ভালোবাসার উষ্ণতা

প্রথম অধ্যায়

 

পেটে কারো স্পর্শ পেতেই গা শিরশির করে উঠলো প্রাপ্তির। চোখে ঘুমের সাগর এসে ভর করায় চোখ খুলতে পারছে না। রাত যে বেশ হয়েছে এটা বুঝতে বাকি নেই, এতো রাতে তার ঘরে কারোর আসা সম্ভব নয়। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কেউ তার ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখ খুলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না, চিৎকার করছে; কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। ব্যাক্তিটির হাত তখন প্রাপ্তির সারা শরীরে স্পর্শ করছে। একটা সময় পর তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। প্রাপ্তি আপ্রাণ চেষ্টা করছে নড়তে; এই বাঁধন থেকে বের হতে চাইছে কিন্তু পারছে না। অজানা ব্যক্তিটি কে?

 

সকাল ৭ টা,

ঘুম ভাঙলে প্রথমেই আশেপাশে নজর ঘোরালো প্রাপ্তি, নাহ কেউ ঢুকে নি তার ঘরে। দরজাটাও ভেতর দিয়ে বন্ধ। শুধু তার পাশের বিছানা চাদরটা খানিকটা কুচকানো, এই বাদে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা না। বেশ কিছুক্ষণ মাথাটা দু হাত দিয়ে চেপে বসে থাকলো, রাতে যা হয়েছে তা কি স্বপ্ন ছিলো! তবে কি সে ঘোরে ছিলো! মাথাটা বন্ধ বন্ধ লাগছে, সাওয়ার নিলে হয়তো ভালো লাগবে। ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আৎকে উঠলো প্রাপ্তি। খেয়াল করে দেখতে পেলো তার গলার খানিকটা নিচে বুকের ঠিক উপরে কিছুটা জায়গা লাল হয়ে আছে। এর মানে কি!! ভয়ে হাত পা জমে গিয়েছে। বাস্তব এবং স্বপ্নের ভেতরে নিজেকে যেন আটকে ফেলেছে প্রাপ্তি; কিছুতেই বের করতে পারছে না। এ নিয়ে এই সপ্তাহে তিন বার এমন হলো। শাওয়ার নেওয়ার পরও মনকে শান্ত করতে পারছে না কিছুতেই। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ঘড়ির বড় কাঁটাটা আটটার উপর বসে আছে। আটটা বেজে গেছে, আবরারের খাবারের সময় হয়ে এসেছে। তার সামনে যেতে না পারলেও লোকটাকে প্রতিদিন খাবার নিজের হাতে বানিয়ে খাওয়ায় প্রাপ্তি।

 

সিকদার ভিলায় আজ তিন মাস হয়েছে বিয়ে হয়ে এসেছে সে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে চাচাদের বাড়িতে মানুষ হয়েছে; আঠারো বছর হতে না হতেই চাচা-চাচীর ঘরে যেনো বোঝা হয়ে গিয়েছিলো। এই সিকদার বাড়ির বড় ছেলে আবরার সিকদারের সাথে তার বিয়ে হয় তিন মাস আগে। আবরার যেনো  নামেই প্রাপ্তির হাসবেন্ড, এই পর্যন্ত প্রাপ্তি তাকে দেখি নি। কারণ সে বরাবরই অসুস্থ থাকে। প্রাপ্তি যতটুকু শুনেছে, একবার তার অনেক ভয়াবহ একটি এক্সিডেন্ট হয়, এক্সিডেন্টের পর থেকে আবরার আর হাটতে পারে নি, তার শরীরের বেশ খানিকটা অংশ এবং মুখের বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে গেছে। বাসর রাতে প্রথম প্রাপ্তির সামনে এসেছিলো সে। সেদিন ঝড় বৃষ্টির রাত ছিলো, খুব জোরে জোরে আকাশ ডাকছিলো, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো। এমনিতেই বিদ্যুৎ চমকানো প্রাপ্তির ভয় লাগে। প্রচুর গা ছমছম করছিলো তার; তাই হুট করে আবরারকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলো। তার পর থেকে প্রাপ্তির সামনে আসে নি আবরার। প্রাপ্তি তাকে ভালোভাবে দেখেও নি, বারবার ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু তাতে তার রাগ পড়ে নি। যখনই প্রাপ্তির সাথে কথা বলে রুমের লাইট অফ করে তারপর কথা বলে যাতে প্রাপ্তি তাকে না দেখতে পারে। এতো কিছু জানা সত্ত্বেও প্রাপ্তি এই বিয়েতে রাজি হয়, না না রাজি হতে বাধ্য হয়। চাচার ব্যবসা ভালো চলছিলো না, প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিলো। উপরে প্রাপ্তি যেনো তাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছিলো। তাই এই বাড়ির ছোট ছেলে অয়ন সিকদার মোটা অংকের টাকা দিয়ে প্রাপ্তিকে নিজের ভাইয়ের দেখভালের জন্য কিনে নিয়েছে। ভদ্র ভাষায় তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। এই বাড়িতে শুধু এই দুই ভাই আর অনেক কাজের মানুষ রয়েছে। প্রাপ্তি যতটুকু শুনেছে, আবরারের মা-বাবা খুব ছোটবেলায় মারা যান। আরেকটি ভাই ও আছে কিন্তু সে এখানে থাকেন না। এই পরিবারের সবকিছুই প্রাপ্তির অদ্ভুত লাগে, মনে হয় হাজারো রহস্য ঘিরে রয়েছে এই বাড়ির আনাচে কানাচে।

 

প্রাপ্তির হাতের ভুনা খিচুড়ি আবরারের খুব প্রিয়, আজ শুক্রবার তাই প্রাপ্তি ঠিক করলো সে খিচুড়ি রান্না করবে। রান্নাঘরে তিন-চারজন কাজের মানুষ আছে। বড়লোক হওয়ার এটাই উপকার, নিজেদের কিছুই করতে হয় না। কিন্তু প্রাপ্তির এই বিলাসিতা পছন্দ নয়। তাই নিজ হাতে সব করতে পছন্দ করে সে। রান্নার মাঝে মনে হতে লাগলো কেউ যেন ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। আচমকা এমনটা হওয়ায় ঘাবড়ে পেছনের দিকে সরে যায় প্রাপ্তি। পেছনে তাকিয়ে যা দেখলো তাতে আরো ভয়ে জমে গেলো সে। এতোক্ষন অয়ন খুব নিখুঁতভাবে প্রাপ্তিকে পর্যবেক্ষণ করছিলো, কখন যে ধীরে ধীরে প্রাপ্তির কাছে চলে আছে এটা নিজেও খেয়াল করে নি। প্রাপ্তির অয়নকে খুব ভয় লাগে। ওর চাহনি যেন বিপদের সংকেত দিতে থাকে, আবার নিজের দিকেও খুব আকর্ষণ করে। প্রাপ্তি কিছুতেই বুঝে উঠে না, এই লোকটার ভেতর কি এমন আছে যা প্রাপ্তিকে নিজের দিকে টানে। তুড়ির আওয়াজে ঘোর কাটে প্রাপ্তির। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর নীল টিশার্ট গায়ে, পকেটে হাত দিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অয়ন। ধীরে ধীরে প্রাপ্তির দিকে এগুতে থাকলে প্রাপ্তি পেছাতে থাকে ওয়ালের দিকে। রান্নাঘরে ওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রাপ্তি থেমে যায়, ওদিকে অয়ন খুব কাছে চলে আসে প্রাপ্তির। কোমরে হাত দিয়ে হ্যাঁচকা টানে নিজের একেবারে কাছে নিয়ে আসে প্রাপ্তিকে সে৷ ভয়ে প্রাপ্তির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে একটা ধুকপুকানি লেগে আছে। ঠিক ভুলের মাত্রা হারিয়ে ফেলেছে। কানের কাছে মুখ লাগিয়ে অয়ন বলতে থাকে,

– এভাবে পেট দেখিয়ে চললে, কি পুরুষের মন জয় করা যায়? কে বলবে তোমার স্বামী মানে আমার ভাই অসুস্থ? তুমি কি ভাবো আমি বুঝি না, সকাল সকাল এতো রুপ দেখিয়ে কাকে বশ করতে চাইছো? তোমার মত মেয়েরা যদি ন্যাংটা হয়ে আমার সামনে হেটে বেড়ায় তাতে এই অয়ন সিকদার পটবে না।

 

বলেই একরকম ধাক্কা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লো অয়ন। অয়নের এই খারাপ ব্যবহার গুলো একেবারে নিতে পারে না প্রাপ্তি, কি এমন পাকা ধানে মই দিয়েছে তার। সব কিছুতে শুধু কিভাবে প্রাপ্তিকে নিচু দেখাবে সেটাই যেন একমাত্র কাজ অয়নের। প্রাপ্তির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, নিজেকে শান্ত করতে চাইছে কিন্তু হয়ে উঠছে না। আজ হয়তো বাবা-মা থাকলে এগুলো তাকে সহ্য করতে হতো না। 

 

অপরদিকে, 

আবরারের রুমে বসে আছে অয়ন। অক্সিজেন লাগানো অবস্থাতে শুয়ে রয়েছে আবরার। দিন পাঁচেক শরীরের অবস্থাটা ভালো নেই তার। ডাক্তার ইহরাম হক বলেই দিয়েছে, আবরারের বেঁচে থাকার ইচ্ছে টুকু নেই। একারণে তার রিকোভারির চান্স খুব কম। আবরারের ডান হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে চোখের পানি ফেলে দিলো অয়ন। 

– ভাই তুমি কমে সুস্থ হবে? তুমি কি সত্যি সেরে উঠবে না?? আজ যাদের জন্য তোমার এই হাল আমি তাদের নাকানিচোবানি খাওয়েছি, এখন মৃত্যুর অপেক্ষা করছে কেবল তারা। 

-….

– ভাই, আমার তুমি বাদে কেউ নেই, আবীর খুব প্রেসার দিচ্ছে বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের। ওর ধারণা ও চাইলেই কোম্পানি সি.ই.ও হয়ে যেতে পারবে। আমি তা কিছুতেই হতে দিবো না। যেটা তোমার সেটার তোমার ই থাকবে। আর সিকদার পরিবারের সামনের উত্তরাধিকার যাতে দ্রুত আসে আমি সেই ব্যবস্থাই করছি। 

– অয়ন বাবা, মেয়েটা তো সত্যিটা জানেই না!

 

সিকদার বাড়ির বিশ্বস্ত লোকমান কথাটা বলতেই অয়নের চোখ মুখ কুচকে যায়। রাগে মাথার রগ ফুলে উঠেছে। কঠিন গলায় বলে,

– ওই দু টাকার মেয়ের সত্যিটা জানার প্রয়োজন ও নেই। ওর কাজ আমাদের উত্তরাধিকার দেওয়ার। যতদিন ভাইয়ের সুস্থতা প্রমান না হবে ততদিন মেয়েটার এই বাড়িতেই থাকতে হবে। 

– কিন্তু, ও তো

– একটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার টুল মাত্র। আপাতত অনেক কিছু সামলাতে হবে। ওই টাকার লোভী মেয়েটাকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে লোকমান কাকা। 

 

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে অয়ন চুপ করে যায়। বাইরে প্রাপ্তি দাঁড়ানো, হাতে সকালের নাস্তা। 

– শুনছেন, আমি আপনার খাবার এনেছি। আপনার যা যা পছন্দ সব বানিয়েছি। শুনছেন।

 

প্রাপ্তির কথা শুনে লোকমান কাকাকে ইশারা করে অয়ন। দ্রুত লোকমান কাকা দরজাটা খুলে খাবার গুলো নিয়ে দরজা দিয়ে দেয়। প্রাপ্তিকে কোনো কথা বলার সুযোগ টুকু দেয় না লোকমান কাকা। দরজার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের রুমে চলে যায় প্রাপ্তি। এটা তার নসিব, তার ভাগ্যে হয়তো সুখটা থাকে না। 

 

রাত ১০টা,

প্রাপ্তি বিছানা করে শুয়ে পড়েছে। সারাদিন অয়ন কিংবা আবরারের সাথে কথা হয় নি। একা একা রুমে কাটিয়েছে। দরজাটা আটকিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে প্রাপ্তি। এ বাড়ির রহস্যগুলো মাথায় যেন একেবারেই ঢুকে না; প্রাপ্তির মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে মন চায়। কিন্তু যাওয়ার জায়গাও নেই। এখানে তবু আরামে আছে, চাচার বাড়ি চাচির মার সহ্য করার থেকে ঢের ভালো। ভাবতে ভাবতেই ঘুমের জগতে পাড়ি দেয় প্রাপ্তি। মাঝ রাতে আবার কারোর উপস্থিতি অনুভব করতে লাগে প্রাপ্তি। কেউ তার গলায় স্পর্শ করছে, গরম নিঃশ্বাস যেন বুকের ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। খুব করে চাচ্ছে যাতে চোখটা খুলতে পারে কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছে না। অচেনা ব্যক্তিটি যখন পায়জামায় হাত দিতে নিয়েছে অমনি…

 

চলবে

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

সূচনা পর্ব

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

প্রথম অধ্যায়

২য় পর্ব

 

অচেনা ব্যক্তিটি যখন পায়জামায় হাত দিতে নিয়েছে অমনি প্রাপ্তি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ব্যক্তিটিকে একটি ধাক্কা দেয়। লোকটি নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায়, ঝমঝম করে কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো প্রাপ্তি। এখনো ঘোরের মাঝেই রয়েছে সে। চোখে অন্ধকার দেখছে, বাস্তবতা আর স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে আলাদা করতে পারছে। খুব কষ্ট করে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে প্রাপ্তি। ভয় করছে খুব তার, এই লোকটা কি চাই! কেনো তাকে এভাবে মোলেস্ট করছে। তাই সবই তার কল্পনা। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সে, বিছানাতেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলো প্রাপ্তি। 

 

সকাল ৯টা,

ডাইনিং টেবিলে অয়ন আর প্রাপ্তি মুখোমুখি বসা। কাল রাতের ঘটনাগুলো বারবার নিজেকে ভাবাতে বাধ্য করছে প্রাপ্তিকে৷ রাতে কাঁচ ভাঙার শব্দ পেলেও সকালে কোনো কাঁচের টুকরো তো দূরে থাক কিছুর অস্তিত্ব পায় নি। তবে কি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে? নাকি আসলেই কেউ তাকে পাগল করার অদম্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। অয়ন মিটিমিটি হাসছে আর নাস্তা করছে। প্রাপ্তির গলা দিয়ে যেন খাবার নামছে না। সত্য মিথ্যার আড়ালে গুমড়ে গুমড়ে থাকছে সে। প্রাপ্তির অবস্থা দেখে মনে মনে বলতে লাগলো,

– আজ যাদের জন্য আমার ভাইয়ের এই হাল, তাদের সুদে আসলে ফেরত দিবো। তুই ও বাদ যাবি না। তোর মতো লোভী মেয়েদের কিভাবে শাস্তি দিতে হয় খুব ভালো করে জানা আছে। 

প্রাপ্তিকে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে অয়ন টিটকারি সুরে বলে,

– আগে তো শুনেছি পচা গলা খাবার খাওয়া হতো, এই দামী খাবার বুঝি গলা দিয়ে নামছে না?? 

-…… 

– বলে না কুকুরের পেটে ঘি সয় না। এখন তো দেখছি ভিখারিদের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য। 

 

এবার নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না প্রাপ্তি। চোখ জ্বলছে, এখনই যেন অশ্রুধারাগুলো চোখকে মুক্ত হয়ে ঝরে পড়বে। চিৎকার করে বলতে লাগলো,

– হ্যা, ভিখিরি তো। আমি ভিখিরি, সব জেনে শুনে কেনো এই ভিখিরিকে নিজের ভাইয়ের জন্য পছন্দ করতে গেলেন? কেনো আনলেন এই বাড়িতে? যদি আমাকে আপনার ভালো নাই লাগে তাহলে কেনো আমার সামনে আসেন বলেন! আর আমি তো আপনার কেউ না, আমি ভিখিরি না বড়লোক তাতে কি যায় আসে আপনার? আর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিন, আমি ভিখিরি বলেই একটা পঙ্গু মানুষকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। পারলে আনুন তো কোনো বড়লোক খুজে, দেখি সে আপনার ভাইকে বিয়ে করে কিনা। 

 

কথাটা শুনতেই অয়নের মুখের ভাব বদলে গিয়েছে, মুখ শক্ত হয়ে গেছে। তড়িৎগতিতে এসে প্রাপ্তির গলা টিপে ধরে সে। অয়নের চোখে মুখে পশুত্ব যেনো ফুটে উঠেছে। এক পর্যায়ে প্রাপ্তির দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। বাড়ির সব কাজের লোকগুলো দৌড়ে এসে অয়নের হাত থেকে প্রাপ্তিকে ছাড়ায়। আর কিছু সময় গেলে হয়তো ওখানেই দম আটকে মারা যেত প্রাপ্তি। অয়ন ছাড়ার পর কিছুক্ষণ বড় বড় নিঃশ্বাস নেয় প্রাপ্তি। একটা কাজের মেয়ে দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় তাকে। পানিটুকু এক নিমিষেই ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। এখনো প্রাপ্তির গা কাঁপছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অয়নের অগ্নিদৃষ্টি এখনো শান্ত হয় নি। রাগের বসে দেয়ালে কিছুক্ষণ ঘুষি মেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। 

 

সন্ধ্যা ৭টা, 

প্রাপ্তি আজ সারাদিন কিছুই খায় নি। এ বাড়ির খাবার যেনো বিশ লাগছে, পানি টুকু খেয়ে দিন কেটেছে তার। বারংবার অয়নের কথাগুলো মনে করে চোখ থেকে পানি পড়ছে। অয়নের প্রতি ঘৃণাটা যেনো আরো বেশি বেড়ে গিয়েছিলো, নিজের ব্যাগ থেকে মা-বাবার ছবিটা বের করে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো প্রাপ্তি। 

– আমি কি অপদার্থ মা? কেনো আমায় ছেড়ে চলে গেলে? কি অপরাধ ছিলো আমার? আচ্ছা আমি কি জীবনে সুখ পাবো না? আল্লাহ বোধহয় সুখের বীজটা আমার ভাগ্যে দেয় নি। কষ্ট নিতে নিতে আমি যে আর পারছি না। 

 

বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙে দরজায় ধামধাম করে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ। এতো জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে যেনো দরজাটাই ভেঙে ফেলবে। চোখ কচলাতে কচলাতে ঘড়ির দিকে তাকালে দেখে ঘড়ির কাঁটা ১১টার কাছাকাছি। এতো রাতে কে আসতে পারে! কৌতুহল নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায় প্রাপ্তি। দরজা খুলতে না খুলতেই অয়ন ব্যালেন্স হারিয়ে প্রাপ্তির গায়ে ঢলে পড়ে। সারা গায়ে বিশ্রী গন্ধ, বোঝাই যাচ্ছে কোনো এলকোহল বাদ দেয় নি সে। মাতাল অবস্থায় এতো রাতে এই বান্দাকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না প্রাপ্তি। কাউকে ডাকতেও পারছে না এই ভেবে যে, মানুষ কি বলবে। দেবর রাত ১১টায় ভাবীর ঘরে ঢুকে ব্যাপারটা পাঁচ কান হলে সবাই প্রাপ্তিকেই দোষাবে। চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে। তাই না পেরে নিজেই কোনো মতে অয়নকে বিছানা অবধি নিয়ে যায় প্রাপ্তি। কোনো মতে শুইয়ে দিয়ে সরে যেতে নিলেই, প্রাপ্তির হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে অয়ন। মাতাল অবস্থাতেই বলতে লাগে,

– খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না? তোমাকে দেখলে মূহুর্তের মধ্যেই আমার ভেতরে আগুন দাও দাও করে জ্বলতে থাকে। আবার তোমার কাছে এলে আগুনটা কেমন শীতল হয়ে যায়। আমার যখনই মনে হয় তুমি আমার না, ইচ্ছে করে একেবারে খুন করে ফেলি তোমাকে। আবার যখন ভাইয়ের কথা মনে করলে পাগল পাগল লাগে৷ 

– কি বলছেন? শুনছেন? আমি তো বুঝতে পারছি না কিছু। কি করেছি আমি?

– আচ্ছা, ভালোবাসা মানেই কি কষ্ট। তুমি আমার ধীর বিষ, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমি পান করতে চাই। তোমার উষ্ণতার ছোয়ায় নিজেকে হারাতে চাই। পরমূহুর্তে তোমার আসল রুপটা মনে পড়লেই জ্যান্ত কবর দিতে ইচ্ছে হয়। তোমার মায়া চেহারার পেছনে কাল নাগিনীটা যে আমার চেনা। 

 

অয়নের কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে প্রাপ্তির। অয়ন বিরবির করে আরো কিছু বললো যা প্রাপ্তির কানে আসলো না। প্রাপ্তি নিজেকে ছাড়িয়ে অয়নের গায়ে কম্বল দিয়ে দিলো। এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো প্রাপ্তি। মাথায় অয়নের বলা কথাগুলো মাথায় ঝেঁকে বসেছে। উফফ! এই লোকটা বিয়ের পর থেকেই শুধু বিরক্ত করছে। কি সমস্যা এই লোকের? কি বলে না বলে ঠিক নেই। প্রাপ্তির দৃষ্টি তখন বাইরের দিকে। সোডিয়ামের লাইটে রাস্তার ওই পাশে একটা মহিলা তার একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। উদবাস্তু হয়েও মা টা তার বাচ্চাকে আগলিয়ে রয়েছে। প্রাপ্তির মূহুর্তে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়তে লাগলো, একটা সময় তার মাও তাকে এভাবে আগলিয়ে রাখতেন। কিন্তু এটা তার পোঁড়া কপাল, কারোর হাতে কিছুই নেই। 

 

ফজরের আযানের সময় ঘুম ভাঙ্গে প্রাপ্তির, নিজেকে বারান্দায় আবিষ্কার করে সে। ধীর পায়ে উঠে রুমের দিকে রওনা দেয় সে। বিছানার দিকে নজর যেতেই খেয়াল করলো অয়ন বেঘুরে ঘুমাচ্ছে। কতোটা নিস্পাপ লাগছে ছেলেটাকে, যেনো নিজের সাদা মনে ধুলিক্ণাটাও জমতে দেয় নি। এই সুন্দর নিস্পাপ চেহারার পেছনে একটা শান্ত পশু লুকিয়ে থাকে কখন যে সেটা কাউকে শেষ করে দিবে কেউ বলতে পারে না। ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে নামায পড়তে যায় প্রাপ্তি। 

 

সকাল ১০ টা, 

মুখের উপর ছিটা পানি পড়ায় অয়নের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলতেই দেখতে পায় এক রমনী, পরণে বেগুনী শাড়ি, খুব নিপুনভাবে নিজের চুল মুছে যাচ্ছে। সকালের স্নিগ্ধতা যেনো চুয়ে চুয়ে পড়ছে। রমনীটা আর কেউ না, প্রাপ্তি। এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো, তারা স্বামী-স্ত্রী। প্রতিদিন সকালটা যদি এভাবে শুরু হতো। অজান্তেই ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি চলে এসেছে অয়নের। সুখের মূহুর্তটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারলো না। ফোনের শব্দে ঘোর কাটে অয়নের। রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে কানে আসে,

– যা করার দ্রুত করতে হবে। 

 

মূহুর্তেই অয়নের মুখ শক্ত হয়ে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে নিজের আর আবরারের ছবি আলোকিত হতেই, নিজের ভেতরের আশার কুড়িগুলোকে মেরে ফেললো অয়ন। নিজের মনকে নিজেই বলতে লাগে,

– ভাইয়ের আজকের পরিণতির জন্য ও দায়ী। ওর সম্মান নষ্ট করা আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। এক তীরে দুই পাখি মারাটাই আমার কাজ। আজ যেমন ভাই বাঁচার কোনো আশা খুজে পাচ্ছে না, এই কাল নাগিনীর জীবনেও এমন দিন আনাই আমার লক্ষ্য। 

প্রাপ্তির তুড়ির আওয়াজে ঘোর কাটে অয়নের। 

– শুনছেন?? কখন থেকে ডাকছি। উঠে যখন গেছেনই এখন নিজের ঘরে চলে যান। আমি চাই না, বাড়িতে আমাদের নিয়ে কোনো বাজে কথা উঠুক। 

– যদি এতোই নিজের রেপুটেশন নিয়ে চিন্তা তাহলে, ঘরে ঢুকানো হলোই বা কেনো আর আমাকে রাখা হলোই বা কেনো। লোকমান কাকাকে বললেই হতো। সত্যি বলতে কি শরীরের চাহিদা মেটাতে হবে তো। এসব মেয়ে নিজের স্বার্থর জন্য কতো নিচে নামতে পারে না আমার ভালো করে জানা আছে। 

 

বলেই গটগট করে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অয়ন। নিজের চোখে নিজেকে আরো ছোট মনে হতে লাগছে প্রাপ্তির। সত্যিই তো নিজেকে টাকার জন্য বিকিয়ে দিয়েছে সে। নয়তো এতো অপমানের পড়েও কেনো এই সিকদার বাড়িতে পড়ে রয়েছে। অয়নের বিকট চিৎকার শোনা যাচ্ছে বাহিরে। রুম থেকে বের হতেই দেখে সবাই ছোটাছুটি করছে, ডাক্তার ডাকা হচ্ছে। সবাইকে ব্যস্ত দেখে কলিজায় কামড় পড়ে প্রাপ্তির। আবরারের কিছু হয় নি তো!! ঠিক তখনই পাশ থেকে শুনে…. 

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

প্রথম অধ্যায়

৩য় পর্ব

 

আবরারের কিছু হয় নি তো!! ঠিক তখনই পাশ থেকে শুনে কিছু কাজের লোক বলাবলি করছে, 

– এই নিয়ে চাইর বার এরাম যায় যায় অবস্থা হইছে। বলতে গেলে তো লোকটা মরাই, ছোট ভাইজান খালি খালি এতো চেষ্টা করে। 

কথাগুলো কানে আসতেই প্রাপ্তি দৌড়ে কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, 

– উনার কি হয়েছে? উনার শরীর ভালো নেই? কি হয়েছে এই মাত্রই তো বলছিলেন, আবরারের এরকম চার বার হলো। কি হয়েছে?

 

আচমকা প্রাপ্তির প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় কাজের লোকগুলো। আমতা আমতা করে “জানি না” বলে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রাপ্তির সামনের থেকে সরে গেলো তারা। প্রাপ্তির বুঝতে বাকি রইলো না, এদের মুখ দিয়ে কথা বার করানো যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলো আবরারের ঘরে যেয়েই দেখিবে কি হয়েছে! সময় নষ্ট না করে আবরারের ঘরের দিকে পা বাড়ালো প্রাপ্তি। আবরারের ঘরের বাইরে চিন্তিত মুখে অয়ন হাটাহাটি করছে। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, ফর্সা চেহারাটা টেনশনে মলিন হয়ে আছে। অয়ন প্রাপ্তির সাথে এ যাবৎকালে ভালো করে কথা বলে নি। তাই প্রাপ্তি খুব ভয় পায় অয়নকে। তাও বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করে,

– কি হয়েছে উনার?

-……

– ভেতরে এতো ডাক্তার কেনো?

-…… 

– সরুন, আমি ভেতরে যাব।

 

প্রাপ্তি অনেকটা জিদের বসেই ভেতরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। অমনি হ্যাচকাটানে পেছনে নিজের সামনে এনে দাঁড় করায় অয়ন তাকে, ডান হাতটা মুড়িয়ে পেছনে আটকে রাখে। ছাড়ানোর চেষ্টা করেও অপারগ প্রাপ্তি। প্রচন্ড জোরে চেপে ধরায় হাতে আংগুলের ছাপটুকু পড়ে যায়। অয়নের চোখ থেকে যেনো আগুন বের হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগে,

– ভাইয়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী তুমি, এখন এসেছো ভালো সাজতে না? এতো আদিক্ষেতা পাও কোথায়?

– মানে? আমি কি করেছি?

– ন্যাকামি করবি না? এখানে আসতে বলেছি তোকে? কেনো এসেছিস? লোকমান কাকা! লোকমান কাকা!

 

অয়নের পাগলামি যেনো বেড়েই চলেছে, প্রাপ্তির হাত ছেড়ে লোকমান কাকাকে ডাকতে থাকে। প্রাপ্তি আর পেরে চেঁচিয়ে উঠে,

– আপনার সমস্যা কি? সে যদি আপনার ভাই হয়ে থাকে আমার ও স্বামী। আমি তার সম্পর্কে জানার অধিকার আছে। মানে কি মগের মুল্লুক! আমি ভেতরে যাবো মানে যাবো। আমাকে আটকানোর চেষ্টা খবরদার করবেন না।

 

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে এক মিনিট দেরি না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লো প্রাপ্তি। ভেতরে এতো বড় শক তার জন্য অপেক্ষা করবে এটা তার জানা ছিলো না। ডাক্তাররা আবরারকে সি.পি.আর দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আবরার অচেতন অবস্থাতে পড়ে রয়েছে বিছানায়। প্রাপ্তির অতর্কিতভাবে ঢুকে যাওয়া কিছুতে আটকাতে না পারায়, অয়নও তার পিছু পিছু রুমে ঢুকে। এই দৃশ্যটি প্রাপ্তি ঠিক কিভাবে নিবে বুঝে উঠতে পারছে না অয়ন। প্রাপ্তি ফ্যালফ্যাল করে বেশ কিছুক্ষণ আবরারের দিকে তাকিয়ে ছিলো। একটা সময় পর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার কাছে। এতো তার স্বামীর গলার স্বরটুকু সে শুনেছে। আজ তাকে দেখছে সে। নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না। আসলেই তো অয়ন তো একটা কথাও ভুল বলে নি, সে সত্যি এই তিনমাস এই লোকটার 

কোনো যত্ন নেয় নি। তার দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। আজ লোকটাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে নিজের মনেই অনুতাপের পোকাগুলো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে আবরারের হাতটি ধরে নিচে বসে পড়ে। অশ্রুধারা যেন থামতেই চাইছে না। শুধু মনে একটাই বাক্য চলছিলো,

– আবরারকে ভালো করে দেও আল্লাহ, আমি স্ত্রীর সকল দায়িত্ব পালন করবো ইনশাআল্লাহ। 

 

দৃশ্যটি কারোর মনে ছুরিঘাত করছিলো, সে আর কেউ নয় সে অয়ন। নিজেকে বুঝ দেওয়ার বাক্যটুকু নেই। প্রাপ্তির দিক থেকে সে কোনো ভুল তো করে নি, তবে কেনো মন চাইছে ওকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু তা সে করতে পারবে না। সত্যিটা জানলে হয়তো প্রাপ্তি এক মূহুর্ত এ বাড়িতে থাকবে না। আজ অলৌকিকতার শেষ নেই, মিনিট বিশেক  পর আবরার অবস্থা স্ট্যাবল হয়। ধীরে ধীরে রেসপন্স করতে লাগে। অয়ন যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রায় দেড় ঘন্টার কষ্ট পেরিয়ে এখন আবরার স্ট্যাবল। শুধু তাই নয়, সে চোখ খুলেছে। তবে কি সে এখনো প্রাপ্তিকে ভালোবাসে? সে কি প্রাপ্তির অস্তিত্বের আভাস পেয়েছিলো??

 

বিকেল ৪টা,

স্টাডি রুমে বসে আছে অয়ন। সকালের ঘটনা এখনো মাথায় ঘুরছে, আবরার ছয় মাস পর আজ চোখ খুলেছে। এই দিনটার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতো অয়ন। অথচ আজ যেন কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছে না। আবরারের অবস্থা ইমপ্রুভ করছে, ডাক্তার বলেছে খুব দ্রুত আবরার ঠিক হয়ে যাবে। খবরটা যতটা খুশির ততটাই ভয়ের। কারণ নিজের মাঝে যে গোপন রহস্য লুকিয়ে রেখেছিলো তা সবার সামনে চলে আসবে। অবশ্য তাতে কারোর কোনো ক্ষতি হবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই অতীতে পাতাগুলো সামনে ভেসে উঠলো অয়নের। আজ থেকে ছয় মাস আগে একটা এক্সিডেন্টে কোমায় চলে যায় আবরার। যদিও এক্সিডেন্টটা একটা ষড়যন্ত্র ছিলো, তবে সেদিনে গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে রাস ড্রাইভ করার কারণ ছিলো আবরারের ভগ্ন হৃদয়। দীর্ঘ তিন বছরের ভালোবাসার মানুষটি তাকে ধোকা দিয়েছিলো। অনলাইন ভালোবাসা তাকে ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠিয়ে ফেলেছিলো। এক্সিডেন্টের পর সিকদার কোম্পানির প্রেসিডেন্সি বজায় রাখতে বলেছিলো আবরারের কিছু ফিজিক্যাল ড্যামেজ বাদে কিছুই হয় নি। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাবে। অয়ন তখন আবরারের ভং ধরে সবার সামনে আসে। আর খোঁজ খবর লাগিয়ে জানতে পারে প্রাপ্তিই সেই মেয়ে যে আবরারকে কষ্ট দিয়েছিলো। প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পড়ে ঠিকই বিশ্বাস করে। প্রাপ্তিকে শাস্তি দেওয়াই অয়নের উদ্দেশ্য। তাই আবরার সেজে প্রাপ্তিকে বিয়ে করে সে। কিন্তু এখন তার কাছে সব ধোয়াশা লাগছে। যদিও বিয়েটা তার কাছে কোনো মুল্য নেই, তবুও বুকে চিনচিনে ব্যথাটা রয়েই গেছে। নিজেকে শান্ত করতে না পেরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় অয়ন। রান্নাঘরে আবরারের জন্য সুপ বানাচ্ছিলো প্রাপ্তি। এক মূহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো দৌড়ে প্রাপ্তিকে জড়িয়ে ধরতে পারলে হয়তো শান্তি লাগতো তার। ধীরে ধীরে প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে…..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

প্রথম অধ্যায়

৪র্থ পর্ব

 

ধীরে ধীরে প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে কি মনে করে নিজেই থেমে যায়। মস্তিষ্ক আর মনের যুদ্ধে আহত সৈনিকের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অয়ন। সুপ বানিয়ে পেছনে ফিরতেই খানিকটা ভয় পেয়ে যায় প্রাপ্তি। অয়ন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাই নিজের বড় ভাই এর জন্য জীবনটাও বাজি ধরতে পারে অথচ আজ পরাজিত সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে যেখানে আবরারের অবস্থা ভালোর দিকে। 

– কিছু লাগবে? 

 

প্রাপ্তির কথায় মাথা তুলে বেশ কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে অয়ন। আজ অয়নের চোখে কোনো ক্ষোভ দেখতে পাচ্ছে না প্রাপ্তি। বরং কিছু চাপা কষ্ট বুকের মাঝে আগলে রাখার প্রমাণ দিচ্ছে এই চোখ জোড়া। প্রাপ্তি অয়নের কাজ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, 

– কি হয়েছে আপনার? কিছু লাগবে?

 

প্রাপ্তির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে অয়ন, যেন ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে। অয়নের পাগলামি আগেও দেখেছে প্রাপ্তি। এই বান্দার কাজের যে কোনো ঠিক ঠিকানা নেই খুব ভালো করেই জানা তার। তাই শান্ত ভাবেই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। অয়ন বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বললো,

– নিজেকে পরাজিত লাগছে, মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে আমি আজ পরাজিত। 

 

বলেই প্রাপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো। প্রাপ্তি কিছুক্ষণ বোকার মতো অয়নের যাবার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এই লোক কখন কি করে, কেনো করে তার কোনো ঠিক নেই। ভেবে মাথাটার বারোটা বাজবে এছাড়া লাভের লাভ কিছুই হবে না। প্রাপ্তি সুপ নিয়ে আবরারের রুমে প্রবেশ করলো। আবরারকে এখন নল দিয়েই খাবার দেয়া হবে, মুখ দিয়ে খেতে সময় লাগবে। এখনো সে কোনো কথা বলে নি। শুধু তাকিয়েই ছিলো, তবে রেসপন্স করছে। ঘুমের ঔষধ নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে তাকে। কি এমন হলো যে, এতোটা খারাপের দিকে চলে গেলো বুঝতে পারছে না প্রাপ্তি। আবরারের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। খুব শান্ত লাগছে তাকে, মুখের বা পাশটা পুড়ে গেছে এক্সিডেন্টে। যতদূর শুনেছিলো আবরারের ৬০ শতাংশ শরীর পুড়ে গিয়েছিলো। এ যাবৎ চার বার সার্জারী হয়েছে। এটা প্রাপ্তিকে জানানো যে হয়েছিলো তা কিন্তু নয়। এ বাড়ির কাজের লোকদের কানাগুসাতে সে জানতে পারে। এই জন্য হয়তো বাসর রাতের দিন এতো ভয় পেয়েছিলো। আবরারের অবস্থা ভালো হলে ইউ.এস.এ এর ক্যালিফোর্নিয়াতে পাঠিয়ে দিবে অয়ন তাকে। প্রাপ্তির এসব কিছুই জানা নেই। জানার সুযোগ সে কখনো পায় নি আর চেষ্টা সে করে নি। আজ নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে এই লোকটার দেখভাল তার দায়িত্ব ছিলো অথচ সে কিছুই করে নি। এসব ভাবতে ভাবতেই আবরারের পাশে ঠায় বসে থাকে সে।।

 

রাত ৮টা,

স্থানঃ জার্মান ক্লাব, গুলশান।

একের পর এক হুইস্কির বোতল শেষ করে যাচ্ছে অয়ন। মনকে শান্ত করাটা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এমনটা হোক এটা তো এতোদিন দোয়া করতো তবে আজ কি হলো। নিজের আবেগগুলো কেনো আজ বেসামাল হয়ে পড়েছে। তবে কি ভেতরে থাকা বরফ কঠিন হৃদয় উষ্ণতার আভা পেয়েছে? তার কাঠিন্য হৃদয়ে কি তবে অনুভূতির বীজ রোপিত হয়েছে?

– লিভারটা তো খেয়ে ফেলবি রে এভাবে মদ খেলে! আর কত খাবি? 

 

পাশে বসতে বসতে সামি বলে উঠে। সামি অয়নের খুব বিশ্বস্ত বন্ধুদের একজন। অয়নের এ টু জি সব খবর সামির জানা। আজ অয়ন মুখে কিছু না বললেও সামি খুব ভালো করেই জানে অয়নের মন যে খারাপ এবং সে নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করে চলেছে। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠে,

– ভাই এখনো ওই মেয়েকে ভালোবাসে। 

– ও, তো? 

– তো মানে? ওই মেয়েটা তো আমার

– তোর কি? বউ? ওটা তো শুধু কাগজের, আর মেয়েটাও জানে সে আবরার ভাইয়ের বউ। আর তুই তো ওকে অন্য একটা কারণে বিয়ে করেছিলি! নাকি এখন তোর লক্ষ্য বদলে দিয়েছিস? নাকি তুই এখনো মেয়েটাকে ভালোবাসিস? 

– কি যা তা বলছিস?

– আমি কিছুই বলছি না। তোর মনের খবর তো তুই জানবি! আমি তো যা দেখতে পারছি তাই বলছি। তোর আজ খুশি হবার কথা অথচ তুই আজ মদ খেয়ে নিজের কষ্টটাকে লুকোচ্ছিস। কেনো কষ্ট হচ্ছে? এজন্য না যে, ভাই যদি জানে তার ভালোবাসাকে তুই বিয়ে করেছিস তখন তোকে ভুল বুঝবে। এজন্য যে তুই যাকে বিয়ে করেছিস সে তোর ভাইয়ের ভালোবাসা। 

– তোর ফালতু কথা শোনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই।

– তাই?

– হ্যা, আমি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছি ওর প্রাপ্য শাস্তি তাকে দিতে পারি। 

– তাহলে দে, মানা কে করেছে।

– ভাই তো

– ভাই এখনো অসুস্থ, তার জন্য কোথাও না কোথাও মেয়েটা কিন্তু দায়ী। আর আমাদের হাতে সময় কিন্তু নেই বললেই চলে৷ 

-… 

– দূর্বলতা খুব খারাপ জিনিস, কারোর প্রতি দূর্বল হয়ে গেলে সে লক্ষ্য থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলে। বাকিটা তোর উপর। 

 

সামির কথাগুলো যেনো অয়নের ঔষধের ন্যায় কাজ করেছে। সত্যিই তো, তার ভাই এর এই অবস্থার জন্য প্রাপ্তি দায়ী। প্রাপ্তি তার প্রাপ্য শাস্তি তো পেতেই হবে। 

 

রাত ১১টা,

আজ কাজের লোকেদের হাতের খাবার প্রাপ্তি খায় নি। নিজেই রান্না করেছে, রান্না শেষে খেয়ে খাবার গুলো গুছাচ্ছিলো। হুট করেই অয়নের কথাটা মনে পড়ে, লোকটা সেই বিকেলে বেরিয়েছে এখনো বাড়ি ফিরে নি। আচ্ছা, লোকটা খেয়েছে তো? পরমূহুর্তে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিলো মাথা থেকে। ওর চিন্তা করার লোকের অভাব নেই। অহেতুক নতুন করে কারোর চিন্তা করা লাগবে না। এই তিন মাসে কম মেয়েকে তো বাড়িতে আনে নি। দেখা যাবে মদ খেয়ে কোনো নারী সঙ্গে লিপ্ত আছে। খাবার গুলো রাখা শেষে রুমের দিকে যেতে লাগলেই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। 

 

দরজাটা খুলতেই দেখে অয়ন অপাশে দাঁড়িয়ে আছে। শার্টের ইন নষ্ট হয়ে আছে, চুল এলোমেলো। আজও ছাইপাশ খেয়েছে এটা বুঝা খুব কঠিন নয়। ঢুলু ঢুলু চোখে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছে অয়ন। তার কাছে এই মূহুর্তে প্রাপ্তিকে কোনো অপ্সরার থেকে কম মনে হচ্ছে না। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে রয়েছে, পাতলা ঠোঁট জোড়া যেনো গোলাপের ভেজা পাপড়ির ন্যায় লাগছে। ফর্সা নাকটায় ঘামের বিন্দু গুলো স্পষ্ট। ওড়না মাজায় বেধে রেখেছে। পুরো যেনো পাকা গিন্নি তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একবার ইচ্ছে করছিলো ঠোঁট জোড়া ছুয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে আটকে রেখে রুমের দিকে রওনা দিলো অয়ন। 

 

প্রাপ্তি বিকেল থেকেই অয়নের পরিবর্তন লক্ষ্য করে যাচ্ছে। আজ অয়নকে বড্ড অন্যমনস্ক লাগছে প্রাপ্তির। কি এমন হলো তার? বিছানাতে শুয়েও কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে। আচ্ছা এতো কেনো ভাবছে অয়নের জন্য সে? অয়ন যে কিনা পদে পদে তাকে অপমান করতে পিছ পা হয় না। 

এসব ভাবতে ভাবতেই হুট করে দরজার খুট খুট শব্দ শুনতে পায় প্রাপ্তি। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে বুঝতে পারে তার দরজার লক কেউ খুলছে। প্রাপ্তি বুকে কামড় পড়ে যায়, এই রাতে কে আসবে তার রুমে? খুট করে দরজা খুলে কেউ ভেতরে আসে। প্রাপ্তির পিঠ দরজার দিকে ছিলো বলে মানুষটার চেহারা সে বুঝতে পারে নি। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। অচেনা ব্যাক্তিটি তখন…..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

প্রথম অধ্যায়

৫ম পর্ব

 

অচেনা ব্যাক্তিটি তখন প্রাপ্তির কাঁধ হাত রাখে। এতোদিন যা হচ্ছিলো তা প্রাপ্তির কল্পনা কিংবা স্বপ্ন ছিলো না। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি সে। এখন যদি ব্যাক্তিটিকে না আটকাতে পারে, তবে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। অন্ধকার ঘরে কি হতে যাচ্ছে তার আভাষ পাওয়া এতো কঠিন কিছু না। বিছানার সাইড টেবিলের টেবিল ল্যাম্পের সুইচ প্রাপ্তির হাতের খুব কাছে। লোকটি যখন প্রাপ্তিকে গভীরভাবে স্পর্শ করার কাজে মেতে উঠে তখন ই সুইচটা লাগিয়ে দেয় প্রাপ্তি। দেরী না করে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লোকটিকে ধাক্কা মেরে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় যা চোখে পড়লো তাতে খুব বড় ধাক্কা খায় প্রাপ্তি। 

– এতো রাতে আমার রুমে কি করছেন আপনি?

 

ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁই ছুঁই, মুখোমুখি বসে আছে প্রাপ্তি আর অয়ন। হ্যা অচেনা ব্যক্তিটি আর কেউ নয় অয়ন। অয়ন ভেবেছিলো প্রতিদিনের মতো ঘুমের ঔষধের ডোজ কাজে দিবে এবং প্রাপ্তি ঘুমের অতল গভীরে থাকবে। কিন্তু আজকে প্রাপ্তি খাবারটা নিজে বানিয়ে খেয়েছে এটা অয়নের জানা ছিলো না। লাইটটা জ্বলতেই অয়ন খানিকটা ঘাবড়ে উঠে। প্রাপ্তি একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে চলছে। অয়ন কোনো কথা না বলে বিছানায় মাথা নিচু করেই বসে ছিলো। 

– কি হলো? কিছু জিজ্ঞাসা করছি তো নাকি?? মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন কেন? আমি তো সম্পর্কে আপনার ভাবি হই, অন্তত আমার সম্মানের কথাটুকু না ভাবেন নিজের ভাইয়ের কথাটুকু তো ভাববেন। নাকি সেটা ভাবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না? 

 

অয়ন শূন্য দৃষ্টিতে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। অয়নের শূন্যতা প্রাপ্তিকে ভাবাতে বারংবার বাধ্য করছে। কিন্তু পর মূহুর্তে অগ্নিরুপ ধারণ করে বলতে লাগলো,

– তিন মাস ধরে আপনাকে সহ্য করে যাচ্ছি, মুখ বুঝে আপনার অন্যায় গুলো মেনে নিচ্ছি বলে এটা ভাববেন না, যে সামনেও তাই হবে। এমন কিছু করার কথা চিন্তাতেও আনবেন না৷ যা আমার চরিত্রে কালিমা লেপে দেয়। আমি কিন্তু বরদাস্ত করবো না। আমার চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যাবেন এবং  এই মূহুর্তে।

-…… 

– আপনি নির্লজ্জ জানতাম, কিন্তু এতোটা নিচ কল্পনায় ও আসে নি। এতোদিন আমার সাথে যা যা হতো তার মানে তা আপনি করতেন। আমি নিজেকে পাগল ভাবতে লেগেছিলাম আপনার জন্য। আমি যে একটা কথাও ভুল বলছি না তা আপনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। কি হলো মুখে কথা নেই কেনো আজ?

-….. 

– আপনি আসলে সব লোকদেখানো করেন। এই যে ভাইকে ভালোবাসা এসব সব নাটক। আপনি আপনার ভাইকে ভালোবাসলে এই রাতের অন্ধকারে আমার রুমে এসে নিজের ভাইয়ের বিশ্বাসকে এভাবে ভাঙ্গতে দিতেন না। 

 

প্রাপ্তির কথাগুলো ছুরির মতো অয়নের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে। আজ সে কোনো খারাপ মতলবে আসে নি; শুধু প্রাপ্তিকে জড়িয়ে ঘুমোতে চেয়েছিলো। তার সে আজ বড্ড উষ্ণতার প্রয়োজন ছিলো। প্রাপ্তি এই তিনটি মাসে অয়নের নেশা কিংবা অভ্যাস যাই বলা হোক তাতে পরিণত হয়েছিলো। রোজ রাতে প্রাপ্তি যখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতো, অয়নের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে সে লক খুলে এই রুমে আসতো। কখনো তাকে দেখতে তো কখনো তার পাশে ঘুমোতে। এই দুই সপ্তাহ প্রাপ্তির ঘুমের ঔষধের ডোজ বাড়িয়ে দিয়েছিলো যাতে প্রাপ্তির অজান্তেই তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে। এতে এক দিকে যেমন সিকদার বাড়ির উত্তরাধিকার আসবে অপরদিকে প্রাপ্তির সম্মানহানির সাথে সাথে সে মানুষিকভাবে ভেঙে পড়বে। কিন্তু যতবার প্রাপ্তির কাছে এসেছে ততোবার বিবেকের তাড়নায় ব্যর্থ হয়েছে। প্রাপ্তির নিস্পাপ মুখ যে কোনো বারবার বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর আজ আবরারের সুস্থতার অগ্রগতি তাকে এই প্লান স্কিপ করতে বাধ্য করেছে। তবু আজ প্রাপ্তির কথাগুলো কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো কাজ করছে। নাক মুখ খিঁচে বললে লাগলো অয়ন,

– বড্ড বেশি বুলি ফুটেছে দেখি! জবান তো না যেনো কেঁচির মতো চলছে। 

– এবার হাত চলতে বাধ্য হবে। 

 

প্রাপ্তির সাহস আর কথার ভঙ্গিতে তড়িৎ গতিতে রেগে যায় অয়ন। আচমকা খুব কাছে চলে আসে প্রাপ্তির, কোমড় চেপে নিজের কাছে টেনে নেয় তাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে লাগে,

– চালাও হাত, আমিও দেখি তুমি কতোটা সাহসী। 

 

অতর্কিত কাছে আসার কারণে প্রাপ্তি যেন জমে যায়, ফ্যালফ্যাল নয়নে অয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু। প্রাপ্তির রেসপন্স না পেয়ে অয়ন পুনরায় বলতে লাগে,

– কি হলো? সাহস উবে গেলো। তোমাদের মতো মেয়েরা টাকার গন্ধে ছেলেদের বিছানায় যেতে দুবার ভাবে না। অথচ এখন সতী সেজে বসে আছো। আমার ভাই সিকদার বারির বড় ছেলে বলেই তুমি যে তাকে বিয়ে করেছো এটা আমার অজানা নয়। তাই চরিত্রে কালিমা লেপে দেয়ার কথাটা তোমার মুখে মানায় না। আরে তোমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে আমাকে পাওয়ার জন্য হাসফাস করে। আর আমি কিনা যাক গে। মদের নেশায় ভুলে এ রুমে চলে এসেছি। তোমার মতো নোংরা মস্তিষ্কের কাউকে আমার ঘরে আসতে ঢুকতে দেই না, মনের ঘরে কথাতো অনেক দূরের। আগে একবার বলেছি, তুমি নগ্ন আমার সামনে দাঁড়ালেও আমি ফিরে তাকাবো না। এই নারীর দেহে অয়ন সিকদারের না কোনোদিন মোহ ছিলো না হবেও না। নারীরা পারে শুধু ছলনা করতে, হয় দেহ নিয়ে নয় রুপ দিয়ে। 

 

বলেই রুম থেকে গটগট করে বেরিয়ে গেলো অয়ন। প্রাপ্তির চোখ থেকে অশ্রুধারা যেনো থামতেই চাইছে না। বারবার চোখ মুছছে লাভ হচ্ছে না। লাল চোখগুলো বড্ড অবুঝ হয়ে পড়েছে। এর আগেও অয়ন তাকে অপমান করেছে। কিন্তু আজ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিলো। এই লোকটা কি চায়! কি এমন করেছে সে, বারবার তাকে এভাবে হেনস্তা হতে হয়। অজান্তে আজ পর্যন্ত কাউকে কষ্ট দিয়েছে বলে জানা নেই তার। অথচ বারবার তার অপমানিত হতে হয়। পাশাপাশি দুটো রুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে দুটো মানুষের নির্ঘুম রাত্রি যাপন। চোখে ঘুমের রেশটুকু নেই। একজনের চোখের পানি বাধ মানছে না, তো আরেকজনের সুপ্ত কষ্টগুলো এলকোহল আর নিকোটিনের আড়ালে মাটি চাপা দিচ্ছে। 

 

সকাল ৮ টা,

ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি নারী ও পুরুষ। গতকালের ঘটনার পরে এখন অবধি তারা কেউ কারোর সাথে কথা বলে নি। সকালে আবরারের রুমে একবার ঢু দিয়েছিলো, লোকমান কাকা জানিয়েছেন উনি ঘুমোচ্ছে। তাই প্রাপ্তি কথা বাড়ায় নি। ডাইনিং টেবিলে আসতে না আসতেই অয়নের সাথে দেখা। মুখ খিঁচিয়ে নাস্তা করতে বসে প্রাপ্তি। অয়নের চোখের নিচের কালি আর লাল চোখ দুইটি নির্ঘুম রাত কাটানোর প্রমাণ দিচ্ছে। নাস্তা করার মাঝখানে অয়নের ফোন বেজে উঠে। নামটি দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় অয়নের। না চাওয়া সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করে সে। অপাশ থেকে কিছু বলতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায় তার। ফোন রাখার পর প্রাপ্তিকে বলে উঠে,

– তুমি কাল থেকে ভার্সিটি যাওয়া শুরু করবে তুমি।

– আমি?

– হ্যা, কেনো কোনো অসুবিধা? 

– না, তা নয় কিন্তু আমি পড়াশুনা ছেড়েছি বছর হবে। ইন্টারের পর আর সুযোগ হয়ে উঠে নি। 

– সেটা সমস্যা নেই, আমি দেখে নিবো। ভাইয়ের বউ মূর্খ হলে তো সমস্যা। আর দাদীমা চাচ্ছিলেন তোমার নামে কিছু শেয়ার লিখে দিবেন। 

– দাদীমা?

– আমাদের যিনি পেলেছেন। তিনি একেবারেই চান না ভাই এর পজিশন অন্যকারোর হাতে যাক। আমি কালকে এইটার ব্যবস্থা করে দিবো। রেডি হয়ে থাকা হয় যাতে। 

– ঠিক আছে।

– তোমার কাকা বেশ কিছুদিন ধরে তোমাকে দেখতে চাইছিলেন। আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত। 

 

চাচাবাড়ির কথা শুনে ভয়ে জড়সড় হয়ে উঠে। প্রাপ্তির এ বছর বিশ বছর হতে চলেছে। প্রাপ্তির বাবা, সোলেমান শেখ ছিলেন খুব নামকরা ব্যাবসায়ীদের একজন। শেখ মার্কেন্টাইল এন্ড কো এর তখন রমরমা অবস্থা। একদিন স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। হাইওয়েতে আচমকা একটা ট্রাক সামনে চলে আসে। ব্রেক তৎক্ষনাৎ কাজ না করায় গাড়িটিকে পিছে ফেলে ট্রাক। শেখ সাহেব এবং তার স্ত্রী জায়গায় মারা যান। অবস্থার প্রতিকূলতার কারণে আগেই সোমা শেখ প্রাপ্তিকে গাড়ি থেকে বাইরে বের করে দেন। যার ফলে আজ প্রাপ্তি জীবিত। সোলেমান শেখের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই খোকন শেখ তার কিছু সম্পত্তি নিজের নামে করিয়ে নেন। কিন্তু ঝামেলা বাধে অন্যখানে। সোলেমান শেখ তার অবর্তমানে সব সম্পত্তি প্রাপ্তির নামে দিয়ে যান, এবং প্রাপ্তি বিশ বছর হলেই এই এসেটগুলো তার নামে ট্রান্সফার হবে। এই কারণগুলোর কারণে বাধ্য হয়ে প্রাপ্তির দেখভাল খোকন শেখ করেন। কিন্তু ব্যবসা কিছুতেই অনুকূলে আনতে পারেন না। অসদ উপায়ে কোনো কিছুতে বরকত হয় না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে তিনি আবরার সিকদারের বিয়ে দিতে রাজী হন টাকার লোভে। প্রাপ্তির ভালো করেই জানা কেনো তার চাচা তাকে দেখতে চাইছেন। যাতে ছলেবলে বাকি সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারেন। 

– আমি ও বাড়িতে যাবো না।

– কেনো? তোমার চাচা তো তোমাকে মেয়ের মতন ভালোবাসেন। তো যেতে না চাওয়ার কারণ কি? 

– আমি যাবো না ব্যস। অহেতুক জোর কেনো করছেন। 

 

বলেই উঠে চলে যায় প্রাপ্তি। অয়নের খটকা লাগে কিন্তু কিছু বলে নি। অয়ন নাস্তা করে আবরারের রুমে যায়। আবরার তখন চোখ মেলে শুয়ে আছে। অয়ন আবরারের পাশের চেয়ারটা টেনে সেখানে বসে। আবরারের ক্যানোলা লাগানো হাতটা আলতো করে নিজের হাতে নিয়ে বলে,

– ভাই, তুই ওই মেয়েটাকে খুব ভালোবাসিস তাই না? তাই তো আমার এতো ডাকেও তুই সাড়া দিস নি অথচ ওর কাছে আসাতেই তুই রেস্পন্স করতে লাগলি। ভাই আমাকে ক্ষমা করে দিস। একটা ভুল করে ফেলেছি আমি। তবে ভুলটা আদৌ ভুল কিনা সেটা জানি না। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হ। অনেক হিসাব মিলার বাকি। 

 

এই সময় অয়নের ফোনে কল আসে। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকালে দেখতে পায় অয়নের এসিস্ট্যান্ট রিয়াদ ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করতেই বলে উঠে,

– স্যার একটা নিউজ ছিলো।

– হুম বলো, কি নিউজ? 

– স্যার, আবীর স্যার বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের হাত করতে শুরু করেছেন তাড়াতাড়ি কিছু না করলে সমস্যা হবে। আর ছোট ম্যাডামের ব্যাপারে কিছু বলার ছিলো, ছোট ম্যাডামের…. 

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

প্রথম অধ্যায় 

৬ষ্ঠ পর্ব

 

– আর ছোট ম্যাডামের ব্যাপারে কিছু বলার ছিলো, ছোট ম্যাডামের আইডিটা আবার এক্টিভেট করা হয়েছে। এবং আগের মতোই ছেলেদের সাথে ফ্লার্ট করা হচ্ছে। 

– তুমি কিভাবে জানলে?

– স্যার বিগত এক সপ্তাহে আমার সাথে প্রায় দিনে ৫-৬ ঘন্টা চ্যাট হয়েছে। 

– আচ্ছা, আমি রাখছি। 

 

রিয়াদের ফোন রাখার পর থেকেই বিষয়টা অয়নকে প্রচন্ড ভাবাতে থাকে। এই এক সপ্তাহ প্রাপ্তির উপর তার কড়া নজর ছিলো। এমনকি প্রাপ্তির নিজস্ব কোনো হ্যান্ডসেট বা ল্যাপটপ ও নেই। তাহলে আইডি অন হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কিছু একটা ভেবে আবার ফোনটা হাতে নেয় অয়ন। ফেসবুকে সার্চ করে “প্রাপ্তি শেখ” আইডিটি পেয়েও যায়। রিয়াদ মিথ্যে বলে নি। আইডিটি সব কিছু লক করা। সুতরাং ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এক্সসেপ্ট না করলে কিছুই বোঝা যাবে না। কিছু একটা ভেবে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠালো অয়ন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। হাতে নাতে প্রমাণ পেলে জ্যান্ত কবর দিতেও পিছ পা হবে না অয়ন, কিন্তু কেনো জানে মন বলছে প্রাপ্তি হয়তো নির্দোষ। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না যে প্রাপ্তির আইডি অন্য কেউ চালায়, হতেই পারে। কিন্তু সেটা হয়ে থাকলে, কে সে যে প্রাপ্তির আইডি দিয়ে ছেলেদের প্রেমের জালে জড়িয়ে হৃদয় ভাঙার মতো অপরাধ করে! আর এতোদিন প্রাপ্তিকে বিনা অপরাধের শাস্তি কি তবে অয়ন দিচ্ছিলো!! না আর ভাবতে পারছি না। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে!!

 

সন্ধ্যা ৭ টা,

প্রাপ্তির ভর্তির সকল কাজ করে মাত্র হাত পা ঝাড়া দিলো অয়ন। আজ একই সাথে অনেক কাজ হয়েছে, একটু চা খেতে পারলে মন্দ হতো না। লোকমান কাকাকে খিবর দিতেই যাচ্ছিলো, অমনি দৌড়াতে দৌড়াতে লোকমান কাকা স্টাডিতে প্রবেশ করলো। 

– কি হয়েছে? তুমি হাফাচ্ছো কেনো?

– ব..ড় বাবা, ব-বড় বাবা

– কি হয়েছে ভাইয়ের?

 

লোকমান কাকার মুখে আবরারের কথা শুনে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় অয়ন। লোকমান কাকা খানিকক্ষণ দম নিয়ে বলতে লাগে,

– বড় বাবা কথা বলছে

– কিহ!! সত্যি??

– হ্যা, অয়ন বাবা। আমি নিজের কানে শুনেছি।

– আপনি ডাক্তার কল করুন, আমি দেখছি। 

 

বলেই আবরারের ঘরে ছুট লাগায় অয়ন। অয়নের যেনো বিঃশ্বাস ই হচ্ছে না! সত্যি আবরার কথা বলছে। আবরারের ঘরে প্রবেশ করতেই অয়ন খেয়াল করলো আবরার বিছানায় শুয়ে হাত ইশারা করছে। ধীর পায়ে কাছে যেতেই মৃদু স্বরে বলে উঠে,

– অ..য়..ন

 

আজ ছয় মাস পর আবরারের মুখে নিজের নাম শুনে অয়ন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি। এই একটাই তো ভাই তার সে একই সাথে তার বাবা এবং মা। নিজেকে সামলিয়ে আবরারের পাশে বসলো সে। আবরার শুধু মুচকি হেসে অয়নের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অয়নের চোখ ছলছল করছে। এখনই যেন অশ্রুধারা চোখ গুলোকে মুক্ত করে ঝরে পড়বে। নিজেকে সামলিয়ে বলে উঠলো,

– আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমার থেকে সুখী বোধহয় কেউ নেই, এখন ফাইনালি আমি রিলিভ পাবো ভাই। 

 

রাত ১০টা, 

অয়ন আবরারের রুম থেকে বের হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, আবরারের ঔষধ কাজ করছে। কিন্তু একটা ছোট অপারেশন করতে হবে, তাহলে আগের মতো কথা বলতে পারবে। আবরার শুধু অয়নের নাম উচ্চারণ করার পর আর কোনো কথাই বলে নি। তবে, এখন সে তার হাত, পা হালকা নড়াতে পারছে। অয়ন চাচ্ছে আবরারকে এখনই ইউ.এস.এ পাঠিয়ে দিতে। তাহলে হয়তো, আরো ইম্প্রুভ করবে আবরার। ফোনে নোটিফিকেশনের আওয়াজ কানে আসতেই ফোনটা হাতে নিলো অয়ন। নোটিফিকেশনটা দেখে মুচকি হেসে প্রাপ্তির রুমের দিকে রওনা দিলো অয়ন। রুমে নক করার প্রায় দশ মিনিট পর প্রাপ্তি দরজা খুললো। এতো রাতে অয়নকে নিজের সামনে দেখে খানিকটা ঘাবড়ে যায় প্রাপ্তি। কালরাতে যা হয়েছে তার পরে অয়নের সাথে জরুরি কোনো ব্যাপার বাদে কথা হয় নি। আমতা আমতা করে বলে উঠে,

– এতো রাতে?

– ভেতরে আসতে পারি?

– কেনো? 

– কিছু কথা ছিলো, ভয় নেই কিছু করবো না

– আচ্ছা, আসুন।

– কিছু ফর্ম এনেছি, নাম পূরণ করা লাগবে। কালকে ভর্তি। আর একটা কথা, তুমি নাকি আঁকা উকি ভালো করো তাই ফাইন আর্টস এর ফর্ম তুলেছি। তোমার ভালো না লাগলে অন্য কিছু চুজ করতে পারো। 

 

প্রাপ্তির ছোটবেলা থেকেই আর্ট খুব ভালো লাগে, শুধু তাই নয় রুমে সারাদিন বসে বসে কিছু না কিছু আঁকা উকি ই করতে থাকে। অয়ন এই তিন মাসে বেশ কয়েকবার তা লক্ষ্য করেছে। প্রাপ্তি অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে অয়নের দিকে। এই লোকের তার পছন্দ অপছন্দ জানার কথা না, তাহলে কিভাবে জেনেছে?

– আপনি কিভাবে জানলেন? আমি আঁকাউকি ভালোবাসি!

– ইচ্ছে থাকলে সব জানা যায়। আচ্ছা, তোমার মোবাইল নেই তাই না?

– আমার তো কারোর সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন হয় না তাই আমি মোবাইল রাখি না কাছে। একটা ছিলো হারিয়ে গেছে। 

– আচ্ছা আমি কাল তোমাকে মোবাইল কিনে দিবো।

– লাগবে না, আমার জন্য অহেতুক।

– এখন তো আর বাসায় থাকা হবে না, তাই বলছিলাম। এতে আমারও টেনশন কম হবে। 

– আচ্ছা আবরার কেমন আছেন? 

– ভাইকে আমি কিছুদিনের জন্য ইউ.এস.এ।পাঠিয়ে দিবো। 

– ওমা, কেনো?

– ভাইয়ের কিছু অপারেশন করা লাগবে। 

– ওখানে একা?

– সেটা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমি ম্যানেজ করে নিয়েছি। সামি আমার বন্ধু ও যাচ্ছে। আচ্ছা একটা কথা ছিলো।

– জ্বী বলেন।

– কোনো সময় যদি জানতে পারো, তোমার সাথে কেউ খুব বড় অন্যায় করেছে, ধোকাবাজি করেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করবে তো? 

– জ্বী?? হঠাৎ এই কথা!

– এমনি জানতে ইচ্ছে হলো, করবে ক্ষমা?

– আমি ক্ষমা করার কেউ না, আর সত্যি বলতে এখন আর কিছু যায় আসে না। জীবনে কম ছলনার স্বীকার তো হই নি। আমি এ ফর্ম পূরণ করে রাখবো। আপনি আসতে পারেন 

 

অয়ন কথা বাড়ালো না, আজ নিজের ভূলের কারণে নিজেকেই পশ্চাতে হচ্ছে। নিজের রুমে এসে গা এলিয়ে দিলো সে। ফোনটা অন করে ফেসবুকে লগ ইন করতেই ম্যাসেজ গুলো চোখে পড়লো। এর মধ্যে প্রাপ্তি শেখের ম্যাসেজ ও চোখে পড়লো। ম্যাসেজটা চোখে পড়তেই চোখ কুচকে ফেললো অয়ন। সারারাত বেশ চ্যাট করে ফজরের দিকে ঘুমাতে যায় অয়ন। 

 

এক সপ্তাহ পর,

আজ প্রাপ্তির প্রথম ক্লাস, এতোদিন পর পড়াশুনা করতে যাচ্ছে খুশি যেন ধরছে না। এই সপ্তাহ অয়নের অন্যরকম রুপ চোখে পড়েছে। শান্ত, ভদ্র এমন অয়ন কল্পনার বাহিরে। সকালে নাস্তার টেবিলে বসে এ কথাই ভাবছিলো। অয়নের তুড়িতে বাস্তবে ফিরে প্রাপ্তি। সামনে তাকাতেই দেখে সাদা শার্ট, নীল জিন্স পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। চুলগুলো কপালে পড়ে রয়েছে। ফর্সা মুখে খোচাখোচা দাড়ি যেন আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে তাকে। 

– কি ভাবছো?

– আপনি কোথাও বের হবেন?

– তোমাকে পৌঁছে দিবো। খাচ্ছো না কেন?

– ও তাহলে গেটেই নামিয়ে দিয়েন, নয়তো 

– নয়তো কি? গেটে নামাবোই বা কেন? তোমাকে ক্লাসে দিয়ে আসবো

– কি দরকার বলুন?

– তুমি খাও এসব নিয়ে তোমার ভাবা লাগবে না।

 

প্রাপ্তি আর কথা বাড়ালো না, এই লোকের সামনে কথা বলা আর উলো বনে মুক্তো ছড়ানো এক। খাওয়া দাওয়া শেষে কলেজের দিকে রওনা দিলো তারা। 

 

দুপুর ২ টা, 

ক্যাফের একটি চেয়ারে বসে আসে অয়ন। অপেক্ষা প্রাপ্তির শেখের আগমনের, ফেসবুকের প্রাপ্তি শেখ। এক ঘন্টা যাবৎ বসে আছে, কিন্তু এখনো আসে নি। অয়নের ধৈর্যের বাধ যেন ভাঙ্গতে লাগলো। ব্যাক্তিটি আসবে না বোঝা যাচ্ছে। এখন আইপি এড্রেস ট্রাক করা ছাড়া উপায় নেই। অয়নের বুঝতে বাকি নেই যে, আবরারের সাথে ধাপ্পাবাজি করা মানুষটি আর যে হোক প্রাপ্তি নয়। প্রাপ্তির ঘরে সি.সি টিভি ক্যামেরা লাগিয়ে ২৪ ঘন্টা অভসারভ করেছে অয়ন। যখন প্রাপ্তি শেখ আইডিটির সাথে চ্যাট করতো তখন প্রাপ্তি ঘরে হয় ঘুমাতো নয় কোনো কাজ করতো। অয়নের সব বিষয়ে খোঁজ নিতেও ভুল হয়েছে। তা না হলে হয়তো আজ প্রাপ্তির চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে পেতো না। চেয়ার থেকে উঠতেই যাবে তখন এক জন রমনী তার সামনে এসে দাঁড়ালো। রমনীটিকে দেখে যেন মাটি থেকে জমি খসে গেছে, রমনীটি আর কেউ নয়….

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

প্রথম অধ্যায় 

৭ম পর্ব

 

চেয়ার থেকে উঠতেই যাবে তখন এক জন রমনী তার সামনে এসে দাঁড়ালো। রমনীটিকে দেখে যেন মাটি থেকে জমি খসে গেছে, রমনীটি আর কেউ নয় আবরারের ছোট বেলার বান্ধবী রাইসা। কালো শাড়ি পরিহিতা রাইসাকে দেখে মূহুর্তের জন্য খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। প্রথমে ভেবেছিলো রাইসাই সে নাকি যে প্রাপ্তি সেজে সবার সাথে ছলনা করে যাচ্ছে। পরে নিজেকে শান্ত করে বোঝালো, এটা অসম্ভব। যতদূর জানে রাইসার বিয়ে হয়ে গেছে, বিয়ের পর কানাডা চলে গিয়েছিলো। আবরার ও রাইসার বিয়ে নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলো না। কিন্তু রাইসাকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব খুশিতেই আছে, মা হতে চলেছে সে। অনেকটা উত্তেজিত ভাবেই জিজ্ঞেস করে অয়ন,

– তুমি? এখানে? কবে এলে রাইসা আপু কানাডা থেকে?

– তাহলে আমায় এখনো মনে রেখেছিস তোরা! খুব কেক খেতে ইচ্ছে করছিলো তাই এখানে আসা। বসতে পারি?

– হ্যা হ্যা বসো না, দুলাভাই কোথায়? তুমি একা যে?

– জানি না, আমি একাই এলাম। শুনলাম, আবরার নাকি বিয়ে করেছে? খুব সুখে আছে নারে?

– আপু তুমিও কি নিউজগুলোই দেখো আর বিশ্বাস করো?

– না বিশ্বাস করার কি আছে? 

– না নেই, ভাই ইউ.এস.এ তে। কিছু কাজে গেছে। 

– ও, বউ কে নিয়ে গেছে বুঝি? 

– না, ও দেশে। তোমার কথা বলো, আসলে কবে? আর এতো বড় গুড নিউজ আমরা কেনো জানি না?

– আমি কখনো যাই ই নি। আর খোঁজ করিস নি বলে জানতে পারিস নি। এটা এমন কিছুই না। আর গুড নিউজ আসতে বেশি দেরি নেই, সাড়ে সাত মাস চলে৷ 

– কিন্তু তুমি তো 

– বিয়েটা আমি করি নি অয়ন। একটা মানুষকে ভালোবেসে অন্য কাউকে বিয়ে করাটা বোধ হয় ঠিক হতো না। আর বিয়ের আগেই আমি এই জানের অস্তিত্ব টের পেয়েছি। ভালোবাসার স্মৃতিটাকে কিভাবে মুছে ফেলি বল। কিন্তু কি বল তো, মানুষটা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখে নি। সেটায় আমার কষ্ট নেই, আমি আমার বাচ্চাকে ঠিক নিজের মতো করে গড়ে নিবো দেখিস। 

– তোমার বাড়ির লোকজন জানে?

– হুম, বাবা আমার মুখ দেখেন না ছয় মাস হবে। 

– তুমি আমাদের বলো নি কেন?

– বলে কি হবে? 

– আমরা এতোটা পর বুঝি?

– যা আপন ছিলো সেই কথা রাখে নি, পরের কাছে কি চাইবো? 

– তুমি এখন কোথায় আছো?

– এক বান্ধবীর বাসায়। একটা জব ম্যানেজ হয়ে গেছে, এভাবেই কাটছি। তোর সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। আচ্ছা, আমি আসি। আবরার এলে একবার ওর সাথে দেখা হওয়াটা দরকার। আমাকে একটু জানাস কেমন?

– তুমি তোমার নাম্বারটা আমায় দাও। আর যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে জানাতে ভুলোনা কিন্তু। 

– হুম, সেভ করে নে। 

 

নম্বর সেভ করার জন্য মোবাইলের লক খুলতেই “প্রাপ্তি শেখ” এর ম্যাসেজ। তাতে লেখা,

” আপনি আমাকে কথা দিয়ে অন্য নারীর সাথে বসে রইবেন, এটা আমি আশা করি নি” 

 

ম্যাসেজটা পেয়েই আশেপাশে নজর ঘুরালো অয়ন। অয়নকে খুব উত্তেজিত লাগছিলো, মথায় ঘাম জমে গেছে। রাইসা অয়নের অস্বাভাবিকতা দেখে জিজ্ঞেস করে,

– কি হলো? তুই এতোটা উত্তেজিত কেনো হচ্ছিস? কোনো সমস্যা

– না, কিছু না। তুমি নম্বর দাও। 

 

রাইসাকে উবারে তুলে দিয়ে, ফোনটা আবার হাতে নেয় অয়ন। ম্যাসেজ অপশনে যেয়ে অই আইডিতে টাইপ করে,

– আপনি যদি ক্যাফেতে এসেই থাকেন তবে দেখা কেনো করলেন না। এক ঘন্টা আপনার অপেক্ষায় কাটিয়েছি। আর ওই নারীটি আমার বোন ছিলো। 

– আমার সাথে দেখা করতে বেশ উতলা হচ্ছেন, বেশ কাল আমার চাচাতো বোন রোশনি শেখ আপনার সাথে দেখা করবে। তাকে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে আমাকেও লাগবে। 

– আচ্ছা, যা আপনার ভালো লাগে। 

 

ম্যাসেজটা পাঠিয়েই রিয়াদকে ফোন দেয় অয়ন। শুধু একটা কথাই বলে,

– আইপি এড্রেস হ্যাক করো। কোন কম্পিউটার বা মোবাইল থেকে ম্যাসেজ আসছে আমি জানতে চাই। তোমাকে তিন দিন সময় দিচ্ছি। আমি জানি না তুমি কিভাবে কি করবে। 

 

ফোনটা রেখে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অয়ন। আজ নিজে প্রাপ্তিকে বাড়ি নিয়ে যাবে সে। উদ্দেশ্য একটাই প্রাপ্তির মনে নিজের জন্য ভালোবাসা তৈরি করা। অনেক ভেবে ঠিক করেছে, একটা চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই। তারপর প্রাপ্তি যদি তাকে ক্ষমা করে দেয়, তাহলে প্রাপ্তিকে মনের মহারানী করে সারাজীবন নিজের মনের রাজত্বে রেখে দিবে। আর যদি তা না হয়, তবে আবরার আর প্রাপ্তির জীবনে বাধা হয়ে কোনোদিনও আসবে না। 

 

বিকেল ৫টা,

স্থানঃ- নবজাগরণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

গেটের সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। প্রাপ্তি এখনো আসে নি, এমনকি মেয়েটার কাছে মোবাইলও নেই। এতো ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে, যদি একটু কথা শুনতো। আজকেই মোবাইল কিনে দিতে হবে। প্রায় দেড় ঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। আজ আসুক ওকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। রাস্তায় পড়ে থাকা ক্যানে লাথি বসাতেই যাবে তখন নজরে পড়লো প্রাপ্তি একটি ছেলের সাথে গেটের দিকে আসছে, তারা যথেষ্ট হাসাহাসি করছিলো যা কারোর কাছে দৃষ্টিকটু না হলেও অয়নের মুহূর্তের মধ্যে মেজাজ বিগড়ে দিতে যথেষ্ট। প্রাপ্তি সামনেই আসছিলো, খেয়াল করে দেখলো গেটের ঠিক অপসিটে গাড়িতে হেলান দিয়ে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। অয়নকে দেখে মোটামুটি ভয়ে জমে গেছে প্রাপ্তি। এমনেই পান থেকে চুন খসলেই এই বান্দা চৌদ্দ গুষ্টির ষষ্ঠী করে দেয়। আর এখন তো একটা ছেলের সাথে সে ঘুরছে না জানি তার ভাগ্যে কি আছে। 

 

অয়নের সামনে গিয়ে আমতা আমতা করে কিছু বলতে গেলে, অয়ন থামিয়ে দেয়। গাড়ির দরজা খুলে নিজে বসায় প্রাপ্তিকে। তারপর রেষ্টুরেন্ট এ খায়াতে নিয়ে যায়। প্রাপ্তির কাছে এ যেনো অন্য অয়ন। এতো দামি রেষ্টুরেন্টে এই প্রথম গিয়েছে প্রাপ্তি। প্রাপ্তির প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও অয়ন পাশে থাকায় তার অস্বস্তিকর পরিস্থিতি স্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। খাওয়া দাওয়া শেষে নদীর পাড়ে ঘুরতে নিয়ে যায় অয়ন তাকে। আজ তিন মাস পর বাহিরে এসেছে প্রাপ্তি। নদীর তীরের ঠান্ডা হাওয়া ভেতরে থাকা মানুষটাকে নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। আজ প্রাপ্তির খুব হালকা লাগছে, পাশে থাকা মানুষটাকেও আজ যেন খুব ভালো লাগছে। বেশ কিছুক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে পাশে তাকাতেই প্রাপ্তির  শরীর জমে গেলো। অয়ন তখন …..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা 

প্রথম অধ্যায়

৮ম পর্ব

 

বেশ কিছুক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে পাশে তাকাতেই প্রাপ্তির  শরীর জমে গেলো। অয়ন তখন এক হাটু গেড়ে মাটিতে বসে আছে। হাতে বেশ কিছু গোলাপফুল, রক্তাক্ত লাল রং যেন ফুলগুলোকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকলে অয়ন বলতে লাগে,

– আজ যে কথাগুলো বলবো তা তোমার কাছে পাগলের প্রলাপ লাগতে পারে, তুমি সবসময় জিজ্ঞেস করতে না আমার সমস্যাটা কি? কেনো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি?  আজ সব প্রশ্নের উত্তর আমি নিবো। তখন না বুঝলেও আজ বুঝি আমি ওই গুলো কেনো করতাম। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার জন্য উত্তপ্ত গরমের ঠান্ডা শীতল পরশ। তুমি আমার পাথর হৃদয়ের উষ্ণতা। আমার খালি জীবনের পূর্ণতা তুমি। আমি তোমার সাথে কোনো সময় ভালো ব্যবহার করতাম না এই ভয়ে যদি ভালোবেসে ফেলি তোমাকে। কিন্তু আজ আমায়ার ভয় আমার জীবনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাপ্তি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমাকে কি তোমার জীবনের ছোট্ট অংশ হবার সুযোগ দিবে? 

– আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?

– হু জানি। সব জেনেই বলছি, একটা সুযোগ কি দেয়া যায় না?

– আমি বিবাহিত অয়ন, আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী। 

– আমি জানি, কিন্তু তোমাদের বিয়েটা কি আদৌ বিয়ে? তুমি কি আমার ভাইকে ভালোবাসো?

– না হয়তো বাসি না, তবে আমি আমার স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে বাদ্ধ। আর আমি সেই মেয়েদের মতো হতে চাই না যারা শুধু টাকার লোভে ওই মানুষটাকে বিয়ে করেছে। উনি কি ভাববেন বলুন তো? 

– ভাই কিছুই ভাববে না আমি সব ঠিক করে দিবো। একটা সুযোগ কি আমি পেতে পারি না বলো? 

– না এটা সম্ভব নয়। আমি উনার সাথে প্রতারণা করতে পারবো না। ক্ষমা করবেন আমায়। 

– বেশ, তুমি যদি সেটা ঠিক মনে করো এটাই হোক। তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো  ভাই তিন মাস পর দেশে ফিরবে। এর মাঝে যদি আমি তোমার মনে জায়গা করে নিতে পারি তবে আমাকে বিয়ে করতে হবে তোমায়।

এবং আমি তা পারবো।

– চ্যালেঞ্জ করছেন?

– উহু, এটা আমার ভালোবাসার পরীক্ষা। যদি তোমার মনে নিজের জন্য জায়গা করতে পারি তবে তোমাকে কোনোদিন নিজ থেকে আলাদা হতে দিবো না। 

– আর যদি তা পারেন?

– তোমার আর ভাইয়ের জীবন থেকে চিরকালের মতো সরে যাবো। প্রমিস

– আমি বাড়ি যাবো।

– আচ্ছা চলো। 

 

বাড়ি আসার পথে রাস্তার দুজনের কোনো কথা হয় নি। গাড়ির গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে সারা রাস্তা প্রাপ্তি শুধু অয়নের বলা কথাগুলোই ভেবেছে। এতো মনের মাঝে যে ক্ষীণ ভয়টা ছিলো তা আজ যেন তীব্র হতে লাগলো। সত্যি যদি এই চ্যালেঞ্জ এ জিতে যায় অয়ন! তখন কি করবে? যত যাই বলুক না কেনো, ভালোবাসা কখন কার প্রতি জন্মাবে তা বলা কঠিন। যতই নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করা হোক না কেনো মনের উপর কোনো কিছুর জোর চলে না। হুট করে ব্রেক লাগতেই হুশ ফিরে প্রাপ্তির। বাহিরে তাকালে দেখতে পায় সিকদার ভিলার বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। কোনো কথা না বলে সরাসরি বাড়ির ভেতরে চলে যায় সে। অয়ন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে একটি বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে৷ 

 

দুই সপ্তাহ পর,

সন্ধ্যা ৭ টা,

স্থানঃ হাভিলি রেস্টুরেন্ট, উত্তরা। 

একটা টেবিলে বসে আসে অয়ন। আজ দুই সপ্তাহ “প্রাপ্তি শেখ” আইডিটি শুধু ঘুরিয়ে যাচ্ছে আজ দেখা করবে, কাল দেখা করবে। এই নিয়ে প্রায় ৫-৭ হাজার টাকার গিফট তাকে পাঠানো হয়ে গেছে। আজ অবশেষে সে দেখা করতে রাজি হয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কোন আইপি এড্রেস দিয়ে ম্যাসেজ গুলো পাঠানো হচ্ছে এটাও ট্রাক করা হয়ে গেছে। এখন শুধু ব্যাক্তিটির আশার অপেক্ষা। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেলো অয়ন। পাশ ফিরে তাকালে একটি নীল শাড়ি পরিহিতা নারী দাঁড়িয়ে আছে। 

– আপনি অয়ন সিকদার ?

– জ্বী আপনি?

– আমি রোশনি শেখ। প্রাপ্তি আমাকে পাঠিয়েছে। এখানে বসা যাবে?

– জ্বী বসুন।

– আমাকে প্রাপ্তি পাঠিয়েছে আপনাকে এটা বলতে সে আপনার সাথে দেখা করবে না। 

– কেনো?

– কারণ, সে এখন আর আপনার প্রতি ইন্টারেস্টেড না। এটা প্রাপ্তির আজকের ব্যাপার না, ও এমন বড়লোকদের পটায়; পটিয়ে পটিয়ে টাকা, গিফট এগুলো নেয়। আসলে এসব দেখেই বাবা ওকে একজনের সাথে নিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমি জানি না কে তিনি তবে শুনেছি অসুস্থ একজন নাকি। যাক গে, আমি আপনাকে এগুলো বলতে এসেছি। এসব নর্দমায় কেনো মুখ দেন সত্যি বুঝি না। ভালো মেয়ের কি অভাব?

 

এতোক্ষণ চুপ করে বসে ছিলো অয়ন। কিন্তু প্রাপ্তির নামের বাজে কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না সে। একে তো নির্দোষ একটা মেয়ে যে জানেই না তার নামে ছেলেদের সাথে ছলনা করে যাচ্ছে উপর থেকে তার নামে যা নয় তাই বলে যাচ্ছে। নিজেকে নিতান্ত শান্ত করে অয়ন জিজ্ঞেস করলো,

– প্রাপ্তি যদি বিবাহিতা হয় তবে তার হাসবেন্ড তো খুব সহজেই এসব কথা জেনে যাবে। 

– ওর হাসবেন্ড তো অসুস্থ। জানবে কিভাবে?

– তোমাকে এখানে আসার কথা  কি ওই জানিয়েছে?

– হুম, ওই আমাকে কালকে জানিয়েছে ফোন করে।

– ফোন নাম্বারটা পেতে পারি?

– জ্বী?

– ফোন নাম্বারটা পেতে পারি? বাংলা ভাষায় বলেছি

– ফো..ফোন নাম্বার? 

– খুব কি কষ্ট হয়ে যাবে ফোন নাম্বার দিতে? 

– ইয়ে.. মানে

– আসলে কি বলেন তো, প্রাপ্তির সাথে আপনার বিগত চার মাসে একবার কথা হয় নি। তাই অহেতুক নাম্বার কোথায় পাবেন? প্রাপ্তির আগে একটা মোবাইল ছিলো, আপনি কোনো ভাবে মোবাইলটা চুরি করেন। এবং তার পর থেকে প্রাপ্তিকে নিচু করতে ওর আইডি থেকে ছেলে ফাসানোর ধান্দা করেন। পরে এতে আপনার প্রেমময় ম্যাসেজে অনেক বাকরা ফাসতে থাকে তাই এটা আপনার একটা নিত্য দিনের কাজ হয়ে যায়। সমস্যাটা হয় যখন প্রাপ্তির বিয়ে ঠিক হয়ে যায় আপনি যেনো কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তারপর তিন মাস আইডিটা বন্ধ থাকে। তারপর আবার এক মাস হয়েছে আইডিটি এক্টিভেট করেছেন আপনি। 

– এসব কি বলছেন আপনি? 

– আমি যে ভুল বলছি না তা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। এতোদিন আমার সাথে প্রাপ্তির আগের নাম্বার দিয়ে আপনি ই কথা বলতেন চ্যাট করতেন। এখন যখন দেখছেন আমি নাছোরবান্দা তখন আপনি আমার সামনে এসে হাজির হয়েছেন এবং প্রাপ্তির নামে যা নয় তাই বলছেন। 

– আপনি কি আজে বাজে কথা বলছেন? আমি ভদ্র ঘরের মেয়ে

 

এবার মেজাজ তুঙে উঠে গেলো অয়নের। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,

– এখন ভালোয় ভালোয় স্বীকার করে নেন, নয়তো পুলিশের ডান্ডায় সব ঠান্ডা হয়ে যাবেন।

– আপনি এতো কিছু জানেন কিভাবে? আপনি কে?

– আমি ওর হাসবেন্ড। আর তোমার কৃতকর্মের জন্য আমি ওই নিস্পাপ মেয়েটাকে দিনের পর দিন শুধু কষ্ট দিয়েছি। 

– আপনি? ওর হাসবেন্ড না অসুস্থ ছিলো?

– ওইটা তোমাদের ফ্রড পরিবারকে ধোয়াশায় রাখতে আমিই অসুস্থতার বাহানা দেই। যাক গে, এবার বলতো আবরার সিকদারের সাথে তোমার থুক্কু অনলাইনের প্রাপ্তি শেখের সম্পর্ক কতোদিনের ছিলো? 

– আবরার সিকদার? আমি চিনি না। কে উনি?

– পুলিশের কাছে না নিলে দেখি মুখ খুলবে না।

– বলছি, বলছি। উনি অনেক পাকাও ছিলেন।এগারো মাস বা তার ও আগে উনার সাথে আমার দেড় মাসের মতো রিলেশন ছিলো। তারপর আমি ওকে ব্লক করে দেই। অই লোক এই ফোনেও অনেক ফোন করতো। কিন্তু তাও আমি রিসিভ করতাম না, পরে না পেরে ব্লক করে দিয়েছলাম। আর তার সাথে আমার যোগাযোগ হয় নি।

– এগারো মাস মানে এক বছর। এতোদিন আগে তার সাথে তোমার ব্রেকআপ হয়েছে? তুমি শিউর? সাত মাস আগে তোমার সাথে তার কথা হয় নি?

– হ্যা? এতে আনশিউর হওয়ার কি আছে? না হয় নি তার সাথে আর কথা।

– ঠিক আছে, আমি তোমাকে দুই ঘন্টার সময় দিচ্ছি প্রাপ্তির আইডি যাতে ডিএক্টিভ হয়ে যায়। আর যদি আমার চোখে পড়ে তো জেলে ঘানি টানার জন্য প্রস্তুত থাকবে তুমি। 

 

বলেই গট গট করে ক্যাফের বাইরে চলে যায় সে। গাড়িতে উঠতেই একটা পিচ্চি গ্লাসে টোকা মারে।  

– ভাই, ফুল নিবেন? তাজা বেলি ফুলের মালাও আছে। ভাবিরে দিলে খুশি হইয়ে যাইবে।

– সত্যি খুশি হবে তো?

– হো, ভাইজান।

– দে তাহলে। 

 

মুচকি হাসি দিয়ে পিচ্চিটাকে বলে। 

– এই নেন পনেরো টেকা।

– তুই এটা রাখ। আজ ভালো করে খাবি ঠিক আছে?

– এইটা তো এক হাজার টাকা।

– রাখতে বললাম তো। এই মালাটা খুব দামী লোকের জন্য নিচ্ছি। 

 

বলে চোখ টিপ্পনী নিয়ে পিচ্চিটাকে এক হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে শিকদার ভিলার দিকে রওনা দেয় অয়ন। আজ তার মন খুব ভালো। এতোদিনের প্রতারকটিকে সে ধরতে পেরেছে। তবে একটা সন্দেহ তার মনের মধ্যে ঘাপ্টি মেরে আসেই। আবরারের যদি এই নকল প্রাপ্তির সাথে এক বছর আগ ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকে তবে সাত মাস আগে সেদিন কেনো এতোটা তাড়াহুড়ো করে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলো! অয়ন জানতো সেদিন প্রাপ্তির সাথে দেখা করতেই এতোটা উত্তেজিত ছিলো আবরার। না এসবের জট আবরার ছাড়া কারোর পক্ষে ছাড়ানো সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতে একটা শাড়ির দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো অয়ন। তৎক্ষনাৎ ব্রেক কসে সে। দোকানের পুতুলের গায়ে একটি কালো শাড়ি খুব ভালো করে চোখে পড়ে তার। বিয়ের এতোদিন পরে প্রাপ্তির জন্য কিছুই কিনা হয় নি অয়নের। কি মনে কিরে শাড়িটা কিনে নেয় সে। 

 

রাত ৯টা,

প্রাপ্তি তখন রান্নাঘরে রাতের খাবার রান্না করছিলো। হঠাৎ কেউ কোমড় জড়িয়ে ধরলে আৎকে উঠে সে। পেছনে ফিরতেই দেখে অয়ন তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। খানিকটা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠে,

– লজ্জা করে না আপনার? এভাবে আমাকে ধরার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে?

– প্রাপ্তি এভাবে বলছো কেন?

– আমি অন্য কারোর স্ত্রী ভুলে যাবেন না। আর কি জানি একবার বলেছিলেন, আমার মতো মেয়ে নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকলেও আপনি নাকি ফিরে চাবেন না। তবে কেনো আমার কাছে এসেছেন?

– প্রাপ্তি আমি তোমাকে ভালোবাসি।

– আপনাদের ভালোবাসা খুব ভালো করে জানা আছে। লাগবে না আমার এরুপ ভালোবাসা যেখানে আমি শুধু অপমান পেয়েছি। 

– আমি কতবার ক্ষমা চাইবো প্রাপ্তি? এই দুই সপ্তাহে কি আমার ভালোবাসা কোথাও বুঝতে পারো নি তুমি? এই দেখো আমি তোমার জন্য এই শাড়ি আর এই মালাটা এনেছি, দেখো।

– কেনো এনেছেন? আমি বলেছিলাম।

 

বলেই শাড়িটা আর মালাটা ছুড়ে ফেলে প্রাপ্তি। আর এক মূহুর্ত না দেরি করে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। চোখের পানিরা বাধ মানছে না। না চাইতেও কেনো এই লোকটার দিকে মনটা ঘুরে। সে তো অন্য কারোর বউ, কেনো তবুও এই লোকটার রং এ মনটা রাঙতে চায়? প্রাপ্তি দোটানার বেড়াজালে আটকে আছে। যার থেকে মুক্তির রাস্তা তার কাছে নেই। হঠাৎ ঘরে চিৎকার চেচামেচি শুরু হয়ে যায়। লোকমান কাকা “অয়ন বাবা, অয়ন বাবা” বলে চিৎকার করছেন। প্রাপ্তি এক মিনিট দেরি না করে অয়নের রুমের দিকে রওনা হয়। সেখানে যা দেখতে পায় তাতে মূহুর্তে হাত পা জমে যায় তার। অয়ন তখন….

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

প্রথম অধ্যায় 

৯ম পর্ব

 

প্রাপ্তি এক মিনিট দেরি না করে অয়নের রুমের দিকে রওনা হয়। সেখানে যা দেখতে পায় তাতে মূহুর্তে হাত পা জমে যায় তার। অয়ন তখন একটা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। ডান হাত থেকে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। ইজি চেয়ারের পাশে কালচে রক্তগুলো জমাট বেধে রয়েছে। লোকমান কাকা একমূহুর্ত দেরি না করে ডাক্তার ডেকে আনলেন। ডাক্তার হাতের রক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে, সাথে ঘুমের ঔষধ খাওয়িয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। চলে যাবার সময় যাতে ডান হাতে পানি না লাগে সেদিকে খেয়াল করতে বলেছেন। অতিরিক্ত এলকোহলের নেশায় ভাঙ্গচুর করতে করতে হাতটা বাজে ভাবে কেটে গেছে অয়নের। প্রাপ্তির এরুপ রুঢ় আচরণ যেন একদম মেয়ে নিতে পারে নি অয়ন। অয়নের এই দুইটা দোষ, ওর রাগ আর ওর জিদ। এই দুইটায় অন্ধ হয়ে জীবনে কতো এ ভুল করেছে তার হিসেব হয়তো জানা নেই। প্রাপ্তি নিজের রুমের দিকে যেতে নিলে লোকমান কাকা তাকে থামিয়ে দেয়,

– মা, তোমাকে কিছু বলার আছে আমার।

– কি হয়েছে লোকমান কাকা?

– আজ তোমাকে কিছু কথা বলব। কথাগুলান আগেই বলা উচিত ছিলো। কিন্তু অয়ন বাবার জন্য বলতে পারি নাই। হয়তো কথা গুলো শুনলে তুমি অয়ন বাবার উপর আরো রাইগে যাবা। কিন্তু কথা গুলো না বললে পরে ব্যাপারটা ঘোলাটেই থাকবে। 

– কি কথা কাকা?

– তোমার বিয়া, বড় বাবার সাথে হয় নাই। হইছে অয়ন বাবার সাথে। 

– জ্বী?? আপনি কি উল্টা পাল্টা কথা বলছেন?

– আমি উল্টা পাল্টা কথা বলি নাই মা, এটাই সত্যি। মা তোমাকে কিছু কথা কই, মন দিয়া শুনবা। তারপর তোমার যদি মনে হয় অয়ন বাবার ভুল আছে, তুমি ওরে যা শাস্তি দিবা অয়ন বাবা তাই মাইনে নিবে। 

-…….

– বড় বাবা আর অয়ন বাবা আপন ভাই না। অয়ন বাবাকে দত্তক নিছিলেন ম্যাডাম। তারপর, একটা এক্সিডেন্টে সাহেব আর ম্যাডাম মারা যান। এর পর বড় ম্যাডাম মানে তাগোর দাদীজানই আবরার বাবা, আবীর বাবা আর অয়ন বাবাকে দেখাশুনা করেন, বড় করেন। আবীর আর আবরার বাবার বয়সের তফাৎ ২ বছর। বড় হইলে আবরার বাবাকে সিকদার কোম্পানীর সি.ই.ও বানানোর সিদ্ধান্ত নেন বড় ম্যাডাম। অয়ন বাবা পালিত বলে তারে কোনোদিন তাদের মধ্যে গুনতো না উনি। এই কারণে আবরার বাবাই অয়ন বাবার সব কিছু ছিলো। যেদিন আবরার বাবারে সব কিছুর দায়িত্ব দেবার চান বড় ম্যাডাম সেই দিন অয়ন বাবা মনে মনে খুব খুশি হইছিলেন। কিন্তু এই খুশি টিকলো না, আবীর বাবা হিংসার কারণে আবরার বাবার নানা রকম ক্ষতি করার কথা চিন্তা করেন। সেটার শাস্তি অবশ্য অয়ন বাবা তারে দিছে। তারপর সাত মাস আগে আবরার বাবা একটা মাইয়ার সাথে দেখা করার জন্য গাড়ি নিয়ে বাইর হইছিলো। তারপর আর কি আবীর বাবার কথায় একটা ট্রাক তার গাড়িরে এক্কেবারে পিসে ফালায়। তার ফলাফল তোমার সামনে। ছয় মাস আবরার বাবা কোমায় ছিলো। এতো চিকিৎসা কোনো কাজে আসে না। এগুলো শুধু বড় ম্যাডাম আর অয়ন বাবা জানতো। বড় ম্যাডাম সিদ্ধান্ত নেয়, আবরার বাবার এই ঘটনা ধামাচাপা রাখবেন। তাই উনি অয়ন বাবাকে বিভিন্ন মেক আপ এর দ্বারা আবরার বাবার মতো সাজায়ে সবার সামনে আনেন। সবাইরে জানান আবরার বাবার শুধু মুখটা পুইড়া গেছে আর হাটতে পারতেছেন না, পড়ে ঠিক হইয়া যাবে। এবং এই নাটকটারে আরো ও বাড়াইতে আবরার বাবার বিয়ের ঘোষণা দেয়। এই নিয়ে অয়ন বাবা আর বড় ম্যাডামের অনেক কথা কাটাকাটি হয়। নিজের সব সম্পত্তি আর উত্তরাধিকারীর ভালোর জন্য অয়ন বাবারে ঢাল বানাইয়ে রাখে বড় ম্যাডাম। বিয়ে করবে অয়ন বাবা, এমনকি বিয়ের পর বাচ্চাটাও তারই হবে কিন্তু সবাই জানবে আবরার বাবার বিয়ে হইছে, বাচ্চাটাও তার। তোমার সামনে আবরার বাবা যতবার দাঁড়াইছে সেটা অয়ন বাবা ছিলো। জানি বিশ্বাস করতে তোমার একটু কষ্ট হইতেছে কিন্তু এটা সত্যি। আর আবরার বাবা যখন ভালা হইয়ে যাবে তখন একটা ডিভোর্স এর একটা নাটক করতো। এই কারণেই ছোট পরিবারের একটা মেয়ে খুইজে বাইর করতে অয়ন বাবাকে আদেশ দিছিলেন। অয়ন বাবা বাধ্য হইছে এগুলা করতে। তবে ওর দোষ ছিলো, নিজের জিদের বসে তোমারে এই গোলকধাঁধাঁয় রাখছিলো। ও ভাবছিলো তুমি টাকার লোভে তারে বিয়ে করছিলা। ওই ছোট বেলা থেকে ভালোবাসার জন্য ছেলেটা ক্ষুধার্ত ছিলো। সে চাইছিলো, তুমি যাতে তারে ভালোবাসো। তার সাথে বিয়া হইছে বা তার টাকার জন্য তার কাছে যাতে তুমি না থাকো। আমি জানি এতোদিন এই ব্যাপার গুলা তোমার কাছে লুকায়ে কাম ডা ভালা করে নাই অয়ন বাবা। কিন্তু বড় ম্যাডামের কথার উপর কথা বলার সাহস বা অধিকার কিছুই নাই তার। এখন তুমি একটু ভাইবে দেইখো তুমি কি করবা। 

 

লোকমান কাকা কথাগুলো বলে রুমের বাইরে চলে গেলো। প্রাপ্তি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখের পানি যেন থামতেই চাচ্ছে না। অয়নের সেই কাজগুলো করার কি দরকার ছিলো! তাহলে দুজনকেই এতোটা কষ্ট পেতে হতো না। আজ হয়তো তাদের ও একটা সুখের সংসার থাকতো। একদিকে ভালোই হয়েছে, এতোদিনের দোটানার অবসান ঘটলো। মনটা হয়তো একারণেই এই মানুষটার দিকে ঘুরতো। এই মানুষটার কথা সারাক্ষণ ভাবতে চাইতো বেহায়া মনটা। শুধু সম্পর্কের মার প্যাঁচে নিজেকে শিটিয়ে রাখতো প্রাপ্তি। আজ এই ধোঁয়াশাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্যু এতো সহজে এই লোকটাকে ক্ষমা করে দিলে তো হবে না, শাস্তিতো পেতেই হবে। প্রাপ্তি মনে মনে ফন্দি আঁটে কিভাবে অয়নকে শাস্তি দেয়া যায়!  এখন শুধু সকালের অপেক্ষা।

 

সকাল ৯টা,

মুখে পানির ছিটা পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় অয়নের। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখে কালো শাড়ি পড়ে এক নারী দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। এই শাড়িটি কাল রাতে কিনে এনেছিলো অয়ন। খুব নিপুন করে চুল মুছছে সে। সকালের শুভ্রতা যেন নারীটি প্রতিটি কণায় জড়িত। নারীটি আর কেউ নয় তার মায়াবতী, তার প্রাপ্তি। প্রথমে মনে হয়েছিলো এটা হয়তো কল্পনা। ঘুমের ঔষধ আর এলকোহলের ঘোরে মিষ্টি স্বপ্ন দেখছে সে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে ঘাড়ের গাঢ় কালো তিলটি। খুব ছুয়ে দিতে মন চাচ্ছিলো, পরক্ষণে রাতের ঘটনাগুলো মনে পড়তেই মনটা ছোট হয়ে গেলো। চোখ কচলে সামনে তাকালে দেখতে পায় রাগী রাগী চোখে প্রাপ্তি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বলে উঠে,

– কি ভেবেছিলেন, সুইসাইডের নাটক করলে আমি পটে যাবো??

– তুমি কল্পনা নও?

– কল্পনা হতে যাবো কেনো? সশরীরে দাঁড়িয়ে আছি। সকাল সকাল নেশা করেছেন নাকি?? উঠুন, উঠুন। বেলা হয়ে এসেছে, নবাব এখানে ভস ভস করে ঘুমোচ্ছে। 

– আমার ক্ষুদা লেগেছে।

– ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন, খাবার রেডি। 

– প্রাপ্তি, তোমাকে কিছু বলবো

– আমি কিছু শুনবো না, এখনই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামেন। 

 

বলেই নিচে চলে আসে প্রাপ্তি। পেছনে ঘুরে তাকালে হয়তো অয়ন হতবাক চেহারাটা চোখে পড়তো। খুব হাসি পাচ্ছে তার। অপরদিকে প্রাপ্তির বদলে যাওয়া অয়নের মনে শত প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটাচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই চক্ষু চোরাকগাছ, আজ সকালের নাস্তা সব অয়নের পছন্দের। লোকমান কাকার দিকে চোখ পড়তেই তিনি না সূচক মাথা নাড়লেন। তার মানে প্রাপ্তি এসব রান্না করেছে। মা মারা যাবার পর থেকে লোকমান কাকা ছাড়া অয়নের পছন্দ না পছন্দ কেউ খেয়াল রাখে নি। 

– কি হলো, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

– এগুলো তুমি করেছো?

– না, আসমান থেকে ডেলিভারি এসেছে। 

– সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে কি হয় তোমার?

–  কিছুই হয় না, বসুন বেড়ে দিচ্ছি। 

 

আজ বহুদিন পর তৃপ্তি করে খাবার খেয়েছে অয়ন। কালরাতের ঘটনার পর, প্রাপ্তিকে এভাবে দেখবে আশা করে নি। খাওয়ার মাঝে ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই “রাইসা আপু” নামটা ভেসে উঠে। ফোন রিসিভ করতেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো অয়ন। অপরপাশ থেকে শুনতে পেলো…..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা 

প্রথম অধ্যায়

১০ম পর্ব

 

ফোন রিসিভ করতেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো অয়ন। অপরপাশ থেকে শুনতে পেলো রাইসা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। অয়ন উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো,

– হ্যালো, হ্যালো। কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো!

 

কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে উত্তর দিলো,

– আপনি কি অয়ন? রাইসার হুট করে পেইন উঠেছে। আমি ওর বান্ধবী, আপনি কি একটু উত্তরা ১১ নম্বরে আসতে পারবেন? ওকে হসপিটালে নিতে হবে হয়তো।

– আচ্ছা আমি আসছি। 

 

ফোনটা রেখেই তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যাচ্ছিলো অয়ন, পেছন থেকে প্রাপ্তি হাতটা টেনে ধরে বললো,

– কোথায় যাচ্ছেন?

– একটা কাজ পড়ে গেছে, আমার হয়তো আসতে দেরি হবে।

– আচ্ছা

– আচ্ছা শুনো?

– জ্বী

– খেয়ে নিও ঠিক মতো, আমি চলে আসবো।

 

বলেই অয়ন বেরিয়ে গেলো। প্রাপ্তির মুখে না বললেও মনে মনে বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলো কারণ অয়নের এভাবে হুট করে বেরিয়ে যাওয়াটা বড্ড অস্বাভাবিক লেগেছে প্রাপ্তির কাছে। 

 

রাত ৮টা, 

আজ সারাদিন অয়নের একটা খোঁজ পায় নি প্রাপ্তি। নিজ থেকেও ফোন করে নি, এই ভেবে যে ও ব্যস্ত আছে হয়তো। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে নিজ মনে স্কেচ করতে করতে অয়নের কথাই ভাবছিল সে। বেশ কিছুক্ষণ পরে, খেয়াল করে দেখলো নিজের আনমনে অয়নের চেহারাই এঁকেছে সে। প্রথম যে দিন অয়নকে দেখেছিলো তখন সে সবে মাত্র এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। তখন জানতো না অয়ন তার স্বামী। ভুল বশত অয়নের রুমে ঢুকে পড়ায় কি ঝাড়িটাই না খেলো। তখন অয়নকে বড্ড বেশি ভয় পেত। ভয়ে কুকড়ে থাকতো এই বুঝি কি না কি বলবে! কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ভয়টা অভিমানে পরিণত হলো। অভিমানটা কখন ভালোলাগা তারপর ভালোবাসায় পরিণত হলো কে জানে। মনের বন্ধ দরজা ভেদ করে ধীর পায়ে ভালোবাসার বীজ বুনে দিলো লোকটা। লোকটার কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। একটিবার ফোন দিলে কি খুব মন্দ হবে! হয়তো না, তাই লোকমান কাকার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন লাগালো অয়নের নাম্বারে। বেশকিছুক্ষণ বাজার পর যখন ধরলো না প্রাপ্তির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আচ্ছা, লোকটার কি সত্যি তার কথা মনে নেই!!

 

রাত ১১টা,

ডাইনিং টেবিলে খাবার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে হাতের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে প্রাপ্তি। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে যায় তার। চোখ কচলিয়ে দরজা খুলে দেখে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো উসখো খুসখো, বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে তাকে। সারাদিনে পেটে দানা পড়েছে কিনা সন্দেহ। প্রাপ্তিকে দেখেই বলে উঠলো,

– বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। একটু খাবার বেড়ে দিও প্লিজ। 

 

বলেই রুমের দিকে চলে যায় অয়ন। প্রাপ্তির খানিকটা রাগ ও হলো। সারাদিন একটা খোঁজ নিলো না লোকটা। কি এমন জরুরি কাজ ছিলো! একটাবার ফোনটাও ধরা যায় না? রান্নাঘরে খাবার গুলো গরম করে ডাইনিং টেবিলে দেয় সে। ততক্ষণে অয়নও চলে আসে। খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললো, 

– সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি নাকি? 

– না, আর বলো না সারাটাদিন একবিন্দু বসার সুযোগ পাই নি। 

– এতো জরুরি কাজ ছিলো বুঝি?

– তাতো ছিলোই।

– জানা যাবে কি? কি এমন করছিলেন?

– তুমি খেয়েছো রাতে?

– কথা পাল্টাচ্ছেন?

– উহু, তুমি না খেলে প্লেট আনো। একসাথে খেতে খেতে বলছি। 

– আমার ক্ষুদা নেই। 

– তা বললে তো হবে না, যাও প্লেট আনো একটা।

– জোর করছেন কেন? ক্ষুদা নেই বললাম তো।

– আচ্ছা বাবা সরি, আর এমন করবো না। কি কাজে গিয়েছিলাম শুনলে তুমিও রাগ করতে পারবে না।

– তাইলে বলেন সারাদিন কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলেন যে ফোন করেও আপনাকে খুজে পাই নি। 

– আমার এক আপু, প্রেগন্যান্ট ছিলো। হুট করেই লেবার পেইন উঠেছে সাথে ব্লিডিং শুরু হয়। ও বান্ধবীর সাথে থাকতো, তাই আমাকে ফোন করেছে। প্রেগ্ন্যাসির আট মাস চলছিলো। হুট করে লেবার পেইন উঠায় ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তারপর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, কমপ্লিকেশন ছিলো অনেক। ডক্টর ভেবেছিলো বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ছেলে হয়েছে। এখন আপুকে রুমে দিয়েছে। বাচ্চাটাকে প্রিম্যাচ্যুরিটির জন্য আই.সি.উ তে রাখা হয়েছে। এখন ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে রেখেছে। তুমি বলো, ফোন কিভাবে ধরতাম?

– উনার পরিবারের কেউ নেই? আর উনার স্বামী?

– ভালোবাসা খুব বাজে জিনিস, মাঝে মাঝে ভুল মানুষকে ভালোবাসলে জীবনটা নরক হয়ে যায়। আর ভালোবাসায় ধোকাটা মানুষকে জীবন্ত মেরে ফেলতে সক্ষম। আপুর ক্ষেত্রে ও তাই। এই বাচ্চাটা না বাঁচলে আপুর বাঁচার আশাটুকু শেষ হয়ে যেত। 

– আমাকে নিয়ে যাবেন তার সাথে দেখা করাতে?

– কি সম্পর্কে যাবে তুমি? 

– যেটা আমাদের সম্পর্কের সত্যতা, সেটা তো বদলানো যাবে না। সেই সম্পর্কেই যাবো। 

– আচ্ছা, আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কি প্রাপ্তি?

– মানে?

– আমি দুই সপ্তাহ আগে তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম। তুমি কালকে সেটার উত্তর দিয়ে দিয়েছো। এর পরে আমাদের মাঝে ঠিক সম্পর্ক আছে প্রাপ্তি?

– আমাকে সত্যিটা বলে দিলে হয়তো আমি এতো কঠোর হতাম না। আপনার কি মনে হয়না কোনো সম্পর্কের ভিত্তি হয় সেই সম্পর্কের সত্যতা। আমাদের সম্পর্কটা একটি মিথ্যে জালে জড়িত ছিল। আমি এতোদিন আপনাকে একজন পরপুরুষ ভাবতাম। কাল লোকমান কাকা যদি আমায় সত্যিটা না বলতো তবে আজও আমি সেই মিথ্যের আড়ালে থাকা সত্যিটুকু জানতে পারতাম না। এবার বলুন আমি কি আমার দিকে ভুল ছিলাম? আমি কিভাবে আপনার প্রেম নিবেদনের উত্তর দিতাম? 

– তুমি জানো সব? তুমি কি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো?

– বেহায়া মনটার সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমি। বাড়ে বাড়ে আপনাকেই চায়, বাড়ে বাড়ে আপনার রঙে নিজেকে রাঙাতে ব্যস্ত সে। কি করবো বলুন?

 

প্রাপ্তির কথাটুকু শুনে চেয়ার ছেড়ে প্রাপ্তির সামনে এসে দাঁড়ায় অয়ন। হাটু গেড়ে নিচে বসে প্রাপ্তির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয় সে। চোখে তার সুখের অশ্রুধারা, এ যেনো জানান দিচ্ছে তার ভালোবাসা জিতে গেছে, আজ সে পরাজিত নয়। প্রাপ্তির চোখে চোখ রেখে বলে,

– আমায় ক্ষমা করে দাও প্রাপ্তি। তোমায় অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না। বিশ্বাস করো ভরসা পাই নি, পরিস্থিতি আমাকে একটা গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছিলো। আজ আমার সামনে সব যেনো পানির মতো পরিষ্কার। এই অয়নটা খুব খারাপ, খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে তোমায়। কথা দিচ্ছি, আর দিবে না। আমার মায়াবতীকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখবো দেখো। কোনো কষ্টের ছিটা তোমার গায়ে লাগতে দিবো না। ভালোবাসি যে, বড্ড ভালোবাসি। আমার এই একলা দুনিয়াতে আমার সঙ্গী কি হবে তুমি?

– আমিও যে এই জেদি, রাগী, খারাপ ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছি। আমার হাতে যে কিছুই নেই। যে মায়ায় জড়িয়ে আছি তা থেকে যে আমার নিস্তার নেই। বড্ড ভালোবাসি, এই দুনিয়ায় আমি বড্ড একা। আমার কষ্ট সহ্যশক্তি খুব কমে গেছে, কথা দিন আর আমাকে জ্বালাবেন না। আমাকে একা করে দিবেন না। কথা দিন?

– কথা দিলাম মায়াবতী। আমি তোমাকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিবো। আমাকে তুমি পরিবারের সুখটা কি দিবে?

– আমার সকল সুখ আপনার, আপনার সকল দুঃখ আমার। 

 

বলেই অয়নকে জড়িয়ে ধরলো প্রাপ্তি। অয়ন ও খুব যত্নে তাকে আগলিয়ে নিয়েছে। আজ দুটি হৃদয় একই সুতোয় বাঁধা পড়েছে। অয়ন পরম যত্নে প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নেয়। নিজের রুমে বিছানার উপর বসিয়ে পরম আদরে প্রাপ্তির কপালে ভালোবাসার উষ্ণ ছোয়া দেয় সে। দুটি দেহ আজ তাদের মিলনে ব্যস্ত। দুটি হৃদয় আজ তাদের প্রাপ্য সুখ কুড়াতে ব্যস্ত। এতোদিনের মান, অভিমান, রাগ, কষ্ট গুলো যেন সুখের তরীতে ভেসে যাচ্ছে। থাক না সাক্ষী হয়ে ঘরের সাদা দেয়াল, আকাশের ওই উজ্জ্বল চাঁদ আর নিঝুম রাত তাদের মিলনের, তাদের ভালোবাসা পাক না পূর্ণতা। 

 

আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গে প্রাপ্তির। চোখ খুলতেই নিজেকে অয়নের বাহুডোরে পায় সে। ক্লান্ত হয়ে চারটার দিকে ঘুমিয়েছে সে। নিজের বরটাকে আজ বড্ড বেশি সুন্দর লাগছে তার কাছে। আচ্ছা, সে কি আসক্ত হয়ে পড়ছে এই মানুষটার প্রতি। হলেও ক্ষতি কি! মানুষটা যে তার একান্ত নিজের। অয়নের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে গোসল করে নেয় সে, ফজরের নামাযের সাথে দু রাকাত নফল নামায পড়ে নেয় সে। এতো সুখ আবার হারিয়ে যাবে নাতো! ধরে রাখতে পারবে তো!! সুখের সময়টা খুব ক্ষণস্থায়ী, আসছে সময় সম্পর্কের কি রুপ নেয় তা হয় তো কারোর জানা নেই।

 

সকাল ১০টা,

বোর্ড মিটিং এ বসে আছে অয়ন। আবীর বোর্ড মিটিং দেখেছে, আজ ভোট হবে তাতে নির্ধারিত হবে সিকদার কোম্পানির সি.ই.ও কে হবে? অয়নের মুখ শক্ত হয়ে আছে। রাগে গা রি রি করছে। সকালবেলায় রিয়াদ ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আবীরের পরিকল্পনা। প্রাপ্তিকে কিছু না বলেই চলে আসতে হয়েছে তাকে। আবরার না থাকায় বাধ্য হয়ে মহিমা সিকদার অর্থাৎ আবরারের দাদীজান অয়নকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। অনেক কথা কাটাকাটির পর বাধ্য হয়েই এই সিদ্ধান্তে রাজি হয় অয়ন। এখন শুধু ফলাফলের অপেক্ষা। রিয়াদ আগ থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। আজ আবীরের সকল খেলার পর্দা উম্মোচিত হবে। দরজায় নক করেই রুমে প্রবেশ করে রিয়াদ। ফলাফল তার হাতে, আবীরের মুখে বিজয়ের হাসি কারণ সব মেম্বারদের টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে নিয়েছে সে। রিয়াদ বলতে লাগলো, 

– এখন আমার হাতে সকল ভোটের গণনা রয়েছে, সিকদার কোম্পানির নতুন সি.ই.ও হলেন…..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা 

প্রথম অধ্যায়

১১ম পর্ব

 

– এখন আমার হাতে সকল ভোটের গণনা রয়েছে, সিকদার কোম্পানির নতুন সি.ই.ও হলেন আবীর সিকদার। 

 

আবীরের মুখে বিজয়ের হাসি, কিন্তু অয়নকে বড্ড শান্ত লাগছে যেন কিছুই হয় নি। হঠাৎ পেছনের প্রজেক্টেরটা অন হয়ে যায়। কিছু ভিডিও র‍্যান্ডমলি চলতে থাকে। তাতে আবীর যে যে বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের ঘুষ দিয়েছে সেটার মূহুর্তগুলি রয়েছে। আবীরের মুখে বিষ্ময় আর ভয় দেখা যাচ্ছে, মুখটা রক্তশূন্য লাগছে। এর পর আরেকটি অডিও ক্লিপ শুরু হয় যাতে আবীরের কন্ঠ স্পষ্ট, 

– আমি ১ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। আবরার সিকদারের লাশ দেখে আরো এক লাখ টাকা পেয়ে যাবে। 

 

আবীরের যেন কিছুই মাথায় আসছে না। এগুলো এতোটা সুন্দর করে কিভাবে যোগাড় করলো অয়ন? এর পর কিছু ভিডিও অন হয় যাতে স্পষ্ট, সিকদার কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির কাছে বেঁচে দিচ্ছে আবীর। এসব ভিডিও দেখে আবীর ধপ করে চেয়ারে বসে পরে। অয়ন রিয়াদকে ইশারা দিলে পুলিশরা রুমে ঢুকে। হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে আবীরকে নিয়ে যাওয়ার সময় অয়নকে ডেকে বলে, 

– আবীর ভাই, তুমি যদি চলো ডালে ডালে, আমি চলি শিরায় শিরায়। তাই তোমার এই বানানো খেলাটা শেষ অনেক আগেই করতে পারতাম। কিন্তু আমি দেখতে চাচ্ছিলাম, তুমি কতোটা নিচে নামতে পারো। এখন জেলের ঘানি টানো। 

 

কথাটা শেষ হবার পর আবীরকে নিয়ে যায় জেলে। অয়ন এবার বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের সোজা ভাষায় বলে দেয়, 

– এখন আপনাদের সি.ই.ও জেলে, এবার ডিসাইড করেন আমাকে কি সি.ই.ও হিসেবে মেনে নিবেন নাকি জালিয়াতির জন্য আপনাদেরও জেলে পুরতে হবে?

– না না, আপনি যা বলবেন তাই হবে (সবাই)

 

বড় একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দেয় অয়ন। আবীর নামক ঝামেলাটি এতোদিন পর একেবারেই ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে সে। এখন হয়তো তাদের জীবনে কোনো বাঁধা আসবে না। কিন্তু আবরার সেদিন কেনো বের হয়েছিলো এটা জানাটা খুব দরকার। আবার রাইসার জীবনটাও নতুন করে সাজানোটা জরুরি। 

 

হাসপাতালে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর জানতে পারে, বাচ্চাটার অবস্থা এখন স্ট্যাবল। ডাক্তারের সাথে কথা বলে আই.সি.উ তে যায় অয়ন। বাচ্চাটি যে এতো সুন্দর, দেখে মনে হচ্ছে একটা শিউলি ফুলের গোছা। ধবধবে সাদা বাচ্চাটির ছোট ছোট চোখগুলো যেন এক অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছে অয়নকে। আচ্ছা, ওর আর প্রাপ্তির জীবনেও কি এরুপ সুখ আসবে? আসবে না কেনো? অবশ্যই আসবে। আল্লাহ যদি তাদের এক সুতোয় বাঁধতে পারে তবে এই সুখটিও অয়নের ভাগ্যে ঠিক লিখবেন। একদিন হুট করে হয়তো জানতে পারবে, প্রাপ্তি আর ওর ভালোবাসা প্রাপ্তির ভেতরে ধীরে ধীরে বাড়ছে। প্রাপ্তির যত্নে কোনো কমতি রাখবে না সে, দিন শেষে মেয়েটাকে সুখের টুকরি সপে দিবে সে। হয়তো দেখতে দেখতে নয় মাস পেরিয়ে ডেলিভারির সময় হবে। তাদের ও একটি ছোট্ট মেয়ে হবে। যাকে কোলে নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হবে সে। রাইসার ছোট্ট শিশুটিকে দেখে কল্পনার সুখের রাজ্যে হারিয়ে গেলো অয়ন। চোখ থেকে খুশির নোনা জল গাল বেয়ে পড়ছে। চোখ দুটি মুছে রাইসার রুমে গেলো সে। রাইসা প্রচুর দূর্বল হয়ে পড়েছে। এই সময়টায় ভালোবাসার মানুষটি সাথে থাকলে হয়তো আজ মেয়েটাকে এতো কিছু সহ্য করতে হতো না। ভালোবাসা নামক জিনিসটি কারো কারো কাছে অমৃত তো কারো কারো কাছে বিষ। 

– কেমন আছো আপু?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই?

– এইতো ভালোই আছি। বাবুর নাম কি রাখলে?

– আব্রাহাম,, কেমন হয়েছে নামটা?

– ভালো। ওর বাবা কি জানে আদৌ ওর ব্যাপারে?

– বলেছিলাম, তাতে তার বাক্য ছিলো এটা একটা ভুল। সে আমার সাথে দেখাও করতে চেয়েছিলো। হয়তো সেদিনই এবোরশন করিয়ে ফেলতো। পরে আর আসলো না সে। আমি অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু লাভ হয় নি, এখন তো শুনেছি বিয়ে করে সুখেই আছে। 

– আমাকে ওই পাষন্ডের নামটা কি বলবে? 

– কি করবি জেনে? কিছুই করার নেই তোর। 

– প্লিজ রাইসা আপু, আমাকে নিজের ভাই ভাবো তো নাকি? প্লিজ একটিবার বলো? চ্যাম্পের ও অধিকার আছে তার বাবার নাম জানা। আর সত্যি বলতে, ওই লোকের জানা উচিত সে যেটাকে ভুল বলে এড়িয়ে গেছে আজ সে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। তার এক রাতের ভুল তোমার জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছে। প্লিজ নামটা বলো আমাকে।

-….. 

– প্লিজ আপু, আজ চুপ করে থেকো না। প্লিজ নামটা বলো। আব্রাহামের ভবিষ্যতের ব্যাপার রাইসা আপু। প্লিজ

– কি করবি জেনে? তোর ভাই কোনোদিন ওকে পিতৃ পরিচয় দিবে না অয়ন। সে আমাকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলো আমাদের মধ্যে যা হয়েছে সেটা একটা ভুল ছিলো। ইমোশনাল হয়ে না ভেবে সে ভুল করে ফেলেছে। এবার তুই বল, আমার কি করার আছে?

– তুমি শিওর ভাই আব্রাহামের বাবা?

– জানতাম তুই ও বিশ্বাস করবি না। আমাকে কি ভাবিস তোরা? এতোজনের সাথে বিছানায় গিয়েছি যে আমার সন্তানের বাবা কে সেটাই জানবো না? 

– না না, তুমি আমায় ভুল বুঝো না। কিন্তু ভাই দায়িত্ব এড়ানোর মতো লোক নন। আমি শিওর কোথাও ভুল হয়েছে। আমাকে কি পুরো ঘটনাটা খুলে বলা যায় আপু? 

– হুম

 

তারপর সাড়ে আট মাস আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো রাইসা অয়নকে বলতে লাগলো। 

 

সাড়ে আট মাস আগে, 

সন্ধ্যা ৭টা,

স্থানঃ- ল্যাকভিউ রেস্টুরেন্ট এন্ড বার, উত্তরা।

হঠাৎ ফোন আসায় সেখানে উপস্থিত হয় রাইসা। আবরারের ফোনে যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেনো রাইসা নিজেকে আটকাতে পারে না নিজেকে। মানুষটাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে এসেছে সে। কিন্তু আফসোস এই মানুষটা কোনোদিন তার ভালোবাসা বুঝা তো দুর চেষ্টা ও করে নি। বরং যখনই রাইসা তাকে মনের কথা বুঝাতে চেয়েছে হয় সেটাকে উড়িয়ে দিয়েছে নয় এটাকে বয়সের দোষ বলে রাইসাকে বুঝাবার চেষ্টা করেছে। তাই রাইসাও হাল ছেড়ে দিয়েছে। কি দরকার, ভালোই তো আছে বন্ধু হিসেবে। কিন্তু আজ তার এনগেজমেন্টের কথাবার্তার ভেতরে যখন আবরার তাকে ফোন দিয়ে জানায় সে তাকে চায় রাইসা নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি। এখানে এসে দেখে একের পর এক ভটকার গ্লাস শেষ করে যাচ্ছে আবরার। আবরারকে আটকানোর জন্য যখন তাকে বাঁধা দেয়, তখন আবরার বলে উঠে,

– রাইসু, তুই এসেছিস? আমি তো ভেবেছিলাম তুই আসবি না। আচ্ছা আমার সাথেই এমন কেনো হয় বলতে পারবি? আচ্ছা আমি তো মেয়েটাকে মন থেকে ভালোবেসেছিলাম, যখন যা চেয়েছি দিয়েছি তাও কেনো আমার সাথেই এমন হলো? জানিস ওইটা একটা ফেক আইডি ছিলো। আমি মানতেই পারছি না। 

 

বলে রাইসাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের প্রলাপ করতে লাগলো। আজ রাইসার থেকে অসহায় হয়তো কেউ নেই। নিজের ভালোবাসার মানুষটি তার কাছে নিজের ব্যার্থ প্রেমের কথা বলছে অথচ এই মানুষটা একবার যদি বুঝতো রাইসা তাকে কতটা ভালোবাসে। রাইসা খুব কষ্টে তাকে সামলায়। এখন আবরারকে কোথাও নেয়া সম্ভব নয় বিধায় একটা হোটেলে খুব কষ্ট করে নিয়ে আসে। বিছানায় আবরারকে শুইয়ে উঠে যেতে নিলেই রাইসার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনে সে। রাইসা কিছু বলার আগেই তার কানের মুখ লাগিয়ে বলে, 

– আজ তোকে বড্ড মায়াবী লাগছে, যেনো এক ফালি চাঁদের টুকরো আমার হাতে কেউ এনে দিয়েছে। খুব আপন করে নিতে ইচ্ছে করছে তোকে। 

– আবরার তুই নেশায় যা তা বলছিস। ছাড় আমাকে আমি উঠবো। 

– নেশা কেটে গেলে তুমিও কেটে যাবে। আজ রাতটা বড্ড বেহায়া হতে মন চাচ্ছে। আমি সত্যি অন্ধ, আমার সামনে পিকাসোর পেইন্টিং থাকতে আমি ছেড়া কাগজের আঁকিবুকির পেছনে ছুটেছি। তোর মাঝে এতো মায়া আমার অন্ধ চোখে পড়লোই না। আজ এ মায়ায় ডুবে যেতে মন চাইছে, দিবি আমাকে সে সুযোগ?

– আবরার কাল সকালে সব ভুলে যাবি তুই, আমি চাই না আমাদের সম্পর্ক এই নেশার বশে একটি ভুলে পরিণত হোক। 

– হবে না, আমি তোর গায়ে কোনো আঁচ আসতে দিবো না। তোকে মনের কোঠরে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবো। আজ আমার তোকে খুব করে চাই রাইসু। অন্যদের মত আমায় একা করে দিস না প্লিজ। আমি থাকতে পারবো না। আমার এসব ভালো লাগছে না রাইসু। অয়ন বাদে, কাছের মানুষ কেউ নেই। তুই আমাকে একা করে দিস না প্লিজ। আমি হয়তো মরেই যাবো।

– কখনোই না, এসব কথা মুখেও আনবি না। তুই সবসম্য আমাকে পাশে পাবি, যত ঝড় আসুক না কেন আমি কখনো তোকে ছেড়ে যাবো না কথা দিলাম। 

 

কথাটা শেষ হতেই রাইসাকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নেয় আবরার। কিছু আর্তনাদ, কিছু বেদনা ধীরে ধীরে কতটা সুখময় হঅয়ে যায় সেটা সেদিন রাইসা অনুভব করতে পারছিলো। ভেবেছিলো এটা সুখের মিলন হবে কিন্তু এই সুখটা যে ক্ষণিকের অতিথি ছিলো সেটা কল্পনাতেও আনে নি রাইসা। এই কালরাত যে কেবল নেশার ঘোরে করা সামান্য ভুল হবে যা তার জীবনকে ৩৬০ ডিগ্রীতে ঘুরিয়ে দিবে সেটার আঁচও তার ভালোবাসায় অন্ধ হৃদয়টি পায় নি। 

 

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখতে পায় আবরার শক্ত মুখে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদরটা পেছিয়ে দাঁড়াতেই যা শুনলো তাতে মাটির নিচের জমি খসে পড়ে রাইসার। 

আবরার এমন কিছু বলবে তা কল্পনাতেও আনে নি। আবরার তখন বলে…..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা  

প্রথম অধ্যায়

১২তম পর্ব

 

চাঁদরটা পেছিয়ে দাঁড়াতেই যা শুনলো তাতে মাটির নিচের জমি খসে পড়ে রাইসার। 

আবরার এমন কিছু বলবে তা কল্পনাতেও আনে নি। আবরার তখন রাইসার দিকে ফিরে বলে উঠে,

– আবেগ আর নেশার তাড়নায় ভুল করে ফেলেছি, পারলে ক্ষমা করে দিস। কাল রাতে নেশার ঘোরে মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে। আমিতো নেশায় ছিলাম কিন্তু তোর বুঝা উচিত ছিলো। যাই হোক ইটস জাস্ট এ মিস্টেক

-…… 

– সকাল হয়ে গেছে, কালরাতে এই হোটেলের রুমে কি হয়েছে এটা এখানে দফন হয়ে থাকবে। তাই তোর সম্মানের কোনো হানি হবে না,, কথা দিচ্ছি। চল কিছু খেয়ে তোকে বাড়ি পৌঁছে দি। 

-…..

– যা, ফ্রেশ হয়ে নে। আমি লবিতে আছি। 

 

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আবরার। মূহুর্তে সব স্বপ্নগুলো যেন দুমড়ে মুচড়ে ছারখার হয়ে গেলো। কাল রাতের সব কিছু একটা স্বপ্ন ছিলো, যেনো একটা মিষ্টি স্বপ্ন যা ভোরের তীব্র আলোতে ঝলসে গেছে। মুখের চাপা কষ্ট, আর্তনাদ নোনতা জ্বলের রুপে চোখের ধার দিয়ে বেয়ে পড়ছে। এখন যদি মরে যেতে পারতো সত্যি হয়তো ভালো হতো, এই নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে মেনে নিতে হতো না। কি দিয়েছে এই সো কল্ড ভালোবাসা তাকে, কষ্টের একটা পাহাড় যা সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। হবেই তো, দোষ যে তার। মেয়েদের ই দোষ, ভালোবাসলে দোষ, বিশ্বাস করলে দোষ। আজ একটা মেয়ে নেশায় ভুত হয়ে এমনটা করে সকাল বেলা বলতো “যাই হোক, ইটস জাস্ট এ মিস্টেক ” তবে এই সমাজ তাকে নষ্টা বলতো। আবার এখন তাকেও সমাজ নষ্টাই বলবে। অথচ তার বিশ্বাস, ভালোবাসায় কি কোনো খুদ ছিলো। হয়তো ছিলো, হয়তো সে অপাত্রে দান করেছে তার ভালোবাসা। তাতে বাস্তবতা পাল্টাবে না, এটা “ইটস জাস্ট এ মিস্টেক” ই থাকবে। 

 

রাইসা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়, গোসল করে লবিতে যায়। আবরার খাওয়ার কথা বললেও সে কোনো কথা ছাড়াই সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। এভাবে সময় কাটতে থাকে। আবরার ফোন করলেও রাইসা তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে না। এর মাঝে দেড় মাস কেটে যায়। রাইসার বিয়ের ডেট ফিক্স হয়ে যাওয়ার পর হুট করেই শরীর খারাপ হতে লাগে তার। বিভিন্ন পরীক্ষা করার পর জানতে পারে সে একা নয়, একটা ছোট্ট অংশ তার মাঝে বড় হচ্ছে। ঐ সময় হিতাহিত জ্ঞানটুকু হারিয়ে ফেলে রাইসা। উত্তেজিত হয়ে ফোন দিয়ে বসে আবরারকে। 

– বাহ! এতোদিন পর কি মনে করে ফোন দিলি? শুনলাম বিয়ে করছিস, বিয়ের দাওয়ার দিবি নাকি?

– আবরার আই এম প্রেগন্যান্ট। চার উইক চলে, আমি কি করবো বুঝছি না।

– তুই পিলস খাস নি? লাইক সিরিয়াসলি? কিছুদিনের মধ্যে আমাকে দাদীজান সিকদার কোম্পানির উত্তরাধিকার ঘোষণা করবেন। এখন এই স্ক্যান্ডালের কথা জানতে পারলে বুঝতেছিস কি হবে?

– আবরার এটা তোর ও। আমার একার নয়।

– এটা একটা ভুল ছিলো রাইসা। এক রাতের আবেগ ছিলো। এখন তুই নিজে ভেবে দেখ, তুই কি রেডি এই বেবির জন্য নাকি আমি রেডি? আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটুকু ও নেই। দায়িত্বের বোঝা কাধে নিয়ে একটা সমঝোতার সম্পর্ক বয়ে নেওয়া কতোটা কঠিন, ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া। 

– বেশ, তোর আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। 

– রাইসু আমার কথা শোন। এখন ইমোশনাল হওয়ার সময় না। বুঝার ট্রাই কর প্লিজ। 

– যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে। তুই ভালো থাকিস।

– আচ্ছা, বেশ আমরা দেখা করি? তারপর ডিসিশন নেই? প্লিজ, মাথা খারাপ করে কোনো কাজ করিস না

– বেশ যেটা ভালো মনে করবি। 

– আমি ৩০০ফিটের দিকে আসছি, তুই ওখানে ওয়েট করিস। 

 

এটাই আবরার আর রাইসার শেষ কথোপকথন ছিলো। এরপর রাইসা পুরো ৬ ঘন্টা ঐ জায়গায় অপেক্ষা করেছিলো। দুপুর গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামলো রাইসার মাঝে বেঁচে থাকা আশাগুলো অস্ত সূর্যের ন্যায় ডুবে গেলো। তারপরের ঘটনা তো কারোর অজানা নয়।।

 

রাইসার মুখে সব কাহিনি শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলো অয়ন। দায়িত্ব পালন করার ভয়ে আজ নিজের সন্তানকেই অস্বীকার করেছে আবরার। আব্রাহাম, তার নিজের ছেলে অথচ সে জানেই না। এখন এই ভাঙা পরিবারটাকে জোড়া লাগাতে হবে। এটা যে নিতান্ত জরুরি। তাই এক মূহুর্ত না ভেবে রাইসাকে ঠান্ডা মাথায় আবরারের এক্সিডেন্ট এবং বিয়ে সম্পর্কিত সত্যিটা বলে দিলো অয়ন। সব শুনে রাইসা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

– তোর দাদীজান তোকে কোনোদিন মেনে নেয় নি, আমাকে মানবে কিভাবে ভাবলি? আর আবরার সুস্থ হবার পর আব্রাহামকে পিতৃ পরিচয় দিবে এটার গ্যারেন্টি? থাক না ভালো আছি তো আমরা দুই মা-ছেলে। আর সত্যি বলতে আমি এই উত্তরাধিকারীর বাজে খেলায় আমার ছেলেকে জড়াতে চাই না। তুই আমার থেকে মহীমা সিকদারকে ভালো করে চিনিস। আমি আবরারের দয়া চাই না। 

– ভাই সামনের মাসে ফিরবে। ওর তোমাকে দরকার কেনো বুঝছো না?

– যেদিন ও সেটার প্রমাণ দিতে পারবে সেদিন আমি বিশ্বাস করবো। আর এ নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। 

 

অয়ন আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বাড়ি চলে যায়। এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে তার পুরো পরিবার কিভাবে দেওয়া যেয় এই চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।

 

দুই মাস পর, 

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই বমি করছে প্রাপ্তি। শরীরটা দুই তিন ভালো যাচ্ছে না, ডাক্তার দেখাতে পারলে ভালো হতো। কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, মাসিক মিস হচ্ছে। কাউকে যে বলবে সেই সুযোগটুকু নেই। অয়ন কোম্পানি নিয়ে ব্যস্ত, উপর থেকে আবরার সুস্থতার পথে দেশে ফিরে আসবে এই সপ্তাহে। এদিকে রাইসা আর আব্রাহামকেও সামলাতে হচ্ছে। প্রাপ্তির দিকে তার নজর কই? এই নিয়ে খুব রাগ হয়, কিন্তু এই লোকটার প্রতি রাগ করার উপায় নেই। বড্ড বেশি ভালোবাসে যে তাকে। তাই একা একা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ভাবে প্রাপ্তি। হুট করেই পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলে হুশ ফিরে তার। 

– কি ভাবছো?

– আমাকে নিয়ে ভাবার সময় আছে আপনার?

– তোমাকে নিয়েই তো ভাবি, আর কি নিয়ে ভাববো বলো। দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র বউ। 

– তাই বুঝি? আজকে অফিস যাবেন না?

– হু যাবো, আচ্ছা রাতে তোমার জন্য খুব বড় সারপ্রাইজ আছে।

– কি সারপ্রাইজ? 

– বললে তা সারপ্রাইজ হয়? রাতে জানবে 

– ধুর, বলেন না?

– উহু, চলো খেতে চলো। আমি রেডি হয়ে নেই।

 

এই বলে অয়ন ফ্রেশ হতে চলে গেলো। আর প্রাপ্তির ভেবে ভেবে চুল ছেড়া হাল। খাওয়া দাওয়া শেষে অয়ন বেরিয়ে পড়ে। আর প্রাপ্তিও ডাক্তারের কাছে চলে যায়। 

 

দুপুর ২ টা,

রিপোর্ট হাতে বসে রয়েছে প্রাপ্তি। আজ সে একা নয়, তার ভেতরে তার আর অয়নের ভালোবাসা বড় হচ্ছে। এই পরিবারটাই তারা দুজন এতোদিন কল্পনা করছিলো। আজ তাদের হাতে সুখের ঝুড়ি এসেছে। এই সুখ যেন পৃথিবীর সর্বোত্তম সুখ, সে যে মা হতে চলেছে। আজ তাদের বিয়ের ছয় মাস পূরণ হলো, মনে মনে ভাবছিলো কি গিফট অয়নকে দেয়া যায়। উপর ওয়ালা স্বয়ং পৃথিবীর সবথেকে বড় সুখ তাদের দিয়েছে। প্রাপ্তি রাতে এই খুশির খবরটা অয়নকে দিবে। হয়তো অয়ন সারপ্রাইজ দিতে যেতে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। এখন শুধু রাতের অপেক্ষামাত্র।

 

লোকমান কাকা দুপুরের দিকে মহীমা সিকদারের সাথে কথা বলে, কিছু কাজের লোককে ডেকে বলে দেয়, 

– প্রাপ্তি মার কোনো অযত্ন যাতে না হয় তোমরা দেখবা।

– কেনো? উনি তো অয়ন স্যারের বউ। 

– তো? এখন মালিক কে? অয়ন বাবা। তোমার কি মনে হয় প্রাপ্তি মা যদি এই তিন মাসের মধ্যে মা না হয় তাহলে সে মালিক থাকবে? আবরার বাবা ফিরে আসতেছে। তাই প্রাপ্তি মার কোনো অযত্ন করা যাবে না। এই সি.ই.ও হওয়া কি এতো সহজ? অয়ন বাবা এত কিছু কেন করতেছে? যাতে বড় ম্যাডাম খুশি হয়। প্রাপ্তি মারে সে কি ভালোবাসতো? সে তো প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করছিলো। কিন্তু এখন বাসে, কেনো? কারণ প্রাপ্তি মা যত তাড়াতাড়ি এই পরিবারে উত্তরাধিকার দিবে তত পাকাপুক্ত ভাবে অয়ন বাবারে বড় ম্যাডাম মাইনে নিবে। এটাই তাদের ডিল। তাই যা বলি শোনো। 

 

তাদের কথোপকথন পুরোপুরি প্রাপ্তি শুনে ফেলে। নিচে এসে অয়নের পছন্দের রান্না করতে এসে তাদের কথাবার্তা শুনে দাঁকড়িয়ে পড়ে সে। লোকমান কাকার কথাগুলো শুনে এক মূহুর্তের জন্য স্তব্দ হয়ে যায় সে। তাহলে কি এই কয়মাসের সুখ নিছক ছলনা ছিলো? ও শুধু উত্তরাধিকার পাওয়ার মাধ্যম কেবল অয়নের কাছে? না এটা সম্ভব নয়। অয়ন তাকে ভালোবাসে। এতো বড় ছলনা সে কখনোই করবে না তার সাথে। কিন্তু লোকমান কাকাও তো মিথ্যে বলবেন না। নিজের রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় প্রাপ্তি৷ ঝর্ণা ছেড়ে ধপ করে বসে পড়লো সে। কতো স্বপ্ন দেখেছিলো সে, সব যেন কাচের টুকরোর মতো ভেঙ্গে গেছে আজ। একজনকে আপন ভেবে আঁকড়িয়ে ধরেছিলো সে। সে ও তার সাথে এতো বড় ছলনা করলো। আজ প্রাপ্তির কাছে স্পষ্ট সে কেবলমাত্র একটি দাবার গুটি অয়নের জীবনে। কিন্তু তার অনাগত বাচ্চাটিকে এই দাবা খেলার গুটি হতে দিবে না সে। এই সিকদার ভিলায় এক মূহুর্ত থাকবে না সে। অয়নের ছায়াও পড়তে দিবে না সে বাচ্চাটির গায়ে। 

 

সন্ধ্যা ৭টা,

রাজপথে হেটে চলেছে প্রাপ্তি। শরীর যেন চলতে চাচ্ছে না, গন্তব্য অজানা তবু হেটে চলেছে প্রাপ্তি। শুধু একটা নোট লিখে চলে এসেছে সে।

” আমাকে ক্ষমা করবেন অয়ন, আপনার সিকদার পরিবারের উত্তরাধিকার খেলার দাবার গুটি আমি আর হতে পারবো না। আল্লাহ যাতে আপনার সামনে আমাকে আর কোনোদিন না আনে। ভালো থাকবেন”

চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, দুঃখ আর কষ্টের বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত প্রাপ্তি। ঘোলাটে লাগছে সবকিছু। সামনে একটি গাড়ি, অথচ নড়তে ইচ্ছে করছে না প্রাপ্তির। সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। গাড়িটি তার বেগে ছুটে আসছে প্রাপ্তির দিকে। 

 

লোকমান কাকার ফোন পেয়েই বাড়ি এসে প্রাপ্তিকে না পেয়ে পাগলের মতো খুজতে লাগলো অয়ন। রুমে খুজতে খুজতে প্রাপ্তির লেখাটা হাতে পড়লো তার। ধপ করে নিচে বসে পড়লো সে। এই একটা ভয় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো তাকে তাহলে কি প্রাপ্তিকে হারিয়ে ফেললো সে? পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। সে যে পারবে না প্রাপ্তিকে ছাড়া থাকতে। এর মধ্যে রিয়াদের ফোন আছে অয়নের কাছে। ফোন ধরতেই

– স্যার একটা লাশ পাওয়া গেছে, আমার মনে হয় এটা ম্যাডামের লাশ। 

 

সমাপ্ত

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

দ্বিতীয় অধ্যায়

সূচনা পর্ব

 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে মেয়েটি। শাড়ির আঁচলের ধার দিয়ে ক্ষত স্থান গুলো আবছা দেখা যাচ্ছে। শাড়ির আঁচলটা ফেলে দিলেই তার ক্ষত স্থানগুলো সেই বিভৎস রাতের স্মৃতিগুলোর প্রমাণ দিবে। গলার নিচ থেকে কোমড় অবধি ক্ষত স্থান শুকিয়ে গেলেও রেশ রয়ে গেছে। অনেক কষ্টে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো সে। পুরোনো বাড়িটি এই একটি রুম সাক্ষী হয়ে রয়েছে তার কান্না, আর্তনাদ, মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কষ্টের। একজন বলেছিলো, ভালোবাসা জিনিসটা কারো কারো কাছে অমৃত তো কারো কারো কাছে বিষ। মেয়েটির ক্ষেত্রে ভালোবাসা নামক জিনিসটা বিষে পরিণত হয়েছে। একটা নামী পরিবারের অন্তরালের দাবা খেলা গুটি ছিলো সে। চার মাস পরেও কথাগুলো মনে পড়লে চোখের নোনা পানিধারা বাধ মানতে চায় না। পেটের দিকে নজর পড়তেই নিজেকে সামলে নেয় সে। আজ আটগারো সপ্তাহ চলতো যদি বাচ্চাটিকে বাঁচানো যেত। বাঁচার আশাটুকুও শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু অয়ন সিকিদারের মুখোমুখি হবার পালা। চোখ মুছে নিজেকে নিজে শান্ত করতে বলে উঠে,

– মৃত ব্যক্তি ফিরে আসে না, প্রাপ্তিও আর ফিরে যাবে না সিকদার ভিলাতে। প্রাপ্তি সেই রাতে মারা গিয়েছে। জন্ম নিয়েছে খুশবু। খুশবু কাঁদবে না, তাকে যে ফিরতে হবে সিকদার ভিলায়। এতোদিন যেই অয়ন সিকদার তার জীবন নিয়ে খেলেছে তাকে এখন শাস্তি দেবার পালা। 

 

অপরদিকে, 

সন্ধ্যা ৭ টা, 

বউয়ের মতো সাজানো হয়েছে সিকদার ভিলাকে, এনগেজমেন্ট বলে কথা। শহরের সবথেকে জাকজমক সাজসজ্জা করা হয়েছে আজ ভিলা। নামীদামী সকল লোকেরা জমা হবে আজ এখানে। মহীমা সিকদার নিজে সব তদারকি করছেন। সিকদার কোম্পানির উত্তরাধিকারের আজ এনগেজমেন্ট বলে কথা, তাও আবার শহরের টপ ফাইভ বিজনেসম্যানদের একজন, হেলাল খানের একমাত্র মেয়ের সাথে। এতোদিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চললো মহীমা সিকদারের। 

 

অন্ধকার রুমের এক কোনায় প্রাপ্তির একটি ছবি হাতে বসে রয়েছে অয়ন। বাহিরের সাজসজ্জা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। চারটা মাস পাগলের মতো খুঁজেছে প্রাপ্তিকে কিন্তু তার ছায়াকেও খুঁজে পায় নি সে। এক পাশে কিছু মদের বোতল আরেক পাশে প্রাপ্তির ছবি, তার লেখা শেষ নোটটি, তার প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট আর মাঝে অয়ন। সবাই মেনে নিলেও এখনো প্রাপ্তির মৃত্যুটুকু মেনে নেয় নি অয়ন। তার বিশ্বাস পৃথিবীর কোনো এক কোনে প্রাপ্তি লুকিয়ে আছে। যেদিন তার রাগ ভেঙে যাবে সেদিন ঠিক ফিরে আসবে সে। দরজার কড়া নাড়ায় বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠে অয়ন,

– আমার ঘরে কেউ ঢুকবে না, মানা করেছি তো একবার। কেনো আসো তোমরা? আজ তোমাদের জন্য আমার মায়াবতী আমার কাছে নেই। আমার বাচ্চার বেড়ে উঠা আমি দেখতে পাচ্ছি না। আর কি চাই তোমাদের? সব ফেরত দিয়ে দিয়েছি তো! কি চাই?

– অয়ন, আমি আবরার। আমাকে অন্তত আসতে দে। 

– কি দেখতে এসেছো?

– আজ আমার এনগেজমেন্ট অয়ন। প্লিজ, আজ অন্তত পাগলামি করিস না। 

-….. 

 

অয়নের জবাব না পেয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে আবরার। ঘরে একটা উটকো গন্ধ যেন ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। লাইট টা অন করতেই অয়নের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে। অন্ধকার যার চিরসঙ্গী, তার কি আলো পছন্দ হবে! চোখ কুচকে মুখ খিঁচে  জিজ্ঞেস করে,

– কি চাই তোমার এখানে?

– দাদীজান অপেক্ষা করছে, তারা চলে এসেছে। 

– একটা কথা বলবো ভাই? তোমার থেকে দূর্ভাগা আমি আমার লাইফে এ দেখি নি। অবশ্য আমিও যে কম তা নয়। দেখো না, আমি আমার পুরো পরিবার পাওয়া সত্ত্বেও একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য হারিয়ে ফেলেছি। তবে আমি জানতামই না আমার একটা অংশ প্রাপ্তির মাঝে রয়েছে,জানলে আমি তাকে মাথায় করে রাখতাম। নিজ থেকে আলাদা হতে দিতাম না। অথচ তুমি, সব জেনে বুঝে নিজের পরিবারটা হারিয়ে ফেলছো। তোমার একটা ভুল এখন একটি রক্ত মাংসের মানুষ। তুমি জানো তোমার একটি ছেলে আছে, অথচ তুমি কখনো তার মুখে বাবা ডাকটি শুনবে না। 

– আমি কি যায় নি রাইসার কাছে? আমি কি চাই নি আমার পরিবারটা থাকুক। কিন্তু পেলাম কোথায়? হারিয়ে গেলো রাইসা আমার ছেলেটিকে নিয়ে।

– সত্যি বলো তো, তুমি কি রাইসা আপুর জন্য তার কাছে গিয়েছিলে? উহু, তুমি মহীমা সিকদারের কথায় ছেলেটিকে ছিনিয়ে নিতে গিয়েছিলে। আচ্ছা, এই পাওয়ার, প্রতিপত্তির জন্য তুমি ওই নিশি মেয়েটিকে বিয়ে তো করবে কিন্তু ভালোবাসতে পারবে তো? তুমি নিজেও জানো রাইসা আপুর মতো ভালো তোমাকে কেউ বাসতে পারবে না। আমরা হয়তো ভালোবাসার যোগ্য নই। তাইতো ভালোবাসার উষ্ণতা পেয়েও আমরা দুজন হারিয়ে ফেলেছি। তুমি জেনে বুঝে হারিয়েছো আমি না জেনে। হাহাহা। যাও আজ তোমার বিশেষ দিন বলে কথা,, আমাকে এর মধ্যে টেনো না। আমি আমার প্রাপ্তিকে নিয়ে ভালো আছি। 

 

আবরারের মুখে কথা নেই, অয়ন তো ভুল কিছু বলে নি। সব পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে সে। রাইসাকে এতোটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে যে এখন তার ক্ষমা পাবে কিনা তাও জানে না।  যখন আবরারকে অয়ন তার ছেলে এবং রাইসার কথা বলেছিলো তখন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে নি সে, নিজের ছেলেকে দেখার আকুলতায় ভুল করে ফেলেছে সে। মহীমা সিকদারকে ফোন করে সাথে সাথে জানায় এই খুশির খবর। কিন্তু মহীমা সিকদার এতোটা স্বার্থপর হবে এটা কল্পনাতেও আনে নি আবরার। অয়নের সব কিছু ছেড়ে দেবার পর, মহীমা সিকদার আবরারকে পুনরায় সিকদার কোম্পানির দায়িত্ব সপে দেন। যার জন্য আবরারকে সোজা সাপটা জানিয়ে দেন, 

– তুমি যদি চাও বাচ্চাটিকে আমাদের পরিবারে নিয়ে আসতে পারো, কিন্তু রাইসা নামক মেয়েটিকে যদি বিয়ে করতে চাও তবে তোমাকে সিকদার পরিবার ছাড়তে হবে। আমি চাই না ওই মেয়ে আমার পরিবারের বউ হয়ে আসুক। অয়নকে নিয়ে আমার কোনো কালে মাথা ব্যাথা ছিলো না, কিন্তু এখানে তোমার ব্যাপার। আমার আপন নাতীর বউ একজন চরিত্রহীন মেয়ে, যে কিনা বিয়ের আগে মা হয়ে যায় এমন মেয়ে হবে এটা আমি মানবো না।  এখন তুমি ভেবে নেও কি করবে।

– কিন্তু আমিও তো একই ভুল করেছি দাদীজান। 

– ছেলেরা টুকটাক ভুল করেই থাকে এটা এতো বড় ব্যাপার না। আর আমার মতে ছেলেটাকে তোমার কাছে আনাই ভালো, তাহলে তোমার ডিভোর্সের নাটকটা আরো শক্তপুক্ত হবে। রাইসা মেয়েটিকে কিছু টাকা দিয়ে দাও তাহলেই তো হবে। 

– কিন্তু…

– আমি বুড়ো হয়েছি, এতো চাপ আমি নিতে পারবো না। ভেবে দেখো তুমি।

 

আবরারকে এই কঠিন সিদ্ধান্তটি স্বার্থপরের মতো নিতে হয়। যখন রাইসাকে এ ব্যাপারে সে জানায়, তখন থেকে রাইসা আব্রাহামকে নিয়ে পালিয়ে যায় শহর থেকে। অনেক খুঁজাখুঁজির পর ও তাকে এই শহরে পায় নি আবরার। আজও খুঁজে যাচ্ছে রাইসাকে, একটা শেষ জায়গা আছে কিন্তু সেখানে রাইসাকে পাবার পসিবিলিটি না এর সমান। আবরার আজ  নিজের সাথে চোখ মেলাতে পারছে না। আজ যদি অয়নের মতো বুকের পাটা থাকতো তবে সব ছেড়ে ছুটে চলে যেতো রাইসার কাছে। কিন্তু সেটা তার নেই, সে দাদীজানের হাতের পুতুল মাত্র। রাইসাকে তার জীবনে ফেরাতে হলে নিজের জায়গা শক্ত করতে হবে। দাদীজানের হাত থেকে পুতুল নাচের দড়ি কেড়ে নিতে হলে নিজেকে লোহার মত শক্ত করতে হবে যাতে ভারের টানে দড়ি ছিড়ে যায়। এখন এই এনগেজমেন্টের মিথ্যে নাটকটা তাকে চালিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু বিয়ে অবধি এই নাটক গড়াতে দিবে না সে। তার জীবনে যদি কোনো নারী আসে সেটা রাইসা ব্যাতীত আর কেউ হবে না। এখন অনেক কাজ বাকি, রাইসাকে পাওয়া বাকি, নিজের পজিশন, প্রতিপত্তি বাড়ানো বাকি। আচ্ছা রাইসা যদি জানে এই এনগেজমেন্টের কথা তবে কি ও আরো বুঝবে আবরারকে!! 

 

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, নিশি আর আবরার মুখোমুখি দাঁড়ানো। মহীমা সিকদারের মুখে হাসি ধরছে না। নিশি মেয়েটা যথেষ্ট আধুনিক একটা মেয়ে। লেখাপড়া শেষে বাবার ব্যবসায় জয়েন করেছে। এমন একটি মেয়েই তো চায় নিজের নাতবউ হিসেবে মহীমা সিকদার। আবরার যেন কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার কোনো আগ্রহ নেই এই মিথ্যে অনুষ্ঠানে। নিশির বান্ধবীরা রিং নিয়ে আসলে রিং সেরেমনি শুরু করেন মহীমা সিকদার। প্রথমে আবরারের হাতে রিং পড়িয়ে দেয় নিশি। এবার আবরারের পালা, যেই না আবরার রিং পড়াতে যাবে অমনি ফোনটা বেজে উঠে। রিং রেখে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবরার। নিশির ব্যাপারটা একদম ভালো লাগে নি। এদিকে ফোন রিসিভ করে যা শুনে তাতে আবরারের মাথা এক মূহুর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অপরপাশ থেকে আবরারের এসিস্ট্যান্ট জিহান বলে,

– স্যার, রাইসা ম্যামকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু…. 

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

দ্বিতীয় অধ্যায়

২য় পর্ব

 

– স্যার, রাইসা ম্যামকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু উনি ভালো নেই স্যার। এখানে একজন পরিচিত আত্নীয়ার বাড়িতে থাকছেন। একটি সাধারণ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। খুব কষ্ট করে বাচ্চাটিকে বড় করছেন। ছেলেটির বয়স সাত মাস হতে চলেছে। এখানে সবাই জানে উনি বিধবা, আসছে দিন উনাকে উত্তক্ত ও কম করা হয় না। মাটি কামড়ে ওখানে পড়ে রয়েছেন। এখানে উনার আত্নীয়া ছাড়া কেউ থাকেন না। উনি প্রায় পঞ্চান্ন বছরের একজন মহিলা। উনার আপন বলতে কেউ নেই, তাই রাইসা ম্যামকে এখানে থাকার পারমিশন দিয়েছেন। স্যার এখন আমরা কি করবো?

– রাইসাকে যাতে কেউ কোনো রকম ডিসটার্ব না করে সেটা দেখার দায়িত্ব তোমার। আমি খুব দ্রুত চিটাগং আসছি। 

 

বলে ফোনটা রেখে দেয় আবরার। আজ রাইসাকে এতো কিছু সহ্য করা লাগছে এটা শুধু মাত্র তার জন্য। সেদিন যে ভুল করেছিলো, আজ সেই একই ভুল সে করবে না। চোখ দুটো মুছে, স্টেজে চলে গেলো সে। আবরারকে দেখে মহীমা চৌধুরীর হাসি কিছুটা মলিন হয়ে গেলো, তিনি আঁচ করতে পারছেন সামনে আবরার কি করতে যাচ্ছে। মাইকটা হাতে নিয়েই আবরার ডিক্লেয়ার করে দিলো,

– আপনাদের দামী সময় নষ্টের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত, সামনে এমনটা যাতে না হয় সেটাই চেষ্টা করবো। আজ এনগেজমেন্টটা হবে না। উই আর সরি, যাওয়ার সময় অবশ্যই খেয়ে যাবেন। থ্যাংক উ।

 

আবরারের ডিক্লেয়ারেশনের পর, মহীমা চৌধুরী যখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে সে পাশ কাটিয়ে নিজ রুমে চলে যায়। তাকে প্যাকিং করতে হবে। রাইসাকে একবার যেহেতু খুজে পেয়েছে আর হারাতে দিবে না সে। আবরারের এটোতা ঔদ্ধত্য দেখে রাগে ফুসছেন মহীমা সিকদার। কোনোভাবে হেলাল খানকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন তিনি। এতোদিনের বন্ধুত্বের খাতিরে উনিও শান্ত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আবরারের, তার সাথে কোনো কথা না বলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াতে অনেক বেশি অখুশি হলেন মহীমা সিকদার। 

 

রাত ১১টা, 

আবরার, অয়ন এবং মহীমা সিকদার মুখোমুখি বসে আছেন। অয়নের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আবরারের কথায় এই মিটিং এ থাকতে রাজি হয়েছে। নিরবতা ভেঙ্গে মহীমা বেগম বলে উঠলেন,

– হুট করে কি এমন হলো যে আমার মান সম্মানের তোয়াক্কা না করেই তুমি এই প্রোগামটা নষ্ট করে দিলে। তুমি জানো আমি কতোটা অপমানিত হয়েছি? হেলাল আমাকে সম্মান করে তাই কিছু বলে নি। এখন কি আমি জানতে পারি কি এমন হয়েছে? 

– আমি কাল চিটাগং যাচ্ছি, ওখানে একটা খুব বড় ইস্যু হয়ে গেছে। আমাদের প্রজেক্ট অর্ধেক কাজেই থেমে গেছে। 

– তাহলে সেটা অয়ন হ্যান্ডেল করবে, তাতে কি খুব কিছু যায় আসবে?

– যায় আসবে, মানুষের জানা উচিত সিকদার কোম্পানির মালিক আমি অয়ন নয়। এই এক বছরের ও বেশি আমি ছিলাম না, সবাই অয়নকেই এই কোম্পানির হেড মেনে নিয়েছে। আমি যেন কিছুই পারি না। আমি চাই এই ইস্যুটাকে আমি হ্যান্ডেল করি। আপনার যদি এতে আপত্তি থাকে আমি কিছু বলবো না। 

 

মহীমা সিকদার, আবরারের কথা শুনে মনে মনে খুশি হন। তার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠে। অপরদিকে অয়নের মুখেও বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। অয়ন খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে প্রজেক্টের জন্য এভাবে ছুটে যাওয়ার মানুষ আবরার নয়। অয়ন আবার বলে উঠে,

– এতোদিন এখানে অয়ন সামলে এসেছে, এতো ও কোনো বড় ইস্যু এখানে নেই তাই এই এক মাস অয়ন সামলাতে পারবে। আপনি দুই মাস সময় উনাদের কাছে নিয়ে নেন। আমার উপর ভরসা রাখেন, আমি আপনার বিশ্বাস ভাঙ্গবো না। 

– এই না হতো আমার নাতি, আমি উনাদের সাথে কথা বলে নিবো। আর অয়নকে বলে রাখি, ভেবো না এখানের দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হচ্ছে বলে তুমি সব সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই একমাস তুমি আবরারের সাবস্টিটিউট হিসেবেই থাকবে। 

 

মহীমা সিকদারের কথা শুনে মুচকি হেসে অয়ন বলে,

– আমি তো সবসময় ভাইয়ের সাবস্টিটিউট ই ছিলাম, এতো ভাববেন না। আমার যদি আর কোনো কাজ না থাকে আমি কি রুমে যাবো?

– হুম, যাও

 

অপরদিকে, 

দরজায় কড়া নাড়লে প্রাপ্তির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুলতেই দেখে বাহিরে নিশান দাঁড়ানো। নিশান সেই ব্যাক্তি যার গাড়িতে সেই রাতে প্রাপ্তির এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধুর মতো নিশান প্রাপ্তিকে আগলিয়ে রেখেছে এই চার মাস। প্রাপ্তির অতীত সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। প্রাপ্তি যখন বেঁচে উঠেছিলো, তখন তার অতীত জানার অনেক চেষ্টা করেছিলো নিশান। কিন্তু প্রাপ্তির একটাই কথা, তার কিছু মনে নেই। তাই আর ঘাটায় ও নি, তার নাম দেয় খুশবু। অনেকদিন যাবৎ প্রাপ্তির জন্য চাকরি খুজার চেষ্টা করে গেছে সে, কিন্তু পারে নি। তাই নিজের বাড়িতেই একটা রুম ভাড়া দেয় তাকে। নিশানের বাবা-মা খুশবুকে নিজের মেয়ে হিসেবেই ভালোবেসে এসেছে। অসহায় মেয়েটি তাদের ছেলের গাড়ির নিচে পড়ে নিজের বাচ্চাও হারিয়েছে। বাঁচার আশাটুকু ছিলো না। উপর ওয়ালা হাতে ধরিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে। নিশান এতো রাতে৷ আশার মতো লোক নয়, হুট করে এতো রাতে তাকে দেখে খুবই অবাক হয় প্রাপ্তি। জিজ্ঞেস করে বসে,

– আপনি? এতো রাতে?

– তোমাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আসলে, আমার এক বন্ধুর ফোন এসেছিলো। তোমার চাকরির ব্যবস্থা সে করে দিতে পারবে। কিন্তু তোমাকে ঢাকা যেতে হবে। আনোয়ার কোম্পানি এন্ড লিমিটেড এর মেইন অফিসে একটি পোস্ট ফাঁকা আছে। আমার বন্ধু ওখানেই চাকরি করে। ও তোমার সি.ভি জমা দিয়ে দিয়েছে। ওরা পরসু ইন্টারভিউ নিবে। তুমি কি যাবে?

– আচ্ছা, আমার কোনো সমস্যা নেই। এমনিতেও আমি ঢাকা যেতে চেয়েছিলাম। অতীতের কিছু প্রশ্নের উত্তর যে আমার চাই। 

– তোমার কি কিছু মনে পড়েছে?

– না, তবে ওখানে যেহেতু আমার অতীত তাই, সেখানে গেলেই উত্তরগুলো পাবো। 

– বেশ আমি কাল তোমাকে নিয়ে যাবো। 

– এতোদিন আমাকে আশ্রয় দেবার জন্য ধন্যবাদ। 

– এটা আমার দায়িত্ব ছিলো। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

– করুন

– তোমার হাসবেন্ডকে যদি খুজে না পাও, তুমি কি তোমার জীবন নতুন করে শুরু করবে না?

– আমি জানি না, আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো না পাওয়া অবধি আমি সত্যি ই জানি না কি করবো। 

– এতোদিন তোমাকে বলি নি, তবে আজকে কিছু জিজ্ঞেস করবো উত্তর দিবে?

– জ্বী, বলুন

– যদি কোনোদিন অতীতকে প্রত্যাক্ষান করো, তবে কি আমাকে তোমার ভবিষ্যৎ মানাতে পারবে? আজ উত্তর দিতে হবে না। তুমি ভেবেচিন্তে উত্তর দিও। 

– আ..আমি কিছু ভাবি নি এই ব্যাপারে। 

– প্লিজ ভেবে দেখো।

 

বলে নিশান বেরিয়ে যায়। প্রাপ্তি তখন ও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যতই অয়নের প্রতি রাগ, অভিমান জমে থাকুক সে অয়নের জায়গা কাউকে দিতে পারবে না। অয়ন হয়তো তাকে ভুলে অন্য কাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছে, ধুমধাম করে এনগেজমেন্ট করছে কিন্তু প্রাপ্তি এখনো তার মনের গহীনে অয়ন নামক মানুষটিকে পুষে রেখেছে। সেই অয়নের সাথে বোঝাপড়া এখনো বাকি যে। কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবার সময় চলে এসেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। 

 

দুইদিন পর,

সকাল ৯টার মধ্যে স্কুলে ঢুকতে হবে রাইসাকে। আব্রাহামকে রেখে যেতে মন চায় না। মাত্র বসা শিখেছে ছেলেটা,কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়ে চাকরিটা করতেই হবে। রেশমা আন্টি এই বিপদে থাকার জন্য ছাদ দিয়েছেন এই কত! ছেলে আর নিজের ভরণপোষণের খরচটা তো তারই চালাতে হবে। শরীরটা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রেগ্ন্যাসির সময়ের থেকে কিছু কমপ্লিকেশনগুলো রয়েই গিয়েছে। মাঝে মাঝে ভয় হয় ছেলেটাকে একা করে দিয়ে না ফেরার দুনিয়াতে চলে যাবে নাতো সে? না না এসব কি ভাবছে, এখনো কত দায়িত্ব বাকি। চিকিৎসা করাতে হবে, কিন্তু টাকাও লাগবে। এখন বিভিন্ন টেস্ট করতেই দশ হাজার পকেট থেকে খসে পড়ে। রেশমা বেগমের কাছে ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিবে রাইসা। দরজাটা খুলে বের হতেই হাত পা জমে গেলো তার। দরজার বাহিরে সেই মানুষটি দাঁড়ানো, যার কাছ থেকে পালাতেই এই দূর শহরে ছেলেকে নিয়ে বহু কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে সে। আবরার রাইসাকে প্রায় বছর খানিক পর দেখছে। গোলগাল চেহারার ফর্সা মেয়েটি যেন হাড্ডিসার হয়ে গেছে। আজ তার চোখে সেই ঔজ্জ্বল্য নেই, চোখের নিচের কালি যেন তার নির্ঘুম রাতের বর্ণনা দিচ্ছে। এক পাশে বেনুনি করে কালো শাড়ি পরিহিতা নারীটি এক সময়ে তার সকল হাসির কারণ ছিলো। অথচ আজ এই নারীর সকল কষ্টের কারণ সে। তার জন্য এই নারীটিকে সকল প্রকার বঞ্চনা মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়েছে। আবরার দু কদম এগিয়ে রাইসার সামনে এসে দাঁড়ায়। রাইসা এখনো চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। মনের মধ্যে কিছু ভয়,জড়তারা মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। তবে কি আব্রাহামকে কেঁড়ে নিতে এতো দূর চলে এসেছে সে। আবরার নিরবতা ভাঙ্গতে বলে উঠলো,

– কেমন আছিস রাইসু?

-…..

– কথা বলবি না?

-……

– ভয় নেই, ছেলেকে নিতে আসি নি। বরং মা-ছেলে দুজনকেই একসাথে নিয়ে যেতে এসেছি। বড্ড দেরি করে ফেলেছি, তাই নারে? অনেক ভুল করেছি, হয়তো সেই ভুলের ক্ষমা হয় না। কিন্তু এই একটা বছর আমি যা বুঝেছি তা হলো আমার তোকে দরকার, খুব করে দরকার। তুই যে আমার রক্তে মিশে আছিস রাইসা। আমার তোকে ছাড়া চলবে না, এই কয়েক মাস পাগলের মতো খুজেছি তোকে। আমি সেদিন বাধ্য ছিলাম আজ নয়। আমি তোর কাছ থেকে আব্রাহামকে কখনো কেড়ে নিবো না। আমার যে আমার পুরো পরিবার চাই। রাইসু প্লিজ একটা সুযোগ দে, আমি নিজেকে তোর যোগ্য করে তুলবো, তোরে কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। প্লিজ রাইসু

 

এতোক্ষণ চুপ করে আবরারের কথা শুনে যাচ্ছিলো রাইসা। এতোদিনের কষ্টগুলো যেনো তাজা হয়ে উঠেছে আবরারকে দেখে। আবরার যে কথাগুলি বললো, কথাগুলি শোনার প্রতিক্ষা এতোগুলো বছর সে করেছে। চোখ থেকে না চাইতেও সোডিয়াম আর পটাশিয়াম ক্লোরাইড মিশ্রিত জল গড়িয়ে পড়ছে। এটা অতীব খুশিতে নাকি সদ্য তাজা হওয়া মনের ক্ষততে, এটা বুঝতে পারছে না রাইসা। খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলে উঠে,……..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

দ্বিতীয় অধ্যায়

৩য় পর্ব

 

খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলে উঠে,

– সময়টাও ঠিক মতো বলতে পারলি না, এক বছর নয়, এক বছর দুই মাস তের দিন। যখন আমার তোকে সবথেকে বেশি দরকার ছিলো, তখন আমি তোকে কাছে পাই নি। তোর কাছে আব্রাহাম কোনোদিন তোর ছেলে ছিলোই না, ও শুধুমাত্র এক রাতে ভুল ছিলো। তুই তো ওকে এবোর্ট করতে চেয়েছিলি। সত্যি বলতে আজ থেকে কয়েকমাস আগেও যদি তুই এই কথাগুলি বলতি আমি মেনে নিতাম। আমি হয়তো তোর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তোকে ক্ষমা করে দিতাম, তোর সাথে পরিবার সাজানোর কথাও ভাবতাম। কিন্তু আজ না, কাল তোর দাদীজান আবার যখন আদেশ দিবে তুই আবার আমাকে একা করে দিবি। আফটার অল, তুই কোম্পানির মালিক বলে কথা। এতো সব কিছু পেয়ে সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার মতো সাহস কি আদৌ আছে তোর?

– আমি সত্যি বলছি, তুই একবার আমাকে বিশ্বাস করে দেখ। আমি দাদীজানকে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু উনার অন্যায় আবদার আর মেনে নিবো না। প্লিস রাইসু। 

– রাইসু না রাইসা। রাইসা ইসলাম, আমার সাথে তোর কোনোদিন কোনো ছিলো ও না, হবে ও না। ভালো তো বেসেছি, তার শাস্তিও পাচ্ছি। তাই অহেতুক আর কথা বাড়াবো না। আমার তাড়া আছে, নিজের সময় নষ্ট করিস না। 

 

বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আবরার হাত টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। কানে মুখ লাগিয়ে বলে,

– বড্ড বেশি অভিমান জমে গেছে, আজ হয়তো আমার কথায় তোর বিশ্বাস হবে না। কিন্তু কথা দিচ্ছি তোর অভিমানগুলোকে আবার ভালোবাসায় পরিণত করবো। নিজেকে তোর এবং আব্রাহামের যোগ্য প্রমাণ না করা অবধি আমি যাচ্ছি না। আমি এজন্য ভালোবাসি না যে তুই আমার বাচ্চার মা, আমি তোকে ভালোবাসি কারণ তুই আমার রন্ধ্রে মিশে আছিস। তোকে যে আমার চাই, খুব করে চাই। তুই আমার হতে বাধ্য।

 

রাইসা কোনো রকম ধাক্কা মেরে আবরারকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। আবরার টাল না সামলাতে পেরে খানিকটা দূরে সরে যায়। রাইসার রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

– নিজের পাওয়ারের গরম অন্যখানে দিস, আমার কাছে না। কিসের বাধ্য? আমি তোর কাছে কোনো কিছুর জন্য বাধ্য নই। আজ স্পষ্ট শুনে রাখ, আমার জীবনে তোর অস্তিত্ব নেই। আমি তোকে ভালোবাসি না। চলে যা এখান থেকে প্লিজ। 

– সেটা সময় বলে দিবে।

 

রাইসা কথা না বাড়িয়ে গটগট করে সেখান থেকে চলে গেলো। আবরার রাইসার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে আশ্বস্ত করে,

– আমি পারবো, আমাকে যে পারতেই হবে। প্রমিস করসি, যদি তোর মনে নিজের জন্য জায়গা না করতে পারি তবে আর কোনোদিন তোর সামনে আসবো না। কিন্তু আমি এতো তাড়াতাড়ি হাল ছাড়বো না। 

 

এক সপ্তাহ পর, 

সকাল ১০টা,

একটা জরুরি কাজের জন্য অয়ন সামির সাথে দেখা করতে এসেছে। মাস খানিক হয়ে গেছে অয়ন সামির সাথে দেখা করে নি। এখানে এসে জানতে পারে সামি আপাতত দেশে নেই। যেকারণে সামির বড় ভাই আসফির সাথেই মিটিং টা কমপ্লিট করতে হবে। আবরারের অবর্তমানে আনোয়ার কোম্পানি এন্ড লিমিটেড এর সাথে প্রজেক্টটা অয়নকেই কমপ্লিট করতে হবে। এতোদিন পর অয়নকে দেখে আসফি তাকে জড়িয়ে ধরে।

– বেশ শুকিয়ে গেছিস, খাওয়া দাওয়া কি কিছুই করছিস না? 

– আর খাওয়া দাওয়া, প্রাপ্তির হাতের রান্নার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর লোকমান কাকার রান্নাও ভালো লাগে না। তোমার খবর বলো, শুনলাম বিয়ের পর নাকি ভাবি তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ করিয়ে দিয়েছে। 

– আর গার্লফ্রেন্ড, এতোদিনের যত মেয়ে ফ্রেন্ড ছিলো তাদের ব্লকলিস্টে পাঠিয়ে দিয়েছে। বু মানেই প্যারা। 

– যাক প্যারাটা কারো লাইফে তো আছে। 

– তুই কি আর বিয়ে শাদি করবি না?

– যদি কোনোদিন আমার মায়াবতী ফিরে আসে, তখন? তখন তাকে কি উত্তর দিবো বলো? তার অবর্তমানে অন্যকাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছি জানলে আরোও রেগে যাবে ও। আমি ওর স্মৃতি আঁকড়ে ভালোই তো আছি।

– সত্যি ভালো আছিস তো?

– তুমি কি কথাই বলবে?  নাকি মিটিং শুরু করবে? 

– আচ্ছা, আচ্ছা চল। 

 

অপরদিকে,

আজ এক সপ্তাহ হয়েছে, নিশানের বন্ধুর সাহায্যে এই কোম্পানিতে জব পেয়েছে প্রাপ্তি। একজন কলিগ সামিয়ার সাথে একটা ছোট বাসায় থাকছে সে। মেয়েটি খুবই ভালো, একা একা এতো ভাড়া দেওয়াটা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিলো তাই প্রাপ্তিকে তার সাথে থাকতে প্রস্তাব দেয়। শহরে অন্য কোথাও থাকাটাও সুবিধার মনে হচ্ছিলো না দেখে প্রাপ্তিও রাজি হয়ে যায়। প্রতিদিনের মতো নিজ ডেস্কে বসে কাজ করছিলো তখন প্রাপ্তির সিনিয়র এসে জানায়, 

– খুশবু, তোমাকে বস ডাকছে মিটিং রুমে। কাল যে ফাইলটা তোমাকে দিয়েছিলেন ওইটাও সাথে নিয়ে যেও। ফাইলটি কমপ্লিট হয়েছে?

– বস তো ক্লাইন্টের সাথে মিটিং এ আছেন। এখনই কি যাবো আমি?

– হ্যা, ফাইলটা ক্লাইন্ট দেখতে চেয়েছে। তুমি গেলেই বুঝবে। 

– ঠিক আছে।

 

মিটিং রুমে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকেই প্রাপ্তি বললো,

– মে আই কাম ইন, স্যার?

– আরে খুশবু, ভেতরে আসো। 

 

ফাইলটি ভেতরে ঢুকতেই প্রাপ্তির হাত পা জমে গেলো, মাথাটা মূহুর্তে ফাকা হয়ে গেছে। ভেতরে বসে থাকা মানুষটি যে তার খুব পরিচিত। চার মাস পর মানুষটিকে দেখছে সে। আজ যার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় এই শহরে তার আগমন, সেই মানুষটির সাথে অতর্কিতে তার দেখা হয়ে যাবে এটা তো জানা ছিলো না। মানুষটা বড্ড শুকিয়ে গেছে, যে চোখের ভাষা এক সময় বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিলো তাকে আজ সেই চোখ যেন গর্তের কোটরে চলে গেছে। লোকটাকে দেখে আজকেও মায়া লাগছে। যার রাগ জিদের পুরো ঘর কাঁপতো, আজ বড্ড শান্ত লাগছে লোকটাকে। তার জীবনে তো নতুন মানুষ চলে এসেছে তবে কেনো এতোটা উদাসীন লাগছে তাকে! আসফির কন্ঠস্বর ঘোর ভাঙ্গায় প্রাপ্তির।

– দরজায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো, ফাইলটা উনাকে( অয়নের দিকে ইশারা করে) দাও। 

– জ্বী স্যার। 

 

এতোক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলেও প্রাপ্তির বলা “জ্বী স্যার” যেন ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে অয়নের। বারংবার প্রাপ্তিকে পাবার আশা এতোটাই নিরাশ করেছে যে আজ আবার সেই আশাটুকুকে পুনোরায় সজাগ করতে মন চাইছে না। চোখ তুলে যদি দেখে মানুষটা ভুল তখন কি করবে? মস্তিষ্কে প্রাপ্তির কথা এতোটাই গেঁথে গেছে যে নিজেই নিজেকে পৃথিবী থেকে আলাদা করিয়ে ফেলেছে। সারাক্ষণ মনে হয় আশেপাশে প্রাপ্তির ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়েছে সে, আবার আশাহত হবার মতো মনের জোর আর যে নেই। তবুও মাথা উঁচিয়ে সামনে বসে থাকা মানুষটির দিকে তাকায় সে। মানুষটি যে আর কেউ নয় প্রাপ্তি, তার মায়াবতী। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে এক মূহুর্ত না দেরি করে জড়িয়ে ধরলো তার মায়াবতীকে। 

– প্রাপ্তি, তুমি ফিরে এসেছো। সত্যি ফিরে এসেছো তুমি? কেনো ছেড়ে গিয়েছিলে আমায়? তোমার রাগ হয়েছিলো আমার উপর আমায় বকতে পারতে, তুমি যা শাস্তি দিতে আমি মাথা পেতে নিতাম। তুমি জানো, এই চার মাস পাগলের মত খুঁজেছি তোমায়। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি?

 

অয়নের কাছ থেকে কোনো মতে নিজেকে ছাড়িয়ে বলতে লাগলো প্রাপ্তি,

– আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার। আমি প্রাপ্তি নই, প্লিজ পাবলিক প্লেসে এমন অসভ্যতা করবেন না। 

– প্রাপ্তি এভাবে কেনো বলছো? আমার প্রাপ্তিকে আমি অন্ধকারের মাঝেও চিনে নিবো। তুমি এভাবে কেনো বলছো? 

– আবার বলছি আমি প্রাপ্তি নই। আমি আপনাকে চিনি না। 

 

এবার মেজাজ খারাপ হতে লাগলো অয়নের। প্রাপ্তি কেনো নিজেকে তার থেকে আড়াল করতে চাইছে? এতোটা রাগ জমে আছে যে সে অয়নকে চিনতে চাইছে না। নিজেকে সংবরণ করে অয়ন আবার প্রাপ্তির কাছে যায়, তার হাত দুইটি প্রাপ্তির গাল আলতো করে ছুয়ে বলে, 

– প্রাপ্তি, তুমিও জানো আমিও জানি তুমি ই আমার প্রাপ্তি তাহলে কেনো অস্বীকার করছো তুমি? রাগ হচ্ছে বলতে পারো, এভাবে আমাদের সম্পর্কটা অস্বীকার তো করো না।

 

অয়নের হাত দুটো ছিটকে চেঁচিয়ে উঠে প্রাপ্তি,

– বারবার অসভ্যতা কেনো করছেন?? আমি প্রাপ্তি নই আমার নাম খুশবু। আপনি বারবার কেনো জোর করে যাচ্ছেন। আমি আজকের আগে আপনাকে দেখিও নি। স্যার, এইযে আপনার ফাইল। প্লিজ আমি আসছি। 

 

বলেই মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলো প্রাপ্তি। দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে, পানি ছেড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। সে তো চেয়েছিলো এই মানুষটির সাথে জীবন কাঁটাতে। চলে গিয়েও ফিরে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু এই মানুষটার জীবনে তো অন্যকার আগমণ ঘটে গেছে। কেনো ফিরবে সে? এক সপ্তাহ আগে তার এনগেজমেন্ট ও হয়ে গেছে। তাহলে আজ  তাকে দেখে এতোটা অনুনয় কেনো করছিলো। কেনো তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, মানুষটা ভাল নেই। গোলকধাঁধার মধ্যে নিজেকে যেনো আউলিয়ে ফেলেছে প্রাপ্তি।

 

অপরদিকে, 

নিজেকে কিছুতে শান্ত করতে পারছে না অয়ন। তার মায়াবতী তাকে চিনতে চাইছে না। অয়নকে উত্তেজিত দেখে আসফি মিটিং রুম ফাকা করে ফেলে। অয়নের কাঁধে হাত রেখে তাকে বলে,

– তোর কোথাও ভুল হচ্ছে, মেয়েটি প্রাপ্তি নয়। ওর নাম খুশবু। এই এক সপ্তাহ হয়েছে ও এখানে জয়েন করেছে। ও তো ঢাকাতেও থাকে না, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। 

– দুজন মানুষ এক চেহারার কিভাবে সম্ভব ভাই?

– সেই প্রশ্ন যে আমাকে ভাবাচ্ছে না তা নয়।

– এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো। তুমি শুধু আমার একটি কাজ করে দিবে। 

– বল কি কাজ?  

 

আসফির সাথে কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে পরে অয়ন। ডেস্কে এসে জানতে পারে সিকদার কোম্পানির প্রজেক্টটার দায়িত্ব প্রাপ্তিকে দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্তি খুব ভালো করে জানে এটা কার কারসাজি। তবে নিজেকে দূর্বল করবে না সে। অয়নকে এবার আর বিশ্বাস করবে না সে। প্রজেক্টের কাজ করতে করতে রাত ১১টা বেজে যায় প্রাপ্তির। একে তো সামিয়া চলে গেছে, উপরে রাত,, এই রাতে একা একা বাসায় যাবে কিভাবে এটা নিয়ে একটা চিন্তায় পড়ে গেলো প্রাপ্তি। অফিস থেকে বের হতেই কেউ একজন পেছন থেকে প্রাপ্তি মুখ চেপে ধরে। প্রাপ্তি কিছু বুঝার আগেই, কালো কাপড় দিয়ে চোখ মুখ বেঁধে তাকে একটি গাড়িতে উঠানো হয়। প্রাপ্তি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গোঙ্গাতে লাগলো। বেশ কিছু সময় পর গাড়িটি কোথাও থামলো। প্রাপ্তিকে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে ধাক্কা মারে অচেনা লোকটি। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায় প্রাপ্তি। অচেনা লোকটি তখন প্রাপ্তিকে…. 

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

দ্বিতীয় অধ্যায়

৪র্থ পর্ব

 

প্রাপ্তিকে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে ধাক্কা মারে অচেনা লোকটি। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায় প্রাপ্তি। অচেনা লোকটি তখন প্রাপ্তিকে চেপে ধরে তার উপর নিজের ভর ছেড়ে দেয়। লোকটির গরম নিঃশ্বাস যেন প্রাপ্তির ভেতরটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছিলো। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ তখন প্রাপ্তি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে না। মুখের গোঙানি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অচেনা মানুষটি প্রাপ্তির গলায় জোরে একটি কামড় দিতেই ব্যাথায় কুকড়ে উঠে৷ তারপর প্রাপ্তিকে রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ কোনো সারা শব্দ না পেলে, প্রাপ্তি নিজের চোখ ও মুখের বাঁধন খুলে ফেলে। আশেপাশে শুনশান নীরবতা,, কেউ নেই। আশেপাশে কাউকে না দেখতে পেয়ে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো প্রাপ্তি। উঠে দাঁড়াতেই যাবে পাশে একটা চিরকুট পেয়ে খুবই অবাক হলো সে। চিরকুট খুলতেই নজরে পড়ে,

   ” আবার দেখা হবে “

প্রথমে ভেবেছিলো এই রকম কাজ অয়ন ই করতে পারে, কিন্তু হাতের লেখাটা অচেনা। যদি অয়ন না হয় তবে কে হতে পারে। আগেও অয়ন তাকে পাগল প্রমাণ করতে নানা রকম জঘন্য প্লান করেছে, এবার ও কি এমন কিছু করছে!! অবাককর ব্যাপার জায়গাটি একটি দোকান যা তার বাসার পাশের গলিতে। অচেনা লোকটি তাকে এখানে কেনো নিয়ে আসলো, যদি তার কোনো খারাপ মতলব থাকতো তবে তো নিরব কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো। মাথাটা বড্ড ব্যাথা করছে, তখন পড়ে যেয়ে মাথায় বেশ জোরে আঘাত পেয়েছে সে,, হাটু ও খানিকটা ছিলে গেছে। খুব কষ্টে বাড়ির পানে রওনা দিলো। বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়ালো প্রাপ্তি। গলার জায়গাটা এখনো জ্বলছে। নিজেকে শান্ত করাটা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে, আজ অয়নকে দেখে মন বারবার চাইছিলো যা হয়েছে ভুলে যাও। মানুষটা ভালো নেই, কিন্তু চার মাস আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে বারংবার অয়নের প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষের ভেতর কত রুপ থাকে সেটা বুঝা যে খুব কঠিন।।

 

 সোডিয়ামের লাইটের আলো প্রাপ্তির অতীতের কালো দাগ যেন আরোও সুস্পষ্ট করে তুলেছে। প্রাপ্তি তো ফিরে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু সে পথ অয়ন নিজে বন্ধ করে দিয়েছিলো। এক্সিডেন্টে যখন বাচ্চাটিকে হারিয়ে প্রাপ্তি নিঃস্ব তখন বাঁচার তাগিদে খড়কুটো টুকু জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলো,, নিজের ভঙ্গুর সম্পর্ককে নতুন রুপ দিতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু তা আর হলো কই! অয়নকে যখন ফোন দিয়েছিলো, তখন একটি মেয়ে কন্ঠস্বর ফোনটি রিসিভ করে। প্রাপ্তি কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলে,

– হ্যালো, কে বলছেন? অয়ন বাথরুমে আছে। আমাকে বলতে পারেন। হ্যালো? অয়ন বের হও,, কেউ তোমাকে ফোন করেছে?

– কে ফোন করেছে?

– জানি না, চুপ করে আছে।

– রেখে দাও, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শুধু ফাউল রং নাম্বারে ফোন আসে। রেখে দাও আর তুমি এখানে আসো

– আচ্ছা

 

ফোনের অপারের অয়ন আর মেয়েটি কথোপকথন শুনে অয়নের প্রতি ভালোবাসাটুকু শূন্য হয়ে যায়। সে তো ভালোই আছে, শুধু শুধু তার জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি হয়ে ফিরে যাবার তো দরকার নেই। হয়তো তার প্রয়োজন অয়নের জীবনে ফুরিয়ে গেছে। থাক না সে নিজের মানুষকে নিয়ে, প্রাপ্তি না হয় মরে গেছে সারাজীবনের জন্য। সেদিনের পর থেকে প্রাপ্তি নিজ আত্নসত্ত্বাকেও প্রকাশ করতে দেয় নি। নিশান ও তার পরিবার বহুবার তাকে তার অতীত সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। কিন্তু প্রাপ্তি লুকিয়ে গেছে,, তবে মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দেয়। কেনো অয়ন প্রাপ্তির সাথেই এমন করেছে। যদি একটা বাচ্চা ই প্রয়োজন ছিলো তবে প্রাপ্তি কেন!! আরো কত মেয়ে রয়েছে যারা টাকার বিনিময়ে সব করতে রাজি। কেনো অয়ন প্রাপ্তির জীবনটাকেই ছারখার করতে চলে এলো। অতীতের কথা মনে পড়তেই চোখ ভিজে এসেছে। কাল সকালে ঐ মানুষটাকে আবার দেখতে হবে। মাথা ব্যাথাটা তীব্রতর হচ্ছে। কখন যে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে প্রাপ্তি নিজের ও হুশ নেই। 

 

অপরদিকে,

রাত ৩টা, 

আব্রাহাম কান্নায় ঘুম ভেঙ্গে গেছে রাইসার। বাচ্চাটা খুব জোরে জোরে কাঁদছে,, সচারাচর এভাবে আব্রাহাম কখনোই কাঁদে না। মাথায় হাত রাখতেই চমকে উঠে রাইসা। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে বেচারার। এতো রাতে কোথায় যাবে কি করবে কিচ্ছু মাথা কাজ করছে না তার। দৌড়ে রেশমা বেগম ঘুম থেকে জাগায় যে। রাত তিনটায় ছেলেটাকে কোথায় নিয়ে যাবে বুঝতে পারছে না সে। রাইসার উত্তেজনা শান্ত করতে রেশমা বেগম বলেন,

– আচ্ছা, রাইসা শান্ত হও। কিচ্ছু হবে না, আমি ড্রাইভ করে দিয়ে যাচ্ছি দরকার হলে। রাতে কোনো না কোনো হসপিটাল খোলা তো থাকবে। 

– সরি আন্টি, আপনাকে এতো রাতে এভাবে হয়রানি করার জন্য। আব্রাহাম আমার সব আন্টি আমি ওকে ছাড়া সত্যি কিচ্ছু ভাবতে পারি না। 

– ইটস ওকে। চলো আমি চাবি নিয়ে আসছি। 

 

বাইরে বের হতেই একটি কালো গাড়ি দেখে অবাক রাইসা৷ গাড়িটা আবরারের, তার মানে বান্দা এখনো যায় নি। বিগত সাত দিন লোকটা গাড়ি নিয়ে তার বাড়ির সামনেই বসে থাকে, সকাল সন্ধ্যা এভাবে রাইসার সামনে ঘুরঘুর করে উত্তক্ত করাই এই বান্দার মুল উদ্দেশ্য। যেন আঠার মতো লেগে আছে রাইসার সাথে সে। রাইসা আর রেশমা বেগমকে হন্তদন্ত করে বের হতে দেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আবরার। আজকাল রাতগুলো নির্ঘুম কাটে তার। রাইসাকে এক ঝলক না দেখলে ঘুমেরা যেন তার কাছে আসতেই চায় না। রাইসার উদ্বিগ্ন মুখখানা তাকে জানান দিচ্ছে, কিছু একটা গুরুতর ঘটেছে। রাইসাকে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাবে না এটা তার অজানা নয় তাই সরাসরি রেশমা বেগমকে প্রশ্ন করে সে। রেশমা বেগম আব্রাহামের শারীরিক অবস্থার কথা সব খুলে বলে আবরারকে। আবরার এক মূহুর্তে দেরি না করে বলে, 

– আন্টি, আপনি বাসায় থাকুন। আমি নিয়ে যাচ্ছি ওদের।

– আন্টি ওকে বলে দিন,, আমার এবং আমার বাচ্চার কারোর দয়ার দরকার নেই।

– আন্টি এটা জেদের সময় নয়, ওকে বলুন প্লিজ গাড়িতে উঠতে। ইট উইল বি ফাস্ট

– আন্টি আমি বললাম তো আমাদের কারোর দয়ার দরকার নেই। এতো আহ্লাদ এতোদিন কোথায় ছিলো? প্লিজ আন্টি দেরি হয়ে যাচ্ছে।

– চুপ করবে তোমরা?? বাচ্চাটার জ্বর, ১০২° আর তোমরা পড়ে আছো নিজেদের জেদ নিয়ে। এই রাতে আবরারের সাথে যাওয়াটাই সেফ হবে রাইসা। আমার এজ হয়েছে আমি এতোটা দ্রুত হয়তো নিতে পারবো না। প্লিজ জেদ করো না। নাও গো ( রেশমা বেগম)

 

অগত্যা বাধ্য হয়ে আবরারের সাথেই হাসপাতালের দিকে রওনা হয় রাইসা। হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ভেতরে ডাক্তার আব্রাহামকে দেখছেন। আব্রাহামের অসুখটা প্রায় ই হয়। তবে এই এক মাস তার কোনো সমস্যা হয় নি। রাইসা চিন্তিত মুখে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। আবরার তাকে নিপুণ দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে। এই মেয়েটার কতরুপ, এক বছর আগে এই মেয়েটি ছিলো বেখেয়ালি, প্রাণোচ্ছল একটি নারী,, যাকে দেখলে তার মনে হাজারো রঙের মেলা লাগতো। হ্যা, তখন এই অনুভূতিকে ঠিক কি বলে সেটা জানতো না। অথচ আজ সেই নারী তার বাচ্চার মা, নিজের শরীরের কথা চিন্তা না করে হাসপাতালের করিডোরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর সিদ্দিক হুসেইনের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে আবরারের। 

– জ্বী বলেন?

– বাবুর বাবা, মা কি আপনারাই?

– জ্বী, বলেন। 

– আমার কেবিনে আসুন কিছু কথা বলার আছে। 

 

চিন্তিত মুখে মুখোমুখি বসা ডক্টর সিদ্দিক এবং আবরার-রাইসা। ডক্টরের হঠাৎ কেবিনে ডাকা তাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। 

– আচ্ছা, বাবুর ইমিউনিটি যে খুবই দূর্বল সেটা কি আপনারা জানেন?

– জ্বী, ও প্রিম্যাচ্যুর বেবি ছিলো। কি হয়েছে ডক্টর? 

– আপনারা বাবা-মা, তাই আপনার কাছ থেকে কিছুই লুকাবো না। বাবুর……

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

দ্বিতীয় অধ্যায়

৫ম পর্ব

 

– আপনারা বাবা-মা, তাই আপনার কাছ থেকে কিছুই লুকাবো না। বাবুর হার্টে কিছু কমপ্লিকেশনস আছে। আমার যতদূর ধারণা বাবুর প্রিম্যাচ্যুরিটি আর ম্যালনিউট্রিশনের কারণে হার্টের প্রবলেমটা হয়েছে। আমি কিছু টেস্ট করিয়েছি, কাল রিপোর্ট আসবে তাহলে আরোও ক্লিয়ার হতে পারবো। 

– ওর যখন বার্থ হয়েছিলো কিছু কমপ্লিকেশনস ছিলো কিন্তু ডক্টর তো বলেছিলো এভ্রিথিং ইজ অলরাইট। তাহলে? (রাইসা)

– আসলে এসব প্রবলেমগুলো তখন হয়তো ধরা পরে নি, ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। আর বাবু বার্থ টাইমে সিরিয়াস ম্যালনিউট্রিশনে ভুগেছে। প্রিম্যাচ্যুরিটির জন্য এই প্রবলেমগুলো আরো সিরিয়াস রুপ নিয়েছে। 

– এখন এটার চিকিৎসা কি ডক্টর? ( আবরার)

– দেখুন বেবি অনেক ছোট, সাত মাস বয়সে বাইপাস করা পসিবল নয়। তবে, কালকের রিপোর্টস আসলে আমি মেডিসিন দিতে পারি। আর ওর বয়স ছয়-সাত হলে বিদেশে নিয়ে হার্টের একটা ছোট অপারেশন করলে হবে, ইফ ন্যাসেসারি। ডোন্ট ওয়ারি, আল্লাহ এতো মাসুম বাচ্চার কিছুই হতে দিবেন না ইনশাআল্লাহ। তবে হ্যা, বাবুকে কোনো রকম মেন্টাল স্ট্রেস দেওয়া যাবে না। এটা মাথায় রাখতে হবে। 

– জ্বী (আবরার) 

 

ডক্টরের কেবিন থেকে বেরিয়ে রাইসা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আব্রাহাম তার একমাত্র বাঁচার আশা, এতো টুকু বাচ্চার শরীরের এই অবস্থা শুনে কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না সে। আবরার আজ একজন হতভাগ্য বাবা, আজ তার ভুলের জন্য তার ছেলে এতোটা কষ্ট পাচ্ছে। সব কিছুর জন্য একমাত্র সেই দায়ী। এতোটুকু বাচ্চার নাকি হার্ট ডিজিজ, না জানি কত কষ্ট তাকে বয়ে বেরাতে হচ্ছে। রাইসার অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে সে। কেবিনের বাহির থেকে উঁকি মারলে আব্রাহামের মাসুম চেহারাটা দেখতে পারে আবরার। সেলাইন দিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। না চাইতে আজ আব্রাহাম কাঁদছে, হ্যা আজ সে কাঁদছে। আজ তার চেয়ে দুর্ভাগা কেউ নাই। 

 

সকাল ৮টা,

রাইসা কেবিনে আব্রাহামের পাশেই চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। আবরার নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে, সারারাত শুধু এক চিন্তা যে রিপোর্ট কি আসবে! আব্রাহামকে নিয়ে তার যে অনেক স্বপ্ন ছিলো। আব্রাহামের বাবা হবার যোগ্যতা হয়তো তার আসলেই নেই। কিন্তু এভাবে রাইসা আর আব্রাহামকে একা রাখতে পারবে না সে, যেভাবেই হোক তাদের দুজনকে তার সাথে নিয়ে যাবে। দরকার হলে সিকদার ভিলা ছাড়তেও সে রাজি। 

 

সূর্যের এক ফালি রোদ মুখে পড়তেই, ঘুম ভেঙে যায় রাইসার। চোখ খুলতেই দেখতে পায় আব্রাহামকে আদর করছে আবরার। এ দৃশ্যটি এতোদিন শুধু কল্পনাই করেছে, তবে আজ তা বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। চুপটি করে ছেলেটা বাবার আদর খাচ্ছে। ভোরের দিকে ছেলেটার জ্বর কমেছে। এখন স্যালাইন খুলে দিয়েছে। আচ্ছা, আব্রাহামের তো অধিকার বাবার ভালোবাসা পাওয়া। নিজের রাগ, জিদের জন্য কি আব্রাহামকে তার বাবার কাছ থেকে দূরে করে দিচ্ছে। ডক্টর বলেছেন কোনো মেন্টাল প্রেসার ওকে দেওয়া যাবে না। আব্রাহামের ভবিষ্যতের কথা ভেবেও আবরারকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিত রাইসার। 

 

রাইসাকে ভাবতে দেখে আবরার জিজ্ঞেস করে,

– কি ভাবছিস? আব্রাহামকে নিয়ে ভাবিস না, আমি আছি তো। কিচ্ছু হতে দিবো না আমার বাচ্চার। 

– তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।

– হুম বল, শুনছি

– এতোদিন আমরা দুজন অনেক স্বার্থপরতা দেখিয়েছি, এবার কি আমাদের বাচ্চার জন্য সব কিছু ভুলে নতুন করে সব শুরু করতে পারি? আব্রাহামের একটা কমপ্লিট ফ্যামিলি দরকার। যা আমি একা ওকে কখনোই দিতে পারবো না। আর তুই যদি ওকে শুধু আপন করে নিতে চাস, সেটাতেও রাজি। আমি শুধু ওর হ্যাপিনেস চাই। 

– তুই জানিস তুই কি বলছিস?

– আমাদের সম্পর্কে আছেই তো এই একটা সুতো, ওর যদি কিছু হয়ে যায় আমাদের কিছুই থাকবে না। ওর জন্য নাহয় আবার একটু চেষ্টা করি।

– আমি তোকে ভালোবাসি রাইসা, আমাদের সম্পর্কে ওই একমাত্র সুতো নয়। আমি জানি হয়তো আমি তোর জন্য পারফেক্ট নই। কিন্তু আমি আমাকে বদলে নিবো দেখিস। আমি তোদের কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। প্লিজ আমাদের বাপ-ছেলেকে একা করে দিস না। আমার যেমন ওকে দরকার, তেমন তোকেও দরকার। আমি তোদের দুজনকেই যে চাই। 

– কিন্তু দাদী

– আমি এসবের পরোয়া এখন আর করি না, কি হবে বল? যদি সিকদার টাইটেল না থাকে। টাকা পয়সা কি সব? তুই একবার বল সব ছেড়ে দিবো। আমি একটা পরিবার চাই, একটা নিজস্ব পরিবার। যেখানে কোনো ছলচাতুরী নেই। প্লিজ রাইসা

– এবার যদি কিছু করেছিস তো দেখবি আমি কি করি?

– তুই বললে জীবন টুকু দিয়ে দিবো, তবে তোকে কষ্ট দিবো না, আই প্রমিস। 

 

রাইসার চোখ চিকচিক করছে, সব অভিমান,রাগ অশ্রু রুপে পড়ছে। আব্রাহামকে শুইয়ে রাইসার কাছে হাটু গেড়ে বসে আবরার। দুটো হাত দিয়ে তার গাল দুইটি ধরে বলে,

– অনেক কাঁদিয়েছি, আর কাঁদাবো না। এই মুক্তকণার দাম যে অনেক। এতো ক্ষতি করা যায়? 

 

রাইসা আর না পেরে আবরারের বুকে মুখ লুকায়, এটা যে তার সবচেয়ে প্রশান্তির জায়গা। আজ সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়েছে। আবরারও পরম যত্নে তার ভালোবাসাকে আগলিয়ে ধরেছে। 

 

অপরদিকে,

প্রাপ্তির মনটা খচখচ করছে, কেনো জানে মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফলো করছে। কিন্তু পেছনে কেউ নেই। বারবার পেছনে ফিরলে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে। তবে সেই অচেনা লোকটি তার পিছু নিয়েছে। অফিস যাবার জন্য রিক্সা খুজে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো রিক্সা না পাওয়ায় হেটে মোড়ে যেতে হচ্ছে তাকে। রাস্তায় হাঁটার সময় বারবার মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিয়েছে। এবার মনে হচ্ছে মানুষটি তার খুব কাছে চলে এসেছে। দেরি না করে পিছনে ফিরলেই দেখতে পায়…..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

দ্বিতীয় অধ্যায়

৬ষ্ঠ পর্ব

 

– আপনি এখানে?

– কেনো বলোতো? আমি আসতে পারি না?

 

দেরি না করে পিছনে ফিরলেই দেখতে পায় নিশান পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে নিশানকে দেখে প্রথমে প্রাপ্তি ও চমকে উঠে। প্রাপ্তিকে ঘাবড়ে যেতে দেখে নিশান জিজ্ঞেস করে,

– খুশবু, তুমি ঠিক আছো তো?

– জ্বী, আমার কি হবে? 

– তোমাকে খুব টেনসড লাগছে, তাই আর কি? 

– আপনি কখন এসেছেন? আমার এড্রেস কিভাবে পেলেন? 

– সকালে এলাম, আর এড্রেস আমার বন্ধুই দিলো, বললো তুমি নাকি এখানে থাকছো। আসলে তুমি তো বেশ কিছুদিন হয়েছে এখানে, তাই দেখতে এলাম। অফিস যাচ্ছো বুঝি?

– জ্বী, আন্টি-আঙ্কেল কেমন আছেন? 

– ভালো, তোমার গলায় কি হয়েছে?

– কিছু না, এল্যার্জি আর কি। চলুন, হাটতে হাটতে কথা বলি। 

 

নিশান আর বেশি ঘাটায় না, প্রাপ্তিও খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে নিশানের প্রশ্নে। একবার বলতে চেয়েও থেমে যায়। শুধু শুধু নিশানকে টেনসন দেওয়ার মানে হয়। তারা দু জন হেটেই  রওনা দিলো মেইন রোডের দিক। আড়াল থেকে কেউ একজন খুব নিপুন ভাবে তাদের লক্ষ্য করছিলো। প্রাপ্তির চলে যাওয়ার দিকে তার শান্ত নজর। প্রাপ্তির, নিশানের সাথে চলে যাবার পর সেও গাড়িতে বসে রওনা দেয় গন্তব্যে।

 

সকাল ১১.৩০টা,

প্রাপ্তি ডেস্কে বসে নতুন প্রজেক্টে কাজ করে যাচ্ছে, আজকে সাইট ভিউয়িং এর জন্য নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে অয়নের সাথে। প্রাপ্তি প্রথমে আপত্তি জানালেও আসফির উপর কথা বলতে পারলো না। মনে মনে অনেক বেশি বিরক্ত সে, কিন্তু কিছুই করার নেই। একটু পর পিয়ন এসে জানায়,

– ম্যাডাম, বস আপনাকে উনার রুমে যাইতে বলছে।

– আচ্ছা।

 

আসফির রুমের বাইরে দরজা নক করতেই আসফি ভেতরে আসতে বলে। সেখানে অয়ন ও উপস্থিত ছিলো। অয়নকে তোয়াক্কা না করে আসফির উদ্দেশ্যে বলে,

– স্যার, আমাকে ডেকেছিলেন।

– অহ, খুশবু আসো। যার জন্য ডেকেছিলাম, তোমাদের এখনি বের হতে হবে। অয়ন চাচ্ছিলো, সকাল সকাল সাইট ভিউ করে আসবে। আর তোমাকে একাই যেতে হবে। 

– কিন্তু স্যার সেটা তো সেকেন্ড হাফ এ ছিলো।

আর আমি একা? থ্যাংক উ আমার উপর ট্রাস্ট করার জন্য বাট…

– নো বাট, আই নো ইউ ক্যান ডু ইট। সো গেট রেডি। 

 

প্রাপ্তি আর কথা বাড়াতে পারে না। অয়নের দিকে তাকালে দেখতে পায় সে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। প্রাপ্তি রাগী লুক দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রাপ্তি যাবার পর অয়ন আসফিকে বলে,

– থ্যাংক উ সো মাচ, তোমার কাছে আমি ঋণি থাকবো।

– ভাই, তোর আর সামির উপর আমার পাঁচ আনার ভরসা নেই। যাই করিস পুলিশ কেস করাইস না।

– ডোন্ট ওয়ারি। আজকে ওর আমাকে বলতেই হবে কেনো ও আমাকে চিনতে চাইছে না। এতো কিসের রাগ?

– যা ভালো মনে হয় করিস, কিন্তু একটা জিনিস মাথায় রাখিস ওর মেন্টাল কন্ডিশন কিন্তু ভালো নয়। মিসক্যারেজ হ্যান্ডেল করার মত মানসিক ক্ষমতা সবার থাকে না। সি হ্যাস বিন সাফারিং সিন্স দেন। সো টেক কেয়ার অফ হার।

– কিচ্ছু হবে না, আমি ওর কিছু হতে দিবো না। 

 

অয়ন আসফির সাথে কথা বলে সোজা পার্কিং এরিয়াতে চলে যায়। রিয়াদকে দিয়ে এই চার মাস এ কি কি হয়েছে প্রাপ্তির জীবনে সব ডিটেইলস কালেক্ট করেছে সে। প্রাপ্তি এই চার মাস কতোটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো, কিভাবে সে নিজেকে একটি রুমে আটকে রেখেছিলো, তার এই চার মাসের প্রতিটি নির্ঘুম রাতের খোঁজ অয়ন নিয়েছে। কাল যখন প্রাপ্তি তাকে চিনতে পারছিলো না, অয়নের রাগ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো প্রাপ্তিকে নিজের কাছে আটকে রাখলে প্রাপ্তি হয়তো তাকে সত্যিটা বলবে। রাতে অচেনা লোকটি যে প্রাপ্তিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো সে আর কেউ না অয়ন। কিন্তু প্রাপ্তির গলায় কামড় দেবার সময় লক্ষ্য করে তার গলা থেকে একটু নিচ থেকে ক্ষত দেখা যাচ্ছে। প্রাপ্তিকে টোকা দিলে যে মানুষটি নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না সে প্রাপ্তির ক্ষত দাগটি দেখে নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলো না। তাই সেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। রিয়াদকে ৭ ঘন্টার সময় দেয় যাতে খুশবুর পুরো ডিটেইলস সে বের করে৷ এবং রিয়াদ সেই কাজটি করেও। অয়ন কে রিয়াদ জানায়, প্রাপ্তি এক্সিডেন্ট এবং মিসক্যারেজের পর মানসিক ট্রমার জন্য Transient amnesia হয়েছে। তবে অয়নের ধারণা প্রাপ্তি কিছু ভুলে নি। কোনো একটা কারণে ইচ্ছে করে প্রাপ্তি নিজেকে গোপন করছে। নিজের অস্তিত্ব মানতে সে নারাজ। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গা এলিয়ে দিলো অয়ন। নিজের ভালোবাসা প্রমাণ করার উপায় তার জানা নেই। রিয়াদের কাছ থেকে সব জানতে পেরে প্রাপ্তির কাছে ছুটে যায় সে। কিন্তু অন্য একটি ছেলের সাথে প্রাপ্তিকে দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে অয়ন। প্রাপ্তিকে এবার হারিয়ে ফেললে বেঁচে থাকার আশাটুকু হারিয়ে ফেলবে সে। গাড়ির কাচে টোকা পড়ায় ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে তার। বাহিরে তাকাতেই দেখে প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে এখন আরো বেশি মাতাল করা সুন্দরী লাগে। আগে খুব কম শাড়ি পড়তো, কিন্তু এখন সব সময় শাড়ি পড়ে। চুলগুলো ঢেউ খেলে মাতাল হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে। মুখটা বড্ড শুকিয়ে গেছে, ঠোঁটের নিচের তিলটা আরো ও সুস্পষ্ট। তিলটা মাদকতা সৃষ্টি করে মনের গহীনে। মেয়েটির এমন এমন জায়গায় তিল আছে যা অয়নের শুধু নেশারঝোঁক বাড়িয়ে তোলে। মেয়েটা যেন জ্বলজ্যান্ত নেশার স্তুপ। নিজের দিকে অয়নের নেশাগ্রস্ত দৃষ্টি প্রাপ্তিকে বেশ অপ্রস্তুত করছে। সে এবার একটু দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,

– যদি যাওয়ার ইচ্ছে না করে থাকে বলতে পারেন। আমার অহেতুক নিজের সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই।

– দরজা খোলা আছে উঠে আসুন। 

 

মুচকি হেসে অয়ন প্রাপ্তিকে বলে। প্রাপ্তি কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসে। প্রাপ্তি বসে পড়লে অয়ন গাড়ি স্টার্ট দেয়। আপন গতিতে গাড়ি চলতে থাকে, দুইটি মানুষ পাশাপাশি কিন্তু নিশ্চুপ পরিবেশ। প্রাপ্তি আড়চোখে অয়নকে দেখে যাচ্ছে। মানুষটাকে দেখলেই মনে মোচড় দেয় তার, আচ্ছা মানুষটা ভালো আছে তো! 

– লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কিছু নেই মিস খুশবু। 

দেখতে হলে সরাসরি দেখুন। চোরের মতো দেখলে আমার লজ্জা লাগবে।

 

অয়নের কথায় বেশ লজ্জায় পড়ে যায় প্রাপ্তি। নজর বাহিরে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,

– আপনাকে দেখতে বয়েই গেছে আমার। একজন বিবাহিত পুরুষের দিকে তাকাবো এতোটা নিচ মানসিকতা আমার নয়। 

– আমার সম্পর্কে সব জানেন দেখি!

– সারা শহর জানে, আমি জানবো না। আপনার বাগদত্তা জানেন আপনি আমার সাথে আছেন এখন?

– বাগদত্তা?

– হুম, তার সাথে তো আপনার শুধু এনগেজমেন্ট হয়েছে। ওয়াইফ তো বলতে পারছি না। 

– হাহাহাহা

 

প্রাপ্তির কথা শুনে জোরে হেসে উঠে অয়ন। অয়নকে হাসতে দেখে প্রাপ্তি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাই জিজ্ঞেস করে,

– আপনি হাসছেন যে?

– তো কি করবো? আমার একবার ই বিয়ে হয়েছে। আমার কোনো বাগদত্তা নেই। আর সারা শহর জানে এনগেজমেন্ট আমার না ভাইয়ের ছিলো। 

– হুম??

– হুম, আপনি আমার প্রাপ্তির মতো দেখতে, আপনি আমার প্রাপ্তি নন। তাই আপনাকে সিকদার ফ্যামিলির ইন্টারনাল ইস্যু আপনাকে বলতে পারবো না। তবে এটুকু জেনে রাখুন আমার কোনো বাগদত্তা নেই। আমার শুধু একটাই বউ, প্রাপ্তি। 

– খুব ভালোবাসেন বুঝি?

– খুব, ও যদি বলে আমি জীবন বাজি রাখতে পারবো

– সত্যি?

– সন্দেহ আছে?

– আমি কে সন্দেহ করার? তবে হয়তো আপনার ভালোবাসায় খুত ছিলো তাই হয়তো উনি….. শুনেছি উনি মারা গেছেন।

 

প্রাপ্তির কথায় মুখ শক্ত হয়ে যায় অয়নের। গম্ভীর এবং রাগী কন্ঠে বলে,

– আমার প্রাপ্তি মারা যায় নি, রেগে আছে শুধু। যেদিন আমি ওর রাগ ভাঙাতে পারবো ও আবার আমার আছে চলে আসবে। 

 

প্রাপ্তি আর কোনো কথা বলে না, অয়নের রাগ সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। কিন্তু অয়ন কি সত্যি তাকে এতোটাই ভালোবাসে! যদি ভালোবাসতো তবে কি তাকে এতো ছলনার মাঝে রাখতো! একবার তাকে খুঁজার চেষ্টা করতো না! তার অবর্তমানে অন্য একটি মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতায় জড়াতো! যদিও তার এনগেজমেন্ট হয় নি কিন্তু এগুলো তো এড়ানো যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে তার হুশ থাকে না প্রাপ্তির।।

 

রাত ৯ টা,

মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাপ্তি এবং অয়ন। কাজ শেষে ঢাকার পথে রওনা দেয় তারা। কিন্তু মাঝ রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় অয়নের। 

একে তো রাত উপর থেকে নাস্তায় তেমন ট্রান্সপোর্ট ও নেই যাতে তারা ঢাকায় যেতে পারে। উপায়ন্তর না দেখে অয়ন প্রাপ্তিকে বলে,

– আমার ভিলা পাশেই আছে, বেশি না বিশ মিনিটের রাস্তা। তোমার আপত্তি না থাকলে আমরা সেখানে থাকতে পারি।

– আপনার মাথা ঠিক আছে? আমি বাসায় যাবো ব্যাস

– কিভাবে যাবা? না তুমি আমাকে বলো কিভাবে যাবা? ওয়ে থাকলে আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যেতাম কিন্তু উপায় কোথায়?

– আর কোনো ওয়ে নেই?

– নাহ, এতোরাত আমি মেকানিক পাবো না, কাল সকাল অবধি এখানে থাকার থেকে ভিলায় আরামসে থাকাটা অনেক বেশি ভালো বলে আমার মনে হয়। আর বৃষ্টি আরম্ভ হবে এখুনি। তুমি থাকতে চাইলে আমার সমস্যা নেই। তবে আমি এখানে রাত কাটাবো না। 

– ঠিক আছে, ঠিক আছে। চলুন। 

 

অয়ন মুচকি হেসে রাস্তায় হাটা শুরু করলো। প্রাপ্তিও পিছু পিছু ধীর পায়ে হাটতে লাগলো। ভিলায় পৌছাতে পৌছাতে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গগণ বিদারী আওয়াজে মেঘ ডাকছে। ভিলায় যেয়ে প্রাপ্তিকে একটি রুম দেখিয়ে দেয় অয়ন। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় প্রাপ্তি। বৃষ্টির ছিটা প্রাপ্তির মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। আজ প্রাপ্তির মাঝেও উম্মাদনার ছোয়া লেগেছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করতে। ঠান্ডা বাতাস আরো উম্মাদনার সৃষ্টি করছে। আজ ভিজতে ইচ্ছে করছে প্রাপ্তির, মন উজাড় করে বৃষ্টির কাছে নিজেকে সপে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই আর নিজেকে না আটকে ছাদের দিকে রওনা দেয় সে। 

 

বেশকিছুক্ষণ ভেজার পর এক জোড়া উষ্ণ হাত তাকে পেছন থেকে আলিঙ্গন করে। শীতল শরীরে উষ্ণ হাতটি যেনো ভালোবাসার উষ্ণতা প্রাপ্তির প্রতিটি লোমকোষে পৌছে দিচ্ছে। পেছনে ফিরতেই দেখে নেশাগ্রস্ত চোখে অয়ন তাকে দেখছে। অয়নের কাছে প্রাপ্তিকে কোনো অপ্সরার চেয়ে কম লাগছে না। ভেজা ঠোঁট জোড়া ছুয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা তাকে মাতাল করছে। মাঝে মাঝে পুরুষের পক্ষে নিজেকে আটকএ রাখা যা বড্ড কঠিন। নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টায় অয়ন হার মেনে নেয়। প্রাপ্তি ও যেনো একটা ঘোরের মাঝে আছে, আজ বৃষ্টি যেন মাতাল করে তুলেছে দুইটি হৃদয়কে। অয়ন প্রাপ্তির নিজের খুব কাছে নিয়ে আছে। শুধু দুজনের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি আর প্রকৃতির মাতাল শব্দ শুনা যাচ্ছে। অয়ন প্রাপ্তির কাছে আসতেই……

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

দ্বিতীয় অধ্যায়

৭ম পর্ব

 

শুধু দুজনের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি আর প্রকৃতির মাতাল শব্দ শুনা যাচ্ছে। অয়ন প্রাপ্তির কাছে আসতেই জোরে আকাশ ডেকে ওঠে, প্রাপ্তিও ভয়ে অয়নকে জড়িয়ে ধরে। আকাশের গর্জনে প্রাপ্তির বরাবরই ভয়। বজ্রপাতের শব্দ যত বাড়ছে ততই ভয়ে অয়নের বুকে সিটিয়ে আছে সে। অয়ন মুচকি হেসে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছে প্রাপ্তিকে, যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। আজ চার মাস পর তার খালি হৃদয় পূর্ণতা পেয়েছে। কিছুসময় পর প্রাপ্তির হুশ ফিরে, এতোক্ষণ ঘোরের বশে কি করছিলো সে। সম্বিত ফিরলে অয়নকে ধাক্কা মেরে চলে যেতে নিলে অয়ন হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে তাকে। কানে মুখ লাগিয়ে বলে,

– নেশা ধরিয়ে পালিয়ে যাচ্ছো?

– আ…আমি ইচ্ছে করে করি নি। ছাড়ুন

– ছেড়ে দিলেই তো পালিয়ে যাও। এই চার মাস একা একা জীবনটাকে বইতে বইতে আমি ক্লান্ত। আর পারছি না প্রাপ্তি।

– আমি শেষবারের বলছি আমি প্রাপ্তি নই, প্রাপ্তি নই। একটা কথা কতবার বলবো!! আমি খুশবু। 

 

চেচিয়ে উঠলো প্রাপ্তি। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলে অয়ন বলে উঠে,

– আমি সব জানি প্রাপ্তি, আমার সামনে অন্তত তোমার এই নাটকগুলি করতে হবে না। তুমি প্রাপ্তি তার সম্পূর্ণ প্রমাণ আমার কাছে আছে। তোমার মিসক্যারেজ হয়েছে, প্রাপ্তি যখন আমাকে ছেড়ে যায় তখন সে প্রেগন্যান্ট ছিলো। এ থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না। তাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ তোমার হ্যান্ডরাইটিং। না হয় তুমি প্রাপ্তির মত দেখতে তোমার সাথে ওর হ্যান্ড রাইটিং ও মিলে যাবে?? তাই অহেতুক চেষ্টা করো না। আর এবাড়িতে তুমি প্রথম এসেছো, তুমি এবাড়ির প্রতিটা জিনিস এতো ভালো করে কি করে চিনো!! কারণ এই বাড়ির সব কিছু আমার প্রাপ্তির গোছানো। মানে তোমার গুছানো। প্রাপ্তি আমার দোষটা কোথায়? আমি জানি না, এতোটা ঘৃণা তুমি কেনো করছো? খুনের আসামীকেও একটা শেষ সুযোগ দেওয়া হয় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার। অথচ তুমি বিগত চার মাস ধরে আমাকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছো, আমি জানিও না আমার দোষ কোথায়! তাও তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মেনে নিবো প্লিজ আমাকে একা করে চলে যেও না। 

 

এতোক্ষন চুপচাপ প্রাপ্তি সব শুনে যাচ্ছিলো। চোখ থেকে ক্রমাগত অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে। প্রাপ্তির রেসপন্স না পেয়ে অয়ন তার কাছে যায়। নিজের দিকে ঘুরিয়ে আলতো করে তার গাল দু হাত দিয়ে ছুয়ে বলে,

– প্লিজ প্রাপ্তি আমি ক্লান্ত, এবার তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে মরে যাবো। সত্যি মরে যাবো। 

– আমি আপনার বলির বাকরা, আপনি কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেন নি। আমি জাস্ট একটা বংশ বৃদ্ধির টুল। আপনি কি ভেবেছেন আমি কিছুই জানি না?? আপনি কোনোদিন আমার কথা ভেবেছেন? প্রথমে ভেবেছিলেন আমি আপনার এক্সিডেন্টের জন্য দায়ী, তাই আমাকে বিয়ে করেন। আমার সম্মান নষ্ট করা ছিলো আপনার মূল উদ্দেশ্য। আমাকে পাগল প্রমাণ করার কোনো ওয়ে বাদ রেখেছিলেন? তারপর যখন প্রুভ হলো আমি নির্দোষ তখন আপনি আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে এজন্য মেনে নেন নি যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনি আমাকে শুধুমাত্র আপনার উত্তরাধিকারিকে জন্ম দেবার জন্য আপনার বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। 

– না, প্রাপ্তি তুমি যা ভাবছো তা ঠিক নয়। 

– তাহলে? দাদীর সাথে আপনার ডিল হয় নি? বাচ্চা হবার পর আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। বলুন? 

– হ্যা, তখন মহীমা সিকদারকে ঠান্ডা করার জন্য আমি হয়েছিলাম কিন্তু

– কিন্তু কি? কোথায় ছিলেন আপনি যখন আমি আই.সি.উ তে পনেরো দিন পড়েছিলাম? কোথায় ছিলেন যখন আমার বাচ্চাটিকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি? আমি বলি? আপনি তখন আপনার নারী সঙ্গীদের সাথে ব্যস্ত ছিলেন। আমি আজও অনুতাপ করি কেনো আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিলো। আপনি আমার জীবনে না আসলে আমার লাইফে এতো কষ্ট থাকতো না। আমি আপনার মুখ ও দেখতে চাই না। 

– বেশ তোমার ইচ্ছে যেনো পূরণ হয়। আমি তোমার সামনে কোনোদিন আসবো না। তবে একটা কথা জেনে রেখো এই অয়ন সিকদারের জীবনে শুধু একজন নারীই এসেছিলো সে হলো কেবল তুমি। প্রাপ্তি ব্যাতীত কোনো নারী আমার জীবনে আসে না। আর সিকদার পরিবারের সম্পত্তিতে আমার কোনোফিন কোনো অধিকার ছিলোই না। আমি সব কিছু ছেড়ে দিয়েছি শুধু তোমার জন্য। জানি তোমার বিশ্বাস হবে না, তবুও বলছি আমি তোমাকে কোনোদিন ঠকাই নি। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসে এসেছি। যাক, আমার মুখ যেন উপর ওয়ালা তোমাকে কোনোদিন না দেখায় এই কামনাই করি। যদি দেখো সেটা যেন আমার মরা মুখ হয়। 

 

বলেই অয়ন সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। প্রাপ্তির কান এখনো বাজছে, অয়নের বলা প্রতিটি কথা যেন কলিজাতে লেগেছে৷ যেন কেউ ভোঁতা ছুরি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে রক্তক্ষরণ করছে। রাগের বশে যা নয় তাই সে বলে তো দিয়েছে না জানি ভাগ্য তাদের কোন নতুন মোড়ে এসে দাড় করাবে। 

 

সকাল ৬টা, 

রাতের মেঘ কেটে ভোরের মিষ্টি সকাল প্রকৃতিকে নতুন রুপে সাজিয়েছে। কিন্তু মেঘের ঘনঘটা প্রাপ্তির জীবনে এখনো চেয়ে আছে। সারারাত চোখের দু পাতা এক করতে পারে নি, সত্যি কি সে অয়নকে ভুল বুঝছে! বারবার অতীতকে মনে করে নোনাজল গাল বেয়ে পড়ছিলো। মনটা যে বড্ড বেহায়া, কিছুতেই স্থির হচ্ছে না। কাল রাতের পর থেকে অয়ন একবার ও তার সামনে আসে নি। হয়তো তাদের সম্পর্কের ইতি এখানেই। এটাই তো চেয়েছিলো প্রাপ্তি তবে আজ কেনো মনটা খালি খালি লাগছে। কেনো বেহায়ার মতো অয়নকে আপন করে নিতে ইচ্ছে করছে। 

 

সকাল ৯টা

স্থানঃ- চিটাগং 

আজই ঢাকার পথে রওনা দিবে আবরার। দাদীর সম্মুখীন তার হতেই হবে। আব্রাহামের রিপোর্ট চলে এসেছে, হার্টে ছোট ব্লক ধরা পড়েছে। ডক্টর সিদ্দিক মেডিসিন দিয়েছেন। যখন ৭-৮ বছর হবে তখন যদি ব্লকটা থাকে তবে বাহিরে নিয়ে ছোট একটি অপারেশন করতে হবে। বাবা হিসেবে ছেলের কোনো অযত্ন সে হতে দিবে না। তাই আজই ঢাকা নিয়ে যাবে রাইসা আর আব্রাহামকে। রাইসা যদিও আপত্তি করেছিলো, কিন্তু কোনো কথাতেই রাজি হয় নি আবরার। রাইসার সাথে তার মনের দূরত্ব এখনো তেমনই আছে। ক্ষতটা অনেক বেশি তাই হয়তো দেরি হবে সেটা পূরনে। ঢাকা যেয়ে প্রথম কাজ নিশির সাথে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া আর রাইসাকে তার যোগ্য স্থান দেওয়া। মেয়েটাকে আর কোনো অসম্মান সহ্য করতে দিবে না আবরার। রাইসার ডাকে হুশ ফিরে আবরারের।

– কি ভাবছিস?

– কিছু না, প্যাকিং শেষ?

– হুম, আবার ও ভেবে দেখ আবরার, আমার মনে হচ্ছে আমাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়াটা হয়তো ভালো ডিসিশন নয়। 

– নিজের পরিবারকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়াটা আমার মনে হয় না অন্যায়। আর কাল রাতেই আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি তোদের ছাড়া ঢাকা ফিরছি না। 

– কিন্তু

– চুপ, আর যেন একটা কথা আমি না শুনি। 

 

রাইসার কাছে এসে দুহাত দিয়ে তার গালকে আলতো ছুয়ে কপালে উষ্ণ ছোয়া দেয় আবরার, তারপর বলে,

– ভালোবাসি তোকে, এই শেষবার বিশ্বাস করে দেখ। তোদের নিরাশ করবো না আই প্রমিস। হয়তো তোদের বিলাসিতা দিতে পারবো না, কিন্তু তোদের কোনো কিছুর কমতি হতে দিবো না। শুধু তুই আমার পাশে থাকিস

– সবসময় থাকবো, আমি জানি তুই ঠিক একজন আদর্শ বাবা হয়ে উঠবি। 

– উহু আমি শুধু আদর্শ বাবা নয় আদর্শ স্বামীও হতে চাই। জানি তোর ক্ষত হৃদয়টায় আবার জায়গা করে নিতে সময় লাগবে কিন্তু আমি হার মানছি না। আমাকে এই শেষ সুযোগটা দিবি রাইসা?

– ভেবে বলিস, এইবার কিন্তু আমি কোনো ছাড় দিবো না। এই রাইসা কিন্তু অনেক গভীর, তলিয়ে যেতে পারিস। 

– সব চলবে। শুধু তোর মাঝে নিজেকে হারাতেও রাজি আমি। 

 

রাইসা মুচকি হেসে আবরারকে জড়িয়ে ধরে। আবরার ও পরম আদরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যতটা শক্ত করে ধরলে একে অপরের সাথে মিশে যেতে পারে। 

 

সকাল ১১ টা, 

প্রাপ্তি ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে কিন্তু অয়নকে কোথাও পায় না। কাজের লোকদের জিজ্ঞেস করলে তারাও কিছুই বলতে পারে না। কিছুক্ষণ পর অচেনা নাম্বার থেকে প্রাপ্তির ফোন আসে। ফোন ধরতেই গলাটা বেশ পরিচিত লাগে,

– হ্যালো 

– হ্যালো প্রাপ্তি ম্যাডাম

– রিয়াদ?

– জ্বী ম্যাম, অয়ন স্যারের…..

 

চলবে

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

ভালোবাসার উষ্ণতা

দ্বিতীয় অধ্যায়

৮ম পর্ব

 

– রিয়াদ?

– জ্বী ম্যাম, অয়ন স্যারের ফোনটা অফ পাচ্ছি সকাল থেকে। আপনি কি জানেন উনি কোথায়? আমি কিছুতেই উনার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। ম্যাম আপনি কি জানেন উনি কোথায় আছেন?

– না, আমি জানি না। উনি কি বাসায় জান নি?

– না ম্যাম, উনি বাসায় যান নি আর উনার সাথে যোগাযোগ ও করতে পারছি না। 

– রিয়াদ, আপনি কি আমার সাথে দেখা করতে পারবেন? 

– জ্বী, কেনো বলুন তো ম্যাম? 

– কিছু কথা আছে আপনার সাথে। আপনি ফ্রি হলে আমাকে জানিয়েন। রাখছি

– জ্বী ম্যাম।

 

ফোনটা রাখার পর থেকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো প্রাপ্তি। মাথা যেন বন্ধ বন্ধ লাগছে। কাজের লোকেরা জানিয়েছে কাল রাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছে সে। কোথায় গেছে, কি করছে সেটা রিয়াদ যদি না জানে তাহলে আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। না চাইতেও বিষয়টা ভাবিয়ে তুলছে প্রাপ্তিকে। অয়নের সবথেকে খারাপ দিক ওর রাগ, রাগের বসে উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলে নি তো! উফফ আর ভাবতে পারছে না প্রাপ্তি। ভিলার ড্রাইভার প্রাপ্তিকে গাড়িতে করে অফিস পৌঁছে দেয়। 

 

বিকেল ৫টা, 

ক্যাফেতে মুখোমুখি বসা রিয়াদ এবং প্রাপ্তি। এখনো অবধি অয়নের কোনো খোঁজ পায় নি সে। না চাইতেও খারাপ চিন্তা ঘিরে রেখেছে প্রাপ্তিকে। রিয়াদ এবং সামি দুজন এমন মানুষ যারা অয়নের সকল গোপন তথ্য জানে। অয়নের লাভ লাইফ, বিজন্যাস লাইফ সবকিছু। মনের সাথে যুদ্ধ করে আজ ক্লান্ত প্রাপ্তি, তাই রিয়াদের কাছেই সকল প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পাবে। 

– ম্যাম, আপনি আমাকে এখানে কেনো ডেকেছেন?

– অয়নের সাথে আমার বিয়ের সত্যতা জানতে। কেনো অয়ন আমাকে বিয়ে করেছিলো? আপনি ছাড়া কেউ আমাকে উত্তর দিতে পারবে না।

– স্যার আপনাকে বিয়ে করেছিলো তার পেছনে সেই মূহুর্তে একটা কারণ ছিলো তা হচ্ছে প্রতিশোধ। আপনার নামের ফেক একাউন্টের কারণে উনি ভেবেছিলেন আবরার স্যারের এক্সিডেন্টে কোথাও না কোথাও আপনার ও দোষ ছিলো। আর আপনাকে একটা গোলকধাঁধার ভেতরে রাখার কারণ দুইটি ছিলো একটি দাদীজান দ্বিতীয়টি ঐ প্রতিশোধ। ধীরে ধীরে স্যার আপনার প্রতি দূর্বল হতে থাকেন, তারপর জানতে পারেন আপনার সাথে আবরার সাহেবের কোনো সম্পর্ক কোনোদিন ই ছিলো না। আপনার চাচাতো বোন আপনার নামে ফেক আইডি চালাতো। ধীরে ধীরে ধোঁয়াশাগুলি কেটে গেলে উনি সিদ্ধান্ত নেন এই সম্পর্কটাকে আবার জীবন্ত করার। উনি বড় ম্যাডামের সাথে অনেক ঝগড়াও করেছেন। এরপর বড় ম্যাডাম এক শর্তে রাজি হন, সেটা হলো খুব দ্রুত আপনি যাতে কনসিভ করেন। স্যার এটাও মেনে নিয়েছিলেন। তারপর আপনি যে রাতে স্যারকে ছেড়ে চলে যান, সেদিন স্যার আপনাকে সব খুলে বলতে চেয়েছিলেন এবং আপনাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করতে চেয়েছিলেন। সে রাতে আমরা একটি লাশ পাই। আমরা তো ভেবেই নিয়েছিলাম সেটি আপনার লাশ, আপনি মারা গেছেন। কিন্তু স্যার সেটা বিশ্বাস করেন নি। স্যার যখন জানতে পারেন আপনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন পাগল প্রায় হয়ে পড়েন। ঢাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন তিনি। আমরা তাকে বুঝাবার চেষ্টা করেও লাভ হয় নি। বড় ম্যাডাম বারবার স্যারকে বিয়ের জন্য জোর করতে লাগেন। স্যারের লাইফে যাতে আপনার পরিবর্তে কেউ না আসে তাই স্যার সিকদার বংশে সম্পত্তির ভাগ ও ছেড়ে দিয়েছেন। এই চার মাস, স্যার কিভাবে জীবন কাটিয়েছেন তা কেবল আমরা জানি। যদি তার জীবনে কোথাও কোনো নারীর প্রবেশ থাকে সেটা শুধুমাত্র রাইসা ম্যামের ছিলো। রাইসা ম্যাম এবং তার বাচ্চাটিকে দেখাশুনার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন বলেই রাইসা ম্যামের সাথে তার কথা বা দেখা হতো। আমার মনে হয় ম্যাম আপনার যা জানার ছিলো আমি তার উত্তর ঠিকমতো দিয়েছি। 

– অয়ন, এখন কোথায় আছে বলতে পারবে।

 

কথা গুলো আটকে যাচ্ছে প্রাপ্তির। না চাইতেও চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। হ্যা সে ভুল করেছে, খুব বড় ভুল করেছে। একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য নিজের সাথে সাথে অয়নকে এতোটা কষ্ট দিয়েছে। এখন অয়নের সামনে যাওয়াটা খুব দরকার। এসময় অয়ন কোথায় আছে তা একমাত্র রিয়াদ জানে। রিয়াদ উত্তরে বলে,

– না ম্যাম, উনি কোথায় আছে সেটা আমি আপনাকে জানাতে পারবো না। তবে উনি বেঁচে আছেন, তাই উনাকে নিয়ে অহেতুক চিন্তা করবেন না। 

– প্লিজ, রিয়াদ আমার উনার সাথে দেখা হওয়াটা খুব জরুরি। আপনি ছাড়া কেউ আমাকে উনার খোঁজ দিতে পারবে না। আমি নিজের ভুলে চারটা মাস দেরি করে ফেলেছি। আর দেরি করলে অয়ন আমার থেকে আরোও দূরে চলে যাবেন যা আমি মেনে নিতে পারবো না। প্লিজ রিয়াদ, আমাকে উনার সাথে দেখা করানোর একটি ব্যাবস্থা করে দিন। 

– বেশ ম্যাম, তবে চলুন। 

 

অপরদিকে, 

মুখোমুখি বসা মহীমা সিকদার এবং আবরার। রাগে গা রি রি করছে মহীমা বেগমের। কিন্তু নাতি তার সিদ্ধান্তে অনড়, রাইসাকেই সে বিয়ে করবে। অনেক বুঝানো সত্ত্বেও সে রাজি নয়। 

– আবরার, আমার আগেও যা সিদ্ধান্ত ছিলো এখনো তাই, তুমি যদি এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাও তবে আমার ঘরে তোমার কোনো জায়গা হবে না। 

– বেশ তবে তাই হবে। রাইসা উনাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। এ বাড়িতে আমাদের কোনো জায়গা হবে না। আরেকটা কথা দাদীজান, আপনার সম্পত্তি কিংবা কোম্পানি ছাড়া আমি দিব্যি চলতে পারবো কিন্তু আমি কিংবা অয়ন ছাড়া সিকদার কোম্পানির কি হাল হবে তা হয়তো আপনি কল্পনাও করতে পারছেন না। 

 

আবরার এক মূহুর্ত দেরি না করে রাইসাকে নিয়ে সিকদার ভিলা থেকে বেরিয়ে পরে। আগে থেকেই এটা তার জানা ছিলো বিধায় অয়নের সাহায্যে আগেই একটা নতুন কোম্পানি স্টার্ট করে আবরার। এখন বেশ ভালো পজিশনেই নিয়ে গিয়েছে সে কোম্পানিটিকে। তাই মহীমা বেগমের হুমকিতে তার কিছুই যায় আসছে না। রাইসা এবং আব্রাহামকে নিয়ে উত্তরার একটি দুই বেডরুম ফ্লাটে উঠে আবরার। এই ফ্লাটটা বিজনেস ক্যারিয়ারের প্রথমে কিনেছিলো আবরার। ফ্লাটটি তার নিজের নামে বিধায় এই ফ্লাটটি মহীমা সিকদার কখোনোই কেড়ে নিতে পারবেন না। আব্রাহামকে শুইয়ে দিয়ে বারান্দায় যায় রাইসা। আবরার তখন নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের চিন্তাগুলোকে উড়াতে ব্যস্ত। আবরারের দিকে নিপুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাইসা। আবরারের দৃষ্টি তখন বাহিরের দিকে। হালকা কেশে বলে উঠে,

– সিগারেট খাওয়া কিন্তু আমার পছন্দ নয়। আর আব্রাহামের জন্য সিগারেট খাওয়াটা উচিত হবে না।

 

আবরার মুচকি হেসে সিগারেটটা বাহিরে ফেলে দেয়। রাইসাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাধে থুতনি রাখে সে। 

– বেশ, আজ থেকে নো সিগারেট। তবে নিকোটিনের নেশা যে বড় খারাপ, সহজে কাটানো যায় না। একটা নেশার বদলে এখন তো অন্য একটি নেশা করতে হবে

– অন্য নেশা বলতে?

 

রাইসাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে আলতো করে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে বলে,

– তুই। জলজ্যান্ত নেশার তরী থাকতে এই নিকোটিনের নেশা আমাকে ছুতে পারবে না। আচ্ছা কাল সকালে কাজী অফিসে যাবো। অয়নকে জানিয়ে দিয়েছি। ওরাই সাক্ষী হিসেবে থাকবে। 

– তাড়াহুড়ো করছিস না?

– অনেক দেরি হয়ে গেছে আর দেরি করবো না। বড্ড খিদে পেয়েছে। কি আনতে হবে বল, নিয়ে আসছি।

– তুই যাবি বাজারে?

– আর কেউ আছে?

– আচ্ছা, লিস্ট দিচ্ছি।

 

বলে রাইসা ভেতরে চলে গেলো। আবরারের মনটা মূহুর্তে ভালো হয়ে গেছে। আজ সত্যি নিজেকে পূর্ণ লাগছে, অবশেষে তার পরিবার পূর্ণতা পেলো। 

 

রাত ৯টা,

অয়নের নিজস্ব গোপন আস্তানার সামনে এসে নামিয়ে দিয়েছে প্রাপ্তিকে রিয়াদ। অয়নের যখন খুব মন খারাপ লাগে তখন এখানে আসে সে। এই আস্তানার খোঁজ কেবল তিনজন জানে, আবরার, সামি এবং রিয়াদ। শহর থেকে দূরে অনাথ আশ্রম যেখান থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিলো তাকে। জায়গাটি মনের খুব কাছের অয়নের। কাল ভিলা ছেড়ে এখানেই ছুটে এসেছে সে। ফোন অফ করে নিজেকে এক রুমে আটকে রেখেছিলো। রিয়াদ ফোনে না পেয়ে বাধ্য হয়ে এখানে চলে আসে। অনাথ আশ্রমের দায়িত্বে যিনি আছেন তার নাম শমশের। শমশের সাহেব অয়নকে ছোট থেকে দেখে এসেছেন। রিয়াদ যখনই এখানে এসেছে তখনই তাকে রাতের সব কথা বলেন তিনি। তারপর দরজা ভেঙ্গে রুমে ঢুকলে দেখে জ্বরের ঘোরে বেহুশ হয়ে পড়ে রয়েছে। প্রাপ্তি ধীর পায়ে ভেতরে আসলে শমশের সাহেবের সাথে তার দেখা হয়৷ শমশের সাহেব তাকে দেখেই বলে,

– তুমি প্রাপ্তি, তাই না? 

– আপনি আমাকে চিনেন? 

– অয়ন তোমার ছবি দেখিয়েছিলো। সকাল থেকে ছেলেটার খুব জ্বর মা, জ্বরের ঘোরে তোমার নাম ডেকে যাচ্ছে। এখন তুমি এসে গেছো ওকে দেখে রেখো। 

– আপনি চিন্তা করবেন না, কিছু হবে না। 

 

রুমে প্রবেশ করে অয়নকে ঘুমন্ত দেখে পাশে বসে প্রাপ্তি৷ মানুষটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। নিজেকে অপরাধী লাগছে, সেদিন কেনো তার জন্য অপেক্ষা করে নি প্রাপ্তি। নিজের একটা ভুল আজকে তাদের এই দুজনকে এভাবে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। অয়নের পাশে বসে, হাতটি ধরে সারারাত সেভাবেই কাটিয়ে দেয় প্রাপ্তি। 

 

সকাল ৭টা,

সূর্যের আলো মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙ্গে অয়নের। মাথাটা এখনো ধরে আছে, জ্বর নেই কিন্তু দূর্বলতা কাটে নি। হাতটি ভার ভার লাগলে পাশ ফিরে দেখে প্রাপ্তি হাতটি দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ওভাবেই ঘুমিয়ে আছে। প্রথমে স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো সব কিছু। প্রাপ্তির ঘুমন্ত মুখটি যেনো তার সকল অসুখের ঔষধ। অজান্তেই হাতটি মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলো। মুখে ছোঁয়া পেতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রাপ্তির। অয়নকে সজাগ দেখে প্রান্তি হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

– কিছু লাগবে? 

– তুমি এখানে? ঠিকানা কোথায় পেলে?

– রিয়াদ দিয়েছেন। আপনার কিছু লাগবে?

– কেনো এসেছো? আমার মুখ যাতে না দেখতে হয় তাই তো এখানে চলে এসেছি। তোমার থেকে দূরে। তাহলে? আমি বলি কি চলে যাও।

– আপনার জ্বর এখন নেই। তবে আপনি ফ্রেশ হয়ে যান আমি খাবার নিয়ে আসছি। 

– জ্বরে মরে যাবো না, তোমার সেবার আমার প্রয়োজন নেই। চলে যাও, আবার মায়ায় বাধবে আবার একা করে চলে যাবে। একাই তো থাকতে হবে, তবে এই মায়ার কি প্রয়োজন! 

– বুঝে বলছেন তো? আমার একটা সামান্য ভুলে চার মাস আমাদের জীবন থেকে চলে গেছে। বাকিটা জীবন ও কি এভাবে একাকিত্বের অন্ধকারে কাটাবো আমরা? মানছি ভুল হয়েছে, ভুল বুঝে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ভালো নেই। আমার হৃদয়টা বড্ড ফাকা। এই বরফ শীতলে জীবনে আমিও ভালোবাসার উষ্ণতা চাই। আর সেটা কেবল আপনি দিতে পারবেন। ভালোবাসি আমি আপনাকে, জেদের বসে যে ভুল করেছি আবার সেটা করতে চাই না। প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না আমাকে। 

 

বলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অয়নকে। প্রাপ্তির স্পর্শে শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল পরশ বয়ে গেলো। নিজেকে কঠিন করে রাখা আর যে সম্ভব না অয়নের পক্ষে। তাই না পেরে সেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রাপ্তিকে। 

– আর একা করে চলে যাবে নাতো

– না, মৃত্যু অবধি আপনার সাথে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিবো, আপনার ছায়া হয়ে, আপনার শক্তি হয়ে। ভালোবাসি অয়ন, আমি আপনাকে ভালোবাসি।

– আমিও যে খুব ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া যে আমার চলবে না প্রাপ্তি, একদম ই না। 

 

আজ তাদের ভালোবাসা যেনো পূর্ণতা পেলো, সকল ভুলবোঝাবুঝি মিটিয়ে ভালোবাসার উষ্ণতায় তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হলো। একই দিন অয়ন এবং প্রাপ্তি আর আবরার এবং রাইসা কাজী অফিসে আবার বিয়ে করলো। মহীমা বেগম শাস্তি স্বরুপ সারাজীবনের একাকিত্ব মেনে নিলো। আব্রাহামকে নিয়ে অয়ন, প্রাপ্তি, আবরার এবং রাইসা আবার নিজেদের মতো করে নিজেদের একটি সুখের আস্তানা সাজালো যেখানে বাহ্যিক ঝড় থাকলেও নিজেদের মাঝে কোনো দুঃখ, ক্লেশের স্থান নেই। 

 

সমাপ্ত।

 

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।