মৃত্যু দূত

    মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো আমি মৃ/ত। সেটা মনে হওয়ার অবশ্য কারন আছে। একটু আগেই আমি স্বপ্নে কালো পাখাওয়ালা অচেনা এক ব্যক্তিকে দেখেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন “চলো তোমার সময় হয়ে গেছে।” আমি ধরফরিয়ে উঠে বসলাম। সারা শরীরে হাত দিয়ে টের পেলাম আমার শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা। তার থেকেও বড় চমকপ্রদ কাহিনী হলো আমি উড়ছি।

    ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছিলাম মানুষ মা//রা যাওয়ার পর তার শরীরে কি কি পরিবর্তন ঘটে। আমার সেই সব পরিবর্তনের সাথে সবকিছুই ঘটে আসছে। বিছানায় তাকিয়ে দেখলাম আমার শরীরটা নিথর হয়ে পড়ে আছে। মৃ//ত্যু হওয়ার আসল কোনো কারন খুঁজে পেলাম না৷ আস্তে গিয়ে শরীরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। নাড়ি পরিক্ষা করতে গিয়ে দেখি নাহ্, আসলেই আমার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বালিশের পাশে থাকা ফোনটা দেখে মনে হলো কাউকে ফোন করা উচিত। সর্বপ্রথম শিশিরের কথাই মনে পড়লো। তবে ফোনটা হাতে নেওয়ার আগেই আমার শরীর ফোন ভেদ করে চলে গেলো।

    মাথায় হাত দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বসে রইলাম৷ মনে করতে লাগলাম আসলে আমার কি কারনে মৃ//ত্যু হলো। এই মুহুর্তে আসলে আমার কিছুই করার নেই। পড়ালেখার সুবাদে পরিবার থেকে দূরে থাকার কারনে আপন বলতে এখানে শিশির ছাড়া কেউই নেই। কিন্তু বাড়িতে খবরটা কে দিবে? সকালের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

    পরিবারের বড় মেয়ে হওয়াতে আমার জন্য একটু বেশিই দুঃখ হবে সবার। মায়ের জন্য খারাপ লাগছে। কারনে অকারনে বহুবার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো মা মুখ ফুটে কিছুই বলেনি। মায়ের ডাকাডাকিতে আমি বিরক্ত হলেও মা কখনো আমার বিরক্তি দেখে নিজে ডাকতে বিরক্তবোধ করতো না। মায়েরা একটু অন্যরকম হয় সবার থেকেই।
    অন্যদিকে আমার বাবা। যিনি আমি বলতে অজ্ঞান। কখনো মা ডাক ছাড়া কথা বলেনি আমার সাথে। বাবার ভালোবাসা গুলো ছোট বেলায় উপলব্ধি করতে না পারলেও, বড় হওয়ার সাথে সাথে এবং দূরে থাকার জন্য বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি আমার এবং বাবার মধ্যকারের ভালোবাসাটা।

    ছোট বোনটার সাথেও তো গতকাল সকালে কথা হয়েছে আমার সাথে। ছোট বোনের সাথে এমন কিছু নেই যা আমি শেয়ার করিনি। দুজন যেন দুই দেহ এক আত্মা। এইতো গতকাল ওর থেকেই আইডিয়া নিয়ে শিশিরের ভাবগতি বোঝার জন্য মিথ্যা খবর দিয়েছিলাম শিশিরকে।

    আসলেই কালকে শেষবারের মতো শিশিরের সাথে দেখা হয়েছে আমার। ওকে যখন ছোট বোনের কথা মতো জানিয়েছিলাম আমি প্রেগন্যান্ট তখন তো হাসিমুখেই মেনে নিয়েছিল সবটা। এছাড়া বাড়ির সবাই বিয়েতেও রাজি ছিল। তাহলে শিশির কিভাবে কি করবে? নাহ্, এগুলো সম্পূর্ণ আমার মনের ভুল। হয়তো আমার ভাগ্যে ছিলনা একসাথে থাকাটা।

    আমার লা//শের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। নিজের জীবনের জন্য বড্ড মায়া হলো। মানুষ কিভাবেই বা তাদের সাধের জীবনটাকে আত্মহ//ত্যা করে শেষ করে দেয়? তাদের কি একটুও মায়া হয়না জীবনের জন্য? পৃথিবীর জন্য কিংবা পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আপন মানুষদের জন্য?
    হু হু করে কেঁদে উঠলাম আমি, তবে চোখের পানি পড়লো না। পড়বেই বা কিভাবে? আমি তো শুধুমাত্র একটা আত্মা। আমার তো কোনো শরীরই নেই এখন। তবে ভেতর থেকে খুব কষ্ট হলো। আমার জন্য, আমার আপন মানুষদের জন্য।

    ভোর হতে বেশি দেরি নেই। আমি উঠে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ালাম। অতিরিক্ত আলসে থাকার কারনে কখনোই সেভাবে ভোরের সূর্যোদয় দেখা হয়নি। আজ দেখলাম, আজ খুব বেশি করেই মন চাইলো আরো কিছুদিন পৃথিবীতে থাকি। সমস্ত যান্ত্রিক কিছু ভুলে গিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টিকে উপভোগ করি। কিন্তু সুযোগ তো স্রষ্টা বারবার দেন না তাইনা? ভোর হতে হতে দেখা গেলো আমার রুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। আমি খানিকটা অবাক হলাম। এতো তাড়াতাড়ি তো আমার রুমে কেউ ভুলেও আসেনা। আর আমার মৃ//ত্যুর খবর তো এখনো কেউ পায়নি।

    আমি চাইলাম নিজে গিয়ে দরজা খুলে দেই। তবে সুযোগ নেই, হাত দরজা ভেদ করে বাইরে চলে গেলো। বাইরে কারা আছে সেটা দেখার জন্য আমি অনায়াসে দরজা ভেদ করে আমি বাইরে চলে গেলাম। দরজায় শিশিরকে দেখে আরো অবাক হলাম আমি। আমার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধবী নিয়ে হাজির শিশির। প্রথমে মনে হলো শিশিরকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছে মতো কান্না করে বলি “প্লিজ আমাকে বাঁচিয়ে নেও!” কিন্তু পরবর্তীতে একটা কথা মাথায় আসলো। শিশির কিভাবে খবর পেলো আমি মা//রা গেছি?

    আরো বড় কথা হচ্ছে শিশির দরজা কেন ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে? যখন দরজা খুলছেই না তখন ও নিজেই বেলকনি থেকে রুমে এসে দরজা খুলে দিতে পারে। যেমনটা আগে আমার সাথে চুপিচুপি দেখা করতে আসতো। হয়তো ওর এখন মাথায় এসব কিচ্ছু নেই। আমিই বা এতো ভাবছি কেন। আমার মৃ//ত্যুটা স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে। আমি এতো চিন্তাই বা করছি কেন?

    অবশেষে দরজা ভাঙা হলো। ভেতরে এসে সবার প্রথমে শিশিরই আমাকে ধরলো। কান্নাকাটিও করেছে প্রচুর। বেচারার জন্য কষ্ট হচ্ছে। কয়েকঘন্টা টানা কথা বলতে না পারলে যেই ছেলেটা ছটফট করতো সে এখন আমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? আমাকে ধরে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। এই ফাঁকে শিশির আমার ফোন নিয়ে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করলো। আমি তখন আমার লা//শ দেখতে ব্যস্ত৷ যখন আমি ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম ও তখন আমার মৃত্যুর খবর আমার বাবা-মাকে দিচ্ছে।

    সকাল ১০ টা নাগাদ বাড়িতে পুলিশ আসলো। তদন্ত শুরু হলো ঠিক ভাবে। আমার ফোন নিয়ে গেলো সমস্ত কিছু চেক করার জন্য। আমার লা//শ পোস্টম//র্টেম করার জন্য নিয়ে যাওয়ার জন্য বললে শিশির আমার গার্ডিয়ান হয়ে কিছুতেই রাজি হলো না। তবে পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দেয়াই লাগবে। অগত্যা সবার অনুরোধে শিশির রাজি হলো। আমাকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বাবা মা পৌঁছে গেলেন। বাবা মা কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান হারাচ্ছেন। কিছু দূরেই আমার ছোটবোন এবং শিশির দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এই প্রথম আমি আমার বোনকে আমার বিপদে ভয় পেতে এবং হালকা খুশি হতেও দেখেছি।

    রাতের মধ্যে আমার পোস্টম//র্টেম রিপোর্ট এবং লা//শ পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিসের জন্য মা//রা গেছি আমি সেটাও বুঝিনি এখনো। অথচ এক দিনের ব্যবধানে আমার শরীরটা কে//টে প্রায় টুকরো টুকরো করে দিয়েছে এরা। কা//টা যায়গা থেকে চুইয়ে চুইয়ে কালো র//ক্ত বের হচ্ছে।
    আব্বু আম্মুর হুঁশ নেই, পোস্টম//র্টেম রিপোর্টে এসেছে আমি নে/শা করেছি। ইঞ্জে”কশনের মাধ্যমে শরীরে ড্রা/গ নিয়েছি আমি। অথচ সারা জীবন আমি ইঞ্জে”কশনকে ভয় পেয়ে এসেছি।

    তবে রিপোর্ট দেখে দুজনেই সমস্বরে চেচিয়ে উঠে বললো “কিহ্? রিতু তাহলে প্রেগন্যান্ট ছিল না? তাহলে….? ভুল হয়ে গেলো খুব বড়।” এই সত্যিটা দেখে শিশির চমকে গেলেও আমার ছোট বোন মিতুর তো চমকানোর কথা নয়? সত্যিটা তো ও জানতো, একপ্রকার মজা করে আমরা দুজনে প্ল্যান করে শিশিরকে এই কথাটা বলেছিলাম। তাহলে শিশিরের সামনে এমন ভাব কেন করছে? আসলেই কি আমার মৃ//ত্যু স্বাভাবিক? নাকি পুরোটাই পূর্ব পরিকল্পিত?

    #চলবে?…
    #গল্প_মৃ_ত্যুদূত
    #লেখিকা_Mst_Moni
    #পর্ব_০১(সূচনা)

    গল্পটা লেখার সময় কিছু জায়গায় আমি নিজে মৃ//ত্যু উপলব্ধি করে কয়েকবার কেঁদেছি। গল্পটা অবশ্যই ভুতুড়ে এবং রহস্যময় হবে।

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।