়া অনেক টা অবাক হচ্ছে। তবে সে বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না রিয়া। আপাতত সে তার নতুন হাইক্লাস লাইফ এনজয় করছে। এতো বড়ো পার্টি, এতো জাঁকজমক এর আগে কখনোই দেখেনি রিয়া। আজ ওর শাশুড়ী কতো দামী দামী গহনা দিয়েছে রিয়াকে।সেই খুশিতেই আপাতত নিজেকে ভাসাতে ব্যাস্ত সে। এসবই তো তার স্বপ্ন ছিল। বড়ো ঘরের বউ হবে,দামী দামী গাড়ীতে ঘুরবে এসবই তো সে চেয়েছিল। তাইতো বাকি জিনিস দেখার সময় নেই ওর। 

     

    রিয়ার বাবা মাও এসেছে পার্টিতে। নিজের মেয়েকে এমন রাজরানীর মতো দেখে রিয়ার মা মনে মনে এক বিশ্ব জয়ের হাসি দিচ্ছে। আজ তার বলা একটা মিথ্যে কথার কারণেই রিয়া আজ এতো সুখে রাজ করছে। হ্যাঁ মিথ্যে কথা। সেদিন যখন অরণ্যের বোন ইরিন রিয়ার মাকে  ফোনের ছবিটা দেখিয়েছিল, তখন রিয়ার মা ছবি দেখেই বুঝে গিয়েছিল যে ওটা মায়ার ছবি।তবে সে সেদিন মিথ্যে বলেছিল যে ওটা রিয়ার ছবি। যাতে মায়ার বদলে রিয়ার বিয়ে হয়ে যায়। যদিও শেষমেশ মায়ার সাথেই বিয়েটা হয়েছে। তবুও রাজ তো আমার মেয়েই করছে। আর সবসময় ওই করবে। ওদের বিয়ের সত্যি টা আমি কখনোই সামনে আসতে দিবোনা। 

     

    অনুষ্ঠান শেষে নিয়ম অনুযায়ী অরণ্যকে আজ রিয়াদের বাড়িতে যেতে হবে। যদিও অরণ্যের যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে হচ্ছে না। তবুও সবার মান রাখতে যেতেই হবে।তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিয়ার সাথে ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিল। তবে সারা আর রাইসা বায়না ধরেছে তারাও অরণ্যের সাথে যাবে। রিয়া মনে মনে বিরক্ত হলেও ওপরে ওপরে মেকি হেসে ওদের যেতে বললো সাথে। তারপর সবাই একসাথে রওয়ানা হলো। 

    _____

     

    মায়া রান্নাঘরে কাজে ব্যাস্ত। ওর মামী যাওয়ার আগে বলে গেছে সব রান্নাবান্না যেন করে রাখে। তাই মায়া সেই বিকাল থেকেই রান্নাঘরে ব্যাস্ত। তাকে দেখে কেউ বলতেই পারবেনা যে,তার জীবনে এতবড় একটা ঝড় বয়ে গেছে। মায়া যে এমনই। নিজের সব কষ্ট নিজের মাঝেই আবদ্ধ রাখে সে। কি দরকার মানুষকে নিজের দুর্বলতা দেখানোর? কেউ কি ওর গ্লানি দূর করতে পারবে? বরং কাটা ঘায়ে শুধু নুনের ছিটা দিয়ে যাবে সবাই। তারচেয়ে ভালো নিজের কষ্ট নিজের মাঝেই রাখা। আর এমনিতেও মায়া কালকের ওই দিনটাকে আর মনে করতে চায়না। যত তাড়াতাড়ি সব ভুলতে পারে ততই ভালো ওর জন্য। নিজেকে মিথ্যে কোন আশা দিতে চায়না ও। আশা যে অনেক ভয়ংকর জিনিস। আশা ভেঙে গেলে যে অনেক কষ্ট হয়। তাই কোন আশা না করাই ভালো। মনকে এসব হাজারো বাহানা দিলেও তার মন কতটা আস্বস্ত হচ্ছে তা জানা নেই মায়ার।

     

    মায়ার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কেউ ওর মুখে হালকা পানির ছিটা মারলো। মায়া একটু হকচকিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো এটা ওর মামাতো ভাই রাদিব। মায়া মিছে রাগ দেখিয়ে বললো। 

    –কিরে রাদিব এসব কি হচ্ছে হ্যাঁ?  তুই না অসুস্থ? তারজন্য তুই বৌভাতেও গেলিনা। তাহলে এখন এখানে কি করছিস তুই? 

     

    –আরে আপু রুমে শুয়ে শুয়ে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম। তুমিতো জানোই আমার মতো ট্যালেন্টেড লোক এভাবে শুয়ে থাকলে কি দুনিয়া চলবে?দুনিয়াতো থেমে থাকবে তাইনা?

     

    মায়া এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো।

    –আচ্ছা তাই? তা এখানে কি আবিষ্কার করতে এসেছেন শুনি? 

     

    রাদিব ভাব নিয়ে বললো। 

    –তেমন কিছু না। দেখতে এসেছিলাম তুমি রান্না করার সময় ট্যাপের পানি ব্যাবহার করো নাকি চোখের পানি দিয়েই রান্না সেরে ফেল। হা হা

     

    –তবেড়ে দুষ্টু, বড়ো বোনের সাথে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। 

    কথাটা বলে মায়া রাদিবের দিকে তেড়ে আসতে লাগলো। রাদিবকে আর পায় কে। সেও দৌড় দিল বাইরের দিকে। ড্রয়িং রুমের চারপাশে দুজন হাসছে আর দৌড়াচ্ছে। রাদিব আগে আগে  আর মায়া ওর পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। মায়াকে হাসতে দেখে রাদিবের ভালো লাগছে। ওকে হাসানোর জন্যই তো এসব করেছে ও। যদিও মায়ার মন খারাপের কারণ জানে না। তবুও কাল থেকে কেমন বিষন্ন লাগছিল মায়াকে। তাইতো ওকে একটু হাসানোর জন্য এসব করেছে ও।

     

    এমন সময় রিয়া আর অরণ্য রাও চলে আসে। রিয়ার মা ওদের সাথে থাকায় সে নিজেই দরজার লক খুলে ওদের ভেতরে ঢুকতে বলে। অরণ্য এক হাতে ফোন টিপতে টিপতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই ভেতরে ঢুকে। ওদিকে মায়া আর রাদিব এখনো ওদের খেয়াল করেনি। ওরা ওদের মতোই মাস্তি করে যাচ্ছে। 

     

    একসময় হঠাৎ মায়া কার্পেটের সাথে পা বেজে পড়ে যেতে নেয়।ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় সে। তবে মায়া নিচে পরে না। সে পড়ে যাওয়ার আগেই কেউ তাকে ধরে ফেলে। আর মায়াও পড়া থেকে বাঁচতে সামনের ব্যাক্তির কাঁধ আঁকড়ে ধরে। আর যেমনটা আমরা সবাই জানি। সেই ব্যাক্তি আর কেউ নয় বরং আমাদের অরণ্য বাবু।

     

    মায়া যখন পা বেজে পড়ে যেতে নেয় তখন সামনে অরণ্য ছিল। আর মায়া অরণ্যের ওপর গিয়েই পরে। আর আকস্মিক ঘটনায় অরণ্যও কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই মায়াকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে ওর পেটের নিচে হাত রেখে ওকে ধরে। মায়ার মুখটা অরণ্যের কাঁধের নিচে ঝুঁকে পড়ে। আর ওর খোলা চুলগুলো সব মুখের ওপর এসে পড়ে। মায়া যখন বুঝতে পারলো ও পরেনি, তখন ও চোখ খুলে তাকালো। মাথাটা একটু উঁচু করে অরণ্যের দিকে তাকালো। 

     

    আর এতেই অরণ্যের সর্বনাশের সূচনা হয়ে গেল। মায়ার এলোমেলো চুলের ফাঁকে ওর মায়াবী চোখ দুটোর দিকে তাকাতেই ওর বুকের ভেতর তুমুল বেগে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। বেড়ে গেল হৃদয়ের স্পন্দন।  আর মায়া কতক্ষণ তাকিয়ে আগে মনে করার চেষ্টা করলো লোকটা কে। আর যখনই ওর মন ওকে জানান দিল যে এটা ওর সেই নামমাত্র স্বামী। তখনই মায়ার পুরো শরীর যেন বরফের মতো ফ্রীজড হয়ে গেল। অদ্ভুত কম্পন শুরু হয়ে গেল হৃদপিণ্ডে। দুজন দুজনের চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । 

     

    চলবে…….

     

    #মায়ারণ্য

    #লেখিকা-মেহরুমা নূর

    #পর্ব-৪

     

    ★রিয়ার মা ভেতরে ঢুকে অরণ্য আর মায়াকে এই অবস্থায় দেখে রাগে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। দাঁতে দাঁত চেপে মায়ার নাম ধরে ডাক দিয়ে বললো। 

    –মায়া, কি হচ্ছে কি এখানে?  

     

    শিউলি বেগমের কথায় দুজনের ঘোর কাটলো। মায়া এক ঝটকায় অরণ্যকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে কাঁপা কন্ঠে বললো। 

    –স সসরি। 

    কথাটা কোনরকমে বলেই মায়া ওখান থেকে দৌড়ে চলে গেল। অরণ্য মায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। 

     

    রিয়া অরণ্যের কাছে এগিয়ে এসে বললো। 

    –চলুন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।

     

    অরণ্য হালকা মাথা ঝাকিয়ে রিয়ার পিছে পিছে গেল। রিয়ার মা সারা আর রাইসাকেও একটা রুমে নিয়ে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। 

     

    মায়া নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। আর কিছুক্ষণ ওখানে থাকলে বোধহয় নিঃশ্বাসই বন্ধ হয়ে যেত ওর। কিন্তু ওই লোকটা কাছে আসতেই এমন লাগলো কেন আমার? বুকের ভেতর এমন তুফান কেন শুরু হয়েছিল আমার?উনাকে তো আমি আগে কখনো দেখিই নি। তাহলে উনাকে আপন লাগলো কেন আমার? লোকে বলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি এক অলৌকিক পবিত্র বন্ধন হয়। তাহলে কি সেই জন্য আমার এমন অনুভূতি হচ্ছে?  না না এসব কি ভাবছি আমি। এসব ভাবা ঠিক না। ওসব শুধুই ভুল ছিল। সে এখন শুধু রিয়ার স্বামী। কিছুদিনের ভেতর হয়তো সত্যিকারের স্বামীও হয়ে যাবে। তাই ওসব মিথ্যে মোহে নিজেকে ডোবানো যাবেনা। আমাদের রাস্তা আলাদা আলাদা। 

     

    হঠাৎ দরজায় টোকা পড়তেই ভাবনায় ছেদ পড়লো মায়ার। মায়া দরজা খুলে দেখলো ওর মামী অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া দরজা খুলতেই সে হনহন করে ভেতরে ঢুকে মায়ার হাত চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললো। 

    –কি করতে চাইছিলি তুই তখন হ্যাঁ? ছেলে দেখেই লাল টপকানো শুরু করে দিয়েছিস? নাকি ওই বিয়েটাকে সত্যি মেনে বসে আছিস তুই?  তাই অরণ্যের বউ হওয়ার শখ জেগেছে তোর? নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেছিস তুই? 

     

    মায়া দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ব্যাথাটাকে হজম করে নিয়ে বললো।

    –আমি কিছুই ভুলিনি মামী। তোমরা চিন্তা করোনা আমি কিছুই করবোনা। আমার জায়গা আমি ভালো করেই জানি। আর তখনও ওটা ভুলে হয়ে গিয়েছিল। আমি ইচ্ছে করে করিনি।

     

    শিউলি বেগম এবার মায়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন।

    –ঠিক আছে এবারের মতো ছেড়ে দিলাম তোকে। এরপর থেকে যেন এমন ভুল আর না হয়। আর একটা শোন। রিয়ার দুজন ননদ এসেছে। বাসায় আর রুম খালি নেই তাই আজ রাতে ওরা এই রুমেই থাকবে। ওদের খাটে দিয়ে তুই নিচে বিছানা পেরে ঘুমাস। 

     

    মায়া মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। তারপর শিউলি বেগম চলে গেলেন  

     

    অরণ্য বেডের ওপর দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে বসে আছে। হঠাৎ কেমন যেন অস্থির লাগছে ওর। ও বুঝতে পারছে না, তখন ওই মেয়েটাকে দেখে ওর এমন লাগলো কেন? কেন মনে হলো মেয়েটা খুব কাছের কেউ? বিষেশ করে ওর চোখ দুটো। ওই চোখে কিছু একটা আছে। যা আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। কিন্তু কেন হচ্ছে এমন? মেয়েটাকে তো আমি চিনিও না। 

     

    রিয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের গহনা খুলছিল। অরণ্য সেদিকে আরচোখে তাকিয়ে ইতস্ততভাবে বললো। 

    –আচ্ছা ওই মেয়েটা কে? 

     

    রিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো। 

    –কোন মেয়েটা?

     

    –আরে বাইরে যে মাত্রই দেখলাম ওই মেয়েটা। না মানে আমিতো জানি তোমার আর কোন বোন নেই। তাহলে উনি কে?

     

    –আরে ও আমার বোন হতে যাবে কেন? ওতো এবাড়ির আশ্রিতা। 

     

    –মানে?

     

    –মানে ও আমার ফুপির মেয়ে। ওর মা বাবা  ছোটবেলায় মারা গেছে। তখন থেকেই আমাদের বাড়িতেই পড়ে আছে আশ্রিতা হয়ে। 

     

    রিয়ার কথাবার্তা মোটেও পছন্দ হলোনা অরণ্যের। নিজের ফুফাতো বোনকে এভাবে আশ্রিতা বলতে পারে কেউ। রিয়ার মনমানসিকতা এতো নিচু কিভাবে হতে পারে। যে মেয়ে রাস্তার অসহায় মানুষের প্রতি এতো সহানুভূতি দেখায় সেই মেয়ে নিজের ফুফাতো বোনকে নিয়ে এমন মন্তব্য কিভাবে করে? রিয়াকে যত দেখছে ততই যেন অরণ্যের মনের ভেতর সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে। তাহলে কি আমি কোন ভুল করলাম? অরণ্যের অস্থিরতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না ওর।

     

    সারা আর রাইসা মায়ার রুমের বেডে বসে আছে। মায়া ওদের জন্য সুন্দর করে বিছানা করে দিয়েছে। এতক্ষণে মায়ার সাথে পরিচয় হয়ে গেছে ওদের। রাইসা সেই কখন থেকে ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফোনে লেগে আছে। সারার কান পেকে যাচ্ছে ওদের কথা শুনে। এতো কথা কেও কিভাবে বলতে পারে? কান পঁচে যায় না এদের? বেচারা জিজু মনে হয় বিয়ের আগেই বয়রা হয়ে যাবে। সারা সামনে তাকিয়ে দেখলো মায়া আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। সারা মায়ার কাছে গিয়ে ওর কিছু চুল হাতে নিয়ে বললো। 

    –ওয়াও মায়া আপু তোমার চুল কত্তো লম্বা। আর অনেক সুন্দরও। এতো সুন্দর চুল কিভাবে বানিয়েছ তুমি? 

     

    মায়া মুচকি হেসে বললো। 

    –আরে আমি কিছুই করিনি। এটাতো এমনি এমনি এতো বড়ো হয়ে গেছে। আর তুমি সুন্দর বলছ এটা তো আমার কাছে একটা ভেজাল। এগুলো সামলাতে অনেক বিরক্ত হয়ে যায় আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় কেটে ফেলি।

     

    –হায়য় আপু কি বলছ এসব? এতো সুন্দর চুল তুমি কেটে ফেলবে? তাহলে আমাকে দিয়ে দিও কেমন?  এতো সুন্দর চুল আমার হলে কতো সুন্দর লাগবে আমাকে। 

     

    মায়া হালকা হেঁসে বললো।

    –আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তুমিতো এমনিতেই অনেক সুন্দর। একদম পরীদের মতো। 

     

    –ধ্যাৎ কিযে বলোনা। আমি আর সুন্দর? ওতো আমার ফরেনার মায়ের জন্য একটু ফর্সা রঙ পেয়েছি। তাছাড়া আর কিছুই না। দেখনা কত্তো মোটা মোটা চশমা পড়তে হয়। একদম মুরুব্বি মুরুব্বি লাগে। স্কুলের সবাই শুধু খেপায় আমাকে।

     

    মায়া সারার গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বললো। 

    –কে বললো তোমাকে? আরে তুমিতো এত্তো কিউট। কেও তোমার মায়ায় পড়লে আর নিজেকে ছাড়াতে পারবে না। 

     

    –অওওওও আপু তুমিও অনেক কিউট। একদম কিউটের ডিব্বা।

    কথাটা বলে সারা মায়ার গাল টেনে দিল।

     

    সারার কথায় মায়া হেঁসে দিয়ে বললো। 

    –আচ্ছা তুমি কোন ক্লাসে পড়ো। 

     

    –আমি ক্লাস টেনে। 

     

    –আচ্ছা এসো আমি তোমার চুলে বিনুনি করে দেই। তাহলে ঘুমুতে সুবিধা হবে। 

     

    সারা খুশি হয়ে বললো।

    –হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই করে দাও। তাহলে আমার চুলও তোমার মতো লম্বা হয়ে যাবে।

     

    মায়া সারার চুলে বিনুনি করে দিতে লাগলো। অল্প সময়েই দুজনের খুব ভাব হয়ে গেল। মেয়েটাকে অনেক ভালো লেগেছে মায়ার। কতো মিশুক মেয়েটা৷ এতো ধনী হয়েও কোন অহংকার নেই ওদের ভেতর। এখানে নিজের মামাতো বোনই কখনো ওর সাথে এভাবে কথা বলেনি। অথচ এরা কতো সুন্দর মিশে গেছে ওর সাথে। মায়া মুচকি হেসে সারাকে বললো।

    –আচ্ছা সারা,রাইসার আপুর কি বাচ্চা আছে?  না মানে কখন থেকে বেবি বেবি করছে। মনে হচ্ছে ওনার বাচ্চার সাথে কথা বলছে। 

     

    মায়ার কথা শুনে সারা হঠাৎ উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। সারাকে হাসতে দেখে মায়া একটু থতমত খেয়ে গেল। সারার হাসির শব্দ শুনে রাইসা ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো। 

    –এই গাধী, এভাবে ছাগলের মতো হাসছিস কেন? আমরা যে আত্মীয়র বাড়িতে আছি সে খেয়াল আছে তোর?

     

    সারা কোনরকমে হাসি থামিয়ে বললো। 

    –আরে আপু তুমি আগে মায়া আপুর কথা শোন।তারপরে দেখ তুমিও হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাবে।

     

    –আচ্ছা কি এমন কথা শুনি?

     

    সারা রাইসাকে মায়ার বলা কথাটা বললো। রাইসাও শুনে হাসতে শুরু করে দিল। মায়া এদের এতো হাসার কারণ কিছুই বুঝতে পারছে না। সারা তখন মায়াকে সবটা খুলে বললো। তখন মায়াও ওদের সাথে হেঁসে দিল। অল্প সময়ের মাঝেই ওদের মাঝে খুব ভাব হয়ে গেল। মায়াকে ওদের দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা ওর নামের মতোই অনেক মায়াবী। মায়া যখন নিচে শুতে চাইলো তখন সারা আর রাইসা ওকে কিছুতেই নিচে শুতে দিলনা। দুজন টেনে ওকে নিজেদের কাছে বিছানার উপর নিয়ে এলো। তারপর তিনজন মিলে নানান গল্প করতে লাগলো। 

     

    রাত ১২টা

    অরণ্য বেডের এক কোণা ঘেঁষে বসে আছে। পাশেই রিয়া বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। অরণ্যের প্রচুর অস্বস্তি লাগছে। মেয়েটার সাথে এক ঘরে থাকতে কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে ওর। কিন্তু এমনটা হওয়ার কারণ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না ও। রিয়া তো ওর বউ। ওতো নিজেই ওকে পছন্দ করে বিয়ে করলো।তাহলে এমন লাগছে কেন ওর? নাহ আর ভাবতে পারছে না ও

    ।মাথাটা কেমন হ্যাং হয়ে আসছে ওর। একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে পারলে ভালো হতো। সাথে কফি হলেও ভালো হতো। কিন্তু এখানে কোথায় পাবে কফি। আর এতরাতে কাকেই বা বলবে।

     

    তবুও অরণ্য একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো। রুমে ওর দমবন্ধ হয়ে আসছিল। অরণ্য ফ্রেশ হাওয়া নিতে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। ছাঁদের সিঁড়ির কাছে আসতেই হঠাৎ একটা মিষ্টি সুর কানে ভেষে আসলো অরণ্যের। এতরাতে কারও গানের সুর শুনে অরণ্য একটু অবাক হলো। তবে গানের সুরটা খুবই মধুর। অরণ্য সুরের উৎস খুঁজতে ধীরে ধীরে ছাঁদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ছাঁদের দরজায় আসতেই সুরটা আরও স্পষ্ট হয়ে এলো। 

     

    আদিত্য সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা এলোকেশী কন্যা ছাদের ব্রেঞ্চের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে নিজের মনে গান গাইছে। 

     

    ♬ না জানি কোন অপরাধে দিলা এমন জীবন 

    ♬আমারে পুড়াইতে তোমার এতো আয়োজন 

    ♬ আমারে ডুবাইতে তোমার এতো আয়োজন 

     

    ♬ সুখে থাকার স্বপ্ন দিলা,সুখতো দিলা না

    ♬ কতো সুখে আছি বেঁচে খবর নিলা না আআ

    ♬ বিধি খবর নিলা না আ আ…

    ♬আমি ছাড়া কেউ নাই আমার দুখের পরিজন 

    ♬ আমারে পুড়াইতে তোমার এতো আয়োজন 

    ♬ আমারে ডুবাইতে তোমার এতো আয়োজন 

     

    অরণ্য যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে এই সুরে। মেয়েটার দীঘল কালো চুল বাতাসে ঢেউ খেলছে। মনে হচ্ছে এই কালো চুল গুলোই যেন রাতের আকাশকে আরও ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে।জোছনা ভরা চাঁদের আলোয় মেয়েটাকে যেন অলৌকিক কিছু মনে হচ্ছে। অরণ্যের কেমন যেন ঘোর লেগে আসছে। অরণ্য আনমনেই মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। 

     

    নিজের পেছনে কারোর পায়ের শব্দ শুনে চমকে গেল মায়া। সাথে সাথে গান বন্ধ করে পেছনে ফিরে তাকালো মায়া। অরণ্যকে এখানে দেখে আবারও বুকের ভেতর কেঁপে উঠল মায়ার। অরণ্যও তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। এবার ওর চেহারাটা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। এটা যে তখনকার সেই মেয়েটা তা চিনতে দেরি হলোনা অরণ্যের। মায়া উঠে দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিল। মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো। 

    –আ আপনি এখানে? 

     

    মায়ার কথায় অরণ্যের ঘোর কাটলো। অরণ্য একটু নড়েচড়ে উঠে বললো। 

    –এই এমনি। একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে এসেছিলাম। 

     

    মায়া আর কিছু না বলে মাথা নিচু করা অবস্থায়ই ওখান থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোত হতেই অরণ্য বলে উঠলো। 

    –কি ব্যাপার আপনি সবসময় এভাবে পালিয়ে যান কেন? আমি কি দেখতেই এতটাই ভয়ানক নাকি যে আমাকে দেখেই ভয়ে পালান? নিজেকে তো আমার বাঘ ভাল্লুক টাইপ মনে হচ্ছে। 

     

    অরণ্যের কথায় মায়া হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো। 

    –বাঘ ভাল্লুক তো শুধু শুধু বদনাম হয়েছে। আসল ভয়ংকর প্রাণী তো মানুষই হয়। মানুষের চেয়ে ভয়ংকর পৃথিবীতে কিছুই নেই। 

     

    অরণ্য মুচকি হেসে বললো। 

    –হুমম পয়েন্ট আছে।তাহলে আমাকে দেখে এভাবে পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? 

     

    –পালানোর কি আছে?  আমিতো শুধু আপনাকে স্পেস দিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনি এখানে এসেছেন ফ্রেশ হাওয়া নিতে। আর আমি থাকলে আপনি ডিস্টার্ব হতে পারেন। তাই চলে যাচ্ছিলাম। 

     

    –আরে তেমন কিছুই না। আমার তো বরং আপনার গান শুনতে অনেক ভালোই লাগছিল। সরি বিনা অনুমতিতে আপনার গান শুনে ফেলেছি। আসলে আমি এদিকেই আসছিলাম হঠাৎ আপনার গান শুনতে পেলাম। তাই চলে আসলাম। সরি আপনাকে হয়তো আমি ডিস্টার্ব করে ফেললাম। 

     

    –আরে না না সরি বলার কি আছে? এটা আপনার শশুর বাড়ি। আপনি যেখানে খুশী সেখানে যেতেই পারেন। তা এতো রাতে আপনি বের হয়েছেন কেন? মানে কোন কিছুর দরকার ছিল আপনার? 

     

    অরণ্য ইতস্ততভাবে বললো।

    –হ্যাঁ একটু তো দরকার ছিল। আসলে একটু কফির দরকার ছিল। তবে এতরাতে আর কাকে বলবো? তাই এমনিই হাঁটছিলাম। 

     

    –ঠিক আছে আমি আপনার জন্য কফি করে আনছি।

    কথাটা বলে মায়া চলে গেল কফি বানাতে। আর অরণ্য ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার সাথে কথা বলে কেমন যেন অনেক ভালো লাগছে ওর। এতক্ষণের দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেছে একদম। মেয়েটার সাথে আরও কথা বলার ইচ্ছে জাগছে ওর। কেন হচ্ছে এমন তা বুঝতে পারছে না ও।

     

    একটু পরেই মায়া ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ নিয়ে হাতে নিয়ে ছাঁদে এলো। অরণ্য এতক্ষণে ব্রেঞ্চের ওপর বসে পড়েছে। মায়া অরণ্যের সামনে এসে কফির মগটা অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিল। অরণ্য মুচকি হেসে মগটা হাতে নিয়ে বললো। 

    –থ্যাংক ইউ সো মাচ। 

     

    মায়া সৌজন্যমূলক স্মিথ হেঁসে আবারও চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই অরণ্য বলে উঠলো। 

    –আরে কি হলো আবারও চলে যাচ্ছেন কেন? একটু বসুন না। অন্তত আমার কফিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকুন। একটু কথা বলি আমরা।

     

    অরণ্য ব্রেঞ্চের একপাশে সরে বসে মায়াকে বসতে ইশারা করলো। মায়ার কেমন বুকের ভেতর কাঁপছে। দ্বিধায় পড়ে গেল মায়া। ও এই লোকটার কাছ থেকে যতটা পারে দূরে থাকতে চাচ্ছে। কারণ সে কোন মিথ্যে মায়ায় নিজেকে জড়াতে চায়না। তাহলে আবারও মনে নতুন আশার জন্ম হবে। যা হয়তো কখনোই পূরণ হবে না।তার ওপর মামী জানতে পারলে এই নিয়ে আরও অশান্তি করবে।  কিন্তু এনাকে তো আর সেটা বলা যাচ্ছে না। তাই অগত্যা অরণ্যের কথায় ব্রেঞ্চের একপাশে গিয়ে বসলো।

     

    অরণ্য বলে উঠলো। 

    –আচ্ছা আমি কি তুমি করে বলতে পারি আপনাকে? না মানে আপনিতো আমাদের বয়সে ছোটই হবেন। আর আমাদের সম্পর্কে টাও তো সেরকমই তাইনা? 

     

    সম্পর্কের কথা শুনে চমকে উঠলো মায়া। অরন্যের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো। 

    –স সম্পর্ক মানে?

     

    –হ্যাঁ সম্পর্ক। কেন তুমি জানো না আমাদের কি সম্পর্ক? 

     

    মায়া ভয়ে শুকনো ঢোক গিলছে। তাহলে কি উনি সব জেনে গেছে?  অরণ্য তখন বলে উঠলো। 

    –আরে আমি শালিকা আর দুলাভাইয়ের কথা বলছি। আমাদের তো সেই সম্পর্কই তাইনা?

     

    মায়া মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে  একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।তবে অরণ্যের বলা শালি দুলাভাইয়ের কথাটা কেমন কাঁটার মতো লাগলো ওর কাছে। জীবনে এমন একটা সিচুয়েশন আসবে তা কখনো ভাবেনি মায়া। জীবন কেমন খেলা খেলছে ওর সাথে। মায়ার ভাবনার মাঝেই অরণ্য বললো। 

    –তাই তোমার সমস্যা না হলে,,,

     

    অরণ্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই মায়া বলে উঠলো। 

    –হ্যাঁ বলতে পারেন। কোন সমস্যা নেই। 

     

    অরণ্য মুচকি হেসে বললো। 

    — ধন্যবাদ। তো এতরাতে ছাঁদে একা একা বসে আছ ভয় লাগেনা তোমার? নাকি একা থাকতে পছন্দ করো?

     

    মায়া সামনের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে আনমনেই বলে উঠলো। 

    –একা থাকাটা সবসময় নিজের পছন্দ না বরং প্রয়োজন হয়ে যায়। কারোর কারোর হয়তো  একাকিত্বই একমাত্র সাথী। আর নিজের একমাত্র সাথীকে তো আর কেউ একা ছাড়তে পারেনা তাইনা? আর ভয়ের কথা বলছেন? রাতকে আবার ভয়ের কি আছে? আমার কাছে তো রাতটাই একমাত্র আপন মনে হয়। রাতের অন্ধকারের বুকে মাথা রেখে মানুষ নিজের সব সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, মনের সব না বলা অনূভুতিগুলো ব্যাক্ত করতে পারে। আর এই বিশাল রাত তার গহিনে আমাদের সবকিছুই সযত্নে রেখে দেয়। কখনো কাওকে কিছু বলে না।

     

    অরণ্য মুগ্ধ হয়ে মায়ার কথাগুলো শুনছে। সত্যিই কত গভীর ভাবে কথাগুলো বললো মেয়েটা। এমনভাবে হয়তো আমরা কখনো ভেবেই দেখেনি। তবে ওর কথায় অরণ্য বুঝতে পারলো যে মেয়েটার মাঝে অনেক কষ্ট জমে আছে। রিয়া বলেছিল মায়ার মা বাবা মারা গেছে। তাই হয়তো মেয়েটার এতো কষ্ট। পৃথিবীতে মা বাবার না থাকার মতো কষ্ট আর কিসে থাকতে পারে। কথাটা ভেবে অরণ্য বলে উঠলো। 

    –আমি তোমার মা বাবার কথা শুনলাম।অ্যাম সরি ফর ইউর লস। 

     

    মায়া একইভাবে থেকেই বলে উঠলো। 

    –আপনি কেন সরি বলছেন? আপনার জন্য কি আর তারা মরেছে। এই ইংরেজ রাও ভালো একটা শব্দ তৈরি করেছে। “সরি”। বাচ যাইহোক সরি বলে দিলেই শেষ। তাইতো লোক কথায় কথায় সরি বলে দেয়।

     

    মায়ার কথায় অরণ্য হেঁসে দিল। মায়া এবার সরাসরি অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্যের হাস্যোজ্জ্বল মুখটায় চোখ আটকে গেল ওর। কত সুন্দর উনার হাসি। লোকটাও খুব সুন্দর। রিয়া ঠিকই বলে উনার মতো এতো সুন্দর লোক আমার মতো কুৎসিত মেয়েকে কখনোই স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে না। কথাটা ভেবে মায়া সাথে সাথে মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। এসব ভাবাও অনর্থক। 

     

    অরণ্য তখন বলে উঠলো। 

    –তুমি সত্যিই অনেক সুন্দর করে কথা বলো।

     

    অরণ্যের কথায় মায়ার খেয়াল হলো। ও নিজেও অনেক টা অবাক হলো। ও কখনো কোন ছেলের সাথে এতো কথা বলেনি। তাহলে আজ ওনাকে এতো কথা কিভাবে বলে দিলাম? কেমন নির্দ্বিধায় এতো কথা বলে দিল। যেন অতি আপন কারোর সাথে কথা বলছে। মায়ার ভাবনার মাঝেই অরণ্য আবার বলে উঠলো। 

    –বায়দা ওয়ে কফিটা কিন্তু অনেক ভালো ছিল। থ্যাংক ইউ। 

     

    মায়া সৌজন্যমূলক হাসি দিল। এভাবে আরও নানান কথা বলতে লাগলো ওরা। অরণ্য যেন সময়ের সাথে আরও মুগ্ধতায় জড়িয়ে পড়ছে। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত প্রশান্তির বাতাস বইছে। চোরা চোখে শুধু মায়াকেই দেখে যাচ্ছে। মেয়েটার চেহারায় কেমন অদ্ভুত এক মায়া আছে। তারওপর  চাঁদের আলোয় মেয়েটাকে আরও বেশি মায়াবী লাগছে। মাথায় ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখলেও সামনের কিছু চুল বাইরে এসে বাতাসে কপালের ওপর উড়ছ। অরণ্যের খুব বলতে ইচ্ছে করছে ওড়নাটা সরিয়ে চুলগুলোকে মুক্ত করে দিতে। মায়াকে দেখতে দেখতে অরণ্যের হঠাৎই মনে হলো মায়ার চেহারা টা ওর সেই কল্পকন্যার সাথে কেমন মিলে যাচ্ছে। 

     

    কথাটা মনে আসতেই চমকে গেল অরণ্য। কি ভাবছে ও এসব? এমন একটা উদ্ভট কথা মাথায় কিভাবে এলো ওর? আমিতো আমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করেছি। তাহলে এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? না না এটা ঠিক না। এসব অনুচিত চিন্তা ভাবনা মাথায় আনা একদম ঠিক না। অরণ্যের ভাবনার মাঝেই মায়া বলে উঠলো।

    –অনেক রাত হয়েছে। আমার এখন যাওয়া উচিত। সকালে আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে। 

     

    অরণ্য মাথা হালকা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো। মায়া উঠে চলে যেতে লাগলো। কিছুদূর যেতেই অরণ্য আবার পেছন থেকে ডাক দিল। মায়া পিছনে তাকাতেই অরণ্য বলে উঠলো। 

    –গুড নাইট।

     

    মায়াও সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো। 

    –গুড নাইট। 

     

    মায়া চলে গেল। তবে পেছনে রেখে গেল অরণ্যের মাঝে অশান্তির ঢেউ। এতক্ষণ শান্তি পেলেও মায়া চলে যেতেই আবারও মনটা অশান্ত হয়ে উঠলো। মায়ার সাথে সময় কাটিয়ে ওর মনের এলোমেলো ভাবনা গুলো আরও যেন গুলিয়ে গেল। কি হচ্ছে ওর সাথে কিছুই বুঝতে পারছে না অরণ্য। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। মনের মাঝে এতো প্রশ্নের উৎপত্তি হচ্ছে কেন? আমি কি কোথাও কিছু ভুল করলাম?

     

    চলবে…..

     

    #মায়ারণ্যে

    #লেখিকা-মেহরুমা নূর

    #পর্ব-৫

     

    ★ সকালের ঝলমলে রোদটা চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে এলো অরণ্যের। কপাল কুঁচকে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো ও এখনো ছাঁদেই আছে। রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। রুমে ওর যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই এখানেই বসে থাকতে থাকতে একসময় হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। 

     

    হঠাৎ কিছু পানির ছিটা এসে লাগলো অরণ্যের মুখে। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকালো। আর তাকাতেই ওর আঁখি যুগল আটকে গেল। সামনে মায়া বালতী থেকে ধোয়া কাপড়চোপড় নেড়ে দিচ্ছে। ভেজা কাপড় গুলো ঝাড়ি দিয়ে নাড়ছে। সেই কাপড়ের পানির ছিটাই লেগেছে অরণ্যের মুখে। পানির ছিটা মায়ার মুখেও লাগছে। পানির ছিটা মায়ার মুখে বিন্দুর কণা হয়ে জমে আছে। সামনের চুলগুলোও ভিজে উঠেছে পানির ছিটাই।অসম্ভব স্নিগ্ধ আর মায়াবী লাগছে মেয়েটিকে। যেন কোন সদ্য ফোটা ফুলের ওপর ভোরের শিশির কণা জমে আছে। সকাল সকাল এমন দৃশ্য দেখে ঘোর লেগে যাচ্ছে অরণ্যের। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। বুকের মাঝে আবারও সেই অজানা অনুভূতির মেলা জমছে। 

     

    হঠাৎই অরণ্য মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। কি হচ্ছে এসব আমার সাথে?  কি করছি আমি এসব? অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে এসব অনুচিত ভাবনা মনে আসে কিভাবে?  না না এসব ঠিক না। একদম ঠিক না।

     

    মায়া এতক্ষণেও অরণ্য কে খেয়াল করেনি।ও ওর মতো কাজ করে যাচ্ছে। কাপড়চোপড় নেড়ে দেওয়া শেষে মায়া চলে যেতে নিলে তখনই অরণ্যেকে দেখতে পেল। এই সময় অরণ্যকে এখানে দক মায়া অনেক টা অবাক হলো। উনি এখানে কি করছেন?  উনি কি এখানেই ছিলেন রাতে? মায়া অরণ্যের দিকে এগিয়ে যেতে নিয়েও আবার গেলনা। উনার থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো। কথাটা ভেবে মায়া আবারও বালতী নিয়ে চলে গেল। 

     

    মায়া ট্রেতে করে দুই কাপ গরম চা নিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো। ট্রে টা টেবিলে রেখে বেডের কাছে এগিয়ে গেল। সারা আর রাইসা এখনো ঘুমে কাদা। মেয়েগুলো সত্যিই ভারি মিষ্টি। কতো রাত পর্যন্ত ওর সাথে গল্প করলো। যেন নিজের বোনের মতো। মায়া মুচকি হেসে সারা আর রাইসাকে ডাক দিল। কতক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করে ওরা দুজন উঠে বসলো। মায়া ওদের বেড টি এনে দিলে ওরা হাসিমুখে বললো। 

    –ওয়াও আপু তুমি কত্তো মিষ্টি। সকাল সকাল আমাদের ওঠার আগেই বেড টি নিয়ে এসেছ। তোমাকে এত্তো গুলো থ্যাংক ইউ। 

     

    মায়া মুচকি হেসে বললো। 

    –ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। এখন বলো তোমরা নাস্তায় কি খাবে? আমি এখুনি তোমাদের নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি। 

     

    রাইসা বলে উঠলো। 

    –আরে আপু তোমার এতো কষ্ট করতে হবে না। একটা কিছু হলেই হবে।

     

    মায়া বলে উঠলো। 

    –বললেই হলো নাকি। তোমরা আমাদের মেহমান। এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছ আর একটু মেহমান নওয়াজি না করলে কি হয়?

     

    সারা মিছে অভিমান দেখিয়ে বললো। 

    –ওও তারমানে আমরা তোমার শুধুই মেহমান। আমরা তো কোথায় তোমাকে আমাদের বোন ভাবছিলাম। আর তুমিতো এখনো আমাদের মেহমানই ভেবে যাচ্ছো। যাও খেলবই না।

     

    মায়া হালকা হেঁসে সারার দুই গাল টেনে বললো।

    –আলে লে আমার বোনুটা রাগ করেছে বুঝি। আচ্ছা ঠিক আছে। কান ধরছি আর কখনো এই ভুল হবে না  এবার ঠিক আছে তো?

     

    সারা এবার একগাল হেঁসে বললো।

    –হ্যাঁ হ্যাঁ হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক আছে। আর হ্যাঁ তোমার যা ভালো লাগে তাই বানাও। আমরা সবই খেয়ে নেব।

     

    –আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসো। আমি তোমাদের জন্য নাস্তা রেডি করছি।

     

    –ওক্কে আপু।

     

    মায়া মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে।

    ____

     

    অরণ্য ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর পেপার পড়ছে। তবে তার অবাধ্য বেহায়া চোখের দৃষ্টি বারবার শুধু রান্নাঘরে দিকেই যাচ্ছে। রান্না ঘরে মায়া রান্না করছে। সোফা থেকে সরাসরি মায়াকে দেখা যাচ্ছে। মায়া ওড়না কোমড়ে বেঁধে চুলে খোঁপা করে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। দেখতে যেন অনন্যা লাগছে। অরণ্য চেষ্টা করেও নিজের দৃষ্টি সরাতে পারছে না। বারবার ঘুরেফিরে চোখ দুটো শুধু সেদিকেই যাচ্ছে। সামনের কিছু চুল বারবার মায়ার মুখের এসে পড়ছে। আর মায়া বিরক্ত হয়ে সেগুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। অরণ্যের ইচ্ছে করছে নিজের হাতে পরম যত্নে ওই চুলগুলো মায়ার কানের পিঠে গুজে দিতে।

     

    নিজের এমন অবাধ্য ভাবনায় নিজেই চমকে যায় অরণ্য। সাথে সাথে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় সে। কি হচ্ছে আমার সাথে?  কি ভাবছি আমি এসব? এমন অনৈতিক চিন্তা ভাবনা আমার মাথায় কেন আসছে? না না এসব ঠিক না। এটা পাপ। আমি এসব অযাচিত কাজ করতে পারি না। কিছুতেই না। আমাকে যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। নাহলে অনেক খারাপ কিছু হয়ে যাবে।

    ____

     

    ড্রয়িং রুমে তনিমা বেগম আর এলিসা বসে নানান কথা বার্তা বলছে। তখনই ওখানে এক প্রতিবেশী মহিলা এসে হাজির হলো। তাকে দেখে তনিমা বেগম হাসিমুখে বললো। 

    –আরে লাবনী ভাবি কেমন আছেন?

     

    মহিলাটি সোফায় বসতে বসতে বললো। 

    –এইতো ভাবি ভালো আছি। আপনাদের কি অবস্থা? নতুন বউ আসলো। তা কেমন নতুন বউ কেমন? 

     

    –জ্বি ভালোই আছে। 

     

    মহিলাটি একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বললো। 

    –ভালো হলেই ভালো। একটু খেয়াল রাইখেন। আবার যেন মেয়ের মতো হয়না। এখনকার ছেলেমেয়েদের তো কোনো ভরসা নেই। কখন কি হয়ে যায় কে যানে।

     

    মহিলার খোঁচা মারা কথায় তনিমা বেগমের মুখটা ছোট হয়ে গেল। মেয়েটার জন্য তাকে কতজনের কত কথাই না শুনতে হয়। এলিসা বেগম তখন কথা ঘোরানোর জন্য বলে উঠলো। 

    –আরে ভাবি এসব ছাড়ুন। আপনি পাদ (ভাত) খেয়ে যান। আজ আমাদের সাথে ইদুর (ইলিশ) দিয়ে পাদ খেয়ে যান। অনেক গাঁজা (মজা) হয়েছে। 

     

    এলিসার খাবারের বর্ননা শুনে মহিলাটির বমি হওয়ার উপক্রম। তনিমা বেগম তখন বলে উঠলো। 

    –আরে ভাবি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আসলে ও বাংলা ঠিকমতো বলতে পারেনা তো তাই ভুলভাল বলে ফেলে।

     

    মহিলাটি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো। 

    –আচ্ছা যাইহোক আমি যে কথা বলতে এসেছিলাম তাই বলি। আপনারা তো জানেনই আমার আবার সবার ভালো করার অভ্যাস। তাই আজও আপনাদের একটা ভালো কাজ করতেই এসেছি। আসলে ইরিনের জন্য আমার হাতে একটা ভালো ছেলে আছে। আপনারা বললে কথা বলতে পারি। 

     

    তনিমা বেগম একটু খুশি হয়ে বললেন। 

    –তাই নাকি?  তা ছেলে কোথাকার?  আর কি করে?

     

    –ছেলে সব দিক দিয়েই সেরা। সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার। নিজের বাড়ি গাড়ি সবই আছে। দেখতেও মাশাল্লাহ। শুধু হালকা একটু সমস্যা আছে। 

     

    তনিমা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন।

    –কি সমস্যা? 

     

    –ছেলেটার আগে বিয়ে হয়েছিল। সেই ঘরের দুটো ছেলে মেয়ে আছে। ব্যাস এতটুকুই। এটুকু তো মানিয়ে নিতেই হবে। আফটার অল আপনাদের মেয়েরও ডিফেক্ট আছে তাইনা? ওমন মেয়ের জন্য তো আর কোন অবিবাহিত তরুণ ছেলে পাবেন না তাইনা?

     

    মহিলাটির কথায় এলিসা বেগম রাগে কিড়মিড় করছে। তনিমা বেগমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। তিনি অসহায় কন্ঠে বললেন।

    –তাই বলে দুই বাচ্চার বাবার সাথে বিয়ে দেব? মা হয়ে এটা কিভাবে করতে পারি বলুন?

     

    –আরে দুই বাচ্চা হয়েছে তো কি হয়েছে? ছেলে মানুষের আবার বয়স দেখে নাকি কেও?  আরে আপনার সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়ের জন্য এমন একটা ছেলে পাচ্ছেন এটাই তো আপনাদের সৌভাগ্যের ব্যাপার। 

     

    –তাহলে সেই সৌভাগ্য টা আপনি কেন লুফে নিচ্ছেন না?

     

    সবাই সামনে তাকিয়ে দেখলো ইহান দাঁড়িয়ে আছে। ইহান সামনে এগিয়ে আসতে আসতে বললো। 

    –হ্যাঁ আন্টি ব্যাপার টা যদি এতোই সৌভাগ্যের, তাহলে আপনি কেন সেই মহামূল্যবান সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হবেন। আপনি নিজেই সেটা লুফে নিন। আপনারও তো মেয়ে আছে তাইনা?

     

    ইহানের কথায় মহিলাটি ঝাঝালো কন্ঠে বললো। –কি আবোল তাবোল বলছ তুমি? আমার মেয়ের সাথে ইরিনের তুলনা করছ তুমি? 

     

    ইহান বাকা হেসে বললো। 

    –না না আন্টি কিযে বলেন না,ইরাবতীর সাথে কি আর আপনার মেয়ের তুলনা হয়? কোথায় চুপচাপ গাইয়ের মতো থাকা ইরাবতী। আর কোথায় আপনার আল্ট্রামডার্ন মেয়ে। বায়দা ওয়ে আপনার মেয়ের যে এতগুলো বডিগার্ড আছে তা আমি জানতামই না। 

     

    মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে বললো। 

    –বডিগার্ড? 

     

    –হ্যাঁ বডিগার্ড। সবসময়ই দেখি আপনার মেয়ের বডির সাথে তিন চারজন ঘেঁষে থাকে। তাই ভাবলাম বডিগার্ড হবে হয়তো।যাই বলুন আন্টি বডিগার্ড গুলো কিন্তু অনেক কেয়ারিং। সেদিন তো পাবে নেশায় ধুত আপনার মেয়েকে কি সুন্দর কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিল। আজকাল এমন কেয়ার কে করে বলুন।

     

    ইহানের তীর মারা কথায় মহিলাটি ক্ষেপে গিয়ে বললেন। 

    –ব্যাস ব্যাস অনেক হয়েছে। কোথায় আমি আপনাদের ভালোর কথা ভাবছিলাম। আর আপনারা কিনা উল্টো আমাকেই অপমান করছেন? আরে আপনার ওই মেয়েকে কোন বুড়োও বিয়ে করবে না। হুহ ভালোর কাল নেই। 

     

    ইহান রাগে চোয়াল শক্ত করে আরও কিছু বলতে গেলেই তনিমা বেগম ওকে চোখের ইশারায় মানা করলো।

    আর কথাগুলো বলতে বলতে মহিলাটি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ওখান থেকে।

     

    ইরিন সিড়ির ওপর থেকে এতক্ষণ সব কথাই শুনছিল। নিজেকে এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে তুচ্ছ প্রাণী মনে হচ্ছে। যেন ও দুনিয়ার ওপর একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে ওর মা বাবার কথা ভেবে। ওর জন্য আজ ওর পরিবারকে সবার এতো কটু কথা শুনতে হচ্ছে। আজ ওর ভুলের জন্য মা বাবাকে এতো ছোট হতে হচ্ছে। এর থেকে মৃত্যুও হয়তো ভালো ছিল। তবে মরাটাও যে এতো সহজ না। নিজের ইচ্ছায় মৃত্যু গ্রহণ করাটা মহাপাপ না হলে,হয়তো কবেই সে এ কাজটা করে ফেলতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইরিন অশ্রু ভরা চোখে ওখান থেকে চলে গেল। 

     

    ইরিনের সেই করুন দৃশ্য ইহানের চোখ এড়ালো না। ইরিনকে এভাবে দেখলে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে তখন। কেন সে তার ইরাবতীর কষ্ট দূর করতে পারে না?এতো ভালোবেসেও কেন সে তাকে আগলে নিতে পারে না? এই কেনোর উত্তর কখনো কি পাবে সে?

     

    ছাঁদে এসে বিষন্ন মনে বসে আছে ইরিন। একটু পরেই ইহান এলো ওখানে। এসেই এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলো। ইরিন সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো। 

    –কিছু খুঁজছ ইহান? 

     

    –হ্যাঁ একটা দামী জিনিস হারিয়ে গেছে সেটাই খুঁজছি। 

     

    –কি জিনিস? 

     

    ইহান এবার ইরিনের সামনে বসে বললো। 

    –ইরাবতীর হাসিটা। অনেকক্ষণ হলো খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি দেখেছ কোথাও?

     

    ইহানের কথায় ইরিন মলিন হেঁসে বললো।

    –আমি জানি তুমি আমার মুড ঠিক করার জন্য এসব বলছ। তবে এসবের কোনো দরকার নেই। আমি ঠিক আছি। এসব তো আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর তেমন গায়ে লাগে না। তবে তোমার ওই আন্টির সাথে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। উনি অনুচিত তো আর কিছু বলেন নি। আমার মতো মেয়েকে কেই বা বিয়ে করতে চাইবে বলো?

     

    ইহাব ফট করে বলে উঠলো। 

    –আমি করবো। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আজ এক্ষুনি আমি তোমাকে বিয়ে করবো ইরাবতী। 

     

    ইরিন কতক্ষণ ইহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর হঠাৎ হো হো করে হেঁসে উঠলো ইরিন। প্রতিবারের মতোই এবারো ইহানের সত্য টাকে মজা ভেবে হেঁসে উড়িয়ে দিল ইরিন। ইহান সেটা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। যাক মজা ভেবেই হোক তবুও তো হাসি ফুটলো তার মুখে। এটাই বা কম কিসে।

    ________

     

    সকালের নাস্তাটা কোনরকমে করে নিয়ে রুমে এসে অরণ্য তড়িঘড়ি করে রেডি হচ্ছে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে ও সত্যি পাগল হয়ে যাবে। মায়াকে দেখলেই ওর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে প্রস্থান করতে চাইছে। নাহলে যে অযাচিত কিছু হয়ে যাবে। যেটা অরণ্য চাইছে না। 

    অরণ্য রিয়াকে বলেছে সে চাইলে কিছুদিন এখানে থাকতে পারে। তবে রিয়া বলেছে সে আজই অরণ্যের সাথেই যাবে। তাই রিয়া আর অরণ্যের বোনেরা সবাই একসাথেই যাবে।

     

    মায়াও নিজের রুমে এসে রেডি হচ্ছে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। মায়া আলমারি খুলে নতুন বোরখা টা বের করলো। সেদিন হঠাৎই মায়ার মামি ওকে এই নতুন বোরখা টা এনে দিয়ে বললো, এখন থেকে যেন এই বোরখাই পরি। পুরানো বোরখা পরার আর দরকার নেই। মায়া সেদিন প্রচুর অবাক হয়েছিল। আজ পর্যন্ত ওর মামি ওর জন্য কখনও কোন জিনিস আনেনি। আর হঠাৎ করে ওমন নতুন বোরখা দেওয়ায় অবাক হওয়াটাও যেন কম ছিল ওর কাছে। তবে যাইহোক নতুন বোরখা পেয়ে মায়া খুশিই ছিল। আগের বোরখা টা এমনিতেও অনেক পূরানো হয়ে গিয়েছিল। মায়ার টিউশনির টাকা দিয়ে রাস্তার পাশের খোলা দোকান থেকে কিনেছিল বোরখা টা। অনেক বছর হয়ে গেছে। তাই অনেক পুরানো আর রঙটাও নষ্ট হয়ে গেছে। 

    তাই মায়া ওর মামির কথামতো সেদিন থেকে এই নতুন বোরখা টাই পরে। 

     

    মায়া রেডি হচ্ছে, তখনই সারা আর রাইসা এসে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বললো। 

    –আমরা চলে যাচ্ছি আপু। তোমাকে অনেক মিস করবো মায়া আপু।

     

    ওদের জন্য মায়ারও একটু খারাপ লাগছে। মায়া মুচকি হেসে বললো। 

    –আরে মন খারাপ করোনা। তোমাদের যখনই মন চাইবে আমার সাথে দেখা করে যেও কেমন?

     

    সারা বলে উঠলো। 

    –ইশশ আপু তোমাকেও যদি আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারতাম তাহলে অনেক মজা হতো। তুমিও আমাদের সাথে চলনা?

     

    সারার কথায় মায়ার বুকের ভেতর হঠাৎ ধুক করে উঠলো। আজ যদি সব ঠিক থাকতো তাহলে এমনটা হয়তো সত্যি সত্যিই হতো। কথাটা ভেবে বুক চিঁড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মায়ার। ওসব ভাবনাও যে বোকামি। তাই জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।

    –এটা হয়না সারা। আমি কি আর তোমাদের সাথে যেতে পারি? তবে তোমাদের যখন ইচ্ছে আমার সাথে এসে দেখা করে যেতে পারো। আমারও ভালো লাগবে। আফটার অল তোমাদের মতো এতো কিউট কিউট বোন আমি কোথায় পাবো বলো। আমিও তোমাদের অনেক মিস করবো। 

     

    সারা আর রাইসা মায়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুম থেকে চলে গেল। মায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার নিজের কাজে মননিবেশ করলো। বোরখা পরে রেডি হয়ে বের হতে যাবে তখনই হঠাৎ রাদিব ওর দিকে দৌড়ে এলো। আচমকা এমন হওয়ায় মায়া আর রাদিব একজন আরেকজনের সাথে ধাক্কা খেল। রাদিবের হাতে ছিল জুসের বোতল। ধাক্কা লাগায় জুসের বোতল থেকে অনেক টা জুস মায়ার বোরখার ওপর পড়ে গেল। ফলে মায়ার বোরখায় জুসের দাগ লেগে গেল। সেটা দেখে রাদিব অপরাধী সুরে বললো। 

    –সরি আপু আমি বুঝতে পারিনি। 

     

    মায়া বলে উঠলো। 

    –ইটস ওকে কোনো ব্যাপার না। আমি এখুনি চেঞ্জ করে নিচ্ছি।

    নতুন বোরখা নষ্ট হওয়ায় মায়া আবারও সেই পুরানো বোরখা টাই বের করে পড়ে নিল।

     

    এদিকে অরণ্যরাও চলে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। বের হওয়ার সময় অরণ্যের অবাধ্য চোখ দুটো আরচোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়াকেই খুঁজছিল। হয়তো চলে যাওয়ার আগে একনজর দেখার আশা জেগেছিল। তবে মায়াকে কোথাও না দেখতে পেয়ে আশাটাকে নিজের মাঝেই দমিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল অরণ্য। বাইরে গাড়ির কাছে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্যও সেখানে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ অরণ্যের মনে পড়লো ও ওর ওয়ালেট রুমের ভেতরেই ভুলে এসেছে। অরণ্য ওর ওয়ালেট টা আনার জন্য আবারও বাসার ভেতর ঢুকলো। 

     

    বাসার ভেতর ঢুকে আনমনেই সামনে তাকালো অরণ্য। আর সামনে তাকাতেই থমকে গেল সে। পুরো পৃথিবী টা যেন মুহূর্তেই ঘুরে উঠলো অরণ্যের। ও যা দেখছে তাকি সত্যি দেখছে নাকি ভ্রম? ওর চোখের সামনে ওর সেই সন্ধ্যামালতীকে দেখতে পাচ্ছে অরণ্য। হ্যাঁ সন্ধ্যামালতী। সেই একই বোরখা,সেই একই চোখ, একই রকম চাহুনি। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? সন্ধ্যামালতী তো রিয়া। তাহলে এই মেয়ে কে? তবে কি আমি সত্যি সত্যিই ভুল কাওকে বিয়ে করলাম?

     

    কথাটা ভাবতেই অরণ্যের চোখের সামনে সবকিছু গোল গোল ঘুরতে লাগলো। না না এটা হতে পারে না। কিছুতেই না। আমার বিশ্বাস এভাবে হেরে যেতে পারে না।

     

    চলবে…..

     

    #মায়ারণ্যে

    #লেখিকা- মেহরুমা নূর 

    #পর্ব-৬

     

    ★ অরণ্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ওতো ভেবেছিল অরণ্যরা হয়তো চলে গেছে। তাইতো সে এখন বের হয়েছিল। কারন মায়া অরণ্যের সামনে পড়তে চাচ্ছিল না। লোকটার সামনে আসলে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয় ওর। আর মায়া নিজেকে কোন মিথ্যে মোহে জড়াতে চায়না। তাইতো যতটা পারে অরণ্যের থেকে দূরে থাকতে চায় ও। কিন্তু অরণ্যকে এভাবে হঠাৎ সামনে আসতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ও। আর অরণ্যের এভাবে তাকিয়ে থাকাটাও কেমন যেন লাগছে ওর কাছে। ওই চোখের চাহুনি যেন অন্য কিছু বলছে। 

    যাইহোক মায়া নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আস্তে করে অরণ্যের পাশ কেটে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে গেল। 

     

    আর অরণ্য মায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে এখনো ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু যেন থমকে গেছে ওর জন্য। গলা শুঁকিয়ে আসছে ওর। হৃদপিন্ডের অশান্ত আহাজারি ওর সমস্ত শরীর টাকে অসার করে দিচ্ছে। চোখের সামনে যা দেখছে তা মন মেনে নিতে চাইছে না। অরণ্য দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে অশান্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। না না এটা হতে পারে না। আমার নিশ্চয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার বিশ্বাস এভাবে হেরে যেতে পারে না। হতে পারে ওই বোরখা টা রিয়ারই ছিল। আজ হয়তো মায়া পড়েছে। ওরা যেহেতু কাজিন তাই একজন আরেকজনের টা পড়তেই পারে। তাই এতো তাড়াতাড়ি কোন পরিনামে আসা ঠিক হবে না। 

     

    নিজের অশান্ত মনকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে শান্ত করতে চাইলেও তাতে সফল হচ্ছে না অরণ্য। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে অরণ্য তাড়াতাড়ি করে বাইরে এসে রিয়া আর সারাদের উদ্দেশ্যে বললো।

    –শোন আমার একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তাই আমি এখন তোদের সাথে যেতে পারবোনা। তোরা ড্রাইভারের সাথে চলে যা। আমি কাজ শেষ করে বাসায় চলে আসবো।

     

    সবাই অরণ্যের কথামতো গাড়িতে উঠে চলে গেল। আর অরণ্য দ্রুত গিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে বসলো। সিএনজি কিছুদূর যেতেই মায়াকে রাস্তার পাশে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলো। অরণ্য সিএনজি চালককে এবার আস্তে আস্তে চালাতে বললো। যাতে ও মায়াকে ফলো করতে পারে। আর সেই ভাবনা মতেই অরণ্য সিএনজিতে বসে মায়াকে ফলো করতে লাগলো। 

     

    কিছুদূর যেতেই অরণ্য দেখলো সেদিনের সেই শিশুটা রাস্তার পাশে বসে আছে। মায়া শিশুটির কাছে এগিয়ে গিয়ে শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে দিল। তারপর যেতে যেতে আরও কিছু মানুষের সাহায্য করছে মায়া। এসব দেখে অরণ্যের সব সন্দেহ ক্লিয়ার হয়ে গেল। ওর মন মস্তিষ্ক দুটোই এবার মানতে রাজি হয়ে গেল যে মায়াই ওর সেই সন্ধ্যামালতী। তাহলে রিয়া কে? তারমানে আমি ভুল কাওকে আমার জীবন সঙ্গী করেছি? কথাটা ভাবতেই অরণ্যের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এ এটা আমি কি করলাম? আমার সাথে এমন কেন হলো? আমিতো আমার সন্ধ্যামালতীকে চেয়েছিলাম। তাহলে অন্য কেউ কেন এলো আমার জীবনে?  এখন কি করবো আমি? আর ভাবতে পারছে না অরণ্য। মাথাটা পুরো হ্যাং হয়ে যাচ্ছে ওর। শরীরের সব স্নায়ুতন্ত্র অকার্য হয়ে পড়ছে। অরণ্য দেখলো মায়া একটা বাসে উঠে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে চলে গেল।  অরণ্য দিশেহারার মতো সিএনজি চালককে কোন এক জায়গায় যাওয়ার কথা বললো।

     

    নির্জন নদীর কিনারায় মাথা চেপে ধরে বসে আছে অরণ্য। নিজের ওপর প্রচন্ড পরিমাণ রাগ হচ্ছে। পারলে যেন নিজেকেই মেরে ফেলে ও। আজ ওর একটা ভুলের জন্য সন্ধ্যামালতীকে পেলনা ও। ও যদি নিজে দেখতে আসতো তাহলে হয়তো এই ভুলটা হতো না। ওর তো পুরো বিশ্বাস ছিল যে সন্ধ্যামালতীই ওর জীবন সঙ্গী হবে। তাহলে ওর বিশ্বাস এভাবে কেন হেরে গেল? কিন্তু আমিতো সেদিন আপুর কাছে সন্ধ্যামালতীর ছবি দিয়েছিলাম। আর রিয়ার মা নাকি বলেছিল ছবির মেয়েটাই নাকি রিয়া। তাহলে এসব কিভাবে হলো? উনি কি তাহলে মিথ্যা বলেছিলেন?  নাকি সেও কনফিউশনে বলে দিয়েছে?  

     

    যেভাবেই হোক না কেন ক্ষতিটা তো আমারই হয়েছে। আর এই ক্ষতির কোন ক্ষতিপূরণও নেই। এইজন্যই বুঝি বিয়ের প্রথম রাত থেকেই আমার এমন লাগছিল। কিছু একটা খালি খালি লাগছিল। সেই খালির কারণ টা যে মায়া ছিল। আর এজন্যই মায়াকে প্রথম দেখেই ওর প্রতি অজানা টান অনুভব করেছিলাম। কারণ মায়াই যে আমার স্বপ্নকণ্যা, আমার সন্ধ্যামালতী,আমার হৃদয়ের রাণী। কিন্তু এখন আমি কি করবো?  আমি যে আমার স্বপ্নকন্যাকে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম। এখন এই অপূর্ণ জীবনের বোঝা কিভাবে বয়ে বেড়াবো আমি? সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া জীবনের বাকিপথ কিভাবে চলবো? যাকে আমি চাই না তার সাথে কিভাবে জীবন কাটাবো আমি?  রিয়াকে কিভাবে নিজের স্ত্রী বলে মেনে নিব আমি? সন্ধ্যামালতী ছাড়া অন্য কাওকে যে কিছুতেই এই মনে জায়গা দিতে পারবোনা আমি। চাইলেও সেটা সম্ভব না আমার দ্বারা। কিন্তু এখন আমি এসব ঠিক করবো কিভাবে? চাইলেই যে রিয়াকে এতো সহজে আমার জীবন থেকে সরানোও যায়না। এখানে যে দুটো ফ্যামিলি ইনভলভ আছে। পরিবারের মানসম্মান জুড়ে আছে।  আমি ইচ্ছে করলেই যা খুশি তাই করতে পারি না। যেখানে আমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। সেখানে বিয়ের পরদিনই কিভাবে বলবো যে এই বিয়ে আমি মানি না? আপুর জন্য বাবার আগেও একবার সমাজে মাথা হেট হয়েছে। এখন যদি আমিও এমনটা করি তাহলে হয়তো বাবা আরও ভেঙে পরবেন। আর ছেলে হয়ে আমি কিভাবে সেটা হতে দিতে পারি? এখন যে আমার চারপাশে অথই সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। না পারছি ডুবে মরতে, না পারছি বের হতে। জীবন এ কোন মোড়ে নিয়ে এলো আমায়?

    ____

     

    বাসায় এসে গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সারা। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো। 

    –এই চশমিশ,

     

    সারার এতক্ষণের ফুরফুরে মেজাজ টাই বিগড়ে গেল। ও জানে এটা ওই বিরক্তিকর লোকটা ছাড়া আর কেউই না। নেহাৎ বয়সে আর সম্পর্কে বড় দেখে ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলেনা সারা। নাহলে এই লোকাটাকে আচ্ছা মতো কিছু শুনিয়ে দিতো সারা। অসহ্যকর লোক একটা। 

     

    –কিরে চোখের সাথে সাথে কি কানের পাওয়ারও কমিয়ে ফেললি নাকি? ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?

     

    সারা দাঁতে দাঁত চেপে পেছনে ফিরে দেখলো সাহিল পুল সাইডে ছাতা বিশিষ্ট চেয়ারে বসে আছে। সারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিকে এগিয়ে গেল। সাহিলের সামনে এসে দেখলো সাহিলের চোখমুখ কেমন লাল হয়ে আছে। যেন কোন কারণে অতিরিক্ত রেগে আছে সে। কিন্তু কিসের রাগ এতো তার?  কে আবার তার পাকা ধানে মই দিলো? যাগ্গে যার খুশী তার ওপর করুগ্গে রাগ তাতে আমার কি। সারা অন্য দিকে তাকিয়ে দায়সারা ভাবে বললো। 

    –বলুন কি বলবেন? 

     

    –নিজের বাড়ির খাওয়া বুঝি তোর জন্য কম পরে যাচ্ছে, তাইজন্য অন্যের বাড়ির খাবার খেতে চলে গিয়েছিলি তাইনা? 

     

    সারা এবার সাহিলের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো। 

    –কি বলছেন এসব? আমি কার বাড়ি খাবার খেতে গেলাম?

     

    –কেন কাল থেকে অরণ্য ভাইয়ার শশুর বাড়ি পড়ে আছিস তো খাওয়ার লোভেই তাইনা? নাকি ওখানে কোন ছেলের সাথে টাংকি মারতে গেছিস হ্যাঁ? 

     

    সারা এবার রাগের সাথে সাথে একটু কনফিউজও হলো। আসলে ও বুঝতে পারছে না টাংকি মারা মানে কি। কিন্তু সেটাতো আর এই লোকটাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। প্রেস্টিজের ব্যাপার স্যাপার বলে কথা। ভাববে যে আমি এইটুকু জিনিসও জানিনা। তাই উপরে উপরে অতি কনফিডেন্স দেখিয়ে বললো। 

    –হ্যাঁ টাংকি মারতেই গিয়েছি। আমার টাংকি মারা অনেক ভালো লাগে। আমার টাংকি আমি মারবো। সকাল, দুপুর, রাতে মারবো তাতে আপনার কি হ্যাঁ? 

     

    সারার কথা শেষ হতে না হতেই সাহিল হাওয়ার বেগে উঠে দাঁড়িয়ে সারার হাতের বাহু চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো। 

    –তুই আগে বল কে সে ? তারপর দেখ আমার কি? তোর সাহস আজকাল অনেক বেড়ে গেছে না? বড়োদের মুখে মুখে তর্ক করা হচ্ছে? এখন বল ছেলেটা কে? কি হলো বল?

     

    সারা কথা বলবে কি। ভয়ে আর হাতের ব্যাথায় পরাণ যায় যায় অবস্থা। সারা ভীতু স্বরে বললো। –কা কার কথা বলছেন সাহিল ভাইয়া? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। 

     

    –আচ্ছা এখন বুঝতে পারছিস না তাইনা? এতক্ষণ ধরে বলছিস টাংকি মারছিস আর কোন ছেলে জিজ্ঞেস করতেই বুঝতে পারছিস না? মজা হচ্ছে আমার সাথে হ্যাঁ? 

     

    –ও ওটাতো আমি এমনিই বলেছি। আসলে আমি না টাংকি মানে বুঝতে পারছিলাম না। তাই এমনি এমনি ওসব বলে দিয়েছি।

     

    সাহিল ভ্রু কুঁচকে বললো।

    –হোয়াট??

     

    সারা ইনোসেন্ট ফেস করে বললো।

    –স সত্যি বলছি। 

     

    সাহিল কি রিয়্যাকশন দিবে ভেবে পাচ্ছে না। সারার হাত ছেড়ে দিয়ে তিন আঙুল দিয়ে সারার কপালে হালকা টোকা দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো। 

    –তুই আসলেই একটা রাম গাধা। গাধার কম্পিটিশনে একদম ফাস্ট প্রাইজ পাবি তুই। যা এখন ভেতরে যা। 

     

    সাহিলের বলতে দেরি, সারার গায়েব হতে দেরি লাগলো না। বেচারি ছু মন্তর হয়ে গেল ওখান থেকে। সারার বোকামির কথা ভেবে সাহিল ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসলো। কাল থেকে ওকে না দেখে যে রাগে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল সেটা যেন মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গিয়েছে। মেয়েটাকে রাগাতে ওর খুব ভালো লাগে। তাইতো ইচ্ছে করেই ওকে রাগায়। ও রাগে যখন মুখটা গোমড়া করে ফেলে তখন,  ওর ফর্সা গাল আর নাকের ডগা লাল হয়ে যায়। একদম পাকা টমেটোর মতো লাগে। দেখতে এত্তো কিউট লাগে। মন চায় একদম খেয়ে ফেলি। কিন্তু পাগলিটা এখনো অনেক ছোট। তাইতো মনের অব্যক্ত অনুভূতি গুলো ওকে বলতে পারিনা। তবে ও যখন রাগ করে দূরে দূরে থাকে তখন ভীষণ রাগ হয়। তাইতো সেই রাগে ওকে তখন আরও রাগাই। জানি না পাগলিটা কবে একটু বড়ো হবে। আর আমাকে একটু বুঝতে পারবে।

    ___

     

    রাত ১০ টার দিকে অরণ্য বাসায় ফেরে। চোখে মুখে ক্লান্তি আর বিষন্নতার ছাপ। কোন মহামূল্যবান কিছু হারানোর হতাশায় চেহারায় বিষাদের ছাপ ভেসে উঠেছে। জীবন টা যেন হঠাৎ করেই অগোছলো হয়ে গেল। কিভাবে সব গোছাবে সেটাও জানা নেই ওর। ভার্সিটি ছুটির সময় অরণ্য আবারও মায়ার ভার্সিটির সামনে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল তার উত্তর জানা নেই ওর। শুধু মনে হচ্ছিল মায়াকে দেখতে পারলে হয়তো ওর অশান্ত মনটা শান্ত হবে। আর সত্যি সত্যিই দূর থেকে মায়াকে দেখে ওর অশান্ত মনে এক প্রশান্তির বাতাস ছুয়ে গিয়েছিল। তবে মায়া চলে যেতেই আবারও কঠিন বাস্তবতা ঘিরে ধরে অরণ্যকে। যে বাস্তবতা অরণ্য না মানতে পারছে, না ফেলতে পারছে। অশান্ত মনে সারাদিন ছন্নছাড়া পথিকের মতো এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়েছে। বাসায় মোটেও আসতে ইচ্ছে করছিল না ওর। কারণ বাসায় আসলেই সেই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে ওর। তাইতো বাসায় আসতে চাইছিল না। একবার ভেবেছিল ইহানের বাসায় চলে যাবে। আবার ভাবলো এতে করে সবাই চিন্তায় পড়ে যাবে। বিশেষ করে ওর মা। তাই ওর মায়ের কথা ভেবেই অগত্যা বাসায় চলে এলো অরণ্য। 

     

    রুমে ঢুকে দেখলো রিয়া বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপছে। রিয়াকে দেখে অরণ্যের মনটা আরও বিষাদ হয়ে উঠলো। এই বাড়ি,এই রুমে ওর সন্ধ্যামালতীকে আনতে চেয়েছিল। তার জায়গায় অন্য কাওকে দেখে অরণ্যের বুকের ভেতর কেমন হাহাকার শুরু হয়ে গেল। 

     

    অরণ্যকে দেখে রিয়া তড়িঘড়ি করে উঠে অরণ্যের কাছে এগিয়ে এলো। অরণ্যের সামনে এসে হাসিমুখে হেলেদুলে বললো।

    –তুমি এসে গেছ?  সারাদিন কোথায় ছিলে? জানো বাড়ির সবাই বারবার শুধু তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল?

    কথা বলতে বলতে রিয়া অরণ্যের দিকে হাত বাড়াতে নিলেই, অরণ্য ছিটকে সরে যায়। অরণ্যের কাছে প্রচুর অস্বস্তি আর বিরক্তিকর লাগছে রিয়াকে। প্রথমে ব্যাপার টা বুঝতে না পারলেও এখন অরণ্য বুঝতে পারছে কেন রিয়ার সামনে ওর এতো অস্বস্তি লাগে। কারণ এযে ওর সন্ধ্যামালতী না। 

     

    অরণ্য অপ্রস্তুত ভাবে ওখান থেকে সরে গেল। অরণ্যের এমন বিহেভিয়ারে রিয়াও অনেক টা অবাক হলো। লোকটার হাবভাব কিছু বুঝতে পারছে না ও। সেতো ওকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে তাহলে এমন দূরে দূরে থাকে কেন? আমার মতো সুন্দরী বউকে রেখে উনি কিভাবে থাকেন? এমন হলে উনাকে বিয়ের জন্য মানাবো কিভাবে? বাবা মা বারবার বলে দিয়েছে আমি যেন তাড়াতাড়িই কোন বাহানায় অরণ্যকে বিয়ের জন্য মানিয়ে নেই। কিন্তু সেতো ধরাই দেয়না।  বেচারা মনে হয় একটু বেশিই লাজুক টাইপের। ব্যাপার না, আমি নিজেই সব ঠিক করে দিবো। আমার জালওয়া থেকে কেউই বেশিক্ষণ দূরে থাকতে পারে না। 

     

    অরণ্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে ঘড়ি খুলছে। রিয়া বাঁকা হেসে অরণ্যের পেছনে গিয়ে ওর পেছন থেকে অরণ্যের ব্লেজার টা খুলতে নিলেই অরণ্য নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো। 

    –আমি নিজেই করতে পারবো। তোমার হেল্প লাগবে না। 

    কথাটা বলেই অরণ্য কাবার্ড থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। রিয়া শুধু বোকার মতো তাকিয়ে রইল। 

     

    শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্য। দেয়ালে দুই হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শাওয়ারের পানি ওর শরীর কে ঠান্ডা করতে পারলেও, ওর মনে যে ঝড় বইছে, হৃদপিণ্ডে যে অগ্নিশিখা দাও দাও করে জ্বলছে তা কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কেঁদে মনের ধাপ বের করতে।  কিন্তু সেটাও যে ও পারবে না।  বাবা বলেছে ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। তাইতো সে মন খুলে কাঁদতেও পারছেনা। তবে তার চোখ দিয়ে নিরব জলরাশি ঠিকই গড়িয়ে পড়ছে। যা শাওয়ারের পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। 

     

    ত্রিশ মিনিট পর অরণ্য শাওয়ার থেকে বের হলো। রিয়া এখনো বসে মোবাইল টিপছে। অরণ্য সেদিকে একবারও তাকালো না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে অরণ্য রিয়ার কাছে এগিয়ে গেল। রিয়ার সামনে বসে নিজের ফোন থেকে মায়ার সেই ছবিটা বের করে রিয়ার সামনে ধরে বললো। 

    –আচ্ছা তুমি কি এই ছবির মেয়েটাকে চিনো?

     

    রিয়া কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর একটু চিন্তা করার মতো করে ভাবতে লাগলো। অরণ্য এখনো মনে মনে আশা করছে ও যা যেনেছে তা যেন সত্যি না হয়। তাই শেষ আশানুযায়ী রিয়াকে ছবিটা দেখাচ্ছে। মনে মনে চাইছে রিয়া যেন নিজের কথাই বলে।  তবে অরণ্যের শেষ আশাকেও ডুবিয়ে দিয়ে রিয়া বলে উঠলো। 

    –আরে এটাতো আমাদের আশ্রিতা। মানে ওই মায়া। 

     

    অরণ্য বিস্মিত চোখে রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো। 

    –তুমি এতো শিওর কিভাবে হলে? 

     

    –আরে শিওর না হওয়ার কি আছে?  এই বাবা আদমের যুগের বোরখা শুধু ওর ছাড়া আর কারোরই নেই। আর ওর আবার এইসব রাস্তার লোকজনের সাথে খুব খাতের। সবসময় এসবই করে ও। নিজের কোন ওয়েটই নেই ওর। নিজে আশ্রিতা তো তাই ওর মতো বাকি লোকেদের প্রতি ওর একটু দরদ বেশি। 

     

    রিয়ার কথায় অরণ্যের চরম রাগ হলো। তবুও চোয়াল চিবিয়ে রাগ দমিয়ে নিয়ে বললো। 

    –কিন্তু তোমার মাতো বলেছে এটা নাকি তুমি?

     

    –কবে বলেছে?

     

    –যেদিন তোমাকে আমাদের বাড়ি থেকে দেখতে গিয়েছিল। 

     

    অরণ্যের কথায় রিয়ার কপাল কুঁচকে এলো। মা এটা কেন বলেছে? নিশ্চয় মা কোন ঘাপলা করেছে। আর মা যখন বলেছে তখন নিশ্চয় কিছু একটা ভেবেই বলেছে। তাই আমাকে কথাটা সেরে নিতে হবে। এসব ভেবে রিয়া জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলো। 

    –আরে এই বোরখা টা প্রথমে আমার ছিল। পুরনো হয়ে যাওয়ায় আমি ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম। তাই হয়তো মা ভেবেছে এটা আমি।

     

    রিয়ার কথা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হলোনা অরণ্যের কাছে। তবুও এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে অরণ্য উঠে চলে যেতে নিলেই রিয়া বলে উঠলো। 

    –বায়দা ওয়ে তুমি  এই ছবি কোথায় পেলে? আর মাকে কিসের জন্য দেখিয়ে ছিল।

     

    অরণ্য অন্য দিকে তাকিয়ে বললো।

    –পেয়েছি কোথাও তোমার জানার দরকার নেই। শুয়ে পড়ো।

     

    অরণ্য আবারও চলে যেতে নিলে রিয়া আবারও বলে উঠলো। 

    –কোথায় যাচ্ছো? খাবার খাবে না?

     

    –এখন ক্ষুদা নেই। সময় হলে আমি খেয়ে নিবো।তোমার চিন্তা করতে হবে না।

    কথাটা বলেই আদিত্য দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। 

     

    রিয়া বিড়বিড় করে বললো। 

    –যা খুশি তাই করুক।  শুধু শুধু আমার বিউটি স্লিপ নষ্ট করতে পারবোনা। 

    রিয়া নিশ্চিন্তমনে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। 

    অরণ্য রুম থেকে বেড়িয়ে ছাঁদে চলে এলো। ওই রুমে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সত্যিটা জানার পরে রিয়ার সাথে একরুমে থাকতে আরও বেশি অস্বস্তিকর লাগছে ওর কাছে।। ছাঁদে এসে একটা বেতের হেলানো চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো অরণ্য। আজ ওর জীবন টা এ কোন মোড়ে এসে দাঁড়াল? এখান থেকে বের হওয়ার যে কোন পথই পাচ্ছে না ও। অরণ্য ফোনটা বের করে মায়ার ছবিটা দেখতে দেখতে মনে মনে বললো। এমনটা কেন হলো সন্ধ্যামালতী? তোমাকে পেয়েও কেন হারিয়ে ফেললাম আমি? এখন তোমাকে ছাড়া এই আমি যে শুধুই প্রাণহীন দেহ। তোমাকে কি কখনোই পাবোনা আমি? 

     

    চলবে…..

     

    #মায়ারণ্যে

    #লেখিকা-মেহরুমা নূর

    #পর্ব-৭

     

    ★ এরইমধ্যে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। সবকিছু ঠিক থেকেও অনেক কিছুই বেঠিক। প্রতিটা অতিবাহিত দিনের সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অরণ্যের বিষাদের জ্বালা। অরণ্য ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না। বেশির ভাগ সময় অফিসেই পড়ে থাকে। বাসায়ও আসে অনেক লেট করে। অরণ্য অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক করার। সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করার। রিয়াকে মেনে নেওয়ারও চেষ্টা করছে। কারণ ওর মতে রিয়ার তো কোন দোষ নেই। তাই রিয়াকে একটা চান্স দিতে চায় ও। কিন্তু চাইলেই কি সব সম্ভব হয়?  যেমনটা সম্ভব হচ্ছে অরণ্যের কাছে। অরণ্য চেয়েও মায়াকে ভুলতে পারছে না। আর না পারছে রিয়াকে মেনে নিতে। রিয়ার সামনে গেলেই ওর কেমন বিরক্তিকর লাগে। ছোঁয়া তো দূরের কথা, কথা বলতেই অস্বস্তি লাগে। বরং দিন দিন মায়ার প্রতি টান যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে ওর। না চাইতেও অরণ্যের অবাধ্য মনটা বারবার শুধু মায়াকেই দেখতে চায়। তাইতো রোজই অরণ্য মায়ার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দূর থেকেই মায়াকে দেখে। অরণ্য জানে ও যা করছে তা ঠিক না। কিন্তু এছাড়া যে আর কোন উপায় নেই ওর কাছে। এই অশান্ত মনটা যে মায়াকে দেখেই একটু শান্ত হয়। ওই একটুখানি সময়ই যেন সারাদিনের শান্তি এনে দেয় অরণ্যের মনপ্রাণ জুড়ে। নাহলে যে ও দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে।

     

    অরণ্যের পরিবর্তন বাসার লোকজনও কিছুটা খেয়াল করেছে। বিশেষ করে ইরিন। ইরিন কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে অরণ্যকে কিছু হয়েছে কিনা। কিন্তু অরণ্য বলেছে কিছুই হয়নি। ইহানও ব্যাপার টা খেয়াল করেছে। সেও কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে। তাকেও কিছু বলেনি। আসলে অরণ্য খুব চাপা স্বভাবের। নিজের সমস্যার কথা সহজে কাওকে বলে না। নিজের জন্য অন্যকে পেরেশান করতে চায়না। আর এই ব্যাপার টা তো এমনিতেও অনেক সেনসেটিভ। চাইলেও সবাইকে বলা যায় না। 

     

    রিয়া এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অরণ্যকে তার মোহে ডুবানোর। তবে সে প্রতিবারই বিফল হচ্ছে। অরণ্যকে ছোঁয়া তো দূরের কথা অরণ্য ওর সাথে দিনে দুটো কথা বলে কিনা সন্দেহ। অরণ্যের এমন বিহেভিয়ারের কারণ কিছুই বুঝতে পারছে না রিয়া। অরণ্যকে পটিয়ে বিয়ের কথা বলবে সেই সুযোগ টাও পাচ্ছে না ও। অন্যদিকে অরণ্যের বাড়ির এতো ঝামেলায় চরম বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে ও। এই বাড়িতে এতো মানুষ। সকাল সকাল উঠে এদের জন্য নাস্তা বানাতে হয়। আরও কতো কাজ করতে হয়। যদিও বেশির ভাগ কাজ কাজের লোকই করে তবুও এতো মানুষের ঝামেলায় তিক্ত হয়ে উঠছে রিয়া। ও ভেবে পায়না এই যুগেও এতো বড়ো জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকার মানেটা কি। অসহ্যকর। রিয়া শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছে। একবার অরণ্যকে পটাতে পারলেই ওকে নিয়ে আলাদা হয়ে থাকবে। এতো মানুষের ভিড়ে থাকতে পারবে না ও।

     

    মায়ার জীবন সেই একই গতীতেই চলছে। কোন পরিবর্তন না হয়েও যেন আবার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। অরণ্য চলে যাওয়ার পর থেকেই কেন যেন অজান্তেই অরণ্যের কথা বারবার মনে উঁকি দেয়। নিঝুম একাকী রাতে হঠাৎই তার কথা মনে পড়ে বুকের ভেতর কেমন ধুকধুক করে ওঠে। কেন এমন হয় তা জানা নেই মায়ার। তবে কি ওরা স্বামী স্ত্রী বলে এমনটা হয়? পাশের বাড়ির দাদীর কাছ থেকে শুনেছিল। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি আলৌকিক এক পবিত্র সম্পর্ক। এই সম্পর্কে নাকি আপনাআপনিই একজন আরেকজনের প্রতি মায়ার সৃষ্টি হয়। তাহলে সেইজন্যই কি আমার এমন লাগে? আচ্ছা উনারও কি আমার জন্য কোন টান অনুভব হয়? কথাটা ভেবে মনে মনে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, তুইও না মায়া কিসব ভাবিস। তার কাছে রিয়ার মতো সুন্দরী বউ থাকতে তোর মতো কুৎসিত মেয়েকে কেন মনে করতে যাবে? তাই এসব ফালতু চিন্তা ভাবনা করে নিজেকে বোকা বানাস না। 

    মায়া আরেক টা জিনিস খেয়াল করেছে। ভার্সিটিতে কেন যেন মনে হয় ওকে কেও দেখছে। কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পায়না ও। আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে। আজকাল প্রায়ই একটা ব্লাঙ্ক কল আসে। ফোন রিসিভ করে হ্যালো হ্যালো বলে যায় কিন্তু ওপাস থেকে কোন জবাবই আসে না। শুধু মাঝে মধ্যে ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আর সেই শব্দেই কেন যেন মায়ার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। শেষে না পেরে মায়া ফোন কেটে দিয়ে নাম্বার টা ব্লক করে দেয়। কিন্তু পরে আবারও অন্য একটা নাম্বারে সেই একই ফোন আসে। মায়া তখন রেগে গিয়ে অনেক কিছুই বলে। তবুও ওপাস থেকে কোন প্রতিত্তর আসে না। 

     

    মায়ার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো। মায়া বিরক্ত হয়ে ভাবলো ওই লোকটাই হবে। তবে ফোন সামনে নিয়ে দেখলো এটা সারার কল। সারা ভিডিও কল করেছে। মায়ার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। মেয়ে দুটো সত্যিই অনেক মিষ্টি। এখান থেকে যাওয়ার পর থেকেই প্রায়ই ওকে ফোন দিয়ে কথা বলে। মায়ারও অনেক ভালো লাগে ওদের সাথে কথা বলে। মায়া মুচকি হেসে ফোনটা রিসিভ করে সামনে ধরলো । ওপাশে সারা আর রাইসা ক্যামেরার সামনে বসে আছে। সারা হাত নেড়ে হাসিমুখে বললো। 

    –হায় মায়া আপু কেমন আছ? 

     

    –ভালো আছি। তোমরা কেমন আছ?

     

    –আমরাও অনেক ভালো আছি। জানো আজকে না একটা গুড নিউজ আছে শুনবে? 

     

    –কি গুড নিউজ? 

     

    –আজ না রাইসা আপুর বয়ফ্রেন্ড নিশান জিজু তার পরিবার নিয়ে আসছে বিয়ের কথা পাকা করতে। 

     

    –তাই নাকি?  এটাতো সত্যিই অনেক ভালো খবর। কংগ্রাচুলেশনস রাইসা।

     

    রাইসা বলে উঠলো। 

    –থ্যাংক ইউ আপু।তবে শুধু মুখে মুখে বললে চলবে না। বিয়েতে কিন্তু তোমাকে আসতে হবে বুঝেছ?

     

    সারাও বলে উঠলো। 

    –হ্যাঁ হ্যাঁ আপু তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে। অনেক মজা হবে। তোমার দাওয়াত সবার আগে। তুমি সাতদিন আগেই চলে আসবে। 

     

    মায়া আপাতত ওদের মন রাখার জন্য বললো।

    –আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাবে। 

     

    অরণ্য অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে। সারা আর রাইসা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে মায়ার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিল। মায়া ফোনের ক্যামেরায় সারা রাইসার পেছনে অরণ্যকে সিড়িতে দেখতে পেল। হঠাৎ অরণ্যকে দেখে মায়ার বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। অরণ্য সেদিকে খেয়াল না করেই চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সারার মুখে মায়া আপু নাম শুনে অরণ্যের কদম আটকে গেল। অরণ্য পাশে তাকিয়ে দেখলো সারা আর রাইসা ফোনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। তাহলে কি ওরা মায়ার সাথে কথা বলছে?  কথাটা ভেবে অরণ্য আগানো কদম ধীরে ধীরে পিছিয়ে নিল। ইতস্তত ভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে সারা আর রাইসার পেছনে এসে দাঁড়াল। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মায়ার মায়াবী মুখটা দেখতে পেল অরণ্য। মুহূর্তেই যেন এক প্রশান্তির বাতাস ছুয়ে দিল মনের কুটিরে। ঘরের ভেতর থাকায় মায়ার মাথায় ঘোমটা নেই। তাই মায়ার খোলা ঘনকালো চুলগুলোও দেখা যাচ্ছে। অরণ্য সব ভুলে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। 

     

    অরণ্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া হঠাৎ করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।কেমন যেন লজ্জা ঘিরে ধরলো ওকে। মায়া সামনের দিকে তাকাতে পারছে না। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সারা অরণ্যকে দেখে বলে উঠলো। 

    –আরে ভাইয়া তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু লাগবে তোমার?

     

    সারার কোথায় অরণ্যের ঘোর কাটলো। ছোটবোনদের সামনে থতমত খেয়ে গেল সে। কোনমতে গলা খাঁকারি দিয়ে অপ্রস্তুত ভাবে বলে উঠলো । 

    –আরে আমিতো মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মা কি জেন বলবে আমাকে তাই দাঁড়িয়ে আছি। তা তোরা কি করছিস? 

     

    সারা বললো।

    –আমরা? আমরাতো মায়া আপুর সাথে কথা বলছিলাম।আজ রাইসা আপুর বিয়ে ঠিক হবে সেটাই বলছিলাম। তুমিও কথা বলোনা আপুর সাথে। আফটার অল তোমার একমাত্র শালিকা বলে কথা। 

     

    সারার শালিকা কথাটায় অরণ্যের কেমন অসহ্যকর লাগলো। তবুও জোরপূর্বক হেসে ফোনে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো। 

    –হায় মায়া কেমন আছ?

     

    মায়াও জোরপূর্বক হেসে বললো। 

    –জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? 

     

    –এইতো আছি। 

     

    এরপর আর কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না ওরা। যদিও মায়ার আরও কথা বলার ইচ্ছে করছে অরণ্যের। তবুও  ছোটবোনদের সামনে এভাবে অনেক ইতস্তত লাগছিল অরণ্যের। তাই বাই বলে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে গেল অরণ্য। সারা আর রাইসা আর কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলো। মায়াকে ওদের অনেক ভালো লাগে। মায়া এতো ভালো, অথচ রিয়া ওদের ভাবি হয়েও এখানো ওদের সাথে ভালোকরে মিশতে পারে নি। ওরা যখনি রিয়ার সাথে কথা বলতে যায় তখনি কেমন যেন বিরক্তির ছাপ দেখতে পায় রিয়ার মুখে।  তাই ওরাও আর তেমন রিয়ার কাছে যায় না।

     

    শুধু ওরা না। বাড়ির বাকি সবাইও রিয়ার প্রতি তেমন একটা খুশি না। রিয়ার ভাবসাব কেমন যেন অন্য রকম।যেন সে এই পরিবারের ওপর বিরক্ত।  মাঝে মধ্যে রিয়ার কথাবার্তায়ও সেটা দেখা যায়। তবে নতুন বউ দেখে কেউ কিছু বলে না। কারণ সবাই চায় রিয়া এবাড়িতে কম্ফোর্টেবল হোক। বাকি সবার মতো সেও মিলেমিশে থাকুক। বউকে কটু কথা শোনানোর মতো শাশুড়ী তনিমা বেগম না। তিনি খুবই নরম মনের মানুষ। 

    ____

     

    সন্ধ্যা ৭ টা

    রাইসার বয়ফ্রেন্ড নিশান তার পরিবার নিয়ে চলে এসেছে অরণ্য দের বাড়িতে। সবাই মেহমান দের খাতির দারি করছে। রাইসাকে নিয়ে এসে সামনের সোফায় বসানো হয়েছে। যদিও এটা শুধুই ফর্মালিটি। নিশান আর রাইসার সম্পর্কের কথা অনেক আগে থেকেই দুই পরিবারের সবাই জানে। আজ শুধু ফর্মালিটির জন্য বউ দেখানো হচ্ছে। 

     

    সাহিল দুষ্টুমি করে বলে উঠলো। 

    — আজকে আমাদের কপালে কি খাবার জুটবে নাকি? 

     

    রাইসা ভ্রু কুঁচকে বললো। 

    –কেন ভাইয়া এভাবে বলছিস কেন?

     

    –না মানে বাসার সব আটা,ময়দা তো তুই নিজের মুখেই লাগিয়েছিস। তাই ভাবছি আজ বোধহয় না খেয়েই থাকতে হবে। 

     

    সাহিলের কথায় সবাই হেঁসে দিল। রাইসা দাঁত কটমট করে বললো। 

    –ভাইয়াআআ,,

     

    সাহিল নিশানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো। 

    –ভাই এখনো সময় আছে। ভেবে দেখ এতো আটা ময়দা কি আমদানি করতে পারবা? শেষে না আবার তোমাদেরও না খেয়ে থাকতে হয়।

     

    ইহান এবার বলে উঠলো। 

    –চুপ করতো সাহিল শুধু শুধু বেচারিকে জ্বালাচ্ছিস কেন?  নাহয় বস্তাখানিক আাটাই মেখেছে। এক বস্তার উপরে তো আর যায়নি। নিশান তুমি এতটুকু তো এফোর্ট করতেই পারবে তাইনা?

     

    ইহানের কথায় আরও একদফা হাসির রোল পড়লো। রাইসা অভিমানী সুরে বললো। 

    –ইহান ভাইয়া তুমিও?

     

    এদের কথা শুনে নিশান বলে উঠলো। 

    –চিন্তা করবেন না ভাইয়া আমি আগে থেকেই আটা,ময়দার ফ্যাক্টরি কিনে রেখেছি। তাই আপনার বোনের কম পরবেনা আশা করি। 

     

    সাহিল বলে উঠলো। 

    –বাহ এই না হলে আদর্শ স্বামী। “মুগাম্বো খুশ হুয়া”। যাও আমার বোন আজ থেকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। যাও জিলো আপনি জিন্দেগী। 

     

    এভাবে হাসি আনন্দের মাঝেই দেখাদেখির পর্ব শেষ হলো। এক সপ্তাহ পর বিয়ের ডেট ফিক্স করা হলো। কথাবার্তা শেষে এলিসা বেগম সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন। 

    — কথাবার্তা তো অনেক হলো। এবার গবর(খাবার) খেয়ে নিন। আজকের সব গবর রাইসা নিজের হাতে রান্না করেছে। গবর অনেক গাঁজা( মজা) হয়েছে। আপনারা গবর খেয়ে নিজেদের আঙুল চাটবেন।

     

    এলিসা বেগমের মহান বানি শুনে নিশানের পরিবারের বমি করে দেওয়ার উপক্রম। তারা অনেক কষ্টে ওখানে বসে আছে। ব্যাপার টা বুঝতে পেরে সাহিল বলে উঠলো। 

    –আরে মামীর কথায় কিছু মনে করবেন না। উনি খাবার খাওয়ার কথা বলছেন। আসলে উনি  আমাদের ফিরাঙ্গি মামী তো, তাই একটু ভুলভাল

     বাংলা বলে ফেলেন।

     

    সাহিলের কথায় ওরা একটু সস্তি পেল। বেচারারা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। শেষমেষ ওদের সত্যি সত্যিই  গবর না খেতে হয়। 

     

    খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। সাহিল খেয়াল করলো নিশানের ছোট ভাইটা বারবার শুধু সারার দিকেই তাকাচ্ছে। নানান বাহানায় সারার সাথে কথাও বলার চেষ্টা করছে। আর সারা গাধীটাও কি সুন্দর ছেলেটার সাথে হেঁসে কথা বলে যাচ্ছে। যেন পুরানো বন্ধু ফিরে পেয়েছে। রাগে শরীর রি রি করছে সাহিলের। কিন্তু লোকজনের সামনে কিছু বলতেও পারছে না। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। 

     

    ছেলেটা হঠাৎ নিজের প্লেট থেকে এক পিচ কাবাব সারার প্লেটে তুলে দিয়ে ন্যাকামি করে বললো। 

    — এটা তুমি খাও। একটু বেশি বেশি খেয়ে শরীরে শক্তি বানাও। 

    কথাটা বলে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো। 

     

    ব্যাস সাহিলের মাথা গরম করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল।  এমনিতেই সাহিল একটু শর্ট টেম্পার্ট। অল্পতেই রেগে যায়। আর এই দৃশ্য দেখে তো ওর রাগ এবার চরম পর্যায়ে উঠে গেছে। সাহিল চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে সারার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো। 

    –অনেক খেয়েছিস। আর খেতে হবে না।  যা রুমে যা। 

     

    সারা সাহিলের কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো। 

    –কেন?  এখুনি কেন যাবো? আমার খাওয়া শেষ হয়নি। 

     

    সাহিল এবার একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো। 

    –বললাম না রুমে যা। কত খেতে হয় তোর হ্যাঁ? এখন কি অন্যের টাও খাওয়া শুরু করবি নাকি?

     

    সবার সামনে এভাবে কথা বলায় সারার প্রচুর অপমান বোধ হলো। চোখ দুটো ছলছল হয়ে এলো। লোকটা এতো খারাপ কেন? এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে বলতে পারলো উনি? আর কখনো খাবোই না আমি। সারা প্রচন্ড অভিমান করে কাঁদো কাঁদো চোখে ওখান থেকে দ্রুত পায়ে চলে গেল। 

     

    তনিমা বেগম একটু শাসনের সুরে বলে উঠলো। 

    — এই সাহিল তুই মেয়েটার সাথে এমন করলি কেন? সবার সামনে এভাবে কেউ বলে? শুধু শুধু মেয়েটার মন খারাপ করে দিলি। এতো রাগ আসে কোথাথেকে তোদের? 

     

    সাহিল কিছু না বলে সে নিজেও ওখান থেকে উঠে চলে গেল। সবার সামনে যে সারাকে এভাবে বলা ঠিক হয়নি তা নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে ও। কিন্তু ওইসময় এতো পরিমাণ রাগ উঠে গিয়েছিল। তাইতো নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। 

     

    রাত ১২ টা

    নিঃশব্দে দরজা খুলে নিরব পায়ে অন্ধকার রুমে ঢুকলো সাহিল। একটুখানি এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল ওর পিচ্চি পরিটা ঘুমিয়ে আছে। সারার মাথার কাছে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলো সাহিল। মায়া ভরা চোখে তাকালো পরিটার দিকে। কান্নার দাগ এখনো লেগে আছে সারার গালে। নাকের ডগাটা এখনো লাল হয়ে আছে। সারা যে কান্না করতে করতেই ঘুমিয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই সাহিলের।  বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। 

     

    আস্তে করে হাতটা উঠিয়ে সারার মাথায় পরম আদরে বুলিয়ে দিতে লাগলো। তুই এতো ছোট কেন হলি পরি? আরেকটু বড়ো কেন হলিনা? কেন এতো অবুঝ তুই? কবে একটু বুঝবি আমায়? আমি যে আর পারছিনা। আর ছোটই যখন হলি, এই আমাকে কেন নিজের মায়ায় আটকালি? আমি যে তোর মায়া থেকে নিজেকে কিছুতেই দূরে রাখতে পারি না। চেষ্টা তো কম করিনি। অরণ্য ভাইয়ার সাথে নিউইয়র্ক চলে গেলাম শুধুমাত্র তোর মায়া কাটানোর জন্য। তবুও কাজের কাজ কিছুই হলোনা। সময়ের ব্যবধানে সেই তুই আরও বেশি করে আমার মন মস্তিষ্ক জুড়ে ভর করে নিলি। এখন তো আমি বলতে আমার মাঝে আর কিছুই নেই। সবটা জুড়েই শুধু তুই আছিস। 

     

    সাহিল আরও কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে সারাকে দেখতে লাগলো। তারপর সারার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে উঠে এলো। যাওয়ার আগে সারার বালিশের পাশে এক বক্স চকলেট রেখে যেতে ভুললো না। সাহিল জানে চকলেট দেখলে সারার সব মন খারাপ গায়েব হয়ে যাবে।

    ______

     

    ব্যালকনির গ্রিলের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে মায়া। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের বিশাল চাঁদ টার দিকে। বিছানায় শুয়ে ওর ঘুম আসছিল না। আজকাল কেন যেন মাঝেমধ্যেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। তখন আর ঘুম আসে না ওর। মনটা কেমন অশান্ত হয়ে ওঠে। তাই ফ্রেশ এয়ার নেওয়ার জন্য ব্যালকনিতে এসে বসে আছে। মনের মাঝে নানান অবান্তর খেয়াল ঘুরপাক খাচ্ছে। যেসব নিয়ে ও ভাবতে চায়না সেসব খেয়ালই ঘুরেফিরে ওর মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে। যেমন আজকাল হঠাৎ করেই অরণ্যের কথা মনে পড়ে যায়। আর তখন বুকের ভেতর টা কেমন অস্থির হয়ে যায়। যদিও মায়া এসব একদমই ভাবতে চায়না। কেনই বা চাইবে সেতো জানে ওসব শুধুই মিথ্যে মোহ ছাড়া আর কিছুই না। বাস্তবতা বড়ই কঠিন। তাই সেটাকে মনে রেখে চলায় শ্রেয়। 

     

    মায়া জানেও না এক জোড়া চোখ তাকে দেখেই মনের খোরাক মেটাচ্ছে। অরণ্য রাস্তায় গাড়ির ভেতর থেকে মায়াকেই দেখে যাচ্ছে। রাত দশটার থেকে এখানে গাড়ি নিয়ে বসেছিল অরণ্য। আজ মায়া ভার্সিটিতে যায়নি। তাই অরণ্য ভার্সিটিতে মায়াকে দেখতে পায়নি। মনটা প্রচুর অস্থির হয়ে ছিল। তাই অফিস থেকে  সোজা এখানেই চলে এসেছে। তবে ভেতরে যায়নি। এতরাতে ভেতরে ঢুকলে সবাই নানান প্রশ্ন করবে তাই আর ভেতরে ঢুকেনি। তখন থেকে এখানেই বসে আছে। মায়াকে একনজর দেখার আশায়। অনেকক্ষণ পরেও মায়াকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে অরণ্য ফিরে যাচ্ছিল। তখনই মায়া ব্যালকনিতে এলো। আর অরণ্যের অশান্ত মনটা আবারও তার প্রশান্তি খুঁজে পেল। 

     

    জোছনার স্নিগ্ধ আলোয় মায়াকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও। মায়ার দিঘল কালো চুলগুলো বাতাসে ঢেউ খেলছে। চাঁদের আলোয় মায়াকে আরও মায়াবী লাগছে। এ যেন এক অনাবিল সুখশান্তির প্রচ্ছায়া। অরণ্যের মনে হচ্ছে সময় টা এখানেই থমকে যাক। ও যেন মায়াকে এভাবেই দেখে যেতে পারে। 

     

    তবে বাস্তবতার কঠিন মুখটা অরণ্যকে সেই খুশিটা বেশিক্ষণ পেতে দিলোনা। মায়া একটু পরে উঠে রুমে চলে গেল। আর অরণ্যও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসার দিকে গাড়ি ঘুরালো। এভাবে যে কতদিন চলবে তা জানা নেই  অরণ্যের। তবে আপাতত ওর হাতে কিছুই নেই। মায়াকে একনজর দেখাটাই যে ওর নিঃশ্বাসের খোরাক। নাহলে হয়তো ও দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবে।

    _____

     

    তনিমা বেগম আর সারা বসে আছেন রিয়াদের বাসায়। সামনেই বসে আছেন রিয়ার মা। তনিমা বেগম রাইসার বিয়ের জন্য দাওয়াত দিতে এসেছেন। আর মায়াকে নিয়ে যেতে এসেছেন। আসলে সারা কাল থেকে অনেক জিদ করছিল, সে মায়াকে বিয়ের জন্য ও বাড়িতে নিয়ে যাবে। তাই সারা আর রাইসার আবদার রাখতেই তনিমা বেগম এসেছেন মায়াকে নিতে। আর রিয়ার মাকেও সেইকথা বলেছেন উনি।

     

    কথাটা শুনে রিয়ার মা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। মায়াকে ও বাড়িতে পাঠানোর ইচ্ছে তার মোটেও নেই। সে কোন রিস্ক নিতে চায়না। যদি কিছু হয়ে যায় তখন? মায়া যদি কাওকে কিছু বলে দেয় তখন? কিন্তু এনাদের তো আর সেটা বলা যাচ্ছে না। আর মেয়ের শশুর বাড়ির লোককে মানাও করতে পারছে না। এতো বারবার করে রিকুয়েষ্ট করছে। মানা করলে খারাপ দেখাবে। শিউলি বেগম কোন একটা বাহানা দিয়ে রুমের ভেতরে এসে রিয়াকে ফোন করলো। ফোন রিসিভ করলে শিউলি বেগম বলে উঠলো। 

    –রিয়া এখন আমি কি করি বলতো?তোর শাশুড়ি তো তোর ননদের বিয়ে উপলক্ষে  মায়াকে নিয়ে যাওয়ার বেগ ধরে বসে আছে। 

     

    রিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বললো।

    –আরে পাঠিয়ে দাও। এতো টেনশনের কি আছে? 

     

    –টেনশনের কি আছে মানে?  তুই জানিস না টেনশনের কি আছে? যদি ওই মেয়ে একবার মুখ খুলে দেয় তাহলে কি হবে তুই জানিস?

     

    –আরে মা কিছুই হবে না। আমিতো আছিই। ওই আশ্রিতার এতো সাহস নেই কাওকে কিছু বলার। কারণ ও জানে ওর মতো কালিকে কেউই মেনে নিবে না। বরং ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।

     

    শিউলি বেগম মনে মনে বললো, আরে গাধি তুইতো আর জানিস না ওই কালিকেই অরণ্যের মনে ধরেছিল। আর বিয়েটাও সে ওকেই করতে চেয়েছিল। যদি মায়া সেটা জানতে পারে তখন কি হবে?  

    শিউলি বেগমের ভাবনার মাঝেই রিয়া আবার বলে উঠলো। 

    –আরে মা এতো ভাবার দরকার নেই। কিছুই হবে না। বরং আমার জন্য একটু ভালো হবে। ওকে দিয়ে আমার সব কাজগুলো করিয়ে নিতে পারবো। এই বাড়িতে এমনেই অনেক কাজ থাকে। তারওপর এরা আবার বিয়ের আয়োজন করে নিয়েছে। এখন তো আরও কাজের ঝামেলা থাকবে। তাই মায়া আসলে একদিক থেকে আমার সুবিধাই হবে। আমার তখন অতো কাজ করতে হবে না। সব ওকে দিয়ে করিয়ে নিবো।

     

    –ঠিক আছে তুই যখন বলছিস তাহলে পাঠিয়ে দিলাম। তবে তুই ওর ওপর নজর রাখিস। কোনো চালাকি যেন না করতে পারে। 

     

    –ঠিক আছে তুমি চিন্তা করোনা। 

     

    সারা সেই কখন থেকে মায়ার রুমে এসে মায়াকে তাড়া দিচ্ছে রেডি হওয়ার জন্য। মায়া কতবার বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সারা কোন কোথায় কানে নেওয়ার পাত্রী না। মায়া রেডি হচ্ছে না দেখে সারা নিজেই মায়ার ব্যাগ বের করে মায়ার কাপড়চোপড় বের করে ব্যাগে ঢুকাতে লাগলো। মায়া কোনমতেই সারাকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না।  তখনই শিউলি বেগম মায়ার রুমে এলো। সারার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো। 

    –সারা মা তুমি একটু বাইরে গিয়ে বসো কেমন? তোমার মায়া আপু একটু পরেই আসছে। 

     

    সারা মাথা ঝাকিয়ে চলে গেল। শিউলি বেগম মায়ার সামনে এসে বললো। 

    –রিয়ার শাশুড়ী অনেক জিদ করছে। তাই মানা করতে পারছিনা। তুই যা ওদের সাথে। তবে হ্যাঁ কোনরকম চালাকি করার চেষ্টা করবি না। কাওকে কিছু বলবি না খবরদার। ওরা সত্যি জানতে পারলে কিন্তু তোর মামাকে জেলে ভরবে মনে রাখিস।

     

    মায়া কিছু না বলে শুধু মাথা ঝাকালো। সে এমনিতেও কিছু বলতো না। বললেই বা কি হবে? শুধু নিজেরই তামশা হবে। মায়ার তো ও বাড়িতে যাওয়ারও কোনো ইচ্ছে নেই। ও বাড়িতে গেলে ওকে অরণ্যের মুখোমুখি হতে হবে। যেটা সে চায়না। কিন্তু সারাকে মানা করলেও মেয়েটা কষ্ট পাবে। তাই সারা আর রাইসার মন রাখার জন্য মায়ার না চাইতেও যেতে হচ্ছে। 

     

    একটু পরে মায়া রেডি হয়ে বাইরে তনিমা বেগম আর সারার কাছে এলো। সারার খুশী আর দেখে কে। খুশিতে লাফাচ্ছে ও। মায়া তনিমা বেগমের সামনে এসে সালাম দিল। তনিমা বেগমও মুচকি হেসে সালামের উত্তর নিল। আজই প্রথম তনিমা বেগম মায়াকে দেখলো। মেয়েটার চেহারায় এক অদ্ভুত মায়া আছে।  মেয়েটা যে সরল মনটা সেটা দেখেই বুঝতে পারলেন তিনি। এজন্যই বুঝি সারা আর রাইসার মায়াকে এতো পছন্দ। 

     

    একটু পরে সবাই রওয়ানা হলো।  মায়া জানে না ও বাড়িতে যাওয়া টা ঠিক হচ্ছে কিনা। তবে এখন আর ভেবেও লাভ নেই। ভাগ্যের লিখনে যা লিখা আছে তাই হবে।

     

    চলবে…….

    ( অরণ্য চরিত্র টা নিয়ে অনেকে নানান কথা বলছেন। তাই অরণ্যের চরিত্র সম্পর্কে কিছু কথা। 

    অরণ্যের চরিত্র কিন্তু আদিত্যের চরিত্রের মতো না। অরণ্য একটা বাস্তব ধর্মী চরিত্র। অরণ্য আদিত্যর(মরুর বুকে বৃষ্টির নায়ক) মতো কোন গ্যাংস্টার না। সে চাইলেই মন মতো যা খুশি তাই করতে পারে না। তার ওপর পরিবারের একটা দায়িত্ব আছে। তাকে পরিবারের দিকটাও দেখতে হয়।  তাই বলে সে বোকা বা দূর্বল না। তার একটা স্ট্রং পার্সোনালিটি আছে।

    অনেকে বলছে মায়ার কালো রং দেখেনি কেন? তো বলতে চাই, মায়াকে যেদিন প্রথম দেখেছিল। সেদিন কিন্তু দূর থেকে দেখেছিল। আর সময়টাও প্রায় সন্ধ্যা ছিল। তাইতো অরণ্য মায়াকে সন্ধ্যামালতী বলে ডাকে। তো ওই সময় মায়ার গায়ের রং টা চোখে পড়ার কথা না। আর ছবিটাও দূর থেকেই তুলেছিল। তারওপর বোরকা পরা ছিল। তাহলে এখানে গায়ের রং বোঝা তো ইম্পসিবল। আর বিয়ের সময়ের কথা বললে, বিয়ের সময় মায়াকে শুধু অল্প কিছুক্ষণের জন্যই আনা হয়েছিল। তো অতটুকু সময়ে তো আর মানুষ খুটেখুটে সবকিছু দেখবে না। কারণ সে বা বাকিরা তো আর জানে না যে বউটা পাল্টে যাবে। আমরা একটু ভালো করে দেখে নেই।

    আর কথা আসে অরণ্যের রিয়াকে সন্দেহ করার। তো অরণ্য রিয়াকে কেন সন্দেহ করবে? সেতো আর এটা ভাবছে না যে তার বউ হয়তো পাল্টে গেছে। সেতো ভাবছে তার ভুলের জন্য সে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। মানুষ সন্দেহ তাকেই করে যাকে আগে থেকে চিনে বা তার স্বভাব সম্বন্ধে ধারণা থাকে। এখানে তো আর অরণ্য জানে না রিয়া আর ওর মা কেমন মানুষ। তারা যে এতবড় একটা ষড়যন্ত্র করেছে সেটার কোন ধারনাই নেই অরণ্যের। তাহলে সে কিসের ভিত্তিতে সন্দেহ করবে। বরং তার কাছে তো রিয়া নিজেই এসবের ভুক্তভোগী। তবে পরবর্তীতে কি হবে সেটা বলা যাচ্ছে না।

    আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন। এরপরও যদি আপনারা না বোঝেন তাহলে আমার কিছু করার নেই। 

     

    ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন) 

     

    #মায়ারণ্যে

    #লেখিকা-মেহরুমা নূর

    #পর্ব-৮

     

    ★ সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার কে রাতের ঘনকালো অন্ধকারে ঘিরে ফেলেছে। সময় গড়িয়ে নয়টার কাটায় থেমেছে। মায়া এবাড়িতে এসেছে সেই দুপুর বেলা। আসার সময় যতটা ভয় আর জড়তা কাজ করছিল। এখন সেটা অনেকটাই কেটে গেছে। মায়া এবাড়ির লোকজনের সাথে খুব সহজেই মিশে গেছে। এবাবড়ির লোকজনও মায়ার সাথে সহজেই কম্ফোর্টেবল হয়ে গেছে। যেন মনেই হচ্ছে না সে এবাড়ির মেহমান। মায়া  নিজেও বিষয় টা দেখে একটু অবাক হয়েছে। ওতো ভেবেছিল ধনী লোকেরা বুঝি অনেক অহংকারী হয়। ওর সাথে হয়তো কথাও বলতে চাইবে না। কিন্তু এরা কতো সুন্দর ওকে নিজের পরিবারের মতো আপন করে নিয়েছে। 

     

    মায়াকে অরণ্যের পরিবারের সবার কাছে ভালো লেগেছে। মেয়েটা সত্যিই ভারি মিষ্টি এবং মায়াবী। চেহারায় এক নিস্পাপ মায়া আছে। সবার সাথে সময় কাটাতে কাটাতে কখন সময় কেটে বুঝতেই পারেনি মায়া।

     

    অরণ্য অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে ড্রয়িং রুমের সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। শরীরের সাথে মনটাও ক্লান্ত আজ। আজও মায়াকে ভার্সিটিতে দেখতে পায়নি অরণ্য। তাইতো আজকের দিনের শান্তির খোরাক টুকু পায়নি অরণ্য। সোফায় বসে পেছনে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো। 

    –মা.. একটু পানি দাও তো।

     

    তনিমা বেগম রান্নাঘরে কিছু কাজ করছিলেন। মায়াও ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল আর টুকটাক হেল্প করছিল। অরণ্যের আওয়াজ কানে আসতেই মায়ার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সারাদিন ভালোই ছিল। তবে এখন মনের মাঝে আবারও সেই উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল। মায়ার মনের তোলপাড়কে আরও শতগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তনিমা বেগম বলে উঠলো। 

    — মায়া একটা কাজ করোতো একটু। আমার হাতে আটা লেগে আছে। তুমি একটু অরণ্যের জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে যাবে? 

     

    মায়া চমকে উঠে বললো। 

    –আ আমি?

     

    –হ্যাঁ। আসলে রিয়া বউমাও নিজের রুমে আছে বোধহয়। তাই তোমাকে বলতে হচ্ছে। একটু যাবে?

     

    অনিচ্ছা সত্ত্বেও তনিমা বেগমের কথার মান রাখতে মায়া পানির গ্লাস ট্রেতে করে বাইরে নিয়ে গেল। অরণ্যেকে দেখে বুকের কম্পন আরও বেড়ে গেল। অরণ্য এখনো ওভাবেই হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মায়া অরণ্যের সামনে এসে গলা খাঁকারি দিলো। অরণ্য চোখ খুলে মাথা তুলে সামনে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। মায়াকে চোখের সামনে দেখে অরণ্যের মনে হলো ও নিশ্চয় কোন ভ্রম দেখছে। হ্যাঁ ভ্রমই হবে। মায়া কি করে এখানে থাকবে? আমার মাথাটা সত্যিই গেছে। সব জায়গায় শুধু মায়কেই দেখতে পাচ্ছি। মনে মনে এসব ভেবে মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললো। 

    –কেন এতো জ্বালাচ্ছ?  কেন যাওনা মনের ঘর থেকে?

     

    মায়া ভ্রু কুঁচকে বললো। 

    –জ্বিহ?? কিছু বললেন?

     

    মায়ার কন্ঠ কানে আসতেই ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো অরণ্য। বিস্মিত চোখে তাকালো মায়ার দিকে। ওকি সত্যিই দেখছে? তাহলে কি মায়া সত্যিই এখানে? অরণ্য উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললো। 

    — মায়া? তুমি সত্যিই এখানে?

     

     অরণ্যের এমন আজব প্রশ্নে মায়া কপাল কুঁচকে বলে উঠলো। 

    –জ্বিহ?? 

     

    অরণ্য নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো। 

    –সরি আসলে হঠাৎ করে তোমাকে দেখলাম তো,তাই একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তা কেমন আছ? কখন আসলে?  

     

    মায়া জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো। 

    — জ্বি ভালো আছি। আর দুপুরে এসেছি। 

     

    তখনই সারা এসে বললো।

    –আমি মায়া আপুকে নিয়ে এসেছি। রাইসা আপুর বিয়ের জন্য। বিয়ে পর্যন্ত আপু আমাদের এখানেই থাকবে। অনেক মজা হবে। ভালো করেছি না ভাইয়া?

     

    তারমানে মায়া বিয়ে পর্যন্ত এবাড়িতেই থাকবে? অরণ্যের চোখের সামনেই থাকবে? যখন খুশি মায়াকে দেখতে পাবে অরণ্য? অরণ্যের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। এ যেন মেঘ না চাইতেই সোজা বর্ষণের ঘনঘটা। নিজের খুশী ব্যাক্ত করার কোন উপায়ন্তর খুঁজে পাচ্ছে না। সারার প্রতি আজকে যেন সব ভালোবাসা উপসে পড়ছে অরণ্যের। এমন একটা মহৎ কাজের জন্য সারাকে অসকার দিতে ইচ্ছে করছে ওর। অরণ্যের বিস্ময়ে ছেদ পড়ে মায়ার কথায়। মায়া পানির গ্লাস রাখা ট্রেটা একটু সামনে এগিয়ে ধরে বললো। 

    –আপনার পানি।

     

    অরণ্য নিজের ইমোশনকে একটু কন্ট্রোল করে নিয়ে মুচকি হেসে পানির গ্লাস টা হাতে তুলে নিলো। এক চুমুকে সব পানি খেয়ে নিল। যেন একটুখানি পানিও গ্লাসে অবশিষ্ট থাকলে মায়া ওকে লাঠিপেটা করবে। আসলে অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে অরণ্য কি রেখে কি করবে বুঝতে পারছে না। পানি খাওয়া শেষে গ্লাসটা আবারও মায়ার হাতে থাকা ট্রেতে রেখে মায়ার দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ বললো। মায়া সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে আবারও কিচেনের দিকে চলে গেল। অরণ্য মায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। 

     

    মায়া যেতেই অরণ্য সারার দিকে ঘুরে হঠাৎ সারাকে জড়িয়ে ধরলো। আচমকা জড়িয়ে ধরায় সারা একটু অবাক হয়ে বললো। 

    –কি হয়েছে ভাইয়া?  

     

    অরণ্য সারাকে ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো। 

    –আই লাভ ইউ বইনা। তুই আমার সত্যিকারের বোন। আজ আমি অনেক খুশী বল তুই কি চাস? যা চাবি তাই পাবি। আজ তোর প্রতি বেশিই ভালোবাসা আসছে আমার।

     

    সারা খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে বললো।

    –সত্যিই? ওয়াও ঠিক আছে আমি এখনি গিয়ে সবকিছুর লিস্ট করে আনছি।

    কথাটা বলেই সারা নিজের রুমের দিকে দৌড়ালো। এতোবড় অফার হাতছাড়া করা যাবে না। ভাইয়ার মন বদলানোর আগেই লিস্ট দিয়ে দিতে হবে। 

     

    আর অরণ্য ওখানেই সোফায় বসে পড়লো। ওর আর এখান থেকে রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেও রুমে ঢুকে রিয়াকে দেখলেই অরণ্যের মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। অরণ্য চেষ্টা করেও রিয়ার সামনাসামনি থাকতে পারে না । ইদানীং তো রিয়ার উপস্থিতিও কাঁটার মতো বিঁধে ওর কাছে। তাইতো অতিরিক্ত দরকার ছাড়া অরণ্য নিজের রুমে বেশিক্ষণ থাকেই না। রাতেও অরন্য অনেক দেরি করে রুমে ঢুকে ততক্ষণে রিয়া ঘুমিয়ে যায়। আর অরণ্য গিয়ে ব্যালকনির ডিভানে গিয়ে ঘুমায়। রিয়ার সাথে এক বেডে তো দূরের কথা, এক রুমে থাকতেও ওর অস্বস্তি লাগে। 

     

    অরণ্য এখানে থাকলে হয়তো আবারও আসতে যেতে মায়াকে দেখতে পাবে। সেই আশায় এখানেই বসে রইলো সে। টিভি চালু করে বসে রইলো। আর আরচোখে মাঝে মধ্যে কিচেনের দিকে উঁকি দিয়ে মায়াকে দেখার চেষ্টা করছে। অরণ্য জানে ও যা করছে তা হয়তো অনুচিত। ভাগ্যের নির্মম খেলায় ভুল মানুষের হলেও,সেতো এখন বিবাহিত। আর বিবাহিত পুরুষ হয়ে এভাবে অন্য নারীর প্রতি মুগ্ধ হওয়া টা ঠিক না। কিন্তু ওর কিছু করার নেই। মনের হাতে যে পরাস্ত সে। সে চাইলেও মায়াকে ভুলতে পারে না।চেষ্টা তো কম করেনি। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। মায়ার প্রতি তার অনুভূতি গুলো দিনদিন বাড়ছে বই কমছে না। মায়াকে শুধু একনজর দেখার জন্য সে হাজারও কষ্ট সহ্য করতে পারবে। তবে মায়াকে দেখতে না পেলে যে তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে। তাইতো বেঁচে থাকার তাগিদে হলেও মায়াকে তার দেখতেই হবে। 

     

    মায়া সেই যে গেল আর বের হচ্ছে না। অরণ্যের আবারও একটু মায়াকে দেখতে ইচ্ছে করছে। অরণ্য একটু গলার আওয়াজের বাড়িয়ে বলে উঠলো। 

    –মা আআ, আমাকে এক কাপ কফি দাও তো।

     

    অরণ্য অধীর আগ্রহে বসে রইলো। মনে মনে শুধু আশা করছে মায়াই যেন ওর কফিটা নিয়ে আসে। পাঁচ মিনিট পর সত্যি সত্যিই মায়া এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি নিয়ে হাজির হলো। অরণ্যের খুশি আর দেখে কে।মায়া কফির মগটা অরণ্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো। 

    –আন্টি কাজ করছিল তাই আমাকেই আনতে বললো।

     

    অরণ্য মুচকি হেসে কফির মগটা হাতে নিয়ে মায়াকে সোফায়া বসতে বললো। মায়া একটু ইতস্তত করলেও অরণ্যের কথা রাখতে সোফায় বসে পড়লো। অরণ্য বললো। 

    — ধন্যবাদ মায়া। আর সরি তোমাকে কষ্ট দিলাম।

     

    মায়া স্মিত হেসে বললো। 

    –আপনার বোধহয় সরি বলাটা হ্যাবিট। কথায় কথায় সরি বলে দেন। থ্যাংক ইউ আর সরি এই দুটো শব্দ যেন বাঙালির ফেবারিট। ঠুস ঠাস বলতে পারলেই নিজেকে ইংরেজ মনে করে।

     

    অরণ্য হালকা হেঁসে বললো।

    –বাপরে তুমিতো দেখছি ঝাঁসি কি রানীর মতো রীতিমতো আন্দোলন শুরু করে দিয়েছ। এখন তো তোমার সামনে থ্যাংক ইউ, সরি বলতেই ভয় লাগবে।

     

    — তেমন কিছু না। তবে কথায় কথায় থ্যাংক ইউ সরি বলাটা আমার মোটেও পছন্দ না। যে জিনিস মন থেকে ফিল করে না বলেন তার কোনো মূল্য থাকে না। শুধুমাত্র তখনই বলা উচিত যখন এটার সঠিক কারণ থাকে। আর আপনি মন থেকে ফিল করে কথাটা বলেন। তখনই কথাটার সঠিক গুরুত্ব পায়।

     

    মায়ার কথাগুলো সত্যিই মনোমুগ্ধকর। যেমন মায়া, তেমনি তার চিন্তাধারা। মায়ার কথায় বোঝা যায় মেয়েটা কতো সুশৃঙ্খল আর গোছানো। অরণ্য মুগ্ধ হয়ে মায়ার বাণী শ্রবণ করছে। মায়া অরণ্যের দিকে তাকাতেই মায়ার চোখাচোখি হয়ে গেল। মায়া অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। ও ভেবে পায়না এই লোকটার সামনে এতো নির্দ্বিধায় কিভাবে কথা বলে ফেলে ও? যেন কতো আপন কেউ। আপন?  কি ভাবছি আমি এসব?  এসব ভাবা ঠিক না। আমি তো একজন অপরাধী। সত্যি টা জানলে সে বা এই পরিবারের কেউই আমাকে মাফ করবে না। তাই এসব মিথ্যে মোহে নিজেকে ডোবানো যাবে না। এসব ভেবে মায়া কিচেনের কথা বলে আবারও উঠে চলে গেল। 

     

    কিছুক্ষণ পরে সবাই ডিনারের জন্য নিচে এলো। রিয়াও নিচে এসে সোজা ডাইনিং টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। যেন সে এবাবাড়ির মেহমান। ব্যাপার টা মায়ার কাছেও কেমন যেন লাগলো। বাড়ির বউয়ের এমন উদাসীনতা টা কেমন চক্ষুসুলভ মনে হলো না। অন্তত বাড়ির কাজে কিছুটা হেল্প তো করা উচিত। মায়া আরও একটা বিষয় খেয়াল করলো। রিয়া অরণ্যের ব্যাপারেও কেমন উদাসীন। অরণ্য সেই কখন অফিস থেকে ফিরেছে। অথচ রিয়ার সেদিকে কোন উদ্বেগই নেই। থাক, আমার এসব ভেবে লাভ নেই। এটা ওদের পার্সোনাল ব্যাপার।

     

    খাবার টেবিলে সবাই এসে বসেছে মায়া তনিমা আর এলিসা বেগমের হেল্প করছে খাবার সার্ভ করতে। সারা এসে মায়াকে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসালো। পাশেই অরণ্য বসেছিল। মায়া পাশে বসতেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগলো অরণ্যের নাকে। ঘ্রাণ টা কেমন নেশা ধরানো। যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে। অরণ্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটা সত্যিই অনেক ভালো। আজ এতো কাছ থেকে মায়াকে দেখতে পাচ্ছে, আর কি চাই ওর। 

     

    সার্ভ করা হলে তনিমা বেগম আর এলিসাও খাবার খেতে বসে পড়লো। এ বাড়িতে সাধারণত সবাই একসাথেই খায়। খাবার খেতে নিয়ে এলিসা বেগম হঠাৎ কাজের মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো। 

    –আচ্ছা নিলু শোন আমার খাবারে চুন (নুন)  কম দিয়েছিস তো?  তুই তো জানিস আমি আবার বেশি চুন খেতে পারি না। চুন বেশি হলে আমার সমচা (সমস্যা) হয়। পেটে জমজ (হজম)হতে সমচা হয়।

     

    এলিসা বেগমের মহান বাণীতে বাকি সবাই তেমন অবাক না হলেও, বেচারি মায়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এলিসা বেগমের সবকথা মাথার ওপর দিয়ে বাউন্সার গেল। মায়া সারার কানে আস্তে করে বললো। 

    –এলিসা আন্টি কি প্রেগন্যান্ট নাকি? আর ওনার পেটে কি জমজ বাচ্চা আছে? 

     

     মায়ার কথায় সারা উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। মায়া বেচারি আবারও থতমত খেয়ে গেল। সবাই সারাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? সারা কোনরকমে হাসি থামিয়ে সবাইকে মায়ার বলা কথাটা বললো। এবার বাকি সবাইও হেঁসে দিল। সাহিল তখন মায়ার উদ্দেশ্যে বললো।

    –আরে বিয়াইন সাহেবা আপনি তো দেখছি চরম বিনোদন দিতে পারেন। আমাদের জমবে ভালোই। তো বিয়াইন সাহেবা আসলে আমাদের এলিসা মামী ফরেনার তো। তাই বাংলা ঠিকমতো বলতে পারে না।

     

    সাহিলের বিয়াইন বলাটা অরণ্যের কেমন যেন পছন্দ হলো না। তাই অরণ্য বলে উঠলো। 

    –এসব বিয়াইন টিয়াইন শুনতে কেমন অড লাগে। এসব বলার দরকার নেই। 

     

    সাহিল মুচকি হেসে বললো। 

    –ওকে ভাই। এমনিতেও আমি মজা করছিলাম। সবসময় কি আর এভাবে সম্বোধন করতাম নাকি।

     

    এভাবেই হাসি আনন্দের সাথেই সবাই খাওয়া দাওয়া করতে লাগলো। সবাইকে এভাবে একসাথে হাসিখুশি দেখে মায়ার মনে হলো, ঠিক এমনই একটা পরিবার সে নিজের জন্য চেয়েছিল। যেখানে সবাই মিলেমিশে হাসিখুশি থাকবে। কেও কাওকে ছোট করে দেখবে না। দুর্ভাগ্যবসত আজ এমন একটা পরিবার পেয়েও সে পেল না। হয়তো তার কপালে পরিবারের সুখই নেই। কথাগুলো ভেবে বুক চিঁড়ে এক হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মায়ার। খাবার শেষ হলে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেল মায়া। এদের সাথে যত কম জড়ানো যায় ততই ভালো। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে কি লাভ। 

    _______

     

    মায়ার অভ্যাস অনুযায়ী সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল ওর। সারা আর রাইসা এখনো ঘুমে কাঁদা। মায়া ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গায়ের চাদর টা ঠিক করে টেনে দিল। মেয়েগুলো সত্যিই ভারী মিষ্টি। কতরাত পর্যন্ত গল্প করে করে তারপর ঘুমিয়েছে। মায়া বিছানা ছেড়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালো। সকাল বেলার প্রাকৃতিক ঠান্ডা বাতাস টা ওর কাছে অনেক ভালো লাগে। তাই রোজকার মতো আজও ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনিতে চলে এলো। ব্যালকনিতে এসে দুই হাত ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির ঠান্ডা শীতল বাতাস অনুভব করতে লাগলো। কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর মায়া চোখ খুলে ফিরে আসতে নিলেই পাশের বারান্দায় চোখ পড়লো ওর। সারাদের রুম আর অরণ্যের রুমের ব্যালকনি পাশাপাশি হওয়ায় এক ব্যালকনি থেকে আরেক ব্যালকনিতে দেখা যায়।

     

    মায়া দেখলো অরণ্য ব্যালকনির ডিভানে ঘুমিয়ে আছে। এটা দেখে একটু অবাক হলো মায়া। উনি কি সারারাত এখানেই ছিলেন? কিন্তু কেন? আচ্ছা উনি কি রোজই এখানেই ঘুমান? না না কিসব ভাবছি?  রোজ কেন এখানে ঘুমাতে যাবেন? হয়তো এমনি কোন কাজে এসে এখানে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এমনিতেও এসব বিষয়ে আমার না ভাবাই ভালো। তাই মায়া আর দাঁড়িয়ে না থেকে ফ্রেশ হতে চলে গেল।। 

     

    ইহান অনেকক্ষণ হলো এসেছে বাসায়। কিন্তু ইরিনকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ও। তাই এবার ইরিনের রুমের দিকেই পা বাড়ালো ও। ইরিনের দরজার কাছে এসে দেখলো দরজা খোলাই আছে তাই ইহান হাসিমুখে বলে উঠলো।

    –হ্যাল্লো মাই ডিয়ার ইরাবতী… 

     

    কথাটা বলতে বলতে ইহান ইরিনের রুমে ঢুকে পড়লো। ইরিন বেডের ওপর বসে ছিল। হঠাৎ ইহানকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি করে নিজের চোখ মুছে নিল। তবে ইহানের চোখ ফাঁকি দিতে পারলোনা। ইহান ভ্রু কুঁচকে ইরিনের পাশে বসে চিন্তিত সুরে বললো। 

    –কি হয়েছে ইরাবতী?  কাদছ কেন? বলনা?

     

    ইরিন জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো। 

    –কই কি হবে? কিছুই হয়নি। 

     

    –দেখ ইরাবতী মিথ্যে বলার চেষ্টা করোনা। তুমি জানো আমাকে বোকা বানানো অতো সহজ না। তাই জলদি করে বলো কি হয়েছে? 

     

    তখনই ইরিনের ফোন ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। ম্যাসেজ দেখে ইরিন কেমন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। ব্যাপার টা দেখে ইহান ভ্রু কুঁচকে ফোনটা খপ করে হাতে তুলে নিলো। ম্যাসেজ টা দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর। ম্যাসেজ টা ইরিনের এক্স হাসবেন্ড এর। ম্যাসেজ এ লেখা আছে, 

    “আমাকে জেলে পাঠিয়ে ঠিক করোনি তুমি। এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। তুমি কি ভেবেছ আমার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে গেছ? কখনোই না। অনেক জলদি আমি আবারও আসবো”

     

    ইহান ইরিনের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো। 

    –এই হারামিটা ছাড়া পেল কবে?

     

    ইরিন বলে উঠলো। 

    –গতকাল। 

     

    –তারমানে কাল থেকে ওই রাসকেল টা তোমাকে এইসব থমকি ভরা ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে?

     

    ইরিন আলতো করে মাথা ঝাকালো। মানে হ্যাঁ।  ইহানের রাগী কন্ঠে বললো। 

    –আর তুমি কাওকে কিছু না বলে একা একা কেঁদে যাচ্ছো তাইনা? আমার তো ওর থেকে বেশি তোমার ওপর রাগ হচ্ছে। তোমার সাহস কি করে হলো ওর মতো বিচকে ভয় পাওয়ার? তোমার ওর প্রতি এই ভয়টাই ওর আসল জিত তা জানো তুমি? 

     

    ইরিন কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো। ইহান একটু শান্ত হয়ে বললো।

    — আচ্ছা একটা কথা বলোতো। তুমি কখনো ওকে গালি দিয়েছ? 

     

    ইরিন একটু থতমত খেয়ে বললো।

    –কি বলছ এসব?  আমি আর গালি? কখনোই না। 

     

    — ঠিক আছে তুমি ওই রাসকেল টাকে এখুনি ফোন করো।

     

    ইরিন ইহানের দিকে চমকে তাকিয়ে বললো। 

    –কিহহ? কি বলছ এসব?  আমি কেন ওকে ফোন করবো? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? 

     

    –আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আর আজ তোমার মন মস্তিষ্কও একদম হালকা করে দেবো দেখ। তুমি হয়তো ওই মুভি দেখোনি যেখানে কারিনা তাঁর পুরানো প্রেমিক কে মন খুলে ইচ্ছে মতো গালি দেয়। এবং তার মনের সব ধাপ বের হয়ে একদম হালকা হয়ে যায়। তুমিও আজ ট্রাই করো দেখবে একদম মন হালকা হয়ে যাবে। 

     

    –কিসব আবোল তাবোল বলছ? এমনটাও হয় নাকি?

     

    –আরে হয় হয়। তুমি ট্রাই তো করে দেখ। বায়দা ওয়ে তুমি গালি দিতে পারো তো? 

     

    –না না ছি ছি। আমি জীবনেও গালি গালাজ করিনি। 

     

    –আচ্ছা ব্যাপার না। আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাকে একটা কাগজে হাই লেভেলের কিছু এক্সট্রা পাওয়ারফুল গালি লিখে দিচ্ছি। যেটা শুনে ওই রাস্কেলের কান দিয়ে রক্ত বের হয়ে যাবে। 

     

    কথাটা বলে ইহান একটা কাগজে গালি লেখা শুরু করে দিলো। লেখা শেষে ইরিনকে বললো তাকে ফোন করতে। ইরিন এখনও ইতস্তত করছে। বারবার মানা করছে কিন্তু কে শুনে কার কথা। শেষে ইহান নিজেই ইরিনের এক্স হাসব্যান্ড এর নাম্বারে ফোন দিয়ে লাউড স্পিকারে দিয়ে ইরিনের হাতে ফোন ধরিয়ে দিল। ইরিন এখনো প্রচুর নার্ভাস। হাত কেমন কাপছে। ফোনে কল ঢুকছে। এবং একসময় কল রিসিভ হলো। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে লোকটি বলে উঠলো। 

    –কি ব্যাপার ইরিন সোনা, এতো জলদি আমার কথা মনে পড়ে গেল?  ভয় পেয়ে গিয়েছ বুঝি তাইনা? এতই যখন ভয় পাও তাহলে আমাকে জেলে দেওয়ার সাহস কি করে পেলে তুমি?  

     

    ইরিন ভয়ে বারবার ঢোক গিলছে। ওর চোখের সামনে ওই লোকটার নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য গুলো ভেসে উঠছে। ইহান শুধু বারবার ইরিনকে গালি দেওয়ার ইশারা করছে। ইরিন কোনরকমে নিজেকে একটু শক্ত করে কাগজের দিকে তাকালো। 

     

    ওইপাশের লোকটা এখনো বলেই যাচ্ছে। 

    –যাইহোক আমাকে যদি আর রাগাতে না চাও তাহলে জলদি আমার কাছে চলে…

     

    আর বলতে পারলোনা লোকটা। ইরিন কাগজের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো। 

    –কু কুত্তা..

     

    –হোয়াট??

     

    –কুত্তা, হারামি,

     

    লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো। 

    –এই এই কি বলছিস এসব? 

     

    –সয়তান,কাপুরুষ, নাজায়েজ বাপের জারজ সন্তান… 

    ইরিন আবারও গালি দেওয়া শুরু করলো। ধীরে ধীরে ইরিনের কনফিডেন্স আসা শুরু হলো। নিজের মনের জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ পেতে লাগলো। নিজের সাথে করা জুলুম গুলোর কথা মনে করে এবার ক্ষিপ্ত সুরে বলতে লাগলো। 

    –মাতা*** পু*, শুয়ো**  হাজারো বাপের একমাত্র সন্তান।আরে তোকে জানোয়ারের গালি দিলে জানোয়ার কেউ অপমান করা হবে।  তোর সাহস কি করে হলো আমাকে ম্যাসেজ দেওয়ার ? তুই কি ভেবেছিস তোকে দেখে আমি ভয় পেয়ে যাবো? সালা নামরদ, তোকে ভয় পাবে আমার জুতা। আর কোনদিন যদি আমার নাম্বারে ম্যাসেজ বা ফোন দিয়েছিস, তাহলে বাড়িতে এসে চাকু দিয়ে তোর পেট কেটে তোর নাড়িভুড়ি টেনে বের করে তোকে নর্দমায় ফেলে দিয়ে আসবো। সালা ইতর, গন্ডারের বাচ্চা, জানোয়ারের পটি খাইয়ে দেব তো…

     

    ব্যাস আর শুনতে পারলোনা বেচারা। ওর কানে যেন বোম ফাটছে। তাই ঠাস করে ফোনটা কেটে দিল। 

     

    ইরিনের যেন সত্যিই অনেক হালকা লাগছে। মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেক শান্তি লাগছে। ইহান ওর দিকে তাকিয়ে বললো। 

    –কেমন লাগছে এখন?  ভালো লাগছে না? 

     

    ইরিন হঠাৎ আবেগি হয়ে ইহানকে জড়িয়ে ধরলো । যদিও এটা শুধুই একটা ফ্রেন্ডলি হাগ ছিলো। তবে ইহানের কাছে যে এটাই পরম পাওয়া। ইহানের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। ইহান আলতো করে নিজের হাতটা ইরিনের পিঠে রেখে চোখ বন্ধ করে মুহূর্ত টা অনুভব করতে লাগলো। মনে হচ্ছে সময় টা এখানেই থেমে যাক। ইরিন সারাজীবন এভাবেই ওর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ থাকুক। 

     

    একটু পরে ইরিন ইহানকে ছেড়ে দিয়ে বললো। 

    –সরি আমি একটু বেশিই আবেগি হয়ে পড়েছিলাম। থ্যাংক ইউ সো মাচ ইহান। আজ সত্যিই অনেক হালকা লাগছে। তুমি না বললে হয়তো আমার মাঝে এতো সাহস কখনোই আসতো না। 

     

    ইহান দুষ্টু হেসে বললো। 

    –দেখেছ আমি কতো ট্যালেন্টেড বান্দা।এখনো বলছি আমাকে বিয়ে করে নাও। লাইফ সেট হয়ে যাবে। 

    কথাটা বলে ইহান একটা চোখ টিপ মেরে দিল। 

     

    আর সবসময়ের মতোই ইরিন হাসির ছলে সব উড়িয়ে দিল। আর ইহান মায়া ভরা চাহনিতে তার ইরাবতীর হাসি দেখতে লাগলো। 

     

    চলবে……

     

    #মায়ারণ্যে

    #লেখিকা- মেহরুমা নূর 

    #পর্ব-৯

     

    ★রাইসার বিয়ে উপলক্ষে সবাই শপিং মলে এসেছে শপিং করতে। মায়া আসতে চাইছিল না কিন্তু সারার জোরাজুরিতে আসতে বাধ্য হয়েছে। মায়া আসায় অরণ্যেরও ভালো লাগছে। নাহলে হয়তো ও নিজেও আসতো না। 

     

    নিশান আর ওর ভাই জোবানও এসেছে ওদের সাথে শপিং করতে। সবাই মলে ঢুকে মনের আনন্দে নিজেদের মতো শপিং করে যাচ্ছে। বড়ো একটা লেহেঙ্গার দোকানে ঢুকে সবাই লেহেঙ্গা দেখছে। বিয়ের সব ফাংশনের জন্য আলাদা আলাদা লেহেঙ্গা পছন্দ করছে। মায়া শুধু সবারটা দেখে যাচ্ছে। তার এমন অত্যাধুনিক শপিং করার না অভ্যাস আছে না দরকার। দুই তিনটা টিউশনি করে নিজের সব খরচ চালাতে হয় ওকে। অপ্রয়োজনীয় এতো টাকা খরচ করাটা মায়ার পছন্দ না। একটা দিনের জন্য এতো টাকা নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। হয়তো এদের কাছে সব সুবিধা আছে বলেই এরা টাকার মূল্য বোঝে না। যাদের কাছে নেই তারা বোঝে টাকার আসল মূল্য। যত টাকা এরা নষ্ট করছে তা দিয়ে কতো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জামাকাপড় হয়ে যাবে। তবে সবাই যে একইরকম ভাববে সেটাতো আর জরুরি না। ওরা ওদের মনের আনন্দের জন্য খরচ করছে। তাই ওদের দিক দিয়ে ওরা ঠিকই আছে।

     

    নিশানের ভাই জোবান সারার পাশে বসে ওকে নানান রকমের লেহেঙ্গা বেছে বেছে দেখাচ্ছে আর ন্যাকামি করছে। যা দেখে সাহিলের মেজাজ টপফ্লোরে উঠে যাচ্ছে। এই জোবান নামের আইটেম টা যদি নিশানের ভাই না হতো তাহলে এতক্ষণে ওকে দুমড়েমুচড়ে পার্সেলে ভরে নাম না জানা গ্রহে পাঠিয়ে দিতো। তাই আপাতত নিজের রাগটাকে পানি ছাড়াই গিলে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে কোন কিছু না বলে সারার হাতটা শক্ত ধরে ওকে টানতে টানতে দোকানের বাইরে চলে গেল। বেচারা সারা সাহিলের হঠাৎ আক্রমণে থতমত খেয়ে গেল। সাহিলের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলতে লাগলো।

    –আরে কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে। আমার লেহেঙ্গা নেওয়া হয়নি এখনো।

     

     তবে সাহিলের সাথে কি আর ওর মতো ননির পুতুল পেরে ওঠে?  সাহিল যেতে যেতে সবার উদ্দেশ্যে বললো।

    –তোমারা এখানে শপিং করো। আমি সারাকে অন্য কিছু দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। 

     

    সবাই আর তেমন কিছু বললো না। জানে সাহিল শুনবে না। ও অনেক জিদ্দি স্বভাবের। 

     

    সাহিল সারাকে একটা ফাঁকা দোকানে নিয়ে গেল। যেখানে শুধু মহিলা স্টাফ আছে। সাহিল সারাকে দোকানে বসিয়ে দিয়ে স্টাফদের উদ্দেশ্যে বললো।

    –ম্যাডামের যা লাগে দেখান। আর যতক্ষণ আমরা এখানে আছি অন্য কোন কাস্টোমার যেন না আসে। তার জন্য আপনাদের এক্সট্রা পেমেন্ট করা হবে।

     

    কথাটা বলে সাহিল একপাশে গিয়ে বসে পড়লো। আর স্টাফরা সারাকে ড্রেসেস দেখাতে লাগলো। সারা সাহিলের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো। 

    –আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন? আমি ওখানেই সবার সাথে শপিং করবো।

    কথাটা বলে সারা উঠে চলে যেতে লাগলো। তখনই সাহিল পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে বললো। –দোকানের বাইরে যদি পা রেখেছিস তাহলে তোর আজকের সব শপিং বন্ধ। রাইসার বিয়েতে তোকে কিছুই কিনে দেওয়া হবে না মনে রাখিস। 

     

    সারা সাহিলের তাকিয়ে চোখ কুঁচকে তেজী সুরে বললো। 

    –কেন কেন?  আপনি বললেই হলো নাকি? আমার শপিং এর টাকা কি আপনি দিবেন নাকি? আমি আমার বাবার কাছ থেকে যথেষ্ট টাকা নিয়ে এসেছি বুজেছেন?  আর কম পড়লে অরণ্য ভাইয়া দিবে। তাই আপনার কথা আমি কেন শুনতে যাবো?

    কথাগুলো বলে সারা আবারও চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হতেই সাহিল সারার হাত ধরে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো। 

    –আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছিস? দিনদিন দেখছি তোর সাহস বেড়েই চলেছে। আমার কথার অমান্য হলে এর পরিণাম তোর জন্যে মোটেও সুখকর হবে না। তাই নিজের ভালো চাসতো চুপচাপ এখানে বসে যা যা লাগবে কিনে নে। নাহলে আমি তোর সারাজীবনের জন্য শপিং এ আসা বন্ধ করে দিবো মনে রাখিস। 

     

    সারা এতক্ষণ সাহস দেখালেও এবার ও দমে গেল। বেচারির ছোট্ট মাসুম জান,এই রাক্ষস দানবের সামনে কি আর টিকতে পারে? সারার কাছে সাহিলকে রুপকথার ভয়ংকর কোন রাক্ষস দানবের মতো লাগে। যেন এখুনি তার বিশাল দাঁত বের করে তাকে খেয়ে ফেলবে। তাই সারা ভীতু ভাবে মাথা ঝাকালো। মানে সে সাহিলের কথা মানতে রাজি। সাহিল সারাকে ছেড়ে দিলে সারা গিয়ে ওর শপিং করতে লাগলো আর মনে মনে সাহিলকে গালির বন্যায় ভাসিয়ে দিল।

    ___

     

    ইহান একটা লেহাঙ্গার ওড়না ইরিনের কাঁধে রেখে বললো। 

    –ওয়াও ইরাবতী এটাতে তোমাকে অনেক মানিয়েছে। অনেক সুন্দর লাগছে। তুমি এটা ট্রাই করে দেখোনা। 

     

    ইরিন মুচকি হেসে লেহেঙ্গা টা নিয়ে ট্রায়াল রুমে চেঞ্জ করতে গেল। কিছুক্ষণ পর ইরিন চেঞ্জ করে বাইরে এসে ইহানকে বললো।

    –কেমন হয়েছে? 

     

    ইহান কি জবাব দিবে? সেতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। মুদিত নয়নের মুগ্ধতায় সিক্ত হচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আঁখি ভেজাচ্ছে ইরিনের সৌন্দর্যের ঝলকানিতে। ইহানের মুগ্ধতার মাঝেই ইরিন আবারও বলে উঠলো। 

    –কি হলো ইহান?  ভালো লাগছে না?  

     

    ইরিনের কথায় ইহানের ঘোর কাটলো। নিজের পাখা ছড়ানো মনটাকে একটু সামলে নিয়ে মুচকি হেসে বললো।

    –আরে চমৎকার পারফেক্ট লাগছে। একদম নতুন বউ বউ লাগছে। 

    ইহান ইরিনের কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো। 

    –চলো আজই বিয়ে করে ফেলি।

     

    ইরিন আবারও হেঁসে দিয়ে বললো। 

    –ধ্যাৎ তুমিও না। সবসময় শুধু মজা করা।

     

    ইরিন আবারও চেঞ্জ করতে চলে গেল। আর ইহান নিজের ওপর নিজেই হাসলো। সেকি কখনো ইরিনের সামনে মজাটাকে সত্যি প্রমান করতে পারবে? পারবে তার মনে জমে থাকা হাজারো অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে? এতোসব প্রশ্নের মেলা থাকলেও, নেই কোন উত্তরের অবকাশ। 

    কথাগুলো ভেবে ইহান গুনগুন করে গেয়ে উঠলো। 

    ♬ শাহেদ কাভি না কেহ সাকু মে তুমকো

    ♬ কাহে বিনা সামাঝ লো তুম শাহেদ

    ♬ শাহেদ মেরে খেয়ালো মে তু ইকদিন

    ♬ মিলো মুঝে কাহি পে গুম শাহেদ 

    ♬ জো তুম না হো রাহেঙ্গে হাম ভি হাম নেহি

    ♬ না চাহিয়ে তুমছে জিয়াদা তুমছে কাম নেহি

    __

     

    রিয়াতো আসা থেকেই চোখের সামনে যা পছন্দ হচ্ছে কিনেই যাচ্ছে। বাদবাকি আর কিছুর আপাতত হুঁশ নেই ওর। হুঁশ রেখেই বা কি করবে।ওর কাছে তো এগুলোই মোস্ট ইম্পরট্যান্ট। এসবই তো ওর চাওয়া ছিল। আর আজ যখন ওর চাওয়া পুরণ হচ্ছে তখন বাকি কিছু দেখার টাইম নেই। 

     

    অরণ্য কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ছিল। মাঝে মধ্যে মায়াকে দেখছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আশে পাশে তাকাতেই হঠাৎ একটা মানেকুইনে রাখা একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ী দেখতে পেল। শাড়িটা দেখে অরণ্যের কেন যেন মনে হলো, এই শাড়িটাতে সন্ধ্যামালতীকে অনেক মানাবে। শাড়িটাতে মায়াকে কল্পনা করছে অরণ্য। অরণ্যের খুব ইচ্ছে হচ্ছে মায়াকে এই শাড়িতে দেখার। কিন্তু এটা কি সম্ভব?  মায়াকে কিভাবে দিবে এই শাড়ি?  আর দিলেও যে মায়া নিবে তারও সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু তার যে খুব মন চাইছে মায়াকে শাড়িটা দেওয়ার। কিন্তু কিভাবে দিবে? 

     

    কিছুক্ষণ ভাবার পর অরণ্যের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। অরণ্য আস্তে করে রাইসাকে নিজের কাছে ডাক দিয়ে বললো। 

    –শোন তোর ওই শাড়িটা কেমন লাগে?

     

    রাইসা দেখে বললো।

    –অনেক সুন্দর ভাইয়া। তুমি কি ভাবির জন্য নিবে?

     

    –আরে না ও এসব নিবে না। ও ওর পছন্দ মতো শপিং করছে।

     

    –তাহলে কার জন্য নিবে?

     

    –তুই নিবি?  তোকেও কিন্তু ভালো মানাবে।

     

    –কিন্তু ভাইয়া আমিতো সব ফাংশনে লেহেঙ্গা পড়বো। আর লেহেঙ্গা অনেক গুলো চয়েজও করে ফেলেছি। 

     

    —হুমম,তাহলে কাকে দিবো শাড়িটা? আসলে শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। 

     

    রাইসা কিছুক্ষণ ভেবে বললো।

    –ভাইয়া এক কাজ করি মায়া আপুকে দেই। মায়া আপুকে অনেক মানাবে শাড়িটাতে। 

     

    অরণ্য কিঞ্চিৎ বাঁকা হাসি দিল। সেতো এটাই চাচ্ছিল। অরণ্য বললো।

    –কিন্তু মায়া কি নিবে শাড়ী?

     

    –আরে নিবে না কেন? আমি দিবো আপুকে। 

     

    –আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমার কথা যেন বলিসনা। তাহলে হয়তো নিবেনা। বলবি তুই পছন্দ করে দিয়েছিস।

     

    –আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এখুনি গিয়ে দিচ্ছি। 

     

    রাইসা শাড়িটা নিয়ে মায়াকে দিয়ে পড়ে ট্রাই করতে বললো। মায়া অনেক মানা করলেও রাইসার জেদের সামনে মায়া শাড়ি টা নিতে বাধ্য হলো। আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও  মায়া শাড়ি নিয়ে ট্রায়াল রুমে গেল। বোরকা খুলে পাশের হ্যাঙ্গারে রেখে শাড়ি পড়তে লাগলো। মায়াকে শাড়ি নিতে দেখে অরণ্য মনে মনে খুশি হয়ে গেল। ট্রায়াল রুমের একটুখানি দূরেই দাঁড়িয়ে রইলো মায়াকে দেখার আশায়।

     

    অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও মায়াকে বাইরে আসতে না দেখে অরণ্যের একটু চিন্তা হলো। মায়ার কোন সমস্যা হলো নাতো? বাইরে আসছে না কেন? অরণ্য এবার দ্বিধা ভুলে মায়ার ট্রায়াল রুমের বাইরে এসে দরজায় হালকা টোকা দিয়ে বললো। 

    –মায়া?  সব ঠিক আছে তো? আর ইউ ওকে?

     

    ভেতর থেকে কোন আওয়াজ এলো না। অরণ্য আরও ঘাবড়ে গেল। অরণ্য আবারও নক করে বললো। 

    –মায়া কি হয়েছে?  কথা বলছ না কেন?  দরজা খোল। 

     

    একটু পরে দরজা খোলার শব্দ পেল অরণ্য। দরজা হালকা খুলে মায়া ওর মাথাটা হালকা বের করে ইতস্তত ভাবে বললো। 

    –আ আপনি একটু সারা বা রাইসা কাউকে ডেকে দিতে পারবেন প্লিজ? 

     

    –কিন্তু সারাকে তো সাহিল কোনদিকে যেন নিয়ে গেল। আর বাকি মেয়েরাও ড্রেস ট্রায়াল দিচ্ছে। কেন?  কোন সমস্যা হয়েছে?  আই মিন কিছু মনে না করলে আমাকে বলতে পারো।

     

    মায়া অনেক টা ইতস্তত ভাবে বললো। 

    –আ আসলে আমার ব্লাউজের পেছনের হুকের সাথে আমার চুল পেচিয়ে গেছে। আমি কিছুতেই ছাড়াতে পারছিনা। 

     

    –ওহ,কিন্তু এখানে আশেপাশে তো ফিমেল স্টাফও দেখছি না। সব মেল স্টাফ। 

     

    মায়া বেচারি চিন্তায় পড়ে গেল। এখন কি করে বের হবে এখান থেকে? অরণ্য ওর অবস্থা বুঝতে পেরে বলে উঠলো। 

    –দেখ তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে আমি কি তোমার হেল্প করতে পারি? 

     

    মায়া চমকে উঠে বললো। 

    –আ আপনি? 

     

    –হ্যাঁ, মানে তুমি যদি চাও আর কি।ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। আমি চোখ বন্ধ করে নিবো। 

     

    মায়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। আপাতত আর কোন পথও পাচ্ছে না ও।আজ পর্যন্ত কোন পরপুরুষ ওকে ছুতেও পারেনি।তবে এই লোকটার ওপর কেন যেন ওর ভরসা হয়। আর সে মানুক না মানুক এই লোকটা তো তার স্বামী কোন পরপুরুষ তো আর না। তাই আর উপায়ন্তর না পেয়ে পেছনে সরে এসে দরজা টা আরও একটু খুলে দিল মায়া। অরণ্য ভেতরে ঢুকে দেখলো মায়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার দেওয়া সেই নীল শাড়ী। অরণ্যের কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে তাঁর সন্ধ্যামালতীকে। যেন এই শাড়িটা শুধু মায়ার জন্যই তৈরি হয়েছে।আসলে ভালোবাসার মানুষকে বুঝি সব রুপেই অপরুপা লাগে। অরণ্যের মনে হচ্ছে সময়টাকে এখানেই থামিয়ে দিতে, যাতে জনম জনম ধরে অরণ্য মায়াকে এভাবেই দেখে যেতে পারে।

     

    অরণ্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া গলা খাঁকারি দিয়ে অরণ্যের সম্ভূতি ফেরানোর চেষ্টা করলো। অরণ্যের ঘোর কাটলো। অরণ্য আস্তে করে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বললো। 

    –ঘুরে দাঁড়াও। 

     

    মায়া আস্তে করে ঘুরে দাঁড়াল। অরণ্য চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে মায়ার পিঠে হাত রাখলো। পিঠে হাতের ছোঁয়া পড়তেই কেঁপে উঠল মায়া। এই প্রথম কোন পুরুষের ছোঁয়া লাগলো মায়ার শরীরে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মায়ার এতে কেন যেন কোন অস্বস্তি বা খারাপ মনোভাব হচ্ছে না।  যেখানে কোন পরপুরুষের খারাপ চাহুনিতেও মায়ার অস্বস্তি লাগে। সেখানে এই লোকটার ছোঁয়ায় কোন রকম অস্বস্তিই কাজ করছে না। বরং রাজ্যের লজ্জা ঘিরে ধরছে মায়াকে। দেয়ালে টানানো আয়নায় তাকিয়ে দেখলো অরণ্য সত্যিই চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এটা দেখে লোকটার প্রতি ওর ভরসা যেন আরও গাঢ় হয়ে গেল।  অরণ্য হাতের চার আঙ্গুল দিয়ে মায়ার চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দিল। চুল সরানোর সময় অরণ্যের আঙুল গুলো মায়ার খোলা পিঠ ছুঁয়ে গেল। মায়ার হৃদকম্পন আরও বেড়ে গেল। দুই হাতে শাড়ী খামচে ধরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে ওর। অরণ্য হাতড়িয়ে মায়ার হুকে পেঁচিয়ে থাকা চুলগুলো ধীরে ধীরে ছাড়াতে লাগলো। অরণ্য খুবই সাবধানে কাজটা করছে যাতে মায়া কোন ব্যাথা না পায়।

     

    চুল ছাড়ানো শেষ হলে অরণ্য চোখ বন্ধ করা অবস্থায়ই বললো।

    –হয়ে গেছে তাইনা?

     

    অরণ্যের কথায় মায়া চোখে খুলে তাকালো। পিঠে হাত দিয়ে দেখলো সত্যিই হয়ে গেছে। মায়া আঁচল টেনে পিঠ ঢেকে নিয়ে অরণ্যের দিকে ঘুরে বললো।

    –হ্যাঁ হয়ে গেছে, ধন্যবাদ। 

     

    অরণ্য এবার চোখ খুলে তাকালো। মায়ার দিকে তাকাতেই দেখলো মায়ার মুখটা কেমন লাল বর্ন হয়ে উঠেছে। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, মায়া কি লজ্জা পেয়েছে?  কিন্তু আমার জন্য লজ্জা পাবে কেন? আমি নাহয় ওকে ভালোবাসি?  কিন্তু ওতো আর আমাকে সেই নজরে দেখেনা। নাকি দেখে?  ধূরর আমি কি না কি ভাবছি। ওর মতো পবিত্র মেয়ে নিজের মনে আমার জন্য এমন ধরনা হয়তো কখনোই আনবে না।  ওর জন্য তো আমি ওর বোনের স্বামী। তাই আমার প্রতি ওর এমন ধারণা আসার কোন সম্ভাবনাই নেই। অরণ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরে চলে গেল। একটু পরে মায়াও চেঞ্জ করে বোরকা পরে বেড়িয়ে এলো।

     

    অনেকক্ষণ শপিং করার পর সবাই ফুড কর্নারে গিয়ে বসলো। সবাই যার যার পছন্দ অনুযায়ী খাবার অর্ডার করে দিলো। শুধু মায়া বাদে।  আসলে ওর এসব জায়গায় আসার অভিজ্ঞতা নেই। তাই এখানকার কোন খাবারের নামও ও জানে না। তাই চুপচাপ বসে রইলো। অরণ্য সেটা দেখে বললো।

    –মায়া তুমি কিছু অর্ডার করলে না? কিছু খাবে না তুমি?  

     

    মায়া কিছু বলার আগেই রিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বললো। 

    –আরে ও কি অর্ডার করবে?  অর্ডার এর অ ও জানে ও? বাপের জন্মে এসব দেখলে না জানবে। ওকে তো যা দেওয়া যায় তাই খেয়ে নেয়।

     

    রিয়ার মায়াকে এমন তিরস্কার করে কথা বলায় অরণ্যের হঠাৎ চরম পরিমাণ রাগ উঠে গেল। চোয়াল শক্ত করে হাতের মুঠো জোড়ালো করে বললো ।

    –এটা কি ধরনের কথা? মায়া তোমার বোন। তুমি সবার সামনে এভাবে কিভাবে ওকে ছোট করে কথা বলতে পারো? মানুষের ভদ্রতা শুধু কাপড়চোপড় আর চালচলনেই শোভা পায় না। তার কথাবার্তা আর কাজকর্মেও শোভা পায়। তাই কথা বলার আগে একটু ভেবেচিন্তে বলা উচিত। 

     

    বাকি সবারও রিয়ার কথাটা ভালো লাগলো না। রিয়ার মনমানসিকতা যে এতো নিচুস্তরের তা জানা ছিলনা ওদের। ওর মত ছোট মনের মেয়েকে অরণ্যের কিভাবে পছন্দ হলো সেটাই ভাবছে সবাই। সিচুয়েশন স্বাভাবিক করার জন্য মায়া বলে উঠলো। 

    –আরে থাকনা। আসলে রিয়া আপু ঠিকই বলেছে। আমি এসব জায়গায় কখনো আসিনি। তাই এখানকার এসব খাবারের নামও জানি না। আর এমনিতেও আমার তেমন ক্ষিদে পায়নি।

     

    অরণ্য বলে উঠলো। 

    –আমরা সবাই বাসা থেকে সেই সকালে খেয়ে বের হয়েছি। আমাদের সবার যদি ক্ষিদে লেগে থাকে তাহলে তোমার কেন লাগবে না? তাই মিথ্যে না বলে তাড়াতাড়ি কি খাবে তাই বলো।

     

    অরণ্য একটা মেনু কার্ড মায়ার হাতে দিয়ে বললো। 

    –এখান থেকে যা চাও অর্ডার করে দাও।

     

    মায়া এবার বাধ্য মেয়ের মতো খাবার অর্ডার দিয়ে দিল। খাবার আসতে আসতে সবাই নানান কথাবার্তা বলছে।  তখনি হঠাৎ দুটো মেয়ে ওদের টেবিলের কাছে এসে অরণ্যের উদ্দেশ্যে বললো।

    –আরে অরণ্য? অনেক দিন পর দেখলাম তোমায়। কেমন আছ তুমি? 

     

    অরণ্য একটু ভ্রু কুঁচকে বললো। 

    –এক্সকিউজ মি, ডু আই নো ইউ??

     

    –আরে বাহ, ভুলেও গেলে আমাদের?  আরে আমি তিন্নি আর ও সাবা। আমরা তোমার কলেজের ফ্রেন্ড ছিলাম মনে নেই। 

     

    অরণ্য একটু মনে করার চেষ্টা করে হঠাৎ মনে পড়তেই বললো। 

    –আরে তিন্নি?  ওহহ এখন মনে পড়েছে। আসলে অনেক দিন দেখা হয়না তো তাই মনে পরছিল না। তা কেমন আছ তোমারা? 

     

    –আমরা ভালো আছি। 

     

    –বসনা প্লিজ। 

     

    ওরা বসতেই ইহান বলে উঠলো। 

    –চিনবে কি করে?তোরা তো তখন এক একটা হাতির বাচ্চার মতো ছিলি। আর এখন তো একদম হিরোইন হয়ে গেছিস। 

     

    ইহানের কথায় সবাই হেঁসে দিল। তিন্নি অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললো। 

    –তবে যায় বলো তুমি কিন্তু এখনো সেই হ্যান্ডসামই আছ। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছ। আমাদের কলেজের সব মেয়েদের ক্রাশ ছিলে।  তা বিয়ে শাদি করেছ নাকি এখনো সিঙ্গেলই আছ? 

     

    বিয়ের কথা শুনে অরণ্যের মুখটা হঠাৎই চুপসে গেল। তবে ইহান বলে উঠলো। 

    –আপনাদের অতি দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে। মিঃ অরণ্য এখন বিবাহিত পুরুষ হয়ে গেছেন। আর এই হলো উনার ওয়াইফ। 

    রিয়ার দিকে ইশারা করে বললো কথাটা।

     

    রিয়াকে অরণ্যের বউ হিসেবে পরিচয় দেওয়ায়। না চাইতেও মায়ার মনের কোনে চিনচিন ব্যাথার অনুভব করলো। তবে ঠোঁটে ফেক হাসি ঝুলিয়ে সেই ব্যাথার অনুধাবন বাইরে আসতে দিলোনা। 

     

    তিন্নি আবারও বলে উঠলো। 

    –এটা তো সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের মিঃ ক্রাশ বিয়ে করে ফেললো। এখন তার আশায় বসে থাকা মেয়েগুলোর কি হবে।  লিমা নামের সেই মেয়েটির কথা মনে আছে?

     

    ইহান বলে উঠলো। 

    –লিমা মানে সেই মেয়েটি না?  যে কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী ছিল? আর আমাদের অরণ্য বাবুর দিওয়ানি ছিল?

     

    –আরে হ্যাঁ সেই লিমা। শুধু দিওয়ানি না। বলতে গেলে পাগল দিওয়ানি ছিল। বেচারি কতো ট্রাই করতো অরণ্যকে পটানোর।কিন্তু অরণ্যের মন গলাতে পারলোনা। বেচারি তো এখনো অরণ্যের আশায় বসে আছে। 

     

    অরণ্য স্মিত হেসে বললো। 

    –আরে ওসব তো সব আগের কথা। বাদ দাওনা। আর এমনিতেও আমার কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্য মাইনে রাখে না। মনের সৌন্দর্য টাই আসল সৌন্দর্য। বাহ্যিক সৌন্দর্য তো একসময় ক্ষীণ হয়ে যায়। তবে মনের সৌন্দর্য সবসময়ই থেকে যায়।

     

    অরণ্যের কথায় মায়া অনেক টা অবাক হলো। উনি যা বলছে তাকি সত্যিই বলছে? নাকি শুধুই মন ভোলানো বাণী গাইছে? সত্যিই কি উনার কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্য মাইনে রাখে না? মায়া নিজের মনের ওপর নিজেই তাচ্ছিল্য করে বললো, হুহ্ সবই লোক দেখানো কথা। বাহ্যিক সৌন্দর্য যদি মাইনেই না রাখবে তাহলে রিয়াকে কি দেখে পছন্দ করলো? বাহ্যিক সৌন্দর্য ছাড়া আর কোন ভালো গুন তো রিয়ার ধারে কাছেও নেই। যে যতই বলুক না কেন, দিনশেষে সবাই প্রথমে বাহ্যিক রুপটাই দেখে। কথাগুলো ভেবে মায়ার মনটা আবারও কঠিন চাদরে ঢেকে নিল। চায়না সে কোন মিথ্যে মায়ায় মন ভোলাতে।

     

    কিছুক্ষণ পরে মেয়ে দুটো চলে গেল। ওদেরও খাওয়া দাওয়া শেষের দিকে। মায়া দেখলো টেবিলে প্রায় সবারই খাবার আধো খওয়া

     হয়ে আছে। খাবারের এতো অপচয় দেখে মায়ার ভালো লাগছে না। কত নিরীহ মানুষ এক বেলা খাবারের অভাবে না খেয়ে মরছে। আর এখানে কতো খাবার নষ্ট হচ্ছে। একটু পরে ওয়েটার টেবিল পরিস্কার করতে আসলো। ওয়েটার প্লেট উঠাতে নিলে মায়া ওদের উদ্দেশ্যে বললো।

    –আচ্ছা ভাইয়া আপনারা এই বাকি খাবার গুলো কি করবেন? 

     

    –কি করবো ম্যাম, ডাস্টবিনে ফেলে দিবো। এটো খাবার তো আর অন্য কাস্টোমার কে দেওয়া যাবে না। 

     

    –তাহলে একটা কাজ করবেন প্লিজ?  এই খাবার গুলো একটা প্যাকেটে ভরে আমাকে দিতে পারবেন? 

     

    –ওকে ম্যাম এখুনি দিচ্ছি। 

     

    রিয়া মায়ার দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বললো। 

    –এই তুই কি আমাদের মানসম্মান ডোবাবি?  এভাবে এটো খাবার প্যাকেট করে নিয়ে যেতে হবে তোর? লোকে কি বলবে? 

     

    এই রিয়ার ওপর অরণ্যের রাগ বেড়েই যাচ্ছে। নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো।

    –মায়া তুমি বাসার জন্য পার্সেল নিতে চাইলে আমাকে বলতে আমি ওয়েটারকে বলে দিতাম।

     

    মায়া বললো।

    –না না এটা বাসার জন্য না।

     

    –তাহলে?

     

    –আসলে এখানে এতো খাবার নষ্ট হচ্ছে। আর খাবার নষ্ট করা একদম ঠিক না। আল্লাহ নারাজ হন। তাই খাবার গুলো নষ্ট না করে প্যাকেট করে নিয়ে গেলে রাস্তার পথশিশুদের দেওয়া যাবে। এমনিতেও এই খাবার গুলো ওনারা ফেলেই দিবে। তারচেয়ে ভালো কিছু অসহায় বাচ্চাদের আহার হোক। খাবারও নষ্ট হবে না। আর অনাহারীকে খাওয়ালে ছোয়াবও পাওয়া যাবে। তাই নিতে চাচ্ছিলাম।

     

    মায়ার এমন মহৎ ভাবনা রিয়া বাদে বাকি সবার মন ছুয়ে গেল। সত্যিই এমন করে ওরা কখনোই ভাবেনি। মায়ার চিন্তাধারা দেখে সবাই মুগ্ধ। মেয়েটা সত্যিই একটা নেক আর পবিত্র মনের অধিকারী। 

     

    আর অরণ্য আজ আবারও একবার মায়ায় চিন্তাধারায় মোহিত হলো। ওর মন ভুল কাওকে পছন্দ করেনি। ওর মন সত্যিকারের এক পবিত্র মনের মানুষকেই পছন্দ করেছে। তবে দূর্ভাগ্যবশত সেই মেয়েটাকে পেয়েও পাওয়া হলোনা ওর। এই না পাওয়ার গ্লানি কিভাবে বয়ে বেড়াবে তা জানা নেই অরণ্যের। 

     

    চলবে……

     

    #মায়ারণ্যে

    #লেখিকা-মেহরুমা নূর

    #পর্ব-১০

     

    ★ আজ রাইসার মেহেদী অনুষ্ঠান। সারাবাড়ি ফুল আর ফেইরি লাইটস দিয়ে জমকালো আয়োজন করা হয়েছে । মেহমানে মেহমানে পুরো বাড়ি প্রায় ভরে উঠেছে। সবাই নানান কাজে ব্যাস্ত। মায়া বাড়ির কাজে অনেক হেল্প করছে। কখনো সাজসজ্জার কাজে তো কখনো বাড়ির মহিলাদের অন্য কাজে। 

     

    মায়াকে এমন প্রফুল্লচিত্তে সবার কাজে সাহায্য করতে দেখে তনিমা বেগমের অনেক ভালো লাগছে। যেখানে তার নিজের ছেলের বউই এসব ব্যাপারে উদাসীন। বাড়ির কোন কাজে হাত দেয় না। অথচ তারই ফুফাতো বোন হয়েও মায়া কত সুন্দর সবার সাথে মিশে গেছে। সবার ভালো মন্দের কতো খেয়াল রাখে। কাল তনিমা বেগমের অনেক মাথা ব্যাথা করছিল দেখে মায়া কতো সুন্দর করে তার মাথায় তেল মালিশ করে দিয়েছিল। যার দরুন তনিমা বেগমের মাথা ব্যাথা একদম বিনা টিকেটে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তনিমা বেগম আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এভাবে আরও অনেক রকম মন ছুয়ে যাওয়া কাজ করে মায়া। মা বাবা না থাকা সত্বেও মেয়েটা কতো সুশৃঙ্খল আর মায়াময়ী।  তাইতো সবাই মায়ার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। 

     

    ছাদের রেলিং এর কাছে দাঁড়িয়ে আছে ইরিন। নিচে সব আয়োজন চলছে সন্ধ্যার মেহেদী অনুষ্ঠানের জন্য। ইরিন কেমন মনমরা হয়ে তাকিয়ে দেখছে সবকিছু। এসব দেখে তার অসফল বিবাহিত জীবনের কথা না চাইতেও মনে পড়ে যায়। নিজের ভুলের মাশুল হয়তো সারাজীবনই ওকে ভোগ করতে হবে। মায়ার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কেউ একটা ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ ইরিনের সামনে ধরলো। ইরিন ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকিয়ে দেখলো এটা মায়া। ইরিন একটু অবাক সুরে বললো। 

    –তুমি??

     

    মায়া হাসিমুখে বললো। 

    –হ্যাঁ আমি। আসলে সবার জন্য চা করেছিলাম। আপনাকে নিচে কোথাও পেলাম না। তাই এখানেই নিয়ে এলাম। 

     

    –তুমি কি করে জানলে আমি এখানেই আছি?

     

    –আগে চা নেন তারপরে বলছি।

     

    ইরিন মুচকি হেসে চায়ের কাপ হাতে নিল। দুজন ছাদের দোলনায় গিয়ে বসলো। চা খেতে খেতে ইরিন আবারও জিজ্ঞেস করলো। 

    –হুমম, তো এখন বলো কিভাবে জানলে।

     

    মায়া নিজের হাতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।। 

    –কারণ যারা নিজের দুঃখ সবার থেকে লুকাতে চায় তারা সবসময় ভীড় থেকে আলাদা থাকতেই পছন্দ করে। কারণ তারা ভাবে হয়তো তার জন্য অন্যের খুশিতে আঘাত পরতে পারে। আর এটা আমার থেকে ভালো আর জানে।

     

    মায়ার কথায় ইরিন অনেক অবাক হলো। মেয়েটা কিভাবে তার অবস্থার কথা বুঝে গেল?  ইরিন ফেক হাসি দিয়ে বললো। 

    –আরে না। এমন কিছুই না। তুমি হয়তো একটু বেশিই ভাবছ। আসলে এমনিতে আমার ভিড়ভাড় তেমন পছন্দ না। তাই এখানে বসে আছি।

     

    –আমার কাছে মিথ্যে বলে লাভ নেই আপু। আমি জানি আপনি ভয় পান আপনার জন্য আপনার পরিবারকে লোকের নানান কথা শুনতে হবে। তাই লোকজনের সামনে না গিয়ে এখানে বসে আছেন। আমি যেদিন এবাড়িতে এসেছি সেদিনই আপনাকে দেখে বুঝে গিয়েছিলাম আপনার মাঝে অনেক বড়ো কষ্ট লুকিয়ে আছে। তাই সারার কাছে আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন সারা আপনার ব্যাপারে আমাকে বলে। 

     

    ইরিন বলে উঠলো। 

    –ওহহ, তো তুমিও জেনে গেছ। তাই বুঝি আমাকে সিমপ্যাথি দেখাতে এসেছ?

     

    মায়া স্মিথ হেসে বললো।

    –মোটেও না।জানেন মানুষ যতই বলুক আমি আপনার কষ্ট টা বুঝতে পারছি। আসলে কেউই কারোর কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে না। শুধুমাত্র যে ওইরকম কোন কষ্টের ভুক্তভোগী, শুধু সেই ব্যাক্তিই আরেকজনের কষ্ট বুঝতে পারে। তাই আমিও আপনার কষ্ট বুঝতে পারছি। তবে একটা কথা কি জানেন। আপনি কিন্তু অনেক লাকি। কারণ আপনার কাছে একটা পরিবার আছে। যার কাছে আপনি সিকিউর। যাদের কাছে আপনি আপনার সুখ দুঃখ শেয়ার করতে পারেন। হ্যাঁ হয়তো একটা ভুল করে ফেলেছেন। তবে ভুলতো মানুষেরই হয়। তবে সবাই কিন্তু ভুল শুধরে নেওয়ার দ্বিতীয় চাঞ্চ পায়না। সেক্ষেত্রে আপনি কিন্তু লাকি। জীবন আপনাকে আরেকটা চাঞ্চ দিয়েছে। তাই এভাবে নিজের ভেতর গুম না হয়ে সবার সাথে মন খুলে মিশুন।অতীত কে ভুলে সামনে এগুবার চেষ্টা করুন। লুকিয়ে না থেকে নিজেকে প্রমান করুন। দেখবেন আপনাকে খুশি দেখে আপনার পরিবারও খুশি হবেন। সবাই কিন্তু আপনার মতো এতো লাকি হয়না। জীবন সবাইকে দ্বিতীয় চাঞ্চ দেয়না। সবার আপনার মতো এতো কেয়ারিং পরিবার নেই। আমার কথাগুলো ভেবে দেখবেন। ছোট হয়ে যদি বেশি কিছু বলে ফেলি তাহলে ছোটবোন ভেবে মাফ করে দিয়েন।

     

    কথাগুলো বলে মায়া চায়ের কাপ দুটো নিয়ে  আবার উঠে চলে গেল। আর ইরিন অবাক চোখে মায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। মায়াকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে ও।কতো সুন্দর করে এতবড় একটা বিষয় বুঝিয়ে গেল। মেয়েটা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান আর সুচিন্তার অধিকারী। অথচ রিয়া এর পুরো উল্টো। ইরিনের মাথায় হঠাৎই একটা ভাবনা ঢুকে পড়লো। অরণ্যের তো সবসময় মায়ার মতো চিন্তাধারার কোনো মেয়ের খোঁজ ছিল। তাহলে রিয়াকে কিভাবে পছন্দ করলো অরণ্য? এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই তো?

    ___

     

    সব কাজ সেরে মায়া গোসল করার জন্য বাথরুমে ঢুকেছে। হঠাৎ পানির ট্যাপ টা মোচড় দিতেই পাইপ থেকে ট্যাপ টা খুলে পড়ে গেল। আর পাইপ থেকে ভীষণ বেগে পানি বের হতে লাগলো। আচমকা এমন একটা কান্ড হওয়ায় মায়া অনেক ঘাবড়ে গেল। দুই হাতে পাইপের পানি ঠেকানোর চেষ্টা করছে। তবে তাতে সফল হচ্ছে না মায়া।পানিতে ওর শরীর প্রায় ভিজে যাচ্ছে। মায়া কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এইভাবে ভেজা কাপড়ে তো বাইরেও যেতে পারছে না।আর পানি এভাবে ছেড়ে দিয়ে গেলে রুমেও পানি ঢুকে পরবে। কিন্তু এটা ঠিক না করলে তো গোসলও করতে পারবে না। তাই মায়া বাথরুমের ভেতর থেকেই জোরে জোরে সারা আর রাইসাকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু রুমে কেউ না থাকায় ওর ডাক কারোর কানে যাচ্ছে না। 

     

    ঠিক সেই মুহূর্তে অরণ্য সারাদের রুমে ঢুকলো। ওর ল্যাপটপের চার্জার কাজ করছিল না। তাই রাইসার চার্জার নিতে এসেছিল। কিন্তু রুমে ঢুকতেই বাথরুম থেকে মায়ার আওয়াজ শুনতে পেল অরণ্য। মায়ার এভাবে জোরে জোরে ডাকা দেখে একটু চিন্তা হলো অরণ্যের। মায়া এভাবে ডাকছে কেন? ও ঠিক আছে তো? বাথরুমে পড়ে টরে গেল নাতো? কথাটা ভেবে অরণ্য ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বললো। 

    –মায়া কি হয়েছে?  ওরা তো কেউ রুমে নেই। তুমি ডাকছ কেন? কোন সমস্যা হয়েছে?  আমাকে বলো।

     

    মায়ার এখন এতকিছু ভাবার সময় নেই।আপাতত এটা ঠিক করা দরকার। তাই অরণ্যের কন্ঠ শুনে মায়া পাইপ ছেড়ে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিয়েই আবারও পাইপের ওপর হাত চেপে ধরলো। অরণ্য বাথরুমে ঢুকে মায়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে বললো। 

    –কি হয়েছে?  তুমি কি পড়ে গিয়েছ?

     

    মায়া পানি ঠেকানোর চেষ্টা করতে করতে বললো। 

    –না না আমি ঠিক আছি। আসলে এই ট্যাপ টা হঠাৎ খুলে গেছে। আর পানি কিছুতেই ঠেকাতে পারছিনা।

     

    –ও ওকে তুমি একটু থাক, আমি এখুনি ঠিক করার কিছু নিয়ে আসছি।

     

    কথাটা বলে অরণ্য দ্রুত বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই হাতে একটা প্লাস আর একটা টেপ নিয়ে এলো। মায়ার সামনে বসে মায়াকে হাত সরাতে বললো।মায়া হাত সরাতেই পানি এসে সোজা অরণ্যের শরীরে লাগছে। অরণ্যও ভিজে গেল। কোনরকমে হাত দিয়ে ঠেকিয়ে ট্যাপ টা আবার পাইপের মাথায় লাগিয়ে দিয়ে, প্লাস আর টেপ দিয়ে ভালোভাবে আটকিয়ে দিল। কাজ হয়ে গেলে অরণ্য বলে উঠলো। 

    –নাও এখন ঠিক হয়ে গেছে। 

     

    –ধন্যবাদ। 

     

    অরণ্য এবার মায়ার দিকে তাকালো। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার পানিতে ভেজা মায়াকে চোখে আবদ্ধ করে ফেললো। ভেজা কাপড় আর চুলগুলো লেপ্টে আছে। পানির কনা জমে আছে মায়ার শ্যামল বদনে। এ যেন এক মরণঘাতী দৃশ্য। অরণ্যের ভেতর টা যেন নাড়া দিয়ে উঠছে। এতদিন শুধু মায়ার মনের মাধুর্যেই মেতে ছিল অরণ্য। তবে আজ মায়ার এমন আবেদনীয় রুপের মোহে ডুবে যাচ্ছে অরণ্য।কেমন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। চেয়েও চোখ ফেরাতে পারছে না। অবাধ্য আর বেহায়া চোখ দুটো মায়াতেই আবদ্ধ। 

     

    অরণ্যের এভাবে তাকিয়ে থাকায় মায়া অনেক টা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। যদিও সেদিনের মতোই মায়ার কোন অস্বস্তি হচ্ছে না। শুধুই চারদিক থেকে লজ্জায় ঘিরে ধরেছে। অরণ্যের এই চাহুনি যেন মায়ার হৃদয় ভেদ করে দিচ্ছে। হৃদকম্পনের গতি অস্বাভাবিক বেগে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে হয়তো ওর দমই বন্ধ হয়ে যাবে। মায়া লজ্জায় জড়সড় হয়ে ফ্লোরে দিকে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। 

     

    মায়াকে এভাবে দেখে অরণ্যের হুঁশ এলো। অরণ্য দ্রুত বেরিয়ে যেতে নিল। কিন্তু ফ্লোরে শাবান পড়ে থাকায় অরণ্যের পা শাবানে পড়তেই, অরণ্য পা পিছলে গিয়ে মায়াকে সহ নিয়ে পড়ে যেতে নিল। অরণ্য দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে নিজেকে আর মায়াকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সক্ষম হলো। দেয়ালে হাত দেওয়ার সময় ভুলবশত হাত লেগে শাওয়ার চালু হয়ে গেল। অরণ্যের দুই হাতের মাঝে মায়া আটকা পড়ে আছে। দুজনের মুখ সামনাসামনি,ওদের মাঝে শুধু দুুই ইঞ্চি ফাঁক আছে।মায়া অনেক আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।  অরণ্যের এতো কাছে আসায় মায়ার হৃদকম্পন যেন এবার ব্লাস্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সারা শরীর প্রচন্ড পরিমাণে কাঁপছে ওর। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে ওর সাথে?  এমনটা তো আগে কখনো হয়নি? একটা পুরুষ মানুষের সন্নিকটে এসেও আমার খারাপ লাগছে না কেন? বরং কোথাও যেন একটা সুখময় অনুভূতি কাজ করছে। তবে কি সে আমার স্বামী বলে এমনটা হচ্ছে? 

     

    শাওয়ারের পানি দুজনকেই ভিজিয়ে দিচ্ছে। পানি মায়ার মুখের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মায়ার ভেজা অধরযুগল যেন সর্বনাশের ডাক দিচ্ছে। অরণ্যের গলা শুঁকিয়ে আসছে। শুকনো ঢোক গিলছে শুধু। নিষিদ্ধ কিছু চাওয়া মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে ওর। নিজের ওপর সব নিয়ন্ত্রণ যেন হারিয়ে ফেলছে অরণ্য। তার মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে সরে যা তুই।  এটা ঠিক না। কিন্তু তার মন মস্তিষ্কের কথা শুনতে মোটেও আগ্রহী না। তার মন বলছে এটাই ঠিক। এতে কোন ভুল নেই। অতঃপর মন আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ে মনই জিতে গেল। অরণ্য ধীরে ধীরে নিজের মুখটা ঝুকিয়ে মায়ার অধরের দিকে এগুতে লাগলো। মায়ার চোখ বন্ধ থাকায় সে কিছু টের পাচ্ছে না। তবে দুজনেরই নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। মায়ার ঠোঁট ছুঁইছুঁই প্রায়। তখনই হঠাৎ বাইরে থেকে সাউন্ড বক্সের আওয়াজ এলো। হুঁশ এলো অরণ্যের। ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো সে। ছিটকে সরে এলো মায়ার কাছ থেকে। কি করতে যাচ্ছিল সে? ছিহহ। অরণ্য আর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। অরণ্য যেতেই চোখ মেলে তাকালো মায়া। দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো সে। কোন এক অজানা কারনেই চোখ দুটো দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়লো তার। হৃদয়ের কোনে আবারও ব্যাথার অনুভব হলো।আচ্ছা সেকি না চাইতেও তার মায়ায় জড়িয়ে পড়লো?

    ______

     

    মেহেদীর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। বাইরে লনে মেহেদীর জন্য বড়ো স্টেজ সাজানো হয়েছে। সবাই সেজে গুঁজে চলে এসেছে মেহেদীর জন্য। মেহেদী আর্টিস্ট আনা হয়েছে। তারা রাইসা আর বাকিদের মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ নাচ গানও করছে। ইরিনও এসেছে মেহেদী দিতে। ইরিনকে আজ অনেক টা হাসিখুশিই লাগছে। যেটা দেখে বাকি সবারও ভালো লাগছে। বিশেষ করে ইহানের। ইরিনকে আজ অনেক দিন পর এভাবে কোন অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখে ওর মনটা ভরে উঠছে। 

     

    সারা ব্রাউন কালারের লেহেঙ্গা পড়ে সারা বাড়ি ধেই ধেই করে নেচে বেড়াচ্ছে। অথচ তার জন্য যে আরেকজনের বুকে হাহাকার হচ্ছে, সেটার কোন ধারণাই নেই সারার। সাহিলের চোখ শুধু তাঁকেই ঘিরে আছে। তার পিচ্চিটাকে আজ সত্যিকারের পরী লাগছে। সাহিল যেখানেই থাকুক তার নজর সবসময় সারার ওপরেই থাকে। যেন চোখের আড়াল হলেই হয়তো সারা হারিয়ে যাবে। সারা রাইসার কাছে গিয়ে সেলফি তুলছে। রাইসার গালের সাথে গাল লাগিয়ে ঠোঁট চোখা করে পাউট করে সেলফি নিচ্ছে। সারার কান্ড দেখে সাহিল শুধু ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসছে। 

     

    অরণ্য একপাশে চুপচাপ বসে আছে। বারবার শুধু তখন কার ঘটনা টা চোখের সামনে ভাসছে। নিজের মনে অনেক অপরাধ বোধ হচ্ছে ওর। কি করতে যাচ্ছিল তখন সে? কি হয়ে গিয়েছিল তখন? মায়া আমার ভালোবাসা হলেও, ওর প্রতি কোন শারীরিক চাহিদা রাখার অধিকার আমার নেই।  যদি মায়া জেনে যেত তাহলে কি হতো? সে আমাকে নিশ্চয় ক্যারেক্টারলেস ভাবতো। এখন আমি ওর দিকে মুখ তুলে তাকাবো কিভাবে? অরণ্যের ভাবনার মাঝেই মায়া স্টেজের কাছে এলো। পরনে তার অরণ্যের দেওয়া সেই নীল শাড়ী। যদিও মায়া জানে এটা রাইসা দিয়েছে। মায়াকে দেখে অরণ্য আবারও সব গুলিয়ে ফেললো। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মায়ার দিকে। মস্তিষ্কের ওপর আবারও মনের জিত হয়ে গেল। 

     

    সারা আর রাইসার জোরাজুরিতে মায়াও মেহেদী লাগাতে বাধ্য হলো। স্টেজের সামনে তখন সবাই মিলে #মেহেদী লাগাকে গানটাতে নাচছে। সাহিল আর ইহান একসময় অরণ্য কেউ টেনে নিয়ে এলো নাচতে। ওদের মন রক্ষার্থে অরণ্যও হালকা পাতলা নাচছে। মায়ার চোখ অরণ্যের হাসিমাখা মুখটাতে আটকে গেল। লোকটাকে হাসিমুখে কতো সুন্দর লাগে। হাসলে গালে টোল পড়ে তার। মায়া কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহেদী আর্টিস্ট বললো,

    –ম্যাম আপনার হাতে কি কারোর নাম লিখবেন?

     

    মায়া অরণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনেই বললো। 

    –অরণ্য। 

    ___

     

    মেহেদী শুকিয়ে গেলে মায়া রুমে আসে মেহেদী ধুতে। মেহেদী ধুয়ে হাতের দিকে তাকাতেই চমকে গেল মায়া। মেহেদীর ডিজাইনের মাঝে জ্বলজ্বল করতে থাকা অরণ্যের নামটা দেখে থমকে গেল সে। এটা কিভাবে হলো? কখন হলো? মায়া মনে করার চেষ্টা করতেই মনে পড়লো তখনকার কথা। যখন সে আনমনেই অরণ্যের নাম বলে ফেলেছিল। কথাটা মনে আসতেই আফসোসে চোখ কুঁচকে নিল। কি হচ্ছে ওর সাথে?  না চাইতেও কেন মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে পরছি আমি? কেউ এটা দেখে ফেললে কি ভাববে?  না না আমাকে এটা ঢাকতে হবে। মায়া বাইরে থেকে একটু মেহেদী নিয়ে এলো। অরণ্য লেখা জায়গা টায় মেহেদী দিয়ে ভরাট করে ঢেকে ফেলতে চাইলো। কিন্তু অরণ্য নামটার দিকে তাকাতেই কেমন যেন একটা মায়া হচ্ছে। মায়ার চেয়েও মেটাতে পারছে না নাম টা। থাকনা। জীবনে জায়গা না পেল হাতে নাহয় তার নামটা জায়গা পাক। মায়া আর পারলোনা নাম মেটাতে। শুধু তাকিয়ে রইল তার জীবনের সাথে হঠাৎ জুড়ে যাওয়া নামটার দিকে। 

     

    চলবে……

     

     

     

     

     

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।